(বই#১০৭৯) [*স্বৈরাচারী ও যুলুমবাজ ফেরাউন ও নমরুদ এর বিপরীতে দাউদ (আ:) ও সোলেমান (আ:) এর কাজ:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৮:সোয়াদ পারা:২৩ ১২-৪০ নং আয়াত:-

: أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৭৯)
[*স্বৈরাচারী ও যুলুমবাজ ফেরাউন ও নমরুদ এর বিপরীতে দাউদ (আ:) ও সোলেমান (আ:) এর কাজ:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ
পারা:২৩
১২-৪০ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১২
کَذَّبَتۡ قَبۡلَہُمۡ قَوۡمُ نُوۡحٍ وَّ عَادٌ وَّ فِرۡعَوۡنُ ذُو الۡاَوۡتَادِ ﴿ۙ۱۲﴾
এরপূর্বে মিথ্যা আরোপ করেছিল নূহের সম্প্রদায়, আদ, কীলকধারী ফেরাউন,
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১৩
وَ ثَمُوۡدُ وَ قَوۡمُ لُوۡطٍ وَّ اَصۡحٰبُ لۡـَٔیۡکَۃِ ؕ اُولٰٓئِکَ الۡاَحۡزَابُ ﴿۱۳﴾
সামুদ, লুত সম্প্রদায় ও আইকা’র অধিবাসী; ওরা ছিল এক-একটি বিশাল বাহিনী।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১৪
اِنۡ کُلٌّ اِلَّا کَذَّبَ الرُّسُلَ فَحَقَّ عِقَابِ ﴿٪۱۴﴾
তাদের প্রত্যেকেই রসূলগণকে অস্বীকার করেছে। ফলে তাদের প্রত্যেকের ওপর আমার শাস্তির ফায়সালা কার্যকর হয়েই গেছে।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১৫
وَ مَا یَنۡظُرُ ہٰۤؤُلَآءِ اِلَّا صَیۡحَۃً وَّاحِدَۃً مَّا لَہَا مِنۡ فَوَاقٍ ﴿۱۵﴾
এরাও শুধু একটি বিষ্ফোরণের অপেক্ষায় আছে, যার পর আর দ্বিতীয় কোন বিষ্ফোরণ হবে না।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১৬
وَ قَالُوۡا رَبَّنَا عَجِّلۡ لَّنَا قِطَّنَا قَبۡلَ یَوۡمِ الۡحِسَابِ ﴿۱۶﴾
এরা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! বিচার দিনের পূর্বেই আমাদের প্রাপ্য আমাদেরকে সত্বর দিয়ে দাও!’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১৭
اِصۡبِرۡ عَلٰی مَا یَقُوۡلُوۡنَ وَ اذۡکُرۡ عَبۡدَنَا دَاوٗدَ ذَا الۡاَیۡدِ ۚ اِنَّہٗۤ اَوَّابٌ ﴿۱۷﴾
তারা যা বলে তাতে আপনি ধৈর্য ধারণ করুন এবং স্মরণ করুন আমাদের শক্তিশালী বান্দা দাউদের কথা; তিনি ছিলেন খুব বেশী আল্লাহ অভিমুখী ।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১৮
اِنَّا سَخَّرۡنَا الۡجِبَالَ مَعَہٗ یُسَبِّحۡنَ بِالۡعَشِیِّ وَ الۡاِشۡرَاقِ ﴿ۙ۱۸﴾
আমি পর্বতমালাকে তার বশীভূত করেছিলাম; ঐগুলি সকাল-সন্ধ্যায় তার সঙ্গে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করত।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-১৯
وَ الطَّیۡرَ مَحۡشُوۡرَۃً ؕ کُلٌّ لَّہٗۤ اَوَّابٌ ﴿۱۹﴾
পাখ-পাখালী সমবেত হতো এবং সবাই তাঁর তাসবীহ অভিমুখী হয়ে যেতো।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২০
وَ شَدَدۡنَا مُلۡکَہٗ وَ اٰتَیۡنٰہُ الۡحِکۡمَۃَ وَ فَصۡلَ الۡخِطَابِ ﴿۲۰﴾
আমি মজবুত করে দিয়েছিলাম তাঁর সালতানাত, তাঁকে দান করেছিলাম হিকমত এবং যোগ্যতা দিয়েছিলাম ফায়সালাকারী কথা বলার।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২১
وَ ہَلۡ اَتٰىکَ نَبَؤُا الۡخَصۡمِ ۘ اِذۡ تَسَوَّرُوا الۡمِحۡرَابَ ﴿ۙ۲۱﴾
তোমার কাছে কি পৌঁছেছে মামলাকারীদের খবর, যারা দেওয়াল টপকে তার মহলে পৌঁছে গিয়েছিল?
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২২
اِذۡ دَخَلُوۡا عَلٰی دَاوٗدَ فَفَزِعَ مِنۡہُمۡ قَالُوۡا لَا تَخَفۡ ۚ خَصۡمٰنِ بَغٰی بَعۡضُنَا عَلٰی بَعۡضٍ فَاحۡکُمۡ بَیۡنَنَا بِالۡحَقِّ وَ لَا تُشۡطِطۡ وَ اہۡدِنَاۤ اِلٰی سَوَآءِ الصِّرَاطِ ﴿۲۲﴾
যখন তারা দাউদের কাছে পৌঁছলো, তাদেরকে দেখে সে ঘাবড়ে গেলো তারা বললো, “ভয় পাবেন না, আমরা মামলার দুই পক্ষ। আমাদের এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর বাড়াবাড়ি করেছে। আপনি আমাদের মধ্যে যথাযথ সত্য সহকারে ফায়সালা করে দিন, বে-ইনসাফী করবেন না এবং আমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে দিন।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২৩
اِنَّ ہٰذَاۤ اَخِیۡ ۟ لَہٗ تِسۡعٌ وَّ تِسۡعُوۡنَ نَعۡجَۃً وَّ لِیَ نَعۡجَۃٌ وَّاحِدَۃٌ ۟ فَقَالَ اَکۡفِلۡنِیۡہَا وَ عَزَّنِیۡ فِی الۡخِطَابِ ﴿۲۳﴾
এ আমার ভাই, এর আছে নিরানব্বইটি দুম্বা, আর আমার আছে একটি; তবুও সে বলে, আমাকে এটি দিয়ে দাও এবং তর্কে সে আমাকে হারিয়ে দিয়েছে।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২৪
قَالَ لَقَدۡ ظَلَمَکَ بِسُؤَالِ نَعۡجَتِکَ اِلٰی نِعَاجِہٖ ؕ وَ اِنَّ کَثِیۡرًا مِّنَ الۡخُلَطَآءِ لَیَبۡغِیۡ بَعۡضُہُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ اِلَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ قَلِیۡلٌ مَّا ہُمۡ ؕ وَ ظَنَّ دَاوٗدُ اَنَّمَا فَتَنّٰہُ فَاسۡتَغۡفَرَ رَبَّہٗ وَ خَرَّ رَاکِعًا وَّ اَنَابَ ﴿ٛ۲۴﴾
দাউদ বললেন, ‘তোমার ভেড়ীটিকে তার ভেড়িগুলোর সঙ্গে যুক্ত করার দাবী করে সে তোমার প্রতি যুলুম করেছে। আর শরীকদের অনেকে একে অন্যের উপর তো সীমালংঘন করে থাকে—করে না শুধু যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, আর তারা সংখ্যায় স্বল্প।’ আর দাউদ বুঝতে পারলেন, আমরা তো তাকে পরীক্ষা করলাম। অতঃপর তিনি তার রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং নত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন , আর তাঁর অভিমুখী হলেন।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২৫
فَغَفَرۡنَا لَہٗ ذٰلِکَ ؕ وَ اِنَّ لَہٗ عِنۡدَنَا لَزُلۡفٰی وَ حُسۡنَ مَاٰبٍ ﴿۲۵﴾
তখন আমি তাঁর ত্রুটি ক্ষমা করে দিলাম এবং নিশ্চয়ই আমার কাছে তাঁর জন্য রয়েছে নৈকট্যের মর্যাদা ও উত্তম প্রতিদান।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২৬
یٰدَاوٗدُ اِنَّا جَعَلۡنٰکَ خَلِیۡفَۃً فِی الۡاَرۡضِ فَاحۡکُمۡ بَیۡنَ النَّاسِ بِالۡحَقِّ وَ لَا تَتَّبِعِ الۡہَوٰی فَیُضِلَّکَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَضِلُّوۡنَ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ لَہُمۡ عَذَابٌ شَدِیۡدٌۢ بِمَا نَسُوۡا یَوۡمَ الۡحِسَابِ ﴿٪۲۶﴾
(আমি তাঁকে বললাম) “হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য সহকারে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করো এবং প্রবৃত্তির কামনার অনুসরণ করো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করবে। যারা আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হয় অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি, যেহেতু তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে।”
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২৭
وَ مَا خَلَقۡنَا السَّمَآءَ وَ الۡاَرۡضَ وَ مَا بَیۡنَہُمَا بَاطِلًا ؕ ذٰلِکَ ظَنُّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ۚ فَوَیۡلٌ لِّلَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنَ النَّارِ ﴿ؕ۲۷﴾
আমি তো আকাশ ও পৃথিবীকে এবং তাদের মাঝখানে যে জগত রয়েছে তাকে অনর্থক সৃষ্টি করিনি। এতো যারা কুফরী করেছে তাদের ধারণা আর এ ধরনের কাফেরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুনে ধ্বংস হওয়া।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২৮
اَمۡ نَجۡعَلُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ کَالۡمُفۡسِدِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ۫ اَمۡ نَجۡعَلُ الۡمُتَّقِیۡنَ کَالۡفُجَّارِ ﴿۲۸﴾
যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে আমরা কি তাদেরকে যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের সমান গণ্য করব? নাকি আমরা মুত্তাকীদেরকে অপরাধীদের সমান গণ্য করব?
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-২৯
کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰہُ اِلَیۡکَ مُبٰرَکٌ لِّیَدَّبَّرُوۡۤا اٰیٰتِہٖ وَ لِیَتَذَکَّرَ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ ﴿۲۹﴾
আমি এ কল্যাণময় গ্রন্থ তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩০
وَ وَہَبۡنَا لِدَاوٗدَ سُلَیۡمٰنَ ؕ نِعۡمَ الۡعَبۡدُ ؕ اِنَّہٗۤ اَوَّابٌ ﴿ؕ۳۰﴾
আর দাউদকে আমি সুলাইমান (রূপ) সন্তান দিয়েছি, সর্বোত্তম বান্দা, বিপুলভাবে নিজের রবের দিকে প্রত্যাবর্তনকারী।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩১
اِذۡ عُرِضَ عَلَیۡہِ بِالۡعَشِیِّ الصّٰفِنٰتُ الۡجِیَادُ ﴿ۙ۳۱﴾
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সে সময় যখন অপরাহ্নে তার সামনে খুব পরিপাটি করে সাজানো দ্রুতগতি সম্পন্ন ঘোড়া পেশ করা হলো।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩২
فَقَالَ اِنِّیۡۤ اَحۡبَبۡتُ حُبَّ الۡخَیۡرِ عَنۡ ذِکۡرِ رَبِّیۡ ۚ حَتّٰی تَوَارَتۡ بِالۡحِجَابِ ﴿ٝ۳۲﴾
তখন তিনি বললেন, ‘আমি তো আমার রবের স্মরণ হতে বিমুখ হয়ে ঐশ্বৰ্য প্রীতিতে মগ্ন হয়ে পড়েছি, এদিকে সূর্য পর্দার আড়ালে চলে গেছে;
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩৩
رُدُّوۡہَا عَلَیَّ ؕ فَطَفِقَ مَسۡحًۢا بِالسُّوۡقِ وَ الۡاَعۡنَاقِ ﴿۳۳﴾
তখন (সে হুকুম দিল) তাদেরকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো তারপর তাদের পায়ের গোছায় ও ঘাড়ে হাত লাগলো।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩৪
وَ لَقَدۡ فَتَنَّا سُلَیۡمٰنَ وَ اَلۡقَیۡنَا عَلٰی کُرۡسِیِّہٖ جَسَدًا ثُمَّ اَنَابَ ﴿۳۴﴾
আমি সুলাইমানকে পরীক্ষা করলাম এবং তার আসনের উপর রাখলাম একটি দেহ; অতঃপর সুলাইমান আমার অভিমুখী হল।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩৫
قَالَ رَبِّ اغۡفِرۡ لِیۡ وَ ہَبۡ لِیۡ مُلۡکًا لَّا یَنۡۢبَغِیۡ لِاَحَدٍ مِّنۡۢ بَعۡدِیۡ ۚ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡوَہَّابُ ﴿۳۵﴾
তিনি বললেন, ‘হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে দান করুন এমন এক রাজ্য যা আমার পর আর কারও জন্যই প্রযোজ্য হবে না। নিশ্চয় আপনি পরম দাতা।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩৬
فَسَخَّرۡنَا لَہُ الرِّیۡحَ تَجۡرِیۡ بِاَمۡرِہٖ رُخَآءً حَیۡثُ اَصَابَ ﴿ۙ۳۶﴾
তখন আমি বাতাসকে তাঁর জন্য অনুগত করে দিলাম, যা তাঁর হুকুমে যেদিকে সে চাইতো মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হতো।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩৭
وَ الشَّیٰطِیۡنَ کُلَّ بَنَّآءٍ وَّ غَوَّاصٍ ﴿ۙ۳۷﴾
আরও অধীন করে দিলাম শয়তানদেরকে; যারা ছিল সকলেই প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী,
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩৮
وَّ اٰخَرِیۡنَ مُقَرَّنِیۡنَ فِی الۡاَصۡفَادِ ﴿۳۸﴾
এবং আরও অন্যান্যকে; যারা শিকলে বাঁধা থাকত।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৩৯
ہٰذَا عَطَآؤُنَا فَامۡنُنۡ اَوۡ اَمۡسِکۡ بِغَیۡرِ حِسَابٍ ﴿۳۹﴾
(আমি তাঁকে বললাম) “এ আমার দান, তোমাকে ইখতিয়ার দেয়া হচ্ছে, যাকে চাও তাকে দাও এবং যাকে চাও তাকে দেয়া থেকে বিরত থাকো, কোন হিসেবে নেই।”
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪০
وَ اِنَّ لَہٗ عِنۡدَنَا لَزُلۡفٰی وَ حُسۡنَ مَاٰبٍ ﴿٪۴۰﴾
অবশ্যই তাঁর জন্য আমার কাছে রয়েছে নৈকট্যের মর্যাদা ও শুভ পরিণাম।

তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
# ওরা যতােই ক্ষমতার বাহাদুরী করুক, যতই দাপট প্রদর্শন করুক এবং পৃথিবীর বুকে কিছু দিনের জন্যে যতই স্বৈর শাসন কায়েম করে রাখুক, তারপরও ওরা দূর্বল অক্ষম। যুগে যুগে এ জাতীয় স্বৈরাচারীদের আবির্ভাব ঘটেছে, কিন্তু ওদের আল্লাহ তায়ালা পরাজিত বাহিনীদের অন্যতম বাহিনী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এদের প্রসংগ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘তাদের পূর্বেও মিথ্যারােপ করেছিলাে নূহের সম্প্রদায়, কীলক বিশিষ্ট ফেরাউন….'(আয়াত ১২-১৪) কোরায়শ সম্প্রদায়ের পূর্বে ইতিহাসের পাতায় যেসব জাতি ও সম্প্রদায়ের পরিচয় পাওয়া যায় এখানে তাদের সম্পর্কেই বলা হয়েছে। তারা হচ্ছে নূহ, আদ এবং ফেরাউনের সম্প্রদায়- যাদের কীলক বিশিষ্ট বলা হয়েছে। কারণ ফেরাউনদের গড়া পিরামিড দেখতে কীলক বা খুঁটির মতােই মনে হয়। আরও রয়েছে সামূদ, লুত ও শােয়ব সম্প্রদায়। এরা হচ্ছে বিভিন্ন দল ও গােষ্ঠী, যারা অতীতে নবী-রসূলদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের অস্বীকার করেছে। এসব দল ও গােষ্ঠী নিশ্চয়ই ক্ষমতাধর ছিলো, প্রতাপশালী ছিলাে এবং স্বৈরাচারী ও যুলুমবাজ ছিলাে, কিন্তু তাতে কি হয়েছে। আল্লাহর আযাব থেকে তারা রক্ষা পায়নি। তারা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখন যা অবশিষ্ট আছে তা ওদের পরাজয় ও পতনেরই সাক্ষ্য বহন করে। এই ছিলাে অতীতের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া জাতিগুলাের অবস্থা, আর এদের অবস্থা কি হবে? এদের আপাতত ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তবে শেষ বিচারের পূর্বক্ষণে এক বিকট চিৎকারের শিকার হয়ে এরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

বলা হয়েছে, ‘এরা কেবল এক বিকট চিৎকারের অপেক্ষায় আছে, যাতে দম ফেলার অবকাশ থাকবে না।'(আয়াত ১৫) এই বিকট চিৎকার যখন দেয়া হবে তখন নির্ধারিত মূহূর্তেই দেয়া হবে। এক মুহূর্তও এদিক সেদিক হবে না। সেই নির্ধারিত মুহূর্ত পর্যন্ত এই সর্বশেষ উম্মতকে সুযােগ দেয়া হবে। পূর্ববর্তী জাতিগুলাের ন্যায় এদের ধ্বংস করা হবে না, নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে না। এটা নিসন্দেহে আল্লাহর পক্ষ থেকে এদের প্রতি বিরাট রহমত ও দয়া, কিন্তু এরা এই রহমতের যথার্থ মর্যাদা দিতে পারেনি, এই দয়া ও করুণার জন্যে এরা আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি; বরং প্রতিদানের জন্যে এরা নিজেরাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং নির্ধারিত দিনের আগেই তাদের ভাগ্যে যা রাখা হয়েছে তা চুকিয়ে দেয়ার জন্যে দাবী করছে। ওরা বলছে, ‘হে আমাদের মালিক! আমাদের প্রাপ্য অংশ হিসাব দিনের আগেই দিয়ে দাও।'(আয়াত-১৬) এ পর্যন্ত এসেই ওদের প্রসঙ্গের ইতি টানা হয়েছে। এর পর রসূলের প্রতি দৃষ্টিপাত করা হচ্ছে। তাঁকে সান্ত্বনা দেয়া হচ্ছে। তিনি যেন স্বজাতির নির্বোধ ও অসৌজন্যমূলক আচরণে, তাদের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত শাস্তি অস্বীকার করার কারণে এবং আল্লাহর রহমত ও দয়ার প্রতি অকৃতজ্ঞ মনােভাব প্রদর্শনের কারণে মনােক্ষুন্ন না হন। সাথে সাথে তাকে অন্যান্য নবী-রসূলদের জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিপদাপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন এবং জানিয়ে দিচ্ছেন যে, বিপদাপদের পরই আসে আল্লাহর রহমত ও দয়া। এ প্রসংগে বলা হয়েছে, ‘তারা যা বলে তাতে তুমি সবর করাে এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদকে স্মরণ করাে…।’

আম্বিয়ায়ে কেরামের এসব ঘটনাবলী রসূলুল্লাহ(স.)-কে সান্তনাস্বরূপ শুনানাে হচ্ছে যাতে তিনি স্বজাতির বিরােধিতা, অপবাদ ও মিথ্যা দোষারােপের কারণে মনােক্ষুন্ন এবং অধৈর্য না হয়ে পড়েন। একই সাথে এসব ঘটনার মাধ্যমে আম্বিয়ায়ে কেরামের প্রতি আল্লাহর রহমত ও মদদ কি ছিলাে এবং তাদের কি ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি দান করেছিলেন তাও বর্ণনা করা হয়েছে। এই বর্ণনা এসেছে কুরাইশ বংশের লােকদের আপত্তি ও বিস্ময়ের জবাবে। ওরা নবুওত ও রেসালাতের জন্যে হযরত মুহাম্মদ(স.)-এর মনােনয়নের প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলাে। ওদের এসব ঘটনাবলী বর্ণনার মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, রসূলুল্লাহ(স.)-ই কেবল নবী নন, তাঁর পূর্বেও নবী রসূলদের আগমন ঘটেছে। তাঁদের নবুওত ও রেসালাতের পাশাপাশি ক্ষমতা ও আধিপত্যও দান করা হয়েছিলাে আল্লাহর পক্ষ থেকে। শুধু তাই নয়, বরং তাদের মাঝে এমন নবীও ছিলেন যার সাথে সুর মিলিয়ে পাহাড়-পর্বত ও পশু-পক্ষী আল্লাহর তসবীহ পাঠ করত। তাদের মাঝে এমন নবীও ছিলেন, বায়ু এবং জ্বিন-শয়তানকে যার অধীনস্থ ও করায়ত্ত করে দেয়া হয়েছিলাে। যেমন দাউদ ও সোলায়মান(আ.)। তাহলে মোহাম্মদের মতাে একজন সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি কোরায়শ বংশ হতে শেষ যামানার নবী হিসেবে নির্বাচিত করা হলে তাতে আশ্চর্যের কি আছে? এসব ঘটনার মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। তা হলো, নবী রসূলদের প্রতি আল্লাহর সদা সজাগ দৃষ্টি এবং তাদের প্রতি তাঁর সার্বক্ষণিক সাবধানবাণী ও নির্দেশাবলী । কারণ, তারাও মানুষ ছিলেন, যেমন মােহাম্মদ(স.)ও একজন মানুষ। ফলে তাদের মাঝেও মানবিক দুর্বলতা থাকাটা বিচিত্র নয়, কিন্তু তাদের প্রতি যেহেতু আল্লাহ তায়ালা সব সময়ই সজাগ দৃষ্টি রাখতেন, তাই সেই দুর্বলতা প্রকাশের সুযােগ তিনি দেননি; বরং তাদের সব সময়ই সতর্ক করে দিয়েছেন, তাঁদের ত্রুটির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করেছেন, তাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, ক্ষমা করে দেয়ার জন্যে এবং সম্মান বৃদ্ধি করে দেয়ার জন্যে তাদের পরীক্ষা করেছেন। এসব বিষয় জানার মধ্য দিয়ে রসূলুল্লাহ(স.)-এর মনে শান্তি আসবে এবং তিনি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহর দিকনির্দেশনা, সহায়তা ও রক্ষার ব্যাপারে আশ্বস্ত হবেন। আয়াতে বলা হয়েছে, তারা যা বলে তাতে তুমি সবর করাে এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদকে স্মরণ করো…'(আয়াত ১৭-২০) ধৈর্য ধারণ করার নির্দেশের মাধ্যমে নবী রসূলদের জীবনে যেসব বিপদাপদ ঘটে থাকে তার প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। কারণ, তাদের সকলকেই এই বিপদ-সংকুল পথ অতিক্রম করতে হয়েছে, প্রত্যেককেই কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। প্রত্যেককেই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তারা সকলেই ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। কারণ, এই ধৈর্যই হচ্ছে তাদের সম্বল, তাদের স্বভাব। নবী-রসূলদের মর্যাদা অনুসারে তাদের প্রত্যেকের জীবনই ছিলাে নানা পরীক্ষা ও দুঃখ কষ্টের অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণ। এমন কি তাদের জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মুহূর্তগুলােও ছিলাে এক ধরনের পরীক্ষা। ফলে দুঃখ কষ্ট ও অভাব অনটনের মুহূর্তে যেমন ধৈর্যের পরিচয় দিতে হতাে, তেমনিভাবে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হতাে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের মুহূর্তেও। কারণ, এই উভয় অবস্থাই হচ্ছে পরীক্ষা। আর এই পরীক্ষার জন্যে ধৈর্য সহ্যের প্রয়ােজন আছে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত নবী রসূলদের ঘটনাবহুল জীবন পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাব, ধৈর্যই ছিলাে তাদের জীবনের মূল বৈশিষ্ট্য ও উপাদান এবং বিপদাপদ ও পরীক্ষা ছিলাে সেই জীবনের নিত্যসহচর।  *নবী রসূলদের প্রতি আল্লাহর দান : নবী রসূলদের এই মনােনীত জীবন যেন গােটা মানবতার সামনে ধৈর্য ও পরীক্ষার খােলা পৃষ্ঠা, যেখানে লিপিবদ্ধ করা আছে, দুঃখ দুর্দশা ও নির্যাতন উৎপীড়ন সহ্য করে মানবাত্মা কিভাবে বিজয়ী হয়, কিভাবে পৃথিবীর মায়া ও আকর্ষণের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে, কিভাবে লােভ লালসা ও কাম ক্রোধ হতে মুক্ত হতে পারে এবং আল্লাহর রাহে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে কিভাবে পরীক্ষায় উত্তির্ণ হয়ে সব কিছুর ঊর্ধ্বে একমাত্র তাকেই স্থান দেয়। পরিশেষে এ তাদের জীবনের এই খােলা পৃষ্ঠা মানবতাকে লক্ষ্য করে বলে, এই হচ্ছে পথ, সে পথই হচ্ছে উর্ধ্বজগতের পথ, সে পথই হচ্ছে আল্লাহকে পাওয়ার পথ। বলা হয়েছে, ‘ওরা যা বলে তার ওপর তুমি ধৈর্য ধারণ করাে।’ হ্যাঁ, ওরা অনেক কিছুই বলেছে। ওরা নবীকে মিথ্যাবাদী বলেছে, যাদুকর বলেছে, এক মাবুদের এবাদাত করার কথা বলাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছে, উপহাস করেছে। কোরায়শ বংশের মধ্য থেকে একমাত্র তার ওপরই কেন ওহী নাযিল করা হলাে, সে জন্যে ওরা আপত্তি করেছে। এসব কিছুর ওপর ধৈর্য ধারণের জন্যে আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন। তাকে এ সকল কাফের মােশরেকদের পরিবর্তে পবিত্র আত্মার অধিকারী নবী-রসূলদের সাথে আত্মার সম্পর্ক সৃষ্টি করে এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে বলছেন। কারণ, নবী-রসূলদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিলাে, বংশের সম্পর্ক ছিলাে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিলাে। আর সে কারণেই রসূলুল্লাহ(স.) তাদের ভাই বলে উল্লেখ করতেন। আলােচ্য আয়াতে দাউদ(আ.)-এর কথা স্মরণ করতে বলা হয়েছে এবং তাকে শক্তিশালী বান্দা ও প্রত্যাবর্তনশীল’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর আগে নূহ, আদ, ফেরাউন, সামূদ ও আইকার লোকের সহ বিভিন্ন শক্তিধর ও প্রতাপশালী সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে। এদের শক্তির বহিপ্রকাশ ঘটত তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অহমিকা এবং আল্লাহদ্রোহিতার মাধ্যমে। অপরদিকে দাউদ(আ.)ও শক্তিধর ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন আল্লাহমুখী। তাই তিনি ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েও ছিলেন আল্লাহর অনুগত, এবাদাতগােযার ও যাকের বান্দা। ইতিপূর্বে সূরা বাকারায় দাউদ(আ.)-এর ঘটনায় আমরা দেখেছি, তিনি তালুতের বাহিনীতে ছিলেন। বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের লােকেরা তাদের নবীর কাছে একজন শাসক প্রেরণের জন্যে অনুরোধ জানালে তিনি তালুতকে শাসক হিসেবে নির্বাচিত করেন। তখন তিনি জালুত ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। যুদ্ধের ময়দানে দাউদ(আ.) জালুতকে হত্যা করেন। তখন তিনি ছিলেন অল্প বয়সের একজন তরুণ। এর ফলে তার জন্যে সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায় এবং পরবর্তীতে তিনিই তালুতের স্থলাভিষিক্ত হন, কিন্তু তা সত্তেও তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগত বান্দা, একজন এবাদতগােযার বান্দা, একজন যাকের বান্দা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারী একজন বান্দা। নবুওত ও রষ্ট্রক্ষমতার পাশাপাশি আল্লাহ দাউদ(আ.)-কে ধ্যানমগ্ন অন্তর ও সুমধুর কণ্ঠস্বর দান করেছিলেন। ফলে তিনি যখন ধ্যানে মগ্ন এবং তেলাওয়াতে মশগুল হতেন তখন তার অস্তিত্ব এই গােটা প্রকৃতির অস্তিত্বের সাথে একাকার হয়ে যেতাে। পাহাড় পর্বত ও পশু পক্ষীর অস্তিত্বের সাথে তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়ে একক সত্তা হিসেবে স্রষ্টার গুণগান ও আরােধনায় মত্ত হয়ে যেতাে। তখন দেখা যেতাে, পাহাড় পর্বত ও তার কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে তসবীহ পাঠ করছে আর পশু পক্ষীও তার সুরে সুর মিলিয়ে মহান স্রষ্টা ও প্রতিপালকের গুণগান গাচ্ছে। বলা হয়েছে, ‘আমি পর্বতমালাকে তার অনুগামী করে দিয়েছিলাম, তারা সকাল সন্ধ্যায় তার সাথে পবিত্রতা ঘোষণা করতে; আর পক্ষীকুলকেও, যারা তার কাছে সমবেত হত । সবাই ছিলাে তার প্রতি প্রত্যাবর্তনশীল।'(আয়াত ১৮-১৯) এটা একটা বিস্ময়কর ব্যাপার। প্রাণহীন পাহাড় পর্বত দাউদ(আ.) এর সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আল্লাহর তসবীহ পাঠ করছে; পশু পক্ষী তার সুমধুর কন্ঠের আকর্ষণে তাঁর সামনে ভিড় করছে এবং তারাও তার সাথে সুর করে আল্লাহর গুণগান গাইছে, এটা মানুষের কাছে একটা অভাবনীয় বিষয়। কারণ, বাস্তবে তারা এমনটি ঘটতে দেখে না। তাছাড়া তারা মানুষ, প্রাণী ও জড় পদার্থের মধ্যে বিরাট তফাতও দেখতে পায়। এমতাবস্থায় মানুষের সাথে পশু পাখী বা পাহাড় পর্বত কণ্ঠ মিলিয়ে কিভাবে আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করতে পারে সেটা তাদের বােধগম্য নয়। কিন্তু এখানে অসম্ভবেরও কিছু নেই এবং অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ, গােটা সৃষ্টিজগত হচ্ছে একটা একক সত্ত্বা। বিভিন্ন জাতি প্রজাতি, আকৃতি প্রকৃতির আড়ালে গােটা সৃষ্টিজগত আসলে একটি মাত্রই সত্ত্বা। আর এই গােটা সত্ত্বার সম্পর্ক যখন সম্পর্ক হচ্ছে একক স্রষ্টার সাথে । তাই মানুষের স্রষ্টার সাথে গভীর হয়, দৃঢ় হয় এবং খাটি হয় তখন সকল ব্যবধান ঘুচে যায়, সকল আড়াল মুছে যায় এবং একক সত্ত্বায় আবির্ভূত হয়। ফলে দৃশ্যমান জগতে জাতি, প্রজাতি, আকৃতি প্রকৃতির যে ব্যবধান পরিলক্ষিত হয় তার বিলুপ্তি ঘটে এবং সবাই তখন একাকার হয়ে যায়। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দা দাউদ(আ.)-কে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন। পাহাড় পর্বত তার করায়ত্ত করে দিয়েছিলেন। ফলে সকাল বিকাল সেগুলাে তার সাথে তাসবীহ পাঠ করত। করায়ত্ত করে দিয়েছিলেন। ফলে সেগুলো তার সামনে জড়াে হয়ে সুর করে আল্লাহর গুণগান গাইত। এগুলাে ছিলাে একান্তই আল্লাহর দান। নবুওত, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এসব অসাধারণ গুণাবলীও দান করেছিলেন। তার সম্বন্ধে আরও বলা হয়েছে, ‘আমি তাঁর সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা।'(আয়াত ২০) অর্থাৎ তার সম্রাজ্য দৃঢ় ছিলাে, শক্তিশালী ছিলাে। তিনি প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সাথে সেই সম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন বাগ্মী ও দৃঢ় মতামতের অধিকারী। সাথে সাথে তিনি ছিলেন অপূর্ব জ্ঞান প্রজ্ঞা এবং দুর্দান্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মালিক। তৎকালীন সময়ে তার সমকক্ষ আর কেউ ছিলাে না।

এতাে সৰ সতেও দাউদ(আ.) পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। আল্লাহর দৃষ্টি তার ওপর সদা নিবদ্ধ ছিলাে। তার প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ এই পর্যবেক্ষণের আওতায় ছিলাে যেন তিনি সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারেন, ভুল-ভ্রান্তি থেকে রক্ষা পান। তার দুর্বলতা ও ভুল-ভ্রান্তির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করার জন্যে আল্লাহর হাতও ছিলাে সক্রিয়। বলা হয়েছে, ‘তােমার কাছে দাবীদারদের বৃত্তান্ত পৌঁছেছে কি? যখন তারা প্রাচীর ডিঙিয়ে এবাদাতখানায় প্রবেশ করেছিল….'(আয়াত ২১-২৪)  *দাউদ(আ.)-এর পরীক্ষা : এই পরীক্ষামূলক ঘটনার বিবরণ হলাে এই যে, দাউদ(আ.) যিনি একাধারে নবীও ছিলেন। এবং শাসকও ছিলেন-তার সময়ের কিছু অংশ সাম্রাজ্য পরিচালনা ও প্রজাদের বিচার-আচারে ব্যয় করতেন- আর কিছু অংশ ব্যয় করতেন এবাদত বন্দেগী, যিকির আযকার, তেলাওয়াত এবং আল্লাহর ধ্যানে। সে কাজগুলাে তিনি নির্জনে এবাদতখানায় করতেন। তিনি যখন থেকে এবাদাতখানায় প্রবেশ করতেন তখন বের হয়ে না আসা পর্যন্ত সেখানে কেউ প্রবেশ করত না। একদিন তিনি দু’জন লােককে প্রাচীর ডিঙিয়ে এবাদাতখানায় প্রবেশ করতে দেখে অবাক হলেন এবং কিছুটা ভীতও হলেন। কারণ, তার কোনাে অনুসারীর পক্ষে এমনটি করা সম্ভব ছিলাে না। যাহােক, লোক দুটো তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘ভয় করবেন না, আমরা বিবদমান দুটি পক্ষ, একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছি। অতএব আমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করুন, অবিচার করবেন না।’ এরপর এদের এক পক্ষ বললাে, “সে আমার ভাই, সে নিরানব্বইটি দুম্বার মালিক, আর আমি হলাম একটি মাদী দুম্বার মালিক। এরপরও সে বলে এটিও আমাকে দিয়ে দাও, সে কথাবার্তায় আমার ওপর বল প্রয়ােগ করে।’ (আয়াত ২৩) এই পক্ষের বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, ব্যাপারটি ছিলাে অত্যন্ত অন্যায় ও গর্হিত কাজ। এখানে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কোনাে অবকাশ নেই। অত্যন্ত সুস্পষ্ট বিষয়। তাই দাউদ(আ.) অপর পক্ষের বক্তব্য না শুনেই এবং তাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়েই এ ব্যাপারে তাঁর রায় ঘােষণা দিয়ে বললেন, ‘সে তােমার দুম্বা কে নিজের দুম্বাগুলাের সাথে সংযুক্ত করার দাবী করে তােমার প্রতি অবিচার করেছে। শরীকদের অনেকেই একে অপরের প্রতি যুলুম করে থাকে। তবে তারা করে না যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ও সৎকর্ম সম্পাদনকারী । অবশ্য এমন লােকের সংখ্যা কম।’ (আয়াত ২৪) মনে হয় তিনি যখন এই রায় ঘােষণা করছিলেন তখন লােক দুটো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলাে। আসলে তারা ছিলাে ফেরেশতা। মানুষের আকৃতি ধারণ করে দাউদ(আ.)-কে পরীক্ষা করার জন্যে তার কাছে এসেছিলাে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা দাউদ(আ.)-কে নবুওতের পাশাপাশি মানুষের মাঝে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বও দান করেছিলেন। তিনি এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন কিনা, তা পরীক্ষা করার জন্যেই ওই দুজন ফেরেশতাকে তার কাছে পাঠানাে হয়েছিলাে। তারা অত্যন্ত উত্তেজনাকর একটি বিষয় নিয়ে দুই বিবদমান পক্ষ সেজে তার সামনে উপস্থিত হয়েছিলাে এবং কেবল এক পক্ষই তার বক্তব্য অত্যন্ত জোরালাে ও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পেরেছিলাে। বাদী উত্তেজিত হলেও বিচারকের কখনও উত্তেজিত হওয়া উচিত নয়, ত্বড়িৎ রায় ঘােষণা করাও উচিত নয়। একজন ন্যায়বিচারক কখনও কেবল এক পক্ষের বক্তব্য শুনেই রায় ঘােষণা করে না; বরং বিপক্ষকেও তার বক্তব্য ও যুক্তি পেশ করার সুযােগ দেয়। উভয় পক্ষের বক্তব্য সামনে আসার পর অনেক সময় মামলার মােড় ঘুরে যায় এবং প্রমাণিত হয়, একতরফা বক্তব্য বিভ্রান্তিকর অথবা মিথ্যা ছিলাে, অথবা অসম্পূর্ণ ছিলাে। এই পর্যায়ে এসে দাউদ(আ.) বুঝতে পেরেছিলেন যে, লােক দুটো তাকে পরীক্ষা করে গেলাে। আর তখনই তার মাঝে নবীসুলভ স্বভাব প্রকৃতি জেগে ওঠে। তিনি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে সাজদায় লুটিয়ে পড়লেন এবং তার দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন। দয়াময় আল্লাহও তাকে ক্ষমা করে দিলেন। বলা হচ্ছে, ‘আমি তার সে অপরাধ ক্ষমা করলাম। নিশ্চয়ই আমার কাছে তার রয়েছে উচ্চমর্যাদা ও সুন্দর আবাসস্থল।'(আয়াত ২৫) পরবর্তী আয়াতের বর্ণনা দ্বারা দাউদ(আ.)-এর পরীক্ষার ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায় এবং সাথে সাথে সেই কথাও বুঝা যায় যে, আল্লাহ তার সেসব বান্দাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দান করেন তাদের কাছ থেকে তিনি কি ধরনের আচরণ কামনা করেন। বলা হচ্ছে, ‘হে দাউদ! আমি তােমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব, তুমি মানুষের মাঝে ন্যায়সংগতভাবে রাজত্ব কর এবং খেয়াল খুশীর অনুসরণ করাে না। তা তােমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে।'(আয়াত ২৬) অর্থাৎ যাদের পৃথিবীর বুকে প্রতিনিধির দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়েছে তাদের উচিত ন্যায়সঙ্গতভাবে মানুষকে শাসন করা, তাদের বিচার আচার করা এবং এসব ক্ষেত্রে খেয়াল খুশীর অনুসরণ না করা। একজন নবীর ক্ষেত্রে খেয়াল খুশীর অনুসরণ বলতে যা বুঝায় তা হলাে, প্রকৃত অবস্থা না জেনে, আগপাছ না ভেবে এবং নিশ্চিত না হয়ে, আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনাে কিছু করা। আর সেই জাতীয় খেয়াল-খুশীর অনুসরণের কারণে পরিণামে মানুষ আল্লাহর রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। পরক্ষণেই এই বিপথগামিতার পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। সে মতে যারাই আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত হবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ভুলে যাবেন এবং পরকালে তারা কঠিন শাস্তির শিকার হবে। কিন্তু দাউদ(আ.)-এর প্রতি আল্লাহর বিশেষ দৃষ্টি ছিলাে। সে কারণেই তিনি তাকে প্রথম দফায়ই হুঁশিয়ার করে দেন, প্রথম পদক্ষেপেই তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং এর চরম পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। অথচ তিনি বিপথগামিতার পথে পা বাড়াননি, আর এটাই হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী যা তিনি বিশেষ বান্দাদের বেলায় করে থাকেন। এ সকল বান্দারা মানব হয়েও চলার পথে তাঁদের পা খুব কমই ফস্কায়। তাই তাদের এই বিচ্যুতি আল্লাহ তাআলা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন, তাদের রক্ষা করেন, পথনির্দেশ করেন, ক্ষমা প্রার্থনার তাওফীক দান করেন, তাদের ক্ষমা করে দেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাদের প্রতি বিশেষ দয়া ও রহমত করেন। পৃথিবীর বুকে খেলাফতের দায়িত্ব এবং মানব সমাজে শাসনকার্য পরিচালনা সম্পর্কিত সঠিক নীতি বর্ণনার মুহূর্তে এবং দাউদ(আ.)-এর প্রসংগের ইতি টানার পূর্বেই এই সত্য নীতির মূল ভিত্তির প্রতি ইংগিত করা হচ্ছে। এই সেই ভিত্তি যার ওপর আসমান ও যমীন এবং এর মধ্যকার সকল বস্তু নির্ভর করে আছে। গােটা সৃষ্টিজগতের গভীরে এই ভিত্তি প্রােথিত রয়েছে। সেই ভিত্তি পৃথিবীতে খেলাফতের দায়িত্ব থেকেও ব্যাপক এবং মানব সমাজে শাসনকার্য পরিচালনার চেয়েও ব্যাপক। সেই ভিত্তি এই পৃথিবীর চেয়ে অনেক বড় এবং এই জাগতিক জীবনের পরিধির তুলনায় অনেক প্রশস্ত। কারণ তা ইহজগতকে অতিক্রম করে পরকালীন জগত পর্যন্ত প্রসারী। এই মূল ভিত্তি থেকেই সর্বশেষে রেসালাত উদ্ভূত এবং এর ওপরই প্রতিষ্ঠিত। সেই মহান ও সর্বব্যাপী সত্যের ভিত্তি কি, ‘আমি আসমান-যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী কোনাে কিছু অযথা সৃষ্টি করিনি। এটা কাফেরদের ধারণা। অতএব, কাফেরদের জন্যে রয়েছে দুর্ভোগ, অর্থাৎ জাহান্নাম।'(আয়াত ২৭-২৯) অর্থাৎ আসমান ও যমীন এবং এই উভয়ের মধ্যকার কোনাে বস্তুই না হকভাবে পয়দা করা হয়নি এবং এগুলাে না-হক বা বাতিলের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়; বরং এ সবের সৃষ্টিও সত্য এবং এসবের ভিত্তিও সত্য। আর এই মহাসত্য হতেই উদ্ভূত হয়েছে অন্যান্য সকল সত্য। যেমন খেলাফতের সত্যতা, শাসনকার্যের সত্যতা এবং মানবীয় অনুভূতি ও কর্মের মূল্যায়নের সত্যতা। কাজেই যারা ঈমানদার এবং সৎকর্মশীল তারা কখনও পৃথিবীতে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের ন্যায় হতে পারে না। তেমনিভাবে সৎ ও আল্লাহভীরু লােকেরা কখনও অসৎ আল্লাহদ্রোহী লােকদের সমপর্যায়ের হতে পারে না। আর এই সত্য যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে এসেছে, তা অনুধাবন করার মতাে শক্তি কোনাে কাফেরের নেই। কারণ, তাদের স্বভাব প্রকৃতি এই সৃষ্টিজগতের মধ্যকার মূল সত্যটির সাথে সম্পৃক্ত নয়। সেই কারণেই তারা নিজেদের স্ৰষ্টা ও প্রতিপালকের সম্পর্কে ভুল ধারণা পােষণ করে থাকে, কিন্তু এই ভুল ধারণার জন্যে তাদের জাহান্নামে অনেক দুর্ভোগ পােহাতে হবে। যে প্রাকৃতিক বিধানের আওতায় আল্লাহ তায়ালা বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন, তারই আওতায় মানব জাতির জন্যে জীবন বিধান হিসেবে শরীয়ত প্রবর্তন করেছেন। আর তিনি যে ঐশী গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন তা হচ্ছে সেই মহাসত্যের ব্যাখ্যাস্বরূপ, যার ওপর সে প্রাকৃতিক বিধান টিকে আছে। অপরদিকে খেলাফত, শাসন ও বিচার নিয়ােজিত ব্যক্তিবর্গের কাছে আল্লাহ তায়ালা যে ন্যায়নীতি দাবী করেন তা সে সামষ্টিক মহাসত্যেরই একটি অংগ। বলাবাহুলা, এই সামষ্টিক মহাসত্যের অংগগুলাে সব সুসংঘবদ্ধ ও সুসংহত না হলে মানব জীবনের কোনা কিছুই সঠিক ধারায় প্রবাহিত হতে পারে না। আর সে কারণেই বলতে পারি, আল্লাহর বিধান হতে বিচ্যুতি, খেলাফতের সত্য নীতি হতে বিচ্যুতি এবং শাসন ও বিচারকার্যের ন্যায়নীতি হতে বিচ্যুতি হচ্ছে সেই প্রাকৃতিক বিধান হতে বিচ্যুতিরই নামান্তর, যার ওপর ভিত্তি করে আসমান ও যমীন টিকে আছে। এই হিসেবে দেখতে গেলে বিষয়টি অমংগলেরও কারণ। তাই যারাই এই বিশাল জাগতিক শক্তিগুলাের সাথে টক্কর দিতে যাবে পরিণতিতে তারাই ধ্বংস হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যারা অত্যাচারী, যারা স্বৈরাচারী এবং যারা আল্লাহর নীতি থেকে বিচ্যুত, বিচ্যুত প্রাকৃতিক বিধান থেকে, বিচ্যুত সৃষ্টিজগতের স্বভাব প্রকৃতি থেকে তারা কখনও নিজেদের স্বল্প ও নগণ্য শক্তি নিয়ে সে সর্বনাশী ও সর্বগ্রাসী শক্তির সামনে টিকে থাকতে পারে না এবং টিকে থাকতে পারে না বিশ্ব জগতের সেই বিশাল নিষ্পেষক চাকার সম্মুখে। জ্ঞানী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের বিষয়টি চিন্তা করে দেখতে হবে।
* সােলায়মান(আ.)-এর পরীক্ষা : সেই মহাসত্যের প্রকৃতি উৎঘাটন করতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসা বক্তব্যের পর এখন মূল ঘটনার দিকে যাওয়া হচ্ছে। এখানে দাউদ(আ.)-এবং তাঁর পুত্র সােলায়মান(আ.) এর প্রতি আল্লাহর বিশেষ দান, করুণা ও দয়া কি ছিলো, সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে। সাথে সাথে সােলায়মান(আ.)-কে কি কি ভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং কিভাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে রক্ষা করেছেন ও কৃতার্থ করেছেন, সে বিষয়েও বলা হচ্ছে। যেমন, ‘আমি দাউদকে সােলায়মান দান করেছি। সে একজন উত্তম বান্দা। সে ছিলাে প্রত্যাবর্তনশীল।'(আয়াত ৩০-৪০) আলােচ্য আয়াতগুলােতে দুটো ইঙ্গিতময় শব্দের ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। একটি হলো উৎকৃষ্ট অশ্বরাজি আর অপরটি হলাে, নিথর দেহ। এই শব্দ দুটোর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে যা বলা হয়েছে তাতে আমার মন আশস্ত হতে পারছে না। কারণ সে ব্যাখ্যাগুলাে হয়ত অনেকটা ভ্রান্ত ইসরাঈলী বর্ণনার ওপর অথবা দলীল প্রমাণহীন মনগড়া বক্তব্যের ওপর নির্ভরশীল। সেই কারণেই উক্ত শব্দ দুটোর আড়ালে কোন ঘটনার কথা বলা হয়েছে, তার প্রকৃতি সম্পর্কে আমি চিন্তা করে কিছু বলতে পারছি না। তাছাড়া এমন কোনাে বিশুদ্ধ হাদীসও আমার সামনে নেই যার ওপর নির্ভর করে আমি সে দুটো শব্দের ব্যাখ্যায় ও বর্ণানায় নিরত হব। অবশ্য হযরত আবু হােরায়রা(রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি বিশুদ্ধ হাদীস রসূলুল্লাহ(স.)-এর বরাত দিয়ে বােখারী শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসটি নিসন্দেহে বিশুদ্ধ, কিন্তু আলােচ্য ঘটনা দুটোর কোনটির সাথে এর সম্পর্ক সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। হাদীসটির বক্তব্য এরূপ, ‘সােলায়মান বলল, আমি আজ রাতে সত্তর জন স্ত্রীর সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হব যাদের প্রত্যেকের গর্ভে বীর সন্তান জন্ম লাভ করবে, যারা আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করবে। সে ইনশাআল্লাহ বলেনি। সে তাদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হলাে, কিন্তু একজন ছাড়া আর কেউ গর্ভধারণ করেনি, আর সেও একজন অর্ধাংগ সন্তান প্রসব করল । আমি সেই সত্ত্বার শপথ করে বলছি যার হাতে আমার প্রাণ, যদি সে ইনশাআল্লাহ বলতাে, তাহলে (আর ঔরসে) বীর সন্তান জন্ম লাভ করত যারা সকলেই আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করত। হতে পারে এটাই সেই পরীক্ষা যার কথা আয়াতে বলা হয়েছে। অথবা ‘নিথর দেহ’ বলতে এই অর্ধাঙ্গ শিশুটিকেই বুঝানাে হয়েছে। মােটকথা, নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। যা কিছু বলা হলাে তা নিছক অনুমান। আর ঘােড়ার কাহিনী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সােলায়মান(আ.) বিকেল বেলায় তাঁর সুসজ্জিত ঘােড়াগুলাে পরিদর্শন করছিলেন। এর ফলে তাঁর আছরের নামায কাযা হয়ে যায়। তাই তিনি সেগুলােকে পুনরায় তার সামনে আনতে বললেন। তার সামনে সেগুলো আনা হলাে। তখন তিনি সেগুলোর গলা ও পা কেটে দিলেন। অর্থাৎ যবাই করে দিলেন। কারণ এগুলাের কারণেই তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং নামাযের সময় অতিবাহিত হয়ে যায় । অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি ঘােড়াগুলাের গলায় ও পায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে দেন। কারণ, এগুলাে আল্লাহর রাস্তায় ব্যবহৃত হয়। এই উভয় বর্ণনার কোনাে একটিরই দলীল প্রমাণ নেই। কাজেই এ সম্পর্কে দৃঢ়ভাবে কিছু বলা কঠিন ব্যাপার। সেই কারণেই কোরআনে বর্ণিত ঘটনা দুটোর ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে কেউ কিছু বলতে পারে এখানে আমরা বড়জোর এতােটুকু বলতে পারি যে, অন্যান্য নবী রসূলদের আল্লাহ তায়ালা যেভাবে পরীক্ষা করেছেন ঠিক সেভাবেই সােলায়মান(আ.)-কেও ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দান করে পরীক্ষা করেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা, দিকনির্দেশনা দেয়া এবং ক্রুটি বিচ্যুতি হতে দূরে রাখা। অপর দিকে সােলায়মান (আ.)ও নিজ প্রভুর প্রতি আত্মনিবেশ করেছেন, তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে বড় আশা নিয়ে ফরিয়াদ জানান, ‘হে আমার পালনকর্তা। তুমি আমাকে মাফ করো এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য দান করাে যা আমার পরে আর কেউ পেতে পারবে না, নিশ্চয় তুমি মহাদাতা।'(আয়াত ৩৫) সােলায়মান(আ.)-এর এই আবেদনের সবচেয়ে যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, তিনি এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত প্রভাব প্রতিপত্তি কামনা করেননি; বরং তিনি এর মাধ্যমে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণ কামনা করেছেন যার বহিপ্রকাশ ঘটবে মােজেযা আকারে। তিনি এর মাধ্যমে বিশেষ এক ধরনের শাসন ক্ষমতা প্রার্থনা করেছেন। যার ভাগীদার পরবর্তী যুগের অন্য কোনাে শাসক হবে না এবং যার অস্তিত্ব হবে অদ্বিতীয়। আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই দোয়া কবুল করেছেন এবং তাকে তার কাংখিত শাসন ক্ষমতারও অতিরিক্ত দান করেছেন, যার কোনাে নফি নেই। বলা হয়েছে, ‘তখন আমি বাতাসকে তার অনুগত করে দিলাম, যা তার হুকুমে অবাধে প্রবাহিত হতাে যেখানে সে পৌছাতে চাইতে।'(আয়াত ৩৬-৩৭) বাতাস আল্লাহর হুকুমেই চলে। তাই তিনি যদি এটাকে তার বিশেষ কোনাে বান্দার অনুগত করে দেন তাহলে সেটাও আল্লাহর হুকুমেরই বাস্তবায়ন বলে গণ্য হবে। এ কারণে বলা যাবে না যে, বাতাসের ওপর আল্লাহর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা খৰ্ব হয়েছে; বরং বলা হবে, আল্লাহর সেই বিশেষ বান্দার নির্দেশের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশেরই বহিপ্রকাশ ঘটেছে। এটা কোনাে অসম্ভব ব্যাপার নয়। এর দৃষ্টান্তও কোরআন শরীফে রয়েছে। যেমন সূরা আহযাবের ৬০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মোনাফেকরা’ যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা এবং মদীনায় গুজব রটনাকারীরা যদি বিরত না হয় তবে আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে তােমাকে উত্তেজিত করবাে। ‘অতপর এই শহরে তােমার প্রতিবেশী অল্পই থাকবে।’ এর অর্থ কি? এর অর্থ এই নয় কি, মােনাফেকগােষ্ঠী তাদের অপকর্ম বন্ধ না করলে আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে রসূলকে উত্তেজিত করবেন, ফলে তিনি তাদের মদীনা থেকে বহিষ্কার করবেন। এখানে প্রকৃতপক্ষে রসূলের কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটছে। তাই বলতে পারি, প্রকৃত ইচ্ছা ও নির্দেশ হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর তার বাস্তবায়ন ঘটছে রসূলের কর্মের মাধ্যমে। ঠিক এই পর্যায়েই পড়ে সােলায়মান(আ.)-এর বিষয়টিও। অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশেই বাতাসকে সােলায়মান(আ.)-এর অনুগত করা হয়েছে। ফলে তিনি এটাকে যেখানে ইচ্ছা প্রবাহিত করতে পারতেন, কিন্তু তার এই কর্মকান্ডের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নির্দেশ ও ইচ্ছারই বহিপ্রকাশ ঘটতাে। ঠিক এইভাবে আল্লাহ তায়ালা শয়তানদেরও সােলায়মান(আ.)-এর অনুগত করেছিলেন। ফলে তারা তাঁর নির্দেশে দালান কোঠা নির্মাণ করত এবং সমুদ্রে ডুব দিত। এদের কেউ অপরাধ করলে বা নির্দেশ অমান্য করলে তাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতাও তাকে দেয়া হয়েছিলাে। তিনি তাদের শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতেন অথবা বেড়ি পরিয়ে রাখতেন। এরপর সােলায়মান(আ.)-কে লক্ষ্য করে বলা হয় যে, তােমাকে ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও ধন-সম্পদ আকারে যা কিছু দান করা হয়েছে সে ব্যাপারে তুমি স্বাধীন। যাকে যা ইচ্ছা দান করতে পারাে, অথবা যার কাছ থেকে যতােটুকু ইচ্ছা আটকে রাখতে পারাে। বলা হয়েছে, ‘এগুলাে আমার অনুগ্রহ। অতএব এগুলাে কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও এর কোনাে হিসেব দিতে হবে না।’ (আয়াত ৩৯) এটা হচ্ছে সােলায়মান(আ.)-এর প্রতি আল্লাহর অতিরিক্ত দয়া ও দান। এর ওপরও অতিরিক্ত দান হিসেবে ইহকালে রয়েছে বিশেষ মর্যাদা আর পরকালে রয়েছে উত্তম পরিণতি। বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই তার জন্যে আমার কাছে রয়েছে মর্যাদা ও শুভ পরিণতি।'(আয়াত ৪০) এই হচ্ছে সােলায়মান (আ.)-এর প্রতি আল্লাহর শুভদৃষ্টি, সন্তুষ্টি এবং অশেষ অনুগ্রহ ও সম্মানের নমুনা।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১২-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সমসাময়িকসহ সকল যুগের কাফির ও মুশরিকদের লক্ষ্য করে বলছেন : শুধু তোমরাই না বরং তোমাদের পূর্বযুগে অনেক জাতি যেমন নূহ, আদ, লূত (আঃ)-এর জাতি এবং ফির‘আউন নাবী-রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। ফলে তাদেরকে শাস্তি পাকড়াও করেছে। অতএব তোমরাও এরূপ করলে তোমাদের প্রতি বিধান ব্যতিক্রম হবে না। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফ, হূদ ও নামলসহ পূর্বে একাধিক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।

(ذُو الْأَوْتَادِ)

অর্থ “কীলকওয়ালা ফির‘আউন” তাফসীরে এর কয়েকটি অর্থ পাওয়া যায়, যেমন : ফির‘আউন অনেক শক্তি ও সৈন্যবাহিনীর অধিকারী ছিল। কেউ বলেছেন, সে মানুষকে চিৎ করে শুইয়ে তার চার হাত পায়ে কীলক এঁটে দিত এবং তার ওপর সাপ বিচ্ছু ছেড়ে দিত। এটাই ছিল তার শাস্তি দানের পদ্ধতি। কেউ বলেছেন, এখানে কীলক দ্বারা সুদৃঢ় অট্টালিকা বুঝানো হয়েছে।

(وَّأَصْحٰبُ لْئَيْكَةِ)

‘আইকার অধিবাসীরা’ আইকা অর্থ জঙ্গল, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল শুআইব (আঃ)-এর জাতি। এটা বলার কারণ হল, এই অবাধ্য জাতি প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ট হয়ে নিজেদের বসতি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সেখানেই ধ্বংস করে দেন। এটাও বলা হয় যে, উক্ত জঙ্গলে ‘আইকা’ বলে একটা গাছকে তারা পূজা করত। যার আশপাশ জঙ্গল বেষ্টিত ছিল। এদের সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৮৫-৯৩ ও হূদের ৮৪-৯৫ নম্বর আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

(صَيْحَةً وَّاحِدَةً)

অর্থাৎ কিয়ামতের জন্য যে ফুঁৎকার দেয়া হবে তারা সে ফুঁৎকারের অপেক্ষা করে। فَوَاقٍ এর একাধিক অর্থ রয়েছে, যেমন : (এক) একবার দুগ্ধ দোহনের পর পুনরায় স্তনে দুধ আসার মধ্যবর্তী সময়কে فَوَاقٍ বলা হয়। (দুই) সুখ-শান্তি। উদ্দেশ্য হল; ইসরাফিল (আঃ)-এর শিঙ্গার ফুঁক অনবরত চলতে থাকবে এতে কোন বিরতি থাকবে না (কুরতুবী)। قِطَّ অর্থ শাস্তির অংশ, অর্থাৎ মক্কার মুশরিকরা বলে আমরা পথভ্রষ্ট হলে বিচার দিনের পূর্বে আমাদেরকে শাস্তি দেয়া হোক।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলদের বিরোধিতা করা কাফের-মুশরিকদের কাজ।
২. ফিরআউনের মতো শক্তিধর শাসকও রাসূলের বিরোধিতা করে সফল হয়নি। অতএব এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত।

১৭-২৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে কাফির-মুশরিকদের অশোভনীয় কথায় ধৈর্য ধারণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন যেমন পূর্ববর্তী নাবীগণ ধৈর্য ধারণ করেছেন। তাদের কথা সত্যের কোন ক্ষতি করতে পারবে না এবং তোমারও কোন ক্ষতি করতে পারবে না, বরং এসব কথা তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। তাই ইবাদতের মাধ্যমে ধৈর্য ধারণের সহযোগিতা কামনা করার নির্দেশ দিয়ে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(فَاصْبِرْ عَلٰي مَا يَقُوْلُوْنَ وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا ج وَمِنْ اٰنَآئِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ لَعَلَّكَ تَرْضٰي)‏

“সুতরাং তারা যা বলে, সে বিষয়ে তুমি ধৈর্য ধারণ কর‎ এবং সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর‎ এবং রাত্রিকালে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর‎, এবং দিবসের প্রান্ত‎সমূহেও, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার।” (সূরা ত্ব-হা ২০ : ১৩০)

নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দেয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নাবী দাঊদ (আঃ) ও তাঁকে যে সকল মু‘জিযাহ দান করেছিলেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

দাঊদ (আঃ)-এর সাহস ও বীরত্ব সম্পর্কে সূরা বাক্বারার ২৪৬-২৫২ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী ছিলেন দাঊদ (আঃ)। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে নবুওয়াত ও মানুষের মাঝে বিচার-ফায়সালা করার প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। বর্তমান ফিলিস্তীনসহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁর রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। দাঊদ (আঃ) হলেন আল্লাহ তা‘আলার সেই বান্দা যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম (আঃ) স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে নিয়ে দান করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুপারিশ করেছিলেন এবং সেই হিসেবে দাঊদের বয়স ৬০ হতে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়। (তিরমিযী, মিশকাত হা. ১১৮, হাসান সহীহ)

আলোচ্য আয়াতগুলোতে দাঊদ (আঃ)-এর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হয়েছে। যেমন-

(১) আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ (আঃ)-কে আধ্যাত্মিক ও দৈহিক শক্তিতে বলিয়ান করে সৃষ্টি করেছিলেন। দৈহিক ও দুনিয়াবী শাসন শক্তির কথার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে- (ذَا الْأَيْدِ) । আর আধ্যাত্মিক শক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে (اِنَّھ۫ٓ اَوَّابٌ)। দাঊদ (আঃ) তাঁর জাতির পক্ষ থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন এবং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে খুব মনোযোগী ছিলেন। তিনি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে এত দৃঢ়পদ ও অটুট ছিলেন যে, তাঁর সাথে তাসবীহ পাঠ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা পাহাড় ও পক্ষীকুলকে অনুগামী করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :

(وَلَقَدْ اٰتَيْنَا دَاو۫دَ مِنَّا فَضْلًا ط يٰجِبَالُ أَوِّبِيْ مَعَه۫ وَالطَّيْرَ ج وَأَلَنَّا لَهُ الْحَدِيْدَ‏)‏

“আর আমি দাঊদকে দিয়েছিলাম আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ (যেমন বলেছিলাম) হে পাহাড়-পর্বত! তোমরা দাঊদের সাথে আমার পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং পাখিগুলোকেও এমন আদেশ দিয়েছিলাম। আর তার জন্য আমি লৌহকে নরম করেছিলাম।” (সূরা সাবা ৩৪ : ১০) যখন দাঊদ (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার যিকির করতেন তখন পাহাড় ও পক্ষীকূল তাঁর সাথে যিকির করত, তিনি তাদের যিকির করা বুঝতে পারতেন। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে যদিও আমরা বুঝতে পারি না। (সূরা ইসরা ১৭ : ৪৪)

হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক প্রিয় সালাত হল দাঊদ (আঃ)-এর সালাত এবং সর্বাধিক প্রিয় সিয়াম হল দাঊদ (আঃ)-এর সিয়াম। তিনি অর্ধরাত্রি পর্যন্ত ঘুমাতেন। অতঃপর এক তৃতীয়াংশ সালাতে কাটাতেন এবং বাকী ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। তিনি একদিন অন্তর অন্তর সিয়াম পালন করতেন। শত্র“র মোকাবেলায় তিনি কখনো পশ্চাদবরণ করতেন না। (সহীহ বুখারী হা. ১০৭৯, মিশকাত হা. ১২২৫)

(২) পাহাড়-পর্বত ও পক্ষীকুল তাঁর অনুগত ছিল। এ সম্পর্কে সূরা সাবার ১০-১১ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

(بِالْعَشِيِّ وَالْإِشْرَاقِ) ‘

সকাল-সন্ধ্যায়’ ইশরাক বলা হয় চাশতের সময়কে, এ সময়ে সালাতকে চাশতের সালাত ও আওয়াবিনের সালাতও বলা হয় (সহীহ মুসলিম হা. ৭৪৮)। চাশতের সালাত দু থেকে বার রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়। চাশতের সময় সালাত আদায় করা অনেক ফযীলতের কাজ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য প্রতিদিন সাদকাহ করতে হয়। প্রত্যেক তাসবীহ পাঠ এক একটি সাদকাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা সাদকাহ, আল্লাহু আকবর বলা সাদকাহ, ভাল কাজের আদেশ করা সাদকাহ, খারাপ কাজে বাধা দেয়া সাদকাহ। এসব ক’টির জন্য যথেষ্ট হবে চাশতের দু’রাকাত সালাত। (সহীহ মুসলিম হা. ৭২০)

مَحْشُوْرَةً অর্থ একত্রিত বা জমা হওয়া। অর্থাৎ তাঁকে অপূর্ব সুমধুর কণ্ঠস্বর দান করা হয়েছিল। যখন তিনি যাবূর তেলাওয়াত করতেন, তখন কেবল মানুষ নয়, পাহাড়-পর্বত ও পক্ষীকুল পর্যন্ত তা একমনে শুনত।

(৩, ৪ ও ৫) তাঁকে দেয়া হয়েছিল সুদৃঢ় সাম্রাজ্য, গভীর প্রজ্ঞা ও অনন্য বাগ্মিতা। যেমন অত্র সূরার ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর এ সাম্রাজ্য ছিল শাম ও ইরাক ব্যাপী। যা বর্তমান ফিলিস্তীনসহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) শামিল করে। যেমন ২৬ নম্বর আয়াতের বলা হয়েছে।

(৬) লোহাকে নরম করে দেয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে সূরা সাবার ১০-১১ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আর তাঁকে দান করেছিলেন হিকমত তথা নবুওয়াত ও মহা প্রজ্ঞা এবং আরো দান করেছেন মীমাংসাকারী জ্ঞান। আরো দান করেছেন সর্বপ্রকার বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিকতা যার মাধ্যমে তাঁর রাজ্যকে করেছিলেন সুদৃঢ়।

ইবাদতখানায় প্রবেশকারী বাদী-বিবাদীর বিচার

দাঊদ (আঃ) যেকোন ঘটনায় যদি বুঝতেন যে, এটি আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে পরীক্ষা, তাহলে তিনি সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার দিকে রুজু হতেন ও ক্ষমা প্রার্থনায় রত হতেন। এরই একটি উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত ঘটনায়-

আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ (আঃ)-কে মীমাংসা করার জ্ঞান দান করার পর দু’টি বিবাদমান ব্যক্তির বর্ণনা দিচ্ছেন যারা প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে দাঊদ (আঃ)-এর নিকট এসেছিল। যখন তারা তাঁর নিকট প্রবেশ করল তখন তিনি ভীত-বিহ্বল হলেন, বিবাদমান ব্যক্তি দু’টি তাঁকে বলল : আপনি ভয় পাবেন না, আমরা বিবাদমান দু’টি পক্ষ। একজন অপরজনের ওপর জুলুম করেছি, আপনি আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিন, কোন প্রকার জুলুম বা অবিচার করবেন না এবং আমাদেরকে সঠিক পথ নির্দেশ করুন। তখন তারা তাদের ঝগড়ার বিষয়বস্তু উপস্থাপন করল। একজন বলল, সে আমার ভাই, তার নিরানব্বইটি স্ত্রী রয়েছে আর আমার একটি মাত্র স্ত্রী, তারপরও সে আমার এ স্ত্রীকে তাকে দিয়ে দিতে বলে এবং আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করে। এটি ছিল তাদের ঝগড়ার মূল ঘটনা।

তখন দাঊদ (আঃ) তাদের কথা অনুপাতে বিচার কার্য শুরু করলেন। তিনি বললেন : তোমার স্ত্রীকে তার স্ত্রীদের সাথে যুক্ত করার দাবী করে সে তোমার প্রতি জুলুম করেছে। অধিকাংশ শরীকরা একে অন্যের ওপর অবিচার করে থাকে, শুধুমাত্র মু’মিন ও সৎ কর্মপরায়ণ ব্যক্তি ব্যতীত। তবে তাদের সংখ্যা স্বল্প। এ মীমাংসা করার পর দাঊদ (আঃ) বুঝতে পারলেন যে, মহান রবের পক্ষ হতে এটা তার পরীক্ষা। তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলেন, সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন এবং তাঁর অভিমুখী হলেন। এ আয়াত পাঠ করার পর সিজদাহ করতে হয়। দাঊদ (আঃ) এখানে সিজদাহ্ করেছেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও এখানে অনুরূপ করেছেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিলেন এবং বললেন : আমার নিকট তার জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ও শুভ পরিণাম। কেননা তিনি ছিলেন তাওবাহ্কারী এবং স্বীয় রাজ্যে তিনি ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠাকারী। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :

إِنَّ الْمُقْسِطِيْنَ عِنْدَ اللّٰهِ عَلَي مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ، عَنْ يَمِينِ الرَّحْمَنِ عَزَّ وَجَلَّ، وَكِلْتَا يَدَيْهِ يَمِيْنٌ، الَّذِينَ يَعْدِلُوْنَ فِي حُكْمِهِمْ وَأَهْلِيهِمْ وَمَا وَلُوا

সুবিচারক ও ন্যায়পরায়ণ লোকেরা নূরের মিম্বরের ওপর দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার ডান দিকে অবস্থান করবে, আল্লাহ তা‘আলার উভয় হাতই ডান হাত তারা ঐ সব সুবিচারক যারা তাদের পরিবার-পরিজন ও অধিনস্তদের প্রতি সুবিচার করবে।” (সহীহ মুসলিম হা. ১৮২৭)

উপরোক্ত পাঁচটি আয়াতে বা অন্য কোথাও এরূপ কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি যে, সে পরীক্ষা কী ছিল, দাঊদ (আঃ) কী ভুল করেছিলেন, যে কারণে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এবং যা আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ফলে সে প্রাচীন যুগের কোন ঘটনার ব্যাখ্যা নাবী ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে এ যুগে দেয়া সম্ভব নয়। তাই ধারণা ও কল্পনার মাধ্যমে যেটাই বলা হবে, তাতে ভ্রান্তির আশঙ্কা থেকেই যাবে। কিন্তু পথভ্রষ্ট ইয়াহূদী পণ্ডিতেরা তাদের স্বগোত্রীয় এ মর্যাদাবান নাবীর উক্ত ঘটনাকে এমন নোংরাভাবে পেশ করেছে, যা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। বলা হয়েছে, দাঊদ (আঃ)-এর নাকি ৯৯ জন স্ত্রী ছিল। এ সত্ত্বেও তিনি তাঁর এক সৈন্যের স্ত্রীকে জোরপূর্বক অপহরণ করেন। অতঃপর উক্ত সৈনিককে হত্যা করে তার স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আল্লাহ তা‘আলা দু’জন ফেরেশতাকে বাদী ও বিবাদীর বেশে পাঠিয়ে তাকে শিক্ষা দেন। (নাঊযুবিল্লাহ)

تَسَوَّرُ অর্থ হলো প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করা।

أيد এটা يد থেকে নয় বরং ادييد-এর মাসদার اَيِّدْ। অর্থ শক্তি ও প্রবলতা।

نَعْجَةٌ শব্দটি আরবরা স্ত্রী, খাসী, দুম্বী ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করে থাকে। তবে এখানে স্ত্রী অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। (কুরতুবী, সা‘দী, অত্র আয়াতের তাফসীর)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ (আঃ)-কে বলে সকল বিচারকদেরকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, তারা যেন মানুষের মধ্যে সুবিচার করে এবং নিজ খেয়াল-খুশির অনুসরণ না করে। কেননা নিজ খেয়াল-খুশির অনুসরণ করলে তা সত্য পথ হতে বিচ্যুত করে দেবে। আর এ কারণে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।

সংশয় নিরসন :

(وَظَنَّ دَاو۫دُ اَنَّمَا فَتَنَّاھُ)

‘আর দাঊদ বুঝতে পারলেন যে, আমি তাকে পরীক্ষা করেছি।’ উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে জালালাইনে বলা হয়েছে, ‘অর্থাৎ উক্ত মহিলার প্রতি আসক্তির মাধ্যমে আমরা তাকে পরীক্ষায় ফেলেছি।’ ভিত্তিহীন এ তাফসীরের মাধ্যমে নাবীগণের উচ্চ মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। বিশেষ করে দাঊদ (আঃ)-এর মত একজন রাসূলের ওপরে পরনারীর প্রতি আসক্ত হওয়ার অমার্জনীয় অপবাদ আরোপ করা হয়েছে। অথচ এটি পরিষ্কারভাবে ইয়াহূদী-খ্রিস্টানদের বানোয়াট গল্প ব্যতীত কিছুই নয়।

সূরা সোয়াদ-এর সিজদার বিধান

এ সিজদাহ জরুরী নয়, এটা সিজদায়ে শোকর। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন : এখানে সিজদাহ্ বাধ্যতামূলক নয়। তিনি বলেন : তবে আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে এতে সিজদাহ্ করতে দেখেছি। (সহীহ বুখারী হা. ১০৬৯)

ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এখানে সিজদাহ্ করার পর বলেন : দাঊদ (আঃ)-এর জন্য এ সিজদাহ্ ছিল তাওবার এবং আমাদের জন্য এ সিজদাহ্ হলো শোকরের।” (সহীহ বুখারী হা. ১০৬৯)

আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা মিম্বারের ওপর সূরা সোয়াদ পাঠ করেন। সিজদার আয়াত পর্যন্ত পৌঁছে তিনি মিম্বার হতে অবতরণ করেন ও সিজদাহ্ করেন। তাঁর সাথে অন্যান্য সবাই সিজদাহ্ করেন।

অন্য একদিন তিনি মিম্বারের ওপর এ সূরাটি পাঠ করেন। যখন তিনি সিজদার আয়াতে পৌঁছেন তখন সকলে সিজদার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তখন তিনি বলেন : এটা ছিল দাঊদ (আঃ)-এর তাওবার সিজদাহ্, তোমরাও সিজদার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছ? অতঃপর তিনি মিম্বার হতে নেমে সিজদাহ্ করেন। (আবূ দাঊদ হা. ১৪১০)

তিলাওয়াতে সিজদার বিধান সম্পর্কে সূরা আল আ‘রাফ-এ আলোচনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন যদিও কাফির-মুশরিকরা মনে করে যে, আকাশ ও জমিন অনর্থক সৃষ্টি করা হয়েছে তথাপি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। এগুলো যথাযথ কারণেই সৃষ্টি করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

(أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنٰكُمْ عَبَثًا وَّأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُوْنَ‏)‏

‘তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?’ (সূরা মু’মিনূন ২৩ : ১১৫)

এগুলো সৃষ্টি করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষা করা, কে সৎ কর্ম করে আর কে অসৎ কর্ম করে? যাতে করে তিনি সৎ কর্মপরায়ণদেরকে জান্নাতে এবং অসৎ কর্মপরায়ণদেরকে জাহান্নামে দিতে পারেন। কারণ উভয়ের প্রাপ্তি সমান হতে পারে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. পর্বতমালা, বিহংগকুলসহ সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে।
২. দাঊদ (আঃ)-এর মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল।
৩. সদা-সর্বদা ন্যায় বিচার করতে হবে। কখনো জুলুম করা যাবে না।
৪. নিজের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে কোন কাজ করা যাবে না।
৫. অনিয়ম দেখলে প্রকৃত অবস্থা জানা পর্যন্ত সবর করা উচিত।
৬. যারা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যে শারীরিক ও আন্তরিকভাবে সুদৃঢ় আল্লাহ তা‘আলা তাদের গুণাগুণ বর্ণনা করেন।
৭. ইসতিগফার, ইবাদত বিশেষ করে সালাত পাপসমূহ মোচন করে দেয়।
৮. কেউ কারো ওপর জুলুম করলে সে বলতে পারবে যে, অমুক ব্যক্তি আমার ওপর জুলুম করেছে।
৯. স্বাভাবিক ভীতি নবুওয়াতের ও ওলীত্বের পরিপন্থী নয়।
১০. ন্যায় প্রতিষ্ঠাই ইসলামী রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।
১১. দায়িত্বশীল নিয়োগের জন্য সর্বপ্রথম দেখার বিষয় হচ্ছে চরিত্র ও দীনদারিত্ব।
৩০-৪০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নাবী দাঊদ (আঃ)-এর সন্তান সুলাইমান (আঃ) ও তাঁকে প্রদত্ত মু‘জিযাহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : সে ছিল উত্তম বান্দা এবং অতিশয় আল্লাহ তা‘আলা অভিমুখী। তাই সূরা নামলের ১৫-৪৪ নম্বর আয়াতের তাফসীরে দেখেছি তিনি এসব ক্ষমতা, জীব-জন্তুর ভাষা বুঝতে পারা ইত্যাদি নেয়ামত পেয়েও কোনরূপ গর্ব-অহঙ্কার করেননি বরং তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে এসব নেয়ামতের কৃতজ্ঞতার তাওফীক চেয়ে দু‘আ করলেন যাতে তিনি সৎআমল করতে পারেন এবং তাকে সৎ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন।

– صَافِنَاتٌ صافن বা صافناة

এর মানে এমন অশ্বরাজি যা তিন পায়ে ভর করে দাঁড়ায়। جياد- جواد এর বহুবচন, অর্থ হল দ্রুতগামী অশ্বরাজি। অর্থাৎ সুলাইমান (আঃ)-এর সামনে জিহাদের জন্য পালিত উৎকৃষ্ট দ্রুতগামী অশ্বরাজি পরিদর্শনের জন্য পেশ করা হলো। بِالْعَشِيِّ যোহর বা আসর থেকে সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত সময়কে বলা হয়, আমরা যাকে বিকাল বলে থাকি।

أَحْبَبْتُ (ভালবেসে ফেলেছি) এর অর্থ اثرت (প্রাধান্য দিয়ে ফেলেছি) আর عن এখানে علي এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (এর দ্বিতীয় অর্থ হলো : আমি তো আমার প্রতিপালকের স্মরণ হতে বিমুখ হয়ে সম্পদ-প্রীতিতে মগ্ন হয়ে পড়েছি।) আর تَوَارَتْ এর স্ত্রী লিঙ্গ কর্তৃকারক হলো الشمس (সূর্য), যা আয়াতে পূর্বে উল্লেখ করা হয়নি; কিন্তু বাগধারায় তা অনুমেয়। সারমর্ম এই যে, অশ্বরাজি পরিদর্শন করতে গিয়ে সুলাইমান (আঃ) আসর সালাতের সময় অতিবাহিত করে ফেলেন অথবা তখন তিনি যে অযীফা পাঠ করতেন তা ছুটে যায়। যার জন্য তিনি অনুতপ্ত হলেন এবং বলতে লাগলেন যে, আমি অশ্বরাজির মহব্বতে এমন মগ্ন হয়ে গেছি যে, সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল এবং আমি আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ, সালাত বা অযীফা থেকে অমনোযোগী হয়ে থেকে গেলাম। সুতরাং তার প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ তিনি সমস্ত অশ্বরাজি আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় কুরবানি করে দিয়েছিলেন। ইমাম শাওকানী ও ইবনু কাসীর (রহঃ) এ তাফসীরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অনেকে এ বর্ণনাকেও যুক্তিযুক্ত মনে করে না। তাই এসব থেকে বিরত থাকাই ভাল।

সিংহাসনের ওপর একটি নিষ্প্রাণ দেহ প্রাপ্তির ঘটনা :

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَلَقَدْ فَتَنَّا سُلَيْمٰنَ)

‘সুলাইমান (আঃ)-কে আমি পরীক্ষা করেছিলাম।’ এ পরীক্ষা কী ছিল, সিংহাসনে রাখা নি®প্রাণ দেহটি কিসের ছিল? তা সিংহাসনে রাখার অর্থ কী? এসব বিবরণ কুরআন বা সহীহ হাদীসে বিদ্যমান নেই। তবে কোন কোন মুফাসসির সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত একটি ঘটনাকে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর বলে সাব্যস্ত করেছেন।

একবার সুলাইমান (আঃ) স্বীয় মনোভাব ব্যক্ত করলেন যে, আজ রাতে আমি আমার (৯০ বা ১০০ জন) সকল স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করব যাতে প্রত্যেকের গর্ভে একটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে, যারা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদ করবে। কিন্তু তিনি এ মনোভাব ব্যক্ত করে ইনশাআল্লাহ তা‘আলা বলেননি। ফলে স্ত্রীদের মধ্যে কেবল একজন গর্ভবতী হলেন এবং তার গর্ভ থেকে একটি মৃত এবং অসম্পূর্ণ সন্তান ভূমিষ্ট হলো। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেন : যদি সুলাইমান (আঃ) ইনশাআল্লাহু তা‘আলা বলতেন তাহলে তার প্রত্যেক স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসতো। (সহীহ বুখারী হা. ৩৪২৪, সহীহ মুসলিম হা. ১৬৫৪) ইনশাআল্লাহ তা‘আলা না বলাই ছিল সুলাইমান (আঃ)-এর ফিতনা, আর সিংহাসনের ওপর নিক্ষিপ্ত দেহ হলো ঐ অসম্পূর্ণ বাচ্চা। তবে এ আয়াতের সাথে উক্ত হাদীসকে তাফসীর হিসেবে উল্লেখ করা অনুমানভিত্তিক। হাদীসটি সহীহ বুখারীর, কিন্তু ইমাম বুখারী একবারও তা অত্র আয়াতের তাফসীরে নিয়ে আসেননি। অথচ জিহাদ, নাবীদের বর্ণনা, শপথসমূহ ইত্যাদি অধ্যায়ে বার বার নিয়ে এসেছেন। সুতরাং যদি উক্ত পরীক্ষা দ্বারা হাদীসে বর্ণিত ঘটনা উদ্দেশ্য হত তাহলে তিনি একবার হলেও নিয়ে আসতেন।

ইস্রাঈলী বর্ণনাগুলোতে আরো সাজিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, সুলাইমান (আঃ) একটি আংটি দিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতেন। একদা শয়তান আংটি হাতিয়ে নিয়ে নিজেই সুলাইমান সেজে সিংহাসনে বসে। ৪০ দিন পর সুলাইমান (আঃ) আংটি উদ্ধার করে সিংহাসন ফিরে পান। সিংহাসনে বসা ঐ শয়তানের রাখা কোন বস্তুকে এখানে নি®প্রাণ দেহ বলা হয়েছে।

বস্তুত এসবই বানোয়াট কাহিনী। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : আহলে কিতাবের একটি দল সুলাইমান (আঃ)-কে নাবী বলে স্বীকারই করতে চায় না। তাহলে তাদের দ্বারা কী আশা করা যায়।

আল্লাহ তা‘আলা সুলাইমান (আঃ)-কে অনেক মু‘জিযাহ তথা বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তন্মধ্যে বায়ু প্রবাহ, পক্ষীকুল ও জিন-শয়তানকে অনুগত করে দেয়া, পিপীলিকার ভাষা বুঝতে পারা ইত্যাদি সূরা সাবার ১২-১৪ নম্বর, নামলের ১৫-৪৪ নম্বর আয়াতে মোট পাঁচটি মু‘জিযাহ উল্লেখ করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতগুলোতের সাথে সম্পৃক্ত বাকী দুটি উল্লেখ করা হল-

(৬) আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন সাম্রাজ্য দান করেছিলেন যা পৃথিবীর আর কাউকে দান করেননি। যেমন ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, নাবীদের কোন দু‘আ আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি ব্যতিরেখে হয় না। সে হিসেবে সুলাইমান (আঃ)-এর এ দু‘আটি আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমেই হয়েছিল। কেবল ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি এ দু‘আ করেননি বরং এর পেছনে আল্লাহ তা‘আলার বিধানাবলী বাস্তবায়ান করা এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সহীহ হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : একটি দুষ্ট জিন গতরাত্রে আমার ওপর বাড়াবাড়ি করেছিল সালাতে বাধা দেয়ার জন্য। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তার ওপর ক্ষমতা দান করেছিলেন তখন আমি ইচ্ছা করেছিলাম যে, মাসজিদের খুটির সাথে তাকে বেঁধে রাখি যাতে সকালে তোমরা তাকে দেখতে পাও। তখন আমার ভাই সুলাইমান যে দু‘আ করেছিল সে কথা আমার মনে পড়ে গেল। তিনি দু‘আ করেছিলেন,

(قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَهَبْ لِيْ مُلْكًا لَّا يَنْۭبَغِيْ لِأَحَدٍ مِّنْۭ بَعْدِيْ)

“হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং এমন এক রাজ্য দান করুন যার অধিকারী আমি ছাড়া আর কেউ না হয়।” (সহীহ বুখারী হা. ৪৮০৮, সহীহ মুসলিম হা. ৫৪১)

(৭) প্রাপ্ত অনুগ্রহরাজির হিসাব রাখা বা না রাখার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। সুলাইমান (আঃ)-এর রাজত্ব লাভের দু‘আ কবূল করার পরে তার প্রতি বায়ু, জিন, পক্ষীকুল ও জীব-জন্তুকে অনুগত করে দেন। অতঃপর বলেন : ‘এগুলো আমার অনুগ্রহ, অতএব তুমি (তা থেকে) কাউকে দান কর কিংবা নিজের জন্য রেখে দাও, তজ্জন্যে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে না।’ বস্তুত এটি ছিল সুলাইমান (আঃ)-এর আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত একপ্রকার সনদ। পৃথিবীর কোন ব্যক্তির জন্য সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এ ধরনের সত্যায়নপত্র নাযিল হয়েছে বলে জানা যায় না। অথচ এ মহান নাবী সম্পর্কে ইসলামের শত্রু ইয়াহূদ-খ্রিস্টানরা বাজে কথা রটনা করে থাকে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত বাদ দিয়ে দুনিয়ার কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত হওয়া যাবে না।
২. আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে কোন জিনিস পরিত্যাগ করলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর চেয়ে আরো উত্তম জিনিস দান করেন।
৩. একজন মু’মিন সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে মশগুল থাকবে।
৪. এ আয়াতগুলোকে কেন্দ্র করে সুলাইমান (আঃ)-এর সম্পর্কে অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনী পাওয়া যায়, সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।
৫. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অনুগত বান্দাদেরকে দুনিয়াতেও মর্যাদার সাথে প্রতিষ্ঠিত রাখেন।
৬. সুলাইমান (আঃ) একজন নাবী ছিলেন, সেই সাথে বাদশাহও ছিলেন। তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারতেন কিন্তু তারপরেও ন্যায় ছাড়া অন্যায় কিছু করেননি।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# ফেরাউনের জন্য ذُو الْأَوْتَادِ (কীলকধারী) এ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে যে, তার সালতানাত এমনই মজবুদ ছিল যেন যমীনে কীলক পোঁতা রয়েছে। অথবা এই অর্থে যে, তার বিপুল সংখ্যক সৈন্য-সমান্ত যেখানেই অবস্থান করতো সেখানের চারদিকে কেবল তাঁবুর খুঁটিই পোঁতা দেখা যেতো। কিংবা এ অর্থে যে, সে যার প্রতি অসন্তুষ্ট হতো তার দেহে কীলক মেরে মেরে শাস্তি দিতো। আবার সম্ভবত কীলক বলতে মিসরের পিরামিডও বুঝানো যেতে পারে, কেননা এগুলো যমীনের মধ্যে কীলকের মতো গাঁথা রয়েছে।
# আযাবের একটিমাত্র ধাক্কা তাদেরকে খতম করে দেবার জন্য যথেষ্ট হবে, দ্বিতীয় কোন ধাক্কার প্রয়োজন হবে না। এ বাক্যের দ্বিতীয় অর্থ হতে পারে, এরপর তারা আর কোন অবকাশ পাবে না। গরুর দুধ দোহন করার সময় এক বাঁট থেকে দুধ টেনে অন্য এক বাঁটে হাত দেবার মাঝখানে প্রথম বাঁটটিতে দুধ নামতে যতটুকু সময় লাগে ততটুকু অবকাশও তারা পাবে না।
# আল্লাহর আযাবের অবস্থা এইমাত্র বর্ণনা করা হয়েছে এবং অন্যদিকে এ নাদানদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, এরা ঠাট্টা করে বলে, তুমি আমাদের যে বিচার দিনের ভয় দেখাচ্ছো তার আসা পর্যন্ত আমাদের ব্যাপারটি মুলতবী করে রেখো না বরং আমাদের হিসেব এখনই চুকিয়ে দাও। আমাদের অংশে যা কিছু সর্বনাশ লেখা আছে তা এখনই নিয়ে এসো।
# ওপরে মক্কার কাফেরদের যেসব কথা বিবৃত হয়েছে এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ নবী ﷺ সম্পর্কে তাদের এ প্রলাপোক্তি যে, এ ব্যক্তি যাদুকর ও মিথ্যুক, তাদের এ আপত্তি যে, রসূল নিযুক্ত করার জন্য আল্লাহর কাছে কি কেবলমাত্র এ ব্যক্তিটিই থেকে গিয়েছিল এবং এ দোষারোপ যে, এ তাওহীদের দাওয়াত থেকে এ ব্যক্তির উদ্দেশ্য ধর্মীয় প্রচারণা নয় বরং অন্য কোন দুরভিসন্ধি রয়েছে।
# এ ব্যাক্যের আর একটি অনুবাদ এও হতে পারে যে, “আমার বান্দা দাউদের কথা স্মরণ করো।” প্রথম অনুবাদের দিক দিয়ে অর্থ হচ্ছে এই যে, এ কাহিনীতে এদের জন্য একটি শিক্ষা রয়েছে। আর দ্বিতীয় অনুবাদের দৃষ্টিতে এর অর্থ হচ্ছে, এ কাহিনীর স্মৃতি তোমাদের ধৈর্য ধারণা করতে সাহায্য করবে। যেহেতু এ কাহিনী বর্ণনা করার পেছনে উভয় উদ্দেশ্যই রয়েছে তাই এতে এমনসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো থেকে উভয়বিধ অর্থ প্রকাশ পায়। (হযরত দাউদের ঘটনার ওপর বিস্তারিত আলোচনা এর আগে নিম্নোক্ত স্থানগুলোতে এসে গেছেঃ তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারাহ ২৭৩ ; বনী ইসরাঈল ৭ , বনী ইসরাঈল ৬৩ ; আল আম্বিয়া ৭০-৭৩ ; আন নামল ১৮-২০ এবং সাবা ১৪-১৬ টীকা সমূহ)
# মূল শব্দাবলী হচ্ছেঃ ذَا الْأَيْدِ “হাতওয়ালা” হাত শব্দটি কেবল আরবী ভাষাতেই নয় অন্যান্য ভাষাতেও শক্তি ও ক্ষমতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। হযরত দাউদের জন্য যখন তাঁর গুণ হিসেবে বলা হয় তিনি “হাতওয়ালা” ছিলেন তখন অবশ্যই এর অর্থ হবে, তিনি বিপুল শক্তির অধিকারী ছিল। জালুতের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে তিনি এর প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি। এর মাধ্যমে তিনি আশপাশের মুশরিক জাতিসমূহকে পরাজিত করে একটি শক্তিশালী ইসলামী সালতানাত কায়েম করেছিলেন। নৈতিক শক্তি এর বদৌলতে তিনি শাহী মসনাদে বসেও ফকিরি করে গেছেন সবসময়। আল্লাহকে ভয় করেছেন এবং তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলেছেন। ইবাদাতের শক্তি। এর অবস্থা এই ছিল যে, রাষ্ট্র পরিচালানা, শাসন কর্তৃত্ব ও আল্লাহর পথে জিহাদের ব্যস্ততার মধ্যেও বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি হামেশা একদিন পরপর রোজা রেখেছেন এবং প্রতিদিন রাতের এক-তৃতীয়াংশ নামাযে অতিবাহিত করতেন। ইমাম বুখারী তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে হযরত আবু দারদার (রা.) বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন, যখন হযরত দাউদের (আ) কথা আলোচিত হতো, নবী ﷺ বলতেন, كَانَ أَعْبَدَ الْبَشَرِ “তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশী ইবাদাতগুযার ব্যক্তি।”
# তাঁর বক্তব্য জটিল ও অস্পষ্ট হতো না। সমগ্র ভাষণ শোনা পর শ্রোতা একথা বলতে পারতো না যে তিনি কি বলতে চান তা বোধগম্য নয়। বরং তিনি যে বিষয়ে কথা বলতেন তার সমস্ত মূল কথাগুলো পরিষ্কার করে তুলে ধরতেন এবং আসল সিদ্ধান্ত প্রত্যাশী বিষয়টি যথাযথভাবে নির্ধারণ করে দিয়ে তার দ্ব্যর্থহীন জবাব দিয়ে দিতেন। কোন ব্যক্তি জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, বিচার-বিবেচনা ও বাকচাতূর্যের উচ্চতম পর্যায়ে অবস্থান না করলে এ যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না।
# এখানে হযরত দাউদের কথা যে উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে তা আসলে এ কাহিনী শুনানো থেকে শুরু হয়েছে। এর আগে তাঁর যে উন্নত গুণাবলীর কথা ভূমিকাস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য ছিল কেবলমাত্র একথা বলা যে, যাঁর সাথে এ ব্যাপারটি ঘটে গেছে সে দাউদ আলাইহিস সালাম কত বড় মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
# সোজা পথ ব্যবহার না করে হঠাৎ দেয়াল টপকে দেশের শাসনকর্তার মহলের নির্জনকক্ষে দু’জন লোক পৌঁছে গেছে, এটাই ছিল ঘাবড়ে যাওয়ার বা ভয় পাওয়ার কারণ।
# ভাই মানে মায়ের পেটের ভাই নয় বরং দ্বীনী এবং জাতীয় ভাই।
# সামনের আলোচনা ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। অর্থাৎ ফরিয়াদী পক্ষ একথা বলছে না যে, এ ব্যক্তি আমার সে একটি দুম্বীও ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের দুম্বীগুলোর মধ্যে তাকে মিশিয়ে দিয়েছে। বরং সে বলছে, এ ব্যক্তি আমার কাছে আমার দুম্বী চাইছে এবং কথাবার্তায় আমাকে দাবিয়ে নিয়েছে। কারণ সে প্রতাপশালী বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং আমি একজন গরীব লোক। এর দাবী রদ করার ক্ষমতা আমার নেই।
# এখানে কারো সন্দেহ করার প্রয়োজন নেই যে, হযরত দাউদ (আ) এক পক্ষের কথা শুনে নিজের সিদ্ধান্ত কেমন করে শুনিয়ে দিলেন। আসল কথা হচ্ছে, বাদীর অভিযোগ শুনে বিবাদী যখন খামুশ হয়ে থাকলো এবং প্রতিবাদে কিছুই বললো না তখন এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার স্বীকৃতিদানের সমর্থক হয়ে গেলো। এ কারণে হযরত দাউদ (আ) স্থির নিশ্চিত হলেন যে, ফরিয়াদী যা বলছে আসল ঘটনাই তাই।
# এ জায়গায় তেলাওয়াতের সিজদা ওয়াজিব কিনা, এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। ইমাম শাফে’ঈ বলেন, এখানে সিজদা ওয়াজিব নয় বরং এ তো একজন নবীর তাওবা। অন্যদিকে ইমাম আবু হানীফা বলেন, ওয়াজিব। এ প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসগণ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “যেসব আয়াত পাঠ করলে সিজদা ওয়াজিব হয় এটি তার অন্তর্ভুক্ত নয়। কিন্তু আমি এ স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সিজদা করতে দেখেছি।” (বুখারী, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ) সা’দ ইবনে জুবাইর তাঁর কাছ থেকে অন্য যে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দাবলী হচ্ছেঃ “সূরা ‘সা-দ’-এ নবী ﷺ সিজদা করেছেন এবং বলেছেনঃ দাউদ আলাইহিস সালাম তাওবা হিসেবে সিজদা করেছিলেন এবং আমরা শোকরানার সিজদা করি।” অর্থাৎ তাঁর তাওবা কবুল হয়েছে এজন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। (নাসাঈ) তৃতীয় যে হাদীসটি মুজাহিদ তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন তাতে তিনি বলেন, কুরআন মজীদে মহান আল্লাহ‌ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দিয়েছেন, أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ “এরা ছিলেন এমনসব লোক যাদেরকে আল্লাহ‌ সঠিক পথ দেখিয়েছিলেন। কাজেই তুমি এদের পথ অনুসরণ করো।”

এখন যেহেতু হযরত দাউদও একজন নবী ছিলেন এবং তিনি এ স্থানে সিজদা করেছিলেন, তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তাঁকে অনুসরণ করে এ স্থানে সিজদা করেছেন। (বুখারী) এ তিনটি বর্ণনা হচ্ছে হযরত ইবনে আব্বাসের। আর হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেছেন, নবী ﷺ একবার খুতবার মধ্যে সূরা সা-দ পড়েন এবং এ আয়াতে এসে পৌঁছলে মিম্বার থেকে নিচে নেমে এসে সিজদা করেন এবং তাঁর সাথে সাথে সমবেত সবাইও সিজদা করে। তারপর দ্বিতীয় আর একবার অনুরূপভাবে তিনি এ সূরাটি পড়েন এবং এ আয়াতটি শুনার সাথে সাথে লোকেরা সিজদা করতে উদ্যত হয়। তখন নবী সরীম ﷺ বলেন, “এটি একজন নবীর তাওবা কিন্তু আমি দেখছি তোমরা সিজদা করতে প্রস্তুত হয়ে গেছো”—-একথা বলে তিনি মিম্বার থেকে নেমে আসেন এবং সিজদা করেন। সমবেত সবাইও সিজদা করে। (আবু দাউদ) এসব হাদীস থেকে যদিও সিজদা ওয়াজিব হবার চূড়ান্ত ও অভ্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না তবুও এতটুকু কথা অবশ্যই প্রমাণিত হয় যে, এ স্থানে নবী ﷺ অধিকাংশ সময় সিজদা করেছেন এবং সিজদা না করার তুলনায় এখানে সিজদা করাটা অবশ্যই উত্তম। বরং ইবনে আব্বাসের (রা.) তৃতীয় যে বর্ণনাটি আমরা ইমাম বুখারীর বরাত দিয়ে উদ্ধৃত করেছি সেটি ওয়াজিব না হওয়ার তুলনায় ওয়াজিব হওয়ার পাল্লার দিকটি ঝুঁকিয়ে দেয়।

এ আয়াতটি থেকে যে আর একটি বিষয়বস্তু বের হয়ে আসে সেটি হচ্ছেঃ আল্লাহ‌ এখানে خَرَّ رَاكِعًا (রুকূ’তে অবনত হয়) শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সকল মুফাসসির এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এর অর্থ خَر سَاجِدًا (সিজদায় অবনত হয়।)। এ কারণে ইমাম আবু হানীফা (র) ও তাঁর সহযোগীগণ এমত পোষণ করেছেন যে, নামাযে বা নামায ছাড়া অন্য অবস্থায় সিজদার আয়াত শুনে বা পড়ে সিজদা না করে কোন ব্যক্তি শুধুমাত্র রুকূ’ও করতে পারে। কারণ আল্লাহ‌ নিজেই যখন রুকূ’ শব্দ বলে সিজদা অর্থ নিয়েছেন তখন জানা গেলো রুকূ’ সিজদার স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। শাফেঈ ফকীহগণের মধ্যে ইমাম খাত্তাবীও এ মত পোষণ করেন। এ অভিমতটি একটি অভিমত হিসেবে নির্ভুল ও যুক্তিযুক্ত সন্দেহ নেই কিন্তু নবী ﷺ এবং সাহাবায়ে কেরামের কার্যক্রমের মধ্যে আমরা এর কোন নজির দেখি না যে, সিজদার আয়াত শুনে বা পড়ে সিজদা করার পরিবর্তে তাঁরা রুকূ’ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। কাজেই এ অভিমত কার্যত বাস্তবায়িত একমাত্র তখনই করা উচিত যখন সিজদা করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে। নিয়মিতভাবে এ রকম করা সঠিক হবে না। নিয়মিত এ রকম করা ইমাম আবু হানীফা ও তাঁর সহযোগীদের উদ্দেশ্যও নয়। বরং তাঁরা কেবলমাত্র এর বৈধতার প্রবক্তা।
# এ থেকে জানা যায়, হযরত দাউদের (আ) ত্রুটি তো অবশ্যই হয়েছিল এবং সেঠি এমন ধরনের ত্রুটি ছিল যার সাথে দুম্বীর মামলার এক ধরনের সাঞ্জস্য ছিল। তাই তার ফায়সালা শুনাতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে চিন্তা জাগে, এর মাধ্যমে আমার পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু এ ত্রুটি এমন মারাত্মক ধরনের ছিল না যা ক্ষমা করা যেতো না অথবা ক্ষমা করা হলেও তাঁকে উন্নত মর্যাদা থেকে দেয়া হতো। আল্লাহ‌ নিজেই এখানে সুস্পষ্ট ভাষায় বলছেন, যখন তিনি সিজদায় পড়ে তাওবা করেন তখন তাঁকে কেবল ক্ষমাই করে দেয়া হয়নি বরং দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি যে উন্নত মর্যাদার অধিষ্ঠিত ছিলেন তাতেও ফারাক দেখা দেয়নি।
# তাওবা কবুল করার ও মর্যাদা বৃদ্ধির সুসংবাদ দেবার সাথে সাথে মহান আল্লাহ‌ সে সময় হযরত দাউদকে (আ) এ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেন। এ থেকে একথা আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে যায় যে, তিনি যে কাজটি করেছিলেন তাতে প্রবৃত্তির কামনার কিছু দখল ছিল, শাসন ক্ষমতার অসঙ্গত ব্যবহারের সাথেও তার কিছু সম্পর্ক ছিল এবং তা এমন কোন কাজ ছিল যা কোন ন্যায়নিষ্ঠ শাসকের জন্য শোভনীয় ছিল না।

এখানে এসে আমাদের সামনে তিনটি প্রশ্ন দেখা দেয়। এক, সেটি কি কাজ ছিল? দুই, আল্লাহ‌ পরিষ্কারভাবে সেটি না বলে এভাবে অন্তরালে রেখে সেদিকে ইঙ্গিত করছেন কেন? তিন, এ প্রেক্ষাপটে তার উল্লেখ করা হয়েছে কোন্ সম্পর্কের ভিত্তিতে? যারা বাইবেল (খৃষ্টান ও ইহুদীদের পবিত্র গ্রন্থ) অধ্যয়ন করেছেন তাঁদের কাছে একথা গোপন নেই যে, এ গ্রন্থ হযরত দাউদের বিরুদ্ধে হিত্তীয় উরিয়ার (Uriah the Hittite) স্ত্রীর সাথে যিনা করার এবং তারপর উরিয়াকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তার স্ত্রীকে বিয়ে করার পরিষ্কার অভিযোগ আনা হয়েছে। আবার এই সঙ্গে একথাও বলা হয়েছে যে, এ মেয়েটি যে এক ব্যক্তির স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে হযরত দাউদের হাওয়ালা করে দিয়েছিল সে-ই ছিল হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের মা। এ সম্পর্কিত পুরো কাহিনীটি বাইবেলের শামুয়েল-২ পুস্তকের ১১-২২ অধ্যায়ে ( শামুয়েল-২ পুস্তকের ১১-১৫ অধ্যায় , শামুয়েল-২ পুস্তকের ১৬-১৯ অধ্যায় , শামুয়েল-২ পুস্তকের ২০-২২ অধ্যায় ) অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। কুরআন নাযিল হবার শত শত বছর পূর্বে এগুলো বাইবেলে সন্নিবেশিত হয়েছিল। সারা দুনিয়ার ইহুদী ও খৃস্টানদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই তাদের এ পবিত্র কিতাব পাঠ করতো অথবা এর পাঠ শুনতো সেই এ কাহিনীটি কেবল জানতোই না বরং এটি বিশ্বাসও করতো। তাদেরই মাধ্যমে দুনিয়ার এ কাহিনীটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আজ অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, পাশ্চাত্য দেশগুলোতে বনী ইসরাঈল ও ইহুদী ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কিত এমন কোন একটি বইও লিখিত হয় না যেখানে হযরত দাউদের বিরুদ্ধে এই দোষারোপের পুনরাবৃত্তি করা হয় না। এ বহুল প্রচলিত কাহিনীতে একথাও লিখিত হয়েছেঃ

“পরে সদাপ্রভূ দাউদের নিকটে নাথনকে প্রেরণ করিলেন। আর তিনি তাঁহার নিকটে আসিয়া তাঁহাকে কহিলেন,–এক নগরে দুইটি লোক ছিল; তাহাদের মধ্যে একজন ধনবান, আর একজন দরিদ্র। ধনবানের অতি বিস্তর মেষাদি পাল ও গোপাল ছিল। কিন্তু সেই দরিদ্রের আর কিছুই ছিল না, কেবল একটি ক্ষুদ্র মেষবৎসা ছিল, সে তাহাকে কিনিয়া পুষিতে ছিল; আর তাহার সঙ্গে ও তাহার সন্তানদের থাকিয়া বাড়িয়া উঠিতেছিল; সে তাহারই খাদ্য খাইত ও তাহারই পাত্রে পান করিত, আর তাহার বক্ষস্থলে শয়ন করিত ও তাহার কন্যার মত ছিল। পরে ঐ ধনবানের গৃহে একজন পথিক আসিল, তাহাতে বাটিতে আগত অতিথির জন্য পান করণার্থে সে আপন মেষাদি পাল ও গোপাল হতে কিছু লইতে কাতর হইল, কিন্তু সেই দরিদ্রের মেষবৎসাটি লইয়া, যে অতিথি আসিয়াছিল, তাহার জন্য তাহাই পাক করিল। তাহাতে দাউদ সেই ধনবানের প্রতি অতিশয় ক্রোধে প্রজ্জলিত হইয়া উঠিলেন তিনি নাথনকে কহিলেন, জীবন্ত সদাপ্রভূর দিব্য, যে ব্যক্তি সেই কর্ম করিয়াছে, সে মৃত্যুর সন্তান; সে কিছু দয়া না করিয়া এ কর্ম্ম করিয়াছে, এই জন্য সেই মেষ বৎসার চর্তুগুণ ফিরাইয়া দিবে। তখন নাথন দাউদকে কহিলেন, আপনিই সেই ব্যক্তি। ইস্রায়েলের ঈশ্বর, সদাপ্রভূ এই কথা কহেন, আমি তোমাকে ইস্রায়েলের উপরে রাজপদে অভিষেক করিয়াছি এবং শৌলের হস্ত হইতে উদ্বার করিয়াছি, আর তোমার প্রভুর বাটী তোমাকে দিয়াছি ও তোমার প্রভূর স্ত্রীগণকে তোমার বক্ষস্থলে দিয়াছি এবং ইস্রায়েলের ও জিহ্‌দার কুল তোমাকে দিয়াছি; আর তাহা যদি অল্প হইত, তবে তোমাকে আরও অমুক অমুক বস্তু দিতাম। তুমি কেন সদাপ্রভূর বাক্য তুচ্ছ করিয়া, তাঁহার দৃষ্টিতে যাহা মন্দ তাহাই করিয়াছ? তুমি হিত্তীয় উরিয়কে খড়গ দ্বারা আঘাত করাইয়াছ ও তাহার স্ত্রীকে লইয়া আপনার স্ত্রী করিয়াছ, আম্মোন-সন্তানদের খড়গ দ্বারা উরিয়াকে মারিয়া ফেলিয়াছ।” ( ২-শমুয়েল ১২: ১-৯ ) এই কাহিনী এবং এর বহুল প্রচারের উপস্থিতিতে কুরআন মজীদে এ সর্ম্পকে কোন বিস্তারিত বর্ণনা দেবার প্রয়োজন ছিল না। এ ধরনের বিষয়গুলোকে আল্লাহর কিতাবে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করাও আল্লাহর রীতি নয়। তাই এখানে পর্দার অন্তরালে রেখে এদিকে ইঙ্গিতও করা হয়েছে এবং এ সঙ্গে একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আসল ঘটনা কি ছিল এবং কিতাবধারীরা তাকে কিভাবে ভিন্নরূপ দিয়েছে। কুরআন মজীদের উপরোল্লিখিত বর্ণনা থেকে যে আসল ঘটনা পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় তা হচ্ছে এইঃ হযরত দাউদ আলাইহিস সাল্লাম উরিয়ার (অথবা এ ব্যক্তির যে নাম থেকে থাকুক) কাছে নিছক নিজের মনের এ আকাঙ্ক্ষা পেশ করেছিলেন যে, সে যেন নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয়। আর যেহেতু এ আকাঙ্ক্ষা একজন সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে পেশ করা হয়নি বরং একজন মহাপরাক্রমশালী শাসক এবং জবরদস্ত দ্বীনী গৌবর ও মাহাত্মের অধিকারী ব্যক্তিত্বের পক্ষ থেকে প্রজামন্ডলীর একজন সদস্যের সামনে প্রকাশ করা হচ্ছিল, তাই এ ব্যক্তি কোন প্রকার বাহ্যিক বল প্রয়োগ ছাড়াই তা গ্রহণ করে নেবার ব্যাপারে নিজেকে বাধ্য অনুভব করছিল। এ অবস্থায় হযরত দাউদের (আ) আহবানে সাড়া দেবার জন্য তার উদ্যোগ নেবার পূর্বেই জাতির দু’জন সৎলোক অকস্মাৎ হযরত দাউদের কাছে পৌঁছে গেলেন এবং একটি কাল্পনিক মামলার আকারে এ বিষয়টি তাঁর সামনে পেশ করলেন। প্রথমে হযরত দাউদ (আ) মনে করেছিলেন এটি যথাযথই তাঁর সামনে পেশকৃত একটি মামলা। কাজেই মামলাটির বিবরণ শুনে তিনি নিজের ফায়সালা শুনিয়ে দিলেন। কিন্তু মুখ থেকে ফায়সালার শব্দগুলো বের হবার সাথে সাথেই তাঁর বিবেক তাঁকে সতর্ক করে দিল যে, এটি একটি রূপক আকারে তাঁর ও ঐ ব্যক্তির বিষয়ের সাথে মিলে যায় এবং যে কাজটিকে তিনি জুলুম গণ্য করছেন তাঁর ও ঐ ব্যক্তির বিষয়ে তার প্রকাশ ঘটছে। এ অনুভূতি মনের মধ্যে সৃষ্টি হবার সাথে সাথেই তিনি আল্লাহর দরবারে সিজদা ও তাওবা করলেন এবং নিজের ঐ কাজটি থেকেও বিরত হলেন।

বাইবেলে এ ঘটনাটি এহেন কলঙ্কিতরূপে চিত্রিত হলো কেমন করে? সামান্য চিন্তা ভাবনা করলে একথাটিও বুঝতে পারা যায়। মনে হয়, কোন উপায়ে হযরত দাউদ (আ) ঐ ভদ্রমহিলার গুণাবলী জানতে পেরেছিলেন। তাঁর মনে আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, এ ধরনের যোগ্যতাসম্পন্না মহিলার পক্ষে একজন সাধারণ অফিসারের স্ত্রী হয়ে থাকার পরিবর্তে রাজরানী হওয়া উচিত। এ চিন্তার বশবর্তী হয়ে তিনি তার স্বামীর কাছে এ ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, সে যেন তাকে তালাক দিয়ে দেয়। বনী ইসরাঈলী সমাজে এটা কোন নিন্দনীয় বিষয় ছিল না বলেই তিনি এতে কোন প্রকার অনিষ্টকারিতা অনুভব করেননি। তাদের সমাজে এটা অত্যন্ত মামুলি ব্যাপার ছিল যে, একজন অন্য একজনের স্ত্রীকে পছন্দ করলে নিঃসংকোচে তার কাছে আবেদন করতো তোমার স্ত্রীকে আমার জন্য ছেড়ে দাও। এ ধরনের আবেদনে কারো মনে খারাপ প্রতিক্রিয়া হতো না। বরং অনেক সময় এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে খুশী করার জন্য নিজের স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিতো। যাতে সে তাকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু একথা বলতে গিয়ে হযরত দাউদের মনে এ অনুভূতি জাগেনি যে, একজন সাধারণ লোকের পক্ষ থেকে এ ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করা জুলুম ও বলপ্রয়োগের রূপধারণ না করতে পারে তবে একজন শাসকের পক্ষ থেকে যখন এ ধরনের ইচ্ছা প্রকাশ করা হয় তখন তা বলপ্রয়োগমুক্ত হতে পারে না। উল্লেখিত রূপক মোকদ্দমার মাধ্যমে যখন এ দিকে তাঁর দৃষ্টি করা হলো তখন নির্দ্বিধায় তিনি নিজের ইচ্ছা ত্যাগ করলেন। এভাবে একটি কথার উদ্ভব হয়েছিল এবং তা খতমও হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু পরে কোন এক সময় যখন তাঁর কোন ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা ছাড়াই ঐ ভদ্রমহিলার স্বামী এক যুদ্ধে শহীদ হয়ে গেলো এবং হযরত দাউদ (আ) তাকে বিয়ে করে নিলেন তখন ইহুদীদের দুষ্ট মানসিকতা কল্পকাহিনী রচনায় প্রবৃত্ত হলো। আর বনী ইসরাঈলীদের একটি দল যখন হযরত সুলাইমানের শত্রু হয়ে গেলো তখন তাদের এ দুষ্ট মানসিকতা দ্রুত কাজ শুরু করে দিল। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আন নামল, ৫৬ টীকা) এসব উদ্যোগ ও ঘটনাবলীর প্রভাবাধীনে এ কাহিনী রচনা করা হলো যে, হযরত দাউদ (আ) নাউযুবিল্লাহ তাঁর প্রাসাদের ছাদের ওপর উরিয়ার স্ত্রীকে এমন অবস্থায় দেখে নিয়েছিলেন যখন তিনি উলংগ হয়ে গোসল করছিলেন। তিনি তাকে নিজের মহলে ডেকে এনে তার সাথে যিনা করলেন। এতে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। তারপর তিনি ব্নী আম্মোন এর মোকাবিলায় উরিয়াকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিলেন এবং সেনাপতি যোয়াবকে হুকুম দিলেন তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে এমন এক জায়গায় নিযুক্ত করতে যেখানে সে নিশ্চিতভাবে নিহত হবে। তারপর যখন সে মারা গেলো, তিনি তার স্ত্রীকে বিয়ে করে নিলেন। এ মহিলার গর্ভে সুলাইমানের (আলাইহিস সালাম) জন্ম হলো। এসব মিথ্যা অপবাদ জালেমরা তাদের পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছে। এভাবে বংশ পরস্পরায় এর পাঠের ব্যবস্থা করেছে। তারা এসব পড়তে থাকবে এবং নিজেদের দু’জন শ্রেষ্ঠতম ও মহত্তম ব্যক্তিকে লাঞ্ছিত করতে থাকবে। হযরত মূসার (আ) পরে এঁরা দু’জনই ছিলেন তাদের সবচেয়ে বড় পথপ্রদর্শক।

কুরআন ব্যাখ্যাদাতাগণের একটি দল তো নবী ইসরাঈলের পক্ষ থেকে তাঁদের কাছে এ সম্পর্কিত যেসব কিসসা কাহিনী এসে পৌঁছেছে সেগুলো হুবহু গ্রহণ করে নিয়েছেন। ইসরাঈলী বর্ণনার মধ্য থেকে কেবলমাত্র যে অংশটুকুতে হযরত দাউদের বিরুদ্ধে যিনার অপবাদ দেয়া হয়েছিল এবং যেখানে ভদ্রমহিলার গর্ভবর্তী হয়ে যাবার উল্লেখ ছিল সে অংশটুকু তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

তাঁদের উদ্ধৃত বাদবাকি সমস্ত কাহিনী বনী ইসরাঈলের সমাজে যেভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল ঠিক সেভাবেই তাঁদের রচনায় পাওয়া যায়। দ্বিতীয় দলটি দুম্বীর মোকদ্দমার সাথে সামঞ্জস্য রাখে হযরত দাউদের এমন কোন কর্মতৎপরতার কথা সরাসরি অস্বীকার করেছেন। এর পরিবর্তে তাঁরা নিজেদের পক্ষ থেকে এ কাহিনীর এমন সব ব্যাখ্যা দেন যা একেবারেই ভিত্তিহীন, যেগুলোর কোন উৎস নেই এবং কুরআনের পূর্বাপর আলোচ্য বিষয়ের সাথেও যার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু মুফাস্‌সিরদের মধ্যে আবার এমন একটি দলও আছে যারা সঠিক তত্ত্ব পেয়ে গেছেন এবং কুরআনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতগুলো থেকে আসল সত্যটির সন্ধান লাভ করেছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ কতিপয় উক্তি অনুধাবন করুনঃ

মাসরূক ও সাঈদ ইবনে জুবাইর উভয়েই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের (রা.) এ উক্তি উদ্বৃত করেছেন যে, “হযরত দাউদ (আ) সে ভদ্র মহিলার স্বামীর কাছে এ ইচ্ছা প্রকাশ করার চাইতে বেশী কিছু করেননি যে, তোমার স্ত্রীকে আমার জন্য ছেড়ে দাও।”(ইবনে জারীর)

আল্লামা যামাখশারী তাঁর কাশ্‌শাফ তাফসীর গ্রন্থে লিখেছেনঃ “আল্লাহ হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের কাহিনীটি যে আকারে বর্ণনা করেছেন তা থেকে তো একথাই প্রকাশিত হয় যে, তিনি ঐ ব্যক্তির কাছে কেবলমাত্র এ ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন যে, সে তাঁর জন্য যেন তার স্ত্রীকে ত্যাগ করে।”

আল্লামা আবূ বকর জাসসাস এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, ঐ ভদ্র মহিলা ঐ ব্যক্তির বিবাহিত স্ত্রী ছিল না বরং ছিল কেবলমাত্র তার বাগদত্তা বা তার সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। হযরত দাউদ সে ভদ্র মহিলাকে বিয়ের পয়গাম দিলেন। এর ফলে আল্লাহর ক্রোধ বর্ষিত হলো। কারণ, তিনি তাঁর মু’মিন ভাইয়ের পয়গামের ওপর পয়গাম দিয়েছিলেন। অথচ তাঁর গৃহে পূর্ব থেকেই কয়েকজন স্ত্রী ছিল। (আহকামূল কুরআন) অন্য কয়েকজন মুফাসসিরও এ অভিমত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একথাটি কুরআনের বর্ণনার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্য রাখে না। কুরআন মজীদে মোকাদ্দমা পেশকারীর মুখ নিসৃত শব্দাবলী হচ্ছেঃ

لِيَ نَعْجَةٌ وَاحِدَةٌ فَقَالَ أَكْفِلْنِيهَا

“আমার কাছে একটি মাত্র দুম্বী আছে এবং এ ব্যক্তি বলছে ওটি আমাকে দিয়ে দাও।” একথাই হযরত দাউদ (আ) তাঁর ফায়সালায়ও বলেছেনঃ

قَدْ ظَلَمَكَ بِسُؤَالِ نَعْجَتِكَ

“তোমার দুম্বী চেয়ে সে তোমার প্রতি জুলুম করেছে।” এ রূপকটি হযরত দাউদ ও উরিয়ার কাহিনীর সাথে তখনই খাপ খেতে পারে যখন ঐ ভদ্র মহিলা হবে তার স্ত্রী। একজনের বিয়ের পয়গামের ওপর যদি অন্য জনের পয়গাম দেবার ব্যাপার হতো তাহলে রূপকটি এভাবে বলা হতোঃ “আমি একটি দুম্বী নিতে চাইছিলাম কিন্তু সে বললো ওটিও আমার জন্য ছেড়ে দাও।”

কাযী আবু বকর ইবনুল আরাবী এ বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “আসল ঘটনা মাত্র এতটুকুই যে, হযরত দাউদ (আ) তাঁর নিজের লোকদের মধ্য থেকে একজনকে বলেন, তোমার স্ত্রীকে আমার জন্য ছেড়ে দাও এবং গুরুত্ব সহকারে এ দাবী করেন। ……………………… কুরআন মজীদে একথা বলা হয়নি যে, তাঁর দাবীর কারণে সে ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ত্যাগ করে, হযরত দাউদ তারপর সে মহিলাকে বিয়ে করেন এবং তারই গর্ভে হযরত সুলাইমানের জন্ম হয়। ……………………. সে কথার জন্য ক্রোধ নাযিল হয় সেটি এছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, তিনি এক মহিলার স্বামীর কাছে এ অভিলাস ব্যক্ত করেন যে, সে যেন তার স্ত্রীকে তাঁর জন্য ছেড়ে দেয়। ………… এ কাজটি সামগ্রিকভাবে কোন বৈধ কাজ হলেও নবুওয়াতে মর্যাদা থেকে এটি ছিল অনেক নিম্নতর ব্যাপার। এ জন্যই তাঁর ওপর আল্লাহর ক্রোধ নাযিল হয় এবং তাঁকে উপদেশও দেয়া হয়।”

এখানে যে প্রেক্ষাপটে এ কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে এ তাফসীরটিই খাপ খেয়ে যায়। বক্তব্য পরস্পরা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে একথা পরিষ্কার জানা যায় যে, কুরআন মজীদের এ স্থানে এ ঘটনাটি দু’টি উদ্দেশ্যে বর্ণনা করা হয়েছে প্রথম উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবর করার উপদেশ দেয়া এবং এ উদ্দেশ্যে তাঁকে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ “এরা তোমার বিরুদ্ধে যা কিছু বলে সে ব্যাপারে সবর করো এবং আমার বান্দা দাউদের কথা স্মরণ করো।” অর্থাৎ তোমাকে শুধুমাত্র যাদুকর ও মিথ্যুক বলা হচ্ছে কিন্তু আমার বান্দা দাউদকে তো জালেমরা ব্যভিচার ও হত্যার ষড়যন্ত্র করার অপবাদ পর্যন্ত দিয়েছিল। কাজেই এদের কাছ থেকে তোমার যা কিছু শুনতে হয় তা বরদাশত করতে থাকো।

দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি হচ্ছে কাফেরদেরকে একথা জানিয়ে দেয়া যে, তোমরা সব রকমের হিসেব নিকেশের শংকামুক্ত হয়ে দুনিয়ায় নানা ধরনের বাড়াবাড়ি করে যেতে থাকো কিন্তু যে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীনে তোমরা এসব কাজ করছো তিনি কাউকেও হিসেব-নিকেশ না নিয়ে ছাড়েন না। এমনকি যেসব বান্দা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ও নৈকট্যলাভকারী হয় তাঁরাও যদি কখনো সামান্যতম ভুল-ভ্রান্তি করে বসেন তাহলে বিশ্ব-জাহানের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী আল্লাহ‌ তাঁদেরকেও কঠিন জবাবদিহির সম্মুখীন করেন। এ উদ্দেশ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে, তাদের সামনে আমার বান্দা দাউদের কাহিনী বর্ণনা করো, যিনি ছিলেন বিচিত্র গুণধর ব্যক্তিত্বের অধিকারী কিন্তু যখন তাঁর দ্বারা একটি অসঙ্গত কাজ সংঘটিত হলো তখন দেখো কিভাবে আমি তাকে তিরস্কার করেছি।

এ সম্পর্কে আর একটি ভুল ধারণাও থেকে যায়। এটি দূর করাও জরুরী। রূপকের মাধ্যমে মোকাদ্দমা পেশকারী বলছে, এ ব্যক্তির ৯৯ টি দুম্বী আছে এবং আমার আছে মাত্র একটি দুম্বী আর সেটিই এ ব্যক্তি চাচ্ছে। এ থেকে বাহ্যত এ ধারণা হতে পারে যে, সম্ভবত হযরত দাউদের ৯৯ জন স্ত্রী ছিলেন এবং তিনি আর একজন মহিলাকে বিয়ে করে স্ত্রীদের সংখ্যা একশত পূর্ণ করে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আসলে রূপকের প্রত্যেকটি অংশের সাথে হযরত দাউদ ও হিত্তীয় উরিয়ার ঘটনার প্রত্যেকটি অংশের ওপরে অক্ষরে অক্ষরে প্রযুক্ত হওয়া জরুরী নয়। প্রচলিত প্রবাদে দশ, বিশ, পঞ্চাশ ইত্যাদি সংখ্যাগুলোর উল্লেখ কেবলমাত্র আধিক্য প্রকাশ করার জন্যই করা হয়ে থাকে সঠিক সংখ্যা উল্লেখ করার জন্য এগুলো বলা হয় না। আমরা যখন কাউকে বলি, দশবার তোমাকে বলেছি তবু তুমি আমার কোথায় কান দাওনি তখন এর মানে এ হয় না যে, গুণে গুণে দশবার বলা হয়েছে বরং এর অর্থ হয়, বারবার বলা হয়েছে। এমনি ধরনের ব্যাপার এখানে ঘটেছে। রূপকের আকারে পেশকৃত মোকদ্দমার মাধ্যমে সে ব্যক্তি হয়রত দাউদের মধ্যে এ অনুভূতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন যে, আপনার তো কয়েকজন স্ত্রী আছেন এবং তারপরও আপনি অন্য ব্যক্তির স্ত্রীকে বিয়ে করতে চাচ্ছেন। একথাটিই মুফাসসির নিশাপুরী হযরত হাসান বসরী (র) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ

لم يكن لداؤد تسع وتسعون امرأة وانما هذا مثل

“হযরত দাউদের ৯৯ টি স্ত্রী ছিল না বরং এটি নিছক একটি রূপক” (এ কাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার তাফহীমাত গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে। আমি এখানে যে ব্যাখ্যার প্রাধান্য দিয়েছি তার সপক্ষে বিস্তারিত দলিল প্রমাণ যারা জানতে চান তারা উক্ত গ্রন্থের ২৯ থেকে ৪৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ুন।)

# নিছক খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি এর পেছনে কোন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা নেই, কোন উদ্দেশ্য লক্ষ্য নেই, এর মধ্যে কোন ন্যায় ও ইনসাফ নেই এবং কোন ভালো ও মন্দ কাজের কোন ফল দেখা যায় না এমন নয়। এ উক্তি পেছনের ভাষণের সারনির্যাস এবং সামনের বিষয়বস্তুর মুখবন্ধও। পেছনের ভাষণের পর এ বাক্য বলার উদ্দেশ্যই হচ্ছে এ সত্যটি শ্রোতাদের মনে বসিয়ে দেয়া যে, মানুষকে এখানে লাগাম ছাড়া উটের মতো ছেড়ে দেয়া হয়নি এবং দুনিয়াতে যার যা মন চাইবে তাই করে যেতে থাকবে এজন্য কারো কাছে কোন জবাবদিহি করতে হবে না এমন কোন শাসকবিহীন অবস্থাও এখানে চলছে না। সামনের দিকের বিষয়বস্তুর মুখবন্ধ হিসেবে এ বাক্য থেকে বক্তব্য শুরু করে একথা বুঝানো হয়েছে যে, যে ব্যক্তি শাস্তি ও পুরস্কারে বিশ্বাস করে না এবং নিজে একথা মনে করে বসেছে যে, সৎকর্মকারী ও দুষ্কৃতিকারী উভয়ই শেষ পর্যন্ত মরে মাটি হয়ে যাবে, কাউকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না, ভালো বা মন্দ কাজের কেউ কোন প্রতিদান পাবে না, সে আসলে দুনিয়াকে একটি খেলনা এবং এর সৃষ্টিকর্তাকে একজন খেলোয়াড় মনে করে। সে আরো মনে করে, বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা দুনিয়া সৃষ্টি করে এবং তার মধ্যে মানুষ সৃষ্টি করে একটি অর্থহীন কাজ করেছেন। একথাটিই কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ভাবে বলা হয়েছে। যেমন,

أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ

“তোমরা কি মনে করেছো আমি তোমাদের অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের আমার দিকে ফিরে আসতে হবে না।” (আল মু’মিনূন, ১১৫) وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَاعِبِينَ – مَا خَلَقْنَاهُمَا إِلَّا بِالْحَقِّ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ – إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ مِيقَاتُهُمْ أَجْمَعِينَ

“আমি আকাশসমূহ ও পৃথিবীকে এবং তাদের মাঝখানে যে বিশ্ব-জাহান রয়েছে তাদেরকে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি তাদেরকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছি। কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না। আসলে চূড়ান্ত বিচারের দিনে তাদের সবার জন্য উপস্থিতির সময় নির্ধারিত রয়েছে।” (আদ দুখান, ৩৮-৪০)
# সৎ ও অসৎ উভয় শেষ পর্যন্ত সমান হয়ে যাবে একথা কি তোমাদের মতে যুক্তিসঙ্গত? কোন সৎলোক তার সততার কোন পুরস্কার পাবে না এবং কোন অসৎলোক তার অসৎকাজের শাস্তি ভোগ করবে না, এ ধারণায় কি তোমরা নিশ্চিত হতে পারো? একথা সুস্পষ্ট, যদি আখেরাত না থাকে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রকার জবাবদিহি না হয় এবং মানুষের কাজের কোন পুরস্কার ও শাস্তি না দেয়া হয় তাহলে এর মাধ্যমে আল্লাহ‌র প্রজ্ঞা ও ইনসাফ অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে এবং বিশ্ব-জাহানের সমগ্র ব্যবস্থা একটি অরাজক ব্যবস্থায় পরিণত হয়। এ ধারণার ভিত্তিতে বিচার করলে দুনিয়ায় আদৌ সৎকাজের কোন উদ্যোক্তা এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখার জন্য কোন প্রতিবন্ধকতাই থাকে না। আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব নাউযুবিল্লাহ যদি এমনি অরাজক ব্যাপার হয় তাহলে এ পৃথিবীতে যে ব্যক্তি কষ্টভোগ করে নিজে সৎ জীবন যাপন করে এবং মানুষের সংস্কার সাধনের কাজে আত্মনিয়োগ করে সে বড়ই নির্বোধ। আর যে ব্যক্তি অনুকূল সুযোগ-সুবিধা পেয়ে সব রকমের বাড়াবাড়ি করে লাভের ফল কুড়াতে থাকে এবং সব ধরনের ফাসেকী ও অশালীন কার্যকলাপের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ করতে থাকে সে বুদ্ধিমান।

# বরকতের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, “কল্যাণ ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি।” কুরআন মজীদকে বরকত সম্পন্ন কিতাব বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, এটি মানুষের জন্য একটি অত্যন্ত উপকারী কিতাব। এ কিতাবটি তার জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বোত্তম বিধান দান করে। এর বিধান মেনে চলায় মানুষের লাভই হয় কেবল, কোনো প্রকার ক্ষতির আশঙ্কা নেই।

# হযরত সুলাইমান সম্পর্কিত আলোচনা ইতিপূর্বে নিম্নোক্ত স্থানগুলোতে এসেছেঃ তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারাহ, ১০৪ ; বনী ইসরাঈল, ৭ ; আল আম্বিয়া, ৭০-৭৫ ; আন নামল, ১৮-৫৬ টীকাসমূহে এবং সাবা, ১২-১৪ আয়াতসমূহে।
# মূলে বলা হয়েছে। الصَّافِنَاتُ الْجِيَادُ এর অর্থ হচ্ছে এমনসব ঘোড়া, যেগুলো দাঁড়িয়ে থাকার সময় অত্যন্ত শান্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, লাফালাফি দাপাদাপি করে না এবং যখন দৌড়ায় অত্যন্ত দ্রুতবেগে দৌড়ায়।
# মূলে الْخَيْرِ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবীতে এ শব্দটির ব্যবহার হয় বিপুল সম্পদ অর্থে এবং ঘোড়ার জন্য পরোক্ষ অর্থেও এর ব্যবহার হয়। হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম যেহেতু ঐ ঘোড়াগুলোকে আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য রেখেছিলেন তাই তিনি “খাইর” শব্দের মাধ্যমে তাদেরকে চিহ্নিত করেছেন।
# এ আয়াতগুলোর অনুবাদ ও ব্যাখ্যায় তাফসীরকারগণের মধ্যে বিভিন্ন মতের সৃষ্টি হয়েছে।

একটি দল এগুলোর অর্থ বর্ণনা করে বলেনঃ হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম ঘোড়া দেখাশুনা ও তাদের দৌড় প্রতিযোগিতায় এতবেশী মশগুল হয়ে পড়েছিলেন যার ফলে আসরের নামাযের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। অথবা কারো কারো কথা মেনে নিজের কোন বিশেষ ওযীফা পড়তে ভুলে গিয়েছিলেন। এ ওয়ীফাটি তিনি পাঠ করতেন আসর ও মাগরিবের নামাযের মাঝামাঝি সময়। কিন্তু সেদিন সূর্য ডুবে গিয়েছিল অথচ তিনি নামায পড়তে বা ওযীফা পাঠ করতে পারেনি। ফলে তিনি হুকুম দিলেনঃ ঘোড়াগুলো ফিরিয়ে আনো। আর সেগুলো ফিরে আসার পর হযরত সুলাইমান (আ) তরবারির আঘাতে সেগুলোকে হত্যা করতে বা অন্য কথায় আল্লাহর জন্য কুরবানী করতে লাগলেন। কারণ, সেগুলো তাঁকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছিল। এ ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে এ আয়াতগুলোর অনুবাদ এভাবে করা হয়েছেঃ “তখন সে বললো, আমি এ সম্পদের প্রতি আসক্তি এত বেশী পছন্দ করেছি যার ফলে আমার রবের স্মরণ (আসরের নামায বা বিশেষ ওযীফা) থেকে গাফেল হয়ে গেছি, এমনকি (সূর্য পশ্চিমাকাশের অন্তরালে) লুকিয়ে পড়েছে। (তখন সে হুকুম দিল) ফিরিয়ে আনো ঐ (ঘোড়া) গুলোকে। (আর যখন সেগুলো ফিরে এলো) তখন তাদের পায়ের গোছায় ও ঘাড়ে (তরবারির) হাত চালিয়ে দিল।” এ ব্যাখ্যাটি কোন কোন খ্যাতিমান তাফসীরকারের দেয়া হলেও এটি অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য নয়। কারণ, এখানে তাফসীরকারকে নিজের পক্ষ থেকে তিনটি কথা বাড়াতে হয়, যেগুলোর কোন উৎস ও ভিত্তি নেই। প্রথমত তিনি ধরে নেন, হযরত সুলাইমানের আসরের নামায বা এ সময় তিনি যে একটি বিশেষ ওযীফা পড়তেন তেমন কোন ওযীফা এ কাজে মশগুল থাকার কারণে ছুটে গিয়েছিল। অথচ কুরআনের শব্দাবলী হচ্ছে কেবলমাত্রঃ

إِنِّي أَحْبَبْتُ حُبَّ الْخَيْرِ عَنْ ذِكْرِ رَبِّي

এ শব্দগুলোর অনুবাদ তো এভাবেও করা যেতে পারে যে, “আমি এ সম্পদ এত বেশী পছন্দ করে ফেলেছি, যার ফলে আমার রবের স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে পড়েছি।” কিন্তু এর মধ্যে আসরের নামায বা কোন বিশেষ ওযীফার অর্থ গ্রহণ করার কোন প্রসঙ্গ বা পূর্বসূত্র নেই। দ্বিতীয়ত তারা এটাও ধরে নেন যে, সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। অথচ সেখানে সূর্যের কোন কথা বলা হয়নি। বরং حَتَّى تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ শব্দাবলী পড়ার পর মানুষের চিন্তা স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসে পেছনের আয়াতে উল্লেখিত الصَّافِنَاتُ الْجِيَادُ এর দিকে। তৃতীয়ত, এটাও ধরে নেন যে, হযরত সুলাইমান ঘোড়াগুলোর পায়ের গোড়ায় ও ঘাড়ে খালি হাত বুলাননি বরং তলোয়ারসহ হাত বুলান। অথচ কুরআনে مَسْحًا بِالسيف শব্দ বলা হয়নি এবং এখানে এমন কোন প্রসঙ্গ বা পর্বসূত্রও নেই যার ভিত্তিতে হাত বুলানোকে তরবারিসহ হাত বুলানো অর্থে গ্রহণ করা যেতে পারে। কুরআনের ব্যাখ্যা করার এ পদ্ধতির সাথে আমি নীতিগতভাবে ভিন্নমত পোষণ করি। আমার মতে কুরআনের শব্দাবলীর বাইরে অন্য অর্থ গ্রহণ করা কেবলমাত্র চারটি অবস্থায়ই সঠিক হতে পারে। এক, কুরআনের বাক্যের মধ্যেই তার জন্য কোন পূর্বসূত্র বা প্রসঙ্গ থাকবে। দুই, কুরআনের অন্য কোন জায়গায় তার প্রতি কোন ইঙ্গিত থাকবে। তিন . কোন সহীহ হাদীসে এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। অথবা চার, তার অন্য কোন নির্ভরযোগ্য উৎস থাকবে। যেমন ইতিহাসের বিষয় হলে ইতিহাসে এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওযা যেতে হবে। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের বিষয় হলে নির্ভরযোগ্য তাত্বিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে হবে। আর শরীয়াতের বিধানের বিষয় হলো ইসলামী ফিকহের উৎস এর ব্যাখ্যা পেশ করবে। যেখানে এর মধ্য থেকে কোন একটি বিষয়ও থাকবে না সেখানে নিছক নিজস্বভাবে একটি কিসসা রচনা করে কুরআনের অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া আমার মতে সঠিক নয়।

একটি দল উপরোক্ত অনুবাদ ও ব্যাখ্যার সামান্য বিরোধিতা করেছেন। তারা বলেন, حَتَّى تَوَارَتْ بِالْحِجَابِ এবং رُبُّوهَا عَلىّ উভয়ের মধ্যে যে সর্বনাম রয়েছে সেটি হচ্ছে সূর্য। অর্থাৎ যখন আসরের নামায ছুটে গেলো এবং সূর্য অস্তমিত হলো তখন হযরত সুলাইমান (আ) বিশ্ব-জাহান পরিচালনায় নিযুক্ত কর্মকর্তাগণকে অর্থাৎ ফেরেশতাগণকে বললেন, সূর্যকে ফিরিয়ে আনো, যাতে আসরের সময় ফিরে আসে এবং আমি নামায পড়তে পারি। এর ফলে সূর্য ফিরে এলো এবং তিনি নামায পড়ে নিলেন। কিন্তু এ ব্যাখ্যাটি ওপরের ব্যাখ্যাটির চাইতেও আরো বেশী অগ্রহণযোগ্য। এজন্য নয় যে, আল্লাহ‌ সূর্যকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম নন বরং এজন্য যে, আল্লাহ‌ আদৌ এর কোন উল্লেখই করেননি। বরং হযরত সুলাইমানের জন্য যদি এত বড় মু’জিযার প্রকাশ ঘটতো তাহলে অবশ্যই তা উল্লেখযোগ্য হওয়া উচিত ছিল। এর আরো একটি কারণ এই যে, সূর্যের অস্তমিত হয়ে তারপর আবার ফিরে আসা এমন একটি অসাধারণ ঘটনা যে, যদি সত্যিই তা ঘটে থাকতো তাহলে দুনিয়ার ইতিহাসে তা কখনো অনুল্লেখিত থাকতো না। এ ব্যাখ্যার সপক্ষে তাঁরা কতিপয় হাদীস পেশ করেও একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, সূর্যের অস্তমিত হয়ে পুনর্বার ফিরে আসার ঘটনা মাত্র একবার ঘটেনি বরং কয়েকবার এ ঘটনা ঘটেছে। মি’রাজের ঘটনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য সূর্যকে ফিরিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। খন্দকের যুদ্ধের সময়ও নবী করীমের ﷺ জন্য তাকে ফিরিয়ে আনা হয়। আর হযরত আলীর (রা) জন্যও ফিরিয়ে আনা হয় যখন নবী (সা) তাঁর কোলে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছিলেন এবং তাঁর আসরের নামায কাযা হয়ে গিয়েছিল। নবী করীম ﷺ সূর্যকে ফিরিয়ে আনার দোয়া করেন এবং তা ফিরে আসে। কিন্তু যে ব্যাখ্যার সমর্থনে এ হাদীসগুলো বর্ণনা করা হয়েছে এগুলো থেকে তার সপক্ষে প্রমাণ পেশ করা তার চাইতেও দুর্বল। হযরত আলী সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণনা করা হয়ে থাকে তার সকল বর্ণনা পরম্পরা ও বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে ইবনে তাইমিয়া একে বনোয়াট ও জাল হাদীস প্রমাণ করেছেন। ইমাম আহমাদ বলেন, এর কোন ভিত্তি নেই। ইবনে জাওযী বলেন, নিঃসন্দেহে এটি জাল হাদীস। খন্দকের যুদ্ধের সময় সূর্যকে ফিরিয়ে আনার হাদীসটিও অনেক মুহাদ্দিসের মতে যঈফ এবং অনেকের মতে বানোয়াট। অন্যদিকে মি’রাজের হাদীসের আসল ব্যাপারটি হচ্ছে, যখন নবী করীম ﷺ মক্কার কাফেরদের কাছে মি’রাজের রাতের অবস্থা বর্ণনা করছিলেন তখন কাফেররা তাঁর কাছে প্রমাণ চাইলো। তিনি বললেন, বাইতুল মাকদিসের পথে অমুক জায়গায় একটি কাফেলার দেখা পেয়েছিলাম এবং তাদের সাথে অমুক ঘটনা ঘটেছিল। কাফেররা জিজ্ঞেস করলো, সে কাফেলাটি কবে মক্কায় পৌঁছবে? তিনি জবাব দিলেন, অমুক দিন। যখন সেদিনটি এলো কুরাইশরা সারদিন কাফেলার অপেক্ষা করতে লাগলো, এমনকি সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তখন নবী (সা.) দোয়া করলেন যেন সূর্য ততক্ষণ পর্যন্ত অস্তমিত না হয় যতক্ষণ কাফেলা না এসে যায়। কাজেই দেখা গেলো সূর্য ডুবার আগে তারা পৌঁছে গেছে। এ ঘটনাটিকে কোন কোন বর্ণনাকারী এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, সেদিন দিনের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং এই বাড়তি সময় পর্যন্ত সূর্য দাঁড়িয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের হাদীস এত বড় অস্বাভাবিক ঘটনার প্রমাণের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য হিসেবে যথেষ্ট হতে পারে কি? যেমন আমি আগেই বলে এসেছি, সূর্যের ফিরে আসা বা ঘণ্টা খানিক আটকে থাকা কোন সাধারণ ঘটনা নয়।

এ ধরনের ঘটনা যদি সত্যিই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকতো তাহলে সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ পড়ে যেতো। দু-চারটে খবরে ওয়াহিদের (যে হাদীসের বর্ণনাকারী কোন স্তরে মাত্র একজন) মধ্যে তার আলোচনা কেমন করে সীমাবদ্ধ থাকতো?

মুফাসসিরগণের তৃতীয় দলটি এ আয়াতগুলোর এমন অর্থ গ্রহণ করেন যা একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি এর শব্দগুলো পড়ে এ থেকে গ্রহণ করতে পারে। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ঘটনা কেবলমাত্র এতটুকুঃ হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের সামনে যখন উন্নত ধরনের ভাল জাতের ঘোড়ার একটি পাল পেশ করা হলো তখন তিনি বললেন, অহংকার বা আত্মম্ভরিতা করার জন্য অথবা শুধুমাত্র আত্মস্বার্থের খাতিরে এ সম্পদ আমার কাছে প্রিয় নয়। বরং এসব জিনিসের প্রতি আমার আকর্ষণকে আমি আমার রবের কালেমা বুলন্দ করার জন্য পছন্দ করে থাকি। তারপর তিনি সে ঘোড়াগুলোর দৌড় করালেন এমনকি সেগুলো দৃষ্টি বাইরে চলে গেলো। এরপর তিনি সেগুলো ফেরত আনালেন। সেগুলো ফেরত আসার পর ইবনে আব্বাসের বক্তব্য অনুযায়ীঃ

جعل يمسح اعراف الخيل وعراقيبها حبالها

“তিনি তাদের পায়ের গোছায় ও ঘাড়ে আদর করে হাত বুলাতে লাগলেন” আমাদের মতে এ ব্যাখ্যাটিই সঠিক। কারণ কুরআন মজীদের শব্দাবলীর সাথে এটি পূর্ণ সামঞ্জস্য রাখে এবং অর্থকে পূর্ণতা দান করার জন্য এর মধ্যে এমন কোন কথা বাড়িয়ে বলতে হয় না যা কুরআনে নেই, কোন সহীহ হাদীসে নেই এবং বনী ইসরাঈলের ইতিহাসেও নেই।

এ প্রসঙ্গে একথাটিও সামনে থাকা উচিত যে, আল্লাহ‌ হযরত সুলাইমানের পক্ষে এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেনঃ نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ (নিজের রবের দিকে বেশী বেশী ফিরে আসা ব্যক্তিই হচ্ছে সর্বোত্তম বান্দা) এর প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করার অব্যবহিত পরেই করেছেন।

এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, আসলে একথা বলাই এখানে উদ্দেশ্য ছিল যে, দেখো, সে আমার কত ভাল বান্দা ছিল, বাদশাহীর সাজ সরঞ্জাম তার কাছে পছন্দনীয় ছিল দুনিয়ার খাতিরে নয় বরং আমার জন্য, নিজের পরাক্রান্ত অশ্ববাহিনী দেখে দুনিয়াদার ও বৈষয়িক ভোগ লালসায় মত্ত শাসনকর্তাদের মতো সে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেনি বরং সে সময়ও তার মনোজগতে ভেসে উঠেছে আমারই স্মৃতি।
# বক্তব্যের ধারাবাহিকতা অনুসারে এখানে একথা বলাই মূল উদ্দেশ্য এবং পেছনের আয়াতগুলো এরই জন্য মুখবন্ধ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে। যেমন প্রথমে হযরত দাউদের প্রশংসা করা হয়েছে, তারপর যে ঘটনার ফলে তিনি ফিতনার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন সেটি উল্লেখ করা হয়েছে, একথা বলা হয়েছে যে, মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ‌ নিজের এত প্রিয় বান্দাকেও জবাবদিহি না করে ছড়েননি, তারপর তাঁর এ কাজকর্ম দেখান যে, ফিতনা সম্পর্কে সজাগ করে দেবার সাথে সাথেই তিনি তাওবা করেন এবং আল্লাহর সামনে মাথা নত করে নিজের ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে ফিরে আসেন, অনুরূপভাবে এখানেও বক্তব্য বিন্যাস এভাবে করা হয়েছেঃ প্রথমে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের উচ্চ মর্যাদা ও মহিমান্বিত বন্দেগীর কথা বলা হয়েছে, তারপর বলা হয়েছে, তাঁকেও পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়েছিল, তারপর তাঁর বন্দেগীর এ কৃতিত্ব দেখান যে, যখন তাঁর সিংহাসনে একটি দেহাবয়ব এনে ফেলে দেয়া হয় তখন সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিজের পদস্খলন সম্পর্কে সজাগ হন, নিজের রবের সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং যে কথার জন্য তিনি ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিলেন নিজের সে কথা ও কার্যক্রম থেকে ফিরে আসেন। অন্য কথায় বলা যায়, এ দু’টি কাহিনী থেকে আল্লাহ একই সঙ্গে দু’টি কথা বুঝতে চান। এক, তাঁর নিরপেক্ষ সমালোচনা পর্যালোচনা ও জবাবদিহি থেকে সাধারণ তো দূরের কথা নবীরাও বাঁচতে পারেননি। দুই, অপরাধ করে ঘাড় বাঁকা করে থাকা বান্দার জন্য সঠিক কর্মনীতি নয়। বরং তার কাজ হচ্ছে যখনই সে নিজের ভুল অনুভব করতে পারবে তখনই বিনীতভাবে নিজে রবের সামনে ঝুঁকে পড়বে। এ কর্মনীতিরই ফল স্বরূপ মহান আল্লাহ‌ এ মনীষীদের পদস্খনগুলো কেবল ক্ষমাই করে দেননি বরং তাঁদের প্রতি আরো বেশী দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করেছেন।

এখানে আবার এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম যে ফিতনার সম্মুখীন হয়েছিলেন সেটি কেমন ফিতনা ছিল? তাঁর আসনের ওপর একটি দেহাবয়ব এনে ফেলে দেয়ার অর্থ কি? এ দেহাবয়ব এনে তাঁর আসনে ফেলে দেয়া তাঁর জন্য কোন্ ধরনের সতর্কীকরণ ছিল যার ফলে তিনি তাওবা করেন? এর জবাবে মুফাস্‌সিরগণ চারটি ভিন্ন ভিন্ন মত অবলম্বন করেছেন।

একটি দল একটি বিরাট কাহিনী বর্ণনা করেছেন। এর বিস্তারিত বিবরণের ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে আবার বহু ধরনের মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। কিন্তু তাদের সবার সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছেঃ হযরত সুলাইমানের থেকে এই ত্রুটি সংঘটিত হয়েছিল যে, তাঁর মহলে এক বেগম সাহেবা চল্লিশ দিন পর্যন্ত পূজায় লিপ্ত ছিলেন এবং তিনি ছিলেন এ ব্যাপারে বেখবর। অথবা তিনি কয়েকদিন পর্যন্ত গৃহমধ্যে বসেছিলেন এবং কোন মজলুমের ফরিয়াদ শুনেননি। এর ফলে তিনি যে শাস্তি পেয়েছিলেন তা ছিল এই যে, এক শয়তান যে কোনভাবেই তাঁর এমন একটি আংটি চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল যার বদৌলতে তিনি জিন ও মানুষ জাতি এবং বাতাসের ওপর রাজত্ব করতেন। আংটি হাতছাড়া হয়ে যেতেই হযরত সুলাইমানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব খতম হয়ে গিয়েছিল এবং চল্লিশ দিন পর্যন্ত তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে থাকলেন। এই অন্তরবর্তীকালে সেই শয়তান সুলাইমানের রূপ ধারণ করে রাজত্ব করতে থাকলো। সুলাইমানের সিংহাসনে একটি দেহাবয়ব এনে ফেলে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁর সিংহাসনে উপবেশনকারী এই শয়তান। কেউ কেউ একথাও বলে ফেলেছেন যে, সে এই শয়তানের হাত থেকে সুলাইমানের হারেমের মহিলাদের সতীত্বও সংরক্ষিত থাকেনি। শেষ পর্যন্ত দরবারের আমাত্যবর্গ, পরিষদ ও উলামায়ে কেরামের মনে তার কার্যকলাপ দেখে সন্দেহের সৃষ্টি হলো এবং তারা মনে করতে থাকলেন, এ ব্যক্তি সুলাইমান নয়। কাজেই তারা তার সামনে তাওরাত খুলে মেলে ধরলেন এবং সে ভয়ে পালিয়ে গেলো। পথে তার হাত থেকে আংটি খুলে গিয়ে সমুদ্রে পড়ে গেলো অথবা সে নিজেই তা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলো। একটি মাছ তা গিলে ফেললো। ঘটনাক্রমে সে মাছটি হযরত সুলাইমানের হস্তগত হলো। মাছটি রান্না করার জন্য তিনি তার পেট কেটে ফেললেন। সেখান থেকে আংটি বের হয়ে পড়লো। আংটি হাতে আসার সাথে সাথেই জিন মানুষ ইত্যাদি সবাই সালাম করতে করতে তাঁর সামনে হাজির হয়ে গেলো।–এ পুরো কাহিনীটিই ছিল একটি পৌরনিক গালগল্প। নওমুসলিম আহ্‌লি কিতাবগণ তালমুদ ও অন্যান্য ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে সংগ্রহ করে এটি মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, আমাদের বড় বড় পণ্ডিতগণ একে কুরআনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা মনে করে নিজেদের ভাষায় এগুলো বর্ণনা করেছেন। অথচ সুলাইমানের আংটির কোন সত্যতা নেই। হযরত সুলাইমানের কৃতিত্ব কোন আংটির ভেল্কিবাজি ছিল না। শয়তানদেরকেও আল্লাহ‌ নবীদের আকৃতি ধরে আসার ও মানুষকে গোমরাহ করার ক্ষমতা দেননি। তাছাড়া আল্লাহ‌ সম্পর্কে এমন কোন ধারণাও করা যেতে পারে না যে, তিনি কোন নবীর কোন ভুলের শাস্তি এমন ফিতনার আকৃতিতে দান করবেন যার ফলে শয়তান নবী হয়ে একটি উম্মাতের সমগ্র জনগোষ্ঠীর সর্বনাশ করে দেবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই যে, কুরআন নিজেই এ তাফসীরের প্রতিবাদ করছে। সামনের আয়াতে আল্লাহ‌ বলেছেন, হযরত সুলাইমান যখন এ পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং তিনি আমার কাছে ক্ষমা চান তখন আমি বায়ু ও শয়তানদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। কিন্তু এ তাফসীর এর বিপরীতে একথা বলছে যে, আংটির কারণে শয়তানরা পূর্বেই হযরত সুলাইমানের হুকুমের অনুগত হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যেসব মনীষী এ তাফসীর বর্ণনা করেছেন তারা পরবর্তী আয়াত কি বলেছে তা আর দেখেননি।

দ্বিতীয় দলটি বলেন, ২০ বছর পর হযরত সুলাইমানের একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। শয়তানরা বিপদ গণে। তারা মনে করে যদি হযরত সুলাইমানের পর তার এ পুত্র বাদশাহ হয়ে যায় তাহলে তাদেরকে আবার একই গোলামীর জিঞ্জির বহন করে চলতে হবে। তাই তারা তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। হযরত সুলাইমান একথা জানতে পারেন। তিনি পুত্রকে মেঘের মধ্যে লুকিয়ে রাখেন। সেখানেই তার লালন-পালনের ব্যবস্থা করেন। এটিই ছিল সেই ফিতনা যার সম্মুখীন তিনি হয়েছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর ওপর ভরসা করার পরিবর্তে তিনি মেঘের হেফাজতের ওপর ভরসা করেছিলেন। এর শাস্তি তাঁকে এভাবে দেয়া হয় যে, সে শিশুটি মরে গিয়ে তাঁর সিংহাসনের ওপর এসে পড়ে।–এ কাহিনীটিও আগাগোড়া ভিত্তিহীন ও উদ্ভট এবং স্পষ্ট কুরআন বিরোধী। কারণ এখানেও ধারণা করে নেয়া হয়েছে যে, বায়ু ও শয়তানরা পূর্ব থেকেই হযরত সুলাইমানের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। অথচ কুরআন পরিষ্কার ভাষায় তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হবার ব্যাপারটিকে এ ফিতনার পরবর্তীকালের ঘটনা বলে উল্লেখ করছে।

তৃতীয় দলটি বলেন, একদিন হযরত সুলাইমান কসম খান, আজ রাতে আমি সত্তরজন স্ত্রীর কাছে যাবো এবং প্রত্যেক গর্ভে একজন করে আল্লাহর পথের মুজাহিদ জন্ম দেব। কিন্তু একথা বলতে গিয়ে তিনি ইনশাআল্লাহ বলেননি। এর ফলে মাত্র একজন স্ত্রী গর্ভবতী হয় এবং তাঁর গর্ভেও একটি অসমাপ্ত ও অপরিপক্ব শিশুর জন্ম হয়। দাই শিশুটিকে এনে হযরত সুলাইমানের আসনের ওপর ফেলে দেয়। এ হাদীসটি হযরত আবু হুরাইরা (রা.) নবী ﷺ থেকে বর্ণনা করেছেন। বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন রাবীর মাধ্যমে এটি উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী শরীফেই এ হাদীসটি যেসব রাবীর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে তার কোনটিতে স্ত্রীদের সংখ্যা বলা হয়েছে ৬০, কোনটিতে ৭০, কোনটিতে ৯০, কোনটিতে ৯৯, আবার কোনটিতে ১০০ও বলা হয়েছে। সনদের দিক দিয়ে এর মধ্য থেকে অধিকাংশই শক্তিশালী এবং রেওয়ায়াত হিসেবে এগুলোর নির্ভুলতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করা যেতে পারে না। কিন্তু এ হাদীসের বিষয়বস্তু সুস্পষ্টভাবে সাধারণ বিবেক-বুদ্ধির বিরোধী। এর ভাষা বলছে, একথা নবী ﷺ কখনো এভাবে বলেননি যেভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে। বরং তিনি সম্ভবত ইহুদীদের মিথ্যা ও অপবাদমূলক কিচ্ছা-কাহিনীর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কোন পর্যায়ে একে এভাবে উদাহরণস্বরূপ বর্ণনা করে থাকবেন এবং শ্রোতার মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়ে থাকবে যে, নবী করীম ﷺ নিজেই এ ঘটনা বর্ণনা করছেন। এ ধরনের রেওয়ায়াতকে নিছক জোরে লোকদের হজম করাবার চেষ্টা করানো দ্বীনকে হাস্যাস্পদ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই হিসেব কষে দেখতে পারেন, শীতের দীর্ঘতম রাত ও এশা থেকে নিয়ে ফজর পর্যন্ত দশ এগারো ঘণ্টার বেশী সময় হয় না। যদি স্ত্রীদের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০ জন বলে মেনে নেয়া যায়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায়, সেই রাতে হযরত সুলাইমান আলাইহি সালাম কোন প্রকার বিশ্রাম না নিয়েই অবিরাম ১০ বা ১১ ঘণ্টা ধরে প্রতি ঘণ্টায় ৬ জন স্ত্রীর সাথে সহবাস করতে থেকেছেন। কার্যত এটা কি সম্ভব? আর একথাও কি আশা করা যেতে পারে যে, নবী করীম ﷺ বাস্তব ঘটনা হিসেবে একথাটি বর্ণনা করে থাকবেন? তারপর হাদীসে কোথাও একথা বলা হয়নি যে, কুরআন মজীদে হযরত সুলাইমানের আসনের ওপর যে দেহাবয়বটি ফেলে রাখার কথা বলা হয়েছে সেটি হচ্ছে এ অপরিণত শিশু। তাই নবী করীম ﷺ এ ঘটনাটি এ আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন তা বলা যায় না। তাছাড়া এ সন্তানের জন্মের পর হযরত সুলাইমানের ইসতিগফার করার কথা তো বোধগম্য হতে পারে কিন্তু তিনি ইসতিগফারের সাথে সাথে “আমাকে এমন রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করো যা আমার পরে আর কারো জন্য শোভনীয় নয়”-এ দোয়াটি কেন করেছিলেন তা বোধগম্য নয়।

এর আর একটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং ইমাম রাযী এটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে, হযরত সুলাইমান কোন কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন অথবা কোন বিপদের কারণে এতবেশী চিন্তান্বিত ছিলেন যার ফলে তিনি শুকাতে শুকাতে হাড্ডিচর্মসার হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এ ব্যাখ্যাটি কুরআনের শব্দের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। কুরআনের শব্দাবলী হচ্ছেঃ “আমি সুলাইমান কে পরীক্ষায় ফেলে দিলাম এবং তার আসনের ওপর একটি দেহাবয়ব নিক্ষেপ করলাম তারপর সে ফিরে এলো।” এ শব্দগুলো পড়ে কোন ব্যক্তিও একথা বুঝতে পারে না যে, এ দেহাবয়ব বলতে হযরত সুলাইমানকেই বুঝানো হয়েছে। এ থেকে তো পরিষ্কার জানা যায়, এ পরীক্ষার সম্মুখীন করার মূলে হযরত সুলাইমানের কোন ভুলচুক বা পদস্খলন ছিল। এ ভুলচুকের কারণে তাকে সতর্ক করে জানিয়ে দেয়া হয় যে, আপনার আসনের ওপর একটি দেহ এনে ফেলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে নিজের ভুলচুক বুঝতে পেরে তিনি ফিরে আসেন।

আসলে এটি কুরআন মজীদের জটিলতম স্থানগুলোর মধ্যে একটি। চূড়ান্তভাবে এর ব্যাখ্যা করার মতো কোন নিশ্চিত বুনিয়াদ আমাদের কাছে নেই। কিন্তু হযরত সুলাইমানের দোয়ার এ শব্দাবলীঃ “হে আমার বর! আমাকে মাফ করে দিন এবং আমাকে এমন রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করুন যা আমার পরে আর কারোর জন্য শোভনীয় নয়” যদি বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের আলোকে পড়া যায় তাহলে আপাতদৃষ্ট অনুভূত হবে, তাঁর মনে সম্ভবত এ আকাঙ্ক্ষা ছিল যে, তাঁর পরে ছেলে হবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত এবং শাসন ও রাষ্ট্র কর্তৃত্ব আগামীতে তাঁর পরিবারের মধ্যে অব্যাহত থাকবে। এ জিনিসটিকেই আল্লাহ‌ তাঁর জন্য ফিতনা গণ্য করেছেন এবং এ ব্যাপারে তিনি এমন সময় সজাগ হয়েছেন যখন তাঁর পুত্র যুবরাজ রাজুবয়াম এমন এক অযোগ্য তরুণ হিসেবে সামনে এসে গিয়েছিল যার আচরণ পরিষ্কার বলে দিচ্ছিল যে, সে দাউদ ও সুলাইমান আলাইহি সালামের সালতানাত চারদিনও টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তাঁর আসনে একটি দেহ নিক্ষেপ করার ভাবার্থ সম্ভবত এই হবে যে, যে পুত্রকে তিনি সিংহাসনে বসাতে চাচ্ছিলেন সে ছিল একটি আযোগ্য পুত্র। এ সময় তিনি নিজের আকাঙ্ক্ষা পরিহার করেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে এ মর্মে আবেদন জানান যে, এ বাদশাহী যেন আমার পর শেষ হয়ে যায় এবং আমার পরে আমার বংশের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অব্যাহত রাখার আকাঙ্ক্ষা আমি প্রত্যাহার করলাম। বনী ইসরাঈলের ইতিহাস থেকেও একথাই জানা যায় যে, হযরত সুলাইমান নিজের পরে আর কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য অসিয়াত করে যাননি এবং কারো আনুগত্য করার জন্য লোকদেরকে বাধ্যও করেননি। পরবর্তীকালে তাঁর রাষ্টীয় পরিষদবর্গ রাজুবয়ামকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু সামান্য কিছুদিন যেতে না যেতেই বনী ইসরাঈলের দশটি গোত্র উত্তর ফিলিস্তিনের এলাকাটি নিয়ে আলাদা হয়ে যায় এবং একমাত্র ইয়াহুদা গোত্র বাইতুল মাকদিসের রাষ্টীয় প্রশাসনের সাথে সংযুক্ত থাকে।
# সূরা আল আম্বিয়ার ব্যাখ্যায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া, ৭৪ টীকা) তবে এখানে একটি কথা সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন। সেটি হচ্ছে, সূরা আল আম্বিয়ায় যেখানে বাতাসকে নিয়ন্ত্রিত করার কথা বলা হয়েছে সেখানে الرِّيحَ عَاصِفَةً (প্রবল বায়ু) শব্দাবলী ব্যবহৃত হয়েছে। আর এখানে সে একই বাতাস সম্পর্কে বলা হচ্ছে, تَجْرِي بِأَمْرِهِ رُخَاءً

(তার হুকুমে সে মৃদুমন্দভাবে প্রবাহিত হতো)। এর অর্থ হচ্ছে, সে বাতাস মূলত প্রবল ছিল যেমন বাতাস চালিত জাহাজ চালাবার জন্য প্রবল বায়ুর প্রয়োজন হয়। কিন্তু হযরত সুলাইমানের জন্য তাকে এ অর্থে মৃদুমন্দ করে দেয়া হয়েছিল যে, তাঁর বাণিজ্যবহর যেদিকে সফর করতে চাইতো সেদিকেই তা প্রবাহিত হতো।

# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আম্বিয়া, ৭৫ টীকা , আন নামল ২৩ , ২৮ , ৪৫ ও ৪৭ টীকা।—শয়তান বলতে জিন বুঝানো হয়েছে। আর শৃংখলিত জিন বলতে এমনসব সেবক জিন বুঝানো হয়েছে যাদেরকে বিভিন্ন দুষ্কর্মের কারণে বন্দী করা হতো। যেসব বেড়ী ও জিঞ্জির দিয়ে এ জিনগুলোকে বাঁধা হতো সেগুলো লোহা নির্মিত হওয়া এবং বন্দীদেরকেও মানুষদের মতো প্রকাশ্যে শৃংখলিত দেখতে পাওয়াও অপরিহার্য ছিল না। মোটকথা তাদেরকে এমন পদ্ধতিতে বন্দী করা হতো যার ফলে তারা পালাবার ও কুকর্ম করার সুযোগ পেতো না।
# এ আয়াতের তিনটি অর্থ হতে পারে। এক, এটি আমার বেহিসেব দান। তুমি যাকে ইচ্ছা দিতে পারো, যাকে ইচ্ছা নাও দিতে পারে। দুই, এটি আমার দান। যাকে ইচ্ছা দাও এবং যাকে ইচ্ছা না দাও, দেয়া বা না দেয়ার জন্য তোমাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না। কোন কোন মুফাসসির এর আরো একটি অর্থ করেছেন। সেটি হচ্ছে, এ শয়তানদেরকে পুরোপুরি তোমার অধীনে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এদের মধ্য থেকে যাকে চাও মুক্তি দিয়ে দাও এবং যাকে চাও আটকে রাখো, এজন্য তোমাকে কোন জবাবদিহি করতে হবে না।
# এখানে একথা উল্লেখ করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা জানিয়ে দেয়া যে, বান্দার অহংকার আল্লাহর কাছে যত বেশী অপ্রিয় ও অপছন্দনীয় তার দ্বীনতা ও বিনয়ের প্রকাশ তাঁর কাছে তত বেশী প্রিয়। বান্দা যদি অপরাধ করে এবং সতর্ক করার কারণে উল্টো আরো বেশী বাড়াবাড়ি করে, তাহলে এর পরিণাম তাই হয় যা সামনের দিকে আদম ও ইবলিসের কাহিনীতে বর্ণনা করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে বান্দার যদি সামান্য পদস্খলন হয়ে যায় এবং সে তাওবা করে দ্বীনতা সহকারে তার রবের সামনে মাথা নত করে, তাহলে তার প্রতি এমন সব দাক্ষিণ্য প্রদর্শন করা হয়, যা ইতিপূর্বে দাউদ ও সুলাইমান আলাইহিমাস সালামের ওপর প্রদর্শিত হয়। হযরত সুলাইমান ইসতিগফারের পরে যে দোয়া করেছিলেন আল্লাহ‌ তাকে অক্ষরে অক্ষরে পূরণ করেন এবং বাস্তবে তাঁকে এমন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দান করেন যা তাঁর পূর্বে কেউ লাভ করেনি এবং তাঁর পরে আজও পর্যন্ত কাউকে দেয়া হয়নি। বায়ু নিয়ন্ত্রণ ও জিনদের ওপর কর্তৃত্ব এ দু’টি এমন ধরনের অসাধারণ শক্তি যা মানুষের ইতিহাসে একমাত্র হযরত সুলাইমানকেই দান করা হয়েছে। অন্য কাউকে এর কোন অংশ দেয়া হয়নি।

Leave a Reply