أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮০)
[*ধৈর্য ধারণ করা ও শপথ করলে তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ
পারা:২৩
৪১- ৬৪ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪১
وَ اذۡکُرۡ عَبۡدَنَاۤ اَیُّوۡبَ ۘ اِذۡ نَادٰی رَبَّہٗۤ اَنِّیۡ مَسَّنِیَ الشَّیۡطٰنُ بِنُصۡبٍ وَّ عَذَابٍ ﴿ؕ۴۱﴾
আর স্মরণ করুন, আমাদের বান্দা আইউবকে, যখন তিনি তার রবকে বলেছিলেন, ‘শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে’,
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪২
اُرۡکُضۡ بِرِجۡلِکَ ۚ ہٰذَا مُغۡتَسَلٌۢ بَارِدٌ وَّ شَرَابٌ ﴿۴۲﴾
(আমি তাঁকে হুকুম দিলাম) তোমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করো, এ হচ্ছে ঠাণ্ডা পানি গোসল করার জন্য এবং পান করার জন্য।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪৩
وَ وَہَبۡنَا لَہٗۤ اَہۡلَہٗ وَ مِثۡلَہُمۡ مَّعَہُمۡ رَحۡمَۃً مِّنَّا وَ ذِکۡرٰی لِاُولِی الۡاَلۡبَابِ ﴿۴۳﴾
আমি তাঁকে ফিরিয়ে দিলাম তাঁর পরিবার পরিজন এবং সেই সাথে তাদের মতো আরো, নিজের পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ এবং বুদ্ধি ও চিন্তাশীলদের জন্য শিক্ষণীয় হিসেবে।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪৪
وَ خُذۡ بِیَدِکَ ضِغۡثًا فَاضۡرِبۡ بِّہٖ وَ لَا تَحۡنَثۡ ؕ اِنَّا وَجَدۡنٰہُ صَابِرًا ؕ نِعۡمَ الۡعَبۡدُ ؕ اِنَّہٗۤ اَوَّابٌ ﴿۴۴﴾
এক আটি ঝাড়ু নাও এবং তা দিয়ে আঘাত করো এবং নিজের কসম ভঙ্গ করো না। আমি তাঁকে সবরকারী পেয়েছি, উত্তম বান্দা ছিল সে, নিজের রবের অভিমুখী।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪৫
وَ اذۡکُرۡ عِبٰدَنَاۤ اِبۡرٰہِیۡمَ وَ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ اُولِی الۡاَیۡدِیۡ وَ الۡاَبۡصَارِ ﴿۴۵﴾
আর স্মরণ করুন, আমাদের বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়া’কুবের কথা, তাঁরা ছিলেন শক্তিশালী ও সূক্ষ্মদর্শী।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪৬
اِنَّاۤ اَخۡلَصۡنٰہُمۡ بِخَالِصَۃٍ ذِکۡرَی الدَّارِ ﴿ۚ۴۶﴾
আমি তাদেরকে এক বিশেষ গুণের অধিকারী করেছিলাম; তা ছিল পরকালের স্মরণ।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪৭
وَ اِنَّہُمۡ عِنۡدَنَا لَمِنَ الۡمُصۡطَفَیۡنَ الۡاَخۡیَارِ ﴿ؕ۴۷﴾
নিশ্চয় তারা ছিলেন আমাদের নিকট মনোনীত উত্তম বান্দাদের অন্যতম।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪৮
وَ اذۡکُرۡ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ الۡیَسَعَ وَ ذَاالۡکِفۡلِ ؕ وَ کُلٌّ مِّنَ الۡاَخۡیَارِ ﴿ؕ۴۸﴾
স্মরণ করুন, ইসমাঈল, আল-ইয়াসা’আ ও যুল-কিফ্লের কথা, আর এরা প্ৰত্যেকেই ছিলেন সজ্জনদের অন্তর্ভুক্ত।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৪৯
ہٰذَا ذِکۡرٌ ؕ وَ اِنَّ لِلۡمُتَّقِیۡنَ لَحُسۡنَ مَاٰبٍ ﴿ۙ۴۹﴾
এ এক স্মরণ’। মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে উত্তম আবাস—
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫০
جَنّٰتِ عَدۡنٍ مُّفَتَّحَۃً لَّہُمُ الۡاَبۡوَابُ ﴿ۚ۵۰﴾
চিরস্থায়ী জান্নাত, যার দরজাসমূহ তাদের জন্য উন্মুক্ত।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫১
مُتَّکِـِٕیۡنَ فِیۡہَا یَدۡعُوۡنَ فِیۡہَا بِفَاکِہَۃٍ کَثِیۡرَۃٍ وَّ شَرَابٍ ﴿۵۱﴾
সেখানে তারা আসীন হবে হেলান দিয়ে, সেখানে তারা যত খুশী ফলমূল ও পানীয়ের জন্য আদেশ দেবে।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫২
وَ عِنۡدَہُمۡ قٰصِرٰتُ الطَّرۡفِ اَتۡرَابٌ ﴿۵۲﴾
আর তাদের পাশে থাকবে আনতনয়না সমবয়স্কারা।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫৩
ہٰذَا مَا تُوۡعَدُوۡنَ لِیَوۡمِ الۡحِسَابِ ﴿ؓ۵۳﴾
বিচার দিনের জন্য তোমাদের এরই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫৪
اِنَّ ہٰذَا لَرِزۡقُنَا مَا لَہٗ مِنۡ نَّفَادٍ ﴿ۚۖ۵۴﴾
নিশ্চয় এটা আমার দেয়া রিযিক যা নিঃশেষ হবার নয়।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫৫
ہٰذَا ؕ وَ اِنَّ لِلطّٰغِیۡنَ لَشَرَّ مَاٰبٍ ﴿ۙ۵۵﴾
এতো হচ্ছে মুত্তাকীদের পরিণাম আর বিদ্রোহীদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্টতম আবাস
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫৬
جَہَنَّمَ ۚ یَصۡلَوۡنَہَا ۚ فَبِئۡسَ الۡمِہَادُ ﴿۵۶﴾
জাহান্নাম, যেখানে তারা দগ্ধীভূত হবে, সেটি বড়ই খারাপ আবাস।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫৭
ہٰذَا ۙ فَلۡیَذُوۡقُوۡہُ حَمِیۡمٌ وَّ غَسَّاقٌ ﴿ۙ۵۷﴾
এ হচ্ছে তাদের জন্য, কাজেই তারা স্বাদ আস্বাদন করুক ফুটন্ত পানির, পুঁজের।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫৮
وَّ اٰخَرُ مِنۡ شَکۡلِہٖۤ اَزۡوَاجٌ ﴿ؕ۵۸﴾
এ ছাড়া রয়েছে এরূপ আরও বিভিন্ন ধরনের শাস্তি।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৫৯
ہٰذَا فَوۡجٌ مُّقۡتَحِمٌ مَّعَکُمۡ ۚ لَا مَرۡحَبًۢا بِہِمۡ ؕ اِنَّہُمۡ صَالُوا النَّارِ ﴿۵۹﴾
‘এ তো এক বাহিনী, তোমাদের সঙ্গে প্ৰবেশ করছে। তাদের জন্য নেই কোন অভিনন্দন। নিশ্চয় তারা আগুনে জ্বলবে।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬০
قَالُوۡا بَلۡ اَنۡتُمۡ ۟ لَا مَرۡحَبًۢا بِکُمۡ ؕ اَنۡتُمۡ قَدَّمۡتُمُوۡہُ لَنَا ۚ فَبِئۡسَ الۡقَرَارُ ﴿۶۰﴾
অনুসারীরা বলবে, ‘তোমাদের জন্যও তো অভিনন্দন নেই। তোমরাই তো আমাদেরকে শাস্তির সম্মুখীন করেছ। সুতরাং কত নিকৃষ্ট এ আবাসস্থল।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬১
قَالُوۡا رَبَّنَا مَنۡ قَدَّمَ لَنَا ہٰذَا فَزِدۡہُ عَذَابًا ضِعۡفًا فِی النَّارِ ﴿۶۱﴾
ওরা বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! যে আমাদেরকে এর সম্মুখীন করেছে জাহান্নামে তার শাস্তি দ্বিগুণ বর্ধিত কর।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬২
وَ قَالُوۡا مَا لَنَا لَا نَرٰی رِجَالًا کُنَّا نَعُدُّہُمۡ مِّنَ الۡاَشۡرَارِ ﴿ؕ۶۲﴾
তারা আরও বলবে, ‘আমাদের কী হল যে, আমরা যেসব লোককে মন্দ বলে গণ্য করতাম তাদেরকে দেখতে পাচ্ছি না।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬৩
اَتَّخَذۡنٰہُمۡ سِخۡرِیًّا اَمۡ زَاغَتۡ عَنۡہُمُ الۡاَبۡصَارُ ﴿۶۳﴾
তবে কি আমরা ওদেরকে অহেতুক ঠাট্টা-বিদ্রূপের পাত্র মনে করতাম, নাকি আমাদের চোখ ওদেরকে দেখতে পাচ্ছে না?’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬৪
اِنَّ ذٰلِکَ لَحَقٌّ تَخَاصُمُ اَہۡلِ النَّارِ ﴿٪۶۴﴾
অবশ্যই একথা সত্য, দোজখবাসীদের মধ্যে এসব বিবাদ হবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪১-৪৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী আইয়ূব (আঃ)-কে পরীক্ষা ও তাঁকে প্রদত্ত কয়েকটি মু‘জিযাহ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আইয়ুব (আঃ) ধৈর্যশীল নাবীগণের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এবং অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন। বিপদে ধৈর্য ধারণ করায় এবং আল্লাহ তা‘আলার পরীক্ষাকে হাসিমুখে বরণ করে নেয়ায় আল্লাহ তা‘আলা আইয়ূব (আঃ)-কে ‘ধৈর্যশীল’ ও ‘সুন্দর বান্দা’ হিসেবে প্রশংসা করেছেন। কুরআনে ৪টি সূরার ৮টি আয়াতে তাঁর কথা উল্লেখ রয়েছে।
(اَنِّیْ مَسَّنِیَ الشَّیْطٰنُ بِنُصْبٍ وَّعَذَابٍ)
‘শয়তান তো আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্টে ফেলেছে’ অর্থাৎ আইয়ুব (আঃ) দীর্ঘ দিন অসুস্থ্য ও কষ্ট ভোগ করার বিষয়টি শয়তানের দিকে সম্বন্ধ করেছেন, আল্লাহ তা‘আলার দিকে নয়। এটা তিনি করেছেন আল্লাহ তা‘আলার প্রতি শিষ্টাচারের দিকে লক্ষ্য রেখে। কেননা শয়তান নাবীদের ওপর কোন ক্ষমতা রাখে না। এমনকি কোন নেক্কার বান্দাকেও শয়তান পথভ্রষ্ট করতে পারে না, তবে সে ধোঁকা দিতে পারে, বিপদে ফেলতে পারে, যা আল্লাহ তা‘আলার হুকুম ব্যতীত কার্যকর হয় না। بِنُصْبٍ দ্বারা শারীরিক কষ্ট বা রোগ আর عَذَابٍ দ্বারা ধন-সম্পদ ধ্বংস হওয়া বুঝোনো হয়েছে। উল্লেখ্য যে, তাঁর শরীরের মাংস খসে পড়ে গিয়েছিল, শরীরে পোকা হয়েছিল, পচে-গলে দুর্গন্ধময় হয়ে যাওয়ায় ঘর থেকে বের করে জঙ্গলে ফেলে আসা হয়েছিল, ১৮ বা ৩০ বছর ধরে রোগগ্রস্ত ছিলেন এ জাতীয় কথা নাবীবিদ্বেষী ও ইসলামের শত্র“দের বানোয়াট গল্পগুজব বৈ কিছুই নয়। তাঁর শারীরিক কী অসুখ হয়েছিল সে ব্যাপারে সহীহ কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে তাঁর ব্যাপারে বানোয়াট যে সকল অশালীন কথা বলা হয় তা একজন নাবীর জন্য সমীচিন না। তিনি বিপদে আক্রান্ত হলে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করলেন এ কথা দিয়েই তাঁর আলোচনা শুরু করা হয়েছে। যেমন সূরা আম্বিয়াতেও এ কথা দ্বারাই শুরু করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দু‘আ কবূল করে সকল কষ্ট ও বেদনা দূর করে দিলেন।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَاسْتَجَبْنَا لَھ۫ فَکَشَفْنَا مَا بِھ۪ مِنْ ضُرٍّ)
‘তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম, তার দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে দিলাম’ (সূরা আম্বিয়া ২১ : ৮৪) কীভাবে দূর করা হয়েছিল তার চিকিৎসা বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তুমি তোমার পা দ্বারা মাটিতে আঘাত কর, ফলে তা থেকে ঠাণ্ডা পানি বের হবে, তুমি তা থেকে পান কর এবং তা দ্বারা গোসল কর এতে তোমার ভেতর ও দেহের কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
(وَّاٰتَیْنٰھُ اَھْلَھ۫ وَمِثْلَھُمْ)
‘তাকে তার পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সঙ্গে তাদের সমপরিমাণ আরো দিলাম’ এখানে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তাঁর বিপদে ধৈর্য ধারণের পুরস্কার দ্বিগুণ পেয়েছিলেন দুনিয়াতে এবং আখেরাতে। বিপদে পড়ে যা কিছু তিনি হারিয়েছিলেন, সবকিছুই তিনি পর্যাপ্ত পরিমাণে ফেরত পেয়েছিলেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَکَذٰلِکَ نَجْزِی الْمُحْسِنِیْنَ)
“আর আমি এভাবেই সৎকর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করি।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৮৪) তিনি কি তাঁর মৃত সন্তানাদি পুনর্জীবিত পেয়েছিলেন, না-কি হারানো গবাদি পশু ফেরত পেয়েছিলেন এসব কষ্ট-কল্পনার কোন প্রয়োজন নেই।
(رَحْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا)
‘আমার বিশেষ রহমতরূপে’ অর্থাৎ আইয়ূব (আঃ)-কে বিপদ থেকে মুক্তি ও পরিবারবর্গকে ফেরত দেয়া ইত্যাদি সবই ছিল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমত। তিনি অনুগ্রহ করে দান করেছেন। আয়াতের এ শব্দটিকে ‘রহীমা’ করে এটিকে আইয়ূব (আঃ)-এর স্ত্রীর নাম হিসেবে একদল লোক সমাজে চালু করে দিয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যেন বলছেন যে, আইয়ূবের স্ত্রী রহীমা তার স্বামীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরে আমি তাকে আইয়ূবের কাছে ফিরিয়ে দিলাম। বস্তুত এটি একটি উদ্ভট মিথ্যা ব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই নয়। মূলতঃ আইয়ূব (আঃ)-এর স্ত্রীর নাম কী ছিল সে বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই।
আইয়ূব (আঃ)-এর অত্র ঘটনা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَذِکْرٰی لِاُولِی الْاَلْبَابِ)
‘এবং জ্ঞানীদের জন্য উপদেশস্বরূপ’ আর সূরা আম্বিয়ায় বলা হয়েছে-
(وَذِکْرٰی لِلْعٰبِدِیْنَ)
‘আর এটা ‘ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ’, অর্থাৎ এতে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর দাসত্বকারী ব্যক্তিই প্রকৃত জ্ঞানী এবং প্রকৃত জ্ঞানী তিনিই যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার দাসত্বকারী।
(وَخُذْ بِیَدِکَ ضِغْثًا)
‘এক মুঠো তৃণশলা হাতে নাও’ অত্র আয়াতে আরেকটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাহল আইয়ূব (আঃ) অসুস্থ অবস্থায় রাগের বশবর্তী হয়ে শপথ করলেন যে, তিনি সুস্থ হলে তাঁর স্ত্রীকে একশত বেত্রাঘাত করবেন। রোগ তাড়িত স্বামী কোন কারণবশত স্ত্রীর ওপর ক্রোধবশে এরূপ শপথ করতেও পারেন। কিন্তু কেন তিনি এ শপথ করেছিলেন তার কোন স্পষ্ট বর্ণনা কুরআন ও সহীহ সুন্নাতে পাওয়া যায় না। ফলে তাফসীরের কিতাবে নানান গল্পগুজব উল্লেখ রয়েছে যা আইয়ূব (আঃ)-এর পুণ্যশীলা স্ত্রীর উচ্চ মর্যাদার বিপরীত। আইয়ূব (আঃ)-এর স্ত্রী আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় বান্দীদের অন্যতম। তাকে কোনরূপ কষ্টদান আল্লাহ তা‘আলা পছন্দ করেননি। অন্যদিকে শপথ ভঙ্গ করাটাও নাবীর মর্যাদার খেলাফ। তাই আল্লাহ তা‘আলা একটি সুন্দর পথ বলে দিলেন। তা হল, একমুষ্ঠি তৃণশলা নিয়ে প্রহার করবে যা মোটেও কষ্টদায়ক নয়।
প্রত্যেক নাবীকেই কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তারা সকলেই সে সব পরীক্ষায় ধৈর্যধারণ করেছেন ও উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু আইয়ূব (আঃ)-এর আলোচনায় বিশেষভাবে
(اِنَّا وَجَدْنٰھُ صَابِرًا)
“আমি তাকে অবশ্যই ধৈর্যশীল পেয়েছি।” (সূরা সোয়াদ ৩৮ : ৪৪) বলার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে কঠিনতম কোন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। তবে সে পরীক্ষা কী তা কুরআনে উল্লেখ নেই। হাদীসে শুধু এতটুকু এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আইয়ূব (আঃ) একদিন নগ্নাবস্থায় গোসল করছিলেন। এমন সময় তাঁর ওপর সোনার টিড্ডি পাখিসমূহ এসে পড়ে। তখন তিনি সেগুলোকে ধরে কাপড়ে ভরতে থাকেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে বলেন : হে আইয়ূব
أَلَمْ أَكُنْ أَغْنَيْتُكَ عَمَّا تَرَي
আমি কি তোমাকে এসব থেকে অমুখাপেক্ষী করিনি? আইয়ূব (আঃ) জবাবে বললেন :
بَلَي وَعِزَّتِكَ وَلَكِنْ لَا غِنَي بِي عَنْ بَرَكَتِكَ
তোমার ইযযতের কসম! অবশ্যই তুমি আমাকে তা দিয়েছ। কিন্তু তোমার বরকত থেকে আমি অমুখাপেক্ষী নই। (সহীহ বুখারী হা. ২৭৯) সুতরাং নাবীর মর্যাদার খেলাফ ও যা ফাসেকদের হাসি-ঠাট্টার খোরাক হয় এমন কথা ও মন্তব্য না করাই শ্রেয়।
আইয়ূব (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত ঘটনা সূরা ‘আম্বিয়ার ৮৩-৮৪ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। যেমন ধৈর্য ধারণ করেছিলেন আইয়ূব (আঃ)।
২. শপথ করলে তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। আর যদি শপথ ভঙ্গ করতে চায় তাহলে কাফ্ফারা আদায় করতে হবে।
৩. বড় পরীক্ষায় বড় পুরস্কার লাভ করা যায়। দুনিয়াতে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন নাবী-রাসূলগণ, তারপর ঈমানে যারা তাদের পরবর্তী স্তরে তারা।
৪. প্রকৃত মু’মিনগণ আনন্দে ও বিষাদে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার রহমতের আশা করে। বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হয় না।
৪৫-৪৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কয়েকজন নাবীর কথা বর্ণনা করেছেন। যাদের সম্পর্কে ইতোপূর্বে সূরা আল ‘আম্বিয়া-সহ আরো অন্যান্য স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।
ইয়াসা‘ (আঃ) সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৮৬ নম্বর, যুল-কিফল সম্পর্কে সূরা আম্বিয়ার ৮৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। তাঁরা সকলেই আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র ছিলেন।
(أُولِي الْأَيْدِيْ وَالْأَبْصَارِ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে ছিলেন দৃঢ় এবং দীনের ব্যাপারে ছিলেন বিচক্ষণ।
(هٰذَا ذِكْرٌ) ‘এতো এক স্মরণীয় বর্ণনা’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা এসব চয়নকৃত নাবী ও তাঁদের গুণাবলীর আলোচনা উপদেশপূর্ণ ক্রুআনে উল্লেখ করেন যাতে এদের থেকে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং যারাই তাদের প্রতিপালকের আদেশ-নিষেধ মেনে চলবে ও তাঁকে ভয় করবে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম আবাসস্থল। এ উত্তম আবাসস্থলের বর্ণনা পরের আয়াতগুলোতে দেয়া হয়েছে।
৫০-৬৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(جَنّٰتِ عَدْنٍ مُّفَتَّحَةً لَّھُمُ …. مَا لَھ۫ مِنْ نَّفَادٍﮅﺊ)
এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৎ বান্দাদের জন্য পরকালে যে উত্তম পুরস্কার ও সুন্দর সুন্দর বাসস্থান ও চিরস্থায়ী জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন সে সম্পর্কে আলোচনা করছেন। জান্নাতের দরজাগুলো তাদের জন্য সর্বদা খোলা থাকবে। তারা সেখানে আসনে হেলান দিয়ে থাকবে এবং বিভিন্ন প্রকার ফলমূলের জন্য তাদেরকে নির্দেশ প্রদান করবেন যারা তাদের নিকট পান পাত্র নিয়ে তাদেরকে প্রদক্ষিণ করবে। তাদের জন্য সেখানে আনতনয়না হুরগণ থাকবে এবং তাদেরকে সেখানে এমন রিযিক দান করা হবে যা কোন দিন শেষ হবে না। এ সম্পর্কে সূরা আস্ সা-ফ্ফা-ত-সহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
(ذَاﺚ وَاِنَّ لِلطّٰغِیْنَ لَشَرَّ مَاٰ…. لَحَقٌّ تَخَاصُمُ اَھْلِ النَّارِﮏﺟ)
আলোচ্য আয়াতগুলোতে জাহান্নামীদের অবস্থা, জাহান্নামে কেমন হবে এবং তারা যে সেখানে পরস্পর তর্ক-বিতর্ক করবে সে কথা আলোচনা করা হয়েছে।
যারা আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধাচরণ করবে ও সীমালঙ্ঘন করবে তারা নিকৃষ্টতম স্থান জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এটা হবে তাদের আবাসস্থল, আর তা খুবই নিকৃষ্ট একটি জায়গা। তারা সেখানে পান করবে ফুটন্ত পানি ও পুঁজ, এরূপ আরো কঠিন শাস্তি তারা সেখানে ভোগ করবে। এ সম্পর্কে সূরা আস্ সা-ফ্ফা-ত, সূরা ইউনুস-সহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা দিচ্ছেন যে, জাহান্নামীরা জাহান্নামে পরস্পর বিতর্ক ও ঝগড়ায় লিপ্ত হবে। নেতারা অনুসারীদেরকে বলবে, এতো তোমাদের মতো আরেকটি দল যারা তোমাদের মতই জাহান্নামে দগ্ধ হবে, এদের জন্য কোন অভিনন্দন নেই। তখন অনুসারীরাও তাদের নেতাদেরকে অনুরূপ কথা বলবে। এভাবে তারা পরস্পর কথা কাটাকাটি করবে। তারা নেতাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি দাবী করবে।
(كُنَّا نَعُدُّهُمْ مِّنَ الْأَشْرَارِ)
‘আমরা যেসব লোককে খারাপ বলে গণ্য করতাম’ অর্থাৎ কাফির-মুশরিকরা জাহান্নামে প্রবেশ করার পর বলবে : আমরা যাদেরকে দুনিয়াতে খারাপ মনে করতাম তথা মুহাম্মাদের সাথী, যারা ঈমান এনেছিল, তারা দুর্বল ছিল, সমাজে তাদেরকে গণ্যই করতাম না তাদেরকে তো আমরা জাহান্নামী মনে করতাম। কারণ তারা মুহাম্মাদের অনুসরণ করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে বলে বিশ্বাস করতাম, তারা কোথায়? আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তিরস্কার করে বলবেন : তাদেরকে কি জাহান্নামে দেখতে পাচ্ছ? জাহান্নামীরা বলবে, তাহলে কি দুনিয়াতে তাদেরকে নিয়ে ঠাট্টাই করেছি, নাকি আমাদের দৃষ্টিতে সমস্যা যে কারণে আমরা তাদেরকে দেখতে পাচ্ছি না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. জান্নাতের দরজা রয়েছে এ কথা জানা গেল।
২. জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামত কোনদিন শেষ হবে না।
৩. জাহান্নাম একটি অতি নিকৃষ্ট আবাসস্থল, যা কাফির-মুশরিকদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
৪. জাহান্নামীদের খাদ্য হিসেবে থাকবে গরম পানি, পুঁজ ইত্যাদি।
৫. যারা মু‘মিনদেরকে নিয়ে দুনিয়াতে ঠাট্টা করত যে, এরা পথভ্রষ্ট তারা জাহান্নামে প্রকৃত সত্য অনুধাবন করতে পারবে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*আইউব(আ.)-এর ত্যাগ ও ধৈর্য : প্রসংগক্ৰমে পুনরায় মােমেনদের বিপদাপদে ধৈর্য সহ্য এবং এর পুরস্কারের ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে। এটা হচ্ছে আইয়ুব(আ.)-এর ঘটনা। বলা হয়েছে, ‘স্মরণ করাে আমার বান্দা আইয়ুবের কথা, যখন সে তার পালনকর্তাকে আহ্বান করে বললাে, শয়তান আমাকে যন্ত্রণা ও কষ্ট পৌছিয়েছে।'(আয়াত ৪১-৪৪) আইয়ুব(আ.)-এর ত্যাগ-তিতীক্ষা ও ধৈর্যের ঘটনা প্রসিদ্ধ। ধৈর্য সহ্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে এই ঘটনা উল্লেখ করা হয়ে থাকে, কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইহুদীদের বর্ণনা করা এমন সব কিসসা কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায় যা, মূল ঘটনাকেই আড়াল করে রেখেছে। কোরআনের বক্তব্য অনুসারে ঘটনার যে বিবরণ পাওয়া যায় সেটুকুই হচ্ছে সত্য বিবরণ। এতে বলা হয়েছে, আইয়ুব(আ.) ছিলেন একজন সৎ ও আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তায়ালা তাকে বিভিন্ন বিপদাপদে ফেলে পরীক্ষা করেছেন। তিনি ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। মনে হয়, তার ধন সম্পদ, পরিবার পরিজন ও সুস্থতা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে পরীক্ষা করা হয়েছিলাে, কিন্তু তিনি সর্বাবস্থায়ই নিজ মালিক ও প্রভুর সাথে সম্পর্ক অটুট রেখেছেন, তাঁর প্রতি দৃঢ় আস্থা রেখেছেন এবং ভাগ্যে যা লেখা ছিলাে তা নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। এই চরম বিপদের মুহূর্তেও যারা তাঁকে ত্যাগ করে যাননি যাদের অন্যতম ছিলেন তার সহধর্মিনী। তাদের মনে শয়তান বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি করতে থাকে। যেমন, আল্লাহ তায়ালা যদি আইয়ুব(আ.)-কে ভালােই বাসতেন তাহলে তাকে এ ধরনের বিপদে ফেলতেন না। এ সব কথা তারা আইয়ুব (আ.)-এর সামনেই বলাবলি করতাে। এগুলাে তার জন্যে ছিলাে সে রোগ বালাইয়ের চেয়েও অধিক পীড়াদায়ক। একদিন তার সহধর্মিনী সে জাতীয় কথা তাঁর সামনে বলাতে তিনি শপথ করে বললেন, আল্লাহ তাকে আরােগ্য দান করলে তাকে এতাে বার (কেউ কেউ একশ বারের কথা উল্লেখ করেছেন) প্রহার করবেন। এরপর তিনি আল্লাহর দরবারে অভিযােগ করেন এবং ফরিয়াদ জানিয়ে বলেন যে, শয়তান তার আপনজনদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি দয়া করেন। কারণ, তিনি তার মাঝে সততা, ধৈর্য ও শয়তানের প্রতি তার ঘৃণার পরিচয় পেয়েছিলেন। ফলে তাকে আরােগ্য দান করেন এবং বিপদ দূর করেন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে জমির ওপর পা দিয়ে আঘাত করতে বলেন। তিনি পা দিয়ে আঘাত করার সাথে সাথে শীতল পানির ঝর্ণা প্রবাহিত হতে থাকে। তিনি সেই পানি পান করেন এবং তা দিয়ে গােসল করেন। এর ফলে তিনি পরিপূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠেন। সে প্রসংগে বলা হয়েছে, ‘তুমি তােমার পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করাে। ঝর্ণা নির্গত হলাে গােসল করার জন্য শীতল ও পান করার জন্যে।'(আয়াত ৪২) এর পরে বলা হয়েছে, আমি তাকে দিলাম তার পরিজনবর্গ (আয়াত ৪৩) কোনাে কোনাে বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তার পুত্রদের জীবিত করেন এবং তাদের ন্যায় আরও সন্তান দান করেন। তবে আল্লাহ তায়ালা আইয়ুব(আ.)-এর মৃত সন্তানদের জীবিত করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কোরআনে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। তাই জীবিত করার অর্থ এও হতে পারে যে, তিনি যখন সুস্থ হয়ে ওঠলেন তখন তাকে ত্যাগ করে চলে যাওয়া ছেলে সন্তানদের আল্লাহ তায়ালা তার কাছে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। এ সকল সন্তান তার কাছে নিখোঁজ বা মৃত হিসেবেই গণ্য ছিলাে । যা হােক, আল্লাহ তায়ালা তাকে আরও সন্তান দান করেন। আর এটা ছিলাে তাঁর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ, দয়া ও দান। এ থেকে বুদ্ধিমান ও বিবেকবান লােকদের জন্যে উপদেশ গ্রহণের অনেক কিছুই রয়েছে। মােট কথা, এসব ঘটনার মাধ্যমে যে বিষয়টি এখানে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে তা হলাে, বিপদাপদে যারা ধৈর্য ধারণ করে, তকদীরের ফয়সালায় যারা রাযি খুশী থাকে তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে দয়া অনুগ্রহ করেন। তবে স্ত্রীকে প্রহার করার যে শপথ তিনি নিয়েছিলেন, আল্লাহ তায়ালা সেটারও একটা সুষ্ঠ সমাধান করে দেন। কারণ, তার প্রতিও আল্লাহর দয়া ছিলাে এবং তার স্ত্রীর প্রতিও আল্লাহর দয়া ছিলাে, যিনি এই চরম বিপদের মুহূর্তে তার সেবা শুশ্রযা করেছেন এবং পরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাই আল্লাহ তায়ালা আইয়ুব(আ.)-কে একগুচ্ছ কাঠি নিতে বললেন এবং তা দিয়ে স্ত্রীকে একবার আঘাত করতে বললেন। আর সেভাবেই তিনি শপথ ভংগের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যান। বলা হয়েছে, ‘তুমি তােমার হাতে এক মুঠো তৃণ শলা নাও, তা দ্বারা আঘাত করাে এবং শপথ ভংগ করাে না।'(আয়াত ৪৪) আল্লাহ রব্বুল আলামীন হযরত আইয়ুব(আ.)-কে নানা প্রকার বালা-মসিবতের মধ্যে সবর এখতিয়ার করতে দেখেছেন, দেখেছেন তাঁর আনুগত্যপূর্ণ কাজ ও ব্যবহার এবং যেভাবে তিনি আল্লাহর কাছে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন, তার ওপর খুশী হয়ে আল্লাহ তায়ালা পুরস্কারস্বরূপ তাকে সকল সমস্যার সহজ সমাধান ও নানা প্রকার নেয়ামত দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছ, ‘অবশ্যই আমি, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে সবর এখতিয়ারকারী হিসাবে পেয়েছি, উৎকৃষ্ট বান্দা (আমার), নিশ্চয়ই সে সর্বান্তকরণে (আমার কাছে) রুজুকারী।’ *এ ঘটনাগুলো আরো কিছু বিবরণ : এ সূরার মধ্যে উল্লেখিত এই তিনটি কাহিনী বর্ণনা করার পর আমরা এসবের কিছু বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করার প্রয়ােজন বােধ করছি। যেন রসূলুল্লাহ(স.) এরূপ যেসব ঘটনার স্মরণ করে অন্যেরা সেগুলাে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং যে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন তাতে সবর করতে পারেন। এ পর্যায়ে অতীতের সকল রসূলের অবস্থা সামনে রেখে তাদের কার্যপ্রণালীর কিছু সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনাও করা হয়েছে। এখানে দেখা যায়, তাদের প্রত্যেক জীবনের ঘটনাবলী নানা প্রকার বিপদ-আপদের মধ্যে ফেলে তাদের চরমভাবে পরীক্ষা করার দৃশ্য, সাথে সাথে আরও দেখা যায় সেই অসংখ্য বিপদের মধ্যে তাদের অপরিসীম সবরের দৃষ্টান্ত রয়েছে। পাশাপাশি বহু রসূলের যিন্দেগীতে অজস্র পুরস্কার ও প্রভূত মান মর্যাদাপ্রাপ্তির ঘটনা দেখা গেছে। যেমন দাউদ, সােলায়মান ও আইয়ুব(আ.)-এর আমলে তাদের জীবনে প্রাচুর্য ও প্রচুর মান সম্মান দেখা গেছে, তাদের মধ্যে এমন অনেকে অতীত হয়েছেন যাদের আগমনকাল জানা আছে আবার অনেকের আগমনকাল জানা যায়নি। কারণ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আল কোরআন এবং সত্যের মূল উৎস তাে রয়েছে আমার কাছে, যার পরিসীমা কেউ করতে পারে না।
# এরশাদ হচ্ছে, ‘(হে নবী,) তুমি আমার বান্দাদের মধ্যে) ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব (-ও) স্বরণ… স্মরণ করো ইসমাইল, ইয়াসা ও যুলকিফলের কথা, এরাও সবাই ভালো মানুষের অন্তর্ভুক্ত ছিলো'(আয়াত ৪৫-৪৮) ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব এবং ইসমাঈল অবশ্য দাউদ ও সুলাইমান(আ.)-এর পরে এসেছেন, কিন্তু আইয়ুব(আ.)-এর যামানায় তারা কে কোথায় ছিলেন তা আমাদের জানা নেই। নবী ইয়াসা ও নবী যুল-কিফল কোন এলাকায় প্রেরিত হয়েছিলেন তাও আমরা কেউ জানি না। আল কোরআনে তাদের কথা বলতে গিয়ে কিছু ইংগিত দেয়া হয়েছে মাত্র, যাতে করে সেই প্রসংগের আলােচনা থেকে দ্রুতগতিতে মনােযােগ পরবর্তী আলােচনার দিকে সরে যায়। অর্থাৎ ওখানে বনী ইসরাঈলদের মধ্যে আগত, হিব্রু ভাষায় উচ্চারিত ইলয়াশা-নামক আর একজন নবী] অতিক্রান্ত হয়েছেন, যাকে সম্ভবত আরবী ভাষায় ‘আল ইয়াসা’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু যুল-কিফল নামক নবী সম্পর্কে শুধু এতােটুকু আমরা জানি যে, আল কোরআনে তাঁর গুণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘সে ভালাে লােকদের মধ্যে একজন ছিলাে।’ অতঃপর মহান আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব(আ.)-এর গুণাবলী প্রকাশ করতে গিয়ে বলছেন, তারা সবাই শক্তিশালী এবং দূরদর্শী মানুষ ছিলাে। এসব কথা দ্বারাও আল্লাহ তায়ালা তাদের ভালাে কাজ, তাদের দূরদর্শিতাপূর্ণ পদক্ষেপ ও সুস্থ চিন্তা-ভাবনা পরিকল্পনার দিকে ইংগিত করেছেন, যেন তিনি বুঝাতে চাইছেন, ভালাে কাজ যে করবে না তার ক্ষমতা পাওয়ার কোন অধিকারই নেই, আর যে সুস্থ চিন্তা না করবে তার বুদ্ধি গ্রহণযােগ্য নয় এবং কোনাে বিষয়ে তার মতামতও গ্রহণযােগ্য নয়। এভাবে অতীতের নবী রসূলদের মর্যাদাপূর্ণ মহৎ গুণের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, তিনি সেসব নবী রসূলকে বিশেষ কিছু গুণাবলী দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন যেন তাদের অনুসারীরা আখেরাতের যিন্দেগীর কথা স্মরণ করতে পারে এবং সেই যিন্দেগীর চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা ছাড়া অন্যসব কিছু পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আমি তাদের পরকালের স্মরণকারী জনগণ হিসাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছি।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পরকালের স্মরণই তাদের বৈশিষ্টমন্ডিত বানানাের আসল হাতিয়ার, আর এই বিশেষ গুণটিই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর বান্দাদের কাছে তাদের মর্যাদাবান বানিয়েছে, বিশেষ করে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে এ গুণটিই তাদের প্রিয় করে তুলেছে। অবশ্যই আমার কাছে ওদের স্থান চিরদিনের জন্যে সম্মানজনক হয়ে রয়েছে।’ আর এমনি করে আল্লাহ রব্বুল আলামীন সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নবী ইসমাঈল, আল ইয়াসা এবং যুল কিফল- এরা সবাই সর্বোৎকৃষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য। এরপর আল্লাহ তায়ালা শেষ নবী ও তাঁর শ্রেষ্ঠ পয়গম্বর মােহাম্মদ(স)-এর মনােযােগ আকর্ষণ করে তাঁকে জানাচ্ছেন যেন তিনি তার পূর্বসূরী নবী রসূলদের অবস্থা স্মরণ করেন এবং যেভাবে তারা শত বিরােধিতাপূর্ণ পরিবেশে অবিচল জীবন যাপন করেছেন, সেভাবে তিনিও যেন সকল অবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেন, তাঁদের সবর থেকে এবং তার ফলে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্তি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, তিনি যেন তাঁর পথভ্রষ্ট জাতির হঠকারিতায় ঘাবড়ে না যান এবং তাকে মিথ্যাবাদী বানানাের হীন প্রচেষ্টার মুখে দাঁড়িয়ে তিনি যেন পর্বতসম দৃঢ়তা অবলম্বন করেন। কারণ সবর বা অবিচলতাই হচ্ছে ভ্রান্ত জনগণের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌছে দেয়ার উত্তম এবং দাওয়াতদানের মােক্ষম পদ্ধতি। আর এটা সত্য কথা যে, আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর দৃঢ়তা অবলম্বনকারী ও ধৈর্যশীল বান্দাদের কখনাে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেন না; বরং সর্বাবস্থায় তাদের সবরের কারণে তিনি উত্তম প্রতিদান দেন এবং তাঁর রহমত, বরকত ও মর্যাদা দানে তাদের তিনি ভূষিত করেন। কেননা আল্লাহর কাছেই রয়েছে সকল কল্যাণের চাবিকাঠি। অপরদিকে চক্রান্তকারীদের বলা হচ্ছে, সত্যকে উৎখাত প্রচেষ্টায় তারা যতাে যাইই করুক না কেন, তারা কিছুতেই সাফল্যমন্ডিত হবে না, যেহেতু রাসূল(স.)-কে তাঁর রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দান করা, তাঁকে পরিচালনা করা, তাকে পুরস্কৃত করা এবং মর্যাদা দান করার সাথে সথে পেয়ারা নবী(স.)-কে মিথ্যাবাদী বানানাের অপচেষ্টারত ব্যক্তিদের চক্রান্ত জাল ছিন্ন করার সকল কাজ তিনিই আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘এ পাক কালাম হচ্ছে এক মহান উপদেশ বা চিরন্তন স্মরণিকা, যে বিষয়ে (আজ) জাহান্নামীরা তর্ক-বিতর্ক করছে।’
ওপরের আয়াতগুলােতে অতীতের ঘটনাপ্রবাহের নিশ্চিত সংবাদ বর্ণিত হয়েছে এবং নানা প্রকার বিপদ আপদের মধ্যে ফেলে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পরীক্ষা করার বহু উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। সে সকল প্রতিকূল ও কন্টকাকীর্ণ পরিবেশ পরিস্থিতিতে তাদের সত্য সঠিক পথে দৃঢ়তা অবলম্বন করা এবং তার পুরস্কার স্বরূপ তাদের জন্যে পরম করুণাময় আল্লাহর রহমত ও মর্যাদা লাভ করার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ সব কিছুই রাসূলুল্লাহ(স.) ও তাঁর সংগী সাথী এবং পরবর্তীকালের মােত্তাকী মুসলমান বান্দাদেরকে এই পৃথিবীতে এক স্বর্ণালী জীবনের সন্ধান দিয়েছে এবং তাদের পরকালীন যিন্দেগীর জন্যে তাদের কাছে মহাসাফল্যের সুসংবাদ বয়ে এনেছে। এরপর আল্লাহর মােত্তাকী বান্দাদের পরবর্তী যিন্দেগীতে কি প্রতিদান দেয়া হবে এবং দুনিয়ার বাকী জীবনেও বা তারা কি পাবে তা জানানাে হয়েছে। পাশাপাশি আরও জানানাে হয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের পরিণতির কথা। এ সবের পর উপরােক্ত উভয় শ্রেণীর লােকদের জন্যে কেয়ামতের নানাবিধ দৃশ্যের মধ্য থেকে একটি বিশেষ দৃশ্য ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। কোরআনুল করীমের বহু পৃষ্ঠাব্যাপী এসব দৃশ্য সম্পর্কে আলােচনা এসেছে। একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখতে পাব সেসব কঠিন দৃশ্যের বর্ণনা যে কোন হৃদয়ে ছাপ রেখে যায়। কেয়ামত পরবর্তি কিছু দৃশ্য কোরআনে বর্ণিত কেয়ামতের নানাবিধ দৃশ্যের মধ্যে এখানে দুটি ছবি দেখা যাচ্ছে, যেগুলাে সকল দিক দিয়েই পরস্পর তুলনাযােগ্য একটি ছবি হচ্ছে মােত্তাকী পরহেযগার লােকদের, যারা জীবনে আল্লাহর ভয়ে ভালাে মন্দ বাছবিচার করে চলেছে। যা কিছু ভালো এবং মানুষের জন্যে কল্যাণকর সেটাই তারা গ্রহণ করেছে, এতে অবশ্য তাদের কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। যা কিছু মন্দ, কষ্টকর হলেও তারা আল্লাহর ভয়ে সেগুলাে ত্যাগ করেছে। এসব লােকদের জন্যে রয়েছে সুন্দর পরিণতি। আর একটি দৃশ্য হচ্ছে অহংকারী ও আল্লাহর রাজ্যে নিজেদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠাকামী বিদ্রোহীদের তাদের জন্যে রয়েছে চরম মন্দ পরিণতি। প্রথম শ্রেণীর লােকদের জন্যে রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাতসমূহ (ফুলে ফলে সুশােভিত বাগ-বাগিচা পরিবেষ্টিত মনােরম বাসস্থান), যেগুলাের দরজাসমূহ তাদের জন্যে উন্মুক্ত থাকবে। তাদের জন্য সেখানে সজ্জিত থাকবে আরাম কেদারার শ্রেণীবিন্যাস, যাতে তারা আরামে গা এলিয়ে দিয়ে বেহেশতের সুরভি ভোগ করবে, থাকবে রকম-বেরকমের খাদ্য ও পানীয় সজ্জিত রেকাবি ও পানপাত্রসমূহ। তাদের বালাখানায় আরও থাকবে নানা উপাদেয় ভােগ্য সামগ্রী (যার জন্যে পৃথিবীতে তারা লালায়িত ছিলাে)। আর যার চাহিদা আল্লাহর ভয়েই পৃথিবীতে তারা নিয়ন্ত্রিত রেখেছে। আরও থাকবে সেখানে তাদের জন্যে সকল নেয়ামতের বড় নেয়ামত আয়তলােচনা সুন্দরী যুবতী ললনারা। এরা সর্বাংগীণ সুন্দরী যুবতী হওয়ার সাথে সাথে হবে ঢুলুঢুলু আঁখি এবং বিনয়ের কারণে চোখ যেন তাদের ওঠতেই চাইবে না, চোখ তুলে চোখে চোখে তাকাতে পারবে না, এরা সবাই হবে সমবয়স্কা। এসব নেয়ামত হবে চিরস্থায়ী, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত এসব নেয়ামত কখনও শেষ হয়ে যাবে না। অর্থাৎ এসব নেয়ামতের লয় বা ক্ষয় থাকবে না থাকবে না এসবের কোনাে পরিসমাপ্তি। অপর ছবির লােকদের জন্যেও থাকবে তাদের কিছু বিছানা, কিন্তু সেখানে কোনাে আরাম থাকবে না। সেটা হবে জাহান্নাম- নিকৃষ্টতম বিছানা। আর তাদের জন্যে সেখানে থাকবে গরম পানীয় এবং এমন খাদ্য যা খেতে গেলে বমি হয়ে তা ওঠে আসবে, বরং এগুলাে হবে নিকৃষ্টতম তরল পানীয়, যা জাহান্নামবাসীর দেহ থেকে পুঁজ বা পাচড়ার ধােয়ানি আকারে বেরিয়ে আসবে। অথবা এ ধরনের আযাবের আরও রকম-বেরকমের সংস্করণ সেখানে উদ্ভাবিত হবে। এর অর্থ করতে গিয়ে বলা হয়েছে। এগুলাে হবে জানা অজানা জোড়া জোড়া আযাব। অর্থাৎ আরও বহু প্রকারের আযাব এতে সংযােজিত হবে। এরপর এই দৃশ্যের যবনিকা পতন হচ্ছে তৃতীয় এক ছবির উল্লেখের মাধ্যমে, যাতে সেই জাহান্নামীদের বাক-বিতন্ডার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ জাহান্নামবাসীদের মধ্যে একটি অহংকারী গােষ্ঠী, দুনিয়ার জীবনে ওই গােষ্ঠী ছিলাে পরস্পরের কাছে প্রিয়, একে অপরের দরদী এবং তাদের মধ্যে মহব্বতের বিনিময় হতাে, কিন্তু আজ কেয়ামতের সেই কঠিন দিনে তারা একে অপরকে ঘৃণা করবে, দোষারােপ করবে পরস্পরকে। তারাই তাে সেসব মানুষ যারা অতীতে একে অপরকে ভুল পথে চলার ব্যাপারে সহায়তা করত । তাদের মধ্যে অনেকে ছিলাে যারা মােমেনদের ওপর নিজেদের পজিশন বড় মনে করে অহংকার প্রদর্শন করতাে এবং তাদের দাওয়াতকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতাে, যেহেতু তারাই তখন সুখ-সম্পদের মধ্যে ছিলাে। কোরায়শ সর্দারদের মতাে তাদের দাবী ছিলাে, তারা দুনিয়াতে যেমন নেয়ামতের মধ্যে রয়েছো, তেমনি পরকালেও তারা সুখ-সম্পদের অধিকারী হবে, যেমন করে তারা কটাক্ষপাত করে বলতাে, ‘আমাদের মধ্যে সেই (ইয়াতীম ও অসহায়) লােকটির ওপরেই কি নাযিল হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসব উপদেশবাণী?’ হাঁ, সেসব লােকই হবে দোযখবাসী যারা দলে দলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং তারা একে অপরকে বলবে, ‘ওই যে দলটি (আসছে) ওরাও তােমাদের সাথেই প্রবেশ করবে (এই দোযখে)… বলুন তাে ওদের পক্ষ থেকে এর জওয়াব কি হবে?… এর জওয়াব দিতে গিয়ে তখন রাগে ফেটে পড়বে এবং বলবে, না, কিছুতেই ওদের জন্যে কোনাে অভ্যর্থনা নয়, ওরা অবশ্যই দোযখে প্রবেশ করবে। এমতাবস্থায় দোষারােপ করা ব্যক্তিরা কি চুপ থাকতে পারে? ওরা সেই একইভাবে জওয়াব দেবে। বলবে, তোমাদের জন্যেও আজ কোনাে অভিনন্দন নেই, তােমরা তাে আমাদের পূর্বে এখানে এসেছো, তােমাদের জন্যে অতি নিকৃষ্ট এ বাসস্থানটি… কিন্তু তােমরাই তাে এই আযাবে আমাদের প্রবেশ করার কারণ ঘটিয়েছ। যখন সেই ডাকের মধ্যে ক্রোধ, সংকীর্ণতা ও প্রতিশােধ গ্রহণের স্পৃহা জেগে যাবে, তখন ওরা বলবে, হে আমাদের রব, কে আমাদের এখানে নিয়ে এলাে? যে বা যারা আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে তাকে বা তাদেরকে আজ তুমি দ্বিগুণ আযাব দাও! এরপর কি হবে? এরপর হঠাৎ করে তাদের সামনে থেকে সেই মােমেনরা হারিয়ে যাবে, যাদের ওপর পৃথিবীর বুকে তারা প্রভুত্ব করতাে বা তাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিলাে, ওরা বরাবর তাদের ক্ষতিগ্রস্ত করে রাখার চেষ্টা করেছে এবং তারা নিজেরা সচ্ছলতা ও প্রাচুর্যের মধ্যে থাকার কারণে সেই গরীব, নিরীহ এবং অসহায় মােমেনদের সদা-সর্বদা উপহাস বিদ্রুপের পাত্র বানিয়ে রেখেছে। সেই কেয়ামতের দিন যখন ওই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিরীহ মােমেনদের জাহান্নামের আযাবের মধ্যে পাবে না এবং যখন তারা দেখবে, হঠাৎ করে সকল কষ্টকর অবস্থা থেকে সে মােমেনদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, তখন তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে শুরু করবে, তারা আজ কই? কোথায় গেলাে ওরা? তােমরা কি তাদের দেখতে পাচ্ছ, নাকি আমাদের চোখগুলাে বিকল হয়ে গেলাে যে, তাদের দেখতে পাচ্ছি না? এরশাদ হচ্ছে, ‘আর ওরা বলবে, কি হলাে আমাদের, আমরা ওদের দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেন দেখছি না আজ সেসব হতভাগা ব্যক্তিদের যাদের আমরা গােবেচারা মনে করতাম এবং নিকৃষ্ট জ্ঞানে যাদের কোনাে দাম দিতাম না, বরং সব সময় তাদের সাথে উপহাস বিদ্রুপ করতাম? না কি আমাদের চোখগুলােই বিকল হয়ে গেলাে? আসলে যখন তাদের সম্পর্কে এসব কথা চলতে থাকবে তখন তাদের অবস্থান হবে জান্নাতের মনােরম বাসস্থানে।’ এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই সেদিন যে আসবে এ কথা সত্য এবং তখন দোযখবাসী পরস্পর ঝগড়া করতে থাকবে।’ অতপর আলােচনার ধারা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, দোযখবাসীদের বাসস্থান, সেসব নেক ও মােত্তাকী পরহেযগার লােকদের বাসস্থান থেকে বেশী দূরে থাকবে না, যাদের ওরা দুনিয়ার জীবনে উপহাস বিদ্রুপ করত এবং সেদিন আল্লাহ তায়ালা যে সম্মান তাদের দেবেন সেটাকে তারা খুব বেশী মনে করতে থাকবে, আর কি ভয়ানক বিপজ্জনকই না হবে তাদের সেদিনের সেই পাওনা, যার জন্যে তারা দুনিয়ার যিন্দেগীতে তারা ব্যস্ততা দেখাতো! তারা বলে ‘হে আমাদের রব, হিসাব নিকাশের দিনটি আসার আগেই আমাদের পাওনাটা দিয়ে দাও না! বলাে, আমি তাে শুধু একজন সতর্ককারী মাত্র…’
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪১-৪৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় বান্দা ও রাসূল হযরত আইয়ুব (আঃ)-এর বর্ণনা দিচ্ছেন এবং তাঁর চরম ধৈর্য ও কঠিন পরীক্ষায় পাশের প্রশংসা করছেন। তার ধন-মাল ধ্বংস হয়ে যায় এবং সন্তান-সন্ততি মৃত্যুবরণ করে। তার দেহে রোগ দেখা দেয়। এমনকি তার দেহে সূচের ছিদ্রের পরিমাণ এমন জায়গাও বাকী ছিল না যেখানে রোগ দেখা দেয়নি। তার অন্তরে শুধু প্রশান্তি বিরাজমান ছিল। আর তাঁর দারিদ্রের অবস্থা এই ছিল যে, এক সন্ধ্যার খাবারও কাছে ছিল না। ঐ অবস্থায় তাঁর কাছে এমন কোন লোক ছিল না যে তার খবরাখবর নেয়। শুধুমাত্র তার এক স্ত্রী তাঁর কাছে থাকতেন ও তাঁর সেবা করতেন যার অন্তরে আল্লাহর ভয় ও স্বামী প্রেম বিদ্যমান ছিল। তিনি লোকদের কাজ কাম করে যা কিছু পেতেন তা দ্বারাই নিজের ও স্বামীর আহারের ব্যবস্থা করতেন। সুদীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত এ অবস্থাই থাকে। অথচ ইতিপূর্বে তাঁর ধন-মাল ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য ছিল। এতে তাঁর সমকক্ষ আর কেউই ছিল না। দুনিয়ার সুখ-শান্তির উপকরণ সবই তাঁর ছিল। কিন্তু সবই ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং শহরের ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গায় তাঁকে রেখে আসা হয়। এ অবস্থায় একদিন দু’দিন নয় এবং এক বছর দু’বছর নয়, বরং দীর্ঘ আটটি বছর অতিবাহিত হয়। আপন ও পর সবাই তার থেকে বিমুখ হয়ে যায়। এমন কেউ ছিল না যে তাঁর অবস্থার কথা তাঁকে জিজ্ঞেস করে। শুধু তার কাছে তাঁর এই পত্নীটিই ছিলেন যিনি সব সময় তার সেবায় লেগে থাকতেন। শুধুমাত্র উভয়ের পেট পালনের জন্যে তাঁকে পরিশ্রম ও মজুরীতে যে সময়টুকু ব্যয় করতে হতো ঐ সময়টুকুই বাধ্য হয়ে তিনি স্বামী হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটাতেন। অবশেষে হযরত আইয়ূব (আঃ)-এর পরীক্ষার পরিসমাপ্তি ঘটে। আল্লাহ পাকের এই মনোনীত বান্দা তাঁর দরবারে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে প্রার্থনা করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তো কষ্ট ও বিপদ স্পর্শ করেছে এবং আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।” বলা হয়েছে যে, তিনি এ প্রার্থনায় তার শারীরিক দুঃখ কষ্ট এবং মাল-ধন ও সন্তান-সন্ততি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দুঃখ-কষ্ট দূর করার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ পরম দয়ালু আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করেন এবং বলেনঃ “তুমি তোমার পদ দ্বারা ভূমিতে আঘাত কর, এই তো গোসলের সুশীতল পানি ও পানীয়।” পা দ্বারা ভূমিতে আঘাত করা মাত্রই সেখানে একটি প্রস্রবণ উথলিয়ে উঠলো। আল্লাহ তাআলার নির্দেশানুসারে তিনি ঐ পানিতে গোসল করলেন। ফলে তার দেহের সব রোগ দূর হয়ে গেল এবং এমনভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেন যে, যেন তাঁর দেহে কোন রোগ ছিল না। আবার অন্য জায়গায় তাকে ভুমিতে পা দ্বারা আঘাত করতে বলা হয়। আঘাত করা মাত্রই আর একটি প্রস্রবণ জারী হয়ে যায় এবং তাকে ঐ পানি পান করতে বলা হয়। ঐ পানি পান করা মাত্রই আভ্যন্তরীণ রোগও দূর হয়ে যায়। এই ভাবে বাহির ও ভিতরের পূর্ণ সুস্থতা তিনি লাভ করেন।
হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর নবী হযরত আইয়ূব (আঃ) আঠারো বছর পর্যন্ত এই দুঃখ কষ্টের মধ্যে জড়িত ছিলেন। তাঁর আপন ও পর সবাই তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। শুধুমাত্র তাঁর দু’জন অন্তরঙ্গ বন্ধু সকাল-সন্ধ্যায় তাঁকে দেখতে আসতো। একদিন তাদের একজন অপরজনকে বললোঃ “আমার মনে হয় যে, হযরত আইয়ুব (আঃ) এমন কোন পাপ করেছেন যে পাপ দুনিয়ার আর কেউই করেনি। কারণ, তিনি দীর্ঘ আঠারো বছর ধরে এ রোগে ভুগছেন, অথচ আল্লাহ তাঁর প্রতি দয়া করছেন না!” সন্ধ্যার সময় দ্বিতীয় ঐ লোকটি প্রথম ঐ লোকটির এ কথা হযরত আইয়ুব (আঃ)-কে বলে দেয়। এ কথা শুনে হযরত আইয়ুব (আঃ) খুবই দুঃখিত হন এবং বলেনঃ “কেন সে একথা বললো? অথচ আল্লাহ খুব ভাল জানেন যে, আমি যখন কোন দুই ব্যক্তিকে পরস্পর ঝগড়া করতে ‘ দেখতাম এবং দু’জনই আল্লাহর নাম নিতো আমি তখন বাড়ী গিয়ে তাদের দু’জনের পক্ষ হতে কাফফারা আদায় করে তাদের ঝগড়া মিটিয়ে দিতাম। কেননা, আমি এটা পছন্দ করতাম না যে, সত্য ব্যাপার ছাড়া আল্লাহর নাম নেয়া হোক (কেননা, এতে আল্লাহর নামে বেয়াদবী করা হয় এবং এটা আমার নিকট অসহনীয় ব্যাপার)।”
ঐ সময় হযরত আইয়ুব (আঃ) একাকী চলাফেরা এমন কি উঠা-বসাও করতে পারতেন না। তাঁর স্ত্রী তাঁকে তাঁর প্রাকৃতিক প্রয়োজনে উঠিয়ে নিয়ে যেতেন ও আসতেন। একদা তাঁর ঐ স্ত্রী হাযির ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছিলেন। ঐ সময় তিনি পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে তার শারীরিক সুস্থতার জন্যে প্রার্থনা করেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর নিকট অহী করেনঃ “তুমি তোমার পদ দ্বারা ভূমিতে আঘাত কর, এই তো গোসলের সুশীলত পানি আর পানীয়।”
অতঃপর তিনি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করেন। দীর্ঘক্ষণ পর তার স্ত্রী ফিরে এসে দেখেন যে, তাঁর রুগ্ন স্বামী তো নেই, বরং তার স্থানে একজন উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট সুস্থ মানুষ বসে আছেন। তিনি তাকে চিনতে পারলেন না। তাঁকে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! এখানে একজন আল্লাহর নবী রুগ্ন অবস্থায় ছিলেন তাঁকে দেখেছেন কি? আল্লাহর কসম! তিনি যখন সুস্থ ছিলেন তখন তার যেমন চেহারা ছিল, ঐ চেহারার সাথে আপনার চেহারার খুবই সাদৃশ্য রয়েছে। তিনি দেখতে যেন প্রায় আপনার মতই ছিলেন।” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আমিই সেই ব্যক্তি।” বর্ণনাকারী বলেন যে, হযরত আইয়ূব (আঃ)-এর দুটি গোলা ছিল। একটিতে গম রাখা হতো এবং অপরটিতে রাখা হতো যব। আল্লাহ তা’আলা দুই খণ্ড মেঘ পাঠিয়ে দেন। এক মেঘখণ্ড হতে সোনা বর্ষিত হয় এবং ঐ সোনা দ্বারা একটি গোলা ভর্তি হয়ে যায়। তারপর দ্বিতীয় মেঘখণ্ড হতেও সোনা বর্ষিত হয় এবং তা দ্বারা অপর গোলাটি ভর্তি করা হয়।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত আইয়ুব (আঃ) উলঙ্গ হয়ে গোসল করছিলেন এমন সময় আকাশ হতে সোনার ফড়িং বর্ষিতে শুরু হয়। হযরত আইয়ুব (আঃ) তাড়াতাড়ি ওগুলো স্বীয় কাপড়ে জড়িয়ে নিতে শুরু করেন। তখন আল্লাহ তা’আলা তাকে ডাক দিয়ে বলেনঃ “হে আইয়ূব (আঃ)! তুমি যা দেখছো তা থেকে কি আমি তোমাকে বেপরোয়া ও অভাবমুক্ত করে রাখিনি?” তিনি জবাবে বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! হ্যা, সত্যিই আপনি আমাকে এসব হতে বেপরোয়া ও অভাবমুক্ত রেখেছেন। কিন্তু আপনার রহমত হতে আমি বেপরোয়া ও অমুখাপেক্ষী নই।” (ইমাম আহমাদ (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) এককভাবে এটা তাখরীজ করেছেন)
সুতরাং মহান আল্লাহ তাঁর এই ধৈর্যশীল বান্দাকে ভাল প্রতিদান ও উত্তম পুরস্কার প্রদান করেন। তাকে তিনি তাঁর সন্তানগুলোও দান করেন এবং অনুরূপ সংখ্যক আরো বেশী দেন। এমনকি হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ্ তাঁর মৃত সন্তানগুলোকেও পুনর্জীবিত করেন এবং অনুরূপ সংখ্যক আরো বেশী দান করেন। এটা ছিল আল্লাহর রহমত যা তিনি হযরত আইয়ূব (আঃ)-কে তার ধৈর্য, স্বৈর্য, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন এবং বিনয় ও নম্রতার প্রতিদান হিসেবে দান করেছিলেন। এটা বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্যে উপদেশ স্বরূপ যে, ধৈর্যশীল লোকেরা পরিণামে এভাবেই স্বচ্ছলতা ও সুখ-শান্তি লাভ করে থাকে।
কোন কোন লোক হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আইয়ুব (আঃ) তাঁর স্ত্রীর কোন এক কাজের কারণে তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে, তাঁর স্ত্রী তার চুলের খোপা বিক্রি করে তাঁদের খাদ্য এনেছিলেন বলে তিনি তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। ঐ সময় তিনি কসম করেছিলেন যে, আরোগ্য লাভ করার পর তিনি তাঁর স্ত্রীকে একশ’ চাবুক মারবেন। অন্যেরা তার অসন্তুষ্টির অন্য কারণ বর্ণনা করেছেন। সুস্থ হওয়ার পর তিনি তাঁর কসম পুরো করার ইচ্ছা করেন। কিন্তু যে শাস্তি দেয়ার শপথ তিনি করেছিলেন তার সতী-সধ্বী স্ত্রীর জন্যে মোটেই তা যোগ্য ছিল না। কারণ তিনি এমন সময় স্বামীর সেবায় সদা লেগে থাকেন যখন তার সেবা করার আর কেউই ছিল না। এ জন্যে বিশ্ব-জগতের প্রতিপালক পরম দয়ালু আল্লাহ তাঁর প্রতি সদয় হন এবং স্বীয় নবী (আঃ)-কে হুকুম করেন যে, তিনি যেন এক মুষ্টি তৃণ নেন (যাতে একশ’টি তৃণ থাকবে) এবং তা দ্বারা তাঁর স্ত্রীকে আঘাত করেন এবং এভাবেই যেন নিজের কসম পুরো করেন। এতে তাঁর কসমও পুরো হয়ে যাবে, আবার ঐ সতী-সাধ্বী ধৈর্যশীলা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারিণীর কোন কষ্ট হবে না। আল্লাহ তাআলার নীতি এই যে, তাঁর যেসব সৎ বান্দা তাকে ভয় করে তাদেরকে তিনি দুঃখ-কষ্ট ও অশান্তি হতে রক্ষা করে থাকেন।
এরপর মহান আল্লাহ হযরত আইয়ূব (আঃ)-এর প্রশংসা করছেন যে, তিনি তাঁকে ধৈর্যশীল পেলেন। তিনি তাঁর কতই না উত্তম বান্দা ছিলেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর অভিমুখী। তার অন্তরে আল্লাহর খাঁটি প্রেম ছিল। তিনি তার দিকেই সদা ঝুঁকে থাকতেন। এ জন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পথ করে দিবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযক। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট। আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেনই। আল্লাহ্ সমস্ত জিনিসের জন্যে স্থির করেছেন নির্দিষ্ট মাত্রা।” (৬৫:২-৩) জ্ঞানী আলেমগণ এ আয়াত হতে বহু ঈমানী ইত্যাদি মাসআলা গ্রহণ করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
৪৫-৪৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বান্দা ও রাসূলদের (আঃ) ফযীলতের বর্ণনা দিচ্ছেন এবং তাঁদের সংখ্যা গণনা করছেন যে, তাঁরা হলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত ইসহাক (আঃ) এবং হযরত ইয়াকূব (আঃ)। তিনি বলেন যে, তাঁদের আমল খুবই উত্তম ছিল এবং তারা ছিলেন সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। তাঁরা আল্লাহর ইবাদতে খুব মযবূত ছিলেন এবং মহাশক্তিশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদেরকে দুরদর্শিতা ও অন্তদৃষ্টি দান করা হয়েছিল। তাদের দ্বীনের বোধশক্তি ছিল, আল্লাহর আনুগত্যে তারাই ছিলেন অটল এবং সত্যকে তাঁরা দর্শনকারী ছিলেন। তাঁদের কাছে দুনিয়ার কোন গুরুত্ব ছিল না। তারা শুধু আখিরাতের প্রতি খেয়াল রাখতেন। দুনিয়ার প্রতি তাদের কোন ভালবাসা ছিল না এবং সদা-সর্বদা তাঁরা আখিরাতের যিকরে মগ্ন থাকতেন। তাঁরা ঐ সব কাজ করে চলতেন যেগুলো জান্নাতের হকদার বানিয়ে দেয়। জনগণকেও তারা ভাল কাজ করতে উৎসাহিত করতেন। তাই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কিয়ামতের দিন উত্তম পুরস্কার ও ভাল স্থান প্রদান করবেন। আল্লাহর দ্বীনের এই বুযর্গ ব্যক্তিরা আল্লাহর খাঁটি ও বিশিষ্ট বান্দা। হযরত ইসমাঈল (আঃ), হযরত ইয়াসাআ (আঃ) এবং হযরত যুলকিফলও (আঃ) আল্লাহর মনোনীত ও বিশিষ্ট বান্দা ছিলেন। তাদের অবস্থাবলী সূরায়ে আম্বিয়ায় গত হয়েছে। এজন্যে এখানে বর্ণনা করা হলো না। তাদের ফযীলত বর্ণনায় তাদের জন্যে উপদেশ রয়েছে যারা উপদেশ লাভ ও গ্রহণ করতে অভ্যস্ত। আর ভাবার্থ এটাও যে, কুরআন হলো যিকর অর্থাৎ নসীহত বা উপদেশ।
৫০-৫৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা তাঁর সৎ বান্দাদের সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, তাদের জন্যে পরকালে উত্তম পুরস্কার ও সুন্দর সুন্দর জায়গা রয়েছে এবং রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত। জান্নাতের দরগুলো তাদের জন্যে বন্ধ থাকবে না, বরং সব সময় খোলা থাকবে। দরযা খুলবার কষ্টটুকুও তাদেরকে করতে হবে না।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতের মধ্যে আদন নামক একটি প্রাসাদ রয়েছে, যার আশে পাশে মিনার রয়েছে। ওর পাঁচ হাজার দর আছে এবং প্রত্যেক দরযার উপর পাঁচ হাজার চাদর রয়েছে। তাতে শুধু নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং ন্যায়পরায়ণ বাদশাহগণ অবস্থান করবেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) আর এটা তো বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত যে, জান্নাতের আটটি দরযা রয়েছে।
মহান আল্লাহ বলেনঃ সেথায় তারা আসীন হবে হেলান দিয়ে। নিশ্চিন্তভাবে অতি আরামে চার জানু হয়ে তারা বসে থাকবে। আর সেথায় তারা বহুবিধ ফল মূল ও পানীয়ের জন্যে আদেশ দিবে। অর্থাৎ যে ফল অথবা যে সুরা পানাহারের তাদের ইচ্ছা হবে, হুকুমের সাথে সাথে পরিচারকের দল সেগুলো এনে তাদের কাছে হাযির করে দিবে। সেথায় তাদের পার্শ্বে থাকবে আনত নয়না সমবয়স্কা তরুণীগণ। তারা হবে অতি পবিত্র। তারা চক্ষু নীচু করে থাকবে এবং জান্নাতীদের প্রতি তারা চরমভাবে আসক্তা থাকবে। তাদের চক্ষু কখনো অন্যের দিকে উঠবে না এবং উঠতে পারে না। তারা হবে সমবয়স্কা।
মহান আল্লাহ বলেনঃ এটাই হিসাব দিবসের জন্যে তোমাদেরকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি। অর্থাৎ এসব গুণ বিশিষ্ট জান্নাতের ওয়াদা আল্লাহ তাআলা তাঁর ঐ বান্দাদের সাথে করেছেন যারা তাকে ভয় করে। তারা কবর হতে উঠে, জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি পেয়ে এবং হিসাব হতে অবকাশ প্রাপ্ত হয়ে এই জান্নাতে গিয়ে পরম সুখে বসবাস করবে।
অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, এটাই তার দেয়া রিযক যা কখনো নিঃশেষ হবে না। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের কাছে যা আছে তা শেষ হয়ে যাবে, আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা বাকী থাকবে (কখনো নিঃশেষ হবে না)।” (১৬:৯৬)
আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের জন্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।”(৮৪:২৫) আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ওর ফলমূল ও পানাহারের জিনিস এবং ওর ছায়া চিরস্থায়ী, পরহেযগারদের পরিণাম ফল এটাই। আর কাফিরদের পরিণাম ফল জাহান্নাম।” (১৩:৩৫) এ বিষয়ের আরো বহু আয়াত রয়েছে।
৫৫-৬৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা পূর্ববর্তী আয়াতগুলোতে সৎলোকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। এখানে তিনি অসৎ ও পাপী লোকদের অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন, যারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করতো। তিনি বলেন যে, এই সব সীমালংঘনকারীর জন্যে রয়েছে জাহান্নাম এবং তা অতি নিকৃষ্টতম স্থান। সেখানে তাদেরকে আগুন চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টন করবে। সুতরাং ওটা খুবই নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল।
(আরবী) ঐ পানিকে বলা হয় যার উষ্ণতা ও তাপ শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। আর (আরবী) হলো এর বিপরীত। অর্থাৎ যার শীতলতা চরমে পৌঁছে গেছে। সুতরাং একদিকে আগুনের তাপের শাস্তি এবং অন্য দিকে শীতলতার শাস্তি! এই ধরনের নানা প্রকারের জোড়া জোড়া শাস্তি তারা ভোগ করবে যা একে অপরের বিপরীত হবে।
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি এক বালতি গাসসাক দুনিয়ায় বইয়ে দেয়া হয় তবে সমস্ত দুনিয়াবাসী দুর্গন্ধময় হয়ে যাবে।”( এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত কা’ব আহবার (রাঃ) বলেন যে, গাসসাক নামক জাহান্নামে একটি নহর রয়েছে যাতে সর্প, বৃশ্চিক ইত্যাদির বিষ জমা হয় এবং ওগুলো গরম করা হয়। ওর মধ্যে জাহান্নামীদের ডুব দেয়ানো হবে। ফলে তাদের দেহের সমস্ত চামড়া ও গোশত অস্থি হতে খসে পড়বে এবং পদনালী পর্যন্ত লটকে যাবে। তারা তাদের ঐ চামড়া ও গোশতগুলোকে এমনভাবে হেঁচড়িয়ে টানতে থাকবে যেমনভাবে কেউ তার কাপড়কে হেঁচড়িয়ে টেনে থাকে। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন) মোটকথা ঠাণ্ডার শাস্তি আলাদাভাবে হবে এবং গরমের শাস্তি আলাদাভাবে হবে। কখনো গরম পানি পান করানো হবে এবং কখনো যাককুম বৃক্ষ ভক্ষণ করানো হবে। কখনো আগুনের পাহাড়ের উপর চড়ানো হবে, আবার কখনো আগুনের গর্তে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হবে।
অতঃপর আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামীদের পরস্পর ঝগড়া করার বর্ণনা দিচ্ছেন যে তারা একে অপরকে খারাপ বলবে ও তিরস্কার করবে। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ … (আরবী) অর্থাৎ যখনই কোন দল জাহান্নামে প্রবেশ করবে তখন অপর দলকে তারা সালামের পরিবর্তে লানত দিবে। (৭:৩৮) এইভাবে এক দল অন্য দলের উপর দোষ চাপাবে। যে দলটি প্রথমে জাহান্নামে চলে গেছে ঐ দলটি দ্বিতীয় দলকে জাহান্নামের দারোগার সাথে আসতে দেখে দারোগাকে বলবেঃ “তোমাদের সাথে যে দলটি রয়েছে তাদের জন্যে অভিনন্দন নেই, তারা তো জাহান্নামে জ্বলবে। তখন আগমনকারী অনুসারীরা বলবেঃ “তোমাদের জন্যেও তো অভিনন্দন নেই। তোমরাই তো আমাদেরকে মন্দ কাজের দিকে আহ্বান করতে, যার ফল এই দাড়ালো? কত নিকৃষ্ট এই আবাসস্থল!’
তারা আরো বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! যে এটা আমাদের সম্মুখীন করেছে জাহান্নামে, তার শাস্তি আপনি দ্বিগুণ বর্ধিত করুন!’ যেমন অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “পরের দুষ্কর্মশীলরা পূর্বের দুষ্কর্মশীলদের সম্পর্কে আরয করবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! এরাই আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, সুতরাং আপনি তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন! আল্লাহ্ তা’আলা উত্তরে বলবেনঃ প্রত্যেকের জন্যে দ্বিগুণ শাস্তি রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না।” (৭:৩৮)
কাফিররা জাহান্নামে মুমিনদেরকে দেখতে না পেয়ে পরস্পর বলাবলি করবেঃ ‘আমাদের কি হলো যে, আমরা যেসব লোককে মন্দ বলে গণ্য করতাম তাদেরকে দেখতে পাচ্ছি না?’ হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আবু জেহেল বলবেঃ “বিলাল (রাঃ), আম্মার (রাঃ), সুহায়েব (রাঃ) প্রমুখ লোকগুলো কোথায়? তাদেরকে তো দেখতে পাচ্ছি না?” মোটকথা, প্রত্যেক কাফির এ কথাই বলবেঃ “আমাদের কি হলো যে, আমরা যাদেরকে মন্দ বলে গণ্য করতাম তাদেরকে দেখছি না? তবে কি আমরা তাদেরকে অহেতুক ঠাট্টা-বিদ্রুপের পাত্র মনে করতাম? না, বরং তাদের ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটেছে। তাদের সম্পর্কে আমাদের ধারণা ঠিকই ছিল। তারা জাহান্নামের মধ্যেই রয়েছে। কিন্তু এমন কোন দিকে রয়েছে যেখানে আমাদের দৃষ্টি পড়ছে না।” তৎক্ষণাৎ জান্নাতীদের পক্ষ থেকে উত্তর আসবে, যেমন মহা মহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “জান্নাতবাসীরা জাহান্নামীদেরকে সম্বোধন করে বলবেঃ আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমরা তো তা সত্য পেয়েছি। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদেরকে যা বলেছিলেন তোমরাও তা সত্য পেয়েছে। কি? তারা বলবেঃ হ্যা। অতঃপর জনৈক ঘোষণাকারী তাদের মধ্যে ঘোষণা করবেঃ আল্লাহর লানত যালিমদের উপর। (৭:৪৪-৪৯)
এরপর মহান আল্লাহ্ বলেনঃ হে নবী (সাঃ)! আমি যে তোমাকে খবর দিচ্ছি যে, জাহান্নামীরা পরস্পর ঝগড়া ও বাদ-প্রতিবাদ করবে এটা নিশ্চিত সত্য। এতে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ নিয়ে চতুর্থবার হযরত আইয়ুবের কথা কুরআন মজিদে আলোচিত হয়েছে। এর আগে সূরা নিসার ১৬৩ , সূরা আন’আমের ৮৪ ও সূরা আম্বিয়ার ৮৩-৮৪ আয়াতে এ সম্পর্কিত আলোচনা এসেছে। ইতিপূর্বে সূরা আম্বিয়ার ব্যাখ্যায় আমি তাঁর অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। (তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, ৭৬-৭৯ টীকা)
# এর অর্থ এ নয় যে, শয়তান আমাকে রোগগ্রন্ত করে দিয়েছে এবং আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে বরং এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, রোগের প্রচণ্ডতা, ধন-সম্পদের বিনাশ এবং আত্মীয়-স্বজনদের মুখ ফিরিয়ে নেবার কারণে আমি যে কষ্ট ও যন্ত্রণার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছি তার চেয়ে বড় কষ্ট ও যন্ত্রণা আমার জন্য এই যে, শয়তান তার প্ররোচনার মাধ্যমে আমাকে বিপদগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় সে আমাকে আমার রব থেকে হতাশ করার চেষ্টা করে, আমাকে আমার রবের প্রতি অকৃতজ্ঞ করতে চায় এবং আমি যাতে অধৈর্য হয়ে উঠি সে প্রচেষ্টায় রত থাকে। হযরত আইয়ূবের ফরিয়াদের এ অর্থটি দু’টি কারণে আমাদের কাছে প্রাধান্য লাভের যোগ্য। এক, কুরআন মজীদের দৃষ্টিতে আল্লাহ শয়তানকে কেবলমাত্র প্ররোচণা দেবার ক্ষমতাই দিয়েছেন। আল্লাহর বন্দেগীকারীদেরকে রোগগ্রস্ত করে এবং তাদেরকে শারীরিক যন্ত্রণা দিয়ে বন্দেগীর পথ থেকে সরে যেতে বাধ্য করার ক্ষমতা তাদেরকে দেননি। দুই, সূরা আম্বিয়ায় যেখানে হযরত আইয়ূব আল্লাহর কাছে তাঁর রোগের ব্যাপারে অভিযোগ পেশ করছেন সেখানে তিনি শয়তানের কোন কথা বলেন না। বরং তিনি কেবল বলেন,
أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ
“আমি রোগগ্রস্ত হয়ে পড়েছি এবং তুমি পরম করুণাময়।”
# আল্লাহর হুকুমে মাটিতে পায়ের আঘাত করতেই একটি পানির ঝরণা প্রবাহিত হলো। এর পানি পান করা এবং এ পানিতে গোসল করা ছিল হযরত আইয়ূবের জন্য তাঁর রোগের চিকিৎসা। সম্ভবত হযরত আইয়ূব কোন কঠিন চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বাইবেলও একথাই বলে যে, তাঁর সারা শরীর ফোঁড়ায় ভরে গিয়েছিল।
# হাদীস থেকে জানা যায়, এ রোগে আক্রান্ত হবার পর হযরত আইয়ূবের স্ত্রী ছাড়া আর সবাই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেছিল, এমন কি সন্তানরাও তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এ দিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলছেন, যখন আমি তাঁর রোগ নিরাময় করলাম, সমস্ত পরিবারবর্গ তাঁর কাছে ফিরে এলো এবং তারপর আমি তাঁকে আরো সন্তান দান করলাম।
# একজন বুদ্ধিমানের জন্য এর মধ্যে এ শিক্ষা রয়েছে যে, ভালো অবস্থায় আল্লাহকে ভুলে গিয়ে তার বিদ্রোহী হওয়া উচিত নয় এবং খারাপ অবস্থায় তার আল্লাহ থেকে নিরাশ হওয়াও উচিত নয়। তাকদীরেরর ভালমন্দ সরাসরি এক ও লা-শরীক আল্লাহর ক্ষমতার আওতাধীন। তিনি চাইলে মানুষের সবচেয়ে ভাল অবস্থাকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পরিবর্তিত করে দিতে পারেন আবার চাইলে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে তাকে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় পৌঁছিয়ে দিতে পারেন। তাই বুদ্ধিমান ব্যক্তির সকল অবস্থায় তাঁর ওপর ভরসা এবং তাঁর প্রতি পুরোপুরি নির্ভর করা উচিত।
# এ শব্দগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, হযরত আইয়ূব (আ) রুগ্ন অবস্থায় নারাজ হয়ে কাউকে মারার কসম খেয়েছিলেন। (কথিত আছে, স্ত্রীকে মারার কসম খেয়েছিলেন) আর এ কসম খাওয়ার সময় তিনি একথাও বলেছিলেন যে, তোমাকে এতো ঘা দোররা মারবো। আল্লাহ যখন তাঁকে সুস্থতা দান করলেন এবং যে রোগগ্রস্ত অবস্থায় ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি এ কসম খেয়েছিলেন এ ক্রোধ স্তিমিত হয়ে গেলো তখন তিনি একথা মনে করে অস্থির হয়ে পড়লেন যে, কসম পুরা করতে গেলে অযথা একজন নিরপরাধকে মারতে হয় এবং কসম ভেঙে ফেললেও গোনাহগার হতে হয়। এ উভয় সংকট থেকে আল্লাহ তাঁকে উদ্ধার করলেন। আল্লাহ তাঁকে হুকুম দিলেন, একটি ঝাড়ু নাও, তাতে তুমি যে পরিমাণ কোড়া মারার কসম খেয়েছিলে সে পরিমাণ কাঠি থাকবে এবং সে ঝাড়ু দিয়ে কথিত অপরাধীকে একবার আঘাত করো এর ফলে তোমার কসমও পুরা হয়ে যাবে এবং সেও অযথা কষ্টভোগ করবে না।
কোন কোন ফকীহ এ রেওয়ায়াতটিকে একমাত্র হযরত আইয়ূবের জন্য নির্ধারিত মনে করেন। আবার কতিপয় ফকীহের মতে অন্য লোকেরাও এ সুবিধাদান থেকে লাভবান হতে পারে। প্রথম অভিমতটি উদ্ধৃত করেছেন ইবনে আসাকির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এবং আবু বকর জাসসাস মুজাহিদ থেকে। ইমাম মালেকেরও অভিমত এটিই। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ, ইমাম যুফার ও ইমাম শাফেঈ দ্বিতীয় অভিমতটি অবলম্বন করেছেন। তাঁরা বলেন, কোন ব্যক্তি যদি তার খাদেমকে দশ ঘা কোড়া মারার কসম খেয়ে বসে এবং পরে দশটি কোড়া মিলিয়ে তাকে এমনভাবে কেবলমাত্র একটি আঘাত করে যার ফলে কোড়াগুলোর প্রত্যেকটির কিছু অংশ তার গায়ে ছুঁড়ে যায় তাহলে তার কসম পুরো হয়ে যাবে।
বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায়, নবী ﷺ বেশী রোগগ্রস্ত বা দুর্বল হবার কারণে যে যিনাকারী একশো দোররার আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা রাখতো না তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি প্রয়োগ করার ব্যাপারে এ আয়াতে বিবৃত পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। আল্লামা আবু বকর জাসসাস হযরত সাঈদ ইবনে সা’দ ইবনে উবাদাহ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, বনী সা ’য়েদে এক ব্যক্তি যিনা করে। সে এমন রুগ্ন ছিল যে, তাকে অস্থি-চর্মসার বলা যেতো। এ কারণে নবী ﷺ হুকুম দিলেনঃ
خذوا عثقالا فيه ماة شمراخ فاضربوه بها ضرية واحدة
“খেজুরের একটি ডাল, নাও, যার একশোটি শাখা রয়েছে এবং তা দিয়ে একবার এ ব্যাক্তিকে আঘাত করো।” (আহকামূল কুরআন)
মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ ইবনে মাজাহ, তাবারানী, আবদুল রাজ্জাক ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থসমূহেও এ সমর্থক কতিপয় হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে একথা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী ﷺ রোগী ও দুর্বলের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিই অবলম্বন করেছিলেন। তবে ফকীহগণ এক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করেছেন যে, প্রত্যেকটি শাখা বা পাতার কিছু না কিছু অংশ অপরাধীর গায়ে অবশ্যই লাগা উচিত এবং একটি আঘাতই যথেষ্ট হলেও অপরাধীকে তা যেন কোন না কোন পর্যায়ে আহত করে। অর্থাৎ কেবল স্পর্শ করা যথেষ্ট নয় বরং আঘাত অবশ্যই করতে হবে।
এখানে এ প্রশ্নও দেখা দেয় যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে এবং পরে জানা যায় যে, সে বিষয়টি অসঙ্গত, তাহলে তার কি করা উচিত। নবী ﷺ প্রত্যেকে এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, এ অবস্থায় মানুষের পক্ষে যা ভালো, তাই করা উচিত এবং এটিই তার কাফফারা। অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে, এ অসঙ্গত কাজের পরিবর্তে মানুষের ভাল কাজ করা এবং নিজের কসমের কাফফারা আদায় করে দেয়া উচিত। এ আয়াতটি এ দ্বিতীয় হাদীসটিকে সমর্থন করে। কারণ একটি অসঙ্গত কাজ না করাই যদি কসমের কাফফরা হতো তাহলে আল্লাহ আইয়ূবকে একথা বলতেন না যে, তুমি একটি ঝাড়ু দিয়ে আঘাত করে নিজের কসম পুরা করে নাও। বরং বলতেন, তুমি এমন অসঙ্গত কাজ করো না এবং এটা না করাই তোমার কসমের কাফফরা। (আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নূর, ২০ টীকা )
এ আয়াত থেকে একথাও জানা যায় যে, কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেলে সঙ্গে সঙ্গেই তা পুরা করা অপরিহার্য হয় না। হযরত আইয়ূব রোগগ্রস্ত অবস্থায় কসম খেয়েছিলেন এবং তা পূর্ণ করেন পুরোপুরি সুস্থ হবার পর এবং সুস্থ হবার পরও তাও সঙ্গে সঙ্গেই পুরা করেননি।
কেউ কেউ এ আয়াতকে শরয়ী বাহানাবাজীর সপক্ষে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। সন্দেহ নেই, হযরত আইয়ূবকে যা করতে বলা হয়েছিল তা একটি বাহানা ও ফন্দিই ছিল। কিন্তু তা কোন ফরয থেকে বাঁচার জন্য করতে বলা হয়নি বরং বলা হয়েছিল একটি খারাপ কাজ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। কাজেই শরীয়াতে একমাত্র এমন বাহানা ও ফন্দি জায়েয যা মানুষের নিজের সত্তা থেকে অথবা অন্য কোন ব্যক্তি থেকে জুলুম, গোনাহ ও অসৎ প্রবণতা দূর করার জন্য করা হয়ে থাকে। নয়তো হারামকে হালাল বা ফরয বাতিল অথবা সৎকাজ থেকে রেহাই পাবার জন্য বাহানাবাজি করা বা ফন্দি আঁটা গোনাহর উপরি গোনাহ। বরং এর সূত্র গিয়ে কুফরীর সাথে মেলে।
কারণ এসব অপবিত্র উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি বাহানা করে সে যেন অন্য কথায় আল্লাহকে ধোঁকা দিতে চায়। যেমন যে ব্যক্তি যাকাত দেয়া থেকে রেহাই পাবার জন্য বছর শেষ হবার আগে নিজের সম্পদ অন্য কারো কাছে স্থানান্তর করে সে নিছক একটি ফরয থেকেই পালায়ন করে না বরং সে একথাও মনে করে যে, আল্লাহ তার এ প্রকাশ্য কাজ দেখে প্রতারিত হবে এবং তাকে ফরযের আওতাভুক্ত মনে করবে না। এ ধরনের ‘হীলা’ বা বাহানার বিষয়সমূহ যেসব ফকীহ তাদের কিতাবের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, শরীয়াতের বিধান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করার জন্য এসব বাহানাবাজীর আশ্রয় নিতে উদ্বুদ্ধ করা তাঁদের উদ্দেশ্য নয় বরং তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যদি কোন ব্যাক্তি গোনাহকে আইনের রূপ দান করে গা বাঁচিয়ে বের হয়ে আসে, তাহলে কাযী বা শাসক তাকে পাকড়াও করতে পারেন না। তার শাস্তির ভার আল্লাহর হাতে সোপর্দ হয়ে যায়।
# এ প্রেক্ষাপটে একথা বলার জন্য হযরত আইয়ূবের কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নেক বান্দারা যখন বিপদের ও কঠিন সংকটের মুখোমুখি হন তখন তাঁরা তাঁদের রবের কাছে অভিযোগ করেন না বরং ধৈর্য সহকারে তাঁর চাপিয়ে দেয়া পরীক্ষাকে মেনে নেন এবং তাতে উত্তীর্ণ হবার জন্য তাঁর কাছেই সাহায্য চান। কিছুকাল আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার পর যদি বিপদ অপসারিত না হয় তাহলে তাঁর থেকে নিরাশ হয়ে অন্যদের দরবারে হাত পাতবেন, এমন পদ্ধতি তাঁরা অবলম্বন করেন না। বরং তারা ভাল করেই জানেন, যা কিছু পাওয়ার আল্লাহর কাছ থেকেই পাওয়া যাবে। তাই বিপদের ধারা যতই দীর্ঘ হোক না কেন তারা তাঁরই করুণা প্রার্থী হন। এজন্য তারা এমন দান ও করুণা লাভে ধন্য হন যার দৃষ্টান্ত হযরত আইয়ূবের জীবনে পাওয়া যায়। এমনকি যদি তারা কখনো অস্থির হয়ে কোন প্রকার নৈতিক দ্বিধা-দন্দ্বের শিকার হয়ে পড়েন তাহলেও আল্লাহ তাদেরকে দুষ্কৃতিমুক্ত করার জন্য একটি পথ বের করে দেন যেমন হযরত আইয়ূবের জন্য বের করে দিয়েছিলেন।
# মূলে বলা হয়েছেঃ أُولِي الْأَيْدِي وَالْأَبْصَارِ (হস্তধারী ও দৃষ্টিধারীগণ) ইতিপূর্বে যেমন আমরা বলেছি, হাত মানে শক্তি ও সামর্থ্য। আর এ নবীগণকে শক্তি ও সামর্থ্যে অধিকারী বলার অর্থ হচ্ছে, তাঁরা অত্যন্ত সক্রিয় ও কর্মশক্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁরা আল্লাহর আনুগত্যকারী ও গোনাহ থেকে সংরক্ষিত থাকার প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী ছিলেন। দুনিয়ায় আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করার জন্য তাঁরা বিরাট প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। দৃষ্টি অর্থ চোখের দৃষ্টি নয় বরং অন্তর্দৃষ্টি। তাঁরা সত্যদ্রষ্টা ছিলেন। দুনিয়ায় তাঁরা চোখ বন্ধ করে চলতেন না। বরং চোখ খুলে জ্ঞান ও তাত্বিক পর্যবেক্ষণের পূর্ণ আলোকে সঠিক সোজা পথ দেখে চলতেন। এ শব্দগুলোর মধ্যে এ দিকে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, দুষ্কৃতিকারী ও পথভ্রষ্টরা আসলে হাত ও চোখ উভয়টি থেকে বঞ্চিত। আসলে যারা আল্লাহর পথে কাজ করে তারাই হস্তধারী এবং যারা সত্যের আলো ও মিথ্যার অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য করে তারাই দৃষ্টির অধিকারী।
# তাঁদের যাবতীয় সাফল্যের মূল কারণ ছিল এই যে, তাঁদের মধ্যে বৈষয়িক স্বার্থলাভের আকাঙ্ক্ষা ও বৈষয়িক স্বার্থপূজার সামান্যতম গন্ধও ছিল না। তাঁদের সমস্ত চিন্তা ও প্রচেষ্টা ছিল আখেরাতের জন্য। তাঁরা নিজেরাও আখেরাতের কথা স্মরণ করতেন এবং অন্যদেরকেও স্মরণ করিয়ে দিতেন। তাই আল্লাহ তাঁদেরকে দু’টি মর্যাদা দান করেছেন। বৈষয়িক স্বার্থ চিন্তায় ব্যাপৃত লোকদের ভাগ্যে কখনো এটা ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে এ সূক্ষ্ম বিষয়টিও দৃষ্টি সমক্ষে থাকা উচিত যে, এখানে আল্লাহ আখেরাতের জন্য কেবলমাত্র “আদদার” (সেই ঘর বা আসল ঘর) শব্দ ব্যবহার করেছেন। এর মাধ্যমে এখানে এ সত্যটি বুঝানোই উদ্দেশ্য যে, এ দুনিয়া আদতে মানুষের ঘর নয় বরং এটি নিছক একটি অতিক্রম করার জায়গা এবং একটি মুসাফিরখানা মাত্র। এখান থেকে মানুষকে অবশ্যই বিদায় নিতে হবে। আসল ঘর হচ্ছে সেই আখেরাতের ঘর। যে ব্যক্তি তাকে সুসজ্জিত কারার চিন্তা করে সে-ই দুরদৃষ্টির অধিকারী এবং আল্লাহর কাছে তাকে অবশ্যই পছন্দনীয় মানুষ হওয়া উচিত। অন্যদিকে যে ব্যক্তি এ মুসাফিরখানায় নিজের সামান্য কয়েক দিনের অবস্থানস্থলকে সুসজ্জিত করার জন্য এমনসব কাজ করে যার ফলে আখেরাতের আসল ঘর তার জন্য বিরাণ হয়ে যায়, তার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ পছন্দ করতে পারেন না।
# কুরআন মজীদে মাত্র দু’জায়গায় তাঁর কথা বলা হয়েছে। সূরা আল আন’আমের ৮৬ আয়াতে এবং এ জায়গায়। উভয় জায়গায় কোন বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। বরং কেবলমাত্র নবীদের কথা বর্ণনা প্রসঙ্গে তাঁর নাম নেয়া হয়েছে। তিনি ছিলেন বনী ইসরাঈলের নেতৃস্থানীয় নবীদের একজন। জর্দান নদীর উপকূলে আবেল মেহুলা (Abel Meholeh) এর অধিবাসী ছিলেন। ইহুদী ও খৃস্টানরা তাঁকে ইলীশার (Elisha) নামে স্মরণ করে। হযরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম যে সময় সিনাই উপদ্বীপে আশ্রয় নিয়েছিলেন তখন কয়েকটি বিশেষ কাজে তাঁকে সিরিয়ায় ও ফিলিস্তিনে ফিরে যাওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একটি কাজ ছিল হযরত আল ইয়াসা’কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। এ হুকুম অনুযায়ী হযরত ইলিয়াস তাঁর জনবসতিতে গিয়ে পৌঁছলেন। তিনি দেখলেন, বারো জোড়া গরু সামনে নিয়ে হযরত আল ইয়াসা’ জমিতে চাষ দিচ্ছেন এবং তিনি নিজে বারোতম জোড়ার সাথে আছেন। হযরত ইলিয়াস তাঁর পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁর ওপর নিজের চাদর নিক্ষেপ করলেন এবং তিনি তৎক্ষণাত ক্ষেতখামার ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাথে চলে এলেন। ( রাজাবলি ১৯: ১৫-২১ ) প্রায় দশ বারো বছর তিনি তাঁর প্রশিক্ষণের অধীনে থাকলেন। তারপর আল্লাহ তাঁকে উঠিয়ে নেবার পর তিনি হযরত ইলিয়াসের স্থলে নিযুক্তি লাভ করলেন। ( ২-রাজাবলিঃ ২ ) বাইবেলের ২-রাজাবলি পুস্তকের ২ থেকে ১৩ অধ্যায় পর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে ( দেখুন : ২-রাজাবলি পুস্তকের ২ থেকে ৮ অধ্যায়, ২-রাজাবলি পুস্তকের ৯ থেকে ১৩ অধ্যায়) । তা থেকে জানা যায়, উত্তর ফিলিস্তিনের ইসরাঈলী সালাতানাত যখন শিরক ও মূর্তি পূজা এবং নৈতিক অপবিত্রতায় ডুবে যেতে থাকলো তখন শেষ পর্যন্ত তিনি নিমশির পৌত্র যিহোশাফটের পুত্র যেহুকে রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে দাঁড় করালেন। এ রাজ পরিবারের মাধ্যমেই ইসরাঈলে এসব দুষ্কৃতি বিস্তার লাভ করেছিল। যেহু কেবল বা’আলপূজাই বন্ধ করলো না বরং এ দুষ্কৃতিকারী পরিবারের প্রত্যেককে হত্যা করলো, একটি শিশুকেও জীবিত ছাড়লো না। কিন্তু ইসরাঈলের শিরায় উপশিরায় যে দৃষ্কৃতি অনুপ্রবেশ করেছিল এ সংস্কার বিপ্লব তাকে পুরোপুরি নির্মূল করতে পারলো না। হযরত আল আয়াসা’আর মৃত্যুর পর তা ঝড়ের বেগে অগ্রসর হলো। এমনকি এরপর সামোরিয়দের ওপর আসিরীয়রা একের পর এক হামলা শুরু করে দিল। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, বনী ইসরাঈল, ৭ এবং সাফফাত, ৭০ – ৭১ টীকা ।)
# হযরত যুল কিফল এর উল্লেখও কুরআনে দু’জায়গায়ই এসেছে। সূরা আল আম্বিয়ায় এবং এখানে। এ সম্পর্কে আমার অনুসন্ধালব্ধ আলোচনা আমি সূরা আল আম্বিয়াতেই করে এসেছি। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সুরা আল আম্বিয়া, ৮১ টীকা।)
# মূলে বলা হয়েছেঃ مُفَتَّحَةً لَهُمُ الْأَبْوَابُ এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, এসব জান্নাতে তারা দ্বিধাহীনভাবে ও নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করবে এবং কোথাও তাদের কোন প্রকার বাঁধার সম্মুখীন হতে হবে না। দুই, জান্নাতের দরোজা খোলার জন্য তাদের কোন প্রচেষ্টা চালাবার দরকার হবে না বরং শুধুমাত্র তাদের মনে ইচ্ছা জাগার সাথে সাথেই তা খুলে যাবে। তিন, জান্নাতের ব্যবস্থাপনায় যেসব ফেরেশতা নিযুক্ত থাকবে তারা জান্নাতের অধিবাসীদেরকে দেখতেই তাদের জন্য দরোজা খুলে দেবে। এ তৃতীয় বিষয়বস্তুটি কুরআনের এক জায়গায় বেশী স্পষ্টভাষায় বর্ণনা করা হয়েছেঃ
حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ
“এমনকি যখন তারা সেখানে পৌঁছবে এবং তার দরোজা আগে থেকেই খোলা থাকবে, তখন জান্নাতের ব্যবস্থাপকরা তাদেরকে বলবে, ‘সালামুন আলাইকুম, শুভ আগমন,’ চিরকালের জন্য এর মধ্যে প্রবেশ করুন।” (আয যুমার, ৭৩)
# সমবয়সী স্ত্রী অর্থ এও হতে পারে যে, তারা পরস্পর সমান বয়সের হবে আবার এও হতে পারে যে, তারা নিজেদের স্বামীদের সমান বয়সের হবে।
# মূলে غَسَّاقٌ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আভিধানিকরা এর কয়েকটি অর্থ বর্ণনা করেছেন। এর একটি অর্থ হচ্ছে, শরীর থেকে বের হয়ে আসা রক্ত, পুঁজ ইত্যাদি জাতীয় নোংরা তরল পদার্থ এবং চোখের পানিও এর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, অত্যন্ত ও চরম ঠাণ্ডা জিনিস। তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, চরম দুর্গন্ধযুক্ত পচা জিনিস। কিন্তু প্রথম অর্থেই এ শব্দটির সাধারণ ব্যবহার হয়, যদিও বাকি দু’টি অর্থও আভিধানিক দিক দিয়ে নির্ভুল।
# এখানে এমন মু’মিনদের কথা বলা হয়েছে, যাদেরকে এ কাফেররা দুনিয়ায় খারাপ ভাবতো। এর অর্থ হচ্ছে, তারা অবাক হয়ে চারদিকে দেখতে থাকবে। ভাবতে থাকবে, এ জাহান্নামে তো আমরা ও আমাদের নেতারা সবাই আছি কিন্তু দুনিয়ায় আমরা যাদের দুর্নাম গাইতাম এবং আল্লাহ, রসূল, আখেরাতের কথা বলার কারণে আমাদের মজলিসে যাদেরকে বিদ্রূপ করা হতো তাদের নাম নিশানাও তো এখানে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।