(বই#১০৮১) [*একটি মহাসংবাদ:-] www.motaher21.net সূরা:- ৩৮:সোয়াদ পারা:২৩ ৬৫-৮৮ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮১)
[*একটি মহাসংবাদ:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ
পারা:২৩
৬৫-৮৮ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬৫
قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا مُنۡذِرٌ ٭ۖ وَّ مَا مِنۡ اِلٰہٍ اِلَّا اللّٰہُ الۡوَاحِدُ الۡقَہَّارُ ﴿ۚ۶۵﴾
বলুন, ‘আমি তো একজন সতর্ককারী মাত্র এবং সত্য কোন ইলাহ্ নেই আল্লাহ ছাড়া, যিনি এক, প্রবল প্ৰতাপশালী।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬৬
رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَہُمَا الۡعَزِیۡزُ الۡغَفَّارُ ﴿۶۶﴾
যিনি আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং ওদের অন্তর্বর্তী সমস্ত কিছুর প্রতিপালক, যিনি পরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬৭
قُلۡ ہُوَ نَبَؤٌا عَظِیۡمٌ ﴿ۙ۶۷﴾
এদেরকে বলো, “এটি একটি মহাসংবাদ,
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬৮
اَنۡتُمۡ عَنۡہُ مُعۡرِضُوۡنَ ﴿۶۸﴾
‘যা থেকে তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৬৯
مَا کَانَ لِیَ مِنۡ عِلۡمٍۭ بِالۡمَلَاِ الۡاَعۡلٰۤی اِذۡ یَخۡتَصِمُوۡنَ ﴿۶۹﴾
‘উর্ধ্বলোক সম্পর্কে আমার কোন জ্ঞান ছিল না যখন তারা বাদানুবাদ করছিল ।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭০
اِنۡ یُّوۡحٰۤی اِلَیَّ اِلَّاۤ اَنَّمَاۤ اَنَا نَذِیۡرٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۷۰﴾
(এদেরকে বলো) অহীর মাধ্যমে একথাগুলো এজন্য জানিয়ে দেয়া হয় যে আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী।”
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭১
اِذۡ قَالَ رَبُّکَ لِلۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنِّیۡ خَالِقٌۢ بَشَرًا مِّنۡ طِیۡنٍ ﴿۷۱﴾
স্মরণ করুন, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদেরকে বলেছিলেন,‘নিশ্চয় আমি মাটি হতে মানুষ সৃষ্টি করব।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭২
فَاِذَا سَوَّیۡتُہٗ وَ نَفَخۡتُ فِیۡہِ مِنۡ رُّوۡحِیۡ فَقَعُوۡا لَہٗ سٰجِدِیۡنَ ﴿۷۲﴾
যখন অমি তাকে পুরোপুরি তৈরি করে ফেলবো এবং তার মধ্যে নিজের প্রাণ ফুঁকে দেবো। তখন তোমরা তার সামনে সিজদানত হয়ে যেয়ো।”
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭৩
فَسَجَدَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ کُلُّہُمۡ اَجۡمَعُوۡنَ ﴿ۙ۷۳﴾
এ হুকুম অনুযায়ী ফেরেশ্‌তারা সবাই সিজদানত হয়ে গেলো,
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭৪
اِلَّاۤ اِبۡلِیۡسَ ؕ اِسۡتَکۡبَرَ وَ کَانَ مِنَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۷۴﴾
কিন্তু ইবলিস নিজে শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার করলো এবং সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭৫
قَالَ یٰۤاِبۡلِیۡسُ مَا مَنَعَکَ اَنۡ تَسۡجُدَ لِمَا خَلَقۡتُ بِیَدَیَّ ؕ اَسۡتَکۡبَرۡتَ اَمۡ کُنۡتَ مِنَ الۡعَالِیۡنَ ﴿۷۵﴾
রব বললেন, “হে ইবলিস! আমি আমার দু’হাত দিয়ে যাকে তৈরি করেছি তাকে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাঁধা দিয়েছে?তুমি কি বড়াই করছো, না তুমি কিছু উচ্চ মর্যাদার অধিকারী?”
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭৬
قَالَ اَنَا خَیۡرٌ مِّنۡہُ ؕ خَلَقۡتَنِیۡ مِنۡ نَّارٍ وَّ خَلَقۡتَہٗ مِنۡ طِیۡنٍ ﴿۷۶﴾
সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদা থেকে৷’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭৭
قَالَ فَاخۡرُجۡ مِنۡہَا فَاِنَّکَ رَجِیۡمٌ ﴿ۚۖ۷۷﴾
তিনি বললেন, ‘তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও, কেননা নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭৮
وَّ اِنَّ عَلَیۡکَ لَعۡنَتِیۡۤ اِلٰی یَوۡمِ الدِّیۡنِ ﴿۷۸﴾
‘আর নিশ্চয় তোমার উপর আমার লা’নত থাকবে, কর্মফল দিন পর্যন্ত।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৭৯
قَالَ رَبِّ فَاَنۡظِرۡنِیۡۤ اِلٰی یَوۡمِ یُبۡعَثُوۡنَ ﴿۷۹﴾
সে বলল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তাহলে তুমি আমাকে পুনরুত্থান দিন পর্যন্ত অবকাশ দাও।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮০
قَالَ فَاِنَّکَ مِنَ الۡمُنۡظَرِیۡنَ ﴿ۙ۸۰﴾
বললেন, ঠিক আছে, তোমাকে সেদিন পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হলো
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮১
اِلٰی یَوۡمِ الۡوَقۡتِ الۡمَعۡلُوۡمِ ﴿۸۱﴾
যার সময় আমি জানি।”
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮২
قَالَ فَبِعِزَّتِکَ لَاُغۡوِیَنَّہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿ۙ۸۲﴾
সে বললো, “তোমার ইজ্জতের কসম, আমি এদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করবোই,
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮৩
اِلَّا عِبَادَکَ مِنۡہُمُ الۡمُخۡلَصِیۡنَ ﴿۸۳﴾
‘তবে তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ব্যতীত।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮৪
قَالَ فَالۡحَقُّ ۫ وَ الۡحَقَّ اَقُوۡلُ ﴿ۚ۸۴﴾
বললেন “তাহলে এটিই সত্য এবং আমি সত্যই বলে থাকি যে,
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮৫
لَاَمۡلَـَٔنَّ جَہَنَّمَ مِنۡکَ وَ مِمَّنۡ تَبِعَکَ مِنۡہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۸۵﴾
তোমার দ্বারা ও ওদের মধ্যে তোমার সকল অনুসারীদের দ্বারা আমি অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব।’
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮৬
قُلۡ مَاۤ اَسۡـَٔلُکُمۡ عَلَیۡہِ مِنۡ اَجۡرٍ وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُتَکَلِّفِیۡنَ ﴿۸۶﴾
বলুন, ‘আমি এর জন্য তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না এবং আমি কৃত্রিমতাশ্রয়ীদের অন্তর্ভুক্ত নই ।
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮৭
اِنۡ ہُوَ اِلَّا ذِکۡرٌ لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۸۷﴾
এ তো একটি উপদেশ সমস্ত পৃথিবীবাসীর জন্য
সূরা:- ৩৮:সোয়াদ-৮৮
وَ لَتَعۡلَمُنَّ نَبَاَہٗ بَعۡدَ حِیۡنٍ ﴿٪۸۸﴾
এর সংবাদের সত্যতা তোমরা কিছুকাল পরে অবশ্যই জানতে পারবে।’

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

এ শিক্ষামূলক অধ্যায় পুনরায় সেই বিষয়টি নিয়ে আসছে যা শুরু হয়েছিলাে সূরার একেবারে গােড়ার দিকে, আর সে বিষয়গুলাে হচ্ছে তাওহীদ, ওহী এবং আখেরাতের ভয়ংকর দিনে নেক প্রতিদান বা শাস্তি দান করা। এ প্রসংগে ওহীর প্রমাণস্বরূপ আদম(আ.)-এর কিসসা পেশ করা হচ্ছে, এটা তাে পূর্বে সিদ্ধান্ত হয়ে রয়েছে যে, এ জীবন শেষে মহাহিসাব দিবসে হেদায়াতপ্রাপ্ত ও পথভ্রষ্ট লােকদের কাছ থেকে হিসাব নেয়া হবে। এ কাহিনীর সাথে ঘটনাও জড়িত রয়েছে, যার সম্পর্ক রয়েছে অহংকারী ও অবাধ্য শয়তানের সাথে, যাকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে বের করে দেয়া হয়েছিলো এবং আল্লাহর রহমত থেকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত করা হয়েছিলাে। যখন সে আদম(আ.)-এর প্রতি আল্লাহর বিশেষ মর্যাদাদানকে একটা মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার মনে করেছিলাে তখনই তাকে বিতাড়িত হতে হয়েছিলাে। এমনি করে সেই দিন থেকেই শয়তান ও আদম(আ.)-এর সন্তানদের মধ্যে এক স্থায়ী রেষারেষি ও চিরস্থায়ী সংঘাতের সূত্রপাত হলাে। এই শত্রুতা শুরু হলাে তাে হলােই, আর কোনােদিন এই দুই সৃষ্টির মধ্যে শত্রুতায় ভাটা পড়েনি। এ শত্রুতার মাত্রাও কোন সময়ে কম মনে হয়নি। তখন থেকেই শয়তানের সকল চিন্তা ও চেষ্টা এ কাজে নিয়ােজিত রয়েছে যেন তার ষড়যন্ত্র জালে সে আদম সন্তানদের বেশী বেশী সংখ্যায় আবদ্ধ করতে পারে এবং তাদের নিয়েই সে দোযখে প্রবেশ করতে পারে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, তাদের বাপের সাথে তার শত্রুতা, যার কারণে তাকে চিরদিনের জন্যে আল্লাহর দরবার থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছিলাে, কাজেই এই সংঘর্ষের লক্ষ্য সুস্পষ্ট, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে হতভাগা আদম সন্তানরা শয়তানের এই দুরভিসন্ধি বুঝেও বুঝতে চায় না, তার দ্বারা বার বার ধোকা খায় এবং তাদের পুরাতন দুশমনের কাছে নিজেদের সােপর্দ করে দেয়। এই ঘটনার মূল কারণ এবং আলোচ্য মূল বিষয়ের প্রতি যথাযথ গুরুত্বদানের সাথেই সূরাটি সমাপ্ত করা হচ্ছে, এর বাইরে অন্য যেসব জিনিস থেকে সে হঠকারী ও মিথ্যারোপকারীদের উদাসীন হয়ে থাকে, সেগুলাের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘বলো, অবশ্যই আমি একজন সতর্ককারী ছাড়া আর কিছুই নই এবং সকল শক্তির আধার আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ নিঃশর্ত ও নিরংকুশ আনুগত্য পাওয়ার যােগ্য নয়, তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সেসব কিছুর মালিক। তিনি মহাশক্তিমান, তিনি মহাক্ষমাশীল।’ বলে দাও সেই মােশরেকদের, যারা হতভম্ব হয়ে থাকতাে, বিস্মিত হয়ে বলতাে, ‘সে কি সকল উপাস্যকে বাদ দিয়ে একজনকেই মাবুদ বানিয়ে দিয়েছে। এটা তাে বড়ই আশ্চর্যের বিষয়? বলে দাও ওদের, হ্যাঁ, এটাই আসল সত্য, ‘প্রকৃতপক্ষে শক্তি ক্ষমতার মালিক সর্বশক্তিমান এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।’ ওদের আরও বলো, অবশ্য তােমার নিজেরও কোনাে কিছু করার ক্ষমতা নেই, আর তােমার ওপর এছাড়া আর কোনাে দায়িত্ব নেই যে, তুমি তাদের আযাবের ভয় দেখাবে এবং সতর্ক করবে, এরপর লােকদের ডাকবে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে। তিনি আল্লাহ, যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে সে সবের মালিক, পালনকর্তা ও পরিচালক। এ সব ক্ষমতার মধ্যে তার অংশীদার কেউই নেই এবং তার কাছে ছাড়া আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে এবং এ দুই মধ্যবর্তী স্থানে এমন কেউ নেই যার কাছে কিছু চাওয়া যেতে পারে, আর একমাত্র তিনিই ক্ষমতাধর। তিনিই শক্তিমান, তিনি সবকিছু করতে সক্ষম। তিনিই ক্ষমাশীল’, তিনি বন্দিার ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করেন এবং প্রকৃত তাওবাকারীর তাওবা কবুল করেন, তিনি তাকে মাফ করে দেন যে অনুতপ্ত হয়ে তাঁর কাছে আশ্রয়প্রার্থী হয় । ওদের বলে দাও, আমি তােমাদের কাছে যা কিছু নিয়ে এসেছি এবং যা কিছু ওরা অস্বীকার করছে বা ওরা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যা ধারণা করছে, তার থেকে তিনি অনেক বড় এবং অনেক মহান। যেসব জিনিসের মধ্যে ওরা আজকে মজে রয়েছে তার বাইরের যে জগত ওদের চোখের আড়ালে রয়েছে, সেসব কিছু থেকে ওরা সম্পূর্ণভাবে গাফেল হয়ে রয়েছে। অর্থাৎ সেসব বিষয়ে ওদের কোনাে ভ্রুক্ষেপ নেই। এরশাদ হচ্ছে, ‘বলে দাও ওটা এক বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ খবর, যার থেকে তােমরা মুখ ফিরিয়ে রয়েছো।’ অর্থাৎ, ওদের কাছাকাছি যেসব জিনিস ওরা দেখছে, সেসব কিছু থেকে অনেক বড় জিনিস সেই মহাগ্রন্থ আল কোরআনের বাণী। এ পবিত্র কালাম হচ্ছে গােটা সৃষ্টির মধ্যে এক মহাগুরুত্বপূর্ণ। জিনিস, এর মর্যাদা হচ্ছে গােটা সৃষ্টির চাইতেও বেশী। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে এ বিশ্বের মধ্যে যা কিছু মূল্যবান এবং যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, সেসবের চাইতেও এ কিতাব বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর প্রেরিত এ মহাবাণী আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সকল বিষয় ও সকল বস্তু থেকে স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন কোনাে জিনিস নয়- সেসকল জিনিস থেকে দূরে অবস্থিত কোনাে বস্তুও নয়; বরং আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যস্থিত সকল জিনিসের সাথে এর অবিচ্ছেদ্য একটা সম্পর্ক রয়েছে। এ পাক কালামে অতীতের অনেক অজানা বিষয় বিবৃত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে দূর ভবিষ্যতের এমন সব খবর দেয়া হয়েছে যা মানুষের বুদ্ধির সীমার বাইরে।  *বিজয়ের ঝান্ডা বুলন্দ করার জন্যেই কোরআন এসেছে : মহাবিস্ময়কর সংবাদবাহী এ মহাগ্রন্থ আল কোরআন এসেছিলাে মক্কা নগরীতে অবস্থিত কোরায়শ ও আরব উপদ্বীপের পৌত্তলিকতা এবং তৎসন্নিহিত ভ্রান্ত মতবাদের ওপর সত্যের বিজয় কেতন উড়ানাের মহান লক্ষ্যে। অতপর এ কেতাবের শক্তিতে যে যে অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। মহাসত্যের এই সম্মােহনী বাণী, সে সমস্ত এলাকাতেও সত্যের জয়-ডংকা বেজে ওঠলাে। এতাে শক্তিশালী এ পাক কালামের আকর্ষণ যে, এর অগ্রযাত্রা স্থান ও কালের সীমানা পেরিয়ে জগদ্বাসীকেও বিমােহিত করলাে এবং ভবিষ্যতের সকল যামানার সকল দেশেও এ পাক কালামের উপস্থাপিত আদর্শ হতাশাগ্রস্ত মানুষকে পুনরায় আশান্বিত করতে সক্ষম হবে। এরই ফলে দেখা গেছে, যারাই এ পবিত্র কিতাবের রংগে রঞ্জিত হয়েছে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্ব পৃথিবীর সবখানে সর্বশ্রেণীর মানুষের ওপরেই ছেয়ে গেছে। এ মহাসত্য সমাগত হওয়ার পর মানব নির্মিত সকল সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর আল কোরআনের উপস্থাপিত ব্যবস্থা বিজয়ী ও পরিব্যাপ্ত হয়ে ততােদিন পর্যন্ত তার ভূমিকা পালন করলাে, যতােদিন আল্লাহ রব্বুল আলামীন চাইলেন। এভাবে এ মহা সংবাদবাহী কিতাব মানব রচিত সকল মত ও পথের গতি পরিবর্তন করে বিশ্ব সম্রাটের প্রদর্শিত পথের সাথে সবাইকে একাত্ম করে দিলাে। এ পাক কালাম প্রদর্শিত পথ এতােই মযবুত এবং এতােই আকর্ষণীয় যে, যে এলাকাতেই এর ধারক বাহকরা নিজেদের ব্যবহার ও বাস্তব কর্মকান্ডের মাধ্যমে এর দাওয়াত যথার্থভাবে পেশ করতে সক্ষম হয়েছে, সেখানকার অধিবাসীরা ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় এ ব্যবস্থাই মানতে বাধ্য হয়েছে; যারা এর ওপর ঈমান এনেছে তারা তাে অন্তর দিয়ে এর আদর্শ গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছে, তারা এর অপ্রতিরােধ্য গতি ঠেকাতে পারেনি। যেসব এলাকায় আল কোরআনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং যে সকল এলাকায় এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে, সে সকল অঞ্চলে এ বিজয় যাত্রার সাথে যারা সহযােগিতা করেছে, আর যারা এর অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে, তারা সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখে নিয়েছে যে, মানবেতিহাসের কোনাে অধ্যায়েই আল কোরআন প্রদর্শিত উন্নত এবং সর্বাংগীণ সুন্দর ব্যবস্থা আর কখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শেষ নবী মােহাম্মদ(স.)-এর সফল পরিচালনায় আল কোরআন প্রদর্শিত এ বিজয়ী ব্যবস্থা মানুষের অন্তরে এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আসন করে নিতে সক্ষম হয়েছিলাে এবং পৃথিবীর সর্বত্র তার ভিত্তি এমন দৃঢ়ভাবে স্থাপন করেছিলাে, যা আরববাসী কোনােদিন কল্পনা করেনি বা এমন অবস্থা তার স্বপ্নেও কোনদিন ভাবতে পারেনি। আল কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সেই কঠিন সময়ে আরববাসীর ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে, এই মহা সংবাদবাহী কেতাব পৃথিবীর চেহারা পরিবর্তন করার মহৎ উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে, ইতিহাসের গতি বদলে দেয়ার জন্যে এবং আল্লাহর আইন কানুন তার রাজ্যে ও মানুষের বাস্তব জীবনে চালু করার জন্যে নাযিল হয়েছে। মানুষের অন্তরের মধ্যে ও বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সৃষ্টির সকল কিছুর দ্বারপ্রান্তে এ ব্যবস্থার মহিমা পৌছে দিতে নাযিল হয়েছে, তাও তারা বুঝতে পারেনি। আকাশমন্ডলী, পৃথিবী এবং এ দুইয়ের মাঝে যা কিছু রয়েছে সে সবের সৃষ্টির মূলে নিহিত রয়েছে এই ব্যবস্থা সর্বত্র চালু করার এক মহাপরিকল্পনা। কাজেই সে বিধান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা কেয়ামত পর্যন্ত অবিরামভাবে চলতে থাকবে। মানুষের জীবনের সঠিক মূল্যায়ন ও তাকে সমৃদ্ধ করার জন্যে এ প্রচেষ্টা দুনিয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আজকের মুসলমানরা আরববাসীদের মতােই সেই শুভ দিনের স্বপ্ন দেখছে। যদিও পৃথিবীতে অতীত কালের কোনাে অধ্যায়ে বা ইতিহাসের কোনাে পর্যায়েই এই ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অনুরূপ কোনাে ব্যবস্থা বাস্তবায়ন কোনােদিনই কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। তবুও তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস। করে যে, একদিন সেই স্বর্ণালী জীবন ব্যবস্থা তেমনি করে চালু হবে যেমন রাসূলুল্লাহ (স.) ও খােলাফায়ে রাশেদীনের আমলে চালু হয়েছিলাে। তারা এ পাক কালামের বিরােধীদের মতাে হতাশাবাদী নয় এবং কখনও এ জীবন ব্যবস্থাকে ছােট করেও দেখে না। অবশ্য মুসলমানরা তাদের এই বিপ্লবাত্মক অবস্থা নিকট অতীতে বা বর্তমানে দেখেনি, তাই ভবিষ্যতে এর রূপরেখা ঠিক কেমন হবে তা তারা সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না, তবে এ কাজ যে শেষ যামানা পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলতে থাকবে- একথা তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। রসূলুল্লাহ(স.)-এর যামানার প্রথম দিকে আরবরা মনে করতাে, তার আনীত এ জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম মােহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ এবং তাদের নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কারণ তার কাছে এ মহাগ্রন্থ যখন নাযিল হয়েছে তখন তার একটা তাৎপর্য অবশ্যই আছে। তারা এইভাবে একটা সীমার মধ্যেই বিষয়টিকে চিন্তা করতাে, কিন্তু তারা যা ভেবেছিলাে পরবর্তীকালে আল কোরআন তাদের দৃষ্টিতে এই প্রসার এনে দিয়েছিলাে যে, আল কোরআনের প্রভাববলয় থেকে আরও অনেক অনেক বেশী প্রশস্ত হয়ে পড়লাে। এর ক্ষেত্র শুধু আরব জগত এবং মােহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ(স.) পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে না। মুহাম্মদ (স.) তে মাত্র এই মহাগ্রন্থের বহনকারী ও পৌছে দেয়ার মালিক। তিনি নিজে এই মহাগ্রন্থের উদ্ভাবক নন এবং আল্লাহ তায়ালা তাকে শিক্ষা না দিলে এর মধ্যে উল্লেখিত কথার সাধারণ অর্থের বাইরে কোনাে অর্থ তার পক্ষেও বুঝা সম্ভব ছিলাে না। আর শুরু থেকে ঊর্ধ্বাকাশের কোথায় কি আছে আল্লাহ তায়ালা তাকে না জানালে তাও তার পক্ষে বুঝা সম্ভব ছিলাে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘যখন ওরা আমার সাথে নানা প্রকার বাদানুবাদে লিপ্ত হলাে তখন উর্ধ্বাকাশ সম্পর্কে আমার তাে জ্ঞান ছিলাে না, তাই ওহীর মাধ্যমে আমাকে তাে শুধু এতােটুকু বলতে বলা হয়েছে যে, আমি একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র।

*মানব সৃষ্টির আদি কাহিনী : এখানে মানব জাতির সৃষ্টির কাহিনী পেশ করা হয়েছে। সৃষ্টির শুরুতে উর্ধ্বলােকে মানব সৃষ্টির প্রথম অবস্থা নিয়ে আল্লাহর সাথে ফেরেশতাদের যে আলােচনা হয়েছিলাে, সেই সম্পর্কে কিছু কথা এ প্রসংগে জানানাে হয়েছে। এ আলােচনায় পৃথিবীর জীবনে মানব জাতির সফরের রূপরেখা চিহ্নিত করা হয়েছে, আল্লাহর নযরে তাদের মর্যাদার কথা এবং পরিশেষে তারা কোথায় ফিরে যাবে এবং তাদের শেষ পরিণতি কি হবে সে সম্পর্কে জানানাে হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের কর্তব্য সম্পর্কেও অবহিত করা হয়েছে। সময় থাকতেই তাদের সতর্ক হয়ে চলার শিক্ষা দান করার জন্যে শেষ যামানায় মুহাম্মদ(স.)-কে পাঠানাে হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন তােমার রব ফেরেশতাদের সম্বােধন করে বললেন, আমি কাদামাটি দ্বারা মানুষ সৃষ্টি করতে চাই, অতপর যখন তার গঠন কাজ সম্পন্ন করবাে এবং তার মধ্যে আমার রূহ থেকে কিছু অংশ ফুঁকে দেবাে তখন তােমরা তার সামনে (শ্ৰদ্ধা দেখাতে গিয়ে) সিজদাবনত হয়ে পড়বে।’ আমরা একথা জানি না আল্লাহ রব্বুল আলামীন কেমন করে বলেছিলেন অথবা কেমন করে তিনি ফেরেশতাদের সাথে কথা বলেন, আর ফেরেশতারাই বা আল্লাহর সাথে কিভাবে সাক্ষাত করে। ফেরেশতাদের প্রকৃতি কেমন তাও আমরা জানি না। আল্লাহর কিতাবে তাদের যেসব গুণ বর্ণিত হয়েছে- ব্যস শুধু ততােটুকুই আমরা জানি। আর সত্যিকারে বলতে কি, তাদের সম্পর্কে আর অধিক জানার বা চিন্তা করার তেমন প্রয়ােজনই বা আমাদের কি আছে এই চিন্তার কোনাে কূল কিনারাও আমরা কোনােদিন পাবাে না। আল কোরআন তাদের সম্পর্কে আমাদের যেটুকু জানিয়েছে, আমরা সেটুকু মাত্র জানি এবং ততােটুকুর ওপরই আমরা তৃপ্ত থাকি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা, যেমন করে এই সৃষ্টিকুলের অন্য সবাইকেও তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মাটির দ্বারাই সকল বস্তু ও সকল উপাদানের অস্তিত্ব এসেছে, আর এসবের মধ্যেই রয়েছে জীবনের সে সকল রহস্য, যা কেউ জানে না। কেউ বলতে পারে না কেমন করে এগুলাে এলাে এবং কোথা থেকে এলাে। এই মাটি থেকে যে মানুষকে সৃষ্টি করার উপাদান গ্রহণ করা হয়েছে, তাও একটি বড় রহস্য। লক্ষণীয় বিষয়, মর্যাদাপূর্ণ রূহ ফুঁক দিয়ে মাটির দেহে প্রবেশ করানাের পর সেই নির্জীব কাঠামােটি কিভাবে মানুষে পরিণত হয়ে গেলাে। এই মানুষের দেহের প্রতিটি অংগ প্রত্যংগ তাে মাটির তেরী। পরবর্তীতে সে শরীর পৃথিবীর পানি থেকেই এসেছে। ফলে তার অংগ প্রত্যংগ সে পানির দ্বারাও নির্মিত, কিন্তু আল্লাহর রহমতের দান অজানা, সেই রহস্যপূর্ণ আত্মা বা রূহ দেহ থেকে সরে গেলে সে দেহ আর মানুষ থাকে না, মানুষ বলে তাকে ডাকা যায় না এবং মানুষের কোনাে গুণাবলীও ভার মধ্যে পাওয়া যায় না। তাহলে দেখা যাচ্ছে, মানুষের অস্তিত্বের জন্যে যেমন সেই কায়াটি প্রয়ােজন তেমনি প্রয়ােজন ওই অজানা অচেনা ও অদৃশ্য রহস্যঘেরা রূহ, যা মানুষকে মানুষের নাম দিয়েছে। এই ফুঁক দেয়ার তাৎপর্য যে কি তা আমরা জানি না, বুঝি না এবং বুঝতে চাইলেও কিছুতেই তা আমরা অনুধাবন করতে পারি না; তবে শূন্য সেই দেহ অবয়বের মধ্যে রূহ থাকলে তার নড়াচড়া ও দেহাভ্যন্তরের সকল কলকব্জার কর্মক্ষমতা প্রত্যক্ষ করি। এ জন্যে বলা হয়, রূহ না দেখতে পেলেও তার কার্যকারিতা বা প্রভাব আমরা অনুভব করি। এই কার্যকারিতা বা তার অস্তিত্বের লক্ষণ মানুষকে অন্য সব কিছু থেকে পৃথক করে এবং পৃথিবীর অন্য সকল সৃষ্টির ওপর তাকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করে। বুদ্ধি বিবেক ও আত্মার প্রভাবে অন্য সব কিছু নিয়ে সে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয় । এই রূহই এমন এক শক্তি যা তাকে অতীতের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ এবং ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণের যােগ্যতা দান করে। শুধু তাই নয়, এই রূহই তাকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা বুদ্ধি বিবেক ও অনুভূতি শক্তির উর্ধ্বের আরও অনেক কিছু আঁচ করার যোগ্যতা দান করে, যার ফলে সে পেছনের অনেক কিছু দেখতে পায় এবং অনুভব করতে পারে। এভাবে মানুষের বিবেক বুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি রূপ যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে তাই তাকে অন্য সব কিছু থেকে স্বাতন্ত্র দেয় এবং তাকে এতাে বেশী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বানায়, যার শামিল দুনিয়ার অন্য কোনো বস্তু বা প্রাণী হতে পারে না। মানব সৃষ্টির লগ্ন থেকে আরও অনেক প্রকার প্রাণী তার সাথে বসবাস করে আসছে, কিন্তু অন্য কোনাে প্রকার বা শ্রেণীর প্রাণীর স্বভাব প্রকৃতি বা কার্যকলাপের আজ পর্যন্ত কোনাে উন্নতি হয়েছে বলে ইতিহাস আমাদের জানায়নি। সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এতাে দীর্ঘকাল অতীত হয়েছে, কিন্তু এ সমগ্র সময়কালের মধ্যে মানুষ ছাড়া অন্য কোনাে একটি প্রাণীর আকার আকৃতি বা স্বভাব প্রকৃতি বা তাদের কার্যপ্রণালীর সামান্যতম কোনাে পরিবর্তন হয়েছে বলেও জানা যায় না। আল্লাহ রব্বুল আলামীন ফুঁক দানের মাধ্যমে একমাত্র মানুষকেই তার রূহ থেকে কিছু অংশ দিয়েছেন কারণ পৃথিবীতে তাকে তার খলীফা বানানাের পরিকল্পনার মধ্যেই তাঁর ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়েছে। একমাত্র তাকেই তিনি পৃথিবী নামক এই গ্রহের মধ্যে তাঁর খলীফা হিসাবে বাস করার যােগ্যতা দিতে চেয়েছেন। তাঁর খলীফা হিসাবে তারই নির্ধারিত এক বিশেষ সীমা পর্যন্ত অপরকে পরিচালনা করার ক্ষমতা, নতুন নতুন বস্তু ও সভ্যতা সংস্কৃতি গড়ে তােলার দায়িত্ব এবং এ দায়িত্ব পালন করার জন্যে যােগ্যতা, শক্তি ক্ষমতা সবই তিনি তাকে দিয়েছেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষের প্রকৃতির মধ্যে জানার বুঝবার এবং বিশ্বভুবনে কোথায় কি আছে তা আবিষ্কার করার প্রচুর ক্ষমতা ও সম্ভাবনা দিয়ে দিয়েছেন। সেই প্রথম রূহ ফুঁকে দেয়ার দিন থেকেই মানব দেহের মধ্যে এসব যােগ্যতার স্ফূরণ ঘটতে শুরু হয়ে গিয়েছিলাে। ওই যােগ্যতা আসছিলাে সকল শক্তি ক্ষমতার উৎসমূল স্বয়ং আল্লাহর কাছ থেকেই। সুতরাং যখন কোনো মানুষ যােগ্যতার সেই মহান উৎসমূল থেকে দূরে সরে যায় তখন সে তার জ্ঞানের চোখ হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে সৃষ্টি রহস্য জানা ও বুঝার যােগ্যতা। তখন তার গােটা অস্তিত্ব ও তার জীবন এলােমেলাে হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যায় তার সকল প্রকার ভারসাম্য তখন সম্মুখপানে যতােই অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করুক না কেন সে আরও পিছিয়ে যায়। জীবনের পরস্পর বিরােধী গতি তার মনােযােগ বিশৃংখল করে দেয়। সে অবস্থায় তার জ্ঞান, যােগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যতাে বেশীই থাকুক না কেন তা কোনাে কাজে লাগে না এবং সে অবস্থায় তার মধ্যে অবস্থিত বৈশিষ্ট্যসমূহ একেবারে খতম হয়ে না গেলেও প্রকৃতপক্ষে তার জীবনের বাঞ্ছিত অগ্রগতি ব্যাহত ও বিপর্যস্ত হয়ে যায়। অতীতের ইতিহাস সামনে রাখলে আমরা দেখতে পাবাে, এই ক্ষুদ্র পৃথিবীর বুকে মানুষের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, গড়ে ওঠেছে অনেক নগর ও সভ্যতা। এমন এমন অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে যা জ্ঞান বিজ্ঞানের আজকের এই চরম উন্নতির যুগের মানুষের জন্যেও এক মহা বিস্ময়, তা সত্তেও সেসব কিছু নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এগুলাে তাদের ভূমিকা পালন করে পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে গেছে এবং এইভাবে এই সত্য কথাটি প্রমাণিত করেছে যে, মানুষের উদ্ভাবিত সকল পদ্ধতি ও সকল অগ্রগতির একটি সীমা আছে, আছে মানুষের শক্তি ও যােগ্যতার একটি পরিমাপ, যা এক পর্যায়ে থেমে যায় এবং যা এক বিশেষ সময় পর্যন্তই ব্যবহার করা যায়। তারা জানতে চায় অনেক, কিন্তু সে জানারও একটা সীমা আছে, ইচ্ছা করলেই যতাে খুশী ততাে জ্ঞান লাভ করা যায় না, আর যা কিছু জ্ঞান অর্জন করা হয় তা সবই মনে রাখা যায় না বা ইচ্ছা করলেই তার পুরােপুরি ব্যবহারও করা যায় না! ততােটুকুই ব্যবহার করা যায়, যা পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে মনযুর করেন। আমাদের সকল উৎকর্ষ সাধনের পেছনে যদি আল্লাহর মেহেরবানী না থাকতাে, তাহলে কে আমাদের পরিচালনা করতো? কে আমাদের কঠিন দিনে সাহায্য করতাে, কারাে আছে কি এমন ক্ষমতা যে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারে? সারা বিশ্বের তুলনায় মানুষ কত ছােট, কত তুচ্ছ এবং কত হীনবল। সে সৃষ্টির বুকে অবস্থিত গ্রহ-উপগ্রহ, তারকা এই অসংখ্য প্রাণীর মধ্যে এক তুচ্ছ এক প্রাণী হিসাবে বেঁচে আছে। শুধু তাই নয়, একবার ভেবে দেখুন মহাবিশ্বের মধ্যে পৃথিবী নামক এই গ্রহটি কত তুচ্ছ, কত ক্ষুদ্র, যা অন্য যে কোনাে এক তারকার ন্যায় এক বিশেষ নিয়মের অধীনে চলছে, চলছে এক অদেখা ক্ষমতাধরের পরিচালনায় । এই তারকারাজির সংখ্যাই বা কত? মহাশূন্যে অবস্থিত কত কোটি কোটি তারকা বর্তমান রয়েছে তার কোনাে সীমা সংখ্যা জানা মানুষের জন্যে অসম্ভব। কেউ কোনােদিন এদের সংখ্যা নিরূপণ করতে পারেনি, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ কোনােদিন তা জানতেও পারবে না। এখন আমাদের কাছে অবশ্যই এটা একটা অবােধ্য ব্যাপার যে, যে মানুষের নিজের কোনাে ক্ষমতা নেই সে মানুষকে শ্রদ্ধা দেখানাের জন্য কেন মহাদয়াময় আল্লাহর ফেরেশতাদের সেজদা করতে বলা হলাে? এর একটা জওয়াবই খুঁজে পাওয়া যায়, আর তা হচ্ছে, যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘অবশ্য আমি মহান আল্লাহ, বনী আদমকে সম্মানিত করেছি।’ অর্থাৎ সারা জগতের সকল প্রাণী ও সকল বস্তুজগতের ওপর তাকে আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা, সম্মানিত করেছি। ফেরেশতাদের ইচ্ছাশক্তি, পরিচালনার স্বাধীনতা না দেয়ায় তারা আল্লাহর হুকুম মানতে বাধ্য। জিনদের ভালাে মন্দ বুঝার শক্তি দেয়ার সাথে সাথে তাদের ইচ্ছাশক্তি খাটানোর অধিকার দেয়া হয়েছে। ইবলীস জিনদের সমগােত্রীয় হওয়া সত্তেও সে ততােদিন স্বেচ্ছায় আনুগত্য করেছিলাে যতােদিন সে কোনাে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়নি। তারপর যখনই আল্লাহ তায়ালা সবার থেকে অধিক মর্যাদা দান করার উদ্দেশ্যে আদমকে সিজদা করার জন্যে উপস্থিত সকল ফেরেশতাদের প্রতি সরাসরি নির্দেশ দিলেন, তখন পরােক্ষভাবে নির্দেশটি আগুনের তৈরী জিন ইবলীসের ওপরও বর্তায় এবং স্বাধীনতা থাকা সত্তেও সে নিজেকে ফেরেশতাদের মতােই আজ্ঞাবহ দাস মনে করতাে বলে সে এ নির্দেশ কেবল ফেরেশতাদের প্রতি-তার প্রতি নয়’-এ কথা বলেনি। একমাত্র মানুষই ইচ্ছাশক্তিতে স্বাধীনতা থাকা সত্তেও যখন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে তখন আনুগত্য প্রকাশের মাধ্যমে অন্যান্য সৃষ্টির ওপর তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পেশ করতে সক্ষম হয়েছে। এ দ্বারা বুঝা গেলাে, আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে বাধা বিঘ্ন কঠিন অবস্থা যাইই আসুক না কেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এবং তার ওপর ভরসা রেখে যে সকল ঝুঁকি নিয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে, একমাত্র সে-ই মহাসম্মানের অধিকারী হয় যা আল্লাহ রব্বল ইযযত তাকে দিতে চেয়েছেন, কিন্তু যখন এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ আনুগত্য করতে মানুষ পিছপা হয়ে গেছে, তখনই রূহের দাবী উপেক্ষা করে সে তার তুচ্ছ গঠন উপাদান মাটির দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে। অর্থাৎ তখনই সে তুচ্ছ ও হীন মাটির পিন্ডে পরিণত হয়ে গেছে। আদমকে সিজদা করার জন্যে যখনই ফেরেশতাদের প্রতি হুকুম এল, তখন তাদের প্রকৃতির দাবী অনুসারে আল্লাহর সে হুকুম তারা যথাযথভাবে পালন করবে এবং তখনই তারা সাজদায় পড়ে গেলাে। যার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে এরশাদ হয়েছে, ফেরেশতাদের সকলেই এবং সবাই (একসাথে) সিজদা করলো। প্রশ্ন জাগে, কেমন করে সাজদা করলো, কোথায় সিজদা করলাে এবং কখন সিজদা করলাে? এসব প্রশ্নের জওয়াব আমরা জানি না, এগুলাে সবই রহস্যের আড়াল ঢাকা, আল্লাহর জ্ঞানের মধ্যে নিহিত রয়েছে। আদম সৃষ্টির কাহিনীর অবতারণা হয়েছে যে উদ্দেশ্যে, তার সাথে এসব রহস্যের সম্পর্ক গৌণ বিধায় আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ বিষয়ে কিছুই জানাননি। ওপরে বর্ণিত আয়াতে এসব ঘটনা উল্লেখের মূল উদ্দেশ্য যা প্রকাশ পেয়েছে তা হচ্ছে, মাটি দিয়ে তৈরী মানুষের মর্যাদা তখনই শ্রেষ্ঠত্বে উন্নীত হয়েছে যখন তার মধ্যে রূহ ফুকে দেয়া হয়েছে এবং পরবর্তীতে যখনই মানুষ তার রূহের আহ্বানে সাড়া দিতে গিয়ে নিজ কর্তব্য পালনে ব্রতী হয়েছে তখনই সে তার সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছে এবং এভাবে তার মালিকের কাছে সে বাঞ্ছিত মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে চিন্তা করে দেখার বিষয়, কেন ফেরেশতাদের আদমের সামনে সিজদাবনত হতে বলা হলাে এবং কেনই বা তারা সিজদা করলেন। আসলে এই সিজদার তাৎপর্য হচ্ছে, আনুগত্যবােধে আল্লাহর হুকুম পালন এবং যা তারা দেখলেন তাতে আল্লাহর হেকমত (হুকুমের যৌক্তিকতা ও যথার্থতা) তারা অনুধাবন করলেন। ব্যতিক্রম হলাে ইবলীস, সে বড়াই করলাে এবং অস্বীকার করে (কাফের) দলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো। এখন স্বভাবতই আমাদের মনে এ প্রশ্ন জাগে, ইবলীস কি তাহলে ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাে?’ সাধারণভাবে আমরা জানি সে ফেরেশতাদের মধ্যকার কেউ নয়। কেননা যদি সে ফেরেশতাদের গােত্রীয় কোন ব্যক্তি হতাে তাহলে সে আল্লাহর হুকুম কিছুতেই অমান্য করতে। ফেরেশতাদের প্রকৃতিই হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের যে হুকুম দেন তারা তা অমান্য করে না, করতে পারে না। যেহেতু অমান্য করার কোনাে ক্ষমতাই তাদের দেয়া হয়নি, তারা তাে তাই করে যা করার জন্যে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়। সত্য কথা হচ্ছে এই যে, ইবলীস হচ্ছে আগুনের সৃষ্টি, আর হাদীস শরীফ থেকে জানা যায়, ফেরেশতাদের সৃষ্টি নূর (স্নিগ্ধ আলাে) থেকে, কিন্তু সে ফেরেশতাদের সাথে ছিলাে এবং (তাদের দলের সাথে মিশে থাকার কারণে) তার প্রতিও সিজদার হুকুম দেয়া ছিলাে। তাকে বিশেষভাবে নাম নিয়ে সিজদা করতে এই জন্যে বলা হয়নি যে, তাতে পরীক্ষা ছাড়াই তার অবমাননা করা হতাে। অবশ্য পরবর্তীতে নাফরমানীর কারণে তার অবমাননাকর স্বভাবের কথা বুঝা গেলাে। সিজদা না করায় পরবর্তীতে তার প্রতি যে ধমক আসল তাতে আমরা জানতে পেরেছি, তার প্রতিও সিজদা করার হুকুম ছিলাে। এই ধমকে বলা হয়েছে, হে ইবলীস, “নিজ হাতে যাকে আমি সৃষ্টি করলাম তাকে সিজদা করার ব্যাপারে তােমাকে কোন জিনিস বাধা দিলাে? তুমি বড়াই করলে, না তুমিই একজন খুব সম্মানী ব্যক্তি হয়ে গেলে?’ অর্থাৎ, কোন জিনিস তােমাকে বাধা দিলো সেই ব্যক্তিকে সিজদা না করতে যাকে আমি নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি। আর আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাে সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু মানুষ সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করার নিশ্চয় কোনাে গুঢ় তাৎপর্য রয়েছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার রূহের কিছু অংশ ফুঁকে দিয়ে যে মানুষকে অস্তিত্বে আনলেন, নিশ্চয়ই তার দ্বারা তিনি গােটা সৃষ্টির প্রতি এক বিশেষ রহমত বর্ষণ করতে চেয়েছেন। ইবলীসের কাছে তার এই যে জিজ্ঞাসা, ‘আমার হুকুম পালন করা থেকে তুমি কি তাকাব্বুর করলে? না, তুমি হয়ে গেলে মহাসম্মানী কোনাে ব্যক্তি।’ অর্থাৎ তুমি কি এতাে বড় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে গেলে যে নত হতে পারে না? জওয়াব এলাে, আমি তাে ওর থেকে ভালো। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছে আগুন দ্বারা আর ওকে সৃষ্টি করেছাে কাদা মাটি দিয়ে। আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে গিয়ে এ কথা বলায় ইবলীসের পক্ষ থেকে প্রচন্ড এক হিংসা। প্রকাশ পেলাে। তার মনে আদমের প্রতি চরম ঘৃণা অবহেলা পয়দা হলাে, অথবা সে আদম নামক সে ব্যক্তিত্বের প্রতি তাচ্ছিল্য ও উদাসীনতা দেখালাে যাকে আল্লাহ তায়ালা কাদা দিয়ে পয়দা করা সত্তেও মর্যাদা দিলেন। অবশ্যই আদম এই মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য, কিন্তু (অহংকারের কারণে) তার কাছ থেকে এই মন্দ জওয়াব এলাে যার মধ্যে সত্য সঠিক ও সুন্দর বিষয় গ্রহণ করার যােগ্যতা নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনর পক্ষ থেকে সে অহংকারী ব্যক্তিকে বিতাড়িত করার নির্দেশ জারি হয়ে গেলাে, তিনি বললেন, ‘বেরিয়ে যাও তুমি এখান থেকে, অবশ্যই তুমি বিতাড়িত ব্যক্তি এবং পরিষ্কারভাবে এ কথা জেনে নাও যে, কেয়ামত পর্যন্ত তােমার ওপর আমার লানত (অভিশাপ) বর্ষিত হতে থাকবে।’ এখন ‘মিনহা’ শব্দটির মধ্যে ‘হা’ দ্বারা যে জায়গা বুঝানাে হয়েছে আমরা (আমাদের বুদ্ধি অনুযায়ী) তার অর্থ সীমাবদ্ধ করে ফেলতে পারি না। এর দ্বারা কি জান্নাত বুঝানাে হয়েছে না এর দ্বারা আল্লাহর রহমতের প্রতি ইংগীত করা হয়েছে………. এ দুটো অর্থই গ্রহণ করা যেতে পারে- এতে বড় রকমের কোনাে বিতর্ক বা জটিলতা অনুভব করার কোনাে কারণ নেই। এখানে মূল কথা হচ্ছে, ইবলীসের অহংকারের কারণে তাকে অভিশাপ দেয়া ও বিতাড়নের মাধ্যমে শাস্তি দান করা এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করার ঔদ্ধত্য প্রকাশের কারণে তাকে চিরদিনের জন্যে তার রহমতের দৃষ্টি থেকে দূরে নিক্ষেপ করা। আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত হয়ে যাওয়ার পর তার হিংসা চরম ঘৃণা ও ক্রোধে পরিণত হলাে এবং তার মধ্যে প্রতিশােধ নেয়ার উদগ্র এক বাসনা জন্ম নিলাে। এ বিষয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘হে আমার রব, পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে বেঁচে থাকার) সময় বা সুযােগ দাও।’ সে যে কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করলাে তার এই দোয়া কবুল করা এবং কেয়ামত পর্যন্ত তাকে বাঁচিয়ে রাখার সুযােগ দানের ফয়সালা গ্রহণ ছিলাে আল্লাহর মহা পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যে এক হেকমত । তাই তিনি বললেন, ঠিক আছে, তােমাকে সুযােগ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযােগ দেয়া হলো। এবার শয়তান তার রাগ ও ঘৃণা চরিতার্থ করার জন্যে এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তৈরী করে ফেললাে। ‘সে বললাে, ঠিক আছে, তােমার ইযযতের কসম খেয়ে আমি ঘােষণা দিচ্ছি, আমি অবশ্যই ওদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বো, তবে যারা তােমার খাঁটি বান্দা হবে তাদের বাদে। এভাবে শয়তান তার পরিকল্পনা ও পদ্ধতি শাণিত করলাে। লক্ষণীয় যে, কেমন করে এই শয়তান আল্লাহর ইযযতের কসম খেয়ে সকল আদম সন্তানকে গোমরাহ করবে বলে ঘােষণা দিচ্ছে। শুধুমাত্র তারাই তার চক্রান্ত জাল থেকে রেহাই পাবে যাদের ওপর তার কোনাে ক্ষমতা খাটবে না। তাদের সে করুণা করে রেয়াত দেবে তা নয়, বরং যেহেতু তার ক্ষমতা সেখানে চলবে না, এজন্যে তাদের থেকে সে সরে আসবে। এভাবে তার ও তার যড়যন্ত্র জাল থেকে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে যে বস্তু ঢাল হয়ে দাঁড়ায় তা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, সেই রক্ষাকারী ঢাল যা উডয় পক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করে তা হচ্ছে আল্লাহর নিরংকুশ ও নিঃশর্ত আনুগত্য। এটাই মুক্তির একমাত্র বন্ধন- এটাই সফল জীবন ধরে রাখার অভংগুর রশি। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ও তার সিদ্ধান্তক্রমে শয়তানের আক্রমণ থেকে মুক্তিলাডের একমাত্র উপায় হিসাবে এই পদ্ধতিই স্থিরীকৃত হয়ে রয়েছে। এজন্যে আল্লাহ তায়ালা তার ইচ্ছা ঘােষণা করেছেন এবং তার পদ্ধতি ও পথ বলে দিয়েছেন, তিনি বলছেন, হক বা সত্য কথা এটাই, আর এই সঠিক কথাটাই আমি বলছি, তােমার ও তােমার অনুসরণ যারা করবে, সবাইকে দিয়ে আমি অবশ্য অবশ্যই জাহান্নাম ভরে দেবো। অবশ্যই আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা সদা-সর্বদাই সত্য সঠিক কথা বলেন। আল কোরআন এই কথাকেই মযবুত বানাচ্ছে এবং এ সূরাটির মধ্যে গুরুত্বসহকারে এই কথাটির দিকে নানাভাবে ও নানা প্রসংগে ইংগিত দিচ্ছে। এরই আরেকটি ঘটনা হচ্ছে দাউদ ও সােলায়মানের ঘটনা। এতে বিবদমান ব্যক্তিরা দাউদ(আ.)-এর এবাদাতের জন্যে নির্দিষ্ট খাস কামরায় কেমনভাবে (দেওয়াল পার হয়ে) প্রবেশ করলাে। তারা বললাে, আমাদের মধ্যে সঠিকভাবে ফয়সালা করে দিন, দেখবেন বিচার যেন সঠিক হয় এবং আপনার ফয়সালা কোনাে প্রকার পক্ষপাতদুষ্ট যেন না হয়… আল্লাহ তায়ালাও তার (নেক) বান্দা দাউদ(আ.)-কে ডাক দিয়ে বলছেন, ‘হা তুমি মানুষের মধ্যে সঠিকভাবে বিচার ফয়সালা করবে এবং কোনাে সিদ্ধান্ত দিতে গিয়ে সাবধান, যেন কোনাে কু-প্রবৃত্তির তাড়নে না পড়ে যাও।’ এরপরই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে সৃষ্টির যে রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সেই দিকে ইশারা করে বলছেন, ‘আমি, মহান আল্লাহ, আকাশ পৃথিবী এবং এ দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে যা কিছু আছে সেগুলােকে বেকার (অর্থহীন) অবস্থায় পয়দা করিনি।’ কাফেররা তাে মনে করে এগুলাে পয়দা করার পেছনে তেমন কোনাে যুক্তিসংগত কারণ নেই। আসলে এটা কাফেরদের একটা নিছক ধারণামাত্র। তারপর সত্য সঠিক আল্লাহর সঠিক বর্ণনা আসছে | সর্বশক্তিমান আল্লাহরই যবানীতে, তিনি বলছেন, ‘এটাই চূড়ান্ত সত্য কথা এবং প্রকৃত সত্য কথাই আমি বলছি।’ অর্থাৎ, তিনিই সত্য, যার বর্ণনা বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্নভাবে এসেছে, তার প্রকৃতি এবং তার জ্ঞানের কথা শাণিত করে বর্ণিত হয়েছে, তার পক্ষ থেকেই এই সত্য ওয়াদা আসছে, ‘অবশ্যই আমি জাহান্নামকে তােমার দ্বারা এবং তােমার যারা অনুসরণ করবে তাদের সবার দ্বারা ভরে দেবাে।’ এই হচ্ছে সেই সংঘর্ষ যা সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই শয়তান ও আদম সন্তানদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। আদম সন্তানরা এ বিষয়ে সেই সুনিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতেই চিন্তা করে। আল্লাহ তায়ালা তার নবী রসূলদের মাধ্যমে তাদেরকে তাই দান করেছেন। তারা কর্তব্যবােধেই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব থেকে শিক্ষা নেয়ার সাথে সাথে নবী রসূলদের জীবনী ও কর্মধারা স্বেচ্ছায় এবং ভক্তিভরে অনুসরণ করে। আল্লাহর রহমতের দাবীও হচ্ছে এই। তারা যেন ভুলেও নবী রসূলদের শিক্ষা পরিত্যাগ না করে বা কখনও তা থেকে গাফিল না হয়ে যায়।
# আল্লাহ তায়ালা এ অধ্যায়ের শেষে এবং সূরাটির পরিসমাপ্তিতে রসূলুল্লাহ(স.)-কে দায়িত্ব। দিচ্ছেন তিনি যেন তাদের এই প্রসংগের শেষ কথাটি জানিয়ে দেন, বলাে (হে রসূল), আমি তােমাদের এ (কাজের জন্যে কোনাে প্রতিদান চাই না, না আমি কোনাে কৃত্রিম লৌকিকতাকারী। এ কিতাব তাে সারাবিশ্বের জন্যে এক স্মরণিকা, আর এর মধ্যে প্রদত্ত) খবর সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তােমরা জানতে পারবে। অবশ্যই এ (কিতাব) নাজাত হাসিল করার জন্যে এক খাটি ও নির্ভেজাল দাওয়াত (আহ্বানকারী গ্রন্থ)। মানুষের শেষ পরিণতি ও প্রত্যাবর্তনস্থল সম্পর্কে খবর পৌছানাে এবং শেষ বিচারের বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে সতর্ক করার সাথে সাথে এ কিতাব মানুষকে সার্বিক কল্যাণের দিকে আহ্বান জানানাের জন্যে এক উপদেশদাতা হিসেবে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। এমন এক ব্যক্তির যবানীতে এ দাওয়াত পেশ করা হচ্ছে, যিনি কোনাে পারিশ্রমিক বা প্রতিদান চান এবং এ দাওয়াত মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির কাছে যুক্তিপূর্ণ ও সর্বতােভাবে গ্রহণযােগ্য। দাওয়াতের এ কিতাব যেন নিজেই কথা বলে, যখন তেলাওয়াত করা হয় তখন এর হৃদয়গ্রাহী যুক্তি ও মিষ্টি মধুর কথামালা শ্রোতার অজান্তেই তার হৃদয়ের মধ্যে দাগ কাটতে থাকে। এ কালাম কথা বলতে গিয়ে কোনাে কৃত্রিমতা করে না, যা বলতে চায় তা সরাসরিই বলে, আর মানুষের স্বভাব প্রকৃতির দাবী পূরণ করতে গিয়ে ওহীস্বরূপ যা কিছুই নাযিল হয়েছে তাই বলে। এ কিতাব এসেছে সারাবিশ্বের সকল মানুষের জন্যে উপদেশবাণী হিসাবে, তবু মানুষ এ বাণী ভুলে যায়, এ কিতাব থেকে তারা বে-পরওয়া হয়ে যায়। অবশ্যই এ কিতাব এক মহাখবর, যার দিকে লক্ষ্য করাটা এখন আর দরকার মনে করা হচ্ছে না, তবে এটা সত্য যে, এর মাধ্যমে যে মহাখবর এসেছে তা এক নির্দিষ্ট সময় পরই মানুষ জানবে। এ মহাসংবাদ পৃথিবীর যিন্দেগীতেই মানুষের জীবনে বাস্তবায়িত হবে, যেমন এর অবতরণকালে যারা এর সামনে ছিলাে তাদের জীবনে কয়েক বছরের মধ্যেই তা বাস্তবায়িত হয়েছে। আল কিতাবের এ খবর অবশ্যই এক সময়ে বাস্তবায়িত হবে। যেদিন আল্লাহর নিশ্চিত ওয়াদা সঠিক বলে প্রমাণিত হবে, ‘অবশ্য আমি ভরে ফেলবাে জাহান্নামকে তােমার দ্বারা এবং যারা তােমার অনুসরণ করবে তাদের সকলের দ্বারা।’ সূরাটির পরিসমাপ্তিতে যে আলােচনা আমরা দেখতে পাচ্ছি তার সাথে এর শুরুতে আলােচিত বিষয়ের পুরােপুরি সামঞ্জস্য রয়েছে। সমাজের গভীরে যে ব্যাধি প্রােথিত রয়েছে তার ওষুধ হিসাবে এ মহা কিতাবের আগমন। যে অবস্থা অবশ্যই একদিন সামনে আসবে, যার প্রেক্ষাপটে এ কিতাব নাযিল হয়েছিলাে, নাযিল হয়েছিলাে আত্মবিস্মৃত জনগণকে সতর্ক করার জন্যে। এরশাদ হচ্ছে, ‘জানবে তােমরা এক নির্দিষ্ট সময় পরে।’

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৬৫-৭০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

সূরায় কয়েকজন নাবী ও তাঁদের মু‘জিযাহ আলোচনা করার পর নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথা নিয়ে এসেছেন, এটাই হল মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এসব ঘটনা থেকে সকল যুগের কাফিররা যেন জেনে নেয়, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন সত্য নাবী, অতএব যারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবে তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ট। তাই অন্যান্য নাবীদের মত নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সকলকে আহ্বান করলেন- আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র প্রভু, তিনি ব্যতীত সঠিক কোন মা‘বূদ নেই। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন বলে দেন : তোমরা আমার ব্যাপারে যে ধারণা পোষণ করো তা সম্পূর্ণ ভুল। আমি তো শুধুমাত্র তোমাদেরকে সতর্ককারী। তা এ বিষয়ে যে, আল্লাহ তা‘আলা তিনিই একমাত্র উপাস্য, তিনি ব্যতীত ইবাদত পাওয়ার যোগ্য আর কেউ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। তিনি আকাশসমূহ ও জমিনের এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সকল কিছুর মালিক। তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।

(هُوَ نَبَؤٌا عَظِيْمٌ)

‘এটা এক মহা সংবাদ’ সুদ্দী বলেন : মহা সংবাদ হল কুরআন। সূরা নাবার শুরুতে উল্লেখ রয়েছে মহা সংবাদ হল কিয়ামত।

(بِالْمَلَإِ الْأَعْلٰي)

অর্থ উর্ধ্ব জগত, ঊর্ধ্ব জগতে রয়েছে ফেরেশতারা। তারা আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি নিয়ে মন্তব্য করে বলেছিল :

( قَالُوْآ أَتَجْعَلُ فِيْهَا مَنْ يُّفْسِدُ فِيْهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَا۬ءَ ج وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ)

তারা বলল আপনি এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যারা সেখানে বিবাদ করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরাই তো আপনার প্রশংসা-গুণগান করছি এবং আপনারই পবিত্রতা বর্ণনা করে থাকি। (সূরা বাকারাহ ২ : ৩০) এসব আমি জানলাম কিভাবে? এ কুরআন আমার প্রতি ওয়াহী করা না হলে এ খবর আমি জানতে পারতাম না। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের উজ্জ্বল প্রমাণ হল তিনি এসব বিষয় জেনেছেন ওয়াহীর মাধ্যমে, যা জানার অন্য কোন উপায় নেই। তাই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন রাসূল ও স্পষ্ট সতর্ককারী।

আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতারা যে মন্তব্য করেছে সে কথাকে এখানে اختصام বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। যার শাব্দিক অর্থ ‘ঝগড়া করা’ অথচ বাস্তব ঘটনা হল ফেরেশতারা কোন ঝগড়া করেনি তারা কেবল পূর্ব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছে। এসব কথা ও উত্তর ঝগড়ার মত হয়ে গিয়েছিল বলে একে اختصام বলা হয়েছে। মুআয (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে ফজরের সালাত আদায় করতে আটকিয়ে রাখলেন। এমনকি সূর্যের শিং উদয় হওয়ার উপক্রম এমন দেখতে পেলাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্রুত আমাদের কাছে বেরিয়ে আসলেন, সালাতের ইকামত দেয়া হল, সালাত সংক্ষিপ্ত করে পড়লেন। সালাম ফেরানোর পর বললেন : তোমরা কাতারবন্দি হয়েই থাক। অতঃপর তিনি আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন : ফজরের সালাত থেকে কেন আটকে রেখেছিলাম তার সংবাদ তোমাদেরকে অচিরেই দেব। আমার যতটুকু তাকদীরে ছিল ততটুকু সালাত গত রাতে আদায় করেছি। সালাতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম তারপর সজাগ হয়ে দেখলাম উত্তম আকৃতিতে আমি রবের পাশে। তিনি বললেন : হে মুহাম্মাদ! ঊর্ধ্ব জগতে কী বিষয়ে বিবাদ করে জানো? আমি বললাম : হে আল্লাহ তা‘আলা আমি জানি না, এরূপ তিনবার বললাম। আমি দেখলাম, আল্লাহ তা‘আলার হাতের তালু আমার কাঁধের ওপর এবং আমার বুকে তাঁর হাতের আঙ্গুলের শিতলতা অনুভব করতে পারছি। আমার কাছে সব প্রকাশ পেয়ে গেল এবং আমি সব জেনে নিলাম। তিনি বললেন : হে মুহাম্মাদ! কী বিষয়ে ঊর্ধ্ব জগতে বিবাদ করেছে? আমি বললাম, গুনাহ মোচনের ব্যাপারে। ……(পূর্ণ হাদীস) (তিরমিযী হা. ৩২৩৫, মুসনাদে আহমাদ হা. ১৬৬২১, সহীহ)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন সতর্ককারী।
২. আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির ক্ষেত্রে ফেরেশতারা নিষেধ করেনি, বরং পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে মন্তব্য করেছে।
৩. সঠিক পথের অনুসরণ করতে হবে। সত্য থেকে বিমুখ থাকা যাবে না।

৭১-৮৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি এবং সৃষ্টি করার পর সকল ফেরেশতা কৃর্তক তাঁকে সিজদাহ্ করানো, ইত্যাদিসহ ইবলিসের সাথে আল্লাহ তা‘আলার কথোপকথন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদেরকে অবগত করলেন যে, তিনি মাটির মানুষ (আদমকে) সৃষ্টি করবেন, এটা ছিল ফেরেশতাদেরকে অবগত করানোর জন্য, পরামর্শ করার জন্য নয়। তখন ফেরেশতারা যে অভিব্যক্তি পেশ করেছিল তা সূরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যখন আদমকে সৃষ্টি করলেন এবং আদমের ভিতরে রূহ দিলেন তখন সকল ফেরেশতা সিজদাহ্ করল কিন্তু ইবলীস করল না, সে অস্বীকার ও অহঙ্কার করল।

(خَلَقْتُ بِيَدَيَّ)

‘নিজের হাতে সৃষ্টি করেছি’ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-কে স্বহস্তে সৃষ্টি করার পর ইবলিসকে বললেন, আমি যাকে স্বহস্তে সৃষ্টি করে অন্যান্য মাখলুক থেকে সম্মানিত করেছি তুমি কেন তাকে সিজদাহ করলে না, তুমি কি অহঙ্কার করলে, না তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? তখন ইবলিস নিজেকে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ও শ্রেষ্ঠ বলে যুক্তি দেখালো যে, আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছ, আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে। আগুন মাটির কাছে মাথা নত করতে পারে না। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে কিয়ামত অবধি লা‘নত করে বিতাড়িত করে দেন। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা আল হিজ্র, সূরা আল আ‘রাফ-সহ অন্যান্য সূরাতেও পূর্ণভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

(بَعْدَ حِيْنٍ) ‘কিছুকাল পরে’ অর্থ কেউ বলেছেন মৃত্যু, আবার কেউ বলেছেন কিয়ামত। তবে দুয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কারণ মৃত্যুর পরেই মানুষের কিয়ামত শুরু হয়ে যায়।

মাসরূক (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আমি আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)-এর কছে গেলাম। তিনি বললেন : হে লোকসকল! যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে অবগত সে তা বর্ণনা করবে। আর যে না জানে তার বলা উচিত, আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। কেননা অজানা বিষয় সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন। এ কথা বলাও জ্ঞানের নিদর্শন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেছেন বল, এর (কুরআন বা তাওহীদ প্রচারের) জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না এবং আমি মিথ্যারোপকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮০৯, সহীহ বুখারী হা. ২৭৯৮)

শয়তান আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, মানুষকে তার অনুসারী বানিয়ে জাহান্নামে নিবেই। এ জন্য তাকে কিয়ামত অবধি অবকাশ দেয়া হয়েছে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যেন কোনক্রমেই শয়তানের ফাঁদে পড়ে নিজেকে জাহান্নামের দিকে ঠেলে না দেই।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. নিজে অনেক বড় হলেও নিম্ন শ্রেণির লোকদেরকে অবহেলা করা যাবে না।
২. গর্ব-অহঙ্কার করা হতে বিরত থাকতে হবে, কারণ অহঙ্কার ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায় যেমন ইবলিসকে নিয়ে গেছে।
৩. শয়তানের ধোঁকা থেকে সাবধান, কারণ সে আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে, তার অনুসারীদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যাবেই।
৪. কেউ আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য হলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অবকাশ দেন, তবে তার জন্য পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৬৫-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন কাফির ও মূশরিকদেরকে বলেনঃ আমার সম্পর্কে তোমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমি তো তোমাদেরকে শুধু সতর্ককারী। আল্লাহ্, যিনি এক ও শরীক বিহীন, তিনি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কেউই নেই। তিনি একক। তিনি সব কিছুর উপরই পূর্ণ ক্ষমতাবান। সব কিছুই তার অধীনস্থ। তিনি যমীন, আসমান এবং এতদুভয়ের মধ্যস্থিত সব জিনিসেরই মালিক। সমস্ত ব্যবস্থাপনা তাঁরই হাতে। তিনি বড় মর্যাদাবান এবং মহা পরাক্রমশালী। তাঁর এই শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব এবং মহাপরাক্রম সত্ত্বেও তিনি মহা ক্ষমাশীলও বটে।

মহান আল্লাহ্ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি বলঃ এটা এক মহা সংবাদ। তা হলো আল্লাহ্ তা’আলার আমাকে তোমাদের নিকট রাসূলরূপে প্রেরণ করা। কিন্তু হে উদাসীনের দল! এরপরেও তোমরা আমার বর্ণনাকৃত প্রকৃত ও সত্য বিষয়গুলো হতে বিমুখ হয়ে রয়েছো! এটাও বলা হয়েছে যে, “এটা বড় জিনিস” দ্বারা কুরআন কারীমকে বুঝানো হয়েছে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন, হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে আরো বলঃ “হযরত আদম (আঃ)-এর ব্যাপারে ফেরেশতাদের মধ্যে যে বাদানুবাদ হয়েছিল, যদি আমার কাছে অহী না আসতো তবে সে ব্যাপারে আমি কিছু জানতে পারতাম কি? ইবলীসের হযরত আদম (আঃ)-কে সিজদা না করা, মহামহিমান্বিত আল্লাহর সামনে শয়তানের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং নিজেকে বড় মনে করা ইত্যাদির খবর আমি কি করে দিতে পারতাম?”

হযরত মুআয (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ফজরের নামাযে আসতে খুবই বিলম্ব করেন। এমনকি সূর্যোদয়ের প্রায় সময় হয়ে আসে। অতঃপর তিনি খুব তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে আসেন। নামাযের ইকামত দেয়া হয় এবং তিনি খুব হালকাভাবে নামায পড়িয়ে দেন। সালাম ফিরানোর পর বলেনঃ “তোমরা যেভাবে আছ ঐ ভাবেই বসে থাকো।” তারপর আমাদের দিকে মুখ করে তিনি বলেনঃ “রাত্রে আমি তাহাজ্জুদের নামাযের জন্যে উঠেছিলাম। নামায পড়তে পড়তে আমাকে তন্দ্রা পেয়ে বসে। শেষ পর্যন্ত আমি জেগে উঠি এবং আমার প্রতিপালককে সুন্দর আকৃতিতে দেখতে পাই। তিনি আমাকে বলেন, “ঊর্ধ্বলোকে ফেরেশতারা এ সময় কি নিয়ে বাদানুবাদ করছে তা জান কি?” আমি উত্তর দিলামঃ হে আমার প্রতিপালক! না, আমি জানি না। এভাবে তিনবার প্রশ্ন ও উত্তর হলো। অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ আমার দুই কাঁধের মাঝে হাত রাখলেন। এমন কি আমি তাঁর অঙ্গুলীসমূহের শীতলতা অনুভব করলাম এবং এরপর আমার কাছে সব কিছু উজ্জ্বল হয়ে গেল। আবার আমাকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “আচ্ছা, এখন বলতো, ঊর্ধ্বলোকে কি নিয়ে বাদানুবাদ হচ্ছে?” আমি উত্তরে বললামঃ গুনাহর কাফফারা সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা চলছে। পুনরায় তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “বলতো কাফফারা (পাপ মোচনের পন্থা) কি কি?” আমি জবাব দিলামঃ জামাআতে নামায পড়ার জন্যে পা উঠিয়ে চলা, নামাযের পরে মসজিদে বসে থাকা এবং মনে না চাওয়া সত্ত্বেও পূর্ণভাবে অযু করা। মহান আল্লাহ্ আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ “কিভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়?” আমি উত্তরে বললামঃ (দরিদ্রদেরকে) খাদ্য খেতে দেয়া, নম্রভাবে কথা বলা এবং রাত্রে যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে তখন উঠে নামায পড়া। তখন আমার প্রতিপালক আমাকে বললেনঃ “কি চাইবে চাও।” আমি বললামঃ আমি আপনার কাছে ভাল কাজ করার, মন্দ কাজ পরিত্যাগ করার এবং দরিদ্রদেরকে ভালবাসার তাওফীক প্রার্থনা করছি। আর এই প্রার্থনা করছি যে, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, আমার প্রতি সদয় হবেন এবং যখন কোন কওমকে ফিত্নায় ফেলার ইচ্ছা করবেন, ঐ ফিতায় আমাকে না ফেলেই উঠিয়ে নিবেন। আর আমি আপনার কাছে আপনার মহব্বত, যে আপনাকে মহব্বত করে তার মহব্বত এবং এমন কাজের মহব্বত প্রার্থনা করছি যা আমাকে আপনার মহব্বতের নিকটবর্তী করে। এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “এটা সম্পূর্ণরূপে সত্য। এটা তোমরা নিজেরা পড়বে ও অন্যদেরকে শিখাবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং এটা বিখ্যাত স্বপ্নের হাদীস। কেউ কেউ বলেন যে, এটা জাগ্রত অবস্থার ঘটনা। কিন্তু এটা ভুল কথা। সঠিক কথা এই যে, এটা স্বপ্নের ঘটনা)
৭১-৮৫ নং আয়াতের তাফসীর:

এ ঘটনাটি সূরায়ে বাকারা, সূরায়ে আ’রাফ, সূরায়ে হিজ্বর, সূরায়ে সুবহান, সূরায়ে কাহাফ এবং সূরায়ে সোয়াদে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করার পূর্বে আল্লাহ্ ফেরেশতাদেরকে নিজের ইচ্ছার কথা বলেন যে, তিনি মাটি দ্বারা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করবেন। তিনি তাদেরকে এ কথাও বললেন যে, যখন তিনি আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করবেন তখন যেন তারা তাকে সিজদা করেন, যাতে আল্লাহর আদেশ পালনের সাথে সাথে আদম (আঃ)-এরও আভিজাত্য প্রকাশ পায়। ফেরেশতারা সাথে সাথে আল্লাহর আদেশ পালন করেন। কিন্তু ইবলীস এ আদেশ পালনে বিরত থাকে। সে ফেরেশতাদের শ্রেণীভুক্ত ছিল না। বরং সে ছিল জ্বিনদের অন্তর্ভুক্ত। তার প্রকৃতিগত অশ্লীলতা এবং স্বভাবগত ঔদ্ধত্যপনা প্রকাশ পেয়ে গেল। মহান আল্লাহ্ তাকে প্রশ্ন করলেনঃ “হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হতে। তোমাকে কিসে বাধা দিলো? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন?” সে উত্তরে বললোঃ “আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কেননা, আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন হতে এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি হতে। সুতরাং মর্যাদার দিক দিয়ে আমি তার চেয়ে বহুগুণে উচ্চ।” ঐ পাপী শয়তান হযরত আদিম (আঃ)-কে বুঝতে ভুল করলো এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করার কারণে নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলো। আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বললেন:“তুমি এখান হতে বের হয়ে যাও, নিশ্চয়ই তুমি বিতাড়িত। তুমি আমার রহমত হতে দূর হয়ে গেলে। তোমার উপর আমার লা’নত কর্মফল দিবস পর্যন্ত স্থায়ী হবে।” সে বললোঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আপনি পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।” মহান ও সহনশীল আল্লাহ্, যিনি স্বীয় মাখলুককে তাদের পাপের কারণে তাড়াতাড়ি পাকড়াও করেন না, ইবলীসের এ প্রার্থনাও কবুল করলেন এবং তিনি তাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিলেন। অতঃপর সে বললোঃ “আপনার ক্ষমতার শপথ! আমি আদম (আঃ)-এর সমস্ত সন্তানকে পথভ্রষ্ট করবো, তবে তাদেরকে নয় যারা তাদের মধ্যে আপনার একনিষ্ঠ বান্দা।” যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে ইবলীসের উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাকে যে আপনি আমার উপর মর্যাদা দান করলেন, কেন? কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যদি আমাকে অবকাশ দেন তাহলে আমি অল্প কয়েকজন ব্যতীত তার বংশধরদেরকে কর্তৃত্ত্বাধীন করে ফেলবো।” (১৭:৬২) এই স্বতন্ত্ৰকৃতদের কথা আল্লাহ্ তা’আলা অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কর্মবিধায়ক হিসেবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট।” (১৭:৬৫)

(আরবী) এখানে (আরবী) শব্দকে মুজাহিদ (রঃ) পেশ দিয়ে পড়েছেন এবং ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন যে, এর অর্থ হলোঃ “আমি স্বয়ং সত্য এবং আমার কথাও সত্য হয়ে থাকে।” হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতেই আর একটি রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, এর অর্থ হলোঃ “সত্য আমার পক্ষ হতে হয় এবং আমি সত্যই বলে থাকি।” অন্যেরা (আরবী) শব্দ দুটোকেই যবর দিয়ে পড়ে থাকেন। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এটা হলো কসম, যার দ্বারা আল্লাহ কসম খেয়েছেন। আমি (ইবনে কাসীর রঃ) বলি যে, এ আয়াতটি আল্লাহ তা’আলার নিম্নের উক্তির মতঃ (আরবী) অর্থাৎ “কিন্তু আমার এ কথা অবশ্যই সত্যঃ আমি নিশ্চয়ই জ্বিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবো।” (৩২:১৩) আর এক জায়গায় মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ বললেনঃ যাও, তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, জাহান্নামই তোমাদের সকলের শাস্তি- পূর্ণ শাস্তি।” (১৭:৬৩)।

Leave a Reply