أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮২)
[*আমি সবার আগে মুসলমান হই,
আল্লাহর আনুগত্য শুধু মুখে উচ্চারণের বিষয় নয় :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার
পারা:২৩
১-২০ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১
تَنۡزِیۡلُ الۡکِتٰبِ مِنَ اللّٰہِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَکِیۡمِ ﴿۱﴾
এ কিতাব মহা পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ فَاعۡبُدِ اللّٰہَ مُخۡلِصًا لَّہُ الدِّیۡنَ ؕ﴿۲﴾
নিশ্চয় আমরা আপনার কাছে এ কিতাব সত্যসহ নাযিল করেছি। কাজেই আল্লাহর ‘ইবাদত করুন তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩
اَلَا لِلّٰہِ الدِّیۡنُ الۡخَالِصُ ؕ وَ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءَ ۘ مَا نَعۡبُدُہُمۡ اِلَّا لِیُقَرِّبُوۡنَاۤ اِلَی اللّٰہِ زُلۡفٰی ؕ اِنَّ اللّٰہَ یَحۡکُمُ بَیۡنَہُمۡ فِیۡ مَا ہُمۡ فِیۡہِ یَخۡتَلِفُوۡنَ ۬ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَا یَہۡدِیۡ مَنۡ ہُوَ کٰذِبٌ کَفَّارٌ ﴿۳﴾
জেনে রাখুন, অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহরই প্রাপ্য। আর যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের ইবাদত এ জন্যে করি যে, এরা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দেবে ।’ তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে নিশ্চয় আল্লাহ তাদের মধ্যে সে ব্যাপারে ফয়সালা করে দেবেন। যে মিথ্যাবাদী ও কাফির, নিশ্চয় আল্লাহ তাকে হিদায়াত দেন না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৪
لَوۡ اَرَادَ اللّٰہُ اَنۡ یَّتَّخِذَ وَلَدًا لَّاصۡطَفٰی مِمَّا یَخۡلُقُ مَا یَشَآءُ ۙ سُبۡحٰنَہٗ ؕ ہُوَ اللّٰہُ الۡوَاحِدُ الۡقَہَّارُ ﴿۴﴾
আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করতে ইচ্ছা করলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করতে পারতেন। পবিত্র ও মহান তিনি! তিনিই আল্লাহ, এক, পরাক্রমশালী।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৫
خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ ۚ یُکَوِّرُ الَّیۡلَ عَلَی النَّہَارِ وَ یُکَوِّرُ النَّہَارَ عَلَی الَّیۡلِ وَ سَخَّرَ الشَّمۡسَ وَ الۡقَمَرَ ؕ کُلٌّ یَّجۡرِیۡ لِاَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اَلَا ہُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡغَفَّارُ ﴿۵﴾
তিনি আসমান ও যমীনকে যুক্তিসঙ্গত ও বিজ্ঞোচিতভাবে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই দিনের প্রান্তসীমায় রাতকে এবং রাতের প্রান্তসীমায় দিনকে জড়িয়ে দেন। তিনি সুর্য ও চাঁদকে এমনভাবে অনুগত করেছেন যে, প্রত্যেকেই একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গতিশীল আছে। জেনে রাখো, তিনি মহা পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৬
خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ ثُمَّ جَعَلَ مِنۡہَا زَوۡجَہَا وَ اَنۡزَلَ لَکُمۡ مِّنَ الۡاَنۡعَامِ ثَمٰنِیَۃَ اَزۡوَاجٍ ؕ یَخۡلُقُکُمۡ فِیۡ بُطُوۡنِ اُمَّہٰتِکُمۡ خَلۡقًا مِّنۡۢ بَعۡدِ خَلۡقٍ فِیۡ ظُلُمٰتٍ ثَلٰثٍ ؕ ذٰلِکُمُ اللّٰہُ رَبُّکُمۡ لَہُ الۡمُلۡکُ ؕ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۚ فَاَنّٰی تُصۡرَفُوۡنَ ﴿۶﴾
তিনি তোমাদের একটি প্রাণী থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার জোড়াও সৃষ্টি করেছেন। আর তিনিই তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুর আট জোড়া নর ও মাদি সৃষ্টি করেছেন। তিনি তোমাদেরকে মায়ের গর্ভে তিন তিনটে অন্ধকার পর্দার অভ্যন্তরে একের পর এক আকৃতি দান করে থাকেন।এ আল্লাহই তোমাদের ‘রব’ তিনিই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, তা সত্ত্বেও তোমাদেরকে কোন্দিকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৭
اِنۡ تَکۡفُرُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ غَنِیٌّ عَنۡکُمۡ ۟ وَ لَا یَرۡضٰی لِعِبَادِہِ الۡکُفۡرَ ۚ وَ اِنۡ تَشۡکُرُوۡا یَرۡضَہُ لَکُمۡ ؕ وَ لَا تَزِرُ وَازِرَۃٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰی ؕ ثُمَّ اِلٰی رَبِّکُمۡ مَّرۡجِعُکُمۡ فَیُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ؕ اِنَّہٗ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۷﴾
যদি তোমরা কুফরী করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু তিনি তাঁর বান্দার জন্য কুফরী আচরণ পছন্দ করেন না। আর যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো তাহলে তিনি তোমাদের জন্য তা পছন্দ করেন। আর কেউ-ই অপর কারো গোনাহের বোঝা বহন করবে না। অবশেষে তোমাদের সবাইকে তোমাদের রবের কাছে ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি জানাবেন তোমরা কি করছিলে। তিনি মনের খবর পর্যন্ত জানেন।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৮
وَ اِذَا مَسَّ الۡاِنۡسَانَ ضُرٌّ دَعَا رَبَّہٗ مُنِیۡبًا اِلَیۡہِ ثُمَّ اِذَا خَوَّلَہٗ نِعۡمَۃً مِّنۡہُ نَسِیَ مَا کَانَ یَدۡعُوۡۤا اِلَیۡہِ مِنۡ قَبۡلُ وَ جَعَلَ لِلّٰہِ اَنۡدَادًا لِّیُضِلَّ عَنۡ سَبِیۡلِہٖ ؕ قُلۡ تَمَتَّعۡ بِکُفۡرِکَ قَلِیۡلًا ٭ۖ اِنَّکَ مِنۡ اَصۡحٰبِ النَّارِ ﴿۸﴾
মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে, তখন সে একনিষ্ঠভাবে তার প্রতিপালককে ডাকে; পরে যখন তিনি তার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তখন সে যার জন্য তাঁকে ডাকছিল তা ভুলে বসে এবং সে আল্লাহর পথ হতে অন্যকে বিভ্রান্ত করার জন্য আল্লাহর অংশী ঠিক করে নেয়। বল, ‘অবিশ্বাস অবস্থায় তুমি কিছুকাল জীবনোপভোগ করে নাও, বস্তুতঃ তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত।’
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৯
اَمَّنۡ ہُوَ قَانِتٌ اٰنَآءَ الَّیۡلِ سَاجِدًا وَّ قَآئِمًا یَّحۡذَرُ الۡاٰخِرَۃَ وَ یَرۡجُوۡا رَحۡمَۃَ رَبِّہٖ ؕ قُلۡ ہَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ ٪﴿۹﴾
যে অনুগত, রাতের বেলা দাঁড়ায় ও সিজদা করে, আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজের রবের রহমতের আশা করে? এদের জিজ্ঞেস করো যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি পরস্পর সমান হতে পারে? কেবল বিবেক-বুদ্ধির অধিকারীরাই উপদেশ গ্রহণ করে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১০
قُلۡ یٰعِبَادِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوۡا رَبَّکُمۡ ؕ لِلَّذِیۡنَ اَحۡسَنُوۡا فِیۡ ہٰذِہِ الدُّنۡیَا حَسَنَۃٌ ؕ وَ اَرۡضُ اللّٰہِ وَاسِعَۃٌ ؕ اِنَّمَا یُوَفَّی الصّٰبِرُوۡنَ اَجۡرَہُمۡ بِغَیۡرِ حِسَابٍ ﴿۱۰﴾
বলো, হে আমার সেসব বান্দা যারা ঈমান গ্রহণ করেছো তোমাদের রবকে ভয় করো। যারা এ পৃথিবীতে সদাচরণ গ্রহণ করেছে তাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ আর আল্লাহর পৃথিবী তো অনেক বড়। ধৈর্যশীলদেরকে তো অঢেল পুরস্কার দেয়া হবে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১১
قُلۡ اِنِّیۡۤ اُمِرۡتُ اَنۡ اَعۡبُدَ اللّٰہَ مُخۡلِصًا لَّہُ الدِّیۡنَ ﴿ۙ۱۱﴾
বলুন, ‘আমি তো আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদাত করতে;
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১২
وَ اُمِرۡتُ لِاَنۡ اَکُوۡنَ اَوَّلَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ﴿۱۲﴾
আমাকে এ আদেশও দেয়া হয়েছে যেন আমি সবার আগে মুসলমান হই।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১৩
قُلۡ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اِنۡ عَصَیۡتُ رَبِّیۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿۱۳﴾
বল, ‘যদি আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই, তাহলে আমি অবশ্যই ভয় করি মহাদিনের শাস্তির।’
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১৪
قُلِ اللّٰہَ اَعۡبُدُ مُخۡلِصًا لَّہٗ دِیۡنِیۡ ﴿ۙ۱۴﴾
বলে দাও, আমি আনুগত্যসহ একনিষ্ঠভাবে আল্লাহরই দাসত্ব করবো।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১৫
فَاعۡبُدُوۡا مَا شِئۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِہٖ ؕ قُلۡ اِنَّ الۡخٰسِرِیۡنَ الَّذِیۡنَ خَسِرُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ وَ اَہۡلِیۡہِمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ اَلَا ذٰلِکَ ہُوَ الۡخُسۡرَانُ الۡمُبِیۡنُ ﴿۱۵﴾
তোমরা তাঁর ছাড়া আর যাদের ইচ্ছা দাসত্ব করতে থাকো। বলো, প্রকৃত দেউলিয়া তারাই যারা কিয়ামতের দিন নিজেকে এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে ক্ষতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ভাল করে শুনে নাও, এটিই হচ্ছে স্পষ্ট দেউলিয়াপনা।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১৬
لَہُمۡ مِّنۡ فَوۡقِہِمۡ ظُلَلٌ مِّنَ النَّارِ وَ مِنۡ تَحۡتِہِمۡ ظُلَلٌ ؕ ذٰلِکَ یُخَوِّفُ اللّٰہُ بِہٖ عِبَادَہٗ ؕ یٰعِبَادِ فَاتَّقُوۡنِ ﴿۱۶﴾
তাদেরকে মাথার ওপর থেকে এবং নীচে থেকে আগুনের স্তর আচ্ছাদিত করে রাখবে। এ পরিণাম সম্পর্কেই আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ভীতি প্রদর্শন করেন, হে আমার বান্দারা, আমার গযব থেকে নিজেদের রক্ষা করো।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১৭
وَ الَّذِیۡنَ اجۡتَنَبُوا الطَّاغُوۡتَ اَنۡ یَّعۡبُدُوۡہَا وَ اَنَابُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ لَہُمُ الۡبُشۡرٰی ۚ فَبَشِّرۡ عِبَادِ ﴿ۙ۱۷﴾
কিন্তু যেসব লোক তাগুতের দাসত্ব বর্জন করেছে এবং আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছে তাদের জন্য সু-সংবাদ। সেসব বান্দাদের সুসংবাদ দিয়ে দাও।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১৮
الَّذِیۡنَ یَسۡتَمِعُوۡنَ الۡقَوۡلَ فَیَتَّبِعُوۡنَ اَحۡسَنَہٗ ؕ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ ہَدٰىہُمُ اللّٰہُ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمۡ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ ﴿۱۸﴾
যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে এবং তার ভাল দিকটি অনুসরণ করে। এরাই সেসব মানুষ যাদের আল্লাহ হিদায়াত দান করেছেন এবং এরাই বুদ্ধিমান।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-১৯
اَفَمَنۡ حَقَّ عَلَیۡہِ کَلِمَۃُ الۡعَذَابِ ؕ اَفَاَنۡتَ تُنۡقِذُ مَنۡ فِی النَّارِ ﴿ۚ۱۹﴾
যে ব্যক্তিকে আযাব দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে তাকে কে রক্ষা করতে পারে? যে আগুনের মধ্যে পড়ে আছে তাকে কি তুমি রক্ষা করতে পার?
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২০
لٰکِنِ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا رَبَّہُمۡ لَہُمۡ غُرَفٌ مِّنۡ فَوۡقِہَا غُرَفٌ مَّبۡنِیَّۃٌ ۙ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ ۬ؕ وَعۡدَ اللّٰہِ ؕ لَا یُخۡلِفُ اللّٰہُ الۡمِیۡعَادَ ﴿۲۰﴾
তবে যারা তাদের রবকে ভয় করে চলছে তাদের জন্য রয়েছে বহুতল সু উচ্চ বৃহৎ প্রাসাদ যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি। আল্লাহ কখনো তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটা বলতে গেলে পুরােপুরিই তাওহীদের আলােচনায় পরিপূর্ণ। সমগ্র সূরা জুড়েই বার বার এ বিষয়টি মানুষের মনে বদ্ধমূল করা হয়েছে। তাই বলা যায়, সূরার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটাই আলােচ্য বিষয়। যেটুকু বিভিন্নতা, তা কেবল বর্ণনাভংগিতে, বিষয়বস্তুতে নয়। সূরার শুরু থেকেই এই একই বিষয় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এটা মহাবিজ্ঞানী মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব। আমি তােমার কাছে ন্যায়সংগতভাবেই কেতাবখানা নাযিল করেছি। তাই একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদাত করাে।’ এ ধরনের বক্তব্য সূরার বিভিন্ন আয়াতে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে উচ্চারিত হয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে যেমন, ‘তুমি বলাে, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন আমি একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদাত করি…'(আয়াত ১১-১৫) অথবা, বলে, ‘ওহে অজ্ঞ লােকেরা, তোমরা কি আমাকে ছাড়া আর কারাে এবাদাত করার আদেশ দিচ্ছ?'(আয়াত ৬৪-৬৬) আর পরােক্ষভাবে যেমন আল্লাহ তায়ালা এক ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছেন….'(আয়াত ২৯) অথবা, ‘আল্লাহ তায়ালা কি তাঁর বান্দার জন্যে যথেষ্ট নন?…'(আয়াত ৩৬) তাওহীদের বিষয়টা ছাড়াও এ সূরায় আমরা মহান আল্লাহর এমন কিছু বাণীও পাই, যা মানুষের মনমগযে চেতনা ও জাগরণের সঞ্চার করতে চায়, তার উদ্দীপনা ও প্রেরণা বৃদ্ধি করতে চায় এবং ঐশী আদেশ গ্রহণের যােগ্যতা ও ক্ষমতা তীব্রতর করতে চায়। যেমন (আয়াত ১৭, ১৮, ২৩ ও ৮)। এ সূরার আরাে একটা লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলাে, এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আখেরাতের আলােচনায় পরিপূর্ণ। পাঠকের বেশীর ভাগ সময় আখেরাতের স্মরণেই কেটে যায়। এ বিষয়টা এ সূরায় বার বার আলােচিত হয়েছে। স্পষ্টভাবে হােক অথবা আভাসে ইংগিতে হােক, খুব ঘন ঘন কেয়ামতের দৃশ্যাবলী তুলে ধরা হয়েছে। কয়েক জায়গায় কেয়ামত ও আখেরাতের বিশদ বিবরণ এসেছে। তাছাড়া নিজের আয়াতগুলােতে সংক্ষিপ্ত বিবরণও লক্ষণীয় (আয়াত ৯, ১৩, ১৯, ২৩, ২৬, ৩২, ৪৭, ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৫৮)। অন্যান্য মক্কী সূরায় প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী তুলে ধরার মাধ্যমে আকীদা বিশ্বাস সংক্রান্ত বক্তব্য হৃদয়গ্রাহী করার প্রচেষ্টা নানা ভংগিতে ও বিপুল পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এ সূরায় তার উপস্থিতি খুবই কম। সূরার প্রথম দিকে একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে (আয়াত ৫০)। অন্যান্য আয়াতে আর একটা দৃশ্য তুলে ধরে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন ইংগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া এ সূরায় মানবজীবনের বিভিন্ন বাস্তব দিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের বক্তব্য রাখা হয়েছে। সূরার শুরুতে মানব সৃষ্টি সম্পর্কে ৬ নং আয়াতে বক্তব্য রাখা হয়েছে। ৮ নং আয়াতে সুখে দুঃখে মানুষের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয় তা বর্ণনা করা হয়েছে। ৪৯ নং আয়াতেও এ বর্ণনার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। ৪১ নং আয়াতে জানানাে হয়েছে যে, নিদ্রিত অথবা জাগ্রত উভয় অবস্থায় মানুষের প্রাণ আল্লাহর মুঠোর মধ্যে থাকে। আখেরাত সংক্রান্ত বক্তব্যও বিস্তৃত রয়েছে সমগ্র সূরা জুড়েই। এমনকি সূরার শেষ আয়তটাতেও কেয়ামতের দৃশ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে; ‘তুমি ফেরেশতাদের দেখবে আরশ বেষ্টন করে রেখেছে…’ সূরার সামগ্রিক পরিবেশ ও এর বিভিন্ন মর্মস্পর্শী আলােচনার সাথে এ দৃশ্যটার মিল রয়েছে। কেননা সূরার সামগ্রিক পরিবেশের আখেরাত সংক্রান্ত ভীতি ও আতংক ছড়িয়ে রয়েছে। সমগ্র সূরায় আমরা এমন সব দৃশ্যের সাক্ষাত পাই যা মানুষের মনকে ভীত সন্ত্রস্ত ও আতংকিত করে। যেমন এক আয়াতে এমন একজন এবাদাতকারীর দৃশ্য অংকন করা হয়েছে যে, আখেরাতের ভয়ে এবং আল্লাহর রহমতের আশায় দাড়িয়ে ও সিজদা করে রাত কাটিয়ে দেয়। আর এক আয়াতে আল্লাহর সেই সব বান্দার দৃশ্য অংকন করা হয়েছে যাদের চামড়া কোরআন শুনে শিউরে ওঠে, আবার তা নরম হয়ে যায় এবং তাদের মন আল্লাহর স্মরণে নিয়ােজিত হয়। কয়েকটা আয়াতে বিশেষভাবে আল্লাহর ভয় ও তার আযাবের ভয় দেখানাে হয়েছে, যেমন (আয়াত ১০, ১৩ ও ১৬)। কেয়ামত ও তার ভয় ভীতি এবং বিনয় ও আনুগত্যের দৃশ্যও দেখানাে হয়েছে বিভিন্ন আয়াতে। সূরাটা ছােট ছােট বিভিন্ন অংশে বিভক্ত এবং সবগুলাে অংশের প্রধান আলােচ্য বিষয় তাওহীদ ও আখেরাত। প্রায় প্রতিটা অংশই কেয়ামতের কোনাে না কোনাে দৃশ্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। শীঘ্রই এই অংশগুলাের বিশদ ব্যাখ্যা ধারাবাহিকভাবে দেয়ার চেষ্টা করবাে। কেননা এ সূরাকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করা কঠিন। এর আয়াতগুলাের প্রত্যেকটা ক্ষুদ্রাকার। সমষ্টির বক্তব্য যথাস্থানে আলােচনা করা যাবে। তবে সামগ্রিকভাবে সমগ্র সূরার আলােচ্য বিষয় হলাে তাওহীদ।
‘এ কিতাব নাযিল হয়েছে মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পক্ষ থেকে'(আয়াত ১-৩) এই চূড়ান্ত বক্তব্য দিয়ে সূরাটা শুরু হয়েছে। আল-আযীয- মহাপরাক্রমশালী’। অর্থাৎ এত ক্ষমতাধর যে, কিতাব নাযিল করার ক্ষমতা রাখেন। আল-হাকীম-প্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ তিনি এত গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী যে, কোন উদ্দেশ্যে ও কোন বক্তব্য দিয়ে এ কিতাব নাযিল করেছেন তা তিনিই জানেন। আর বিচক্ষণতার সাথে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা সহকারে ও সুকৌশলে এই কিতাব নাযিল করার কাজটা তিনিই সম্পন্ন করেন। আয়াতে এ বিষয়টা অর্থাৎ কোরআন নাযিল করার বিষয়ের আলােচনাকে আর দীর্ঘায়িত করা হয়নি। কেননা এটাকে সেই আসল বিষয়ের ভূমিকা হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যার আলােচনায় বলতে গেলে সমগ্র সূরাটাই নিবেদিত এবং যাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এই কিতাব নাযিল হয়েছে। সে বিষয়টা হলাে আল্লাহর একত্ব, আল্লাহর এবাদাতের একনিষ্ঠতা, তার ঐকান্তিক আনুগত্য, সর্বপ্রকারের শিরক থেকে তার পবিত্রতা ঘােষণা এবং যে কোনাে সুপারিশকারী বা মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই তার শরণাপন্ন হওয়া, তার কাছে ধর্না দেয়া ও তার প্রতি মনােনিবেশ করা। বলা হচ্ছে, ‘আমি তােমার কাছে সত্য সহকারে কিতাব নাযিল করেছি।’ আর যে সত্য সহকারে এ কিতাব নাযিল হয়েছে তার ভিত্তি হলাে সর্বাত্মক একত, যার ওপর গােটা সৃষ্টিজগত টিকে আছে। পঞ্চম আয়াতেও বলা হয়েছে, তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে সত্য সহকারে সৃষ্টি করেছেন। বস্তুত সেই একই সত্যের ভিত্তিতে আসমান যমীনের সৃষ্টি হয়েছে, এই কিতাবও নাযিল হয়েছে। সে-ই একক সত্য, যার পক্ষে আকাশ ও পৃথিবীর একীভূত ব্যবস্থাপনা সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং এই কিতাবও সাক্ষ্য দিচ্ছে। মহাবিশ্বে মহান স্রষ্টার হাত থেকে নির্গত প্রতিটা সৃষ্টিই একই সত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। ‘সুতরাং তুমি আল্লাহর এবাদাত করাে তার একনিষ্ঠ আনুগত্য সহকারে।’ এখানে সম্বােধনটা করা হয়েছে অর্থাৎ আল্লাহর একনিষ্ঠ এবাদাতের আদেশ দেয়া হয়েছে রসূল(স.)-কে, যার ওপর কিতাব নাযিল হয়েছে। তিনি যে বিধানের দিকে সমগ্র মানব জাতিকে আহ্বান জানান তা হলাে এক আল্লাহর এবাদাত, এক আল্লাহর আনুগত্য এবং গােটা জীবনকে আল্লাহর একত্ব ও একনিষ্ঠ আনুগত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা। আর আল্লাহর আনুগত্য ও ভর একনিষ্ঠ আনুগত্য কেবল মুখ দিয়ে উচ্চারণ করার মতাে কথাই নয়; বরং একটা পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, যার সূচনা হয় অন্তরে একটা বিশেষ আকীদা ও বিশ্বাস পােষেণের মধ্য দিয়ে, আর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সকল দিক এবং বিভাগে একটা সর্বাত্মক বিধানের আকারে কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে যার সমাপ্তি।
**আল্লাহর আনুগত্য শুধু মুখে উচ্চারণের বিষয় নয় যে ব্যক্তি অন্তরে আল্লাহর একত্বের বিশ্বাস পােষণ করে, সে সমগ্র জীবনে এক আল্লাহর প্রতিই আনুগত্য প্রকাশ করে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে সামনে মাথা নেয়ায় না, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে কাছে কিছু চায় না এবং তার সৃষ্টিজগতের কারাে ওপর নির্ভর করে না। কেননা তার কাছে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, একমাত্র তিনিই তার সকল বান্দার ওপর পরাক্রমশালী। বান্দারা সবাই দুর্বল ও অক্ষম। কেউ তার ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও নয়। সুতরাং তাদের কারাে কাছে তার মাথা নত করার প্রয়ােজন হয় না। তারা সবাই তারই মতাে। লাভ লােকসান করার ক্ষমতা রাখে না। একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সব কিছুর দাতা অথবা বঞ্চিতকারী। একমাত্র তিনিই ধনী আর সমগ্র সৃষ্টি দরিদ্র। কাজেই আল্লাহ ছাড়া আর কারাে কাছে তার ধর্না দেয়ার প্রয়ােজন নেই। যে ব্যক্তির মন এক আল্লাহ তায়ালাকে বিশ্বাস করে, সে সমগ্র সৃষ্টিজগত পরিচালনাকারী প্রাকৃতিক নিয়মের একত্বেও বিশ্বাস করে, আর এ কথাও বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির জন্যে যে জীবন ব্যবস্থা মনােনীত করেছেন, তা সেই প্রাকৃতিক বিধানেরই অংশবিশেষ এবং এই জীবন ব্যবস্থার অনুসরণ ছাড়া মানব জীবন এই বিশ্ব প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না যার ভেতরে সে বসবাস করে। এ বিশ্বাসের কারণেই সে আল্লাহর মনােনীত জীবন ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনাে জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না এবং গােটা প্রাকৃতিক ব্যবস্থার সাথে সমন্বিত ও সামঞ্জস্যশীল, আল্লাহর শরীয়ত ছাড়া আর কোনাে কিছুর আনুগত্য অনুসরণও করে না। যে ব্যক্তির হৃদয়ে আল্লাহর একত্বের ধারণা বদ্ধমূল হয়, সে আল্লাহর সৃষ্টি করা বিশ্বজগতের প্রতিটা বস্তু বা প্রাণীর সাথে নিজের নৈকট্য অনুভব করে। এমন একটা বন্ধুপ্রতিম বিশ্বে সে বাস করে যা তার প্রতি সহমর্মিতা পোষণ করে ও তার প্রতি সাড়া দেয়। সে তার চারপাশের সব কিছুতে আল্লাহর হাত রয়েছে বলে অনুভব করে। ফলে সে আল্লাহর সাথে এবং তার চোখে পড়া ও হাতে লাগা প্রত্যেকটা সৃষ্টির প্রতি সখ্য অনুভব করে এবং এই পরিবেশেই সে বেঁচে থাকে। অনুরূপভাবে সে এ ব্যাপারে সচেতন থাকে যে, সকল বস্তুর স্রষ্টা, সকল জীবের জীবনদাতা, সকল জীব ও বস্তুর প্রভু এবং তার প্রভু মহান আল্লাহর হুকুম ও অনুমতি ছাড়া কাউকে কষ্ট দেয়া, কোনাে বস্তু নষ্ট করা এবং কোনাে জিনিস বা প্রাণীকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা তার কর্তব্য। এই একত্ববাদ বা তাওহীদ বিশ্বাসের লক্ষণাদি চিন্তায় ও অনুভূতিতে এবং সকল কাজে ও আচরণে প্রকাশ পায় আর তা মানবজীবনের জন্যে একটা পূর্ণাংগ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা তৈরী করে দেয়। বস্তুত তাওহীদ কেবল মুখে উচ্চারিত একটা কথা কখনাে নয়। সে কারণেই তাওহীদী আকীদা বিশ্বাস যুক্তি প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তার পুন পুন আলােচনা কোরআনে এতাে বেশী দেখা যায়। কেননা এ বিষয়টা সর্বকালে ও সকল পরিবেশে এতাে গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রত্যেকেরই তা বুঝা দরকার। তাই তাওহীদ একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যাপক বিষয়। জেনে রেখাে, নির্ভেজাল আনুগত্য একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য।’ এটা একটা গম্ভীর ঘােষণা। এর বর্ণনাভংগি খুবই লক্ষণীয়। কথাটার শুরু হয়েছে সতর্কতার সংকেতবাহী অব্যয় ‘আলা’ দিয়ে, যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘জেনে রেখাে’, ‘মনে রেখাে’ বা সাবধান। আর ‘কাসর’-এর প্রক্রিয়ার কথাটা উচ্চারিত হওয়ায় এর অর্থ দাঁড়ায় একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। এভাবে শাব্দিক গঠনপ্রণালী দিয়েই বিষয়টির ওপর প্রচন্ড গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেননা এটা সেই স্তম্ভ, যার ওপর গােটা জীবনই শুধু নয়, বরং গোটা সৃষ্টি জগতেরই ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। এ জন্যেই এরূপ প্রবল ও জোরদার ভংগিতে কথা বলা হয়েছে যে, “মনে রেখাে’ একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য নির্ভেজাল আনুগত্য।’ এর পরে আলােচনা করা হয়েছে মােশরেকদের সেই জটিল ভুয়া ও খোঁড়া যুক্তিটা নিয়ে, যা দিয়ে তারা তাওহীদী আকীদা বিশ্বাসের মােকাবেলা করতে। ‘আর যারা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদের মনিব হিসাবে গ্রহণ করে, তারা যুক্তি দেয় যে, আমরা তাে এ সব দেব-দেবীর উপাসনা কেবল এ জন্যেই করি যেন তারা আমাদের আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পৌছে দেয়…'(আয়াত ৩) বস্তুত মােশরেকরা স্বীকার করতাে যে, আল্লাহ তায়ালাই তাদের ও আসমান যমীনের সৃষ্টিকর্তা, কিন্তু যিনি সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র তারই উপাসনা এবং একমাত্র তাঁরই নির্ভেজাল ও নিরংকুশ আনুগত্য করা উচিত- এই স্বভাবগত যুক্তি তারা গ্রহণ করেনি। তারা বরঞ্চ একটা উদ্ভট কাল্পনিক মতবাদ তৈরী করেছিলাে। সেটা ছিল এই যে, ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে। এই ধারণার ভিত্তিতে তারা ফেরেশতাদের কাল্পনিক প্রতিমূর্তি তৈরী করতাে এবং সেগুলাের পূজা করতো। সেই সাথে তারা দাবী করতাে যে, ফেরেশতাদের মূর্তির পূজা করাতে কোনাে দোষ নেই। কেননা এ পূজা নিছক ফেরেশতাদের সন্তুষ্ট করার জন্যে করা হয় না; বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে করা হয় পূজায় তুষ্ট হয়ে ফেরেশতারা তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে এবং তাদের আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী করবে, এই আশায় তারা এসব মূর্তির পূজা করতাে। এসব মূর্তির মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলাে লাত, মানাত ও ওজ্জা। অথচ এই বিশ্বাসটা সহজ সরল ও স্বভাবসুলভ চিন্তাধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে চরম বিকৃতি এবং ভ্রষ্টতার পথে পা বাড়ানাের শামিল। কেননা ফেরেশতারা যেমন আল্লাহর মেয়ে নয়, তেমনি মুর্তিগুলােও ফেরেশতাদের প্রতিমূর্তি নয়। আর মহান আল্লাহও এই বিচ্যুতি ও ভ্রষ্টতায় খুশী নন। তিনি তাদের ব্যাপারে কোনাে সুপারিশ গ্রহণ করতেও প্রস্তুত নন আর এ পন্থায় কাউকে তিনি নিকটবর্তীও হতে দেন না। যে সহজ সরল ও নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস নিয়ে ইসলাম এসেছে এবং যা প্রত্যেক রসূল প্রচার করেছেন, তা থেকে মানব জাতি যখনই বিচ্যুত হয়, তখনই প্রকৃতির স্বভাবগত যুক্তি থেকে সে বিচ্যুত হয়। আজকাল আমরা সর্বত্র ধর্মযাজক ও ওলী আওলিয়াদের উপাসনা দেখতে পাই। প্রাচীন আরবদের ফেরেশতা পূজা বা ফেরেশতাদের মূর্তিগুলাে পূজা করার সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। আল্লাহর নৈকট্যলাভ ও আল্লাহর কাছে তাদের সুপারিশ লাভের আশা উভয় ক্ষেত্রেই সমভাবে বিদ্যমান। অথচ সুপারিশ ও নৈকট্য লাভের পন্থা আল্লাহ তায়ালা নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সে পন্থাটা হলাে নির্ভেজাল তাওহীদ, এই আদিম পদ্ধতির সুপারিশ বা মধ্যস্থতার সাথে যার কোনাে সাদৃশ্য বা মিল নেই। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সেই ব্যক্তিকে সুপথ দেখান না যে মিথ্যুক, অতিশয় অবিশ্বাসী। মােশরেকরা মিথ্যুক। কারণ একে তাে তারা ফেরেশতাদের আল্লাহর মেয়ে বলে, যা নির্জলা মিথ্যা। উপরন্তু এই মূর্তিপূজাকে তারা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদের মুক্তির ব্যবস্থা বলে প্রচার করে থাকে। অথচ এটাও মিথ্যা প্রচারণা। মােশরেকরা অতিশয় অবিশ্বাসীও। কেননা তারা মূর্তিপূজার মাধ্যমে আল্লাহর নির্ভেজাল এবাদতে অবিশ্বাস প্রকাশ করছে এবং আল্লাহর সুস্পষ্ট ও অকাট্য আদেশের অবাধ্যতা প্রদর্শন করছে। আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরােপ ও তার প্রতি কুফরী যে ব্যক্তিই করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সুপথ দেখান না। কেননা সুপথপ্রাপ্তি হচ্ছে একটা পুরস্কার। আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ মনােনিবেশ। নির্ভেজাল আনুগত্য, তার মনােনীত পথপ্রাপ্তির আকাংখা এবং তার অনুসন্ধানের বিনিময়ে ও প্রতিদানে এ পুরস্কার দেয়া হয়। যারা মিথ্যাচার ও কুফরীতে লিপ্ত থাকে তারা আল্লাহর হেদায়াত ও অভিভাবকত্ব পাওয়ার যােগ্য নয়। কেননা তারা নিজেরাই সে পথ থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
*গােটা প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে তাওহীদের প্রমাণ : পরবর্তী আয়াতে মােশরেকদের সেই ধারণার নিকৃষ্টতা ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা যদি কোনাে সন্তান গ্রহণ করতে চাইতেন, তাহলে নিজের সৃষ্টির মধ্য থেকে যাকেই চাইতেন তাকেই গ্রহণ করতে পারতেন।'(আয়াত ৪) এটা চিন্তাধারা সংশােধনের উদ্দেশ্যে তর্কের খাতিরে সাময়িকভাবে ধরে নেয়া একটা বিষয়ে মতাে। বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা যদি কোনাে সন্তান গ্রহণ করতে চাইতেন, তাহলে তার সৃষ্টিজগতের মধ্য থেকে যে কোনাে একটা সৃষ্টিকে গ্রহণ করতে পারতেন। কেননা তার ইচ্ছার পথে কেউ বাধা দিতে পারে না। তার ইচ্ছা বাধাবন্ধনহীন ও চুড়ান্ত, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা নিজেকে সন্তান গ্রহণের অপবাদ থেকে মুক্ত ও পবিত্র রেখেছেন। এরপর তার সন্তান থাকার কথা বলা এবং অমুকে তার সন্তান ইত্যাদি বলার অধিকার কারাে নেই। এটা একমাত্র আল্লাহরই একচ্ছত্র অধিকার, একচ্ছত্র সিদ্ধান্ত ও একচ্ছত্র ইচ্ছা। আল্লাহ তায়ালা আয়াতের শেষাংশে সন্তান গ্রহণের এ অপবাদ খন্ডন কর বলেছেন ‘তিনি পবিত্র! তিনিই এক, অদ্বিতীয়, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ।’ সন্তান গ্রহণের প্রশ্ন ওঠে কোত্থেকে? তিনি তাে সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, সব কিছুর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক, সকল বস্তু ও সকল প্রাণী তারই মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি। ‘তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে ন্যায়সংগতভাবে সৃষ্টি করেছেন। রাত দিয়ে দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং দিন দিয়ে রাতকে আচ্ছাদিত করেন।'(আয়াত ৫) আকাশ ও পৃথিবীর সম্রাজ্য, দিন ও রাত, সূর্য ও চন্দ্রকে অনুগত ও বশীভূত করে রাখার প্রতি এই দৃষ্টি আকর্ষণী বক্তব্য মানবীয় বিবেকবুদ্ধিতে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এই সত্য বদ্ধমূল করছে যে, তাঁর কোনাে সন্তান বা অংশীদার থাকা তার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। কেননা যিনি এই বিশ্বজগত একাকীই সৃষ্টি করেছেন, তিনি কোনাে সন্তান বা অংশীদারের মুখাপেক্ষী থাকেন না। আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি কৌশল এবং বিশ্বজগতের পরিচালনাকারী প্রাকৃতিক বিধিমালায় মহান সৃষ্টিকর্তার একত্বের নিদর্শন সুস্পষ্ট, এমনকি আকাশ ও পৃথিবীর দিকে খালি চোখে তাকালেও মনে হয়, যে ইচ্ছাশক্তি ও সিদ্ধান্তকারী শক্তি এর সৃষ্টি এবং ব্যবস্থাপনার পেছনে সক্রিয়, তা এক ও অদ্বিতীয়। এ যাবত মানুষের যতাে আবিষ্কার উদ্ভাবনের তথ্য জানা গেছে, তাতেও পর্যাপ্ত একত্বের প্রমাণ মেলে। বিশ্বজগতের যতটুকু এ যাবত মানুষের কাছে পরিচিত হয়েছে, তা এমন সব অণু-পরমাণু দিয়ে গঠিত, যা এই স্বভাব প্রকৃতির অধিকারী, আর সেই অণু-পরমাণুও একই স্বভাব প্রকৃতির অধিকারী রশ্মিসমূহ দ্বারা গঠিত। এ কথাও সন্দেহাতীতভাবে জানা গেছে, আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি, সেখানে অথবা সমস্ত গ্রহ নক্ষত্রে যে সমস্ত অণু-পরমাণু রয়েছে এবং সেসব অণু-পরমাণু দ্বারা গঠিত যেসব বস্তু রয়েছে, তার সবই স্থায়ীভাবে আবর্তনশীল। এই আবর্তন একটা চিরস্থায়ী বিধান। ক্ষুদ্র অণু-পরমাণু থেকে শুরু করে বিশালাকার নক্ষত্র পর্যন্ত কোনাে কিছুই এই বিধানের বাইরে নয়। এটাও জানা গেছে যে, এই আবর্তনের আগে একটা চিরস্থায়ী বিধি ব্যবস্থা রয়েছে, যা বিশ্বজগতের সৃষ্টির একত্ব ও ব্যবস্থাপনার একত্বের অকাট্য সাক্ষ্য দেয়। উপরন্তু এই বিশ্বজগতের পরিকল্পনায়ও যে ঐক্য রয়েছে, মানব জাতি প্রতিনিয়ত তার প্রমাণাদি একের পর এক উদঘাটন করে চলেছে। এই পরিকল্পনায় এমন একটা চিরস্থায়ী ন্যায়নীতিরও উপস্থিতির সন্ধান পাওয়া গেছে, যা কারাে খেয়াল খুশী বা ঝোকের বশে পরিবর্তিত হয় না, তার রদবদল ঘটে না এবং তা কোনাে পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট হয় না। ‘তিনি ন্যায়সংগতভাবে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন।’ তিনি তাে কিতাবও সত্য দ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন। সুতরাং মহাবিশ্বে কার্যকর সত্য ও ন্যায়নীতি এবং এই কিতাবের মধ্যে কার্যকর সত্য ও ন্যায়নীতি একই জিনিস, তা একই উৎস থেকে নির্গত এবং মহাবিজ্ঞানী, মহা শক্তিশালী স্রষ্টার একত্বেরই নিদর্শন বহন করে। ‘রাত দিয়ে দিনকে এবং দিন দিয়ে রাতকে আচ্ছাদিত করেন। এটা একটা তাৎপর্যপূর্ণ বাচনভংগি, যা সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত পৃথিবীর গােলাকার হওয়ার তত্ত্বের প্রতি দৃষ্টি দিতে পাঠককে বাধ্য করে। এ কথা সত্য যে আমি সমগ্র যিলালিল কোরআনে এই মনােভাব পােষণ করে এসেছি যে, মানুষের রচিত বা আবিষ্কৃত মতবাদগুলাের ওপর ভিত্তি করে কোরআনের ব্যাখ্যা করবাে না। কেননা ওগুলাে কখনাে ভুল, কখনো সঠিক, কখনাে গ্রহণযােগ্য কখনাে বাতিল সাব্যস্ত হয়ে থাকে। অথচ কোরআন চিরসত্য। এর সত্যতার প্রমাণ সে নিজেই বহন করে। দুর্বল ও সীমিত ক্ষমতার অধিকারী মানুষের আবিষ্কার উদ্ভাবনের দেয়া সম্মতি বা অসম্মতি থেকে কোরআন নিজের বক্তব্যের সত্যাসত্য প্রমাণ করার অপেক্ষায় থাকে না। কিন্তু এই মনােভাব পােষণ করা সত্তেও এ আয়াতটার বর্ণনাভংগি আমাকে পৃথিবীর গােলাকার হওয়ার তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। ভূপৃষ্ঠে বাস্তবিকভাবে দৃষ্টিগােচর একটা সত্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। গােলাকার পৃথিবী সূর্যের সম্মুখে নিজেরই চারপাশে ঘােরে। এই ঘােরার সময়ে তার গােলাকার পৃষ্ঠের যে অংশটা সূর্যের সম্মুখে থাকে তা সূর্যালােকে উদ্ভাসিত হয় এবং সেই স্থানে দিন হয়। কিন্তু এই অংশটা স্থিতিশীল থাকে না। কেননা পৃথিবী আবর্তনশীল। যখনই তা আবর্তিত হয়, অমনি রাত এসে সেই অংশটাকে অন্ধকার দিয়ে ঢেকে দেয় যেখানে দিন ছিলাে। আর এই ভূ-পৃষ্ঠ গােলাকার বিধায় দিন তাকে ঢেকে দেয় এবং তার অব্যবহিত পরই আবার রাত এসে তাকে ঢেকে দেয়। আবার কিছু সময় অপরদিক থেকে দিন উদ্ভূত হয়ে রাতের ওপর চড়াও হয়। এভাবেই চলতে থাকে চিরন্তন আবর্তন। ‘রাত দিয়ে দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং দিন দিয়ে রাতকে আচ্ছাদিত করেন।’ আয়াতের ভাষা আকৃতি, অবস্থা এবং পৃথিবী ও তার আবর্তনের ধরন চিহ্নিত করছে। পৃথিবী গােলাকার ও তার ঘূর্ণায়মান হওয়ার মতবাদ দ্বারা রাতের এ অংশটার অধিকতর নির্ভুল তাফসীর পাওয়া যায়। আর তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে অনুগত করেছেন। উভয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলমান থাকে। সূর্য ও চন্দ্র নিজ নিজ কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। উভয়ে আল্লাহর হকুমে চলে। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ দাবী করে না এবং করতে পারে না যে, সে চন্দ্র ও সূর্যকে পরিচালনা করে। আবার স্বাভাবিক বিবেকবুদ্ধি এ কথাও মানতে রাযি নয় যে, উভয়ে কোনাে চালক ছাড়াই চলতে সক্ষম। কোটি কোটি বছর ধরে এমন সুশৃংখলভাবে চলতে থাকা যে, এক চুলও পরিবর্তন নেই, কোনাে পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক ছাড়া সম্ভব নয়। একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সূর্য ও চন্দ্র এভাবে চলতে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ জানে না সেই মেয়াদের পরিমাণ কী। মনে রেখাে, তিনিই মহাশক্তিধর, ক্ষমাশীল।’ অর্থাৎ সর্বময় ক্ষমতা, সীমাহীন শক্তি এবং পরাক্রম সত্তেও তিনি ক্ষমাপ্রার্থী ও পাপের পথ থেকে ফিরে আসা লােকদের জন্যে ক্ষমাশীল। চাই তারা অতীতে যতােই কুফরী, মিথ্যাচার ও শিরকে লিপ্ত থাক না কেন, তাদের সামনে সব সময় তাওবার দরজা খােলা আছে। মহাবিশ্বের অথৈ দিগন্তে দৃষ্টি আকর্ষণের পর বান্দাদের নিজ সত্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং মানুষ তিনি একই সত্ত্বা থেকে সৃষ্টি করেছেন…'(আয়াত ৬) আর যখন মানুষ তার নিজের সত্ত্বা সম্পর্কে চিন্তা করে, তখন দেখতে পায় যে, এই সত্ত্বাকে সে নিজে সৃষ্টি করেনি এবং এর সৃষ্টি সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাকে যা কিছু তথ্য জানিয়েছেন তা ছাড়া সে আর কিছুই জানে না। সে আরাে জানতে পারে যে, প্রত্যেক মানুষেরই সত্ত্বা একই প্রকৃতি এবং একই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যা তাকে অন্যান্য সৃষ্টি থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করে। এই বৈশিষ্ট্যগুলাের আওতায় এসে যায় পৃথিবীর সকল মানুষ। পৃথিবীর সকল অঞ্চল ও সকল প্রজন্মের কোটি কোটি মানুষের মনমানসিকতা ও স্বভাব বৈশিষ্ট্য একই রকমের। আর প্রত্যেকের জোড়াও তারই মতাে। এ সকল বৈশিষ্ট্যের খুঁটিনাটি ব্যাপারে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু সকল নারী ও পুরুষের মধ্যে সাধারণ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মােটামুটি মিল রয়েছে। এ দ্বারা প্রমাণিত হয়, মানুষ সৃষ্টির মূল নকশা ও পরিকল্পনায় নারী পুরুষে কোনাে ভেদাভেদ ছিলাে না। মানব সত্ত্বার জোড়ার এই বৈশিষ্ট্যের উল্লেখের সাথে সাথে বলা হচ্ছে, পশুদের বেলায়ও এই বৈশিষ্ট্য বহাল রয়েছে। এ থেকে বুঝা যায়, সকল প্রাণীর সৃষ্টির মূলে একই মূলনীতি কার্যকর ছিলাে। ‘আর তােমাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা পশুদের মধ্য থেকে আট জোড়া সৃষ্টি করেছেন।’ অন্য আয়াতে এই আট জোড়ার বিবরণ এসেছে এভাবে, মেষ (নারী ও পুরুষ), ছাগল (নারী ও পুরুষ) গরু (নারী ও পুরুষ) এবং উট (নারী ও পুরুষ)। নারী ও পুরুষকে একত্রে উল্লেখ করে জোড়া বলা হয়ে থাকে। এভাবে তার সামগ্রিকভাবে আট জোড়া হলো। ‘তােমাদের জন্যে নাযিল করেছেন’ কথা দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের মানব জাতির অনুগত করে দিয়েছেন। এই অনুগত করাটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা। তার পক্ষ থেকে এটা অনুমােদিত। মানুষ ও পশুর ভেতরে নর নারীর জোড়া সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া সমভাবে প্রচলিত- এ কথা উল্লেখ করার পর মাতৃগর্ভে এদের জন্মের কি কি স্তর পার হতে হয় তা বর্ণনা করা হচ্ছে, ‘তোমাদেরকে তােমাদের মায়ের পেটে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেন। যেমন বীর্য ফোঁটা থেকে জমাট রক্তে, জমাট রক্ত থেকে গােশতের টুকরােয় রূপান্তর, অতপর এই স্তর থেকে মানুষের উপাদান ও আকৃতি স্পষ্ট বুঝা যায়, এমন স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনটি অন্ধকারের মধ্য দিয়ে। প্রথম অন্ধকারটা হলাে থলির অন্ধকার, দ্বিতীয়টা এই থলি যে জরায়ুতে থাকে তার অন্ধকার এবং তৃতীয় যে পেটে এই জরায়ু থাকে সেই পেটের অন্ধকার। এই তিন রকমের অন্ধকারের ভেতরে আল্লাহ তায়ালা এই ক্ষুদ্র ভ্রুণটাকে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেন। এই ক্ষুদ্র সৃষ্টিকে তিনি তত্ত্বাবধান করেন, বেড়ে ওঠার শক্তি দেন, ক্রমবিকাশ ও ক্রমােন্নতির ক্ষমতা দেন এবং তার স্রষ্টা তার জন্যে যেভাবে পূর্ণাংগ মানুষের রূপ ধারণ করার পরিকল্পনা করেছেন সেভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দেন। এবার মানব দ্রুণের এই স্বল্পমেয়াদী অথচ সুদূরপ্রসারী সফরের দিকে লক্ষ্য করুন, এই বিকাশ, বৃদ্ধি ও অগ্রগতির কথা ভাবুন এবং সেই বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্যগুলাে নিয়ে চিন্তাভাবনা করুন, যা এই দুর্বল কোষটাকে তার বিস্ময়কর অভিযাত্রার দিকে টেনে নিয়ে যায়। ভেবে দেখুন, যে মানুষের জ্ঞান, দৃষ্টি ও ক্ষমতার আওতার বাইরে গভীর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এ বিস্ময়কর বিকাশ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া কিভাবে চলে। এই প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবলেই মানুষের মন মহান স্রষ্টার হাত সক্রিয় দেখতে পায়। দেখতে পায় সেই জীবন্ত, স্পষ্ট ও মূর্তিমান হাতের নিদর্শনের মাধ্যমে, দেখতে পায় সৃষ্টি প্রক্রিয়ার একত্বের প্রকাশ্য লক্ষণগুলােতে বিশ্বাস স্থাপনের মাধ্যমে। এজন্যেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে যে, এমন দেদীপ্যমান সত্যের দর্শন থেকে মানুষের মনকে কিভাবে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুত করা সম্ভব? এই হচ্ছেন তােমাদের প্রভু আল্লাহ তায়ালা। সমগ্র রাজত্ব তারই। তিনি ছাড়া কোনাে মাবুদ নেই। অতএব তােমরা পথচ্যুত হয়ে কোথায় যাচ্ছ? মহান আল্লাহর একত্ব ও সর্বময় ক্ষমতার নিদর্শনের এই সুস্পষ্ট দর্শনের পর পরবর্তী আয়াতে মানুষকে তার নিজ সত্তা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে বলা হচ্ছে, তাকে কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতার মধ্য থেকে যে কোনাে একটা পথ বেছে নিতে বলা হচ্ছে, আর এই পথ বেছে নেয়ার দায়দায়িত্ব তাকেই নিতে বলা হচ্ছে। অতপর এই যাত্রার শেষ গন্তব্যস্থল এবং সেখানে তার জন্যে যে হিসাবনিকাশ অপেক্ষা করছে, তা দেখানাে হচ্ছে। যিনি তাকে তিন রকমের অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি করেন এবং তারা যা কিছু হৃদয়ের অভ্যন্তরে গােপন করে রাখে তা যিনি জানেন, তিনিই তার এই হিসাব নিকাশ গ্রহণ করবেন। যদি তােমরা অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন কর, তা হলে (আল্লাহর কিছুই আসে যায় না।) তিনি তােমাদের মুখাপেক্ষী নন…'(আয়াত ৭) মাতৃগর্ভে বিকাশ বৃদ্ধির এই সফরটা দীর্ঘ যাত্রাপথের একটা ধারা মাত্র। এর পরই আসছে মাতৃগর্ভের বাইরের জীবনের স্তর। তারপর আসবে হিসাব ও কর্মফল পাওয়ার স্তর। মহাজ্ঞানী মহান স্রষ্টার ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনাক্রমেই একে একে এ স্তরগুলাে আসে ও যায়। মহান আল্লাহ দুর্বল ও দরিদ্র মানুষের কাছে কোনাে ব্যাপারেই মুখাপেক্ষী নন। মানুষের দুর্বলতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কেবল নিজ দয়াগুণেই মানুষের তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন। ‘তােমরা যদি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করাে, তা হলে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের মুখাপেক্ষী নন।’ বস্তুত আল্লাহর প্রতি তােমাদের ঈমান আনয়নের ফলে আল্লাহর সম্পত্তিতে কিছুই বৃদ্ধি ঘটে । আর তােমাদের কুফরী এবং অকৃতজ্ঞতায়ও তার কণা পরিমাণ ক্ষতি বা লােকসান হয় না। ‘তবে তিনি কাফেরদের কুফরীতে সন্তুষ্ট হন না এবং তা পছন্দও করেন না। তিনি তার বান্দাদের কুফরীতে সন্তুষ্ট হন না।’ আর যদি তােমরা শােকর করাে তবে তিনি তােমাদের ওপর খুশী হবেন। অর্থাৎ এটা তিনি তােমাদের জন্যে পছন্দ করবেন এবং এ জন্যে তােমাদের ভালােও বাসবেন। এরপর বলা হচ্ছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের কর্মের জন্যেই দায়ী, একমাত্র নিজের কাজের জন্যেই তাকে হিসাব দিতে হবে, কেউ অন্যের দায়িত্ব বহন করবে না। কেননা প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে। ‘কোনাে গুনাহগার অন্যের গুনাহর দায়িত্ব বহন করে না। আর সর্বশেষ গন্তব্য একমাত্র আল্লাহই, আর কেউ নয়। ‘তার কাছ থেকে কারাে পালানাের জায়গা নেই এবং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ কাউকে আশ্রয় দিতে পারে না।’ ‘অতপর তার কাছেই তেমাদের ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি তােমাদের জানিয়ে দেবেন। তােমরা কি কাজ করছিলে।’ এ ব্যাপারে তার অজানা কিছু নেই। কেননা ‘তিনি হৃদয়ের মধ্যে গােপন করা সব কিছু জানেন। এ হচ্ছে পরিণতি। আর এই সাথে হেদায়াতের প্রমাণাদিও বর্ণনা করা হলাে। এ হচ্ছে বিভিন্ন পথের মিলনস্থল। তাই এখানে বসে প্রত্যেককে নিজ নিজ পথ বেছে নিতে হবে যুক্তি প্রমাণের আলােকে, বিচক্ষণতা সহকারে এবং জ্ঞান ও চিন্তাভাবনার সাহায্যে।
# প্রথম পর্বে মানুষকে তার জন্মের কাহিনী শুনিয়ে, একই ব্যক্তি থেকে সমগ্র মানব জাতির সৃষ্টির তথ্য জানিয়ে, তার স্বজাতীয় অপর জনের সাথে তার জোড়া বানানাে, পশুদের একইভাবে জোড়া বানানাে এবং তিনটি অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির কিসসা শুনিয়ে তার হৃদয় স্পর্শ করা হয়েছে। শুরুতে আল্লাহ তায়ালা কিভাবে তাকে মানবীয় স্বভাব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরী করেছেন এবং তারপর কিভাবে তাকে বেঁচে থাকা ও উন্নতি লাভ করার যােগ্যতা দান করেছেন, তা জানিয়েছেন। বিপদ মসিবতের সময় মানুষের আসল প্রকৃতি ধরা পড়ে এখানে দেখানাে হয়েছে, সুখের সময় মানুষের কী অবস্থা হয় এবং দুঃখের সময় কী অবস্থা হয়। মানুষের ভেতরে কত দ্রুত পরিবর্তন আসে, কত দুর্বলতার শিকার হয়, কত বড় বড় বুলি আওড়ায় এবং আদর্শের ওপর সে কেমন অস্থিতিশীল, তা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে এটাও দেখানাে হয়েছে যে, মানুষ যখন আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ও তার অনুগত হয়, তখন সে সঠিক পথ চিনতে পারে, প্রকৃত সত্য সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হয় এবং আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যে গুণ বৈশিষ্ট্য দান করেছেন তা দ্বারা উপকৃত হয়। ‘আর যখন মানুষের ওপর কোনাে দুঃখ মসিবত আসে তখন সে তার প্রতিপালককে পরম বিনয় সহকারে ডাকে।’ (আয়াত ৮) বস্তুত মানুষ যখন দুঃখ কষ্টে পতিত হয়, তখন তার স্বভাব প্রকৃতি নগ্নভাবে ধরা পড়ে, তার ওপর থেকে সমস্ত মরিচা দূর হয়ে যায়, সকল পর্দা সরে যায় এবং সমস্ত কু-সংস্কার ও কু-ধারণা সে ঝেড়ে ফেলে দেয়। ফলে সে তার প্রতিপালকের দিকে মনােনিবেশ করে এবং একমাত্র তার কাছেই বিনীত হয়। কেননা সে বুঝতে পারে যে, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে না। সে এও বুঝতে পারে যে, সে যেসব শরীক বা সুপারিশকারীর প্রতি বিশ্বাস রাখে, তা সবই মিথ্যা। কিন্তু যখনই বিপদ মসিবত দূর হয়ে যায়, যখনই আল্লাহ তায়ালা তাকে নেয়ামত ও অনুগ্রহ দান করেন এবং তার দুর্যোগ হটিয়ে দেন, তখনই তার ওপর আবার মরিচা পড়ে, আল্লাহর একত্বের কথা সে ভুলে যায়, বিপদের সময় সে যে একমাত্র তার কাছেই ধর্না দিয়েছিলাে ও তারই সাহায্য চেয়েছিলাে তাও ভুলে যায়। সে সময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ যে তাকে সাহায্য করতে ও বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারতাে না, তা আর তার মনে থাকে না। ফলে সে আল্লাহর সাথে অন্য শরীক গণ্য করে। হয় সে জাহেলী যুগের মত অন্যদের সরাসরি মাবুদ হিসাবে গ্রহণ করে নতুবা কোনাে বিশেষ চিন্তাধারাকে, মূল্যবোধকে, ব্যক্তিকে বা ব্যবস্থাকে আল্লাহর শরীক বানায়, যেমন বহু জাহেলী সমাজে করা হয়। শেষোক্ত ক্ষেত্রে মানুষ নিজের প্রকৃতির লালসাকে, কামনা ও বাসনাকে, বাঞ্ছিত বস্তুকে, ভীতিজনক ব্যক্তি বা বস্তুকে, সম্পদ সম্পত্তিকে, সন্তান সন্তুতিকে, মুরব্বীদের বা শাসকদের আল্লাহর মতােই বা তার চেয়েও একনিষ্ঠভাবে পূজা করে, সেগুলােকে আল্লাহর মতােই বা তার চেয়েও বেশী ভালােবাসে। শিরক বহু রকমের হয়ে থাকে। কোনােটা এতাে সুক্ষ্ম যে, মানুষ তাকে শিরকই মনে করে না। কেননা তা প্রচলিত শিরকের আকৃতি ধারণ করে না, কেবল প্রকৃতিগতভাবে তা শিরকের আওতাভুক্ত। কিন্তু এর পরিণতি হয়ে থাকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্টতা। কেননা আল্লাহর পথ একটা একাধিক নয়। একমাত্র এককভাবে তাকে ভালােবাসলে, তার কাছে একনিষ্ঠভাবে ধর্না দিলে এবং একমাত্র তাঁর এবাদাত করলেই তাকে পাওয়া যায়। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলে অন্তরে আর কাউকে তার সাথে অংশীদার করার অবকাশ থাকে না। ধন সম্পদ, সন্তান সন্তুতি, দেশ, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়কে তার সমপর্যায়ে রাখা চলে না। এর কোনাে একটাকেও আল্লাহর সমপর্যায়ে রাখলে তা শিরকে পরিণত হবে এবং গোমরাহী বলে গণ্য হবে। ‘বলো, তুমি কিছুকাল তােমার কুফরীর সুফল ভােগ করে নাও। তুমি তাে অবশ্যই দোযখবাসী।’ পৃথিবীর ভােগ বিলাস যতাে বেশী ও দীর্ঘস্থায়ী হােক না কেন, তা নিতান্তই তুচ্ছ। তার আয়ুষ্কাল যতােই বেশী হােক না কেন, তা সামান্য। বরঞ্চ আখিরাতের তুলনায় সমগ্র মানব জাতির পার্থিব জীবন খুবই ক্ষুদ্র ও ক্ষণস্থায়ী। মানুষের এই দুর্ভাগ্যজনক চিত্রের পাশাপাশি অন্য একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে। এটা হচ্ছে আল্লাহভীরু, আল্লাহকে নিরন্তর স্মরণকারী, সুখে দুঃখে কোনাে অবস্থায় আল্লাহকে ভােলে না, পৃথিবীতে জীবন যাপনকালে আখেরাত সম্পর্কে সচকিত থাকে, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের প্রত্যাশায় থাকে এবং আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার কারণে জগত ও জীবন সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী হয় এমন মােমেনের চিত্র। আর যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সাজদারত অবস্থায় অথবা দাড়িয়ে এবাদাত করে, আখেরাতকে ভয় করে…!'(আয়াত-৯) সিজদারত ও দাঁড়ানাে অবস্থায় থাকা এ একটা উজ্জ্বল মনােরম চিত্র। এবাদাত, আনুগত্যে মনােনিবেশ করা এবং এতে সংবেদনশীল থাকা যে, সর্বক্ষণ আখেরাতের ভয়ে ভীত ও আল্লাহর রহমতের আশায় আশান্বিত- এটা এমন একটা স্বচ্ছ ও সুন্দর অবস্থা যা মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয় এবং হৃদয়কে দর্শন ও গ্রহণের ক্ষমতা দান করে। এসব কিছু মানুষের একটা উজ্জ্বল ও চমকপ্রদ চিত্র তুলে ধরে, যা পূর্ববর্তী আয়াতে অংকিত দুর্ভাগ্যজনক চিত্রের ঠিক বিপরীত। তাই আয়াতের শেষভাগে যে তুলনাটা করা হয়েছে তা অত্যন্ত প্রাসংগিক; ‘বলাে, যাদের জ্ঞান আছে আর যাদের জ্ঞান নেই, তারা কি সমান?’ বস্তুত সত্যের জ্ঞান ও উপলব্ধিই হলাে প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞান অন্তর্চক্ষুকে খুলে দেয়। এই জ্ঞান দ্বারাই বিশ্বজগতের চিরন্তন সত্যের সাথে মানুষের সংযােগ স্থাপিত হয়। বিচ্ছিন্ন যেসব তথ্য মনমগযে ভিড় জমায়, অথচ জগত ও জীবনের বৃহত্তম সত্য সম্পর্কে অবহিত করে না এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যমান জগতের বাইরে প্রসারিত হয় না, তা জ্ঞান বা এলেম নয়। এটাই হলাে প্রকৃত জ্ঞান ও আলােকময় তত্ত্বজ্ঞান লাভের পথ। আল্লাহর এবাদাত, হৃদয়ের সংবেদনশীলতা, আখেরাত সম্পর্কে সতর্কতা, আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহের আশা এবং আল্লাহর ভয়ে সর্বক্ষণ ভীতসন্ত্রস্ত থাকা- এই হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানলাভের পথ। যারা এই পথ অবলম্বন করে তারাই জ্ঞানবান হয়, যা দেখে শােনে ও যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা দ্বারা উপকৃত হয় এবং ছােট ছােট অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে চিরন্তন সত্যের কাছে পৌছে যায়। পক্ষান্তরে যারা বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা ও বাহ্যিক পর্যবেক্ষণের সীমানায় গিয়েই থেমে যায়, তারা তথ্য সংগ্রহকারী বটে কিন্তু জ্ঞানী নয়। ‘জ্ঞানবান লােকেরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।’ অ্থাৎ যারা এতাে খােলা মনের অধিকারী যে, দৃশ্যমান জগতের বাইরের তথ্যও তারা অর্জন করে এবং যা দেখে ও যা জানে, যা কিছু দেখে ও স্পর্শ করে তা দ্বারা উপকৃত হয়, তাতে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং কোনাে অবস্থায়ই আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের দিনকে ভােলে না। এই দুটো চিত্র তুলে ধরার পর মােমেনদের তাকওয়া ও এহসান অর্জনের আহবান জানানাে হচ্ছে এবং দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে আখেরাতের জীবনের জন্যে দীর্ঘস্থায়ী পুণ্য অর্জন করতে উপদেশ দেয়া হয়েছে। (আয়াত ১০) বলে, ‘হে আমার মােমেন বান্দারা, তােমরা তােমাদের প্রভুকে ভয় করো…’ অর্থাৎ আমার মােমেন বান্দাদের উদ্দেশ্যে বলল, তােমরা তােমাদের প্রভুকে ভয় করো। তবে কথাটা আহবান জানানাের রীতিতে বলা হয়েছে। কেননা আহবান জানানােতে ঘােষণা এবং সর্তকবাণীও থাকে আসলে রসূল(স.) মানুষদের কখনাে ‘হে আমার বান্দারা বলে আহবান জানাবেন না। কেননা মানুষ আল্লাহর বান্দা। কাজেই এ আহবানটা মােহাম্মদ(স.)-কে জানাতে বলা হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহরই আহবান। রসূল(স.) শুধু আহবান পৌছে দেয়ার জন্যে আদিষ্ট। তাকওয়া হচ্ছে হৃদয়ের তীব্র অনুভূতি ও স্পর্শকাতরতা, আল্লাহর ক্রোধের ভয় ও তাঁর অনুগ্রহের আশা। এ হচ্ছে সেই উজ্জবল ছবি, যা পূর্ববতী আয়াতে অংকিত হয়েছে। এ হচ্ছে আল্লাহর অনুগত বান্দাদের ছবি। যারা পৃথিবীতে এহসান (সৎকাজ) করবে, তাদের জন্যে রয়েছে উত্তম প্রতিদান। কী চমৎকার প্রতিদান। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের একটা ভালাে কাজের প্রতিদান দেয়া হবে চিরস্থায়ী আখেরাতের জীবনে। এটা কেবল মানুষের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহেরই ফল। তিনি তার দুর্বলতা, অক্ষমতা ও তার চেষ্টার দীনতা হীনতার কথা জানেন, তাই তাকে রেয়াত দেন ও তার প্রতি মহানুভবতা দেখান। আর আল্লাহর পৃথিবী সুপ্রশস্ত। কাজেই নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডের ভালােবাসা ও প্রেম যেন তােমাদের আটকে না রাখে, আত্মীয়স্বজন যদি তােমাদের দ্বীন অনুসারে জীবন যাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সেখানে বসে সকাজ করা অসম্ভব হয়। বস্তুত এ রকম পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট ভূ-খন্ড আঁকড়ে পড়ে থাকা শয়তান অনুপ্রবেশের পথ করে দেয়ার শামিল হবে এবং মানব হৃদয়ে আল্লাহর অংশীদার গ্রহণেরই পর্যায়ভুক্ত হবে। এটা মানব মনের গােপন শিরকের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের একটা নিপুণ কোরআনী কৌশল। আল্লাহর একত্ব ও তাকওয়া সংক্রান্ত আলােচনার একটা অনুষংগ হিসেবে এটা এসেছে। এ দ্বারা এই কোরআনের উৎস সম্পর্কেও আভাস দেয়া হয়েছে। কেননা মানুষের অন্তরের ব্যাধির এমন সুন্দর চিকিৎসা তার সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ করতে পারে না, যিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মদর্শী ও অন্তর্যামী। তিনি মানুষের স্রষ্টা বিধায় জানেন, জন্মস্থান থেকে হিজরত করা তার পক্ষে খুবই কঠিন কাজ। জন্মস্থানের সাথে নানাভাবে জড়িয়ে থাকা সম্পর্ক ও বন্ধনগুলাে ছিন্ন করা এবং নতুন জায়গায় জীবন যাপন জীবিকা খুঁজে পাওয়া ও জীবনের আদত অভ্যাসগুলাে ত্যাগ করা মানুষের। পক্ষে খুবই কষ্টকর। এজন্যে এখানে হিজরতকারীদের ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহর কাছে এর জন্যে অফুরন্ত সওয়াবের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। ‘ধৈর্যশীলদের তাদের প্রতিদান পুরােপুরিভাবে দেয়া হবে।’ এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাদের হৃদয়কে উপযুক্ত আশ্বাস ও সান্ত্বনা দান করেছেন, তাদের দুর্বল হৃদয়ের যথােচিত চিকিৎসা করেছেন, কঠিন দুঃখ-কষ্ট ভােগ করার পর তাদের দয়া ও অনুগ্রহের আশ্বাস দিয়ে প্রবােধ দিয়েছেন এবং মাতৃভূমিতে ছেড়ে আসা জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ী ও আত্মীয়স্বজনের উপযুক্ত প্রতিদান নিজের কাছ থেকে বিনা হিসাবে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মানব হৃদয়ের অভ্যন্তরের এতাে সূক্ষ্ম ও গােপন অবস্থা সম্পর্কে অবহিত মহান রব্দুল আলামীনের পবিত্রতা ঘােষণা করছি।
# এ অংশটাতে সম্পূর্ণরূপে আখেরাতের বিবরণ, আখেরাতের আযাবের ভীতি ও সেখানকার পুরস্কারের আশার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এর শুরু হয়েছে রসূল(স.)-কে নির্ভেজাল তাওহীদের বাণী প্রচারের আদেশদান এবং নবী হয়েও তিনি যদি তাওহীদ থেকে বিচ্যুত হন তবে তার ভয়ংকর পরিণতি হবে বলে ঘােষণা করার নিদের্শ দানের মাধ্যমে। সেই সাথে তাকে তার আদর্শ ও নীতির ওপর অবিচল থাকার ঘােষণা দিতে, মােশরেকদের তাদের আদর্শ ও মতবাদের ওপর ছেড়ে দিতে এবং কেয়ামতের দিন এই উভয় গােষ্ঠীর পরিণাম জানিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তুমি বলাে, আমি আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্য সহকারে তার এবাদাত করতে আদিষ্ট হয়েছি এবং সবার আগে আত্মসমর্পণকারী হতে আদিষ্ট হয়েছি। তুমি বলাে, আমি আমার প্রভুর অবাধ্যতা করলে ভয়াবহ দিনের আযাবের আশংকা করি।’ রাসূল(সা.) যে আল্লাহর পক্ষ থেকে একমাত্র আল্লাহর এবাদাত করতে, তার একনিষ্ঠ আনুগত্য করতে ও এভাবে প্রথম আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) হতে আদিষ্ট, আর তিনি আল্লাহর অবাধ্য হলে তার যে ভয়ংকর আযাবের আশংকা রয়েছে এ ঘােষণা ইসলামের তাওহীদ আকীদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে বিরাট অবদান রাখে। এখানে রসূল(স.) নিছক আল্লাহর দাস ছাড়া আর কিছু নন। এবাদাত বা দাসত্বের জায়গায় দাসরা সব এক কাতারে দাঁড়ায়। আর মহান আল্লাহর সত্তা সকল দাসের ওপর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। এটাই এখানে বুঝানাে হয়েছে। এই পর্যায়ে উলুহিয়াত তথা প্রভুত্ব এবং উবুদিয়াত তথা দাসত্বের অর্থটা এতাে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, উভয়ের ভেতরে আর কানাে অস্বচ্ছতা ও দুর্বোধ্যতা নেই। আল্লাহ তায়ালা যে এক এবং তাঁর কোনাে শরীক বা সমকক্ষ নেই, সে বিষয়টা দ্ব্যর্থহীনভাবে ফুটে ওঠেছে আর স্বয়ং মুহাম্মদ(সা.) যখন আল্লাহর একনিষ্ঠ দাসত্বের স্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে এই ঘােষণা দেন এবং অবাধ্যতা করলে এমন আযাবের ভয় পান, তখন মােশরেকরা তাদের এবাদাতে আল্লাহর সাথে ফেরেশতাদের বা মূর্তিগুলােকে অংশীদার বানিয়ে তাদের সুপারিশে আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার আশা করবে, এর কোনাে অবকাশই নেই। *তাওহীদ আলােচনার পুনরাবৃত্তি : পরবর্তী আয়াত কয়টিতে পুনরায় এই তাওহীদের ঘােষণা দেয়া হয়েছে। আর মােশরেকদের তাদের বাতিল মতাদর্শ নিয়ে থাকতে ও যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি ভােগ করতে দিতে আদেশ দেয়া হয়েছে। ‘তুমি বলাে, আমি শুধু আল্লাহরই দাসত্ব করবো তার প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য সহকারে। আর তােমরা আল্লাহ ছাড়া যার ইচ্ছা দাসত্ব করে। ‘বলো, যারা কেয়ামতের দিন নিজেদের ও নিজেদের পরিজনদের ক্ষতি সাধন করে, মনে রেখাে, তাদের সেই ক্ষতিই সুস্পষ্ট ক্ষতি।’ অর্থাৎ এখানে এই ঘােষণার পুনরাবৃত্তি করানাে হলাে যে, আমি আমার পথে চলবােই । একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব ও এবাদাত করবে এবং তার একনিষ্ঠ আনুগত্য করবাে। আর তােমরা? তােমরা যে পথে ইচ্ছা চলাে। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর যার যার দাসত্ব করতে চাও করো। তবে জেনে রেখাে, এতে এমন ক্ষতি হবে যার চেয়ে বড় ক্ষতি আর হতে পারে না। প্রথমত নিজের ক্ষতি জাহান্নামে যাওয়া। দ্বিতীয়ত আপনজনদের হারানাে। তারা মোমেন কিংবা কাফের যাই হােক না কেন। তারা যদি মােমেন হয় তবে মােশরেকরা তাদের হারাবে। কেননা তারা যাবে একদিকে আর মােশরেকরা যাবে অন্যদিকে। আর যদি তারা মােশরেক হয় তবে সবাই মিলেই যাবে জাহান্নামে। তারপর এই সুস্পষ্ট ক্ষতির ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে, তাদের ওপর থেকে নামবে রাশি রাশি আগুন, আর নীচ থেকেও ওঠবে রাশি রাশি। এও সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সতর্ক করেন। অতএব হে আমার বান্দারা, তােমরা আমাকে ভয় করাে। এটা যথার্থই একটা আতংকজনক দৃশ্য। ওপর থেকেও আগুন, নীচ থেকেও আগুন। এই আগুনের মাঝখানে থাকবে তারা। আগুন তাদের ঘিরে রাখবে। এটা একটা ভয়াবহ দৃশ্য। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সামনে এ দৃশ্য তুলে ধরেন। তারা এ পরিণতি থেকে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম। আর তারা যাতে আত্মরক্ষা করে সে জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের সতর্ক করেন, আল্লাহ তায়ালাও এ বিষয় থেকেই তার বান্দাদের সাবধান করেন। তিনি তাদেরকে তাকওয়া অবলম্বনের জন্যে আহবান জানান। হে আমার বান্দারা, আমাকে ভয় করো। অপরদিকে অবস্থান নেবে মুক্তিপ্রাপ্তরা, যারা এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিকে ভয় পেতো। আর যারা তাগুতের উপাসনা থেকে বিরত থাকতাে এবং আল্লাহর অনুগত থাকতাে, তাদের জন্যে সুসংবাদ। এতএব আমার বান্দাদের সুসংবাদ দাও।(আয়াত ১৭, ১৮) ‘তাগুত শব্দটার উৎপত্তি ‘তুগইয়ান থেকে, যেমন মিল্ক থেকে মালাকুত ইত্যাদি। এতে আধিক্য ও বড়ত্ব বুঝানাে হয়। যে কোনাে সীমা অতিক্রমকারী ও বিদ্রোহকারীকে ‘তাগুত’ বলা যায়। যারা তাগুতের উপাসনা পরিহার করে তারাই হচ্ছে আল্লাহর অনুগত এবং একমাত্র তাঁরই এবাদাতকারী। এসব লােকের জন্যেই সুসংবাদ। ঊধ্বজগত থেকে এ সুসংবাদ এসেছে আর রসূল(স.) আল্লাহর আদেশে তাদের কাছে এ সুসংবাদ পৌছাবেন। একজন মহান রসূল যে উর্ধ্বজগতের এ সুসংবাদ বহন করছেন, এটাই একমাত্র অনুগ্রহ। এদের অন্যতম গুণ হলাে, তারা সবার সব কথা শােনে, কিন্তু কেবল ভালো কথাগুলােই করে এবং অন্য কথাগুলাে প্রত্যাখ্যান করে। তারা কেবলমাত্র সেসব পবিত্র কথাবার্তাই অনুসরণ করে, যা দ্বারা হৃদয় পবিত্র হয়। যাদের মন পবিত্র, তারা ভালাে কথা গ্রহণ করে ও মেনে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকে। আর যাদের মন অপবিত্র, তারা কেবল অপবিত্র কথাই শােনে ও মেনে নেয়। তারাই সেসব লােক, যাদের আল্লাহ হেদায়াত করেছেন। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা জানেন যে তাদের অন্তর সত্যপন্থী ও কল্যাণমুখী, তাই তিনি তাদের সৎ কথা শােনা ও মেনে নেয়ার পথে চালিত করেছেন। আর আল্লাহ যে পথ দেখান সেটাই প্রকৃত পথ। ‘আর তারাই বিবেকবান লােক।’ বস্তুত পরিচ্ছন্ন ও নির্মল বিবেকই মানুষকে শুদ্ধি ও মুক্তির পথে টেনে নিয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি শুদ্ধি ও মুক্তির পথ অনুসরণ করে না, সে যেন বিবেকের ন্যায় আল্লাহ অমূল্য নেয়ামত থেকে বঞ্চিত। এই বিবেকবান মােমেনরা আখেরাতে যে নেয়ামত উপভােগ করবে, তার দৃশ্য তুলে ধরার আগে বলা হচ্ছে যে, তাগুতের উপাসকরা ইতিমধ্যেই জাহান্নামে পৌছে গেছে। কেউ তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করতে পারে না। ‘যে ব্যক্তির ওপর আযাবের হুকুম অবধারিত হয়ে গেছে, তুমি কি সেই জাহান্নামীকে মুক্তি দিতে পারবে?’ (আয়াত-১৯) এখানে রসূল(স.)-কে সম্বােধন করা হয়েছে তিনি যদি তাদের আগুন থেকে মুক্ত করতে না পারেন তাহলে আর কে পারবে? এদের দোযখে অবস্থানের দৃশ্য তুলে ধরার পর পরই দেখানাে হয়েছে আল্লাহভীরু মােমেনদের জান্নাতে অবস্থানের দৃশ্য, ‘কিন্তু যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করতাে তাদের জন্যে থাকবে প্রাসাদের ওপর প্রাসাদ…(আয়াত-২০) প্রাসাদগুলাে এমনভাবে নির্মিত হবে যে, তার নীচ দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত থাকবে এবং ওপরে থাকবে আরাে বহু প্রাসাদ। এ দৃশ্যটা হলাে জাহান্নামের দৃশ্যের ঠিক বিপরীত। সেখানেও নীচে রাশি রাশি আগুন এবং ওপরে রাশি রাশি আগুন। পরস্পর বিরােধী দৃশ্য তুলে ধরার এই রীতি কোরআনের বাচনভংগির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটা আল্লাহর প্রতিশ্রুতি। আর আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। আল্লাহ তায়ালা কখনো প্রতিশ্রুতি ভংগ করেন না। যে মুসলমানদের কাছে কোরআন প্রথম এসেছিলো, তারা এ সকল দৃশ্যকে দূর ভবিষ্যতের কোনাে প্রতিশ্রুতি বা হুমকি নয়, বরং বর্তমানের বাস্তব ঘটনা হিসেবে দেখতেন। তারা এগুলাে দেখতেন, অনুভব করতেন, প্রভাবিত হতেন, শিহরিত হতেন এবং সাড়া দিতেন। এ কারণেই তাদের ভেতরে এমন সর্বাত্মক পরিবর্তন আসতাে এবং তাদের ইহকালীন জীবন পরকালীন বাস্তবতার আলােকে গড়ে ওঠতাে। কেননা ইহকালীন জীবনের তারা পরকালীন জীবনের বাস্তবতা অনুভব করতাে। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি প্রত্যেক মুসলমানের এভাবেই গ্রহণ করা উচিত।