(বই#১০৮২)
[*আমি সবার আগে মুসলমান হই,
আল্লাহর আনুগত্য শুধু মুখে উচ্চারণের বিষয় নয় :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার
পারা:২৩
১-২০ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৩৯-যুমার) : নামকরণ:
আয়াত নম্বর ৭১ ও ৭৩ وَسِيقَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ زُمَرًا এবং وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا থেকে সূরাটির নাম গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ এটি সে সূরা যার মধ্যে ‘যুমার’ শব্দের উল্লেখ আছে।
(৩৯-যুমার) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
এ সূরা যে হাবশায় হিজরত করার পূর্বে নাযিল হয়েছিল, সে ব্যাপারে ১০ নম্বর আয়াত وَأَرْضُ اللَّهِ وَاسِعَةٌ থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কোন কোন রেওয়ায়াতে একথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, হযরত জাফর ইবনে আবী তালেব ও তার সংগী সাথীগণ হাবশায় হিজরতের সংকল্প করলে তাদের সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছিল (রূহুল মায়ানী, ২৩ তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২২৬)।
(৩৯-যুমার) : বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য :
হাবশায় হিজরতের কিছু পূর্বে মক্কার পরিবেশ ছিল জুলুম-নির্যাতন এবং শত্রুতা ও বিরোধিতায় ভরা। ঠিক এ পরিবেশে এ গোটা সূরাটিকে একটি অত্যন্ত মনোজ্ঞ ও মর্মস্পর্শী বক্তৃতারূপে পেশ করা হয়েছে। এটা একটা নসীহত। এতে মাঝে মধ্যে ঈমানদারদের সম্বোধন করা হলেও বেশীরভাগ কুরাইশ গোত্রের কাফেরদের সম্বোধন করা হয়েছে এবং হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। আর সে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে, মানুষ যেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণ করে এবং তার আল্লাহপ্রীতিকে অন্য কারো দাসত্ব ও আনুগত্য দ্বারা কলুষিত না করে। এ মৌলিক নীতিকে বারবার বিভিন্ন ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে অত্যন্ত জোরালো পন্থায় তাওহীদের সত্যতা এবং তা মেনে চলার উত্তম ফলাফল আর শির্কের ভ্রান্তি ও তা আঁকড়ে ধরে থাকার মন্দ ফলাফল অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া মানুষকে ভ্রান্ত আচরণ পরিত্যাগ করে আল্লাহর রহমতের দিকে ফিরে আসার জন্য আহবান জানানো হয়েছে। এ প্রসংগে ঈমানদারদেরকে পথনির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, যদি আল্লাহর দাসত্বের জন্য একটি জায়গা সংকীর্ণ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তাঁর এ পৃথিবী অনেক প্রশস্ত। নিজের দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য অন্য কোথাও চলে যাও। আল্লাহ তোমাদের ধৈর্যের পুরস্কার দান করবেন। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে যে, কাফেরদের জুলুম-নির্যাতন একদিন না একদিন তোমাদেরকে এ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে, এমন দুরাশা কাফেরদের মন থেকে দূর করে দাও এবং পরিষ্কারভাবে বলে দাও যে, আমার পথ রোধ করার জন্য তোমরা যা কিছু করতে চাও করো, আমি আমার কাজ চালিয়েই যেতে থাকবো।
# এটা এ সূরার সংক্ষিপ্ত ভূমিকা। এতে শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, এটা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের কথা নয় যা অস্বীকারকারীরা বলছে। বরং এটা আল্লাহ তা’আলার বাণী। তিনি নিজে এ বাণী নাযিল করেছেন। এর সাথে আল্লাহর দু’টি গুণ উল্লেখ করে শ্রোতাদেরকে দু’টি মহাসত্য সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে যাতে তারা এ বাণীকে মামুলি জিনিস মনে না করে, বরং এর গুরুত্ব উপলব্ধি করে। বর্ণিত গুণের একটি হচ্ছে, যে আল্লাহ এ বানী নাযিল করেছেন তিনি “আযীয” অর্থাৎ এমন মহা পরাক্রমশালী যে, কোন শক্তিই তাঁর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তাবলী কার্যকরী হওয়া ঠেকাতে পারে না এবং তাঁর বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এমন কোন শক্তিও নেই। আরেকটি গুণ হচ্ছে, তিনি ‘হাকীম’ অর্থাৎ এ কিতাবে তিনি যে হিদায়াত দিচ্ছেন তা আগাগোড়া বিজ্ঞোচিত। কেবল কোন অজ্ঞ ও মূর্খই তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আস সাজদা টীকা, ১ )
# তার মধ্যে যা আছে তা ন্যায় ও সত্য, বাতিলের কোন সংমিশ্রণ তার মধ্যে নেই।
# এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এ আয়াতটি পড়ার সময় অমনোযোগী হওয়া উচিত নয়। বরং এর অর্থ ও প্রতিপাদ্য বিষয়টি ভালভাবে বুঝার চেষ্টা করা উচিত। এর মৌলিক বিষয় দু’টি। এ দু’টি বিষয় বুঝে নেয়া ছাড়া আয়াতটির অর্থ অনুধাবন সম্ভব নয়। একটি বিষয় হচ্ছে, এখানে আল্লাহর ইবাদাত করতে বলা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সে ইবাদাত হবে এমন যা আনুগত্যকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে করা হয়।
ইবাদাত শব্দের শব্দমূল বা ধাতু হচ্ছে عبد । এ শব্দটি আরবী ভাষায় ‘স্বাধীন’ শব্দের বিপরীত শব্দ হিসেবে ‘দাস’ বা ‘ক্রীতদাস’ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এ অর্থের দিক দিয়ে ‘ইবাদাত’ শব্দের মধ্যে দু’টি অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। একটি অর্থ হচ্ছে পূজা-অর্চনা। আরবী ভাষার বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ আছে عبد الله অর্থাৎ التنسك , والتعبد , تأله له । আরেকটি অর্থ হচ্ছে সবিনয় আনুগত্য এবং সন্তুষ্টি ও সাগ্রহ আদেশ পালন। যেমন “লিসানুল আরবে” বলা হয়েছেঃ
الطاعة – العبادة ومعنى العبادةِ في اللغة الطاعةُ مع الخُضُوعِ – وكلُّ من دانَ لملك فهو عابد له (وقومهما لنا عابدون) والعابد , الخاضع لربه المستسلم المُنْقاد لأَمره- عبدَ الطاغوتَ , أَطاعه يعني الشيطانَ فيما سَوّلَ له وأَغواه- إِياك نعبد, أَي نُطِيعُ الطاعةَ التي يُخْضَعُ معها- اعبدوا ربكم , أَطيعوا ربكم-
সুতরাং অভিধানের এসব নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা অনুসারে আল্লাহর ইবাদাত করা অর্থ শুধু তাঁর পূজা-অর্চনার দাবী করাই নয়, বরং বিনা বাক্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন, তাঁর শরয়ী আইন-কানুন সন্তুষ্ট চিত্তে সাগ্রহে মেনে চলা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মনে প্রাণে অনুসরণ করার দাবীও বুঝায়। আরবী ভাষায় دين (দ্বীন) শব্দ কতিপয় অর্থ ধারণ করেঃ
একটি অর্থ হচ্ছে, আধিপত্য ও ক্ষমতা, মালিকানা ও প্রভুত্বমূলক মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও সার্বভৌম ক্ষমতা এবং অন্যদের ওপর সিদ্ধান্ত কার্যকারী করা। তাই “লিসানুল আরবে” আছেঃ
دان الناسَ أَي قَهَرَهم على الطاعة- دِنْتُهم أَي قَهرْتهم- دِنْتُه ¸ سُسْته و مَلَكْتُه- وفي الحديث : الكيِّس من دانَ نَفْسَه , أَي أَذلها واستعبدها- الديان , القاضى , الحكم , القهار , ولا انت اى لست بقاهرلى فتسوس امرى- ما كان ليأخذ اخاه فى دين الملك , اى فى تضاء الملك-
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আনুগত্য, আদেশ পালন ও দাসত্ব। লিসানুল আরব অভিধানে আছেঃ
الدين , الطاعة – دنته ودنت له , اى اطعته – والدين الله , انما هو طاعته والتعبد له – فى الحديث اريد من قريش كلمة تدين لهم بها العرب , اى تطيعهم وتخضع لهم – ثم دانت بعد الرباب , اى ذلت له واطاعته – يمرقون من الدين , اى انهم يخرجون من طاعة الامام المفترض الطاعة , المدين , العبد – فلولا ان كنتم غير مدينين , اى غير مملوكين – الدين , العادة والشأن – يقال ما زال ذلك دينى وديدنى , اى عادتى الدين , الطاعة – دنته ودنت له , اى اطعته – والدين الله , انما هو طاعته والتعبد له – فى الحديث اريد من قريش كلمة تدين لهم بها العرب , اى تطيعهم وتخضع لهم – ثم دانت بعد الرباب , اى ذلت له واطاعته – يمرقون من الدين , اى انهم يخرجون من طاعة الامام المفترض الطاعة , المدين , العبد – فلولا ان كنتم غير مدينين , اى غير مملوكين –
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে অভ্যাস ও পন্থা-পদ্ধতি—- মানুষ যা অনুসরণ করে। লিসানুল আরবে আছে, الدين , العادة والشأن – يقال ما زال ذلك دينى وديدنى , اى عادتى এ তিনটি অর্থের প্রতি খেয়াল এ আয়াতে ‘দ্বীন’ শব্দটি এমন কর্মপদ্ধতি ও আচরণকে বুঝায় যা মানুষ কারো শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার এবং কারো আনুগত্য গ্রহণ করার মাধ্যমে অবলম্বন করে। আর “দ্বীন”কে শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদিত করে তাঁর দাসত্ব করার অর্থ হলো “আল্লাহর দাসত্বের সাথে মানুষ আর কাউকে শামিল করবে না বরং শুধু তাঁরই পূজা করবে, তাঁরই অনুসরণ এবং তাঁরই হুকুম আহকাম ও আদেশ পালন করবে।”
# এটা একটা বাস্তবসম্মত ও সত্য ব্যাপার। ওপরে বর্ণিত দাবীর সপক্ষে প্রমাণস্বরূপ এটা পেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ তোমার উচিত দ্বীনকে কেবল আল্লাহর জন্য নিবেদিত করে তাঁর বন্দেগী ও দাসত্ব করা। কারণ নির্ভেজাল ও অবিমিশ্র আনুগত্য আল্লাহর অধিকার। অন্য কথায় বন্দেগী ও দাসত্ব পাওয়ার মতো অন্য কেউ আদতেই নেই। সুতরাং আল্লাহর সাথে তার পূজা-অর্চনা করা এবং তার হুকুম-আহকাম ও আইন-কানুনের আনুগত্য করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো একনিষ্ঠ ও অবিমিশ্র দাসত্ব করে তাহলে সে ভ্রান্ত কাজ করে। অনুরূপভাবে সে যদি আল্লাহর দাসত্বের সাথে সাথে অন্য কারো দাসত্বের সংমিশ্রণ ঘটায় তাহলে সেটাও সরাসরি ন্যায় ও সত্যের পরিপন্থী। ইবনে মারদুইয়া কর্তৃক ইয়াযীদ আর রাকাশী থেকে উদ্ধৃত হাদীসটিই এ আয়াতের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি বলেনঃ এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, আমরা নাম ডাক সৃষ্টি করার জন্য আমাদের অর্থ-সম্পদ দেই। এতে কি আমরা কোন পুরস্কার পাব? নবী (সা.) বললেনঃ না। সে জিজ্ঞেস করলোঃ আমাদের নিয়ত যদি আল্লাহর পুরস্কার এবং দুনিয়ার সুনাম অর্জন দু’টিই থাকে? তিনি বললেনঃ
أَنَّ اللهَ تَعَالَىلَا يُقْبَلُ أَلَا مَنْأُخْلِصَ لَهُ
“কোন আমল যতক্ষণ না আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠভাবে হবে ততক্ষণ তিনি তা গ্রহণ করেন না।” এরপর নবী (সা.) এ আয়াত পাঠ করলেন।
# মক্কার কাফেররা বলতো, আর সাধারণত দুনিয়ার সব মুশরিকও একথাই বলে থাকে যে, আমরা স্রষ্টা মনে করে অন্যসব সত্তার ইবাদাত করি না। আমরা তো আল্লাহকেই প্রকৃত স্রষ্টা বলে মানি এবং সত্যিকার উপাস্য তাঁকেই মনে করি। যেহেতু তাঁর দরবার অনেক উঁচু। আমরা সেখানে কি করে পৌঁছতে পারি? তাই এসব বোযর্গ সত্তাদেরকে আমরা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করি যাতে তারা আমাদের প্রার্থনা ও আবেদন-নিবেদন আল্লাহর কাছে পৌঁছিয়ে দেন।
# একথা ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, কেবল তাওহীদের ব্যাপারেই ঐকমত্য হওয়া সম্ভব। শিরকের ব্যাপারে কোন প্রকার ঐকমত্য হতে পারে না। কোন্ কোন্ সত্তা আল্লাহর কাছে পৌঁছার মাধ্যম সে ব্যাপারে দুনিয়ার মুশরিকরা কখনো একমত হতে পারেনি। কারো কাছে কোন দেবতা বা দেবীরা এর মাধ্যমে। কিন্তু তাদের মধ্যেও সব দেবতা ও দেবী সম্পর্কে ঐকমত্য নেই। কারো কাছে চাঁদ, সূর্য, মঙ্গল ও বৃহস্পতি এর মাধ্যম। কিন্তু তাদের মধ্যে কার কি মর্যাদা এবং কে আল্লাহর কাছে পৌঁছার মাধ্যম সে ব্যাপারে তারাও পরস্পর একমত নয়। কারো মতে মৃত মহাপুরুষগণ এর মাধ্যম। কিন্তু এদের মধ্যেও অসংখ্য ভিন্নমত বিদ্যমান। কেউ একজন মহাপুরুষকে মানলে আরেকজন অপর একজনকে মানছে। এর কারণ হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন এসব মহাপুরুষ সম্পর্কে তাদের এই ধারণা কোন জ্ঞানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেনি কিংবা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের কাছে এমন কোন তালিকাও আসেনি যাতে বলা হয়েছে, অমুক ও অমুক ব্যক্তি আমার বিশেষ নৈকট্যপ্রাপ্ত। সুতরাং আমাকে পেতে হলে তাদেরকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করো। এটা বরং এমন এক আকীদা—যা কেবল কুসংস্কার ও অন্ধভক্তি এবং পুরনো দিনের লোকদেরকে অযৌক্তিক এবং অন্ধ অনুসরণের কারণে মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে। তাই ক্ষেত্রে মতের বিভিন্নতা অবশ্যম্ভাবী।
# আল্লাহ এখানে সেসব লোকের জন্য দু’টি শব্দ ব্যবহার করেছেন। একটি كَاذِبٌ (মিথ্যাবাদী) এবং অপরটি كَفَّارٌ (অস্বীকারকারী)। তাদেরকে كَاذِبٌ বলা হয়েছে এজন্য যে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে মিথ্যা এ আকীদা বানিয়ে নিয়েছে এবং অন্যদের মধ্যে এ মিথ্যাই প্রচার করছে। আর ‘কাফফা’ শব্দের দু’টি অর্থ। একটি, ন্যায় ও সত্যের চরম অস্বীকারকারী। অর্থাৎ তাওহীদের শিক্ষা সামনে আসার পর এরা এ ভ্রান্ত আকীদা আঁকড়ে ধরে আছে। আরেকটি, নিয়ামতের অস্বীকারকারী। অর্থাৎ এরা নিয়ামত লাভ করছে আল্লাহর কাছ থেকে আর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে সেসব সত্তার যাদের সম্পর্কে তারা নিজের থেকেই ধরে নিয়েছে যে, তাদের হস্তক্ষেপের কারণেই তারা এসব নিয়ামত লাভ করছে।
# আল্লাহর ছেলে হওয়া একেবারেই অসম্ভব। যা সম্ভব তা হচ্ছে, আল্লাহ কাউকে বাছাই করে নিতে পারেন। আর যাকে তিনি বাছাই করবেন সে অবশ্যই সৃষ্টির মধ্যকার কেউ হবে। কারণ পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি। এ কথাও সবার জানা যে, সৃষ্টি যত সম্মানিতই হোক সে কখনো সন্তানের মর্যাদা পেতে পারে না। কারণ স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিরাট মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। কিন্তু সন্তান হওয়াটা পিতা ও সন্তানের মধ্যে মৌলিক ঐক্যের দাবী করে। সাথে সাথে এ বিষয়টির প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, “আল্লাহ যদি কাউকে ছেলে বানাতে চাইতেন তাহলে এ রকম করতেন” কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। একথা থেকে স্বতই এ অর্থ প্রকাশ পায় যে, আল্লাহ কখনো এরূপ বেটা হিসেবে গ্রহণ করা তো দূরের কথা এরূপ করার ইচ্ছাও আল্লাহ কখনো পোষণ করেননি।
# এসব যুক্তি প্রমাণ দিয়েই সন্তান হওয়ার আকীদা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে৷
প্রথম প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা সব রকমের ত্রুটি দোষ এবং দুর্বলতা থেকে পবিত্র৷ একথা সুস্পষ্ট যে , সন্তানের প্রয়োজন হয় অকর্মন্য ও দুর্বলের ৷ যে ব্যক্তি নশ্বর ও ধবংসশীল সেই সন্তান লাভের মুখাপেক্ষী হয় যাতে তার বংশ ও প্রজন্ম টিকে থাকে৷ আর কাউকে পালক পুত্রও কেবল সে ব্যক্তিই গ্রহণ করে , যে হয়তো উত্তরাধিকারীহীন হওয়ার কারণে কাউকে উত্তরাধিকারী বানানোর প্রয়োজন অনুভব করে৷ নয়তো ভালবাসার আবেগে তাড়িত হয়ে কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করে৷ এসব মানবিক দুর্বলতাকে আল্লাহর ওপর আরোপ করা এবং তার ওপর ভিত্তি করে ধর্মীয় আকীদা – বিশ্বাস রচনা করে নেয়া মূর্খতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টি ছাড়া আর কি ?
দ্বিতীয় প্রমাণ হচ্ছে , তিনি এক অদ্বিতীয় এবং একক সত্তার অধিকারী , কোন বস্তু বা দ্রব্যের কিংবা কোন পুরুষের অংশ নন৷ আর এ বিষয় সুস্পষ্ট যে , সন্তান সমগোত্রীয় হয়ে থাকে ৷ আর দাম্পত্য জীবন ছাড়া সন্তানের কল্পনাই করা যায় না৷ আর দাম্পত্য সম্পর্কও কেবল সমগোত্রীয়ের সাথেই হতে পারে৷ সুতরাং একক ও অদ্বিতীয় সত্তা আল্লাহ সন্তান থাকার কথা যে ব্যক্তি বলে সে চরম মূর্খ ও নির্বোধ৷
তৃতীয় প্রমাণ হচ্ছে , তিনি قهار বা অপরাজেয় এক মহাশক্তি৷ অর্থাৎ পৃথিবীতে সব জিনিসই তাঁর অজেয় আধিপত্যের অধীন৷ এ বিশ্ব – জাহানের কোন কিছুই কোন পর্যায়েই তাঁর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়৷ তাই কোন জিনিস সম্পর্কেই এ ধরাণা করা যেতে পারে না যে , আল্লাহর সাথে তার কোন আত্মীয়তার বন্ধন আছে৷
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইবরাহীম, টীকা ২৬ ; আন নাহল ; টীকা ৬ ; আল আনকাবূত, টীকা ৭৫ ।
# এমন মহাপরাক্রমশালী যে, তিনি যদি তোমাদের আযাব দিতে চান তাহলে কোন শক্তিই তা রোধ করতে সক্ষম নয়। কিন্তু এটা তাঁর মেহেরবানী যে তোমরা এসব অপরাধ ও অবমাননা করা সত্ত্বেও তখনই তোমাদের পাকড়াও করছেন না, বরং একের পর এক অবকাশ দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করা এবং অবকাশ দেয়াকে ক্ষমা (দেখেও না দেখা) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
# একথার অর্থ এ নয় যে, প্রথমে হযরত আদম থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং পরে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন। এখানে বক্তব্যের মধ্যে সময়ের পরম্পরার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বর্ণনার পরম্পরার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রত্যেক ভাষায়ই এ ধরনের দৃষ্টান্ত বর্তমান। যেমনঃ আমরা বলি তুমি আজ যা করেছো তা জানি এবং গতকাল যা করেছো তাও আমার জানা আছে। এ ধরনের বর্ণনার অর্থ এ নয় যে, গতকালের ঘটনা আজকের পরে সংঘটিত হয়েছে।
# গবাদি পশু অর্থ উট, গরু, ভেড়া, বকরী। এ চারটি নর ও চারটি মাদি মিলে মোট আটটি নর ও মাদি হয়।
# তিনটি পর্দা অর্থ পেট, গর্ভথলি এবং ঝিল্লি (সে ঝিল্লি যার মধ্যে বাচ্চা জড়িয়ে থাকে)।
# মালিক, শাসক ও পালনকর্তা।
# সমস্ত ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের মালিক তিনিই। গোটা বিশ্ব-জাহান তার হুকুমেই চলছে।
# অন্যকথায় এখানে যুক্তি পেশ করা হচ্ছে যে, তিনিই যখন তোমাদের প্রভু এবং সমস্ত রাজত্ব তাঁরই তখন নিশ্চিতভাবে তোমাদের ইলাহও (উপাস্য) তিনিই। অন্য কেউ কি করে ইলাহ হতে পারে যখন প্রতিপালনের ক্ষেত্রে তার কোন অংশ নেই এবং রাজত্বের ক্ষেত্রেও তার কোন দখল নেই। তোমাদের বিবেক-বুদ্ধির কাছে একথা কি করে গ্রহণযোগ্য হতে পারে যে, যমীন-আসমানের সৃষ্টিকর্তা হবেন আল্লাহ এবং সূর্য ও চন্দ্রকে আনুগত্য গ্রহণকারী আর রাতের পর দিন ও দিনের পর রাত আনায়নকারীও হবেন আল্লাহ। তাছাড়া তোমাদের নিজেদের এবং সমস্ত জীব-জন্তুর স্রষ্টা ও পালনকর্তাও হবেন আল্লাহ অথচ তোমাদের উপাস্য হবে তিনি ছাড়া অন্যরা?
# একথাটি চিন্তা করে দেখার মত। এখানে একথা বলা হয়নি যে, তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছো? বরং বলা হয়েছে এই যে, তোমাদের কোথায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? অর্থাৎ অন্য কেউ তোমাদের বিপথগামী করছে এবং তোমরা তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সাদামাটা যুক্তিসঙ্গত কথাও বুঝতে পারছো না। এ বর্ণনাভঙ্গি থেকে দ্বিতীয় যে কথাটি প্রতীয়মান হয় তা হচ্ছে ‘তোমরা’ বলে সম্বোধন করে যারা ফিরিয়ে নিচ্ছে তাদেরকে সম্বোধন করা হয়নি, বরং যারা তাদের প্রভাবে পড়ে ফিরে যাচ্ছিলো তাদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে, কিছুটা চিন্তা-ভাবনা করলে যা সহজেই বোঝা যায়। যারা ফিরিয়ে নিচ্ছিলো তারা সে সমাজে সবার চোখের সামনেই ছিলো এবং সবখানে প্রকাশ্যেই কাজ করছিলো। তাই তাদের নাম নিয়ে বলার প্রয়োজন ছিলো না। তাদের সরাসরি সম্বোধন করাও ছিলো নিরর্থক। কারণ, তারা নিজেদের স্বার্থের জন্যই মানুষকে এক আল্লাহর দাসত্ব থেকে ফিরতে এবং অন্যদের দাসত্বে শৃঙ্খলিত করতে এবং করিয়ে রাখতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো। এটা জানা কথা যে, এ ধরনের লোকদের বুঝালেও তারা তা বুঝতে রাজি ছিল না। কারণ, না বুঝার মধ্যেই তাদের স্বার্থ নিহিত ছিল এবং বুঝার পরও তারা তাদের স্বার্থ ত্যাগ করতে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। তবে জনসাধারণ যারা তাদের প্রতারণা ও চতুরতার ফাঁদে পতিত হচ্ছিলো তারা ছিল করুণার পাত্র। এ কারবারে তাদের কোন স্বার্থ ছিল না। তাই তাদেরকে বুঝালে বুঝতে পারতো এবং চোখ কিছুটা খুলে যাওয়ার পরে তারা এও দেখতে পারতো যে, যারা তাদেরকে আল্লাহর নিকট থেকে সরিয়ে অন্যদের আস্তানার পথ দেখাচ্ছে তারা তাদের এ কারবার থেকে কি স্বার্থ হাসিল করছে। এ কারণেই গোমরাহীতে নিক্ষেপকারী মুষ্টিমেয় লোকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে গোমরাহীর দিকে অগ্রসরমান জনসাধারণকে সম্বোধন করা হচ্ছে।
# তোমাদের কুফরীর কারণে তাঁর প্রভুত্বের সামান্যতম ক্ষতিও হতে পারে না। তোমরা মানলেও তিনি আল্লাহ, না মানলেও তিনি আল্লাহ আছেন এবং থাকবেন। তাঁর নিজের ক্ষমতায়ই তাঁর কর্তৃত্ব চলছে। তোমাদের মানা বা না মানাতে কিছু এসে যায় না। হাদীসে নবী ﷺ বলেছেন যে, আল্লাহ বলেনঃ
يَا عِبَادِى لَوْ أَنَّ أَوَّلَكُمْ وَآخِرَكُمْ وَإِنْسَكُمْ وَجِنَّكُمْ كَانُوا عَلَى أَفْجَرِ قَلْبِ رَجُلٍ مِنْكُمْ مَا نَقَصَ مِنْ مُلْكِى شَيْئًا-
“হে আমার বান্দারা, যদি তোমরা আগের ও পরের সমস্ত মানুষ ও জিন তোমাদের মধ্যকার কোন সর্বাধিক পাপিষ্ঠ ব্যক্তির মত হয়ে যাও তাতেও আমার বাদশাহীর কোন ক্ষতি হবে না।” (মুসলিম)।
# নিজের কোন স্বার্থের জন্য নয়, বরং বান্দার স্বার্থের জন্য তার কুফরী করা পছন্দ করেন না। কেননা, কুফরী তাদের নিজেদের জন্যই ক্ষতিকর। এখানে একথা মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর ইচ্ছা ও অভিপ্রায় এক জিনিস এবং তাঁর সন্তুষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি জিনিস। পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থী কোন কাজ হতে পারে না। কিন্তু তাঁর সন্তুষ্টির পরিপন্থী কাজ হতে পারে এবং রাত দিন হয়ে আসছে। উদাহরণস্বরূপঃ পৃথিবীতে স্বেচ্ছাচারী ও জালেমদের শাসনকর্তা হওয়া, চোর ও ডাকাতদের অস্তিত্ব থাকা এবং হত্যাকরী ও ব্যভিচারীদের বর্তমান থাকা এ কারণেই সম্ভব যে, আল্লাহ তা’আলা তাঁর রচিত প্রাকৃতিক বিধানে এসব অকল্যাণ ও অপকর্মের অস্তিত্ব লাভের অবকাশ রেখেছেন। তাছাড়া তাদেরকে মন্দ কাজে লিপ্ত হওয়ার সুযোগও তিনিই দেন এবং ঠিক তেমনিভাবে দেন যেমনভাবে সৎকর্মশীলদের সৎকাজ করার সুযোগ দেন। তিনি যদি এসব কাজ করার আদৌ কোন সুযোগ না রাখতেন এবং যারা এসব কাজ করে তাদের আদৌ কোন সুযোগই না দিতেন তাহলে পৃথিবীতে কখনো কোন অকল্যাণ আত্মপ্রকাশ করতো না। এসব কিছুই তাঁর ইচ্ছার ভিত্তিতে হচ্ছে। কিন্তু ইলাহী ইচ্ছার অধীনে কোন কাজ সংঘটিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তার পেছনে আল্লাহর সন্তুষ্টিও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একথাটিকে এভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন যে, কেউ যদি হারাম পন্থার মাধ্যমে তার রিযিক লাভের চেষ্টা করে তাহলে আল্লাহ তাকে ঐ পন্থায়ই রিযিক দান করেন। এটা তাঁর ইচ্ছা। কিন্তু তাঁর ইচ্ছার অধীনে চোর ডাকাত বা ঘুষখোরকে রিযিক দেয়া অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ চুরি, ডাকতি এবং ঘুষও পছন্দ করেন। এখানে আল্লাহ তা’আলা একথাটিই বলছেন যে, তোমরা কুফরি করতে চাইলে করো। আমি জোর করে তাতে বাঁধা দিয়ে তোমাদেরকে মু’মিন বানাবো না। তবে তোমরা বান্দা হয়ে স্রষ্টা ও পালনকর্তার সাথে কুফরি করবে তাও আমার পছন্দ নয়। কারণ, তা তোমাদের জন্যই ক্ষতিকর। এতে আমার প্রভুত্বে আদৌ আঁচড়ে লাগে না।
# এখানে ‘কুফর’ এর বিপরীতে ‘ঈমান’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘শোকর’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে আপনা থেকেই এ বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কুফরী প্রকৃতপক্ষে অকৃতজ্ঞতা ও নেমক হারামির নাম আর ঈমান প্রকৃতপক্ষে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অনিবার্য দাবী। যে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানীর সামান্য অনুভূতিও আছে সে ঈমান ছাড়া অন্য কোন পথ গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণে ‘শোকর’ ও ‘ঈমান’ এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যে, যেখানে শোকর থাকবে সেখানে ঈমানও অবশ্যই থাকবে। অপর দিকে যেখানে কুফরী থাকবে সেখানে শোকর বা কৃতজ্ঞতা থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কারণ কুফরীর সাথে “শোকরের” কোন অর্থ হয় না।
# তোমাদের মধ্যকার প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে তার কাজ কর্মের জন্য দায়ী। কেউ যদি অন্যদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিংবা তার অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার জন্য কুফরী করে তাহলে সে লোকেরা তার কুফরীর বোঝা নিজেদের মাথায় উঠিয়ে নেবে না। বরং তাকেই তার কাজের পরিণাম ভোগ করার জন্য রেখে দেবে। সুতরাং কুফরীর ভ্রান্তি এবং ঈমানের সত্যতা যার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে তার উচিত ভুল আচরণ পরিত্যাগ করে সঠিক আচরণ গ্রহণ করা এবং নিজের বংশ, জ্ঞাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের সাথে থেকে নিজেকে আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত না বানানো।
# মানুষ বলতে এখানে সেসব কাফেরদের বুঝানো হয়েছে যারা অকৃতজ্ঞতার আচরণ করে যাচ্ছে।
# সুদিনে সে যেসব উপাস্যকে ডাকতো সেই সময় তাদের কথা মনে হয় না। সে তখন তাদের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ে এবং বিশ্ব-জাহানের পালনকর্তা একমাত্র আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। সে যে তার মনের গভীরে অন্য উপাস্যদের ক্ষমতা ও ইখতিয়ারহীন হওযার অনুভূতি রাখে এবং আল্লাহই যে প্রকৃত ক্ষমতা-ইখতিয়ারের মালিক এ বাস্তবতাবোধও তার মন-মস্তিস্কের কোথাও না কোথাও অবদমিত হয়ে পড়ে আছে এটা যেন তারই প্রমাণ।
# যে সময় সে অন্যসব উপাস্যদের পরিত্যাগ করে কেবল একক ও লা-শরীক আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করছিলো সে দুঃসময়ের কথা তার মনে থাকে না।
# অন্যদের দাসত্ব করতে শুরু করে। তাদেরই আনুগত্য করে। তাদের কাছেই প্রার্থনা করে এবং তাদের সামনেই নযর-নিয়াজ পেশ করতে শুরু করে।
# নিজে পথভ্রষ্ট হয়েই ক্ষান্ত হয় না। অন্যদেরকেও একথা বলে পথভ্রষ্ট করে যে, আমার ওপর যে বিপদ এসেছিলো তা অমুক হযরতের কিংবা অমুক বুযর্গের বা অমুক দেবী ও দেবতাকে নযরানা পেশ করে দূর হয়েছে। এতে আরো অনেক মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্যের ভক্ত ও অনুসারী হয়ে যায় আর প্রত্যেক জাহেল এ ধরনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জনসাধারণের গোমরাহী বাড়িয়ে তুলতে থাকে।
# প্রকাশ থাকে যে, এখানে দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তুলনা করা হচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষ দুঃসময় আসলে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গায়রুল্লাহর বন্দেগী করে। আরেক শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর দাসত্বকে তাদের স্থায়ী নীতি বানিয়ে নিয়েছে। রাতের অন্ধকারে আল্লাহর ইবাদাত করা তাদের একনিষ্ঠ হওয়ার প্রমাণ। এর মধ্যে প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত লোকদেরকে আল্লাহ তা’আলা জ্ঞানহীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে তারা বড় বড় গ্রন্থাগার চষে থাকলেও কিছু এসে যায় না। আর দ্বিতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত লোকদেরকে জ্ঞানী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এক্ষেত্রে একেবারে নিরক্ষর হলেও কিছু এসে যায় না। কারণ, প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে সত্য সম্পর্কে জ্ঞান ও তদানুযায়ী কাজ। এর ওপরেই মানুষের সাফল্য নির্ভরশীল। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ এই দুই শ্রেণীর মানুষ কি করে সমান হতে পারে। কি করে সম্ভব যে, তারা দুনিয়ায় মিলে মিশে একই নিয়ম পন্থায় চলবে এবং আখেরাতেও একই পরিণামের সম্মুখীন হবে।
# শুধু মেনে নেবে তাই নয়, বরং তার সাথে সাথে তাকওয়াও অবলম্বন করো, আল্লাহ যেসব কাজ করতে আদেশ দিয়েছেন তার ওপর আমল করো, যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকো এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহির কথা মনে রেখে দুনিয়াতে কাজ করো।
# দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টির কল্যাণ। তাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতেরই কল্যাণ সাধিত হবে।
# যদি একটি শহর , অঞ্চল বা দেশ আল্লাহর বান্দাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে যেখানে বিপদাপদ নেই সেখানে চলে যাও।
# যারা আল্লাহভীরুতা ও নেকীর পথে চলার ক্ষেত্রে সব রকমের দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছে কিন্তু ন্যায়ের পথ থেকে সরেনি তার মধ্যে সেসব লোক অন্তর্ভুক্ত যারা দীন ও ঈমানের কারনে হিজরত করে দেশান্তরিত হওয়ার দুঃখ-কষ্ট সহ্য করবে এবং সেসব লোকও অন্তর্ভুক্ত যারা জুলুম নির্যাতনে ভরা দেশে থেকে সাহসিকতার সাথে সব বিপদের মোকাবিলা করতে থাকবে।
# আমার কাজ শুধু অন্যদের বলা নয়, নিজে করে দেখানোও। আমি যে পথের দিকে মানুষকে আহবান জানাই সর্বপ্রথম আমিই সে পথে চলি।
# কোন ব্যক্তির কারবারে খাটানো সমস্ত পুঁজি যদি নষ্ট হয়ে যায় এবং বাজারে তার পাওনাদারের সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, নিজের সবকিছু দিয়েও সে দায়মুক্ত হতে পারে না তাহলে এরূপ অবস্থাকেই সাধারণভাবে দেউলিয়াত্ব বলে। এখানে আল্লাহ তা’আলা কাফের ও মুশরিকদের জন্য এ রূপক ভাষাটিই ব্যবহার করেছেন। মানুষ এ পৃথিবীতে জীবন, আয়ু, জ্ঞান-বুদ্ধি, শরীর, শক্তি, যোগ্যতা উপায়-উপকরণ এবং সুযোগ-সুবিধা যত জিনিস লাভ করেছে তার সমষ্টি এমন একটি পুঁজি যা সে পার্থিব জীবনের কারবারে খাটায়। কেউ যদি এ পুঁজির সবটাই এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে খাটায় যে, কোন ইলাহ নেই কিংবা অনেক আছে আর সে তাদের বান্দা। তাকে কারো কাছে হিসেব দিতে হবে না, কিংবা হিসেব-নিকেশের সময় অন্য কেউ এসে তাকে রক্ষা করবে, তাহলে তার অর্থ হচ্ছে সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং নিজের সবকিছু খুইয়ে বসলো। এটা হচ্ছে প্রথম ক্ষতি। দ্বিতীয় ক্ষতি হচ্ছে, এ ভ্রান্ত অনুমানের ভিত্তিতে সে যত কাজই করলো সেসব কাজের ক্ষেত্রে সে নিজেকে সহ দুনিয়ার বহু মানুষ, ভবিষ্যৎ বংশধর এবং আল্লাহর আরো বহু সৃষ্টির ওপর জীবনভর জুলুম করলো। তাই তার বিরুদ্ধে অসংখ্য দাবী আসলো। কিন্তু তার কাছে এমন কিছুই নেই যে, সে এসব দাবী পূরণ করতে পারে। তাছাড়া আরো একটি ক্ষতি হচ্ছে, সে নিজেই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হলো না, বরং নিজের সন্তান-সন্ততি, প্রিয়জন ও আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব ও স্বজাতিকেও তার ভ্রান্ত শিক্ষা-দীক্ষা এবং ভ্রান্ত দৃষ্টান্ত দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করলো। এ তিনটি ক্ষতির সমষ্টিকে আল্লাহ তা’আলা সুস্পষ্ট ক্ষতি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
#
طَاغُوْتَ শব্দটি طغيان শব্দ থ উদ্ভূত। এর অর্থ বিদ্রোহ। কাউকে طاغى বিদ্রোহী না বলে যদি ‘তাগুত’ (বিদ্রোহ) বলা হয় তাহলে তার অর্থ হয় চরম মাত্রার বিদ্রোহী। উদাহরণস্বরূপ কাউকে সুন্দর বলার পরিবর্তে যদি সৌন্দর্য বলা হয় তাহলে তার অর্থ হয় সে যারপরনাই সুন্দর। আল্লাহ ছাড়া অন্য সব উপাস্যদের তাগুত বলার কারণ হলো, আল্লাহ ছাড়া অন্যদের দাসত্ব করা তো নিছক বিদ্রোহ। কিন্তু যে অন্যদের দিয়ে নিজের দাসত্ব করায় সে চরম পর্যায়ের বিদ্রোহী। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল-বাকারাহ, টীকা, ২৮৬ ; আন নাহল, টীকা, ৩২)। এখানে طاغوت শব্দটি طواغيت অর্থাৎ বহু সংখ্যক বিদ্রোহী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই أَنْ يَعْبُدُوهَا বলা হয়েছে। যদি একবচন হতো তাহলে ব্যবহৃত শব্দ হতো يَعْبُدُوْهُ
# এ আয়াতের দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ হচ্ছে, তারা যে কোন কথা শুনলেই তা অনুসরণ করে না। তারা প্রত্যেকের কথা শুনে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং যেটি ন্যায় ও সত্য কথা তা গ্রহণ করে। আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তারা কোন কথা শুনে তার ভুল অর্থ করার চেষ্টা করে না বরং তার ভাল অর্থ গ্রহণ করে।
# যে নিজেই নিজেকে আল্লাহর আযাবের উপযুক্ত বানিয়ে নিয়েছে এবং আল্লাহও তাকে শাস্তি দানের ফায়সালা করেছেন।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ ও ফাযীলাত :
(الزُّمَرُ) যুমার শব্দের অর্থ দল, গ্রুপ ইত্যাদি। এ সূরাতে জান্নাতী ও জাহান্নামী দু’টো দলের কথা বিশেষভাবে আলোচনা করায় উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) (নফল) সিয়াম এমন পর্যায়ক্রমে পালন করতেন যে, আমরা মনে করতাম তিনি যেন আর সিয়াম ভঙ্গই করবেন না। আবার কখনো পর্যায়ক্রমে সিয়াম পালনই করতেন না। আমরা মনে করতাম, তিনি যেন আর সিয়াম পালন করবেন না। আর তিনি প্রতি রাত্রে সূর্ াবানী ইসরাঈল ও সূরা আয্ যুমার পাঠ করতেন। (মুসনাদ আহমাদ হা. ২৫৬৬৪, নাসায়ী হা. ২৩৪৬, ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সূরা যুমার একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা। এ সূরার শুরুতে আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব, যারা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের ইবাদত করে তাদের ভ্রান্ত দাবী, দুনিয়ার সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় হয় কিন্তু বান্দা তাঁর সাথে কুফরী করুক তিনি তা পছন্দ করেন না, মানুষ বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকে কিন্তু বিপদ থেকে মুক্তি পেলে আল্লাহ তা‘আলাকে ভুলে যায়, আবার অনেকে তাঁর সাথে শির্ক করে, যে কোন কথা শুনলেই মানা যাবে না বরং উত্তম কথা মানতে হবে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতেকাল করেছেন, সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলাই বান্দার জন্য যথেষ্ট, মক্কার মুশরিকদের তাওহীদে রুবুবিয়্যাহর স্বীকারোক্তি, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে তাদের নিরাশ না হওয়ার সুসংবাদ, মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলাকে চিনলেও যথাযথ মর্যাদা দিতো না এবং সূরার শেষে জাহান্নামীদেরকে দলে দলে জাহান্নামে ও জান্নাতীদেরকে দলে দলে জান্নাতের নিয়ে যাওয়া হবে ও প্রহরীদের সম্ভাষণ জানানো ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
মক্কার কাফির-মুশরিকরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতকে অস্বীকার, তাঁর প্রতি অবতীর্ণ কিতাবকে অবিশ্বাস, বরং এটা মানব রচিত একটি কিতাব বলে বিশ্বাস করার কথা খণ্ডন করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : এ কুরআন পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতারিত। এর বিধি-বিধান সত্য, এতে কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় নেই।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَإِنَّه۫ لَكِتٰبٌ عَزِيْزٌ لا - لَّا يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْمبَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِه۪ ط تَنْزِيْلٌ مِّنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ)
“এবং এটা অবশ্যই এক মহিমাময় গ্রন্থ। কোন মিথ্যা এতে অনুপ্রবেশ করবে না- অগ্র হতেও নয়, পশ্চাত হতেও নয়। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসনীয় আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ।” (সূরা হা-মীম আস্ সাজদাহ্ ৪১ : ৪১-৪২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(وَاِنَّھ۫ لَتَنْزِیْلُ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَﰏﺚنَزَلَ بِھِ الرُّوْحُ الْاَمِیْنُﰐﺫعَلٰی قَلْبِکَ لِتَکُوْنَ مِنَ الْمُنْذِرِیْنَﰑﺫبِلِسَانٍ عَرَبِیٍّ مُّبِیْنٍﰒ)
“নিশ্চয়ই এ কুরআন জগতসমূহের প্রতিপালক হতে অবতীর্ণ। জিব্রাঈল এটা নিয়ে অবতরণ করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারী হতে পার। (অবতীর্ণ করা হয়েছে) সুস্পষ্ট আরবি ভাষায়।” (সূরা আশ্ শু‘আরা- ২৬ : ১৯২-১৯৫)
(فَاعْبُدِ اللّٰهَ…. الْخَالِصُ)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে এ নির্দেশ প্রদান করছেন যে, তারা যেন একনিষ্ঠভাবে বিশুদ্ধচিত্তে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক বা অংশীদার না করে। কেননা তিনি ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য আর কেউ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(وَمَآ أُمِرُوْآ إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللّٰهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ)
“তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদত করবে।” (সূরা আল বাইয়্যিনাহ ৯৮ : ৫)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো ইবাদত করা যাবে না। এমনকি নাবী-রাসূলগণেরও না। বরং নাবী-রাসূলগণের দেখানো পদ্ধতিতে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে। এটা মূলত আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী :
(قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللّٰهَ فَاتَّبِعُوْنِيْ يُحْبِبْكُمُ اللّٰهُ)
“তুমি বলে দাও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন ।” (সূরা আলি ইমরান ৩ : ৩১)
আর ইবাদত কবূল হওয়ার জন্য প্রধানত দুটি শর্ত রয়েছে। এ দুটি শর্ত সঠিকভাবে আদায় না করলে ইবাদত কবূল হবে না।
১. إخلاص العبادة لله وحده
একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার উপাসনা করা। অর্থাৎ ইবাদত কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই হতে হবে, অন্য কারো জন্য নয়। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যত মা‘বূদ রয়েছে সকলেই ভ্রান্ত।
২. متابعة لسنة الرسول
ইবাদত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো পদ্ধতিতে হতে হবে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেভাবে ইবাদত করেছেন ও করতে বলেছেন ঠিক সেভাবেই আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
আয়াতে دين অর্থ ইবাদত ও আনুগত্য এবং إخلاص অর্থ বিশুদ্ধচিত্তে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নেক আমল করা। এ আয়াতটি নিয়্যাত ওয়াজিব ও তাতে ইখলাস থাকা জরুরী হওয়ার একটি দলীল। হাদীসেও খালেস নিয়্যাতের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। প্রত্যেক আমলের ফলাফল নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল। (সহীহ বুখারী হা. ১) আর এ নিয়্যাত হবে মনে মনে, মুখে উচ্চারণ করে নয়। কেননা মুখে উচ্চারণ করে নিয়্যাত করার কোন প্রমাণ নেই। তবে হাজ্জের নিয়্যাত ব্যতীত, কেননা হাজ্জের নিয়্যাত সশব্দে মুখে উচ্চারণ করে বলতে হয়।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা মক্কার মুশরিকদের গাইরুল্লাহর ইবাদত করার কারণ বর্ণনা করছেন, যে কারণ আমাদের দেশের একশ্রেণির মুসলিম নামধারী মাযার পূজারীদের মাঝে বিদ্যমান। তাদেরকে অন্যান্য মা‘বূদের ইবাদত করার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলত : আমরা মূলত এদের ইবাদত করি না, আমরা কেবল এদের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভ করতে চাই। যার ফলে আমরা তাদের উপাসনা করি। তাই আল্লাহ তা‘আলা ও ইবাদতের মাঝে কোন মাযারে শায়িত ব্যক্তি, পীর, দরবেশ ও ওলী-আওলিয়ার মধ্যস্থতা স্থাপন করা যাবে না, বরং সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে এবং সরাসরি তাঁর কাছে চাইতে হবে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল মুশরিকদের কথার উত্তর দিচ্ছেন যারা বলে- আল্লাহ তা‘আলার সন্তান রয়েছে। যেমন মুশরিকরা বলত- ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার কন্যা। ইয়াহূদীরা বলত, উযায়ের (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার পুত্র। তাদের এ কথা খণ্ডন করতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আল্লাহ তা‘আলা সন্তান গ্রহণ করার ইচ্ছা করলে তাঁর সৃষ্টির মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তিনি সন্তান মনোনীত করতেন অর্থাৎ তারা যা নির্বাচন করে এমনটি নয় বরং তিনি চাইলে তাঁর পছন্দ মতো সন্তান গ্রহণ করতে পারতেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(قُلْ اِنْ کَانَ لِلرَّحْمٰنِ وَلَدٌﺣ فَاَنَا اَوَّلُ الْعٰبِدِیْنَ)
“বল : দয়াময় আল্লাহর কোন সন্তান থাকলে আমিই হতাম তাঁর উপাসকগণের সর্বপ্রথম।” (সূরা যুখরুফ ৪৩ : ৮১)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন গ্রহণ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। তিনি এক ও তাঁর কোনই অংশীদার নেই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতারিত কিতাব। এর বিধি-বিধান সত্য।
২. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না।
৩. ইবাদত হতে হবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দেখানো পদ্ধতিতে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রকার সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী-পরিজন ও অংশীদার থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।
৫. আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ইবাদত করার মাঝে কোন মধ্যস্থতা অবলম্বন করা যাবে না।
৫-৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
এ আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর স্বীয় ক্ষমতার কথা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তিনি যথাযথভাবে আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে, আবার দিন দ্বারা রাতকে আচ্ছাদিত করেন।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,
(يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُه۫ حَثِيْثًا)
“তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন যাতে তাদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে” (সূরা আল আ‘রাফ ৭ : ৫৪)
يُكَوِّرُ অর্থ হলো এক বস্তুকে অপর বস্তুর ওপর পেঁচিয়ে বা জড়িয়ে দেয়া।
এরপর বলা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলাই চন্দ্র ও সূর্যকে নিয়মাধীন করে দিয়েছেন যারা তাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ ছাড়া কখনো অন্যত্র চলাচল করে না। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ গতিসীমা বজায় রেখে চলাচল করে। এ সম্পর্কে পূর্বে সূরা আন্ নাহ্লসহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
(خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ….. أَزْوَاجٍ)
একই ব্যক্তি দ্বারা উদ্দেশ্য হল আদম (আঃ)। এ সম্পর্কে সূর্ াআন্ নিসা’র এক নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِّنَ الْأَنْعَامِ ثَمٰنِيَةَ أَزْوَاجٍ)
এ সম্পর্কে সূরা আল আন‘আম-এর ১৪২-১৪৪ নম্বর আয়াতে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
(فِيْ ظُلُمٰتٍ ثَلَاثٍ)
মানব জাতিকে তিন অন্ধকার স্তরের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ মাতৃগর্ভের ত্রিবিধ অন্ধকারে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করা হয়েছে। সে অন্ধকারগুলো হলো-
১. গর্ভাশয়ের অন্ধকার।
২. গর্ভাশয়ের ওপরে আবরণ বা ঝিল্লীর অন্ধকার, যা শিশুকে সুরক্ষিত রাখে।
৩. এবং পেটের অন্ধকার। এ মোট তিন অন্ধকার স্তরের মধ্যে মানব জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল কিছুর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আকাশ-জমিন, চন্দ্র-সূর্য সবকিছু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলমান, তারপর সব ধ্বংস হয়ে যাবে।
৩. মানব জাতিকে ত্রিবিধ অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে।
৭-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এ আয়াতে তাঁর বান্দাদেরকে খবর দিচ্ছেন। তিনি মানব জাতির কোন কিছুরই মুখাপেক্ষী নন। তিনি একাই স্বয়ং সম্পূর্ণ। তাঁর কারো নিকট কোন কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হয় না। বরং সকলে তাঁর নিকট চায় আর তিনি সকলের চাহিদা পূরণ করে থাকেন। সুতরাং আমরা সকলেই মিলিত হয়েও যদি আল্লাহ তা‘আলার সাথে কুফরী করি তাতে তাঁর কোন ক্ষতিই হবে না। আল্লাহ এ সম্পর্কে অন্যত্র বলেন,
(إِنْ تَكْفُرُوْآ أَنْتُمْ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ جَمِيْعًا لا فَإِنَّ اللّٰهَ لَغَنِيٌّ حَمِيْدٌ)
‘তোমরা এবং পৃথিবীর সকলেই যদি অকৃতজ্ঞ হও (তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না) তথাপি আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং প্রশংসিত। (সূরা ইব্রাহীম ১৪ : ৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(قُلْ هُوَ اللّٰهُ أَحَدٌ = اَللّٰهُ الصَّمَدُ)
“বল : তিনিই আল্লাহ একক। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।” (সূরা ইখলাস ১১২ : ১-২)
হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন : হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের এবং জিনদের পূর্ববর্তীরা এবং পরবর্তীরা সকলেই সর্বাপেক্ষা পাপী ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তির মতো হয়ে যাও তাহলে এতে আমার রাজত্বের বিন্দু পরিমাণও কমবে না। (সহীহ মুসলিম হা. ১৯৯৪)
(وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ أُخْرٰي)
‘কোন বোঝা (পাপ) বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না’ এ সম্পর্কে সূর্ াবানী ইসরাঈল-এর ১৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَإِذَا مَسَّ الْإِنْسَانَ….. سَبِيْلِه)
অর্থাৎ বিপদে পড়লে মানুষ আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান করে কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধার হলে আল্লাহ তা‘আলার কথা ভুলে যায় এবং তাঁর সাথে শির্ক করে। যেমন মানুষ সড়ক পথ বা নৌপথে ভ্রমণকালে কোন একসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখলে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকে। আল্লাহ তা‘আলার কাছে খুব কাকুতি-মিনতি করে আহ্বান করে যেন তিনি তাদেরকে বিপদ থেকে মুক্তি দেন। কিন্তু যখন বিপদ চলে যায় তখন বলে, ড্রাইভার খুব ভাল ছিল। অন্যথায় বাঁচার কোন উপায় ছিল না; ইত্যাদি কথা বলে থাকে যা আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামতকে অস্বীকার করে এবং তাঁর সাথে শির্ক সাব্যস্ত করে। এ সম্পর্কে সূরা ইউনুস-এর ১২ নম্বর আয়াতসহ অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে।
(قُلْ تَمَتَّعْ بِكُفْرِكَ قَلِيْلًا)
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলন : হে নাবী! যারা কাফির-মুশরিক তুমি তাদেরকে এ বাণী শুনিয়ে দাও যে, তোমরা দুনিয়াতে যে-সকল কার্য-কলাপে জড়িত রয়েছো এরূপ জীবন-যাপন আর কিছু দিন করে নাও। তোমাদের এ জীবন শেষ হলেই তোমরা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে অন্য আয়াতে বলেন,
(قُلْ تَمَتَّعُوْا فَإِنَّ مَصِيْرَكُمْ إِلَي النَّارِ)
‘ভোগ করে নাও, নিশ্চয়ই তোমাদের প্রত্যাবর্তনস্থল জাহান্নাম।’ (সূরা ইব্রা-হীম ১৪ : ৩০)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলা বান্দার প্রতি মুখাপেক্ষী নন।
২. প্রত্যেককেই তার নিজ নিজ কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
৩. সুখে-দুঃখে সর্বদা আল্লাহ তা‘আলাকে ডাকতে হবে এবং তাঁর শুকরিয়া আদায় করতে হবে।
৪. দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী আর পরকালের জীবন চিরস্থায়ী।
৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে ঈমানদার আর কাফিরের মধ্যে পার্থক্যের উপমা দিচ্ছেন। আল্লাহ বলেন : যারা দৈনন্দিন ইবাদতের পাশাপাশি রাত্রিকালে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে মশগুল থাকে, সে কখনো সিজদাবনত হয়ে তাঁর ইবাদত করে আবার কখনো দাঁড়িয়ে। কখনো এ ব্যক্তির সমান মর্যাদা লাভ করতে পারে না ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করে ও তাঁর দেয়া বিধানকে অস্বীকার করে। যেমন অন্যত্র আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন,
(لَيْسُوْا سَوَا۬ءً ط مِنْ أَهْلِ الْكِتٰبِ أُمَّةٌ قَآئِمَةٌ يَّتْلُوْنَ اٰيٰتِ اللّٰهِ اٰنَا۬ءَ الَّيْلِ وَهُمْ يَسْجُدُوْنَ)
“তারা সবাই সমান নয়; আহলে কিতাবদের মধ্যে একটি দল রয়েছে দীনের ওপর অটল, তারা রাতের বেলা আল্লাহর আয়াত তেলাওয়াত করে এবং সিজদা করে।” (সূরা আলি ‘ইমরান ৩ : ১১৩)
তাঁর মর্যাদা অবশ্যই কাফির ব্যক্তির থেকে বেশি হবে। কেননা এ সকল আমলের দ্বারা তার মন আখিরাতের ভয়ে ভীত এবং প্রভুর রহমতের আশাধারী হয়। অর্থাৎ ভয় ও আশা উভয় অবস্থা-ই তার মধ্যে পাওয়া যায়, যা প্রকৃত ঈমানের পরিচয়। এরা দুজন কখনো সমান হতে পারে না। ভয় ও আশা সম্পর্কে সহীহ হাদীস রয়েছে।
‘আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, একটি লোকের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার নিকট গমন করেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করেন : নিজেকে তুমি কী অবস্থায় পাচ্ছ? উত্তরে লোকটি বলল : নিজেকে আমি এমন অবস্থায় পাচ্ছি যে, আমি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করছি এবং তাঁর রহমতের আশা করছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : এরূপ সময়ে যার অন্তরে এ দুটো জিনিস একত্রিত হয় তার আশা আল্লাহ তা‘আলা পূরণ করে থাকেন এবং যা হতে সে ভয় পায় তা হতে তাকে মুক্তি দান করেন। (নাসায়ী হা. ১০৬২, ইবনু মাজাহ হা. ৪২৬১)
এরপর আল্লাহ মূর্খের ওপর জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদার কথা বর্ণনা করে বলেন যে, জ্ঞানী ব্যক্তি ও মূর্খ ব্যক্তি কখনো সমান হতে পারে না। জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা মূর্খ ব্যক্তির চেয়ে বেশি। জ্ঞানীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :
(يَرْفَعِ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ لا وَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجٰتٍ ط وَاللّٰهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ)
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদের মর্যাদা আরো উন্নত করে দেবেন। তোমরা যা কিছু কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবহিত।” (সূরা মুজাদালাহ ৫৮ : ১১)
অন্ধ এবং চক্ষুষ্মান ব্যক্তি যেমন সমান হতে পারে না তেমনি জ্ঞানী ও মূর্খ কখনো সমান হতে পারে না। তবে এখানে জ্ঞানী দ্বারা উদ্দেশ্য হলো যারা কুরআন ও সহীহ হাদীসের জ্ঞানে জ্ঞানী, যারা তাদের প্রতিপালক সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, যারা শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে এবং সে অনুপাতে আমল করে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. তাহাজ্জুদের সলাত অনেক মর্যাদাপূর্ণ, তাই যথাসম্ভব কম হলেও নিয়মিত আদায় করা উচিত।
২. কুফরীর ওপর ঈমানের মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল।
৩. মূর্খ ব্যক্তিদের ওপর জ্ঞানীদের মর্যাদা অনেক বেশি।
১০-১২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ প্রদান করছেন যে, তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার মাধ্যমে এবং তাঁর অবাধ্য হওয়া থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে তাঁকে যথাযথ ভয় করে। মনে রাখবে যারা এ দুনিয়াতে ভাল কাজ করে তাদের জন্য দুনিয়া ও পরকাল উভয় অবস্থাতেই রয়েছে কল্যাণ। পরকালে রয়েছে চিরস্থায়ী জান্নাত আর দুনিয়াতে তারা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত সুস্থতা, নিরাপত্তা, বিজয়, সাহায্য, গনিমত ইত্যাদি প্রাপ্ত হবে। কেননা সৎ কর্মের প্রতিদান ভালই হয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(هَلْ جَزَا۬ءُ الْإِحْسَانِ إِلَّا الْإِحْسَانُ)
“উত্তম কাজের পুরস্কার উত্তম (জান্নাত) ব্যতীত আর কী হতে পারে?” (সূরা র্আ রহমান ৫৫ : ৬০)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : আল্লাহ তা‘আলার পৃথিবী সঙ্কীর্ণ নয়, বরং তা প্রশস্ত। যদি আল্লাহ তা‘আলার দীন পালন করতে গিয়ে তোমরা কোথাও বাধাগ্রস্ত হও তাহলে সেখান থেকে হিজরত করে অন্যত্র চলে যাও, যেখানে গিয়ে তোমরা নিরাপদে আল্লাহ তা‘আলার দীন পালন করতে পারবে। যেখানে তোমাদেরকে ধর্ম পালনে কেউ কখনো বাধা দেবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ تَوَفّٰهُمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ ظَالِمِيْٓ أَنْفُسِهِمْ قَالُوْا فِيْمَ كُنْتُمْ ط قَالُوْا كُنَّا مُسْتَضْعَفِيْنَ فِي الْأَرْضِ ط قَالُوْآ أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ اللّٰهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوْا فِيْهَا)
“যারা নিজেদের ওপর জুলুম করে, তাদের প্রাণ হরণের সময় ফেরেশতাগণ বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, ‘দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম।’
তারা বলে, ‘আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে?’’ (সূরা আন্ নিসা ৪ : ৯৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ إِنَّ أَرْضِيْ وَاسِعَةٌ فَإِيَّايَ فَاعْبُدُوْنِ)
“হে আমার মু’মিন বান্দাগণ! নিশ্চয় আমার পৃথিবী প্রশস্ত; সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর।” (সূরা ‘আনকাবূত ২৯ : ৫৬)
সুতরাং পরবর্তীতে কোন অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না যে, আমরা জমিনে ইবাদত করতে বাধাগ্রস্ত হয়েছি। তাই যেখানে ইবাদত করতে বাধা আসবে সেখান থেকে নিরাপদ স্থানে হিজরত করতে হবে। তথাপি সঠিক ধর্ম ত্যাগ করা যাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সৎ কর্মের প্রতিদান ভাল-ই হয়ে থাকে।
২. ইবাদত করতে বাধা আসলে নিরাপদ স্থানে হিজরত করতে হবে।
৩. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে।
১৩-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেন : হে নাবী! তুমি কাফির-মুশরিকদেরকে এ সম্পর্কে অবহিত করে দাও যে, আমি যে-শাস্তির ব্যাপারে তোমাদেরকে সতর্ক করছি সে-শাস্তি আমাকেও পেতে হবে যদি আমি আমার রবের অবাধ্য হই।
এখানে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে সকলকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, রাসূল হওয়া সত্ত্বেও যদি কোন অপরাধ তাঁর দ্বারা হয় তাহলে তাঁকেও শাস্তি থেকে পরিত্রাণ দেয়া হবে না। তাহলে সাধারণ মানুষের আরো বেশি বেঁচে থাকা উচিত মহান আল্লাহর অবাধ্য হওয়া থেকে। সুতরাং আমি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করব। তারপর ধমক দিয়ে তাদেরকে বলছেন তোমরা যদি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ইবাদত কর তবে মনে রেখ! কিয়ামতের মাঠে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে যারা নিজেদের এবং নিজেদের পরিবারবর্গের ক্ষতিসাধন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(قَدْ خَسِرَ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِلِقَا۬ءِ اللّٰهِ وَمَا كَانُوْا مُهْتَدِيْنَ)
“আল্লাহর সাক্ষাৎ যারা অস্বীকার করেছে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা সৎ পথ প্রাপ্ত ছিল না।” (সূরা ইউনুস ১০ : ৪৫)
আর সেদিন অগ্নি তাদেরকে বেষ্টন করে নেবে যা হবে তাদের অবাধ্যতার শাস্তি। তাদের ঊর্ধ্বদিকে থাকবে আগুন, তাদের নিম্ন দিকেও থাকবে আগুন । আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(لَهُمْ مِّنْ جَهَنَّمَ مِهَادٌ وَّمِنْ فَوْقِهِمْ غَوَاشٍ ط وَكَذٰلِكَ نَجْزِي الظّٰلِمِيْنَ)
“তাদের শয্যা হবে জাহান্নামের এবং তাদের ওপরে আচ্ছাদনও, এভাবেই আমি জালিমদেরকে প্রতিফল দেব।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৪১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
(يَوْمَ يَغْشٰهُمُ الْعَذَابُ مِنْ فَوْقِهِمْ وَمِنْ تَحْتِ أَرْجُلِهِمْ وَيَقُوْلُ ذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ)
“সেদিন শাস্তি তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে ঊর্ধ্ব ও অধঃদেশ হতে এবং তিনি বলবেন : ‘তোমরা যা করতে তার স্বাদ আস্বাদন কর।’ (সূরা আল ‘আনকাবূত ২৯ : ৫৫)
সুতরাং সেদিন এ সমস্ত ক্ষতিগ্রস্ত লোক জাহান্নামের শাস্তি থেকে কোনই রেহাই পাবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে, তাঁর নাফরমানী করা যাবে না।
২. যারা নাফরমানী করবে তারা পরকালে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।
৩. জাহান্নামীদের ওপরে, নীচে, সামনে ও পেছনে সর্বদিকে আগুন তাদেরকে বেষ্টন করে নেবে।
১৭-২০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
যারা দুনিয়াতে ভাল কাজ করবে, শয়তানের আনুগত্য করা থেকে বেঁচে থাকবে, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে সুসংবাদ। দুনিয়াতে তারা আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যপ্রাপ্ত হবে, আর আখিরাতে তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি এবং জান্নাতে চিরস্থায়ী নেয়ামত লাভ করবে। যে নেয়ামত কখনো শেষ হবার নয়।
أحسن দ্বারা সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ কথাকে বুঝানো হয়েছে।
পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন যে, হে নাবী! তুমি যে সকল লোকদের হিদায়াতের ব্যাপারে চেষ্টা করছ তারাতো এমন লোক যাদের অবাধ্যতার কারণে তাদের ওপর জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে। সুতরাং তাদেরকে তুমি হিদায়াতের পথে নিয়ে আসতে পারবে না। তাদের জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম বিধিবদ্ধ হয়ে গেছে। তাই তাদেরকে তুমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না।
তবে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করে তাদের জন্য রয়েছে বহুতলবিশিষ্ট প্রাসাদ। অর্থাৎ জান্নাতে একের ওপর এক তলা হবে, যেমন পৃথিবীতে বহুতলবিশিষ্ট বিল্ডিং দেখা যায়। আর তার নিম্নদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে ঝর্ণাধারা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে হবে এবং তাগুতের অনুসরণ করা হতে বেঁচে থাকতে হবে।
২. দীনি আলোচনা মনোযোগসহকারে শুনতে হবে এবং তদানুযায়ী আমল করতে হবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) নফল রোযা এমন পর্যায়ক্রমে রেখে চলতেন যে, আমরা ধারণা করতাম, তিনি বুঝি রোযা রাখা বন্ধ আর করবেনই না। আবার কখনো কখনো এমনও হতো যে, তিনি পরপর বেশ কিছু দিন রোযা রাখতেনই না। শেষ পর্যন্ত আমরা ধারণা করতাম যে, তিনি বুঝি (নফল) রোযা আর রাখবেনই না। আর তিনি প্রতি রাত্রে সূরায়ে বানী ইসরাঈল ও সূরায়ে যুমার পাঠ করতেন। (এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, এই কুরআন কারীম তাঁরই কালাম এবং তিনিই এটা অবতীর্ণ করেছেন। এটা যে সত্য এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ … (আরবী) অর্থাৎ “এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অবতারিত। যা বিশ্বস্ত আত্মা (হযরত জিবরাঈল আঃ) আনয়ন করেছে এবং তোমার (নবীর সঃ) অন্তরের উপর অবতীর্ণ করেছে, যাতে তুমি সতর্ককারী হয়ে যাও। এটা স্পষ্ট আরবী ভাষায় অবতারিত।” মহামহিমান্বিত আল্লাহ আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অবশ্যই এটা মহা সম্মানিত কিতাব। এর সামনে হতে ও পিছন হতে বাতিল বা মিথ্যা আসতে পারে না। এটা বিজ্ঞানময়, প্রশংসিত (আল্লাহ)-এর পক্ষ হতে অবতারিত।” (৪১:৪১-৪২)।
মহান আল্লাহ এখানে বলেনঃ এই কিতাব অবতীর্ণ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট হতে, যিনি তাঁর কথায়, কাজে, শরীয়তে, তকদীর ইত্যাদি সব কিছুতেই মহা বিজ্ঞানময়।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! আমি তোমার নিকট এই কিতাব যথাযথভাবে অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং তুমি নিজে আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার আনুগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে যাও। আর সারা দুনিয়াবাসীকে তুমি এদিকেই আহ্বান কর। কেননা, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের যোগ্য আর কেউই নেই। তিনি অংশীবিহীন ও অতুলনীয়। দ্বীনে খালেস অর্থাৎ তাওহীদের সাক্ষ্যদানের মোগ্য তিনিই। অবিমিশ্র আনুগত্য তাঁরই প্রাপ্য।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তারা বলেঃ আমরা তো তাদের পূজা এজন্যেই করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে। যেমন তারা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী মনে করে তাদের পূজা অর্চনা শুরু করে দেয়, এই মনে করে যে, তারা তাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়ে দিবে। এর ফলে তাদের রুযী রোযগারে বরকত লাভ হবে। তাদের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, কিয়ামতের দিন ফেরেশতারা তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দিবে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করাবে। কেননা, তারা তো কিয়ামতকে বিশ্বাসই করতো না। এটাও বলা হয়েছে যে, তারা তাদেরকে তাদের সুপারিশকারী মনে করতো। অজ্ঞতার যুগে তারা হজ্ব করতে যেতো এবং ‘লাব্বায়েক’ শব্দ উচ্চারণ করতে করতে বলতোঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমরা আপনার দরবারে হাযির আছি। আপনার কোন অংশীদার নেই, শুধু এক অংশীদার রয়েছে, তার মালিকও আপনিই এবং সে যত কিছুর মালিক সেগুলোরও প্রকৃত মালিক একমাত্র আপনিই।” পূর্বযুগীয় ও পরযুগীয় সমস্ত মুশরিকদের আকীদা বা বিশ্বাস এটাই ছিল এবং সমস্ত নবী এ বিশ্বাস খণ্ডন করে তাদেরকে এক আল্লাহর পথে আহ্বান করেছেন। এ আকীদা মুশরিকরা বিনা দলীল প্রমাণেই গড়ে নিয়েছিল, যাতে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি এ ঘোষণা দেয়ার জন্যেঃ তোমরা আল্লাহরই ইবাদত করো ও তাগুত (শয়তান) হতে দূরে থাকো।” (১৬:৩৬) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার পূর্বে আমি যে রাসূলই পাঠিয়েছি তার কাছেই আমি অহী করেছিঃ আমি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর।”(২১:২৫) সাথে সাথে আল্লাহ তা’আলা এ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আকাশে যত ফেরেশতা রয়েছে, তারা যত বড়ই মর্যাদার অধিকারী হোক না কেন, তারা সবাই আল্লাহর সামনে সম্পূর্ণরূপে অসহায় ও শক্তিহীন। সবাই তাঁর দাস। তাদের তো এ অধিকারও নেই যে, তারা কারো সুপারিশের জন্যে মুখ খুলতে পারে। এটা তাদের সম্পূর্ণ ভুল আকীদা যে; ফেরেশতারা এ অধিকার রাখবেন, যেমন রাজা-বাদশাহদের দরবারে আমীর উমারা থাকে এবং তারা কারো জন্যে সুপারিশ করলে তার কাজ সফল হয়ে থাকে। আল্লাহ তা’আলা তাদের এ ভুল আকীদাকে এভাবে খণ্ডন করছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা আল্লাহর জন্যে মিসাল বর্ণনা করো না।” (১৬:৭৪) তিনি তো বে-মিসাল বা অতুলনীয়। তার সাথে কারো তুলনা চলে না। তিনি এটা হতে বহু ঊর্ধ্বে রয়েছেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ তারা যে বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ করছে আল্লাহ তার ফায়সালা করে দিবেন। প্রত্যেককেই তিনি কিয়ামতের দিন তার কাজের প্রতিফল প্রদান করবেন।
আল্লাহ পাক বলেনঃ “ঐ দিন আমি সকলকে একত্রিত করবো, অতঃপর ফেরেশতাদেরকে বলবোঃ এরা কি তোমাদেরই ইবাদত করতে? তারা উত্তরে বলবেঃ আপনি তো মহান ও পবিত্র, আপনিই আমাদের অভিভাবক, তারা আমাদের নয়, বরং জ্বিনদের উপাসনা করতো। তাদের অধিকাংশই তাদেরই উপর ঈমান রাখতো।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যে মিথ্যাবাদী ও কাফির আল্লাহ তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন না। অর্থাৎ যাদের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করা এবং যাদের অন্তরে আল্লাহর নিদর্শনাবলী এবং দলীল প্রমাণাদির উপর কুফরী দৃঢ়মূল হয়ে গেছে তাদেরকে তিনি সুপথে পরিচালিত করেন না।
এরপর আল্লাহ তা’আলা ঐ সব লোকের বিশ্বাসকে খণ্ডন করছেন যারা তার সন্তান সাব্যস্ত করে, যেমন মক্কার মুশরিকরা বলতো যে, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা, ইয়াহূদীরা বলতো, উযায়ের (আঃ) আল্লাহর পুত্র এবং খৃষ্টানরা বলতো যে, ঈসা (আঃ) আল্লাহর পুত্র (নাউযুবিল্লাহ)। তাদের এ আকীদা খণ্ডন করতে গিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করার ইচ্ছা করলে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি সন্তান মনোনীত করতেন। অর্থাৎ তারা যা ধারণা করছে, বিষয়টি তার বিপরীত হতো। এখানে শর্ত ঘটনার জন্যেও নয় এবং সম্ভাবনার জন্যেও নয়। বরং এটা সম্ভবই নয় যে, আল্লাহর সন্তান হবে। এখানে উদ্দেশ্য হলো শুধু ঐ লোকদের অজ্ঞতার বর্ণনা দেয়া। যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি আমি এই নিকৃষ্ট বিষয়ের (সন্তান গ্রহণের) ইচ্ছা করতাম তবে অবশ্যই আমার নিকটবর্তীদের (মধ্য) হতেই গ্রহণ করতাম, যদি আমাকে (সন্তান গ্রহণ) করতেই হতো।”(২১:১৭) আর এক আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি রহমানের (আল্লাহর) সন্তান হতো তবে সর্বপ্রথম আমিই হতাম ওর উত্তরাধিকারী।”(৪৩:৮১) সুতরাং এসব আয়াতে শর্ত ঘটে যাওয়াকে অসম্ভব বলা হয়েছে। এটা ঘটা বা ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনাকে বুঝাবার জন্যে বলা হয়নি। ভাবার্থ এই যে, এটাও হতে পারে না এবং ওটাও হতে পারে না। আল্লাহ তা’আলা এসব হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি আল্লাহ এক, প্রবল পরাক্রমশালী। সব কিছুই তার অধীনস্থ। সবাই তার কাছে বাধ্য, অপারগ, মুখাপেক্ষী, অভাবী এবং শক্তিহীন। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সবারই উপর তাঁর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য রয়েছে। যালিমদের এই আকীদা ও অজ্ঞতাপূর্ণ কথা হতে তার সত্তা সম্পূর্ণরূপে পবিত্র।
৫-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনিই সবারই সৃষ্টিকর্তা, অধিকর্তা এবং শাসনকর্তা। দিবস ও রজনীর পরিবর্তনও তাঁরই হুকুমে হচ্ছে। তাঁর নির্দেশক্রমে দিনরাত্রি শৃংখলার সাথে একের পিছনে আর একটি বরাবরই চলে আসছে। একটির পর অপরটি আসে না এমন কোন সময়ই হয় না। মহান আল্লাহ সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করেছেন। প্রত্যেকেই এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত পরিক্রমণ করবে। কিয়ামত পর্যন্ত এই শৃংখলা ও ব্যবস্থাপনায় কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হবে না। তিনি হলেন মহা পরাক্রমশালী ও ক্ষমাশীল।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একই ব্যক্তি হতে অর্থাৎ হযরত আদম (আঃ) হতে। অথচ মানুষের মধ্যে কতই না পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তাদের রঙ, ঢ, শব্দ, কথাবার্তা, আচার-আচরণ ইত্যাদি সবই পৃথক পৃথক। হযরত আদম (আঃ) হতেই তিনি তাঁর স্ত্রী হযরত হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। যেমন মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে মানব মণ্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতেই সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা হতে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দু’জন হতে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন।”(৪:১)
আল্লাহ তা’আলার উক্তিঃ তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন আট প্রকার আনআম। এর বর্ণনা সূরায়ে আনআমের নিম্নের আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নর ও মাদী আটঃ মেষের দু’টি ও ছাগলের দুটি।” (৬:১৪৩) (আরবী) অর্থাৎ “এবং উটের দু’টি ও গরুর দুটি।”(৬:১৪৪)।
এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তিনি তোমাদেরকে মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মৃত্তিকার উপাদান হতে। অতঃপর ওকে শুক্র বিন্দুরূপে স্থাপন করি এক নিরাপদ আধারে। পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি আলাকে, অতঃপর আলাককে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থি পঞ্জরে, অতঃপর অস্থি পঞ্জরকে ঢেকে দিই গোশত দ্বারা। অবশেষে ওকে গড়ে তুলি অন্য এক সৃষ্টি রূপে। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা কত মহান!” তিন অন্ধকার হলোঃ গর্ভাশয়ের অন্ধকার, গর্ভাশয়ের উপরের ঝিল্লীর অন্ধকার এবং পেটের অন্ধকার।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ তিনিই আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক, সার্বভৌমত্ব তাঁরই, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। বড়ই দুঃখের বিষয় যে, তোমাদের জ্ঞান-বিবেক সব লোপ পেয়ে গেছে। তা না হলে তোমরা এমন মহান ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহূকে ছেড়ে অন্যদের কখনো ইবাদত করতে না।
৭-৮ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা নিজের পবিত্র সত্তা সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তাঁর বান্দাদের মোটেই মুখাপেক্ষী নন। কিন্তু বান্দারা সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী। যেমন কুরআন কারীমে হযরত মূসা (আঃ)-এর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “যদি তোমরা কুফরী কর এবং ভূ-পৃষ্ঠে যারা রয়েছে সবাই কুফরীতে লিপ্ত হয়ে পড়ে তবে জেনে রেখো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ (বান্দাদের হতে) বেপরোয়া এবং প্রশংসিত।”(১৪:৮) সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “হে আমার বান্দারা! যদি তোমাদের পূর্ববর্তীরা ও পরবর্তীরা, তোমরা (মানবরা) ও জ্বিনেরা সবাই সর্বাপেক্ষা পাপী ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তির অন্তরের মত অন্তর বিশিষ্ট হয়ে যাও তবে আমার রাজত্বের তিল পরিমাণও হ্রাস পাবে না। বা আমার মর্যাদার অণু পরিমাণও হানি হবে না।”
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ আল্লাহ্ স্বীয় বান্দাদের অকৃতজ্ঞতা পছন্দ করেন না এবং তারা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হলে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং আরো বেশী বেশী নিয়ামত দান করেন।
এরপর ঘোষিত হচ্ছে:একের ভার অন্যে বহন করবে না। একজনের বদলে অন্যজনকে পাকড়াও করা হবে না। আল্লাহ্ তা’আলার কাছে কোন কিছুই গোপন নেই। মানুষের অন্তরে যা রয়েছে তা তিনি সম্যক অবগত আছেন।
অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ মানুষকে যখন দুঃখ-দৈন্য স্পর্শ করে তখন সে একনিষ্ঠভাবে তার প্রতিপালককে ডেকে থাকে। অর্থাৎ মানুষ তার প্রয়োজনের সময় অত্যন্ত বিনয় ও মিনতির সাথে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে এবং তাঁকে এক ও অংশীবিহীন মেনে নেয়। যেমন মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সমুদ্রে যখন তোমাদেরকে বিপদ স্পর্শ করে তখন শুধু তিনি ব্যতীত অপর যাদেরকে তোমরা আহ্বান করে থাকে। তারা অন্তর্হিত হয়ে যায়। অতঃপর তিনি যখন তোমাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে আনেন তখন তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও। মানুষ অতিশয় অকৃতজ্ঞ।”(১৭:৬৭) এ জন্যেই এখানে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ পরে যখন তিনি তার প্রতি অনুগ্রহ করেন তখন সে বিস্মৃত হয়ে যায় তার পূর্বে যার জন্যে সে ডেকেছিল। অর্থাৎ পূর্বে বিপদের সময় যে আল্লাহকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ডেকেছিল তাঁকে সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে যায়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন মানুষকে বিপদ স্পর্শ করে তখন সে শুয়ে, বসে অথবা দাঁড়িয়ে আমাকে আহ্বান করে থাকে, অতঃপর যখন আমি তার বিপদ দূর করে দিই। তখন সে এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয় যে, তাকে বিপদ স্পর্শ করার সময় সে যেন আমাকে আহ্বান করেনি।”(১০:১২) অর্থাৎ নিরাপদে থাকা অবস্থায় সে আল্লাহর সাথে শরীক স্থাপন করতে শুরু করে দেয়।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাও- কুফরীর জীবন অবস্থায় কিছুকাল উপভোগ করে নাও। বস্তুত তুমি জাহান্নামীদের অন্যতম।” এটা ধমক ও ভীতি প্রদর্শন। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তুমি বলঃ তোমরা (কিছুকাল) উপকার লাভ ও সুখ ভোগ করে নাও, তোমাদের প্রত্যাবর্তন স্থল জাহান্নাম।” (১৪:৩০) আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদেরকে কিছুকাল সুখ ভোগ করাববা, অতঃপর তাদেরকে কঠিন শাস্তির দিকে আসতে বাধ্য করবো।” (৩১:২৪)
# মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেন যে, যাদের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলী রয়েছে। তারা আল্লাহ্ তা’আলার নিকট মুশরিকদের সমতুল্য নয়। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা সবাই এক রকম নয়। কিতাবীদের মধ্যে অবিচলিত একদল আছে। তারা রাত্রিকালে আল্লাহর আয়াত আবৃত্তি করে এবং সিজদা করে।”(৩:১১৩)
(আরবী) দ্বারা এখানে নামাযের খুশু-খুযু’ (বিনয় ও নম্রতা) বুঝানো হয়েছে, শুধু দাঁড়ানো অবস্থাকে বুঝানো হয়নি। হযরত ইবনে মাসউদ (রা) হতে (আরবী)-এর অর্থ ‘অনুগত ও বাধ্য বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ সাহাবী হতে বর্ণিত আছে যে, (আরবী) দ্বারা অর্ধ রাত্রি বুঝানো হয়েছে। মানসূর (রঃ) বলেন যে, এটা হলো মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়। কাতাদা (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেন যে, এর দ্বারা প্রথম, মধ্য ও শেষ রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে।
এই আবেদ লোকগুলো একদিকে আল্লাহর ভয়ে থাকেন ভীত-সন্ত্রস্ত এবং অপরদিকে থাকেন তাঁর করুণার আশা পোষণকারী। সক্কর্মশীলদের অবস্থা এই যে, তাদের জীবদ্দশায় তাঁদের উপর আল্লাহর ভয় তার রহমতের আশার উপর বিজয়ী থাকে। কিন্তু মৃত্যুর সময় ভয়ের উপর আশাই জয়যুক্ত হয়।
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোকের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তার নিকট গমন করেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “নিজেকে তুমি কি অবস্থায় পাচ্ছ?” উত্তরে লোকটি বলেঃ “নিজেকে আমি এ অবস্থায় পাচ্ছি যে, আমি আল্লাহকে ভয় করছি ও তাঁর রহমতের আশা করছি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এরূপ সময়ে যার অন্তরে এ দুটো জিনিস একত্রিত হয় তার আশা আল্লাহ্ পুরো করে থাকেন এবং যা হতে সে ভয় করে তা হতে তাকে মুক্তি দান করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আবৃদ ইবনে হুমায়েদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। জামে তিরমিযী ও সুনানে ইবনে মাজাহতেও এটা বর্ণিত হয়েছে)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) … (আরবী)-এই আয়াতটি তিলাওয়াত করার পর বলেনঃ “এই গুণ তো হযরত উসমান (রাঃ)-এর মধ্যে ছিল। তিনি রাত্রিকালে বহুক্ষণ ধরে (তাহাজ্জুদ) নামায পড়তেন এবং তাতে কুরআন কারীমের লম্বা কিরআত করতেন, এমনকি কখনো কখনো তিনি একই রাকাআতে কুরআন খতম করে দিতেন।” যেমন এটা হযরত আবু উবাইদা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। কবি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সকালে তাঁর মুখমণ্ডল সিজদার কারণে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কেননা, তিনি তাসবীহ ও কুরআন পাঠে রাত্রি কাটিয়ে দেন।”
হযরত তামীমুদ দারী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি এক রাত্রে একশটি আয়াত পাঠ করে, তার আমলনামায় সারা রাত্রির কুনূতের সওয়াব লিখা হয়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
সুতরাং এরূপ লোক এবং মুশরিকরা কখনো সমান হতে পারে না। অনুরূপভাবে যারা আলেম এবং যারা আলেম নয় তারাও মর্যাদার দিক দিয়ে কখনো সমান হতে পারে না। প্রত্যেক বিবেকবান ব্যক্তির কাছে এই দুই শ্রেণীর লোকের পার্থক্য প্রকাশমান।
১০-১২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় মুমিন বান্দাদেরকে স্বীয় প্রতিপালকের আনুগত্যের উপর অটল ও স্থির থাকার এবং প্রতিটি কাজে ঐ পবিত্র সত্তার খেয়াল রাখার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং বলছেন যে, যারা এই দুনিয়াতে কল্যাণকর কাজ করে তাদের জন্যে আছে কল্যাণ। অর্থাৎ তাদের জন্যে ইহজগত ও পরজগত উভয় জায়গাতেই কল্যাণ রয়েছে।
এরপর আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ আল্লাহর পৃথিবী প্রশস্ত। সুতরাং এক জায়গায় যদি স্থিরতার সাথে আল্লাহর ইবাদত করতে সক্ষম না হও তবে অন্য জায়গায় চলে যাও। আল্লাহর অবাধ্যতার কাজ হতে বাঁচবার চেষ্টা কর। শিককে কোনক্রমেই স্বীকার করে নিয়ো না। ধৈর্যশীলদেরকে বিনা মাপে ও ওযনে এবং বিনা হিসাবে প্রতিদান প্রদান করা হয়। জান্নাত তাদেরই বাসস্থান।
মহান আল্লাহ্ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ তুমি বলে দাও আমাকে আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমাকে এটাও আদেশ করা হয়েছে যে, আমি যেন আত্মসমর্পণকারীদের অগ্রণী হই। অর্থাৎ আমি যেন আমার সমস্ত উম্মতের পূর্বে নিজেই আত্মসমর্পণকারী হই এবং আমার প্রতিপালকের অনুগত এবং তাঁর নির্দেশাবলী পালনকারী হই।
১৩-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি ঘোষণা করে দাও- যদিও আমি আল্লাহর রাসূল, তবুও আমি আল্লাহর আযাব হতে নির্ভয় নই। যদি আমি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই তবে কিয়ামতের দিন আমিও আল্লাহর আযাব হতে বাঁচতে পারবো না। সুতরাং অন্য লোকদের আল্লাহর অবাধ্যতা হতে বহুগুণে বেশী বেঁচে থাকা উচিত। হে নবী (সঃ)! তুমি আরো ঘোষণা করে দাও- আমি ইবাদত করি আল্লাহরই তাঁর প্রতি আমার আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে। অতএব তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইচ্ছা তার ইবাদত কর। এতেও ভীতি প্রদর্শন ও ধমক রয়েছে, অনুমতি নয়।
কিয়ামতের দিন পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হবে যারা নিজেদের ও নিজেদের পরিজনবর্গের ক্ষতি সাধন করে। কিয়ামতের দিন তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা এসে যাবে। তাদের পরিজনবর্গ জান্নাতে গেলে এরা জাহান্নামে যাচ্ছে। আর সবাই জাহান্নামে গেলে মন্দভাবে একে অপর হতে সরে থাকবে এবং হতবুদ্ধি ও চিন্তিত থাকবে। এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি।
অতঃপর জাহান্নামে তাদের অবস্থার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে যে, তাদের জন্যে থাকবে তাদের উধ্বদিকে অগ্নির আচ্ছাদন এবং নিম্নদিকেও আচ্ছাদন। যেমন। মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের বিছানা হবে জাহান্নামের আগুনের এবং তাদের উপরেও হবে আগুনের চাদর, এবং এরূপেই আমি যালিমদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকি।”(৭:৪১) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই দিন শাস্তি তাদের উপরে ও পায়ের নীচে পর্যন্ত ঢেকে ফেলবে এবং তিনি (আল্লাহ) বলবেনঃ তোমরা যা আমল করতে তার স্বাদ গ্রহণ কর।” (২৯:৫৫)
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ এতদ্বারা আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে সতর্ক করেন তার প্রকৃত শাস্তি হতে যে, নিশ্চিত রূপে ঐ শাস্তি দেয়া হবে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সুতরাং তার বান্দাদের সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত এবং পাপকার্য ও আল্লাহর অবাধ্যাচরণ পরিত্যাগ করা তাদের একান্তভাবে কর্তব্য। তাই তিনি বলেনঃ হে আমার বান্দাগণ! তোমরা আমার পাকড়াও, আমার শাস্তি, আমার ক্রোধ এবং আমার প্রতিশোধ ও হিসাব গ্রহণকে ভয় কর।
১৭-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:
বর্ণিত আছে যে, এ আয়াত দু’টি হযরত যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়েল (রাঃ), হযরত আবু যার (রাঃ) এবং হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু সঠিক কথা এই যে, এ আয়াত দু’টি যেমন এই মহান ব্যক্তিবর্গকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, অনুরূপভাবে এমন প্রত্যেক ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত যার মধ্যে এই পবিত্র গুণাবলী বিদ্যমান রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া সবারই প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করা এবং মহান আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকা। এ ধরনের লোকদের জন্যে উভয় জগতে সুসংবাদ রয়েছে। যারা মনোযোগ সহকারে কথা শুনে এবং ওর মধ্যে যা উত্তম তা গ্রহণ করে। এই প্রকৃতির লোকদেরকে মহান আল্লাহ্ সৎপথে পরিচালিত করেন এবং এঁরাই বোধশক্তি সম্পন্ন। যেমন আল্লাহ্ তাবারাকা ওয়া তা’আলা হযরত মূসা (আঃ)-কে তাওরাত প্রদানের সময় বলেছিলেনঃ “এটাকে তুমি শক্তভাবে ধারণ কর এবং তোমার কওমকে নির্দেশ দাও যে, তারা যেন এটাকে উত্তমরূপে ধারণ করে।” সুতরাং জ্ঞানী ও সৎ লোকদের মধ্যে ভাল কথা গ্রহণ করার সঠিক অনুভূতি অবশ্যই বিদ্যমান থাকে।
১৯-২০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ) ! হতভাগ্য হওয়া যার তকদীরে লিখা আছে তুমি তাকে সুপথ প্রদর্শন করতে পার না। আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, কে এমন আছে যে, তাকে পথ দেখাতে পারে? তোমার দ্বারা এটা সম্ভব নয় যে, তুমি তাকে সুপথে আনতে পার এবং আল্লাহর আযাব হতে রক্ষা করতে পার। হ্যা, তবে যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের জন্যে রয়েছে বহু প্রাসাদ, যার উপর নির্মিত রয়েছে আরো প্রাসাদ। সমস্ত আসবাবপত্র ওগুলোর মধ্যে সুন্দরভাবে সজ্জিত রয়েছে। প্রাসাদগুলো প্রশস্ত, সুউচ্চ ও সুদৃশ্য।
হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতে এমন কক্ষসমূহ রয়েছে যেগুলোর ভিতরের অংশ বাহির হতে এবং বাহিরের অংশ ভিতর হতে দেখা যায়। তখন একজন বেদুইন জিজ্ঞেস করলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এগুলো কাদের জন্যে?” তিনি জবাবে বললেনঃ “এগুলো তাদের জন্যে যারা কথাবার্তায় কোমল হয়, (দরিদ্রদেরকে) আহার করায় এবং রাত্রিকালে যখন লোকেরা ঘুমিয়ে থাকে তখন উঠে (তাহাজ্জুদের) নামায পড়ে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু মালিক আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতে এমন কক্ষসমূহ রয়েছে যেগুলোর বাহির ভিতর হতে এবং ভিতর বাহির হতে দেখা যায়। এগুলো আল্লাহ্ তা’আলা ঐসব লোকের জন্যে বানিয়েছেন যারা (দরিদ্রদেরকে) খাদ্য খেতে দেয়, কথাবার্তায় কোমলতা অবলম্বন করে, পর্যায়ক্রমে রোযা রাখে এবং (রাত্রে) লোকদের ঘুমন্ত অবস্থায় (উঠে তাহাজ্জুদের) নামায পড়ে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতীরা জান্নাতের মধ্যস্থিত কক্ষগুলোকে এমনিভাবে দেখবে যেমনিভাবে তোমরা আকাশ প্রান্তে তারকাগুলো দেখে থাকো।” (এ হাদীসটিও ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য হাদীসে আছে যে, জান্নাতের ঐ কক্ষগুলোর প্রশংসা শুনে সাহাবীগণ (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ওগুলো কি নবীদের জন্যে?” তিনি জবাব দিলেনঃ “হ্যা, নবীদের জন্যে তো বটেই, তাছাড়া ঐ লোকদের জন্যেও যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করে এবং রাসূলদেরকে সত্যবাদী বলে স্বীকার করে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা আপনার খিদমতে হাযির থাকি এবং আপনার চেহারা মুবারক অবলোকন করি ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের অন্তর নরম থাকে এবং আমরা আখিরাতের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। কিন্তু যখন আপনার নিকট হতে বিদায় গ্রহণ করি এবং পার্থিব কাজ-কারবারে লিপ্ত হই ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ি তখন আর আমাদের অবস্থা ঐরূপ থাকে না।” আমাদের এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যদি তোমরা সদা-সর্বদা ঐ অবস্থাতেই থাকতে যে অবস্থা আমার সামনে তোমাদের থাকে তাহলে ফেরেশতারা তাদের হাত দ্বারা তোমাদের সাথে মুসাফাহা করতেন এবং তোমাদের বাড়ীতে এসে তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। জেনে রেখো যে যদি তোমরা গুনাহই না করতে তবে আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্থলে এমন লোকদেরকে নিয়ে আসতেন যারা পাপ করতো, যেন আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করতে পারেন। আমরা জিজ্ঞেস করলাম:হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! জান্নাতের ভিত্তি কি দ্বারা তৈরী? তিনি উত্তরে বললেনঃ “স্বর্ণ ও রৌপ্যের ইট দ্বারা তৈরী। ওর চূন হলো খাটি মেশক আম্বর। ওর কংকরগুলো মণি-মুক্তা ও ইয়াকূত। ওর মাটি হলো যাফরান। যে তাতে প্রবেশ করবে সে প্রচুর মালের অধিকারী হবে, যার পরে মাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোনই আশংকা নেই। চিরস্থায়ীভাবে সে তথায় অবস্থান করবে। তাকে সেখান হতে কখনো বের করে দেয়া হবে এরূপ কোন সম্ভাবনাই নেই। সেখানে মৃত্যুর কোন ভয় নেই। সেখানে তাদের কাপড় পুরাতন হবে না। সেখানে তারা চির যৌবন লাভ করবে। জেনে রেখো যে, তিন ব্যক্তির দুআ অগ্রাহ্য হয় না। তারা হলোঃ ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ, রোযাদার ব্যক্তি এবং অত্যাচারিত ব্যক্তি। তাদের দুআ উপরে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং ওর জন্যে আকাশের দরগুলোকে খুলে দেয়া হয়। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা তখন বলেনঃ “আমার ইযযতের কসম! কিছুকাল পরে হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করবো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
মহান আল্লাহ বলেনঃ এ প্রাসাদগুলোর পাদদেশে নদী প্রবাহিত এবং তা এমন যে, যেখানে ইচ্ছা সেখানে পৌঁছাতে পারে এবং যখন যতটুকু ইচ্ছা প্রবাহিত করতে পারে। মুমিন বান্দাদেরকে আল্লাহ এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর আল্লাহ তা’আলা কখনো তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না।