أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৩)
[*পৃথিবী চিরস্থায়ী নয়,নিশ্চয় তোমার মৃত্যু হবে এবং ওদেরও মৃত্যু হবে:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার
পারা:২৪
২১-৩৫ নং আয়াত:-
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২১
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَسَلَکَہٗ یَنَابِیۡعَ فِی الۡاَرۡضِ ثُمَّ یُخۡرِجُ بِہٖ زَرۡعًا مُّخۡتَلِفًا اَلۡوَانُہٗ ثُمَّ یَہِیۡجُ فَتَرٰىہُ مُصۡفَرًّا ثُمَّ یَجۡعَلُہٗ حُطَامًا ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَذِکۡرٰی لِاُولِی الۡاَلۡبَابِ ﴿٪۲۱﴾
আপনি কি দেখেন না, আল্লাহ আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা ভূমিতে নির্ঝররূপে প্রবাহিত করেন তারপর তা দ্বারা বিবিধ বর্ণের ফসল উৎপন্ন করেন, তারপর তা শুকিয়ে যায়। ফলে আপনি তা হলুদ বর্ণ দেখতে পান, অবশেষে তিনি সেটাকে খড়-কুটোয় পরিণত করেন? এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে বোধশক্তিসম্পন্নদের জন্য।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২২
اَفَمَنۡ شَرَحَ اللّٰہُ صَدۡرَہٗ لِلۡاِسۡلَامِ فَہُوَ عَلٰی نُوۡرٍ مِّنۡ رَّبِّہٖ ؕ فَوَیۡلٌ لِّلۡقٰسِیَۃِ قُلُوۡبُہُمۡ مِّنۡ ذِکۡرِ اللّٰہِ ؕ اُولٰٓئِکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۲۲﴾
আল্লাহ তা’আলা যে ব্যক্তির বক্ষ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন এবং যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত আলোতে চলছে সেকি (সে ব্যক্তির মতো হতে পারে যে এসব কথা থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি?) ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের অন্তর আল্লাহর উপদেশ বাণীতে আরো বেশী কঠোর হয়ে গিয়েছে। সে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ডুবে আছে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২৩
اَللّٰہُ نَزَّلَ اَحۡسَنَ الۡحَدِیۡثِ کِتٰبًا مُّتَشَابِہًا مَّثَانِیَ ٭ۖ تَقۡشَعِرُّ مِنۡہُ جُلُوۡدُ الَّذِیۡنَ یَخۡشَوۡنَ رَبَّہُمۡ ۚ ثُمَّ تَلِیۡنُ جُلُوۡدُہُمۡ وَ قُلُوۡبُہُمۡ اِلٰی ذِکۡرِ اللّٰہِ ؕ ذٰلِکَ ہُدَی اللّٰہِ یَہۡدِیۡ بِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰہُ فَمَا لَہٗ مِنۡ ہَادٍ ﴿۲۳﴾
আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী নাযিল করেছেন, এমন একটি গ্রন্থ যার সমস্ত অংশ সামঞ্জস্যপূর্ণ যার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের পূনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এসব শুনে সে লোকদের লোম শিউরে ওঠে যারা তাদের রবকে ভয় করে। তারপর তাদের দেহমন বিগলিত হয়ে আল্লাহর স্মরণের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এটা হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত। এর দ্বারা তিনি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথে নিয়ে আসেন। আর যাকে আল্লাহ নিজেই হিদায়াত দান করেন না তার জন্য কোন হিদায়াতকারী নেই।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২৪
اَفَمَنۡ یَّتَّقِیۡ بِوَجۡہِہٖ سُوۡٓءَ الۡعَذَابِ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ وَ قِیۡلَ لِلظّٰلِمِیۡنَ ذُوۡقُوۡا مَا کُنۡتُمۡ تَکۡسِبُوۡنَ ﴿۲۴﴾
তুমি সে ব্যক্তির দুর্দশা কি করে উপলব্ধি করবে যে কিয়ামতের দিন আল্লাহর আযাবের কঠোর আঘাত তার মুখমণ্ডলের ওপর নেবে? এসব জালেমদের বলে দেয়া হবেঃ এখন সেসব উপার্জনের ফল ভোগ করো যা তোমরা উপার্জন করেছিলে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২৫
کَذَّبَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ فَاَتٰىہُمُ الۡعَذَابُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۲۵﴾
এদের পূর্বেও বহু লোক এভাবেই অস্বীকার করেছে। শেষ পর্যন্ত এমন এক দিক থেকে তাদের ওপর আযাব আপতিত হয়েছে যা তারা কল্পনাও করতে পারতো না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২৬
فَاَذَاقَہُمُ اللّٰہُ الۡخِزۡیَ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۚ وَ لَعَذَابُ الۡاٰخِرَۃِ اَکۡبَرُ ۘ لَوۡ کَانُوۡا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۶﴾
আল্লাহ দুনিয়ার জীবনেই তাদেরকে লাঞ্ছনার শিকার করেছেন। আখেরাতের আযাব তো তার চেয়েও অধিক কঠোর। হায়! তারা যদি তা জানতো।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২৭
وَ لَقَدۡ ضَرَبۡنَا لِلنَّاسِ فِیۡ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنِ مِنۡ کُلِّ مَثَلٍ لَّعَلَّہُمۡ یَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿ۚ۲۷﴾
এ কুরআনের মধ্যে আমি মানুষের জন্য নানা রকমের উপমা পেশ করেছি যাতে তারা সাবধান হয়ে যায়,
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২৮
قُرۡاٰنًا عَرَبِیًّا غَیۡرَ ذِیۡ عِوَجٍ لَّعَلَّہُمۡ یَتَّقُوۡنَ ﴿۲۸﴾
আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-২৯
ضَرَبَ اللّٰہُ مَثَلًا رَّجُلًا فِیۡہِ شُرَکَآءُ مُتَشٰکِسُوۡنَ وَ رَجُلًا سَلَمًا لِّرَجُلٍ ؕ ہَلۡ یَسۡتَوِیٰنِ مَثَلًا ؕ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ ۚ بَلۡ اَکۡثَرُہُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۹﴾
আল্লাহ্ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছেনঃ এক ব্যক্তির প্রভু অনেক, যারা পরস্পর বিরুদ্ধভাবাপন্ন এবং আরেক ব্যক্তি, যে এক প্রভুর অনুগত; এ দু’জনের অবস্থা কি সমান? সমস্ত প্ৰশংসা আল্লাহরই; কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩০
اِنَّکَ مَیِّتٌ وَّ اِنَّہُمۡ مَّیِّتُوۡنَ ﴿۫۳۰﴾
নিশ্চয় তোমার মৃত্যু হবে এবং ওদেরও মৃত্যু হবে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩১
ثُمَّ اِنَّکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ عِنۡدَ رَبِّکُمۡ تَخۡتَصِمُوۡنَ ﴿٪۳۱﴾
অবশেষে তোমরা সবাই কিয়ামতের দিন তোমাদের রবের সামনে নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করবে।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩২
فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ کَذَبَ عَلَی اللّٰہِ وَ کَذَّبَ بِالصِّدۡقِ اِذۡ جَآءَہٗ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَہَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۳۲﴾
সে ব্যক্তির চাইতে বড় জালেম আর কে যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছে এবং তার সামনে যখন সত্য এসেছে তখন তা অস্বীকার করেছে? এসব কাফেরের জন্য কি জাহান্নামে কোন জায়গা নেই?
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩৩
وَ الَّذِیۡ جَآءَ بِالصِّدۡقِ وَ صَدَّقَ بِہٖۤ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ ﴿۳۳﴾
যে সত্য নিয়ে এসেছে এবং যে তা সত্য বলে মেনেছে তারাই তো মুত্তাকী।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩৪
لَہُمۡ مَّا یَشَآءُوۡنَ عِنۡدَ رَبِّہِمۡ ؕ ذٰلِکَ جَزٰٓوٴُا الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿ۚۖ۳۴﴾
তারা তাদের রবের কাছে যা চাইবে তা-ই পাবে। এটা সৎকর্মশীলদের প্রতিদান।
সূরা:- ৩৯:আয-যুমার-৩৫
لِیُکَفِّرَ اللّٰہُ عَنۡہُمۡ اَسۡوَاَ الَّذِیۡ عَمِلُوۡا وَ یَجۡزِیَہُمۡ اَجۡرَہُمۡ بِاَحۡسَنِ الَّذِیۡ کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۳۵﴾
যাতে এরা যেসব মন্দকাজ করেছে আল্লাহ্ তা ক্ষমা করে দেন এবং এদেরকে এদের সর্বোত্তম কাজের জন্য পুরস্কৃত করেন।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২১-২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
দুনিয়ার জীবনটা ক্ষণস্থায়ী, পৃথিবীটাও নশ্বর, তাই দুনিয়া থেকে একদিন চলে যেতে হবে এমন একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর ঐ পানি পৃথিবীতে প্রবাহিত করে তার দ্বারা বিভিন্ন রকমের ফসল উৎপন্ন করেন। অতঃপর যখন এ ফসল শুকিয়ে যায় তখন তা পীতবর্ণ ধারণ করে; অবশেষে তিনি এগুলোকে খড়-কুটায় পরিণত করেন।
يَنَابِيْعَ অর্থ ঝর্ণা, অর্থাৎ বৃষ্টিরূপে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ হয় এবং তা শোষিত হয়ে ভূগর্ভে নেমে গিয়ে ঝর্ণার আকারে নির্গত হয়। তারপর এ পানি দ্বারা বিভিন্ন রকমের ফল-মূল উৎপন্ন করেন। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللّٰهَ أَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ءِ مَا۬ءً ج فَأَخْرَجْنَا بِه۪ ثَمَرٰتٍ مُّخْتَلِفًا أَلْوَانُهَا)
তুমি কি লক্ষ্য করনি? আল্লাহ আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন। তারপর আমি তা দিয়ে নানা বর্ণের ফলমূল উৎপন্ন করি। (সূরা ফাতির ৩৫ : ২৭) অতঃপর এসব ফল-মূল হলূদ বর্ণ ধারণ করতে করতে একসময় তা নষ্ট হয়ে যায়, পরে তা খড় কুটা ছাড়া অন্য কোন কাজে আসে না। মানুষের জীবনটাও এরূপ : যেমন শিশুকাল, বাল্যকাল, যৌবনকাল অতঃপর বৃদ্ধকাল-এভাবে একসময় মৃত্যুমুখে পড়তে হবে। সুতরাং এসব কিছুর মাঝে রয়েছে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন।
(أَفَمَنْ شَرَحَ اللّٰهُ صَدْرَه۫ لِلْإِسْلَامِ)
‘আল্লাহ যার বক্ষকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করেছেন’ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : ইসলামের জন্য অন্তর প্রশস্ত করে দিয়েছেন ফলে ইসলাম তার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে সূরা আন‘আম-এর ১২৫ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. পৃথিবী একদিন শেষ হবে, এটা চিরস্থায়ী নয়।
২. ইসলাম গ্রহণ করাটা মূলত আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে একটি নূর বা জ্যোতি ও নিয়ামত। সকলের ইসলাম গ্রহণ করার মতো সৌভাগ্য হয় না।
৩. কঠোর হৃদয়ের হওয়া যাবে না। বরং হৃদয়টাকে সর্বদা নরম রাখতে হবে।
২৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(أَحْسَنَ الْحَدِيْثِ)
‘অতি উত্তম বাণী’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল কুরআনুল কারীম।
(مُّتَشَابِهًا) এর অর্থ কুরআনের শ্র“তিমধুর ও সুখপাঠ্য বাণী, তার সাহিত্যশৈলী, শব্দালঙ্কার, অর্থের সত্যতা ইত্যাদি গুণাবলীতে পারস্পরিক সাদৃশ্যপূর্ণতা। অথবা কুরআন পূর্ব আসমানী গ্রন্থসমূহের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। অর্থাৎ কুরআন অন্য সকল আসমানী কিতাবের অনুরূপ ও সত্যায়নকারী সর্বোত্তম কিতাব।
مَّثَانِيَ ‘বার বার তেলাওয়াত করা হয়’ অর্থাৎ এ কুরআনে কাহিনী, আদেশ-উপদেশ ও বিধি-বিধানগুলোকে বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যারা আল্লাকে ভয় করে তারাই ঐ সকল আযাব ও শাস্তির ধমক ও সর্তকবাণী বুঝতে পারে। যার ফলে আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে তাদের দেহ শিউরে ওঠে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : তাদের দেহ-মন অর্থাৎ মু’মিন বান্দাদের মন আল্লাহ তা‘আলার স্মরণে নরম হয়ে যায়। এর কারণ হল, যখন তাদের মনে আল্লাহ তা‘আলার করুণা, ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভের আশা জাগে তখন তাদের অন্তর নরম হয়ে যায় এবং তখন তারা আল্লাহ তা‘আলার স্মরণে মগ্ন হয়ে পড়ে। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, এতে আল্লাহ তা‘আলার আওলীয়াগণের গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার ভয়ে তাঁদের অন্তর কম্পিত হয়, তাঁদের চোখ অশ্র“সিক্ত হয়ে যায় এবং আল্লাহ তা‘আলার যিকির দ্বারা তাঁরা মনে শান্তি পান। যিকির করতে গিয়ে তাঁরা নেশাগ্রস্ত মাতালদের মত সংজ্ঞাহীন হয়ে যান না। কারণ দলবদ্ধভাবে মাতালের মত উঁচু আওয়াজ করে যিকির করা শরীয়ত পরিপন্থী। এ সম্পর্কে যত বর্ণনা রয়েছে সব মানুষের তৈরি করা কথা, একটাও আল্লাহ তা‘আলার রাসূলের হাদীস নয়। আসমা বিনতে আবূ বকর (রাঃ) বলেন : সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ অবস্থা ছিল তা-ই। তাদের সামনে কুরআন তেলাওয়াত করা হলে তাদের চক্ষু অশ্র“সিক্ত হয়ে যেত এবং দেহ শিউরে উঠত। (কুরতুবী)
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন, এ বিষয়ে মু’মিনগণ কাফিরদের থেকে কয়েক দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। প্রথমত : মু’মিনদের শ্রাব্যবস্তু হল কুরআনুল কারীম, আর কাফিরদের হল নির্লজ্জ গায়িকাদের গান-বাজনা। দ্বিতীয়ত : মু’মিনরা কুরআন শোনে ভয়, আশা, অনুধাবন, উপলব্ধির সাথে। আর তারা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমার আশায় কান্না করেন এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। পক্ষান্তরে কাফিররা হৈ-হুল্লা করে এবং খেলাধূলায় ব্যস্ত থাকে। মু’মিনগণ কুরআন শুনে আদব ও বিনয় প্রকাশ করে যার ফলে শাস্তির কথায় তাদের দেহ শিউরে ওঠে এবং তাদের অন্তর আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আসক্ত হয়ে যায়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মু’মিনদের বৈশিষ্ট্যাবলী সম্পর্কে জানলাম।
২. কাউকে হিদায়াত দান আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো ক্ষমতা নেই।
৩. প্রতিটি আমল ছোট হোক আর বড় হোক তা শরীয়তসম্মত পন্থায় হতে হবে, অন্যথায় আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না।
২৪-৩১ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(اَفَمَنْ یَّتَّقِیْ بِوَجْھِھ۪ سُوْ۬ئَ الْعَذَابِ….. لَوْ کَانُوْا یَعْلَمُوْنَﭩ)
এ আয়াতগুলোতে কিয়ামতের মাঠে কাফির-মুশরিকদের কেমন অবস্থা হবে, তারা কেমন শাস্তি প্রাপ্ত হবে সে কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যারা দুনিয়াতে মন্দ কাজ করত পরকালে তারা তাদের চেহারা দ্বারা জাহান্নামের আগুন ঠেকাতে চাইবে। কিন্তু তা করতে সক্ষম হবে না, তখন তাকে ভর্ৎসনা করা হবে এবং বলা হবে- তুমি তোমার অপকর্মের প্রতিদানস্বরূপ এ কাঠিন শাস্তি ভোগ কর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(يَوْمَ يُسْحَبُوْنَ فِي النَّارِ عَلٰي وُجُوْهِهِمْ ط ذُوْقُوْا مَسَّ سَقَرَ)
“যেদিন তাদেরকে উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; (বলা হবে) জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন কর।” (সূরা কামার ৫৪ : ৪৮)
অতএব যারা দুনিয়াতে মন্দ আমল করবে, যারা শয়তানের অনুসরণ করবে তাদের অবস্থা মৃত্যুর পর খবুই কঠিন হবে। তাই আমাদের উচিত শয়তানের আনুগত্য বর্জন করে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করা। তাহলেই পরকালে নাজাত পাওয়ার আশা করতে পারি।
(وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ…)
দৃষ্টান্ত বর্ণনা এক প্রকার ভাষা অলঙ্কার। প্রত্যেক ভাষায় দৃষ্টান্তের ব্যবহার দেখা যায়। আল্লাহ তা‘আলাও কুরআনে অসংখ্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। এগুলোকে আমসালুল কুরআন বলা হয়। দৃষ্টান্তের মাধ্যমে কোন অবোধগম্য বিষয়কে সহজে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়। তাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে প্রত্যেক প্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে বুঝানোর জন্য এ কুরআনে সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে যাতে সকল কথা তাদের মনে গেঁথে যায় এবং তারা নসীহত গ্রহণ করে।
(غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ)
‘এতে বিন্দুমাত্রও বক্রতা নেই’ অর্থাৎ কুরআন শুদ্ধ আরবী ভাষায় নাযিল করা হয়েছে যা সকল প্রকার বক্রতা ও জটিলতা থেকে মুক্ত। যাতে মানুষ তাতে বর্ণিত শাস্তিসমূহকে ভয় করে এবং তাতে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি অর্জন করার নিমিত্তে আমল করে।
দৃষ্টান্তের উপকারিতা উল্লেখ করার পর একটি দৃষ্টান্তের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা হল-
(رَّجُلًا فِيْهِ شُرَكَا۬ءُ…)
এটি বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ও একত্ববাদে বিশ্বাসীর একটি দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ একজন দাস যার কয়েকজন মনিব আছে যাদের মন-মানসিকতা আলাদা আলাদা, সুতরাং তারা আপোষে তাকে নিয়ে ঝগড়া করে। আর একজন দাস যার মাত্র একজন মনিব, তার মালিকানায় অন্য কেউ শরীক নেই। উক্ত দাস দু’টি কি সমান হতে পারে? না, কক্ষণই না। অনুরূপ ঐ মুশরিক ব্যক্তি যে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য উপাস্যের ইবাদত করে এবং ঐ মু’মিন ব্যক্তি যে একমাত্র এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে, তার সাথে কাউকে শরীক করে না, এদের উভয়ে সমান হতে পারে না।
(إِنَّكَ مَيِّتٌ وَّإِنَّهُمْ مَّيِّتُوْنَ….. تَخْتَصِمُوْنَ)
অর্থাৎ হে নাবী! তুমি ও তোমার বিরোধী সকলেই মৃত্যুবরণ করে আখিরাতে আমার নিকট উপস্থিত হবে। পৃথিবীতে তোমাদের মাঝে তাওহীদ ও শির্কের ফায়সালা সম্ভব হয়নি এবং তুমি এ বিষয়ে ঝগড়া করতেই থেকেছ। কিন্তু আমি এখানে তার ফায়সালা করব এবং মিথ্যাবাদীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাব।
উক্ত দু’টি আয়াত দ্বারা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর কথা প্রমাণ হয়। যেমন সূরা আলি-ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াতেও সে কথা প্রমাণ হয়। অতএব নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে “হায়াতুন নাবী” বলে বিশ্বাস করা সম্পূর্ণ কুরআন সুন্নাহ বিরোধী আক্বিদাহ। বরং তিনিও অন্যান্য মানুষের মত মৃত্যুবরণ করেছেন, ফলে তাঁকেও দাফন করা হয়েছে এবং কবরে তিনি অবশ্যই বারযাখী জীবন পেয়েছেন। তাঁর কবর এখনো মদীনাতে রয়েছে। তবে নাবীদের মৃত্যু ও সাধারণ মানুষের মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য হলো, নাবীরা মারা গেলে তাদের দেহ অক্ষত থাকে, নষ্ট হয় না। আর আমাদের নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম দিলে আল্লাহ তা‘আলা সে সালাম তাঁর নিকট পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন।
হাশরের আদালতে মাজলূম ব্যক্তি যেভাবে কিসাস আদায় করবে :
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এখানে إِنَّكُمْ শব্দের মধ্যে মু’মিন, কাফির, জালিম-মাজলূম সবাই শামিল। তারা সবাই নিজ নিজ মোকদ্দমা আল্লাহ তা‘আলার আদালতে দায়ের করবে এবং আল্লাহ তা‘আলা জালিমকে মাজলূমের হক ফেরৎ দিতে জালিমকে বাধ্য করবেন। সহীহ বুখারীতে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : কারো যিম্মায় কারো কোন হক থাকলে তার উচিত দুনিয়াতেই তা আদায় করা অথবা ক্ষমা নিয়ে মুক্ত হয়ে যাওয়া। কেননা পরকালে টাকা-পয়সা থাকবে না যে, তা দিয়ে হক আদায় করা যাবে। সেখানে জালিম ব্যক্তির কিছু সৎ কর্ম থাকলে তা জুলুমের পরিমাণে তার কাছ থেকে নিয়ে মাজলুম ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়া হবে। তার কাছে কোন সৎকর্ম না থাকলে মাজলুম ব্যক্তির গুনাহ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হা. ২৪৪৯, সহীহ মুসলিম হা. ৯৩৩২)
আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : একদিন সাহাবায়ে কেরামকে প্রশ্ন করলেন তোমরা কি জান নিঃস্ব কে? তারা বললেন : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমরা তো নিঃস্ব মনে করি তাকে যার কোন অর্থকড়ি নেই এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র নেই। তিনি বললেন : আমার উম্মাতের মধ্যে সত্যিকার নিঃস্ব সে ব্যক্তি যে কিয়ামতের দিন অনেক সালাত, সিয়াম, হাজ্জ ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত হবে কিন্তু দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছিল, কারো বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়েছিল, কারো অর্থকড়ি অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করেছিল। কাউকে হত্যা করেছিল এবং কাউকে প্রহার করে দুঃখ দিয়েছিল। এসব মাজলূম সবাই আল্লাহ তা‘আলার সামনে তাদের প্রতি জুলূমের বিচার দাবী করবে। ফলে তার সৎ কর্মসমূহ তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হবে। যদি তার সৎ কর্ম নিঃশেষ হয়ে যায় এবং হকদারের হক অবশিষ্ট থাকে তবে হকদারের গুনাহ তার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে জাহ্ন্নাামে নিক্ষেপ করা হবে। অতএব এ ব্যক্তির সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হয়ে যাবে। সেই প্রকৃত নিঃস্ব। (সহীহ মুসলিম হা. ২৫৮১)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. শয়তানের অনুসরণ করে কোনদিন সফলতার আশা করা যায় না।
২. কাফিররা পরকালে চরমভাবে লাঞ্ছিত হবে।
৩. মানুষের বোধগম্যের জন্য আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে প্রত্যেক প্রকার দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন।
৪. মুশরিকরা কক্ষনো তাওহীদপন্থী মু’মিনের সমান হতে পারে না।
৫. নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতেকাল করেছেন, তিনি ‘হায়াতুন নাবী’ নন, বরং তিনি কবরের জীবনে রয়েছেন।
৩২-৩৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পরকালে কাফির ও মুশরিকদের এবং তাদের বিপরীতে মু’মিনদের অবস্থা কেমন হবে সে বিষয়ে এ আয়াতগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন- ঐ ব্যক্তিই সবচেয়ে বড় জালিম, যে আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যা আরোপ করে অর্থাৎ বলে আল্লাহ তা‘আলার সন্তান-সন্ততি, স্ত্রী অথবা তাঁর শরীক আছে, অথচ তিনি এ সমস্ত জিনিস থেকে পাক ও পবিত্র। তারা তাদের নিকট আগত সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। অর্থাৎ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদের নিকট যে তাওহীদের বাণী নিয়ে এসেছেন তারা তা প্রত্যাখ্যান করে শির্কেই লিপ্ত থাকে। তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা‘আলা বলেন : এরাই হল জাহান্নামী।
পক্ষান্তরে যারা মু’মিন তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা হল ঐ সকল লোক যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে অর্থাৎ মুহাম্মাদ ও যারা আগত সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে তারা পরকালে চিরসুখের উদ্যান জান্নাতে বসবাস করবে। তথায় তাদের জন্য তা-ই থাকবে যা তাদের মন কামনা করবে। আর এটাই হল مُحْسِنِيْن অর্থাৎ সৎ কর্মপরায়ণদের পুরস্কার। مُحْسِنِيْن এর একটি অর্থ হল, যারা নেক কাজ করেন। দ্বিতীয় অর্থ- যারা নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করা সবচেয়ে বড় জুলুম, যার পরিণতি জাহান্নাম।
২. সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলে বিশ্বাস করতে হবে। এর উল্টো করা যাবে না।
৩. মুহসীনদের (সৎকর্মশীলদের) পরিচয় জানলাম, যাদের শেষ পরিণতি চির সুখের জান্নাত।
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
**সূরার এ অংশে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামার পর পৃথিবীর উদ্ভিদ ও তরুলতার কী অবস্থা হয় এবং কিভাবে তা পার্থিব জীবনের শেষ পরিণতিতে পৌছে যায়, তার উদাহরণ দেয়া হয়েছে। দুনিয়ার জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব বুঝানাের জন্যে অনেক সময় এটাকে উদাহরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। বিবেকবান লােকদের এ উদাহরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেও বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে আকাশ থেকে বৃষ্টি নামার উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়কে পুনরুজীবিত করার জন্যে আকাশ থেকে কিতাব ও ওহী নাযিল হওয়ার দিকেও ইংগিত করা হয়েছে। সেই সাথে এই কিতাবের প্রতি যাদের অন্তর উন্মুক্ত, তাদের অন্তরের সাড়াদানের বিষয়টাও চিত্রিত করে দেখানাে হয়েছে। দেখানাে হয়েছে যে, কত ভয় ভীতি শিহরণ, নম্রতা ও বিনয়ের সাথে তাদের অন্তর এই কিতাবের প্রতি সাড়া দেয়। অনুরূপভাবে যারা আল্লাহর কিতাবকে মেনে নেয় এবং যারা পাষাণ হৃদয় হওয়ার কারণে মেনে নেয় না, এই উভয় গােষ্ঠীর পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। সবার শেষে তাওহীদ বিষয়ে আলােচনা করতে গিয়ে এক আল্লাহর এবাদাতকারী ও একাধিক উপাস্যের উপাসকের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। এই উভয় গােষ্ঠী এক সমান নয় এবং তাদের অবস্থাও এক রকম নয়। অনুরূপ যে দাস একাধিক মালিকের অধীন এবং যে দাস একজনমাত্র মালিকের অধীন ও অধিষ্ঠিত, এই দু’জন দাসও সমান নয়। ‘তুমি কি দেখােনি যে, আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন…’(আয়াত-২২) *বৃষ্টির পানি ও মাঠের ফসল সবই আল্লাহর কুদরত : এখানে যে বিষয়টার প্রতি কোরআন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং চিন্তাভাবনা করার আহবান জানিয়েছে, তা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বার বার সংঘটিত হয়ে থাকে। ফলে এটাকে আর নতুন কিছু মনে হয় না এবং এর প্রতি কারাে তেমন কৌতুহল থাকে না। তথাপি কোরআন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর হাত সক্রিয় থাকা ও তার ফলশ্রুতির প্রতি মনােযোগ আকর্ষণ করে। আকাশ থেকে বর্ষিত এই পানি আসলে কী এবং কিভাবে বর্ষে? বার বার দেখার কারণে এর সাথে আমরা এত পরিচিত হয়ে গেছি যে, এর প্রতি আমরা গভীরভাবে দৃষ্টি দেয়া ও এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার কোনাে প্রয়ােজন অনুভব করি না; বরং ব্যাপারটা এক নযর দেখেই তাড়াতাড়ি নিজের কাজে চলে যাই। আসলে পানির সৃষ্টিই একটা অলৌকিক ঘটনা। আমরা যদিও জানি, নির্দিষ্ট পরিবেশে দুই বিন্দু হাইড্রোজেনের সাথে এক বিন্দু অক্সিজেন মিলিত হলেই পানির সৃষ্টি হয়, কিন্তু এই তথ্য আমাদের মনকে সচকিত করে দেয় যেন আমরা এই জিনিসটার সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর হাত সক্রিয় দেখি। আল্লাহর হাত এই সমগ্র বিশ্বজগত এমনভাবে সৃষ্টি করেছে যে, এখানে ঠিক প্রয়ােজনীয় পরিমাণে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যায় এবং এগুলাের মিলিত হওয়া ও মিলিত হওয়ার মাধ্যমে পানি সৃষ্টি হওয়ার অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করে। এ কারণেই পৃথিবীতে পানি যদি না থাকতাে তাহলে জীবনের অস্তিত্বও থাকতাে না। এভাবে আসলে একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় প্রথমে পানি ও তারপর জীবনের উদ্ভব ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ার পেছনে রয়েছেন মহান আল্লাহ। আর এর প্রতিটা ধাপ ও প্রতিটা জিনিস আল্লাহর তৈরী। তারপর পানির সৃষ্টি হওয়ার পর তা যেভাবে পৃথিবীতে নামে, সেটা আরেকটা আলৌকিক ব্যাপার। পৃথিবী ও প্রাকৃতিক জগত সৃষ্টিই করা হয়েছে এমনভাবে যে, আল্লাহর ব্যবস্থাপনা অনুযায়ী পানির উৎপত্তি ও তার বর্ষণ সম্ভব হয়। এরপর পানি আকাশ থেকে নামার পরবর্তী সময়ে যে কাজটা সম্পন্ন হয়, তা হলাে, তারপর সেই পানিকে তিনি জলাশয়গুলােতে নিয়ে যান। এই জলাশয় দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠস্থ নদীনালা এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস উভয়ই বুঝানাে হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠের পানি চুইয়ে চুইয়ে ধীরে ধীরে ভূগর্ভে গিয়ে সংরক্ষিত হয়। তারপর পুনরায় তা ঝর্ণা ও পুকুরের আকারে বয়ে আসে। আল্লাহর হাত এই পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ভূগর্ভের এতাে তলদেশে যেতে দেয় না যেখান থেকে তা আর বেরিয়ে আসবে না। ‘অতপর তা দ্বারা নানা রকমের ফসল ফলান।’ বৃষ্টির পানি থেকে যে উদ্ভিদ-জীবনের উন্মেষ ঘটে, সেটাও একটা অলৌকিক ব্যাপার। এর ভেতরে মানুষের চেষ্টা তদবীরের কোনােই হাত থাকে না। ক্ষুদ্র একটা চারাগাছ তার ওপর থেকে মাটির আবরণ ঝেড়ে ফেলে দেয় এবং বিপুল পরিমাণ মাটির ভারী বােঝা সরিয়ে ভূ-পৃষ্ঠের ওপরে আলাে বাতাসপূর্ণ মুক্ত দিগন্তে মাথা তােলে। তারপর সে ধীরে ধীরে শূন্যের দিকে ওঠতে থাকে। এ দৃশ্য দেখলেই যে কোনাে মানুষের মুক্ত মন আল্লাহর স্মরণে সােচ্চার হয়ে ওঠতে পারে। প্রত্যেক জিনিসের সৃষ্টিকর্তা ও পথপ্রদর্শক মহান আল্লাহর অনুভূতি ও চেতনা সেখানে জেগে ওঠতে পারে। একই জমিতে কত রকমারি উদ্ভিদ জন্মে। আবার একই উদ্ভিদে এবং একই ফুলে কত রংয়ের সমারােহ ঘটে। এটা আসলে সৃষ্টিকর্তার অসীম ক্ষমতার প্রতীক আর একই সাথে মানুষ যে কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, তারও অকাট্য প্রমাণ। এই বাড়ন্ত, অপরিপক্ক, কোমল ও কচি চারাটি পূর্ণতা লাভ করে এবং নির্ধারিত সময় পূর্ণ করার পর তা ভিন্নরূপ ধারণ করে। বলা হয়েছে, ফলে তোমরা তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও। অর্থাৎ চারাটি এখন সেই লক্ষ্যে পৌছে গেছে যা সৃষ্টির বিধানে, জগতের নিয়মে এবং জীবনের বিবর্তনে একই ধারায় নির্ধারিত করা আছে। তাই এখন সেটা কাটার উপযুক্ত হয়েছে। এরপর আসছে আর একটি স্তর। তা হলাে, ‘এরপর তাকে খড়-কুটায় পরিণত করে দেন।’ কারণ এখন এর সময় ফুরিয়ে এসেছে, এর কার্যকারিতা শেষ হয়েছে এবং জীবনদাতা তার জন্যে যে কালচক্র নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন সেটাও থমকে গেছে। এসব বিষয় নিয়ে চিন্তাশীল ও বুদ্ধিমান লােকদের চিন্তা ভাবনা করা এবং আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত জ্ঞান ও চিন্তাশক্তি দ্বারা উপকৃত হওয়া উচিত। তাই বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় এতে বুদ্ধিমানদের জন্যে উপদেশ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যার বক্ষ ইসলামের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন…'(আয়াত ২২-২৩) আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হলে যেরূপ বৃক্ষ তরুলতা ও ফলমূল উৎপন্ন হয়, ঠিক তদ্রুপ আকাশ থেকে ঐশীবাণী প্রেরিত হয়, যার স্পর্শ পেলে হৃদয় সজীবতা লাভ করে, উন্মুক্ত হয় এবং স্পন্দিত হয়, কিন্তু কঠিন হৃদয়ে এর কোনাে প্রভাবই পড়ে না, যেমন প্রভাব পড়ে না কঠিন পাথরের ওপর। কারণ পাথরে জীবনের কোনাে বৈশিষ্ট্য নেই, কোনাে কোমলতা নেই। যেসব হৃদয়ের মাঝে সত্য ও মঙ্গল গ্রহণ করার মতাে যােগ্যতা আছে বলে আল্লাহ তায়ালা জানেন কেবল সে হৃদয়কেই তিনি ইসলামের জন্যে উন্মুক্ত করে দেন, তার আলোর সাথে সংযুক্ত করে দেন, ফলে সেসব হৃদয় তার নূরে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর সে কারণেই এসব হৃদয়ের মাঝে এবং অন্যান্য কঠিন হৃদয়ের মাঝে বিরাট পার্থক্য ও দূরত্ব লক্ষ্য করা যায়। তাই বলা হয়েছে, ‘যাদের অন্তর আল্লাহ তায়ালার স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্য দুর্ভোগ। তারা সুস্পষ্ট গােমরাহীতে রয়েছে।’ আলােচ্য আয়াতে সেসব হৃদয়ের গুণাগুণ ও প্রকৃতি বর্ণনা করা হয়েছে যা ইসলাম গ্রহণ করার উপযুক্ত। কেবল সেসব হৃদয়ই ইসলামের জন্যে উন্মুক্ত হয়। কারণ, এসব হৃদয় আল্লাহর নূর থেকে আলােকপ্রাপ্ত হয় এবং তার কাছ থেকেই জীবন ও সজীবতা লাভ করে। অপরদিকে কঠিন হৃদয়ের বর্ণনাও দেয়া হয়েছে। এসব হৃদয় হয় কঠিন শুষ্ক, মৃত ও আলােশূন্য। কাজেই দু’ধরনের হৃদয়ের মাঝে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে মােমেনদের হৃদয় এই কোরআন কিভাবে গ্রহণ করে সে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই কোরআন হচ্ছে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ, যার প্রকৃতিতে কোনাে অসংগতি নেই, যার দিকনির্দেশনায় কোনাে অসংগতি নেই, যার মূল বক্তব্যে কোনাে অসংগতি নেই এবং যার বৈশিষ্ট্যের মাঝে কোনাে গরমিল নেই। এর ঘটনাগুলাে বার বার বর্ণিত হয়েছে। এর নির্দেশাবলী বার বার বর্ণিত হয়েছে। এর দৃশ্যগুলাে বার বার চিত্রায়িত হয়েছে, কিন্তু তা সত্তেও এতে আদৌ কোনাে বিরােধ নেই, কোনাে অসংগতি নেই। বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে অত্যন্ত সুচারুরূপে ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ ভংগিতে সেগুলাের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। যারা আল্লাহকে ভয় করে চলে, যারা সতর্কভাবে জীবন যাপন করে, যারা আল্লাহর ব্যাপারে আশা পোষণ করে, তারা এই মহান বাণী গ্রহণ করতে গিয়ে ভয়ে কেঁপে ওঠে, এক অব্যক্ত ও প্রচণ্ড প্রভাবের ফলে তাদের পশম খাড়া হয়ে ওঠে। এরপর তাদের আত্মা শান্ত হয়ে যায়, তাদের মন এই বাণীর সাথে পরিচিত হয়। ফলে তাদের দেহ-মন ভরে ওঠে অনাবিল প্রশান্তি ও বিনম্রতা। এই জীবন্ত ও সংবেদনশীল দৃশ্যটি শব্দের মাধ্যমে এমনভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে যেন তাতে একটা গতির সঞ্চার হয়েছে। দেহ ও মনের এই অবস্থা কেন এমন হয়, সেদিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে, ‘এটাই আল্লাহর পথনির্দেশ, এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন।’ অর্থাৎ সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে যখন আল্লাহর কুদরতী হাত মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয় তখনই তাতে স্পন্দন জাগে, তাতে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। অপরদিকে পথভ্রষ্টদের ব্যাপারে বলা হয়েছে ‘আর আল্লাহ যাকে গােমরাহ করেন তার কোনাে পথপ্রদর্শক নেই।’ অর্থাৎ তিনি যাদের সম্বন্ধে জানেন যে, এরা কখনও হেদায়াত গ্রহণ করবে না; বরং পথভ্রষ্টতার ওপরই দাঁড়িয়ে থাকবে, কেবল তাদেরই তিনি সত্যের আলাে থেকে বঞ্চিত রাখেন। পরকালে এদের পরিণতি কি হবে সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি কেয়ামতের দিন তার মুখ দ্বারা অশুভ আযাব ঠেকাবে…'(আয়াত ২৪) মানুষ সাধারণত দু’হাত দিয়ে নিজের চেহারা ও দেহকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করে, কিন্তু সে পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে এই হাত দিয়েও রক্ষা করতে পারবে না, আর পা দিয়েও রক্ষা করতে পারবে না। ফলে সেদিন তাকে চেহারার সাহায্যেই সে আগুন ঠেকাতে হবে এবং নিজেকে কঠিন আযাব থেকে রক্ষা করার ব্যর্থ চেষ্টা করবে। কি ভয়ানক দৃশ্য, কি মর্মান্তিক শাস্তি। এই কঠিন মুহুর্তে আবার তাকে শুনতে হবে তিরস্কার ও ভৎর্সনাপূর্ণ মন্তব্য। তাকে বলা হবে, ‘তোমরা যা করতে তার স্বাদ আস্বাদন করবে।’ এই দৃশ্য বর্ণনা করার পর এখন প্রসংগ চলে যাচ্ছে কাফের মােশরেকদের আলােচনার দিকে, যারা রসূলুল্লাহ(স.) এর মুখােমুখি হতাে, তার বিরুদ্ধাচরণ করতাে। এদের সতর্ক করে দেয়ার জন্যে পূর্ববর্তী আল্লাহদ্রোহী লােকদের পরিণতি কি হয়েছিলাে তা তুলে ধরা হচ্ছে। এ প্রসংগে বলা হয়েছে, ‘তাদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যারােপ করেছিলাে, ফলে তাদের কাছে…’(আয়াত ২৫) এই হচ্ছে কাফের সম্প্রদায়ের অবস্থা। দুনিয়াতে তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনা গঞ্জনা আর পরকালে রয়েছে মহা শাস্তি। আল্লাহর শাস্তির এই বিধান চিরকালই চলতে থাকবে। এতে কোনাে ব্যতিক্রম হবে না। অতীতের জাতিগুলাের করুণ পরিণতি এর জুলন্ত সাক্ষী। ওদিকে পরকালের শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহর সতর্কবাণী এখনও বহাল রয়েছে। তাই এখনও পূর্ণাংগ সুযোগ রয়েছে। এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করে তাদের সংশোধন হওয়া উচিত, উপদেশ গ্রহণ করা উচিত, যদি তাদের মাঝে বিবেক বুদ্ধি বলতে কিছু থেকে থাকে। ‘আমি এ কোরআনে মানুষের জন্যে সব দৃষ্টান্তই বর্ণনা করেছি…’(আয়াত ২৭-২৯) এখানে আল্লাহ তায়ালা তাওহীদবাদী বান্দা ও শিরকবাদী বান্দার দৃষ্টান্ত তুলে ধরছেন। শিরকবাদী বান্দার দৃষ্টান্ত সেই ক্রীতদাসের ন্যায় যার রয়েছে একাধিক মালিক বা প্রভু। এ সকল প্রভু তাকে নিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটিতে লিপ্ত থাকে। তার ওপর প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে, মালিকানা রয়েছে। ফলে তাকে প্রত্যেকের কথাই শুনতে হয়, প্রত্যেকের নির্দেশই মানতে হয়, প্রত্যেকের দেয়া দায়িত্বই পালন করতে হয় এসব করতে গিয়ে সে খেই হারিয়ে ফেলে, দিশাহারা হয়ে পড়ে। বুঝতে পারে না সে কোন দিকে যাবে, কার কথা শুনবে। তাদের সবাইকে এক সঙ্গে খুশী করা এবং প্রত্যেকের পরস্পর বিরােধী মানােবাঞ্ছা পূরণ করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে তার জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। অপরদিকে তাওহীদবাদী বান্দার দৃষ্টান্ত হচ্ছে এমন ক্রীতদাসের ন্যায়, যার মালিক মাত্র একজন। এই একজন মালিকের নির্দেশ পালন করতে তার জন্যে কোনাে সমস্যা হয় না। কারণ, মালিক তাকে এককভাবে নির্দেশ করে আর সে এককভাবেই তা পালন করে। ফলে সে সুখ শান্তিতে এক অবস্থার ওপরই টিকে থাকে। তাই প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাদের উভয়ের অবস্থা কি সমান? না, কখনও সমান হতে পারে না। কারণ এক প্রভুর অধীনে যে কাজ করে সে শান্তিতে থাকে, প্রভুর চাহিদা জানতে পারে। তার চলার পথ থাকে সরল ও স্পষ্ট, কিন্তু যে একাধিক ঝগড়াটে প্রভুর অধীনে কাজ করে সে সারাক্ষণ মানসিক যন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তায় ভােগে, অস্থিরতায় ভােগে। ফলে সে সবাইকে সন্তুষ্ট করবে তো দূরের কথা, একজনকেও সন্তুষ্ট করতে পারে না। এই উপমার মধ্য দিয়ে তাওহীদ ও শিরকের বাস্তবতা এবং প্রকৃতি ফুটে ওঠেছে। তাওহীদ বা একত্ববাদে বিশ্বাসী মন এই পৃথিবীর বুকে তার চলার পথ সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমেই সম্পন্ন করে। কারণ এই চলার পথে সরাক্ষণ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে দিগন্তে উদ্ভাসিত কেবল একটি নক্ষত্রের ওপর। তাই সে পথ হারায় না। তাছাড়া সে ভালাে করেই জানে, জীবন জীবিকা ও শক্তি ক্ষমতার উৎস এক, লাভ ক্ষতির উৎস এক, দেয়া ও না দেয়ার মালিক এক, তাই এই একক ও অভিন্ন উৎসের পানেই সে ধাবিত থাকে, তার কাছ থেকেই সে শক্তি আহরণ করে এবং একমাত্র তার ওপরই নির্ভর করে। এর ফলে তার লক্ষ্য থাকে এক ও নির্দিষ্ট। সে লক্ষ্য থেকে সে একবিন্দুও বিচ্যুত হয় না। সে যেহেতু একক মালিক প্রভুর আনুগত্য দাসত্ব করে, তাই মালিকের মর্জি ও চাহিদা তার জানা থাকে আর সে অনুযায়ী সে কাজ করে। যা করলে মালিক সন্তুষ্ট হয় সে তাই করে আর যা করলে মালিক অসন্তুষ্ট হবে, রুষ্ট হবে সে তা পরিহার করে। এভাবেই সে পৃথিবীর বুকে স্থির পায়ে দাঁড়িয়ে এক আল্লাহর পানে তাকিয়ে গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়ােগ করতে এবং নিজের দক্ষতা ও প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারে। এই দৃষ্টান্ত পেশ করার পর যে মন্তব্য এসেছে তাতে আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, তিনি নিজ বান্দাদের জন্যে সুখ, শান্তি, পরিতুষ্টি, স্থিরতা ও স্থিতিশীলতার পথ নির্বাচিত করেছেন। এ সত্তেও তারা বিপথগামী হয়। কারণ তাদের অধিকাংশই বির্বোধ ও অজ্ঞ। এ জাতীয় দৃষ্টান্ত বা উপমার মাধ্যমে পবিত্র কোরআন মানুষকে উপদেশ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এই কোরআনের ভাষা হচ্ছে আরবী, এতে কোনাে জড়তা নেই, অস্পষ্টতা নেই এবং কোনাে বক্রতা নেই। যুক্তির মাধ্যমে এবং বােধগম্য ভাষায় মানুষের সামনে তার বক্তব্য তুলে ধরে।
‘নিশ্চয়ই তােমারও মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে…'(আয়াত ৩০-৩৫)। এই অংশটুকু পূর্ববর্তী আয়াতগুলাের উপসংহার হিসেবে এসেছে। প্রথমে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের কথা বলা হয়েছে। এরপর বৃষ্টির পানির দ্বারা শস্য উৎপন্ন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর আল্লাহর কাছ থেকে ঐশী গ্ৰন্থ অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর পবিত্র কোরআনে কি কি উপমা বর্ণনা করা হয় সে কথা বলা হয়েছে। এসব কথার পর বলা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর বিষয় এবং তার বিরুদ্ধবাদীদের বিষয় আল্লাহর হাতেই ন্যস্ত থাকবে। তিনিই মৃত্যুর পর তাদের বিচার করবেন। সে বিচারে তিনি অবিশ্বাসী ও মিথ্যাবাদীদের প্রাপ্য সাজায় দন্ডিত করবেন এবং বিশ্বাসী ও সত্যবাদীদের পুরস্কৃত করবেন। ‘নিশ্চয়ই তােমারও মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে…’ অর্থাৎ মৃত্যুই হচ্ছে সকল প্রাণীর শেষ পরিণতি । অমরত্বের গুণে কেবল আল্লাহই ভূষিত। মৃত্যুর ক্ষেত্রে সকল মানব সমান। রসূলও একজন মানব। কাজেই তার বেলায়ও মৃত্যু একটা অভিন্ন সত্য। এরপর দ্বিতীয় যে সত্যটির প্রতি ইংগিত করা হয়েছে তা হলাে, মৃত্যুর সাথে সাথেই মানুষের জীবনযাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটলেও তার চলার পথ কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না; বরং তার সামনে রয়েছে পরকালীন জীবনের দীর্ঘ পথ। এই দীর্ঘ পথের সূচনা হচ্ছে মৃত্যু। পরকালে মানুষ যখন পরস্পরের সাথে বিবাদ বিসংবাদে লিপ্ত হয়ে পড়বে তখন রসূলুল্লাহ(স.) সেখানে এসে উপস্থিত হবেন এবং নিজ প্রভুর সামনে দাড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবেন এবং জীবদ্দশায় তারা তাকে কি বলেছিলাে, তার সাথে কি আচরণ করেছিলাে, আল্লাহর দেখানাে সত্য পথ কিভাবে ত্যাগ করেছিলাে, এসব বিষয়ে বিচার দাবী করবেন। পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে মিথ্যা বলে এবং তার কাছে সত্য আগমন করার পর তাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করে…'(আয়াত ৩২) আলােচ্য আয়াতের প্রশ্নবােধক বক্তব্যটি অজানা বিষয় জানার জন্যে নয়; বরং জানা বিষয় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এসেছে। কারণ সবাই জানে, আল্লাহর বিরুদ্ধে যারা মিথ্যা বলে, তাদের চেয়ে অত্যাচারী আর কেউ নয়। তারা মনে করে আল্লাহর কন্যা আছে, তার শরীক আছে। তাছাড়া তারা রসূলকে অস্বীকার করেছে, আল্লাহর সত্য বাণী অস্বীকার করেছে। তারা একত্ববাদ বা তাওহীদ বিশ্বাস করেনি। আর এটাই হচ্ছে কুফর। এই কুফরী মতবাদের যারা ধারক তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নামে। মােট কথা, প্রশ্ন আকারে বক্তব্যটি পেশ করে মূল বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে, আরও দৃঢ় করা হয়েছে। বিবাদের এক পক্ষ হচ্ছে এই অবিশ্বাসী ও যালেমদের দল। আর অপর পক্ষ হচ্ছে স্বয়ং সেই মহান আত্মা, যিনি আল্লাহর কাছ থেকে সত্য বাণী প্রাপ্ত হয়েছেন, যিনি সেই সত্য বাণী স্বীকার করে নিয়ে তার প্রচার করেছেন এবং তার প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখেছেন। এই গুণের অধিকারী হচ্ছেন রসূলুল্লাহ(স.) এবং অন্যান্য সকল নবী-রসূলরা। এই গুণের অংশীদার তারাও যারা সত্যকে বিশ্বাস করবে এবং সত্যকে সত্য বলে বুঝে ও জেনে তার প্রচার করবে। শুধু তাই নয়; বরং তাদের কথায় ও কাজে এই সত্যের প্রতিফলন ঘটতে হবে। এদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘তারাই তো আল্লাহভীরু।’ এদের জন্যে কি পুরষ্কার রয়েছে সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তাদের জন্যে পালনকর্তার কাছে তাই রয়েছে যা তারা চাইবে, এটা সৎকর্মশীলদের পুরস্কার।'(আয়াত ৩৪) এটা ব্যাপক অর্থবােধক একটা বাক্য। এর দ্বারা মােমেনদের মনের সকল কামনা বাসনা ও আশা আকাংখার কথাই বুঝানাে হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে, তাদের পালনকর্তার কাছে তাদের জন্যে রয়েছে…’ অর্থাৎ সেগুলাে তাদের প্রাপ্য অধিকার। এই অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হবে না; বরং তাদের এই অধিকারের অতিরিক্ত আরও দেয়া হবে। তাদের প্রতি আরও সম্মান ও কৃপা প্রদর্শন করা হবে। বলা হয়েছে, ‘যাতে আল্লাহ তায়ালা তাদের মন্দ কাজসমূহ মার্জনা করেন এবং উত্তম কর্মের পুরস্কার তাদের দান করেন।'(আয়াত ৩৫) ন্যায় ও ইনসাফের দাবী হচ্ছে, সৎকর্ম ও অসৎ কর্মের পুরােপুরি হিসাব-নিকাশ করে উপযুক্ত প্রতিদান দেয়া। আর দয়া ও করুণার দাবী হচ্ছে, সকল পাপ ক্ষমা করে দিয়ে কেবল পুণ্যের হিসাব-নিকাশ নিয়ে বান্দাকে পুরস্কৃত করা। এর ফলে তার পুণ্যের পাল্লাই ভারী হবে এবং তার পুরস্কারও হবে সর্বোত্তম। এই দয়া আল্লাহ তায়ালা তার যে কোনাে বান্দার সাথে করতে পারেন, এটা তিনি ওয়াদা করে রেখেছেন। এটা হবেই। তাই এই ওয়াদার ব্যাপারে আল্লাহভীরু ও সর্মশীল বান্দারা আশ্বস্ত।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# মূল আয়াতে يَنَابِيعَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা এ তিনটি জিনিস বুঝাতেই ব্যবহার করা হয়।
# এ থেকে একজন বুদ্ধিমান মানুষ এ শিক্ষা গ্রহণ করে যে, দুনিয়ার এ জীবন ও এর সব সৌন্দর্য ও চাকচিক্য অস্থায়ী। প্রতিটি বসন্তের পরিণামই শরতের মলিনতা এবং যৌবনের পরিণাম বার্ধক্য ও মৃত্যু। প্রতিটি উত্থানই অবশেষে পতনে পরিণতি লাভ করে। সুতরাং এ পৃথিবী এমন জিনিস নয় যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে মানুষ আল্লাহ ও আখেরাতকে ভুলে যেতে পারে এবং এখানকার ক্ষণস্থায়ী বসন্তের মজা উপভোগ করার জন্য এমন আচরণ করবে যা তার পরিণামকে ধ্বংস করবে। তাছাড়া একজন বুদ্ধিমান লোক এসব দৃশ্য দেখে শিক্ষা গ্রহণ করে যে, এ দুনিয়ার বসন্ত ও শরত আল্লাহর ইখতিয়ারে। তিনি যাকে ইচ্ছা উত্থান ঘটান এবং যাকে ইচ্ছা দুর্দশাগ্রস্ত করেন। আল্লাহ যাকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করছেন তার বেড়ে ওঠা যেমন কেউ রোধ করতে পারে না। তেমনি আল্লাহ যাকে ধ্বংস করতে চান তাকে মাটিতে মিশে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে এমন শক্তিও কারো নেই।
# এ সমস্ত বাস্তব ব্যাপার দ্বারা শিক্ষা গ্রহণ এবং ইসলামকে অকাট্য ও নির্ভুল সত্য বলে মেনে নেয়ার যোগ্যতা ও সুযোগ আল্লাহ যাকে দিয়েছেন। কোন ব্যাপারে মানুষের বক্ষ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া মূলত এমন একটি মানসিক অবস্থার নাম, যখন তার মনে উক্ত বিষয় সম্পর্কে কোন দুশ্চিন্তা বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা সন্দেহ-সংশয় থাকে না এবং কোন বিপদের আভাস বা কোন ক্ষতির আশঙ্কাও তাকে ঐ বিষয় গ্রহণ করতে বাঁধা দিতে পারে না। বরং সে পূর্ণ মানসিক তৃপ্তির সাথে এ সিদ্ধান্ত করে যে, এ জিনিসটি ন্যায় ও সত্য। তাই যাই ঘটুক না কেন আমাকে এর ওপরই চলতে হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোন ব্যক্তি যখন ইসলামের পথ অবলম্বন করে তখন আল্লাহ ও রসূলের পক্ষ থেকে যে নির্দেশই আসে তা সে অনিচ্ছায় নয় খুশী ও আগ্রহের সাথে মেনে নেয়। কিতাব ও সুন্নাহ থেকে যে আকাইদ ও ধ্যান-ধারণা এবং যে নীতিমালা ও নিয়ম-কানুন তার সামনে আসে তা সে এমনভাবে গ্রহণ করে যেন সেটাই হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। কোন অবৈধ সুবিধা পরিত্যাগ করতে তার কোন অনুশোচনা হয় না। সে মনে করে ঐগুলো তার জন্য কল্যাণকর কিছু ছিল না। বরং তা ছিল একটি ক্ষতি যা থেকে আল্লাহর অনুগ্রহ রক্ষা পেয়েছে। অনুরূপ ন্যায় ও সত্যের ওপর কায়েম থাকার কারণে তার যদি কোন ক্ষতি হয় তাহলে সে সেই জন্য আফসোস করে না, ঠাণ্ডা মাথায় বরদাশত করে এবং আল্লাহর পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পরিবর্তে তার কাছে ঐ ক্ষতি হালকা মনে হয়। বিপদাপদ আসলে তার এ একই অবস্থা হয়। সে মনে করে, আমার দ্বিতীয় কোন পথই নেই—এ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য, যে পথ দিয়ে আমি বের হয়ে যেতে পারি। আল্লাহর সরল-সোজা পথ একটিই। আমাকে সর্বাবস্থায় ঐ পথেই চলতে হবে। বিপদ আসলে আসুক।
# জ্ঞানের আলো হিসেবে সে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত লাভ করেছে যার উজ্জ্বল আলোতে সে জীবনে চলার অসংখ্য ছোট ছোট পথের মধ্যে কোনটি ন্যায় ও সত্যের সোজা রাস্তা তা প্রতি পদক্ষেপে স্পষ্ট দেখতে পায়।
# “শরহে সদর” (উন্মুক্ত বক্ষ বা খোলা মন) এর বিপরীতে মানুষের মনের দু’টি অবস্থা হতে পারে। একটি হচ্ছে ‘দ্বীকে সদর’ (বক্ষ সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া, মন সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া) এর অবস্থা। এ অবস্থায় মনের মধ্যে ন্যায় ও সত্য প্রবেশের কিছু না কিছু অবকাশ থাকে। দ্বিতীয়টি ‘কাসাওয়াতে ক্বালব’ (মন কঠিন হয়ে যাওয়া) এর অবস্থা। এ অবস্থায় মনের মধ্যে ন্যায় ও সত্য প্রবেশের কোন সুযোগই থাকে না। দ্বিতীয় অবস্থাটি সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলছেনঃ যে ব্যক্তি এ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে তার জন্য সর্বাত্মক ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নেই। এর অর্থ হচ্ছে, মনের সংকীর্ণতার সাথে হলেও কেউ যদি একবার ন্যায় ও সত্যকে কোনভাবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে যায় তাহলেও তার জন্য রক্ষা পাওয়ার কিছু না কিছু সম্ভাবনা থাকে। আয়াতের বর্ণনাভঙ্গি হতে এ দ্বিতীয় বিষয়টি আপনা থেকেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা তা সুস্পষ্ট করে বলেননি। কারণ, যারা রসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতায় জেদ ও হঠকারিতা করতে একপায়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেছিলো যে, কোনমতেই তাঁর কোন কথা মানবে না, আয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে সাবধান করা। তাদেরকে এ মর্মে সাবধান করা হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের এ জিদ ও হঠকারিতাকে অত্যন্ত গর্বের বিষয় বলে মনে করে থাকো। কিন্তু আল্লাহর যিকির এবং তাঁর পক্ষ থেকে আসা উপদেশ বাণী শুনে বিনম্র হওয়ার পরিবর্তে কেউ যদি আরো বেশী কঠোর হয়ে যায় তাহলে একজন মানুষের জন্য এর চেয়ে বড় অযোগ্যতা ও দুর্ভাগ্য আর কিছুই নেই।
#ঐ সব বাণীর মধ্যে কোন বৈপরীত্য ও বিরোধ নেই। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা কিতাব একই দাবী, একই আকীদা-বিশ্বাস এবং চিন্তা ও কর্মের একই আদর্শ পেশ করে। এর প্রতিটি অংশ অন্য সব অংশের এবং প্রতিটি বিষয় অন্য সব বিষয়ের সত্যায়ন, সমর্থন এবং ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষেণ করে। অর্থ ও বর্ণনা উভয় দিক দিয়েই এ গ্রন্থের পূর্ণ মিল ও সামঞ্জস্য (Consistency) বিদ্যমান।
# মানুষ মুখমণ্ডলের ওপর কোন আঘাত তখনই করে যখন সে পুরোপুরি অক্ষম ও নিরূপায় হয়ে পড়ে। অন্যথায় যতক্ষণ পর্যন্ত তার মধ্যে প্রতিরোধের সামান্যতম শক্তিও থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সে শরীরের প্রত্যেকটি অংশে আঘাত সহ্য করতে থাকে কিন্তু মুখের ওপর আঘাত লাগতে দেয় না। তাই এখানে ঐ ব্যক্তির চরম অসহায়ত্বের চিত্র অংকন করা হয়েছে এই বলে যে, সে নিজের মুখের ওপর চরম আঘাত সহ্য করবে।
# মূল আয়াতে كسب শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআন মজীদে পরিভাষায় كسب শব্দের অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি তার কর্মের ফলশ্রুতি হিসেবে শাস্তি ও পুরস্কার লাভের যে উপযুক্ততা অর্জন করে তাই। সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের আসল উপার্জন হচ্ছে এই যে, সে তার কাজের ফলশ্রুতিতে আল্লাহর কাছে পুরস্কারের যোগ্য হয়ে যায়। আর গোমরাহী ও বিপথগামীতা অবলম্বনকারী ব্যক্তিদের প্রকৃত উপার্জন হচ্ছে, সে শাস্তি যা সে আখেরাতে লাভ করবে।
# এ কিতাব অন্য কোন ভাষায় নাযিল হয়নি যে, তা বুঝার জন্য মক্কা ও আরবের লোকদের কোন অনুবাদক বা ব্যাখ্যাকারের দরকার হয়। এ কিতাব তাদের নিজের ভাষায় নাযিল হয়েছে। যা তারা নিজেরাই সরাসরি বুঝতে সক্ষম।
# তার মধ্যে কোন বক্রতা বা জাটিলতাপূর্ণ কোন কথা নেই যে, তা বুঝা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হবে। বরং এর মধ্যে পরিষ্কারভাবে সহজ-সরল কথা বলা হয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তি এখান থেকে জেনে নিতে পারে এ গ্রন্থ কোন্ জিনিসকে ভ্রান্ত বলে এবং কেন বলে? কোন্ জিনিসকে সঠিক বলে এবং কিসের ভিত্তিতে? কি স্বীকার করাতে চায় এবং কোন্ জিনিস অস্বীকার করাতে চায়। কোন্ কোন্ কাজের নির্দেশ দেয় এবং কোন্ কোন্ কাজে বাঁধা দেয়।
# এ উপমাতে আল্লাহ তা’আলা শিরক ও তাওহীদের পার্থক্য এবং মানব জীবনের ওপর এ দু’টির প্রভাব এমন পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন যে, এতো বড় বিষয়কে এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত কথায় এবং এতটা কার্যকর পন্থায় বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। একথা সবাই স্বীকার করবে যে, যে ব্যক্তি অনেক মালিক বা মনিবের অধীন এবং তারা প্রত্যেকেই তাকে নিজের দিকে টানে। তারা এমন বদমেজাজী যে, প্রত্যেকে তার সেবা গ্রহণ করতে চায় কিন্তু অন্য মালিকের নির্দেশ পালনের সুযোগ তাকে দেয় না, তাছাড়া তাদের পরস্পর বিরোধী নির্দেশ শুনতে গিয়ে যার নির্দেশই সে পালন করতে অপরাগ হয় সে তাকে শুধু ধমক ও বকাঝকা দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, বরং শাস্তি দিতেও বদ্ধপরিকর হয়, এমন ব্যক্তির জীবন অনিবার্যরূপেই অত্যন্ত সংকীর্ণতার মধ্যে পতিত হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি একই মনিবের চাকর সে ব্যক্তি অতীব আরাম ও শান্তিতে জীবন যাপন করবে। তাকে অন্য কারো খেদমত এবং সন্তোষ বিধান করতে হয় না। এটা এমন সহজ-সরল কথা যা বুঝার জন্য বড় বেশী চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন হয় না। এ উপমা পেশ করার পর কারো জন্য একথা বুঝাও কঠিন নয় যে এক আল্লাহর দাসত্বে মানুষের জন্য যে শান্তি ও নিরাপত্তা আছে বহু সংখ্যক ইলাহর দাসত্ব করে কখনো তা লাভ করা যেতে পারে না।
এখানে একথাও ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, পাথরের মূর্তির সাথে বহু সংখ্যক বক্র স্বভাবের এবং পরস্পর কলহপ্রিয় মনিবদের উপমা খাটে না। এ উপমা সেসব জীবন্ত মনিবদের ক্ষেত্রেই খাটে যারা কার্যতই পরস্পর বিরোধী নির্দেশ দান করে এবং বাস্তবেও তাকে নিজের দিকে টানতে থাকে। পাথরের মূর্তি কাকে কবে আদেশ দেয় এবং কাকে কখন নিজের খেদমতের জন্য ডাকে? এ তো জীবন্ত মনিবদের কাজ। মানুষের নিজের প্রবৃত্তির মধ্যে, বংশের মধ্যে, জ্ঞাতি-গোষ্ঠির মধ্যে, জাতি ও দেশের সমাজের মধ্যে, ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে, শাসক ও আইন প্রণেতাদের মধ্যে, কায়কারবার ও জীবিকার গণ্ডির মধ্যে এবং পৃথিবীর সভ্যতার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিসমূহের মধ্যে সর্বত্র বিদ্যমান। তাদের পরস্পর বিরোধী আকাঙ্ক্ষা ও বিভিন্ন দাবী মানুষকে সবসময় নিজের দিকে টানতে থাকে। সে তাদের যার আকাঙ্ক্ষা ও দাবী পূরণ করতে ব্যর্থ হয় সে তাকে নিজের কর্মের গণ্ডির মধ্যে শাস্তি না দিয়ে ছাড়ে না। তবে প্রত্যেকেরে শাস্তির উপকরণ ভিন্ন ভিন্ন। কেউ মনে আঘাত দেয়, কেউ অসন্তুষ্ট হয়, কেউ উপহাস করে, কেউ সম্পর্ক ছিন্ন করে। কেউ নির্বোধ বলে আখ্যায়িত করে, কেউ ধর্মের ওপর আক্রমণ করে এবং কেউ আইনের আশ্রয় নিয়ে শাস্তি দেয়। মানুষের জন্য এ সংকীর্ণতা থেকে বাঁচার একটিই মাত্র উপায় আছে। আর তা হচ্ছে তাওহীদের পথ গ্রহণ করে শুধু এক আল্লাহর বান্দা হয়ে যাওয়া এবং গলদেশ থেকে অন্যদের দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দূরে নিক্ষেপ করা।
তাওহীদের পথ অবলম্বন করারও দু’টি পন্থা আছে এবং এর ফলাফলও ভিন্ন ভিন্ন।
একটি পন্থা এই যে, কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেবে কিন্তু আশে-পাশের পরিবেশ তার সহযোগী হবে না। এক্ষেত্রে তার জন্য বাইরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও সংকীর্ণতা আগের চেয়েও বেড়ে যেতে পারে। তবে সে যদি সরল মনে এ পথ অবলম্বন করে থাকে তাহলে মনের দিক দিয়ে শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করবে। সে প্রবৃত্তির এমন প্রতিটি আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাখ্যান করবে যা আল্লাহর নির্দেশের পরিপন্থী বা যা পূরণ করার পাশাপাশি আল্লাহভীরুতার দাবী পূরণ করা যেতে পারে না। সে পরিবার, গোত্র, গোষ্ঠী, জাতি, সরকার, ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং আর্থিক কর্তৃত্বেরও এমন কোন দাবী গ্রহণ করবে না যা আল্লাহর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এর ফলে সে সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার সম্মুখীন হতে পারে তথা অনিবার্যরূপেই হবে কিন্তু তার মন এ ব্যাপারে পুরোপুরি পরিতৃপ্ত থাকবে যে, আমি যে আল্লাহর বান্দা তার দাসত্বের দাবী আমি সম্পূর্ণরূপে পূরণ করছি। আর আমি যাদের বান্দা নই আমার কাছে তাদের এমন কোন অধিকার নেই, যে কারনে আমি আমার রবের নির্দেশের বিরুদ্ধে তাদের দাসত্ব করবো। দুনিয়ার কোন শক্তিই তার থেকে মনের এ প্রশান্তি এবং আত্মার এ শান্তি ও তৃপ্তি ছিনিয়ে নিতে পারে না। এমনকি তাকে যদি ফাঁসি কাষ্ঠেও চড়তে হয় তাহলে সে প্রশান্ত মনে ফাঁসির কাষ্ঠেও ঝুলে যাবে। সে একথা ভেবে সামান্য অনুশোচনাও করবে না যে, আমি কেন মিথ্যা প্রভুদের সামনে মাথা নত করে আমার জীবন রক্ষা করলাম না।
আরেকটি পন্থা এই যে, গোটা সমাজ তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক এবং সেখানে নৈতিক চরিত্র, সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম, আইন-কানুন, রীতি-নীতি ও দেশাচার, রাজনীতি, অর্থনীতি মোট কথা জীবনের প্রতিটি বিভাগের জন্য আকীদা-বিশ্বাস হিসেবে সেসব মূলনীতি মেনে নেয়া হোক এবং কার্যত চালু করা হোক যা মহান আল্লাহ তাঁর কিতাব ও রসূলের মাধ্যমে দিয়েছেন। আল্লাহর দ্বীন যেটিকে গোনাহ বলবে আইন সেটিকেই অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে, সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সেগুলোকে উৎখাত করার চেষ্টা করবে, শিক্ষা-দীক্ষা সেটি থেকে বাঁচার জন্য মন-মানসিকতা তৈরী করবে। মিম্বার ও মিহরাব থেকে এর বিরুদ্ধেই আওয়াজ উঠবে সমাজ এটিকে দোষণীয় মনে করবে এবং জীবিকা অর্জনের প্রতিটি কায়-কারবারে তা নিষিদ্ধ হবে। অনুরূপভাবে আল্লাহর দ্বীন যে জিনিসকে কল্যাণ ও সুকৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করবে আইন তাকেই সমর্থন করবে। ব্যবস্থাপনার শক্তি তার লালন-পালন করবে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা মন-মগজে সেটিকে বদ্ধমূল করতে এবং চরিত্র ও কর্মে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করবে। মিম্বর ও মিহরাব তারই শিক্ষা দেবে, সমাজও তারই প্রশংসা করবে। তার ওপরেই প্রচলিত রীতি-নীতি কার্যত প্রতিষ্ঠিত করবে এবং কায়-কারবার ও জীবন জীবিকার প্রক্রিয়াও সে অনুসারেই চলবে। এভাবেই মানুষ পূর্ণ আভ্যন্তীণ ও বাহ্যিক শান্তি লাভ করে এবং বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উন্নতির সমস্ত দরজা তার জন্য খুলে যায়। কারণ, আল্লাহ ও গায়রুল্লাহর দাসত্বের দাবীর যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তা তখন প্রায় শেষ হয়ে যায়।
ইসলাম যদিও প্রত্যেক ব্যক্তিকে এই বলে আহবান জানায় যে, দ্বিতীয় অবস্থাটা সৃষ্টি হোক বা না হোক সর্বাবস্থায় সে তাওহীদকেই তার আদর্শ হিসেবে মেনে চলবে এবং সব রকম বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টের মোকাবিলা করে আল্লাহর দাসত্ব করবে। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য এ দ্বিতীয় অবস্থা সৃষ্টি করা। সমস্ত নবী ও রসূল আলাইহিমুস সালামের প্রচেষ্টা ও দাবীও এই যে, একটি মুসলিম উম্মাহর উত্থান ঘটুক যারা কুফর ও কাফেরদের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে জামায়াত বদ্ধভাবে আল্লাহর দ্বীন অনুসরণ করবে। কুরআন ও সুন্নাত সম্পর্কে অজ্ঞ এবং বিবেক-বুদ্ধিহীন না হয়ে কেউই একথা বলতে পারে না যে, নবী রসূল আলাইহিমুস সালামের চেষ্টা সাধানার লক্ষ্য ছিল শুধু ব্যক্তিগত ঈমান ও আনুগত্য। সামাজিক জীবনে ‘দ্বীন হক’ বা ন্যায় ও সত্যের আদর্শ কায়েম করার উদ্দেশ্য আদৌ তাঁদের ছিল না।
# এখানে “আলহামদুলিল্লাহ” এর অর্থ বুঝার জন্য মনের মধ্যে এ চিত্রটি অংকন করুন যে, শ্রোতাদের সামনে উপরোক্ত প্রশ্ন পেশ করার পর বক্তা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন যাতে তাওহীদের বিরোধীতাকারীদের কাছে তার কোন জবাব থাকলে যেন দিতে পারে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে যখন কোন জবাব আসলো না এবং কোন দিক থেকে এ জবাবও আসলো না যে, দু’টি সমান, তখন বক্তা বললেন ‘আলহামদুলিল্লাহ’ অর্থাৎ আল্লাহর শুকরিয়া যে তোমরা নিজেরাও মনে মনে এ দু’টি অবস্থার পার্থক্য অনুভব করে থাকো। একজন মনিবের দাসত্বের চেয়ে অনেক মনিবের দাসত্ব উত্তম বা দু’টি সমান পর্যায়ের একথা বলার ধৃষ্ঠতা তোমাদের কারোই নেই।
# একজন মনিবের দাসত্ব ও বহু সংখ্যক মনিবের দাসত্বের মধ্যকার পার্থক্য তো বেশ বুঝতে পার কিন্তু এক প্রভুর দাসত্ব ও বহু সংখ্যক প্রভুর দাসত্বের মধ্যকার পার্থক্য যখন বুঝানোর চেষ্টা করা হয় তখন অজ্ঞ সেজে বসো।
# এ বাক্যাংশ ও পূর্ববর্তী বাক্যাংশের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম শূন্যতা আছে যা স্থান কাল ও পূর্বাপর বিষয়ে চিন্তা করে যে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিজেই পূর্ণ করতে পারেন। এখানে এ বিষয়টি প্রচ্ছন্ন আছে যে, তোমরা এভাবে একটি পরিষ্কার সহজ-সরল কথা সহজ-সরল উপায়ে এসব লোককে বুঝাচ্ছো আর এরা হঠকারিতা করে তোমাদের কথা শুধু প্রত্যাখ্যানই করছে না বরং এ সুস্পষ্ট সত্যকে পরাভূত করার জন্য তোমাদের চরম শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক আছে! চিরদিন তোমরাও থাকবে না, এরাও থাকবে না। একদিন উভয়কেই মরতে হবে। তখন সবাই যার যার পরিণাম জানতে পারবে।
# কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলার আদালতে যে মোকদ্দমা দায়ের হবে তাতে কোন্ লোকেরা শাস্তি লাভ করবে তা তোমরা আজই শুনে নাও। তাতে নিশ্চিতভাবে সে লোকেরাই শাস্তি পাবে যারা এ মিথ্যা আকীদা গড়ে নিয়েছিল যে, আল্লাহর সত্তা, গুণাবলী, ইখতিয়ার এবং অধিকারে অন্য কিছু সত্তাও শরীক আছে। তাদের আরো বড় অপরাধ ছিল এই যে, তাদের সামনে সত্য পেশ করা হয়েছে কিন্তু তারা তা মানেনি। বরং যিনি সত্য পেশ করেছেন উল্টো তাকেই মিথ্যাবাদী বলে আখ্যায়িত করেছে।
পক্ষান্তরে যিনি সত্য এনেছেন আর যারা তা সত্য বলে মেনে নিয়েছে আল্লাহর আদালতে তাদের শাস্তি পাওয়ার কোন প্রশ্ন ওঠে না।
# একথা লক্ষ্য রাখতে হবে যে, এখানে فِى الْجَنَّةِ (জান্নাতে) না বলে عِنْدَ رَبِّهِمْ (তাদের রবের কাছে) কথাটি বলা হয়েছে। একথা সুস্পষ্ট যে মৃত্যুর পরেই কেবল বান্দা তার রবের কাছে পৌঁছে। তাই জান্নাতে পৌঁছার পর এ আচরণ করা হবে না। বরং মৃত্যুর পর থেকে জান্নাতে প্রবেশ পর্যন্ত সময়েও মু’মিন নেককার বান্দার সাথে আল্লাহ তা’আলা এ আচরণ করবেন। এটাই আয়াতের প্রতিপাদ্য বিষয় বলে মনে হয়। ঈমানদার সৎকর্মশীল বান্দা বরযখের আযাব থেকে, কিয়ামতের দিনের কষ্ট থেকে, হিসেবের কঠোরতা থেকে, হাশরের ময়দানের অপমান থেকে এবং নিজের দুর্বলতা ও অপরাধের কারণে পাকড়াও থেকে অবশ্যই রক্ষা পেতে চাইবে, আর মহিমান্বিত আল্লাহ তার এসব আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবেন।
# যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান এনেছিলো তাদের দ্বারা জাহেলী যুগে আকীদাগত ও চরিত্রগত উভয় ধরনের জঘন্যতম গোনাহর কাজও সংঘটিত হয়েছিল। ঈমান গ্রহণের পর তারা যে শুধু পূর্ব অনুসৃত মিথ্যা পরিত্যাগ করে নবীর ﷺ পেশকৃত সত্যকে গ্রহণ করেছিলো এবং এটিই তাদের একমাত্র নেকীর কাজ ছিল তাই নয়, বরং তারা নৈতিক চরিত্র, ইবাদাত এবং পারস্পরিক লেনদেন ও আচার আচরণের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম নেক আমল করেছিলো। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ জাহেলী যুগে তাদের দ্বারা যেসব জঘন্যতম কাজকর্ম সংঘটিত হয়েছিলো তাদের হিসেব থেকে তা মুছে দেয়া হবে এবং তাদের আমলনামায় সর্বোত্তম যেসব নেক আমল থাকবে তার হিসেবে তাদেরকে পুরস্কার দেয়া হবে।