(টপিক#১০৮৬) [* *হক বাতিলের চিরন্তন লড়াই:-] www.motaher21.net সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন পারা:২৪ ১-১৭ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৬)
[* *হক বাতিলের চিরন্তন লড়াই:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
১-১৭ নং আয়াত:-
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১
حٰمٓ ۚ﴿۱﴾
হা, মীম।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:২
تَنۡزِیۡلُ الۡکِتٰبِ مِنَ اللّٰہِ الۡعَزِیۡزِ الۡعَلِیۡمِ ۙ﴿۲﴾
এ গ্রন্থ পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকট হতে অবতীর্ণ হয়েছে–
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৩
غَافِرِ الذَّنۡۢبِ وَ قَابِلِ التَّوۡبِ شَدِیۡدِ الۡعِقَابِ ۙ ذِی الطَّوۡلِ ؕ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ؕ اِلَیۡہِ الۡمَصِیۡرُ ﴿۳﴾
গোনাহ মাফকারী, তাওবা কবুলকারী, কঠোর শাস্তিদাতা এবং অত্যন্ত দয়ালু। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। সবাইকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪
مَا یُجَادِلُ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ اِلَّا الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا فَلَا یَغۡرُرۡکَ تَقَلُّبُہُمۡ فِی الۡبِلَادِ ﴿۴﴾
আল্লাহর আয়াতসমূহে বিতর্ক কেবল তারাই করে যারা কুফরী করেছে; কাজেই দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন আপনাকে ধোঁকায় না ফেলে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫
کَذَّبَتۡ قَبۡلَہُمۡ قَوۡمُ نُوۡحٍ وَّ الۡاَحۡزَابُ مِنۡۢ بَعۡدِہِمۡ ۪ وَ ہَمَّتۡ کُلُّ اُمَّۃٍۭ بِرَسُوۡلِہِمۡ لِیَاۡخُذُوۡہُ وَ جٰدَلُوۡا بِالۡبَاطِلِ لِیُدۡحِضُوۡا بِہِ الۡحَقَّ فَاَخَذۡتُہُمۡ ۟ فَکَیۡفَ کَانَ عِقَابِ ﴿۵﴾
এর পূর্বে নূহের (আ) কওম অস্বীকার করেছে এবং তাদের পরে আরো বহু দল ও গোষ্ঠী এ কাজ করেছে। প্রত্যেক উম্মত তার রসূলকে পাকড়াও করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা সবাই বাতিলের হাতিয়ারের সাহায্যে হককে অবদমিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি। দেখে নাও, কত কঠিন ছিল আমার শাস্তি।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬
وَ کَذٰلِکَ حَقَّتۡ کَلِمَتُ رَبِّکَ عَلَی الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَنَّہُمۡ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۘ﴿ؔ۶﴾
অনুরূপ যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য তোমার রবের এ সিদ্ধান্তও অবধারিত হয়ে গিয়েছে যে, তারা জাহান্নামের বাসিন্দা হবে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭
اَلَّذِیۡنَ یَحۡمِلُوۡنَ الۡعَرۡشَ وَ مَنۡ حَوۡلَہٗ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّہِمۡ وَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِہٖ وَ یَسۡتَغۡفِرُوۡنَ لِلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۚ رَبَّنَا وَسِعۡتَ کُلَّ شَیۡءٍ رَّحۡمَۃً وَّ عِلۡمًا فَاغۡفِرۡ لِلَّذِیۡنَ تَابُوۡا وَ اتَّبَعُوۡا سَبِیۡلَکَ وَ قِہِمۡ عَذَابَ الۡجَحِیۡمِ ﴿۷﴾
আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতাগণ এবং যারা আরশের চার পাশে হাজির থাকে তারা সবাই প্রশংসাসহ তাদের রবের পবিত্রতা বর্ণনা করে। তাঁর প্রতি ঈমান পোষণ করে এবং ঈমানদারদের জন্য দোয়া করে। তারা বলেঃ হে আমাদের রব, তুমি তোমার রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছু পরিবেষ্টন করে আছো। তাই মাফ করে দাও এবং দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করো যারা তাওবা করেছে এবং তোমার পথ অনুসরণ করেছে তাদেরকে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৮
رَبَّنَا وَ اَدۡخِلۡہُمۡ جَنّٰتِ عَدۡنِۣ الَّتِیۡ وَعَدۡتَّہُمۡ وَ مَنۡ صَلَحَ مِنۡ اٰبَآئِہِمۡ وَ اَزۡوَاجِہِمۡ وَ ذُرِّیّٰتِہِمۡ ؕ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ۙ﴿۸﴾
‘হে আমাদের রব! আর আপনি তাদেরকে প্রবেশ করান স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তাদেরকেও ৷ নিশ্চয়ই আপনি পরাক্রমশালী, প্ৰজ্ঞাময়।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৯
وَ قِہِمُ السَّیِّاٰتِ ؕ وَ مَنۡ تَقِ السَّیِّاٰتِ یَوۡمَئِذٍ فَقَدۡ رَحِمۡتَہٗ ؕ وَ ذٰلِکَ ہُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ٪﴿۹﴾
‘আর আপনি তাদেরকে অপরাধের শাস্তি হতে রক্ষা করুন। সেদিন আপনি যাকে (অপরাধের) খারাপ পরিণতি হতে রক্ষা করবেন, তাকে অবশ্যই অনুগ্রহ করবেন; আর এটাই মহাসাফল্য!’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১০
اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یُنَادَوۡنَ لَمَقۡتُ اللّٰہِ اَکۡبَرُ مِنۡ مَّقۡتِکُمۡ اَنۡفُسَکُمۡ اِذۡ تُدۡعَوۡنَ اِلَی الۡاِیۡمَانِ فَتَکۡفُرُوۡنَ ﴿۱۰﴾
যারা কুফরী করেছে কিয়ামতের দিন তাদের ডেকে বলা হবে, “আজ তোমরা নিজেদের ওপর যতটা ক্রোধান্বিত হচ্ছো, আল্লাহ‌ তোমাদের ওপর তার চেয়েও অধিক ক্রোধান্বিত হতেন তখন যখন তোমাদেরকে ঈমানের দিকে আহ্বান জানানো হতো আর তোমরা উল্টা কুফরী করতে।”
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১১
قَالُوۡا رَبَّنَاۤ اَمَتَّنَا اثۡنَتَیۡنِ وَ اَحۡیَیۡتَنَا اثۡنَتَیۡنِ فَاعۡتَرَفۡنَا بِذُنُوۡبِنَا فَہَلۡ اِلٰی خُرُوۡجٍ مِّنۡ سَبِیۡلٍ ﴿۱۱﴾
তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে দু’বার মৃত্যু দিয়েছেন এবং দু’বার আমাদেরকে জীবন দিয়েছেন। অতঃপর আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি। অতএব (জাহান্নাম থেকে) বের হবার কোন পথ আছে কি ?’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১২
ذٰلِکُمۡ بِاَنَّہٗۤ اِذَا دُعِیَ اللّٰہُ وَحۡدَہٗ کَفَرۡتُمۡ ۚ وَ اِنۡ یُّشۡرَکۡ بِہٖ تُؤۡمِنُوۡا ؕ فَالۡحُکۡمُ لِلّٰہِ الۡعَلِیِّ الۡکَبِیۡرِ ﴿۱۲﴾
এ অবস্থা যার মধ্যে তোমরা আছো, তা এ কারণে যে, যখন একমাত্র আল্লাহর দিকে ডাকা হতো তখন তোমরা তা মানতে অস্বীকার করতে। কিন্তু যখন তাঁর সাথে অন্যদেরকেও শামিল করা হতো তখন মেনে নিতে। এখন তো ফায়সালা মহান ও মর্যাদাবান আল্লাহর হাতে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১৩
ہُوَ الَّذِیۡ یُرِیۡکُمۡ اٰیٰتِہٖ وَ یُنَزِّلُ لَکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ رِزۡقًا ؕ وَ مَا یَتَذَکَّرُ اِلَّا مَنۡ یُّنِیۡبُ ﴿۱۳﴾
তিনিই তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখান এবং আকাশ হতে তোমাদের জন্য রিযিক নাযিল করেন। আর যে আল্লাহ্-অভিমুখী সেই কেবল উপদেশ গ্ৰহণ করে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১৪
فَادۡعُوا اللّٰہَ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ وَ لَوۡ کَرِہَ الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿۱۴﴾
সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ডাক তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। যদিও কাফিররা অপছন্দ করে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১৫
رَفِیۡعُ الدَّرَجٰتِ ذُو الۡعَرۡشِ ۚ یُلۡقِی الرُّوۡحَ مِنۡ اَمۡرِہٖ عَلٰی مَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِہٖ لِیُنۡذِرَ یَوۡمَ التَّلَاقِ ﴿ۙ۱۵﴾
তিনি উচ্চ মর্যাদার অধিকারী, আরশের অধিপতি। তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছা নিজের হুকুমে ‘রূহ’ নাযিল করেন যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সাবধান করে দেয়।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১৬
یَوۡمَ ہُمۡ بٰرِزُوۡنَ ۬ۚ لَا یَخۡفٰی عَلَی اللّٰہِ مِنۡہُمۡ شَیۡءٌ ؕ لِمَنِ الۡمُلۡکُ الۡیَوۡمَ ؕ لِلّٰہِ الۡوَاحِدِ الۡقَہَّارِ ﴿۱۶﴾
সেটি এমন দিন যখন সব মানুষের সবকিছু প্রকাশ হয়ে পড়বে। আল্লাহ‌র কাছে তাদের কোন কথাই গোপন থাকবে না। (সেদিন ঘোষণা দিয়ে জিজ্ঞেস করা হবে)। আজ রাজত্ব কার? (সমস্ত সৃষ্টি বলে উঠবে) একমাত্র আল্লাহর যিনি কাহ্‌হার।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:১৭
اَلۡیَوۡمَ تُجۡزٰی کُلُّ نَفۡسٍۭ بِمَا کَسَبَتۡ ؕ لَا ظُلۡمَ الۡیَوۡمَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ سَرِیۡعُ الۡحِسَابِ ﴿۱۷﴾
আজ প্রত্যেককে তার অর্জন অনুসারে প্রতিফল দেয়া হবে; আজ কোন যুলুম নেই । নিশ্চয় আল্লাহ দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী।

ফী জিলালিল কুরআন‌ বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলোচনা : এ সূরাটায় প্রধানত হক ও বাতিল, ঈমান ও কুফরী, দাওয়াত ও তা প্রত্যাখ্যান করার বিষয় আলােচিত হয়েছে এবং সর্বশেষে পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে একনায়কত্ব ও জবরদস্তি প্রয়োগ এবং একনায়ক ও জবরদস্তি প্রয়ােগকারীদের ওপর আল্লাহর শাস্তির বিষয়ও বর্ণনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ও হেদায়াতপ্রাপ্ত ও অনুগত মােমেনদের ভূমিকা ও তাদের প্রতি আল্লাহর সাহায্য, তাদের জন্যে ফেরেশতাদের ক্ষমা প্রার্থনা, আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের দোয়া কবুল করা এবং আখেরাতে তাদের জন্যে প্রতিশ্রুত পুরস্কারের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এ কারণেই সূরার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বলে প্রতীয়মান হয়। এ যুদ্ধ হক ও বাতিলের যুদ্ধ, ঈমান ও আল্লাহদ্রোহিতার যুদ্ধ এবং পৃথিবীতে একনায়কত্ব ও স্বৈরাচারদের সাথে আল্লাহর সেই ভয়াবহ আযাবের যুদ্ধ, যা তাদেরকে পদে পদে বিধ্বস্ত ও লাঞ্ছিত করে। আর এর মাঝে যখন মােমেনদের প্রসংগ আসে, তখন আল্লাহর করুণা ও সন্তোষেৱ সুবাতাস বয়ে যায়। সূরার প্রেক্ষাপটে অতীত জাতিগুলাের ধ্বংসের কাহিনী এবং কেয়ামতের দৃশ্যাবলীও তুলে ধরা হয়েছে। আর এই দুটো বিষয় সূরার আয়াতগুলােতে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খুবই লক্ষণীয়ভাবে। এগুলােকে সূরার সঠিক প্রেক্ষাপটের সাথে মিল রেখে অত্যন্ত ভীতিপ্রদ আকারে তুলে ধরা হয়েছে। এভাবে সূরার প্রেক্ষাপটে যে কঠোরতা রয়েছে, আলােচ্য বিষয়গুলােতেও তা রয়েছে। এ বৈশিষ্ট্য সূরার উদ্বোধনী অংশেও পরিলক্ষিত হয়। একটা বিশেষ ছন্দময় সূরেলা ঝংকারের সাথে বলা হয়েছে, ‘তিনি গুনাহ মাফকারী, তাওবা কবুলকারী, কঠিন শাস্তিদানকারী এবং মহাশক্তিধর…’(আয়াত ৩) এ আয়াতের শব্দগুলাে যেন হাতুড়ি দিয়ে তাল মিলিয়ে পিটিয়ে ঘন্টা বাজানাের ধ্বনি। এর আঘাতের প্রভাব যেন স্থায়ী। এর প্রত্যেকটা শব্দ যেন স্বতন্ত্র এক। এর প্রত্যেকটা শব্দের অর্থও এর ঝংকৃত সুরের সমর্থক ও শক্তি যােগানদাতা। বা’স, বাসুল্লাহ ও বা’সুনা (আযাব, আল্লাহর আযাব ও আমার আযাব) শব্দটাকেও বারবার সূরার বিভিন্ন জায়গায় পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া এর কাছাকাছি অর্থের আরাে বহু শব্দ রয়েছে। সামগ্রিকভাবে দেখলে, সমগ্র সুরাটা মানুষের মনের ওপর তীব্র প্রভাব সৃষ্টি করা ও গভীর দাগ কাটার মতাে বহু উপাদানে সমৃদ্ধ। অতীতের ধ্বংস হওয়া জাতিগুলাের কাহিনী এবং কেয়ামতের দৃশ্যাবলী এ প্রসংগে বিশেষভাবে উল্লেযােগ্য। কোনাে কোনাে জায়গায় আবার হৃদয়ের ওপর কোমল পরশ বুলানাে কথাবার্তাও লক্ষ্য করা যায়। যেমন আরশবহনকারী ও আরশের চারপাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর মুমিন বান্দাদের জন্যে দোয়া করা, প্রাকৃতিক জগতের নিদর্শনাবলী ও মানুষের নিজ সত্ত্বার ভেতরে বিরাজমান নিদর্শনাবলীর উল্লেখ ইত্যাদি। নিম্নে সূরার এইসব বিষয় ও পটভূমি নির্দেশকারী কয়েকটা আয়াত উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করছি, অতীতের জাতিগুলাের ধ্বংসের কাহিনী ৫, ২১, ২২, নং আয়াত সমূহ। কেয়ামতের দৃশ্যাবলী, ১৮, ৭০, ৭১ ও ৭২ নং আয়াতসমূহ। আর কোমল পরশ বুলানাে আয়াত ৭, ৮, ৯ নং আয়াত লক্ষ্য করুন। প্রকৃতিতে ও মানবসত্তায় বিরাজিত নিদর্শনাবলীর উল্লেখ, ৬৭, ৬৮, ৬৪, ৬৫, ৬১ নং আয়াত লক্ষ্য করুন। এসব আয়াত থেকে সূরার সামগ্রিক পটভূমি ও আলােচ্য বিষয় জানা যায়। আর এগুলাে দ্বারা এর বিষয়বস্তুর সাথে এর প্রকৃতির সমন্বয় ঘটানাে যায়। সূরাটা মােটামুটিভাবে চারটি অংশে বিভক্ত এবং এর প্রত্যেকটা অংশ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, প্রথম অংশটায় রয়েছে সূরার উদ্বোধনী পর্ব, যা বর্ণমালার দুটো অক্ষর দ্বারা শুরু হয়েছে। যেমন, ‘হা-মীম, এটা মহাপরাক্রান্ত মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কিতাব'(আয়াত ১ ও ২) এরপর রয়েছে সেই অপূর্ব ছন্দময় সুরে ঝংকৃত আয়াত, ‘গুনাহ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী…'(আয়াত ৩) পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, সমগ্র সৃষ্টিজগত আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পিত। মানুষের ভেতর থেকে কিছু কাফের ছাড়া বিশ্বজগতের কোনাে সৃষ্টিই আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে তর্ক করে না। তর্ককারী এই অকৃতজ্ঞ মানুষগুলাে সমগ্র সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন, তাই ধন সম্পদের দিক দিয়ে তাদের অবস্থা যতােই পাল্টে যাক রসূল(স.)-এর কাছে তাদের কোনােই গুরুত্ব নেই। কেননা পূর্ববর্তী কাফেরদের মতােই তাদের পরিণাম হবে শােচনীয়। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে কাঠোরভাবে পাকড়াও করেছিলেন এবং এমন শাস্তি দিয়েছিলেন, যা অহংকারীদের যথার্থই প্রাপ্য। আর শুধু দুনিয়ার শাস্তিই তাে শেষ নয়, তাদের জন্যে আখেরাতের আযাবও অপেক্ষা করছে। ওদিকে আরশ বহনকারী ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের এবাদাত করে ও দুনিয়াবাসী মােমেনদের মাগফেরাত কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করে। এর পাশাপাশি কেয়ামতের দিন কাফেরদের কী শােচনীয় পরিণতি হবে তাও দেখানাে হয়েছে। মােমেনদের পক্ষ থেকে তাদেরকে ডেকে বলা হবে, আজ তােমরা নিজেদের ওপর যতােটা ক্ষুব্ধ হচ্ছো, তােমাদেরকে যেদিন ঈমানের দাওয়াত দেয়া হচ্ছিলাে, আর তােমরা সে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করছিলে, সেদিন আল্লাহর ক্রোধ আরাে সাংঘাতিক ছিলাে। দুনিয়ার জীবনের অহংকার ও গর্ব সেদিন ধুলােয় মিশে যাবে। সেদিন তারা চরম বিনয়ের সাথে নিজেদের সমস্ত পাপের স্বীকারােক্তি করবে এবং তাদের প্রতিপালককে মেনে নেবে। কিন্তু এই স্বীকারােক্তিও মেনে নেয়াতে কোনাে লাভ হবে না। আসলে তারা শুধু তাদের পার্থিব জীবনের শিরক দাম্ভিকতা ও যাবতীয় অপকর্মই স্মরণ করবে। আখেরাতে আল্লাহর সামনে তাদের অবস্থান প্রসংগে দুনিয়ার কথা পুনরায় স্মরণ করানাে হবে, ‘তিনিই সেই আল্লাহ তায়ালা, যিনি তােমাদেরকে তার নিদর্শনাবলী দেখান এবং তােমাদের জন্যে আকাশ থেকে জীবিকা অবতীর্ণ করেন।’ তিনি এসব নিদর্শন স্মরণ করান এ জন্যে যেন তারা তাদের প্রতিপালকের অনুগত হয় এবং একমাত্র তার এবাদাত করে, ‘অতএব আল্লাহর এবাদাত করাে একনিষ্ঠ আনুগত্য সহকারে, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ এরপর সেই কঠিন দিন সম্পর্কে যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছিলাে এবং ওহী পাঠানাে হয়েছিলাে, তার উল্লেখ করে কেয়ামতের ভয়াবহ দৃশ্য পুনরায় তুলে ধরা হচ্ছে, ‘যেদিন তারা আত্মপ্রকাশ করবে, সেদিন তাদের কিছুই আল্লাহর কাছে গােপন থাকবে না।’ সেদিন বড় বড় দাম্ভিক, একনায়ক ও বিতর্ককারী সবাই উধাও হয়ে যাবে। ‘সেদিন বলা হবে আজকের রাজত্ব কার? একমাত্র পরাক্রমশালী এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর।’ এরপর এই দিনের আরাে কিছু চিত্র দেখানাে হয়েছে, যেদিন আল্লাহ তায়ালাই এককভাবে শাসন ও বিচার পরিচালনা করবেন। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য যা কিছুর পূজা উপাসনা করা হতাে সেদিন সে সবের আর কোন পাত্তা থাকবে না। অনুরূপভাবে দুনিয়ায় যারা অবাধে পাপাচারে লিপ্ত থাকতাে ও জনগণের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন চালাতাে, তাদেরও আর কোনাে খোজ থাকবে না। দ্বিতীয় অংশটা প্রাচীনকালের ধ্বংস হয়ে যাওয়া আল্লাহদ্রোহীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে। এটা এসেছে ফেরাউন, হামান ও কারূণের সাথে হযরত মূসার ঘটনাবলী বর্ণনার ভূমিকা হিসাবে। সত্যের দাওয়াতের বিরুদ্ধে ফেরাউনের ভূমিকার বর্ণনা প্রসংগে এখানে এমন একটা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে, যা হযরত মূসার কাহিনীতে ইতিপূর্বে কখনাে উল্লেখ করা হয়নি এবং এই সূরায় ছাড়া আর কোথাও তার উল্লেখ নেই। এই ঘটনা হলাে, ফেরাউনের অনুসারীদের মধ্য এমন এক ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ, যিনি এ যাবত তার ঈমান গােপন রেখে আসছিলেন। হযরত মূসাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হতে দেখে এই ব্যক্তি আর চুপ থাকতে পারেননি। তিনি এই হত্যার ষড়যন্ত্র নস্যাত করতে সচেষ্ট হন। প্রথমদিকে তিনি সত্য ও ঈমানের কথা অত্যন্ত সন্তর্পণে ও বিনীতভাবে প্রকাশ করেন এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে খােলাখুলি ও স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেন। তিনি ফেরাউনের সাথে অত্যন্ত জোরালাে ও অকাট্য যুক্তি প্রমাণ দিয়ে তর্ক করেন। তাকে ও তার দলবলকে কেয়ামতের দিন সম্পর্কে সতর্ক করেন। অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ভাষায় কেয়ামতের কিছু কিছু দৃশ্যও তুলে ধরেন এবং তাদের ও তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেন। এ প্রসংগে তিনি হযরত ইউসুফ ও তার রেসালাতের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন। এভাবে এ কিসসা বর্ণনা করতে করতে ফেরাউনের আখেরাতে কী অবস্থা হবে, তাও ব্যক্ত করেন। সূৰ্বার এই পটভূমিকায় আল্লাহ তায়ালা স্বীয় রসূলকে ধৈর্যধারণ ও আল্লাহর ওয়াদার প্রতি আস্থাশীল থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তার পবিত্রতা ঘােষণা ও তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার উপদেশ দিয়েছেন। সূরার তৃতীয় অংশটা শুরু হয়েছে এই বক্তব্য দিয়ে যে, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে কোনাে সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়াই তর্কে লিপ্ত হয়, তাদের অন্তরে সত্যের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের ধৃষ্টতা ও ঔদ্ধত্য থাকে বলেই তারা এটা করে। অথচ তারা এই সত্যের তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র। এরপর আল্লাহর সৃষ্টি করা এই বিশাল বিশ্বজগতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যা সমগ্র মানব জাতির চেয়েও বিরাট ও বিশাল। অহংকারী ও দাম্ভিক লােকেরা যদি আল্লাহর সৃষ্টির | বিশালত্বের সামনে নিজেদের ক্ষুদ্রত্বকে অনুধাবন করতাে, তাহলে তারা এমন অন্ধ ও গোঁড়া হতাে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘চক্ষুস্মান ব্যক্তি ও অন্ধ ব্যক্তি, আর সৎকর্মশীল ব্যক্তি ও অসংকর্মশীল ব্যক্তি সমান হয় না। তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো।’ এই পর্যায়ে মানুষকে কেয়ামতের আগমনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং দোয়া কবুলকারী মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। পক্ষান্তরে যারা দান্তিকতা দেখায় তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতপর আল্লাহ তায়ালার এমন কিছু কিছু প্রাকৃতিক নিদর্শন স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, যার কাছ দিয়ে তারা উদাসীনভাবে চলাচল করে। রাতকে অবকাশ যাপন ও বিশ্রামের সময় এবং দিনকে আলােকোজ্জ্বল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। পৃথিবীকে অবস্থানের জায়গা ও আকাশকে ছাদ বলে অভিহিত করা হয়েছে, আর তাদের নিজেদের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, তাদেরকে তিনি কতাে সুন্দর গঠন ও আকৃতি দান করেছেন। অতপর তাদেরকে একনিষ্ঠ আনুগত্য সহকারে আল্লাহর এবাদাত করার নির্দেশ দান করেছেন। রসূল(স.)-কে আদেশ দিয়েছেন যেন তিনি তাদের মূর্তিপূজা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখেন, তাদের দেব দেবী থেকে দুরে থাকা সম্পর্কে আল্লাহর আদেশ জনগণকে অবহিত করেন, তাকে বিশ্ব জাহানের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করার আদেশ প্রচার করেন। জনগণের মনে এই সত্য বদ্ধমূল করা হয়েছে যে, এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে প্রথমে মাটি থেকে, অতপর বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন। তিনিই জীবনদাতা ও মৃত্যুদাতা। অতপর পুনরায় রাসূল(স.)-এর কাছে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে বিতর্ককারীদের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাদেরকে কেয়ামতের আযাব সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সেদিন তাদের ঘাড়ের ওপর বেড়ি ও শিকল পরানাে হবে, তাদেরকে ফুটন্ত পানির দিকে টেনে নেয়া হবে, অতপর তাদেরকে আগুনে পােড়ানাে হবে।’ যাদেরকে তারা আল্লাহর সাথে শরীক করতো তারা সেদিন সব দায়দায়িত্ব অস্বীকার করবে। এমনকি স্বয়ং মােশরেকেরাও দুনিয়ায় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে উপাসনা করার কথা অস্বীকার করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের জাহান্নামে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তাদেরকে বলা হবে, জাহান্নামের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে এবং ওখানে চিরদিন অবস্থান করাে। দাম্ভিকদের আবাসস্থল কতই না জঘন্য। এ দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাঁর রসূলকে পুনরায় ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিচ্ছেন এবং আস্থা রাখতে বলছেন যে, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, চাই এই প্রতিশ্রুতির কিছু অংশ দুনিয়াতেই কার্যকরী হওয়া পর্যন্ত সে বেঁচে থাক অথবা তার আগেই মারা যাক। সর্বাবস্থায় প্রতিশ্রুতি কার্যকর হবেই। সূরার শেষ ভাগটি তৃতীয় অংশের সাথেই সংযুক্ত। রসূল(স.)-কে ধৈর্যধারণ ও অপেক্ষা করতে আদেশ দেয়ার পর বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তার আগে বহু রসূল পাঠিয়েছেন। ‘কোনাে রসূলই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনাে নিদর্শন নিয়ে আসতে পারে না। সাধারণভাবে বিশ্ব প্রকৃতির সর্বত্র এবং সকলের চোখের সামনে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু এগুলাে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার ব্যাপারে সবাই উদাসীন। যেমন ধরা যাক, এইসব জীবজন্তু যারা মানুষের ইংগিতে চলে । কে তাদেরকে মানুষের অনুগত করলাে? আর এইসব নৌযান, যা মানুষকে এখান থেকে ওখানে নিয়ে যায়। নিদর্শন তারা কি দেখতে পায় না? আর অতীতের জাতিগুলাের ধ্বংসের বৃত্তান্ত কি তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে না? কোনাে উপদেশই কি তাদেরকে দেয় না? সূরাটার সমাপ্তি টানা হয়েছে কাফেরদের ধ্বংসের কাহিনী সম্পর্কে একটা জোরদার মন্তব্য করার মধ্য দিয়ে। তারা আল্লাহর আযাব দেখে ঈমান এনেছিলাে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এই সমাপনী বক্তব্য থেকে দাম্ভিক লােকদের পরিণতি কী হয়, তা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। এবার এটা সূরার বিশদ ব্যাখ্যায় মনােনিবেশ করা যাক।

‘হা-মীম…’(আয়াত ১-৩) এই সূরা থেকে শুরু হয়েছে হা-মীম দিয়ে আরম্ভ করা সাতটা সূরা। এগুলাের মধ্যে একটা সূরায় হা-মীমের পর আইন-সীন-কাফ’ও যুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন সূরার প্রথমে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন বর্ণমালার ব্যবহারের তাৎপর্য সম্পর্কে ইতিপূর্বে আলােচনা হয়েছে। এ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে যে, এই কোরআন এসব বর্ণমালা দিয়েই রচিত হয়েছে, তথাপি এ বর্ণমালা দিয়ে মােশরেকরা এ ধরনের কিতাব রচনা করতে পারে না। অথচ এসব বর্ণমালা তাদেরই ভাষার বর্ণমালা, এগুলাে দিয়ে তারা কথা বলে ও লেখে। এগুলাে তাদের কাছে সুপরিচিত এবং এগুলাের প্রয়ােগ ও ব্যবহার তাদের কাছে খুবই সহজ। এর অব্যবহিত পরই কিতাব নাযিল করার বিষয়টার উল্লেখ করা হয়েছে। আকীদা বিশ্বাস সংক্রান্ত আলােচনার পর্যায়ে মক্কী সূরাগুলােতে যে তত্ত্বটা বারবার বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে, এটা তার মধ্যে অন্যতম।

*আল্লাহর জন্যে সংরক্ষিত নাম ও তার ক্ষমতা : ‘মহাপরাক্রান্ত ও মহাজ্ঞানী আল্লাহর পক্ষ থেকে এ কিতাব নাযিল হয়েছে।’ এখানে কিতাব সংক্রান্ত বিষয়টা এতােটুকুই উল্লেখ করা হয়েছে। এরপরই প্রসংগ পাল্টে এই কিতাব নাযিলকারী মহান আল্লাহর কিছু গুণাবলীর বর্ণনা দেয়া হয়েছে।(আয়াত ৩) এই গুণগুলাে হচ্ছে শক্তি ও পরাক্রম, জ্ঞান, গুনাহ মাফ করা, তাওবা গ্রহণ করা, কঠিন শাস্তি দান, অনুগ্রহ ও পুরস্কার দান, প্রভুত্বের একত্ব এবং শেষপরিণতি ও কর্মফল স্থলের একত্ব। সূরার সবকটা আলােচ্য বিষয় এই গুণাবলীর সাথেই সংশ্লিষ্ট । এই গুণাবলী সূরার শুরুতেই এতো প্রভাবশালী ভংগীতে উল্লেখিত হয়েছে যে, তাতে স্থীতিশীলতার আভাস পাওয়া যায়। মহান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদেরকে নিজের এমন গুণাবলীর পরিচয় দেন, যা তাদের জীবনে ও অস্তিত্বে প্রভাব বিস্তার করে, যা তাদের হৃদয় ও ভাবাবেগকে স্পর্শ করে, যা তাদের আশা ও অভিলাষকে জাগিয়ে তােলে, আবার তাদের মনে ভয় ভীতির সঞ্চার করে এবং তাদেরকে এরূপ ধারণা দেয় যে, তারা আল্লাহরই মুঠোর মধ্যে রয়েছে। সেখান থেকে তাদের পালানাের কোনো উপায় থাকে না। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য গুণাবলী হলাে, আল-আযীয : মহাশক্তিধর, মহাপরাক্রমশালী, যিনি শুধু বিজয়ী হন, কখনাে পরাজিত হন না, যিনি নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী, কেউ তার ওপর ক্ষমতা লাভ করে না এবং কেউ তার ওপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করে না। আল আলীম : মহাজ্ঞানী, যিনি গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলােকে গােটা বিশ্বজগতকে পরিচালিত করেন। কোনাে কিছু তার আগাচরে ও অজানা থাকে না। গাফেরুজ্ জামবি : পাপ ক্ষমাকারী । কেননা তিনি জানেন, কারা ক্ষমা পাওয়ার যােগ্য। কাবিলুত তাওবি : তাওবা কবুলকারী, তাদেরকে নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে আশ্রয় দেন এবং তাদের জন্যে তার দরজা খুলে দেন। শাদীদুল ইকাবি : কঠিন শাস্তি দাতা, যিনি সেইসব অহংকারীদেরকে নিপাত করেন এবং সেইসব বিদ্রোহীরেকে শাস্তি দেন, যারা তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে না। যিত তাওলি : বিপুল বিত্তশালী, যিনি তাঁর বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করেন, সৎকাজের বহুগুণ বেশী প্রতিদান দেন এবং বিনা হিসাবে তাদের দান করেন। লা-ইলাহা ইল্লা হুয়া : তিনি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই, তার কোনাে শরীক ও সমকক্ষ নেই। ইলাইহিল মাসীর : একমাত্র তার কাছেই সবাইকে ফিরে যেতে হবে। তার কাছে জবাবদিহী না করে ও সাক্ষাত না করে কারাে পালানাের স্থান নেই। এভাবে তার বান্দাদের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ও তার সাথে তার বান্দাদের সম্পর্ক স্পষ্ট হয়ে যায়। তাদের আবেগ, অনুভূতি ও উপলব্ধি স্পষ্ট হয়ে যায়। এতে তারা বুঝতে পারে সচেতনভাবে কেমন করে তার সাথে আচরণ করবে। কিসে তিনি খুশী এবং কিসে অসন্তুষ্ট হন, তা জানতে পারবে। মােশরেকরা তাদের মূর্তিপূজা করতো বটে। তবে এগুলোর সম্পর্কে তাদের কোনাে নিশ্চিত জ্ঞান ছিলাে না। কিসে তারা সন্তুষ্ট, কিসে অসন্তুষ্ট হয়, তা তারা জানতাে না কেবল নানারকমের তাবীয-তুমার ও পশু বলির প্রচলন করে তাদেরকে খুশী রাখতে চেষ্টা করতো তাও নিছক আন্দাজের ওপর নির্ভর করে। এতে তারা সন্তুষ্ট হলাে, না অসন্তুষ্ট হলাে তা জানতাে। এই পরিস্থিতিতে ইসলাম এসে সকল অস্পষ্টতা ও অসচ্ছতা ঘুচিয়ে দিলাে। মানুষকে তার প্রকৃত উপাস্যের সাথে যুক্ত করে দিলাে, তার গুণাবলীর সাথে তাকে পরিচিত করলাে, তার ইচ্ছা ও অনিচ্ছা কি তা জানিয়ে দিলাে এবং কিভাবে তার নৈকট্য লাভ করা যায়, কিভাবে তার করুণা লাভ করা যায় । আযাব থেকে বাঁচা যায় এবং সরল ও সঠিক পথে থাকা যায় তা জানিয় দিলাে।

*হক বাতিলের চিরন্তন লড়াই ও কাফেরদের পরিণতি : ‘কাফেররা ছাড়া আল্লাহর আয়াতগুলাে নিয়ে কেউ বিতর্ক করে না…’(আয়াত ৪-৬) আল্লাহর উল্লেখিত মহান গুণাবলী ও একত্বের বর্ণনা দেয়ার পর বলা হচ্ছে যে, এসব সত্য এ বিশ্বজগতের প্রতিটা সৃষ্টি অম্লান বদনে মেনে নিয়েছে এবং কেউই বিতর্কে লিপ্ত হয়নি। একমাত্র কাফেররাই বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং সৃষ্টির অধম বলে চিহ্নিত হয়। অথচ এই পৃথিবীর তুলনায় তারা পিপড়ার চেয়েও ক্ষুদ্র। তারা যখন আল্লাহর নিদর্শনগুলাে নিয়ে তর্ক তােলে, তখন তারা থাকে এক কাতারে, আর মহাবিশ্বর তাবৎ সৃষ্টি অপর কাতারে অবস্থানে নেয়। কেননা এই মহাবিশ্ব তার সৃষ্টিকর্তার ও তার অসীম ক্ষমতার স্বীকৃতি দেয়। কাফেররা এ অবস্থান গ্রহণ করে তাদের পরকালের সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়, চাই তারা যতােই শক্তিধর, যতােই প্রতাপশালী ও যতােই বিত্তশালী হােক না কেন তাতে কিছুই আসে যায় না। অতএব নগরে বন্দরে তাদের ঘোরাফেরা যেন তােমাকে প্রভাবিত না করে। কেননা তারা যতােই ঘােরাফেরা করুক, যতােই দর্প দেখাক, তাদের শেষ পরিণাম ধ্বংস অবধারিত। মহান স্রষ্টার সাথে এই দুর্বল মানুষের যদি যুদ্ধ হতাে, তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াতো এবং যুদ্ধের ফলাফল কী হতাে, তা সুবিদিত। ইতিপূর্বে তাদেরই মতাে কিছু জাতি ও দল অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তাদের যে পরিণতি হয়েছিলাে, সেটা প্রত্যেক বিদ্রোহীর জন্যে অবধারিত, ‘তাদের পূর্বে নূহ-এর জাতি অস্বীকার করেছে…’(আয়াত ৫) এটা একটা প্রাচীন ঘটনা। হযরত নূহ(আ.)-এর আমল থেকেই এটা চলে আসছে। এটা এমন এক লড়াই। যা সকল যুগেই সংঘটিত হওয়া সম্ভব। এ আয়াত থেকে সংক্ষেপে পুরাে ঘটনাটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ অতীতে প্রত্যেক যুগেই রসূলরা এসেছেন, তাদেরকে অংগীকার করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত সবাই একই পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে। রসূল আসেন, আর তার জাতির চরম উচ্ছৃংখল লােকেরা তাকে অস্বীকার করে। অথচ এ জন্য তারা কোনাে যুক্তি প্রমাণের ধারও ধারে না। তারা নিছক উচ্ছৃংখলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। এমনকি রসূলকে তারা শারীরিকভাবেও আক্রমণ করতে চেষ্টা করে এবং জনগণের ওপর বাতিলকে চাপিয়ে দেয়, যাতে তা সত্যের ওপর বিজয়ী হয়। ঠিক এই পর্যায়ে আল্লাহ তায়ালা হস্তক্ষেপ করেন এবং ভয়াবহ আযাব নাযিল করেন, যার ফলে কাফেররা ধ্বংস হয়ে যায়। আবার কখনাে কখনাে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায়, আমার শাস্তি কেমন ছিলাে? বস্তুত শাস্তি ছিলাে সর্বনাশা, ধ্বংসাত্মক ও ভয়াবহ। জাতির ধ্বংসযজ্ঞের যে নিদর্শনাবলী। পরবর্তীকালে পাওয়া গেছে, তা থেকে এর সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত জনশ্রুতি থেকেও জানা গেছে যে, আল্লাহর সেই আযাব ছিলাে লােমহর্ষক। এখানেই শাস্তির শেষ নয়। বরং পরকাল পর্যন্তও তা বিস্তৃত থাকে। এভাবেই তােমার প্রতিপালকের এ ফয়সালা বাস্তবায়িত হয়েছিলাে যে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী। বস্তুত আল্লাহর ফয়সালা যখন কারাে ওপর কার্যকরী হয়ে যায়, তখন আযাব এসেই যায় এবং যাবতীয় বিতর্কের মীমাংসা হয়ে যায় । এভাবেই কোরআন সেই চিরন্তন সত্যটাকে চিত্রিত করে। সত্যটা হলাে, ঈমান ও কুফরির মাঝে, হক ও বাতিলের মাঝে এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর পথে আহ্বানকারীদের এবং অন্যায়ভাবে দম্ভকারী স্বৈরাচারীদের মাঝে লড়াই চিরদিনই লেগে থাকবে, কখনাে বন্ধ হবে না। এ লড়াই মানবজাতির জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে। এ লড়াই আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এর ময়দান সমগ্র পৃথিবীর চেয়েও প্রশস্ত। কেননা গােটা সৃষ্টিজগত তার প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাসী, নতি স্বীকারকারী ও আত্মসমর্পিত। আর মহান আল্লাহকে যারা মানে না, তারা এই বিশাল সৃষ্টিজগত থেকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে। এ অসম লড়াই এর পরিণাম কী তা সবাই জানে। হকপন্থীদের কাতার সুদীর্ঘ ও বাহিনী বিশাল। আর বাতিল পন্থীদের সংখ্যা মুষ্টিমেয় এবং তারা দুর্বল, চাই তারা পৃথিবীতে যতােই বুক ফুলিয়ে চলুক এবং যতােই শক্তির বাহাদুরি দেখাক। হক ও বাতিলের লড়াই সংক্রান্ত এই চিরন্তন সত্য, এর প্রধান পক্ষ ও বিপক্ষ এবং এর কালগত ও স্থানগত অবস্থানের চিত্রটাই কোরআন এঁকে দেখায়, যাতে তা মানুষের মানসপটে স্থায়ী হয় এবং বিশেষভাবে, স্থান ও কাল নির্বিশেষে যারা সত্য ও ঈমানের দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিত তারা এটা উপলব্ধি করে। উপলব্ধি করতে পারলে তারা স্থান ও কালের গন্ডীতে সীমাবদ্ধ বাতিলের দৃশ্যমান শক্তি দেখে ঘাবড়ে যাবে না। কেননা এগুলাে বাস্তব নয়। বাস্তব হচ্ছে শুধু আল্লাহর কিতাবের বক্তব্য তথা আল্লাহর বক্তব্য। কেননা তিনিই সবচেয়ে সত্যবাদী ও বাস্তববাদী বক্তা এবং সবচেয়ে প্রতাপশালী ও মহাজ্ঞানী।
*মােমেনদের জন্যে ফেরেশতাদের দোয়া : আর উল্লেখিত প্রথম সত্যটার সাথে পরবর্তী আয়াতে এ কথাও যুক্ত হয়েছে যে, আরশ বহনকারী ও আরশের আশপাশে অবস্থানকারী ফেরেশতারা, যারা সৃষ্টিজগতের ঈমানদার শক্তিগুলাের অন্তর্ভুক্ত, আল্লাহর কাছে ঈমানদার মানুষদের কথা উল্লেখ করে থাকে। তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাদের ব্যাপারে প্রদত্ত আল্লাহর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবী জানায়। কেননা তাদের সাথে মােমেনদের ঈমান ভিত্তিক সংহতি, সংযােগ ও সৌহার্দ্য বিদ্যমান, ‘যারা আরশ বহন করে ও যারা আরশের আশপাশে থাকে, তারা তাদের প্রতিপালকের প্রশংসাসহ পবিত্রতা পােষণও গুণকীর্তন করে…’(আয়াত ৮-৯) আরশ কী জিনিস আমরা জানি না। এর কোনাে ছবিও আমাদের কাছে নেই। যারা আরশকে বহন করে, তারা কিভাবে বহন করে এবং যারা তার আশপাশে থাকে তারাই বা কিভাবে থাকে। আর যে জিনিস উপলব্ধি করার ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবেই মানুষের নেই, তার পেছনে ছুটোছুটি করে কোনাে লাভ নেই। আর যে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা কাউকে অদৃশ্য জ্ঞান দেননি, তা নিয়ে তর্ক বিতর্ক করেও কোনাে ফায়দা নেই। এ আয়াত কটাতে যে তথ্যটা জানানাে হয়েছে তা কেবল এতটুকুই যে, আল্লাহর কিছু ঘনিষ্ঠ বান্দা তার প্রশংসাসহ তাসবীহ করে থাকে এবং তার প্রতি ঈমান আনে। কোরআন তাদের ঈমানের বিষয়টা উল্লেখ না করলেও বুঝা যাচ্ছিলাে যে, তারা মােমেন। তথাপি উল্লেখ করার উদ্দেশ্য ঈমানদার আদম সন্তানদের সাথে তাদের সম্পর্ক ও সখ্য প্রকাশ করা। এসব ঘনিষ্ঠ বান্দা আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করার পর ঈমানদার মানুষদের জন্যে সর্বোত্তম কল্যাণ কামনা করে। একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের জন্যে যেমন সার্বিক কল্যাণ কামনা করে দোয়া করে, তারাও তদ্রুপ করে। এখানে তাদের শুধু দোয়াটাই তুলে ধরা হচ্ছে না, বরং দোয়া করার আদব ও নিয়ম পদ্ধতিটাও শিখিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি দয়া ও জ্ঞান দিয়ে সব কিছুকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছো।’ দোয়ার আগে তারা জানাচ্ছেন যে, তারা মানব জাতির জন্যে আল্লাহর সেই দয়া ও করুণা কামনা করছেন, যা কোনাে নির্দিষ্ট গন্ডীতে সীমাবদ্ধ নয় এবং কোনাে বিশেষ সৃষ্টির জন্যে নির্দিষ্ট নয়। বরং সকল সৃষ্টির জন্যে অবারিত এবং সকল সৃষ্টির ওপর পরিব্যাপ্ত। তারা আল্লাহর সর্বব্যাপী জ্ঞানের কথাও উল্লেখ করেছেন। তারা আল্লাহর সামনে আগ বাড়িয়ে কোনাে কথা বলছেন না এবং কোনাে অনধিকার চর্চা করছেন না; বরং আল্লাহর সর্বব্যাপী জ্ঞান ও দয়ার কাছেই আশ্রয় চাইছেন এবং তারই খানিকটা প্রার্থনা করছেন, ‘অতএব, যারা তাওবা করেছে এবং তােমার পথে চলেছে, তাদেরকে ক্ষমা করাে এবং দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করো।’ এখানে যে তাওবা ও ক্ষমার উল্লেখ করা হয়েছে, তার সাথে সূরার শুরুতে ‘গুনাহ ক্ষমাকারী ও তাওবা কবুলকারী’ বলে আল্লাহর যে গুণকীর্তন করা হয়েছে তার মিল রয়েছে। অনুরূপভাবে এখানে যে দোযখের আযাব এর উল্লেখ করা হয়েছে, তার সাথে সূরার শুরুতে বর্ণিত কঠিন শাস্তিদাতা শব্দটার মিল রয়েছে। এরপর ফেরেশতারা তাদের দোয়ায় ক্ষমা ও আযাব থেকে রক্ষা করার আবেদনের পর আরাে এক ধাপ এগিয়ে আল্লাহর সৎ বান্দাদের জন্যে জান্নাত ও তার প্রতিশ্রুতি পালনের আবেদন জানান, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আর তাদেরকে সেই চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করাও, যার প্রতিশ্রুতি তাদেরকে এবং তাদের সৎ পিতামাতা, স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তুমি দিয়েছে। নিশ্চয়ই পরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞানী।’ এ কথা বলাই বাহুল্য যে, জান্নাতে প্রবেশ একটা বিরাট নেয়ামত ও সাফল্য। সেই সাথে সেখানে যদি সততার বলে প্রবেশাধিকার প্রাপ্ত পিতামাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের সাহচার্যও পাওয়া যায়, তবে সেটা হবে পৃথক আরাে একটা নেয়ামত। এই ঈমান ও সততার বন্ধন ঈমানদারদের সকলের ঐকোর প্রতীক। এই ঈমানের বন্ধনের কারণেই স্ত্রী পুত্র পরিজনের মধ্যে সম্মিলন ঘটবে। এ বন্ধন না থাকলে তাদের মধ্যে আর কোনাে যােগাযােগ থাকবে না, সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। এই দোয়ার শেষ বাক্য নিশ্চয়ই মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী একটা সমাপনী মন্তব্য। এতে শক্তি ও পরাক্রমের দিকে এবং বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার দিকে ইংগিত করা হয়েছে। এই বিজ্ঞতা দ্বারাই বান্দাদের ওপর শাসন কার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। আর তাদেরকে সকল অসততা ও পাপাচার থেকে রক্ষা করাে। যাকে সেদিন পাপাচার থেকে মুক্ত করে ওঠাবেন, তার ওপর তুমি অবশ্যই অনুগ্রহ করবে। বস্তুত এটা একটা বিরাট সাফল্য। চিরস্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করানাের আবেদন জানানাের পর এই দোয়াটা কঠিন পরিস্থিতিতে সর্বোত্তম আশ্রয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেহেতু অসৎ কাজ ও পাপ কাজ আখেরাতে মানুষের সর্বনাশ ঘটায়, সেহেতু আল্লাহ যখন তাঁর বান্দাদেরকে পাপকাজ থেকে বিরত ও মুক্ত রাখেন, তখন তার কুফল ও অশুভ পরিণাম থেকেও তাকে রক্ষা করেন। তাই সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এটা একটা, রহমতরূপে গন্য হয়। আর এটা সাফল্য ও সৌভাগ্যেরও সর্বোত্তম ব্যবস্থা। সুতরাং এ নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নিছক পাপাচার থেকে রক্ষা পাওয়াও একটা বিরাট ব্যাপার।

*দ্বীনের দাওয়াত অস্বীকার করার পরিণতি : একদিকে যখন আরশ বহনকারী ও আরশের আশপাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের পক্ষ থেকে তাদের ঈমানদার ভাইদের জন্যে এই দোয়া করা হয়। অন্যদিকে তখন কাফেরদেরকে আমরা এমন শােচনীয় অবস্থায় পতিত দেখতে পাই, যখন প্রত্যেক প্রাণী সাহায্যকারী কামনা করে, অথচ সাহায্যকারীর কোনাে পাত্তা থাকে না। এইসব কাফেরের সাথে অন্য সকলের ও সকল সৃষ্টির সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। কেয়ামতের দিন তাদেরকে চারদিক থেকে অপমানজনকভাবে ধমক দিয়ে ডাকা হবে। দম্ভ ও অহংকারের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার জীবন কাটিয়ে আসার পর তাদেরকে সহসাই এই অবমাননাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। ‘তাদের সকল আশা সেদিন নিস্ফল হয়ে যাবে, নিশ্চয় যারা কুফরী করেছে তাদেরকে ডেকে বলা হবে’(আয়াত ১০-১২) আল মাকতু হচ্ছে সর্বোচ্চ মাত্রার ক্ষোভ বা অসন্তোষ। কেয়ামতের দিন কাফেরদেরকে চারদিক থেকে সমস্বরে ডেকে বলা হবে যে, যেদিন তােমাদেরকে ঈমানের আহ্বান জানানাে হচ্ছিলাে, আর তােমরা তা অগ্রাহ্য করছিলে, সেদিন তােমাদের ওপর আল্লাহর যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছিলাে, সেটা তােমাদের ওপর তােমরা নিজেরা আজ যে ক্ষোভ ও অনুশােচনা প্রকাশ করছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেশী তীব্র ছিলাে। কেয়ামতের সেই ভয়াবহ পরিবেশে কাফেরেদের এই অনুশােচনা এতাে মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক হবে যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তখন তাদের সকল ধোকাবাজি ও বিভ্রান্তির পর্দা সরে যাবে এবং তারা বুঝতে পারবে যে, আজকে কেবল আল্লাহ তায়ালা ছাড়া তাদের আর কোনাে আশ্রয়স্থল নেই, তাই সেদিকেই তারা মনােনিবেশ করবে, তারা বলবে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, তুমি আমাদেরকে দু’বার মৃত্যু দিয়েছো এবং দু’বার জীবন দিয়েছো। আমরা আমাদের গুনাহর কথা স্বীকার করেছি। এখন বের হবার কি কোনাে পথ আছে?’ এ হচ্ছে চরম দুদর্শাগ্রস্ত, হতাশ ও অপমানিত ব্যক্তির উক্তি, ‘হে আমাদের প্রতিপালক।’ অথচ দুনিয়ায় থাকতে এই প্রতিপালককে তারা চিনতােইনা এবং অস্বীকার করতাে। ‘দু’বার জীবন দিয়েছ’ কথাটার অর্থ হলাে, একবার প্রাণহীন ভ্রুণে প্রাণ ফুঁকে দিয়ে জীবন দিয়েছ, আর একবার মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবিত করে এই কেয়ামতের ময়দানে সমবেত করেছে। আমরা এখন যে ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আছি, তা থেকে বের করার ক্ষমতা তােমার আছে। আমরা তাে আমাদের অপরাধ স্বীকার করেছি। বের হবার কি কোনাে পথ আছে কথাটার ভেতরে স্পষ্টতই তীব্র হতাশা ফুটে উঠেছে। এই হতাশাব্যঞ্জক শােচনীয় পরিস্থিতিতে তাদেরকে জানানাে হচ্ছে এই শােচনীয় পরিণতির কারণ কী? ‘তোমাদের এ অবস্থার কারণ হলো, যখন এক আল্লাহকে ডাকা হতো, তখন তােমরা তা অস্বীকার করতে। আর যদি তার সাথে শরীক করা হতাে, তাহলে তােমরা তা বিশ্বাস করতে। সুতরাং মহামহিম সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহ তায়ালাই আজ এর ফয়সালা করবেন।’ অর্থাৎ আল্লাহর কল্পিত শরীকদের প্রতি তােমাদের বিশ্বাস এবং তাঁর একত্বের প্রতি তােমাদের অবিশ্বাস তােমাদের এই শোচনীয় অবমাননাকর পরিস্থিতিকে টেনে এনেছে। অতএব মহামহিম সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহ তায়ালাই আজ এর ফয়সালা করবেন। ‘আল-আলী’ ও ‘আল-কাবীর’ আল্লাহর এই দুটো গুণবাচক বিশেষণ এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এই দুটো গুণই ফায়সালা করার সাথে সংগতিপূর্ণ। কেননা আল-আলী অর্থ সব কিছুর ঊর্ধে যিনি । আর আল-কাবীর অর্থ সবকিছুর চেয়ে বড় যিনি। এই দুটো গুণই চূড়ান্ত ফয়সালা ও মীমাংসার জন্যে প্রয়ােজনীয় হয়ে থাকে।

*আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতা : প্রসংগক্রমে পরবর্তী কটা আয়াতে আল্লাহর আরাে কিছু গুণের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ। সেই সাথে মােমেনদেরকে আল্লাহর দিকে একনিষ্ঠভাবে মনােনিবেশ করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, কেয়ামতের দিন একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই হবেন সবকিছুর মালিক ও সর্বময় কর্তা, ‘তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি তােমাদের নিজের নিদর্শনাবলী দেখান এবং তােমাদের জন্যে আকাশ থেকে জীবিকা অবতীর্ণ করেন…’(আয়াত ১৩-১৮) ‘তিনি নিজের নিদর্শনাবলী তােমাদেরকে দেখান’ আল্লাহর নিদর্শনাবলী জগতের প্রত্যেকটা জিনিসেই দৃশ্যমান। সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, রাত দিন, মেঘ বৃষ্টি, এবং বজ্রবিদ্যুতের ন্যায় বড় বড় জিনিসে যেমন বিদ্যমান, তেমনি ফুল, পাতা, অণু পরমাণু ও জীবকোষের ন্যায় ছােট ছােট জিনিসেও নিদর্শন বিরাজমান। এগুলাের প্রত্যকটাতেই অলৌকিক নিদর্শন রয়েছে। এই আলৌকিক নিদর্শনের মাহাত্ম্য তখনই প্রকাশ পায়, যখন মানুষ তার অনুকরণের চেষ্টা চালায়। নতুন সৃষ্টি করা তাে তার সাধ্যাতীত। তাই অনুকরণই ভরসা। কিন্তু পরিপূর্ণ ও নির্ভুল অনুকরণও তার অসাধ্য। মহান আল্লাহর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সৃষ্টির হুবহু অনুকরণ তার পক্ষে শুধু সাধ্যাতীত নয় বরং কল্পনারও অতীত। ‘আর তােমাদের ওপর আকাশ থেকে জীবিকা অবতীর্ণ করে।’ আকাশ থেকে অবতীর্ণ জীবিকার মধ্যে মানুষ এ যাবত যা কিছু জানতে পেরেছে, তার একটা হলাে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি পৃথিবীতে জীবনের উৎস এবং খাদ্য ও পানীয়ের মূল উপাদান। বৃষ্টি ছাড়া আরাে বহু জিনিস রয়েছে যা পর্যায়ক্রমে আবিস্কৃত হচ্ছে। এর মধ্যে একটা হলাে আলােকরশ্মি, যা না থাকলে ভূপৃষ্ঠে জীবনের অস্তিত্ব থাকতাে না। নবী ও রসূলদের কাছে অবতীর্ণ কিতাব বা ওহীও সম্ভবত আকাশ থেকে অবতীর্ণ জীবিকার আওতাভুক্ত, যা মানবজাতিকে নির্ভুল ও নিরাপদ পথে বহাল রাখে এবং আল্লাহর সাথে যুক্ত জীবন ও তার নির্ভুল নিয়ম-বিধির সন্ধান দেয়। ‘একমাত্র বিনয়ী ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ স্মরণ করে না। বস্তুত আল্লাহমুখী বিনম্র ও বিনয়ী মানুষ তার নেয়ামত ও অনুগ্রহের কথা ও তার নিদর্শনাবলীর কথা স্মরণ করে, আর পাষাণ হৃদয়ের মানুষ তা ভুলে যায়। বিনয় মানুষকে নিদর্শনাবলী স্মরণ করতে ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাই এর উল্লেখের পর আল্লাহ তায়ালা মােমেনদেরকে এক আল্লাহর এবাদাত ও একনিষ্ঠ আনুগত্য করার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং এতে কাফেরদের পছন্দ অপছন্দের তােয়াক্কা না করার আদেশ দিয়েছেন, ‘অতএব এক আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ডাকো, যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’ বস্তুত মুসলমানরা আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্য ও একক এবাদাত করুক এটা অমুসলিমরা। কখনাে পছন্দ করে না। মুসলমানরা তাদের সাথে যতােই কোমল ও বিনম্র আচরণ করুক, তাতেও তারা সন্তুষ্ট হবে বলে আশা করা যায় না। কাজেই মুসলমানদেরকে আল্লাহর এবাদাত ও তাঁর একনিষ্ঠ আনুগত্য চালিয়ে যাওয়া উচিত। কাফেরদের সন্তোষ অসন্তোষের তােয়াক্কা করা উচিত নয়। কেননা তারা কোনােদিনও সন্তুষ্ট হবে না। এরপর আল্লাহর এমন কয়েকটা গুণ বর্ণনা করা হচ্ছে, যা আল্লাহ তায়ালার একনিষ্ঠ এবাদাত ও আনুগত্যের সাথে সংগতিপূর্ণ ‘তিনি উচ্চমর্যাদাশালী, আরশের অধিপতি। নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছে করেন নিজের নির্দেশ পাঠান, অর্থাৎ একমাত্র তিনিই উচ্চমর্যাদাশালী এবং সর্বোচ্চ আরশের মালিক। তিনিই তার সেই বিধান তার মনােনীত বান্দার কাছে পাঠান, যা অন্তর ও আত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করে। এটা আসলে রেসালাত ও ওহীর দিকে ইংগিত। তবে যে বাচনভংগী এখানে অবলম্বন করা হয়েছে, তাতে ওহীর সুষ্ঠু পরিচয় নিহিত রয়েছে। সেটা হলাে, ওহী মানবজাতির আত্মা ও জীবনী শক্তির উৎস, আর এই ওহী নির্বাচিত ব্যক্তিদের কাছে পাঠানাে হয় ওপর থেকে। এই কথাগুলাের সবই আল্লাহর উল্লেখিত গুণ ‘আল-আলী’ ও ‘আল কাবীর’ (বড় ও উচ্চ)-এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

Leave a Reply