أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৬)
[* *হক বাতিলের চিরন্তন লড়াই:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
১-১৭ নং আয়াত:-
তাফসীরে তাফহীম উল কুরআন বলেছেন:-
# (৪০-মুমিন) : নামকরণ:
সূরার ২৮ আয়াতের وَقَالَ رَجُلٌ مُؤْمِنٌ مِنْ آلِ فِرْعَوْنَ অংশ থেকে নাম গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ এটা সে সূরা যার মধ্যে সেই বিশেষ মু’মিন ব্যক্তির উল্লেখ আছে।
(৪০-মুমিন) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল : ইবনে আব্বাস ও জাবের ইবনে যায়েদ বর্ণনা করেছেন যে, এ সূরা সূরা যুমার নাযিল হওয়ার পর পরই নাযিল হয়েছে। কুরআন মজীদের বর্তমান ক্রমবিন্যাস এর যে স্থান, নাযিল হওয়ার ধারাক্রম অনুসারেও সূরাটির সে একই স্থান।
(৪০-মুমিন) : নাযিলের উপলক্ষ / প্রেক্ষাপট :
যে পটভূমিতে এ সূরা নাযিল হয়েছিলো এর বিষয়বস্তুর মধ্যে সেদিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বিদ্যমান। সে সময় মক্কার কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে দুই ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলো।
এক, বাক-বিতণ্ডা ও তর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করে নানা রকমের উল্টা-পাল্টা প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং নিত্য নতুন অপবাদ আরোপ করে কুরআনের শিক্ষা, ইসলামী আন্দোলন এবং খোদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে মানুষের মনে এমন সন্দেহ সংশয় ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দেয়া যে, তা খণ্ডন করতেই যেন নবী (সা.) ও ঈমানদারগণ বিরক্ত হয়ে ওঠেন।
দুই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ উদ্দেশ্যে তারা একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিলো। একবার তারা কার্যত এ পদক্ষেপ নিয়েও ফেলেছিলো। বুখারীতে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) বর্ণিত হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন হারাম শরীফের মধ্যে নামায পড়ছিলেন। হঠাৎ ‘উকবা ইবনে আবু মু’আইত অগ্রসর হয়ে তাঁর গলায় কাপড় পেঁচিয়ে দিল। অতপর তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার জন্য কাপড়ে মোচড় দিতে লাগলো। ঠিক সে মুহূর্তে হযরত আবু বকর (রা.) সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন এবং ধাক্কা মেরে উকবা ইবনে আবু মু’আইতকে হটিয়ে দিলেন। হযরত আবদুল্লাহ বর্ণনা করেছেন, হযরত আবু বকর যে সময় ধাক্কা দিয়ে ঐ জালেমকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন তখন তাঁর মুখ থেকে উচ্চারিত হচ্ছিলো, أَتَقْتُلُونَ رَجُلًا أَنْ يَقُولَ رَبِّيَ اللَّهُ (তোমরা কি শুধু এতটুকুন অপরাধে একজন মানুষকে হত্যা করছো যে, তিনি বলছেন, আমার রব আল্লাহ ?) এ ঘটনাটি সীরাতে ইবনে হিশাম গ্রন্থেও কিছুটা ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া নাসায়ী ও ইবন আবী হাতেমও ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।
(৪০-মুমিন) : বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য :
বক্তব্যের শুরুতেই পরিস্থিতির এ দু’টি দিক পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। অবশিষ্ট গোটা বক্তব্যই এ দু’টি দিকের অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও শিক্ষাপ্রদ পর্যালোচনা মাত্র। হত্যার ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষিতে ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যকার ঈমানদার ব্যক্তির কাহিনী শুনানো হয়েছে (আয়াত ৩৩ থেকে ৫৫) এবং এ কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে তিনটি গোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি শিক্ষা দেয়া হয়েছে: এক: কাফেরদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যা কিছু করতে চাচ্ছো ফেরাউন নিজের শক্তির ওপর ভরসা করে হযরত মূসার (আ) সাথে এমন একটা কিছুই করতে চেয়েছিলো। একই আচরণ করে তোমরাও কি সে পরিণাম ভোগ করতে চাও যা তারা ভোগ করেছিলো?
। দুই: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, এসব জালেম দৃশ্যত যত শক্তিশালী ও অত্যাচারীই হোক না কেন এবং তাদের মোকাবিলায় তোমরা যতই দুর্বল ও অসহায় হও না কেন, তোমাদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকা উচিত, যে আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য তোমরা কাজ করে যাচ্ছো তাঁর শক্তি যে কোন শক্তির তুলনায় প্রচণ্ডতম। সুতরাং তারা তোমাদের যত বড় ভীতিকর হুমকিই দিক না কেন তার জবাবে তোমরা কেবল আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে নাও এবং তারপর একেবারে নির্ভয় হয়ে নিজেদের কাজে লেগে যাও। আল্লাহর পথের পথিকদের কাছে যে কোন জালেমের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের একটিই জবাব, আর তা হচ্ছে:
। إِنِّي عُذْتُ بِرَبِّي وَرَبِّكُمْ مِنْ كُلِّ مُتَكَبِّرٍ لَا يُؤْمِنُ بِيَوْمِ الْحِسَابِ
। এভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা করে বিপদ সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে যদি কাজ করো তাহলে শেষ পর্যন্ত তাঁর সাহায্য অবশ্যই লাভ করবে এবং অতীতের ফেরাউন যে পরিণামের সম্মুখীন হয়েছে বর্তমানের ফেরাউনও সে একই পরিণামের সম্মুখীন হবে। সে সময়টি আসার পূর্বে জুলুম-নির্যাতনের তুফান একের পর এক যতই আসুক না কেন তোমাদেরকে তা ধৈর্য্যের সাথে বরদাশত করতে হবে।
। তিন: এ দু’টি গোষ্ঠী ছাড়াও সমাজে তৃতীয় আরেকটি গোষ্ঠী ছিল। সেটি ছিল এমন লোকদের গোষ্ঠী যারা মনে-প্রাণে বুঝতে পেরেছিলো যে, ন্যায় ও সত্য আছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষে আর কুরাইশ গোত্রের কাফেররা নিছক বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু একথা জানা সত্ত্বেও তারা হক ও বাতিলের এ সংঘাতে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলো। এক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলা বিবেককে নাড়া দিয়েছেন। তিনি তাদের বলছেন, ন্যায় ও সত্যের দুশমনরা যখন তোমাদের চোখের সামনে এত বড় নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ নেয়ার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে তখনও যদি তোমরা বসে বসে তামাসা দেখতে থাকো তাহলে আফসোস। যে ব্যক্তির বিবেক একেবারে মরে যায়নি তাদের কর্তব্য ফেরাউন যখন মূসাকে (আ) হত্যা করতে চেয়েছিলো তখন তার ভরা দরবারে সভাসদদের মধ্য থেকে একজন ন্যায়পন্থী ব্যক্তি যে ভূমিকা পালন করেছিলো সে ভূমিকা পালন করা। যে যুক্তি ও উদ্দেশ্য তোমাদেরকে মুখ খোলা থেকে বিরত রাখছে সে একই যুক্তি ও উদ্দেশ্য, ঐ ব্যক্তির সামনে পথের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু সে أُفَوِّضُ أَمْرِي إِلَى اللَّهِ (আমার সব বিষয় আল্লাহর ওপর সোপর্দ করলাম) বলে সমস্ত যুক্তি ও উদ্দেশ্যকে পদাঘাত করেছিলেন। কিন্তু দেখো, ফেরাউন তার কিছুই করতে পারেনি।
। ন্যায় ও সত্যকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য পবিত্র মক্কায় রাতদিন কাফেরদের যে তর্ক-বিতর্ক ও বাক-বিতণ্ডা চলছিলো তার জবাবে একদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কাফেরদের মধ্যকার মূল বিবাদের বিষয় তাওহীদ ও আখিরাতের আকীদা বিশ্বাসের যথার্থতা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছে এবং এ সত্য স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, এসব লোক কোন যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই খামাখা সত্যের বিরোধিতা করছে। অপর দিকে কুরাইশ নেতারা এতটা তৎপরতার সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলো কেন সে কারণগুলোকে উন্মোচিত করা হয়েছে। বাহ্যত তারা দেখাচ্ছিলো যে, নবীর (সা.) শিক্ষা এবং তাঁর নবুওয়াতে দাবী সম্পর্কে তাদের বাস্তব আপত্তি আছে যার কারণে তারা এসব কথা মেনে নিতে পারছে না। তবে মূলত তাদের জন্য এটা ছিলো ক্ষমতার লড়াই। কোন রাখঢাক না করে ৫৬ আয়াতে তাদেরকে পরিষ্কার একথা বলে দেয়া হয়েছে যে, তোমাদের অস্বীকৃতির আসল কারণ তোমাদের গর্ব ও অহংকার যা দিয়ে তোমাদের মন ভরা। তোমরা মনে করো মানুষ যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত মেনে নেয় তাহলে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকবে না। এ কারণে তাঁকে পরাস্ত করার জন্য তোমরা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছো।
। এ প্রসংগে কাফেরদেরকে একের পর এক সাবধান করা হয়েছে যে, যদি তোমরা আল্লাহর আয়াতসমূহের বিরুদ্ধে বিতর্ক সৃষ্টি করা থেকে বিরত না হও তাহলে অতীতের জাতিসমূহ যে পরিণাম ভোগ করেছে তোমরাও সে একই পরিণামের সম্মুখীন হবে এবং আখিরাতে তোমাদের জন্য তার চেয়েও নিকৃষ্ট পরিণাম ভাগ্যের লিখন হয়ে আছে। সে সময় তোমরা অনুশোচনা করবে, কিন্তু তাতে কোন লাভ হবে না।
# এটা বক্তব্যের ভূমিকা। এর মাধ্যমে পূর্বাহ্ণেই শ্রোতাদেরকে এ মর্মে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সামনে যে বাণী পেশ করা হচ্ছে তা কোন সাধারণ সত্তার বাণী নয়, বরং তা নাযিল হয়েছে, এমন আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি এসব গুণাবলীর অধিকারী। এরপর একের পর এক আল্লাহ তা’আলার কতিপয় গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। যা পরবর্তী বিষয়বস্তুর সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিতঃ
প্রথম গুণটি হচ্ছে তিনি পরাক্রমশালী বা সর্বমক্তিমান অর্থাৎ সবার ওপরে বিজয়ী। কারো ব্যাপারে তিনি যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেন তা নিশ্চিতভাবেই কার্যকরী হয়। তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে কেউ বিজয়ী হতে পারে না। কিংবা কেউ তাঁর পাকড়াও থেকেও বাঁচতে পারে না। তাই তাঁর নির্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কেউ যদি সফলতার আশা করে এবং তাঁর রসূলের বিরোধিতা করে তাঁকে পরাভূত ও অবদমিত দেখানোর আশা করে, তাহলে তা তার নিজের বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধরনের আশা কখনো পূরণ হতে পারে না।
দ্বিতীয় গুণটি হচ্ছে, তিনি সবকিছু জানেন। অর্থাৎ তিনি অনুমান ও ধারণার ভিত্তিতে কোন কথা বলেন না, বরং তিনি প্রতিটি বস্তু সম্পর্কেই সরাসরি জ্ঞানের অধিকারী। এজন্য অনুভূতি ও ইন্দ্রিয় বহির্ভূত বিষয়ে তিনি যেসব তথ্য দিচ্ছেন কেবল সেগুলোই সঠিক হতে পারে এবং তা না মানার অর্থ হচ্ছে অযথা অজ্ঞতার অনুসরণ করা। একইভাবে তিনি জানেন কোন্ জিনিসে মানুষের উন্নতি এবং তার কল্যাণের জন্য কোন্ নীতিমালা, আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধ আবশ্যক। তাঁর প্রতিটি শিক্ষা সঠিক কৌশল ও জ্ঞানভিত্তিক যার মধ্যে ভুল-ভ্রান্তির কোন সম্ভাবনা নেই। অতএব, তাঁর পথনির্দেশনা গ্রহণ না করার অর্থ হচ্ছে, ব্যক্তি নিজেই তার ধ্বংসের পথে চলতে চায়। তাছাড়া মানুষের কোন গতিবিধি তাঁর নিকট গোপন থাকতে পারে না। এমনকি মনের যে নিয়ত ও ইচ্ছা মানুষের সমস্ত কাজ-কর্মের মূল চালিকাশক্তি তাও তিনি জানেন। তাই কোন অজুহাত বা বাহানা দেখিয়ে মানুষ তাঁর শাস্তি থেকে রক্ষা পেতে পারে না।
তৃতীয় গুণ হচ্ছে, “গোনাহ মাফকারী ও তাওবা কবুলকারী” এটা তাঁর আশা ও উৎসাহ দানকারী গুণ। এ গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা এখনো পর্যন্ত বিদ্রোহ করে চলেছে তারা যেন নিরাশ না হয় বরং একথা ভেবে নিজেদের আচরণ পুনর্বিবেচনা করে যে, এখনো যদি তারা এ আচরণ থেকে বিরত হয় তাহলে আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারে। এখানে একথা বুঝে নিতে হবে যে, গোনাহ মাফ করা আর তাওবা কবুল করা একই বিষয়ের দু’টি শিরোনাম মোটেই নয়। অনেক সময় তাওবা ছাড়াই আল্লাহ তা’আলা গোনাহ মাফ করতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ এক ব্যক্তি ভুল-ত্রুটিও করে আবার নেকীর কাজও করে এবং তার নেকীর কাজ গোনাহ মাফ হওয়ার কারণ হয়ে যায়, চাই ঐ সব ভুল-ত্রুটির জন্য তার তাওবা করার ও ক্ষমা প্রার্থনা করার সুযোগ হোক বা না হোক। এমনকি সে যদি তা ভুলে গিয়ে থাকে তাও। অনুরূপভাবে পৃথিবীতে কোন ব্যক্তির ওপর যত দুঃখ-কষ্ট, বিপদাপদ, রোগ-ব্যাধি এবং নানা রকম দুশ্চিন্তা ও মর্মপীড়াদায়ক বিপদাপদই আসে তা সবই তার গোনাহ ও ভুল-ত্রুটির কাফফরা হয়ে যায়। এ কারণে গোনাহ মাফ করার কথা তাওবা কবুল করার কথা থেকে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাওবা ছাড়াই গোনাহ মাফ লাভের এ সুযোগ কেবল ঈমানদারদের জন্যই আছে। আর ঈমানদারদের মধ্যেও কেবল তারাই এ সুযোগ লাভ করবে যারা বিদ্রোহ করার মানসিকতা থেকে মুক্ত এবং যাদের দ্বারা মানবিক দুর্বলতার কারণে গোনাহর কাজ সংঘটিত হয়েছে, অহংকার ও বার বার গোনাহ করার কারণে নয়।
চতুর্থ গুণ হচ্ছে, তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। এ গুণটি উল্লেখ করে মানুষকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, বন্দেগী ও দাসত্বের পথ অনুসরণকারীদের জন্য আল্লাহ তা’আলা যতটা দয়াবান, বিদ্রোহ ও অবাধ্যতার আচরণকারীদের জন্য তিনি ঠিক ততটাই কঠোর। যেসব সীমা পর্যন্ত তিনি ভুল-ত্রুটি ক্ষমা ও উপেক্ষা করেন, যখন কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি সে সীমাসমূহ লংঘন করে তখন তারা তাঁর শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়। আর তাঁর শাস্তি এমন ভয়াবহ যে, কোন নির্বোধ মানুষই কেবল তা সহ্য করার মত বলে মনে করতে পারে।
পঞ্চম গুণ হচ্ছে, তিনি অত্যন্ত দয়ালু অর্থাৎ দানশীল, অভাবশূন্য এবং উদার ও অকৃপণ। সমস্ত সৃষ্টিকূলের ওপর প্রতিমুহূর্তে তাঁর নিয়ামত ও অনুগ্রহরাজি ব্যাপকভাবে বর্ষিত হচ্ছে। বান্দা যা কিছু লাভ করছে তা তাঁর দয়া ও অনুগ্রহেই লাভ করছে। এ পাঁচটি গুণ বর্ণনা করার পর অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে দু’টি সত্য বর্ণনা করা হয়েছে। একটি হচ্ছে, মানুষ আর যত মিথ্যা উপাস্যই বানিয়ে রাখুক না কেন প্রকৃত উপাস্য একমাত্র তিনি। অপরটি হচ্ছে, অবশেষে সবাইকে আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে। মানুষের কৃতকর্মসমূহের হিসেব গ্রহণকারী এবং সে অনুসারে পুরস্কার বা শাস্তি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী আর কোন উপাস্য নেই। অতএব, কেউ যদি তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদের উপাস্য বানিয়ে নেয় তাহলে তার এ নির্বুদ্ধিতার ফল সে নিজেই ভোগ করবে।একটি হচ্ছে, মানুষ আর যত মিথ্যা উপাস্যই বানিয়ে রাখুক না কেন প্রকৃত উপাস্য একমাত্র তিনি। অপরটি হচ্ছে, অবশেষে সবাইকে আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে। মানুষের কৃতকর্মসমূহের হিসেব গ্রহণকারী এবং সে অনুসারে পুরস্কার বা শাস্তি দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী আর কোন উপাস্য নেই। অতএব, কেউ যদি তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদের উপাস্য বানিয়ে নেয় তাহলে তার এ নির্বুদ্ধিতার ফল সে নিজেই ভোগ করবে।
# বিতর্ক সৃষ্টি করার অর্থ বাক চাতুরী করা, ত্রুটি বের করা, আবোল-তাবোল আপত্তি উত্থাপন করা, পূর্বাপর প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোন একটা শব্দ বা বাক্যাংশ নিয়ে তা থেকে নানা রকম বিষয় বের করে তার ওপর সন্দেহ-সংশয় ও অপবাদের ইমারত নির্মাণ করা। বাক্যের প্রকৃত উদ্দেশ্য উপেক্ষা করে তার বিভ্রান্তিকর অর্থ করা যাতে ব্যক্তি নিজেও কথা বুঝতে না পারে এবং অন্যদেরকেও বুঝতে না দেয়। মতানৈক্য ও বিরোধ করার এ পন্থা কেবল তারাই গ্রহণ করে, যাদের মতানৈক্য ও মতবিরোধ অসদোদ্দেশ্য প্রণোদিত। সৎ নিয়তে বিরোধকারী বিতর্কে লিপ্ত হলেও বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উদ্দেশ্যেই এবং প্রকৃত আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে বিষয়টি সম্পর্কে তার নিজের দৃষ্টিকোণ সঠিক না বিপক্ষের দৃষ্টিকোণ সঠিক তা নিশ্চিত করতে চায়। এ ধরনের বিতর্ক হয় সত্যকে জানার জন্য, কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য নয়। পক্ষান্তরে অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিপক্ষের লক্ষ্য তা বুঝা বা বুঝানো নয় বরং সে বিপক্ষকে পরাস্ত ও উত্যক্ত করতে চায়। অপরের কথা কোনভাবেই চলতে দেয়া যাবে না সে এ উদ্দেশ্যেই বিতর্কে লিপ্ত হয়। এ কারণে সে কখনো মূল প্রশ্নের মুখোমুখি হয় না, বরং সবসময় একথা সেকথা বলে পাশ কাটিয়ে যেতে চায়।
# এখানে “কুফর” শব্দটি দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এক, নিয়ামতের অস্বীকৃতি অর্থে, দুই, ন্যায় ও সত্যের অস্বীকৃতি অর্থে। প্রথম অর্থ অনুসারে এ বাক্যাংশের মানে হচ্ছে, আল্লাহর আয়াতসমূহ অর্থাৎ বাণী বা আদেশ-নিষেধসমূহের বিরুদ্ধে এ কর্মপন্থা কেবল সেসব লোকেরাই গ্রহণ করে যারা তাঁর অনুগ্রহরাজি ভুলে গিয়েছে এবং এ অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে যে, তাঁরই নিয়ামতের সাহায্যে তারা পালিত হচ্ছে। দ্বিতীয় অর্থ অনুসারে এ বাক্যাংশের মানে হচ্ছে, যারা ন্যায় ও সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং না মানার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে কেবল তারাই এ কর্মপন্থা গ্রহণ করে থাকে। পূর্বাপর বিষয় বিবেচনা করলে এ বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এক্ষেত্রে কুফরীতে লিপ্ত ব্যক্তি বলতে যারা মুসলমান নয় এমন সব ব্যক্তি মাত্রকেই বুঝানো হয়নি। কেননা, যেসব অমুসলিম ইসলামকে বুঝার উদ্দেশ্যে সৎ নিয়তে বিতর্ক করে এবং যে কথা বুঝতে তার কষ্ট হচ্ছে তা বুঝার জন্য ব্যাখ্যা পাওয়ার চেষ্টা করে, ইসলাম গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত পারিভাষিক অর্থে তারা কাফের বটে, কিন্তু সাথে সাথে একথাও সত্য যে, এ আয়াতে যে জিনিসটির নিন্দা করা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।
# আয়াতের প্রথমাংশ ও দ্বিতীয়াংশের মধ্যে একটা শূন্যতা আছে যা বুঝে নেয়ার দায়িত্ব শ্রোতাদের মন-মগজ ও চিন্তা-ভাবনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কথার ধরন থেকে আপনা আপনি এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যারা আল্লাহর আয়াত বা আদেশ-নিষেধের বিরুদ্ধে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার কর্মপন্থা গ্রহণ করে, তারা শাস্তি থেকে কখনো রক্ষা পেতে পারে না। তাদের দুর্ভাগ্যের পালা একদিন না একদিন অবশ্যই আসবে। এ মুহূর্তে যদিও তোমরা দেখছো যে, তারা এসব কিছু করেও আল্লাহর দুনিয়ায় নিশ্চিন্তে বুকটান করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের জম-জমাট কারবার চলছে, জাঁক-জমকের সাথে তাদের কর্তৃত্ব ও শাসন চলছে এবং খুব ভোগ ও আরাম-আয়েশের মধ্যে ডুবে আছে, তবুও এ ধোঁকায় পড়ো না যে, তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে বেঁচে গিয়েছে। কিংবা আল্লাহর আদেশ-নিষেধের বিরুদ্ধে লড়াই কোন খেল-তামাশার বিষয় যা তামাশা হিসেবে খেলা যেতে পারে এবং এ খেলার খেলোয়াড়দেরকে এর মন্দ ফলাফল কখনো ভোগ করতে হবে না। প্রকৃতপক্ষে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের দেয়া অবকাশ। এ অবকাশকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগিয়ে যারা যতটা অপকর্ম করে তাদের জাহাজ ততটা পূর্ণ হয়ে নিমজ্জিত হয়।
# দুনিয়াতে তাদের ওপর যে আযাব এসেছে তা তাদের জন্য নির্ধারিত চূড়ান্ত আযাব ছিল না। আল্লাহ তা’আলা তাদের জন্য এ ফায়সালাও করে দিয়েছেন যে, তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হবে। এ আয়াতের আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, যেভাবে অতীত জাতিসমূহের দুর্ভাগ্য এসেছে, এখন যারা কুফরী করছে অনুরূপভাবে তাদের জন্যও আল্লাহর স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, তাদেরকেও জাহান্নামে যেতে হবে।
# নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গীদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য একথা বলা হয়েছে। তারা সে সময় মক্কার কাফেরদের বিদ্রূপ, কটূভাষণ ও অত্যাচার এবং তাদের সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব দেখে দেখে ভগ্ন হৃদয় হয়ে পড়ছিলো। তাই বলা হয়েছে, এসব নীচু ও হীন লোকদের কথায় তোমরা মন খারাপ করছো কেন? তোমরা এমন মর্যাদার অধিকারী যে, আল্লাহর আরশের ধারক ফেরেশতারা এবং আরশের চারপাশে অবস্থানরত ফেরেশতারা পর্যন্ত তোমাদের সহযোগী। তারা তোমাদের জন্য মহান আল্লাহর কাছে সুপারিশ করছে। সাধারণ ফেরেশতাদের কথা না বলে আল্লাহর আরশের ধারক ও তার চারপাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এ ধারণা দেয়ার জন্য যে, মহান আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যের কর্মচারীরা তো বটেই, তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থানরত যেসব ফেরেশতা ঐ সাম্রাজ্যের স্তম্ভ স্বরূপ এবং বিশ্ব-জাহানের শাসন কর্তার কাছে যারা নৈকট্য লাভ করেছে তারা পর্যন্ত তোমাদের প্রতি গভীর আগ্রহ ও সমবেদনা পোষণ করে। আরো বলা হয়েছে যে, এসব ফেরেশতা আল্লাহর প্রতি ঈমান পোষণ এবং ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। একথা দ্বারা প্রকাশ পায় যে, ঈমানের বন্ধনই প্রকৃত বন্ধন যা আসমান ও যমীনবাসীদেরকে পরস্পর একই সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। এ সম্পর্কের কারণেই আরশের পাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাদের তাদের মতই আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমান পোষণকারী মাটির মানুষদের সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহর প্রতি ফেরেশতাদের ঈমান পোষণ করার অর্থ এই নয় যে, তারা কুফরি করতে পারতো। কিন্তু তা না করে তারা ঈমান গ্রহণ করেছে। বরং এর অর্থ হচ্ছে, তারা এক ও লা-শরীক আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকেই স্বীকার করে নিয়েছে। এমন আর কোন সত্তা নেই যে তাদের আদেশ দান করে আর তারাও তার আনুগত্য করে চলে। ঈমান গ্রহণকারী মানুষ যখন এ পথই গ্রহণ করলো তখন এত বড় জাতিগত পার্থক্য ও স্থানগত দূরত্ব সত্ত্বেও তাদের এবং ফেরেশতাদের মধ্যে একই দৃষ্টিভঙ্গিগত দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
# তোমার বান্দার দুর্বলতা, বিচ্যুতি ও ভুল-ত্রুটি তোমার অজানা নয়। নিঃসন্দেহে তুমি সবকিছু জানো। কিন্তু তোমার জ্ঞানের মত তোমার রহমতও ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাই তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি জানা সত্ত্বেও এই অসহায়দের ক্ষমা করে দাও। আরেকটি অর্থ এও হতে পারে যে, তোমার জ্ঞানানুসারে যাদের সম্পর্কে তুমি জান যে, তারা সরল মনে ‘তাওবা’ করেছে এবং প্রকৃতপক্ষে তোমার পথ অবলম্বন করেছে, দয়া ও রহমত দিয়ে তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দাও।
# ক্ষমা করা ও দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করা যদিও পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এর একটি কথা বলার পর বাহ্যত অপর কথাটি বলার কোন প্রয়োজন থাকে না। তবে এ বাচনভঙ্গি দ্বারা মূলত ঈমনদারদের প্রতি ফেরেশতাদের গভীর আগ্রহ প্রকাশ পায়। প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে, কোন ব্যাপারে কারো মন যদি আকৃষ্ট হয় সে যখন শাসকের কাছে আবেদন জানানোর সুযোগ লাভ করে তখন একই আবেদনকে সে বার বার নানাভাবে মিনতি করে পেশ করতে থাকে। এক্ষেত্রে একটি কথা একবার মাত্র পেশ করে সে তৃপ্তি ও সান্ত্বনা পায় না।
# অবাধ্যতা পরিত্যাগ করেছে, বিদ্রোহ থেকে বিরত হয়েছে এবং আনুগত্য গ্রহণ করে তোমার নিজের নির্দেশিত জীবন পথে চলতে শুরু করেছে।
# একথাটির মধ্যেও সেই মিনতি ভরা আবেদনের সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান, যার প্রতি আমরা ওপরে ৮ নং টীকায় ইঙ্গিত দিয়েছি। একথা সুস্পষ্ট যে, ক্ষমা করা এবং দোযখ থেকে রক্ষা করা দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করার অর্থও আপনা আপনিই এবং অনিবার্যভাবেই প্রকাশ পায়। তাছাড়া আল্লাহ তা’আলা নিজে ইমানদারদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মু’মিনদেরকে সেটি দেয়ার জন্য দোয়া করা বাহ্যত অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয় কিন্তু ফেরেশতাদের মনে ঈমানদারদের জন্য কল্যাণকামিতার এতটা আবেগ বিদ্যমান যে, তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তাদের জন্য একাধারে কল্যাণ কামনা করে দোয়া করে যাচ্ছে। অথচ তারা জানে, আল্লাহ তাদের প্রতি এসব অনুগ্রহ অবশ্যই করবেন।
# তাদের চক্ষু শীতল করার জন্য তাদের মা-বাবা, স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততিদেরও তাদের সাথে একত্রিত করে দেবেন। জান্নাতে ঈমানদারদেরকে যেসব নিয়ামত দান করা হবে তার বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা নিজেও একথা বলেছেন। দেখুন, সূরা রা’দ, আয়াত ২৩ এবং সূরা তূর, আয়াত ২১ । সূরা তূরের আয়াতে এ কথাও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কেউ যদি জান্নাতে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয় এবং তার মা, বাবা ও সন্তান-সন্ততি অনুরূপ মর্যাদার লাভ না করে তাহলে তাকে উচ্চ মর্যাদা থেকে নাযিয়ে তাদের সাথে মিলিত করার পরিবর্তে আল্লাহ তা’আলা তার বাবা-মা ও সন্তান-সন্ততিকেই উচ্চ মর্যাদা দিয়ে তার পর্যায়ে উন্নীত করবেন।
# سَيِّئَات (মন্দ কাজসমূহ) তিনটি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে তিনটি অর্থই প্রযোজ্য। এক, ভুল আকীদা-বিশ্বাস, বিকৃত নৈতিক চরিত্র এবং মন্দ কাজ কর্ম। দুই, গোমরাহী ও মন্দ কাজের পরিণাম। তিন, বিপদাপদ ও দুঃখ কষ্ট—–তা এ পৃথিবীর হোক, আলমে বারযাখ বা মৃত্যুর পরের জীবনের হোক কিংবা কিয়ামতের দিনের হোক। ফেরেশতাদের দোয়ার লক্ষ্য হলো, যেসব জিনিস তাদের জন্য অকল্যাণকর সেরূপ প্রতিটি জিনিস থেকে তাদের রক্ষা করো।
# কিয়ামতের দিনের অকল্যাণ অর্থ হাশরের ময়দানের ভয়াবহতা ছাড়াও অন্যান্য আরাম-আয়েশ ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়া, হিসেবে-নিকেশের কঠোরতা, সমস্ত সৃষ্টির সামনে জীবনের গোপন বিষয়সমূহ প্রকাশ হয়ে যাওয়ার লাঞ্ছনা ও অপমান এবং সেখানে অপরাধীরা আর যেসব লাঞ্ছনা ও কষ্টের সম্মুখীন হবে তাও।
# কিয়ামতের দিন কাফেররা যখন দেখবে যে, তারা পৃথিবীতে শিরক, নাস্তিকতা, আখেরাত অস্বীকৃতি এবং নবী রসূলদের বিরোধিতার ওপর নিজেদের গোটা জীবনের তৎপরতার ভিত্তি স্থাপন করে যারপরনাই নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে এবং সে নির্বুদ্ধিতার কারণে এখন চরম অকল্যাণকর ও অশুভ পরিণামের সম্মুখীন হয়েছে তখন তারা নিজেদের আঙ্গুল কামড়াতে থাকবে এবং বিরক্ত হয়ে নিজেরাই নিজেদেরই অভিশাপ দিতে থাকবে। তখন ফেরেশতারা তাদের ডেকে বলবে, আজ তোমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হচ্ছো। কিন্তু ইতিপূর্বে পৃথিবীতে তোমাদেরকে এ পরিণাম থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তা’আলা এবং সৎকর্মশীল লোকেরা সঠিক পথের দিকে আহবান জানাতেন আর তোমরা সে আহবান প্রত্যাখ্যান করতে তখন আল্লাহ তা’আলার ক্রোধ এর চেয়েও বেশী করে প্রজ্জ্বলিত হতো।
# দু’বার মৃত্যু এবং দু’বার জীবন বলতে সূরা বাকারার ২৮ আয়াতে যা বলা হয়েছে তাই বুঝানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর সাথে কি কুফরী করো, অথচ তোমরা প্রাণহীন ছিলে, তিনি তোমাদের প্রাণ দান করেছেন। এরপর তিনি পুনরায় তোমাদের মৃত্যু দিবেন এবং পরে আবার জীবন দান করবেন। কাফেররা এসব ঘটনার প্রথম তিনটি অস্বীকার করে না। কারণ, ঐগুলো বাস্তবে প্রত্যক্ষ করা যায় এবং সেজন্য অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তারা শেষোক্ত ঘটনাটির সংঘটন অস্বীকার করে। কারণ, এখনো পর্যন্ত তারা তা প্রত্যক্ষ করেনি এবং শুধু নবী-রসূলগণই এটির খবর দিয়েছেন। কিয়ামতের দিন এ চতুর্থ অবস্থাটিও তারা কার্যত দেখতে পাবে এবং তখন স্বীকার করবে যে, আমাদেরকে যে বিষয়ের খবর দেয়া হয়েছিলো তা প্রকৃতই সত্যে পরিণত হলো।
# এ দ্বিতীয় জীবনটির কথা অস্বীকার করে আমরা যে ভুল করেছি এবং এ ভ্রান্ত মতবাদ অনুসারে কাজ করে আমাদের জীবন যে পাপে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে তা আমরা স্বীকার করি।
# এখন আমরা আযাবের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি আমাদের পক্ষ থেকে অপরাধের স্বীকৃতিকে গ্রহণ করে তা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা কি আছে?
# যে আল্লাহর প্রভুত্ব মেনে নিতে তোমরা রাজি ছিলে না সেই একমাত্র অল্লাহর হাতেই এখন ফায়সালা। আর ইলাহী ক্ষমতা ও কর্তৃত্বে যাদেরকে অংশীদার বানাতে তোমরা জিদ ধরেছিলে, ফায়সালার ক্ষেত্রে এখন তাদের কোন হাত নেই। (একথাটা বুঝার জন্য সূরা যুমারের ৪৫ আয়াত এবং তার ৬৪ নং টীকার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে) এ আয়াতংশের মধ্যে আপনা থেকে এ অর্থও অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে যে, এখন আযাবের এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথও নেই। কারণ, তোমরা শুধু আখেরাত অস্বীকার করেছিলে তাই নয়, বরং তোমাদের স্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহর প্রতিও ছিল তোমাদের চরম বিদ্রূপভাব। তাছাড়া তাঁর সাথে অন্যদের শরীক করা ছাড়া তোমরা আদৌ কোন মানসিক তৃপ্তি লাভ করতে পারতে না।
# নিদর্শনসমূহ বলতে সেসব নিদর্শনকে বুঝানো হয়েছে যা থেকে এ বিশ্ব-জাহানের নির্মাতা, কারিগর, প্রশাসক ও ব্যবস্থাপক যে একমাত্র আল্লাহ তা’আলা তা জানা যায়।
# এখানে রিযিক অর্থ বৃষ্টিপাত। কেননা, মানুষ এ পৃথিবীতে যত প্রকার রিযিক লাভ করে থাকে তা সবই বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর অসংখ্য নিদর্শনসমূহের মধ্য থেকে এ একটি মাত্র নিদর্শনের কথা তুলে ধরে এ মর্মে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, তোমরা যদি কেবল এ একটি জিনিসের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করো তাহলে বুঝতে পারবে, কুরআনে তোমাদেরকে বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা বিধানের যে ধারণা দেয়া হচ্ছে সেটিই বাস্তব ও সত্য। পৃথিবী ও তার সমস্ত সৃষ্টিকুল এবং পানি, বাতাস, সূর্য, উষ্ণতা ও শীতলতা সবকিছুর স্রষ্টা যদি একমাত্র আল্লাহ হন কেবল সে ক্ষেত্রেই এ ধরনের ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা বিধান সম্ভব। আর সে অনাদি অনন্ত আল্লাহই যদি চালু রাখেন কেবল তখনই এ ব্যবস্থা লক্ষ কোটি বছর পর্যন্ত একাধারে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠাকারী কেবল একমাত্র আল্লাহই হতে পারেন যিনি মহাজ্ঞানী, অতি দয়াবান ও পালনকর্তা। যিনি পৃথিবীতে মানুষ, জীবজন্তু ও উদ্ভিদরাজি সৃষ্টি করার সাথে সাথে তাদের প্রয়োজন অনুসারে পানিও সৃষ্টি করেছেন এবং তা নিয়মিতভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠে পৌঁছিয়ে দেয়া ও ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বিস্ময়কর এ ব্যবস্থাপনাও দিয়েছেন। যে ব্যক্তি এসব দেখে শুনেও আল্লাহকে অস্বীকার করে কিংবা আরো কিছু সত্তাকে তাঁর প্রভুত্বে অংশীদার বানায় তার চেয়ে বড় জালেম আর কে হতে পারে?
# আল্লাহ বিমুখ ব্যক্তি যার জ্ঞান বুদ্ধির ওপর গাফলতি এবং গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার পর্দা পড়ে আছে সে কোন জিনিস দেখেও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। তার পশু-চক্ষু এ দৃশ্য অবশ্যই দেখবে যে, বাতাস বয়ে গেল, মেঘরাশি উড়ে আসলো, বিদ্যুৎ চমকালো ও বজ্র ধ্বনি হলো এবং বৃষ্টিপাত হলো কিন্তু তার মানবিক মন-মগজ ভেবে দেখবে না, এসব কেন হচ্ছে, কে করছে এবং আমার কাছে তার কি কি অধিকার ও প্রাপ্য রয়েছে।
# এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়াত। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এ আয়াতটি পড়ার সময় অমনোযোগী হওয়া উচিত নয়। বরং এর অর্থ ও প্রতিপাদ্য বিষয়টি ভালভাবে বুঝার চেষ্টা করা উচিত। এর মৌলিক বিষয় দু’টি। এ দু’টি বিষয় বুঝে নেয়া ছাড়া আয়াতটির অর্থ অনুধাবন সম্ভব নয়। একটি বিষয় হচ্ছে, এখানে আল্লাহর ইবাদাত করতে বলা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সে ইবাদাত হবে এমন যা আনুগত্যকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে করা হয়।
ইবাদাত শব্দের শব্দমূল বা ধাতু হচ্ছে عبد । এ শব্দটি আরবী ভাষায় ‘স্বাধীন’ শব্দের বিপরীত শব্দ হিসেবে ‘দাস’ বা ‘ক্রীতদাস’ বুঝাতে ব্যবহৃত হয়। এ অর্থের দিক দিয়ে ‘ইবাদাত’ শব্দের মধ্যে দু’টি অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। একটি অর্থ হচ্ছে পূজা-অর্চনা। আরবী ভাষার বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ আছে عبد الله অর্থাৎ التنسك , والتعبد , تأله له । আরেকটি অর্থ হচ্ছে সবিনয় আনুগত্য এবং সন্তুষ্টি ও সাগ্রহ আদেশ পালন। যেমন “লিসানুল আরবে” বলা হয়েছেঃ
الطاعة – العبادة ومعنى العبادةِ في اللغة الطاعةُ مع الخُضُوعِ – وكلُّ من دانَ لملك فهو عابد له (وقومهما لنا عابدون) والعابد , الخاضع لربه المستسلم المُنْقاد لأَمره- عبدَ الطاغوتَ , أَطاعه يعني الشيطانَ فيما سَوّلَ له وأَغواه- إِياك نعبد, أَي نُطِيعُ الطاعةَ التي يُخْضَعُ معها- اعبدوا ربكم , أَطيعوا ربكم-
সুতরাং অভিধানের এসব নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা অনুসারে আল্লাহর ইবাদাত করা অর্থ শুধু তাঁর পূজা-অর্চনার দাবী করাই নয়, বরং বিনা বাক্যে তাঁর আদেশ-নিষেধ পালন, তাঁর শরয়ী আইন-কানুন সন্তুষ্ট চিত্তে সাগ্রহে মেনে চলা এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মনে প্রাণে অনুসরণ করার দাবীও বুঝায়। আরবী ভাষায় دين (দ্বীন) শব্দ কতিপয় অর্থ ধারণ করেঃ
একটি অর্থ হচ্ছে, আধিপত্য ও ক্ষমতা, মালিকানা ও প্রভুত্বমূলক মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও সার্বভৌম ক্ষমতা এবং অন্যদের ওপর সিদ্ধান্ত কার্যকারী করা। তাই “লিসানুল আরবে” আছেঃ
دان الناسَ أَي قَهَرَهم على الطاعة- دِنْتُهم أَي قَهرْتهم- دِنْتُه ¸ سُسْته و مَلَكْتُه- وفي الحديث : الكيِّس من دانَ نَفْسَه , أَي أَذلها واستعبدها- الديان , القاضى , الحكم , القهار , ولا انت اى لست بقاهرلى فتسوس امرى- ما كان ليأخذ اخاه فى دين الملك , اى فى تضاء الملك-
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আনুগত্য, আদেশ পালন ও দাসত্ব। লিসানুল আরব অভিধানে আছেঃ
الدين , الطاعة – دنته ودنت له , اى اطعته – والدين الله , انما هو طاعته والتعبد له – فى الحديث اريد من قريش كلمة تدين لهم بها العرب , اى تطيعهم وتخضع لهم – ثم دانت بعد الرباب , اى ذلت له واطاعته – يمرقون من الدين , اى انهم يخرجون من طاعة الامام المفترض الطاعة , المدين , العبد – فلولا ان كنتم غير مدينين , اى غير مملوكين – الدين , العادة والشأن – يقال ما زال ذلك دينى وديدنى , اى عادتى الدين , الطاعة – دنته ودنت له , اى اطعته – والدين الله , انما هو طاعته والتعبد له – فى الحديث اريد من قريش كلمة تدين لهم بها العرب , اى تطيعهم وتخضع لهم – ثم دانت بعد الرباب , اى ذلت له واطاعته – يمرقون من الدين , اى انهم يخرجون من طاعة الامام المفترض الطاعة , المدين , العبد – فلولا ان كنتم غير مدينين , اى غير مملوكين –
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে অভ্যাস ও পন্থা-পদ্ধতি—- মানুষ যা অনুসরণ করে। লিসানুল আরবে আছে, الدين , العادة والشأن – يقال ما زال ذلك دينى وديدنى , اى عادتى এ তিনটি অর্থের প্রতি খেয়াল এ আয়াতে ‘দ্বীন’ শব্দটি এমন কর্মপদ্ধতি ও আচরণকে বুঝায় যা মানুষ কারো শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার এবং কারো আনুগত্য গ্রহণ করার মাধ্যমে অবলম্বন করে। আর “দ্বীন”কে শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদিত করে তাঁর দাসত্ব করার অর্থ হলো “আল্লাহর দাসত্বের সাথে মানুষ আর কাউকে শামিল করবে না বরং শুধু তাঁরই পূজা করবে, তাঁরই অনুসরণ এবং তাঁরই হুকুম আহকাম ও আদেশ পালন করবে।”
# সমস্ত সৃষ্টি থেকে তার মর্যাদা অনেক উচ্চে। এ বিশ্ব-জাহানে বিদ্যমান কোন সত্তাই সে ফেরেশতা, নবী, অলী বা অন্য কোন সৃষ্টি যাই হোক না কেন আর তার মর্যাদা অন্য সব সৃষ্টিকুলের তুলনায় যত উচ্চ ও উন্নতই হোক না কেন, আল্লাহ তা’আলার গুণাবলী এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের তাঁর শরীক হওয়ার ধারণা করা তো দূরের কথা তাঁর সুউচ্চ মর্যাদার ধারে কাছে পৌঁছার কথাও কল্পনা করা যায় না।
# সমগ্র বিশ্ব-জাহানের বাদশাহ ও শাসক এবং এ সাম্রাজ্যের সিংহাসনের অধিপতি। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আ’রাফ, টীকা ৪১ ; ইউনুস, টীকা ৪ ; আর রা’দ, টীকা ৩ ; ত্বা-হা, টীকা ২ )।
# রূহ অর্থ অহী ও নবুওয়াত। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, আন-নাহল, টীকা ২ ; বনী ইসরাঈল, টীকা ১০৩ ।) আর “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার ওপর ইচ্ছা এ রূহ নাযিল করেন।” এ বাণীর অর্থ হচ্ছে আল্লাহর মেহেরবাণী ও অনুগ্রহের ওপর করো কোন ইজারাদারী নেই। অমুক ব্যক্তিকে সৌন্দর্য দান করা হয়েছে কেন এবং অমুক ব্যক্তিকে স্মরণ শক্তি বা অসাধারণ মেধা শক্তি দান করা হয়েছে কেন, একথা বলার অধিকার যেমন কেউ রাখে না, তেমনি কেউ একথা বলারও অধিকার রাখে না যে, অমুক ব্যক্তিকে নবুওয়াতের পদমর্যাদার জন্য বাছাই করা হয়েছে কেন এবং আমরা যাকে চাই তাকে নবী বানানো হয়নি কেন?
# যেদিন সমস্ত মানুষ, জিন ও শয়তান একই সময় তাদের রবের সামনে উপস্থিত হবে এবং তাদের কাজ-কর্মের সমস্ত সাক্ষীও উপস্থিত হবে।
# পৃথিবীতে তো বহু অহংকারী ভ্রান্ত লোক নিজেদের বাদশাহী ও শক্তিমত্তার ডঙ্কা বাজাতো আর বহু সংখ্যক নির্বোধ তাদের বাদশাহী ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতো। এখন বলো প্রকৃতপক্ষে বাদশাহী কার? ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের প্রকৃত মালিক কে? আর হুকুমই বা চলে কার? এটা এমন একটা বিষয় যে কোন ব্যক্তি যদি তা বুঝার চেষ্টা করে তাহলে সে যত বড় বাদশাহ কিংবা একনায়ক হয়ে থাকুক না কেন, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে এবং তার মন-মগজ থেকে শক্তিমত্তার সমস্ত অহংকার উবে যাবে। এখানে ঐতিহাসিক এ ঘটনাটা উল্লেখ্য যে, সামানী খান্দানের শাসক নাসর ইবনে আহমাদ (৩০১-৩৩১হিঃ) নিশাপুরে প্রবেশ করলে একটি দরবার ডাকেন এবং সিংহাসনে বসার পর কুরআন মজীদ তিলাওয়াতের মাধ্যমে কাজকর্ম শুরু হবে বলে আদেশ দেন। একথা শুনে একজন সম্মানিত জ্ঞানী ব্যক্তি অগ্রসর হন এবং এ রুকূ’টি তিলাওয়াত করেন। যখন তিনি এ আয়াতটি তিলাওয়াত করছিলেন তখন নাসর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি কাঁপতে কাঁপতে সিংহাসন থেকে নামলেন এবং মাথার মুকুট খুলে সিজদায় পড়ে বললেনঃ হে আমার প্রভু, বাদশাহী তোমারই, আমার নয়।
# কোন ধরনের জুলুমই হবে না। প্রকাশ থাকে যে, প্রতিদানের ক্ষেত্রে জুলুমের কয়েকটি রূপ হতে পারে। এক, প্রতিদানের অধিকারী ব্যক্তিকে প্রতিদান না দেয়া। দুই, সে যতটা প্রতিদান লাভের উপযুক্ত তার চেয়ে কম দেয়া। তিন, শাস্তি যোগ্য না হলেও শাস্তি দেয়া। চার, যে শাস্তির উপযুক্ত তাকে শাস্তি না দেয়া। পাঁচ, যে কম শাস্তির উপযুক্ত তাকে বেশী শাস্তি দেয়া। ছয়, জালেমের নির্দোষ মুক্তি পাওয়া এবং মজলুমের তা চেয়ে দেখতে থাকা। সাত, একজনের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দেয়া। আল্লাহ তা’আলার এ বাণীর উদ্দেশ্যে হচ্ছে, তাঁর আদালতে এ ধরনের কোন জুলুমই হতে পারবে না।
# এর অর্থ হিসেব নিতে আল্লাহর কোন বিলম্ব হবে না। যেভাবে তিনি গোটা বিশ্ব-জাহানের সমস্ত সৃষ্টিকে যুগপৎ রিযিক দান করছেন এবং কাউকে রিযিক পৌঁছানোর ব্যবস্থাপনায় এমন ব্যস্ত নন যে, অন্যদের রিযিক দেয়ার অবকাশই তিনি পান না। যেভাবে তিনি গোটা বিশ্ব-জাহানের প্রতিটি জিনিসকে যুগপৎ দেখছেন, সমস্ত শব্দ যুগপৎ শুনছেন, প্রতিটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এবং বৃহৎ থেকে বৃহত্তর ব্যাপারের ব্যবস্থাপনাও তিনি যুগপৎ করছেন এবং কোন জিনিস এমনভাবে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে না যে, ঠিক সে মুহূর্তে তিনি আর সব বস্তুর প্রতি মনোযোগ দিতে পারেন না, তেমনি তিনি যুগপৎ প্রত্যেক ব্যক্তির হিসেবে গ্রহণ করবেন এবং একটি বিচার্য বিষয়ের শুনানিতে তিনি কখনো এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন না যে, সে সময়ে অন্য অসংখ্য মোকদ্দমার শুনানি করতে পারবেন না। তাছাড়া তাঁর আদালতে এ কারণেও কোন বিলম্ব হবে না যে, মোকদ্দমার পটভূমি ও ঘটনাবলীর বিচার-বিশ্লেষণ এবং তার সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ কঠিন হবে। আদালতের বিচারক নিজে সরাসরি বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফাহল থাকবেন। মোকদ্দমার বাদী-বিবাদী উভয় পক্ষের সবকিছুই তাঁর জানা থাকবে। সমস্ত ঘটনার খুঁটি-নাটি সব দিক পর্যন্ত অনস্বীকার্য সাক্ষ্য প্রমাণসহ অনতিবিলম্বে সবিস্তার পেশ করা হবে। তাই সমস্ত মোকদ্দমার ফায়সালা ঝটপট হয়ে যাবে।