(টপিক#১০৮৬) [* *হক বাতিলের চিরন্তন লড়াই:-] www.motaher21.net সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন পারা:২৪ ১-১৭ নং আয়াত:- তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:- নামকরণ :

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৬)
[* *হক বাতিলের চিরন্তন লড়াই:-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
১-১৭ নং আয়াত:-

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :

(الْمُؤْمِنُ) মু’মিন শব্দের অর্থ বিশ্বাস স্থাপনকারী, অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমানের রুকনগুলো অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি ও আমলে পরিণত করে সে ব্যক্তি মু’মিন। এ সূরাতে মু’মিন ব্যক্তিদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ মর্যাদার কথা আলোচনা করা হয়েছে বলে সূরাকে সূরা আল মু’মিন নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরার তৃতীয় আয়াতে উল্লেখিত غَافِرِ শব্দের দিকে লক্ষ্য করে একে সূরা আল গাফিরও বলা হয়। আবার সূরা “ত্বাওল”-ও বলা হয়।

১-৩ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা আল বাকারার শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক অর্থ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নিজের কিছু বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তিনি হলেন বান্দার পাপ ক্ষমাকারী, তাওবা কবূলকারী। অর্থাৎ যদি কেউ আল্লাহ তা‘আলার নিকট অপরাধ করার পর ক্ষমা প্রার্থনা করে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষমা করে দেন এবং যে কারণে তাওবা করে সে তাওবাকে তিনি কবূল করে নেন। কেউ এর অর্থ করেছেন যে, তাঁর বন্ধুদের জন্য ক্ষমাকারী এবং কাফির ও মুশরিকদের তাওবা কবূলকারী যদি তারা তাওবা করে। আর তাওবা না করলে তিনি হলেন কঠোর শাস্তিদাতা। অর্থাৎ যারা ঈমান বর্জন করে আল্লাহ তা‘আলার সাথে বিদ্রোহ ও সীমালঙ্ঘনের পথ অবলম্বন করেছে তাদের জন্য তিনি কঠোর শাস্তিদাতা। যেমন তিনি অতীব দয়াশীল তেমনি তাঁর শাস্তিও বড় কঠোর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(نَبِّئْ عِبَادِيْٓ أَنِّيْٓ أَنَا الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ لا – وَأَنَّ عَذَابِيْ هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيْمُ)‏

“আমার বান্দাদেরকে বলে দাও যে, আমি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু এবং আমার শাস্তি‎- সে অতি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি‎!” (সূরা হিজ্র ১৫ : ৪৯-৫০)

সুতরাং প্রতিটি মানুষকে স্মরণ রাখা উচিত আল্লাহ তা‘আলা যেমন ক্ষমাশীল তেমনি কঠিন শাস্তিদাতা। তাঁর ক্ষমার আশার পাশাপাশি শাস্তিকেও ভয় করতে হবে।

(ذِي الطَّوْل)-طول)

অর্থ হলো স্বচ্ছলতা, ধনৈশ্বর্য। অর্থাৎ তিনিই স্বচ্ছলতা ও ধনশ্বৈর্য দানকারী। কেউ কেউ বলেছেন- এর অর্থ পুরস্কার ও অনুগ্রহ। অর্থাৎ তিনি স্বীয় বান্দাদেরকে পুরস্কৃত করবেন আর তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহকারী।

আল্লাহ তা‘আলার কত অনুগ্রহ! বান্দা অপরাধ করার পরেও তাওবা করলে তিনি ক্ষমা করে দেন, তিনি খুশী হন। প্রতিটি মু’মিন ব্যক্তির উচিত হবে আল্লাহ তা‘আলার কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতারিত জীবন বিধান, একটি মহান গ্রন্থ ।
২. আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য ক্ষমাশীল যারা তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, যারা অহংকার প্রকাশ করে তাদের জন্য তিনি কঠিন শাস্তিদাতা।
৩. আল্লাহ ছাড়া কোন সঠিক মা‘বূদ নেই। মৃত্যুর পর সকলকে তাঁরই নিকট ফিরে যেতে হবে।

৪-৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের একটি মন্দ অভ্যাসের বর্ণনা দিয়ে মুসলিমদেরকে সতর্ক করে বলছেন : আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনাবলী প্রতিহত ও বাতিল করার জন্য একমাত্র কাফিররাই বিতর্ক করে থাকে। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَيُجَادِلُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِالْبَاطِلِ لِيُدْحِضُوْا بِهِ الْحَقَّ وَاتَّخَذُوْآ اٰيٰتِيْ وَمَآ أُنْذِرُوْا هُزُوًا)

কিন্তু কাফিররা মিথ্যা অবলম্বণে বিতণ্ডা করে সেটা দ্বারা সত্যকে ব্যর্থ করে দেবার জন্য আর তারা আমার নিদর্শনাবলী ও যার দ্বারা তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে সে সমস্ত‎কে তারা বিদ্রূপের বিষয়রূপে গ্রহণ করে থাকে। (সূরা কাহফ ১৮ : ৫৬)।

এসব অসৎ কাজ করার উদ্দেশ্য হল তারা শয়তানের অনুসারী এবং তারা এ ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُّجَادِلُ فِي اللّٰهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَّيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيْدٍ لا‏- كُتِبَ عَلَيْهِ أَنَّه۫ مَنْ تَوَلَّاهُ فَأَنَّه۫ يُضِلُّه۫ وَيَهْدِيْهِ إِلٰي عَذَابِ السَّعِيْرِ)‏

“মানুষের মধ্যে কতক অজ্ঞতাবশত আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে এবং অনুসরণ করে প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের, তার সম্বন্ধে এ নিয়ম করে দেয়া হয়েছে যে, যে কেউ তার সাথে বন্ধুত্ব করবে সে তাকে পথভ্রষ্ট করবে এবং তাকে পরিচালিত করবে প্রজ্জ্বলিত অগ্নির শাস্তি‎র দিকে।” (সূরা আল হাজ্জ ২২ : ৩-৪)

(فَلَا يَغْرُرْكَ تَقَلُّبُهُمْ فِي الْبِلَادِ)

‘সুতরাং শহরগুলিতে তাদের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে’ কুরাইশরা শীতকালে ইয়ামান এবং গ্রীষ্মকালে সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরে যেত। বায়তুল্লাহর সেবক হওয়ার সুবাদে সমগ্র আরবে তাদের সম্মান ও সুখ্যাতি ছিল। ফলে তারা নিরাপদে তাদের ঐশ্বর্য ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বিরোধিতা সত্ত্বেও তাদের এ সুখ্যাতি ও প্রভাব কায়েম থাকা তাদের জন্য গর্ব ও অহংকারের বিষয় ছিল। তারা বলত আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে অপরাধী হলে এসব নেয়ামত ও ধনৈশ্বর্য ছিনিয়ে নেয়া হত। এ পরিস্থিতির কারণে কিছু সংখ্যক মুসলিমদের মাঝেও সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাই আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ উদ্দেশ্যে তাদেরকে সাময়িক অবকাশ দিয়ে রেখেছেন। এতে ধোঁকায় পড়া যাবে না। বস্তুত তাদের সকল প্রভাব ও রাজনৈতিক কাঠামো বদর যুদ্ধের সূচনা থেকে মক্কা বিজয় পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ অন্যত্র বলেন :

(لَا یَغُرَّنَّکَ تَقَلُّبُ الَّذِیْنَ کَفَرُوْا فِی الْبِلَادِﰓمَتَاعٌ قَلِیْلٌﺤ ثُمَّ مَاْوٰٿھُمْ جَھَنَّمُﺚ وَبِئْسَ الْمِھَادُ)

“শহরসমূহে কাফিরদের স্বাচ্ছন্দ্য চাল-চলন যেন তোমাকে প্রতারিত না করে। এসব মাত্র কয়েকদিনের সম্ভোগ; অতঃপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম এবং তা কতইনা নিকৃষ্ট স্থান!” (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ১৯৬-১৯৭)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে সান্ত্বনা প্রদান করছেন যে, হে নাবী! লোকেরা যে তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে এ কারণে তুমি দুঃখিত ও চিন্তিত হয়ো না। এদের কাজই হলো সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। এরা শুধু তোমাকে নয়, বরং তোমার পূর্ববর্তী সকল নাবী-রাসূলকেই মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। ফলে তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। অনুরূপ এরাও ধ্বংস হবে এবং এরাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী। এদের বিরুদ্ধে তোমার রবের বিধান এমনই যে, এদের ওপর জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে। সুতরাং আমাদের এমন আচরণ বর্জন করা উচিত যা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. অমুসলিম ব্যতীত কেউই আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করে না।
২. শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আখিরাত হারানো থেকে সাবধান থাকতে হবে।
৩. যারা সত্যকে অস্বীকার করবে তাদের জন্যই জাহান্নাম।
৭-৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

বান্দার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ দয়ার সংবাদ দিচ্ছেন এবং বান্দার কল্যাণ বয়ে আনে এমন কিছু মাধ্যম যা তাদের সাধ্যাতীত তার বর্ণনা দিচ্ছেন। তা হল আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, দীন ও পরকালে তাদের জন্য যা কল্যাণকর তা চেয়ে দু‘আ করে। এ সংবাদে আল্লাহ তা‘আলার আরশ বহনকারী ফেরেশতা ও তার পার্শ্ববর্তী ফেরেশতাদেরও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহ তা‘আলার বেশি বেশি ইবাদত করে, তারা আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল এবং বান্দাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আরশ বহনকারী ফেরেশতা বর্তমানে চারজন, কিয়ামতের দিন তা হবে আটজন। (সূরা হাক্কাহ ৬৯ : ১৭)

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমাকে আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের বর্ণনা দিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে। তাঁদের কানের লতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত সাতশত বছরের দূরত্বের সমান। (আবূ দাঊদ হা. ৪৭২৭, মিশকাত হা. ৫৭২৮, সহীহ)

মূলত এখানে যারা মু’মিন ও মুত্তাকী তাদেরকে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে যে, তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার আরশ বহনকারী/ধারণকারী ও নিকটতম ফেরেশতাগণ যারা তাদের রবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর প্রশংসা করে তাঁরা পৃথিবীবাসী (মুত্তাকী) মু‘মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রার্থনা করে।

এখানে নিকটতম ফেরেশতাদের দুটো কাজের কথা বর্ণনা করা হয়েছে- একটি হলো, এঁরা আল্লাহ তা‘আলার পবিত্রতা ঘোষণা করে, তাঁর পরিপূর্ণতা ও গুণাবলীকে তাঁর জন্য সাব্যস্ত করে এবং তাঁর সামনে অসহায়ত্য ও বিনয় প্রকাশ করে। দ্বিতীয়টি হলো, এঁরা ঈমানদারদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং বলে, হে আমাদের রব! আপনার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব যারা তাওবা করে ও আপনার পথ অবলম্বন করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। আর তাদেরকে প্রবেশ করান চিরস্থায়ী জান্নাতে যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের মাতা-পিতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে যারা সৎ কাজ করেছে তাদেরকেও। যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে অন্যত্র বলেন,

(وَالَّذِيْنَ صَبَرُوا ابْتِغَا۬ءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَأَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّعَلَانِيَةً وَّيَدْرَأُوْنَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ أُولٰ۬ئِكَ لَهُمْ عُقْبَي الدَّارِ لا -‏ جَنّٰتُ عَدْنٍ يَّدْخُلُوْنَهَا وَمَنْ صَلَحَ مِنْ اٰبَا۬ئِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيّٰتِهِمْ وَالْمَلٰ۬ئِكَةُ يَدْخُلُوْنَ عَلَيْهِمْ مِّنْ كُلِّ بَابٍ) ‏

“এবং যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের আশায় ধৈর্য ধারণ করে, সালাত কায়েম করে আমি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দিয়েছি তা হতে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে এবং যারা ভাল দ্বারা মন্দ দূরীভূত করে, এদের জন্য শুভ পরিণাম- (তা হল) স্থায়ী জান্নাত, এতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পতœী ও সন্ত‎ান-সন্ত‎তিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তারাও, এবং ফেরেশতাগণ তাদের নিকট উপস্থিত হবে প্রত্যেক দ্বার দিয়ে।” (সূরা রা‘দ ১৩ : ২২-২৩)

সুতরাং যখন কোন ব্যক্তি অনুপস্থিত মু’মিন ভাইয়ের জন্য দু‘আ করে তখন ফেরেশতারা সে দু‘আকারী ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। সহীহ মুসলিমে এসেছে : যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দু‘আ করে তখন ফেরেশতারা তার দু‘আয় আমীন বলে এবং বলে : আল্লাহ তা‘আলা তোমাকেও অনুরূপ প্রদান করুক যা তুমি তোমার ঐ মু’মিন ভাইয়ের জন্য চাচ্ছ। (সহীহ মুসলিম ৪/২০৯৪) এবং ফেরেশতারা আরো দু‘আ করে বলে- তাদেরকে শাস্তি হতে রক্ষা করুন। সেদিন আপনি যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবেন তাকেইতো অনুগ্রহ করবেন। সুতরাং আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার আরশ ধারণ করে আছে এ কথা জানা গেল।
২. ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করে, তাঁর তাসবীহ পাঠ করে এবং মু‘মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।
৩. মু’মিনদের মর্যাদার কথা জানা গেল।

১০-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

কাফির-মুশরিকরা যখন জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করবে এবং এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাবে যে, তাদের ঠিকানা জাহান্নাম তখন তারা নিজেদের প্রতি খুব ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশ করবে। এমন সময় তাদেরকে ডেকে বলা হবে, তোমাদের নিজেদের প্রতি তোমাদের ক্ষোভ অপেক্ষা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষোভ ছিল অধিক। কারণ যখন তোমাদেরকে এক আল্লাহ তা‘আলার ওপর ঈমান আনতে বলা হয়েছিল তখন তোমরা অস্বীকার করেছিলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّا كَذٰلِكَ نَفْعَلُ بِالْمُجْرِمِيْنَ إِنَّهُمْ كَانُوْآ إِذَا قِيْلَ لَهُمْ لَآ إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ يَسْتَكْبِرُوْنَ)

“আমি অপরাধীদের সাথে এরূপই করে থাকি। যখন তাদেরকে বলা হত, আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, তখন তারা অহংকার করত।” (সূরা সাফফাত ৩৭ : ৩৫)

কাফিররা তখন তাদের অপরাধের কথা স্বীকার করবে এবং জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ/মুক্তি পাবার রাস্তা অšে¦ষণ করবে, কিন্তু সেখান থেকে বের হবার কোনই রাস্তা থাকবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَوْ تَرٰٓي إِذِ الْمُجْرِمُوْنَ نٰكِسُوْا رُؤُوْسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ ط رَبَّنَآ أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوْقِنُوْنَ)

“আর যদি তুমি দেখতে, যখন পাপীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে স্বীয় মাথা নীচু করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শ্রবণ করলাম, (এখন) তুমি আমাদেরকে পুনরায় (পৃথিবীতে) প্রেরণ কর; আমরা নেক কাজ করব। আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী হয়েছি।” (সূরা আস্ সাজদাহ্ ৩২ : ১২)

এভাবে কাফিররা জাহান্নাম থেকে বের হবার চেষ্টা করেও কোনই পথ পাবে না। কাফিররা দ্বিতীয়বার দুনিয়াতে আসার ফরিয়াদ করলেও তাদের সে সুযোগ দেয়া হবে না । কারণ যদিও তারা বলে দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ দেয়া হলে সৎ আমল করে নেক্কারদের মধ্যে শামিল হয়ে মৃত্যু বরণ করবে কিন্তু এগুলো তাদের মুখের কথা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(وَلَوْ رُدُّوْا لَعَادُوْا لِمَا نُهُوْا عَنْهُ وَإِنَّهُمْ لَكٰذِبُوْنَ)

“এবং তারা প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তাই করত এবং নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।” (সূরা আন‘আম ৬ : ২৮)

(أَمَتَّنَا اثْنَتَيْنِ وَأَحْيَيْتَنَا اثْنَتَيْنِ)

‘আপনি আমাদেরকে মৃত অবস্থায় দুবার রেখেছেন এবং দু’বার আমাদেরকে প্রাণ দিয়েছেন’ অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে, প্রথম মৃত্যু হলো যখন বীর্য অবস্থায় পিতার পৃষ্ঠদেশে থাকে। অর্থাৎ অস্তিত্বের পূর্বে তার অস্তিত্বহীনতাকে মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় মৃত্যু হলো, যা মানুষ তার দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করার পর বরণ করে।

পক্ষান্তরে দুটি জীবন বলতে, একটি হলো এ পার্থিব জীবন, যার আরম্ভ হয় জন্ম থেকে এবং শেষ হয় মৃত্যুর দ্বারা। আর দ্বিতীয় জীবন হলো- সে জীবন, যা কিয়ামতের দিন কবর থেকে ওঠার পর লাভ করবে। এ দুটি মৃত্যু ও দুটি জীবনের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

(كَيْفَ تَكْفُرُوْنَ بِاللّٰهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَاتًا فَأَحْيَاكُمْ ج ثُمَّ يُمِيْتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيْكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ)

“কিভাবে তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার করছ? অথচ তোমরা নির্জীব ছিলে, পরে তিনিই তোমাদেরকে জীবন দান করেছেন, এরপর তিনি তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন, পরে আবার জীবিত করবেন, অবশেষে তোমাদেরকে তাঁরই দিকে ফিরে যেতে হবে।” (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ২৮)

(وَإِنْ يُّشْرَكْ بِه۪ تُؤْمِنُوْا)

‘এবং আল্লাহর শরীক স্থির করা হলে তোমরা তা মেনে নিতে’ অর্থাৎ জাহান্নাম থেকে নিস্কৃতি না পাওয়ার কারণ হলো : দুনিয়াতে তারা আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদকে বর্জন করেছিল আর সর্বদা শির্কে লিপ্ত ছিল। তাই আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন।

(هُوَ الَّذِيْ يُرِيْكُمْ اٰيٰتِه)

‘তিনিই তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখান’ আল্লাহ তাঁর নিদর্শনাবলী মানুষকে প্রতিনিয়ত দেখাচ্ছেন কিন্তু মানুষ তা দেখেও শিক্ষা নেয় না বরং উপলব্ধী করার চেষ্টাও করে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

(إِنَّ فِي السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ لَاٰيٰتٍ لِّلْمُؤْمِنِيْنَ وَفِيْ خَلْقِكُمْ وَمَا يَبُثُّ مِنْ دَا۬بَّةٍ اٰيٰتٌ لِّقَوْمٍ يُّوْقِنُوْنَ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَآ أَنْزَلَ اللّٰهُ مِنَ السَّمَا۬ءِ مِنْ رِّزْقٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَتَصْرِيْفِ الرِّيٰحِ اٰيٰتٌ لِّقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ)

“নিশ্চয়ই আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে অনেক নিদর্শন রয়েছে মু’মিনদের জন্য। তোমাদের সৃষ্টিতে এবং জীবজন্তুর বিস্তারে নিদর্শনাবলী রয়েছে দৃঢ় বিশ্বাসীদের জন্য। রাত ও দিনের পরিবর্তনে, আল্লাহ আকাশ হতে যে পানি বর্ষণ দ্বারা পৃথিবীকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন তাতে এবং বায়ুর পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য।” (সূরা জাসিয়া ৪৫ : ৩-৫) এরূপ আরো অনেক আয়াত রয়েছে।

(وَيُنَزِّلُ لَكُمْ مِّنَ السَّمَا۬ءِ رِزْقًا)

তিনি আকাশ হতে রিযিক তথা বৃষ্টি বর্ষণ করেন যার দ্বারা সর্বপ্রকার শস্য, নানা রং ও স্বাদের ফল-মূল উৎপাদিত হয়ে থাকে। পানি ও জমিন এক হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উৎপাদিত বিভিন্ন ফলের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সুতরাং যে আল্লাহ তা‘আলা এতসব দান করেছেন একমাত্র তাঁর জন্যই ইবাদত করব। কে খুশী হল আর কে রাগ করল তা দেখার বিষয় নয়।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. মানুষের দুটি জীবন ও দুটি মৃত্যু হয় এ কথা জানতে পারলাম।
২. রিযিক দাতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
৩. একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদত করতে হবে।
৪. কর্তৃত্ব চলবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার, অন্য কারো নয়, যিনি একক ও অদ্বিতীয়।
৫. আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করলে তিনি তা সহ্য করেন না।
১৫-১৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনার পাশাপাশি ওয়াহী প্রেরণ করার উদ্দেশ্য আলোচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তার প্রতি ওয়াহী করেন, উদ্দেশ্য হলো তাঁর সেই মনোনীত বান্দা এ ওয়াহী দ্বারা যেন জনসাধারণকে সতর্ক করতে পারে ঐ-দিন সম্পর্কে যে-দিন মানুষ কবর থেকে বেরিয়ে সবাই আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে দণ্ডায়মান হবে। আর সে-দিন কোন কিছুই আল্লাহ তা‘আলার নিকট গোপন থাকবে না। সকল কিছুই প্রকাশ হয়ে পড়বে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(يُنَزِّلُ الْمَلٰ۬ئِكَةَ بِالرُّوْحِ مِنْ أَمْرِه۪ عَلٰي مَنْ يَّشَا۬ءُ مِنْ عِبَادِه۪ٓ أَنْ أَنْذِرُوْآ أَنَّه۫ لَآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنَا فَاتَّقُوْنِ)

“ তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে ওয়াহীসহ ফেরেশতা প্রেরণ করেন এ বলে যে, তোমরা সতর্ক কর‎, নিশ্চয়ই আমি ব্যতীত কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; সুতরাং আমাকেই ভয় কর‎।” (সূরা আন্ নাহ্ল ১৬ : ২)

আর সেদিন কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব সকল কিছু হবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য। সেদিন আর কারো কোন ক্ষমতা চলবে না। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি। (কিয়ামতের দিবসে) আল্লাহ তা‘আলা জমিনকে কবজায়ত্ব করে নেবেন এবং আকাশকে ডান হাতে গুটিয়ে নিয়ে বলবেন, আমিই বাদশা, (আজ) দুনিয়ার বাদশারা কোথায়? (সহীহ বুখারী হা. ৪৮১২, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৮৭)

আর সেদিন প্রত্যেককেই তার কৃত-কর্মের পরিপূর্ণ প্রতিদান দেয়া হবে। কারো ওপর বিন্দু পরিমাণও জুলুম করা হবে না। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, আবূ যার (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা বলেন : হে আমার বান্দারা! নিশ্চয়ই আমি আমার নিজের ওপর জুলুম হারাম করে নিয়েছি, (অর্থাৎ কারো প্রতি জুলুম করি না) এবং তোমাদের জন্যও তা হারাম করে দিয়েছি। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন কারো ওপর জুলুম না করে। হে আমার বান্দারা! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের আমলগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখছি। আমি এগুলোর পূর্ণ প্রতিফল দান করব। সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যাণ পাবে সে যেন আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণ প্রশংসা করে। আর যে ব্যক্তি এটা ছাড়া অন্য কিছু পাবে সে যেন নিজেকেই ভর্ৎসনা করে। (সহীহ মুসলিম হা. ১৯৯৪) সুতরাং কারো প্রতি কোন জুলুম করা হবে না। সবাই তার কর্মের পূর্ণ প্রতিফল পাবে।

الرُّوْحَ দ্বারা আয়াতে “ওয়াহী” বুঝানো হয়েছে। (يَوْمَ التَّلَاقِ) এটি কিয়ামতের নামসমূহের মধ্য হতে একটি নাম।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ওয়াহী প্রেরণ করার উদ্দেশ্য হলো মানব জাতিকে সতর্ক করা।
২. কিয়ামতের দিন কর্তৃত্ব চলবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার।
৩. কিয়ামতের মাঠে মানুষের সকল আমল আল্লাহ তা‘আলা প্রকাশ করে দেবেন।
৪. আল্লাহ তা‘আলা জালিম নন, তাই তিনি কারো প্রতি কোন প্রকার জুলুম করবেন না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

পূর্বযুগীয় কোন কোন গুরুজনের উক্তি এই যে, যেসব সূরা (আরবী) দ্বারা শুরু করা হয়েছে ওগুলোকে (আরবী) বলা মাকরূহ্, ওগুলোকে (আরবী) বলা উচিত। হযরত মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রঃ)-ও এ কথাই বলেন। হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) হলো কুরআন কারীমের মুখবন্ধ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যেক জিনিসেরই দরযা রয়েছে, আর (আরবী) অথবা (বলেছেনঃ) (আরবী) হলো কুরআন কারীমের দর। মাসআ’র ইবনে কুদাম (রঃ) বলেন যে, এই সূরাগুলোকে (আরবী) বলা হতো। (আরবী) কলা হয় নব বধূকে। হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) বলেন যে, কুরআন কারীমের দৃষ্টান্ত ঐ ব্যক্তির মত যে তার পরিবারবর্গের জন্যে কোন একটি ভাল মঞ্জিলের অনুসন্ধানে বের হলো। সে এমন এক জায়গায় পৌছলো যেখানে সবেমাত্র যেন বৃষ্টিপাত হয়েছে। সে আরো একটু অগ্রসর হলো। দেখে যে, সবুজ-শ্যামল কয়েকটি বাগান রয়েছে। সে প্রথমে সিক্ত ভূমি দেখেই তো মুগ্ধ হয়েছিল, এখন সে আরো বেশী মুগ্ধ হলো। তখন তাকে বলা হলোঃ প্রথমটির দৃষ্টান্ত তো হলো কুরআন কারীমের শ্রেষ্ঠত্বের দৃষ্টান্ত এবং ঐ বাগানগুলোর দৃষ্টান্ত হলো এমনই যেমন কুরআন কারীমে (আরবী) যুক্ত সূরাগুলো রয়েছে। (ইমাম বাগাভী (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যেক জিনিসেরই দরযা থাকে, কুরআন কারীমের দরযা হলো (আরবী) যুক্ত সূরাগুলো।

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “যখন আমি কুরআন কারীম পাঠ করতে করতে যুক্ত সূরাগুলোর উপর পৌছি তখন আমার মনে হয় যে, আমি যেন সবুজ-শ্যামল ফুলে-ফলে ভর্তি বাগানসমূহে ভ্রমণ করছি।”

একটি লোক হযরত আবু দারদা (রাঃ)-কে মসজিদ নির্মাণ করতে দেখে জিজ্ঞেস করেঃ “এটা কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমি এটা (আরবী) দ্বারা শুরুকৃত সূরাগুলোর জন্যে নির্মাণ করছি।” এটা হলো ঐ মসজিদ যা দামেশকের দূর্গের মধ্যে রয়েছে এবং তাঁরই নামে সম্পর্কিত আছে। এও হতে পারে যে, ওর হিফাযত হযরত আবু দারদা (রাঃ)-এর নেক নিয়তের কারণে হয়েছিল এবং যে উদ্দেশ্যে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল তারই বরকতের কারণে হয়েছিল। এই কথায় শক্রদের উপর জয় লাভ করার দলীলও রয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) কোন এক জিহাদে তাঁর সাহাবীদেরকে (রাঃ) বলেনঃ “রাত্রে তোমরা অকস্মাৎ আক্রমণ করলে (আরবী) বল।” আর একটি রিওয়াইয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) বল।”

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আয়াতুল কুরসী এবং হা-মীম-আল মুমিনের প্রথম অংশ পাঠ করে নেয়, সে ঐ দিনের সর্বপ্রকারের অনিষ্ট হতে রক্ষা পায়।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বার (রঃ) এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর বর্ণনাকারীর স্মরণশক্তির ব্যাপারে কিছু সমালোচনা রয়েছে)

১-৩ নং আয়াতের তাফসীর:

সূরাসমূহের শুরুতে যে হুরূফে মুকাত্তাআ’ত বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলো এসে থাকে সেগুলোর পূর্ণ আলোচনা সূরায়ে বাকারার তাফসীরের শুরুতে গত হয়েছে। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। কারো কারো উক্তি আছে যে, আল্লাহ তা’আলার একটি নাম এবং এর দলীল হিসেবে তাঁরা নিম্নের কবিতাংশটুকু পেশ করে থাকেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “সে আমাকে (আরবী)-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে এবং বর্শা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, সুতরাং কেন সে এর পূর্বেই (আরবী) পাঠ করেনি?”

হযরত মিহলাব ইবনে আবু সার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি তোমরা রাত্রে আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড় তবে তোমরা (আরবী) বল।” হযরত আবু উবায়েদ (রাঃ) বলেন যে, তার নিকট পছন্দনীয় হলো হাদীসটিকে এভাবে রিওয়াইয়াত করা যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “তোমরা বলঃ (আরবী) অর্থাৎ (আরবী) ছাড়াই। তাহলে তার নিকট যেন (আরবী)-এর (আরবী) হলো (আরবী) ক্রিয়াটি। অর্থাৎ “তোমরা যদি এটা বল তবে তোমরা পরাজিত হবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ও ইমাম তিরমিযী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ বলেনঃ এই কিতাব অর্থাৎ কুরআন মাজীদ আল্লাহর নিকট হতে অবতারিত যিনি পরাক্রমশালী ও সর্বজ্ঞ। যিনি পবিত্র মর্যাদার অধিকারী, যার কাছে অণু পরিমাণ জিনিসও গোপন নেই যদিও তা বহু পর্দার মধ্যে লুক্কায়িত থাকে। তিনি পাপ ক্ষমাকারী। যে তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে তিনিও তার দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। পক্ষান্তরে, যে তার থেকে বেপরোয়া হয় তাঁর সামনে অহংকার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে, দুনিয়াকে আখিরাতের উপর প্রাধান্য দেয় এবং আল্লাহর হুকুম অমান্য করে তাকে তিনি কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। যেমন মহান আল্লাহ্ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে নবী সঃ)! আমার বান্দাদেরকে তুমি (আমার সম্পর্কে) খবর দাও যে, আমি হলাম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু, আবার আমার শাস্তিও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। (১৫:৪৯-৫০) কুরআন কারীমের মধ্যে এই ধরনের বহু আয়াত। রয়েছে, যেগুলোতে রহম ও করমের সাথে সাথে আযাব ও শাস্তির কথাও রয়েছে, যাতে বান্দা ভয় ও আশা এই উভয় অবস্থার মধ্যে থাকে। তিনি অভাবমুক্ত ও প্রশংসাৰ্হ। তিনি বড় মর্যাদাবান, অত্যন্ত অনুগ্রহশীল, সীমাহীন নিয়ামত ও করুণার আধার। বান্দাদের উপর তার ইনআ’ম ও ইহসান এতো বেশী রয়েছে। যে, কেউ ওগুলো গণনা করতে পারে না। মানুষ আল্লাহ্ তা’আলার একটি নিয়ামতেরও শুকরিয়া আদায় করতে সক্ষম নয়। তাঁর মত কেউই নেই। তাঁর একটি গুণও কারো মধ্যে নেই। তিনি ছাড়া কেউই ইবাদতের যোগ্য নয়। তিনি ছাড়া কেউ কারো পালনকর্তা হতে পারে না। সবারই প্রত্যাবর্তন তাঁরই নিকট। ঐ সময় তিনি প্রত্যেককে তার আমল অনুযায়ী পুরস্কার ও শাস্তি প্রদান করবেন। তিনি তাড়াতাড়ি হিসাব গ্রহণকারী।

একটি লোক হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট এসে বলেঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! আমি একজনকে হত্যা করে ফেলেছি, এমতাবস্থায় আমার তাওবা কবুল হবে কি?” তিনি তখন (আরবী) হতে (আরবী) পর্যন্ত তাকে পাঠ করে শুনান এবং বলেনঃ “তুমি কাজ করে যাও এবং নিরাশ হয়ো না।” (এটা ইমাম ইবনে হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সিরিয়ার একজন প্রভাবশালী লোক মাঝে মাঝে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর নিকট আসতো। একবার দীর্ঘদিন পর্যন্ত সে তাঁর নিকট আগমন করেনি। আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার (রাঃ) জনগণকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তর দেয় যে, সে এখন খুব বেশী মদ্য পান করতে শুরু করে দিয়েছে। হযরত উমার (রাঃ) তখন তাঁর লেখককে ডেকে নিয়ে বলেনঃ “লিখো, এই পত্রটি হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর পক্ষ হতে অমুকের পুত্র অমুকের নিকট। সালামের পর আমি তোমার সামনে ঐ আল্লাহর প্রশংসা করছি। যিনি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, যিনি পাপ ক্ষমা করেন, তওবা কবুল করেন, যিনি শাস্তি দানে কঠোর, শক্তিশালী। তিনি ব্যতীত কোন মাবুদ নেই। প্রত্যাবর্তন তারই নিকট।” ঐ লোকটির নিকট পত্রটি পাঠিয়ে দিয়ে হযরত উমার (রাঃ) স্বীয় সহচরদেরকে বলেনঃ “তোমরা তোমাদের এই (মুসলমান) ভাইটির জন্যে প্রার্থনা কর যে, আল্লাহ্ তা’আলা যেন তার অন্তর তার দিকে ফিরিয়ে দেন এবং তার তাওবা কবূল করেন।” লোকটির নিকট পত্রটি পৌছলে সে বারবার তা পড়তে থাকে এবং বলতে শুরু করেঃ “আল্লাহ তা’আলা আমাকে তার শাস্তির ভয়ও দেখিয়েছেন এবং এর সাথে আমাকে তাঁর রহমতের আশা দিয়ে আমার পাপ ক্ষমা করে দেয়ার ওয়াদাও দিয়েছেন। কয়েকবার ওটা পাঠ করে সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এবং খাটি অন্তরে তাওবা করে, যখন হযরত উমার (রাঃ) এ খবর জানতে পারেন তখন তিনি অত্যন্ত খুশী হন এবং স্বীয় সাথীদেরকে বলেনঃ “দেখো, তোমরা তোমাদের কোন মুসলমান ভাই-এর পদস্খলন ঘটতে দেখলে তাকে সোজা করে দিবে ও সুদৃঢ় করবে এবং তার জন্যে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করবে। তোমরা শয়তানের সাহায্যকারী হবে না।” (এ ঘটনাটিও ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত সাবিত বানাঈ (রঃ) বলেনঃ “আমি হযরত মুসআব ইবনে যুবায়ের (রাঃ)-এর সাথে কূফার আশেপাশে ছিলাম। একদা আমি একটি বাগানে গিয়ে দুই রাকআত নামায শুরু করি এবং এই সূরায়ে মুমিন তিলাওয়াত করতে থাকি। আমি যেই মাত্র (আরবী) পর্যন্ত পৌছেছি এমতাবস্থায় একটি লোক, যিনি আমার পিছনে সাদা খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন এবং যার গায়ে ইয়ামনী চাদর ছিল, আমাকে বললেনঃ “যখন (আরবী) পড়বে তখন (আরবী) বলো, যখন (আরবী) পড়বে তখন (আরবী) বলো এবং যখন (আরবী) পড়বে তখন (আরবী) বলো।” আমি চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, কিন্তু কাউকেও দেখতে পেলাম না। নামায শেষ করে দরযার উপর পৌছলে দেখি যে, সেখানে কতকগুলো লোক বসে রয়েছে। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলামঃ ইয়ামনী চাদর পরিহিত একটি লোককে তোমাদের এখান দিয়ে যেতে দেখেছো কি? তারা উত্তরে বললোঃ “না তো, এখান দিয়ে কোন লোককে তো যেতে আসতে দেখিনি।” তখন লোকেরা এ ধারণ করলো যে, তিনি হযরত ইলিয়াস (আঃ) ছিলেন। (এ ঘটনাটিও ইমাম ইবনে হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ রিওয়াইয়াতটি অন্য সনদেও বর্ণিত আছে। কিন্তু তাতে হযরত ইলিয়াস (আঃ)-এর উল্লেখ নেই। মহান আল্লাহই এসব ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন)
৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ সত্য প্রকাশিত হয়ে যাবার পর ওকে না মানা এবং তাতে ক্ষতি সৃষ্টি করা কাফিরদেরই কাজ। হে নবী (সঃ)! এ লোকগুলো যদি ধন-মাল ও মান-মর্যাদার অধিকারী হয়ে যায় তবে তুমি যেন প্রতারিত না হও যে, এরা যদি আল্লাহর নিকট ভাল না হতো তবে তিনি তাদেরকে এই নিয়ামতগুলো কেন দিয়ে রেখেছেন? যেমন মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা কুফরী করেছে, দেশে দেশে তাদের অবাধ বিচরণ যেন কিছুতেই তোমাকে বিভ্রান্ত না করে। এটা সামান্য ভোগ মাত্র; অতঃপর জাহান্নাম তাদের আবাস, আর ওটা কত নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল!” (৩:১৯৬-১৯৭) অন্য এক আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সামান্য দিন তাদেরকে আমি সুখ ভোগ করতে দিবো, অতঃপর তাদেরকে কঠিন শাস্তির দিকে আসতে বাধ্য করবো।”(৩১-২৪)

এরপর আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সান্ত্বনা দিচ্ছেনঃ হে নবী (সঃ)! লোকেরা যে তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করছে এ কারণে তুমি দুঃখিত ও চিন্তিত হয়ো না। তোমার পূর্ববর্তী নবীদের (আঃ) অবস্থার প্রতি লক্ষ্য কর যে, তাদেরকেও তাদের কওম অবিশ্বাস করেছিল এবং তাদের প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। হযরত নূহ, যিনি বানী আদমের মধ্যে সর্বপ্রথম রাসল হয়ে এসেছিলেন, জনগণের মধ্যে যখন প্রথম প্রথম প্রতিমা-পূজা শুরু হয় তখন ঐ লোকগুলো তাঁকেও অবিশ্বাস করে এবং তার পরেও যতজন নবী এসেছিলেন তাদেরকেও তাদের উম্মতরা অবিশ্বাস করতে থাকে। এমনকি সবাই নিজ নিজ যামানার নবীকে বন্দী করা ও হত্যা করার ইচ্ছা করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাতে সফলকামও হয় এবং নিজেদের সন্দেহ ও মিথ্যা দ্বারা সত্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করতে চায় এবং সত্যকে ব্যর্থ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি সত্যকে দুর্বল করে দেয়ার উদ্দেশ্যে বাতিলের সাহায্য করে তার উপর হতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) দায়িত্বমুক্ত হয়ে যান।” (এ হাদীসটি আবুল কাসেম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ আমি ঐ বাতিলপন্থীদেরকে পাকড়াও করলাম এবং তাদেরকে তাদের বড় পাপ ও ঘৃণ্য হঠকারিতার কারণে ধ্বংস করে দিলাম। এখন তোমরা চিন্তা করে দেখো যে, তাদের উপর আমার শাস্তি কতই না কঠোর ছিল! অর্থাৎ তাদের উপর আমার শাস্তি ছিল অত্যন্ত কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক।

এরপর প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ যেমনভাবে তাদের উপর তাদের জঘন্য আমলের কারণে আমার শাস্তি আপতিত হয়েছিল, তেমনিভাবে এই উম্মতের মধ্যে যারা এই শেষ নবী (সঃ)-কে অবিশ্বাস করছে, তাদের উপরও এরূপই শাস্তি আপতিত হবে। যদিও তারা পূর্ববর্তী নবীদেরকে (আঃ) সত্য বলে স্বীকার করে নেয়, কিন্তু যে পর্যন্ত তারা শেষ নবী (সঃ)-এর নবুওয়াতকে স্বীকার না করবে, পূর্ববর্তী নবীদের উপর তাদের বিশ্বাস প্রত্যাখ্যাত হবে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ্।
৭-৯ নং আয়াতের তাফসীর:

আরশ বহনকারী চারজন ফেরেশতা এবং এর আশেপাশের সমস্ত ভাল ও সম্মানিত ফেরেশতা এক দিকে তো আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করেন, সমস্ত দোষ ও অপরাধ হতে তাঁকে দূর বলেন এবং অপরদিকে তাকে সমস্ত গুণ ও প্রশংসার যোগ্য মেনে নিয়ে তার প্রশংসা কীর্তন করেন। মোটকথা, যা আল্লাহর মধ্যে নেই তা হতে তারা তাকে পবিত্র ও মুক্ত বলেন এবং যা তাঁর মধ্যে রয়েছে তা তারা সাব্যস্ত করেন। তারা তার উপর ঈমান ও বিশ্বাস রাখেন এবং নিজেদের নীচতা ও অপারগতা প্রকাশ করেন। যমীনবাসী সমস্ত মুমিন পুরুষ ও স্ত্রীর জন্যে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। পৃথিবীবাসীদের আল্লাহর উপর ঈমান তাঁকে না দেখেই ছিল বলে তিনি তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তাঁর নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাদেরকে নিযুক্ত করে দেন। সুতরাং তারা তাদেরকে না দেখেই সদা-সর্বদা তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, যখন কোন মুসলিম তার কোন (মুসলিম) ভাই-এর অনুপস্থিতির সময় তার জন্যে দু’আ করে তখন ফেরেশতা তার দু’আয় আমীন বলেন এবং বলেনঃ “আল্লাহ তোমাকেও ওটাই প্রদান করুন যা তুমি তোমার ঐ মুমিন ভাই-এর জন্যে চাচ্ছ।”

মুসনাদে আহমাদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উমাইয়া ইবনে সালাতের কোন কোন কবিতার সত্যতা স্বীকার করেন। যেমন নিম্নের কবিতাঃ (আরবী) অর্থাৎ “আর বহনকারী ফেরেশতা চারজন। দুই জন একদিকে এবং অপর দুই জন অন্যদিকে থাকেন।”

তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেনঃ “সে সত্য বলেছে।” তারপর ঐ কবি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সূর্য প্রত্যেক রাত্রির শেষে রক্তিম বর্ণে উদিত হয়, তারপর গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। এটা কখনো স্বীয় আকৃতিতে প্রকাশিত হয় না, বরং রুক্ষ ও পানসেই থাকে।” এবারও রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “সে সত্য বলেছে।” (এর সনদ খুব পাকা ও মযবৃত। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এই সময় আরশ বহনকারী ফেরেশতাদের সংখ্যা চারজন হবে)

কিয়ামতের দিন কিন্তু আটজন ফেরেশতা আরশ বহন করবেন। যেমন কুরআন মাজীদে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই দিন আটজন ফেরেশতা তাদের প্রতিপালকের আর্শকে ধারণ করবে তাদের ঊর্ধ্বে।” (৬৯-১৭) হ্যাঁ, তবে এই আয়াতের ভাবার্থেও এই হাদীস হতে দলীল গ্রহণে একটি প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, সুনানে আবি দাউদের একটি হাদীসে রয়েছেঃ হযরত আব্বাস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা বাতহা নামক স্থানে একটি সমাবেশে ছিলেন যেখানে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-ও অবস্থান করছিলেন। এমন সময় (আকাশে) এক খণ্ড মেঘ চলতে দেখা যায়। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ঐ মেঘের দিকে তাকিয়ে বলেনঃ “এর নাম কি?” সাহাবীগণ (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “আমরা এটাকে (আরবী) বলে থাকি।” তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ “তোমরা কি এটাকে (আরবী)-ও বল না?” তাঁরা জবাব দিলেনঃ “হ্যা এটাকে আমরা (আরবী)-ও বলে থাকি।” তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমরা এটাকে (আরবী)-ও কি বল না?” তারা উত্তর দিলেনঃ “ হ্যা, (আরবী)-ও বলি বটে।” তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাঁদেরকে প্রশ্ন করলেনঃ “আসমান ও যমীনের মধ্যে দূরত্ব কত তা কি তোমরা জান?” তারা উত্তরে বললেনঃ “জ্বী, না।” তিনি বললেনঃ “এ দু’টোর মধ্যে দূরত্ব হচ্ছে একাত্তর, বাহাত্তর অথবা তেহাত্তর বছরের পৃথ। এর উপরের আসমানও এই প্রথম আসমান হতে এরূপই দূরত্বে রয়েছে। সপ্তম আকাশ পর্যন্ত একটি হতে অপরটির মাঝে অনুরূপ দূরত্ব রয়েছে। সপ্তম আকাশের উপর একটি সমুদ্র রয়েছে যার গভীরতা এই পরিমাণই। ওর উপর আট জন ফেরেশতা পাহাড়ী ছাগলের আকারে রয়েছেন যেগুলোর খুর হতে হাঁটু পর্যন্ত স্থানের দূরত্ব হলো এক আকাশ হতে অন্য আকাশের দূরত্বের সমান। তাঁদের পিঠের উপর আল্লাহ্ তা’আলার আরুশ রয়েছে। যার উচ্চতাও এই পরিমাণ। এর উপরে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা রয়েছেন। (এ হাদীসটি জামেউত তিরমিযীতেও রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে গারীব বলেছেন) এর দ্বারা জানা যাচ্ছে যে, এই সময় আল্লাহ্ তা’আলার আরশ আটজন ফেরেশতার উপর রয়েছে। তাদের মধ্যে চারজনের তাসবীহ্ নিম্নরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি আপনার প্রশংসাসহ আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। সমস্ত প্রশংসা আপনারই প্রাপ্য যে, আপনি (আপনার বান্দাদের পাপরাশি) জানা সত্ত্বেও সহনশীলতা প্রদর্শন করছেন।”

অপর চারজন ফেরেশতার তাসবীহ নিম্নরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমতার পরেও (আপনার বান্দাদের পাপরাশি) ক্ষমা করছেন এ জন্যে আমি আপনার মহিমা ঘোষণা করছি এবং আপনার প্রশংসা করছি।” এ জন্যেই মুমিনদের ক্ষমা প্রার্থনায় তারা এ কথাও বলেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। বানী আদমের সমস্ত গুনাহ ও তাদের অপরাধের উপর আপনার রহমত ছেয়ে আছে। অনুরূপভাবে আপনার জ্ঞানও তাদের সমস্ত কথা এবং কাজকে পরিবেষ্টন করে আছে। তাদের সমস্ত অঙ্গ-ভঙ্গী সম্পর্কে আপনি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। সুতরাং তাদের এই ব্যক্তিরা যখন তাওবা করতঃ আপনার দিকে ঝুঁকে পড়ে। পাপকার্য হতে বিরত থাকে, আপনার আহকাম পালন করে, ভাল কাজ করে ও মন্দ কাজ পরিত্যাগ করে তখন আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদেরকে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হতে রক্ষা করুন এবং আপনি তাদেরকে দাখিল করুন স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকেও ক্ষমা করে দিন। আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” যেমন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের সন্তানরাও তাদের ঈমানের অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সন্তানদেরকেরও তাদের সাথে মিলিত করবো এবং তাদের আমলের কিছুই কম করবো না।” (৫২:২১) অর্থাৎ তাদের সবকেই মর্যাদার দিক দিয়ে সমান করবো, যাতে উভয় পক্ষেরই চক্ষু ঠাণ্ডা হয়। আর আমি এটা করবো না যে, উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন লোকদের মর্যাদা কমিয়ে দিবো, বরং যাদের মর্যাদা কম তাদের মর্যাদা আমি বাড়িয়ে দিবো এবং এটা তাদের উপর আমার দয়া ও অনুগ্রহেরই ফল।

হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) বলেন, মুমিন জান্নাতে গিয়ে জিজ্ঞেস করবেঃ “আমার পিতা, আমার ভাই এবং আমার সন্তান-সন্ততি কোথায়?” উত্তর দেয়া হবেঃ “তাদের পুণ্য এতো ছিল না যে, তারা এরূপ মর্যাদায় পৌছতে পারে।” সে বলবেঃ “আমি তো আমার জন্যে এবং তাদের সবারই জন্যে আমল করেছিলাম। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাদেরকেও তার মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দিবেন। অতঃপর তিনি (আরবী) এ আয়াতটি পাঠ করেন।

হযরত মুতরাফ ইবনে আবদিল্লাহ (রঃ) বলেন যে, ফেরেশতারাও মুমিনদের মঙ্গল কামনা করে থাকেন। অতঃপর তিনিও এই আয়াতটিই পাঠ করেন। আর শয়তান তাদের অমঙ্গল কামনা করে।

মহান আল্লাহর উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “আপনি তো পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” অর্থাৎ তিনি এমন বিজয়ী যার উপর কেউ বিজয় লাভ করতে পারে না এবং যাকে কেউ বাধা দিতে পারে না। তিনি যা চান তাই হয় এবং যা চান না তা হয় না। তিনি স্বীয় কথায়, কাজে এবং শরীয়তে ও তকদীরে প্রজ্ঞাময়। সুতরাং ফেরেশতারা প্রার্থনায় আরো বলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি মুমিনদেরকে আপনার শাস্তি হতে রক্ষা করুন। সেই দিন আপনি যাকে শাস্তি হতে রক্ষা করবেন তার প্রতি তো আপনি অনুগ্রহই করবেন। আর এটাই তো মহা সাফল্য।
১০-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন যে, কিয়ামতের দিন যখন তারা আগুনের কূপে থাকবে এবং আল্লাহর আযাব দেখে নিবে এবং যেসব শাস্তি হবে সবই চোখের সামনে থাকবে, তখন তারা নিজেদের প্রাণের শত্রু হয়ে যাবে এবং কঠিন শত্রু হবে। কেননা, নিজেদের মন্দ কর্মের কারণে তাদেরকে জাহান্নামে যেতে হচ্ছে। ঐ সময় ফেরেশতারা তাদেরকে উচ্চ কণ্ঠে বলবেনঃ আজ তোমাদের নিজেদের প্রতি তোমাদের ক্ষোভ অপেক্ষা দুনিয়ায় তোমাদের উপর আল্লাহর অপ্রসন্নতা ছিল অধিক, যখন তোমাদেরকে ঈমানের প্রতি আহ্বান করা হয়েছিল আর তোমরা তা অস্বীকার করেছিলে।

মহান আল্লাহর … (আরবী)-এই উক্তিটি তাঁর নিম্নের উক্তিটির মতইঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কিরূপে আল্লাহকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনি তোমাদেরকে জীবন্ত করেছেন, আবার তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন ও পুনরায় জীবন্ত করবেন, পরিণামে তার দিকেই তোমরা ফিরে যাবে।” (২:২৮)

সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, তাদেরকে দুনিয়ায় একবার মৃত্যু দান করা হয়, তারপর কবরে একবার জীবিত করা হয়, এরপর সওয়াল-জবাব শেষ করে আবার মৃত্যু ঘটান হয় এবং কিয়ামতের দিন পুনরায় জীবিত করা হবে। দুইবার মৃত্যু দান ও দুইবার জীবন দানের অর্থ এটাই। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, হযরত আদম (আঃ)-এর পৃষ্ঠদেশ হতে অঙ্গীকার গ্রহণের দিন জীবিত করা হয়, এরপর মায়ের পেটের মধ্যে রূহ ফুকে দেয়া হয়, তারপর মৃত্যু দান করা হয় এবং এরপর কিয়ামতের দিন আবার জীবন দান করা হবে। কিন্তু এ উক্তি দু’টি ঠিক নয়। কেননা, এটা অর্থ হলে তিনবার মৃত্যু দান ও তিনবার জীবন দান অপরিহার্য হচ্ছে, অথচ আয়াতে দু’বার মৃত্যু দান ও দু’বার জীবন দানের উল্লেখ রয়েছে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং তাঁদের সঙ্গী সাথীদের উক্তিটিই সঠিক। অর্থাৎ মায়ের পেট হতে ভূমিষ্ট হওয়া একটি জীবন ও কিয়ামতের দিনের জীবন হলো দ্বিতীয় জীবন। আর দুনিয়ায় সৃষ্ট হওয়ার পূর্বের অবস্থা হলো একটি মৃত্যু এবং দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ হচ্ছে আর একটি মৃত্যু। আয়াতে এ দুই মত্য ও এ দুই জীবনই উদ্দেশ্য। ঐ দিন কাফিররা কিয়ামতের মাঠে আল্লাহ তা’আলার নিকট আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবে যে, তাঁদেরকে যদি আর একবার দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হতো! যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং হায়, তুমি যদি দেখতে! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে অধোবদন হয়ে বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম; এখন আপনি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ করুন, আমরা সকার্য করবো, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।” (৩২:১২) কিন্তু তাদের এ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা হবে না। অতঃপর যখন তারা জাহান্নাম এবং ওর আগুন দেখবে এবং তাদেরকে জাহান্নামের ধারে পৌছিয়ে দেয়া হবে তখন দ্বিতীয়বার তারা ঐ আবেদন করবে এবং প্রথমবারের চেয়ে বেশী জোর দিয়ে বলবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হায়, তুমি যদি দেখতে! যখন তাদেরকে জাহান্নামের পার্শ্বে দাড় করানো হবে তখন তারা বলবেঃ যদি আমাদেরকে দুনিয়ায় ফিরিয়ে দেয়া হতো তাহলে আমরা আমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করতাম না এবং আমরা ঈমানদার হতাম! বরং ইতিপূর্বে তারা যা গোপন করতো তা তাদের জন্যে প্রকাশ হয়ে পড়েছে, যদি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়াও হয় তবে আবার তারা ওটাই করবে যা হতে তাদেরকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।” (৬:২৭-২৮)

এর পরে যখন তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে দেয়া হবে এবং তাদের আযাব শুরু হয়ে যাবে তখন তারা আরো জোর ভাষায় এই আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ করবে। ঐ সময় তারা অত্যন্ত চীৎকার করে বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! এখান হতে আমাদেরকে বের করে নিন, আমরা ভাল কাজ করবো, ঐ কাজ করবো না যা ইতিপূর্বে করতাম। (উত্তরে বলা হবেঃ) আমি কি তোমাদেরকে এমন বয়স দেইনি যে, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা করতো সে উপদেশ গ্রহণ করতে পারতো? আর তোমাদের কাছে তো সতর্ককারী এসেছিল? সুতরাং তোমরা (শাস্তির) স্বাদ গ্রহণ কর, যালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।” (৩৫:৩৭) তারা আরো বলবেঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান হতে বের করে নিন, এর পরেও যদি আমরা ঐ কাজই করি তবে তো আমরা নিশ্চিতরূপে যালিম হিসেবে পরিগণিত হবো। আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ দূর হয়ে যাও, এর মধ্যেই তোমরা পড়ে থাকে এবং আমার সাথে কথা বলো না।” (২৩:১০৭-১০৮)

এই আয়াতে ঐ লোকগুলো নিজেদের প্রশ্নের বা আবেদনের পূর্বে একটি মুকদ্দমা কায়েম করে আবেদনের মধ্যে এই ধরনের নমনীয়তা সৃষ্টি করেছে। তারা আল্লাহ তা’আলার ব্যাপক শক্তির বর্ণনা দিয়েছে যে, তারা মৃত ছিল, তিনি তাদেরকে জীবন দান করেছিলেন। তারপর আবার তাদের মৃত্যু ঘটিয়েছিলেন এবং পুনরায় জীবন দান করেছেন। সুতরাং আল্লাহ সব কিছুর উপরই পূর্ণ। ক্ষমতাবান। তিনি যা চান তাই করতে পারেন। তাই তারা বলেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের পাপ ও অপরাধ স্বীকার করছি। নিশ্চয়ই আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি ও সীমালংঘন করেছি। এখন আমাদের পরিত্রাণের কোন উপায় আছে কি? অর্থাৎ আপনি আমাদের পরিত্রাণের উপায় বের করে দিন এবং আমাদেরকে পুনরায় দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন, যার ক্ষমতা আপনার রয়েছে। এবার দুনিয়ায় গিয়ে আমরা ভাল কাজ করবো এবং এটা হবে আমাদের পূর্বের কৃতকর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত। এবার দুনিয়ায় গিয়েও যদি আমরা পূর্বের কর্মের পুনরাবৃত্তি করি তবে তো আমরা অবশ্যই যালিম বলে গণ্য হবো।” তাদেরকে জবাবে বলা হবেঃ “এখন দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার কোন পথ নেই। কেননা, যদি তোমাদেরকে আবার ফিরিয়ে দেয়াও হয় তবুও তোমরা পূর্বে যা করতে তাই করবে। তোমরা আসলে নিজেদের অন্তর বক্র করে ফেলেছে। এখনো তোমরা সত্যকে কবুল করবে না, বরং বিপরীতই করবে। তোমাদের অবস্থা তো এই ছিল যে, যখন এক আল্লাহকে ডাকা হতো তখন তোমরা তাঁকে অস্বীকার করতে এবং আল্লাহর শরীক স্থাপন করা হলে তোমরা তা বিশ্বাস করতে। এই অবস্থাই তোমাদের পুনরায় হবে। দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় গেলে তোমরা পুনরায় এই কাজই করবে। সুতরাং প্রকৃত হাকিম যার হুকুমে কোন প্রকারের। যুলুম নেই, বরং যার ফায়সালায় ন্যায় ও ইনসাফই রয়েছে তিনিই আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন। যার উপর। ইচ্ছা তিনি রহম করেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি প্রদান করেন। তার ফায়সালা ও ইনসাফের ব্যাপারে তার কোন শরীক নেই। ঐ আল্লাহ স্বীয় ক্ষমতা লোকদের উপর প্রকাশ করে থাকেন। যমীন ও আসমানে তাঁর তাওহীদের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। যার দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সবারই সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা একমাত্র তিনিই। তিনি আকাশ হতে রূযী অর্থাৎ বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকেন যার দ্বারা সর্বপ্রকারের শস্য, নানা প্রকারের উত্তম স্বাদের, বিভিন্ন রং-এর এবং নানা আকারের ফল-ফুল উৎপন্ন হয়ে থাকে। অথচ পানিও এক এবং যমীনও এক। সুতরাং এর দ্বারা মহান আল্লাহর মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। সত্য তো এই যে, শিক্ষা ও উপদেশ এবং চিন্তা ও গবেষণার তাওফীক শুধু সেই লাভ করে যে আল্লাহ তা’আলার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার দিকে প্রত্যাবর্তন করে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ সুতরাং আল্লাহকে ডাকো তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে, যদিও কাফিররা এটা অপছন্দ করে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) প্রত্যেক ফরয নামাযের সালামের পরে নিম্নের তাসবীহ পাঠ করতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, রাজতু ও প্রশংসা তারই এবং তিনি প্রত্যেক জিনিসের উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া গুনাহ হতে বেঁচে থাকার ও আল্লাহর ইবাদতে লেগে থাকার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, আমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করি। নিয়ামত, অনুগ্রহ এবং উত্তম প্রশংসা তাঁরই। আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই। আল্লাহর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে আমরা শুধু তাকেই ডাকি, যদিও কাফিররা এটা অপছন্দ করে।” হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) বলতেন যে, রাসূলুল্লাহও (সঃ) প্রত্যেক নামাযের পরে এটা পাঠ করতেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে রয়েছে এবং এটা ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা আল্লাহর নিকট দু’আ করো এবং ককূল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস রেখো এবং জেনে রেখো যে, উদাসীন ও অমনোযোগী অন্তরের দু’আ আল্লাহ কবূল করেন না।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
১৫-১৭ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় গৌরব, শ্রেষ্ঠত্ব এবং নিজের আরশের বড়ত্ব ও প্রশস্ততার বর্ণনা দিচ্ছেন যা সমস্ত মাখলুককে ছাদের মত আচ্ছাদন করে রয়েছে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(এই শাস্তি আসবে) আল্লাহর পক্ষ হতে, যিনি সমুচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ফেরেশতা এবং রূহ আল্লাহর দিকে ঊর্ধ্বগামী হয় এমন এক দিনে যা পার্থিব পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।” (৭০:৩-৪) এর বর্ণনা ইনশাআল্লাহ সামনে আসবে যে, এই দূরত্ব হলো সাত আসমান ও যমীন হতে নিয়ে আরশ পর্যন্ত স্থানের। যেমন পূর্বযুগীয় ও পরযুগীয় মনীষীদের একটি দলের উক্তি এটাই এবং সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত এটাই বটে।

বহু তাফসীরকার হতে বর্ণিত আছে যে, আরশ রক্তিম বর্ণের মণি-মাণিক্য দ্বারা নির্মিত। যার দু’টি প্রান্তের প্রশস্ততা পঞ্চাশ হাজার বছরের পথের দূরত্বের সমান। আর যার উচ্চতা সপ্তম যমীন হতে পঞ্চাশ হাজার বছরের পথ। ইতিপূর্বে যে হাদীসে ফেরেশতাদের আরশ বহন করার কথা বর্ণিত হয়েছে তাতে এও রয়েছে যে, ওটা সপ্ত আকাশ হতেও উঁচু।

আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যার প্রতি ইচ্ছা অহী প্রেরণ করেন। যেমন অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি ফেরেশতাদেরকে অহীসহ স্বীয় নির্দেশে স্বীয় বান্দাদের মধ্যে। যাদের নিকট ইচ্ছা প্রেরণ করেন (এই বলে) যে, তোমরা তাদেরকে (আমার ব্যাপারে) সতর্ক করে দাও যে, আমি ছাড়া কোন মা’বুদ নেই, সুতরাং তোমরা আমাকেই ভয় কর।” (১৬:২) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অবতারিত। এটা নিয়ে বিশ্বস্ত আত্মা (জিবরাঈল আঃ) অবতরণ করে এবং তা তোমার (মুহাম্মাদ সঃ) অন্তরে অবতীর্ণ করে যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হও।” (২৬:১৯২-১৯৪) এ জন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ এখানে বলেনঃ যাতে সে সতর্ক করতে পারে কিয়ামত দিবস সম্পর্কে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) কিয়ামতের নামসমূহের মধ্যে একটি নাম, যা হতে আল্লাহ তাআলা স্বীয় বান্দাদেরকে ভয় প্রদর্শন করেছেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) একথাও বলেন যে, এই দিনে হযরত আদম (আঃ) এবং তাঁর সর্বশেষ সন্তানেরও মিলন ঘটবে। হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, বান্দা আল্লাহ তা’আলার সঙ্গে মিলিত হবে। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, আসমানবাসী ও যমীনবাসী পরস্পর মিলিত হবে। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টজীবের মধ্যে মিলন ঘটবে। মায়মূন ইবনে মাহরান (রঃ) বলেন যে, অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের মধ্যে মিলন হবে। ভাবার্থ এই যে, প্রত্যেকেই অন্যের সঙ্গে মিলিত হবে। এমনকি আমলকারীর সাথে তার আমল মিলিত হবে, যেমন অন্যান্য গুরুজন বলেছেন।

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ সেই দিন আল্লাহর নিকট তাদের কিছুই গোপন থাকবে না। অর্থাৎ সবাই আল্লাহ তা’আলার সামনে থাকবে। আল্লাহ তা’আলা হতে কিছুই তাদেরকে গোপন রাখতে পারবে না। এমন কি কোন ছায়ার স্থানও থাকবে না। ঐ দিন আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ “আজ রাজত্ব ও কর্তৃত্ব কার?” সেই দিন কার এমন ক্ষমতা হবে যে, তাঁর এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে? সুতরাং নিজেই তার এই প্রশ্নের জবাবে বলবেনঃ “আজ কর্তৃত্ব ও রাজত্ব হলো এক, পরাক্রমশালী আল্লাহরই।” এ হাদীস গত হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা আসমান ও যমীনকে জড়িয়ে নিয়ে স্বীয় দক্ষিণ হস্তে রাখবেন এবং বলবেনঃ “(আজ) আমিই বাদশাহ, আমিই গর্বকারী। দুনিয়ার বাদশাহ, প্রতাপশালী ও অহংকারীরা আজ কোথায়?”

শিংগায় ফুৎকার দেয়ার হাদীসে রয়েছে যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহ সমস্ত সৃষ্টজীবের রূহ কবয করে নিবেন এবং ঐ এক অংশীবিহীন আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জীবিত থাকবে না। ঐ সময় তিনি তিনবার বলবেনঃ “আজ রাজত্ব কার?” অতঃপর তিনি নিজেই জবাব দিবেনঃ “আজ রাজত্ব ও কর্তৃত্ব এক পরাক্রমশালী আল্লাহরই।” অর্থাৎ আজ ঐ আল্লাহর কর্তৃত্ব যিনি এক, সর্ববিজয়ী এবং যার হাতে রয়েছে সব কিছুরই আধিপত্য।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময় একজন ঘোষক ঘোষণা করবেনঃ “হে লোক সকল! কিয়ামত এসে গেছে। এ ঘোষণা জীবিত ও মৃত সবাই শুনবে। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আকাশের উপর অবতরণ করবেন এবং বলবেনঃ “আজ কর্তৃত্ব কার?” অতঃপর তিনি নিজেই জবাব দিবেনঃ “(আজ কতৃত্ব) এক, পরাক্রমশালী আল্লাহরই।”

এরপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় ন্যায় ও ইনসাফের বর্ণনা দিচ্ছেন যে, আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের ফল দেয়া হবে; আজ কারো প্রতি যুলুম করা হবে না। অর্থাৎ “আজ আল্লাহ তা’আলা কারো প্রতি অণু পরিমাণও যুলুম করবেন না। এমন কি পুণ্যগুলো দশগুণ করে বাড়িয়ে দেয়া হবে, আর পাপরাশি ঠিকই রেখে দেয়া হবে, তিল পরিমাণও বেশী করা হবে না। যেমন হযরত আবু যার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ “হে আমার বান্দারা! নিশ্চয়ই আমি আমার নিজের উপর যুলুমকে হারাম করে দিয়েছি (অর্থাৎ আমি বান্দার উপর যুলুম করাকে নিজের উপর হারাম করে দিয়েছি)। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন কারো উপর যুলুম না করে। শেষের দিকে রয়েছেঃ “হে আমার বান্দাগণ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের আমলগুলো গণে গণে রাখছি (অর্থাৎ তোমাদের আমলগুলোর উপর পূর্ণভাবে দৃষ্টি রাখছি), আমি এগুলোর পূর্ণ প্রতিফল প্রদান করবো। সুতরাং যে ব্যক্তি কল্যাণ পাবে সে যেন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার প্রশংসা করে। আর যে ব্যক্তি এটা ছাড়া অন্য কিছু পাবে সে যেন নিজেকেই ভৎসনা করে (কেননা ওটা তার নিজেরই কৃতকর্মের ফল)।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

অতঃপর মহান আল্লাহ তাড়াতাড়ি হিসাব গ্রহণের বর্ণনা দিচ্ছেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর। সমস্ত সৃষ্টজীবের হিসাব গ্রহণ তাঁর কাছে একজনের হিসাব গ্রহণের মতই সহজ। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের সকলকে সৃষ্টি করা এবং মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করা আমার নিকট একটি লোককে সৃষ্টি করা এবং তার মৃত্যুর পর তাকে পুনর্জীবিত করার মতই (সহজ)।” (৩১:২৮) মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার হুকুমের সাথে সাথেই কাজ হয়ে যায়, যেমন কেউ চক্ষু বন্ধ করেই খুলে দেয় (এটুকু সময় লাগে মাত্র)।” (৫৪:৫০)

Leave a Reply