أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৮৯)
[ * *পথভ্রষ্ট নেতা ও তার অনুসারীদের পরিণতি :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
৪৫-৫৬ নং আয়াত:-
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৫
فَوَقٰىہُ اللّٰہُ سَیِّاٰتِ مَا مَکَرُوۡا وَ حَاقَ بِاٰلِ فِرۡعَوۡنَ سُوۡٓءُ الۡعَذَابِ ﴿ۚ۴۵﴾
শেষ পর্যন্ত তারা ঐ ঈমানদারের বিরুদ্ধে যেসব জঘন্য চক্রান্ত করেছে আল্লাহ তা’আলা তাকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। আর ফেরাউনের সাংগপাংগরাই জঘন্য আযাবের চক্রে পড়ে গিয়েছে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৬
اَلنَّارُ یُعۡرَضُوۡنَ عَلَیۡہَا غُدُوًّا وَّ عَشِیًّا ۚ وَ یَوۡمَ تَقُوۡمُ السَّاعَۃُ ۟ اَدۡخِلُوۡۤا اٰلَ فِرۡعَوۡنَ اَشَدَّ الۡعَذَابِ ﴿۴۶﴾
দোযখের আগুন, যে আগুনের সামনে তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় পেশ করা হয়। কিয়ামত সংঘটিত হলে নিদের্শ দেয়া হবে, ফেরাউনের অনুসারীদের কঠিন আযাবে নিক্ষেপ করো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৭
وَ اِذۡ یَتَحَآجُّوۡنَ فِی النَّارِ فَیَقُوۡلُ الضُّعَفٰٓؤُا لِلَّذِیۡنَ اسۡتَکۡبَرُوۡۤا اِنَّا کُنَّا لَکُمۡ تَبَعًا فَہَلۡ اَنۡتُمۡ مُّغۡنُوۡنَ عَنَّا نَصِیۡبًا مِّنَ النَّارِ ﴿۴۷﴾
একটু চিন্তা করে দেখো সে সময়ের কথা যখন এসব লোক দোযখের মধ্যে পরস্পর ঝগড়ায় লিপ্ত হবে। যারা দুনিয়ায় দুর্বল ছিল তারা সেসব লোকদের বলবে যারা নিজেদের বড় মনে করতো, “আমরা তো তোমাদের অনুসারী ছিলাম। এখন এখানে কি তোমরা আমাদেরকে জাহান্নামের কষ্টের কিছু অংশ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করবে?”
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৮
قَالَ الَّذِیۡنَ اسۡتَکۡبَرُوۡۤا اِنَّا کُلٌّ فِیۡہَاۤ ۙ اِنَّ اللّٰہَ قَدۡ حَکَمَ بَیۡنَ الۡعِبَادِ ﴿۴۸﴾
বড়ত্বের দাবীদাররা বলবেঃ আমরা সবাই এখানে একই অবস্থায় আছি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্যাপারে ফায়সালা করে দিয়েছেন।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৪৯
وَ قَالَ الَّذِیۡنَ فِی النَّارِ لِخَزَنَۃِ جَہَنَّمَ ادۡعُوۡا رَبَّکُمۡ یُخَفِّفۡ عَنَّا یَوۡمًا مِّنَ الۡعَذَابِ ﴿۴۹﴾
দোযখে নিক্ষিপ্ত এসব লোক জাহান্নামের কর্মকর্তাদের বলবেঃ “তোমাদের রবের কাছে দোয়া করো তিনি যেন একদিনের জন্য আমাদের আযাব হ্রাস করেন।”
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫০
قَالُوۡۤا اَوَ لَمۡ تَکُ تَاۡتِیۡکُمۡ رُسُلُکُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ ؕ قَالُوۡا بَلٰی ؕ قَالُوۡا فَادۡعُوۡا ۚ وَ مَا دُعٰٓؤُا الۡکٰفِرِیۡنَ اِلَّا فِیۡ ضَلٰلٍ ﴿٪۵۰﴾
তারা বলবে, “তোমাদের রসূলগণ কি তোমাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে আসেননি?” “তারা বলবে হ্যাঁ।” জাহান্নামের কর্মকর্তারা বলবেঃ “তাহলে তোমরাই দোয়া করো। তবে কাফেরদের দোয়া ব্যর্থই হয়ে থাকে।”
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫১
اِنَّا لَنَنۡصُرُ رُسُلَنَا وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ یَوۡمَ یَقُوۡمُ الۡاَشۡہَادُ ﴿ۙ۵۱﴾
নিশ্চিত জানো, আমি এ পার্থিব জীবনে আমার রসূল ও ঈমানদারদের অবশ্যই সাহায্য করি এবং যেদিন সাক্ষীদের পেশ করা হবে সেদিনও করবো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫২
یَوۡمَ لَا یَنۡفَعُ الظّٰلِمِیۡنَ مَعۡذِرَتُہُمۡ وَ لَہُمُ اللَّعۡنَۃُ وَ لَہُمۡ سُوۡٓءُ الدَّارِ ﴿۵۲﴾
যেদিন ওজর ও যুক্তি পেশ জালেমদের কোন উপকারে আসবে না, তাদের ওপর লা’নত পড়বে এবং তাদের জন্য হবে জঘন্যতম ঠিকানা।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫৩
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡہُدٰی وَ اَوۡرَثۡنَا بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ الۡکِتٰبَ ﴿ۙ۵۳﴾
আমি মূসাকে অবশ্যই পথনির্দেশিকা দান করেছিলাম এবং ইস্রাঈল বংশধরদেরকে দান করেছিলাম গ্রন্থ,
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫৪
ہُدًی وَّ ذِکۡرٰی لِاُولِی الۡاَلۡبَابِ ﴿۵۴﴾
পথনির্দেশ ও উপদেশস্বরূপ বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫৫
فَاصۡبِرۡ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ وَّ اسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۡۢبِکَ وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ بِالۡعَشِیِّ وَ الۡاِبۡکَارِ ﴿۵۵﴾
অতএব আপনি ধৈর্য ধারণ করুন; নিশ্চয় আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। আর আপনি আপনার ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং আপনার রবের সপ্রশংস পবিত্রতা-মহিমা ঘোষনা করুন সন্ধ্যা ও সকালে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫৬
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ بِغَیۡرِ سُلۡطٰنٍ اَتٰہُمۡ ۙ اِنۡ فِیۡ صُدُوۡرِہِمۡ اِلَّا کِبۡرٌ مَّا ہُمۡ بِبَالِغِیۡہِ ۚ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿۵۶﴾
নিশ্চয় যারা নিজেদের কাছে কোন দলীল না থাকলেও আল্লাহর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদের অন্তরে আছে শুধু অহংকার, তারা এ ব্যাপারে সফলকাম হবে না। অতএব আপনি আল্লাহর নিকট আশ্রয় চান; নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্ৰষ্টা।
তাফসীরে ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*পথভ্রষ্ট নেতা ও তার অনুসারীদের পরিণতি : তর্ক বিতর্ক ও কথা বার্তা এ পর্যন্ত এসে শেষ হয়েছে। এই কথাবার্তার মাধ্যমে ফেরাউনের গােষ্ঠীভুক্ত মােমেন লােকটি যে সত্য কথাটি উচ্চারণ করে গেছে তা চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মূসা(আ.)-এর মাঝে এবং ফেরাউন ও বনী ইসরাঈলের মাঝে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরবর্তী অবস্থান সম্পর্কে ইঙ্গিত করে বলা হবে, অতপর আল্লাহ তায়ালা তাকে তাদের চক্রান্তের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করলেন এবং ফেরাউন গােত্রকে শােচনীয় আযাব গ্রাস করলো…।(আয়াত ৪৫-৫০) পার্থিব জীবনের অবসান ঘটানাের পর পরকালীন জীবনের প্রথম ধাপ সামনে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে দেখা গেলাে যে, মােমেন ব্যক্তিটিকে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউন ও তার লােকজনদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন। ওরা পৃথিবীতেও তার কোনাে ক্ষতি করতে পারেনি এবং পরকালে তাে পারবেই না। অথচ খোদ ফেরাউন ও তার লােকজনকে কঠিন আযাব গ্রাস করে নিয়েছে। এই আযাবের স্বরূপ কি, সে সম্পর্কে নীচের আয়াতে বলা হচ্ছে, সকালে ও সন্ধ্যায় তাদেরকে আগুনের সামনে পেশ করা হয় এবং যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফেরাউন গোত্রকে কঠিনতর আযাবে দাখিল করাে।’ (আয়াত ৪৬) কোরআনের বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, সকাল বিকাল ফেরাউন ও তার লােকজনদেরকে আগুনের সামনে নিয়ে এসে শাস্তি দেয়ার ঘটনাটি ঘটবে মৃত্যুর পর থেকে নিয়ে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। কবরের আযাব বলতে খুব সম্ভবত, এটাকেই বুঝানাে হয়ে থাকে। কারণ, এর পরেই বলা হয়েছে, ‘যেদিন কেয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন আদেশ করা হবে, ফেরাউন গোত্রকে কঠিনতর আযাবে প্রবেশ করাও এ দ্বারা বুঝা যায় পূর্বের আযাবটি কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগে ছিল। এটাও কঠিন আযাব। সকাল বিকাল আগুনের সামনে হাযির করানাের মাধ্যমে এই আযাব দেয়া হবে। অর্থাৎ জাহান্নামের কঠিন শাস্তি তাদের চোখের সামনে বার বার এনে তাদেরকে মানসিকভাবে শাস্তি দেয়া হবে, অথবা আগুনের তাপ তাদের চোখেমুখে স্পর্শ করার ফলে তারা শাস্তি পাবে। এর পরের শাস্তিতাে আরও কঠিন এবং তা হবে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পর। পরবর্তী আয়াতে কেয়ামতের পরের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে ফেরাউন ও তার লােকজনদেরকে জাহান্নামের ভেতর দাঁড়িয়ে তর্ক করতে দেখা যাচ্ছে। যেমন, যখন তারা জাহান্নামে পরস্পর বিতর্ক করবে, অতপর দুর্বলরা অহংকারীদেরকে বলবে, আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম…(আয়াত ৪৭) আয়াতের বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, দুর্বলরাও জাহান্নামে তাদের সাথে অবস্থান করবে। সেই বড়দের লেজুরবৃত্তি আর মােসাহেবী করেও আজ তাদের ভাগ্যে বড়দের কোনাে সুপারিশ জুটছে না। সেই বড়রা তাদেরকে ভেড়া-বকরীর মতাে যেমন চাইছে এবং যেখানে চাইছে হাকিয়ে নিয়ে যেতাে, সেই ব্যাপারে তাদের স্বাধীন কোনাে মত থাকতাে না, কোনাে ইচ্ছা থাকতাে না এবং কোনাে পছন্দ অপছন্দও থাকতাে না; কিন্তু তারা আজ কঠিন শাস্তির মৃহূর্তে তাদের কোনােই উপকারে আসছে না। আল্লাহ তায়ালা সেই দুর্বলদেরকে মর্যাদা দান করেছিলেন। তা হচ্ছে মানবতার মর্যাদা, ব্যক্তি স্বাধীনতার মর্যাদা এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার মর্যাদা। কিন্তু তারা নিজেরাই এসব মর্যাদা ও স্বাধিকার স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেছে এবং এসব ত্যাগ করে তারা বড়দের পেছনে ছুটেছে, যালেমদের পেছনে ছুটেছে, দরবারী লােকদের পেছনে ছুটেছে এবং আমলা কামলাদের পেছনে ছুটেছে। কখনও ‘না’ বলার মতাে শক্তি তাদের ছিলাে না। বরং যা বলার কথা তারা কোনােদিন চিন্তাও করতাে না। সেই বড়রা তাদেরকে কী বলছে এবং কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তারা কোনোদিন ভেবেও দেখতাে না। তারা নিজেদেরকে নিছক অনুসারী বলেই ভাবতো। তারা আল্লাহ প্রদত্ত এই স্বাধীনতা ও মর্যাদা বড়দের স্বার্থে ত্যাগ করেছিলাে এবং মনে করেছিলাে, বিপদের মুহূর্তে তারা কাজে আসবে, আল্লাহর সামনে তাদের জন্যে সুপারিশ করবে। কিন্তু না, সে আশা পূর্ণ হয়নি। পৃথিবীর বুকে সেই বড়ােরা তাদেরকে ভেড়া বকরীর মতাে যেমন হাঁকিয়ে নিয়ে যেত’ তেমনিভাবে এখানেও ওরা এদেরকে এই জাহান্নামে হাঁকিয়ে নিয়ে এসেছে। তাই স্বভাবতই ওরা তাদেরকে প্রশ্ন করছে,’ তােমরা এখন জাহান্নামের আগুনের কিছু অংশ আমাদের থেকে নিবৃত করবে কি? কারণ পৃথিবীতে এই বড়রা ওদেরকে ধারণা দিতাে যে, ওরা ওদেরকে সঠিক পথেই নিয়ে যাচ্ছে, ওদেরকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করছে এবং সর্বপ্রকারের অমংগল, অনিষ্ট ও শত্রুদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করছে। কিন্তু এই ক্ষমতাধর অহংকারীরা তখন সেই ছােট ও নিচু শ্রেণীর লােকদের সামনে বড় বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে এবং অত্যন্ত ত্যক্ত বিরক্ত ও অতিষ্ঠ হয়ে উত্তর দেবে। তারা তাদের অক্ষমতা স্বীকার করে নেবে, ‘অহংকারীরা বলবে, আমরা সবাই তাে জাহান্নামে আছি, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের মাঝে নিজ ফয়সালা করে দিয়েছেন।'(আয়াত নং ৪৮) তাদের স্বতস্ফূর্ত স্বীকৃতি যে, ‘আমরা সবাইতাে জাহান্নামে আছি’ অর্থাৎ আমরা সবাই দুর্বল ও অক্ষম। এখানে আমাদেরকে সাহায্য করার মতাে এবং রক্ষা করার মতাে কেউ নেই। এই যন্ত্রণা ও কষ্টের আমরা সবাই সমান। যখন ক্ষমতাশালী ও দুর্বল সবাইকে এক সমান দেখছাে, তখন আমাদেরকে আর কেন প্রশ্ন করছো? যেহেতু ‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মাঝে ফয়সালা করে দিয়েছেন’ তাই এই ফয়সালা পুনর্বিবেচনার কোনাে সুযােগ নেই এবং এতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনেরও অবকাশ নেই। রায় ঘােষণা হয়ে গেছে, কাজেই কোনাে বান্দার পক্ষেই আল্লাহর এই রায়কে লঘু করা সম্ভবপর নয়। যখন উভয় দল বুঝে ফেলবে যে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনাে সহায় নেই, তখন তারা সবাই অত্যন্ত বিনয় ও কাতর সুরে জাহান্নামের প্রহরীদেরকে লক্ষ্য করে বলবে, ‘তোমরা তােমাদের পালনকর্তাকে বল, তিনি যেন আমাদের থেকে একদিনের আযাব লাঘব করে দেন'(আয়াত ৪৯) অত্যন্ত কাতর স্বরে তারা জাহান্নামের প্রহরীদেরকে এই আবেদন জানাবে। তাদের আশা, প্রহরীরা আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদের এই কঠিন শাস্তি কিছুটা লাঘব করাবে। খুব দীর্ঘ সময়ের জন্যে নয়, মাত্র একদিনের জন্যে যাতে করে কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা যাবে, একটু আরাম পাওয়া যাবে। এই একদিনের জন্যে শাস্তি লাঘব করার সুপারিশ ও দোয়া তাদের প্রাপ্য হওয়াটা অযৌক্তিক নয় । কিন্তু জাহান্নামের রক্ষীরা এই কাকুতি মিনতিভরা আবেদন রক্ষা করতে পারে না। কারণ, তাদের নিয়ম জানা আছে, আল্লাহর বিধান জানা আছে, তারা ভালাে করেই জানে যে, এ জাতীয় আবেদনের এখন আর কোনােই সুযােগ নেই। তাই তারা ভৎর্সনা করে এবং এই শাস্তির কারণ মনে করিয়ে দিয়ে ওদের যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, রক্ষীরা বলবে, তােমাদের কাছে কি সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ তােমাদের রসূল আসেনি? তারা বলবে, হাঁ…'(আয়াত ৫০) প্রশ্ন ও এর উত্তরের মাঝেই যে চূড়ান্ত বক্তব্য এসেছে, তারপর আর কোনাে কথাই চলে না। তাই তখন জাহান্নামের রক্ষীরা ওদেরকে অসহায় অবস্থায়ই ফেলে রাখবে এবং তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে ওদের অসহায়ত্বকে আরও বাড়িয়ে দেবে। কারণ, তারা ওদেরকে লক্ষ্য করে বলবে, ‘তােমরা নিজেরাই আল্লাহকে বলাে তােমাদের বলার কারণে যদি তােমাদের অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয় তাহলে সেই কাজ তােমাদের নিজেদেরই করা উচিত। কিন্তু, তাদের এই আবেদন করার পূর্বেই আল্লাহ পাক ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘বস্তুত, কাফেরদের দোয়া নিস্ফলই হয় …….! অর্থাৎ এই দোয়া জায়গা মতা গিয়ে পৌছবে না এবং এর কোনাে উত্তরও আসবে না। এই অবজ্ঞা আর উপেক্ষা ক্ষমতাধর ও দুর্বল উভয় শ্রেণীর ভাগ্যেই সেদিন জুটবে।
*জয় পরাজয়ের সত্যিকার মাপকাঠি এই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পূর্বের বক্তব্য ও ঘটনাকে সামনে রেখে সর্বশেষ একটা মন্তব্য করা হচ্ছে। এই মন্তব্যের মাঝে সেইসব দল ও গােষ্ঠীর প্রতিও ইংগিত করা হয়েছে যারা আল্লাহর সত্য বাণীকে অস্বীকার করার কারণে এবং অহংকার করার কারণে শাস্তির সম্মুখীন হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘আমি সাহায্য করবাে রসূলদেরকে মােমেনদেরকে…(আয়াত ৫১-৫৫) এই মন্তব্যটি যথার্থ স্থানেই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মানুষ সত্য ও মিথ্যার চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পারবে, মানুষ বুঝতে পারবে, সত্য ও মিথ্যার ফলাফল পার্থিব জগতে কী হয় আর পরকালে কী হয়। এর মাধ্যমে মানুষ আরও জানতে পারবে, ফেরাউন ও তার লােকজনদের পরিণতি পৃথিবীতে কি হয়েছিলাে এবং পরকালে কী হবে। অর্থাৎ তাদের পরিণতি হবে অবজ্ঞা ও লাঞ্জনা। পবিত্র কোরআন জানিয়ে দিচ্ছে যে, এ জাতীয় সব ঘটনার পরিণতি এ রকমই হবে। বলা হচ্ছে, সেদিন যালেমদের ওযর আপত্তি কোনাে উপকারে আসবে না, তাদের জন্যে থাকবে অভিশাপ এবং তাদের জন্যে থাকবে খারাপ নিবাস।'(আয়াত ৫২) তবে পরকালে বিশ্বাসী কোনাে মােমেন বান্দা পরকালের এই পরিণতি সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হবে না। তাছাড়া এ জাতীয় বিতর্কের কোনাে প্রয়ােজনও তার হবে না। কিন্তু পার্থিব জগতের বিজয় ও সফলতা সম্পর্কে কখনও কখনও নিশ্চয়তা ও সুস্পষ্ট বক্তব্যের প্রয়ােজন দেখা দেয়। তাই বলা হয়েছে, আমি পার্থিব জীবনে আমার রসূলদেরকে এবং যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করবাে’ অথচ বাস্তবে মানুষ দেখতে পায়, কোনাে কোনাে রসূলকে হত্যা করা হচ্ছে, কোনাে কোনাে রসূলকে নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে এবং কোনা কোনাে রসূলকে তার পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে। অপরদিকে মােমেন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে কঠিন শাস্তি দেয়া হয়, কাউকে জ্বলন্ত অগ্নিকূপে নিক্ষেপ করা হয়, কাউকে শহীদ করে দেয়া হয়, তাদের কেউ কেউ যন্ত্রণা, দুঃখ-কষ্ট ও যুলুম-অত্যাচারের মাঝে বেঁচে থাকে। তাহলে পৃথিবীতে সাহায্য করা সম্পর্কে সেই আসমানী ওয়াদা কোথায়? এই ছিদ্র দিয়েই শয়তান মানুষের মনে ঢুকে এবং যা করার তাই করে। মানুষ সচরাচর যা দেখে তার মাধ্যমেই ঘটনার বিচার করে এবং অনেক মূল্যবােধ ও বাস্তব তাই তখন তার বিবেচনায় থাকে না। মানুষ অত্যন্ত সংকীর্ণ স্থান ও কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে ঘটনাসমূহের বিচার করে। বিচারের এই মানবীয় মানদণ্ড নিসন্দেহে খুবই সংকীর্ণ। অপরদিকে ব্যাপক মানদন্ডে যখন ঘটনার বিচার করা হয় তখনও স্থান ও কালের গন্ডি থাকে প্রশস্ত ও বিস্তীর্ণ। সেখানে কালের মাঝে কোনাে ব্যবধান থাকে না এবং স্থানের মাঝেও কোনাে ব্যবধান থাকে না। এই মানদন্ডের ভিত্তিতে যদি আমরা আকিদা বিশ্বাসের বিষয়টি বিচার করি তাহলে আমরা নিসন্দেহে এর বিজয়কে দেখতে পাবাে। আসলে কোনাে আকিদা বিশ্বাস বা আদর্শের বিজয়ের অর্থ হচ্ছে এর ধারক ও বাহকদেরই বিজয়। কাজেই, এই আদর্শের অস্তিত্বের বাইরে এর ধারক ও বাহকদের নিজস্ব কোনাে অস্তিত্ব নেই। কারণ, এই আদর্শের প্রথম দাবীই হচ্ছে এই যে, এর ধারক ও বাহকরা তাতে বিলীন হয়ে যাবে, এবং নিজেরা পর্দার আড়ালে থাকবে আর আদর্শকে সামনে তুলে ধরবে। বিজয় ও সাফল্যের বিষয়টিও মানুষ অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থে দেখে থাকে এবং সচরাচর এর যে চিত্র তারা প্রত্যক্ষ করে তার ওপর ভিত্তি করেই বিচার করে। অথচ বিজয় বিভিন্নরূপে ও আকারে প্রকাশ পায়। বাহ্যিক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিতে এই বিজয় কখনও কখনও পরাজয়ের রূপেও প্রকাশ পেয়ে থাকে। ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনায় দেখতে পাই, তাকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা সত্তেও তিনি নিজের আদর্শ থেকে সরে আসেননি এবং এই আদর্শের প্রচার থেকেও বিরত হননি। তাহলে তার এই অবস্থানকে কি নামে আখ্যায়িত করবাে? বিজয়ের নামে, না পরাজয়ের নামে? যদি ঈমান ও আকীদার মানদন্ডে বিচার করি, তাহলে নিসন্দেহে বলতে পারি, এটা ছিলাে সর্বোচ্চ বিজয়। যখন অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হচ্ছিলেন তখনও তিনি ছিলেন বিজয়ী এবং যখন অগ্নিকুন্ড থেকে সহি-সালামতে বের হয়ে আসেন তখনও ছিলেন বিজয়ী, অথচ বাহ্যিকভাবে দুটো অবস্থার মাঝে কতাে ব্যবধান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দুটো অবস্থার মাঝে কোন ব্যবধান নেই। হযরত হােসেন(রা.) অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও করুণভাবে শাহাদত বরণ করেছেন। একদিকে শাহাদত হচ্ছে এক বিরাট মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা। অপরদিকে সেটা অত্যন্ত মর্মবিদারী ও বিয়ােগান্তক এক ঘটনাও। এখন এই ঘটনাকে বিজয় বলবাে, না পরাজয়? বাহ্যিক দৃষ্টিতে এবং সংকীর্ণ মানদন্ডে এটা ছিলাে পরাজয়। কিন্তু, প্রকৃত সত্যের আলােকে এবং উদার মানদভে এটা ছিলাে বিজয়। কারণ, পৃথিবীর বুকে এমন কোনাে শহীদ নেই যার প্রতি ভক্তি ও ভালােবাসায় হৃদয় সিক্ত হয় না, মন কেঁদে ওঠে না। ইমাম হােসেন(রা.)-এর ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে পেশ করতে পারি। তার বিয়ােগান্তক ঘটনায় শুধু মুসলমানই নয়, অনেক অমুসলিমও বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এমন অনেক শহীদ আছেন যিনি এক হাজার বছর জীবিত থাকলেও তিনি তার আদর্শের প্রচার ও প্রসারে বিজয়ী হতে পারতেন না, তার শাহাদাতই তার আদর্শকে বিজয়ী করেছেন। শহীদের রক্তে লেখা সর্বশেষ বক্তৃতাই হৃদয়ের মাঝে মহান চেতনার উন্মেষ ঘটায় এবং হাজার হাজার মানুষকে মহান কাজে আত্মনিয়োগ উদ্বুদ্ধ করে। শাহাদতের রক্তাক্ত অধ্যায় ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে যুগ যুগ ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। বিজয় কাকে বলে? আর পরাজয়ইবা কাকে বলে? আমাদের মনে জয় পরাজয়ের যে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার প্রয়ােজন আছে। পার্থিব জগতে নবী রসূল ও মােমেনদের বিজয় সম্পর্কিত আল্লাহর অবশ্যই এই বদ্ধমূল ধারণা তলিয়ে দেখতে হবে। এটা ঠিক যে, বিজয় অনেক সময় তার বাহ্যিক রূপেও প্রকাশ পেয়ে থাকে বিশেষ করে যখন এই বাহ্যিক রূপটি অমর ও চিরন্তন রূপটির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়, মিলে যায়। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মােহাম্মদ(স.) তার জীবনে বিজয় দেখেছেন। এটা সঠিক অর্থেই বিজয় ছিলাে । কারণ এই বিজয়ের সম্পর্ক ছিলাে পৃথিবীর বুকে তার প্রচারিত আদর্শের সত্যিকার ও পূর্ণ প্রতিষ্ঠার সাথে। এই আদর্শের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়, যদি তা গােটা মানব জীবনকে প্রভাবিত না করে, তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ না করে। ব্যক্তির হৃদয় থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের শাসক পর্যন্ত এর বিস্তার না থাকে। আল্লাহর ইচ্ছায় এই আদর্শের ধারক তার জীবদ্দশায়ই বিজয় লাভ করতে পেরেছেন। কারণ, তিনি এই আদর্শকে এর পূর্ণাংগরূপে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন এবং এই বাস্তব সত্যটিকে ইতিহাসের একটি নির্দিষ্ট ঘটনা হিসেবে রেখে গেছেন। শুধু তাই নয়, বরং বিজয়ের এই চাক্ষুষ ও নিকটস্থ রূপটি দূরবর্তী রূপটির সাথে মিশে গেছে। ফলে বাহ্যিক রূপটি প্রকৃত রূপটির সাথে মিলে একটি অভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। আর এটা আল্লাহর নির্দেশ ও ব্যবস্থায়ই সম্পন্ন হয়েছে। এখানে আর একটি বিষয় বিবেচনার দাবী রাখে। আর তা হলাে, আল্লাহ তায়ালা তার সকল রাসূল ও মুমিন বান্দাদের জন্যে বিজয়ের যে ওয়াদা করেছেন তা পুরােপুরিই বহাল আছে। তবে এই ওয়াদা কেবল সেই সব লােকদের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য হবে যাদের অন্তরে প্রকৃত ঈমান থাকবে। প্রকৃত ঈমানের ধারণা অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। প্রকৃত ঈমান বা নির্ভেজাল ঈমান তাকেই বলে যার মাঝে বিন্দুমাত্র শিরকের সংমিশ্রন থাকবে না। শিরকের এমন কিছু কিছু প্রকার আছে যা খুবই সূক্ষ্ম। এই সূক্ষ্ম শিরকের কবল থেকে মানুষ কেবল তখনই মুক্তি পেতে পারে যখন সে পুরােপুরি আল্লাহমুখী হবে, একমাত্র তার ওপরই ভরসা করবে, তার ফয়সালায় রাজী-খুশী থাকবে এবং অনুভব করবে যে, একমাত্র আল্লাহই তাকে পরিচালিত করছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন। কাজেই আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে তার কোনাে মংগল নেই। এই বাস্তব সত্যটিকে সে সন্তুষ্টচিত্তে ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে গ্রহণ করে নেয়। তার অবস্থা যখন এই পর্যায়ে উন্নীত হবে তখন আল্লাহর নির্দেশের বাইরে সে কোনাে কাজ করবে না। বিজয় বা সাফল্যের নির্দিষ্ট বিশেষ কোনাে রূপের জন্যে আল্লাহর কাছে আব্দার করবে না; বরং গােটা বিষয়টিই সে তখন আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়ােগ করবে। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব বিপদাপদ ও পরীক্ষার সম্মুখীন হবে সেগুলােকেই নিজের জন্যে মঙ্গলজনক মনে করবে। আর এটাই হচ্ছে প্রকৃত অর্থে বিজয় ও সাফল্য। অর্থাৎ এখানে বিজয় হচ্ছে নিজের আমিত্বকে জয় করা, প্রবৃত্তিকে জয় করা। এটি হচ্ছে অন্তর্নিহিত বিজয়। কোনাে অবস্থাতেই বাহ্যিক বিজয় লাভ করা যায় না। বিজয় ব্যতীত আলােচ্য আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, পরকালে যালেম অত্যাচারীদের কোনাে ওযর আপত্তিই কাজে আসবে না, বরং তারা ভৎর্সনাও লাঞ্ছনার শিকার হবে এবং পরিশেষে নিকৃষ্ট জায়গায় স্থান পাবে। অপরদিকে মূসা(আ.)-এর ঘটনায় ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। সেখানে তাকে আমরা বিজয়ীবেশে দেখতে পাই। যেমন বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি মূসাকে হেদায়েত দান করেছিলাম এবং বনী ইসরাঈলকে কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছিলাম…’(আয়াত ৫৩-৫৪) এটাও আল্লাহর পক্ষ থেকে এক ধরনের বিজয়। এই বিজয়ের সারমর্ম হচ্ছে, কিতাব ও হেদায়াতের অধিকারী হওয়া এবং কিতাব ও হেদায়াতকেই নিজের উত্তরাধিকার স্বরূপ রেখে যাওয়া। মূসা(আ.)-এর ঘটনার মধ্য দিয়ে বিজয়ের যে দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে উন্মোচিত করে দেয়, তার মাধ্যমে আমরা এক বিশেষ ধরনের বিজয়ের রূপ দেখতে পাই। বিজয়ের এই রূপটি কোনাে ধারার ওপর ভিত্তি করে লাভ হয় তার ইংগিতও বহন করে। আলােচনার এই পর্বে এখন সর্বশেষ বক্তব্য আসছে যার মাঝে রসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি দিক নির্দেশনা রয়েছে, তার সাথে মক্কায় যুলুম নির্যাতনভােগকারী মােমেনদের প্রতি দিকনির্দেশনা রয়েছে এবং তাঁর উম্মতের ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রত্যেকের জন্যে দিক নির্দেশনা রয়েছে যারা অনুরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। বলা হয়েছে, অতএব তুমি সবর করাে, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য, তুমি তােমার গােনাহের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে…।(আয়াত ৫৫) এই সর্বশেষ বক্তব্যে ধৈর্য সহ্যের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। মিথ্যারােপের ওপর ধৈর্যধারণ করা, যুলুম নির্যাতনের ওপর ধৈর্যধারণ করা, বাতিলের সাময়িক উত্থান ও প্রভাবপ্রতিপত্তির ওপর ধৈর্যধারণ করা, মানুষের স্বভাব চরিত্র ও আচার ব্যবহারের ওপর ধৈর্যধারণ করা, মনের বিভিন্ন চাহিদা, আশা আকাংখা, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এবং তাৎক্ষণিক বিজয়ের জন্যে মনের ব্যাকূলতা ও অস্থিরতাকে ধৈর্যের সাথে মােকাবেলা করা। এ ছাড়াও আরও অনেক কিছুই ধৈর্যের সাথে মােকাবেলা করা যা শত্রুদের আগে বন্ধুদের কাছ থেকেই আসতে পারে। বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য’ অর্থাৎ সময় যতােই দীর্ঘ হােকনা কেন, অবস্থা যতই জটিল হােকনা কেন এবং পরিস্থিতি যতােই অস্থিতিশীল হােকনা কেন, এই ওয়াদা বাস্তবায়িত করা হবেই। কারণ, এই ওয়াদা তিনিই করেছেন যিনি এর বাস্তবায়নের ক্ষমতাও চলার পথে পাথেয় হিসেবে যা গ্রহণ করতে হবে তা হচ্ছে এই, তােমার গােনাহের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করাে এবং সকাল সন্ধ্যায় তােমার পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করাে কঠিন ও দীর্ঘপথের জন্যে এটাও হচ্ছে প্রকৃত পাথেয়। অর্থাৎ গুনাহের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এবং আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করা। আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করে ক্ষমা প্রার্থনা করা হলে তা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী। এছাড়া এর মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও মানসিক প্রস্তুতিও লাভ হয়। আর এটাই বিজয়ের সেই রূপ যা মনােজগতে লাভ হয়। এর পরই লাভ হয় জাগতিক জীবনের বিজয়। এখানে সকাল সন্ধ্যা বলতে হয়তাে দিনের গােটা সময় বুঝানাে হয়েছে। অথবা এই দুটো তাই এভাবে বলা হয়েছে। বিজয় লাভের জন্যে এটাই হচ্ছে যথার্থ পন্থা, এটাই হচ্ছে প্রকৃত পাথেয় যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ, এটা হচ্ছে এক ধরনের যুদ্ধ। আর প্রত্যেক যুদ্ধের জন্যেই প্রস্তুতির প্রয়ােজন আছে এবং পাথেয়রও প্রয়ােজন আছে।
‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে তাদের কাছে আসা কোনাে দলীল ব্যতিরেকে…’(আয়াত ৫৬-৭৭) এই পর্বটিও আগের পর্বটির সাথে অংগাংগীভাবে জড়িত ও সম্পৃক্ত এবং পূর্বের আলােচনার শেষ অনুচ্ছেদটির সাথে এটি ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আসছে। অর্থাৎ রসূলুল্লাহ(স.) কে মিথ্যারােপ, যুলুম-নির্যাতন, সত্যকে প্রতিহত করা এবং বাতিলের লম্ফ-ঝম্ফ ধৈর্য সহকারে মােকাবেলার যে নির্দেশ পূর্বে দেয়া হয়েছিলাে তারই সম্পূরক হিসেবে এই পর্বটি আলােচিত হচ্ছে। এই নির্দেশনার পর আল্লাহর আয়াতের ব্যাপারে তর্ক বিতর্কের মূল কারণটি উল্লেখ করা হচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে, অহংকার; এই অহংকারই মানুষকে সত্য মেনে নিতে বাধা দেয়। অথচ যে অহংকার তাদের মনে দানা বেঁধে উঠে সে তুলনায় তাদের অস্তিত্ব খুবই তুচ্ছ ও নগন্য। এরপর সাবধানবাণীস্বরূপ এই সৃষ্টিজগতের বড়ত্ব ও মাহাত্মের কথা বলা হয়েছে, যা মহান আল্লাহর সৃষ্টির অন্যতম, গােটা মানব জাতির অস্তিত্ব এই বিশাল সৃষ্টি জগতের তুলনায় খুবই তুচ্ছ। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিশ্ব জগত থেকে কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, মানুষ তুচ্ছ ও নগন্য হওয়া সত্তেও এই বিশাল সৃষ্টি জগতকে তার করায়ত্ত করে দেয়া হয়েছে। এটা নিসন্দেহে আল্লাহর মেহেরবানী ও দয়া। এই দয়া ও করুনা তিনি খােদ মানুষের অস্তিত্বের ক্ষেত্রেও প্রদর্শন করেছেন। যার কিছু কিছু নমুনা, আলােচ্য পর্বে তুলে ধরা হয়েছে। এসব কিছুই মহান সৃষ্টিকর্তার একত্বের প্রমাণ বহন করে। অথচ এই একক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার সাথেই মানুষ মানুষকে ও বিভিন্ন দেব-দেবীকে শরীক করে। তাই আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে প্রকাশ্যে তাওহীদের বক্তব্য তুলে ধরতে নির্দেশ দিচ্ছেন এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য সকল কাল্পনিক ও মনগড়া উপাস্যদেরকে উপেক্ষা করতে বলছেন। আলােচ্য পর্বের শেষ দিকে কেয়ামতের ভয়াবহ কিছু দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে যেখানে মােশরেকদেরকে তাচ্ছিল্য ও ভৎর্সনার সুরে নিজেদের মনগড়া শরীকদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। পূর্ববর্তী পর্বের ন্যায় এই পর্বও রসূলুল্লাহ(স.)-কে ধৈর্য সহ্যের উপদেশের মাধ্যমে সমাপ্ত হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, আল্লাহর ওয়াদার আংশিক বাস্তবায়ন তিনি জীবদ্দশায় দেখে যান, অথবা এর পূর্বেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যান এসবই নির্ভর করছে একন্তভাবে আল্লাহর ইচ্ছার ওপর। তবে যাই হােক না কেন, পরিশেষে সবাইকে আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে। *আল্লাহর আয়াত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত অহংকারীদের পরিণতি : বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে তাদের কাছে আগত কোনাে দলীল…'(আয়াত ৫৬-৬০) মানুষ নামী এই জীবটি অনেক সময়ই নিজের স্বরূপ ভুলে যায়। সে ভুলে যায় যে, সে একজন ছােট ও দুর্বল প্রাণী, তার নিজস্ব কোনাে শক্তি নেই, বরং তার যাবতীয় শক্তি ও সামার্থ সেই মহান আল্লাহর কাছ থেকেই গ্রহণ করে যিনি শক্তির আদি উৎস। অথচ এই মানুষ সেই উৎস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে অহংকারে ফুলে ফেপে ওঠে, উন্নাসিকতায় মেতে ওঠে, বাহাদুরী প্রদর্শন করতে থাকে। তার মনে আত্মম্ভরিতা দানা বেঁধে ওঠে। এই অহংকার সেই শয়তানের কাছ থেকে সে লাভ করে যে শয়তান এই অহংকারের কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন সে মানুষকে ধ্বংস করার জন্যে এই অহংকারকে তাদের ওপরও চাপিয়ে দিচ্ছে। এই মানুষ আল্লাহর আয়াতকে নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠে। অথচ এই আয়াত হচ্ছে এমন সবাক প্রমাণ যা প্রকৃতিকে প্রকৃতির ভাষায়ই প্রকাশ করে, ব্যক্ত করে। বিতর্কের কারণ হিসেবে সে নিজেকে এবং অন্যান্য মানুষকে এই ধারণা দিতে চেষ্টা করে যে, সে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। সে নিশ্চিত নয় বলেই বিতর্ক করছে। কিন্তু, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে যথার্থরূপে অবগত আছেন। কারণ, তিনি সর্বস্রষ্টা ও সর্বজ্ঞানী। বান্দাদের অন্তরের ভেদ সম্পর্কেও তিনি অবগত আছেন। তিনি যথার্থরূপেই জানেন যে, একমাত্র অহংকারের কারণেই মানুষ বিতর্কে লিপ্ত হয়। এই অহংকারই মানুষকে এমন একটি বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে উদ্বুদ্ধ করে যা তর্কাতীত। অহংকারের বশবর্তী হয়েই মানুষ নিজের অস্তিত্ব ও বাস্তবতার তুলনায় অনেক বড় কিছু দাবী করার চেষ্টা করে, এমন স্থান দখল করতে চায় যার যােগ্য সে নয়। তাছাড়া কোনােরূপ দলীল প্রমাণ ও যুক্তি ছাড়াই সে বিতর্কে লিপ্ত হয়। এটাকে অহংকার ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে? তাই বলা হচ্ছে, ‘তাদের অন্তরে আছে কেবল আত্মম্ভরিতা যা অর্জনে তারা সফল হবে না।’ মানুষ যদি তার বাস্তবতা এবং এই সৃষ্টিজগতের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারতাে; তার ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন থাকতাে তাহলে সে কখনও সীমালংঘন করার চেষ্টা করতাে না। সে যদি সন্তুষ্টিত্তে উপলব্ধি করতে পারতাে যে, তার অস্তিত্ব অগনিত ও অসংখ্য অস্তিত্বের মাঝে সামান্য একটা অস্তিত্ব যা আল্লাহর নির্দেশেই পরিচালিত হচ্ছে এবং এই বিশ্বজগতে টিকে আছে তার অজানা ও অদৃশ্য নিয়মের অধীনেই; তেমনিভাবে মানুষ যদি বিশ্বাস করতাে যে, এই বিশাল সৃষ্টি জগতে তার ভূমিকা তার অস্তিত্বের বাস্তবতা অনুসারেই নির্ধারণ করা আছে, তাহলে সে শান্তি পেতো, স্বস্তি পেতাে, বিনয়ী হতাে এবং নিজেকে নিয়ে, নিজের পারিপার্শ্বিকতাকে নিয়ে সুখে ও সাচ্ছন্দেই জীবন যাপন করতে পারতাে। আর সাথে সাথে মহান আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করতাে ও তার নির্দেশ মেনে নিতাে। তাই বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহর আশ্রয় কামনা করাে, নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শুনেন, সবকিছু দেখেন।’ অহংকার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে এখানে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করতে বলা হয়েছে। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, অহংকার হচ্ছে নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য একটি পাপ। কারণ, মানুষ কেবল সেই সব বস্তু থেকেই আল্লাহর আশ্রয় কামনা করে যা নিকৃষ্ট ও ক্ষতিকর। বলা বাহুল্য, অহংকারের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কারণ, অহংকার খােদ অহংকারীকে অতিষ্ট করে তােলে, তার আশেপাশের লােকজনকে অতিষ্ট করে তােলে, যে মনের ভেতর অহংকার জন্ম নেয়, সে অন্তরকে যন্ত্রণায় কাতর করে তােলে এবং অন্যদের অন্তরকেও যন্ত্রণায় ভারাক্রান্ত করে তােলে। কাজেই, এই অহংকার হচ্ছে অমংগল ও অনিষ্ট যার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করার প্রয়ােজন হয়। ‘আল্লাহ তায়ালা সব কিছু শুনেন ও সব কিছু দেখেন’ অর্থাৎ নিকৃষ্ট অহংকার আচার আচরণে প্রকাশ পেলে আল্লাহ তায়ালা তা দেখেন এবং কথা-বার্তায় প্রকাশ পেলে তাও তিনি শুনেন। কাজেই অহংকারীদের বিচারের ভার আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিত।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ থেকে জানা যায়, ফেরাউনের সাম্রাজ্যে সে ব্যক্তি এতটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিল যে, ভরা দরবারে ফেরাউনের মুখের ওপরে এ ধরনের সত্য কথন সত্ত্বেও তাকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়ার সাহস হয়নি। এ কারণে তাকে হত্যা করার জন্য ফেরাউন ও তার সহযোগীদের গোপনে ষড়যন্ত্র করতে হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ সে ষড়যন্ত্রও বাস্তবায়িত হতে দেননি।
# এ বর্ণনাভঙ্গি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ফেরাউনের সভাসদদের মধ্যকার ঈমানদার ব্যক্তির সত্য কথনের এ ঘটনা হযরত মূসা (আ) ও ফেরাউনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের একেবারে শেষ যুগে সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত এ দীর্ঘ দ্বন্দ্ব-সংঘাতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ফেরাউন হযরত মূসাকে হত্যা করার সংকল্প করে থাকবে। কিন্তু তার সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী এ ব্যক্তির সত্য কথনের কারণে সে হয়তো আশঙ্কা করেছিলো যে, মূসা আল্লাইহিস সালামের প্রভাব সরকারের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের ওপরেও পড়েছে। হয়তো এ কারণেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে, মূসার (আ) বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বেই সাম্রাজ্যের আমীর, উমরা ও উচ্চ পদ মর্যাদার অধিকারী লোকদের মধ্যে যারা এ আন্দোলনে প্রভাবিত হয়েছে সেসব লোকদের খুঁজে বের করা হোক যাতে তাদের মূলোৎপাটনের পর মূসাকে হত্যা করা যায়। কিন্তু সে এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকাকালেই আল্লাহ তা’আলা হযরত মূসা (আ) ও তাঁর অনুসরীদের হিজরতের আদেশ দিলেন। আর পশ্চাদ্ধাবন করতে গিয়ে ফেরাউন তার সৈন্য-সামন্তসহ ডুবে মারা যায়।
# বহু সংখ্যক হাদীসে কবরের আযাব নামক বরযখের আযাবের যে উল্লেখ আছে এ আয়াত তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। আল্লাহ তা’আলা এখানে সুস্পষ্ট ভাষায় আযাবের দু’টি পর্যায়ের উল্লেখ করছেন। একটি হচ্ছে কম মাত্রার আযাব যা কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে ফেরাউনের অনুসারীদের দেয়া হচ্ছে অর্থাৎ তাদেরকে সকাল ও সন্ধ্যায় দোযখের আগুনের সামনে পেশ করা হয় আর ঐ আগুন দেখে তারা সর্বক্ষণ আতংকিত হয়ে কাটায় এই ভেবে যে, এ দোযখেই তাদেরকে শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। এরপর কিয়ামত আসলে তাদেরকে তাদের জন্য নির্ধারিত বড় এবং সত্যিকার আযাব দেয়া হবে। ডুবে মরার সময় থেকে আজ পর্যন্ত তাদেরকে যে আযাবের দৃশ্য দেখানো হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত দেখানো হবে। এ ব্যাপারটি শুধু ফেরাউন ও ফেরাউনের অনুসারীদের জন্য নির্দিষ্ট নয়। অপরাধীদের জন্য যে জঘন্য পরিণাম অপেক্ষা করছে, মৃত্যুর মুহূর্ত থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তারা সবাই সে দৃশ্য দেখতে পায় আর সমস্ত সৎকর্মশীল লোকের জন্য আল্লাহ তা’আলা যে শুভ পরিণাম প্রস্তুত করে রেখেছেন তার সুন্দর দৃশ্যও তাদেরকে দেখানো হয়। বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا مَاتَ عُرِضَ عَلَيْهِ مَقْعَدُهُ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِىِّ إِنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ فَمِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ وَإِنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ النَّارِ فَمِنْ أَهْلِ النَّارِ فَيُقَالُ هَذَا مَقْعَدُكَ حَتَّى يَبْعَثَكَ اللَّهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তিই মারা যায় তাকেই সকাল ও সন্ধ্যায় তার শেষ বাসস্থান দেখানো হতে থাকে। জান্নাতী ও দোযখী উভয়ের ক্ষেত্রেই এটি হতে থাকে। তাকে বলা হয় কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তোমাকে পুনরায় জীবিত করে তাঁর সান্নিধ্যে ডেকে নেবেন, তখন তোমাকে আল্লাহ যে জায়গা দান করবেন, এটা সেই জায়গা।” (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আন নিসা, আয়াত ৯৭ ; আল আন’আম, ৯৩, ৯৪ ; আল আনফাল ৫০ ; আন নাহল ২৮ , ৩২ , আল মু’মিনূন, ৯৯ , ১০০ ; ইয়াসীন ২৬, ২৭ ; টীকা ২২ ও ২৩ ; মুহাম্মাদ ২৭ , টীকা ৩৭ )।
# তারা এমন কোন আশা নিয়ে একথা বলবে না যে, তাদের ঐ সব পূর্বতন নেতা কিংবা শাসক বা পথপ্রদর্শক প্রকৃতই তাদেরকে আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে বা তা কিছুটা লাঘব করিয়ে দেবে। তখন তাদের কাছে এ সত্য স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, এখানে এসব লোক আমাদের কোন কাজে আসার মত নয়। তারা তাদেরকে হেয় ও লাঞ্ছিত করার জন্য তাদেরকে বলবেঃ দুনিয়ায় তো জনাব অত্যন্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ফলিয়ে আমাদের ওপর আপনার নেতৃত্ব চালাতেন। আপনাদের কল্যাণে এখন এখানে যে বিপদ আমাদের ওপর আপতিত তা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন তো দেখি।
# আমরা ও তোমরা সবাই সাজাপ্রাপ্ত এবং আল্লাহর আদালত থেকে যার যে সাজা প্রাপ্য তা পেয়ে গেছি। তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা কিংবা তাঁর দেয়া শাস্তি হ্রাস বৃদ্ধি করার সাধ্য কারো নেই।
# ঘটনা যখন এই যে, রসূল তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছিলেন। আর তোমরা তাঁর কথা মানতে অস্বীকার (কুফরী) করেছিলে সে কারণে সাজা প্রাপ্ত হয়ে এখানে এসেছো তখন আমাদের পক্ষে তোমাদের জন্য আল্লাহ তা’আলার কাছে দোয়া করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ, এ ধরনের দোয়ার জন্য কোন না কোন ওজর বা যুক্তি থাকা চাই। কিন্তু তোমরা নিজেদের পক্ষ থেকে কোন ওজর বা যুক্তি পেশের সুযোগ আগেই নষ্ট করে ফেলেছো। এ অবস্থায় তোমরা নিজেরা দোয়া করতে চাইলে করে দেখো। তবে আমরা তোমাদেরকে প্রথমেই একথা বলে দিতে চাই যে, তোমাদের মত কুফরী করে যারা এখানে এসেছে তাদের দোয়া করা একেবারেই নিরর্থক।
# আল্লাহর সেনাদল বলতে এমন ঈমানদারদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা আল্লাহর রসূলের আনুগত্য করে এবং তাঁর সহযোগী হয়। তাছাড়া এমন অদৃশ্য শক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত হয় যাদের সাহায্যে মহান আল্লাহ সত্যপন্থীদেরকে সাহায্য-সহায়তা দান করে থাকেন।
এ সাহায্য ও বিজয়ের অর্থ অবশ্যই এ নয় যে, প্রত্যেক যুগে আল্লাহর প্রত্যেক নবী এবং তাঁর প্রত্যেক অনুসারী দল রাজনৈতিক বিজয়ই লাভ করবেন। বরং এ বিজয় বহু ধরনের হবে। রাজনৈতিক বিজয়ও এর মধ্যে একটি। যেখানে আল্লাহর নবীগণ এ ধরনের প্রাধান্য লাভ করেননি সেখানেও তাঁদের নৈতিক প্রাধান্য প্রমাণিত হয়েই থাকবে। যেসব জাতি তাদের কথা মানেনি এবং তাদের দেয়া হিদায়াতের বিরোধী পথ অবলম্বন করেছে তারা শেষ পর্যন্ত বরবাদই হয়ে গেছে। মূর্খতা ও ভ্রষ্টতার যে দর্শনই মানুষ তৈরি করেছে এবং যে বিকৃত জীবনাচরণই জোরপূর্বক প্রচলন করা হয়েছে তা সবই কিছুদিন পর্যন্ত টিকে থাকার পর শেষ পর্যন্ত স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে। কিন্তু হাজার হাজার বছর থেকে আল্লাহর নবীগণ যে সত্যগুলোকে প্রকৃত সত্য হিসেবে পেশ করে এসেছেন তা আগেও ছিল অপরিবর্তনীয় এবং আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। কেউ তাকে স্বস্থান থেকে নড়াতে পারেনি।
# যখন আল্লাহর আদালত কায়েম হবে এবং তাঁর সামনে সাক্ষী পেশ করা হবে।
# আমি মূসাকে (আ) ফেরাউনের মোকাবিলায় পাঠিয়ে তাঁকে অসহায়ভাবে ছেড়ে দিয়েছিলাম না। বরং প্রতি পদে আমি তাঁকে পথনির্দেশনা দিচ্ছিলাম এবং এভাবে তাঁকে সাফল্যের দ্বার প্রান্তে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম। একথাটির মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে। ইঙ্গিতটি হচ্ছে, হে মুহাম্মাদ, (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি তোমার সাথেও একই আচরণ করবো। তোমাকেও মক্কা নগরীতে কুরাইশ গোত্রের মধ্যে নবুওয়াত দিয়ে পাঠানোর পর তোমাকে অসহায়ভাবে ছেড়ে দেইনি যে, এ জালেমরা তোমার সাথে যেমন ইচ্ছা আচরণ করবে। বরং আমি নিজে তোমার পৃষ্ঠপোষক আছি এবং তোমাকে পথনির্দেশনা দান করছি।
# যেভাবে মূসার (আ) দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীরা এ নিয়ামত ও কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলো এবং তাঁর প্রতি ঈমান পোষণকারী বনী ইসরাঈলকেই কিতাবের উত্তরাধিকারী বানানো হয়েছে তেমনিভাবে এখন যারা তোমাকে অস্বীকার করবে তারা বঞ্চিত হবে এবং তোমার প্রতি ঈমান পোষণকারীরাই কুরআনের উত্তরাধীকারী এবং পৃথিবীতে হিদায়াতের পতাকাবাহী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে।
# তুমি যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছো তা অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে প্রশান্ত মনে বরদাশত করতে থাকো।
# “আমি এ পার্থিব জীবনেও আমার রসূল ও ঈমানদারদের অবশ্যই সাহায্য করি।” একটু আগেই ওপরে বর্ণিত এ বাক্যাংশের প্রতিশ্রুতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
# যে প্রসঙ্গে একথা বলা হয়েছে তা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে স্পষ্ট বুঝা যায়, এক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটি দ্বারা বুঝানো হয়েছে ধৈর্যহীনতার সে পরিস্থিতিকে যখন চরম বিরোধিতার সে পরিবেশে বিশেষ করে তাঁর সঙ্গী সাথীদেরকে ক্রমাগত নির্যাতিত হতে দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছিলো। তিনি চাচ্ছিলেন শীঘ্রই এমন মু’জিযা দেখিয়ে দিতে যা দেখে কাফেররা স্বীকার করে নেবে কিংবা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অনতিবিলম্বে এমন কিছু প্রকাশ পাক যা দেখে বিরোধিতার এ আগুন নিভে যায়। এ ধরনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ কোন গোনাহ ছিল না যে, সেজন্য তাওবা ও ইসতিগফারের প্রয়োজন পড়তো। তবে আল্লাহ তা’আলা নবীকে ﷺ যে উচ্চ আসনে সমাসীন করেছিলেন এবং সে পদমর্যাদ যে উচ্চ ও মহত সংকল্পের দাবী করে সে দিকের বিচারে এ যৎসামান্য ধৈর্যচ্যুতি ও আল্লাহর কাছে তাঁর মর্যাদর চেয়ে অনেক নীচু মনে হয়েছে। তাই বলা হয়েছে, এ দুর্বলতার জন্য তোমার রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং পাথরের মত অটল হয়ে স্বীয় ভূমিকায় এমন অবিচল থাকো যেমনটি তোমার মত মহত মর্যাদার লোকদের হওয়া প্রয়োজন।
# এ প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করাই সে উপায় যার মাধ্যমে আল্লাহর পথের কর্মীরা আল্লাহর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ানো দুঃখ-কষ্টের মোকাবিলা করার শক্তি অর্জন করে। সকাল ও সন্ধ্যায় ‘হামদ’ ও ‘তাসবীহ’ বা প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করার দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, সদা সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। দুই, এ নির্দিষ্ট সময় দু’টিতে নামায আদায় করো। দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করা হলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যা এ সূরা নাযিল হওয়ার কিছুদিন পর সমস্ত ঈমানদারদের জন্য ফরয করে দেয়া হয়েছিল। কারণ, আরবী ভাষায় عشى শব্দটি সূর্য মাথার ওপর থেকে হেলে পড়ার সময় থেকে রাতের প্রথম অংশ পর্যন্ত সময় বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এ সময়ের মধ্যে যোহর থেকে শুরু করে এশা পর্যন্ত চার ওয়াক্ত নামায অন্তর্ভুক্ত। আর ابكار শব্দটি ভোর বেলার ঊষার আলো প্রকাশ পাওয়ার সময় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়কে অর্থাৎ ফজরের নামাযের ওয়াক্তকে বলা হয়। (অধিক বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারা, টীকা ৫ , ৫৯ , ৬০ , ২৬৩ ; হূদ, টীকা ১১৩ ; আল হিজর, টীকা ৫৩ ; বনী ইসরাঈল ভূমিকা এবং টীকা ১ , ৯১ থেকে ৯৮ ; ত্বা-হা, টীকা ১১১ ; আন নূর, টীকা ৮৪ থেকে ৮৯ ; আল আনকাবূত, টীকা ৭৬ থেকে ৭৯ ; আর রূম, টীকা ২৪ , ৫০ )।
# এসব লোকের যুক্তি-প্রমাণহীন বিরোধিতা এবং যুক্তিহীন কূট তর্কের মূল কারণ এ নয় যে, আল্লাহর আয়াতসমূহে যেসব সত্য এবং কল্যাণের কথা তাদের সামনে পেশ করা হচ্ছে তা তাদের বোধগম্য হয় না। সুতরাং তারা তা বুঝার জন্য সৎ নিয়তে তর্কে লিপ্ত হয়। বরং তাদের এহেন আচরণের মূল কারণ হচ্ছে, তাদের মনে গর্ব ও অহংকার একথা মেনে নিতে প্রস্তুত নয় যে, তারা থাকতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নেতৃত্ব ও দিকনিদের্শনা মেনে নেয়া হবে এবং একদিন তাদের নিজেদেরকেও এ ব্যক্তি নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে, যার তুলনায় নিজেদেরকেই তারা নেতৃত্বের অধিক উপযুক্ত মনে করে। তাই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লামের নেতৃত্ব যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সেজন্য তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে। এ উদ্দেশ্য সাধনের জন জঘন্য থেকে জঘন্যতর কোন কৌশল কাজে লাগাতেও তারা দ্বিধান্বিত নয়।
# অন্য কথায় এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ যাকে বড় বানিয়েছেন সে-ই বড় হয়ে থাকবে এবং এসব ছোট লোক নিজেদের বড়ত্ব কায়েম রাখার জন্য যে চেষ্টা-সাধনা করছে তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
# ফেরাউনের হুমকির মুখে মহাপরাক্রমশালী একমাত্র আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে মূসা (আ) যেমন চিন্তা মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তেমনি কুরাইশ নেতাদের হুমকি ও ষড়যন্ত্রের মুখে তুমিও তাঁর আশ্রয় নাও এবং চিন্তামুক্ত হয়ে তাঁর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাও।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪৭-৫০ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
জাহান্নামীরা জাহান্নামে পরস্পর বাক-বিতণ্ডা করবে এবং একজন অপরজনকে দোষারোপ করবে- সে সম্পর্কেই উক্ত আয়াতগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে। যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করবেন তখন একদল প্রবেশ করবে জান্নাতে, আর অন্যদল প্রবেশ করবে জাহান্নামে। জাহান্নামীরা জাহান্নামে পরস্পর ঝগড়া করবে এবং একে অপরকে দোষারোপ করবে। যারা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলাকে ব্যতীত অন্যের ইবাদত করত তারা তাদের নেতাদেরকে বলবে : আমরা তো দুনিয়াতে তোমাদেরই অনুসরণ করতাম। আজ তোমরা আমাদের থেকে কিছু শাস্তি রহিত করো। তখন তারা তা করতে অস্বীকার করবে। এমনকি তারা জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলবে : তারা যেন আল্লাহর নিকট আবেদন করে একদিনের জন্য হলেও শাস্তিকে হালকা করার জন্য। তখন প্রহরীরা বলবে! তোমরা নিজেরাই প্রার্থনা করো। পরিশেষে তারা নিজেরাই প্রার্থনা করবে কিন্তু সেখানে তাদের প্রার্থনা শোনা হবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(قَالَ اخْسَئُوْا فِيْهَا وَلَا تُكَلِّمُوْنِ)
আল্লাহ বলবেন, “তোরা হীন অবস্থায় এখানেই থাক্ এবং আমার সাথে কোন কথা বলিস্ না।’ (সূরা মু’মিনূন ২৩ : ১০৮)
এভাবেই তারা প্রতিনিয়ত চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে। যে শাস্তির কোনই ঘাটতি বা হ্রাস করা হবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. জাহান্নামীরা জাহান্নামে ঝগড়া করবে- এ কথা জানা গেল।
২. জাহান্নামীরা শাস্তি কমানোর জন্য প্রার্থনা করবে, কিন্তু তাদের প্রার্থনা কবূল করা হবে না।
৫১-৫৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(إِنَّا لَنَنْصُرُ رُسُلَنَا……..)
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ কথা ঘোষণা দিয়েছেন যে, তাঁর রাসূলগণ এবং যারা মু’মিন অর্থাৎ বিশ্বাসী তাঁরাই ইহজগত ও পরকালে বিজয়ী হবে। যত শক্তিশালী বাহিনীই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করুক না কেন তারা পরাজয় বরণ করবে আর মু’মিনরা বিজয়ী হবে। স্বযং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সাহায্য করে থাকেন। আর তাদের শত্র“দেরকে লাঞ্ছিত করেন।
এখান থেকে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে যে, নাবীদের কাউকে তো হত্যা করা হয়েছে। যেমন ইয়াহইয়া ও যাকারিয়া (আঃ) প্রমুখ। আবার কাউকে হিজরত করতে হয়েছে। যেমন ইব্রা-হীম (আঃ) ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও কেন এমনটি হলো?
আসলে এ প্রতিশ্রুতির সম্পর্ক হলো অধিকাংশ অবস্থা এবং বেশিরভাগ ব্যক্তিবর্গের সাথে। তাই কোন কোন অবস্থায় এবং কোন কোন ব্যক্তিবর্গের ওপর কাফিরদের জয়যুক্ত হওয়া এ প্রতিশ্রুতির পরিপন্থি নয়, বরং তা তাদের জন্য পরীক্ষাও বটে। অথবা এর অর্থ হলো, ক্ষণস্থায়ীভাবে কখনো কখনো আল্লাহ নিজ কৌশল ও ইচ্ছায় কাফিরদেরকে বিজয় দান করেন। কিন্তু পরিশেষে ঈমানদাররাই জয়লাভ ও সফলতা অর্জন করে।
অনুরূপভাবে তারা পরকালেও বিজয়ী হবে। কিয়ামতের দিন আম্বিয়া (আঃ) ও ফেরেশতাগণ সাক্ষ্য দেবেন। ফেরেশতাগণ সাক্ষ্য দেবেন যে, হে আল্লাহ তা‘আলা! নাবীগণ তোমার বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁদের উম্মাত তাঁদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। এছাড়াও উম্মাতে মুহাম্মাদী এবং স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা সাক্ষ্য দেবেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. যারা ঈমানদার তারাই সর্বদা বিজয়ী হবে।
২. যারা কাফির তাদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র সর্বদাই ব্যর্থ হয়।
৩. বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করতে হবে এবং অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
৪. অহংকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে বেঁচে থাকতে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪৭-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, জাহান্নামীরা জাহান্নামের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে ও তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়বে। ছোটরা বড়দের সাথে বাক-বিতণ্ডা করবে। অর্থাৎ অনুসারীরা যাদের অনুসরণ করতো এবং বড় বলে মানতো ও তাদের কথা মত চলতো তাদেরকে বলবেঃ “দুনিয়ায় আমরা তোমাদের অনুসারী ছিলাম। তোমরা আমাদেরকে যা করার আদেশ করতে আমরা তা পালন করতাম। তোমাদের কুফরী ও বিভ্রান্তিমূলক হুকুমও আমরা মেনে চলতাম। তোমাদের পবিত্রতা, জ্ঞান, মর্যাদা এবং নেতৃত্বের ভিত্তিতে আমরা সবই মানতাম। এখন এই ভয়াবহ অবস্থায় তোমরা আমাদের কোন উপকার করতে পারবে কি? এখন আমাদের শাস্তির কিছু অংশ তোমরা নিজেদের উপর উঠিয়ে নাও তো।” তাদের এ কথার জবাবে ঐ নেতারা বলবেঃ “আমরা নিজেরাও তো তোমাদের সাথে জ্বলতে পুড়তে রয়েছি। আমাদের উপর যে শাস্তি হচ্ছে তা কি কিছু কম? মোটেই কম বা হালকা নয়। সুতরাং কি করে আমরা তোমাদের শাস্তির কিছু অংশ আমাদের উপর উঠাতে পারি। নিশ্চয়ই আল্লাহ তো বান্দাদের বিচার করে ফেলেছেন। প্রত্যেককেই তিনি তার অসৎ আমল অনুযায়ী শাস্তি দিয়েছেন। এটা কম করা সম্ভব নয়।” যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি বলবেনঃ প্রত্যেকের জন্যে দ্বিগুণ (শাস্তি), কিন্তু তোমরা জান না।’ (৭:৩৮)
মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “জাহান্নামীরা ওর প্রহরীদেরকে বলবেঃ তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা কর, তিনি যেন আমাদের হতে লাঘব করেন শাস্তি এক দিনের। অর্থাৎ জাহান্নামীরা যখন বুঝে নিবে যে, আল্লাহ তা’আলা তাদের দু’আ কবুল করবেন না, বরং তিনি তাদের কথার দিকে কানও দেন না। এমনকি তাদেরকে ধমকের সুরে বলে দিয়েছেনঃ “তোমরা এখানেই পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কথা বলো না, তখন তারা জাহান্নামের প্রহরীদেরকে বলবে, যারা দুনিয়ার জেলখানার রক্ষক ও প্রহরীর মত জাহান্নামের প্রহরী হিসেবে রয়েছেনঃ ‘তোমরাই আমাদের জন্যে আল্লাহ তা’আলার নিকট একটু প্রার্থনা কর যে, তিনি যেন এক দিনের জন্যে হলেও আমাদের শাস্তি লাঘব করেন। তারা উত্তরে বলবেনঃ “তোমাদের নিকট কি স্পষ্ট নিদর্শনসহ তোমাদের রাসূলগণ আগমন করেননি?’ তারা জবাবে বলবেঃ ‘হ্যা, আমাদের নিকট রাসূলদের (আঃ) আগমন ঘটেছিল বটে।’ তখন ফেরেশতাগণ বলবেনঃ তাহলে তোমরা নিজেরাই আল্লাহ তা’আলার নিকট দু’আ কর। আমরা তোমাদের পক্ষ হতে তার কাছে কোনই আবেদন করতে পারবো না। বরং আমরা নিজেরাও আজ তোমাদের হা-হুতাশের প্রতি কোনই দৃকপাত করবো না। আমরা নিজেরাও তো। তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট রয়েছি। আমরা আজ তোমাদের শত্রু। আমরা তোমাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছি যে, তোমরা হয় নিজেরাই দু’আ কর অথবা অন্য কেউ তোমাদের জন্যে দু’আ করুক, তোমাদের শাস্তি হালকা হওয়া অসম্ভব। কাফিরদের প্রার্থনা প্রত্যাখ্যাত ও ব্যর্থই হয়ে থাকে।
৫১-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে রাসূলদেরকে (আঃ) সাহায্য করার ওয়াদা রয়েছে। আমরা দেখি যে, কতক নবী (আঃ)-কে তাঁদের সম্প্রদায়ের লোকেরা হত্যা করে দিয়েছে। যেমন হযরত ইয়াহইয়া (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ) এবং হযরত শা’ইয়া (আঃ)। আর কোন কোন নবী (আঃ)-কে হিজরত করতে হয়েছে। যেমন হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ)। আল্লাহ তাআলা হযরত ঈসা (আঃ)-কে আসমানে হিজরত করান। এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, দুনিয়ায় যে আল্লাহ তা’আলা স্বীয় নবীদেরকে সাহায্য করার ওয়াদা করেছেন তা পূর্ণ হলো কিরূপে? এর দু’টি উত্তর রয়েছে। একটি উত্তর এই যে, এখানে খবর আম বা সাধারণ হলেও এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কতক। আর অভিধানে এটা প্রায়ই দেখা যায়। আর দ্বিতীয় উত্তর এই যে, এখানে সাহায্য করা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো প্রতিশোধ গ্রহণ করা। দেখা যায় যে, এমন কোন নবী গত হননি যাঁকে কষ্টদাতাদের উপর চরমভাবে আল্লাহ্ তা’আলা প্রতিশোধ গ্রহণ না করেছেন। যেমন হযরত ইয়াহইয়া (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ) এবং হযরত শা’ইয়া (আঃ)-এর হন্তাদের উপর তাদের শত্রুদেরকে বিজয় দান করেছেন, যারা তাদেরকে হত্যা করে রক্তের স্রোত বহিয়ে দিয়েছে এবং তাদেরকে অত্যন্ত লাঞ্ছিত অবস্থায় মৃত্যুর ঘাটে নামিয়ে দিয়েছে। বিশ্বাসঘাতক নমরূদকে আল্লাহ্ তা’আলা কিভাবে পাকড়াও করেছিলেন এবং সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তা সর্বজন বিদিত। হযরত ঈসা (আঃ)-কে যে ইয়াহুদীরা শূলবিদ্ধ করার চেষ্টা। করেছিল তাদের উপর আল্লাহ্ তা’আলা রোমকদেরকে বিজয়ী করেছিলেন। তাদের হাতে ঐ ইয়াহূদীরা খুবই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। কিয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে যখন হযরত ঈসা (আঃ) দুনিয়ায় অবতরণ করবেন তখন তিনি দাজ্জালসহ ঐ ইয়াহুদীদেরকেও মেরে ফেলবেন যারা তার সেনাবাহিনীর লোক হবে। তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে তশরীফ আনবেন। তিনি ক্রুশকে ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকরকে হত্যা করবেন, জিযিয়াকে বাতিল করবেন এবং ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কিছুই ককূল করবেন না। এটাই হলো আল্লাহর বিরাট সাহায্য। এটাই হলো আল্লাহর রীতি, যা পূর্ব হতেই আছে এবং এখনো চালু রয়েছে যে, তিনি স্বীয় মুমিন বান্দাদেরকে পার্থিব সাহায্যও করে থাকেন এবং তিনি স্বয়ং তাদের শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করে তাদের চক্ষু ঠাণ্ডা করে থাকেন।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ “যে ব্যক্তি আমার বন্ধুদের সাথে শত্রুতা করে সে আমার সাথে যুদ্ধের জন্যে বের হয়ে থাকে। (সে যেন তার সাথে যুদ্ধের জন্য আল্লাহ তা’আলাকে তলব করে)।” অন্য হাদীসে রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “আমি আমার বন্ধুদের পক্ষ হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকি যেমন প্রতিশোধ গ্রহণ করে সিংহ।” এজন্যেই মহামহিমান্বিত আল্লাহ হযরত নূহ (আঃ)-এর কওম, আ’দ, সামূদ, আসহাবুর রাসস, হযরত লূত (আঃ)-এর কওম, আহলে মাদইয়ান এবং তাদের ন্যায় ঐ সমুদয় লোক হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছেন যারা রাসূলদেরকে (আঃ) অবিশ্বাস করেছিল এবং সত্যের বিরোধী হয়েছিল। এক এক করে বেছে বেছে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আর তাদের মধ্যে যারা মুমিন ছিল তাদেরকে তিনি রক্ষা করেছেন। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে)
ইমাম সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, যে কওমের মধ্যে আল্লাহর রাসূল এসেছেন অথবা মুমিন বান্দা তাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্যে দাঁড়িয়েছেন, অতঃপর ঐ কওম ঐ নবী বা মুমিনদের অসম্মান করেছে, তাদেরকে মারপিট করেছে বা হত্যা করেছে, তাদের উপর অবশ্যই ঐ যুগেই আল্লাহর শাস্তি আপতিত হয়েছে। নবীদের (আঃ) হন্তাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণকারীরা উঠে দাঁড়িয়েছে এবং পানির মত তাদের রক্ত দ্বারা তৃষ্ণার্ত ভূমিকে সিক্ত করেছে। সুতরাং এখানে যদিও নবীরা (আঃ) ও মুমিনরা নিহত হয়েছেন, কিন্তু তাদের রক্ত বৃথা যায়নি। তাদের শত্রুদেরকে তুষের ন্যায় উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এরূপ বিশিষ্ট বান্দাদের সাহায্য করা হবে না এটা অসম্ভব। তাদের শত্রুদের উপর পূর্ণমাত্রায় প্রতিশোধ গ্রহণ করা হয়েছে। নবীকূল শিরোমণি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর জীবনী দুনিয়াবাসীর সামনে রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে এবং তাঁর সহচরদেরকে বিজয় দান করেন, তাঁর কালেমা সুউচ্চ করেন এবং তাঁর শত্রুদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। তাঁর দ্বীন দুনিয়ার সমস্ত দ্বীনের উপর ছেয়ে যায়। যখন তাঁর কওম চরমভাবে তাঁর বিরোধিতা শুরু করে তখন মহান আল্লাহ তাঁকে মদীনায় পৌঁছিয়ে দেন এবং মদীনাবাসীকে তাঁর পরম ভক্ত বানিয়ে দেন। মদীনাবাসী তাঁর জন্যে জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত হয়ে যান। অতঃপর বদরের যুদ্ধে মুশরিকদের সমস্ত শক্তি শেষ হয়ে যায়। তাদের বহু নেতৃস্থানীয় লোক এ যুদ্ধে নিহত হয় এবং অনেকে মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। এভাবে তারা চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়। পরম দয়ালু আল্লাহ তাদের উপর ইহসান করেন এবং তাদের নিকট হতে মুক্তিপণ নিয়ে তাদেরকে মুক্ত করে দেয়া হয়। এভাবে তাদেরকে আল্লাহর পথে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু এর পরেও যখন তারা অন্যায় হতে বিরত হলো না, বরং পূর্বের দুষ্কর্মকেই আঁকড়ে ধরে থাকলো তখন এমন এক সময় এসে গেল যে, যেখান হতে নবী (সঃ)-কে রাত্রির অন্ধকারে চুপে চুপে পদব্রজে হিজরত করতে হয়েছিল, সেখানে তিনি বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন এবং অত্যন্ত অসহায় ও নিরুপায় অবস্থায় তার শত্রুদেরকে তাঁর সামনে হাযির করা হলো। হারাম শহরের ইযযত ও হুরমত মহান রাসূল (সঃ)-এর কারণে পূর্ণভাবে রক্ষিত হলো। সমস্ত শিরক ও কুফরী এবং সর্বপ্রকারের বে-আদবী হতে আল্লাহর ঘরকে পবিত্র করা হলো। অবশেষে ইয়ামনও বিজিত হলো এবং সারা আরব উপদ্বীপের উপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো। অতঃপর জনগণ দলে দলে এসে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে শুরু করলো। পরিশেষে মহান রাব্বল আলামীন স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে নিজের কাছে ডেকে নিলেন এবং তথায় তাঁকে স্বীয় সম্মানিত অতিথি হিসেবে গ্রহণ করলেন। তারপর তার সকর্মশীল সাহাবীদেরকে (সঃ) তার স্থলাভিষিক্ত করলেন, যারা মুহাম্মাদ (সঃ) ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আল্লাহর মাখলুককে তাঁর একত্ববাদের দিকে ডাকতে লাগলেন। তাঁরা পথের বাধাকে অতিক্রম করলেন এবং ইসলামরূপ বাগানের কাটাকে কেটে সাফ করলেন। এভাবে তারা গ্রামে গ্রামে এবং শহরে শহরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিলেন। এ পথে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলো তাদেরকে তারা এর স্বাদ চাখিয়ে দিলেন। এরূপে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে ইসলামী সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করলো।
সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) শুধু যমীনের উপর এবং যমীনবাসীর দেহের উপরই বিজয় লাভ করেননি, বরং তাদের অন্তরকেও জয় করে নেন। তারা তাদের অন্তরে ইসলামের চিত্র অংকিত করে দেন এবং সকলকে কালেমায়ে তাওহীদের পতাকা তলে একত্রিত করেন। দ্বীনে মুহাম্মাদ (সঃ) ভূ-পৃষ্ঠের প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছে যায় এবং এভাবে সব জায়গাই ওর দখলে এসে পড়ে। দাওয়াতে মুহাম্মাদ (সঃ) বধির কর্ণেও পৌঁছে যায়, সিরাতে মুহাম্মাদী (সঃ) তারাও দেখে নেয়।
সমুদয় প্রশংসা মহান আল্লাহর প্রাপ্য যে, আজ পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন জয়যুক্তই হয়েছে। এখন পর্যন্ত মুসলমানদের হাতে হুকুমত ও শাসন ক্ষমতা বিদ্যমান রয়েছে। আজ পর্যন্ত তাদের হাতে আল্লাহর এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর কালাম মওজুদ আছে। এখনও তাদের মাথার উপর আল্লাহর হাত রয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত এই দ্বীন জয়যুক্ত ও সাহায্য প্রাপ্তই থাকবে। যে এর মুকাবিলায় আসবে তার মুখে চুনকালি পড়বে এবং আর কখনো সে মুখ দেখাতে পারবে না। এই পবিত্র আয়াতের ভাবার্থ এটাই। কিয়ামতের দিনেও দ্বীনদারদের সাহায্য করা হবে এবং ঐ সাহায্য হবে খুব উচ্চ পর্যায়ের। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, সাক্ষী দ্বারা ফেরেশতাদেরকে বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহ তাআলার (আরবী)-এই উক্তিটি তার (আরবী)-এ উক্তি হতে (আরবী) হয়েছে। অন্যেরা পড়েছেন (আরবী) তখন এটা যেন পূর্বের -এর তাফসীর। এখানে যালিমদের দ্বারা মুশরিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। কিয়ামতের দিন তাদের কোন ওযর-আপত্তি ও মুক্তিপণ গৃহীত হবে না। সেদিন তাদেরকে আল্লাহর রহমত হতে দূর করে দেয়া হবে। তাদের জন্যে হবে নিকৃষ্ট আবাস অর্থাৎ জাহান্নাম। তাদের পরিণাম হবে মন্দ।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি অবশ্যই মূসা (আঃ)-কে দান করেছিলাম পথ-নির্দেশ এবং বানী ইসরাঈলকে উত্তরাধিকারী করেছিলাম সেই কিতাবের।’ অর্থাৎ তাদেরকে ফিরাউনের ধন-দৌলত ও ভূমির ওয়ারিশ বানিয়েছিলাম। কেননা তারা আল্লাহ ও তার রাসূল (আঃ)-এর আনুগত্যে স্থির থেকে কষ্ট ও বিপদাপদ সহ্য করেছিল। যে কিতাবের তাদেরকে ওয়ারিশ করা হয়েছিল তা ছিল বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্যে পথ-নির্দেশ ও উপদেশ স্বরূপ।
মহান আল্লাহ বলেনঃ সুতরাং হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি ধৈর্য ধারণ কর; আল্লাহর ওয়াদা সত্য। তোমারই পরিণাম ভাল হবে, আর তোমরাই হবে বিজয়ী। তোমার প্রতিপালক আল্লাহ কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর দ্বীন সমুচ্চ থাকবে। তুমি তোমার ত্রুটির জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তাকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দ্বারা প্রকৃতপক্ষে তাঁর উম্মতকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। রাত্রির শেষাংশে, দিনের প্রথমভাগে এবং দিনের শেষাংশে বিশেষভাবে মহান আল্লাহর সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এরপর আল্লাহ পাক বলেনঃ যারা নিজেদের নিকট কোন দলীল না থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়, আল্লাহর কালামের কোন মর্যাদা দেয় না, তাদের অন্তরে আছে শুধু অহংকার, কিন্তু যে বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ মর্যাদা তারা কামনা করে তা কখনো সফল হবার নয়। ওটা তারা কখনো লাভ করতে পারবে না। অতএব আল্লাহর শরণাপন্ন হও; আল্লাহ তো সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
এই আয়াত ইয়াহূদীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। তারা বলতো যে, দাজ্জাল তাদের মধ্য হতেই হবে, যে তার যামানায় যমীনের বাদশাহ হবে। তাই মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলেনঃ ‘দাজ্জালের ফিত্না হতে তুমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।” (হযরত কা’ব (রঃ) ও হযরত আবুল আলিয়া (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ আয়াত
ইয়াহূদীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বলা, দাজ্জালের বাদশাহী এবং তার ফিত্র থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনার হুকুম ইত্যাদি কথাগুলো লৌকিকতায় ভরপুর। এটা স্বীকার্য যে, তাফসীরে ইবনে হাতিমে এটা রয়েছে। কিন্তু এটা খুবই দুর্বল উক্তি। সঠিক কথা এটাই যে, এটা সাধারণ। এসব ব্যাপারে আল্লাহ পাকই সবচেয়ে ভাল জানেন)