أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯০)
[ * *বিশাল সৃষ্টিজগতে মানুষের অবস্থান, *কোনাে সুস্থ মানুষ আল্লাহর গােলামী না করে পারে না : -]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
৫৭-৭৬ নং আয়াত:-
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫৭
لَخَلۡقُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ اَکۡبَرُ مِنۡ خَلۡقِ النَّاسِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۵۷﴾
মানব সৃষ্টি অপেক্ষা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি তো কঠিনতর, কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫৮
وَ مَا یَسۡتَوِی الۡاَعۡمٰی وَ الۡبَصِیۡرُ ۬ۙ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ لَا الۡمُسِیۡٓءُ ؕ قَلِیۡلًا مَّا تَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿۵۸﴾
অন্ধ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী এক রকম হতে পারে না এবং ঈমানদার ও সৎকর্মশীল এবং দুষ্কৃতিকারী সমান হতে পারে না, কিন্তু তোমরা কমই বুঝতে পারো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৫৯
اِنَّ السَّاعَۃَ لَاٰتِیَۃٌ لَّا رَیۡبَ فِیۡہَا وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۵۹﴾
নিশ্চয় কিয়ামত অবশ্যম্ভাবী, এতে কোন সন্দেহ নেই; কিন্তু অধিকাংশ লোক ঈমান আনে না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬০
وَ قَالَ رَبُّکُمُ ادۡعُوۡنِیۡۤ اَسۡتَجِبۡ لَکُمۡ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَسۡتَکۡبِرُوۡنَ عَنۡ عِبَادَتِیۡ سَیَدۡخُلُوۡنَ جَہَنَّمَ دٰخِرِیۡنَ ﴿٪۶۰﴾
তোমাদের রব বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। নিশ্চয় যারা অহংকারবশে আমার ‘ইবাদাত থেকে বিমুখ থাকে, তারা অচিরেই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে ।’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬১
اَللّٰہُ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الَّیۡلَ لِتَسۡکُنُوۡا فِیۡہِ وَ النَّہَارَ مُبۡصِرًا ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی النَّاسِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَشۡکُرُوۡنَ ﴿۶۱﴾
আল্লাহই তো সেই মহান সত্তা যিনি তোমাদের জন্য রাত সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা রাতের বেলা আরাম করতে পারো। আর দিনকে আলোকিত করেছেন। সত্য এই যে, আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুকম্পাশীল। তবে অধিকাংশ লোক শুকরিয়া আদায় করে না।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬২
ذٰلِکُمُ اللّٰہُ رَبُّکُمۡ خَالِقُ کُلِّ شَیۡءٍ ۘ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۫ۚ فَاَنّٰی تُؤۡفَکُوۡنَ ﴿۶۲﴾
তিনিই তো আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক, সব কিছুর স্রষ্টা, তিনি ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই, সুতরাং তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছ?
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬৩
کَذٰلِکَ یُؤۡفَکُ الَّذِیۡنَ کَانُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ یَجۡحَدُوۡنَ ﴿۶۳﴾
এভাবেই সেসব লোককে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করতো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬৪
اَللّٰہُ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ قَرَارًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً وَّ صَوَّرَکُمۡ فَاَحۡسَنَ صُوَرَکُمۡ وَ رَزَقَکُمۡ مِّنَ الطَّیِّبٰتِ ؕ ذٰلِکُمُ اللّٰہُ رَبُّکُمۡ ۚۖ فَتَبٰرَکَ اللّٰہُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۶۴﴾
আল্লাহ্, যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে স্থিতিশীল করেছেন এবং আসমানকে করেছেন ছাদ এবং তিনি তোমাদের আকৃতি দিয়েছেন অতঃপর তোমাদের আকৃতিকে করেছেন সুন্দর এবং তোমাদেরকে রিযিক দান করেছেন পবিত্ৰ বস্তু থেকে। তিনিই আল্লাহ্ তোমাদের রব। সুতরাং সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহ্ কত বরকতময়!
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬৫
ہُوَ الۡحَیُّ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ فَادۡعُوۡہُ مُخۡلِصِیۡنَ لَہُ الدِّیۡنَ ؕ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۶۵﴾
তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। তোমাদের দ্বীন তাঁর জন্য নিবেদিত করে তাঁকেই ডাকো। গোটা সৃষ্টি জগতের রব আল্লাহর জন্যই সব প্রশংসা।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬৬
قُلۡ اِنِّیۡ نُہِیۡتُ اَنۡ اَعۡبُدَ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ لَمَّا جَآءَنِیَ الۡبَیِّنٰتُ مِنۡ رَّبِّیۡ ۫ وَ اُمِرۡتُ اَنۡ اُسۡلِمَ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۶۶﴾
বল, ‘আমার প্রতিপালকের নিকট হতে আমার নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী আসার পর তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাকে আহবান কর, তার উপাসনা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। আর আমাকে আদেশ করা হয়েছে বিশ্ব-প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করতে।’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬৭
ہُوَ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ثُمَّ مِنۡ عَلَقَۃٍ ثُمَّ یُخۡرِجُکُمۡ طِفۡلًا ثُمَّ لِتَبۡلُغُوۡۤا اَشُدَّکُمۡ ثُمَّ لِتَکُوۡنُوۡا شُیُوۡخًا ۚ وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّتَوَفّٰی مِنۡ قَبۡلُ وَ لِتَبۡلُغُوۡۤا اَجَلًا مُّسَمًّی وَّ لَعَلَّکُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿۶۷﴾
তিনিই তো সে সত্তা যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর শুক্র থেকে। তারপর রক্তের পিণ্ড থেকে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে শিশুর আকৃতিতে বের করে আনেন। এরপর তিনি তোমাদেরকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করেন যাতে তোমরা নিজেদের পূর্ণ শক্তিতে উপনীত হতে পারো। তারপর আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত করেন যাতে তোমরা বৃদ্ধাবস্থায় উপনীত হও। তোমাদের কাউকে আগেই ফিরিয়ে নেয়া হয়। এসব কাজ করা হয় এজন্য যাতে তোমরা তোমাদের নির্ধারিত সময়ের সীমায় পৌঁছতে পারো এবং যাতে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে পারো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬৮
ہُوَ الَّذِیۡ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۚ فَاِذَا قَضٰۤی اَمۡرًا فَاِنَّمَا یَقُوۡلُ لَہٗ کُنۡ فَیَکُوۡنُ ﴿٪۶۸﴾
তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান এবং যখন তিনি কিছু করা স্থির করেন তখন তিনি তার জন্য বলেন ‘হও’, ফলে তা হয়ে যায়।’
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৬৯
اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ یُجَادِلُوۡنَ فِیۡۤ اٰیٰتِ اللّٰہِ ؕ اَنّٰی یُصۡرَفُوۡنَ ﴿ۖۛۚ۶۹﴾
তুমি কি ওদের লক্ষ্য কর না, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে বিতর্ক করে? ওরা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭০
الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِالۡکِتٰبِ وَ بِمَاۤ اَرۡسَلۡنَا بِہٖ رُسُلَنَا ۟ۛ فَسَوۡفَ یَعۡلَمُوۡنَ ﴿ۙ۷۰﴾
যারা এ কিতাবকে অস্বীকার করে এবং আমি আমার রসূলদের যা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম তাও অস্বীকার করে? এসব লোক অচিরেই জানতে পারবে,
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭১
اِذِ الۡاَغۡلٰلُ فِیۡۤ اَعۡنَاقِہِمۡ وَ السَّلٰسِلُ ؕ یُسۡحَبُوۡنَ ﴿ۙ۷۱﴾
যখন ওদের গলদেশে বেড়ি ও শিকল থাকবে, ওদেরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে,
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭২
فِی الۡحَمِیۡمِ ۬ۙ ثُمَّ فِی النَّارِ یُسۡجَرُوۡنَ ﴿ۚ۷۲﴾
ফুটন্ত পানির দিকে এবং দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭৩
ثُمَّ قِیۡلَ لَہُمۡ اَیۡنَ مَا کُنۡتُمۡ تُشۡرِکُوۡنَ ﴿ۙ۷۳﴾
পরে ওদেরকে বলা হবে, ‘কোথায় তারা, যাদেরকে তোমরা শরীক করতে–
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭৪
مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ ؕ قَالُوۡا ضَلُّوۡا عَنَّا بَلۡ لَّمۡ نَکُنۡ نَّدۡعُوۡا مِنۡ قَبۡلُ شَیۡئًا ؕ کَذٰلِکَ یُضِلُّ اللّٰہُ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۷۴﴾
আল্লাহকে বাদ দিয়ে ? তারা জবাব দেবে, তারা আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। এর আগে আমরা যাদেরকে ডাকতাম তারা কিছুই না। আল্লাহ এভাবে কাফেরদের ভ্রষ্টতাকে কার্যকর করে দেবেন।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭৫
ذٰلِکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَفۡرَحُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ بِغَیۡرِ الۡحَقِّ وَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَمۡرَحُوۡنَ ﴿ۚ۷۵﴾
তাদের বলা হবে, তোমাদের এ পরিণতির কারণ হচ্ছে, তোমরা পৃথিবীতে অসত্য নিয়ে মেতে ছিলে এবং সেজন্য গর্ব প্রকাশ করতে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭৬
اُدۡخُلُوۡۤا اَبۡوَابَ جَہَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ۚ فَبِئۡسَ مَثۡوَی الۡمُتَکَبِّرِیۡنَ ﴿۷۶﴾
ওদেরকে বলা হবে, ‘জাহান্নামে চিরকাল বসবাসের জন্য ওতে প্রবেশ কর, কত নিকৃষ্ট উদ্ধতদের আবাসস্থল।’
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*বিশাল সৃষ্টিজগতে মানুষের অবস্থান : পরবর্তী আয়াতে দৃশ্যমান জগতের তুলনায় মানুষের অস্তিত্বের নগ্নতা ও তুচ্ছতার ব্যাপারটি তুলে ধরা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, মানুষের সৃষ্টি অপেক্ষা আসমান ও যমীনের সৃষ্টি কঠিনতর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বােঝে।'(আয়াত ৫৭) আসমান ও যমীন মানুষের দৃষ্টির সামনেই উক্ত রয়েছে। তারা সচক্ষে এ দুটোকে দেখছে। এ দুটোর তুলনায় তাদের অস্তিত্ব কতটুকু তা সহজেই তারা অনুমান করতে পারে। কিন্তু মানুষ যখন তার সৃষ্টির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত হয়, তার আকার ও মাপ সম্পর্কে অবগত হয় এবং তার শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে অবগত হয় তখন তার অহংকার নিমিষে উবে যায়, নিজেকে সে অত্যন্ত তুচ্ছ ও নগন্য মনে করতে থাকে, এমনকি নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে করতে থাকে। আর যখন সে তার অন্তর্নিহিত সেই উচ্চমার্গীয় উপাদানের কথা ভাবে যার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী বলে ভূষিত করেছেন তখন একমাত্র সেই উপাদানটির বদৌলতেই সে নিজেকে এই বিশাল ও মহাজগতের সামনে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। বলা নিম্প্রয়ােজন যে, মানুষের এই উপলব্ধি আসমান ও যমীনের দিকে ক্ষণিকের জন্যে তাকালেই লাভ হয়। এই যে, পৃথিবীর ওপর আমরা বাস করছি তা সৌরমন্ডলের প্রায় ত্রিশ লক্ষ গ্রহের মাঝে ছােট্ট একটা গ্রহ। এই পৃথিবীর আকৃতি সূর্যের আকৃতির তুলনায় দশ লক্ষ ভাগের এ ভাগের চেয়েও কম। আর সূর্যের সংখ্যা কত? সূর্যের সংখ্যা হচ্ছে দশ কোটি। আর সেটাও কেবল আমাদের সবচেয়ে নিকটতম ছায়াপথের সূর্যের সংখ্যা। এ পর্যন্ত মানুষ প্রায় দশ কোটি ছায়াপথের সন্ধান পেয়েছে যা এই মহাশূন্যে বিক্ষিপ্ত আকারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা চিন্তা করলে অবশ্যই বিষয়টি বুঝতে পারতাম; কেননা বিষয়টা সুস্পষ্ট এবং বেশ তাড়াতাড়িই তা বুঝা যায়। এ বিষয়ে নিজে বুঝা এবং অপরকে বুঝানাে থেকে বেশী আর কিছু করার প্রয়ােজন নেই। এরপর যদি আমরা আখেরাত সম্পর্কে চিন্তা করতাম এবং আখেরাতের যিন্দেগী যে আসবেই একথা বিশ্বাস করতে পারতাম, বুঝতে পারতাম সেখানে আমাদের অবস্থা কী হবে এবং সে সময়ে অনুষ্ঠিতব্য দৃশ্যাবলীকে আমাদের নযরের সামনে টেনে আনতে পারতাম, তাহলে কতােই না ভালাে হতাে। এরশাদ হচ্ছে, অবশ্যই কেয়ামত সংঘটিত হবে, এর মধ্যে কোনাে সন্দেহ নেই, তবু অধিকাংশ মানুষ (এ বিষয়ে) বিশ্বাস করে না। অর্থাৎ, বিশ্বাস তাে করেই না, বরং এ বিষয়ে তারা তর্ক-বিতর্ক করে এবং নিজের বড়ত্বকে ফুটিয়ে তুলতে চায়, যার কারণে তারা সত্যের সামনে মাথা নত করতে পারে না। তারা তাদের প্রকৃত অবস্থাটাও বুঝতে পারে না, জানে না যে তারা সে অবস্থাটাকে কোনােভাবেই এড়িয়ে যেতে পারবে না। এবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর দিকে এগিয়ে যাওয়া, তাঁর কাছে প্রার্থনা,করা এবং বিনয়াবনত হয়ে তার দরবারে কাকুতি মিনতি করতে থাকা, এই সব প্রক্রিয়া অন্তরের গভীরে অবস্থিত সেই অহংকারকে দূর করতে সাহায্য করে, যার কারণে মানুষ আস্তে আস্তে ফুলতে থাকে এবং অকারণে ও যুক্তিহীনভাবে আল্লাহর আয়াতগুলােকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস করে। অথচ আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের জন্যে তাঁর মেহেরবাণীর দরজা সদা-সর্বদা অবারিত রেখেছেন, যেন আমরা তার দিকে রুজু করি ও কায়মনােবাক্যে তার কাছে প্রার্থনা করি। আলােচ্য আয়াতে বিশ্বজগতের প্রতিপালক রহমানুর রহীম আল্লাহ তায়ালা পরিস্কার ঘােষণা দিয়েছেন যে, যে কোনাে ব্যক্তি তাকে মনপ্রাণ দিয়ে ডাকবে, তিনি তারই দোয়া কবুল করবেন, সাথে সাথে তিনি তাদেরকে সতর্কও করছেন, যারা নিজেদের বড়ত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে তার কাছে মাথা নত করতে প্রস্তুত নয়। তার আনুগত্য করা থেকে এরা দূরে থাকছে, আর এই কারণেই দোযখের আগুন এবং হীনতা ও অপমান তাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমাদের রব বলছেন তােমরা ডাকো আমাকে, আমি তােমাদের ডাকের জবাব দেবাে। ‘অবশ্যই যে সব মানুষ অহংকারবশত আমার এবাদাত থেকে দূরে থাকবে, শীঘ্রই তারা সমবেতভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করার জন্যে কিছু আদব-কায়দা (বা নিয়ম শৃংখলা) রয়েছে যা পালন করা প্রয়ােজন, আর তা হচ্ছে অন্তরের ঐকান্তিকতা বা কায়মনােবাক্যে প্রার্থনা করা। কখন কোন দোয়া কিভাবে কবুল করা হবে সে বিষয়ে কোনাে চিন্তা না করে অবশ্যই দোয়া কবুল হবে বলে গভীর আস্থা পােষণ করতে থাকা। কারণ এইভাবে আমার দোয়া কবুল করতে হবে বলে পরামর্শ দেয়া অবশ্যই আদবের খেলাফ। এ বিশ্বাস করতে হবে যে, মহান রব্বুল আলামীনের কাছে চাইবার জন্যে মনের মধ্যে ইচ্ছা পয়দা হওয়া এটা তারই মেহেরবানী, তারপর দোয়া কবুল হওয়া এটাও তারই আর এক রহমত। হযরত ওমর(রা.) বলতেন, ‘দোয়া করার সময়ে আমার মনের মধ্যে কবুল হবে কি না হবে এ চিন্তা জাগে না, বরং দোয়া আমার করা দরকার এ চিন্তাটাই আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে তারপর যখন দেখি আমার অন্তরের মধ্য থেকে আমার অজান্তেই দোয়া বেরিয়ে আসছে, তখনই আমি বুঝি অবশ্যই আমার দোয়া কবুল হবে। আসলে এটাই হচ্ছে সেই সচেতন মনের উপলব্ধি যে মন অনুভব করে যে, মহান আল্লাহ যখন দোয়া কবুল করতে চাইবেন, তখনই তিনি দোয়া করার তাওফীক দান করবেন। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে, দোয়া চাওয়ার মনােবৃত্তির সাথে দোয়া কবুল হওয়ার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। এখন যেসব মানুষ তাকাব্বুরির কারণে দোয়া করতেই নারায তাদের প্রতিদান হচ্ছে তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত অবস্থায় জাহান্নামের দিকে এগিয়ে দেয়া, আর এটাই সেই অহংকারের পরিণাম যা তাদেরকে এই ছােট্ট ও অতি তুচ্ছ পৃথিবীর বুকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে রাখে। এ নশ্বর জীবনে তাদের অন্তরগুলােকে সত্য গ্রহণ করার জন্যে অযােগ্য বানিয়ে দেয়, তাকে আল্লাহর সৃষ্ট এ মহাবিশ্বের বিশালত্বকে ভুলিয়ে দেয়। এ অবস্থায় প্রশ্নই আসে না যে, এসব ব্যক্তি আল্লাহর মহানত্ব ও মর্যাদা এবং আখিরাতের চেতনা প্রাপ্ত হবে। তাদের আমিত্ব তাদেরকে একথাও ভুলিয়ে রাখে যে, এভাবে অহংকারের ফলে তাদেরকে চরম লাঞ্চনা ও গঞ্জনা ভােগ করতে হবে। অহংকারের কারণে মানুষ আল্লাহর এবাদাত থেকে দূরে থাকে।
*কোনাে সুস্থ মানুষ আল্লাহর গােলামী না করে পারে না : আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা এ পর্যায়ে তার বেশ কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। এসব নেয়ামত আমাদেরকে মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের শ্রেষ্ঠত্বের কথা জানায়। তার সেই সব মেহেরবানীর কথা জানায়, যেসবের জন্যে অকৃতজ্ঞ মানুষ মহান মাবুদের প্রতি কোনাে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, বরং তার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করার ব্যাপারে অহংকার প্রদর্শন করে এবং অহংকারের কারণে তার দিকে রুজু করতে চায় না। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা সেই মহান সত্ত্বা, সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক’(আয়াত ৬১-৬৫) সৃষ্টিজগতের মধ্যে রাত ও দিন এ দুটি এমন প্রকাশ্য প্রাকৃতিক অবস্থা, যা সবার চোখে সকল সময়েই ডাকছে। যমীন ও আসমানও একইভাবে দৃশ্যমান আরাে দুটি সৃষ্টি। এ দুটি সৃষ্টি মানুষের জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও দয়ার যেন বাস্তব এক ছবি। তাদের জন্যে এসবই পবিত্র রিযিক, যার দ্বারা মানুষের জীবন ধারণ করা সম্ভব হয়। এসব কিছুর মাধ্যমেই আল্লাহ রব্বুল আলামীন পৃথিবীতে মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাদের সকল প্রয়ােজন এ দুই-এর মধ্য থেকেই মেটানাের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই দুই-এর মধ্য থেকে প্রাপ্ত ব্তুসমূহ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে এসবের মালিক একমাত্র আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা। তিনিই সকল শক্তির আধার এবং বিশ্বের সকল ব্যবস্থা যেমন তার পরিচালনাধীন রয়েছে, তেমনি মানব জীবনের সকল বিধান তারই দান, যেহেতু সকলের সৃষ্টিকর্তা বিধায় তিনিই জানেন কার কী প্রয়ােজন, আর এটাও আমরা বুঝতে পারি যে, সৃষ্টির বুকে যেখানে যা কিছু আছে সব কিছু পরস্পর এক নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ এবং পারস্পরিক সম্পর্কের মাধ্যমে সবাই নিজ নিজ গন্তব্য পথে নিরন্তর এগিয়ে চলেছে। এ মহা-সৃষ্টির নির্মাণের ভিত্তি তাঁরই পূর্ব পরিকল্পিত এক ব্যবস্থামতে রচিত হয়েছে। তারপর তিনি এসব কিছুকে তারই কর্মসূচী অনুযায়ী পরিচালনা করেছেন যা তিনি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। তিনিই দয়া করে এই সৃষ্টি জগতকে বাস্তবে এনেছেন এবং একে মানুষের বাসোপযােগী করে ক্রমান্বয়ে এর উন্নতি বিধান করেছেন, যেমন করে তিনি মানব প্রকৃতি ও তার গঠন প্রক্রিয়াকে সকল দিক দিয়ে সুন্দর করে বানিয়েছেন। তাদেরকে সুকৌশলপূর্ণ ক্ষমতা দিয়েছেন, মানুষের সকল প্রয়ােজনকে পূর্ণ করেছেন এবং তাদের প্রয়ােজন মেটানাের জন্যে সকল ব্যবস্থা ও সাজ সরঞ্জাম তিনি পৃথিবীর বুকে আগেই দিয়ে দিয়েছেন। তিনিই বিশ্রাম গ্রহণ করার, ক্লান্তি হরনের জন্যে এবং শ্রান্ত ক্লান্ত দেহে পূর্ণ আরাম পাওয়ার জন্যে রাতকে বানিয়েছেন, আর দিনকে বানিয়েছেন সব কিছু দেখার জন্যে, অর্থাৎ এর আলােকে চলাফেরা ও প্রয়ােজনীয় সব কিছু দেখে শুনে ব্যবহার করার জন্যে এই সমুজ্জ্বল দিবসের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি পৃথিবীকে স্থির এবং জীবনের জন্য বানিয়েছেন। জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্যে এবং তাদেরকে সকল কাজের ব্যাপারে পারদর্শী করে তােলার উদ্দেশ্যে তিনি পৃথিবীকে সঠিকভাবে এর উপযােগী বানিয়েছেন, আকাশকে বানিয়েছেন সকল কিছুকে তার আওতার মধ্যে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে। ওদের মধ্যে কেউ কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকে না, আর কেউ কাউকে তিরস্কারও করে না। এর মধ্যে অবস্থিত কোনাে জিনিস নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে একটি থেকে আর একটি দূরে চলে যায় না বা সে নিয়ম লংঘন করে কেউ কারাে কাছাকাছিও এসে যায় না। যদিও এদের সবার সম্মিলিত কার্যক্রমের মাধ্যমে দুনিয়ার বুকে মানুষের অস্তিত্ব টিকে আছে, বরং আরাে বড় সত্য হচ্ছে সকলের সমন্বিত কর্মধারার কারণেই মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। তিনিই তো সেই মহান সত্ত্বা, যিনি আকাশের মধ্য থেকে আসা বৃষ্টি সিঞ্চিত পৃথিবীর মাটি থেকে গােটা সৃষ্টির জন্যে যাবতীয় প্রয়ােজন মেটানাের ব্যবস্থা করেছেন, ব্যবস্থা করেছেন মানুষের জন্যে পাকছাফ খাদ্য খাবার ও উপকারী অন্যান্য বস্তুসমূহ, অতপর মানুষকে দিয়েছেন শ্রবণ শক্তি তার আকৃতিকে এমন সুন্দর গঠন দিয়েছেন যার থেকে বেশী সুন্দর আর কিছু চিন্তাই করা যায় না। তাকে নানা প্রকার বৈশিষ্ট্য কাজে লাগাতে পারে। সুতরাং, এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, সৃষ্টির বুকে যা কিছু আছে তার প্রত্যেকটি পরস্পর এমন সুসামঞ্জস্যভাবে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে, যা একটু খেয়াল করলেই নযরে পড়ে। এসব বিষয়কে আল কোরআন এমন সুন্দরভাবে এই একটিমাত্র জায়গায় বর্ণনা করেছে যা আমাদের চিন্তা স্রোতের মধ্যে এক প্রচন্ড আলােড়ন সৃষ্টি করে। আমাদের সামনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অস্তিত্ব ও একত্ব সম্পর্কে এমন সব সুস্পষ্ট প্রমাণ হাযির করে দেয় যা গভীরভাবে আমাদের অন্তরে রেখাপাত করে। তখন পরিষ্কারভাবে আমরা বুঝতে পারি যে সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর কেউ নয়। এই অনুভূতির আলােকে যে দাওয়াত দেয়া হয় তা মানুষের ওপর সহজে প্রভাব বিস্তার করে এবং আমাদের মনে প্রত্যয় জাগায় যে, তার দেয়া জীবন ব্যবস্থাই একমাত্র ব্যবস্থা যা জীবনের সকল সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তখন তার অন্তরের মধ্য থেকে আওয়ায বেরিয়ে আসে, আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। সে সময়ে তার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মায় যে, যিনি এই সৃষ্টিকে চালাচ্ছেন এবং যিনি এসব কিছুকে অস্তিত্বে এনেছেন একমাত্র তিনিই সকল ক্ষমতার মালিক হতে পারেন তাকেই আমরা আল্লাহ তায়ালা বলে জানি এবং বুঝি, তিনিই বিশ্বজগতের প্রতিপালক। ভাবতে অবাক লাগে কেমন করে মানুষ এই সুস্পষ্ট সত্য থেকে দূরে থাকতে পারে? এখানে উল্লেখযােগ্য যে, মাঝে মাঝে একান্ত হঠাৎ করেই প্রকৃতির কিছু বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়ে যায়। তখন আমরা বুঝতে পারি যে প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবনের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ট। আল্লাহর কিতাবে সে বিশেষ মুহূর্তগুলাের দিকে কিছু অস্পষ্ট ইংগীত রয়েছে বলে বলা হয়। যেমন বলা হয়, যদি পৃথিবী সূর্যের সামনে দিয়ে চলার সময় তার মেরু রেখার ওপর আবর্তন না করত তাহলে রাত দিন কখনই পর্যায়ক্রমে এইভাবে আসতাে না। আরও বলা হয়, পৃথিবী মেরু রেখার চতুর্দিকে যে গতিতে এখন ঘুরছে যদি তার থেকে একটু বেশী দ্রুত গতিতে তা ঘুরতাে তাহলে অবশ্যই নভােমন্ডলের অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের ওপর তার প্রভাব পড়তো এবং গােটা পৃথিবীটাই এক সময় ভেংগে চুরমার হয়ে যেতাে, এর ফলে আকাশমন্ডলীর সব কিছুর মধ্যে এক চরম বিপর্যয় নেমে আসতাে। যদি মেরু রেখার ওপর পৃথিবী তার বর্তমান গতি থেকে অপেক্ষাকৃত কম গতিতে আবর্তন করতাে তাহলে কোনাে এক অঞ্চলে তাপমাত্রার আধিক্য এবং অন্য কোনাে অঞ্চলে অপেক্ষাকৃত তাপ হ্রাস হওয়ার ফলে সব মানুষ মরে সাফ হয়ে যেতাে। এখন যে গতিতে পৃথিবী নিজ মেরু রেখার ওপর আবর্তিত হচ্ছে, এর সাথে অন্যান্য গ্রহ উপগ্রহের সামঞ্জস্য রয়েছে এবং এর ফলে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে সবকিছুর সাথে পৃথিবী আবহমান কাল ধরে চলছে এবং এর পিঠের ওপর সকল প্রাণীজগৎ তাই আজও বেঁচে আছে। পৃথিবী যদি নিজ মেরু রেখার ওপর আবর্তন না করতাে তাহলে সাগর মহাসাগর সবই পানিশূন্য হয়ে যেতাে।’ যদি পৃথিবী তার মেরুদন্ডের ওপর স্থির হয়ে দাড়িয়ে যেতাে এবং তার অক্ষরেখার ওপর চলতে চলতে সূর্যের চতুর্দিকে এগিয়ে যেতাে, একবার পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে এ পৃথিবীটা ঘুরে না আসত তাহলে কী হতাে? সূর্যকে কেন্দ্র করে যদি কক্ষপথ চলতেই থাকতাে তাহলে মৌসুমের আর কখনও পরিবর্তন হতাে না, মানুষ জানতাে না গ্রীষ্ম কি, আর শীতই বা কি, বসন্ত কি, আর শরৎই বা কি! যদি পৃথিবী পৃষ্ঠে পুরুত্ব আট নয় কদম-এর কিছু বেশী হতাে তাহলে পৃথিবীর সমগ্র অক্সিজেনকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিতাে, আর সে অবস্থায় ভূ পৃষ্ঠের কোনাে গাছপালাই বেঁচে থাকতে পারতাে না। আবার যে পরিমাণ বায়ু পৃথিবীর বুকে রয়েছে, তার থেকে একটু বেশী পরিমাণে যদি বায়ু বেড়ে যেতাে তাহলে সামান্য কিছু সংখ্যক ছাড়া কোটি কোটি উল্কাপিন্ড পৃথিবীর বুকে পতিত হওয়ার পূর্বেই অক্সিজেনের স্তরের বাইরের বায়ু মন্ডলে তা জ্বলে শেষ হয়ে যেতাে। তার অনেকগুলােই সে অতিরিক্ত বায়ু দ্বারা তাড়িত হয়ে পৃথিবীতে আঘাত করতাে এবং এর ফলে পৃথিবী সকল উপাদান ধ্বংস হয়ে যেতাে। আলােকময় এসব উষ্কাপিন্ডের গতি হচ্ছে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল এবং এসব উষ্কা পিন্ডের আঘাতে সব কিছুই আগুনের অংগারে পরিণত হয়ে যেতাে। এমনকি যদি ধীরে ধীরেও সে উল্কাগুলাে আসত তাহলেও তা বন্দুকের গুলির গতিতে পৃথিবীতে আঘাত হানতাে, ফলে এখানে একটা ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হতাে। প্রকৃতপক্ষে সে উল্কাগুলাে পতিত হতাে বন্দুকের গুলী থেকেও কমপক্ষে নব্বই গুণ বেশী দ্রুত বেগে, যার ফলে সব কিছু টুকরাে টুকরাে হয়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতাে। অক্সিজেন যদি বাতাসের মধ্যে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ বা তার বেশী বা এর পরিবর্তে শতকরা একশ ভাগ হয়ে যেতাে, তাহলে বিশ্বের সব কিছু আগুনের অংগারে পরিণত হয়ে যেতাে। এই সব বিদ্যুতের অগ্নিস্ফুলিংগ কোনাে জংগলে পড়ার সাথে সাথে গােটা জংগলটাই আগুনে পরিণত হয়ে যেতাে। তাতে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটতাে। বাতাসের মধ্যে যদি অক্সিজেন শতকরা দশ ভাগে নেমে আসে অথবা আরাে কম হয়ে যায়, তাহলে মানুষ বাঁচতেই পারতাে না। কিন্তু এ অবস্থায় তা মানুষের জীবন থাকবে না, সেটা হবে প্রচন্ড একটা আগুনের চুল্লি।(ডক্টর আহমাদ যাকী রচিত ‘মায়াল্লাহি ফিসসামায়ি’ গ্রন্থ থেকে গৃহীত) বর্তমানে আল্লাহর ইচ্ছায় পৃথিবীতে যে অনুপাতে সব কিছুর উপাদান রয়েছে এবং তারা পারস্পরিক সহযােগিতার ভেতর দিয়ে টিকে আছে, এগুলাের মধ্যে সামান্যতম হেরফের হলেই যে কী বিপর্যয় নেমে আসবে তার কল্পনাও মানুষ করতে পারে না। এখন প্রশ্ন আসে, কেন এসব উপাদানের মধ্যে সামান্যতম হেরফেরও হচ্ছে না বা হেরফের হতে পারছে না। কে আছে সব কিছুর মূলে, যার অমােঘ শাসন চলছে এবং যার অভংগুর নিয়মের মধ্যে ব্যতিক্রম করার ক্ষমতা কারও নেই। লক্ষ্য করার বিষয় যে, মানুষের এই যে সুন্দর আকৃতি প্রকৃতি, চেহারা সূরত এবং তার অংগ প্রত্যংগের বিন্যাস, সামঞ্জস্যভাবে সব কিছুর মধ্যে একই নিয়মের আনুপাতিক বরাদ্দ, অসংখ্য কর্মকান্ডের জন্যে যোগ্য কর্মক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তার জন্য প্রত্যেকের শরীরকে সেইভাবে গড়ে তােলা হয়েছে। এসব কোনাে মহাশিল্পীর উদ্ভাবনা? আরও ভাবতে হয়, উপরােল্লেখিত গুণাবলীর সাথে সর্বোত্তম যে গুণটি যােগ হয়েছে তা হচ্ছে পৃথিবীর বুকে খেলাফত বা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব ও তার জন্যে প্রয়ােজনীয় যােগ্যতা। অভূতপূর্ব এ দায়িত্ব দানের সাথে সাথে তাকে যে সব বিশেষ গুণাবলী দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে, বুদ্ধি ও তার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শারীরিক গঠন ও অন্যান্য যােগ্যতার সাথে রূহ-এর এক পূর্ব সম্মিলন। আমরা আরও একটু গভীরভাবে সৃষ্টির এই সেরা সুন্দর মানুষ নামক প্রাণীটির দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাবাে, তার শরীরের অংগ-প্রত্যংগ ও তার জন্যে বরাদ্দকৃত বৃত্তির মধ্যে এক অকল্পনীয় সামঞ্জস্য রয়েছে, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষের জন্যেই তার স্রষ্টা বিশেষ বিশেষ পেশা বা বৃত্তি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার মধ্যে উক্ত বৃত্তি গ্রহণ করার মানসিকতা ও রুচিও সৃষ্টি করে দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তার পছন্দনীয় এই বৃত্তির জন্যে তাকে উপযুক্ত শারীরিক ও মানসিক যােগ্যতাও তিনি দান করেছেন। তার এ সব গুণাবলী সম্পর্কে এই আয়াতে উল্লেখ এসেছে, ‘তিনি তােমাদেরকে সুন্দর আকৃতি দিয়েছেন, অতপর অতি সুন্দর করে তিনি সে আকৃতিকে গড়ে দিয়েছেন।’ তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক এসব বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে আমরা অবশ্যই দেখতে পাবাে, প্রত্যেকেরই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংগগুলাের মধ্যে রয়েছে কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য একক এবং একের সাথে অন্যের কোনােই মিল নেই। মানুষের বিস্ময়কর এসব অংগ প্রত্যংগ ও যােগ্যতার একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ হচ্ছে তার চোয়ালে স্থাপিত দাতের পাটিগুলাে। এগুলােকে সম্পূর্ণ এক যান্ত্রিক নিয়মে সংস্থাপন করা হয়েছে। এই চোয়ালের কাজটি বড়ই সূক্ষ্ম, কারণ এই চোয়ালের মধ্যে স্থাপিত মাড়ির দাঁতগুলাে সংস্থাপন করা হয়েছে মাড়ির মাংসের মধ্যে- যা রয়েছে দশ মিলিমিটার গভীরে, যার ওপর ওপরের মাড়ির দাঁত ও জিহ্বা মুদু চাপ দেয় এবং পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে খাদ্য দ্রব্যকে দ্রবীভূত করে পেটের মধ্যে পাঠিয়ে দেয়। আরও খেয়াল করার বিষয় যে, খাদ্য চিবানাের সময় সামনের দাঁত, পাশের দাত বা মাড়ির দাঁতের ওপর ও নীচের মধ্যে ঘর্ষণে যে শব্দ হয় এ সবগুলাের মধ্যে কিন্তু একটা তাল আছে। এসবগুলাের মাংসের ওপরের অংশগুলাে প্রায় সবগুলােই একই মাপের হয়ে থাকে। আর ওপর ও নীচের চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত সিগারেটের কাগজের মতােই একটি পর্দা থাকে, উভয় চোয়ালের চাপের সাহায্যে তা খাদ্য চূর্ণ করতে সাহায্য করে। অতপর দাঁতগুলাের চাপ প্রয়ােগের ফল প্রকাশ পায় এভাবে যে পুরু খাদ্য টুকরােগুলাে বিচুর্ণ হয়ে উদরে প্রবিষ্ট হয়। এরপর আরাে চিন্তনীয় বিষয় হচ্ছে, যে দুনিয়ার বুকে মানুষের জীবন এইভাবেই চলছে এবং তার বেঁচে থাকার জন্যে তাকে প্রয়োজনীয় খাদ্য খাওয়ার শিক্ষা প্রকৃতিগতভাবেই দেয়া হয়েছে। এভাবে কাজের যােগ্যতা দিয়েই তাকে তৈরী করা হয়েছে। আলাের কম্পন মাপার যন্ত্র হচ্ছে চোখ, যার দ্বারা সে পৃথিবীতে দেখার দায়িত্ব পালন করে এবং যে শব্দ দ্বারা মানুষ পৃথিবীতে শােনার দায়িত্ব পালন করে তা মাপার যন্ত্র হচ্ছে কান। মানুষের শরীরের যে কোনাে ইন্দ্রিয় বা শক্ত অংগ রয়েছে তাকে গড়ে তােলা হয়েছে তার আভ্যন্তরীণ মযবুত জীবনী শক্তি অনুযায়ী এবং তার দেহাবয়ব অনুযায়ী তাকে সীমিত আকারে কিছু শক্তি সামর্থ্য দান করা হয়েছে, আবার পারিপার্শিক অবস্থা অথবা পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারে এগুলাের মধ্যে কিছু হেরফেরও হয়ে থাকে। মানুষ এই মহাবিশ্বের বুকে এখানে বসবাসকারী এক সৃষ্টিমাত্র। এ বিশ্বের সব কিছু থেকে সে যেমন প্রভাব গ্রহণ করে তেমনি সে নিজেও এর ওপর প্রভাব ফেলে, আর এ জন্যে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কও বিরাজমান রয়েছে। এ সম্পর্ক এ বিশ্বকে গড়ার ব্যাপারে যেমন দরকার, তেমনি মানুষের উন্নয়ন কল্পেও তার প্রয়ােজন রয়েছে। পৃথিবীর সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্কের কারণেই তার আকৃতি প্রকৃতিকে এই ভাবে গড়ে দেয়া হয়েছে। শুধু পৃথিবীই নয়, আকাশের সাথেও মানুষ অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। এই জন্য কোরআনুল করীমের আলােচ্য আয়াতে তার সেই আকৃতির বর্ণনা এসেছে যার মধ্যে আকাশ ও পৃথিবীর কথাও বলা হয়েছে। কোরআনের মােজেযার এও একটি চমৎকার দিক বরং একে এক স্বতন্ত্র মােজেযাই বলা যায়। এই সব সংক্ষিপ্ত ইংগিতের মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে, জানানাে হয়েছে যে, বিশ্বপ্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় বন্ধন। আল কোরআনের আলোকে একথাগুলাে বুঝার চেষ্টা করা উচিত। ‘আল্লাহ তায়ালা সেই মহান সত্ত্বা, যিনি তােমাদের জন্যে রাত্রি বানিয়েছেন, যেন তােমরা তার মধ্যে প্রশান্তি গ্রহণ করতে পারাে, আর দিনকে উজ্জ্বল আলােকে ভরপুর বানিয়েছেন, যার দ্বারা তােমরা সব কিছুকে দেখতে পারাে।’ রাত্রির প্রশান্তি সকল জীবজন্তুর জন্যই প্রয়ােজনীয়। রাত্রির অন্ধকারের অবসরে সকল জীব কোষগুলাে বিশ্রাম পায়, ফলে সেগুলাের মধ্যে এক মধুর শান্তির পরশ জাগে, সেগুলাের প্রয়ােজনীয় বিশ্রাম হয়ে যাওয়ার ফলে পরবর্তী দিবসের আলাে যখন শুরু হয়ে যায়, তখন নবউদ্যমে আবার সবাই কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে এ প্রশান্তি শুধু নিদ্রার মাধ্যমেই আসে না, এর জন্যে অবশ্য রাত্রির সুষমাও প্রয়ােজন। দিনের প্রখর আলাে যখন নিস্তেজ হয়ে আসে, তখন প্রকৃতির বুকে এক অবর্ণনীয় শান্তি ছেয়ে যেতে থাকে। শরীরের কোষগুলাের তেজ কমে আসতে থাকে। শান্ত শীতল ঘন অন্ধকারের আমেজে শরীরের অভ্যন্তরের সকল কিছুর মত চোখগুলাে ঢুলু ঢুলু করতে থাকে, শরীর এলিয়ে পড়তে চায়। গােটা পরিবেশে যখন অন্ধকার নেমে আসে তখন বাতি নিভিয়ে দেয়ার সাথে সাথে ঘরের অন্ধকার বাইরের অন্ধকারে সাথে একাকার হয়ে গিয়ে সবাইকে জানাতে থাকে যে, তােমরা আল্লাহ সােবহানাহু তায়ালার ভালোবাসার দান এই আঁধারের পরশে ঘুমিয়ে পড়ার আনন্দ গ্রহণ করো, আপ্লুত হয়ে যাক তােমার দেহ মন, যেন পরবর্তী দিনের কাজ পরম পুলকে ও নবউদ্যমে শুরু করতে পারাে। এটা সত্য যে, যে সব জীব-কোষ সারাক্ষণ আলাের মধ্যে থাকে তারা ক্লান্তির চরম সীমায় পৌছে যায় এবং শরীরের অভ্যন্তরভাগের সকল শিরা উপশিরাগুলােও ক্লান্ত হয়ে যায়। কারণ গোটা বিশ্বের সবকিছুর সাথে মানব প্রকৃতির যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি দেহাভ্যন্তরের সকল কলকব্জাগুলাের একটার সাথে অপরটার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর দিনকে দেখানাের ও কাজ করার যােগ্যতাসম্পন্ন (বানিয়েছেন)’ এর জন্যে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তা বাস্তব এক চিত্রের মতাে ফুটে রয়েছে, দিন যেন এখানে একটি জীবিত সত্ত্বা, যে দেখায় ও নিজে দেখে। আর মানুষরাও যেন সবাই সে দিনের মধ্যে সব কিছু দেখতে পায়, কারণ দেখার এ গুণটাই তার সর্ববিজয়ী গুণ। এইভাবেই অনাদিকাল থেকে রাত ও দিনের আনাগােনা চলছে এবং রাত ও দিনের এই আসা ও যাওয়াটাই হচ্ছে আল্লাহর এক বড় নেয়ামত। যদি এ দুটির যে কোনাে একটি স্থায়ীভাবে থেকে যেতাে বা যদি কোনটা আরও একটু বড় বা আরও একটু ছােট হতাে তাহলে পৃথিবীর বুকে সকল প্রাণী খতম হয়ে যেতাে। অতএব, রাত ও দিনের পর্যায়ক্রমিক আসা যাওয়াকে আল্লাহর এক বিরাট মেহেরবানী বলাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, অথচ অধিকাংশ মানুষ এ নেয়ামতকে বুঝতে চায় না এবং এর শােকরগােযারীও করে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মানুষের ওপর বড়ই দয়াবান, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।’ ওপরে বর্ণিত সুস্পষ্ট প্রাকৃতিক নেয়ামত দুটির বর্ণনাদানের পর জানানাে হচ্ছে যে, এতাে বড় সব নেয়ামত যিনি সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তিনিই এই মহান নামের অধিকারী হওয়ার যােগ্য। তিনি আল্লাহ, তিনিই তােমাদের রব, তিনিই সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি ছাড়া সর্বময় ক্ষমতার মালিক আর কেউ নেই। সুতরাং ধােকা দিয়ে তােমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ আনন্দের বিষয়, হা আনন্দের ব্যাপারই বটে যে, মানুষ সকল কাজের মধ্যে আস্তে আস্তে আল্লাহর হাত দেখতে পাচ্ছে, তারা জানতে বা বুঝতে পারছে যে সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা একমাত্র তিনি। এটা এমন এক সত্য যা, যে কোনাে বুদ্ধিমান ব্যক্তি বুঝতে পারে, মানুষের বুদ্ধিতে যেমন অন্যান্য সকল কিছুর সত্যতা ধরা পড়ে, তেমনি এসবের মালিক একজন আছেন এবং তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী এটাও সবার নযরে ধরা পড়ে। এ কথা তার আর মনে জাগবে না এবং এ কথার ওপরও তার দৃঢ়তা আসতে পারে না যে, কোনাে বস্তু সৃষ্টিকর্তা ছাড়া এমনি এমনিই বাস্তবে এসে গেছে। এটা আজব কথা যে, সব কিছু আপনা থেকেই বাস্তবে এসেছে। এ সব কথা শুনলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। অবশ্য মানুষের মনে এসব কথা দোলা দেয় এর পরও মানুষ ঈমান ও সত্যকে স্বীকার করা থেকে দূরে সরে যায়। এরশাদ হচ্ছে, ‘সুতরাং ধােকা খেয়ে তােমরা কোথায় চলে যাচ্ছ?’ এতদসত্তেও মানুষ এ সরল ও স্পষ্ট সত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, আল কোরআন প্রথম যাদেরকে সম্বােধন করেছিলাে সে কুরাইশদের পক্ষ থেকেও এসব অস্বীকৃতির ঘটনা ঘটেছে। এমনি করে প্রত্যেক যমানাতেই এ রকম কিছু হঠকারী ও সত্য বিরােধী লােক থাকে, তারা কোনাে যুক্তি মানে না, অকারণে ও কোনাে প্রমাণ ছাড়াই তারা এইভাবে সত্য বিরােধী তৎপরতায় লেগে থাকে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারাই এইভাবে বিভ্রান্ত হয় ও ভুল পথে এগিয়ে যায়, যারা আল্লাহর আয়াতগুলােকে অস্বীকার করে।’
*সৃষ্টি যার সার্বভৌমত্ব ও তার : এবারে রাত ও দিন-এ দুটির সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য বিস্ময়কর বিষয় থেকে নযর ফেরানাে হচ্ছে সেই পৃথিবীর অবস্থার দিকে, যাকে স্থির থাকার জন্যে এবং আকাশকে ছাদ-স্বরূপ বানানাে হয়েছিলাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা সেই মহান সত্ত্বা যিনি পৃথিবীকে বানিয়েছেন স্থির এবং আকাশকে বানিয়েছেন ছাদ।’ পৃথিবী স্থির ও মানুষের বাস করার জন্যে উপযােগী হয়ে রয়েছে এবং এমন চমৎকারভাবে মানুষ যাবতীয় প্রাণীর আবাসস্থলের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে যার দিকে আমরা ইতিপূর্বে সংক্ষেপে ইংগিত করেছি। আকাশকে একটি সুরক্ষিত ছাদ বা দূর্গ বানানাে হয়েছে যা দৃঢ়ভাবে স্থির হয়ে রয়েছে, যা হেলে দুলে পড়ে যায় না বা নড়বড়ে হয়েও যায় না। এ আকাশ কাউকে প্রদক্ষিণও করে না। ফলে যে মহাকাশ মানুষ ও জীব জগতের জন্যে স্থির তা স্থায়িত্বের দায়িত্ব বহন করে চলেছে বলে বুঝা যায় । এই গােটা অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যে এ মহাকাশ যেন এক গ্যারান্টি এর নির্মাণ পূর্বনির্ধারিত এক অমাঘ সিদ্ধান্তক্রমে সম্পন্ন হয়েছে এ নিশ্চিত ধারণা সবার মনেই জাগে। এরপর আরও গভীরভাবে খেয়াল করলে বুঝা যায়, আকাশ ও পৃথিবীর অস্তিত্ব সকল প্রকার পাক পবিত্র ও নিরাপদ বস্তুসমূহ থেকে মানুষের জীবন ধারণ সামগ্রীর সরবরাহ করার উৎস। এসব কিছুর মধ্যে পারস্পরিক এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিরাজ করছে। এসব এমন রহস্যঘেরা বাস্তবতা, যার দিকে তাকালে হয়রান হয়ে যেতে হয়। সেগুলাের কোনাে কোনােটার দিকে আমরা ইতিমধ্যে ইশারা করেছি, যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি তােমাদের বিভিন্ন আকৃতি দিয়েছেন, অতপর অতি সুন্দর করে তিনি তােমাদের আকৃতি গড়েছেন এবং তিনি পবিত্র খাদ্য ও বস্তু থেকে তােমাদেরকে রেখে দিয়েছেন।’ এ সকল আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের বিভিন্ন দানের কথা বলার পর জানানাে হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা বলে যাকে তােমরা জানাে তিনিই তােমাদের রব। সুতরাং বরকতময় (অভাবনীয় কল্যাণময়) আল্লাহ জাল্লা শানুহ, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক। সকল প্রকার কমতি ও ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে পবিত্র সেই মহান সত্ত্বাই সবকিছুকে পয়দা করেছেন এবং তিনিই সব কিছুর ওপর ক্ষমতা রাখেন এবং সকল কিছুকে তিনিই পরিচালনা করেন। দুনিয়ায় বসবাস করার সময় তােমাদের সবাইকে তিনিই চালাচ্ছেন এবং তােমাদের জন্যে তার রাজ্যের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থান তিনিই নির্ধারণ করে রেখেছেন। সেই মহান পরওয়ারদেগারের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি নিজেই বলছেন, মহা বরকতময় আল্লাহ তায়ালা। অর্থাৎ তার বরকতের ভান্ডার শুধু বাড়ছেই বাড়ছে, যেহেতু তিনি সারা বিশ্বের সবার মালিক। তিনি একই ভাবে চিরদিন জীবিত আছেন ও থাকবেন। তার নিজের শক্তিতে তিনি চিরদিন প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। তার অস্তিত্ব চিরদিন আছে চিরদিন থাকবে। এমন নয় যে, কোনাে সময় তাঁর অস্তিত্ব ছিলাে না। কিংবা কেউ তার অস্তিত্বকে বাস্তবে এনেছে বা অন্য কেউ তাকে সৃষ্টি করেছে বরং তিনি চিরদিন আছেন, চিরদিন থাকবেন। তার কোন শুরু বা শেষ নেই। তার কার্যক্রমের পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না বা তার কাজ কেউ শেষও করে দিতে পারে না। তার কাজের গতি কেউ ঘুরিয়ে দিতে পারে না বা তার কীর্তি কেউ পরিবর্তিতও করতে পারে না। তার চির জীবিত থাকার এই গুণের অধিকারী আর কেউ হতে পারে না। এ বিষয়ে তিনি একক। এই একত্ব বা একক ভূমিকা। আর কেউ লাভ করতে পারে না। সর্বময় শক্তি ক্ষমতার মালিক হওয়া, এই বৈশিষ্ট্য একমাত্র তারই এ বিষয়ে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ কোনােভাবেই হতে পারে না। কেউ চিরঞ্জীব হতে পারে না। একমাত্র তিনি একাই চিরদিন আছেন-চিরদিন থাকবেন, তিনিই আল্লাহ তায়ালা । তাই এরশাদ হয়েছে, ‘সর্বময় কর্তৃত্বের মালিক, তিনি ছাড়া কেউ নেই। অতএব, একমাত্র তাকেই ডাকো, তাঁর আনুগত্য করতে গিয়ে এবং একমাত্র তারই জীবন… আর দোয়া প্রার্থনা করতে গিয়ে শুধু তার কাছেই চাও এবং তাঁরই কৃতিত্বের কথা ঘোষণার মাধ্যমে তার তারীফ করাে, বলাে। ‘আল হামদু লিল্লাহে রাব্বিল আলামীন (সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি সৃষ্টিকূলের প্রতিপালক)।’ আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার এসব নিদর্শন এবং তার অবদানের কথা সামনে রেখে, যে সব শাস্তির কথা উল্লেখিত হয়েছে সেগুলাের দিকে তাকিয়ে তার একত্ব সম্পর্কে তাঁর সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে এবং তার আইন দাতা হওয়া সম্পর্কে যে সব ঘােষণা দেয়া হয়েছে সে সব কিছুকে সামনে রেখে এবার রসূলুল্লাহ(স.)-এর প্রতি চুড়ান্ত নির্দেশ আসছে, যেন তিনি তাঁর জাতির কাছে ঘােষণা দিয়ে দেন যে, তাঁকে নিষেধ করা হয়েছে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া সে সকল বস্তু ও ব্যক্তির গােলামী করতে, যার বা যাদের সামনে তারা বিনা যুক্তিতে মাথা নত করে। তিনি যেন ওদেরকে আরও জানিয়ে দেন যে, তাঁর প্রতি ইসলাম গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে অর্থাৎ পুরােপুরি আল্লাহ রক্বুল আলামীনের কাছে আত্মসর্পণের জন্যে তাকে হুকুম দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বলাে হে রসূল, আমাকে মানা করা হয়েছে তাদের নিশর্ত আনুগত্য করতে, যাদের তােমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে (সাহায্যের জন্যে) ডাকো। বিশেষ করে যখন আমার কাছে আমার রবের কাছ থেকে সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ এসে গেছে। আমাকে আরাে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন আমি একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে আত্মসমর্পণ করি।’ অর্থাৎ হে রসূল, তুমি ঘােষণা করে দাও সে সকল লােকের কাছে, যারা আল্লাহর আয়াতগুলাে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নেয়ামতগুলােকে অস্বীকার করছে, বলাে তােমাকে সেসব ব্যক্তি বা বস্তুর এবাদাত করতে নিষেধ করা হয়েছে, যাদেরকে ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে (সাহায্যের জন্যে) ডাকে এবং তাদেরকে বলে দাও যে, আমাকে মানা করা হয়েছে (অন্য কারাে গােলামী করতে) আর যখন আমার কাছে আমার রবের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী এসে গেছে তখন তা আমি কেন করতে যাবাে? সুতরাং আমার কাছে (সত্যের দাওয়াত দেয়ার জন্যে এবং সত্যের ওপর টিকে থাকার জন্যে) সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ রয়েছে। আমি তার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখি। আর এটাও সত্য যে, এই স্পষ্ট সত্যের পক্ষেই আমি ধৈর্য ধরে টিকে আছি, একে সত্য বলে বিশ্বাস করেছি এবং এর সত্যতার ঘােষণা করছি; উপরন্তু আমি সাফ জানিয়ে দিচ্ছি যে, আমি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারও এবাদাত করা বন্ধ করে দিয়েছি। এটা হচ্ছে অপরের অন্ধ আনুগত্যের প্রতি সুস্পষ্ট অস্বীকৃতি বা না সূচক কথা। আমি আরও জানাচ্ছি যে ইসলাম আনুগত্য একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনের জন্যেই নির্দিষ্ট। এটাই হচ্ছে ইতিবাচক কাজ, এই দুটি কাজ এক সাথে হলেই তবে আকীদা বিশ্বাসের পূর্ণতা আসে।
*জীবন মৃত্যুর পর্যায়ক্রমিক ধারা : এরপর প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর আয়াতগুলাের মধ্য থেকে বা তার শক্তি ক্ষমতার অসংখ্য চিহ্ন সমূহের মধ্য থেকে একটি তাদের কাছে পেশ করা হচ্ছে এবং তা হচ্ছে মানুষের জীবন এবং তার বিচিত্র ব্যবহারগুলাে। মানুষকে তার জীবনের মূল তাৎপর্য বুঝার জন্য আল্লাহর সামনে উপস্থিত হতে হবে একথা বুঝতে হবে। এই যে জীবন রয়েছে এর থেকেই কিছু নযির বা কিছু তথ্য এগিয়ে দিতে হবে, যেমন, ‘তিনি তােমাদেরকে… হয়ে যাও, ব্যস হয়ে যায়।’(আয়াত ৬৭-৬৮) ওপরে বর্ণিত কথা এ চিত্র হচ্ছে মানব জীবনের সূচনা লগ্নের অবস্থা। এটা ছিলাে মানুষের অস্তিত্ব বাস্তবে আসার প্রাথমিক ইতিহাস। এ সময়ে অন্যান্য যে সব অবস্থা সামনে আসে সেগুলােও আলােচ্য প্রসংগে ফুটে উঠেছে। কিন্তু আল কোরআন অবতরণের পর এ বিষয়ক আলােচনার সমাপ্তি ঘটেছে, তাও তাে বহু শতাব্দী আগের কথা! মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি দিয়ে। এটা মানব সত্ত্বার অস্তিত্বের প্রথম কথা। এর দ্বারা আরও জানা যায় যে, পৃথিবীতে সকল জীবনের মূলেই রয়েছে এই মাটি। সব জীবনের মতােই তাে মানুষের এই জীবন, আর আল্লাহ তায়ালা ছাড়া এ বিষয়ে কেউ জানে না কেমন করে এ অলৌকিক অবস্থার অবসান ঘটল। এটাও কেউ জানেনা পৃথিবীর ইতিহাসে ও মানব জীবনের ইতিহাসে এতাে বড় একটা ঘটনা কেমন করে সংঘটিত হলাে। তারপর বৈবাহিক জীবনের পদ্ধতি অবলম্বনে মানব সন্তানদের বৃদ্ধি হতে লাগলাে, অতপর মানুষ পুরুষ জীবকোষ নিক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবে আসতে লাগলাে, সে জীবকোষ হচ্ছে ডিম্বকোষ এর সাথে শুক্র বীজের সম্মিলন এবং মাতৃ গর্ভাশয়ে রক্তপিন্ড হিসাবে এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তার অবস্থান গ্রহণ। মানব জীবনের সফর পরিক্রমায় এই রক্তপিন্ড বিভিন্ন পর্যায় পার হয়ে ভ্রুণের আকার নেয়। চিন্তার বিষয় হচ্ছে এই যে, জরায়ুর মধ্যে প্রথম জীব কোষের প্রবেশের পর বহু বড় বড় ও দীর্ঘ পর্যায় অতিক্রম করার পর এ শুক্রকীটটি অবশেষে নবজাতক শিশু হিসাবে ভূমিষ্ট হয়। যদি আমরা গভীরভাবে এই ক্রমিক ধারার প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তাহলে দেখতে পাবাে যে মানব শিশুর জন্মলগ্ন থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত তাকে আরও বহু পর্যায় পাড়ি দিতে হয়। শিশুকাল থেকে কৈশাের ও যৌবনকাল এবং এ সময় কাল প্রায় ত্রিশ বছর। এরপর প্রৌঢ়ত্ব ও তৎপরবর্তীকালে বার্ধক্য। এ সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে ত্রিশের পূর্বেকার উদ্যম উৎসাহ, শক্তি সাহস ও বলবীর্য কমে আসতে থাকে, অর্থাৎ ত্রিশাের্থ বয়সের সময়কালের শুরু থেকে নিয়ে এর শেষ পর্যন্ত হচ্ছে দুর্বলতার সময়। এই আয়াতাংশ এই দিকেই ইশারা করেছে, ‘এ সময়ের মধ্যে কিংবা তার আগেই তােমাদের মধ্য থেকে কেউ মৃত্যুবরণ করে’ অর্থাৎ এই সব পর্যায়ের সবগুলাে অথবা এগুলাের কোনাে কোনােটি পর্যন্ত পৌছুবার পূর্বেই কোনাে ব্যক্তিকে মৃত্যু দেয়া হয়, আবার কাউকে অনেক বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযােগ দেয়া হয়। তবে যাই হােক না কেন তা পূর্ব থেকে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত রয়েছে। এ সময় আসার আগেও কেউ মরবে না এবং এরপরও কারাে মৃত্যু আসবে না। আর হয়তাে (এর থেকে) তােমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে। সুতরাং জরায়ুর মধ্যে থাকাকালীন সফর ও বাচ্চা আকারে পৃথিবীর জীবনে এসে বসবাস করার এই সফরের সময়ের মধ্যে এমন সময় মানুষকে দেয়া হয়, যখন সে চিন্তা করার ক্ষমতা পায় এবং তাকে সুন্দর চরিত্রের বিকাশ ঘটানাের মত সুযােগ দেয়া হয়। এই সুযােগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সে তার তাকদীর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু অবদান রাখতে পারে। এর মধ্যে যে কোনাে মুক্ত বুদ্ধির অধিকারী মানুষেরা চিন্তা করবে, যে ভ্রুণের এই পথ পরিক্রমা অবশ্যই বেশ মূল্যবান এবং এ সময়ে তার বিকাশ ও বৃদ্ধি এক আজব রহস্য ভরা ব্যাপার। সম্প্রতি স্বাস্থ্য বিজ্ঞান এবং ভ্রুণ বিজ্ঞান আমাদেরকে কিছু নতুন জ্ঞান দিয়েছে, কিন্তু প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে আল কোরআন আমাদেরকে ইশারায় এই সূক্ষ্ম বিষয়টি সম্পর্কে এমনভাবে জ্ঞান দিয়েছে যে, সেদিকে খেয়াল করে দেখলে আজ আমাদের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় আর এই কারণেই এই বিষয়টি সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে একটু ধীর স্থিরভাবে চিন্তা না করে দ্রুত গতিতে কেউ এগিয়ে যাবে তা সম্ভব নয়। এখানে লক্ষণীয় যে, ভ্রুণ ও শিশুকালের পর্যায়ক্রমিক পরিক্রমা দুটি মানুষের অনুভূতির জগতে বিরাট এক আলােড়ন সৃষ্টি করে এবং যে কোনাে পরিবেশে ও জ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে মানুষের হৃদয়কে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়। অতীতেও দেখা গেছে এ বিষয়ে মানুষ তাদের জ্ঞান গবেষণার উৎকর্ষ অনুযায়ী চিন্তা-ভাবনা করেছে। এ জন্যে সব যুগের সকল মানুষকে লক্ষ্য করে আল কোরআন কথা বলেছে। ফলে মানুষ আজ এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে পারছে। কিন্তু আশ্চর্য এরপরও কেউ কোরআনের ডাকে সাড়া দিচ্ছে, আর কেউ দিচ্ছে না। এরপরে জীবিত করা ও মৃত্যু দান করার ওপর আলােচনা করা হয়েছে। আলােচনা করা হয়েছে সৃষ্টি ও সবার দুনিয়ার বুকে ব্যাপ্তি সম্পর্কে। এরশাদ হচ্ছে, তিনিই সেই সত্ত্বা যিনি যিন্দা করেন ও মৃত্যুদান করেন, তারপর যখন তিনি কোনাে বিষয়ে ফায়সালা করতে চান, বলেন, হয়ে যাও আর অমনি তা হয়ে যায়। জীবন ও মৃত্যু, আল্লাহর ক্ষমতার এই দুটি নিদর্শনের ওপর আল কোরআনের বহু ইশারা এসেছে। কারণ এ দুটি বিষয়ই অত্যন্ত গভীরভাবে মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে। তারপর তা আমাদের জানায় যে, এই উভয় বিষয়ই সাধারণ মানুষের কাছে এমন এক প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট বিষয় যা প্রত্যেক মানুষের জীবনকে স্পর্শ করে এবং এ দুটির ওপর সঠিকভাবে চিন্তা করার মাধ্যমেই মানুষের জীবনে শান্তি ও সৌন্দর্য নেমে আসতে পারে। মানুষের কাছে সর্বপ্রথম এবং সব থেকে দৃশ্যমান যে জিনিসটি ধরা পড়ে তা হচ্ছে জীবন এবং মৃত্যু। এ জীবনের কতাে রং তা ভেবে পাওয়া মুশকিল, অনুরূপভাবে মৃত্যুরও রয়েছে বহু ধরণ। বাহ্যিকভাবে ভূমিকে মৃত দেখায় তারপর আবার এই মৃত ভূমির মধ্যে জীবনের স্পন্দন দেখা দেয়। মৌসুমের বিশেষ বিশেষ সময়ে গাছের বহু ডাল এবং পাতা শুকিয়ে যায়। শীতকালে সাধারণভাবে গাছের পাতা ঝরে যায়। তারপর এই জীবন মৃত্যুর ধারা শুধু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর আওতায় ছড়িয়ে রয়েছে পৃথিবীর সকল প্রাণী ও গাছপালা, সবুজ বৃক্ষ-লতা-পাতা। জীবন-মৃত্যুর এ ধারা অব্যাহত থাকায় সবুজ শ্যামল পত্র পল্লবে গােটা পরিবেশ ভরে ওঠে, গাছে গাছে ফুল ফোটে, ফল মূলে ভরে যায় বাগ বাগিচা। এ সব তাে জীবনেরই স্পন্দন তাদের জীবন্ত এবং প্রাণের পরশ। তারপর নযরে পড়ে পাখীকূলের ডিম, যার থেকে নাদুশ নুদুশ বাচ্চা বের হয়ে আসে। এরপর দেখতে পাই ফলমূল ও গাছপালার বীজ, যার থেকে সবুজ শ্যামল বৃক্ষ বেরিয়ে আসে। অপরদিকে এর বিপরীত পরিক্রমা দেখা যায়, জীবন থেকে মৃত জিনিসের নির্গমন। ঠিক তেমনি করে মৃত জিনিস থেকে জীবন সঞ্চারের রহস্যও এখানে জানা যায়। এ দুটি ধারার সবগুলাে মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করে। এ রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করতে এবং এ সব জীবন মৃত্যু ও মৃত্যু জীবন সম্পর্কিত পর্যায়ক্রমিক ধারা থেকে প্রয়ােজনীয় শিক্ষা নিতে তাদের উদ্বুদ্ধ করে। এটা অতীব সত্য কথা যে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন অবস্থা থেকে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা পাওয়া যায়। জীবন ও মৃত্যুর এই যে পর্যায়ক্রমিক ধারা-এ সবের ওপর চিন্তা ভাবনা করলে কি করে মানুষ পয়দা হলাে এবং তার সৃষ্টিকালে কি কি উপাদান ব্যবহার করা হয়েছিলাে এগুলাে জানার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে এক কৌতুহল উদ্রেক হয়। এ বিষয়ের ওপর সঠিকভাবে একমাত্র আল কোরআন থেকেই আমরা জানতে পারি। আমরা এতটুকু জানতে পারি যে, মহামহিম আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা যখনই সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করেছেন, বলেন, ‘হয়ে যাও’, আর অমনি তার ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়ে গেলাে। এইভাবে অন্য যতাে কিছুই তিনি করতে চেয়েছেন, শুধু একটি কথাই বলেছেন, হয়ে যাও আর অমনি হয়ে গেছে। বিশ্বজগতের সবখানে ও সব কিছুর মাঝে এই একই সৃষ্টির গতিধারা চলতে থেকেছে। সুতরাং বড়ই বরকতময় আল্লাহ তায়ালা যিনি অতি উত্তম সৃষ্টিকারী ।
*ভয়ংকর আযাবের কিছু দৃশ্য : মক্কার কোরায়শদের সামনে একাধারে মানবগােষ্ঠীর প্রবৃদ্ধি ও তাদের এসব আয় উন্নতি ছিলাে, তারা জীবন মৃত্যুর সর্ববােধগম্য দৃশ্য দেখছিলাে। মানুষের অগ্রগতি ও আবিষ্কারের তাৎপর্য তারা বুঝতে পারছিলাে, এতদসত্তেও তারা আল্লাহর আয়াতগুলাের ওপর বিস্ময় প্রকাশ করছিলাে এবং তার নিদর্শনগুলােকে প্রত্যাখ্যান করছিলাে। তাদের কাজে, কথায় ও আচরণে পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছিলাে যে তারা রসূলদের কার্যাবলীকে ঘৃণা করতাে, তাদের প্রচারের ওপর আশ্চর্যান্বিত হতাে এবং তাদেরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার জন্যে তারা তৎপর ছিলাে, এমন কি যাকে পরােপকারী ও ভালাে লােক বলে তারা জেনেছে এবং সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করে ও ডালােবেসে আল আমীন বলে খেতাব দিয়েছে, তাকেও তারা ধন সম্পদ প্রভাব প্রতিপত্তি ও সর্দারী বা নেতৃত্বের খাতিরে জেনে বুঝে মিথ্যাবাদী বানানাের জন্যে সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছে। এ কারণেই তাদের সামনে কেয়ামতের ভয়ানক আযাবের দৃশ্য তুলে ধরে তাদেরকে ভয় দেখানাে হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখনি …… সুতরাং নিকৃষ্ট সেই অহংকারী ব্যক্তিদের ঠিকানা।’(আয়াত ৬৯-৭৬) ওপরের আয়াতগুলােতে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে সেই সকল মানুষ সম্পর্কে, যারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর বিভিন্ন শক্তি-ক্ষমতার নিদর্শনের ওপর তর্ক বিতর্ক করে, তাদের পরিণতি সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখনি সেই ব্যক্তিদেরকে, যারা আল্লাহর আয়াতগুলো নিয়ে ঝগড়া করছে? কেমন করে ওদেরকে (সঠিক পথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ ওরা হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি যারা আল কিতাবকে প্রত্যাখ্যান করেছে, আর সেই সব জিনিসকে অস্বীকার করেছে যা দিয়ে আমি আমার রাসূল পাঠিয়েছি। ওপরে সব রসূলদেরকেই অস্বীকার করার কথা বলা হয়েছে, অথচ তারা তাে একটি কিতাব এবং একজন রসূলকেই অস্বীকার করেছে। আসলে এর অর্থ হচ্ছে রসূলদের মিশন একই, একই দাওয়াত এবং একই সংস্কার কর্মসূচী নিয়ে তারা সবাই এসেছেন। তাদের সবার আকীদা একই এবং যা কিছু তারা করেছেন তার পূর্ণতাপ্রাপ্তি হয়েছে শেষ রসূল(স.)-এর ওপর। এ জন্যে একজন রসূলকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে সকল রসূলকেই অস্বীকার করা। এতােসব কথার পরও যখন তারা হঠকারিতা থেকে বিরত হচ্ছে না এবং নবী(স)-এর বিরােধিতা করেই চলেছে, তখন তাদের সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘শীঘ্রই ওরা জানতে পারবে।’ তারা কি জানতে পারবে তা অত্যন্ত জোরালাে ভাষায় জানিয়ে দেয়া হচ্ছে বলা হচ্ছে, তারা জানতে পারবে যে তাদেরকে যে আযাব দেয়া হবে তার মধ্যে যাবতীয় কষ্টসহ চরম অপমান ও হীনতা গ্লানি থাকবে। শুধু শাস্তি নয়, বরং তাদের গলায় ও হাতে পায়ে হাঁসুলি এবং শিকল থাকবে এবং শৃংখলিত অবস্থায় তাদেরকে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সামনের দিকে হাটতে অনেক গরু ছাগল ও জীব জানােয়ারকে যেমন করে জোর করে টেনে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়, তেমনি করে চরম অপমানের সাথে তাদেরকে আগুনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে। আর কিভাবে তাদেরকে আজ সম্মান দেয়া যেতে পারে। ওরা তাে তাদের ওপর থেকে সম্মানের শেষ চিহ্নটুকু পর্যন্ত খুলে ফেলে দিয়েছে। এই চরম অপমানের সাথে টেনে হেঁচড়ে, টানতে টানতে আগুনের মধ্যে ফেলে দেয়ার পর তাদের এই যাত্রা শেষ হবে। আল কোরআনে তাদের সেই ভীষণ অপমানজনক শাস্তি ও করুণ অবস্থার চিত্র আঁকতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘এরপর গরম পানি ও জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে তাদের নিক্ষেপ করা হবে।’ অর্থাৎ, বেঁধে ও গ্রেফতার করে তাদেরকে তেমনিভাবে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হবে, যেমন করে কুকুরকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের জন্যে সে স্থানটিতে গরম পানি ও প্রজ্জ্বলিত থাকা এভাবেই তাদের বিচারের সমাপ্তি ঘটবে। এই কঠিন ও অপমানজনক আযাবের মধ্যেই তাদের প্রতি ধমক ও লজ্জাদায়ক তিরস্কারসমূহ বর্ষিত হতে থাকবে; যেমন তারপর তাদেরকে বলা হবে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তােমরা ক্ষমতাবান মনে করতে এবং যাদেরকে তােমরা আল্লাহর শরীক ভাবতে, তারা আজ কোথায়? তখন তারা বুঝতে পারবে কিভাবে তারা ঠকেছে, চরম লজ্জিত হয়ে ও কাতরকণ্ঠে ‘তারা বলবে, (আজ) ওরা আমাদের থেকে সরে গেছে। না, আমরা তাে এর আগে কারাে পূজা অর্চনা অন্ধ আনুগত্য করতাম না? অর্থাৎ সেই কঠিন দিনে মােশরেকরা তাদের পরিচালকদের সম্পর্কে বলবে, আমরা যাদের কথামতাে শিরক করতাম বা যাদেরকে আমরা আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার অংশীদার মনে করতাম, তারা সবাই আজ আমাদেরকে এই কঠিন অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়ে উধাও হয়ে গেছে, আজ তাদের খুঁজে বের করার কোনাে উপায়ই আমাদের কাছে নেই। তারাও এগিয়ে এসে তাদের কাছে পৌছানাের কোনাে পথ আমাদের বাতলে দেবে না। আমরা সেদিন বুঝেসুঝে যে কারাে অনুসরণ করতাম তা নয়, আমাদেরকে সেই সব প্রভাবশালী লােকেরা ভুল বুঝিয়ে এইসব কাজ করিয়েছিলাে এবং আমরাও বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে এমন ধােকা খেয়েছিলাম যে কিছুতেই সত্য কথাটা তখন বুঝতে পারিনি, তাই আজ আমাদের এই দুর্দশা। তাদের সেই অসহায় মূলক এই জবাবের পর পরই তাদের সবার জন্যে এক চরম ধমক আসবে। ‘হা, এমনি করেই আল্লাহ তায়ালা কাফেরদেরকে সত্য সঠিক পথ থেকে সরিয়ে দেন।’ এরপর আরেকটি ধমক আসবে, পৃথিবীর বুকে অন্যায়ভাবে তােমরা যে ফুর্তি ও অহংকার করেছিলে, তারই পরিণতিতে আজ তােমাদের জন্যে এই (কঠিন সাজার) ব্যবস্থা রয়েছে। অতএব, জাহান্নামের দরজাগুলাে দিয়ে প্রবেশ করো। চিরদিন তােমরা সেখানে থাকবে, এই নিকৃষ্ট বাসস্থানই অহংকারীদের সঠিক ঠিকানা। কে আছাে আজ আমাদের সাহায্যকারী! আজ জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে এবং গলায় বেড়িপরা অবস্থায় আমাদেরকে দোযখের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আজ আমাদেরকে উত্তপ্ত পানি ও আগুনের মধ্যে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হতে হচ্ছে, কেউ আছে কি, আমাদেরকে রক্ষা করার? ওপরের আয়াতটি পড়ে মনে হচ্ছিল, চিরস্থায়ী জাহান্নামে দাখিল হওয়ার পূর্বে তাদের পক্ষ থেকে এই কথাগুলােই বলা হবে। অতএব, নিকৃষ্ট তম ঠিকানা অহংকারীদের জন্য। উক্ত আয়াতে বুঝা যাচ্ছে বড়াই করার জন্যেই তাদের এই অপমানজনক শান্তি নির্ধারিত হয়ে রয়েছে, অহংকারের প্রতিদানেই বরাদ্দ হয়েছে এই ঘূণাব্যঞ্জক কঠিন সাজা!