(বই#১০৯১) [ *দাওয়াতী কাজে সবরের অপরিহার্যতা :-] www.motaher21.net সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন পারা:২৪ ৭৭-৮৫ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯১)
[ *দাওয়াতী কাজে সবরের অপরিহার্যতা :-]
www.motaher21.net
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন
পারা:২৪
৭৭-৮৫ নং আয়াত:-
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭৭
فَاصۡبِرۡ اِنَّ وَعۡدَ اللّٰہِ حَقٌّ ۚ فَاِمَّا نُرِیَنَّکَ بَعۡضَ الَّذِیۡ نَعِدُہُمۡ اَوۡ نَتَوَفَّیَنَّکَ فَاِلَیۡنَا یُرۡجَعُوۡنَ ﴿۷۷﴾
ধৈর্য্য অবলম্বন করো। আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আমি তাদেরকে যে মন্দ পরিণতির ভয় দেখাচ্ছি এখন তোমার সামনেই এদেরকে তার কোন অংশ দেখিয়ে দেই কিংবা (তার আগেই) তোমাকে পৃথিবী থেকে উঠিয়ে নেই, সর্বাবস্থায় এদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭৮
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا رُسُلًا مِّنۡ قَبۡلِکَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ قَصَصۡنَا عَلَیۡکَ وَ مِنۡہُمۡ مَّنۡ لَّمۡ نَقۡصُصۡ عَلَیۡکَ ؕ وَ مَا کَانَ لِرَسُوۡلٍ اَنۡ یَّاۡتِیَ بِاٰیَۃٍ اِلَّا بِاِذۡنِ اللّٰہِ ۚ فَاِذَا جَآءَ اَمۡرُ اللّٰہِ قُضِیَ بِالۡحَقِّ وَ خَسِرَ ہُنَالِکَ الۡمُبۡطِلُوۡنَ ﴿٪۷۸﴾
তোমার আগে আমি বহু রসূল পাঠিয়েছিলাম। আমি তাদের অনেকের কাহিনী তোমাকে বলেছি আবার অনেকের কাহিনী তোমাকে বলিনি। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন নিদর্শন দেখানোর ক্ষমতা কোন রসূলেরই ছিল না। অতঃপর যখন আল্লাহর হুকুম এসেছে তখন ন্যায়সঙ্গতভাবে ফায়সালা করা হয়েছে এবং ভ্রান্ত কাজে লিপ্ত ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৭৯
اَللّٰہُ الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَنۡعَامَ لِتَرۡکَبُوۡا مِنۡہَا وَ مِنۡہَا تَاۡکُلُوۡنَ ﴿۫۷۹﴾
আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্য গবাদিপশু সৃষ্টি করেছেন, যাতে তার কিছু সংখ্যকের উপর তোমরা আরোহণ কর এবং কিছু সংখ্যক হতে তোমরা খাও।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৮০
وَ لَکُمۡ فِیۡہَا مَنَافِعُ وَ لِتَبۡلُغُوۡا عَلَیۡہَا حَاجَۃً فِیۡ صُدُوۡرِکُمۡ وَ عَلَیۡہَا وَ عَلَی الۡفُلۡکِ تُحۡمَلُوۡنَ ﴿ؕ۸۰﴾
এসবের মধ্যে তোমাদের জন্য আরো অনেক কল্যাণ নিহিত আছে। তোমাদের মনে যেখানে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয় এসবের পিঠে আরোহণ করে তোমরা সেখানে পৌঁছতে পার। এসব পশু এবং নৌকাতেও তোমাদের আরোহণ করতে হয়।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৮১
وَ یُرِیۡکُمۡ اٰیٰتِہٖ ٭ۖ فَاَیَّ اٰیٰتِ اللّٰہِ تُنۡکِرُوۡنَ ﴿۸۱﴾
আল্লাহ‌ তোমাদেরকে তাঁর এসব নির্দশন দেখাচ্ছেন। তোমরা তাঁর কোন্‌ কোন্‌ নিদর্শন অস্বীকার করবে?
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৮২
اَفَلَمۡ یَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَیَنۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ؕ کَانُوۡۤا اَکۡثَرَ مِنۡہُمۡ وَ اَشَدَّ قُوَّۃً وَّ اٰثَارًا فِی الۡاَرۡضِ فَمَاۤ اَغۡنٰی عَنۡہُمۡ مَّا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿۸۲﴾
সুতরাং এরা কি এ পৃথিবীতে বিচরণ করেনি, তাহলে এরা এদের পূর্ববর্তী লোকদের পরিণতি দেখতে পেত? তারা সংখ্যায় এদের চেয়ে বেশী ছিল, এদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী ছিল এবং পৃথিবীর বুকে এদের চেয়ে অধিক জাঁকালো নিদর্শন রেখে গেছে। তারা যা অর্জন করেছিল, তা শেষ পর্যন্ত তাদের কাজে লাগেনি।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৮৩
فَلَمَّا جَآءَتۡہُمۡ رُسُلُہُمۡ بِالۡبَیِّنٰتِ فَرِحُوۡا بِمَا عِنۡدَہُمۡ مِّنَ الۡعِلۡمِ وَ حَاقَ بِہِمۡ مَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿۸۳﴾
তাদের রসূল যখন সুস্পষ্ট নিদর্শনাদি নিয়ে তাদের কাছে এসেছিলেন তখন তারা নিজের কাছে বিদ্যমান জ্ঞান নিয়েই মগ্ন ছিল এবং যে জিনিস নিয়ে তারা বিদ্রূপ করতো সে জিনিসের আবর্তেই তারা পড়ে গিয়েছিলো।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৮৪
فَلَمَّا رَاَوۡا بَاۡسَنَا قَالُوۡۤا اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَحۡدَہٗ وَ کَفَرۡنَا بِمَا کُنَّا بِہٖ مُشۡرِکِیۡنَ ﴿۸۴﴾
তারা যখন আমার আযাব দেখতে পেল তখন চিৎকার করে বলে উঠলো, আমরা এক ও লা-শরীক আল্লাহকে মেনে নিলাম। আর যেসব উপাস্যদের আমরা শরীক করতাম তাদের অস্বীকার করলাম।
সূরা:- ৪০: আল-মু’মিন:৮৫
فَلَمۡ یَکُ یَنۡفَعُہُمۡ اِیۡمَانُہُمۡ لَمَّا رَاَوۡا بَاۡسَنَا ؕ سُنَّتَ اللّٰہِ الَّتِیۡ قَدۡ خَلَتۡ فِیۡ عِبَادِہٖ ۚ وَ خَسِرَ ہُنَالِکَ الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿٪۸۵﴾
কিন্তু আমার আযাব দেখার পর তাদের ঈমান গ্রহণ কোন উপকারে আসার নয়। কারণ, এটাই আল্লাহর সুনির্ধারিত বিধান যা সবসময় তাঁর বান্দাদের মধ্যে চালু ছিল। সেসময় কাফেররা ক্ষতির মধ্যে পড়ে গেল।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*দাওয়াতী কাজে সবরের অপরিহার্যতা : এই দৃশ্যের সামনে রয়েছে দোযখবাসীদের অপদস্থ, লাঞ্ছনা গঞ্জনা ও অপমানের দৃশ্য এবং তাদেরকে প্রদত্ত ভয়ানক আযাবের ছবি, আরও রয়েছে আল্লাহর নিদর্শনাবলী নিয়ে তারা যে তর্ক বিতর্ক করতাে এবং বুক ভরা অহংকার নিয়ে তারা যে ফুলে ফেঁপে উঠতাে, তাদের অপমানজনক পরিণতির দৃশ্য। এ কঠিন পরিণতিকে সামনে রেখেই আলােচনার গতিকে রসূলুল্লাহ(স.)-এর দিকে ফেরানাে হচ্ছে। তার জাতি চরম অহংকার করার কারণে তার সাথে যে তর্কে লিপ্ত হচ্ছে, সে অবস্থায় তাকে সবর করার জন্যে বিশেষভাবে উপদেশ দেয়া হচ্ছে। তাকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করা হচ্ছে যে, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্যের ওয়াদা সর্বাবস্থাতেই সত্য, সে সাহায্য আসবেই, সে ওয়াদার কিছু অংশকে তার জীবদ্দশায় তিনি হয়ত পূরণ করবেন, অথবা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রিয় বন্ধুকে তার কাছে তুলে নেবেন এবং সকল কাজের দায়িত্ব তাঁর কাছ থেকে ফিরিয়ে নেবেন। কী ফয়সালা তিনি করবেন সেটা সম্পূর্ণ তার ব্যাপার। রসূলুল্লাহ(স.)-এর দায়িত্ব তাে শুধু মানুষের কাছে আল্লাহর কথা পৌছে দেয়া, তারপরই তিনি দায়িত্বমুক্ত। সবাইকে অবশেষে তার কাছেই ফিরে যেতে হবে, তাই তাঁকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘অতএব ধৈর্য অবলম্বন করো, নিশ্চয়ই আল্লাহর ওয়াদা সত্য। আমি আমার ওয়াদা করা সাহায্যের কিছু অংশ যদি আমি এখন তােমাকে দেখিয়ে দেই, অথবা যদি (তা দেখানাের আগে) তােমাকে আমি আমার কাছে তুলে নেই (সেটা হবে আমার মর্জি) জেনে রেখাে, অবশেষে আমার কাছেই সবাইকে ফিরে আসতে হবে।’ এখানে আমাদের চিন্তাস্রোত একটা মােড়ে এসে থেমে যাচ্ছে, সেখানে বেশ গভীরভাবে তাকে চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে এবং খুবই সন্তর্পণে ও যথাসাধ্য ধীরস্থীর ভাবে তাকে তার গন্তব্যপথ বেছে নিতে হচ্ছে। তিনি হচ্ছেন সেই রসূল, যাঁকে তার জাতির তরফ থেকে চরম বিরােধিতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রত্যাখ্যান, দাম্ভিকতা, অমান্যতা ও চরম অবজ্ঞায় কষ্ট পেতে হচ্ছে। এসময়ে তাঁকে যা বলা হচ্ছে তার অর্থ দাঁড়ায়, তুমি তােমার দায়িত্ব পালন করো এবং তার কাছেই আশ্রয় গ্রহণ করাে, পরিণতি কী হবে সেটা তােমার ব্যাপার নয়। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব(স.) এ হুকুম যথাযথভাবেই তামিল করেছিলেন, যার ফলে এতােসব কঠিন অবস্থায়ও তিনি সান্তনা-বােধ করছিলেন। তার অন্তরের মধ্যে একথা বিরাজ করছিলাে যে, তিনি দেখতে পাবেন, সেই উদ্ধত ও প্রত্যাখ্যানকারীদের ওপর অবশ্যই কিছু না কিছু আযাব এসে পড়েছে, বেশীদিন তাঁর অন্তরকে ঝুলিয়ে রাখা হবে না! আল্লাহ রব্বুল আলামীন অবশ্যই তার কাজ করবেন এবং তার কাজ করার জন্যে তিনিই যথেষ্ট। তার ওয়াদা তিনি পালন করবেনই এবং তার রাজ্যে তার ক্ষমতা অবশ্যই চলবে। সুতরাং এটা নবীর নিজের কোনাে সমস্যা নয় এবং কোনো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া এটা তার ব্যাপারও নয়। সকল কাজই আল্লাহর কাজ এবং তিনি তাইই করেন যা তিনি করতে চান। ইয়া আল্লাহ! হে মহামহিম সম্রাট, হে পরওয়ারদেগারে আলম, হে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা-বিধানকারী, তুমি আমাদের আকুল আবেদন শুনাে, তােমার সম্মানিত ও পেয়ারা নবীর পদাংক অনুসরণ করে যারা বাতিলের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তাদের করুণ কন্ঠের দোয়া কবুল করাে, যারা তােমার নবীর পথে থেকে এ দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে তাদেরকে তুমি সাহায্য করো। এতােসব কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটা মানুষের জন্যে সত্যিই একটা কঠিন ব্যাপার। এ এমনই এক ব্যাপার যেখানে বড় ধৈর্যের প্রয়ােজন, প্রয়ােজন বড় শক্ত হৃদয়ের। এখানে যে জিনিসটি মানুষকে তার মিশনে অনমনীয় করে রাখতে পারবে, তা হচ্ছে সকল অবস্থাতেই অবিচল হয়ে থাকা এবং কোনাে অবস্থাতেই মুষড়ে না পড়া। এই সবর-এর কথাটাকেই আলােচ্য সূরার মধ্যে বিশেষ প্রতিপাদ্য বিষয় হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। এ সবর-এর গুণটি অর্জন করার জন্যে ইতিপূর্বে বারবার বলা হলেও এই সূরার মধ্যে এক নতুন আংগিকে এই মহামূল্য গুণটি পয়দা করার জন্যে বিশেষভাবে তাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। সত্যের দিকে দাওয়াত দানকারীদের হঠকারী ও আল্লাহদ্রোহী গােষ্ঠীর তরফ থেকে যে কষ্ট দেয়া হয়, যে অহংকার প্রদর্শন করা হয় এবং যেভাবে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয় তাতে হয়তাে তাদের সবর থেকেও আরও বেশ কিছু কঠিন গুণ গ্রহণ করা প্রয়ােজন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সেই সব মহামূল্যবান গুণের অধিকারী হওয়ার তাওফীক দান করুন যা তাঁর দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে আজ বড় প্রয়ােজন! বিভিন্ন মানবীয় ঝোঁক প্রবণতা ও প্রবৃত্তির তাড়ন থেকে এ প্রশ্নে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখা এবং দেখতে থাকা যে আল্লাহ তায়ালা তার দুশমন এবং তার দাওয়াতের বিরােধীদের সাথে কী ব্যবহার করেন। এটি একটি কঠিন অবস্থা। কারণ মানুষ হিসাবে সেই সব অপরাধীদের বিরুদ্ধে মনটা বিক্ষুব্ধ হয়ে থাকে এবং মন চায় যে তাদের প্রতি কঠিন একটা শাস্তি নেমে আসুক। এটা মানুষের প্রকৃতির সাধারণ দাবী। কিন্তু মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মেহেরবাণী ও তাঁর বিবেচনা আমাদের কল্পনার বাইরে। তিনি প্রকৃতপক্ষে ভালোদেরকে খুঁজে বের করেন এবং মন্দের মধ্য থেকে বেরিয়ে এসে ভালাে কাজে মনােনিবেশ করলে তাদেরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করেন। তিনি সকল মহল থেকে ভালাে লােকদেরকে খুঁজে বের করে নিয়ে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দান করার নির্দেশ দেন। তাদেরকে ভালাের দিকে টানতে উৎসাহিত করেন এবং একথা জানান যে, তাদের মধ্যেও অনেক ভালাে লােক থাকা সম্ভব, যদিও দ্বীন-ইসলামের বিরােধিতা করায় ওদের বিরুদ্ধে মন খারাপ হয়ে থাকে। আলােচ্য আয়াতগুলাে অধ্যয়নকালে অন্তরের মধ্যে যখন এভাবে পরিবর্তন অনুভূত হয় সেই সময় এবং সেই সকল নাযুক মুহূর্তে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে প্রার্থনারত হৃদয়গুলােকে তার কাছে সােপর্দ করা দরকার। এই নশ্বর পৃথিবীতে আশা আকাংখা, লােভ লালসা ও চাহিদা সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার সময় এই নিবেদিত প্রাণের আকুতিভরা আত্মসমপর্ণই মােমেনের একমাত্র রক্ষাকবচ। কেননা এসব অদম্য চাহিদা ও খাহেশ সর্বাগ্রে মানুষকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়, আর পরক্ষণেই শয়তান চাহিদা জগতের সীমাহীন হাতছানিতে সাড়া দেয়ার জন্যে তাকে অবিরতভাবে উস্কানি দিতে থাকে তখনই সে আবেগের মহাসাগরবক্ষে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। এই অসহায় অবস্থা থেকে বাঁচানাের জন্যে মহাদয়াময় পরওয়ারদেগারে হাকীম সর্বকালে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন।

# এইটিই হচ্ছে বিগত অধ্যায়ের শেষের দিকে আলােচিত বিষয়ের সম্পূরক কথা; এইটিই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ(স.) ও মােমেনদের হৃদয়কে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করে অবিচল ও দৃঢ় আস্থা নিয়ে ঈমানের পথে টিকে থাকার শেষ রক্ষাকবচ। যখন এইভাবে মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এবং বিগলিত ধারায় তার অশ্রু ঝরাতে থাকে তখনই মহান আল্লাহর রহমতের দরিয়ায় জোয়ার দেখা দেয়, আর তিনি তার মনকে নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ত ও অবিচল বানিয়ে দেন। তখন তাদের জন্যে তার ওয়াদা বাস্তবায়িত হয় এবং সত্যের দুশমনদের প্রতি তাদের প্রাপ্য শান্তি নেমে আসে। অবশ্য রাসূলুল্লাহ(স.) এর জন্যে আল্লাহর দেয়া এ ওয়াদা তার জীবদ্দশায় বাস্তবায়িত হবে, না তার ওফাতের পর মানুষ তা দেখবে- সেটা আল্লাহরই ইচ্ছা। এতে তার কিছু করার নাই, যেহেতু এ বিষয়ে ফায়সালা করা তাঁর নিজের ব্যাপার নয়। তার কাজ হচ্ছে, যে আকীদা নিয়ে তিনি এসেছেন তার প্রচার ও প্রসার ঘটানাে, মােমেনদেরকে শিক্ষাদান এবং এ আকিদাকে প্রতিহত করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত বিরােধী ও অহংকারী জনগণকে বুঝানাের জন্যে অবিরাম চেষ্টা করে যাওয়া। এ বিষয়ে ফয়সালার মালিক আল্লাহ তায়ালা নিজেই। তিনিই এ আন্দোলনকে পরিচালনা করতে থাকবেন এবং যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে তার নিবেদিত প্রাণ বান্দাদেরকে তার কাজের দিকে অগ্রসর করে দেবেন। এবারে এখানে নতুন আর একটি বিষয় সংযােজিত হচ্ছে এবং সেই সাথে সূরাটিরও সমাপ্তি টানা হচ্ছে। এ প্রসংগে মূল আলােচ্য বিষয় থেকে সাময়িকভাবে নযরকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ ও অতি পুরাতন কাহিনীর অবতারণা করা হচ্ছে, এ কাহিনীর মধ্যে যে বিষয়টি আলােচিত হয়েছে সেটা আসলে পৃথক কোনাে বিষয় নয় এবং সেটা মােহাম্মদ(স.)-এর ব্যাপারেই যে শুধু ঘটেছিলাে তাও নয়। প্রত্যেক যুগেই মানুষের পক্ষ থেকে রসূলদের কাছে নবুওতের প্রমাণস্বরূপ মােজেযা বা অলৌকিক ক্ষমতা দেখানাের দাবী করা হয়েছে এবং এসব দাবী দ্বারা তাদেরকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করার চেষ্টা হয়েছে। তাদের সাথে অহংকারপূর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে এবং তাদেরকে এতবেশী কষ্ট দেয়া হয়েছে যে, তাঁরা প্রত্যেকেই কামনা করেছেন, আহ্ যদি তারা সাথে সাথে সেই রকম বিশেষ কোনাে ক্ষমতা দেখাতে পারতেন! যদি অলৌকিক কোনাে ক্ষমতা দ্বারা মিথ্যা আরােপকারীদের নমনীয় করা যেতাে! কিন্তু এটা অতীব সত্য কথা যে, আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা বা অনুমতি ছাড়া কারও পক্ষেই কোনাে বিশেষ ক্ষমতা দেখানাে সম্ভব নয়। তাদের কাজ তাে শুধু দাওয়াত পৌছানাে, কোনাে অলৌকিক ক্ষমতা দেখানাের মাধ্যমে কাউকে ঈমান আনতে বাধ্য করা তাঁদের কাজ নয়। তারা দাওয়াত দেবেন, এ দাওয়াত কে কোনভাবে গ্রহণ করলাে, কার অন্তরে এর কী প্রভাব পড়লাে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় কে কী দাবী করলাে সে বিষয়ে তাদের চিন্তা করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। এ দাওয়াতকে আল্লাহ তায়ালা যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করবেন, চাইলে তাদের কাছে এ দাওয়াতকে গ্রহণযােগ্য বানাবেন, না চাইলে না বানাবেন। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের শক্তি ক্ষমতার নিদর্শন গােটা সৃষ্টির বুকে ছড়িয়ে রয়েছে, প্রত্যেক যুগে ও প্রত্যেক দেশেই মানুষের নযরে এগুলাে ছিলাে, চাইলে যে কোনাে মানুষ এসব থেকে আল্লাহর অস্তিত্ব ও ক্ষমতার নিদর্শন দেখতে পারে, প্রয়ােজন শুধু একটা আকাংখী মন। এসব নিদর্শনের মধ্যে এখানে গৃহপালিত পশু এবং সমুদ্রগামী জাহাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারপর ইশারা করা হয়েছে সামগ্রিকভাবে সেইসব বিষয়ের দিকে, যেগুলােকে কেউই অস্বীকার করতে পারে না। এরপর সূরাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে অতীতের সেই সকল জাতির সত্য বিরােধী তৎপরতার ইতিহাস উল্লেখের মাধ্যমে, যারা সত্যকে পর্যুদস্ত করার জন্যে কোনাে চেষ্টাকেই কাজে লাগাতে কসুর করেনি। তাদের শক্তি সামর্থ, জ্ঞান বুদ্ধি, স্থাপত্য, কলা কৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিস্তার প্রসারের কারণে নিজেদের সম্পর্কে তারা অনেক বেশী চিন্তা করে ফেলেছে। ভুলে গেছে যে, এসবের লয় আছে, ক্ষয় আছে এবং এসবের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব তাদের কারাে হাতেই নেই। সাময়িকভাবে ব্যবহার করার জন্যে এসব বিদ্যা বুদ্ধিকে আমানত স্বরূপই তাদেরকে দেয়া হয়েছে, একথা ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী অবশেষে তাদের ওপর শান্তি নেমে এসেছে। অতপর, যখন তারা আযাবকে নিজেদের চোখে দেখে নিয়েছে তখন তারা ঈমান এনেছে, কিন্তু তখন তাদের ঈমান আর কোনাে কাজে লাগেনি (অর্থাৎ সে ঈমান কবুল করে তাদেরকে আযাব থেকে রেহাই দেয়া হয়নি), বরং আল্লাহর নিয়ম অনুযায়ী সেই কাফেররা চরমভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’  *দ্বীনের দায়ীদের দায়িত্ব ও সীমাবদ্ধতা : অতীতের সেইসব ঘটনাবলীর উল্লেখের সাথে সূরাটিকে সমাপ্ত করা হচ্ছে। হক ও বাতিলের মধ্যে সংঘর্ষের ফয়সালার দৃষ্টান্ত পরিষ্কারভাবে সামনে এসে গেছে। ঈমান ও কুফরীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং আনুগত্য ও বিদ্রোহাত্মক ব্যবহারের মধ্যে বিরাজমান ঝগড়ারও চূড়ান্ত মীমাংসাও হয়ে গেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর আমি মহান আল্লাহ, তােমার পূর্বে রাসূল পাঠিয়েছি আর সে সময়ে বাতিলপন্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’(আয়াত ৭৮) এ বিষয়ের জন্যে পূর্বের বহু ঘটনা প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে কাজ করছে, যেগুলাের কিছু কিছু আল্লাহ তায়ালা তার রসূলকে এই আল-কোরআনের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। আবার এমনও অনেক ঘটনা আছে সেগুলাে সম্পর্কে আল কোরআন কিছুই জানায়নি। আল কোরআন রসূলদের মূখ্য দায়িত্ব সম্পর্কে বলেছে এবং তাদের জীবনের দীর্ঘ কর্মধারা সম্পর্কেও জানিয়েছে। অতীতের সেই সব ঘটনাবলী থেকেই নবীদের নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার কোনাে পরিবর্তন নেই। সেইসব শিক্ষা থেকে তাদের দায়িত্বসমূহ ভালােভাবেই জানা যায়, জানা যায় তাদের কাজের সীমাসমূহ সম্পর্কেও। এ আয়াতটি এমন একটি সত্যের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে যা প্রকৃতপক্ষে যে কোনাে সত্যাশ্রয়ীর অন্তরের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই সত্যের ওপর নির্ভর করার কথা বলছে, যাতে করে মানুষ দৃঢ়তার সাথে সেই সত্যকে মযবুত করে ধরতে পারে; এরশাদ হচ্ছে, ‘কোনাে রসূলের পক্ষেই আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোনাে আয়াত বা কোনাে নিদর্শন আনা সম্ভব নয়।’ কোনাে মানুষ এমনকি আল্লাহর কোনাে রসূলের পক্ষেও আশা করা বা দাবী করা সম্ভব নয় যে, তিনি তার দাওয়াতকে কার্যকরভাবে মানুষের সামনে পেশ করবেন। অথবা আশা করবে যে অহংকারী ব্যক্তিরা তার দাওয়াতের প্রতি ধাবিত হবে, কিংবা সত্যের পক্ষে এমন কোনাে অলৌকিক ক্ষমতা তিনি দেখিয়ে দেবেন, যার ফলে অহংকারী ব্যক্তিরা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবে। বরং আল্লাহ তায়ালা চান তার পছন্দনীয় বান্দারা বিরােধী পরিবেশে এবং প্রতিকূলতার মধ্যে অস্থির না হয়ে দৃঢ়তা অবলম্বন করুক এবং সকল অবস্থার সাথেই তারা নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিক; এর ফলে তাদের কাছে একথাটি স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, তাদের এখতিয়ারে কিছুই নেই। এখানে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে তারা দাওয়াতের কাজ করে যাবে। কোনো অলৌকিক নিদর্শনের মাধ্যমে তাদেরকে সাহায্য করা, তাদের মনকে পরিতৃপ্ত করা, তাদেরকে অবিচলিত করা, এটা একমাত্র আল্লাহরই হাতে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন চান, তাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় যতােটুকু সাফল্য আসে তাতেই তারা খুশী থাকুক। আল্লাহ তায়ালা আরও চান, মানুষ সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার উলুহিয়্যাত (সার্বভৌমত্ব) এবং নবুওতের প্রকৃতিকে অনুধাবন করুক। তারা জানুক যে, নবীরা তাদের মতােই মানুষ এবং তাদের মধ্য থেকেই তাদের আগমন ঘটেছে। তারা আরও জেনে নিক যে, মানুষ হওয়ার সাথে সাথে তাদেরকে এই বৈশিষ্ট্যও দেয়া হয়েছে যে গােটা মানব মন্ডলীর মধ্য থেকে মানুষের শিক্ষক হিসেবে তাদেরকে বেছে নেয়া হয়েছে। এজন্যেই তাদের চরিত্রকে নির্মল নিখুঁত বানানাে হয়েছে এবং এমন কিছু বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বানানাে হয়েছে যেন চিন্তা করলে তারা বুঝতে পারে যে, তারা মানুষ হওয়া সত্তেও এমন কিছু গুণের অধিকারী হয়, যা ইচ্ছা করলেই কোনাে মানুষ নিজে নিজে অর্জন করতে পারে না। মানুষ স্বভাবতই ব্যস্ত চরিত্রের অধিকারী এবং একারণেই তারা তাড়াতাড়িই নবীর কাছে কোনাে অলৌকিক ক্ষমতার দাবী করে। এসব দাবীর মধ্যে আযাব নাযিল করার দাবীও রয়েছে: কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সাথে সাথে কোনাে মােজেযা দেখান না এবং জলদি করে কোনাে শাস্তিও নাযিল করেন না। কারণ তিনি মহা দয়াময় তিনি চান মানুষ একটু চিন্তা করুক এবং তাদেরকে দেয়া বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সত্য সঠিক পথে এগিয়ে আসুক; সুতরাং মােজেযা দেখাতে বিলম্ব করা প্রকারান্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ রহমত। যেহেতু আগেই এটা জানানাে হয়েছে যে, মােজেযা প্রকাশিত হওয়ার পর যদি কেউ সাথে সাথে তাকে গ্রহণ না করে, তাহলে অবিলম্বেই চরম আযাব নাযিল হয়ে যাবে এবং তার থেকে বাচার আর কোনাে উপায়ই থাকবে না। এজন্যে মোজেযা বা আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার সরাসরি নিদর্শন পেশ করতে বিলম্ব করায় বিরােধীদেরকে যে সুযােগ দেয়া হয় তা তাদের জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে এক বিরাট মেহেরবানী। এরশাদ হচ্ছে, ‘অতপর যখন আল্লাহর হুকুম এসে যাবে, তখন যথাযথভাবে তিনি চূড়ান্ত ফয়সালা করে দেবেন। তখন অবশ্যই বাতিলপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ যখন এই আযাব এসে যাবে তখন ভালাে কাজ করার বা তাওবা করে সংশােধিত হয়ে যাওয়ার আর কোনাে সুযােগ থাকবে না। আর আল্লাহ রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে আখেরী ফায়সালা এসে যাওয়ার পর পেছনে ফিরে যাওয়ারও আর কোনাে উপায় থাকবে না।
*মানবজাতির প্রতি আল্লাহর অসীম করুণা : এরপর সাধারণ মানুষের মনােযােগকে আকর্ষণ করা হচ্ছে। তাদের সেইসব মানুষের দিকে তাকাতে বলা হচ্ছে, যারা চাইছে তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর শক্তি ক্ষমতার নিদর্শনাবলী নাযিল হােক। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে দীর্ঘদিন ধরে এহসান করে চলেছেন তাই তারা তার কথা ভুলেই গেছে, অথচ তারা একটু চিন্তা করলেই প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা আল্লাহর আলৌকিক ক্ষমতা দেখতে পারতাে; এমনকি আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব কে তারা প্রত্যক্ষ করতে পারতাে। আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কেউ সৃষ্টি কাজে অংশীদারিত্ব রাখে বলে যারা দাবী করে তাদের দাবীর অসারতাও তাদের কাছে প্রমাণিত হয়ে যেতাে, এ দাবীও তাদের বাতিল হয়ে যেতাে যে, এসব কিছু এমনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে, এর পেছনে কোনাে সৃষ্টিকর্তা নেই। যেমন এরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালাই সেই মহান সত্ত্বা যিনি তােমাদের জন্যে সকল জীব জন্তু বানিয়েছেন, যাতে করে তােমরা সেগুলােতে আরােহন করাে এবং তাদের মধ্যে অনেক পশু এমনও আছে যেগুলোর গোশত তােমরা খাও… সুতরাং তােমরা আল্লাহর কোন কোন নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করছাে?’ (আয়াত ৭৯-৮১) এসব জীব জানােয়ারকে মানুষের মতােই অলৌকিক বা আশ্চর্য সৃষ্টি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিলাে, তাদের প্রসার ঘটা, তাদের গঠন প্রক্রিয়া এবং চেহারা ছবি সব কিছুই আশ্চর্যজনক। এগুলােকে মানুষের কাছে অবনমিত করা এবং তাদেরকে মানুষের নিয়ন্ত্রণাধীন করা সবই এক বিস্ময়কর ঘটনা বটে! এমনকি এসব জীব জন্তুর মধ্যে এমন জন্তুও আছে যা মানুষের তুলনায় বহু গুণ বিশিষ্ট দেহের অধিকারী এবং অনেক বেশী শক্তিশালী। বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা সেই সত্তা যিনি তােমাদের জন্যে গৃহপালিত পশু বানিয়েছেন যার ওপর তােমরা আরােহন করাে আর যার থেকে তােমরা ভক্ষণও করাে…’ এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির কথা মােটেই গ্রহণযােগ্য নয়, যে বলে এগুলো সব এমনি এমনিই পয়দা হয়েছে। তারপর আপনা থেকেই সব চলছে এবং এমনি এমনিই একদিন সব শেষ হয়ে যাবে; বরং তারা অত্যন্ত অকৃতজ্ঞতার সাথে বলে; এগুলাে মানুষের জন্যে এমন আশ্চর্যজনক কিছু নয়। তারা এটাও বলে; এগুলােকে দেখে নাকি সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কোনাে আন্দাজই করা যায় না। মূলত আল্লাহ তায়ালাই তাদের গড়ে তুলেছেন, তাদেরকে নানারকম বৈশিষ্ট্য দিয়েছেন এবং এদেরকে মানুষের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। এসব আশ্চর্য নিদর্শন ও বড় বড় নেয়ামতের বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘যেন তােমরা এগুলোর ওপর আরােহন করাে এবং এগুলাে থেকে তােমরা খাদ্যও সংগ্রহ করাে… এদের ওপর তােমরা সওয়ার হও এবং সমুদ্রগামী জাহাজে আরােহন করে তােমরা সফর করে।’ এ আয়াতগুলাে যখন নাযিল হচ্ছিলাে তখন এসব পশুর ব্যবহার সম্বন্ধে তাদের অন্তরের মধ্যে যে সব কথা ছিলাে সে সম্পর্কে মানুষদের তেমন জানা ছিলাে না। তখনকার দিনে তাে এগুলােকে যান-বাহন হিসেবেই ব্যবহার করা হতাে, এমনকি এই চরম বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষের যুগেও, যখন ট্রেন, বাস ও বিমানের এতাে প্রাচুর্য ও উন্নতি, সে সময়েও বহু দুর্গম পর্বতাঞ্চল এমন আছে যেখানে এসব পশুর ওপর আরােহন করে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনাে গত্যন্তর নেই এবং ভবিষ্যতেও সেইসব অঞ্চলে এসব পশুকেই যানবাহন হিসাবে ব্যবহার করতে হবে, কারণ সেখানকার পথঘাট এমনই আঁকা-বাঁকা, খাড়াই উৎরাই ও সংকীর্ণ যে সেসব এলাকার সফরে গাধা, খচ্চর ও ঘােড়া ছাড়া অন্য কোনাে যানবাহন কোনাে সময়েই উপযােগী নয় । এজন্যেই বলা হয়েছে, ‘এগুলাের ওপর তােমরা আরােহন করানো এবং জাহাজে তােমাদেরকে সওয়ার করানাে হয়।’ এই সব জীব জানােয়াররের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, মানুষের ব্যবহারের জন্যে কতাে নিপুণভাবে এদের উপযােগী বানিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এগুলােকে মানুষের আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন। এগুলাে কি আল্লাহর মােজেযা বা নিদর্শনাবলীর মধ্যে উল্লেখযােগ্য বিষয় নয়? অবশ্যই মানুষের জন্যে বরাদ্দ করা নেয়ামতসমূহের মধ্যে এগুলাে উল্লেখযােগ্য। আরও ভেবে দেখার বিষয় যে, পানির উপরিভাগ দিয়ে ভ্রমণরত নৌকা ও জাহাজসমূহ অনাদিকাল থেকে মানুষের যানবাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এগুলাে আল্লাহর অলৌকিক অবদানসমূহের মধ্যে অন্যতম এবং তার শক্তি ক্ষমতার জলজ্যান্ত উদাহরণের নমুনা। এগুলাে সবই আল্লাহ তায়ালা এই সৃষ্টির জন্যে কর্ম উপযােগী করে বানিয়েছেন, যেমন করে তিনি বানিয়েছেন এর আকাশ ও পৃথিবী, স্থল ও পানি ভাগ । এ পৃথিবীর প্রকৃতির মধ্যে যেসব বস্তু ও উপাদান রয়েছে সে সবের দিকে একটু খেয়াল করলেই বুঝা যাবে অকুল সাগরে ভাসমান এসব নৌকা ও জাহাজ কতাে রহস্যময়, তা পাল তুলেই চলুক, বা বাম্প ইঞ্জিনের দ্বারা চালিত হােক অথবা আনবিক শক্তি চালিত ইঞ্জিনের সাহায্যেই চলুক কিংবা এসব ছাড়া আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত অন্য শক্তি বা জীব জানােয়ারের সাহায্যেই চালিত হােক, এগুলাে সবই আল্লাহর নেয়ামত। তার নেয়ামত হিসাবে সবগুলােই তাঁর নযরে সমান। বিগত সময়ের সেইসব নেয়ামতের সমতুল্য আজকের বহু নেয়ামতও পৃথিবীর বুকে বর্তমান রয়েছে এবং যেগুলাের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা কোনা মানুষই অস্বীকার করতে পারবে না।
*আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতার পরিণতি : ‘তিনি তােমাদেরকে তাঁর নিদর্শনসমূহ দেখাচ্ছেন; সুতরাং আল্লাহ তায়ালার কোনাে আয়াত (নিদর্শন) গুলােকে তোমরা অস্বীকার করছাে?’ উপরের আয়াতে বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে কেউ কেউ এমন আছে যারা আল্লাহর শক্তি ক্ষমতাকে স্বীকার করে না। এক দল লােক আছে যারা সত্যকে পর্যুদস্ত করার জন্যে যুক্তিহীনভাবে তর্ক বিতর্ক করে, আসলে এরা শুধু বিরােধিতা করার জন্যেই বিরোধিতা করে, অথবা ব্যক্তি স্বার্থ বা অহংকার প্রদর্শন কিংবা ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে, সত্য ছাড়া অন্য যে কোনাে জিনিস চালু করার হীন উদ্দেশ্যে নানাপ্রকার কূটতর্কের অবতারণা করে। আবার এমনও কোনাে কোনাে লােক এ সমাজে আছে যে ব্যক্তি ফেরাউন এবং তার মতােই অন্যান্য বলদর্পীদের মতাে নিজের বড়ত্বকে প্রমাণ করা এবং নিজের প্রাধান্য বিস্তার করার জন্যে নবী(স.)-এর সাথে ঝগড়া করে, তার ভয় থাকে। যদি লােকেরা নবী(স.)-এর কথা শুনতে শুরু করে দেয় এবং তার প্রাধান্য যদি সত্যিই কায়েম হয়ে যায় তাহলে সে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যাবে, কারণ তার ক্ষমতা তাে নানাপ্রকার ভুল তথ্য ও কল্প-কাহিনীর ওপরই টিকে আছে এবং এর দ্বারাই সে সত্যকে দাবিয়ে রাখছে। এখন সে যদি এক আল্লাহর দাস হয়ে যায় তাহলে তার ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার মসনদ খান খান হয়ে ভেংগে পড়বে। আবার কেউ কেউ এজন্যেও নবী(স.)-এর আনীত সত্যের বিরােধিতা করে যে, সে যে মত ও পথের ওপর টিকে আছে, সত্য সমাগত হয়ে গেলে তার সে ভুল মতাদর্শ ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে। মানুষের অন্তরে আসমানী সত্যের জয়-জয়কার শুরু হয়ে যাওয়ার পর সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ ভেংগে খান খান হয়ে যাবে; যেহেতু এর প্রবক্তারা চেয়েছিলাে মানুষকে নিছক পৃথিবীভিত্তিক এক জীব বানাতে, তারা মানুষকে বুঝিয়েছিলাে যে, মানুষ পৃথিবীতে নিজে নিজেই এসেছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর তারা মরে যাবে এবং পৃথিবীর মাটির সাথে মিশে তারাও মাটি হয়ে যাবে। এর পরবর্তীতে কিছু নেই, প্রয়ােজনও নেই; সতরাং যতােদিন পৃথিবীতে তারা বেঁচে আছে তাদের পেটের চিন্তাই করা দরকার। পেট আছে বলে তাদের ক্ষুধা আছে এবং সেই পেট পুর্তির জন্যে প্রয়ােজন খাদ্য আর তা লাভ করার জন্যে প্রয়ােজন পরিশ্রমলব্ধ পয়সা রোজগার। তাদের আরও প্রয়ােজন আছে জীব-জানোয়ারের মতাে ইন্দ্রিয় চাহিদা মেটানাের ব্যবস্থা। অতএব জীব-জানােয়াররা সেগুলাে যেমনভাবে মেটায়, তারাও সেইভাবে মেটাবে। এসব চাহিদা মেটানাের জন্যে এসব মানুষরূপী জীব জানােয়াররা যেমন মধ্যযুগে গীর্জার ইতিহাসে কিছুসংখ্যক স্বার্থপর মানুষের কর্তৃত্ব কায়েম করেছিলাে, পরবর্তীতে তাদেরই সন্তানরা সেইসব কুক্ষিগত মানুষের গােলামী থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে আর এক চরম পন্থা অবলম্বন করে গীর্জার সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, কারণ ওরাও মানুষের মুক্তির দোহাই দিয়ে এক সময় মানুষের কাছ থেকে নিরংকুশ আনুগত্যের দাবী করেছিলাে। এখানে দেখা যায় দু’পক্ষেরই যুক্তি রয়েছে। প্রত্যাখ্যানকারীরা যখন বিরােধী ভূমিকায় নেমে গেছে তখন তারা গীর্জার কর্তৃত্বের দাবীকে তাদের মুখের ওপর ছুঁড়ে মেরেছে। প্রাকৃতিক যুক্তি ছাড়াও এই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং এই গীর্জার প্রভুত্ব খতম হওয়ার পেছনে আরাে বহু কারণ ছিলাে-তা অল্প বিস্তর আমাদের সবার জানা। আজ বিশ্ব বিবেকের কাছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবক্তাদের প্রচার ও প্রসারের অযৌক্তিকতা ধরা পড়ে গেছে এবং সাথে সাথে মানব কল্যাণে ইসলামের বলিষ্ঠ ভূমিকাও মানুষের বিবেকের কাছে আবেদন রাখতে শুরু করেছে। পরিশেষে এ পর্যায়ের শেষ ও চূড়ান্ত শক্তিশালী যুক্তিটি আসছে, ‘ওরা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করে না এবং দেখে না কি কঠিন পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে তাদের পূর্ববর্তী লােকেরা? তারা তাে পৃথিবীর বুকে সংখ্যা ও শক্তিতে এবং প্রভাব প্রতিপত্তিতে ওদের থেকেও অনেক বেশী ছিলাে; কিন্ত অবশেষে অস্বীকারকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’(আয়াত ৮২-৮৫) এধরনের বহু ধ্বংসের কাহিনী মানবজীবনের প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় বিধৃত হয়েছে, যা বিদগ্ধ পাঠকের জ্ঞান-পিপাসা নিবারণের জন্যে যথেষ্ট। এসব ঐতিহাসিক ঘটনার কোনাে কোনােটা অত্যন্ত শিক্ষাপ্রদ বিধায় আজও মানুষের মধ্যে তা কিংবদন্তী আকারে ছড়িয়ে রয়েছে। এসবের মধ্যে কোনাে ঘটনা মানুষের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এর পাশাপাশি আল কোরআন মানব প্রকৃতি ও তার বিবেককে লক্ষ্য করে এমনসব যুক্তিপূর্ণ কথা বলছে, যা প্রকৃতির তাৎপর্যকে ফুটিয়ে তুলছে এবং যা তার চলার পথ সম্পর্কে তাকে সঠিক নির্দেশনা দিচ্ছে, তাকে তার অবস্থান সম্পর্কেও প্রয়োজনীয় হেদায়েত দিচ্ছে। তাদেরকে সেসব সিংহদ্বারের কথাও জানিয়ে দিচ্ছে যা তাদেরকে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌছে দিতে পারে। এই পথে যখন নিবেদিতপ্রাণ মানুষেরা অগ্রসর হবে তখন তাদের জন্যে এগুলো খুলে দেয়া হবে, কোনাে কোনােটা হালকা খটখটানির সাথে খুলে দেয়া হবে এবং কোনাে কোনােটা খােলা হবে অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর। এখানে নানাপ্রকার কথা তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে এবং সেই সময়কার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যে পৃথিবীর জীবনকে সহজ সরল বানানাে হবে। সেই সফরে মানুষ যেন খােলা চোখে, কম্পমান অনুভূতি নিয়ে এবং দৃষ্টিসম্পন্ন অন্তর দিয়ে ওখানকার সব কিছুর দিকে তাকায়। ইতিপূর্বে পৃথিবীর জীবনে তারা কি অবস্থায় থেকেছে তা যেন তারা দেখতে পায় এবং সেখানে তাদের ওপর কি ঝড় তুফান সংঘটিত হয়েছে সেগুলােও তাদের সামনে হাযির করা যায়; এরশাদ হচ্ছে; ‘ওরা কি পৃথিবীর বুকে ভ্রমণ করেনি এবং দেখেনি সেখানে তাদের পূর্বেকার মানুষের অবস্থা কেমন হয়েছিলাে?’ এপর্যায়ে তাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হবে সে বিষয়ে বলার পূর্বে সেইসব লােকের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করতে বলা হচ্ছে, যারা পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। তারপর তাদের এবং নিজেদের অবস্থাকে পাশাপাশি রাখতে বলা হচ্ছে, যেন তাদের পক্ষে তাদের নিজেদের জীবনের পরিমাপ করাটা সহজ হয় এবং তারা সঠিকভাবে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। বলা হচ্ছে, ওরা সংখ্যায় ওদের থেকে অনেক বেশী ছিলাে এবং পৃথিবীর বুকে তারা ছিলাে অধিক শক্তিশালী ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী। এতে জানানাে হচ্ছে যে পূর্বেকার মানুষেরা এদের তুলনায় যেমন ছিলাে সংখ্যায় বেশী, তেমনি শক্তিসামর্থ উন্নতি অগ্রগতি বিবেচনাতেও তারা ছিলাে আরও অনেক বেশী অগ্রসর সেইসব যুগ এবং সেসব জনপদের বৃত্তান্ত আরবদের সামনেই ছিলাে। যাদের অনেকের কাহিনী আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসূলের কাছে বর্ণনা করেছেন এবং তাদের অনেকের কথাই আরবরা জানতাে, কিন্তু সে কথাগুলাে সরাসরি আল কোরআনে বর্ণিত হয়নি। ধ্বংসপ্রাপ্ত সেসব জাতির ঘটনাবলী আরবরা জানে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত সেইসব জাতির ধংসাবশেষের পাশ দিয়ে তারা যাতায়াত করতাে, কিন্তু পৃথিবীর জীবনে যা কিছু তারা উপার্জন করেছে তা তাদের কোনাে কাজে আসেনি অর্থাৎ, তাদের শক্তি, তাদের সংখ্যাধিক্য এবং তাদের দালান কোঠা যা নিয়ে তারা বড়াই করতাে এবং সে সব সুখ সম্পদের বস্তু নিয়ে তারা আখেরাতের চরম পরিণতির কথা ভুলে থাকতাে সেসব বস্তুসম্ভার সেই কঠিন দিনে তাদের কোনাে কাজেই লাগবে না। বরং সেদিন সেইসব জিনিসই তাদের দুর্ভাগের কারণ হবে এবং তাদের সেইসব পার্থিব জাঁকজমক সেদিন তাদের জন্যে চরম ধ্বংস ডেকে আনবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর যখন তাদের রসূলরা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছে তখন তারা তাদের কাছে মজুত থাকা জ্ঞান বিজ্ঞানের যােগ্যতা নিয়ে এবং তার দ্বারা অর্জিত সুখ সম্পদের বস্তু নিচয় নিয়ে ফুর্তি করতে থেকেছে, আনন্দে মেতে থেকেছে। ঈমান ব্যতীত জ্ঞান বিজ্ঞানের যে যােগ্যতা, তা হচ্ছে মূলত এক ফিৎনা (বা বিপজ্জনক বস্তু), তা এমনই বিপজ্জনক জিনিস, যা মানুষকে অন্ধ বানিয়ে দেয় এবং চরম অহংকারী করে তােলে। এই বাহ্যিক জ্ঞানের যে রং মানুষকে রঞ্জিত করে, তা তখনই মানুষকে ধোকার মধ্যে ফেলে দেয় যখন সে মনে করতে থাকে যে, তার জ্ঞান তাকে বিরাট শক্তি ক্ষমতার অধিকারী বানিয়ে দেবে এবং তাকে বহু মর্যাদার অধিকারী বানাবে। এই অনুভূতির ফলেই সেই সীমা অতিক্রম করতে থাকে। তার যোগ্যতা, পদমর্যাদা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ওপর সে এতাে বেশী আস্থাশীল হয়ে ওঠে যে, নিজের সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতার অনুভূতিটুকু পর্যন্ত সে হারিয়ে ফেলে, তার জীবনের বিরাট লক্ষ্যের কথা সে ভুলে যায় এবং এই বিস্মৃতি তাকে নাদান ও মূর্খ বানিয়ে ফেলে। সে ভুলে যায় যে, তার অস্তিত্ব এ বিশাল প্রকৃতির মধ্যে বর্তমান রয়েছে বটে, কিন্তু বিশ্ব প্রকৃতির কোনাে কিছুর ওপর তার কোনাে কর্তৃত্ব নেই, বরং সে জানেও না বিশ্বের কোথায় কি রয়েছে। সত্য কথা হচ্ছে যে, মানুষ যে কোনাে জিনিসের শুধুমাত্র প্রান্তিক অবস্থাটুকুই জানতে পারে, আর তারই কারণে তার অহংকারের সীমা নেই, আংশিক এতােটুকু জ্ঞানের দায়ে এমনভাবে সে ফুলতে থাকে যে, সে মনে করে, সে অধিকাংশ রহস্যই বুঝি ভেদ করে ফেলেছে। এই জ্ঞানের দম্ভের ফলে আসলে তার জ্ঞানকেই সে অপমান করে। এই দম্ভের কারণেই সে তার অজ্ঞতার কথা ভুলে যায়। অথচ তার মূর্খতা ও অজ্ঞতা তাৎক্ষণিকভাবে তার কাছে যদি ধরা পড়তাে, যদি শুধু সে একটু ভাবতাে যে কত কম সে জানে, আর কতাে বেশী সে জানে না তাহলে এই আংগিকে সে চিন্তা করতে পারতাে। যদি সে হিসাব করে দেখতো যে, বিশ্বের কয়টা জিনিসের ওপর তার কর্তৃত্ব রয়েছে, আর কত শত শত সহস্র জিনিস রয়েছে তার এখতিয়াবের বাইরে, কতােটুকু তার জ্ঞানের পরিধির মধ্যে ধরা পড়েছে আর কতাে অসংখ্য জিনিস অজানার অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছে, তাহলে তার জানার ওপর অহেতুক অহংকার করাটা থেমে যেতাে। সেই অপরিণামদর্শী মানব সন্তানরাই আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সৃষ্টি রহস্য যেটুকু জানে তাই নিয়েই আনন্দে অস্থির। শুধু তাই নয়, তাদের ঔদ্ধত্য এতােদূর পর্যন্ত পৌছে গেছে যে, তাদের জ্ঞানের পরিধির বাইরের কোনাে কিছু তাদের কাছে পেশ করা হলে তারা তা নিয়ে ঠাট্টা-মঙ্কারি ও বিদ্রুপ করতে শুরু করে দেয়। তাই সেই হতভাগা লােকদের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সম্পর্কে আল কোরআন জানাচ্ছে, ‘তাদেরকে তাদের সেই অহমিকাই ধ্বংস করে দিয়েছে, যা নিয়ে তারা(নবী (স.)-এর সাথে) ঠাট্টা-মঙ্কারি করে। তারপর যখন ওরা আল্লাহর আযাব দেখে নিলাে তখন তাদের সকল অহমিকা খতম হয়ে গেলাে। অতীতে যেসব বিষয় তারা অস্বীকার করেছে তা সবই তারা স্বীকার করলাে; তখন তারা আল্লাহর একত্বকে মেনে নিলাে এবং তিনি ছাড়া অন্য যাদেরকে তারা আল্লাহর শক্তি ক্ষমতায় অংশীদার মনে করতাে, তাদের সবাইকে অস্বীকারও করলাে কিন্তু তখন তাে সময় শেষ হয়ে গেছে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর যখন তারা আমার আযাব দেখে নিলাে, বললাে আমরা এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনলাম, যাদেরকে আমরা শরীক মনে করতাম তাদেরকে অস্বীকার করলাম, কিন্তু আমার আযাব দেখে নেয়ার পর তাদের ঈমান তাে আর কোনাে কাজে লাগলাে না।’ এ হচ্ছে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের চিরন্তন অপরিবর্তনীয় নিয়ম। আল্লাহর আযাব হয়ে যাওয়ার পর আর কারাে ঈমান কবুল করা হয় না, কারণ এটা সঠিক ঈমান নয়, এ হচ্ছে ভয়ে ঈমান আনা। এরশাদ হচ্ছে, ‘এ হচ্ছে আল্লাহর সেই নিয়ম যা অতীতে তাঁর বান্দাদের মধ্যে চালু থেকেছে আর আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিয়ম চিরস্থায়ী, যার পরিবর্তন হয় না।’ নড়বড়ে হয়ে যায় না এবং সে নিয়ম বাতিলও হয়ে যায় না। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘কাফেররা, সে সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেলাে। এই কঠিন দৃশ্যটি সামনে রাখলেই আল্লাহর সেই আযাবকে কল্পনা করা যায়। এ আযাবই সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের পাকড়াও করবে। তাদের আযাবের সেই দৃশ্যের মধ্যে যেন স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, তারা কাতরকণ্ঠে সাহায্য ভিক্ষা চাইছে, ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থর থর করে কাঁপছে, আনুগত্য করার ওয়াদা করছে এবং আত্মসমর্পণ করবে বলে কথা দিচ্ছে। এসব দৃশ্যের জীবন্ত কিছু ছবি তুলে ধরে সূরাটিতে সম্পর্কিত আলােচনার সমাপ্তি ঘটানাে হচ্ছে। এই সমাপ্তির সাথে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মর্যাদার কথাও বিশেষভাবে ঘােষণা করা হচ্ছে, যা ছিলাে সূরাটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সূরাটির বিভিন্ন অংশের আলােচনার মধ্যে আমরা আকীদা সম্পর্কিত অনেক কথা দেখতে পেয়েছি। মক্কায় অবতীর্ণ সুরা সমূহের মধ্যে প্রধান আলােচ্য বিষয় হিসেবেই এগুলাে এসেছে। এ আকীদার মধ্যে রয়েছে এক আল্লাহর নিরংকুশ ক্ষমতা সম্পর্কিত বিশ্বাস (তাওহীদ), মৃত্যুর পর আর এক যিন্দেগী আসবে যা হবে চিরস্থায়ী (আল-বা’সু বা’দাল মওত) এবং মানুষের হেদায়াতের জন্যে অবতীর্ণ আল্লাহর পয়গাম (ওহী); কিন্তু এগুলােকে সূরার আলােচ্য বিষয় হিসাবে সুস্পষ্টভাবে পেশ করা হয়নি, আলােচনার ধারার দিকে তাকালে বাহ্যত দেখা যায়, হক ও বাতিলের মধ্যে সংঘর্ষের বর্ণনা দেয়া হয়েছে বেশী। আলােচনা এসেছে ঈমান ও কুফরের দ্বন্দ্ব সম্পর্কে। সততা ও অহংকারের মধ্যে বিরাজমান পার্থক্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সূরাটির যে প্রধান বৈশিষ্ট্য সবার নযরে ধরা পড়ে তা হচ্ছে, সূরাটির সবটুকু জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন সংঘর্ষের ইতিহাস, আল কোরআনের অন্যান্য সূরা সমূহের মধ্য থেকে এই সূরার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যটি অনন্য হয়ে ফুটে উঠেছে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# যারা ঝগড়া ও বির্তক দ্বারা তোমাদের মোকাবিলা করছে এবং হীন চক্রান্তের মাধ্যমে তোমাদেরকে হেয় করতে চাচ্ছে তাদের কথা ও আচরণের জন্য ধৈর্য অবলম্বন করো।
# যে ব্যক্তিই তোমাকে পরাভূত করার জন্য চেষ্টা করেছে তাকেই এ পৃথিবীতে এবং তোমার জীবদ্দশাতেই আমি শাস্তি দেবো তা জরুরী নয়। কেউ এখানে শাস্তি পাক বা না পাক সে আমার শাস্তি থেকে কোন অবস্থায়ই রক্ষা পেতে পারে না। মৃত্যুর পর তাকে আমার কাছেই আসতে হবে। তখন সে তার কৃতকর্মের পুরো শাস্তি ভোগ করবে।
# এখান থেকে ভিন্ন একটি বিষয় শুরু হচ্ছে। মক্কার কাফেররা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতো, আমাদের দাবিকৃত মু’জিযা না দেখানো পর্যন্ত আমরা আপনাকে আল্লাহর রসূল বলে মেনে নিতে পারি না। তাদের একথা উল্লেখ না করেই পরবর্তী আয়াতসমূহে তার জবাব দেয়া হচ্ছে। (তারা যে ধরনের মু’জিযা দেখানোর দাবী করতো তার কয়েকটি নমুনার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, হূদ, টীকা ১৩ ; আল হিজর, টীকা ৪ ও ৫ ; বনী ইসরাঈল, টীকা ১০৫ ও ১০৬ ও আল ফুরকান, টীকা ৩৩ )
#কোন নবীই নিজের ইচ্ছা মত কখনো কোন মু’জিযা দেখাননি। তাছাড়া নিজের পক্ষে থেকে মু’জিযা দেখানোর ক্ষমতাও কোন নবীর নেই। কোন নবীর মাধ্যমে মু’জিযা কেবল তখনই প্রকাশ পেয়েছে যখন আল্লাহ‌ তা’আলা তাঁর মাধ্যমে কোন অবাধ্য কওমকে দেখাতে চেয়েছেন। এটা কাফেরদের দাবির প্রথম জবাব।
# খেল-তামাসা হিসেবে কখনো মু’জিযা দেখানো হয়নি। মু’জিযা তো একটি সিদ্ধান্ত সূচক জিনিস। তা প্রকাশ পাওয়ার পরও কোন কওম যখন মানে না তখন তাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তোমরা শুধু তামাশা দেখার জন্য মু’জিযা দাবী করছো। কিন্তু তোমরা বুঝতে পারছো না যে, এভাবে দাবীর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে তোমরা নিজেদের দুর্ভাগ্যকে ডেকে আনছো। এটা কাফেরদের এ ধরনের দাবীর দ্বিতীয় জবাব। ইতিপূর্বে কুরআনের কয়েকটি স্থানে এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। (দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল হিজর, টীকা ৫ ও ৩০ ; বনী ইসরাঈল, টীকা ৬৮ ও ৬৯ ; আল আম্বিয়া, টীকা ৭ ও ৮ ; আল ফুরকান, টীকা ৩৩ ও আশ শু’আরা, টীকা ৪৯ )।
# তোমরা যদি শুধু তামাশা দেখা ও মনের আনন্দের জন্য মু’জিযার দাবী করে থাকো অর্থাৎ এতোটুকু নিশ্চিত হওয়া তোমাদের প্রয়োজন হয়ে থাকে যে, মুহাম্মাদ ﷺ যেসব কথা মানার জন্য তোমাদেরকে আহবান জানাচ্ছেন তা সত্য কিনা তাহলে আল্লাহর যেসব নিদর্শনাবলী তোমরা সর্বদা অবলোকন করছো এবং তোমাদের অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত হচ্ছে সেগুলোই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। প্রকৃত সত্য বুঝার জন্য এসব নিদর্শনের বর্তমানে আর কোন নিদর্শনের কি প্রয়োজন থাকতে পারে। এটা মু’জিযা দাবী করার প্রেক্ষিতে তৃতীয় জবাব। কুরআন মজীদের কতিপয় স্থানে এ জবাবটিও ইতিপূর্বে দেয়া হয়েছে। সেখানে আমরা ভালভাবে এর ব্যাখ্যা করেছি। (দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, আল আন’আম, টীকা ২৬ ও ২৭ ; ইউনুস, টীকা ১০৫ ; আর রা’দ, টীকা ১৫ থেকে ২০ ; আশ শু’আরা, টীকা ৩ , ৪ ও ৫ )।

পৃথিবীতে যেসব জন্তু মানুষের নিয়োজিত আছে তার মধ্যে বিশেষ করে আছে গরু, মোষ, ভেড়া, বকরী, উট ও ঘোড়া। এসব জন্তুর সৃষ্টিকর্তা এমন নকশা অনুসারে এদের সৃষ্টি করেছেন যে, এসব অতি সহজেই মানুষের পোষ মানা সেবকে পরিণত হয়ে যায় এবং তাদের সাহায্যে মানুষের অসংখ্য প্রয়োজন পূরণ হয়। মানুষ এসবের ওপর আরোহণ করে এসবকে ভার বহন করার কাজে লাগায়, ক্ষেত, কৃষি ও ফসল উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে, এর দুধ দোহন করে পান করে আবার তা দিয়ে লাচ্ছি, মাখন, ঘি, দধি, পনির এবং নানা রকমের মিষ্টি তৈরী করে। এর গোশত খায় এবং চর্বি ব্যবহার করে। এর পশম, লোম, চামড়া, নাড়িভুঁড়ি, হাড্ডি, রক্ত, গোবর তথা প্রতিটি জিনিস তার কাজে লাগে। এটা কি সুস্পষ্ট প্রমাণ নয় যে, মানুষের সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে তাকে সৃষ্টি করার পূর্বেই তার এ অসংখ্য প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে একটি বিশেষ পরিকল্পনাধীনে এ জন্তুটিকে সৃষ্টি করেছেন যাতে সে তা দ্বারা উপকৃত হতে পারে?

তাছাড়া পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ পানি এবং এক-চতুর্থাংশ স্থলভাগ। স্থলভাগেরও বহু সংখ্যক ছোড় বড় অঞ্চলের মধ্যে জলভাগ অবস্থিত। পৃথিবী গ্রহের এসব স্থলভাগে মানব বসতির বিস্তার এবং তাদের মাঝে পর্যটন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া আদৌ সম্ভব হতো না যদি পানি, সমুদ্র ও বাতাসকে এমন নিয়ম-বিধির অধীন না করা হতো যার কারণে নৌ-পরিবহন করা সম্ভব হয়েছে এবং এমন সব উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করা না হতো যা ব্যবহার করে মানুষ জাহাজ নির্মাণে সক্ষম হয়েছে। এটা কি এ বিষয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ নয় যে, এক সর্বশক্তিমান, দয়ালু ও মহাজ্ঞানী প্রভু আছেন যিনি মানুষ, পৃথিবী, পানি, সমুদ্র, বাতাস এবং ভূপৃষ্ঠের সমস্ত জিনিসকে তাঁর নিজের বিশেষ পরিকল্পনা অনুসারে সৃষ্টি করেছেন? এমনকি মানুষ যদি শুধু নৌপরিবহনের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করে তাহলে নক্ষত্রসমূহের অবস্থান এবং গ্রহসমূহের নিয়মিত আবর্তন থেকে এক্ষেত্রে যে সাহায্য পাওয়া যায় তা প্রমাণ করে যে, শুধু পৃথিবী নয়, মহানুভব সে প্রভু আসমানসমূহেরও স্রষ্টা। তাছাড়া এ বিষয়টিও একটু ভেবে দেখুন, যে মহাজ্ঞানী আল্লাহ‌ তাঁর এ অসংখ্য জিনিস মানুষের কর্তৃত্বাধীনে দিয়ে রেখেছেন এবং তার কল্যাণের জন্য এসব সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করেছেন, জ্ঞান ও চেতনা সুস্থ থাকলে আপনি কি তাঁর সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করতে পারেন যে, সে আল্লাহ‌ (নাউযুবিল্লাহ) এমন নির্বোধ যে, তিনি মানুষকে এসব দিয়েছেন কিন্তু কখনো তার হিসেব নেবেন না?
# এটা সমাপ্তিসূচক বাক্য। এ অংশ পাঠ করার সময় ৪, ৫ ও ২১ আয়াত ক’টি আরেকবার দেখে নিন।
# নিজেদের দর্শন ও বিজ্ঞান, নিজেদের পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান, নেতাদের মনগড়া ধর্মীয় কিসসা কাহিনী (Mythology) এবং ধর্মীয় বিধি-বিধানকেই (Theology) তারা প্রকৃত জ্ঞান মনে করেছে এবং আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের আনীত জ্ঞানকে হীন ও নগণ্য মনে করে সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপই করেনি।
# আল্লাহর আযাব কিংবা মৃত্যুর মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্তই কেবল তাওবা ও ঈমান উপকারে আসে। আযাব এসে পড়া বা মৃত্যুর লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর ঈমান আনা কিংবা তাওবা করা আল্লাহ‌ তা’আলার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৭৭-৭৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللّٰهِ حَقٌّ….)

অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন অস্বীকারকারীদের দেয়া কষ্টের ওপর বিচলিত না হয়ে ধৈর্য ধারণ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলার দেয়া প্রতিশ্রুতি সত্যে পরিণত হবে। আর তা হলো এই যে, আমি কাফিরদের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করব। আর এটা আমি ইহজগতেও করতে পারি অথবা মৃত্যুর পরও তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারি।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যখন নির্ধারিত সময় এসে যাবে অর্থাৎ কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে সেদিন যারা অবিশ্বাসী ও মিথ্যাবাদী তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

(اَمْرُ اللہِ) আল্লাহ তা‘আলার আদেশ বলতে কিয়ামতকে বুঝানো হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, অধৈর্য হওয়া যাবে না।
২. কোন রাসূল-এর পক্ষে মু‘জিযাহ নিয়ে আসা সম্ভব নয়, যদি তাতে আল্লাহর অনুমতি না থাকে।
৩. কিয়ামতের মাঠে পাপীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
৭৯-৮৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

(اَللہُ الَّذِیْ جَعَلَ لَکُمُ …..مَّا کَانُوْا یَکْسِبُوْنَﮡ)

এ আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলার কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হচ্ছে- যথা চতুস্পদ জন্তু, এগুলোতে আরোহন করা, এদের গোসত ভক্ষণ করা, আর এদের দ্বারা বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করা, সমুদ্রে নৌযানে আরোহণ করা এগুলো মূলত আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত বান্দার প্রতি নিদর্শন ও তাঁর অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। এ সম্পর্কে সূরা নাহ্ল-এর প্রথম দিকে আলোচনা করা হয়েছে।

(اَفَلَمْ یَسِیْرُوْا فِی الْاَرْضِ …..وَخَسِرَ ھُنَالِکَ الْکٰفِرُوْنَ)

এখানে আল্লাহ তা‘আলা পুনরায় বিশ্ব ভ্রমণ করে পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিসমূহের ওপর আপতিত শাস্তি প্রত্যক্ষ করে তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করছেন। অতীত জাতিসমূহ তাদের প্রবলশক্তি থাকা সত্ত্বেও তাদের অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে রেহাই পায়নি। তাদেরকে শাস্তি পরিবেষ্টন করে নিয়েছিল। সুতরাং তোমরাও যদি এরূপ অবাধ্য হও তাহলে তোমাদেরকেও এরূপ শাস্তির মুখোমুখী হতে হবে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়েও অবগত করে দিচ্ছেন যে, তোমরা শাস্তি আসার পূর্বে ঈমান আনো। কেননা যখন শাস্তি এসে যাবে তখন ঈমান এনে আর কোনই লাভ হবে না। পূর্ববর্তী জাতির লোকেরাও যখন শাস্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছিল তখন বলেছিল আমরা এক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনলাম এবং যাদেরকে আমরা শরীক করতাম তাদেরকে অস্বীকার করলাম। যেমন ফির‘আউন বলেছিল-

(وَجٰوَزْنَا بِبَنِيْٓ إِسْرَا۬ئِيْلَ الْبَحْرَ فَأَتْبَعَهُمْ فِرْعَوْنُ وَجُنُوْدُه۫ بَغْيًا وَّعَدْوًا ط حَتّٰيٓ إِذَآ أَدْرَكَهُ الْغَرَقُ قَالَ اٰمَنْتُ أَنَّه۫ لَآ إِلٰهَ إِلَّا الَّذِيْٓ اٰمَنَتْ بِه۪ بَنُوْآ إِسْرَا۬ئِيْلَ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ)

“আমি বনী ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করালাম এবং ফির‘আউন ও তার সৈন্যবাহিনী ঔদ্ধত্যসহকারে সীমালঙ্ঘন করে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। পরিশেষে যখন সে ডুবতে শুরু করল তখন বলল : ‘আমি ঈমান এনেছি যে, তিনি ছাড়া কোন মা‘বূদ নেই যাঁর প্রতি ঈমান এনেছে বানী ইসরাঈল এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’’ (সূরা ইউনুস ১০ : ৯০)

কিন্তু ঐ সময়ের ঈমান কোনই কাজে আসেনি। ফির‘আউনের কথার উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(آٰلْئٰنَ وَقَدْ عَصَيْتَ قَبْلُ وَكُنْتَ مِنَ الْمُفْسِدِيْنَ)

‘এখন! ইতোপূর্বে তো তুমি অমান্য করেছ এবং তুমি অশান্তি সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে। (সূরা ইউনুস ১০ : ৯১)

সুতরাং আমাদের সকলকে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য কাজ বর্জন করতঃ ঈমানের ওপর বহাল থাকা উচিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের সংশোধন করে নেয়া উচিত।
২. মৃত্যুর পূর্বেই ঈমান আনতে হবে। যখন মৃত্যুর সময় এসে যাবে তখন ঈমান এনে আর কোন লাভ হবে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৭৭-৭৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে কাফিরদের তাঁকে অবিশ্বাস করার উপর ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ হে রাসূল (সঃ)! যারা তোমার কথা মানছে না, বরং তোমাকে মিথ্যাবাদী বলছে এবং তোমাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি এতে ধৈর্য ধর। তাদের উপর আল্লাহ তোমাকে জয়যুক্ত করবেন। পরিণামে সব দিক দিয়ে তোমারই মঙ্গল হবে। তুমি এবং তোমার অনুসারীরা সারা বিশ্বের উপর বিজয়ী থাকবে। আর আখিরাতের কল্যাণ তো শুধু তোমাদেরই জন্যে। জেনে রেখো যে, আমি তোমার সঙ্গে যে ওয়াদা করেছি তার কিছুটা আমি তোমার জীবদ্দশাতেই পূর্ণ করে দেখিয়ে দিবো। আর হয়েছিলও তাই। বদরের যুদ্ধের দিন কাফিরদের মস্তক দেহ হতে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল। কুরায়েশদের বড় বড় নেতা মারা গিয়েছিল। পরিশেষে রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবদ্দশাতেই মক্কা বিজিত হয়। তিনি দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করেননি যে পর্যন্ত না সারা আরব উপদ্বীপ তাঁর পদানত হয় এবং তার শত্রুরা তাঁর সামনে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয় এবং মহান আল্লাহ তাঁর চক্ষু ঠাণ্ডা করেন। আর যদি আল্লাহ তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে মৃত্যুদান করে নিজের নিকট উঠিয়েও নেন তবুও তাদের এটা জেনে রাখা উচিত যে, তাদেরকে তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্বাদ গ্রহণ করাবেন।

এরপর আল্লাহ পাক স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে আরো সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেনঃ ‘আমি তো তোমার পূর্বে অনেক রাসূল প্রেরণ করেছিলাম; তাদের কারো কারো কথা আমি তোমার নিকট বিবৃত করেছি আর কারো কারো কথা তোমার নিকট বিবৃত করিনি। যেমন সূরায়ে নিসাতেও এটা বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং যাদের ঘটনা আমি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি তাদের সাথে তাদের কওম কি দুর্ব্যবহার করেছিল এবং কিভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল তা তুমি দেখে নাও ও বুঝে নাও! আর তাদের কারো কারো ঘটনা আমি তোমার নিকট বিবৃত করিনি।” এদের সংখ্যা তাদের তুলনায় অনেক বেশী। যেমন আমরা সূরায়ে নিসার তাফসীরে বর্ণনা করেছি। সুতরাং প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই প্রাপ্য।

অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোন নিদর্শন বা মুজিযা দেখানো কোন রাসূলের কাজ নয়। হ্যা, তবে আল্লাহর হুকুম ও অনুমতির পর তারা তা দেখাতে পারেন। কেননা, নবীদের অধিকারে কোন কিছুই নেই। যখন আল্লাহর আযাব কাফিরদের উপর এসে পড়ে তখন তারা আর রক্ষা পেতে পারে না। মুমিন পরিত্রাণ পেয়ে যায় এবং মিথ্যাশ্রয়ীরা ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৭৯-৮১ নং আয়াতের তাফসীর:

আন’আম অর্থাৎ উট, গরু, ছাগল ইত্যাদিকে আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের বিভিন্ন প্রকারের উপকারের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। ওগুলো সওয়ারীর কাজে লাগে এবং কতকগুলোকে খাওয়া হয়ে থাকে। উট দ্বারা সওয়ারীর কাজ হয়, গোশতও খাওয়া হয়, দুধও দেয়, বোঝাও বহন করে, দূর-দূরান্তের সফর অতি সহজে অতিক্রম করায়। গরুর গোশত খাওয়া হয়, দুধও দেয়, লাঙ্গলও চালায়। ছাগলের গোশত খাওয়া হয় এবং দুধও দেয়। এগুলোর পশমও বহু কাজে লাগে। যেমন সূরায়ে আন’আম, সূরায়ে নাহল ইত্যাদির মধ্যে এর বর্ণনা গত হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ এতে তোমাদের জন্যে রয়েছে বহু উপকার, তোমরা যা প্রয়োজনবোধ কর, এটা দ্বারা তা পূর্ণ করে থাকো এবং এদের উপর ও নৌযানের উপর তোমাদেরকে বহন করা হয়।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখিয়ে থাকেন। দুনিয়া জাহান এবং ওর প্রান্তে প্রান্তে, জগতের অণু-পরমাণুর মধ্যে এবং স্বয়ং তোমাদের নিজেদের জীবনের মধ্যে আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত বিদ্যমান রয়েছে। সঠিক কথা তো এটাই যে, তাঁর অগণিত নিয়ামত রাশির কোন একটিকেও কোন লোক প্রকৃত অর্থে অস্বীকার করতে পারে না। তারা যে হঠকারিতা ও অহংকার করছে সেটা হলো অন্য কথা।
৮২-৮৫ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা পূর্ববর্তী উম্মতদের খবর দিচ্ছেন যারা ইতিপূর্বে তাদের রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করেছিল। সাথে সাথে তিনি তাদের পরিণামে শাস্তি ভোগ করার কথাও বলেছেন। অথচ তারা এদের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী ছিল। ভূ-পৃষ্ঠে তারা বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণ করেছিল এবং তারা ছিল প্রচুর ধন-মালের অধিকারী। কিন্তু এগুলোর কোন কিছুই তাদের কোন উপকারে আসেনি। এগুলো তাদের শাস্তি না পেরেছে দূর করতে এবং না পেরেছে হ্রাস করতে। তারা ধ্বংস হওয়ারই যোগ্য ছিল। কেননা, তাদের কাছে যখন রাসূলগণ সুস্পষ্ট দলীলসমূহ সহ আগমন করেছিলেন এবং তাদের কাছে এনেছিলেন মু’জিযা ও পবিত্র তা’লীম, তখন তারা তাদের দিকে চোখ তুলেও দেখেনি, গর্বভরে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল এবং রাসূলদের শিক্ষার প্রতি তারা ঘৃণা প্রদর্শন করেছিল। তারা বলেছিল যে, তারাই বড় আলেম বা বিদ্বান। তাদের মধ্যে বিদ্যার কোন অভাব নেই। হিসাব-নিকাশ এবং শাস্তি ও সওয়াব এগুলো কিছুই নয়। এভাবে নিজেদের অজ্ঞতাকে তারা জ্ঞান মনে করে নিয়েছিল। অতঃপর তাদের উপর এমন শাস্তি এসে পড়ে যা তারা মিথ্যা বলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে উড়িয়ে দিতো। ঐ শাস্তি তাদেরকে তচনচ করে দেয়। তারা সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহর শাস্তি আসতে দেখে তারা ঈমান আনয়নের কথা স্বীকার করে এবং একত্ববাদে বিশ্বাসী হয় এবং গায়রুল্লাহকে স্পষ্টভাবে অস্বীকারও করে। কিন্তু ঐ সময়ের তাওবা, ঈমান আনয়ন এবং আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ সবই বৃথা হয়। ফিরাউনও সমুদ্রে নিমজ্জিত হবার সময় বলেছিলঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি ঈমান আনলাম যে, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই যার উপর বানু ইসরাঈল ঈমান এনেছে এবং আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হলাম।” (১০:৯০) তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এখন? অথচ ইতিপূর্বে তুমি অবাধ্যাচরণ করে এসেছে এবং তুমি বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।” (১০:৯১) অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা তার ঈমান কবুল করলেন না। কেননা, তার নবী হযরত মূসা (আঃ) তাদের বিরুদ্ধে যে বদ দু’আ করেছিলেন তা তিনি ককূল করে নিয়েছিলেন। হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউন ও তার কওমের বিরুদ্ধে বদ দুআ করেছিলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদের অন্তরকে কঠিন করে দিন, সুতরাং তারা যেন ঈমান আনয়ন করে যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবলোকন করে।” (১০:৮৮) অনুরূপভাবে এখানেও আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তারা যখন আমার শাস্তি প্রত্যক্ষ করলো তখন তাদের ঈমান তাদের কোন উপকারে আসলো না। আল্লাহর এই বিধান পূর্ব হতেই চলে আসছে।” অর্থাৎ এটাই আল্লাহর বিধান যে, যে কেউই শাস্তি প্রত্যক্ষ করার পর তাওবা করবে তার তাওবা গৃহীত হবে না। এজন্যেই হাদীসে এসেছেঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবা কবূল করে থাকেন যে পর্যন্ত না তার ঘড়ঘড়ি শুরু হয়ে যায়। (অর্থাৎ যে পর্যন্ত না প্রাণ কষ্ঠাগত হয়)।” যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হয়ে যায় তখন তার তাওবা কবূল হয় না। এজন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “সেই ক্ষেত্রে কাফিররা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

Leave a Reply