أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৫)[* نَّ الَّذِیۡنَ قَالُوۡا رَبُّنَا اللّٰہُ ثُمَّ اسۡتَقَامُوۡا নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’, তারপর অবিচলিত থাকে,:-]
www.motaher21.net
সূরা:৪১:হামীম-আস-সাজদাহ
পারা:২৪
৩০-৩৬ নং আয়াত:-
اِنَّ الَّذِیۡنَ قَالُوۡا رَبُّنَا اللّٰہُ ثُمَّ اسۡتَقَامُوۡا تَتَنَزَّلُ عَلَیۡہِمُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ اَلَّا تَخَافُوۡا وَ لَا تَحۡزَنُوۡا وَ اَبۡشِرُوۡا بِالۡجَنَّۃِ الَّتِیۡ کُنۡتُمۡ تُوۡعَدُوۡنَ ﴿۳۰﴾
নিশ্চয় যারা বলে, ‘আমাদের রব আল্লাহ’, তারপর অবিচলিত থাকে, তাদের কাছে নাযিল হয় ফেরেশতা (এ বলে) যে, ‘তোমরা ভীত হয়ে না, চিন্তিত হয়ো না এবং তোমাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তার জন্য আনন্দিত হও।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩১
نَحۡنُ اَوۡلِیٰٓؤُکُمۡ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ لَکُمۡ فِیۡہَا مَا تَشۡتَہِیۡۤ اَنۡفُسُکُمۡ وَ لَکُمۡ فِیۡہَا مَا تَدَّعُوۡنَ ﴿ؕ۳۱﴾
আমরা এই দুনিয়ার জীবনেও তোমাদের বন্ধু এবং আখেরাতেও। সেখানে তোমরা যা চাবে তাই পাবে। আর যে জিনিসেরই আকাঙ্খা করবে তাই লাভ করবে।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩২
نُزُلًا مِّنۡ غَفُوۡرٍ رَّحِیۡمٍ ﴿٪۳۲﴾
এটা সেই মহান সত্তার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর আয়োজন যিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩৩
وَ مَنۡ اَحۡسَنُ قَوۡلًا مِّمَّنۡ دَعَاۤ اِلَی اللّٰہِ وَ عَمِلَ صَالِحًا وَّ قَالَ اِنَّنِیۡ مِنَ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ﴿۳۳﴾
সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো আমি মুসলমান।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩৪
وَ لَا تَسۡتَوِی الۡحَسَنَۃُ وَ لَا السَّیِّئَۃُ ؕ اِدۡفَعۡ بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ فَاِذَا الَّذِیۡ بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَہٗ عَدَاوَۃٌ کَاَنَّہٗ وَلِیٌّ حَمِیۡمٌ ﴿۳۴﴾
ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। উৎকৃষ্ট দ্বারা মন্দ প্রতিহত কর; তাহলে যাদের সাথে তোমার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩৫
وَ مَا یُلَقّٰہَاۤ اِلَّا الَّذِیۡنَ صَبَرُوۡا ۚ وَ مَا یُلَقّٰہَاۤ اِلَّا ذُوۡحَظٍّ عَظِیۡمٍ ﴿۳۵﴾
এ চরিত্রের অধিকারী কেবল তারাই হয় যারা ধৈর্যশীল, এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয় যারা মহাভাগ্যবান।
৪১:হামীম-আস-সাজদাহ-৩৬
وَ اِمَّا یَنۡزَغَنَّکَ مِنَ الشَّیۡطٰنِ نَزۡغٌ فَاسۡتَعِذۡ بِاللّٰہِ ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۳۶﴾
যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৩০-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত কুরআন, রিসালাত ও তাওহীদ অস্বীকারকারীদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। আল্লাহর কুদরতের নিদর্শনাবলী তাদের দৃষ্টির সামনে উপস্থিত করে তাওহীদের দাওয়াত ও অস্বীকারকারীদের পরিণাম এবং আখিরাতের আযাব তথা জাহান্নামের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
এখানে পূর্ণ মু’মিনদের অবস্থা, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের সম্মান এবং তাদের জন্য বিশেষ পথনির্দেশ উল্লেখ করা হয়েছে, যারা ঈমান আনার পর ঈমানের ওপর অটল থাকে, পুরোপুরিভাবে শরীয়তের অনুসারী হয় এবং যারা অপরকেও আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দেয়, তাদের সংশোধনের চেষ্টা করে। তাদেরকে সবর করতে এবং মন্দের জওয়াবে ভাল ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যারা বলে, আমাদের রব হলেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা এবং এর ওপরই অটল থাকে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলাকে রব হিসেবে অন্তরে বিশ্বাস ও মুখে স্বীকার করে, তাঁর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে, কখনো র্শিক করে না, এক আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন বাতিল মা‘বূদের উপাসনা করে না, অন্যকে বিধানদাতা মনে করে না তাদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় খুশির সংবাদ নিয়ে যে, তোমরা ভীত হয়ো না ও চিন্তিতও হয়ো না এবং তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُوْنَ أُولٰ۬ئِكَ أَصْحٰبُ الْجَنَّةِ خٰلِدِيْنَ فِيْهَا جَزَا۬ءًۭ بِمَا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ)
“নিশ্চয়ই যারা বলেছে, আল্লাহই আমাদের প্রতিপালক, তারপর এ কথার ওপর অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা পেরেশানও হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী। চিরদিন তারা সেখানে থাকবে। তারা (দুনিয়ায়) যেসব আমল করছিল এটা তারই প্রতিদান।” (সূরা আহকাফ ৪৬ : ১৩-১৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
(اَلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَلَمْ يَلْبِسُوْآ إِيْمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولٰ۬ئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُّهْتَدُوْنَ )
“যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানকে জুলুম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎ পথপ্রাপ্ত।” (সূরা আনআম ৬ : ৮২)
সা‘ঈদ ইবনু ‘ইমরান (রহঃ) বলেন : এ আয়াতটি আবূ বক্র (রাঃ)-এর সম্মুখে পাঠ করা হলে তিনি বলতেন যে, এর দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা কালিমা পাঠ করার পর আর কখনো র্শিক করে না। (তাবারী ২১/৪৬৪)
অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে, সুফিয়ান ইবনু ‘আবদুল্লাহ আস সাকাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললাম : হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমাকে ইসলামের ব্যাপারে এমন একটি কথা বলুন যা আপনার পর আর কাউকে জিজ্ঞাসা করব না, অন্য বর্ণনায় রয়েছে আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে জিজ্ঞাসা করব না। তিনি বললেন : তুমি বলো : আমি আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান এনেছি, তারপর এর ওপর অটল থাকো। আমি বললাম : আমি বেঁচে থাকব কী থেকে? তিনি তার জিহ্বা ধরলেন এবং বললেন : এটা হতে। (সহীহ মুসলিম হা. ৩৮, তিরমিযী হা. ২৩১০)
(تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ)
‘তাদের নিকট অবতীর্ণ হয় ফেরেশতা’ ফেরেশতাগণের এ অবতরণ ও সম্বোধন সম্পর্কে মুজাহিদ বলেন : তা হবে মৃত্যুর সময়। কাতাদাহ বলেন : পুনরুত্থানের জন্য কবর থেকে যখন উঠবে। ইবনু আব্বাস বলেন : এ সুসংবাদ হবে আখিরাতে।
এরপর ফেরেশতারা দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত মু’মিনদেরকে আরো সুসংবাদ প্রদান করেন যে, আমরা দুনিয়ায় তোমাদের বন্ধু এবং আখিরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য সমস্ত কিছু রয়েছে যা তোমাদের মন চায় এবং যা তোমরা আকাক্সক্ষা করো। ক্ষমাশীল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এটা তোমাদের জন্য আপ্যায়ন। জান্নাতের এ বর্ণনা পূর্বে আরো একাধিক স্থানে দেয়া হয়েছে। সুতরাং আখিরাতে ফেরেশতাদের এমন আচরণ পাওয়ার জন্য আমাদেরকে ঈমানের ওপর অটল থাকতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলাকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করতে হবে এবং তার ওপরই অবিচল থাকতে হবে।
২. ফেরেশতারা মু’মিন ব্যক্তিদের বন্ধু আর কাফিরদের বন্ধু হলো শয়তান।
৩. দীনের ওপর অটল থাকার অর্থ জানলাম।
৪. মু’মিনদের জন্য আখিরাতে কোন চাহিদা অপূর্ণ থাকবে না।
৩৩-৩৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
(الْمُسْلِمِيْنَ…… وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّنْ)
যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে মানুষকে আহ্বান করে ও সাথে সাথে নিজে সৎ আমল করে এবং বলে আমি আল্লাহ তা‘আলার বিধানের কাছে আত্মসমর্পণকারী, সে ব্যক্তির কথা পৃথিবীর বুকে সর্বশ্রেষ্ঠ- এ কথাই এখানে প্রতীয়মান হয়েছে। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ আয়াতটি ঐ সকল ব্যক্তিদের জন্য যারা নিজেরা সৎ পথে চলে এবং অন্যদেরকে দাওয়াত প্রদান করে। এ দাওয়াতী কাজে মানুষকে দীন শিক্ষা দেয়া, ওয়াজ নসিহত করা, দীনের ওপর অটল থাকতে উৎসাহ প্রদান করা সব কিছুই শামিল (তাফসীর সাদী, অত্র আয়াতের তাফসীর)। এ আয়াতে মূলত এটাই সাব্যস্ত হয় যে, নিজে ভাল কাজ করতে হবে এবং সাথে সাথে মানুষকে ভাল কাজ করার জন্য, আল্লাহ তা‘আলার একত্বের দিকে তাঁর ইবাদত করার জন্য আহ্বান করতে হবে। শুধু নিজে করলেই চলবে না বরং সকলকে এ কাজের দিকে দা‘ওয়াত দিতে হবে। যেমনভাবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষকে ইসলাম ও দীনের পথে দা‘ওয়াত দিয়েছিলেন। সুতরাং যারা ভাল কাজ করে এবং অন্যকে উদ্বুদ্ধ করে সে হলো সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট এবং সম্মানিত ব্যক্তি।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের দা‘ওয়াত দেয়ার পদ্ধতি এবং উপকারিতা সম্পর্কে বর্ণনা করছেন যে, যারা আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করবে তারা যেন নম্র-ভদ্রভাবে এবং সুন্দরভাবে আল্লাহ তা‘আলার পথে আহ্বান করে। মন্দকে দূরীভূত করে ভাল দ্বারা। যা উৎকৃষ্ট তা দিয়ে মন্দকে প্রতিহত করতে হবে। অর্থাৎ অন্যায়ের বদলা নিতে হবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার দ্বারা, জুলুমের বদলা নিতে হবে ক্ষমা করে, ক্রোধের বদলা নিতে হবে ধৈর্য ধারণ করে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী : “মন্দের মুকাবিলা কর যা উত্তম তা দ্বারা; তারা যা বলে আমি সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। বল : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি শয়তানের প্ররোচনা হতে, আর ‘হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট তাদের উপস্থিতি হতে।’ (সূরা মু’মিনূন ২৩ : ৯৬-৯৮)
ফলে এতে করে উপকারিতা হলো : শত্র“ বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাবে, তোমার থেকে দূরে দূরে থাকত এমন ব্যক্তি নিকটতম হয়ে যাবে। আর এ গুণটা অর্থাৎ মন্দকে ভাল দ্বারা পরিবর্তন করার অভ্যাস সকল মানুষের মধ্যে থাকে না, শুধুমাত্র ঐ ব্যক্তিই এটা করতে সক্ষম যারা ধৈর্য ধারণ করতে পারে, রাগকে দমন করতে পারে এবং অপছন্দনীয় কথা-বার্তা সহ্য করতে পারে। এটা তাদের দ্বারাই সম্ভব, অন্য কারো পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : যদি ভাল কাজ করতে গিয়ে শয়তান তোমাকে কুমন্ত্রণা দেয় তাহলে তুমি মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করো। কেননা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা এক আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো নেই। এ সম্পর্কে সূরা আল আ‘রাফ-এর ২০০ নম্বর আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় মানুষকে আহ্বান করার পদ্ধতি ও ফযীলত জানতে পারলাম।
২. সত্য দ্বারা বাতিলকে, ভাল দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করতে হবে।
৩. সত্য ও মিথ্যা কখনো সমান হতে পারে না।
৪. বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, বিচলিত হওয়া যাবে না।
৫. শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নিকটই আশ্রয় চাইতে হবে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ পর্যন্ত কাফেরদেরকে তাদের হঠকারিতা এবং ন্যায় ও সত্যের বিরোধিতার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করার পর এখন ঈমানদারদের ও নবী ﷺ কে সম্বোধন করা হচ্ছে।
# হঠাৎ কখনো আল্লাহকে রব বলে ঘোষণা করেই থেকে যায়নি এবং এ ভ্রান্তিতেও লিপ্ত হয়নি যে, আল্লাহকে রব বলে ঘোষণাও করেছে এবং তাঁর সাথে অন্যদেরকেও রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। বরং একবার এ আকীদা পোষণ করার পর সারা জীবন তার ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছে, তার পরিপন্থী অন্য কোন আকীদা গ্রহণ করেনি কিংবা এর সাথে কোন বাতিল আকীদার সংমিশ্রণও ঘটায়নি এবং নিজের কর্মজীবনে তাওহীদের আকীদার দাবীসমূহও পূরণ করেছে।
তাওহীদের ওপর দৃঢ় থাকার অর্থ কি নবী ﷺ ও বড় বড় সাহাবা তার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ
হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, নবী ﷺ বলেছেনঃ قَدْ قَالَها النَّاسُ ثُمَّ كَفَرَ أَكْثَرُهُمْ فَمَنْ مَاتَ عَلَيْهَا فَهُوَ مِمَّنِ اسْتَقَامَ
“বহু মানুষ আল্লাহকে তাদের রব বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই আবার কাফের হয়ে গিয়েছে। দৃঢ় পদ সেই ব্যক্তি যে মৃত্যু পর্যন্ত এই আকীদা আঁকড়ে ধরে রয়েছে।” (ইবনে জারির, নাসায়ী, ইবনে আবী হাতেম)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ لَمْ يُشْرِكُوا بِاللَّهِ شَيْئًالَمْ يَلْتَفِتُوا الى إِلَيْهِ غيره “এরপর আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেনি, তাঁকে ছাড়া আর কোন উপাস্যের প্রতি আকৃষ্টও হয়নি।” (ইবনে জারির)
একবার হযরত উমর (রাঃ) মিম্বরে উঠে এ আয়াত পাঠ করে বললেনঃ “আল্লাহ্র শপথ, নিজ আকীদায় দৃঢ় ও স্থির তারাই যারা দৃঢ়ভাবে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শিয়ালের মত এদিক থেকে সেদিকে এবং সেদিক থেকে এদিকে ছুটে বেড়ায়নি।” (ইবনে জারির)
হযরত উসমান (রাঃ) বলেনঃ “নিজের আমলকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে।” (কাশ্শাফ)
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বিধিবদ্ধ করা ফরযসমূহ আনুগত্যের সাথে আদায় করেছে।” (কাশ্শাফ)
# উপলব্ধি করা যায় এমন অবস্থায় ফেরেশতারা নাযিল হবে এবং ঈমানদারগণ চর্ম চোখে তাদের দেখবে কিংবা তাদের আওয়াজ কানে শুনতে পাবে এটা জরুরী নয়। যদিও মহান আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা ফেরেশতাকে প্রকাশ্যে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সাধারণত ঈমানদারদের কাছে বিশেষতঃ যখন তারা ন্যায় ও সত্যের দুশমনদের হাতে নাজেহাল হতে থাকে সেই সময় তাদের অবতরণ অমনুভূত পন্থায় হয় এবং তাদের কথা কানের পর্দায় প্রতিধ্বনিত হওয়ার পরিবর্তে হৃদয়ের গভীরে প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তি হয়ে প্রবেশ করে। কোন কোন তাফসীরকার ফেরেশতাদের এই আগমনকে মৃত্যুর সময় কিংবা কবরে অথবা হাশরের ময়দানের জন্য নির্দিষ্ট বলে মনে করেছেন। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে এ আয়াতগুলো নাযিল হয়েছে সে সম্পর্কে যদি গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা যায় তাহলে এই পার্থিব জীবনে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার জন্য যারা জীবনপাত করছে তাদের কাছে ফেরেশতাদের অবতরণের কথা বর্ণনা করাই যে এখানে মূল উদ্দেশ্য সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। যাতে তারা প্রশান্তি লাভ করতে পারে, মনোবল ফিরে পায় এবং এই অনুভূতিতে তাদের হৃদয়-মন পরিতৃপ্ত হয় যে, তারা সহযোগী ও বন্ধুহীন নয়, বরং আল্লাহর ফেরেশতারা তাদের সাথে আছে। যদিও মৃত্যুর সময়ও ফেরেশতারা ঈমানদারদের স্বাগত জানাতে আসে, কবরেও (আলমে বরযখ) তারা তাদের স্বাগত জানায় এবং যেদিন কিয়ামত হবে সেদিনও হাশরের শুরু থেকে জান্নাতে পৌঁছা পর্যন্ত সব সময় তারা তাদের সাথে থাকবে। তবে তাদের এই সাহচর্য সেই জগতের জন্য নির্দিষ্ট নয়, এ পৃথিবীতেও চলছে। কথার ধারাবাহিকতা বলছে, হক ও বাতিলের সংঘাতে বাতিলের অনুসারীদের সাথে যেমন শয়তান ও অপরাধীরা থাকে তেমনি ঈমানদারদের সাথে ফেরেশতারাও থাকে। একদিকে বাতিলপন্থীদের কৃতকর্মসমূহকে তাদের সঙ্গী-সাথীরা সুদৃশ্য করে দেখায় এবং তাদেরকে এ মর্মে নিশ্চয়তা দেয় যে, হককে হেয় করার জন্য তোমরা যে জুলুম-অত্যাচার ও বে-ঈমানী করছো সেটিই তোমাদের সফলতার উপায় এবং এভাবে পৃথিবীতে তোমাদের নেতৃত্ব নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। অপরদিকে হকপন্থীদের কাছে আল্লাহর ফেরেশতারা এসে সেই সুখবরটি পেশ করে যা পরবর্তী আয়াতাংশে বলা হচ্ছে।
# এটা একটা ব্যাপক অর্থবোধক কথা যা দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত ঈমানদারদের জন্য প্রশান্তির একটি নতুন বিষয় বহন করে। পৃথিবীতে ফেরেশতাদের এই উপদেশের অর্থ হচ্ছে, বাতিল শক্তি যতই পরাক্রমশালী ও স্বৈরাচারী হোক না কেন তাদের দেখে কখনো ভীত হয়ো না এবং হকের অনুসারী হওয়ার কারণে যত দুঃখ-কষ্ট ও বঞ্চনাই সইতে হোক সেজন্য দূঃখ করবে না। কেননা, ভবিষ্যতে তোমাদের জন্য এমন কিছু আছে যার কাছে দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামত তুচ্ছ। মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা যখন এই কথাগুলো বলে তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, তুমি সামনে যে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছো সেখানে তোমার জন্য ভয়ের কোন কারণ নেই। কারণ, সেখানে জান্নাত তোমার জন্য অপেক্ষমান। আর দুনিয়াতে তুমি যা কিছু ছেড়ে যাচ্ছো সেজন্য তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই কেননা, এখানে আমি তোমাদের অভিভাবক ও বন্ধু। আলমে বরযখ ও হাশরের ময়দানে যখন ফেরেশতারা এ কথাগুলো বলবে তখন তার অর্থ হবে, এখানে তোমাদের জন্য কেবল শান্তি আর শান্তি। পার্থিব জীবনে তোমরা যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছো সেজন্য দুঃখ করো না এবং আখেরাতে যা কিছু সামনে আসবে সেজন্য ভয় করবে না। কারণ, আমরা তোমাদেরকে সেই জান্নাতের সুসংবাদ জানাচ্ছি যার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা হচ্ছে।
# মু’মিনদের সান্ত্বনা দেয়া এবং মনোবল সৃষ্টির পর এখন তাদেরকে তাদের আসল কাজের প্রতি উৎসাহিত করা হচ্ছে। আগের আয়াতে তাদের বলা হয়েছিলো, আল্লাহর বন্দেগীর ওপর দৃঢ়পদ হওয়া এবং এই পথ গ্রহণ করার পর পুনরায় তা থেকে বিচ্যুত না হওয়াটাই এমন একটা মৌলিক নেকী যা মানুষকে ফেরেশতার বন্ধু এবং জান্নাতের উপযুক্ত বানায়। এখন তাদের বলা হচ্ছে, এর পরবর্তী স্তর হচ্ছে, তোমরা নিজে নেক কাজ করো, অন্যদেরকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে ডাকো এবং ইসলামের ঘোষণা দেয়াই যেখানে নিজের জন্য বিপদাপদ ও দুঃখ-মুসিবতকে আহবান জানানোর শামিল এমন কঠিন পরিবেশেও দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করো। আমি মুসলমান। মানুষের জন্য এর চেয়ে উচ্চস্তর আর নেই। এ কথার গুরুত্ব পুরোপুরি উপলব্ধি করার জন্য যে পরিস্থিতিতে তা বলা হয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সে সময় অবস্থা ছিল এই যে, যে ব্যক্তিই মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করতো সে হঠাৎ করেই অনুভব করতো যেন হিংস্র শ্বাপদ ভরা জঙ্গলে পা দিয়েছে যেখানে সবাই তাকে ছিঁড়ে ফেড়ে খাওয়ার জন্য ছুটে আসছে। যে ব্যক্তি আরো একটু অগ্রসর হয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য মুখ খুলেছে সে যেন তাকে ছিঁড়ে ফেড়ে খাওয়ার জন্য হিংস্র পশুকুলকে আহবান জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তির আল্লাহকে রব হিসেবে স্বীকার করে সোজা পথ গ্রহণ করা এবং তা থেকে বিচ্যুত না হওয়া নিঃসন্দেহে বড় ও মৌলিক কাজ।
কিন্তু আমি মুসলমান বলে কোন ব্যক্তির ঘোষণা করা, পরিণামের পরোয়া না করে সৃষ্টিকে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে আহবান জানানো এবং কেউ যাতে ইসলাম ও তার ঝাণ্ডাবাহীদের দোষারোপ ও নিন্দাবাদ করার সুযোগ না পায় এ কাজ করতে গিয়ে নিজের তৎপরতাকে সেভাবে পবিত্র রাখা হচ্ছে পূর্ণ মাত্রার নেকী।
# এ কথার অর্থও পুরোপুরি বুঝার জন্য যে অবস্থায় নবী ﷺ কে ও তাঁর মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তা বিবেচনা থাকা দরকার। তখন অবস্থা ছিল এই যে, চরম হঠকারিতার এবং আক্রমণাত্মক বিরোধিতার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের মোকাবিলা করা হচ্ছিলো যেখানে নৈতিকতা, মানবতা এবং ভদ্রতার সমস্ত সীমা লংঘন করা হয়েছিলো। নবী ﷺ ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের বিরুদ্ধে সব রকমের মিথ্যা আরোপ করা হচ্ছিলো। তাঁকে বদনাম করা এবং তাঁর সম্পর্কে লোকের মনে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য সব রকমের দুষ্টবুদ্ধি ও কূটকৌশল কাজে লাগানো হচ্ছিলো। তাঁর বিরুদ্ধে নানা রকমের অপবাদ আরোপ করা হচ্ছিলো এবং শত্রুতামূলক প্রচারণার জন্য পুরো একদল লোক তাঁর বিরুদ্ধে মানুষের মনে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করে যাচ্ছিলো। তাঁকে তাঁর সঙ্গীদেরকে সর্ব প্রকার কষ্ট দেয়া হচ্ছিলো। তাতে অতিষ্ঠ হয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তাছাড়া তাঁর ইসলাম প্রচারের ধারাকে বাঁধাগ্রস্ত করার জন্য পরিকল্পনা মাফিক হৈ চৈ ও হট্টগোলকারী একদল লোককে সব সময় ওঁত পেতে থাকার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। যখনই তিনি ন্যায় ও সত্যের দাওয়াত দেয়ার জন্য কথা বলতে শুরু করবেন তখনই তারা শোরগোল করবে এবং কেউ তাঁর কথা শুনতে পাবে না। এটা এমনই একটা নিরুৎসাহব্যঞ্জক পরিস্থিতি ছিল যে, বাহ্যিকভাবে আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ বলে মনে হচ্ছিলো। বিরোধিতা নস্যাৎ করার জন্য সেই সময় নবীকে ﷺ এসব পন্থা বলে দেয়া হয়েছিলো।
প্রথম কথা বলা হয়েছে, সৎকর্ম ও দুষ্কর্ম সমান নয়। অর্থাৎ তোমাদের বিরোধীরা যত ভয়ানক তুফানই সৃষ্টি করুক না কেন এবং তার মোকাবিলায় নেকীকে যত অক্ষম ও অসহায়ই মনে হোক না কেন দুষ্কর্মের নিজের মধ্যেই এমন দুর্বলতা আছে যা শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যর্থ করে দেয়। কারণ, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ, ততক্ষণ পর্যন্ত তার স্বভাব প্রকৃতি দুষ্কর্মকে ঘৃণা না করে পারে না। দুষ্কর্মের সহযোগীই শুধু নয় তার ধ্বজাধারী পর্যন্ত মনে মনে জানে যে, সে মিথ্যাবাদী ও অত্যাচারী এবং সে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য হঠকারিতা করছে। এ জিনিসটি অন্যদের মনে তার প্রতি সম্মানবোধ সৃষ্টি করা তো দূরের কথা নিজের কাছেই তাকে খাটো করে দেয়। এভাবে তার নিজের মনের মধ্যেই এক চোর জন্ম নেয়। শত্রুতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের সময় এই চোর ভেতর থেকেই তার সংকল্প ও মনোবলের ওপর সঙ্গোপনে হানা দিতে থাকে। এই দুষ্কর্মের মোকাবিলায় যে সৎকর্মকে সম্পূর্ণ অক্ষম ও অসহায় বলে মনে হয় তা যদি ত্রুমাগত তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত সে-ই বিজয়ী হয়। কারণ, প্রথমত সৎকর্ম নিজেই একটি শক্তি যা হৃদয়-মনকে জয় করে এবং ব্যক্তি যতই শত্রুতাভাবাপন্ন হোক না কেন সে নিজের মনে তার জন্য সম্মানবোধ না করে পারে না। তাছাড়া নেকী ও দুষ্কর্ম যখন সামনা-সামনি সংঘাতে লিপ্ত হয় এবং উভয়ের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি উন্মোচিত হয় এমন পরিস্থিতিতে কিছুকাল সংঘাতে লিপ্ত থাকার পর এমন খুব কম লোকই থাকতে পারে যারা দুষ্কর্মের প্রতি ঘৃণা পোষণ করবে না এবং সৎকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবে না।
দ্বিতীয় কথাটি বলা হয়েছে এই যে, দুষ্কর্মের মোকাবিলা শুধুমাত্র সৎকর্ম দিয়ে নয়, অনেক উচ্চমানের সৎকর্ম দিয়ে করো। অর্থাৎ কেউ যদি তোমাদের সাথে খারাপ আচরণ করে আর তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও তাহলে শুধু সৎকর্ম। উন্নত পর্যায়ের সৎকর্ম হচ্ছে, যে তোমার সাথে খারাপ আচরণ করবে সুযোগ পেলে তুমি তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করো।
এর সুফল বলা হয়েছে এই যে, জঘণ্যতম শত্রুও এভাবে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। কারণ, এটিই মানুষের প্রকৃতি। আপনি যদি গালির জবাব না দিয়ে চুপ থাকেন তাহলে নিঃসন্দেহে তা হবে একটি নেকী বা সৎকর্ম। অবশ্য তা গালিদাতার মুখ বন্ধ করতে পারবে না। কিন্তু গালির জবাবে আপনি যদি তার কল্যাণ কামনা করেন তাহলে চরম নির্লজ্জ শত্রুও লজ্জিত হবে এবং আর কখনো আপনার বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলার জন্য মুখ খোলা তার জন্য কঠিন হবে। একজন লোক আপনার ক্ষতি করার কোন সুযোগই হাত ছাড়া হতে দেয় না। আপনি যদি তার অত্যাচার বরদাশত করে যেতে থাকেন তাহলে সে হয়তো তার দুস্কর্মের ব্যাপারে আরো সাহসী হয়ে উঠবে। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে সে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তখন যদি আপনি তাকে রক্ষা করেন তাহলে আপনার একান্ত অনুগত হয়ে যাবে। কারণ, ঐ সুকৃতির মোকাবিলায় কোন দুস্কৃতিই টিকে থাকতে পারে না। তা সত্ত্বেও এই সাধারণ নিয়মকে এ অর্থে গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, উন্নত পর্যায়ের সৎকর্মের মাধ্যমে সব রকমের শত্রুর অনিবার্যরূপে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন জঘন্য মনের মানুষও আছে যে, তার অত্যাচার ক্ষমা করা ও দুষ্কৃতির জবাব অনুকম্পা ও সুকৃতির মাধ্যমে দেয়ার ব্যাপারে আপনি যতই তৎপর হোন না কেন তার বিচ্ছুর ন্যায় বিষাক্ত হুলের দংশনে কখনো ভাটা পড়বে না। তবে এ ধরনের মূর্তিমান খারাপ মানুষ প্রায় ততটাই বিরল যতটা বিরল মূর্তিমান ভাল মানুষ।
# এটা অত্যন্ত কার্যকর ব্যবস্থা হলেও তা কাজে লাগানো কোন ছেলেখেলা নয়। এজন্য দরকার সাহসী লোকের। এজন্য দরকার দৃঢ় সংকল্প, সাহস, অপরিসীম সহনশীলতা এবং চরম আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। সাময়িকভাবে কেউ কোন দুষ্কর্মের মোকাবিলায় সৎকর্ম করতে পারে। এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে এমন সব বাতিলপন্থী দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে ন্যায় সত্যের জন্য লড়াই করতে হয় যারা নৈতিকতার যে কোন সীমালঙ্ঘন করতে দ্বিধা করে না এবং শক্তি ও ক্ষমতার নেশায় চূর হয়ে আছে সেখানে দুষ্কর্মের মোকাবিলা সৎকর্ম দিয়ে করে যাওয়া তাও আবার উচ্চ মাত্রার সৎকর্ম দিয়ে এবং একবারও নিয়ন্ত্রণের বাগডোর হাত ছাড়া হতে না দেয়া কোন সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কেবল সেই ব্যক্তিই এ কাজ করতে পারে যে বুঝে শুনে ন্যায় ও সত্যকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে, যে তার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার শক্তির অনুগত করে নিয়েছে এবং যার মধ্যে নেকী ও সততা এমন গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, বিরোধীদের কোন অপকর্ম ও নোংরামি তাকে তার উচ্চাসন থেকে নীচে নামিয়ে আনতে সফল হতে পারেনা।
# এটা প্রকৃতির বিধান। অত্যন্ত উচু মর্যাদার মানুষই কেবল এসব গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি এসব গুণাবলীর অধিকারী হয় দুনিয়ার কোন শক্তিই তাকে সাফল্যের মনযিলে মকসুদে পৌঁছা থেকে বিরত রাখতে পারে না। নীচ প্রকৃতির মানুষ তাদের হীন চক্রান্ত, জঘন্য কৌশল এবং কুৎসিত আচরণ দ্বারা তাকে পরাস্ত করবে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
# শয়তান যখন দেখে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দ্বারা হীনতার এবং সুকৃতি দ্বারা দুষ্কৃতির মোকাবিলা করা হচ্ছে তখন সে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। সে চায় কোনভাবে একবারের জন্য হলেও হকের জন্য সংগ্রামকারী বিশেষ করে তাদের বিশিষ্ট লোকজন ও নেতৃবৃন্দের দ্বারা এমন কোন ত্রুটি সংঘটিত করিয়ে দেয়া যাতে সাধারণ মানুষকে বলা যায়, দেখুন খারাপ কাজ এক তরফা হচ্ছে না। এক পক্ষ থেকে নীচ ও জঘন্য কাজ করা হচ্ছে বটে, কিন্তু অপর পক্ষের লোকেরাও খুব একটা উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ নয়, তারাও তো অমুক হীন আচরণ করেছে। এক পক্ষের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি এবং অপর পক্ষের জবাবী তৎপরতার মধ্যে ইনসাফের সাথে তুলনামূলক বিচারের যোগ্যতা সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকে না। যতক্ষণ তারা দেখে বিরোধীরা সব রকমের জঘন্য আচরণ করছে কিন্তু এই লোকগুলো ভদ্রতা ও শিষ্টচার এবং মর্যাদা নেকী ও সত্যবাদীতার পথ থেকে বিন্দুমাত্রও দূরে সরে যাচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের ওপর তার গভীর প্রভাব পড়তে থাকে। কিন্তু যদি কোথাও তাদের পক্ষ থেকে কোন অযৌক্তিক বা তাদের মর্যাদার পরিপন্থী আচরণ হয়ে যায়, তা কোন বড় জুলুমের প্রতিবাদে হলেও তাদের দৃষ্টিতে তারা উভয়েই সমান হয়ে যায় এবং বিরোধীরাও একটি শক্ত কথার জবাব হঠকারিতার সাহায্যে দেয়ার অজুহাত পেয়ে যায়। এ কারণে বলা হয়েছে, শয়তানের প্রতারণার ব্যাপারে সাবধান থাকো। সে অত্যন্ত দরদী ও মঙ্গলকামী সেজে এই বলে তোমাদেরকে উত্তেজিত করবে যে, অমুক অত্যাচার কখনো বরদাশত করা উচিত নয়, অমুক কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত এবং এই আক্রমনের জবাবে লড়াই করা উচিত। তা না হলে তোমাদেরকে কাপুরুষ মনে করা হবে এবং তোমাদের আদৌ কোন প্রভাব থাকবে না। এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমরা যখন নিজেদের মধ্যে কোন অযথা উত্তেজনা অনুভব করবে তখন সাবধান হয়ে যাও। কারণ, তা শয়তানের প্ররোচনা। সে তোমাদের উত্তেজিত করে কোন ভুল সংঘটিত করাতে চায়। সাবধান হয়ে যাওয়ার পর মনে করো না আমি আমার মেজাজকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখছি, শয়তান আমাকে দিয়ে কোন ত্রুটি করাতে পারবে না। নিজের এই ইচ্ছা শক্তির বিভ্রম হবে শয়তানের আরেকটি বেশী ভয়ংকর হাতিয়ার। এর চেয়ে বরং আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত। কারণ তিনি যদি তাওফীক দান করেন ও রক্ষা করেন তবেই মানুষ ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা পেতে পারে।
ইমাম আহমদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে যে ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন সেটি এ বিষয়ের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি বলেনঃ নবী ﷺ এর সামনে একবার এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকলো। হযরত আবু বকর চুপচাপ তার গালি শুনতে থাকলেন আর তাঁর দিকে চেয়ে নবী ﷺ মুচকি হাসতে থাকলেন। অবশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ধৈর্য্য হারিয়ে ফেললেন এবং জবাবে তিনিও তাকে একটি কঠোর কথা বলে ফেললেন। তার মুখ থেকে সে কথাটি বের হওয়া মাত্র নবীর ﷺ ওপর চরম বিরক্তি ভাব ছেয়ে গেল এবং ক্রমে তা তাঁর পবিত্র চেহারায় ফুট উঠতে থাকলো। তিনি তখনই উঠে চলে গেলেন। হযরত আবু বকরও উঠে তাঁকে অনুসরণ করলেন এবং পথিমধ্যেই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কি? সে যখন আমাকে গালি দিচ্ছিলো তখন আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন। কিন্তু যখনই আমি তাকে জবাব দিলাম তখনই আপনি অসন্তুষ্ট হলেন? নবী ﷺ বললেনঃ তুমি যতক্ষন চুপচাপ ছিলে ততক্ষন একজন ফেরেশতা তোমার সাথে ছিল এবং তোমার পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু যখন তুমি নিজেই জবাব দিলে তখন ফেরেশতার স্থানটি শয়তান দখল করে নিল। আমি তো শয়তানের সাথে বসতে পারি না।
# বিরোধিতার তুফানের মুখে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার পর যে জিনিসটি মু’মিনের হৃদয়ে ধৈর্য্য, প্রশান্তি ও তৃপ্তির গভীর শীতলতা সৃষ্টি করে তা এই বিশ্বাস যে আল্লাহ বিষয়টি সম্পর্কে অনবহিত নন। আমরা যা করছি তাও তিনি জানেন এবং আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে তাও তিনি জানেন। আমাদের ও আমাদের বিরোধীদের সব কথাই তিনি শুনছেন এবং উভয়ের কর্মনীতি যা কিছুই হোক না কেন তা তিনি দেখছেন। এই আস্থার কারণেই মু’মিন বান্দা নিজের এবং ন্যায় ও সত্যের দুশমনের ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিন্ত হয়ে যান।
কুরআন মজীদের এই পঞ্চম বার নবী ﷺ কে ও তাঁর মাধ্যমে ঈমানদারদেরকে দ্বীনে ইসলামের দাওয়াত এবং সমাজ সংস্কারের এ কৌশল শেখানো হয়েছে। এর পূর্বে আরো চারবার চারটি স্থানে এ কৌশল শেখানো হয়েছে। সে সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা আ’রাফ, ১১০ থেকে ১১৪ আয়াত, টীকাসহ; সূরা আন নাহল, আয়াত ১২৫ থেকে ১২৭, টীকাসহ; সূরা আল মু’মিনুন, আয়াত ৯৬, টীকাসহ; সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪৬, টীকাসহ।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*মোমেনের মাপকাঠি : আজ তারা সবাই এর উচিত প্রতিদান পাবে, পাবে সেই সকল প্ররােচনা ও ধোঁকাবাজির বদলা যা দুনিয়ার জীবনে শুভাকাংখী হিসাবে সর্বদা তারা করেছে। তাদের কুমন্ত্রণা ও মিথ্যা শুভেচ্ছা প্রদর্শনের প্রতিশোধ পাবে। অপর দিকে বলা হচ্ছে, তারাই হচ্ছে সত্যিকারে মােমেন, যারা বলে, আমাদের রব আল্লাহ, তারপর মযবুত হয়ে সেই সুন্দর সমুজ্জ্বল পথে অবিচল থাকে, যা তাদেরকে ঈমান ও তদনুযায়ী ভাল কাজসমূহের দিকে আহ্বান জানায়। এমন লােকদেরকে যাবতীয় খারাবী থেকে আল্লাহ রব্বুল ইযযত হেফাযত করবেন এবং কিছুতেই তাদের পিছনে নিকৃষ্ট জিন ও নিকৃষ্ট মানুষদেরকে লাগিয়ে দেবেন না। আল্লাহ সােবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের বন্ধু ও সাহায্যকারী ফেরেশতাদেরকে হিসাবে নিয়ােগ করে দেবেন। তারা তাদের অন্তরের মধ্যে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা ও প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে দেবেন এবং তাদেরকে সুসংবাদ দেবেন সেই জান্নাতের, যার ওয়াদা তাদের সাথে করা হয়েছিলাে। দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় স্থানেই তারা বন্ধু হিসাবে তাদের সংগে সংগে থাকবেন। নীচের আয়াতে এই কথাটাই জানানাে হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের রব আল্লাহ… তাদের মেহমানদারী করা হবে ক্ষমার মালিক মেহেরবান আল্লাহর পক্ষ থেকে।’(৩০-৩২) অর্থাৎ আল্লাহকে প্রতিপালক, মনিব ও শাসনকর্তা মানার পর যেভাবে দৃঢ়তা অবলম্বন করা দরকার সেভাবেই মযবুত হয়ে টিকে থাকা। কোনাে সংকট ও তয়ভীতির কাছে নতি স্বীকার না করা। এই দৃঢ়তার তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝা, বুঝে সুঝে সচেতনভাবে ও বিবেক বুদ্ধি নিয়ে জীবন পথে পাড়ি দেয়া এবং এ পথে চলতে গিয়ে অবশ্যম্ভাবী বাধার সামনে অবিচল হয়ে থাকার নাম হচ্ছে ‘এসতেকামাত’ যে কোনাে কঠিন দায়িত্ব আসুক না কেন তা যথাযথভাবে পালন করা, বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে নিজ নিজ কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে থাকা- এ সবকটি অর্থই এসতেকামাত’ শব্দের মধ্যে রয়েছে। এই দৃঢ়তা অবলম্বন করার জন্যে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোনাে বড় সন্দেহকে মনে জায়গা না দেয়া এবং সকল কঠিন অবস্থাতেই অবিচল থাকাও হচ্ছে, ‘এসতেকামাত’-এর তাৎপর্য। এই দৃঢ়তার জন্যেই আল্লাহর কাছ থেকে বড় পুরস্কার দেয়ার অংগীকার করা হয়েছে। ফেরেশতাদের সাথে থাকা বলতে কী বুঝানাে হয়েছে এবং তাদের বন্ধুত্ব ও ভালােবাসা বলতেই বা কী বুঝায় এ কথাগুলাে তাদের কথায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তারা তাদের মােমেন বন্ধুদের বলে, ‘ভয় পেয়াে না, দুঃখ করাে না, সুসংবাদ গ্রহণ করাে জান্নাতের, যার ওয়াদা তােমাদের সাথে করা হয়েছে। আমরা তোমাদের বন্ধু দুনিয়ার জীবনে এবং আখেরাতেও।’ তারপর তাদের জন্যে ওয়াদা করা জান্নাতের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। যারা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারী এবং তার সত্যিকারের বন্ধু তাদের জন্যে তাদের পাওনা বুঝিয়ে দেয়ার ওয়াদা করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘সেখানে তােমাদের জন্যে রয়েছে তাই, যা তােমাদের অন্তর চাইবে এবং যার দাবী তােমরা করবে। এরপর তাদের জন্যে সৌন্দর্য ও সম্মান বৃদ্ধি করা হবে। এটা হবে তোমার মালিক মেহেরবান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক আতিথেয়তা। তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই আপ্যায়ন করা হবে এবং এর সাথে থাকবে তার ক্ষমা ও মেহেরবানী… এর থেকে বড় নেয়ামত আর কি হতে পারে।
*আল্লাহর পথে আহবানকারীদের জন্যে কোরআনের নির্দেশনা : আল্লাহর দিকে দাওয়াতের প্রকৃতি বর্ণনা করার সাথে এই অধ্যায়টি শেষ করা হচ্ছে। দাওয়াতের মূল কথা ও তার শব্দাবলী সম্পর্কে জানান হচ্ছে, এ বিষয়ে প্রথম রসূল(স.)-কে এবং তাঁর উম্মতের অন্যান্য দাওয়াত দানকারীদেরকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। তাদের সাথে করা দুর্ব্যবহার, অহংকারপূর্ণ ব্যবহার ও তাদেরকে যে নানাভাবে কষ্ট দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে জানানাে হচ্ছে। এ সব কিছু জানিয়ে রসূলদেরকে এই কথাটিই বুঝানাে হয়েছে যে পৃথিবীর অহংকারী ও দুনিয়া কেন্দ্রিক মানুষের স্বভাবই হচ্ছে যে, তাদের কর্তৃত্বে আঘাত পড়ে-এমন কথা যার তরফ থেকেই এসেছে। চিরদিন তাদের সাথে এই একই আচরণ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তার চেয়ে ভালাে কথা আর কার হবে…. নিশ্চয়ই তিনি শুনেন, তিনি জানেন’(আয়াত ৩৩-৩৬) আলােচ্য আয়াতগুলােতে প্রধান যে কথাগুলাে ফুটে উঠেছে তা হচ্ছে, সকল যামানাতেই আল্লাহর দিকে আহবান জানানাের জন্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যেন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, স্বেচ্ছাচারিতা এবং হঠকারিতার মোকাবেলা করা যায়। মানুষের আত্মম্ভরিতা ও অহংকার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সীমাবদ্ধ বয়স, সীমাবদ্ধ দৃষ্টিশক্তি ও সীমাবদ্ধ জ্ঞানের অধিকারী মানুষের পক্ষে নিজেদের বুদ্ধিতে চলতে চাওয়া এবং নিজেদের জীবন ব্যবস্থা নিজেরাই রচনা করার প্রবণতা এবং নিজেদের ইচ্ছামতাে চলতে চাওয়া অবশ্যই একটা বড়াে গােমরাহী এবং নিজেদেরকে নিজেদের ভালাে মন্দের মালিক মনে করারও কোনাে ক্ষমতা তাদের নাই। এই প্রবণতাকে দমন করে এক আল্লাহর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাই আলােচ্য আয়াতগুলাের মূল লক্ষ্য। পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা সবার সৃষ্টিকর্তা এবং তার নযরে সবাই সমান। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দিকে আহবান জানানাের কাজটি মােটেই সহজ নয়। বরং কায়েমী স্বার্থবাদীদের সকল বিরােধিতার মােকাবেলায় টিকে থাকা এবং মানুষকে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের একনিষ্ঠ গােলামে পরিণত করার কাজ অবশ্যই বড় কঠিন এক দায়িত্ব। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তার চেয়ে ভালাে কথা আর কার হবে, যে আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকে, নিজেও ভালাে কাজ করে এবং (প্রকাশ্যভাবে ঘােষণা দিতে গিয়ে) বলে, অবশ্যই আমি মুসলমান দলের একজন সদস্য।’ এ কথা থেকে বুঝা যায় যে, কালেমার দিকে দাওয়াত দেয়া পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম কথা। এ পবিত্র কথা আকাশ পর্যন্ত পৌছে যায়, তার রাজ্যে তার প্রভুত্ব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্যে প্রদত্ত আহ্বানের কথাগুলাে অবশ্যই তিনি শুনেন ও তার মূল্যায়ন করেন, কিন্তু এ দাওয়াত ঐকান্তিকভাবে তখনই আল্লাহর জন্যে (নিবেদিত) হয়, যখন এ দাওয়াতের সাথে ভালা কাজের যােগ হয়, যেহেতু দাওয়াত দানকারীর দায়িত্ব তাে শুধু তাবলীগ করাই নয়; বরং তা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাই দাওয়াত দানকারী যখন নিজেও যদি ভালাে কাজ করে, তাহলেই তার দাওয়াত জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং হঠকারী ও বিরােধীদের অন্তরে, (তাদের অজান্তেই) এর একটা প্রভাব পড়তে থাকে। কোনাে দাওয়াত দানকারীর জন্যে কড়া কথা বলা অথবা অপ্রিয় ও অশােভন কথা বলা মােটেই উচিত নয়, তার কর্তব্য হচ্ছে সুন্দর ও বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ কথা ব্যবহার করা, যেহেতু সে আল্লাহর পথে আহ্বানকারী হিসাবে মর্যাদাবান মানুষ, সাধারণ মানুষ থেকে তার পজিশন অনেক ওপরে। অন্যরা কটু কথা বলতে পারে বা দুর্ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ইসলামের পতাকাবাহী, সত্যের প্রতি আহ্বানকারী কোনাে ব্যক্তি এমন অশােভণ আচরণ কোনাে অবস্থায়ই করতে পারে না। তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘ভালাে আর মন্দ কখনও সমান হতে পারে না।’ কারাে মন্দ কথা বা আচরণের জওয়াবে মন্দ কথা বলা বা মন্দ ব্যবহার করা তার কাজ নয়। যেহেতু মন্দ আচরণের প্রতিক্রিয়া যা, ভালাে আচরণের প্রতিক্রিয়া অবশ্যই তা নয়, যেমন মন্দের মূল্য আর ভালাে মূল্য এক নয়। সাধারণভাবে মন্দ ব্যবহারের বদলে মানুষ মন্দ ব্যবহারই করে থাকে- এটাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তির ওপর মানুষ যখন জয়ী হয় এবং সবর ও ক্ষমাশীলতার গুণাবলী দ্বারা যখন কোনাে প্রতিক্রিয়াশীলতার মুখােমুখী হয় তখন সেই অহংকারী ব্যক্তি থমকে যায় এবং তার মনটা ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসে, মার্জিত ব্যবহারের ফলে তার মনের মধ্যে এই ব্যক্তির প্রতি আস্থার সূচনা হতে শুরু করে। তখনই তার মন গলতে শুরু করে এবং তার বিবদমান সত্ত্বা পরিবর্তিত হয়ে অন্তরংগ বন্ধুরূপে গ্রহণ করে চরম শত্রু পরম বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। অহংকার দূরীভূত হয়ে সেখানে বিনম্রতা আসে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ভালাে (আচরণ) দিয়েই মন্দ (আচরণ) প্রতিহত করো। তার ফল দাঁড়াবে এই যে, যার সাথে তােমার চরম শত্রুতা রয়েছে সে তােমার পরম বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাবে।’ আমাদের জীবনের বাস্তব অবস্থাকে সামনে রাখলে এ কথার সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। আমরা যদি আল কোরআনের এ শিক্ষাকে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগাই তাহলে দেখতে পাবাে আমাদের উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে যাবে, ক্রোধের বদলে আসবে শান্তি ও সান্তনা অহংকার রূপান্তরিত হয়ে যাবে লজ্জাবনত মনােভাবে, কর্কশ ভাষা পরিবর্তিত হয়ে সেখানে প্রিয় ও মধুর বচন আসবে, কণ্ঠের উগ্রতা মােলায়েম হয়ে যাবে, রূঢ় চেহারাতে মিষ্টিমধুর হাসির রেখা ফুটে উঠবে এবং ক্রুদ্ধ ও সীমাহীন অহংকারী ব্যক্তি আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে। অপরদিকে প্রতিপক্ষের জবাবে যদি তারই ব্যবহারের অনুরূপ ব্যবহার করা হয়, তারই মতাে মেজাজ ভাষা ও ভংগী ব্যবহার করা হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীসুলভ ব্যবহার করা হয় তাহলে বিরাজমান বিরােধ বৃদ্ধি পেয়ে চরম শত্রুতার রূপ নেবে, ক্রোধ, অহংকার ও বিদ্রোহাত্মক কার্যাবলী বাড়বে। সেখানে লজ্জা শরম, দূর হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যাবে এবং অন্যায় অহংকার দানা বেঁধে উঠবে। তবে এটা ঠিক যে, যদি ব্যক্তিগতভাবে কেউ আক্রমণ করে এবং যদি এমন কোনাে কারণে কেউ দুর্ব্যবহার করে বসে, যা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট, সে অবস্থায় ধৈর্য ধরা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। সে অবস্থায় ক্ষমা করার জন্যে প্রয়ােজন বড় প্রশস্ত হৃদয়ের, যার মধ্যে দরদ মহব্বত সত্তেও ক্ষমা করা সম্ভব হবে। কিন্তু ক্ষমার সুফল পাওয়ার জন্যে প্রয়ােজন এমন হৃদয়ের ঔদার্য এবং এমন আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, যার বর্ণনা উপরােক্ত আয়াতে এসেছে। এর ফলে অন্যায়কারীর অন্তরে অপমানের অনুভূতি আসবে, আসবে পরাজয়ের গ্লানি। সেখানে মানবীয় গুণের বিজয় হবে, প্রতিপক্ষের মধ্যে মানবতা ও মহানুভবতা জাগবে, যেমন করে একটি ল্যাম্পের আলাে থেকে হাজারাে ল্যাম্প জ্বালানাে হলেও প্রথম ল্যাম্পের বাতি এতােটুকু কম হয় না, অথচ অন্যান্যরা অনেকেই এর থেকে আলাে পেয়ে ধন্য হয়। এইই হচ্ছে ক্ষমাশীলতার মহান মর্যাদা। বিশ্বাসগত কারণে বা ঈমান আকীদার পাথর্ক্যের কারণে দুর্ব্যবহার সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা। তা মােমেনরা অনেক সময় সহ্য করে। কিন্তু বস্তুগত কারণে বা ব্যক্তিগত কোনাে স্বার্থের সংঘাতে যদি কোনাে আঘাত বা অবমাননা পেতে হয়, সেখানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বড়ই দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা কোনাে একটা সুন্দর সমাধান না দেয়া পর্যন্ত ধৈর্য অবলম্বন করা, ভালাে কাজের ওপর অবিচল থাকা এবং অন্যায়ের প্রতিদানে ভাল কিছু দিতে পারাটা অবশ্যই বড় মহৎ গুণ। বিলম্বে হলেও এ গুণের সুফল আসবেই। এইটিই হচ্ছে সেই মহান মর্যাদা, যা অন্যায়কে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ভালাে ব্যবহার দ্বারা অর্জিত হয়। প্রচন্ড আক্রোশ থামিয়ে দেয়, ক্রোধ ও আক্রমণাত্মক মনােভাবকে দমন করে। এই মহান ক্ষমা, সহিষ্ণুতা ও মন্দকে ভালাে দ্বারা প্রতিহত করার পলিসি সবার জীবনেই ভারসাম্য আনে। এই ক্ষমাশীলতা, সহনশীলতা ও ভালাে দিয়ে মন্দের প্রতিদান দেয়ার মনােভাব মানুষকে সত্যিই এ মহান মর্যাদার আসনে বসিয়ে দেয়, যা সকল মানুষ পেতে পারে না। এ মহান মর্যাদা লাভ করার জন্যে কঠিন সবরের প্রয়ােজন। আল্লাহ তায়ালা এই মহাগুণের মাধ্যমেই সেসব মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মান দান করেন। ফলে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা সেই মহান মর্যাদায় ভূষিত করেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে এবং সদা সর্বদা সবর করে চলেছে তারা ছাড়া একাজ আর কেউ করতে পারবে না। আরাে পারবে তারা, যারা মহা সৌভাগ্যশালী’(আয়াত ৩৫) এটা হচ্ছে এমন এক উঁচু মর্যাদার স্তর যে পর্যন্ত রসূল(স.)-ই সঠিকভাবে পৌছুতে পেরেছেন। তিনি তাে ছিলেন এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজের জন্যে বা ব্যক্তিগত কারণে কখনও রাগ করেননি। আর আল্লাহর উদ্দেশ্যে যখন তিনি রাগ করেছেন, তখন আবার এতাে বেশী রাগ করেছেন যে অন্য কেউ এইভাবে রাগ করতে পারে না। তাঁর সম্পর্কে এবং তার মতাে অন্যান্য সকল দাওয়াত দানকারীদের সম্পর্কে আল কোরআনে একই কথা এসেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে তুমি কোনাে উস্কানি অনুভব করাে তাহলে আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাও, নিশ্চয়ই তিনি শুনেন এবং জানেন।’ এখানে বুঝা যাচ্ছে ক্রোধ এমন এক অবস্থা যেটা আপনা থেকে আসে না। কোনাে বাহ্যিক কারণেই এর উদ্রেক হয় এবং এ অবস্থা আসে তখন যখন কোনাে দুর্ব্যবহার বা অন্যায় আচরণ সহ্য করতে গিয়ে সবরের কমতি দেখা যায়। অথবা ক্ষমার প্রশ্নে কারাে বুক সংকীর্ণ হয়ে যায়। সে অবস্থায় শয়তানের ধোকা থেকে বাঁচার জন্যে মরদূদ শয়তান থেকে পানাহ চাওয়া দরকার। যাতে তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এই মানবীয় অন্তরের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। এই অন্তরের মধ্যে প্রবেশের সকল দরজা এবং এর মধ্যে চলাচলের সকল গােপন পথ তিনি জানেন। শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচার জন্যে তিনি তার শক্তি ও যােগ্যতাও জানেন, তিনি জানেন কোত্থেকে শয়তান তার কাছে আসে। তাদেরকে শয়তানের ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচার জন্যে নিরাপত্তাদান করতে পারেন। তিনি তাকে ক্রোধের উত্তাপ থেকে রক্ষা করতে পারেন। আর তিনিই সহিষ্ণু লোকদেরকে সেসব ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারেন, যা ক্রোধের কারণে মানুষকে স্পর্শ করে। এই ক্রোধকে দমন করার পদ্ধতি বড়ই কঠিন। এটা হচ্ছে কু-প্রবৃত্তির গােপন সুড়ংগ পথ, কন্টকাকীর্ণ গিরি সংকট এবং জংগলে ভরা কঠিন উপত্যকা। এই সব পথ দিয়ে দ্বীনের দাওয়াতদানকারীদেরকে জান্নাতে যাওয়ার পথ অতিক্রম করতে হয়, এভাবেই বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করে তারা গন্তব্য স্থানে এবং সফরের শেষ প্রান্তে পৌছে যায়!
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৩০-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
আল্লাহ তা’আলা বলেন যে, যারা মুখে আল্লাহ তাআলাকে প্রতিপালক বলে মেনে নিয়েছে অর্থাৎ তার একত্ববাদে বিশ্বাসী হয়েছে, অতঃপর এর উপর অটল থেকেছে, অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করেছে, তাদের কোন ভয় ও চিন্তা নেই। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেনঃ “বহু লোক আল্লাহ তাআলাকে প্রতিপালক মেনে নেয়ার পর আবার কুফরী করে থাকে (তারা এদের অন্তর্ভুক্ত নয়), যারা এটা বলে এবং মৃত্যু পর্যন্ত এর উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকে (তারাই এই সুসংবাদ প্রাপ্তির যোগ্য)।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু ইয়ালা (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সুনানে নাসাঈতেও এটা বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সামনে এ আয়াতটি যখন তিলাওয়াত করা হতো তখন তিনি বলতেন যে, এর দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা কালেমা পড়ে আর কখনো শিরক করে না।
আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, একদা হযরত আবু বকর (রাঃ) জনগণকে এই আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তরে বলেনঃ “এখানে ইসতিকামাত বা প্রতিষ্ঠিত থাকার অর্থ হচ্ছে আর গুনাহ না করা।” তিনি তখন বলেনঃ “তোমরা ভুল বুঝেছে। এর ভাবার্থ হলো- আল্লাহর একত্বকে স্বীকার করে নিয়ে আবার অন্যের দিকে কখনো ভ্রুক্ষেপ না করা।”
হযরত ইকরামা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার কিতাবে (হুকুম ও প্রতিদানের দিক দিয়ে) সবচেয়ে সহজ আয়াত কোনটি? তিনি উত্তরে (আরবী)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেন যে, আল্লাহর তাওহীদ বা একত্ববাদের উপর আমরণ প্রতিষ্ঠিত থাকা। (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত উমার (রাঃ) মিম্বরের উপর এ আয়াতটি তিলাওয়াত করে বলেনঃ “আল্লাহর কসম! এর দ্বারা ঐ লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং খেক শিয়ালের চলন গতির মত এদিক ওদিক চলে না।” (এটা ইমাম যুহরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে,। -এর অর্থ হচ্ছে যে, তারা আল্লাহর (আদিষ্ট) ফরযগুলো আদায় করে থাকে। কাতাদাও (রঃ) এ কথা বলেন। হযরত হাসান (রঃ) দুআ করতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি আমাদের প্রতিপালক। আপনি আমাদেরকে অটলতা ও পক্কতা দান করুন।” আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, (আরবী)-এর অর্থ হলোঃ তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আমল করা।
সুফিয়ান সাকাফী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাকে ইসলামের এমন একটি বিষয় বলে দিন যা অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করার আমার প্রয়োজন না হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ “তুমি বলঃ আমি আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম। অতঃপর ওর উপর অটল থাকো।” লোকটি বললোঃ “এতো আমল হলো। আমি বেঁচে থাকবো কি হতে তা আমাকে বলে দিন।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিহ্বার দিকে ইশারা করলেন এবং বললেনঃ “এটা হতে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন)
তাদের কাছে তাদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতারা আগমন করেন এবং তাদেরকে সুসংবাদ শুনাতে গিয়ে বলেনঃ “তোমরা এখন আখিরাতের মনযিলের দিকে যাচ্ছি। তোমরা নির্ভয়ে থাকো। সেখানে তোমাদের কোন ভয় নেই।
তোমাদের পিছনে তোমরা যে দুনিয়া ছেড়ে এসেছে সে ব্যাপারেও তোমরা নিশ্চিন্ত থাকো। তোমার পরিবারবর্গের, সম্পদ ও আসবাবপত্রের এবং দ্বীন ও আমানতের হিফাযতের দায়িত্ব আমাদের যিম্মায় রয়েছে। আমরা তোমাদের প্রতিনিধি। আমরা তোমাদেরকে সুসংবাদ শুনাচ্ছি যে, তোমরা জান্নাতী। তোমাদেরকে সঠিক ও সত্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তা পূর্ণ হবেই।”
সুতরাং তারা তাদের মৃত্যুর সময় খুশী হয়ে যায় যে, তারা সমস্ত অকল্যাণ হতে বেঁচে গেছে এবং সর্বপ্রকারের কল্যাণ লাভ করেছে।
হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, মুমিনের রূহকে সম্বোধন করে ফেরেশতারা বলেনঃ “হে পবিত্র রূহ, যে পবিত্র দেহে ছিলে, চলো, আল্লাহর ক্ষমা, ইনআম এবং নিয়ামতের দিকে। চলো, ঐ আল্লাহর দিকে যিনি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন।”
এটাও বর্ণিত আছে যে, মুমিনরা যখন তাদের কবর হতে উঠবে তখনই ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবেন এবং সুসংবাদ শুনাবেন। হযরত সাবিত (রাঃ) এই সূরাটি পড়তে পড়তে যখন … (আরবী)-এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছেন তখন থেমে যান, অতঃপর বলেন, আমাদের নিকট খবর পৌঁছেছে যে, মুমিন বান্দা যখন কবর হতে উঠবে তখন ঐ দু’জন ফেরেশতা তার কাছে আসবেন যারা দুনিয়ায় তার সাথে থাকতেন, এসে তাকে বলবেনঃ “ভয় করো না, হতবুদ্ধি হয়ো না এবং চিন্তিত হয়ো না। তুমি জান্নাতী। তুমি খুশী হয়ে যাও। তোমার সাথে আল্লাহ তা’আলার যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা পূর্ণ হবেই।” মোটকথা, ভয় নিরাপত্তায় পরিবর্তিত হবে, চক্ষু ঠাণ্ডা হবে এবং অন্তর প্রশান্ত থাকবে। কিয়ামতের সমস্ত ভয় ও সন্ত্রাস দূরীভূত হবে। ভাল কাজের বিনিময় স্বচক্ষে দেখবে এবং খুশী হয়ে যাবে। মোটকথা, মৃত্যুর সময়, কবরে এবং কবর হতে উঠবার সময়, সর্বাবস্থাতেই রহমতের ফেরেশতারা মুমিনের সাথে থাকবেন। সদা-সর্বদা তাকে সুসংবাদ শুনাতে থাকবেন। ফেরেশতাগণ মুমিনদেরকে একথাও বলবেনঃ “পার্থিব জীবনেও আমরা তোমাদের সাথে তোমাদের বন্ধু হিসেবে ছিলাম, তোমাদেরকে পুণ্যের পথে পরিচালিত করতাম, কল্যাণের পথ দেখাতাম এবং তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতাম। অনুরূপভাবে আখিরাতেও তোমাদের সাথে থাকবো, তোমাদের ভয়-ভীতি দূর করে দিবো, কবরে, হাশরে, কিয়ামতের মাঠে, পুলসিরাতের উপর, মোটকথা, সব জায়গাতেই তোমাদের বন্ধু ও সঙ্গী হিসেবে থাকবো। সুখময় জান্নাতে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমরা তোমাদের থেকে পৃথক হবে না। জান্নাতে পৌঁছে তোমরা যা কিছু চাইবে তা পাবে। তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়ে যাবে। এটা হবে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ হতে আপ্যায়ন। তাঁর স্নেহ, মেহেরবানী, ক্ষমা, দান সীমাহীন ও খুবই প্রশস্ত। ()
হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রঃ) এবং হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ)-এর একবার পরস্পর সাক্ষাৎ ঘটলো। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ “আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের উভয়কে জান্নাতের বাজারে মিলিত করেন এই দুআ করি।” তখন হযরত সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “জান্নাতের মধ্যেও কি বাজার আছে?” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা! রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে খবর দিয়েছেন যে, জান্নাতীরা যখন জান্নাতে যাবে এবং নিজ নিজ আমলের মর্যাদা অনুযায়ী (জান্নাতের) শ্ৰেণী লাভ করবে তখন দুনিয়ার অনুমানে জুমআর দিন তাদের সবাইকে এক জায়গায় জমা হবার অনুমতি দেয়া হবে। যখন তারা সবাই একত্রিত হয়ে যাবে তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাদের উপর স্বীয় ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করবেন। তাঁর আরশ প্রকাশিত হবে। তারা সবাই জান্নাতের বাগানে নূর, মণি-মাণিক্য, ইয়াকূত, যবরজদ এবং স্বর্ণ ও রৌপ্যের মিম্বরের উপর সমাসীন থাকবে। তাদের কেউ কেউ, যারা পুণ্যের দিক দিয়ে কম মর্যাদা বিশিষ্ট হবে, কিন্তু জান্নাতী হওয়ার দিক দিয়ে কারো অপেক্ষা কম মর্যাদা সম্পন্ন হবে না, তারা মিশক আম্বর এবং কপূরের টিলার উপর অবস্থান করবে। কিন্তু তারা নিজেদের এ জায়গাতেই এমন খুশী থাকবে যে, কুরসীর উপর উপবিষ্টদেরকে তাদের চেয়ে মর্যাদাবান মনে করবে না। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলামঃ আমরা কি আমাদের প্রতিপালককে দেখতে পাবো? উত্তরে তিনি বললেনঃ “হঁ্যা, হঁ্যা, অবশ্যই দেখতে পাবে। অর্ধ দিনের সূর্য এবং চৌদ্দ তারিখের চন্দ্রকে যেভাবে দেখে থাকো তেমনি ভাবেই আল্লাহ তাআলাকে দেখতে পাবে।” ঐ মজলিসে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকের সাথে কথা বলবেন। এমন কি কোন কোনজনকে তিনি জিজ্ঞেস করবেনঃ “অমুক জায়গায় তুমি আমার অমুক বিরোধিতা করেছিলে তা তোমার স্মরণ আছে কি?” সে উত্তরে বলবেঃ “হে আল্লাহ্ ! আপনি ওটা সম্মন্ধে কেন প্রশ্ন করছেন? ওটা তো আপনি ক্ষমা করে দিয়েছেন!” আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ “হ্যা, তুমি ঠিকই বলেছো। আমার এই অসীম ক্ষমার কারণেই তো তুমি এত বড় মর্যাদার অধিকারী হয়েছে।” তারা ঐ অবস্থাতেই থাকবে। এমন সময় এক মেঘখণ্ড তাদেরকে ঢেকে ফেলবে এবং তা হতে এমন সুগন্ধি বর্ষিত হবে যার মত সুঘ্রাণ কেউ কখনো গ্রহণ করেনি। অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ তাদেরকে বলবেনঃ “তোমরা উঠো এবং আমি তোমাদের জন্যে যে পুরস্কার ও পারিতোষিক প্রস্তুত রেখেছি তা গ্রহণ কর?” তারপর বাজারে পৌঁছবে যা ফেরেশতারা চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টন করে থাকবেন। সেখানে তারা এমন সব জিনিস দেখতে পাবে যা কখনো দেখেনি, শুনেনি এবং অন্তরেও খেয়াল জাগেনি। যে ব্যক্তি যে জিনিস চাইবে নিয়ে নিবে। সেখানে ক্রয়-বিক্রয় হবে না, বরং পুরস্কার হিসেবে দেয়া হবে। সেখানে সমস্ত জান্নাতবাসী একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করবে। একজন নিম্ন শ্রেণীর জান্নাতী উচ্চ শ্রেণীর জান্নাতীর সাথে মোলাকাত করবে। তখন দেখবে যে, তার দেহে সুন্দর সুন্দর পোশাক রয়েছে। তার মনে ওগুলোর খেয়াল জাগা মাত্রই সে তার নিজের দেহের দিকে চেয়ে দেখবে যে, সে ওগুলোর চেয়েও সুন্দর পোশাক পরিহিত রয়েছে। কেননা, সেখানে কারো মনে কোন দুঃখ-চিন্তা থাকবে না। অতঃপর তারা সবাই নিজ নিজ বাসভবনে ফিরে যাবে। সেখানে প্রত্যেককে তার স্ত্রী মারহাবা বলে সাদর সম্ভাষণ জানাবে। অতঃপর বলবেঃ “এখান থেকে যাবার সময় তো আপনার মধ্যে এইরূপ সজীবতা ও ঔজ্বল্য ছিল না, কিন্তু এখন তো সৌন্দর্য, লাবণ্য এবং সুগন্ধ খুব বেশী হয়ে গেছে, এর কারণ কি?” সে উত্তরে বলবেঃ “হ্যা, ঠিকই বটে। আজ আমরা আল্লাহ্ তা’আলার মজলিসে ছিলাম। ফলে আমাদের এই অবস্থা হয়েছে।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার সাথে সাক্ষাৎ পছন্দ করে, আল্লাহ তাআলাও তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি তার সাথে সাক্ষাৎকে মন্দ মনে করে, তিনিও তার সাথে সাক্ষাৎ করা অপছন্দ করেন।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা তো মৃত্যুকে অপছন্দ করি?” জবাবে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “এর অর্থ মৃত্যুকে অপছন্দ করা নয়। বরং মৃত্যুর যন্ত্রণার সময় তার কাছে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে সুসংবাদ আসে, যা শুনে তার কাছে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ ছাড়া অধিক প্রিয় আর কিছুই থাকে না। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলাও তার সাথে সাক্ষাৎ পছন্দ করেন। আর পাপী এবং কাফিরের মৃত্যু-যন্ত্রণার সময় যখন তাকে দুঃসংবাদ শুনানো হয় যা তার উপর পতিত হবে, তখন সে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎকে অপছন্দ করে এবং আল্লাহ তা’আলাও তার সাথে সাক্ষাৎ করাকে ঘৃণা করেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ হাদীসটি সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ। এর বহু সনদ রয়েছে)
৩৩-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ যারা আল্লাহর বান্দাদেরকে তাঁর পথে আহ্বান করে। এবং নিজেও সকর্মশীল হয় ও ইসলাম গ্রহণ করে, তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে? এ হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেরও উপকার সাধন করেছে এবং আল্লাহর সৃষ্টজীবেরও উপকার করেছে। ঐ ব্যক্তি এর মত নয় যে মুখে বড় বড় কথা বলে, কিন্তু নিজেই তা পালন করে না। পক্ষান্তরে, এ লোকটি তো নিজেও ভাল কাজ করে এবং অন্যদেরকেও ভাল কাজ করতে বলে।
এ আয়াতটি আম বা সাধারণ। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-ই সর্বোত্তমরূপে এর আওতায় পড়েন। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা মুআযযিনকে বুঝানো হয়েছে যিনি সকর্মশীলও বটে। যেমন সহীহ মুসলিমে রয়েছেঃ “কিয়ামতের দিন মুআযযিনগণ সমস্ত লোকের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উচ্চ গ্রীবা বিশিষ্ট হবে।” সুনানে মারফু’রূপে বর্ণিত আছেঃ “ইমাম যামিন এবং মুআযিন আমানতদার। আল্লাহ ইমামদেরকে সুপথ প্রদর্শন করুন এবং মুআযযিনদেরকে ক্ষমা করে দিন!”
হযরত সা’দ ইবনে আবি অক্কাস (রাঃ) বলেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলার নিকট মুআযিনদের অংশ তাঁর পথে জিহাদকারীদের অংশের মত হবে। আযান ও ইকামতের মধ্যভাগে মুআযযিনদের অবস্থা ঐরূপ, যেমন কোন মুজাহিদ আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে রক্তে রঞ্জিত হয়।” (এটা ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “আমি যদি মুআযযিন হতাম তবে আমি হজ্ব, উমরা ও জিহাদকে এতো বেশী পরোয়া করতাম না।”
হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বলেনঃ “আমি যদি মুআখ্যাযিন হতাম তবে আমার আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতো এবং আমি রাত্রে দাঁড়িয়ে নফল ইবাদত এবং দিবসের নফল রোযার প্রতি এতো বেশী গুরুত্ব দিতাম না। আমি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “হে আল্লাহ্! আপনি মুআযযিনদেরকে ক্ষমা করুন!” এটা তিনবার বলেন। আমি তখন বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি দু’আতে আমাদের কথা উল্লেখ করলেন না? অথচ আমরা আপনার হুকুম পাওয়া মাত্র তরবারী টেনে নেই (অর্থাৎ আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাই)!” উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “হ্যা, তা ঠিকই বটে। কিন্তু হে উমার (রাঃ)! এমন এক যুগ আসবে যখন আযান দেয়ার কাজটি শুধুমাত্র গরীব-মিসকীনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। হে উমার (রাঃ)! জেনে রেখো যে, যেসব লোকের দেহের গোশত জাহান্নামের উপর হারাম, মুআযিনরাও তাদের অন্তর্ভুক্ত।”
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন যে, … (আরবী)-এ আয়াতে মুআযিনেরই প্রশংসা করা হয়েছে। তার (আরবী) বলাটাই আল্লাহর পথে আহ্বান করা বুঝায়। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) ও হযরত ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি মুআযযিনদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। আর এখানে যে বলা হয়েছে এবং সে ভাল কাজ করে। এর দ্বারা আযান ও ইকামতের মাঝে দুই রাকআত নামায পড়াকে বুঝানো হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক দুই আযানের (আযান ও ইকামতের) মাঝে নামায রয়েছে।”
তৃতীয়বারে তিনি বলেনঃ “যে ব্যক্তি (দুই রাকআত নামায পড়ার) ইচ্ছা করে।” একটি হাদীসে আছে যে, আযান ও ইকামতের মধ্যভাগের দু’আ প্রত্যাখ্যাত হয় না।
সঠিক কথা এটাই যে, আয়াতটি সাধারণ হওয়ার দিক দিয়ে মুআযযিন ও গায়ের মুআযিন সবকেই শামিল করে। যে কেউই আল্লাহর পথে ডাক দেয় সেই এর অন্তর্ভুক্ত।
এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার সময় আযান দেয়ার প্রচলনই হয়নি। কেননা, এ আয়াত অবতীর্ণ হয় মক্কায়। আর আযান দেয়ার পদ্ধতি শুরু হয় মদীনায় হিজরতের পর, যখন আবদুল্লাহ্ ইবনে যায়েদ আবদি রাব্বিহ্ (রাঃ) স্বপ্নে আযান দিতে দেখেন ও শুনেন এবং তা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর নিকট বর্ণনা করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “আযানের শব্দগুলো হযরত বিলাল (রাঃ)-কে শিখিয়ে দাও, কেননা তার কণ্ঠস্বর উচ্চ।” অতএব, সঠিক কথা এই যে, আয়াতটি আম বা সাধারণ এবং মুআযযিনও এর অন্তর্ভুক্ত।
হযরত হাসান বসরী (রঃ) এই আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ “এই লোকগুলোই আল্লাহর বন্ধু। এরাই আল্লাহর আউলিয়া। আল্লাহ্ তা’আলার নিকট এরাই সবচেয়ে বেশী পছন্দনীয় এবং সবচেয়ে বেশী প্রিয়। কেননা, তারা নিজেরা আল্লাহর কথা মেনে নেয় এবং অন্যদেরকেও মানাবার চেষ্টা করে। আর সাথে সাথে তারা নিজেরা ভাল কাজ করে এবং ঘোষণা করে যে, তারা আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। এরাই আল্লাহর প্রতিনিধি।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ্ বলেনঃ ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না, বরং এ দু’য়ের মধ্যে বহু পার্থক্য রয়েছে। যে তোমার সাথে মন্দ ব্যবহার করে তুমি তার সাথে ভাল ব্যবহার কর। এভাবে মন্দকে ভাল দ্বারা প্রতিহত কর।
হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “তোমার ব্যাপারে যে আল্লাহর অবাধ্যচরণ করে, তার ব্যাপারে তুমি আল্লাহর আনুগত্য কর। এর চেয়ে বড় জিনিস আর কিছুই নেই।”
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ এর ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। এই গুণের অধিকারী করা হয় শুধু তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল এবং এই গুণের অধিকারী শুধু তাদেরকেই করা হয় যারা মহা ভাগ্যবান।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ মুমিনদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তারা যেন ক্রোধের সময় ধৈর্য ধারণ করে এবং অন্যদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার উপর নিজেদের সহনশীলতার পরিচয় দেয়। তারা যেন অপরের অপরাধকে ক্ষমার চোখে দেখে। এরূপ লোককে আল্লাহ তাআলা শয়তানের আক্রমণ হতে রক্ষা করে থাকেন এবং তাদের শত্রুরা তাদের অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হয়ে যায়। এতো হলো মানবীয় অনিষ্ট হতে বাঁচবার পন্থা। এখন মহান আল্লাহ্ শয়তানী অনিষ্ট হতে বাঁচবার পন্থা বলে দিচ্ছেনঃ যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে তুমি আল্লাহর শরণাপন্ন হবে এবং তার দিকে ঝুঁকে পড়বে। তিনিই শয়তানকে শক্তি দিয়ে রেখেছেন যে, সে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিবে। তার অনিষ্ট হতে রক্ষা করার ক্ষমতা তাঁরই রয়েছে। আল্লাহর নবী (সঃ) নামাযে বলতেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকট বিতাড়িত শয়তানের প্ররোচনা, ফুকার এবং অনিষ্ট হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
আমরা পূর্বেই বর্ণনা করেছি যে, কুরআন কারীমের মধ্যে এই স্থানের সাথে তুলনীয় সূরায়ে আরাফের একটি স্থান এবং সূরায়ে মুমিনূনের একটি স্থান ছাড়া আর কোন স্থান নেই। সূরায়ে আ’রাফের স্থানটি হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার নিম্নের উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে উপেক্ষা কর। যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে আল্লাহর শরণ নিবে, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”(৭:১৯৯-২০০) সূরায়ে মুমিনূনের স্থানটি হলো মহান আল্লাহর নিম্নের উক্তিঃ (আরবী) অর্থাৎ “মন্দের মুকাবিলা কর যা উত্তম তা দ্বারা; তারা যা বলে আমি সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত। বলঃ হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি শয়তানের প্ররোচনা হতে। হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট তাদের উপস্থিতি হতে।”(২৩:৯৬-৯৮)