أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১০৯৭)[*মতভেদ নিরসনের সঠিক উপায় :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪২:আশ-শূরা
পারা:২৫
১- ১২ নং আয়াত:-
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১
حٰمٓ ۚ﴿۱﴾
হা-মীম।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-২
عٓسٓقٓ ﴿۲﴾
আইন-সীন-ক্বাফ।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৩
کَذٰلِکَ یُوۡحِیۡۤ اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۙ اللّٰہُ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿۳﴾
মহাপরাক্রমশালী ও জ্ঞানময় আল্লাহ তোমার কাছে ও তোমার পূর্ববর্তীদের (রসূল) কাছে এভাবেই অহী পাঠিয়ে আসছেন।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৪
لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ ہُوَ الۡعَلِیُّ الۡعَظِیۡمُ ﴿۴﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তাঁরই। তিনি সমুন্নত, সুমহান।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৫
تَکَادُ السَّمٰوٰتُ یَتَفَطَّرۡنَ مِنۡ فَوۡقِہِنَّ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّہِمۡ وَ یَسۡتَغۡفِرُوۡنَ لِمَنۡ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اَلَاۤ اِنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ ﴿۵﴾
আসমান ওপর থেকে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়। ফেরেশতারা প্রশংসাসহ তাদের রবের পবিত্রতা বর্ণনা করছে এবং পৃথিবীবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে যায়। জেনে রাখো, প্রকৃতই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৬
وَ الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءَ اللّٰہُ حَفِیۡظٌ عَلَیۡہِمۡ ۫ۖ وَ مَاۤ اَنۡتَ عَلَیۡہِمۡ بِوَکِیۡلٍ ﴿۶﴾
যারা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে নিজেদের অভিভাবক বানিয়ে নিয়েছে আল্লাহই তাদের তত্বাবধায়ক। তুমি তাদের জিম্মাদার নও।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৭
وَ کَذٰلِکَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡکَ قُرۡاٰنًا عَرَبِیًّا لِّتُنۡذِرَ اُمَّ الۡقُرٰی وَ مَنۡ حَوۡلَہَا وَ تُنۡذِرَ یَوۡمَ الۡجَمۡعِ لَا رَیۡبَ فِیۡہِ ؕ فَرِیۡقٌ فِی الۡجَنَّۃِ وَ فَرِیۡقٌ فِی السَّعِیۡرِ ﴿۷﴾
এভাবে আমি তোমার প্রতি আরবী ভাষায় কুরআন অহী করেছি; যাতে তুমি সতর্ক করতে পার মক্কাবাসীদেরকে এবং ওর আশেপাশের বাসিন্দাকে, আর সতর্ক করতে পার জমায়েত হওয়ার দিন (কিয়ামত) সম্পর্কে, যাতে কোন সন্দেহ নেই; সেদিন একদল জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং একদল প্রবেশ করবে জাহান্নামে।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৮
وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰہُ لَجَعَلَہُمۡ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً وَّ لٰکِنۡ یُّدۡخِلُ مَنۡ یَّشَآءُ فِیۡ رَحۡمَتِہٖ ؕ وَ الظّٰلِمُوۡنَ مَا لَہُمۡ مِّنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ ﴿۸﴾
আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে এদের সবাইকে এক উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করে দিতেন। কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা তাঁর রহমতের মধ্যে শামিল করেন। জালেমদের না আছে কোন অভিভাবক না আছে সাহায্যকারী।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-৯
اَمِ اتَّخَذُوۡا مِنۡ دُوۡنِہٖۤ اَوۡلِیَآءَ ۚ فَاللّٰہُ ہُوَ الۡوَلِیُّ وَ ہُوَ یُحۡیِ الۡمَوۡتٰی ۫ وَ ہُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ٪﴿۹﴾
এরা কি (এমনই নির্বোধ যে) তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য অভিভাবক বানিয়ে রেখেছে? অভিভাবক তো একমাত্র আল্লাহ। তিনিই মৃতদের জীবিত করেন এবং তিনি সব কিছুর ওপর শক্তিশালী।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১০
وَ مَا اخۡتَلَفۡتُمۡ فِیۡہِ مِنۡ شَیۡءٍ فَحُکۡمُہٗۤ اِلَی اللّٰہِ ؕ ذٰلِکُمُ اللّٰہُ رَبِّیۡ عَلَیۡہِ تَوَکَّلۡتُ ٭ۖ وَ اِلَیۡہِ اُنِیۡبُ ﴿۱۰﴾
তোমাদের মধ্যে যে ব্যাপারেই মতানৈক্য হোক না কেন তার ফায়সালা করা আল্লাহর কাজ। সেই আল্লাহই আমার রব, আমি তাঁর ওপরেই ভরসা করেছি এবং তাঁর কাছেই আমি ফিরে যাই।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১১
فَاطِرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ جَعَلَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا وَّ مِنَ الۡاَنۡعَامِ اَزۡوَاجًا ۚ یَذۡرَؤُکُمۡ فِیۡہِ ؕ لَیۡسَ کَمِثۡلِہٖ شَیۡءٌ ۚ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿۱۱﴾
তিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং পশুদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন পশুদের জোড়া; এভাবে তিনি ওতে তোমাদের বংশ বিস্তার করেন। কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ।
সূরা:৪২:আশ-শূরা-১২
لَہٗ مَقَالِیۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۚ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ اِنَّہٗ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۱۲﴾
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর চাবি তাঁরই নিকট। তিনি যার প্রতি ইচ্ছা তার রুযী বর্ধিত করেন এবং সংকুচিত করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটায় অন্যান্য মক্কী সূরার মতাে আকীদা ও ঈমান সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই আলােচনা করা হয়েছে। তবে এ সূরা ওহী ও রেসালাতের ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলতে গেলে এটাই এ সূরার কেন্দ্রীয় ও প্রধান আলােচা বিষয়। অন্যান্য বিষয় নিয়ে এখানে যা কিছু আলােচনা করা হয়েছে, তা কেবল ওহী ও রেসালাতের আনুষংগিক বিষয় হিসাবেই করা হয়েছে। এ ছাড়া এ সূরায় তাওহীদ, কেয়ামত ও আখেরাতের বিষয় নিয়েও বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। সূরার বিভিন্ন স্থানে কেয়ামত ও আখেরাতের বিভিন্ন দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। অনুরূপভাবে জোর দেয়া হয়েছে কেয়ামত ও আখেরাতের প্রতি ঈমান আনয়নের ওপর এবং ঈমান আনয়নকারীদের চমকপ্রদ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সদগুণাবলীকে তুলে ধরা হয়েছে। একপর্যায়ে জীবিকা, জীবিকার স্বল্পতা ও প্রাচুর্য কিভাবে হয় এবং স্বল্পতা ও প্রাচুর্যে মানুষের মতিগতি কি ধরনের হয়, সে বিষয়েও আলােচনা করা হয়েছে। তবে সব কিছু সত্তেও ওহী ও রেসালাতই সূরার প্রধান আলােচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। অন্য যেসব বিষয় আলােচিত হয়েছে, তা এই ওহী ও রেসালাতের গুরুত্ব বর্ধক হিসাবেই আলােচিত হয়েছে বলে মনে হয়। সূরায় উক্ত বিষয়টা ও তার অনুষংগ অন্যান্য বিষয়কে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, অধিকতর চিন্তা গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করে। এ জন্যে বিভিন্ন আয়াতে বিষয়টাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব আয়াতের মাঝখানে স্রষ্টার একত্ব, জীবিকাদাতার একত্ব, মন মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণকারীর একত্ব বিষয়ক আয়াত রয়েছে। তাছাড়া ওহী ও রেসালাত বিষয়ক আয়াতগুলােতে আনুষংগিকভাবে ওহী প্রেরণকারীর একত্ব, ওহীর একত্ব, ইসলামী আকীদার একত্ব, ইসলামী আইন ও বিধানের একত্ব এবং সর্বশেষে ইসলামী আকীদার আওতাধীন মানবজাতির নেতৃত্ব সম্পর্কেও আলােকপাত করা হয়েছে। এভাবে সূরা অধ্যয়ন করলে সামগ্রিকভাবে অন্তরে একত্বের সুস্পষ্ট ছাপ পড়ে, যদিও এই একত্বের মাঝে বিবিধ রকমের ইশারা-ইংগিত ও তাৎপর্য রয়েছে। সূরায় বহু বিষয়ই আলােচিত হয়েছে। সূরার বিস্তারিত আলােচনার আগে এ সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত উদাহরণ পেশ করছি। প্রথমে বিচ্ছিন্ন বর্ণমালার প্রসংগ আসা যাক। সূরার শুরুতেই রয়েছে, ‘হা-মীম-আইন-সীন-কাফ’। এর অব্যবহিত পরেই আল্লাহ তায়ালা বলছেন, এভাবেই তােমার এবং তােমার পূর্ববর্তীদের কাছে মহা পরাক্রমশালী মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ ওহী প্রেরণ করে থাকেন। এ আয়াতের মাধ্যমে জানানাে হলাে যে, সকল যুগের নবীদের কাছে প্রেরিত ওহীর উৎস একটাই তােমার ও তােমার পূর্ববর্তীদের কাছে,’ কথাটা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। এরপর মহান আল্লাহ কেমন মহাপরাক্রমশালী ও কেমন মহাবিজ্ঞানী তা বুঝানাের জন্যে বলা হয়েছে, ‘যা কিছু আকাশে ও যা কিছু পৃথিবীতে আছে, সব তারই মালিকানাধীন।'(আয়াত ৪) এ আয়াতের মাধ্যমে জানানাে হলাে যে, আকাশ ও পৃথিবীতে বিদ্যমান যাবতীয় প্রাণী বা বস্তুর মালিক একজন মাত্র এবং সব কিছুর ওপর একমাত্র তারই আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত। এরপর বিশ্বজাহানের মালিকের প্রতি ঈমান আনয়নের ব্যাপারে ও মানবজাতির একাংশের মােশরেক হওয়ার ব্যাপারে সমগ্র সৃষ্টিজগত কী ভূমিকা পালন করে, তা তুলে ধরা হয়েছে ৫-৬ নং আয়াতে। এখানে বলা হয়েছে যে, সমগ্র সৃষ্টিজগত ঈমান ও শিরকের ব্যাপারে এতােটা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে যে, বিশ্ববাসীর একাংশ মহান আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী না হওয়ায় তারা যেন বিক্ষোভে ফেটে পড়ার উপক্রম। অপরদিকে মানবজাতির এই বিকারগ্রস্ত শ্রেণীটার এই জঘন্য কর্মকান্ড ক্ষমা করার জন্যে ফেরেশতারা আল্লাহর কাছে আবেদন জানান। এই প্রথম পর্বটা শেষ করার পর ৭ নং আয়াত থেকে পুনরায় শুরু হয়েছে মূল বিষয়টা অর্থাৎ ওহী ও রেসালাত সংক্রান্ত আলােচনা। বলা হয়েছে যে, মানবজাতির একটা গােষ্ঠী ওহী ও রেসালাতে বিশ্বাস করার কারণে জান্নাতে এবং অপর গােষ্ঠী বিশ্বাস না করায় জাহান্নামে যাবে। এই দুটো গােষ্ঠীর উল্লেখের পর পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা যদি চাইতেন তবে সমগ্র মানব জাতিকে একটা জাতিতেই পরিণত করতেন। তবে তিনি নিজের সীমাহীন জ্ঞান ও বিচক্ষণতা দ্বারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তার পছন্দসই লােকদেরকে (অর্থাৎ ঈমানদার সৎ লােকদেরকে) তার রহমতের ভেতরে প্রবেশ করাবেন। পক্ষান্তরে অত্যাচারীদের কোনাে অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই। তারপর বলা হয়েছে যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সকলের অভিভাবক, জীবনদাতা, মৃত্যু-সংঘটনকারী ও সর্বশক্তিমান।(আয়াত-৯) এখানে থেকে পুনরায় মূল বিষয় অর্থাৎ ওহী ও রেসালাত সংক্রান্ত আলােচনায় প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, মানবজাতি যেসব বিষয়ে মতভেদে লিপ্ত হয়, সেসব বিষয়ের চূড়ান্ত নিষ্পত্তিকারী হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা, যিনি এই কোরআন নাযিল করেছেন, যাতে মানুষ যে কোনাে মতভেদ নিরসনের জন্যে কোরআনেরই শরণাপন্ন হতে পারে।(আয়াত-১০) এরপর ১১ ও ১২ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, তিনিই একক স্রষ্টা, অতুলনীয় সত্ত্বা, আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ের নিরংকুশ ও সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। জীবিকা প্রশস্ত বা সংকীর্ণ করার একচেটিয়া ক্ষমতার মালিক এবং সর্ববিষয়ে সর্বাত্মক জ্ঞানের অধিকারী। এরপর পুনরায় ওহী ও রেসালাত বিষয়ক আলােচনা এসেছে ১৩-১৫ নং আয়াতে। এভাবে সমস্ত সূরা জুড়ে ওহী ও রেসালাতের বিষয়টা বারবার ঘুরে ঘুরে অন্যান্য বিষয় দ্বারা বেষ্টিত হয়ে এসেছে। তাই আকীদা বিশ্বাস সংক্রান্ত এই সব বিষয় ওহী ও রেসালাতের অনুষংগ হলেও মনে হয় যেন ওগুলােই মূল আলোচ্য বিষয়। আর আলােচ্য বিষয়ের এই ধারাবিন্যাস বিশেষভাবে সূরার প্রথম অংশে সম্পূর্ণরূপে পরিস্ফুট। কয়েকটা আয়াত পরপরই পাঠক কোনাে না কোনােভাবে ওহী ও রিসালাতের বিষয়ক বক্তব্যের সাক্ষাত পায়। সূরার দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে সূরার বাদ বাকী অংশ। এ অংশের শুরুতে জীবন জীবিকার সংকীর্ণতা ও স্বচ্ছলতা, আল্লাহর দয়াক্রমে বৃষ্টি বর্ষণে, প্রাণীসমূহের বিচরণে এবং সমুদ্রে চলাচলকারী জাহাজে ও নৌকায় আল্লাহর যে নিদর্শন রয়েছে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। এরপর উল্লেখ করা হয়েছে মােমেনদের গুণাবলী, যা তাদেরকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে থাকে। এরপর কেয়ামতের একটি দৃশ্যে দেখানাে হয়েছে অপরাধীরা আযাব দেখে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। (আয়াত ৪৪-৪৫) সেই সাথে মােমেনদের উচ্চ মর্যাদা এবং যালেমদের শাস্তির প্রতি তাদের সমর্থনেরও উল্লেখ রয়েছে ৪৫ নং আয়াতে। আর এই দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতেই সময় থাকতে আত্মশুদ্ধি করে আযাব থেকে আত্মরক্ষা করার আহ্বান জানানো হয়েছে ৪৭ নং আয়াতে। আবার এখান থেকে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে ওহী ও রেসালাত সংক্রান্ত আলােচনায় ৪৮ নং আয়াতে। এরপর প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে এই বিষয়েই আলােচনা অব্যাহত রয়েছে সূরার শেষ পর্যন্ত (আয়াত ৫২-৫৩) সূরার সমগ্র অবয়ব জুড়ে ওহী ও রেসালত বিষয়ক আলােচনার এই প্রাধান্য থেকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সূরার বিষয়বস্তুর ধারা বিন্যাস ও বর্ণনাভংগীর সাথে এই উদ্দেশ্যের মিল রয়েছে। এই উদ্দেশ্যটা হলো, শেষ নবী ও তাঁর অনুসারী এই শেষ উম্মাহকে মানব জাতির নেতা ও পথ প্রদর্শকরূপে নিযুক্ত করা। কেননা এই উম্মাহ আল্লাহর সেই বিধান ও শরীয়তের অনুসারী, যা চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। সূরার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘এভাবেই তােমার কাছে ও তােমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহী নাযিল করেন মহা প্রতাপশালী ও মহাকুশলী আল্লাহ তায়ালা।'(আয়াত ৩) এ উক্তি থেকে স্পষ্টতই প্রতিভাত হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালাই সকল নবী ও রসূলের কাছে ওহী পাঠান এবং শেষ নবীর কাছে আগত দ্বীন ও শরীয়ত নতুন কিছু নয়, বরং প্রাচীন কাল থেকে অব্যাহতভাবে চলে আসা একটা প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ মাত্র। কিছুক্ষণ পরে পুনরায় বলা হয়েছে, এভাবেই আমি তােমার কাছে আরবী কোরআন নাযিল করেছি, যাতে তুমি মক্কা ও তার আশপাশের অধিবাসীদেরকে সতর্ক করাে।(আয়াত-৭) এভাবে নতুন নেতৃত্বের কেন্দ্রস্থল কী, তা জানিয়ে দেয়া হলাে। ৩ নং আয়াতে সকল রেসালাত ও নবুওতের উৎস এক ও অভিন্ন বলে উল্লেখ করার পর ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, এই রেসালাত ও নবুওত মূলত এক ও অভিন্ন জিনিস। তারপর ১৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, যদিও রেসালাত ও তার উৎস এক ও অভিন্ন এবং এ নিয়ে ভেদাভেদ করার অবকাশ নেই, তথাপি ১৩ নং আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর নিষেধাজ্ঞাকে লংঘন করে ভেদাভেদ করা হয়েছে। আর উক্ত মহান রসূলদের অনুসারীরা এই ভেদাভেদ জেনে ও বুঝে করেছে, হিংসা ও অহংকারের মনােভাব নিয়ে করেছে। এরপর এই ভেদাভেদকারীদের উত্তরাধিকারীদের চরিত্রও তুলে ধরা হয়েছে এই বলে যে, তারা ঘোরতর সংশয়ে লিপ্ত। এই পর্যায়ে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মানবজাতি সন্দেহ উচ্ছৃংখলতার যুগে ফিরে গিয়েছিলাে এবং নির্ভুল পথে পরিচালিত কোনাে নেতৃত্ব তার ছিলাে না। কেননা মহান আল্লাহর প্রেরিত রসূলের নেতৃত্বের ব্যাপারে তার অনুসারীরা সংশয়ে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের উত্তরাধিকারীরাও সংশয়ে লিপ্ত থাকে এবং কোনাে সঠিক নেতৃত্ব তাদের মধ্যে ছিলাে না। এ কারণেই সর্বশেষ রসূলকে এই নেতৃত্বের ম্যান্ডেট দেয়া হয়েছে এই বলে, ‘অতএব, তুমি দাওয়াত দাও, তােমাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার ওপর অবিচল থাকে এবং বলাে, আল্লাহ যে কেতাব নাযিল করেছেন, তাতে আমি ঈমান এনেছি। আর আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে যেন তােমাদের প্রতি ন্যায় বিচার করি’ (আয়াত ১৫) আর এ কারণেই এ সূরার দ্বিতীয় অংশে মানবজাতিকে নির্ভুল ও স্থীতিশীল ওহীভিত্তিক আদর্শবাদী নেতৃত্ব প্রদানের স্বাভাবিক যোগ্যতা মুসলমানদের অন্যতম জাতীয় ও সামষ্টিক বৈশিষ্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এই সূরার প্রধান আলােচ্য বিষয় ও অন্যান্য আলােচ্য বিষয়ের মূল সূর ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সূরার বিশদ তাফসীরে এ বিষয়টা ক্রমান্বয়ে আরাে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
# ‘হা-মীম-আইন-সীন কাফ…’ (আয়াত ১-৬)। কতিপয় সূরার শুরুতে উল্লেখিত এ ধরনের বিচ্ছিন্ন বর্ণমালার ব্যাখ্যা সম্পর্কে ইতিপূর্বে যা কিছু আলােচনা করা হয়েছে, এ সূরার শুরুতে বর্ণিত এই কটা বর্ণমালার ব্যাখ্যায়ও সেই আলােচনাই প্রযােজ্য এবং সেইটুকুই যথেষ্ট। এর অব্যবহিত পর আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘এভাবেই তােমার প্রতি ও তােমার পূর্ববর্তীদের প্রতি ওহী নাযিল করেন।’ অর্থাৎ তােমার ও তােমার পূর্ববর্তীদের কাছে যে ওহী পাঠানাে হয়েছিলাে তা এভাবেই পাঠানাে হয়েছিলাে এবং এসব অক্ষর দিয়েই তা রচিত হয়েছিলাে। এসব অক্ষর বা বর্ণমালা তাদের কাছে সুপরিচিতি। অথচ তারা তাদের সুপরিচিতি এসব অক্ষর দিয়ে এ ধরনের বাণী রচনা করতে পারেনি। অন্যদিক দিয়ে দেখলে এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, স্থান কাল ও পাত্র নির্বিশেষে সকল ওহীই মূলত এক ও অভিন্ন এবং তার উৎসও এক ও অভিন্ন। ওহীর প্রেরণকারী হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা আর এর প্রাপক হচ্ছেন বিভিন্ন যুগ ও বিভিন্ন অঞ্চলের নবী ও রসূলরা। তোমার প্রতি ও তােমার পূর্ববর্তীদের প্রতি বস্তুত এ একটা সুর্দীঘ প্রক্রিয়া, যার সূচনা বহু আগেই হয়েছে, যুগ যুগ কাল ধরে অব্যাহত থেকেছে এবং শাখা প্রশাখা বহুসংখ্যক হলেও মূল ও শেকড় একটাই-এ সত্যটা যখন মােমেনদের মন মগযে বন্ধমূল হয়, তখন তারা উপলব্ধি করতে পারে যে, তাদের নীতি ও আদর্শের মূল ও উৎস এক ও অভিন্ন। সেই উৎস হচ্ছেন মহা পরাক্রমশালী ও মহাকুশলী আল্লাহ তায়ালা। কাজেই এই আদর্শের অনুসারীরা সবাই পরস্পরের একান্ত আপনজন, চাই তাদের স্থান ও কালে যতােই ভিন্ন ভিন্ন হােক না কেন। তারা ইতিহাসের হাজার হাজার বছরের ব্যবধানের মধ্য দিয়েও একই পরিবার হিসাবে চিহ্নিত। তাদের শেকড় যুগ যুগ কালব্যাপী বিস্তৃত হলেও শেষ পর্যন্ত তারা মহান আল্লাহর সাথেই মিলিত হয়। তিনি মহাপরাক্রমশালী’ অর্থাৎ সীমাহীন শক্তি ও ক্ষমতার মালিক। মহাকুশলী অর্থাৎ মহা প্রজ্ঞাবান। তিনি গভীর প্রজ্ঞা ও কুশলতা দ্বারা বুঝতে পারেন কাকে কী ওহী পাঠানাে উচিত এবং সেই অনুসারেই তিনি তা উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠান। সুতরাং তার এই প্রাজ্ঞ একক ও চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে তারা অন্যান্য বিক্ষিপ্ত ব্যবস্থাকে কেন গ্রহণ করে, যার কোনাে উৎস জানা যায় না এবং যা কোনাে সঠিক গন্তব্যের দিকে অগ্রসর হয় না? যে আল্লাহ তায়ালা সকল রসূলের কাছে ওহী পাঠান, তার গুণাবলী বর্ণনা করে বলা হচ্ছে যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সে সবের তিনিই একমাত্র মালিক এবং তিনিই সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ।(আয়াত ৪) মানুষ কখনাে কখনাে প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে ভাবতে থাকে যে, সে অনেক ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সহায় সম্পদের মালিক। সে এ কথা ভাবে শুধু এ জন্যে যে, সে বহুসংখ্যক জিনিসকে নিজেদের চোখের সামনে নিজের অনুগত দেখতে পায়, সেগুলাে দ্বারা সে উপকৃত হয় এবং সেগুলােকে নিজেদের ইচ্ছেমত কাজে লাগায়। অথচ এগুলাের সত্যিকার মালিক সে নয়। প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা, যিনি সৃষ্টি করেন, আবার সৃষ্টিকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করেন, বাচান ও মারেন। মানুষকে যা ইচ্ছে দিতে পারেন এবং যা ইচ্ছা তা থেকে বঞ্চিত করতে পারেন। তিনি মানুষকে যা ইচ্ছে বিতরণ করেন, আর যা ইচ্ছা, তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারেন, আবার যা ছিনিয়ে নেন, তার পরিবর্তে নতুন কিছু দিতেও পারেন। তিনিই সেই আসল মালিক, যিনি পৃথিবীর যাবতীয় জিনিসের প্রকৃতির ও স্বভাবসিদ্ধ গুণাগুণ স্থির করেন, সেগুলােকে প্রাকৃতিক বিধি বিধান অনুসারে পরিচালনা করেন, আর এর ফলে সেই প্রাকৃতিক বিধানের দাবী অনুসারে সকল জিনিস তার অনুগত ও বশীভূত থাকে এবং এই হিসাবে তিনি আকাশ ও পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল জিনিসের প্রকৃত মালিক। আর তিনি উচ্চ মর্যাদাশালী ও মহামহিম। অর্থাৎ তিনি শুধু পৃথিবীর সকল জিনিসের মালিকই নন, বরং পৃথক পৃথকভাবে শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বেরও মালিক। তার শ্রেষ্ঠত্বের সামনে আর সব কিছুই হীন এবং তার মহত্বের সামনে আর সবই নগণ্য। আর যখন এই সত্য অন্তরে যথাযথভাবে বদ্ধমূল হয়, তখন মানুষ বুঝতে পারে নিজের জন্যে জীবিকা উপার্জন করতে সে যেসব কর্মপন্থা অবলম্বন করছে তা সঠিক কিনা। কেননা আকাশ ও পৃথিবীর সব কিছু যখন আল্লাহর, তার হাতেই যখন সব কিছু, তখন এ জন্যে বেপরােয়া হয়ে ন্যায় ও অন্যায় এবং হালাল হারামের বাছ-বিচার পরিহার করা উচিত নয়। তাছাড়া তিনি যখন মহান ও উচ্চ মর্যাদাশালী তখন তার কাছে যে ব্যক্তি হাত পাতবে, সে তুচ্ছ ও নগণ্য হবে না।
*বিশ্বপ্রকৃতিতে তাওহীদের নিদর্শন : এরপর বিশ্ব প্রকৃতিতে আল্লাহর মালিকানা কেমন নির্ভেজাল ও অংশীদারবিহীন, তা বুঝানাের জন্যে একটা দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেটা হলো, মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমার অনুভূতির তীব্রতায় আকাশ যেন ফেটে পড়ার উপক্রম হয় এবং ফেরেশতারা তার কাছে বিশ্ববাসীর পাপের জন্যে ক্ষমা চায় ও তাসবীহ পাঠ করে।(আয়াত ৫) আকাশ হচ্ছে সেই বিশাল ও বিরাট সৃষ্টি, যাকে আমরা পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের মাথার ওপর দেখতে পাই! এ বস্তুটা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সামান্য ও অপ্রতুল। এ যাবত আমরা যেসব তথ্য জানতে পেরেছি তার একটা হলাে, এই মহাকাশে আল্লাহ তায়ালার যে সকল সৃষ্টি রয়েছে, তন্মধ্যে এক লক্ষ মিলিয়ন সৌর মন্ডল অন্যতম। এর প্রত্যেকটা সৌর মন্ডলে আমাদের এই সূর্যের মত এক লক্ষ মিলিয়ন সূর্য রয়েছে। এর প্রত্যেকটা সূর্য আমাদের এই পৃথিবীর দশ লক্ষ গুণের চেয়েও বড়। আর এই সমস্ত সৌর মন্ডলকে আমরা আমাদের দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে পেয়েছি এবং এগুলাে আকাশে এত দূরে দূরে ছড়িয়ে রয়েছে যে, এগুলাের পরস্পরের মধ্যকার ব্যবধান লক্ষ লক্ষ ও কোটি কোটি আলোকবর্ষ সমান। অর্থাৎ আলাের গতি প্রতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। এই হিসাবে আলােক বর্ষ গণনা করা হয়েছে। যে আকাশ সম্পর্কে আমরা এই সামান্য তথ্যটুকু জানতে পেরেছি, সেই আকাশ মহান আল্লাহর ভয়ে ও বিশ্ববাসীর পাপের পরিণতির আশংকায় ফেটে পড়তে চায়। আর ফেরেশতারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ঘােষণা করে ও বিশ্ববাসীর জন্যে ক্ষমা চায়। ফেরেশতারা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। তারাই প্রথম সৃষ্ট জাতি, যারা পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশে জীবন যাপন করে। তবে তারা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বকে অনুভব করে এবং আল্লাহর প্রশংসা ও আনুগত্যের প্রতীক স্বরূপ সর্বক্ষণ তাসবীহ পাঠ করে। অথচ পৃথিবীর পাপপ্রবণ অধিবাসীরা ঈমান আনে না ও বিপথগামী হয়। এ জন্যে ফেরেশতারা সর্বক্ষণ ভীত সন্ত্রস্ত থাকে যে, কখন যেন আল্লাহর গযব এসে পড়ে। তাই তারা পৃথিবীতে সংঘটিত পাপাচার ও অপরাধসমূহের ব্যাপারে বিশ্ববাসীর জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়। এখানে বিশ্ববাসীর জন্যে ক্ষমা চায়’ কথাটার অর্থ এও হতে পারে যে, ঈমানদারদের জন্যে ক্ষমা চায়, যেমন সূরা ‘মােমেন’-এ বলা হয়েছে, যারা আরশকে বহন করে ও যারা আরশের আশে পাশে থাকে, তারা তাদের প্রতিপালকের গুণগান করে তার প্রতি ঈমান আনে এবং মােমেনদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট বুঝা যায় ফেরেশতারা পৃথিবীতে যে কোনাে ধরনের পাপাচার সংঘটিত হওয়াকে ভয় পায়। এমনকি মােমেনদের দ্বারা সংঘটিত হওয়াকেও তারা ভয় পায়। বুঝা যায় এই ভয়ের কারণেই তারা আল্লাহর প্রশংসা সহকারে গুণগান করে ও ক্ষমা চায়। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে, তার রাজত্বে তার অবাধ্যতা সংঘটিত হওয়া যে বিপজ্জনক, সে কথা ব্যক্ত করে এবং আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার প্রত্যাশা ও আবেদন জানায়। জেনে রেখাে, আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়াশীল। এভাবে আল্লাহর পরাক্রম ও প্রতাপ এবং বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতা-এই দুটো গুণের সাথে মহত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, দয়াশীলতা ও ক্ষমাশীলতা-এই চারটি গুণের সংযােজন ঘটানাে হলো। কেননা আল্লাহর বান্দারা আল্লাহকে তার গুণাবলীর মাধ্যমেই চিনে থাকে। উক্ত গুণাবলী ও সমগ্র সৃষ্টি জগতের ওপর ওগুলাের প্রভাব বর্ণনা করার পর আয়াতটার শেষাংশে মােশরেকদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যান্যদেরকে নিজেদের অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের জানা উচিত যে, বিশ্বজগতে আল্লাহ ছাড়া আর কোনাে অভিভাবক নেই। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হলাে, রসূল(স.)-কে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান। কেননা তিনি মােশরেকদের অপকর্মের জন্যে দায়ী নন। তাদের তত্ত্বাবধায়ক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনিই তাদের তদারককারী। ‘যারা তাকে ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তাদের রক্ষক আল্লাহ তায়ালা। তুমি তাদের দায়ী নও।’ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যান্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণকারী এসব হতভাগা মােশরেকের শোচনীয় ভাবমূর্তি প্রত্যেক সচেতন বিবেকের কাছেই ধরা পড়ে। তার ও তাদের অভিভাবকরা দুনিয়া ও আখেরাতে শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ। তাদের তত্ত্বাবধায়ক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। আল্লাহর মুঠোর ভেতরে তারা নিদারুণ অসহায় ও অক্ষম। রসূল(স.) ও তাঁর সাথী মােমেনরা তাদের জন্যে দায়ী নন। তাদের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই নিয়েছেন। মুসলমানদের অন্তরে এ সত্যটা বদ্ধমূল হওয়া খুবই জরুরী, যাতে তারা অন্তত এ দিক দিয়ে সর্বাবস্থায় নিশ্চিন্ত হয়। আল্লাহকে ছাড়া অন্যান্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণকারীরা দুনিয়ার জীবনে প্রভাবশালী হােক অথবা অপ্রভাবশালী, কোনাে অবস্থাতেই মুসলমানদের দুশ্চিন্তার কোনাে কারণ নেই। কেননা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালীরা যতােই স্বৈরাচারী হােক না কেন, তারা যতােক্ষণ আল্লাহর অনুগত হয়ে আল্লাহর কাছ থেকে তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির ছাড়পত্র গ্রহণ করবে, ততােক্ষণ তারা প্রকৃত পক্ষে দুর্বলই থেকে যাবে। কেননা আল্লাহ তায়ালাই তাদের রক্ষক এবং তাদের আশপাশের সমগ্র সৃষ্টিই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী। অথচ একমাত্র তারাই বিপথগামী। একটা সুশৃংখল, সুসমন্বিত ও সুপ্রশিক্ষিত বাদক দলে একজন বেসুরাে বাদক যেমন বেখাপ্পা ও বেমানান, এই মােশরেকরাও তেমনি মহা বিশ্বের একমাত্র বিদ্রোহী সৃষ্টি হিসাবে বেমানান। আর যারা তেমন প্রভাবশালী নয়, তাদের ব্যাপারেও মােমেনদের দুশ্চিন্তার প্রয়ােজন নেই। কারণ তারা যদি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তবে তাতে মােমেনদের ঘাড়ে কোনাে দোষ বর্তাবে না। কেননা বিপথগামীদের কোনাে দায় দায়িত্ব তাদের ওপর ছিলাে না এবং নেই। সদুপদেশ দান ও প্রচার ছাড়া তাদের আর কোনাে দায়িত্ব ও কর্তব্য নেই। বান্দাদের মন ও মানসিকতার রক্ষণাবেক্ষণ কেবল আল্লাহর কাজ অন্য কারাে নয়। এ জন্যে মােমেনরা নিশ্চিন্তে নিজেদের পথে চলতে থাকে, কারণ তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্ভুল পথনির্দেশনার আলােকে চলে। যারা বিপথগামী, তাদের বিপথগামিতা যে ধরনেরই হােক তাতে তাদের কিছু এসে যায় না।
*আরব উপদ্বীপকে ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে বাছাই করণ : পুনরায় প্রথম কেন্দ্রীয় বিষয়টা নিয়ে বলা হচ্ছে, এভাবেই আমি তােমার কাছে আরবী কোরআন ওহী করেছি…’ (আয়াত ৭) আয়াতের উক্ত অংশটাকে সূরার প্রথম আয়াতের সাথে যুক্ত করা হয়েছে ওয়াও (এবং) দ্বারা। সেই বিচ্ছিন্ন বর্ণমালা ও এখানকার আরবী কোরআনের মাঝে সুস্পষ্ট সমন্বয় বিদ্যমান। কেননা সেই বর্ণমালাও আরবী, আর এই কোরআনও আরবী। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তার ওহীকে এই আরবী পুস্তকের আকারে নাযিল করেন, যাতে করে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হয়। সেই লক্ষ্য হলাে, যেন তুমি উন্মুল কোরা ও তার আশপাশের এলাকাকে সতর্ক করো। উম্মুল কোরা হচ্ছে মক্কা শরীফ। আল্লাহর প্রাচীনতম ঘর কাবা শরীফ এখানে অবস্থিত হওয়ায় তা সম্মানিত। আল্লাহ তায়ালা সর্বশেষ রেসালাতের অবস্থানস্থল হিসাবে মক্কা ও তার আশপাশের জনপদগুলােকে মনােনীত করেছেন। আর যে উদ্দেশ্যে তিনি কোরআনকে আরবী ভাষায় নাযিল করেছেন তা তিনিই জানেন। ‘আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন কোথায় তার রেসালাতকে পাঠাবেন।’ আজ যখন আমরা বিভিন্ন ঘটনাবলী, পরিস্থিতি ও তার দাবী এবং ইসলামের বিস্তৃতি কিভাবে ঘটেছে, তা লক্ষ্য করি, তখন বুঝতে পারি সেই সময়ে এই ভূখন্ডটাকে মনােনীত করার পেছনে আল্লাহর কী গভীর প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা নিহিত ছিলাে। জানতে পারি, এ স্থানটাকে সর্বশেষ ও সমগ্র মানব জাতির জন্যে আগত ঐশী বিধান ইসলামের কেন্দ্রস্থল হিসাবে মনােনীত করার যৌক্তিকতা কী ছিলাে। অনুধাবন করতে পারি যে, প্রথম দিন থেকেই আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহকারী পূর্ণাংগ জীবন বিধান ইসলাম কেন এ স্থানটাকে নিজের প্রথম রাজধানী বানিয়েছিলাে। এই সর্বশেষ রেসালাতের আগমনকালে সভ্য দুনিয়া চারটে সাম্রাজ্যে বিভক্ত ছিলাে। রােম সাগ্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য, চীন সম্রাজ্য ও ভারত সাম্রাজ্য। এগুলাের মধ্যে রােম সাম্রাজ্য ছিলাে ইউরােপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার অংশ বিশেষ জুড়ে বিস্তৃত। পারস্য সম্রাজ্যের আধিপত্য বিরাজ করতাে এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। আর চীনা ও ভারতীয় সাম্রাজ্য দুটো বলতে গেলে নিজ নিজ ভূখন্ডেই সীমাবদ্ধ ছিলাে। এরা উভয়ে নিজ নিজ আকীদা বিশ্বাস ও রাজনৈতিক যােগাযােগের কারণে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ও একঘরে ছিলাে। এ কারণে প্রথমােক্ত সাম্রাজ্য দুটোরই ছিলাে প্রকৃত পক্ষে বিশ্বজোড়া প্রভাব ও বিস্তৃতি। ইসলামের আগমনের পূর্বে দুটো ওহীভিত্তিক ধর্ম ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ প্রথমােক্ত সাম্রাজ্য দুটোর প্রভাবাধীন ছিলাে। এ ধর্ম দুটোর ওপর রাষ্ট্র কর্তৃত্বশীল ছিলাে, রাষ্ট্রের ওপর এ দুটোর কোনাে কর্তৃত্ব ছিলাে না। তা ছাড়া এ দুটো ধৰ্মই ছিলাে বিকৃত ও বিপর্যস্ত। ইহুদী ধর্ম কখনাে বা রােমান সাম্রাজ্য কর্তৃক নিগৃহিত হতাে, আবার কখনাে পারস্য সাম্রাজ্যের নির্যাতনের শিকার হতাে। কোনাে অবস্থাতেই এই ভূখন্ডের কোনাে উল্লেখযােগ্য অংশের ওপর কিছুমাত্র কর্তৃত্ব ও আধিপত্য তার ছিলাে না। বরঞ্চ বিভিন্ন কারণে শেষ পর্যন্ত এটা কেবল মাত্র বনী ইসরাঈলের ধর্ম হিসেবেই টিকে ছিলাে এবং অন্যান্য জাতিকে এর আওতায় আনার কোনাে ইচ্ছা বা আগ্রহই তার ছিলাে না। খৃষ্টধর্মের জন্ম হয়েছিলাে রােমান সাম্রাজ্যের অধীন। এই ধর্মের আবির্ভাবকালে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিসর ও যেসব অঞ্চলে গােপনে এ ধর্মের বিস্তৃতি ঘটেছিলাে, সেসব অঞ্চলের ওপর রোমান সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিরাজ করছিল এ সময় রোমান সাম্রাজ্য সদ্য আবির্ভূত খৃষ্ট ধর্মের ওপর লােমহর্ষক অত্যাচার চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। পরে যখন রোমান সাম্রাজ্যের অত্যাচারের যুগের অবসান ঘটলাে এবং রােমান সাম্রাজ্য খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হলাে। তখন তার সাথে সাথে রােমকদের পৌত্তলিক ধ্যান ধারণাও তাতে ঢুকে পড়লাে এবং গ্রীক পৌত্তলিক দর্শনেরও অনুপ্রবেশ ঘটলাে। এভাবে খৃষ্টধর্ম একটা অভিনব জগাখিচুড়ির রূপ ধারণ করলাে এবং আসল ওহীভিত্তিক খৃষ্টধর্মরূপে আর নিজেকে বহাল রাখতে পারলাে না। তা ছাড়া রােমান সাম্রাজ্য প্রকৃতিগতভাবেও ধর্ম দ্বারা খুব বেশী প্রভাবিত ছিলাে না এবং ধর্মীয় আকীদা বিশ্বাস তার ওপর কর্তৃত্বশীল ছিলাে না। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রই তার ওপর কর্তৃত্বশীল ছিলাে। উপরন্তু খৃষ্টধর্মে উপদলীয় কোন্দল এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছিলাে যে, তা গীর্জাকে ছিন্ন ভিন্ন ও গােটা সাম্রাজ্যকে টুকরাে টুকরাে করে দেয়ার উপক্রম করেছিলাে। খৃষ্টবাদের রাষ্ট্রীয় সংস্করণের বিরােধীদের ওপর কঠোরতম পাশবিক নির্যাতনের খড়গ নেমে আসে। আর রাষ্ট্রীয় বা অরাষ্ট্রীয় উভয় সংস্করণই ছিলাে আসল খৃস্টীয় তত্ত্বের বিকৃতরূপ। ঠিক এই পরিস্থিতিতেই ইসলামের শুভাগমন ঘটলাে। তৎকালীন বিশ্বের প্রতিটা জনঅধ্যুষিত অঞ্চলে মানবজাতি যে চরম বিশৃংখলা, অরাজকতা, বিকৃতি, বিভ্রান্তি, নির্যাতন ও অন্ধ জাহেলিয়াতের শিকার হয়েছিলো, তা থেকে তাকে উদ্ধার করার জন্যেই তার আবির্ভাব ঘটেছিলাে। ইসলাম এসেছিলাে মানব জীবনের ওপর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার করতে এবং মানব জাতিকে আল্লাহ তায়ালার আলােকোজ্জল হেদায়াতের পথে নিয়ে যেতে। মানব জীবনে এই সর্বব্যাপী পরিবর্তন বাস্তবায়িত করার জন্যে সমাজ তথা রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর ইসলামের কর্তৃত্বশীল ভূমিকা ছিলাে অপরিহার্য। আর এ জন্য তাকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিলাে এমন একটা স্বাধীন ভূখন্ড থেকে, যার ওপর সেই চারটে সাম্রাজ্যের কোনােটারই কোনাে প্রভাব প্রতিপত্তি ছিলাে না। তাকে এমন এক স্বাধীন জীবন শুরু করতে হয়েছিলাে, যার ওপর কোনাে বহির্শক্তি প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে; বরং সে নিজেই নিজের ওপর ও পার্শবর্তী অন্য সকলের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে। বস্তুত আরব উপদ্বীপ, বিশেষত মক্কা ও তার পার্শ্ববর্তী জনপদগুলােই ছিলাে তৎকালে ইসলামের অভ্যুদয়ের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান এবং তার সেই বিশ্ব অভিযান শুরু করার জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত সূচনা বিন্দু, যার জন্যে প্রথম দিন থেকেই তার আবির্ভাব ঘটেছিলে। সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে এমন কোনাে সুসংগঠিত সরকার ছিলাে না, যা আইন-কানুন, আইন সভা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, সমগ্ৰ উপদ্বীপ জুড়ে শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়, যা নিজের সুসংগঠিত ক্ষমতা দিয়ে নতুন আকীদা বিশ্বাসের প্রচার ও প্রসারের পথ রােধ করতে পারে এবং যার পরিপূর্ণ আনুগত্য করতে জনগণ বাধ্য থাকে-যেমনটি এই চার সম্রাজ্যে ছিলাে। সেখানে কোনাে স্থীতিশীল সুরক্ষিত ও সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ধর্মের অস্তিত্ব ছিলাে না। জাহেলী পৌত্তলিকতা তখন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিলাে এবং তার আকীদা বিশ্বাস ও পূজা উপাসনাও হয়ে গিয়েছিলাে শতধা ছিন্ন। আরবরা ফেরেশতা, জিন, নক্ষত্র ও দেব-দেবীর পূজারীতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলাে। যদিও কাবা ও কোরায়শের একটা যৌথ ধর্মীয় আধিপত্য সমগ্র আরবে বিস্তৃত ছিলাে, কিন্তু সেটা এতােটা মযবুত কোনাে শাসন ব্যবস্থা ছিলাে না, যা নতুন ধর্মের পথে যথার্থ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পারে। কোরায়শ সরদারদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও বিশেষ বিশেষ কায়েমী স্বার্থ যদি না থাকতো, তাহলে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে এতটা মরিয়া হয়ে রুখে দাঁড়াতাে না। কেননা তাদের ধর্মে যে বিশৃংখলা ও বিভেদ বিরাজ করছিলাে, সেটা তারা উপলব্ধি করছিলাে। ধর্মীয় বিশৃংখলার সাথে আরবের রাজনৈতিক অরাজকতা যুক্ত হয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলাে, যা একটা নতুন ধর্মের সম্পূর্ণ নতুন স্বভাব প্রকৃতি নিয়ে ও সম্পূর্ণ বাধাবন্ধন মুক্ত অবস্থায় আত্মপ্রকাশ করার সবচেয়ে উপযােগী ছিলাে। এই বিশৃংখলার পাশাপাশি আরবের সামাজিক অবস্থাও একটা নতুন ধর্মের অভ্যুদয়ের অনুকূল ছিলাে। সেখানে গােত্রীয় শাসনের প্রাধান্য ছিলাে এবং এই শাসনে গােত্রের ভূমিকা ছিলাে সবচেয়ে মুখ্য। মােহাম্মদ(স.) যখন ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন, তখন বনু হাশেমের তরবারী তার রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলাে এবং গােত্রীয় ভারসাম্য তার পথকে করেছিলাে অপেক্ষাকৃত বাধামুক্ত। কেননা বনু হাশেম মােহাম্মদ(স.)-এর প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ না করেও তাকে যেভাবে সংরক্ষণ ও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলাে, তাতে অন্যান্য গােত্র বনু হাশেমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করতে ভয় পাচ্ছিলাে। এমনকি দাওয়াতের সূচনালগ্নে যে মুষ্টিমেয় সংখ্যক লােক বিভিন্ন গােত্রে ইসলাম গ্রহণ করেছিলাে, তাদের ওপরও ভিন্ন গােত্রের লােকেরা কোনাে আক্রমণ চালানাের সাহস পেতাে না এবং তাদেরকে দমন ও পীড়ন করার কাজ সেই গোত্রের জন্যেই রেখে দিতাে। যে সমস্ত দাসদাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাে। তাদের ওপর তাদের মনিবরাই নির্যাতন চালিয়েছিলাে। এ জন্যে হযরত আবু বকর এসব দাস-দাসীকে ক্রয় করে স্বাধীন করে দিতেন। এতে তাদের ওপর অত্যাচার করা এবং তাদেরকে সাবেক ধর্মে ফিরে আসতে বাধ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়তাে। এতে নতুন ধর্মের প্রসারে যে সুবিধার সৃষ্টি হতাে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ছাড়া আরবদের কিছু ঐতিহ্যবাহী মানবিক গুণাবলী যথা বীরত্ব, আত্মমর্যাদাবােধ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি নতুন আদর্শ গ্রহণ ও তার জন্যে ত্যাগ স্বীকার করার প্রেরণা সৃষ্টির সহায়ক ছিলো। তৎকালীন আরব উপদ্বীপে একটা নতুন অভ্যুত্থানের জন্যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাে এবং দেশটা এ জন্যে উন্মুখ হয়েছিলাে। সকলের অজান্তে এ ধরনের একটা অভ্যুত্থানের উপযােগী যােগ্যতা, দক্ষতা ও ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিলাে। জাতি এর জন্যে প্রয়ােজনীয় অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছিলাে রােমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য সফরের মধ্য দিয়ে। এ সব সফরের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছিলাে শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন সফর, যার উল্লেখ কোরআনে সূরা কোরায়শে রয়েছে। ক্রমে এ সব অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বৃদ্ধি পেতে থাকে সেই বিরাট অভ্যুত্থানকে সফল করার জন্যে, যার জন্যে আল্লাহ তায়ালা এই দ্বীপকে মনােনীত করেছিলেন। যখন ইসলামের আবির্ভাব ঘটলাে, তখন সে এসব সঞ্চিত উপাদানকে ও শক্তিকে কাজে লাগালাে। শেষ পর্যন্ত কাংখিত সেই অভ্যুত্থান সংঘটিত হলাে এবং আল্লাহ তায়ালা ইসলামকে বিজয়ী করলেন। রাসূল(স.)-এর জীবনে সাহাবাদের যে প্রথম প্রজন্মের সাক্ষাত পাওয়া যায়। যেমন হযরত আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, হামযা, আব্বাস, আবু ওবায়দা, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, খালেদ ইবনে ওলীদ, সাদ ইবনে মায়ায ও আবু আইয়ুব আনসারী প্রমুখ (রাদিয়াল্লাহ আনহুম) যারা ইসলাম গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তাকে বিজয়ী করার জন্যে জান ও মালের ত্যাগ ও কোরবানীর মাধ্যমে সর্বাত্মক সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন, এরাই ছিলেন পরিপূর্ণ বিজয়াভিযানের প্রধান উপাদান। এখানে এর চেয়ে বেশী বিস্তারিতভাবে বলার অবকাশ নেই যে, ইসলামের সফল অভূত্থান ঘটানো এবং তার সর্বাত্মক বিজয় ছিনিয়ে আনার উপযুক্ত আর কি কি উপাদান আরব উপদ্বীপে বিদ্যমান ছিলাে, যা দ্বারা বুঝা যায় সমগ্র বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্যে আগত এই মহান মতাদর্শের লীলাভূমি হিসাবে এই দেশটাকে বেছে নেয়া যুক্তিসংগত ছিলো এবং বিশেষভাবে এই কাবা শরীফকে নতুন রেসালাতের অভ্যুদয় ক্ষেত্র হিসাবে মনােনয়ন করা মানানসই হয়েছিলাে। এই আলােচনা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। আমাদের পক্ষে এতােটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, আরব উপদ্বীপকে ইসলামকে অভ্যুদয়ের কেন্দ্র হিসাবে বেছে নেয়ার মূলে মহান আল্লাহর সেই প্রজ্ঞা বিচক্ষণতা সক্রিয় রয়েছে, যা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না। মানবীয় অভিজ্ঞতা ও জীবন রহস্যের উপলব্ধি যখন ব্যাপকতর ও প্রশস্ততর হতে থাকে, তখন গভীরতর চিন্তা-গবেষণা চালালে এই প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার কিছু কিছু দিক উদঘাটিত হয়ে থাকে। এ ভাবেই কোরআন প্রাথমিকভাবে মক্কা শরীফ ও তার আশপাশের জনপদকে সতর্ক করার জন্যে এসেছে। এরপর আরব উপদ্বীপ যখন জাহেলিয়াতকে বর্জন করে ইসলামে প্রবেশ করলাে। এবং পুরােপুরিভাবে ইসলামের জন্যে উৎসর্গিত হলাে, তখন সে ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে পাশ্চাত্যে ও প্রতীচ্যে সফরে বেরিয়ে পড়লাে এবং নতুন রেসালাত ও তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মানবীয় ব্যবস্থাকে বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করলাে। যারা এটা বহন করে নিলাে, তারা ছিলাে একে বহন করার সর্বোত্তম যােগ্যতা সম্পন্ন মানুষ। আর পৃথিবীর সর্বোত্তম স্থান থেকেই তারা বেরিয়ে এসেছিলাে। এটা নিছক কোনাে কাকতালীয় ঘটনা ছিলাে না যে, রসূল(স.)-এর আবির্ভাব ঘটতেই আরব উপদ্বীপ ইসলামের আবাসভূমিতে পরিণত হয়ে গেলাে । বরং মহান আল্লাহ নিজ জ্ঞানের আলােকে এই উপদ্বীপকে ইসলামের জন্য মনােনীত করেন এবং একইভাবে এর জন্যে সেই ভাষাকেও মনােনীত করেন, যা সারাবিশ্বে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্যে সবচেয়ে বেশী উপযােগী। বস্তুত এই সময়ে আরবী ভাষা সর্বোচ্চ উৎকর্ষ ও পরিপক্কতা লাভ করে এবং এই মহান দ্বীনকে সারাবিশ্বে পৌছানাের যােগ্য হয়। এটা যদি কোনাে মৃত ভাষা হতাে অথবা দুর্বল ভাষা হতাে, তাহলে প্রথমত তা ইসলামের দাওয়াত বহনের যােগ্য হতাে না এবং দ্বিতীয়ত তা বিশেষভাবে আরব জগতের বাইরে এই বাণীকে পৌছাতে পারতাে না। বস্তুত এ বাণীকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে এর পরিবেশ ও এর ব্যক্তিবর্গ যেমন উপযোগী প্রমাণিত হয়েছিলাে, তেমনি এর ভাষাও প্রমাণিত হয়েছে সর্বাধিক উপযােগী। এভাবে ইসলামের অনুকূল উপকরণ ও উপাদানের একটা বিরাট বহর প্রত্যেক গবেষকের চোখে পড়বে, যখনই সে এ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আল্লাহ কোথায় তার রেসালাতকে পাঠাবেন, তা তিনিই ভালাে জানেন।’ (সূরা আল আনয়াম) ‘যেন তুমি উম্মুল কোরা ও তার আশপাশের জনপদবাসীকে সাবধান করতে পারাে এবং সন্দেহ-সংশয়হীন সমাবেশ দিবস সম্পর্কে সাবধান করতে পারাে। একটা দল জান্নাতে এবং একটা দল জাহান্নামে।’ কোরআনে যে বিষয়টাকে ঘিরে সবচেয়ে কঠোর এবং সবচেয়ে ঘন ঘন সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, তা হচ্ছে কেয়ামতের দিন। একে সমাবেশের দিন বলা হয়েছে এ জন্যে যে, এ দিন সকল যুগের মৃত মানুষকে একসাথে সমবেত করা হবে। ‘একদল জান্নাতে এবং একদল জাহান্নামে’ অর্থাৎ পার্থিব জীবনে কৃতকর্মের ফল হিসাবে। আর যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তাহলে সবাইকে একই জাতিতে পরিণত করতেন। তবে তিনি যাদেরকে ইচ্ছে করেন, তার অনুগ্রহের অন্তর্ভুক্ত করেন। ‘আর যালেমদের কোনাে অভিভাবক নেই, সাহায্যকারীও নেই।’ অর্থাৎ আল্লাহ যদি ইচ্ছে করতেন, মানুষকে নতুন করে এমনভাবে সৃষ্টি করতেন যে, তাদের আচরণ একইরকম হয়ে যেতাে এবং একইরকম ফলাফলও তারা ভােগ করতাে। হয় জান্নাতে, নচেত জাহান্নামে যেতাে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মানুষকে একটা বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যে পাঠিয়েছেন। তাকে পৃথিবীতে খেলাফতের দায়িত্ব পালন করতে পাঠিয়েছেন। আর তার ইচ্ছা অনুযায়ী খেলাফতের দায়িত্ব পালনের দাবী হলাে, মানুষের ভেতরে বিশেষ ধরনের যােগ্যতার সৃষ্টি হবে, যা তাকে ফেরেশতা ও শয়তান থেকে এবং অনুরূপ একমুখী স্বভাব প্রকৃতি বিশিষ্ট সৃষ্টি থেকে পৃথক করবে। এই সমস্ত যােগ্যতা দ্বারা একটা দল হেদায়াত ও সৎ কাজের দিকে ধাবিত হবে এবং অপর একটা দল গােমরাহী ও অসৎ কাজের প্রতি আকৃষ্ট হবে। প্রত্যেকটা দল মানবীয় চরিত্র গঠনে যে কোনাে একটা সম্ভাব্য পথ ধরে এগিয়ে যাবে এবং এক সময় এই যাত্রার নির্ধারিত গন্তব্যে পৌছে যাবে। এই গন্তব্য হচ্ছে জান্নাত ও জাহান্নাম। ‘আর এভাবেই তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় অনুগ্রহের ভেতরে প্রবেশ করান, আর অত্যাচারীদের কোনাে অভিভাবক নেই, সাহায্যকারীও নেই।’ যে দলের যে অবস্থা আল্লাহ তায়ালা জানেন, সেই অনুসারেই তার হেদায়াত লাভ দ্বারা অনুগ্রহ প্রাপ্তি অথবা গােমরাহী দ্বারা আযাব প্রাপ্তি নির্ধারিত হয়। ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, তাদের কেউ কেউ আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্যদেরকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করে। তাই এখানে তাদেরকে অত্যাচারী আখ্যায়িত করে বলা হচ্ছে যে, তাদের কোনাে অভিভাবক ও সাহায্যকারী থাকবে না। সুতরাং যাদেরকে তারা গ্রহণ করবে, তাদের প্রকৃতপক্ষে কোনাে অস্তিত্ব ও বাস্তবতা থাকবে না। অতপর পুনরায় নেতিবাচক প্রশ্ন করা হচ্ছে, ‘তারা কি আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য অভিভাবক গ্রহণ করেছে।’ অভিভাবক হিসাবে এভাবে প্রশ্ন করা হচ্ছে এ জন্যে, যেন এর পরই বলা যায়, মহান আল্লাহই একমাত্র অভিভাবক। তিনিই অভিভাবক হবার ক্ষমতা রাখেন এবং সেই ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায় তার মৃতকে জীবন দানের মধ্য দিয়ে। বস্তুত এ কাজটার মধ্য দিয়েই এই অতুলনীয় ক্ষমতা সর্বোত্তমভাবে প্রমাণিত হয়। আল্লাহই একমাত্র অভিভাবক এবং তিনিই মৃতকে জীবিত করেন। এরপর মহান আল্লাহর ক্ষমতা যে অফুরন্ত এবং সর্বক্ষেত্রেই তা কার্যকর, সে কথা বুঝানাের জন্যে বলা হয়েছে, তিনি সকল বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।
*মতভেদ নিরসনের সঠিক উপায় : এরপর পুনরায় সেই প্রথম বিষয় অর্থাৎ ওহী ও রেসালাত সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে, যাতে যে কোনাে বিরােধ নিরসনের জন্যে লােকেরা এই কোরআনের শরণাপন্ন হয়। কেননা এই ওহী আল্লাহর কাছ থেকে আসে এবং এতে আল্লাহর ফয়সালা বর্ণিত হয়ে থাকে, যাতে মানব জীবনের পর প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল প্রকৃতির খেয়ালখুশীর প্রভাব না পড়ে এবং আল্লাহর চিরস্থায়ী বিধানের ওপর মানুষ অবিচল থাকতে পারে । আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা যে বিষয়েই মতভেদে লিপ্ত হও, তার নিষ্পত্তি আল্লাহর কাছে…!'(আয়াত ১০-১২) এই তিনটি আয়াতে যেরূপ ধারাবাহিকভাবে এই বক্তব্যগুলাে দেয়া হয়েছে, তা খুবই আশ্চর্যজনক ও চিন্তার উদ্রেককারী। এর এক একটা অংশের সাথে অপর অংশের গােপন ও প্রকাশ্য সংযোগ খুবই সূক্ষ্ম ও চমকপ্রদ। প্রথমে বলা হয়েছে যে, মানুষে মানুষে যে কোনাে মতবিরােধ দেখা দিক, তার নিষ্পত্তির জন্যে আল্লাহর শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা এই কোরআনে তার চূড়ান্ত ও অকাট্য ফয়সালা নাযিল করেছেন, চাই তা দুনিয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে হােক কিংবা আখেরাত সংক্রান্ত ব্যাপারে। মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের জন্যে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও চারিত্রিক বিধান দিয়েছেন, তা কার্যকরী করেছেন এবং তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ। করেছেন। এই কোরআনকে মানব জীবনের জন্যে এমন পূর্ণাংগ সংবিধান হিসাবে দিয়েছেন, যা রাষ্ট্রীয় সংবিধানগুলা এর চেয়ে প্রশস্ত ও বিস্তারিত। সুতরাং যখনই কোনাে বিরােধ দেখা দেবে, তখন সে ব্যাপারে আল্লাহর ফয়সালা এতে পাওয়া যাবে। রসূল(স.)-এর কাছে ওহী যােগে প্রেরিত আল্লাহর এ ফয়সালার ভিত্তিতে জীবন সমস্যার সমাধান করে নিতে হবে। এ কথা বলার পর রসূল(স.)-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হচ্ছে, যাতে তিনি তার যাবতীয় সমস্যা আল্লাহর কাছে সােপর্দ করে দেন এবং তার প্রতিপালকের প্রতি নিজের পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি হচ্ছেন আল্লাহ, আমার প্রতিপালক, তার ওপর আমি নির্ভরশীল ও অনুগত। এখানে আনুগত্য ও নির্ভরশীলতার ঘোষণা দেয়া হলাে রসূল(স.)-এর মুখ দিয়ে এবং তা তার উপযুক্ত মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রেই দেয়া হয়েছে। প্রথমােক্ত নীতিগত ঘােষণার উপসংহার হিসাবে এ বক্তব্য দেয়া হলাে। মহান আল্লাহর রসূল স্বয়ং সাক্ষ্য দিলেন যে, আল্লাহ তায়ালাই তার প্রভু, তার ওপর তিনি নির্ভর করেন এবং একমাত্র তার কাছেই তিনি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সুতরাং মতবিরােধ দেখা দিলে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যের শরণাপন্ন হওয়া ও অন্যের ফয়সালা গ্রহণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে কিভাবে বৈধ হতে পারে- যখন হেদায়াতপ্রাপ্ত নবী তিনি ছাড়া আর কারাে শরণাপন্ন হন না? আল্লাহর চূড়ান্ত ফয়সালার শরণাপন্ন হওয়াই তাে সর্বোত্তম ব্যবস্থা। অন্য কোনাে দিকে ভ্রুক্ষেপও করা উচিত নয়। রসূল নিজেই যখন একমাত্র আল্লাহ তায়ালারই ওপর নির্ভর করেন এবং তারই আনুগত্য প্রকাশ করেন, তখন তাঁর উম্মতের পক্ষে কিভাবে অন্য কারাে শরণাপন্ন হওয়া বৈধ্য হতে পারে? আল্লাহ তায়ালাই তাে তাদের প্রতিপালক, অভিভাবক ও পথনির্দেশক। মােমেনের অন্তরে উক্ত সত্য বদ্ধমূল হয়ে গেলে তার দ্বীনের প্রতি ও জীবন বিধানের প্রতি তার আস্থা, শ্রদ্ধা ও সচেতনতা বেড়ে যাবে। ফলে সে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনাে বিধি-ব্যবস্থার কাছ থেকে নিজের কোনাে সমস্যার সমাধান খুঁজতে যাবে না এবং সে আল্লাহর ফয়সালা ছাড়া আর কোনাে ফয়সালাকে ভ্রুক্ষেপের যােগ্যই মনে করবে না। কেননা নবী স্বয়ং আল্লাহর ফয়সালার অনুগত থেকেছেন। এই সত্যটা যাতে অন্তরে আরাে স্থায়ীভাবে বদ্ধমূল হয় সে জন্যে পরবর্তী আয়াতে মহান আল্লাহর আঁরাে গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। ‘তিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা…'(আয়াত ১১) অর্থাৎ যে আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা, পরিচালক নিয়ামক ও শাসক, সেই আল্লাহই কুরআন নাযিল করেছেন, যাতে তা মানব জাতির সকল বিরােধের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দেয়। যে আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করে, তারই ফয়সালা মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান করে। মানব জীবনের সমস্যাবলী আকাশ ও পৃথিবীর সার্বিক সমস্যাবলীরই অংশবিশেষ মাত্র। সুতরাং তার ফয়সালা মানব জীবনের সাথে মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক জীবনের সমন্বয় সাধন করে এবং মানুষকে গােটা প্রকৃতির সাথে শান্তিতে বসবাস করার পথ দেখায়। কেননা এই মহাবিশ্বকে শাসন করার ক্ষেত্রেও আল্লাহর সাথে আর কোনাে শরীক নেই। জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান ও যাবতীয় বিরােধের নিষ্পত্তির জন্যে যে আল্লাহর ফয়সালার শরণাপন্ন হওয়া প্রত্যেক বান্দার জন্যে জরুরী। তিনিই তােমাদের স্রষ্টা এবং তিনিই তােমাদের জন্যে জোড়া সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তিনি তােমাদের জীবনকে সুশৃংখল করেছেন এবং জীবনের জন্যে কিসের প্রয়ােজন তা তিনিই ডালােভাবে জানেন। তিনি তােমাদের জীবন সৃষ্টির সেই শাশ্বত বিধান অনুসারে পরিচালিত করেছেন যা তিনি সকল প্রাণীর ক্ষেত্রে কার্যকর করেছেন। এবং পশুদের মধ্য থেকেও জোড়া সৃষ্টি করেছেন।’ অর্থাৎ গােটা সৃষ্টি জগতেই একটা মৌলিক ঐক্য বিরাজ করছে এবং এ দ্বারা প্রকৃতির মূল পদ্ধতি, আল্লাহর ইচ্ছা ও পরিকল্পনার ঐক্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনিই তােমাদের এবং পশুদের সৃষ্টি করেছেন এবং এই প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসারেই তােমাদের বংশবৃদ্ধি ঘটছে। অপরদিকে তিনি নিজে গােটা সৃষ্টিজগত থেকে পৃথক ও অতুলনীয়। বিশ্বজগতের কোনাে জিনিসেই তাঁর সাদৃশ্য নেই। তাঁর মতাে কিছুই নেই। মানুষের স্বভাব প্রকৃতি স্বতস্ফূর্তভাবে এই সত্যে বিশ্বাস করে। যিনি স্রষ্টা, তার সাথে তার সৃষ্টি করা কোনাে জিনিসের তুলনা হতে পারে না। তাই তারা সবাই যে কোনাে মতবিরােধের ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহর ফয়সালার শরণাপন্ন হয়, অন্য কারো দিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। কেননা অন্য কেউ তার সমকক্ষ নয় যে, মতভেদের সময় তার শরণাপন্ন হলেও কাজ হতে পারে। আবার যদিও তাঁর সমকক্ষ কোনাে জিনিস নেই এবং সৃষ্টির সাথে স্রষ্টার কোনােই মিল বা সাদৃশ্য নেই, তথাপি তিনি তার সৃষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন নন। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। এই শ্রবণ ও দৃষ্টির গুণেই তিনি সৃষ্টির যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন এবং ফায়সালা করেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সকল বিরােধের যে নিষ্পত্তি দেন, সেটাই একমাত্র চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। কেননা আকাশ ও পৃথিবীর প্রথম সৃষ্টির পর থেকেই উভয়ের সমস্ত চাবিকাঠি তথা সমস্ত সমস্যার সমাধান তাঁর হাতেই নিবদ্ধ রয়েছে এবং সব কিছুর পরিচালনাকারী বিধি-বিধান তিনিই রচনা করেছেন, আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত চাবিকাঠি তাঁরই হাতে। আর যেহেতু মানব জাতি। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তাঁরই একটা অংশ, তাই তাদেরও চাবিকাঠি অর্থাৎ সমস্যার সমাধান আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ। তাছাড়া তিনিই তাদের জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং তিনিই জীবিকা সংকীর্ণ বা প্রশস্ত করেন। তিনিই তাদের জীবিকাদাতা, তাদের ভরণ পােষণকারী ও তাদের পানাহারের ব্যবস্থাকারী । তাহলে তাদের বিরােধের নিষ্পত্তিতে তারা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কার শরণাপন্ন হবে একমাত্র তারই শরণাপন্ন হতে পারে যিনি তাদের জীবিকা ও পানাহারের ব্যবস্থাকারী। যিনি নিজের জ্ঞান ও পরিকল্পনার ভিত্তিতেই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী।’ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী, তিনিই ফয়সালা করেন, নিষ্পত্তি করেন এবং তার ফয়সালা ন্যায়সংগত ও চূড়ান্ত হয়ে থাকে। এভাবে এ আয়াতগুলাের বক্তব্যে এমন চমকপ্রদ ও পরিপূর্ণ সমন্বয় দেখতে পাওয়া যায় যাতে তা মানুষের কাছে হৃদয়গ্রাহী হয় ও মন-মগজ দখলকারী হয় এবং এক গভীর ও সাবলীল সূর ধ্বনিত হয়।