(বই#১১০৭) [ * তোমরা সীমালংঘনকারী, শুধু এ কারণে কি আমি তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উপদেশমূলক শিক্ষা পাঠানো পরিত্যাগ করবো? :-] www.motaher21.net সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫ ১-৮ নং আয়াত:-

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#১১০৭)
[ * তোমরা সীমালংঘনকারী, শুধু এ কারণে কি আমি তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উপদেশমূলক শিক্ষা পাঠানো পরিত্যাগ করবো? :-]
www.motaher21.net
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ পারা:২৫
১-৮ নং আয়াত:-
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-১
حٰمٓ ۚ﴿ۛ۱﴾
হা – মীম।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-২
وَ الۡکِتٰبِ الۡمُبِیۡنِ ۙ﴿ۛ۲﴾
এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-৩
اِنَّا جَعَلۡنٰہُ قُرۡءٰنًا عَرَبِیًّا لَّعَلَّکُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ۚ﴿۳﴾
আমি একে আরবী ভাষার কুরআন বানিয়েছি যাতে তোমরা তা বুঝতে পারো।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-৪
وَ اِنَّہٗ فِیۡۤ اُمِّ الۡکِتٰبِ لَدَیۡنَا لَعَلِیٌّ حَکِیۡمٌ ؕ﴿۴﴾
প্রকৃতপক্ষে এটা মূল কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে২ যা আমার কাছে অত্যন্ত উচুঁ মর্যাদা সম্পন্ন ও জ্ঞানে ভরা কিতাব।
সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-৫
اَفَنَضۡرِبُ عَنۡکُمُ الذِّکۡرَ صَفۡحًا اَنۡ کُنۡتُمۡ قَوۡمًا مُّسۡرِفِیۡنَ ﴿۵﴾
তোমরা সীমালংঘনকারী, শুধু এ কারণে কি আমি তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে উপদেশমূলক শিক্ষা পাঠানো পরিত্যাগ করবো?
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-৬
وَ کَمۡ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ نَّبِیٍّ فِی الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۶﴾
পূর্ববর্তীদের নিকট আমি বহু রসূল প্রেরণ করেছি।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-৭
وَ مَا یَاۡتِیۡہِمۡ مِّنۡ نَّبِیٍّ اِلَّا کَانُوۡا بِہٖ یَسۡتَہۡزِءُوۡنَ ﴿۷﴾
এবং যখনই ওদের নিকট কোন নবী এসেছে, তখন ওরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে।
সূরা:৪৩: সূরা:- ‌আয-যুখরুফ-৮
فَاَہۡلَکۡنَاۤ اَشَدَّ مِنۡہُمۡ بَطۡشًا وَّ مَضٰی مَثَلُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۸﴾
যারা এদের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী ছিল তাদেরকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। পূর্ববর্তী জাতিসমূহের উদাহরণ অতীত হয়ে গিয়েছে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এ সুরা ইসলামী আন্দোলনের এমন একটা অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে যখন তা ছিলাে নানাবিধ বাধা-বিপত্তি, সমস্যা-সংকট এবং প্রশ্ন ও আপত্তির বাণে জর্জরিত। সেই সাথে এটাও দেখানো হয়েছে যে, কোরআন কিভাবে সেই সব সমস্যার সমাধান দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছে, আর এই সব সমস্যার সমাধান দেয়ার মাধ্যমে কিভাবে বা সে মানুষের মন মগয থেকে জাহেলী যুগের বাতিল ধ্যান ধারণাকে দূর করে সেখানে তার নিজস্ব ধ্যান ধারণা ও মূল্যবোেধকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সেই সব জাহেলী ধ্যান ধারণা, চরিত্র ও মানসিকতা শুধু তৎকালীন আরবের গন্ডীতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং সকল যুগে ও সকল দেশে তা আংশিকভাবে হলেও বিদ্যমান থাকে, আছে ও থাকবে। জাহেলী যুগের পৌত্তলিকেরা বলতো, মানুষের অধীনস্থ এই সব জীব জন্তুতে আল্লাহর একটা অংশ রয়েছে এবং আমাদের দেব দেবীদেরও একটা অংশ রয়েছে। (আনআম ১৬৬) জাহেলী সমাজে পশুদের সম্পর্কে নানারকমের কুসংস্কার প্রচলিত ছিলাে। বিকৃত আকীদা বিশ্বাস থেকে এসব কুসংস্কারের উদ্ভব ঘটেছিলাে। এ সব কুসংস্কার অনুসারে কিছু পশুর পিঠে সওয়ার হওয়া এবং কিছু পশুর গোশত খাওয়া তারা নিষিদ্ধ করে রেখেছিলাে। (আনয়াম-১৩৮) আলােচ্য সূরা যােখরুফে এসব বিকৃত আকীদা বিশ্বাসের সংশােধন করা হয়েছে এবং মানুষকে প্রকৃত ও নির্ভুল তথ্য পরিবেশন করে বলা হয়েছে যে, পশুরা সব আল্লাহর সৃষ্টি। আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির সাথে এগুলাের যােগসূত্র রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এগুলােকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের অনুগত বানিয়েছেন, যাতে তারা আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করে শােকর আদায় করে। এ জন্যে নয় যে, তারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বানাবে এবং পশুদের ব্যাপারে এমনসব মনগড়া নিয়ম-বিধি ও প্রথা তৈরী করে নেবে, যা আল্লাহ তায়ালা তৈরী করতে বলেননি। তারা স্বীকার করে যে, আল্লাহ তায়ালাই সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু এ কথা স্বীকার করলেও এর ফলশ্রুতিতে যে দায়িত্ব তাদের ওপর এসে পড়ে, তা তারা স্বীকার করে না। এ সত্যটাকে তারা বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে এবং মনগড়া ভ্রান্ত ধ্যান ধারণার অনুসরণ করে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদেরকে যদি তুমি জিজ্ঞেস কর, আকাশ ও পৃথিবীকে কে সৃষ্টি করেছে, তারা অবশ্যই বলবে, মহা পরাক্রমশালী মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালা ওগুলোকে সৃষ্টি করেছেন।'(আয়াত ৯-১৪) জাহেলী যুগের পৌত্তলিকরা বলতাে, ফেরেশতারা হলাে আল্লাহর মেয়ে। যদিও তারা নিজেরা পছন্দ করতাে না যে, তাদের কারাে মেয়ে হােক, তবুও আল্লাহর জন্যে তারা মেয়ে পছন্দ করতাে। আর এই ফেরেশতাদের তারা পূজো করতে ও বলতাে, আমরা তাে আল্লাহর ইচ্ছামতােই ওদের পূজো করি। আল্লাহর ইচ্ছে না থাকলে আমরা তা করতাম না। অথচ এটা ছিলাে নিছক তাদের ভ্রান্ত আকীদা বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত তাদের কুসংস্কার। এই সূরায় আল্লাহ তায়ালা কোথাও মােশরেকদের যুক্তি দিয়েই তাদের দাবী খন্ডন করেছেন। আবার কোথাও সুস্পষ্ট প্রাকৃতিক যুক্তি দিয়ে তাদের সামাজিক কূপ্রথার অসারতা প্রমাণ করেছেন। (আয়াত ১৫-২২) আর যখন তাদের বলা হয়, তােমরা মূর্তি ও গাছ-পালার পূজো করে থাকো, তােমরা ও তােমাদের উপাস্যরা দোজখের কাঠ, আল্লাহ ছাড়া আর যারই উপাসনা করা হােক উপাসকও জাহান্নামের কাঠ, তখন এই সুস্পষ্ট বক্তব্যকে তারা বিকৃত করে এবং এ নিয়ে তর্ক বাধায়। তারা বলে, ঈসাকেও তাে তার জাতি পূজো করে থাকে। তিনিও দোযখে যাবেন নাকি? তারা আরাে বলে, মূর্তিগুলো হলাে ফেরেশতাদের প্রতীক। আর ফেরেশতারা আল্লাহর মেয়ে। সুতরাং আমাদের উপাসন খৃষ্টানদের উপাসনার চেয়ে ভালাে। কেননা তারা হযরত ঈসার পূজো করে। হযরত ঈসা তো মানুষ। মানবীয় প্রকৃতির অধিকারী। এই সূরায় তাদের কূটতর্কের জবাব দেয়া হয়েছে এবং হযরত ঈসার অনুসারীরা ঈসাকে আকাশে তুলে নেয়ার পর যেসব অপকর্ম করেছে, তার দায় দায়িত্ব থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া। হয়েছে। (আয়াত ৫৭-৫৯) জাহেলিয়াতের মধ্যে ডুবে থেকেও মােশরেকরা দাবী করতাে যে, তারা হযরত ইবরাহীমের ধর্মের অনুসারী। এদিক দিয়ে তারা নাকি ইহুদী খৃষ্টানদের চেয়ে উত্তম ধার্মিক। এ জন্যে এ সূরায় হযরত ইবরাহীমের ধর্মের প্রকৃত রূপ তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, ওটা তাে নির্ভেজাল তাওহীদ। সে তাওহীদের বাণী এখনাে বহাল রয়েছে। সেই তাওহীদের বাণী নিয়েই রসূল(স.) এসেছেন। কিন্তু তারা সেই বাণী ও রসূল(স)-কে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, হযরত ইব্রাহীম বংশধরের পক্ষে তা মােটেই শােভনীয় হয়নি।(২৬-৩০) কোন যুক্তিতে ও কোন মহৎ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালা রাসূল(স.)-কে রসূলরূপে মনােনীত করেছেন, তা তারা উপলব্ধি করেনি। যে অসার ও নিকৃষ্ট জড়বাদী মূল্যবােধের নিরীখে তারা মানুষের মূল্যায়ন করতে অভ্যস্ত, সেই সব মূল্যবােধই তাদেরকে উপলব্ধি করতে দেয়নি। এ প্রসংগেই আলােচ্য সূরায় তাদের ধ্যান-ধারণা ও কথাবার্তা উদ্ধৃত করা হয়েছে, তাদের সামনে বিচার বিবেচনার আসল মানদণ্ড তুলে ধরা হয়েছে এবং তারা যেসব মূল্যবােধে বিশ্বাসী তার অসারতা ব্যক্ত করা হয়েছে।(আয়াত ৩১-৩৫) এরপর হযরত মূসা(আ.)-এর কাহিনীর একটা অংশ আলোচনা করা হয়েছে। এ অংশটাতে দেখা যায়, ফেরাউন সেই সব অসার জড়বাদী মূল্যবােধ নিয়ে কেমন গর্বিত ছিলাে, অথচ আল্লাহর কাছে ওগুলাে ও ফেরাউন কে তুচ্ছ ও নগণ্য ছিলাে।(আয়াত ৪৬-৫৬) উল্লেখিত পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণা ও কুসংস্কার, আকীদাগত বিভ্রান্তি এবং উল্লেখিত ভ্রান্ত ও অসার মানদন্ড ও মূল্যবােধকে কেন্দ্র করেই সমগ্র সূরা আবর্তিত এবং ওগুলােই সূরাটার আলােচ্য বিষয়। সুরাটা তিনটি অংশে বিভক্ত। এবার বিশদ তাফসীরে মনােনিবেশ করা যাক।
#
‘হা-মীম, সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ…’(আয়াত ১-৮) সূরাটা হা-মীম এই দুটো বর্ণ দিয়ে শুরু হয়েছে। এর পরপরই বলা হয়েছে সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ। আল্লাহ তায়ালা হা-মীম ও কিতাবের শপথ করছেন । হা-মীম ও কিতাব মূলত একই শ্রেণীভুক্ত। এই স্বচ্ছ, সহজবােধ্য ও প্রাঞ্জল কিতাবখানা শাব্দিক আকৃতির দিক দিয়ে উক্ত অক্ষর দুটোরই শ্রেণীভুক্ত। আর এই অক্ষর দুটো মানবীয় ভাষায় অন্যান্য অক্ষরের মতাে সৃষ্টিকর্তার নিদর্শনাবলীর অন্যতম । যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাদের উচ্চারিত ও উচ্চারণযােগ্য এই সব শব্দ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং কোরআন সংক্রান্ত আলােচনার প্রাক্কালে এই সব বিচ্ছিন্ন বর্ণমালার উল্লেখ্য গভীর তাৎপর্যবহ ও বিপুল অর্থবহ। আল্লাহ তায়ালা হা-মীম ও সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ করছেন। কোরআনকে আরবদের পাঠোপযােগী করে আরবী ভাষায় পাঠিয়ে যে উদ্দেশ্য অর্জন করতে চেয়েছেন, সেই উদ্দেশ্যটাই এই শপথের লক্ষ্যবস্তু। তাই বলছেন, ‘আমি একে আরবী কোরআন বানিয়েছি, যেন তােমরা বুঝতে পারাে।’ অর্থাৎ আরবরা এই কোরআনকে তাদের মাতৃভাষায় পেয়ে বুঝতে পারুক, এটাই উদ্দেশ্য। কোরআন হচ্ছে মহান আল্লাহর ওহীর সমষ্টি। তাকে বর্তমান আরবী গ্রন্থের আকৃতি দিয়েছেন এ জন্যে যে, প্রথমে এই কোরআনকে গ্রহণ ও এর দায়-দায়িত্ব বহনকারী হিসাবে আরবদেরকেই আল্লাহ তায়ালা মনােনীত করেছেন। এই মনােনয়নের পেছনে যে যুক্তি ও যে মহৎ উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে, তার একটা দিক আমি সূরা শুরার তাফসীরে আলােচনা করে এসেছি। অপরদিকটা এই যে, আল্লাহ তায়ালা জানতেন এই জাতির ভেতরে ও এই ভাষার ভেতরে কোরআনের বাণী বহন করা ও তাকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার যোগ্যতা রয়েছে। আর রসূলদেরকে প্রেরণ ও নিয়োগের সঠিক স্থান একমাত্র একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন।
#   *আল্লাহর বাণীর মর্যাদা ও তা অস্বীকার করার পরিণতি : এরপর আল্লাহর শাশ্বত ও চিরন্তন বিচার বিবেচনায় এই কোরআনের মূল্য ও মর্যাদা কতখানি, তা বলা হচ্ছে। ‘নিশ্চয় তা আমার কাছে প্রধান কিতাবের মধ্যে রয়েছে। তা অত্যন্ত মহিমান্বিত জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ।’(আয়াত ৪) মূল আয়াতে উল্লেখিত উম্মুল কিতাব তথা প্রধান কিতাব দ্বারা লওহে মাহফুকে বুঝানাে হয়েছে, না আল্লাহর চিরন্তন ও শাশ্বত জ্ঞান ভান্ডারকে, সে বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাই না। কেননা এই শব্দের এমন কোনাে সুনির্দিষ্ট শাব্দিক অর্থ নেই যা আমাদের বােধগম্য হতে পারে। তবে এ থেকে আমরা এমন একটা মর্ম উপলব্ধি করতে পারি, যা আমাদের একটা মৌল সত্য সম্পর্কে ধারণা জন্মাতে সাহায্য করে। আমরা এ আয়াতটা (৪ নং) যখন পড়ি, তখন বুঝতে পারি মহান আল্লাহর জ্ঞানে ও বিবেচনায় এই কোরআনের স্থায়ী ও আসল মূল্যায়ন কতাে উচু। এটুকু বুঝতে পারাই আমাদের যথেষ্ট। বস্তুত এই কোরআন আলী’ অর্থাৎ মহিমান্বিত এবং হাকীম অর্থাৎ জ্ঞানগর্ভ বা বিজ্ঞানময়। এ দুটো এমন গুণবাচক শব্দ, যা কোরআনের একটা বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন প্রাণীর মতাে ভাবমূর্তি তুলে ধরে । কোরআন আসলেও তাই। যেন তার ভেতরে প্রাণ রয়েছে। সে প্রাণের যেন অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যারা তাকে স্পর্শ করে, তাদের প্রতি সে যেন সাড়া দেয়। সে তার সমস্ত মহত্ব ও বিজ্ঞানময়তা নিয়ে মানুষের সামনে প্রতিভাত হয়, তাকে সৎপথ প্রদর্শন করে এবং তার স্বভাব প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অনুসারে তাকে নেতৃত্ব দেয়। আর তার বিবেকবুদ্ধি ও বাস্তব জীবনকে সেই সব মানদন্ড মূল্যবােধ, চিন্তাধারা ও তথ্যের ভিত্তিতে গড়ে তােলে, যা আলী’ ও ‘হাকীম (মহিমান্বিত ও বিজ্ঞানময়) এই দুটো গুণ থেকে উদ্ভূত। আর কোরআন সম্পর্কে উপরােক্ত আয়াত দুটোতে যে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে, তা কোরআনের ভাষাভাষী আরবদের চোখ খুলে দিতে সক্ষম। এ তথ্যগুলাে দ্বারা তারা সহজেই উপলব্ধি করতে পারে যে, কোরআন তাদেরকে দেয়া আল্লাহর কাতো বড় দান, কতাে মূল্যবান নেয়ামত, আর এই কোরআনের প্রতি তারা যে সীমাহীন অবজ্ঞা ও অবহেলা দেখিয়েছে তা কতাে নিন্দনীয় এবং কতো শাস্তিযােগ্য। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে কতো নিকৃষ্ট ধরনের উপেক্ষা ও বঞ্চনা তাদের প্রাপ্য। এ জন্যে পরবর্তী আয়াতে তাদের মুখোশ উন্মােচন ও সীমালংঘনের বিবরণ দেয়া হয়েছে এবং এর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে উপেক্ষা করার হুমকি দেয়া হয়েছে। ‘তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী বলে আমি কি তােমাদের কাছ থেকে এই উপদেশপূর্ণ কোরআন প্রত্যাহার করে নেবাে?’ এটা খুবই বিস্ময়কর যে, মহামহিম আল্লাহ, যিনি কারাে মুখাপেক্ষী নন এবং কারাে ভালোমন্দের তােয়াক্কা করার তার কোনাে প্রয়ােজন হয় না, তিনি আরবের এই মােশরেক গােষ্ঠীটার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেন, তাদের ভাষায় একখানা কিতাব পাঠালেন, সেই কিতাবে তাদের মনের কথা বললেন, তাদের সামনে তাদের অন্তরাত্মাকে খুলে দেখালেন, তাদেরকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করলেন, তাদেরকে প্রাচীনকালের লােকদের কাহিনী শোনালেন এবং তাদেরকে আল্লাহর শাশ্বত বিধান স্মরণ করিয়ে দিলেন। অথচ এরপরও তারা উপেক্ষা ও অবহেলা অব্যাহত রেখেছে।
# এরপর তাদের পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী ও তার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করায় তাদের সেই জঘন্য ধৃষ্টতার শাস্তি দেয়ার জন্যে কঠোর হুমকি দেয়া হয়েছে। আর এই হুমকির পাশাপাশি রসূলের দাওয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের ব্যাপারে আল্লাহর নীতি কী, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। (আয়াত ৬-৮) অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যখন তাদের চেয়েও দোর্দন্ড প্রতাপশালীদেরকে তাদেরই মতাে অপরাধ করার কারণে অর্থাৎ রসূলদেরকে উপহাস করার কারণে ধ্বংস করে দিয়েছেন, তখন তারা আর কিসের অপেক্ষায় আছে? মােশরেকদের চরিত্রের একটা বিস্ময়কর দিক এই যে, তারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতো এবং তিনি যে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা তও বিশ্বাস করতাে, অথচ এই দুটো জিনিসকে বিশ্বাস করার স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ফলস্বরূপ আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করা ও তার প্রতি একনিষ্ঠ ও একাগ্রচিত্ত হওয়ার যে দায়িত্ব ঘাড়ে চাপে, তা তারা স্বীকার করতাে না। এ জন্যে আল্লাহর সাথে অন্যান্য জিনিসকে শরীক করতাে, আল্লাহর সৃষ্টি করা কয়েক ধরনের পশুকে সেসব শরীকের জন্য নির্দিষ্ট করতাে। ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর মেয়ে বলে দাবী করতাে এবং তাদের মূর্তি বানিয়ে পূজো করতাে। আল্লাহ তায়ালা যে আছেন এবং তিনি যে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সে ব্যাপারে মােশরেকদের স্বীকৃতিকে কোরআন উদ্ধৃত করে, এর স্বতস্ফূর্ত ফলাফলকেও তুলে ধরে, যে প্রাকৃতিক যুক্তিকে তারা এড়িয়ে যেতে চায়, সেদিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, নৌকা ও পশুর ন্যায় যেসব নেয়মিত তাদেরকে দিয়েছেন, সে ব্যাপারে তাদের করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে। অতপর ফেরেশতাদের সম্পর্কে তাদের উদ্ভট দাবীর অযৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
(৪৩-যুখরুফ) : নামকরণ:

সূরার ৮৫ আয়াতের وَزُخْرُفًا শব্দ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে, অর্থাৎ যে সূরার মধ্যে زُخْرُف ‘যুখরুফ’ এটা সেই সূরা।

(৪৩-যুখরুফ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :

কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে নাযিল হওয়ার সময়-কাল সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে সূরার বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়, যে যুগে সূরা আল-মু’মিন, হা-মীম আস সাজদা ও আশ্‌ শূরা নাযিল হয়েছিলো এ সূরাটিও সেই যুগেই নাযিল হয়। মক্কার কাফেররা যে সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণ সংহার করতে বদ্ধ পরিকর হয়েছিলো সেই সময় যে সূরাগুলো নাযিল হয়েছিলো এ সূরাটিও তারই একটি বলে মনে হয়। সেই সময় মক্কার কাফেররা সভায় বসে বসে নবীকে (সা.) কিভাবে হত্যা করা যায় তা নিয়ে পরামর্শ করতো। তাঁকে হত্যা করার জন্য একটি আক্রমণ সংঘটিতও হয়েছিলো। ৭৯ ও ৮০ আয়াতে এ পরিস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে।

(৪৩-যুখরুফ) : বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য:

কুরাইশ ও আরববাসীরা যেসব জাহেলী আকীদা-বিশ্বাস ও কুসংস্কার আঁকড়ে ধরে চলছিলো এ সূরায় প্রবলভাবে তার সমালোচনা করা হয়েছে এবং অত্যন্ত মজবুত ও হৃদয়গ্রাহী পন্থায় ঐগুলোর অযৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে যাতে সমাজের যেসব ব্যক্তির মধ্যে কিঞ্চিত যুক্তিবাদিতাও আছে তারা সবাই একথা চিন্তা করতে বাধ্য হয় যে, এসব কেমন ধরনের অজ্ঞতা যা আমাদের জাতি চরমভাবে আঁকড়ে ধরে বসে আছে আর যে ব্যক্তি এই আবর্ত থেকে আমাদের উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন আদাপানি খেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে লেগেছে। বক্তব্যের সূচনা করা হয়েছে এভাবে যে, তোমরা চাচ্ছো তোমাদের দুষ্কর্মের ফলে এই কিতাব নাযিল হওয়া বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু আল্লাহ দুষ্কৃতিকারীদের কারণে কখনো নবী-রসূল প্রেরণ ও কিতাব নাযিল বন্ধ করেননি। বরং যে জালেমেরা তাঁর হিদায়াতের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো তাদেরকেই ধ্বংস করে দিয়েছেন। এখনো তিনি তাই করবেন। পরে আরো একটু অগ্রসর হয়ে আয়াত ৪১, ৪৩ ও ৭৯, ৮০তে এ বিষয়টির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণ সংহার করতে বদ্ধপরিকর ছিল তাদের শুনিয়ে নবীকে (সা.) বলা হয়েছে, ‘তুমি জীবিত থাক বা না থাক এ জালেমদের আমি শাস্তি দেবই।’ তাছাড়া দুস্কৃতিকারীদেরকেও পরিষ্কার ভাষায় সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, তোমরা যদি আমার নবীর বিরুদ্ধে একটি পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাক তাহলে আমিও সেক্ষেত্রে একটি তাদের উদ্দেশ্যে মানত করা হয় এবং তাদের কাছেই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য দোয়া করা হয়। তারা একথা কি করে জানলো যে ফেরেশতারা নারী?এসব অজ্ঞতার কারণে সমালোচনা করা হলে তাকদীরের বাহানা পেশ করে এবং বলে, আল্লাহ আমাদের এসব কাজ পছন্দ না করলে আমরা কি করে এসব মূর্তির পূজা করছি। অথচ আল্লাহর পছন্দ-অপছন্দ জানার মাধ্যম তাঁর কিতাব। পৃথিবীতে তাঁর ইচ্ছাধীনে যেসব কাজ হচ্ছে তা তাঁর পছন্দ-অপছন্দ অবহিত হওয়ার মাধ্যম নয়। তাঁর ইচ্ছা বা অনুমোদনে শুধূ এক মূর্তি পূজাই নয়, চুরি, ব্যভিচার, ডাকাতি, খুন সব কিছুই হচ্ছে। পৃথিবীতে যত অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে তার সবগুলোকেই কি এই যুক্তিতে বৈধ ও ন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হবে? যদি জিজ্ঞেস করা হয়, এই শির্কের সপক্ষে তোমাদের কাছে এই ভ্রান্ত যুক্তি-প্রমাণ ছাড়া কি আর কোন প্রমাণ আছে তখন জবাব দেয়, বাপ-দাদার সময় থেকে তো এ কাজ এভাবেই হয়ে আসছে। এদের কাছে যেন কোন ধর্মের ন্যায় ও সত্য হওয়ার জন্য এই যুক্তি-প্রমাণই যথেষ্ট। অথচ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম—যার অধস্তন পুরুষ হওয়ার ওপরেই তাদের গর্ব ও মর্যাদার ভিত্তি—তাঁর বাপ-দাদার ধর্মকে পদাঘাত করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং পূর্ব পুরুষদের এমন অন্ধ অনুসরণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন যার সপক্ষে কোন যুক্তিসংগত দলিল-প্রমাণ ছিল না। এসব সত্ত্বেও যদি তাদেরকে পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুসরণই করতে হয় তাহলেও তো সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান পূর্ব পুরুষ ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস সালামকে ছেড়ে এরা নিজেদের চরম জাহেল পূর্ব পুরুষদের বাছাই করলো কেন? এদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আল্লাহর সাথে অন্যারাও উপাসনা লাভের যোগ্য, কোন নবী বা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত কোন একটি কিতাবও কি কখনো এ শিক্ষা দিয়েছে? এর জবাবে তারা খৃস্টানদের হযরত ঈসা ইবনে মার্‌য়ামকে আল্লাহর বেটা হিসেবে মানার ও উপাসনা করাকে এ কাজের দলীল হিসেবে পেশ করে। অথচ কোন নবীর উম্মত শির্ক করেছে বা করেনি প্রশ্ন সেটা ছিল না। প্রশ্ন ছিল কোন নবী শির্কের শিক্ষা দিয়েছেন কিনা? কবে ঈসা ইবনে মার্‌য়াম বলেছিলেন, আমি আল্লাহর পুত্র, তোমরা আমার উপাসনা করো। দুনিয়ার প্রত্যেক নবী যে শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁর শিক্ষাও তাই ছিল। প্রত্যেক নবীর শিক্ষা ছিল আমাদের ও তোমাদের প্রত্যেকের রব আল্লাহ। তোমরা তাঁরই ইবাদত করো।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালত মেনে নিতে তাদের মনে দ্বিধা শুধু এ কারণে যে, তাঁর কাছে ধন-সম্পদ এবং ক্ষমতা ও জাঁকজমক তো মোটেই নেই। তারা বলে, আল্লাহ যদি আমাদের এখানে কাউকে নবী মনোনীত করতে চাইতেন তাহলে আমাদের দু’টি বড় শহরের (মক্কা ও তায়েফ) গণ্য মান্য ব্যক্তিদের কাউকে মনোনীত করতেন। এই যুক্তিতে ফিরাউনও হযরত মূসাকে নগণ্য মনে করে বলেছিলো, আসমানের বাদশা যদি যমীনের বাদশার কাছে (আমার কাছে) কোন দূত পাঠাতেন তাহলে তাকে স্বর্ণের বালা পরিয়ে এবং তার আর্দালী হিসেবে একদল ফেরেশতাসহ পাঠাতেন। এ মিসকীন কোত্থেকে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। আমিই মর্যাদার অধিকারী। কারণ, মিসরের বাদশাহী আমার এবং এই নীল নদ আমার আজ্ঞাধীনেই প্রবাহিত হচ্ছে। আমার তুলনায় এ ব্যক্তির এমন কি মর্যাদা আছে! এর না আছে ধন-সম্পদ না আছে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব।

এভাবে কাফেরদের এক একটি অজ্ঞতাপ্রসূত কথার সমালোচনা করা এবং অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও সপ্রমাণ জবাব দেয়ার পর পরিষ্কার বলা হয়েছে, না আল্লাহর কোন সন্তানাদি আছে, না আসমান ও যমীনের আল্লাহ আলাদা, না এমন কোন সুপারিশকারী আছে যে জেনে বুঝে গোমরাহীর পথ অনুসরণকারীদের আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারে। আল্লাহর সন্তানাদি থাকবে এমন অবস্থা থেকে তাঁর সত্তা পবিত্র। তিনি একাই গোটা বিশ্ব-জাহানের খোদা। আর কেউ তাঁর খোদায়ীর গুণাবলী এবং ক্ষমতা ও ইখতিয়ারে শরীক নয়, বরং সবাই তাঁর বান্দা। তাঁর দরবারে শাফায়াত কেবল সেই ব্যক্তিই করতে পারে যে নিজে ন্যায় ও সত্যপন্থী এবং তাদের জন্য করতে পারে যারা পৃথিবীতে ন্যায় ও সত্যের পথ অবলম্বন করেছিলো।
#. যে বিষয়টির জন্য কুরআন মজীদের শপথ করা হয়েছে তা হচ্ছে এ গ্রন্থের রচয়িতা মুহাম্মাদ ﷺ নন, “আমি।” আর শপথ করার জন্য কুরআনের যে বৈশিষ্ট্যটি বেছে নেয়া হয়েছে তা হচ্ছে, ‘কিতাবুম মুবীন’। কুরআন যে আল্লাহর বাণী এ বৈশিষ্ট্যের জন্য কুরআনেরই শপথ করা স্বতই এ অর্থ প্রকাশ করে যে, হে লোকজন, এই সুস্পষ্ট কিতাব তোমাদের সামনে বিদ্যমান। চোখ মেলে তা দেখো; এর সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন বিষয়বস্তু, এর ভাষা, এর সাহিত্য, এর সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য সূচনাকারী শিক্ষা, সব কিছুই এ সত্যের সাক্ষ্য পেশ করছে যে, আল্লাহ‌ ছাড়া এর রচয়িতা আর কেউ হতে পারে না।

অতঃপর বলা হয়েছে, ‘আমি একে আরবী ভাষার কুরআন বানিয়েছি যাতে তোমরা তা উপলব্ধি করো। এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক-এ কুরআন অন্য কোন ভাষায় নয়, বরং তোমাদের নিজেদের ভাষায় রচিত হয়েছে। তাই এর যাচাই বাছাই এবং মর্যাদা ও মূল্য নির্ণয় করতে তোমাদের কোন কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এটা যদি আরবী ছাড়া অন্য কোন ভাষায় হতো তাহলে এই বলে তোমরা ওজর পেশ করতে পারতে যে, এটা আল্লাহর বাণী কিনা তা আমরা কিভাবে পরখ করবো। কারণ, এ বাণী বুঝতেই আমরা অক্ষম। কিন্তু আরবী ভাষার এই কুরআন সম্পর্কে তোমরা এ যুক্তি কি করে পেশ করবে? এর প্রতিটি শব্দ তোমাদের কাছে পরিষ্কার। ভাষা ও বিষয়বস্তু উভয় দিক থেকে এর প্রতিটি বাক্য তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট। এটা মুহাম্মাদ ﷺ কিংবা অন্য কোন আরবী ভাষাভাষীর বাণী হতে পারে কিনা তা নিজেরা বিচার করে দেখো। এই বাণীর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, আমি এই কিতাবের ভাষা আরবী রেখেছি এই জন্য যে, আমি আরব জাতিকে সম্বোধন করে কথা বলছি। আর তারা কেবল আরবী ভাষার কুরআনই বুঝতে সক্ষম। আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করার এই সুস্পষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ উপেক্ষা করে শুধু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষা আরবী হওয়ার কারণে একে আল্লাহর বাণী না বলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী বলে যারা আখ্যায়িত করে তারা বড়ই জুলুম করে। (এই দ্বিতীয় অর্থটি বুঝার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা হা-মীম আস সাজদার ৪৪ আয়াত ৫৪ নং টীকাসহ )।
#
أُمِّ الْكِتَابِ অর্থ اص সেই কি যেখা থেকে সমস্ত নবী-রসূলদের প্রতি নাযিলকৃত কিতাবসমূহও গৃহীত হয়েছে। সূরা ওয়াকিয়ায় এ কিতাবকেই كِتَابٍ مَكْنُونٍ (গোপন ও সুরক্ষিত কিতাব) বলা হয়েছে এবং সূরা বুরুজে এজন্য ‘লওহে মাহফুজ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ এমন ফলক যার লেখা মুছে যেতে পারে না এবং যা সব রকম প্রক্ষেপন ও হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত। কুরআন সম্পর্কে أُمِّ الْكِتَابِ এ লিপিবদ্ধ আছে একথা বলে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সত্য সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশ ও জাতিকে হিদায়াতের জন্য নবী-রসূলদের কাছে বিভিন্ন ভাষায় কিতাব নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু সব কিতাবে একই আকীদা-বিশ্বাসের প্রতি দাওয়াত দেয়া হয়েছে, একই সত্যকে ন্যায় ও সত্য বলা হয়েছে, ভাল ও মন্দের একই মানদণ্ড পেশ করা হয়েছে, নৈতিকতা ও সভ্যতার একই নীতি বর্ণনা করা হয়েছে এবং এসব কিতাব যে দ্বীন পেশ করেছে তা সবদিক দিয়ে একই দ্বীন। কারণ, এ দ্বীনের মূল ও উৎস এক, শুধু ভাষা ও বর্ণনা ভংগি ভিন্ন। একই অর্থ যা আল্লাহর কাছে একটি মূল গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। যখনই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তিনি কোন নবী পাঠিয়েছেন এবং পরিবেশ ও অবস্থা অনুসারে সেই অর্থ একটি বিশেষ বাক্যে ও বিশেষ ভাষায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। ধরা যাক, আল্লাহ‌ যদি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আরব ছাড়া অন্য কোন জাতির মধ্যে পয়দা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তাহলে তিনি এই কুরআনকে সেই জাতির ভাষায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল করতেন। সেই জাতি এবং দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারেই তাতে বক্তব্য পেশ করা হতো। বাক্যসমূহ ভিন্ন ধাঁচের হতো ভাষাও ভিন্ন হতো, কিন্তু শিক্ষা ও নির্দেশনা মৌলিকভাবে এটাই থাকতো। সেটাও এই কুরআনের মতই কুরআন হতো, যদিও আরবী কুরআন হতো না। সূরা শু’আরাতে এই এ বিষয়টিই এভাবে বলা হয়েছেঃ

وَإِنَّهُ لَتَنْزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ ……………………………… بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُبِينٍ – وَإِنَّهُ لَفِي زُبُرِ الْأَوَّلِينَ “এটা রব্বূল আলামীনের নাযিলকৃত কিতাব……… পরিষ্কার আরবী ভাষায়। আর এটি পূর্ববর্তী লোকদের কিতাবসমূহেও বিদ্যমান।” (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা শু’আরা, টীকা ১১৯ – ১২০ – ১২১ )
# এ আয়াতাংশের সম্পর্ক كِتَابٍ مُبِينٍ ও اُمُّ الْكِتَابউভয়ের সাথে। অর্থাৎ এটি এক দিকে কুরআনের পরিচয় এবং অন্যদিকে উম্মুল কিতাবেরও পরিচয় যেখান থেকে কুরআন গৃহীত বা উদ্ধৃত হয়েছে। কুরআনের এই পরিচিতি দানের মাধ্যমে মন-মগজে একথাই বদ্ধমূল করে দেয়া উদ্দেশ্য যে, কেউ যদি তার অজ্ঞতার কারণে এ কিতাবের মূল্য ও মর্যাদা উপলব্ধি না করে এবং এর জ্ঞান গর্ভ শিক্ষা দ্বারা উপকৃত না হয় তাহলে সেটা তার নিজের দুর্ভাগ্য। কেউ যদি এর মর্যাদা খাটো করার প্রয়াস পায় এবং এর বক্তব্যের মধ্যে ত্রুটি অন্বেষণ করে তাহলে সেটা তার নিজের হীনমন্যতা। কেউ একে মর্যাদা না দিলেই এটা মূল্যহীন হতে পারে না এবং কেউ গোপন করতে চাইলেই এর জ্ঞান ও যুক্তি গোপন হতে পারে না। এটা স্বস্থানে একটি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব যাকে এর অতুলনীয় শিক্ষা, মু’জিযাপূর্ণ বাগ্মিতা, নিষ্কলুষ জ্ঞান এবং এর রচিয়তার আকাশচুম্বী ব্যক্তিত্ব উচ্চে তুলে ধরেছে। তাই কেউ এর অবমূল্যায়ণ করলে তা কি করে মূল্যহীন হতে পারে। পরে ৪৪ আয়াতে কুরাইশদের বিশেষভাবে এবং আরববাসীদের সাধারণভাবে বলা হয়েছে যে, এভাবে তোমরা যে কিতাবের বিরোধিতা করছো তার নাযিল হওয়াটা তোমাদের মর্যাদা লাভের একটি বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। তোমরা যদি এই সুযোগ হাতছাড়া করো তাহলে তোমাদের আল্লাহর কাছে কঠোর জবাবদিহি করতে হবে। (দেখুন, টীকা ৩৯ )
# মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ঘোষণার সময় থেকে এ আয়াতগুলো নাযিল হওয়া পর্যন্ত বিগত কয়েক বছরে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার পুরো কাহিনী এই আয়াতাংশে একত্রে বিবৃত করা হয়েছে। আয়াতাংশটি আমাদের সামনে এই চিত্রই ফুটিয়ে তোলে যে, একটি জাতি শত শত বছর ধরে চরম অজ্ঞতা, অধঃপতন ও দুরবস্থার মধ্যে নিমজ্জিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে হঠাৎ তার ওপর করুণার দৃষ্টি পড়ছে। তিনি তাদের মধ্যে একজন সর্বশ্রেষ্ট নেতার জন্ম দিচ্ছেন এবং তাদেরকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে উদ্ধার করার জন্য তাঁর নিজের বাণী পাঠাচ্ছেন। যাতে তারা অলসতা ঝেড়ে জেগে ওঠে, জাহেলী কুসংস্কারের আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসে এবং পরম সত্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে জীবনে চলার সঠিক পথ অবলম্বন করে। কিন্তু সেই জাতির নির্বোধ লোকেরা এবং তার স্বার্থপর গোত্রপতিরা সেই নেতার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগছে এবং তাঁকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করছে। যতই বছরের পর বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে তাদের দুষ্কর্ম ততই বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি তারা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে বলা হচ্ছে, তোমাদের এই অযোগ্যতার কারণে কি আমি তোমাদের সংস্কার ও সংশোধনের প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করবো? উপদেশ দানের এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করবো? এবং শত শত বছর ধরে তোমরা যে অধঃপতনের মধ্যে পড়ে আছ সেই অধঃপতনের মধ্যেই পড়ে থাকতে দেব? তোমাদের কাছে আমার রহমতের দাবী কি এটাই হওয়া উচিত? তোমরা কি কখনো ভেবে দেখেছো, আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাখ্যান করা এবং ন্যায় ও সত্য সামনে এসে যাওয়ার পর বাতিলকে আঁকড়ে থাকা তোমাদের কেমন পরিণতির সম্মুখীন করবে?
# এই নিরর্থক ও অযৌক্তিক কাজকর্ম যদি নবী এবং কিতাব প্রেরণের পথে প্রতিবন্ধক হতো তাহলে কোন জাতির কাছে কোন নবী আসতো না এবং কোন কিতাবও পাঠানো হতো না।
# বিশিষ্ট লোকদের অযৌক্তিক আচরণের ফলে গোটা মানবজাতিকে নবুওয়াত ও কিতাবের পথ নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত করা হবে এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। বরং সর্বদাই এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই যে, যারাই বাতিল পরস্তির নেশায় এবং নিজেদের শক্তির গর্বে উম্মত্ত হয়ে নবী-রসূলদের বিদ্রূপ ও হেয় প্রতিপন্ন করা থেকে বিরত হয়নি, শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। তখন যে শক্তির বলে এই কুরাইশদের ছোট ছোট এসব নেতা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছে। তাদের চেয়ে হাজার গুণ অধিক শক্তির অধিকারীদেরকে মশা-মাছির ন্যায় পিষে ফেলা হয়েছে।

তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :

الزخرف (যুখরুফ) শব্দের অর্থ চাকচিক্য, কারুকার্য, স্বর্ণ ইত্যাদি। সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে زخرف শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ, তবে মুকাতিল (রহঃ) বলেন :

(وَسْئَلْ مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُّسُلِنَآ)

আয়াতটি মদীনায় অবতীর্ণ।

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সূরা। সূরাতে প্রত্যেক জাতির কাছে আগত নাবী-রাসূলদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা, মক্কার মুশরিকদের আল্লাহর রুবুবিয়্যাহ স্বীকার করা, মানুষের জন্য আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত অসংখ্য নেয়ামত প্রদান করা, অধিংকাশ মানুষ পূর্বপুরুষের দোহাই দিয়ে সত্যবিমুখ হওয়া, শির্ক ও মুশরিকদের সাথে আপোষহীন নাবী ইবরাহীম (আঃ) ও তাঁর কথা পরবর্তীদের জন্য শিক্ষাস্বরূপ বহাল রাখা, প্রত্যেকের উপযুক্ত রিযিক বন্টন করে দেয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

১-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

حٰمٓ (হা-মীম) এ জাতীয় “হুরূফুল মুক্বাত্বআত” বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর সম্পর্কে সূরা আল বাকারার শুরুতেই আলোচনা করা হয়েছে। এগুলোর সঠিক উদ্দেশ্য/অর্থ একমাত্র আল্লাহই ভাল জানেন।

আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট কিতাবের অর্থাৎ- কুরআনের শপথ করে বলেছেন, নিশ্চয়ই আমি এ কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে করে মানুষের বুঝতে সহজ হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْاٰنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُّدَّكِرٍ ‏)‏

“কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, সুতরাং উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি?” (সূরা কামার ৫৪ : ১৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :

(قُرْاٰنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ‏)‏

“এ কুরআন আরবি ভাষায়, এতে বিন্দুমাত্রও বক্রতা নেই, যাতে তারা সাবধানতা অবলম্বন করে।” (সূরা যুমার ৩৯ : ২৮)

আরবি ভাষায় কুরআন অবতীর্ণ করার হেকমত আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলে দিচ্ছেন যে, যাতে তোমরা এ কুরআন বুঝতে পার। আরবি এমন একটি ভাষা যা সকলের বোধগম্য এবং তা অল্প কথায় অনেক কিছু বুঝায় যা অন্যান্য ভাষায় এ বৈশিষ্ট্য নেই। তাছাড়া আরো দুটো কারণ হতে পারে। যেমন-

১. যেহেতু তা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ও সুন্দরতম ভাষা এবং সহজ ভাষা।

২. প্রাথমিক পর্যায়ে সম্বোধন আরবদেরকেই করা হয়েছে। তাই তাদের ভাষাতেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যাতে তারা সহজেই বুঝতে ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।

(أُمِّ الْكِتٰبِ) দ্বারা এখানে লাওহে মাহফূযকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ- এ কুরআন লাওহে মাহফূযে সংরক্ষিত রয়েছে, যা সুউচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন এবং তাতে কোন মতবিরোধ ও বৈপরিত্য নেই।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন : কোন জাতি অন্যায় কাজে লিপ্ত হলেই তাদের অন্যায় কাজের কারণে তাদের থেকে উপদেশবাণী প্রত্যাহার করে নেন না। বরং তাদের কাছে নাবী-রাসূল, কিতাব প্রেরণ করতে থাকেন। যাতে তারা কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করতে না পারে।

এর দ্বারা বিভিন্ন ধরনের উদ্দেশ্য হতে পারে।

১. তোমরা যেহেতু পাপসমূহে একেবারে মেতে আছ এবং অব্যাহতভাবে তা করেই যাচ্ছ বলে কি তোমরা ভেবে নিয়েছ যে, আমি তোমাদেরকে ওয়ায-নসীহত করা ছেড়ে দেব?

২. অথবা তোমাদের কুফরী ও সীমাতিক্রম করার জন্য আমি তোমাদেরকে কিছুই বলব না এবং আমি তোমাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেব?

৩. অথবা আমি তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেব এবং তোমাদেরকে না কোন বিষয়ের নির্দেশ দেব, আর না কোন কর্ম থেকে নিষেধ করব।

৪. অথবা, এমনটিও হতে পারে যে, তোমরা যেহেতু কুরআনের ওপর ঈমান আনছ না। তাই আমি কুরআন অবতীর্ণ করার ধারাই বন্ধ করে দেব। এটা আল্লাহ তা‘আলার অশেষ অনুগ্রহ যে, তিনি কল্যাণ যিক্র-এর প্রতি দা‘ওয়াত দেয়ার ধারাবাহিকতা বন্ধ করে দেননি, যদিও তারা বিমুখ হওয়া এবং অস্বীকার করার ব্যাপারে সীমাতিক্রম করছিল।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান করছেন যে, মক্কার কুরাইশরা সত্যের দা‘ওয়াত থেকে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেয়া নতুন কোন বিষয় নয়, বরং ইতোপূর্বে যত নাবী-রাসূল এসেছেন তাদের সাথে জাতির অধিকাংশ লোকেরাই হাসি-তামাশা ও ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে এমনকি তাঁদেরকে হত্যাও করেছে। তাদের এ সকল বাড়াবাড়ি করার ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন, যারা ছিল মক্কার কুরাইশদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী।

যেমন- আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

(يَا حَسْرَةً عَلَي الْعِبَادِ مَا يَأْتِيْهِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا كَانُوْا بِه۪ يَسْتَهْزِئُوْنَ أَلَمْ يَرَوْا كَمْ أَهْلَكْنَا قَبْلَهُمْ مِّنَ الْقُرُوْنِ أَنَّهُمْ إِلَيْهِمْ لَا يَرْجِعُوْنَ ‏)‏

“আফসোস বান্দাদের জন্য! তাদের কাছে কখনও এমন কোন রাসূল আসেনি, যাকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেনি। তারা কি লক্ষ্য করেনি যে, আমি তাদের পূর্বে বহু মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছি, যারা তাদের দিকে আবার ফিরে আসবে না?” (সূরা ইয়াসীন ৩৬ : ৩০)

এটা মূলত মক্কার কুরাইশদের জন্য ধমকস্বরূপ বলা হয়েছে যে, পূর্বের জাতিরা এত শক্তিশালী থাকার পরও যেহেতু নিজেদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারেনি, তারাও যদি এরূপ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে তাহলে তাদের ন্যায় এরাও ধ্বংস হয়ে যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. কুরআন আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে যাতে সহজেই মানুষ বুঝতে পারে।
২. কোন সম্প্রদায়ের অন্যায়ের কারণে আল্লাহ তা‘আলা সেখানে সতর্ককারী পাঠানো বন্ধ করে দেন না বরং নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তাদেরকে সতর্ক করেই যান।
৩. আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে কোন শক্তিশালীর শক্তিই কোন উপকারে আসবে না। যত শক্তিশালীই হোক না কেন যদি অপরাধ করে তাহলে তার শাস্তি তাকে ভোগ করতেই হবে।
৪. দাওয়াত কবূল করবে না বলে নিরাশ হয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই, বরং চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

তাফসীরে‌ ইবনে কাছীর বলেছেন:-

১-৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমের শপথ করেছেন যা সুস্পষ্ট, যার অর্থ জাজ্বল্যমান এবং যার শব্দগুলো উজ্জ্বল। যা সর্বাপেক্ষা সুন্দর ও অলংকারপূর্ণ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। এটা এই জন্যে যে, যেন লোকজন জানে, বুঝে ও উপদেশ গ্রহণ করে। মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি এই কুরআনকে আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি।’ যেমন অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি এই কুরআনকে স্পষ্ট আরবী ভাষায় অবতীর্ণ করেছি।”(২৬:১৯৫)

মহান আল্লাহ বলেনঃ “এটা রয়েছে আমার নিকট উম্মুল কিতাবে, এটা মহান, জ্ঞানগর্ভ। উম্মুল কিতাব অর্থ লাওহে মাহফু। (আরবী) অর্থ আমার নিকট। (আরবী) অর্থ মরতবা, ইযযত, শরাফত ও ফযীলত। (আরবী) অর্থ দৃঢ়, মযবূত, বাতিলের সাথে মিলিত হওয়া এবং অন্যায়ের সাথে মিশ্রিত হওয়া হতে পবিত্র। অন্য জায়গায় এই পবিত্র কালামের বুযুর্গীর বর্ণনা নিম্নরূপে দেয়া হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কুরআন, যা আছে সুরক্ষিত কিতাবে, যারা পূত পবিত্র তারা ব্যতীত অন্য কেউ স্পর্শ করে না। এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট হতে অবতীর্ণ।”(৫৬:৭৭-৮০) আর এক জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “না, এই আচরণ অনুচিত, এটা তো উপদেশ বাণী; যে ইচ্ছা করবে সে এটা স্মরণ রাখবে, ওটা আছে মহান লিপিসমূহে, যা উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন, পবিত্র, মহান, পূত চরিত্র লিপিকর-হস্তে লিপিবদ্ধ ।”(৮০:১১-১৬) সুতরাং এই আয়াতগুলোকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করে আলেমগণ বলেন যে, অযু বিহীন অবস্থায় কুরআন কারীমকে হাতে নেয়া উচিত নয়, যেমন একটি হাদীসেও এসেছে, যদি তা সত্য হয়। কেননা, ঊর্ধ্ব জগতে ফেরেশতারা ঐ কিতাবের ইযযত ও সম্মান করে থাকেন যাতে এই কুরআন লিখিত আছে। সুতরাং এই পার্থিব জগতে আমাদের তো আরো বেশী এর সম্মান করা উচিত। কেননা, এটা যমীনবাসীর নিকটই তো প্রেরণ করা হয়েছে। এটা দ্বারা তো তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। অতএব, এই পৃথিবীবাসীর এর খুব সম্মান ও আদব করা উচিত। কেননা, মহান আল্লাহ বলেনঃ “এটা রয়েছে আমার নিকট উম্মুল কিতাবে, এটা মহান, জ্ঞানগর্ভ।

এর পরবর্তী আয়াতের একটি অর্থ এই করা হয়েছেঃ “তোমরা কি এটা মনে করে নিয়েছে যে, তোমাদের আনুগত্য না করা এবং আদেশ নিষেধ মান্য না করা সত্ত্বেও আমি তোমাদেরকে ছেড়ে দিবো? এবং তোমাদেরকে শাস্তি প্রদান করবো না?” আর একটি অর্থ এই করা হয়েছেঃ “এই উম্মতের পূর্ববর্তী লোকেরা যখন এই কুরআনকে অবিশ্বাস করেছিল তখনই যদি এটাকে উঠিয়ে নেয়া হতো তবে গোটা দুনিয়া ধ্বংস করে দেয়া হতো। কিন্তু আল্লাহর প্রশস্ত রহমত এটা পছন্দ করেনি এবং বিশের অধিক বছর ধরে এ কুরআন অবতীর্ণ হতে থাকে। এ উক্তির ভাবার্থ হচ্ছেঃ “এটা আল্লাহ তা’আলার স্নেহ ও দয়া যে, অস্বীকারকারী ও দুষ্টমতি লোকদের দুষ্টামির কারণে তাদেরকে ওয়ায-নসীহত ও উপদেশ দান পরিত্যাগ করা হয়নি যাতে তাদের সৎ লোকেরা সংশোধিত হয়ে যায় এবং সংশোধন হতে অনিচ্ছুক লোকদের উপর যুক্তি-প্রমাণ সমাপ্ত হয়ে যায়।”

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তোমাকে তোমার কওম যে অবিশ্বাস করছে এতে তুমি দুঃখিত ও চিন্তিত হয়ো না, বরং ধৈর্যধারণ কর। এদের পূর্ববর্তী কওমদের নিকটেও নবী রাসূলগণ এসেছিল, তখন তারাও তাদেরকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও উপহাস করেছিল।”

অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা বলেনঃ ‘তাদের মধ্যে যারা এদের অপেক্ষা শক্তিতে প্রবল ছিল তাদেরকে আমি ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। আর এই ভাবে চলে আসছে পূর্ববর্তীদের অনুরূপ দৃষ্টান্ত। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখতো এদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছিল! পৃথিবীতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা সংখ্যায় অধিক এবং শক্তিতে প্রবলতর।” (৪০:৮২) এই বিষয়ের আরো বহু আয়াত রয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেনঃ পূর্ববর্তীদের দৃষ্টান্ত গত হয়েছে অর্থাৎ তাদের রীতি-নীতি, শাস্তি ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা তাদের পরিণামকে পরবর্তীদের জন্যে শিক্ষা ও উপদেশের বিষয় করেছেন। যেমন তিনি এই সূরার শেষের দিকে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তৎপর পরবর্তীদের জন্যে আমি তাদেরকে করে রাখলাম অতীত ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত।” অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহর নিয়ম তাঁর বান্দাদের মধ্যে গত হয়েছে।”(৪০:৮৫) অন্য এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি আল্লাহর নিয়মের কোন পরিবর্তন পাবে না।”(৩৩:৬২)

Leave a Reply