أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৩১)
সুরা: আল্ বনি ইসরাইল
সুরা:১৭
০৪-০৮ নং আয়াত:-
[ لَتُفْسِدُنَّ فِي الَارْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا
নিশ্চয়ই তোমরা পৃথিবীতে দু-দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে ।
এবং তোমরা অতিশয় অহংকারস্ফীত হবে ।
“Indeed you would do mischief in the land twice and you will become tyrants and extremely arrogant!” ]
www.motaher21.net
وَ قَضَیۡنَاۤ اِلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ فِی الۡکِتٰبِ لَتُفۡسِدُنَّ فِی الۡاَرۡضِ مَرَّتَیۡنِ وَ لَتَعۡلُنَّ عُلُوًّا کَبِیۡرًا ﴿۴﴾
আর আমি (তাওরাত) কিতাবে বানী ইস্রাঈলকে জানিয়েছিলাম যে, নিশ্চয়ই তোমরা পৃথিবীতে দু-দুবার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমরা অতিশয় অহংকারস্ফীত হবে ।
And We conveyed to the Children of Israel in the Scripture that, “You will surely cause corruption on the earth twice, and you will surely reach [a degree of] great haughtiness.
فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ اُوۡلٰىہُمَا بَعَثۡنَا عَلَیۡکُمۡ عِبَادًا لَّنَاۤ اُولِیۡ بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ فَجَاسُوۡا خِلٰلَ الدِّیَارِ ؕ وَ کَانَ وَعۡدًا مَّفۡعُوۡلًا ﴿۵﴾
অতঃপর এই দু-এর প্রথম প্রতিশ্রুত কাল যখন উপস্থিত হল, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করলাম আমার কঠোর রণ-কুশলী বীর দাসদেরকে; যারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সমস্ত কিছু ধ্বংস করল; আর এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হওয়ারই ছিল।
So when the [time of] promise came for the first of them, We sent against you servants of Ours – those of great military might, and they probed [even] into the homes, and it was a promise fulfilled.
ثُمَّ رَدَدۡنَا لَکُمُ الۡکَرَّۃَ عَلَیۡہِمۡ وَ اَمۡدَدۡنٰکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّ بَنِیۡنَ وَ جَعَلۡنٰکُمۡ اَکۡثَرَ نَفِیۡرًا ﴿۶﴾
অতঃপর আমি তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জন্য যুদ্ধের পালা ঘুরিয়ে (বিজয়) দিলাম, তোমাদেরকে ধন ও সন্তান-সন্ততি দ্বারা সাহায্য করলাম এবং তোমাদেরকে করলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ।
Then We gave back to you a return victory over them. And We reinforced you with wealth and sons and made you more numerous in manpower.
اِنۡ اَحۡسَنۡتُمۡ اَحۡسَنۡتُمۡ لِاَنۡفُسِکُمۡ ۟ وَ اِنۡ اَسَاۡتُمۡ فَلَہَا ؕ فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ الۡاٰخِرَۃِ لِیَسُوۡٓءٗا وُجُوۡہَکُمۡ وَ لِیَدۡخُلُوا الۡمَسۡجِدَ کَمَا دَخَلُوۡہُ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّ لِیُتَبِّرُوۡا مَا عَلَوۡا تَتۡبِیۡرًا ﴿۷﴾
তোমরা সৎকর্ম করলে সৎকর্ম নিজেদেরই জন্য করবে, আর মন্দকর্ম করলে তাও নিজেদের জন্য; অতঃপর পরবর্তী প্রতিশ্রুত কাল উপস্থিত হলে আমি আমার দাসদেরকে প্রেরণ করলাম তোমাদের মুখমন্ডল কালিমাচ্ছন্ন করবার জন্য, প্রথমবার তারা যেভাবে মসজিদে প্রবেশ করেছিল পুনরায় সেই ভাবেই তাতে প্রবেশ করবার জন্য এবং তারা যা অধিকার করেছিল তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবার জন্য।
[And said], “If you do good, you do good for yourselves; and if you do evil, [you do it] to yourselves.” Then when the final promise came, [We sent your enemies] to sadden your faces and to enter the temple in Jerusalem, as they entered it the first time, and to destroy what they had taken over with [total] destruction.
عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یَّرۡحَمَکُمۡ ۚ وَ اِنۡ عُدۡتُّمۡ عُدۡنَا ۘ وَ جَعَلۡنَا جَہَنَّمَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ حَصِیۡرًا ﴿۸﴾ সম্ভবতঃ তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের প্রতি দয়া করবেন; কিন্তু তোমরা যদি তোমাদের পূর্ব আচরণের পুনরাবৃত্তি কর; তবে আমিও (আমার শাস্তির) পুনরাবৃত্তি করব। আর জাহান্নামকে আমি করেছি সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য কারাগার।
[Then Allah said], “It is expected, [if you repent], that your Lord will have mercy upon you. But if you return [to sin], We will return [to punishment]. And We have made Hell, for the disbelievers, a prison-bed.”
৪-৮ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
উক্ত আয়াতগুলোতে বানী ইসরাঈলের বাড়াবাড়ি ও অবাধ্যতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা আরো দু’বার জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তারা অহঙ্কারী হবে। আল্লাহ তা‘আলার কথা মতে তারা যখন প্রথম বার বিপর্যয় ও বাড়াবাড়ি করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এমন এক বাহিনী দ্বারা শাস্তি দিলেন যারা তাদের সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল। বাণী ইসরাঈলের কোন কিছুই টিকে ছিল না।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই ধ্বংসের পর পুনরায় আবার তাদেরকে জমিনে ক্ষমতা দান করলেন এবং বললেন, যদি তোমরা ভাল কাজ কর তবে তাতে তোমাদের নিজেদেরই উপকার হবে। আর যদি মন্দ কাজ কর তাহলে তার জন্য তোমাদেরকেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِه۪ ج وَمَنْ أَسَا۬ءَ فَعَلَيْهَا)
“যে সৎ আমল করে সে নিজের কল্যাণের জন্যই তা করে এবং কেউ মন্দ আমল করলে তার প্রতিফল সেই ভোগ করবে।” (হা-মীম সাজদাহ ৪১:৪৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(مَنْ كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُه۫ ج وَمَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِأَنْفُسِهِمْ يَمْهَدُوْنَ)
“যে ব্যাক্তি কুফরী করে, তারই ওপর পড়বে তার কুফরীর ফল। আর যে ব্যাক্তি নেক কাজ করে, তারা নিজেদেরই জন্য সুখের ঠিকানা করে নিচ্ছে।” (সূরা রূম ৩০:৪৪)
কিন্তু তারা পরবর্তীতে তাদের এই শান্তির কথা ভুলে গিয়ে পুনরায় অন্যায় আচরণে লিপ্ত হলে আল্লাহ তা‘আলা আবার তাদেরকে বিপর্যস্ত করেন এবং শত্র“ বাহিনী প্রথম বারের মত এবারও তাদের পবিত্র ঘর মাসজিদ ‘বায়তুল মাকদাস’ দখল করে নেয় এবং তাদেরকে শাস্তি প্রদান করে। এবারও আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা বাস্তবায়িত হয়ে গেল।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আবার তাদের ওপর রহম করলেন এবং তাদেরকে পৃথিবীর বুকে বিজয়ী করেন ও তাদেরকে সতর্ক করলেন যে, যদি তারা আবার তাদের এই অবাধ্য আচরণে লিপ্ত হয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলাও পুনরায় তাদের অবস্থা আগের মত করে দিবেন। তারা তা-ই করল আর আল্লাহ তা‘আলা তাদের এই অপরাধের কারণে তাদের ওপর উম্মতে মুহাম্মাদীকে বিজয় দান করলেন এবং তাদেরকে লাঞ্ছিত অবস্থায় পৃথিবীতে রেখে দিলেন। যার ফলে ইয়াহুদীরা আজও পৃথিবীর বুকে লাঞ্ছিত ও অবহেলিত। আর কিয়ামত পর্যন্ত তারা এভাবেই জীবন অতিবাহিত করবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা বাস্তবায়িত হবেই।
২. সৎ কাজের মর্যাদা ও অসৎ কাজের পরিণাম সম্পর্কে জানা গেল।
৩. উম্মতে মুহাম্মাদীর মর্যাদা সম্পর্কে জানা গেল।
৪. অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে।
৫. আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার ওপর পরম দয়াশীল।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# কিতাব মানে এখানে তাওরাত নয় বরং আসমানী সহীফাসমূহের সমষ্টি। কুরআনে এজন্য পারিভাষিক শব্দ হিসেবে “আল কিতাব” কয়েক জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে।
# পবিত্র গ্রন্থাদির সমষ্টি বাইবেলে এ সতর্ক বাণী কয়েক জায়গায় পাওয়া যায়। প্রথম বিপর্যয় ও তার অশুভ পরিণতির জন্য বনী ইসরাঈলকে গীতসংহিতা, যিশাইয়র, যিরমিয় ও যিহিষ্কেলে সতর্ক করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় বিপর্যয় ও তার কঠিন শাস্তির যে ভবিষ্যদ্বাণী হযরত ইসা (আ) করেছেন তা মথি ও লুকের ইনজীলে পাওয়া যায়। নিচে আমি এ গ্রন্থগুলোর সংশ্লিষ্ট কথাগুলো উদ্ধৃত করছি। এ থেকে কুরআনের বক্তব্যের পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যাবে।
প্রথম বিপর্যয় সম্পর্কে সর্বপ্রথম সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম। তাঁর কথা ছিল নিম্নরূপঃ “তাহারা জাতিগুলিকে ধ্বংস করিল না, যাহা সদাপ্রভু করিতে আজ্ঞা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহারা জাতিগুলির সহিত মিশিয়া গেল, উহাদের কার্যকলাপ শিখিল। আর উহাদের প্রতিমার পূজা করিল, তাহাতে সে সকল তাহাদের ফাঁদ হইয়া উঠিল, ফলে তাহারা আপনাদের পুত্রদিগকে আর আপনাদের কন্যাদিগকে শয়তানদের উদ্দেশ্যে বলিদান করিল। তাহারা নির্দোষদের রক্তপাত, তথা স্ব স্ব পুত্র কন্যাদেরই রক্তপাত করিল, কেনানীয় প্রতিমাগণের উদ্দেশ্যে তাহাদিগকে বলিদান করিল; দেশ রক্তে অশুদ্ধ হইল। এই রূপে তাহারা আপনাদের কার্যে অশুচি, আপনাদের ক্রিয়ায় ব্যভিচারী হইল। তাহাতে আপন প্রজাদের উপরে সদাপ্রভূর ক্রোধ জ্বলিয়া উঠিল, তিনি আপন অধিকারকে ঘৃণা করিলেন। তিনি তাহাদিগকে জাতিগণের হস্তে সমর্পণ করিলেন, তাহাতে তাহাদের শত্রুরা তাহাদের শাসক হইয়া গেল।” গীতসংহিতা ১০৬: ৩৪-৪১
যেসব ঘটনা পরে ঘটতে যাচ্ছিল এ বাক্যগুলোয় সেগুলোকে অতীত কালের ক্রিয়াপদে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সেগুলো যেন ঘটে গেছে। এটি হচ্ছে আসমানী কিতাবের একটি বিশেষ বর্ণনারীতি। তারপর যখন এ বিরাট বিপর্যয় সংঘটিত হয়ে গেল তখন এর ফলে যে ধ্বংস সংঘটিত হলো হযরত ইয়াসঈয়াহ নবী নিজের সহীফায় তার খবর এভাবে দিচ্ছেনঃ
“আহা, পাপিষ্ঠ জাতি, অপরাধে ভারগ্রস্ত লোক, দুষ্কর্মকারীদের বংশ, নষ্টাচারী সন্তানগণ; তাহারা সদাপ্রভূকে ত্যাগ করিয়াছে, ইসরাঈলের পবিত্রাত্মাকে অবজ্ঞা করিয়াছে, বিপথে গিয়াছে, পরান্মুখ হইয়াছে। তোমরা আর কেন প্রহৃত হইবে? হইলে অধিক বিদ্রোহাচরণ করিবে।” যিশইয় ১: ৪-৫ “সতী নগরী কেমন বেশ্যা হইয়াছে। সে তো ন্যায় বিচারে পূর্ণা ছিল। ধার্মিকরা তাহাতে বাস করিত, কিন্তু এখন হত্যাকরী লোকেরা থাকে …………………. তোমার সরদাররা বিদ্রোহী ও চোরদের সখা; তাহাদের প্রত্যেক জন উৎকোচ ভালবাসে ও পারিতোষিকের অনুধাবন করে; তাহারা পিতৃহীন লোকের প্রতি ইনসাফ করে না এবং বিধবার বিবাদ তাহাদের নিকট আসিতে পায় না। এজন্য প্রভু বাহিনীগণের সদাপ্রভূ ইসরাঈলের এক বীর কহেন, আহা, আমি আপন বিপক্ষদিগকে (দণ্ড দিয়া) শাস্তি পাইব ও আমার শত্রুদের নিকট হইতে প্রতিশোধ নিব।” যিশাইয় ১: ২১-২৪
“তাহারা পূর্বদেশের প্রথায় পরিপূর্ণ ও পলেষ্টীয়দের ন্যায় গণক হইয়াছে এবং বিজাতীয় সন্তানদের হস্তে হস্ত দিয়াছে। ………………..আর তাহাদের দেশ প্রতিমায় পরিপূর্ণ, তাহারা আপনাদের হস্ত নির্মিত বস্তুর কাছে প্রণিপাত করে, তাহাত তাহাদেরই আংগুলি দ্বারা নির্মিত।” যিশাইয় ২: ৬-৮
“সদাপ্রভূ আরো বলিলেন, সিয়োনের কন্যাগণ গর্বিতা, তাহারা গলা বাড়াইয়া কটাক্ষ করিয়া বেড়ায়, লঘুপদ সঞ্চারে চলে ও চরণে রুনু রুনু শব্দ করে। অতএব প্রভু সিয়োনের কন্যাগণের মস্তক টাক পড়া করিবেন, ও সদাপ্রভূ তাহাদের গুহ্যস্থান অনাবৃত করিবেন। ……….. তোমার পুরুষেরা খড়গ দ্বারা ও তোমার বিক্রমীগণ সংগ্রামে পতিত হইবে। তাহার পুরদ্বার সকল ক্রন্দন ও বিলাপ করিবে; আর সে উৎসন্না হইয়া ভূমিতে বসিবে।” যিশাইয় ৩: ১৬-২৬
“এখন দেখ, প্রভু ফরাৎ নদীর প্রবল ও প্রচুর জল, অর্থাৎ অশূর-রাজ ও তাহার সমস্ত প্রতাপকে, তাহাদের উপরে আনিবেন; সে ফাঁপিয়া সমস্ত খাল পূর্ণ করিবে ও সমস্ত তীর ভূমির ওপর দিয়া যাইবে।” যিশাইয় ৮: ৭
“কেননা, উহারা বিদ্রোহী জাতি ও মিথ্যাবাদী সন্তান; উহারা সদাপ্রভূর ব্যবস্থা শুনিতে অসম্মত। তাহারা দর্শকদিগকে বলে, তোমরা দর্শন করিও না, নবীগণকে বলে, তোমরা আমাদের কাছে সত্য নবুওয়াত প্রকাশ করিও না, আমাদিগকে স্নিগ্ধ বাক্য বল, মিথ্যা নবুওয়াত প্রকাশ কর, পথ হইতে ফির, রাস্তার ছাড়িয়া দাও, ইসরাঈলের পবিত্রতমকে আমাদের দৃষ্টিপথ হইতে দূর কর। অতএব ইসরাঈলের পবিত্রতম এই কথা কহেন, তোমরা এই বাক্য হেয় জ্ঞান করিয়াছ এবং উপদ্রবের ও কূটিলতার উপর নির্ভর করিয়াছ ও তাহা অবলম্বন করিয়াছ, এইহেতু সেই অপরাধ তোমাদের জন্য উচ্চ ভিত্তির পতনশীল দেয়ালের ন্যায় হইবে। যাহার ভঙ্গ হঠাৎ মুহূর্ত মধ্যে উপস্থিত হয়। আর যেমন কুম্ভকারের পাত্র ভাঙ্গা যায়, তেমনি তিনি তাহা ভাঙ্গিয়া ফেলিবেন, চূর্ণ করিবেন, মমতা করিবেন না; যাহাতে চূলা হইতে অগ্নি তুলিতে কিম্বা কূপ হইতে জল তুলিতে একখানা খোলাও পাওয়া যাইবে না।” যিশাইয় ৩০: ৯-১৪
তারপর যখন বন্যায় বাঁধ একেবারেই ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয় তখন ইয়ারমিয়াহ (যিরমিয়) নবীর আওয়াজ বুলন্দ হয় এবং তিনি বলেনঃ
“সদাপ্রভূ এই কথা বলেন, তোমাদের পিতৃপুরুষেরা আমার কি অন্যায় দেখিয়াছে যে, তাহারা আমা হইতে দূরে গিয়াছে, অসারতার অনুগামী হইয়া অসার হইয়াছে? ………… আমি তোমাদিগকে এই ফলবান দেশে আনিয়াছিলাম যেন তোমরা এখানকার ফল ও উত্তম উত্তম সামগ্রী ভোজন কর। কিন্তু তোমরা প্রবেশ করিয়া আমার দেশ অশুচি করিলে, আমার অধিকার ঘৃণাস্পদ করিলে। …………….. বস্তুত দীর্ঘকাল হইল আমি তোমার যোয়ালি ভগ্ন করিয়াছিলাম, তোমার বন্ধন ছিন্ন করিয়াছিলাম; আর তুমি বলিয়াছিলে, আমি দাসত্ব করিব না; বাস্তবিক সমস্ত উচ্চ পর্বতের উপরে ও সমস্ত হরিৎপূর্ণ বৃক্ষের তলে তুমি নত হইয়া ব্যভিচার করিয়া আসিতেছ। (অর্থাৎ প্রত্যেকটি শক্তির সামনে নত হইয়াছ এবং প্রত্যেকটি মূর্তিকে সিজদা করিয়াছ। ………… চোর ধরা পড়িলে যেমন লজ্জিত হয় তেমনি ইসরাঈলকুল, আপনারা ও তাহাদের রাজাগণ, অধ্যক্ষবর্গ, যাজকগণ ও ভাববাদিগণ লজ্জিত হইয়াছে, বস্তুত তাহারা কাষ্ঠকে বলে, তুমি আমার পিতা, শিলাকে বলে, তুমি আমার জননী, তাহারা আমার প্রতি পৃষ্ঠ ফিরাইয়াছে, মুখ নয়, কিন্তু বিপদকালে তহারা বলিবে, ‘তুমি উঠ, আমাদিগকে রক্ষা কর।’ কিন্তু আপনার জন্য যাহাদিগকে নির্মাণ করিয়াছ, তোমার সেই দেবতারা কোথায়? তাহারাই উঠুক, যদি বিপদকালে তোমাকে রক্ষা করিতে পারে; কেননা হে যিহূদা! তোমার যত নগর তত দেবতা।” যিরমিয় ২: ৫-২৮
“যোশিয় রাজার সময়ে সদাপ্রভূ আমাকে কহিলেন, বিপথগামিনী ইসরাঈল যাহা করিয়াছে, তাহা কি তুমি দেখিয়াছ? সে প্রত্যেক উচ্চ পর্বতের উপরে ও প্রত্যেক হরিৎপূর্ণ বৃক্ষের তলে গিয়া সেই সকল স্থানে ব্যভিচার করিয়াছে। সে এই সকল কর্ম করিলে পরে আমি কহিলাম, সে আমার কাছে ফিরিয়া আসিবে কিন্তু সে ফিরিয়া আসিল না এবং তাহার বিশ্বাসঘাতিনী ভগিনী যিহূদা তাহা দেখিল। আর আমি দেখিলাম, বিপথগামিনী ইসরাঈল ব্যভিচার (অর্থাৎ শিরক) করিয়াছিল, এই কারণ প্রযুক্তই যদ্যপি আমি তাহাকে ত্যাগপত্র দিয়া ত্যাগ করিয়াছিলাম, তথাপি তাহার ভগিনী বিশ্বাসঘাতিনী যিহূদা ভয় করিল না, কিন্তু আপনিও গিয়া ব্যভিচার করিল। তাহার ব্যভিচারের নির্লজ্জতায় দেশ অশুচি হইয়াছিল; সে প্রস্তর ও কাষ্ঠের সহিত ব্যভিচার (অর্থাৎ মূর্তিপূজা) করিত।” যিরমিয় ৩: ৬-৯
“তোমরা জেরুশালেমের সড়কে সড়কে দৌড়াদৌড়ি কর, দেখ, জ্ঞাত হও এবং তথাকার সকল চকে অন্বেষণ কর, যদি এমন একজনকেও পাইতে পার, যে ন্যায়াচরণ করে, সত্যের অনুশীলন করে, তবে আমি নগরকে ক্ষমা করিব। ……… আমি কিরূপে তোমাকে ক্ষমা করিব? তোমার সন্তানগণ আমাকে ত্যাগ করিয়াছে, অনীশ্বরদের নাম লইয়া শপথ করিয়াছে; আমি তাহাদিগকে পরিতৃপ্ত করিলে তাহারা ব্যভিচার করিল ও দলে দলে বেশ্যার বাটিতে গিয়া একত্র হইল। তাহারা খাদ্যপুষ্ট অশ্বের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইল, প্রত্যেকজন পরস্ত্রীর প্রতি হ্রেষা করিল। আমি এই সকলের প্রতিফল দিব না, ইহা সদাপ্রভূ কহেন, আমর প্রাণ কি এই প্রকার জাতির প্রতিশোধ দিবে না?” যিরমিয় ৫: ১-৯
“হে ইসরাঈল কুল, দেখ, আমি তোমাদের বিরুদ্ধে দূর হইতে এক জাতিকে আনিব; সে বলবান জাতি, সে প্রাচীন জাতি; তুমি সেই জাতির ভাষা জান না, তাহারা কি বলে তাহা বুঝিতে পার না। তাহাদের তূন খোলা কবরের ন্যায়, তাহারা সকলে বীর পুরুষ। তাহারা তোমার পক্ক শস্য ও তোমার অন্ন, তোমার পুত্রকন্যাগণের খাদ্য গ্রাস করিবে; তাহারা তোমার মেষপাল ও গোপাল গ্রাস করিবে, তোমার দ্রাক্ষালতা ও ডুমুরবৃক্ষ গ্রাস করিবে, তুমি যেসব প্রাচীরবেষ্টিত নগরে বিশ্বাস করিতেছ, সে সকল তাহারা খড়গ দ্বারা চুরমার করিবে।” যিরমিয় ৫: ১৫-১৭
“এই জাতির শব আকাশের পক্ষীসমূহের ও ভূমির পশুগণের ভক্ষ্য হইবে, কেহ তাহাদিগকে খেদাইয়া দিবে না। তখন আমি যিহূদার সকল নগরে ও জেরুশালেমের সকল পথে আমাদের রব ও আনন্দের রব, বরের রব ও কন্যার রব নিবৃত্ত করিব; কেননা দেশ ধ্বংসস্থান হইয়া পড়িবে।” যিরমিয় ৭: ৩৩-৩৪
“তুমি আমার সম্মুখ হইতে তাহাদিগকে বিদায় কর, তাহারা চালিয়া যাউক। আর যদি তাহারা তোমাকে বলে কোথায় চলিয়া যাইবে? তবে তাহাদিগকে বলিও, সদাপ্রভূ এইকথা কহেন, মৃত্যুর পাত্র মৃত্যুর স্থানে, খড়গের পাত্র খড়গের স্থানে, দুর্ভিক্ষের পাত্র দুর্ভিক্ষের স্থানে ও বন্দিত্বের পাত্র বন্দিত্বের স্থানে গমন করুক।” যিরমিয় ১৫: ১-৩
তারপর যথাসময়ে যিহিষ্কেল নবী উঠেন এবং তিনি জেরুশালেমকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
“হে নগরী, তুমি নিজের মধ্যে রক্তপাত করিয়া থাকো, যেন তোমার কাল উপস্থিত হয়; তুমি নিজের জন্য পুত্তলিগণকে নির্মাণ করিয়া থাকো, যেন তুমি অশুচি হও। …….. দেখ, ইসরাঈলের অধ্যক্ষগণ, প্রত্যেক আপন আপন ক্ষমতা অনুসারে, তোমার মধ্যে রক্তপাত করিবার জন্য প্রস্তুত ছিল। তোমাদের মধ্যে পিতা মাতাকে তুচ্ছ করা হইয়াছে, তোমার মধ্যে বিদেশীর প্রতি উপদ্রব করা হইয়াছে; তোমার মধ্যে পিতৃহীনের ও বিধবার প্রতি জুলুম করা হইয়াছে। তুমি আমার পবিত্র বস্তুসমূহ অবজ্ঞা করিয়াছ ও আমার বিশ্রামের দিনগুলিকে অপবিত্র করিয়াছ। রক্তপাত করণার্থে তোমার মধ্যে চোগলখোররা আসিয়াছে; তোমার মধ্যে লোক কুকর্ম করিয়াছে; তোমার মধ্যে লোকে পিতার উলঙ্গতা অনাবৃত করিয়াছে; তোমার মধ্যে লোকে ঋতুমতী অশুচি স্ত্রীকে বলাৎকার করিয়াছে; তোমার মধ্যে কেহ আপন প্রতিবেশীর স্ত্রীর সহিত ঘৃণার্হ কাজ করিয়াছে; কেহবা আপন পুত্রবধূকে কুকর্মে অশুচি করিয়াছে; আর কেহ বা তোমার মধ্যে আপনার ভগিনীকে, আপন পিতার কন্যাকে বলাৎকার করিয়াছে। রক্তপাত করণার্থে তোমার মধ্যে লোকে উৎকোচ গ্রহণ করিয়াছে; তুমি সুদও বৃদ্ধি লইয়াছ, উপদ্রপ করিয়া লোভে প্রতিবেশীদের কাছে লাভ করিয়াছ এবং আমাকেই ভুলিয়া গিয়াছ, ইহা প্রভু সদাপ্রভূ বলেন। ……. তোমার হস্ত কি সবল থাকিবে? আমি সদাপ্রভূ ইহা বলিলাম, আর ইহা সিদ্ধ করিব। আমি তোমাকে জাতিগণের মধ্যে ছিন্ন ভিন্ন ও নানা দেশে বিকীর্ণ করিব এবং তোমার মধ্য হইতে তোমার অশুচিতা দূর করিব। তুমি জাতিগণের সাক্ষাতে আপনার দোষে অপবিত্রীকৃত হইবে, তাহাতে তুমি জানিবে যে, আমিই সদাপ্রভূ।” যিহিষ্কেল ২২: ৩-১৬
প্রথম মহাবিপর্যয়ের সময় বনী ইসরাঈলকে এই হুশিয়ার বাণীগুলো শুনানো হয়। তারপর দ্বিতীয় মহাবিপর্যয় ও তার ভয়াবহ ফলাফলের সম্মুখীন হবার পর হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে সতর্ক করেন। মথি ২৩ অধ্যায়ে তাঁর একটি বিস্তারিত ভাষণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাতে তিনি নিজের জাতির মারাত্মক নৈতিক অধঃপতনের আলোচনা করে বলেনঃ
“হা জেরুশালেম, জেরুশালেম তুমি ভাববাদিগণকে (নবীগণ) বধ করিয়া থাক ও তোমার নিকট যাহারা প্রেরিত হয়, তাহাদিগকে পাথর মারিয়া থাক। কুক্কুটী যেমন আপনা শাবকদিগকে পক্ষের নীচে একত্র করে, তদুরূপ আমিও কতবার তোমার সন্তানদিগকে একত্র করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, কিন্তু তোমরা সম্মত হইলে না। দেখ, তোমাদের গৃহ তোমাদের জন্য উৎসন্ন পড়িয়া রহিল।” ২৩: ৩৭-৩৮
“আমি তোমাদিগকে সত্য বলিতেছি, এই স্থানের একখানি পাথর অন্য পাথরের উপর থাকিবে না, সমস্ত ভূমিস্মাৎ হইবে।” মথি ২৪: ২
তারপর রোমান সরকারের কর্মকর্তারা তাঁকে শূলে চড়াবার (তাদের কথা মতো) জন্য নিয়ে যাচ্ছিল এবং নারীসহ বিপুল সংখ্যক জনতা বিলাপ করতে করতে তাঁর পেছনে পেছনে চলছিল তখন তিনি শেষবার জনতাকে সম্বোধন করে বলেনঃ
“ওগো জেরুশালেমের কন্যাগণ, আমার জন্য কাঁদিওনা বরং আপনাদের ও আপন আপন সন্তান-সন্তুতিদের জন্য কাঁদ। কেননা দেখ, এমন সময় আসিতেছে, যে সময় লোকে বলিবে, ধন্য সেই স্ত্রী লোকেরা, যাহারা বন্ধ্যা, যাহাদের উদর কখনো প্রসব করে নাই, যাহাদের স্তন কখনো দুগ্ধ দেয় নাই। সেই সময় লোকেরা পর্বতগণকে বলিতে আরম্ভ করিবে, আমাদের উপরে পড়; এবং উপপর্বতগণকে বলিবে, আমাদিগকে ঢাকিয়া রাখ।” লুক ২৩: ২৮-৩০ ( ( সবগুলো রেফারেন্স দেখুন। )
# এখানে আসিরীয়াবাসী ও ব্যবিলনবাসীদের হাতে বনী ইসরাঈলদের ওপর যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এসেছিল সে কথাই বলা হয়েছে। এর ঐতিহাসিক পটভূমি অনুধাবন করার জন্য ওপরে আমি নবীগণের সহীফাসমূহ থেকে যে উদ্ধৃতিগুলো দিয়েছি শুধুমাত্র সেটুকু জানাই যথেষ্ট নয়, বরং এখানে একটি সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক বর্ণনারও প্রয়োজন রয়েছে। এভাবে যেসব কারণে মহান আল্লাহ একটি কিতাবধারী জাতিকে মানব জাতির নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে একটি পরাজিত, গোলাম ও অনুন্নত জাতিতে পরিণত করেছিলেন সেই মূল কারণগুলো একজন অনুসদ্ধিৎসু পাঠকের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
হযরত মূসা (আ) ইন্তিকালের পর বনী ইসরাঈল যখন ফিলিস্তীনে প্রবেশ করে তখন সেখানে বিভিন্ন জাতি বাস করতো। হিত্তী, আম্মাত্তরী, কানআনী, ফিরিযযী, ইয়াবূসী, ফিলিস্তী ইত্যাদি। এসব জাতি মারাত্মক ধরনের শিরকে লিপ্ত ছিল। এদের সবচেয়ে বড় মাবুদের নাম ছিল “ঈল।” একে তারা বলতো দেবতাগণের পিতা। আর সাধারণত তারা একেষাঁড়ের সাথে তুলনা করতো। তার স্ত্রীর নাম ছিল “আশীরাহ।” তার গর্বজাত সন্তানদের থেকে ঈশ্বর ও ঈশ্বরীদের একটি বিশাল বংশধারা শুরু হয়। এ সন্তানদের সংখ্যা ৭০ এ গিয়ে পৌঁছেছিল। তার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল বা’ল। তাকে বৃষ্টি ও উৎপাদনের ঈশ্বর এবং পৃথিবী ও আকাশের মালিক মনে করা হতো। উত্তরাঞ্চলে তার স্ত্রীকে ‘উনাস’ বলা হতো এবং ফিলিস্তীনে বলা হতো ‘ইসরাত’। আর এ মহিলাদ্বয় ছিল প্রেম ও সন্তান উৎপাদনের দেবী। এরা ছাড়া আরো যেসব দেবতা ছিল তাদের মধ্যে কেউ ছিল মৃত্যুর দেবতা, কেউ ছিল স্বাস্থ্যের দেবী আবার কোন দেবতা দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর আবির্ভাব ঘটাতো এভাবে প্রভুত্বের কাজ কারবার বহু সংখ্যক উপাস্যের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঐ সব দেব দেবীকে এমনসব গুণে গুণান্বিত করা হয়েছিল যে, সমাজের নৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও দুরাচার ব্যক্তিও তাদের সাথে নিজের নাম জড়িত করে লোকসম্মুখে পরিচিত লাভ করা পছন্দ করতো না। এখন একথা সুস্পষ্ট, যারা এ ধরনের বদ ও নিকৃষ্ট সত্তাদেরকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করে তাদের পূজা-উপাসনা করে, তারা নৈতিকতার নিকৃষ্টস্তরে নেমে যাওয়া থেকে নিজেদেরকে কেমন করে রক্ষা করতে পারে। এ কারণেই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ খনন করার পর তাদের অবস্থার যে চিত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে তা তাদের মারাত্মক ধরনের নৈতিক অধঃপতনের সাক্ষ্য দিচ্ছে। শিশু বলিদানের ব্যাপারটি তাদের সমাজে সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। তাদের উপাসনালয়গুলো ব্যভিচারের আড্ডায় পরিণত হয়েছিল। মেয়েদেরকে দেবদাসী বানিয়েউপসনালয়গুলোতে রাখা এবং তাদের দিয়ে ব্যভিচার করানো ইবাদাত ও উপাসনার অংগে পরিণত হয়েছিল। এ ধরনের আরো বহু চরিত্র বিধ্বংসী কাজ তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।
তাওরাতে হযরত মূসার (আ) সাহায্যে বনী ইসরাঈলকে যে হেদায়াত দেয়া হয়েছিল। তাতে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছিল, তোমরা ঐ সব জাতিকে ধ্বংস করে দিয়ে ফিলিস্তীন ভূখণ্ড তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে এবং তাদের সাথে বসবাস করা থেকে দূরে থাকবে এবং তাদের নৈতিক ও আকীদা-বিশ্বাসগত দোষ ত্রুটিগুলো এড়িয়ে চলবে।
কিন্তু বনী ইসরাঈল যখন ফিলিস্তীনে প্রবেশ করলো তখন তারা একথা ভুলে গেলো। তারা নিজেদের কোন সংযুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করলো না। গোত্র প্রীতি ও গোত্রীয় বিদ্বেষে তারা মত্ত হয়ে গেলো। তাদের বিভিন্ন গোত্র বিজিত এলাকার এক একটি অংশ নিয়ে নিজের এক একটি পৃথক রাষ্ট্র কায়েম করাই মুশরিকদেরকে পুরোপুরি নির্মূল করে দেবার মতো শক্তি অর্জন করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত মুশরিকদের সাথে মিলেমিশে বসবাস করাটাই তাদের পছন্দ করে নিতে হলো। শুধু এ নয় বরং তাদের বিজিত এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ঐ সব মুশরিক জাতির ছোট ছোট নগর রাষ্ট্রও অক্ষুণ্ণ থাকলো। বনী ইসরাঈলরা সেগুলো জয় করতে পারলো না। যাবুরের (গীতসংহিতা) বক্তব্য এরই অভিযোগ করা হয়েছে। এই সূরার ৬ টীকার শুরুতে আমি এ বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি।
হযরত মূসার (আ) পরবর্তী ফিলিস্তিন :
হযরত মূসার (আ) পর বনী-ইসরাঈলীরা ফিলিস্তিনের সমগ্র অঞ্চল জয় করিয়া লয় বটে। কিন্তু তারা ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত হইয়া নিজেদের কোন একটি সুসংবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিতে সক্ষম হয় নাই। তাহারা এই গোটা অঞ্চলটিকে বিভিন্ন বনী ইসরাঈল গোষ্ঠীয় লোকদের মধ্যে বিভক্ত ও বণ্টন করিয়া লয়। ফলে তাহারা নিজেদের ক্ষুদ্রায়তন বহু কয়টি গোত্রীয়রাষ্ট্রকায়েম করে। অত্র চিত্রে দেখানো হইয়াছে যে, ফিলিস্তানের সংক্ষিপ্ততম অঞ্চলটি বনীইসরাঈলের বনু ইয়াহুদাহ, বনু শামউন, বনু দান, বনু বিনইয়াসিন, বনু আফারায়াম, বনু রুবন, বনু জাদ্দ, বনু মুনাসসা, বনু আশকার , (মানচিত্র), , বনু জুবুলুন, বনু নাফতালী ও বনু আশের এ গোত্রসমূহের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
এ কারণে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই দুর্বল হইয়া থাকিল। ফলে তাহারা তাওরাত কিতাবের লক্ষ অর্জনে সম্পূর্ণ অক্ষম থাকিয়া গেল। আর সেই লক্ষ ছিল এই অঞ্চলের অধিবাসী মুশরিক জাতিগুলির সম্পূর্ণ মূলোৎপাটন ও বহিষ্কার। ইসরাঈলী গোত্রসমূহের অধীন এ অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে মুশরিক কিনয়ানী জাতিসমূহের বহু কতকগুলি নগর রাষ্ট্র রীতিমত প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাইবেল পাঠে জানিতে পারা যায় যে, তালূত এর শাসন আমল পর্যন্ত সাইদা, সূর, দুয়ার ও মুজেদ্দু, বাইতেশান, জজর, জেরুশালেম প্রভৃতি শহরগুলি প্রখ্যাত মুশরিক জাতিগুলির দখলে থাকিয়া গিয়াছিল। আর বনী ইনসরাঈলদের উপর এসব শহরে অবস্থিত মুশরিকী সভ্যতার অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার হয়েছিল।
উপরন্তু ইসরাঈলী গোত্রগুলোর অবস্থানের সীমান্ত এলাকায় ফলিস্তিয়া, রোমক, মুয়াবী ও আমূনীয়দের অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিও যথারীতি প্রতিষ্ঠিত এবং তাহারা পরবর্তীকালে উপর্যুপরি আক্রমণ চালাইয়া ইসরাঈলীদের দখল হতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল কেড়ে নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এ দাঁড়িয়েছিল যে, সমগ্র ফিলিস্তিন হতে ইয়াহুদীদেরকে কান ধরিয়া ও গলা ধাক্কা দিয়া বহিষ্কৃত করা হইত–যদি যথা সময়ে আল্লাহ তায়ালা তালূত এর নেতৃত্বে ইসরাঈলীদেরকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করিয়া না দিতেন।
বনী ইসরাঈলকে এর প্রথম দণ্ড ভোগ করতে হলো এভাবে যে, ঐ জাতিগুলোর মাধ্যমে তাদের মধ্যে শিরক অনুপ্রবেশ করলো এবং এ সাথে অন্যান্য নৈতিক অনাচারও ধীরে ধীরে প্রবেশ করার পথ পেয়ে গেলো। বাইবেলের বিচারকর্তৃগণ পুস্তকে এ সম্পর্কে এভাবে অনুযোগ করা হয়েছেঃ “ইসরাঈল সন্তানগণ সদাপ্রভুর দৃষ্টিতে যাহা মন্দ তাহাই করিতে লাগিল এবং বা’ল দেবগণের সেবা করিতে লাগিল। আর যিনি তাহাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর, যিনি তাহদিগকে মিসর দেশ হইতে বাহির করিয়া আনিয়াছিলেন, সেই সদাপ্রভুকে ত্যাগ করিয়া অন্য দেবগণের, অর্থাৎ আপনাদের চতুর্দিকস্থিত লোকদের দেবগণের অনুগামী হইয়া তাহাদের কাছে প্রণিপাত করিতে লাগিল, এই রূপে সদাপ্রভুকে অসস্তুষ্ট করিল। তাহারা সদাপ্রভুকে ত্যাগ করিয়া বাল দেবের ও অষ্টারোৎ দেবীরদের সেবা করিত। তাহাতে ইসরাঈলের বিরুদ্ধে সদাপ্রভুর ক্রোধ প্রজ্জ্বলিত হইল।” বিচারকর্তৃগণ ২: ১১-১৩
এরপর তাদের দ্বিতীয় দণ্ড ভোগ করতে হলো। সেটি হচ্ছে, যেসব জাতির নগর রাষ্ট্রগুলোকে তারা ছেড়ে দিয়েছিল তারা এবং ফিলিস্তীয়রা, যাদের সমগ্র এলাকা অবিজিত রয়ে গিয়েছিল, বনী ইসরাঈলদের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত জোট গঠন করলো এবং লাগাতার হামলা করে ফিলিস্তীনের বৃহত্তম অংশ থেকে তাদেরকে বেদখল করলো। এমনকি তাদের কাছ থেকে সদাপ্রভুর অঙ্গীকারের সিন্দুকও (শান্তির তাবুত) ছিনিয়ে নিল। শেষ পর্যন্ত বনী ইসরাঈলরা অনুভব করলো, তাদের একজন শাসকের অধীনে একটি সংযুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ফলে তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে শামুয়েল নবী ১০২০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে তালূতকে তাদের বাদশাহ নিযুক্ত করলেন। (সূরা বাকারাহ ৩২ রুকূ’তে) এর উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।)
এ সংযুক্ত রাষ্ট্রের শাসনকর্তা হয়েছিলেন তিনজন। খৃঃ পূঃ ১০২০ থেকে ১০০৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন তালূত, খৃঃ পূঃ ১০০৪ থেকে ৯৬৫ সাল পর্যন্ত হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম এবং খৃঃ পূঃ ৯৬৫ থেকে ৯২৬ সাল পর্যন্ত হযরত সোলাইমান আলাইহিস সালাম। হযরত মূসা আলাইহিস সালামের পর বনী ইসরাঈলরা যে কাজটি অসম্পূর্ণ রেখে দিয়েছিলএ শাসনকর্তাগণ সেটি সম্পূর্ণ করেন। শুধুমাত্র উত্তর উপকূলে ফিনিকিয়দের এবং দক্ষিণ উপকূলে ফিলিস্তিয়দের রাষ্ট্র অপরিবর্তিত থেকে যায়। এ রাষ্ট্র দু’টি জয় করা সম্ভব হয়নি। ফলে এদেরকে শুধু করদ রাষ্ট্রে পরিণত করেই ক্ষান্ত হতে হয়।
হযরত সোলাইমান আলাইহিস সালামের পরে বনী ইসরাঈল আবার ভীষণভাবে দুনিয়াদারী ও বৈষয়িক স্বার্থপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়লো। পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে তারা নিজেরদের দু’টো পৃথক রাষ্ট্র কায়েম করে নিল। উত্তর ফিলিস্তীন ও পূর্ব জর্দানে ইসরাঈল রাষ্ট্র। শেষ পর্যন্ত সামেরীয়া এর রাজধানী হলো। অন্যদিকে দক্ষিণ ফিলিস্তীন ও আদোন অঞ্চলে কায়েম হলো ইহুদিয়া রাষ্ট্র। জেরুশালেম হলো এর রাজধানী। প্রথম দিন থেকেই এ দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো মারাত্মক ধরনের রেষারেষি ও সংঘাত-সংঘর্ষ এবং শেষ দিন পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকলো।
এদের মধ্যে ইসরাঈলী রাষ্ট্রের শাসক ও বাসিন্দারাই সর্বপ্রথম প্রতিবেশী জাতিদের মুশরিকী আকীদা-বিশ্বাস ও নৈতিক বিকৃতি দ্বারা প্রভাবিত হলো। এ রাষ্টের শাসক আখীয়াব সাইদার মুশরিক মাহজাদী ইসাবেলাকে বিয়ে করার পর এ দুরাবস্থা চরমে পৌঁছে গেল। এ সময় ক্ষমতা ও উপায়-উপকরণের মাধ্যমে শিরক ও নৈতিক আনাচার বন্যার বেগে ইসরাঈলীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। হযরত ইলিয়াস ও হযরত আল-ইয়াসা, আলাইহিমাস সালাম এ বন্যা রুখে দেবার জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালালেন। কিন্তু এ জাতি যে অনিবার্য পতনের দিকে ছুটে চলছিল তা থেকে আর নিবৃত্ত হলো না। শেষে আশূরীয় বিজেতাদের আকারেআল্লাহর গযব ইসরাঈল রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে এলো এবং খৃষ্টপূর্ব নবম শতক থেকে ফিলিস্তীনের ওপর আশূরীয় শাসকদের উপর্যূপরি হামলা শুরু হয়ে গেলো। এ যুগে আমূস (আমোস) নবী (খৃঃ পূঃ ৭৮৭-৭৪৭) এবং তারপর হোসী ’ (হোশেয়) নবী (খৃষ্টপূর্ব ৭৪৭-৭৩৫) ইসরাঈলীদেরকে অনবরত সতর্ক করে যেতে থাকলেন। কিন্তু যে গাফলতির নেশায় তারা পাগল হয়ে হিয়েছিল সতর্কবাণীর তিক্ত রসে তার তীব্রতা আরো বেড়ে গেলো। এমন কি ইসরাঈলী বাদশাহ আমূস নবীকে দেশত্যাগ করার এবং সামেরীয় রাজের এলাকার চতুঃসীমার মধ্যে তাঁর নবুওয়ারে প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। এরপর আর বেশীদিন যেতে না যেতেই ইসরাঈলী রাষ্ট্র ও তার বাসিন্দাদের ওপর আল্লাহর আযাব নেমে এলো। খৃষ্টপূর্ব ৭২১ অব্দে অশূরীয়ার দুর্ধর্ষ শাসক সারাগুন সামেরীয়া জয় করে ইসরাঈল রাষ্ট্রের পতন ঘটালো। হাজার হাজার ইসরাঈলী নিহত হলো। ২৭ হাজারেরও বেশী প্রতিপত্তিশীল ইসরাঈলীকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে আশূরীয় রাষ্ট্রের পূর্ব প্রান্তের জেলাসমূহে ছড়িয়ে দেয়া হলো এবং অন্যান্য এলাকা থেকে ইসরাঈলীদেরকে এনে ইসরাঈলী এলাকায় পুনর্বাসিত করা হলো। এদের মধ্যে বসবাস করে ইসরাঈলীদের দলছুট অংশও নিজেদের জাতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি থেকে দিনের পর দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকলো।
ইহুদীয়া নামে বনী ইসরাঈলদের যে দ্বিতীয় রাষ্ট্রটি দক্ষিণ ফিলিস্তীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটিও হযরত সুলাইমান আলাইহি সালামের পর অতি শীঘ্রই শিরক ও নৈতিক অনাচারে ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু ইসরাঈলী রাষ্ট্রের তুলনায় তার আকীদাগত এবং নৈতিক অধঃপতনের গতি ছিল মন্থর। তাই তার অবকাশকালও ছিল একটু বেশী দীর্ঘ। ইসরাঈলী রাষ্ট্রের মত তার ওপরও আশূরীয়রা যদিও উপর্যুপরি হামলা চালিয়েযাচ্ছিল, তার নগরগুলো ধ্বংস করে চলছিল এবং তার রাজধানী অবরোধ করে রেখেছিল, তবুও এ রাজ্যটি আশূরীয়দের হাতে পুরোপুরি বিজিত হয়নি, বরং এটি তাদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। তারপর যখন হযরত ইয়াসইয়াহ (যিশাইয়) ও হযরত ইয়ারমিয়াহর (যিরমিয়) অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টা সত্বেও ইয়াহুদিয়ার লোকেরা মূর্তি পূজা ও নৈতিক অনাচার ত্যাগ করলো না তখন খৃষ্টপূর্ব ৫৯৮ সালে ব্যবিলনের বাদশাহ বখতে নসর জেরুশালেমসহ সমগ্র ইয়াহুদীয়া রাজ্য জয় করে নিল এবং ইয়াহুদীয়ার বাদশাহ তার হাতে বন্দী হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলো। ইহুদীদের অপকর্মের ধারা এখানেই শেষ হলো না। হযরত ইয়ারমিয়াহর হাজার বুঝানো সত্বেও তারা নিজেদের চরিত্র কর্ম সংশোধন করার পরিবর্তে ব্যবিলনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে লাগলো। শেষে ৫৮৭ খৃষ্টপূর্বাব্দে বখতে নসর একটি বড় আকারের হামলা চালিয়ে ইয়াহুদিয়ার ছোট বড় সমস্ত শহর ধ্বংস করে দিল এবং জেরুশালেম ও হাইকেলে সুলায়মানীকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করলো যে, তার একটি দেয়ালও অক্ষত রইলো না, সবকিছু ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিল। বিপুল সংখ্যক ইহুদীদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে বিভিন্ন দেশে বিতাড়িত করলো। আর যেসব ইহুদী নিজেদের এলাকায় থেকে গেলো তারাও প্রতিবেশী জাতিদের পদতলে নিকৃষ্টভাবে দলিত মথিত ও লাঞ্ছিত হতে থাকলো।
এটিই ছিল প্রথম বিপর্যয়। বনী ইসরাঈলকে এ বিপর্যয় সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল। আর এটিই ছিল প্রথম শাস্তি। এ অপরাধে তাদেরকে এ শাস্তি দেয়া হয়েছিল।
#এখানে ইহুদীদেরকে (ইয়াহুদিয়াবাসী) ব্যবিলনের দাসত্বমুক্ত হবার পর যে অবকাশ দেয়া হয় সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। সামেরীয়া ও ইসরাঈলের লোকদের সম্পর্কে বলা যায়, আকীদাগত ও নৈতিক পতনের গর্তে পা দেবার পর তারা আর সেখান থেকে উঠতে পারেনি। কিন্তু ইয়াহুদিয়ার অধিবাসীদের মধ্যে কিছু লোক ছিল, যারা সততা ও ন্যায়-নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং সুকৃতি ও কল্যাণের দাওয়াত দিয়ে আসছিল। তারা ইয়াহুদিয়ায় যেসব ইহুদী থেকে গিয়েছিল তাদের মধ্যে সংস্কারমূলক কাজ করতে থাকলো এবং ব্যবিলন ও অন্যান্য এলাকায় যাদেরকে বিতাড়িত করা হয়েছিল তাদেরকেও তাওবা ও অনুশোচনা করতে উদ্বুদ্ধ করলো। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমত তাদের সহায়ক হলো। ব্যাবিলন রাষ্ট্রের পতন হলো। খৃষ্টপূর্ব ৫৩৯ সালে ইরানী বিজেতা সাইরাস (খুরস বা খসরু) ব্যবিলন জয় করে এবং তারপরের বছরই এক ফরমান জারী করে। এ ফরমানের সাহায্যে বনী ইসরাঈলকে নিজেদের স্বদেশভূমিতে ফিরে যাবার এবং সেখানে পুনরায় বসবাস করার সাধারণ অনুমতি দেয়া হয়। এরপর ইয়াহুদিয়ার দিকে ইহুদীদের কাফেলার সারি চলতে থাকে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এর সিলসিলা অব্যাহত থাকে। সাইরাস ইহুদীদেরকে হাইকেলে সুলাইমানী পুনর্বার নির্মাণ করারও অনুমতি দেয়। কিন্তু দীর্ঘকাল পর্যন্ত এ এলাকায় নতুন বসতিকারী প্রতিবেশী জাতিগুলো এতে বাধা দিতে থাকে। শেষে প্রথম দারায়ুস (দারা) ৫২২ খৃস্টপূর্বাব্দে ইয়াহুদিয়ার শেষ বাদশাহর নাতি সরুব্বাবিলকে ইয়াহুদিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করে। সে হাজ্জী (হগয়) নবী, যাকারিয়া (সখরিয়) নবী ও প্রধান পুরোহিত যেশূয়ের তত্বাবধানে পবিত্র হাইকেল পুনরনির্মাণ করে। তারপর খৃস্টপূর্ব ৪৫৮ সালে হযরত উযাইর (ইয্রা) ইয়াহুদিয়ায় পৌঁছেন। পারস্যরাজ ইর্দশীর এক ফরমান বলে তাঁকে এ মর্মে ক্ষমতা দান করেনঃ
“হে উযাইর তোমার ঈশ্বর বিষয়ক যে জ্ঞান তোমার করতলে আছে, তদনুসারে নদী পারস্থ সকল লোকের বিচার করিবার জন্য, যাহারা তোমার ঈশ্বরের ব্যবস্থা জানে, এমন শাসনকর্তা ও বিচারকর্তাদিগকে নিযুক্ত কর; এবং যে তাহা না জানে, তোমরা তাহাকে শিক্ষা দাও। আর যে কেহ তোমার ঈশ্বরের ব্যবস্থা ও রাজার ব্যবস্থা পালন করিতে অসম্মত তাহাকে সমুচিত শাস্তি প্রদান করা হউক; তাহার প্রাণদণ্ড, নির্বাসন, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত কিম্বা কারাদণ্ড হউক।” ইয্রা ৭ ২৫-২৬
এ ফরমানের সুযোগ গ্রহণ করে হযরত উযাইর মূসার দ্বীনের পুনরুজ্জীবনের বিরাট দায়িত্ব সম্পাদন করেন। তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে ইহুদী জাতির সকল সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ লোককে একত্র করে একটি শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাওরাত সম্বলিত বাইবেলের পঞ্চ পুস্তক একত্র সংকলিত ও বিন্যস্ত করে তিনি তা প্রকাশ করেন। দ্বীনী শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। অন্য জাতিদের প্রভাবে বনী ইসরাঈলদের মধ্যে যেসব আকীদাগত ও চারিত্রিক অনাচারের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল শরীয়াতের আইন জারী করে তিনি সেগুলো দূর করে দিতে থাকেন। ইহুদীরা যেসব মুশরিক মেয়েকে বিয়ে করে তাদেরকে নিয়ে ঘর সংসার করছিল তাদেরকে তালাক দেবার ব্যবস্থা করেন। বনী ইসরাঈলদের থেকে আবার নতুন করে আল্লাহর বন্দেগী করার এবং আইন মেনে চলার অঙ্গীকার নেন।
খৃস্টপূর্ব ৪৪৫ সালে নহিমিয়ের নেতৃত্বে আর একটি বহিষ্কৃত ইহুদী দল ইয়াহুদিয়ায় ফিরে আসে। পারস্যের রাজা নহিমিয়কে জেরুশালেমের গভর্নর নিযুক্ত করে তাকে এই নগরীর প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করার অনুমতি দেয়। এভাবে দেড়শো বছর পরে বায়তুল মাকদিস পুনরায় আবাদ হয় এবং তা ইহুদী ধর্ম ও সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্রে পরিণত হয়। কিন্তু সামেরিয়া ও উত্তর ফিলিস্তীনের ইসরাঈলীরা হযরত উযাইরের সংস্কার ও পুনরুজ্জীবন কর্মকাণ্ড থেকে লাভবান হবার কোন সুযোগ গ্রহণ করেনি। বরং বায়তুল মাকদিসের মোকাবিলায় জারযীম পাহাড়ে নিজেদের একটি ধর্মীয় কেন্দ্র নির্মাণ করে তাকে আহলি কিতাবদের কিবলায় পরিণত করার চেষ্টা করে। এভাবে ইহুদী ও সামেরীয়দের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যেতে থাকে।
পারস্য সাম্রাজ্যের পতন এবং আলেকজাণ্ডারের বিজয় অভিযান ও গ্রীকদের উত্থানের ফলে কিছুকালের জন্য ইহুদীরা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য তিনটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। তার মধ্যে সিরিয়ার এলাকা পড়ে সালূকী রাজ্যের অংশে। এর রাজধানী ছিল ইনতাকিয়ায়। এর শাসনকর্তা তৃতীয় এন্টিউকাস খৃস্টপূর্ব ১৯৮ সালে ফিলিস্তীন করে দখল নেয়। এ গ্রীক বিজেতা ছিল মুশরিক ও নৈতিক চরিত্রহীন। ইহুদী ধর্ম ও সভ্যতা-সংস্কৃতিকে সে অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতো। এর মোকাবিলা করার জন্য সে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপের মাধ্যমে গ্রীক সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসারে আত্মনিয়োগ করে। এ সঙ্গে ইহুদীদেরে একটি উল্লেখযোগ্য অংশও তার ক্রীড়নকে পরিণত হয়। এ বাইরের অনুপ্রবেশ ইহুদীজাতির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। তাদের একটি দল গ্রীক পোষাক, গ্রীক ভাষা, গ্রীক জীবন যাপন পদ্ধতি ও গ্রীক খেলাধূলা গ্রহণ করে নেয় এবং অন্য দল নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে কঠোরভাবে আঁকড়ে ধরে। খৃস্টপূর্ব ১৭৫ সালে চতুর্থ এন্টিউকাস (যার উপাধি ছিল এপিফানিস বা আল্লাহর প্রকাশ) সিংহাসনে বসে ইহুদী ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য রাজশক্তির পূর্ণ ব্যবহার করে। বায়তুল মাকদিসের হাইকেলে সে জোরপূর্বক মূর্তি স্থাপন করে এবং সেই মূর্তিকে সিজদা করার জন্য ইহুদীদেরকে বাধ্য করে। ইতিপূর্বে যেখানে কুরবানী করা হতো সেখানে কুরবানী করাও বন্ধ করিয়ে দেয় এবং ইহুদীদেরকে মুশরিকদের কুরবানী করার জায়গায় কুরবানী করার হুকুম দেয়। যারা নিজেদের ঘরে তাওরাত রাখে অথবা শনিবারের দিনের বিধান মেনে চলে কিংবা নিজেদের শিশু সন্তানদের খতনা করায় তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান জারী করে। কিন্তু ইহুদীরা এ শক্তি প্রয়োগের সামনে মাথা নত করেনি। তাদের মধ্যে একটি দুর্বার আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে এ আন্দোলনটি “মাক্কাবী বিদ্রোহ” নামে পরিচিত। যদিও এ সংঘাত-সংঘর্ষকালে গ্রীক প্রভাবিত ইহুদীদের যাবতীয় সহানুভূতি গ্রীকদের পক্ষেই ছিল এবং তারা কার্যত মাক্কাবী বিদ্রোহ নির্মূল করার জন্য ইনতাকিয়ার জালেমদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল তবুও সাধারণ ইহুদীদের মধ্যে হযরত উযাইরের দ্বীনী কার্যক্রমের বিপ্লবাত্মক ভাবধারা এতদূর প্রভাব বিস্তার করেছিল যার ফলে তারা সবাই শেষ পর্যন্ত মাক্কাবীদের সাথে সহযোগিতা করে। এভাবে একদিন তারা গ্রীকদের বিতাড়িত করে নিজেদের একটি স্বাধীন দ্বীনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। এ রাষ্ট্রটি খৃস্টপূর্ব ৬৭ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত থাকে। এ রাষ্ট্রটির সীমানা সম্প্রসারিত হতে হতে ধীরে ধীরে পূর্বতন ইয়াহুদিয়া ও ইসরাঈল রাষ্ট্র দু’টির আওতাধীন সমগ্র এলাকার ওপর পরিব্যাপ্ত হয়। বরং ফিলিস্তিয়ার একটি বড় অংশও তার কর্তৃত্বাধীনে চলে আসে। হযরত দাউদ (আ) এবং হযরত সুলাইমানের (আ) আমলেও এ এলাকাটি বিজিত হয়নি। কুরআন মজীদের সংশিষ্ট আয়াতগুলো এ ঘটনাবলীর প্রতি ইঙ্গিত করে। মানচিত্র———– হযরত দাউদ ও সোলাইমানের (আ) সাম্রাজ্য (১০০০-৯৩০ খৃষ্টপূর্ব) , মানচিত্র——- বনী ইসরাঈলদের দুই রাষ্ট্র ইয়াহুদীয়া ও ইসরাইল (খৃষ্টপূর্ব ৮৬০)
# এ দ্বিতীয় বিপর্যয়টি এবং এর ঐতিহাসিক শাস্তির পটভূমি নিম্নরূপঃ
মাক্কাবীদের আন্দোলন যে নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও দ্বীনী প্রেরণা সহকারে শুরু হয়েছিল তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। নির্ভেজাল বৈষয়িক স্বার্থপূজা ও অন্তসারশূন্য লৌকিকতা তার স্থান দখল করে। শেষে তাদের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। তারা নিজেরাই রোমক বিজেতা পম্পীকে ফিলিস্তীনে আসার জন্য আহবান জানায়। তাই খৃস্টপূর্ব ৬৩ সনে পম্পী এ দেশের দিকে নজর দেয় এবং বায়তুল মাকদিস জয় করে ইহুদীদের স্বাধীনতা হরণ করে। কিন্তু রোমীয় বিজেতাদের স্থায়ী নীতি ছিল, তারা বিজিত এলাকায় সরাসরি নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতো না। বরং স্থানীয় শাসকদের সহায়তায় আইন শৃংখলা ব্যবস্থা পরিচালনা করে পরোক্ষভাবে নিজেদের কার্যোদ্ধার করা বেশী পছন্দ করতো। তাই তারা নিজেদের ছত্রছায়ায় ফিলিস্তীনে একটি দেশীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। খৃঃ পূঃ ৪০ সনে এটি হীরোদ নামক এক সুচতুর ইহুদীর কর্তৃত্বাধীন হয়। ইতিহাসে এ ইহুদী শাসক মহান হীরোদ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সমগ্র ফিলিস্তীন ও ট্রান্স জর্দান এলাকায় খৃস্টপূর্ব ৪০ থেকে ৪ সন পর্যন্ত তার শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকে। একদিকে ধর্মীয় নেতা পুরোহিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করে সে ইহুদীদেরকে সন্তুষ্ট করে এবং অন্যদিকে রোমান সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করে রোম সাম্রাজ্যের প্রতি নিজের অত্যাধিক বিশ্বস্ততার প্রমাণ পেশ করে। এভাবে কাইসারের সন্তুষ্টিও অর্জন করে। এ সময় ইহুদীদের দ্বীনী ও নৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে ঘটতে তার একেবারে শেষ সীমানায় পৌঁছে যায়। হীরোদের পর তার রাষ্ট্র তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েঃ
তার এক ছেলে আরখালাউস সামেরীয়া, ইয়াহুদিয়া ও উত্তর উদমিয়ার শাসনকর্তা হয়। কিন্তু ৬ খৃষ্টাব্দে রোম সম্রাট আগস্টাস তাকে পদচ্যুত করে তার কর্তৃত্বাধীন সমগ্র এলাকা নিজের গভর্নরের শাসনাধীনে দিয়ে দেয়। ৪১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত এ ব্যবস্থাই অপরিবর্তিত থাকে। এ সময় হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলের সংস্কারের জন্য নবুওয়াতের দায়িত্ব নিয়ে আবির্ভূত হন। ইহুদীদের সমস্ত ধর্মীয় নেতা ও পুরোহিতরা একজোট হয়ে তাঁর বিরোধিতা করে এবং রোমান গভর্নর পোন্তিসপীলাতিসের সাহায্যে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দান করার প্রচেষ্টা চালায়।
হীরোদের দ্বিতীয় ছেলে হীরোদ এন্টিপাস উত্তর ফিলিস্তীনের গালীল এলাকা ও ট্রান্স জর্দানের শাসনকর্তা হয়। এ ব্যক্তিই এক নর্তকীর ফরমায়েশে হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের শিরশ্ছেদ করে তাকে নযরানা দেয়।
তার তৃতীয় ছেলের নাম ফিলিপ। হারমুন পর্বত থেকে ইয়ারমুক নদী পর্যন্ত সমগ্র এলাকা তার অধিকারভুক্ত ছিল। এ ব্যক্তি রোমীয় ও গ্রীক সংস্কৃতিতে নিজের বাপ ও ভাইদের তুলনায় অনেক বেশী ডুবে গিয়েছিল। তার এলাকায় কোন ভাল কথার বা ভাল কাজের বিকশিত হবার তেমন সুযোগ ছিল না যেমন ফিলিস্তীনের অন্যান্য এলাকায় ছিল।
মহামতি হীরোদ তাঁর নিজের শাসনামলে যেসব এলাকার ওপর কর্তৃত্ব করতেন ৪১ খৃস্টাব্দে তার নাতি হীরোদাগ্রীপ্পাকে রোমীয়রা সেসব এলাকার উপর শাসনকর্তা নিযুক্ত করে। এ ব্যক্তি শাসন কতৃত্ব লাভ করার পর ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসারীদের ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন শুরু করে দেয়। তাঁর তাওয়ারীগণ আল্লাহভীতি ও নৈতিক চরিত্র সংশোধনের যে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন তাকে বিধ্বস্ত করার জন্য সে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করে।
হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম এ সময়ের সাধারণ ইহুদী এবং তাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সমালোচনা করে যেসব ভাষণ দিয়েছিলেন সেগুলো পাঠ করলে তাদের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যাবে। চার ইনজীলে এ ভাষণগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে। তারপর এ সম্পর্কে ধারণা লাভ করার জন্য এ বিষয়টিও যথেষ্ট যে, এ জাতির চোখের সামনে হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের মতো পুন্যাত্মাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হলো কিন্তু এ ভয়ংকর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি আওয়াজও শোনা গেল না। আবার অন্যদিকে সমগ্র জাতির ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ঈসা আলাইহিস সালামের জন্য মৃত্যুদণ্ড দাবী করলো কিন্তু হাতে গোনা গুটিকয় সত্যাশ্রয়ী লোক ছাড়া জাতির এ দুর্ভাগ্য দুঃখ করার জন্য আর কাউকে পাওয়া গেল না। জাতীয় দুরাবস্থা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, পোন্তিসপীলাতিস এ দুর্ভাগ্য লোকদেরকে বললো, আজ তোমাদের ঈদের দিন। প্রচলিত নিয়ম মোতাবিক আজ মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অপরাধীদের একজনকে মুক্তি দেবার অধিকার আমার আছে। এখন তোমরা বলো, আমি ঈসাকে মুক্তি দেবো, না বারাব্বা ডাকাতকে? সমগ্র জনতা এক কন্ঠে বললো, বারাব্বা ডাকাতের মুক্তি দাও। এটা যেন ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এ জাতির গোমরাহীর পক্ষে শেষ প্রমাণ পেশ।
এর কিছুদিন পরেই ইহুদী ও রোমানদের মধ্যে কঠিন সংঘাত-সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলো। ৬৪ ও ৬৬ খৃস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ইহুদীরা প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। দ্বিতীয় হীরোদাগ্রিপ্পা ও রোম সম্রাট নিযুক্ত প্রাদেশিক দেওয়ান ফ্লোরাস উভয়ই এ বিদ্রোহ দমন করতে ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যন্ত রোম সম্রাট বড় ধরনের সামরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এ বিদ্রোহ নির্মূল করলো। ৭০ খৃস্টাব্দে টীটুস সেনাবাহিনীর সাহায্যে যুদ্ধ করে জেরুশালেম জয় করলো। এ সময় যে গণহত্যা সংঘটিত হলো তাতে ১ লাখ ৩৩ হাজার লোক মারা গেলো। ৬৭ হাজার লোককে গ্রেফতার করে গোলামে পরিণত করা হলো। হাজার হাজার লোককে পাকড়াও করে মিসরের খনির মধ্যে কাজ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়া হলো। হাজার হাজার লোককে ধরে বিভিন্ন শহরে এম্ফী থিয়েটার ও ক্লুসীমুতে ভিড়িয়ে দেয়া হলো। সেখানে তারা বন্য জন্তুর সাথে লড়াই বা তরবারি যুদ্ধের খেলার শিকার হয়। দীর্ঘাংগী সুন্দরী মেয়েদেরকে বিজেতাদের জন্য নির্বাচিত করে নেয়া হলো। সবশেষে জেরুশালেম নগরী ও হাইকেলকে বিধ্বস্ত করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হলো। এরপর ফিলিস্তীন থেকে ইহুদী কৃর্তৃত্ব ও প্রভাব এমনভাবে নির্মূল হয়ে গেলো যে, পরবর্তী দু’হাজার বছর পর্যন্ত ইহুদীরা আর মাথা উঁচু করার সুযোগ পেলো না। জেরুশালেমের পবিত্র হাইকেলও আর কোনদিন নির্মিত হতে পারেনি। পরবর্তীকালে কাইসার হিড্রিয়ান এ নগরীতে পুনরায় জনবসতি স্থাপন করে কিন্তু তখন এর নাম রাখা হয় ইলিয়া। আর এ ইলিয়া নগরীতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত ইহুদীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। দ্বিতীয় মহাবিপর্যয়ের অপরাধে ইহুদীরা এ শাস্তি লাভ করে।
মানচিত্র—- মুকাবিয়া শাসন আমলের ফিলিস্তিন (৯ নং টীকা) (খৃষ্টপূর্ব ১৬৮-৬২)
মানচিত্র—— মহান হিরোদ সাম্রাজ্য (খৃষ্টপূর্ব ৪০-৪০)
মানচিত্র——- হযরত ঈসার (আ) আমলে ফিলিস্তিন
# এ থেকে এ ধারণা করা ঠিক নয় যে, বনী ইসরাঈলদেরকে উদ্দেশ্য করে এ সমগ্র ভাষণটি দেয়া হয়েছে। সম্বোধন তো করা হয়েছে মক্কার কাফেরদেরকে। কিন্তু তাদেরকে সতর্ক করার জন্য এখানে বনী ইসরাঈলদের ইতিহাস থেকে কয়েকটি শিক্ষাপ্রদ সাক্ষ্য প্রমাণ পেশ করা হয়েছিল, তাই একটি প্রসঙ্গ কথা হিসেবে বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছে, যাতে এক বছর পরে মদীনায় সংস্কারমূলক কার্যাবলী প্রসঙ্গে যেসব ভাষণ দিতে হবে এটি তার ভূমিকা হিসেবে কাজ করতে পারে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*বনী ইসরাইলের পতনের কারণ : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম এবং ওই কিতাবকে বানিয়েছিলাম বনী ইসরাঈলের হেদায়াতের উৎস'(আয়াত ২-৮) বনি ইসরাঈলের ইতিহাসের এ অধ্যায়টা সমগ্র কোরআনে শুধু এই সূরাতেই আলােচিত হয়েছে। এই সূরায় বনী ইসরাঈলের রাষ্ট্রীয় শক্তির পতনের বিবরণও দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, উত্থান পতনের যে অমোঘ নিয়ম আল্লাহর সৃষ্টি জগতে আবহমানকালব্যাপী চালু রয়েছে, সেই নিয়মের অধীন দুনিয়ার সকল জাতির পতনের মূল কারণ হলাে তার নৈতিক অধপতন ও চারিত্রিক বিপর্যয়। আর একটু সামনে অগ্রসর হয়ে বিষয়টা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, ‘আল্লাহ যখন কোনাে মানব গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাদের মধ্যকার বিত্তশালীদের দুর্নীতি ও বিপথগামীতাকে তাদের ধ্বংস ও পতনের কারণে পরিণত করেন। এ অধ্যায়ে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েহে হযরত মূসা(আ.)-এর কাছে অবতীর্ণ আসমানী কিতাব তাওরাত এবং ওই কিতাবে বনী ইসরাঈলকে প্রদত্ত হুশিয়ারী। অতপর তাদের মহান পূর্ব পুরুষ পরম কৃতজ্ঞ বান্দা হযরত নূহ(আ.) ও তার সাথে নৌকায় আরােহী মােমেনদের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন,’আর আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম…(শুনে রাখো যে) নূহ একজন কৃতজ্ঞ বান্দা ছিলাে'(আয়াত ২-৩) উল্লেখিত হুঁশিয়ারী এবং এই স্মারক বক্তব্য আল্লাহর সেই প্রতিশ্রুতিরই বাস্তব রূপ, যা এই সূরার কিছু পরে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিশ্রুতি হলাে, ‘আল্লাহ যতোক্ষণ কোনাে জাতির কাছে রসূল না পাঠান এবং সেই রসূল তাদেরকে পূর্বদের পরিণতি স্মরণ না করান ও সতর্ক না করেন, ততােক্ষণ তাদের ধ্বংস করেন না।’ মূসা(আ.)-কে কিতাব দেয়ার প্রথম উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে ‘বনী ইসরাঈলের হেদায়াতের উপকরণ এবং (বলেছিলাম যে) আমাকে ছাড়া আর কাউকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করাে না।’ অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে ওপর নির্ভর এবং আর কারাে কাছে নতি স্বীকার করে না। এটাই হলাে হেদায়াতের পথ এবং এটাই ঈমানের দাবি। অতপর যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কাউকে অভিভাবক মানে সে ঈমানদারও নয়, হেদায়াতপ্রাপ্তও নয়। আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলকে তাদের সেসব পিতৃ পুরুষের নামে সম্বােধন করেছেন, যাদেরকে তিনি নূহ(আ.)-এর নৌকার আরােহী বানিয়েছিলেন। পৃথিবীতে প্রেরিত প্রথম রসূলের আমলে তারাই ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর একমাত্র মানব গােষ্ঠী। আল্লাহ তায়ালা তাদের নামে সম্বােধন করার মাধ্যমে বনী ইসরাঈলকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের পূর্ব পুরুষদেরকে তাঁর পরম কৃতজ্ঞ বান্দা নূহের একনিষ্ঠ সাথী ও অনুসারী বানিয়েছিলেন এবং বনী ইসরাঈল সেই পূত পবিত্র মােমেন বান্দাদেরই বংশধর। হযরত নূহ(আ.)-কে বান্দা হিসাবে উল্লেখ করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলাে আল্লাহর প্রিয় রসূলদের সাথে তার সমন্বয় সাধন। ইতিপূর্বে এই বিশেষণে বিশেষিত করেছেন মােহাম্মদ(স.)-কেও। বস্তুত এ হচ্ছে কোরআনের সেই সময় প্রক্রিয়া, যা এ সূরায় কার্যকরী রয়েছে। বনী ইসরাঈলের হেদায়াতের উৎস হিসাবে হযরত মূসা(আ.)-কে আল্লাহর দেয়া সেই কিতাব তাদেরকে জানিয়েছে যে, তাদের অনাচার অত্যাচার ও দুর্নীতির কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বিধ্বস্ত করে দেয়ার ফয়সালা করেছেন। এই অনাচার ও দুর্গতি দু’বার দেখা দেয়ার কারণে তাদের পতনও দু’বার ঘটানাে হয়েছে। সেই সাথে তাদেরকে হুশিয়ার করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে তারা পুনরায় যখনই বিপর্যয় ও অনাচার ছড়াবে, তখনই পুনরায় তাদের অনুরূপ পরিণতি ঘটানাে হবে। কেননা এ ব্যাপারে আল্লাহর অমােঘ নিয়ম চালু রয়েছে, যার কখনাে রদবদল হয় না। আমি (তাওরাত) কিতাবে বনী ইসরাঈল সম্পর্কে এ সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেছি যে, ‘তােমরা পৃথিবীতে অবশ্যই দু’বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তােমরা অবশ্যই বিরাট বিজয় লাভ করবে।’ এই সিদ্ধান্ত ঘােষণার অর্থ হলাে, বনী ইসরাঈলের পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নির্ভুল জ্ঞানের ভিত্তিতে পূর্বাভাস দিচ্ছেন। এই ঘােষণা দ্বারা তিনি তাদেরকে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে বাধ্য করছেন না এবং এই ঘােষণা থেকে তাদের কার্যকলাপও তৈরী হচ্ছে না, কেননা আল্লাহ তায়ালা তার কোনাে বান্দাকে বিপর্যয় সৃষ্টিতে বাধ্য করেন না। সূরা আ’রাফে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তুমি বলে দাও যে, আল্লাহ তায়ালা কোনাে খারাপ কাজ করতে নির্দেশ দেন । বস্তুত যে ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটবে বলে আল্লাহ তায়ালা জানেন, সেটাই তিনি আমাদেরকে জানান। আর আল্লাহ তায়ালা যা ঘটবে বলে জানেন, তা ঘটবেই, চাই মানুষের জানামতে তা এখনাে পর্যন্ত না ঘটে থাকুক এবং সে সম্পর্কে কিছুই জানা না থাকুক। হযরত মূসা(আ.)-কে প্রদত্ত কিতাবে আল্লাহ তায়ালা বনী ইসরাঈলের জন্যে এরূপ ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন যে, তারা দু’বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং পবিত্র স্থানে তারা বিজয়ী ও কর্তৃত্বশীল হবে। আর যখনই তারা বিজয়ী ও কর্তৃত্বশীল হবে এবং সেই কর্তৃত্বকে দেশে বিপর্যয়, দুর্নীতি ও অনাচারের বিস্তার ঘটানাের জন্য ব্যবহার করবে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে এমন লােকদেরকে আধিপত্য দান করবেন, যারা তাদের ওপর নিপীড়ণ চালাবে, তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে পদদলিত করবে এবং তাদেরকে ধ্বংস করে ছাড়বে। যখন আমার প্রথম বিপর্যয়ের প্রতিশ্রুতির সময় এসে যেতাে, তখন আমি তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিতাম আমার অত্যন্ত শক্তিশালী বান্দাদেরকে…'(আয়াত ৫) বস্তুত প্রথম বিপর্যয়টা ঘটবে এভাবে যে, তারা পবিত্র ভূমিতে কর্তৃত্ব লাভ করবে, ক্ষমতা ও আধিপত্যের অধিকারী হবে, অতপর সেখানে অনাচার ও দুর্নীতি ছড়াবে, তখন আল্লাহ তায়ালা তার পরাক্রমশালী ও প্রতাপশালী বান্দাদেরকে পাঠাবেন, যারা তাদের বাড়ীঘর দখল করবে, ঔদ্ধত্য সহকারে চলাফেরা করবে এবং সেখানকার অধিবাসী ও সহায় সম্পদের ওপর লুন্ঠন ও নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাবে। এবং প্রতিশ্রুতি পালিত হবে। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি মিথ্যা সাব্যস্ত হবে না এবং তার বরখেলাপ কিছু করা হবে না। এভাবে বনী ইসরাঈল যখন হানাদার যালেম শাসকদের নিষ্ঠুর নির্যাতনে, লাঞ্ছনায় গঞ্জনায় ও অপমানে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতাে, তাদের ওপর চেপে বসা বিপদ মুসিবতের দরুন অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতাে, আত্মশুদ্ধি করতাে, অপরদিকে হানাদাররা বিপর্যয় সৃষ্টি করতো এবং ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে চরম স্বেচ্ছাচারীর ভূমিকায় অবর্তীণ হতাে, তখন আল্লাহ তায়ালা পরাজিতদের পক্ষ হয়ে বিজয়ীদের কাছ থেকে প্রতিশােধ নিতেন এবং দাম্ভিক হানাদারদেরকে পর্যুদস্ত করে হীনবল পরাজিত পক্ষকে পুনরায় পরাক্রান্ত ও বিজয়ী করে দিতেন। ‘পুনরায় আমি তােমাদের দিন ফিরিয়ে দিতাম এবং জনবল ও ধনবল দিয়ে তােমাদেরকে সাহায্য করতাম….'(আয়াত ৬) এভাবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতাে। অবশিষ্ট নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা সাধনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বিবরণ দেয়ার আগে আল্লাহর কর্মফল সংক্রান্ত চিরন্তন বিধিকে তুলে ধরা হয়েছে পরবর্তী আয়াতে ‘তোমরা যদি ভালাে কাজ করো, তবে তাতে তোমাদেরই লাভ হবে। আর যদি খারাপ কাজ কর তবে তাতে তােমাদেরই ক্ষতি হবে। এই ফল বিধি এমন এক বিধি, যা দুনিয়া ও আখেরাতের কোথাও পরিবর্তিত হয় না।’ এ বিধি মানুষের যাবতীয় তৎপরতাকে তার সমস্ত ফল ও ফসল সমেত মানুষের নিজের জন্যেই দির্দিষ্ট করে দেয়, ফলাফলকে কাজের স্বাজবিক ফল গণ্য করে এবং মানুষকে তার নিজের যাবতীয় কাজের জন্যে দায়ী করে। সে ইচ্ছা করলেই নিজের উপকার অথবা ক্ষতি সাধন করতে পারে। কাজেই সে যখন তার নিজের কাজের ফল ভােগ করে, তখন তার নিজেকেই তিরস্কার করা উচিত, অন্য কাউকে নয়।
# *বনী ইসরাঈলের দ্বিতীয় বিপর্যয় : কর্মফলনীতিটা তুলে ধরার পর পরবর্তী আয়াতে পুনরায় ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। ‘অতঃপর যখন শেষ প্রতিশ্রুতি সমাগত হলাে, যাতে হানাদাররা তােমাদের মুখে কালিমা লেপন করে…'(আয়াত ৭) দ্বিতীয়বার বনী ইসরাঈল ক্ষমতা ও আধিপত্য লাভ করার পর যে বিপর্যয় ও অনাচার ছড়ালাে, তার উল্লেখ এখানে করা হয়নি। কেননা ইতিপূর্বে দু’বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তা থেকেই এটা বুঝা যায়। এ দ্বারা তাদের ওপর পুনরায় যে যালেম হানাদারদের শাসন চেপে বসে তাও প্রমাণিত হয়। ‘তারপর যখন শেষ প্রতিশ্রুতি সময় সমাগত হলাে, যাতে হানাদাররা তােমাদের মুখে কালিমা লেপন করে…’ অর্থাৎ তােমাদের ওপর নানাভাবে অত্যাচার চালাবে এবং তােমাদের পবিত্র স্থানসমূহের অবমাননা করবে। ‘আর প্রথমবারের মতােই মসজিদে প্রবেশ করবে, এবং তাদের দখলীকৃত জনপদ ও সহায় সম্পদকে ধ্বংস করবে।’ এখানে হানাদারদের হাতে সাধিত সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের ছবিই ফুটে উঠেছে। এই ভবিষ্যদ্বাণী ও প্রতিশ্রুতি যথার্থই পূর্ণ হয়েছিলাে। প্রথমবারে বনী ইসরাঈলের ওপর স্বৈরাচারী একনায়ক শাসক জেঁকে বসে। দ্বিতীয়বার যারা জেঁকে বসে তারা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে এবং তাদের রাজ্যকে পুরাে মাত্রায় বিধ্বস্ত করে। কোরআন বনী ইসরাঈলের ওপর জেঁকে বসা এই শাসকদের পরিচয় দেয়নি। কেননা পরিচয়ের ভেতরে বাড়তি কোনাে শিক্ষা নেই। শিক্ষাটাই হচ্ছে এখানে কাংখিত বিষয়। সৃষ্টি জগতে আল্লাহর নির্ধারিত উত্থান পতনের বিধান কী, সেটাই এখানে মূল আলােচ্য বিষয়। সত্য প্রমাণিত ভবিষ্যদ্বাণী ও বাস্তবায়িত প্রতিশ্রুতির মন্তব্য করে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, এই ধ্বংসযজ্ঞ ও তােমাদের জন্যে করুণায় পর্যবসিত হতে পারে যদি তােমরা তা থেকে শিক্ষা নাও। ‘তােমাদের প্রভু তােমাদের ওপর করুণা বর্ষণ করতে পারেন।’ আর বনী ইসরাঈল আবার আগের মতাে আচরণ করলে আল্লাহ আবার শান্তি দিতে পারেন। আর যদি তােমরা প্রত্যাবর্তন করাে তবে আমিও প্রত্যাবর্তন করবে। বনী ইসরাইল বাস্তবিক পক্ষেই তাদের সাবেক অপকর্ম ও অনাচারের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিলাে এবং তার বদলায় আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর মুসলমানদেরকে চাপিয়ে দেন। মুসলমানরা তাদেরকে সমগ্র আরব উপদ্বীপ থেকে বিতাড়িত করে ছেড়েছিলাে। এরপর আবারাে তারা অপকর্মের পুনরাবৃত্তি করে। ফলে যুগে যুগে তাদের ওপর বিভিন্ন নিষ্ঠুর শাসকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। আধুনিককালে তাদের ওপর নেমে আসে হিটলারের পৈশাচিক অত্যাচার। এরপরও তারা পুনরায় বিপর্যয় ছড়াতে আরম্ভ করেছে। ‘ইসরাঈল’ নামক রাষ্ট্রের মাধ্যমে তারা আসল আরব অধিবাসীদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে। এর বদল তারা অবশ্যই পাবে। (ইসরাঈল রাষ্ট্র জন্ম নেয়ার পর আটান্ন বছর অতিবাহিত হতে চললাে। এ সামান্য সময়ের মধ্যে তাদের লম্ফ ঝম্ফ দেখে এটা মনে করা উচিত নয় যে আল্লাহর ওয়াদা সত্য নয়। আল্লাহর এই ওয়াদার সততা দেখার জন্যে আমাদের আরাে কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে এই যা!-সম্পাদক) তাদের ওপর আবারাে এমন কোনাে শাসন চেপে বসবে, যা আল্লাহর অকাট্য ওয়াদা ও অমােঘ প্রাকৃতিক বিধি অনুসারে তাদের নিষ্ঠুরতম শাস্তি দেবে। তাদের এ পরিণতির বাস্তবরূপ লাভ করতে বেশী দেরী নেই। আয়াতের শেষাংশে আখেরাতে কাফেরদের কী পরিণতি হবে তা তুলে ধরা হয়েছে। কেননা তাদের পরিণতিও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বনি ইসরাঈলের মেয়ে। আর আমি জাহান্নামকে বানিয়েছি কাফেরদের খোয়াড়। এই খোয়াড়ে তাদেরকে আটক রাখা হয়। ফলে কেউ বেরুতে পারে না। বনি ইসরাঈলের ইতিহাসের এই পর্বটা এবং তাদের হেদায়াতের জন্যে মূসা(আ.)-এর কাছে প্রেরিত তাদের কিতাব ও ওই কিতাবের অবাধ্যতাবশত তাদের গােমরাহ ও ধ্বংসের প্রসংগ আলােচনার পর কোরআন সম্পর্কে আলােচনা এসে গেছে পরবর্তী আয়াতে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪-৮ নং আয়াতের তাফসীর
বাণী ইসরাঈলের উপর যে, কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল তাতেই আল্লাহ তাআলা তাদেরকে প্রথম থেকেই খবর দিয়েছিলেন যে, তারা যমীনে দু’বার হঠকারিতা করবে এবং ঔদ্ধত্যপণা দেখাবে এবং কঠিন হাঙ্গামা সৃষ্টি করবে। সুতরাং এখানে (আরবি) শব্দের অর্থ হচ্ছে নির্ধারণ করা এবং প্রথম থেকেই খবর দিয়ে দেয়। যেমন (আরবি) (১৫:৬৬) এই আয়াতে (আরবি) এর অর্থ এটাই। আল্লাহপাক বলেনঃ তাদের প্রথম হাঙ্গামার সময় আমি আমার মাখলুকের মধ্য হতে ঐ লোকদের আধিপত্য তাদের উপর স্থাপন করি যারা খুব বড় যোদ্ধা এবং বড় বড় যুদ্ধাস্ত্রের অধিকারী। তারা তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, তাদের শহর দখল করে নেয় এবং লুটপাট করে তাদের ঘর গুলিকে শূন্য করে দিয়ে নির্ভয়ে ও নির্বিবাদে ফিরে যায়। আল্লাহ তাআলার ওয়াদা পূর্ণ হওয়ারও ছিল। কথিত আছে যে, তারা ছিল বাদশাহ জালুতের সেনাবাহিনী। তারপর আল্লাহ তাআলা বাণী ইসরাঈলকে সাহায্য করেন এবং তারা হযরত তালূতের মাধ্যমে আবার জা’তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। হযরত দাউদ (আঃ) বাদশাহ জালূতকে হত্যা করেন।
এটাও বলা হয়েছে যে, মূসিলের বাদশাহ সাখারীব এবং তার সেনাবাহিনী বাণী ইসরাঈলের উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। কেউ কেউ বলেন যে, বাবেলের বাখতে নাসর তাদেরকে আক্রমণ করেছিল। ইবনু আবি হাতিম (রঃ) এখানে একটি বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, এই লোকটি (বাখতে নাসর) কিভাবে ধীরে ধীরে উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করেছিল। প্রথমে সে একজন ভিক্ষুক ছিল। ভিক্ষা করে সে কালাতিপাত করতো। পরে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সে জয় করে ফেলে এবং সেখানে নৃশংস ভাবে সে বাণী ইসরাঈলকে হত্যা করে।
ইমাম ইবনু জারীর (রাঃ) এই আয়াতের তাফসীরে একটি সুদীর্ঘ মার’ হাদীস বর্ণনা করেছেন যা মাওযূ’ (বানানো) ছাড়া কিছুই নয়। ওটা মাওযূ’ হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহের লেশমাত্র নেই। এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কেমন করে ইমাম ইবনু জারীর (রাঃ) এই মাও’ হাদীস আনয়ন করেছেন। আমার উস্তাদ শায়েখ হাফিয আ’ল্লামা আবুল হাজ্জাজ (রঃ) এই হাদীসটির মাওযূ হওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং কিতাবের হা’শিয়াতেও অনেক রিওয়াইয়াত রয়েছে, কিন্তু আমরা অযথা ওগুলো আনয়ন করে আমাদের কিতাবের কলেবর বৃদ্ধি করতে চাইনে। কেননা, এগুলির কিছু কিছু তো মাওযূ’ আর কতকগুলি এরূপ না হলেও ওগুলো আনয়নে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহ তাআলার কিতাবই আমাদেরকে অন্যান্য কিতাব থেকে বেপরোয়া করেছে। আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের (সঃ) হাদীস সমূহ আমাদেরকে ঐ সব কিতাবের মুখাপেক্ষী করেনি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।
ভাবার্থ শুধু এটাই যে, বাণী ইসরাঈলের ঔদ্ধত্যপণা ও হঠকারিতার সময় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর তাদের শত্রুদের আধিপত্য স্থাপন করেন, তাদেরকে উত্তমরূপে তাদের দুষ্কার্যের মজা চাখিয়ে দেন। ফলে তাদের দুর্গতির কোন শেষ থাকে নাই। তারা তাদের শিশু সন্তানদের কচু কাটা করে। তারা তাদেরকে এমনভাবে লাঞ্ছিত করে যে, তাদের ঘরেই তারা প্রবেশ করে এবং তাদের সর্বনাশ সাধন করে এবং তাদের হঠকারিতার পূর্ণ শাস্তি দেয়।
বাণী ইসরাঈলও কিন্তু জুলুম ও বাড়াবাড়ী করতে এতটুকুও ত্রুটি করে নাই। সাধারণ লোক তো দুরের কথা, নবীদেরকে হত্যা করতেও তারা ছাড়ে নাই। বহু আলেমকেও তারা হত্যা করে ফেলেছিল। বাখতে নাসর সিরিয়ার উপর আধিপত্য লাভ করে। সে বায়তুল মুকাদ্দাসকে ধ্বংস করে দেয়, তথাকার অধিবাসীদেরকে হত্যা করে। তারপর সে দামেশকে পৌঁছে। সেখানে সে দেখে যে, একটি কঠিন পাথরের উপর রক্ত উৎসারিত হচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করেঃ “এটা কি?” জনগণ উত্তরে বলেনঃ “এই খুন বা রক্ত বরাবরই উৎসারিত হতেই থাকে, কোন সময়েই বন্ধ হয় না।”
সে তখন সেখানেই সাধারণ হত্যা শুরু করে দেয়। সত্তর হাজার মুসলমান তার হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়। এ সময় ঐ রক্ত বন্ধ হয়ে যায়। সে। আলেমদেরকে, হাফেজদেরকে এবং সমস্ত সম্মানিত লোককে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। সেখানে তাওরাতের কোন হাফিজ বাকী থাকেন নাই। তারপর সে বন্দী করতে শুরু করে। এ বন্দীদের মধ্যে নবীদের ছেলেরাও ছিলেন। মোট কথা, এক ভয়াবহ হাঙ্গামা হয়ে যায়। কিন্তু সহীহ রিওয়াইয়াত দ্বারা অথবা সহীহ’র কাছাকাছি রিওয়াইয়াত দ্বারা কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, তাই আমরা এগুলো ছেড়ে দিয়েছি। এইসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ যারা সৎ কাজ করে তারা নিজেদেরই লাভ করে, আর যারা খারাপ করে তারাও নিজেদেরই ক্ষতি করে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যে ভাল কাজ করে তা সে নিজের উপকারের জন্যেই করে, পক্ষান্তরে যে খারাপ কাজ করে ওর ফল তাকেই ভোগ করতে হয়।”
তারপর যখন দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতির সময় আসলো এবং পুনরায় বাণী ইসরাঈল আল্লাহ তাআলার অবাধ্যাচরণ ও মন্দ কাজে উঠে পড়ে লেগে গেল, আর নির্লজ্জভাবে জুলুম করতে শুরু করে দিলো, তখন আবার শত্রুরা তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়লো। তারা তাদের চেহারা বদলিয়ে এবং যেভাবে পূর্বে বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদকে নিজেদের দখলে এনে ফেলেছিল, আবারও তাই করলো। সাধ্যমত তারা সব কিছুরই সর্বনাশ সাধন করলো সুতরাং আল্লাহ তাআলার দ্বিতীয় ওয়াদাও পূর্ণ হয়ে গেল।
মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমাদের প্রতিপালক তো পরম দয়ালু বটেই। সুতরাং তার থেকে নিরাশ হওয়া মোটেই শোভনীয় নয়। খুব সম্ভব, তিনি পুনরায় তোমাদের শত্রুদেরকে তোমাদের পদানত করে দিবেন। হাঁ, তবে তোমাদের এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, আবারও যদি তোমরা তোমাদের পূর্ব আচরণের পুনরাবৃত্তি কর তবে তিনিও তার আচরণের পুনরাবৃত্তি করবেন। আর এতো হলো পার্থিব শাস্তি। এখনো পরকালের ভীষণ ও চিরস্থায়ী শাস্তি বাকী রয়েছে। জাহান্নাম কাফিরদের কয়েদখানা, যেখান থেকে তারা বের হতেও পারবে না এবং পালাতেও পারবে না। সব সময় তাদেরকে এ শাস্তির মধ্যে। পড়ে থাকতে হবে। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ আবার তারা মস্তক উত্তোলন। করে, আল্লাহর ফরমানকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগে যায়। ফলে আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মদের (সঃ) উম্মতকে তাদের উপর বিজয়ী করে দেন এবং লাঞ্ছিত অবস্থায় তাদেরকে জিযিয়া কর দিয়ে মুসলমানদের অধীনে থাকতে হয়।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 831)
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Al- Boni Israyel
Sura: 17
Verses :- 04-08
[ لَتُفْسِدُنَّ فِي الَارْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا
“Indeed you would do mischief in the land twice and you will become tyrants and extremely arrogant!” ]
www.motaher21.net
وَ قَضَیۡنَاۤ اِلٰی بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ فِی الۡکِتٰبِ لَتُفۡسِدُنَّ فِی الۡاَرۡضِ مَرَّتَیۡنِ وَ لَتَعۡلُنَّ عُلُوًّا کَبِیۡرًا ﴿۴﴾
And We conveyed to the Children of Israel in the Scripture that, “You will surely cause corruption on the earth twice, and you will surely reach [a degree of] great haughtiness.
فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ اُوۡلٰىہُمَا بَعَثۡنَا عَلَیۡکُمۡ عِبَادًا لَّنَاۤ اُولِیۡ بَاۡسٍ شَدِیۡدٍ فَجَاسُوۡا خِلٰلَ الدِّیَارِ ؕ وَ کَانَ وَعۡدًا مَّفۡعُوۡلًا ﴿۵﴾
So when the [time of] promise came for the first of them, We sent against you servants of Ours – those of great military might, and they probed [even] into the homes, and it was a promise fulfilled.
ثُمَّ رَدَدۡنَا لَکُمُ الۡکَرَّۃَ عَلَیۡہِمۡ وَ اَمۡدَدۡنٰکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّ بَنِیۡنَ وَ جَعَلۡنٰکُمۡ اَکۡثَرَ نَفِیۡرًا ﴿۶﴾
Then We gave back to you a return victory over them. And We reinforced you with wealth and sons and made you more numerous in manpower.
اِنۡ اَحۡسَنۡتُمۡ اَحۡسَنۡتُمۡ لِاَنۡفُسِکُمۡ ۟ وَ اِنۡ اَسَاۡتُمۡ فَلَہَا ؕ فَاِذَا جَآءَ وَعۡدُ الۡاٰخِرَۃِ لِیَسُوۡٓءٗا وُجُوۡہَکُمۡ وَ لِیَدۡخُلُوا الۡمَسۡجِدَ کَمَا دَخَلُوۡہُ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّ لِیُتَبِّرُوۡا مَا عَلَوۡا تَتۡبِیۡرًا ﴿۷﴾
[And said], “If you do good, you do good for yourselves; and if you do evil, [you do it] to yourselves.” Then when the final promise came, [We sent your enemies] to sadden your faces and to enter the temple in Jerusalem, as they entered it the first time, and to destroy what they had taken over with [total] destruction.
عَسٰی رَبُّکُمۡ اَنۡ یَّرۡحَمَکُمۡ ۚ وَ اِنۡ عُدۡتُّمۡ عُدۡنَا ۘ وَ جَعَلۡنَا جَہَنَّمَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ حَصِیۡرًا ﴿۸﴾
[Then Allah said], “It is expected, [if you repent], that your Lord will have mercy upon you. But if you return [to sin], We will return [to punishment]. And We have made Hell, for the disbelievers, a prison-bed.”
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book# 831)
English Tafsir:-
Tafsir Ibn Kathir:-
Sura:- Al- Boni Israyel
Sura: 17
Verses :- 04-08
[ لَتُفْسِدُنَّ فِي الَارْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا
“Indeed you would do mischief in the land twice and you will become tyrants and extremely arrogant!” ]
www.motaher21.net
It was mentioned in the Tawrah that the Jews would spread Mischief twice
Allah tells;
وَقَضَيْنَا إِلَى بَنِي إِسْرَايِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الَارْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا
And We decreed for the Children of Israel in the Scripture:”Indeed you would do mischief in the land twice and you will become tyrants and extremely arrogant!”
Allah tells us that He made a declaration to the Children of Israel in the Scripture, meaning that He had already told them in the Book which He revealed to them, that they would cause mischief on the earth twice, and would become tyrants and extremely arrogant, meaning they would become shameless oppressors of people, Allah says:
وَقَضَيْنَأ إِلَيْهِ ذَلِكَ الاٌّمْرَ أَنَّ دَابِرَ هَـوُلاْءِ مَقْطُوعٌ مُّصْبِحِينَ
And We made known this decree to him, that the root of those (sinners) was to be cut off in the early morning. (15:66),
meaning, We already told him about that and informed him of it.
The First Episode of Mischief caused by the Jews, and their Punishment for it
Allah tells
فَإِذَا جَاء وَعْدُ أُولاهُمَا
So, when the promise came for the first of the two,
meaning the first of the two episodes of mischief.
بَعَثْنَا عَلَيْكُمْ عِبَادًا لَّنَا أُوْلِي بَأْسٍ شَدِيدٍ
We sent against you servants of Ours given to terrible warfare.
means, `We unleashed soldiers against you from among Our creatures who were given to terrible warfare,’ i.e., they had great strength and weapons and power.
فَجَاسُواْ خِلَلَ الدِّيَارِ
They entered the very innermost parts of your homes.
meaning they took possession of your land and invaded the very innermost parts of your homes, going between and through your houses, coming and going freely with no fear of anyone.
وَكَانَ وَعْدًا مَّفْعُولاً
And it was a promise (completely) fulfilled.
The earlier and later commentators differed over the identity of these invaders.
Many Israiliyyat (reports from Jewish sources) were narrated about this, but I did not want to make this book too long by mentioning them, because some of them are fabricated, concocted by their heretics, and others may be true, but we have no need of them, praise be to Allah.
What Allah has told us in His Book (the Qur’an) is sufficient and we have no need of what is in the other books that came before. Neither Allah nor His Messenger required us to refer to them.
Allah told His Messenger that when (the Jews) committed transgression and aggression, Allah gave their enemies power over them to destroy their country and enter the innermost parts of their homes. Their humiliation and subjugation was a befitting punishment, and your Lord is never unfair or unjust to His servants. They had rebelled and killed many of the Prophets and scholars.
Ibn Jarir recorded that Yahya bin Sa`id said:”I heard Sa`id bin Al-Musayyib saying:
`Nebuchadnezzar conquered Ash-Sham (Greater Syria, including Palestine), destroying Jerusalem and killing them, then he came to Damascus and found blood boiling in a censer.
He asked them:What is this blood?
They said:We found our forefathers doing this.
Because of that blood, he killed seventy thousand of the believers and others, then the blood stopped boiling.
This report is Sahih from Sa`id bin Al-Musayyib, and this event is well-known, as he (Nebuchadnezzar) killed their nobles and scholars, and did not leave alive anyone who knew the Tawrah by heart. He took many prisoners from the sons of the Prophets and others, and did many other things that would take too long to mention here. If we had found anything that was correct or close enough, we could have written it and reported it here. And Allah knows best.
ثُمَّ رَدَدْنَا لَكُمُ الْكَرَّةَ عَلَيْهِمْ وَأَمْدَدْنَاكُم بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَجَعَلْنَاكُمْ أَكْثَرَ نَفِيرًا
Then We gave you a return of victory over them. And We helped you with wealth and children and made you more numerous in manpower.
Then Allah says
إِنْ أَحْسَنتُمْ أَحْسَنتُمْ لاَِنفُسِكُمْ وَإِنْ أَسَأْتُمْ فَلَهَا
(And We said):”If you do good, you do good for your own selves, and if you do evil (you do it) against yourselves.”
As Allah says elsewhere:
مَّنْ عَمِلَ صَـلِحاً فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَأءَ فَعَلَيْهَا
Whosoever does a righteous good deed, it is for (the benefit of) himself; and whosoever does evil, it is against himself. (45:15)
The Second Episode of Mischief
Then Allah says:
فَإِذَا جَاء وَعْدُ الاخِرَةِ
Then, when the second promise came to pass,
meaning, the second episode of mischief, when your enemies came again,
لِيَسُووُواْ وُجُوهَكُمْ
(We permitted your enemies) to disgrace your faces,
meaning, to humiliate you and subdue you,
وَلِيَدْخُلُواْ الْمَسْجِدَ
and to enter the Masjid,
meaning, Bayt Al-Maqdis (Jerusalem).
كَمَا دَخَلُوهُ أَوَّلَ مَرَّةٍ
as they had entered it before,
when they entered the very innermost parts of your homes.
وَلِيُتَبِّرُواْ
and to destroy,
wrecking and inflicting ruin upon it.
مَا عَلَوْاْ
all that fell in their hands.
everything they could get their hands on.
تَتْبِيرًا
عَسَى رَبُّكُمْ أَن يَرْحَمَكُمْ
with utter destruction. It may be that your Lord may show mercy unto you,
meaning that He may rid you of them.
وَإِنْ عُدتُّمْ عُدْنَا
but if you return (to sins), We shall return (to Our punishment).
meaning, if you return to causing mischief,
عُدْنَا
(We shall return) means,
We `will once again punish you in this world, along with the punishment and torment We save for you in the Hereafter.’
وَجَعَلْنَا جَهَنَّمَ لِلْكَافِرِينَ حَصِيرًا
And We have made Hell a prison (Hasir) for the disbelievers.
meaning, a place of permanent detention, a prison which cannot be avoided or escaped.
Ibn Abbas said,
“Hasir here means a jail.”
Mujahid said,
“They will be detained in it.”
Others said like- wise.
Al-Hasan said,
“Hasir means a bed of Fire.”
Qatadah said:
“The Children of Israel returned to aggression, so Allah sent this group against them, Muhammad and his companions, who made them pay the Jizyah, with willing submission, and feeling themselves subdued.