أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৪১) [তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন =:-৪]
সুরা: আল্ বনি ইসরাইল
সুরা:১৭
২৯-৩০ নং
[ وَ لَا تَجۡعَلۡ یَدَکَ مَغۡلُوۡلَۃً اِلٰی عُنُقِکَ
তুমি বদ্ধমুষ্টি হয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না;]
www.motaher21.net
وَ لَا تَجۡعَلۡ یَدَکَ مَغۡلُوۡلَۃً اِلٰی عُنُقِکَ وَ لَا تَبۡسُطۡہَا کُلَّ الۡبَسۡطِ فَتَقۡعُدَ مَلُوۡمًا مَّحۡسُوۡرًا ﴿۲۹﴾
তুমি বদ্ধমুষ্টি হয়ো না এবং একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না; হলে তুমি তিরস্কৃত ও অনুতপ্ত (নিঃস্ব) হয়ে পড়বে।
اِنَّ رَبَّکَ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ اِنَّہٗ کَانَ بِعِبَادِہٖ خَبِیۡرًۢا بَصِیۡرًا ﴿٪۳۰﴾
তোমার প্রতিপালক যার জন্য ইচ্ছা তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন এবং যার জন্য ইচ্ছা তা হ্রাস করেন; নিশ্চয় তিনি তাঁর দাসদেরকে ভালভাবে জানেন ও দেখেন।
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বের আয়াতে গরীব-দুঃখীদেরকে দান করার সামর্থ্য না থাকলে ওজর পেশ করার ও বিদায় দেয়ার আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ব্যয় করার নীতি ও আদব শিক্ষা দিচ্ছেন। ব্যয় করার ক্ষেত্রে এমন কৃপণতা করবে না যে, নিজ ও পরিবারের ভরণ-পোষণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করতে ইতস্ততবোধ কর। আবার এমন মুক্ত হস্তে দান ও ব্যয় করো না যে, নিজের সামর্থের দিকে লক্ষ্য থাকে না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন করবে। কারণ কৃপণতা করলে তিরষ্কৃত ও নিন্দার পাত্র হবে আর অপব্যয় করলে অনুতপ্ত, ক্ষতিগ্রস্থ ও শয়তানের ভাই বলে গণ্য হবে। তাই ব্যয় করার ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা মু’মিনের বৈশিষ্ট্য। যেমন
দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার বান্দাদের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَآ أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা আছে এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থায়।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, রিযিক দেয়ার মালিক একমাত্র তিনি, তিনি যাকে খুশি রিযিক প্রসারিত করে দেন আবার যাকে খুশি হ্রাস করে দেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলাই ক্ষমতাবান।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاللّٰهُ يَقْبِضُ وَيَبْصُطُ ص وَإِلَيْهِ تُرْجَعُوْنَ)
“আর আল্লাহ (মানুষের রিযিক) কমান ও বাড়ান এবং তাঁর দিকেই তোমরা ফিরে যাবে।” (সূরা বাকারাহ ২:২৪৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(اَللّٰهُ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَّشَا۬ءُ وَيَقْدِرُ)
“আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা তার জীবনোপকরণ বর্ধিত করেন এবং সংকুচিত করেন।” (রা‘দ ১৩:২৬) তবে যিনি যতটুকু রিযিকের উপযুক্ত তাকে ততটুকই রিযিক দিয়ে থাকেন। অন্যথায় জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি হবে। (সূরা শুরা ৪২:২৭)
অতএব রিযিক দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তাই তাঁর কাছে রিযিক চাইতে হবে। রিযিক শুধু ধন-সম্পদের ভিতর সীমাবদ্ধ নয়, বরং জীবন থেকে মরণ পর্যন্ত যা কিছু রয়েছে সবই রিযিকের শামিল।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কৃপণতা ও সাধ্যাতীত ব্যয় উভয়টা নিন্দনীয় ও বর্জণীয়।
২. মানুষ নিজের সামর্থ্যানুযায়ী ব্যয় করবে, তবে কৃপণতা করবে না।
৩. রিযিক দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
“হাত বাঁধা” একটি রূপককথা। কৃপণতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর “হাত খোলা ছেড়ে দেয়া’র মানে হচ্ছে, বাজে খরচ করা। ৪র্থ ধারার সাথে ৬ষ্ঠ ধারাটির এ বাক্যোংশটি মিলিয়ে পড়লে এর পরিষ্কার অর্থ এই মনে হয় যে, লোকদের মধ্যে এতটুকু ভারসাম্য হতে হবে যাতে তারা কৃপণ হয়ে অর্থের আবর্তন রুখে না দেয় এবং অপব্যয়ী হয়ে নিজের অর্থনৈতিক শক্তি ধ্বংস না করে ফেলে। এর বিপরীত পক্ষে তাদের মধ্যে ভারসাম্যের এমন সঠিক অনুভূতি থাকতে হবে যার ফলে তারা যথার্থ ব্যয় থেকে বিরত হবে না আবার অযথা ব্যয়জনিত ক্ষতিরও শিকার হবে না। অহংকার ও প্রদর্শনেচ্ছামূলক এবং লোক দেখানো খরচ, বিলাসিতা, ফাসেকী ও অশ্লীল কাজে ব্যয় এবং এমন যাবতীয় ব্যয় যা মানুষের প্রকৃত প্রয়োজনেও কল্যাণমূলক কাজে লাগার পরিবর্তে ধন-সম্পদ ভুল পথে নিয়োজিত করে, তা আসলে আল্লাহর নিয়ামত অস্বীকার ছাড়া আর কিছুই নয়। যারা এভাবে নিজেদের ধন-দৌলত খরচ করে তারা শয়তানের ভাই।
এ ধারাগুলোও নিছক নৈতিক শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত হেদায়াত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। বরং এদিকে পরিষ্কার ইঙ্গিত করছে যে, একটি সৎ ও সত্যনিষ্ঠ সমাজকে নৈতিক অনুশীলন, সামষ্টিক চাপ প্রয়োগ ও আইনগত বাধা-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে অযথা অর্থ ব্যয় থেকে বিরত রাখা উচিত। এ কারণেই পরবর্তীকালে মদীনা রাষ্ট্রে বিভিন্ন কার্যকর পদ্ধতিতে এ উভয় ধারা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করা হয়। প্রথমত, অপব্যয় ও বিলাসিতার বহু নীতি প্রথাকে আইনগতভাবে হারাম করা হয়। দ্বিতীয়ত, কৌশল অবলম্বন করে অযথা অর্থ ব্যয়ের পথ বন্ধ করা হয়। তৃতীয়ত, সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে এমন বহু রসম-রেওয়াজের বিলোপ সাধন করা হয় যেগুলোতে অপব্যয় করা হতো। তারপর রাষ্ট্রকে বিশেষ ক্ষমতা বলে এবং বিশেষ ব্যবস্থাপনা বিধান জারী করে সুস্পষ্ট অপব্যয়ের ক্ষেত্রে বাধা ইখতিয়ার দেয়া হয়। এভাবে যাকাত ও সাদকার বিধানের মাধ্যমে কৃপণতার শক্তিতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয় এবং লোকেরা সম্পদ পুঞ্জীভূত করে অর্থের আবর্তনের পথ বন্ধ করে দেবে এ সম্ভাবনা ও নির্মূল করে দেয়া হয়। এসব কৌশল অবলম্বন করার সাথে সাথে সমাজে এমন একটি সাধারণ জনমত সৃষ্টি করা হয়, যা দানশীলতা ও অপব্যয়ের মধ্যকার পার্থক্য সঠিকভাবে জানতো এবং কৃপণতা ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যয়ের মধ্যে ভালভাবেই ফারাক করতে পারতো। এ জনমত কৃপণদেরকে লাঞ্ছিত করে, ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষাকারীদেরকে মর্যাদাশালী করে, অপব্যয়কারীদের নিন্দা করে এবং দানশীলদেরকে সমগ্র সমাজের খোশবুদার ফুল হিসেবে কদর করে। সে সময়ের নৈতিক ও মানসিক প্রশিক্ষণের প্রভাব আজও মুসলিম সমাজে রয়েছে। আজও দুনিয়ার সব দেশেই মুসলমানরা কৃপণ ও সম্পদ পুঞ্জীভূতকারীদেরকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখে এবং দানশীলরা আজও তাদের চোখে সম্মানার্হ ও মর্যাদা সম্পন্ন।
# মহান আল্লাহ নিজের বান্দাদের মধ্যে রিযিক কমবেশী করার ক্ষেত্রে যে পার্থক্য রেখেছেন তার উপযোগিতা বুঝা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই রিযিক বন্টনের যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা রয়েছে কৃত্রিম মানবিক কৌশলের মাধ্যমে তার মধ্যে হস্তক্ষেপ না করা উচিত। প্রাকৃতিক অসাম্যকে কৃত্রিম সাম্যে পরিবর্তিত করা অথবা এ অসাম্যকে প্রাকৃতিক সীমার চৌহদ্দী পার করিয়ে বে-ইনসাফীর সীমানায় পৌঁছিয়ে দেয়া উভয়টিই সমান ভুল। একটি সঠিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবস্থান আল্লাহ নির্ধারিত রিযিক বণ্টন পদ্ধতির নিকটতরই হয়ে থাকে।
এ বাক্যে প্রাকৃতিক আইনের যে নিয়মটির দিকে পথনির্দেশ করা হয়েছিল তার কারণে মদীনার সংস্কার কর্মসূচিতে এ ধারণাটি আদতে কোন ঠাঁই করে নিতে পারেনি যে, রিযিক ও রিযিকের উপায়-উপকরণগুলোর মধ্যে পার্থক্য ও শ্রেষ্ঠত্ব আসলে এমন কোন অকল্যাণকর বিষয় নয়, যাকে বিলুপ্ত করা এবং একটি শ্রেণীহীন সমাজ গঠন করা কোন পর্যায়ে কাংখিত হতে পারে। পক্ষান্তরে সৎকর্মশীলতা ও সদাচারের ভিত্তিতে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বুনিয়াদ কায়েম করার জন্য মদীনা তাইয়েবায় এক বিশেষ কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। সে কর্মপদ্ধতি ছিল এই যে, আল্লাহর প্রকৃতি মানুষের মধ্যে যে পার্থক্য করে রেখেছে তাকে আসল প্রাকৃতিক অবস্থায় অপরিবর্তিত রাখতে হবে এবং ওপরে প্রদত্ত পথনির্দেশনা অনুযায়ী সমাজের নৈতিকতা, আচার-আচরণ ও কর্মবিধানসমূহ এমনভাবে সংশোধন করে দিতে হবে, যার ফলে জীবিকার পার্থক্য ও ব্যবধান কোন জুলুম ও বে-ইনসাফির বাহনে পরিণত হবার পরিবর্তে এমন অসংখ্য নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও তামাদ্দুনিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বাহনে পরিণত হবে, যে জন্য মূলত বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা তাঁর বান্দাদের মধ্যে এ পার্থক্য ও ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছেন।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
অপচয় ও অপব্যয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার পর প্রসংগত যাবতীয় ব্যয় সাপেক্ষ কাজে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তােমার হাত ঘাড়ের ওপর তুলে রেখাে না, আবার হাতকে পুরােপুরি প্রসারিতও করাে না। তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও অক্ষম হয়ে বসে পড়বে।’ ভারসাম্যতা হচ্ছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। উগ্রতা ও চরম ভাবাপন্নতা যেমন ভারসাম্যকে ব্যাহত করে, তেমনি ঢিলেমী ও উদাসীনতাও ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কোরআনের বর্ণনাভংগী এখানে ছবির মতাে একে স্পষ্ট করে দিয়েছে তার বক্তব্যকে। কৃপণতাকে সে ঘাড়ের ওপর তুলে রাখা হাত সদৃশ, অপব্যয়কে এমন উন্মুক্ত হাত সদৃশ, যা কোনাে কিছুই ধরে রাখতে পারে না এবং কার্পন্য ও দানশীলতার চরমাবস্থাকে নিন্দিত, তিরস্কৃত ও অক্ষম হয়ে বসে থাকার সদৃশ বলে উল্লেখ করেছে। আভিধানিক অর্থে ‘হামীর’ বলা হয় সেই পশুকে, যা দীর্ঘপথ চলতে চলতে কাহিল ও অক্ষম হয়ে বসে পড়েছে এবং আর পথ চলতে পারছে না। কার্পণ্য দ্বারা মানুষ যেমন নিজেকে অপাংক্তেয় ও অক্ষম বানিয়ে ফেলে, তেমনি অপব্যয়ী ব্যক্তিও তার অপব্যয়ের কারণে অচল হয়ে পড়ে। কৃপণ ও অব্যয়কারী উভয়েই হয় নিন্দিত ও তিরস্কৃত। তাই মধ্যম পন্থাই সর্বোত্তম পন্থা।
# এরপর ব্যয়ের মধ্যম পন্থা অবলম্বনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে যে, মূলত আল্লাহ তায়ালাই রেযেকদাতা। তিনিই জীবিকা প্রসারিত বা সংকুচিত করেন। তিনি রেযেকদাতা, তিনিই ব্যয়ের মধ্যম পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন। ৩০ নং আয়াত লক্ষ্য করুন, ‘নিশ্চয় তােমার প্রতিপালক যার জন্যে চান রিযিক প্রশস্ত ও সংকুচিত করেন। নিশ্চয়ই তিনি তার বান্দাদের সম্পর্কে সব কিছু জানেন এবং সব কিছু দেখেন।’ অর্থাৎ যার জীবিকা বাড়িয়ে দেন, জেনে বুঝেই বাড়িয়ে দেন। আর যার জীবিকা কমিয়ে দেন জেনে বুঝেই কমিয়ে দেন। তিনি মধ্যম পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেন এবং কৃপণতা ও অপব্যয়। করতে নিষেধ করেন। সর্বাবস্থায় কোন পন্থাটা সঠিক, সেটা তিনিই জানেন ও দেখেন। তিনি এই কোরআনকে সেই বিধান সহকারে নাযিল করেছেন, যা নির্ভুল ও নিখুঁত।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
২৯-৩০ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিচ্ছেনঃ জীবনে খরচ করার ব্যাপারে তোমরা মধ্যম পন্থা অবলম্বন কর। কৃপণ ও হয়ো না এবং অপব্যয়ীও হয়ো না। তোমার হাত তোমার গ্রীবার সাথে বেঁধো না, অর্থাৎ এমন কৃপণ হয়ো না যে, কাউকেও কিছু দিবে না। ইয়াহূদীরাও এই বাক পদ্ধতিই ব্যবহার করতো এবং বলতো যে, আল্লাহর হাত বদ্ধ রয়েছে। তাদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাৎ অবতীর্ণ হোক যে, তারা কার্পণ্যের দিকে আল্লাহ তাআলার সম্পর্ক স্থাপন করতো। অথচ আল্লাহ তাআলা বড় দাতা, দয়ালু এবং পবিত্র। কার্পণ্য থেকে তিনি বহু দূরে রয়েছেন। মহান আল্লাহ কার্পণ্য থেকে নিষেধ করার পর অপব্যয় থেকেও নিষেধ করছেন। তিনি বলেছেনঃ তোমরা এতো মুক্ত হস্ত হয়ো না যে, সাধ্যের অতিরিক্ত দান করে ফেলবে। অতঃপর তিনি এই হুকুম দু’টির কারণ বর্ণনা করছেন যে, কৃপণতা করলে তোমরা নিন্দার পাত্র হয়ে যাবে। সবাই বলবে যে, লোকটি বড়ই কৃপণ। সুতরাং সবাই তোমার থেকে দূরে সরে থাকবে। কারণ, তারা জানে যে, তোমার কাছে দান প্রাপ্তির কোন আশা নেই। যেমন যুহায়ের ইবনু আবি সালমা তাঁর মুআল্লাকায় বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “যে মালদার হয়ে তার মাল তার কওমের উপর খরচ করতে কার্পণ্য করে, তার থেকে মানুষ অমুখাপেক্ষী হয়ে তার দুর্নাম করে থাকে।” সুতরাং কাপণ্যের কারণে মানুষ মরূপে গণ্য হয়ে যায় এবং সে মানুষের চোখের বালি হয়ে পড়ে। সবাই তাকে ভৎসনা করে থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি দান খায়রাত করার ব্যপারে সীমা ছাড়িয়ে যায়, শেষে সে অসমর্থ হয়ে বসে পড়ে। তার হাত শূন্য হয়ে যায় এবং এর ফলে সে দুর্বল ও অপারগ হয়ে পড়ে। যেমন কোন জন্তু চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং পথে আটকে পড়ে। (আরবি) শব্দটি সূরায়ে মুকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে ক্লান্ত হওয়া।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কৃপণ ও দাতার দৃষ্টান্ত ঐ দুই ব্যক্তির মত যাদের গায়ে বক্ষ হতে গলা পর্যন্ত দু’টি লোহার জুব্বা রয়েছে। দাতা ব্যক্তি যখন যখন খরচ করে তখন তখন ওর কড়া গুলি আলগা হয়ে যায় এবং তার হাত খুলে যায়। শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং ওর চিহ্ন মিটিয়ে দেয় আর কৃপণ ব্যক্তি যখনই খরচ করার ইচ্ছা করে তখনই তার জুব্বার কড়া গুলি আরো জড়ো হয়ে যায়। সে যতই ওটাকে প্রশস্ত করার ইচ্ছা করে ততই তা সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং কোন জায়গাই থাকে না।” সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আরো রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আসমা বিনতে আবি বকরকে (রাঃ) বলেনঃ “এদিকে ওদিকে আল্লাহর পথে খরচ করতে থাকো, জমা রেখো না। অন্যথায় আল্লাহ তাআলাও দান বন্ধ করে দিবেন।” অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ গণে গণে রেখো না, অন্যথায় আল্লাহ তাআলা ও গণে গণে বন্ধ করে দিবেন।
সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বলেনঃ “হে আবূ হুরাইরা (রাঃ) ! তুমি আল্লাহর পথে খরচ করতে থাকো, আল্লাহ তাআলাও তোমাকে দিতে থাকবেন।” সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রত্যেক সকাল ও সন্ধ্যায় দু’জন ফেরেশতা আকাশ থেকে অবতরণ করে থাকেন। একজন প্রার্থনা করেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি দাতাকে প্রতিদান প্রদান করুন।” আর অন্যজন প্রার্থনা করেনঃ হে আল্লাহ! আপনি কৃপণের মাল ধ্বংস করে দিন।
সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ দান খয়রাতে কারো মাল কমে যায় না এবং প্রত্যেক দাতাকে আল্লাহ তাআলা সম্মানিত করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশক্রমে অন্যদের সাথে বিনয়পূর্ণ ব্যবহার করে, আল্লাহ তাআলা তার মর্যাদা উঁচু করে দেন।” অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা লোভ হতে বেঁচে থাকো। এই লোভ লালসাই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। লোভ লালসার প্রথম হুকুম হলোঃ “তুমি কার্পণ্য কর। তখন সে কার্পণ্য করে। তারপর সে বলেঃ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কর। সে তা-ই করে। অতঃপর সে বলেঃ ‘অসৎ কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়। এবারও সে তার কথা মতই কাজ করে।”
ইমাম বায়হাকীর (রঃ) হাদীস গ্রন্থে রয়েছে যে, মানুষ যখন দান করে তখন শয়তানের চোয়াল ভেঙ্গে যায়। মুসনাদের হাদীসে আছে যে, মধ্যম পন্থায় ব্যয়কারী কখনো দরিদ্র হয় না।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আল্লাহ তাআ’লাই হচ্ছেন তাঁর বান্দাদেরকে রিযকদাতা। তিনিই রিযক বৃদ্ধি করে থাকেন এবং তিনিই হ্রাস করে থাকেন। তিনি যাকে ইচ্ছা ধনী এবং যাকে ইচ্ছা গরীব করে থাকেন। তাঁর প্রতিটি কাজ হিকমত বা নিপূণতায় পরিপূর্ণ। তিনি ভাল রূপে জানেন কে সম্পদ লাভের যোগ্য, আর কে দরিদ্র অবস্থায় কালাতিপাত করার যোগ্য। হাদীসে কুদসীতে রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমার কতকগুলি বান্দা এমন রয়েছে যারা দরিদ্র থাকারই যোগ্য। যদি আমি তাদেরকে ধনী করে দিই তবে তাদের দ্বীন ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার কতক বান্দা এমনও রন্মেছে যে, যারা সম্পদশালী হওয়ারই যোগ্য। যদি আমি তাদেরকে দরিদ্র করে ফেলি তবে তাদের দ্বীন নষ্ট হয়ে যাবে। হাঁ তবে এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, কতকগুলি লোকের পক্ষে ধনের প্রাচুর্য ঢিল বা অবকাশ হিসেবে হয়ে থাকে। এবং কতকগুলি মানুষের পক্ষে দারিদ্র শাস্তি স্বরূপ হয়ে থাকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই দু’টো হতেই রক্ষা করুন!