(বই#৮৪৩) [তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন =:-৬ যিনার কাছেও যেয়ো না,] সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল সুরা:১৭ ৩২ নং [ وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤى যিনার কাছেও যেয়ো না,] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৪৩) [তোমার রব নির্দেশ দিয়েছেন =:-৬
যিনার কাছেও যেয়ো না,]
সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল
সুরা:১৭
৩২ নং
[ وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤى
যিনার কাছেও যেয়ো না,]
www.motaher21.net

সুরা: বনী ইসরাঈল
আয়াত নং :-৩২

وَ لَا تَقْرَبُوا الزِّنٰۤى اِنَّهٗ كَانَ فَاحِشَةً١ؕ وَ سَآءَ سَبِیْلًا

যিনার কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ।
৩২ নং আয়াতের তাফসীর:

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*ব্যভিচারের কুফল : সন্তান হত্যার নিষেধাজ্ঞার পরেই এসেছে ব্যাভিচারের নিষেধাজ্ঞা। ‘তােমরা ব্যাভিচারের ধারে কাছেও যেও না। কেননা ওটা একটা অশ্লীল কাজ একং জঘন্য পন্থা।’ বস্তুত সন্তান হত্যা ও ব্যাভিচারের মধ্য এক ধরনের সংযোগ ও সাদৃশ্য রয়েছে। এই সংযােগ ও সাদৃশ্যের কারণেই সন্তান হত্যা ও নরহত্যার নিষেধাজ্ঞার মাঝখানে ব্যাভিচারের নিষেধাজ্ঞা এসেছে। ব্যাভিচারের মধ্যে একাধিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রথমত এতে জীবনের উপাদান বীর্যকে তার অযােগ্য স্থানে নিক্ষেপ করা হয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাভিচারকারী নরনারী সন্তান থেকে অব্যাহতি পেতে চায়-চাই তা ভ্রুণ হত্যার আকারেই হােক অথবা গর্ভপাতের আকারে। আর যদি সন্তানকে ভূমিষ্ট হবার সুযােগ দেয়াও হয়, তবে সেটা হয় একটা দুষ্কর্মময় কিংবা লাঞ্ছনা গঞ্জনাময় জীবনের আবির্ভাব। মানব সমাজে একটা জারজ সন্তানের জীবন যেভাবেই হােক, ব্যর্থ ও নিস্ফল জীবনে পর্যবসিত হয়ে থাকে। আকারে কিছুটা ভিন্নতর হলেও এটাও একটা হত্যাকান্ড। যে সমাজে সে লালিত পালিত হয় সেই সমাজটারই বিলুপ্তি ঘটে। সমাজ তার বংশ পরিচিতি হারিয়ে বসে, আসল ও নকল রক্ত মিশে একাকার হয়ে যায় এবং সন্তান ও সম্পদের বিশ্বস্ততা বিনষ্ট হয়। এভাবে সমাজ ক্রমান্বয়ে তার সমস্ত সম্পর্ক-বন্ধনসহ বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তার সার্বিক ধ্বংস সাধন করে। আরাে এক দিক দিয়েও এটা সমাজের অপমৃত্যুর শামিল। কেননা কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার এই সহজ বিকল্প পথ দাম্পত্য জীবনকে নিস্প্রয়ােজন ঐচ্ছিক ব্যাপারে পর্যবসিত করে। পরিবার হয়ে ওঠে একটা অবাঞ্ছিত বােঝা। অথচ পরিবারই হলাে সুস্থ, স্বাভাবিক ও সৎ সন্তানের সুতিকাগার। পরিবারের নির্মল পরিবেশে ছাড়া আর কোথাও তার সুষ্ঠু বিকাশ বৃদ্ধি এবং নিখুঁত লালন, প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণের সুযােগ নেই। আদিমকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত যখনই যে জাতিতে ব্যাভিচার ব্যাপক আকার ধারণ করেছে, সে জাতির অস্তিত্ব বিলুপ্তির ও ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়েছে। অনেকের ধারণা যে, ইউরােপ ও আমেরিকায় ব্যাভিচারের ব্যাপক বিস্তৃতি সত্তেও বস্তুগত শক্তির দিক দিয়ে প্রবল ও পরাক্রান্ত রয়েছে। কিন্তু এ অঞ্চলের যে জাতিগুলাে প্রাচীন (যেমন ফ্রান্স) সেগুলাের জীবনে আসন্ন ধ্বংসের চিহ্ন বেশ স্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত হয়। তবে মার্কিনীদের মতাে নবীন জাতিগুলাের জীবনে এ লক্ষণ এখনো পরিষ্কার নয়। এর কারণ এ জাতির তারুণ্য ও সম্পদের ব্যাপকতা। একজন নবীন যুবক যতােই যৌন উচ্ছৃংখলতায় লিপ্ত হােক, এর কুফল সে যৌবনকালে টের পাবে না, টের পাবে প্রৌঢ় বয়সে। তখন বয়সের ভারে সে নুয়ে পড়বেই। অথচ যে সব যুবক সুশৃংখল ও মধ্যপন্থী জীবন যাপন করে, তারা প্রৌঢ়ত্বেও বেশ সবল থাকে। (এই তাফসীর প্রকাশিত হবার পর বিগত তিন দশকে মার্কিন মুলুকসহ সমগ্র পশ্চিমী দুনিয়ায় যেভাবে ব্যাভিচারের অভিশাপ নেমে এসেছে তাতে সেখানকার চিন্তাশীল মহল এখনই তাদের সভ্যতারূপী এই প্রসাদে বড়াে আকারের ধ্বংস দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।-সম্পাদক) কোরআন শুধু ব্যাভিচার করতেই নিষেধ করে না, বরং তার ধারে কাছেও ঘেষতে নিষেধ করে। এ হচ্ছে তার প্রবল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। কেননা প্রবল কামােত্তেজনা মানুষকে ব্যাভিচারে প্ররােচিত করে। তাই তার ধারে কাছেও যেতে নিষেধ করা অধিকতর নিরাপদ। উত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণসমূহের কাছাকাছি চলে গেলে আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনাে ব্যবস্থা থাকবে না। এ কারণে ইসলাম ব্যাভিচারে প্ররােচনাদানকারী উপকরণগুলোর পথ রােধ করে, যাতে তাতে লিপ্ত হবার আশংকা দেখা না দেয়। নিষ্প্রয়ােজনে নর নারীর মেলামেশাকে সে অবাঞ্ছিত ও নির্জনে মেলামেশা হারাম ঘােষণা করে। সৌন্দর্য প্রদর্শনী করে নারীর বাইরে ঘােরাফেরা করাকে সে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। যে ব্যক্তি বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে তাকে বিয়ে করতে এবং যে বিয়ে করতে অসমর্থ, তাকে রােযা রাখার নির্দেশ দেয়। বিয়ের পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী কারণগুলাে যেমন মাত্রাতিরিক্ত দেনমােহর ধার্যকরণ, ইত্যাদি দূর করে। সন্তানের কারণে অভাব অনটনের আশংকাও সে অমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করে। যারা বিয়ে করে নিজেদের চরিত্র রক্ষা করতে চায়, তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসার জন্যে কোরআন সকলকে আহ্বান জানায়। এতােসব ব্যবস্থার পরও ব্যাভিচার সংঘটিত হলে তার ওপর কঠিন শাস্তি প্রয়ােগ করে। অনুরূপ, নিরীহ সতী সাধ্বী মহিলাদের বিনা প্রমাণে ব্যাভিচারের অপবাদ আরােপকারীকেও ইসলাম কঠোর শান্তি দেয়। এভাবে ইসলাম মুসলিম সমাজকে নৈতিক অধপতন ও ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করার জন্যে বহুসংখ্যক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

“যিনার কাছেও যেয়ো না” এ হুকুম ব্যক্তির জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও। ব্যক্তির জন্য এ হুকুমের মানে হচ্ছে, সে নিছক যিনার কাজ থেকে দূরে থেকেই ক্ষান্ত হবে না বরং এ পথের দিকে টেনে নিয়ে যায় যিনার এমন সব সূচনাকারী এবং প্রাথমিক উদ্যোগ ও আকর্ষণ সৃষ্টিকারী বিষয় থেকেও দূরে থাকবে। আর সমাজের ব্যাপারে বলা যায়, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে যিনা, যিনার উদ্যোগ-আকর্ষণ এবং তার কারণসমূহের পথ বন্ধ করে দেয়া সমাজের জন্য ফরয় হয়ে যাবে। এ উদ্দেশ্যে সে আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ও অনুশীলন দান, সামাজিক পরিবেশের সংস্কার সাধন, সমাজ জীবনের যথাযোগ্য বিন্যাস এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।

এ ধারাটি শেষ পর্যন্ত ইসলামী জীবন ব্যবস্থার একটি বৃহত্তম অধ্যায়ের বুনিয়াদে পরিণত হয়। এর অভিপ্রায় অনুযায়ী যিনা ও যিনার অপবাদকে ফৌজদারী অপরাধ গণ্য করা হয়। পর্দার বিধান জারী করা হয়। অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রচার কঠোরভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। মদ্যপান, নাচ, গান ও ছবির (যা যিনার নিকটতম আত্মীয়) ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। আর এ সঙ্গে এমন একটি দাম্পত্য আইন প্রণয়ন করা হয় যার ফলে বিবাহ সহজ হয়ে যায় এবং এ যিনার সামাজিক কারণসমূহের শিকড় কেটে যায়।

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

আল্লাহ তা‘আলা ব্যভিচারের মত অশ্লীল বেহায়াপনাপূর্ণ কাজের নিকটবর্তী হতেও নিষেধ করছেন। এটি এমন একটি অপরাধ যে, অপরাধী বিবাহিত হলে ইসলামী সমাজে তার জীবিত থাকার অধিকার থাকে না। এমনকি তরবারী দিয়ে হত্যা করলেও যথেষ্ট হয় না, বরং পাথর মেরে হত্যা করতে হয় যাতে সমাজে এ শ্রেণির লোকদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে এবং লোকেরা তা থেকে শিক্ষা নেয়। তাই এখানে ব্যভিচারের কথা বলা হয়নি, ব্যভিচারের প্রতি উৎসাহিত করে, ধাবিত করে এমন কাজ ও কথাবার্তার কাছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন গায়ের মাহরাম নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, কোমল কন্ঠে কথা বলা, মহিলাদের সাজ-সজ্জা করে বাড়ির বাইরে যাওয়া, অশ্লীল গান-বাজনা ও ভিডিও ফিল্ম ইত্যাদি। আল্লাহ তা‘আলা এটাকে فَاحِشَةً বা অশ্লীল বলে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ এটা শরীয়তের দিক থেকে যেমন খারাপ কাজ তেমনি মানুষের বিবেকও খারাপ বলে। এতে আল্লাহ তা‘আলার হক নষ্ট হয়, মহিলার হক নষ্ট হয়, স্বামীর হক নষ্ট হয় সর্বোপরি সমাজে অশ্লীতা সৃষ্টি হয় ও মানুষের বংশনামা নষ্ট হয়। তাই আমাদের প্রত্যেককে এ অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
# যিনা-ব্যাভিচারের মত অশ্লীল কাজ করা তো দূরের কথা, এর নিকটবর্তীও হওয়া যাবে না।

 

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
আল্লাহ তাআলা ব্যভিচার ও ওর চতুষ্পর্শ্বের সমস্ত দুষ্কার্য হতে চরমভাবে নিষেধ করেছেন। শরীয়তে ব্যভিচারকে কাবীরা ও কঠিন পাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, একজন যুবক রাসূলুল্লাহর (সঃ) কাছে। ব্যভিচারের অনুমতি প্রার্থনা করে। জনগণ প্রতিবাদ করে বলেঃ “চুপ কর, কি বলছো?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বলেনঃ “বসে যাও।” সে বসে গেলে তিনি তাকে বলেনঃ তুমি এই কাজ কি তোমার মায়ের জন্যে পছন্দ কর?” উত্তরে সে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ আমাকে আপনার উপর উৎসর্গ করুন! আল্লাহর কসম! আমি কখনো এটা পছন্দ করি না।” তখন তিনি তাকে বললেনঃ “তাহলে অন্য কেউ এটাকে কি করে পছন্দ করতে পারে?” এরপর তিনি তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, এই কাজটি তুমি। তোমার মেয়ের জন্যে পছন্দ কর কি?” লোকটি চরমভাবে এটাও অস্বীকার করলো। তিনি বললেনঃ “ঠিক এরূপই অন্য কেউই এটা তার মেয়ের জন্যে পছন্দ করে না। তারপর তিনি বললেনঃ “তুমি তোমার বোনের জন্যে এটা পছন্দ করবে কি?” অনুরূপভাবে সে এটাকেও অস্বীকার করলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এইরূপ অন্যেরাও তাদের বোনদের জন্যে এটাকে অপছন্দ করবে।” অতঃপর তিনি বললেনঃ “কেউ তোমার ফুফুর সাথে এই কাজ করুক এটা তুমি পছন্দ কর কি?” সে এটাকেও কঠিনভাবে অস্বীকার করলো। তিনি বললেনঃ “অনুরূপ ভাবে অন্যেরাও এটা পছন্দ করবে না।” এরপর তিনি। বলেনঃ “তোমার খালার জন্যে এ কাজ তুমি পছন্দ কর কি?” উত্তরে সে বলেঃ “কখনই নয়।” তিনি বললেনঃ “এইরূপ সবাই এটা অপছন্দ করে।” অতঃপর তিনি স্বীয় হস্ত মুবারক তার মস্তকের উপর স্থাপন করে দুআ করলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি এর পাপ মার্জনা করুন! এর অন্তর পবিত্র করে দিন এবং একে অপবিত্রতা হতে বাঁচিয়ে নিন!” অতঃপর তার অবস্থা এমন হলো যে, সে কোন মহিলার দিকে দৃষ্টিপাতও করতো না।

ইবনু আবিদ দুনিয়া (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “শিরকের পরে ব্যভিচার হতে বড় পাপ আর কিছুই নেই যে, মানুষ তার শুক্র এমন গর্ভাশয়ে নিক্ষেপ করবে যা তার জন্যে বৈধ নয়।”

Leave a Reply