(বই#৮৪৯) সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল সুরা:১৭ ৪০-৪৩ নং [ اِنَّکُمۡ لَتَقُوۡلُوۡنَ قَوۡلًا عَظِیۡمًا ﴿٪۴۰﴾ তোমরা তো নিশ্চয়ই ভয়ানক কথা বলে থাক। ] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৪৯)
সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল
সুরা:১৭
৪০-৪৩ নং
[ اِنَّکُمۡ لَتَقُوۡلُوۡنَ قَوۡلًا عَظِیۡمًا ﴿٪۴۰﴾
তোমরা তো নিশ্চয়ই ভয়ানক কথা বলে থাক। ]
www.motaher21.net

اَفَاَصۡفٰىکُمۡ رَبُّکُمۡ بِالۡبَنِیۡنَ وَ اتَّخَذَ مِنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ اِنَاثًا ؕ اِنَّکُمۡ لَتَقُوۡلُوۡنَ قَوۡلًا عَظِیۡمًا ﴿٪۴۰﴾
তোমাদের রব কি তোমাদেরকে পুত্র সন্তানের জন্য নির্বাচিত করেছেন এবং তিনি নিজে কি ফিরিশতাদেরকে কন্যারুপে গ্রহণ করেছেন? তোমরা তো নিশ্চয়ই ভয়ানক কথা বলে থাক।
وَ لَقَدۡ صَرَّفۡنَا فِیۡ ہٰذَا الۡقُرۡاٰنِ لِیَذَّکَّرُوۡا ؕ وَ مَا یَزِیۡدُہُمۡ اِلَّا نُفُوۡرًا ﴿۴۱﴾
আর অবশ্যই আমরা এ কুরআনে (বহু বিষয়) বারবার বিবৃত করেছি যাতে তাঁরা উপদেশ গ্রহণ করে। কিন্তু এতে তাঁদের বিমুখতাই বৃদ্ধি পায়।
قُلۡ لَّوۡ کَانَ مَعَہٗۤ اٰلِـہَۃٌ کَمَا یَقُوۡلُوۡنَ اِذًا لَّابۡتَغَوۡا اِلٰی ذِی الۡعَرۡشِ سَبِیۡلًا ﴿۴۲﴾
বলুন, ‘যদি তাঁর সাথে আরও ইলাহ থাকতো যেমন তারা বলে, তবে তারা ‘আরশ-অধিপতির (নৈকট্য লাভের) উপায় খুঁজে বেড়াত।
سُبۡحٰنَہٗ وَ تَعٰلٰی عَمَّا یَقُوۡلُوۡنَ عُلُوًّا کَبِیۡرًا ﴿۴۳﴾
তিনি পবিত্র, মহিমার্নিত এবং তারা যা বলে, তা হতে তিনি বহু ঊর্ধ্বে।

৪০-৪৩ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

যারা বলে ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার কন্যা সন্তান তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কঠিন ধমক দিয়ে বলছেন: আমি কি তোমাদের জন্য পুত্র সন্তান চয়ণ করে দিয়েছি আর নিজের জন্য কন্যা সন্তান বেছে নিয়েছি? কক্ষনো হতে পারে না, বরং এটা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বড় মিথ্যা অপবাদ। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সন্তান গ্রহণ করার ইচ্ছা থাকলে যে কোন মাখলুক থেকে নিতে পারতেন যেমন সূরা যুমারের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(أَلَكُمُ الذَّكَرُ وَلَهُ الْأُنْثٰي -‏ تِلْكَ إِذًا قِسْمَةٌ ضِيْزٰي)‏

“তবে কি তোমাদের জন্য পুত্র, আর তাঁর জন্য কন্যা সন্তান? এই প্রকার বন্টন তো অসঙ্গত। ” (সূরা নাজম ৫৩:২১-২২)

এ সম্পর্কে সূরা নাহল এর ৫৭-৫৯ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনি এ কুরআনে সকল প্রকার বিধি-বিধান, দৃষ্টান্ত, নসীহত বর্ণনা করেছেন। যাতে মানুষ বুঝতে ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তারা কুফরী ও শির্কের মধ্যে এমনভাবে ডুবে আছে যে, তারা সত্যের নিকটবর্তী হওয়ার পরিবর্তে তা থেকে আরো দূরে সরে গেছে। যার ফলে এসমস্ত দৃষ্টান্ত তাদের অন্তরকে আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের প্রতি উৎসাহিত করে না।

(قُلْ لَّوْ كَانَ مَعَه۫ٓ اٰلِهَةٌ…. )

এর অর্থ এমন যে, যদি একাধিক উপাস্য থাকত তাহলে একজন বাদশাহ যেমন অন্য বাদশার উপর বিজয়ী হওয়ার জন্য সৈন্যদল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে অনুরূপ দ্বিতীয় প্রভুও বিজয়ী হওয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার বিরুদ্ধে পথ খুঁেজ বেড়াত। কিন্তু তা হয়নি। মুশরিকরা যার উপাসনা করে তারা যদি সত্যিই মা‘বূদ হত তাহলে তা-ই করত। এতে প্রমাণিত হয় যে, তাদের এ সমস্ত মা‘বূদ সকলই ভ্রান্ত। আর ইবাদত পাওয়ার একমাত্র হকদার আল্লাহ তা‘আলা। সুতরাং মুশরিকরা যা বলে থাকে তা থেকে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র ও মহান।

যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(مَا اتَّخَذَ اللہُ مِنْ وَّلَدٍ وَّمَا کَانَ مَعَھ۫ مِنْ اِلٰھٍ اِذًا لَّذَھَبَ کُلُّ اِلٰھٍۭ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُھُمْ عَلٰی بَعْضٍﺚ سُبْحٰنَ اللہِ عَمَّا یَصِفُوْنَﮪﺫعٰلِمِ الْغَیْبِ وَالشَّھَادَةِ فَتَعٰلٰی عَمَّا یُشْرِکُوْنَﮫﺟ)‏

“আল্লাহ কোন সন্ত‎ান গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে অপর কোন ইলাহ্ নেই; যদি থাকত তবে প্রত্যেক মা‘বূদ স্বীয় সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত। তারা যা বলে তা হতে আল্লাহ পবিত্র! তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তারা যাকে তাঁর সাথে শরীক করে তিনি তার ঊর্ধ্বে।” (সূরা মু’মিনুন ২৩:৯১-৯২)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(لَوْ كَانَ فِيْهِمَآ اٰلِهَةٌ إِلَّا اللّٰهُ لَفَسَدَتَا ج فَسُبْحَانَ اللّٰهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُوْنَ)

“যদি আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে বহু ইলাহ্ থাকত, তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে তা হতে ‘আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র, মহান।” (সূরা আম্বিয়া ২১:২২)

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সৃষ্টিকুলের সবকিছুই তার তাসবীহ পাঠ করে যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(إِنَّا سَخَّرْنَا الْجِبَالَ مَعَه۫ يُسَبِّحْنَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِشْرَاقِ‏)‏

“আমি পাহাড়গুলোকে অনুগত করে দিয়েছিলাম, তার সাথে তারা সকাল-সন্ধ্যায় আমার তাসবীহ পাঠ করত।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:১৮)

সুতরাং পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব স্বীয় পদ্ধতিতে আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে। বর্ণিত আছে, সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে খাবার খাওয়ার সময় খাবার থেকে তাসবীহ পড়ার ধ্বনি শুনেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৫৭৯)

অন্য বর্ণনায় এসেছে পিঁপড়াও আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে। (সহীহ বুখারী হা: ৩০১৯)

অনুরূপ খেজুর গাছের যে গুড়িতে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুৎবা দিতেন সে গুড়ির কান্নার আওয়াজ তিনি শুনতে পেয়েছেন। মক্কার একটি পাথর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সালাম দিত যা সহীহ মুসলিমের ১৭৮২ নং হাদীসে রয়েছে। অতএব সব কিছু আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করে কিন্তু আমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পারি না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলা কোন সন্তান গ্রহণ করেন না।
২. কুরআনে প্রত্যেক জিনিসের বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
৩. আরশের অধিপতি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই, অন্য কেউ নয়।
৪. জড় পদার্থও একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই তাসবীহ পাঠ করে।
৫. ফেরেশতারা আল্লাহ তা‘আলার কন্যা নয় বরং তারাও আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যশীল বান্দা।
৬. একাধিক প্রভু থাকলে আকাশ-জমিন ধ্বংস হয়ে যেত।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

#ব্যাখ্যার জন্য সূরা নাহলের ৫৭ থেকে ৫৯ পর্যন্ত আয়াতগুলো টীকাসহকারে দেখুন।

# সে নিজেই আরশের মালিক হবার চেষ্টা করতো। কারণ অনেকগুলো সত্তা আল্লাহর সার্বভৌমত্বে শরীক হলে সেখানে অনিবার্যভাবে দু’টি অবস্থার সৃষ্টি হবে। এক, তারা সবাই হবে প্রত্যেকের জায়গায় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ইলাহ। দুই, তাদের একজন হবে আসল ইলাহ আর বাদবাকি সবাই হবে তার বান্দা এবং সে তাদেরকে নিজের প্রভুত্ব কর্তৃত্বের কিছু অংশ সোপর্দ করবে। প্রথম অবস্থাটিতে কোনক্রমেই এসব স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী ইলাহর পক্ষে সবসময় সব ব্যাপারে পরস্পরের ইচ্ছা ও সংকল্পের প্রতি আনুকূল্য বজায় রেখে এ অনন্ত অসীম বিশ্বলোকের আইন-শৃংখলা ব্যবস্থা এতো পরিপূর্ণ ঐক্য, সামঞ্জস্য, সমতা ও ভারসাম্য সহকারে পরিচালনা করা সম্ভবপর ছিল না। তাদের পরিকল্পনা ও সংকল্পের প্রতি পদে পদেই সংঘর্ষ বাধা ছিল অনিবার্য। প্রত্যেকেই যখন দেখতো অন্য ইলাহদের সাথে আনুকুল্য ছাড়া তার প্রভুত্ব চলছে না তখন সে একাই সমগ্র বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র মালিক হয়ে যাবার চেষ্টা করতো। আর দ্বিতীয় অবস্থা সম্পর্কে বলা যায়, বান্দার সত্তা প্রভুত্বের ক্ষমতা তো দূরের কথা প্রভুত্বের সামান্যতম ভাবকল্প ও স্পর্শ-গন্ধ ধারণ করার ক্ষমতাও রাখে না। যদি কোথাও কোন সৃষ্টির দিকে সামান্যতম প্রভুত্ব কর্তৃত্ব স্থানান্তরিত করে দেয়া হতো তাহলে তার পায়া ভারি হয়ে যেতো, আর সামান্য ক্ষণের জন্যও সে বান্দা হয়ে থাকতে রাজী হতো না এবং তখনি সে বিশ্ব-জাহানের ইলাহ হয়ে যাবার জন্য প্রচেষ্টা শুরু করে দিতো।

যে বিশ্ব-জাহানের পৃথিবী ও আকাশের সমস্ত শক্তি মিলে একসাথে কাজ না করলে গমের একটি দানা এবং ঘাসের একটি পাতা পর্যন্তও উৎপন্ন হতে পারে না তার সম্পর্কে শুধুমাত্র একজন নিরেট মূর্খ ও স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন লোকই একথা চিন্তা করতে পারে যে, একাধিক স্বাধীন বা অর্ধ স্বাধীন ইলাহ তার শাসন কার্য পরিচালনা করছে। অন্যথায় যে ব্যক্তিই এ ব্যবস্থার মেজাজ ও প্রকৃতি বুঝবার জন্য সামান্যতম চেষ্টাও করেছে সে এ সিদ্ধান্তে না পৌঁছে থাকতে পারে না যে, এখানে শুধুমাত্র একজনেরই প্রভুত্ব চলছে এবং তাঁর সাথে অন্য কারোর কোন পর্যায়েই কোন প্রকারের শরীক হবার আদৌ কোন সম্ভাবনা নেই।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
#এখানে থেকে শুরু হচ্ছে সুরায়ে বনি ইসরাঈল বা ইসরার দ্বিতীয় পাঠ, এ অধ্যায়ে আলােচনা এসেছে আল্লাহর একত্ব ও শিরকের প্রতি নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে। এ আলােচনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরাে অংশের মধ্যে আরও যুক্ত হয়ে রয়েছে আল্লাহর নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত অনেক কথা। এসব কিছু এবং এসব কিছুর জন্যে যা নিয়ম শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হয়েছে আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস (বা তাওহীদ)-এর ভিত্তিতে।  *শিরকের অসারতা : অধ্যায়টি শুরু ও শেষ হয়েছে আল্লাহর সন্তান হওয়া ও তার শরীক হওয়ার অলীক ধারণাকে প্রতিহত করতে গিয়ে! জানানাে হয়েছে, মানুষের মনগড়া ও অনুমানভিত্তিক এসব কথা সমাজ জীবনকে পেরেশান করে মাত্র এবং মানবতার মূল্যকে নীচে নামিয়ে দেয়। এর সাথে সাথে দৃঢ়তার সাথে প্রমাণ করা হয়েছে যে গােটা সৃষ্টি জগৎ এক স্রষ্টার দিকে কেন্দ্রীভূত হয়ে রয়েছে এবং তার অদৃশ্য ইশারায় একই নিয়মে দিবারাত্র সব কিছু আবর্তিত হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যতো কিছু (দৃশ্য জগতে) আছে সবই (তাঁর হুকুম পালনের মাধ্যমে) তার তাসবীহ জপে চলেছে।’ অর্থাৎ সব কিছু জানাচ্ছে যে আখেরাতে তারা এক ও অদ্বিতীয় মহান সত্ত্বা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এর কাছেই ফিরে যাবে, আরাে জানাচ্ছে যে, একমাত্র সেই মহান সত্ত্বাই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে অবস্থিত সব কিছুর খবর রাখেন, আর কেউ নয়, আর তিনি সব কিছুকে একাই পরিচালনা করে চলেছেন, যার জনন্য কারাে কাছে তাকে কৈফিয়ত দেয়া লাগে না। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি চাইলে তােমাদের প্রতি রহম করবেন এবং চাইলে তােমাদেরকে আযাব দেবেন।’ আলােচনার মধ্যে শিরকের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে এবং পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এটা মানুষের মনগড়া এক ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে মহান সেই সত্ত্বা, যার হাতে রয়েছে সবার জীবন ও মৃত্যু একমাত্র তারই দিকে সবাইকে রুজু করতে হবে, এবং সকল ক্ষমতা একমাত্র তাঁরই; সবাইকে পরিচালনা করা এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সৃষ্টিজগতের সবাইকে প্রকাশ্যে ও গােপনে নির্দেশ দানের ক্ষমতা একমাত্র তারই। আরও প্রকাশ পাচ্ছে যে, জীবিত মৃত সজীব নির্জীব, জীব জন্তু, কীট পতংগ ও যতাে পদার্থ আছে সবাই তাদের সৃষ্টিকর্তার দিকে রুজু হয়ে আছে এবং তাদের সারাক্ষণের আনুগত্যের মাধ্যমে এটা জানা যাচ্ছে। ‘তােমাদের রব কি তােমাদের জন্যে বরাদ্দ করলেন পুত্র সন্তান এবং নিজের জন্যে গ্রহণ করলেন কন্যা সন্তান?'(আয়াত ৪০) এখানে জিজ্ঞাসাবােধক বাক্য ব্যবহার করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফেরদের এ কথার প্রতি ঘৃনা ও অসন্তোষ প্রকাশ করছেন যে তারা বলছে, ‘ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা’ তারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে যেসব বাজে কথা উচ্চারণ করছে, যে আল্লাহর সন্তান আছে, আছে জীবন সংগিনী, আছে তার শরীক, এসব কথার কারণে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করছেন এবং আরও ক্রোধ প্রদর্শন করছেন এজন্যে যে তারা আল্লাহর জন্যে বাছাই করেছে কন্যা আর নিজেদের জন্যে পুত্র, অথচ তারা নিজেরা কন্যাদেরকে পুত্রদের তুলনায় তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করে; তারা দারিদ্র ও লজ্জার ভয়ে কন্যা সন্তানদের হত্যা করে, এতদসত্তেও আল্লাহর জন্যে তারা কন্যা-সন্তান পছন্দ করছে! আল্লাহ তায়ালা যখন পুত্র কন্যা উভয়টিই দান করছেন তখন তাদের পক্ষে আল্লাহর জন্যে কন্যা সন্তান পছন্দ করার হেতু কি এবং নিজেদের জন্যে পুত্র সন্তান পছন্দ করারই বা যৌক্তিকতা কি? এখানে এসব ভুল দাবীর কারণে যে আত্ম-বিস্মৃতি মানুষে মানুষে অনৈক্য এবং অধপতন শুরু হয়েছে এগুলােকে যাতে করে সঠিক পথে আনা যায় তার যুক্তি তর্ক-দিয়ে বুঝানাের চেষ্টা করা হয়েছে এ কাজ না হলে মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও চেতনার বুনিয়াদই ধসে যেতাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘অবশ্যই তােমরা বিরাট কথা বলছাে…’ নিকৃষ্ট চরিত্র ও ব্যবহারের দিক দিয়ে তােমার কথা ছিলাে অবশ্য খুবই বড়, দন্ড ও অসভ্যতার দিক দিয়ে ওরা এটা বিরাট কথা বলছে। বিরাট কথা বলছে তারা মিথ্যা হওয়ার দিক দিয়ে এবং সঠিক ও চেতনাও কল্পনা থেকে দূরে সরে যাওয়ার দিক দিয়েও তাদের কথা খুবই বড় ও মারত্মক। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর অবশ্যই আমি, এই আল কোরআনের মধ্যে সব কিছুকে বিশদভাবে বর্ণনা করেছি, যাতে করে ওরা শিক্ষা গ্রহণ করে, কিন্তু এতদসত্তেও সত্য থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কোনাে ফায়দা হয়নি।’ মহা পবিত্র আল কোরআন আল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমের জন্যেই এসেছে আর এই আকীদাকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে এবং এ বিশ্বাসকে সুস্পষ্টভাবে মানুষকে বুঝানাের জন্যে। সারাক্ষণ এর তৎপরতা এগিয়ে চলেছে, এজন্যে নানা প্রকার পদ্ধতি ও হিকমত অবলম্বন করা হয়েছে, বিভিন্ন উপায় ও ওসীলা গ্রহণ করা হয়েছে-এর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন অন্তর প্রাণ দিয়ে তাওহীদের মর্মকথা মানুষ বুঝতে পারে এবং স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে নিজেদের বুঝ শক্তির নিরিখেই এ মহা সত্যকে গ্রহণ করতে পারে, তাই বলা হয়েছে, ‘যেন তারা শিক্ষা নিতে পারে।’ অতপর চিন্তা করে দেখুন, তাওহীদকে বুঝনোর জন্য এর প্রয়ােজন ও যৌক্তিকতা বুঝানাে ছাড়া আর কিছু করার নাই, মানুষকে তাদের বাস্তব প্রকৃতির দিকে ফিরে যাওয়ার কথা বলা ও যুক্তি প্রদর্শন করা এবং সৃষ্টির বিভিন্ন নিদর্শন দেখিয়ে তাদেরকে সত্যের দিকে উদ্বুদ্ধ করা ইসলামী দাওয়াতের সর্বপ্রধান কাজ। কিন্তু, দুনিয়ার স্বার্থ ও জাহেলিয়াতের অন্ধ অনুসরণে তারা এমনই নির্বোধ হয়ে গেছে যে আল কোরআন থেকেই তারা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, যখনই আল কোরআন তারা শোনে তখনই তারা দূরে সরে যায়, এভাবে যতােবারই তাদেরকে সত্যের দিকে ডাকা হচ্ছে ততােবারই তারা সত্যের বাতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যে আকীদা গ্রহণ করার জন্যে তাদেরকে আহবান জানানাে হয়েছে তার থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে—আল কোরআন থেকে তাদের দূরে সরে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে যেন আল কোরআনের আওয়ায তাদের ওপর বিজয়ী হয়ে তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে তাদেরকে সরিয়ে দিতে না পারে আর আল কোরানের যতােটুকু আওয়ায তাদের কানে গেছে এবং এর সম্মােহনী শক্তি যতােটুকু তারা দেখার সুযােগ পেয়েছে তাতে তাদের মধ্যে প্রতীতি জন্মে গেছে যে এ কিতাবের আওয়ায যদি ব্যাপকভাবে মানুষের কান পর্যন্ত পৌছে যায় তাহলে মানুষকে এর থেকে বেশীদিন দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা; তাদের সেই মিথ্যা ও কাল্পনিক ধারণা বিশ্বাসের ওপর আল কোরআন অবশ্যই বিজয় লাভ করবে যাকে তারা অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। তাদের শিরকের আকীদা, তাদের মনগড়া মাবুদদের প্রতি ভক্তি বিশ্বাস ও আনুগত্য এবং তুচ্ছ ও গুরুত্বহীন যেসব জিনিসকে অযথা তারা গুরুত্ব দিয়ে চলেছে আল কোরআনের সামনে একদিন সেসব কিছুই অসার ও অর্থহীন প্রমাণিত হবে। যেমন করে ইতিমধ্যে তাদের কাছে আল্লাহর জন্যে কন্যা বানানাের কথাটা যুক্তিহীন ও অসার প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি করে ইলাহ বা জীবন-মৃত্যুর মালিক ও ভালাে মন্দের কর্তা বলে যেসব মাবুদদেরকে তারা গ্রহণ করেছিলাে তারাও যে সত্যিকারে কোনাে শক্তি-ক্ষমতার মালিক নয় তা এখন তাদের নযরে ধরা পড়ে গেছে। তাদেরকে বুঝানাে হচ্ছিলাে যে তাদের অধপতনের মূল কারণ হচ্ছে অন্ধভাবে ওইসব অলীক দেব-দেবীর পূজা উপাসনা করা এবং তাদের কাছে সাহায্যের জন্যে হাত পাতা। তাদেরকে জানানাে হচ্ছিলাে যে এসব দেব-দেবী যদি আল্লাহর সাথে তার ক্ষমতায় শরীক হতাে বা তারা আল্লাহর আত্মীয় হতাে তাহলে তারা অবশ্যই আল্লাহর নৈকট্য-লাভের চেষ্টা করতাে এবং আল্লাহর কাছে পৌছে যাওয়ার জন্যে নানা প্রকার উপায় তালাশ করতাে। এরশাদ হচ্ছে, বলাে, সত্যই যদি আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আরও বিভিন্ন ব্যক্তি বা দেব-দেবী ক্ষমতার মালিক হতাে, যেমন ওরা বলে, তাহলে অবশ্যই তারা আকাশবাসীর কাছে পৌঁছানাের চেষ্টা করতাে। ব্যাকরণবিদ বা ভাষাবিদরা যেমন বলেন, কোনাে বিষয়ে না সুচক কোনাে কথা বলা বা বিরােধিতা করা যদি শুধু বিরােধিতার জন্যেই হয় তাহলে পুরাে বিষয়টাই রদ হয়ে যায়, সেখানে কোনাে যুক্তি পেশ করার সুযােগ থাকে না বা যুক্তি পেশ করে কোনাে লাভও হয় না। প্রকৃত পক্ষে, আল্লাহর সাথে তার ক্ষমতায় ভাগ বসানাের মতাে কোনাে ক্ষমতাবান সত্ত্বা নাই, যে নিজের এবং অন্য কারাে মালিক হতে পারে, কোনাে জীবন মৃত্যুর কর্তা হতে পারে অথবা সকল শক্তি ক্ষমতার মালিক অথবা সর্বময় ক্ষমতার মালিকের সমকক্ষ বা অংশীদার হওয়ার দাবী করতে পারে। যেসব জিনিস অথবা ব্যক্তিকে তার পূজনীয় মনে করে, তাদের সামনে মাথা নত করে এবং বিপদ আপদে তাদের কাছে সাহায্যের জন্যে হাত প্রসারিত করে তারা সবাই তাে আল্লাহরই সৃষ্টি, সে কোনাে তারকা হােক, হােক কোনা গ্রহ, মানুষ বা পশু, বৃক্ষ বা কোনাে ইট পাথর নির্মিত জড় পদার্থ যাইই হােক না কেন সবাই প্রকৃতিগতভাবে সৃষ্টি কর্তার দিকে ফিরে যেতে বাধ্য, সবারই লয় আছে, আছে ক্ষয় এবং অবশেষে সবাইকে ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিরে যেতে হবে তিনি যা ইচ্ছা করেন, সে ইচ্ছার কাছে সবাইকেই নতি স্বীকার করতে হয় এবং অবশ্যই একদিন সবাইকে তার ডাকে সাড়া দিয়ে তার কাছে ফিরে যেতে হবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘ক্ষমতা অন্য কারাে হাতে যদি থাকতাে তাহলে অবশ্যই তারা আরশের মালিকের কাছে পৌছে যাওয়ার চেষ্টা করতাে…’ আরশের উল্লেখ হয়েছে এই জন্যে যে আল্লাহ তায়ালা মহান ও তার মর্যাদা সর্বোচ্চ আর যেসব সৃষ্টিকে ওরা আল্লাহর সাথে মাবুদ বা ক্ষমতাধর মনে করে ডাকে, তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর নীচে বা তার অধীনস্থ তার সাথে বা পাশাপাশি কেউ নয়, একথা বলার পর পরই জানানাে হচ্ছে, তিনি ওই সকল দুর্বলতা থেকে পবিত্র যা সৃষ্টিজগতের সবার আছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি পবিত্র সব কিছু দুর্বলতা থেকে, সমুচ্চ তার মর্যাদা, তার সম্পর্কে যা বলে তার থেকে তিনি বহু বহু উর্ধ্বে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
#আল্লাহ তাআলা অভিশপ্ত মুশরিকদের কথা খণ্ডন করছেন। তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ এটা তোমরা খুব চমৎকার বন্টনই করলে যে, পুত্র তোমাদের আর কন্যা আল্লাহর! যাদেরকে তোমরা নিজেরা অপছন্দ কর, এমনকি জীবন্ত কবর দিতেও দ্বিধাবোধ কর না, তাদেরকেই আল্লাহর জন্যে স্থির করছো! অন্যান্য আয়াত সমূহেও তাদের এই ইতরামির বর্ণনা দেয়া হয়েছে যে, তারা বলেঃ আল্লাহর রহমানের সন্তান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা তাদের অত্যন্ত জঘন্য উক্তি। খুব সম্ভব, তাদের এই উক্তির কারণে আকাশ ফেটে পড়বে, যমিন ধ্বসে যাবে এবং পাহাড় পর্বত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে যে, আল্লাহ রহমানের সন্তান রয়েছে। অথচ তিনি এর থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। এটা তার জন্যে মোটেই শোভনীয় নয়। যমিন ও আসমানের সমস্ত সৃষ্টজীব তারই দাস। সবই তাঁর গণনার মধ্যে রয়েছে। কিয়ামতের দিন এক এক করে সবকেই তাঁর সামনে পেশ করা হবে।
# আল্লাহ পাক বলেনঃ এই পবিত্র কিতাবে (কুরআনে) আমি সমস্ত দৃষ্টান্ত খুলে খুলে বর্ণনা করে দিয়েছি। প্রতিশ্রুতি ও ভীতি প্রদর্শন স্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে, যাতে মানুষ মন্দ কাজ ও আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকে। কিন্তু তবুও অত্যাচারী লোকেরা সত্য হতে ঘৃণা করা ও ওর থেকে দূরে পলায়নে বেড়ে চলেছে।
#
যে মুশরিকরা আল্লাহ তাআলার সাথে অন্যদেরও ইবাদত করে এবং তাদেরকে তাঁর শরীক মনে করে, আর মনে করে যে, তাদের কারণে তারা তাঁর নৈকট্য লাভ করবে তাদেরকে বলে দাওঃ তোমাদের এই বাজে ধারণার যদি কোন মূল্য থাকতো তবে তারা যাদেরকে ইচ্ছা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতো এবং যাদের জন্যে ইচ্ছা সুপারিশ করতো। তবে তো স্বয়ং এ মাবুদই তাঁর ইবাদত করতো ও তাঁর নৈকট্য অনুসন্ধান করতো। সুতরাং তোমাদের শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত করা উচিত। তিনি ছাড়া আর কারো ইবাদত করা মোটেই উচিত নয়। অন্য মা’ৰূদদের কোন প্রয়োজনই নেই যে, তারা তোমাদের মধ্যে মাধ্যম হবে। এই মাধ্যম আল্লাহ তাআলার নিকট খুবই অপছন্দনীয়। তিনি এটা অস্বীকার করছেন। তিনি তাঁর সমস্ত নবী ও রাসূলের ভাষায় এর থেকে নিষেধ করেছেন।

আল্লাহর সত্তা অত্যাচারীদের বর্ণনাকৃত এই বিশেষণ হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র এবং তিনি ছাড়া অন্য কোন মা’বূদ নেই। এই মলিনতা ও অপবিত্রতা হতে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ পাক রয়েছে। তিনি এক ও অভাবমুক্ত। তিনি পিতা-মাতা ও সন্তান হতে পবিত্র। তাঁর সমকক্ষ কেউই নেই।

Leave a Reply