(বই#৮৫১) সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল সুরা:১৭ ৪৫-৪৮ নং আয়াত:- [وَ اِذَا قَرَاۡتَ الۡقُرۡاٰنَ তুমি যখন কুরআন পাঠ কর, ] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৫১)
সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল
সুরা:১৭
৪৫-৪৮ নং আয়াত:-

[وَ اِذَا قَرَاۡتَ الۡقُرۡاٰنَ
তুমি যখন কুরআন পাঠ কর, ]
www.motaher21.net
وَ اِذَا قَرَاۡتَ الۡقُرۡاٰنَ جَعَلۡنَا بَیۡنَکَ وَ بَیۡنَ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ حِجَابًا مَّسۡتُوۡرًا ﴿ۙ۴۵﴾
তুমি যখন কুরআন পাঠ কর, তখন তোমার ও যারা পরলোকে বিশ্বাস করে না, তাদের মধ্যে এক আবরক পর্দা করে দিই।
وَّ جَعَلۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ اَکِنَّۃً اَنۡ یَّفۡقَہُوۡہُ وَ فِیۡۤ اٰذَانِہِمۡ وَقۡرًا ؕ وَ اِذَا ذَکَرۡتَ رَبَّکَ فِی الۡقُرۡاٰنِ وَحۡدَہٗ وَلَّوۡا عَلٰۤی اَدۡبَارِہِمۡ نُفُوۡرًا ﴿۴۶﴾
আমি তাদের অন্তরের উপর আবরণ দিয়েছি, যেন তারা উপলব্ধি করতে না পারে এবং তাদের কানে বধিরতা দিয়েছি। আর যখন তুমি তোমার প্রতিপালকের একত্বের কথা কুরআনে উল্লেখ কর, তখন তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে সরে পড়ে।
نَحۡنُ اَعۡلَمُ بِمَا یَسۡتَمِعُوۡنَ بِہٖۤ اِذۡ یَسۡتَمِعُوۡنَ اِلَیۡکَ وَ اِذۡ ہُمۡ نَجۡوٰۤی اِذۡ یَقُوۡلُ الظّٰلِمُوۡنَ اِنۡ تَتَّبِعُوۡنَ اِلَّا رَجُلًا مَّسۡحُوۡرًا ﴿۴۷﴾
যখন তারা কান পেতে তোমার কথা শোনে, তখন তারা কেন কান পেতে তা শোনে তা আমি ভাল করে জানি এবং এটাও জানি যে, গোপনে আলোচনাকালে সীমালংঘনকারীরা বলে, ‘তোমরা তো এক যাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ।’
اُنۡظُرۡ کَیۡفَ ضَرَبُوۡا لَکَ الۡاَمۡثَالَ فَضَلُّوۡا فَلَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ سَبِیۡلًا ﴿۴۸﴾
দেখুন, তারা আপনার কি উপমা দেয়! ফলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে , সুতরাং তারা পথ পাবে না।

৪৫-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

#আখেরাতের প্রতি ঈমান আনার স্বাভাবিক ফলশ্রুতিতে মানুষের মনের দরজায় তালা লেগে যায় এবং কুরআন যে দাওয়াত পেশ করে তার কানে তা প্রবেশ করে না। কুরআনের দাওয়াতের মূল কথাই তো হচ্ছে এই যে, দুনিয়াবী জীবনের বাইরের দিকটি দেখে প্রতারিত হয়ো না। এখানে কোন হিসেব ও জবাব গ্রহণকারীর অস্তিত্ব দৃষ্টিগোচর না হলেও একথা মনে করো না যে, তোমাকে কারো সামনে নিজের দায়িত্বপালনের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে না। এখানে যদি কুফরী, শিরক, নাস্তিক্যবাদ, তাওহীদ ইত্যাদি সবরকমের মতবাদ স্বাধীনভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে এবং এর ফলে পার্থিব দৃষ্টিতে কোন বিশেষ ফারাক দেখা দেয় না বলে মনে হয়, তাহলে একথা মনে করো না যে, তাদের কোন আলাদা ও স্থায়ী ফলাফলই নেই। এখানে যদি ফাসেকী ও অনাচারমূলক এবং আনুগত্য ও তাকওয়ার সবরকম কর্মনীতি অবলম্বন করা যেতে পারে এবং বাস্তব এদের মধ্য থেকে কোন একটি কর্মনীতির কোন অনিবার্য ফল দেখা না দেয়, তাহলে ও একথা মনে করো না যে আদতে কোন কার্যকর ও অপরিবর্তনশীল নৈতিক আইন নেই। আসলে হিসেব নেয়া ও জবাবদিহি করা সবকিছুই হবে কিন্তু তা হবে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে। একমাত্র তাওহীদের মতবাদ সত্য ও স্থায়িত্ব লাভকারী এবং বাদবাকি সব মতবাদই বাতিল। কিন্তু তাদের আসল ও চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ হবে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে এবং এ বাহ্যিক পর্দার পেছনে যে সত্য লুকিয়ে আছে তা সেখানে প্রকাশিত হবে। একটি অনড় ও অপরিবর্তনশীল নৈতিক আইন নিশ্চয়ই আছে যার দৃষ্টিতে পাপাচার মানুষের জন্য ক্ষতিকর এবং আল্লাহর আনুগত্য লাভজনক। কিন্তু সেই আইন অনুযায়ী শেষ ও চূড়ান্ত ফায়সালাও হবে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে। কাজেই তোমরা দুনিয়ার এ সাময়িক জীবনের মোহে মুগ্ধ হয়ে যেয়ো না এবং এর সন্দেহপূর্ণ ফলাফলের ওপর নির্ভর করো না। বরং সবশেষে নিজেদের অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন রবের সামনে তোমাদের যে জবাবদিহি করতে হবে সেদিকে নজর রাখো এবং যে সঠিক আকীদাগত ও নৈতিক দৃষ্টিভংগী তোমাদের আখেরাতের পরীক্ষায় সফলকাম করবে তা অবলম্বন করো। —এ হচ্ছে কুরআনের দাওয়াত। এখন যে ব্যক্তি আদৌ আখেরাতকেই মেনে নিতে প্রস্তুত নয় এবং এ দুনিয়ার ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ যাবতীয় বস্তু বিষয়ের মধ্যেই যার সমস্ত আস্থা ও বিশ্বাস সীমাবদ্ধ, সে কখনো কুরআনের এ দাওয়াতকে বিবেচনাযোগ্য মনে করতে পারে না। এ আওয়াজ হামেশা তার কানের পর্দায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকবে, কখনো মনোরাজ্যে প্রবেশ করার পথ পাবে না। এটি একটি মনস্তাত্বিক সত্য। সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ মনস্তাত্বিক সত্যকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, যে ব্যক্তি আখেরাত মানে না আমি তার অন্তর ও কান কুরআনের দাওয়াতের জন্য বন্ধ করে দিই। অর্থাৎ এটি আমার প্রাকৃতিক আইন। আখেরাত অস্বীকারকারীর ওপর এ আইনটি এভাবে প্রবর্তিত হয়। একথাও মনে থাকা দরকার যে, এটি মক্কার কাফেরদের নিজেদেরই উক্তি ছিল। আল্লাহ তাদের কথাটি তাদের ওপর উল্টে দিয়েছেন মাত্র। সূরা ‘হা-মীম-সাজদা’য় তাদের এ উক্তি উদ্ধৃত হয়েছেঃ

وَ قَالُوۡا قُلُوۡبُنَا فِیۡۤ اَکِنَّۃٍ مِّمَّا تَدۡعُوۡنَاۤ اِلَیۡہِ وَ فِیۡۤ اٰذَانِنَا وَقۡرٌ وَّ مِنۡۢ بَیۡنِنَا وَ بَیۡنِکَ حِجَابٌ فَاعۡمَلۡ اِنَّنَا عٰمِلُوۡنَ ؓ﴿۵﴾

অর্থাৎ “তারা বলে হে মুহাম্মাদ! তুমি যে জিনিসের দিকে দাওয়াত দিচ্ছো, তার জন্য আমাদের মনের দুয়ার বন্ধ, আমাদের কান বধির এবং আমাদের ও তোমার মধ্যে অন্তরাল সৃষ্টি হয়ে গেছে। কাজেই তুমি তোমার কাজ করো, আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।” (আয়াতঃ ৫)

এখানে তাদের এ উক্তিটির পুনরাবৃত্তি করে আল্লাহ বলছেন, এই যে অবস্থাটিকে তোমরা নিজেদের প্রশংসার্হ গুণ মনে করে বর্ণনা করছো, এটিতো আসলে একটি অভিশাপ, তোমাদের আখেরাত অস্বীকৃতির বদৌলতে যথার্থ প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী এটি তোমাদের ওপর পড়ছে।

# তুমি যে একমাত্র আল্লাহকে নিজের রব গণ্য করো তাদের তৈরী করা রবদের কোন কথা বলো না, এটা তাদের কাছে বড়ই বিরক্তিকর ঠেকে। মানুষ কেবল আল্লাহর মন্ত্র জপ করতে থাকবে, বুযর্গদের কার্যকলাপের কোন কথা বলবে না, মায়ার, পবিত্রস্থান ইত্যাদির অনুগ্রহ ও দাক্ষিণ্যলাভের কোন স্বীকৃতি দেবে না এবং তাদের মতে যেসব ব্যক্তির ওপর আল্লাহ তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়েছেন উদ্দেশ্যে তাদের কোন প্রশংসা বাণীও নিবেদন করবে না, এ ধরনের ‘ওহাবী’ আচরণ তাদের একদম পছন্দ নয়। তারা বলেঃ এ অদ্ভূত ব্যক্তিটির মতে, অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ, ক্ষমতা ও কুদরতের মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং অধিকার ও ব্যবহার ক্ষমতার অধিকারীও একমাত্র আল্লাহ। তাহলে আমাদের এ আস্তানা-মাযারের অধিবাসীদের গুরুত্ব কোথায় রইলো! অথচ তাদের ওখান থেকে আমরা সন্তান পাই, রুগীদের রোগ নিরাময় হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতি হয় এবং মনের আশা পূর্ণ হয়।

# মক্কার কাফের সরদাররা পরস্পর যেসব কথা বলাবলি করতো, এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের অবস্থা ছিল এই যে, তারা লুকিয়ে লুকিয়ে কুরআন শুনতো এবং তারপর তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতো। অনেক সময় তাদের নিজেদের লোকদের মধ্য থেকে কারো প্রতি তাদের সন্দেহ হতো যে, সে কুরআন শুনে প্রভাবিত হয়েছে। তাই তারা সবাই মিলে তাকে এ বলে বুঝাতো যে, ভাই এ তুমি কার ধোঁকায় পড়ে গেলে? এতো একজন যাদুগ্রস্ত ব্যক্তি। অর্থাৎ কোন শত্রু এর ওপর যাদু করে দিয়েছে। তাইতো প্ররোচনামূলক কথা বলে চলছে।
# এরা তোমার সম্পর্কে কোন একটি মত প্রকাশ করছে না। বরং বিভিন্ন সময় সম্পূর্ণ ভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী কথা বলছে। কখনো বলছে, তুমি নিজে যাদুকর। কখনো বলছে, তোমাকে কেউ যাদু করেছে। কখনো বলছে, তুমি কবি। কখনো বলছে, তুমি পাগল। এদের যে আসল সত্যের খবর নেই, এদের এসব পরস্পর বিরোধী কথাই তার প্রমাণ। নয়তো প্রতিদিন তারা একটা করে নতুন মত প্রকাশ করার পরিবর্তে কোন একটা চূড়ান্ত মত প্রকাশ করতো। তাছাড়া এ থেকে একথাও জানা যায় যে, তারা নিজেরা নিজেদের কোন কথায়ও নিশ্চিত নয়। একটি অপবাদ দেয়ার পর নিজেরাই অনুভব করছে, এটা তো ঠিকমতো খাপ খাচ্ছে না। তাই পরে আর একটা অপবাদ দিচ্ছে। আবার সেটাকেও খাপ খেতে না দেখে তৃতীয় আর একটা অপবাদ তৈরী করছে। এভাবে তাদের প্রত্যেকটা নতুন অপবাদ পূর্বের অপবাদের প্রতিবাদ করে। এ থেকে জানা যায়, সত্য ও সততার সাথে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। নিছক শত্রুতা বশত তারা একের পর এক বড় বড় মিথ্যা রচনা করে চলছে।

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

কাফির, মুশরিকরা কী কারণে সত্য পথ গ্রহণ করতে পারে না সে সম্পর্কে উক্ত আয়াতগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন যে, যখন তুমি কুরআন পাঠ কর তখন তোমার ও তাদের মাঝে পর্দা তৈরি করে দেই, ফলে তারা কুরআন শোনলেও বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পারে না। আর সেজন্যই তারা সঠিক পথ লাভ করতে পারে না।

এখানে مستور শব্দটি ساتر এর অর্থে ব্যবহৃত। এ পর্দা যদিও দেখা যায় না কিন্তু হিদায়াত গ্রহণের মধ্যে ও তাদের মধ্যে আড়াল সৃষ্টি হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَقَالُوْا قُلُوْبُنَا فِيْٓ أَكِنَّةٍ مِّمَّا تَدْعُوْنَآ إِلَيْهِ وَفِيْٓ اٰذَانِنَا وَقْرٌ وَّمِنْمبَيْنِنَا وَبَيْنِكَ حِجَابٌ فَاعْمَلْ إِنَّنَا عَامِلُوْنَ‏)‏

“তারা বলেঃ তুমি যার প্রতি আমাদেরকে আহ্বান করছ সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণে আচ্ছাদিত, কর্ণে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে আছে অন্তরায়; সুতরাং তুমি তোমার কাজ কর এবং আমরা আমাদের কাজ করি।” (সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১:৫)

আর এই সকল কারণে তারা সঠিক কথা শোনার পরও তা তাদের কাছে সঠিক বলে মনে হয় না। আর তারা সঠিক পথের অনুসরণ করতে পারে না। তারা তা থেকে পশ্চাদনুসরণ করে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَإِذَا ذُكِرَ اللّٰهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوْبُ الَّذِيْنَ لَا يُؤْمِنُوْنَ بِالْاٰخِرَةِ ج وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِيْنَ مِنْ دُوْنِه۪ٓ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُوْنَ)

“এক আল্লাহর কথা বলা হলে যারা আখিরাতকে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর ঘৃণায় ভরে যায় এবং যখন আল্লাহর পরিবর্তে (তাদের দেবতাগুলোর) উল্লেখ করা হয় তারা আনন্দিত হয়ে যায়।” (সূরা যুমার ৩৯:৪৫)

মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন কুরআন পাঠ করত তখন তারা তা চুপিসারে কান পেতে শ্রবণ করত, আর এ কথা শ্রবণ করে বিভিন্ন ধরনের কথা-বার্তা বানিয়ে তাঁর ওপর আরোপ করত। কখনো বলত জাদুকর, কখনো জাদুগ্রস্থ, কখনো উন্মাদ এবং কখনো জ্যোতিষী বলে আখ্যায়িত করত। তাদের এ সমস্ত কথা যে মিথ্যা তা তাদের কথার মাধ্যমেই বুঝা যায়। কারণ তারা তাদের মতের ওপর সঠিক ছিল না বলেই ভিন্ন ভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কথা বলত। এ সকল চিন্তা-ভাবনা তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করাতে বাধা দিত। সুতরাং ভাল কথা সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে না শুনলে কোন কাজে আসবে না, বরং তা গ্রহণের নিয়তে শুনতে হবে, তাহলেই উপকৃত হওয়া যাবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. যারা সত্য জানার ও মানার জন্য কুরআন ও হাদীস শোনে না তাদের মাঝে ও কুরআনের মাঝে আল্লাহ তা‘আলা পর্দা তৈরি করে দেন।
২. সঠিক কথা জানতে পারলে মেনে নেয়া আবশ্যক, অন্যথায় পরিণতি ভাল হবে না।

 

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

#  *কোরআনের বিস্ময়কর সম্মােহনী শক্তি : কোরায়শ সর্দাররা কোরআন শুনত এবং বুঝত যে, অবশ্যই এ সম্মােহনী বাণী হচ্ছে আল্লাহর কিন্তু তবু তারা মনের সাথে সংগ্রাম করতাে, যেন মন নরম না হয়, যেন তাদের স্বভাবের ওপর এর কোনাে প্রভাব পড়তে না পারে এই কারণেই তিনি তাদের ও রসূলের মধ্যে গােপন এক পর্দার আড়াল করে দিয়েছেন তাদের হৃদয় দুয়ারকে বন্ধ করে দিয়েছেন, ফলে কোরআন শুনলেও তারা বুঝতাে না। তাদের কানগুলোকে বধির করে দিয়েছেন, এজন্যে যা শুনত তা বেশীক্ষণ তারা মনে রাখতে পারতাে না। এরশাদ হচ্ছে,  “আর যখন তুমি কোরআন পড় তখন আমি, তােমার ও আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসীদের মধ্যে একটি পর্দা নিক্ষেপ করি যা তাদেরকে সত্য থেকে আড়াল করে রাখে… দেখো, কেমনভাবে তােমার জন্যে আল্লাহ তায়ালা উদাহরণ পেশ করছেন, এর পরও তারা ভুল পথটিই বেছে নিলো, ফলে তারা আর সঠিক পথে এগুতে পারবে না।'(আয়াত ৪৫-৪৮) ইবনে ইসহাক, তার রচিত ‘সীরাতে ইবনে হিশাম’ গ্রন্থে মােহাম্মাদ ইবনে মুসলিম থেকে রেওয়াত করেছেন যে মক্কার কিছুসংখ্যক কোরায়শ সর্দার যেমন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আবু জেহেল ইবনে হিশাম এবং আখনাস ইবনে শােরায়েক প্রমুখ ব্যক্তিরা ছিলাে বনু যােহরার মিত্র। এরা এক রাতে রসূলুল্লাহ(স.)-এর যবান মােবারক থেকে খেয়াল করে কোরআন পাঠ শােনার জন্যে রওয়ানা হলাে। তিনি তার বাড়ীতে নামায পড়ছিলেন এবং নামাযে কোরআন পাঠ করছিলেন। তখন তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ পছন্দমত জায়গায় বসে তারা মনােযােগ সহকারে কোরআন তেলাওয়াত শুনতে লেগে গেলাে, অন্ধকারের কারণে কে কোথায় বসেছে তারা দেখতে পাচ্ছিলাে না। অতপর তারা পাক কালামের তেলাওয়াত শুনতে শুনতে রাত কাটিয়ে দিলাে, অবশেষে ফজরের সময় হয়ে গেলে তারা সেখান থেকে উঠে গেলাে এং যাওয়ার পথে পরস্পরের সাথে সাক্ষাত হয়ে গেলাে; তখন তারা ‘সারারাত ধরে কেন থাকা হয়েছে’ একথা বলে একে অপরকে দোষারােপ করতে লেগে গেলাে এবং পরস্পর বলাবলি করলাে, যদি আমাদেরকে কেউ দেখে ফেলে এবং আমাদের এই ঘটনা জানতে পারে তাহলে মুশিকল হয়ে যাবে, অবশ্যই তার মনে কিছু না কিছু দাগ কেটে যাবে। সুতরাং অন্য কেউ যেন জানতে না পারে এবং আর যেন একাজের পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্যে একে অপরকে সাবধান করে তারা নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে গেলো। এরপর পরবর্তী রাত্রিতে, পূর্বের মতাে আবারও তারা লােভ সামলাতে না পেরে আল্লাহর পাক কালাম শুনতে গেলাে এবং পূর্ব রাত্রির ন্যায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় আসন নিলাে। এইভাবে এ রাতটিও কোরআন শুনতে শুনতে কাটিয়ে দিলাে এবং ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাে ও পথের মধ্যে আবারও পরস্পর সবার সাক্ষাত হয়ে গেলাে। তখন পূর্ব রাত্রির মতাে এবারও তারা পরস্পরকে দোষারােপ করলাে এবং তাই বললাে যা আগের রাত্রিতে বলেছিলাে। এরপর তারা নিজ নিজ বাড়ীতে ফিরে গেলাে। তৃতীয় রাত্রিতেও তারা এমনি করে, আল্লাহর পবিত্র কালাম শােনার প্রবল লােভ সামলাতে না পেরে আবারও আগের মতাে গেলাে, নিজ নিজ স্থানে বসে সারারাত ধরে শুনলাে এবং ফজরের ওয়াজ হয়ে গেলে বেরিয়ে এলাে, তারপর পথিমধ্যে পরস্পর মিলিত হলে আগের মতাে বলাবলি করলাে এবং বলল, আমরা এমনি করে, রোজ পরস্পর দেখা সাক্ষাত করে মত বিনিময় না করা পর্যন্ত ফিরবাে না। এ কথার ওপর একমত হয়ে তারা আপন আপন বাড়ীতে ফিরে গেলাে। পরে সকাল হয়ে গেলে আখনাস ইবনে শোরায়েক লাঠি হাতে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে গেলাে এবং তাকে ডেকে বললো, আচ্ছা, আবু হানযালা (এটা ছিলাে তার ডাকনাম), যা কিছু তুমি এ পর্যন্ত শুনেছে সে বিষয়ে তােমার মন্তব্য কী? আবু সুফিয়ান বললাে, শােনাে হে আবু সালাবা,আমি যা শুনেছি তা ঠিকই বুঝেছি এবং এর উদ্দেশ্য কি তাও বুঝেছি, আর এমন আরও কিছু কথা শুনেছি যা আমি বুঝিনি এবং তার উদ্দেশ্য কি তা হৃদয়ংগম করতে পারিনি। তখন আখনাস বললাে, আমি এবং ওই ব্যক্তি যার সাথে আমি হলফ করে বলেছি যে এসব কথা প্রকাশ করবাে না একইভাবে বুঝছি যা তুমি বুঝেছাে। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে এসে সে আবু জেহেলের বাড়ীতে গেলাে এবং তাকে বললাে, হে আবুল হাকাম, মােহাম্মদের কাছ থেকে যা কিছু শুনেছ-সে বিষয়ে তামার মতামত কী? সে বললো, তুমি কী শুনেছাে? আখনাস বললো, আমরা এবং বনু আবদে মানাফ বংশ মর্যাদা ও ঐশ্বর্য দেখানাের ব্যাপারে প্রতিযােগীতা করেছি, তারা দাওয়াত করে মানুষকে খাওয়ালাে, আমরাও লােকদেরকে দাওয়াত করে খাওয়ালাম, তারা যুদ্ধাভিযান চালালাে, আমরাও বীরত্বের সাথে যুদ্ধাভিযান চালালাম, তারা মানুষকে দান খয়রাত করলাে আমরাও যথেষ্ট লােককে দান খয়রাত করে তাদের সমানে সমানে থাকলাম, তারা হাঁটু গেড়ে বসে মানুষকে বিনয় প্রদর্শন করলাে আমরাও বিনয় দেখানাের প্রতিযােগিতায় হার মানলাম না এবং উট ও ঘােড়া সওয়ারীর প্রতিযােগিতায় আমরা তাদের সমান সমান থাকলাম। কিন্তু ওরা বললাে, আমাদের মধ্যে একজন নবী আছে, যার কাছে আকাশ থেকে ওহী আসে, এখন এটা আমরা কোত্থেকে পাবাে? আল্লাহর কসম, কিছুতেই এবং কখনােই তার প্রতি আমরা ঈমান আনবাে না এবং তাকে নবী বলে মানবও না ! বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আখনাস সেখান থেকে উঠে এলাে এবং তাকে পরিত্যাগ করলাে (ও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললে)। তৎকালীন কোরায়শ জনগণের প্রকৃতির ওপর অবশ্যই আল কোরআনের প্রভাব পড়তাে, কিন্তু তারা, নিজেদের প্রাধান্যকে টিকিয়ে রাখার হীন মানসিকতার কারণে এ প্রভাবকে সর্বদাই প্রতিহত করতাে। তবুও তাদের অন্তর আল কোরআনের দিকে অবশ্যই আকৃষ্ট হয়ে থাকতাে, যা তারা শত চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারতাে না। তাদের নিজ প্রকৃতির বিরুদ্ধে, পার্থিব ক্ষণস্থায়ী স্বার্থের অপচেষ্টার কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাদের ও রসূলের মাঝে এক অদেখা পর্দা দিয়ে আড়াল সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন, এজন্যে সত্যকে তারা অনুভব করা সত্তেও চোখে দেখতে পেত না, এর ফলে কোরআন থেকে তারা কোনাে ফায়দা গ্রহণ করতে পারতাে না, আর অনেক সময় তারা কোরআন তেলাওয়াত করা সত্তেও এর থেকে সঠিক পথের সন্ধান (হেদায়াত) নিতে পারতাে না। এইভাবে, তাদের অন্তরের ওপর কোরআনের প্রভাবের ব্যাপারে তারা পরস্পর পরামর্শ করতাে বটে, কিন্তু অবশেষে কোরআন থেকে দূরে থাকতে হবে, আর শােনা ঠিক হবে না-ইত্যাদি কথা বলাবলি করতাে, তবু পুনরায় অজানা এক আকর্ষণে আবার শোনার জন্যে এগিয়ে যেত, আবারও কোরআনের ধারে কাছে ঘেঁষা যাবে না বলে নতুন করে পরামর্শ করত, শেষ পর্যন্ত আর আসা যাবে না বলে দৃঢ়তার সাথে সংকল্প নিত এবং পরম আকর্ষণীয় এ পাক কালাম থেকে তাদের হৃদয় মনকে দূরে সরিয়ে নিত। এই আকর্ষণের কারণ ছিলাে এই যে, সমগ্র কোরআনের মধ্যে বারবার ঘুরে ঘুরে এ তাওহীদের আকীদাকেই তুলে ধরা হয়েছে যা তাদের হৃদয় দুয়ারে প্রচন্ড আঘাত হানত এবং চাপ সৃষ্টি করতাে তাদের বন্ধমূল ধারণা ও অলীক কল্পনার ওপরে এবং তাদের মেকী শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মানসিকতার ওপরে কিন্তু তবুও তারা কোরআন থেকে ঘৃণাভরে দূরেই সরে যেতাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যখন তুমি কোরআন তেলাওয়াত করার মধ্য দিয়ে একমাত্র তােমার রবকেই স্মরণ করাে তখন ওরা ঘৃণা ভরে পিঠ ফিরিয়ে চলে যায়।’ তাদের ঘৃণা ছিলাে তাওহীদের প্রতি, কারণ এ ধ্বনি ছিলাে তাদের প্রচলিত সামাজিক জীবনের ওপর এক প্রচন্ড শেলের আঘাতের মতাে, যার ভিত্তি ছিলাে পৌত্তলিকতা ও অন্ধ জাহেলী অনুসরণের ওপর। তা ছাড়া কোরায়শরা তাদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে যে অধপতন সৃষ্টি হয়েছিলাে সে বিষয়ে ভালভাবেই বুঝত এবং ইসলাম গ্রহণ করার পর মানুষের মধ্যে যে দৃঢ়তা পয়দা হতাে তাও তাদের সামনে ছিলাে, মহগ্রন্থ আল কোরআনের মধ্যে যে সব অজানা রহস্যপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলােচনা এসেছে এবং এর ভাষা ভংগি, আলােচ্য বিষয়সমূহের ব্যাপকতা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের যে গভীর রহস্য এর মধ্যে বিদ্যমান এসব কিছু যে তাদের অজানা ছিল তা নয়। আল কোরআনের এ সম্মােহনী আকর্ষণকে তারা কিছুতেই দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম ছিলাে না। এর প্রভাব বলয় থেকেও তারা এড়াতে পারছিলাে না এবং যতােই মন থেকে আল কোরআনের কথা ঝেড়ে মুছে ফেলতে চাইতাে, ততােবারই তাদের অজান্তে তারা দেখতাে কোরআনের কথাগুলাে সদা সর্বদা তাদের মনের মধ্যে আনাগােনা করছে এবং কিছুতেই তাদের মন থেকে এসব কথা মুছে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। আর তৎকালীন মানুষের প্রকৃতি তাদেরকে আল্লাহর কালাম শুনতে এবং এর প্রভাব গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করছিলাে, অপরদিকে তাদের অহংকার কোরআনকে মেনে নিতে ও আনুগত্য করতে বাধা দিচ্ছিলাে। একারণে তারা রসূলুল্লাহ(স.)-কে নানাভাবে দোষারােপ করে চলছিলাে ও তার বিরুদ্ধে নানা প্রকার অপবাদ রটাচ্ছিলাে-এতে তাদের স্বার্থ ছিলাে নিজেদের বড় প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা ও বিদ্বেষ প্রদর্শন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর ওই যালেমরা বললাে, (তােমরা ত যাদুগ্রন্ত যাদুর স্পর্শ পাওয়া) একজন মানুষেরই অনুসরণ করছো।’ ওপরের এই কথাটিই সাক্ষ্য দেয়, কত গভীরভাবে আল কোরআন তাদের হৃদয়কে প্রভাবিত করতাে, আর এই প্রভাবকে এড়ানাের উদ্দেশ্যে ও অন্তর থেকে কোরআনের আকর্ষণ ধুয়ে মুছে ফেলে দেয়ার জন্যে তারা অত্যন্ত বেশী বেশী করে বলতাে, ‘এটা মানুষের কথা।’ কারণ তারা গভীরভাবে অনুভব করত যে এর মধ্যে মানবীয় শক্তির উর্ধ্বের বেশ কিছু উপাদান রয়েছে, যার কিছু নীরব পদধ্বনি তাদের চেতনার মধ্যে যেন তারা শুনতে পেতাে এবং তার নীরব স্পর্শকে তারা যাদু বলে অভিহিত করতাে-আর যার মুখ দিয়ে তাদের কাছে কথাগুলাে পৌছত তাকে বলতাে সে অবশ্যই একজন যাদুগ্রস্ত মানুষ, অর্থাৎ আল্লাহর কালাম তাদের হৃদয় প্রাণকে এমন গভীরভাবে আকর্ষণ করতাে যে দিশেহারা হয়ে গিয়ে তারা কি বলবে ঠিক পেতাে না, কখনও বলতাে ‘এ লােকটি যাদুকর’, যার কথা হৃদয়কে মােহিত করে ফেলে। আবার তাকেই যাদুগ্রস্ত বা পাগল বলে লােকদেরকে তার থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করতাে, কিন্তু তার ফল হতাে উলটা, অর্থাৎ লােকজন আরাে বেশী কৌতূহলী হয়ে তার কথা শােনার জন্যে এগিয়ে যেতাে। প্রকৃতপক্ষে, এসব লাগামছাড়া কথা দ্বারা নিজেদেরই তারা সাধারণ মানুষের কাছে অস্থির মস্তিষ্ক বলে প্রমাণিত করতাে, সাথে সাথে কোরআনে পাকের উজ্জ্বলতা বলিষ্ঠতা, যৌক্তিকতা, সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য দেখানাের যােগ্যতা এর ভাষার মধ্যে ছন্দের গতিময়তা, এর অর্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব ও হৃদয়গ্রাহী গাঁথুনী তাদের যেন ডাক দিয়ে বলতাে, না, না, এসব বাজে কথা নয়, মােহাম্মদের নিজের তৈরী করা কথাও এসব নয়। অবশ্যই একথাগুলাে সে নিজে বলছে না, নিশ্চয়ই একথাগুলাে যাদু, কারণ যাদর স্পর্শ না হলে কোনাে মানুষের কথায় এতাে শক্তি থাকতে পারে না! তবে, অবশ্যই এটা সত্য কথা, যদি ওরা বিবেচক হতাে, ইনসাফ করে কথা বলত তাহলে বলতে বাধ্য হত যে, এগুলাে নিশ্চয়ই আল্লাহর কথা, অবশ্যই এগুলাে কোনাে মানুষের কথা হতে পারে না। এমন কেউও এসব কথা বানাতে পারে না, যাকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘দেখাে কেমন করে ওরা তােমার উদাহরণ দিয়েছে, এর ফলে তারা সঠিক পথ থেকে সরে গেছে, অতপর কিছুতেই তারা আর হেদায়াতের পথে আসতে পারবে না।’ তােমার উদাহরণ দিতে গিয়ে ওরা বুঝাচ্ছে যে, তুমি একজন যাদুগ্রস্ত মানুষ, অথচ অবশ্যই তুমি যাদুগ্রস্ত নও। অবশ্য অবশ্যই তুমি একজন রসূল বিশ্বপ্রভুর বার্তাবাহক কিন্তু তারা সঠিক পথ থেকে সরে গেলো এবং তারা হেদায়াত পেলাে না, আর দিশেহারা হয়ে গেলাে তারা, যার ফলে তারা এমন পথ পাচ্ছে না যার ওপর দৃঢ়তার সাথে চলতে পারে কখনােই তারা সরল সঠিক পথ পাবে না, পাবে না সন্দেহমুক্ত ও যুক্তিপূর্ণ পথের সন্ধান! এটাই ছিলো আল কোরআন সম্পর্কে তাদের মন্তব্য এবং রসূল(স.) সম্পর্কে তাদের মতামত, অথচ তিনি তাে তাদের সামনে আল কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন, কালামে পাক থেকেই তাদেরকে শােনাচ্ছিলেন পুনরুথান সম্পর্কে এবং তারা অস্বীকার করছিলাে আখেরাতকে।

 

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# ৪৫-৪৬ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ কুরআন পাঠের সময় তাদের অন্তরে পর্দা পড়ে যায়। কাজেই কুরআন তাদের অন্তরে মোটেই ক্রিয়াশীল হয় না। ঐ পর্দা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখানে (আরবি) শব্দটি (আরবি) এর অর্থবোধক। যেমন (আরবি) ও (আরবি) যথাক্রমে (আরবি) এবং (আরবি) এর অর্থবোধক। এ পর্দা যদিও বাহ্যতঃ দেখা যায় না, কিন্তু হিদায়াতের মধ্যে ও তাদের মধ্যে আল্লাহ তাআ’লী পৃথককারী হয়ে যান।

মুসনাদে আবি ইয়ালা মুসিলীর মধ্যে বর্ণিত আছে যে, যখন (আরবি) সূরাটি অবতীর্ণ হয় তখন (আবু লাহাবের স্ত্রী) উম্মে জামীল একটি তীক্ষ্ণ পাথর হাতে নিয়ে এই নিন্দিত ব্যক্তিকে আমরা মানবো না’ একথা চীৎকার করে বলতে বলতে আসে। সে আরো বলেঃ তার দ্বীন আমাদের কাছে পছন্দনীয় নয়। আমরা তার ফরমানের বিরোধী। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) বসে ছিলেন। হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর পাশেই ছিলেন। তিনি তাঁকে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সে তো আসছে! আপনাকে দেখে ফেলবে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “নিশ্চিন্ত থাকো। সে আমাকে দেখতে পাবে না।” অতঃপর তিনি তার থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ শুরু করে দেন। এই আয়াতটিই তিনি পাঠ করেন। সে এসে হযরত আবু বকরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেঃ “আমি শুনেছি যে, তোমাদের নবী (সঃ) নাকি আমার দুনমি করেছে?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “না, না। কা’বার প্রতিপালকের শপথ! তিনি তোমার কোন দুর্নাম বা নিন্দা করেন নাই।” সে সমস্ত কুরায়েশ জানে যে, আমি তাদের নেতার কন্যা’ একথা বলতে বলতে ফিরে গেল। (আরবি) শব্দটি (আরবি) শব্দের বহুবচন। ঐ পর্দা তাদের অন্তরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, যার কারণে তারা কুরআন বুঝতে পারে না। তাদের কানে বধিরতা রয়েছে, যার কারণে তারা তা এমনভাবে শুনতে পায় না যাতে তাদের উপকার হয়।

মহান আল্লাহ স্বীয় নবীকে (সঃ) বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! যখন তুমি কুরআনের এ অংশ পাঠ কর যাতে আল্লাহর একত্বের বর্ণনা রয়েছে তখন তারা পলাতে শুরু করে। (আরবি) শব্দটি (আরবি) শব্দের বহুবচন , যেমন (আরবি) শব্দের বহু বচন এসে থাকে। আবার এও হতে পারে যে, এটা ক্রিয়া ছাড়াই ধাতুমূল রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ “একক আল্লাহর বর্ণনায় বেঈমান লোকদের মন বিরক্ত হয়ে ওঠে।” মুসলমানদের “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ মুশরিকদের মন বিষিয়ে তোলে। ইবলীস এবং তাঁর সেনাবাহিনী এতে খুবই বিরক্ত হতো ও এটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করতো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল তাদের বিপরীত। তিনি চান তার এই কালেমাকে সমুন্নত করতঃ এটাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে। এটা এমন একটি কালেমা যে, এর উক্তিকারী সফলকাম হয় এবং এর উপর আমলকারী সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। দেখো, এই উপদ্বীপের অবস্থা তোমাদের চোখের সামনে রয়েছে, এখান থেকে ওখান পর্যন্ত এই পবিত্র কালেমা ছড়িয়ে পড়েছে। একথাও বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা শয়তানদের পলায়নকে বুঝানো হয়েছে। একথাও সঠিকই বটে যে, আল্লাহ তাআলার যিকর হতে, আযান হতে এবং কুরআন পাঠ হতে শয়তান পলায়ন করে থাকে। কিন্তু এই আয়াতের এই তাফসীর করা গারাবাত বা দুর্বলতা মুক্ত নয়।
# ৪৭-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেনঃ কাফির নেতৃবর্গ পরম্পর কথা বানিয়ে নিতো, সেটাই মহান আল্লাহ স্বীয় নবীকে (সঃ) জানিয়ে দিচ্ছেন। তিনি স্বীয় নবীকে (সঃ) সম্বোধন করে বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! যখন তুমি কুরআন পাঠে নিমগ্ন থাকো তখন এই কাফির ও মুশরিকদের দল চুপে চুপে পরস্পর বলাবলি করেঃ এর উপর কেউ যাদু করেছে। ভাবার্থ এও হতে পারে? এতো একজন মানুষ, যে পানাহারের মুখাপেক্ষী। যদিও এই শব্দটি এই অর্থে কবিতাতেও এসেছে এবং ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) এটাকে সঠিকও বলেছেন, কিন্তু এতে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এই স্থলে তাদের একথা বলার উদ্দেশ্য এই ছিল যে, স্বয়ং এ ব্যক্তি যার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে কেউ কি আছে যে, তাকে এই সময় কিছু পড়িয়ে যায়? কাফিররা তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা প্রকাশ করতো। কেউ বলতো যে, তিনি কবি। কেউ বলতো যাদুকর এবং কেউ বলতো পাগল। এজন্যেই আল্লাহ পাক বলনেঃ দেখো, কিভাবে এরা বিভ্রান্ত হচ্ছে! তারা সত্যের দিকে আসতেই পারছে না। বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) মুখে আল্লাহর কালাম শুনবার উদ্দেশ্যে রাত্রিকালে আবু সুফিয়ান ইবনু হারব, আবু জেহেল ইবনু হিশাম এবং আখনাস ইবনু শুরায়েক নিজ নিজ ঘর হতে বেরিয়ে আসে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের ঘরে রাত্রের নামায (তাহাজ্জদ) পড়ছিলেন। এই তিন ব্যক্তি চুপে চুপে। এদিকে ওদিকে বসে পড়ে। তাদের একের অপরের কোন খবর ছিল না। রাত্রি পর্যন্ত তারা শুনতে থাকে। ফজর হয়ে গেলে তারা সেখান থেকে চলে যায়। ঘটনাক্রমে পথে তাদের পরপরে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। তখন তারা একে অপরকে তিরস্কার করে বলেঃ “আমাদের এরূপ করা উচিত নয়। নতুবা সব লোক তাঁরই হয়ে যাবে।” কিন্তু পরবর্তী রাত্রেও আবার ঐ তিন জনই আসে এবং নিজ নিজ জায়গায় বসে গিয়ে কুরআন শুনতে শুনতে রাত্রি কাটিয়ে দেয়। ফজরের সময় তারা চলে যায়। পথে আবার তাদের মিলন ঘটে। আবার তারা পূর্ব রাত্রির কথার পুনরাবৃত্তি করে। তৃতীয় রাত্রেও এরূপই ঘটে। তখন তারা পরস্পর বলাবলি করেঃ “এসো, আমরা অঙ্গীকার করি যে, এরপর আমরা এভাবে কখনোই আসবো না।” এভাবে আহদ ও অঙ্গীকার করে তারা পৃথক হয়ে যায়। সকালে আখনাস তার লাঠি ধরে আবু সুফিয়ানের (রাঃ) বাড়ীতে যায় এবং বলেঃ “হে আবূ হানযালা’! বলতো, মুহাম্মদের (সঃ) ব্যাপারে তোমার মত কি?” আবু সূফিয়ান (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “হে আবু সালারা! আমি কুরআনের যে আয়াতগুলি শুনেছি সেগুলির মধ্যে অনেকগুলিরই ভাবার্থ। আমি বুঝেছি। কিন্তু বহু আয়াতের অর্থ আমি বুঝতে পারিনি।” আখনাস বললোঃ “আমার অবস্থাও তাই।” এখান থেকে বিদায় হয়ে আখনাস আবু জেহেলের কাছে গেল এবং তাকেও অনুরূপ প্রশ্ন করলো। তখন আবূ জেহেল বললোঃ “শুন, শরাফত ও নেতৃত্বের ব্যাপার নিয়ে আবদে মানাফের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের ঝগড়া চলে আসছে। তারা মানুষকে সওয়ারী দান করেছে, তাদের দেখা দেখি আমরাও মানুষকে সওয়ারীর জন্তু দান করেছি। তারা জনগণের সাথে সদাচরণ করেছে এবং তাদেরকে পুরস্কার দিয়েছে, এ ব্যাপারে আমরাও তাদের পিছনে থাকা পছন্দ করি নাই। এসব কাজে যখন তারা ও আমরা সমান হয়ে গেলাম এবং কোন ক্রমেই তারা আমাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারলো না তখন হঠাৎ করে তারা বলে বসলো যে, তাদের মধ্যে নুবুওয়াত রয়েছে। তাদের মধ্যে এমন একটি লোক রয়েছে যার কাছে নাকি আকাশ থেকে ওয়াহী এসে থাকে। এখন তুমি বলতো, আমরা কি করে একে মানতে পারি? আল্লাহর শপথ! আমরা কখনো এর উপর ঈমান আনবো না এবং কখনো তাকে সত্যবাদী বলে স্বীকার করবো না।” এ সময় আখনাস তাকে ছেড়ে যায়। (এ ঘটনাটি ‘সীরাত ইবনু ইসহাক’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে)।

Leave a Reply