(বই#৮৫৩) সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল সুরা:১৭ ৪৯-৫২ নং আয়াত:- [ وَقَالُواْ أَيِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا তারা বলে, ‘আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হলেও কি . ..? ] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৫৩)
সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল
সুরা:১৭
৪৯-৫২ নং আয়াত:-
[ وَقَالُواْ أَيِذَا كُنَّا عِظَامًا وَرُفَاتًا
তারা বলে, ‘আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হলেও কি . ..? ]
www.motaher21.net
وَ قَالُوۡۤاءَ اِذَا کُنَّا عِظَامًا وَّ رُفَاتًاءَ اِنَّا لَمَبۡعُوۡثُوۡنَ خَلۡقًا جَدِیۡدًا ﴿۴۹﴾
তারা বলে, ‘আমরা অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হলেও কি নতুন সৃষ্টিরূপে পুনরুত্থিত হব?’

قُلۡ کُوۡنُوۡا حِجَارَۃً اَوۡ حَدِیۡدًا ﴿ۙ۵۰﴾
বল, ‘তোমরা হয়ে যাও পাথর অথবা লোহা।
اَوۡ خَلۡقًا مِّمَّا یَکۡبُرُ فِیۡ صُدُوۡرِکُمۡ ۚ فَسَیَقُوۡلُوۡنَ مَنۡ یُّعِیۡدُنَا ؕ قُلِ الَّذِیۡ فَطَرَکُمۡ اَوَّلَ مَرَّۃٍ ۚ فَسَیُنۡغِضُوۡنَ اِلَیۡکَ رُءُوۡسَہُمۡ وَ یَقُوۡلُوۡنَ مَتٰی ہُوَ ؕ قُلۡ عَسٰۤی اَنۡ یَّکُوۡنَ قَرِیۡبًا ﴿۵۱﴾
‘অথবা এমন কোন সৃষ্টি যা তোমাদের অন্তরে খুবই বড় মনে হয় ; ‘ তবুও তারা বলবে, ‘কে আমাদেরকে পুনরুত্থিত করবে? বলুন, ‘তিনিই, যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন ।’ অতঃপর তারা আপনার সামনে মাথা নাড়বে ও বলবে , ‘সেটা কবে? ’ বলুন, সম্ভবত সেটা হবে শীঘ্রই,
یَوۡمَ یَدۡعُوۡکُمۡ فَتَسۡتَجِیۡبُوۡنَ بِحَمۡدِہٖ وَ تَظُنُّوۡنَ اِنۡ لَّبِثۡتُمۡ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿٪۵۲﴾
যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহবান করবেন[১] এবং তোমরা প্রশংসার সাথে তাঁর আহবানে সাড়া দিবে এবং তোমরা মনে করবে, তোমরা অল্পকালই অবস্থান করেছিলে?’

৪৯-৫২ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

যারা কিয়ামত ও পুনরুত্থানকে অস্বীকার করে, অসম্ভব মনে করে এখানে তাদের উত্তর দেয়া হয়েছে। বস্তুবাদী কাফির-মুশরিকরা মনে করে কিভাবে পুনরুত্থান সম্ভব? অথচ আমরা মরে গেলে হাড়ে পরিণত হয়ে যাব, দেহ ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, কোন অস্তিত্ব থাকবে না, এরপরেও কি নতুন করে সৃষ্টি করা সম্ভব? এটা কোনদিন সম্ভব হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে দিতে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, বল: শুধু হাড় বা মাটি কেন তোমরা পাথর হয়ে গেলেও অথবা লোহা হয়ে গেলেও অথবা এমন কিছুতে পরিণত হয়ে যাও যা তোমাদের ধারণায় তার মধ্যে জীবন দেয়া খুবই কঠিন, তা হতেও আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে পুনরায় জীবিত করবেন, এটা তাঁর জন্য কোন কঠিন বিষয় নয়। তাদের এ কথা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَّنَسِیَ خَلْقَھ۫ﺚ قَالَ مَنْ یُّحْیِ الْعِظَامَ وَھِیَ رَمِیْمٌﮝقُلْ یُحْیِیْھَا الَّذِیْٓ اَنْشَاَھَآ اَوَّلَ مَرَّةٍﺚ وَھُوَ بِکُلِّ خَلْقٍ عَلِیْمُﮞ)

“আর সে আমার সম্পর্কে উদাহরণ বর্ণনা করে, অথচ সে নিজের জন্মের কথা ভুলে যায়। সে বলে: কে জীবিত করবে এ হাড়গুলোকে, যখন তা পঁচে গলে যাবে? বলুন! তিনিই এগুলোকে আবার জীবিত করবেন, যিনি তা প্রথমবারে সৃষ্টি করেছেন। আর যিনি সর্বপ্রকার সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন।” (সূরা ইয়াসিন ৩৬:৭৮-৭৯)

যখন এভাবে উত্তর দেয়া হয় তখন স্বীকার করেও অস্বীকৃতিমূলকভাবে মাথা নাড়িয়ে বলে এটা কখন করা হবে। তারা বলত:

(وَيَقُوْلُوْنَ مَتٰي هٰذَا الْوَعْدُ إِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِيْنَ)

“আর তারা বলে: তোমরা যদি সত্যবাদী হও (তবে বল:) এই প্রতিশ্রুতি কবে বাস্তবায়িত হবে?” (সূরা মুলক ৬৭:২৫)

তাদের এ কথার উত্তর দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(ثُمَّ اِذَا دَعَاکُمْ دَعْوَةًﺣ مِّنَ الْاَرْضِﺣ اِذَآ اَنْتُمْ تَخْرُجُوْنَ)

“আবার যখন তিনি তোমাদেরকে জমিন থেকে (বের হয়ে আসার জন্য) আহ্বান করবেন, তখন তোমরা সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে আসবে।” (সূরা রূম ৩০:২৫) আর সে সময়টা খুবই নিকটে। যখন আল্লাহ তা‘আলার ডাকে সাড়া দিয়ে পুনরুত্থিত হবে তখন তাদের কাছে দুনিয়ার জীবনটা মনে হবে খুবই সামান্য সময়ের।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوْآ إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا) ‏

“যেদিন তারা তা দেখবে, তাতে তাদের মনে হবে যেন তারা (পৃথিবীতে) এক সন্ধ্যা অথবা এক সকালের অধিক অবস্থান করেনি।” (সূরা নাযিয়াত ৭৯:৪৬)

এরূপ সূরা মু’মিনুনের ১১২-১১৪ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং পুনরুত্থানকে মানুষ যতই অসম্ভব মনে করুক, তাতে অসম্ভবের কিছুই নেই বরং সকলকে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে হাজির হতে হবে। সে পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হোক আর মাটিতে মিশে যাক আল্লাহ তা‘আলা তাকে উপস্থিত করবেন।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. মানুষ মৃত্যুর পর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও আল্লাহ তা‘আলা পুনরুত্থিত করবেন।
২. যিনি প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন তিনি দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আরো অধিক সক্ষম।
৩. পুনরুত্থানের পর মানুষের কাছে মনে হবে যেন তারা অল্প কিছুক্ষণ পৃথিবীতে অবস্থান করেছে।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*একটি অবধারিত মহাসত্য : এরশাদ হচ্ছে, ‘আর ওরা বললাে, আমরা যখন হাডিডতে পরিণত হব এবং চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাব, তখন কি আবার নতুন এক সৃষ্টি হয়ে উঠে আসব?… সেদিন তিনি তােমাদেরকে ডাক দেবেন আর তােমরা তখন তার অনুগত বান্দা হিসাবে, তার প্রশংসা গীতি গাইতে গাইতে তার ডাকে সাড়া দিবে, আর তােমরা তখন ভাবতে থাকবে যে তােমরা সামান্য কিছু সময়ের জন্যেই (কবরের মধ্যে) অবস্থান করেছিলে।'(আয়াত ৪৯-৫২) মৃত্যুর পর আবার জীবিত হওয়ার বিষয়টি ছিলাে রসূলুল্লাহ(স.) ও মােশরেকদের মধ্যে বিরাট একটি বিতর্কের বিষয়। কোরআনে কারীমে এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন প্রসংগে বিস্তর আলােচনা এসেছে, এর ব্যাখ্যাও অনেকভাবে দেয়া হয়েছে। যার কারণে জীবন ও মৃত্যুর রহস্য সম্পর্কে অনুমান করা যায়, পুনরায় জীবিত হওয়া ও আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়ার বিষয়ে অনুমান করা যায়। এ বিষয়ের ওপর কোরআনে করীম বহুবার আলােকপাত করেছে, কিন্তু ওই হতভাগা জাতি এ ব্যাখ্যাকে সঠিকভাবে ও বিস্তারিতভাবে বুঝতে সক্ষম হয়নি। তাদের কাছে মৃত্যুর পরে আবার জীবিত হয়ে উঠে আসা এবং হাশরের ময়দানে হাযির হওয়ার ব্যাপারটা খুবই কঠিন এবং বড়ােই অবােধ্য মনে হচ্ছিলাে, কেননা যে দেহ পচে গলে মাটিতে মিশে যাবে, যার কোনাে চিহ্নই থাকবে না, তার অণুপরমাণুগুলো আবার একত্রিত হয়ে জীবিত মানুষ আকারে কি উঠে আসবে, এটা কিছুতেই বুঝা যায় না। এজন্যে তাদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘আর ওরা বলতে লাগলাে, আমরা যখন হাড্ডিতে পরিণত হয়ে যাবাে, হয়ে যাবাে চূর্ণ বিচূর্ণ অস্থি সে অবস্থা থেকে কি আমরা নতুন এক সৃষ্টি হিসাবে আবারও উঠে আসবাে?’ এসব লােক পুনরুত্থান সম্পর্কে এতাে সন্দিহান হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারা কখনাে এটা চিন্তা করেনি যে তাদের অস্তিত্ব না থেকে ‘হা’তে কেমন করে আসলাে-সেটাই যদি সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে দ্বিতীয়বার জন্ম হওয়া সম্ভব না হবে কেন। প্রকৃতপক্ষে প্রথমবারে অস্তিত্বে আসা তো আরাে কঠিন ছিলাে। আরাে আমাদের চিন্তা করা দরকার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে যখন সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মনে করা হয়, তখন তাে একথা বুঝা দরকার যে সবই তার ক্ষমতাধীন, এমন কোনাে জিনিস নেই যেখানে তার ক্ষমতা কাজ করে না, অতএব, মহান আল্লাহর পক্ষে অসম্ভব কিছুই নেই। সব কিছুর ব্যাপারে সৃষ্টি যন্ত্র এবং সৃষ্টিক্রিয়া তাে একই, আর তা হচ্ছে যখন বলা হয়, ‘হয়ে যাও’, আর তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।’ একথাটা মানুষের নযরে কঠিন হলেও সৃষ্টিকর্তার কাজে এটা সব সময়ে একইভাবে সহজ। এজন্যে শুধু প্রয়ােজন তার এরাদা বা ইচ্ছা। আসলে এর বিপরীত চিন্তাটাই হচ্ছে আশ্চর্যজনক, এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, পাথর অথবা লােহা অথবা তােমাদের অন্তরে এর থেকে আরাে কোনাে বড় জিনিসও যদি হতে ইচ্ছা করে তাহলে তাই হয়ে যাও।’ হাড় ও চুর্ণ বিচূর্ণ দেহাবশেষের মধ্যে মানুষের গন্ধ পাওয়া যায় এবং এগুলাে বলার সাথে সাথে পার্থিব জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। অপরদিকে লােহা ও পাথর জীবন থেকে অধিক দূরের জিনিস, এজন্যে তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা পাথর অথবা লােহা হয়ে যাও অথবা অন্য কোনাে সৃষ্টি, কিংবা পাথর ও লােহা থেকেও আরাে অনেক দূরের জিনিস যা মানুষের কাছে খুব বড় বলে মনে হয়। তবে মনে রেখাে তোমরা যাই হওনা কেন পুনরায় তােমাদের উঠতেই হবে। লােহা এমন একটি খনিজ পদার্থ যা অত্যন্ত শক্ত ও বড় জিনিস বলে মানুষ জানে এবং শক্তির প্রতীক হিসাবে এটাকে ব্যবহার করে। এর মধ্যে জীবনের সজীবতা ও বলিষ্ঠতার সন্ধান পাওয়া যায় যা তােমাদের অন্তর অনেকাংশে বুঝতে পারে, এতদসত্বেও শীঘ্রই আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে (কবর থেকে) তুলবেন। আসলে যতাে চিন্তা করা হােক না কেন আর যতাে প্রকার উপমাই দেয়া হােক না কেন, ওরা কখনও পাথর বা লােহা বা আর কিছু হবে না, ওরা মাটির মানুষ মাটিতেই মিশে যাবে এবং সুনির্দিষ্ট দিনে সেখান থেকেই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তুলে আনবেন। ওপরে প্রদত্ত উপমাটা দেয়া হয়েছে একটা সীমার মধ্যে মানুষের মন মগযকে সীমাবদ্ধ রাখার জন্যে। এমনিভাবে ওপরের কথার মধ্যে একটি ধমকের সুরও প্রচ্ছন্ন রয়েছে। পাথর এবং লােহা জড় পদার্থ, যা না পারে অনুভব করতে, আর না পারে কারাে ওপর প্রভাব ফেলতে। একথার মধ্যে একটা ইশারা রয়েছে যে মানুষের চিন্তা চেতনার মধ্যে, আংশিক হলেও বন্ধাত্ব এবং পাথরের জড়ত্ব রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, অতপর শীঘ্রই ওরা বলবে, কে আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। অর্থাৎ, আমরা যদি গলিত লাশে পরিণত হয়ে যাই এবং শুধু জীর্ণ শীর্ণ হাড়গুলাে অবশিষ্ট থেকে যায়, আর তাও যদি মাটিতে মিশে যায়-সে অবস্থায়-কে আমাদেরকে পুনরায় জীবন দান করবে? যা মৃত্যুর পর এবং জীবনের সকল চিহ্ন মুছে যাওয়ার পর পুনরায় জীবিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনা আরাে আরাে কঠিন হবে না কি? এরশাদ হচ্ছে, ‘বলাে, (যিন্দা করে তুলবেন তিনি) যিনি তােমাদেরকে প্রথম বারে সৃষ্টিকরেছেন।’ তারা এ জীবন শেষে পুনরায় উঠে আল্লাহর দরবারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে যে সন্দেহ করছিলাে এবং পচে গলে মাটিতে মিশে যাওয়ার পর পুনরায় জীবিত হয়ে উঠাকে অসম্ভব মনে করছিলাে, তার জবাবে বিস্তারিতভাবে জানানাে হচ্ছে, যিনি কারাে কোনাে অস্তিত্ব না থাকা অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দিতে পারলেন, তার পক্ষে পুনরায় অস্তিত্বে ফিরিয়ে আনা কি বড়ই কঠিন হয়ে গেলো। এভাবে তাদের সৃষ্টির গােড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ রাব্বুুল আলামীন তাদের বিবেককে আকর্ষণ করছেন এবং বলছেন যিনি প্রথম বারে সৃষ্টি করেছেন তার পক্ষে পুনরায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনা কোনাে কঠিন নয়, বরং খুবই সহজ এবং তাদেরকে আবার জীবিত করতে তিনি সম্পূর্ণ সক্ষম, কিন্তু এতােসব যুক্তি প্রদর্শন করা সত্তেও এর থেকে তারা কোনাে ফায়দা হাসিল করতে পারেনি এবং তারা একথার ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাও স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘(দ্বিধা দ্বন্দ চিত্তে ও অস্বীকার করতে গিয়ে তারা তােমার দিকে (না সূচক মাথা নাড়তাে।’ তারা ওপরে নীচে মাথা দোলাতাে, অস্বীকার করতে গিয়েও বিদ্রুপ করে বলতাে ওরা, কখন হবে এটা?’ এ প্রশ্ন দ্বারা তারা বুঝাতে চাইতাে এটা বহু দূরের এক কল্পনা এবং সুদূর পরাহত এক অবাস্তব চিন্তা। তাই আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘বলাে হয়তাে খুব শীঘ্রই এটা সংঘটিত হবে।’ অবশ্য এটাও ঠিক, ঠিক কখন এ ঘটনাটা ঘটবে রসূলুল্লাহ(স.) তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না, তবে এটা ঠিক যে অবশ্যই এটা ঘটবে এবং যত বিলম্বে এটা ঘটবে বলে তারা মনে করে তার থেকে অনেক কম সময়ের মধ্যেই এটা ঘটবে। ওরা যতােটা ধারণা করতে পারে সম্ভবত তার থেকেও অনেক অনেক তাড়াতাড়ি এটা সংঘটিত হবে। যতােই তারা কেয়ামতের ভয়কে দূরে ঠেলে রাখার চেষ্টা করুক না কেন, এ ব্যাপারে যতাে উদাসীনতাই তারা দেখাক না কেন, যতােই অস্বীকার করুক এবং মরার পর পচে গলে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার পরে আবার নাকি জীবিত হয়ে উঠতে হবে। এসব কথা বলে যত উপহাসই তারা করুক না কেন-এটা ঘটবেই ঘটবে। ঠাটা বিদ্রুপ করতে গিয়ে যখন আজে বাজে কথা বলতে থাকবে, তখন হঠাৎ করেই তাদের কাছে একদিন মৃত্যুদূত (মালাকুল মওত) হাযির হয়ে যাবে। তখন তারা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে থাকবে বটে, কিন্তু তাতে কোনাে ফায়দা হবে না। এর পরের আয়াতেই সেই দিনের দৃশ্যের কথা বর্ণনা করা হচ্ছে-যা হঠাৎ করে এসে পড়বে। এটা সংঘটিত হবে সেই দিন, ‘যেদিন তিনি তােমাদেরকে আহ্বান করবেন তখন তােমরা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাবে এবং তার শক্তি ক্ষমতার কথা ঘােষণা করতে করতে তার ডাকের জবাব দেবে এবং তােমরা ধারণা করতে থাকবে যে-পৃথিবীতে মাত্র সামান্য কিছু সময়ের জন্যেই অবস্থান করেছিলে।’ (আয়াত ৫২) মৃত্যুর পর আবার উঠতে হবে সেই কথাটা অস্বীকারকারীর ডাকে সাড়া দিয়ে দাড়িয়ে যাবে এবং তাদের জিহবাগুলাে আল্লাহর প্রশংসা গীতিতে তখন মুখরিত হতে থাকবে। সে দিন আল্লাহর প্রশংসা ছাড়া কারাে মুখে আর কোনাে কথা থাকবে না আর কারাে কোন জওয়াবও থাকবে না। যারা আজকের দিনে আল্লাহকে অস্বীকার করছে, সেদিন তাদের জওয়াব হবে বড়ই আশ্চর্যজনক। তারা বলবে, আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, এছাড়া তাদের আর কোনাে জবাব থাকবে না। সে দিন ছায়ার মতই দুনিয়ার জীবন তাদের অনুসরণ করবে এবং তাদেরকে পেছনের কথা স্মরণ করাতে থাকবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তােমাদের কাছে মনে হবে যে তােমরা দুনিয়ার জীবনে অতি সামান্য কিছু সময়ের জন্যে অবস্থান করেছিলে।’ এভাবে দুনিয়া সম্পর্কে তাদের অনুভূতিকে ছবির মত তুলে ধরে মানুষের সামনে পার্থিব জীবনের তুচ্ছতা প্রমাণ করা হচ্ছে, অর্থাৎ বলা হচ্ছে আখেরাতের চিরন্তন জীবনের তুলনায় দুনিয়ার জীবন অতি অল্প, অতি তুচ্ছ। সেদিন ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের ছায়াও মানুষের স্মৃতিপটে উদিত হবে না, তার অনুভূতির মধ্যে এ তুচ্ছ জীবনের কোনাে চিহ্নও থাকবে না। বরং মনে হবে এটা ভুলে যাওয়া একটি মুহূর্ত মাত্র, যা শেষ হয়ে গেছে এবং কোনাে দিন ওই হারানাে মুহূর্তটিকে তারা ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

# “ইন্গাদ” মানে হচ্ছে, ওপর থেকে নিচের দিকে এবং নিচে থেকে ওপরের দিকে মাথা নাড়া। এভাবে মাথা নেড়ে বিস্ময় প্রকাশ বা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হয়।

#দুনিয়ায় মৃত্যুকাল থেকে নিয়ে কিয়ামতের দিনে উত্থান পর্যন্তকার সময়কলটা মাত্র কয়েক ঘণ্টার বেশী বলে মনে হবে না। তোমরা তখন মনে করবে, আমরা সমান্য একটু সময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার মধ্যে হঠাৎ এ কিয়ামতের শোরগোল আমাদের জাগিয়ে দিয়েছে।

আর “তোমরা আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে উঠে আসবে।” একথা বলার মাধ্যমে একটি মহাসত্যের দিকে সূক্ষ্মতম ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মু’মিন ও কাফের প্রত্যেকের মুখে সে সময় থাকবে আল্লাহর প্রশংসা বাণী। মু’মিনের কন্ঠে এ ধ্বনি হবার কারণ, পূর্ববর্তী জীবনে এরই ওপর ছিল তার বিশ্বাস এবং এটিই ছিল তার জপতপ। আর কাফেরের কন্ঠে এ ধ্বনি উচ্চারিত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তার প্রকৃতিতে এ জিনিসটি গচ্ছিত রাখা হয়েছিল কিন্তু নিজের বোকামির কারণে সে এর ওপর আবরণ দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। এখন নতুন জীবন লাভ করার সাথে সাথেই সমস্ত কৃত্রিম আবরণ খসে পড়বে এবং তার আসল প্রকৃতির সাক্ষ্য স্বতস্ফূর্তভাবে তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হবে।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

৪৯-৫২ নং আয়াতের তাফসীর

কাফির, যারা কিয়ামতে বিশ্বাসী ছিল না এবং মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানকে অসম্ভব মনে করতো, তারা অস্বীকারের উদ্দেশ্য নিয়ে জিজ্ঞেস করতোঃ আমরা অস্থি ও মাটি হয়ে যাওয়ার পরেও কি আমাদেরকে নতুনভাবে সৃষ্টি করা হবে?

সুরায়ে নাযিআ’তে এই অস্বীকারকারীদের উক্তি নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছেঃ “আমরা কি আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবো? তবে কি আমরা যখন চুর্ণ-বিচূর্ণ হাড়ে পরিণত হয়ে যাবে তখন (পুনর্জীবনে) প্রত্যাবর্তিত হবো? বলতে লাগলোঃ এমতাবস্থায় এই প্রত্যাবর্তন (আমাদের জন্যে) বড়ই ক্ষতিকর হবে।” সূরায়ে ইয়াসীনে রয়েছেঃ “সে আমার সম্বন্ধে এক অভিনব বিষয় বর্ণনা করলো এবং নিজের মূল সৃষ্টিকে ভুলে গেল; সে বলেঃ কে জীবিত করবে এই হাড়গুলিকে, যখন তা পচে গেল?” সুতরাং তাদেরকে উত্তর দেয়া হচ্ছেঃ হাড় তো দূরের কথা, তোমরা পাথর হয়ে যাও বা লোহা হয়ে যাও অথবা এর চেয়ে শক্ত জিনিস হয়ে যাও, যেমন পাহাড় বা যমীন অথবা আসমান, এমনকি তোমরা যদি স্বয়ং মৃত্যুও হয়ে যাও, তবুও তোমাদেরকে পূনরুজ্জীবিত করা আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই সহজ। তোমরা যাই হয়ে যাও না কেন, পুনরুত্থিত হবেই।

হাদীসে রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থানে মৃত্যুকে নেকড়ে বাঘের আকারে আনয়ন করা হবে এবং জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসী উভয় দলকেই বলা হবেঃ “তোমরা একে চিনো কি?” সবাই সমস্বরে বলে উঠবেঃ “হাঁ, চিনি।” তারপর ওকে যবাহ করে দেয়া হবে। তারপর ঘোষণা করা হবেঃ “জান্নাতী লোকেরা! এখন থেকে তোমাদের চিরস্থায়ী জীবন হয়ে গেল, আর মৃত্যু হবে না। হে জাহান্নামী লোকেরা! আজ থেকে তোমাদের জীবন চিরস্থায়ী হয়ে গেল, আর তোমরা মৃত্যুবরণ করবে না।”

এখানে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তারা (কাফির ও মুশরিকরা) জিজ্ঞেস করেঃ “আচ্ছা, আমরা যখন অস্থিতে পরিণত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবো, অথবা পাথর ও লোহা হয়ে যাবো, বা এমন কিছু হয়ে যাবো যা খুবই শক্ত, তখন কে এমন আছে যে, আমাদেরকে নতুন সৃষ্টি রূপে পুনরুত্থিত করবে? হে নবী (সঃ)! তুমি তাদের এই প্রশ্ন ও বাজে প্রতিবাদের জবাবে তাদেরকে বুঝিয়ে বলঃ তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন তিনিই যিনি তোমাদের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। যিনি তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন যখন তোমরা কিছুই ছিলে না। তাহলে দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করা তাঁর পক্ষে কঠিন হতে পারে কি? না, বরং এটা তাঁর পক্ষে খুবই সহজ, তোমরা যা কিছুই হয়ে যাও না কেন। এই উত্তরে। তারা সম্পূর্ণরূপে নির্বাক হয়ে যাবে বটে, কিন্তু এর পরেও তারাহঠকারিতা ও দুষ্টামি হতে বিরত থাকবে না এবং তাদের বদ আকীদা পরিত্যাগ করবে না। বরং তারা উপহাসের ছলে মাথা নাড়তে নাড়তে বলবেঃ “আচ্ছা, এটা হবে কখন? যদি সত্যবাদী হও তবে এর নির্দিষ্ট সময় বলে দাও?” বেঈমানদের অভ্যাস এই যে, তারা সব কাজেই তাড়াহুড়া করে থাকে। এই সময় অতি নিকটবর্তী। তোমরা এজন্যে অপেক্ষা করতে থাকো। এটা যে, আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যা আসবার তা আসবেই এটা মনে করে নাও। আল্লাহ তাআলার একটা শব্দের সাথে সাথেই তোমর যমীন হতে বের হয়ে পড়বে। চোখের পলক ফেলার সময় পরিমাণও বিলম্ব হবে না। আল্লাহর নির্দেশের সাথে সাথেই তোমাদের দ্বারা হাশরের ময়দান পূর্ণ হয়ে যাবে। কবর হতে উঠে আল্লাহর প্রশংসা করতঃ তাঁর নির্দেশ পালনে তোমরা দাঁড়িয়ে যাবে। প্রশংসার যোগ্য তিনিই; তোমরা তাঁর হুকুম ও ইচ্ছার বাইরে নও।

হাদীসে এসেছে যে, যারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়েছে তাদের জন্যে তাদের কবরে কোন ভয় ও সন্ত্রাস সৃষ্টি হবে না। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি যেন তাদেরকে দেখতে রয়েছি যে, তারা কবর থেকে উঠতে রয়েছে। তারা মাথা হতে মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে এবং “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করতে করতে উঠে দাঁড়াবে এবং বলবেঃ “আল্লাহরই সমস্ত প্রশংসা যিনি আমাদের দুঃখ দুর। করেছেন।” সূরায়ে ফাতিরের তাফসীরে এই বর্ণনা আসবে ইনশা-আল্লাহ। ঐ সময় মানুষের বিশ্বাস হবে যে, তারা খুব অল্প সময় দুনিয়ায় অবস্থান করেছে। যেন তারা সকালে বা সন্ধ্যায় দুনিয়ায় থেকেছে। কেউ বলবে দশ দিন, কেউ বলবে একদিন এবং কেউ মনে করবে মাত্র এক ঘন্টা। প্রশ্নের উত্তরে তারা একথাই বলবেঃ “আমরা একদিন বা একদিনের কিছু কম সময় অবস্থান করেছি।” আর একথা তারা শপথ করে বলবে। অনুরূপভাবে তারা দুনিয়াতেও মিথ্যা কথার উপর কসম খেতো।

Leave a Reply