أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৫৫)
সুরা: আল্ বনি ইসরাইল
সুরা:১৭
৫৬-৫৮ নং আয়াত:-
[قُلِ ادْعُواْ الَّذِينَ زَعَمْتُم
বল, তাদেরকে আহবান কর ,]
www.motaher21.net
قُلِ ادۡعُوا الَّذِیۡنَ زَعَمۡتُمۡ مِّنۡ دُوۡنِہٖ فَلَا یَمۡلِکُوۡنَ کَشۡفَ الضُّرِّ عَنۡکُمۡ وَ لَا تَحۡوِیۡلًا ﴿۵۶﴾
বল, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে উপাস্য মনে কর, তাদেরকে আহবান কর; করলে দেখবে তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করবার অথবা পরিবর্তন করবার শক্তি তাদের নেই।
اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ یَبۡتَغُوۡنَ اِلٰی رَبِّہِمُ الۡوَسِیۡلَۃَ اَیُّہُمۡ اَقۡرَبُ وَ یَرۡجُوۡنَ رَحۡمَتَہٗ وَ یَخَافُوۡنَ عَذَابَہٗ ؕ اِنَّ عَذَابَ رَبِّکَ کَانَ مَحۡذُوۡرًا ﴿۵۷﴾
তারা যাদেরকে আহবান করে, তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকট হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে; নিশ্চয় তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।
وَ اِنۡ مِّنۡ قَرۡیَۃٍ اِلَّا نَحۡنُ مُہۡلِکُوۡہَا قَبۡلَ یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ اَوۡ مُعَذِّبُوۡہَا عَذَابًا شَدِیۡدًا ؕ کَانَ ذٰلِکَ فِی الۡکِتٰبِ مَسۡطُوۡرًا ﴿۵۸﴾
এমন কোন জনপদ নেই, যা আমি কিয়ামতের দিনের পূর্বে ধ্বংস করব না অথবা যাকে কঠোর শাস্তি দেব না; এটা তো কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।
৫৬-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*শিরকের অসারতা ও তাওহীদের যৌক্তিকতা : এখানেই এ পাঠটি শেষ হচ্ছে। আমরা দেখতে পেয়েছি এ পাঠের মধ্যে আল্লাহর পক্ষে সন্তান গ্রহণ ও কোনাে অংশীদার থাকার কথাকে অত্যন্ত কঠোরভাবে অস্বীকার করা হয়েছে এবং সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একমাত্র আল্লাহর দিকে মনােযােগ দেয়ার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জানানাে হয়েছে যে, বান্দাদের শেষ পরিণতি সম্পর্কিত জ্ঞান একমাত্র তার কাছেই রয়েছে। যেসব অর্বাচীন, নিজেদের দুঃখ কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের কাছে কাতর মিনতি জানায় এবং মনে করে, আল্লাহর অংশীদার হিসাবে তাদেরও কিছু ক্ষমতা আছে, তাদেরকে চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, চাইলে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আযাব দেবেন অথবা তিনি চাইলে অন্য কাউকে আযাব দেবেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘(হে রসূল তুমি এদের) বলাে তােমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে, তােমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যে যাদের কাছে মিনতি জানাও-আসলে কারাে দুঃখ দুর্দশা দূর করার মতাে কোনাে ক্ষমতাই তাদের নেই অথবা তারা আমাদের দুঃখকে কিছুমাত্র লাঘবও করতে পারে না।’ অতপর একথা স্বতসিদ্ধ যে দুঃখ দুর্দশা দূর করনেওয়ালা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কেউ নেই, তিনি তার বান্দাহর জন্যে যা কিছু বরাদ্দ করেন তাই হয়, এর বাইরে কিছু হওয়া সম্ভব নয়। আর এটা তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে ফেরেশতা, জিন বা মানুষ যাদেরকেই ওরা উপাস্য মনে করুক না কেন এবং যাদেরকেই ওরা ক্ষমতার অধিকারী মনে করুক না, তারা সবাই অন্যান্য সৃষ্টির মতােই আল্লাহরই সৃষ্টি, তারা সবাই আল্লাহর কাছে পৌছুনাের জন্যে চেষ্টা করে যাচ্ছে, সবাই তার সন্তুষ্টি লাভ করার জন্যে চেষ্টা করে চলেছে এবং যারা আল্লাহর আযাবকে জানে, বুঝে এবং ভয় করে, তারা সবাই সেই আযাবের ভয়ে কম্পমান। এরশাদ হচ্ছে, তারা আল্লাহর কাছে পৌছুনাের জন্যে এবং তার নৈকট্যে ধন্য হওয়ার জন্যে ওসীলা তালাশ করে, ওরা তাঁর রহমত পাওয়ার আশা করে এবং তার আযাবকে ভয় করে নিশ্চয়ই তাঁর আযাব ভীতিপ্রদ। ওরা নিজেরাই তাে হচ্ছে সেসব অসহায় ব্যক্তি যারা নিজেরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, ওদের মধ্যে অনেকে আছে, যারা ওযায়েরকে আল্লাহর পুত্র বলে এবং তার পূজা করে (তার কাছে সাহায্য প্রার্থী হয়ে তাঁর কাছে বা তার মূর্তির সামনে মাথা নত করে) অনেকে ঈসা(আ.) কে আল্লাহর পুত্র বলে অভিহিত করে এবং তাঁর কাছে সাহায্য চায় ও তার পূজা করে, আবার অনেকে আছে যারা ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে মনে করে এবং তাদের কাল্পনিক মূর্তি তৈরী করে তাদের উপাসনা করে, আর তাদের মধ্যে আরাে বহু লােক আছে, যারা এদের ছাড়া অন্যান্য জিনিসের (যেমন গাছ পালা, চাঁদ সূর্য তারা ইত্যাদির) পূজা করে। আল্লাহ সবাইকে লক্ষ্য করে বলছেন, এসকল ব্যক্তি ও বন্ধু তােমরা যাদেরই পূজা উপাসনা কর না কেন তাদের মধ্যে যাকে তােমরা সব থেকে বেশী আল্লাহর ধন্য কাছে বা নৈকট্য ধন্য মনে কর সেও আল্লাহর কাছে পৌছুনাের জন্যে ওসীলা তালাশ করে চলেছে এবং দিবানিশি তার হুকুম পালন করার মাধ্যমে তার নৈকট্য হাসিল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তার রহমত কামনা করছে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করছে। আর অবশ্যই আল্লাহর আযাব বড়ই কঠিন যার থেকে বাঁচার জন্যে সদা সর্বদা হুঁশিয়ার থাকতে হয় এবং সব সময় তাঁকে ভয় করে চলতে হয়, সুতরাং তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়া থেকে বড় জিনিস তােমাদের কাছে আর কি হতে পারে বলাে দেখি! আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁর যে সব বান্দাদের পূজা উপাসনা তােমরা করছো তারা যে ভাবে আল্লাহর আনুগত্য করেছিলাে সেইভাবে তােমরা কেন আল্লাহর হুকুম পালন করছাে না? যে ভাবে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তির জন্যে চেষ্টা করে গেছেন, তােমরা কেন সেইভাবে তাঁর সন্তুষ্টি প্রাপ্তির জন্যে চেষ্টা কর না?
# সংক্ষিপ্ত আলোচনা (৫৮-৭২) : এখানে এসে পুনরায় সব ধরনের শিরক-এর অসারতা এবং এসব ভুল বিশ্বাস সম্পর্কে আলােচনা শুরু হয়েছে। এসব অলীক বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে সর্বময় ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহকে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে এবং এ আলােচনার সমাপ্তি টানা হচ্ছে এই কথা দিয়ে যে সকল ব্যাপারে তাঁরই আনুগত্য করতে হবে ও তারই মুখাপেক্ষী হতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর কোনাে জনবসতি এমন নেই, যাদেরকে আমি মহান আল্লাহ কেয়ামতের পূর্বে ধ্বংস না করে ছেড়ে দেব’ অর্থাৎ সকল জনপদকেই আমি কেয়ামতের পূর্বে ধ্বংস করে দেব। আর যে এই পৃথিবীতে অন্ধ হয়ে থাকবে সে আখেরাতেও অন্ধ হয়ে উঠবে আর বহু দূরে থাকবে সে সঠিক পথ থেকে।(আয়াত ৫৮-৭২) পূর্ববর্তী পাঠ এই সিদ্ধান্তের সাথে শেষ হয়েছে যে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তাঁর বান্দাদের পরিণতি নির্ধারণকারী। তিনি চাইলে তাদের প্রতি রহম করবেন, আর চাইলে তাদেরকে আযাব দেবেন, আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে বানানো উপাস্যদেরকে তারা কার্য উদ্ধার ও সাহায্যের জন্যে ডাকে, প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের কোনাে দুঃখ দুর্দশা দূর করতে সক্ষম নয় বা তাদের কষ্ট থেকে কিছু কম করিয়ে দিতেও সক্ষম নয়। এবারে আলােচনার মােড় ফিরে যাচ্ছে সকল মানুষের শেষ পরিণতির দিকে যার তাকদীরে যা আছে তার পরিণতি তাই হবে এবং এ খবর একমাত্র আল্লাহরই জ্ঞান ভান্ডারের মধ্যে লুকিয়ে আছে। আর এই শেষ পরিণতির অবস্থা হচ্ছে এই যে কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে সকল জনপদ ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সবাই মৃত্যুমুখে পতিত হবে অথবা কেউ মারাত্মক কোনাে অপরাধ করলে তার ওপর বা ওই জনপদের অংশ বিশেষের ওপর তাদের অপরাধের কারণে শাস্তি এসে পড়বে, কিন্তু কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বে সবাইকেই ধ্বংস করে দেয়া হবে। এ ধ্বংস দুই অবস্থার যে কোনাে একটির মাধ্যমে আসবে। স্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমে অথবা আযাব নাযিল হওয়ার মাধ্যমে, যার কারণে পৃথিবীতে আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। অতীতের যে সকল জাতির ওপর আযাব নাযিল হয়েছিলাে তাদের বর্ণনা প্রসংগে জানানাে হচ্ছে যে মােহাম্মদ(স.)-এর পূর্বে বহু জাতিকে, আল্লাহর গযব নাযিল করার মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিলাে এবং সে আযাব এসেছিলাে এক অস্বাভাবিক পন্থায়, হঠাৎ করে। কিন্তু মােহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ(স.)-এর আগমনের পর ওই ধরনের আকস্মিক আযাব নাযিল করে সামগ্রিকভাবে উম্মতে মােহাম্মাদীকে ধ্বংস করে দেয়া হবে না, কারণ অতীতের জাতিসমূহের কাছে রসূলরা আল্লাহর বাণী নিয়ে আগমন করেছেন এবং তারা আল্লাহর ক্ষমতার নিদর্শন হিসাবে মােজেযা দেখিয়েছেন। কিন্তু ওইসব জনপদের অধিকাংশই আল্লাহর তরফ থেকে তাদের আনীত বার্তাকে অস্বীকার করেছে, উপেক্ষা করেছে, নবী রসূলদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং শেষ পর্যন্তও তারা হেদায়াতের পথকে গ্রহণ করেনি, যার ফলে তাদের ওপর ধ্বংস ও বিপর্যয় নেমে আসাটা অবধারিত হয়ে গেছে। উম্মতে মােহাম্মদীর ওপর এই ধরনের সর্বাত্মক ধ্বংস নেমে আসবে না এটা পূর্বেই সিদ্ধান্ত হয়ে রয়েছে, যার কারণে অস্বাভাবিক বা অলৌকিক কোনাে বস্তুগত নিদর্শন উম্মতে মােহাম্মদীর ওপর নাযিল হবে না। অতীত জাতিসমূহের জন্যে অলৌকিক ক্ষমতা (মােজেযা) প্রদর্শন ছিলাে তাদেরকে ভয় দেখানাের জন্যে, কিন্তু মােজেযা দেখার পরও যখন নবীকে তারা মানেনি তখন তাদের ওপর এমন কঠিন ও সর্বাত্মক আযাব নাযিল হয়েছে যে গােটা জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রসূলুল্লাহ(স.)-কে কাফেরদের মারাত্মক আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছেন, ফলে তারা, চাইলেও তার তেমন বড় কোনাে ক্ষতি করতে পারছে না। এরপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রসূলুল্লাহ(স.) কে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে তাকে এক অত্যাশ্চর্য বাস্তব সফরের দৃশ্য দেখালেন, যা ছিলাে সকল মানুষের জন্যে ঈমানের এক পরীক্ষা স্বরূপ। কিন্তু পূর্ববর্তী উম্মতদের জন্যে প্রেরিত অলৌকিক ক্ষমতার (মােজেযার) মতাে কোনাে মােজেযা এটা ছিলাে না। এরপর, আল্লাহ তায়ালা ‘যাককুম’ নামক এক ভীষণ তিতা ফল তাদেরকে খেতে দেবেন বলে ভয় দেখিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ জানিয়েছেন যে তিনি জাহান্নামের গভীরে এ ফলটি দেখেছেন কিন্তু হলে কি হবে তার জাতি এতাে বড় হঠকারী ও যালেম ছিলাে যে তাঁকে চির সত্যবাদী জানা সত্তেও তাঁর একথাকে তারা উপহাস বিদ্রুপ করে উড়িয়ে দিয়েছে এবং এ ভীতি প্রদর্শন ও তাদের বিদ্রোহাত্মক ব্যবহার ও ক্রোধাগ্নিতে আরাে ঈন্ধন জোগানাে ছাড়া আর কোনাে ফায়দা হয়নি। এখানে প্রসংক্রমে আদম(আ.)-এর সাথে ইবলিসের কিসসাটা এসে গেছে, এসেছে আল্লাহর নেক বান্দার ছাড়া আদম সন্তানদের অন্য সবার প্রতি ইবলিস-এর ক্ষমতা খাটানাের অনুমতি প্রাপ্তির কথা, একথা স্পষ্টভাবে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তার অনুগত ও সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে শয়তানের ক্ষমতা ও জারিজুরি থেকে নিজেই রক্ষা করবেন। এরপর উল্লেখ করা হয়েছে সেই মূল কারণগুলােকে যা আদম ও বিবি হাওয়াকে শয়তানের ধোকায় ফেলে দিয়েছিলাে এবং যা মানুষকে কুফরী কাজের দিকে টেনে নিয়ে যায়, অহংকারী বানায় এবং আল্লাহর নিদর্শনগুলাের ওপর চিন্তা ভাবনা করা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় । এখানে প্রসংক্রমে আদম সন্তানদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানীর কথা উল্লেখ করে তাদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি মােহব্বত ও আবেগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পাশাপাশি এই মােহাব্বতের সাথে তুলনা করা হচ্ছে ওই অহংকার ও অস্বীকৃতি (কুফরী)কে। যখন মানুষের মধ্যে মন্দ খাসলাতটি পয়দা হয়ে যায় তখন আর তারা কঠিন ও ভীষণ বিপদের মধ্যে না পড়া পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করে না। দেখা গেছে, সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে যখন তারা কষ্ট পায় তখন তার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করে, তারপর যখন তিনি তাদেরকে নাজাত দিয়ে স্থলভাগে পৌছে দেন তখন তারা আল্লাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু (এটা তারা ভাবে না) স্থলে বা পানিতে যেখানেই তারা থাকুক না কেন, সবখানে সমানভাবেই তিনি তাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন, আর অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সৃষ্টির মধ্যে অনেকের ওপরে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দিয়েছেন, কিন্তু তারা তাঁর শােকরগাযারি করে না তবে তারা যখন অসহায় হয়ে পড়ে তখন তাকে স্মরণ ঠিকই করে। আলােচনার এ প্রসংগটিকে শেষ করা হচ্ছে কেয়ামতের দৃশ্যগুলাের মধ্য থেকে একটি ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা তুলে ধরে। যেদিন তাদের কৃতকর্মের ফল তারা পেতে শুরু করবে, সেদিন কেউ তাদেরকে বাঁচাতে পারবে না একমাত্র পেছনের ভাল কাজের ফলেই তারা রেহাই পেতে পারবে। ‘কেয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই, আমি, সকল জনবসতিকে ধ্বংস করে দেবাে অথবা তাদেরকে কঠিন আযাবের মধ্যে তাদেরকে ফেলে দেবাে। এটা (আল্লাহর কাছে রক্ষিত) কিতাবের মধ্যে লিখিত রয়েছে।’ আল্লাহ তায়ালা সুনিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন যে অবশ্যই তিনি কেয়ামত সংঘটিত করবেন এবং এ যমীনকে সকল প্রাণী থেকে খালি করবেনই, সুতরাং যত প্রকার জীবজন্তু ও জীবন্ত যা কিছু আছে, সবাই ওয়াদাকৃত ওই দিনটি আসার আগেই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় কাল গুনে চলেছে। এমনি করে যে সকল এলাকাবাসী নানা প্রকার অপরাধের মধ্যে লিপ্ত রয়েছে, তারাও সবাই আল্লাহর আযাবে গ্রেফতার হয়ে যাবে একথা আল্লাহর জ্ঞানের পরিধির মধ্যে রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা জানেন যা শীঘ্রই সংঘটিত হবে, আর যা বিলম্বে সংঘটিত হবে। সুতরাং, এটাও সত্য, যা আগেই সংঘটিত হয়ে গেছে এবং যা ভবিষ্যতে সংঘটিত হবে তা সমানভাবে তিনি জানেন।
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৫৬-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
(قُلِ ادْعُوا الَّذِيْنَ زَعَمْتُمْ مِّنْ… )
আয়াতের শানে নুযূল:
ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, কিছু কিছু কাফির-মুশরিক কতিপয় জিনের ইবাদত করত। অতঃপর ঐ জিনগুলো মুসলিম হয়ে যায়। আর ঐ কাফির-মুশরিকরা নিজেদেরকে কুফরীর উপরই প্রতিষ্ঠিত রাখে। অতঃপর আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭১৪, সহীহ মুসলিম হা: ৩০৩০)
উক্ত আয়াতগুলোতে মূলত বর্ণনা করা হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত যে সমস্ত মূর্তি, ফেরেশতা, পাথর, জিন ও মানুষের উপাসনা করা হয় তাদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন যে, তারা কিছুই করতে পারে না। তারা কারো কষ্ট দূর করতে পারে না, কারো অবস্থার পরিবর্তনও করতে পারে না। বরং তারাও আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে এবং সৎ আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের ইচ্ছা করে। কারণ তারা জানে যে, ভাল-মন্দ, লাভ-ক্ষতি সবকিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ, অন্য কেউ নয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “বল, তোমরা তাদেরকে আহ্বান কর, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে (মা‘বূদ) মনে করতে, তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অণু পরিমাণ কিছুরও অধিকারী নয়, এতদুভয়ে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ আল্লাহর সহায়তাকারীও নয়। আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ উপকারে আসবে না, কিন্তু তার সুপারিশ উপকারে আসবে যাকে তিনি অনুমতি দেবেন।” (সূরা সাবা ৩৪:২২-২৩)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “তোমরা কি ভেবে দেখেছ যে আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কি সেই অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহকে বন্ধ করতে পারবে? বল: আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁর উপরই নির্ভর করে। ” (সূরা যুমার ৩৯:৩৮)
সুতরাং মানুষের বানানো মা‘বূদেরা কারো কোন কল্যাণ ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখে না। তাই তারা ইবাদত পাওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। الوسيلة বা মাধ্যম গ্রহণ করার ব্যাপারে কিছু শর্ত রয়েছে যা সূরা মায়িদার ৩৫ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনি কিয়ামত সংঘটিত হবার পূর্বেই প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেবেন। কেউ তখন আর পৃথিবীর বুকে জীবিত থাকবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, অতএব সমস্ত উপকার-ক্ষতি, ভাল-মন্দ সকল কিছুর মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাই, অন্য কেউ নয়। আর তিনিই একমাত্র উপাসনার যোগ্য। তাঁকে ব্যতীত আর যাদের ইবাদত করা হয় তারা সকলেই ভ্রান্ত ও বাতিল। তাই একমাত্র তাঁরই উপাসনা করতে হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সকল ক্ষমতার অধিকারী কেবলমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীর সকল বস্তু ধ্বংস/শেষ হয়ে যাবে।
৩. দুনিয়াতে যা কিছু সংঘটিত হবে সকল বিষয় পূর্বে থেকেই লিপিবদ্ধ করা আছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
৫৬-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
# এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, কেবল গায়রুল্লাহকে (আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তা) সিজদা করাই শির্ক নয় বরং আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তার কাছে দোয়া চাওয়া বা তাকে সাহায্য করার জন্য ডাকাও শির্ক। দোয়া ও সাহায্য চাওয়া ও মূলতাত্বিক বিচারে ইবাদতেরই অন্তর্ভুক্ত। কাজেই গায়রুল্লাহর কাছে প্রার্থনাকরী একজন মূর্তি পূজকের সমান অপরাধী। তাছাড়া এ থেকে একথাও জানা যায় যে, আল্লাহ ছাড়া কারোরও কোন সামান্যতম ইখতিয়ার নেই। অন্য কেউ কোন আপদ-বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে না এবং কোন খারাপ অবস্থাকে ভাল অবস্থায় পরিবর্তিত করে দিতেও পারে না। আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন সত্তার সম্পর্কে এ ধরনের বিশ্বাস রাখা একটি মুশরিকী বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়।
# এ শব্দগুলো নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, মুশরিকদের যেসব মাবুদ ও ত্রাণকর্তার কথা এখানে বলা হচ্ছে তারা পাথরের মূর্তি নয় বরং তারা হচ্ছে ফেরেশতা বা অতীত যুগের আল্লাহর প্রিয় নেক বান্দা। এর অর্থ পরিষ্কার। অর্থাৎ নবী হোক বা আউলিয়া অথবা ফেরেশতা, কারোই তোমাদের প্রার্থনা শুনার এবং তোমাদের সাহায্য করার ক্ষমতা নেই। তোমরা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাদেরকে অসিলায় পরিণত করছো কিন্তু তাদের অবস্থা এই যে, তারা নিজেরাই আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশী, তাঁর আযাবের ভয়ে ভীত এবং তাঁর বেশী বেশী নিকটবর্তী হবার জন্য অসিলা ও উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
# কারোর চিরন্তন স্থায়িত্ব নেই। প্রত্যেকটি জনপদকে হয় স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করতে হয় আর নয়তো আল্লাহর আযাবের মাধ্যমে ধ্বংস হতে হবে। তোমাদের এ জনপদগুলো চিরকাল এমনি প্রাণবন্ত ও জীবন্ত থাকবে এই ভুল ধারণা তোমরা কেমন করে পোষণ করতে পারলে?
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫৬-৫৮ নং আয়াতের তাফসীর:
#
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলেছেনঃ হে নবী (সঃ)! যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের ইবাদত করে তাদেরকে বলে দাওঃ তোমরা তাদেরকে খুব ভাল করে আহবান করতঃ দেখে নাও যে, তারা তোমাদের কোন উপকার করতে পারে কি না তাদের এই শক্তি আছে যে, তোমাদের কষ্ট কিছু লাঘব করে? জেনে রেখো যে, তাদের কোনই ক্ষমতা নেই। ব্যাপক ক্ষমতাবান একমাত্র আল্লাহ। তিনি এক। তিনিই সবার সৃষ্টিকর্তা এবং হুকুম দাতা একমাত্র তিনিই। এই মুশরিকরা বলতো যে, তারা ফেরেশতাদের হযরত ঈসার (আঃ) -এবং হযরত উযায়েরের (আঃ) ইবাদত করে। তাই মহান আল্লাহ তাদেরকে বলেনঃ তোমরা যাদের ইবাদত কর তারা নিজেরাই তো আল্লাহর নৈকট্য অনুসন্ধান করে।
সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই মুশরিকরা যে জ্বিনদের ইবাদত করতো তারা নিজেরাই মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এরা এখন পর্যন্ত নিজেদের কুফরীর উপরই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।”এ জন্যেই তাদেরকে সতর্ক করে বলা হচ্ছেঃ তোমাদের মা’বূদরা নিজেরাই আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। হযরত ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন যে, এই জ্বিনেরা ফেরেশতাদের একটি শ্ৰেণীভূক্ত ছিল। হযরত ঈসা (আঃ), হযরত মরিয়ম (আঃ), হযরত উযায়ের (আঃ), সূর্য, চন্দ্র এবং ফেরেশতা সবাই আল্লাহর নৈকট্যের অনুসন্ধিৎসু।
ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বলেন যে, সঠিক ভাবার্থ হচ্ছেঃ এই মুশরিকরা যে। জ্বিনদের ইবাদত করতো এই আয়াতে তারাই উদ্দেশ্য। কেননা, হযরত ঈসা (আঃ) প্রভৃতির যুগতো শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং ফেরেশতারা পূর্ব হতেই আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল থাকতেন। সুতরাং এখানে জ্বিনেরাই উদ্দেশ্য।
(আরবি) এর অর্থ হচ্ছে নৈকট্য, যেমন কাতাদা (রঃ) বলেছেন। এই বুযুর্গদের একমাত্র চিন্তা ছিল যে, কে বেশী আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ করতে পারেন? তারা আল্লাহর করুণার আকাংখী এবং তাঁর শাস্তি হতে ভীত সন্ত্রস্ত। বাস্তবিক এ দুটো ছাড়া ইবাদত পূর্ণ হয় না। ভয় পাপ থেকে বিরত রাখে এবং আশা-আকাংখা আনুগত্যে উদ্বুদ্ধ করে। প্রকৃতপক্ষেই তার শাস্তি ভীত সন্ত্রস্ত হওয়ার যোগ্য। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন!
# আল্লাহ তাআলা বলেনঃ সেই লিখিত বস্তু যা লাওহে মাহফুযে লিখে দেয়া হয়েছে, সেই হুকুম যা জারি করে দেয়া হয়েছে, এটা অনুযায়ী পাপীদের জনপদগুলি নিশ্চয়ই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে বা ধ্বংসের কাছাকাছি হবে। এটা হবে তাদের পাপের কারণে। আমার পক্ষ থেকে এটা কোন জুলুম নয়। বরং এটা হবে তাদের কর্মেরই ফল হিসেবে। এটা তাদের কৃতকর্মেরই শাস্তি, আমার আয়াত সমূহ এবং আমার রাসুলদের সাথে ঔদ্ধত্যপনা ও হঠকারিতা করারই পরিণাম।