أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৫৭) [মুনাফিক কি?বই নং ২৩]
সুরা: ৬৩ আল-মুনাফিকুন
১-৪ নং আয়াত:-
[اِذَا جَآءَکَ الۡمُنٰفِقُوۡنَ قَالُوۡا
যখন মুনাফিকরা আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে,]
www.motaher21.net
اِذَا جَآءَکَ الۡمُنٰفِقُوۡنَ قَالُوۡا نَشۡہَدُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُ اللّٰہِ ۘ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ اِنَّکَ لَرَسُوۡلُہٗ ؕ وَ اللّٰہُ یَشۡہَدُ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ لَکٰذِبُوۡنَ ۚ﴿۱﴾
যখন মুনাফিকরা আপনার কাছে আসে তখন তারা বলে, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি নিশ্চয় আল্লাহর রাসূল।’ আর আল্লাহ জানেন যে, আপনি নিশ্চয় তাঁর রাসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।
اِتَّخَذُوۡۤا اَیۡمَانَہُمۡ جُنَّۃً فَصَدُّوۡا عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ؕ اِنَّہُمۡ سَآءَ مَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲﴾
আর তাদের শপথগুলোকে ঢালরূপে ব্যবহার করে, ফলে তারা আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করে। তারা যা করে, নিশ্চয় তা কতই না মন্দ !
ذٰلِکَ بِاَنَّہُمۡ اٰمَنُوۡا ثُمَّ کَفَرُوۡا فَطُبِعَ عَلٰی قُلُوۡبِہِمۡ فَہُمۡ لَا یَفۡقَہُوۡنَ ﴿۳﴾
এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে। ফলে তাদের হৃদয় মোহর করে দেয়া হয়েছে ; তাই তারা বুঝতে পারছে না।
وَ اِذَا رَاَیۡتَہُمۡ تُعۡجِبُکَ اَجۡسَامُہُمۡ ؕ وَ اِنۡ یَّقُوۡلُوۡا تَسۡمَعۡ لِقَوۡلِہِمۡ ؕ کَاَنَّہُمۡ خُشُبٌ مُّسَنَّدَۃٌ ؕ یَحۡسَبُوۡنَ کُلَّ صَیۡحَۃٍ عَلَیۡہِمۡ ؕ ہُمُ الۡعَدُوُّ فَاحۡذَرۡہُمۡ ؕ قٰتَلَہُمُ اللّٰہُ ۫ اَنّٰی یُؤۡفَکُوۡنَ ﴿۴﴾
তুমি যখন তাদের দিকে তাকাও, তখন তাদের দেহাকৃতি তোমাকে মুগ্ধ করে এবং তারা যখন কথা বলে, তখন তুমি সাগ্রহে তা শ্রবণ কর; তারা যেন দেওয়ালে ঠেকানো কাঠের খুঁটি, তারা যে কোন শোরগোলকে মনে করে তাদেরই বিরুদ্ধে। তারাই শত্রু অতএব তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও, আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! বিভ্রান্ত হয়ে তারা কোথায় চলেছে?
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
(৬৩-মুনাফিকুন) : নামকরণ:
প্রথম আয়াতের إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ অংশ থেকে এ সূরার নাম গ্রহণ করা হয়েছে। এটি এ সূরার নাম এবং বিষয়বস্তু শিরোনামও। কারণ এ সূরায় মুনাফিকদের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করা হয়েছে।
(৬৩-মুনাফিকুন) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
বনী মুসতালিক যুদ্ধভিযান থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে অথবা মদীনায় পৌছার অব্যবহিত পরে এ সূরা নাযিল হয়েছিল। ৬ হিজরীর শা’বান মাসে বনী মুসতালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল একথা আমরা সূরা নূরের ভূমিকায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বর্ণনা করেছি। এভাবে এর নাযিল হওয়ার সময় সঠিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। এ বিষয়ে আমরা পরে আরো আলোচনা করব।
(৬৩-মুনাফিকুন) : ঐতিহাসিক পটভূমি :
যে বিশেষ ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে এ সূরা নাযিল হয়েছিল তা আলোচনার পূর্বে মদীনার মুনাফিকদের ইতিহাসের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। কারণ ঐ সময়ে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তা আদৌ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ছিল না। বরং তার পেছনে ছিল একটি পুরো ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ যা পরিশেষে এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল।
পবিত্র মদীনা নগরীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বে আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটি পারস্পরিক গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। তারা যথারীতি তাকে বাদশাহ বানিয়ে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। এমন কি তার জন্য রাজ মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল। এ ব্যক্তি ছিল খাযরাজ গোত্রের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল। মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খাযরাজ গোত্রে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বসম্মত এবং আওস ও খাযরাজ ইতিপূর্বে আর কখনো একযাগে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। (ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৪, ।
এই পরিস্থিতিতে ইসলামের বাণী মদীনায় পৌঁছে এবং এই দুটি গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। হিজরতের আগে আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদলা (রা.) আনসারী এ আহবান জানাতে শুধু এ কারণে দেরী করতে চাচ্ছিলেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও বাইয়াত ও দাওয়াতে শামিল হয় এবং এভাবে মদীনা যেন সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। কিন্তু যে প্রতিনিধি দল বাইয়াতের জন্য হাজির হয়েছিল তারা এই যুক্তি ও কৌশলকে কোন গুরুত্বই দিলেন না এবং এতে অংশগ্রহণকারী দুই গোত্রের ৭৫ ব্যক্তি সব রকম বিপদ মাথা পেতে নিয়ে নবী (সা.) কে দাওয়াত দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল। (ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৯) আমরা সূরা আনফালের ভূমিকায় এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছি।
এরপর নবী (সা.) যখন মদীনায় পৌছলেন তখন আনসারদের ঘরে ঘরে ইসলাম এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিরূপায় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য তার নিজের জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই সে তার বহু সংখ্যক সহযোগী ও সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উভয় গোত্রের প্রবীণ ও নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকেরা। অথচ তাদের সবার অন্তর জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। বিশেষ করে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অন্তর্জ্বালা ও দু:খ ছিল অত্যন্ত তীব্র। কারণ সে মনে করতো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রাজত্ব ও বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার এই মুনাফেকীপূর্ণ ঈমান এবং নেতৃত্ব হারানোর দু:খ কয়েক বছর ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে থাকল। একদিকে তার অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বরে উঠে বসতেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উঠে বলতো, “ভাইসব, আল্লাহর রসূল আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। তাই আপনারা সবাই তাঁকে সাহায্য, সহযোগিতা করুন। এবং তিনি যা বলেন গভীর মনযোগ সহকারে শুনুন এবং তার আনুগত্য করুন। “(ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা, ১১১, । অপরদিকে অবস্থা ছিল এই যে, প্রতিদিনই তার মুনাফেকীর মুখোশ খুলে পড়ছিল এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইসলাম, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা পোষণ করে।
একবার নবী (সা.) কোন এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় পথে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর সাথে অভদ্র আচরণ করে। তিনি হযরত সা’দ ইবনে উবাদাকে বিষয়টি জানালে সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, আপনি এ ব্যক্তির প্রতি একটু নম্রতা দেখান। আপনার আগমনের পূর্বে আমরা তার জন্য রাজমুকুট তৈরী করেছিলাম। এখন সে মনে করে, আপনি তার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। “(ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ২৩৭, ২৩৮, ।
বদর যুদ্ধের পর বনী কাইনুকা গোত্রের ইহুদীরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও অকারণে বিদ্রোহ করলে রসূলুল্লাহ (সা.) তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তখন এই ব্যক্তি তাদের সমর্থনে কোমর বেঁধে কাজ শুরু করে। সে নবীর (সা.) বর্ম ধরে বলতে লাগলো, এই গোত্রটির সাতশত বীরপুরুষ যোদ্ধা শত্রুর মোকাবেলায় সবসময় আমাকে সাহায্য করেছে, আজ একদিনেই আপনি তাদের হত্যা করতে যাচ্ছেন? আল্লাহর শপথ, আপনি যতক্ষণ আমার এই মিত্রদের ক্ষমা না করবেন আমি ততক্ষণ আপনাকে ছাড়বো না। (ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫১-৫২, ।
উহুদ যুদ্ধের সময় এই ব্যক্তি খোলাখুলি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যুদ্ধের ঠিক পূর্ব মুহুর্তে সে তার তিনশত সঙ্গী-সাথীকে নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসেছে। কি সাংঘাতিক নাজুক মুহূর্তে সে এই আচরণ করেছে তা এই একটি বিষয় থেকেই অনুমান করা যায় যে, কুরাইশরা তিন হাজার লোকের একটি বাহিনী নিয়ে মদীনার ওপরে চড়াও হয়েছিল আর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র এক হাজার লোক নিয়ে তাদের মোকাবিলা ও প্রতিরোধের জন্য বেরিয়েছিলেন। এক হাজার লোকের মধ্যে থেকেও এই মুনাফিক তিনশত লোককে আলাদা করে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল এবং নবী (সা.) কে শুধু সাতশত লোকের একটি বাহিনী নিয়ে তিন হাজার শত্রুর মোকাবিলা করতে হলো।
এ ঘটনার পর মদীনার সব মুসলমান নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলো যে, এ লোকটি কট্টর মুনাফিক। তার যেসব সংগীসাথী এই মুনাফিকীতে তার সাথে শরীক ছিল তাদেরকেও তারা চিনে নিল। এ কারণে উহুদ যুদ্ধের পর প্রথম জুম’আর দিনে নবীর (সা.) খোতবা দেয়ার পূর্বে এ ব্যক্তি যখন বক্তৃতা করতে দাঁড়ালো তখন লোকজন তার জামা টেনে ধরে বলল: “তুমি বসো, তুমি একথা বলার উপযুক্ত নও।” মদীনাতে এই প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে এ ব্যক্তিকে অপমানিত করা হলো। এতে সে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও রাগান্বিত হলো এবং মানুষের ঘাড় ও মাথার উপর দিয়ে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে গেল। মসজিদের দরজার কাছে কিছু সংখ্যক আনসার তাকে বললেন, “তুমি একি আচরণ করছো? ফিরে চলো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করো।” এতে সে ক্রোধে ফেটে পড়লো এবং বললো! “তাকে দিয়ে আমি কোন প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করাতে চাই না”। (ইবনে হিশাম, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১১১, ।
হিজরী ৪ সনে বনু নাযীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সময় এই ব্যক্তি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আরো খোলাখুলিভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের শত্রুদের সাহায্য সহযোগিতা দান করে। একদিনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর জান কবুল সাহাবীগণ এসব ইহুদী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অপরদিকে এই মুনাফিকরা গোপনে গোপনে ইহুদীদের কাছে খবর পাঠাচ্ছিল যে, তোমরা রুখে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের সাথে আছি। তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হলে আমরা তোমাদের সাহায্য করবো এবং তোমাদেরকে বহিষ্কার করা হলে আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব। আল্লাহ তা’আলা তাদের এই গোপন গাঁটছড়া বাঁধার বিষয়টি প্রকাশ করে দিলেন। সূরা হাশরের দ্বিতীয় রুকূ’তে এ বিষয়েই আলোচনা করা হয়েছে।
কিন্তু তার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মুখোশ খুলে পড়ার পরও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কার্যকলাপ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ মুনাফিকদের একটা বড় দল তার সহযোগী ছিল। আওস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের বহু সংখ্যক নেতা তার সাহায্যকারী ছিল। কম করে হলেও মদীনার গোটা জনবসতির এক তৃতীয়াংশ ছিল তার সাঙ্গপাঙ্গ। উহুদ যুদ্ধের সময় এ বিষয়টিই প্রকাশ পেয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সাথে সাথে আভ্যন্তরীণ শত্রুর সাথেও যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়া কোন অবস্থায়ই সমীচীন ছিল না। এ কারণে তাদের মুনাফিকী সম্পর্কের অবহিত থাকা সত্ত্বেও নবী (সা.) দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাহ্যিকভাবে ঈমানের দাবি অনুসারেই তাদের সাথে আচরণ করেছেন। অপরদিকে এসব লোকেরও এতটা শক্তি ও সাহস ছিল না যে, তারা প্রকাশ্যে কাফের হয়ে ঈমানদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করত অথবা খোলাখুলি কোন হামলাকারী শত্রুর সাথে মিলিত হয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হতো। বাহ্যত তারা নিজেদের একটা মজবুত গোষ্ঠী তৈরী করে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে বহু দুর্বলতা ছিল। সূরা হাশরের ১২ থেকে ১৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা স্পষ্টভাবে সেইসব দুর্বলতার কথাই তুলে ধরেছেন। তাই তারা মনে করতো মুসলমান সেজে থাকার মধ্যেই তাদের কল্যাণ নিহিত। তারা মসজিদে আসত, নামায পড়তো এবং যাকাতও দিতো। তাছাড়া মুখে ঈমানের লম্বা চওড়া দাবি করতো, সত্যিকার মুসলমানদের যা করার আদৌ কোন প্রয়োজন পড়তো না। নিজেদের প্রতিটি মুনাফিকী আচরণের পক্ষে হাজারটা মিথ্যা যুক্তি তাদের কাছে ছিল। এসব কাজ দ্বারা তারা নিজেদের স্বগোত্রীয় আনসারদেরকে এই মর্মে মিথ্যা আশ্বাস দিত যে, আমরা তোমাদের সাথেই আছি। আনসারদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তাদের অনেক ক্ষতি হতো। এসব কৌশল অবলম্বন করে তারা যেসব ক্ষতি থেকে নিজেদের রক্ষা করেছিল। তাছাড়া তাদের ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ থেকে মুসলমানদের ভেতরে কলহ কোন্দল ও ফ্যাসাদ সৃষ্টির এমন সব সুযোগও তারা কাজে লাগাচ্ছিল যা অন্য কোন জায়গায় থেকে লাভ করতে পারত না।
এসব কারণে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ মুনাফিকরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বনী মুসতালিক যুদ্ধাভিযানে শরীক হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিল এবং এই সুযোগে একই সাথে এমন দুটি মহাফিতনা সৃষ্টি করেছিল যা মুসলমানদের সংহতি ও ঐক্যকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারত। কিন্তু পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সাহচর্য থেকে ঈমানদাগণ যে সর্বোত্তম প্রশিক্ষণ লাভ করেছিলেন তার কল্যাণে যথা সময়ে এ ফিতনার মুলোৎপাটন হয়ে যায় এবং এসব মুনাফিক নিজেরাই অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়। এ দুটি ফিতনার মধ্যে একটির উল্লেখ করা হয়েছে সূরা নূরে। আর অপর ফিতনাটির উল্লেখ করা হয়েছে আলোচ্য এই সূরাটিতে।
বুখারী, মুসলিম, আহমাদ, নাসায়ী, তিরমিযী, বায়হাকী, তাবারানী, ইবনে মারদুইয়া, আবদুর রাযযাক, ইবনে জারীর, তাবারী, ইবনে সা’দ এবং মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বহু সংখ্যক সনদসূত্রে এই ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। যে অভিযানের সময় এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল কিছু সংখ্যক রেওয়ায়াতে তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। আবার কোন কোন রেওয়ায়াতে তাবুক যুদ্ধের সময়কার ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু মাগাযী (যুদ্ধ বিষয়ক ইতিহাস) ও সীরাত (নবী জীবন) বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে একমত যে, এ ঘটনা বনী মুসতালিক যুদ্ধের সময় সংঘটিত হয়েছিল। বিভিন্ন রেওয়ায়াত একত্রিত করলে ঘটনার যে বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় তা হচ্ছে:
বনী মুসতালিক গোত্রকে পরাস্ত করার পর ইসলামী সেনাবাহিনী তখনও মুরাইসী নামক কূপের আশেপাশের জনবসতিতে অবস্থান করেছিল। ইতিমধ্যে হঠাৎ পানি নিয়ে দুই ব্যক্তির মধ্যে বচসা হয়। তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল জাহ্জাহ্ ইবনে মাসউদ, গিফারী। তিনি ছিলেন হযরত উমরের (রা.) কর্মচারী। তিনি তাঁর ঘোড়ার দেখাশোনা ও তত্বাবধান করতেন। অন্যজন ছিলেন সিনান ইবনে ওয়াবার ইল জুহানী। ১ তাঁর গোত্র খাযরাজ গোতের মিত্র ছিল। মৌখিক বাদানুবাদ শেষ পর্যন্ত হাতাহাতিতে পরিণত হয় এবং জাহজাহ সিনানকে একটি লাথি মারে। প্রাচীন ইয়ামানী ঐতিহ্য অনুসারে আনসারগণ এ ধরনের আচরণকে অত্যন্ত অপমানজনক ও লাঞ্ছনাকর মনে করতেন। এতে সিনান সাহায্যের জন্য আনসারদেরকে আহবান জানায় এবং জাহজাহও মুহাজিরদের আহবান জানায়। এই ঝগড়ার খবর শোনামাত্র আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আওস ও খাযরাজ গোত্রের লোকদের উত্তেজিত করতে শুরু করে। সে চিৎকার করে বলতে থাকে দ্রুত এসো, নিজের মিত্রদের সাহায্য করো। অপরদিকে থেকে কিছু সংখ্যক মুহাজিরও এগিয়ে আসেন। বিষয়টি আরো অনেক দূর পর্যন্ত গড়াতে পারতো। ফলে আনসার ও মুহাজিরগণ সম্মিলিতভাবে সবেমাত্র যে স্থানটিতে এক দুশমন গোত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাদের পরাজিত করেছিলেন এবং তখনও তাদের এলাকাতেই অবস্থান করেছিলেন সে স্থানটিতেই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের লিপ্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু শোরগোল শুনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগিয়ে গেলেন এবং বললেন:
“কি ব্যাপার! জাহেলিয়াতের আহবান শুনতে পাচ্ছি কেন? জাহেলিয়াতের আহবানের সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? এসব ছেড়ে দাও, এগুলো দুর্গন্ধময় নোংরা জিনিস। ২ এতে উভয়পক্ষের সৎ ও নেককার লোকজন অগ্রসর হয়ে ব্যাপারটি মিটমাট করে দিলেন এবং সিনান জাহজাহকে মাফ করে আপোষ করে নিলেন।
১. বিভিন্ন রেওয়ায়াতে উভয়ের বিভিন্ন নাম বর্ণনা করা হয়েছে। আমরা ইবনে হিশামের বর্ণনা থেকে এ নাম গ্রহণ করেছি।
২. এই সময় নবীর (সা.) বলা একথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের সঠিক মর্মবাণীকে বুঝতে হলে একথাটি যথাযথভাবে বুঝে নেয়ার প্রয়োজন। ইসলামের নীতি হচ্ছে, দুই ব্যক্তি যদি তাদের বিবাদের ব্যাপারে সাহায্যের জন্য মানুষকে আহবান জানাতে চায় তাহলে সে বলবে, মুসলমান ভাইয়েরা, এগিয়ে এসো, আমাদের সাহায্য করো। অথবা বলবে, হে লোকেরা, আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আস। কিন্তু তাদের প্রত্যেকে যদি নিজ গোত্র, স্বজন, বংশ ও বর্ণ অথবা অঞ্চলের নাম নিয়ে আহবান জানায় তাহলে তা জাহেলিয়াতের আহবান হয়ে দাঁড়ায়। এ আহবানের সাড়া দিয়ে আগমনকারী যদি কে অত্যাচারী আর কে অত্যাচারিত তা না দেখে এবং হক ও ইনসাফের ভিত্তিতে অত্যাচারিতকে সাহায্যে করার পরিবর্তে নিজ নিজ গোষ্ঠীর লোককে সাহায্য করার জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাহলে তা একটি জাহেলিয়াতপূর্ণ কাজ। এ ধরনের কাজ দ্বারা দুনিয়াতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। তাই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একে নোংরা ও ঘৃণিত জিনিস বলে আখ্যায়িত করে মুসলমানদের বলেছেন যে, এরূপ জাহেলিয়াতের আহবানের সাথে তোমাদের কি সম্পর্ক? তোমরা ইসলামের ভিত্তিতে একটি জাতি হয়েছিলে। এখন আনসার ও মুহাজিরদের নাম দিয়ে তোমাদের কি করে আহবান জানানো হচ্ছে, আর সেই আহবান শুনে তোমরা কোথায় ছুটে যাচ্ছে? আল্লামা সুহাইলী “রাওদুল উনুফ” গ্রন্থে লিখেছেন: কোন ঝগড়া-বিবাদ বা মতানৈক্যের ক্ষেত্রে জাহেলিয়াপূর্ণ আহবান জানানোকে ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদগণ রীতিমত ফৌজদারী অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছেন। একদল আইনবিদের মতে এর শাস্তি পঞ্চাশটি বেত্রাঘাত এবং আরেক দলের মতে দশটি। তৃতীয় আরেক দলের মতে, তাকে অবস্থার আলোকে শাস্তি দেয়া দরকার। কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু তিরস্কার ও শাসনই যথেষ্ট। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরনের আহবান উচ্চারণকারীকে বন্দী করা উচিত। সে যদি বেশী দুষ্কর্মশীল হয় তাহলে তাকে বেত্রাঘাত করতে হবে।
কিন্তু যাদের অন্তরে মুনাফিকী ছিল তারা সবাই এরপর আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের কাছে সমবেত হয়ে তাকে বললো: “এতদিন আমরা তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তুমি প্রতিরোধও করে আসছিলে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তুমি আমাদের বিরুদ্ধে এসব কাঙাল ও নি:স্বদের ১ সাহায্যকারী হয়ে গিয়েছো। “আবদুল্লাহ ইবনে উবাই আগে থেকেই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিল। একথা শুনে সে আরো জ্বলে উঠল। সে বলতে শুরু করল: এসব তোমাদের নিজেদেরই কাজের ফল। তোমরা এসব লোককে নিজের দেশে আশ্রয় দিয়েছো, নিজেদের অর্থ-সম্পদ তাদের বন্টন করে দিয়েছো। এখন তারা ফুলে ফেঁপে উঠেছে এবং আমাদেরই প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এবং কুরাইশদের এই কাঙালদের বা মুহাম্মাদের (সা.) (সঙ্গীসাথীদের) অবস্থা বুঝাতে একটি উপমা হুবহু প্রযোজ্য। উপমাটি হলো, তুমি নিজের কুকুরকে খাইয়ে দাইয়ে মোটা তাজা করো, যাতে তা একদিন তোমাকেই ছিঁড়ে ফেড়ে খেতে পারে। তোমরা যদি তাদের থেকে সাহায্যের হাত গুটিয়ে নাও তাহলে তারা কোথায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আল্লাহর শপথ, মদীনা ফিরে গিয়ে আমাদের মধ্যে যারা মর্যাদাবান লোক তারা হীন ও লাঞ্ছিত লোকদের বের করে দেবে। “
এ বৈঠকে ঘটনাক্রমে হযরত যায়েদ ইবনে আরকমাও উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি একজন কমবয়স্ক বালক ছিলেন। এসব কথা শোনার পর তিনি তাঁর চাচার কাছে তা বলে দেন। তাঁর চাচা ছিলেন আনসারদের একজন নেতা। তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে সব বলে দেন। নবী (সা.) যায়েদকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি যা শুনেছিলেন আদ্যপান্ত খুলে বললেন। ২নবী (সা.) বললেন: তুমি বোধ হয় ইবনে উবাইয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। সম্ভবত তোমার শুনতে ভুল হয়েছে। ইবনে উবাই একথা বলছে বলে হয়তো তোমার সন্দেহ হয়েছে। কিন্তু যায়েদ বললেন, হে আল্লাহর রসূল, তা নয়। আল্লাহর শপথ আমি নিজে তাকে এসব কথা বলতে শুনেছি। অতপর নবী (সা.) ইবনে উবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে সরাসরি অস্বীকার করলো। সে বারবারের শপথ করে বলতে লাগলো আমি একথা কখনো বলি নাই। আনসারদের লোকজনও বললেন: হে আল্লাহর নবী, এতো একজন ছেলে মানুষের কথা, হয়তো তার ভুল হয়েছে।
তিনি আমাদের নেতা ও সম্মানিত ব্যক্তি। তার কথার চেয়ে একজন বালকের কথার প্রতি বেশী আস্থাশীল হবেন না। বিভিন্ন গোত্রের প্রবীণ ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরাও যায়েদকে তিরস্কার করলো। বেচারা যায়েদ এতে দু:খিত ও মন:ক্ষুণ্ন হয়ে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকলেন। কিন্তু নবী (সা.) যায়দে ও আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উভয়কেই জানতেন। তাই প্রকৃত ব্যাপার কি তা তিনি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারলেন।
১. যারা ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় চলে আসছিল মদীনার মুনাফিকরা তাদের সবাইকে () বলে আখ্যায়িত করতো। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কম্বল বা মোটা বস্ত্র পরিধানকারী। কিন্তু গরীব মুহাজিরদেরকে হেয় ও অবজ্ঞা করার জন্যই তারা এ শব্দটি ব্যবহার করতো। যে অর্থ বুঝাতে তারা শব্দটি বলত, ‘কাঙাল’ শব্দ দ্বারা তা অধিকতর বিশুদ্ধভাবে ব্যক্ত হয়।
২. এ ঘটনা থেকে ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন যে, ধর্মীয়, নৈতিক ও জাতীয় স্বার্থের খাতিরে কেউ যদি কারো ক্ষতিকর কথা অন্য করো কাছে বলে তা হলে চোগলখুরীর পর্যায়ে পড়ে না। ফিতনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় সৃষ্টি এবং মানুষের পরস্পরের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে যে চোগলখুরী করা হয় সেই চোখলখুরীকে ইসলামী শরীয়াত হারাম ঘোষণা করেছে।
হযরত ‘উমর এ বিষয়টি জানতে পেরে নবীর (সা.) কাছে এসে বললেন: “আমাকে অনুমতি দিন, আমি এই মুনাফিকের গর্দান উড়িয়ে দেই। অথবা এরূপ অনুমতি দেয়া যদি সমীচীন মনে না করেন তাহলে আনসারদের নিজেদের মধ্যে থেকে মুআয ইবনে জাবাল অথবা আববাদ ইবনে বিশর, অথবা সা’দ ইবনে মু’আয অথবা মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাকে নির্দেশ দিন ১ সে তাকে হত্যা করুক। “কিন্তু নবী (সা.) বললেন: “এ কাজ করো না। লোকে বলবে, মুহাম্মাদ (সা.) নিজের সংগী-সাথীদেরকেই হত্যা করেছে”। এরপর নবী(সা.) তৎক্ষনাৎ যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিয়ে দিলেন। অথবা নবী (সা.) এর স্বাভাবিক রীতি ও অভ্যাস অনুসারে তা যাত্রার সময় ছিল না। ক্রমাগত ৩০ ঘন্টা পর্যন্ত যাত্রা অব্যাহত থাকলো। এমন কি লোকজন ক্লান্তিতে নিস্তেজ ও দুর্বল হয়ে পড়লো। তখন তিনি একস্থানে তাবু করে অবস্থান করলেন। ক্লান্ত শ্রান্ত লোকজন মাটিতে পিঠ ঠেকানো মাত্র সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এ কাজ তিনি এ জন্য করলেন যাতে, মুরইসী কূপের পাশে যে ঘটনা ঘটেছিল মানুষের মন-মগজ থেকে তা মুছে যায়। পথিমধ্যে আনসারদের একজন নেতা হযরত উসাইদ ইবনে হুদায়ের তাঁর কাছে গিয়ে বললেন: “হে আল্লাহর রসূল, আজ আপনি এমন সময় যাত্রার নির্দেশ দিয়েছেন যা সফরের জন্য উপযুক্ত নয়। আপনি তো এ রকম সময়ে কখনো সফর শুরু করতেন না?”নবী (সা.) বললেন: তোমাদের সেই লোকটি কি কথা প্রচার করেছে তা কি তুমি শোন নাই? তিনি জিজ্ঞেস করলেন: কোন লোকটি? তিনি বললেন: আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। উসাইদ জিজ্ঞেস করলেন, সে কি বলেছে? তিনি বললেন: “সে বলেছে মদীনায় পৌছার পর সম্মানী লোকেরা হীন ও নীচ লোকদের বহিষ্কার করবে। তিনি আরয করলেন, হে আল্লাহর রসূল। সম্মানিত ও মর্যাদাবান তো আপনি। আর হীন ও নীচ তো সে নিজে। আপনি যখন ইচ্ছা তাকে বহিষ্কার করতে পারেন”।
১. বিভিন্ন রেওয়াওয়াতে আনসারদের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নাম উল্লেখিত হয়েছে। হযরত উমর (রা.) নবীর (সা.) কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন “আমি মুহাজির হওয়ার কারণে আমার হাতে সে নিহত হলে ফিতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকলে এসব লোকদের মধ্য থেকে কোন একজনকে দিয়ে এ কাজ করিয়ে নিন”।
কথাটা আস্তে আস্তে আনসারদের সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো এবং ইবনে উবাইয়ের বিরুদ্ধে তাদের মনে ভীষণ ক্রোধের সৃষ্টি হলো। লোকজন ইবনে উবাইকে বললো, তুমি গিয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের কাছে ক্ষমা চাও। কিন্তু সে ক্রদ্ধ স্বরে জবাব দিল: তোমরা বললে তার প্রতি ঈমান আন। আমি ঈমান আনলাম। তোমরা বললে, অর্থ-সম্পদের যাকাত দাও। আমি যাকাতও দিয়ে দিলাম। এখন তো শুধু মুহাম্মাদকে আমার সিজদা করা বাকী আছে। এসব কথা শুনে তার প্রতি ঈমানদার আনসারদের অসন্তুষ্টি আরো বৃদ্ধি পেল এবং চারদিক থেকে তার প্রতি ধিক্কার ও তিরস্কার বর্ষিত হতে থাকলো। যে সময় এ কাফেলা মদীনায় প্রবেশ করছিল তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের পুত্র (তার নামও) আবদুল্লাহ খোলা তরবারি হাতে পিতার সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন: “আপনিই তো বলেছেন, মদীনায় ফিরে গিয়ে সম্মানিত ব্যক্তিরা হীন ও নীচ লোকদের সেখান থেকে বহিষ্কার করবে। এখন আপনি জানতে পারবেন সম্মান আপনার, না আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের। আল্লাহর কসম! যতক্ষণ পর্যন্ত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুমতি না দেবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবেন না”। এতে ইবনে উবাই চিৎকার করে বলে উঠল “হে খাযরাজ গোত্রের লোকজন, দেখো, আমার নিজের ছেলেই আমাকে মদীনায় প্রবেশ করতে বাধা দিচ্ছে”। লোকজন গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ খবর দিলে তিনি বললেন: “আবদুল্লাহকে গিয়ে বলো তার পিতাকে যেন নিজের বাড়ীতে প্রবেশ করতে দেয়”। তখন আবদুল্লাহ বললেন: “নবী (সা.) অনুমতি দিয়েছেন তাই এখন আপনি প্রবেশ করতে পারেন”। এই সময় নবী (সা.) হযরত উমরকে (রা.) বললেন: “হে উমর, এখন তোমার মতামত কি? যে সময় তুমি বলেছিলে, আমাকে তাকে হত্যা করার অনুমতি দিন, সে সময় তুমি যদি তাকে হত্যা করতে তাহলে অনেকেই নাক সিটকাতো এবং নানা রকম কথা বলতো। কিন্তু আজ যদি আমি তার হত্যার আদেশ দেই তাহলে তাকে হত্যা পর্যন্ত করা যেতে পারে”। হযরত উমর বললেন: “আল্লাহর শপথ, এখন আমি বুঝতে পেরেছি আল্লাহর রসূলের কথা আমার কথার চেয়ে অধিক যুক্তিসঙ্গত ছিল”। ১ এই পরিস্থিতি ও পটভূমিতে অভিযান শেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় পৌছার পর এ সূরাটি নাযিল হয়।
১. এ থেকে শরীয়াতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাসায়ালা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা যায়। এক, ইবনে উবাই যে কর্মনীতি গ্রহণ করেছিল এবং যে ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত থেকে কেউ যদি এ ধরনের আচরণ করে তাহলে সে হত্যাযোগ্য অপরাধী। দুই, শুধু আইনের দৃষ্টিতে কোন ব্যক্তি হত্যার উপযুক্ত হলেই যে তাকে অবশ্যই হত্যা করতে হবে তা জরুরী নয়। এরূপ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দেখতে হবে, তাকে হত্যা করার ফলে কোন বড় ধরনের ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে কিনা। পরিবেশ-পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে অন্ধভাবে আইনের প্রয়োগ কোন কোন সময় আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যের পরিপন্থী ফলাফল নিয়ে আসে। যদি একজন মুনাফিক ও ফিতনাবাজের পেছনে কোন উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি থাকে তাহলে তাকে শাস্তি দিয়ে আরো বেশী ফিতনাকে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ দেয়ার চেয়ে উত্তম হচ্ছে, যে রাজনৈতিক শক্তির জোরে সে দুষ্কর্ম করছে কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার সাথে তার মূলোৎপটন করা। এই সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যেই নবী (সা.) তখনো আবদুল্লাহ ইবনে উবাইকে শাস্তি দেননি যখন তিনি তাকে শাস্তি দিতে সক্ষম ছিলেন। বরং তার সাথে সবসময় নম্র আচরণ করেছেন। শেষ পর্যন্ত দুই তিন বছরের মধ্যেই মদীনায় মুনাফিকদের শক্তি চিরদিনের জন্য নির্মূল হয়ে গেল।
# যে কথা তারা মুখে বলেছে তা আসলে সত্য। কিন্তু তারা মুখে যা প্রকাশ করছে নিজেরা যেহেতু তা বিশ্বাস করে না, তাই তাঁর রসূল হওয়ার যে সাক্ষ্য তারা দেয় সে ব্যাপারে তারা মিথ্যাবাদী। এখানে একথাটি ভালভাবে বুঝে নিতে হবে যে, দু’টি জিনিসের সমন্বয়ের নাম সাক্ষ্য। এক, যে মূল বিষয়টির সাক্ষ্য দেয়া হয় সেটি। দুই, সেই বিষয়টি সম্পর্কে সাক্ষ্যদানকারীর বিশ্বাস। এখন বিষয়টি যদি আসলে সত্য হয় এবং সাক্ষ্য দানকারী মুখে যা বলছে তার বিশ্বাসও যদি তাই হয়, তাহলে সে সবদিক দিয়েই সত্যবাদী হবে। আর বিষয়টি যদি মিথ্যা হয়, কিন্তু সাক্ষ্যদাতা সেটিতে সত্য বলে বিশ্বাস করে তাহলে একদিক দিয়ে আমরা তাকে সত্যবাদী বলবো। কেননা সে তার বিশ্বাসকে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সত্যবাদী। কিন্তু আরেক দিক দিয়ে তাকে মিথ্যাবাদী বলব। কেননা, সে যে বিষয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে তা প্রকৃতপক্ষে ভুল। অপরদিকে বিষয়টি যদি সত্য হয় কিন্তু সাক্ষ্যদাতার বিশ্বাস তার পরিপন্থী হয় তাহলে সঠিক বিষয়টির সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আমরা তাকে সত্যবাদী বলব। কিন্তু সে মুখে যা প্রকাশ করছে তার বিশ্বাস না হওয়ার কারণে আমরা তাকে মিথ্যাবাদী বলব। যেমন কোন ঈমানদার ব্যক্তি যদি ইসলামকে সত্য বলে তাহলে সে সবদিক দিয়ে সত্যবাদী। কিন্তু একজন ইহুদী যদি ইহুদী ধর্মের ওপর বিশ্বাসী থেকে ইসলামকে সত্য বলে তাহলে তার কথা সত্য কিন্তু তার সাক্ষ্য মিথ্যা বলে গণ্য করা হবে। কেননা, সে তার বিশ্বাসের পরিপন্থী সাক্ষ্য দিচ্ছে। আর সে যদি ইসলামকে বাতিল বা মিথ্যা বলে তাহলে আমরা তার একথা মিথ্যা বলবো। কিন্তু সে যে সাক্ষ্য দিচ্ছে তা তার নিজের বিশ্বাস অনুসারে সত্য।
# নিজেরা মুসলমান ও ঈমানদার এ কথা বিশ্বাস করানোর জন্য তারা যেসব শপথ করে সেগুলোকে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যাতে মুসলমানদের ক্রোধ থেকে রক্ষা পায় এবং প্রকাশ্য শত্রুর সাথে মুসলমানগণ যে আচরণ করে থাকে তাদের সাথে তা করতে না পারে।
এসব শপথ দ্বারা ঐ সব শপথও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে যা সাধারণত তারা নিজেদের ঈমানের বিষয়টি বিশ্বাস করানোর করতো। তাদের মুনাফিকী আচরণ ধরা পড়ার পর যেসব শপথ করে তারা মুসলমানদের বুঝাতে চাইতো যে, তা তারা মুনাফিকীর কারণে করেনি সেসব শপথও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। আবার যায়েদ ইবনে আরকামের দেয়া খবর মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে উবাই যে শপথ করেছিল তাও বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। এসব সম্ভাবনার সাথে আরো একটি সম্ভাবনা আছে। তা হলো, “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসূল” তাদের একথাটিকে আল্লাহ তা’আলা শপথ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই সম্ভাবনার ভিত্তিতে ফিকাহবিদদের মধ্যে একটি বিষয়ে বিতর্কের সুত্রপাত হয়েছে। বিষয়টি হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যদি “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি” বলে কোন কথা বর্ণনা করে তাহলে তা শপথ বা হলফ(Oath) বলে বিবেচিত হবে কিনা। ইমাম আবু হানিফা (র) ও তাঁর সাথীগণ (ইমাম যুফার ছাড়া) এবং ইমাম সুফিয়ান সাওরী ও ইমাম আওযায়ী একে শপথ (শরীয়াতের পরিভাষা ইয়ামীন) বলে মনে করেন। ইমাম যুফার বলেনঃ এটা শপথ নয়। ইমাম মালেক থেকে দু’টি মত বর্ণিত হয়েছে, একটি হচ্ছে, এটা নিছক শপথ। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, “সাক্ষ্য দিচ্ছি” বলার সময় সে যদি এরূপ নিয়ত করে যে, “আল্লাহর শপথ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি” অথবা “আল্লাহকে সাক্ষী রেখে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি” তাহলে সে ক্ষেত্রে এটা শপথমূলক বর্ণনা হবে। অন্যথায় হবে না। ইমাম শাফেয়ী (র) বলেন, বক্তব্য পেশকারী ব্যক্তি যদি এ কথাও বলে যে, “আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে সাক্ষ্য দিচ্ছি” তবুও তা তার শপথমূলক বক্তব্য বলে গণ্য হবে না। কিন্তু সে যদি এরূপ কথা শপথের নিয়তেই বলে থাকে তাহলে তা শপথ বলে গণ্য হবে। (আহকামূল কুরআন-জাসসাস, আহকামুল কুরআন-ইবনুল আরাবী)।
# আরবী ভাষায় صَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ শব্দটি সকর্মক এবং অকর্মক এই উভয় প্রকার ক্রিয়া হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। এ কারণে صد আয়াতাংশের অর্থ “তারা নিজেরা আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকে” যেমন হয়, তেমনি “তারা অন্যদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে”ও হয়। তাই অনুবাদে আমরা দু’টি অর্থই উল্লেখ করেছি। প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে আয়াতাংশের অর্থ হবে এসব শপথের মাধ্যমে তারা মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের অবস্থান সুরক্ষিত করে নেয়ার পর ঈমানের দাবী পূরণ না করার এবং আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য থেকে পাশ কাটিয়ে চলার ব্যাপারে সুযোগ সৃষ্টি করে নেয়। দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করলে আয়াতাংশের অর্থ হবে, এসব মিথ্যা শপথের আড়ালে তারা শিকারের সন্ধানে থাকে, মুসলমান সেজে থেকে ভিতর থেকেই মুসলমানদের জামায়াতের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে। মুসলমানদের গোপনীয় বিষয়সমূহ জেনে নিয়ে তা শত্রুদের জানিয়ে দেয়, ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের মধ্যে খারাপ ধারণা সৃষ্টি করতে এবং সহজ-সরল মুসলমানদের মনে সন্দেহ-সংশয় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে তারা এমন সব কৌশল অবলম্বন করে যা কেবল মুসলমান সেজে থাকা একজন মুনাফিকের পক্ষেই সম্ভব। ইসলামের প্রকাশ্য শত্রুরা ঐ সব কৌশল কাজে লাগাতে পারে না।
# এ আয়াতে ঈমান আনার অর্থ বুঝানো হয়েছে ঈমানের স্বীকৃতি দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে শামিল হওয়াকে আর কুফরের অর্থ বুঝানো হয়েছে আন্তরিকভাবে ঈমান না আনা এবং মৌখিকভাবে ঈমান আনার পূর্বে যে কুফরের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই কুফরের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকাকে। কথাটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, তারা যখন খুব ভালভাবে বুঝে শুনে সোজাসুজি ঈমানের পথ অবলম্বন অথবা পরিষ্কাভাবে কুফরের পথ গ্রহণের পরিবর্তে মুনাফিকীর এই নীতি ও পন্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিল তখন আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তাদের অন্তরের ওপর মোহর মেরে দেয়া হলো এবং একজন সত্যবাদী, নিষ্কলুষ, সৎ ও ভদ্র মানুষের মত নীতি ও পন্থা অবলম্বন করার সামর্থ্য ও শুভবুদ্ধিই আল্লাহ তা’আলা তাদের থেকে ছিনিয়ে নিলেন। এখন তাদের জ্ঞান ও উপলব্ধির যোগ্যতাই হারিয়ে গিয়েছে এবং নৈতিক অনুভূতির মৃত্যু ঘটেছে। রাতদিনের এই মিথ্যা প্রতি মূহূর্তের এই প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি এবং কথা এবং কাজের এ স্থায়ী বৈপরীত্য-যার মধ্যে তারা নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলেছে-তা যে কত হীন ও লাঞ্ছনাকর অবস্থা, সে উপলব্ধিটুকু পর্যন্ত এখন তাদের আসে না।
আল্লাহর পক্ষ থেকে কারো অন্তরে মোহর মেরে দেয়ার অর্থ কুরআন মজীদের যেসব আয়াতে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে আলোচ্য আয়াতটি তার একটি। এসব মুনাফিকের অন্তরে আল্লাহ তা’আলা মোহর মেরে দেয়ার কারণে ঈমান তাদের অন্তরে প্রবেশ করতে পারেনি এবং তারা বাধা হয়ে মুনাফিক রয়ে গিয়েছে-ব্যাপারটি তা নয়। বরং বাহ্যিকভাবে ঈমান প্রকাশ করা সত্ত্বেও যখন তারা কুফরির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন আল্লাহ তা’আলা তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিয়েছেন। এ সময়ই তাদের থেকে নির্ভেজাল ঈমান ও তা থেকে জন্মলাভকারী নৈতিক আচরণ করার সামর্থ্য ও শুভবুদ্ধি ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং তারা নিজেদের জন্য যে মুনাফিকী ও মুনাফিকী চরিত্র পছন্দ করেছিল তার সামর্থ্য ও বুদ্ধিই তাদের দান করা হয়েছে।
# হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অত্যন্ত সুঠামদেহী, সুস্থ, সুদর্শন ও বাকপটু ব্যক্তি ছিল। তার সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকও তাই ছিল। এরা সবাই ছিল মাদীনার নেতৃস্থানীয় লোক। তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে যখন আসতো তখন দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসতো এবং রসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা বলতো। তাদের দেহাবয়ব ও চেহারা-আকৃতি দেখে আর কথাবার্তা শুনে কেউ কল্পনাও করতে পারতো না যে, সমাজের এসব সম্মানিত লোকেরা চরিত্রের দিক দিয়ে এত নীচ ও জঘন্য হতে পারে।
# এরা যারা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে তারা মানুষ নয়, বরং কাঠের গুড়ি। তাদেরকে কাষ্ঠখণ্ডের সাথে তুলনা করে বুঝানো হয়ে ছে যে, নৈতিক চরিত্র মানুষের মূল প্রাণসত্তা, সেই প্রাণসত্তাই তাদের মধ্যে নেই। তারপর তাদেরকে দেয়ালগাত্রে হেলান দিয়ে খাড়া করা কাষ্ঠখন্ডের সাথে তুলনা করে এ কথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, তা একেবারেই অকেজো, অপদার্থ। কেননা, কাঠ কেবল তখনই উপকারে আসে যদি তা ছাদে অথবা দরজায় বা আসবাব তৈরীর কাজে ব্যবহার করা হয়। দেয়াল গাত্রে হেলান দিয়ে রাখা কাষ্ঠখন্ড কোন উপকারেই আসে না।
# ছোট্ট এই আয়াতাংশে তাদের অপরাধী বিবেকের চিত্র অংকন করা হয়েছে। ঈমানের বাহ্যিক পর্দার আড়ালে মুনাফিকীর যে খেলা তারা খেলছিল তা নিজেরা যেহেতু ভাল করেই জানতো, তাই সবসময় তারা ভীতসন্ত্রস্ত থাকতো যে কখনো যেন তাদের অপরাধের গোপনীয়তা প্রকাশ পেয়ে যায়, অথবা তাদের আচরণের ব্যাপারে ঈমানদারদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় এবং তাদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়। জনপদের কোন স্থান থেকে কোন বড় আওয়াজ শোনা গেলে অথবা কোথাও কোন শোরগোল উত্থিত হলে তারা ভয়ে জড়সড় হয়ে যেত এবং মনে করত, আমার দুর্ভাগ্য বোধ হয় এসেই পড়ল।
# অন্য কথায় প্রকাশ্য দুশমন তুলনায় ছদ্মবেশী এসব দুশমন অনেক বেশী ভয়ংকর।
# তাদের বাহ্যিক চালচলন ও আচার আচরণ দেখে প্রতারিত হয়ো না। এ ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকো যে, এরা যে কোন সময় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।
# এটা বদদোয়া নয়, বরং তারা যে আল্লাহর গযবের উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং সে গযব যে অবশ্যই নাযিল হবে-এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তারই ঘোষণা। এও হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলা এ বাকাংশটি আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করেননি এবং আরবী বাকরীতি অনুসারে, অভিশাপ ও তিরস্কার অর্থে ব্যবহার করেছেন। আমাদের নিজস্ব ভাষায় আমরা যেমন বলিঃ ওর সর্বনাশ হোক, কি জঘন্য মানুষ সে। এখানে “সর্বনাশ” শব্দটি দ্বারা তার জঘন্যতার তীব্রতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, বদদোয়া করা নয়।
# তাদেরকে ঈমানের পথ থেকে মুনাফিকীর পথে কে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা বলা হয়নি। একথাটি স্পষ্ট করে না বলার কারণে আপনা থেকেই যে অর্থ প্রকাশ পায় তা হলো, তাদের এই এলোপাতাড়ি ও অস্বাভাবিক আচরণের চালিকাশক্তি একটি নয়, বরং বহু সংখ্যক চালিকাশক্তি এর পেছনে সক্রিয় রয়েছে। তাদের পেছনে এই চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে শয়তান, অসৎ বন্ধু-বান্ধব এবং তাদের কুপ্রবৃত্তির আকাংখাসমূহ। কারো স্ত্রী, কারো সন্তান-সন্তুতি, কারো নিজ গোত্র ও গোষ্ঠীর অসৎলোকজন তাকে এ পথে চলতে বাধ্য করছে। আবার কাউকে তার হিংসা, বিদ্বেষ ও অহমিকা এ পথে তাড়িত করেছে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
#সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এই সূরাটির নাম আল মুনাফিকুন। এই নাম দ্বারাই এর আলােচ্য বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে মুনাফিকদের আলােচনা এবং তাদের স্বভাব চরিত্র ও চক্রান্তের বিবরণ শুধু যে এই সূরাতেই এসেছে তা নয়; বরং বলতে গেলে মদীনায় নাযিল হওয়া কোনাে সূরাতেই মুনাফিকদের প্রসঙ্গ বাদ যায়নি। তা প্রত্যক্ষভাবেই হােক বা পরােক্ষভাবেই হােক। কিন্তু এই সূরা মুনাফিকদের এবং তাদের কথিত কিছু কথাবার্তা ও তাদের দ্বারা সংঘটিত কিছু ঘটনার আলােচনায় সীমাবদ্ধ। তাছাড়া মুনাফিকের চরিত্র, মিথ্যাচার, জালিয়াতি, ষড়যন্ত্র, তাদের অন্তরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সঞ্চিত আক্রোশ, চক্রান্ত, নীচাশয়তা, কাপুরুষতা এবং চোখ ও মনের অন্ধত্ব সম্পর্কেও এই সূরায় তীব্র সমালােচনা করা হয়েছে। এছাড়া এ সূরায় অন্য কোনাে প্রসংগ আলােচিত হয়নি বললেই চলে। কেবল শেষের দিকে মােমেনদের অতি সংক্ষেপে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা যেন মুনাফিকদের সামান্যতম দোষেও দুষ্ট না হয়। এই সাথে কয়েকটি জিনিসকে মুনাফিকদের ন্যূনতম চারিত্রিক দোষ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহর জন্যে সর্বতােভাবে আত্মনিবেদিত না হওয়া, ধন সম্পদ ও সন্তান সন্ততি নিয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকার কারণে আল্লাহকে ভুলে যাওয়া এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করতে কার্পণ্য প্রদর্শন করতে থাকা, যতােক্ষণ না মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসে- যেদিন কোনাে দানশীলতাই কাজে আসবে না। মুনাফিকী নামক রােগটা মুসলমানদের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে মদীনায় ইসলামের আগমনের সাথে সাথেই। রসূল(স.)-এর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে এবং বলতে গেলে কোনাে সময়ে তা পুরােপুরি নির্মূল হয়নি। অবশ্য সময়ে সময়ে তার বৈশিষ্ট্য, নিদর্শনাবলী ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। রসূল(স.)-এর জীবদ্দশায় ইসলামের যে ঐতিহাসিক যুগটা অতিবাহিত হয়েছে, তার বিভিন্ন ঘটনাবলীতে এই রােগটার যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মুসলমানদের চেষ্টা-সাধনা, সময় ও শক্তির এক বিরাট অংশ এই রােগের কবলে পড়ে নষ্ট হয়েছে। কোরআন ও হাদীসে এ রােগ সম্পর্কে এতােবার আলােচনা করা হয়েছে যে, তা দ্বারা বুঝা যায়, এ রােগটি কতাে সাংঘাতিক এবং তৎকালীন ইসলামী আন্দোলনের ওপর এর প্রভাব কতাে বেশী ছিলাে। অধ্যাপক মােহাম্মদ ইযযত দারুয়া লিখিত ‘সীরাতুর রাসূল, সুয়ারুম মুকতাবাসাতুম মিনাল কোরআনিল কারীম (কোরআনে রাসূল জীবনের কয়েকটি চিত্র) নামক গ্রন্থে মুনাফিকী সম্পর্কে একটি চমৎকার অধ্যায় রয়েছে। নিম্নে সেই অধ্যায় থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি… মদীনায় এই ব্যাধিটি ছড়িয়ে পড়ার কারণ সুবিদিত। রসূল(স.) ও প্রথম যুগের মুসলমানরা মক্কায় থাকাকালে এমন শক্তি সামর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন না যে, তাদের ভয়ে বা তাদের কাছ থেকে সুবিধা লাভের আশায় কেউ প্রকাশ্যে তাদের চাটুকারিতায় লিপ্ত হবে ও তাদের সাথে মিতালী পাবে, আর গােপনে তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবে, ফন্দিফিকির আঁটবে ও ধােকাবাজি করবে, যেমনটি ছিলাে মুনাফিকদের সাধারণ স্বভাব। মক্কাবাসীরা ও বিশেষত তাদের নেতারা রাসূল(স.)-এর বিরােধিতা প্রকাশ্যেই করতাে, মুসলমানদের মধ্যে যাকে যতােটা পারতাে কঠোর নির্যাতন করতাে এবং কোনাে রকম রাখঢাক না করেই ইসলামী আন্দোলনের প্রতিরােধ করতাে। শক্তি সামর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তি যা কিছু ছিলাে মক্কাবাসী কাফেরদেরই ছিলাে। শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা নিজেদের প্রাণ ও ঈমান বাঁচানাের জন্যে প্রথমে আবিসিনিয়ায় ও পরে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়। কেউবা কাফেরদের নৃশংসতা ও বল প্রয়ােগের কারণে, কেউবা প্রলােভন ও সন্ত্রাসের দরুন ইসলাম পরিত্যাগে বাধ্য হয়েছে, কেউবা পদদলিত হয়েছে, কেউবা দ্বার্থবােধক শব্দ উচ্চারণ করতে ও মােশরেকদের সাথে কপটতার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি কেউ কেউ ইসলামকে অবিচলভাবে আঁকড়ে ধরার ফলে নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত বরণ করেছে। কিন্তু মদীনার পরিস্থিতি ছিলাে একেবারেই ভিন্ন রকমের । রাসূল(স.) মদীনায় হিজরত করার আগেই আওস এবং খাযরাজ গােত্রদ্বয় থেকে বেশ কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী ও জোরালাে সমর্থক লােক পেতে সক্ষম হয়েছিলেন। মদীনায় নিজের অবস্থান সুসংহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং প্রায় প্রতিটি পরিবারে ইসলাম প্রবেশ না করা পর্যন্ত তিনি হিজরত করেননি। এরূপ পরিবেশে ইসলাম গ্রহণ করেনি এমন লােকদের পক্ষে এটা মােটেই সহজ ছিলাে না যে, তারা রাসূল(স.), মদীনার আদি অধিবাসী মুসলমান (আনসার) ও হিজরত করে আসা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিরােধিতা ও শত্রুতামূলক অবস্থান গ্রহণ করবে, চাই তাদের ইসলাম গ্রহণ না করার কারণ অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা হােক অথবা ইচ্ছাকৃত হঠকারিতা, গােয়ার্তুমি, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষই হােক। সম্ভাব্য এই হঠকারিতা ও বিদ্বেষের কারণ এই যে, রসূল(স.)-এর আগমনে তাদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পথ রুদ্ধ হওয়া যে অবধারিত তা তার আঁচ করতে পেরেছিলাে। প্রকাশ্য শত্রুতা করতে না পারার আরাে একটা কারণ এই যে, ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে মদীনাবাসীর এক ধরনের আত্মীয়তার সম্পর্কও সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিলাে। কেননা, আওস ও খাযরাজের বেশীর ভাগ মানুষ মুসলমান হয়ে গিয়েছিলাে এবং তাকে সাহায্য করা ও সংরক্ষণ করার অংগীকারে আবদ্ধ ছিলাে। শুধু তাই নয়, তাদের অধিকাংশ ইসলামের প্রতি এত আন্তরিক ও একনিষ্ঠ ছিলাে যে, রাসূল(স.)-কে তারা শুধু আল্লাহর রসূলই মনে করতাে না, বরং নিজেদের সর্বোচ্চ নেতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ পথপ্রদর্শকও মনে করতাে এবং তাঁর আনুগত্য অনুসরণ অপরিহার্য বলে বিবেচনা করতাে। তাই যারা তখনাে শিরকের প্রতি অধিকতর ঝোঁক ও অনুরাগ পােষণ করতাে, অহংকার ও হিংসার ন্যায় মানসিক ব্যাধি তাদের মনের ওপর প্রবলতর প্রভাব বিস্তার করে রাখতে এবং এই ব্যাধি তাদের রসূল(স.), তার আন্দোলন ও তার প্রভাব প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে প্ররােচিত করতো, তাদের পক্ষে তাদের উক্ত ঝোঁক ও বিরােধিতার মনােভাব খােলাখুলিভাবে প্রকাশ করা সম্ভব ছিলাে না। ইসলামের প্রতি আনুগত্য লােক দেখানাে ভাবে হলেও জাহির না করে তাদের উপায় ছিলাে না। ইসলামের মৌলিক এবাদাতসমূহ পালন এবং তাদেরই স্বগােত্রীয় মুসলমানদের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিলাে না। আর তাদের ধােকা, শঠতা ও ষড়যন্ত্রগুলাে চরম জালিয়াতির মাধ্যমে ভিন্ন মােড়কে পেশ করতে তারা বাধ্য ছিলাে। কদাচিত তারা কোনাে প্রকাশ্য মুনাফিকী ও ভন্ডামিপূর্ণ আচরণ এবং ধােকা ও প্রবঞ্চনাপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করতাে বটে, তবে সেটা করতাে শুধুমাত্র কতিপয় সংকটজনক অবস্থাতেই যা রসূল(স.) ও মুসলমানদের ওপর সময় সময় আপতিত হতাে। আর এসব সংকটজনক পরিস্থিতিকে তারা তাদের আচরণের অজুহাত হিসাবে দাড় করাতাে। কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই তারা তাদের কুফরী বা মােনাফেকীর কথা স্বীকার করতাে না। তথাপি তাদের কুফরী, মুনাফি ও চক্রান্ত রসূল(স.) ও তার নিবেদিতপ্রাণ সাহাবীদের কাছে গােপন থাকতাে না। আর এই সংকটজনক অবস্থা তাদের প্রকাশ্য ইসলাম বিরােধী ভূমিকা ও আচরণ, তাদের কুফরী ও মুনাফিকের আরাে অপমানজনক এবং নিন্দনীয়ভাবে প্রকাশ করে দিতে। কোরআনের আয়াত ও তাদের নিন্দা ভৎর্সনা সহকারে বারংবার নাযিল হতাে এবং রসূল(স.) ও মুসলমানদের তাদের সম্পর্কে সাবধান করে দিতাে। মুনাফিকের আচরণ ও চক্রান্তের প্রভাব যে খুবই সুদূরপ্রসারী ছিলাে, সে কথা কোরআনের মদীনায় নাযিল হওয়া অংশ থেকে বুঝা যায়। এ অংশটি এমন একটি দুরন্ত সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে, যা রসূল(স.) ও মক্কার নেতাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব সংঘাত স্মরণ করিয়ে দেয়। অবশ্য মক্কার দুই পক্ষের ভূমিকা ও তার ফলাফল মদীনায় দুই পক্ষের ভূমিকা ও ফলাফল থেকে ভিন্নতর ছিল। কেননা, মদীনায় রাসূল(স.)-এর কেন্দ্র ক্রমেই শক্তিশালী, তার ক্ষমতা ক্রমেই সংহত এবং ইসলাম ক্রমেই প্রসার ও বিস্তার লাভ করতে থাকে। এখানে তিনি ছিলেন ক্ষমতাসীন ও পরাক্রান্ত শাসক, আর মুনাফিকদের না ছিলাে কোনাে সুসংগঠিত দল, না ছিলাে কোনাে খ্যাতিমান বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। উপরন্তু রসূল(স.)-এর পর্যায়ক্রমিক শক্তি বৃদ্ধি, ইসলামের বিকাশ ও বিস্তার এবং তার শক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তির প্রসারের সাথে সাথে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিলাে তাদের দুর্বলতা, কমে যাচ্ছিলাে তাদের জনশক্তি ও প্রভাব প্রতিপত্তি। মুনাফিকদের ভূমিকা, বিশেষত সেই প্রাথমিক যুগের পটভূমিতে কতাে মারাত্মক ও ক্ষতিকর ছিলাে, তা বুঝার জন্যে এটুকু জানাই যথেষ্ট যে, (১) মুনাফিকদের যা কিছু শক্তি ও প্রতিপত্তি ছিলাে, তার প্রধান উৎস ছিলাে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক তাদের গোত্রসমূহের জনগণের মনে তখনাে অত্যন্ত শক্তভাবে বিরাজ করছিলাে। (২) তারা তখনাে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে পুরােপুরিভাবে চিহ্নিত ও কলংকিত হয়নি। (৩) মদীনার গােত্রসমূহের সাধারণ জনতার মনে ইসলাম তখনাে যথেষ্ট শক্তি নিয়ে বন্ধমূল হয়নি। (৪) রসূল(স.) চারদিক থেকে ইসলামের ঘােরতর শত্রু মােশরেকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন। (৫) বিশেষত মক্কাবাসী তখনাে তাঁর কট্টরতম শত্রু ছিলাে। আরব দেশের কেন্দ্রভূমিতে তাদের অবস্থান ছিলাে। প্রতি মুহূর্তে তারা তার ক্ষতি সাধনে এবং সাধ্যে কুলালে তাকে সমূলে ধ্বংস করার সুযােগ সন্ধানে তৎপর ছিলাে। (৬) মদীনায় ও তার আশেপাশে ইহুদীরা শুরু থেকেই তাকে অস্বীকার এবং নিজেদের জন্যে অশুভ এবং অকল্যাণকর মনে করে আসছিলাে। এক পর্যায়ে তারা প্রকাশ্যভাবেই তাঁর প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এবং শত্রুতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করতে আরম্ভ করে। (৭) এই পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে ও মুনাফিকদের মধ্যে ইসলামের বিরােধিতা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকানাের ব্যাপারে একাত্মতা, চেষ্টার ঐক্য এবং স্বাভাবিক মৈত্রী গড়ে ওঠে। এক কথায় বলা চলে, ইহুদীদের পক্ষ থেকে সহযােগিতা, সমর্থন ও শক্তি অর্জন করা ছাড়া মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে এতােটা শক্তি ও স্থিতি লাভ করতে পারতাে না, এতােটা মারাত্মক নির্যাতনকারী বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকের ভূমিকা পালন করতে পারতাে না, যেটা কার্যত করতে পেরেছিলাে। আর রসূল(স.)-কে আল্লাহ তায়ালা পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও প্রতাপ দান করে তাদের ওপর বিজয়ী করা এবং তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার পূর্ব পর্যন্ত তাদের শক্তি কিছুমাত্র স্তিমিত হয়নি, তাদের দিক থেকে ভয় ভীতি মোটেই হ্রাস পায়নি।(মুহাম্মাদ ইজ্জত দারুশার উক্ত গ্রন্থের ১৭৬ থেকে ২১৬ পৃঃ দ্রষ্টব্য)
# সূরার শুরুতেই বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে মুনাফিকরা তাদের অন্তরে কুফরী পুষে রাখতাে, মুখে ইসলামের ঘােষণা দিত এবং রসূল(স.)-কে আল্লাহর রাসূল বলে মিথ্যামিথ্যি কসম খেয়ে স্বীকৃতি দিতাে, যাতে মুসলমানরা তাদের বিশ্বাস করে। এভাবে তারা তাদের এই কসম খাওয়াকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতাে এবং এর আড়ালে তাদের প্রকৃত অবস্থা লুকিয়ে মুসলমানদের ধােকা দিত। *মুনাফিকী চরিত্রের বিশ্লেষণ : ‘যখন মুনাফিকরা তােমার কাছে আসে তখন বলে, আমরা আপনাকে আল্লাহর রসূল বলে সাক্ষ্য দিচ্ছি। অথচ আপনি যে আল্লাহর রসূল সে কথা তাে আল্লাহ জানেনই। আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। তারা তাদের শপথকে ঢাল হিসাবে গ্রহণ করছে এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তারা যে কাজ করে থাকে, তা কতাে জঘন্য। তারা রসূল(স.)-এর কাছে আসতাে এবং তার সামনে তার রেসালাতের পক্ষে মৌখিক সাক্ষ্য দিতাে। এ দ্বারা সত্যের প্রতি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা প্রকাশ করা তাদের কাম্য ছিলাে না। কেবল চলমান সমাজের ঘৃণা ও গণরােষ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই তারা এরূপ করতাে। মুসলমানদের কাছ থেকে তাদের প্রকৃত মনােভাব গােপন করাই ছিলাে তাদের আসল উদ্দেশ্য। তারা রাসূল(স.)-এর রেসালাতের সাক্ষ্য দিতে এসেছে বলে যে উক্তি করতাে, তা ছিলাে তাদের নির্জলা মিথ্যাচার। আসলে তারা এসেছিলাে মুসলমানদের ধােকা দিতে এবং নিজেদের মনকে সান্তনা দিতে। এজন্যে আল্লাহর রসূলের রেসালাত যে অকাট্য ও চরম সত্য, তা প্রথমে ঘােষণা করে আল্লাহ তায়ালা তাদের সাক্ষ্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছেন। বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।’ এখানে এমন সূক্ষ্ম ও সতর্ক ভাষা প্রয়ােগ করা হয়েছে, যা মুনাফিকদের বক্তব্য মিথ্যা প্রতিপন্ন করার আগে রেসালাতকে সত্য প্রমাণ করা হয়েছে। অন্যথায় বাহ্যত প্রতীয়মান হতাে যে, মুনাফিকরা যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে সেটাই মিথ্যা। অথচ সেটা বলা উদ্দেশ্য নয়। যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা এই যে, রেসালাতের প্রতি ঈমান আনা সংক্রান্ত তাদের ঘোষণাটা মিথ্যা। তারা আন্তরিকভাবে এ ঘােষণা দেয় না এবং প্রকৃতপক্ষে মুহাম্মদ(স.)-কে রাসূল বলে মানে না। তারা তাদের শপথকে ঢাল বানিয়ে নিয়েছে। এ বাক্য দ্বারা বুঝা যায়, যখনই তাদের প্রকৃত মনােভাব ফাঁস হয়ে যেতাে, তাদের কোনাে চক্রান্ত বা দুরভিসন্ধি জানাজানি হয়ে যেতাে এবং মুসলমানদের মধ্যে তাদের সম্পর্কে কোনাে খারাপ খবর প্রচারিত হতাে, তখনই তারা কসম খেয়ে খেয়ে তা অস্বীকার করতাে, যাতে সেসব গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার কুফল থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। এভাবে তারা তাদের শপথ বা কসমকে ঢাল বানিয়ে তার আড়ালে লুকাত, যাতে মুসলমান সমাজের সাথে প্রতারণা অব্যাহত রাখা যায়। ‘অতপর তারা আল্লাহর পথ থেকে ফেরাতাে।’ অর্থাৎ এই মিথ্যা শপথের সাহায্যে নিজেদেরও ফেরাতাে, অন্যদেরও ফেরাতাে। নিশ্চয় তারা খুবই জঘন্য কাজ করতাে। বস্তুত মিথ্যাচার, ধােকাবাজি ও জালিয়াতির মতাে জঘন্য কাজ আর কী হতে পারে? পরবর্তী আয়াতে মুনাফিকদের এই অবস্থার অর্থাৎ মিথ্যা সাক্ষ্যদান, মিথ্যা ও শঠতাপূর্ণ কসম খাওয়া, আল্লাহর পথ থেকে ফেরানাে ও জঘন্য কার্যকলাপের কারণ দর্শানাে হয়েছে। সে কারণ এই যে, তারা ঈমান আনার পর এবং ইসলামকে জানা ও বুঝার পর কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে। ‘এর কারণ এই যে, তারা প্রথমে ঈমান এনেছিলাে, তারপর কাফের হয়েছে। ফলে তাদের হৃদয়ে সিল মেরে দেয়া হয়েছে। তাই এখন তারা আর বুঝতে পারে না।'(আয়াত-৩) অর্থাৎ তারা ঈমান কী জিনিস তা জানতাে, কিন্তু তা সত্তেও তারা ঈমান ছেড়ে কুফরীতে প্রত্যাবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাে। ঈমান কী জিনিস তা জানা এবং জানার পর কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন এমন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব, যার হৃদয়ে কিছুমাত্র উপলব্ধি, অনুভূতি অথবা জীবনীশক্তি আছে। জগত ও জীবন সম্পর্কে যার ইসলামী ধারণা বিশ্বাস, ইসলামী চেতনা-অনুভূতি আছে, যে ইসলামের আলােকোজ্জ্বল ও শীতল পরিবেশে জীবন ধারণ করেছে, সে কিভাবে কুফরীর কালাে ও অশুভ পরিবেশে ফিরে যেতে পারে? এটা একমাত্র সে ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব, যার জ্ঞানবুদ্ধি ও চেতনা বিকৃত হয়ে গেছে, ফলে সে সত্য উপলব্ধি করতে পারে না এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে তা দেখতে পায় না। আয়াতে ‘সিল মারা’ বলতে চেতনা, রুচি ও বােধশক্তির এই বিকৃতিকেই বুঝানাে হয়েছে, যার দরুন সত্যকে আর চেনা ও বুঝা সম্ভব হয় না। ৪ নং আয়াতে এই বিকৃত রুচি ও চেতনাসম্পন্ন মানুষের এক বিস্ময়কর এবং হাস্যকর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ‘তুমি যখন তাদের দেখবে, তখন তাদের দেহ দেখে তুমি বিস্মিত হবে…’ অর্থাৎ তাদের দেখে মনে হবে, তাদের যেন নিশ্চল নিথর দেহখানাই একমাত্র সম্বল, প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে এমন কোনাে সচেতন মানবীয় সত্ত্বা যেন তাদের নেই। যতােক্ষণ তারা চুপ থাকে ততােক্ষণ দর্শকদের চোখে তাদের নাদুস নুদুস দেহ বেশ চিত্তাকর্ষক লাগে। কিন্তু যখনই তারা কথা বলে অমনি মনে হয়, তারা একেবারেই তাৎপর্যহীন, চেতনাহীন ও বােধশক্তিহীন। তাদের কথা শুনে তােমার মনে হবে যেন তারা নিশ্চল, নিথর ও দেয়ালে হেলিয়ে রাখা কাঠ মাত্র। এই নিথর নিস্তব্ধ জড়তা একদিকে তাদের আত্মােপলব্ধির ইংগিতবহ যদি আগে তাদের কোনাে আত্মা থেকে থাকে! অপরদিকে এক ধরনের সার্বক্ষণিক সতর্কতা এবং আতংকেরও ইংগিতবহ, যে আয়াতের নিম্নোক্ত বাক্য দ্বারা বুঝানাে হয়েছে, ‘তারা প্রতিটি ধ্বনিকে নিজেদের জন্যে বিপজ্জনক মনে করে।’ অর্থাৎ যেহেতু নিজেদের সম্পর্কে তাদের এতােটুকু জানা আছে যে, তারা বর্ণচোরা মুনাফিক এবং মিথ্যে শপথ ও লােক দেখানাের পাতলা আবরণের আড়ালে আত্মগােপনকারী। তাই প্রতি মুহূর্তে তারা শংকিত থাকে যে, এই বুঝি তাদের সমস্ত গুপ্তভেদ ফাঁস হয়ে গেলাে, এই বুঝি তাদের ভন্ডামির রহস্য উদঘাটিত হয়ে গেলাে! আয়াতের উল্লিখিত বাক্যটির বর্ণনাভংগি থেকে মুনাফিকদের এরূপ একটি চিত্র ফুটে ওঠেছে যে, তারা যেন ভীত সন্ত্রস্ত মনে অনবরত চারপাশে তাকাতে থাকে এবং প্রতিটি শব্দ থেকেই তাদের মনে হতে থাকে, তাদের প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে কেউ বুঝি তাদের পাকড়াও করার জন্যে খোঁজাখুঁজি করছে। নিজেদের পাপ ও অপরাধপ্রবণ মানসিকতার উপলব্ধি থেকে যখন তারা কাষ্ঠের মতাে জড়তা ও স্থবিরতায় ভােগে, আর নিজেদের জান ও মালের ভয়ে যখন তারা বায়ুপ্রবাহে দোদুল্যমান বাঁশের মতাে দুলতে থাকে, উভয় অবস্থাতেই তারা রসূল(স.) ও মুসলমানদের এক নম্বর দুশমন হিসাবে বিরাজ করে। এ কথাই বলা হয়েছে পরবর্তী বাক্যটিতে- ‘তারা দুশমন, সুতরাং তাদের থেকে সাবধান হও।’ অর্থাৎ তারা আসল শক্র। তারা গৃহ শক্র বিভীষণ। প্রকাশ্যভাবে বিরাজমান বহিঃশত্রুর চেয়েও তারা মারাত্মক। লক্ষণীয় যে, এখানে তাদের থেকে সাবধান থাকতে বলা হয়েছে। রসূল(স.)-কে বলা হয়নি যে তাদের হত্যা করাে। বরঞ্চ একটি ভিন্নতর পরিকল্পনার মাধ্যমে তাদের সাথে আচরণ করা হয়েছে, যা উদারতা, বিচক্ষণতা ও তাদের চক্রান্ত থেকে মুক্তির পথনির্দেশক (শীঘ্রই এ ধরনের আচরণের একটি নমুনা তুলে ধরা হবে)। আল্লাহ তায়ালা তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন তারা যেখানেই থাক না কেন বস্তুত আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন, তারা যেখানে যে অবস্থায়ই অবস্থান করুক না কেন। আল্লাহর পক্ষ থেকেই যুদ্ধ করুন বলে যখন দোয়া করা হয়েছে, তখন বুঝতে হবে, যুদ্ধ পরিচালনার ফয়সালা হয়ে গেছে এবং সে ফয়সালা আর কেউ রুখতে বা বদলাতে পারবে না। কার্যত এটাই হয়েছিলাে তাদের চূড়ান্ত পরিণতি।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ :
الْمُنٰفِقُوْنَ শব্দটি المنافق শব্দের বহুবচন। অর্থ হল : যারা দ্বিমুখীতা অবলম্বন করে, যারা মুখে বলে ঈমানের কথা কিন্তু অন্তরে কুফরী, কপটতা। সূরার প্রথম আয়াতের মুনাফিকুন শব্দ থেকে উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর সালাতের প্রথম রাকআতে সূরা জুমু‘আহ পড়তেন আর এর দ্বারা মু’মিনদের উৎসাহিত করতেন। আর দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকুন পড়তেন, আর এর দ্বারা মুনাফিকদের তিরস্কার করতেন। (মাযমাউয যাওয়ায়েদ ২/১৯১, সনদ হাসান)। সূরায় মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সাথীদের মুনাফিকী কর্মকাণ্ড ও মুসলিমদের সাথে তাদের আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। তারা নিজেদেরকে সম্মানিত মনে করে আর আল্লাহর রাসূল ও মু’মিনদেরকে অসম্মানিত মনে করে থাকে। তাদের এসব ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা হয়েছে। সবশেষে মু’মিনদেরকে সম্পদ ও সন্তান সম্পর্কে সতর্ক করছেন যেন কিছুতেই তারা আল্লাহ তা‘আলা থেকে বিমুখ না হয়।
শানে নুযূল :
জায়েদ বিন আরকাম (রাঃ) বলেন : একদা আমি কোন এক যুদ্ধে ছিলাম। অন্য বর্ণনাতে বলা হয়েছে তাবুক যুদ্ধে (সহীহ বুখারী হা. ৩৫১৮) শুনতে পেলাম আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলছে; যদি আমরা মদীনাতে ফিরে যাই তাহলে সম্মানিতরা অসম্মানিতদেরকে মদীনা থেকে বের করে দেব। সাহাবী জায়েদ বলেন : এ কথাটা আমি আমার চাচা অথবা উমার (রাঃ)-এর কাছে বললাম। তিনি এটা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উল্লেখ করলেন। জায়েদ (রাঃ) বলছেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে ডাকলেন, আমি গেলাম এবং এ ঘটনা বললাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সঙ্গীদের নিকট ডেকে লোক পাঠালেন। তারা এসে শপথ করে বলল : আমরা এরূপ কথা বলিনি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে মিথ্যাবাদী মনে করলেন আর তাদের কথা বিশ্বাস করে নিলেন। ফলে আমাকে এমন চিন্তা আক্রান্ত করল যা ইতোপূর্বে কখনো করেনি। আমি (মনের দুঃখে) ঘরে বসে গেলাম। আমার চাচা আমাকে বললেন : রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করেছেন এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে তোমার মন খারাপ? এ প্রসঙ্গে এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। পরে নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার কাছে লোক প্রেরণ করলেন এবং এ সূরাটি পাঠ করে শুনালেন আর বললেন আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে সত্য বলে উল্লেখ করেছেন হে জায়েদ। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯০০, সহীহ মুসলিম হা. ২৭৭২)
১-৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
অত্র সূরাতে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। যার অধিকাংশগুলো সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদীনায় আগমনের পর মানুষ প্রতিনিয়ত ইসলামে দিক্ষিত হতে লাগল। এমনকি যখন আওস ও খাজরায গোত্রের অধিকাংশ লোক ইসলাম গ্রহণ করল তখন এক শ্রেণির লোক বাহ্যিক ঈমানের কথা প্রকাশ করল আর অন্তরে কুফরী গোপন রাখল যাতে সমাজে তাদের সম্মান, রক্ত ও সম্পদ হেফাযতে থেকে যায়। এরাই হল মুনাফিক। আল্লাহ তা‘আলা এদের গুণাবলী উল্লেখ করে দিয়েছেন যাতে মু’মিনরা তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে পারে।
(إِذَا جَا۬ءَكَ الْمُنٰفِقُوْنَ)
‘যখন মুনাফিকরা তোমার নিকট আসে’ এখানে মুনাফিক বলতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সহচর মুনাফিকদেরকে বুঝানো হয়েছে। এরা নিজেদের কপটতা গোপন রাখার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে এসে বলে, আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আপনি আল্লাহর রাসূল।
(وَاللّٰهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُوْلُه۫)
‘আল্লাহ জানেন যে, তুমি নিশ্চয়ই তাঁর রাসূল’ এ বাক্যটি পূর্বের বাক্য থেকে আলাদা একটি বাক্য, যা পূর্বের বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করেছে এবং যার প্রকাশ মুনাফিকরা মুনাফিক হিসাবে করত। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : মুনাফিকদের এটা শুধু মুখের কথা, অন্তরে এর বিশ্বাস নেই। তবে আমি জানি যে, তুমি সত্যিই আমার রাসূল।
(إِنَّ الْمُنَافِقِيْنَ لَكَاذِبُوْنَ)
অর্থাৎ মুনাফিকরা কথায় ও দাবীতে মিথ্যেবাদী।
(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً)
‘তারা তাদের শপথগুলোকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে’ অর্থাৎ মুনাফিকরা তাদের মিথ্যা শপথসমূহকে ঢালস্বরূপ ব্যবহার করে। কারণ যারা তাদের প্রকৃত অবস্থা জানেনা তারা তাদেরকে মুসলিম মনে করবে। ফলে তাদেরকে মুরতাদ হিসাবে হত্যা করা হবে না। এভাবে তারা বেঁচে যাবে। তাদের এরূপ কার্যকলাপে মুসলিমদের অনেক ক্ষতি হয়। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমরা তাদেরকে নিজেদের মত মুসলিম মনে করে তাদের কথা ও কাজের অনুসরণ করে। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :
(اِتَّخَذُوْآ أَيْمَانَهُمْ جُنَّةً فَصَدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ ط إِنَّهُمْ سَا۬ءَ مَا كَانُوْا يَعْمَلُوْن)
“তারা তাদের শপথগুলোকে ঢাল স্বরূপ ব্যবহার করে। তারা যা করছে তা কতই না মন্দ।”
মুনাফিকদের এসব কার্যকলাপের কারণ হল তারা তাদের কর্মের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরকে কুফরীর ওপর বদ্ধমূল করে দিয়েছেন।
(ذٰلِكَ بِأَنَّهُمْ اٰمَنُوْا ثُمَّ كَفَرُوْا)
‘এটা এজন্য যে, তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে’ এখানে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা কাফির। তারা মুখে ঈমানের কথা স্বীকার করেছে তারপর অন্তর দ্বারা অস্বীকার করেছে। তাই দুনিয়াতে তাদের ওপর কাফিরদের বিধান কার্যকর না হলেও আখিরাতে কাফিরদের কাতারে থাকবে।
(وَإِذَا رَأَيْتَهُمْ تُعْجِبُكَ)
আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলছেন : তুমি তাদের দৈহিক কাঠামো, সৌন্দর্য ও সজীবতা দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে। আর তাদের ভাষার যে বিশুদ্ধতা ও তারা যে বাকপটু তাতে তুমি তাদের কথা সাগ্রহে শুনবে। কিন্তু তারা হিদায়াত থেকে বিমুখ। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন :
(كَأَنَّهُمْ خُشُبٌ مُّسَنَّدَةٌ)
অর্থাৎ দেওয়ালে ঠেকানো কাঠ দেখতে ভাল কিন্তু কোন উপকারে আসে না, এ সকল মুনাফিকরাও প্রাচীরে ঠেকানো কাঠের মত, এরা হিদায়াতের কথা শোনার মত নয়।
(يَحْسَبُوْنَ كُلَّ صَيْحَةٍ)
অর্থাৎ এ সকল মুনাফিকদের অন্তরে সন্দেহ, দুর্বলতা, ভীরুতা ও ভয় থাকার কারণে যে কোন ভীতিকর অবস্থা বা হট্টগোল শুনলেই তারা মনে করে হয়তো কোন বিপদ আমাদের ওপর আপতিত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(أَشِحَّةً عَلَيْكُمْ ج فَإِذَا جَا۬ءَ الْخَوْفُ رَأَيْتَهُمْ يَنْظُرُوْنَ إِلَيْكَ تَدُوْرُ أَعْيُنُهُمْ كَالَّذِيْ يُغْشٰي عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ ج فَإِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوْكُمْ بِأَلْسِنَةٍ حِدَادٍ أَشِحَّةً عَلَي الْخَيْرِ ط أُولٰ۬ئِكَ لَمْ يُؤْمِنُوْا فَأَحْبَطَ اللّٰهُ أَعْمَالَهُمْ ط وَكَانَ ذٰلِكَ عَلَي اللّٰهِ يَسِيْرًا)
“তোমাদের প্রতি কার্পণ্য করে আর যখন কোন ভয়ের কারণ সামনে আসে, তখন আপনি তাদেরকে দেখতে পাবেন যে, তারা মৃত্যুভয়ে অচেতন ব্যক্তির ন্যায় চোখ উল্টিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। অতঃপর যখন সেই ভয় চলে যায়, তখন তারা ধন-সম্পদের লোভে তীব্র ভাষায় তোমাদেরকে আক্রমণ করে। তারা ঈমান আনেনি। অতএব আল্লাহ তাদের কার্যসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এরূপ করা আল্লাহ্র জন্য খুবই সহজ।” (সূরা আহযাব ৩৩ : ১৯)
মুনাফিকী একটি মারাত্মক ব্যাধি যা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর। মুনাফিকরা মুসলিমদের জন্য কাফিরদের চেয়ে ভয়ংকর। সুতরাং নিজেরা মুনাফিকী চরিত্র থেকে বেঁচে থাকব এবং মুসলিম সমাজকে এ সম্পর্কে সতর্ক করব।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মুনাফিকরা কাফিরদের চেয়েও মুসলিমদের জন্য বেশি ক্ষতিকর।
২. মুনাফিকরা ফেতনা-ফাসাদ ও অরাজকতা সৃষ্টি করে বেড়ায়।
৩. মুনাফিকরা নিজেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য বেশি বেশি শপথ করবে।
৪. মুনাফিকরা ঈমানদারদের সামনে খুব চমকপ্রদভাবে নিজেদের কথা উত্থাপন করে থাকে যাতে তারা তাদের অন্তরের খবর বুঝতে না পারে।
৫. মুনাফিকরা ইসলাম ও মুসলিমদের চরম শত্রু।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
১-৪ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তা’আলা মুনাফিকদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে বলেন যে, যখন তারা নবী (সঃ)-এর নিকট আসে তখন শপথ করে করে ইসলাম প্রকাশ করে এবং তাঁর রিসালাত স্বীকার করে। কিন্তু প্রকতপক্ষে তাদের অন্তর ইসলাম হতে বহু দূরে রয়েছে। নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদ (সঃ) আল্লাহর নবী এবং মুনাফিকদের উক্তিও এটাই। কিন্তু তাদের অন্তরে এর কোন ক্রিয়া নেই। সুতরাং তারা মিথ্যাবাদী।
মহান আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ এই মুনাফিকরা তোমার কাছে এসে কসম খেয়ে খেয়ে তোমার রিসালাতের স্বীকারোক্তি করে। কিন্তু তুমি বিশ্বাস রেখো যে, তাদের এই কসমের কোনই মূল্য নেই। এটা তাদের মিথ্যাকে সত্য বানাবার একটা মাধ্যম মাত্র।
এর দ্বারা মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো এই যে, মুমিনগণ যেন তাদের হতে সতর্ক থাকে। তারা যেন এই মুনাফিকদেরকে খাঁটি মুমিন মনে করে তাদের কোন কাজে তাদের অনুসরণ না করে। কেননা, তারা ইসলামের নামে কুফরী করিয়ে ফেলবে। তারা আল্লাহর পথ হতে বহু দূরে রয়েছে এবং তাদের আমল অতি জঘন্য।
যহহাক (রাঃ)-এর কিরআতে (আরবি) অর্থাৎ (আরবি) তে যের দিয়ে রয়েছে। তখন ভাবার্থ হবেঃ তারা তাদের বাহ্যিক স্বীকারোক্তিকে নিজেদের জীবন রক্ষার মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে যে, তারা হত্যা ও কুফরীর হুকুম হতে দুনিয়ায় বেঁচে যাবে। তাদের অন্তরে নিফাক স্থান করে নিয়েছে। তাই তারা ঈমান হতে ফিরে গিয়ে কুফরীর দিকে এবং হিদায়াত হতে সরে গিয়ে গুমরাহীর দিকে চলে এসেছে। এখন তাদের হৃদয় মোহর করে দেয়া হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে যে বোধশক্তি ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। বাহ্যতঃ তো তারা মুখে মিষ্টি কথা বলে এবং তারা বেশ বাকপটু। কিন্তু তাদের অন্তর কালিমাময়।
আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ “তারা যে কোন শোরগোলকে মনে করে তাদেরই বিরুদ্ধে।’ অর্থাৎ যখনই কোন ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তখন তারা ধারণা করে নেয় যে, তাদের উপর হয়তো তা আপতিত হচ্ছে। তাই তারা মৃত্যুর ভয়ে হা-হুতাশ করে। যেমন আল্লাহ তা’আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তোমাদের ব্যাপারে কৃপণতা বশতঃ (যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্য করার ব্যাপারে মুনাফিকরা কৃপণতা প্রকাশ করেছিল), যখন বিপদ আসে তখন তুমি দেখবে, মৃত্যু ভয়ে মূৰ্ছাতুর ব্যক্তির মত চক্ষু উলটিয়ে তারা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু যখন বিপদ চলে যায় তখন তারা ধনের লালসায় তোমাদেরকে তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। তারা ঈমান আনেনি, এই জন্যে আল্লাহ তাদের কার্যাবলী নিষ্ফল করেছেন, আর আল্লাহর পক্ষে এটা সহজ।” (৩৩:১৯)
এ জন্যেই আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তারাই শত্রু, অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক হও, আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন! বিভ্রান্ত হয়ে তারা কোথায় চলেছে?
হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মুনাফিকদের বহু নিদর্শন রয়েছে যেগুলো দ্বারা তাদেরকে চেনা যায়। তাদের সালাম হলো লা’নত, তাদের খাদ্য হলো লুঠতরাজ, তাদের গানীমাত হলো হারাম ও খিয়ানত, তারা মসজিদের নিকটবর্তী হওয়াকে অপছন্দ করে, নামাযের জন্যে তারা শেষ সময়ে এসে থাকে, তারা অহংকারী ও আত্মগর্বী হয় এবং তারা নম্রতা ও বিনয় প্রকাশ হতে বঞ্চিত থাকে। তারা নিজেরাও ভাল কাজ করে না এবং অন্যদেরকেও ভাল কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে না। তারা রাত্রে খড়ি এবং দিনে শোরগোলকারী।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত রয়েছে) অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, তারা দিনে খুবই পানাহারকারী হয় এবং রাত্রে শুষ্ক কাঠের মত তারা পড়ে থাকে।
Motaher21.net
SEARCH RESULTS FOR: মুনাফিক
(Book# 744)[মুনাফিক কি?বই নং ২২] (Book# 635)[তোমাদের আশপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফিক।]{মুনাফিক কি? ১৯ নং বই} www.motaher21.net Sura: 13 Verses :- 25
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (Book# 744)[মুনাফিক কি?বই নং ২২] (Book# 635)[তোমাদের আশপাশে আছে তাদের কেউ[…]
READ MORE
(Book# 647){মুনাফিক কি? ২১ নং বই} [أَوَلَا يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُونَ মুনাফিক কি লক্ষ্য করে না যে? See they not that they are put in trial?] www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 647){মুনাফিক কি? ২১ নং বই} [أَوَلَا يَرَوْنَ أَنَّهُمْ يُفْتَنُونَ মুনাফিক কি লক্ষ্য করে না[…]
READ MORE
Book# 640){মুনাফিক কি? ২০ নং বই}[মসজিদে জিরার।] www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 640){মুনাফিক কি? ২০ নং বই}[মসজিদে জিরার।] www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯ ১০৭-১১০ নং আয়াত:-[…]
READ MORE
(Book# 635)[তোমাদের আশপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফেক।]{মুনাফিক কি? ১৯ নং বই} www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 635)[তোমাদের আশপাশে আছে তাদের কেউ কেউ মুনাফেক।]{মুনাফিক কি? ১৯ নং বই} www.motaher21.net সুরা: আত্[…]
READ MORE
(Book# 632)[মুনাফিক কি? ১৮ নং বই]{তারা তোমাদের কাছে অজুহাত পেশ করবে।} www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 632)[মুনাফিক কি? ১৮ নং বই]{তারা তোমাদের কাছে অজুহাত পেশ করবে।} www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ[…]
READ MORE
(Book# 630)[মুনাফিক কি?১৭ নং বই] {‘শক্তিসামর্থ্য’দ্বারা উদ্দেশ্য সামর্থবান, ধনী শ্রেণির লোক..} www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 630)[মুনাফিক কি?১৭ নং বই] {‘শক্তিসামর্থ্য’দ্বারা উদ্দেশ্য সামর্থবান, ধনী শ্রেণির লোক..} www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ[…]
READ MORE
(Book# 629)[মুনাফিক কি? ১৬ নং বই] {তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য জানাযার সালাত পড়বেন না।} www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 629)[মুনাফিক কি? ১৬ নং বই] {তাদের মধ্যে কারো মৃত্যু হলে আপনি কখনো তার জন্য[…]
READ MORE
(Book# 628)[মুনাফিক কি? ১৫ নং বই]{তুমি বল, তোমরা কখনো আমার সাথে বের হবে না এবং আমার সাথী হয়ে কোন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধও করবে না।} www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 628)[মুনাফিক কি? ১৫ নং বই]{তুমি বল, তোমরা কখনো আমার সাথে বের হবে না এবং[…]
READ MORE
(Book# 627)[মুনাফিক কি? ১৪ নং বই]{ মুনাফিককে আল্লাহ কখনই ক্ষমা করবেন না।}
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 627)[মুনাফিক কি? ১৪ নং বই]{ মুনাফিককে আল্লাহ কখনই ক্ষমা করবেন না।} www.motaher21.net সুরা: আত্[…]
READ MORE
(Book# 626)[মুনাফিক কি? ১৩ নং বই]{মু’মিনদের নিয়ে কটাক্ষ করা, উপহাস করা ও অপবাদ দেয়া মুনাফিকদের নিদর্শন।}
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 626)[মুনাফিক কি? ১৩ নং বই]{মু’মিনদের নিয়ে কটাক্ষ করা, উপহাস করা ও অপবাদ দেয়া মুনাফিকদের[…]
READ MORE
(Book# 625)[মুনাফিক কি? ১২ নং বই]
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 625)[মুনাফিক কি? ১২ নং বই] www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯ ৭৫-৭৮ নং আয়াত:- مِن[…]
READ MORE
(Book# 624)[কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর।]{মুনাফিক কি?বই নং ১১} www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 624)[কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর।]{মুনাফিক কি?বই নং ১১} www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯[…]
READ MORE
(Book# 622)[মুনাফিক কি? ১০ নং বই] www.motaher21.net
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 622)[মুনাফিক কি? ১০ নং বই] www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯ ৬৭-৭০ নং আয়াত:- الْمُنَافِقُونَ[…]
READ MORE
(Book# 621)[মুনাফিক কি? ৯ নং বই ]
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 621)[মুনাফিক কি? ৯ নং বই ] www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯ ৬৫- ৬৬[…]
READ MORE
(Book# 620)[মুনাফিক কি? ৮ নং বই]
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 620)[মুনাফিক কি? ৮ নং বই] www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯ ৬১-৬৪ নং আয়াত:- يَحْلِفُونَ[…]
READ MORE
(Book# 618) [মুনাফিক কি? ৭ নং বই]
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 618) [মুনাফিক কি? ৭ নং বই] www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯ ৫৬-৫৯ নং আয়াত:-[…]
READ MORE
(Book# 617)[মুনাফিক কি? ৬ নং বই]
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم (Book# 617)[মুনাফিক কি? ৬ নং বই] www.motaher21.net সুরা: আত্ তাওবাহ সুরা:০৯ ৫০-৫৫ নং আয়াত:- Sura[…]
READ MORE
(Book# 114/١٦٢)-৩৬৪ www.motaher21.net إِنَّ الْمُنٰفِقِينَ فِى الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّار নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে। Verily, the hypocrites will be in the lowest depths of the Fire; সুরা: আন-নিসা আয়াত নং :-১৪৪-১৪৭
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (Book# 114/١٦٢)-৩৬৪ www.motaher21.net إِنَّ الْمُنٰفِقِينَ فِى الدَّرْكِ الْأَسْفَلِ مِنَ النَّار নিশ্চয়[…]
READ MORE
(Book# 114/١٦١)-৩৬৩ www.motaher21.net إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ Verily, the hypocrites seek to deceive Allah, but it is He Who deceives them. নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়। আর তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন। সুরা: আন-নিসা আয়াত নং :-১৪২-১৪৩
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (Book# 114/١٦١)-৩৬৩ www.motaher21.net إِنَّ الْمُنَافِقِينَ يُخَادِعُونَ اللّهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ Verily, the[…]
READ MORE
(Book# 114/١٤١)-৩৪৩ www.motaher21.net فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِيَتَيْنِ মুনাফিকদের ব্যাপারে তোমাদের কী হল যে, তোমরা দু’ দল হয়ে গেলে? What is the matter with you that you are divided into two parties about the hypocrites? সুরা: আন-নিসা আয়াত নং :-৮৮-৯১
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ (Book# 114/١٤١)-৩৪৩ www.motaher21.net فَمَا لَكُمْ فِي الْمُنَافِقِينَ فِيَتَيْنِ মুনাফিকদের ব্যাপারে তোমাদের[…]
READ MORE
(Book# 114/ন) মুনাফিকদের চরিত্র । The character of hypocrites . وَهُوَ أَلَدُّ الْخِصَامِ
The character of hypocrites
READ MORE