(বই#৮৬১) সুরা:- আল্ জুমআ। সুরা:৬২ ০৫-০৮ নং আয়াত:- [ ثُمَّ لَمۡ یَحۡمِلُوۡہَا کَمَثَلِ الۡحِمَارِ یَحۡمِلُ اَسۡفَارًا ؕ কিন্তু তারা তা বহন করেনি, তারা গাধার মত! যে বহু পুস্তক বহন করে।] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৬১)
সুরা:- আল্ জুমআ।
সুরা:৬২
০৫-০৮ নং আয়াত:-
[ ثُمَّ لَمۡ یَحۡمِلُوۡہَا کَمَثَلِ الۡحِمَارِ یَحۡمِلُ اَسۡفَارًا ؕ
কিন্তু তারা তা বহন করেনি, তারা গাধার মত! যে বহু পুস্তক বহন করে।]
www.motaher21.net

مَثَلُ الَّذِیۡنَ حُمِّلُوا التَّوۡرٰىۃَ ثُمَّ لَمۡ یَحۡمِلُوۡہَا کَمَثَلِ الۡحِمَارِ یَحۡمِلُ اَسۡفَارًا ؕ بِئۡسَ مَثَلُ الۡقَوۡمِ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰہِ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یَہۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۵﴾
যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বহন করেনি, তারা গাধার মত! যে বহু পুস্তক বহন করে। কত নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে ! আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।
قُلۡ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ ہَادُوۡۤا اِنۡ زَعَمۡتُمۡ اَنَّکُمۡ اَوۡلِیَآءُ لِلّٰہِ مِنۡ دُوۡنِ النَّاسِ فَتَمَنَّوُا الۡمَوۡتَ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۶﴾
বলুন, ‘ হে ইয়াহূদী হয়ে যাওয়া লোকরা! যদি তোমরা মনে কর যে, তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য লোকেরা নয় ; তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’
وَ لَا یَتَمَنَّوۡنَہٗۤ اَبَدًۢا بِمَا قَدَّمَتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌۢ بِالظّٰلِمِیۡنَ ﴿۷﴾
কিন্তু তারা তাদের হস্ত যা অগ্রে প্রেরণ করেছে তার কারণে কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। আর আল্লাহ যালেমদের সম্পর্কে সম্যক অবগত।
قُلۡ اِنَّ الۡمَوۡتَ الَّذِیۡ تَفِرُّوۡنَ مِنۡہُ فَاِنَّہٗ مُلٰقِیۡکُمۡ ثُمَّ تُرَدُّوۡنَ اِلٰی عٰلِمِ الۡغَیۡبِ وَ الشَّہَادَۃِ فَیُنَبِّئُکُمۡ بِمَا کُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ ٪﴿۸﴾
বলুন, ‘তোমারা যে মৃত্যু হতে পলায়ন কর সে মৃত্যু তোমাদের সাথে অবশ্যই সাক্ষাত করবে। তারপর তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে গায়েব ও প্রকাশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে অতঃপর তোমারা যা আমল করতে সে সম্পর্কে তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন।’

০৫-০৮ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

# এ আয়াতাংশের দু’টি অর্থ। একটি সাধারণ অর্থ এবং অপরটি বিশেষ অর্থ। সাধারণ অর্থ হলো, যাদের ওপর তাওরাতের জ্ঞান অর্জন, তদনুযায়ী আমল এবং তাওরাত অনুসারে দুনিয়াকে পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তারা তাদের এ দায়িত্ব বুঝেনি এবং তার হকও আদায় করেনি। বিশেষ অর্থ হলো, তাওরাতের ধারক ও বাহক গোষ্ঠী হওয়ার কারণে যাদের কাজ ছিল সবার আগে অগ্রসর হয়ে সেই রসূলকে সাহায্য-সহযোগিতা করা যার আগমনের সুসংবাদ তাওরাতের স্পষ্ট ভাষায় দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারাই তাঁর সবচেয়ে বেশী শত্রুতা ও বিরোধিতা করেছে এবং তাওরাতের শিক্ষার দাবী পূরণ করেনি।

# গাধার পিঠে বই-পুস্তকের বোঝা চাপানো থাকলেও পিঠের ওপর কি আছে সে যেমন তা জানে না। অনুরূপ এই তাওরাতের বোঝাও তাদের ওপর চাপানো আছে। কিন্তু তারা আদৌ জানে না, এই মহান গ্রন্থ কি জন্য এসেছে এবং তাদের কাছে কি দাবী করছে।

# তাদের অবস্থা গাধার চেয়েও নিকৃষ্টত। গাধার কোন বিবেক-বুদ্ধি ও উপলব্ধি নেই বলে সে অক্ষম, কিন্তু এদের তো বিবেক-বুদ্ধি ও উপলব্ধি আছে। এরা নিজেরা তাওরাত পড়ে এবং অন্যদের পড়ায় তাই এর অর্থ তাদের অজানা নয়। এরপরও তারা জেনে শুনে এর হিদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ও উপেক্ষা করছে এবং সেই নবীকে মানতে ইচ্ছাকৃতভাবে অস্বীকার করছে যিনি তাওরাত অনুসারে অবিসংবাদিতভাবে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এরা জানে না বা বুঝে না বলে দোষী নয়, বরং জেনে শুনে আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলার অপরাধে অপরাধী।
# এ বিষয়টি লক্ষণীয় যে, এখানে, “হে ইহুদীরা” বলা হয়নি। বলা হয়েছে “হে ইহুদী হয়ে যাওয়ার লোকগণ” অথবা “যারা ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছো।” এর কারণ হলো, মূসা আলাইহিস সালাম এবং তাঁর আগের ও পরের নবী-রাসূগগণ আসল যে দ্বীন এনেছিলেন, তা ছিল ইসলাম। এসব-রসূলদের কেউই ইহুদী ছিলেন না এবং তাদের সময়ে ইহুদীদের সৃষ্টিও হয়েছিল না। এই নামে এ ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে বহু পরে। ইয়াকুব আলাইহিস সালামের চতুর্থ পুত্র ইয়াহুদার বংশোদ্ভুত গোত্রটির নামানুসারে এ ধর্মের নামকরণ হয়েছে। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের পরে তার সাম্রাজ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলে এই গোত্রটি ইয়াহুদীয়া নামক রাষ্ট্রটির মালিক হয় এবং বনী ইসরাঈলদের অন্যান্য গোত্রগুলো নিজেদের একটি আলাদা রাষ্ট্র কায়েম, করে যা সামেরিয়া নামে খ্যাত হয়। পরবর্তীকালে আসিরীয়রা সামেরিয়াকে শুধু ধ্বংসই করেনি, বরং এই রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাতা ইসরাঈলী গোত্রগুলোর নাম-নিশানা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়েছে। এরপরে শুধু ইয়াহুদা এবং তার সাথে বিন ইয়ামীনের বংশ অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু তার ওপর ইয়াহুদা বংশের প্রভাব ও আধিপত্যের কারণে তাদের জন্য ইয়াহুদ শব্দটির প্রয়োগ হতে থাকে। ইহুদী ধর্মযাজক, রিব্বী এবং আহবাররা নিজেদের ধ্যান-ধারণা, মতবাদ ও ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী এই বংশের মধ্যে আকীদা-বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান এবং ধর্মীয় বিধি-বিধানের যে কাঠামো শত শথ বছর ধরে নির্মাণ করেছে তার নাম ইহুদীবাদ। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে এই কাঠামো নির্মাণ শুরু হয় এবং খৃস্টীয় পঞ্চম শতক পর্যন্ত চলতে থাকে। আল্লাহর রসূলদের আনীত আল্লাহর হিদায়াতের উপাদান খুব সামান্যই এতে আছে এবং যা আছে তার চেহারাও অনেকখানি বিকৃত হয়েছে। এ কারণে কুরআন মজীদের অধিকাংশ স্থানে তাদেরকে الَّذِينَ هَادُوا বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ সেই সব লোক যারা ইহুদী হয়ে গিয়েছে বা ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যকার সবাই আবার ইসরাঈলী ছিল না। যেসব অইসরাঈলী ইহুদীবাদ গ্রহণ করেছিল তারাও এর মধ্যে ছিল। কুরআন মজীদে যেখানে বনী ইসরাঈল জাতিকে সম্বোধন করা হয়েছে সেখানে “হে বনী ইসরাঈল” বলা হয়েছে। আর যেখানে ইহুদী ধর্মের অনুসারীদের সম্বোধন করা হয়েছে সেখানে الَّذِينَ هَادُوا বলা হয়েছে।

# কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে তাদের এই দাবী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমনঃ তারা বলেন, ইহুদীরা ছাড়া কেউ জান্নাতে যাবে না। (আল বাকারাহ, ১১১)। দোযখের আগুন আমাদের কখনো স্পর্শ করতে না। আর আমাদেরকে যদি নিতান্তই শাস্তি দেয়া হয় তাহলে মাত্র কয়েক দিনের জন্য দেয়া হবে (আল বাকারাহ, ৮০; আলে ইমরান, ২৪)। আমরা আল্লাহর বেটা এবং তাঁর প্রিয়পাত্র (আল মায়েদা, ১৮)। ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থসমূহেও এ ধরনের কিছু দাবী-দাওয়া দেখা যায়। সারা বিশ্বে অন্তত এতটুকু কথা জানে যে, তারা নিজেদেরকে আল্লাহর বাছাই করা সৃষ্টি বলে থাকে। তারা এরূপ এক খোশ খেয়ালে মত্ত যে, তাদের সাথে খোদার একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে যা অন্য কোন মানব গোষ্ঠীর সঙ্গে নেই।

# এখানে কুরআন মজীদে একথাটি দ্বিতীয়বারের মত ইহুদীদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে। প্রথম সূরা বাকারায় বলা হয়েছিল, এদের বলো, আল্লাহর কাছে সমস্ত মানুষকে বাদ দিয়ে আখেরাতকের ঘর যদি কেবল তোমাদের জন্যই নির্দিষ্ট থেকে থাকে আর এ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে মৃত্যু কামনা করো। কিন্তু যেসব অপকর্ম তারা করেছে তার কারণে তারা কখনো মৃত্যু করবে না। আল্লাহ‌ জালেমদের খুব ভাল করেই জানেন। বরং তোমরা দেখবে তারা কোন না কোন কোনভাবে বেঁচে থাকতে সমস্ত মানুষের চেয়ে এমনকি মুশরিকদের চেয়েও বেশী লালায়িত। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আকাঙ্ক্ষা করে হাজার বছর বেঁচে থাকার। অথচ দীর্ঘ আয়ূ লাভ করলেও তা তাদেরকে এই আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবেনা। তাদের সমস্ত কৃতকর্মেই আল্লাহর দৃষ্টিতে আছে (আয়াত ৯৪-৯৬)। এ কথাটিই এখানে পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এটা শুধু পুনরুক্তিই নয়। সূরা বাকারার আয়াতগুলোতে একথা বলা হয়েছে। তখন, যখন ইহুদীদের সাথে মুসলমানদের কোন যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু এই সূরায় তার পুনরুক্তি করা হয়েছে এমন এক সময় যখন তাদের সাথে ইতিপূর্বে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর আরবভুমিতে চূড়ান্তভাবে তাদের শক্তি চূর্ণ করা হয়েছে। পূর্বে সূরা বাকারায় যে কথা বলা হয়েছিল এসব যুদ্ধ এবং তাদের পরিণাম অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষন দুই ভাবেই তা প্রমাণ করে দিয়েছিল। মদীনা এবং খায়বারে সংখ্যার দিক দিয়ে ইহুদী শক্তি কোনভাবেই মুসলমানদের তুলনায় কম ছিল না এবং উপায়-উপকরণ ও তাদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল। তাছাড়া আরবের মুশরিকদের ধ্বংস করার জন্য তারা মুনাফিকরাও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করছিল। কারণ মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য তারা বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু এই অসম মোকাবিলায় যে জিনিসটি মুসলমানদের বিজয়ী এবং ইহুদীদের পরাজিত করেছিল তা ছিল এই যে, মুসলমানগণ আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করতে ভীত হওয়া তো দূরের কথা বরং হৃদয়ের গভীর থেকে মৃত্যু কামনা করতো এবং মরণপণ করে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কারণ, তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তারা আল্লাহর পথে লড়াই করছে। আর এ বিষয়ে ও পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, এ পথে শাহাদাত বরণকারীর জন্য রয়েছে জান্নাত। অপরদিকে ইহুদীদের অবস্থা ছিল এই যে, তারা কোন পথেই জান দিতে প্রস্তুত ছিল না; না খোদার পথে, না নিজের কওমের পথে এবং না নিজের জান, মাল ও ইজ্জত রক্ষার পথে। যে ধরনের জীবনই হোক না কেন তাদের প্রয়োজন ছিল কেবল বেঁচে থাকার। এ জিনিসটিই তাদেরকে ভীরু ও কাপুরুষ বানিয়ে দিয়েছিল।

# অন্য কথায় মৃত্যু থেকে তাদের এই পালানো বিনা কারণে নয়। মুখে তারা যত বড় বড় কথাই বলুক না কেন, আল্লাহর দ্বীনের সাথে তারা যে আচরণ করেছে এবং পৃথিবীতে তারা যা করেছে আখেরাতে সেই সব আচরণ ও কাজকর্মের কিরূপ ফলাফল আশা করা যায় তাদের জ্ঞান ও বিবেক তা ভাল করেই জানতো। এ কারণে তাদের প্রবৃত্তি আল্লাহর আদালতের মুখোমুখি হতে টালবাহানা করে।

 

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*দ্বীনী দায়িত্ব অবহেলার পরিণতি : এরপর গােটা মানব জাতির উপকারার্থে আল্লাহ পাক আর একটি কথা স্মরণ করাচ্ছেন যে, তার এই অমানত বহন করার জন্যে ইহুদী জাতিকে তিনি যে দীর্ঘ সময় দান করেছিলেন, তা সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে গেছে। আর কোনাে দিন তাদের এই আমানত বহন করার দায়িত্ব দেয়া হবে না এবং এই দায়িত্বভার বহন করার জন্যে তাদের মধ্যে আর কখনও কোনাে অন্তরও তৈরী হবে না, যেহেতু এই আমানত বহন করার জন্যে এমন যিন্দাদিল লােকের প্রয়ােজন, যারা সঠিক বুঝ গ্রহণ করতে সক্ষম, অন্তরে আগত সঠিক বুঝ ধরে রাখতেও সক্ষম এবং সেই বুঝ অনুসারে কাজ করতেও প্রস্তুত। তাই এরশাদ হচ্ছে, যাদের তাওরাতের আমানতের বােঝা বহন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলাে, কিন্তু এ দায়িত্ব লাভ করার পর তারা এর হক আদায় করলাে না, তারা এমন একটি গাধার মতো, যা বড় বড় বইয়ের বােঝা বহন করে বটে, কিন্তু তারা নিজেরা তা কিছুই বুঝে না। এর থেকেও নিকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সে ব্যক্তিদের, যারা আল্লাহর আয়াতগুলাে অস্বীকার করেছে এবং নবীকে মিথ্যাবাদী বলে দোষারােপ করেছে! এমন যালেম জাতিকে আল্লাহ তায়ালা কখনও হেদায়াত করেন না।’ বনী ইসরাঈল জাতিকে তাওরাত কিতাব দেয়া হয়েছিলাে এবং তাদের ঈমান আকীদা ও শরীয়তের বিধি বিধানের আমানত দান করা হয়েছিলো, ‘কিন্তু এ দায়িত্বের হক তারা আদায় করলাে না।’ এ দায়িত্বের দাবী ছিলাে, ওই কিতাবটিকে আল্লাহর কিতাব হিসাবে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করা, বিবেক বুদ্ধি খরচ করে বুঝতে চেষ্টা করা এবং অন্তরের গভীরে অনুধাবন করা, আর পরিশেষে বিবেকের কাছে গৃহীত ও বাস্তবতার নিরিখে যথার্থ বলে প্রমাণিত সত্যকে বাস্তব কর্মে রূপায়িত করা, কিন্তু আল কোরআনে বর্ণিত বনী ইসরাঈল জাতির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এবং আজও বাস্তবে তাদের যে আচরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে কিছুতেই বুঝা যায় না যে, তারা এই মহান আমানতের কিছুমাত্র মূল্যায়নও করেছে, বরং এটাই সত্য কথা যে, তারা এর সত্যতা অনুধাবন তাে করেইনি আর না তারা এ কিতাব অনুসারে কোনাে কাজ করেছে। এই কারণেই বলা হয়েছে যে, গাধার মতাে তারা বড় বড় কিতাব বহন করেছে বটে, কিন্তু সেই ভারী বােঝা বহন করা ছাড়া এ কিতাব তাদের কোনােই উপকারে আসেনি। আসলে এ কিতাবের অধিকারী হওয়ার যােগ্যই তারা নয় এবং এর লক্ষ্যও তারা জানে না। তাদের এই চরম নিকৃষ্ট চরিত্র ও কদর্যতম ব্যবহার তুলে ধরে আল কোরআন তাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে আহবান জানিয়েছে। চরম নিকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সেই জাতির, যারা আল্লাহ তায়ালার আয়াতগুলােকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার চেষ্টা করেছে এবং সেগুলাে মিথ্যা বলে অস্বীকারও করেছে। ‘আর কখনই আল্লাহ তায়ালা এই সব যালেম জাতিকে হেদায়াত করেন না।’ যাদের তাওরাত কিতাব বহন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু এ মহান ও পবিত্র দায়িত্ব লাভ করেও যারা এর হক আদায় করেনি, তাদের মতােই আজকের পৃথিবীতে এক জাতির উদাহরণ পাওয়া যায়, যাদের ঈমান ও ইসলামের আমানত দেয়া হয়েছে, কিন্তু তারা তার হক আদায় করছে না। ইতিপূর্বে যুগ যুগ ধরে মুসলমানদেরও অনেক সম্প্রদায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে এবং আজও যারা বর্তমান রয়েছে, তারা মুসলমান নাম ধারণ করে রেখেছে বটে, কিন্তু বাস্তবে মুসলমানের মতাে কোনাে কাজই তারা করছে না, বিশেষ করে সেসব ব্যক্তি যারা আল কোরআন এবং অন্যান্য বহু ইসলামী বইপত্র পড়ছে, কিন্তু এগুলাের শিক্ষা অনুসারে তাদের মধ্যে কোনাে জাগরণ আসছে না, এরা সবাই হচ্ছে সেই গাধার মতো, যা বড় বড় বইয়ের বােঝাই বহন করে চলে, কিন্তু সেই বইগুলাের কোনাে মর্ম সে বুঝে না। এ ধরনের গাধাসম ব্যক্তি আজ সমাজে বহু বহু সংখ্যায় বিরাজ করছে। অবশ্য প্রশ্ন এটা নয় যে, তারা বইয়ের বােঝা বহন করছে বা অধ্যয়ন করছে। প্রশ্ন তাে হচ্ছে এই যে, তারা এসব কিতাবপত্র বুঝেছে কিনা বা এসব কিতাব অনুসারে আমল করছে কিনা।  *ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে মােবাহালার পদ্ধতি : আগেও ইহুদীরা মনে করতাে এবং এখনও মনে করে, তারাই একমাত্র আল্লাহর প্রিয় জাতি এবং অন্যান্য সকল জাতি থেকে তারাই আল্লাহর বেশী মহব্বতধন্য, আর অন্যান্য মানুষ তারা তাে সব অশিক্ষিত জাহিল, অথবা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অতি সাধারণ কতিপয় মানুষ। এসব সাধারণ মানুষের সাথে তার দ্বীনী হুকুম আহকামের ব্যাপারে কোনাে মতৈক্যে পৌঁছতে বা আপসে আসতে চায় না। তাই তারা বলে, ‘এই উন্মী লােকদের (মুক্তি ও উন্নতির) জন্যে আমাদের কাছে কোনাে পথ খােলা নেই।’ এতােটুকু বলেই তারা ক্ষান্ত নয়, বরং কোনাে দলীল প্রমাণ ছাড়াই তারা আল্লাহর ওপর নির্জলা মিথ্যা আরাপ করতে দ্বিধাবােধ করে না। আর সেই জন্যেই তাদের মােবাহালা করতে আহবান জানানাে হয়েছে। আহবান জানানাে হয়েছে নাসারা ও মােশরেকদেরও এই মােবাহালা করতে। ‘বলাে, হে ওসব ব্যক্তিরা, যারা নিজেদের ইহুদী বলে মনে করাে অথবা মনে করে নিজেদের হেদায়াতপ্রাপ্ত, তােমরা যদি মনে করাে যে… ব্যবহার সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন যা তোমরা পৃথিবীর বুকে করছিলে।’ মুবাহালা বলতে বুঝায় একই কথা বলার উদ্দেশ্যে দুটি বিবদমান দলের মুখােমুখি দাঁড়ানাে এবং উভয় দলের পক্ষ থেকে একই সাথে আল্লাহর কাছে প্রকৃত মিথ্যাবাদীর ওপর গযব নাযিল করার জন্যে দোয়া করা। রসূলুল্লাহ(স.) যখনই এইভাবে কাউকে মােবাহালা করার জন্যে আহবান জানিয়েছেন, তখনই তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে এবং প্রতি বারই তারা এই কঠিন প্রতিযােগিতা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং কিছুতেই এই প্রতিযােগিতায় নামতে রাযি হয়নি। কারণ তাদের অন্তরের মধ্যে তাে অবশ্যই তারা রসূলুল্লাহ(স.)-কে সত্যবাদী বলে জানতাে এবং প্রকৃতপক্ষেই তিনি যে আল্লাহর রসূল, তাদের মনের গভীরে অবশ্যই এ বিশ্বাস ছিলাে এবং এই দ্বীন ই যে সত্য জীবন ব্যবস্থা তাও তারা বুঝতাে। ইমাম আহমাদ হযরত ইবনে আব্বাস(রা.)-এর হাদীস রেওয়ায়াত করতে গিয়ে বলেন, একদিন আবু জাহল বললাে, ওর ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত হােক, কাবা ঘরে ওকে যদি আমি দেখতে পাই, তাহলে অবশ্যই ওর গর্দানের ওপরে পা রেখে ওকে আমি দলিত মথিত করে ফেলবাে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেন, রসূলুল্লাহ(স.) একথা শুনে বললেন, ওরা যদি সত্য সত্যই মোবাহালা করে তাহলে ফেরেশতারা তৎক্ষণাৎ তাদের পাকড়াও করে বসতাে। আর যদি ইহুদীরা মৃত্যু কামনা করতাে, তাহলে সাথে সাথেই মৃত্যু এসে যেতাে এবং এর পর পরই তারা নিজেদের দোযখে দেখতে পেতাে। যদি তারা রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে মােবাহালা করার জন্যে বের হয়ে আসতাে, তাহলে তারা এমন অবস্থায় ফিরে যেতাে যে, তারা তাদের মাল-সম্পদ ও পরিবারের কাউকে আর খুঁজে পেতাে না।(বুখারী, তিরমিযী এবং নাসাঈ ও অনুরূপ হাদীস রেওয়ায়াত করেছেন) এই মােবাহালা করার উদ্দেশ্য ছিলাে সে হঠকারী ব্যক্তিদের মুখ বন্ধ করে দেয়া, যারা মনে করতাে যে, তারাই একমাত্র আল্লাহর বন্ধু ও প্রিয়পাত্র, অন্য কেউ এই মর্যাদার অধিকারী নয়। তারাই যদি একমাত্র প্রিয়পাত্র হবে, তাহলে তাদের মৃত্যুর এত ভয় কেন? সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে সব থেকে তারা এতাে ভীরুই বা কেন ? মৃত্যুর পর পরই তাে তারা সেই মর্যাদার অধিকারী হয়ে যাবে, যা আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয়পাত্র ও তার আপন জনের জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাদের নিজেদের কথাতে তাদের আটকিয়ে দেয়ার পর তাদের বুঝার সুযােগ করে দিচ্ছেন যে, যে জিনিসের দাবী তারা করছে তা সত্য নয়। আর এটাও তারা জানে যে, যে কথাগুলাে তারা বলছে তাতে তারা নিজেরাও তৃপ্ত বা নিশ্চিন্ত নয়। এসব কথা দ্বারা কোনাে সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার আশাও তারা করে না। তারা এমন নাফরমানীর কথা বলছে, যা তাদেরকেই মৃত্যুর ভয় ও মৃত্যুর পরবর্তী কঠিন অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং এ আচরণ জীবনের বন্ধুর পথের ভয়াবহতা কম করার ব্যাপারে তাদের সামান্যতম সাহায্যও করতে পারবে না। তাদের সামনে তাদের যে কাজের ফিরিস্তি রয়েছে, তার কারণেই তাে তারা কিছুতেই মৃত্যু কামনা করে না, করতে পারে না এবং আল্লাহ তায়ালা যালেমদের সম্পর্কে ভালাে করেই জানেন। আলােচনার সমাপ্তি টানতে গিয়ে ও আল্লাহ তায়ালা মৃত্যু ও তৎপরবর্তী অবস্থার সঠিক চিত্র ও তাৎপর্য তুলে ধরতে গিয়ে বলছেন, যে মৃত্যু থেকে পালানের চেষ্টা তারা করছে, তাতে আসলে তাদের কোনাে ফায়দা নেই; বরং এ ভয়ংকর অবস্থা আসবেই আসবে। এ অবস্থা থেকে তাদের বাঁচারও কোনাে উপায় নেই। মৃত্যু এসে গেলে আল্লাহর দরবারে হাযির হওয়া ও তাঁর কাছে নিজেদের কাজে হিসাব নিকাশ দেয়া ছাড়া অন্য কোনাে গত্যন্তরও তাদের নেই। এ হিসাবের দিন যে আসবেই আসবে, তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। একথা বুঝাতে গিয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘বলে দাও (হে রসূল)! যে মৃত্যু থেকে তােমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছাে, তা তােমাদের সাথে সাক্ষাত করবেই, তারপর তােমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অনুপস্থিত ও উপস্থিত জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহর দিকে এবং তখন তিনি তােমাদেরকে তােমাদের অতীতের সকল কীর্তিকলাপ সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন, যা তােমরা জীবনভর করতে থেকেছ। আল কোরআন যাদের সরাসরি সম্বােধন করছে এবং যাদের পরােক্ষভাবে বলেছে, তাদের প্রত্যেকের জন্যে এ মহাগ্রন্থের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভংগি তুলে ধরা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে এ এক বিশেষ দৃষ্টিভংগি। আল কোরআন সকল কথার মধ্যেই চিরন্তন এ সত্য বার বার তুলে ধরেছে যে, আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাত করতেই হবে, এ ছাড়া তাদের কোনাে উপায় নেই এবং তার আশ্রয় ছাড়া অন্য কোনাে আশ্রয়ও নেই। তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাঁর কাছেই তাদের ফিরে যেতে হবে এবং তাঁর কাছে ফিরে গিয়ে অতীতের যাবতীয় কাজের হিসাব পেশ করতে। হবে। এ হিসাব দান করা থেকে পালানাের বা তার থেকে মুক্তি লাভ করারও কোনাে উপায় নেই। ইমাম তাবারী তাঁর রচিত অভিধান গ্রন্থে একটি বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন, মৃত্যু থেকে পলায়নপর ব্যক্তি হচ্ছে এমন একটি শেয়ালের মতাে, যাকে পৃথিবীর মাটি তার দেনা পরিশােধ করার জন্যে খুঁজে বেড়াতে থাকে, কিন্তু সে এ দাবী এড়ানাের জন্যে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়ায়, শেষ পর্যন্ত কোন জায়গায় আশ্রয় না পেয়ে শ্ৰান্ত ক্লান্ত হয়ে আবার সে নিজের গর্তের মধ্যেই ঢুকে পড়ে। তখন আবার তাকে মাটি বলে, কোথায় হে শেয়াল পন্ডিত, আমার পাওনাটা কই? এরপর ছুরি বের করা হয় তাকে কতল করার জন্যে। তখন সে আবার পালায়, আবারও ঘুরে-ফিরে এসে সেই গর্তের মধ্যে আশ্রয় নেয়, অবশেষে তার গর্দান কেটে দিলে সে মারা যায়। মানুষকে তাদের পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে সজাগ করার জন্যে এ উদাহরণ বড়ই হৃদয়গ্রাহী।

 

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৫-৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :

আলোচ্য আয়াতেগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহূদীদের নিন্দা করছেন। তাদেরকে তাওরাত প্রদান করা হয়েছিল তারা আমল করার জন্য তাওরাতকে গ্রহণ করে নিয়েছিল কিন্তু আমল করেনি। আল্লাহ তা‘আলা বলছেন তাদের উপমা হল গাধার মত, যে গাধা তার পিঠে পুস্তক বহন করে কিন্তু সে জানে না তাতে কী মূল্যবান জিনিস আছে এবং তা থেকে কোন উপকারও নিতে পারে না। অনুরূপভাবে এ ইয়াহূদীরা বাহ্যিকভাবে তাওরাতের শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করছে কিন্তু তা বুঝে না ও আমল করে না। বরং পরিবর্তন পরিবর্ধন করেছে। সুতরাং তারা নির্বোধ গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেছেন :

(أُولٰ۬ئِكَ كَالْأَنْعَامِ بَلْ هُمْ أَضَلُّ ط أُولٰ۬ئِكَ هُمُ الْغٰفِلُوْنَ)

“তারাই পশুর ন্যায়, বরং তারা অধিক বিভ্রান্ত তারাই গাফিল।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ১৭৯)

তাই আল্লাহ তা‘আলা এরূপ জালিম জাতির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার পর বলেন :

(بِئْسَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِيْنَ كَذَّبُوْا بِاٰيٰتِ وَاللّٰهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظّٰلِمِيْنَ)

“কত নিকৃষ্ট সেই সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।”

পূর্বের আয়াতগুলোতে উম্মাতে মুহাম্মাদীর প্রতি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ ও আসমানী কিতাব কুরআন দ্বারা যে অনুগ্রহ করেছেন সে আলোচনা করার পর এ আয়াতগুলোতে ইয়াহূদীরা আল্লাহ তা‘আলার কিতাব তাওরাতের সাথে যে আচরণ করেছে সে সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হল আমরা উম্মাতে মুহাম্মাদীও যেন ইয়াহূদীদের মত আচরণ না করি। ইয়াহূদীদের মত কিতাবে বিকৃতি এবং কোনরূপ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন না করি।

ইয়াহূদীদের অন্যতম জুলুম ছিল তারা জানত যে, আমরা বাতিলের ওপর আছি তারপরেও দাবী করত আমরা হকের ওপর আছি এবং অন্যদের বাদে আমরা আল্লাহ তা‘আলার ওলী। যেমন তারা বলত “আমরা আল্লাহর সন্তান ও প্রিয় পাত্র” (সূরা মায়িদা ৫ : ১৮)

আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে দিতে বলছেন, যদি তাই হয় তাহলে তারা যেন মৃত্যু কামনা করে, তখন জেনে নেবে প্রকৃত ব্যাপার কী? আল্লাহ তা‘আলা বলছেন তারা যে কুফরী করেছে ও যে জুলুম করেছে তা তাদের জ্ঞাত, তাই তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৯৪-৯৬ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হযেছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আবূ জাহল বলল : আমি যদি মুহাম্মাদকে কাবার নিকট দেখতে পাই তাহলে তার গর্দান পিষে দেব। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন : যদি সে এরূপ করত তাহলে ফেরেশতারা তাকে জনগণের সামনেই পাকড়াও করত। ইয়াহূদীরা যদি মৃত্যু কামনা করত তাহলে তারা মারা যেত এবং জাহান্নামে তাদের ঠিকানা দেখতে পেত। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৫৮)

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. ইয়াহূদীদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার লা‘নত, কারণ তারা তাওরাতের ওপর আমল করেনি।
২. যারা সঠিক জ্ঞান পাওয়ার পরেও আমল করে না তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার তিরস্কার।
৩. ইয়াহূদীদের মিথ্যা দাবীর কথা জানতে পারলাম।
৪. মৃত্যু নামক পেয়ালা অবশ্যই সবাইকে পান করতে হবে। অতঃপর দুনিয়ার কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে।
৫. জেনে শুনে আল্লাহ তা‘আলার কিতাবের শাব্দিক ও আর্থিক পরিবর্তন করা ইয়াহূদীদের চরিত্র।

 

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫-৮ নং আয়াতের তাফসীর:

এই আয়াতগুলোতে ইয়াহূদীদেরকে নিন্দে করা হচ্ছে যে, তাদেরকে তাওরাত। প্রদান করা হয় এবং আমল করার জন্যে তারা তা গ্রহণ করে, কিন্তু আমল করেনি। ঘোষিত হচ্ছে যে, তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে পুস্তক বহনকারী গর্দভ। যদি গর্দভের উপর কিতাবের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় তবে সে তো এটা বুঝতে পারবে যে, তার উপর বোঝা রয়েছে, কিন্তু কি বোঝা রয়েছে তা সে মোটেই বুঝতে পারবে না। অনুরূপভাবে এই ইয়াহূদীরা বাহ্যিকভাবে তো তাওরাতের শব্দগুলো মুখে উচ্চারণ করছে, কিন্তু মতলব কিছুই বুঝে না। এর উপর তারা আমল তো করেই না, এমন কি একে পরিবর্তন পরিবর্ধন করে ফেলছে। সুতরাং প্রকতপক্ষে তারা এ নির্বোধ ও অবুঝ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট। কেননা, মহান আল্লাহ এদেরকে বোধশক্তিই দান করেননি। কিন্তু এ লোকগুলোকে তো তিনি বোধশক্তি দিয়েছেন, অথচ তারা তা ব্যবহার করে না ও কাজে লাগায় না। এ জন্যেই অন্য আয়াতে বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট! তারাই গাফিল।” (৭:১৭৯)

এখানে বলা হচ্ছে যে, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করে ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করে তাদের দৃষ্টান্ত কতই না নিকৃষ্ট। তারা অত্যাচারী এবং আল্লাহ তা’আলা অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি জুমআর দিন ইমামের খুৎবাহ দান অবস্থায় কথা বলে সে পুস্তক বহনকারী গর্দভের মত এবং যে ব্যক্তি তাকে বলেঃ চুপ কর তার জুমআ’হ্ হয় না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে ইয়াহুদীগণ! যদি তোমরা মনে কর যে, তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য কোন মানব গোষ্ঠী নয়, তবে তোমরা মৃত্যু কামনা কর যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ অর্থাৎ হে ইয়াহূদীদের দল! যদি তোমাদের দাবী এই হয় যে, তোমরা সত্যের উপর রয়েছে আর হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এবং তাঁর সহচরবৃন্দ অসত্যের উপর রয়েছেন তবে তোমর প্রার্থনা করঃ আমাদের দুই দলের মধ্যে যারা অসত্যের উপর রয়েছে তাকে যেন আল্লাহ মৃত্যু দান করেন।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “কিন্তু তাদের হস্ত যা অগ্রে প্রেরণ করেছে তার কারণে কখনো মত্য কামনা করবে না। অর্থাৎ যারা যে কুফরী, যুলম ও পাপের কাজ করেছে সেই কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না।

আল্লাহ তা’আলা যালিমদের সম্পর্কে সম্যক অবগত।

সূরায়ে বাকারার নিম্নের আয়াতগুলোর তাফসীরে ইয়াহুদীদের সাথে। মুবাহালার পূর্ণ বর্ণনা গত হয়েছেঃ “বলঃ যদি আল্লাহর নিকট পরকালের বাসস্থান অন্য লোকে ব্যতীত বিশেষভাবে শুধু তোমাদের জন্যেই হয় তবে তোমরা মুত্যু কামনা কর- যদি সত্যবাদী হও। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের জন্যে তারা কখনো ওটা কামনা করবে না এবং আল্লাহ যালিমদের সম্বন্ধে অবহিত। তুমি অবশ্যই তাদেরকে জীবনের প্রতি সমস্ত মানুষ, এমনকি মুশরিকদের অপেক্ষা অধিক লোভী দেখতে পাবে। তাদের প্রত্যেকে সহস্র বছর বাঁচার আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু দীর্ঘায়ু তাদেরকে শাস্তি হতে দূরে রাখতে পারবে না। তারা যা করে আল্লাহ ওর দ্রষ্টা।” সূরায়ে আলে ইমরানের নিম্নের আয়াতে খৃষ্টানদের সাথে মুবাহালার বর্ণনা রয়েছেঃ

“তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয়ে তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বলঃ এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রদেরকে ও তোমাদের পুত্রদেরকে, আমাদের নারীদেরকে ও তোমাদের নারীদেরকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে; অতঃপর আমরা বিনীত আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের উপর দিই আল্লাহর লানত।” আর মুশরিকদের সাথে মুবাহালার বর্ণনা রয়েছে সূরায়ে মারইয়ামের নিম্নের আয়াতে “বলঃ যারা বিভ্রান্তিতে রয়েছে, দয়াময় তাদেরকে প্রচুর ঢিল দিবেন।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আবু জেহেল (আল্লাহ তা’আলা তার প্রতি লা’নত বর্ষণ করুন!) বলেঃ “আমি যদি মুহাম্মাদ (সঃ)-কে কা’বার নিকট দেখতে পাই তবে অবশ্যই তার গর্দান পরিমাপ করবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এ খবর পৌঁছলে তিনি বলেনঃ “যদি সে এরূপ করতো তবে অবশ্যই ফেরেশতাগণ জনগণের চোখের সামনে তাকে পাকড়াও করতেন। আর যদি ইয়াহূদীরা মৃত্যু কামনা করতো তবে অবশ্যই তারা মরে যেতো এবং জাহান্নামে তাদের জায়গা দেখে নিতো। আর আল্লাহর সাথে যারা মুবাহালা করতে চেয়েছিল তারা যদি মুবাহালার জন্যে বের হতো তবে অবশ্যই তারা এমন অবস্থায় ফিরে আসতো যে, তাদের পরিবারবর্গ এবং মাল-ধন তারা। পেতো না।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলার উক্তিঃ বলঃ (হে মুহাম্মাদ সঃ)! তোমরা যে মৃত্যু হতে পলায়ন কর সেই মৃত্যুর সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হবেই। অতঃপর তোমরা প্রত্যানীত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা আল্লাহর নিকট এবং তোমাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে যা তোমরা করতে। যেমন সূরায়ে নিসার মধ্যে আল্লাহ তা’আলার উক্তি রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা যেখানেই থাকো না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, সুউচ্চ ও সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান করলেও।”

তিবরানী (রঃ)-এর মু’জাম গ্রন্থে হযরত সমরা’ (রাঃ) হতে একটি মারফ হাদীস বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি মৃত্যু হতে পলায়ন করে তার দৃষ্টান্ত হলো ঐ খেকশিয়াল যার কাছে ভূমি তার প্রদত্ত ঋণ চায়। তখন সে দ্রুত বেগে পালাতে শুরু করে। শেষে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তার গর্তে ঢুকে পড়ে। তখন ভূমি তাকে বলেঃ “হে খেকশিয়াল! আমাকে আমার ঋণ দিয়ে দাও।” একথা শুনে সে পুনরায় লেজগুটিয়ে ভীষণ বেগে দৌড়াতে শুরু করে। অবশেষে তার গর্দান ভেঙ্গে যায় এবং সে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।”

Leave a Reply