(বই#৮৬৩) সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল সুরা:১৭ ৬১-৬৫ নং আয়াত:- [ وَ مَا یَعِدُہُمُ الشَّیۡطٰنُ اِلَّا غُرُوۡرًا ﴿۶۴﴾ শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র। ] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৬৩)
সুরা: আল্ বনি‌ ইসরাইল
সুরা:১৭
৬১-৬৫ নং আয়াত:-
[ وَ مَا یَعِدُہُمُ الشَّیۡطٰنُ اِلَّا غُرُوۡرًا ﴿۶۴﴾
শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ছলনা মাত্র। ]
www.motaher21.net

সুরা: বনী ইসরাঈল
আয়াত নং :-৬১
وَ اِذْ قُلْنَا لِلْمَلٰٓئِكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْۤا اِلَّاۤ اِبْلِیْسَ١ؕ قَالَ ءَاَسْجُدُ لِمَنْ خَلَقْتَ طِیْنًاۚ

আর স্মরণ করো, যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা করো, তখন সবাই সিজদা করলো কিন্তু ইবলীস করলো না। সে বললো, “আমি কি তাকে সিজদা করবো যাকে তুমি বানিয়েছো মাটি দিয়ে?”

আয়াত নং :-৬২
قَالَ اَرَءَیْتَكَ هٰذَا الَّذِیْ كَرَّمْتَ عَلَیَّ١٘ لَئِنْ اَخَّرْتَنِ اِلٰى یَوْمِ الْقِیٰمَةِ لَاَحْتَنِكَنَّ ذُرِّیَّتَهٗۤ اِلَّا قَلِیْلًا

তারপর সে বললো, “দেখোতো ভালো করে, তুমি যে একে আমার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছো, এ কি এর যোগ্য ছিল? যদি তুমি আমাকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত অবকাশ দাও তাহলে আমি তার সমস্ত সন্তান-সন্ততির মূলোচ্ছেদ করে দেবো, মাত্র সামান্য ক’জনই আমার হাত থেকে নিস্তার পাবে।”

আয়াত নং :–৬৩

قَالَ اذْهَبْ فَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ فَاِنَّ جَهَنَّمَ جَزَآؤُكُمْ جَزَآءً مَّوْفُوْرًا

আল্লাহ বললেন, “ঠিক আছে, তুমি যাও, এদের মধ্য থেকে যারাই তোমার অনুসরণ করবে তুমিসহ তাদের সবার জন্য জাহান্নামই হবে পূর্ণ প্রতিদান।

আয়াত নং :-৬৪

وَ اسْتَفْزِزْ مَنِ اسْتَطَعْتَ مِنْهُمْ بِصَوْتِكَ وَ اَجْلِبْ عَلَیْهِمْ بِخَیْلِكَ وَ رَجِلِكَ وَ شَارِكْهُمْ فِی الْاَمْوَالِ وَ الْاَوْلَادِ وَعِدْهُمْ١ؕ وَ مَا یَعِدُهُمُ الشَّیْطٰنُ اِلَّا غُرُوْرًا

তুমি যাকে যাকে পারো তোমার দাওয়াতের মাধ্যমে পদস্খলিত করো, তাদের ওপর অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর আক্রমণ চালাও, ধন-সম্পদে ও সন্তান-সন্ততিতে তাদের সাথে শরীক হয়ে যাও এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতির জালে আটকে ফেলো, —আর শয়তানের প্রতিশ্রুতি ধোঁকা ছাড়া আর কিছুই নয়,

আয়াত নং :-৬৫
اِنَّ عِبَادِیْ لَیْسَ لَكَ عَلَیْهِمْ سُلْطٰنٌ١ؕ وَ كَفٰى بِرَبِّكَ وَكِیْلًا

নিশ্চিতভাবেই আমার বান্দাদের ওপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব অর্জিত হবে না৮০ এবং ভরসা করার জন্য তোমার রবই যথেষ্ট।

৬১-৬৫ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

# তুলনামূলক অধ্যয়নের জন্য সূরা আল বাকারার ৪ রুকূ’ , আন নিসার ১৮ রুকূ’ , আল হিজরের ৩ রুকূ’ এবং ইবরাহীমের ৪ রুকূ’ দেখুন। এ বক্তব্য প্রসঙ্গে আলোচ্য ঘটনাটা আসলে যে কথা বুঝাবার জন্য বর্ণনা জন্য করা হচ্ছে তা হচ্ছে, আল্লাহর মোকাবিলায় কাফেরদের এ অহংকার, সতর্কবাণীর প্রতি তাদের এ উপেক্ষা এবং বাঁকা পথে চলার জন্য তাদের এ অনমনীয় ঔদ্ধত্য ঠিক সেই শয়তানেরই অনুকরণ যে প্রথম দিন থেকেই মানুষের শত্রুতা করে আসছে। এ কর্মনীতি অবলম্বন করে এরা আসলে এমন একটি জালে জড়িয়ে পড়ছে যে জালে আদমের বংশধরদেরকে জড়িয়ে ধ্বংস করে দেবার জন্য শয়তান মানব ইতিহাসের সূচনালগ্নেই চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল।

# “মূলোচ্ছেদ করে দেবো,” অর্থাৎ শান্তি ও নিরাপত্তার পথ থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেবো। ‘ইহতিনাক’ শব্দের আসল মানে হচ্ছে, কোন জিনিসকে শিকড় সুদ্ধ উপড়ে ফেলা। যেহেতু মানুষের আসল মর্যাদা হচ্ছে আল্লাহর খেলাফত এবং এর দাবী হচ্ছে আনুগত্যের ক্ষেত্রে দৃঢ়পদ থাকা, তাই এ মর্যাদা থেকে তার সরে যাওয়া গাছকে শিকড় সুদ্ধ উপড়ে ফেলারই মতো।

# মূলে “ইস্তিস্যায” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে হালকা করা। অর্থাৎ দুর্বল বা হালকা পেয়ে কাউকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া বা তার পা পিছলিয়ে দেয়া।

# এ বাক্যাংশে শয়তানকে এমন একটি ডাকাতের সাথে তুলনা করা হয়েছে যে তার অশ্বারোহী ও পদাতিক ডাকাত বাহিনী নিয়ে একটি জনপদ আক্রমণ করে এবং তাদেরকে হুকুম দিতে থাকে, এদিকে লুটপাট করো ওদিকে সাঁড়াসী আক্রমণ চালাও এবং সেদিকে ধ্বংস করো। শয়তানের অশ্বারোহী ও পদাতিক বলতে এমনসব অসংখ্য জিন ও মানুষকে বুঝানো হয়েছে, যারা বিভিন্ন আকৃতিতে ও বিভিন্নভাবে ইবলীসের মানব বিধ্বংসী অভিযানে সহযোগিতা করছে।

# এ বাক্যাংশটি বড়ই অর্থপূর্ণ। এখানে শয়তান ও তার অনুসারীদের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি পূর্ণাংগ ছবি আঁকা হয়েছে। যে ব্যক্তি অর্থ উপার্জন ও তা খরচ করার ব্যাপারে শয়তানের ইঙ্গিতে নড়াচড়া করে, তার সাথে যেন শয়তান বিনা অর্থ ব্যয়ে শরীক হয়ে গেছে। পরিশ্রমে তার কোন অংশ নেই, অপরাধ, পাপ ও দুষ্কর্মের অশুভ পরিণতিতে সে অংশীদার নয়, কিন্তু তার ইঙ্গিতে এ নির্বোদ এমনভাবে চলছে যেন তার ব্যবসায়ে সে সমান অংশীদার বরং বৃহত্তম অংশীদার। এভাবে সন্তান তো হয় মানুষের নিজের এবং তাকে লালন-পালন করার জন্য সে নিজের সব যোগ্যতা, কর্মক্ষমতা ও সম্পদ ব্যয় করে কিন্তু শয়তানের ইঙ্গিতে এ সন্তানকে সে এমনভাবে গোমরাহী ও নৈতিক চরিত্রহীনতার শিক্ষা দেয় যেন মনে হয় সে একা এ সন্তানের বাপ নয় বরং তার পিতৃত্বে শয়তানেরও শরীকানা আছে।

# তাদেরকে মিথ্যা আশার কুহকে ভুলিয়ে রাখো এবং মিথ্যার আকাশ কুসুম রচনা করে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দাও।
# এর দু’টি অর্থ। স্ব স্ব স্থানে দু’টি অর্থই সঠিক। একটি অর্থ হচ্ছে, আমার বান্দা অর্থাৎ মানুষের ওপর তুমি এমন কর্তৃত্ব লাভ করবে না, যার ফলে তুমি তাদেরকে জবরদস্তি নিজের পথে টেনে নিয়ে যেতে পারো। তুমি নিছক প্ররোচিত করতে ও ফুসলাতে এবং ভুল পরামর্শ দিতে ও মিথ্যা ওয়াদা করতে পারো। কিন্তু তোমার কথা গ্রহণ করা বা না করা হবে বান্দার নিজের কাজ। তারা তোমার পথে যেতে চাইলে বা না চাইলেও তুমি হাত ধরে তাদেরকে নিজের পথে টেনে নিয়ে যাবে— তোমার এমন ধরনের কোন কর্তৃত্ব তাদের ওপর থাকবে না। দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, আমার বিশেষ বান্দাদের অর্থাৎ নেক বান্দাদের ওপর তোমার কোন প্রভাব খাটবে না। শক্তিহীন ও দুর্বল সংকল্পধারী লোকেরা নিশ্চয়ই তোমার প্রতিশ্রুতিতে প্রতারিত হবে, কিন্তু যারা আমার বন্দেগীতে অবিচল থাকবে তারা কখনো তোমার নিয়ন্ত্রণে আসবে না।

# যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করবে এবং যারা পথনির্দেশনা, সুযোগ দান ও সাহায্যের ওপর আস্থা রাখবে তাদের এ আস্থা ভুল প্রমাণিত হবে না। তাদের অন্য কোন সহায় ও নির্ভরের প্রয়োজন হবে না। তাদের পথ দেখাবার এবং হাত ধরার ও সাহায্য করার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট হবেন। তবে যারা নিজেদের শক্তির ওপর ভরসা করে অথবা আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কারো ওপর নির্ভর করে তারা এ পরীক্ষা পর্ব সাফল্যের সাথে অতিক্রম করতে পারবে না।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*মানবজাতির চিরশত্রু : রসূলুল্লাহ(স.) মেরাজের রাত্রিতে যেসব দৃশ্য দেখেছিলেন, যেসব নিগুঢ়তম রহস্য সমূহ অবগত হয়েছিলেন এবং জাহান্নামের গভীর তলদেশে উদ্গত যাককুম বৃক্ষ সম্পর্কে জেনেছিলেন যার ফল খেতে আল্লাহর অবাধ্য, আল্লাদ্রোহী ও শয়তানের অনুগামী ব্যক্তিদেরকে বাধ্য করা হবে… এসব কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁর কাছে মালউন (চির নিন্দিত-বিকৃত ও অভিশপ্ত) শয়তানের সেই সব কারসাজি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলাে না পথভ্রষ্টদেরকে কখনও ভয় দেখিয়েছে, কখনও অমর হওয়ার কুহকে ফেলেছে, আবার কখনও দুনিয়ার সুখ-সৌন্দর্যে এতাে বেশী মাতিয়ে ফেলেছে যে তারা হেদায়েতের পথ থেকে অনেক সুদূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করে দেখাে ওই সময়ের কথা, যখন আমি, মহান আল্লাহ, ফেরেশতাদেরকে ডেকে বলেছিলাম সেজদা করাে আদমকে, অতপর সবাই সেজদা করলাে ইবলিস ছাড়া। সে বললাে, আমি কি তাকে সেজদা করবো যাকে তুমি সৃষ্টি করেছ মাটি দিয়ে… প্রকৃত পক্ষে যারা আমার বান্দাহ, তাদের ওপর তােমার কোনাে ক্ষমতা নেই এবং তােমার রব অভিভাবক ও পরিচালক হিসাবে যথেষ্ট'(আয়াত ৬১-৬৫) যে সব মানুষ ভুল পথে চালিত হয়েছে তাদের পথভ্রষ্টতার মূল কারণগুলাে এ আলােচনা প্রসংগে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। মানুষকে সতর্ক করার জন্যেই এ দৃশ্যটিকে এখানে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে, যেহেতু তারা গােমরাহীর কারণগুলাে দেখতে পাচ্ছে এবং স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে যে ইবলিস তাদের ও তাদের বাপ-দাদাদের দুশমন। সময় থাকতেই তাদেরকে হুঁশিয়ার করা হচ্ছে যেন তারা তাদের চিরাচরিত হঠকারিতা পরিহার করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর স্মরণ করে দেখাে ওই সময়ের কথা যখন… মাটি দিয়ে’ এ কথা দ্বারা আদমের প্রতি ইবলিসের হিংসা পরিস্ফূুট হয়ে উঠেছে এবং মাটি দ্বারা সৃষ্টি’-এ কথাটি উল্লেখ করায় তার প্রচন্ড হিংসা প্রকাশ পাচ্ছে, অথচ সে ভুলে গেছে যে মাটি দ্বারা সৃষ্টি হলেও তার মধ্যে আল্লাহ তায়ালা রূহ (প্রাণ) স্থাপন করেছেন। আর যেহেতু ইবলিসকে জানানাে হয়েছে যে আদমের মধ্যে কিছু দুর্বলতা আছে আরও আছে তার মধ্যে ভুল করার প্রবনতা, এজন্যে সে অহংকারের সাথে বলছে, ‘তুমি কি চিন্তা করে দেখেছ ওই ব্যক্তিটি সম্পর্কে যাকে তুমি শ্রেষ্ঠত্ব দিলে আমার ওপর?’ (ঠিক আছে, যখন এমনই করলে তখন) যদি কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযােগ আমাকে তুমি দাও তাহলে (দেখতে পাবে) আমি তার বংশধরদেরকে অবশ্যই গােমরাহ করে ছাড়ব, কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বাদে-যাদের আমি ভুল পথে চালাতে পারবাে না… অর্থাৎ, ভাল কাজ থেকে আমি তাদের মুখ ফিরিয়ে দেবে, তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবাে, তাদেরকে আমি নিয়ন্ত্রণ করবাে এবং আমার অধীনে নিয়ে এসে যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবেই তাদের কাজকে আমি পরিচালনা করবাে। ইবলিস যখন দাবী করে ওপরের কথাগুলাে বলছিলাে তখন সে একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাে যে বাবা আদমের মধ্যে যেমন মন্দের প্রভাব গ্রহণের প্রবণতা আছে, তেমনি তার মধ্যে কল্যাণ ও হেদায়াতের পথ অনুসরণ করার যােগ্যতাও রয়েছে। বিশেষ করে আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে তিনি নিজেই তাে তার মর্যাদাকে উন্নীত করবেন, তাকে সম্মান দেবেন এবং অন্যায় ও ভুল পথ থেকে তাকে বাঁচাবেন, আর তিনি তাদের ওই সব ভুলভ্রান্তি থেকে নযর ফিরিয়ে নেবেন যেগুলাে সে ইচ্ছাকৃতভাবে করবে না। মর্যাদাবান বানানাের সাথে সাথে ভুলভ্রান্তি হয়ে যাওয়ার প্রবণতাও এই বিশেষ সৃষ্টির মধ্যে তিনি নিজেই রেখে দিয়েছেন, কিন্তু পাশাপাশি তিনি তাকে এ যােগ্যতাও দিয়েছেন যে ভুল বুঝার পরপরই সে অনুতপ্ত হবে এবং জেনে বুঝে ও ইচ্ছা করে অন্যায় কাজ করবে না এবং অন্যায়ের ওপর জিদ ধরেও থাকবে না-সুতরাং দেখা যাচ্ছে এই বিস্ময়কর সৃষ্টির প্রকৃতির মধ্যে ইচ্ছা শক্তি ও তার প্রয়ােগই এক বিশেষ রহস্যময় জিনিস যা তাকে অন্যান্য সবার ওপর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। অবশ্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর মর্জিতে একথাও এসেছে যে, অন্যায় ও অনিষ্টের দূত ইবলিস মানব জাতিকে অন্যায় পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করতে পারে। সাথে সাথে যারা তার অনুসরণ করবে তাদেরকেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তিনি বললেন, বেরিয়ে যাও এখান থেকে, যারা তােমার অনুসরণ করবে, তােমাদের সেই সকল ব্যক্তির জন্যে জাহান্নাম হচ্ছে সমুচিত প্রতিদান।’ অর্থাৎ, ঠিক আছে ওদেরকে বিপথগামী করার প্রচেষ্টা চালানাের স্বাধীনতা তােমাকে দেয়া হলাে। এই স্বাধীনতা নিয়ে তুমি তােমার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাও, তবে তােমার জেনে রাখা দরকার আমার প্রিয়তম সৃষ্টি মানুষকে আমি জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রবল ইচ্ছা শক্তি দ্বারা ভূষিত করেছি, তাদেরকে যে মযবুত ইচ্ছা শক্তির স্বাধীনতা দিয়েছে তা ব্যবহার না করে যেমন তারা তােমার অনুগামী হবে তেমনি সে স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে তারা তোমাকে অস্বীকারও করতে পারবে। অতপর, ওদের মধ্যে যে কোনাে ব্যক্তি তােমার অনুসরণ করবে অর্থাৎ, হেদায়াতের পথের তুলনায় যারা যারা ভুল পথের দিকে ঝুকে থাকবে, মহা দয়াময় আল্লাহর আহবানে সাড়া না দিয়ে যারা শয়তানের ডাকে সাড়া দেবে, যারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নিদর্শনগুলাে থেকে উদাসীন থাকবে এবং রেসালাত সম্পর্কিত আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে ভ্রুক্ষেপ করবে না। ‘তােমাদের সেই সব ব্যক্তিদের জন্যে রয়েছে জাহান্নাম।’ অর্থাৎ, হে অভিশপ্ত শয়তান, তােমার জন্যে ও তােমার অনুসারীদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামই সমুচিত প্রতিদান। এরশাদ হচ্ছে, ‘এদের মধ্যে যাকেই পার তােমার কথা দ্বারা গােমরাহ করে দাও। তােমার অশ্বারােহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তার ওপর গিয়ে চড়াও হও।’ অর্থাৎ, ভুল পথে চালিত করার জন্যে শয়তান যতাে প্রকার উপায়-উপকরণ অবলম্বন করতে পারে সে সব পন্থা পদ্ধতিগুলােকে ওপরের কথাগুলাের মাধ্যমে যেন বাস্তব রূপ দেয়া হয়েছে। অন্তর, চেতনা ও বুদ্ধিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করা এসব কথা দ্বারা হয়েছে। আসলে আদম সন্তানদের সাথে শয়তানের সাথে চলছে অবিরত এক কঠিন যুদ্ধ। এ যুদ্ধে শয়তান তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নানা প্রকার অস্ত্র ব্যবহার করে চলেছে, যেমন করে বাস্তব কোনাে যুদ্ধে ব্যবহৃত হয় নানা প্রকার অস্ত্র। যেমন কঠিন শব্দ, ঘােড় সওয়ার বাহিনী ও পদাতিক বাহিনী। শব্দের অহংকার ধ্বনিতে শত্রুদের উজ্জীবিত ও উত্তেজিত করা হয় এবং তাদেরকে কেল্লা থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য করা হয়; অথবা প্রচন্ড শব্দের ঝংকারে শত্রু বাহিনীর মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং যখন তারা প্রতিপক্ষের প্রচন্ড শব্দে আতংকিত হয়ে দিক-বিদিক জ্ঞান হারা হয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করে দেয়, তখন তাদের অশ্বারােহী বাহিনী ঘিরে ফেলে এবং পদাতিক বাহিনীর সৈন্যরা সাক্ষাত আক্রমণে তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে থাকে। এরপর এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তুমি শরীক হয়ে যাও তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে।’ এই শরীক হওয়া-কথাটি জাহেলী যুগে পৌত্তলিকতাপূর্ণ যে সমাজ ছিলাে তারই চিত্র তুলে ধরেছে। ওই পৌত্তলিক সমাজের লােকেরা তাদের অলীক ও কাল্পনিক দেব-দেবীদের জন্যে নিজেদের সম্পদের একটি ভাগকে আলাদা করে দিত অনেক সময়ে তাদের নামে অনেক কিছুই উৎসর্গ করতাে। প্রকৃতপক্ষে ঐটি হতাে শয়তানের জন্যে। তারা তাদের সন্তানদের মধ্যে কোনাে কোনাে বাচ্চাকে দেবতার নামে মানত করে বা উৎসর্গ করতে, অথবা দেবতার সেবাদাস বানিয়ে দিতাে। প্রকৃত পক্ষে এগুলােও হতাে শয়তানেরই জন্যে, যেমন বলা হয়েছে, লাত-এর গােলাম, উযযার গােলাম বা মানাত-এর গােলাম, আর কখনও তারা সরাসরি শয়তানের নামেই ছেড়ে দিয়ে সেইভাবে তার নামকরণ করতাে; যেমন আব্দুল হারেস। এমনি করে-হারাম বা অবৈধভাবে অর্জিত ধন-সম্পদ, নাহক ভাবে ব্যয়িত সোনা-দানা-টাকা-পয়সা, অপরাধজনক কাজের জন্যে নিয়ােজিত সম্পদ-সম্পত্তি, অন্যায় ও অবৈধভাবে প্রাপ্ত সন্তান ইত্যাদির মধ্যেও শয়তানের জন্যে একটা হিসসা তারা বরাদ্দ করতাে। এসব কিছুর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দেখা যায়, শয়তানের ভক্তরা তাদের গুরুর সাথে সম্পদ ও সন্তানের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়াকেই কাল্পনিকভাবে জীবনের জন্যে কল্যাণকর ও সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করতাে; তারা মনে করতাে এই ভাগাভাগির মধ্যে রয়েছে তাদের জীবনের সাফল্যের চাবিকাঠি। মানুষকে গােমরাহ করার জন্যে ইবলিসকে সব রকমের উপায় উপাদান ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ সবের মধ্যে মানুষকে আবেগমুগ্ধ করে ধোকার মধ্যে ফেলার শক্তি শয়তানের এক মােক্ষম হাতিয়ার। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর তাদের সাথে তুমি ওয়াদা করাে, (হে মােমেনগণ জেনে রেখাে) অবশ্যই শয়তানের ওয়াদা ধোকা ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।’ যেমন শাস্তি দেওয়া হবে না প্রতিশােধও নেওয়া হবে না বলে ওয়াদা করা হয়েছে। আবার হারাম উপায় উপকরণ ব্যবহার করার মাধ্যমে স্বচ্ছলতা আসবে এবং ধোকাবাজি, মন্দ ব্যবহার ও অসচ্চরিত্রতার মাধ্যমে আসবে বিজয় ও সাফল্য। আর সম্ভবত সব থেকে অপরাধ ও ভুলভ্রান্তি যাইই করা হােক না কেন এক সময় সব ক্ষমা করে দেয়া হবে। এইই হচ্ছে সেই সুড়ংগ পথ যার ভিতর দিয়ে বহু হৃদয়ের মধ্যে শয়তান প্রবেশ করে, আর এই ধোকাপ্রাপ্ত হৃদয়গুলােই তাদেরকে অপরাধ এবং মারাত্মক দোষগুলাে করতে উঙ্কানি দেয়। এমনই দুর্বলতার অবস্থায় তাদের প্রবৃত্তি মন্দ কাজ ও মন্দ ব্যবহারে লিপ্ত হয়ে যায়, তখন তাদের কাছে অপরাধজনক কাজগুলাে সুন্দর ও শােভনীয় মনে হয় এবং তাদেরকে জানায় যে, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা করার ক্ষমতা এতাে প্রশস্ত যার কোনাে সীমা নেই। একথা মনে করে অন্যায় কাজ করতে থাকা এবং চিন্তা করা যে তিনি যখন এতাে দয়াময় তখন মাফ তাে অবশ্যই করবেন। কাজেই আমাদের অন্যায় কাজে লিপ্ত থাকাতে কোনো অসুবিধা নেই এটাই হচ্ছে অন্যায় কাজ করার জন্যে সুড়ং পথ তালাশ করা! এহেন মানুষের জন্যে আল্লাহর কথা, যে যে ব্যক্তি তােমার দিকে ঝুকে থাকবে তাদেরকে ধোকা দিয়ে তােমার পথে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুমতি দেয়া হলাে। কিন্তু তুমি এমনও এক দল লােক দেখতে পাবে যার ওপর তােমার কোনাে ক্ষমতা খাটবে না, কারণ তাদের রয়েছে এমন এক মযবুত কেল্লাহ যা তাদেরকে রক্ষা করবে তােমার অশ্ববাহিনী এবং তােমার পদাতিক বাহিনী থেকে। অবশ্যই যারা আমার অনুগত বান্দা তাদের ওপর তােমার কোনাে ক্ষমতা নেই-আর অভিভাবক হিসাবে তােমার প্রতিপালকই যথেষ্ট। সুতরাং যখন কোনাে অন্তর আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত হয়ে যায় এবং তার আনুগত্য করার মাধ্যমে তার দিকে ঝুঁকে থাকে, যখন সে বান্দা এমন এক রশি দ্বারা নিজেকে বেঁধে রাখে যা কোনাে দিন ছিড়বার নয়, যখন সে তার অন্তরের মধ্যে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মােহাব্বতের পরশ অনুভব করে এবং দেখতে পায় যে তার গােটা অস্তিত্ব আল্লাহর নূরের আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে, তখন আর মরদূদ শয়তানের কোনো জারিজুরিই তার ওপর খাটে না; যেহেতু সে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত হয়ে গেছে। অবশ্যই এমন সব আত্মা ঈমানের আলােকে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে, ‘তাদের জন্যে তােমার রব অভিভাবক হিসাবে যথেষ্ট’। তিনি তাদের বাচাবেন, তিনিই তাদেরকে সাহায্য করবেন এবং শয়তানের যাবতীয় ষড়যন্ত্রকে অবশ্যই তিনি বানচাল করে দেবেন। সদা-সর্বদা শয়তানের প্রতিশ্রুতি এগিয়ে চলেছে, প্রতিনিয়ত সে চেষ্টা করে যাচ্ছে আল্লাহর অনুগত বান্দাদেরকে বশীভূত করার জন্যে; কিন্তু যারা প্রকৃতপক্ষে করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর বান্দা, তাদের ওপর ওর কোনােই ক্ষমতা নেই এবং ভবিষ্যতেও কোনাে দিন থাকবে না।

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৬১-৬৫ নং আয়াতের তাফসীর:

উক্ত আয়াতগুলোতে ইবলীস শয়তানের কঠিন শত্র“তা ও মানুষকে পথভ্রষ্ট করণে তার উদ্দীপনা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেকে অবগত করছেন। আল্লাহ তা‘আলা আদম (عليه السلام)-কে স্বহস্তে সৃষ্টি করার পর সকল ফেরেশতাকে সিজদা করার নির্দেশ দিলে সকলেই সিজদা করল কিন্তু ইবলীস আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশের অবাধ্য হল এবং অহংকার করল। যেমন সূরা বাকারার ৩৪ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। ইবলীস বলল: যাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন তাকে আমি সিজদা করব? এ অস্বীকারের কারণ হল ইবলীস আগুনের তৈরি। এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ১১-১২ নং আয়াতে আলোচনা রয়েছে।

ইবলীস বলল: أَرَأَيْتَكَ অর্থাৎ আমাকে বলুন, কিভাবে আমার ওপর তাকে সম্মান দিয়েছেন? অথচ আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, আবার তাকে সিজদাও দিতে বলছেন। لَأَحْتَنِكَنَّ এর অর্থ: ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইবলীস বলল: আমি তাদের ওপর কৃর্তত্ব প্রতিষ্ঠিত করব। মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: আমি তাদেরকে আমার দলে শামিল করে নেব। ইবনু যায়েদ বলেন: আমি তাদেরকে পথভ্রষ্ট করব। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: সবগুলোর অর্থ কাছাকাছি। অর্থাৎ পথভ্রষ্ট ও ধোঁকা দিয়ে তাদেরকে সমূলে ধবংসের দিকে নিয়ে যাব। তবে অল্প সংখ্যক ব্যতীত, তারাই হল আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা। যেমন সূরা হিজর ৪০ নং আয়াতে বলা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা তাকে ভর্ৎসনার সাথে বের করে দিলেন এবং বললেন: মানুষ ও জিনদের মাঝে যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের পরিণাম হল জাহান্নাম।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِيْنَ‏)‏

“অবশ্যই আমি জাহান্নাম পূর্ণ করব তোমাকে দিয়ে এবং তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের সবাইকে দিয়ে।” (সূরা স্ব-দ ৩৮:৮৫)

اسْتَفْزِز, أَجْلِبْ, شَارِكْهُمْ,

এ সব ক্রিয়া আল্লাহ তা‘আলা ধমক দেয়ার জন্য ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ যাকে পারিস তোর আওয়াজ দ্বারা সত্যচ্যুত কর। আওয়াজ বলতে প্রত্যেক প্রতারণামূলক আহ্বান অথবা গান-বাজনা ও রঙ-তামাশা ও পাপ কাজের দিকে সকল আহ্বান।

অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী বলতে যারা আরোহন করে ও হেঁটে পাপ কাজের দিকে ধাবিত হয় তারা সবাই শয়তানের অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী। ধন-মালে শয়তানের অংশ গ্রহণের অর্থ হল- অবৈধ পন্থায় মাল উপার্জন করা এবং হারাম পথে ব্যয় করা। অনুরূপ মূর্তির নামে পশু উৎসর্গ করা।

আর সন্তান-সন্ততিতে শরীক হওয়ার অর্থ হল ব্যভিচার করা, ইসলামী নাম ব্যতীত অনৈসলামিক নাম রাখা, অনৈসলামী আদব-কায়দায় তাদেরকে লালন পালন করা, যাতে তারা দুশ্চরিত্রবান হয়। অভাবের ভয়ে তাদেরকে হত্যা করা, অথবা জীবিত প্রোথিত করা, সন্তানদেরকে অগ্নিপূজক, ইয়াহূদী, খ্রিস্টান ইত্যাদি বানানো। এমনকি শয়তান মানুষের খাবার, পানীয় ও সহবাসের ক্ষেত্রেও শরীক হয় যখন বিসমিল্লাহ না বলে শুরু করে।

সবশেষে আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, শয়তানের ধোঁকায় পড়ো না, কারণ সে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা সব ধোঁকা। শয়তানের ধোঁকা থেকে রক্ষা পায় কেবল তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা। তাই আল্লাহ তা‘আলার একনিষ্ঠ বান্দা হওয়ার মাধ্যমে শয়তানের ধোঁকা থেকে নিজেকে রক্ষা করে জাহান্নাম থেকে মুক্ত হতে হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. সন্তান-সন্ততিকে অনৈসলামিক পন্থায় লালন-পালন করা, শয়তানের পথে পরিচালিত করার শামিল।
২. শয়তান মানুষের চিরশত্র“, তাই তার অনুসরণ করা যাবে না।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

#
আল্লাহ তাআলা মানুষকে ইবলীসের প্রাচীন শত্রুতা সম্পর্কে সতর্ক করতে গিয়ে বলছেনঃ “দেখো, এই শয়তান তোমাদের পিতা হযরত আদমের (আঃ) প্রকাশ্য শত্রু ছিল। তার সন্তানরা অনুরূপ ভাবে বরাবরই তোমাদের শত্রু। সিজদার নির্দেশ শুনে সমস্ত ফেরেশতা বিনা বাক্য ব্যয়ে হযরত আদমের (আঃ) সামনে মাথা নত করে। কিন্তু ইবলীস গর্ব প্রকাশ করে এবং তাঁকে তুচ্ছ জ্ঞানে সিজদা করতে অস্বীকৃতি জানায়।” সে বলেঃ “যাকে আপনি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন তার সামনে আমার মাথা নত হবে এটা অসম্ভব। আমি তো তার চেয়ে উত্তম। আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুন দ্বারা, আর তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি দ্বারা। অতঃপর সে মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহর সামনে সম্পর্ধা দেখিয়ে বলেঃ আচ্ছা, আপনি যে আদমকে (আঃ) আমার উপর মর্যাদা দান করলেন তাতে কি হলো? জেনে রাখুন যে, আমি তাঁর সন্তানদেরকে ধ্বংস করে ছাড়বো। তাদের সকলকেই আমি আমার অনুগত বানিয়ে নিবো এবং তাদের কে পথভ্রষ্ট করবো। অল্প কিছুলোক আমার ফাঁদ থেকে ছুটে যাবে বটে, কিন্তু অধিকাংশকেই আমি ধ্বংস করে ফেলবো।

# ৬৩-৬৫ নং আয়াতের তাফসীর

ইবলীস আল্লাহ তাআলার কাছে অবকাশ চায়, তিনি তা মঞ্জুর করে নেন। ইরশাদ হয়ঃ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোকে অবকাশ দেয়া হলো। তোর ও তোর অনুসারীদের দুষ্কর্যের প্রতিফল হচ্ছে জাহান্নাম, যা পূর্ণ শাস্তি। তোর আহবান দ্বারা তুই যাকে পারিস বিভ্রান্ত কর অর্থাৎ গান, তামাশা দ্বারা তাদেরকে বিপথগামী করতে থাক। যে কোন শব্দ আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতার দিকে আহ্বান করে সেটাই শয়তানী শব্দ। অনুরূপভাবে তুই তোর পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা যার উপর পারিস আক্রমণ চালা। শব্দটি শব্দের বহুবচন। যেমন শব্দের বহুবচন এবং শব্দের বহু বচন এসে থাকে। ভাবার্থ হচ্ছেঃ হে শয়তান! তোর সাধ্যমত তুই তাদের উপর তোর আধিপত্য ও ক্ষমতা প্রয়োগ কর। এটা হলো আমরে কী, নিদের্শ সূচক আমর নয়। শয়তানদের অভ্যাস এটাই যে, তারা আল্লাহর বান্দাদেরকে উত্তেজিত ও বিভ্রান্ত করতে থাকে। তাদেরকে পাপকার্যে উৎসাহিত করে। আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতার কাজে যে ব্যক্তি সওয়ারীর উপর চলে বা পদব্রজে চলে সে শয়তানের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। এইরূপ মানবও রয়েছে এবং দানবও রয়েছে; যারা শয়তানের অনুগত। যখন কারো উপর শব্দ উঠানো হয় বা কাউকে আহবান করা হয় তখন আরববাসী বলেঃ (আরবি) অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তিকে সশব্দে আহবান করেছে। আল্লাহ তাআলার এই নিদের্শ এখানে এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এটা ঘোড়া দৌড়ের ‘জালব’ নয়। ওটাও এর থেকেই নির্গত হয়েছে (আরবি) শব্দটিও এর থেকেই বের হয়েছে। অর্থাৎ শব্দ উচ্চ হওয়া।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ হে ইবলীস! তুই তাদের ধন-মালে ও সন্তানসন্ততিতেও শরীক থাক। অর্থাৎ তুই তাদেরকে তাদের মাল আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে খরচ করাতে থাক। যেমন তারা সূদ খাবে, হারাম উপায়ে মাল জমা করবে এবং হারাম কাজে তা ব্যয় করবে। হালাল জন্তুগুলিকে তারা হারাম করে নেবে ইত্যাদি। আর সন্তান সন্ততিতে তার শরীক হওয়ার অর্থ হলোঃ যেমন ব্যভিচারের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হওয়া, বাল্যকালে অজ্ঞতা বশতঃ পিতা-মাতারা তাদের সন্তানকে জীবন্ত প্রোথিত করা, তাদের ইয়াহূদী, খৃস্টান, মাজুসী ইত্যাদি বানিয়ে দেয় সন্তানদের নাম আবদুল হারিস, আবদুশশামস, আবদে ফুলান (অমুকের দাস) ইত্যাদি রাখা। মোট কথা, যে কোন ভাবে শয়তানকে তাতে সঙ্গী করে নিলো। এটাই হচ্ছে সন্তান-সন্ততিতে শয়তানের শরীক হওয়া।

সহীহ মুসিলমে বর্ণিত আছে যে, মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ “আমি আমার বন্দাদেরকে একনিষ্ঠ একত্ববাদী করে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান এসে তাদেরকে বিভ্রান্ত করে দেয় এবং হালাল জিনিসগুলিকে তারা হারাম বানিয়ে নেয়।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের কেউ যখন তার স্ত্রীর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা করবে তখন যেন সে পাঠ করেঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমাদেরকে আপনি শয়তান হতে রক্ষা করুন এবং তাকেও শয়তান হতে রক্ষা করুন যা আপনি আমাদেরকে দান করবেন।” এর ফলে যদি কোন সন্তান আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে টিকে যায়, তবে শয়তান কখনো তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।”

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ হে শয়তান! যা, তুই তাদেরকে মিথ্যা ওয়াদা-অঙ্গীকার দিতে থাক। কিয়ামতের দিন এই শয়তান তার অনুসারীদেরকে বলবেঃ “আল্লাহ তাআলার ওয়াদা ছিল সব সত্য, আর আমার ওয়াদা ছিল সব মিথ্যা।” তারপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমীর মু’মিন বান্দারা আমার রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে। আমি তাদেরকে বিতাড়িত শয়তান হতে রক্ষা করতে। থাকবো। আল্লাহর কর্মবিধান, তাঁর হিফাযত, তাঁর সাহায্য এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্যে যথেষ্ট।

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘মু’মিন শয়তানকে এমনভাবে আয়ত্তাধীন করে ফেলে যেমন কেউ কোন জন্তুকে লাগাম লাগিয়ে দিয়ে আয়ত্তাধীন করে থাকে।”

Leave a Reply