أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৬৫)
সুরা: আল্ বনি ইসরাইল
সুরা:১৭
৭১-৭২ নং আয়াত:-
[ وَمَن كَانَ فِي هَـذِهِ أَعْمَى
যে লোক ইহলোকে অন্ধ, .. ]
www.motaher21.net
یَوۡمَ نَدۡعُوۡا کُلَّ اُنَاسٍۭ بِاِمَامِہِمۡ ۚ فَمَنۡ اُوۡتِیَ کِتٰبَہٗ بِیَمِیۡنِہٖ فَاُولٰٓئِکَ یَقۡرَءُوۡنَ کِتٰبَہُمۡ وَ لَا یُظۡلَمُوۡنَ فَتِیۡلًا ﴿۷۱﴾
স্মরণ করুন সে দিনকে, যখন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের ইমাম সহ ডাকব। অতঃপর যাদের ডান হাতে তাদের ‘আমলনামা দেয়া হবে, তারা তাদের ‘আমলনামা পড়বে এবং তাদের উপর সামান্ন পরিমাণও যুলুম করা হবে না।
وَ مَنۡ کَانَ فِیۡ ہٰذِہٖۤ اَعۡمٰی فَہُوَ فِی الۡاٰخِرَۃِ اَعۡمٰی وَ اَضَلُّ سَبِیۡلًا ﴿۷۲﴾
যে লোক ইহলোকে অন্ধ, সে লোক পরলোকেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট।
৭১-৭২ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের নেতাদের সাথে আহ্বান করবেন। এখানে নেতা বলতে কী উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখ করা হল।
কেউ কেউ বলেন, এখানে ইমাম বা নেতা বলতে রাসূলদেরকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যেক উম্মতকে তাদের নাবীদের সাথে ডাকা হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلِكُلِّ أُمَّةٍ رَّسُوْلٌ ج فَإِذَا جَا۬ءَ رَسُوْلُهُمْ قُضِيَ بَيْنَهُمْ بِالْقِسْطِ وَهُمْ لَا يُظْلَمُوْنَ)
“প্রত্যেক জাতির জন্য (পাঠানো হয়েছে) একজন রাসূল এবং যখন তাদের রাসূল এসেছে তখন ন্যায়বিচারের সাথে তাদের মীমাংসা হয়েছে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হয়নি।” (সূরা ইউনুস ১২:৪৭)
এ সম্পর্কে সূরা যুমার ৬৯ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।
কারো মতে এখানে ইমাম বা নেতা বলতে আসমানী কিতাব বুঝানো হয়েছে। যা তাদের নাবীদের ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে। অর্থাৎ হে তাওরাতধারী! হে ইঞ্জিলধারী! হে কুরআনধারী! ইত্যাদি বলে ডাকা হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَتَرٰی کُلَّ اُمَّةٍ جَاثِیَةً ﺨ کُلُّ اُمَّةٍ تُدْعٰٓی اِلٰی کِتٰبِھَاﺚ اَلْیَوْمَ تُجْزَوْنَ مَا کُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَﭫ)
“এবং প্রত্যেক সম্পদায়কে দেখবে (ভয়ে) নতজানু, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার কিতাবের প্রতি আহ্বান করা হবে, আজ তোমাদেরকে তারই বিনিময় দেয়া হবে যা তোমরা করতে।” (সূরা জাসিয়া ৪৫:২৮)
আবার কারো মতে ‘ইমাম’ দ্বারা এখানে আমলের কিতাব। তাদের দলীল, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَأَمَّا مَنْ أُوْتِيَ كِتٰبَه۫ بِيَمِيْنِه۪ لا فَيَقُوْلُ هَآؤُمُ اقْرَئُوْا كِتٰبِيَهْ)
“অতঃপর যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: নাও, আমার আমলনামা পড়ে দেখো; (সূরা হাক্বাহ ৬৯:১৯)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنٰهُ فِيْٓ إِمَامٍ مُّبِيْنٍ)
আমি প্রত্যেক বস্তু স্পষ্ট কিতাবে হিফাযত করে রেখেছি। (সূরা ইয়াসিন ৩৬:১৩)
তবে এখানে ইমাম বলতে আমলনামাকে বুঝানো হয়েছে, এটাই সঠিক। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যে লোক ইহকালে অন্ধ সে আখিরাতেও অন্ধ। এখানে অন্ধ বলতে দুনিয়াতে যে চোখে দেখে না তাকে বুঝানো হয়নি, বরং যে সত্য জিনিস দেখেও দেখে না, বুঝেও বুঝে না তারা আখিরাতে অন্ধ হবে। তারা বলবে, হে আল্লাহ তা‘আলা! আমাদেরকে অন্ধ করে হাশর করলেন কেন?
আল্লাহ তা‘আলা বলবেন:
(قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِيْٓ أَعْمٰي وَقَدْ كُنْتُ بَصِيْرًا - قَالَ كَذٰلِكَ أَتَتْكَ اٰيٰتُنَا فَنَسِيْتَهَا ج وَكَذٰلِكَ الْيَوْمَ تُنْسٰي)
“সে বলবে: ‘হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলে? আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান।’
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘এরূপই আমার নিদর্শনাবলী তোমার নিকট এসেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবে আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হচ্ছে।’’ (সূরা ত্বা-হা- ২০:১২৫)
সুতরাং যারা দুনিয়াতে সত্য বিমুখ হবে আখিরাতে তাদের এ শাস্তি দেয়া হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মানুষকে মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করা হবে।
২. প্রত্যেক জাতিকে তাদের নেতাদের সাথে ডাকা হবে।
৩. কিয়ামতের দিন কারো প্রতি কোন জুলুম, অত্যাচার করা হবে না, প্রত্যেককে উপযুক্ত প্রতিদান দেয়া হবে।
৪. যারা দুনিয়াতে সত্য বিমুখ তারা আখিরাতেও সত্য থেকে বিমুখ হবে এবং অন্ধ অবস্থায় উঠবে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় একথা বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন নেক লোকদের আমলনামা তাদের ডান হাতে দেয়া হবে এবং তারা সানন্দে তা দেখতে থাকবে বরং অন্যদেরকেও দেখাবে। অন্যদিকে অসৎলোকদের দুষ্কৃতির তালিকা তাদের বাঁ হাতে দেয়া হবে এবং তারা তা পাওয়ার সাথে সাথেই পেছন দিকে লুকাবার চেষ্টা করবে। এ প্রসঙ্গে দেখুন সূরা আল হাক্কাহ ১৯-২৮ এবং ইনশিকাক ৭-১৩ আয়াত।
# সুরা: আল-হাক্বাহ্
আয়াত নং :-১৯
فَاَمَّا مَنْ اُوْتِیَ كِتٰبَهٗ بِیَمِیْنِهٖ١ۙ فَیَقُوْلُ هَآؤُمُ اقْرَءُوْا كِتٰبِیَهْۚ
সে সময় যাকে তার আমলনামা ডান হতে দেয়া হবে, সে বলবেঃ নাও, আমার আমলনামা পড়ে দেখো।
তাফসীর :
# ডান হাতে আমলনামা দেয়ার অর্থই হবে তার হিসেব-নিকেশ অত্যন্ত পরিষ্কার। আর সে আল্লাহ তাআলার আদালতে অপরাধী হিসেবে নয়, বরং একজন সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে উপস্থিত হতে যাচ্ছে। অধিকতর সম্ভাবনা হলো, আমলনামা দেয়ার সময়ই সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষগুলো নিজেরাই ডান হাত বাড়িয়ে আমলনামা গ্রহণ করবে কারণ মৃত্যুর সময় থেকে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হওয়ার সময় পর্যন্ত তার সাথে যে আচরণ করা হবে তাতে তার মনে এতটা আস্থা ও প্রশান্তি থাকবে যে, সে মনে করবে আমাকে এখানে পুরস্কার প্রদানের জন্য হাজির করা হচ্ছে, শাস্তিদানের জন্য নয়। একজন মানুষ সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরপারে যাত্রা করছে, না অসৎ ও পাপী হিসেবে যাত্রা করছে মৃত্যুর সময় থেকেই তা তার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। একথাটি কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তাছাড়া মৃত্যুর সময় থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত একজন নেককার মানুষের সাথে সম্মানিত মেহমানের মত আচরণ করা হয়। কিন্তু একজন অসৎ ও বদকার মানুষের সাথে আচরণ করা হয় অপরাধে অভিযুক্ত কয়েদীর মত। এরপর কিয়ামতের দিন আখেরাতের জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই নেককার মানুষের জীবন যাপনের ধরন-ধারণাই পাল্টে যায়। একইভাবে কাফের, মুনাফিকও পাপীদের জীবন যাপনের ধরনও ভিন্ন রূপ হয়ে যায়। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কোরআন, সূরা আনফাল, আয়াত ৫০ ; আল নাহল, আয়াত ২৮ ও ৩২ এবং টীকা ২৬ ; বনী ইসরাঈল, আয়াত ৯৭ ; ত্বা-হা আয়াত ১০২, ১০৩ ও ১২৪ থেকে ১২৬ এবং টীকা ৭৯ , ৮০ ও ১০৭ ; আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৩ টীকা ৯৮ ;আল ফুরকান, আয়াত ২৪ ও টীকা ৩৮ ; আন নামল, আয়াত ৮৯ ও টীকা ১০৯ ; সাবা আয়াত ৫১ ও টীকা৭২ ; ইয়াসীন, আয়াত ২৬ও ২৭ এবং টীকা ২২-৩২; আল মু’মিন আয়াত ৪৫ ও ৪৬ এবং টীকা ৬৩ ; মুহাম্মাদ, আয়াত ২৭ এবং টীকা ৩৭ ; ক্বাফ, আয়াত ১৯থেকে ২৩ পর্যন্ত টীকা ২২ , ২৩ ও ২৫ )।
# আমলনামা পাওয়ার সাথে সাথেই তারা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে এবং নিজের বন্ধু-বান্ধবদের তা দেখাবে। সূরা ইনশিকাকের ৯ আয়াতে বলা হয়েছে যে, “সে আনন্দ চিত্তে আপনজনদের কাছে ফিরে যাবে। “
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
# এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করে দেখাে সেদিনের কথা যেদিন আমি সকল জনপদকে তাদের নেতাদের সহকারে ডাকবাে… সে আখেরাতেও অন্ধ হয়ে থাকবে এবং সঠিক পথ থেকে সে অনেক দূরে সরে থাকবে।’ এমন একটি দৃশ্যের ছবি এখানে আঁকা হচ্ছে যার মধ্যে যেন দেখা যাচ্ছে গােটা মানব গােষ্ঠী… জড় হয়ে রয়েছে এবং দেখা যাচ্ছে যেন প্রত্যেক জাতিকে তাদের পরিচয়বহ বিশেষ চিহ্ন ধরে ডাকা হচ্ছে, ডাকা হচ্ছে সেই পথের পথিক হিসাবে যে পথে তারা চলতাে, অথবা যে নবীর অনুসারী তারা ছিলাে সেই নবীর নাম ধরে তাদেরকে ডাকা হবে, বা দুনিয়ার বুকে যে নেতার অনুসরণ করে তারা জীবন যাপন করে সেই নেতাদের নাম ধরে তাদের অনুসারীদেরকে ডাকা হবে। ডাকা হবে তাদেরকে নিজেদের হাতে তাদের আমলনামা গ্রহণ করার জন্যে এবং ওই আমলনামাতে তাদের যে প্রতিদান প্রাপ্য হিসাবে লিপিবদ্ধ থাকবে তা গ্রহণ করার জন্যে। এ সময় যার ডান হাতে কিতাব দেয়া হবে, সে তার কিতাব নিয়ে পড়ে মহা খুশীতে উল্লসিত হবে এবং তখন তাকে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হবে, সে পাওনা থেকে তাদেরকে কিছুমাত্র কম দেয়া হবে না, এমন কি খেজুরের দানা বিভক্তকারী যে সূক্ষ্ম সূতার মতাে আঁশ আছে, ওই তুচ্ছ আঁশটির মতাে সামান্য পাওনাও তাকে কম দেয়া হবে না। আর যে ব্যক্তি সত্য থেকে অন্ধ হয়ে থাকবে অথবা আজ যে চোখ থাকতেও সত্যকে দেখতে পায় না, সেদিনের চুলচেরা বিচারের দিনেও সে আগের মতােই অন্ধ হয়ে থাকবে, কঠিন এক দেয়াল তুলে দেয়া হবে তার ও সত্যের মাঝে। তার প্রতিদান তাে জানাই আছে। কিন্তু ওই কঠিন ভীড়ের মধ্যে সে এমনই অন্ধ হয়ে থাকবে যে কোথায় যাবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারবে না, হয়রাণ পেরেশান হয়ে এদিক ওদিক গুঁতা খেতে থাকবে সেখানে এমন কাউকে পাবে না যে তাকে পথ দেখিয়ে আল্লাহর দরবারে নিয়ে যাবে বা সঠিক পথ-প্রদর্শন করবে। এমনি করে এমন অবস্থায় তাকে সেদিন ছেড়ে দেয়া হবে যে সে কোনাে কিছুই স্থির করতে পারবে না, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেদিন সে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়াবে। কারণ সেদিনকার ওই কঠিন দিনে এইভাবে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ানােই হবে নিজেকে জীবদ্দশায় অন্ধ ও পথভ্রষ্ট রাখার এক করুণ পরিণাম। আল্লাহর পাক কালামে ওই অন্তর এ বর্ণনায় অভিভূত হয়ে পড়ে। এজন্যে বুদ্ধিমান মানুষের আজকে বড় প্রয়ােজন, সময় থাকতে এ সব আয়াত অধ্যয়ন করা বা কারাে মুখ থেকে এ আয়াতগুলাে শ্রবণ করা।
# *অপরাধীদের শাস্তি ও মুমিনের পুরস্কার : এরপর পেশ করা হচ্ছে মুক্তিপ্রাপ্তদের ও দন্ডিতদের দৃশ্য। দৃশ্যটা একেবারেই চাক্ষুস ও প্রত্যক্ষ বলে মনে হয়! ‘অতপর যাকে তার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে সে বলবে, এই যে আমার আমলনামা, তােমরা পড়ে দেখো। আমার যে হিসাব নিকাশ হবে, সে ব্যাপারে আমার অটল বিশ্বাস ছিল। অতঃপর সে বড়ই আরামদায়ক ও সুখকর জীবন যাপন করবে।… তোমরা সৎ কাজ করেছিলে।’ আমলনামা ডান হাতে, বাম হাতে ও পিঠের পেছন দিয়ে পাওয়া আক্ষরিকভাবে বাস্তব ব্যাপার হতে পারে, অথবা রূপক বাগধারা হতে পারে। আরবীর প্রচলিত পরিভাষায় ভালাে জিনিসকে ডান এবং খারাপ জিনিসকে বাম বা পেছনের জিনিস বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যেটাই বুঝানাে হােক না কেন, এ দ্বারা মূল দৃশ্য একই থাকে। মূল দৃশ্য এই যে, মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি সেই সংকটময় দিনে নিজের আনন্দ-উল্লাস সমবেত জনতার মাঝে এভাবে প্রকাশ করবে যে, এই আমার আমলনামা। এটা পড়ে দেখো। তারপর আরাে আনন্দের সাথে বলবে যে, আমি এতাে সহজে মুক্তি পেয়ে যাবাে ভাবিনি। আমার বিশ্বাস ছিলাে আমাকে পুংখানুপুংখ হিসাবের সম্মুখীন হতে হবে। হযরত আয়েশা(রা.) বর্ণিত হাদীসে আছে যে, রসূল(স.) বলেছেন, যার হিসাব কড়াকড়িভাবে পর্যালােচনা করা হবে, তার শাস্তি হবে। হযরত আয়েশা(রা.) বললেন, ইয়া রসূলুল্লাহ! আল্লাহ কি বলেননি যে, যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব সহজ করা হবে এবং সে তার পরিবার পরিজনের কাছে আনন্দিত অবস্থায় ফিরে যাবে?’ রসূল(স.) বললেন, ওটা হলাে শুধু হাযির হওয়ার ব্যাপার। সুক্ষ্মভাবে যার হিসাব নেয়া হবে সে রেহাই পাবে না।’ অর্থাৎ নেককারদের ভাসাভাসা হিসাব হবে। হযরত আবু ওসমান থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল(স.) বলেছেন, মােমেনকে তার ডান হাতে আমলনামা দেয়া হবে পর্দার আড়ালে। সে তার খারাপ কাজগুলাে পড়তে থাকবে আর সাথে সাথে তার মুখমন্ডলের বর্ণ বিকৃত হতে থাকবে। অবশেষে যখন তার সৎ কাজগুলাের বিবরণ পড়তে আরম্ভ করবে তখন তার মুখের বর্ণ স্বাভাবিক হয়ে আসবে। পুনরায় আমলনামার ওপর দৃষ্টি বুলাতেই দেখবে তার সকল খারাপ কাজ সৎ কাজে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। তখন সে বলে উঠবে, ‘তোমরা আমার আমলনামা পড়ো। ফেরেশতারা যার লাশ গােছল করিয়েছিলেন সেই ভাগ্যবান সাহাবী হযরত হানযালার ছেলে আব্দুল্লাহ(রা.) বর্ণনা করেন যে, রসূল(স.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা তার এক বান্দাকে কেয়ামতের দিন থামিয়ে তার আমলনামার ওপরে তার খারাপ কাজ দেখিয়ে বলবেন, তুমি কি এ কাজ করেছিলে? সে বলবে, হা। আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আমি এ জন্য তােমাকে অপমান করলাম না। তােমাকে মাফ করে দিলাম। তখনই সে বান্দা বলে উঠবে, ‘এই আমার আমলনামা । তােমরা পড়ে দেখাে। আমি বিশ্বাস করতাম যে, আমি হিসাবের সম্মুখীন হব।'[হযরত হানযালা ওহদ যুদ্ধে শহীদ হন। তার সম্পর্কে রসূল(স.) বললেন, তোমাদের এই সহকর্মীটিকে ফেরেশতারা গোসল করাচ্ছেন। সাহাবীরা কৌতুহলী হয়ে হানযালার পরিবারকে তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তার স্ত্রী বললেন, হানযালা জিহাদের ডাক শুনে যখন বেরিয়ে যান তখন তার গােসল ফরয ছিলাে। (বিস্তারিত বিবরণের জন্যে আল কোরআন একাডেমী লন্ডন বাংলাদেশ সেন্টার পরিবেশিত ‘আর রাহীকুল মাখতম’ গ্রন্থটি দেখুন।)] কেয়ামতের দিনের গােপন আলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে হযরত ইবনে ওমর(রা.) বলেন, আমি রাসূল(স.) কে বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার জনৈক বান্দাকে কাছে ডেকে নিয়ে তার সমস্ত গুনাহর স্বীকারােক্তি আদায় করবেন। এভাবে সে বান্দার ধারণা জন্মাবে যে, তার আর মুক্তির আশা নেই। তখন আল্লাহ তায়ালা বলবেন, আমি দুনিয়াতেও তােমার এ সব গুনাহ লুকিয়ে রেখেছিলাম। আর আজও তা মাফ করে দিচ্ছি। তারপর তার সৎ কাজের বিবরণ তার ডান হাতে দেবেন। পক্ষান্তরে কাফের ও মোনাফেক সম্পর্কে সাক্ষীরা বলবে যালেমদের ওপর আল্লাহর অভিসম্পাত!’ এরপর আল্লাহ তায়ালা সেই সাক্ষীদের সামনে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির জন্যে বরাদ্দকৃত নেয়ামত সমূহের নাম ঘোষণা করবেন। সে সব নেয়ামত হবে বাহ্যিক নেয়ামত, যা তখনকার শ্রোতাদের জন্যে উপযােগী হবে। কেননা তারা প্রথম জীবনে জাহেলিয়াতের অনুসারী ছিলাে। এ নেয়ামত সুদীর্ঘ কাল আগে ঈমান আনয়নকারীর জন্যে তৃপ্তিকর হবে না। তাকে দেয়া হবে আরাে উঁচু স্তরের ও মূল্যবান নেয়ামত। তাই বলা হয়েছে, ‘সে থাকবে তৃপ্তিকর জীবনে। উচ্চ বেহেস্তে। তার ফলসমূহ ঝুলতে থাকবে। বলা হবে, তােমরা অতীত দিনগুলােতে যে সৎ কাজ করে পাঠিয়েছাে, তার বিনিময়ে আজ যত খুশী পানাহার করাে।’ এ সম্ভাষণের মধ্য দিয়ে শুধু মােমেনদের নেয়ামতের উঁচু মানই ব্যক্ত হয়েছে তা নয়, বরং তাদের উচ্চ সম্মান ও মর্যাদাও প্রকাশ পেয়েছে। তবে যারা প্রাথমিক যুগে কোরআনের আহবানে সাড়া দিয়ে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সখ্যতা গড়ে তুলেছে, তারা এ সব নেয়ামতের চেয়েও মূল্যবান যে জিনিসটি পাবে তা হলাে আল্লাহর নৈকট্য ও ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে। এটাই মহাসত্য যে, আল্লাহর নৈকট্যই যুগে যুগে মানুষের বহু সমস্যার সমাধান করে দিয়ে থাকে, আর নেয়ামত তো হাজারাে রকমের হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তিকে বাম হাতে আমলনামা দেয়া হবে, সে তো বুঝতেই পারবে যে, তার খারাপ কাজগুলাের কঠোর হিসাব নেয়া হবে এবং তার আযাব থেকে রেহাই পাওয়ার কোনাে উপায় নেই। সে সেই বিশাল জনতার ভিড়ে হতাশা ও অনুতাপের গ্লানি নিয়ে বলতে থাকবে, হায়! আমার আমলনামা একেবারে না দিলেই ভালাে হতাে এবং আমার হিসাব যদি আদৌ না জানতাম তাহলেই ভালাে হতাে। হায়! আফসােস! প্রথম মৃত্যুই যদি আমার জন্যে চূড়ান্ত হতাে। আবার যদি জীবিত না হতে হতাে! তাহলে কতই না ভাল হতাে। আমার ধনসম্পদ কোনাো কাজে লাগলাে না। আমার প্রভাব প্রতিপত্তি সবই বিফলে গেলো। এটা হবে একটা দীর্ঘ একটানা বিবৃতি। দীর্ঘ হতাশার হা-হুতাশ। চরম অসহায়ত্বের চিত্র ফুটে ওঠেছে এর মধ্য দিয়ে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা ধারায় এ অবস্থাটাকে দীর্ঘস্থায়ী বলে চিত্রিত করা হয়েছে। মনে হয় যেন এর কোনাে শেষ নেই। এ হতাশা ও আক্ষেপ যেন অনন্তকাল ধরে চলবে। কোরআনের এ এক চমকপ্রদ বর্ণনাভংগী যে, কোনাে বিষয়কে সংক্ষেপে বর্ণনা করে আবার কোনােটার দীর্ঘ বিবরণ দেয়। এটা নির্ভর করে মানুষের মনে সে কি ধরনের ভাব বদ্ধমূল করতে চায় তার ওপর। এখানে সে সেই অনুতাপপূর্ণ দৃশ্যের মধ্য থেকে তার আক্ষেপ ও অনুশােচনার অবস্থাটাই শ্রোতার মনে বদ্ধমূল করতে চায়। তাই সে এটার একটু দীর্ঘ বর্ণনা দিয়েছে। সেই হতাশাগ্রস্ত লােকটি কি কি ভাববে আর কি কি বলে বিলাপ করবে তা সবিস্তারে তুলে ধরেছে। এই পরিস্থিতি মােটেই তার সামনে না পড়লে ভালাে হতাে, হিসাব নিকাশ না হয়ে যে মৃত্যু তার হয়েছিলাে, সেই মৃত অবস্থায় থাকতে পারলেই ঢের ভালো হতাে। তার এতাে সহায় সম্পদ, প্রভাব প্রতিপত্তি কোনাে কিছুই তার কাজে আসলাে না… ইত্যাদি কোরআন তার এই সমস্ত বিলাপােক্তির বিবরণ দিয়েছে।
# আমলনামা দেয়ার দু’টি পন্থা : উপরোক্ত সম্বোধনে এই বক্তব্য সুপ্ত রয়েছে, তাই চেষ্টা সাধনাকারীরা যখন তাদের পথের শেষ প্রান্তে পৌছবে, তখন তারা তার যথাযথ প্রতিদান লাভ করবে এবং শ্রম ও সাধনার পর প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে, তাই প্রত্যেকেরই উচিৎ এমন কাজ করা যাতে তার মালিক তার আমলনামা দেখে খুশি হন, তাইতো বলা হয়েছে- ‘যার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে তার হিসাব একান্ত সহজভাবেই গ্রহণ করা হবে । পক্ষান্তরে যে ব্যক্তিকে তার আমলনামা পেছন দিক থেকে দেয়া হবে।’ যাকে আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে সৌভাগ্যশালী এবং তার ওপর আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট। সে ব্যক্তি হচ্ছে ঈমান আনয়নকারী ও সংকর্মশীল ৷ আল্লাহ তায়ালা তার ওপর খুশী এবং তার জন্যে মুক্তির সিদ্ধান্ত লিখে দিয়েছেন তার হিসাব নিকাশ হাল্কা ও সহজ হবে, খুঁটিনাটির হিসাব নেয়া হবে না এবং তার কাছ থেকে কড়া হিসাব নেয়া হবে না । বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, যার পুংখানুপুংখ হিসাব নেয়া হবে সে আযাবে ভুগবে। আমি বললাম, আল্লাহ তায়ালা কি এ কথা বলেননি যে, তার হিসাব সহজ করা হবে? রসূলুল্লাহ (স.) বললেন, ওটা কোনো হিসাব নয়। ওটা কেবল উপস্থাপন করা । কেয়ামতের দিন যার হিসাব নিরীক্ষণ করা হবে, সে আযাব এড়াতে পারবে না।’ (বোখারী, মুসলিম, তিরমিমী, নাসায়ী) হযরত আয়েশা (রা.) থেকে আরো বর্ণীত আছে যে, রসূল (স.)-কে কোনো কোনো নামাযে বলতে শুনেছি যে, ‘হে আল্লাহ তায়ালা, আমার কাছ থেকে সহজ হিসাব নিও ।’ নামায শেষে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! সহজ হিসাব বলতে কী বুঝায়? রসূল (স.) বললেন, আল্লাহ তায়ালা কারো আমলনামার ওপর কেবল একটু নযর বুলালেন, তারপর ভুলত্রুটি উপেক্ষা করলেন- এটাই সহজ হিসাব । ওহে আয়েশা! যার হিসাব কড়াকড়িভাবে নেয়া হবে, তার সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ (আহমদ) এই হলো ডান হাতে আমলনামা প্রাপ্তদের সহজ হিসাব ৷ এরপর সে মুক্তি পাবে এবং ‘আপন পরিজনের কাছে আনন্দিত চিত্তে ফিরে যাবে ।’ অর্থাৎ তার যেসব আপনজন মুক্তি পেয়ে আগেই বেহেশতে প্রবেশ করেছে তাদের কাছে ফিরে যাবে। এ বক্তব্য দ্বারা বুঝা যায় যে, ঈমান ও সংকর্মশীলতার দিক দিয়ে যারা একই গোষ্ঠীভুক্ত, তারা বেহেশতে মিলিত হবে। আত্মীয় স্বজন ও প্রিয়জনদের ব্যাপারটাও তদ্রুপ ৷ এখানে যে দৃশ্যটি তুলে ধরা হয়েছে, তা হলো, হিসাব নিকাশের পর মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি এমন প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হবে, যারা কড়া হিসাবের সমস্যা সংকুল স্তর পার হয়ে জান্নাতে যাবে। এ সময় সে কি আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ করবে, তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত এই ব্যক্তির অবস্থা সেই ব্যক্তির অবস্থার ঠিক বিপরীত হবে, যাকে তার কুকর্মের জন্যে গ্রেফতার ও শাস্তি দিয়ে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হবে। তাকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার আমলনামা দেয়া হবে। ‘যাকে পেছন দিক থেকে আমলনামা দেয়া হবে, সে মৃত্যুকে ডাকবে এবং (ডাকতে ডাকতে) গিয়ে জলন্ত আগুনে পড়বে ।’ এ আয়াতটিতে সে কথাই বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আমরা সচরাচর দুটো পরিভাষার ব্যবহার দেখতে পাই, ডান হাতের আমলনামা ও বাম হাতের আমলনামা । কিন্তু এ আয়াতে একটা নতুন জিনিসের উল্লেখ করা হয়েছে। সেটি হচ্ছে, পেছন দিক থেকে প্রাপ্ত আমলনামা । সম্ভবত বাম হাতের আমলনামাটিই এভাবে কাউকে পেছন দিক থেকে দেয়া হবে৷ কেননা সে লজ্জায় আমলনামার মুখোমুখি হতে চাইবে না এবং তা নিতেও চাইবে না কিন্তু তাকে জোরপূর্বক তা পেছন দিক থেকে দেয়া হবে! আমরা অবশ্য জানিনা এই আমলনামাটি কি রকম আর কিভাবেই বা তা ডান হাত দিয়ে, বাম হাত দিয়ে বা পেছন দিক দিয়ে দেয়া হবে। তবে সোজা কথায় বুঝি যে, ডান হাত দিয়ে আমলনামা দেয়ার অর্থ মুক্তি আর বাম হাত দিয়ে আমলনামা দেয়ার অর্থ ধ্বংস ও বিনাশ ৷ এই দুটো তত্ত্বই বুঝে নেয়া ও বিশ্বাস করা আমাদের দায়িত্ব ৷ এছাড়া আর যে সব কথা বলা হয়েছে, তা শুধু আমাদের মনে কেয়ামতের ময়দানের দৃশ্য জাগরূক করা এবং চেতনায় তার সুদৃঢ় ছাপ অংকিত করার লক্ষ্যেই বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কি ঘটবে এবং কিভাবে ঘটবে, সেটা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন । বস্তুত যে ব্যক্তি পৃথিবীতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে আয়ুষ্কাল কাটিয়ে দিয়েছে, কিছু গুনাহ ও নাফরমানীর মধ্যে দিন কাটিয়েছে, সেই দুকুলহারা দেউলে ব্যক্তি নিজের পরিণতি কি হবে তা জানে। সে জানে যে, তার সকল শ্রম-সাধনা বৃথা গেছে এবং তার কষ্টের কোনো বিরতি ও শেষ সীমা নেই। তাই সে মৃত্যুকে ডাকবে। সে নিজের ধ্বংস কামনা করবে, যাতে তাকে তার অবধারিত দুর্ভাগ্যের মুখোমুখি হতে না হয়। আর মানুষ যখন মুক্তি লাভের জন্যে নিজের ধ্বংস ও মৃত্যু কামনা করে, তখন সে এমন একটা স্তরে উপনীত হয়, যেখানে তার আর কোনো কিছু থেকে সংযম অবলম্বন করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। তাই নিজের ধ্বংসই হয়ে দাড়ায় তার চূড়ান্ত বাসনা। কবি মুতানাব্বী তার একটি কবিতায় এ কথাটাই বলেছেন- ‘মৃত্যুকে যখন তুমি নিরাময়কারী হিসাবে বিবেচনা করো, তখন ব্যাধি হিসাবে সেটাই তোমার জন্যে যথেষ্ট। আর মৃত্যু যখন মানুষের কাম্য হয়ে দাড়ায়, তখন মৃত্যুই তার জন্যে যথেষ্ট’ বস্তুত এটা এমন দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয় যে, এর চেয়ে বড় আর কোনো দুর্ভাগ্য ও বিপর্যয় নেই । ‘সে আগুনে প্রবেশ করবে।’ এটাই তার অবধারিত পরিণতি ৷ এটা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যেই সে মৃত্যু কামনা করবে। কিন্তু সে আশা সুদূর পরাহত ৷ এই বিপর্যয়কর ও মর্মান্তিক দৃশ্যের বর্ণনা দেয়ার পরই এই দুর্ভাগা ব্যক্তির অতীতের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সেই অতীতই তাকে এই মর্মসুদ ও শোচনীয় পরিণতির সম্মুখীন করেছে। ‘সে তার পরিবার পরিজনদের মধ্যে আনন্দে মেতে থাকতো, সে ভাবতো যে তাকে আর কখনো ফিরে যেতে হবে না ।” সেটি ছিলো দুনিয়ার ব্যাপার । সত্যিই তার অবস্থা সেই রকম ছিলো। কিন্তু এখন আমরা এই কোরআনের বর্ণনা অনুসারে হিসাব-নিকাশ ও কর্মফল দিবসের মধ্যে আছি। দুনিয়ার জীবনকে আমরা স্থান ও কাল উভয়ের বিচারে অনেক দূরে ফেলে এসেছি। ‘সে তার পরিবার পরিজনদের মধ্যে আনন্দে মেতে থাকতো ।’ অর্থাৎ বর্তমান মুহূর্তটি বাদে আর সব কিছু সম্পর্কে উদাসীন থাকতো । আখেরাতে তার জন্যে কি পরিণতি অপেক্ষা করছে তা নিয়ে সে ভাবতো না। আর তাই সে জন্যে কোনো জবাবদিহীরও প্রয়োজন অনুভব করতো না। আর তার জন্যে সে কোনো প্রস্তুতিও নিতো না। সে ভাবতো যে, সে কখনো আপন স্রষ্টা ও প্রতিপালকের কাছে ফিরে যাবে না। শেষ মুহূর্তেও সে যদি চিন্তা করতো, তাহলে জবাবদিহীর জন্যে কিছুটা হলেও প্রস্তুতি নিতো । ‘হাঁ, তার প্রভু তার প্রতি দৃষ্টি রেখেছিলেন ।’ অর্থাৎ সে যদিও ভেবেছিলো যে, তার প্রতিপালকের কাছে তার ফিরে যেতে হবে না, কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তার মনিব তার ব্যাপারে ওয়াকেফহাল ছিলেন এবং তার চালচলন সবকিছুই পর্যবেক্ষন করছিলেন ৷ তিনি জানতেন যে, তাকে তার কাছে ফিরে আসতে হবেই এবং তাকে তার কৃতকর্মের প্রতিফল দেয়া হবেই । আর এই হতভাগা যখন পার্থিব জীবনে আপন পরিবার পরিজনের মধ্যে আনন্দে গা ভাসিয়ে চলে, তখন তার ঠিক সেই সৌভাগ্যশালী বেহেশতবাসীর বিপরীত অবস্থা হয়ে থাকে, যে আখেরাতের দীর্ঘস্থায়ী জীবনে আপন পরিবারের কাছে আনন্দ চিত্তে ফিরে যায়। লক্ষণীয় যে, প্রথমোক্ত ব্যক্তির পার্থিব জীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী, তেমনি তা কঠোর পরিশ্রমে পরিপূর্ণ-তা যে ধরনের পরিশ্রমই হোক না কেন। পক্ষান্তরে শেষোক্ত ব্যক্তির পরকালীন জীবন অনন্তকালব্যাপী স্থায়ী, সর্বাত্মক ও অবাধ স্বাধীনতায় অলংকৃত, চিত্তাকর্ষক ও মনোরম, নির্মল সুখ-শাস্তিতে পরিপূর্ণ এবং সর্বপ্রকারের শ্রম ও ক্লেশ থেকে মুক্ত ।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৭১-৭২ নং আয়াতের তাফসীর
এখানে ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য নবী। প্রত্যেক উম্মতকে কিয়ামতের দিন তাদের নবীসহ ডাকা হবে যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “প্রত্যেক উম্মতেরই রাসূল রয়েছে, যখন তাদের রাসূল আসবে তখন তাদের ন্যায়ের সাথে ফায়সালা করে দেয়া হবে এবং তাদের প্রতি জুলুম করা হবে না।” (১০:৪৭)
পূর্ব যুগীয় কোন কোন মনীষীর উক্তি রয়েছে যে, এতে আহলে হাদীসের খুবই বড় মর্যাদা রয়েছে। কেননা, তাঁদের ইমাম হলেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। ইবনু যায়েদ (রঃ) বলেন যে, এখানে ইমাম দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর কিতাব যা তাদের শরীয়তের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল। ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) এই তাফসীরকে খুবই পছন্দ করেছেন এবং এটাকেই মনোনীত বলেছেন। মজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের কিতাব। সম্ভবতঃ কিতাব দ্বারা উদ্দেশ্য আল্লাহর আহকামের কিতাব অথবা আমলনামা অর্থ নিয়েছেন। আবুল আলিয়া (রঃ), হাসান (রঃ) এবং যহহাক ও (রঃ) এটাই বলেন। আর এটাই বেশী প্রাধান্য প্রাপ্ত উক্তি। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ আমি প্রত্যেক বিষয়কে এক সমুজ্জ্বল কিতাবে সংরক্ষিত করে রেখেছি।” (৩৬:১২) অন্য আয়াতে আছেঃ
(আরবি) অর্থাৎ “কিতাব অর্থাৎ আমলনামা মধ্যস্থলে রেখে দেয়া হবে, এ সময় তুমি দেখবে যে, পাপীরা ওর মধ্যে লিখিত বিষয় দেখে ভীত সন্ত্রস্ত থাকবে।” (১৮:৪৯) অন্য আয়াতে রয়েছেঃ “প্রত্যেক উম্মতকে তুমি হাঁটুর ভরে পড়ে থাকতে দেখবে, প্রত্যেক উম্মতকে তার কিতাবের দিকে ডাকা হবে, (এবং বলা হবেঃ) আজ তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিফল দেয়া হবে। এটাই হচ্ছে। আমার কিতাব যা তোমাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফায়সালা করবে, তোমরা যা কিছু করতে আমি বরাবরই তা লিখে রাখতাম।” এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এই তাফসীর প্রথম তাফসীরের বিপরীত নয়। একদিকে আমলনামা হাতে থাকবে, অপর দিকে স্বয়ং নবী সামনে বিদ্যমান থাকবেন। যেমন কুরআন কারীমে ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “যমীন স্বীয় প্রতিপালকের নূরে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, আমলনামা রেখে দেয়া হবে এবং নবীদেরকে ও সাক্ষীদেরকে হাজির করে দেয়া হবে।” (৩৯:৬৯) অন্য একটি আয়াতে আছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “ঐ সময়েই বা কি অবস্থা হবে? যখন আমি প্রত্যেক উম্মত হতে এক একজন সাক্ষী উপস্থাপিত করবো এবং তোমাকে তাদের উপর সাক্ষীরূপে উপস্থিত করবো।” (৪:৪১) কিন্তু এখানে ইমাম দ্বারা আমলনামাই উদ্দেশ্য। এজন্যেই এরপরেই আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ যাদেরকে দক্ষিণ হস্তে তাদের আমলনামা দেয়া হবে তারা তাদের আমলনামা পাঠ করবে। এমন কি খুশীতে অন্যদেরকেও দেখাবে ও পাঠ করাবে। এরই আরো বর্ণনা সূরায়ে তে রয়েছে। দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঐ লম্বা সুতা যা খেজুরের আঁটির মধ্যে থাকে। বাযার (রঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেছেনঃ “একটি লোককে ডেকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়াহবে। তখন তার দেহ বেড়ে যাবে, চেহারা উজ্জ্বল হবে এবং মাথায় উজ্জ্বলহীরার মুকুট পরিয়ে দেয়া হবে। সে তার দলীয় লোকদের দিকে এগিয়ে যাবে। তারা তাকে ঐ অবস্থায় আসতে দেখে সবাই আকাংখা করে বলবেঃ “হে আল্লাহ! আমাদেরকেও এটা দান করুন এবং আমাদেরকে এতে বরকত দিন।” ঐ লোকটি তাদের কাছে এসেই বলবেঃ “তোমরা আনন্দিত হও। তোমাদের প্রত্যেককেও এটা দেয়া হবে।” কিন্তু কাফিরের চেহারা কালো ও মলিন হয়ে যাবে এবং তারও দেহ বেড়ে যাবে। তাকে দেখে তার সঙ্গীরা বলবেঃ “আমরা তার থেকে আল্লাহ তাআলার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, তার দুষ্কৃতি থেকে আমরা আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! তাকে আমাদের কাছে আনয়ন করবেন না।” ইতিমধ্যে সে সেখানে চলে আসবে। তারা তখন তাকে বলবেঃ “আল্লাহ তোমাকে অপদস্থ করুন।” সে জবাবে তাদেরকে বলবেঃ “তোমাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করুন! এটা আল্লাহর মার। এটা তোমাদের সবারই জন্যে অবধারিত রয়েছে।”এই দুনিয়ায় যারা আল্লাহ তাআলার আয়াত সমূহ হতে, তাঁর কিতাব হতে এবং তাঁর হিদায়াতের পথ হতে চক্ষু ফিরিয়ে নিয়েছে, পরকালে বাস্তবপক্ষেই তারা অন্ধ হয়ে যাবে এবং দুনিয়ার চেয়েও বেশী পথভ্রষ্ট হবে। আমরা এর থেকে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#865)
Sura:17
Sura: Bony Israyel.
Ayat: 71- 72
[ ;وَمَن كَانَ فِي هَـذِهِ أَعْمَى
And whoever is blind in this,…]
www.motaher21.net