أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৬৮)[ اَقِمِ الصَّلٰوةَ
নামায কায়েম করো, নামাজের সময়সূচী। ]
সুরা: আল্ বনি ইসরাইল
সুরা:১৭
৭৮-৭৯ নং আয়াত:-
[ اَقِمِ الصَّلٰوةَ
নামায কায়েম করো।]
www.motaher21.net
সুরা: বনী ইসরাঈল
আয়াত নং :-৭৮
اَقِمِ الصَّلٰوةَ لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ اِلٰى غَسَقِ الَّیْلِ وَ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ١ؕ اِنَّ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْدًا
নামায কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং ফজরে কুরআন পড়ারও ব্যবস্থা করো। কারণ ফজরের কুরআন পাঠ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
আয়াত নং :-৭৯
وَ مِنَ الَّیْلِ فَتَهَجَّدْ بِهٖ نَافِلَةً لَّكَ١ۖۗ عَسٰۤى اَنْ یَّبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحْمُوْدًا
আর রাতে তাহাজ্জুদ পড়ো এটি তোমার জন্য নফল। অচিরেই তোমার রব তোমাকে “প্রশংসিত স্থানে” প্রতিষ্ঠিত করবেন।
৭৮-৭৯ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# পর্বত প্রমাণ সমস্যা ও সংকটের আলোচনা করার পর পরই নামায কায়েম করার হুকুম দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ মর্মে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত করেছেন যে, এ অবস্থায় একজন মু’মিনের জন্য যে অবিচলতার প্রয়োজন হয় তা নামায কায়েমের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে।
# دُلُوۡک এর অনুবাদ করেছি “সূর্য ঢলে পড়া।” অবশ্যি কোন কোন সাহাবা ও তাবেঈ “দুলূক” অর্থ নিয়েছেন সূর্যাস্ত। কিন্তু অধিকাংশের মতে এর অর্থ হচ্ছে দুপুরে সূর্যের পশ্চিমে ঢলে পড়া। হযরত উমর, ইবনে উমর, আনাস ইবনে মালিক, আবু বায়যাতাল আসলামী, হাসান বাস্রী, শা’বী, আতা, মুজাহিদ এবং একটি বর্ণনামতে ইবনে আব্বাসও এ মতের সমর্থক। ইমাম মুহাম্মাদ বাকের ও ইমাম জাফর সাদেক থেকেও এই মত বর্ণিত হয়েছে। বরং কোন কোন হাদীসে নবী ﷺ থেকেও دُلُوۡک এর এ ব্যাখ্যাও উদ্ধৃত হয়েছে, যদিও এর সনদ তেমন বেশী শক্তিশালী নয়।
# غَسَقِ الَّیۡلِ এর অর্থ কেউ কেউ নিয়েছেন “রাতের পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যাওয়া।” আবার কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন মধ্যরাত। যদি প্রথম অর্থটি মেনে নেয়া হয় তাহলে এর মানে হবে এশার প্রথম ওয়াক্ত। আর দ্বিতীয় অর্থটি মেনে নিলে এখানে এশার শেষ ওয়াক্তের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
# ফজর শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ভোর হওয়া বা প্রভাতের উদয় হওয়া অর্থাৎ একেবারে সেই প্রথম লগ্নটি যখন প্রভাতের শুভ্রতা রাতের আঁধার চিরে উঁকি দিতে থাকে। ফজরের কুরআন পাঠ মানে হচ্ছে, ফজরের নামায, কুরআন মজীদে নামায প্রতিশব্দ হিসেবে কোথাও ‘সালাত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে আবার কোথাও বিভিন্ন অংশের মধ্য থেকে কোন একটির নাম নিয়ে সমগ্র নামাযটি ধরা হয়েছে। যেমন তাসবীহ, যিকির, হামদ (প্রশংসা) কিয়াম (দাঁড়ানো) রুকূ’ সিজদাহ ইত্যাদি। অনুরূপভাবে এখানে ফজরের সময় কুরআন পড়ার মানে শুধু কুরআন পাঠ করা নয় বরং নামাযে কুরআন পাঠ করা। এভাবে নামাযের উপাদান ও অংশ কি ধরনের হতে হবে কুরআন মজীদ সেদিকে পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছে। আর এ ইঙ্গিতের আলোকে নবী ﷺ নামাযের কাঠামো নির্মাণ করেন। বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে নামাযের এ কাঠামোই প্রচলিত।
# ফজরের কুরআন পরিলক্ষিত হওয়ার মানে হচ্ছে, আল্লাহর ফেরেশতারা এর সাক্ষী হয়। হাদীসে সুস্পষ্ট একথা বর্ণনা করা হয়েছে যদিও ফেরেশতারা প্রত্যেক নামায ও প্রত্যেক সৎকাজের সাক্ষী তবুও যখন ফজরের নামাযের কুরআন পাঠে তাদের সাক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে তখন এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, এ কাজটি একটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। এ কারণেই নবী ﷺ ফজরের নামাযে দীর্ঘ আয়াত ও সূরা পড়ার পদ্ধতি অবলম্বন করেন। সাহাবায়ে কেরামও তাঁর এ পদ্ধতি অনুসরণ করেন এবং পরবর্তী ইমামগণ একে মুস্তাহাব গণ্য করেন।
এ আয়াতে সংক্ষেপে মি’রাজের সময় যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছিল তার সময়গুলো কিভাবে সংগঠিত ও বিন্যস্ত করা হবে তা বলা হয়েছে। নির্দেশ দেয়া হয়েছে, একটি নামায পড়ে নিতে হবে সূর্যোদয়ের আগে। আর বাকি চারটি নামায সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত পড়ে নিতে হবে। তারপর এ হুকুমটি ব্যাখ্যা করার জন্য জিব্রীল আলাইহিস সালামকে পাঠানো হয়েছে। তিনি এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযগুলোর সঠিক সময়ের শিক্ষা দান করেছেন। আবু দাউদ ও তিরমিযীতে ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী ﷺ বলেছেনঃ
“জিব্রীল দু’বার আমাকে বায়তুল্লাহর কাছাকাছি জায়গায় নামায পড়ান। প্রথম দিন যোহরের নামায ঠিক এমন সময় পড়ান যখন সূর্য সবেমাত্র হেলে পড়েছিল এবং ছায়া জুতার একটি ফিতার চাইতে বেশী লম্বা হয়নি। তারপর আসরের নামায পড়ান এমন এক সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের সমপরিমাণ ছিল। এরপর মাগরিবের নামায এমন সময় পড়ান যখন রোযাদার রোযা ইফতার করে। অতঃপর পশ্চিমাকাশের লালিমা খতম হবার পরপরই এশার নামায পড়ান আর ফজরের নামায পড়ান ঠিক যখন রোযাদারের ওপর খাওয়া দাওয়া হারাম হয়ে যায় তেমনি সময়। দ্বিতীয় দিন তিনি আমাকে যোহরের নামায এমন সময় পড়ান যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের সমান ছিল। আসরের নামায পড়ান এমন সময় যখন প্রত্যেক জিনিসের ছায়া তার দৈর্ঘের দ্বিগুণ ছিল। মাগরিবের নামায পড়ান এমন সময় যখন রোযাদার রোযা ইফতার করে। এশার নামায পড়ান এমন সময় যখন রাতের তিনভাগের একভাগ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং ফজরের নামায পড়ান আলো চারদিকে ভালভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর। তারপর জিব্রীল আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, হে মুহাম্মাদ! এই হচ্ছে নবীদের নামায পড়ার সময় এবং এ দু’টি সময়ের মাঝখানেই হচ্ছে নামাযের সঠিক সময়।” (অর্থাৎ প্রথম দিন প্রত্যেক নামাযের প্রথম সময় এবং দ্বিতীয় দিন শেষ সময় বর্ণনা করা হয়। প্রত্যেক ওয়াক্তের নামায এ দু’টি সময়ের মাঝখানে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত।) কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায়ও পাঁচটি নামাযের এ ওয়াক্তসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
যেমন সূরা হূদে বলা হয়েছেঃ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ طَرَفَیِ النَّہَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیۡلِ ؕ اِنَّ الۡحَسَنٰتِ یُذۡہِبۡنَ السَّیِّاٰتِ ؕ ذٰلِکَ ذِکۡرٰی لِلذّٰکِرِیۡنَ ﴿۱۱۴﴾ۚ |
“নামায কায়েম করো দিনের দুই প্রান্তে (অর্থাৎ ফজর ও মাগরিব) এবং কিছু রাত পার হয়ে গেলে (অর্থাৎ এশা)।” (১১৪ আয়াত)
সূরা ‘তা-হা’য়ে বলা হয়েছেঃ فَاصۡبِرۡ عَلٰی مَا یَقُوۡلُوۡنَ وَ سَبِّحۡ بِحَمۡدِ رَبِّکَ قَبۡلَ طُلُوۡعِ الشَّمۡسِ وَ قَبۡلَ غُرُوۡبِہَا ۚ وَ مِنۡ اٰنَآیِٔ الَّیۡلِ فَسَبِّحۡ وَ اَطۡرَافَ النَّہَارِ لَعَلَّکَ تَرۡضٰی ﴿۱۳۰﴾ “হে মুহাম্মাদ! এরা যেসব কথা বলে তাতে সবর করো এবং আর নিজের রবের হামদ (প্রশংসা) সহকারে তাঁর তাসবীহ (পবিত্রতা বর্ণনা) করতে থাকো সূর্যোদয়ের পূর্বে (ফজর) ও সূর্যাস্তের পূর্বে (আসর) এবং রাতের সময় আবার তাসবীহ করো (এশা) আর দিনের প্রান্তসমূহে (অর্থাৎ সকাল, যোহর ও মাগরিব)” (১৩০ আয়াত)
তারপর সূরা রূমে বলা হয়েছেঃ
فَسُبۡحٰنَ اللّٰہِ حِیۡنَ تُمۡسُوۡنَ وَ حِیۡنَ تُصۡبِحُوۡنَ ﴿۱۷﴾
وَ لَہُ الۡحَمۡدُ فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ عَشِیًّا وَّ حِیۡنَ تُظۡہِرُوۡنَ ﴿۱۸﴾ “কাজেই আল্লাহর তাসবীহ করো যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় (মাগরিব) এবং যখন সকাল হয় (ফজর)। তাঁরই জন্য প্রশংসা আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে এবং তাঁর তাসবীহ করো দিনের শেষ অংশে (আসর) এবং যখন তোমাদের দুপুর (যোহর) হয়।” ১৭-১৮ আয়াত
নামাযের সময় নির্ধারণ করার সময় যেসব প্রয়োজনীয় দিকে নজর রাখা হয়েছে তার মধ্যে সূর্য পূজারীদের ইবাদাতের সময় থেকে দূরে থাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সকল যুগেই সূর্য মুশরিকদের সবচেয়ে বড় বা অনেক বড় মাবুদের স্থান দখল করেছে। সূর্য উদয় ও অস্তের সময়টায়ই তারা বিশেষ করে তার পূজা করে থাকে। তাই এসব সময় নামায পড়াকে হারাম করা হয়েছে। তাছাড়া সাধারণত সূর্য উদয়ের পর থেকে নিয়ে মধ্য গগণে পৌঁছার সময়ে তার পূজা করা হয়ে থাকে। কাজেই ইসলামে হুকুম দেয়া হয়েছে, দিনের বেলার নামাযগুলো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে পড়া শুরু করতে হবে এবং সকালের নামায সূর্য হবার আগেই পড়ে ফেলতে হবে। এ প্রয়োজনীয় বিষয়টি নবী ﷺ বিভিন্ন হাদীসে বর্ণনা করেছেন। একটি হাদীসে হযরত আমর ইবনে আবাসাহ (রা.) বর্ণনা করছেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাযের সময় জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ
“ফজরের নামায পড়ো এবং সূর্য উদিত হতে থাকলে বিরত হও, সূর্য ওপরে উঠে যাওয়া পর্যন্ত। কারণ সূর্য যখন উদিত হয় তখন শয়তানের শিং দু’টির মাঝখান দিয়ে বের হতে থাকে এবং এ সময় কাফেররা তাকে সিজদা করে।”
তারপর তিনি আসরের নামাযের উল্লেখ করার পর বললেনঃ
“তারপর নামায থেকে বিরত হও সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। কেননা, সূর্য শয়তানের শিং দু’টির মাঝখানে অস্ত যায় এবং এ সময় কাফেররা তার পূজা করে।” (মুসলিম)
এ হাদীসে সূর্যের শয়তানের শিংয়ের মাঝখান দিয়ে উদয় হওয়া ও অস্ত যাওয়াকে একটা রূপক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এ ধারণা দেয়া হয়েছে যে সূর্যের উদয় ও অস্ত যাবার সময় শয়তান লোকদের জন্য একটি বিরাট বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দেয়। লোকেরা যখন সূর্যের উদয় ও অস্ত যাবার সময় তার সামনে সিজদা করে তখন যেন মনে হয় শয়তান তাকে নিজের মাথায় করে এনেছে এবং মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে। রসূল ﷺ তাঁর নিজের নিম্নোক্ত বাক্য দিয়ে এ রূপকের রহস্য ভেদ করেছেন “এ সময় কাফেররা তার পূজা করে।”
# তাহাজ্জুদ মানে ঘুম ভেঙ্গে উঠে পড়া। কাজেই রাতের বেলা তাহাজ্জুদ পড়া মানে হচ্ছে, রাতের একটি অংশে ঘুমুবার পর উঠে নামায পড়ে নাও।
# নফল মানে ফরযের অতিরিক্ত। এ থেকে আপনা আপনি এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আগের আয়াতে যে পাঁচটি নামাযের ওয়াক্ত বর্ণনা করা হয়েছিল সেগুলো ফরয এবং এ ষষ্ঠ নামাযটি ফরযের অতিরিক্ত।
# দুনিয়ায় ও আখেরাতে তোমাদেরকে এমন মার্যাদায় পৌঁছে দেবেন যেখানে তোমরা মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়ে থাকবে। তোমাদের অস্তিত্ব দুনিয়ায় একটি প্রশংসনীয় অস্তিত্বে পরিণত হবে। আজ তোমাদের বিরোধীরা গালাগালি ও নিন্দাবাদের মাধ্যমে তোমাদের অভ্যর্থনা করছে এবং সারাদেশে তোমাদের বদনাম করার জন্য তোমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের তুফান সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু সে সময় দূরে নয় যখন সারা দুনিয়ায় তোমাদের প্রশংসা শ্রুত হবে এবং আখেরাতেও তোমরা সমগ্র সৃষ্টির প্রশংসার অধিকারী হবে। কিয়ামতের দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াতকারীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়াও এ প্রশংসনীয় মর্যাদারই একটি অংশ।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*আল্লাহর সান্নিধ্যে : এরপর, আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন তাঁর প্রিয় রসূল(স.) তার কাছে সান্নিধ্যে আগমন করুক, তার মধুর পরশে ধন্য হােক আখেরী নবীর জীবন-মন-প্রাণ, বিশ্বপতির ক্ষমতা রাজ্যের সর্বত্র পরিব্যাপ্ত মহান মালিকের শক্তি-ক্ষমতা সন্দর্শনে হৃদয় তার সর্বোচ্চ শক্তিতে ভরপুর হয়ে যাক, যেন মালিকের রাজ্যে তার বিজয় কেতন উড্ডীন করার প্রশ্নে তিনি আপােসহীন হতে পারেন সারা দুনিয়ার সম্মিলিত বিরােধী শক্তিও তার বিজয়াভিযানের সামনে তৃণসম তুচ্ছজ্ঞানে পরিত্যক্ত ও উপেক্ষিত হয়ে যায় । তাই দেখা যায় বজ্র-নির্ঘোষে উত্থিত মহানবী(স.)-এর ঘােষণা, সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী ও মিথ্যার পতন অলংঘণীয়। এরপর আসছে বিশ্ব বিজয়ের মূল চালিকা শক্তি কর্মসূচী, যা মানুষের ধমনীতে চিরদিন এক অমিত তেজ যােগাতে থাকবে, যার বলে বলীয়ান হয়ে আল্লাহর সৈনিকরা জাহেলিয়াতের নিশ্চিদ্র অমানিশায় চলতে থাকবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘কায়েম কর নামায সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে নিয়ে রাতের অন্ধকার ঘনীভূত হওয়া পর্যন্ত… কিন্তু যালেমদের জন্যে বৃদ্ধি করে এ পাক কালাম শুধু ক্ষতিই ক্ষতি।'(আয়াত ৭৮-৮২) সূর্য ঢলে পড়া বলতে বুঝায় মধ্যাহ্ন কাল অতিক্রম করার পর সূর্যের পশ্চিম দিগন্তের দিকে ঢলে পড়া। এখানে বিশেষভাবে রসূল(স.)-কে লক্ষ্য করে কথাগুলাে বলা হয়েছে; বিশেষ করে ফরয নামাযগুলাের ওয়াক্ত নির্দেশ করতে গিয়ে একথাগুলাে এসেছে-এবং মুতাওয়াতির হাদীসের মাধ্যমে তার বাস্তব কাজ সম্পর্কে এ কথাগুলাে জানা গেছে। আবার দেখুন, কোনাে কোনাে মুফাসসির বলেন, ‘দুলুকে শামস’ বলতে মধ্য আকাশের অবস্থান থেকে সূর্যের পশ্চিম দিগন্তের দিকে ঝুঁকে পড়াকে বুঝায় । আর রাত্রির প্রথম ভাগকেই ‘গাসাক’ বলা হয়েছে এবং ফজরের সময়ে কোরআন পড়তে হবে বলে বুঝানাে হয়েছে, বলা হয়েছে ফজরের নামাজে অবশ্যই সশব্দে কোরআন এমনভাবে পড়তে হবে যেন মানুষ সহজেই কোরআনের শব্দ ও ভাব বুঝতে পারে। এরপর, ফজরের সময়ে কোরআন পাঠ বলতে ফজরের নামাযকেই বুঝানাে হয়েছে। তারপর দেখুন তাহাজ্জুদের নামায পড়ার জন্যে আল্লাহ তায়ালা শুধুমাত্র একজনকেই হুকুম দিয়েছেন। এ হচ্ছে সেই নিভৃত নামায যা আল্লাহ তায়ালা তার রসূল(স.)-এর জন্যে খাস করে দিয়েছেন। যার কারণে তার জন্যে ছিলাে এ নামায অতিরিক্ত এক ফরয, আর অন্যদের জন্যে হচ্ছে এ নামাজ নফল। কেউ কেউ এ নামাজ কে রাসূলের জন্যে নফল মনে করেন, কিন্তু প্রথমে বর্ণিত কথা, অর্থাৎ রসূলুল্লাহ(স.)-এর জন্যে এ নামায এক বিশেষ ও অতিরিক্ত হুকুম বিধায় তার জন্যে ছিলাে এটা ফরজ। আল কোরআনে নামাযের ওয়াক্তগুলােকে সরাসরি আয়াতের মাধ্যমে নিরূপণ করা হয়নি, বরং হাদীস শরীফে রসূলুল্লাহ(স.)-এর কথা ও বাস্তব ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি নামাযের সময় সুস্পষ্টভাবে জানা যায়, এরশাদ হচ্ছে, ‘নামায কায়েম করাে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার সময় থেকে নিয়ে রাত্রিতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসা পর্যন্ত।’ অথবা অস্তমিত হওয়ার জন্যে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশের দিকে ঝুঁকে পড়ে সেই সময় ও রাতের ঘন অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত সময়ে নামায পড়াে এই প্রান্তিক সময়ের মধ্যে নামায কায়েম করাে। আর, পড় ফজরের সময় কোরআনে করীম। নিশ্চয়ই ফজরের সময় কোরআন পাঠ শ্রুত হয় (দলবদ্ধভাবে) এই দুটি সময়ের উল্লেখের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি বুঝা যায় তা হচ্ছে, দিন শেষে ও রাতের আগমনে এবং রাতের শেষে ও দিনের আগমনে নামাযের ওয়াক্তগুলো আবর্তিত হতে থাকে। আয়াত দুটির দিকে একটু খেয়াল করলে পাঠকের অজান্তেই তার হৃদয়ের ওপর এক গভীর আবেগ সৃষ্টি হয়। দেখুন, প্রথমত হচ্ছে রাতের আগমন, অতপর ধীরে ধীরে গভীর অন্ধকার ছেয়ে যাওয়া। এ অবস্থা অনুরূপভাবে স্নিগ্ধ আলাের উন্মেষ ও অন্ধকার দূরীভূত হওয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। দুটি সময়ে অন্তর নরম হয় এবং উভয় সময়েই বিশ্ব প্রকৃতির রহস্য রাশি ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে মােমনের অন্তরে এমনভাবে চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক করে যা এক মুহূর্তের জন্যেও দূর হতে চায় না বা একটিবারের জন্যেও সে চিন্তা মুক্ত হয় না। নামাযের জন্যে মােমেন-দিল উদগ্রীব হয়ে থাকে, তেমনি উন্মুখ হয়ে থাকে কোরআন শােনা বা পড়ার জন্যেও। ভােরের আলাে প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে যখন প্রভাতী সমীরণ মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হতে শুরু করে, গােটা পরিবেশে নেমে আসে মিষ্টি মধুর সরস সজীবতা, পাখীকুল শুরু করে মধুর কলরব, তখন আল্লাহপ্রেমিক মানুষ মােহব্বতের আবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। ভােরের আলাের আগমনে তার অন্তরের দুয়ার যেমন খুলে যায়, জেগে উঠে নব জীবনের স্পন্দন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর রাতের কিছু অংশে তার সান্নিধ্য লাভের বাসনায় (কোরআনের আয়াতসমূহ দ্বারা) তাহাজ্জুদ পড়-এটা তােমার জন্যে অতিরিক্ত (এক কর্তব্য) আর তাহাজ্জুদ পড়ার উপযুক্ত সময় হচ্ছে প্রথম রাতে ঘুমের কিছু পর। আয়াতটির মধ্যে ‘বিহী’ যে সর্বনাম ব্যবহৃত হয়েছে তারই ইংগিত হচ্ছে আল কোরআন, কারণ কোরআনই নামাযের প্রাণ এবং মুসলমানদের মাথা সমুন্নত রাখার জন্যে উদ্দীপক শক্তি হিসাবে নিয়ােজিত । এরশাদ হচ্ছে, ‘হয়ত তােমার রব তােমাকে মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত করবেন…’ ওই স্থানে পাঠাবেন আল্লাহ তায়ালা তাহাজ্জুদ গােযার ওই নেক লােকদেরকে, যারা তাহাজ্জুদ ও পবিত্র কোরআনের কারণে এবং নির্জনে নিভৃতে আল্লাহর সান্নিধ্যে হাযির হওয়ার সময়ে অপূর্ব এক ঘনিষ্ট সম্পর্ক সৃষ্টি হয়-সেই মােহব্বতপূর্ণ সম্পর্কের কারণে(কোরআন হাদীসের অনেকগুলাে বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সবাই যখন ঘুমিয়ে, সেই প্রিয় বিছানা ত্যাগ করে মােমেন যখন একমাত্র আল্লাহর মােহাব্বতে দন্ডায়মান হয় তখন অবশ্যই সে আল্লাহর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে যে তাকে নিয়ে আল্লাহ তায়ালা গৌরব করেন, আর এই নামাযই কেয়ামতের দিনে তার জন্যে শাফায়াত করতে এগিয়ে আসবে)। এই তাহাজ্জুদের কারণে কোনাে মানুষ আল্লাহর বাছাইকৃত মানুষের মর্যাদা লাভ করবে এবং সে হবে তার পরওয়ারদেগারের পছন্দনীয় বান্দা। সুতরাং অন্য কারও পক্ষে এ মর্যাদার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে বিশেষ মর্যাদা লাভের একমাত্র পথ এটাই। এই তাহাজ্জুদই সর্বাধিক মর্যাদা লাভের পথে সর্ব প্রধান পাথেয়। এর করুনাময় আল্লাহ তায়ালা শিখিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে তাকে ডাকতে হবে।
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
পূর্বের আয়াতগুলোতে কাফির-মুশরিকদের চক্রান্ত ও অন্যান্য বিষয় আলোচনা করার পর অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে সকলকে সঠিক সময়ে সালাত আদায় করার নির্দেশ প্রদান করছেন সে সাথে সালাতের সময়সীমাও উল্লেখ করে দিয়েছেন।
(لِدُلُوْكِ الشَّمْسِ) – لِدُلُوْكِ
শব্দের অর্থ ঢলা বা ঢলে পড়া। অর্থাৎ সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর সালাত আদায় কর। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যুহর ও আসরের সালাতের ওয়াক্ত। এবং غَسَقِ اللَّيْلِ অর্থ রাতের অন্ধকার অর্থাৎ সূর্যাস্তের পর রাতের অন্ধকার আগমন কালে মাগরিব ও এশার সালাত আদায় কর। আর قُرْاٰنَ الْفَجْرِ বলে ফজরের সালাতের কথা বুঝানো হয়েছে। ফজরের সালাতকে এজন্য কুরআন বলা হয়েছে, কারণ এতে লম্বা কিরাত পাঠ করা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَأَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ اللَّيْلِ ط إِنَّ الْحَسَنٰتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّاٰتِ ط ذٰلِكَ ذِكْرٰي لِلذّٰكِرِيْنَ)
“তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দু’ প্রান্তে রজনীর কিছু অংশ অতিবাহিত হওয়ার পর। সৎকর্ম অবশ্যই অসৎকর্ম মিটিয়ে দেয়। উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য এটা এক উপদেশ।” (সূরা হূদ ১১:১১৪)
এভাবে আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা বর্ণনা করেছেন এবং বিশেষ করে ফজরের কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা এ সময় ফেরেশতাগণ উপস্থিত হন। হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করার মর্যাদা পঁচিশ গুণ বেশি। আর ফজরের সালাতের সময় দিনের ও রাতের ফেরেশতারা একত্রিত হয়। তোমরা ইচ্ছা করলে এ আয়াতটি তেলাওয়াত করতে পারে। (সহীহ বুখারী: ৪৭১৭, সহীহ মুসলিম: ৬৪৯)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাহাজ্জুদ বলা হয়, রাতের শেষ প্রহরে ঘুম থেকে উঠে যে সালাত আদায় করা হয়। একে কিয়ামুল লাইলও বলা হয়। রমযান মাসে এ সালাতকেই তারাবীর সালাত বলা হয়।
نَافِلَةً لَّكَ শব্দের অর্থ আপনার জন্য অতিরিক্ত, এখানে نَافِلَةً এর অর্থ নিয়ে ইমামগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
কেউ বলেন, এটা শুধুমাত্র রাসূলের জন্য অতিরিক্ত ফরয ছিল, অন্য কারো জন্য নয়। এখানে نَافِلَةً শব্দ দ্বারা ফরযকেই বুঝানো হয়েছে।
আর কেউ বলেন, এখানে নফল দ্বারা নফলই বুঝানো হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ অন্য কারো ওপর পাঁচ ওয়াক্ত ছাড়া কোন সালাত ফরয ছিল না। (ইবনে কাসীর ৫ম খণ্ড, পৃ. ১০৮)
তবে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর প্রথমে রাতের সালাত ফরয ছিল যেমন সূরা মুযযাম্মিলে বলা হয়েছে। তারপর এ আয়াত দ্বারা নফল করে দেয়া হয়। এতদসত্ত্বেও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনো রাতের সালাত ছাড়তেন না। রাতের সালাতের যেমন ফযীলত রয়েছে তেমনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে দায়িত্ব মনে করে তা আদায় করতেন। ফযীলতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১১৬৩)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্যত্র বলেন: মানুষ যখন ঘুমিয়ে যায় তখন সালাত আদায় কর, নিরাপদে জান্নাতে যাবে। (সহীহ, তিরমিযী হা: ১৮৫৫)
রাতে সালাত আদায় করতে করতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পা মুবারক ফুলে যেত। জিজ্ঞাসা করা হল, আপনার অগ্র-পশ্চাত সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, তারপরেও আপনি এত কষ্ট করেন কেন? তিনি বললেন:
أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا
আমি কি আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞ বান্দা হব না! (সহীহ বুখারী হা: ১১৩০)
(مَقَامًا مَّحْمُوْدًا)
এখানে عَسٰٓي অর্থ নিশ্চিত, অর্থাৎ অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে প্রশংসিত স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন। এ প্রশংসিত স্থানটি কি তা নিয়ে ইমাম কুরতুবী (রহঃ) স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে চারটি মত নিয়ে এসেছেন। সঠিক কথা হল কিয়ামতের দিন যখন মানুষ দীর্ঘক্ষণ অবস্থান করবে কিন্তু তাদের বিচার ফায়সালা শুরু হবে না তখন সকলে মিলে আদম (عليه السلام)-এর আছে যাবে, যাতে তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে সুপারিশ করে বিচার-ফায়সালার কাজ শুরু করান। এভাবে তারা নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসাসহ সকল নাবীদের কাছে যাবে কিন্তু কেউ সুপারিশ করার দুঃসাহস পাবেন না। তখন সকলে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আসবে, আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সিজদায় পড়ে যাবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: হে মুহাম্মাদ! মাথা তোল। কী চাও? বল, তোমাকে দেয়া হবে। সুপারিশ কর, কবুল করা হবে। তখন সকল মানুষের বিচার ফায়সালা শুরু করার জন্য সুপারিশ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এমন একটি স্থানে অধিষ্ঠিত করবেন যা পাওয়ার জন্য আদম সন্তানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবাই কামনা করবে। এটাকেই বলা হয় বড় শাফাআত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের সময়সীমা জানতে পারলাম।
২. ফজরের সালাতের ফযীলত জানা গেল।
৩. তাহাজ্জুদ সালাত পড়ার ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৭৮-৭৯ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা নামাযের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার নির্দেশ দিচ্ছেন শব্দ দ্বারা সূর্য অস্তমিত হওয়া বা হেলে পড়া উদ্দেশ্য। ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) সূর্য হেলে পড়া অর্থই পছন্দ করেছেন। অধিকাংশ তাফসীরকারেরও উক্তি এটাই। হযরত জাবির ইবনু আবদিল্লাহ (রাঃ) বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সঙ্গীয় কয়েকজন সাহাবীর (রাঃ) সাথে দাওয়াতের খাদ্য খাই। সূর্য হেলে পড়ার পর তারা আমার এখান থেকে বিদায় হন। হযরত আবু বকরকে (রাঃ) তিনি বলেনঃ “চল, এটাই হচ্ছে সূর্য হেলে পড়ার সময়।” সুতরাং পাঁচ নামাযের সময়েরই বর্ণনা (আরবি) এই আয়াতে রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে অন্ধকার। যারা বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছে সূর্য অস্তমিত হওয়া, তাঁদের মতে এতে যুহর, আসর, মাগরিব ও এশার নামাযের বর্ণনা আছে। আর ফজরের বর্ণনা রয়েছে। এর মধ্যে। হাদীস দ্বারা রাসূলুল্লাহর (সঃ) কথা ও কাজের এই ধারাবাহিকতা হতে পাচ নামাযের সময় সাব্যস্ত আছে এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে, মুসলমানরা এখন পর্যন্ত এর উপরই রয়েছে। প্রত্যেক পরবর্তী যুগের লোক পূর্ববর্তী যুগের লোকদের হতে বরাবরই এটা গ্রহণ করে আসছে। যেমন এই মাসআলাগুলির বর্ণনার জায়গায় এর বিস্তারিত বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্যে।
ফজরের কুরআন পাঠের সময় দিন ও রাত্রির ফেরেশতাগণ এসে থাকেন। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তির নামাযের উপর জামাআতের নামাযের পূন্য পঁচিশ গুণ বেশী। ফজরের নামাযের সময় দিন ও রাত্রির ফেরেশতাগণ একত্রিত হন। এটা বর্ণনা করার পর এই হাদীসের বর্ণনাকারীহযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “তোমরা কুরআনের এই আয়াতটি পড়ে নাও।” সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “রাত্রি ও দিনের ফেরেশতা তোমাদের কাছে পর্যায়ক্রমে আসতে রয়েছেন। ফজর ও আসরের সময় তাঁদের (উভয় দলের) মিলন ঘটে যায়। তোমাদের মধ্যে ফেরেশতাদের যে দলটি রাত্রি অতিবাহিত করেন তাঁরা যখন আকাশে উঠে যান তখন আল্লাহ তাআলার খবর রাখা সত্ত্বেও তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমরা আমার বান্দাদের কে কি অবস্থায় ছেড়ে এসেছে।?” তাঁরা উত্তরে বলেনঃ “আমরা তাঁদের কাছে পৌঁছে দেখি যে, তাঁরা নামাযে রয়েছে, ফিরে আসার সময়েও তাদেরকে নামাযের অবস্থাতেই ছেড়ে এসেছি।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন যে, এই প্রহরী ফেরেশতারা ফজরের নামাযে একত্রিত হন। তারপর একদল আকাশে উঠে যান এবং অপর দল রয়ে যান। ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা স্বয়ং অবতরণ করেন এবং বলেনঃ “এমন কেউ আছে, যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো? কে আছে, যে আমার কাছে চাবে এবং আমি তাকে দেবো? কে আছে, যে আমার কাছে প্রার্থনা করবে এবং আমি তার প্রার্থনা কবূল করবো?” শেষ পর্যন্ত ফজর হয়ে যায়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা এ সময় বিদ্যমান থাকেন এবং রাত্রির ও দিনের ফেরেশতারাও একত্রিত হন।
এরপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় রাসূলকে (সঃ) তাহাজ্জুদ নামাযের নির্দেশ দিচ্ছেন, ফরয নামাযের নির্দেশ তো রয়েছেই। সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করা হয়ঃ ফরয নামাযের পরে কোন নামায উত্তম?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “তাহাজ্জুদের নামায।” তাহাজ্জুদ বলা হয় রাত্রে ঘুম থেকে উঠে আদায়কৃত নামাযকে। তাফসীরকারদের তাফসীরে এবং হাদীসে ও অভিধানে এটা বিদ্যমান রয়েছে। আর রাসূলুল্লাহর (সঃ) অভ্যাসও ছিল এটাই যে, তিনি ঘুম হতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়তেন। যেমন এটা স্বস্থানে বিদ্যমান রয়েছে। তবে হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এশার পরে যে নামায পড়া হয় ওটাই তাহাজ্জুদের নামায। খুব সম্ভব তার এই উক্তিরও উদ্দেশ্য হচ্ছে এশার পরে ঘুমানোর পর জেগে উঠে যে নামায পড়া হয় তাই তাহাজ্জুদের নামায।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলেনঃ হে নবী (সঃ)! এটা তোমার একটা অতিরিক্ত কর্তব্য। কেউ কেউ তো বলেন যে, তাহাজ্জুদের নামায অন্যদের জন্যে নয়। বরং শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহর (সঃ) উপর ফরয ছিল। অন্য কেউ বলেনঃ এই বিশেষত্বের কারণ এই যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) পূর্বের ও পরের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছিল। আর উম্মতেরা এটা পালন করলে তাদের গুনাহ দূর হয়ে যায়।
এরপর মহান আল্লাহ স্বীয় নবীকে (সঃ) বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি আমার এই নির্দেশ পালন করলে আমি তোমাকে এমন স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবো যেখানে প্রতিষ্ঠিত থাকার কারণে সমস্ত সৃষ্টজীব তোমার প্রশংসা করবে আর স্বয়ং মহান সৃষ্টিকর্তাও প্রশংসা করবেন। বর্ণিত আছে যে, কিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর উম্মতের শাফাআতের জন্যে এই মাকামে মাহমূদে যাবেন, যাতে সেই দিনের ভয়াবহতা থেকে তিনি তাঁর উম্মতের মনে শান্তি আনয়ন করতে পারেন। হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেন যে, সমস্ত মানুষকে একই ময়দানে একত্রিত করা হবে, ঘোষণাকারী তার ঘোষণা তাদেরকে শুনিয়ে দিবেন। ফলে তাদের চক্ষু খুলে যাবে এবং তারা উলঙ্গ পায়ে ও উলঙ্গ দেহে থাকবে, যেমন ভাবে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছিল। সবাই দাঁড়িয়ে থাকবে। আল্লাহ তাআলার অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। শব্দ আসবেঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! তিনি উত্তরে বলবেনঃ “লাব্বায়কা ওয়া সা’দায়কা’ হে আমার প্রতিপালক! সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে, অকল্যাণ আপনার পক্ষ থেকে নয়। সুপথ প্রাপ্ত সেই যাকে আপনি সুপথ দেখিয়েছেন। আপনার দাস আপনার সামনে বিদ্যমান। সে আপনার সাহায্যেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। এবং আপনার দিকেও ঝুঁকে পড়েছে। আপনার দয়া ছাড়া কেউ আপনার পাকড়াও হতে রক্ষা পাবে না। আপনার দরবার ছাড়া আর কোন আশ্রয় স্থল নেই। আপনি কল্যাণময় ও সমুচ্চ। হে রাব্দুল বায়েত! আপনি পবিত্র।” এটাই হলো মাকামে মাহমূদ, যার উল্লেখ আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে করেছেন। এই স্থানই হচ্ছে শাফাআতের স্থান।
কাতাদা (রঃ) বলেন যে, কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যমীন হতে বের হবেন রাসূলুল্লাহ (সঃ); সর্বপ্রথম শাফাআত তিনিই করবেন। আহলুল ইলম বলেন যে, এটাই মাকামে মাহমূদ, যার ওয়াদা আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় নবীর (সঃ) সাথে করেছেন। নিঃসন্দেহে কিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহর (সঃ) বহু এমন মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পাবে যাতে তার অংশীদার কেউ হবে না। সেই দিন বহু বুযর্গ ব্যক্তি এমন থাকবেন যারা তার সমকক্ষতা লাভ করতে পারবেন না। সর্বপ্রথম তাঁরই যমীনের কবর ফেটে যাবে এবং তিনি সওয়ারীর উপর আরোহণ করে হাশরের ময়দানের দিকে যাবেন। তাঁর কাছে একটা পতাকা থাকবে যার নীচে হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে সবাই থাকবেন। তাঁকে হাউজে কাওসার দান করা হবে যার উপর সবচেয়ে বেশী লোক জমায়েত হবে। শাফাআতের জন্যে মানুষ হযরত আদম (আঃ), হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত ঈসার (আঃ) কাছে যাবে, কিন্তু তারা সবাই অস্বীকার করবেন। শেষ পর্যন্ত তারাহযরত মুহাম্মদের (সঃ) কাছে সুপারিশের জন্যে আসবে। তিনি সম্মত হয়ে যাবেন, যেমন বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হাদীস সমূহ আসছে ইনশাআল্লাহ।
যাদেরকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়ে গিয়ে থাকবে, তাদের ব্যাপারে তিনি সুপারিশ করবেন। অতঃপর তাদেরকে তার সুপারিশের কারণে ফিরিয়ে আনা হবে। সর্বপ্রথম তাঁর উম্মতেরই ফায়সালা করা হবে। তিনিই নিজের উম্মতসহ সর্বপ্রথম পুলসিরাত পার হবেন। জান্নাতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তিনিই হবেন প্রথম সুপারিশকারী। যেমন এটা সহীহ মুসলিমের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
সূর বা শিঙ্গার ফুৎকার দেয়ার হাদীসে আছে যে, মু’মিনেরা তাঁরই সুপারিশের মাধ্যমে জান্নাতে যাবে। সর্বপ্রথম তিনিই জান্নাতে যাবেন এবং তার উম্মত অন্যান্য উম্মতদের পূর্বে জান্নাতে যাবে। তার শাফাআতের কারণে নিম্নশ্রেণীর জান্নাতীরা উচ্চ শ্রেণীর জান্নাত লাভ করবে। ওয়াসীলা’-এর অধিকারী তিনিই, যা জান্নাতের সর্বোচ্চ মনযিল। এটা তিনি ছাড়া আর কেউই লাভ করবে না। এটা সঠিক কথা যে, আল্লাহ তাআলার নির্দেশক্রমে পাপীদের জন্যে শাফাআত ফেরেতাগণই করবেন এবং নবীরাও করবেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহর (সঃ) শাফাআ’ত এতোবেশী লোকের ব্যাপারে হবে যাদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া আর কারো জানা নেই। এই ব্যাপারে তাঁর সমকক্ষ আর কেউই কিতাবুস সীরাতের শেষাংশে বাবুল খাসায়েসের মধ্যে অমি এটাকে খুব বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। এখন মাকামে মাহমূদের ব্যাপারে যে হাদীস সমূহ রয়েছে সেগুলি বর্ণনা করা হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সাহায্য করুন! সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনু উমার (রাঃ) বলেনঃ “কিয়ামতের দিন মানুষ হাঁটুর ভরে পড়ে থাকবে। প্রত্যেক উম্মত তাদের নবীর পিছনে থাকবে। তারা বলবেঃ “হে অমুক! আমাদের জন্য সুপারিশ করুন!” শেষ পর্যন্ত শাফাআতের দায়িত্ব হযরত মুহাম্মদের (সঃ) উপর অর্পিত হবে। সুতরাং এটা হচ্ছে ওটাই যে, আল্লাহ তাআলা তাঁকে মাকামে মাহমূদে প্রতিষ্ঠিত করবেন।” ইমাম ইবনু জারীরের (রঃ) বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সূর্য খুবই নিকটে হবে, এমনকি ঘর্ম কানের অর্ধেক পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। ঐ সময় মানুষ সুপারিশের জন্যে হযরত আদমের (আঃ) নিকট গমন করবে। কিন্তু তিনি পরিষ্কারভাবে অস্বীকার করবেন। তারপর তারা হযরত মূসার (আঃ) কাছে যাবে। তিনি উত্তরে বলবেনঃ “আমি এর যোগ্য নই।” তারা তখন হযরত মুহাম্মদের (সঃ) কাছে যাবে এবং তাঁকে সুপারিশের জন্যে অনুরোধ জানাবে। তিনি মাখলুকের শাফাআতের জন্যে অগ্রসর হবেন এবং জান্নাতের দরজার পাল্লা ধরে নিবেন। সুতরাং ঐ দিন আল্লাহ তাআলা তাঁকে মাকামে মাহমূদে পোঁছিয়ে দিবেন। সহীহ বুখারীতে এই রিওয়াইয়াতের শেষাংশে এও রয়েছে যে, হাশরের ময়দানের সমস্ত লোক সেই সময় তার প্রশংসা করবে।
সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি আযান শুনে (আরবি) এই দুআটি পাঠ করে না, কিয়ামতের দিন তার জন্যে আমার শাফাআত হালাল হবে না।”
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আমি নবীদের ইমাম, তাঁদের খতীব এবং তাঁদের সুপারিশকারী হবো। আমি যা কিছু বলছি তা ফখর হিসেবে বলছি না।” এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযীও এনেছেন এবং তিনি এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন। সুনানে ইবনু মাজাহতেও এটা বর্ণিত হয়েছে। হযরত উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত ঐ হাদীসটি গত হয়ে গেছে যাতে কুরআনকে সাত কিরআতে পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসের শেষাংশে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহ! আমার উম্মতকে ক্ষমা করুন। হে আমার মাবুদ! আমার উম্মতকে মাফ করে দিন! তৃতীয় দুআ’টি আমি ঐ দিনের জন্যে উঠিয়ে রেখেছি যেই দিন সমস্ত মাখলুক আমার দিকেই ঝুঁকে পড়বে, এমন কি হযরত ইবরাহীম (আঃ)।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, মু’মিনরা কিয়ামতের দিন একত্রিত হবে। তারপর তাদের অন্তরে ধারণা সৃষ্টি করা হবে যে, তাদের কারো কাছে সুপারিশের জন্যে যাওয়া উচিত, যার সুপারিশের ফলে তারা ঐ ভয়াবহ স্থানে শান্তি লাভ করতে পারে। একথা মনে করে তারা হযরত আদমের (আঃ) কাছে যাবে এবং তাঁকে বলবেঃ “হে আদম (আঃ)! আপনি সমস্ত মানুষের পিতা। আল্লাহ তাআলা আপনাকে নিজের হাতে সষ্টি করেছেন, ফেরেশতাদের দ্বারা আপনাকে সিজদা করিয়েছেন এবং আপনাকে সমস্ত জিনিসের নাম শিখিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আপনি আপনার প্রতিপালকের নিকট আমাদের সুপারিশের জন্যে গমন করুন। যাতে আমরা এই জায়গায় শান্তি লাভ করতে পারি।” তখন উত্তরে তিনি বলবেনঃ “আমি এর যোগ্য নই।” এ সময় তাঁর নিজের পাপের কথা স্মরণ হবে এবং তিনি লজ্জিত হয়ে যাবেন তাই, তিনি তাদেরকে বলবেনঃ “তোমরা হযরত নূহের (অঃ), কাছে যাও। তিনি আল্লাহর প্রথম রাসূল যাকে তিনি পৃথিবীবাসীর নিকট প্রেরণ করেছিলেন। তারা তখন তার কাছে আসবে। কিন্তু তাঁর কাছেও এই জবাবই পাবেন যে, তিনি এর যোগ্য নন। তাঁরও নিজের পাপের কথা স্মরণ হয়ে যাবে যে, তিনি আল্লাহর কাছে এমন প্রার্থনা করেছিলেন, যে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল না। (হযরত নূহ (আঃ) তাঁর কাফির পুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্যে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন। ঐ সময় আল্লাহ তাকে ধমক দিয়েছিলেন। এখানে ঐদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে) তাই তিনি এ সময় লজ্জাবোধ করবেন। তাদেরকে তিনি বলবেনঃ “তোমরা হযরত ইবরাহীমের (আঃ) কাছে যাও।” তারা তাঁর কাছে গেলে তিনি বলবেনঃ “আমি এর যোগ্য নই। তোমরা হযরত মুসার (আঃ) কাছে যাও। তাঁর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাঁকে তাওরাত দান করেছেন।” তখন লোকেরাহযরত মূসার (আঃ) কাছে আসবে। তিনি বলবেনঃ “আমার মধ্যে এ যোগ্যতা কোথায়?” অতঃপর তার ঐ পাপের কথা স্মরণ হয়ে যাবে যে, তিনি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন, অথচ এ হত্যা কোন নিহত ব্যক্তির কিসাস বা প্রতিশোধ গ্রহণ হিসেবে ছিল না। এই কারণে তিনি আল্লাহ তাআলার কাছে যেতে লজ্জা পাবেন এবং তাদেরকে বলবেনঃ “তোমরা হযরত ঈসার (আঃ) কাছে যাও। তিনি আল্লাহর বান্দা, তার কালেমা এবং তাঁর রূহ।” তারা তখন তাঁর কাছে আসবে। কিন্তু তিনি বলবেনঃ “আমি এর যোগ্যতা রাখি না। তোমরা হযরত মুহাম্মদের (সঃ) কাছে যাও। তার পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “অতঃপর তারা আমার কাছে আসবে। আমি তখন দাঁড়িয়ে যাবো এবং আমার প্রতিপালকের কাছে শাফাআতের অনুমতি চাইবো। আমি তাঁকে দেখা মাত্রই সিজদায় পড়ে যাবো। যতক্ষণ আল্লাহর ইচ্ছা, আমি সিজদায় পড়েই থাকবো। অতঃপর তিনি বলবেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! তুমি মাথা উঠাও। বল, তোমার কথা শোনা হবে। শাফাআত কর, কবুল করা হবে। তুমি যা চাও, দেয়া হবে।” আমি তখন মাথা উঠাবো এবং আল্লাহর এসব প্রশংসা করবো যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। তারপর আমি সুপারিশ পেশ করবো। তখন আমাকে একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। আমি ঐ সীমার মধ্যের লোকদেরকে জান্নাতে পৌঁছিয়ে আসবো। দ্বিতীয়বার জনাব বারী তাআলার দরবারে হাযির হয়ে তাঁকে দর্শন করতঃ সিজদায় পড়ে যাবো। তাঁর ইচ্ছামত তিনি আমাকে সিজদায় থাকতে দিবেন। তারপর বলবেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ); মাথা উঠাও বল, শোনা হবে চাও, দেয়া হবে শাফাআত কর, ককূল করা হবে। তারপর আমি মাথা উঠিয়ে আমার প্রতিপালকের ঐ প্রশংসা করবো যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। অতঃপর আমি শাফাআত করবো। এবারও আমার জন্যে একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হবে। আমি তাদেরকেও জান্নাতে পৌঁছিয়ে আসবো। তৃতীবার আবার ফিরে যাবো। আমার প্রতিপালককে দেখা মাত্রই সিজদায় পড়ে যাবো। যতক্ষণ তিনি চাইবেন, ঐ অবস্থাতেই আমি পড়ে থাকবে। তারপর বলাহবেঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! মাথা উঠাও। কথা বল, তোমার কথা শোনা হবে। চাও, দেয়া হবে এবং সুপারিশ কর, ককূল করা হবে। আমি তখন আমাকে তার শেখানো প্রশংসা দ্বারা তাঁর প্রশংসা করবো। তারপর সুপারিশ করবো। এবারও আমার জন্যে একটা সীমা বেঁধে দেয়া হবে। আমি তাদেরকে জান্নাতে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবো। চতুর্থবার আবার আমি ফিরে যাবো এবং বলবোঃ “হে বিশ্বপ্রতিপালক! এখন তো শুধু তারাই বাকী রয়েছে। যাদেরকে কুরআন আটকিয়ে দিয়েছে।” তিনি বলবেনঃ “এমন প্রত্যেক ব্যক্তি জাহান্নাম হতে বেরিয়ে আসবে যে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করেছে এবং তার অন্তরে গমের দানা পরিমাণও ঈমান আছে।” অতঃপর এই ধরনের লোকদেরকেও জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে, যারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করেছে এবং তাদের অন্তরে এক অনু-পরমাণু পরিমাণও ঈমান আছে।”
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মত পুলসিরাত পার হতে থাকবে, আর আমি সেখানে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে থাকবো। এমন সময় হযরত ঈসা (আঃ) আমার কাছে এসে বলবেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! নবীদের দল আপনার কাছে কিছু চাচ্ছেন এবং তারা সব একত্রিত রয়েছেন। তারা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছেন যে, তিনি যেন যেখানেই ইচ্ছা সমস্ত উম্মতকে পৃথক পৃথক করে দেন। এই সময় তাঁরা অত্যন্ত চিন্তিত রয়েছেন। সমস্ত মাখলুক ঘর্মের মধ্যে এমনভাবে ডুবে রয়েছে যে, যেন তাদেরকে ঘামের লাগাম পরিয়ে দেয়া হয়েছে। মুমিনের উপর এটা যেন শ্লেষ্ম স্বরূপ; কিন্তু কাফিরের উপর এটা মৃত্যু তুল্য।” আমি তাঁকে বলবোঃ থামুন, আসছি। তারপর আমি গিয়ে আরশের নীচে দাঁড়িয়ে যাবো এবং আমি এমন সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবো যা কোন সম্মানিত ফেরেশতা এবং কোন প্রেরিত নবীও লাভ করতে পারবেন না। তারপর আল্লাহ তাআলা হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) বলবেনঃ তুমি মুহাম্মদের (সঃ) কাছে যাও এবং তাঁকে মাথা উঠাতে বল। তিনি যা চাবেন, সুপারিশ করলে তাঁর সুপারিশ কবুল করা হবে। তখন আমাকে আমার উম্মতের জন্যে শাফাআত করার অনুমতি দেয়া হবে এবং বলা হবে যে, আমি যেন প্রতি নিরানব্বই হতে একজনকে বের করে আনি। আমি তখন বার বার আমার প্রতিপালকের নিকট যাতায়াত করবো এবং প্রত্যেক বারই সুপারিশ করতে থাকবো। শেষ পর্যন্ত মহামহিমান্বিত আল্লাহ আমাকে বলবেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! যাও, আল্লাহর মাখলুকের মধ্যে যে মাত্র একদিনও আন্তরিকতার সাথে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাক্ষ্য প্রদান করেছে এবং ওরই উপর মৃত্যু বরণ করেছে, তাকেও জান্নাতে পৌঁছিয়ে দিয়ে এসো।”
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, হযরত বারীদা (রাঃ) একদা হযরত মুআবিয়ার (রাঃ) নিকট গমন করেন। ঐ সময় একটি লোক তার সাথে কিছু কথা বলছিল। হযরত বারীদাও (রাঃ) কিছু বলার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, প্রথম ব্যক্তি যে কথা বলছিল, হযরত বারীদাও (রাঃ) ঐ কথাই বলবেন। হযরত বারীদা (রাঃ) তাঁকে বলেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলতে শুনেছিঃ “আল্লাহ তাআলার কাছে আমি আশা রাখি যে, যমীনে যত গাছ ও কংকর রয়েছে, ওগুলির সংখ্যা বরাবর লোকের জন্যে সুপারিশ করার অনুমতি আমি লাভ করবো।” সুতরাং হে মুআবিয়া (রাঃ) ! আপনার তো এই আশা আছে, আর হযরত আলী (রাঃ) কি এর থেকে নিরাশ হবেন?”
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, মুলাইকার দুই ছেলে রাসূলুল্লাহর (সঃ) দরবারে হাজির হয়ে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের মাতা আমাদের পিতার খুবই সম্মান করতেন। শিশুদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও স্নেহশীলা। অতিথিদের আতিথেয়তার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই যত্নবতী। কিন্তু অজ্ঞতার যুগে তিনি তাঁর কন্যা সন্তানদেরকে জীবন্ত প্রোথিত করতেন। (তার পরিণাম কি হবে?)।”
রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বলেনঃ “সে তো জাহান্নামে চলে গেছে। তারা দু’ভাই রাসূলুল্লাহর (সঃ) মুখে এ জবাব শুনে দুঃখিত মনে ফিরে যাচ্ছিল। তখন রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে ফিরিয়ে ডাকেন তারা ফিরে আসে। এ সময় তাদের চেহারায় আনন্দের ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তারা ধারণা করেছিল যে, হয়তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের মাতার ব্যাপারে কোন ভাল কথাই বলবেন। তিনি তাদেরকে বললেনঃ “জেনে রেখো যে, আমার মা এবং তোমাদের মা এক সাথেই রয়েছে।” একথা শুনে একজন মুনাফিক বললোঃ “এতে তাদের মাতার উপকার কি হলো? আমরা তার পিছনে যাচ্ছি।” রাসূলুল্লাহকে (সঃ) সবচেয়ে বেশী প্রশ্ন করতে অভ্যস্ত একজন আনসারী প্রশ্ন করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এর ব্যাপারে বা এ দু’জনের ব্যাপারে ওয়াদা করেছেন কি?” রাসুলুল্লাহ (সঃ) বুঝে নিলেন যে, সে কিছু শুনেছে। তিনি বললেনঃ “না আমার প্রতিপালক চেয়েছেন, না আমাকে এই ব্যাপারে কোন লোভ দিয়েছেন। জেনে রেখো যে, কিয়ামতের দিন আমাকে মাকামে মাহমূদে পৌঁছিয়ে দেয়া হবে।” আনসারী জিজ্ঞেস করলেনঃ “ওটা কি স্থান?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “এটা ঐ সময়, যখন তোমাদেরকে উলঙ্গ পায়ে ও উলঙ্গ দেহে ও খৎনাহীন অবস্থায় আনয়ন করা হবে। সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) কাপড় পরানো হবে। আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “আমার খলীল (দোস্তকে কাপড় পরিয়ে দাও।” তখন সাদা রং-এর দু’টি চাদর তাঁকে পরানো হবে। তিনি আরশের দিকে মুখ করে বসে পড়বেন। তার পর আমার পোষাক আনয়ন করা হবে। আমি তাঁর ডানদিকে ঐ জায়গায় দাঁড়াবো যে, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত লোক তা দেখে ঈর্ষা করবে। আর কাওসার থেকে নিয়ে হাউজ পর্যন্ত তাদের জন্যে খুলে দেয়া হবে।” মুনাফেক একথা শুনে বলতে লাগলোঃ “পানি প্রবাহিত হওয়ার জন্যে তো মাটি ও কংকরের প্রয়োজন?” তিনি উত্তরে বলবেনঃ “হাঁ, ওর মাটি হলো মুশকে আম্বার এবং কংকর হলো মনিমুক্তা।” সে বললোঃ “আমরা তো এরূপ কখনো শুনি নাই। আচ্ছা, পানির ধারে তো গাছ থাকারও প্রয়োজন রয়েছে?” আনসারী জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সেখানে গাছও থাকবে কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হাঁ, সোনার শাখা বিশিষ্ট গাছ থাকবে।” মুনাফিক বললোঃ এরূপ কথা তো আমরা কখনো শুনি নাই? আচ্ছা, গাছে তো পাতা ও ফলও থাকতে হবে?” আনসারী জিজ্ঞেস করলেনঃ “ঐ গাছগুলিতে ফলও থাকবে কি?” জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হাঁ, নানা প্রকারের মণিমুক্তা (হবে ওর ফল)। ওর পানি হবে দুধ অপেক্ষাও বেশী সাদা এবং মধু অপেক্ষা বেশী মিষ্ট। ওর থেকে এক চুমুক যে পান করবে সে আর কখনো পিপাসার্ত হবে না এবং যে তার থেকে বঞ্চিত থাকবে সে কখনো পরিতৃপ্ত হবে না।”
আবু দাউদ তায়ালেসী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা। শাফাআতের অনুমতি দিবেন। তখন রূহল কুক্স হযরত জিবরাঈল (আঃ) দাঁড়িয়ে যাবেন। তারপর দাঁড়াবেন হযরত ইবরাহীম (আঃ), তারপর হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত ঈসা (আঃ) দাঁড়াবেন। এরপর তোমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) পঁড়িয়ে যাবেন। তাঁর চেয়ে বেশী কারো শাফাআত হবে না। এটাই হলো মাকামে মাহমূদ, যার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছে।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ আমি আমার উম্মতসহ একটি টিলার উপর দাঁড়িয়ে যাবো। আল্লাহ তাআলা আমাকে একটি সবুজ রং এর ‘হুল্লা’ (পোষাক বিশেষ) পরিধান করবেন। তারপর আমাকে অনুমতি দেয়া হবে এবং আমি যা বলতে চাবো, বলবো। এটাই মাকামে মাহমূদ।”
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আমাকে সিজদা করার অনুমতি দেয়া হবে। আর আমাকেই সর্বপ্রথম মাথা উঠাবারও অনুমতি দান করা হবে। আমি আমার সামনে, পিছনে, ডানে ও বামে তাকিয়ে অন্যান্য উম্মতদের মধ্য হতে আমার উম্মতকে চিনে নিবো।” তখন কেউ একজন জিজ্ঞেস করলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হযরত নূহের (আঃ) সময় পর্যন্ত যত উম্মত রয়েছে তাদের মধ্য থেকে আপনার উম্মতকে আপনি কি করে চিনতে পারবেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “অযুর কারণে তাদের হাত, পা এবং চেহারায় ঔজ্জ্বল্য দেখা দেবে। তারা ছাড়া আর কেউ এরূপ হবে না। তাছাড়া এভাবেও আমি তাদেরকে চিনতে পারবো যে, তাদের আমলনামা তার ডান হাতে প্রাপ্ত হবে। আরো পরিচয় এই যে, তাদের সন্তানরা তাদের আগে আগে চলতে ফিরতে থাকবে।”
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) কাছে একদা গোশত আনয়ন করা হয়। তিনি কাঁধের গোশত খুবই ভালবাসতেন বলে ঐ গোশতই তাকে দেয়া হয়। তিনি ওর থেকে গোশত ভেঙ্গে ভেঙ্গে খেতে লাগলেন এবং বললেনঃ কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষের নেতা আমিই হবো। আল্লাহ তাআলার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত মানুষকে একই মাঠে জমা করা হবে। ঘোষণাকারী তাদেরকে ঘোষণা শুনিয়ে দিবেন। তাদের চক্ষুগুলি উপরের দিকে উঠে যাবে। সূর্য খুবই নিকটে আসবে এবং মানুষ এতো কঠিন দুঃখ ও চিন্তার মধ্যে জড়িত হয়ে পড়বে যে, তা সহ্য করার মত নয়। এ সময় তারা পরস্পর বলাবলি করবেঃ “আমরা তো ভীষণ বিপদে জড়িয়ে পড়েছি। চল, কাউকে বলে কয়ে সুপারিশী বানিয়ে নিই এবং তাঁকে আল্লাহ তাআলার নিকট পাঠিয়ে দিই।” এইভাবে পরামর্শে একমত হয়ে তারা হযরত আদমের (আঃ) কাছে যাবে এবং তাঁকে বলবেঃ “আপনি সমস্ত মানুষের পিতা। আল্লাহ তাআলা আপনাকে নিজের হাতে সৃষ্টি করেছেন এবং আপনার মধ্যে নিজের রূহ ফুকে দিয়েছেন। আর ফেরেশতাদেরকে আপনার সামনে হুকুম দিয়ে আপনাকে সিজদা করিয়েছেন। আপনি কি আমাদের দুরবস্থা দেখছেন না? আপনি আমাদের জন্যে প্রতিপালকের নিকট শাফাআত করুন।” হযরত আদম (আঃ) উত্তরে বলবেনঃ “আজ আমার প্রতিপালক এতো রাগান্বিত রয়েছেন যে, এর পূর্বে তিনি কখনো এতো রাগান্বিত হন নাই এবং এর পরেও কখনো এতো রাগান্বিত হবেন না। তিনি আমাকে একটি গাছ থেকে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আমার দ্বারা তাঁর অবাধ্যাচরণ হয়ে গেছে। আমি আজ নিজের চিন্তাতেই ব্যাকুল রয়েছি। তোমরা অন্য কারো কাছে যাও।” তারা তখন হযরত নূহের (আঃ) কাছে যাবে এবং বলবেঃ “হে নূহ (আঃ)! আপনাকে আল্লাহ তাআলা। দুনিয়াবাসীর কাছে সর্বপ্রথম রাসূল করে পাঠিয়েছিলেন। আপনাকে তিনি তাঁর কৃতজ্ঞ বান্দা নামে আখ্যায়িত করেছেন। আপনি আমাদের জন্যে প্রতিপালকের কাছে শাফাআত করুন! আমরা কি ভীষণ বিপদের মধ্যে রয়েছি তা তো। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন?” হযরত নূহ (আঃ) জবাবে বলবেনঃ “আজ তো আমার প্রতিপালক এতো ক্রোধান্বিত রয়েছেন যে, ইতিপূর্বে তিনি কখনো এতো বেশী রাগান্বিত হন নাই এবং এর পরেও এতো বেশী ক্রোধান্বিত হবেন না। আমার জন্যে একটি প্রার্থনা ছিল যা আমি আমার কওমের বিরুদ্ধে করেছিলাম। আজ তো আমি নিজেই নফসী! নফসী! করতে রয়েছি। তোমরা অন্য কারো কাছে যাও। তোমরা এখন হযরত ইবরাহীমের (আঃ) কাছে যাও।” তারা তখন হযরত ইবরাহীমের (আঃ) কাছে যাবে এবং তাঁকে বলবেঃ “আপনি আল্লাহর নবী ও তাঁর বন্ধু। আপনি কি আমাদের এই দুরবস্থা দেখছেন না?” হযরত ইবরাহীম (আঃ) উত্তরে বলবেনঃ “আজ আমার প্রতিপালক ভীষণ রাগান্বিত রয়েছেন। ইতিপূর্বে তিনি কখনো এতো বেশী রাগান্বিত হন নাই এবং এর পরেও কখনো এতো বেশী রাগান্বিত হবেন না।” তারপর তাঁর নিজের একটা মিথ্যা কথা বলা স্মরণ হয়ে যাবে এবং তিনি নফসী! নফসী! করতে শুরু করবেন এবং বলবেনঃ “তোমরা হযরত মূসার (আঃ) কাছে যাও।” তারা তখন হযরত মূসার (আঃ) কাছে যাবে এবং তাঁকে বলবেঃ “হে মূসা (আঃ)! আপনি আল্লাহর রাসূল। তিনি আপনার সাথে কথা বলেছিলেন। আপনি আমাদের প্রতিপালকের কাছে গিয়ে আমাদের জন্যে সুপারিশ করুন! দেখেন তো আমরা কি দুরবস্থায় রয়েছি?” তিনি জবাব দিবেনঃ “আজতো আমার প্রতিপালক কঠিন বিরক্ত হয়ে রয়েছেন। ইতিপূর্বে কখনো তিনি এতো বেশী বিরক্ত হননি এবং এর পরে হবেনও না আমি একবার তাঁর বিনা হুকুমে একটি লোককে মেরে ফেলেছিলাম। কাজেই আমি আজ নিজের চিন্তাতেই ব্যাকুল রয়েছি। সুতরাং তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও এবং অন্য কারো কাছে যাও। তোমরাহযরত ঈসার (আঃ)! কাছে যাও।” তারা তখন বলবেঃ “হে ঈসা (আঃ)! আপনি আল্লাহর রাসূল, তাঁর কালেমা এবং তাঁর রূহ! যা তিনি হযরত মরিয়মের (আঃ) প্রতি প্রেরণ করেছিলেন। শৈশবে দোলনাতেই আপনি কথা বলেছিলেন। আপনি আমাদের জন্যে প্রতিপালকের নিকট সুপারিশ করুন! আমরা যে কত উদ্বিগ্ন অবস্থায় রয়েছি তাতো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন?”হযরত ঈসা (আঃ) উত্তর দিবেনঃ “আমার প্রতিপালক আজ খুবই রাগান্বিত রয়েছেন। ইতিপূর্বে তিনি কখনো এতো বেশী রাগান্বিত হন নাই এবং এরপরে আর কখনো এতো বেশী ক্রোধান্বিত হবেন না। তিনিও নফসী! নফসী! করতে থাকবেন। কিন্তু তিনি নিজের কোন পাপের কথা উল্লেখ করবেন না। অতঃপর তিনি তাদেরকে বলবেনঃ “তোমরা হযরত মুহাম্মদের (সঃ) কাছে চলে যাও।” তারা তখন তার কাছে আসবে এবং বলবেঃ “আপনি সর্বশেষ নবী। আল্লাহ তাআলা আপনার পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। আপনি আমাদের জন্যে শাফাআত করুন! আমরা যে কি কঠিন বিপদের মধ্যে জড়িত হয়ে পড়েছি তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন?” আমি তখন দাঁড়িয়ে যাবো এবং আরশের নীচে এসে আমার মহামহিমান্বিত প্রতিপালকের সামনে সিজদায় পড়ে যাবো। তারপর আল্লাহ তাআলা আমার উপর তাঁর প্রশংসা ও গুণকীর্তণের ঐ সব শব্দ খুলে দিবেন যা আমার পূর্বে আর কারো কাছে খুলেন নাই। অতঃপর তিনি আমাকে সম্বোধন করে বলবেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! তোমার মস্তক উত্তোলন কর। চাও, তোমাকে দেয়া হবে এবং শাফাআত কর, কবুল করা হবে।” আমি তখন সিজদ্দা হতে আমার মস্তক উত্তোলন করবো এবং বলবোঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমার উম্মত (এর কি হবে!) হে আমার রব! আমার উম্মত (এর কি অবস্থা হবে!), হে আল্লাহ! আমার উম্মত (কে রক্ষা করুন। তখন তিনি আমাকে বলবেনঃ “যাও, তোমার উম্মতের ঐ লোকদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাও যাদের কোন হিসাব নেই। তাদেরকে জান্নাতের ডান দিকের দরজা দিয়ে পৌঁছিয়ে দাও। তবে অন্য সব দরজা দিয়ে যেতেও কোন বাধা নেই। যার হাতে মুহাম্মদের (সঃ) প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! জান্নাতের দুটি চৌকাঠের মধ্যে এতো দূর ব্যবধান রয়েছে যতদূর ব্যবধান রয়েছে মক্কা ও হুমায়েরের মধ্যে অথবা মক্কা ও বসরার মধ্যে। (এই হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও বর্ণিত আছে)
সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন। আদম সন্তানদের নেতা আমিই হবো। ঐ দিন সর্বপ্রথম আমারই কবরের যমীন ফেটে যাবে। আমিই হবো প্রথম শাফাআতকারী এবং আমার শাফাআতই প্রথম কবুল করা হবে।”
ইমাম ইবনু জারীর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহকে (সঃ) এই আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “এটা শাফাআত।”
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মাকামে মাহমুদ হলো এ স্থান যেখানে আমি আমার উম্মতের জন্যে শাফাআত করবো।”
মুসনাদে আবদির রায্যাকে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা যমীনকে চামড়ার মত টেনে নিবেন। এমনকি প্রত্যেক মানুষের জন্যে শুধু দুটি পা রাখার জায়গা থাকবে। সর্বপ্রথম আমাকে তলব করা হবে। আমি গিয়ে দেখতে পাবো যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহ রহমান তাবারাকা ওয়া তাআ’লার ডান দিকে রয়েছেন। আল্লাহর শপথ! এর পূর্বে হযরত জিবরাঈল (আঃ) আল্লাহ তাআলাকে কখনো দেখেন নাই। আমি বলবোঃ হে আল্লাহ! এই ফেরেশতা আমাকে বলেছিলেন যে, আপনি তাঁকে আমার নিকট পাঠিয়েছিলেন? মহামহিমান্বিত আল্লাহ উত্তরে বলবেনঃ “হাঁ, সে সত্য কথাই বলেছে।” আমি তখন একথা বলে শাফাআত শুরু করবো যে, হে আল্লাহ! আপনার বান্দারা যমীনের বিভিন্ন অংশে আপনার ইবাদত করেছে। তিনি বলেন যে, এটাই মাকামে মাহমুদ। (এই হাদীসটি মুরসাল)