أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৭৪)
সুরা: আল্ বনি ইসরাইল
সুরা:১৭
৯০-৯৬ নং আয়াত:-
[ قُلۡ لَّوۡ کَانَ فِی الۡاَرۡضِ مَلٰٓئِکَۃٌ
বল, ‘ফিরিশতারা যদি পৃথিবীতে বিচরণ করত,]
www.motaher21.net
সুরা: বনী ইসরাঈল
আয়াত নং :-৯০
وَ قَالُوْا لَنْ نُّؤْمِنَ لَكَ حَتّٰى تَفْجُرَ لَنَا مِنَ الْاَرْضِ یَنْۢبُوْعًاۙ
তারা বলে, “আমরা তোমার কথা মানবো না যতক্ষণ না তুমি ভূমি বিদীর্ণ করে আমাদের জন্য একটি ঝরণাধারা উৎসারিত করে দেবে।
আয়াত নং :-৯১
اَوْ تَكُوْنَ لَكَ جَنَّةٌ مِّنْ نَّخِیْلٍ وَّ عِنَبٍ فَتُفَجِّرَ الْاَنْهٰرَ خِلٰلَهَا تَفْجِیْرًاۙ
অথবা তোমার খেজুর ও আংগুরের একটি বাগান হবে এবং তুমি তার মধ্যে প্রবাহিত করে দেবে নদী-নালা।
আয়াত নং :-৯২
اَوْ تُسْقِطَ السَّمَآءَ كَمَا زَعَمْتَ عَلَیْنَا كِسَفًا اَوْ تَاْتِیَ بِاللّٰهِ وَ الْمَلٰٓئِكَةِ قَبِیْلًاۙ
অথবা তুমি আকাশ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে তোমার হুমকি অনুযায়ী আমাদের ওপর ফেলে দেবে। অথবা আল্লাহ ও ফেরেশতাদেরকে আমাদের সামনে নিয়ে আসবে।
আয়াত নং :-৯৩
اَوْ یَكُوْنَ لَكَ بَیْتٌ مِّنْ زُخْرُفٍ اَوْ تَرْقٰى فِی السَّمَآءِ١ؕ وَ لَنْ نُّؤْمِنَ لِرُقِیِّكَ حَتّٰى تُنَزِّلَ عَلَیْنَا كِتٰبًا نَّقْرَؤُهٗ١ؕ قُلْ سُبْحَانَ رَبِّیْ هَلْ كُنْتُ اِلَّا بَشَرًا رَّسُوْلًا۠
অথবা তোমার জন্য সোনার একটি ঘর তৈরি হবে। অথবা তুমি আকাশে আরোহণ করবে এবং তোমার আরোহণ করার কথাও আমরা বিশ্বাস করবো না যতক্ষণ না তুমি আমাদের প্রতি একটি লিখিত পত্র আনবে, যা আমরা পড়বো।” হে মুহাম্মাদ! এদেরকে বলো, পাক-পবিত্র আমার পরওয়ারদিগার, আমি কি একজন বাণীবাহক মানুষ ছাড়া অন্য কিছু?
আয়াত নং ৯৪
وَ مَا مَنَعَ النَّاسَ اَنْ یُّؤْمِنُوْۤا اِذْ جَآءَهُمُ الْهُدٰۤى اِلَّاۤ اَنْ قَالُوْۤا اَبَعَثَ اللّٰهُ بَشَرًا رَّسُوْلًا
লোকদের কাছে যখনই কোন পথনির্দেশ আসে তখন তাদের একটা কথাই তাদের ঈমান আনার পথ রুদ্ধ করে দেয়। কথাটা এই যে, “আল্লাহ কি মানুষকে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন?”
আয়াত নং :-৯৫
قُلْ لَّوْ كَانَ فِی الْاَرْضِ مَلٰٓئِكَةٌ یَّمْشُوْنَ مُطْمَئِنِّیْنَ لَنَزَّلْنَا عَلَیْهِمْ مِّنَ السَّمَآءِ مَلَكًا رَّسُوْلًا
তাদেরকে বলো, যদি পৃথিবীতে ফেরেশতারা নিশ্চিন্তভাবে চলাফেরা করতো তাহলে নিশ্চয়ই আমি কোনো ফেরেশতাকেই তাদের কাছে রসূল বানিয়ে পাঠাতাম।
আয়াত নং :-96
টিকা নং:109,
قُلْ كَفٰى بِاللّٰهِ شَهِیْدًۢا بَیْنِیْ وَ بَیْنَكُمْ١ؕ اِنَّهٗ كَانَ بِعِبَادِهٖ خَبِیْرًۢا بَصِیْرًا
হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলে দাও, আমারও তোমাদের শুধু একমাত্র আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। তিনি নিজের বান্দাদের অবস্থা জানেন এবং সবকিছু দেখছেন।
৯০-৯৬ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৯৪-৯৬ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে অধিকাংশ মানুষের ঈমান না আনার কারণ এবং মানুষের মধ্য হতে রাসূল প্রেরণের হিকমত বর্ণনা করা হয়েছে। অধিকাংশ মানুষ রাসূলদের প্রতি ঈমান আনেনি। কারণ হল তাদের মত একজন রক্ত-মাংসে গড়া মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের কথা হল একজন রাসূল আমাদের মত হতে পারে না। রাসূল একজন ফেরেশতা হবেন অথবা তাদের সাথে কোন ফেরেশতা থাকবে। অতএব আমরা যদি একজন মানুষের অনুসরণ করি তাহলে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হব, ক্ষতিগ্রস্থ হব। এ সম্পর্কে সূরা ইবরাহীমের ১০ নং, সূরা মু’মিনূনের ৪৭ নং, সূরা কামারের ২৪ নং এবং সূরা তাগাবুনের ৬ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
মানুষের মধ্য হতে রাসূল প্রেরণ করার হিকমত বর্ণনা ও তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘ফেরেশতাগণ যদি নিশ্চিন্ত হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ করত তবে আমি আকাশ হতে তাদের নিকট অবশ্যই ফেরেশ্তা রাসূল করে পাঠাতাম।’ যেহেতু পৃথিবীতে মানুষ বাস করে সেহেতু আমি মানুষকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি। রাসূল মানুষ না হলে রিসালাতের দায়িত্ব্ পালন করতে পারবে না এবং যাদের কাছে প্রেরণ করবেন তারাও কোন উপকৃত হতো না। সুতরাং মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার দয়া যে, মানুষের মধ্য হতেই রাসূল প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(لَقَدْ مَنَّ اللہُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْھِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِھِمْ یَتْلُوْا عَلَیْھِمْ اٰیٰتِھ۪ وَیُزَکِّیْھِمْ وَیُعَلِّمُھُمُ الْکِتٰبَ وَالْحِکْمَةَﺆ وَاِنْ کَانُوْا مِنْ قَبْلُ لَفِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ)
“নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাসীর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের নিজেরদেরই মধ্য হতে একজন রাসূল তাদের কাছে প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের নিকট তাঁর নিদর্শনাবলী (আয়াতসমূহ) পাঠ করেন ও তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও বিজ্ঞান শিক্ষা দান করেন যদিও তারা এর পূর্বে প্রকাশ্য ভ্রান্তির মধ্যে ছিল।” (সূরা আলি ইমরান ৩:১৬৪)
অতঃপর তাদের আচরণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর উত্তর কী হবে তা বলে দিচ্ছেন যে, তুমি বল, তোমরা আমাকে মানুষ বলে প্রত্যাখ্যান করছ; জেনে রেখ, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সকল কাজকর্ম প্রত্যক্ষ করছেন ও খবর রাখেন। তিনি সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট, তিনিই আমাদের মাঝে ফায়সালা করবেন। সুতরাং মানুষের মধ্য থেকে রাসূল প্রেরণ করা এটা মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার একটি অনুগ্রহ। নাবীরা আমাদের মত রক্ত-মাংসের মানুষ এ কথা পূর্বের জাতিরাও জানত। কিন্তু আমাদের সমাজে একশ্রেণির মুসলিম দাবীদার রয়েছে যারা আমাদের নাবীকে মাটির মানুষ বলতে চায় না। তারা বলে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নাকি নূরের তৈরী। এদেরকে পূর্ববর্তী জাতিদের থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাধারণ মানুষের মতই একজন মানুষ, কোন ফেরেশতা বা জিন নন, পার্থক্য হল তাঁকে রিসালাত দিয়ে রাসূলের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।
২. মানুষ মানুষের দুঃখ-বেদনা, সমস্যা ইত্যাদি বুঝে। কোন ফেরেশতা বা জিন মানুষের সমস্যা বুঝবে না, তাই মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করাই যুক্তিযুক্ত।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
মু’জিযা দাবী করার একটি জবাব এর আগে ৬ রুকূ’র (আরবী—————-) আয়াতের মধ্যে এসে গেছে। এখানে এ দাবীর দ্বিতীয় জবাব দেয়া হয়েছে। এ সংক্ষিপ্ত জবাবটির মধ্যে রয়েছে সাহিত্যের অতুলনীয় অলংকার। বিরোধীদের দাবী ছিল, যদি তুমি আল্লাহর নবী হয়ে থাকো তাহলে যমীনের দিকে ইশারা করো এবং তার ফলে অকস্মাৎ একটি ঝরণাধারা প্রবাহিত হোক, অথবা এখনই একটি সবুজ শ্যামল বাগান তৈরী হয়ে যাক এবং তার মধ্যে নদী-নালা বয়ে চলুক। আকাশের দিকে ইশারা করো এবং সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ ভেঙ্গে চৌচির হয়ে তোমরা বিরোধিতাকারীদের ওপর পড়ুক। একটা ফুঁক দাও এবং চোখের পলকে একটি সোনার প্রাসাদ গড়ে উঠুক। একটা আওয়াজ দাও এবং দেখতে না দেখতেই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা সামনে এসে দাঁড়াক এবং তাঁরা সাক্ষ্য দিক যে, আমরা মুহাম্মাদকে পয়গম্বর করে পাঠিয়েছি। আমাদের চোখের সামনে আকাশে উঠে যাও এবং আল্লাহর কাছ থেকে একটি পত্র আমাদের নামে লিখিয়ে আনো। এ পত্রটি আমরা হাত স্পর্শ করবো এবং নিজেদের চোখে দেখে পড়বো। —এসব লম্বা চওড়া দাবী দাওয়ার জবাবে একথা বলেই শেষ করে দেয়া হয়েছে যে, “এদেরকে বলে দাও, আমার পরওয়ারদিগার পাক-পবিত্র! আমি একজন বাণীবাহক ছাড়া কি অন্য কিছু?” অর্থাৎ নির্বোধের দল! আমি কি আল্লাহ হবার দাবী করেছিলাম? তাহলে তোমরা কেন আমার কাছে এ দাবী করছো? আমি কবে তোমাদের বলেছিলাম, আমি সর্বশক্তিমান? আমি কবে বলেছিলাম, এ পৃথিবী ও আকাশে আমার শাসন চলছে? আমার দাবী তো প্রথম দিন থেকে এটিই ছিল যে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বাণী বহনকারী একজন মানুষ। তোমাদের যদি যাচাই করতে হয় তাহলে আমার বাণী যাচাই করো। ঈমান আনতে হলে এ বাণীর সত্যতা ও যৌক্তিকতা যাচাই করে ঈমান আনো। আর অস্বীকার করতে হলে এ বাণীর মধ্যে কোন ত্রুটি বের করে দেখাও। আমার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে হলে একজন মানুষ হিসেবে আমার জীবন, চরিত্র ও কার্যকলাপ দেখো। এ সবকিছু বাদ দিয়ে তোমরা আমার কাছে এ যমীন চিরে ফেলা এবং আকাশ ভেঙ্গে ফেলার কি সব উদ্ভট দাবী নিয়ে এসেছো? নবওয়াতী কাজের সাথে এগুলোর কি সম্পর্ক?
# প্রত্যেক যুগের অজ্ঞ ও মূর্খ লোকেরা এ ভুল ধারণায় নিমজ্জিত থাকে যে, মানুষ কখনো রসূল হতে পারে না। তাই যখন কোন রসূল এসেছেন এবং তারা দেখছে তিনি পানাহার করছেন, তাঁর স্ত্রী-সন্তানাদি আছে, তিনি রক্ত-মাংসের মানুষ তখন তারা ফায়সালা দিয়ে বসেছে যে, এ ব্যক্তি রসূল নয়, কারণ এতো মানুষ। আর তিনি চলে যাবার দীর্ঘকাল পর তাঁর ভক্তদের মধ্যে এমনসব লোক জন্ম নিতে থাকে যারা বলতে থাকে, তিনি মানুষ ছিলেন না কারণ তিনি ছিলেন রসূল। ফলে কেউ তাঁকে আল্লাহ বানিয়েছেন, কেউ বানিয়েছেন আল্লাহর পুত্র, আবার কেউ বলেছে আল্লাহ তাঁর মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিলেন। মোটকথা মানবিক সত্তা ও নবুওয়াতী সত্তার একই সত্তার মধ্যে একত্র হওয়া হামেশা মূর্খদের কাছে একটি হেঁয়ালি হয়েই থেকেছে।
#মানুষের কাছে গিয়ে পয়গাম শুনিয়ে দেয়া হলো, শুধু এতটুকুই নবীর কাজ নয়। বরং এ পয়গাম অনুযায়ী মানব জীবনের সংশোধন করারও তাঁর কাজ। তাঁকে এ পয়গামের মূলনীতিগুলোকে মানবিক অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে প্রয়োগ করতে হয়। নিজের জীবনেও এ নীতিগুলো বাস্তবায়িত করতে হয়। যে অসংখ্য মানুষ এ পয়গাম শুনার ও বুঝার চেষ্টা করে তাদের মনে যেসব জটিল প্রশ্ন জাগে সেগুলোর জবাব তাঁকে দিতে হয়। যারা এ পয়গাম গ্রহণ করে, এর শিক্ষাবলীর ভিত্তিতে একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য তাদেরকে সংগঠিত করার ও প্রশিক্ষণ দেবার দায়িত্বও তাঁকে গ্রহণ করতে হয়।
বিকৃত ও ধ্বংসের সমর্থক শক্তিগুলোকে দাবিয়ে দেবার এবং যে সংস্কারের কর্মসূচী দিয়ে আল্লাহ নিজের নবী পাঠিয়েছেন তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাঁকে অস্বীকার, বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের মোকাবিলায় প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাতে হয়। এসব কাজ যখন মানুষের মধ্যেই করতে হয় তখন এগুলোর জন্য মানুষ ছাড়া আর কাকে পাঠানো যায়? ফেরেশতা তো বড় জোর এসে পয়গাম পৌঁছিয়ে দিয়ে চলে যেতো। মানুষের মধ্যে মানুষের মতো বসবাস করে মানুষের মতো কাজ করা এবং তারপর আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী মানুষের জীবনে সংস্কার সাধন করে দেখিয়ে দেয়া কোন ফেরেশতার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। একজন মানুষই ছিল এ কাজের উপযোগী।
#যেসব বহুবিধ পদ্ধতিতে আমি তোমাদের বুঝাচ্ছি এবং তোমাদের অবস্থার সংস্কার সাধনের জন্য প্রচেষ্টা চলাচ্ছি তাও আল্লাহ জানেন। আর তোমরা আমার বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছো তাও আল্লাহ দেখছেন। এসব কিছুর পর শেষ পর্যন্ত ফায়সালা তাঁকেই করতে হবে। তাই শুধুমাত্র তাঁর জানা ও দেখাই যথেষ্ট।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*কাফেরদের অমূলক দাবী : আমি এই কোরআনে মানুষদের বুঝানাের জন্যে… পড়তে পারবাে। (হে নবী,) তুমি (এদের এসব উদ্ভট কথার উত্তরে) বলো, মহান পবিত্র (আমার) আল্লাহ তায়ালা, আমি তাে কেবল একজন মানুষ (একজন) রসূল বৈ কিছুই নই'(আয়াত ৮৯-৯৩) পবিত্র কোরআনের অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করার চ্যালেঞ্জ এর মােকাবেলা করতে না পেরে তারা অদ্ভুত সব অলৌকিক কর্মকান্ডের দাবী জানাতে আরম্ভ করে দেয়। এসব দাবী দাওয়ার ব্যাপারে তাদের অনমনীয়তা ও কঠোরতার দ্বারা দুটো বিষয় প্রমাণিত হয়। এক. তাদের বালখিল্যতা, দুই. আল্লাহর প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বিভিন্নভাবে ও বিচিত্র দৃষ্টান্তসহ পবিত্র কোরআনের স্বরূপ তাদের সামনে পেশ করেছেন। এর দ্বারা পবিত্র কোরআনের স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং বাস্তবতা উপলব্ধি করা যে কোনাে বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু এতােসব সত্তেও মক্কার মুশরিকরা এটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করেনি, রসূলকে সত্য বলে স্বীকার করেনি, বরং রসূলের প্রতি ঈমান গ্রহণের পূর্বশর্ত স্বরূপ তারা দাবী জানায়, রসূল যেন শুষ্ক ভূমি থেকে ঝর্ণা প্রবাহিত করে দেখান, অথবা তার কাছে খেজুর ও আঙুরের এমন একটি বাগান থাকতে হবে যার মধ্য দিয়ে নহর প্রবাহিত হবে, অথবা তিনি আকাশ থেকে আযাব নামিয়ে আনবেন, সে আযাবের ফলে আকাশ টুকরাে টুকরাে হয়ে তাদের ওপর পতিত হবে যেমনটি কেয়ামতের দিন অথবা তিনি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ও ফেরেশতাদেরকে তাদের মুখােমুখী এনে হাযির করবেন এবং তারা স্বগােত্রীয় লােকদের যেভাবে সাহায্য সহযােগিতা করে থাকে ঠিক সেভাবেই আল্লাহ তায়ালা ও ফেরেশতারাও রসূলকে সাহায্য করবেন, রক্ষা করবেন। অথবা তার এমন একটি বাড়ি থাকতে হবে যা প্রস্তুত করা হবে মূল্যবান সব মনি মুক্তা উঠলেই চলবে না বরং সাথে লিখিত একখানা বাণীও আনতে হবে সেটা তারা স্বয়ং পড়ে দেখবে। এসব অযৌক্তিক ও হাস্যকর দাবী দাওয়া দ্বারা ওদের চিন্তা ও বুদ্ধি বিবেচনায় দৈন্যদশাই প্রমাণিত হয়। সাথে সাথে ওদের গােয়ার্তুমীও প্রমাণিত হয়। কি অদ্ভূত ওদের বিচার বুদ্ধি। ওরা একটি সজ্জিত ঘর ও উর্ধ্বলােকে গমনকে এক করে দেখে! ওরা শুষ্ক ভূমি থেকে ঝর্ণার প্রবাহন আর আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাদের ভূমিতে অবতরণকে এক করে দেখে। এসব উদ্ভট দাবী দাওয়া পেশ করার পেছনে একটিই কারণ বিদ্যমান, আর তা হচ্ছে এই যে, এগুলাে অলৌকিক অসাধারণ ব্যাপার। কাজেই এই অসাধারণ কাজগুলাে যদি নবী করে দেখাতে পারেন তাহলেই ওরা ঈমান গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে। কিন্তু ওরা বেমালুম ভুলে যায় যে, পবিত্র কোরআনই হচ্ছে স্বয়ং একটি অলৌকিক ও অসাধারণ বস্তু। এর অসাধারণ রচনাশৈলী, এর অসাধারণ বক্তব্য এবং এর অসাধারণ বিধি-বিধানের অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করে দেখানাে ওদের সাধ্যের সম্পূর্ণ বাইরে। এরপরও ওরা নবীর কাছে অলৌকিক ও অসাধারণ কাজের ফরমায়েশ জানায়। কারণ, পবিত্র কোরআনের অলৌকিকতা ও অসাবধানতার বিষয়টি চাক্ষুষ নয়। কাজেই ওরা চাক্ষুষ অলৌকিক ঘটনা দেখতে আগ্রহী। এই সত্যটি মনে রাখা উচিত যে, অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন করা নবী রসূলদের আওতাধীন নয়। তারা এসব কাজের জন্যে প্রেরিতও নন, বরং গােটা বিষয়টিই হচ্ছে একান্ত আল্লাহর ইচ্ছা ও বিবেচনা নির্ভর। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এসব অসাধারণ ঘটনাবলী প্রদর্শনের ক্ষমতা প্রদান না করে থাকলে তা কামনা করাও নবী-রসূলদের জন্যে অশােভনীয়। নবুওত ও রেসালাতের অন্যতম দাবীই হচ্ছে এই যে, যা করার অনুমতি নেই, তা আল্লাহর কাছে কামনা না করা। এ ক্ষেত্রে একজন নবী ও রসূল তার মানবীয় সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করবেন এবং তা প্রকাশ্যে ঘােষণা দিয়ে জানিয়েও দেবেন। এই নির্দেশই আল্লাহ তাঁর রসূলকে দিয়েছেন। (আয়াত ৯৩) অর্থাৎ মানবীয় সীমাবদ্ধতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই একজন নবী তার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাবেন। নিজের সাধ্যের বাইরে অথবা রেসালাতের দায়িত্বের বাইরে কোনাে কিছুর জন্যে যেন আল্লাহর কাছে আরযি পেশ না করেন। রসূলুল্লাহ(স.)-এর আগমনের আগে ও পরে বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়কে যে বদ্ধমূল ধারণাটি নবীদের প্রতি ঈমান গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে সেটা হচ্ছে, কোনাে মানুষ নবী হতে পারে না, বরং এই মহান দায়িত্ব ফেরেশতা ব্যতীত অন্য কোনাে মখলুক পালন করতে পারে না। তাদের সেই বদ্ধমূল ধারণার বিষয় সম্পর্কেই আল্লাহ তায়ালা বলছেন। (আয়াত ৯৪) আসলে মনুষ্যত্যের প্রকৃত মর্যাদা ও মূল্য অনুধাবন করতে অক্ষম বলেই ওদের মাঝে এ জাতীয় ভুল ধারণা জন্ম নিয়েছে। তদ্রুপ জীবন ও জগতের প্রকৃতি এবং ফেরেশতাদের সঠিক পরিচিতি সম্পর্কে অজ্ঞ বলেও ওদের মাঝে এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নিয়েছে। ওদের ধারণাই নেই যে, ফেরেশতাদেরকে পৃথিবীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যে সৃষ্টি করা হয়নি। তাছাড়া ফেরেশতারা কখনও তাদের আসল আকৃতি নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করে না। তাহলে একজন মানব ও ফেরেশতার মাঝে ওরা কিভাবে পার্থক্য করবে। এতােসব সত্তেও একজন মানুষ নবীকে বিশ্বাস করতে ওদের বড়ই কষ্ট হয়। এরই উত্তরে বলা হয়েছে। ‘(হে নবী) তুমি (তাদের) বলাে যে, (যদি এমন হতাে যে,) যমীনে (মানুষের বদলে) ফেরেশতারাই (বসবাস করতাে এবং মানুষের মতােই তারা) নিশ্চিন্তভাবে (এখানে) ঘুরে বেড়াত তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্যে আসমান থেকে কোনাে ফেরেশতাকেই নবী করে পাঠাতাম।'(আয়াত ৯৫) ফেরেশতাদেরকে পৃথিবীতে আবাদ করার ইচ্ছা যদি আল্লাহর থাকতাে, তাহলে তাদেরকে অবশ্যই তিনি মানুষের আকৃতি দান করতেন। কারণ পৃথিবীর প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্যে সেটাই উপযুক্ত। অন্য একটি আয়াতে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, আমি যদি কোনাে ফেরেশতাকে নবী হিসাবে প্রেরণ করতাম তাহলে তাকে পুরুষের আকৃতিতেই প্রেরণ করতাম। আল্লাহর জন্যে এটা আদৌ অসম্ভব নয়। কারণ, তিনি সব কিছুই করতে পারেন। কিন্তু তিনি প্রত্যেক বস্তুকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ধর্ম দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাঁরই কুদরত ও ইচ্ছায় প্রত্যেক বস্তু স্ব স্ব ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য নিয়েই টিকে আছে। এতে কোনাে ব্যতিক্রম বা পরিবর্তন সচরাচর ঘটেনা। কিন্তু অবিশ্বাসী সম্প্রদায় এই সত্যটুকু উপলব্ধি করতে চায় না। এই সহজ সরল বিষয়টি যারা বুঝতে চেষ্টা করে না, তাদের সাথে অহেতুক বাক-বিতন্ডা ও তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ার জন্যে রসূলুল্লাহ(স.)-কে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন। তাঁকে আল্লাহ তায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি যেন এসব বিষয়ের ফয়সালার ভার স্বয়ং তাঁর হাতেই ছেড়ে দেন। তিনিই এসব বিষয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন। কারণ, তিনি সব বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেফহাল। এ আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে। (আয়াত ৯৬)
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৯০-৯৩ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, রাবীআ’র দুই ছেলে উৎবা ও শায়বা আবু সুফিয়ান ইবনু হারব, বান্ আবদিন্দার গোত্রের দু’টি লোক, বান্ আসাদ গোত্রের আবু নজিতারী, আসওয়াদ ইবনু মুত্তালিব ইবনু আসদ, নাওমা, ইবনু আসওয়াদ, ওয়ালী ইবনু মুগীরা, আবু জেহেল ইবনু হিশাম, আবদুল্লাহ ইবনু উবাই, উমাইয়া, উমাইয়া ইবনু আস ইবনু অয়েল এবং হাজ্জাজের দুই পুত্র এরা সবাই বা এদের মধ্যে কিছু লোক সূর্যাস্তের পরে কাবা ঘরের পিছনে একত্রিত হয় এবং পরম্পর বলাবলি করেঃ “কাউকে পাঠিয়ে মুহাম্মদকে (সঃ) ডাকিয়ে নাও তার সাথে আজ আলাপ আলোচনা করে একটা ফায়সালা করে নেয়া যাক, যাতে কোন ওযর বাকী না থাকে। সুতরাং দূত রাসূলুল্লাহর (সঃ) কাছে গিয়ে খবর দিলোঃ “আপনার কওমের সম্রান্ত লোকেরা একত্রিত হয়েছেন এবং তাদের কাছে আপনার উপস্থিত কামনা করেছেন।” দূতের একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ধারণা করলেন যে, সম্ভবতঃ আল্লাহ তাআলা তাদেরকে সঠিক বোধশক্তি প্রদান করেছেন, কাজেই তারা হয়তো সত্য পথে চলে আসবে। তাই, তিনি কালবিলম্ব না করে তাদের কাছে গমন করলেন। তাঁকে দেখেই তারা সমস্বরে বলে উঠলো “দেখো আজ আমরা তোমার সামনে যুক্তি প্রমাণ পূরো করে দিচ্ছি যাতে আমাদের উপর কোন অভিযোগ না আসে। এজন্যেই আমরা তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। আল্লাহর কসম! তুমি আমাদের উপর যত বড় বিপদ চাপিয়ে দিয়েছো এতো বড় বিপদ কেউ কখনো তার কওমের উপর চাপায় নাই। তুমি আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে গালি দিচ্ছ, আমাদের দ্বীনকে মন্দ বলছো, আমাদের বড়দেরকে নির্বোধ বলে আখ্যায়িত করছো, আমাদের মা’বুদ বা উপাস্যদেরকে খারাপ বলছো এবং আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে গৃহ যুদ্ধের সূত্রপাত করছো। আল্লাহর শপথ! তুমি আমাদের অকল্যাণ সাধনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি কর নাই। এখন পরিষ্কার ভাবে শুনে নাও এবং বুঝে সুঝে জবাব দাও। এসব করার পিছনে মাল জমা করা যদি তোমার উদ্দেশ্য হয় তবে আমরা এজন্যে প্রস্তুত আছি। আমরা তোমাকে এমন মালদার বানিয়ে দেবো যে, আমাদের মধ্যে তোমার সমান ধনী আর কেউ থাকবে না। আর যদি নেতৃত্ব করা তোমার উদ্দেশ্য হয় তবে এজন্যেও আমরা তৈরী আছি। আমরা তোমারই হাতে নেতৃত্ব দান করবো এবং আমরা তোমার অধীনতা স্বীকার করে নেবো। যদি বাদশাহ হওয়ার তোমার ইচ্ছা থাকে তবে বল, আমরা তোমার বাদশাহীর ঘোষণা করছি। আর যদি আসলে তোমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে থাকে বা তোমাকে জ্বিনে। ধরে থাকে, তবে এ ক্ষেত্রেও আমরা প্রস্তুত আছি যে, টাকা পয়সা খরচ করে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। এতে হয় তুমি আরোগ্য লাভ করবে, না হয় আমাদেরকে অপারগ মনে করা হবে। তাদের এসব কথা শুনে নবীদের নেতা, পাপীদের শাফাআতকারী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বললেনঃ “জেনে রেখো যে, আমার মস্তিষ্ক বিকৃতিও ঘটে নাই, আমি এই রিসালাতের মাধ্যমে ধনী হতেও চাই না, আমার নেতৃত্বেরও লোভ নেই এবং আমি বাদশাহ হতেও চাই না। বরং আল্লাহ তাআলা আমাকে তোমাদের সকলের নিকট রাসূল করে পাঠিয়েছেন এবং আমার উপর তাঁর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। আমাকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমাদেরকে (জান্নাতের সুসংবাদ দান করি এবং (জাহান্নাম হতে) ভয় প্রদর্শনকারী। আমি আমার প্রতিপালকের পয়গাম তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের মঙ্গল কামনা করেছি। তোমরা যদি এটা কবুল করে নাও তবে উভয় জগতেই সুখের অধিকারী হবে। আর যদি না মানেনা, তবে আমি ধৈর্য ধারণ করবো, শেষ পর্যন্ত মহামহিমান্বিত আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সত্য ফায়সালা করবেন।”
রাসূলুল্লাহর (সঃ) এই জবাব শুনে কওমের নেতারা বললোঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! আমাদের এই প্রস্তাবগুলির একটিও যদি তুমি সমর্থন না কর তবে শুনো! তুমি তো নিজেও জান যে, আমাদের মত সংকীর্ণ শহর আর কারো নেই। আর আমাদের মত কম মালও আর কোন কওমের নেই এবং আমাদের মত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এতো কম রুজীও কোন কওম অর্জন করে না। তুমি যখন বলছো যে, তোমার প্রতিপালক তোমাকে স্বীয় রিসালাত দিয়ে পাঠিয়েছেন তখন তাঁর নিকট প্রার্থনা কর যে, তিনি যেন এই পাহাড় আমাদের এখান থেকে সরিয়ে দেন, যাতে আমাদের অঞ্চলটি প্রশস্ত হয়ে যায়, শহরটিও বড় হয়, তাতে নহর ও প্রস্রবণ প্রবাহিত হয়, যেমন সিরিয়া ও ইরাকে রয়েছে। আর এটাও প্রার্থনা কর যে, তিনি যেন আমাদের মৃত বাপ-দাদাদেরকে জীবিত করে দেন এবং তাদের মধ্যে কুসাই ইবনু কিলাব যেন অবশ্যই থাকেন। তিনি আমাদের মধ্যে একজন সম্ভ্রান্ত ও সত্যবাদী লোক ছিলেন। আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করবো, তিনি তোমাদের সম্পর্কে যা বলবেন তাতে আমাদের মনে তৃপ্তি আসবে। যদি তুমি এটা করে দিতে পারো তবে আমরা খাটি অন্তরে তোমার প্রতি ঈমান আনবো এবং তোমার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেবো।” তিনি। বললেনঃ “এগুলো নিয়ে আমাকে পাঠানো হয় নাই। এগুলো কোনটিই আমার শক্তির মধ্যে নয়। আমি তো শুধু আল্লাহ তাআলার কথাগুলি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে এসেছি। তোমরা কবুল করলে উভয় জগতে সুখী হবে। এবং কবুল না করলে আমি ধৈর্য ধরবো এবং মহান আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করবো। তিনি আমার ও তোমাদের মধ্যে ফায়সালা করে দিবেন।” তারা তখন বললোঃ “আচ্ছা, তুমি এটাও পারবে না, তা হলে আমরা স্বয়ং তোমার জন্যে এটাই বিবেচনা করছি যে, তুমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা কর যে, তিনি যেন তোমার কাছে কোন ফেরেশতা প্রেরণ করেন যিনি তোমার কথাকে সত্যায়িত করে তোমার পক্ষ থেকে আমাদেরকে উত্তর দেন। আর তাকে বলে তোমার নিজের জন্যে বাগ-বাগিচা, ধনভাণ্ডার এবং সোনা রূপার অট্টালিকা তৈরী করে নাও। যাতে তোমার অবস্থা সুন্দর ও পরিপাটী হয়ে যায় এবং তোমাকে খাদ্যের সন্ধানে আমাদের মত বাজার ঘুরে বেড়াতে না হয়। এটাও যদি হয়ে যায় তবে আমরা স্বীকার করে নিবো যে, সত্যি আল্লাহ তাআলার কাছে তোমার মর্যাদা রয়েছে এবং বাস্তবিকই তুমি আল্লাহর রাসূল।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “না আমি এগুলো করবো, না এগুলোর জন্যে আমার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা জানাবো এবং না আমি এজন্যে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ তাআলা আমাকে সুসংবাদ দাতা ও ভয়প্রদর্শক বানিয়েছেন, এ ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমরা যদি মেনে নাও তবে উভয় জগতে নিজেদের কল্যাণ আনয়ন করবে এবং না মানলে ঠিক আছে, দেখি আমার প্রতিপালক আমার ও তোমাদের মধ্যে কি ফায়সালা করেন। তারা বললোঃ “তা হলে আমরা বলছি যে, যাও! তোমার প্রতিপালককে বলে আমাদের উপর আকাশ নিক্ষেপ করিয়ে নাও; তুমি তো বলছোই যে, আল্লাহ ইচ্ছা করলে এইরূপ করবেন। কাজেই আমরা বলছি যে, এটাই করিয়ে নাও, বিলম্ব করো না।” তিনি জবাবে বললেনঃ “এটা আল্লাহর অধিকারের ব্যাপার। তিনি যা চান তা করেন। যা চান না করেন না।” মুশরিকরা তখন বললোঃ “দেখো, আল্লাহ তাআলার কি এটা জানা ছিল না যে, আমরা এ সময়ে তোমার কাছে বসবো এবং তোমাকে এ সবগুলো করতে বলবো? সুতরাং তাঁর তো উচিত ছিল এগুলো তোমাকে পূর্বে অবহিত করা? আর এটাও তাঁর বলে দেয়া উচিত ছিল যে, তোমাকে কি জবাব দিতে হবে? আর যদি আমরা না মানি তবে আমাদের সাথে কি ব্যবহার করা হবে? দেখো, আমরা শুনেছি যে, ইয়ামামার রহমান নামক একটি লোক তোমাকে এগুলো শিখিয়ে যায়। আল্লাহর কসম! আমরা। তো রহমানের উপর ঈমান আনবো না। আমরা তাকে মানবো এটা অসম্ভব। আমরা তোমার ব্যাপারে নিজেদেরকে দোষমুক্ত করেছিলাম। যা বলার ও শোনার ছিল তা সব কিছুই হয়ে গেল। তুমি তো আমাদের সুবিবেচনাপূর্ণ কথা মানলে না। সুতরাং এখন থেকে তুমি সাবধান থাকবে। তোমাকে একাজে আমরা মুক্ত ছেড়ে দিতে পারি না। হয় তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে, না হয় আমরাই তোমাকে ধ্বংস করে দেবো।” কেউ কেউ বললোঃ “আমরা তো ফেরেশতাদেরকে পূজা করে থাকি, যারা আল্লাহর কন্যা (নাউযুবিল্লাহ)।” অন্য কেউ কেউ বললোঃ “যে পর্যন্ত তুমি আল্লাহকে ও তাঁর ফেরেস্তাদেরকে সরাসরি আমাদের কাছে হাযির না করবে, আমরা ঈমান আনবো না।” অতঃপর মজলিস ভেঙ্গে গেল। আবদুল্লাহ ইবনু উমাইয়া ইবনু মুগীরা ইবনু আবিল্লাহ ইবনু মাখমুগ, যে তার ফুফু আতেফা বিতে আবদুল মুত্তালিবের ছেলে ছিল, তার সাথে রয়ে গেল। তার ফুফাতো ভাই তাকে বললোঃ “দেখো, এটা তো খুবই অন্যায় হলো যে, তোমার কওম যা বললো তুমি সেটাও স্বীকার করলে না এবং তারা যা চাইলো তুমি সেটাও করতে পারলে না? তারপর তুমি তাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখাচ্ছিলে, ওটা তারা চাইলো, কিন্তু সেটাও তুমি করলে না? এখন, আল্লাহর কসম! আমিও তো তোমার উপর ঈমান আনবো না যে পর্যন্ত না তুমি সিঁড়ি লাগিয়ে আকাশে আরোহণ করতঃ সেখান থেকে কোন কিতাব আনবে ও চার জন ফেরেস্তাকে সাক্ষী হিসেবে তোমার সাথে আনয়ন করবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই সমুদয় কথায় চরমভাবে দুঃখিত। হয়েছিলেন। তিনি বড়ই আশা নিয়ে এসেছিলেন যে, হয়তো তাঁর কওমের নেতৃস্থানীয় লোকেরা তাঁর কথা মেনে নেবে। কিন্তু যখন তিনি তাদের ঔদ্ধত্যপনা দেখলেন এবং লক্ষ্য করলেন যে, তারা ঈমান থেকে বহু দূরে সরে গেছে। তখন তিনি অত্যন্ত দুঃখিত মনে বাড়ী ফিরে আসলেন।
কথা হলো এই যে, তাদের এ সব কথার এক মাত্র উদ্দেশ্য ছিল রাসূলুল্লাহকে (সঃ) খাটো করে দেয়া এবং তাঁকে লা-জবাব করা। ঈমান। আনয়নের উদ্দেশ্য তাদের মোটেই ছিল না। যদি সত্যিই ঈমান আনয়নের উদ্দেশ্যে তারা এই প্রশ্নগুলি করে থাকতো তবে খুব সম্ভব আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এই মু’জিযাগুলি দেখিয়ে দিতেন। কেননা, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলা হয়েছিলঃ “যদি তুমি চাও তবে এরা যা চাচ্ছে। আমি তা দেখিয়ে দেই। কিন্তু জেনে রেখো যে, এর পরেও যদি তারা ঈমান না আনে তবে আমি তাদেরকে এমন শিক্ষামূলক শাস্তি দেবো যা কখনো কাউকেও দিই নাই। আর যদি তুমি চাও তবে আমি তাদের জন্য তাওবা ও রহমতের দরজা খুলে রাখি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) দ্বিতীয়টিই পছন্দ করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর অসংখ্য দরূদ ও সালাম বর্ষণ করুন! (আরবি) (১৭:৫৯) ও (আরবি) (২৫:৯) এই আয়াত দ্বয়ে রয়েছে যে, এই সব কিছুরই ক্ষমতা তার রয়েছে এবং সবই তিনি করতে পারেন। কিন্তু এগুলো বন্ধ রাখার কারণ এই যে, এগুলো প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পরেও যারা ঈমান আনবে না তাদেরকে তিনি ছেড়ে দিবেন না। বরং এমন শাস্তি প্রদান করবেন যা পূর্বে কখনো করেন নাই।
আল্লাহ তাআলা এই কাফিরদেরকে অবকাশ দিয়ে রেখেছেন এবং তাদের শেষ ঠিকানা হলো জাহান্নাম।
তাদের আবেদন ছিল যে, আরব মরু ভূমিতে যেন নদী-নালা প্রবাহিত হয় বা প্রস্রবণের ব্যবস্থা হয়ে যায় ইত্যাদি। এটা স্পষ্ট কথা যে, ব্যাপক ক্ষমতাবান আল্লাহ তাআলার কাছে এগুলোর কোনটিই কঠিন নয়। সবকিছুই তাঁর ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে। তিনি শুধু আদেশ করলেই হয়ে যায়। কিন্তু তিনি পূর্ণরূপে অবগত রয়েছেন যে, ঐ সব নিদর্শন দেখেও ঐ কাফিররা ঈমান আনবে না। যেমন এক জায়গায় তিনি বলেছেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “নিশ্চয় যাদের জন্যে তোমার প্রতিপালকের আযাবের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হয়ে গেছে তারা ঈমান আনবে না, যদিও তাদের কাছে সমস্ত নিদর্শন এসে পড়ে, যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি অবলোকন করে।” (১০:৯৬-৯৭) অন্য জায়গায় তিনি বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তাদের চাহিদা অনুযায়ী যদি আমি তাদের উপর ফেরেতাও অবতীর্ণ করি এবং মৃতেরা তাদের সাথে কথাও বলে, শুধু এটা নয়, বরং অদৃশ্যের সমস্ত কিছুই যদি তাদের সামনে খোলাখুলি। ভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তবুও এই কাফিররা আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া তার উপর ঈমান আনবে না। তাদের অধিকাংশ অজ্ঞ।”
ঐ কাফিররা নিজেদের জন্যে নদী-নালা চাওয়ার পর নবীকে (সঃ) বললোঃ আচ্ছা, তোমার জন্যে বাগ-বাগিচা ও নদী নালা হয়ে যাক। তারপর বললোঃ এটাও যদি না হয় তবে তুমি তো বলছো যে, কিয়ামতের দিন আকাশ ফেটে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে, তাহলে আজই আমাদের উপর ওর টুকরাগুলি নিক্ষেপ করা হোক? তারা নিজেরাও আল্লাহ তাআলার কাছে এই প্রার্থনাই করেছিলঃ “হে আল্লাহ! এ সব যদি তোমার পক্ষ থেকে সত্য হয়ে থাকে তবে আমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষণ কর (শেষ পর্যন্ত)।”
হযরত শুআ’ইবের (আঃ) কওমও এই ইচ্ছাই পোষণ করেছিল, যার ফলে তাদের উপর সায়েবানের দিনের শাস্তি অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু আমাদের নবী (সঃ) ছিলেন বিশ্ব শান্তির দূত এবং তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেছিলেনঃ “হে আল্লাহ! তাদেরকে ধ্বংস হতে রক্ষা করুন! এরা ঈমান আনয়ন করবে, একত্ববাদে বিশ্বাসী হবে এবং শিরক পরিত্যাগ করবে।” আল্লাহ পাক তাঁর এ প্রার্থনা ককূল করেছিলেন। তাই, তিনি তাদের উপর আযাব নাযিল করনে নাই। পরে তাদের অনেকেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। এমনকি আবদুল্লাহ ইবনু উমাইয়া, যে শেষে রাসুলুল্লাহর (সঃ) সাথে যাওয়ার পথে তাকে অনেক কথা শুনিয়েছিল এবং ঈমান না আনার শপথ গ্রহণ করেছিল, সেও ইসলাম গ্রহণ করে নিজের জীবনকে ধন্য করে নেয়।
(আরবি) শব্দ দ্বারা স্বর্ণকে বুঝানো হয়েছে। এমনকি হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদের (রাঃ) কিরআতে (আরবি) রয়েছে।
কাফিরদের আরো আবেদন ছিল এই যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) যেন সোনার ঘর হয়ে যায়, অথবা তাদের চোখের সামনে যেন তিনি সিঁড়ি লাগিয়ে আকাশে উঠে যান এবং সেখান থেকে কোন কিতাব নিয়ে আসেন যা প্রত্যেকের নামের আলাদা আলাদা কিতাব হয়। রাতারাতি যেন ঐ পর্চাগুলো তাদের শিয়রে পৌঁছে যায় এবং ওগুলির উপর তাদের নাম লিপিবদ্ধ থাকে। তাদের এই কথার উত্তরে মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে (সঃ) বলেনঃ “তুমি তাদেরকে বলে দাও যে, আল্লাহর সামনে কারো কিছুই খাটবে না। তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের মালিক নিজেই। তিনি যা চাবেন করবেন যা চাবেন না করবেন না। তোমাদের মুখের চাওয়ার জিনিসগুলো প্রকাশ করা বা না করার অধিকার তাঁর। আমি তো শুধু আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্যেই তোমাদের নিকট প্রেরিত হয়েছি। আমি আমার কর্তব্য পালন করেছি। আল্লাহ তাআলার আহকাম আমি তোমাদের নিকট পৌঁছিয়ে দিয়েছি। এখন তোমরা যা কিছু চেয়েছো সেগুলি আল্লাহর ক্ষমতার জিনিস। আমার সাধ্য নেই যে, এগুলি আমি তোমাদের নিকট আনয়ন করি।। মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মক্কা ভূমি সম্পর্কে আমাকে আল্লাহ তাআলা বলেছিলেনঃ “তুমি চাইলে আমি এটাকে সোনা বানিয়ে দিতে পারি।” আমি বললামঃ “হে আমার প্রতিপালক! না, এটা চাই না। আমি তো চাই যে, একদিন পেট পুরে খাবো এবং আর একদিন না খেয়ে থাকবো। যেই দিন না খেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় থাকবো সেই দিন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে খুব বেশী বেশী আপনাকে স্মরণ করবো। আর যেই দিন পেট পুরে খাবো সেই দিন আপনার প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো।” (জামে তিরমিযীতেও এ হাদীসটি রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে দুর্বল বলেছেন)
# ৯৪-৯৫ নং আয়াতের তাফসীর
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অধিকাংশ লোক ঈমান আনয়ন হতে এবং রাসূলদের আনুগত্য হতে একারণেই বিরত থাকছে যে, কোন মানুষ যে আল্লাহর রাসূল হতে পারেন এটা তাদের বোধগম্যই হয় না, এতে তারা অত্যন্ত বিস্মিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করে বসে। তারা পরিষ্কারভাবে বলে দেয়ঃ “একজন মানুষ আমাদেরকে পথ প্রদর্শন করবে?” ফিরাউন ও তার কওম একথাই বলেছিলঃ “আমরা আমাদের মতই দু’টি মানুষের উপর কি করে ঈমান আনতে পারি? বিশেষ করে ঐ অবস্থায় যে, তাদের কওমের সমস্ত লোক আমাদেরই অধীনে রয়েছে?” একথাই অন্যান্য উম্মতেরাও নিজ নিজ যামানার নবীদেরকে বলেছিলঃ “তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ। তোমরা তো এটা ছাড়া আর কিছুই করছো না যে, আমাদেরকে আমাদের বড়দের মা’ৰূদের থেকে বিভ্রান্ত করছো। আচ্ছা, কোন বিরাট নিদর্শন পেশ কর দেখি?” এ বিষয়ের আরো বহু আয়াত রয়েছে। এরপর মহান আল্লাহ নিজের স্নেহ, দয়া এবং মানুষের মধ্য হতেই রাসূল পাঠানোর কারণ বর্ণনা করেছেন এবং এর নিপূণতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেনঃ ফেরশতারা যদি রিসালাতের কাজ চালাতো, তবে না তোমরা তাদের কাছে উঠা-বসা করতে পারতে, ভালভাবে তাদের কথা বুঝতে পারতে। মানবীয় রাসূল তোমাদেরই শ্রেণীভুক্ত হয়ে থাকে বলেই তোমরা তাদের সাথে মেলামেশা করতে পার, তাদের আচার আচরণ দেখতে পার এবং তাদের সাথে মিলেজুলে নিজেদের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পার। আর তাদের আমল দেখে নিজেরা শিখে নিতে সক্ষম হও। যেমন আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) (৩:১৬৪) (আরবি) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবি) (৯:১২৮) অন্য আর এক স্থানে রয়েছেঃ (আরবি) (২:১৫১)
সবগুলিরই ভাবার্থ হচ্ছেঃ “এটাতো আল্লাহ তাআলার এক বড় অনগ্রহ যে, তিনি তোমাদেরই মধ্য হতে রাসূল পাঠিয়েছেন। সে তোমাদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনিয়ে থাকে, তোমাদেরকে (পাপ থেকে) পবিত্র করে এবং তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, আর তোমরা যা জানতে না তা তোমাদেরকে শিখিয়ে থাকে। সুতরাং আমাকে খুব বেশী বেশী স্মরণ করা তোমাদের উচিত, তা হলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো। তোমাদের উচিত আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং অকৃতজ্ঞ না হওয়া” এখানে মহান আল্লাহ বলেনঃ অবশ্যই আমি কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম। কিন্তু তোমরা নিজেরা মানুষ এই যৌক্তিকতাতেই মানুষের মধ্য হতেই আমি রাসূল পাঠিয়েছি।
# ৯৪-৯৫ নং আয়াতের তাফসীর
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ অধিকাংশ লোক ঈমান আনয়ন হতে এবং রাসূলদের আনুগত্য হতে একারণেই বিরত থাকছে যে, কোন মানুষ যে আল্লাহর রাসূল হতে পারেন এটা তাদের বোধগম্যই হয় না, এতে তারা অত্যন্ত বিস্মিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করে বসে। তারা পরিষ্কারভাবে বলে দেয়ঃ “একজন মানুষ আমাদেরকে পথ প্রদর্শন করবে?” ফিরাউন ও তার কওম একথাই বলেছিলঃ “আমরা আমাদের মতই দু’টি মানুষের উপর কি করে ঈমান আনতে পারি? বিশেষ করে ঐ অবস্থায় যে, তাদের কওমের সমস্ত লোক আমাদেরই অধীনে রয়েছে?” একথাই অন্যান্য উম্মতেরাও নিজ নিজ যামানার নবীদেরকে বলেছিলঃ “তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ। তোমরা তো এটা ছাড়া আর কিছুই করছো না যে, আমাদেরকে আমাদের বড়দের মা’ৰূদের থেকে বিভ্রান্ত করছো। আচ্ছা, কোন বিরাট নিদর্শন পেশ কর দেখি?” এ বিষয়ের আরো বহু আয়াত রয়েছে। এরপর মহান আল্লাহ নিজের স্নেহ, দয়া এবং মানুষের মধ্য হতেই রাসূল পাঠানোর কারণ বর্ণনা করেছেন এবং এর নিপূণতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলছেনঃ ফেরশতারা যদি রিসালাতের কাজ চালাতো, তবে না তোমরা তাদের কাছে উঠা-বসা করতে পারতে, ভালভাবে তাদের কথা বুঝতে পারতে। মানবীয় রাসূল তোমাদেরই শ্রেণীভুক্ত হয়ে থাকে বলেই তোমরা তাদের সাথে মেলামেশা করতে পার, তাদের আচার আচরণ দেখতে পার এবং তাদের সাথে মিলেজুলে নিজেদের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে পার। আর তাদের আমল দেখে নিজেরা শিখে নিতে সক্ষম হও। যেমন আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) (৩:১৬৪) (আরবি) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবি) (৯:১২৮) অন্য আর এক স্থানে রয়েছেঃ (আরবি) (২:১৫১)
সবগুলিরই ভাবার্থ হচ্ছেঃ “এটাতো আল্লাহ তাআলার এক বড় অনগ্রহ যে, তিনি তোমাদেরই মধ্য হতে রাসূল পাঠিয়েছেন। সে তোমাদেরকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনিয়ে থাকে, তোমাদেরকে (পাপ থেকে) পবিত্র করে এবং তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, আর তোমরা যা জানতে না তা তোমাদেরকে শিখিয়ে থাকে। সুতরাং আমাকে খুব বেশী বেশী স্মরণ করা তোমাদের উচিত, তা হলে আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো। তোমাদের উচিত আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং অকৃতজ্ঞ না হওয়া” এখানে মহান আল্লাহ বলেনঃ অবশ্যই আমি কোন ফেরেশতাকে রাসূল করে পাঠাতাম। কিন্তু তোমরা নিজেরা মানুষ এই যৌক্তিকতাতেই মানুষের মধ্য হতেই আমি রাসূল পাঠিয়েছি।
# আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি এই কাফিদেরকে বলে দাও আমার সত্যতার ব্যাপারে আমি অন্য কোন সাক্ষী খোজ করবো কেন? আল্লাহর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আমি যদি তাঁর পবিত্র সত্তার উপর অপবাদ আরোপ করে থাকি তবে তিনি আমার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। যেমন কুরআন কারীমের সূরায়ে আল-হাক্কাহতে রয়েছেঃ “যদি সে (নবী সঃ) আমার উপর কোন (মিথ্যা) আরোপ করতো, তবে আমি তার ডান হাত (দৃঢ়ভাবে) ধরতাম; অতঃপর তার প্রাণ শিরা কেটে ফেলতাম। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউই তার এই শাস্তি হতে রক্ষাকারী হতো না।” এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর কোন বান্দার অবস্থা গোপন নেই। কারা ইনআম, ইহসান, হিদায়াত ও স্নেহ পাওয়ার যোগ্য এবং কারা পথ ভ্রষ্ট ও হতভাগ্য হওয়ার যোগ্য তা আল্লাহ তাআলা ভালভাবেই জানেন।