أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৮১)
সূরা:- আল-কাহাফা।
সুরা:১৮
০১-০৫ নং আয়াত:-
[ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجَا
এতে তিনি কোন প্রকার বক্রতা রাখেননি। ]
www.motaher21.net
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ عَلٰی عَبۡدِہِ الۡکِتٰبَ وَ لَمۡ یَجۡعَلۡ لَّہٗ عِوَجًا ؕ﴿ٜ۱﴾
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং এতে তিনি কোন প্রকার বক্রতা রাখেননি।
قَیِّمًا لِّیُنۡذِرَ بَاۡسًا شَدِیۡدًا مِّنۡ لَّدُنۡہُ وَ یُبَشِّرَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ اَجۡرًا حَسَنًا ۙ﴿۲﴾
তিনি একে করেছেন সুপ্রতিষ্ঠিত; যাতে ওটা তাঁর নিকট হতে (অবতীর্ণ) কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করে এবং সৎকর্মশীল বিশ্বাসীগণ এই সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য আছে উত্তম পুরস্কার (জান্নাত);
مَّاکِثِیۡنَ فِیۡہِ اَبَدًا ۙ﴿۳﴾
যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে।
وَّ یُنۡذِرَ الَّذِیۡنَ قَالُوا اتَّخَذَ اللّٰہُ وَلَدًا ٭﴿۴﴾
এবং তাদেরকেও সতর্ক করে, যারা বলে যে, ‘আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন।’
مَا لَہُمۡ بِہٖ مِنۡ عِلۡمٍ وَّ لَا لِاٰبَآئِہِمۡ ؕ کَبُرَتۡ کَلِمَۃً تَخۡرُجُ مِنۡ اَفۡوَاہِہِمۡ ؕ اِنۡ یَّقُوۡلُوۡنَ اِلَّا کَذِبًا ﴿۵﴾
এই বিষয়ে তাদের কোনই জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না; তাদের মুখনিঃসৃত বাক্য কি সাংঘাতিক! তারা তো শুধু মিথ্যাই বলে।
০১-০৫ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
নামকরণ:
الْكَهْف শব্দের অর্থ গুহা, অত্র সূরাতে বাণী-ইসরাঈলের গুহাবাসিন্দা তথা “আসহাবুল কাহ্ফ” সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ফলে একে “সূরাতুল কাহ্ফ” নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ফযীলত:
সূরা কাহ্ফ তেলাওয়াত করলে বাড়িতে শান্তি ও বরকত নাযিল হয়। একজন সাহাবী এই সূরাটি পাঠ করতে শুরু করেন। তাঁর বাড়িতে একটি জন্তু ছিল, তা লাফাতে শুরু করে। সাহাবী গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে সামিয়ানার মত এক খণ্ড মেঘ দেখতে পান যা তাঁর ওপর ছায়া করেছে। তিনি এটা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন: তুমি এটা পাঠ করতে থাকতে। এটা হল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ঐ ‘সাকীনা’ বা প্রশান্তি যা কুরআন পাঠের সময় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৮৯৩)
এ সূরার প্রথম ও শেষ দশ আয়াতের ফযীলতের ব্যাপারে হাদীসগুলো এভাবে বর্ণিত হয়েছে: যে ব্যক্তি সূরা কাহ্ফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্ত করবে, সে ব্যক্তি দাজ্জালের ফিৎনা থেকে সুরক্ষিত থাকবে। (নাসাঈ হা: ৮০২৪, তিরমিযী হা: ২৮৮৬, সহীহ) সহীহ মুসলিমে শেষ দশটি আয়াত মুখস্তের এ ফযীলত বর্ণনা এসেছে (হাদীস নং ৮০৯)। যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরা কাহ্ফ পড়বে, তার জন্য আগামী জুমআহ পর্যন্ত একটি বিশেষ জ্যোতি আলোকিত হয়ে থাকবে। (সহীহুল জামে হা: ৬৪৭০)
শানে নুযূল:
কুরাইশরা নাযার ইবনু হারিস ও ‘উকবা বিন মুঈতকে মদীনার ইয়াহূদী আলেমদের নিকট পাঠিয়ে দেয় এবং তাদেরকে বলে: তোমরা তাদের কাছে গিয়ে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরবে। কারণ ইয়াহূদী আলেমদের কাছে পূর্ববর্তী নাবীদের সম্পর্কে জ্ঞান ছিল, তাই তারা সত্য মিথ্যা বলতে পারবে। সুতরাং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে তাদের মতামত কী তা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে। এই দু’জন তখন মদীনার ইয়াহূদী আলেমদের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তাদের সামনে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অবস্থা সম্পর্কে সব কিছু তুলে ধরে, তারা এদেরকে বলে: দেখ আমরা তোমাদেরকে একটা মীমাংসার কথা বলছি। তোমরা ফিরে গিয়ে মুহাম্মাদকে তিনটি প্রশ্ন করবে। যদি তিনি উত্তর দিতে পারেন, তবে তিনি সত্য নাবী এতে কোন সন্দেহ নেই। আর যদি উত্তর দিতে না পারেন, তবে তাঁর মিথ্যাবাদী হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। তখন তোমরা তাঁর ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবে। তোমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করবে: (এক) পূর্বযুগে যে যুবকরা বেরিয়ে গিয়েছিল তাদের ঘটনা কী? কেননা এটা অত্যন্ত বিস্ময়কর ঘটনা। (দুই) তাঁকে ঐ ব্যক্তির অবস্থা জিজ্ঞেস করবে যিনি সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি পূর্ব প্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে এসেছিলেন। (তিন) তাঁকে তোমরা রূহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। যদি তিনি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন, তবে তোমরা তাকে নাবী বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর অনুসরণ করবে। আর যদি উত্তর দিতে না পারেন তবে জানবে যে, তিনি মিথ্যাবাদী। সুতরাং যা ইচ্ছা তা-ই করবে। এরা দু’জন মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশদেরকে বলে: “শেষ ফায়সালার কথা ইয়াহূদী আলেমগণ বলে দিয়েছেন। সুতরাং চল আমরা তাকে প্রশ্নগুলি করি। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আগমন করে এবং তাঁকে ঐ তিনটি প্রশ্ন করে। তিনি তাদেরকে বললেন: তোমরা আগামী দিন এস, আমি তোমাদের এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেব। কিন্তু তিনি ‘ইন্শা-আল্লাহ’ বলতে ভুলে যান। এরপর পনের দিন অতিবাহিত হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর কাছে না কোন ওয়াহী আসে, না আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাঁকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে মক্কাবাসী ক্ষুব্ধ হয় এবং পরস্পর বলাবলি করে: দেখ কালকের ওয়াদা ছিল আর আজ পনের দিন কেটে গেল, তবুও সে জবাব দিতে পারল না। এতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দ্বিগুণ দুঃখে জর্জরিত হতে লাগলেন। একদিকে কুরাইশদেরকে জবাব দিতে না পারায় তাদের কথা শুনতে হচ্ছে। অন্যদিকে: ওয়াহী আসা বন্ধ হয়েছে। এরপর জিবরীল (عليه السلام) আগমন করেন এবং সূরা কাহ্ফ অবতীর্ণ হয়। এতেই ইনশা-আল্লাহ তা‘আলা না বলায় তাঁকে ধমকানো হয়, ঐ যুবকদের ঘটনা বর্ণনা করা হয়, ঐ ভ্রমণকারীর বর্ণনা দেয়া হয় এবং রূহের ব্যাপারে জবাব দেয়া হয়। (তাফসীর ত্ববারী ১৫/১২৭-১২৮, ইবুন কাসীর খ. ৫/পৃ. ১৪২)
সূরা কাহফ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূরা, সূরাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সান্ত্বনা প্রদান, তারপর আসহাবে কাহফ-এর বর্ণনা, অতঃপর দুটি বাগানের মালিকের দৃষ্টান্ত, তারপর দুনিয়ার উপমা এবং সবশেষে যুলকারনাইন ও ইয়া’জূজ-মা’জূজের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
সূরা শুরু করলেন আল্লাহ তা‘আলা নিজের প্রশংসা করার মাধ্যমে। আল্লাহ তা‘আলা যে কোন বিষয় শুরু বা শেষ করার ক্ষেত্রে নিজের প্রশংসা করেন। মূলত এর মাধ্যমে বান্দাদেরকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, কোন ভাল কাজের শুরু-শেষসহ সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করতে হয়। এ সূরাটি হল সে পাঁচটি সূরার অন্তর্ভুক্ত (সূরা ফাতিহা, আন‘আম, সাবা ও ফাতির) যে পাঁচটি সূরা ‘আল হামদুলিল্লাহ’ দ্বারা শুরু করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি কিতাব তথা কুরআন নাযিল করে যেমন ভাল কাজ করেছেন তেমনি তা দ্বারা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-সহ সকল মানুষকে অনুগ্রহ করেছেন। সুতরাং তিনি প্রশংসার পাত্র।
এখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলা عَبْدِ বা দাস বললেন, যেমন সূরা বানী ইসরাঈলে বলেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার আবদ বা দাস হওয়া একটি মহৎ ও বড় গুণ।
عِوَجًا শব্দের অর্থ বক্রতা, ত্র“টি। অর্থাৎ শাব্দিক ও আর্থিক কোন দ্ব্যর্থতা নেই, পূর্ববর্তীদের সকল সংবাদ সত্য, বিধি-বিধানগুলো ত্র“টি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত। হালাল-হারাম, ভাল-মন্দ, কি কাজ করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচা যাবে, কোন্টি হিদায়াতের পথ কোন্টি ভ্রষ্টতার পথ ইত্যাদি প্রতিটি দিক যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(قُرْاٰنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِيْ عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُوْنَ)
“এ কুরআন আরবি ভাষায়, এতে বিন্দুমাত্রও বক্রতা নেই, যাতে তারা সাবধানতা অবলম্বন করে।” (সূরা যুমার ৩৯:২৮)
مستقيما لاميل فيه ولازيغ – قَيِّمًا
অর্থাৎ এ কুরআন সুপ্রতিষ্ঠিত, কোন বক্রতা ও বিচ্যুতি নেই, এটি সঠিক পথ প্রদর্শন করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ هٰذَا الْقُرْاٰنَ يَهْدِيْ لِلَّتِيْ هِيَ أَقْوَمُ)
“নিশ্চয়ই এ কুরআন দিশ দান করে সে পথের দিকে যা সুদৃঢ়।” (সূরা ইসরা ১৭:৯)
সুতরাং যারা কাফির-মুশরিক তাদেরকে এ কুরআন কঠিন শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করে, আর সৎকর্মপরায়ণ মু’মিন-মুত্তাকিদেরকে উত্তম পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়ে থাকে। এটা হল কুরআনের অন্যতম একটি মূলনীতি যেখানে কাফিরদের কথা উল্লেখ থাকবে সেখানে মু’মিনদের কথাও উল্লেখ থাকবে, যেখানে জাহান্নামের বর্ণনা থাকবে সেখানে জান্নাতের কথাও থাকবে এবং যেখানে ভীতি প্রদর্শন থাকবে সেখানে সুসংবাদও থাকবে।
(بَأْسًا شَدِيْدًا)
‘কঠিন শাস্তি’ এতে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের শাস্তি শামিল। (أَجْرًا حَسَنًا) এতে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভসহ সকল সফলতা অন্তর্ভুক্ত। তাই পরের আয়াতে বলা হয়েছে তারা সেখানে তথা জান্নাতে সর্বদা থাকবে সেখান থেকে কখনো বের করে দেয়া হবে না।
এবং এতে আরো সতর্ক করা হয়েছে ঐ সমস্ত লোকদেরকে, যারা কোন প্রকার দলীল-প্রমাণ ছাড়াই বলে যে, আল্লাহ তা‘আলার সন্তান রয়েছে। এটা আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করে তাঁর ওপর অপবাদ দেয়া। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ওপর এরূপ অপবাদ দেয়, আল্লাহ তা‘আলা তার এ গুনাহ ক্ষমা করবেন না। এর জন্য কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা সর্বপ্রকার শরীক (স্ত্রী, পুত্র, ওয়ালী ইত্যাদি) গ্রহণ করা থেকে মুক্ত। যেরূপ সূরা ইসরার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি জেনে শুনে আল্লাহ তা‘আলার সাথে এই ধরনের শরীক স্থাপন করবে তার জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যাবে এবং সে চিরকাল জাহান্নামে অবস্থান করবে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(إِنَّه۫ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللّٰهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللّٰهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوٰهُ النَّارُ ط وَمَا لِلظّٰلِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ)
“কেউ আল্লাহর সাথে শরীক করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত অবশ্যই হারাম করবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। জালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৭২)
মূলত যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করে তাদের এ ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান নেই, যদি সঠিক জ্ঞান থাকত তাহলে কখনো শির্ক করত না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা কোথাও শির্ক করার নির্দেশ দেন নাই এবং শির্ক করার নির্দেশ দিয়ে কোন কিতাব ও রাসূল প্রেরণ করেননি এবং তারা যে তাদের বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে বলে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এরূপ শির্ক করতে পেয়েছি, তাদের বাপ-দাদাদেরও সঠিক জ্ঞান ছিল না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلٰي مَآ أَنْزَلَ اللّٰهُ وَإِلَي الرَّسُوْلِ قَالُوْا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ اٰبَا۬ءَنَا ط أَوَلَوْ كَانَ اٰبَآؤُهُمْ لَا يَعْلَمُوْنَ شَيْئًا وَّلَا يَهْتَدُوْنَ)
“যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার দিকে ও রাসূলের দিকে আস, তারা বলে, ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যাতে পেয়েছি তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’ যদিও তাদের পূর্বপুরুষগণ কিছুই জানত না এবং সৎপথ প্রাপ্তও ছিল না, (তবুও কি তাদের অনুসরণ করবে?)।” (সূরা মায়িদা ৫:১০৪)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার পুত্র রয়েছে তাদের এ কথা কতইনা জঘণ্য কথা। এ কথা সূরা ইসরার ৪০ নং আয়াতেও বলা হয়েছে। তাদের এসব কথা শুনে আকাশ ভেঙ্গে জমিন ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে যায়।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক হয় এমন সকল প্রকার কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। কেননা শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম। আর যারা শির্ক করে তারা সবচেয়ে বড় জালিম।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা উচিত, কেননা তাঁর অনুগ্রহ ব্যতীত এক মুহূর্ত চলা সম্ভব নয়।
২. কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সঠিক পথের দিশারী, এতে কোন প্রকার বক্রতা নেই।
৩. আল্লাহ তা‘আলার কোন শরীক নেই, তিনি একক ও অদ্বিতীয়।
৪. কোন অন্যায় কাজে বড়দের অনুসরণ করা যাবে না।
৫. আল্লাহ তা‘আলার বান্দা হওয়া অনেক মর্যাদার বিষয়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
(১৮-কাহাফ) : নামকরণ: প্রথম রুকূ’র ৯ আয়াত اِذۡ اَوَى الۡفِتۡيَةُ اِلَى الۡكَهۡفِ থেকে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ নাম দেবার মানে হচ্ছে এই যে, এটা এমন একটা সূরা যার মধ্যে আল কাহফ শব্দ এসেছে।
(১৮-কাহাফ) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :\nএখান থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ে অবতীর্ণ সূরাগুলো শুরু হচ্ছে। মক্কী জীবনকে আমি চারটি বড় বড় অধ্যায়ে ভাগ করেছি। সূরা আন’আমের ভূমিকায় এর বিস্তারিত বিবরণ এসে গেছে। এ বিভাগ অনুযায়ী তৃতীয় অধ্যায়টি প্রায় ৫ নববী সন থেকে শুরু হয়ে ১০ নববী সন পর্যন্ত বিস্তৃত। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর মোকাবিলায় এ অধ্যায়টির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, পূর্ববর্তী অধ্যায় দু’টিতে কুরাইশরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর আন্দোলন ও জামায়াতকে বিপর্যস্ত করার জন্য বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে উপহাস, ব্যাংগ-বিদ্রূপ, আপত্তি, অপবাদ, দোষারোপ, ভীতি প্রদর্শন, লোভ দেখানো ও বিরুদ্ধ প্রচারণার ওপর নির্ভর করছিল। কিন্তু এ তৃতীয় অধ্যায়ে এসে তারা জুলুম, নিপীড়ন, মারধর ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির অস্ত্র খুব কড়াকড়িভাবে ব্যবহার করে। এমনকি বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে দেশ ত্যাগ করে হাবশার দিকে যেতে হয়। আর বাদবাকি মুসলমানদের এবং তাদের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পরিবার ও বংশের লোকদের আবু তালেব গিরি গুহায় পূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বয়কটের মধ্যে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করতে হয়। তবুও এ যুগে আবু তালেব ও উমমূল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রা.) ন্যায় দু’ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রভাবের ফলে কুরাইশদের দু’টি বড় বড় শাখা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল। ১০ নববী সনে এ দু’জনের মৃত্যুর সাথে সাথেই এ অধ্যায়টির সমাপ্তি ঘটে। এরপর শুরু হয় চতুর্থ অধ্যায়। এ শেষ অধ্যায়ে মুসলমানদের মক্কায় জীবন যাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি শেষ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত মুসলমানদের নিয়ে মক্কা ত্যাগ করতে হয়। সূরা কাহফের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করলে বুঝা যায়, মক্কী যুগের এ তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতেই এ সূরাটি নাযিল হয়ে থাকবে। এ সময় জুলুম-নিপীড়ন, বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তখনো মুসলমানরা হাবশায় হিজরত করেনি। তখন যেসব মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছিল তাদেরকে আসহাবে কাহফের কাহিনী শুনানো হয়, যাতে তাদের হিম্মত বেড়ে যায় এবং তারা জানতে পারে যে, ঈমানদাররা নিজেদের ঈমান বাঁচাবার জন্য ইতিপূর্বে কি করেছে।
(১৮-কাহাফ) : বিষয়বস্ত ও মূল বক্তব্য : \n মক্কার মুশরিকরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরীক্ষা নেবার জন্য আহলি কিতাবদের পরামর্শক্রমে তাঁর সামনে যে তিনটি প্রশ্ন করেছিল তার জবাবে এ সূরাটি নাযিল হয়। প্রশ্ন তিনটি ছিলঃ এক, আসহাবে কাহ্ফ কারা ছিলেন? দুই, খিযিরের ঘটনাটি এবং তার তাৎপর্য কি?১ তিন, যুলকারনাইনের ঘটনাটি কি? এ তিনটি কাহিনীই খৃস্টান ও ইহুদীদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত ছিল। হিজাযে এর কোন চর্চা ছিল না। তাই আহলি কিতাবরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সত্যিই কোন গায়েবী ইলমের মাধ্যম আছে কিনা তা জানার জন্যই এগুলো নির্বাচন করেছিল। কিন্তু আল্লাহ তাঁর নবীর মুখ দিয়ে কেবল এগুলোর পূর্ণ জবাব দিয়েই ক্ষান্ত হননি বরং এ সংগে এ ঘটনা তিনটিকে সে সময় মক্কায় কুফর ও ইসলামের মধ্যে যে অবস্থা বিরাজ করছিল তার সাথে পুরোপুরি খাপ খাইয়ে দিয়েছেন।\n । ১. হাদীসে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল রূহ সম্পর্কে। বনী ইসরাঈলের ১০ রুকূ’তে এর জবাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু সূরা কাহ্ফ ও বনী ইসরাঈলের নাযিলের সময়কালের মধ্যে রয়েছে কয়েক বছরের ব্যবধান। আর সূরা কাহফে দু’টির জায়গায় তিনটি কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তাই আমার মতে, দ্বিতীয় প্রশ্নটি হযরত খিযির সম্পর্কেই ছিল, রূহ সম্পর্কে নয়। খোদ কুরআনেই এমনি একটি ইশারা আছে, তা থেকে আমার এ অভিমতের প্রতি সমর্থন পাওয়া যাবে। (দেখুন ৬১ টীকা)\n । একঃ আসহাবে কাহ্ফ সম্পর্কে বলেন, এ কুরআন যে তাওহীদের দাওয়াত পেশ করছে তারা ছিলেন তারই প্রবক্তা। তাদের অবস্থা মক্কার এ মুষ্টিমেয় মজলুম মুসলমানদের অবস্থা থেকে এবং তাদের জাতির মনোভাব ও ভূমিকা মক্কার কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের ভূমিকা থেকে ভিন্নতর ছিল না। তারপর এ কাহিনী থেকে ঈমানদারদেরকে এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, যদি কাফেররা সীমাহীন ক্ষমতা ও আধিপত্যের অধিকারী হয়ে গিয়ে থাকে তাদের জুলুম-নির্যাতনের ফলে সমাজে একজন মু’মিন শ্বাস গ্রহণ করারও অধিকার হারিয়ে বসে তবুও তার বাতিলের সামনে মাথা নত না করা উচিত বরং আল্লাহর ওপর ভরসা করে দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। এ প্রসংগে আনুসংগিকভাবে মক্কার কাফেরদেরকে একথাও বলা হয়েছে যে, আসহাবে কাহফের কাহিনী আখেরাত বিশ্বাসের নির্ভুলতার একটি প্রমাণ। যেভাবে আল্লাহ তা’আলা আসহাবে কাহফকে সুদীর্ঘকাল মৃত্যু নিদ্রায় বিভোর করে রাখার পর আবার জীবিত করে তোলেন ঠিক তেমনিভাবে মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন মেনে নিতে তোমরা অস্বীকার করলে কি হবে, তা আল্লাহর ক্ষমতার বাইরে নয়।\nদুইঃ মক্কার সরদার ও সচ্ছল পরিবারের লোকেরা নিজেদের জনপদের ক্ষুদ্র নও মুসলিম জামায়াতের ওপর যে জুলুম-নিপীড়ন চালাচ্ছিল এবং তাদের সাথে ঘৃণা ও লাঞ্ছনাপূর্ণ আচরণ করছিল আসহাবে কাহফের কাহিনীর পথ ধরে সে সম্পর্কে আলোচনা শুরু করা হয়েছে। এ প্রসংগে একদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, এ জালেমদের সাথে কোন আপোস করবে না এবং নিজের গরীব সাথীদের মোকাবিলায় এ বড় লোকদের মোটেই গুরুত্ব দেবে না। অন্যদিকে এ ধনী ও সরদারদেরকে এ মর্মে নসীয়ত করা হয়েছে যে, নিজেদের দু’দিনের আয়েশী জীবনের চাকচিক্য দেখে ভুলে যেয়ো না বরং চিরন্তন ও চিরস্থায়ী কল্যাণের সন্ধান করো।\n । তিনঃ এ আলোচনা প্রসংগে খিযির ও মূসার কাহিনীটি এমনভাবে শুনিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাতে কাফেরদের প্রশ্নের জবাবও এসে গেছে এ সংগে মু’মিনদেরকেও সরবরাহ করা হয়েছে সান্তনার সরঞ্জাম। এ কাহিনীতে মূলত যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, যেসব উদ্দেশ্য ও কল্যাণকারিতার ভিত্তিতে আল্লাহর এ বিশাল সৃষ্টিজগত চলছে তা যেহেতু তোমাদের দৃষ্টির অন্তরালে রয়েছে তাই তোমরা কথায় কথায় অবাক হয়ে প্রশ্ন করো, এমন কেন হলো? এ কি- হয়ে গেলো? এ-তো বড়ই ক্ষতি হলো! অথচ যদি পর্দা উঠিয়ে দেয়া হয় তাহলে তোমরা নিজেরাই জানতে পারবে এখানে যা কিছু হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে এবং বাহ্যত যে জিনিসের মধ্যে ক্ষতি দেখা যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত তার ফলশ্রুতিতে কোন না কোন কল্যাণই দেখা যায়।\n । চারঃ এরপর যুলকারনাইনের কাহিনী বলা হয়। সেখানে প্রশ্নকারীদেরকে এ শিক্ষা দেয়া হয় যে, তোমরা তো নিজেদের এ সামান্য সরদারীর মোহে অহংকারী হয়ে উঠেছো অথচ যুলকারণাইনকে দেখো। কত বড় শাসক। কত জবরদস্ত বিজেতা। কত বিপুল বিশাল উপায়- উপকরণের মালিক হয়েও নিজের স্বরূপ ও পরিচিত বিস্মৃত হননি। নিজের স্রষ্টার সামনে সবসময় মাথা হেঁট করে থাকতেন। অন্যদিকে তোমরা নিজেদের এ সামান্য পার্থিব বৈভব ও ক্ষেত খামারের শ্যামল শোভাকে চিরস্থায়ী মনে করে বসেছো। কিন্তু তিনি দুনিয়ার সবচেয়ে মজবুত ও সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা প্রাচীর নির্মাণ করেও মনে করতেন সর্বাবস্থায় একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভর করা যেতে পারে, এ প্রাচীরের ওপর নয়। আল্লাহ যতদিন চাইবেন ততদিন এ প্রাচীর শত্রুদের পথ রোধ করতে থাকবে এবং যখনই তাঁর ইচ্ছা ভিন্নতর হবে তখনই এ প্রাচীরে ফাটল ও গর্ত ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।\n । এভাবে কাফেরদের পরীক্ষামূলক প্রশ্নগুলো তাদের ওপরই পুরোপুরি উল্টে দেবার পর বক্তব্যের শেষে আবার সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে, বক্তব্য শুরু করার সময় যা বলা হয়েছিল। অর্থাৎ তাওহীদ ও আখেরাত হচ্ছে পুরোপুরি সত্য। একে মেনে নেয়া, সে অনুযায়ী নিজেদের সংশোধন করা এবং আল্লাহর সামনে নিজেদের জবাবদিহি করতে হবে বলে মনে করে দুনিয়ায় জীবন যাপন করার মধ্যেই তোমাদের নিজেদের মংগল। এভাবে না চললে তোমাদের নিজেদের জীবন ধ্বংস হবে এবং তোমাদের সমস্ত কার্যকলাপও নিষ্ফল হয়ে যাবে।
#এর মধ্যে এমন কোন কথাবার্তা নেই যা বুঝতে পারা যায় না। আবার সত্য ও ন্যায়ের সরল রেখা থেকে বিচ্যুত এমন কোন কথাও নেই যা মেনে নিতে কোন সত্যপন্থী লোক ইতস্তত করতে পারে।
# যারা আল্লাহর সন্তান-সন্তুতি আছে বলে দাবী করে। এদের মধ্যে রয়েছে খৃস্টান, ইহুদী ও আরব মুশরিকরা।
# তাদের এ উক্তি যে, অমুক আল্লাহর পুত্র অথবা অমুককে আল্লাহ পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এগুলো তারা এজন্য বলছে না যে, তাদের আল্লাহর পুত্র হবার বা আল্লাহর কাউকে পুত্র বানিয়ে নেবার ব্যাপারে তারা কিছু জানে। বরং নিছক নিজেদের ভক্তি শ্রদ্ধার বাড়াবাড়ির কারণে তারা একটি মনগড়া মত দিয়েছে এবং এভাবে তারা যে কত মারাত্মক গোমরাহীর কথা বলছে এবং বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভু আল্লাহর বিরুদ্ধে যে কত বড় বেয়াদবী ও মিথ্যাচার করে যাচ্ছে তার কোন অনুভূতিই তাদের নেই।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
#সংক্ষিপ্ত আলােচনা : কিসসা কাহিনীই হচ্ছে এই সূরার প্রধান উপাদান। এর শুরুতেই রয়েছে ‘আসহাবুল কাহাফের’ ঘটনা। এরপর দুটো বাগিচার কিসসা। তারপর ইবলীস ও হযরত আদমের সংক্ষিপ্ত আলোচনা, মাঝখানে হযরত মুসা(আ.) ও আল্লাহর জনৈক সৎ বান্দার ঘটনা এবং সবার শেষে জুলকারনাইনের ঘটনা। এই সূরার অধিকাংশ ঘটনাগুলােই বিস্তৃত। সূরার মোট একশ দশ আয়াতের মধ্য থেকে ৭১ আয়াত জুড়েই রয়েছে এসব কাহিনী। বাদ-বাকী আয়াতগুলােরও বেশীর ভাগ এসব কাহিনীসংক্রান্ত মন্তব্যে পরিপূর্ণ। এই কিসসা কাহিনীর পাশাপাশি কেয়ামতের কিছু দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আরাে রয়েছে জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ কিছু দৃশ্য, যা দৃশ্যের মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশের কোরআনী রীতির অস্বাভাবিক প্রতিফলন। তবে সূরার যে কেন্দ্রীয় বিষয়টির সাথে তার আলােচ্য বিষয়গুলাে সম্পৃক্ত এবং তার গােটা আলােচনা যে বিষয়টির ওপর কেন্দ্রীভূত, তা হলাে মানুষের আকীদা বিশ্বাস, চিন্তা ও দৃষ্টিভংগির সংশােধন এবং এই আকীদা বিশ্বাসের নিরীখে মূল্যবােধগুলাের সংশােধন। আকীদা বিশ্বাসের সংশােধনমূলক বক্তব্য সূরার শুরুতেও রয়েছে, শেষেও রয়েছে। শুরুতে রয়েছে, ‘যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি তার বান্দার ওপর কিতাব নাযিল করেছেন…'(আয়াত ১-৫) আবার সূরার শেষে রয়েছে, বলাে, আমি তােমাদের মতােই মানুষ, আমার কাছে ওহী আসে, তােমাদের মাবুদ একমাত্র মাবুদ…’ এভাবে আল্লাহর একত্ব প্রমাণে, শিরক বাতিল করণে, ওহীর সত্যতা প্রতিষ্ঠায় এবং আল্লাহর অবিনশ্বর সত্ত্বা ও তাবত সৃষ্টির নশ্বর সত্ত্বার মধ্যে চূড়ান্ত বৈপরীত্য প্রমাণে এ সূরার প্রথম ও শেষ আয়াতগুলাের সমতান অকাট্য ও দ্ব্যর্থহীন। সূরার একাধিক জায়গায় এ বিষয়টা বিভিন্নভাবে আলােচিত হয়েছে। আসহাবুল কাহাফ এর ঘটনায় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারী যুবকদের এ বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে, ‘আমাদের প্রভু হচ্ছেন আকাশ ও পৃথিবীর প্রভু। আমরা কখনাে তাকে ছাড়া অন্য কোনাে সত্ত্বাকে মাবুদ মানবো না। তখন যা বলেছি, ভুল বলেছি।’ এরপর এই কিসসার উপসংহারে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ছাড়া তাদের আর কোনাে অভিভাবক নেই। তার শাসনে আর কারো অংশীদার হবার অধিকার নেই।’ দুটি বাগিচা সংক্রান্ত ঘটনায় ঈমানদার ব্যক্তিটি তার সংগীর সাথে কথা বলার সময় বলেছিলাে, ‘যিনি তােমাকে প্রথমে মাটি থেকে এবং পরে এক ফোটা পঁচা পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতপর একজন পূর্ণাংগ ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। তাকে তুমি অস্বীকার করলে?’ আর এই ঘটনার উপসংহারে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘তাকে সাহায্য করতে পারে এমন কোনাে দল তার ছিলাে না এবং সেও সাহায্য গ্রহণ করতে সক্ষম ছিলো না। সেখানে অভিভাবকত্ব একমাত্র আল্লাহর-যিনি পরম সত্য। তিনি উত্তম প্রতিদান দাতা ও উত্তম শান্তিদাতা।’ কেয়ামতের একটা দৃশ্য তুলে ধরে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘যেদিন আল্লাহ বলবেন, আমার সাথে যাদেরকে তোমরা শরীক বানিয়েছিলে, তাদেরকে ডাকো। তখন তারা তাদেরকে ডাকবে, কিন্তু তারা ডাক শুনবে না, আর আমি তাদের মাঝে রেখে দেবাে একটা ধ্বংসকূপ।’ অন্য একটা দৃশ্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তবে কি কাফেররা ভেবেছে যে, আমাকে বাদ দিয়ে তারা আমার বান্দাদেরকে অভিভাবক মেনে নেবে? আমি জাহান্নামকে কাফেরদের আপ্যায়নের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছি।’ এরপর আসে চিন্তা পদ্ধতি ও দৃষ্টিভংগি সংশােধনের প্রসংগ। এ বিষয়টা মােশরেকদের প্রমাণহীন ও অজ্ঞতাপ্রসূত বক্তব্য প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়ে, মানুষকে ভালােভাবে জেনে শুনে কথা বলা ও অজানা কথা না বলার নির্দেশ দানের মধ্য দিয়ে এবং অজানা বিষয় আল্লাহর হাতে ন্যস্ত করার নির্দেশ দানের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমন সূরার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘এবং তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করবে, যারা বলেছে যে, আল্লাহ একজন পুত্র গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে তাদেরও কোনাে জ্ঞান নেই, তাদের বাপদাদারও নেই।’ আর গুহাবাসী (আসহাবুল কাহফ) তরুণরা বলেছে, ‘এই হচ্ছে আমাদের স্বজাতির অবস্থা। তারা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যান্যকে উপাস্য মেনে নিয়েছে। সেই উপাস্যদের পক্ষে ওরা কোনাে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আসে না কেন? তারা নিজেদের অবস্থানকাল নিয়ে পরস্পরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় এ সংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য আল্লাহর ওপর ন্যস্ত করে। তারা বললাে, তােমাদের প্রতিপালকই ভালাে জানেন তােমরা কতােদিন অবস্থান করেছ।’ ঘটনার বিবরণ দান প্রসংগে এক জায়গায় যারা তাদের সংখ্যা বিষয়ে অনুমান নির্ভর কথা বলে, তাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, ‘কেউ কেউ বলবে, তারা ছিলাে তিন জন, তাদের চতুর্থটা তাদের কুকুর। কেউ কেউ বলবে, তারা ছিলাে পাঁচজন, তাদের ষষ্ঠটা তাদের কুকুর…'(আয়াত ২২) আর আল্লাহর সৎ বান্দার সাথে হযরত মুসা(আ.)-এর ঘটনায় রয়েছে যে, ‘তার যে সব কার্যকলাপে মূসা(আ.) অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন, তার আসল রহস্য যখন তিনি স্বয়ং উদঘাটন করলেন। তখন বললেন, তােমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অনুগ্রহস্বরূপ এটা করা হয়েছে। আমি এগুলাে নিজ উদ্যোগে করিনি।'(আয়াত ৮২) এখানেও বিষয়টাকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। আকীদা বিশ্বাসের আলােকে মূল্যবােধের পরিশুদ্ধির বিষয়টাও এখানে বিভিন্ন জায়গায় আলােচিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ঈমান ও সৎ কাজকে । এছাড়া অন্য যেসব জড়বাদী মূল্যবােধ ও ধ্যান ধারণা রয়েছে, তাকে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে যতাে সাজসজ্জা ও ভােগবিলাসের সামগ্রী রয়েছে তা নিছক পরীক্ষার জন্যে। সেগুলাের শেষ পরিণতি ধ্বংস ও বিলীন হওয়া ছাড়া আর কিছু নয়, ‘আমি পৃথিবীতে বিদ্যমান সকল জিনিসকে পৃথিবীর সৌন্দর্যবর্ধক বানিয়েছি, যেন পরীক্ষা করতে পারি মানব জাতির মধ্যে কে অধিকতর সৎ কর্মশীল। পৃথিবীর যাবতীয় জিনিসকে আমি উদ্ভিদশূন্য মৃত্তিকায় পরিণত করবো'(আয়াত ৭-৮) এই পর্যায়ে আরাে বলা হয়েছে যে, মানুষ যতাে কঠিন ও সংকীর্ণ পর্বতগুহায় আশ্রয় নিক না কেন, আল্লাহর আশ্রয়টাই অধিকতর প্রশস্ত। গুহাবাসী মােমেন যুবকরা তাদের স্বজাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পরকে বলেছিলাে, ওদের ও আল্লাহ ছাড়া অন্য যেসব উপাস্যকে ওরা পূজা করে তাদের সংশ্রব যখন তােমরা ত্যাগ করেছে, তখন চলো, পর্বত গুহায় আশ্রয় নাও। তােমাদের প্রতিপালক তােমাদের ওপর রহমত বিস্তার করবেন এবং তােমাদের কাজকে ফলপ্রসূ করবেন।'(আয়াত ১৬) অন্য এক জায়গায় রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে বলা হয়েছে, যেন তিনি মােমেনদের সাথে ধৈর্য সহকারে অবস্থান করেন এবং দুনিয়ার ভােগ বিলাস ও উদাসীন দুনিয়া-পূজারীদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করেন।(আয়াত ২৮-২৯) দুটো বাগান সংক্রান্ত ঘটনায় দেখানাে হয়েছে-কিভাবে একজন মােমেন অর্থ সম্পদ, পদ মর্যাদা ও জাঁকজমক ছাড়াই কেবল ঈমানী সম্পদ দ্বারা সম্মানিত হয়ে থাকে, কিভাবে সে দর্পিত ঐশ্বর্যশালী ব্যক্তির মােকাবেলা করে এবং আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার জন্যে তাকে ভৎর্সনা করে।(আয়াত ৩৭-৪১) পার্থিব জীবন এবং তার সমৃদ্ধির পর ত্বরিত ধ্বংস প্রাপ্তির উদাহরণ দিয়ে এই কিসসার ওপর মন্তব্য করা হয়েছে।(আয়াত ৪৫) অনুরূপভাবে ধ্বংসশীল মূল্যবােধ ও চিরঞ্জীব মূল্যবােধের বিবরণও দেয়া হয়েছে এই ঘটনার উপসংহারে।(আয়াত ৪৬) একজন সম্রাট বলে নয়, বরং একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি হিসাবে আলােচিত হয়েছেন যুলকারনাইন। দুটো বাধের মাঝখানে বসবাসকারী একটা জাতি যখন তাকে ইয়াজুজ ও মাজুজের কবল থেকে তাদেরকে রক্ষার নিমিত্তে একটা বাঁধ নির্মাণের অনুরােধ জানালাে এবং সেজন্যে তারা তাকে টাকা পয়সা দিতে রাযী হলাে, তখন তিনি টাকা পয়সা নিতে অস্বীকার করলেন। তিনি জানালেন যে, তাদের টাকা পয়সার চেয়ে আল্লাহ তায়ালা তাকে যা দিয়েছেন, তা ঢের ভালাে।(আয়াত ৯৫) যখন বাঁধ নির্মাণ শেষ হলাে, তখন ওই কাজের জন্যে নিজের মানবীয় ক্ষমতার কৃতিত্ব যাহির করলেন না, বরং এটা আল্লাহর রহমাতের অবদান বলে ঘােষণা করলেন।(আয়াত ৯৮) সূরার শেষে জানানাে হয়েছে যে, আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, যারা আল্লাহর কোনাে নিদর্শন বা কোনাে বাণীকে অগ্রাহ্য করেছে এবং তার সাথে সাক্ষাতের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করেছে। বলা হয়েছে যে, এ জাতীয় লােকেরা নিজেদের অন্যান্য কাজ কর্মকে যতােই ভালাে মনে করুক, আসলে তার কোনাে গুরুত্ব বা মূল্য নেই।(আয়াত ১০৩-১০৫) এভাবে আমরা দেখতে পাই, এ সূরাটার কেন্দ্রীয় আলােচ্য বিষয় হলাে আকীদা বিশ্বাস, চিন্তা পদ্ধতি ও দৃষ্টিভংগি সংশােধন এবং আকীদা বিশ্বাসের আলােকে মূল্যবােধ ও ধ্যান ধারণার পরিশুদ্ধি। কয়েকটা অধ্যায়ে এই বিষয়গুলাে নিয়ে এই সূরায় আলােচনা করা হয়েছে। সূরাটা শুরুই হয়েছে আল্লাহর প্রশংসা, যিনি মােমেনদেরকে সুসংবাদ দান এবং আল্লাহর পুত্র আছে-এই মিথ্যা উক্তিকারীদেরকে ভীতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। সেই সাথে পৃথিবীর সাজসজ্জার সামগ্রীগুলােকে পরীক্ষার সরঞ্জাম বলে আখ্যায়িত এবং তার শেষ পরিণতি ধ্বংস বলে ঘােষণা করা হয়েছে। এরপরই শুরু হয়েছে আসহাবুল কাহাফ তথা গুহাবাসী যুবকদের ঘটনার বিবরণ । এ কিসসা আসলে পার্থিব সম্পদ ও ঝাঁকজমকের ওপর ঈমানকে প্রাধান্য ও অগ্রাধিকার দানের একটা নমুনা মাত্র, এটা ঈমান বাঁচানাের জন্যে গুহায় আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর রহমত কামনারও দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় অধ্যায়টা শুরু হয়েছে রসুল(স.)-কে ধৈর্য সহকারে মােমেনদের সাথে অবস্থান করার আদেশ দানের মধ্য দিয়ে। এরপর এসেছে দুই বাগানের মালিকদের ঘটনা, যার মাধ্যমে দেখানাে হয়েছে মােমেনের মনে ঈমানের গৌরববােধ কত জোরদার এবং তার মােকাবেলায় দুনিয়ার সহায় সম্পদকে সে কতাে মূল্যহীন মনে করে। আসল ও চিরস্থায়ী মূল্যবােধগুলাে সংক্রান্ত আলােচনার মধ্য দিয়ে সূরার এই অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে কেয়ামত সংক্রান্ত কিছু দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। তবে এর মাঝখানে রয়েছে। আদম ও ইবলীসের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। শেষে এসেছে যালেমদেরকে ধ্বংস করার ব্যাপারে আল্লাহর অনুসৃত নীতির বর্ণনা। সেখানে এ কথাও জানানাে হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা পাপীদের ওপরও যথেষ্ট দয়ালু এবং তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সময় দেয়া হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়টা পুরােপুরিই ব্যয়িত হয়েছে হযরত মূসা(আ.) ও জনৈক সৎ বান্দার ঘটনা বর্ণনায় । পঞ্চম অধ্যায় যুলকারনাইনের কিসসার বিবরণ দানে। আর উপসংহারে আলােচিত হয়েছে সূরার সূচনা পর্বের বিষয়গুলাে। যথা মােমেনদেরকে সুসংবাদ দান, কাফেরদেরকে ভীতি প্রদর্শন, ওহীর সত্যতা প্রতিপাদন এবং আল্লাহকে শিরক থেকে পবিত্র ঘােষণা। এবার আমরা সূরার প্রথম অধ্যায়ের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হব।
# সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর…'(আয়াত ১-৪৬) অত্যন্ত দৃপ্ত, বলিষ্ঠ ও আপােষহীন বক্তব্য দিয়ে সূরার সূচনা করা হয়েছে। একই বলিষ্ঠতা সহকারে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে ‘নিজ বান্দার ওপর এমন এক কিতাব নাযিল করার কারণে, যাতে কোনাে বক্রতা, অস্পষ্টতা, বা পক্ষপাতিত্ব নেই। যাতে তিনি তার পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখাতে পারেন।’ প্রথম আয়াত থেকেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বক্তব্য রাখা হয়েছে। ফলে আকীদা বিশ্বাসে কোনাে অস্পষ্টতা থাকার অবকাশ নেই। আল্লাহ তায়ালা কিতাব নাযিলকারী। কিতাব নাযিল করার জন্যে তার প্রশংসা করা হয়েছে। আর মােহাম্মদ(স.) আল্লাহর বান্দা। আসলে সমগ্র সৃষ্টিজগতই আল্লাহর বান্দা ও গােলাম। কোথাও কেউ তার সন্তান নয় এবং শরীকও নয়। আর এ কিতাবে কোনাে বক্রতা নেই। কাইয়িমান অর্থাৎ অকাট্য ও বলিষ্ঠ । একবার বক্রতা নেই বলা এবং আর একবার বলিষ্ঠতা ব্যক্ত করার মাধ্যমে এই কিতাবের স্থিতিশীলতাকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বারবার ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। কিতাব নাযিল করার উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন, যেন তিনি নিজের পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখাতে পারেন এবং সৎ কর্মশীল মােমেনদেরকে আশ্বাস দিতে পারেন যে, তাদের জন্যে উত্তম পুরস্কার রয়েছে। *আকীদা গ্রহণে কাফেরদের ভ্রান্তনীতি : সমগ্র বক্তব্যে কঠোর ভীতি প্রদর্শনের মনােভাবটা প্রবল। প্রথমে একবার সংক্ষেপে এই মনােভাব ব্যক্ত করা হয়েছে এভাবে, ‘যেন তিনি নিজের পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করতে পারেন।’ তারপর পুনরায় বিশেষভাবে বলা হয়েছে, ‘এবং যারা বলে যে আল্লাহ একজন পুত্র সন্তান গ্রহণ করেছেন, তাদেরকে সাবধান করার জন্যে।’ এরই মাঝখানে এসেছে সৎকর্মশীলদের পুরস্কারের সুসংবাদ। ‘যারা সৎকর্মশীল’ এই কথাটা যুক্ত করার মাধ্যমে ঈমানের প্রকাশ্য বাস্তব প্রমাণ তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থাৎ সৎকর্মশীলতাই যে ঈমানের বাস্তব প্রমাণ, সে কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
# এরপর শুরু হয়েছে সেই ভ্রান্ত নীতির সমালােচনা যা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বড় বিষয় আকীদা বিশ্বাস সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে কাফেররা অনুসরণ করে থাকে। বলা বাহুল্য, সেই ভ্রান্ত নীতিটা হলাে, না জেনে শুনে একেবারেই অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলা, আল্লাহ তায়ালা কাউকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেছেন কিনা সে বিষয়ে তাদেরও কোনাে জ্ঞান নেই, তাদের বাপদাদারও নাই। পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে যে, এ ধরনের অজানা বিষয়ে অনুমানের ভিত্তিতে কথা বলা বড়ই জঘন্য ও ভয়ংকর অপরাধ তাদের মুখ থেকে বের হওয়া এ কথাটা বড়ই সাংঘাতিক। ‘তারা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই বলে না।’ আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন- এ কথাটা যে অত্যন্ত সাংঘাতিক, তা বুঝানাের জন্যে উপরােক্ত আয়াতাংশের ভাব ও ধ্বনি দুটোই সমভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এর প্রথম শব্দটা ‘কাবুরাত’ অর্থ বড়ই সাংঘাতিক। এ শব্দটার উচ্চারণে এমন ধ্বনির সৃষ্টি হয় যে, শ্রোতা তা শােনামাত্রই তার ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আঁতকে ওঠে এবং গােটা পরিবেশেই আতংকের ছাপ পড়ে যায়। এরপর ‘কালিমাতান’ শব্দটা এই উপলব্ধিকে আরাে তীব্র ও শাণিত করে। তাদের মুখ থেকে বের হওয়া এ কথা দ্বারা বােঝানাে হয়েছে যে, কথাটা তাদের মুখ থেকে বিচার বিবেচনা ছাড়াই যেন বেরিয়ে আসে এবং কোনাে ভাবনা চিন্তা ও জ্ঞান বুদ্ধি প্রয়ােগ ছাড়াই তা নিছক ঝােকের বশেই যেন বলা হয়। ‘আফওয়াহিহিম’ শব্দটার বিশেষ ধ্বনিগত ব্যঞ্জনা এই কথার সাংঘাতিক ও ভয়াবহ রূপটাকে আরাে ভয়াবহ করে প্রকাশ করে। কেননা এই শব্দটা উচ্চারণকারীকে প্রথমে মুখ খুলে হা করতে হয়, তারপর ক্রমাগত দুটো ‘হা (আরবী বর্ণ মালার হা) থাকায় এর ধ্বনিতে মুখটা সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে যায় এবং শব্দের শেষে ‘মিম’ এর সাথে মিলিত হওয়া পর্যন্ত মুখ ভর্তি থাকে। এভাবে এই শিরকমূলক বক্তব্যের ভয়াবহতাকে অর্থ ও ধ্বনি উভয় দিক দিয়েই ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। অতপর আয়াতের শেষ ভাগে, ‘তারা মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই বলে না’ এই বাক্য দ্বারা এই সমালােচনাকে আরাে জোরদার করা হয়েছে এবং এই ভ্রান্ত অসার ও অসত্য কথাকে আরাে নিকৃষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
সূরার ফজীলত বিশেষ করে প্রথম দশটি আয়াতের ফজীলতের বর্ণনা এবং সূরাটি যে দাজ্জালের ফিৎনা হতে রক্ষাকারী তার বর্ণনা।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, একজন সাহাবী এই সূরাটি পাঠ করতে শুরু করেন। তাঁর বাড়ীতে একটি জন্তু ছিল, সে লাফাতে শুরু করে। সাহাবী গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করে সামিয়ানার মত এক খণ্ড মেঘ দেখতে পান যা তাঁর উপর ছায়া করে রয়েছে। তিনি এটা রাসূলুল্লাহর (সঃ) কাছে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি এটা পাঠ করতে থাকো। এটা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে ঐ ‘সাকীনা’ যা কুরআন পাঠের সময় অবতীর্ণ হয়ে থাকে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এই রিওয়াইয়াতটি রয়েছে। এই সাহাবী ছিলেন হযরত উসায়েদ ইবনু হুযায়ের (রাঃ), যেমন সূরায়ে বাকারার তাফসীরে আমরা বর্ণনা করেছি।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি সূরায়ে কাহফের প্রথম দশটি আয়াত মুখস্থ, করে তাকে দাজ্জালের ফিত্রা হতে রক্ষা করা হয়; জামে তিরমিযীতে তিনটি আয়াতের বর্ণনা রয়েছে। সহীহ মুসলিমে শেষ দশটি আয়াতের বর্ণনা আছে। সুনানে নাসায়ীতে সাধারণভাবে দশটি আয়াতের বর্ণনা রয়েছে।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি সূরায়ে কাহফের প্রথম ও শেষ আয়াত পাঠ করে, তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নূর হবে। আর যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ সূরাটি পড়বে সে যমীন হতে আসমান পর্যন্ত নূর লাভ করবে। একটি গারীব বা দুর্বল সনদে ইবনু মীরদুওয়াই (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, জুমআর দিন যে ব্যক্তি সূরায়ে কাহফ পাঠ করবে সে তার পায়ের নীচ থেকে নিয়ে আকাশের উচ্চতা পর্যন্ত নূর লাভ করবে। ওটা কিয়ামতের দিন খুবই উজ্জ্বল হবে এবং পরবর্তী জুমআ পর্যন্ত তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। এই হাদীসের মর’ হওয়ার ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার অবকাশ রয়েছে। এর মাওকুফ হওয়টাই সঠিক কথা।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরায়ে কাহফ পাঠ করে তার পার্শ্ব থেকে নিয়ে বায়তুল্লাহ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে যায়।
মুসতাদরিকে হাকিমে মারফু রূপে বর্ণিত আছে যে, যে ব্যক্তি জুমআর দিন সূরায়ে কাহফ পড়ে তার জন্যে দুই জুমআর মধ্যবর্তী সময় আলোকিত হয়ে থাকে।
ইমাম বায়হাকীর (রঃ) হাদীস গ্রন্থে রয়েছে যে, যে ব্যক্তি সূরায়ে কাফকে ঐ ভাবে পড়বে যেভাবে তা নাযিল হয়েছে, তার জন্যে কিয়ামতের দিন জ্যোতি হয়ে যাবে।
হাফিয যিআ’ মুকাদ্দাসীর (রঃ) কিতাবুল মুখতারা’ গ্রন্থে আছে যে, যেই ব্যক্তি জুমআর দিন সূরায়ে কাহফ পাঠ করবে সে আট দিন পর্যন্ত সমস্ত ফিৎনা ফাসাদ হতে নিরপিত্তা লাভ করবে। এমন কি যদি এই সময়ের মধ্যে দাজ্জালও এসে পড়ে তবে তারও ফিন্যা হতে তাকে রক্ষা করা হবে।
১-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আমরা পূর্বেই এটা বর্ণনা করে দিয়েছি যে, আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বিষয়ের শুরুতে ও শেষে তার প্রশংসা করে থাকেন। সর্বাবস্থাতেই তিনি তা’রীফ ও প্রশংসার যোগ্য। প্রথমে ও শেষে প্রশংসার যোগ্য একমাত্র তিনিই। তিনি স্বীয় নবীর (সঃ) উপর কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন যা তার একটি বড় নিয়ামত। এর মাধ্যমে আল্লাহর সমস্ত বান্দা অন্ধকার হতে। বেরিয়ে আলোকের দিকে আসতে পারে। এই কিতাবকে তিনি ঠিকঠাক, সোজা ও সঠিক রেখেছেন। এতে কোনই বক্রতা নেই এবং নেই কোন ত্রুটি। এটা যে সরল ও সঠিক পথ প্রদর্শন করে এটা স্পষ্ট, পরিষ্কার ও প্রকাশমান। এই কিতাব অসৎ লোকদেরকে ভয় প্রদর্শন করে এবং সৎলোকদেরকে শুভসংবাদ দেয়। এটা বিরুদ্ধাচরণকারী ও প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে ভয়াবহ শাস্তির খবর দেয়, যে শাস্তি আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে। দুনিয়াতেও হবে এবং আখেরাতেও হবে। এমন শাস্তি যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। যারা এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, ঈমান আনবে এবং আমল করবে, এই কিতাব তাদেরকে মহাপুরস্কারের সুসংবাদ শুনাচ্ছে। যে পুরস্কার হলো চিরস্থায়ী ও অবিনশ্বর, যা তারা জান্নাতে প্রাপ্ত হবে, যা কখনো ধ্বংস হবে না এবং যার নিয়ামতরাশি চিরকাল থাকবে।
এই কিতাব ঐ লোকদেরকে ভীষণ শাস্তি হতে সর্তক করছে যারা বলছে যে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে। যেমন মক্কার মুশরিকরা বলতো যে, ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা (নাউযু বিল্লাহি মিন্যালিকা)। না জেনে শুনেই তারা মুখ দিয়ে একথা বলে ফেলতো। তারা তো দূরের কথা, তাদের বড়রাও এরূপ কথা বলতে থেকেছে।
(আরবী) শব্দের উপর যবর দেয়া হিসেবে (আরবী)। বাকপদ্ধতির গঠন হবে (আরবী) এইরূপ। আবার একথাও বলা হয়েছে যে, শব্দের দেয়া হয়েছে হিসেবে। তখন ইবারতের গঠন হবে (আরবী) এইরূপ। যেমন বলা হয় (আরবী) অর্থাৎ যায়েদ মানুষ হিসেবে কতই না সম্মানিত। বসরাবাসী কারো কারো উক্তি এই যে, কোন কোন কারী এটাকে (আরবী) পড়েছেন। যেমন-বলা হয় (আরবী) অর্থাৎ তোমার কথা বিরাট হয়েছে এবং তোমার শান শওকত বড় হয়েছে। জমহুরের কিরআতে তো অর্থ সম্পূর্ণরূপে প্রকাশমান যে, তাদের কথা যে খুবই মন্দ ও জঘন্য, তারই এখানে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা মিথ্যা ও অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়। এজন্যেই বলা হয়েছে। যে, তারা শুধু মিথ্যা বলে।
এই সূরার শানে নুযূল এই যে, কুরায়েশরা নাযার ইবনু হারিস ও উকবা’ ইবনু মুঈতকে মদীনার ইয়াহুদী আলেমদের নিকট পাঠিয়ে দেয় এবং তাদেরকে বলেঃ “তোমরা তাদের কাছে গিয়ে তাদের সামনে মুহাম্মদের (সঃ) সমস্ত অবস্থা বর্ণনা করবে। পূর্ববর্তী নবীদের সম্পর্কে তাদের জ্ঞান রয়েছে। সুতরাং মুহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে তাদের মতামত কি তা তাদেরকে জিজ্ঞেস করবে।” এই দু’জন তখন মদীনার ইয়াহূদী আলেমদের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং তাদের সামনে হযরত মুহাম্মদের (সঃ) অবস্থা ও গুণাবলী বর্ণনা করে, তারা এদেরকে বলেঃ “দেখো, আমরা তোমাদেরকে একটা মীমাংসাযুক্ত কথা বলছি। তোমরা ফিরে গিয়ে তাঁকে তিনটি প্রশ্ন করবে। যদি তিনি উত্তর দিতে পারেন, তবে তিনি যে সত্য নবী এতে কোন সন্দেহ নেই। আর যদি উত্তর দিতে না পারেন, তবে তার মিথ্যাবাদী হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকবে না। তখন তোমরা তার ব্যাপারে যা ইচ্ছা করতে পার।” তোমরা তাকে জিজ্ঞেস করবেঃ “পূর্বযুগে যে যুবকগণ বেরিয়ে গিয়েছিলেন তাদের ঘটনা বর্ণনা করুন তো? এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা তারপর তাকে ঐ ব্যক্তির অবস্থা জিজ্ঞেস করবে যিনি সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি পূর্ব প্রান্ত হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে এসেছিলেন। আর তাকে তোমরা রূহের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। যদি তিনি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পারেন, তবে তোমরা তাকে নবী বলে স্বীকার করে নিয়ে তার অনুসরণ করবে। আর যদি উত্তর দিতে না পারেন তবে জানবে যে, তিনি মিথ্যাবাদী। সুতরাং যা ইচ্ছা তা-ই করবে।” এরা দু’জন মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরায়েশদেরকে বলেঃ
“শেষ ফায়সালার কথা ইয়াহূদী আলেমগণ বলে দিয়েছেন। সুতরাং চল আমরা তাকে প্রশ্নগুলি করি।” অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহর (সঃ) কাছে আগমন করে এবং তাঁকে ঐ তিনটি প্রশ্ন করে। তিনি তাদেরকে বলেনঃ “তোমরা আগামী কাল এসো, আমি তোমাদের এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিবো।” কিন্তু তিনি ইনশা আল্লাহ (আল্লাহ চান তো) বলতে ভুলে যান। এরপর পনেরো। দিন অতিবাহিত হয়ে যায়, কিন্তু তাঁর কাছে না কোন ওয়াহী আসে, না আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁকে এই প্রশ্নগুলির জবাব জানিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে মক্কাবাসী ফুলে ওঠে এবং পরস্পর বলাবলি করেঃ “দেখো, কালকার ওয়াদা ছিল, আর আজ পনেরো দিন কেটে গেল, তবুও সে জবাব। দিতে পারলো না।” এতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) দ্বিগুণ দুঃখে জর্জরিত হতে লাগলেন। একতো কুরায়েশদেরকে জবাব দিতে না পারায় তাদের কথা শুনতে হচ্ছে, দ্বিতীয়তঃ ওয়াহী আসা বন্ধ হয়েছে। এরপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন এবং সূরায়ে কাহফ অবতীর্ণ হয়। এতেই ইনশা আল্লাহ না বলায় তাঁকে ধমকানো হয়, ঐ যুবকদের ঘটনা বর্ণনা করা হয়, ঐ ভ্রমণকারীর বর্ণনা দেয়া হয় এবং রূহের ব্যাপারে জবাব দেয়া হয়।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#881)
Sura:18
Sura: Al-Kahf
Ayat: 01-05
[ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجَا
Has not placed therein any crookedness ;]
www.motaher21.net
18:1
اَلۡحَمۡدُ لِلّٰہِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ عَلٰی عَبۡدِہِ الۡکِتٰبَ وَ لَمۡ یَجۡعَلۡ لَّہٗ عِوَجًا ؕ﴿ٜ۱﴾
[All] praise is [due] to Allah, who has sent down upon His Servant the Book and has not made therein any deviance.
18:2
قَیِّمًا لِّیُنۡذِرَ بَاۡسًا شَدِیۡدًا مِّنۡ لَّدُنۡہُ وَ یُبَشِّرَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ الَّذِیۡنَ یَعۡمَلُوۡنَ الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَہُمۡ اَجۡرًا حَسَنًا ۙ﴿۲﴾
[He has made it] straight, to warn of severe punishment from Him and to give good tidings to the believers who do righteous deeds that they will have a good reward
18:3
مَّاکِثِیۡنَ فِیۡہِ اَبَدًا ۙ﴿۳﴾
In which they will remain forever
18:4
وَّ یُنۡذِرَ الَّذِیۡنَ قَالُوا اتَّخَذَ اللّٰہُ وَلَدًا ٭﴿۴﴾
And to warn those who say, ” Allah has taken a son.”
18:5
مَا لَہُمۡ بِہٖ مِنۡ عِلۡمٍ وَّ لَا لِاٰبَآئِہِمۡ ؕ کَبُرَتۡ کَلِمَۃً تَخۡرُجُ مِنۡ اَفۡوَاہِہِمۡ ؕ اِنۡ یَّقُوۡلُوۡنَ اِلَّا کَذِبًا ﴿۵﴾
They have no knowledge of it, nor had their fathers. Grave is the word that comes out of their mouths; they speak not except a lie.
Tafsir Ibne Kasir Said:-
The Revelation of the Qur’an brings both Good News and a Warning
Allah praises His Holy Self;
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجَا
All praise is due to Allah, Who has sent down to His servant the Book, and has not placed therein any crookedness.
In the beginning of this Tafsir, we mentioned that Allah, praises His Holy Self at the beginning and end of matters, for He is the One to be praised in all circumstances, all praise and thanks be to Him, in the beginning and in the end. He praises Himself for revealing His Mighty Book to His Noble Messenger Muhammad, which is the greatest blessing that Allah has granted the people of this earth. Through the Qur’an, He brings them out of the darkness into light. He has made it a Book that is straight, neither distorted nor confusion therein. It clearly guides to a straight path, plain and manifest, giving a warning to the disbelievers and good news to the believers. This is why Allah says:
وَلَمْ يَجْعَل لَّهُ عِوَجَا
and has not placed therein any crookedness.
meaning, there is nothing twisted or confusing about it. But He has made it balanced and straightforward as He said
قَيِّمًا
(He has made it) straight,
meaning straightforward,
لِّيُنذِرَ بَأْسًا شَدِيدًا مِن لَّدُنْهُ
to give warning of a severe punishment from Him,
meaning, to those who oppose His Prophet and disbelieve in His Book, He issues a warning of severe punishment hastened in this world and postponed to the world Hereafter.
مِن لَّدُنْهُ
(from Him).
means, from Allah. For none can punish as He punishes and none is stronger or more reliable than Him.
وَيُبَشِّرَ الْمُوْمِنِينَ
and to give good news to the believers,
means, those who believe in this Qur’an and confirm their faith by righteous actions.
الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ
who do righteous deeds,
أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا حَسَنًا
that they shall have a fair reward.
means, a beautiful reward from Allah.
مَاكِثِينَ فِيهِ
They shall abide therein,
means, in what Allah rewards them with, and that is Paradise, where they will live forever.
أَبَدًا
forever.
means, for always, never ending or ceasing to be.
وَيُنذِرَ الَّذِينَ قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا
And to warn those who say, “Allah has begotten a child.”
Ibn Ishaq said:
“These are the pagan Arabs, who said, `We worship the angels who are the daughters of Allah.”
مَّا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ
No knowledge have they of such a thing,
meaning, this thing that they have fabricated and made up.
وَلَا لاِبَايِهِمْ
nor had their fathers.
meaning, their predecessors.
كَبُرَتْ كَلِمَةً
Mighty is the word,
This highlights the seriousness and enormity of the lie they have made up.
Allah says:
كَبُرَتْ كَلِمَةً
تَخْرُجُ مِنْ أَفْوَاهِهِمْ
Mighty is the word that comes out of their mouths.
meaning, it has no basis apart from what they say, and they have no evidence for it apart from their own lies and fabrications.
Hence Allah says:
إِن يَقُولُونَ إِلاَّ كَذِبًا
They utter nothing but a lie.
Reason why this Surah was revealed
Muhammad bin Ishaq mentioned the reason why this Surah was revealed. He said that an old man from among the people of Egypt who came to them some forty-odd years ago told him, from Ikrimah that Ibn Abbas said:
“The Quraysh sent An-Nadr bin Al-Harith and Uqbah bin Abi Mu`it to the Jewish rabbis in Al-Madinah, and told them:`Ask them (the rabbis) about Muhammad, and describe him to them, and tell them what he is saying. They are the people of the first Book, and they have more knowledge of the Prophets than we do.’
So they set out and when they reached Al-Madinah, they asked the Jewish rabbis about the Messenger of Allah.
They described him to them and told them some of what he had said.
They said, `You are the people of the Tawrah and we have come to you so that you can tell us about this companion of ours.’
They (the rabbis) said, `Ask him about three things which we will tell you to ask, and if he answers them then he is a Prophet who has been sent (by Allah); if he does not, then he is saying things that are not true, in which case how you will deal with him will be up to you.
– Ask him about some young men in ancient times, what was their story For theirs is a strange and wondrous tale.
– Ask him about a man who travelled a great deal and reached the east and the west of the earth. What was his story?
– And ask him about the Ruh (soul or spirit) — what is it?
If he tells you about these things, then he is a Prophet, so follow him, but if he does not tell you, then he is a man who is making things up, so deal with him as you see fit.’
So An-Nadr and Uqbah left and came back to the Quraysh, and said:`O people of Quraysh, we have come to you with a decisive solution which will put an end to the problem between you and Muhammad. The Jewish rabbis told us to ask him about some matters,’ and they told the Quraysh what they were. Then they came to the Messenger of Allah and said, `O Muhammad, tell us,’ and they asked him about the things they had been told to ask.
The Messenger of Allah said,
أُخْبِرُكُمْ غَدًا عَمَّا سَأَلْتُمْ عَنْه
(I will tell you tomorrow about what you have asked me), but he did not say `If Allah wills.’ So they went away, and the Messenger of Allah stayed for fifteen days without any revelation from Allah concerning that, and Jibril, peace be upon him, did not come to him either.
The people of Makkah started to doubt him, and said, `Muhammad promised to tell us the next day, and now fifteen days have gone by and he has not told us anything in response to the questions we asked.’
The Messenger of Allah felt sad because of the delay in revelation, and was grieved by what the people of Makkah were saying about him.
Then Jibril came to him from Allah with the Surah about the companions of Al-Kahf, which also contained a rebuke for feeling sad about the idolators. The Surah also told him about the things they had asked him about, the young men and the traveler.
The question about the Ruh was answered in the Ayah;
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ
(And they ask you concerning the Ruh (the spirit); say:”The Ruh…”). (17:85
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran