(বই#৮৯৮) সূরা:- মরিয়ম। সুরা:১৯ ৪১-৫০ নং আয়াত:- [ وَ اذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ اِبۡرٰہِیۡمَ ۬ؕ বর্ণনা করেন এই কিতাবে ইব্রাহীমের কথা;] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৮৯৮)
সূরা:- মরিয়ম।
সুরা:১৯
৪১-৫০ নং আয়াত:-
[ وَ اذۡکُرۡ فِی الۡکِتٰبِ اِبۡرٰہِیۡمَ ۬ؕ
বর্ণনা করেন এই কিতাবে ইব্রাহীমের কথা;]
www.motaher21.net
১৯:৪১
وَ اذْكُرْ فِی الْكِتٰبِ اِبْرٰهِیْمَ١ؕ۬ اِنَّهٗ كَانَ صِدِّیْقًا نَّبِیًّا

আর এই কিতাবে ইবরাহীমের কথা বর্ণনা করেন। নিঃসন্দেহে সে একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষ এবং একজন নবী ছিলেন।
১৯:৪২
اِذْ قَالَ لِاَبِیْهِ یٰۤاَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا یَسْمَعُ وَ لَا یُبْصِرُ وَ لَا یُغْنِیْ عَنْكَ شَیْئًا

(এদেরকে সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ করিয়ে দাও) যখন সে নিজের বাপকে বললো, “আব্বাজান! আপনি কেন এমন জিনিসের ইবাদত করেন, যা শোনেও না দেখেও না এবং আপনার কোন কাজও করতে পারে না?
১৯:৪৩
یٰۤاَبَتِ اِنِّیْ قَدْ جَآءَنِیْ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ یَاْتِكَ فَاتَّبِعْنِیْۤ اَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِیًّا

আব্বাজান! আমার কাছে এমন এক জ্ঞান এসেছে যা আপনার কাছে আসেনি, আপনি আমার অনুসরণ করে চলুন, আমি আপনাকে সোজাপথ দেখিয়ে দেবো।
১৯:৪৪
یٰۤاَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّیْطٰنَ١ؕ اِنَّ الشَّیْطٰنَ كَانَ لِلرَّحْمٰنِ عَصِیًّا

আব্বাজান! আপনি শয়তানের বন্দেগী করবেন না। শয়তান তো করুণাময়ের অবাধ্য।
১৯:৪৫
یٰۤاَبَتِ اِنِّیْۤ اَخَافُ اَنْ یَّمَسَّكَ عَذَابٌ مِّنَ الرَّحْمٰنِ فَتَكُوْنَ لِلشَّیْطٰنِ وَلِیًّا

আব্বাজান! আমার ভয় হয় আপনি করুণাময়ের আযাবের শিকার হন কি না এবং শয়তানের সাথী হয়ে যান কি না।”
১৯:৪৬
قَالَ اَرَاغِبٌ اَنْتَ عَنْ اٰلِهَتِیْ یٰۤاِبْرٰهِیْمُ١ۚ لَئِنْ لَّمْ تَنْتَهِ لَاَرْجُمَنَّكَ وَ اهْجُرْنِیْ مَلِیًّا

বাপ বললো, “ইবরাহীম! তুমি কি আমার মাবুদদের থেকে বিমুখ হয়েছো? যদি তুমি বিরত না হও তাহলে আমি পাথরের আঘাতে তোমাকে শেষ করে দেবো। ব্যাস তুমি চিরদিনের জন্য আমার থেকে আলাদা হয়ে যাও।”
১৯:৪৭
قَالَ سَلٰمٌ عَلَیْكَ١ۚ سَاَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّیْ١ؕ اِنَّهٗ كَانَ بِیْ حَفِیًّا

ইবরাহীম বললো, “আপনাকে সালাম। আমি আমার রবের কাছে আপনাকে মাফ করে দেবার জন্য দোয়া করবো। আমার রব আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান।
১৯:৪৮
وَ اَعْتَزِلُكُمْ وَ مَا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ وَ اَدْعُوْا رَبِّیْ١ۖ٘ عَسٰۤى اَلَّاۤ اَكُوْنَ بِدُعَآءِ رَبِّیْ شَقِیًّا

আমি আপনাদেরকে ত্যাগ করছি এবং আপনারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে ডাকেন তাদেরকেও, আমি তো আমার রবকেই ডাকবো। আশা করি আমি নিজের রবকে ডেকে ব্যর্থ হবো না।”

১৯:৪৯
فَلَمَّا اعْتَزَلَهُمْ وَ مَا یَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ١ۙ وَهَبْنَا لَهٗۤ اِسْحٰقَ وَ یَعْقُوْبَ١ؕ وَ كُلًّا جَعَلْنَا نَبِیًّا

অতঃপর যখন সে তাদের থেকে এবং তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করতো তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেলো এবং তখন আমি তাকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিলাম এবং প্রত্যেককে নবী করলাম।
১৯:৫০
وَ وَهَبْنَا لَهُمْ مِّنْ رَّحْمَتِنَا وَ جَعَلْنَا لَهُمْ لِسَانَ صِدْقٍ عَلِیًّا۠

আর তাদেরকে নিজের অনুগ্রহ দান করলাম এবং তাদেরকে দিলাম যথার্থ নাম-যশ।

৪১-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর মূর্তিপূজক বাবাকে যেভাবে তাওহীদের প্রতি আহ্বান করেছিলেন সে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন, তিনি যেন তার উম্মাতের নিকট ইবরাহীম (عليه السلام)-এর দৃষ্টান্ত পেশ করেন। তিনি ছিলেন একজন সত্যবাদী নাবী। صِدِّيْقًا শব্দটি صدق থেকে উ™ূ¢ত, অর্থ হল অত্যন্ত বা পরম সত্যবাদী। যিনি কথায় ও কাজে কোন বিপরীত করেন না। সর্বদা সত্য কথা বলেন।

ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতাকে মূর্তিপূজো করার কারণে কোন কর্কশ ভাষা ব্যবহার করেননি; বরং নম্র ভাষায় বললেন, হে আমার পিতা! আপনি কেন এমন কিছুর ইবাদত করেন, যে কোন কিছু শোনে না, দেখে না বরং কোন উপকারও করতে পারে না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম (عليه السلام) এর কথা তুলে ধরে বলেন: (إِذْ قَالَ لِأَبِيْهِ وَقَوْمِه۪ مَا تَعْبُدُوْنَ)‏ “সে যখন তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, ‘তোমরা কিসের ইবাদত কর‎?’’ (সূরা শুয়ারা ২৬:৭০)

তিনি আরো বললেন, হে আমার পিতা! আমার কাছে এমন জ্ঞান এসেছে যা আপনার কাছে আসেনি। অতএব আপনি আমার অনুসরণ করুন। আমি আপনাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করব। অতঃপর তিনি বললেন: হে আমার পিতা! শয়তানের ইবাদত করবেন না। শয়তান দয়াময় আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য; তাই তার আনুগত্য করে কেউ মুক্তি পাবে না।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(اَلَمْ اَعْھَدْ اِلَیْکُمْ یٰبَنِیْٓ اٰدَمَ اَنْ لَّا تَعْبُدُوا الشَّیْطٰنَﺆ اِنَّھ۫ لَکُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ)

“আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেইনি হে বানী আদম! তোমরা শয়তানের ইবাদত কর না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্র“।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৬০)

এরপর ইবরাহীম (عليه السلام) আবার তাঁর পিতাকে বললেন: হে আমার পিতা! আমি আশংকা করছি যে, আপনি যদি এ শির্ক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন তাহলে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি আপনাকে স্পর্শ করবে, ফলে আপনি শয়তানের বন্ধু হয়ে যাবেন। অতএব আপনি সতর্ক হোন।

ইবরাহীম (عليه السلام)-এর এ দাওয়াতে পিতা উত্তর দিল, হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার মা‘বূদ হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ। যদি তুমি তোমার এরূপ কাজ থেকে নিবৃত্ত না হও তাহলে আমি অবশ্যই পাথর মেরে তোমাকে শেষ করে দেব। অতএব তুমি আমার সম্মুখ হতে চিরতরের জন্য দূর হয়ে যাও। পৃথিবীতে এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে যেখানে ছেলে বাবাকে কল্যাণ ও মুক্তির দিকে আহ্বান করছে সেখানে নিজের সন্তানকে বাবা হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে। ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতার এ ধরণের কথা শুনেও রাগান্বিত হননি এবং আল্লাহ তা‘আলার গযব কামনা করেননি, বরং তিনি আরো নম্রভাবে বললেন: আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।

এ সালাম বলতে মুসলিম ব্যক্তি অপর মুসলিমদের দেখে যে সালাম দেয় তা উদ্দেশ্য নয়, বরং কারো সাথে বা অজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে কথা-কাটাকাটি হলে সুন্দর করে বিদায় জানানো। যেমন সূরা ফুরকানের ৬৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে।

(سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّيْ)

‘আমি আমার প্রতিপালকের নিকট আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব’ ইবরাহীম (عليه السلام) এর এ ক্ষমা প্রার্থনা ঐ সময় ছিল যখন মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নিষেধ হওয়া সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না। অতঃপর যখন তিনি জানতে পারলেন তখন সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেললেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাওবার ১১৪ নং আয়াতে উল্লেখ করেছেন।

আমি আমার পালনকর্তার নিকট আপনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি দয়াবান। আর আমি পরিত্যাগ করছি আপনাদেরকে এবং আল্লাহ তা‘আলাকে ব্যতীত আপনারা যার ইবাদত করে থাকেন তাদেরকেও। আমি আমার পালনকর্তাকে আহ্বান করব। আমি আমার পালনকর্তাকে আহ্বান করে বঞ্চিত হব না।

অর্থাৎ যখন ইবরাহীম (عليه السلام) পিতা, স্বজন ও স্বদেশ ছেড়ে চলে এলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে ইসহাক ও ইয়াকুব (عليه السلام)-কে দান করলেন। যাতে তাদের আদর-স্নেহে পিতাকে ছেড়ে আসার শোক ভুলে থাকতে পারেন।

সুতরাং একজন আল্লাহ তা‘আলার পথে আহ্বানকারী কাফির-মুশরিকদের আহ্বান করবেন শালীন ভাষায় ও নম্র-ভদ্র আচরণে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলাকে ব্যতীত অন্য কোন বাতিল মা‘বূদের ইবাদত করা যাবে না।
২. দীনের তাবলীগ করতে হবে এবং সেক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করতে হবে। অধৈর্য হলে চলবে না।
৩. মানুষকে নম্রভাষায় দাওয়াত দিতে হবে। যেমন ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতাকে দিয়েছেন।
৪. মানুষ দাওয়াত গ্রহণ না করলে তার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়া যাবে না। বরং তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করতে হবে তাকে হিদায়াত দান করার জন্য।
৫. হিদায়াতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-
#এখান থেকে মক্কাবাসীদেরকে সম্বোধন করে কথা বলা হচ্ছে। তারা তাদের যুবক পুত্র, ভাই ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদেরকে ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের অপরাধে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল যেমন হযরত ইবরাহীমকে (আ) তার বাপ-ভাইয়েরা দেশ থেকে বের করে দিয়েছিল। কুরাইশ বংশের লোকেরা হযরত ইবরাহীমকে নিজেদের নেতা বলে মানতো এবং তাঁর আওলাদ হবার কারণে সারা আরবে গর্ব করে বেড়াতো, একারণে অন্য নবীদের কথা বাদ দিয়ে বিশেষ করে হযরত ইবরাহীমের কথা বলার জন্য এখানে নির্বাচিত করা হয়েছে।

# মূল শব্দ হচ্ছে, لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ অর্থাৎ “শয়তানের ইবাদাত করো না।” যদিও হযরত ইবরাহীমের পিতা এবং তাঁর জাতির অন্যান্য লোকেরা মূর্তি পূজা করতো কিন্তু যেহেতু তারা শয়তানের আনুগত্য করছিল তাই হযরত ইবরাহীম তাদের এ শয়তানের আনুগত্যকেও শয়তানের ইবাদাত গণ্য করেন। এ থেকে জানা যায় নিছক পূজাও উপসনা আরাধনারই নাম নয় বরং আনুগত্যের নামও। তাছাড়া এ থেকে জানা যায় যদি কোন ব্যক্তি কারোর প্রতি অভিশাপ বর্ষণরত থেকেও তার আনুগত্য করে তাহলে সে তার ইবাদাত করার অপরাধে অপরাধী হয়। কারণ শয়তান কোন কালেও মানুষের মাবুদ (প্রচলিত অর্থে) ছিল না বরং তার নামে প্রতি যুগে মানুষ অভিশাপ বর্ষণ করেছে। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা আল কাহাফ, ৪৯-৫০ )
# হযরত ইবরাহীম তার মুশরিক পিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় যে কথা বলেছিলেন সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি বলেছিলেনঃ

سَلَامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيًّا

আপনার প্রতি সালাম, আপনার জন্য আমি আমার রবের কাছে দোয়া করবো যেন তিনি আপনাকে মাফ করে দেন। তিনি আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান। (মারয়ামঃ ৪৭) তিনি আরো বলেছিলেনঃ

لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ

আমি আপনার জন্য অবশই ক্ষমা চাইবো। তবে আপনাকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আমার নেই। (আল মুমতাহিনাঃ ৪) উপরোক্ত ওয়াদার ভিত্তিতে তিনি নিজের পিতার জন্য এ দোয়া করেছিলেনঃ

وَاغْفِرْ لِأَبِي إِنَّهُ كَانَ مِنَ الضَّالِّينَ – وَلَا تُخْزِنِي يَوْمَ يُبْعَثُونَ – يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ – إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

আর আমার পিতাকে মাফ করে দাও, তিনি পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর যেদিন সকল মানুষকে উঠানো হবে সেদিন আমাকে লাঞ্ছিত করো না। যেদিন ধনসম্পদ এবং সন্তান সন্তুতি কারোর কোন কাজে লাগবে না। একমাত্র সেই নাজাত পাবে, যে আল্লাহর সামনে হাযির হবে বিদ্রোহ মুক্ত হৃদয় নিয়ে। (আশ শুআরাঃ ৮৬-৮৯)

এ দোয়া তো প্রথমত অত্যন্ত সতর্ক ও সংযত ভাষায় করা হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই হযরত ইবরাহীম চিন্তা করলেন যে, তিনি যে ব্যক্তির জন্য দোয়া করেছেন সে তো ছিল প্রকাশ্য আল্লাহ‌ দ্রোহী এবং আল্লাহর দ্বীনের ঘোরতর শত্রু তখন তিনি এ থেকে বিরত হলেন এবং একজন যথার্থ বিশ্বস্ত মু’মিনের মত বিদ্রোহীর প্রতি সহানুভূতি দেখানো থেকে পরিষ্কারভাবে সরে দাঁড়লেন। অথচ এ বিদ্রোহী ছিল তার পিতা, যে এক সময় স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে লালন পালন করেছিল।

#যেসব মুহাজির গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন এগুলো তাদের জন্য সান্তনাবাণী। তাদেরকে বলা হচ্ছে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যেমন তাঁর পরিবারবর্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধ্বংস হয়ে যান নি বরং উল্টা উন্নতশির ও সফলকাম হয়েছিলেন ঠিক তেমনি তোমরাও ধ্বংস হয়ে যাবে না বরং তোমরা এমন মর্যাদালাভ করবে জাহেলিয়াতের অন্ধকার আবর্তে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা কুরাইশ বংশীয় কাফেররা যার কল্পনাই করতে পারে না।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলোচনা (৪১-৬৫) : ‘আর স্মরণ করাে এই আল কিতাবের মধ্যে ইবরাহীমের কথা, অবশ্যই সে ছিলাে পরম সত্যবাদী নবী… আল্লাহ তায়ালা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক এবং তিনিই মালিক ওই সব বস্তুর যা এই দুয়ের মাঝে বর্তমান রয়েছে, অতএব পূর্ণাংগও নিঃশর্তভাবে আনুগত্য করে তাঁর এবং তাঁর এই পূর্ণাংগ আনুগত্য করার জন্যে দৃঢ়তা অবলম্বন করাে। সর্বময় ক্ষমতার মালিক সেই মহান সত্ত্বার মতাে ক্ষমতাবান আর কারাে নাম তােমার জানা আছে কি?'(আয়াত ৪১-৬৫) ওপরের বর্ণনা মতে ঈসা(আ.) আল্লাহর ছেলে হওয়া সম্পর্কিত যে কাল্পনিক কথা প্রচার করে রাখা হয়েছে তার বিবরণ এই আয়াতগুলােতে শেষ হলাে। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে এসব অবাস্তব কথাকে খুব খুব জোরেশােরেই প্রচার করা হয়েছিলাে; কিন্তু আল কোরআন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ওইসব বিভ্রান্তিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। মারইয়ামের পেটে ঈসা(আ.)-এর অস্বাভাবিকভাবে আগমনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনাে কোনাে আহলে কিতাব (খৃষ্টান) ঈসা(আ.)-কে আল্লাহর পুত্র বলে প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। তাদের বিভ্রান্তিকর এ দাবীর ভিত্তি নিছক অনুমান ও কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়, বরং এটার পেছনে রয়েছে তাদের শুধু এক অন্ধ বিশ্বাস। এর পরবর্তী আলােচনা আসছে ইবরাহীম(আ.)-কে কেন্দ্র করে যা ঈসায়ীদের মধ্যে বিরাজমান শিরকের আকীদা বিশ্বাসকে ভুল ও মিথ্যা প্রমাণিত করেছে। ইবরাহীম(আ.) সেই মহান নবী যার বংশধর হওয়ার দাবী করে আরব জাতি নিজেদেরকে গৌরবান্বিত বােধ করে, এসব মােশরেকরা দাবী করে বলে যে তারাই সেই কা’বা শরীফের রক্ষক যা ইবরাহীম ও ছেলে ইসমাঈল এক সাথে মিলে তৈরী করেছিলেন। আলোচ্য অধ্যায় ইবরাহীম(আ.)-এর ব্যক্তিত্বের মধ্যে ভদ্রতা ও সহনশীলতার প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর শান্ত ও বিনম্র স্বভাব যেমন প্রকাশ পেতাে তাঁর চাল-চলনে তেমনি তার প্রতিটি কথা ও ব্যবহারে এই মহান গুণাবলী ফুটে উঠতাে। আরবী ভাষায় অবতীর্ণ আল কোরআন তার এই মহান প্রকৃতির বর্ণনা অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবােধক শব্দাবলীর মাধ্যমে পেশ করেছে। এটা অবশ্যই এক বিস্ময়কর ব্যাপার, তার স্বভাব প্রকৃতি ছিলাে তার বদ-মেজাজী ও হঠকারী পিতার সম্পূর্ণ চেষ্টার বিপরীত। সত্য বিরােধিতায় ইবরাহীম(আ.)-এর পিতার যে যুক্তিহীন ও হঠকারিতাপূর্ণ ভূমিকা ছিলাে তার মােকাবেলা করতে গিয়ে ইবরাহীম(আ.) যে ধৈর্য-সহ্য ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন তা সর্বকালের মানুষের জন্যে এক বিস্ময়কর ও অতীব বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে, একই সাথে তার পিতা ও মােশরেক স্বগােত্রীয় লােক এবং প্রতিবেশীদের সাথে মধুর ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এমন এক মহান আদর্শ যার কারণে তিনি পরবর্তীকালের লােকদেরকে নিয়ে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন এক মহিমান্বিত জাতি। এ জাতির মধ্যে জন্ম নিয়েছেন পর্যায়ক্রমে বহু নবী রসূল নেককার মানুষ ও সত্যসেবী নেতা। আবার এটাও সত্য, কালক্রমে তার মতাদর্শকে দূরে নিক্ষেপ করে আর একদল মানুষ কুপ্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়েছে; লােভ লালসা ও নেতৃত্বের বাসনা তাদেরকে এমনভাবে বিপথগামী করেছে যে তারা মানবতার সকল দাবীকে উপেক্ষা করে সত্য পথ থেকে বহু দূরে সরে গেছে, আল্লাহর সাথে সম্পর্কের রক্ষাকবচ যে সত্যপ্রিয়তা ও সরলতা তাকে বিসর্জন দিয়ে তারা শয়তানের দাসত্ব শুরু করেছে এবং এভাবে তাদের সবার পূর্ব পুরুষ মহান নবী ইবরাহীম(আ.)-এর স্থাপিত আদর্শকে বাদ দিয়ে তারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে গেছে। এরা হচ্ছে মক্কাবাসী ও তৎসন্নিহিত মােশরেক গােত্রসমূহ।

*ইবরাহীম(আ.)-এর ঘটনা : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইবরাহীম(আ.)-এর পরিচয় দিতে গিয়ে জানাচ্ছেন যে তিনি ছিলেন বড়ই সত্যবাদী নবী। সিদ্দীক শব্দটির দুটি অর্থ প্রকাশ করে; পরম সত্যবাদী ও সত্যের পক্ষে দৃঢ়তার সাথে সাক্ষ্যদানকারী এবং এ উভয় অর্থেই ইবরাহীম(আ.)-এর জন্যে এ শব্দটি যথাযথভাবে প্রজোয্য। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করাে এই আল কিতাবের মধ্যে ইবরাহীম(আ.)-কে অবশ্যই সে ছিলাে একজন পরম সত্যবাদী ও সত্য প্রতিষ্ঠাতাকারী নবী… হে আমার পিতা, মহা দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে এক কঠিন আযাব আপনাকে পেয়ে বসবে বলে আমার ভয় হয়, যার কারণে শয়তানই আপনার দরদী বন্ধুতে পরিণত হবে।’ উপরােক্ত বাক্যসমূহে ইবরাহীম(আ.) তার পিতার জন্যে এমনই এক চিত্তাকর্ষক বাক্যমালা ব্যবহার করেছেন, যাতে দেখা যাচ্ছে, তিনি তার পিতাকে সেই মহা কল্যাণের দিকে এগিয়ে নেয়ার করছেন যে দিকে বড় মেহেরবানী করে তার আল্লাহ তায়ালা তাকে পরিচালনা করেছেন এবং তাকে তিনি যে শিক্ষা দিয়েছেন, এ শিক্ষাকে তিনি মহব্বতের সাথে গ্রহণ করছেন এবং এ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে পিতাকে সম্বােধন করতে গিয়ে বলছেন, হে আমার পিতা, তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করছেন, কেন আপনি এমন জিনিসের পূজা করেন যা শােনে না, দেখে না এবং যা আপনার কোনাে উপকারও করতে পারে না?’ ইবাদাত শব্দটির মধ্যে আসল যে অর্থ নিহিত রয়েছে তা হচ্ছে এই যে মানুষের প্রকৃতিই হলে, সে তার থেকে শক্তি-সামর্থ, জ্ঞান বুদ্ধি ও যােগ্যতা দক্ষতায় যখন কাউকে বড় মনে করে তখন তার মুখাপেক্ষী হয়ে যায় এবং তার ওপর পুরােপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তাকে অতি মানুষ মনে করে, সাধারণ মানুষের মর্যাদা থেকে তাকে অনেক বেশী মর্যাদা দিতে থাকে এবং মনে করে, সে সাধারণ মানুষের তুলনায় বহু বহু গুণে উন্নত শ্রেণীর মানুষ, এমতাবস্থায়, যে মানুষ নয়, বরং মানুষ থেকে শক্তি-সামর্থ ও মর্যাদার দিক দিয়ে অনেক নিম্নমানের বরং মাটি পাথর নির্মিত যে সব মূর্তি তারা নিজেরা বানায়, যারা শােনেনা, দেখে না, কারাে ক্ষতি বৃদ্ধিও করতে পারে না, তার সামনে সৃষ্টির সেরা এই মানুষ কিভাবে মাথা নত করতে পারে। বলা হচ্ছে যে আজকে কোরায়শ জাতি তাে সেই একইভাবে মূর্তি পূজা করে চলেছে যেভাবে ইবরাহীম(আ.)-এর বাপের আমল থেকে দেব-দেবীর পূজা প্রথা চলে আসছিলাে। এই হচ্ছে সেই প্রথম বিষয় যার দ্বারা ইবরাহীম(আ.) তার পিতাকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেয়ার কাজ শুরু করেছিলেন, এরপর সুস্পষ্টভাবে পিতাকে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, এ কাজ তিনি নিজের ইচ্ছায় বা নিজের বুদ্ধিতে শুরু করেননি, বরং আল্লাহর নির্দেশেই তিনি এ কাজ শুরু করেছেন, এ জ্ঞান আল্লাহর পক্ষ থেকেই তাকে দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাকে পরিচালনা করছেন। যদিও পিতার থেকে তিনি বয়সে ছােট এবং অভিজ্ঞতাও কম, তবুও মহান আল্লাহর সাহায্যে তিনি, অন্য যে কোনাে ব্যক্তি থেকে বেশী বুঝেন ও সত্যকে বেশী চেনেন। এজন্যেই পিতাকে উপদেশ দেয়ার দায়িত্ব তিনি পালন করছেন, কেননা তার কাছে তাে সঠিক জ্ঞান নেই, পিতাকে সেই পথেই তিনি চলতে বলছেন যে পথে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে চালানাে হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘হে আমার পিতা অবশ্যই আমার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সেই সঠিক জ্ঞান এসেছে, যা আপনার কাছে আসেনি। অতএব, আপনি আমার অনুসরণ করুন। আমি আপনাকে সঠিক পথেই চালাবাে।’ দেখুন, পিতাকে, সঠিক পথ প্রাপ্তির ব্যাপারে, পুত্রের অনুসরণ করার আহ্বানে কোনাে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা নরম কথা নেই, কেননা পুত্র তাে সর্বজ্ঞ ও সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে জ্ঞান ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত। তিনি নিজে মূল উৎস থেকে জ্ঞান পাচ্ছেন বলেই নির্বিকার চিত্তে ও বলিষ্ঠ কণ্ঠে হেদায়াতের পথে পিতাকে আহ্বান জানাতে পারছেন। মূর্তি-পূজার অসারতা ও খারাবী সম্পর্কে জানার পর এবং পূর্ণাংগ জ্ঞানের উৎসের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা এসে যাওয়ার পরই তিনি পিতাকে দাওয়াত দিচ্ছেন। একারণেই সুস্পষ্টভাবে তিনি পিতাকে জানাতে পারছেন যে তার পথ অবশ্যই শয়তানের পথ। তার একমাত্র বাসনা যে পিতা মহাদয়াময় আল্লাহর পথে চলুক-কেননা প্রতিনিয়ত তার ভয় হচ্ছে, পিতা যে পথে চলছে তা যে কোনাে সময় তাকে আল্লাহর গযবের মধ্যে ফেলে দিবে এবং শয়তানের অনুসারী হিসাবে তার প্রতি চিরস্থায়ী আযাবের ফয়সালা হয়ে যাবে। তাই ইবরাহীম(আ.)-এর সতর্কবাণী উদ্ধৃত করতে গিয়ে এরশাদ হচ্ছে, ‘হে আমার পিতা, শয়তানের অনুসরণ করবেন না, অবশ্যই শয়তান আল্লাহর নাফরমান হয়ে গেছে। হে আমার পিতা, আমার ভয় হচ্ছে, আপনাকে মহা দয়াময় আল্লাহর আযাব পাকড়াও করে নেবে, ফলে আপনি শয়তানের বন্ধুতে পরিণত হয়ে যাবেন।’ আর শয়তান তাে সেই দুরাশয় খবিস, যে আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে প্রতিনিয়ত মূর্তিপূজার দিকে মানুষকে প্ররােচিত করে চলেছে, সুতরাং যে ব্যক্তি এসব মূর্তির পূজা করে, সে যেন শয়তানের পূজা করে, আর শয়তান তার মহা দয়াময় পরওয়ারদেগারের সরাসরি না-ফরমানি করেছে। এখানে ইবরাহীম(আ.) তার পিতাকে চূড়ান্তভাবে সতর্ক করে দিচ্ছেন যেন সে কোনাে অবস্থাতেই আল্লাহকে ক্রোধান্বিত না করে, তা করলে অবশ্যই তাকে আল্লাহ তায়ালা শাস্তি দেবেন এবং তাকে শয়তানের বন্ধু ও অনুগামী বানিয়ে দেবেন। অতপর, বুঝতে হবে যে আল্লাহ তায়ালা যে তার বান্দাকে তার আনুগত্য করার তাওফীক দেন এটা অবশ্যই তার জন্যে এক অপার নেয়ামত এবং যখন আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে শাস্তি দেন তখন শয়তানকে তার বন্ধু বানিয়ে দেন। এটা এমনই এক প্রতিশােধ বা শাস্তি যে কেয়ামতের দিন হবে এটা আরাে কঠিন ও আরাে বেশী ক্ষতিকর এবং হিসাব নিকাশের দিনে এ শাস্তি হবে আরাে মারাত্মক। কিন্তু পরম প্রিয় ও মধুর কথা দ্বারা প্রদত্ত এই মর্মস্পশী দাওয়াত কিছুসংখ্যক বিবেকবান লােকের অন্তর স্পর্শ করলেও খুঁতখুঁতে প্রাণ মােশরেক ও কঠিন হৃদয়ে এ দাওয়াত কোনাে দাগ কাটতে সক্ষম হয় না। তাই দেখা যায়, ইবরাহীম(আ.)-এর মােলায়েম ও যৌক্তিক কথাকে তার পিতা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করছে এবং তাকে চরমভাবে তিরস্কার করতেও ক্ষান্ত হচ্ছে না বরং তাকে কঠিন শাস্তি দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে। কালামে পাকে তার কথা উদ্ধৃত করতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি আমার মাবুদদের সংস্পর্শ থেকে দূরে সরে যেতে চাও এবং তাদের থেকে আমাকেও বিমুখ বানাতে চাও? হে ইবরাহীম এসব বাজে কথা বলা যদি বন্ধ না করাে তাহলে অবশ্যই আমি তােমাকে পাথর মেরে ফেলবাে, দূর হয়ে যাও এখান থেকে আর সহসা যেন তােমাকে আমি এ অঞ্চলে না দেখি।’ অর্থাৎ তুমি কি আমার মাবুদদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো, হে ইবরাহীম। তাদের পূজা করতেও কি তুমি অনিচ্ছুক, তুমি কি তাদেরকে অস্বীকার করো? এতােদূর স্পর্ধা তােমার, যে আমার মাবুদদের সম্পর্কে তুমি এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলতে সাহস পেয়েছাে? ভালাে করে জেনে নাও, যদি আমার মাবুদদের সম্পর্কে পুনরায় তােমার মুখে এসব জঘন্য উক্তি শুনতে পাই তাহলে তােমাকে অত্যন্ত কঠিন মৃত্যুবরণ করতে হবে। এরশাদ হচ্ছে, ‘তুমি যদি না থামাে তাহলে অবশ্যই তােমাকে আমি পাথর নিক্ষেপে মেরে ফেলবাে।’ সুতরাং দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে, আর শােনাে, তুমি এতাে দূরে চলে যাবে যেন বহু দিন ধরে আর তােমাকে আমি না দেখি, যদি বাঁচতে চাও তাে শীঘ্র পালাও এখান থেকে। ‘দীর্ঘদিনের জন্যে আমার থেকে দূরে চলে যাও।’ যখনই কোনাে বিপথগামী ব্যক্তি কাউকে হেদায়াতের দিকে ডাকে তখন এমনই হয় তার প্রতিক্রিয়া আর এই ধরনের কঠিন কথাই ভদ্র রুচিবান ও সম্ভ্রান্ত মানুষদেরকে শুনতে হয়। এই হচ্ছে ঈমান ও কুফর এর মধ্যে সম্পর্ক আর কুফরীর কারণে যে অস্তর বিগড়ে গেছে তার মােকাবেলায় কথা বলতে গিয়ে এমনই কঠিন অবস্থা বরদাশত করতে হয় সে অন্তরকে যা ঈমানের আলােয় আলােকিত হয়েছে। দেখুন, আল্লাহর পরম প্রিয় বন্ধু ইবরাহীম(আ.) কেমন প্রশান্ত বদনে বাপের এসব তিরস্কার ও কঠিন কথাকে সহ্য করছেন। তিনি কোনাে রাগ করলেন না, আদবের খেলাফ কোনাে কথাও বলছেন না বা এমন কোনাে আচরণও করছেন না যার দ্বারা তার অধৈর্য হওয়ার কথা প্রকাশ পেতে পারে বা তার উন্নত চরিত্র ও ব্যবহার থেকে তিনি সরে গেছেন বলে মনে হতে পারে! নীচের শব্দগুলাের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হচ্ছে, ‘সে বলে, আপনার প্রতি শাস্তি বর্ষিত হােক, শীঘ্রই আমি আমার রবের কাছে আপনার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবাে, অবশ্যই তিনি আমার প্রতি বড়ই মেহেরবান। ঠিক আছে, আমি আপনাদের এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য যাদের পূজা অর্চনা আপনারা করে চলেছেন, তাদের সবাইকে ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি। আমি আমার রবের কাছে প্রার্থনা জানাব যেন তিনি আমাকে তার কাছে যাওয়ার তাওফীক দেন এবং তার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে হতভাগ্য না বানান। খেয়াল করে দেখুন, ইবরাহীম(আ.) পিতার সাথে কোনাে ঝগড়া করছেন না, তাকে কোনাে কষ্ট দিচ্ছেন না, তার ধমক ও শাস্তি দানের ভয় দেখানােতে কোনাে প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করছেন তিনি বলছেন, আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাবাে যেন তিনি আপনাকে ক্ষমা করে দেন এবং তিনি চিরস্থায়ী গোমরাহীর মধ্যে হাবুডুবু খেতে এবং শয়তানের সহচর অবস্থায় থাকার জন্যে আপনাকে ছেড়ে না দেন, বরং তিনি যেন আপনার প্রতি রহম করেন এবং হেদায়াতরূপ নেয়ামত আপনাকে দান করেন, অবশ্যই তিনি আমাকে সম্মানিত করবেন এবং আমার দোয়া কবুল করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। কিন্তু আমার উপস্থিতি ও আপনার পাশে আমার অবস্থান যদি আপনার জন্যে কষ্টদায়ক হয়, তাহলে অবশ্যই আপনাকে এবং আপনার জাতিকে আমি ছেড়ে চলে যাবাে, আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসবের পূজা অর্চনা আপনারা করে চলেছেন তাদের সবাইকেই আমি পরিত্যাগ করতে এতােটুকু কুণ্ঠাবোধ করবাে না, সাহায্যের জন্যে বুকভরা আশা নিয়ে একমাত্র তাকেই আমি ডাকবাে যিনি প্রকৃতপক্ষে আমার রব, আর আল্লাহকে আমার ডাকার কারণে অবশ্যই আমি আশা করবাে যে তিনি আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না। সুতরাং, এখানে একথা সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে ইবরাহীম যার কাছে আশা করছেন একমাত্র তিনিই যে তাকে যে কোনাে ক্ষতি থেকে বাঁচাতে পারেন সে বিষয়ে তিনি পুরােপুরিভাবে নিশ্চিত। যাকে ইবরাহীম মনে প্রাণে অনুভব করেন এবং যার অস্তিত্ব ও করুণারাশি সবখানে পরিব্যাপ্ত বলে তার হৃদয় মন ভরপুর, একমাত্র তার কাছে আশা করাটাই তাে যুক্তিযুক্ত, অথচ তাকে তিনি নিজের চোখে দেখছেন না এবং তিনিই যে ক্ষতি থেকে বাঁচাতে পারেন এই অনুভূতি ছাড়া তার সম্পর্কে অতিরিক্ত আর কিছু তিনি জানেন না। এভাবেই ইবরাহীম তার বাপকে, তার জাতিকেও তাদের পূজা অর্চনা এবং পূজনীয় বস্তু ও ব্যক্তিবর্গকে ছেড়ে চলে গেলেন, পরিত্যাগ করলেন তার পরিবারবর্গ ও ঘরবাড়ী। কাজেই আল্লাহ তায়ালাও তাকে নিঃসংগ ও একাকী অবস্থায় ছেড়ে দিলেন না, বরং তার স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়া নির্বাসনের মধ্যে তাকে মহান আল্লাহ দান করলেন তার বংশধর এবং তাকে উত্তম প্রতিদান দিলেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর যখন সে পরিত্যাগ করে চলে গেলাে তাদেরকে এবং সেইসব বস্তু বা ব্যক্তিকে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের পূজা অর্চনা তারা করছিলাে তখন আমি তাকে দান করলাম ইসহাক নামক এক ছেলে এবং ইসহাকের ছেলে ইয়াকুব নবীকে, আর এদের প্রত্যেককে বানালাম নবী, আর আমার রহমতের মধ্য থেকে তাদের প্রত্যেককে দান করলাম বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত ও প্রভূত মান সম্ভ্রম, আর তাদের প্রত্যেকের জন্যে বানিয়ে দিলাম অতি মর্যাদাপূর্ণ সত্য কথা বলার ক্ষমতা। আসুন, এবার আমরা এই নবীদের পরিচয় জেনে নেই, ইসহাক(আ.) ছিলেন ইবরাহীম(আ.)-এর পুত্র, যিনি তার স্ত্রী সারার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, অথচ ইতিপূর্বে সে স্ত্রী ছিলেন বন্ধা, আর ইয়াকুব(আ:) ছিলেন ইসহাক(আ.)-এর ছেলে। কিন্তু অনেকে তাকে ইবরাহীম(আ.)-এর ছেলে মনে করে থাকে কারণ ইসহাক(আ.) ইয়াকুব(আ.) কে তার দাদা ইবরাহীমের জীবদ্দশায় তার বাড়ীতেই এমনভাবে লালন-পালন করেছিলেন যে তিনি সরাসরি তার ছেলের মতােই আদর মহব্বত পেয়েছেন তাকে তার বাপের মতাে আল্লাহ তায়ালা নবীও বানিয়েছিলেন। এরশাদ হচ্ছে, আর দান করেছি তাদেরকে আমি আমার রহমত থেকে বহু নবী যেমন ইবরাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তাদের বংশে আরাে বহু নবী… আর আল্লাহর রহমতের কথা এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, কারণ এ সূরার প্রতি ছত্রের মধ্যে আল্লাহর রহমতের কথা মূর্ত হয়ে রয়েছে, আর আল্লাহর নবুওত রূপ এ রহমত একান্তভাবে একমাত্র তারই দান যা তিনি ইবরাহীম ও তার বংশধরদের মধ্যে দিয়েছেন। ইবরাহীম(আ.)-এর সমগ্র গােষ্ঠী ও তার গােত্রের পর গােত্র ধরে বহু বহু লােক এ মহান নেয়ামতের অধিকারী হয়েছেন এবং দুনিয়াকে তারা হেদায়াতের আলো দেখিয়েছেন। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর বানিয়েছি আমি, তার কথাকে সমুন্নত।’ এর ফলে, বরাবরই দাওয়াত দিতে গিয়ে তারা সততা ও সত্যবাদিতার সাক্ষ্য রেখে গেছেন। তাদের জাতির লােকেরা মুগ্ধ হৃদয়ে সাড়া দিয়েছে তাদের দাওয়াতে এবং মহব্বতের সাথে তারা এই নবীদের আনুগত্য করেছে।

 

 

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

৪১-৪৫ নং আয়াতের তাফসীর:

মক্কার মুশরিকরা যারা মূর্তিপুজক ছিল এবং নিজেদেরকে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) অনুসারী মনে করতো তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন এবং স্বীয় নবীকে (সঃ) বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি তাদের সামনে স্বয়ং হযরত ইবরাহীম খলীলের (আঃ) ঘটনা বর্ণনা কর। এ সত্য নবী নিজের পিতাকেও পরওয়া করেন নাই। তার সামনে তিনি সত্যকে খুলে দিয়েছিলেন এবং তাকে মূর্তিপূজা হতে বিরত থাকতে বলেছিলেন। তাকে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেনঃ “যে মূর্তি তোমার কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে তার পূজা কর কেন?

তিনি স্বীয় পিতাকে বলেছিলেনঃ “নিশ্চয়ই আমি তোমার পুত্র। কিন্তু আমার মধ্যে আল্লাহর দেয়া যে জ্ঞান রয়েছে তা তোমাদের মধ্যে নেই। তুমি আমার অনুসরণ করো। আমি তোমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করছি এবং আমি তোমাকে অকল্যাণের পথ হতে সরিয়ে কল্যাণের পথে পৌঁছিয়ে দেবো। হে আমার পিতা! মূর্তি পূজা দ্বারা তো শয়তানেরই অনুসরণ করা হয়। সে ঐ পথে পরিচালিত করে এবং এতে সে খুশী হয়। যেমন সূরায়ে ইয়াসীনে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি কি তোমাদেরকে সতর্ক করে দিই নাই হে অদিম সন্তানগণ (এবং হে জ্বিনগণ)! তোমরা শয়তানের পূজা করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু!” (৩৬:৬০) আর এক আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ তারা স্ত্রীলোকদেরকে ডেকে থাকে এবং আল্লাহকে পরিত্যাগ করে, প্রকৃত পক্ষে তারা উদ্ধত শয়তানকেই ডেকে থাকে।” (৪:১১৭)

হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পিতাকে আরো বলেনঃ শয়তান আল্লাহ তাআলার অবাধ্য ও বিরোধী। তার আনুগত্য স্বীকার করার ব্যাপারে সে অহংকারী। এ কারণেই সে মহান আল্লাহর দরবার হতে বিতাড়িত হয়েছে। যদি তুমিও এই শয়তানের আনুগত্য কর, তবে সে তোমাকেও তার অবস্থায় পৌঁছিয়ে দেবে। হে আমার পিতা! তেমাির এই শিরুক ও অবাধ্যতার কারণে আমি আশংকা করছি যে, হয়তো তোমার উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়বে এবং তুমি শয়তানের বন্ধু ও সঙ্গী হয়ে যাবে। আর এর ফলে তোমার উপর থেকে আল্লাহর সাহায্য সহানুভূতি দূর হয়ে যাবে। দেখো, শয়তানের কোনই ক্ষমতা নেই। তার আনুগত্য করলে তুমি অতি জঘন্য স্থানে পৌঁছে যাবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এটা নিশ্চিত ও শপথ যুক্ত কথা যে, তোমার পূর্ববর্তী উম্মতদের নিকট ও আমি রাসূল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু শয়তান তাদের খারাপ কাজগুলিকে তাদের কাছে শোভনীয় ও সুন্দররূপে দেখিয়েছিল এবং সেই আজ তাদের সঙ্গী ও বন্ধু হয়ে যায় (কিন্তু সুফল কিছুই হলো না), তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” (১৬:৬৩)
৪৬-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

হ্যরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পিতাকে আল্লাহর পথে আহবান করলে এবং মূর্তি পূজা পরিত্যাগ করতে বললে সে তাকে যে উত্তর দিয়েছিল এখানে আল্লাহ তাআলা তারই খবর দিচ্ছেন। সে হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) বললোঃ “তুমি কি আমার মা’দদের প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তাদের উপাসনা করতে অস্বীকার করছো? তুমি কি তাদেরকে খারাপ বলছে, দোষ দিচ্ছ এবং গালাগালি করছো? জেনে রেখো যে, তুমি যদি এ কাজ থেকে বিরত না হও, তবে আমি তোমাকে প্রস্তুরাঘাতে হত্যা করে ফেলবো। তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ো না এবং আমাকে কিছুই বলো না। এটাই উত্তম যে, তুমি আমার নিকট থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করো। নচেৎ আমি তোমাকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবো। উত্তরে হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি খুশী হও যে, আমি তোমাকে কোন কষ্ট দিবো না। কেননা, তুমি আমার পিতা। বরং আমি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করবো যে, তিনি যেন তোমাকে ভাল হওয়ার তাওফীক দেন এবং তোমার গুনাহ মাফ করেন। মুমিনদের নীতি এটাই যে, তারা অজ্ঞদের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। যেমন কুরআন কারীমে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে, তখন তারা জবাব দেয় প্রশান্তভাবে।” (২৫:৬৩) আর এক জায়গায় আছেঃ “যখন তারা বাজে কথা শুনে, তখন তারা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলেঃ আমাদের কাজ আমাদের জন্যে এবং তোমাদের কাজ তোমাদের জন্যে। তোমাদের উপর সালাম এবং আমরা অজ্ঞদের মুখোমুখী হতে চাইনে (অর্থাৎ তাদের সাথে ঝগড়া করতে চাইনে)।”

অতঃপর হযরত ইবরাহীম (আঃ) বলেনঃ “আমার প্রতিপালক আমার প্রতি অতিশয় অনুগ্রহশীল। এটা তারই অনুগ্রহ যে, তিনি আমাকে ঈমান, ইখলাস এবং হিদায়াত দান করেছেন। আমি আশা রাখি যে, তিনি আমার প্রার্থনা কবুল করবেন। পিতার সাথে তাঁর এ ওয়াদা অনুযায়ী তিনি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। সিরিয়ায় হিজরত করার পরেও, মসজিদে হারাম নির্মাণ করার পরেও এবং তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণ করার পরেও তিনি প্রার্থনা করতেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং সমস্ত মুমিনকে হিসাব কায়েম হওয়ার দিন ক্ষমা করে দিবেন। অবশেষে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাঁর নিকট ওয়াহী আসেঃ “মুশরিকদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো না।” তাঁকে অনুসরণ করে ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানরাও তাঁদের মুশরিক আত্মীয় স্বজনের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। অতঃপর নিম্নের আয়াত নাযিল হয়ঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে ইবরাহীমের (আঃ) মধ্যে ও তাঁর সঙ্গীয় লোকদের মধ্যে; যখন তারা তাদের কওমকে বলেছিলঃ ক তোমাদের থেকে ও আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের ইবাদত করছে তাদের থেকে মুক্ত………., ইবরাহীমের (আঃ) ঐ কথাটি ছাড়া যা সে তার পিতাকে বলেছিলঃ আমি সত্বরই তোমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবো এবং আমি তোমার জন্যে আল্লাহর নিকট কোন কিছুরই মালিক নই।” (৬০:৪) অর্থাৎ হে মুসলমানরা! নিঃসন্দেহে ইবরাহীম (আঃ) তোমাদের অনুসরণ যোগ্য। কিন্তু তিনি যে তাঁর পিতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন এ ব্যাপারে তিনি তোমাদের অনুসরণ যোগ্য নন। অন্য এক জায়গায় আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘নবী (সঃ) ও মু’মিনদের জন্যে উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে।” (৯:১১৩) এরপরে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ “ইব্রাহীমের (আঃ) তার পিতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা শুধু ঐ ওয়াদার কারণেই যে ওয়াদা সে তার সাথে করেছিল। কিন্তু যখন তার কাছে এটা প্রকাশিত হয়ে গেল যে, সে আল্লাহর শত্রু, তখন সে তার থেকে বিরত থাকলো, নিশ্চয় ইবরাহীম (আঃ) (আল্লাহর দিকে) প্রত্যাবর্তনকারী এবং সহনশীল।”

এরপর হযরত ইবরাহীম (আঃ) বলেনঃ আমি তোমাদের দিক হতে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত কর তাদের দিক হতে পৃথক হচ্ছি, আমি শুধু আমার প্রতিপালককে আহবান করি। তার ইবাদতে অন্য কাউকেও আমি শরীক করি না। আমি শুধু তার কাছেই প্রার্থনা জানাই। আমি আশা রাখি যে, আমার প্রতিপালককে আহবান করে আমি ব্যর্থকাম হবে না, বরং সফলকাম হবো। তিনি অবশ্যই আমার আহবানে সাড়া দিবেন। ঘটনাও এটাই বটে। এখানে (আরবী) শব্দটি (আরবী) এর অর্থে এসেছে। কেননা, হযরত মুহাম্মদের (সঃ) পরে তিনিই নব্বীদের সরদার বা নেতা। তাদের সবারই উপর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।

৪৯-৫০ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তাআলা বলছেন যে, হযরত ইবরাহীম খলীল (আঃ) পিতামতা, আত্মীয় স্বজন, দেশ ও গোত্রকে আল্লাহর দ্বীনের উপর উৎসর্গ করেছিলেন। এই সব থেকে তিনি পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে তাদের থেকে মুক্ত ও পৃথক বলে ঘোষণা করেন। ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে দান করেন ইসহাককে (আঃ) এবং ইসহাককে (আঃ) দান করেন ইয়াকূবকে (আঃ)। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনি ইয়াকূবকে (আঃ) অতিরিক্ত রূপে দান করেন।” (২১৪ ৭২) আর একটি আয়াতে আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “ইসহাকের (আঃ) পিছনে ইয়াকূবকে (আঃ) দান করেন।” (১১:৭১) সুতরাং হযরত ইসহাক (আঃ) ছিলেন হযরত ইয়াকুবের (আঃ) পিতা। যেমন সূরায়ে বাকারায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা কি হাজির ছিলে যখন ইয়াকূবের (আঃ) মৃত্যুর সময় উপস্থিত হয়। তখন সে তার পুত্রদেরকে বলেঃ আমার পরে তোমরা কার ইবাদত করবে? উত্তরে তারা বলেঃ আমরা ইবাদত করবো আপনার মাবুদের এবং আপনার পিতৃ পুরুষ ইবরাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) এবং ইসহাকের (আঃ) মাবুদের।” (২:১৩৩) সুতরাং এখানে ভাবার্থ হচ্ছেঃ আমি তার বংশক্রম চালু রেখেছি। তাকে আমি পুত্র দান করেছি এবং পুত্রকে পুত্র দান করেছি এবং এভাবে তার চক্ষু ঠাণ্ডা রেখেছি। এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে, হযরত ইয়াকুবের (আঃ) পর তাঁর পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ) নবী হন। এখানে তার কথা উল্লেখ করা হয় নাই। কেননা, হযরত ইউসুফের (আঃ) নুবওয়াতের সময় হযরত ইবরাহীম (আঃ) জীবিত ছিলেন না। এই দুজন অর্থাৎ হযরত ইসহাক (আঃ) ও হযরত ইয়াকুবের (আঃ) নুবওয়াত তার জীবদ্দশায় তাঁর সামনেই ছিল। এই জন্যেই এই অনুগ্রহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহকে (সঃ) প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ “সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি কে? উত্তরে তিনি বলেছিলেনঃ “আল্লাহর নবী ইউসুফ (আঃ), তার পিতা আল্লাহর নবী ইয়াকূব (আঃ), তার পিতা আল্লাহর নবী ইসহাক (আঃ) এবং তাঁর পিতা আল্লাহর নবী ও খলীল ইবরাহীম (আঃ)।” অন্য শব্দে রয়েছেঃ “কারীম ইবনু কারীম, ইবনু কারীম, ইবনু কারীম ইউসুফ ইবনু ইয়াকূব, ইবনু ইসহাক, ইবনু ইবরাহীম। (সবারই উপর শান্তি বর্ষিত হোক)।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ তাদেরকে আমি দান করলাম আমার অনুগ্রহ এবং তাদেরকে দিলাম সমুচ্চ খ্যাতি। সারা দুনিয়াবাসী আজ তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁদের সবারই উপর আল্লাহর দুরূদও সালাম বর্ষিত হোক।

Leave a Reply