(বই#৯১০) [ اِذۡہَبَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّہٗ طَغٰی ﴿ۚۖ۴۳﴾ তোমরা দু’জন ফিরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালংঘন করেছে।] সূরা:- ত্বাহা। সুরা:২০ ৩৭-৪৮ নং আয়াত:- www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯১০)
[ اِذۡہَبَاۤ اِلٰی فِرۡعَوۡنَ اِنَّہٗ طَغٰی ﴿ۚۖ۴۳﴾
তোমরা দু’জন ফিরাউনের নিকট যাও, সে তো সীমালংঘন করেছে।]

সূরা:- ত্বাহা।
সুরা:২০
৩৭-৪৮ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২০:৩৭
وَ لَقَدْ مَنَنَّا عَلَیْكَ مَرَّةً اُخْرٰۤىۙ

আমি আর একবার তোমার প্রতি অনুগ্রহ করলাম।
২০:৩৮
اِذْ اَوْحَیْنَاۤ اِلٰۤى اُمِّكَ مَا یُوْحٰۤىۙ

সে সময়ের কথা মনে করো যখন আমি তোমার মাকে ইশারা করেছিলাম, এমন ইশারা যা অহীর মাধ্যমে করা হয়,
২০:৩৯
اَنِ اقْذِفِیْهِ فِی التَّابُوْتِ فَاقْذِفِیْهِ فِی الْیَمِّ فَلْیُلْقِهِ الْیَمُّ بِالسَّاحِلِ یَاْخُذْهُ عَدُوٌّ لِّیْ وَ عَدُوٌّ لَّهٗ١ؕ وَ اَلْقَیْتُ عَلَیْكَ مَحَبَّةً مِّنِّیْ١ۚ۬ وَ لِتُصْنَعَ عَلٰى عَیْنِیْۘ

এই মর্মে যে, এ শিশুকে সিন্দুকের মধ্যে রেখে দাও এবং সিন্দুকটি দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও, দরিয়া তাকে তীরে নিক্ষেপ করবে এবং আমার শত্রু ও এ শিশুর শত্রু একে তুলে নেবে। আমি নিজের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার করেছিলাম এবং এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে তুমি আমার তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হও।
২০:৪০
اِذْ تَمْشِیْۤ اُخْتُكَ فَتَقُوْلُ هَلْ اَدُلُّكُمْ عَلٰى مَنْ یَّكْفُلُهٗ١ؕ فَرَجَعْنٰكَ اِلٰۤى اُمِّكَ كَیْ تَقَرَّ عَیْنُهَا وَ لَا تَحْزَنَ١ؕ۬ وَ قَتَلْتَ نَفْسًا فَنَجَّیْنٰكَ مِنَ الْغَمِّ وَ فَتَنّٰكَ فُتُوْنًا١۫۬ فَلَبِثْتَ سِنِیْنَ فِیْۤ اَهْلِ مَدْیَنَ١ۙ۬ ثُمَّ جِئْتَ عَلٰى قَدَرٍ یّٰمُوْسٰى

স্মরণ করো, যখন তোমার বোন চলছিল, তারপর গিয়ে বললো, “আমি কি তোমাদের তার সন্ধান দেবো, যে এ শিশুকে ভালোভাবে লালন করবে?” এভাবে আমি তোমাকে আবার তোমার মায়ের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছি, যাতে তার চোখ শীতল থাকে এবং সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়। এবং (এটাও স্মরণ করো) তুমি একজনকে হত্যা করে ফেলেছিলে, আমি তোমাকে এ ফাঁদ থেকে বের করেছি এবং তোমাকে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে নিয়ে এসেছি, আর তুমি মাদইয়ানবাসীদের মধ্যে কয়েক বছর অবস্থান করেছিলে। তারপর এখন তুমি ঠিক সময়েই এসে গেছো। হে মূসা!
২০:৪১
وَ اصْطَنَعْتُكَ لِنَفْسِیْۚ

আমি আমার নিজের জন্য তৈরী করে নিয়েছি।
২০:৪২
اِذْهَبْ اَنْتَ وَ اَخُوْكَ بِاٰیٰتِیْ وَ لَا تَنِیَا فِیْ ذِكْرِیْۚ

যাও, তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনগুলোসহ এবং দেখো আমার স্মরণে ভুল করো না।
২০:৪৩
اِذْهَبَاۤ اِلٰى فِرْعَوْنَ اِنَّهٗ طَغٰىۚۖ

যাও, তোমরা দু’জন ফেরাউনের কাছে, সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে।
২০:৪৪
فَقُوْلَا لَهٗ قَوْلًا لَّیِّنًا لَّعَلَّهٗ یَتَذَكَّرُ اَوْ یَخْشٰى

তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে।”
২০:৪৫
قَالَا رَبَّنَاۤ اِنَّنَا نَخَافُ اَنْ یَّفْرُطَ عَلَیْنَاۤ اَوْ اَنْ یَّطْغٰى

উভয়েই – বললো, “হে আমাদের রব! আমাদের ভয় হয়, সে আমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবে অথবা আমাদের ওপর চড়াও হবে।”
২০:৪৬
قَالَ لَا تَخَافَاۤ اِنَّنِیْ مَعَكُمَاۤ اَسْمَعُ وَ اَرٰى

বললেন, “ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, সবকিছু শুনছি ও দেখছি।
২০:৪৭
فَاْتِیٰهُ فَقُوْلَاۤ اِنَّا رَسُوْلَا رَبِّكَ فَاَرْسِلْ مَعَنَا بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ١ۙ۬ وَ لَا تُعَذِّبْهُمْ١ؕ قَدْ جِئْنٰكَ بِاٰیَةٍ مِّنْ رَّبِّكَ١ؕ وَ السَّلٰمُ عَلٰى مَنِ اتَّبَعَ الْهُدٰى

যাও তার কাছে এবং বলো, আমরা তোমার রবের প্রেরিত, বনী ইসরাঈলকে আমাদের সাথে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দাও এবং তাদেরকে কষ্ট দিয়ো না। আমরা তোমার কাছে নিয়ে এসেছি তোমার রবের নিদর্শন এবং শান্তি তার জন্য যে সঠিক পথ অনুসরণ করে।
২০:৪৮
اِنَّا قَدْ اُوْحِیَ اِلَیْنَاۤ اَنَّ الْعَذَابَ عَلٰى مَنْ كَذَّبَ وَ تَوَلّٰى

আমাদের অহীর সাহায্যে জানানো হয়েছে যে, শাস্তি তার জন্য যে মিথ্যা আরোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।”

৩৭-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*জীবনব্যাপী মূসা(আ.)-এর ওপর আল্লাহর রহমতের ছায়া : হযরত মূসা(আ.)-এর প্রতি যে অনুগ্রহ ও সম্মান এখানে দেখানাে হয়েছে, তা পর্যাপ্ত ছিলাে, কিন্তু এরপরও তার সাথে আলাপ ও তার প্রতি আরাে অনুগ্রহ প্রদর্শন অব্যাহত রাখা হয়েছে। বস্তুত তাঁর কৃপা অনুগ্রহ সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা আর কারাে নেই। তিনি ইতিপূর্বে তার প্রতি যে অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, যাতে তার মন অধিকতর আশ্বস্ত হয়। ‘আমি তােমার ওপর আরাে একবার অনুগ্রহ করেছিলাম, যখন তােমার মাকে বলেছিলাম…'(আয়াত ৩৭-৪১) হযরত মূসা(আ.) সে কালের পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতাপশালী পরাক্রমশালী এবং সবচেয়ে স্বৈরাচারী বাদশার কাছে যাত্রা করলেন, যাত্রা করলেন কুফুরের সাথে ঈমানের সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে। প্রথমে ফেরাউনের সাথে এবং পরে নিজ গােত্র বনী ইসরাঈলের সাথে তার অনেক ঘটনা ঘটে ও অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বনী ইসরাঈলের সাথে সমস্যা সৃষ্টির কারণ ছিলাে, ফেরাউনের সুদীর্ঘ দাসত্ব তাদের বিবেক ও চেতনা নিস্ক্রিয় এবং তাদের স্বভাব প্রকৃতি ও মেজাজ বিকৃত করে দিয়েছিলাে। ফেরাউনের দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের পর হযরত মূসা(আ.)-এর নেতৃত্বে একটি স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পিত ছিলাে, সে দায়িত্ব পালনে তাদের মানসিক প্রস্তুতি ওই গােলামীর কারণেই নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিলাে। আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা(আ.)-কে জানাচ্ছেন যে, তিনি তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাঠাবেন না বরং পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রস্তুত করেই পাঠাবেন। তাকে তিনি শৈশব থেকেই নিজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লালন পালন করেছেন, দুধ খাওয়ার সময় থেকেই তাকে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, শিশুকালে তিনি ফেরাউনের মুঠোর মধ্যেই ছিলেন, তখন তার হাতে আদৌ কোনাে প্রতিরােধ ক্ষমতা বা সাজসরঞ্জাম ছিলাে না। তথাপি ফেরাউন তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। কেননা মহান আল্লাহর অদৃশ্য হাত তাকে প্রতি মুহর্তে রক্ষা করে বলছিলো; সুতরাং আজ যখন মূসা বড়াে হয়েছেন, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তার সাথে রয়েছেন এবং তাকে নিজের রসূল রূপে মনােনীত করেছেন, তখন মূসা(আ.)-এর এখন আর কোনাে দুশ্চিন্তার কারণই থাকতে পারে না। ‘আমি তােমাকে ইতিপূর্বে আরাে একবার অনুগ্রহ করেছি।’ অর্থাৎ তােমার প্রতি আমার অনুগ্রহ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে, বিশেষত রেসালাতের দায়িত্বে নিযুক্তির পর এখন তা অব্যাহত না থেকেই পারে না। যখন তােমার মাকে যা ওহী করা প্রয়ােজন তা ওহী করেছিলােমি এবং সে ধরনের পরিস্থিতিতে তাকে যে নির্দেশ দেয়া প্রয়ােজন তা দিয়েছিলাম, তখন তােমার প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম। সেই নির্দেশ ছিলাে, ‘ওকে (মূসাকে) সিন্দুকে রাখো, অতপর সেই সিন্দুক সমুদ্রে নিক্ষেপ করাে। অতপর সমুদ্র তাকে তীরে নিক্ষেপ করুক…’ লক্ষণীয়, এখানে উল্লিখিত প্রতিটি কাজ নির্মম ও নিষ্ঠুর ধরনের। একটা শিশুকে সিন্দুকে পুরে সে সিন্দুক সমুদ্রে নিক্ষেপ করা অতপর সমুদ্র কর্তৃক সিন্দুককে তীরে ঠেলে দেয়া। এরপর কী? কে গ্রহণ করবে ওই সিন্দুক? সেই ব্যক্তি গ্রহণ করবে যে আমার (আল্লাহর) শত্রু এবং তার (মূসার) শত্রু। এতােসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ভিড়ে এবং এতােসব ঘাত প্রতিঘাতের পর, এই দুর্বল ও অক্ষম শিশুর ভাগ্যে কী ঘটলাে? যে সিন্দুকটির আদৌ কোনাে সংরক্ষণ ব্যবস্থা ছিলাে না, তার কী হলাে! এর জবাব হলাে, ‘আমি আমার পক্ষ থেকে তােমার প্রতি স্নেহ মমতা ঢেলে দিয়েছিলাম যাতে তুমি আমার চোখের সামনেই লালিত পালিত হও।’ মহান আল্লাহর অসীম ক্ষমতার কী বিস্ময়কর কীর্তি! পেলব কোমল স্নেহ মমতা ও ভালােবাসকে তিনি এমন হাতিয়ারে পরিণত করলেন, যার সামনে সকল আঘাত ব্যর্থ ও সকল তরংগ ভেংগে চুরমার হয়ে যায়। যে ব্যক্তি এই স্লেহ মমতা ও ভালােবাসার অধিকারী হয়, কোনাে অপশক্তিই তার ক্ষতি করতে পারে না। এমনকি সে যদি দুধ খাওয়া, অচল, অক্ষম ও অবলা শিশুও হয়।  *মূসা(আ.)-এর প্রতিপালন : দৃশ্যপটের এ এক বিস্ময়কর পরস্পর বিরােধী চিত্র। একদিকে রয়েছে ক্ষুদ্র শিশুকে ঘিরে থাকা স্বৈরাচারী শক্তি ও নিষ্ঠুরতার পরিবেশ। অপরদিকে রয়েছে পেলব কোমল স্নেহ মমতা, যা তাকে যাবতীয় ভয়ভীতি, দুঃখ-কষ্ট ও নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা করে। ‘যাতে তুমি আমার চোখের সামনে বেড়ে ওঠা।’ কোরআনের এই অপূর্ব বাচনভংগিতে যে কোমলতা ও মমত্বের ভাব ফুটে ওঠে, কোনাে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণেই তার চেয়ে বেশী কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর চোখের সামনে লালিত পালিত হয়, তার যথার্থ রূপ বর্ণনা করা কোনাে মানুষের পক্ষে অসম্ভব। মানুষ বড় জোর তা শুধু কল্পনাই করতে পারে। এক মুহূর্তের জন্যে মহান আল্লাহর সুদৃষ্টি লাভ করাই যেখানে মানুষের পক্ষে বিরাট সম্মান মর্যাদার বিষয়, সেখানে আল্লাহর চোখের সামনে লালিত পালিত হওয়া যে কত বড় মর্যাদার ব্যাপার, তা ভাষায় বর্ণনা করা দুসাধ্য। এই কারণেই মূসা(আ.)-এর সত্ত্বায় সেই ঐশী উপাদান অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাে, যার বদৌলতে তিনি আল্লাহর সাথে কথা বলতে সক্ষম হয়েছিলেন। আল্লাহর শত্রু ও হযরত মুসা(আ.)-এর শত্রু ফেরাউনের চোখের সামনে এবং তার মুঠোর মধ্যে থেকেই কোনাে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই মূসা বেড়ে ওঠলেন। এ সময়ে মূসা(আ.)-এর দিকে ফেরাউন একটা ক্রোধপূর্ণ দৃষ্টিও আরােপ করতে পারেনি। কেননা তার মনে মূসা(আ.)-এর প্রতি স্নেহ জন্মে গিয়েছিলাে। আর আল্লাহর চোখের সামনে যে লালিত পালিত হয়, কার সাধ্য যে তার বিন্দুমাত্রও ক্ষতি করে? আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা(আ.)-কে যেমন ফেরাউনের প্রাসাদে নিরাপত্তা হেফাযতে বন্দী করে রাখেননি, তেমনি তার মাকেও নিজ বাড়ীতে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা সহকারে আবদ্ধ করে রাখেননি; বরং উভয়কে একত্রিত করেছেন। যখন তোমার বােন গিয়ে বললাে, এই শিশুকে লালন পালন করতে পারে আমি এমন একজনের সন্ধান দেবাে কি? তারপর আমি তােমাকে তােমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলাম, যাতে তার চোখ ঠান্ডা হয় এবং সে উদ্বিগ্ন না হয়। শিশু মূসা(আ.) যাতে তার মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারেন সে জন্যে আল্লাহ তায়ালা এক অভাবনীয় কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি শিশুকে এমন জেদী বানিয়ে দিলেন যে, সে কোনাে ধাত্রীরই দুধ গ্রহণ করলাে না। অথচ ফেরাউন ও তার স্ত্রী সমুদ্রে ভেসে আসা শিশুটিকে সন্তান হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাে। এ বিষয়টা এ সূরায় না হলেও অন্য সূরায় আলােচিত হয়েছে। তারা একজন ধাত্রীর সন্ধানে ব্যাপৃত ছিলাে এবং সে কথা ব্যাপকভাবে জানাজানি হয়ে পড়েছিলাে। মূসা(আ.)-এর বােন তার মায়ের নির্দেশে ফেরাউনের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হয় এবং তাদেরকে বলে, এই শিশুর লালন পালনের ভার নিতে পারে এমন একজনের সন্ধান দেবাে কি? অতপর সে ফেরাউনের সম্মতি পেয়ে তার মাকে নিয়ে আসে এবং মা তাকে দুধ খাওয়ায়। এভাবেই আল্লাহর কৌশল সফল হয় এবং শিশু তার মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার সুযােগ পায় । এই মাতাই গায়েবী নির্দেশ শুনে নিজের কলিজার টুকরােকে বাক্সবন্দী করে সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। আর পরবর্তীতে সে বাক্সবন্দী শিশু নদীতে ভাসতে ভাসতে ফেরাউনের প্রাসাদের অদূরে তীরে ভিড়েছিলাে। সেখান থেকে তাকে সেই ফেরাউনই কুড়িয়ে নিলাে, যে আল্লাহরও শত্রু এবং মূসা(আ.)-এরও ভবিষ্যতের শত্রু। এভাবে প্রতি মুহূর্তে যেখানে মৃত্যুর আশংকা; সেই অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়েও মূসা(আ.) নিরাপত্তা লাভ করলেন এবং বনী ইসরাঈলের শিশুদের পাইকারী হারে হত্যাকারী ফোউনের কাছে সমূর্ণ অরক্ষিত অসহায় অবস্থায় নীত হয়েও তিনি তার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেন।  *মূসা(আ.)-এর হিজরত : হযরত মূসা(আ.)-এর ওপর আল্লাহর আরেকটা অনুগ্রহ ছিলাে এরূপ, ‘তুমি একজন মানুষকে হত্যা করেছিলাে। তখন আমি তােমাকে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করলাম এবং বহু পরীক্ষা নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ করলাম। তারপর তুমি বহু বছর মাদইয়ানবাসীর কাছে অবস্থান করলে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে তুমি ফিরে এলে হে মূসা। আর আমি তােমাকে আমার জন্যেই গড়ে তুলেছি। ফেরাউনের প্রাসাদে লালিত পালিত হয়ে বয়ােপ্রাপ্ত হবার পর মূসা(আ.)-এর হাতে এ হত্যাকান্ডটা ঘটে। একদিন যুবক মূসা শহরে বেরিয়ে দেখেন, দুই ব্যক্তি মারামারিতে লিপ্ত। তাদের একজন ইসরাঈলী এবং অপরজন মিসরীয়। ইসরাঈলী লােকটা মূসা(আ.)-এর কাছে সাহায্য চাইলাে। মূসা(আ.) মিসরীয় লােকটাকে একটা চপেটাঘাত করতেই সে মারা গেলাে। কিন্তু তাকে হত্যা করা তার উদ্দেশ্য ছিলাে না, তার উদ্দেশ্য ছিলাে কেবল তার আক্রমণ প্রতিহত করা। যা হােক, লােকটা মারা যাওয়াতে ভীষণ দুশ্চিন্তায় তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লাে। জন্মের পর থেকেই যিনি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হয়ে এসেছেন, তিনি কিনা এমন একটা কাজ করে বসলেন। তার বিবেক ভীষণ বিব্রতবােধ করতে লাগলাে এবং নিজের আকস্মিক উত্তেজনা সংযত করতে না পেরে অনুশােচনায় দগ্ধ হতে লাগলেন। এখানে আল্লাহ তায়ালা তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, সে সময় তিনি তার ওপর কতাে বড়াে অনুগ্রহ করেছেন, তাকে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন, অতপর এ দ্বারা তাকে সংকোচ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত করেছেন, কিন্তু এতদসত্তেও তাকে পরীক্ষা না নিয়ে ছেড়ে দেননি। হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড লাভের আশংকায় বাধ্য হয়ে দেশ থেকে পালানাে, দেশ ও পরিবার পরিজনকে ছেড়ে বিদেশে বসবাস করতে বাধ্য হওয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে এবং সবচেয়ে বিলাসী সম্রাটের প্রাসাদে লালিত পালিত হয়েও এ অনিচ্ছাকৃত দূর্ঘটনার পর মেষপালক ও গৃহভৃত্যরূপে কাজ করতে বাধ্য হওয়ার মতাে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। এসব পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিলাে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার মতাে কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্যে তাকে প্রস্তুত করা।

*ফেরাউনের দরবারে যাওয়ার নির্দেশ : তারপর যখন তিনি প্রস্তুত হয়ে গেলেন, পরিপক্কতা অর্জন করলেন, বিপদ মুসিবতে ধৈর্যধারণ করে টিকে থাকার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, মিসরের পরিবেশ পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল হলো এবং বনী ইসরাঈলের ওপর নির্যাতন নিপীড়নও থামলো, তখনই মূসাকে মাদইয়ান থেকে ফিরিয়ে আনা হলাে। যদিও মূসা (আ.) মনে করছিলেন যে, তিনি নিজেই এসেছেন। ‘তারপর তুমি নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে এলে ‘ অর্থাৎ সেই সময়ে ফিরে এলে, যে সময়টাকে আমি তােমার ফিরে আসার সময় হিসেবে নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম। ‘আর আমি তােমাকে নিজের জন্যেই গড়ে তুলেছি।’ অর্থাৎ নির্ভেজাল ও একান্তভাবে আমার রিসালাত এবং দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্যেই আমি তােমাকে গড়ে তুলেছি। দুনিয়ার আর কোন কাজের জন্যে তােমাকে গড়ে তােলা হয়নি। সুতরাং তােমাকে যে কাজের জন্যে তৈরী করা হয়েছে সেই কাজে এগিয়ে যাও। ‘তুমি ও তােমার ভাই আমার নির্দেশনাবলী নিয়ে এগিয়ে যাও। আমার শিক্ষা প্রচার করতে সংকোচ বােধ করে না। ফেরাউনের কাছে চলে যাও। সে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলাে, হয়তাে সে শিক্ষা গ্রহণ করবে কিংবা ভয় পাবে।’ অর্থাৎ আমার নিদর্শনাবলী সম্বল করে তুমি ও তােমার ভাই চলে যাও। ইতিপূর্বে হযরত মূসা আল্লাহর এই নিদর্শনাবলীর মধ্য থেকে দুটো হাত ও লাঠি দেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, আর শিক্ষা প্রচার করতে সংকোচ ও দুর্বলতা বোধ করো না। কেননা আমার শিক্ষাই তোমাদের সম্বল ও সরঞ্জাম, হাতিয়ার ও সহায় যার সাহায্যে তোমরা মনে এক দুর্জয় শক্তির ওপর আশ্রয় নিতে পার। ফেরাউনের কাছে নির্ভয়ে চলে যাও। ভয় পাওয়ার কোনাে কারণ নেই। আমি তো তোমাকে শিশুকালে তার কবল থেকে রক্ষা করেছি। তখন তার ভয়ে তোমাকে বাক্সবন্দী করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিলাে। সেই বাক্স ভাসতে ভাসতে তীরে এসে উঠেছিলো। এতো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাও তােমার কোনাে ক্ষতি ও কষ্টের কারণ ঘটাতে পারেনি। এখন তুমি সুস্থ সবল যুবক। তােমার সাথে তােমার ভাইও রয়েছে। কাজেই এর চেয়েও কঠিন এবং বিপজ্জনক অবস্থায় যখন মারাত্মক পরিণতি থেকে রক্ষা পেয়েছো, তখন আজ তােমার ঘাবড়াবার কিছুই নেই। তােমরা দু’জনে সীমা অতিক্রমকারী, স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসক ফেরাউনের কাছে চলে যাও ‘এবং তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বলো।’ কেননা নম্র কথাবার্তা মানুষের অন্যায় দম্ভ ও হঠকারিতাকে উল্টে দেয় না এবং স্বৈরাচারীদের স্বভাবসুলভ অহংকার ও গােয়ার্তুমিকে উত্তেজিত করে না; বরঞ্চ এতে মানুষের মনের সদবৃত্তিগুলাে উজ্জীবিত হবার এবং অহংকার ও হঠকারিতার পরিণাম সম্পর্কে ভীতি সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফেরাউনের সুপথপ্রাপ্তি সম্পর্কে হতাশ হয়ে নয়; বরং তার সৎপথের দিকে আকৃষ্ট হওয়া ও তার মনে ভীতি সঞ্চারিত হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়েই তার কাছে যাও। এ কথা বলার কারণ কোনাে দাওয়াত দাতা বা প্রচারক যদি কারাে হেদায়াত লাভের ব্যাপারে হতাশ হয়, তবে সে তার দাওয়াত আবেগময় ও আকর্ষণীয় ভাষায় প্রচার করতে সক্ষম হয় না এবং প্রাথমিক অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানের মুখে টিকে থাকতে পারে না। ফেরাউন কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা আল্লাহই ভালাে জানেন। দাওয়াতের কাজে পরিণাম ও ফলাফলের ফথা আগাম ভেবে কোনাে লাভ নেই; বরং বাহ্যিক অবস্থা ও উপকরণাদির ওপর নির্ভর করা জরুরী। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শুধু সেই কাজের ফলাফল- শাস্তি বা পুরস্কার দিয়ে থাকেন যা সে বাস্তবে সম্পন্ন করে। নচেত কে কি করবে সেটা আল্লাহ তায়ালা জানেনই। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত সকল ঘটনা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সমানভাবে অবহিত। তাই বলে নিজের জ্ঞানের ভিত্তিতে কাউকে তার সেই কাজের আগাম প্রতিদান তিনি দেন না, যা সে এখনাে করেনি বরং ভবিষ্যতে করবে। এককভাবে মুসা(আ.)-এর সাথে আল্লাহর কথা বার্তা এ পর্যন্তই হয়েছিলাে। এ কথাবার্তার স্থান ছিলাে মরুভূমি। এখানে সুরার ভাষায় স্থান ও কালের ব্যবধান একীভূত করে ফেলা হয়েছে। এরপর সহসাই মূসা(আ.)-এর সাথে হারুন যুক্ত হন। তখন উভয়ে ফেরাউনের মুখােমুখি হতে ভীতি প্রকাশ করেন। তারা আশংকা প্রকাশ করেন যে, ফেরাউনের সামনে যাওয়া মাত্রই সে আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত হবে এবং তাকে দাওয়াত দিলে আরাে ক্রুব্ধ আচরণ করবে। তারা উভয়ে বললাে, হে আমাদের মনিব, আমরা ভয় পাচ্ছি যে, সে আমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবে বা সীমা অতিক্রম করবে। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘তােমরা ভয় পেয়াে না। আমি তােমাদের সাথে আছি, সব কিছু শুনছি ও দেখছি ‘(আয়াত ৪৫-৪৮) হযরত হারুন(আ.) যে এই দীর্ঘ সংলাপে হযরত মূসা(আ.)-এর সাথে ছিলেন না তা নিশ্চিত। আল্লাহ তায়ালা এ সময়ে তার বান্দার সাথে সুদীর্ঘ সংলাপ করেছেন, বিশদভাবে কথা বলেছেন এবং সুপ্রশস্ত প্রশ্নোত্তর অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই তাদের দুই ভাইয়ের এই সম্মিলিত জবাব আমরা ভয় পাচ্ছি যে, ‘সে আমাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবে বা সীমা অতিক্রম করবে’- দীর্ঘ সংলাপের স্থানে বসে দেয়া হয়নি। শুধু কোরআনের বাচনভংগিতেই এভাবে স্থান ও কালের ব্যবধান গুটিয়ে ফেলা হয়েছে। কাহিনী বর্ণনাকালে তা বিভিন্ন পর্যায়ের দৃশ্যের মাঝে শূন্যতা রেখে দেয়া হয়। এই শূন্যতার অস্তিত্ব আয়াতের ভাষা থেকেই বুঝা যায়। এ শূন্যতা রাখার উদ্দেশ্য হলাে সরাসরি আসল বক্তব্যে উপনীত হওয়া, যা বলার জন্যে ও যার শিক্ষায় মানুষের চেতনা উজ্জীবিত করার জন্যে কাহিনীর অবতারণা। সুতরাং হযরত মূসা তুর পর্বতের পাশ্ববর্তী নির্জন মরু প্রান্তরের দীর্ঘ সংলাপ শেষে ফিরে আসার পরই হারুন ও মূসা(আ.) একত্রিত হন। ওদিকে হারুন(আ.)-কেও আল্লাহ তায়ালা মূসা(আ.)-এর সাথে ফেরাউনকে দাওয়াত দেয়ার কাজে অংশ গ্রহণের আদেশ ওহীর মাধ্যমে দিয়ে ছিলেন। তারপর উভয়ে একত্রিত হয়ে তাদের আশংকার কথা জানালেন যে, ফেরাউন তাদের কথাবার্তা শােনার কোনাে পরােয়া না করেই তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে বসতে পারে । ‘ইয়াফরুতা’ ক্রিয়ার মূল হচ্ছে ‘ফারতুন’। এর অর্থ দেখামাত্রই কারাে ওপর ত্বরিত আঘাত হানা বা ক্ষতিকর কিছু করা। ‘ইয়াতগা’ ক্রিয়ার মূল হচ্ছে ‘তুগইয়ান’। এর অর্থ ‘ফারতুন’-এর চেয়েও ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী কোনাে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ বা আচরণ। সে সময় ফেরাউন এতে প্রতাপশালী ছিলাে যে, তার কাছে মূসা ও হারুন(আ.) যৌথভাবে গেলেও সে তাদের কোনাে রকম সমীহ করতাে না। এই পর্যায়ে তাদের কাছে আল্লাহর সেই চুড়ান্ত জবাব এলাে, যার পরে আর কোনাে ভয় বা শংকার প্রশ্নই উঠে না। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘তােমরা ভয় পেয়াে না। আমি তােমাদের সাথে রয়েছি, সব কিছু শুনছি ও দেখছি।’ ‘আমি তােমাদের সাথে আছি’- এই একটি মাত্র সংক্ষিপ্ত বাক্যই যথেষ্ট ছিলাে। কেননা এ কথাটা সেই মহাশক্তিধর, সর্বোচ্চ ও সর্বময় কর্তা এবং সমগ্র সৃষ্টির ওপর সর্বাত্মক আধিপত্যশীল আল্লাহর- যার যাবতীয় জীব ও জড়ের সৃষ্টিতে একটি মাত্র শব্দ হও ছাড়া আর কিছু প্রয়ােগ করতে হয়নি। তথাপি তিনি তার বান্দাদ্বয়কে তার সাহায্য সম্পর্কে আরাে নিশ্চিত করার জন্যে বললেন, ‘আমি সব কিছু শুনছি ও দেখছি। কাজেই আল্লাহ তায়ালা যদি তাদের সাথে থাকেন এবং তিনি সব কিছু শােনেন ও জানেন, তাহলে ফেরাউন যতােই বাড়াবাড়ি করুক বা সীমা অতিক্রম করুক, তাদের দু’জনের কিছুই করতে পারবে না। সাহায্য ও নিরাপত্তার আশ্বাস দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা দাওয়াত বিতর্ক বিতন্ডার পদ্ধতিও শিখিয়ে দিলেন। ‘তোমরা উভয়ে তার কাছে পৌছে যাও, অতপর বলো, আমরা তােমার প্রভুর প্রেরিত দূত। আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে পাঠিয়ে দাও, তাদের ওপর আর নির্যাতন চালিও না। আমরা তােমার প্রভুর কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি। যে ব্যক্তি সঠিক পথের অনুসরণ করে তার ওপর শান্তি বর্ষিত হােক। আমাদের কাছে ওহী এসেছে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে ও প্রত্যাখ্যান করে, তার ওপর আযাব আসবে।’ আমরা তােমার প্রভুর প্রেরিত দূত’- এই কথার মাধ্যমে তারা নিজেদের মূল বক্তব্যটা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন। প্রথম মুহূর্তেই তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, একজন ইলাহ আছেন যিনি ফেরাউনেরও মনিব, সারা দুনিয়ার মানুষেরও মনিব। শুধু মুসা, হারুন ও বনী ইসরাঈলের জাতি বা গােত্রের এক বা একাধিক ইলাহ বা দেবতা থাকে। এক সময়ে এ ধারণাও চালু ছিলাে যে, মিসরের ফেরাউন একজন দেবতা যাকে মিসরে উপাসনা করা হয়। কেননা সে দেবতাদের বংশধর। এরপরের বাক্যটিতে তারা তাদের দূত হিসেবে আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘অতএব আমাদের সাথে বনী ইসরাঈলকে পাঠিয়ে দাও এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালিও না।’ এটাই ছিলাে তাদের ফেরাউনের কাছে গমনের মূল উদ্দেশ্য। বনী ইসরাঈলকে তারা ফেরাউনের নির্যাতন নিপীড়ন থেকে মুক্ত করতে, বিশুদ্ধ তাওহীদের আদর্শে পুনর্বহাল করতে এবং তাদের আবাসভূমি হিসেবে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনে পুনর্বাসিত করতে চেয়েছিলেন (যতাে দিন তারা নৈতিক ও আদর্শিকভাবে বিপথগামী না হয় । বিপথগামী হলে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দেবেন)। এরপরের বাক্যে তারা তাদের রেসালাতের প্রমাণ উপস্থাপন করলেন, ‘আমরা তােমার প্রভুর কাছ থেকে নিদর্শন নিয়ে এসেছি।’ অর্থাৎ আমরা যে উদ্দেশ্যে আল্লাহর নির্দেশে তােমার কাছে এসেছি, তার অকাট্য প্রমাণ নিয়ে এসেছি। পরবর্তী বাক্যটায় তারা ফেরাউনকে দাওয়াত গ্রহণে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করলেন, ‘যে ব্যক্তি সঠিক পথ অনুসারী, তার ওপর শান্তি বর্ষিত হােক।’ যেন তারা প্রত্যাশা করছেন যে, ফেরাউন সঠিক পথের অনুসারী হােক এবং শান্তি লাভ করুক। এরপরের আয়াতে ফেরাউনকে অত্যন্ত সতর্ক ভাষায় ও পরােক্ষভাবে সাবধান করে হুমকি দেয়া হয়েছে, যাতে তার দাম্ভিক মেযাজ উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত না হয়, আমাদের কাছে ওহীর মাধ্যমে বার্তা পাঠানাে হয়েছে যে, যে ব্যক্তি আমাদের মিথুক সাব্যস্ত করবে ও মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার ওপর আযাব আসবে।’ যেন তারা আশা করছেন, ফেরাউন এ ধরনের প্রত্যাখ্যানকারী হবে না। এভাবে আল্লাহ তায়ালা মূসা ও হারুন(আ.)-কে আশ্বস্ত করলেন, পথ নির্দেশ দিলেন ও কৌশল বুঝিয়ে দিলেন, যাতে তারা নিশ্চিন্ত মনে বুঝে শুনে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারেন। বক্তব্য পেশের প্রশিক্ষণের পালা এখানে শেষ। এবার শুরু হচ্ছে বিদ্রোহী ফেরাউনের সামনে উপস্থিতি ও বিতর্কের বিবরণ।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

# এরপর আল্লাহ‌ হযরত মূসাকে তাঁর জন্ম থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত তার প্রতি যতগুলো অনুগ্রহ করা হয়েছিল, এক এক করে তার সবক’টি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন। সূরা কাসাসে এ ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে কেবলমাত্র ইংগিত করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে হযরত মূসাকে এ অনুভূতি দান করা যে, এখন যে কাজে তোমাকে নিযুক্ত করা হচ্ছে এ কাজের জন্যই তোমাকে পয়দা করা হয়েছে এবং এ কাজের জন্যই আজ পর্যন্ত বিশেষ সরকারী তত্ত্বাবধানে তুমি প্রতিপালিত হয়ে এসেছো।
# মানুষ দু’ভাবে সঠিক পথে আসে। সে নিজে বিচার-বিশ্লেষণ করে বুঝে-শুনে ও উপদেশ বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করে অথবা অশুভ পরিণামের ভয়ে সোজা হয়ে যায়।

# মনে হচ্ছে এটা এমন সময়ের কথা যখন হযরত মূসা (আ) মিসরে পৌঁছে গিয়েছিলেন এবং হযরত হারুন কার্যত তাঁর সাথে শরীক হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় ফেরাউনের কাছে যাওয়ার আগে উভয়েই আল্লাহর কাছে এ নিবেদন পেশ করে থাকবেন।

# এ ঘটনাটি বাইবেল ও তালমূদে যেভাবে পেশ করা হয়েছে তার ওপরও একবার নজর বুলানো দরকার। এর ফলে কুরআন মজীদ আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের কথা কেমন মর্যাদা সহকারে বর্ণনা করেছে এবং বনী ইসরাঈলের বর্ণনসমূহে এর কি চিত্র অংকন করা হয়েছে তা আন্দাজ করা যাবে। বাইবেলের বর্ণনা হচ্ছে, প্রথমবার আল্লাহ‌ যখন মূসাকে বললেন, “এখন আমি তোমাকে ফেরাউনের কাছে পাঠাচ্ছি এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি আমার জাতি বনী ইসরাঈলকে মিসর থেকে বের করে আনবে” তখন হযরত মূসা জবাব দিলেন, “ফেরাউনের কাছে যাবার এবং বনী ইসরাঈলকে মিসর থেকে বের করে আনার আমি কে? ” তারপর আল্লাহ‌ হযরত মূসাকে অনেক বুঝালেন, তাঁর মনে শক্তি সঞ্চার করলেন, মুজিযা দান করলেন কিন্তু মূসা আবার এ কথাই বললেন, “হে আমার প্রভু বিনয় করি, অন্য যাহার হাতে পাঠাইতে চাও এ বার্তা পাঠাও।” (যাত্রা-পুস্তক ৩-১১) তালমূদের বর্ণনা আবার এর চাইতে কয়েক কদম এগিয়ে গেছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ এ ব্যাপারটি নিয়ে আল্লাহ‌ ও হযরত মূসার সাথে সাতদিন পর্যন্ত বাদানুবাদ হতে থাকে। আল্লাহ‌ বলতে থাকেন, নবী হও। কিন্তু মূসা বলতে থাকেন, আমার কণ্ঠই খুলছে না, কাজেই আমি নবী হই কেমন করে। শেষে আল্লাহ‌ বললেন, তুমি নবী হয়ে যাও এতেই আমি খুশী। একথায় হযরত মূসা বলেন, লূতকে বাঁচাবার জন্য আপনি ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন, হাজেরা যখন সারার গৃহ থেকে বের হলেন তখন তার জন্য পাঁচজন ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন, আর এখন নিজের বিশেষ সন্তান (বনী ইসরাঈল)-দেরকে মিসর থেকে বেরকরে আনার জন্য আপনি আমাকে পাঠাচ্ছেন? একথায় আল্লাহ‌ অসন্তুষ্ট হলেন এবং তিনি রিসালাতের কাজে তাঁর সাথে হারুনকে শরীক করে দিলেন। আর মূসার সন্তানদের বঞ্চিত করে পৌরোহিত্যের দায়িত্ব সন্তানদের দিয়ে দিলেন—- এগুলোই হচ্ছে প্রাচীন কিতাব এবং নির্লজ্জ লোকেরা এগুলো সম্পর্কে বলে থাকে যে, কুরআনের এ কাহিনীগুলো নাকি এসব কিতাব থেকে নকল করা হয়েছে।

তাফসীরে‌ হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৩৬-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

উপরোক্ত আয়াতগুলোতে মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার নেয়ামত ও ফির‘আউনের কাছে দাওয়াত, জাদুকরদের সাথে মুকাবেলাসহ সংশ্লিষ্ট ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।

(قَدْ أُوْتِيْتَ سُؤْلَكَ)

অর্থাৎ হে মূসা! তুমি যা চাইলে সব দেয়া হল। তোমার বুক উন্মুক্ত করা, সকল কাজ সহজ করা, মুখের জড়তা দূর করা এবং তোমাকে শক্তিশালী করা হল।

দু‘আ কবুল হওয়ার সাথে সাথে অধিক সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর বাল্যকালের অনুগ্রহের কথাও স্মরণ করিয়ে দিলেন। আরেকটি নেয়ামত হল এটাই যে তোমার মা আশংকা করছিল ফির‘আউন তোমাকে হত্যা করে ফেলবে, তখন তোমার মায়ের কাছে স্বভাবগত ইলহাম দিয়ে জানিয়ে দেয়া হল: তুমি তাকে সিন্দুকে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দাও

(عَدُوٌّ لِّيْ) আমার শত্র“ বলতে ফির‘আউনকে বুঝানো হয়েছে। ফির‘আউন আল্লাহ তা‘আলার শত্র“ কারণ সে কুফরী করত, কিন্তু তখন সে তো মূসা (عليه السلام)-এর শত্র“তে পরিণত হয়নি। এতদসত্ত্বেও তাকে মূসা (عليه السلام)-এর শত্র“ বলা হল শেষ পরিণতির দিকে বিবেচনা করে অর্থাৎ অবশেষে ফির‘আউনের শত্র“তে পরিণত হওয়ার বিষয়টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানে ছিল।

مَحَبَّةً অর্থ ভালবাসা, সোহাগ। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-এর প্রতি সকলের ভালবাসা ও সোহাগ ভরে দিয়েছিলেন, যেই দেখবে আদর করতে চাইবে, ভালবাসবে।

(عَلٰي عَيْنِيْ) অর্থাৎ আমার চোখের সামনে, আমার সংরক্ষণে তুমি প্রতিপালিত হবে। আল্লাহ তা‘আলার মহাশক্তি ও সংরক্ষণের নৈপুণ্যতা কত চমৎকার; আপন গৃহে শত্র“কে লালন-পালন করলেন। যে ফির‘আউন শত্র“কে মারার জন্য অসংখ্য শিশু-সন্তানকে হত্যা করেছে, শেষ পর্যন্ত সে শত্র“কে নিজের গৃহে লালন-পালন করলো; এমনকি দুধ পান করানোর জন্য স্বয়ং মূসা (عليه السلام)-এর মাকে পারিশ্রমিক দিয়ে ধাত্রি হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছে। কত বোকা ফির‘আউন, আবার সে নিজেকে রব দাবী করে। আল্লাহ তা‘আলা কত মহান, ক্ষমতাবান ও মহত্ত্বের অধিকারী।

আল্লাহ তা‘আলার চোখ রয়েছে তার প্রমাণ আয়াতের এ অংশ। অনেকে বলতে পারে এখানে তো চোখ উদ্দেশ্য নয় বরং সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধায়ন। যেমন আমরা বলে থাকি-ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখ। হ্যাঁ, এখানে অর্থ সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধান। কিন্তু যদি কারো চোখ না থাকে তাহলে কি সে ব্যক্তিকে সম্বোধন করে এ কথা বলা যাবে যে, ছেলেটিকে চোখে চোখে রেখ? না, কেবল তাকেই বলা যাবে যার এ অঙ্গ আছে। যেমন যদি বলি ছেলেটিকে শিঙে শিঙে রেখ, বলা যাবে? না, কারণ মানুষর শিং নেই। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার চোখ আছে বলেই ওভাবে ব্যক্ত করেছেন।

মূসা (عليه السلام)-এর দীর্ঘ প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তুমি যা চেয়েছ তার সবই তোমাকে দেয়া হল। শুধু এবার কেন, আমি তোমার ওপরে আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম।

(إِذْ تَمْشِيْٓ أُخْتُكَ)

অর্থাৎ যখন মূসা (عليه السلام)-কে সিন্দুকে ভরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হল তখন দূর থেকে মূসা (عليه السلام)-এর বোন লক্ষ্য রাখছেন তা কোথায় যায়, কী হয়? এ সম্পর্কে সূরা ক্বাসাসের ১১-১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে।

(وَقَتَلْتَ نَفْسًا)

অর্থাৎ মিশরে কিবতী বংশের ও বানী-ইসরাঈল বংশের দুজন ব্যক্তি ঝগড়া করছিল তখন মূসা (عليه السلام) কিবতী বংশের লোকটাকে চড় মেরেছিলেন ফলে লোকটা মারা যায়। তিনি মেরে ফেলার জন্য চড় মারেননি। সূরা ক্বাসাসের ১৫ নং আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ তা‘আলা।

(وَفَتَنَّاكَ فُتُوْنًا)

অর্থাৎ আমি তোমাকে অনেক পরীক্ষা করেছি। যেমন যে বছর জন্মেছিলে সে বছর সব ছেলে শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। কিবতীকে হত্যা করেছিলে সেখান থেকে তোমাকে মুক্তি দিয়েছি ইত্যাদি।

(فَلَبِثْتَ سِنِيْنَ)

অর্থাৎ মূসা (عليه السلام)-এর শ্বশুর নিজ কন্যার মাহরস্বরূপ যে আট অথবা দশ বছর কাজ করার জন্য বলেছিলেন সে কয় বছর মাদইয়ানে অবস্থান করেছিলেন। যেমন সূরা ক্বাসাসের ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে। উক্ত বছরগুলো অবস্থান করার পর মূসা (عليه السلام) আবার মিসরে ফিরে আসলেন।

(ثُمَّ جِئْتَ عَلٰي قَدَر)

অর্থাৎ এমন সময়ে এসে উপস্থিত হলে যে সময়টি আমি তোমার সাথে কথা বলার ও তোমাকে নবুওয়াত দান করার জন্য নির্ধারণ করেছিলাম। অথবা এখানে قَدَرٍ অর্থ বয়স। অর্থাৎ বয়সের এমন এক পর্যায় যখন তুমি নবুওয়াতের জন্য উপযুক্ত ছিলে।

(اِذْهَبْ أَنْتَ وَأَخُوْكَ)

অর্থাৎ দুনিয়াবী ও দীনি নেয়ামত দান করার পর আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূন (عليه السلام)-কে ফির‘আউনের কাছে তাঁর দিকে আহ্বান করার জন্য যেতে বললেন। সে সাথে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করা থেকে যেন শৈথিল্য না করা হয় সে পরামর্শ ও নির্দেশ দিলেন। কারণ এ বিশাল দায়িত্ব পালনে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ রাখলে মনে বল থাকবে এবং সাহস হারাবে না। সেই সাথে আরো বললেন: ফির‘আউনের সাথে ভদ্রতা ও নম্রতা বজায় রেখে কথা বলবে। কারণ যে ব্যক্তি যেমন পদমর্যাদার অধিকারী তাকে তেমন সম্মান দিয়ে কথা বললে কথা বলা ফলপ্রসূ হতে পারে। প্রথমেই যদি সম্মানে আঘাত হানা হয় তাহলে পরবর্তী কথা শুনবে না। যেমন আবূ সুফিয়ান মক্কার একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের দিন আবূ সুফিয়ানের সম্মান হানি না করে সম্মান বজায় রেখে বললেন, যে ব্যক্তি আবূ সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে সে নিরাপদ। অর্থাৎ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে দাওয়াতের পদ্ধতি ভিন্ন হবে।

তাই আল্লাহ তা‘আলার পথে দায়ীদের এখানে বড় শিক্ষা হল আপনি যার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছেন তিনি ফির‘আউনের চেয়ে খারাপ নন, আর আপানি মূসা (عليه السلام)-এর চেয়ে উত্তম নন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যদি মূসা (عليه السلام)-কে ফির‘আউনের কাছে নম্র-ভদ্রতার সাথে দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার কতটুকু সতর্ক হওয়া উচিত।

নির্দেশ পেয়ে মূসা ও হারূন (عليه السلام) ফির‘আউনের কাছে যেতে লাগলেন, আর ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ একজন দেশের প্রধানের কাছে দেশের প্রচলিত বিধানের বিপরীত দাওয়াত দেয়া সহজ কথা নয়! তাছাড়া মূসা (عليه السلام) পূর্বে একটি অপরাধ করেছেন কিবতীকে হত্যা করে। সে বিষয় তো ফির‘আউনের স্মরণ আছে। সব মিলিয়ে ভয় পেলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বললেন: তোমরা ভয় কর না, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি শুনছি ও দেখছি। সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং বল: অবশ্যই আমরা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল, সুতরাং আমাদের সাথে বাণী ইসরাঈলকে যেতে দাও। আর তাদেরকে কষ্ট দিও না। আমরা তো তোমার নিকট এসেছি তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে নিদর্শন ও শান্তির বিধান নিয়ে তাদের প্রতি যারা সৎ পথের অনুসরণ করে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(فَأْتِيَا فِرْعَوْنَ فَقُوْلَآ إِنَّا رَسُوْلُ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ لا‏ أَنْ أَرْسِلْ مَعَنَا بَنِيْٓ إِسْرَآئِيْلَ ‏)‏

“অতএব তোমরা উভয়ে ফির‘আউনের নিকট যাও এবং বল:‎ ‘আমরা জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল, ‘আমাদের সাথে যেতে দাও বানী ইসরাঈলকে।’’ (সূরা শু‘আরা ২৬:১৬-১৭)

(إِنَّنِيْ مَعَكُمَا)

আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে রয়েছেন, কিভাবে রয়েছেন তা পরের দুটি শব্দ ব্যক্ত করে দিয়েছে, অর্থাৎ তিনি শ্রবণ ও দর্শন দিয়ে সাথে রয়েছেন।

(إِنَّا قَدْ أُوْحِيَ إِلَيْنَا)

অর্থাৎ আমাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যা আরোপ করবে ও আমাদের দাওয়াত থেকে বিমুখ হবে তার ওপর শাস্তি নেমে আসবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَأَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظّٰي ج ‏ لَا يَصْلٰهَآ إِلَّا الْأَشْقَي لا ‏ الَّذِيْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰي ‏)‏

“অতএব, আমি তোমাদেরকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করেছি। এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা লাইল ৯২:১৬)

তখন ফির‘আউন বলল: হে মূসা! তোমাদের প্রতিপালক কে? কারণ রবের একটি অর্র্থ হল লালন-পালন করা, ফির‘আউন মূসাকে লালন-পালন করেছে, সে অর্থে সেই হল মূসার রব। সে জন্য সে আশ্চর্য হয়ে এ কথা বলছে। তাছাড়া সে নিজেই তো বড় রব বলে দাবী করত। (সূরা নাযিআত ৭৯:২৪)

তার উত্তরে মূসা (عليه السلام) বললেন: আমার প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথনির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যে মাখলুককে যে জন্য সৃষ্টি করেছেন তাকে সে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ফির‘আউন বলল: তাহলে অতীতের লোক যারা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের ইবাদত করত তাদের অবস্থা কী হবে? মূসা বললেন: এর জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকট লিপিবদ্ধ আছে: তিনি ভুল করেন না এবং বিস্মৃতও হন না। অর্থাৎ তাদের ভাল-মন্দ আমল লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তাঁর জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন। সুতরাং তা হারিয়ে যাবে না এবং তিনি ভুলেও যাবেন না।

অতঃপর মূসা (عليه السلام) আরো বর্ণনা করে দিচ্ছেন, আমি সে আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দিচ্ছি যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বিছানা এবং তাতে করে দিয়েছেন তোমাদের জন্য চলাচলের পথ। তিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন আর আমরা তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন। যা তোমরা আহার কর। তোমাদের গবাদি পশু চরাও।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

ھُوَ الَّذِیْٓ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً لَّکُمْ مِّنْھُ شَرَابٌ وَّمِنْھُ شَجَرٌ فِیْھِ تُسِیْمُوْنَﭙیُنْۭبِتُ لَکُمْ بِھِ الزَّرْعَ وَالزَّیْتُوْنَ وَالنَّخِیْلَ وَالْاَعْنَابَ وَمِنْ کُلِّ الثَّمَرٰتِﺚ اِنَّ فِیْ ذٰلِکَ لَاٰیَةً لِّقَوْمٍ یَّتَفَکَّرُوْنَ‏

“তিনিই আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা হতে জন্মায় উদ্ভিদ যাতে তোমরা পশু চারণ করে থাকো। তিনি তোমাদের জন্য সেটার দ্বারা জন্মান শস্য, যায়তুন, খেজুর বৃক্ষ, আঙ্গুর এবং সর্বপ্রকার ফল। অবশ্যই এতে চিন্ত‎াশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।” (সূরা নাহল ১৬:১০-১১)

نُهيِ শব্দটি نهية এর বহুবচন অর্থ হল বিবেক, জ্ঞান। اولوا النهي অর্থ বিবেকবান, জ্ঞানী ব্যক্তি।

(تَارَةً أُخْرٰي)

অর্থাৎ পুনরুত্থানের জন্য আবার কবর থেকে উঠানো হবে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখাকালীন তিন মুষ্ঠি মাটি দেয়ার সময় এ আয়াত পাঠ করতে হয়। এ বর্ণনা দুর্বল, তবে তিনবার মাটি দেয়ার বর্ণনা সহীহ সূত্রে ইবনু মাযাতে বর্ণিত হয়েছে। সে জন্য দাফনের সময় দু’হাত দিয়ে কবরে তিনবার মাটি দেয়া মুস্তাহাব বলা হয়। (আহকামুল জানাইয লিল আলবানী ১৫২ পৃ: ইরওয়াউল গালীল ৩/২০০)

 

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

৩৬-৪০ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত মূসার (আঃ) সমস্ত প্রার্থনা কবুল হয় এবং মহান আল্লাহ তাকে বলেনঃ তুমি যা চেয়েছো তা তোমাকে দেয়া হলো। এই অনুগ্রহের সাথে সাথেই আল্লাহ তাআলা আরো একটা অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ আমি তোমার প্রতি আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম। অতঃপর তিনি সংক্ষেপে ঐ ঘটনাটি তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেনঃ হে মূসা (আঃ)! আমি তোমার মাতার অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছিলাম যা নির্দেশ দেয়ার ছিল। তুমি ছিলে ঐ সময় দুগ্ধ পোষ্য শিশু। তোমার মা ফিরাউন ও তার লোক লশকরকে ভয় করছিল। কেননা, ঐ বছর তারা বানী ইসরাঈলের পুত্র সন্তানদেরকে হত্যা করছিল। ঐ ভয়ে সে সদা প্রকম্পিতা। হচ্ছিল। তখন আমি তার কাছে ওয়াহী করলাম (ইংগিত দ্বারা নির্দেশ দিলাম) একটি সিন্দুক নির্মাণ কর। দুধপান করিয়ে শিশুকে ঐ সিন্ধুকে রেখে দাও এবং নীল নদে ওটাকে ভাসিয়ে দাও। তোমার মা তাই করে। সে একটি রজ্জ তাতে বেঁধে রাখতো যার মাথাটি ঘরের সাথে বেঁধে দিতো। একদা রঙ্কুটি সে সিন্দুকে বাধতে ছিল, কিন্তু ঘটনাক্রমে তা তার হাত থেকে ছুটে যায়। ফলে ঢেউ-এর দোলায় সিন্দুকটি ভেসে চলে যায়। এতে তোমার মা কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ে। সে এতো বেশী দুঃখিত হয় যে, ধৈর্যধারণ তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে রহস্য খুলেই দেয় আর কি। কিন্তু আমি তার হৃদয় শক্ত করে দিই। সিন্দুকটি ভাসতে ভাসতে ফিরাউনের প্রাসাদের পার্শ্ব দিয়ে চলতে থাকে। ফিরাউনের পরিবারের লোকেরা সিন্দুকটি উঠিয়ে নেয়। ফিরাউন যে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে চাচ্ছিল তা তার সামনেই এসে পড়ে। যার জীবন। প্রদীপ নির্বাসিত করার লক্ষ্যে সে নিস্পাপ শিশুদেরকে সাধারণ ভাবে হত্যা করছিল তা তারই তেলে তারই বাড়ীতে জুলে উঠলো। আল্লাহর ইচ্ছা বিনা বাধায় পূর্ণ হতে চললো। তার শত্রু তারই বাড়ীতে তারই তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হতে লাগলো। তার স্ত্রী যখন শিশুকে দেখলেন তখন তাঁর শিরায় শিরায় শিশুর প্রতি ভালবাসা জমে উঠলো। তাঁকে নিয়ে তিনি লালন পালন করতে লাগলেন। তিনি তাঁকে নয়নের মণি মনে করলেন। অত্যন্ত আদরের সাথে তাকে তিনি প্রতিপালন করতে থাকলেন। শাহী দরবারই হয়ে গেল তাঁর অবস্থানস্থল।

মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি আমার নিকট হতে তোমার উপর ভালবাসা। ঢেলে দিয়েছিলাম। ফিরাউন তোমার শত্রু হলেও আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে কে? তোমার প্রতি ভালবাসা শুধু ফিরাউনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো না, বরং যেই দেখে সেই তোমাকে ভালবাসতে থাকে। এটা এজন্যেই ছিল যে, তোমার প্রতিপালন যেন আমার চোখের সামনে হয়। তুমি যেন শাহী খানা খেতে থাকে এবং মর্যাদার সাথে অবস্থান কর।

ফিরাউনের লোকেরা সিন্দুকটি উঠিয়ে নিলো। তারা সেটা খুলে দেখলো, শিশুকে পেলো এবং লালন পালন করার ইচ্ছা করলো। কিন্তু তিনি কারো দুধ পান করলেন না। এমনকি কারো স্তনে তিনি মুখই দিলেন না। তাঁর বোন সিন্দুকটি দেখতে দেখতে নদীর তীরে ধরে আসতেছিল। সেও ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। সে বলে উঠলোঃ “যদি আপনারা এই শিশুটিকে প্রতিপালনের ইচ্ছা করে থাকেন এবং ন্যায্য পারিশ্রমিক দেন তবে আমি একটা পরিবারের কথা আপনাদেরকে বলতে পারি যারা একে অত্যন্ত যত্নের সাথে লালন পালন করবে এবং চরম হিতাকাংখী হবে।” সবাই বলে উঠলোঃ “আমরা সম্মত আছি।” তার বোন তখন তাকে নিয়ে মায়ের নিকট হাজির হলো এবং তার কোলে রেখে দিলো। মায়ের কোলে রাখা মাত্রই তিনি দুধ পান করতে শুরু করলেন। এতে ফিরাউন ও তার লোকজনের খুশীর কোন সীমা থাকলো না। তার মাকে বহু কিছু পুরস্কার দেয়া হলো এবং বেতন নির্ধারিত হয়ে গেল। তিনি নিজেরই ছেলেকে দুধ পান করাতে থাকলেন, আবার বেতন, পুরস্কার ও মান সম্মানও লাভ করলেন। আল্লাহ তাআলার কি মহিমা! তিনি দুনিয়াও পেলেন, দ্বীনও পেলেন। এজন্যেই হাদীসে আছে যে, যে ব্যক্তি নিজের কাজ ভাল নিয়তে সম্পাদন করে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে হযরত মূসার (আঃ) মাতার মত। তিনি নিজেরই ছেলেকে দুধ পান করিয়ে পারিশ্রমিক লাভ করেছিলেন।

মহান আল্লাহ বলেনঃ এটাও আমারই একটা অনুগ্রহ যে, আমি তোমাকে তোমার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম যাতে তার চক্ষু ঠাণ্ডা হয় ও দুঃখ দূরীভূত হয়। অতঃপর তোমার হাতে একজন ফিরাউনী কিবতী নিহত হয়। তখনও আমি তোমাকে রক্ষা করে ছিলাম। ফিরাউনের লোকেরা তোমাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল এবং গুপ্ত কথা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। ঐ সময় আমি তোমাকে মুক্তি দান করি এবং তুমি এখান হতে পালিয়ে যাও। মাদইয়ানের কূপের কাছে গিয়ে তুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলো। সেখানে আমার এক সৎবান্দা তোমাকে সুসংবাদ প্রদান করে যে, তোমার আর কোন ভয় নেই। ঐ অত্যাচারীদের হাত থেকে তুমি রক্ষা পেয়েছে। পরীক্ষা হিসেবে আমি তোমাকে আরো বহু ফিৎনা বা হাঙ্গামায় ফেলেছিলাম।

হযরত সাঈদ ইবনু জুবাইর (রঃ) বলেনঃ আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাসকে (রাঃ) এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেনঃ আজকে তো সূর্য অস্তমিত হতে চলেছে, ঘটনাও দীর্ঘ। অন্য সময় বলবো। আমি তখন পরের দিন সকালে আবার তাকে ঐ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি বলেনঃ “তা হলে শুনো। ফিরাউনের দরবারে একদিন আলোচনা হয়ঃ হযরত ইবরাহীমের (আঃ) সাথে আল্লাহ তাআলা ওয়াদা করেছিলেন যে, তাঁর সন্তান ও বংশধরদের মধ্যে তিনি নবী ও বাদশাহ করবেন। সুতরাং বনী ইসরাঈল আজ পর্যন্ত তারই অপেক্ষায় রয়েছে এবং তাদের এ বিশ্বাস আছে যে, মিসরের রাজত্ব আবার তাদের হাতেই চলে আসবে। প্রথমে তো তাদের ধারণা ছিল যে, এই ওয়াদা হযরত ইউসুফের (আঃ) ব্যাপারে ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত যখন এই ওয়াদা পূর্ণ হলো না তখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে, তাদের মধ্যে আল্লাহ তাআলা একজন নবী পাঠাবেন যার মাধ্যমে তারা মিসরের রাজত্ব লাভ করবে এবং তাদের জাতীয় ও ধর্মীয় উন্নতিও সাধিত হবে। ফিরাউনের দরবারে এটা আলোচিত হয়ে তারা পরামর্শ করে যে, কি পন্থা অবলম্বন করলে ভবিষ্যতে এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে? অবশেষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, একটা পুলিশ বাহিনী গঠন করা হোক। যারা শহরে চক্কর দিতে থাকবে এবং বনী ইসরাঈলের মধ্যে কারো পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করলেই তাকে তৎক্ষণাৎ সরকারের কাছে পেশ করা হবে এবং যবাহ্ করে দেয়া হবে। কিন্তু কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পর তারা অনুভব করে যে, এ কাজ অব্যাহত রাখলে তো বানী ইসরাঈল সম্পূর্ণরূপেই শেষ হয়ে যাবে এবং তাদের কাছ থেকে যে লাঞ্ছনাকর সেবাকার্য আদায় করা হচ্ছে তা বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং নতুন ভাবে আবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, এক বছর তাদের পুত্র সন্তানগুলিকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং আর এক বছর তাদেরকে হত্যা করা হবে। তা হলে বর্তমানে বানী ইসরাঈলের যে সংখ্যা রয়েছে তা বেড়েও যাবে না, আবার এতো কমেও যাবে না যে, তাদের দ্বারা সেবা কার্য করিয়ে নেয়ার ব্যাপারে লোক পাওয়া যাবে না। যতটি বুড়ো দু বছরে মারা যাবে ততটি শিশু এক বছরে জন্মগ্রহণ করবে।

যে বছর হত্যা কার্য বন্ধ ছিল সেই বছর হযরত হারূণ (আঃ) জন্মগ্রহণ করেন। আর যে বছর সাধারণ ভাবে শিশু হত্যা কার্য চালু ছিল সেই বছর হযরত মূসার (আঃ) জন্ম হয়। সেই বছর হযরত মূসার (আঃ) মায়ের ভীতি ও উদ্বেগের সীমা ছিল না। এটা ছিল প্রথম ফিৎনা। এই বিপদ ঐ সময় কেটে যায় যখন মহান আল্লাহ তার মায়ের কাছে ওয়াহী করেনঃ “তুমি ভয় করো না, তোমার শিশুকে আমি তোমার কাছেই ফিরিয়ে আনবো এবং তাকে আমার রাসূলরূপে মনোনীত করবো।” সুতরাং তিনি তাঁর শিশুপুত্রকে সিন্দুকের মধ্যে বন্ধ করে নদীতে ভাসিয়ে দেন। তখন শয়তান অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে শুরু করে এবং তিনি মনে মনে বলেনঃ “হায়! এটাই তো ভাল ছিল যে, আমার এই পুত্র সন্তানকে আমার সামনেই হত্যা করা হতো! তাহলে আমিই তার কাফন দাফন করতাম! এখনতো আমি তাকে মাছের খদ্যি বানিয়ে দিলাম!”

সিন্ধুকটি ভাসতে ভাসতে গিয়ে ফিরাউনের ঘাটে লেগে গেল। ঐ সময় সেখানে রাজপ্রাসাদের দাসীরা বিদ্যমান ছিল। তারা ঐ সিন্দুকটিকে উঠিয়ে নিয়ে খোলার ইচ্ছা করলো। কিন্তু তারা চোর সাব্যস্ত হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তালাবদ্ধ অবস্থাতেই সিন্দুকটিকে নিয়ে গিয়ে ফিরাউনের নিকট পৌঁছিয়ে দিলো। বাদশাহ ও বেগমের সামনে সিন্দুকটি খোলা হলো। তাতে রৌপ্যজ্জ্বল একটি ছোট নিস্পাপ শিশু পাওয়া গেল। শিশুটিকে দেখা মাত্রই ফিরাউনের স্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন এবং তাঁর অন্তরে শিশুর প্রতি চরম ভালবাসা জন্মে গেল। আর ওদিকে হযরত মূসার (আঃ) মায়ের অবস্থা ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁর অন্তরে তাঁর প্রিয় সন্তানের চিন্তা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যারা শিশুদেরকে হত্যা করার কাজে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োজিত ছিল তারা খবর পেয়েই তাদের ছুরিগুলি তীক্ষ্ণ করে নিয়ে হাজির হয়ে গেল এবং বেগমের কাছে দাবী জানালো যে, শিশুটিকে যেন তাদের হাতে সমর্পণ করা হয়, যাতে তারা তাকে হত্যা করতে পারে। হে ইবনু জুবাইর (রঃ)! এটা ছিল দ্বিতীয় ফিৎনা বেগম তাদেরকে বললেনঃ “থামো, আমি স্বয়ং বাদশাহর সাথে সাক্ষাৎ করছি এবং শিশুটির প্রাণ রক্ষার জন্যে প্রার্থনা জানাচ্ছি। তিনি যদি শিশুটি আমাকে দান করেন তবে তো ভাল কথা, অন্যথায় তোমাদের কর্তব্য তোমরা পালন করবে।” একথা বলে তিনি বাদশা হর কাছে গিয়ে বললেনঃ “দেখুন, এই শিশুটির মাধ্যমে আমার ও আপনার চক্ষু ঠাণ্ডা হবে।” তার একথা শুনে ঐ কুলষিত ব্যক্তি বললোঃ “এর দ্বারা তুমি তোমার নিজের চক্ষু ঠাণ্ডা কর, আমার চক্ষু ঠাণ্ডা করার কোন প্রয়োজন নেই।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) শপথ করে বলেনঃ “যদি ফিরাউনও বলে দিতো যে, অবশ্যই শিশুটি তারও চক্ষু ঠাণ্ডা করবে তবে নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা তাকেও সুপথ প্রদর্শন করতেন, যেমন তার স্ত্রী সুপথ লাভ করেছিলেন। কিন্তু সে তার থেকে বঞ্চিত থাকতে চেয়েছিল, তাই তিনি তাকে বঞ্চিত করে দেন। মোট কথা, যেন তেন প্রকারে ফিরাউনকে সম্মত করে তার স্ত্রী শিশুটিকে ফিরিয়ে আনলেন এবং তাকে লালন পালন করার অনুমতি পেলেন। এখন রাজপ্রাসাদের যতগুলি ধাত্রী ছিল সবকেই তিনি একত্রিত করলেন। এক একজনের কোলের শিশুটিকে দেয়া হলো, কিন্তু মহান আল্লাহ সবারই দুধ তার জন্যে হারাম করে দিলেন। তিনি কারো স্তনে মুখ দিলেন না। এতে বেগম খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন। কারণ এ অবস্থায় তো শিশু মারা যাবে। অবশেষে চিন্তা করে তিনি শিশুটিকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং এদিক ওদিক খোজ খবর নিতে বললেন যে, যদি এই নিস্পাপ শিশু কারো দুধপান করে তবে যেন কৃতজ্ঞতার সাথে তার নিকট শিশুটিকে সমর্পণ করা হয়। বাইরে বাজার মেলার মত লোক সমাবেশ হয়ে গেল। প্রত্যেকেই নিজেকে এই সৌভাগ্যের অধিকারী বানিয়ে নিতে চাচ্ছিলো। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) কারো দুধ পান করলেন না। তাঁর মাতা তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যাকে অর্থাৎ হযরত মূসার (আঃ) বড় বোনকে কি ঘটে তা দেখবার জন্যে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ঐ সমাবেশে হাজির ছিলেন এবং সবকিছু অবলোকন করছিলেন। তারা যখন সবাই অপারগ হয়ে গেল তখন তিনি বললেনঃ ‘যদি আপনারা চান তবে আমি এমন এক বাড়ীর মহিলার সন্ধান দিতে পারি যে এর রক্ষণাবেক্ষণ করবে এবং এর হিতাকাংখী হবে।” তিনি একথা বলা মাত্রই জনগণ সন্দেহ করে বসে যে, অবশ্যই এই মেয়েটি এই শিশুর খবর রাখে এবং বাড়ীর খবরও জানে। হে ইবনু জুবাইর (রঃ) এটা ছিল তৃতীয় ফিৎনা। কিন্তু আল্লাহ তাআলা মেয়েটিকে হঠাৎ করে বুদ্ধিমান করেন এবং তিনি ঝট করে বলে ওঠেনঃ “আপনারা কি এটুকুও বুঝেন না যে, এমন কোন হতভাগ্য নেই যে এই শিশুর শুভাকাংখায় বা লালন পালনে কোন ত্রুটি করতে পারে? কেননা, এই শিশু তো আমাদের বেগমের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র। সত্তরাং কে চাবে না যে শিশুটি তার বাড়ীতে প্রতিপালিত হোক এবং তার বাড়ী উপটৌকন ও পুরস্কারে পরিপূর্ণ হয়ে যাক?” তাঁর এ কথা শুনে সবাই বুঝে নিলো এবং তাঁকে বললোঃ “তাহলে বল, কোন ধাত্রীর কথা তুমি বলতে চাচ্ছ?” তিনি বললেনঃ “আচ্ছা, আমি এখনই নিয়ে আসছি।” দৌড়িয়ে তিনি তার মায়ের কাছে গেলেন এবং তাকে সুসংবাদ শুনালেন। মা তখন বড় আগ্রহ ও আশা নিয়ে আসলেন এবং নিজের শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে মুখে দুধ দিলেন। শিশু পেট পুরে দুধ পান করলেন। তৎক্ষণাৎ রাজ প্রাসাদে সুসংবাদ পৌঁছানো হলো। বেগম নির্দেশ দিলেনঃ “এখনই ঐ ধাত্রী ও শিশুকে আমার নিকট নিয়ে এসো।” যখন মাতা ও শিশু তার কাছে পৌঁছলেন তখন তিনি তার সামনে দুধ পান করালেন। যখন তিনি দেখলেন যে, শিশু ভালভাবে দুধ পান করছে তখন তিনি অত্যন্ত খুশী হলেন এবং বলতে লাগলেনঃ “হে ধাত্রী আম্মা! এই শিশুর প্রতি আমার এতো ভালবাসা রয়েছে। যা দুনিয়ার অন্য কোন কিছুর উপর নেই। তুমি এই রাজপ্রাসাদেই অবস্থান কর এবং শিশুকে প্রতিপালন করতে থাকো।” কিন্তু হযরত মূসার (আঃ) মায়ের সামনে আল্লাহ তাআলার ওয়াদা ছিল এবং তার ওয়াদার প্রতি তাঁর পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। এই জন্যে তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। অতঃপর বললেনঃ “আমি বাড়ীঘর ও ছেলে মেয়ে ছেড়ে এখানে থাকবো এটা সদ্য নয়। আপনি ইচ্ছা করলে শিশুটিকে আমার কাছে সমর্পণ করে দিন। আমি তাকে বাড়ী নিয়ে যাচ্ছি এবং তার লালন পালনের ব্যাপারে মোটেই ত্রুটি করবো না।” বেগম সাহেবা বাধ্য হয়ে তার একথা মেনে নিলেন। সুতরাং হযরত মূসার (আঃ) মতাি সেই দিনই আনন্দিত চিত্ত্বে তাকে নিয়ে বাড়ী ফিরলেন। এই শিশুর কারণে ঐ প্রাসাদে অবস্থানরত বানী ইসরাঈলরাও ফিরাউনের লোকদের অত্যাচার হতে মুক্তি পেয়ে গেল।

কিছুদিন অতিবাহিত হলে বাদশাহর বেগম নির্দেশনামা পাঠালেন যে, কোন এক দিন যেন তার বাচ্চাকে তাঁর নিকট আনয়ন করা হয়। একটা দিন নির্ধারিত হলো। উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও সভাষদবর্গকে নির্দেশ দেয়া হলোঃ “আজ আমার শিশু সন্তান আমার নিকট আসর্বে। সুতরাং আপনারা সবাই তাকে অভ্যর্থনা করবেন এবং খুবই ধূমধামের সাথে উপহার-উপঢৌকন প্রদান করতে করতে আমার অন্দর পর্যন্ত নিয়ে আসবেন।” সুতরাং যখন সওয়ারী রওয়ানা হয়ে গেল তখন সেখান থেকে নিয়ে হেরেম পর্যন্ত উপহার-উপটৌকন ও হাদিয়া দিতে থাকা হলো এবং অত্যন্ত মর্যাদার সাথে অন্দর মহলে নিয়ে আসা হলো। বেগম নিজেও বহু উপহার-উপঢৌকন পেশ করলেন এবং বড় আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা করা হলো তারপর বেগম সাহেবা বলতে লাগলেনঃ “আমি নিজেই একে বাদশাহর নিকট নিয়ে যাচ্ছি। তিনিও পুরস্কার ও উপঢৌকন দিবেন।” একথা বলে তিনি শিশুকে ফিরাউনের কাছে নিয়ে গেলেন এবং তার কোলে বসিয়ে দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) তার দাড়ী ধরে জোরে টানতে লাগলেন। এতে সে ভারী অমঙ্গলের আশংকা করলো। তার সভাষদবর্গ বলতে শুরু করল্যেঃ “এটা যে ঐ ছেলেই হবে এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই। সুতরাং আপনি এখনই তাকে হত্যা করার নির্দেশ দিন।” হে ইবনু জুবাইর (রঃ)! এটা ছিল চতুর্থ ফিত্না। বেগম ব্যাকুল হয়ে ফিরাউনকে বললেনঃ “হে বাদশাহ! আপনি কি ইচ্ছা করছেন? আপনি তো এই শিশু আমাকে দান করে দিয়েছেন এবং আমি একে নিজের পুত্র বানিয়েও নিয়েছি?” ফিরাউন বললোঃ “তোমার কথা সত্য বটে, কিন্তু তুমি তো স্বচক্ষে দেখলে যে, সে আসা মাত্রই আমার দাড়ী ধরে নিয়ে আমাকে খাটো করে দিয়েছে? এই যেন আমার পতন ঘটাবে এবং আমাকে ধ্বংস করে দেবে?” বেগম সাহেবা উত্তরে বললেনঃ “দেখুন বদিশাহ! এ শিশুর এসবের কোন জ্ঞান বুদ্ধি আছে কি? পরীক্ষা করে দেখুন, তার সামনে জ্বলন্ত আগুনের একটি অঙ্গার এবং এক খণ্ড উজ্জ্বল মুক্তা রেখে দিন। দেখা যাক কোটা সে উঠিয়ে নেয়। যদি আগুনের অঙ্গার উঠায় তবে জানবেন যে, তার জ্ঞানবুদ্ধি নেই। আর যদি মুক্তা উঠিয়ে নেয় তবে বুঝতে হবে যে, তার বুদ্ধি বিবেক আছে। সুতরাং যদি সে আগুনের অঙ্গারই ধারণ করে তবে আপনার দাড়ি ধারণ করায় এতো দীর্ঘ ধারণা করতঃ তার প্রাণ নাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কি বুদ্ধিমানের কাজ। হবে?” তা-ই করা হলো দুটি জিনিস তাঁর সামনে রেখে দেয়া হলো। তিনি জ্বলন্ত অঙ্গারই উঠিয়ে নিলেন। হাত পুড়ে যাওয়ার ভয়ে সাথে সাথে ত্য তাঁর হাত থেকে নেয়া হলো। এ দেখে ফিরাউনের ক্রোধাগ্নি প্রশমিত হয়ে গেল। এবং মত পরিবর্তন করলো। সত্য ব্যাপার তো এটাই যে, মহান আল্লাহ যে কাজ করার ইচ্ছা করেন তার সর্বপ্রকারের উপকরণ প্রস্তুত হয়েই যায়। হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউনের দরবারে তার খাস মহলে তার স্ত্রীর ক্রোড়েই লালিত পালিত হয়ে থাকেন। অতঃপর তিনি প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছে যান। তাঁর কারণে বানী ইসরাঈলের উপর ফিরাউনের যে অত্যাচার ও উৎপীড়ন চলতো তা কমে যায়। সবাই বেশ নিরাপদেই বসবাস করছিল। একদা হযরত মূসা (আঃ) কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে দেখেন যে, একজন কিবতী (ফিরাউনী) ও বানী ইসরাঈলের একটি লোকের মধ্যে লড়াই বেধে গেছে। ইসরাঈলী লোকটি ফিরাউনীর বিরুদ্ধে তাঁর কাছে অভিযোগ করে। তাঁর ভীষণ রাগ হয়ে যায়। কেননা, ঐ সময় ফিরাউনী ইসরাঈলীকে ঘায়েল করে ফেলেছিল। তিনি ফিরাউনীকে এক ঘুষি মারেন। সাথে সাথে সে মারা যায়। সাধারণভাবে জনগণের এটা জানা ছিল যে, হযরত মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলের পক্ষপাতিত্ব করে থাকেন। তবে তারা এতো দিন পর্যন্ত এর কারণ এটাই বুঝে আসছিল যে, তিনি বানী ইসরাঈলের মধ্যে দুধ পান করেছেন বলেই তাদের পৃক্ষ লম্বন করে থাকেন। প্রকৃত রহস্যের অবগতি শুধু তাঁর মায়েরই ছিল। আর খুব সম্ব, মহান আল্লাহ হযরত মূসাকেও (আঃ) এটা জানিয়েছিলেন। মৃতদেহ দেখেই হযরত মূসা (আঃ) কেঁপে ওঠেন এবং তিনি বুঝে নেন যে, এটা শয়তানী কাজ। সে তো বিভ্রান্তকারী ও প্রকাশ্য শত্রু। তারপর তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলেনঃ “হে আল্লাহ! আমি আমার নফসের উপর জুলুম করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দিন!” মহান আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়ালু। যেহেতু ওটা হত্যার ব্যাপার ছিল সেহেতু তিনি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি সদা সজাগ দৃষ্টি রাখেন যে, না জানি কখন রহস্য উদঘাটিত হয়ে পড়ে। এদিকে ফিরাউনের কাছে অভিযোগ পেশ করা হয় যে, বানী ইসরাঈলের কোন লোক একজন কিবতীকে হত্যা করেছে। ফিরাউন হুকুম জারী করে দিলোঃ “ঘটনাটি পূর্ণরূপে তদন্ত কর এবং হত্যাকারীকে অনুসন্ধান করে ধরে আনো এবং সাক্ষীও হাজির কর। অপরাধ প্রমাণিত হয়ে গেলে তাকেও হত্যা করে ফেলো।” পুলিশরা। যথারীতি তল্লাশী চালাতে থাকলো। কিন্তু হত্যাকারীর কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। ঘটনাক্রমে পরের দিনও হযরত মূসা (আঃ) কোথাও যাচ্ছিলেন। দেখেন যে, গতকল্য যে ইসরাঈলীকে তিনি রক্ষা করেছিলেন তার সাথেই আর একজন কিবতীর ঝগড়া হচ্ছে। হযরত মূসাকে (আঃ) দেখা মাত্রই তার কাছে সে ফরিয়াদ করে। কিন্তু সে অনুভব করে যে, সম্বতঃ হযরত মূসা (আঃ) তার গতকল্যের কাজে লজ্জিত আছেন। তাঁকেও তার এই বারবার। ঝগড়া এবং বারবার ফরিয়াদ করন খারাপ লাগলো। তাই তিনি ইসরাঈলীকেই লক্ষ্য করে বললেনঃ “তুমিই খুব দুষ্ট লোক এবং বড়ই ঝগড়াটে।’ একথা বলে তিনি কিবতীকে ধরার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু ঐ কাপুরুষ ইসরাঈলী লোকটি মনে করলো যে, তিনি তার উপর অসন্তুষ্ট আছেন, কাজেই তাকেই হয়তো ধরতে আসছেন। অথচ ওটা ছিল তার সম্পূর্ণভীরুতা মূলক ধারণা। তিনি তো ঐ ফিরাউনীকেও ধরতে চাচ্ছিলেন। এবং তাকে বাচাবার ইচ্ছা করছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসের অবস্থায় ঐ ইসরাঈলীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লোঃ “হে মূসা (আঃ)! যেমন আপনি গতকল্য একটি লোককে মেরে ফেলেছিলেন। তেমনই কি আজ আমাকেও মেরে ফেলতে চান?” একথা শুনে ঐ কিতবী তাকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায় এবং পুলিশকে ঐ খবর দিয়ে দেয়। ফিরাউনও ঘটনাটি জানতে পারে। তৎক্ষণাৎ সে জল্লাদদেরকে হুকুম দেয়ঃ “মূসাকে (আঃ) ধরে হত্যা করে দাও।” তারা তখন হযরত মূসার (আঃ) খোজে ছুটে পড়ে। এদিকে একজন বনী ইসরাঈল রাস্তা কেটে নিকট রাস্তা দিয়ে এসে হযরত মূসাকে (আঃ) এ খবর অবহিত করে। হে ইবনু জুবাইর (রঃ)! এটা তো ছিল পঞ্চম ফিৎনা। এ খবর শোনা মাত্রই হযরত মূসা (আঃ) মিসর ছেড়ে মাদইয়ানের পথে যাত্রা শুরু করে দেন। না তিনি কখনো পদব্রজে চলেছেন, না কখনো কোন বিপদে পড়েছেন। শাহজাদাদের মত অতি আদরে লালিত পালিত হয়েছেন। এই পথও ছিল তার অজানা। কোন দিন তার সফরের কোন সুযোগ আসেনি। মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং তার কাছে সোজা পথে চালিত হওয়ার প্রার্থনা জানিয়ে তিনি চলতে লাগলেন। অবশেষে তিনি মাদইয়ানের সীমান্তে পৌঁছে যান। সেখানে তিনি দেখতে পান যে, লোকেরা তাদের জন্তু গুলিকে পানি পান করাচ্ছে। তিনি আরো দেখেন যে, দুটি মেয়ে তাদের পশুগুলিকে ধরে দাড়িয়ে আছে। তাদেরকে তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “লোকগুলির সাথে তোমরাও তোমাদের পশুগুলিকে পানি পান করাচ্ছ না কেন? কি জন্যে দুর দাড়িয়ে থেকে পশুগুলিকে পানি পানে বিরত রেখেছো?”তারা উত্তরে বললোঃ “এই ভীড় ঠেলে পশুগুলিকে পানি পান করানো আমাদের দ্বারা সম্ব হচ্ছে না। লোকেরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে চলে গেলে আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে থাকি।” হযরত মূসা (আঃ) তখন সামনে অগ্রসর হয়ে তাদের জন্তুগুলিকে পানি পান করিয়ে দেন। তিনি খুব শক্তিশালী লোক ছিলেন বলে সবারই আগে তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে দেন। মেয়ে দুটি তাদের বকরিগুলি নিয়ে তাদের বাড়ীর পথে রওয়ানা হয়ে যায়। হযরত মূসা (আঃ) একটি গাছের ছায়ায় বসে পড়েন। বসে বসে তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেনঃ“হে আল্লাহ! আমি আপনার সর্বপ্রকারের করুণার মুখাপেক্ষী।”

মেয়ে দু’টি বাড়ী পৌঁছলে তাদের পিতা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আজকে তোমরা সময়ের পূর্বে কি করে আসতে পারলে এবং বকরিগুলিকেও তো পেট ভর্তি মনে হচ্ছে?” তারা উত্তরে ঘটনাটি খুলে বললো। তিনি বললেনঃ “তোমাদের একজন এখনই গিয়ে লোকটিকে আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো।” মেয়েটি গিয়ে হযরত মূসাকে (আঃ) তার আব্বার কাছে ডেকে নিয়ে আসে। তাদের পিতা হযরত শুআইব (আঃ) হযরত মূসাকে (আঃ) তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেন। তাঁর ঘটনা শুনে হযরত শুআইব (আঃ) তাকে বলেনঃ “এখন কোন ভয়ের কারণ নেই। তুমি অত্যাচারীদের হাত হতে রক্ষা পেয়েছে। আমরা ফিরাউনের প্রজা নই এবং আমাদের উপর তার কোন অধিকারও নেই।” তৎক্ষণাৎ একটি মেয়ে তার পিতাকে বলে উঠলোঃ “আব্বা! তিনি আমাদের কাজ করে দিয়েছেন। তিনি খুব শক্তিশালী লোক এবং বড়ই বিশ্বস্তও বটে। যদি তাকে আমাদের কাজে নিযুক্ত করতেন তবে খুব ভাল হতো! তিনি মজুরীর উপর আমাদের বকরিগুলি চরাবেন।” একথা শুনে পিতা লজ্জিত হলেন এবং মেয়ের উপর তাঁর কঠিন রাগও হলো। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কি করে জানতে পারলে যে, সে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত?” উত্তরে মেয়েটি বললোঃ “তার শক্তির পরিচয় আমি এভাবেই পেলাম যে, তিনি আমাদের বকরিগুলিকে পানি পান করানোর জন্যে পানি ভর্তি বড় বালতি একাই বহন করেছিলেন এবং খুবই দ্রুতগতিতে কাজ করছিলেন। আর তাঁর বিশ্বস্ততার পরিচয় এভাবে পেলাম যে, আমার শব্দ শুনেই তিনি দৃষ্টি উচু করলেন এবং যখন বুঝতে পারলেন যে, আমি একজন মহিলা তখন তিনি গ্রীবা নীচ করে আমার কথা শুনতে থাকলেন। আল্লাহর কসম! আপনার পুর্ণ পয়গাম পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি দৃষ্টি উপরে উঠান নাই। তারপর তিনি আমাকে বলেনঃ “তুমি আমার পিছনে থাকো এবং দূরে থেকে আমাকে পথ বাতলিয়ে দাও। এটা তার খোদাভীতি ও বিশ্বস্ততার পরিচয় বটে।” মেয়ের এ কথা শুনে পিতার মর্যাদা রক্ষা পেলো, ক্রোধ দুরীভূত হলো এবং মেয়ের দিক থেকে তার অন্তর পরিষ্কার হলো। আর তার অন্তরে হযরত মূসার (আঃ) প্রতি ভালবাসা জমে গেল। সুতরাং তিনি হযরত মূসাকে (আঃ) বললেনঃ “আমি ইচ্ছা করছি যে, আমার এই দুটি মেয়ের মধ্যে একটির সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দেবো এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার বাড়ীতে কাজ করবে। আর যদি দশ বছর কাজ কর তবে আরো ভাল হয়। আমি যে লোক এটা তুমি দেখতে পাবে।” উভয়ের মধ্যে চুক্তি হয়ে গেল। হযরত মূসা (আঃ) আট বছরের পরিবর্তে দশ বছরই পূর্ণ করলেন।

হযরত সাঈদ ইবনু জুবাইর (রঃ) বলেনঃ “এটা আমার পূর্বে জানা ছিল। তাই, একজন খৃস্টান আমাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে আমি কোন উত্তর দিতে পারি নাই। তারপর আমি হযরত ইবনু আব্বাসকে (রাঃ) এটা জিজ্ঞেস করি এবং তিনি উত্তর দেন। তখন আমি ঐ খৃস্টানের নিকট এটা বর্ণনা করি। এটা শুনে সে বলেঃ “তোমার শিক্ষক বড় পণ্ডিতই বটে।” আমি বললামঃ তা তো বটেই।”

হযরত মূসা (আঃ) চুক্তিকৃত সময় পূর্ণ করে স্বীয় স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মাদইয়ান হতে বিদায় গ্রহণ করেন। তারপর ঐ সব ঘটনা ঘটে যার বর্ণনা এই আয়াতগুলিতে রয়েছে। তিনি আগুন দেখে সেখানে গমন করেন, মহান আল্লাহর সাথে কথা বলেন, তাঁর লাঠি সাপ হয়ে যায়, হাতে উজ্জ্বলতা প্রকাশ পায়, নবওয়াত লাভ করেন এবং ফিরাউনের কাছে প্রেরিত হন। অতঃপর তিনি তার একটি লোককে হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে নিজে নিহত হওয়ার আশংকা প্রকাশ করেন এবং এর থেকে নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে নিজের জিহ্বার জডত্য র করার প্রার্থনা জানান। তার এই প্রার্থনাও কবুল করা হয়। তারপর তিনি তার ভাই হারূণের (আঃ) সহায়তা লাভ ও নুবওয়াত প্রাপ্তির জন্যে মহান আল্লাহর নিকট দুআ করেন। তাঁর এই দুআও মঞ্জুর করা হয়। অতঃপর তিনি লাঠি নিয়ে মিসরের বাদশাহ ফিরাউনের নিকট গমন করেন। এদিকে হযরত হারূণের (আঃ) কাছে ওয়াহী আসেঃ “তুমি তোমার ভাই মূসার (আঃ) কাজে সহায়তা কর এবং তার সঙ্গী হয়ে যাও।” এই নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা দভাই মিলিত হয়ে ফিরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। তার কাছে তাদের প্রবেশের অনুমতি চাওয়া হলে বহু বিলম্বে তারা অনুমতি প্রাপ্ত হন। তারা তার কাছে প্রবেশ করে তাকে বলেনঃ “আমরা আল্লাহ তাআলার রাসূলরূপে তোমার নিকট আগমন করেছি। তারপর তাদের মধ্যে যে প্রশ্ন ও উত্তরের আদান-প্রদান হয় তা কুরআন কারীমে বিদ্যমান রয়েছে। ফিরাউন তাদেরকে জিজ্ঞেস করলোঃ “আচ্ছা বলতো, তোমরা চাও কি?” এরপর সে হযরত মূসাকে (আঃ) তাঁর কিবতীকে হত্যার ঘটনাটি স্মরণ করিয়ে দিলো। এর যে ওজর তিনি পেশ করলেন তা কুরআন কারীমে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর তারা বললেনঃ “আমরা চাই যে, তুমি আল্লাহ তাআলার উপর ঈমান আনবে এবং আমাদের সাথে বানী ইসরাঈলকে পাঠিয়ে দেবে।” ফিরাউন এটা অস্বীকার করলো এবং বললোঃ “যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে কোন মুজিযা’ প্রদর্শন কর। হযরত মূসা (আঃ) তৎক্ষণাৎ তার লাঠি ফেলে দেন ওটা মাটিতে পড়া মাত্রই এক বিরাট ভয়াবহ অজগর সাপ হয়ে গিয়ে হা করতঃ ফিরাউনের দিকে ধাবিত হয়। ফিরাউন ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সিংহাসন হতে লাফিয়ে পড়ে এবং পালাতে পালাতে অনুনয় বিনয়ের সুরে। হযরত মূসাকে (আঃ) সম্বোধন করে বলেঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমাকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, এটাকে ধরে নাও।” হযরত মূসা (আঃ) তাতে হাত লাগানো মাত্রই ওটা পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসে। অতঃপর তিনি স্বীয় হাতটি বুকের দিকে প্রবেশ করিয়ে তা বের করলেন। তৎক্ষণাৎ তা কোন রোগের দাগ ছাড়াই উজ্জ্বলরূপে প্রকাশ পায়। তা দেখে ফিরাউন হতভম্ব হয়ে যায়। আবার তিনি হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বের করলে তা আসল অবস্থায় ফিরে আসে। তখন ফিরাউন তার সভাষদবর্গকে বলেঃ “তোমরা তো দেখতেই পেলে যে, এরা দু’জন যাদুকর। যাদুর জোরে তারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে দেশকে দখল করে নেবে এবং তোমাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে।” অতঃপর সে তাদের দু’জনকে বললোঃ “আমরা তোমাদের নুবওয়াত স্বীকার করছি না এবং তোমাদের দাবী দাওয়াও পূর্ণ করতে সম্মত নই। বরং আমরা আমাদের যাদুকরদেরকে তোমাদের সাথে মুকাবিলা করার জন্যে আহবান করছি, যারা তোমাদের উপর জয়যুক্ত হয়ে যাবে।”

সুতরাং ফিরাউনের লোকেরা এই চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগে গেল। দেশের সর্বস্থান হতে যাদুকরদেরকে অতি মর্যাদার সাথে ডেকে এনে একত্রিত করলো। তারা জিজ্ঞেস করলোঃ “এদের যাদু কি প্রকারের?” ফিরাউনের লোকেরা উত্তরে বললোঃ“ লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।” যাদুকররা তখন বললোঃ “তাতে কি হলোঃ আমরা লাঠির দড়িগুলিকে এমন সাপ বানিয়ে দেবো যার মুকাবিলা ভূ-পৃষ্ঠের কেউই করতে পারে না। কিন্তু আমাদের জন্যে পুরস্কার নির্ধারণ করতে হবে।” ফিরাউন তাদেরকে কথা দিয়ে বললোঃ “পুরস্কার কি আমি তোমাদেরকে বিশিষ্ট সভাষদবর্গের অন্তর্ভুক্ত করে নেবে। আর তোমরা যা চাইবে তাই দেবো।” সুতরাং তারা ঘোষণা করে দিলোঃ “ঈদের দিন কিছু। বেলা হলে অমুক জায়গায় মুকাবিলা হবে।” বর্ণিত আছে যে, তাদের ঐ ঈদের দিন ছিল আশূরার দিন (১০ই মুহররম)। ঐদিন লোকেরা সকাল সকালই প্রতিযোগিতার মাঠে পৌঁছে গেল। কে হারে ও জিতে তা তারা স্বচক্ষে দেখতে চায়। তারা বলেঃ “আমাদের যাদুকররা পূর্ণ অভিজ্ঞ। সুতরাং তারা জয়যুক্ত হবেই এবং আমরা তাদেরকেই মানবো ।” আবার মাঝে মাঝে তারা উপহাস করে বলেঃ “দেখা যাক, এই দু’জন যাদুকরই যদি বিজয়ী হয়ে। যায় তবে আমরা তাদেরই অনুগত হয়ে যাবো।”

ময়দানে এসে যাদুকররা হযরত মূসাকে (আঃ) বললোঃ “তোমরাই প্রথমে তোমাদের যাদু প্রকাশ করবে, না আমরা?” উত্তরে হযরত মূসা (আঃ) বললেনঃ “তোমরাই প্রথমে শুরু কর।” তখন তারা তাদের লাঠি ও দড়িগুলি মাঠে নিক্ষেপ করলো। ওগুলি সাপ হয়ে গিয়ে আল্লাহর নবীদের দিকে ধাবিত হলো। এ দেখে ভয়ে তারা পিছনে সরতে শুরু করলেন। তৎক্ষণাৎ হযরত মূসার (আঃ) কাছে আল্লাহর ওয়াহী আসলোঃ “তুমি তোমার লাঠিটি মাটিতে নিক্ষেপ কর।” তিনি তাই করলেন। তখন ওটা এক ভয়াবহ বিরাট অজগর হয়ে গিয়ে তাদের সমস্ত সাপকে গ্রাস করে ফেললো। এ দেখে যাদুকররা বুঝে নিলো যে, এটা যাদু নয়। বরং আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এটা একটা নিদর্শন। সুতরাং তারা সবাই ঈমান আনলো এবং ঘোষণা করে দিলোঃ “আমরা মূসা (আঃ) ও হারূণের (আঃ) প্রতিপালকের উপর ঈমান আনলাম। আমরা এই দুই ভাই এর নুবওয়াতকে স্বীকার করে নিলাম। আমরা আমাদের অতীতের পাপকার্য হতে তাওবা করলাম। এর ফলে ফিরাউন ও তার লোকদের কোমর ভেঙ্গে গেল। লজ্জায় তাদের মুখ কালো হয়ে গেল। অপমানিত হয়ে তাদের মুখে কথা সরলো না। এদিকে তো এই হলো, আর ঐ দিকে ফিরাউনের স্ত্রী, যিনি হযরত মূসাকে (আঃ) নিজের পুত্ররূপে লালন পালন করেছিলেন, অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন এবং আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করছিলেন যে, তিনি যেন স্বীয় নবীদ্বয়কে জয়যুক্ত করেন। ফিরাউনও তাঁর এ অবস্থা লক্ষ্য করছিল। কিন্তু তার ধারণা হয়েছিল যে, পালিত পুত্রের পক্ষপাতিত্বের কারণেই তার এ অবস্থা হয়েছে।

এখানে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরাউন বেঈমানীর উপর কোমর কষে নেয়। মহান আল্লাহর পক্ষ হতে হযরত মূসার (আঃ) হাতে আরো বহু মু’জিযা প্রকাশ পায়। যখনই কোন বিপদে পড়তো তখনই ফিরাউন হতবুদ্ধি হয়ে বিনীতভাবে হযরত মূসার (আঃ) কাছে আবেদন করতোঃ “হে মূসা (আঃ)! যদি এই বিপদ দূর হয়ে যায় তবে আমি বানী ইসরাঈলকে তোমাদের সাথে পাঠিয়ে দিবো।” কিন্তু যখনই বিপদ কেটে যেতো তখনই সে আবার অস্বীকার করে বসতো এবং ঔদ্ধত্যপণা শুরু করে দিতো। আর বলতোঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার প্রতিপালক কি এ ছাড়া বেশী কিছু আর করতে পারে?” সুতরাং তার উপর তূফান আসলো, ফড়িং আসলো, উকুন আসলো, ব্যাঙ আসলো, রক্ত আসলো এবং আরো বহু নিদর্শন সে স্বচক্ষে দেখলো। যখনই বিপদ আসে তখনই সে হযরত মূসার (আঃ) কাছে দৌড়িয়ে যায় এবং ওয়াদা করে। আর যখনই বিপদ দূর হয়ে যায় তখনই সে আবার ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। অবশেষে আল্লাহ তাআলার নির্দেশ আসেঃ “হে মূসা (আঃ)! বানী ইসরাঈলকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও।”এই নির্দেশ অনুযায়ী হযরত মূসা (আঃ) রাতারাতিই বানী ইসরাঈলকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যান। সকালে ফিরাউনের লোকেরা দেখতে পায় যে, রাত্রেই সমস্ত বানী ইসরাঈল পালিয়ে গিয়েছে। তারা ফিরাউনকে খবর দেয়। সে সারা দেশে নির্দেশনামা পাঠিয়ে চতুর্দিক থেকে সৈন্য একত্রিত করে এবং বিরাট দল নিয়ে বানী ইসরাঈলের পশ্চাদ্ধাবন করে। পথে যে নদী পড়ে তার প্রতি মহান আল্লাহর ওয়াহী প্রেরণ করেনঃ “যখন আমার বান্দা মূসার (আঃ) লাঠি তোমার উপর পড়বে তখন। তুমি তাদের জন্যে পথ করে দিয়ে। তোমার মধ্যে যেন বারোটি পথ হয়ে যায়, যাতে বানী ইসরাঈলের বারোটি গোত্র তাদের জন্যে পৃথক পৃথক পথ পেয়ে যায়। অতঃপর যখন তারা পার হয়ে যাবে এবং ফিরাউন তার লোকলস্করসহ এসে পড়বে তখন তুমি মিলে যাবে এবং ফিরাউন ও তার লোকদের একজনকেও ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে না।” হযরত মূসা (আঃ) তার লোকজনসহ নদীর তীরে পৌঁছে দেখেন যে, ওটা তরঙ্গায়িত হচ্ছে, পানি ঘুরপাক খাচ্ছে এবং ভীষণ গর্জন করছে। এতে হয়রত মূসা (আঃ) হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন এবং তাতে লাঠির আঘাত করতে ভুলে যান। এদিকে নদী এই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে যে, হয়তো হযরত মূসা (আঃ) কোন অংশে লাঠির আঘাত করবেন, আর সে হয়তো খরব রাখবে না, ফলে সে আল্লাহর অবাধ্যচিরণের কারণে তার শাস্তির কবলে পতিত হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে ফিরাউন তার লোক লস্করসহ বানী ইসরাঈলের নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। তখন তারা হতবুদ্ধি হয়ে বলেঃ “আপনার উপর আল্লাহর যে নির্দেশ রয়েছে তা পালন করুন! আল্লাহ মিথ্যাবাদী নন এবং আপনিও না।” হযরত মূসা (আঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা তো আমাকে নির্দেশ দিয়েছেনঃ “যখন তুমি নদীর তীরে পৌঁছবে তখন সে তোমার জন্যে বারোটি রাস্তা করে দেবে, তখন তোমরা ঐ রাস্তাগুলি ধরে পার হয়ে যাবে।” তৎক্ষণাৎ তাঁর লাঠির আঘাত করার হুকুমের কথা স্মরণ হয়ে যায়। সুতরাং তিনি লাঠির আঘাত করেন। এদিকে ফিরাউনের সেনাবাহিনীর প্রথমাংশে বানী ইসরাঈলের শেষাংশের কাছে পৌঁছেই গিয়েছিল। এমতাবস্থায় নদীর ঐপথগুলি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। হযরত মূসা (আঃ) তার লোকজনসহ নিরাপদে নদী পার হয়ে যান। যখন তারা পার হয়ে গেলেন তখন ফিরাউনও তার লোক লস্করসহ ঐ পথগুলি দিয়ে যেতে শুরু করে। যখন তারা সবাই নেমে পড়েছে তখনই নদী আল্লাহর নির্দেশক্রমে পরস্পর মিলিত হয়ে যায়। ফলে তারা সবাই নদীতে নিমজ্জিত হয়। বানী ইসরাঈল ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখছিল। তথাপি তারা বলেঃ“হে আল্লাহর রাসূল (আঃ)! ফিরাউন মরলো কি না তা আমরা কি করে জানবো?” হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করলেন, ফলে নদী ফিরাউনের মৃত দেহ তীরে নিক্ষেপ করলো। তা দেখে তার মৃত্যু সম্পর্কে বানী ইসরাঈলের দৃঢ় বিশ্বাস হলো। তারা বুঝতে পারলো যে, ফিরাউন তার লোক-লস্করসহ ধ্বংস হয়ে গেছে। অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) সেখান থেকে যাত্রা শুরু করেন। পথে তিনি দেখতে পান যে, একটি সম্প্রদায় মূর্তি পূজায় মেতে গেছে। তখন বানী ইসরাঈল হযরত মূসাকে (আঃ) বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (আঃ)! আমাদের জন্যেও এ ধরনের কোন মা’ৰূদ নির্ধারণ করে দিন!” হযরত মূসা (আঃ) তখন তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে বলেনঃ “তোমরা বড়ই অজ্ঞ লোক (শেষ পর্যন্ত)।” “তোমরা এতো বড় শিক্ষামূলক নিদর্শন দেখলে এবং এরূপ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা শুনলে তথাপি এখন পর্যন্ত না উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণ করলে, না লজ্জিত হলে। এখান থেকে সামনে আরো কিছু দূর অগ্রসর হয়ে তারা এক মঞ্জিলে অবস্থান করলেন এবং সেখানে তাঁর ভাই হারূণকে (আঃ) নিজের স্থলাভিষিক্ত করে কওমকে। বললেনঃ “আমার ফিরে আসা পর্যন্ত তোমরা এর আনুগত্য করবে। আমি আমার প্রতিপালকের নিকট যাচ্ছি। তার সাথে ত্রিশ দিনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) স্বীয় কওম হতে পৃথক হয়ে ওয়াদার স্থানে পৌঁছে যান এবং ত্রিশ দিন রাত্রির রোযা পূর্ণ করতঃ স্বীয় প্রতিপালকের সাথে কথা বলার আকাংখা করেন। কিন্তু মনে করলেন যে, রোযা রাখার কারণে মুখ দিয়ে হয়তো, গন্ধ বের হচ্ছে, তাই অল্প কিছু ঘাস নিয়ে চর্বন করেন। আল্লাহ তাআলা জানা সত্ত্বেও তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি এরূপ করলে কেন?” তিনি জবাবে বলেনঃ “শুধু এই কারণে যে, আপনার সাথে কথা বলার সময় যেন আমার মুখ দিয়ে সুগন্ধ বের হয়। আল্লাহ তাআলা তখন তাকে বলেনঃ “তোমার কি এটা জানা নেই যে, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আমার কাছে মেস্ক আম্বারের চেয়েও বেশী সুগন্ধময়? তুমি আরো দশটি রোযা রেখে নাও, তার পরে আমার সাথে কথা বলো।”এই নির্দেশ অনুযায়ী হযরত মূসা (আঃ) রোযা রাখতে শুরু করেন। তাঁর কওমকে তিনি যে ত্রিশ দিনের কথা বলে এসেছিলেন তা যখন অতিক্রান্ত হয়ে গেল এবং তিনি ফিরলেন না তখন তারা চিন্তিত হয়ে পড়লো। হযরত হারূণ (আঃ) তাদের মধ্যে ভাষণ দান কালে বললেনঃ “তোমরা যখন মিসর হতে রওয়ানা হয়ে। এসেছিলে তখন তোমাদের কাছে কিবতীদের টাকা পয়সা ছিল, কারো উপর ঋণ ছিল এবং কারো কারো কাছে তাদের আমানত ছিল। এগুলি তো আমরা তাদের ফিরিয়ে দিতে পারছি না। আবার এটাও আমরা সমীচীন মনে করছি যে, ওগুলো আমাদের মালিকানায় থেকে যাবে। সুতরাং তোমরা একটি গভীর গর্ত খনন কর এবং তোমাদের কাছে তাদের যে সব আসবাবপত্র, অলংকার এবং সোনা রূপা রয়েছে সবগুলিই তাতে নিক্ষেপ কর। অতঃপর তাতে আগুন ধরিয়ে দাও।” তাঁর কথামতই কাজ করা হলো। তাদের সাথে সামেরী নামক একটি লোক ছিল। সে গায়-বাছুর পূজারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে বানী ইসরাঈলের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু সে বানী ইসরাঈলের প্রতিবেশী হওয়ায় এবং ফিরাউনের কওমের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় এদের সাথে সেখান থেকে চলে এসেছিল। সে কোন একটা নিদর্শনের কিছুটা মুষ্টিতে উঠিয়ে নিয়েছিল।হযরত হারূণ (আঃ) তাকে বলেনঃ “হে সামেরী! তুমিও তোমার। হাতের মধ্যকার ওটা এতে নিক্ষেপ করে দাও।” সে উত্তরে বললোঃ “এটা তো রাসূলের (আঃ) নিদর্শনেরই এক মুষ্টি যার মাধ্যমে আমাদেরকে নদী পার করিয়ে নেয়া হয়েছিল। ভাল কথা, আমি এটাকেও নিক্ষেপ করছি এই শর্তে যে, আপনি আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করবেন যেন এর দ্বারা আমি যা চাইবো তা-ই হয়ে যায়।” হযরত হারূণ দুআ করলেন এবং সে ওটা গর্তে নিক্ষেপ করে দিলো এবং বললোঃ “আমি চাই যে, এর দ্বারা যেন একটি বাছুর সৃষ্ট হয়ে যায়।” মহান আল্লাহর ক্ষমতা বলে ঐ গর্তে যা ছিল তা। একটা বাছুরের (গো-বৎসের) আকার বিশিষ্ট হয়ে যায়। ওর ভিতর ছিল শুন্য। ওতে রূহ ছিল না। কিন্তু ওর পিছনের ছিদ্র দিয়ে বায় প্রবেশ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেতো। ফলে একটা শব্দ হতো। বানী ইসরাঈল তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ হে সামেরী! এটা কি?” ঐ বেঈমান উত্তরে বললোঃ “এটাই তোমাদের সবারই প্রতিপালক। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) পথ ভুলে গেছেন এবং অন্য জায়গায় প্রতিপালকের সন্ধানে চলে গেছেন। তার এই কাজ ও উক্তি বানী ইসরাঈলকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে দেয়। একটি দল বললোঃ “হযরত মূসা (আঃ) ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি না। যদি সত্যই এটা মাবুদ হয় তবে আমরা এর বেআদবী করি কেন। আর যদি এটা মাবুদ না হয় তবে হযরত মূসা (আঃ) ফিরে আসলেই প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হয়ে যাবে। অন্য একটি দল বললোঃ “এটা বাজে কথা এবং শয়তানী কাজ। আমরা এই বাজে কাজের উপর ঈমান আনতে পারি না। এটা আমাদের প্রতিপালকও নয় এবং এর উপর আমাদের ঈমানও নেই।” আর একটি দুষ্টদল আন্তরিকভাবে ওটাকে মেনে নেয় এবং সামেরীর কথার উপর ঈমান আনে। কিন্তু বাহ্যিকভাবে তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। তৎক্ষণাৎ হযরত হারূণ (আঃ) তাদের সকলকেই একত্রিত করেন এবং বলেনঃ “হে লোক সকল! আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তোমাদের উপর এটা একটা পরীক্ষা। তোমরা এই ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েছো কেন? তোমাদের প্রতিপালক ও মাবুদ তো একমাত্র রহমান (আল্লাহ)। তোমরা আমার আনুগত্য কর ও আমার কথা মেনে নাও।” তারা বললোঃ হযরত মূসা (আঃ) ত্রিশ দিনের ওয়াদা করে গেলেন, আর আজ চল্লিশ দিন অতিক্রান্ত হতে চলেছে তবুও তিনি ফিরলেন না এর কারণ কি?” কোন কোন নির্বোধ লোক একথাও বলে ফেললো যে, তার প্রতিপালক ভুল করেছেন। এখন তিনি তার সন্ধানেই থাকবেন। এদিকে দশটি রোযা পূর্ণ হওয়ার পর হযরত মূসা (আঃ) আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার মর্যাদা লাভ করেন। তাঁকে বলা হলোঃ “তোমার এখানে আসার পর তোমার কওমের অবস্থা কি হয়েছে তার খবর রাখো কি (তারা যে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে)?” একথা শুনে হযরত মূসা (আঃ) অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ অবস্থায় ফিরে আসেন এবং কওমকে বহু কিছু বলেন ও শুনেন। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তিনি তার ভাই হারূণের (আঃ) মাথার চুল ধরে টানতে থাকেন। তার ক্রোধ এতো বৃদ্ধি পায় যে, পুস্তিকাটিও হাত থেকে ফেলে দেন। তারপর প্রকৃত ব্যাপার অবগত হয়ে তিনি স্বীয় ভাই এর নিকট ওজর পেশ করেন এবং তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। অতঃপর তিনি সামেরীকে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে সামেরী! তুমি এ কাজ কেন করেছো?” উত্তরে সে বলেঃ “আল্লাহর প্রেরিত পুরুষের পায়ের নীচে থেকে এক মুষ্টি আমি। উঠিয়ে নিয়েছিলাম। এ লোকগুলি ওটা চিনতে পারে নাই, আমি চিনে। ছিলাম। আমি ঐ মুষ্টিই আগুনে নিক্ষেপ করেছিলাম। আমি এটাই পছন্দ করেছিলাম।” হযরত মূসা (আঃ) তখন তাকে বললেনঃ দূর হও। তোমার জীবদ্দশায় তোমার জন্যে এটাই রইলো যে, তুমি বলবেঃ আমি অস্পৃশ্য এবং তোমার জন্যে রইলো এক নির্দিষ্টকাল, তোমার বেলায় যার ব্যতিক্রম। হবে না এবং তুমি তোমার সেই মা’বৃদের প্রতি লক্ষ্য কর যার পূজায় তুমি রত ছিলে, আমরা ওকে জ্বালিয়ে দিবই। অতঃপর ওকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে নিক্ষেপ করবই।” তিনি তাই করলেন। তখন বানী ইসরাঈলের পূর্ণ বিশ্বাস হলো যে, আসলে ওটা মাবুদ ছিল না। কাজেই তারা বড়ই লজ্জিত হয় এবং যে সব মুসলমান হযরত হারূণের আকীদার উপর ছিলেন তারা ছাড়া সবাই হযরত মূসার (আঃ) নিকট ওজর পেশ করে বলতে লাগলোঃ “হে আল্লাহর নবী (আঃ)! আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করুন যেন তিনি। আমাদের জন্যে তাওবার দরজা খুলে দেন। তিনি যা বলবেন আমরা তা-ই পালন করবো যাতে আমাদের এই কঠিন অপরাধ তিনি মার্জনা করে দেন।” হযরত মূসা (আঃ) বানী ইসরাঈলের ঐ দলের মধ্য হতে সত্তর জন লোককে বাছাই করে পৃথক করে নেন এবং তাওবার জন্যে নিয়ে যান। সেখানে যমীন ফেটে যায় এবং তার সমস্ত সঙ্গীকে ওর মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। এতে হযরত মূসা (আঃ) অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন যে, তিনি বানী ইসরাঈলকে মুখ দেখাবেন কিরূপে? তিনি কান্নাকাটি করতে শুরু করেন এবং দুআ করেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি ইচ্ছা করলে ইতিপূর্বেই আমাকে ও এদের সবাইকে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। আমাদের নির্বোধদের পাপের কারণে আমাদেরকে আপনি ধ্বংস করবেন না।” হযরত মূসা (আঃ) তাদের বাহ্যিক দিক দেখছিলেন, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টি ছিল তাদের ভিতরের দিকে। তাদের মধ্যে এমন লোকও ছিল যারা বাহ্যিকভাবে ঈমান এনেছিল বটে, কিন্তু অন্তরে তারা ঐ বাছুরের মাবুদ হওয়াকেই বিশ্বাস করছিল। ঐ মুনাফিকদের কারণেই তাদের সকলকেই যমীনেই ধ্বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হযরত মুসার (আঃ) কান্নাকাটির কারণে আল্লাহর রহমত উথলিয়ে উঠে। তিনি তাকে জবাবে বলেনঃ “আমার রহমত তো সবারই উপর ছেয়ে আছে কিন্তু আমি এটা ওদেরই নামে দান করে থাকি যারা মুত্তাকী ও খোদাভীরু। যারা ঈমান আনে। আর আমার ঐ রাসূলের (সঃ) আনুগত্য স্বীকার কর যার গুণাবলীর বর্ণনা তারা তাদের কিতাবে অর্থাৎ তাওরাত ও ইঞ্জীলে পেয়ে থাকে।” তখন হযরত মূসা (আঃ) আরয করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমি তো আমার কওমের জন্যে এটা প্রার্থনা করলাম, আর আপনি উত্তরে বললেন যে, আপনার রহমত আপনি ঐ লোকদের উপর নাযিল করবেন যারা আগামীতে আসবে। তাহলে হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এই রহমত প্রাপ্ত নবীর (সাঃ) উম্মতেরই অন্তর্ভুক্ত করতেন!” বিশ্ব প্রতিপালক বললেনঃ “জেনে রেখো, এই লোকদের তাওবা কবূল হওয়ার পন্থা এই যে, তারা পরস্পর একে অপরকে হত্যা করতে শুরু করে দিবে। পুত্র পিতাকে দেখবে না এবং পিতা পুত্রকে ছাড়বে না।” বানী ইসরাঈল তা-ই করলো এবং যারা মুনাফিক ছিল তারাও সত্য অন্তরে তাওবা করলো। আল্লাহ তাআলা তাদের তওবা কবুল করলেন। যারা বাঁচলো তাদেরকেও ক্ষমা করা হলো এবং যারা নিহত হলো তাদেরকেও মাফ করা হলো।

অতঃপর হযরত মূসা (আঃ) এখান হতে বায়তুলমুকাদ্দাসের পথে গমন করেন। তাওরাতের ফলকটি তিনি সাথে নেন। তাদেরকে তিনি আল্লাহর আহকাম শুনিয়ে দেন। তা তাদের কাছে খুবই ভারীবোধ হয় এবং তারা পরিষ্কারভাবে তা অস্বীকার করে বসে। তখন একটি পাহাড়কে তাদের মাথার উপর উঠিয়ে খাড়া করে দেয়া হয়। ওটা সামিয়ানার মত তাদের মাথার উপর ছিল এবং তাদের মাথার উপর পড়ে যাওয়ার সদাভয় ছিল। তারা যখন তাওরাত গ্রহণ করে নিলো তখন পাহাড় সরে গেল। তারপর তাদেরকে নিয়ে তিনি পবিত্র ভূমিতে আগমন করেন। সেখানে এসে তিনি দেখতে পান যে, ওটা একটি বড় শক্তিশালী কওমের দখলে রয়েছে। তারা হযরত মূসাকে (আঃ) অত্যন্ত কাপুরুষের মত বললোঃ “এখানে তো বড় শক্তিশালী কওম রয়েছে। তাদের সাথে মুকাবিলা করার শক্তি আমাদের নেই। তারা বেরিয়ে গেলে পর আমরা ঐ শহরে প্রবেশ করবো। তারা তো এইভাবে ভীরুতা প্রদর্শন করতে থাকে। আর ওদিকে আল্লাহ তাআলার ঐ উদ্ধত ও অবাধ্য লোকদের মধ্য হতে দুই ব্যক্তিকে হিদায়াত দান করেন। তারা শহর হতে বেরিয়ে এসে হযরত মূসার (আঃ) কওমের সাথে মিলিত হয় এবং তাদের বুঝাতে থাকে। তাদেরকে তারা বলেঃ “তোমরা তাদের দেহ ও সংখ্যা দেখে ভয় করো না। তারাবীর পুরুষ নয়। তাদের মন খুবই দুর্বল। তোমরা সামনে অগ্রসর হও। তাদের শহরের দরজায় তোমরা প্রবেশ করো, তোমরা অবশ্যই বিজয় লাভ করবে।” একথাও বলা হয়েছে যে, যে দুটি লোক বানী ইসরাঈলকে বুঝাচ্ছিল এবং তাদের সাহসী করে তুলছিল তারা বানী ইসরাঈলেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

তাদের এতো করে বুঝানো, আল্লাহ তাআলার নির্দেশ এবং হযরত মূসার (আঃ) ওয়াদা সত্ত্বেও তারা কাপুরুষতা পরিত্যাগ করলো না। বরং তারা স্পষ্টভাবে বলে দিলোঃ “যতক্ষণ পর্যন্ত এই লোকগুলি শহরে অবস্থান করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এখান থেকে এক পা সামনে অগ্রসর হবো না। হে মূসা। (আঃ)! তুমি ও তোমার প্রতিপালক গিয়ে যুদ্ধ করা, আমরা এখানে বসে থাকছি।” হযরত মূসা (আঃ) আর ধৈর্য ধারণ করতে পারলেন না। ঐ কাপুরুষদের বিরুদ্ধে তাঁর মুখ দিয়ে বদ দু’আ বেরিয়ে গেল এবং তিনি তাদেরকে ‘ফাসেক’ নামে অভিহিত করলেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেও তাদের এই নামই নির্ধারিত হয়ে গেল। তাদেরকে স্বাভাবিকভাবে ঐ ময়দানেই বন্দী করে দেয়া হলো। ঐ মরুভূমিতেই তারা হতবুদ্ধি ও বিচলিতভাবে ফিরতে লাগলো। ঐ বন্দীর মাঝে তাদেরকে বরাবরই মেঘ দ্বারা ছায়া করা হয় এবং তাদের উপর মান্না ও সালওয়া অবতারিত হয়। তাদের কাপড় ছিড়তো না এবং ময়লাও হতো না। একটি চার কোণ বিশিষ্ট পাথর তাদের সাথে রাখা হয়েছিল। ওর উপর হযরত মূসা (আঃ) লাঠি মারলে তা হতে বারোটি প্রস্রবণ প্রবাহিত হয়। প্রত্যেক কোণে তিনটি করে মোট বারোটি প্রস্রবণ। ঐ লোকগুলি চলতে চলতে সামনে অগ্রসর হতো। তারপর কান্ত হয়ে পড়তো এবং বিশ্রাম গ্রহণ করতো। সকালে উঠে দেখতো যে, পাথরটি গতকাল যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে।

হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) এ হাদীসটি মারফু’রূপে বর্ণনা করেছেন। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে এই রিওয়াইয়াতটি শুনে বলেনঃ “এতে যে রয়েছে যে, ঐ ফিরাউনী লোকটি হযরত মূসার (আঃ) পূর্ব দিনের হত্যার খবর প্রচার করেছিল, এটা বুঝে আসে না। কেননা, কিবতীর হত্যার সময় ঐ কিবতীর সাথে লড়াইরত বানী ইসরাঈলের ঐ লোকটি ছাড়া আর কেউই উপস্থিত ছিল না। তার একথা শুনে হযরত ইবনু উমার (রাঃ) খুব রাগান্বিত হন এবং হযরত মুআবিয়ার (রাঃ) হাত ধরে হযরত সা’দ ইবনু মালিকের (রাঃ) নিকট নিয়ে যান এবং তাকে বলেনঃ “আপনার স্মরণ আছে কি যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে ঐ ব্যক্তির অবস্থা বর্ণনা করেছিলেন যে হযরত মূসার (আঃ) হত্যার রহস্য খুলে দিয়েছিল? বলুন তো, ওটা কি বানী ইসরাঈলের লোক ছিল, না ফিরাউনী ছিল?” হযরত সা’দ (রাঃ) উত্তরে বলেন, “বানী ইসরাঈলের ঐ লোকটির মূখে ঐ ফিরাউনী লোকটি শুনেছিল, তারপর সে গিয়ে শাসন কর্তৃপক্ষকে খবর দিয়েছিল। আর সে নিজেই তার সাক্ষী হয়েছিল। (ইমাম নাসায়ী (রঃ) এটা সুনানে কুল্লায় বর্ণনা করেছেন) এই রিওয়াইয়াতটিই অন্যান্য কিতাবেও রয়েছে। হযরত ইবনু আব্বাসের (রাঃ) কালাম হতে খুব কম অংশই মারফু’রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। খুব সম্ভব তিনি বানী ইসরাঈলের কারো নিকট হতে এ রিওয়াইয়াতটি নিয়ে থাকবেন। অথবা হয়তো তিনি হযরত কাব আহব্বার (রাঃ) হতেই এই রিওয়াইয়াতটি শুনে থাকবেন। আবার অন্য কারো নিকট থেকেও শুনে থাকতে পারেন। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। আমি আমার উসতাদ ও শায়েখ হাফিয আবুল হাজ্জাদ মাযী (রঃ) হতেও এটাই শুনেছি।

৪১-৪৪ নং আয়াতের তাফসীর:

হযরত মূসাকে (আঃ) আল্লাহ তাআলা সম্বোধন করে বলেনঃ হে মূসা (আঃ)! তুমি ফিরাউনের নিকট থেকে পালিয়ে গিয়ে মাদইয়ানে পৌঁছে ছিলে। সেখানে তুমি শ্বশুরবাড়ীতে আশ্রয় পেয়েছিলে এবং শর্ত অনুযায়ী কয়েক বছর ধরে তোমার শ্বশুরের বকরী চরিয়েছিলে। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে তুমি তার কাছে পৌঁছেছে। তোমার প্রতিপালকের কোন চাহিদা পূর্ণ হতে বাকী থাকে না এবং কোন ফরমান ছুটে যায় না। তার ওয়াদা অনুযায়ী তার নির্ধারিত সময়ে তোমাদের তার কাছে পৌছা অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার ছিল। ভাবার্থ এও হতে পারেঃ তুমি তোমার মর্যাদায় পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ তুমি নবুওয়াত লাভ করেছে। আমি তোমাকে আমার মনোনীত পয়গাম্বর করেছি।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত আদম (আঃ) ও হযরত মূসার (আঃ) পরস্পর সাক্ষাৎ হয়। তখন হযরত মূসা (আঃ) হযরত আদমকে (আঃ) বলেনঃ “আপনি তো ঐ ব্যক্তি যে, আপনি মানব মণ্ডলীর ভাগ্য বিড়ম্বনা সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে বেহেশত হতে বহিস্কৃত করেছেন?’ তখন হযরত আদম (আঃ) হযরত মূসাকে (আঃ) উত্তরে বলেনঃ “আপনি তো ঐ ব্যক্তি যে, আল্লাহ তাআলা আপনাকে স্বীয় রাসূলরূপে মনোনীত করেছেন এবং নিজের জন্যে আপনাকে বেছে নিয়েছেন, আর আপনার উপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন? জবাবে হযরত মূসা (আঃ) বলেনঃ “” হযরত আদম (আঃ) তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি কি ওটা আমার সৃষ্টির পূর্বে লিখিত পান নাই?” হযরত মূসা (আঃ) জবাব দেনঃ “ হাঁ, তা-ই পেয়েছি।” অতঃপর হযরত আদম (আঃ) হযরত মূসার (আঃ) অভিযোগ খণ্ডন করে বিজয়ী হলেন।” (হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ বলেনঃ হে মূসা (আঃ)! তুমিও তোমার ভ্রাতা আমার নিদর্শনসহ যাত্রা শুরু করো এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না। তোমরা দু’জন ফিরাউনের নিকট গমন কর, সে তো সীমালংঘন করেছে।

সুতরাং তারা দু’জন ফিরাউনের সামনে আল্লাহর যিকরে লেগে থাকতেন যাতে আল্লাহর সাহায্য তঁারা লাভ করতে পারেন এবং ফিরাউনের শান শওকত নষ্ট হয়ে যায়। যেমন হাদীসে এসেছে যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমার খাটি ও সত্যবাদী বান্দা সেই যে সারা জীবন ধরে আমাকে স্মরণ করে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা ভ্রাতৃদ্বয় আমার পয়গাম নিয়ে ফিরাউনের নিটক গমন কর। সে মস্তক উঁচু করে রয়েছে এবং আমার অবাধ্যতার সীমালংঘন করেছে। আর নিজের মালিক ও সৃষ্টিকর্তাকে সে ভুলে গেছে।

এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে। এই আয়াতে বড় উপদেশ ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তা এই যে, ফিরাউন হচ্ছে চরম অহংকারী ও আত্মী। পক্ষান্তরে হযরত মূসা (আঃ) হলেন অত্যন্ত ভদ্র ও নির্মল চরিত্রের অধিকারী। এতদসত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাকে তার সাথে নম্রভাবে কথা বলার নির্দেশ দিচ্ছেন। হযরত ইয়াযীদ রাক্কাশী (রঃ) এই আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে সেই সত্ত্বা! যিনি শত্রুর সাথেও নরম ব্যবহার করে থাকেন, তাঁর ব্যবহার ঐ ব্যক্তির সাথে কিরূপ হতে পারে যে তার সাথে বন্ধুত্ব রাখে ও তাকে আহ্বান করে।”

হযরত অহাব (রঃ) বলেন যে, নরম কথাবার্তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাকে বলাঃ আমরি ক্রোধ গোস্বা হতে আমার ক্ষমা ও করুণা অনেক বড়। ইকরামা (রঃ) বলেন যে, নরম কথা বলা দ্বারা আল্লাহর একত্ববাদের দিকে দাওয়াত দেয়া বুঝানো হয়েছে যাতে সে ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এই উক্তিকারী হয়ে যায়। হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলো তাকে বলাঃ তোমার প্রতিপালক রয়েছেন। তোমার মৃত্যুর পর তোমাকে তাঁর ওয়াদাকৃত জায়গায় পৌঁছতে হবে, যেখানে জান্নাত ও জাহান্নাম রয়েছে। হযরত সুফইয়ান সাওরী (রঃ) বলেনঃ এর দ্বারা বুঝানো হয়েছেঃ তুমি তাকে আমার দরার উপর এনে দাঁড় করিয়ে দাও। মোট কথা, হে মূসা (আঃ) ও হারূণ (আঃ)! তোমরা ফিরাউনের সাথে নম্রভাবে কথা বলবে, এর ফলে হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে নবী (সঃ)! তোমার প্রতিপালকের পথে হিকমত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে (মানুষকে) আহ্বান কর এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে বুঝাতে থাকো, যাতে তারা বুঝে এবং পথভ্রষ্টতা ও ধ্বংস হতে দূরে থাকে এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকে। আর তাঁর আনুগত্য ও ইবাদতের দিকে ঝুঁকে পড়ে।” (১৬:১২৫) যেমন এক জায়গায় ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “এটা উপদেশ হচ্ছে ঐ ব্যক্তির জন্যে যে উপদেশ গ্রহণ করে অথবা ভয় করে।” সুতরাং উপদেশ গ্রহণ করার অর্থ হলো মন্দ কাজ ও ভয়ের জিনিস থেকে সরে যাওয়া এবং ভয় করার অর্থ হলো আনুগত্যের দিকে ঝুঁকে পড়া। হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, তার ধ্বংসের জন্যে দুআ না করা যে পর্যন্ত না তার সমস্ত ওজর শেষ হয়ে যায়। এখানে ইবনু ইসহাক (রঃ) যায়েদ ইবনু আমর ইবনু নুফায়েল এবং অন্য একটি বর্ণনা মতে উমাইয়া ইবনু আবিসসালাতের নিম্ন লিখিত কবিতাংশ বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আপনি ঐ সত্ত্বা যে, আপনি স্বীয় অনুগ্রহ ও দয়ায় মূসাকে (আঃ) রাসূল ও আহ্বানকারী রূপে প্রেরণ করেছেন। তাকে আপনি বলেছেনঃ তুমি ও হারূণ (আঃ) বিদ্রোহী ফিরাউনের কাছে গমন কর এবং তাকে বলোঃ তুমিই কি আকাশকে বিনা স্তম্ভে ধারণ করে রেখেছো? তুমিই কি ওটাকে এভাবে বানিয়ে ছো? তুমিই কি ওর মাঝে উজ্জ্বল সূর্য স্থাপন করেছে যা অন্ধকারকে আলোতে পরিবর্তিত করে? এদিকে সকালে ওটা উদিত হলো, ওদিকে দুনিয়া হতে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে গেল। আচ্ছা বলতো, মাটি হতে বীজ উদগীরণকারী কে? আর কে ওর মাথায় শীষ সৃষ্টিকারী? এ সব নিদর্শন দ্বারাও কি তুমি আল্লাহকে চিনতে পারলে না?

৪৫-৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহর দু’জন নবী (আঃ) তার আশ্রয় প্রার্থনা করতঃ নিজেদের দুর্বলতার কথা তাঁর সামনে পেশ করছেন। তাঁরা বলেনঃ হে আমাদের প্রতিপালক। আমাদের ভয় হচ্ছে যে, না জানি ফিরাউন হয়তো আমাদের উপর জুলুম করবে, আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করবে, আমাদের মুখবন্ধ করার জন্যে তাড়াতাড়ি আমাদেরকে কোন বিপদে জড়িয়ে ফেলবে এবং আমাদের প্রতি অবিচার করবে। তাদের একথার জবাবে মহান আল্লাহ তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেনঃ তাকে তোমরা মোটেই ভয় করবে না। আমি স্বয়ং তোমাদের সাথে রয়েছি। আমি তোমাদের ও তার কথাবার্তা শুনতে থাকবে এবং তোমাদের কোন কিছুই আমার কাছে গোপন থাকতে পারে না। তার চুলের ঝুঁটি আমার হাতে রয়েছে। সে আমার অনুমতি ছাড়া নিঃশ্বাসও গ্রহণ করতে পারে না। সে কখনো আমার আয়ত্বের বাইরে যেতে পারে না। আমার হিফাযত ও সাহায্য সহযোগিতা সদা তোমাদের সাথে থাকবে।

হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, হযরত মূসা (আঃ) মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেনঃ হে আমার প্রতিপালক! ফিরাউনের কাছে যাওয়ার সময় যা পাঠ করবো তা আমাকে শিখিয়ে দিন!” তখন আল্লাহ তাআলা তাকে নিম্নের দুআটি শিখিয়ে দেনঃ (আরবী) যার আরবী অর্থ হচ্ছেঃ (আরবী) অর্থাৎ সব কিছুর পূর্বেও আমি জীবিত এবং সব কিছুর পরেও আমি জীবিত।” এরপর ফিরাউনের কাছে গিয়ে কি বলতে হবে তা আল্লাহ তাআলা তাদেরকে শিখিয়ে দেন।

হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ তারা গিয়ে ফিরাউনের দরযার উপর দাড়িয়ে যান। অতঃপর তারা তার নিকট প্রবেশের অনুমতি চান। বহু বিলম্বে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়।

মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (রঃ) বলেন যে, তারা দু’জন দু’বছর পর্যন্ত প্রত্যহ সকাল ও সন্ধ্যায় ফিরাউনের কাছে যেতেন। দারোয়ানদেরকে বলতেন যে, তারা যেন তাদের আগমন সংবাদ ফিরাউনকে জানিয়ে দেয়। কিন্তু ফিরাউনের ভয়ে কেউ তাকে সংবাদ দেয় নাই। দু’বছর পর একদা ফিরাউনের এক অন্তরঙ্গ বন্ধু, যে বাদশাহর সাথে কৌতুকও করতো, তাকে বলেঃ “আপনার দরার উপর একটি লোক দাড়িয়ে আছে এবং এক বিস্ময়কর মজার কথা বলছে। সে। বলছে যে, আপনি ছাড়া নাকি তার অন্য এক মাবুদ রয়েছেন যিনি তাকে। রাসূল করে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন। ফিরাউন জিজ্ঞেস করেঃ “সে আমারই দরযার উপর দাড়িয়ে রয়েছে?” তার বন্ধু উত্তরে বললোঃ “হ” ফিরাউন তাকে তার কাছে ডেকে আনার নির্দেশ দিলো। সুতরাং লোক গেল এবং দু’জন নবীকে (আঃ) ফিরাউনের দরবারে হাজির করলো। হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউনকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “আমি বিশ্ব প্রতিপালকের রাসূল।” ফিরাউন তাকে চিনতে পেরে বলে উঠলোঃ “ আরে, এ যে মূসা (আঃ)!”

সুদ্দী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মূসা (আঃ) মিসরে তার নিজের বাড়ীতেই অবস্থান করেছিলেন। তাঁর মাতা ও ভাই তাঁকে প্রথমে চিনতে পারেন নাই। তাঁকে অতিথি মনে করে বাড়ীতে যা রান্না করা হয়েছিল তাই তাঁর সামনে হাজির করেন। পরে তারা তাকে চিনতে পারেন এবং সালাম দেন। হযরত মূসা (আঃ) তাঁর ভাইকে সম্বোধন করে বলেনঃ “হে হারূণ (আঃ)! আমার প্রতি আল্লাহ তাআলার নির্দেশ হয়েছে যে, আমি যেন বাদশাহ ফিরাউনকে আল্লাহর পথে আহ্বান করি। আর তোমার সম্পর্কে আমার উপর আল্লাহর নির্দেশ এই যে, তুমি আমার পৃষ্ঠপোষকতা করবে। তখন হযরত হারূণ (আঃ) তাকে বললেনঃ “তা হলে আল্লাহর নামে শুরু করে দিন।” রাত্রে তারা দু’ভাই ফিরাউনের কাছে গমন করেন। হযরত মূসা (আঃ) স্বীয় লাঠি দ্বারা দরযায় করাঘাত করেন। এ দেখে ফিরাউন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে এবং বলেঃ “কার এমন দুঃসাহস যে, দরবারের আদবের বিপরীত লাঠি দ্বারা আমাকে সতর্ক করছে?” দরবারের লোকেরা জবাবে বললোঃ “হে শাহানশাহ! “ তেমন কিছু নয়, একজন পাগল লোক বলতে রয়েছেঃ “আমি একজন রাসূল।” ফিরাউন হুকুম দিলোঃ “তাকে আমার সামনে হাজির কর।” সুতরাং হযরত মূসা (আঃ) হযরত হারূণকে (আঃ) সাথে নিয়ে ফিরাউনের নিকট হাজির হলেন এবং তাকে বললেনঃ “আমরা আল্লাহর রাসূল। তুমি আমাদের সাথে বানী ইসরাঈলকে পাঠিয়ে দাও এবং তাদের প্রতি জুলুম করো না। আমরা বিশ্বপ্রতিপালকের নিকট থেকে আমাদের রিসালাতের প্রমাণাদি ও মুজিযা নিয়ে আগমন করেছি। তুমি আমাদের কথা মেনে নাও, তাহলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে পত্র রোমক সম্রাট হিরাত্মািসের নামে পাঠিয়ে ছিলেন তাতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এরপরে লিখিত ছিলঃ “এই পত্রটি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের (সঃ) পক্ষ হতে রোমক সম্রাট হিরাকিয়াসের নামে লিখিত। যে হিদায়াতের অনুসরণ করে তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর তুমি ইসলাম গ্রহণ কর, শান্তি লাভ করবে। আল্লাহ তাআলা তোমাকে দ্বিগুণ পুরস্কার প্রদান করবেন।”

মুসাইলামা কাযযাব সত্যবাদী ও সত্যায়িত রাসূলকে (সঃ) একটি পত্র লিখেছিলেন যাতে লিখিত ছিলঃ “এই পত্রটি আল্লাহর রাসূল মুসাইলামার পক্ষ হতে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের (সঃ) নামে লিখিত। আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি আপনাকে শরীক করে নিয়েছি। শহর আপনার জন্যে এবং গ্রাম আমার জন্যে। এই কুরায়েশরা তো বড়ই অত্যাচারী লোক।” তার এই পত্রের জবাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে লিখেনঃ “মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সঃ) পক্ষ থেকে মুসাইলামা কায্যাবের নামে। ঐ ব্যক্তির উপর শান্তি বর্ষিত হোক যে হেদায়াতের অনুসরণ করে। জেনে রেখো যে, যমীনের অধিকারী হলেন আল্লাহ। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে চান তার ওয়ারিস বানিয়ে দেন। পরিণামের দিক দিয়ে ভাল লোক তারাই যাদের অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে।

মোট কথা আল্লাহর রাসূল হযরত মূসা কালীমুল্লাহও (আঃ) ফিরাউনকে ঐ কথাই বলেন যে, তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক যে সত্যের অনুসারী। অতঃপর তিনি বলেনঃ আল্লাহ তাআ’লর ওয়াহীর মাধ্যমে আমাদেরকে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহর শাস্তির যোগ্য শুধু তারাই যারা আল্লাহর কালামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং তার কথা মানতে অস্বীকার করে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যে ব্যক্তি ঔদ্ধত্যপনা ও হঠকারিতা করে এবং পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দেয়, তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম।” (৭৯:৩৭-৩৯) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ “আমি তোমাদেরকে লেলিহান শিখাযুক্ত আগুন হতে ভয় প্রদর্শন করছি, যার মধ্যে শুধু ঐ হতভাগ্যই প্রবেশ করবে যে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর এক জায়গায় আছেঃ “সে বিশ্বাস করে নাই এবং নামায আদায় করে নাই। বরং সে সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।

Leave a Reply