أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯১১)
[ لَا تَخَفْ
“ভয় পেয়ো না, “]
সূরা:- ত্বাহা।
সুরা:২০
৪৯-৭৩ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২০:৪৯
قَالَ فَمَنْ رَّبُّكُمَا یٰمُوْسٰى
ফেরাউন বললো, “আচ্ছা, তাহলে তোমাদের দু’জনের রব কে হে মূসা?”
২০:৫০
قَالَ رَبُّنَا الَّذِیْۤ اَعْطٰى كُلَّ شَیْءٍ خَلْقَهٗ ثُمَّ هَدٰى
মূসা জবাব দিল, “আমাদের রব তিনি যিনি প্রত্যেক জিনিসকে তার আকৃতি দান করেছেন তারপর তাকে পথ নির্দেশ দিয়েছেন।
২০:৫১
قَالَ فَمَا بَالُ الْقُرُوْنِ الْاُوْلٰى
ফেরাউন বললো, “আর পূর্ববর্তী বংশধর যারা অতীত হয়ে গেছে তাদের তাহলে কি অবস্থা ছিল?”
২০:৫২
قَالَ عِلْمُهَا عِنْدَ رَبِّیْ فِیْ كِتٰبٍ١ۚ لَا یَضِلُّ رَبِّیْ وَ لَا یَنْسَى٘
মূসা বললো “সে জ্ঞান আমার রবের কাছে লিপিবদ্ধ অবস্থায় সংরক্ষিত আছে। আমার রব ভুলও করেন না, বিস্মৃতও হন না।”
২০:৫৩
الَّذِیْ جَعَلَ لَكُمُ الْاَرْضَ مَهْدًا وَّ سَلَكَ لَكُمْ فِیْهَا سُبُلًا وَّ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً١ؕ فَاَخْرَجْنَا بِهٖۤ اَزْوَاجًا مِّنْ نَّبَاتٍ شَتّٰى
–তিনিই তোমাদের জন্য যমীনের বিছানা বিছিয়েছেন, তার মধ্যে তোমাদের চলার পথ তৈরী করেছেন এবং উপর থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, তারপর তার মাধ্যমে আমি বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করি।
২০:৫৪
كُلُوْا وَ ارْعَوْا اَنْعَامَكُمْ١ؕ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیٰتٍ لِّاُولِی النُّهٰى۠
খাও এবং তোমাদের পশুও চরাও। অবশ্যই এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিমানদের জন্য বহু নিদর্শনাবলী।
২০:৫৫
مِنْهَا خَلَقْنٰكُمْ وَ فِیْهَا نُعِیْدُكُمْ وَ مِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً اُخْرٰى
এ মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরই মধ্যে আমি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো এবং এ থেকেই আবার তোমাদেরকে বের করবো।
২০:৫৬
وَ لَقَدْ اَرَیْنٰهُ اٰیٰتِنَا كُلَّهَا فَكَذَّبَ وَ اَبٰى
আমি ফেরাউনকে আমার সমস্ত নিদর্শন দেখালাম কিন্তু সে মিথ্যা আরোপ করতে থাকলো এবং মেনে নিল না।
২০:৫৭
قَالَ اَجِئْتَنَا لِتُخْرِجَنَا مِنْ اَرْضِنَا بِسِحْرِكَ یٰمُوْسٰى
বলতে লাগলো, “হে মূসা! তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছো যে, নিজের যাদুর জোরে আমাদের দেশ থেকে আমাদের বের করে দেবে?
২০:৫৮
فَلَنَاْتِیَنَّكَ بِسِحْرٍ مِّثْلِهٖ فَاجْعَلْ بَیْنَنَا وَ بَیْنَكَ مَوْعِدًا لَّا نُخْلِفُهٗ نَحْنُ وَ لَاۤ اَنْتَ مَكَانًا سُوًى
বেশ, আমরাও তোমার মোকাবিলায় অনুরূপ যাদু আনছি, ঠিক করো কবে এবং কোথায় মোকাবিলা করবে, আমরাও এ চুক্তির অন্যথা করবো না, তুমিও না। খোলা ময়দানে সামনে এসে যাও।”
২০:৫৯
قَالَ مَوْعِدُكُمْ یَوْمُ الزِّیْنَةِ وَ اَنْ یُّحْشَرَ النَّاسُ ضُحًى
মূসা বললো, “উৎসবের দিন নির্ধারিত হলো এবং পূর্বাহ্নে লোকদেরকে জড়ো করা হবে।
২০:৬০
فَتَوَلّٰى فِرْعَوْنُ فَجَمَعَ كَیْدَهٗ ثُمَّ اَتٰى
ফেরাউন পেছনে ফিরে নিজের সমস্ত কলাকৌশল একত্র করলো এবং তারপর মোকাবিলায় এসে গেলো।
২০:৬১
قَالَ لَهُمْ مُّوْسٰى وَیْلَكُمْ لَا تَفْتَرُوْا عَلَى اللّٰهِ كَذِبًا فَیُسْحِتَكُمْ بِعَذَابٍ١ۚ وَ قَدْ خَابَ مَنِ افْتَرٰى
মূসা (যথা সময় প্রতিপক্ষ দলকে সম্বোধন করে) বললো, “দুর্ভাগ্যপীড়িতরা! আল্লাহর প্রতি অপবাদ দিয়ো না, অন্যথায় তিনি কঠিন আযাব দিয়ে তোমাদের ধ্বংস করে দেবেন। যে-ই মিথ্যা রটনা করেছে সে-ই ব্যর্থ হয়েছে।”
২০:৬২
فَتَنَازَعُوْۤا اَمْرَهُمْ بَیْنَهُمْ وَ اَسَرُّوا النَّجْوٰى
একথা শুনে তাদের মধ্যে মতবিরোধ হয়ে গেলো এবং তারা চুপিচুপি পরামর্শ করতে লাগলো।
২০:৬৩
قَالُوْۤا اِنْ هٰذٰىنِ لَسٰحِرٰنِ یُرِیْدٰنِ اَنْ یُّخْرِجٰكُمْ مِّنْ اَرْضِكُمْ بِسِحْرِهِمَا وَ یَذْهَبَا بِطَرِیْقَتِكُمُ الْمُثْلٰى
শেষ কিছু লোক বললো, “এরা দু’জন তো নিছক যাদুকর, নিজেদের যাদুর জোরে তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে উৎখাত করা এবং তোমাদের আদর্শ জীবন যাপন পদ্ধতি ধ্বংস করে দেয়াই এদের উদ্দেশ্য।
২০:৬৪
فَاَجْمِعُوْا كَیْدَكُمْ ثُمَّ ائْتُوْا صَفًّا١ۚ وَ قَدْ اَفْلَحَ الْیَوْمَ مَنِ اسْتَعْلٰى
আজ নিজেদের সমস্ত কলাকৌশল একত্র করে নাও এবং একজোট হয়ে ময়দানে এসো। ব্যস, জেনে রাখো, আজকে যে প্রাধান্য লাভ করবে সেই জিতে গেছে।”
২০:৬৫
قَالُوْا یٰمُوْسٰۤى اِمَّاۤ اَنْ تُلْقِیَ وَ اِمَّاۤ اَنْ نَّكُوْنَ اَوَّلَ مَنْ اَلْقٰى
যাদুকররা বললো, “হে মূসা! তুমি নিক্ষেপ করবে, নাকি আমরাই আগে নিক্ষেপ করবো?”
২০:৬৬
قَالَ بَلْ اَلْقُوْا١ۚ فَاِذَا حِبَالُهُمْ وَ عِصِیُّهُمْ یُخَیَّلُ اِلَیْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ اَنَّهَا تَسْعٰى
মূসা বললো, “না তোমরাই নিক্ষেপ করো।” অকস্মাৎ তাদের যাদুর প্রভাবে তাদের দড়িদড়া ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে বলে মূসার মনে হতে লাগলো
২০:৬৭
فَاَوْجَسَ فِیْ نَفْسِهٖ خِیْفَةً مُّوْسٰى
এবং মূসার মনে ভীতির সঞ্চার হলো।
২০:৬৮
قُلْنَا لَا تَخَفْ اِنَّكَ اَنْتَ الْاَعْلٰى
আমি বললাম, “ভয় পেয়ো না, তুমিই প্রাধান্য লাভ করবে।
২০:৬৯
وَ اَلْقِ مَا فِیْ یَمِیْنِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوْا١ؕ اِنَّمَا صَنَعُوْا كَیْدُ سٰحِرٍ١ؕ وَ لَا یُفْلِحُ السَّاحِرُ حَیْثُ اَتٰى
ছুঁড়ে দাও তোমার হাতে যা কিছু আছে, এখনি এদের সব বানোয়াট জিনিসগুলোকে গ্রাস করে ফেলবে, এরা যা কিছু বানিয়ে এনেছে এতো যাদুকরের প্রতারণা এবং যাদুকর যেভাবেই আসুক না কেন কখনো সফল হতে পারে না।”
২০:৭০
فَاُلْقِیَ السَّحَرَةُ سُجَّدًا قَالُوْۤا اٰمَنَّا بِرَبِّ هٰرُوْنَ وَ مُوْسٰى
শেষ পর্যন্ত এই হলো যে, সমস্ত যাদুকরকে সিজদাবনত করে দেয়া হলো এবং তারা বলে উঠলোঃ “আমরা মেনে নিলাম হারুন ও মূসার রবকে।”
২০:৭১
قَالَ اٰمَنْتُمْ لَهٗ قَبْلَ اَنْ اٰذَنَ لَكُمْ١ؕ اِنَّهٗ لَكَبِیْرُكُمُ الَّذِیْ عَلَّمَكُمُ السِّحْرَ١ۚ فَلَاُقَطِّعَنَّ اَیْدِیَكُمْ وَ اَرْجُلَكُمْ مِّنْ خِلَافٍ وَّ لَاُصَلِّبَنَّكُمْ فِیْ جُذُوْعِ النَّخْلِ١٘ وَ لَتَعْلَمُنَّ اَیُّنَاۤ اَشَدُّ عَذَابًا وَّ اَبْقٰى
ফেরাউন বললো, “তোমরা ঈমান আনলে, আমি তোমাদের অনুমতি দেবার আগেই? দেখছি, এ তোমাদের গুরু, এ-ই তোমাদের যাদুবিদ্যা শিখিয়েছিল। এখন আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কাটাচ্ছি এবং খেজুর গাছের কাণ্ডে তোমাদের শুলিবিদ্ধ করছি এরপর তোমরা জানতে পারবে আমাদের দু’জনের মধ্যে কার শাস্তি বেশী কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী।”
২০:৭২
قَالُوْا لَنْ نُّؤْثِرَكَ عَلٰى مَا جَآءَنَا مِنَ الْبَیِّنٰتِ وَ الَّذِیْ فَطَرَنَا فَاقْضِ مَاۤ اَنْتَ قَاضٍ١ؕ اِنَّمَا تَقْضِیْ هٰذِهِ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَاؕ
যাদুকররা জবাব দিল, “সেই সত্তার কসম! যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, উজ্জ্বল সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সামনে এসে যাওয়ার পরও আমরা (সত্যের ওপর) তোমাকে প্রাধান্য দেবো, এটা কখনো হতে পারে না। তুমি যা কিছু করতে চাও করো। তুমি বড়জোর এ দুনিয়ার জীবনের ফায়সালা করতে পারো।
২০:৭৩
اِنَّاۤ اٰمَنَّا بِرَبِّنَا لِیَغْفِرَ لَنَا خَطٰیٰنَا وَ مَاۤ اَكْرَهْتَنَا عَلَیْهِ مِنَ السِّحْرِ١ؕ وَ اللّٰهُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰى
আমরা তো তোমাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের ভুল ত্রুটিগুলো মাফ করে দেন এবং এ যাদু বৃত্তিকেও ক্ষমা করে দেন, যা করতে তুমি আমাদের বাধ্য করেছিলে। আল্লাহই শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই স্থায়িত্ব লাভকারী।”
৪৯–৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
(اِذْهَبْ أَنْتَ وَأَخُوْكَ)
অর্থাৎ দুনিয়াবী ও দীনি নেয়ামত দান করার পর আল্লাহ তা‘আলা মূসা ও হারূন (عليه السلام)-কে ফির‘আউনের কাছে তাঁর দিকে আহ্বান করার জন্য যেতে বললেন। সে সাথে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করা থেকে যেন শৈথিল্য না করা হয় সে পরামর্শ ও নির্দেশ দিলেন। কারণ এ বিশাল দায়িত্ব পালনে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ রাখলে মনে বল থাকবে এবং সাহস হারাবে না। সেই সাথে আরো বললেন: ফির‘আউনের সাথে ভদ্রতা ও নম্রতা বজায় রেখে কথা বলবে। কারণ যে ব্যক্তি যেমন পদমর্যাদার অধিকারী তাকে তেমন সম্মান দিয়ে কথা বললে কথা বলা ফলপ্রসূ হতে পারে। প্রথমেই যদি সম্মানে আঘাত হানা হয় তাহলে পরবর্তী কথা শুনবে না। যেমন আবূ সুফিয়ান মক্কার একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের দিন আবূ সুফিয়ানের সম্মান হানি না করে সম্মান বজায় রেখে বললেন, যে ব্যক্তি আবূ সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে সে নিরাপদ। অর্থাৎ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে দাওয়াতের পদ্ধতি ভিন্ন হবে।
তাই আল্লাহ তা‘আলার পথে দায়ীদের এখানে বড় শিক্ষা হল আপনি যার কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে যাচ্ছেন তিনি ফির‘আউনের চেয়ে খারাপ নন, আর আপানি মূসা (عليه السلام)-এর চেয়ে উত্তম নন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যদি মূসা (عليه السلام)-কে ফির‘আউনের কাছে নম্র-ভদ্রতার সাথে দাওয়াত দেয়ার নির্দেশ দিয়ে থাকেন তাহলে আপনার কতটুকু সতর্ক হওয়া উচিত।
নির্দেশ পেয়ে মূসা ও হারূন (عليه السلام) ফির‘আউনের কাছে যেতে লাগলেন, আর ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ একজন দেশের প্রধানের কাছে দেশের প্রচলিত বিধানের বিপরীত দাওয়াত দেয়া সহজ কথা নয়! তাছাড়া মূসা (عليه السلام) পূর্বে একটি অপরাধ করেছেন কিবতীকে হত্যা করে। সে বিষয় তো ফির‘আউনের স্মরণ আছে। সব মিলিয়ে ভয় পেলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বললেন: তোমরা ভয় কর না, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি শুনছি ও দেখছি। সুতরাং তোমরা তার নিকট যাও এবং বল: অবশ্যই আমরা তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল, সুতরাং আমাদের সাথে বাণী ইসরাঈলকে যেতে দাও। আর তাদেরকে কষ্ট দিও না। আমরা তো তোমার নিকট এসেছি তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে নিদর্শন ও শান্তির বিধান নিয়ে তাদের প্রতি যারা সৎ পথের অনুসরণ করে।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَأْتِيَا فِرْعَوْنَ فَقُوْلَآ إِنَّا رَسُوْلُ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ لا أَنْ أَرْسِلْ مَعَنَا بَنِيْٓ إِسْرَآئِيْلَ )
“অতএব তোমরা উভয়ে ফির‘আউনের নিকট যাও এবং বল: ‘আমরা জগতসমূহের প্রতিপালকের প্রেরিত রাসূল, ‘আমাদের সাথে যেতে দাও বানী ইসরাঈলকে।’’ (সূরা শু‘আরা ২৬:১৬-১৭)
(إِنَّنِيْ مَعَكُمَا)
আল্লাহ তা‘আলা তাদের সাথে রয়েছেন, কিভাবে রয়েছেন তা পরের দুটি শব্দ ব্যক্ত করে দিয়েছে, অর্থাৎ তিনি শ্রবণ ও দর্শন দিয়ে সাথে রয়েছেন।
(إِنَّا قَدْ أُوْحِيَ إِلَيْنَا)
অর্থাৎ আমাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ওপর মিথ্যা আরোপ করবে ও আমাদের দাওয়াত থেকে বিমুখ হবে তার ওপর শাস্তি নেমে আসবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَأَنْذَرْتُكُمْ نَارًا تَلَظّٰي ج لَا يَصْلٰهَآ إِلَّا الْأَشْقَي لا الَّذِيْ كَذَّبَ وَتَوَلّٰي )
“অতএব, আমি তোমাদেরকে প্রজ্জ্বলিত অগ্নি সম্পর্কে সতর্ক করেছি। এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা লাইল ৯২:১৬)
তখন ফির‘আউন বলল: হে মূসা! তোমাদের প্রতিপালক কে? কারণ রবের একটি অর্র্থ হল লালন-পালন করা, ফির‘আউন মূসাকে লালন-পালন করেছে, সে অর্থে সেই হল মূসার রব। সে জন্য সে আশ্চর্য হয়ে এ কথা বলছে। তাছাড়া সে নিজেই তো বড় রব বলে দাবী করত। (সূরা নাযিআত ৭৯:২৪)
তার উত্তরে মূসা (عليه السلام) বললেন: আমার প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথনির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ যে মাখলুককে যে জন্য সৃষ্টি করেছেন তাকে সে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। ফির‘আউন বলল: তাহলে অতীতের লোক যারা আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্যের ইবাদত করত তাদের অবস্থা কী হবে? মূসা বললেন: এর জ্ঞান আমার প্রতিপালকের নিকট লিপিবদ্ধ আছে: তিনি ভুল করেন না এবং বিস্মৃতও হন না। অর্থাৎ তাদের ভাল-মন্দ আমল লাওহে মাহফূজে লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। তাঁর জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন। সুতরাং তা হারিয়ে যাবে না এবং তিনি ভুলেও যাবেন না।
অতঃপর মূসা (عليه السلام) আরো বর্ণনা করে দিচ্ছেন, আমি সে আল্লাহ তা‘আলার দিকে দাওয়াত দিচ্ছি যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন বিছানা এবং তাতে করে দিয়েছেন তোমাদের জন্য চলাচলের পথ। তিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করেন আর আমরা তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন। যা তোমরা আহার কর। তোমাদের গবাদি পশু চরাও।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
ھُوَ الَّذِیْٓ اَنْزَلَ مِنَ السَّمَا۬ئِ مَا۬ئً لَّکُمْ مِّنْھُ شَرَابٌ وَّمِنْھُ شَجَرٌ فِیْھِ تُسِیْمُوْنَﭙیُنْۭبِتُ لَکُمْ بِھِ الزَّرْعَ وَالزَّیْتُوْنَ وَالنَّخِیْلَ وَالْاَعْنَابَ وَمِنْ کُلِّ الثَّمَرٰتِﺚ اِنَّ فِیْ ذٰلِکَ لَاٰیَةً لِّقَوْمٍ یَّتَفَکَّرُوْنَ
“তিনিই আকাশ হতে বারি বর্ষণ করেন। তাতে তোমাদের জন্য রয়েছে পানীয় এবং তা হতে জন্মায় উদ্ভিদ যাতে তোমরা পশু চারণ করে থাকো। তিনি তোমাদের জন্য সেটার দ্বারা জন্মান শস্য, যায়তুন, খেজুর বৃক্ষ, আঙ্গুর এবং সর্বপ্রকার ফল। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।” (সূরা নাহল ১৬:১০-১১)
نُهيِ শব্দটি نهية এর বহুবচন অর্থ হল বিবেক, জ্ঞান। اولوا النهي অর্থ বিবেকবান, জ্ঞানী ব্যক্তি।
(تَارَةً أُخْرٰي)
অর্থাৎ পুনরুত্থানের জন্য আবার কবর থেকে উঠানো হবে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে মৃত ব্যক্তিকে কবরে রাখাকালীন তিন মুষ্ঠি মাটি দেয়ার সময় এ আয়াত পাঠ করতে হয়। এ বর্ণনা দুর্বল, তবে তিনবার মাটি দেয়ার বর্ণনা সহীহ সূত্রে ইবনু মাযাতে বর্ণিত হয়েছে। সে জন্য দাফনের সময় দু’হাত দিয়ে কবরে তিনবার মাটি দেয়া মুস্তাহাব বলা হয়। (আহকামুল জানাইয লিল আলবানী ১৫২ পৃ: ইরওয়াউল গালীল ৩/২০০)
ফির‘আউনকে এ সমস্ত নিদর্শন দেখানোর পরেও সে মিথ্যা আরোপ করেছিল এবং অমান্য করেছিল। এমনকি সে আনুগত্য করার পরিবর্তে আরো বলল যে, তুমি কি তোমার জাদু দ্বারা আমাদেরকে দেশ হতে বহিস্কার করার জন্য এসেছ? যেমন ফির‘আউন বলল:
(قَالَ الْمَلَأُ مِنْ قَوْمِ فِرْعَوْنَ إِنَّ هٰذَا لَسٰحِرٌ عَلِيْمٌ لا يُّرِيْدُ أَنْ يُّخْرِجَكُمْ مِّنْ أَرْضِكُمْ ج فَمَاذَا تَأْمُرُوْنَ)
“ফির‘আউন সম্প্রদায়ের প্রধানগণ বলল: ‘এ তো একজন সুদক্ষ জাদুকর, ‘এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে বহিষ্কার করতে চায়, এখন তোমরা কী পরামর্শ দাও?’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১০৯-১১০)
ফির‘আউন মূসা (عليه السلام)-এর এ সকল বিষয় জাদু মনে করে তার মোকাবিলা করার জন্য বলল: আমিও তোমার মত জাদু নিয়ে আসছি।
(فَاجْعَلْ بَيْنَنَا وَبَيْنَكَ مَوْعِدًا)
অর্থাৎ এমন একটা সময় নির্ধারণ কর এবং একটি (مَكَانًا سُوًي) তথা সমতল খোলা জায়গা নির্ধারণ কর, যাতে সকলে উপস্থিত হতে পারে এবং দেখতে পারে। যেমন সূরা শুআরার ৩৮-৪০ নং আয়াতে বলা আছে। মূসা (عليه السلام) বললেন: তোমাদেরকে ঈদের দিনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যেদিন তোমরা সাজ-গোজ করে থাক। আর সময় হল দ্বিপ্রহরের সময়। ফির‘আউন প্রতিশ্রুতির সময় নিয়ে চলে গেল এবং তার সকল চক্রান্ত তথা জাদুকরদের একত্রিত করে নিয়ে আসল। সূরা আ‘রাফের ১১১-১১২ নং আয়াতে এ সম্পর্কে আলোচনা আছে। জাদুকররা রাজ দরবারে উপস্থিত হলে ফির‘আউন তাদেরকে আশ্বাস দিল এবং জাদুকরদের দাবী অনুপাতে পুরস্কার ও নৈকট্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল। মূসা (عليه السلام) শুরুতেই জাদুকরদের লক্ষ্য করে বললেন: তোমরা সত্য বলবে, তোমরা তোমাদের জাদুর ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি মিথ্যা আরোপ কর না। যদি মিথ্যারোপ কর তাহলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।
(فَتَنَازَعُوْآ أَمْرَهُمْ)
অর্থাৎ মূসা (عليه السلام)-এর কথা শুনে জাদুকরদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি হল। কেউ বলল, সে যদি সত্য নাবী হয় তাহলে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাব, কেউ বিপরীত মত পোষণ করল।
الْمُثْلٰي শব্দটির অর্থ উৎকৃষ্ট, অর্থাৎ তোমরা যে উৎকৃষ্ট জাদুবিদ্যা নিয়ে আছো তা তারা নস্যাৎ করে দিতে চায়, সুতরাং তোমরা দৃঢ়ভাবে কাজ কর, কোন মতভেদ করো না। কারণ তারা বিজয়ী হয়ে গেলে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে।
(بَلْ أَلْقُوْا) মূসা (عليه السلام) প্রথমে তাদেরকে নিক্ষেপ করতে বললেন এজন্য যে, যাতে এটা সকলের নিকট পরিস্কার হয়ে যায় যে, দেশের শীর্ষস্থানীয় জাদুকররাও মূসা (عليه السلام)-এর কাছে হেরে গেছে। তাছাড়া জাদুকররাও বুঝতে পারবে যে, মূসা (عليه السلام) যা নিয়ে এসেছে তা জাদু নয় বরং সে একজন সত্য নাবী এবং তার সাথে যা আছে তা মু‘জিযাহ।
(حِبَالُهُمْ وَعِصِيُّهُمْ)
জাদুকরদের লাঠি ও রশিগুলো কি সত্যি সাপ হয়েছিল না বাহ্যতঃ সাপ বানিয়ে দেখিয়েছিল। অত্র আয়াত বলছে:
(يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعٰي)
“তাদের জাদু-প্রভাবে মূসার মনে হল তাদের দড়ি ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে।” অর্থাৎ সত্য সাপ হয়ে যায়নি। বরং জাদুকররা এক প্রকার মেসমেরিজমের মাধ্যমে দর্শকদের কল্পনাশক্তিকে ক্রিয়াশীল করে দৃষ্টি বিভ্রাট ঘটিয়ে দিয়েছিল। ফলে এগুলো দর্শকদের কাছে ছুটাছুটিরত সাপ মনে হচ্ছিল।
(فَأَوْجَسَ فِيْ نَفْسِه۪ خِيْفَةً مُّوْسٰي)
অর্থাৎ মূসা (عليه السلام) তাদের জাদু দেখে স্বভাবত ভয় পেয়ে গেলেন। যা স্বাভাবিকভাবে মানুষের হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা মূসা (عليه السلام)-কে ভয় করতে নিষেধ করলেন ও নিজের হাতের লাঠি ছাড়তে বললেন, ফলে মূসা (عليه السلام)-এর লাঠি সাপে পরিণত হল আর তা তাদের পক্ষ থেকে যাদুর প্রভাবে যা সাপ হিসেবে দেখা যাচ্ছিল তার সবকেই খেয়ে ফেলল।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(فَأَلْقٰي مُوْسٰي عَصَاهُ فَإِذَا هِيَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُوْنَ)
“অতঃপর মূসা তার লাঠি নিক্ষেপ করল, সহসা তা তাদের অলীক সৃষ্টিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল।” (সূরা শু‘আরা ২৬:৪৫)
যখন তারা মূসা (عليه السلام) ও আল্লাহর এ সমস্ত নিদর্শনাবলী দেখতে পেল তখন তারা বুঝতে পারল যে, এটা জাদু নয়, বরং এটা বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহ প্রদত্ত মু‘জিযা। তখন তারা সাথে সাথে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলল যে, আমরা মূসা ও হারূনের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম। তখন ফির‘আউন তাদের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বলল যে, আমি তোমাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা ঈমান নিয়ে আসলে। সুতরাং শাস্তিস্বরূপ আমি তোমাদের বিপরীত দিক থেকে অর্থাৎ একপার্শ্বের হাত আর অন্যপার্শ্বের পা কেটে ফেলব। আর অবশ্যই তোমাদেরকে খেজুর বৃক্ষের কাণ্ডে শূলবিদ্ধ করব।
যেমন ফির‘আউন বলেছিল:
(ققَالَ اٰمَنْتُمْ لَھ۫ قَبْلَ اَنْ اٰذَنَ لَکُمْﺆ اِنَّھ۫ لَکَبِیْرُکُمُ الَّذِیْ عَلَّمَکُمُ السِّحْرَﺆ فَلَسَوْفَ تَعْلَمُوْنَﹽ لَاُقَطِّعَنَّ اَیْدِیَکُمْ وَاَرْجُلَکُمْ مِّنْ خِلَافٍ وَّلَاُصَلِّبَنَّکُمْ اَجْمَعِیْنَ)
“ফির‘আউন বলল: ‘আমি তাদেরকে অনুমতি দেয়ার পূর্বেই তোমরা তাতে ঈমান আনলে? সে তোমাদের প্রধান যে তোমাদেরকে জাদু শিখিয়েছে। শীঘ্রই তোমরা এর পরিণাম জানবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত এবং তোমাদের পা বিপরীত দিক হতে কর্তন করব এবং তোমাদের সকলকে শূলবিদ্ধ করবই।’’ (সূরা শু‘আরা ২৬:৪৯)
এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ১২৩-১২৪ নং আয়াতেও আলোচনা রয়েছে।
তখন জাদুকররা বলল: আমাদের নিকট যে স্পষ্ট বিধান এসেছে তার ওপর ও আমাদের রবের ওপর আমরা কখনো তোমাকে প্রাধান্য দেব না। সুতরাং তুমি তোমার ইচ্ছা মত যে শাস্তি দেয়ার দিতে থাক। আমরা আমাদের রবের প্রতি ঈমান আনলাম যাতে তিনি আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেন। যেমন তাদের উক্তি:
(قَالُوْا لَا ضَيْرَ ز إِنَّآ إِلٰي رَبِّنَا مُنْقَلِبُوْنَ)
“তারা বলল: ‘কোন ক্ষতি নেই, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করব।” (সূরা শু‘আরা ২৬:৫০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(قَالُوْآ إِنَّآ إِلٰي رَبِّنَا مُنْقلِبُوْنَ ج وَمَا تَنْقِمُ مِنَّآ إِلَّآ أَنْ اٰمَنَّا بِاٰيٰتِ رَبِّنَا لَمَّا جَا۬ءَتْنَا ط رَبَّنَآ أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَّتَوَفَّنَا مُسْلِمِيْنَ )
“তারা বলল: ‘আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব। ‘তুমি তো আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছো শুধু এজন্য যে, আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনে ঈমান এনেছি যখন সেটা আমাদের নিকট এসেছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্য দান কর এবং মুসলমানরূপে আমাদেরকে মৃত্যু দাও।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১২৫-১২৬)
কেননা যারা অপরাধী হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে তারা তো তথায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আর তারা তথায় মরবেও না আবার বাঁচবেও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ ج لَا يُقْضٰي عَلَيْهِمْ فَيَمُوْتُوْا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمْ مِّنْ عَذَابِهَا ط كَذٰلِكَ نَجْزِيْ كُلَّ كَفُوْرٍ ج )
“আর যারা কুফরী করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাদেরকে মৃত্যুর আদেশও দেয়া হবে না যে, তারা মরে যাবে এবং তাদের থেকে জাহান্নামের আযাবও হালকা করা হবে না। আমি এরূপই শাস্তি দিয়ে থাকি প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে।” (সূরা ফাতির ৩৫:৩৬)
পক্ষান্তরে যারা সৎ কাজ করবে ও ঈমান নিয়ে আসবে আর এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে তাদের জন্য থাকবে উচ্চ মর্যাদা। আর তারা তথায় এমন জান্নাতে প্রবেশ করবে যা চিরস্থায়ী এবং যার নিচে দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنّٰتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا لا خٰلِدِيْنَ فِيْهَا لَا يَبْغُوْنَ عَنْهَا حِوَلًا )
“নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে তাদের আপ্যায়নের জন্য আছে ফিরদাউসের উদ্যান, সেথায় তারা স্থায়ী হবে, তা হতে স্থানান্তর কামনা করবে না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮:১০৭-১০৮)
সুতরাং মানুষের অন্তরে যখন ঈমান প্রবেশ করে তখন যে কোন কিছু প্রতিহত করতে পারে, সেটা যত বড় হুমকি বা শাস্তিই হোক। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফির‘আউনের জাদুকর বাহিনী। তারা সত্য উপলদ্ধি করার পর ঈমান আনতে বিলম্ব করেনি এমনকি মর্মন্তুদ শাস্তিও তাদেরকে ঈমান থেকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
ফির‘আউন এ সকল মু’জিযাহ দেখার পরেও ঈমান আনতে অস্বীকার করল, বরং তার কুফরী আরো বেড়ে গেল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَجَحَدُوْا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَآ أَنْفُسُهُمْ ظُلْمًا وَّعُلُوًّا ط فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِيْنَ ع)
“তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলোকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল। দেখ, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কেমন হয়েছিল।” (সূরা নামল ২৭:১৪)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
# যাদের মাঝে ঈমানের স্বাদ প্রবেশ করেছে তাদেরকে শত বাধা ও শাস্তি ঈমান থেকে ফেরাতে পারে না।
#আল্লাহ তা‘আলা সকল প্রকার ভুল-ত্র“টি থেকে মুক্ত।
#জাদু বিদ্যা কখনো সফলতা লাভ করতে পারে না।
# জাদু বিদ্যা সম্পূর্ণ হারাম।
# ঈমান আনার পর আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে পরীক্ষা করেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৪৯-৫২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারকারী ফিরাউন হযরত মূসার (আঃ) মুখে আল্লাহ্ব পয়গাম শুনে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করন হিসেবে তাঁকে প্রশ্ন করেঃ “তোমাকে প্রেরণকারী ও তোমার প্রতিপালক কে? আমি তো তাকে জানি না, বুঝি না এবং মানি না। বরং আমার জ্ঞানে তো তোমাদের সবারই প্রতিপালক আমি ছাড়া আর কেউ নয়। তার এ কথার জবাবে আল্লাহর রাসূল হযরত মূসা (আঃ) তাকে বলেনঃ “আমার প্রতিপালক তিনিই যিনি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জোড়া দান করেছেন। যিনি মানুষকে মানুষের আকারে, গাধাকে গাধার আকারে, বকরীকে বকরীর আকারে, এভাবে প্রত্যেক প্রাণীকে পৃথক পৃথক আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন ।প্রত্যেককেওর বিশিষ্ট আকার দান করেছেন। প্রত্যেকের সৃষ্টি পৃথক গুণ বিশিষ্টরূপে সৃষ্টি করেছেন। মানব সৃষ্টির পন্থা আলাদা, চতুষ্পদ জন্তুর সৃষ্টির নিয়ম পৃথক এবং হিংস্র জন্তুর গঠন রীতি পৃথক। প্রত্যেকের জোড়ার গঠন-কৌশল স্বতন্ত্র। খাদ্য ও পানীয় এবং পানাহারের জিনিসগুলি সব পৃথক পৃথক। সবকিছুর পরিমাণ নির্ধারণ করে গঠনরীতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। আমল, আযল এবং রিযক নির্ধারণ করে তারই উপর লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্ত মাখলুকের কারখানা সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কেউই এগুলোকে এধার ওধার করতে পারে না। সৃষ্টির স্রষ্টা, তকদীর, নির্ধারণকারী এবং ইচ্ছামত সৃষ্টজীব সৃষ্টিকারীই হলেন আমার প্রতিপালক।” এ সব শুনে ঐ নির্বোধ আবার প্রশ্ন করলোঃ “আচ্ছা, যারা আমাদের পূর্বে গত হয়েছে এবং আল্লাহর ইবাদত অস্বীকার করেছে তাদের অবস্থা কি?” এই প্রশ্নটি সে খুব গুরুত্বের সাথে করলো। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) এমনভাবে এর উত্তর দিলেন যে, সে হতবাক হয়ে গেল। তিনি বললেনঃ “তাদের সবারই জ্ঞান আমার প্রতিপালকের রয়েছে। তিনি লাওহে মাহফুজে তাদের আমল সমূহ লিখে রেখেছেন। পুরস্কার প্রদান ও শাস্তি দেয়ার দিন নির্ধারিত রয়েছে। তিনি ভুল করবেন না এবং ছোট বড় কেউই তার পাকড়াও হতে ছুটতে পারবে না। এমন নয় যে, ভুলে কোন অপরাধী তার শাস্তি হতে মুক্তি পেয়ে যাবে। তার জ্ঞান সবকিছুকেই পরিবেষ্টন করে রয়েছে। তাঁর পবিত্র সত্ত্বা ভুল ভ্রান্তি হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। কোন কিছুই তাঁর জ্ঞান বহির্ভূত নয়। জানার পরে ভুলে যাওয়া তাঁর বিশেষণ নয়। তিনি জ্ঞানের স্বল্পতা ও ভুলে যাওয়ার ক্রটি হতে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র।
৫৩-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউনের প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ তাআলার গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে আরো বলেনঃ ঐ আল্লাহই যমীনকে লোকদের জন্যে বিছানা বানিয়েছেন। (আরবী) শব্দটি অন্য কিরআতে (আরবী) ও রয়েছে ।
মহান আল্লাহ যমীনকে বিছানারূপে বানিয়ে দিয়েছেন, যেন তোমরা তার উপর স্থির থাকতে পারো এবং ওরই উপর শুইতে, বসতে ও চলা ফেরা করতে পারো। তিনি যমীনে তোমাদের চলা ফেরা ও সফর করার জন্যে পথ বানিয়ে দিয়েছেন, যাতে তোমরা পথ ভুলে না যাও এবং সহজেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারো। তিনিই আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করে থাকেন এবং এর মাধ্যমে যমীন হতে বিভিন্ন প্রকারের ফসল উৎপন্ন করেন। তোমরা তা নিজেরা খেয়ে থাকো এবং তোমাদের গবাদি পশু গুলিকেও আহার করিয়ে থাকো। তোমাদের খাদ্য, ফল-ফলাদি এবং তোমাদের জীব জন্তুর চারা-ভূষি শুষ্ক ও সিক্ত সবকিছুই এই বৃষ্টির মাধ্যমেই আল্লাহ তাআলা উৎপন্ন করে থাকেন। এই সব নিদর্শন দলীল হচ্ছে আল্লাহর আল্লাহ হওয়ার এবং তার একত্ব ও অস্তিত্বের উপর।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তোমাদেরকে মাটি হতে সৃষ্টি করেছি। এর থেকেই তোমাদের সূচনা। কেননা, তোমাদের পিতা আদমের (আঃ) সৃষ্টি এই মাটি থেকেই। এর মধ্যেই তোমাদেরকে আবার ফিরে যেতে হবে। মৃত্যুর পর তোমাদেরকে এর মধ্যেই দাফন করা হবে। অতঃপর আমি এটা হতেই পুনর্বার তোমাদেরকে বের করবো। আমার আহবানে সাড়া দিয়ে আমার প্রশংসা করতে করতে তোমরা উঠবে এবং বিশ্বাস করে নিবে যে, তোমরা খুব অল্প দিনই দুনিয়ায় অবস্থান করেছে। অন্য আয়াতে আছেঃ “এই যমীনেই তোমাদের জীবন অতিবাহিত হবে, মৃত্যুর পরেও তোমরা এর মধ্যেই যাবে এবং এর মধ্য হতেই তোমরা পুনরুত্থিত হবে।” সূনানের হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক মৃত ব্যক্তির দাফনের পরে তার কবরে মাটি দেয়ার সময় প্রথমবার (আরবী) বলেন, দ্বিতীয় বার (আরবী) বলেনঃ এবং তৃতীয়বার (আরবী) বলেন।
মোট কথা, ফিরাউনের সামনে সমস্ত দলীল প্রমাণ এসে যায়। সে মু’জিযা ও নিদর্শনসমূহ স্বচক্ষে দেখে নেয় কিন্তু সবকিছুই সে অস্বীকার করে। এবং মিথ্যা প্রতিপন্ন করতেই থাকে। সে কুফরী, ঔদ্ধত্যপনা, হঠকারিতা, এবং অহংকার হতে বিরত থাকে নাই। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ তাদের অন্তর ওটা বিশ্বাস করে নেয়া সত্ত্বেও তারা যুলুম, বাড়াবাড়ি ও অস্বীকার করা হতে বিরত থাকলো না।” (২৭:১৪)
৫৭-৫৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা বলেন যে, হযরত মূসার (আঃ) লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া এবং হাত উজ্জ্বল হওয়া ইত্যাদি মু’জিযা দেখে ফিরাউন তাকে বললোঃ “এটা তো যাদু ছাড়া কিছুই নয়। তুমি যাদুর জোরে আমাদের রাজ্য ছিনিয়ে নিতে চাও। তুমি অহংকার করো না। আমরাও এই যাদূতে তোমার মুকাবিলা করতে পারি। দিন ও জায়গা নির্ধারণ করা হোক এবং মুকাবিলা হোক। আমরাও ঐ দিনে ঐ জায়গায় যাবো এবং তুমিও যাবে। কেউ আসবে না। এটা যেন না হয়। খোলা মাঠে সবারই সামনে হার-জিত হবে।” হযরত মূসা (আঃ) তার এ কথার জবাবে বললেনঃ “আমি এটা মেনে নিলাম। আমার মতে এর জন্যে তোমাদের ঈদের দিনটিই নির্ধারিত হওয়া উচিত। কেননা, এটা অবকাশের দিন। সেই দিন সবাই একত্রিত হতে পারবে। সুতরাং তারা দেখে শুনে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য দেখতে সক্ষম হবে। মুজিযা ও যাদু পার্থক্য সবারই উপর প্রকাশিত হয়ে পড়বে। সময়টা হতে হবে বেলা ওঠার সময়, যাতে যা কিছু ময়দানে আসবে সবাই তা দেখতে পায়।” হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, তাদের ঐ ঈদ বা খুশীর দিনটি আশুরার দিন (১০ই মুহররম)। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এরূপ স্থলে নবীরা (আঃ) কখনো পিছনে সরে যান না। তারা এমন কাজ করেন যাতে সত্য পরিস্ফুট হয়ে ওঠে এবং সবারই উপর তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এজন্যেই তিনি প্রতিযোগিতার জন্যে তাদের ঈদের দিনটি ধার্য করেন। আর সময় নির্ধারিত করলেন বেলা ওঠার সময় এবং জায়গারূপে সমতল ভূমিকে নির্ধারণ করলেন যাতে সবাই দেখতে পায়। ফিরাউন অবকাশ চাইলো। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) অবকাশ দিতে অস্বীকার করলেন। তখন তার উপর ওয়াহী করা হলোঃ “সময় নির্ধারণ করে নাও।” ফিরাউন চল্লিশ দিনের অবকাশ চাইলো। তা মঞ্জুর করা হলো।
৬০-৬৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, যখন ফিরাউনের সঙ্গে হযরত মূসার (আঃ) মুকাবিলার দিন, সময় ও স্থান নির্ধারিত হয়ে গেল তখন ফিরাউন এদিক ওদিক থেকে যাদুকরদেরকে এনে একত্রিত করতে শুরু করলো। ঐ যুগে যাদুকরদের খুবই শক্তি ও প্রভাব ছিল এবং বড় বড় যাদুকর বিদ্যমান ছিল। ফিরাউন সাধারণ ভাবে নির্দেশ জারী করে দিয়েছিল যে, সমস্ত জ্ঞানী অভিজ্ঞ যাদুকরদেরকে যেন তার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সময় মত সমস্ত যাদুকর। একত্রিত হয়ে যায়। ফিরাউন ঐ মাঠেই তার সিংহাসনটি বের করে আনে এবং ওর উপর উপবেশন করে। সভাষদ ও মন্ত্রীবর্গ নিজ নিজ জায়গায় বসে পড়ে। জনসাধারণও একত্রিত হয়। যাদুকরর সিংহাসনের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে যায়। ফিরাউন তাদেরকে উত্তেজিত করতে শুরু করে এবং বলেঃ “দেখো, আজ তোমাদেরকে এমন কলা-কৌশল প্রদর্শন করতে হবে যাতে তা। দুনিয়ায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকে।” যাদুকররা বললোঃ “যদি আমরা জয়যুক্ত হই তবে পুরস্কৃত হবো তো?” সে উত্তরে বলেঃ “ কেন হবে না? আমি তো তোমাদেরকে আমার দরবারের বিশিষ্ট লোক বানিয়ে নেবো।”
আর এদিকে হযরত মূসা (আঃ) তাদের কাছে তাবলীগের কাজ শুরু করে দেন। তিনি তাদেরকে বলেনঃ “দেখো, তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করো না, অন্যথায় তিনি তোমাদেরকে শাস্তি দ্বারা সমূলে ধ্বংস করে দিবেন। তোমরা মানুষের চোখে ধূলো দিয়ো না যে, আসলে কিছুই নয় অথচ যদুর মাধ্যমে তোমরা অনেক কিছু দেখবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ সৃষ্টিকর্তা নেই যে বাস্তবে কিছু সষ্টি করতে পারে। জেনে রেখো যে মিথ্যা উদ্ভাবনকারীরা কখনো সফলকাম হতে পারে না।” হযরত মূসার (আঃ) এ কথা শুনে তাদের মধ্যে তাদের কর্ম সম্বন্ধে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ বুঝে নেয় যে, এটা যাদুকরদের কথা নয়। সত সত্যই ইনি আল্লাহর রাসুল (আঃ)। আবার অন্যেরা বললো যে, তিনি যাদুকরই বটে। সুতরাং তার সাথে মুকাবিলা করতেই হবে। এসব আলাপ আলোচনা তারা অত্যন্ত সতর্কতা ও গোপনীয়তার সাথে করলো।
(আরবী) এর দ্বিতীয় পঠন (আরবী) ও রয়েছে। দু’টোর ভাবার্থ একই। অতঃপর তারা সশব্দে বললোঃ “এই দু’জন অবশ্যই যাদুকর। তারা তাদের যাদু দ্বারা তোমাদেরকে তোমাদের দেশ হতে বহিষ্কৃত করতে এবং তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবনব্যবস্থার অস্তিত্ব নাশ করতে চায়। যদি তারা আজ জয়যুক্ত হয়ে যায় তবে স্পষ্ট কথা যে, শাসন ক্ষমতা তাদের হাতেই চলে যাবে। তারা। তোমাদের হাত থেকে রাজত্ব কেড়ে নেবে এবং সাথে সাথে তোমাদের ধর্মও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রাজত্ব আরাম-আয়েশ সবকিছুই তারা ছিনিয়ে নেবে। তোমাদের মান মর্যাদা, জ্ঞান-বিবেক, রাজত্ব ইত্যাদি সবকিছুই তাদের অধিকারভুক্ত হয়ে যাবে। তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকেরা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে, বাদশাহ ফকীর হয়ে যাবে, তোমাদের জাকজমক ও শান শওকত বিনষ্ট হবে এবং এই সব কিছুই বানী ইসরাঈলের দখলে চলে যাবে যারা আজ তোমাদের দাস-দাসীরূপে জীবন যাপন করছে। অতএব, তোমরা তোমাদের যাদু ক্রিয়া সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধ হয়ে হাজির হয়ে যাও। জেনে রেখো যে, যে আজ বিজয় লাভ করবে সেই হবে প্রকৃত পক্ষে সফলকাম। আজ যদি আমরা জয়যুক্ত হই তবে বাদশাহ আমাদেরকে তার দরবারের বিশিষ্ট লোক বানিয়ে নিবেন।”
৬৫-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:
যাদুকররা হযরত মূসাকে (আঃ) বললোঃ হে মূসা (আঃ)! তুমি কি প্রথমে তোমার যাদুর ক্রিয়াকলাপ দেখাবে, না আমরাই প্রথমে দেখাবো?” উত্তরে হযরত মূসা (আঃ) বললেনঃ “তোমরাই প্রথমে দেখাও যাতে দুনিয়াবাসী দেখে নেয় যে, তোমরা কি করলে? অতঃপর আল্লাহ তাআলা তোমাদের কীর্তিকলাপকে কিরূপে মিটিয়ে দেন।” তখন যাদুকররা তাদের লাঠিগুলি ও রশিগুলি মাঠে নিক্ষেপ করলো। মনে হলো যেন ওগুলি সাপ হয়ে গিয়ে চলতে ফিরতে রয়েছে এবং ময়দানে দৌড়াতে শুরু করেছে। যাদুকররা বলতে লাগলোঃ “ফিরাউনের ভাগ্যগুণে আমরাই জয়যুক্ত হবো।” জনগণের চোখে যাদু করে তারা তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে দিলো এবং যাদুর চরম ভেল্কী প্রদর্শন করলো। তারা সংখ্যায়ও ছিল অনেক। তাদের নিক্ষিপ্ত রশি ও লাঠির মাধ্যমে সারা মাঠ সাপে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে হযরত মূসা (আঃ) আতংকিত হয়ে উঠলেন যে, না জানি হয়তো জনগণ তাদের কলাকৌশল ও নৈপুণ্য দেখে তাদেরই দিকে ঝুঁকে পড়বে এবং মিথ্যার ফাঁদে আবদ্ধ হয়ে যাবে। তৎক্ষণাৎ মহান আল্লাহ তাঁর কাছে ওয়াহী পাঠালেনঃ “হে মূসা (আঃ)! তোমার লাঠিখানা তুমি ময়দানে নিক্ষেপ করো এবং মোটেই ভয় করো না।” তিনি হুকুম পালন করলেন। মহামহিমান্বিত আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে ঐ লাঠিটি এক বিরাট অজগর সাপে রূপান্তরিত হলো। সাপটির পা, মাথা এবং দাতও ছিল। সে সবারই চোখের সামনে সারা ময়দান সাফ করে দিলো। মাঠে যাদুকরদের যাদুর যতগুলি সাপ ছিল সবকে গ্রাস করে ফেললো। এখন সবারই কাছে সত্য উদঘাটিত হয়ে গেল এবং তারা মুজিযা ও যাদুর পার্থক্য বুঝে নিলো এবং হক ও বাতিলের পরিচয় পেয়ে গেল। সবাই জানতে পারলো যে, যাদুকরদের সবকিছুই কৃত্রিম এবং তাতে বাস্তবতা কিছুই নেই। সুতরাং তারা যে পরাজিত হবে এতে বিস্ময়ের কিছুই নেই।
হযরত জুনদুব ইবনু আবদিল্লাহ আল বাজালী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যাদুকরদেরকে যেখানেই পাও মেরে ফেলো।” অতঃপর তিনি এই বাক্যটি পাঠ করেন। (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেন) অর্থাৎ তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে নিরাপত্তা দান করা হবে না।
যাদুকররা যখন এটা দেখলো তখন তাদের দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেল যে, এ কাজ মানবীয় শক্তির বাইরে। তারা ছিল যাদু বিদ্যায় পারদর্শী। প্রথম দর্শনেই তারা বুঝে নেয় যে, প্রকৃতপক্ষে এটা ঐ আল্লাহরই কাজ যার ফরমান অটল। তিনি যা কিছু চান তা তাঁর নির্দেশক্রমে হয়ে যায়। তাদের বিশ্বাস এতো দৃঢ় হয় যে, তৎক্ষণাৎ ঐ ময়দানেই সবারই সামনে বাদশাহর বিদ্যমানতায় তারা আল্লাহর সামনে সিজদায় পড়ে যায় এবং বলে ওঠেঃ “আমরা হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত হারূণের (আঃ) প্রতিপালকের উপর ঈমান আনলাম। তিনিই হলেন বিশ্বপ্রতিপালক।” সুবহানাল্লাহ! সকালে যারা ছিল কাফির ও যাদুকর, সন্ধ্যায় তারা হয়ে গেল মু’মিন ও আল্লাহর পথের শহীদ! বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল সংখ্যায় আশি হাজার। এটা মুহাম্মদ ইবনু কাবের (রাঃ) উক্তি। কাসিম ইবনু আবি বুয্যা (রাঃ) বলেন যে, তারা সংখ্যায় সত্তর হাজারের কিছু বেশী ছিল। সাওরী (রঃ) বলেন যে, ফিরাউনের যাদুকরদের সংখ্যা ছিল উনিশ হাজার। মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (রঃ) বলেন যে, তারা সংখ্যায় পনরো হাজার ছিল। কাবুল আহবার (রঃ) বলেন যে, তারা ছিল বারো হাজার।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল সত্তরজন। সকালে ছিল তার যাদুকর এবং সন্ধ্যায় হয়ে গেল শহীদ। ইমাম আওযায়ী (রঃ) বলেন যে, যখন তারা সিজদায় পড়ে যায় তখন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জান্নত দেখিয়ে দেন এবং তারা জান্নাতে নিজেদের স্থান স্বচক্ষে দেখে নেয়। (এটা ইবনু আবি হাতিম ও (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
৭১-৭৩ নং আয়াতের তাফসীর:
ফিরাউন সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেনঃ তার তো উচিত ছিল এই প্রতিযোগিতার পরে সঠিক পথে চলে আসা। যাদেরকে সে প্রতিযোগিতার জন্যে আহবান করেছিল তারা সাধারণ সমাবেশে পরাজিত হয়। তারা নিজেদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়। তারা নিজেদের কাজকে যাদু এবং হযরত মূসার (আঃ) ক্রিয়াকলাপকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে প্রদত্ত মু’জিযা বলে মেনে নেয়। স্বয়ং তারা ঈমান আনছে যাদেরকে মুকাবিলার জন্যে আহ্বান করা হয়েছিল। সাধারণ সমাবেশে তারা জনগণের সামনে নির্দ্বিধায় সত্য ধর্ম কবুল করে নেয়। কিন্তু ফিরাউন তার শয়তানী ও ঔদ্ধত্যপনায় আরো বেড়ে যায় এবং নিজের শক্তির দাপট দেখাতে থাকে। কিন্তু সত্য পথের পথিকরা এই সব শক্তিকে কিছুই মনে করে না। প্রথমতঃ সে ঐ আত্মসমর্পনকারী যাদু করের দলটিকে বললোঃ “আমার বিনানুমতিতে তোমরা তার উপর ঈমান অনলে কেন?” অতঃপর সে এমন অপবাদমূলক কথা বললো যা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন হওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সে যাদুকরদেরকে বললোঃ “মূসা (আঃ) তোমাদের উসতাদ। তার কাছেই তোমরা যাদু বিদ্যা শিক্ষা করেছো। তোমরা পরস্পর একই। আমাকে সিংহাসনচ্যুত করার মানসে তোমরা পরামর্শক্রমে পূর্বে তাকে প্রেরণ করেছিলে। তারপর তার সাথে মুকাবিলা করার জন্যে তোমরা নিজেরা এসেছে। অতঃপর নিজেদের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত মুতাবেক নিজেরা পরাজয়বরণ করলে এবং তাকে জিতিয়ে দিলে। এরপর তোমরা তার দ্বীন কবুল করে নিলে। উদ্দেশ্য এই যে, যেন তোমাদের দেখা দেখি আমার প্রজাবৰ্গও এই ফঁাদে জড়িত হয়ে পড়ে। এখন তোমরা তোমাদের এই চক্রান্তমূলক কাজের পরিণাম জানতে পারবে। আমি তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করবো এবং তোমাদেরকে খর্জুর বৃক্ষের কাণ্ডে শুলবিদ্ধ করবো ? এমনি কঠোরতার সাথে তোমাদের প্রাণ বের করবো যাতে অন্যদের জন্যে এটা শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে যায়। এই ফিরাউনই সর্বপ্রথম এই শাস্তি প্রদান করে। সে আরো বলেঃ “তোমরা যে মনে করছে যে, তোমরা হিদায়াতের উপর রয়েছে, আর আমি ও আমার কওম ভ্রান্ত পথে রয়েছি এর অবস্থা তোমরা এখনই জানতে পারবে যে, আমাদের মধ্যে কার শাস্তি কঠোরতর ও অধিক স্থায়ী।” আল্লাহর ঐ ওয়ালীদের উপর ফিরাউনের এই হুমকীর ক্রিয়া বিপরীত হলো। এতে তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেয়ে গেল এবং তারা হয়ে গেলো পূর্ণ ঈমানের অধিকারী। তাই, তারা অত্যন্ত বেপরোয়া ভাবে তাকে জবাব দিলোঃ “আমরা আমাদের এই হিদায়াত ও বিশ্বাসের ফলে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যা লাভ করেছি তা ছেড়ে আমরা কোন ক্রমেই তোমার ধর্ম ককূল করতে পারি না। তোমাকে আমরা আমাদের খালেক ও মালেকের সামনে কিছুই মনে করি না।” অথবা এটা শপথ সূচক বাক্য হতে পারে। অর্থাৎ “যিনি আমাদেরকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহর শপথ! আমরা এই সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণের উপর তোমার গুমরাহীকে প্রাধান্য দিতে পারি না; তুমি আমাদের সাথে যে ব্যবহারই করো না কেন। ইবাদতের যোগ্য তিনিই যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তুমি নও। তুমি নিজেও তো তাঁরই সৃষ্ট। তোমার যা কিছু করবার আছে। তাতে তুমি মোটেই ত্রুটি করো না। তুমি তো আমাদেরকে ততক্ষণই শাস্তি দিতে পার যতক্ষণ আমরা এই পার্থিব জীবনে বন্দী রয়েছি। আমাদের বিশ্বাস আছে যে, এরপরে আমরা চিরস্থায়ী শান্তি ও অবিশ্বর সুখ ও আনন্দ লাভ করবো। আমরা আমাদের প্রতিপালকের উপর ঈমান এনেছি। আমরা আশা রাখি যে, তিনি আমাদের পূর্ববর্তী অপরাধসমূহ মার্জনা করবেন। বিশেষ করে ঐ অপরাধ তাঁর সত্য নবীর সাথে (আঃ) মুকাবিলা করতে গিয়ে আমাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ফিরাউন বানী ইসরাঈলের মধ্য হতে চল্লিশজন ছেলে বাছাই করে নিয়ে যাদুকরদের হাতে সমর্পন করে, যেন তারা তাদেরকে যাদু বিদ্যা শিক্ষা দেয়। তারা তাদেরকে যাদুবিদ্যায় এমন পারদর্শী করে তুলেছিল যে, দুনিয়ায় তাদের তুলনা ছিল না। তারাই এই উক্তি করেছিল। হযরত আবদুর রহমান ইবনু যায়েদও (রঃ) একথাই বলেছেন।
তারা ফিরাউনকে আরো বললোঃ “আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ তোমার তুলনায় বহু গুণে শ্রেষ্ঠ ও স্থায়ী। তিনি আমাদেরকে চিরস্থায়ী পুণ্য দানকারী। আমাদের না আছে তোমার শাস্তির ভয় এবং না আছে তোমার পুরস্কারের লোভ। আল্লাহর সত্ত্বাই এর যোগ্য যে তারই ইবাদত করা হবে। তার শাস্তিও চিরস্থায়ী এবং অত্যন্ত ভয়াবহ যদি তাঁর নাফরমানী করা হয়।”
সুতরাং ফিরাউন তাদের সাথে এই ব্যবহারই করলো যে, তাদের হাত-পা বিপরীত ভাবে কেটে নিয়ে তাদেরকে শূলে চড়িয়ে দিলো। সূর্যোদয়ের সময় যে দলটি ছিল কাফির, সূর্যাস্তের পূর্বেই ঐ দলটিই হয়ে গেল আল্লাহর পথের শহীদ! আল্লাহ তাদের সবারই উপর সন্তুষ্ট থাকুন!