أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯১৯)
[ وَ اۡمُرۡ اَہۡلَکَ بِالصَّلٰوۃِ وَ اصۡطَبِرۡ عَلَیۡہَا ؕ
তুমি তোমার পরিবারবর্গকে নামাযের আদেশ দাও এবং ওতে অবিচলিত থাক।]
সূরা:- ত্বাহা।
সুরা:২০
১৩০-১৩২ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২০:১৩০
فَاصْبِرْ عَلٰى مَا یَقُوْلُوْنَ وَ سَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَ قَبْلَ غُرُوْبِهَا١ۚ وَ مِنْ اٰنَآئِ الَّیْلِ فَسَبِّحْ وَ اَطْرَافَ النَّهَارِ لَعَلَّكَ تَرْضٰى
কাজেই হে মুহাম্মাদ! এরা যেসব কথা বলে তাতে সবর করো এবং নিজের রবের প্রশংসা ও গুণগান সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো সূর্য উদয়ের আগে ও তার অস্ত যাবার আগে, আর রাত্রিকালেও প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং দিনের প্রান্তগুলোতেও। হয়তো এতে তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবে।
২০:১৩১
وَ لَا تَمُدَّنَّ عَیْنَیْكَ اِلٰى مَا مَتَّعْنَا بِهٖۤ اَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا١ۙ۬ لِنَفْتِنَهُمْ فِیْهِ١ؕ وَ رِزْقُ رَبِّكَ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰى
আর চোখ তুলেও তাকাবে না দুনিয়াবী জীবনের শান-শওকতের দিকে, যা আমি এদের মধ্য থেকে বিভিন্ন ধরনের লোকদেরকে দিয়ে রেখেছি। এসব তো আমি এদেরকে পরীক্ষার মুখোমুখি করার জন্য দিয়েছি এবং তোমার রবের দেয়া হালাল রিযিকই উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী।
২০:১৩২
وَ اْمُرْ اَهْلَكَ بِالصَّلٰوةِ وَ اصْطَبِرْ عَلَیْهَا١ؕ لَا نَسْئَلُكَ رِزْقًا١ؕ نَحْنُ نَرْزُقُكَ١ؕ وَ الْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوٰى
নিজের পরিবার পরিজনকে নামায পড়ার হুকুম দাও এবং নিজেও তা নিয়মিত পালন করতে থাকো। আমি তোমার কাছে কোন রিযিক চাই না, রিযিক তো আমিই তোমাকে দিচ্ছি এবং শুভ পরিণাম তাকওয়ার জন্যই।
১৩০-১৩২ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# যেহেতু মহান আল্লাহ এখনই তাদেরকে ধ্বংস করতে চান না এবং তাদের জন্য একটি অবকাশ সময় নির্ধারিত করে ফেলেছেন, তাই তাঁর প্রদত্ত এ অবকাশ সময়ে তারা তোমার সাথে যে ধরনের আচরণই করুক না কেন তোমাকে অবশ্যি তা বরদাশত করতে হবে এবং সবরের সাথে তাদের যাবতীয় তিক্তও কড়া কথা শুনেও নিজের সত্যবাণী প্রচার ও স্মরণ করিয়ে দেবার দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। তুমি নামায থেকে এ সবর, সহিষ্ণুতা ও সংযমের শক্তি লাভ করবে। এ নির্ধারিত সময়গুলোতে তোমার প্রতিদিন নিয়মিত এ নামায পড়া উচিত। “রবের প্রশংসা ও গুণকীর্তন সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা” করা মানে হচ্ছে নামায। যেমন সামনের দিকে আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا “নিজের পরিবার পরিজনকে নামায পড়ার নির্দেশ দাও এবং নিজেও নিয়মিত তা পালন করতে থাকো।”
নামাযের সময়গুলোর প্রতি এখানেও পরিষ্কার ইশারা করা হয়েছে। সূর্য উদয়ের পূর্বে ফজরের নামায। সূর্য অস্তে যাবার আগে আসরের সময় আর রাতের বেলা এশা ও তাহাজ্জুদের নামায। দিনের প্রান্তগুলো অবশ্যি তিনটিই হতে পারে। একটি প্রান্ত হচ্ছে প্রভাত, দ্বিতীয় প্রান্তটি সূর্য ঢলে পড়ার পর এবং তৃতীয় প্রান্তটি হচ্ছে সন্ধ্যা। কাজেই দিনের প্রান্তগুলো বলতে ফজর, যোহর ও মাগরিবের নামায হতে পারে। আরো বিস্তারিত জানার জন্য তাফহীমুল কুরআন, সূরা হূদ ১১৩ , বনী ইসরাঈল ৯১ থেকে ৯৭ , আর রূম ২৪ ও আল মু’মিন ৭৪ টীকাগুলো দেখুন।
# এর দু’টি অর্থ হতে পারে এবং সম্ভবত দু’টি অর্থই এখানে প্রযোজ্যও। একটি অর্থ হচ্ছে, তুমি নিজের বর্তমান অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকো। এই অবস্থায় নিজের কর্তব্য পালনের কারণে তোমাকে নানা অপ্রীতিকর কথা শুনতে হচ্ছে। তোমার প্রতি যারা অন্যায় বাড়াবাড়ি ও জুলুম করছে তাদেরকে এখনো শাস্তি দেয়া হবে না, তারা সত্যের আহবায়ককে কষ্ট দিতেও থাকবে এবং পৃথিবীর বুকে বুক ফুলিয়েও চলবে, আল্লাহর এই ফায়সালায় তুমি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তুমি একবার একাজটি করে দেখো। এর এমন ফলাফল সামনে এসে যাবে যাতে তোমার হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। এ দ্বিতীয় অর্থটি কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন সূরা বনী ইসরাঈলে নামাযের হুকুম দেবার পর বলা হয়েছেঃ عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا “আশা করা যায়, তোমার রব তোমাকে ‘মাকামে মাহমুদে’ (প্রশংসিত স্থানে) পৌঁছিয়ে দেবেন।” ( ৭৯ আয়াত ) অন্যত্র সূরা দু-হায় বলা হয়েছেঃ وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى – وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى “তোমার জন্য পরবর্তী যুগ অবশ্যি পূর্ববর্তী যুগের চাইতে ভালো। আর শিগগির তোমার রব তোমাকে এত কিছু দেবেন যার ফলে তুমি খুশী হয়ে যাবে।” ( ৯৩:৫ )
# “রিযক” শব্দের অনুবাদ আমি করেছি “হালাল রিযিক।” এর কারণ মহান আল্লাহ কোথাও হারাম সম্পদকে “রবের রিযিক” হিসেবে পেশ করেননি। এর অর্থ হচ্ছে, এ ফাসেক ও দুশ্চরিত্র লোকেরা অবৈধ পথে টাকা-পয়সা সংগ্রহ করে নিজেদের জীবনে যে বাহ্যিক চমক সৃষ্টি করে নেয় তোমার ও তোমার মু’মিন সাথীদের তাকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। এ ধন-দৌলত ও শান শওকত তোমাদের জন্য মোটেও ঈর্ষনীয় নয়। তোমরা নিজেরা পরিশ্রম করে যে পাক-পবিত্র রিযিক উপার্জন করো তা যতই সামান্য হোক না কেন সত্যনিষ্ঠ ও ঈমানদার লোকদের জন্য তাই ভালো এবং তার মধ্যে এমন কল্যাণ রয়েছে যা দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত বজায় থাকবে।
# তোমাদের সন্তানরা যেন নিজেদের অভাব অনটন ও দুরবস্থায় মোকাবিলায় এ হারামখোরদের ভোগ বিলাসিতা দেখে মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে। তাদেরকে নামায পড়ার আদেশ দাও। এ জিনিসটি তাদের দৃষ্টিভংগীতে পরিবর্তন ঘটাবে তাদের মূল্যবোধ বদলে দেবে। তাদের আগ্রহ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন করে দেবে। তারা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রিযিকের ওপর সবর করবে এবং তাতে পরিতুষ্ট হবে ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে যে কল্যাণ অর্জিত হয় তাকে তারা এমন ভোগের ওপর অগ্রাধিকার দিতে থাকবে, যা ফাসেকী, দুশ্চরিত্রতা ও পার্থিব লোভ লালসা থেকে অর্জিত হয়।
# আমার কোন লাভের জন্য আমি তোমাদের নামায পড়তে বলছি না। বরং এতে লাভ তোমাদের নিজেদেরই। সেটি হচ্ছে এই যে, তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হবে। আর এটিই দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে স্থায়ী ও শেষ সাফল্যের মাধ্যম।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
ওদের শাস্তি বিলম্বিত করা হয়েছে মাত্র, রহিত করা হয়নি। কাজেই হে নবী ওদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবন, ওদের চাকচিক্যময় আহার বিহার দেখে তুমি বিস্মিত হয়াে না, বিচলিত হয়াে না, এগুলাের মাধ্যমে তাে ওদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে, ওদের দায়ভার আরাে বাড়িয়ে তােলা হয়েছে। অপরদিকে আল্লাহ তায়ালা তােমাকে যে নেয়ামত দান করেছেন তা তুলনাহীন, ওদের সে ক্ষণস্থায়ী চাকচিক্যময় জীবনের তুলনায় তা অনেক বেশী মূল্যবান ও মংগলময়। কাজেই তােমার দায়িত্ব হচ্ছে এই। (আয়াত ১৩০-১৩২) অর্থাৎ বিদ্রোহমূলক কার্যকলাপ, ওদের উপহাস বিদ্রুপ, ওদের অহমিকা অস্বীকৃতি এবং ওদের তাচ্ছিল্য ও ঔদাসীন্য মােকাবেলায় তুমি ধৈর্যধারণ করো। এর কারণে তুমি মনােক্ষুণ্ন হয়াে না। ওদের এই অবস্থার জন্যে তােমার হা হুতাশ করারও প্রয়ােজন নেই; বরং আল্লাহর প্রতি মনােনিবেশ করাে। সকাল বিকাল তাকেই স্মরণ করাে, তারই প্রশংসা বাক্য উচ্চারণ করাে। প্রভাতের নির্জন মুহর্তে যখন জীবনের চাঞ্চল্য ও কর্মতৎপরতার সূচনা হয় এবং বেলা শেষে যখন গােটা প্রকৃতি ঝিমিয়ে পড়ে, চোখের পাতা বন্ধ করে নেয়, অর্থাৎ দিনের প্রতিটি মুহূর্তেই নিজেকে আল্লাহর সাথে জড়িয়ে রাখাে, সম্পৃক্ত রাখাে, এর মাধ্যমে তুমি শান্তি পাবে, তুপ্তি পাবে। আল্লাহর যিকির ও তসবীহের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এই সম্পর্কের ফলে সে এক অনাবিল মানসিক শান্তি ও সুখ অনুভব করে। এই শান্তি হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্যের, আর এই সুখ হচ্ছে তারই নিরাপদ সান্নিধ্যের। তাহলে বুঝা গেলো যে, এবাদাত রিয়াযতের ফল হচ্ছে মানসিক প্রশান্তি। পার্থিব জীবনের জন্যে এটাই হচ্ছে উত্তম প্রতিদান । এর মাধ্যমে বান্দার হৃদয় মন সুখ শান্তিতে ভরে উঠে। আল্লাহর এবাদাতের প্রতি মনােনিবেশ করুন। কাফের মােশরেকদের ধন দৌলত, সন্তান সন্তুতি, প্রভাব প্রতিপত্তি এবং জৌলুসময় জীবনের দিকে ভ্রুক্ষেপ করার দরকার নেই। কারণ এগুলাে অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, ফুল যেমন দেখতে খুব সুন্দর লাগে, আকর্ষণীয় লাগে, এসব ক্ষণস্থায়ী বিলাস সামগ্রীও তেমনিই, কিন্তু ফুল সুন্দর হলেও তার এই সৌন্দর্য ক্ষণস্থায়ী। কারণ খুব কম সময়ের ব্যবধানেই ফুল শুকিয়ে যায়, নেতিয়ে পড়ে। পার্থিব ভোগ বিলাসিতার অবস্থাও ঠিক এমনটিই হয়ে থাকে। তাছাড়া এগুলাে হচ্ছে পরীক্ষার জন্যে। এর মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে, কিন্তু আপনাকে যা দান করা হয়েছে তা পরীক্ষাস্বরূপ নয়, বরং নেয়ামতস্বরূপ দান করা হয়েছে। এই নেয়ামত মংগলময়, কল্যাণময় । এর অস্তিত্ব ক্ষণস্থায়ী নয়, চোখের ধােকা নয় এবং কোনাে আপদও নয়। এটা কিন্তু বৈরাগ্যের প্রতি আহবান নয়, জীবনের বৈধ আরাম আয়েশ ত্যাগ করার আহ্বান নয়; বরং এটা হচ্ছে শাশ্বত ও চিরন্তন মূল্যবােধের প্রতি গৌরব প্রকাশের আহ্বান, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বান, তার প্রতি রাযি খুশী থাকার আহবান। অর্থাৎ মানুষ যেন ধন দৌলতের জৌলুসে আত্মহারা না হয়ে পড়ে। এর কারণে সে যেন তার প্রকৃত ও উন্নত আদর্শের প্রতি তার গৌরব এবং শ্রদ্ধাবােধ হারিয়ে না ফেলে; বরং সব সময়ই যেন এসব ক্ষণস্থায়ী ও চোখ ধাঁধানাে বিলাস সামগ্রীর ব্যাপারে সে নিস্পৃহ থাকে এবং নিজেকে এসবের অনেক উর্ধ্বে মনে করে।
*পরিবার পরিজনদের প্রতি নামাযের আদেশ : ‘তুমি তোমার পরিবার পরিজনকে নামাযের নির্দেশ দাও।’ এই আয়াতের আলােকে প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে তার ঘরকে একটা মুসলিম ঘরে রূপান্তরিত করা। তার পরিবারের সবাইকে নামায আদায়ে উদ্বুদ্ধ করা যাতে করে আল্লাহর সাথে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তাদের জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য অভিন্ন হয়ে যায়। যে পরিবারের সকলের লক্ষ্য কেবল আল্লাহমুখী হয়, সে পরিবারের ছায়াতলে বাস করার মাঝে যে কি শান্তি তা বলে শেষ করার মতাে নয় ‘এবং এর ওপর অবিচল থাকো, অর্থাৎ পরিপূর্ণরূপে নামায কায়েম করার ব্যাপারে অবিচল থাকো। এই নামাযের সৎ প্রভাব নিজের মাঝে সৃষ্টি করার ব্যাপারে অবিচল থাকো। মন্দ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখাই হচ্ছে নামাযের মূল ও যথার্থ প্রভাব। নামাযীর আচার আচরণে এই প্রভাব সৃষ্টি করার জন্যে নামাযের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে। যদি এই কাংখিত প্রভাব সৃষ্টি হয় তখনই বলা যাবে, নামায কায়েম করা হচ্ছে। অন্যথায় এই নামাযে কিছু বাক্য ও কিছু ক্রিয়াকলাপ ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। এই নামায, এই এবাদাত বন্দেগী এবং এই আল্লাহমুখী কর্মকান্ড হচ্ছে তােমার দায়িত্ব কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে আল্লাহর কিছুই পাওয়ার নেই। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তােমার মুখাপেক্ষী নন। বান্দার এবাদাতেরও তিনি মুখাপেক্ষী নন। ‘আপনার কাছে আমি কোনাে রিযিক কামনা করছি না রিযিক তাে আমিই আপনাকে প্রদান করবাে।’ নামায হচ্ছে একটি এবাদাত। এর মাধ্যমে তাকওয়া পরহেযগারী অর্জিত হয়। আর শুভ পরিণতি কেবল তারাই লাভ করবে যারা তাকওয়া পরহেযগারীর অধিকারী হবে। কাজেই মানুষ নিজেই এই এবাদাতের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানে লাভবান হবে। কারণ, এবাদাতের বিনিময়ে সে নিজেই দুনিয়ার যিন্দেগীতে সুখ শান্তি ভােগ করবে এবং পরকালে পাবে পরম পুরস্কার। এতে আল্লাহর লাভ লােকসানের কিছুই নেই এবং জগদ্বাসীর কাছেও তার চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
(قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا)
সূর্যোদয়ের পূর্বে কথা দ্বারা ফজর ও সূর্যাস্তের পূর্বে কথা দ্বারা আসরের সালাত উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা ও তাসবীহসহ সালাত আদায় কর। যেমন হাদীসে এসেছে: জারীর বিন আবদুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট বসেছিলাম। তিনি পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন: তোমরা সত্বরই তোমাদের রবকে এভাবেই দেখতে পাবে যেভাবে এ চাঁদকে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই দেখতে পাচ্ছ। সুতরাং সম্ভব হলে তোমরা সূর্যোদয়ের পূর্বের ও সূর্যাস্তের পূর্বের সালাতের হেফাযত কর। এরপর তিনি উক্ত আয়াতটি পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৫৪, সহীহ মুসলিম হা: ৪৩৯)
(وَمِنْ اٰنَآئِ اللَّيْلِ فَسَبِّحْ وَأَطْرَافَ النَّهَارِ)
এখানে রাত্রিকালে বলতে তাহাজ্জুদের সালাত বুঝানো হয়েছে। তবে কেউ কেউ বলেন, এর দ্বারা মাগরিব ও এশার সালাত বুঝানো হয়েছে। আর দিবসের প্রান্তসমূহেও, যাতে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَسَوْفَ يُعْطِيْكَ رَبُّكَ فَتَرْضٰي)
“তোমার পালনকর্তা সত্বরই তোমাকে দান করবেন, অতঃপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন।” (সূরা যুহা ৯৩:৫) হাদীসে এসেছে আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: হে জান্নাতবাসীরা! তারা উত্তরে বলবে: হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা হাজির আছি। তখন তিনি বলবেন: তোমরা খুশী হয়েছ কি? তারা জবাব দেবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কী হয়েছে যে, আমরা খুশী হব না? আপনি তো আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা আপনার সৃষ্টজীবের আর কাউকেও দেননি। আল্লাহ তা‘আলা তখন বলবেন, এগুলো অপেক্ষাও উত্তম জিনিস আমি তোমাদেরকে প্রদান করবো। তারা উত্তরে বলবে: এর চেয়েও উত্তম জিনিস আর কী আছে? আল্লাহ তা‘আলা জবাব দেবেন: আমি তোমাদেরকে আমার সন্তুষ্টি প্রদান করছি। এরপরে আর কোন দিন আমি তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হব না। (সহীহ বুখারী হা: ৬৫৪৯, সহীহ মুসলিম হা: ২৮২৯)।
#ফজর ও আসর এবং তাহাজ্জুদ সালাতের গুরুত্ব সম্পর্কে জানা গেল।
১৩১-১৩২ নং আয়াতের তাফসীর:
দুর্বল ঈমানের মু’মিনগণ বলে থাকে আমরা ঈমান আনা সত্ত্বেও দুনিয়াতে কত কষ্টে আছি অথচ কাফিররা কত সুখে, আরাম-আয়েশে বাস করছে। তাদের উত্তর অত্র আয়াতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে সকল মু’মিনকে বলে দিচ্ছেন যে, দুনিয়াতে কাফিরদেরকে যে আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি, ভোগ-বিলাস ও চাকচিক্যময় জীবন দান করেছি সে দিকে দৃষ্টিপাত করো না। এসব দুনিয়ার ঐশ্বর্য ধ্বংসশীল ও ক্ষণস্থায়ী, আল্লাহ তা‘আলা পরীক্ষা করার জন্য দিয়েছেন, কে তা পেয়ে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস রাখে, আর কে নাফরমানী করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَي الْأَرْضِ زِيْنَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا)
“পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার শোভা সৌন্দর্য করেছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে সৎ কর্মে কে শ্রেষ্ঠ। ” (সূরা কাহফ ১৮:৭) এরূপ সূরা হিজরের ৮৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ও তোমার মাধ্যমে মু’মিনদের যে নেয়ামত দান করেছেন তা উত্তম ও চিরস্থায়ী যা আখিরাতের জীবনের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالْاٰخِرَةُ خَيْرٌ وَّأَبْقٰي)
“অথচ আখিরাত (জীবন) উত্তম ও চিরস্থায়ী।” (সূরা আ‘লা ৮৭:১৭)
একদা উমার (রাঃ) এসে দেখলেন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাটাইয়ের ওপর শুয়ে থাকায় চাটাইয়ের দাগ পিঠে লেগে রয়েছে। উমার (রাঃ) তা দেখে কেঁেদ ফেললেন। কী ব্যাপার উমার কাঁদ কেন? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: রোম পারস্যের রাজা-বাদশারা কত সুখ-শান্তিতে জীবন অতিবাহিত করছে, আর আপনি সৃষ্টির সেরা হওয়া সত্ত্বেও কত কষ্ট করছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: উমার! তোমার কি এখনো সন্দেহ আছে? ওরা তো তারা যাদের সুখ-শান্তি পৃথিবীতেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। পরকালে তাদের কোন সুখ থাকবেনা। (সহীহ বুখারী, সূরা তাহরীমের তাফসীর)
সুতরাং মু‘মিনদের উচিত দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের প্রতি প্রাধান্য না দিয়ে আখিরাতের সফলতাকে প্রাধান্য দেয়া।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন: তিনি যেন তার পরিবারবর্গকে সালাতের নির্দেশ দেন এবং তার ওপর অটল থাকেন। এ নির্দেশ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মাধ্যমে উম্মাতের সকল মু’মিনকে দেয়া হয়েছে। সুতরাং সকল মু’মিন নিজে সালাত আদায় করবে সাথে সাথে পরিবাবর্গকে সালাত আদায় করার নির্দেশ দেবে। একদিন সালাত আদায় করবে আরেকদিন ছেড়ে দেবে তা নয়, বরং তা অবিরত আদায় করতে থাকবে, তার ওপর অবিচল থাকবে। যেমন ইসমাঈল (عليه السلام)-এর ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার উক্তি
(وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَه بِالصَّلٰوةِ وَالزَّكٰوةِ ص وَكَانَ عِنْدَ رَبِّه۪ مَرْضِيًّا )
“সে তার পরিবার পরিজনকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিত এবং সে ছিল তার প্রতিপালকের সন্তোষভাজন।” (সূরা মারইয়াম ১৯:৫৫)
আর এটিই হচ্ছে তাক্বওয়া বা আল্লাহ তা‘আলাভীতির পরিচয়, আর যারা তাক্বওয়া অবলম্বন করে তারাই সফল হবে এবং তাদের জন্যই উত্তম প্রতিদান।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সাত বছর বয়সে সালাত আদায় করার নির্দেশ দাও, দশ বছর বয়সে প্রহার কর (যদি সালাত আদায় না করে)। (আবূ দাউদ হা: ৪৯৫, সহীহ) এ আয়াত নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রত্যেক সকালে ফাতিমা (রাঃ) এর বাড়িতে চলে যেতেন এবং সালাতের কথা বলতেন। উমার (রাঃ) রাতে কিয়াম করার জন্য বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে দিতেন। (কুরতুবী, অত্র আয়াতের তাফসীর)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. পার্থিব ক্ষণস্থায়ী ধন-সম্পদ আল্লাহ তা‘আলার প্রিয়পাত্র হওয়ার আলামত নয়।
২. পার্থিব সম্পদ মানুষের পরীক্ষার বস্তু।
৩. মু’মিনরা দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের ওপর আখিরাতের সফলতাকে প্রাধান্য দেয়।
৪. নিজে সালাত আদায় করতে হবে এবং পরিবারকে সালাত আদায় করার নির্দেশ দিতে হবে।
# আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করার গুরুত্ব জানা গেল।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# ‘সূর্যোদয়ের পূর্বে একথা দ্বারা ফজরের নামায উদ্দেশ্য এবং সুর্যাস্তের পূর্বে একথা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আসরের নামায।
হযরত জারীর ইবনু আবদিল্লাহ বাজালী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা আমরা রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট বসেছিলাম। তিনি চৌদ্দ তারিখের চাদের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ “তোমরা সত্বরই তোমাদের প্রতিপালককে এভাবেই দেখতে পাবে যেভাবে এই চাদকে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই দেখতে পাচ্ছ। সুতরাং সম্ভম্ব হলে তোমরা সূর্যোদয়ের পূর্বের ও সূর্যাস্তের পূর্বের নামাযের হিফাযত করো।” অতঃপর তিনি এই আয়াতটি পাঠ করেন।” (এহাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আম্মারা ইবনু রাবিয়া (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলতে শুনেছেনঃ “এমন কেউই কখনো জাহান্নামে যাবে না যে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বের নামায আদায় করলো।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সবচেয়ে নিম্নমানের জান্নাতী হলো ঐ ব্যক্তি যে দুই হাজার বছরের রাস্তা পর্যন্ত নিজের অধিকারভুক্ত জায়গায়ই দেখতে পাবে। সবচেয়ে দুরবর্তী জিনিস তার জন্যে এমনই হবে যেমন হবে সবচেয়ে নিকটবর্তী জিনিস। আর সবচেয়ে উচ্চমানের জান্নাতী তো প্রতি দিন দু’বার করে আল্লাহ তাআলার দর্শন লাভ করবে।” (এ হাদীসটি মুসনাদে ও সুনান গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে)
মহান আল্লাহ বলেনঃ এবং রাত্রিকালে (তোমার প্রতিপালকের) পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। অর্থাৎ রাত্রে তাহাজ্জুদের নামায পড়। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো মাগরিব ও এশার নামায। আর দিনের প্রান্ত সমূহেও আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর, যাতে তার পুরস্কার ও প্রতিদান পেয়ে তুমি সন্তুষ্ট হতে পার। যেমন আল্লাহ তাআলা এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে অনুগ্রহ দান করবেন, আর তুমি সন্তুষ্ট হবে।” (৯৩:৫)
সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ “হে জান্নাতবাসীরা!” তারা উত্তরে বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা হাজির আছি।” তখন তিনি বলবেনঃ “তোমরা খুশী হয়েছে কি?” তারা জবাব দিবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা খুশী হবো না? আপনি তো আমাদেরকে এমন কিছু দিয়েছেন যা আপনার সৃষ্টজীবের আর কাউকেও দেন নি!” আল্লাহ তাআলা তখন বলবেনঃ “এগুলি অপেক্ষাও উত্তম জিনিস আমি তোমাদেরকে প্রদান করবো।” তারা উত্তরে। বলবেঃ “এর চেয়েও উত্তম জিনিস আর কি আছে?” আল্লাহ তাআলা জবাব দিবেনঃ “আমি তোমাদেরকে আমার সন্তুষ্টি প্রদান করছি। এরপরে আর কোনও দিন আমি তোমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হবে না।”
অন্য হাদীসে আছে যে, বলা হবেঃ “হে জান্নাতীরা! আল্লাহ তাআলা তোমাদের সাথে যে ওয়াদা করেছিলেন তা তিনি পূর্ণ করতে চান। তারা বলবেঃ “আল্লাহ তাআলার সব ওয়াদা তো পূর্ণ হয়েই গেছে। আমাদের চেহারা উজ্জ্বল হয়েছে, আমাদের পুণ্যের পাল্লা ভারী হয়ে গেছে, আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবিষ্ট করা হয়েছে। সুতরাং আর কিছুই তো বাকী নেই।” তৎক্ষণাৎ পর্দা উঠে যাবে এবং তারা। মহামহিমান্বিত আল্লাহকে দেখতে পাবে। আল্লাহর শপথ! এর চেয়ে উত্তম নিয়ামত আর কিছুই হবে না এটাই প্রচুর।
১৩১-১৩২ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবী হযরত মুহাম্মদকে (সঃ) বলছেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি কাফিরদের পার্থিব সৌন্দর্য ও সুখ ভোগের প্রতি আফসোস পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখো না। এটা তো অতি অল্প দিনের সুখ ভোগ মাত্র। তাদের রীক্ষার জন্যেই এ সব তাদেরকে দেয়া হয়েছে। আমি দেখতে চাই যে, তারা এ সব পেয়ে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে কি অকৃতজ্ঞ হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কৃতজ্ঞ বান্দাদের সংখ্যা খুবই কম। তাদের ধনীদেরকে যা কিছু দেয়া হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণে উত্তম নিয়ামত তো তোমাকে দান করা হয়েছে। আমি তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দান করেছি যা বারবার পঠিত হয় (অর্থাৎ সূরায়ে ফাতেহা)। আর তোমাকে মর্যাদা সম্পন্ন কুরআন দান করা হয়েছে। সুতরাং তুমি তোমার দৃষ্টি ঐ কাফিরদের পার্থিব সৌন্দর্য ও উপভোগের উপকরণের প্রতি নিক্ষেপ করো না। অনুরূপভাবে হে নবী (সঃ) ! তোমার জন্যে তোমার প্রতিপালকের নিকট যে আতিথ্যের ব্যবস্থা রয়েছে তার কোন তুলনা নেই এবং এটা বর্ণনাতীত। তোমার প্রতিপালক প্রদত্ত জীবনোপকরণ উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।
সহীহ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্ত্রীদের সাথে স হবাস করা হতে বিরত থাকার শপথ করেছিলেন। তিনি একটি নির্জন কক্ষে অবস্থান করছিলেন। হযরত উমার (রাঃ) সেখানে প্রবেশ করে দেখেন যে, তিনি একটি খেজুরের পাতার চাটাই এর উপর শুয়ে রয়েছেন। চামড়ার একটা টুকরা একদিকে পড়ে রয়েছে এবং কয়েকটি চামড়ার মশক লটকানো আছে। আসবাবপত্র বিহীন ঘরের এ অবস্থা দেখে তার চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! (রোম সম্রাট) কায়সার এবং (পারস্যের বাদশাহ) কিসরা কত সুখে শান্তিতে ও আরাম আয়েশে জীবন যাপন করছে, অথচ আপনি সৃষ্টজীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন হওয়া সত্ত্বেও আপনার এই অবস্থা তাঁর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে খাত্তাবের পুত্র! এখনো তো তুমি সন্দেহের মধ্যেই পড়ে রয়েছে! তারা এমন সম্প্রদায় যে, তাদের পার্থিব জীবনেই তাদেরকে তাড়তািড়ি সুখ ভোগের সুযোগ দেয়া হয়েছে। (পরকালে তাদের কোনই অংশ নেই)।”।
সুতরাং জানা গেল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ক্ষমতা ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও দুনিয়ার প্রতি খুবই অনাসক্ত ছিলেন। যা কিছু হাতে আসতো তা-ই আল্লাহর ওয়াস্তে একে একে দান করে দিতেন এবং নিজের জন্যে এক পয়সাও রাখতেন না।
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদের ব্যাপারে ঐ সময়কেই সবচেয়ে বেশী ভয় করি যখন দুনিয়া তার সমস্ত সৌন্দর্যও আসবাবপত্র তোমাদের পদতলে নিক্ষেপ করবে।” সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেনঃ “দুনিয়ার সৌন্দর্য ও আসবাবপত্রের অর্থ কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “যমীনের বরকত। (এ হাদীসটি মুসনাদে ইবনু আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে) মোট কথা, কাফিরদের পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্যেই দেয়া হয়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ তোমার পরিবারবর্গকে নামাযের আদেশ দাও যাতে তারা আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচতে পারে। নিজেও ওর উপর অবিচলিত থাকো। নিজেকে এবং নিজের পরিবারবর্গকে জাহান্নাম হতে রক্ষা কর।
হযরত উমার ফারূকের (রাঃ) অভ্যাস ছিল এই যে, রাত্রে যখন তিনি তাহাজ্জদের নামাযের জন্যে উঠতেন তখন তাঁর পরিবারবর্গকেও জাগাতেন এবং এই আয়াতটি পাঠ করতেন।
আল্লাহ পাক বলেনঃ আমি তোমার কাছে কোন জীবনোপকরণ চাই না। তুমি নামাযের পাবন্দী কর, আল্লাহ তোমাকে এমন জায়গা হতে রিযক দিবেন যে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা খোদাভীরুদেরকে মুক্তিদান করে থাকেন এবং তাদেরকে কল্পনাতীত জায়গা হতে জীবিকা প্রদান করেন।
সমস্ত দানব ও মানবকে শুধুমাত্র ইবাদতের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। রিযুকদাতা ও ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। এজন্যেই মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তোমার কাছে রিযক চাই না, বরং আমিই তোমাকে রিযুক দান করে থাকি।
বর্ণিত আছে যে, হযরত হিশামের (রঃ) পিতা যখন আমীর-উমারার নিকট গমন করতেন এবং তাদের শান-শওকত দেখতেন তখন তিনি নিজের বাড়ীতে ফিরে এসে এই আয়াতটিই তিলাওয়াত করতেন এবং বলতেনঃ “হে আমার পরিবারবর্গ! তোমরা নামাযের হিফাযত করো, নামাযের পাবন্দী করো, তা হলে আল্লাহ তাআলা তোমাদের উপর দয়া করবেন।” (এটাও মুসনাদে ইবনু আবি হাতিমে বর্ণিত আছে)
হযরত সাবিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন সংকীর্ণতার সম্মুখীন হতেন তখন তিনি বলতেনঃ “হে আমার পরিবারবর্গ! তোমরা নামায পড় এবং নামাযকে প্রতিষ্ঠিত রাখো।” হযরত সাবিত (রাঃ) আরো বলেনঃ সমস্ত নবীরই এই নীতিই ছিল যে, কোন কারণে তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেই নামায শুরু করে দিতেন। (এটাও মুসনাদে ইবনু আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “হে ইবনু আদম! তুমি নিজেকে আমার ইবাদতের জন্যে মুক্ত করে দাও, আমি তোমার বক্ষকে ঐশ্বর্য ও অভাবহীনতা দ্বারা পূর্ণ করে দিবো। তোমার দারিদ্র ও অভাব দূর করে দিবো। আর যদি তা না কর তবে আমি তোমার অন্তরকে ব্যস্ততা দ্বারা পূর্ণ করবো এবং তোমার দারিদ্র দূর করবো না।” (এ হাদীসটি জামে তিরমিযী ও সুনানে ইবনু মাজাহতে বর্ণিত আছে)
হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার সমস্ত চিন্তা ফিকির এবং ইচ্ছা ও খেয়াল একমাত্র আখেরাতের জন্যে হয় এবং তাতেই নিমগ্ন থাকে, আল্লাহ তাআলা তাকে দুনিয়ার সমস্ত চিন্তা ও উদ্বেগ থেকে রক্ষা করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়ার চিন্তায় নিমগ্ন থাকে, সে যে কোন উপত্যকায় ধ্বংস হয়ে যাক এতে আল্লাহ তাআলার কোন পরওয়া নেই।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, দুনিয়ার চিন্তায় নিমগ্ন ব্যক্তির সমস্ত কাজে আল্লাহ তাআলার উদ্বেগ নিক্ষেপ করেন এবং তার দারিদ্র তার চোখের সামনে করে দেন। মানুষ দুনিয়া হতে ঐ পরিমাণই প্রাপ্ত হবে যে পরিমাণ তার ভাগ্যে লিপিবদ্ধ আছে। আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে তার কেন্দ্র স্থল বানিয়ে নেবে এবং নিজের নিয়াত শুধু ওটাই রাখবে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতিটি কাজে প্রশান্তি আনয়ন করবেন এবং তার অন্তরকে পরিতৃপ্ত করবেন। আর দুনিয়া তার পায়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে।
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্যেই। সহীহ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আজ রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমরা যেন উকবা ইবনু রাফে’র (রাঃ) বাড়ীতে রয়েছি। সেখানে আমাদের সামনে ইবনু তাবের (রাঃ) বাগানের রসাল খেজুর পেশ করা। হয়েছে। আমি এর তা’বীর (ব্যাখ্যা) এই নিয়েছি যে, পরিণামের দিক দিয়ে দুনিয়াতেও আমাদেরই পাল্লা ভারী হবে। উচ্চতাও উন্নতি আমরাই লাভ করবো। আর আমাদের দ্বীন পাক পবিত্র এবং পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ।”
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#919)
[ وَ اۡمُرۡ اَہۡلَکَ بِالصَّلٰوۃِ وَ اصۡطَبِرۡ عَلَیۡہَا ؕ
And enjoin prayer upon your family and be steadfast therein.]
Sura:20
Sura: Taa-Haa
Ayat: 130-132
www.motaher21.net