أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯২১)
[ اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ
মানুষের হিসেব-নিকেশের সময় কাছে এসে গেছে,]
সূরা:- আল্ আম্বিয়া।
সুরা:২১
০১- ০৬ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২১:০১
اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَ هُمْ فِیْ غَفْلَةٍ مُّعْرِضُوْنَۚ
মানুষের হিসেব-নিকেশের সময় কাছে এসে গেছে, অথচ সে গাফলতির মধ্যে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আছে।
২১:০২
مَا یَاْتِیْهِمْ مِّنْ ذِكْرٍ مِّنْ رَّبِّهِمْ مُّحْدَثٍ اِلَّا اسْتَمَعُوْهُ وَ هُمْ یَلْعَبُوْنَۙ
তাদের কাছে তাদের রবের পক্ষ থেকে যে উপদেশ আসে, তা তারা দ্বিধাগ্রস্তভাবে শোনে এবং খেলার মধ্যে ডুবে থাকে,
২১:০৩
لَاهِیَةً قُلُوْبُهُمْ١ؕ وَ اَسَرُّوا النَّجْوَى١ۖۗ الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا١ۖۗ هَلْ هٰذَاۤ اِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ١ۚ اَفَتَاْتُوْنَ السِّحْرَ وَ اَنْتُمْ تُبْصِرُوْنَ
তাদের মন (অন্য চিন্তায়) আচ্ছন্ন। আর জালেমরা পরস্পরের মধ্যে কানাকানি করে যে, “এ ব্যক্তি মূলত তোমাদের মতোই একজন মানুষ ছাড়া আর কি, তাহলে কি তোমরা দেখে শুনে যাদুর ফাঁদে পড়বে?”
২১:০৪
قٰلَ رَبِّیْ یَعْلَمُ الْقَوْلَ فِی السَّمَآءِ وَ الْاَرْضِ١٘ وَ هُوَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ
রসূল বললো, আমার রব এমন প্রত্যেকটি কথা জানেন যা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে বলা হয়, তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন।
২১:০৫
بَلْ قَالُوْۤا اَضْغَاثُ اَحْلَامٍۭ بَلِ افْتَرٰىهُ بَلْ هُوَ شَاعِرٌ١ۖۚ فَلْیَاْتِنَا بِاٰیَةٍ كَمَاۤ اُرْسِلَ الْاَوَّلُوْنَ
তারা বলে, “বরং এসব বিক্ষিপ্ত স্বপ্ন, বরং এসব তার মনগড়া বরং এ ব্যক্তি কবি। নয়তো সে আনুক একটি নিদর্শন যেমন পূর্ববর্তীকালের নবীদেরকে পাঠানো হয়েছিল নিদর্শন সহকারে।”
২১:০৬
مَاۤ اٰمَنَتْ قَبْلَهُمْ مِّنْ قَرْیَةٍ اَهْلَكْنٰهَا١ۚ اَفَهُمْ یُؤْمِنُوْنَ
অথচ এদের আগে আমি যেসব জনবসতিকে ধ্বংস করেছি, তাদের কেউ ঈমান আনেনি। এখন কি এরা ঈমান আনবে?
০১-০৬ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
(২১-আম্বিয়া) : নামকরণ:
কোন বিশেষ আয়াত থেকে এ সূরার নাম গৃহীত হয়নি। এর মধ্যে যেহেতু ধারাবাহিকভাবে বহু নবীর কথা আলোচিত হয়েছে তাই এর নাম রাখা হয়েছে “আল আম্বিয়া”। এটাও সূরার বিষয়বস্তু ভিত্তিক শিরোনাম নয় বরং নিছক সূরা চিহ্নিত করার একটি আলামত মাত্র।
(২১-আম্বিয়া) : নাযিল হওয়ার সময়-কাল :
বিষয়বস্তু ও বর্ণনাভংগী উভয়ের দৃষ্টিতেই মনে হয় এর নাযিলের সময়-কাল ছিল মক্কী জীবনের মাঝামাঝি অর্থাৎ আমাদের বিভক্তিকরণের দৃষ্টিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কী জীবনের তৃতীয় ভাগে। শেষ ভাগের সূরাগুলোর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় এর পটভূমিতে তা ফুটে ওঠে না।
(২১-আম্বিয়া) : বিষয়বস্তু ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরাইশ সরদারদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলছিল এ সূরায় তা আলোচিত হয়েছে। তারা নবী করীমের (সা.) রিসালাতের দাবী এবং তাওহীদ ও আখেরাত বিশ্বাসের দাওয়াতের বিরুদ্ধে যেসব সন্দেহ-সংশয় ও আপত্তি উত্থাপন করতো তার জবাব দেয়া হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে তাঁর মোকাবিলায় যেসব কৌশল অবলম্বন করা হতো সেগুলোর বিরুদ্ধে হুমকি প্রদর্শন করা হয়েছে এবং তাদের অশুভ ফলাফল জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা যে ধরনের গাফলতি ও ঔদ্ধত্যের মনোভাব নিয়ে তাঁর দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করছিল সে সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। সবশেষে তাদেরকে একথা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, যে ব্যক্তিকে তোমরা নিজেদের জন্য দুঃখ ও বিপদ মনে করছো তিনি আসলে তোমাদের জন্য রহমত হয়ে এসেছেন।
। ভাষণের মধ্যে বিশেষভাবে যে সমস্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে সেগুলো নিচে দেয়া হলোঃ
। একঃ মানুষ কখনো রসূল হতে পারে না, মক্কার কাফেরদের এ বিভ্রান্তি এবং এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসূল মেনে নিতে অস্বীকার করাকে— বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে নিরসন ও খণ্ডন করা হয়েছে।
। দুইঃ নবী করীমের (সা.) ও কুরআনের বিরুদ্ধে তাদের বিভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী ধরনের আপত্তি উত্থাপন করা এবং কোন একটি কথার ওপর অবিচল না থাকার— ওপর সংক্ষিপ্তভাবে কিন্তু অত্যন্ত জোরালো ও অর্থপূর্ণ পদ্ধতিতে পাকড়াও করা হয়েছে।
। তিনঃ তাদের ধারণা ছিল, জীবন নেহাতই একটি খেলা, কিছুদিন খেলা করার পর তাকে এমনিই খতম হয়ে যেতে হবে, এর কোন ফল বা পরিণতি ভুগতে হবে না। কোন প্রকার হিসেব-নিকেশ এবং শাস্তি ও পুরস্কারের অবকাশ এখানে নেই। —যে ধরনের গাফলতি ও অবজ্ঞা সহকারে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করছিল, ঐ ধারণাই যেহেতু তার মূল ছিল, তাই বড়ই হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে এর প্রতিকার করা হয়েছে।
। চারঃ শির্কের প্রতি তাদের অবিচল নিষ্ঠা এবং তাওহীদের বিরুদ্ধে অন্ধ বিদ্বেষ ছিল তাদের ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে বিরোধের মূল ভিত্তি। —এর সংশোধনের জন্য শির্কের বিরুদ্ধে ও তাওহীদের পক্ষে সংক্ষিপ্ত কিন্তু মোক্ষম ও চিত্তাকর্ষক যুক্তি প্রদান করা হয়েছে।
। পাঁচঃ এ ভুল ধারণাও তাদের ছিল যে, নবীকে বারবার মিথ্যা বলা সত্ত্বেও যখন তাদের ওপর কোন আযাব আসে না তখন নিশ্চয়ই নবী মিথ্যুক এবং তিনি আমাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে যে আযাবের ভয় দেখান তা নিছক অন্তসারশূন্য হুমকি ছাড়া আর কিছুই নয়। —একে যুক্তি ও উপদেশ উভয় পদ্ধতিতে দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে।
। এরপর নবীগণের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী থেকে কতিপয় নজির পেশ করা হয়েছে। এগুলো থেকে একথা অনুধাবন করানোই উদ্দেশ্য যে, মানবেতিহাসের বিভিন্ন যুগে আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব পয়গম্বর এসেছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন মানুষ। নবুওয়াতের বিশিষ্ট গুণ বাদ দিলে অন্যান্য গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাঁরা দুনিয়ার অন্যান্য মানুষদের মতই মানুষ ছিলেন। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের গুণাবলী এবং খোদায়ীর সামান্যতম গন্ধও তাদের মধ্যে ছিল না। বরং নিজেদের প্রত্যেকটি প্রয়োজনের জন্য তারা সবসময় আল্লাহর সামনে হাত পাততেন। এই সংগে একই ঐতিহাসিক নজির থেকে আরো দু’টি কথাও সুস্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, নবীদের ওপর বিভিন্ন প্রকার বিপদ-আপদ এসেছে এবং তাদের বিরোধীরাও তাঁদেরকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে অস্বাভাবিক পদ্ধতিতে তাদেরকে সাহায্য করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সকল নবী একই দ্বীনের অনুসারী ছিলেন। এবং সেটি ছিল সেই দ্বীন যেটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পেশ করছেন। এটিই মানব সম্প্রদায়ের আসল ধর্ম। বাদবাকি যতগুলো ধর্ম দুনিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে সেগুলো নিছক পথভ্রষ্ট মানুষদের বিভেদাত্মক প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
। সবশেষে বলা হয়েছে, এ দ্বীনের অনুকরণ ও অনুসরণের ওপরই মানুষের নাজাত ও মুক্তি নির্ভরশীল। যারা এ দ্বীন গ্রহণ করবে তারাই আল্লাহর শেষ আদালত থেকে সফলকাম হয়ে বের হয়ে আসবে এবং তারাই হবে এ পৃথিবীর উত্তরাধিকারী। আর যারা তাকে প্রত্যাখান করবে তারা আখেরাতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট পরিণতির সম্মুখীন হবে। শেষ বিচারের সময় আসার আগেই আল্লাহ নিজের নবীর মাধ্যমে মানুষকে এ সত্য সম্পর্কে অবহিত করে চলছেন, এটি তাঁর বিরাট মেহেরবানী। এ অবস্থায় নবীর আগমনকে যারা নিজেদের জন্য রহমতের পরিবর্তে ধ্বংস মনে করে তারা অজ্ঞ ও মূর্খ ছাড়া আর কিছুই নয়।
# এর অর্থ হচ্ছে, কিয়ামত নিকটবর্তী। অর্থাৎ লোকদের নিজেদের কাজের হিসেব দেবার জন্য তাদের রবের সামনে হাজির হবার সময় আর দূরে নেই। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন একথারই আলামত যে, মানবজাতির ইতিহাস বর্তমানে তার শেষ পর্যায়ে প্রবেশ করছে। এখন সে তার সূচনাকালের পরিবর্তে পরিণামের বেশী নিকটবর্তী হয়ে গেছে। সূচনা ও মধ্যবর্তীকালীন পর্যায় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং এবার শেষ পর্যায় শুরু হয়ে গেছে। নবী ﷺ তাঁর একটি হাদীসে একথাই বলেছেন। তিনি নিজের হাতের দু’টি আঙ্গুল পাশাপাশি রেখে বলেনঃ
بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةَ كَهَاتَيْنِ
“আমার আগমন এমন সময়ে ঘটেছে যখন আমি ও কিয়ামত এ দু’টি আঙ্গুলের মতো অবস্থান করছি।” অর্থাৎ আমার পরে শুধু কিয়ামতই আছে, মাঝখানে অন্য কোন নবীর আগমনের অবকাশ নেই। যদি সংশোধিত হয়ে যেতে চাও তাহলে আমার দাওয়াত গ্রহণ করে সংশোধিত হও। আর কোন সুসংবাদদানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী আসবেন না।
# কোন সতর্ক সংকেত ও সতর্কবাণীর প্রতি দৃষ্টি দেয় না। নিজেরাও পরিণামের কথা ভাবে না, আর যে নবী তাদেরকে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন তাঁর কথাও শোনে না।
# কুরআনের যে নতুন সূরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল হয় এবং তাদেরকে শুনানো হয়।
# وَهُمْ يَلْعَبُونَ —এর দু’টি অর্থ হতে পারে। একটি অর্থ ওপরে অনুবাদে গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে খেলা মানে হচ্ছে এই জীবনের খেলা। আল্লাহ ও আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল লোকেরা এ খেলা খেলছে। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে এই যে, তারা গুরুত্ব ও মনোযোগ সহকারে তা শোনে না বরং খেলা, ঠাট্রা-তামাসা ও কৌতুকচ্ছলে তা শুনে থাকে।
# “পড়ে যেতে থাকবে” —ও অনুবাদ হতে পারে এবং দু’টি অর্থই সঠিক। মক্কার যেসব বড় বড় কাফের সরদাররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের মোকাবিলা করার চিন্তায় বড়ই পেরেশান হয়ে পড়েছিল তারাই পরস্পর বসে বসে এই কানাকানি করতো। তারা বলতো, এ ব্যক্তি তো কোনক্রমে নবী হতেই পারে না। কারণ এতো আমাদেরই মতো মানুষ, খায় দায়, বাজারে ঘুরে বেড়ায়, স্ত্রী-সন্তানও আছে। কাজেই এর মধ্যে এমন নতুন কথা কি আছে যা তাঁকে আমাদের থেকে বিশিষ্ট করে এবং আমাদের মোকাবিলায় তাঁকে আল্লাহর সাথে একটি অস্বাভাবিক সম্পর্কের অধিকারী করে? তবে কিনা এ ব্যক্তির কথাবার্তায় এবং এর ব্যক্তিত্বের মধ্যে যাদু আছে। ফলে যে ব্যক্তি এর কথা কান লাগিয়ে শোনে এবং এর কাছে যায়, সে এর ভক্ত হয়ে পড়ে। কাজেই যদি নিজের ভালো চাও তাহলে এর কথায় কান দিয়ো না এবং এর সাথে মেলামেশা করো না। কারণ এর কথা শোনা এবং এর নিকটে যাওয়া সুস্পষ্ট যাদুর ফাঁদে নিজেকে আটকে দেয়ার মতই।
যে কারণে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে “যাদু”র অভিযোগ আনতো তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত প্রাচীন সীরাত লেখক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (মৃত্যু ১৫২ হিঃ) তাঁর সীরাত গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, একবার উতবা ইবনে আবী রাবীআহ (আবু সুফিয়ানের শ্বশুর এবং কলিজা খাদক হিন্দার বাপ) কুরাইশ সরদারদেরকে বললো, যদি আপনারা পছন্দ করেন তাহলে আমি গিয়ে মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাত করি এবং তাকে বুঝাবার চেষ্টা করি। এটা ছিল হযরত হামযার (রা.) ইসলাম গ্রহণের পরবর্তীকালের ঘটনা। তখন নবী করীমের ﷺ সাহাবীগণের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছিল এবং এ অবস্থা দেখে কুরাইশ সরদাররা বড়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিল। লোকেরা বললো, হে আবুল ওলীদ! তোমার প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। তুমি অবশ্যি গিয়ে তার সাথে কথা বলো। সে নবী করীমের ﷺ কাছে গিয়ে বললো, “হে ভাতিজা! আমাদের এখানে তোমার যে মর্যাদা ছিল তা তুমি নিজেই জানো এবং বংশের দিক দিয়েও তুমি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তুমি নিজের জাতির ওপর একটি বিপদ চাপিয়ে দিয়েছো? তুমি সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করেছো। সমগ্র জাতিকে বোকা ঠাউরেছো। তার ধর্ম ও উপাস্যদের দুর্নাম করেছো। মৃত বাপ-দাদাদের সবাইকে তুমি পথভ্রষ্ট ও কাফের বানিয়ে দিয়েছো। হে ভাতিজা! যদি এসব কথা ও কাজের মাধ্যমে দুনিয়ায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করাই তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে এসো আমরা সবাই মিলে তোমাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ দিয়ে দেবো যে, তুমি সবচেয়ে বড় ধনী হয়ে যাবে। নেতৃত্ব চাইলে আমরা তোমাকে নেতা মেনে নিচ্ছি। বাদশাহী চাইলে তোমাকে বাদশাহ বানিয়ে দিচ্ছি। আর যদি তোমার কোন রোগ হয়ে থাকে যে কারণে সত্যিই তুমি শয়নে-জাগরণে কিছু দেখতে পাচ্ছো, তাহলে আমরা সবাই মিলে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের সহায়তায় তোমার রোগ নিরাময় করবো।” এসব কথা সে বলতে থাকলো এবং নবী ﷺ নীরবে সব শুনতে থাকলেন। যখন সে যথেষ্ট বলে ফেলেছে তখন নবী করীম ﷺ বললেন, “আবুল ওলীদ! আপনি যা কিছু বলতে চান সব বলে শেষ করেছেন, নাকি এখনো কিছু বলার বাকি আছে?” সে বললো, হ্যাঁ আমার বক্তব্য শেষ। তখন তিনি বললেন, আচ্ছা, তাহলে এখন আপনি আমার কথা শুনুন,
حم – تَنْزِيلٌ مِنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِبِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ,
এরপর কিছুক্ষণ পর্যন্ত তিনি একনাগাড়ে সূরা হা-মীম আস সাজদাহ তেলাওয়াত করতে থাকলেন এবং উতবা পেছনে মাটির ওপর হাত ঠেকিয়ে দিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকলো। আটতিরিশ আয়াতে পৌঁছে তিনি সিজদা করলেন এবং তারপর মাথা উঠিয়ে উতবাকে বললেন, “হে আবুল ওলীদ! আমার যা কিছু বলার ছিল তা আপনি শুনে নিয়েছেন, এখন আপনার যা করার আপনি করবেন।”
উতবা এখান থেকে উঠে কুরাইশ সরদারদের কাছে ফিরে যেতে লাগলো। লোকেরা তাকে দূর থেকে আসতে দেখে বললো, “আল্লাহর কসম, আবুল ওলীদের চেহারা পাল্টে গেছে। যে চেহারা নিয়ে সে এখান থেকে গিয়েছিল এটা সে চেহারা নয়। তার ফিরে আসার সাথে সাথেই লোকেরা প্রশ্ন করলো, “বলো, হে আবুল ওলীদ! তুমি কি করে এলে? ” সে বললো, আল্লাহর কসম, আজ আমি এমন কালাম শুনেছি যা এর আগে কখনো শুনিনি। আল্লাহর কসম এ কবিতা নয়, যাদুও নয়, গণৎকারের ভবিষ্যদ্বাণীও নয়। হে কুরাইশ জনতা! আমার কথা মেনে নাও এবং এ ব্যক্তিকে এর অবস্থার ওপর ছেড়ে দাও। এর যেসব কথা আমি শুনেছি তা একদিন স্বরূপে প্রকাশিত হবেই। যদি আরবরা তার ওপর বিজয়ী হয় তাহলে তোমাদের ভাইয়ের রক্তপাতের দায় থেকে তোমরা মুক্ত থাকবে, অন্যেরা তার দায়ভার বহন করবে। আর যদি সে আরবদের ওপর বিজয়ী হয় তাহলে তার শাসন কর্তৃত্ব হবে তোমাদেরই শাসন কর্তৃত্ব এবং তার সম্মান তোমাদেরই সম্মানে রূপান্তরিত হবে।” লোকেরা বললো, “আল্লাহর কসম, হে আবুল ওলীদ! তুমিও তার যাদুতে আক্রান্ত হয়েছো।” সে বললো, “এটা আমার ব্যক্তিগত মত। এখন তোমরা নিজেরাই তোমাদের সিদ্ধান্ত নেবে। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, ৩১৩-১১৪পৃঃ) ইমাম বায়হাকী এ ঘটনা সম্পর্কে যেসব বর্ণনা সংগ্রহ করেছেন তার একটিতে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে, যখন নবী করীম ﷺ সূরা হা-মীম সাজদাহ তেলাওয়াত করতে করতে এ আয়াতে পৌঁছে গেলেন-
فَإِنْ أَعْرَضُوا فَقُلْ أَنْذَرْتُكُمْ صَاعِقَةً مِثْلَ صَاعِقَةِ عَادٍ وَثَمُودَ
(তবুও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে বলে দাও, আমি তো তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি এমন একটি আকস্মিক আযাবে পতিত হওয়া থেকে, যেমন আযাবে পতিত হয়েছিল আদ ও সামূদ।) তখন উতবাহ স্বতস্ফূর্তভাবে সামনের দিকে এগিয়ে এসে তাঁর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে উঠলো, আল্লাহর দোহাই নিজের জাতির প্রতি করুণা করো।
দ্বিতীয় ঘটনাটি ইবনে ইসহাক এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ একবার আরাশ গোত্রের একজন লোক কিছু উট নিয়ে মক্কায় এলো। আবু জেহেল তার উটগুলো কিনে নিলো। যখন সে দাম চাইলো তখন আবু জেহেল টালবাহানা করতে লাগলো। আরাশী ব্যক্তি বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত একদিন কা’বার হারামে কুরাইশ সরদারদেরকে ধরলো এবং প্রকাশ্য সমাবেশে ফরিয়াদ করতে থাকলো। অন্যদিকে হারাম শরীফের অন্য প্রান্তে নবী ﷺ বসে ছিলেন। কুরাইশ সরদাররা তাকে বললো, “আমরা কিছুই করতে পারবো না। দেখো, ঐ দিকে ঐ কোণে যে ব্যক্তি বসে আছে তাকে গিয়ে বলো। সে তার কাছ থেকে তোমার টাকা আদায় করে দেবে।” আরাশী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কুরাইশ সরদাররা পরস্পর বলতে লাগলো, “এবার মজা হবে।” আরাশী গিয়ে নবী করীমের ﷺ কাছে নিজের অভিযোগ পেশ করলো, তিনি তখনই উঠে দাঁড়ালেন এবং তাকে নিয়ে আবু জেহেলের গৃহের দিকে রওয়ানা দিলেন। সরদাররা তাদের পেছনে একজন লোক পাঠিয়ে দিল। আবু জেহেলের বাড়ীতে কি ঘটে তা সে সরদারদেরকে জানাবে। নবী ﷺ সোজা আবু জেহেলের দরজায় পৌঁছে গেলেন এবং শিকল ধরে নাড়া দিলেন। সে জিজ্ঞেস করলো “কে? ” তিনি জবাব দিলেন, “মুহাম্মাদ।” সে অবাক হয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। তিনি তাকে বললেন, “এ ব্যক্তির পাওনা দিয়ে দাও।” সে কোন দ্বিরুক্তি না করে ভেতরে চলে গেলো এবং উটের দান এনে তার হাতে দিল। এ অবস্থা দেখে কুরাইশদের প্রতিবেদক হারাম শরীফের দিকে দৌড়ে গেলো এবং সরদারদেরকে সমস্ত ঘটনা শুনাবার পর বললো, আল্লাহর কসম, আজ এমন বিস্ময়কর ব্যাপার দেখলাম, যা এর আগে কখনো দেখিনি। হাকাম ইবনে হিশাম (অর্থাৎ আবু জেহেল) যখন গৃহ থেকে বের হয়ে মুহাম্মাদকে দেখলো তখনই তার চেহারার রং ফিকে হয়ে গেলো এবং যখন মুহাম্মাদ তাকে বললো, তার পাওনা দিয়ে দাও তখন এমন মনে হচ্ছিল যেন হাকাম ইবনে হিশামের দেহে প্রাণ নেই। (ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড ২৯-৩০ পৃঃ)
এ ছিল ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের প্রভাব। আবার অন্যদিকে ছিল কালাম ও বাণীর প্রভাব, যাকে তারা যাদু মনে করতো এবং অজ্ঞ ও অনভিজ্ঞ লোকদেরকে এ বলে ভয় দেখাতো যে, এ লোকটির কাছে যেয়ো না, কাছে গেলেই তোমাদেরকে যাদু করে দেবে। ( সীরাতে ইবনে হিশাম, অনলাইন সংস্করণ পড়তে পারেন )
# নবী কখনো মিথ্যা প্রচারণা ও গুজব রটনার এই অভিযানের (Whispering Campaign) জবাবে এছাড়া অন্য কোন কথা বলেননি যে, “তোমরা যেসব কথা তৈরী করো, সেগুলো জোরে জোরে বলো বা চুপিসারে কানে কানে বলো, আল্লাহ সবই শোনেন ও জানেন। তিনি কখনো অন্যায়পন্থী শত্রুর সাথে মুখোমুখি বিতর্ক করেন না।
# এর পটভূমি হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের প্রভাব যখন ছড়িয়ে পড়তে লাগলো, মক্কার সরদাররা পরস্পর পরামর্শ করে এ সিদ্দান্তে পৌঁছলো যে, তাঁকে মোকাবিলা করার জন্য একটি জোরদার প্রচারাভিযান চালাতে হবে। মক্কায় যিয়ারত করার জন্য যে ব্যক্তিই আসবে তার মনে পূর্বাহ্ণেই তাঁর বিরুদ্ধে এত বেশী কুধারণা সৃষ্টি করে দিতে হবে যার ফলে সে তার কোন কথায় কান দিতে রাজিই হবে না। এমনিতে এ অভিযান বছরের বারো মাসই জারি থাকতো কিন্তু বিশেষ করে হজ্জের মওসুমে বিপুল সংখ্যক লোক চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হতো, তারা বাইর থেকে আগত সকল যিয়ারতকারীর তাঁবুতে গিয়ে তাদেরকে এই বলে সতর্ক করে দিতো যে, এখানে এমন এমন ধরনের একজন লোক আছে, তার ব্যাপারে সাবধান থেকো। এসব আলোচনার সময় নানান ধরনের কথা বলা হতো। কখনো বলা হতো, এ ব্যক্তি যাদুকর। কখনো বলা হতো, সে নিজেই একটা বাণী রচনা করে বলছে এটা আল্লাহর বাণী। কখনো বলা হতো, আরে হ্যাঁ তা আবার এমন কি বাণী! ডাহা পাগলের প্রলাপ এবং অগোছালো চিন্তার একটা আবর্জনা স্তুপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কখনো বলা হতো, কিছু কবিত্বমূলক ভাব-কল্পনা ও ছন্দ-গাঁথাকে সে আল্লাহর বাণী নাম দিয়ে রেখেছে। যেনতেনভাবে লোকদেরকে প্রতারিত করাই ছিল উদ্দেশ্য। কোন একটি কথার ওপর অবিচল থেকে একটি মাপাজোকা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারা পেশ করছিল না। কারণ সত্যের কোন প্রশ্নই তাদের সামনে ছিল না। কিন্তু এ মিথ্যা প্রচারণার ফল যা হলো তা হচ্ছে এই যে, তারা নিজেরাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম দেশের সবর্ত্র ছড়িয়ে দিল। মুসলমানদের বছরের পর বছরের প্রচেষ্টায় তার যে প্রচার ও পরিচিত হওয়া সম্ভবপর ছিল না কুরাইশদের এ বিরোধিতার অভিযানে তা মাত্র সামান্য কিছু সময়ের মধ্যেই হয়ে গেলো। প্রত্যেক ব্যক্তির মনে একটি প্রশ্ন জাগলো, যার বিরুদ্ধে এ বিরাট অভিযান, এ মারাত্মক অভিযোগ, কে সেই ব্যক্তি? আবার অনেকে ভাবলো, তার কথা তো শোনা উচিত। আমরা তো আর দুধের শিশু নই যে, অযথা তার কথায় পথভ্রষ্ট হবো।
এর একটি মজার দৃষ্টান্ত হচ্ছে তোফাইল ইবনে আমর দাওসীর ঘটনা। ইবনে ইসহাক বিস্তারিত আকারে তাঁর নিজের মুখেই এ ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলছেনঃ আমি দাওস গোত্রের একজন কবি ছিলাম। কোন কাজে মক্কায় গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছতেই কুরাইশদের কয়েকজন লোক আমাকে ঘিরে ফেললো এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে আমাকে অনেক কথা বললো। ফলে তাঁর সম্পর্কে আমার মনে খারাপ ধারণা জন্মালো। আমি স্থির করলাম, তাঁর কাছ থেকে দূরে থাকবো। পরদিন আমি হারাম শরীফে গেলাম। দেখলাম তিনি কা’বা গৃহের কাছে নামায পড়ছেন। তাঁর মুখ নিঃসৃত কয়েকটি বাক্য আমার কানে পড়লো। আমি অনুভব করলাম, বড় চমৎকার বাণী। মনে মনে বললাম, আমি কবি, যুবক, বুদ্ধিমান। আমি কোন শিশু নই যে, ঠিক ও বেঠিকের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবো না। তাহলে এ ব্যক্তি কি বলেন, এঁর সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করি না কেন। তাই নবী ﷺ যখন নামায শেষ করে চলে যেতে লাগলেন তখন আমি তাঁর পিছু নিলাম। তাঁর গৃহে পৌঁছে তাঁকে বললাম, আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা আপনার সম্পর্কে আমাকে এসব কথা বলেছিল, ফলে আমি আপনার ব্যাপারে এতই খারাপ ধারণা পোষণ করেছিলাম যে, নিজের কানে তুলো ঠেসে দিয়েছিলাম, যাতে আপনার কথা শুনতে না পাই। কিন্তু এখনই যে কয়েকটি বাক্য আমি আপনার মুখ থেকে শুনেছি তা আমার কাছে বড়ই চমৎকার মনে হয়েছে। আপনি কি বলেন, আমাকে একটু বিস্তারিতভাবে জানান। জবাবে নবী ﷺ আমাকে কুরআনের একটি অংশ শুনালেন। তাতে আমি এত বেশী প্রভাবিত হয়ে পড়লাম যে, তখনই ইসলাম গ্রহণ করে ফেললাম। সেখান থেকে ফিরে গিয়ে আমি নিজের পিতা ও স্ত্রীকে মুসলমান করলাম। এরপর নিজের গোত্রের মধ্যে অবিরাম ইসলাম প্রচারের কাজ করতে লাগলাম। এমন কি খন্দকের যুদ্ধের সময় পর্যন্ত আমার গোত্রের সত্তর আশিটি পরিবার ইসলাম গ্রহণ করে ফেললো। (ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড, ২২-২৪ পৃঃ)
ইবনে ইসহাক যে আর একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন তা থেকে জানা যায় যে, কুরাইশ সরদাররা নিজেদের মাহফিলগুলোতে নিজেরাই একথা স্বীকার করতো যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে তারা যেসব কথা তৈরী করে সেগুলো নিছক মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি লিখেছেনঃ একটি মজলিসে নযর ইবনে হারেস বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলে, “তোমরা যেভাবে মুহাম্মাদের মোকাবিলা করছো তাতে কোন কাজ হবে না। সে যখন যুবক ছিল তখন তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সদাচারী ব্যক্তি ছিল। সবচেয়ে বড় সত্যনিষ্ঠ ও সবচেয়ে বেশী বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিত ছিল। আর এখন তার চুল সাদা হতে যাচ্ছে, এখন তোমরা বল কিনা সে যাদুকর, গণক, কবি, পাগল। আল্লাহর কসম সে যাদুকর নয়। আমি যাদুকরদের দেখেছি এবং তাদের ঝাড়ফুঁক সম্পর্কেও জানি। আল্লাহর কসম, সে গণক নয়। আমি গণকদের তন্ত্রমন্ত্র শুনেছি, তারা যেসব রহস্যময় ও বহুমুখী কথা বলে থাকে তা আমি জানি। আল্লাহর কসম, সে কবিও নয়। কবিতার বিভিন্ন প্রকারের সাথে আমি পরিচিত। তাঁর বাণী এর কোন প্রকারের মধ্যেই পড়ে না। আল্লাহর কসম, সে পাগলও নয়। পাগল যে অবস্থায় থাকে এবং সে যে প্রলাপ বকে সে ব্যাপারে কি আমরা কেউ অনভিজ্ঞ? হে কুরাইশ সরদাররা! অন্য কিছু চিন্তা করো। তোমরা যে বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছো এসব ঠুনকো কথায় তাঁকে পরাজিত করবে, ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়।” এরপর সে এই প্রস্তাব পেশ করলো, আরবের বাহির থেকে রুস্তম ও ইসফিনদিয়ারের কাহিনী এনে ছড়াতে হবে। লোকেরা সেদিকে আকৃষ্ট হবে এবং তা তাদের কাছে কুরআনের চাইতেও বেশী বিস্ময়কর মনে হবে। সেই অনুসারে কিছুদিন এই পরিকল্পনা কার্যকর করার কাজ চলতে লাগলো এবং নযর নিজেই গল্প বলার কাজ শুরু করে দিল। (ইবনে হিশাম, ১ খণ্ড, ৩২০-৩২১পৃঃ) ( সীরাতে ইবনে হিশাম, অনলাইন সংস্করণ পড়তে পারেন )
#.এ সংক্ষিপ্ত বাক্যে নিদর্শন দেখাবার দাবীর যে জবাব দেয়া হয়েছে তার মধ্যে তিনটি বিষয় রয়েছে। এক, পূর্ববর্তী রসূলদেরকে যে ধরনের নিদর্শন দেয়া হয়েছিল তোমরা তেমনি ধরনের নিদর্শন চাচ্ছো? কিন্তু তোমরা ভুলে যাচ্ছো হঠকারী লোকেরা সেসব নিদর্শন দেখেও ঈমান আনেনি। দুই, তোমরা নিদর্শনের দাবী তো করছো কিন্তু একথা মনে রাখছো না যে, সুস্পষ্ট মু’জিযা স্বচক্ষে দেখে নেবার পরও যে জাতি ঈমান আনতে অস্বীকার করেছে তারা এরপর শুধু ধ্বংসই হয়ে গেছে। তিন, তোমাদের চাহিদা মতো নিদর্শনাবলী না পাঠানো তো তোমাদের প্রতি আল্লাহর একটি বিরাট মেহেরবানী। কারণ এ পর্যন্ত তোমরা আল্লাহর হুকুম শুধুমাত্র অস্বীকারই করে আসছো কিন্তু এজন্য তোমাদের ওপর আযাব পাঠানো হয়নি। এখন কি তোমরা নিদর্শন এজন্য চাচ্ছো যে, যেসব জাতি নিদর্শন দেখার পরও ঈমান আনেনি এবং এজন্য তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে তোমরাও তাদের মতো একই পরিণতির সম্মুখীন হতে চাও?
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
সংক্ষিপ্ত আলােচনা : এ সূরাটা মক্কী। অন্যান্য মক্কী সূরার মতােই এর প্রধান আলােচ্য বিষয় হলাে আকীদা বিশ্বাস সংক্রান্ত তথা তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত। এই আকীদাগত বিষয়গুলাে এ সূরায় প্রাকৃতিক জগতের বড়ো বড়াে নিয়ম ও উপাদানের বিবরণ দানের মাধ্যমে এবং আকীদা বিশ্বাসকে তার সাথে সংযুক্ত করণের মাধ্যমে আলােচিত হয়েছে। বস্তুত আকীদা বিশ্বাস মহাবিশ্বের সৃষ্টিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা তার প্রধান প্রধান নিয়ম ও উপাদানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। এইসব নিয়ম ও উপাদান সেই মহাসত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যার ওপর আকাশ ও পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে এবং সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, যার ভিত্তিতে আকাশ ও পৃথিবী পরিচালিত। এইসব প্রাকৃতিক নিয়ম ও উপাদান এবং এই মহাবিশ্ব মােটেই উদ্দেশ্যহীন ও লক্ষ্যহীন নয়, নয় তা নেহাত লীলাখেলা। যেমন আল্লাহ তায়ালা সুরা দোখানে বলেছেন, ‘আমি আকাশ ও পৃথিবীকে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।’ এ জন্যে সূরাটা মানুষের হৃদয়, দৃষ্টি ও চিন্তাধারাকে মহাবিশ্বের কয়েকটা জোড়া জোড়া অংশ যথা আকাশ ও পৃথিবী, পাহাড় ও সমতল, দিন ও রাত এবং সূর্য ও চন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে এইসব সৃষ্টিকে পরিচালনা ও শাসনকারী প্রাকৃতিক বিধানের একত্বের দিকে। এই প্রাকৃতিক বিধানের একত্ব দ্বারা যে প্রাকৃতিক জগত তথা সমগ্র মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও অধিপতির একত্বই প্রমাণিত হয় সে বিষয়ের দিকেও তার মনােযােগ আকর্ষণ করেছে। এ কথাও উপলব্ধি করার আবেদন জানানাে হয়েছে যে, মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে যেমন অন্য কেউ আল্লাহর সাথে শরীক ছিলাে না, তেমনি তার মালিকানা, আধিপত্য ও কর্তৃত্বেও কেউ তার অংশীদার নেই। বলা হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যদি আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য প্রভুও থাকতাে, তাহলে সে দুটোই ধ্বংস হয়ে যেতাে। এরপর মানুষের বিবেককে এ কথা উপলব্ধি করার আহ্বান জানানাে হয়েছে যে, পৃথিবীর অভ্যন্তরের প্রাণীজগত একই প্রাকৃতিক নিয়মে পরিচালিত ও শাসিত এবং সমুদয় প্রাণীর জীবন একই উৎস থেকে উৎসারিত। বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকটি প্রাণীকে আমি পানি থেকে তৈরী করেছি।’ এমনকি সমুদয় প্রাণীর জীবনের পরিসমাপ্তিও ঘটে একইভাবে, ‘প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবেই’ এবং মৃত্যুর পরে সবাই একই গন্তব্যের দিকে ফিরে যাবে। অতপর তােমরা আমার দিকেই ফিরে আসবে।’ তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত সংক্রান্ত মৌল আকীদা সেসব প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক উপাদান ও নিয়মের সাথে যােগসূত্র স্থাপন করে। এই আকীদাও চিরদিন এক ও অভিন্ন, যদিও যুগে যুগে বহু নবী ও রসূল দুনিয়ায় এসেছেন, ‘আমি তােমার পূর্বে যাকেই রসূল করে পাঠিয়েছি, তার কাছে এই ওহীই পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া আর কোনাে ইলাহ নেই, তাই তােমরা একমাত্র আমারই এবাদাত করাে।’ রসূলরা সবাই মানুষের মধ্য থেকেই জন্ম নিক, এটাই আল্লাহর শাশ্বত ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমার পূর্বে আমি শুধু কিছু মানুষকেই রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি।’ ইসলামী আকীদা বিশ্বাস যেমন মহাবিশ্বের বড়াে বড়াে নিয়ম কানুন ও উপাদানের সাথে যােগসূত্র স্থাপন করে, এই আকীদা বিশ্বাসের পার্থিব বৈশিষ্ট্যগুলােও তেমনি। তাই বিশ্ব প্রকৃতির চিরন্তন রীতি হলাে, চূড়ান্ত পর্যায়ে বিশ্বে সত্যই বিজয়ী এবং বাতিল পরাজিত হবে। সত্য হচ্ছে মহাবিশ্বের অন্যতম স্তম্ভ এবং তার বিজয় আল্লাহর শাশ্বত নীতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বরং আমি সত্যকে বাতিলের ওপর নিক্ষেপ করি, ফলে তা বাতিলকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং বাতিল বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ অনুরূপ, অত্যাচারী ও মিথ্যা আরােপকারীদের ধ্বংস এবং রসূল ও মােমেনদের মুক্তি লাভও আল্লাহর এক চিরন্তন নীতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতপর আমি তাদের প্রতিশ্রুতি সত্যে পরিণত করেছি, তাদেরকে ও অন্য যাদেরকে ইচ্ছা করেছি, মুক্তি দিয়েছি এবং সীমালংঘনকারীদের ধ্বংস করেছি।’ পৃথিবী আল্লাহ সৎ লােকদের অধিকারভুক্ত থাকুক এটাও আল্লাহর অন্যতম নীতি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি যাবুরে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎ বান্দারাই পৃথিবীর মালিক হবে।’ এ জন্যে এই সূরায় সকল রাসূলের উম্মতদেরকে একই উম্মত গণ্য করে তাদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করা হয়েছে এবং সে আলােচনা সূরার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে অবস্থান করছে। হযরত ইবরাহীম(আ.) সংক্রান্ত আলােচনা কিছুটা দীর্ঘ হয়েছে। কিন্তু হযরত দাউদ, সোলায়মান, নূহ, মূসা, হারুন, লূত, ইসমাঈল, ইদ্রীস, যুলকিফল, যুন্নুন, যাকারিয়া ও ইয়াহিয়া(আ.) সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে অত্যন্ত সংক্ষেপে। এ আলােচনার মধ্য দিয়ে সূরার শুরুতে আলােচিত তত্ত্বসমূহকে বাস্তব ঘটনার আকারে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। সেখানে যা সাধারণ নীতিমালা ও আদর্শের আকারে বিবৃত হয়েছে, পরবর্তীতে তা নবীদের জীবন ও আন্দোলনের ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে বাস্তবতার রূপ নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। সুরায় কেয়ামতের কিছু দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে। এসব দৃশ্যের মধ্য দিয়েও সে সব তত্ত্ব ও নীতিমালা কেয়ামতের বাস্তবতার আকারে মূর্ত হয়ে উঠেছে। এভাবে সূরার বিভিন্ন দৃশ্য একই লক্ষ্যের ওপর কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সেই লক্ষ্য হলাে মানুষের মনকে সেই মহাসত্য উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করা, যা শেষনবী(স.) এর আনীত আকীদা ও আদর্শে প্রতিফলিত হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জিত হলে মানুষ সেই মহাসত্য সম্পর্কে উদাসীন ও বিমুখ থাকতে পারবে না। এই মহাসত্য সম্পর্কে তাদের উদাসীনতা ও বিমুখতার বিষয়টি সূরার প্রথম তিন আয়াত জুড়ে আলােচিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘মানুষের হিসেব গ্রহণের সময় ঘনিয়ে এসেছে, অথচ তারা তা থেকে উদাসীন ও বিমুখ রয়েছে'(১-৩) মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর এই সৃষ্টিজগত যেমন সত্য ও গুরুগম্ভীর বাস্তবতা, নবী ও রসূলদের আনীত বাণী ও দাওয়াতও তেমনি সত্য ও গুরুগম্ভীর বাস্তবতা। কাজেই তা ঠাট্টা ও উপহাস করে যেমন উড়িয়ে দেয়া চলে না। তেমনি তার সমর্থনে অলৌকিক ঘটনাবলী দেখতে চাওয়াও সমীচীন নয়। গােটা বিশ্ব নিখিলে বিদ্যমান আল্লাহর নিদর্শনাবলী ও চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়মাবলী যখন সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, এই সমুদয় সৃষ্টির তিনিই একমাত্র স্রষ্টা, একমাত্র সর্বশক্তিমান সত্ত্বা এবং নবীর আনীত বাণী ও বার্তা সেই অসীম শক্তিধর একক স্রষ্টার কাছ থেকেই এসেছে, তখন এর প্রমাণ হিসেবে আর কোনাে অলৌকিক ঘটনার দাবী সংগত নয়। শব্দ ও সুরের দিক দিয়ে এ সূরার সার্বিক কাঠামাে প্রতিবেদনমূলক এবং তার আলােচ্য বিষয় ও পূর্বাপর পটভূমির সাথে তার পূর্ণ সময় বিদ্যমান। সূরা মারইয়াম ও সূরা ত্বা-হার সাথে এ সূরার তুলনা করলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়। সে দুটো সূরার সুর অত্যন্ত উদার ও বিনীত এবং সূরা দুটোর সার্বিক পটভূমির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর এ সূরার সুর গম্ভীর, স্থিতিশীল এবং সূরার আলােচ্য বিষয় ও পটভূমির সাথে সংগতিশীল। এই পার্থক্যটা তখন আরাে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন সূরা মরিয়ম ও আলােচ্য সূরায় হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনীর বর্ণনাধারার তুলনামূলক পর্যালােচনা করা হয়। সূরা মারইয়ামে হযরত ইবরাহীম(আ.) ও তার পিতার মধ্যে উদার ও বিনীত কথােপকথন তুলে ধরা হয়েছে। পক্ষান্তরে এ সূরায় যে কথােপকথন হয়েছে, তা মূর্তিভাংগা ও ইবরাহীম(আ.)-কে আগুনে নিক্ষেপের মতাে চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এভাবে উভয় জায়গাতেই সূরার বর্ণনাভংগী শাব্দিক কাঠামাে, পটভূমি ও বিষয়বস্তুর মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় সাধিত হয়েছে। সূরা আম্বিয়ায় চারটি পর্ব বা অধ্যায় দেখা যায় প্রথম পর্বটা শুরু হয়েছে বিবেককে জোরদার আঘাত করে জাগিয়ে তােলা ও মন মগযকে প্রচন্ড ধাক্কা ও ঝাকুনী দিয়ে ভুলে যাওয়া আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচকিত করার মধ্য দিয়ে। এর প্রথম আয়াত হলাে ‘মানুষের হিসেব গ্রহণের সময় ঘনিয়ে আসছে, অথচ তারা উদাসীন ও বিমুখ…’ অতপর অতীতের জাতিগুলাের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্য বর্ণনাপূর্বক আরাে একটা ধাক্কা দেয়া হয়েছে, যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলী সম্পর্কে উদাসীন এবং বিভ্রান্তি ও অপরাধে নিমজ্জিত ছিলাে। ‘কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি, যারা যুলুম অত্যাচারে ডুবেছিলাে…'(আয়াত ১১-১৫) এরপর দাওয়াত ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে আদর্শ ও বাস্তবতার মাঝে এবং প্রাকৃতিক বিধি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আদর্শ ও বাস্তবতার মাঝে যােগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে। আরাে যােগসূত্র স্থাপন করা হয়েছে তাওহীদী আকীদা ও প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে, বিশ্ব জগতের স্রষ্টা ও বিধাতার একত্ব এবং সকল নবী ও রসূলের প্রচারিত আকীদা ও বিধানের অভিন্নতার মধ্যে, জীবনের আরম্ভ ও অবসান এবং উৎস ও পরিণতির অভিন্নতার মধ্যে। দ্বিতীয় পর্বটায় রসূল(স.)-এর সাথে ব্যাংগ বিদ্রুপকারী কাফেরদেরকে সম্বােধন করা হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, এমন অকাট্য সত্য ও গুরুতর বাস্তবতাকে উপহাস করা তােমাদের উচিত নয়। তাদের চারদিকে বিরাজমান গােটা পরিবেশ যখন সচেতন ও সচকিত হবার আহ্বান জানাচ্ছে তখন তা নিয়ে তামাশা করা এবং আযাব যখন আসন্ন, তখন আযাব পাঠানাের জন্যে তাড়াহুড়াে করা খুবই অন্যায় ও অসংগত। এখানে কেয়ামতের একটা দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে। অতীতে যারা নবীদেরকে ব্যংগ বিদ্রুপ করতাে, তাদের পরিণতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাদেরকে জানানাে হয়েছে যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে পারে এমন কেউ কোথাও নেই। মহান আল্লাহর অসীম শক্তিশালী হাত কিভাবে পৃথিবীকে চতুর্দিক থেকে সংকুচিত করে আনছে, সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যাতে তাদের প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধিজনিত উদাসীনতা থেকে সতর্ক ও সচেতন করা যায়। এ পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে রসূল(স.)-কে তাঁর আসল কর্তব্য সম্পর্কে সতর্ক করার মধ্য দিয়ে। যথা, ‘বলাে, আমি তাে শুধু ওহী দ্বারা তােমাদেরকে সতর্ক করছি।’ তাদের উদাসীনতার অশুভ পরিমাণ সম্পর্কে হুঁশিয়ারী দেয়া হয়েছে এই বলে, বধিররা কোনাে সতর্কবাণী শুনতে পায় না।’ আরাে বলা হয়েছে যে, তারা উদাসীন থাকতে থাকতে একদিন কেয়ামত এসে পড়বে এবং দাড়িপাল্লা স্থাপিত হয়ে যাবে। তৃতীয় পর্বে রয়েছে পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের পর্যালােচনা । এর মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে যে, সকল নবীর একই দাওয়াত, একই আকীদা বিশ্বাস ও একই ধর্ম ইসলাম নিয়ে এসেছিলেন, আল্লাহ তায়ালা তার সৎ বান্দাদের প্রতি রহমত নাযিল করেন, তাদেরকে আযাব থেকে রক্ষা করেন এবং কাফেরদেরকে পাকড়াও করেন। চতুর্থ ও সর্বশেষ পর্বে আলােচিত হয়েছে আখেরাত ও কেয়ামত প্রসংগ। সূরার শেষের কথাগুলাে প্রথম দিককার কথাগুলাের মতাে জোরদার সতর্কীকরণ মূলক। এবার আমরা প্রথম পর্ব নিয়ে বিশদ আলােচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি।
*ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও যারা উদাসীন : ‘মানুষের হিসেব নিকাশের সময় ঘনিয়ে এসেছে…'(আয়াত ১-৯) অলস ও উদাসীন লােকদেরকে এখানে একটা প্রচন্ড ধাকা দিয়ে সচকিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, হিসাব নিকাশের সময় ঘনিয়ে এসেছে, অথচ তারা উদাসীন। তাদের সামনে নিদর্শনাবলী তুলে ধরা হয়েছে। অথচ তারা হেদায়াত বিমুখ। পরিস্থিতি গুরুতর, অথচ তারা সে সম্পর্কে অচেতন। যখনই কোরআনের একটা নতুন আয়াত নাযিল হয়, অমনি তারা তার প্রতি বিদ্রুপ করে। বলা হয়েছে, তাদের হৃদয় উপহাসকারী। অথচ হৃদয় হলাে চিন্তা, গবেষণা ও বিবেচনার স্থান। এখানে এমন এক ধরনের মানুষের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, যারা কোনাে গুরুতর অবস্থাকেই গুরুতর মনে করে না, বরং গুরুতর অবস্থাকেও তারা হাসি তামাশার বিষয় গন্য করে এবং অতি পবিত্র ক্ষেত্রেও ধৃষ্টতাপূর্ণ ও বেয়াদবীপূর্ণ আচরণ করা হয়। তাদের কাছে ওহী যােগে যে বাণী আসে, তা তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আসা সত্তেও তাকে মস্করার বিষয়ে পরিণত করে। তার প্রতি কোনাে ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না। যারা সব কিছুকেই অবহেলার যােগ্য ভাবতে পারে, কোনাে কিছুর প্রতিই শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারে না, কোনাে কিছুকেই গুরুত্ব দেয় না, তারা নিজেরাই এক সময় গুরুত্বহীন ও মর্যাদাহীন হয়ে পতন ও বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হয়। মানবজীবনে তারা কোনাে মতে পতন ও বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পেলেও কোনাে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হয় না এবং তাদের জীবন হয়ে পড়ে নিস্ক্রিয়, স্থবির, মর্যাদাহীন ও মূল্যহীন । পবিত্র ও মহিমান্বিত জিনিসগুলােকে যারা অবহেলা ও তামাশার যােগ্য মনে করে, তারা এক ধরনের মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ। অবহেলা ও তামাশা হচ্ছে উদারতা ও সহনশীলতার পরিপন্থী। যাদের উদারতা ও সহিষ্ণুতা আছে, তারা দৃঢ়চেতা ও তীব্র অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ। আর যারা অবহেলা প্রবণ, তারা অনুভূতিহীন ও উদাসীন। পবিত্র কোরআন এখানে যাদের বিবরণ দিয়েছে, তারা কোরআনের বিরােধিতা করতো এ জন্যে যে, কোরআন একটা পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা, একটা পরিপূর্ণ আইন ও সংবিধান এবং পারস্পরিক আদান প্রদান ও আচার ব্যবহারের একটা পূর্ণাংগ বিধান। তারা ব্যংগ বিদ্রুপ ও হাসি তামাশার মাধ্যমে কোরআনকে প্রতিরােধ করতে চেষ্টা করতাে। তারা কেয়ামতের জবাবদিহিতার বিষয়টিকেও উদাসীনতার মাধ্যমে অগ্রাহ্য করতাে। এ ধরনের মানুষ সবযুগেই পাওয়া যায়। গুরুত্ববােধ, মর্যাদাবােধ ও শ্রদ্ধাবােধ যাদের ভেতরে নেই, তারা সেইসব বিকারগ্রস্ত রােগীর পর্যয়েই উপনীত হয়। যাদের চিত্র কোরআন এখানে তুলে ধরেছে। এই বদস্বভাব মানুষের গােটা জীবনকেই একটা অসার পরিহাসে পরিণত করে দেয়, যার কোনাে উদ্দেশ্যও নেই এবং যার কোনাে মূল্যও নেই। অথচ প্রকৃত মােমেনদের অবস্থা হলাে যে, এ সূরা তাদের মনকে দুনিয়ার প্রতিই বীতশ্রদ্ধ ও নিরাসক্ত করে তােলে। এ প্রসংগে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যাচ্ছে, আমাদীর রচিত হযরত আমের বিন রবীয়ার জীবন চরিতে আছে যে, একবার তার কাছে জনৈক মেহমান এসেছিলাে। তিনি সে মেহমানকে যথেষ্ট সম্মান ও সমাদর প্রদর্শন করেন। এতে সে এতাে অভিভূত হয় যে, পরবর্তীতে সে একটা ভূ-সম্পত্তির মালিক হওয়ার পর পুনরায় তার কাছে আসে এবং তাকে বলে, আমি রসূলুল্লাহর কাছ থেকে একটা ভূ-সম্পত্তি লাভ করেছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, সে সম্পত্তির একটা অংশ তােমাকে দেবে, যা দ্বারা তোমার ও তােমার বংশধরের উপকার হবে। আমের বললেন, তােমার যমীন দিয়ে আমার কাজ নেই। আজ এমন একটা সূরা নাযিল হয়েছে, যা আমাদেরকে দুনিয়া সম্পর্কে নিরাসক্ত করে দিয়েছে। সূরাটার শুরুতেই বলা হয়েছে, মানুষের হিসাব নিকাশ ঘনিয়ে এসেছে। অথচ তারা তা থেকে উদাসীন ও বিমুখ রয়েছে। এই হলাে জীবন্ত মুক্ত ও সচেতন এবং নির্জীব, একগুঁয়ে ও অবরুদ্ধ মনের পার্থক্য। নির্জীব ও একগুয়ে মন তার নির্জীবতাকে লুকানাের জন্যে ঠাট্টা বিদ্রুপের আশ্রয় নেয় এবং তার অকর্মন্যতাকে লুকানাের জন্যে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করে। এ ধরনের মনকে ওহীর বাণী দ্বাঁরা প্রভাবিত করা যায় না। কেননা তার মধ্যে আর কোনাে জীবনী শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। ‘যারা অপরাধীদের সাথে গােপন সলাপরামর্শ করে…’ ইতিপূর্বে কাফেররা নিজেদের মধ্যেই গােপন ষড়যন্ত্র ও সলাপরামর্শ করতাে। তারা রসূল(স.) সম্পর্কে বলতাে, ‘এই ব্যক্তি কি তােমাদের মতাে মানুষ ছাড়া আর কিছু তােমরা কি দেখে শুনেও যাদুর কাছে আসাে?’ মৃত ও জীবনী শক্তি থেকে বঞ্চিত মন নিয়ে এই কোরআনের মােকাবেলা করতে গিয়ে তাদের বুক দুরু দুরু করে কাঁপতাে। তাই কোরআনের অপ্রতিরােধ্য প্রভাবের প্রতিরােধ করার জন্যে তারা নানা ছলচাতুরি ও তালবাহানার আশ্রয় নিতাে। তারা বলতাে, মােহাম্মদ তাে অন্য দশজন মানুষের মতােই মানুষ। তােমরা নিজেদের মতােই একজন মানুষকে কিভাবে নবী হিসেবে মেনে নিতে পারাে? সে যা কিছু নিয়ে এসেছে, তাতাে যাদু ছাড়া কিছু নয়। তােমাদের চোখ থাকতে যাদুমন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত ও যাদুর অনুগত হও কিভাবে? এই পর্যায়ে রাসূল(স.) তাঁর নিজের কাজ ও বিরােধীদের অশুভ তৎরতার ব্যাপারটাকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেন। ইতিপূর্বে আল্লাহ তায়ালা তাদের গােপন ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন এবং যে ফন্দি ফিকির দিয়ে তারা কোরআনের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার অপচেষ্টা চালায়, তা রাসূল(স.)-কে জানান। ‘সে বললাে, আমার প্রতিপালক আকাশ ও পৃথিবীতে যে কথাই বলা হয় তা জানেন। তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশ্রোতা।’ অর্থাৎ তিনি যখন আকাশ ও পৃথিবীর যেখানে যা বলা হয় তা জানেন, তখন পৃথিবীর কোনাে জায়গায় বসে যে গােপন সলা-পরামর্শ করা হয়, যড়ন্ত্র আঁটা হয়, তা তিনি অবহিত হন এবং স্বীয় রসূলকে তা অবহিত করেন। তিনি তাে সব কিছুই জানেন ও শােনেন। তারা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাে যে, কোরআনকে কোন নামে আখ্যায়িত করবে এবং কিভাবে তা থেকে রেহাই পাবে। কখনাে তারা বলতাে, ওটা যাদুমন্ত্র । কখনাে বলতাে, ওসব হচ্ছে মোহাম্মদের দেখা রকমারি স্বপ্নের জগাখিচুড়ি বর্ণনা । আবার কখনাে বলতাে, ও হচ্ছে কবিতা। আবার কখনাে বলে, মােহাম্মদ(স.) নিজেই ওসব তৈরী করেছে আর দাবী করেছে যে, এগুলাে আল্লাহর তরফ থেকে নাযিল হওয়া ওহী। ‘ওরা বরং বলেছে যে, রকমারি বাজে স্বপ্ন, না বরং ওর মনগড়া কথা। বরং সে একজন কবি।’ এর কোনাে একটা কথার ওপরও তারা স্থির থাকেনি। কোনাে একটা মতের ওপরও তারা দৃঢ়তা দেখায়নি। কেননা তারা কেবল ওযর বাহানা ও ছল-ছুঁতো খুঁজেছে, যাতে তাদের মনের ওপর থেকে কোরআনের প্রভাবকে নানা কৌশলে ফেরাতে পারে। কিন্তু তা তারা পারেনি। তাই তারা এখন এক দাবী এবং তখন এক দাবী করতাে। এখন এক ছুঁতাে, তখন এক ছুঁতাে দেখাতাে। কোনাে বক্তব্যের ওপরই স্থির থাকতাে না, সব সময় অস্থির ও দিশেহারা থাকতাে। তারপর এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে কোরআনের পরিবর্তে পূর্ববর্তী জাতিগুলাের সামনে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটতাে সেগুলাের ঘটানাে দাবী জানাতাে। ‘সুতরাং মুহাম্মাদ(স.)-এর উচিত পূর্ববর্তী জাতিগুলাের মতাে আমাদের কাছেও কোনাে নিদর্শন নিয়ে আসা।’ অলৌকিক ঘটনাবলী ইতিপূর্বেও এসেছে। কিন্তু যাদের কাছে এসেছে, তারা ঈমান আনেনি। ফলে তাদের ওপর ধ্বংস নেমে এসেছে। অলৌকিক ঘটনাকে যারা মিথ্যা সাব্যস্ত করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়াই আল্লাহর নীতি। এই নীতি অনুসারেই তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে, ‘তাদের পূর্বে যেসব নগরকে আমি ধ্বংস করেছি, তারা ঈমান আনেনি।’ কারণ চর্মচক্ষু দিয়ে দেখা ও অন্তর দিয়ে অনুভব করা যায় এমন অলৌকিক ঘটনায়ও যে বিশ্বাস করে না, তার আর কোনাে ওযর-বাহানা গ্রহণযােগ্য থাকে না এবং তার সংশােধনের আর কোনো আশাও অবশিষ্ট থাকে না। তাই তারা ধ্বংসের যােগ্য হয়ে যায়। এ ধরনের অলৌকিক ঘটনা বহুবার ঘটানাে হয়েছে, বহুবার তাকে অবিশ্বাসও করা হয়েছে এবং অবিশ্বাসকারীদেরকে ধ্বংসও করা হয়েছে বহুবার। এখন মক্কার যেসব মােশরেক আবার ওই সব অলৌকিক ঘটনার দাবী জানাচ্ছে, তা যদি তাদের সামনে পুনরায় ঘটানােও হয়, তবে তারা যে ঈমান আনবে, তার কী নিশ্চয়তা আছে? তারাও তাে আগেকার ধ্বংসপ্রাপ্তদের মতােই মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘তারা কি ঈমান আনবে।’
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
সূরার নামকরণ:
الْأَنْبِيَاءِ আম্বিয়া শব্দটি নাবী শব্দের বহুবচন। এই সূরাতে একাধিক নাবী ও রাসূলের আলোচনা করা হয়েছে বিধায় একে সূরা আম্বিয়া নামে নামকরণ করা হয়েছে।
সূরাতে কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সে সম্পর্কে গাফেল, নাবীদের বৈশিষ্ট্য, পূর্ববর্তী কয়েকটি অবাধ্য জাতির ধ্বংস, একাধিক মা‘বূদ থাকলে কী সমস্যা হত এবং যে ফেরেশতাদেরকে অনেকে আল্লাহ তা‘আলার কন্যা মনে করে তারা মূলত তা নয় সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অতঃপর কয়েকজন নাবীর কাহিনী, তাদের আহ্বানে আল্লাহ তা‘আলার সাড়া দান, ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পিতা ও জাতিকে তাওহীদের দাওয়াত, দাওয়াত পেয়ে তাদের অবস্থান এবং সবশেষে জাহান্নামী ও জান্নাতীদের সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে আসা হয়েছে।
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
(اِقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সতর্ক করছেন যে, তাদের কৃতকর্মের হিসাব নেয়ার দিন তথা কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে। কারণ সময় যাচ্ছে কিয়ামত ঘনিয়ে আসছে, যতই সময় যাবে কিয়ামত ততই কাছে চলে আসবে। এভাবে একদিন কিয়ামত চলে আসবে আর প্রত্যেককে সেদিন ভাল-মন্দ সকল কর্মের হিসাব দিতে হবে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: কিয়ামতের দিন আদম সন্তান পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দেয়া পর্যন্ত এক পাও আগাতে পারবে না (১) জীবন কোন পথে ব্যয় করেছে, (২) তোমার যৌবনকাল কোন পথে ব্যয় করেছে, (৩) সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, (৪) এবং কোন পথে ব্যয় করেছে, (৫) জ্ঞানানুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। (মুসনাদে আবী ইয়ালা হা: ৫২৭১) অথচ মানুষ এসব থেকে উদাসীন রয়েছে। তারা এর জন্য এমন কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করছে না; যা কিয়ামতের দিন উপকারে আসবে। বরং দিন দিন অন্যায় কাজের দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন যাতে তারা মন্দ কার্যকলাপ ছেড়ে দিয়ে ভাল কাজের দিকে ধাবিত হয়। কেননা সেদিনের অবস্থা হবে খুবই ভয়াবহ। আল্লাহ তা‘আলা তা‘আলা বলেন:
(اِقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ – وَإِنْ يَّرَوْا اٰيَةً يُّعْرِضُوْا وَيَقُوْلُوْا سِحْرٌ مُّسْتَمِرٌّ)
“কিয়ামত নিকটবর্তী হয়েছে, চন্দ্র ফেটে গেছে, তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলেঃ এটা তো পূর্ব হতে চলে আসা বড় জাদু।” (সূরা ক্বামার ৫৪:১-২)
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন, তাদের কাছে যখন কোন নতুন উপদেশ আসে অর্থাৎ কুরআন যা প্রয়োজন মত অবতীর্ণ হয়। যদিও তা তাদেরই উপদেশের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে কিন্তু তারা এমনভাবে তা শ্রবণ করে যেন তা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, উপহাস ও খেলা করছে, অর্থাৎ তা নিয়ে তারা কোন চিন্তাভাবনা করে না।
(لَاهِيَةً قُلُوْبُهُمْ)
অর্থাৎ তাদের অন্তর কুরআন থেকে গাফেল, দুনিয়ার বাতিল ও কু-প্রবৃত্তি নিয়ে ব্যস্ত।
মক্কার কুরাইশ কাফিররা গোপনে নিজেদের মাঝে শলাপরামর্শ করল কিভাবে মানুষদেরকে মুহাম্মাদ থেকে দূরে রাখা যায়, তারা চিন্তা করে বলল: মুহাম্মাদ তো তোমাদের মত একজন সাধারণ মানুষ, তার মধ্যে আর তোমাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সুতরাং সে যে কুরআন নিয়ে এসেছে তা একটি জাদু, তাহলে কিভাবে তার জাদুকে তোমরা মেনে নিয়ে তার অনুসরণ করবে? মক্কার কাফিররা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাদের মত একজন মানুষ বলে প্রত্যাখ্যান করল, নাবী হিসেবে মেনে নিল না। অথচ আল্লাহ তা‘আলা যত নাবী প্রেরণ করেছেন সকল নাবীই মানুষ ছিলেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ الْمُرْسَلِيْنَ إِلَّآ إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُوْنَ الطَّعَامَ وَيَمْشُوْنَ فِي الْأَسْوَاقِ)
“তোমার পূর্বে আমি যে সকল রাসূল প্রেরণ করেছি তারা সকলেই তো আহার করত ও হাটে-বাজারে চলাফেরা করত।” (সূরা ফুরক্বান ২৫:২০)
মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করার রহস্য হচ্ছে যদি আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ না করে কোন ফেরেশতা বা জিনকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করতেন তাহলে রিসালাতের পরিপূর্ণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হত না। মানুষের পক্ষে ফেরেশতা বা জিনদের কথা বোঝা সম্ভব হত না। মাটির মানুষ যে সকল সমস্যা অনুভব করবে তা নূরের তৈরি ফেরেশতা বা আগুনের তৈরি জিন অনুভব করতে পারবে না। একত্রে চলাফেরা করা কষ্টকর হত। তাই সার্বিক দিক বিবেচনা করেই আল্লাহ তা‘আলা মানুষকেই মানুষের নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। যদি পৃথিবীতে ফেরেশতা বসবাস করত তাহলে তিনি ফেরেশতাদেরকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করতেন। যেহেতু পৃথিবীতে মানুষের বসবাস তাই তিনি মানুষকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
(رَبِّيْ يَعْلَمُ الْقَوْل)
যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিনে যত কথা হয় সকল কথা অবগত রয়েছেন সেহেতু হে কাফিররা! তোমরা আমার ব্যাপারে যা কিছু বলছ সব আল্লাহ তা‘আলা শুনছেন, সে হিসেবে তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে। এ কথা বলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সতর্কসাবধান করছেন। অতএব মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ব্যাপারে যেসব মিথ্যা বলছ সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে।
(أَضْغَاثُ أَحْلَامٍ)
এমন স্বপ্ন যার কোন ব্যাখ্যা নেই। কেউ বলেছেন, মিথ্যা স্বপ্ন। অর্থাৎ মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে কুরআন পাঠ করে তা মিথ্যা বা আবোল-তাবোল স্বপ্ন। যখন তারা দেখল বিষয়টি এমন নয় তখন তারা বলল: সে এটা আবিষ্কার করেছে এবং নিজের পক্ষ থেকে উদ্ভাবন করেছে। এ কথা থেকেও ফিরত এসে বলল: না, সে একজন কবি। তাদের এ সকল দাবীর প্রতিবাদ করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “এটা কোন কবির কথা নয়; তোমরা অল্পই বিশ্বাস কর, এটা কোন গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ কর। এটা জগতসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। যদি সে নিজে কোন কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিত, তবে অবশ্যই আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম, এবং কেটে দিতাম তার হৃৎপিণ্ডের শিরা। অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেউ থাকত না, যে আমার থেকে তাকে রক্ষা করতে পারে।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯:৪১-৪৭)
তারা এ দাবী করত, যদি মুহাম্মাদ সত্যবাদী হয় তাহলে তাদের নিকট পূর্ববর্তীদের মত নিদর্শন নিয়ে আসুক। যেমন সালেহ (عليه السلام) উটনী নিয়ে এসেছিলেন, মূসা (عليه السلام) লাঠি নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথা অনুপাতে নিদর্শন অবতীর্ণ করেননি। কারণ আল্লাহ তা‘আলা জানেন যে, তারা নিদর্শন দেখে ঈমান আনবে না। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলছেন: ইতোপূর্বে যত জনপদ ধ্বংস করেছি তাদের কেউ ঈমান আনেনি, অতএব এরা কি ঈমান আনবে? কক্ষনো না, এরা পূর্ববর্তীদের অনুগামী।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:
(وَاَقْسَمُوْا بِاللہِ جَھْدَ اَیْمَانِھِمْ لَئِنْ جَا۬ءَتْھُمْ اٰیَةٌ لَّیُؤْمِنُنَّ بِھَاﺚ قُلْ اِنَّمَا الْاٰیٰتُ عِنْدَ اللہِ وَمَا یُشْعِرُکُمْﺫ اَنَّھَآ اِذَا جَا۬ءَتْ لَا یُؤْمِنُوْنَ)
“তারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, তাদের নিকট যদি কোন নিদর্শন আসত তবে অবশ্যই তারা তাতে ঈমান আনত। বল: ‘নিদর্শন তো (আসে একমাত্র) আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাদের নিকট নিদর্শন আসলেও তারা যে ঈমান আনবে না এটা কিভাবে তোমাদের বোধগম্য করান যাবে?” (সূরা আন‘আম ৬:১০৯)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামত অতি নিকটবর্তী, তাই কিয়ামতের কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মন্দ আমল ছেড়ে দিয়ে সৎ আমল করতে হবে।
২. কুরআন মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে, কৌতুকচ্ছলে নয়।
৩. যুগে যুগে মানুষের মধ্য হতে মানুষকে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করার হেকমত জানলাম।
৪. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাব, কোন অলীক কাহিনী নয়।
৫. পূর্ববর্তী যাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছে সবাই আল্লাহ তা‘আলার সাথে নাফরমানী করেছে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সূরায়ে বানী ইসরাঈল, সূরায়ে কাহফ, সূরায়ে মারইয়াম, সূরায়ে তা-হা এবং সূরায়ে আম্বিয়া হলো প্রথম মনোনীত সূরাসমূহ এবং এগুলোই (আরবী)।
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
মহামহিমান্বিত আল্লাহ মানুষকে সতর্ক করছেন যে, কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে, অথচ মানুষ তা থেকে সম্পূর্ণ উদাসীন রয়েছে। তারা ওর জন্যে এমন কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করছে না যা সেই দিন তাদের উপকারে আসবে। বরং তারা সম্পূর্ণরূপে দুনিয়ায় জড়িয়ে পড়েছে। দুনিয়ায় তারা এমনভাবে লিপ্ত হয়ে পড়েছে যে, ভুলেও একবার কিয়ামতকে স্মরণ করে না। অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহর আদেশ আসবেই; সুতরাং তোমরা ওকে ত্বরান্বিত করতে চেয়ো না।” (১৬:১) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে। তারা কোন নিদর্শন দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (৫৪:১-২) কবি আবু নুওয়াসের এই অর্থেরই নিম্নরূপ একটি কবিতাংশ রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “মানুষ তাদের উদাসিনতায় ডুবে আছে, অথচ মৃত্যুর যাতা ঘুরতে রয়েছে। তখন তাকে প্রশ্ন করা হয়ঃ “কি থেকে এটা নেয়া হয়েছে? ” উত্তরে সে বলেঃ আল্লাহ তাআলার এই উক্তি হতে।”
বর্ণিত আছে যে, হযরত আমির ইবনু রাবীআহ (রাঃ) বড়িীতে একটি লোক অতিথিরূপে আগমন করে। হযরত আমির (রাঃ) তার খুব খাতিরসম্মান করে তাকে বাড়ীতে রাখেন এবং তার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাথেও আলোচনা করেন। একদা এ অতিথি হযরত আমিরকে (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে অমুক উপত্যকা দান করেছেন। আমি চাই যে, ঐ উত্তম ভূ-খণ্ডের কিছু অংশ আপনার নামে করে দিই, যাতে আপনার অবস্থা স্বচ্ছল হয়।” উত্তরে হযরত আমির (রাঃ) বলেনঃ “ভাই, আমার এর কোন প্রয়োজন নেই। আজ এমন একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে যা দুনিয়াকে আমার কাছে তিক্ত করে তুলেছে।” অতঃপর তিনি (আরবী) এই আয়াতটিই পাঠ করেন।
এরপর আল্লাহ তাআলা কুরায়েশ এবং তাদের মত অন্যান্য কাফিরদের সম্পর্কে বলেনঃ যখনই তাদের নিকট তাদের প্রতিপালকের কোন নতুন উপদেশ আসে তখন তারা তা শ্রবণ করে কৌতুকচ্ছলে। তারা আল্লাহর কালাম ও তাঁর ওয়াহীর দিকে কানই দেয় না। তারা এক কানে শুনে এবং অন্য কান দিয়ে উড়িয়ে দেয়। তাদের অন্তর হাসি-তামাশায় লিপ্ত থাকে।
সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেনঃ “আহলে কিতাবদের কিতাবের কথা কিজ্ঞেস করা তোমাদের কি প্রয়োজন। তারা তো আল্লাহর কিতাবে বহু কিছু রদ-বদল করে দিয়েছে, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে ফেলেছে। তোমাদের কাছে তো নতুনভাবে অবতারিত আল্লাহর কিতাব বিদ্যমান রয়েছে। এতে কোন প্রকার পরিবর্তন ঘটে নাই। এলাকগুলি নিজেদের অন্তরকে এর ক্রিয়া থেকে শূন্য রাখতে চাচ্ছে। তারা অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করছে এবং বলছেঃ “আমাদেরই মত একজন মানুষের তো আমরা অধীনতা স্বীকার করতে পারি না। তোমরা কেমন লোক যে, দেখে শুনে যদুিকে মেনে নি? এটা অসম্ভব যে, আল্লাহ তাআলা আমাদের মতই মানুষকে রিসালাত ও ওয়াহী দ্বারা বিশিষ্ট করবেন। সুতরাং এটা বিস্ময়কর ব্যাপার যে, লোক বুঝে সুঝেও তার যাদুর মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। তাদের একথার জবাবে আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সাঃ) বলেনঃ তুমি বলঃ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমস্ত কথাই আমার প্রতিপালক অবগত আছেন। তাঁর কাছে কোন কিছুই গোপন নেই। তিনি এই পাক কালাম কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন। এতে পূর্ব ও পরের সমস্ত খবর বিদ্যমান রয়েছে। এটা একথাই প্রমাণ করে যে, এটা অবতীর্ণকারী হলেন আলেমুল গায়েব। তিনি তোমাদের সব কথাই শ্রবণ করেন এবং তিনি তোমাদের সমস্ত অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল। সুতরাং তোমাদের তাঁকে ভয় করা উচিত।
এরপর কাফিরদের ঔদ্ধত্যপনা ও হঠকারিতার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, তারা বলে এ সব অলীক কল্পনা হয় সে উদ্ভাবন করেছে, না হয় সে একজন কবি। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তারা নিজেরাই এ ব্যাপারে হয়রান পেরেশান রয়েছে। কোন এক কথার উপর তারা স্থির থাকতে পারছে না। তাই, তারা আল্লাহর কালামকে কখনো যাদু বলছে এবং কখনো কবিতা বলছে এবং কখনো আবার বিক্ষিপ্ত ও উদ্ভট কথা বলছে। কখনো আবার তারা একথাও বলছে যে, হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ওগুলি নিজেই বানিয়ে নিয়েছেন। মোট কথা, তাদের মুখে যা আসছে তাই তারা বলছে। কখনো তারা বলছেঃ যদি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সত্য নবী হন তবে হ্যরত সালেহের (আঃ) মত কোন উস্ত্রী আমাদের নিকট আনয়ন করুন, বা হযরত মূসার (আঃ) মত কোন মু’জিযা প্রদর্শন করুন অথবা হযরত ঈসার (আঃ) মত কোন মুজিযা প্রকাশ করুন না কেন? অবশ্যই আল্লাহ তাআলা এ সবের উপরপূর্ণ ক্ষমতাবান। কিন্তু যদি এগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং পরেও তারা ঈমান আনয়ন না করে তবে আল্লাহ তাআলার নীতি অনুযায়ী তারা তার শাস্তির কোপানলে পড়ে যাবে এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। তাদের পূর্ববর্তী লোকেরাও একথাই বলেছিল এবং ঈমান আনয়ন করে নাই। ফলে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল। অনুরূপভাবে এরাও মুজিযা দেখতে চাচ্ছে, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়ে পড়লে তারা ঈমান আনবে না। সুতরাং পূর্ববর্তী লোকদের মত তারাও ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয় যাদের উপর তোমার প্রতিপালকের কথা বাস্তবায়িত হয়েছে তারা ঈমান আনয়ন করবেনা, যদিও তাদের কাছে সমস্ত নিদর্শন এসে যায়, যে পর্যন্ত না তারা যন্ত্রণাদায়ক শস্তি অবলোকন করে। (১০:৯৬-৯৭)
কিন্তু তখনকার ঈমান আনয়ন বৃথা। প্রকৃত ব্যাপার এটাই যে, তার ঈমান অনবেই না। তাদের চোখের সামনে তো রাসলল্লাহর (সঃ) অসংখ্য মজিয়া বিদ্যমান ছিল। এমন কি তার মু’জিযাগুলি ছিল অন্যান্য নবীদের মু’জিযা গুলি অপেক্ষা বেশী প্রকাশমান।
হযরত উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “একদা আমরা মসজিদে অবস্থান করছিলাম। হযরত আবু বকর (রাঃ) কুরআন পাঠ করছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনু উবাই ইবনু সাল মুনাফিক আগমন করে এবং নিজের গদী বিছিয়ে এবং বালিশে হেলান দিয়ে আঁকজমকের সাথে বসে পড়ে। সে খুব বাকপটুও ছিল। হযরত আবু বকরকে (রাঃ) সে বললোঃ “হে আবু বকর (রাঃ)! হযরত মুহাম্মদকে (সঃ) বলুন যে, তিনি যেন আমাদের কাছে কোন নিদর্শন আনয়ন করেন যেমন তাঁর পূর্ববর্তী নবীরা (আঃ) নিদর্শন সমূহ আনয়ন করেছিলেন। যেমন হযরত মুসা (আঃ) ফলক আনয়ন করেছিলেন, হযরত সালেহ (আঃ) এনেছিলেন উষ্ট্ৰী, হযরত দাউদ (আঃ) আনয়ন করেছিলেন যবুর এবং হযরত ঈসা (আঃ) আনয়ন করেছিলেন ইঞ্জীল ও আসমানী খাদ্য পূর্ণ খাঞ্চা।” তার একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) কাঁদতে শুরু করেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আগমন করেন। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) অন্যান্য সাহাবীদেরকে বলেনঃ “রাসূলুল্লাহর (সঃ) সম্মানার্থে দাড়িয়ে যান এবং এই মুনাফিকের ফরিয়াদ তাঁর কাছে পৌছিয়ে দাও।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ আমার জন্যে দাঁড়ানো চলবে না। দাঁড়াতে হবে শুধুমাত্র মহামহিমান্বিত আল্লাহর জন্যে। আমরা তখন বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! এই মুনাফিকের কারণে আমরা বড়ই কষ্ট পাচ্ছি।” তখন তিনি বললেনঃ “এখনই অমাির কাছে হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেছিলেন এবং আমাকে বললেনঃ “আপনি বাইরে গিয়ে জনগণের সামনে আল্লাহর ঐ নিয়ামত রাজির বর্ণনা দিন যা তিনি আপনাকে দান করেছেন এবং ঐ মর্যাদার কথা প্রকাশ করুন যা তিনি আপনাকে দিয়েছেন।” অতঃপর তিনি আমাকে সুসংবাদ দিলেন যে, আমাকে সারা দুনিয়ার জন্যে রাসূলরূপে প্রেরণ করা হয়েছে। আমাকে নিদর্শন দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন জ্বিনদের কাছেও আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিই। মহান আল্লাহ আমাকে তার পবিত্র কিতাব (কুরআন) দান করেছেন, অথচ আমি সম্পূর্ণরূপে নিরক্ষর। তিনি আমার পূর্বেও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। ফেরেশতাদের মাধ্যমে তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার সামনে তিনি ভক্তি প্রযুক্ত ভয় রেখে দিয়েছেন। আমাকে হাওজে কাউসার দান করা হয়েছে যা কিয়ামতের দিন সমস্ত হাওজ অপেক্ষা বড় হবে। আমার সাথে তিনি মাকামে মাহমুদের ওয়াদা করেছেন যখন সমস্ত লোক উদ্বিগ্ন অবস্থায় মাথা নীচু করে থাকবে। তিনি আমাকে ঐ প্রথম দলভূক্ত করেছেন যারা লোকদের মধ্য হতে বের হবে। আমার শাফাআতের ফলে আমার উম্মতের মধ্য হতে সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে জান্নাতে চলে যাবে। আমাকে বিজয় ও রাজ্য দান করা হয়েছে। আমাকে সুখময় জান্নাতের ঐ সুউচ্চ কক্ষ দান করা হবে যার মত উচ্চ মঞ্জিল আর কারো হবে না। আমার উপর শুধুমাত্র ঐ ফেরেশতারা থাকবেন যারা আল্লাহর আরশ উঠিয়ে নিয়ে থাকবেন। আমার জন্যে ও আমার উম্মতের জন্যে গনীমতের মাল (যুদ্ধলব্ধমাল) হালাল করা হয়েছে, অথচ আমার পূর্বে কারো জন্যে এটা হালাল ছিল না। ”
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#921)
[ اِقۡتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُہُمۡ
Their account has approached for the people,]
Sura:21
Sura: Al-Anbiyaa
Ayat: 01-06
www.motaher21.net
21:1
اِقۡتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُہُمۡ وَ ہُمۡ فِیۡ غَفۡلَۃٍ مُّعۡرِضُوۡنَ ۚ﴿۱﴾
[The time of] their account has approached for the people, while they are in heedlessness turning away.
The Hour is at hand but People are heedless
Allah says:
اقْتَرَبَ لِلنَّاسِ حِسَابُهُمْ وَهُمْ فِي غَفْلَةٍ مَّعْرِضُونَ
Draws near for mankind their reckoning, while they turn away in heedlessness.
This is a warning from Allah of the approach of the Hour, and that people are heedless of it, i.e., they are not working for it or preparing for it.
An-Nasa’i recorded that Abu Sa`id reported from the Prophet:
فِي غَفْلَةٍ مَّعْرِضُونَ
(while they turn away in heedlessness), he said,
فِي الدُّنْيَا
(in this world).
Allah says:
أَتَى أَمْرُ اللَّهِ فَلَ تَسْتَعْجِلُوهُ
The Event ordained by Allah will come to pass, so seek not to hasten it. (16:1)
اقْتَرَبَتِ السَّاعَةُ وَانشَقَّ الْقَمَرُ
وَإِن يَرَوْاْ ءَايَةً يُعْرِضُواْ
The Hour has drawn near, and the moon has been cleft asunder. And if they see a sign, they turn away. (54:1-2)
Then Allah states that they do not listen to the revelation (Wahy) that He sends down to His Messenger, which is addressed to the Quraysh and all disbelievers like them
21:2
مَا یَاۡتِیۡہِمۡ مِّنۡ ذِکۡرٍ مِّنۡ رَّبِّہِمۡ مُّحۡدَثٍ اِلَّا اسۡتَمَعُوۡہُ وَ ہُمۡ یَلۡعَبُوۡنَ ۙ﴿۲﴾
No mention comes to them anew from their Lord except that they listen to it while they are at play
مَا يَأْتِيهِم مِّن ذِكْرٍ مَّن رَّبِّهِم مُّحْدَثٍ
Comes not unto them an admonition from their Lord as a recent revelation,
meaning, newly-revealed,
إِلاَّ اسْتَمَعُوهُ وَهُمْ يَلْعَبُونَ
لَااهِيَةً قُلُوبُهُمْ
but they listen to it while they play. With their hearts occupied.
This is like what Ibn Abbas said,
“Why do you ask the People of the Book about what they have, which has been altered and distorted, and they have added things and taken things away, when your Book is the most recently revealed from Allah, and you read it pure and unadulterated”
Al-Bukhari recorded something similar to this.
وَأَسَرُّواْ النَّجْوَى الَّذِينَ ظَلَمُواْ
Those who do wrong, conceal their private counsels,
meaning, what they say to one another in secret.
هَلْ هَذَا إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ
Is this more than a human being like you!
meaning, the Messenger of Allah.
They did not believe that he could be a Prophet because he was a human being like them, so how could he have been singled out to receive revelation, and not them!
21:3
لَاہِیَۃً قُلُوۡبُہُمۡ ؕ وَ اَسَرُّوا النَّجۡوَی ٭ۖ الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا ٭ۖ ہَلۡ ہٰذَاۤ اِلَّا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ ۚ اَفَتَاۡتُوۡنَ السِّحۡرَ وَ اَنۡتُمۡ تُبۡصِرُوۡنَ ﴿۳﴾
With their hearts distracted. And those who do wrong conceal their private conversation, [saying], “Is this [Prophet] except a human being like you? So would you approach magic while you are aware [of it]?”
They said:
…
أَفَتَأْتُونَ السِّحْرَ وَأَنتُمْ تُبْصِرُونَ
Will you submit to magic while you see it!
meaning, will you follow him and be like one who submits to magic when he knows that it is magic!
Allah said in response to their fabrications and lies:
21:4
قٰلَ رَبِّیۡ یَعۡلَمُ الۡقَوۡلَ فِی السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ۫ وَ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ ﴿۴﴾
The Prophet said, “My Lord knows whatever is said throughout the heaven and earth, and He is the Hearing, the Knowing.”
قَالَ رَبِّي يَعْلَمُ الْقَوْلَ فِي السَّمَاء وَالَارْضِ
He said:”My Lord knows what is said in the heavens and on earth…”
Nothing at all is hidden from the One Who knows that, and He is the One Who reveals this Qur’an which contains news of the earliest and last generations. No one can produce the like of this except the One Who knows all the secrets of the heavens and the earth.
وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
And He is the All-Hearer, the All-Knower.
means, He hears all that they say and He knows all their circumstances.
This is a warning and a threat to them.
The Disbelievers’ Ideas about the Qur’an and the Messenger; their demand for a Sign and the Refutation of that:
Allah says
21:5
بَلۡ قَالُوۡۤا اَضۡغَاثُ اَحۡلَامٍۭ بَلِ افۡتَرٰىہُ بَلۡ ہُوَ شَاعِرٌ ۚۖ فَلۡیَاۡتِنَا بِاٰیَۃٍ کَمَاۤ اُرۡسِلَ الۡاَوَّلُوۡنَ ﴿۵﴾
But they say, “[The revelation is but] a mixture of false dreams; rather, he has invented it; rather, he is a poet. So let him bring us a sign just as the previous [messengers] were sent [with miracles].”
بَلْ قَالُواْ أَضْغَاثُ أَحْلَمٍ بَلِ افْتَرَاهُ بَلْ هُوَ شَاعِرٌ
Nay, they say:”These are mixed up false dreams!
Nay, he has invented it! — Nay, he is a poet!
Here Allah tells us of the stubbornness and heresy of the disbelievers, and the various things they said about the Qur’an, and how they were confused and misguided about it. Sometimes they described it as magic, and sometimes they described it as poetry, or mixed up false dreams, or a fabrication.
As Allah says:
انْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُواْ لَكَ الاٌّمْثَالَ فَضَلُّواْ فَلَ يَسْتَطِيعْونَ سَبِيلً
See what examples they have put forward for you. So they have gone astray, and never can they find a way. (17:48)
فَلْيَأْتِنَا بِأيَةٍ كَمَا أُرْسِلَ الَاوَّلُونَ
Let him then bring us an Ayah like the ones that were sent before!
They were referring to the she-camel of Salih, and the signs of Musa and `Isa.
And Allah says,
وَمَا مَنَعَنَأ أَن نُّرْسِلَ بِالاٌّيَـتِ إِلاَّ أَن كَذَّبَ بِهَا الاٌّوَّلُونَ
And nothing stops Us from sending the Ayat but that the people of old denied them. (17:59)
So Allah said here:
مَا امَنَتْ قَبْلَهُم مِّن قَرْيَةٍ أَهْلَكْنَاهَا أَفَهُمْ يُوْمِنُونَ
21:6
مَاۤ اٰمَنَتۡ قَبۡلَہُمۡ مِّنۡ قَرۡیَۃٍ اَہۡلَکۡنٰہَا ۚ اَفَہُمۡ یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۶﴾
Not a [single] city which We destroyed believed before them, so will they believe?
Not one of the towns of those which We destroyed, believed before them; will they then believe!
None of the peoples to whom Messengers were sent were given a sign at the hands of their Prophet and believed. On the contrary, they disbelieved and We destroyed them as a result. Would these people believe in a sign if they saw it! Not at all!
In fact,
إِنَّ الَّذِينَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لَا يُوْمِنُونَ
وَلَوْ جَأءَتْهُمْ كُلُّ ءايَةٍ حَتَّى يَرَوُاْ الْعَذَابَ الاٌّلِيمَ
Truly, those, against whom the Word of your Lord has been justified, will not believe. Even if every sign should come to them, until they see the painful torment. (10:96-97)
Indeed, they witnessed clear signs and definitive proof at the hands of the Messenger of Allah, signs which were far clearer and more overwhelming than any that had been witnessed in the case of any other Prophet, may the blessings and peace of Allah be upon them all
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran