أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৩১)
[ وَ نَصَرْنٰهُ مِنَ الْقَوْمِ الَّذِیْنَ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَا١ؕ
এমন সম্প্রদায়ের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করেছিলাম যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছিল।]
সূরা:- আল্ আম্বিয়া।
সুরা:২১
৭১-৭৭ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২১:৭১
وَ نَجَّیْنٰهُ وَ لُوْطًا اِلَى الْاَرْضِ الَّتِیْ بٰرَكْنَا فِیْهَا لِلْعٰلَمِیْنَ
আর আমি তাঁকে ও লূতকে বাঁচিয়ে এমন দেশের দিকে নিয়ে গেলাম যেখানে আমি দুনিয়াবাসীদের জন্য বরকত রেখেছিলাম।
২১:৭২
وَ وَهَبْنَا لَهٗۤ اِسْحٰقَ١ؕ وَ یَعْقُوْبَ نَافِلَةً١ؕ وَ كُلًّا جَعَلْنَا صٰلِحِیْنَ
আর তাঁকে আমি ইসহাক দান করলাম এবং এর ওপর অতিরিক্ত ইয়াকুব এবং প্রত্যেককে করলাম সৎকর্মশীল।
২১:৭৩
وَ جَعَلْنٰهُمْ اَئِمَّةً یَّهْدُوْنَ بِاَمْرِنَا وَ اَوْحَیْنَاۤ اِلَیْهِمْ فِعْلَ الْخَیْرٰتِ وَ اِقَامَ الصَّلٰوةِ وَ اِیْتَآءَ الزَّكٰوةِ١ۚ وَ كَانُوْا لَنَا عٰبِدِیْنَۚۙ
আর আমি তাঁদেরকে নেতা বানিয়ে দিলাম, তারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথনির্দেশনা দিতো এবং আমি তাঁদেরকে অহীর মাধ্যমে সৎকাজের, নামায কায়েম করার ও যাকাত দেবার নির্দেশ দিয়েছিলাম এবং তারা আমার ইবাদাত করতো।
২১:৭৪
وَ لُوْطًا اٰتَیْنٰهُ حُكْمًا وَّ عِلْمًا وَّ نَجَّیْنٰهُ مِنَ الْقَرْیَةِ الَّتِیْ كَانَتْ تَّعْمَلُ الْخَبٰٓئِثَ١ؕ اِنَّهُمْ كَانُوْا قَوْمَ سَوْءٍ فٰسِقِیْنَۙ
আর লূতকে আমি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম এবং তাকে এমন জনপদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম যার অধিবাসীরা বদ কাজে লিপ্ত ছিল— আসলে তারা ছিল বড়ই দুরাচারী পাপিষ্ঠ জাতি—
২১:৭৫
وَ اَدْخَلْنٰهُ فِیْ رَحْمَتِنَا١ؕ اِنَّهٗ مِنَ الصّٰلِحِیْنَ۠
আর লূতকে আমি নিজের রহমতের আওতায় নিয়ে নিয়েছিলাম, সে ছিল সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত।
২১:৭৬
وَ نُوْحًا اِذْ نَادٰى مِنْ قَبْلُ فَاسْتَجَبْنَا لَهٗ فَنَجَّیْنٰهُ وَ اَهْلَهٗ مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِیْمِۚ
আর এ একই নিয়ামত আমি নূহকে দান করেছিলাম। স্মরণ করো যখন এদের সবার আগে সে আমাকে ডেকেছিল, আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছিলাম এবং তাঁকে ও তাঁর পরিবারবর্গকে মহাবিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলাম।
২১:৭৭
وَ نَصَرْنٰهُ مِنَ الْقَوْمِ الَّذِیْنَ كَذَّبُوْا بِاٰیٰتِنَا١ؕ اِنَّهُمْ كَانُوْا قَوْمَ سَوْءٍ فَاَغْرَقْنٰهُمْ اَجْمَعِیْنَ
আর এমন সম্প্রদায়ের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করেছিলাম যারা আমার আয়াতসমূহকে মিথ্যা বলেছিল। তারা খুবই খারাপ লোক ছিল, কাজেই আমি তাদের সবাইকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম।
৭১- ৭৭ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী নাহূরা ও হারান নামে হযরত ইবরাহীমের দুই ভাই ছিল। হযরত লূত ছিল হারানের ছেলে। (আদি পুস্তক ১১:২৬) সূরা আনকাবুতে হযরত ইবরাহীমের যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে বাহ্যত একথাই জানা যায় যে, তাঁদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে একমাত্র হযরত লূতই তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। (দেখুন ২৬ আয়াত )
# সিরিয়া ও ফিলিস্তিনে। তার বরকত তথা সমৃদ্ধি বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় ধরনেরই। বস্তুগত দিক দিয়ে তা দুনিয়ার উর্বরতম এলাকাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। আর আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দু’হাজার বছর থেকে তা থেকেছে আল্লাহর নবীগণের কর্মক্ষেত্র। দুনিয়ার কোন এলাকায় এতো বিপুল সংখ্যক নবী আবির্ভূত হয়নি।
# ছেলের পরে পৌত্রকেও নবুওয়াতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করেছি।
# বাইবেলে হযরত ইবরাহীমের জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির কোন উল্লেখ নেই। বরং তাঁর জীবনের ইরাকী যুগের কোন ঘটনাই এ গ্রন্থে স্থান পেতে পারেনি। নমরূদের সাথে তাঁর মুখোমুখি সংঘাত, পিতা ও সম্প্রদায়ের সাথে সংঘর্ষ, মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, অগ্নিতে নিক্ষেপের ঘটনা এবং সবশেষে দেশ ত্যাগে বাধ্য হওয়া— এসবের কোনটিই বাইবেলের আদিপুস্তক লেখকের দৃষ্টিগ্রাহ্য হবার যোগ্যতা লাভ করেনি। তিনি কেবলমাত্র তাঁর দেশ ত্যাগের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাও এমন ভংগীতে যেমন একটি পরিবার পেটের ধান্দায় এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে বসতি গড়ে তোলে। কুরআর ও বাইবেলের বর্ণনায় এর চাইতেও মজার যে পার্থক্য তা হচ্ছে এই যে, কুরআনের বর্ণনা মতে হযরত ইবরাহীমের মুশরিক পিতা তাঁর প্রতি জুলুম করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে বাইবেল বলে, তাঁর পিতা নিজেই পুত্র, পৌত্র ও পুত্রবধূদেরকে নিয়ে হারানে গিয়ে বসতি গড়ে তোলে। (আদি পুস্তক ১১: ৭-৩২) তারপর অকস্মাৎ একদিন আল্লাহ হযরত ইবরাহীমকে বলেন, তুমি হারান ত্যাগ করে কেনানে গিয়ে বসবাস করো এবং “আমি তোমা হইতে এক মহাজাতি উৎপন্ন করিব এবং তোমাকে আশীর্বাদ করিয়া তোমার নাম মহৎ করিব, তাহাতে তুমি আশির্বাদের আকর হইবে। যাহারা তোমাকে আশীর্বাদ করিবে, তাহাদিগকে আমি আশীর্বাদ করিব, যে কেহ তোমাকে অভিশাপ দিবে তাহাকে আমি অভিশাপ দিব; এবং তোমাতে ভূমণ্ডলের যাবতীয় গোষ্ঠী আশীর্বাদ প্রাপ্ত হইবে।” (১২: ১-৩) বুঝতে পারলাম না, হঠাৎ হযরত ইবরাহীমের প্রতি বাইবেল প্রণেতার এমন অনুগ্রহ দৃষ্টি কেমন করে হলো?
অবশ্য কুরআনের বিভিন্ন স্থানে হযরত ইবরাহীমের জীবনের ইরাকী যুগের যে বিস্তারিত ঘটনাবলী বিকৃত হয়েছে তালমূদে তার বেশীর ভাগ আলোচনা পাওয়া যায়। কিন্তু উভয় বর্ণনা একত্র করলে শুধুমাত্র কাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশেই পার্থক্য দেখা যাবে না বরং একথা পরিষ্কার অনুভব করা যাবে যে, তালমূদের বর্ণনা বহু স্থানে বেখাপ্পা এবং বাস্তবতা ও যুক্তি বিরোধী। অন্যদিকে কুরআন একদম পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীনভাবে হযরত ইবরাহীমের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী পেশ করে। সেখানে কোন অর্থহীন ও আজেবাজে কথা নেই। বক্তব্য সুস্পষ্ট করার জন্য আমি এখানে তালমূদের কাহিনীর সংক্ষিপ্তসার পেশ করছি। এর ফলে যারা কুরআনকে বাইবেল ও ইহুদীবাদী সাহিত্যের চর্বিত চর্বন গণ্য করে থাকেন তাদের বিভ্রান্তির ধুম্রজাল বিদীর্ণ হয়ে যাবে।
তালমূদের বর্ণনা মতে হযরত ইবরাহীমের জন্মদিনে জ্যোতিষীরা আকাশে একটি আলামত দেখে তারেহ —এর গৃহে যে শিশুর জন্ম হয়েছে তাকে হত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিল। তদনুসারে সে তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তারেহ নিজের ক্রীতদাসের পুত্রকে তার বিনিময়ে প্রদান করে তাকে বাঁচায়। এরপর তারেহ নিজের স্ত্রী ও শিশু পুত্রকে একটি পর্বত গুহায় লুকিয়ে রাখে। সেখানে তারা দশ বছর অবস্থান করে। এগার বছর বয়সে হযরত ইবরাহীমকে সে হযরত নূহের কাছে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে উনচল্লিশ বছর পর্যন্ত তিনি হযরত নূহ ও তাঁর পুত্র সামের তত্বাবধানে বাস করতে থাকেন। এ সময়ে হযরত ইবরাহীম তাঁর আপন ভাইয়ের মেয়ে সারাহকে বিয়ে করেন। সারাহ তাঁর চেয়ে ৪২ বছরের ছোট ছিল। (বাইবেল একথা সুস্পষ্ট করে বলেনি যে, সারাহ হযরত ইবরাহীমের ভ্রাতুষ্পুত্রী ছিলেন। তাছাড়া বাইবেলের বর্ণনা মতে তাদের উভয়ের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল দশ বছরের। ( আদি পুস্তক ১১: ২৯ এবং ১৭: ১৭)
তারপর তালমূদ বলছে, হযরত ইবরাহীম পঞ্চাশ বছর বয়সে হযরত নূহের গৃহ ত্যাগ করে নিজের পিতার গৃহে চলে আসেন। এখানে তিনি দেখেন পিতা মূর্তিপূজারী এবং গৃহে বারো মাসের হিসেবে বারোটি মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। তিনি প্রথমে পিতাকে বুঝাবার চেষ্টা করেন। তাকে বুঝাতে অক্ষম হয়ে একদিন ঘরোয়া মূর্তি মন্দিরের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। তারেহ গৃহে এসে নিজের দেবতাদের এ অবস্থা দেখে সোজা নমরূদের কাছে চলে যায়। সেখানে অভিযোগ করে, পঞ্চাশ বছর আগে আমার গৃহে যে সন্তান জন্মেছিল আজ সে আমার ঘরে এ কাজ করেছে, আপনি এর বিহিত ব্যবস্থা করুন। নমরূদ হযরত ইবরাহীমকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তিনি কঠোর জবাব দেন। নমরূদ তখনই তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। তারপর শলা-পরামর্শ করে ব্যাপারটির নিষ্পত্তির জন্য নিজের পরিষদের সামনে পেশ করে। পরিষদের সদস্যরা পরামর্শ দেয় এ ব্যক্তিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হোক। তাই একটি বিরাট আগুনের কুণ্ড তৈরী করা হয় এবং হযরত ইবরাহীমকে তার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়। হযরত ইবরাহীমের সাথে তাঁর ভাই ও শ্বশুর হারানকেও নিক্ষেপ করা হয়। কারণ নমরূদ যখন তারেহকে জিজ্ঞেস করে, তোমার এ ছেলেকে তো আমি এর জন্মের দিনেই হত্যা করতে চেয়েছিলাম, তুমি তখন একে বাঁচিয়ে এর বিনিময়ে অন্য শিশু হত্যা করিয়েছিলে কেন? এর জবাবে তারেহ বলে, আমি হারানের কথায় এ কাজ করেছিলাম। তাই এ কাজ যে করেছিল তাকে ছেড়ে দিয়ে পরামর্শদাতাকে হযরত ইবরাহীমের সাথে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার সাথে সাথেই হারান জ্বলে পুড়ে কয়লা হয়ে যায় কিন্তু হযরত ইবরাহীমকে লোকেরা দেখে তিনি তার মধ্যে নিশ্চিন্তে আরামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নমরূদকে এ ব্যাপারে জানানো হয়। সে এসে স্বচক্ষে এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে বলে, “ওহে আসমানের ইলাহর বান্দা! আগুন থেকে বের হয়ে এসো এবং আমার সামনে দাড়াও।” হযরত ইবরাহীম বাইরে আসেন। নমরূদ তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ে। তাঁকে বহু মূল্যবান নজরানা দিয়ে বিদায় করে।
এরপর তালমূদের বর্ণনা মতে হযরত ইবরাহীম দু’বছর পর্যন্ত সেখানে থাকেন। তারপর নমরূদ একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। তার জ্যোতিষীরা এর তাবীর বর্ণনা করে বলে, ইবরাহীম আপনার সাম্রাজ্য ধ্বংসের কারণ হবে কাজেই তাঁকে হত্যা করুন। সে তাঁকে হত্যা করার জন্য লোক পাঠায়। কিন্তু স্বয়ং নমরূদের প্রদত্ত একজন গোলাম আল ইয়াযার পূর্বাহ্নেই তাঁকে এ পরিকল্পনার খবর দেয়। ফলে হযরত ইবরাহীম পালিয়ে হযরত নূহের কাছে আশ্রয় নেন। সেখানে তারেহ এসে তাঁর সাথে গোপনে দেখা করতে থাকে। শেষে পিতা-পুত্র পরামর্শ করে দেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত করা হয়। হযরত নূহ ও সামও এ পরিকল্পনা সমর্থন করেন। এভাবে তারেহ স্বীয় পুত্র ইবরাহীম, পৌত্র লূত এবং পৌত্রী ও পুত্রবধূ সারাহকে নিয়ে উর থেকে হারান চলে আসে। (তালমূদ নির্বাচিত অংশ, এইচ, পোলানো লন্ডন, পৃষ্ঠা ৩০-৪২)
এ বর্ণনা দেখে কোন বিবেকবান ব্যক্তি কি একথা বলতে পারে যে, এটি কুরআনের উৎস হতে পারে?
# মূলে “হুকুম ও ইলম” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কুরআনে সাধারণত হুকুম ও ইলম দান নবুওয়াদ দান করার সমার্থক হয়। “হুকম” অর্থ প্রজ্ঞাও হয়, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতাও হয়, আবার আল্লাহর পক্ষ থেকে কর্তৃত্ব করার বিধিসঙ্গত অনুমতি (Authority) লাভও হয়। আর “ইলম” –এর অর্থ হচ্ছে এমন সত্য ও যথার্থ ইলম যা অহীর মাধ্যমে দান করা হয়েছে। হযরত লূতের সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সূরা আ’রাফ ৮০-৮৪ , সূরা হূদ ৬৯-৮৪ এবং সূরা আল হিজর ৫৭-৭৬ আয়াত।
# হযরত নূহের দোয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুদীর্ঘকাল নিজের জাতির সংশোধনের অবিরাম প্রচেষ্টা চালাবার পর শেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে তিনি দোয়া করেছিলেন أَنِّي مَغْلُوبٌ فَانْتَصِرْ “পরওয়ারদিগার। আমি হেরে গেছি আমাকে সাহায্য করো।” ( আল কামারঃ ১০ ) এবং رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا “হে আমার রব! পৃথিবী পৃষ্ঠে একজন কাফেরকেও ছেড়ে দিয়ো না।” ( সূরা নূহঃ ২৬ )
# “মহাবিপদ” অর্থ একটি অসৎ কর্মশীল জাতির মধ্যে জীবন যাপন করার বিপদ অথবা মহাপ্লাবন। হযরত নূহের কাহিনী বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন সূরা আল আ’রাফ ৫৯ থেকে ৬৪ , সূরা ইউনূস ৭১ থেকে ৭৩ , সূরা হূদ ২৫ থেকে ৪৮ এবং বনী ইসরাঈল ৩ আয়াতসমূহ।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
‘তাকে আমি ইসহাক ও ইয়াকুব দিয়েছিলাম…'(আয়াত ৭২-৭৩) হযরত ইবরাহীম(আ.) নিজ পরিবার, জাতি ও মাতৃভূমি ত্যাগ করে গিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে বিনিময়ে তার মাতৃভূমির চেয়েও কল্যাণময় দেশ দান করেন, তার পরিবারের চেয়েও উত্তম পরিবার তথা ইসহাক(আ.)-এর ন্যায় সন্তান ও ইয়াকুব(আ.)-এর ন্যায় পৌত্র দান করেন। তার বংশধর থেকে তিনি এমন এক বিশাল জাতির সৃষ্টি করেন, যা তার পূর্বতন জাতির চেয়েও উত্তম ছিলাে। তার বংশে আল্লাহ তায়ালা এমন এক দল মহা মানব সৃষ্টি করেন, যারা আল্লাহর আদেশ অনুসারে মানুষকে সুপথে চালাতেন, তাদের ওপর সব রকমের সৎ কাজের নির্দেশ সম্বলিত ওহী পাঠাতেন, নামায কায়েম করতে ও যাকাত দিতে আদেশ দিতেন এবং তারা সবাই ছিলো আল্লাহর অনুগত বান্দা। এটা কতাে সুন্দর বিনিময় এবং কতাে সুন্দর প্রতিদান ছিলাে। আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম(আ.)-কে জীবনের প্রথম ভাগে নানা বিপদ আপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। ধৈর্যধারনের মাধ্যমে তিনি সে সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাই শেষ জীবনে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার ধৈর্যের প্রতিদান হিসেবে সর্বদিক দিয়েই সুখ শান্তি দান করেন। ‘আর আমি লূতকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান এবং তাকে ঘৃণ্য কার্যকলাপে লিপ্ত লােকদের গ্রাম থেকে উদ্ধার করেছিলাম'(আয়াত ৭৪-৭৫) ইতিপূর্বে হযরত লুতের কাহিনী বিশদভাবে আলােচিত হয়েছে। এখানে কেবল সে কাহিনীর প্রতি ইংগিত করেই ক্ষান্ত থাকা হয়েছে। তিনি তার চাচা হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সাথে ইরাক থেকে সিরিয়া যান। অতপর সদোম নগরীতে বসবাস করতে থাকেন। সেখানে জঘন্য নােংরা কাজের প্রচলন ছিলাে সেখানকার লােকেরা পুরুষে পুরুষে প্রকাশ্যে নির্দ্বিধায় ও নিসংকোচে সমকামে অভ্যস্ত ছিলাে। আল্লাহ তায়ালা ওই নগরী ও তার অধিবাসীদেরকে ধ্বংস করে দিলেন। ‘তারা দুষ্কৃতকারী ফাসেক জাতি ছিলো।’ আল্লাহ তায়ালা লূতকে ও তার পরিবারকে উদ্ধার করেন। কিন্তু তার স্ত্রীকে উদ্ধার করেননি। তাকে আমার রহমতের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছিলাম। সে সৎকর্মশীল ছিলাে। আল্লাহর রহমত হলাে নিরাপদ আশ্রয় । আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন এই আশ্রয়ে প্রবেশ করান। যে এখানে আশ্রয় পায় সে হয়ে যায় নিরাপদ। হযরত নূহ(আ.) সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত ইংগিত দেয়া হয়েছে, ‘নূহের কথা স্মরণ করাে, যখন সে ইতিপূর্বে আহ্বান জানালাে, আমি তার দোয়া গ্রহণ করলাম…'(আয়াত ৭৬-৭৭) এখানেও কোনাে বিশদ বিবরণ নেই। শুধু তার দোয়া কবুল করা হয়েছিলাে এই বিষয়টা তুলে ধরার জন্যেই এটুকু ইংগিত দেয়া হয়েছে। তিনি হযরত ইবরাহীম ও লুত(আ.)-এর পূর্ববর্তী। তাকেও আল্লাহ তায়ালা তার পরিবারসহ রক্ষা করেছেন। তবে তার ছেলেকে রক্ষা করেননি। তার জাতিকে প্লাবন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন। সূরা হুদে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
তাফসীরে হাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৭১-৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:
প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম ও লূত (عليه السلام)-কে ইরাকের এ জালিম সম্প্রদায়ের কবল থেকে উদ্ধার করে এমন ভূমিতে নিয়ে গেলেন যেথায় বিশ্ববাসীর জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর তা হল সিরিয়া। কারণ ইবরাহীম (عليه السلام)-এর প্রতি কেবল লূত (عليه السلام) ঈমান এনেছিল, তিনি ইবরাহীম (عليه السلام)-এর চাচাতো ভাই ছিলেন। যেমন বলেন:
(فَاٰمَنَ لَھ۫ لُوْطٌﺭ وَقَالَ اِنِّیْ مُھَاجِرٌ اِلٰی رَبِّیْﺚ اِنَّھ۫ ھُوَ الْعَزِیْزُ الْحَکِیْمُ)
“লূত তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করল। লূত বলল: ‘আমি আমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করছি, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’’ (সূরা আনকাবুত ২৯:২৬) অনুরূপভাবে ইবরাহীম (عليه السلام) বলেছিলেন:
(وَقَالَ إِنِّيْ ذَاهِبٌ إِلٰي رَبِّيْ سَيَهْدِيْنِ)
“আর সে (ইবরাহীম) বলল: আমি আমার প্রতিপালকের দিকে চললাম, তিনিই আমাকে সৎ পথে পরিচালিত করবেন।” (সূরা স্বফ্ফাত ৩৭:৯৯)
ইবরাহীম (عليه السلام) ইরাক ছেড়ে সিরিয়াতে চলে আসার পর আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে ইসহাক ও পৌত্ররূপে ইয়া‘কূব (عليه السلام)-কে দান করলেন। نَافِلَةً অর্থ অতিরিক্ত, অর্থাৎ ইবরাহীম (عليه السلام) শুধু পুত্রের জন্য দু‘আ করেছিলেন কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে বিনা দু‘আয় অতিরিক্ত হিসেবে পৌত্র তথা নাতি ইয়াকুব (عليه السلام)-কে দান করলেন যিনি ইসহাকের পুত্র। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَبَشَّرْنَاهَا بِإِسْحَاقَ وَمِنْ وَّرَا۬ءِ إِسْحَاقَ يَعْقُوبَ)
“অতঃপর আমি তাকে ইস্হাকের ও ইস্হাকের পরবর্তী ইয়া‘কূবের সুসংবাদ দিলাম।” (সূরা হূদ ১১:৭১) ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পুত্র ইসহাক, ইসহাকের পুত্র ইয়া‘কূব, ইয়া‘কূবের পুত্র ইউসুফ। ইয়া‘কূব (عليه السلام)-এর বংশধরকে বানী ইসরাঈল বলা হয়। এদের উম্মাত অনেক বেশি, এদের মধ্যে অনেক নাবী আগমন করেছেন। ইবরাহীম (عليه السلام)-এর অপর পুত্র ইসমাঈল, তাঁর বংশধর হল আরবরা, এ বংশেই নাবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমন।
(وَكُلًّا جَعَلْنَا صٰلِحِيْنَ)
অর্থাৎ ইবরাহীম ও ইসহাক উভয়ে আল্লাহ তা‘আলার সৎ বান্দা ছিলেন এবং তাদের প্রত্যেককে আল্লাহ তা‘আলা ইমাম তথা ধর্মীয় নেতা বানিয়েছিলেন, ভাল ও আনুগত্যমূলক কাজে মানুষ তাদের অনুসরণ করত। তারা আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশক্রমে মানুষকে হিদায়াতের পথ দেখাতেন। আর তাদের প্রতি ওয়াহী করেছেন যেন তারা ভাল কাজ করে, মানুষকেও ভাল কাজের নির্দেশ দেয়, সালাত প্রতিষ্ঠা করে এবং যাকাত প্রদান করে। তারা সবাই আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতগুজার বান্দা ছিলেন, আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করতেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা লূত (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে حُكْمًا তথা নবুওয়াত দান করেছিলেন এবং عِلْمًا তথা বিবাদ মীমাংসা করার জ্ঞান দান করেছিলেন। তিনি যে এলাকার নাবী ছিলেন তার নাম সাদূম। এটি ফিলিস্তিন ও মৃতসাগর পার্শ্ববর্তী জর্ডানের নিকটতম একটি শস্য-শ্যামল এলাকা ছিল। যার বড় অংশ এখন সমুদ্রের গর্ভে। তাঁর জাতি সমকামিতার মত জঘন্য অপরাধ, রাস্তায় বসে পথচারীদের প্রতি কটূক্তি করা, তাদেরকে কষ্ট দেয়া ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত ছিল। লূত (عليه السلام) তাদেরকে এসব খারাপ কাজ থেকে বারণ করলেন। কিন্তু তারা কিছুতেই বিরত থাকল না। অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাদের এলাকা উল্টিয়ে দিয়ে ধ্বংস করে দেন।
আল্লাহ তা‘আলা লূত (عليه السلام) ও তাঁর প্রতি যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে শাস্তি থেকে নাজাত দিয়েছিলেন। এ সম্পর্কে সূরা হিজর এ আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১। মুসলিম সমাজের নেতাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য থাকবে তারা নিজেরা সৎ আমল করবে, অন্যদেরকে সেদিকে দাওয়াত দিবে।
২. যারা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।
৩. কোন এলাকায় দীন রক্ষা না করতে পারলে সে এলাকা ছেড়ে যেথায় যথাযথভাবে দীন রক্ষা করা যাবে সেখানে হিজরত করতে হবে।
৭৬-৭৭ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতদ্বয়ে নূহ (عليه السلام)-এর কথা আলোচনা করা হয়েছে। مِنْ قَبْلُ অর্থাৎ ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পূর্বে। নূহ (عليه السلام) ইবরাহীম (عليه السلام)-এর পূর্বে দুনিয়াতে এসে স্বজাতির মাঝে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েেিছলেন। তিনি বিভিন্নভাবে দাওয়াত দিয়েছিলেন, তাঁর দাওয়াতী পদ্ধতিগুলো সূরা নূহে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু যখন তাঁর জাতি দাওয়াত গ্রহণ করল না, তখন তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করলেন এভাবে: যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন
(وَقَالَ نُوْحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَي الْأَرْضِ مِنَ الْكٰفِرِيْنَ دَيَّارًا - إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوْا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوْآ إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا)
“ নূহ আরো বলেছিল: হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে ছেড়ে দেবেন না। তুমি যদি তাদেরকে ছেড়ে দাও তারা তোমার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং যারা জন্ম লাভ করবে তারা হবে দু®কৃতিকারী ও কাফির।” (সূরা নূহ ৭১:২৬-২৭) আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন, তাঁকে ও তাঁর পরিবার তথা যারা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছিল তাদেরকে রক্ষা করে অবাধ্য সবাইকে মহাপ্লাবনে ডুবিয়ে মারলেন।
এ স¤পর্কে সূরা হিজর, সূরা সফফাতের ৭৫-৭৭ নং, সূরা কামারের ১০-১১ নং আয়াতসহ অনেক স্থানে আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলাকে একনিষ্ঠভাবে আহ্বান করলে আল্লাহ তা‘আলা আহ্বানে সাড়া দেন এবং বিপদ থেকে মুক্তি দান করেন।
২. অপরাধ করলে অবশ্যই তার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৭১-৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা বলছেন যে, তিনি তার বন্ধু হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) কাফিরদের অগ্নি হতে রক্ষা করে সিরিয়ার পবিত্র ভূমিতে পৌঁছিয়ে দেন। হযরত উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) বলেন যে, সমস্ত সুমিষ্ট পানি সিরিয়ায় সাখরা’র নিম্নদেশ হতে বের হয়ে থাকে। হযরত কাতাদা (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) ইরাকের ভূ-খণ্ড হতে মুক্তি দিয়ে সিরিয়ায় পৌঁছিয়ে দেন। সিরিয়াই নবীদের (আঃ) হিজরতের জায়গা। যমীন। হতে যা ঘাটতি হয় সিরিয়ায় তা বৃদ্ধি পায় এবং সিরিয়ায় যা ঘাটতি হয়। ফিলিস্তিনে তা বৃদ্ধি হয়। সিরিয়াই হলো হাশরের মাঠ। এখানেই হযরত ঈসা (আঃ) অবতরণ করবেন। এখানেই দাজ্জালকে হত্যা করা হবে। হযরত কাবের (রাঃ) উক্তি হিসেবে জানা যায় যে,হযরত ইবরাহীম (আঃ) হিরানে গমণ করেন। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, তথাকার বাদশাহর কন্যা তার কওমের দ্বীনের প্রতি বীতঃশ্রদ্ধা হয়ে পড়েছেন এবং ওটাকে তিনি অন্তরে ঘৃণা করেন এমনকি ঐ ধর্মকে তিনি বিদ্রুপ করে থাকেন। তখন হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাকে তার এই স্বীকারোক্তির উপর বিয়ে করেন যে, তিনি তার সাথে হিজরত করে সেখান থেকে চলে যাবেন। তারই নাম হযরত সারা’ (রাঃ)। আর এটাও প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে যে, হযরত সারা’ (রাঃ) (এই রিওয়াইয়াতটি গারীব বা দুর্বল) ছিলেন তার চাচাতো বোন। তিনি তার সাথেই হিজরত করে চলে এসেছিলেন। হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, তাঁর এই হিজরত মক্কা শরীফে শেষ হয়। এই মক্কা শরীফ সম্পর্কেই মহান আল্লাহ বলেনঃ “এটাই আল্লাহর প্রথম ঘর যা মানবমণ্ডলীর জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা কল্যাণময় ও সারা বিশ্বের জন্যে হিদায়াত স্বরূপ। এতে বহু নিদর্শন রয়েছে, যেগুলির মধ্যে একটি নিদর্শন হলো মাকামে ইব্রাহীম। যে তাতে প্রবেশ করে সে নিরাপত্তা লাভ করে।”
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি ইবরাহীমকে (আঃ) দান করেছিলাম ইসহাক (আঃ) ও পৌত্ররূপে ইয়াকূব (আঃ)। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাকে সুসংবাদ দিয়েছিলাম ইসহাকের (আঃ) এবং ইসহাকের (আঃ) পিছনে (পরে) ইয়াকূবের (আঃ)। (১১:৭১) হযরত ইবরাহীম (আঃ) শুধু একটি সন্তানের জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি প্রার্থনায় বলেছিলেনঃ (আরবী)
অর্থাৎ “হে আমার প্রতিপালক! আমাকে একটি সুসন্তান দান করুন!” (৩৭:১০০) আল্লাহ তাঁর এ প্রার্থনা কবুল করেন। সন্তানও দান করেন। কাজেই এটা ছিল তার প্রার্থনার উপর অতিরিক্ত দান। আর প্রত্যেককেই তিনি সৎকর্মপরায়ণ করে দেন।
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমি তাদেরকে করেছিলাম নেতা; তারা আমার নিদের্শ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করতো। আর আমি তাদেরকে সৎকর্ম করার ওয়াহী করেছিলাম। এই সাধারণ কথার উপর আতফ বা সংযোগ করে তিনি বিশেষ কথা অর্থাৎ নামায ও যাকাতের বর্ণনা দেন। ইরশাদ হয় যে, তারা জনগণকে ভাল কাজের আদেশ করতেন এবং সাথে সাথে নিজেরাও ভাল কাজ করতেন।
এরপর হযরত লুতের (আঃ) বর্ণনা শুরু হচ্ছে। তিনি হলেন নূত ইবনু। হারাণ ইবনু আযন (আঃ)। তিনি হযরত ইবরাহীমের (আঃ) উপর ঈমান এনেছিলেন, তার অনুসরণ করেছিলেন এবং তাঁর সাথে হিজরত করেছিলেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “লুত (আঃ) তার উপর ঈমান আনয়ন করে এবং বলেঃ আমি আমার প্রতিপালকের দিকে হিজরতকারী।” (২৯:২৬) আল্লাহ তাআলা তাঁকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলেন এবং তার উপর ওয়াহী অবতীর্ণ করেন ও তাঁকে নবীদের দলভূক্ত করেন। তাঁকে তিনি সুদূম ও ওর পার্শ্ববর্তী জনপদগুলির দিকে প্রেরণ করেন। তারা তার বিরুদ্ধাচরণে উঠে পড়ে লেগে যায়। এই কারণে তারা আল্লাহর শাস্তির কবলে পতিত হয় এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। তাদের ধ্বংসের ঘটনা আল্লাহ তাআলার পবিত্র গ্রন্থের কয়েক জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। এখানে মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি তাকে এমন জনপদ হতে উদ্ধার করেছিলাম যার অধিবাসীরা লিপ্ত ছিল অশ্লীল কর্মে তারা ছিল একমন্দ সম্প্রদায়, সত্যত্যাগী। আর সে সৎকর্মপরায়ণ ছিল বলে আমি তার উপর আমার করুণা বর্ষণ করি।
৭৬-৭৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, হযরত নূহকে (আঃ) তাঁর কওম যখন মিথ্যা প্রতিপাদন করে ও কষ্ট দেয় তখন তার প্রতিপালককে ডাক দিয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহ! আমি অপারগ হয়ে গেছি। সুতরাং আপনি আমাকে সাহায্য করুন!” তিনি আরো বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! পৃথিবীতে কাফিরদের মধ্য হতে কোন গৃহবাসীকে অব্যাহতি দিয়েন না। যদি আপনি তাদেরকে অব্যাহতি দেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে বিভ্রান্ত করবে এবং জন্ম দিতে থাকবে শুধু দুষ্কৃতিকারী ও কাফির।” আল্লাহ তাআলা তার প্রার্থনা কবুল করলেন। তিনি তাকে ও তার মু’মিন অনুসারীদেরকে পরিত্রাণ দেন। এবং তার পরিবার পরিজনকেও রক্ষা করেন। শুধু তাদেরকে নয় যাদের নাম ধ্বংস প্রাপ্তদের তালিকা ভুক্ত ছিল। তার উপর ঈমান আনয়নকারীদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (আঃ) তাঁর কওমের জুলুম ও অবিচার হতে মুক্তি দেন। সাড়ে নয়শত বছর তিনি তাদের মধ্যে অবস্থান করে তাদেরকে তাবলীগ করতে থাকেন। কিন্তু অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই শিরক ও কুফরীর উপরই রয়ে যায়। এমন কি তারা তাকে কষ্ট দিতে থাকে। এবং তাঁকে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে একে অপরকে উত্তেজিত করে। মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি হযরত নূহকে (আঃ) সাহায্য করেছিলাম ঐ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যারা আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকার করেছিল এবং তাকে তাদের উৎপীড়ন হতে রক্ষা করেছিলাম এবং তার প্রার্থনা অনুযায়ী ভূ-পৃষ্ঠে একজন কাফিরও পরিত্রাণ পায় নাই। সবকেই ডুবিয়ে দেয়া হয়।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#931)
[ وَ نَصَرۡنٰہُ مِنَ الۡقَوۡمِ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا ؕ
And We saved him from the people who denied Our signs. ]
Sura:21
Sura: Al-Anbiyaa
Ayat: 71-77
www.motaher21.net
21:71
وَ نَجَّیۡنٰہُ وَ لُوۡطًا اِلَی الۡاَرۡضِ الَّتِیۡ بٰرَکۡنَا فِیۡہَا لِلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۷۱﴾
And We delivered him and Lot to the land which We had blessed for the worlds.
The Migration of Ibrahim to Ash-Sham (Greater Syria), accompanied by Lut
Allah tells:
وَنَجَّيْنَاهُ وَلُوطًا إِلَى الاَْرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا لِلْعَالَمِينَ
And We rescued him and Lut to the land which We have blessed for the nations.
Allah tells us that He saved Ibrahim from the fire lit by his people, and brought him out from among them, migrating to the land of Ash-Sham, to the sacred regions thereof.
21:72
وَ وَہَبۡنَا لَہٗۤ اِسۡحٰقَ ؕ وَ یَعۡقُوۡبَ نَافِلَۃً ؕ وَ کُلًّا جَعَلۡنَا صٰلِحِیۡنَ ﴿۷۲﴾
And We gave him Isaac and Jacob in addition, and all [of them] We made righteous.
وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَقَ وَيَعْقُوبَ نَافِلَةً
And We bestowed upon him Ishaq, and Ya`qub Nafilatan.
Ata’ and Mujahid said,
“Nafilatan means as a gift.”
Ibn Abbas, Qatadah and Al-Hakam bin `]Uyaynah said,
“The gift of a son who has a son,”
meaning that Yaqub was the son of Ishaq, as Allah says:
فَبَشَّرْنَـهَا بِإِسْحَـقَ وَمِن وَرَاءِ إِسْحَـقَ يَعْقُوبَ
But We gave her glad tidings of Ishaq, and after Ishaq, of Yaqub. (11:71)
Abdur-Rahman bin Zayd bin Aslam said,
“He asked for one (son), and said,
رَبِّ هَبْ لِى مِنَ الصَّـلِحِينِ
“My Lord! Grant me from the righteous.” (37:100)
So Allah gave him Ishaq, and gave him Yaqub in addition.
وَكُلًّ جَعَلْنَا صَالِحِينَ
Each one We made righteous.
means, both of them were good and righteous people.
21:73
وَ جَعَلۡنٰہُمۡ اَئِمَّۃً یَّہۡدُوۡنَ بِاَمۡرِنَا وَ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلَیۡہِمۡ فِعۡلَ الۡخَیۡرٰتِ وَ اِقَامَ الصَّلٰوۃِ وَ اِیۡتَآءَ الزَّکٰوۃِ ۚ وَ کَانُوۡا لَنَا عٰبِدِیۡنَ ﴿ۚۙ۷۳﴾
And We made them leaders guiding by Our command. And We inspired to them the doing of good deeds, establishment of prayer, and giving of zakah; and they were worshippers of Us.
وَجَعَلْنَاهُمْ أَيِمَّةً
And We made them leaders,
means, examples to be followed.
يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا
guiding by Our command,
inviting to Him by His leave.
Allah says:
وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلَأةِ وَإِيتَاء الزَّكَاةِ
and We revealed to them the doing of good deeds, performing Salah, and the giving of Zakah,
Here the general is followed by the specific.
وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ
and of Us (Alone) they were the worshippers.
means, they did what they enjoined others to do.
The Prophet Lut
Then Allah mentions Lut, whose full name was Lut bin Haran bin Azar. He believed in Ibrahim and followed him, and migrated with him, as Allah says:
فَـَامَنَ لَهُ لُوطٌ وَقَالَ إِنِّى مُهَاجِرٌ إِلَى رَبِّى
So Lut believed in him. He (Ibrahim) said:”I will emigrate for the sake of my Lord.” (29:26)
Allah gave him wisdom and knowledge; He sent Revelation to him, made him a Prophet and appointed him to Sadum (Sodom) and its vicinity, but they rejected him and resisted him, so Allah utterly destroyed them, as He tells us in several places in His Book.
Allah says;
وَلُوطًا اتَيْنَاهُ حُكْمًا وَعِلْمًا وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْقَرْيَةِ الَّتِي كَانَت تَّعْمَلُ الْخَبَايِثَ إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمَ سَوْءٍ فَاسِقِينَ
21:74
وَ لُوۡطًا اٰتَیۡنٰہُ حُکۡمًا وَّ عِلۡمًا وَّ نَجَّیۡنٰہُ مِنَ الۡقَرۡیَۃِ الَّتِیۡ کَانَتۡ تَّعۡمَلُ الۡخَبٰٓئِثَ ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمَ سَوۡءٍ فٰسِقِیۡنَ ﴿ۙ۷۴﴾
And to Lot We gave judgement and knowledge, and We saved him from the city that was committing wicked deeds. Indeed, they were a people of evil, defiantly disobedient.
وَأَدْخَلْنَاهُ فِي رَحْمَتِنَا إِنَّهُ مِنَ الصَّالِحِينَ
21:75
وَ اَدۡخَلۡنٰہُ فِیۡ رَحۡمَتِنَا ؕ اِنَّہٗ مِنَ الصّٰلِحِیۡنَ ﴿٪۷۵﴾
And We admitted him into Our mercy. Indeed, he was of the righteous.
and We saved him from the town who practiced Al-Khaba’ith. Verily, they were a people given to evil, and were rebellious. And We admitted him to Our mercy; truly, he was of the righteous
21:76
وَ نُوۡحًا اِذۡ نَادٰی مِنۡ قَبۡلُ فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ فَنَجَّیۡنٰہُ وَ اَہۡلَہٗ مِنَ الۡکَرۡبِ الۡعَظِیۡمِ ﴿ۚ۷۶﴾
And [mention] Noah, when he called [to Allah ] before [that time], so We responded to him and saved him and his family from the great flood.
Nuh and His People
Allah tells us how He responded to His servant and Messenger Nuh, peace be upon him, when he prayed to Him against his people for their disbelief in him:
فَدَعَا رَبَّهُ أَنُّى مَغْلُوبٌ فَانتَصِرْ
Then he invoked his Lord (saying):”I have been overcome, so help (me)!” (54:10)
وَقَالَ نُوحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الاٌّرْضِ مِنَ الْكَـفِرِينَ دَيَّاراً
إِنَّكَ إِن تَذَرْهُمْ يُضِلُّواْ عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُواْ إِلاَّ فَاجِراً كَفَّاراً
And Nuh said:”My Lord! Leave not any inhabitant of the disbelievers on the earth! If You leave them, they will mislead Your servants, and they will beget none but wicked disbelievers. (71:26-27)
So Allah says here,
وَنُوحًا إِذْ نَادَى مِن قَبْلُ فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ
And (remember) Nuh, when he cried (to Us) aforetime. We answered to his invocation and saved him and his family,
meaning, those who believed with him, as Allah says elsewhere:
وَأَهْلَكَ إِلاَّ مَن سَبَقَ عَلَيْهِ الْقَوْلُ وَمَنْ ءَامَنَ وَمَأ ءَامَنَ مَعَهُ إِلاَّ قَلِيلٌ
and your family — except him against whom the Word has already gone forth — and those who believe. And none believed with him, except a few. (11:40)
مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِيمِ
from the great distress.
meaning, from difficulty, rejection and harm.
For he remained among them for one thousand years less fifty, calling them to Allah, and no one had believed in him except for a few. His people were plotting against him and advising one another century after century, generation after generation, to oppose him.
21:77
وَ نَصَرۡنٰہُ مِنَ الۡقَوۡمِ الَّذِیۡنَ کَذَّبُوۡا بِاٰیٰتِنَا ؕ اِنَّہُمۡ کَانُوۡا قَوۡمَ سَوۡءٍ فَاَغۡرَقۡنٰہُمۡ اَجۡمَعِیۡنَ ﴿۷۷﴾
And We saved him from the people who denied Our signs. Indeed, they were a people of evil, so We drowned them, all together.
وَنَصَرْنَاهُ مِنَ الْقَوْمِ
We helped him against the people,
means, `We saved him and helped him against the people,’
…
الَّذِينَ كَذَّبُوا بِأيَاتِنَا إِنَّهُمْ كَانُوا قَوْمَ سَوْءٍ فَأَغْرَقْنَاهُمْ أَجْمَعِينَ
who denied Our Ayat. Verily, they were a people given to evil. So We drowned them all.
meaning, Allah drowned them all, and not one of them was left on the face of the earth, as their Prophet had prayed would happen to them.
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran