أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৩২)
[ وَ عَلَّمْنٰهُ صَنْعَةَ لَبُوْسٍ لَّكُمْ
আর আমি তাঁকে তোমাদের উপকারার্থে বর্ম নির্মাণ শিল্প শিখিয়েছিলাম, ]
সূরা:- আল্ আম্বিয়া।
সুরা:২১
৭৮- ৮২ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২১:৭৮
وَ دَاوٗدَ وَ سُلَیْمٰنَ اِذْ یَحْكُمٰنِ فِی الْحَرْثِ اِذْ نَفَشَتْ فِیْهِ غَنَمُ الْقَوْمِ١ۚ وَ كُنَّا لِحُكْمِهِمْ شٰهِدِیْنَۗۙ
আর এ নিয়ামতই আমি দাউদ ও সুলাইমানকে দান করেছিলাম। স্মরণ করো সে সময়ের কথা, যখন তারা উভয়ই একটি শস্য ক্ষেতের মোকদ্দমার ফায়সালা করছিল, যেখানে রাতের বেলা ছড়িয়ে পড়েছিল অন্য লোকদের ছাগল এবং আমি নিজেই দেখছিলাম তাদের বিচার।
২১:৭৯
فَفَهَّمْنٰهَا سُلَیْمٰنَ١ۚ وَ كُلًّا اٰتَیْنَا حُكْمًا وَّ عِلْمًا١٘ وَّ سَخَّرْنَا مَعَ دَاوٗدَ الْجِبَالَ یُسَبِّحْنَ وَ الطَّیْرَ١ؕ وَ كُنَّا فٰعِلِیْنَ
সে সময় আমি সুলাইমানকে সঠিক ফায়সালা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, অথচ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান আমি উভয়কেই দান করেছিলাম। দাউদের সাথে আমি পর্বতরাজী ও পক্ষীকূলকে অনুগত করে দিয়েছিলাম, যারা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতো, এ কাজের কর্তা আমিই ছিলাম।
২১:৮০
وَ عَلَّمْنٰهُ صَنْعَةَ لَبُوْسٍ لَّكُمْ لِتُحْصِنَكُمْ مِّنْۢ بَاْسِكُمْ١ۚ فَهَلْ اَنْتُمْ شٰكِرُوْنَ
আর আমি তাঁকে তোমাদের উপকারার্থে বর্ম নির্মাণ শিল্প শিখিয়েছিলাম, যাতে তোমাদেরকে পরস্পরের আঘাত থেকে রক্ষা করে, তাহলে কি তোমরা কৃতজ্ঞ হবে?
২১:৮১
وَ لِسُلَیْمٰنَ الرِّیْحَ عَاصِفَةً تَجْرِیْ بِاَمْرِهٖۤ اِلَى الْاَرْضِ الَّتِیْ بٰرَكْنَا فِیْهَا١ؕ وَ كُنَّا بِكُلِّ شَیْءٍ عٰلِمِیْنَ
আর সুলাইমানের জন্য আমি প্রবল বায়ু প্রবাহকে বশীভূত করে দিয়েছিলাম, যা তাঁর হুকুমে এমন দেশের দিকে প্রবাহিত হতো যার মধ্যে আমি বরকত রেখেছিলাম আমি সব জিনিসের জ্ঞান রাখি।
২১:৮২
وَ مِنَ الشَّیٰطِیْنِ مَنْ یَّغُوْصُوْنَ لَهٗ وَ یَعْمَلُوْنَ عَمَلًا دُوْنَ ذٰلِكَ١ۚ وَ كُنَّا لَهُمْ حٰفِظِیْنَۙ
আর শয়তানের মধ্য থেকে এমন অনেককে আমি তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলাম যারা তাঁর জন্য ডুবুরীর কাজ করতো এবং এছাড়া অন্য কাজও করতো, আমিই ছিলাম এদের সবার তত্ত্বাবধায়ক।
৭৮- ৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*লৌহশিল্পের জনক সুকন্ঠি নবী হযরত দাউদ(আ.) : এরপর হযরত দাউদ ও সোলায়মান কাহিনীর কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে, (আয়াত ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১ ও ৮২) কৃষি খামার সংক্রান্ত যে ঘটনায় হযরত দাউদ ও সোলায়মান বিচারক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সে সম্পর্কে এমন কিছু শ্রুতিকথা পাওয়া যায় যে, একদিন হঠাৎ দুই ব্যক্তি হযরত দাউদ(আ.)-এর কাছে উপস্থিত হলাে। তাদের একজন ছিল একটা কৃষি খামারের মালিক। মতান্তরে সে ছিলাে একটা আংগুর বাগানের মালিক। অপরজন এক পাল মেষের মালিক। খামার মালিক মেষের মালিককে দেখিয়ে বললাে, এই ব্যক্তির মেষপাল রাতের বেলা আমার ক্ষেতে ঢুকেছে এবং ক্ষেতের ফসল খেয়ে শেষ করেছে। হযরত দাউদ ক্ষেত মালিকের পক্ষে এই মর্মে রায় দিলেন যে, সে তার নষ্ট হওয়া ফসলের বিনিময়ে অভিযুক্তের মেষগুলাে নিয়ে যেতে পারে। মেঘমালিক চলে যাওয়ার সময় হযরত সােলায়মানের সাথে তার দেখা হলো। সে তাকে হযরত দাউদ(আ.)-এর ফয়সালার কথা জানালাে। হযরত সােলায়মান পিতার কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর নবী, আপনি যে ফয়সালা করেছেন তা সঠিক হয়নি। তিনি বললেন, তাহলে কিভাবে ফয়সালা করলে সঠিক হবে? হযরত সুলায়মান বললেন, মেষপালকে খামার মালিকের হাতে সাময়িকভাবে দিয়ে দিন সে তা দ্বারা উপকৃত হতে থাকুক। আর খামারটা মেষ মালিকের হাতে অর্পণ করুন, সে ওটা পরিচালনা করতে থাকুক। যতােক্ষণ না তা সাবেক অবস্থায় ফিরে যায়। তারপর উভয়ে তার জিনিস সাবেক মালিককে ফিরিয়ে দেবে। খামারের মালিক খামার এবং মেষ মালিক মেষ ফেরত পাবে। হযরত দাউদ(আ.) বললেন, তােমার ফয়সালাই সঠিক। অতপর সােলায়মানের রায়টাকেই কার্যকরী করলেন। হযরত দাউদ ও সােলায়মান উভয়ের ফয়সালাই ছিলাে তাদের ইজতেহাদ তথা নিজস্ব চিন্তা গবেষণার ফল। আল্লাহ তায়ালা উভয়ের রায় দানের সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি সােলায়মানকে অধিকতর প্রজ্ঞাময় ও অধিকতর নির্ভুল রায় কী হবে তা জানিয়ে ও বুঝিয়ে দিলেন। হযরত দাউদ(আ.) তার রায়ে খামার মালিককে একটা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করেই ক্ষান্ত থেকেছিলেন। এতে শুধু ন্যায় বিচারের দাবীই পূর্ণ হয়েছিলাে। কিন্তু হযরত সােলায়মান যে রায় দিলেন, তাতে ন্যায় বিচারের সাথে সাথে গঠনমূলক ব্যবস্থাও যুক্ত ছিলাে। ন্যায়বিচারকে গঠন ও উন্নয়নের দিকে পরিচালিত করলেন। এটা ছিলাে ইতিবাচক, গঠনমূলক ও জীবন্ত রায়। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছিলাে এবং আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা করেন এভাবে সঠিক ফয়সালা বুঝিয়ে দেন। হযরত দাউদ ও সােলায়মান উভয়কেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করা হয়েছিলাে। হযরত দাউদের বিচারে কোনাে ভুল ছিলাে না। কিন্তু সােলায়মানের বিচার ছিলাে বিশুদ্ধতর। কেননা তা এসেছিলাে আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহামের (সুপ্ত ওহী) আকারে। এরপর উভয়ের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হচ্ছে, প্রথমে পিতার বৈশিষ্ট্য ‘আমি পাহাড়গুলােকে ও পাখিকুলকে দাউদের অনুগত করে দিয়েছিলাম, তারা সবাই আল্লাহর গুণগান করতাে এসব আমিই করেছিলাম। আর তাকে তােমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা যুদ্ধ থেকে তােমাদেরকে রক্ষা করে। তাহলে তােমরা কি শােকর করবে?’ দাউদ(আ.) তার সুমধুর সুরের জন্যে খ্যাত হয়ে আছেন। তিনি মধুর সুরে আল্লাহর মহিমা বর্ণনা করতেন, তার চারপাশের প্রকৃতিতে তা প্রতিধ্বনি তুলতো এবং পাহাড় ও পাখিরা তার সাথে সমস্বরে মুখরিত হতাে। যখন কোনাে বান্দার অন্তর আল্লাহর সাথে মিলিত হয়, তখন সে নিজেকে গােটা সৃষ্টি জগতের সাথেই যুক্ত বলে অনুভব করে। তাই গােটা সৃষ্টি জগতের হৃদয় তার সাথে সাথে স্পন্দিত হয়। বিভিন্ন জাত ও প্রকারের সৃষ্টির মাঝে বিরাজমান পার্থক্য, ভেদাভেদ, প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতা থেকে দূরত্ব ও প্রভেদ সৃষ্টি হয়, তা নিমিষেই দূরীভূত হয়ে যায়। আর ঠিক সেই মুহুর্তে সকল সৃষ্টি মহাবিশ্বের বিশাল প্রান্তরে একই সমতলে সমবেত হয়ে একদেহে ও এক আত্মায় পরিণত হয়ে যায়। আত্মা যখন ঐশী জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়ে যায়, তখন তা নিজেকে সমগ্র সৃষ্টির সাথে একাত্ম ও সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে বিলীন বলে অনুভব করে। তখন সে কোনাে জিনিসকেই নিজের বাইরে এবং নিজেকে পারিপার্শিক কোনাে জিনিস থেকে বিছিন্ন করে না। সমগ্র পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা তার মধ্যে এবং সমগ্র পরিবেশ পারিপাশ্বিকতায় সে বিলীন হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনের আয়াত থেকে আমরা হযরত দাউদের এমন এক চিত্র কল্পনা করতে পারি, যেন তিনি সমধুর সুরে ঐশী কিতাব তেলাওয়াত করছেন, তেলাওয়াত করতে গিয়ে তিনি নিজের স্বতন্ত্র সত্ত্বাকে ভুলে বসে আছেন এবং তার আত্মা সমগ্র বিশ্বের প্রাণী ও বস্তুসমূহের সাথে মিলে মিশে মহান আল্লাহর অনুগ্রহ সিক্ত ছায়াতলে সর্বত্র বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। এর ফলে সমগ্র সৃষ্টিজগত তার কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাচ্ছে, তার সূরে মুখরিত হচ্ছে এবং আল্লাহর মহিমা বর্ণনা, গুণগান ও প্রশংসা করছে। আল্লাহ তায়ালা সুরা বনী ইসরাঈলে বলেছেন, ‘এমন কোনাে জিনিস নেই, যা আল্লাহর প্রশংসা সহকারে মহিমা বর্ণনা করে না। তবে তােমরা তাদের মহিমা বর্ণনা বুঝতে পার না।’ বস্তুত জড় জীবন ও উদ্ভিদ নির্বিশেষে সমগ্ৰ সৃষ্টি জগত আল্লাহর যে প্রশংসা ও গুণবর্ণনা করে, তা শুধু সেই ব্যক্তিই বুঝতে পারে, যে নিজেকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখে না এবং মহান আল্লাহর একান্ত অনুগত সৃষ্টিজগতের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। ‘দাউদের জন্যে অনুগত করে দিয়েছি পাহাড় পর্বত ও পাখিকূলকে। তারা সকলেই আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘােষণা করে। এ সব কিছু আমিই করেছি।’ অর্থাৎ আল্লাহর শক্তির সামনে দন্ত প্রকাশ করতে পারে কিংবা তার ইচ্ছা পূরণ করতে অস্বীকার করতে পারে এমন কোনাে জিনিস কোথাও নেই,-মানুষের পরিচিত বা অপরিচিত কিছুই নয়। ‘আর আমি তাকে তােমাদের জন্যে বর্ম বানানাে শিখিয়েছি, যাতে তা তােমাদেরকে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে নিরাপদে রাখে। তবে কি তােমরা কৃতজ্ঞ হবে?’ এ হচ্ছে পরস্পরে আবদ্ধ রিং দ্বারা তৈরী লৌহ বর্মের শিল্প। এ বর্ম ইতিপূর্বেকার ঢালাও লােহার পাত দিয়ে তৈরী লৌহ বর্মের চেয়ে সহজে ও অনায়াসে ব্যবহারযােগ্য ও ঢিলা ঢালা। সম্ভবত হযরত দাউদ(আ.) সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত নির্দেশিকার আলােকে এই উন্নতমানের বর্ম তৈরী করেছিলেন। মানুষকে যুদ্ধের দৈহিক ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে হযরত দাউদ(আ.)-কে আল্লাহ তায়ালা এই বর্ম বানানাে শিখিয়ে সমগ্র মানব জাতির উপকার সাধন করেন, ‘যাতে তা তােমাদেরকে যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে নিরাপদে রাখে।’ এরপর উদ্বুদ্ধকরণের ভংগীতে প্রশ্ন করেন, ‘তবে কি তােমরা কৃতজ্ঞ হবে?’ মানব সভ্যতা রকমারি আবিষ্কার উদ্ভাবনের পথে ধাবিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ও ধীরে ধীরে রাতারাতি নয়। কেননা পৃথিবীর খেলাফত তথা শাসন পরিচালনার দায়িত্বটা মানুষের জন্যেই রেখে দেয়া হয়েছে। আর এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাকে উপযুক্ত মেধা ও যােগ্যতাও দিয়েছেন, যাতে সে জীবনকে প্রচলিত ধারার সাথে সমন্বিত করতে প্রতিদিন কিছু না কিছু সামনে অগ্রসর হতে পারে। নতুন বিধি ব্যবস্থা অনুসারে জীবনকে সমন্বিত করা ও সাজানাে মানুষের পক্ষে সহজ কাজ নয়। এ কাজ করতে গিয়ে তাকে নিজের ভেতরে বিরাট আলােড়ন সৃষ্টি করতে ও প্রচুর পরিবর্তন আনতে হয়, আদত অভ্যাস পাল্টাতে হয় এবং দীর্ঘসময় পাড়ি দিয়ে সে উৎপাদন ও অগ্রগতির উপযােগী শান্তি, একাগ্রতা ও স্থীতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, এ জন্যেই প্রতিবারই সভ্যতার সমন্বয় সাধনের পর একটা স্থীতিশীলতার যুগ আসুক এটাই আল্লাহর প্রজ্ঞা ও কর্মকুশলতার দাবী হয়ে থাকে, চাই সে যুগ ক্ষুদ্র হােক বা দীর্ঘ হােক। আজকের বিশ্বে মানব জাতির স্নায়ুমন্ডলী যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় ভারাক্রান্ত, তার প্রধান কারণ হলাে ঘন ঘন সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনের হিড়িক, যা মানুষের শান্তি ও স্থীতি কেড়ে নিয়েছে এবং তার জন্যে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে চলার সুযােগ রাখেনি। এতাে গেলাে হযরত দাউদের অবস্থা।
*কিংবদন্তি নবী হযরত সুলায়মান(আ.) : হযরত সুলায়মান(আ.)-এর অবস্থা এর চেয়েও উন্নত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর সুলায়মানের জন্যে অনুগত করে দিয়েছি বাতাসকে, যা তার আদেশ দ্রুতগতিতে কল্যাণময় ভূখন্ডের দিকে ধাবিত হয়। আমি সব কিছু সম্পর্কে অবহিত …'(আয়াত ৮১-৮২) হযরত সুলায়মানকে ঘিরে বহু কিসসা কাহিনী প্রচলিত আছে। যার অধিকাংশই ইসরাইলী বর্ণনা থেকে উৎসারিত ! তবে আমরা এ সবের আলােচনায় যাবাে না। আমরা শুধু কোরআনের বর্ণনার মধ্যে সীমিত থাকব। এর বাইরে হযরত সুলায়মান সম্পর্কে প্রামাণ্য কিছুই নেই। এখানে কোরআনের আয়াতে হযরত সুলায়মানের জন্যে প্রবল বাতাসকে অনুগত ও বশীভূত করার বিষয়টা আলােচিত হয়েছে। এই বাতাস তার আদেশে কল্যাণময় ভূখন্ডের দিকে ধাবিত হবে। এই ‘কল্যাণময় ভূখন্ড’ দ্বারা বুঝানাে হয়েছে সিরিয়াকে। কেননা ইতিপূর্বে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর কাহিনী বর্ণনা করার সময় এই শব্দ দ্বারা সিরিয়াকেই বুঝানাে হয়েছিলাে। এখন প্রশ্ন হলাে, বাতাসকে বশীভূত করার প্রক্রিয়াটা কেমন ছিলাে? এ প্রসংগে বাতাসের ওপর দিয়ে চলাচলকারী বিছানার কাহিনী বর্ণনা করা হয়ে থাকে। বলা হয় যে, হযরত সােলায়মান তার পাইক পেয়াদাসহ সে বিছানায় চড়ে বসে থাকতেন। অতপর অতি অল্পসময়ে সে বিছানা তাদেরকে সিরিয়ায় নিয়ে যেত ও নিয়ে আসত। অথচ তখন উটের পিঠে চড়ে সিরিয়া যেতে এক মাস লাগতাে। এ কাহিনীর প্রমাণ হিসেবে সূরা সাবার নিম্নোক্ত আয়াতের উল্লেখ করা হয়ে থাকে, ‘আর সুলায়মানের জন্যে বাতাসকে অনুগত করে দিয়েছিলাম, যার যাওয়ার পথও এক মাসের, আসার পথও এক মাসের।’ কিন্তু কোরআন বাতাসের ওপর দিয়ে চলাচলকারী বিছানার কোনাে উল্লেখ করেনি। আর এটা কোনাে প্রামাণ্য হাদীস নেই। সুতরাং বিছানার ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্যে আমাদের কাছে নির্ভরযােগ্য কোনাে তথ্য নেই। কাজেই বাতাসকে বশীভূত করার ব্যাখ্যা হিসেবে যে কথা সংশয়মুক্তভাবে বলা যায় তা এই যে, আল্লাহ বাতাসকে নিজ আদেশের মাধ্যমে কল্যাণময় ভূখন্ড সিরিয়ার দিকে সরে পাঠাতেন এবং সে সফরে যাওয়া ও আসায় একমাস ব্যয় হতাে। এটা কিভাবে হতো? আমি আগেই বলেছি যে, আল্লাহর শক্তি সীমাহীন। কাজেই আল্লাহর কোনাে কাজ সম্পর্কে এ প্রশ্ন করার অবকাশ নেই যে, কিভাবে হলাে? প্রাকৃতিক নিয়ম ও উপাদানগুলােকে সৃষ্টি করা ও আদেশ দিয়ে কাজে নিয়ােজিত করা আল্লাহর সেই সীমাহীন শক্তিরই ফলশ্রুতি ও বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর এই প্রাকৃতিক নিয়ম ও উপাদানগুলাের খুব সামান্য অংশই মানুষ এ যাবত জানতে পেরেছে। মানুষের অজানা এমন বহু প্রাকৃতিক উপাদান থাকতে পারে, যা অজান্তে ও অলক্ষ্যে সক্রিয় থাকে এবং যখন আল্লাহ তায়ালা সেগুলােকে আত্মপ্রকাশের অনুমতি দেন কেবল তখনই তার লক্ষণাদি প্রকাশিত হয়। আমি সব কিছুই জানি। অর্থাৎ আমার জ্ঞান সীমাহীন, মানুষের জ্ঞানের মতাে সীমাবদ্ধ নয়। জিনদেরকে হযরত সোলায়মান বশীভূত করার ব্যাপারটাও তদ্রুপ। তারা সমুদ্রের তলদেশে ও স্থলভাগের মাটির নিম্নভাগে ডুবুরির ভূমিকা পালন করতাে এবং হযরত সােলায়মানকে সমুদ্র তলদেশের ও ভূগর্ভের রত্নরাজি কুড়িয়ে এনে দিত অথবা অন্য নানাবিধ কাজ করে দিতাে। আভিধানিক অর্থে যে কোনাে গােপন জিনিসই জ্বিন। তবে কোরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, জ্বিন নামক এক ধরনের সৃষ্টিজীব রয়েছে, যারা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থাকে। তাদের মধ্য থেকেই একটা গােষ্ঠীকে আল্লাহ তায়ালা ডুবুরি হিসাবে এবং অন্যান্য পর্যায়ে কাজ করার জন্যে হযরত সুলায়মানের অনুগত করে দিয়েছিলেন। সেই সাথে তাদের কাজ ছেড়ে পলায়ন, অবাধ্যতা প্রদর্শন ও অরাজকতা বিস্তারের পথও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বস্তুত আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের ওপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, যখন যাকে বশীভূত করতে চান যেভাবে করতে চান, করতে পারেন ও করেন। কোরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্যের এই নিরাপদ সীমার মধ্যেই আমি আমার বিচরণ সীমিত রাখতে চাই- ইহুদীদের জনশ্রুতি নির্ভর কিংবদন্তীসমূহের মধ্যে গা ভাসিয়ে দিতে চাই না। আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদ ও সােলায়মান(আ.)-কে সুখ ও সমৃদ্ধি দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। উভয়কে দুটো নেয়ামত দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। দাউদ(আ.)-কে পরীক্ষা করেছিলেন বিচারকের পদে অধিষ্ঠিত করে। আর সােলায়মান(আ.) উৎকৃষ্ট ঘােড়া দিয়ে। সূরা ‘সাদ’ এ প্রসংগটা এসেছে। কাজেই যথাস্থানেই এই পরীক্ষার বিষয়ে আলােচনা করা হবে। এখানে শুধু সে পরীক্ষার ফল কী হয়েছিলাে সংক্ষেপে তাই তুলে ধরা হলাে। ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে ব্রিতকর পরিস্থিতিতে উদ্ধার পাওয়ার পর অঢেল সুখ ও ঐশ্বর্য লাভের পরীক্ষায় হযরত দাউদ ও সােলায়মান(আ.) ধৈর্যধারনের মাধ্যমে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এতে তারা আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী রূপে পরিগণিত হন।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# বাইবেলে এ ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়নি। ইহুদী সাহিত্যেও আমরা এর কোন চিহ্ন দেখি না। মুসলমান তাফসীরকারগণ এর যে ব্যাখ্যা করেছেন তা হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তির শস্যক্ষেতে অন্য এক ব্যক্তির ছাগলগুলো রাতের বেলা ঢুকে পড়ে। সে হযরত দাউদের কাছে অভিযোগ করে। তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তির ছাগলগুলো ছিনিয়ে নিয়ে প্রথম ব্যক্তিকে দিয়ে দেবার ফায়সালা শুনিয়ে দেন। হযরত সুলায়মান এ ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তিনি রায় দেন, ছাগলগুলো ততদিন পর্যন্ত ক্ষেতের মালিকের কাছে থাকবে যতদিন না সে আবার নিজের ক্ষেত শস্যে পূর্ণ করে নিতে পারে। এ সম্পর্কেই আল্লাহ বলছেন, সুলায়মানকে এ ফায়সালাটি আমিই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু মোকাদ্দামার এ বিস্তারিত বিবরণ কুরআনে বর্ণিত হয়নি এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন হাদীসেও এ বিবরণ আসেনি তাই একথা বলা যেতে পারে না যে, এ ধরনের মামলায় এটিই ইসলামী শরীয়াতের প্রমাণ্য আইন। এ কারণেই হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী ও অন্যান্য ইসলামী ফকীহগণের মধ্যে এ ব্যাপারে মতবিরোধ হয়েছে যে, যদি কারো ক্ষেত অন্যের পশু দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তাকে কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে কিনা এবং দিতে হলে কোন অবস্থায় হবে এবং কোন অবস্থায় হবে না তাছাড়া কিভাবে এ ক্ষতিপূরণ করা হবে?
এ প্রেক্ষাপটে হযরত দাউদ (আ) ও হযরত সুলায়মানের (আ) এ বিশেষ ঘটনাটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে একথা বুঝিয়ে দেয়া যে, নবীগণ নবী হবার এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অসাধারণ শক্তি ও যোগ্যতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মানুষই হতেন। আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার সামান্যতম গন্ধও তাদের মধ্যে থাকতো না। এ মোকাদ্দমার ব্যাপারে অহীর মাধ্যমে হযরত দাউদকে সাহায্য করা হয়নি। ফলে তিনি ফায়সালা করার ব্যাপারে ভুলের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে হযরত সুলায়মানকে অহীর মাধ্যমে সাহায্য করা হয়েছে, ফলে তিনি সঠিক ফায়সালা দিয়েছেন। অথচ দু’জনই নবী ছিলেন। সামনের দিকে এ উভয় নবীর যেসব দক্ষতার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাও একথা বুঝাবার জন্য যে, এসব আল্লাহ প্রদত্ত দক্ষতা এবং এ ধরনের দক্ষতার কারণে কেউ আল্লাহর সমকক্ষ হয়ে যায় না।
এ আয়াত থেকে পরোক্ষভাবে ন্যায়বিচারের এ মূলনীতিও জানা যায় যে, দু’জন বিচারপতি যদি একটি মোকাদ্দমার ফায়সালা করে এবং দু’জনের ফায়সালা বিভিন্ন হয়, তাহলে যদিও একজনের ফায়সালাই সঠিক হবে তবুও দু’জনেই ন্যায়বিচারক বিবেচিত হবেন। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে বিচার করার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা উভয়ের মধ্যে থাকতে হবে। তাদের কেউ যেন অজ্ঞতা ও অনভিজ্ঞতা সহকারে বিচারকের আসনে বসে না যান। নবী ﷺ হাদীসে একথা আরো বেশী সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করে দিয়েছেন। বুখারীতে আমর ইবনুল আস (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী ﷺ বলেছেনঃ
إِذَا اجْتَهَدَ الْحَاكِمُ فَأَصَابَ فله اجران و إِذَا اجْتَهَدَ فأَخْطَأَ فله اجر
“যদি বিচারক নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ফায়সালা করার পূর্ণ প্রচেষ্টা চালান, তাহলে সঠিক ফায়সালা করার ক্ষেত্রে তিনি দু’টি প্রতিদান পাবেন এবং ভুল ফায়সালা করলে পাবেন একটি প্রতিদান।”
আবু দাউদ ও ইবনে মাজায় বুরাইদার (রা.) রেওয়ায়াত বর্ণিত হয়েছে। সেখানে নবী (সা.) বলেছেনঃ “বিচারক তিন প্রকারের। এদের একজন জান্নাতী এবং দু’জন জাহান্নামী। জান্নাতের অধিকারী হচ্ছেন এমন বিচারক, যিনি সত্য চিহ্নিত করতে পারলে সে অনুযায়ী ফায়সালা দেন। কিন্তু যে ব্যক্তি সত্য চিহ্নিত করার পরও সত্য বিরোধী ফায়সালা দেয় সে জাহান্নামী। আর অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি জ্ঞান ছাড়াই লোকদের মোকদ্দমার ফায়সালা করতে বসে যায় সেও জাহান্নামী।
# মূলে مَعَ دَاوُودَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, لداؤد বলা হয়নি। অর্থাৎ “দাউদ আলাইহিস সালামের জন্য” নয় বরং “তাঁর সাথে” পাহাড় ও পাখীদেরকে অনুগত করা হয়েছিল এবং সে কারণে তারাও হযরত দাউদের (আ) সাথে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতো। একথাটিই সূরা সাদ-এ বলা হয়েছেঃ
إِنَّا سَخَّرْنَا الْجِبَالَ مَعَهُ يُسَبِّحْنَ بِالْعَشِيِّ وَالْإِشْرَاقِ – وَالطَّيْرَ مَحْشُورَةً كُلٌّ لَهُ أَوَّابٌ
“আমি তার সাথে পাহাড়গুলোকে অনুগত করে দিয়েছিলাম। সকাল-সাঁঝে তারা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতো। আর পাখিদেরকেও অনুগত করা হয়েছিল। তারা একত্র হতো, সবাই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করতো।”
সূরা সাবায় এর ওপর অতিরিক্ত বলা হয়েছেঃ يَا جِبَالُ أَوِّبِي مَعَهُ وَالطَّيْرَ “পাহাড়গুলোকে আমি হুকুম দিয়েছিলাম যে, তাঁর সাথে সাথে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করো এবং এই একই হুকুম পাখিদেরকেও দিয়েছিলাম।” এ বক্তব্যগুলো থেকে যে কথা বুঝা যায় তা হচ্ছে এই যে, হযরত দাউদ যখন আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা গীতি গাইতেন তখন তাঁর উচ্চতর ও সুরেলা আওয়াজে পাহাড় গুঞ্জরিত হতো, পাখিরা থেমে যেতো এবং একটা অপূর্ব মূর্ছনার সৃষ্টি হতো। এ অর্থের সমর্থন একটি হাদীস থেকে পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একবার হযরত আবু মূসা আশ’আরী (রা.) কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল অসাধারণ সুরেলা। নবী ﷺ সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার আওয়াজ শুনে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং অনেকক্ষণ শুনতে থাকলেন। তার পড়া শেষ হলে তিনি বললেনঃ لَقَدْ أُوتِيَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيرِ آلِ دَاوُدَ অর্থাৎ এ ব্যক্তি দাউদের সুরেলা কণ্ঠের একটি অংশ পেয়েছে।
# সূরা সাবায় এর ওপর আরো বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছেঃ
وَأَلَنَّا لَهُ الْحَدِيدَ – أَنِ اعْمَلْ سَابِغَاتٍ وَقَدِّرْ فِي السَّرْدِ
“আর আমি তার জন্য লোহা নরম করে দিয়েছি (এবং তাকে নির্দেশ দিয়েছি) যে, পূর্ণমাপের বর্ম তৈরী করো এবং বুনন করার ক্ষেত্রে যথাযথ পরিমাণ রক্ষা করো।”
এ থেকে জানা যায়, আল্লাহ হযরত দাউদকে লোহা ব্যবহার করার ক্ষমতা দান করেছিলেন। বিশেষ করে যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বর্ম নির্মাণের কায়দা-কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান যুগের ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্বিক গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে এ আয়াতের অর্থের ওপর যে আলোকপাত হয় তা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীতে লৌহ যুগ (Iron age) শুরু হয় খৃস্টপূর্ব ১২০০ ও ১০০০ অব্দের মাঝামাঝি সময়ে। আর এটিই ছিল হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের যুগ। প্রথম দিকে সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের হিত্তী (Hittites) জাতি লোহা ব্যবহার করে। ২০০০ থেকে ১২০০ খৃস্ট পূবাব্দ পর্যন্ত এ জাতির উত্থান দেখা যায়। তারা লোহা গলাবার ও নির্মাণের একটা জটিল পদ্ধতি জানতো। সারা দুনিয়ার দৃষ্টি থেকে তারা একে কঠোরভাবে গোপন রাখে। কিন্তু এ পদ্ধতিতে যে লোহা তৈরী করা হতো তা সোনা রূপার মতো এত বেশী মূল্যবান হতো যে, তা সাধারণ কাজে ব্যবহার করা যেতো না। পরে ফিলিস্তিনীরা এ পদ্ধতি জেনে নেয় এবং তারাও একে গোপন রাখে। তালূতের রাজত্বের পূর্বে হিত্তী ও ফিলিস্তিনীরা বনী ইসরাঈলকে যেভাবে উপর্যুপরি পরাজিত করে ফিলিস্তীন থেকে প্রায় বেদখল করে দিয়েছিল বাইবেলের বর্ণনা মতে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এই যে, তারা লোহার রথ ব্যবহার করতো এবং তাদের কাছে লোহার তৈরী অন্যান্য অস্ত্রও থাকতো। (যিহোশূয় ১৭: ১৬ , বিচারকর্তৃগণ ১: ১৯, ৪: ২-৩) খৃস্টপূর্ব ১০২০ অব্দে তালূত যখন আল্লাহর হুকুমে বনী ইসরাঈলদের শাসক পদে অধিষ্ঠিত হন তখন তিনি তাদেরকে পরপর কয়েকবার পরাজিত করে ফিলিস্তীনের বেশীর ভাগ অংশ তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেন। তারপর হযরত দাউদ (১০০৪-৯৬৫ খৃঃ পূঃ) শুধুমাত্র ফিলিস্তীন ও ট্রান্স জর্দানই নয় বরং সিরিয়ারও বড় অংশে ইসরাঈলী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় লৌহ নির্মাণ শিল্পের যে গোপন কলাকৌশল হিত্তী ও ফিলিস্তীনদের নিয়ন্ত্রণে ছিল তা উন্মোচিত হয়ে যায় এবং কেবলমাত্র উন্মোচিত হয়েই থেমে যায়নি বরং লৌহ নির্মাণের এমন পদ্ধতিও উদ্ভাবিত হয় যার ফলে সাধারণ ব্যবহারের জন্য লোহার কম দামের জিনিসপত্রও তৈরী হতে থাকে। ফিলিস্তীনের দক্ষিণে আদূম এলাকা আকরিক লোহায় (Iron Ore) সমৃদ্ধ ছিল। সম্প্রতি এ এলাকায় যে প্রত্মতাত্বিক খননকার্য চালানো হয় তার ফলে এমন অনেক জায়গার প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনসমূহ পাওয়া গেছে যেখানে লোহা গলাবার চুল্লী বসানো ছিল। আকাবা ও আইলার সাথে সংযুক্ত হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের জামানার বন্দর ইসয়ুন জাবেরের প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে যে চুল্লী পাওয়া গেছে তা পর্যবেক্ষণের পরে অনুমান করা হয়েছে যে, তার মধ্যে এমনসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো যা আজকের অত্যাধুনিক যুগের Blast Furnace এ প্রয়োগ করা হয়। এখন স্বাভাবিকভাবেই হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম সবার আগে ও সবচেয়ে বেশী করে এ নতুন আবিষ্কারকে যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকবেন। কারণ কিছুকাল আগেই আশপাশের শত্রু জাতিরা এ লোহার অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁর জাতির জীবন ধারণ কঠিন করে দিয়েছিল।
# হযরত দাউদ সম্পর্কে আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা আল-বাকারাহ ২৫১ আয়াত ও বনী ইসরাঈল ৭ টীকা , ৬৩ টীকা )
# এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে সূরা সাবায় এভাবেঃ
وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ غُدُوُّهَا شَهْرٌ وَرَوَاحُهَا شَهْرٌ
“আর সুলায়মানের জন্য আমি বায়ূকে বশীভূত করে দিয়েছিলাম, সকালে তাঁর চলা এক মাসের পথ পর্যন্ত এবং সন্ধ্যায় তাঁর চলা এক মাসের পথ পর্যন্ত।” এর আরো বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে সূরা সাদ-এ। সেখানে বলা হয়েছেঃ
فَسَخَّرْنَا لَهُ الرِّيحَ تَجْرِي بِأَمْرِهِ رُخَاءً حَيْثُ أَصَابَ
“কাজেই আমি তাঁর জন্য বায়ূকে বশীভূত করে দিয়েছিলাম, যা তাঁর হুকুমে সহজে চলাচল করতো যেদিকে সে যেতে চাইতো।”
এ থেকে জানা যায়, বাতাসকে হযরত সুলায়মানের হুকুমের এভাবে অনুগত করে দেয়া হয়েছিল যে, তাঁর রাজ্যের এক মাস দূরত্বের পথ পর্যন্ত যে কোন স্থানে তিনি সহজে সফর করতে পারতেন। যাওয়ার সময়ও সবসময় তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী অনুকূল বাতাস পেতেন আবার ফেরার সময়ও। বাইবেল ও আধুনিক ঐতিহাসিক গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে এ বিষয়বস্তুর ওপর যে আলোকপাত হয় তা হচ্ছে এই যে, হযরত সুলায়মান তাঁর রাজত্বকালে নৌ-বাণিজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটান। এদিকে ইসয়ূন জাবের বন্দর থেকে তাঁর বাণিজ্য বহর লোহিত সাগরে ইয়ামেন এবং অন্যান্য পূর্ব ও দক্ষিণ দেশসমূহে যাতায়াত করতো এবং অন্যদিকে ভূ-মধ্যসাগরের বন্দরসমূহ থেকে তাঁর নৌবহর (যাকে বাইবেলে তর্শীশী নৌবহর বলা হয়েছে) পশ্চিম দেশসমূহে যেতো। ইসয়ূন জাবেরে তাঁর সময়ের যে বিশাল চুল্লী পাওয়া গেছে তার সাথে তুলনীয় কোন চুল্লী আজ পর্যন্ত পশ্চিম এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে পাওয়া যায়নি। প্রত্মতত্ব বিশেষজ্ঞগণের মতে এখানে আদুমের আরাবাহ এলাকার খনি থেকে অশোধিত লোহা ও তামা আনা হতো এবং এই চুল্লিতে গালাবার পর সেগুলো অন্যান্য কাজ ছাড়া জাহাজ নির্মাণ কাজেও ব্যবহার করা হতো। এ থেকে কুরআন মজীদে হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সূরা সাবায় যে কথা বলা হয়েছে وَأَسَلْنَا لَهُ عَيْنَ الْقِطْر
(আর আমি তার জন্য গলিত ধাতুর ঝরণা প্রবাহিত করে দিয়েছিলাম) তার ওপর আলোকপাত হয়। তাছাড়া এ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সামনে রাখলে হযরত সুলায়মানের জন্য এক মাসের পথ পর্যন্ত বায়ু প্রবাহকে “বশীভূত” করার অর্থ অনুধাবন করা যায়। সেকালে সামূদ্রিক সফর পুরোপুরি অনুকূল বাতাসের ওপর নির্ভর করতো। মহান আল্লাহ হযরত সুলায়মানের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ করেছিলেন, যার ফলে তাঁর দু’টি সামূদ্রিক বহর সবসময় তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী এই অনুকূল বাতাস পেতো। তবুও যদি বাতাসের ওপর হযরত সুলায়মানকে হুকুম চালাবার কোন কতৃত্ব ক্ষমতা দেয়া হয়ে থাকে যেমন تَجْرِي بِأَمْرِهِ (তাঁর হুকুমে চলতো) এর শব্দাবলীর বাহ্যিক অর্থ থেকে মনে হয়, তাহলে আল্লাহর কুদরাতের জন্য এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। তিনি নিজের রাজ্যের মালিক। নিজের যে কোন বান্দাকে যে কোন ক্ষমতা তিনি চাইলে দিতে পারেন। তিনি কাউকে কোন ইখতিয়ার ও ক্ষমতা দান করলে আমাদের মনকষ্টের কোন কারণ নেই।
# সূরা সাবা-য় এর বিস্তারিত বর্ণনা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ وَمِنَ الْجِنِّ مَنْ يَعْمَلُ بَيْنَ يَدَيْهِ بِإِذْنِ رَبِّهِ وَمَنْ يَزِغْ مِنْهُمْ عَنْ أَمْرِنَا نُذِقْهُ مِنْ عَذَابِ السَّعِيرِ – يَعْمَلُونَ لَهُ مَا يَشَاءُ مِنْ مَحَارِيبَ وَتَمَاثِيلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُورٍ رَاسِيَاتٍ ………… فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَى مَوْتِهِ إِلَّا دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ الْجِنُّ أَنْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوا فِي الْعَذَابِ الْمُهِينِ– (سبا : 12-14) “আর জিনদের মধ্য থেকে এমন জিনকে আমি তাঁর জন্য অনুগত করে দিয়েছিলাম যারা তাঁর রবের হুকুমে তাঁর সামনে কাজ করতো। আর তাদের মধ্য থেকে যে কেউ আমার হুকুম অমান্য করতো আমি তাকে জ্বলন্ত আগুনের স্বাদ আস্বাদন করাতাম। তারা তাঁর জন্য যেমন সে চাইতো প্রাসাদ, মূর্তি, হাউজের মতো বড় আকারের পাত্র এবং দৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করতো। …………তারপর যখন আমি সুলায়মানকে মৃত্যুদান করলাম, এই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যুর কথা জানালো কেবল মাটির পোকা (অর্থাৎ ঘূণ) যারা তার লাঠি খাচ্ছিল। তাই যখন সে পড়ে গেলো তখন জিনেরা বুঝতে পারলো যে, তারা যদি সত্যিই অদৃশ্য বিষয় অবগত থাকতো তাহলে এ লাঞ্ছনাকর শাস্তিতে এত দীর্ঘ সময় আবদ্ধ থাকতো না। এ আয়াত থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, হযরত সুলায়মানকে যেসব জিনের ওপর কতৃত্ব দেয়া হয়েছিল এবং যারা তাঁর বিভিন্ন কাজ করে দিতো তারা এমন পর্যায়ের জিন ছিল যাদের সম্পর্কে আরব মুশরিকদের বিশ্বাস ছিল এবং তারা নিজেরাও এ ভুল ধারণা পোষণ করতো যে, তারা অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে। এখন যে ব্যক্তি সতর্ক দৃষ্টিতে কুরআন মজীদ পড়বে এবং নিজের পূর্বাহ্ণে বদ্ধমূল ধ্যান-ধারণার অনুসারী না হয়ে পড়বে, সে নিজেই দেখে নিতে পারে যেখানে কুরআন নির্বিশেষে “শয়তান” ও “জিন” শব্দ ব্যবহার করে সেখানে তার অর্থ হয় কোন্ ধরনের সৃষ্টি এবং আরবের মুশরিকরা যাদেরকে অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী বলে মনে করতো কুরআনের দৃষ্টিতে তারা কোন্ ধরনের জিন।
আধুনিক যুগের মুফাসসিরগণ একথা প্রমাণ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন যে, হযরত সুলায়মানের জন্য যেসব জিন ও শয়তানকে আনুগত করে দেয়া হয়েছিল তারা মানুষ ছিল এবং আশেপাশের বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে তাদেরকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু কুরআনের শব্দাবলীর মধ্যে তাদের এ ধরনের জটিল অর্থ করার শুধু যে, কোন অবকাশই নেই তাই নয় বরং কুরআনের যেখানেই এ ঘটনাটি এসেছে সেখানে আগে পিছের আলোচনা ও বর্ণনাভংগীই এ অর্থের পথে পরিষ্কার অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। হযরত সুলায়মানের জন্য ইমারত নির্মাণকারীরা যদি মানুষই হয়ে থাকবে তাহলে তাদের এমন কি বিশেষত্ব ছিল যে, তাদের কথা কুরআন মজীদে এমন বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে? মিসরের পিরামিড থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের গগনচুম্বী ইমারতগুলো পর্যন্ত কোনটি মানুষ তৈরী করেনি? অথচ কোন বাদশাহ, ধনকুবের ও বিশ্বখ্যাত ব্যবসায়ীর জন্য এমন ধরনের “জিন” ও “শয়তান” সরবরাহ করা হয়নি যা হযরত সুলায়মানের জন্য করা হয়েছিল।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৭৮-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ ও তাঁর ছেলে সুলাইমান (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে এসেছেন। বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী পিতা ও পুত্র তথা দাঊদ (عليه السلام) ও সুলাইমান (عليه السلام)। আল্লাহ তা‘আলা উভয়কেই নবুওয়াত ও মানুষের মাঝে বিচার-ফায়সালা করার প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। বর্তমান ফিলিস্তীনসহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। দাঊদ (عليه السلام) হলেন আল্লাহ তা‘আলার সে বান্দা যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম (عليه السلام) স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুপারিশ করেছিলেন এবং সেমতে দাঊদের বয়স ৬০ হতে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়। (তিরমিযী, মিশকাত হা: ১১৮, হাসান সহীহ) তবে বিভিন্ন ঘটনার আলোকে জানা যায় দাঊদ (عليه السلام) থেকে সুলাইমান (عليه السلام)-এর বিচার ফায়সালার হেকমত বেশি ছিল। যেমন
মেষপাল ও শস্যক্ষেতের মালিকের বিচার:
ঘটনাক্রমে তারা উভয়ে একটি শস্যক্ষেত্র সম্পর্কে ফায়সালা করলেন। এ ফায়সালা ওয়াহীভিত্তিক ছিল। তবে সুলাইমান (عليه السلام)-এর কাছে এ ফায়সালার যে ওয়াহী নাযিল করা হয়ে ছিল তা দাঊদ (عليه السلام)-এর ওপর অবতীর্ণ ওয়াহীকে রহিত করে দিয়েছিল। কেউ বলেছেন, তা ওয়াহীভিত্তিক ছিল না বরং ইজতিহাদভিত্তিক ছিল। দাঊদ (عليه السلام) ইজতিহাদে সঠিক করতে পারেননি, তবে তাকে তিরস্কার করা হয়নি, সুলাইমান (عليه السلام) ইজতিহাদে সঠিক করেছিলেন এজন্য তার প্রশংসা করা হয়েছে।
ইমাম বাগাভী ইবনু আব্বাস, কাতাদাহ ও যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা দু’জন লোক দাঊদ (عليه السلام)-এর নিকটে একটি বিষয়ে মীমাংসার জন্য আসে। তাদের একজন ছিল মেষপালের মালিক এবং অন্যজন ছিল শস্যক্ষেতের মালিক। শস্যক্ষেতের মালিক মেষপালের মালিকের নিকট দাবী পেশ করল যে, তার মেষপাল রাত্রিকালে আমার শস্যক্ষেতে প্রবেশ করে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। দাঊদ (عليه السلام) একজন নাবী হওয়ার সাথে সাথে একজন বাদশাহও ছিলেন। তিনি ফায়সালা দিলেন, ক্ষেতের মালিক মেষগুলো নিয়ে যাবে যাতে তার ক্ষতিপূরণ হয়। সম্ভবতঃ শস্যের মূল্য ও মেষের মূল্যের হিসাব সমান বিবেচনা করে তিনি এ ফায়সালা দিয়েছেন। বাদী ও বিবাদী উভয়ে বাদশাহ দাঊদ (عليه السلام)-এর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার মুখে পুত্র সুলাইমান (عليه السلام)্ এর সাথে দেখা হয়। তিনি মোকাদ্দামার রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সব খুলে বলল। সুলাইমান (عليه السلام) এ ফায়সালার সাথে একমত হলেন না। তিনি পিতার কাছে গিয়ে বললেন, আমি রায় দিলে তা ভিন্নরূপ হত এবং উভয়ের জন্য কল্যাণকর হত। অতঃপর পিতার নির্দেশে তিনি বললেন, মেষের পাল ক্ষেতের মালিককে কিছু দিনের জন্য দিয়ে দেয়া হোক, সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দ্বারা উপকৃত হবে এবং ক্ষেত মেষের মালিকের হাতে তুলে দেয়া হোক। সে ক্ষেতের পরিচর্যা করে ঠিক করুক। যখন ক্ষেত পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে তখন ক্ষেতের মালিক মেষগুলো ফেরত দিবে আর মেষের মালিক ক্ষেত দিয়ে দিবে। প্রথম ফায়সালা থেকে দ্বিতীয়টি উত্তম, এতে কারো ক্ষতি হবে না, বরং প্রত্যেকেই স্ব-স্ব জিনিস ফিরে পাবে।
দাঊদ (عليه السلام) উপযুক্ত বিচার না করতে পারায় তাঁকে তিরস্কার করা হয়নি বরং প্রশংসা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘তাদের প্রত্যেককে আমি দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও জ্ঞান’ এখান থেকেই বলা হয় মুজতাহিদ ভুল করলেও পাকড়াও করা হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
(إِذَا حَكَمَ الحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ)
যখন বিচারক বিচার করতে গিয়ে ইজতিহাদ করে, যদি ইজতিহাদ সঠিক হয় তাহলে দুটি নেকী পাবে, আর যদি ভুল করে তাহলে একটি নেকী পাবে। (সহীহ বুখারী হা: ৭৩৬২, সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৬)
আর তাদের বিচারকার্য আল্লাহ তা‘আলার সম্মুখে হচ্ছিল অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিচারকার্য প্রত্যক্ষ করছিলেন। আর আল্লাহ তা‘আলা সুলাইমানকে এ বিষয়ের ফায়সালা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবং উভয়কেই প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। যেমন হাদীসে এসেছে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: দুজন মহিলা ছিল যাদের সাথে তাদের দু’জন পুত্র ছিল। একজনের শিশুকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। তখন মহিলা দু’জনেই একে অপরকে বলে: বাঘে তোমার শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে এবং যেটা আছে সেটা আমার সন্তান। অবশেষে তারা দাঊদ (عليه السلام)-এর নিকট মুকাদ্দামা পেশ করে। তখন তিনি ফায়সালা দেন যে, শিশুটি বড় স্ত্রী লোকটির প্রাপ্য। অতঃপর তারা দু’জন বেরিয়ে আসে এবং সুলাইমান (عليه السلام)-এর কাছে ঘটনাটি খুলে বলে। সুলাইমান (عليه السلام) তাদেরকে বললেন: ছুরি নিয়ে এসো, এই শিশুকে কেটে দু’টুকরা করব। তখন ছোট স্ত্রী লোকটি বলল: আল্লাহ তা‘আলা আপনার ওপর রহম করুন। এটি তার সন্তান, একে কাটবেন না। অতঃপর তিনি এটিকে ছোট মহিলার জন্য ফায়সালা করে দেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪২৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৩৪৪)
سَخَّرْ অর্থ নিয়ন্ত্রণাধীন করে দেয়া। অর্থাৎ দাঊদ (عليه السلام)-এর সাথে পাহাড়-পর্বত ও পক্ষীকুল আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করত, যখন তাসবীহ পাঠ করতে বলত তখনই করত। দাঊদ (عليه السلام) একজন ইবাদতগুজার বান্দা ছিলেন। তিনি বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করতেন এবং একদিন অন্তর সিয়াম পালন করতেন। তাঁর কন্ঠস্বর অত্যন্ত মধুর ছিল; ফলে পাখি, পাহাড়-পর্বত এমনকি সাগরের মাছ তাঁর সুর শুনতে চলে আসতো এবং আল্লাহ তা‘আলার তাসবীহ পাঠ করত।
(وَكُنَّا فٰعِلِيْنَ) অর্থাৎ দাঊদ (عليه السلام)-কে নবুওয়াত দেয়া, বিচার-ফায়সালা বুঝিয়ে দেয়া, পাখি ও পাহাড়কে তার অনুগত করে দেয়া এবং অন্যান্য মু‘জিযাহ আমিই দান করেছিলাম, সুতরাং এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।
(صَنْعَةَ لَبُوْسٍ) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা দাঊদ (عليه السلام)-এর জন্য লোহাকে নরম করে দিয়েছিলেন, ফলে তিনি তা দিয়ে যুদ্ধের বর্ম তৈরি করতে পারতেন। পৃথিবীর বুকে তিনিই সর্বপ্রথম এ কাজ করেন, তারপর থেকে এ শিক্ষা শুরু হয়। দাঊদ (عليه السلام) সম্পর্কে সূরা সাবার ১০-১১ নং আয়াত ও সূরা স্ব-দ-এর ১৭-১৯ নং আয়াতে আরো আলোচনা রয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি দাঊদ (عليه السلام)-এর জন্য যেমন পাহাড়, পাখি ইত্যাদি অনুগত করে দিয়েছিলেন, তেমনি বাতাসকে সুলাইমান (عليه السلام)-এর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পরিষদবর্গসহ সিংহাসনে বসতেন এবং যেখানে ইচ্ছা করতেন এক মাসের পথ কয়েক ঘন্টায় পৌঁছে যেতেন। বাতাস তাঁর সিংহাসন উড়িয়ে নিয়ে যেত।
(الْأَرْضِ الَّتِيْ بَارَكْنَا)
কল্যাণের দেশ বলতে সিরিয়াকে বুঝানো হয়েছে।
জিন-শয়তানরাও সুলাইমান (عليه السلام)-এর অনুগত ছিল, তারা তাঁর নির্দেশে সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণি-মুক্তা তুলে আনত। অনুরূপভাবে অন্যান্য নির্মাণ কাজ করত, যেমন বায়তুল মুকাদ্দাস নির্মাণ করেছিল।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يَعْمَلُوْنَ لَه۫ مَا يَشَا۬ءُ مِنْ مَّحَارِيْبَ وَتَمَاثِيْلَ وَجِفَانٍ كَالْجَوَابِ وَقُدُوْرٍ رّٰسِيٰتٍ ط اِعْمَلُوْآ اٰلَ دَاو۫دَ شُكْرًا ط وَقَلِيْلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُوْرُ)
“তারা (জিনেরা) সুলাইমানের জন্য সেসব বস্তু নির্মাণ করত যা তিনি ইচ্ছা করতেন, যেমন বড় বড় অট্টালিকা, মূর্তি, চৌবাচ্চার ন্যায় বড় পাত্র এবং চুল্লির ওপর দৃঢ়ভাবে স্থাপিত বড় ডেগসমূহ। হে দাঊদের ক্বাওম! কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে খুব অল্পই কৃতজ্ঞ।” (সূরা সাবা ৩৪:১৩)
(وَكُنَّا لَهُمْ حٰفِظِيْنَ)
অর্থাৎ জিনদের মধ্যে যে অবাধ্যতা ও ফাসাদী স্বভাব ছিল, তা থেকে আল্লাহ সুলাইমান (عليه السلام)-কে রক্ষা করেছিলেন। ফলে তাঁর সম্মুখে তাদের অবাধ্য হওয়ার উপায় ছিল না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. দাঊদ ও সুলাইমান (عليه السلام)-এর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহের বিবরণ জানলাম।
২. বিচারক কোন বিষয়ে ফায়সালা করতে গিয়ে সঠিকতায় পৌঁছার জন্য ইজতিহাদ করার পরেও ভুল করলে একটি নেকী পাবেন।
৩. জ্ঞান-বুদ্ধির দিক থেকে ছেলে বাপের চেয়েও বড় হতে পারে।
৪. দাঊদ (عليه السلام) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে বর্ম তৈরি করেন।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৭৮-৮২ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, ওটা ছিল আঙ্গুরের ক্ষেত্র বা বাগান। ঐ সময় আঙ্গুর গাছের গুচ্ছ বের হয়েছিল। (আরবী) শব্দের অর্থ হলো রাত্রিকালে পশুর চারণ ভূমিতে চরতে থাকা। দিবাভাগে চরাকে আরবী ভাষায় (আরবী) বলা হয়। হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, ঐ বাগানটিকে বকরীগুলি নষ্ট করে দেয়। হযরত দাউদ (আঃ) ফায়সালা দেন যে, বাগানের ক্ষতি পুরণ স্বরূপ বকরীগুলি বাগানের মালিক পেয়ে যাবে। হযরত সুলাইমান (আঃ) এই ফায়সালা শুনে আরয করেনঃ “ হে আল্লাহর নবী (আঃ)! এটা ছাড়া অন্য একটা ফায়সালা করা যেতে পারে তো?” হযরত দাউদ (আঃ) উত্তরে বললেনঃ “ওটা কি?” তিনি জবাব দিলেনঃ “প্রথমতঃ বকরীগুলি বাগানের মালিকের হাতে সমর্পণ করা হোক। সে ওগুলি দ্বারা ফায়েদা উঠাতে থাকবে। আর বাগান বকরীর মালিককে দেয়া হোক। সে আঙ্গুরের চারার খিদমত করতে থাকবে। অতঃপর যখন আঙ্গুরের গাছ গুলি ঠিক ঠাক হয়ে যাবে এবং পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসবে তখন বাগানের মালিককে বাগান ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং বাগানের মালিকও বকরীগুলি বকরীর মালিককে ফিরিয়ে দেবে।” এই আয়াতের ভাবার্থ এটাইঃ ‘আমি এই ঝগড়ার সঠিক ফায়সালা সুলাইমানকে (আঃ) বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।”
হযরত ইবনু আব্বাস (রা) বলেন যে, হযরত দাউদ (আঃ) যখন বকরীগুলি বাগানের মালিককে দিয়ে দেয়ার ফায়সালা করেন তখন বকরীর মালিকরা বেরিয়ে আসে। তাদের সাথে কুকুর ছিল। হযরত সুলাইমান (আঃ) তাদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমাদের ফায়সালা কি হলো?” তারা তাদের ফায়সালার খবর দিলে তিনি বললেনঃ “আমি সেখানে হাযির থাকলে এই ফায়সালা দেয়া হতো না, বরং অন্য ফায়সালা হতো। তার এ কথা হযরত (আরবী) দাউদের (আঃ) কানে পৌঁছলে তিনি হযরত সুলাইমানকে (আঃ) ডেকে পাঠান এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি কি ফায়সালা করতে?” তখন তিনি তাঁর উপরিউক্ত ফায়সালার কথা শুনিয়ে দেন।
হযরত মাসরূক (রাঃ) বলেন যে, ঐ বকরীগুলি আঙ্গুর গাছের গুচ্ছ ও পাতা সব খেয়ে ফেলেছিল। তখন হযরত সুলাইমান (আঃ) হযরত দাউদের (আঃ) বিপরীত ফায়সালা দেন যে, ঐ লোকদের বকরীগুলি বাগানের মালিকদের দিয়ে দেয়া হোক এবং ছাগলওয়ালাদেরকে বাগান সমর্পন করা হোক। যত দিন পর্যন্ত বাগান পূর্ব অবস্থায় ফিরে না আসবে ততদিন পর্যন্ত বকরী, বাচ্চা, দুধ এবং অন্যান্য সমস্ত উপকার বাগানের মালিকরা ভোগ করবে। অতঃপর প্রত্যেককে নিজনিজ জিনিস ফিরিয়ে দেয়া হবে।
কাযী শুরাইহ্ এর (রাঃ) কাছেও এইরূপ একটি বিচার আসলে তিনি এই ফায়সালা করেন যে, দিনের বেলায় বকরী কোন ক্ষতি করলে ওর কোন ক্ষতিপূরণ করতে হবে না। আর যদি রাত্রি বেলায় ক্ষতি করে তবে বকরীওয়ালাদেরকে যামিন হতে হবে। অতঃপর তিনি এই আয়াতটিই তিলাওয়াত করেন।
হযরত সা’দ ইবনু মাহীসাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত বারা ইবনু আযিবের (রাঃ) উন্থী একটি বাগানে প্রবেশ করে এবং বড়ই ক্ষতি করে ফেলে। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফায়সালা করেন যে, দিনের বেলায় বাগানওয়ালাদের দায়িত্ব হলো বাগানের হিফাযত করা। আর যদি পশু রাত্রিকালে বাগানের ক্ষতি করে তবে পুশুর মালিকদেরকেই ওর যামিন হতে। হবে (অর্থাৎ ক্ষতি পূরণ করতে হবে)। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রাঃ) ইমাম আবু দাউদ (রাঃ) এবং ইমাম ইবনু মাজাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন) এই হাদীসে ইল্লাত সমূহ বের করা হয়েছে। আমরা কিতাবুল আহকামে আল্লাহর ফলে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছি।
বর্ণিত আছে যে, হযরত আইয়াম ইবনু মুআবিয়াকে কাযী পদে নিয়োগ করার জন্যে যখন তাঁর কাছে আবেদন জানানো হয় তখন তিনি হযরত হাসান্দ্রে (রাঃ) কাছে এসে কেঁদে ফেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আবু সাঈদ (রাঃ)! আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমার কাছে এই রিওয়াইয়াত পৌঁছেছে যে, কাযী যদি ইজতিহাদ করার পরেও ভুল করে তবে সে জাহান্নামী হবে। আর যে কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঝুঁকে পড়ে সেও জাহান্নামী। কিন্তু যে ইজতিহাদ করার পর সঠিকতায় পৌঁছে যায় সে জান্নাতে যাবে।” তার এ কথা শুনে হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেনঃ “শুনুন, আল্লাহ তাআলা হযরত দাউদ (আঃ) ও হযরত সুলাইমানের (আঃ) ফায়সালার কথা বর্ণনা করেছেন। আর এটা প্রকাশমান যে, নবীরা (আঃ) ন্যায় বিচারক হয়ে থাকেন এবং তাঁদের কথা দ্বারা এই লোকদের কথা খণ্ডন করা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা হযরত সুলাইমানের (আঃ) প্রশংসা করেছেন বটে, কিন্তু হযরত দাউদকে (আঃ) তিনি নিন্দা করেননি। জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তাআলা বিচারকদের নিকট তিনটি কথার অঙ্গীকার নিয়েছেন। প্রথম অঙ্গীকার এই যে, তাঁরা যেন পার্থিব লোভের বশবর্তী হয়ে শরীয়তের আহকাম পরিবর্তন না করেন। দ্বিতীয় অঙ্গীকার এই যে, তারা যেন অন্তরের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির পিছনে না পড়েন বা প্রবৃত্তির অনুসরণ না করেন। তৃতীয় অঙ্গীকার এই যে, তারা যেন আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকেও ভয় না করেন। তারপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে দাউদ (আঃ)! আমি তোমাকে যমীনের খলীফা বা প্রতিনিধি বানিয়েছি, সুতরাং তুমি লোকদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফায়সালা কর এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, অন্যথায় ওটা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিভ্রান্ত করে ফেলবে।” (৩৮:২৬) অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “মানুষকে ভয় করো না, বরং আমাকেই ভয় কর।” (৫:৪৪) অন্য একস্থানে মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা সামান্য বা নগণ্য মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াতসমূহ। বিক্রি করো না।” (৫:৪৪) আমি বলি যে, নবীরা যে নিস্পাপ এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাদেরকে যে সাহায্য করা হয়ে থাকে এ বিষয়ে পূর্বযুগীয় ও পরযুগীয় গুরুজনদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। তাদের ছাড়া অন্যদের ব্যাপারে কথা এই যে, হযরত আম্র ইনবুল আস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “বিচারক যখন ইজতিহাদ ও চেষ্টা করার পর সঠিকতায় পৌঁছে যায় তখন সে দুটো প্রতিদান লাভ করে। আর ইজতিহাদের পর যদি তার ভূল হয়ে যায় তবে তার জন্যে রয়েছে একটি প্রতিদান।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রাঃ) স্বীয় সহীহ্ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন) এহাদীসটি পরিষ্কারভাবে বলে দিচ্ছে যে, পুর্ণভাবে চেষ্টা চালানোর পরেও যদি বিচারক ভুল করে দেয় তবে সে জাহান্নামী হবে বলে যে ধারণা ও সন্দেহ হযরত আইয়াস (রাঃ) করেছেন তা ঠিক নয়। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সুনানের একটি হাদীসে রয়েছে যে, বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকারের বিচারক জান্নাতী ও দু’প্রকারের বিচারক জাহান্নামী। যে সত্য ও ন্যায় জানে এবং তদনুযায়ী ফায়সালা করে সে জান্নাতী। যে না জেনে ফায়সালা করে সে জাহান্নামী এবং যে সত্য জেনে শুনে ওর বিপরীত ফায়সালা করে সেও জাহান্নামী।
কুরআন কারীমে বর্ণিত এই ঘটনার কাছাকাছিই আর একটি ঘটনা মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “দু’টি মহিলা ছিল, যাদের সাথে তাদের দুটি পুত্র সন্তান ছিল, (তারা ছিল দুগ্ধ পোষ্য শিশু)। একজনের শিশুকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। এখন মহিলা দুটির প্রত্যেকেই একে অপরকে বলেঃ “বাঘে তোমার শিশুকে ধরে নিয়ে গেছে এবং যেটা আছে আমারই।” অবশেষে তারা হযরত দাউদের (আঃ) নিকট এই মুকাদ্দামা পেশ করে। তখন তিনি ফায়সালা দেন যে, শিশুটি বড় স্ত্রী লোকটির প্রাপ্য। অতঃপর তারা দুজন বেরিয়ে আসে। পথে হযরত সুলাইমান (আঃ) ছিলেন। তিনি তাদেরকে ডাকলেন এবং (লোকদেরকে) বললেন “ছুরী নিয়ে এসো। আমি এই শিশুটিকে কেটে দুটুকরা করে দেবো এবং অর্ধেক করে দু’জনকে প্রদান করবো।” এতে বড় স্ত্রী লোকটি চুপ থাকলো। কিন্তু ছোট স্ত্রী লোকটি বললোঃ “আল্লাহ আপনার উপর রহম করুন! শিশুটিকে কাটবেন ন। এটা বড় স্ত্রী লোকটিরই। সুতরাং তাকেই দিয়ে দিন।” হযরত সুলাইমান (আঃ) প্রকৃত ব্যাপার বুঝে নেন এবং শিশুটিকে ঐ ছোট স্ত্রী লোকটিকে দিয়ে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও এটা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম নাসায়ী (রাঃ) এর উপর একটি অনুচ্ছেদ বেঁধেছেন যে, বিচারক যদি নিজের ফায়সালা অন্তরে গোপন রেখে প্রকৃত রহস্য জানবার উদ্দেশ্যে ওর বিপরীত কিছু বলেন তবে তা জায়েয হবে)
এ ধরনেরই একটি ঘটনা হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, বানী ইসরাঈলের যুগে একটি সুন্দরী নারী ছিল, যার প্রেমে চারজন নেতৃস্থানীয় লোক আসক্ত হয়ে পড়ে এবং তার সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়ার ইচ্ছা করে। কিন্তু ঐ নারী তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে। তখন তারা তার প্রতি চরম দুঃখিত ও রাগান্বিত হয় এবং চারজন একমত হয়ে হযরত দাউদের (আঃ) বিচারালয়ে উপস্থিত হয় ও সাক্ষ্য প্রদান করে যে, সে তার কুকুরের দ্বারা নিজের কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করে। চার জনের সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে হযরত দাউদ (আঃ) মহিলাটিকে রজম (পাথর নিক্ষেপে হত্যা করার নিদের্শ দেন। ঐ দিনই সন্ধ্যায় হযরত সুলাইমান (আঃ) নিজের সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে বসেন। তিনি বিচারক হন এবং চার জন ছেলে ঐ লোকগুলির মত তার কাছে ঐ মুকাদ্দামা পেশ করে এবং একটি স্ত্রীলোকের সম্বন্ধে ঐ কথাই বলে। হযরত সুলাইমান (আঃ) ঐ চারজনকে পৃথক পৃথক করে দেয়ার নিদের্শ দেন। তার পর একজনকে তিনি তাঁর কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “ঐ কুকুরটির রং কেমন ছিল?” সে উত্তরে বলেঃ “কালো”। এরপর দ্বিতীয় জনকে পৃথক ভাবে ডেকে ঐ প্রশ্নই করেন। সে জবাব দেয়ঃ “সাদা।” তিনি তৎক্ষণাৎ ফায়সালা দেন যে, স্ত্রী লোকটির উপর এটা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয় এবং এই চারজনকে হত্যা করে দেওয়া হোক।” হযরত দাউদের (আঃ) নিকটও এই ঘটনাটি পেশ করা হলো। তিনি তখনই ঐ চারজন নেতৃ স্থানীয় লোককে ডেকে পাঠান এবং ঐ রূপেই পৃথক পৃথক ভাবে তাদেরকে কুকুরটির রং সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হয়। তারা এক একজন এক এক কথা বলে এবং গড় বড় করে দেয়। হযরত দাউদের (আঃ) কাছে তারা মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয়ে যায়। সুতরাং তিনি তাদেরকে হত্যা করে দেয়ার নিদের্শ দেন। (এটা হাফিয আবুল কাসিম ইবনু আসাকির (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমি বিহঙ্গকুলের জন্যে নিয়ম করে দিয়েছিলাম যে, তারা যেন হযরত দাউদের (আঃ) সাথে আমার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। হযরত দাউদকে (আঃ) এমন মিষ্ট কণ্ঠস্বর দান করা হয়েছিল যে, যখন তিনি মিষ্টি সুরে ও আন্তরিকতার সাথে যরূর পাঠ করতেন। তখন পক্ষীকূল উড়ন বাদ দিয়ে থেমে যেতো এবং তার সুরে সুরে মিলিয়ে আল্লাহর তাসবীহ পাঠে লেগে পড়তো। অনুরূপভাবে পাহাড় পর্বতও তাসবীহ পাঠ করতো।
বর্ণিত আছে যে, একদা রাত্রে হযরত আবূ মূসা আশআরী (রাঃ) কুরআন কারীম পাঠ করছিলেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখান দিয়ে গমন করছিলেন। তার মিষ্টি সূরে কুরআন পাঠ শুনে তিনি দাড়িয়ে যান এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে শুনতে থাকেন। তারপর তিনি বলেনঃ “একে তো আ’লে দাউদের (আঃ) মত মিষ্টি সুর দান করা হয়েছে। হযরত আবু মূসা (রাঃ) এটা জানতে পেরে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি যদি জানতাম যে, আপনি আমার কুরআন পাঠ শুনতে ছিলেন। তবে আমি আরো উত্তম রূপে পাঠ করতাম।”
হযরত আবু উছমান নাহদী (রাঃ) বলেনঃ “ আমি কোন উত্তম বাজনার মধ্যে ঐ মজা পাই নাই যা হযরত আবূ মূসার (রাঃ) কণ্ঠস্বরে পেতাম।” সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার উত্তম কণ্ঠ স্বরকে হযরত দাউদের (আঃ) উত্তম ও মিষ্ট কণ্ঠস্বরের একটি অংশ বলেছেন। তাহলে স্বয়ং হযরত দাউদের কণ্ঠস্বর কত মধুর ছিল তা সহজেই অনুমেয়।
আল্লাহ তাআলা তাঁর আর একটি অনুগ্রহের বর্ণনা দিচ্ছেনঃ “আমি দাউদকে (আঃ) তোমাদের জন্যে বর্ম নির্মাণ শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে ওটা তোমাদেরকে তোমাদের যুদ্ধে রক্ষা করে। তার যুগের পূর্বে হল্কা বিহীন বর্ম নির্মিত হতো। হলকা বিশিষ্ট বর্ম তিনিই তৈরী করেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) “তার জন্যে আমি লৌহকে নমনীয় করেছিলাম। (হে দাউদ (আঃ)! উদ্দেশ্য এই যে, যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরী করতে এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করতে পার।” (৩৪:১০-১১) এই বর্ম যুদ্ধের মাঠে কাজে লাগতো। সুতরাং এটা ছিল এমনই নিয়ামত যার কারণে মানুষের উচিত মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাই তিনি বলেনঃ তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে না?”
এরপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি সুলাইমানের (আঃ) বশীভূত করেছিলাম উদ্দাম বায়ুকে, ওটা তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হতো সেই দেশের দিকে যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি। অর্থাৎ ঐ বায়ু তাকে সিরিয়ায় পৌঁছিয়ে দিতো। মহান আল্লাহ বলেনঃ প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত হযরত সুলাইমান (আঃ) তার লোক-লশকর, সাজ-সরঞ্জাম এবং আসবাবপত্রসহ তার সিংহাসনে বসে যেতেন। অতঃপর বায়ু তাঁকে তাঁর গন্তব্য স্থানে ক্ষণিকের মধ্যে পৌছিয়ে দিতো। সিংহাসনের উপর হতে পাখী পালক দ্বারা তাকে ছায়া করতো। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তার অধীন করে দিলাম বায়ুকে, যা তার আদেশে সে যেখানেই ইচ্ছা করতো সেথায় মৃদুমন্দ গতিতে প্রবাহিত হতো।” (৩৮:৩৬) মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(আমি সুলাইমানের (আঃ) অধীন করেছিলাম বায়ুকে) যা প্রভাতে এক মাসের পথ অতিক্রম করতো এবং সন্ধ্যায় এক মাসের পথ অতিক্রম করতো।” (৩৪:১২)
হযরত সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাঃ) বলেন যে, ছয় লক্ষ চেয়ার রাখাহতো। তার পাশে বসতো মু’মিন মানুষ এবং তাদের পিছনে বসতো মু’মিন জ্বিন। তারপর তাঁর নির্দেশক্রমে পক্ষীকুল সবারই উপর ছায়া করতো। অতঃপর তার আদেশ অনুযায়ী বায়ু তাঁকে নিয়ে চলতে শুরু করতো। (এটা ইবনু আবি হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন) তার উপর দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনু উবাইদিল্লাহ ইবনু উমাইর (রাঃ) বলেন যে, হযরত সুলাইমান (আঃ) বাতাসকে হুকুম করতেন তখন ওটা স্থূপাকারে জমা হয়ে যেতো, যেন ওটা পাহাড়। তারপর তিনি তাঁর ফরাশ আনার নিদের্শ দিতেন। তখন উচু জায়গায় রেখে দেয়া হতো। অতঃপর তিনি তাঁর ডানা ওয়ালা ঘোড়া আনার হুকুম করতেন।
এরপর তিনি ঐ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে স্বীয় ফরাশে উঠে বসতেন। অতঃপর তাঁর নির্দেশক্রমে বায়ূ তাকে উপরে উঠিয়ে নিয়ে যেতো। ঐ সময় তিনি মাথা নীচু করে থাকতেন। ডানে বামে মোটেই তাকাতেন না। এর দ্বারা তার উদ্দেশ্য হতো বিনয় ও আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। কেননা, নিজের নীচতার জ্ঞান তাঁর ছিল। অতঃপর বায়ুকে তিনি যেখানে নামাবার হুকুম করতেন সেখানেই নামিয়ে দিতো।
অনুরূপভাবে অবাধ্য শয়তানদেরকেও আল্লাহ তাআলা তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তার জন্যে ডুবুরী কাজ করতো। তারা সমুদ্রে ডুব দিয়ে ওর তলদেশ হতে মণি মুক্তা বের করে আনতো। আরো বহু কাজ তারা করতো।
যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “এবং শয়তানদেরকে (আমি তার বাধ্য করেছিলাম), যারা সবাই ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী।” (৩৮:৩৭) এরা ছাড়া অন্যান্য শয়তানরাও তার অনুগত ছিল, যাদেরকে শিকলে আবদ্ধ রাখা হতো।
মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখতাম। কোন শয়তানই তার কোন ক্ষতি করতে পারতো না। বরং সবাই ছিল তার অনুগত ও অধীনস্থ। কেউই তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারতো না। তাদের উপর তাঁরই শাসন চলতো। যাকে ইচ্ছা তিনি বন্দী করতেন এবং যাকে ইচ্ছা ছেড়ে দিতেন। তাদের কথাই বলেনঃ ‘অন্যান্য জ্বিন ছিল যারা শৃংখলে আবদ্ধ থাকতো।’
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#932)
[ وَ عَلَّمْنٰهُ صَنْعَةَ لَبُوْسٍ لَّكُمْ
We taught him the fashioning of coats of armor.]
Sura:21
Sura: Al-Anbiyaa
Ayat: 78-82
www.motaher21.net
21:78
وَ دَاوٗدَ وَ سُلَیۡمٰنَ اِذۡ یَحۡکُمٰنِ فِی الۡحَرۡثِ اِذۡ نَفَشَتۡ فِیۡہِ غَنَمُ الۡقَوۡمِ ۚ وَ کُنَّا لِحُکۡمِہِمۡ شٰہِدِیۡنَ ﴿٭ۙ۷۸﴾
And [mention] David and Solomon, when they judged concerning the field – when the sheep of a people overran it [at night], and We were witness to their judgement.
Dawud and Suleiman and the Signs which They were given; the Story of the People whose Sheep pastured at Night in the Field
(Abu) Ishaq narrated from Murrah from Ibn Mas`ud:
“That crop was grapes, bunches of which were dangling.”
This was also the view of Shurayh.
Ibn Abbas said:
“Nafash means grazing.”
Shurayh, Az-Zuhri and Qatadah said:
“Nafash only happens at night.”
Qatadah added,
“(and) Al-Haml is grazing during the day.”
Allah tells:
وَدَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ إِذْ يَحْكُمَانِ فِي الْحَرْثِ إِذْ نَفَشَتْ فِيهِ غَنَمُ الْقَوْمِ
And (remember) Dawud and Suleiman, when they gave judgement in the case of the field in which the sheep of certain people had pastured at night;
Ibn Jarir recorded that Ibn Mas`ud said:
“Grapes which had grown and their bunches were spoiled by the sheep. Dawud (David) ruled that the owner of the grapes should keep the sheep.
Suleiman (Solomon) said, `Not like this, O Prophet of Allah!’
(Dawud) said, `How then’
(Suleiman) said:`Give the grapes to the owner of the sheep and let him tend them until they grow back as they were, and give the sheep to the owner of the grapes and let him benefit from them until the grapes have grown back as they were. Then the grapes should be given back to their owner, and the sheep should be given back to their owner.’
This is what Allah said:
فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ
(And We made Suleiman to understand (the case).”
This was also reported by Al-`Awfi from Ibn Abbas.
وَكُنَّا لِحُكْمِهِمْ شَاهِدِينَ
and We were witness to their judgement.
21:79
فَفَہَّمۡنٰہَا سُلَیۡمٰنَ ۚ وَ کُلًّا اٰتَیۡنَا حُکۡمًا وَّ عِلۡمًا ۫ وَّ سَخَّرۡنَا مَعَ دَاوٗدَ الۡجِبَالَ یُسَبِّحۡنَ وَ الطَّیۡرَ ؕ وَ کُنَّا فٰعِلِیۡنَ ﴿۷۹﴾
And We gave understanding of the case to Solomon, and to each [of them] We gave judgement and knowledge. And We subjected the mountains to exalt [Us], along with David and [also] the birds. And We were doing [that].
فَفَهَّمْنَاهَا سُلَيْمَانَ وَكُلًّ اتَيْنَا حُكْمًا وَعِلْمًا
And We made Suleiman to understand (the case); and to each of them We gave wisdom and knowledge.
Ibn Abi Hatim recorded that;
when Iyas bin Mu`awiyah was appointed as a judge, Al-Hasan came to him and found Iyas weeping. (Al-Hasan) said, “Why are you weeping?”
(Iyas) said, “O Abu Sa`id, What I heard about judges among them a judge is he, who studies a case and his judgment is wrong, so he will go to Hell; another judge is he who is biased because of his own whims and desires, so he will go to Hell; and the other judge he who studies a case and gives the right judgement, so he will go to Paradise.”
Al-Hasan Al-Basari said:”But what Allah tells us about Dawud and Suleiman (peace be upon them both) and the Prophets and whatever judgments they made proves that what these people said is wrong.
Allah says:
وَدَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ إِذْ يَحْكُمَانِ فِي الْحَرْثِ إِذْ نَفَشَتْ فِيهِ غَنَمُ الْقَوْمِ وَكُنَّا لِحُكْمِهِمْ شَاهِدِينَ
And (remember) Dawud and Suleiman, when they gave judgement in the case of the field in which the sheep of certain people had pastured at night; and We were witness to their judgement.
Allah praised Suleiman but He did not condemn Dawud.”
Then he — Al-Hasan — said, “Allah enjoins three things upon the judges:
not to sell thereby for some miserable price;
not to follow their own whims and desires; and
not to fear anyone concerning their judgments.”
Then he recited:
يدَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَـكَ خَلِيفَةً فِى الاٌّرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ
O Dawud! Verily, We have placed you as a successor on the earth; so judge you between men in truth and follow not your desire — for it will mislead you from the path of Allah. (38:26)
فَلَ تَخْشَوُاْ النَّاسَ وَاخْشَوْنِ
Therefore fear not men but fear Me. (5:44)
وَلَا تَشْتَرُواْ بِـَايَـتِى ثَمَناً قَلِيلً
and sell not My Ayat for a miserable price. (5:44)
I say:with regard to the Prophets (peace be upon them all), all of them were infallible and supported by Allah. With regard to others, it is recorded in Sahih Al-Bukhari from `Amir bin Al-`As that the Messenger of Allah said:
إِذَا اجْتَهَدَ الْحَاكِمُ فَأَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ
وَإِذَا اجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْر
If the judge does his best, studies the case and reaches the right conclusion, he will have two rewards.
If he does his best, studies the case and reaches the wrong conclusion, he will have one reward.
This Hadith refutes the idea of Iyas, who thought that if he did his best, studied the case and reached the wrong conclusion, he would go to Hell.
And Allah knows best.
Similar to story in the Qur’an is the report recorded by Imam Ahmad in his Musnad from Abu Hurayrah, who said that the Messenger of Allah said:
بَيْنَمَا امْرَأَتَانِ مَعَهُمَا ابْنَانِ لَهُمَا إِذْ جَاءَ الذِّيْبُ فَأَخَذَ أَحَدَ الاْبْنَيْنِ فَتَحَاكَمَتَا إِلَىىَداوُدَ فَقَضَى بِهِ لِلْكُبْرَى فَخَرَجَتَا فَدَعَاهُمَا سُلَيْمَانُ فَقَالَ هَاتُوا السِّكِّينَ أَشُقُّهُ بَيْنَكُمَا فَقَالَتِ الصُّغْرَى يَرْحَمُكَ اللهُ هُوَ ابْنُهَا لَا تَشُقَّهُ فَقَضَى بِهِ لِلصُّغْرَى
There were two women who each had a son. The wolf came and took one of the children, and they referred their dispute to Dawud. He ruled that the (remaining) child belonged to the older woman. They left, then Suleiman called them and said, “Give me a sword and I will divide him between the two of you.”
The younger woman said, “May Allah have mercy on you! He is her child, do not cut him up!”
So he ruled that the child belonged to the younger woman.
This was also recorded by Al-Bukhari and Muslim in their Sahihs.
An-Nasa’i also devoted a chapter to this in the Book of Judgments.
وَسَخَّرْنَا مَعَ دَاوُودَ الْجِبَالَ يُسَبِّحْنَ وَالطَّيْرَ
And We subjected the mountains and the birds to glorify Our praises along with Dawud.
This refers to the beauty of his voice when he recited his Book, Az-Zabur. When he recited it in a beautiful manner, the birds would stop and hover in the air, and would repeat after him, and the mountains would respond and echo his words.
وَكُنَّا فَاعِلِينَ
And it was We Who were the doer (of all these things).
The Prophet passed by Abu Musa Al-Ash`ari while he was reciting Qur’an at night, and he had a very beautiful voice, he stopped and listened to his recitation, and said:
لَقَدْ أُوتِيَ هَذَا مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيرِ الِ دَاوُد
This man has been given one of the wind instruments (nice voices) of the family of Dawud.
He said:”O Messenger of Allah, if I had known that you were listening, I would have done my best for you.”
21:80
وَ عَلَّمۡنٰہُ صَنۡعَۃَ لَبُوۡسٍ لَّکُمۡ لِتُحۡصِنَکُمۡ مِّنۡۢ بَاۡسِکُمۡ ۚ فَہَلۡ اَنۡتُمۡ شٰکِرُوۡنَ ﴿۸۰﴾
And We taught him the fashioning of coats of armor to protect you from your [enemy in] battle. So will you then be grateful?
وَعَلَّمْنَاهُ صَنْعَةَ لَبُوسٍ لَّكُمْ لِتُحْصِنَكُم مِّن بَأْسِكُمْ
And We taught him the making of metal coats of mail, to protect you in your fighting.
meaning, the manufacture of chain-armor.
Qatadah said that before that, they used to wear plated armor; he was the first one to make rings of chain-armor.
This is like the Ayah:
وَأَلَنَّا لَهُ الْحَدِيدَأَنِ اعْمَلْ سَـبِغَـتٍ وَقَدِّرْ فِى السَّرْدِ
And We made the iron soft for him. Saying:”Make you perfect coats of mail, and balance well the rings of chain armor.” (34:10-11),
meaning, do not make the pegs so loose that the rings (of chain mail) will shake, or make it so tight that they will not be able to move at all.
Allah says:
…
لِتُحْصِنَكُم مِّن بَأْسِكُمْ
to protect you in your fighting.
meaning, in your battles.
…
فَهَلْ أَنتُمْ شَاكِرُونَ
Are you then grateful. means,
`Allah blessed you when He inspired His servant Dawud and taught him that for your sake.’
The Power of Suleiman is unparalleled
And Allah tells:
21:81
وَ لِسُلَیۡمٰنَ الرِّیۡحَ عَاصِفَۃً تَجۡرِیۡ بِاَمۡرِہٖۤ اِلَی الۡاَرۡضِ الَّتِیۡ بٰرَکۡنَا فِیۡہَا ؕ وَ کُنَّا بِکُلِّ شَیۡءٍ عٰلِمِیۡنَ ﴿۸۱﴾
And to Solomon [We subjected] the wind, blowing forcefully, proceeding by his command toward the land which We had blessed. And We are ever, of all things, Knowing.
وَلِسُلَيْمَانَ الرِّيحَ عَاصِفَةً
And to Suleiman (We subjected) the wind strongly raging,
means, `We subjugated the strong wind to Suleiman.’
تَجْرِي بِأَمْرِهِ إِلَى الاَْرْضِ الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا
running by his command towards the land which We had blessed.
meaning, the land of Ash-Sham (Greater Syria).
وَكُنَّا بِكُلِّ شَيْءٍ عَالِمِينَ
And of everything We are the All-Knower.
He had a mat made of wood on which he would place all the equipment of his kingship; horses, camels, tents and troops, then he would command the wind to carry it, and he would go underneath it and it would carry him aloft, shading him and protecting him from the heat, until it reached wherever he wanted to go in the land. Then it would come down and deposit his equipment and entourage.
Allah says:
فَسَخَّرْنَا لَهُ الرِّيحَ تَجْرِى بِأَمْرِهِ رُخَأءً حَيْثُ أَصَابَ
So, We subjected to him the wind; it blew gently by his order whithersoever he willed. (38:36)
غُدُوُّهَا شَهْرٌ وَرَوَاحُهَا شَهْرٌ
its morning was a month’s (journey), and its afternoon was a month’s. (34:12)
21:82
وَ مِنَ الشَّیٰطِیۡنِ مَنۡ یَّغُوۡصُوۡنَ لَہٗ وَ یَعۡمَلُوۡنَ عَمَلًا دُوۡنَ ذٰلِکَ ۚ وَ کُنَّا لَہُمۡ حٰفِظِیۡنَ ﴿ۙ۸۲﴾
And of the devils were those who dived for him and did work other than that. And We were of them a guardian.
وَمِنَ الشَّيَاطِينِ مَن يَغُوصُونَ لَهُ
And of the Shayatin were some who dived for him,
means, they dived into the water to retrieve pearls, jewels, etc., for him.
وَيَعْمَلُونَ عَمَلً دُونَ ذَلِكَ
and did other work besides that;
This is like the Ayah:
وَالشَّيَـطِينَ كُلَّ بَنَّأءٍ وَغَوَّاصٍ
وَءَاخَرِينَ مُقَرَّنِينَ فِى الاٌّصْفَادِ
And also the Shayatin, every kind of builder and diver. And also others bound in fetters. (38:37-38)
وَكُنَّا لَهُمْ حَافِظِينَ
and it was We Who guarded them.
means, Allah protected him lest any of these Shayatin did him any harm. All of them were subject to his control and domination, and none of them would have dared to approach him. He was in charge of them and if he wanted, he could set free or detain whomever among them he wished.
Allah says:
وَءَاخَرِينَ مُقَرَّنِينَ فِى الاٌّصْفَادِ
And also others bound in fetters. (38:38
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran