(বই#৯৩৪) [ اَنْ لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ١ۖۗ اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَۚۖ “তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধ করেছি।”] সূরা:- আল্ আম্বিয়া। সুরা:২১ ৮৭-৮৮ নং আয়াত:- www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৩৪)
[ اَنْ لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ١ۖۗ اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَۚۖ
“তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধ করেছি।”]
সূরা:- আল্ আম্বিয়া।
সুরা:২১
৮৭-৮৮ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২১:৮৭
وَ ذَا النُّوْنِ اِذْ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنْ لَّنْ نَّقْدِرَ عَلَیْهِ فَنَادٰى فِی الظُّلُمٰتِ اَنْ لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ١ۖۗ اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَۚۖ

আর মাছওয়ালাকেও আমি অনুগ্রহভাজন করেছিলাম। স্মরণ করো যখন সে রাগান্বিত হয়ে চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল আমি তাকে পাকড়াও করবো না। শেষে সে অন্ধকারের মধ্য থেকে ডেকে উঠলোঃ “তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধ করেছি।”
২১:৮৮
فَاسْتَجَبْنَا لَهٗ١ۙ وَ نَجَّیْنٰهُ مِنَ الْغَمِّ١ؕ وَ كَذٰلِكَ نُـْۨجِی الْمُؤْمِنِیْنَ

তখন আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছিলাম এবং দুঃখ থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছিলাম, আর এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি।

৮৭- ৮৮ নং আয়াতের তাফসীর:

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*ইউনুস(আ.)-এর ঘটনা থেকে দ্বীনের দায়ীদের জন্যে শিক্ষণীয় : এরপর আসছে হযরত ইউনুসের কিসসা। তার উপাধি হচ্ছে যুন্নুন বা মাছওয়ালা। ‘মাছওয়ালার কথা স্মরণ করাে, যখন সে রাগান্বিত হয়ে চলে গেলাে।'(আয়াত ৮৭) আলােচনার ধারাবাহিকতার সাথে সমন্বয় রক্ষার জন্যে হযরত ইউনুসের কাহিনী এতাে সংক্ষেপে আলােচিত হয়েছে। সূরা সাফফাত বিশদ বিবরণ হয়েছে। এখানে কিছুটা বিশদ বিবরণ দরকার। হযরত ইউনুসকে কে জুন্নুন বা মাছওয়ালা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। কারণ তাকে মাছে গিলে খেয়েছিলাে এবং পরে আবার উপরে ফেলে দিয়েছিলাে। ঘটনা এই যে, তাকে এক শহরে পাঠানাে হয়েছিলাে। তিনি সেখানে গিয়ে আল্লাহর দিকে জনগণকে আহ্বান জানালেন। কিন্তু তারা সবাই তার দাওয়াত অমান্য করলাে। তিনি ভীষণ বিরক্ত হলেন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের ত্যাগ করে চলে গেলেন। তিনি দাওয়াতের দুঃখ কষ্ট সহ্য করলেন না । ভাবলেন, আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে দুনিয়াকে সংকীর্ণ করবেন না। দুনিয়া তাে সুপ্রশস্ত। আরো বহু শহর ও জনপদ রয়েছে। এরা দাওয়াত অস্বীকার করলে ক্ষতি নেই। আল্লাহ তায়ালা তাকে অন্য জাতির কাছে পাঠাবেন। ‘সে ভাবলাে আল্লাহ তার জন্যে সুযােগ সংকীর্ণ করবেন না’ কথাটার অর্থ এটাই। অর্থাৎ তার দাওয়াতের জায়গার অভাব হবে না। ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে তিনি সমুদ্রের কিনারে চলে গেলেন। সেখানে একটা যাত্রী বােঝাই জাহাজ পেয়ে তাতে চড়ে বসলেন। জাহাজটা গভীর সমুদ্রে গেলে চালকের মনে হলাে জাহাজে একজন যাত্রী অতিরিক্ত বহন করা হয়েছে। তাই সে বললাে, জাহাজ থেকে কমের পক্ষে একজন যাত্রীকে সাগরে ফেলে দেয়া অনিবার্য হয়ে উঠেছে। একমাত্র এভাবেই বাদবাকী যাত্রীদেরকে সাগরে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করা যাবে। তখন লটারি করা হলাে। লটারিটা উঠলাে হযরত ইউনুসের নামে। অগত্যা তাকে সাগরে ফেলে দেয়া হলাে। ফেলে দেয়া মাত্রই তাকে একটা বড়াে মাছে গিলে খেয়ে ফেললাে। এবার তিনি পড়লেন জীবনের কঠিনতম সংকটে। একে তাে মাছের পেটের ভেতরের অন্ধকার, তদুপরি সাগরের অন্ধকার এবং রাতের। অন্ধকার এই তিন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি ছাড়া আর কোনাে মাবুদ নেই, তােমার পবিত্রতা ঘােষণা করছি, নিশ্চয়ই। আমি অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছি।’ আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করলেন এবং তাকে তার সংকট থেকে উদ্ধার করলেন। মাছটা তাকে সমুদ্রের কিনারে উগরে ফেলে দিল। এর পরের অবস্থাটা সূরা সাফফাতে সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে আমাদের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট। হযরত ইউনুসের কাহিনীর যে অংশটুকু এখানে আলােচিত হয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ও শিক্ষাপূর্ণ। হযরত ইউনুস(আ.) রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ধৈর্য ও দৃঢ়তা দেখাননি, যারা তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছিলাে, তাদের ওপর তিনি ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হয়ে দাওয়াতের দায়িত্বের বােঝা ঘাড়ের ওপর থেকে নামিয়ে রাখলেন, অতপর ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হয়ে তাদেরকে ছেড়ে চলে গেলেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে এমন বিরক্তিকর ও কষ্টকর অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করলেন, যার তুলনায় তাকে প্রত্যাখ্যানকারীদের সৃষ্টি করা পরিস্থিতি ছিলাে অনেক সহজ। তিনি যদি আল্লাহর কাছে আশ্রয় না চাইতেন, তার নিজের ওপর যে যুলুম করেছেন, তার দায়িত্ব ও দাওয়াতের কাজের প্রতি যে অবিচার করেছেন, তা যদি স্বীকার না করতেন, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার মুসিবত থেকে উদ্ধার করতেন না। তার বিনীত স্বীকৃতি ও দোয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা শেষ পর্যন্ত তাকে তার কষ্টকর ও উদ্বেগজনক অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন। দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে নিয়ােজিত লােকদেরকে এই ময়দানের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট, বাধা বিপত্তি ও সমস্যা সংকট সহ্য করতেই হয় এবং প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করা জনিত পরিস্থিতিতে ধৈর্যধারণ করতেই হয়। একজন নিরেট সত্যবাদী প্রচারকের দাওয়াতকে অগ্রাহ্য ও প্রত্যাখ্যান করলে এবং তাকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করলে সেটা সহ্য করা খুবই কঠিন মনে হয়। তবে এটা রসূল সুলভ দায়িত্বেরই অংশ। যারা দাওয়াতের দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকে তাদের ধৈর্যধারণ না করে উপায় থাকে না। সর্বাবস্থায় তাদের দৃঢ় থাকতে ও মনােবল অটুট রাখতে হয়, দাওয়াত প্রত্যাখ্যাত হলেও তা অব্যাহত রাখতে হয় ও পুনঃ পুনঃ দাওয়াত দিয়ে যেতে হয়। মানুষের সংশােধন ও দাওয়াত গ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কে হতাশ হতে নেই- চাই যতােই প্রত্যাখ্যান, অস্বীকার ও বিরুদ্ধাচরণ করুক না কেন । একশাে বার দাওয়াত দিয়েও যেখানে কাজ হয় না, সেখানে একশাে একবার বা এক হাজার একবার দিয়ে সুফল পাওয়া যেতে পারে এবং দাওয়াত গৃহীত হতে পারে। তাই ধৈর্যধারণ করে এবং হতাশ না হয়ে দাওয়াত অব্যাহত রাখলে একদিন শ্রোতার মনের দরজা খুলেও যেতে পারে। দাওয়াতের পথ সহজ ও কুসুমাস্তীর্ণ নয় এবং মানুষের হৃদয়ের কাছে দাওয়াত গ্রহণযােগ্য হওয়াও মােটেই সহজসাধ্য নয়। কেননা বাতিল ও বিভ্রান্তিপূর্ণ ধ্যান ধারণা, আদত অভ্যাস, ঐতিহ্য ও প্রথা মানুষের মনের ভেতর স্তুপীকৃত হয়ে দাওয়াতের প্রবেশের পথ আগলে রাখে । সব স্তুপ সরানাে অপরিহার্য। যে কোনাে পন্থায় মনকে ভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত করা জরুরী। সব কটা স্পর্শকাতর কেন্দ্রকে নাড়া দেয়া এবং মন মগজের সব কটা গিরা খুলে দেয়া প্রয়ােজন। আর এর প্রতিটা পর্যায়ে ধৈর্য সহকারে, অধ্যবসায় সহকারে ও আশাবাদী মন নিয়ে কাজ করতে হয়। এর কোনাে একপর্যায়ে একটা নাড়া বা ধাক্কা দিতেই এক মুহূর্তের ভেতরেই মানুষের সমগ্র মনমগজ পুরােপুরিভাবে পাল্টে যেতে পারে- যদি নাড়াটা সঠিক জায়গায় পড়ে। মানুষ হাজারবার চেষ্টা করেও যেখানে ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে একটা সঠিক চেষ্টার সাফল্য দেখে তাকে অনেক সময় বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। এর সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলাে বেতার যন্ত্র। বেতার যন্ত্রে যখন প্রেরণ কেন্দ্র অনুসন্ধান করা হয়, তখন বহুবার একই সংকেত বিন্দুর ওপর দিয়ে নির্দেশক কাটা নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসা সত্তেও ষ্টেশন ধরা পড়ে না। অথচ এভাবে নাড়া চাড়া করতে করতে হঠাৎ এক সময় এক নাড়াতেই ষ্টেশন ধরা পড়ে। আর তখন সঠিক তরংগের সাথে সংযােগ স্থাপিত হয় এবং প্রচারিত প্রােগ্রাম শােনা যায়।(স্মরণ রাখা দরকার যে, এই তাফসীর আজ থেকে প্রায় ৫০ বসর আগের লেখা, তখন বেতার যন্ত্রই ছিলাে বিজ্ঞানের আধুনিকতম আবিষ্কার -সম্পাদক) মানুষের মন অনেকটা বেতার যন্ত্রের মতােই। দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিত লােকদের উচিত অনবরত নির্দেশক কাটা ঘােরাতে থাকা, যাতে শ্রোতার মনের নাগাল পাওয়া যায়। হাজার বার নাড়া দেয়ার পর ব্যর্থ হলেও তার পরে হঠাৎ একবারেই ষ্টেশন ধরা সম্ভব হতে পারে । মানুষ দাওয়াত গ্রহণ করছে না এই ওজুহাত দেখিয়ে রেগে গিয়ে দাওয়াত ছেড়ে দেয়া ও প্রত্যাখ্যানকারীদের সংশ্রব বর্জন করে দূরে সরে যাওয়া খুবই সহজ ও আরামদায়ক কাজ। এতে কিছুক্ষণ পর ক্রোধ প্রশমিত হবে এবং উত্তপ্ত স্নায়ুগুলাে ঠান্ডা হবে। কিন্তু দাওয়াতের কী হবে? বিরােধী প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় ফায়দা কী হবে? মনে রাখতে হবে দাওয়াতের কাজটা চালু থাকাই আসল ও জরুরী বিষয়, দাওয়াত দাতার ভালাে লাগা-মন্দ লাগা কোনাে বিবেচ্য বিষয় নয়। তার বিরক্ত লাগে লাগুক, রাগ হয় হােক। রাগকে হযম করে ফেলতে হবে এবং সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ধৈর্য ধারণই তার জন্যে কল্যাণকর। ধৈর্যধারনের অভ্যাস করলে যে যাই বলুক, তাতে বিরক্তি লাগবে না। দাওয়াতদানকারী আল্লাহর হাতিয়ার। আল্লাহ তায়ালা তার দাওয়াতের শ্রেষ্ঠ তদারককারী ও তত্ত্বাবধায়ক। দাওয়াতদানকারীর কর্তব্য হলাে সর্বাবস্থায় ও সকল পরিবেশে দাওয়াত চালিয়ে যাওয়া। বাকী যেটুকু, তা আল্লাহর হাতে সমর্পিত। হেদায়াতের দায়িত্ব আল্লাহর। হযরত ইউনুসের ঘটনায় দাওয়াতের কাজে নিয়ােজিত ব্যক্তিদের জন্যে যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে, তা বিবেচনা করা দরকার। তার আল্লাহর কাছে প্রত্যাবর্তন ও ভুল স্বীকার করায়ও শিক্ষা রয়েছে, সেটাও অনুধাবন করা প্রয়ােজন। অনুরূপভাবে, মহাসংকটে নিপতিত হযরত ইউনুসের ওপর আল্লাহর রহমত নাযিল হওয়া ও তার সকাতর দোয়া কবুল হওয়ার ভেতরেও মােমেনদের জন্যে সুসংবাদ রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেছেন, ‘এভাবে আমি মােমেনদেরকে রক্ষা করে থাকি।’

এরশাদ হচ্ছে, ইউনুস (নবীর) সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য (কোন) জনপদ…..(আয়াত ৯৮) এ আয়াত আমাদেরকে পেছনের দিকে ফিরে তাকাবার নির্দেশ দিচ্ছে। পেছনে ফিরে তাকালে এ বিষয়টি আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আলােচ্য আয়াতের মর্মার্থ কখনাে বাস্তবায়িত হওয়ার নয়। এমন কোনাে দৃষ্টান্ত আছে কি যে, উল্লেখিত জনবসতির মধ্য হতে একটি জনবসতি চাক্ষুষ আযাব দেখে ঈমান এনেছে। এদের মধ্য হতে অতি নগণ্য সংখ্যক জনবসতিই ঈমান এনেছে। তাই বলা হয়েছে একটি জনবসতি ছাড়া তারা ঈমান আনেনি। আর যে জনবসতি ঈমান এনেছিলে তা ছিলাে হযরত ইউনুস(আ.)-এর জনবসতি। ‘কারইয়া’ বলতে সভ্য ও শহুরে জনবসতিকে বুঝায়। এভাবে বলার মাধ্যমে একথার দিকেই ইংগিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা সকল রসূলকেই সভ্য শহরে জনবসতির কাছে পাঠিয়েছিলেন, বেদুইন জনবসতির কাছে পাঠাননি। আলােচ্য আয়াতে হযরত ইউনুস এবং তার সমাজের বিস্তারিত ঘটনাবলী বর্ণিত হয়নি। বরং সেই ঘটনার পরিসমাপ্তির দিকে এখানে ইংগিত করা হয়েছে। আর এ পরিসমাপ্তিটি বর্ণনা করাই এখানে উদ্দেশ্য। সুতরাং আমি এখানে বিস্তারিত আলােচনার অবতারণা করবাে না। এক্ষেত্রে আমাদের এতােটুকু জানাই যথেষ্ট যে, কুফরী ও অবাধ্যতার দরুন অপমানকর আযাব ইউনুস(আ.)-এর সম্প্রদায়ের দ্বার প্রান্তে এসে উপনীত হলাে। আযাব নাযিল হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ঈমান আনার দরুন সেই আযাব তাদের থেকে দূরীভূত হয়ে যায়। অতপর নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তারা দুনিয়ার জীবন উপভােগ করে। যদি তারা ঈমান আনা থেকে বিরত থাকতো, তবে তাদের আচরণের দরুন আল্লাহর চিরাচরিত বিধানানুসারে তাদের ওপর আযাব নাযিল হতাে। এখানে আমাদের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপলব্ধি করা দরকার। ১. অস্বীকারকারীদের মুক্তির সর্বশেষ অবলম্বনের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার আহ্বান জানানাে হয়েছে। যাতে তারা সম্ভাব্য আযাব থেকে মুক্তি পেতে পারে- যেমনিভাবে ইউনুস(আ.)-এর সম্প্রদায় দুনিয়ার জীবনে অপমানকর আযাব থেকে মুক্তি পেয়েছিলাে। ইউনুস(আ.)-এর ঘটনার এখানে অবতারণার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য এটাই। ২. আল্লাহর বিধান নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি এবং সে বিধান ইউনুস(আ.) সম্প্রদায়ের ওপর থেকে আযাব দূরে সরে যাওয়া এবং তাদেরকে দুনিয়াতে উপভােগ করার জন্যে পুনরায় ছেড়ে দেয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং সে বিধান এখানে চলমান ও কার্যকরী অবস্থায় আছে। কারণ আল্লাহর বিধানের দাবী হচ্ছে আযাব আসা পর্যন্ত যদি তারা মিথ্যারােপের ওপর অটল থাকতাে, তবে তাদের ওপর আযাব চলে আসতাে। যখন তারা মিথ্যারােপ থেকে ফিরে আসলাে, তখন তাদেরকে আযাব থেকে মুক্ত করার জন্যে তার বিধান কার্যকরী হলাে। সুতরাং মানুষের আচার আচরণ এবং কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে কোনাে বাধ্যবাধকতা নেই, বরং তার প্রভাবের ধারাবাহিকতায় বাধ্যবাধকতা নিহিত রয়েছে। এটা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, মানুষের আচার আচরণ ও কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে সব কিছুই নিয়তি নির্ধারিত এ বিশ্বাস প্রযােজ্য নয়, বরং তার প্রভাবের ধারাবাহিকতায় বাধ্যবাধকতা নিহিত রয়েছে। এটা এভাবেও বলা যেতে পারে যে, মানুষের আচার আচরণ ও কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে সব কিছুই নিয়তি নির্ধারিত এ বিশ্বাস প্রযোজ্য নয়, বরং তার প্রভাবের ধারাবাহিকতা বর্তাবার ক্ষেত্রে এ বিশ্বাস প্রযােজ্য।

*হেদায়াত প্রাপ্তির উপায় ও তা খেকে বঞ্চিত হওয়া : পরবর্তী আয়াতে কুফর এবং ঈমানের ক্ষেত্রে সাধারণ একটি নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে।  এরশাদ হচ্ছে, (হে নবী) তােমার মালিক চাইলে এ যমীনে যতাে মানুষ……. (আয়াত ৯৯-১০০) যদি তােমার রবের ইচ্ছা হতাে, তবে তিনি মানব জাতিকে এমন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করতেন যে, একটি মাত্র পথ ছাড়া আর কিছুই জানতাে না। আর সেটা হচ্ছে ফেরেশতাদের ন্যায় ঈমান আনার পথ। অথবা তিনি তাদের মাঝে এমন এক ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করতেন যা তাদের সকলকে ঈমানের দিকে টেনে নিয়ে যেতে। যদি আল্লাহ তায়ালা চাইতেন যে, এ পৃথিবীতে শুধুমাত্র তার আদেশ পালনকারী অনুগতরাই বাস করবে এবং কুফরী ও নাফরমানীর কোনাে অন্তিত্বই থাকবে না, তবে তিনি সকল মানুষকে ঈমান গ্রহণ করার প্রতি এমনভাবে বাধ্য করতেন যে, তাদের স্বেচ্ছায় ঈমান বা কুফর গ্রহণ করার ক্ষমতাই থাকতাে না। আসলে সৃষ্টির অন্তরালে আল্লাহর হেকমত আমরা কখনও বুঝতে সক্ষম হই, আবার কখনাে সক্ষম হই না। তিনি মানব জাতিকে ভালাে মন্দ এবং হেদায়াত ও গােমরাহীর ক্ষমতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি এ দুয়ের যে কোনােটি গ্রহণ করার শক্তিও দিয়েছেন। যদি মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত ইন্দ্রিয় ও অনুভূতি জাতীয় শক্তির সঠিক ব্যবহার করে এবং সে তাকে সৃষ্টি এবং আত্মার মধ্যকার হেদায়াতের দলীল প্রমাণাদি এবং বিভিন্ন রাসূল কর্তৃক আনীত সুপষ্ট নিদর্শনসমূহের প্রতি দিক নির্দেশনা দেয়, তবে সে ঈমান আনতে বাধ্য। আর ঈমান আনার মাধ্যমে সে মুক্তির পথ পাবে। পক্ষান্তরে যদি সে তার অনুভূতি এবং ইন্দ্রিয়সমূহকে নিষ্ক্রিয় ও রুদ্ধ রাখে এবং ঈমানের বিভিন্ন দলীল প্রমাণ থেকে এগুলােকে দূরে রাখে, তবে তার অন্তর শক্ত হয়ে যায়, বিবেক রুদ্ধ হয়ে যায়। পরিণামে সে মিথ্যারােপ ও অন্বীকারের প্রতি ধাবিত হয়। তার পরিণতি হয় অস্বীকারকারীদের পরিণতি। সুতরাং ঈমান স্বেচ্ছায় গ্রহণ করা এবং না করার বিষয়। রসূল(স.) ঈমান গ্রহণ করার জন্যে কাউকে বাধ্য করেননি। কারণ অন্তরের আবেগ অনুভূতি এবং বিবেকের গতি বিধি নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্য করার কোনাে সুযােগ নেই। ‘তবে কি তুমি মােমেন হবার জন্যে লােকদের ওপর জবরদস্তি করবে?’ এ প্রশ্নটি একটি নেতিবাচক প্রশ্ন। কারণ এ জবরদস্তি কখনাে বাস্তবায়িত হবার নয়। ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না।’ আল্লাহর চিরন্তন বিধান (যা আমি ইতিপূর্বে বর্ণনা করেছি) অনুসারে যদি কোনাে ব্যক্তি এমন পথের অনুসরণ করে, যা তাকে ঈমান পর্যন্ত পৌছায় না, কখনাে সে ঈমান পর্যন্ত পৌছতে সক্ষম হবে না। উপরােক্ত আয়াতের অর্থ এটা নয় যে, সে ঈমান গ্রহণ করার লক্ষ্যে ঈমানের রাস্তার অনুসরণ করে, অতপর তাকে ঈমান গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়। এ আয়াতের মূল অর্থ হচ্ছে, যদি কোনাে ব্যক্তি আল্লাহর বিধান ও অনুমতি মােতাবেক সঠিক পথের অনুসরণ করে, তবেই সে ঈমান পর্যন্ত পৌছতে পারবে। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে সঠিক পথের দিশা দেবেন যাতে ঈমান তার অনুমতি সাপেক্ষে বান্দার অন্তরে প্রবেশ করতে পারে। প্রত্যেক বস্তু একটি নির্দিষ্ট সীমানা পর্যন্তই কার্যকর হয়ে থাকে। মানুষ যখন স্বেচ্ছায় কোনাে রাস্তার অনুসরণ করে, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্যে সে রাস্তার পরিণাম নির্ধারিত করে থাকেন। সঠিক পথ পাওয়ার জন্যে তারা যতােটুকু চেষ্টা চালিয়ে থাকে, তার বিনিময় স্বরূপ তিনি সেই পরিণাম ধার্য করেন। আয়াতের শেষাংশ উপরােক্ত কথার দিকেই ইংগিত বহন করে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর আল্লাহর রীতি হচ্ছে, যারা বুদ্ধি প্রয়ােগ করে কাজ করে না, তাদের ওপর কলুষতা চাপিয়ে দেন।’ যারা নিজেদের বিবেককে চিন্তা ভাবনা থেকে নিষ্কৃয় করে রাখে, তিনি তাদের ওপর কলুষতা চাপিয়ে দেন। কলুষতা সর্বনিকৃষ্ট আঙ্গিক অপবিত্রতা। তারা তাদের ইন্দ্রিয়সমূহকে চিন্তা ভাবনা করা থেকে নিষ্ক্রিয় করার দরুন এ কলুষতা ও অপবিত্রতা তাদেরকে পেয়ে বসে। যার পরিণাম হচ্ছে মিথ্যারোপ ও অস্বীকার করা।

*হযরত ইউনুস(আ.)-এর ঘটনা : মাছওয়ালা নবী ইউনুস(আ.)-এর বৃত্তান্ত বর্ণনার সাথে এ অধ্যায়টি সমাপ্ত হচ্ছে। ‘আর ইউনুসও একজন রসূল ছিলাে…. অতপর তারা ঈমান আনল, যার কারণে আমি মহান আল্লাহ এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের ধনদৌলতসহ বিভিন্ন জীবন সামগ্রী সরবরাহ করতে থাকলাম।’ ইউনুস(আ.)-এর কওম যে ঠিক কোন এলাকায় বসবাস করতাে আল কোরআন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানায়নি, তবে সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে যে, তারা সাগর উপকূলবর্তী কোনাে এক এলাকায় বাস করত। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, তাঁর কওমের দুর্ব্যবহারের কারণে তাঁর অন্তরটা অত্যন্ত সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিলাে, যার কারণে তিনি তাদের আসন্ন আযাবের ভয় দেখালেন এবং ভীষণভাবে রেগে গিয়ে তাদের পরিত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। অতপর তার ক্রোধ তাঁকে সাগর সৈকতের দিকে নিয়ে গেলাে, যেখানে গিয়ে তিনি এক সমুদ্রগামী লােক ভর্তি জাহাজে আরােহণ করলেন। জাহাজ যখন গভীর মহাসাগরে উপনীত হলাে তখন সমুদ্র বক্ষ প্রচন্ড বায়ু ও উত্তাল তরংগাভিঘাতে উন্মত্ত হয়ে উঠলাে। এসময় আরােহীরা প্রমাদ গুনল যে, অবশ্যই জাহাজের মধ্যে এমন কোনাে অলক্ষুণে ব্যক্তি উপস্থিত রয়েছে যার কঠিন অপরাধের কারণে তাদের আজকের এই দুর্গতি; তাকে সাগরবক্ষে নিক্ষেপ করলেই হয়তাে এই জাহাজটি ডুবে যাওয়া থেকে উদ্ধার পেয়ে যাবে। অতপর তারা যাত্রীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে সেই অপরাধী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে উদ্যোগী হলাে এবং অবশেষে তাতে ইউনুস(আ.)-এর নাম ওঠলাে। যদিও উপস্থিত যাত্রীদের মধ্যে তিনি ভালাে মানুষ বলে পরিচিত ছিলেন, তা সত্তেও লটারির মাধ্যমে তাঁর নাম উঠানোতে তারা একে অধিকতর গুরুত্ব দিলাে এবং নির্দ্বিধায় তাকে সেই বিক্ষুব্ধ সাগরের বুকে নিক্ষেপ করলাে, আর অমনি এক বৃহদাকার মাছ এসে তাকে গিলে ফেললাে। তিনি তাে নিন্দিতই ছিলেন, অর্থাৎ প্রকৃতই তিনি নিন্দার পাত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাকে যে দায়িত্বে নিয়ােজিত করেছিলেন সেই মহা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পরিত্যাগ করে তিনি পালিয়ে এসেছিলেন। আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই তিনি তার জাতিকে ছেড়ে দিয়ে শুধু নিজের জানটা নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এরপর মাছের পেটের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যখন ত্রুটি ধরা পড়লাে তখন তিনি আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তাসবীহ জপতে শুরু করলেন, তার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন এবং বুঝলেন যে, অবশ্যই তিনি তার অপরাধের কারণে যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। ‘সুতরাং তিনি পড়তে শুরু করলেন, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোনাে মাবুদ নেই, অবশ্যই আমি যালেমদের দলভুক্ত হয়ে পড়েছি।’ অতপর মেহেরবান আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করলেন এবং তাকে পুরােপুরিভাবে ক্ষমা করে দিলেন। তারপর সেই মাছটি তাকে উগরে দিলাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘যদি তিনি তাসবীহ জপতে শুরু না করতেন তাহলে অবশ্যই কেয়ামত পর্যন্ত সেই মাছের পেটের মধ্যেই থেকে যেতেন।’ মাছটি তাকে উগরে দেয়ার পর তিনি যে মুহূর্তে বাইরে এলেন তখন তিনি উলংগ ও অসুস্থ অবস্থায় একটি দ্বীপের কিনারায় উৎক্ষিপ্ত হলেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর তার জন্যেই আমি মহান আল্লাহ উৎপন্ন করলাম লতাবিশিষ্ট একটি লাউ গাছ।’ ‘ইয়াকতীন’ বলতে কোনাে কোনাে সময় পানিকদু বা লাউও বুঝায়। ইউনুস(আ.) যখন দ্বীপের কিনারায় নিক্ষিপ্ত হলেন তখন তাঁকে সেই দ্বীপে উৎপন্ন লাউয়ের বিরাট পাতা ছায়া করে ফেললাে এবং সেই পাতাগুলাে তাঁর গায়ে মাছি পড়া থেকে তাঁকে রক্ষা করলাে। কথিত আছে, এমন গাছের কাছেও নাকি মাছি ঘেঁষে না। অবশ্য এটা ছিলাে সম্পূর্ণ আল্লাহর তদবীর ও মেহেরবানীরই ফল। তারপর তিনি পুরােপুরি সুস্থ হয়ে ওঠলে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে তাঁর পরিত্যক্ত জাতির কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি রাগ করে যখন তাদের ছেড়ে চলে এসেছিলেন তখন তারা একথা মনে করে ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাে যে, আল্লাহর রসূল ইউনূস(আ.) তাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অবশ্যই তাদের সেই আযাব ঘিরে ফেলবে যার ভয় তিনি তাদের দেখিয়েছিলেন। এজন্যে ইউনুস(আ.) বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তারা অবিলম্বে ঈমান এনে ফেলেছিলাে এবং তাওবা এস্তেগফার করে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছিলাে। কাজেই আল্লাহ তায়ালাও তাদের ডাকে সাড়া দিলেন এবং তাঁর রসূলকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে পাওনা শাস্তি থেকে তাদের রেহাই দিলেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘তারপর তারা ঈমান আনল, যার কারণে আমি মহান আল্লাহ, এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের দুনিয়ার সুখ সম্পদ দিয়ে ধন্য করলাম।’ এরা সংখ্যায় লাখখানেক কি তার থেকেও হয়তাে কিছু বেশী ছিলাে, তারা সবাই ইউনুস(আ.)-এর ফিরে যাওয়ার পর ঈমান এনােছিলাে। উপস্থিত প্রসংগের আলােচনায় ঈমানদারদের শুভ পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে জানা গেলাে এবং পাশাপাশি, পেছনের অন্যান্য কাহিনী থেকেও বেঈমানদের ওপর কি কি শাস্তি নেমে এসেছে তা বুঝা গেলাে। সুতরাং মােহাম্মদ(স.)-এর জাতি যখন এ ঘটনাবলী পড়বে তখন তাদের বুঝমতাে যে কোনাে পথ বেছে নিতে পারবে। এভাবে সূরাটির এ অধ্যায়টিতে বর্ণিত দীর্ঘ এক ঐতিহাসিক কাহিনীর আলােচনা শেষ হচ্ছে, যার ধারা বর্ণনা নূহ(আ.) এর আমল থেকে চলে আসছে। যাদের বিভিন্ন আদলে সতর্ক করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকে ঈমান এনেছে এবং অনেকে ঈমান আনেও নাই।

 

 

তাফসীরে‌ ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৮৭-৮৮ নং আয়াতের তাফসীর:

অত্র আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তা‘আলা ইউনুস (عليه السلام)-এর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। النُّوْنُ অর্থ মাছ, আর ذَا النُّوْنِ অর্থ মাছওয়ালা। সূরা ক্বালামের ৪৮ নং আয়াতে সাহেবুল হূত

(صاحب الحوت)

তথা মাছ ওয়ালা বলা হয়েছে। এ নামে নামকরণের পেছনে একটি বিশেষ ঘটনার জড়িত রয়েছে।

সংক্ষিপ্ত ঘটনা

আল্লাহ তা‘আলা ইউনুস (عليه السلام)-কে ইরাকের নীনাওয়া (বর্তমান মুসেল) নামক শহরের নিকটবর্তী জনপদের অধিবাসীদের প্রতি নাবী হিসেবে প্রেরণ করেন। এখানে আশুরীদের শাসন ছিল, যারা এক লক্ষ্য বানী ইসরাঈলকে বন্দী করে রেখেছিল, সুতরাং তাদের হিদায়াত ও পথপ্রদর্শনের জন্য ইউনুস (عليه السلام)-কে প্রেরণ করা হয়। তিনি যথারীতি তাঁর সম্প্রদায়কে তাওহীদের দিকে আহ্বান করলেন। কিন্তু তারা তাঁর কথা কর্ণপাত করল না এবং ঈমানও আনল না। বারংবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হলে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতোমধ্যে তাঁর জাতির ওপর আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। তিনি জনপদ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, তিনদিন পর তোমাদের ওপর আযাব আসতে পারে। তারা ভাবল নাবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে তাঁর জাতি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শির্ক হতে তাওবা করে এবং সকলকে নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল। সেখানে আসন্ন গযব হতে আল্লাহ তা‘আলার দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের তাওবা কবূল করেন এবং আযাব তুলে নেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَلَوْلَا کَانَتْ قَرْیَةٌ اٰمَنَتْ فَنَفَعَھَآ اِیْمَانُھَآ اِلَّا قَوْمَ یُوْنُسَﺋ لَمَّآ اٰمَنُوْا کَشَفْنَا عَنْھُمْ عَذَابَ الْخِزْیِ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَمَتَّعْنٰھُمْ اِلٰی حِیْنٍ)

“অতএব কোন জনপদবাসী কেন এমন হল না যে, তারা এমন সময় ঈমান আনত যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? তবে ইউনুসের সম্প্রদায় ব্যতীত। তারা যখন ঈমান আনল তখন আমি তাদের হতে পার্থিব জীবনের অপমানজনক শাস্তি তুলে নিলাম এবং তাদেরকে কিছু কালের জন্য জীবনোপকরণ ভোগ করতে দিলাম।” (সূরা ইউনুস ১০:৮৬)

ওদিকে ইউনুস (عليه السلام) ভেবেছিলেন যে, তাঁর জাতি আল্লাহ তা‘আলার গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব আসেনি। তখন তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন যে, এখন তাঁর জাতি তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসেবে প্রথানুযায়ী হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমের অপেক্ষা না করে রাগান্বিত হয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(وَاِنَّ یُوْنُسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِیْنَﯚﺚاِذْ اَبَقَ اِلَی الْفُلْکِ الْمَشْحُوْنِﯛﺫ فَسَاھَمَ فَکَانَ مِنَ الْمُدْحَضِیْنَﯜﺆفَالْتَقَمَھُ الْحُوْتُ وَھُوَ مُلِیْمٌ)

“আর ইউনুসও ছিল রাসূলদের মধ্যে একজন। যখন সে পালিয়ে বোঝাই নৌযানে গিয়ে পৌঁছল, অতঃপর সে লটারীতে শরীক হল এবং অপরাধী সাব্যস্ত হল। তারপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল, তখন সে নিজেকে তিরস্কার করতে লাগল।” (সূরা সফফাত ৩৭:১৩৯-১৪২)

মাছের পেটে ইউনুস (عليه السلام):

হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হলে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। লটারীতে পরপর তিনবার ইউনুস (عليه السلام) এর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। নদীতে ফেলে দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে একটি বিরাটকায় মাছ তাঁকে গলধঃকরণ করে নেয়। কিন্তু মাছের পেটে হযম হননি বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা। মাওয়ার্দী বলেন: মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকে। (কুরতুবী, অত্র আয়াতের তাফসীর)

ইউনুস (عليه السلام)-এর মুক্তি:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَلَوْلَآ أَنَّه۫ كَانَ مِنَ الْمُسَبِّحِيْنَ)

অর্থাৎ যদি মাছের পেটে যাওয়ার পূর্ব থেকেই তাঁর অধিক ইবাদত ও সৎ আমল না থাকত এবং মাছের পেটে যাওয়ার পর তাওবাহ ইস্তিগফার ও তাসবীহ পাঠ না করত তাহলে মাছের পেটেই থেকে যেতো, সেখানেই তার কবর হতো এবং সেখান হতেই কিয়ামতের দিন পুনরুত্থান হতো। তাওবাহ-ইস্তিগফার ও তাসবীহ দ্বারা বিপদাপদ দূর হয় এবং তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি মাছের পেটে থাকাবস্থায় বিশেষভাবে এ কালেমা পাঠ করতেন

( لَّآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنْتَ سُبْحٰنَكَ ﺣ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِيْنَ)

‘তুমি ব্যতীত কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; তুমি পবিত্র, মহান! আমি তো সীমা লঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা আম্বিয়া ২১:৮৭)

তাঁর অধিক পরিমাণ ইবাদত ও সৎ আমল এবং তাওবা ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওবা কবূল করত মাছের পেট থেকে জীবিত অবস্থায় নদীর তীরে তরুলতাহীন শূন্য এলাকায় রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন ইউনুস (عليه السلام) স্বাভাবিকভাবেই রুগ্ন ছিলেন। ঐ অবস্থায় সেখানে উদ্গত লাউ জাতীয় গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করেছিলেন যা পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। কোন বর্ণনাতে লাউ গাছের কথা উল্লেখ রয়েছে। ছায়া ও অন্যান্য উপকার নেয়ার জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

এভাবে আল্লাহ তা‘আলা বিপদ থেকে তাঁকে মুক্ত করেন। সূরা সফফাতের ১৩৯-১৪৮ নং আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

( فَظَنَّ لَّنْ نَّقْدِرَ عَلَيْهِ)

“সে মনে করেছিল আমি তার প্রতি সংকীর্ণতা করব না।” এর দুটি অর্থ হতে পারে, দুটিই সঠিক ১. ইউনুস (عليه السلام) ধারণা করেছিলেন তাঁর প্রতি মাছের পেটের ভিতরে আল্লাহ তা‘আলা সংকীর্ণতা সৃষ্টি করবেন না। ২. অথবা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর শাস্তির ফয়সালা করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ওপর ক্ষমতা রাখেন না বা পাকড়াও করতে পারবেন না এমন ব্যাখ্যা করা ভুল, কারণ কোন নাবীরই আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে এমন ধারণা থাকতে পারে না। (আযউয়াউল বায়ান)

সুতরাং দীনের পথে দাওয়াত দিতে গিয়ে অধৈর্য হওয়া যাবে না, বরং সর্বাবস্থায় ধৈর্যধারণ করতে হবে। তবে কেউ বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলা তাকে তা থেকে উদ্ধার করবেন। কারণ শেষ আয়াতে মু’মিনদেরকে সে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. কোন অবস্থাতেই অধৈর্য হওয়া যাবে না, ধৈর্যধারণ করে যা অর্জন সম্ভব ধৈর্যহারা হয়ে তা সম্ভব নয়।
২. যেকোন কঠিন মুহূর্তে কেবল আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য চাইতে হবে।
৩. কাজ করার পর আফসোস করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করা উচিত।
৪. নেক নিয়তে বিপদগ্রস্ত অবস্থায়

(لَّآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنْتَ سُبْحٰنَكَ ﺣ إِنِّيْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِيْنَ)

এ দু‘আ পড়লে আল্লাহ তা‘আলা তা সহজ করে দেন।
৫. যারা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আস্থাশীল তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই সাহায্য করবেন।

 

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন‌্য বলেছেন :-

# হযরত ইউনুস (আ)। কোথাও সরাসরি তাঁর নাম নেয়া হয়েছে আবার কোথাও “যুন্নুন” ও “সাহেবুল হূত” বা মাছওয়ালা উপাধির মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। তিনি মাছ ধরতেন বা বেচতেন বলে তাঁকে মাছওয়ালা বলা হতো না বরং আল্লাহর হুকুমে একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলেছিল, তাই তাঁকে বলা হয়েছে মাছওয়ালা।

# সূরা সাফফাতের ১৪২ আয়াতে একথা বর্ণনা করা হয়েছে।

:- এ বাক্যগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে ঘটনার যে চিত্রটি সামনে ভেসে ওঠে তা হচ্ছেঃ

একঃ হযরত ইউনুস যে নৌকায় আরোহণ করেছিলেন তা তার ধারণা ক্ষমতার চাইতে বেশী বোঝাই (Overloade) ছিল।

দুইঃ নৌকায় লটারী অনুষ্ঠিত হয় এবং সম্ভবত এমন সময় হয় যখন সামূদ্রিক সফরে মাঝখানে মনে করা হয় যে, নৌকা তার ধারণ ক্ষমতার বেশী বোঝা বহন করার কারণে সকল যাত্রীর জীবন বিপদের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। কাজেই লটারীতে যার নাম উঠবে তাকেই পানিতে নিক্ষেপ করা হবে, এ উদ্দেশ্যে লটারী করা হয়।

তিনঃ লটারীতে হযরত ইউনুসের নামই ওঠে। তাঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয় এবং একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলে।

চারঃ হযরত ইউনুসের এ পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তিনি নিজে প্রভুর (অর্থাৎ মহান আল্লাহ) অনুমতি ছাড়াই তাঁর কর্মস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। “আবাকা” শব্দটি এ অর্থই প্রকাশ করছে ওপরের ৭৮ টীকায় এ ব্যাখ্যাই করা হয়েছে। “মুলীম” শব্দটিও একথাই বলছে। মুলীম এমন অপরাধীকে বলা হয় যে নিজের অপরাধের কারণে নিজেই নিন্দিত হবার হকদার হয়ে গেছে, তাকে নিন্দা করা হোক বা না হোক। (يقال قد الام الرجل اذا مايلام عليه من الامر وان لم يلم- ابن جرير)

# আরো বেশী জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনূস ৯৮-১০০ :-

সুরা: ইউনুস
আয়াত নং :-৯৮

فَلَوْ لَا كَانَتْ قَرْیَةٌ اٰمَنَتْ فَنَفَعَهَاۤ اِیْمَانُهَاۤ اِلَّا قَوْمَ یُوْنُسَ١ؕ لَمَّاۤ اٰمَنُوْا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الْخِزْیِ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ مَتَّعْنٰهُمْ اِلٰى حِیْنٍ

এমন কোন দৃষ্টান্ত আছে কি যে, একটি জনবসতি চাক্ষুষ আযাব দেখে ঈমান এনেছে এবং তার ঈমান তার জন্য সুফলদায়ক প্রমাণিত হয়েছে? ইউনুসের কওম ছাড়া (এর কোন নজির নেই) তারা যখন ঈমান এনেছিল তখন অবশ্যই আমি তাদের ওপর থেকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনার আযাব হটিয়ে দিয়েছিলাম এবং তাদেরকে একটি সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছিলাম।

# ইউনুস (আ) (যাকে বাইবেলে যোনা নামে উল্লেখ করা হয়েছে এবং যার সময়কাল খৃষ্টপূর্ব ৮৬০ থেকে ৭৮৪ সালের মাঝামাঝি সময় বলা হয়ে থাকে) যদিও বনী ইসরাঈলী নবী ছিলেন তবুও তাকে আসিরিয়াবাসীদের হেদায়াতের জন্য ইরাকে পাঠানো হয়েছিল। এ কারণে আসিরিয়াবাসীদেরকে এখনে ইউনূসের কওম বলা হয়েছে। সে সময় এ কওমের কেন্দ্র ছিল ইতিহাস খ্যাত নিনোভা নগরী। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এ নগরীর ধ্বংসাবশেষ আজো বিদ্যমান। দাজলা নদীর পূর্ব তীরে আজকের মুসেল শহরের ঠিক বিপরীত দিকে এ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এ এলাকায় ইউনুস নবী নামে একটি স্থান আজো বর্তমান রয়েছে। এ জাতির রাজধানী নগরী নিনোভা প্রায় ৬০ মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত ছিল। এ থেকে এদের জাতীয় উন্নতির বিষয়টি অনুমান করা যেতে পারে।

# কুরআনে এ ঘটনার দিকে তিন জায়গায় শুধুমাত্র ইঙ্গিত করা হয়েছে। কোন বিস্তারিত বিবরণ সেখানে দেয়া হয়নি। (দেখুন আম্বিয়া ৮৭-৮৮ আয়াত , আস্ সাফফাত ১৩৯-১৪৮ আয়াত ও আল কলম ৪৮-৫০ আয়াত ) তাই “আযাবের ফায়সালা হয়ে যাবার পর কারোর ঈমান আনা তার জন্য উপকারী হয় না।” আল্লাহ‌ তার এ আইন থেকে হযরত ইউনুসের কওমকে কোন্ কোন্ কারণে নিষ্কৃতি দেন তা নিশ্চয়তার সাথে বলা সম্ভব নয়। বাইবেলে “যোনা ভাববাদীর পুস্তক” নাম দিয়ে যে সংক্ষিপ্ত সহীফা লিপিবদ্ধ হয়েছে তাতে কিছু বিবরণ পাওয়া গেলেও বিভিন্ন কারণে তা নির্ভরযোগ্য নয়। প্রথমত তা আসমানী সহীফা নয় এবং ইউনুস (আ) এর লেখাও না। বরং তার তিরোধানের চার পাচশো বছর পর কোন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ইউনূসের ইতিহাস হিসেবে লিখে এটিকে পবিত্র গ্রন্থসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেন। দ্বিতীয়ত এর মধ্যে কতক একেবারেই আজেবাজে কথাও পাওয়া যায়। এগুলো মেনে নেবার মত নয়। তবুও কুরআনের ইশারা ও ইউনুসের সহীফার বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলে কুরআনের তাফসীরকারকগণ যে কথা বলেছেন তাই সঠিক বলে মনে হয়। তারা বলেছেন, হযরত ইউনূস (আ) যেহেতু আযাবের ঘোষণা দেবার পর আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই নিজের আবাসস্থল ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন তাই আযাবের লক্ষণ দেখে যখন আসিরীয়রা তওবা করলো এবং গোনাহের জন্য ক্ষমা চাইলো তখন মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ‌ তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। কুরআন মজীদে আল্লাহর বিধানের যে মৌলিক নিয়ম কানুন বর্ণনা করা হয়েছে তার একটি স্বতন্ত্র ধারা হচ্ছে এই যে, আল্লাহ‌ কোন জাতিকে ততক্ষণ আযাব দেন না যতক্ষণ না পূর্ণাঙ্গ দলীল-প্রমাণ সহকারে সত্যকে তাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তোলেন। কাজেই নবী যখন সংশ্লিষ্ট জাতির জন্য নির্ধারিত অবকাশের শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত উপদেশ বিতরণের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেননি এবং আল্লাহর নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজ দায়িত্বে হিজরত করে চলে গেছেন তখন আল্লাহর সুবিচার নীতি এ জাতিকে আযাব দেয়া সমীচীন মনে করেনি। কারণ তার কাছে পূর্ণাঙ্গ দলীল প্রমাণ সহকারে সত্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার আইনগত শর্তাবলী পূর্ণ হতে পারেনি। (আরো বেশী জানার জন্য দেখুন সূরা আস সাফাফাত এর ব্যাখ্যা ৮৫ টীকা) ।

# ঈমান আনার পর যে জাতিটির আয়ু বাড়িয়ে দেয়া হলো। পরে তারা আবার চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে ভুল পথে পা বাড়ানো শুরু করলো। নাহোম নবী (খৃষ্টপূর্ব ৭২০-৬৯৮) এ সময় তাদেরকে সতর্ক করলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলো না। তারপর সফনীয় নবী (খৃস্টপূর্ব ৬৪০-৬০৯) তাদেরকে শেষবারের মত সতর্ক করলেন। তাও কার্যকর হলো না। শেষ পর্যন্ত ৬১২ খৃষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে আল্লাহ‌ তাদের ওপর মিডিয়াবাসীদের আগ্রাসন সংঘটিত করালেন। মিডিয়ার বাদশাহ ব্যাবিলনবাসীদের সহায়তায় আসিরিয়া এলাকা আক্রমণ করলেন। আসিরীয় সেনাদল পরাজিত হয়ে রাজধানী নিনোভায় অন্তরীণ হলো। কিছুকাল পর্যন্ত তারা জোরেশোরে মোকাবিলা করলো। তারপর দাজলায় এলো বন্যা। এ বন্যায় নগর প্রাচীর ধ্বসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে আক্রমণকারীরা নগরে প্রবেশ করলো এবং পুরো শহর জ্বালিয়ে ভস্ম করলো। আশপাশের এলাকারও একই দশা হলো। আসিরীয়ার বাদশাহও নিজের মহলে আগুন লাগিয়ে তাতে পুড়ে মরলো। আর এ সাথে আসিরীয় রাজত্ব ও সভ্যতারও ইতি ঘটলো চিরকালের জন্য। আধুনিক কালে এ এলাকায় প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ খননের যে প্রচেষ্টা চলছে তাতে এখানে অগ্নিকান্ডের চিহ্ন অত্যন্ত স্পষ্ট দেখা গেছে।

# সুরা: ইউনুস
আয়াত নং :-৯৯

وَ لَوْ شَآءَ رَبُّكَ لَاٰمَنَ مَنْ فِی الْاَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِیْعًا١ؕ اَفَاَنْتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتّٰى یَكُوْنُوْا مُؤْمِنِیْنَ

যদি তোমার রবের ইচ্ছা হতো (যে, যমীনে সবাই হবে মুমিন ও অনুগত) তাহলে সারা দুনিয়াবাসী ঈমান আনতো।তবে কি তুমি মুমিন হবার জন্য লোকদের ওপর জবরদস্তি করবে?

# আল্লাহ‌ যদি চাইতেন যে, এ পৃথিবীতে শুধুমাত্র তার আদেশ পালনকারী অনুগতরাই বাস করবে এবং কুফরী ও নাফরমানীর কোন অস্তিত্বই থাকবে না তাহলে তার জন্য সারা দুনিয়াবাসীকে মু’মিন ও অনুগত বানানো কঠিন ছিল না এবং নিজের একটি মাত্র সৃজনী ইঙ্গিতের মাধ্যমে তাদের অন্তর ঈমান ও আনুগত্যে ভরে তোলাও তার পক্ষে সহজসাধ্য ছিল। কিন্তু মানব জাতিকে সৃষ্টি করার পেছনে তার যে প্রজ্ঞাময় উদ্দেশ্য কাজ করছে এ প্রাকৃতিক বল প্রয়োগে তা বিনষ্ট হয়ে যেতো। তাই আল্লাহ‌ নিজেই ঈমান আনা বা না আনা এবং আনুগত্য করা বা না করার ব্যাপারে মানুষকে স্বাধীন রাখতে চান।

# এর অর্থ এ নয় যে, নবী (সা.) লোকদেরকে জোর করে মু’মিন বানাতে চাচ্ছিলেন এবং আল্লাহ‌ তাকে এমনটি করতে বাধা দিচ্ছিলেন। আসলে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে আমরা যে বর্ণনা পদ্ধতি পাই এ বাক্যও সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখি, সম্বোধন করা হয়েছে বাহ্যত নবী (সা.) কে কিন্তু আসলে নবীকে সম্বোধন করে যে কথা বলা হয় তা লোকদেরকে শুনানোই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। এখানে যা কিছু বলতে চাওয়া হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, হে লোকেরা! যুক্তি প্রমাণের সাহায্যে হেদায়াত ও গোমরাহীর পার্থক্য স্পষ্ট করে তুলে ধরার এবং সঠিক পথ পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেবার যে দায়িত্ব ছিল তা আমার নবী পুরোপরি পালন করেছেন। এখন যদি তোমরা নিজেরাই সঠিক পথে চলতে না চাও এবং তোমাদের সঠিক পথে চলা যদি এর ওপর নির্ভরশীল হয় যে, কেউ তোমাদের ধরে বেঁধে সঠিক পথে চালাবে, তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত, নবীকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। এভাবে জবরদস্তি ঈমান আনা যদি আল্লাহর অভিপ্রেত হতো তাহলে এ জন্য নবী পাঠাবার কি প্রয়োজন ছিল? এ কাজ তো তিনি নিজেই যখন ইচ্ছা করতে পারতেন।

# সুরা: ইউনুস
আয়াত নং :-100

وَ مَا كَانَ لِنَفْسٍ اَنْ تُؤْمِنَ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ١ؕ وَ یَجْعَلُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِیْنَ لَا یَعْقِلُوْنَ

আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউই ঈমান আনতে পারে না। আর আল্লাহর রীতি হচ্ছে, যারা বুদ্ধি প্রয়োগ করে কাজ করে না তাদের ওপর কলুষতা চাপিয়ে দেন।

# সমস্ত নিয়ামত যেমন আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানাধীন এবং আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন ব্যক্তি কোন নেয়ামতও নিজে লাভ করতে বা অন্যকে দান করতে পারে না ঠিক তেমনভাবে এ ঈমানের নিয়ামতও আল্লাহর একচ্ছত্র মালিকানাধীন। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির ঈমানদার হওয়া এবং তার সত্য সঠিক পথের সন্ধান লাভ করাও আল্লাহর অনুমতির ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন ব্যক্তি এ নিয়ামতটি নিজে লাভ করতে পারে না এবং কোন মানুষ ইচ্ছা করলে কাউকে এ নিয়ামতটি দান করতেও পারে না। কাজেই নবী যদি লোকদেরকে মু’মিন বানাবার জন্য একান্ত আন্তরিকভাবে কামনাও করেন তাহলেও তার জন্য আল্লাহর হুকুম এবং তার পক্ষ থেকে এ কাজের জন্য সুযোগ দানেরও প্রয়োজন হয়।

# এখানে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে, আল্লাহর অনুমতি ও তার সুযোগ দান অন্ধভাবে বিচার-বিবেচনা ছাড়াই সম্পন্ন হয় না। কোন রকম মহৎ উদ্দেশ্য ছাড়া এবং কোন প্রকার যুক্তিসঙ্গত নিয়ম কানুন ছাড়াই যেভাবে ইচ্ছা এবং যাকে ইচ্ছা এ নিয়ামতটি লাভ করার সুযোগ দেয়াও হয় না এবং যাকে ইচ্ছা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত ও করা হয়না। বরং এর একটি অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ নিয়ম হচ্ছে, যে ব্যক্তি সত্যের সন্ধানে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে নির্দ্বিধায় যথাযথভাবে ব্যবহার করে তার জন্য তো আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যে পৌঁছে যাবার কার্যকরণ ও উপায়উপকরণ তার- নিজের প্রচেষ্টা ও চাহিদার অনুপাতে সরবরাহ করে দেয়া হয় এবং তাকেই সঠিক জ্ঞান লাভ করার ঈমান আনার সুযোগ দান করা হয়। আর যারা সত্যসন্ধানি নয় এবং নিজেদের বুদ্ধিকে অন্ধগোষ্ঠী প্রীতি ও সংকীর্ণ স্বার্থ-বিদ্বেষের ফাঁদে আটকে রাখে অথবা আদৌ তাকে সত্যের সন্ধানে ব্যবহারই করে না তাদের জন্য আল্লাহর নিয়তির ভাণ্ডারে মূর্খতা, অজ্ঞতা, ভ্রষ্টতা, ত্রুটিপূর্ণ দৃষ্টি ও ত্রুটিপূর্ণ কর্মের আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা নিজেদেরকে এ ধরনের আবর্জনা ও অপবিত্রতার যোগ্য করে এবং এটিই হয়ে যায় তাদের নিয়তির লিখন।

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৩৯
وَ اِنَّ یُوْنُسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِیْنَؕ

আর অবশ্যই ইউনুস রসূলদের একজন ছিল।

# কুরআন মজীদে এ তৃতীয়বার হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের বিষয় আলোচিত হয়েছে। এর আগে সূরা ইউনুস ও সূরা আম্বিয়ায় তাঁর আলোচনা এসেছে এবং আমি তার ব্যাখ্যা করেছি। (দেখুন তাফহীমুল কুরআন সূরা ইউনুস, ৯৮-১০০ টীকা এবং সূরা আল আম্বিয়া, ৮২-৮৫ টীকা)

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪০

اِذْ اَبَقَ اِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُوْنِۙ

স্মরণ করো যখন সে একটি বোঝাই নৌকার দিকে পালিয়ে গেলো,

# মূলে ابق শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী ভাষায় এ শব্দটি কেবলমাত্র তখনই ব্যবহার করা হয় যখন গোলাম তার প্রভুর কাছ থেকে পালিয়ে যায়। الاباق هرب العبد من سيده অর্থাৎ “ইবাক অর্থ হচ্ছে প্রভুর কাছ থেকে গোলামের পালিয়ে যাওয়া।” (লিসানুল আরব)

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪১

فَسَاهَمَ فَكَانَ مِنَ الْمُدْحَضِیْنَۚ

তারপর লটারীতে অংশগ্রহণ করলো এবং তাতে হেরে গেলো।

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪২
فَالْتَقَمَهُ الْحُوْتُ وَ هُوَ مُلِیْمٌ

শেষ পর্যন্ত মাছ তাঁকে গিলে ফেললা এবং সে ছিল ধিকৃত।

 

# এ বাক্যগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে ঘটনার যে চিত্রটি সামনে ভেসে ওঠে তা হচ্ছেঃ

একঃ হযরত ইউনুস যে নৌকায় আরোহণ করেছিলেন তা তার ধারণা ক্ষমতার চাইতে বেশী বোঝাই (Overloade) ছিল।

দুইঃ নৌকায় লটারী অনুষ্ঠিত হয় এবং সম্ভবত এমন সময় হয় যখন সামূদ্রিক সফরে মাঝখানে মনে করা হয় যে, নৌকা তার ধারণ ক্ষমতার বেশী বোঝা বহন করার কারণে সকল যাত্রীর জীবন বিপদের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। কাজেই লটারীতে যার নাম উঠবে তাকেই পানিতে নিক্ষেপ করা হবে, এ উদ্দেশ্যে লটারী করা হয়।

তিনঃ লটারীতে হযরত ইউনুসের নামই ওঠে। তাঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হয় এবং একটি মাছ তাঁকে গিলে ফেলে।

চারঃ হযরত ইউনুসের এ পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হবার কারণ হচ্ছে এই যে, তিনি নিজে প্রভুর (অর্থাৎ মহান আল্লাহ) অনুমতি ছাড়াই তাঁর কর্মস্থল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। “আবাকা” শব্দটি এ অর্থই প্রকাশ করছে ওপরের ৭৮ টীকায় এ ব্যাখ্যাই করা হয়েছে। “মুলীম” শব্দটিও একথাই বলছে। মুলীম এমন অপরাধীকে বলা হয় যে নিজের অপরাধের কারণে নিজেই নিন্দিত হবার হকদার হয়ে গেছে, তাকে নিন্দা করা হোক বা না হোক। (يقال قد الام الرجل اذا مايلام عليه من الامر وان لم يلم- ابن جرير)

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪৩

فَلَوْ لَاۤ اَنَّهٗ كَانَ مِنَ الْمُسَبِّحِیْنَۙ

এখন যদি সে তাস্‌বীহকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হতো,

# এর দু’টি অর্থ হয় এবং দু’টি অর্থই এখানে প্রযোজ্য। একটি অর্থ হচ্ছে, হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম পূর্বেই আল্লাহ‌ থেকে গাফিল লোকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না বরং তিনি তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা ছিলেন আল্লাহর চিরন্তন প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণাকারী। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যখন তিনি মাছের পেটে পৌঁছলেন তখন আল্লাহরই দিকে রুজূ’ করলেন এবং তারই প্রশংসা, মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষাণা করতে থাকলেন। সূরা আল আম্বিয়ায় বলা হয়েছেঃ

فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

“তাই সে অন্ধকারের মধ্যে তিনি ডেকে উঠলেন, তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, পাক-পবিত্র তোমার সত্তা, অবশ্যই আমি অপরাধী।”

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪৪

لَلَبِثَ فِیْ بَطْنِهٖۤ اِلٰى یَوْمِ یُبْعَثُوْنَۚ

তাহলে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত এ মাছের পেটে থাকতো।

# এর অর্থ এ নয় যে, এ মাছটি কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকতো এবং হযরত ইউনুস (আ) কিয়ামত পর্যন্ত তার পেটে বেঁচে থাকতেন। বরং এর অর্থ হচ্ছে, কিয়ামত পর্যন্ত এ মাছের পেটই তাঁর কবরে পরিণত হতো। প্রখ্যাত মুফাসসিরগণ এ আয়াতটির এ অর্থই বর্ণনা করছেন।

#সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪৫

فَنَبَذْنٰهُ بِالْعَرَآءِ وَ هُوَ سَقِیْمٌۚ

শেষ পর্যন্ত আমি তাঁকে বড়ই রুগ্ন অবস্থায় একটি তৃণলতাহীণ বিরান প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম।

 

# হযরত ইউনুস (আ) যখন তাঁর অপরাধ স্বীকার করে নিলেন এবং একজন মু’মিন ও ধৈর্যশীল বান্দার ন্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা গাইতে লাগলেন তখন আল্লাহর হুকুমে মাছ তাঁকে উপকূলে উদগীরণ করলো। উপকূলে ছিল একটি বিরাণ প্রান্তর। সেখানে সবুজের কোন চিহ্ন ছিল না এবং এমন কোন জিনিসও ছিল না যা হযরত ইউনুসকে ছায়াদান করতে পারে। সেখানে খাদ্যেরও কোন সংস্থান ছিল না।

এখানে এসে অনেক বুদ্ধি ও যুক্তিবাদের দাবীদারকে একথা বলতে শুনা গেছে যে, মাছের পেটে ঢুকে যাবার পর কোন মানুষের জীবিত বের হয়ে আসা অসম্ভব। কিন্তু বিগত শতকের শেষের দিকে এ তথাকথিত বুদ্ধিবাদ ও যুক্তিবাদিতার কেন্দ্র ভূমির (ইংল্যাণ্ড) উপকূলের সন্নিকটে একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাটি তাদের দাবী খণ্ডন করে। “১৮৯১ সালের আগষ্ট মাসে Star of the East নামক জাহাজে চড়ে কয়েকজন মৎস্য শিকারী তিমি শিকারের উদেশ্যে গভীর সমুদ্রে যায়। সেখানে তারা ২০ ফুট লম্বা, ৫ ফুট চওড়া ও ১০০ টন ওজনের একটি বিশাল মাছকে আহত করে। কিন্তু তার সাথে লড়াই করার সময় জেমস বার্ডলে নামক একজন মৎস্য শিকারীকে তার সাথীদের চোখের সামনেই মাছটি গিলে ফেলে। একদিন পরে জাহাজের লোকেরা মাছটিকে মৃত অবস্থায় পায়। বহু কষ্টে সেটিকে তারা জাহাজে ওঠায় এবং তারপর দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তার পেট কাটলে জেমস তার মধ্য থেকে জীবিত বের হয়ে আসে। এ ব্যক্তি মাছের পেটে পুরা ৬০ ঘণ্টা থাকে।” (উর্দূ ডাইজেষ্ট, ফেব্রুয়ারী ১৯৬৪) চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে, সাধারণ অবস্থায় প্রাকৃতিকভাবে যদি এমনটি হওয়া সম্ভবপর হয়ে থাকে, তাহলে অস্বাভাবিক অবস্থায় আল্লাহর মু’জিযা হিসেবে এমনটি হওয়া কেমন করে অসম্ভব হতে পারে? ( বর্তমানে উইকিপিডিয়াতে ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করা আছে : James Bartley (1870–1909) is the central figure in a late nineteenth-century story according to which he was swallowed whole by a sperm whale. He was found still living days later in the stomach of the whale, which was dead from constipation. The story originated of an anonymous firm, began to appear in American newspapers. The anonymous article appeared in the St. Louis Globe Democrat of Saint Louis, Missouri, then the note appeared in other newspapers with the title “A Modern Jonah” or something similar in multiple newspapers. The news spread beyond the ocean in articles as “Man in a Whale’s Stomach. “Rescue of a Modern Jonah” in page 8 of the August 22, 2017 issue of the Yarmouth Mercury newspaper of Great Yarmouth on England.- এ্যাপ নির্মাতা, মো: নুর হোসেন, আরবী ও বাংলা সার্চ ( উইকিপিডিয়া লিংক )

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪৬

وَ اَنْۢبَتْنَا عَلَیْهِ شَجَرَةً مِّنْ یَّقْطِیْنٍۚ

এবং তার ওপর একটি লতানো গাছ উৎপন্ন করলাম।

# মূলে বলা হয়েছে شَجَرَةً مِنْ يَقْطِينٍ ইয়াকতীন আরবী ভাষায় এমন ধরনের গাছকে বলা হয় যা কোন গুঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না বরং লতার মতো ছড়িয়ে যেতে থাকে। যেমন লাউ, তরমুজ, শশা ইত্যাদি। মোটকথা সেখানে অলৌকিকভাবে এমন একটি লতানো গাছ উৎপন্ন করা হয়েছিল যার পাতাগুলো হযরত ইউনুসকে ছায়া দিচ্ছিল এবং ফলগুলো একই সঙ্গে তাঁর জন্য খাদ্য সরবরাহ করছিল এবং পানিরও যোগান দিচ্ছিল।

# সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪৭

وَ اَرْسَلْنٰهُ اِلٰى مِائَةِ اَلْفٍ اَوْ یَزِیْدُوْنَۚ

এরপর আমি তাঁকে এক লাখ বা এর চেয়ে বেশী লোকদের কাছে পাঠালাম।

# “এক লাখ বা এর বেশী” বলার মানে এ নয় যে, এর সঠিক সংখ্যার ব্যাপারে আল্লাহর সন্দেহ ছিল। বরং এর অর্থ হচ্ছে, যদি কেউ তাদের জনবসতি দেখতো তাহলে সে এ ধারণাই করতো যে, এ শহরের জনসংখ্যা এক লাখের বেশীই হবে কম হবে না। সম্ভবত হযরত ইউনুস যে শহরটি ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন এটি সেই শহরই হবে। তাঁর চলে যাবার পর সে শহরের লোকেরা আযাব আসতে দেখে যে ঈমান এনেছিল তার অবস্থা ছিল এমন তাওবার মতো যা কবুল করে নিয়ে তাদের ওপর থেকে আযাব হটিয়ে দেয়া হয়েছিল। এখন হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামকে পুনর্বার তাদের কাছে পাঠানো হলো, যাতে তারা নবীর প্রতি ঈমান এনে যথারীতি মুসলমান হয়ে যায়। এ বিষয়টি বুঝার জন্য সূরা ইউনুসের ৯৮ আয়াতটি সামনে থাকা দরকার।

#সুরা: আস-সাফ্ফাত
আয়াত নং :-১৪৮

فَاٰمَنُوْا فَمَتَّعْنٰهُمْ اِلٰى حِیْنٍؕ

তারা ঈমান আনলো এবং আমি একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত তাদেরকে টিকিয়ে রাখলাম।

# হযরত ইউনুসের (আ) এ ঘটনা সম্পর্কে আমি সূরা ইউনুস ও সূরা আম্বিয়ার ব্যাখ্যায় যা কিছু লিখেছি সে সম্পর্কে কেউ কেউ আপত্তি উঠিয়েছেন। তাই সঙ্গতভাবেই এখানে অন্যান্য মুফাসসিরগণের উক্তিও উদ্ধৃত করছিঃ

বিখ্যাত মুফাসসির কাতাদা সূরা ইউনুসের ৯৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ “এমন কোন জনপদ দেখা যায়নি যার অধিবাসীরা কুফরী করেছে এবং আযাব এসে যাবার পরে ঈমান এনেছে আর তারপর তাদেরকে রেহাই দেয়া হয়েছে। একমাত্র ইউনুসের সম্প্রদায় এর ব্যতিক্রম।। তারা যখন তাদের নবীর সন্ধান করে তাঁকে না পেয়ে অনুভব করলো আযাব নিকটে এসে গেছে তখন আল্লাহ‌ তাদের মনে তাওবার প্রেরণা সৃষ্টি করলেন।” (ইবনে কাসীর, ২ খণ্ড, ৪৩৩ পৃষ্ঠা)

একই আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখছেন, এ জাতির কাহিনী হচ্ছেঃ “হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মসুল এলাকায় নিনেভাবাসীদের কাছে আগমন করেছিলেন। তারা ছিল কাফের ও মুশরিক। হযরত ইউনুস তাদেরকে এক ও লা-শরীক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার ও মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করার আহবান জানান। তারা তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে। হযরত ইউনুস তাদেরকে জানিয়ে দেন, তৃতীয় দিন আযাব আসবে এবং তৃতীয় দিন আসার আগেই অর্ধ রাতে তিনি জনপদ থেকে বের হয়ে পড়েন। তারপর দিনের বেলা যখন এ জাতির মাথার ওপর আযাব পৌঁছে যায় …………………. এবং তাদের বিশ্বাস জন্মে যে, তারা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তারা নিজেদের নবীকে খুঁজতে থাকে কিন্তু তাঁকে খুঁজে পায় না। শেষ পর্যন্ত তারা সবাই নিজেদের ছেলে-মেয়ে, পরিবার-পরিজন ও গবাদি পশু নিয়ে খোলা প্রান্তরে বের হয়ে আসে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে ও তাওবা করে। ………………………….. আল্লাহ‌ তাদের প্রতি করুণা করেন এবং তাদের দোয়া কবুল করেন।” (রূহুল মা’আনী, ১১ খণ্ড, ১৭০ পৃষ্ঠা)

সূরা আম্বিয়ার ৮৭ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা আলূসী লিখেছেনঃ “হযরত ইউনুসের নিজের জাতির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে বের হয়ে যাওয়া ছিল হিজরাতের কাজ। কিন্তু তাঁকে এর হুকুম দেয়া হয়নি।” (রুহুল মা’আনী, ১৭ খণ্ড, ৭৭ পৃষ্ঠা) তারপর তিনি হযরত ইউনুসের দোয়ার বাক্যাংশ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ এর অর্থ বর্ণনা করেছেন এভাবেঃ “অর্থাৎ আমি অপরাধী ছিলাম। নবীদের নিয়মের বাইরে গিয়ে হুকুম আসার আগেই হিজরাত করার ব্যাপারে আমি তাড়াহুড়া করেছিলাম। হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের পক্ষ থেকে এটি ছিল তাঁর নিজের গোনাহের স্বীকৃতি এবং তাওবার প্রকাশ, যাতে আল্লাহ‌ তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন।” (রূহুল মা’আনী ১৭ খণ্ড, ৭৮ পৃষ্ঠা)

এ আয়াতটির টীকায় মওলানা আশরাফ আলী থানবী লিখেছেনঃ “তাঁর নিজের জাতি তাঁর প্রতি ঈমান না আনায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে চলে যান এবং জাতির ওপর থেকে আযাব হটে যাবার পরও নিজে তাদের কাছে ফিরে আসেননি। আর এ সফরের জন্য আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষাও করেননি।” (বায়ানুল কুরআন)

এ আয়াতের টীকার মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেনঃ “জাতির কার্যকলাপে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধচিত্তে শহর থেকে বের হয়ে যান। আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করেননি এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান যে, তিনি দিনের মধ্যে তোমাদের ওপর আযাব নেমে আসবে। إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ……………. বলে নিজের অপরাধ স্বীকার করেন এ মর্মে যে, অবশ্যই আমি তাড়াহুড়া করেছি, তোমার হুকুমের অপেক্ষা না করেই জনপদের অধিবাসীদের ত্যাগ করে বের হয়ে পড়ি।”

সূরা সা-ফফা‌-তের ওপরে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাযী লিখেছেনঃ হযরত ইউনুসের অপরাধ ছিল, তাঁর যে জাতি তাঁর প্রতি মিথ্যা আরোপ করেছিল আল্লাহ‌ তাকে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এ আযাব নির্ঘাত এসে যাবে। তাই তিনি সবর করেননি। জাতিকে দাওয়াত দেবার কাজ বাদ দিয়ে বাইরে বের হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ দাওয়াতের কাজ সবসময় জারী রাখাই ছিল তাঁর দায়িত্ব। কারণ আল্লাহ‌ তাদেরকে ধ্বংস না করার সম্ভাবনা তখনো ছিল।” (তাফসীরে কবীর, ৭ খণ্ড, ১৬৮ পৃষ্ঠা)

আল্লামা আলুসী إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ সম্পর্কে লিখেছেনঃ “আবাকা এর আসল মানে হচ্ছে, প্রভুর কাছ থেকে দাসের পালিয়ে যাওয়া। যেহেতু হযরত ইউনুস তাঁর রবের অনুমতি ছাড়াই নিজের জাতির কাছ থেকে পলায়ন করেছিলেন তাই তাঁর জন্য এ শব্দটির ব্যবহার সঠিক হয়েছে। “তারপর সামনের দিকে তিনি আরো লিখেছেনঃ “তৃতীয় দিনে হযরত ইউনুস আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই বের হয়ে গেলেন। এখন তাঁর জাতি তাঁকে না পেয়ে তাদের বড়দের ছোটদের ও গবাদি পশুগুলো নিয়ে বের হয়ে পড়লো। আযাব অবতীর্ণ হবার বিষয়টি তাদের কাছে এসে পৌঁছেছিল। তারা আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করলো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলো। আল্লাহ‌ তাদেরকে মাফ করে দিলেন।” (রূহুল মা’আনী, ২৩ খণ্ড, ১০৩ পৃষ্ঠা)

মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী وَهُوَ مُلِيمٌ এ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ “অভিযোগ এটিই ছিল যে, ইজতিহাদী ভুলের দরুন আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে জনপদ থেকে বের হয়ে পড়েন এবং আযাবের দিন নির্ধারণ করে দেন্‌”

আবার সূরা আল কলম—-এর فَاصْبِرْ لِحُكْمِ رَبِّكَ وَلَا تَكُنْ كَصَاحِبِ الْحُوتِ আয়াতের টীকার মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী লিখেছেনঃ “অর্থাৎ মাছের পেটে প্রবেশকারী পয়গম্বরের (হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম) মতো মিথ্যা আরোপকারীদের ব্যাপারে সংকীর্ণমনতা ও ভাতি-আশংকার প্রকাশ ঘটাবে না।” তারপর একই আয়াতের وَهُوَ مَكْظُومٌ বাক্যাংশের টীকায় তিনি লিখেছেনঃ “অর্থাৎ জাতির বিরুদ্ধে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে দ্রুত আযাবের জন্য দোয়া এবং ভবিষ্যদ্বাণী করে বসলেন।”

মুফাসসিরগণের এসব বর্ণনা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তিনটি ভুলের কারণে হযরত ইউনুসের (আ) ওপর অসন্তোষ ও ক্রোধ নেমে আসে। এক, তিনি নিজেই আযাবের দিন নির্দিষ্ট করে দেন। অথচ আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন ঘোষণা হয়নি। দুই, সেদিন আসার আগেই হিজরাত করে দেশ থেকে বের হয়ে যান। অথচ আল্লাহর হুকুম না আসা পর্যন্ত নবীর নিজ স্থান ত্যাগ করা উচিত নয়। তিন, সে জাতির ওপর থেকে আযাব হটে যাওয়ার পর তিনি নিজে তাদের মধ্যে ফিরে যাননি।

# তিনি নিজের সম্প্রদায়ের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে চলে যান। আল্লাহর পক্ষ থেকে তখনো হিজরত করার হুকুম আসেনি, যার ফলে তাঁর পক্ষ থেকে নিজের কর্তব্য ত্যাগ করা জায়েয হতে পারতো।

# তিনি মনে করেছিলেন, আমার সম্প্রদায়ের ওপর আল্লাহর আযাব এসে যাচ্ছে। এখন আমাকে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেয়া উচিত। না হলে আমি নিজেও আযাবের মধ্যে ঘেরাও হয়ে যাবো। নীতিগতভাবে এ বিষয়টি তো পাকড়াওযোগ্য ছিল না। কিন্তু নবীর পক্ষে আল্লাহর হুকুম ছাড়া দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়া ছিল পাকড়াওযোগ্য।

# মাছের পেটের মধ্য থেকে সেখানে তো অন্ধকার ছিলই, তার ওপর ছিল সাগরের অন্ধকার।

 

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

৮৭-৮৮ নং আয়াতের তাফসীর:

এই ঘটনাটি এখানেও বর্ণিত হয়েছে এবং সূরায়ে ‘সাফাত ও সূরায়ে ‘নূন’-এও বর্ণিত হয়েছে। ইনি হলেন নবী হযরত ইউনুস ইবনু মাত্তা (আঃ)। তাকে আল্লাহ তাআলা মূসিল অঞ্চলের নীনওয়া নামক গ্রামে নবীরূপে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি ঐ গ্রামবাসীদেরকে আল্লার পথে আহবান করেন; কিন্তু তারা ঈমান আনলো না। তখন তিনি তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে সেখান থেকে চলে যান এবং তাদেরকে বলে যান যে, তাদের উপর তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর শাস্তি এসে পড়বে। তার কথায় তাদের বিশ্বাস হয়ে যায় এবং তারা জেনে নেয় যে, নবীর (আঃ) কথা মিথ্যা হয় না। তাই, তারা তাদের শিশুদেরকে ও গৃহপালিত পশুগুলিকে নিয়ে ময়দানের দিকে বেরিয়ে পড়লো। শিশুদেরকে তারা মাতাদের থেকে পৃথক করে দিলো। অতঃপর তারা কাদতে কাঁদতে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করতে লাগলো। একদিকে তাদের কান্নার রোল, আর অপরদিকে জীব জন্তুগুলোর ভয়ানক চীৎকার। এর ফলে আল্লাহর রহমত উথলিয়ে ওঠে। সুতরাং তিনি তাদের উপর হতে শাস্তি উঠিয়ে নেন। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তবে ইউনুসের (আঃ) সম্প্রদায় ব্যতীত কোন জনপদবাসী কেন এমন হলো না যারা ঈমান আনতো এবং তাদের ঈমান তাদের উপকারে আসতো? যখন তারা ঈমান আনলো তখন আমি তাদেরকে পার্থিব জীবনে হীনতাজনক শাস্তি হতে মুক্ত করলাম এবং কিছু কালের জন্যে জীবনোপভোগ করতে দিলাম।” (১০:৯৮)

হযরত ইউনুস (আঃ) এখান হতে চলে গিয়ে একটি নৌকায় আরোহণ করেন। নৌকা কিছুদূর এগিয়ে গেলে তুফানের লক্ষণ প্রকাশ পায়। শেষ পর্যন্ত নৌকাটি ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। নৌকার আরোহীদের মধ্যে পরামর্শক্রমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, নৌকার ভার হাল্কা করার জন্যে কোন একজন লোককে সমদ্রে নিক্ষেপ করা হোক। সুতরাং নির্বাচনের গুটিকা নিক্ষেপ করা হলে দেখা গেল যে, হযরত ইউনুসেরই (আঃ) নাম বের হয়েছে। কিন্তু কেউই তাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা পছন্দ করলো না। দ্বিতীয়বার গুটিকা নিক্ষেপ করা হলো। এবারও তার নামই উঠলো। তৃতীয়বার পুনরায় গুটিকা ফেলা হলে এবারও তাঁর নামই দেখা দিল। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সে লটারীতে যোগদান করলো এবং পরাভূত হলো।” (৩৭:১৪১) তখন হযরত ইউনুস (আঃ) নিজেই দাড়িয়ে গেলেন এবং কাপড় খুলে ফেলে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়লেন। তখন হযরত ইবনু মাসউদের (রাঃ) উক্তি অনুসারে আল্লাহ তাআলা ‘বাহরে আখ্যার’ (সবুজ সাগর) হতে একটি বিরাট মাছ পাঠিয়ে দিলেন। মাছটি পানি ফেড়ে ফেড়ে আসলো এবং হযরত ইউনুসকে (আঃ) গিলে ফেললো। কিন্তু মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে মাছটি তার মাংসও খেলো না, অস্থিও ভেঙ্গে ফেললো না। এবং কোন ক্ষতিও করলো না। মাছটির তিনি খাদ্য ছিলেন না, বরং ওর পেট ছিল তার জন্যে কয়েদখানা স্বরূপ। আরবী ভাষায় মাছকে নূন বলা হয়। হযরত ইউনুসের (আঃ) ক্রোধ ছিল তাঁর কওমের উপর। তার ধারণা ছিল যে, আল্লাহ তাআলা তার প্রতি সংকীর্ণতা আনয়ন করবেন না। এখানে হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ), হযরত যহাক (রঃ) প্রভৃতি গুরুজন (আরবী) এর অর্থ এটাই করেছেন। ইমাম ইবনু জারীরও (রাঃ) এটাকেই পছন্দ করেছেন। দলীল হিসেবে আল্লাহ তাআলার নিম্নেন উক্তিটি পেশ করা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ যার জীবনোপকরণ সংকীর্ণ বা সীমিত সে আল্লাহ যা দান করেছেন তা হতে ব্যয় করবে; আল্লাহ যাকে যে সামর্থ দিয়েছেন তদপেক্ষা গুরুতর বোঝা তিনি তার উপর চাপান না; আল্লাহ কষ্টের পর দিবেন স্বস্তি।” (৬৫:৭) হযরত আতিয়্যাহ আওফী এটার অর্থ করেছেনঃ “আমি তার উপর নির্ধারণ করবো না। আরববাসীরা (আরবী) ও (আরবী) এর একই অর্থ করে থাকে। কোন কবি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “ঐ যুগ আর প্রত্যাবর্তনকারী নয় যা অতীত হয়েছে। আপনি কল্যাণময়, আপনি যা নির্ধারণ করেন সেই কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে।” আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অতঃপর সব পানি মিলিত হলো এক পরিকল্পনা অনুসারে।” (৫৪:১২)

ঐ অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করে হযরত ইউনুস (আঃ) মহান আল্লাহকে ডাকতে শুরু করেন। সেখানে সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকার, মাছের পেটের অন্ধকার এবং রাত্রির অন্ধকার এই তিন অন্ধকার একত্রিত হয়েছিল। তিনি সমুদ্রের তলদেশের কংকর গুলির তাসবীহ পাঠ শুনে নিজেও তাসবীহ পাঠ করতে শুরু করেন। তিনি মাছের পেটে গিয়ে প্রথমতঃ মনে করে ছিলেন যে, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তারপর তিনি পা নাড়িয়ে দেখেন এবং তা নড়ে ওঠে। সুতরাং মাছের পেটের মধ্যেই তিনি সিজদায় পড়ে যান এবং বলেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমি এমন এক জায়গাকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছি। যে, সতঃ কেউই এই জায়গাকে ইতিপূর্বে সিজদার জায়গা বানায় নাই।

হযরত হাসান বসরী (রাঃ) বলেন যে, হযরত ইউনুস (আঃ) চল্লিশ দিন মাছের পেটে ছিলেন। তাফসীরে ইবনু জারীরে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা যখন হযরত ইউনুসকে (আঃ) বন্দী করার ইচ্ছা করেন তখন তিনি মাছকে নির্দেশ দেনঃ “তুমি তাকে গিলে নাও, কিন্তু তার মাংস ভক্ষণ করো না এবং অস্থিও ভেঙ্গে ফেলো না।” যখন তিনি সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছেন তখন সেখানে তাসবীহ পাঠ শুনে তিনি হতবাক হয়ে যান। ওয়াহীর মাধ্যমে তাকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, এটা হলো সমুদ্রের জন্তু গুলির তাসবীহ পাঠ। তখন তিনিও আল্লাহর তাসবীহ পাঠ শুরু করে দেন। তার তাসবীহ পাঠ শুনে ফেরেশতারা বলেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! এটা খুবই দুরের শব্দ এবং খুবই দুর্বল অওয়ায, কার আওয়ায এটা? আমরা তে বুঝতে পারলাম না। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে উত্তরে বললেনঃ “এটা আমার বান্দা ইউনুসের (আঃ) শব্দ। সে আমার নাফরমানী করেছে বলে আমি তাকে মাছের পেটে বন্দী করেছি।”

ফেরেশতারা তখন বললেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! তার নেক আমলগুলি তো দিনরাত্রির সব সময় আকাশে উঠতেই থাকতো ।?” উত্তরে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “হা।” তখন তারা তার জন্যে সুপারিশ করেন। আল্লাহ তাদের সুপারিশ ককূল করেন। তিনি মাছকে নিদের্শ দেন যে, সে যেন তাঁকে সমুদ্রের তীরে উগলিয়ে দেয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “অতঃপর আমি তাকে নিক্ষেপ করলাম এক তৃণহীন প্রান্তরে এবং সে ছিল রুগ্ন।” (৩৭:১৪৫) উপরে বর্ণিত রিওয়াইয়াতটির ঐ একটি মাত্র সনদ।

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন- (আরবী) এই কালেমাটির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করেন তখন এই কালেমাটি আরূশের চারদিকে ঘুরতে থাকে। তখন ফেরেশতারা বলেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! এটা তো খুবই দূরের শব্দ। কিন্তু কান এ শব্দের সাথে পরিচিত। এটা অত্যন্ত দুর্বল ও ক্ষীণ শব্দ!” আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এটা কার শব্দ তা কি তোমরা জান না?” উত্তরে তারা বলেনঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! না তো! কে তিনি?” আল্লাহ তাআলা তখন বলেনঃ “এটা হলো আমার বান্দা ইউনুসের (আঃ) শব্দ। ফেরেশতারা তখন বলেনঃ “তা হলে তিনি তো সেই ইউনস (আঃ} যার ককূলকৃত পবিত্র আমল প্রত্যেক দিন আপনার নিকট উঠে আসতো এবং যার প্রার্থনা আপনি ককূল করতেন! হে আমাদের প্রতিপালক! তিনি যখন সুখের সময় ভাল আমল করতেন তখন এই বিপদের সময় আপনি তার প্রতি দয়া করুন!” তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাআলা মাছকে হুকুম করলেন যে, সে যেন কোন কষ্ট না দিয়েই তাকে সমুদ্রের তীরে নিক্ষেপ করে। (এ হাদীসটি ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তখন আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করলাম দুশ্চিন্তা হতে। আর এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। সে বিপদে পরিবেষ্টিত হয়ে যখন আমাকে আহবান করলো, আমি তখন তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং ঐ বিপদ থেকে তাকে মুক্তি দান করলাম।

বিশেষ করে যারা বিপদ আপদের সময় এই দুআয়ে ইউনুস (আঃ) পাঠ করে তাদেরকে আল্লাহ তাআলা ঐ সব বিপদ আপদ থেকে উদ্ধার করে থাকেন। এ ব্যাপারে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদের (সঃ) পক্ষ হতে খুবই উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

হযরত সা’দ ইবনু আবি অক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি মসজিদে হযরত উছমান ইবনু আফানের (রাঃ) নিকট গমন করি। আমি তাকে সালাম করি। তিনি আমাকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন, কিন্তু আমার সালামের জবাব দিলেন না। আমি তখন আমীরুল মু’মিনীন হযরত উমার ইবনু খাত্তাবের (রাঃ) নিকট গিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করি। তিনি হযরত উছমানকে ডেকে পাঠান এবং তাঁকে বলেনঃ “আপনি আপনার এই মুসলমান ভাই-এর সালামের জবাব দেন নাই কেন?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি এরূপ করি নাই (অর্থাৎ তিনি আমার কাছে আসেন নাই এবং সালামও দেন নাই।” আমি। বললামঃ হাঁ (অর্থাৎ আমি এসেছি ও সালাম দিয়েছি)। শেষ পর্যন্ত তিনি শপথ করলেন এবং আমিও শপথ করলাম। তারপর কি মনে করে তিনি বললেনঃ “আমি আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তার কাছে তাওবা করছি। অবশ্যই ইতিপূর্বে আমার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু ঐ সময় আমি মনে মনে ঐকথা বলছিলাম যা আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে শুনেছিলাম। আল্লাহর শপথ! যখন আমার ঐ কথা মনে হয়ে যায় তখন শুধু আমার চোখের উপরই পর্দা পড়ে না, বরং আমার অন্তরের উপরও পর্দা পড়ে যায়। আমি তখন বললামঃ আমি আপনাকে ঐ খবর দিচ্ছি। একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের সামনে প্রথম দুআ’র বর্ণনা দিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় এক বেদুঈন এসে পড়ে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) কথার মোড় নিজের দিকে ফিরিয়ে নেন। এভাবে অনেক্ষণ কেটে যায়। তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেখান থেকে উঠে পড়েন এবং নিজের বাড়ীর দিকে চলতে শুরু করেন। আমিও তার পিছনে পিছনে চলতে থাকি। যখন তিনি বাড়ীর কাছাকাছি হয়ে যান তখন আমি আশংকা করি যে, তিনি হয়তো বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ করবেন, আর আমি এখানেই রয়ে যাবো। সুতরাং আমি জোরে জোরে পা ফেলে চলতে লাগলাম। আমার জুতার শব্দ শুনে তিনি আমার দিকে ফিরে তাকান এবং বলেনঃ “আরে, তুমি আবু ইসহাক?” আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাঁ, আমিই বটে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “খবর কি?” আমি জবাব দিলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আপনি প্রথম দুআ’র বর্ণনা দিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ঐ বেদুঈন এসে পড়েছিল এবং আপনার কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তিনি আমার একথা শুনে বললেনঃ “হাঁ, হাঁ।” ওটা ছিল যুন নূনের (আঃ) দুআ যা তিনি মাছের পেটের মধ্যে থাকা অবস্থায় করেছিলেন। অর্থাৎ (আরবী) এই দুআ’টি। জেনে রেখো যে, যে কোন মুসলমান যে কোন ব্যাপারে যখনই তার প্রতিপালকের কাছে এই দুআ’টি করবে, তিনি তা ককূল করবেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)

হযরত সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে কেউই হযরত ইউনুসের (আঃ) এই দুআ’র মাধ্যমে দুআ করবে, আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তার দুআ কবূল করবেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে ইবনু আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে) হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন যে, এই আয়াতেই এরপরেই রয়েছেঃ “এভাবেই আমি মু’মিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি।”

হযরত সা’দ ইবনু আবি অক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলতে শুনেছেনঃ “আল্লাহ তাআলার ঐ নামটি যার মাধ্যমে তাঁকে ডাকলে তিনি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে থাকেন এবং কিছু চাইলে প্রদান করে থাকেন তা হলো হযরত ইউনুস ইবনু মাত্তার (আঃ) দুআটি।” হযরত সাদ (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা কি হযরত ইউনুসের (আঃ) জন্যে বিশিষ্ট ছিল, না সমস্ত মুসলমানের জন্যেই সাধারণ?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “তুমি কি কুরআন কারীমে পড় নাই যে, তাতে রয়েছেঃ “আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম ও তাকে দুশ্চিন্তা হতে উদ্ধার করে ছিলাম এবং এভাবেই আম মু’মিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি।” সুতরাং যে কেউই এই দুআ করবে আল্লাহ তা কবূল করার ওয়াদা করেছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত কাসীর ইবনু মা’বাদ (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি। হযরত হাসান বসরীকে (রঃ) জিজ্ঞেস করলামঃ হে আবু সাঈদ (রঃ)! আল্লাহ তাআলার যে ইসমে আযমের মাধ্যমে তার কাছে দুআ করলে তিনি তা ককূল করে থাকেন এবং কিছু চাইলে তা প্রদান করে থাকেন ওটা কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “হে আমার ভ্রাতুস্পুত্র! তুমি কি কুরআন কারীমের মধ্যে উল্লিখিত আল্লাহ তাআলার এই ফরমনি পাঠ কর নাই?” অতঃপর তিনি (আরবী) পর্যন্ত পাঠ করেন। তারপর বলেনঃ “হে আমার ভাতিজা! এটাই হলো আল্লাহ তাআলার ঐ ইসমে আযম যে, যখন এর মাধ্যমে তাঁর নিকট দুআ করা হয়। তখন তিনি তা কবুল করে থাকেন এবং যা চাওয়া হয় তা তিনি দিয়ে থাকেন।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#934)
[ اَنْ لَّاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنْتَ سُبْحٰنَكَ١ۖۗ اِنِّیْ كُنْتُ مِنَ الظّٰلِمِیْنَۚۖ
“There is no deity except You; exalted are You. Indeed, I have been of the wrongdoers.”]
Sura:21
Sura: Al-Anbiyaa
Ayat: 87-
www.motaher21.net

21:87

وَ ذَاالنُّوۡنِ اِذۡ ذَّہَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ اَنۡ لَّنۡ نَّقۡدِرَ عَلَیۡہِ فَنَادٰی فِی الظُّلُمٰتِ اَنۡ لَّاۤ اِلٰہَ اِلَّاۤ اَنۡتَ سُبۡحٰنَکَ ٭ۖ اِنِّیۡ کُنۡتُ مِنَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿ۚۖ۸۷﴾

And [mention] the man of the fish, when he went off in anger and thought that We would not decree [anything] upon him. And he called out within the darknesses, “There is no deity except You; exalted are You. Indeed, I have been of the wrongdoers.”

 

Yunus

This story is mentioned here, and in Surah As-Saffat and Surah Nun.

Yunus bin Matta, upon him be peace, was sent by Allah to the people of Nineveh, which was a town in the area of Mawsil (in northern Iraq). He called them to Allah, but they rejected him and persisted in their disbelief. So he left them in anger, threatening them with punishment after three (days).

When they realized that he was telling the truth and that a Prophet never lies, they went out to the desert with their children and cattle and flocks. They separated the mothers from their children, then they beseeched Allah and pleaded to Him, with the camels and their young groaning, the cows and their calves mooing, and the sheep and their lambs bleating, so Allah spared them from the punishment.

Allah says:

فَلَوْلَا كَانَتْ قَرْيَةٌ ءَامَنَتْ فَنَفَعَهَأ إِيمَانُهَا إِلاَّ قَوْمَ يُونُسَ لَمَّأ ءَامَنُواْ كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الخِزْىِ فِى الْحَيَوةَ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَى حِينٍ

Was there any town that believed (after seeing the punishment), and its faith saved it Except the people of Yunus;

when they believed, We removed from them the torment of disgrace in the life of the world, and permitted them to enjoy for a while. (10:98)

Yunus, meanwhile, went and traveled with some people on a ship, which was tossed about on the sea. The people were afraid that they would drown, so they cast lots to choose a man whom they would throw overboard.

The lot fell to Yunus, but they refused to throw him overboard. This happened a second and a third time.

Allah says:

فَسَـهَمَ فَكَانَ مِنَ الْمُدْحَضِينَ

Then he (agreed to) cast lots, and he was among the losers. (37:141)

meaning, the draw went against him, so Yunus stood up, removed his garment and cast himself into the sea.

Then Allah sent from the Green Sea — according to what Ibn Mas`ud said — a large fish which cleaved the oceans until it came and swallowed Yunus when he threw himself into the sea.

Allah inspired that large fish not to devour his flesh or break his bones, (as if He said) Yunus is not food for you, rather your belly is a prison for him.

وَذَا النُّونِ

إِذ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا

And (remember) Dhun-Nun,

Here Nun refers to the fish; it is correct for it to be attributed to him here.

when he went off in anger,

Ad-Dahhak said:

“Anger towards his people.”

فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ

and imagined that We shall not punish him!

meaning, constrict him in the belly of the fish.

Something similar to this was reported from Ibn Abbas, Mujahid, Ad-Dahhak and others.

This was the view favored by Ibn Jarir, and he quoted as evidence for that the Ayah:

وَمَن قُدِرَ عَلَيْهِ رِزْقُهُ فَلْيُنفِقْ مِمَّأ ءَاتَاهُ اللَّهُ لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلاَّ مَأ ءَاتَاهَا سَيَجْعَلُ اللَّهُ بَعْدَ عُسْرٍ يُسْراً

and the man whose resources are restricted, let him spend according to what Allah has given him. Allah puts no burden on any person beyond what He has given him. Allah will grant after hardship, ease. (65:7)

فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَن لاَّ إِلَهَ إِلاَّ أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

But he cried through the depths of darkness (saying):”There is no God but You, Glorified be You! Truly, I have been of the wrongdoers.”

Ibn Mas`ud said regarding the `depths of darkness’:

“The darkness of the belly of the fish, the darkness of the sea and the darkness of the night.”

This was also narrated from Ibn Abbas, `Amr bin Maymun, Sa`id bin Jubayr, Muhammad bin Ka`b, Ad-Dahhak, Al-Hasan and Qatadah.

Salim bin Abu Al-Ja`d said:

“The darkness of the fish in the belly of another fish in the darkness of the sea.”

Ibn Mas`ud, Ibn Abbas and others said:

“This was because the fish took him through the sea, cleaving it until it reached the bottom of the sea. Yunus heard the rocks at the bottom of the sea uttering glorification of Allah, at which point he said:

لااَّ إِلَـهَ إِلااَّ أَنتَ سُبْحَـنَكَ إِنِّى كُنتُ مِنَ الظَّـلِمِينَ

There is no God but You, Glorified be You! Truly, I have been of the wrongdoers.

`Awf Al-A`rabi said:

“When Yunus found himself in the belly of the fish, he thought that he had died. Then he moved his legs. When he moved his legs, he prostrated where he was, then he called out:`O Lord, I have taken a place of worship to You in a place which no other person has reached.”‘

21:88

فَاسۡتَجَبۡنَا لَہٗ ۙ وَ نَجَّیۡنٰہُ مِنَ الۡغَمِّ ؕ وَ کَذٰلِکَ نُــۨۡجِی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۸۸﴾

So We responded to him and saved him from the distress. And thus do We save the believers.

 

فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ

So `We answered his call, and delivered him from the distress.

means, `We brought him forth from the belly of the fish and from that darkness.’


وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُوْمِنِينَ

And thus We do deliver the believers.

means, when they are in difficulty and they call upon Us and repent to Us, especially if they call upon Us with these words at the time of distress.

The leader of the Prophets encouraged us to call upon Allah with these words.

Imam Ahmad recorded that Sa`d bin Abi Waqqas, may Allah be pleased with him, said:

“I passed by Uthman bin Affan, may Allah be pleased with him, in the Masjid, and greeted him. He stared at me but did not return my Salam.

I went to Umar bin Al-Khattab and said:`O Commander of the faithful, has something happened in Islam!’ I said that twice.

He said, `No, why do you ask?’

I said, `I passed by Uthman a short while ago in the Masjid and greeted him, and he stared at me but he did not return my Salam.’

Umar sent for Uthman and asked him, `Why did you not return your brother’s Salam?’

He said, `That is not true.’

Sa`d said, `Yes it is.’

It reached the point where they both swore oaths. Then Uthman remembered and said, `Yes, you are right, I seek the forgiveness of Allah and I repent to Him. You passed by me a short while ago but I was preoccupied with thoughts of something I had heard from the Messenger of Allah, which I never think of but a veil comes down over my eyes and my heart.’

Sa`d said:`And I will tell you what it was. The Messenger of Allah told us the first part of the supplication then a Bedouin came and kept him busy, then the Messenger of Allah got up and I followed him. When I felt worried that he would enter his house, I stamped my feet. I turned to the Messenger of Allah , who said,

مَنْ هَذَا أَبُو إِسْحَاقَ

Who is this Abu Ishaq?

I said, “Yes, O Messenger of Allah.”

He said,
فَمَه
(What is the matter)?

I said, “Nothing, by Allah, except that you told us the first part of the supplication, then this Bedouin came and kept you busy.”

He said,

نَعَمْ دَعْوَةُ ذِي النُّونِ إِذْ هُوَ فِي بَطْنِ الْحُوتِ

Yes, the supplication of Dhun-Nun when he was in the belly of the fish:

لااَّ إِلَـهَ إِلااَّ أَنتَ سُبْحَـنَكَ إِنِّى كُنتُ مِنَ الظَّـلِمِينَ

There is no God but You, Glorified be You! Truly, I have been of the wrongdoers.

فَإِنَّهُ لَمْ يَدْعُ بِهَا مُسْلِمٌ رَبَّهُ فِي شَيْءٍ قَطُّ إِلاَّ اسْتَجَابَ لَه

No Muslim ever prays to his Lord with these words for anything, but He will answer his prayer.”

It was also recorded by At-Tirmidhi, and by An-Nasa’i in Al-Yawm wal-Laylah.

Ibn Abi Hatim recorded that Sa`d said that the Messenger of Allah said:

مَنْ دَعَا بِدُعَاءِ يُونُسَ اسْتُجِيبَ لَه

Whoever offers supplication in the words of the supplication of Yunus, will be answered.

Abu Sa`id said:

“He was referring to:
وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُوْمِنِينَ
(And thus We do deliver the believers).

For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran

Leave a Reply