أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৩৯)
[ أَنَّ الاَْرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ
নিশ্চয় আমার সৎকর্মশীল বান্দারা পৃথিবীর অধিকারী হবে।’]
সূরা:- আল্ আম্বিয়া।
সুরা:২১
১০৪-১০৭ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২১:১০৪
সুরা: আল-আম্বিয়া
আয়াত নং :-১০৪
یَوْمَ نَطْوِی السَّمَآءَ كَطَیِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ١ؕ كَمَا بَدَاْنَاۤ اَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِیْدُهٗ١ؕ وَعْدًا عَلَیْنَا١ؕ اِنَّا كُنَّا فٰعِلِیْنَ
সেদিন, যখন আকাশকে আমি এমনভাবে গুটিয়ে ফেলবো যেমন বাণ্ডিলের মধ্যে গুটিয়ে রাখা হয় লিখিত কাগজ, যেভাবে আমি প্রথমে সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম ঠিক তেমনিভাবে আবার তার পুনরাবৃত্তি করবো, এ একটি প্রতিশ্রুতি, যা আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং এ কাজ আমাকে অবশ্যই করতে হবে।
২১:১০৫
وَ لَقَدْ كَتَبْنَا فِی الزَّبُوْرِ مِنْۢ بَعْدِ الذِّكْرِ اَنَّ الْاَرْضَ یَرِثُهَا عِبَادِیَ الصّٰلِحُوْنَ
আর যবুরে আমি উপদেশের পর একথা লিখে দিয়েছি যে, যমীনের উত্তরাধিকারী হবে আমার নেক বান্দারা।
২১:১০৬
اِنَّ فِیْ هٰذَا لَبَلٰغًا لِّقَوْمٍ عٰبِدِیْنَؕ
এর মধ্যে একটি বড় খবর আছে ইবাদাতকারী লোকদের জন্য।
২১:১০৭
وَ مَاۤ اَرْسَلْنٰكَ اِلَّا رَحْمَةً لِّلْعٰلَمِیْنَ
হে মুহাম্মাদ! আমি যে তোমাকে পাঠিয়েছি, এটা আসলে দুনিয়াবাসীদের জন্য আমার রহমত।
১০৪- ১০৭ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
# সেই মহা দুর্যোগের দিনটিতে গােটা জগত কি রূপ ধারণ করবে এবং এর পরিণতি কি দাড়াবে, সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, ‘সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে নেব, যেমন গুটানাে হয় লিখিত কাগজ পত্র'(আয়াত ১০৪) বিচারকের রায় ঘােষণার পর মুহুরী যেমন কাগজপত্রগুলাে গুটিয়ে নেয় এভাবেই মানুষের চির পরিচিত এই বিশ্বকেও গুটিয়ে নেয়া হবে। এরপর আসবে এক নতুন বিশ্ব, এক নতুন জগত। এই দৃশ্যমান জগতের সৃষ্টি যেভাবে হয়েছিলাে, ঠিক সেভাবেই সৃষ্টি করা হবে কেয়ামত পরবর্তী নতুন জগতও! এটা আল্লাহর ওয়াদা আর ওই ওয়াদা আল্লাহ তায়ালা পূরণ করবেনই। ‘আমার ওয়াদা নিশ্চিত, আমাকে তা পূর্ণ করতেই হবে।'(আয়াত ১০৪)
*বিশ্ব নেতৃত্বের পালাবদলে আল্লাহর শাশ্বত নীতি : জীবন ও জগতের পরিসমাপ্তি ও পরকালীন জীবনের খন্ড চিত্র তুলে ধরার পর এখন ভিন্ন একটি প্রসংগ নিয়ে আলােচনা করা হচ্ছে। আর সেটা হলাে, পৃথিবীর বুকে ক্ষমতার পালা বদলে আল্লাহর বিধানের দাবী কি? এই দাবী অনুযায়ী ইহকালীন জীবনে আল্লাহর সৎ বান্দাদের অবস্থান কোথায়? এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘আমি উপদেশের পর যবুরে লিখে দিয়েছি যে, আমার সৎকর্ম পরায়ন বান্দারা অবশেষে পৃথিবীর অধিকারী হবে'(আয়াত ১০৫) এখানে যবুর বলতে হযরত দাউদ আ.)-এর প্রতি প্রেরিত আসমানী কিতাবকে বুঝানাে হয়েছে যা তাওরাতের পরে অবতীর্ণ হয়েছে। এক্ষেত্রে আয়াতে বর্ণিত যিকর শব্দ দ্বারা তৌরাতই বুঝতে হবে। অথবা যবুর বলতে যে কোনাে আসমানী কিতাবকে বুঝানাে হয়েছে। যার সম্পর্ক লৌহে মাহফুয এর সাথে। আর এই লৌহে মাহফুজই হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা বিধান, সকল ঐশী বাণী পূর্ণাংগ আধার ও উৎস। যা হােক এখানে আলােচ্য আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তায়ালাই বিধান অনুযায়ী পৃথিবীর মালিকানা ও কর্তৃত্ব অবশেষে আল্লাহর সৎ ও আদর্শবান বান্দাদের হাতেই ফিরে আসে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মালিকানা বলতে কি বুঝায় এবং সৎ বান্দা বলতে কাদেরকে বুঝানাে হয়েছে? আমরা জানি, আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম(আ.)-কে প্রতিনিধিরূপে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এই পৃথিবীকে আবাদ করার জন্যে, সংস্কার করার জন্যে, এর উন্নতি সাধন করার জন্যে, এর মাঝে লুকায়িত বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ও শক্তিকে কাজে লাগানাের জন্যে এবং এর প্রকাশ্য ও গােপন সব ধরনের সম্পদকে ব্যবহার করে একে উন্নতির সেই চুড়ান্ত সীমা পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়ার জন্যে যা আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন। এই পৃথিবীর বুকে মানুষ কি ভাবে জীবন যাপন করবে এবং কিভাবে লেন-দেন করবে সে সম্পর্কে পূর্ণাংগ ও বিস্তারিত নিয়ম নীতি ও আইন কানুন তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এই নিয়ম নীতি ও আইন কানুনের ভিত্তি হচ্ছে ঈমান ও সৎ কাজ। এর বিস্তারিত বিবরণ সর্বশেষ আসমানী কিতাবে এসেছে। এই যে বিধান- এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এগুলাে মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করে এবং তাকে সাবধানী হতে অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয়, বরং তার চলাফেরা ও আচার আচরণের মাঝে একটা সামঞ্জস্য ও ভারসাম্যের নিশ্চয়তাও বিধান করে। আল্লাহর এই বিধান অনুযায়ী কেবল পৃথিবীর উন্নতিই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এর সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারই মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। বরং এই উদ্দেশ্য সাধন করার সাথে সাথে তাকে আরাে একটি মহান উদ্দেশ্য সাধন করতে হবে, আর তা হলাে, তার আত্মার উন্নতি এবং পার্থিব জগতে তার মানবীয় গুণাবলীর চরম বিকাশ। এর ফলে সে এই বস্তুতান্ত্রিক রংগীন সভ্যতার মাঝে বিলীন হয়ে গিয়ে মানুষ পশুত্বের পর্যায়ে নেমে যাবে না এবং পৃথিবীর তাবৎ প্রাকৃতিক ও গােপন সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের পরও মানবীয় গুণাবলীর উচ্চ শিখর থেকে তার পতন ঘটবে না। এই ভারসাম্য ও সংগতি রক্ষা করতে গিয়ে কখনও পাল্লা হালকা হবে, আবার কখনও ভারী হবে। কখনও এই পৃথিবীর ওপর আধিপত্য ঘটবে স্বৈরাচারী, অত্যাচারী ও যুলুমবাজদের, কখনও আধিপত্য ঘটবে বর্বর, হিংস্র ও আগ্রাসনবাদীদের, আবার কখনও ঘটবে আল্লাহদ্রোহী ও ভােগবাদী লােকদের যারা পৃথিবীর সম্পদ ও শক্তির কেবল বস্তুতান্ত্রিক ব্যবহারেই পারদর্শী। তবে এসব ঘটবে ও ঘটতে থাকবে চলার পথের নিছক বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে এই পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর সৎ বান্দাদের হাতেই ন্যস্ত হবে। কারণ, তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, তারা ঈমান ও সৎ কাজকে অভিন্ন রূপে দেখে থাকে। তাদের জীবনের কোনাে পর্যায়েই এ দুটো জিনিসের মাঝে পার্থক্য ও ব্যবধান সৃষ্টি হয় না। যে জাতির মাঝে ঈমানের গভীরতা ও কর্মের স্পৃহার গুণ দুটোর সমাহার যতাে বেশী ঘটবে ততােই সে জাতি পৃথিবীর উত্তরাধিকার মালিকানা লাভের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হবে ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে এর অসংখ্য নমুনা রয়েছে। কিন্তু যখনই এই শুণ দুটোর অভাব দেখা দেবে, তখনই অপর পক্ষের পাল্লা ভারী হবে। কখনও বস্তুগত উপায় উপকরণ গ্রহণকারীদের পাল্লা ভারী হয় বিশেষ করে যখন ঈমানের দাবীদাররা এসব উপায় উপকরণ গ্রহণে উদাসীন হয়ে পড়ে, তাদের হৃদয় সঠিক ঈমান থেকে শূন্য হয়ে পড়ে সৎ কর্মের প্রেরণাদানকারী ঈমান থেকে শূন্য হয়ে পড়ে, পৃথিবীকে আবাদ করার মতাে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আরােপিত খেলাফতের সঠিক দায়িত্ব পালনের স্পৃহা হারিয়ে ফেলে। ঈমানের দাবী পূরণ করাই হচ্ছে মোমেনদের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর এই ঈমানের দাবী হচ্ছে, সৎ কাজ করা এবং খেলাফতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। আর এমন সময় এলেই আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। তখন বিধান অনুসারে সৎ বান্দারাই পৃথিবীর মালিকানা লাভ করতে সক্ষম হবে। কারণ, সৎ বান্দারা কেবল ঈমানেরই অধিকারী নয়, তারা কর্মস্পৃহার অধিকারীও।
*সভ্যতা ও মানবতার বিকাশে মুহাম্মদ(স.)-এর আদর্শ : সুরার সূচনায় যে ধরনের সুর ধ্বনিত হয়েছে, সে একই ধরনের সূর শেষের দিকেও ধ্বনিত হচ্ছে। যেমন, ‘এতে এবাদতকারী সম্প্রদায়ের জন্যে…'(আয়াত ১০৬-১১২) জীবন ও জগত সম্পর্কে, দুনিয়া ও আখেরাতে মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে এবং কর্ম ও তার বিনিময়ের বিধান সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে যা কিছু পেশ করা হয়েছে, তা আল্লাহভক্ত লোকদের জন্যে বার্তা স্বরূপ। এদেরকে ‘আবেদ’ বা এবাদাতগােযার বলা হয়েছে। কারণ, যারা আল্লাহভক্ত বা এবাদাতগােযার বান্দা, তারা এমন হৃদয়ের অধিকারী, যার মাঝে থাকে আল্লাহর ভয় ও আনুগত্য গ্রহণের যােগ্যতা, চিন্তার যােগ্যতা এবং কল্যাণমুখী ব্যবহারের যােগ্যতা। পৃথিবীতে নবী রসূলদের আগমন ঘটেছে মূলত মানুষের প্রতি আল্লাহর দয়া ও রহমতস্বরূপ। তারা মানুষকে হাত ধরে সৎ ও সত্যের পথে পরিচালিত করেন। আর যাদের মাঝে সত্যকে গ্রহণ করার যােগ্যতা আছে এবং আগ্রহ আছে কেবল তারাই নবী রসূলদের প্রদর্শিত পথের পথিক হতে পারে। আল্লাহর করুণা ও দয়ার পাত্র মােমেন ও কাফের সকলেই। কিন্তু হেদায়াতের ভাগী কেবল তারাই হবে যাদের মাঝে হেদায়াত গ্রহণের যােগ্যতা থাকবে। শেষ নবী মোহাম্মদ(স.) যে আদর্শ ও জীবন বিধান নিয়ে এই পৃথিবীতে আগমন করেছেন তা গােটা মানব জাতির জন্যেই উপযুক্ত। এর মাধ্যমে মানব জাতি এই জাগতিক জীবনে তার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতি সাধন করতে পারবে। মানবতা যখন চিন্তা চেতনায় পরিপক্কতা লাভ করে তখনই এই আদর্শ নিয়ে শেষ নবীর আগমন ঘটে। একটা খােলা চিঠির ন্যায় মানুষের সামনে এই আদর্শকে তুলে ধরা হয়। এই আদর্শ সুস্পষ্ট ও স্বচ্ছ। এই আদর্শ পূর্ণাংগ। জীবনের সকল দিক নির্দেশনাই এতে রয়েছে। এই আদর্শ অপরিবর্তনীয়। কিন্তু যুগের চাহিদা মেটানাের জন্যে তা যথাযথ যােগ্যতা ও ক্ষমতাসম্পন্ন। কেননা অনাগত যুগ চাহিদার কথা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই ভালভাবে জানেন। কারণ, তিনি সুক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞানী। সকল সৃষ্টি জগতই তার জ্ঞানের আওতাধীন। এই মহান গ্রন্থে চির পরিবর্তনশীল মানব জীবনের জন্যে কিছু স্থায়ী ও সুনির্দিষ্ট মূলনীতি প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে খুঁটি নাটি বিষয়গুলাের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা তাকে দেয়া হয়েছে। যুগ চাহিদা ও জীবন চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে সে নতুন নতুন আইন, নীতি ও পন্থা উদ্ভাবন করতে পারবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, তা যেন কোনাে ভাবেই সে স্থায়ী ও সুনির্দিষ্ট মূলনীতির সাথে সংঘর্ষপূর্ণ না হয়। মানুষের বিবেক বুদ্ধিকেও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযােগ দেয়া হয়েছে। স্বাধীনভাবে চিন্তা করারও সুযােগ দেয়া হয়েছে। এই মুক্ত চিন্তার পথ সুগম করার জন্যে অনুকূল সমাজ ব্যবস্থারও প্রবর্তন করা হয়েছে। তবে মানুষের এই মুক্ত চিন্তার একটা সীমারেখা থাকতে হবে। সে অবশ্যই স্বাধীনভাবে এবং অবাধে তার চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগাবে, তবে তা অবশ্যই মানুষের কল্যাণের জন্যে হতে হবে, মানুষের উন্নতি ও বিকাশের জন্যে হতে হবে এবং সর্বোপরি মানব জীবনের জন্যে নির্ধারিত আল্লাহর বিধান ও মৌলনীতির আওতাধীন হতে হবে। অতীত থেকে নিয়ে বর্তমান কাল পর্যন্ত মানব অভিজ্ঞতা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সে জীবন বিধান ও মৌলনীতি সব সময়ই মানব অগ্রগতির পুরােধা হিসেবে কাজ করেছে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং সকল পর্যায়ে সার্বিক উন্নতি একমাত্র এই জীবন বিধানের ছায়াতলেই সম্ভব এটাও প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, এই জীবন বিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এটা মানব জীবনকে সব সময়ই সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। জীবনকে গতিহীন ও স্থবির করে তােলে না। জীবনকে পশ্চাদমুখী করে তােলে না। বরং জীবনের অগ্রগতির পথে সদা অগ্রগামী থাকে এবং জীবনের প্রতিটি চলার পথকে প্রশস্ত করে থাকে। উন্নতি ও অগ্রগতি সাধনের মানবীয় আকাংখা চরিতার্থ করতে গিয়ে এই জীবন বিধান কখনােই এবং কোনােভাবেই মানুষের শক্তি ও সামর্থ্য দাবিয়ে রাখে না, ব্যক্তি পর্যায়েও রাখে না এবং সামাজিক পর্যায়েও রাখে না। ঠিক তেমনিভাবে এই জীবন বিধান মানুষকে তার শ্রমের ফল ভােগ করতে বারন করে না এবং বৈধ পন্থায় জীবনকে ভোগ করতেও নিষেধ করে না। এই জীবন বিধান একটা ভারসাম্যপূর্ণ বিধান, সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান। এই জীবন বিধানে আত্মার উন্নতির জন্যে দেহকে শাস্তি দেয়ার নিয়ম নেই। তেমনিভাবে দৈহিক আরাম আয়েশের জন্যে আত্মাকে অবহেলা করার নিয়মও নেই। এই জীবন বিধান দেশ ও সমাজের স্বার্থে ব্যক্তির শক্তি সামর্থের ব্যবহারকে নিষেধ করে না, ব্যক্তির স্বভাবজাত ও সুস্থ আশা আকাংখার বাস্তবায়নের পথে কোনাে বাধার সৃষ্টি করে না। তেমনিভাবে এই জীবন বিধান ব্যক্তির অদম্য ও অসৎ কামনা-বাসনাকে লাগামহীন ছেড়ে দিয়ে সমষ্টিগত জীবনকে কলুষিত করার সুযােগ দেয় না, ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযােগ দেয় না। এই জীবন বিধানে ব্যক্তির ভোগ বিলাস ও লােভ লালসার খাতিরে সমাজকে পদানত করার কোনাে অবকাশ নেই। এই জীবন বিধানের আওতায় মানুষের ওপর যখন কোনাে দায়িত্ব ও কর্তব্য আরােপ করা হয় তখন তার শক্তিসামর্থ্য ও স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। সাথে সাথে ব্যক্তির মাঝে এমন আগ্রহ ও স্পৃহাও সৃষ্টি করা হয় যার ফলে সে দায়িত্ব ও কর্তব্য স্বেচ্ছায় ও সানন্দে পালন করতে উদ্বুদ্ধ হয়। এমনকি এই দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে গিয়ে সে কখনও কোনাে কষ্টের শিকার হলেও বিচলিত হয় না, ধৈর্যহারা হয় না। মােহাম্মদ(স.)-এর রিসালাত তাঁর জাতি এবং তার পরবর্তী যুগের সকল মানব গােষ্ঠীর জন্যেও রহমত স্বরূপ ছিলাে এবং আছে। তিনি যে আদর্শ প্রতিহত করেছেন তা প্রাথমিকভাবে মানুষের কাছে এক অজানা অপরিচিত আদর্শ হিসেবে মনে হতাে। কারণ তাদের আদর্শের সাথে এই নবীর আদর্শের কোনাে মিল ছিলাে না। কিন্তু, তা সত্তেও মানুষ ধীরে ধীরে যতােই এই আদর্শের কাছে আসতে থাকলাে, তখনই তাদের বিস্ময়ভাব কাটতে লাগলাে এবং তারা বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন পরিচয়ে হলেও সেই আদর্শকে গ্রহণ করতে এবং নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে শুরু করলাে। জাতিগত, বর্ণগত ও অঞ্চলগত সকল প্রকার ভেদাভেদ মিটিয়ে দিয়ে সকল মানব গােষ্ঠীকে একটিমাত্র আদর্শ ও সামাজিক ব্যবস্থার অধীনে একীভূত করার উদ্দেশ্যে ইসলামের আগমন ঘটেছে। কিন্তু তৎকালীন সমাজ, চিন্তাধারা ও বাস্তবতার জন্যে এটা ছিলাে এক অদ্ভূত বিষয়। সমাজপতিরা তখন নিজেদেরকে ক্রীতদাসদের তুলনায় ভিন্ন মানব প্রজাতি মনে করতাে। কিন্তু এই চৌদ্দশত বছরের ব্যবধানে মানব জাতি ইসলামেরই নির্ধারিত পথে ধাবিত হতে চেষ্টা করেছে। তবে ইসলামের পূর্ণাংগ আদর্শের আলাে থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে মানবতা তার চলার পথে বার বার হােচট খাচ্ছে, তা সত্তেও অন্তত দাবী ও কথায় হলেও সে এই আদর্শের কিছুটা কাছাকাছি পৌছতে পেরেছে। অথচ যে ঘৃণ্য বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ইসলাম সেই চৌদ্দশত বছর আগেই যুদ্ধ ঘােষণা করেছিলাে, তা এখনও ইউরােপ ও আমেরিকার কোনাে কোনাে রাষ্ট্রে টিকে আছে। আইন ও বিচারের ক্ষেত্রে সকল মানুষ সমান এ কথা ঘােষণা করেছে ইসলাম। যে মুহূর্তে মানুষে বেচাকেনা স্বীকৃত ছিলাে, শ্ৰেণী বৈষম্য প্রচলিত নিয়মে পর্যবশিত হয়েছিলাে, প্রত্যেক শ্রেণীর জন্যে পৃথক পৃথক আইন ও বিচার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলাে, দাস ও সামন্ত প্রথার যুগে যখন ব্যক্তির ইচ্ছাই আইন বলে গন্য হতাে সেই মুহূর্তে আইনের চোখে সকলে সমান- ইসলামের এই ঘােষণা মানুষের কাছে বড়ই বে-মানান লেগেছে। কিন্তু পরবর্তীতে তারাই ধীরে ধীরে ইসলামের এই সার্বজনীন নীতিকে অন্তত তাত্ত্বিক রূপে হলেও উপলব্ধি করতে প্রয়াস পাচ্ছে। অথচ এই সার্বজনীন নীতির বাস্তবায়ন সেই চৌদ্দশত বছর আগেই ইসলাম করে দিয়েছে। এ ছাড়াও হযরত মোহাম্মদ(স.)-এর নবুওতে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী প্রায় সকলেই তার আগমনকে গােটা বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত ও আশির্বাদ হিসেবে গণ্য করে। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, মানব জাতি ইচ্ছায় হােক বা অনিচ্ছায় হােক, সজ্ঞানে হােক অথবা অজান্তে রসূলুল্লাহ(স.)-এর মহান আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারেনি। এখনও তার এই আদর্শ আল্লাহর রহমতের ছায়াস্বরূপ পৃথিবীর বুকে বিরাজ করছে, যে কেউ ইচ্ছা করলে এই ছায়ার নিচে আশ্রয় নিয়ে এই হাংগামাপূর্ণ ও উত্তপ্ত পৃথিবীর বুকে বাস করেও স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতে পারে। বর্তমান অস্থিতিশীল পৃথিবীতে মানুষ দিক শূন্য হয়ে পড়েছে, দিশাহারা হয়ে পড়েছে। আজ মানুষ বস্তুতান্ত্রিকতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং হৃদয়হীনতার শিকার হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে মানব জাতির জন্যে ইসলামের সুশীতল ছায়ার সত্যিই বড় প্রয়ােজন।
# ছয়টি গুণ মােমেনদের সাফল্যের গ্যারান্টি হিসাবে আলােচ্য সূরাটি জানিয়েছে, বলেছে যাদের মধ্যে এ ছয়টি গুণ থাকবে তারা অবশ্যই সাফল্যমন্ডিত হবে। এ গুণগুলাে মােমেন দল ও সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে সমভাবে ক্রিয়াশীল ও প্রভাব সৃষ্টিকারী হবে। যেসব মানুষের মধ্যে উক্ত গুণাবলী গড়ে উঠবে তারা যেখানেই থাকুক না কেন এবং যে জনপদেই বসবাস করুক না কেন অন্যদের ওপর তাদের প্রভাব পড়বেই এবং তারা মর্যাদাবান মানুষ বলে বিবেচিত হবে, তারা বিবেচিত হবে আল্লাহর কৃপাধন্য মানুষ হিসাবে। প্রকৃতপক্ষে এসব গুণাবলীর অধিকারী মানুষকে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণত্ব দান করতে চেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা চান না, তার প্রিয়তম সৃষ্টি আশরাফুল মাখলকাত জীব জানোয়ারের মত জীবন যাপন করুক, পশুরা যেভাবে আহার বিহার করে তারাও সেইভাবে আহার বিহার করুক এটাও আল্লাহ তায়ালা চান না। যখন পৃথিবীতে গােটা মানব জাতির সবাই পশুত্বের স্তর পার হয়ে মানবতার পূর্ণ মর্যাদা লাভ করার চেষ্টা করছে তখন অন্তত যেসব মােমেনরা আল্লাহর পথে চলবে বলে অংগীকারাবদ্ধ, আল্লাহ তায়ালা চান, তারা মানবতার পূর্ণ বিকাশ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা রাখুক, যার জন্যে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাহলে তাদের জন্যে জান্নাতুল ফেরদাউস প্রস্তুত রয়েছে, যার ক্ষয় নেই, লয় নেই, যেখানে তারা চিরদিন থাকবে নিরাপদ নির্ভয়ে, স্থায়িত্বের নেই সীমা, নেই কোনাে শেষ। এদের সম্পর্কেই এরশাদ হচ্ছে, ‘তারাই হচ্ছে ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী, তারা সেখানে চিরদিন থাকবে।’ সকল সাফল্যের শেষ লক্ষ্যই তাে এই জান্নাত লাভ এবং মােমেনদের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা এই মনােরম বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখে দিয়েছেন। কোনাে মানুষ এর বাইরে আর কিছুই আশা করে না।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করতে অনেকে ভীষণভাবে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। তারা এর এমন একটি অর্থ বের করে নিয়েছেন যা সমগ্র কুরআনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়ায় এবং দ্বীনের সমগ্র ব্যবস্থাটিকেই শিকড় শুদ্ধ উপড়ে ফেলে দেয়। তারা আয়াতের অর্থ এভাবে করেন যে, দুনিয়ার বর্তমান জীবনে যমীনের উত্তরাধিকার (অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসন এবং পৃথিবীর বস্তু সম্পদ ও উপকরণাদির ভোগ-ব্যবহার) শুধুমাত্র সৎলোকেরাই লাভ করে থাকে এবং তাদেরকেই আল্লাহ এ নিয়ামত দান করেন। তারপর এ সার্বিক নিয়ম থেকে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে, সৎ ও অসতের মধ্যকার ফারাক ও পার্থক্যের মানদণ্ড হচ্ছে এ পৃথিবীর উত্তরাধিকার। যে এ উত্তরাধিকার লাভ করে সে সৎ এবং যে এ থেকে বঞ্চিত হয় সে অসৎ। এরপর তারা সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে দুনিয়ায় ইতিপূর্বে যেসব জাতি পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করেছিল এবং যারা আজ উত্তরাধিকারী হয়ে আছে তাদের প্রতি দৃষ্টি দেয়। এখানে কাফের, মুশরিক, নাস্তিক, দুষ্কৃতিকারী সবাই এ উত্তরাধিকার আগেও লাভ করেছে এবং আজো লাভ করছে। কুরআন যেসব গুণকে কুফরী, ফাসেকী, দুষ্কৃতি, পাপ ও অসৎ বলে চিহ্নিত করেছে যেসব জাতির মধ্যে সেগুলো পাওয়া গেছে এবং আজও পাওয়া যাচ্ছে তারা এ উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি বরং এটি তাদেরকে দান করা হয়েছে এবং আজো দান করা হচ্ছে। ফেরাউন, নমরূদ থেকে শুরু করে এ যুগের কম্যুনিষ্ট শাসকরা পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক লোক প্রকাশ্যে আল্লাহকে অস্বীকার করে, আল্লাহর বিরোধিতা করে বরং আল্লাহর প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এবং এরপরও তারা যমীনের উত্তরাধিকার লাভ করেছে। এ চিত্র দেখে তারা এ মত পোষণ করেন যে, কুরআন বর্ণিত সার্বিক নিয়ম তো ভুল হতে পারে না। কাজেই ভুল যা কিছু তা এ “সৎ” শব্দটির অর্থের মধ্যে রয়ে গেছে। অর্থাৎ মুসলমানরা এ পর্যন্ত “সালেহ” বা “সৎ” শব্দটির যে অর্থ গ্রহণ করে এসেছে তা সম্পূর্ণ ভুল। তাই তারা সৎ শব্দটির একটি নতুন সংজ্ঞা তালাশ করছেন। এ শব্দটির এমন একটি অর্থ তারা চাচ্ছেন যার পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভকারী সকল ব্যক্তি সমানভাবে “সৎ” গণ্য হতে পারে। তিনি আবু বকর সিদ্দীক ও উমর ফারুক অথবা চেংগীস ও হালাকু যে কেউ হতে পারেন। এ নতুন অর্থ সন্ধান করার ক্ষেত্রে ডারউইনের ক্রমবিবর্তন মতবাদ তাদেরকে সাহায্য করে। ফলে তারা কুরআনের “সৎ” এর মতবাদকে ডারউইনী “যোগ্যতা” বা Fitness (صلاح) (صلاحيت) -এর মতবাদের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন।
এ সংশ্লিষ্ট তাফসীরের প্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াতের অর্থ দাঁড়াবে এইঃ যে ব্যক্তি বা দল দেশ জয় করার জন্য শক্তি প্রয়োগ করে, তার ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালাবার এবং পৃথিবীর বস্তু সম্পদ ও জীবন যাপনের উপকরণাদি সাফল্যের সাথে ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখে সে-ই হচ্ছে “আল্লার সৎ বান্দা।” তার এ কর্ম সমস্ত “ইবাদাত গুজার” মানব সমাজের জন্য এমন একটি বাণী যাতে বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি ও দল যে কাজটি করছে সেটিই “ইবাদাত।” তোমরা যদি এ ইবাদাত না করো এবং পরিণামে পৃথিবীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাও তাহলে তোমাদেরকে “সৎলোক”দের মধ্যে গণ্য করা হবে না এবং তোমাদেরকে আল্লাহর ইবাদাত গুজার বান্দাও বলা যেতে পারে না।
এ অর্থ গ্রহণ করার পর এদের সামনে প্রশ্ন দেখা দিল যে, যদি “সততা” ও ইবাদাতের” সংজ্ঞা এই হয়ে থাকে তাহলে ঈমান (আল্লাহর প্রতি ঈমান, আখেরাতের প্রতি ঈমান, রসূলের প্রতি ঈমান ও কিতাবের প্রতি ঈমান) এর অর্থ কি? ঈমান ছাড়া তো স্বয়ং এ কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর কাছে কোন সৎকাজ গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাছাড়া এরপর কুরআনের এ দাওয়াতের কি অর্থ হবে যেখানে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর রসূলের মাধ্যমে যে নৈতিক ব্যবস্থা ও জীবন বিধান পাঠিয়েছেন তার আনুগত্য করো? আবার বারবার কুরআনের একথা বলার অর্থই বা কি যে, রসূলকে যে মানে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের যে আনুগত্য করে না সে কাফের, ফাসেক, শাস্তিলাভের অধিকারী এবং আল্লাহর দরবারে ঘৃণিত অপরাধী? এ প্রশ্নগুলো এমন পর্যায়ের ছিল যে, এরা যদি ঈমানদারীর সাথে এগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন তাহলে অনুভব করতেন যে, এ আয়াতের অর্থ অনুধাবন করার এবং সততার একটি নতুন ধারণা সৃষ্টি করার ব্যাপারে তারা ভুল করছেন। কিন্তু তারা নিজেদের ভুল অনুভব করার পরিবর্তে অত্যন্ত দুঃসাহসের সাথে ঈমান, ইসলাম, তাওহীদ, আখেরাত, রিসালাত প্রত্যেকটি জিনিসের অর্থ বদলে দিয়েছেন, শুধুমাত্র এ সবগুলোকে তাদের একটি আয়াতের ব্যাখ্যার সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য। একটিমাত্র জিনিসকে ঠিকভাবে বসাবার জন্য কুরআনের সমস্ত শিক্ষাকে ওলট-পালট করে দিয়েছেন। এর ওপর আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যারা তাদের এ “দ্বীনের মেরামতি”র বিরোধী তাদের বিরুদ্ধে তারা উলটো অভিযোগ আনছেন এই বলে যে, “নিজেরা পরিবর্তিত না হয়ে করছেন কুরআনের পরির্বতন। এটি আসলে বস্তুগত উন্নয়নেচ্ছার বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। কিছু লোক মারাত্মকভাবে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এজন্য তারা কুরআনের অর্থ বিকৃত করতেও দ্বিধা করছেন না।
তাদের এ ব্যাখ্যার প্রথম মৌলিক ভুলটি হচ্ছে এই যে, তারা কুরআনের একটি আয়াতের এমন একটি ব্যাখ্যা করছেন যা কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষার বিরোধী। অথচ নীতিগতভাবে কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের এমন ব্যাখ্যাই সঠিক হতে পারে যা তার অন্যান্য বর্ণনা ও তার সামগ্রিক চিন্তাধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। যে ব্যক্তি কুরআনকে অন্তত একবারও বুঝে পড়ার চেষ্টা করেছেন তিনি একথা না জেনে পারেন না যে, কুরআন যে জিনিসকে নেকী, তাকওয়া ও কল্যাণ বলছে তা “বস্তুগত উন্নতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার যোগ্যতার” সমার্থক নয়। আর “সৎ” কে যদি “যোগ্যতা সম্পন্ন”-এর অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে এ একটি আয়াত সমগ্র কুরআনের বিরোধী হয়ে ওঠে।
তাদের এ ভুলের দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে এই যে, তারা একটি আয়াতকে তার প্রেক্ষাপট ও পূর্বাপর সম্পর্ক থেকে আলাদা করে নিয়ে নির্দ্ধিধায় ইচ্ছা মতো যে কোন অর্থ তার শব্দাবলী থেকে বের করে নিচ্ছেন। অথচ প্রত্যেকটি আয়াতের সঠিক অর্থ কেবলমাত্র সেটিই হতে পারে যা তার পূর্বাপর সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্য রাখে। যদি এ ভুলটি তারা না করতেন তাহলে সহজেই দেখতে পেতেন যে, উপর থেকে ধারাবাহিকভাবে যে বিষয়বস্তু চলে আসছে সেখানে আখেরাতের জীবনে সৎকর্মশীল মু’মিন এবং কাফের ও মুশরিকদের পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে। এ বিষয়বস্তুর মধ্যে আকস্মিকভাবে দুনিয়ায় যমীনের উত্তরাধিকার ব্যবস্থা কোন্ নিয়মের ভিত্তিতে চলছে একথা বলার সুযোগ কোথায় পাওয়া গেলো?
কুরআন ব্যাখ্যার সঠিক নীতি অনুসরণ করলে দেখা যাবে আয়াতের অর্থ পরিষ্কার। অর্থাৎ এর আগের আয়াতে যে দ্বিতীয়বার সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে সে সৃষ্টিকালে যমীনের উত্তরাধিকারী হবে শুধুমাত্র সৎকর্মশীল লোকেরা। সেই চিরন্তন জীবনের ব্যবস্থাপনায় বর্তমানের সাময়িক জীবন ব্যবস্থার অবস্থা বিরাজিত থাকবে না। এখানে বর্তমান জীবন ব্যবস্থায় তো যমীনে জালেম ও ফাসেকদেরও রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় কিন্তু সেখানে তা হবে না। সূরা মু’মিনূনের ৪-১১ আয়াতে এ বিষয়বস্তুই আলোচিত হয়েছে। এর চাইতেও পরিষ্কার ভাষায় সূরা যুমারের শেষে বলা হয়েছে। সেখানে আল্লাহ কিয়ামত এবং প্রথম সিংগা ধ্বনির কথা বলার পর নিজের ন্যায় বিচারের উল্লেখ করেছেন এবং তারপর কুফরীর পরিণাম বর্ণনা করে সৎলোকদের পরিণাম এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
وَسِيقَ الَّذِينَ اتَّقَوْا رَبَّهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ زُمَرًا حَتَّى إِذَا جَاءُوهَا وَفُتِحَتْ أَبْوَابُهَا وَقَالَ لَهُمْ خَزَنَتُهَا سَلَامٌ عَلَيْكُمْ طِبْتُمْ فَادْخُلُوهَا خَالِدِينَ – وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي صَدَقَنَا وَعْدَهُ وَأَوْرَثَنَا الْأَرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَاءُ فَنِعْمَ أَجْرُ الْعَامِلِينَ
“আর যারা নিজেদের রবের ভয়ে তাকওয়া অবলম্বন করেছিল তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে যখন তারা সেখানে পৌঁছে যাবে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হবে এবং তার ব্যবস্থাপক তাদেরকে বলবে তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, তোমরা খুব ভালো থেকেছো, এখন এসো, এর মধ্যে চিরকাল থাকার জন্য প্রবেশ করো। আর তারা বলবেঃ প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাদের সাথে তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেছেন এবং আমাদের যমীনের উত্তরাধিকারী বানিয়ে দিয়েছেন। আমরা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিতে পারি। কাজেই সর্বোত্তম প্রতিদান হচ্ছে সৎকর্মশীলদের জন্য।” ( যুমারঃ৭৩-৭৪ )
দেখুন এ দু’টি আয়াত একই বিষয় বর্ণনা করছে এবং দু’জায়গায়ই যমীনের উত্তরাধিকারের সম্পর্ক পরকালীন জগতের সাথে প্রতিষ্ঠিত, ইহকালীন জগতের সাথে নয়। এখন যবুরের প্রসঙ্গে আসা যাক। আলোচ্য আয়াতে এর বরাত দেয়া হয়েছে। যদিও আমাদের পক্ষে একথা বলা কঠিন যে, বাইবেলের পুরাতন নিয়মে যবুর নামে যে পুস্তকটি বর্তমানে পাওয়া যায় তা তার আসল অবিকৃত অবস্থায় আছে কি নেই। কারণ, এখানে দাউদের গীতের মধ্যে অন্য লোকদের গীতও মিশে একাকার হয়ে গেছে এবং মূল যবুরের কপি কোথাও নেই। তবুও যে যবুর বর্তমানে আছে সেখানেও নেকী, সততা, সত্যনিষ্ঠা ও আল্লাহ নির্ভরতার উপদেশ দেয়ার পর বলা হচ্ছেঃ
“কারণ দুরাচারগণ উচ্ছিন্ন হইবে, কিন্তু যাহারা সদাপ্রভুর অপেক্ষা করে, তাহারাই দেশের অধিকারী হইবে। আর ক্ষণকাল, পরে দুষ্টলোক আর নাই, তুমি তাহার স্থান তত্ব করিবে, কিন্তু সে আর নাই। কিন্তু মৃদুশীলেরা দেশের অধিকারী হইবে এবং শান্তির বাহুল্যে আমোদ করিবে। . . . . . . . . . তাহাদের অধিকার চিরকাল থাকিবে। . . . . . . . . . . ধার্মিকেরা দেশের অধিকারী হইবে, তাহারা নিয়ত তথায় বাস করিবে।” (দাউদের সঙ্গীত ৩৭: ৯, ১০, ১১, ১৮, ২৯) দেখুন এখানে ধার্মিকদের জন্য যমীনের চিরন্তন উত্তরাধিকারের কথা বলা হয়েছে। আর একথা সুস্পষ্ট যে, আসমানী কিতাবগুলোর দৃষ্টিতে “খুলূদ”, “তথা চির অবস্থান” ও চিরন্তন জীবন আখেরাতেরই হয়ে থাকে, এ দুনিয়ায় নয়।
দুনিয়ায় যমীনের সাময়িক উত্তরাধিকার যে নিয়মে বন্টিত হয় তাকে সূরা আ’রাফে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
إِنَّ الْأَرْضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ
“যমীনের মালিক আল্লাহ, নিজের বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন।” (১২৮ আয়াত) আল্লাহর ইচ্ছার আওতায় মু’মিন ও কাফের, সৎ ও অসৎ এবং হুকুম পালনকারী ও হুকুম অমান্যকারী নির্বিশেষে সবাই এর উত্তরাধিকার লাভ করে। কর্মফল হিসেবে তারা এটা লাভ করে না বরং লাভ করে পরীক্ষা হিসেবে। যেমন এ আয়াতের পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছেঃ
وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ
“আর তিনি তোমাদেরকে যমীনে খলীফা করবেন তারপর দেখবেন তোমরা কেমন কাজ করো।” ( ১২৯ আয়াত )
এ উত্তরাধিকার চিরন্তন নয়। এটি নিছক একটি পরীক্ষার ব্যাপার। আল্লাহর একটি নিয়মের আওতায় দুনিয়ায় বিভিন্ন জাতিকে পালাক্রমে এ পরীক্ষায় ফেলা হয়। বিপরীতপক্ষে আখেরাতে এ যমীনেরই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হবে এবং কুরআনের বিভিন্ন সুস্পষ্ট উক্তির আলোকে তা যে নিয়মের ভিত্তিতে হবে তা হচ্ছে এই যে, “যমীনের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ। তিনি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে একমাত্র সৎকর্মশীল মু’মিনদেরকে এর উত্তরাধিকারী করবেন। পরীক্ষা করার জন্য নয় বরং দুনিয়ায় তারা যে সৎ প্রবণতা অবলম্বন করেছিল তার চিরন্তন প্রতিদান হিসেবে।” (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা নূর ৮৩ টীকা )।
# সুরা: আল-মু’মিনূন
আয়াত নং :-১০
اُولٰٓئِكَ هُمُ الْوٰرِثُوْنَۙ
তারাই এমন ধরনের উত্তরাধিকারী যারা নিজেদের উত্তরাধিকার হিসেবে ।
# ফিরদৌস জান্নাতের সবচেয়ে বেশী পরিচিত প্রতিশব্দ। মানব জাতির প্রায় সমস্ত ভাষায়ই এ শব্দটি পাওয়া যায়। সংস্কৃতে বলা হয় পরদেষা, প্রাচীন কুলদানী ভাষায় পরদেসা, প্রাচীন ইরানী (যিন্দা) ভাষায় পিরীদাইজা, হিব্রু ভাষায় পারদেস, আর্মেনীয় ভাষায় পারদেজ, সুরিয়ানী ভাষায় ফারদেসো, গ্রীক ভাষায় পারাডাইসোস, ল্যাটিন ভাষায় প্যারাডাইস এবং আরবী ভাষায় ফিরদৌস। এ শব্দটি এসব ভাষায় এমন একটি বাগানের জন্য বলা হয়ে থাকে যার চারদিকে পাচিল দেয়া থাকে, বাগানটি বিস্তৃত হয়, মানুষের আবাসগৃহের সাথে সংযুক্ত হয় এবং সেখানে সব ধরনের ফল বিশেষ করে আঙ্গুর পাওয়া যায়। বরং কোন ভাষায় এর অর্থের মধ্যে একথাও বুঝা যায় যে, এখানে বাছাই করা গৃহপালিত পশু-পাখিও পাওয়া যায়। কুরআনের পূর্বে আরবদের জাহেলী যুগের ভাষায় ও ফিরদৌস শব্দের ব্যবহার ছিল। কুরআনে বিভিন্ন বাগানের সমষ্টিকে ফিরদৌস বলা হয়েছে। যেমন সূরা কাহফে বলা হয়েছেঃ
كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا
তাদের আপ্যায়নের জন্য ফিরদৌসের বাগানগুলো আছে। এ থেকে মনের মধ্যে যে ধারণা জন্মে তা হচ্ছে এই যে, ফিরদৌস একটি বড় জায়গা, যেখানে অসংখ্য বাগ-বাগীচা–উদ্যান রয়েছে। মু’মিনেদর ফিরদৌসের অধিকারী হবার বিষয়টির ওপর সূরা ত্বা-হা ( ৮৩ টীকা ) ও সূরা আল আম্বিয়া ( ৯৯ টীকা ) যথেষ্ট আলোকপাত করা হয়েছে।
# সুরা: আল-মু’মিনূন
আয়াত নং :-১১
الَّذِیْنَ یَرِثُوْنَ الْفِرْدَوْسَ١ؕ هُمْ فِیْهَا خٰلِدُوْنَ
ফিরদাউস, লাভ করবে এবং সেখানে তারা থাকবে চিরকাল।
# ফিরদৌস জান্নাতের সবচেয়ে বেশী পরিচিত প্রতিশব্দ। মানব জাতির প্রায় সমস্ত ভাষায়ই এ শব্দটি পাওয়া যায়। সংস্কৃতে বলা হয় পরদেষা, প্রাচীন কুলদানী ভাষায় পরদেসা, প্রাচীন ইরানী (যিন্দা) ভাষায় পিরীদাইজা, হিব্রু ভাষায় পারদেস, আর্মেনীয় ভাষায় পারদেজ, সুরিয়ানী ভাষায় ফারদেসো, গ্রীক ভাষায় পারাডাইসোস, ল্যাটিন ভাষায় প্যারাডাইস এবং আরবী ভাষায় ফিরদৌস। এ শব্দটি এসব ভাষায় এমন একটি বাগানের জন্য বলা হয়ে থাকে যার চারদিকে পাচিল দেয়া থাকে, বাগানটি বিস্তৃত হয়, মানুষের আবাসগৃহের সাথে সংযুক্ত হয় এবং সেখানে সব ধরনের ফল বিশেষ করে আঙ্গুর পাওয়া যায়। বরং কোন ভাষায় এর অর্থের মধ্যে একথাও বুঝা যায় যে, এখানে বাছাই করা গৃহপালিত পশু-পাখিও পাওয়া যায়। কুরআনের পূর্বে আরবদের জাহেলী যুগের ভাষায় ও ফিরদৌস শব্দের ব্যবহার ছিল। কুরআনে বিভিন্ন বাগানের সমষ্টিকে ফিরদৌস বলা হয়েছে। যেমন সূরা কাহফে বলা হয়েছেঃ
كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا
তাদের আপ্যায়নের জন্য ফিরদৌসের বাগানগুলো আছে। এ থেকে মনের মধ্যে যে ধারণা জন্মে তা হচ্ছে এই যে, ফিরদৌস একটি বড় জায়গা, যেখানে অসংখ্য বাগ-বাগীচা–উদ্যান রয়েছে। মু’মিনেদর ফিরদৌসের অধিকারী হবার বিষয়টির ওপর সূরা ত্বা-হা ( ৮৩ টীকা ) ও সূরা আল আম্বিয়া ( ৯৯ টীকা ) যথেষ্ট আলোকপাত করা হয়েছে।
# এ আয়াতগুলেতে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হয়েছেঃ
একঃ যারাই কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মেনে নিয়ে এ গুণাবলী নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করবে এবং এ নীতির অনুসারী হবে তারা যে কোন দেশ, জাতি ও গোত্রের হোক না কেন অবশ্যই তারা দুনিয়ায় ও আখেরাতে সফলকাম হবে।
দুইঃ সফলতা নিছক ঈমানের ঘোষণা, অথবা নিছক সৎচরিত্র ও সৎকাজের ফল নয়। বরং উভয়ের সম্মিলনের ফল। মানুষ যখন আল্লাহর পাঠানো পথনির্দেশ মেনে চলে এবং তারপর সে অনুযায়ী নিজের মধ্যে উন্নত নৈতিকতা ও সৎকর্মশীলতা সৃষ্টি করে তখন সে সফলতা লাভ করে।
তিনঃ নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সম্পদশীলতা এবং সীমিত সাফল্যের নাম সফলতা নয়। বরং তা একটি ব্যাপকতর কল্যাণকর অবস্থার নাম। দুনিয়ার ও আখেরাতে স্থায়ী সাফল্য ও পরিতৃপ্তিকেই এ নামে অভিহিত করা হয়। এটি ঈমান ও সৎকর্ম ছাড়া অর্জিত হয় না। পথভ্রষ্টদের সাময়িক সমৃদ্ধি ও সাফল্য এবং সৎ মু’মিনদের সাময়িক বিপদ আপদকে এ নীতির সাথে সাংঘর্ষিক গণ্য করা যেতে পারে না।
চারঃ মু’মিনদের এ গুণাবলীকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মিশনের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয়েছে। আবার এ বিষয়বস্তুটিই সামনের দিকের ভাষণের সাথে এ আয়াতগুলোর সম্পর্ক কায়েম করে। তৃতীয় রুকু’র শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভাষণটির যুক্তির ধারা যেভাবে পেশ করা হয়েছে তা হচ্ছে এই যে, শুরুতে আছে অভিজ্ঞতা প্রসূত যুক্তি। অর্থাৎ এ নবীর শিক্ষা তোমাদেরই সমাজের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে এ বিশেষ ধরনের জীবন, চরিত্র, কর্মকাণ্ড, নৈতিকতা ও গুণাবলি সৃষ্টি করে দেখিয়ে দিয়েছে। এখন তোমরা নিজেরাই ভেবে দেখো, এ শিক্ষা সত্য না হলে এ ধরণের কল্যাণময় ফল কিভাবে সৃষ্টি করতে পারতো? এরপর হচ্ছে প্রত্যক্ষ দর্শনলব্ধ যুক্তি। অর্থাৎ মানুষের নিজের সত্তায় ও চারপাশের বিশ্বে যে নিদর্শনাবলী পরিদৃষ্ট হচ্ছে তা সবই তাওহীদ ও আখেরাতের এবং মুহাম্মাদ ﷺ প্রদত্ত শিক্ষার সত্যতার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তারপর আসে ঐতিহাসিক যুক্তিগুলোতে বলা হয়েছে, নবী ও তাঁর দাওয়াত অস্বীকারকারীদের সংঘাত আজ নতুন নয় বরং একই কারণে অতি প্রাচীনকাল থেকে তা চলে আসছে। এ সংঘাতের প্রতিটি যুগে একই ফলাফলের প্রকাশ ঘটেছে। এ থেকে পরিষ্কার জানা যায়, উভয় দলের মধ্যে থেকে কে সত্য পথে ছিল এবং কে ছিল মিথ্যার পথে।
# সুরা: আল-আরাফ
আয়াত নং :-১২৮
قَالَ مُوْسٰى لِقَوْمِهِ اسْتَعِیْنُوْا بِاللّٰهِ وَ اصْبِرُوْا١ۚ اِنَّ الْاَرْضَ لِلّٰهِ١ۙ۫ یُوْرِثُهَا مَنْ یَّشَآءُ مِنْ عِبَادِهٖ١ؕ وَ الْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِیْنَ
মূসা তার জাতিকে বললোঃ “আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং সবর করো। এ পৃথিবী তো আল্লাহরই। তিনি নিজের বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চান তাকে এর উত্তরাধিকারী করেন। আর যারা তাঁকে ভয় করে কাজ করে চূড়ান্ত সাফল্য তাদের জন্য নির্ধারিত।”
# এ বক্তব্যের শুরুতেই আমি ইঙ্গিত করেছি, এ উক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফিকদেরকে এ মর্মে সতর্ক করা যে, আল্লাহ মুসলমানদের খিলাফত দান করার যে প্রতিশ্রুতি দেন তা নিছক আদমশুমারীর খাতায় যাদের নাম মুসলমান হিসেবে লেখা হয়েছে তাদের জন্য নয় বরং এমন মুসলমানদের জন্য যারা সাচ্চা ঈমানদার, চরিত্র ও কর্মের দিক দিয়ে সৎ, আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীনের আনুগত্যকারী এবং সব ধরনের শিরক মুক্ত হয়ে নির্ভেজাল আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বকারী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, নিছক মুখে ঈমানের দাবীদার, তারা এ প্রতিশ্রুতি লাভের যোগ্য নয় এবং তাদের জন্য এ প্রতিশ্রুতি দানও করা হয়নি। কাজেই তারা যেন এর অংশীদার হবার আশা না রাখে।
কেউ কেউ খিলাফতকে নিছক রাষ্ট্র ক্ষমতা, রাজ্য শাসন, প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি অর্থে গ্রহণ করেন। তারপর আলোচ্য আয়াত থেকে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, দুনিয়ায় যে ব্যক্তিই এ শক্তি অর্জন করে সে মু’মিন, সৎ, আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীনের অনুসারী, আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বকারী এবং শিরক থেকে দূরে অবস্থানকারী। এরপর তারা নিজেদের এ ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রতিপন্ন করার জন্য ঈমান, সৎকর্মশীলতা, সত্য দ্বীন, আল্লাহর ইবাদাত ও শির্ক তথা প্রত্যেকটি জিনিসের অর্থ বিকৃত করে তাকে এমন কিছু বানিয়ে দেন যা তাদের এ মতবাদের সাথে খাপ খেয়ে যায়। এটা কুরআনের নিকৃষ্টতম অর্থগত বিকৃতি। এ বিকৃতি ইহুদী ও খৃস্টানদের বিকৃতিকেও ম্লান করে দিয়েছে। এ বিকৃতির মাধ্যমে কুরআনের একটি আয়াতের এমন একটি অর্থ করা হয়েছে যা সমগ্র কুরআনের শিক্ষাকে বিকৃত করে দেয় এবং ইসলামের কোন একটি জিনিসকেও তার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকতে দেয় না। খিলাফতের এ সংজ্ঞা বর্ণনা করার পর নিশ্চিতভাবে এমন সব লোকের ওপর এ আয়াত প্রযোজ্য হয় যারা কখনো দুনিয়ায় প্রাধান্য ও রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছে অথবা বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। তারা আল্লাহ, অহী, রিসালাত, আখেরাত সবকিছু অস্বীকারকারী হতে পারে এবং ফাসেকী ও অশ্লীলতার এমন সব মলিনতায় আপ্লুতও হতে পারে যেগুলোকে কুরআন কবীরা গুনাহ তথা বৃহৎ পাপ গণ্য করেছে, যেমন সুদ, ব্যভিচার, মদ, জুয়া। এখন যদি এসব লোক সৎ মু’মিন হয়ে থাকে এবং এজন্যই তাদেরকে খিলাফতের উন্নত আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে, তাহলে এরপর ঈমানের অর্থ প্রাকৃতিক আইন মেনে নেয়া এবং সৎকর্মশীলতা অর্থ এ আইনগুলোকে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা ছাড়া আর কি হতে পারে? আর আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীন বলতে প্রাণী বিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করে শিল্প, কারিগরী, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে ব্যাপক উন্নতি লাভ করা ছাড়া আর কি হতে পারে? এরপর আল্লাহর বন্দেগী বলতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রচেষ্টা ও সংগ্রামে সাফল্য লাভ করার জন্য যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলা প্রকৃতিগতভাবে লাভজনক ও অপরিহার্য হয়ে থাকে সেগুলো মেনে চলা ছাড়া আর কি হতে পারে? তারপর এ লাভজনক নিয়ম-কানুনের সাথে কোন ব্যক্তি বা জাতি কিছু ক্ষতিকর পদ্ধতি অবলম্বন করলে তাকেই শির্ক নামে অভিহিত করা ছাড়া আর কাকে শির্ক বলা যাবে? কিন্তু যে ব্যক্তি কখনো দৃষ্টি ও মন আচ্ছন্ন না রেখে বুঝে কুরআন পড়েছে সে কি কখনো একথা মেনে নিতে পারে যে, সত্যিই কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী ঈমান, সৎকাজ, সত্য দ্বীন, আল্লাহর ইবাদাত এবং তাওহীদ ও শিরকের এ অর্থই হয়? যে ব্যক্তি কখনো পুরো কুরআন বুঝে পড়েনি এবং কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু আয়াত নিয়ে সেগুলোকে নিজের চিন্তা-কল্পনা ও মতবাদ অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়েছে সে-ই কেবল এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অথবা এমন এক ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে, যে কুরআন পড়ার সময় এমন সব আয়াতকে একেবারেই অর্থহীন ও ভুল মনে করেছে যেগুলোতে আল্লাহকে একমাত্র রব ও ইলাহ, তাঁর নাযিল করা অহীকে পথনির্দেশনার একমাত্র উপায় এবং তাঁর পাঠানো প্রত্যেক নবীকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অপরিহার্যভাবে মেনে নেবার ও নেতা বলে স্বীকার করে অনুসরণ করার আহবান জানানো হয়েছে। আর এই সঙ্গে বর্তমান দুনিয়াবী জীবনের শেষে দ্বিতীয় আর একটি জীবন কেবল মেনে নেবারই দাবী করা হয়নি বরং একথাও পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, যারা এ জীবনে নিজেদের জবাবদিহির কথা অস্বীকার করে বা এ ব্যাপারে সকল প্রকার চিন্তা বিমুক্ত হয়ে নিছক এ দুনিয়ায় সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করবে তারা চূড়ান্ত সাফল্য থেকে বঞ্চিত থাকবে। কুরআনে এ বিষয়বস্তুগুলো এত বেশী পরিমাণে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে এবং সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বারবার বলা হয়েছে যে, খিলাফত লাভ সম্পর্কিত এ আয়াতের এ নতুন ব্যাখ্যাদাতাগণ এ ব্যাপারে যে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন, যথার্থ সততা ও আন্তরিকতার সাথে এ কিতাব পাঠকারী কোন ব্যক্তি কখনো তার শিকার হতে পারেন, একথা মেনে নেয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ খিলাফত ও খিলাফত লাভের যে অর্থের ওপর তারা নিজেদের চিন্তার এ বিশাল ইমারত নির্মাণ করেছেন তা তাদের নিজেদের তৈরী। কুরআনের জ্ঞান রাখে এমন কোন ব্যক্তি কখনো এ আয়াতের এ অর্থ করতে পারেন না।
আসলে কুরআন খিলাফত ও খিলাফত লাভকে তিনটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে। প্রত্যেক জায়গায় পূর্বাপর আলোচ্য বিষয় থেকে কোথায় এ শব্দটি কি অর্থে বলা হয়েছে তা জানা যায়।
এর একটি অর্থ হচ্ছে, “আল্লাহর দেয়া ক্ষমতার অধিকারী হওয়া।” এ অর্থ অনুসারে সারা দুনিয়ার সমস্ত মানব সন্তান পৃথিবীতে খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত।
দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, “আল্লাহর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তাঁর শরীয়তী বিধানের (নিছক প্রাকৃতিক বিধানের নয়) আওতায় খিলাফতের ক্ষমতা ব্যবহার করা।” এ অর্থে কেবল মাত্র সৎ মু’মিনই খলীফা গণ্য হয়। কারণ সে সঠিকভাবে খিলাফতের হক আদায় করে। বিপরীতপক্ষে কাফের ও ফাসেক খলীফা নয় বরং বিদ্রোহী। কারণ তারা আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাকে নাফরমানীর পথে ব্যবহার করে।
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, “এক যুগের বিজয়ী ও ক্ষমতাশালী জাতির পরে অন্য জাতির তার স্থান দখল করা।” খিলাফতের প্রথম দু’টি অর্থ গৃহীত হয়েছে “প্রতিনিধিত্ব” শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ থেকে। আর এ শেষ অর্থটি “স্থলাভিষিক্ত” শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। এ শব্দটির এ দু’টি অর্থ আরবী ভাষায় সর্বজন পরিচিত। এখন যে ব্যক্তিই এখানে এ প্রেক্ষাপটে খিলাফত লাভের আয়াতটি পাঠ করবে সে এক মুহূর্তের জন্যও এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে পারে না যে, এখানে খিলাফত শব্দটি এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা আল্লাহর শরীয়াতী বিধান অনুযায়ী (নিছক প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী নয়) তাঁর প্রতিনিধিত্বের যথাযথ হক আদায় করে। এ কারণেই কাফের তো দূরের কথা ইসলামের দাবীদার মুনাফিকদেরকেও এ প্রতিশ্রুতিতে শরীক করতে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে। তাই বলা হচ্ছে, একমাত্র ঈমান ও সৎকর্মের গুণে গুণান্বিত লোকেরাই হয় এর অধিকারী। এজন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠার ফল হিসেবে বলা হচ্ছে, আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম মজবুত বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আর এজন্য পুরস্কার দানের শর্ত হিসেবে বলা হচ্ছে, নির্ভেজাল আল্লাহর বন্দেগীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। এ বন্দেগীতে যেন শিরকের সামান্যতমও মিশেল না থাকে। এ প্রতিশ্রুতিকে এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক ময়দানে পৌঁছিয়ে দেয়া এবং আমেরিকা থেকে নিয়ে রাশিয়া পর্যন্ত যারই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ-প্রতিপত্তির ডংকা দুনিয়ায় বাজতে থাকে তারই সমীপে একে নজরানা হিসেবে পেশ করা চূড়ান্ত মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ শক্তিগুলো যদি খিলাফতের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে থাকে তাহলে ফেরাউন ও নমরূদ কি দোষ করেছিল, আল্লাহ কেন তাদেরকে অভিশাপ লাভের যোগ্য গণ্য করেছেন? (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, ৯৯ টিকা)। এখানে আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালের মুসলমানদের জন্য এ প্রতিশ্রুতি পরোক্ষভাবে পৌঁছে যায়। প্রত্যক্ষভাবে এখানে এমন সব লোককে সম্বোধন করা হয়েছিল যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ছিলেন। প্রতিশ্রুতি যখন দেয়া হয়েছিল তখন সত্যিই মুসলমানরা ভয়-ভীতির মধ্যে অবস্থান করছিল এবং দ্বীন ইসলাম তখনো হিজাযের সরেজমিনে মজবুতভাবে শিকড় গেড়ে বসেনি। এর কয়েক বছর পর এ ভয়ভীতির অবস্থা কেবল নিরাপত্তায় বদলে যায়নি বরং ইসলাম আরব থেকে হয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার শিকার কেবল তার জন্মভূমিতেই নয়, বহির্বিশ্বেও মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আল্লাহর তাঁর এ প্রতিশ্রুতি আবু বকর সিদ্দীক, উমর ফারুক ও উসমান গনী রাদিয়াল্লাহু আনহুমের জামানায় পুরা করে দেন, এটি একথার একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ। এরপর এ তিন মহান ব্যক্তির খিলাফতকে কুরআন নিজেই সত্যায়িত করেছে এবং আল্লাহ নিজেই এদের সৎ মু’মিন হবার সাক্ষ্য দিচ্ছেন, এ ব্যাপারে কোন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির পক্ষে সন্দেহ পোষণ করা কঠিন। এ ব্যাপারে যদি কারোর মনে সন্দেহ দেখা দেয় তাহলে তাঁর “নাহ্জুল বালাগায়’ সাইয়েদুনা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ভাষণ পাঠ করা দরকার। হযরত উমরকে ইরানীদের বিরুদ্ধে সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য তিনি এ ভাষণটি দিয়েছিলেন। এতে তিনি বলেনঃ এ কাজের বিস্তার বা দুর্বলতা সংখ্যায় বেশী হওয়া ও কম হওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। এ হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। তিনি একে বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত করেছেন। আর আল্লাহর সেনাদলকে তিনি সাহায্য-সহায়তা দান করেছেন। শেষ পর্যন্ত উন্নতি লাভ করে তা এখানে পৌঁছে গেছে। আল্লাহ নিজেই আমাদের বলেছেনঃ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ………………. “আল্লাহ নিশ্চয়ই এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন এবং নিশ্চয়ই নিজের সেনানীদেরকে সাহায্য করবেন। মোতির মালার মধ্যে সূতোর যে স্থান, ইসলামে কাইয়েম তথা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকারীও সে একই স্থানে অবস্থান করছেন। সূতো ছিড়ে গেলেই মোতির দানাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং শৃংখলা বিনষ্ট হয়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর আবার একত্র হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে সন্দেহ নেই, আরবরা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু ইসলাম তাদেরকে বিপুল সংখ্যায় পরিণত করেছে এবং সংঘবদ্ধতা তাদেরকে শক্তিশালী করে দিয়েছে। আপনি কেন্দ্রীয় পরিচালক হিসেবে এখানে শক্ত হয়ে বসে থাকুন, আরবের যাঁতাকে নিজের চারদিকে ঘুরাতে থাকুন এবং এখানে বসে বসেই যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে থাকুন। নয়তো আপনি যদি একবার এখান থেকে সরে যান তাহলে সবদিকে আরবীয় ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করবে এবং অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছবে যে, আপনাকে সামনের শত্রুর তুলনায় পেছনের বিপদের কথা বেশী করে চিন্তা করতে হবে। আবার ওদিকে ইরানীরা আপনার ওপর দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করবে। তারা মনে করবে, এই তো আরবের মূল গ্রন্থি, একে কেটে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কাজেই আপনাকে খতম করে দেবার জন্য তারা নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। আর আজমবাসীরা এসময় বিপুল সংখ্যায় এসে ভীড় জমিয়েছে বলে যে কথা আপনি বলেছেন এর জবাবে বলা যায়, এর আগেও আমরা তাদের সাথে লড়েছি, তখনো সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে লড়িনি বরং আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তাই আজ পর্যন্ত আমাদের সফলকাম করেছে।”
জ্ঞানী পর্যবেক্ষক নিজেই দেখতে পারেন হযরত আলী (রা.) এখানে কাকে খিলাফত লাভের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করছেন।
# এর আর একটি অনুবাদ হতে পারে, “আমি তোমাকে দুনিয়াবাসীদের জন্য রহমতে পরিণত করেই পাঠিয়েছি।” উভয় অবস্থায়ই এর অর্থ হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন আসলে মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ। কারণ, তিনি এসে গাফলতিতে ডুবে থাকা দুনিয়াকে জাগিয়ে দিয়েছেন। তাকে সত্য ও মিথ্যার মধ্যে ফারাক করার জ্ঞান দিয়েছেন। দ্বিধাহীন ও সংশয় বিমুক্ত পদ্ধতিতে তাকে জানিয়ে দিয়েছেন। তার জন্য ধ্বংসের পথ কোনটি এবং শান্তি ও নিরাপত্তার পথ কোনটি। মক্কার কাফেররা নবীর ﷺ আগমনকে তাদের জন্য বিপদ ও দুঃখের কারণ মনে করতো। তারা বলতো, এ ব্যক্তি আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে, নখ থেকে গোশত আলাদা করে রেখে দিয়েছে। তাদের একথার জবাবে বলা হয়েছেঃ অজ্ঞের দল! তোমরা যাকে দুঃখ ও কষ্ট মনে করো তা আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রহমত।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১০৪ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা, মহত্ব ও বড়ত্বের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সাত আকাশকে তাঁর ডান হাতে গুটিয়ে নেবেন। লেখক লেখার পর খাতাপত্র যেমন গুটিয়ে নেয় তেমনি আল্লাহ তা‘আলা আকাশকে গুটিয়ে নেবেন।
তারকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যাবে, চন্দ্র-সূর্য আলোহীন হয়ে যাবে। ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: একদা জনৈক ইয়াহূদী পন্ডিত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আগমন করে বলল: হে মুহাম্মাদ! আমরা পাই যে, আল্লাহ তা‘আলা আকাশসমূহ এক আঙ্গুলের ওপর রাখবেন, জমিন এক আঙ্গুলের ওপর রাখবেন, গাছ-পালা এক আঙ্গুলের ওপর রাখবেন, পানি এক আঙ্গুলের ওপর রাখবেন, কাদা এক আঙ্গুলের ওপর রাখবেন এবং সারা সৃষ্টি এক আঙ্গুলের ওপর রাখবেন; অতঃপর বলবেন আমিই রাজাধিরাজ। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার কথার সত্যতার কারণে হেসে দিলেন এমনকি তার দাঁত প্রকাশ পেয়ে গিয়েছিল। তখন তিনি এ আয়াত তেলাওয়াত করেন:
(وَمَا قَدَرُوا اللّٰهَ حَقَّ قَدْرِه۪ وَالْأَرْضُ جَمِيْعًا قَبْضَتُه۫ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَالسَّمَاوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِينِه۪ سُبْحَانَه۫ وَتَعَالٰي عَمَّا يُشْرِكُوْنَ)
“তারা আল্লাহর যথাযথ সম্মান করে না। সমস্ত পৃথিবী কিয়ামতের দিন থাকবে তাঁর হাতের মুষ্ঠিতে এবং আকাশমন্ডলী থাকবে ভাঁজকৃত তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাকে তাঁর সাথে শরীক করে তিনি তার থেকে ঊর্ধ্বে।” (সূরা যুমার ৩৯:৬৭) (সহীহ বুখারী হা: ৪৮১১, সহীহ মুসলিম হা: ২৭৮৬)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় আবার সৃষ্টি করব। আর আমি এতে পূর্ণমাত্রায় সক্ষম। যেমন হাদীসে এসেছে: ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সামনে উলঙ্গ পায়ে ও উলঙ্গ দেহে এবং খাৎনাবিহীন অবস্থায় একত্রিত করা হবে। তারপর তিনি তেলাওয়াত করেন:
(كَمَا بَدَأْنَآ أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيْدُه۫ ط وَعْدًا عَلَيْنَا ط إِنَّا كُنَّا فٰعِلِيْنَ)
‘যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব; এ আমার কৃত ওয়াদা, আমি এটা পালন করবই।” (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৪৭, সহীহ মুসলিম হা: ১০১৭)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা সাত আকাশ গুটিয়ে নেবেন। অতঃপর সকল বস্তু পুনরায় আবার সৃষ্টি করা হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা মহা শক্তি ও ক্ষমতার মালিক যা এ আয়াত থেকে বুঝা যায়।
১০৫-১০৭ নং আয়াতের তাফসীর:
الزَّبُوْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হল সকল নাযিলকৃত আসমানী কিতাব, যেমন তাওরাত, ইঞ্জিল ইত্যাদি। الذِّكْرِ দ্বারা উদ্দেশ্য হল লাওহে মাহফুজ যা সকল কিতাবের মূল। অর্থাৎ লাওহে মাহফুজে লিখার পর সকল আসমানি কিতাবে এ মর্মে লিখা হয়েছে যে, আমার সৎ বান্দারা জান্নাতের অধিকারী হবে।
(الْأَرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصّٰلِحُوْنَ)
‘আমার সৎ কর্মশীল বান্দাগণ পৃথিবীর অধিকারী হবে’ দ্বারা উদ্দেশ্য কী তা নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায় ১. তা হল জান্নাতের জায়গা বা জমিন কিয়ামতের দিন মু’মিন বান্দারা যার উত্তরাধিকারী হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَالُوا الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِيْ صَدَقَنَا وَعْدَه۫ وَأَوْرَثَنَا الْأَرْضَ نَتَبَوَّأُ مِنَ الْجَنَّةِ حَيْثُ نَشَا۬ءُ ج فَنِعْمَ أَجْرُ الْعٰمِلِيْنَ)
“যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে অধিকারী করেছেন এই ভূমির, আমরা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছা বসবাস করব। সুতরাং (সৎ) আমলকারীদের বিনিময় কতই না উত্তম!” (সূরা যুমার ৩৯:৭৪)
২. জমিন দ্বারা উদ্দেশ্য শত্র“দের জমিন মুসলিমরা দুনিয়াতে যার উত্তরাধিকারী হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَعَدَ اللّٰهُ الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ ص وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِيْنَهُمُ الَّذِي ارْتَضٰي لَهُمْ)
“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎ কর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব) দান করবেন, যেমন তিনি খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব) দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন।” (সূরা নুর ২৪:৫৫) অধিকাংশ আলেম প্রথমটাকেই বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের প্রশংসা করে বলেন: নিশ্চয়ই এ কুরআন ইবাদতকারীদের জন্য যথেষ্ট। তারা এ কুরআন অনুসরণ করে ইবাদত করার মাধ্যমে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّآ أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتٰبَ يُتْلٰي عَلَيْهِمْ ط إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَرَحْمَةً وَّذِكْرٰي لِقَوْمٍ يُّؤْمِنُوْنَ)
“এটা কি তাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, যা তাদের নিকট পাঠ করা হয়। তাতে অবশ্যই অনুগ্রহ ও উপদেশ রয়েছে সে কওমের জন্য যারা ঈমান আনে।” (সূরা আনকাবুত ২৯:৫১)
তারপর আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রশংসা করে বলেন: আমি তোমাকে পৃথিবীবাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি। এর অর্থ হল যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাতের ওপর ঈমান আনবে সে আসলে উক্ত করুণা ও রহমতকে গ্রহণ করবে। ফলে সে দুনিয়া ও আখেরাতে সুখ ও শান্তিতে থাকবে। আর যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত বিশ্বজগতের জন্য, সেহেতু তিনি বিশ্বজগতের রহমতরূপে অর্থাৎ নিজের শিক্ষা দ্বারা বিশ্ববাসীকে ইহ-আখিরাতের সুখের সন্ধান দিতে প্রেরিত হয়েছিলেন। কোন কোন বিদ্বান বলেছেন: তাঁকে এ অর্থে বিশ্ববাসীর রহমত বলা হয়েছে যে, তাঁর কারণেই এ উম্মত সমূলে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। যেভাবে পূর্ববর্তী বহু জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, উম্মাতে মুহাম্মাদীকে সেভাবে সমূলে ধ্বংস করা হবে না। হাদীসে এসেছে আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলা হল, হে আল্লাহ তা‘আলার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! মুশরিকদের ওপর বদদু‘আ করুন। রাসুল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আমি বদদু‘আ করার জন্য প্রেরিত হইনি, বরং আমি রহমতস্বরূপ প্রেরিত হয়েছি। (সহীহ মুসলিম হা: ২০০৬, ২০০৭)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا كُنْتَ تَرْجُوْآ أَنْ يُّلْقٰٓي إِلَيْكَ الْكِتٰبُ إِلَّا رَحْمَةً مِّنْ رَّبِّكَ فَلَا تَكُوْنَنَّ ظَهِيْرًا لِّلْكٰفِرِيْنَ)
“তুমি আশা করনি যে, তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করা হবে। এটা কেবল তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। সুতরাং তুমি কখনও কাফিরদের সহায় হয়ো না।” (সূরা ক্বাসাস ২৮:৮৬)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিনরা যদি সঠিক ঈমান ও আমলে ফিরে আসে তাহলে অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলার ওয়াদা অনুসারে জান্নাত পাওয়ার সাথে সাথে দুনিয়ার উত্তরাধিকারী হবেই।
২. কুরআন এমন একটি কিতাব যা মু’মিনদের জন্য সকল দিক থেকে যথেষ্ট।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারা বিশ্বের জন্য রহমত, তাঁর দু‘আয় উম্মতে মুহাম্মাদীকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হবে না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
আল্লাহ তাআলা বলেন যে, এটা কিয়ামতের দিন হবে। তিনি বলেনঃ আমি আকাশকে গুটিয়ে নেবো। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তারা আল্লাহর সেইরূপ মর্যাদা দেয় নাই যেইরূপ তার মর্যাদা দেয়া উচিত ছিল, অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন তার মুষ্টির মধ্যে থাকবে এবং আকাশ সমূহ তার দক্ষিণ হস্তে গুটানো থাকবে, তিনি মহিমান্বিত এবং তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্ধ্বে।” (৩৯:৬৭)।
হযরত ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা সমস্ত যমীনকে স্বীয় মুষ্টির মধ্যে গ্রহণ করবে এবং আকাশসমূহ তার ডান হাতে হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তাআ’লী সপ্ত আকাশ ও ওগুলির মধ্যস্থিত সমস্ত মাখলুক এবং সপ্ত যমীন ও ওগুলির মধ্যস্থিত সবকিছু স্বীয় দক্ষিণ হস্তে গুটিয়ে নিবেন, ওগুলি তাঁর হাতে শরিষার দানার মত থাকবে।” (এটা ইবনু আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
(আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য কিতাব। বলা হয়েছে যে, এখানে (আরবী) দ্বারা ঐ ফেরেশতাকে বুঝানো হয়েছে যার নিকট দিয়ে কারো ইসতিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা উপরে ওঠার সময় তিনি বলেনঃ “এটাকে জ্যোতিরূপে লিপিবদ্ধ কর।” এই ফেরেশতা আমল নামার কাজের উপর নিযুক্ত রয়েছেন। যখন মানুষ মারা যায় তখন তিনি তার কিতাব (আমলনামা) অন্যান্য কিতাবগুলির সাথে গুটিয়ে নিয়ে কিয়ামতের দিনের জন্যে রেখে দেন। একথাও বলা হয়েছে যে, এই নাম হচ্ছে ঐ সাহাবীর যিনি রাসূলুল্লাহর (সঃ) ওয়াহী লেখক ছিলেন। কিন্তু এই রিওয়াইয়াতটি প্রমাণিত নয়। হাদীসের অধিকাংশ হাফি এটাকে মাওযূ’ বা বানোনা কথা বলেছেন। বিশেষ করে আমাদের উসতাদ আল হাফিযুল কাবীর আবুল হাজ্জাজ মুযী (রঃ) এটাকে মাওযূ বলেছেন। আমি এই হাদীসকে একটি পৃথক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেছি। ইমাম আবু জাফর ইবনু জারীরও (রঃ) এই হাদীসের উপর খুবই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন এবং বহুভাবে এটাকে খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেছেন যে, সিজুল নামের কোন সাহাবীই নেই। রাসূলুল্লাহর (সঃ) সমস্ত ওয়াহী লেখকের নাম সুপ্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত হয়ে রয়েছে। তাদের কারো নামই সিজ্বল নেই। বাস্তবিকই ইমাম সাহেব খুব সঠিক কথাই বলেছেন। এ হাদীসটি অস্বীকৃত হওয়ার এটা একটি বড় কারণ। এমন কি এটাও স্মরণ রাখার বিষয় যে, যিনি এই সা হাবীর নাম উল্লেখ করেছেন তিনি এই হাদীসের উপর ভিত্তি করেই তা করেছেন। যখন এই হাদীসই প্রমাণিত নয় তখন উল্লিখিত নামও সম্পূর্ণরূপে ভুল প্রমাণিত হলো। সঠিক কথা এটাই যে, (আরবী) দ্বারা সাহীফা’কেই বুঝানো হয়েছে। অধিকাংশ মুফাসসিরেরও এটাই উক্তি। এর আভিধানিক অর্থও এটাই। সুতরাং অর্থ হলো সেই দিন আমি আকাশকে গুটিয়ে ফেলবো, যেভাবে গুটানো হয় লিখিত দফতর। (আরবী) এখানে (আরবী) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন (আরবী) এখানেও (আরবী) এসেছে (আরবী) অর্থে। অভিধানে এর আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেইভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো। প্রথমে সৃষ্টি করার উপর আমি যখন সক্ষ ছিলাম তখন দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করতে আমি আরো বেশী সক্ষম। এটা আমার প্রতিশ্রুতি। আর প্রতিশ্রুতি পালন আমার কর্তব্য। আমি এটা পালন করবই।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদের সামনে ভাষণ দিতে দাড়িয়ে যান। ভাষণে তিনি বলেনঃ “তোমাদেরকে আল্লাহ তাআলার সামনে উলঙ্গ পায়ে ও উলঙ্গ দেহে এবং খনা বিহীন অবস্থায় একত্রিত করা হবে। মহান আল্লাহ বলেনঃ “যেভাবে আমি প্রথম সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য, আমি তা পালন করবই।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাখরীজ করেছেন) সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পুনরায় সৃষ্টি করা হবে।
১০৫-১০৭ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, তিনি তাঁর সবান্দাদেরকের যেমন আখেরাতে ভাগ্যবান করে থাকেন তেমনই দুনিয়াতেও তাদেরকে রাজ্য ও ধনমাল দান করেন। এটা আল্লাহর নিশ্চিত ওয়াদা এবং সত্য ফায়সালা। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয় যমীন আল্লাহর অধিকারভুক্ত। তিনি তাঁর বান্দাদের যাকে চান ওর ওয়ারিস বানিয়ে দেন, আর উত্তম পরিণাম তো খোদাভীরুদের জন্যেই।” (৭:১২৮) অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসূলদেরকে ও মু’মিনদেরকে পার্থিব জীবনেও সাহায্য করবো এবং যেই দিন সাক্ষীরা দণ্ডায়মান হবে সেই দিনও (অর্থাৎ আখেরাতেও) সাহায্য করবো।” (৪০:৫১) অন্যত্র বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও সৎ কার্যাবলী সম্পাদন করেছে তাদের সঙ্গে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, তিনি তাদেরকে ভূ-পৃষ্ঠে বিজয়ী ও শক্তিমান করবেন যেমন বিজয়ী ও শক্তিমান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে আর তিনি তাদের জন্যে তাদের দ্বীনকে সদঢ় করবেন যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেন ও যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন।” (২৪:৫৫)
আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন যে, এটা শারইয়্যাহ ও কাদরিয়্যাহ কিতাব সমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং এটা অবশ্য অবশ্যই হবে। তাই, তিনি বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘আমি উপদেশের পর কিতাবে লিখে দিয়েছি।’
হযরত সাঈদ ইবনু জুবাইর (রঃ) বলেন যে, ‘যাকূর’ দ্বারা তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ‘যাবুর দ্বারা বুঝানো হয়েছে কিতাবকে। কেউ কেউ বলেন যে, যাবুর হলো ঐ কিতাবের নাম যা হযরত দাউদের (আঃ) উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। এখানে ‘যি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তাওরাত। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, “যি দ্বারা কুরআন কারীমকে বুঝানো হয়েছে। হযরত সাঈদ ইবনু জুবাইর (রঃ) বলেন যে, যি হলো ওটাই যা আকাশে রয়েছে। অর্থাৎ যা আল্লাহর নিকট বিদ্যমান উম্মুল কিতাব, যা সর্বপ্রথম কিতাব। অর্থাৎ লাওহে মাহ। এটাও বর্ণিত আছে যে, যাবুর’ হলো ঐ আসমানী কিতাবসমূহ যে গুলি নবীদের (আঃ) উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। আর যি হলো প্রথম কিতাব অর্থাৎ লাওহে মাহফুয।
হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তাআলা তাওরাত ও যাবুরে এবং আসমান ও যমীন সৃষ্ট হওয়ার পূর্বে তার সাবেক জ্ঞানে খবর দিয়েছেন যে, হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) উম্মত যমীনের বাদশাহ হয়ে যাবে এবং সৎকর্মশীল হয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবে। একথাও বলা হয়েছে যে, যমীন দ্বারা এখানে জান্নাতের যমীন বুঝানো হয়েছে। হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেনঃ “সৎকর্মশীল লোক আমরাই।” সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা মুমিন লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ শেষ নবী হযরত মুহাম্মদের (সঃ) উপর অবতারিত পূর্ণ উপদেশ বাণী রয়েছে ঐ সম্প্রদায়ের জন্যে যারা ইবাদত করে। যারা আমাকে মেনে চলে এবং আমার নামে নিজেদের প্রবৃত্তিকে দমন করে।
অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ হে নবী (সঃ)! আমি তোমাকে বিশ্ব জগতের প্রতি শুধু রহমত বা করুণী রূপেই প্রেরণ করেছি। সুতরাং যারা এই রহমতের কারণে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তারা হবে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম। পক্ষান্তরে, যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা উভয় জগতে হবে ধ্বংস প্রাপ্ত। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে নবী (সঃ)! তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য কর না যারা আল্লাহর অনুগ্রহের বদলে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং তারা তাদের সম্প্রদায়কে নামিয়ে আনে ধ্বংসের ক্ষেত্র জাহান্নামে যার মধ্যে তারা প্রবেশ করবে, কত নিকৃষ্ট এই আবাস স্থল!” (১৪:২৮-২৯)
কুরআন কারীমের গুণাবলী বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “(হে নবী (সঃ)! তুমি বলে দাওঃ মু’মিনদের জন্যে এটা (কুরআন) পথ-নির্দেশ ও ব্যাধির প্রতিকার। কিন্তু যারা অবিশ্বাসী তাদের কর্ণে রয়েছে। বধিরতা এবং কুরআন হবে তাদের জন্যে অন্ধত্ব। তারা এমন যে, যেন তাদেরকে আহ্বান করা হয় বহু দূর হতে!” (৪১:৪৪)।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলা হয়ঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি মুশরিকদের উপর বদ দুআ করুন!” তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমি লানতকারীরূপে প্রেরিত হই নাই, বরং রহমত রূপে প্রেরিত হয়েছি।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছে) অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তো শুধু রহমত ও হিদায়াত।” অন্য রিওয়াইয়াতে এর সাথে এটাও রয়েছেঃ “আমাকে এক কওমের উত্থান ও অন্য কওমের পতনের সাথে প্রেরণ করা হয়েছে।”
বর্ণিত আছে যে, আবৃ জাল একদা বলেঃ “হে কুরায়েশের দল! মুহাম্মদ (সঃ) ইয়াসরিবে (মদীনায়) চলে গেছে এবং পরিভ্রমণকারী প্রহরী সে এদিকে ওদিকে তোমাদের অনুসন্ধানে পাঠিয়ে দিয়েছে। দেখো, তোমরা সদা সতর্ক থাকো। সে ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায় ওৎ পেতে রয়েছে। কেননা, তোমরা তাকে দেশ হতে বিতাড়িত করেছে। আল্লাহর শপথ! তার যাদু অতুলনীয়। আমি যখনই তাকে বা তার যে কোন সঙ্গীকে দেখি তখনই তার সাথে শয়তানি আমার দৃষ্টি গোচর হয়। তোমরা তো জান যে, (মদীনার) আউস ও খাযরাজ গোত্র আমাদের শত্রু। আমাদের এই শত্রুকে ঐ শত্রুরা আশ্রয় দিয়েছে। তার এই কথার জবাবে মুতইম ইবনু আ’দী তাকে বলেনঃ “হে আবুল হাকাম! আল্লাহর কসম! তোমাদের যে ভাইটিকে তোমরা দেশ থেকে বিতাড়িত করেছো তাঁর চেয়ে তো অধিক সত্যবাদী ও প্রতিশ্রুতি পালনকারী আর কাউকেও আমি দেখি নাই! যখন তোমরা এই ভাল লোকটির সাথে দুর্ব্যবহার করেছে তখন তাকে ছেড়ে দাও। তোমাদের এখন উচিত তার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক থাকা।” তখন আবু সুফিয়ান ইবনু হারিস বললোঃ “না, না। বরং তার উপর কঠোরতা অবলম্বন করা উচিত। জেনে রেখো যে, যদি তার পক্ষের লোকেরা তোমাদের উপর জয়যুক্ত হয় তবে তোমাদের কোথাও ঠাঁই মিলবে না। তোমাদের আত্মীয় স্বজনই তোমাদেরকে আশ্রয় দেবে না। সুতরাং তোমাদের উচিত মদীনাবাসীদের উপর এই চাপ সৃষ্টি করা যে, তারা যেন মুহাম্মদকে (সঃ) পরিত্যাগ করে, যাতে সে একাকী হয়ে যায়। যদি তারা এটা অস্বীকার করে তবে তাদের উপর আক্রমণ চালাতে হবে। যদি তোমরা এতে সম্মত হও তবে আমি মদীনার প্রান্তে প্রান্তে সৈন্য মোতায়েন করে দেবো এবং তাদেরকে সমুচিত শিক্ষা প্রদান করবো।” যখন রাসূলুল্লাহর (সঃ) কানে এ সংবাদ পৌঁছলো তখন তিনি বললেনঃ “যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আমি তাদেরকে হত্যা ও ধ্বংস করবো এবং কতকগুলিকে বন্দী করার পর অনুগ্রহ করে ছেড়ে দেবো। আমি হলাম রহমত স্বরূপ। আমাকে দুনিয়া হতে উঠিয়ে নিবেন না, যে পর্যন্ত না তিনি তার দ্বীনকে সারা দুনিয়ার উপর বিজয়ী না করবেন। আমার পাঁচটি নাম রয়েছে। সেগুলি হলোঃ মুহাম্মদ (সঃ), আহমাদ (সঃ), মাহী, কেননা আমার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা কুফরীকে নিশ্চিহ্ন করবেন। আমার চতুর্থ নাম হাশির। কেননা, আমার পায়ের উপর লোকদেরকে একত্রিত করা হবে। আর আমার পঞ্চম নাম হলো আকিব।” (এ হাদীসটি আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। আহমাদ ইবনু সালিহ বলেন: “আমি আশা করি হাদীসটি বিশুদ্ধ)
বর্ণিত আছে যে, হযরত হুযাইফা (রাঃ) মাদায়েনে অবস্থান করছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি এমন কিছু আলোচনা করতেন যা রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন। একদা হযরত হুযাইফা (রাঃ) সালমান ফারসীর (রাঃ) নিকট আগমন করেন। তখন হযরত সালমান (রাঃ) বলেনঃ হে হুযাইফা (রাঃ)! একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় ভাষণে বলেছিলেনঃ “ক্রোধের সময় যদি আমি কাউকেও ভাল মন্দ কিছু বলে দিই বা লানত করি তবে জেনে রেখো যে, আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ। তোমাদের মত আমারও রাগ হয়। হাঁ, তবে যেহেতু আমি সারা বিশ্বের জন্যে রহমত স্বরূপ, সেহেতু আমার প্রার্থনা এই যে, আল্লাহ যেন আমার এই শব্দগুলিকেও মানুষের জন্যে করুণার কারণ বানিয়ে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এখন বাকী থাকলো এই কথা যে, কাফিরদের জন্যে কি করে তিনি রহমত হতে পারেন? এই উত্তরে বলা যেতে পারেঃ হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে এই আয়াতেরই তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, মু’মিনদের জন্যে তো তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে রহমত স্বরূপ ছিলেন। কিন্তু যারা মুমিন নয় তাদের জন্যে তিনি দুনিয়াতেই রহমত স্বরূপ ছিলেন। তারা তাঁরই র হমতের বদৌলতে যমীনে ধ্বসে যাওয়া হতে, আকাশ হতে পাথর বর্ষণ হতে রক্ষা পেয়ে যায়। পূর্ববর্তী অবাধ্য উম্মতদের উপর এই শাস্তি এসেছিল। (এটা ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#939)
[ أَنَّ الاَْرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ
My righteous servants shall inherit the land.]
Sura:21
Sura: Al-Anbiyaa
Ayat: 104- 107
www.motaher21.net
21:104
یَوۡمَ نَطۡوِی السَّمَآءَ کَطَیِّ السِّجِلِّ لِلۡکُتُبِ ؕ کَمَا بَدَاۡنَاۤ اَوَّلَ خَلۡقٍ نُّعِیۡدُہٗ ؕ وَعۡدًا عَلَیۡنَا ؕ اِنَّا کُنَّا فٰعِلِیۡنَ ﴿۱۰۴﴾
The Day when We will fold the heaven like the folding of a [written] sheet for the records. As We began the first creation, We will repeat it. [That is] a promise binding upon Us. Indeed, We will do it.
The Heavens will be rolled up on the Day of Resurrection
Allah says:this will happen on the Day of Resurrection:
يَوْمَ نَطْوِي السَّمَاء كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ
And (remember) the Day when We shall roll up the heaven like a Sijill for books.
This is like the Ayah:
وَمَا قَدَرُواْ اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ وَالاٌّرْضُ جَمِيعـاً قَبْضَـتُهُ يَوْمَ الْقِيَـمَةِ وَالسَّمَـوَتُ مَطْوِيَّـتٌ بِيَمِينِهِ سُبْحَـنَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
They made not a just estimate of Allah such as is due to Him. And on the Day of Resurrection the whole of the earth will be grasped by His Hand and the heavens will be rolled up in His Right Hand. Glorified be He, and High be He above all that they associate as partners with Him! (39:67)
Al-Bukhari recorded that Nafi` reported from Ibn Umar that the Messenger of Allah said:
إِنَّ اللهَ يَقْبِضُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الاَْرَضِينَ وَتَكُونُ السَّمَوَاتُ بِيَمِينِه
On the Day of Resurrection, Allah will seize the earth and the heavens will be in His Right Hand.
This was recorded by Al-Bukhari, may Allah have mercy on him.
كَطَيِّ السِّجِلِّ لِلْكُتُبِ
like a Sijill rolled up for books.
What is meant by Sijill is book.
As-Suddi said concerning this Ayah:
“As-Sijill is an angel who is entrusted with the records; when a person dies, his Book (of deeds) is taken up to As-Sijill, and he rolls it up and puts it away until the Day of Resurrection.”
But the correct view as narrated from Ibn Abbas is that;
As-Sijill refers to the record (of deeds).
This was also reported from him by Ali bin Abi Talhah and Al-`Awfi.
This was also stated by Mujahid, Qatadah and others.
This was the view favored by Ibn Jarir, because this usage is well-known in the (Arabic) language.
Based on the above, the meaning is:
the Day when the heaven will be rolled up like a scroll. This is like the Ayah:
فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ
Then, when they had both submitted themselves (to the will of Allah), and he had laid him prostrate on his forehead. (37:103)
There are many more linguistic examples in this respect.
Allah knows best.
كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ
As We began the first creation, We shall repeat it. (It is) a promise binding upon Us. Truly, We shall do it.
means, this will inevitably come to pass on the Day when Allah creates His creation anew. As He created them in the first place, He is surely able to re-create them. This must inevitably come to pass because it is one of the things that Allah has promised, and He does not break His promise. He is able to do that. Because He says:
إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ
(Truly, We shall do it).
Imam Ahmad recorded that Ibn Abbas said:
“The Messenger of Allah stood among us exhorting us, and said:
إِنَّكُمْ مَحْشُورُونَ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلاً
كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ
You will be gathered before Allah barefoot, naked and uncircumcised.
As We began the first creation, We shall repeat it. (It is) a promise binding upon Us. Truly, We shall do it.
And he mentioned the entire Hadith.
It was also recorded in the Two Sahihs, and Al-Bukhari mentioned it in his Tafsir of this Ayah
21:105
وَ لَقَدۡ کَتَبۡنَا فِی الزَّبُوۡرِ مِنۡۢ بَعۡدِ الذِّکۡرِ اَنَّ الۡاَرۡضَ یَرِثُہَا عِبَادِیَ الصّٰلِحُوۡنَ ﴿۱۰۵﴾
And We have already written in the book [of Psalms] after the [previous] mention that the land [of Paradise] is inherited by My righteous servants.
The Earth will be inherited by the Righteous
Allah tells us of His decree for His righteous servants who are the blessed in this world and in the Hereafter, those who will inherit the earth in this world and in the Hereafter.
As Allah says:
إِنَّ الَارْضَ للَّهِ يُورِثُهَا مَن يَشَأءُ مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَـقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ
Verily, the earth is Allah’s. He gives it as a heritage to whom He wills of His servants; and the (blessed) end is for those who have Taqwa. (7:128)
إِنَّا لَنَنصُرُ رُسُلَنَا وَالَّذِينَ ءَامَنُواْ فِى الْحَيَوةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ يَقُومُ الاٌّشْهَـدُ
Verily, We will indeed make victorious Our Messengers and those who believe in this world’s life and on the Day when the witnesses will stand forth. (40:51)
وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ ءامَنُواْ مِنْكُمْ وَعَمِلُواْ الصَّـلِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِى الاْرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِى ارْتَضَى لَهُمْ
Allah has promised those among you who believe and do righteous good deeds, that He will certainly grant them succession in the land, as He granted it to those before them, and that He will grant them the authority to practice their religion which He has chosen for them. (24:55)
Allah tells us that this is recorded in the Books of Divine Laws and Decrees, and that it will inevitably come to pass.
Allah says:
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ
And indeed We have written in Az-Zabur after Adh-Dhikr,
Al-A`mash said:”I asked Sa`id bin Jubayr about the Ayah:
وَلَقَدْ كَتَبْنَا فِي الزَّبُورِ مِن بَعْدِ الذِّكْرِ
(And indeed We have written in Az-Zabur after Adh-Dhikr, He said:
`Az-Zabur means the Tawrah, the Injil and the Qur’an.”‘
Mujahid said,
“Az-Zabur means the Book.”
Ibn Abbas, Ash-Sha`bi, Al-Hasan, Qatadah and others said,
“Az-Zabur is that which was revealed to Dawud, and Adh-Dhikr is the Tawrah.”
Mujahid said:
“Az-Zabur means the Books which came after Adh-Dhikr, and Adh-Dhikr is the Mother of the Book (Umm Al-Kitab) which is with Allah.”
This was also the view of Zayd bin Aslam:
“It is the First Book.”
Ath-Thawri said:
“It is Al-Lawh Al-Mahfuz.”
أَنَّ الاَْرْضَ يَرِثُهَا عِبَادِيَ الصَّالِحُونَ
that My righteous servants shall inherit the land.
Mujahid said, narrating from Ibn Abbas,
“This means, the land of Paradise.”
This was also the view of Abu Aliyah, Mujahid, Sa`id bin Jubayr, Ash-Sha`bi, Qatadah, As-Suddi, Abu Salih, Ar-Rabi` bin Anas and Ath-Thawri (may Allah have mercy on them).
إِنَّ فِي هَذَا لَبَلَغًا لِّقَوْمٍ عَابِدِينَ
21:106
اِنَّ فِیۡ ہٰذَا لَبَلٰغًا لِّقَوۡمٍ عٰبِدِیۡنَ ﴿۱۰۶﴾ؕ
Indeed, in this [Qur’an] is notification for a worshipping people.
Verily, in this (the Qur’an) there is a plain Message for people who worship Allah.
means, `in this Qur’an which We have revealed to Our servant Muhammad, there is a plain Message which is beneficial and is sufficient for a people who worship Allah.’
This refers to those who worship Allah in the manner which He has prescribed and which He loves and is pleased with, and they would rather obey Allah than follow the Shaytan or their own desires.
Muhammad is a Mercy to the Worlds
Allah says:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
21:107
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ اِلَّا رَحۡمَۃً لِّلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۰۷﴾
And We have not sent you, [O Muhammad], except as a mercy to the worlds.
And We have sent you not but as a mercy for the `Alamin.
Here Allah tells us that He has made Muhammad a mercy to the `Alamin, i.e., He sent him as a mercy for all of them (peoples), so whoever accepts this mercy and gives thanks for this blessing, will be happy in this world and in the Hereafter. But whoever rejects it and denies it, will lose out in this world and in the Hereafter, as Allah says:
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ بَدَّلُواْ نِعْمَتَ اللَّهِ كُفْرًا وَأَحَلُّواْ قَوْمَهُمْ دَارَ الْبَوَارِ
جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا وَبِيْسَ الْقَرَارُ
Have you not seen those who have changed the blessings of Allah into disbelief, and caused their people to dwell in the house of destruction Hell, in which they will burn, — and what an evil place to settle in! (14:28-29)
And Allah says, describing the Qur’an:
قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْ هُدًى وَشِفَأءٌ وَالَّذِينَ لَا يُوْمِنُونَ فِى ءَاذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى أُوْلَـيِكَ يُنَادَوْنَ مِن مَّكَانٍ بَعِيدٍ
Say:”It is for those who believe, a guide and a healing. And as for those who disbelieve, there is heaviness in their ears, and it is blindness for them. They are those who are called from a place far away.” (41:44)
Muslim reports in his Sahih:Ibn Abi `Umar told us, Marwan Al-Fazari told us, from Yazid bin Kisan, from Ibn Abi Hazim that Abu Hurayrah said that;
it was said, “O Messenger of Allah, pray against the idolators.”
He said:
إِنِّي لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَة
I was not sent as a curse, rather I was sent as a mercy.
This was recorded by Muslim.
Imam Ahmad recorded that `Amr bin Abi Qurrah Al-Kindi said:
“Hudhayfah was in Al-Mada’in and he was mentioning things that the Messenger of Allah had said.
Hudhayfah came to Salman and Salman said:`O Hudhayfah, the Messenger of Allah (would sometimes be angry and would speak accordingly, and would sometimes be pleased and would speak accordingly. I know that the Messenger of Allah) addressed us and said:
أَيُّمَا رَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي سَبَبْتُهُ سَبَّةً فِي غَضَبِي أَوْ لَعَنْتُهُ لَعْنَةً فَإِنَّمَا أَنَا رَجُلٌ مِنْ وَلَدِ ادَمَ أَغْضَبُ كَمَا تَغْضَبُونَ إِنَّمَا بَعَثَنِي اللهُ رَحْمَةً لِلْعَالَمِينَ فَاجْعَلْهَا صَلَةً عَلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَة
Any man of my Ummah whom I have insulted or cursed when I was angry — for I am a man from among the sons of Adam, and I get angry just as you do. But Allah has sent me as a Mercy to the Worlds, so I will make that (my anger) into blessings for him on the Day of Resurrection.”
This was also recorded by Abu Dawud from Ahmad bin Yunus from Za’idah.
It may be asked:what kind of mercy do those who disbelieve in him get?
The answer is what Abu Jafar bin Jarir recorded from Ibn Abbas concerning the Ayah:
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ
(And We have sent you not but as a mercy for the `Alamin), He said,
“Whoever believes in Allah and the Last Day, mercy will be decreed for him in this world and in the Hereafter;
whoever does not believe in Allah and His Messenger, will be protected from that which happened to the nations of earthquakes and stoning.”
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran