أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৪৬)
[ لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاوُهَا
আল্লাহর কাছে কখনোও ওগুলির গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না;]
সূরা:- আল্ – হাজ্জ।
সুরা:২২
২৬-৩৭ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২২:২৬
وَ اِذۡ بَوَّاۡنَا لِاِبۡرٰہِیۡمَ مَکَانَ الۡبَیۡتِ اَنۡ لَّا تُشۡرِکۡ بِیۡ شَیۡئًا وَّ طَہِّرۡ بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡقَآئِمِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ ﴿۲۶﴾
স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন আমি ইবরাহীমের জন্য এ ঘরের (কাবাঘর) জায়গা নির্ধারণ করেছিলাম (এ নির্দেশনা সহকারে) যে, আমার সাথে কোন জিনিসকে শরীক করবে না এবং আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও রুকূ’-সিজদা-কিয়ামকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।
২২:২৭
وَ اَذِّنۡ فِی النَّاسِ بِالۡحَجِّ یَاۡتُوۡکَ رِجَالًا وَّ عَلٰی کُلِّ ضَامِرٍ یَّاۡتِیۡنَ مِنۡ کُلِّ فَجٍّ عَمِیۡقٍ ﴿ۙ۲۷﴾
এবং লোকদেরকে হজ্বের জন্য সাধারণ হুকুম দিয়ে দাও, তারা প্রত্যেকে দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে ও উটের পিঠে চড়ে।
২২:২৮
لِّیَشۡہَدُوۡا مَنَافِعَ لَہُمۡ وَ یَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰہِ فِیۡۤ اَیَّامٍ مَّعۡلُوۡمٰتٍ عَلٰی مَا رَزَقَہُمۡ مِّنۡۢ بَہِیۡمَۃِ الۡاَنۡعَامِ ۚ فَکُلُوۡا مِنۡہَا وَ اَطۡعِمُوا الۡبَآئِسَ الۡفَقِیۡرَ ﴿۫۲۸﴾
তোমার কাছে আসবে, যাতে এখানে তাদের জন্য যে কল্যাণ রাখা হয়েছে তা তারা দেখতে পায় এবং তিনি তাদেরকে যেসব পশু দান করেছেন তার উপর কয়েকটি নির্ধারিত দিনে আল্লাহর নাম নেয় নিজেরাও খাও এবং দুর্দশাগ্রস্ত অভাবীকেও খাওয়াও।
২২:২৯
ثُمَّ لۡیَقۡضُوۡا تَفَثَہُمۡ وَ لۡیُوۡفُوۡا نُذُوۡرَہُمۡ وَ لۡیَطَّوَّفُوۡا بِالۡبَیۡتِ الۡعَتِیۡقِ ﴿۲۹﴾
অতঃপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন (কা’বা) গৃহের।
২২:৩০
ذٰلِکَ ٭ وَ مَنۡ یُّعَظِّمۡ حُرُمٰتِ اللّٰہِ فَہُوَ خَیۡرٌ لَّہٗ عِنۡدَ رَبِّہٖ ؕ وَ اُحِلَّتۡ لَکُمُ الۡاَنۡعَامُ اِلَّا مَا یُتۡلٰی عَلَیۡکُمۡ فَاجۡتَنِبُوا الرِّجۡسَ مِنَ الۡاَوۡثَانِ وَ اجۡتَنِبُوۡا قَوۡلَ الزُّوۡرِ ﴿ۙ۳۰﴾
এ ছিল (কাবা নির্মাণের উদ্দেশ্য) এবং যে কেউ আল্লাহ প্রতিষ্ঠিত পবিত্র অনুষ্ঠানগুলোকে সম্মান করবে, তার রবের কাছে এ হবে তারই জন্য ভালো। আর তোমাদের জন্য গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু হালাল করে দেয়া হয়েছে, সেগুলো ছাড়া যেগুলো তোমাদের বলে দেয়া হয়েছে। কাজেই মূর্তিসমূহের আবর্জনা থেকে বাঁচো, মিথ্যা কথা থেকে দূরে থাকো,
২২:৩১
حُنَفَآءَ لِلّٰہِ غَیۡرَ مُشۡرِکِیۡنَ بِہٖ ؕ وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰہِ فَکَاَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَآءِ فَتَخۡطَفُہُ الطَّیۡرُ اَوۡ تَہۡوِیۡ بِہِ الرِّیۡحُ فِیۡ مَکَانٍ سَحِیۡقٍ ﴿۳۱﴾
আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হয়ে, তাঁর কোন শরীক না করে; আর যে কেউ আল্লাহর শরীক করে (তার অবস্থা) সে যেন আকাশ হতে পড়ল, অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, কিংবা বায়ু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।
২২:৩২
ذٰلِکَ ٭ وَ مَنۡ یُّعَظِّمۡ شَعَآئِرَ اللّٰہِ فَاِنَّہَا مِنۡ تَقۡوَی الۡقُلُوۡبِ ﴿۳۲﴾
এ হচ্ছে আসল ব্যাপার (এটি বুঝে নাও), আর যে ব্যক্তি আল্লাহ নির্ধারিত রীতি-নীতির প্রতি সম্মান দেখায়, তার সে কাজ তার অন্তরের আল্লাহভীতির পরিচায়ক।
২২:৩৩
لَکُمۡ فِیۡہَا مَنَافِعُ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ثُمَّ مَحِلُّہَاۤ اِلَی الۡبَیۡتِ الۡعَتِیۡقِ ﴿٪۳۳﴾
একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের ঐ সমস্ত (কুরবানীর পশু) থেকে উপকার লাভের অধিকার আছে। তারপর ওগুলোর (কুরবানী করার) জায়গা এ প্রাচীন ঘরের নিকটেই।
২২:৩৪
وَ لِکُلِّ اُمَّۃٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا لِّیَذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰہِ عَلٰی مَا رَزَقَہُمۡ مِّنۡۢ بَہِیۡمَۃِ الۡاَنۡعَامِ ؕ فَاِلٰـہُکُمۡ اِلٰہٌ وَّاحِدٌ فَلَہٗۤ اَسۡلِمُوۡا ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُخۡبِتِیۡنَ ﴿ۙ۳۴﴾
প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে (সে উম্মতের) লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদেরকে দিয়েছেন।৬৪ (এ বিভিন্ন নিয়মের উদ্দেশ্য একই) কাজেই তোমাদের ইলাহও সে একজনই এবং তোমরা তাঁরই ফরমানের অনুগত হয়ে যাও। আর হে নবী! সুসংবাদ দিয়ে দাও বিনয়ের নীতি অবলম্বনকারীদেরকে,
২২:৩৫
الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰہُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُہُمۡ وَ الصّٰبِرِیۡنَ عَلٰی مَاۤ اَصَابَہُمۡ وَ الۡمُقِیۡمِی الصَّلٰوۃِ ۙ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰہُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ﴿۳۵﴾
যাদের অবস্থা এই যে, আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে, যে বিপদই তাদের ওপর আসে তার ওপর তারা সবর করে, নামায কায়েম করে এবং যা কিছু রিযিক তাদেরকে আমি দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।
২২:৩৬
وَ الۡبُدۡنَ جَعَلۡنٰہَا لَکُمۡ مِّنۡ شَعَآئِرِ اللّٰہِ لَکُمۡ فِیۡہَا خَیۡرٌ ٭ۖ فَاذۡکُرُوا اسۡمَ اللّٰہِ عَلَیۡہَا صَوَآفَّ ۚ فَاِذَا وَجَبَتۡ جُنُوۡبُہَا فَکُلُوۡا مِنۡہَا وَ اَطۡعِمُوا الۡقَانِعَ وَ الۡمُعۡتَرَّ ؕ کَذٰلِکَ سَخَّرۡنٰہَا لَکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ ﴿۳۶﴾
আর কুরবানীর উটকে আমি করেছি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত; তোমাদের জন্য রয়েছে তার মধ্যে কল্যাণ। কাজেই তাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে৬৯ তাদের ওপর আল্লাহর নাম নাও। আর যখন (কুরবানীর পরে) তাদের পিঠ মাটির সাথে লেগে যায়৭ তখন তা থেকে নিজেরাও খাও এবং তাদেরকেও খাওয়াও যারা পরিতুষ্ট হয়ে বসে আছে এবং তাদেরকেও যারা নিজেদের অভাব পেশ করে। এ পশুগুলোকে আমি এভাবেই তোমাদের জন্য বশীভূত করেছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।
২২:৩৭
لَنۡ یَّنَالَ اللّٰہَ لُحُوۡمُہَا وَ لَا دِمَآؤُہَا وَ لٰکِنۡ یَّنَالُہُ التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡ ؕ کَذٰلِکَ سَخَّرَہَا لَکُمۡ لِتُکَبِّرُوا اللّٰہَ عَلٰی مَا ہَدٰىکُمۡ ؕ وَ بَشِّرِ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۳۷﴾
আল্লাহর কাছে কখনোও ওগুলির গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া (সংযমশীলতা); এভাবে তিনি ওগুলিকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে।
২৬-৩৭ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*হজ্জের তাৎপর্য ও কা’বা নির্মাণের ইতিহাস : অতপর মাসজিদুল হারামের নির্মাণের ইতিহাস পুনরুল্লেখ করা হচ্ছে। কারণ আজ এই মাসজিদুল হারামে বসেই মােশরেকরা চরম স্বৈরাচারী আচরণ করে চলেছে। যারা আল্লাহর একত্বে বিশ্বাসী ও পৌত্তলিকতার নােংরামি থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তাদেরকে সেখানে যেতে দিচ্ছে না। বলা হচ্ছে যে, এই পবিত্র কাবাগৃহ আল্লাহর প্রত্যক্ষ নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর হাতে নির্মিত হয়েছিলাে এবং একে শিরক ও পৌত্তলিকতা থেকে পবিত্র ঘােষণা করা হয়েছিলাে। একে তাওহীদের ভিত্তির ওপরই এক আল্লাহর এবাদাতের উদ্দেশ্যেই এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এর তওয়াফকারীদের জন্যেই নির্মাণ করা হয়েছিলাে, ‘ম্মরণ করাে, যখন আমি ইবরাহীম(আ.)-কে এই গৃহের স্থান নির্ধারণ করে বলেছিলাম যে…'(আয়াত ২৬-২৯) এখানে স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে যে, নির্মাণের প্রথম মুহূর্ত থেকেই এ পবিত্র গৃহ শুধু তাওহীদের উদ্দেশ্যেই তৈরী হয়েছে। ইবরাহীম(আ.)-কে আল্লাহ তায়ালা এর স্থান দেখিয়ে দিয়ে তাকে ক্ষমতা দিয়েছেন যেন তিনি এই ভিত্তির ওপর তা নির্মাণ করেন। তাকে বলেছেন যে, ‘আমার সাথে আর কাউকে শরীক করাে না’ কেননা এটা একমাত্র আল্লাহর ঘর, আর কারাে নয়। তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, একে হাজী ও নামাজের জন্যে, রুকু ও সেজদাকারীদের জন্যে পবিত্র করাে। কেননা এ ঘর তাদের জন্যেই নির্মিত পৌত্তলিকদের জন্যে নয়। অতপর কা’বা গৃহের নির্মাতা হযরত ইবরাহীম(আ.) যখন প্রদত্ত নির্দেশ মােতাবেক উল্লেখিত ভিত্তির ওপর তার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে আদেশ দিলেন যেন তিনি মানুষকে আল্লাহর সম্মানিত ঘরে হজ্জ করার জন্যে আহ্বান করেন। তিনি তাকে প্রতিশ্রুতিও দিলেন যে, লােকেরা তার আহ্বানে সাড়া দেবে, তারা তার কাছে পায়ে হেঁটেও আসবে, ক্ষুধায় ও দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে যাওয়া উঠের পিঠে সওয়ার হয়েও আসবে। ইবরাহীম(আ.)-এর সময় থেকেই আজ পর্যন্ত আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি পালিত হয়ে আসছে। বহু লােকের হৃদয় আল্লাহর ঘরের প্রতি উৎসুক, তার তাওয়াফ ও দর্শনের জন্যে উদগ্রীব। সমর্থ ও সচ্ছল লােকেরা বিভিন্ন পশুর পিঠে ও বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে আসে। আর যে দরিদ্র ব্যক্তির পা ছাড়া আর কোনাে বাহন নেই সে পায়ে হেঁটেই আসে। হাজার হাজার বছর ধরে এভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ হযরত ইবরাহীমের কণ্ঠে উচ্চারিত আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে। এ আয়াত ক’টিতে হজ্জের কিছু কিছু উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, ‘যাতে তারা বহুবিধ কল্যাণ লাভ করে, নির্দিষ্ট দিনগুলােতে সেইসব চতুস্পদ জন্তু যবেহ করার সময়, যা তাদেরকে তিনি রিযিক হিসেবে দান করেছেন। অতপর তােমরা নিজেরাও খাও, বিপন্ন ও অভাবীকেও খাওয়াও।’ ‘তারপর তারা যেন দূর করে ফেলে নিজেদের শরীরের অপরিচ্ছন্নতা এবং নিজেদের মান্নত পূর্ণ করে ও প্রাচীন কা’বা গৃহের তাওয়াফ করে।’ হাজীরা বহুবিধ কল্যাণ লাভ করে থাকে। হজ্জ একটা মৌসুমও, সম্মেলনও। হজ্জ একদিকে যেমন বাণিজ্যের মৌসুম, অপরদিকে তেমনি এবাদাতেরও মৌসুম। হজ্জ মুসলমানদের আন্তর্জাতিক মহামিলনের ক্ষেত্র ও পারস্পরিক পরিচয় আদান প্রদান ক্ষেত্র, পারস্পরিক সহযােগিতা ও সমন্বয়ের সম্মেলন। এটা এমন একটা ফরয এবাদাত, যার ভেতরে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গার স্বার্থের সমাবেশ যেমন ঘটেছে, তেমনি সমাবেশ ঘটেছে দূরবর্তী ও নিকটবর্তী আকীদা বিশ্বাসের স্মৃতিচারণের। ব্যবসায়ীরা হজ্জের মৌসুমে একটা চালু বাজার পেয়ে যান। সকল ধরনের ফলমূল পৃথিবীর সকল অঞ্চল থেকে এখানে আসে। হাজীরা প্রত্যেক দেশ থেকে আগমন করেন, আর তাদের সাথে এই সম্মানিত দেশে একই মৌসুমে বিপুল অর্থের সমাগম ঘটে, যা বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকে। এক কথায় বলা যায়, এটা একটা পবিত্র এবাদাতের মৌসুম হওয়া সত্তেও পাশাপাশি একটা আন্তর্জাতিক বাৎসরিক বাণিজ্যিক মেলাও, যেখানে সব ধরনের উৎপাদিত পণ্যের সমাবেশ ঘটে থাকে। এটা এমন একটা এবাদাতের মৌসুম, যখন মানুষের অন্তরাত্মা সর্বোচ্চ নিষ্ঠা ও একাগ্রতা লাভ করে, আল্লাহর মহা সম্মানিত ঘরে আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে অবস্থানের সুখ ও তৃপ্তি উপভােগ করে। এই ঘরের চারপাশে অবস্থানের সময়কালে মানবাত্মা এই ঘরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত নিকট ও দুর অতীতের সকল পবিত্র স্মৃতি রোমন্থন করে। রােমন্থন করে আল্লাহর বন্ধু হযরত ইবরাহীম(আ)-এর সেই সময়কার স্মৃতি, যখন তিনি এই ঘরের কাছে তার স্ত্রী পুত্রকে রেখে যান এবং আল্লাহর প্রতি নিজের মনের সকল আবেগকে উজাড় করে দিয়ে এই বলে আকুতি জানান যে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক আমি তােমার সম্মানিত ঘরের কাছে একটা চাষাবাদহীন অনুর্বর উপত্যকায় আমার বংশধরের একাংশকে আবাসিত করে রেখে এসেছি। হে আমার প্রতিপালক! আমার উদ্দেশ্য এই যে, ওরা নামায কায়েম করুক। সুতরাং আপনি কিছু লােকের অন্তর তাদের দিকে আকৃষ্ট করে দিন এবং ফলমূল দিয়ে তাদের জীবিকার ব্যবস্থা করুন যাতে তারা শােকর আদায় করে।’ কল্পনায় ভেসে ওঠে হযরত হাজেরার ছবি, যখন তিনি পবিত্র কাবা ঘরের পার্শ্ববর্তী সেই রৌদ্রতপ্ত প্রান্তরে হন্তদন্ত হয়ে নিজের জন্যে ও নিজের দুগ্ধপােষ্য শিশুর জন্যে পানি খুঁজে বেড়িয়েছিলেন। পিপাসায় কাতর শিশু পুত্রের স্নেহের ডােরে আবদ্ধ, জননী হাজেরা সাফা ও মারওয়ার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে একনাগাড়ে ছয়বার ছুটাছুটি করে শ্রান্ত ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে যখন সপ্তম বারে সন্তানের কাছে ফিরে আসেন, তখন সহসাই দেখতে পান শিশু পুত্রের কাছেই যমযমের ঝর্ণা ফুটে বেরিয়েছে। দেখতে পান হতাশায় আচ্ছন্ন সেই অনুর্বর মরুপ্রান্তরে আত্মপ্রকাশ করছে আল্লাহর রহমতের প্রস্রবণ। মনে পড়ে যায় হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সেই স্বপ্নের স্মৃতিবিজড়িত কাহিনী, যা দেখার পর তিনি নিজের কলিজার টুকরােকে নির্দ্বিধায় কোরবানী করতে প্রস্তুত হয়ে যান। আল্লাহর প্রতি পরম আনুগত্যের পরিচয় দিয়ে ছেলেকে খােলাখুলি বলে দেন, ‘আমি স্বপ্নে দেখেছি যেন তােমাকে যবাই করছি। এখন ভেবে দেখো, তােমার মতামত কী।’ একই রকম নিবেদিত প্রাণ ছেলে পূর্ণ সন্তুষ্টি সহকারে বলেন, ‘হে পিতা! যা আদিষ্ট হয়েছেন তা করে ফেলুন। আল্লাহ তায়ালা চাহে তাে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’ এরপর সহসাই আল্লাহর রহমত নাযিল হয়ে যায় বিকল্প কোরবানীর পশুর আকারে, ‘আমি তাকে ডেকে বললাম, ওহে ইবরাহীম, তুমি তোমার স্বপ্নকে স্বার্থক করেছো। এরূপ সৎ কর্মশীলদেরকে আমি এভাবে পুরস্কৃত করি। এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে একটা মহান বিকল্প কোরবানীর জন্তু দিলাম।’ মনে পড়ে যায় হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈল(আ.)-এর কা’বা ঘর নির্মাণের সাথে সাথে তাদের বিনীত দোয়া- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করাে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে তােমার অনুগত বানাও, আর আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে একটা অনুগত জাতি সৃষ্টি করো। আমাদের এবাদাতের পন্থা শিখিয়ে দাও এবং আমাদেরকে ক্ষমা করাে। তুমি তো অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ এসব স্মৃতির পাশাপাশি মনে পড়ে যায় আব্দুল মুত্তালিবের স্মৃতিও। তিনি মান্নত করলেন, আল্লাহ তায়ালা তাকে দশটা ছেলে দিলে দশম ছেলেকে কোরবানী করবেন। মােহাম্মদ (স.)-এর পিতা আব্দুল্লাহ সেই দশম ছেলে হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেন। আব্দুল মুত্তালিব নিজের অংগীকার পুরণে উদগ্রীব হয়ে উঠলে তার গােত্রের লােকেরা তাকে বিকল্প কোরবানীর প্রস্তাব দেয়। তিনি কা’বা গৃহের পাশে লটারির ব্যবস্থা করলেন। প্রতিবার আব্দুল্লাহর নামে লটারী বের হয়। দশম বারের পর আদুল্লাহর পরিবর্তে কোরবানীর পরিমাণ দাঁড়ায় একশাে উট। অতপর বিকল্প কোরবানী গৃহীত হয় এবং আব্দুল্লাহর প্রাণ রক্ষা পায়। তাও রক্ষা পায় শুধু এজন্যে যে, আমেনার গর্ভে যেন সৃষ্টির সেরা মােহাম্মদ(স.)-এর সেই কোরায়শ শুক্র বিন্দুটি রক্ষিত হয়। এর পর পরই আব্দুল্লাহর মৃত্যু ঘটে। অর্থাৎ কিনা, আল্লাহ তায়ালা তাকে একমাত্র এই মহান ইচ্ছা পূরণের জন্যেই যবাই হওয়া থেকে অব্যাহতি দেন। এরপর আরাে কত স্মৃতি চিত্ত পটে একে একে ভাসতে থাকে। এই পবিত্র ভূমিতেই মােহাম্মদ(স.) তার শৈশব ও কৈশাের কাটান এই ঘরেরই চারপাশে। তিনি নিজ হাতে হাজরে আসওয়াদকে যথাস্থানে স্থাপন করে কোরায়শ গােত্রগুলােকে এক অনিবার্য সংঘাতের কবল থেকে রক্ষা করেন। এখানেই তিনি নামায পড়তেন, তওয়াফ করতেন, ভাষণ দিতেন, ইতেকাফ করতেন, তার সেই সব স্মৃতি জ্বলজ্যান্ত হয়ে মানসপটে ভেসে ওঠে। প্রত্যেক হাজী এসব দৃশ্যকে যেন সেখানে চাক্ষুস দেখতে পায়। হজ্জ সারাবিশ্বের মুসলমানদের সমবেত হওয়ার মহা মিলন ক্ষেত্রে ও মহা সম্মেলন। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম(আ.) থেকে শুরু করে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত তাদের মূল জাতিসত্ত্বা এই সম্মেলনের মধ্য দিয়েই প্রফিলিত। ‘এটা তােমাদের পিতা ইবরাহীমের প্রতিষ্ঠিত জাতিসত্ত্বা। তিনি তােমাদেরকে মুসলিম নাম রেখেছেন…'(সূরা হজ্জ) এর মাধ্যমেই সারা দুনিয়ার মুসলমানরা খুঁজে পায় তাদের ঐক্যের অটুট বন্ধন সৃষ্টিকারী সেই কিবলা, যার অভিমুখে দুনিয়ার সকল মুসলমান আপন আপন মনকে নিবিষ্ট ও কেন্দ্রীভূত করে। এটা হচ্ছে তাদের সেই সম্মিলিত আকীদা বিশ্বাসের পতাকা, যার নিচে দেশ, বর্ণ, বংশ ও জাতীয়তার যাবতীয় ভেদাভেদ মুছে একাকার হয়ে যায়, এই পাতাকার নিচে সমবেত হয়েই তারা তাদের ভুলে যাওয়া সেই দুর্জয় শক্তি ফিরে পায়, কোটি কোটি মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করে। একক আকীদা বিশ্বাসের প্রতীক এই পতাকার নিচে সমবেত হলে তারা এমন অজেয় জাতিতে পরিণত হয়, যার সামনে কোনাে বৈরী শক্তি টিকে থাকতে পারে না। হজ্জের মহা সম্মেলন বিশ্ব মুসলিমকে সুযােগ এনে দেয়, বছরে একবার আল্লাহর ঘরের কাছে একত্রিত হয়ে পরস্পরে পরিচিত হওয়ার পরামর্শ করার পরিকল্পনা করার শক্তি সঞ্চয়ের, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের, গণদ্রব্য ও কল্যাণ বিনিময়ের এবং মুসলিম বিশ্বকে পুনরেকত্রিত ও সংঘবদ্ধ করার। এ কাজের জন্যে এর চেয়ে মহৎ স্থান, উপযােগী সময় ও সুন্দর পরিবেশ আর কিছু হতে পারে না। এ কথাটাই আল্লাহ এভাবে বলেছেন, ‘যাতে তারা কল্যাণ লাভ করতে পারে।’ অর্থাৎ প্রত্যেক প্রজন্ম নিজ নিজ যুগের চাহিদা, প্রয়ােজন, পরিবেশ ও অভিজ্ঞতা অনুসারে যা কিছু কল্যাণকর, তা অর্জন করতে পারে। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের ওপর হজ্জ ফরয করার সময়েই মানব জাতির এই সুদূর প্রসারী কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। আর এই দিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি হযরত ইবরাহীমকে বিশ্বময় হজ্জের আহ্বান প্রচারের আদেশ দিয়েছিলেন।
* এরশাদ হচ্ছে, ‘আর স্মরণ করে দেখ, সে সময়ের কথা যখন আমি এই মহান কা’বা ঘরকে সমগ্র মানবমন্ডলীর কেবলা বানিয়েছিলাম এবং নির্দেশ দিয়েছিলাম যে ইবরাহীম এর অবস্থানের জায়গাটিকে তোমরা সেজদার জায়গা বানিয়ে নাও । আর ইবরাহীম ও ইসমাঈল থেকে ওয়াদা নিয়েছিলাম এই বলে যে, তারা দুজনে আমার এই ঘরটিকে তাওয়াফকারী, এখানে অবস্থানকারী এবং রুকু ও সিজদা দানকারীদের জন্যে পবিত্র করে রাখবে ।’ (আয়াত ১২৫) ক্বাবাঘর প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : এক সময় এই পবিত্র কা’বা ঘরের খেদমতের ভার গ্রহণ করে মক্কার কোরায়শরা ৷ এই কারণেই তারা মোমেনদেরকে ভীত সন্তস্ত করে রাখতো, তাদেরকে কষ্ট দিতো এবং দ্বীন-ইসলাম পরিত্যাগ করার জন্যে তাদেরকে চাপ দিতো, যার ফলে তারা নিজেদের আত্মীয়-পরিজনকে ছেড়ে হিজরত করতে বাধ্য হলো। আল্লাহ তায়ালা চেয়েছিলেন, এ ঘরটি দূর-দুরান্তর থেকে আগত সকল মানুষের আশ্রয়স্থলে পরিণত হোক, তাদেরকে কেউ ভয় না দেখাক, বরং তাদের জান-মাল যেন এই ঘরে এসে নিরাপদ হয়ে যায়। চেয়েছিলেন এ ঘরকে শাস্তির আধার, শান্তি-দানকারী এবং নিরাপদ স্থান বানাতে । মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যেন তারা ‘মাকামে ইবরাহীমকে’ নামাযের স্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করে নেয়। বস্তুত মাকামে ইবরাহীম বলতে পুরো ঘরটাকেই বুঝানো হয়েছে। আমরাও এখানে মাকাম ইবরাহীম-এর ব্যাখ্যায় পুরো ঘরকেই বুঝিয়েছি। এখন মুসলমানদের পক্ষে বায়তুল্লাহকে কেবলা হিসেবে গ্রহণ করা এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ব্যাপার, যার ওপর কারো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। এটাই প্রথম কেবলা যার দিকে ইবরাহীম (আ.)-এর যামানা থেকে তার মুসলিম উত্তরাধিকারীরা বরাবর নামায পড়ে এসেছে । নামায পড়েছে তারা যারা সঠিকভাবে তওহীদে বিশ্বাসী ছিলো । তারা জানতো যে এটা আল্লাহরই ঘর-কোন মানুষের নয়। ঘরের যিনি মূল মালিক, তিনি তার দু’জন নেক বান্দাহর কাছ থেকে এ ওয়াদা গ্রহণ করেছিলেন যে, তারা ঘরটিকে যাবতীয় আবিলতা থেকে পরিচ্ছন্ন রাখবে এবং এ ঘরকে সদা-সর্বদা তাওয়াফকারী, এখানে অবস্থানকারী ও রুকু সেজদাদানকারীদের জন্যে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে ৷ চারদিক থেকে আগত হজ্জ যাত্রীদের জন্যে একে প্রস্তুত রাখবে । এ ঘরের রক্ষণা-বেক্ষণকারীরাই হচ্ছে এ ঘরের অবস্থানকারী, যারা তাদের সার্বক্ষণিক দেখাশুনার তাগিদে এখানে থাকতে বাধ্য হয়। আর যারা এখানে নামায পড়বে, রুকু দেবে, সেজদা করবে তারা নিজ নিজ প্রয়োজন মত এখানে আসবে, তাদের কেউই এ ঘরের মালিক নয়, এমন কি ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস্সালামও এ ঘরের মালিক ছিলেন না৷ সুতরাং কেউই উত্তরাধিকার সূত্রে এ ঘরের মালিক হতে পারে না। তারা উভয়ে ছিলেন এ ঘরের খাদেম । তাঁদের কাজ ছিলো এখানে আগত আল্লাহর মোমেন বান্দাহদের জন্যে ঘরটিকে উপযুক্ত সেজদাগাহের উপযোগী বানিয়ে রাখা ৷
# এরশাদ হচ্ছে, “যখন ইবরাহীম বললো, হে আমার রব এ শহরটিকে নিরাপদ বানিয়ে দাও এবং রোজ হাশরের ওপর ঈমান আনয়নকারী এর বাসিন্দাদেরকে নানাপ্রকার ফলমূল থেকে রেযেক (যাবতীয় জীবনধারণকারী সামগ্রী) দান করো । আল্লাহ তায়ালা বললেন, যে কুফরী করবে তাকেও কিন্তু সামান্য কিছু মালমাত্তা আমি দেবো, আর তারপর তাদেরকে দোযখের আগুনে প্রবেশ করতে বাধ্য করবো, আর সে বড়ই নিকৃষ্ট হবে সে প্রত্যাবর্তনস্থল ‘ (আয়াত ১২৬) ইবরাহীম (আ.)-এর দোয়ার মাধ্যমে এই ঘরের নিরাপদ হওয়ার বিষয়টিকে আর একবার তুলে ধরা হলো এবং উত্তরাধিকার বলতে যে শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণ বুঝায় তার গুরুত্বও আর একবার জানিয়ে দেয়া হলো। ইবরাহীম (আ.) প্রথমেই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে উপদেশ পেয়েছিলেন । তিনি তখন থেকেই এ কথাগুলো মনে রেখেছিলেন যখন তার রব তাকে বলেছিলেন, আমার এ ওয়াদা যালেমদের কাছে পৌছবে না । তিনি এ শিক্ষাকে স্মরণ রেখেছিলেন, এইজন্যে তার দোয়াতে এ কথাগুলো দেখা যায়, যেন সে শহরবাসীকে আল্লাহ তায়ালা ফলমুল-দ্বারা রেযেক দান করেন। এখানে এই দোয়ার হকদার বলতে তাদেরকেই বিশেষভাবে বুঝানো হয়েছে যারা সে শহরবাসীর মধ্য থেকে আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের প্রতি ঈমানদার হবে। অবশ্যই ইবরাহীম (আ.) ছিলেন বড়ই বিনয়ী, বড়ই সহিষ্ণু, বড়ই নিষ্ঠাবান এবং সত্যের ধারক ও বাহক হিসেবে অত্যন্ত মজবুত ৷ তিনি ছিলেন তার রব-এর শিক্ষাপ্রাপ্ত, অত্যন্ত পরিমার্জিত আদব-এর প্রতিমূর্তি । তিনি আল্লাহ পাকের কাছে চাওয়ার সময় এই আদবের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রেখেছেন এবং প্রার্থনা জানানোর সময় খুবই বিনয়াবনত থেকেছেন। এই কারণেই তার রব-এর নিকট থেকে তার কাছে স্পষ্ট জওয়াব আসছে । শেষের কথাগুলোর বিষয়ে তিনি মুখ খোলেননি, অর্থাৎ যারা ঈমান আনবে না তাদের পরিণতি সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি ।
# সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-১২৭
وَ اِذْ یَرْفَعُ اِبْرٰهٖمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَیْتِ وَ اِسْمٰعِیْلُ١ؕ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا١ؕ اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِیْعُ الْعَلِیْمُ
আর স্মরণ করো, ইবরাহীম ও ইসমাঈল যখন এই গৃহের প্রাচীর নির্মাণ করছিল, তারা দোয়া করে বলছিলঃ “হে আমাদের রব! আমাদের এই খিদমত কবুল করে নাও। তুমি সবকিছু শ্রবণকারী ও সবকিছু জ্ঞাত।
#এরপর ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস্সালামের প্রতি তাওয়াফকারী, রুকু-দানকারী ও সেজদাদানকারীদের জন্যে যে ঘরটিকে এবাদাতগাহ হিসেবে প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো সে নির্দেশ কত চমৎকারভাবে তারা পালন করেছিলেন তার সুন্দর ছবি এখানে তুলে ধরা হয়েছে । সে দৃশ্যের ছবি কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে এমন নিপুণভাবে আঁকা হয়েছে যে পড়ার সময় তাদের কাজগুলো চোখের সামনে ভাসতে থাকে আর আমাদের কানগুলো যেন তাদের কথোপকথনগুলো স্পষ্টভাবে শুনতে পায়। এরশাদ হচ্ছে, “স্মরণ করে দেখো ঐ সময়ের কথা যখন গড়ে তুলছিলো ইবরাহীম কাবা ঘরের ভিত্তি । আর ইসমাঈলও ছিলো তার সাথে । তারা দুজনে বলছিলো ………… তিনি তাদেরকে পবিত্র করবেন যাবতীয় কলুষ কালিমা থেকে ৷ অবশ্যই আপনি একমাত্র শক্তিমান এবং আপনি একমাত্র বিজ্ঞানময় ।’ (আয়াত ১২৭) আমরা এবার একথাগুলোর ব্যাখ্যার দিকে মনোনিবেশ করবো। এখানে ব্যাখ্যা আসছে একটি ঐতিহাসিক খবর-পরিবেশনের আকারে ৷ ঘটনার বিবরণে বলা হচ্ছে, “স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন ইবরাহীম কা’বা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিলো, আর তার সাথে ছিলো ইসমাঈলও।” ইবরাহীম (আ.)-এর দোয়া : এতটুকু শোনার পর বাকি খবরটুকু শোনার জন্যে আমাদের মন উন্মুখ হয়ে উঠে, এমন সময় আমরা যেন বাস্তব চোখে দেখছি পিতা-পুত্র ঘর্মাক্ত ও পরিশ্রান্ত অবস্থায় কাতর কষ্ঠে দোয়া করছেন, আমরা যদিও আমাদের মানস-চোখে তাদের দেখছি না, কিন্তু মনে হচ্ছে তারা দুজনে যেন আমাদের সামনেই রয়েছেন, আমরা তাঁদের কাতর-কন্ঠের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছি, “ইবরাহীম ও ইসমাঈল যখন এই ঘরের ভিত্তি উঠাচ্ছিলো (তখন তারা এই বলে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো, হে আমাদের মালিক, (আমরা যে উদ্দেশ্যে এ ঘর নির্মাণ করেছি) তুমি আমাদের কাছ থেকে সেই কাজটাকে কবুল করো, একমাত্র তুমিই (মানুষের ভেতর বাইরের) সব কিছু জানো এবং শুনো । (তারা আরো বললো,) হে আমাদের মালিক, আমাদের উভয়কেই তুমি তোমার অনুগত মুসলিম বান্দা বানাও । আমাদের পরবর্তী বংশধরদের মাঝ থেকেও তুমি তোমার অনুগত বান্দা বানিয়ে দাও । (হে মালিক) তুমি আমাদের তোমার এবাদাতের আনুষ্ঠানিকতাসমূহ দেখিয়ে দাও। (যদি আমরা এতে কোনো ভুলত্রুটি করি, তাহলে) তুমি আমাদের তাওবা কবুল করো, কারণ তুমিই একমাত্র তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু ৷” (আয়াত ১২৭-১২৮) জনশূন্য নিঝুম সে উপত্যকায় আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে কর্মরত শ্রান্ত ক্লান্ত পিতা-পুত্রের কাতর কণ্ঠের আবেগময় দোয়ার সেই মধুর সুরের লহরী ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে আশ-পাশের পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত । সেই সুর আজও যেন আমাদের প্রাণে বাজে । সেই নীরবতা, সেই শূন্যতা আজও যেন সেখানে বিরাজমান, আর তারই মধ্য থেকে যেন ভেসে আসছে আল্লাহ তায়ালার দু’জন বান্দার সেই সুমধুর কথার ধ্বনি । এর সবই যেন আমাদের সামনে ভাসছে, এই মনোরম দৃশ্যের ছবি আজো যেন জীবন্ত রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাযির হয়েছে। আমাদের হৃদয়ের তারে তা সুমধুর ঝংকার বাজিয়ে তুলছে। কোরআনে কারীমে উপস্থাপিত বর্ণনাশেলীর এই হচ্ছে চমৎকারিত্ব ৷ অতীতের ঘটনাবলীকে এমন সুন্দরভাবে কোরআনে করীম আমাদের সামনে তুলে ধরে যে, অতীত আর অতীত মনে হয় না, বরং তা জীবস্ত ও বাস্তব বর্তমানে পরিণত হয়ে যায়। তা যেন আমরা শুনতে পাই দেখতে পাই । সেগুলো যেন গতিশীল ও জীবস্ত ছবি হয়ে আমাদের মানস পটে ফুটে ওঠে, সেখানে যেন জীবনের স্বগৌরব স্পন্দন শোনা যায়। এইটিই হচ্ছে. সে মহাশিল্লীর তুলির আঁচড় । আর যে কেতাবে এই মহামূল্যবান শিল্পের সমারোহ তা অবশ্যই চির-অম্লান,চির অমর । দোয়ার কথাগুলোতে কাতর কষ্ঠে কি বলা হচ্ছে । এই-ই হচ্ছে নবীর দোয়ার আদব এ হচ্ছে সেই আদব, সেই ঈমান, সেই চেতনা যা কোরআনে করীম নবীদের উত্তরাধিকারদের শেখাতে চায় এবং তাদের হৃদয়ের গভীরে ও চেতনার মধ্যে জীবন্তরূপে ফুটিয়ে তুলতে চায়। ‘হে আমাদের রব, আমাদের দোয়া মেহেরবাণী করে তুমি কবুল করে নাও, অন্তরের গহীন কোণে আমাদের যে অব্যক্ত কথা লুকিয়ে আছে, যা প্রকাশ করার মত ভাষা আমাদের নেই সে কথাগুলো তুমি একমাত্র শুনতে পাও, আর বিশ্ব-মানবতার কি দুঃখ, কি ব্যথা যা কেউ দেখতে পায় না কেউ জানে না তা একমাত্র দেখো, তুমিই জানো।” একথাগুলো হচ্ছে দোয়া কবুল হওয়ার জন্যে পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে কাতরকন্ঠের আরযি পেশ, যাতে করে দুঃখ দারিদ্র ও মানুষের প্রতি যুলুমের অবসান ঘটে, যাতে তার রাজ্যে তার বিধান চালু হওয়ার মাধ্যমে নিগৃহীত মানবতা শাস্তির আশ্রয় খুঁজে পায় । এ কাতরকন্ঠের প্রার্থনাই আল্লাহর কাছে সবচাইতে বেশী প্রিয় । এর পরিসমাপ্তিতে আল্লাহ তায়ালার মেহেরবাণীর বারিধারা বর্ষিত হয়। আল্লাহ তায়ালা নিজের অন্যতম নাম ‘সামীউদ্-দুয়া’- “দোয়ার শ্রবণকারী’ রেখে বান্দাহর অন্তরে আশার আলো জালিয়ে দিয়েছেন। বান্দাহর অব্যক্ত ইচ্ছা ও চেতনার পরিপূর্ণ অভিব্যক্তি তার দ্বারা সম্ভব নয় বিধায় আল্লাহ তায়ালা বান্দার নিয়তের কথা জানেন এবং তিনি সে বিষয়ে বিবেচনা করবেন বলে সুসংবাদ দিয়েছেন ৷
# সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-১২৮
رَبَّنَا وَ اجْعَلْنَا مُسْلِمَیْنِ لَكَ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِنَاۤ اُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ١۪ وَ اَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَ تُبْ عَلَیْنَا١ۚ اِنَّكَ اَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِیْمُ
হে আমাদের রব! আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম (নির্দেশের অনুগত) বানিয়ে দাও। আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম। তোমার ইবাদাতের পদ্ধতি আমাদের বলে দাও এবং আমাদের ভুলচুক মাফ করে দাও। তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী।
#ইবরাহীম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর কথার উদ্ধৃতি পেশ করতে গিয়ে এরশাদ হচ্ছে, “হে আমাদের রব, আমাদের দু’জনকে পরিপূর্ণভাবে আপনার নিকট আত্মসমর্পণকারী বানিয়ে দাও। আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও একদল মুসলিম বানিয়ে দিন এবং আল্লাহর আমাদেরকে আমাদের বন্দেগীর পদ্ধতিসমূহ শিখিয়ে দিন, আর আমাদের তওবা কবুল করে নিন। নিশ্চয়ই আপনিই একমাত্র তওবা কবুলকারী মেহেরবাণ ।’ এই দোয়ার মাধ্যমে, তাদের ইসলামের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে আল্লাহ তায়ালার কাছে আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর চেতনায় এ কথা জাগরুক হয়েছিলো যে তাদের অন্তর যেন আল্লাহ পাকের দু’টি আংগুলের মধ্যে অবস্থিত । আল্লাহর পথই সঠিক পথ এবং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোন ক্ষমতা বা কোন শক্তি আর কারও নেই ৷ তার দিকেই পিতা-পুত্র দুজনই প্রত্যাবর্তন করছেন এবং নিজেদেরকে তার কাছে সোপর্দ করছেন মূলত একমাত্র আল্লাহ তায়ালার কাছেই সাহায্য চাওয়ার জায়গা রয়েছে। এরপর এই দোয়ার অনুসরণেই মুসলিম উম্মাহ্ বংশ পরম্পরায় দোয়া করতে থাকবে, উম্মাতের মধ্যে আমাদের একদল নিবেদিত প্রাণ মুসলমান বানিয়ে দাও । এই দোয়া মোমেন অন্তরের চাহিদাগুলোর বহিপ্রকাশ ৷ আকীদা-বিশ্বাস সকল মানুষেরই কিছু না কিছু থাকে এবং তা হচ্ছে প্রথম সেই জিনিস যা মানুষকে যে কোন কাজ করার জন্যে অনুপ্রেরণা যোগায় । ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস্ সালামের চেতনার মধ্যে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত-পুষ্ট হওয়ার কথা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে বর্তমান ছিলো, যার জন্যেই তারা সদা-সর্বদা কৃতজ্ঞতা অনুভব করতেন। এ নেয়ামত ছিলো ঈমানের নেয়ামত ৷ এই ঈমানের জন্যে তারা লালায়িত ছিলেন আর তাঁদের রব এর নিকট এই প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন যে, তাদেরকে দেয়া নেয়ামত যেন তাঁদের বংশধরদেরকেও দেয়া হয় । একদিকে বংশধরদের জন্যে যেমন জীবনধারণ সামগ্রী সরবরাহের জন্যে তারা দোয়া করছিলেন, তেমনি দোয়া করছিলেন যেন ঈমানের নেয়ামতও তাদের দান করা হয় এবং তাদেরকে যেন এবাদতের সঠিক পদ্ধতি জানিয়ে দেয়া হয়, স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়-কি এবাদত তাঁরা করবেন এবং তাদের তাওবা যেন কবুল করে নেয়া হয় কেননা তিনিই একমাত্র তাওবা-গ্রহণকারী মেহেরবান।
# সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-১২৯
رَبَّنَا وَ ابْعَثْ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِكَ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَةَ وَ یُزَكِّیْهِمْ١ؕ اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ۠
হে আমাদের রব! এদের মধ্যে স্বয়ং এদের জাতি পরিসর থেকে এমন একজন রসূল পাঠাও যিনি এদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শুনাবেন, এদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং এদের জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত করবেন। অবশ্যি তুমি বড়ই প্রতিপত্তিশালী ও জ্ঞানবান।
# রাসূল পাঠানোর জন্যে বিশেষ দোয়া : আরও দোয়া করেছেন যেন তাদের পরবর্তী বংশধরদের পথের সন্ধান না জানা অবস্থায় ছেড়ে দেয়া না হয়, এরশাদ হচ্ছে, “হে আমাদের রব তাদের মধ্যে তাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একজন…….. নিশ্চয় আপনিই একমাত্র শক্তিমান, বিজ্ঞানময় ।’ (আয়াত ১২৯) ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস্ সালামের দোয়ার বহু বহু যুগ পরে মোহাম্মদ (স.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তি ঘটেছে। তার আগমন ঘটেছে ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস্ সালামের বংশের মধ্যেই । এদেরকেই তিনি আল্লাহ তায়ালার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে শোনাবেন, তাদেরকে কেতাব ও হেকমাত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের সর্বপ্রকার খারাবী কলুষতা থেকে পবিত্র করবেন। তাদের দোয়া আল্লাহ পাকের দরবারে কবুল হয়েছিলো, কিছু তার বাস্তবায়ন করার সময় যখন আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছিলেন তিনি তখনই এসেছিলেন-এর আগে নয়। এতে কারো ব্যস্ত হওয়া বা হতাশ হওয়ার পরওয়া আল্লাহর নেই । আরবের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ইহুদী ও মুসলমানদের মধ্যে যে বিদ্বেষ চলছিলো তা নিরসনের ক্ষেত্রে এই দোয়া বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস্ সালাম থেকে আল্লাহ্ তায়ালা ওয়াদা নিয়েছিলেন, কা’বা ঘরের ভিত্তি গড়ে তোলার পর সে ঘরকে যেন তাওয়াফকারী, এখানে অবস্থানকারী, রুকুদানকারী ও সেজদা-দানকারীদের জন্যে প্রস্তুত রাখা হয়। কোরায়শদের এরাই ছিলেন পূর্বপুরুষ যারা কা’বা শরীফের খাদেম হিসেবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নিযুক্ত ছিলেন৷ তারা স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘হে আমাদের মালিক, আমাদের দুজনকে তোমার কাছে আত্মসমর্পণকারী বানিয়ে দাও ৷ আমাদের বংশধরদের মধ্য থেকেও একদল মুসলিম বানিয়ে দাও ৷ আরও স্পষ্ট ভাষায় তারা দরখাস্ত পেশ করেছেন, “হে আমাদের রব তাদের মধ্যে, তাদের নিজেদের মধ্য থেকে একজন রসূল প্রেরণ করো যে তাদেরকে তোমার আয়াতসমূহ পড়ে শোনাবে এবং তাদেরকে কেতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবে । আর তাদেরকে পবিত্রও করবে।” তারা দু’জনই গোটা উম্মতে মুসলিমাহর জন্যে ইবরাহীম (আ.)-এর উত্তরাধিকারকে তাদের দোয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন । একইভাবে তারা বায়তুল হারামেরও উত্তরাধিকার হয়েছিলেন ৷ এই কারণেই সেই ঘরের দিকে মুখ করে নামায পড়া হয় । এ ঘরকে মোশরিকরাও কেবলা মানতো এবং একে ইহুদী নাসারাদের কেবলা থেকে তারা উত্তম মনে করতো । সাধারণ নাসারাদের মধ্যে যারা নিজেদেরকে ইবরাহীম (আ.)-এর বংশধর মনে করে এবং এই উত্তরাধিকার প্রাপ্তির কারণে নিজেদের হেদায়াত ও জান্নাতের অধিকারী বলে দাবী করে-মনে করে সব কোরায়েশ ব্যক্তিই ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর, তাদের বুঝা উচিত যে, ইবরাহীম (আ.) তার বংশধরদের উত্তরাধিকারের আমানত ছেড়ে যাওয়ার সময় দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা বলেছিলেন, আমার এই ওয়াদা কিন্তু যালেমরা পাবে না। আর ওই শহরবাসীকে রিযিক ও বরকতদান করার জন্যে দোয়া করার সময় ইবরাহীম (আ.) বিশেষ করে বলেছিলেন । “যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও রোয হাশরের ওপর ঈমান আনবে ।’ যখন ইবরাহীম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর হুকুমে কা’বা ঘর নির্মাণ ও তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু করেছিলেন তখন ত্যরা এই বলে দোয়া করেছিলেন, যেন তাঁরা নিজেরা মুসলমান থাকেন এবং একদল মুসলিম জনতা যেন তাদের বংশধরদের মধ্যে পয়দা হয়। যেন তাদের বংশের মধ্যেই তাদের মধ্যকার এক ব্যক্তিকে রসূল নিযুক্ত করা হয়৷ আল্লাহ তায়ালা তাদের এ দোয়া কবুল করেছিলেন এবং আহ্লে বায়ত (বনী ইসমাঈল) দের মধ্য থেকে মোহম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহকে রসূল নিযুক্ত করলেন। আল্লাহ তায়ালার হুকুমে তার মাধ্যমে এক মুসলিম জাতি গড়ে উঠলো । তারা দ্বীনে ইবরাহীমীর যথাযথ উত্তরাধিকার বলে পরিচিত হলো । ইবরাহীম (আ.)-এর ইতিহাসের এই পর্যায়ে এসে একসময় দেখা যায় ইমাম নিয়ে ঝগড়া শুরু হয় । অবশ্য এই পর্যায়ে সমস্ত কথাগুলো একত্রিত হওয়ায় এই ঝগড়া মিটানোর মত যথেষ্ট যুক্তিও এখানে হাযির হয়ে গেলো । কেউ উম্মতে মুসলিমাহ্র সাথে ইমামত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হলো, আর কেউ লিপ্ত হলো রসূল (স.) নবুওয়ত ও রেসালাত সম্পর্কে ৷ এ’দুটো কথার ওপরও প্রশ্ন আসলো । আরও প্রশ্ন আসলো সঠিক দ্বীন এর তাৎপর্য সম্পর্কে । এসব কথার জওয়াবে নিচের আলোচনা আসছে, “সেই ব্যক্তি ছাড়া’ কে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে ইবরাহীম এর দ্বীন থেকে যে তার ব্যক্তি সত্ত্বাকে বুদ্ধিহীনতা ও যুক্তিহীনতার দিকে এগিয়ে …… জন্যে মনোনীত করেছেন, অতএব তোমরা পুরোপুরি মুসলমান (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করো না।” (আয়াত ১৩০, ১৩১ ও ৩২)
# সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-৯৬
اِنَّ اَوَّلَ بَیْتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیْ بِبَكَّةَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًى لِّلْعٰلَمِیْنَۚ
নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদাত গৃহটি নির্মিত হয় সেটি মক্কায় অবস্থিত। তাকে কল্যাণ ও বরকত দান করা হয়েছিল এবং সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াতের কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছিল।
# সর্বপ্রথম কিবলা কাবার ইতিহাস মর্যাদা ও ইহুদীদের ভূমিকা : এরশাদ হচ্ছে, ‘বলো (হে রসূল), নিয়ে এসো তাওরাত, এনে পড়ে শোনাও দেখি, যদি তোমরা সতাবাদী হন থাকো ।’ তারপর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করছে অত্যন্ত কঠিনভাবে তাকে ধমক দিয়ে বলা হচ্ছে যে, ‘সে অবশ্যই জালেম হিসাবে পরিগণিত হবে ।’ সে না প্রকৃত সত্যের প্রতি, না নিজের প্রতি, আর না জনগণের প্রতিও সে কোনো ইনসাফ করছে । তাদের জেনে য়াখা দরকার যে, যালেমের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। সুতরাং সেসব যালেমদের জন্যে তিরঙ্কারের এই ভাষা প্রয়োগই তাদের করুণ পরিণতি জানানোর জন্যে যথেষ্ট । এতে করে বুঝা যায়, তাদের জন্যে বিভিন্ন প্রকারের যন্ত্রণাদায়ক আযাব অপেক্ষা করছে। এমনি করে ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের ব্যাপারটিও তুলে ধরলো এবং বারবার সে কথার পুনরাবৃত্তি করলো। রসূল(স.) হিজরতের পরেও ষোল-সতের মাস ধরে বায়তুল মাকদাসের দিকে মুখ করে নামায পড়েছেন এবং এ বিষয়ে ইতিপূর্বে সূরা বাকারার বিস্তারিত আলোচনায় একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মুসলমানদের জন্যে কাবা শরীফকে কেবলা হিসাবে গ্রহণ করাটাই সঠিক এবং এটাই প্রথম কেবলা । অপরদিকে বায়তুল মাকদাসকে কেবলা হিসাবে গ্রহণ কযরাটা ছিলো একটা সাময়িক ব্যাপার এবং বিশেষ এক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রয়োজন ছিলো ৷ এর উপযোগিতা সম্পর্কেও আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করেছেন। এতদসত্ত্বেও ইহুদীরা এ প্রসংগটার বারবার এর পুনরাবৃত্তিও করছে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে স্পষ্ট সত্যের ব্যাপারে নানা প্রকার সন্দেহ আরোপ করে সত্যকে জটিল করে তোলা। আজও দ্বীন-ইসলামের ওসব দুশমনরা একইভাবে ইসলামী জীবনব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রশ্ন তুলে দ্বীন ইসলামকে সন্দেহজনক করে তোলার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে । তাই এখানে আল্লাহ তায়ালা নতুন এক বর্ণনাভংগীর মাধ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রকে তাদেরই মুখের ওপর ছুঁড়ে মারছেন। এরশাদ হচ্ছে, “বলে দাও (হে রসূল) আল্লাহ তায়ালা সত্য বলেছেন। অতএব, নিষ্ঠার সাথে ইবরাহীমের জীবনের আদর্শকে অনুসরণ করো, আর (জেনে রেখো) সে কখনো মোশরেকদের অন্তর্গত ছিলো না। প্রথম যে ঘরটিকে স্থাপন করা হয় গোটা মানবজাতির জন্যে, তা হচ্ছে মক্কা নগরীতে স্থাপিত (এই কাবাঘর), এ ঘর বিশ্ব জগতের সবার জন্যেই হেদায়াতের কেন্দ্র । এই ঘরের মধ্যে রয়েছে কিছু স্পষ্ট নিদর্শন। (যেমন) মাকামে ইবরাহীম, আর যে ব্যক্তি এই ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হয়ে বাবে। আর তার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সেই সকল মানুষের ওপর এই ঘরের হজ্জ ফরয করা …… কোনো কিছুরই মুখাপেক্ষী নন ।” সম্ভবত ‘কুল সাদাকামাল্লাহু’……. আয়াতের শেষ পর্যন্ত যে কথাগুলো বলা হয়েছে তার দ্বারা আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে যা কিছু ইতিপূর্বে বলেছেন সেই দিকেই ইংগীত করেছেন। বলেছেন, মানুষের আশ্রয়স্থল ও নিরাপত্তা লাভের স্থান হিসাবে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.) এই ঘরটিই বানিয়েছিলেন, আর চেয়েছিলেন যেন এ ঘরটি হেদায়াত প্রদর্শনের কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং সার্বক্ষণিক এবাদতের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। আর এই কারণেই ইবরাহীম (আ.)-এর শিরকমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদবাদী জীবনাদর্শকে অনুসরণ করার জন্যে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘ইবরাহীম (আ.)-এর জীবনাদর্শকে নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করো। আর সে কোনো মোশরেকদের অন্তর্গত ব্যক্তি ছিলো না ।’ অপরদিকে ইহুদীরা মনে করতো তারাই ইবরাহীম (আ.)-এর বংশধর এবং উত্তরাধিকারী । সুতরাং এই পর্যায়ে কোরআনে করীম তাদেরকে সঠিকভাবে ইবরাহীম(আ.)এর আদর্শ সম্পর্কে জানিয়ে দিচ্ছে। সে আদর্শ হচ্ছে সর্বপ্রকার শিরক থেকে দূরে থাকা । এ সত্যটিকে অত্যন্ত শুরুত্বের সাথে দুইবার বর্ণনা করা হচ্ছে, প্রথম বারে বলা হচ্ছে, তিনি ছিলেন সত্যপথের নিষ্ঠাবান একজন পথিক এবং দ্বিতীয় বারে বলা হচ্ছে, মোশরেকদের দলে শামিল ছিলেন না। এপর সুনির্দিষ্টভাবে স্থির করে দেয়া হচ্ছে যে, কাবাকে কেবলা হিসাবে গ্রহণ করে সেই দিকে মুখ করে নামায পড়ো । কারণ এই ঘরটিকেই পৃথিবীর বুকে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো, যাতে করে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশের প্রতিজ্ঞা এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে সোপর্দ করার জন্যে এই ঘরকেই মানুষ কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। আর এই কারণেই এ ঘরের ভিত্তিগুলোকে সমুন্নত করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম (আ.)-কে নির্দেশ দেন । তিনি তাকে আরো জানিয়ে দেন যে, এই ঘর তাদের জন্যে নির্দিষ্ট, যারা এই ঘরটির তাওয়াফ করবে, আল্লাহ্র স্মরণে ধ্যানমগ্ন হয়ে একনিষ্ঠভাবে এখানে পড়ে থাকবে এবং রুকু ও সেজদা দান করার মাধ্যমে তারা আল্লাহ পাকের নৈকট্য লাভ করার চেষ্টা করতে থাকবে৷ তিনি এ ঘরকে বরকতময় বানিয়েছেন এবং বিশ্বমানবতার হেদায়াত লাভের উৎস স্থল করেছেন। এখানে তারা আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত জীবনব্যবস্থার সন্ধান পাবে, যা ইবরাহীম(আ.) কর্তৃক প্রদর্শিত হয়েছিলো ৷ যেখানে দাড়িয়ে ইবরাহীম(আ.) এ ঘরের নির্মাণ কাজ চালিয়েছিলেন সেই স্থানে তার পদচিহ্নের স্পষ্ট ছাপ এখনও বর্তমান (মাকামে ইবরাহীম বলতে বুঝায় সেই ছাপযুক্ত পাথরটি- যার ওপর দাড়িয়ে ইবরাহীম(আ.) এই পবিত্র ঘরটি নির্মাণ করেছিলেন) ৷ এ পাথরটি পবিত্র কাবা শরীফের একেবারে সংলগ্ন ছিলো, দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর(রা.) এই পাথরটি একটু দূরে সরিয়ে নেন যাতে করে এই পাথর দেখার জন্যে আগত তাওয়াফকারীদের নামায আদায়ে কোনো কষ্ট না হয়। এই স্থানটিকে নামাযের স্থান করার জন্যে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘আর মাকামে ইবরাহীম(আ.)-কে নামাযের জায়গা হিসাবে গ্রহণ করো ।’ এই ঘরের মর্যাদা সম্পর্কে আরো বলা হয়, যে ব্যক্তি এ ঘরে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হয়ে যাবে। এমন কি যে কোনো ভীত-সন্ত্রস্ত ব্যক্তির জন্যেও এ ঘর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ৷ এমন নিরাপদ স্থান পৃথিবীতে আর কোথাও নেই৷ ইবরাহীম ও ইসমাঈল(আ.) এ ঘরটি তৈরী করার পর থেকে বরাবরই নিরাপদ থেকেছে। এমনকি সেই জাহেলী যুগেও- যখন আরবরা ইবরাহীম(আ.)-এর প্রদর্শিত জীবনপদ্ধতি থেকে যোজন যোজন দূরে সরে দাড়িয়েছিলো। এ বিষয়ে হাসান বস্রী ও আরো অনেকের কথা থেকে জানা যায় যে, অনেক সময় এমনও হয়েছে, কখনও কোনো ব্যক্তি কাউকে হত্যা করার পর এই বায়তুল হারামে প্রবেশ করেছে, সেখানে নিহত ব্যক্তির পুত্রের সাথে তার সাক্ষাত হয়েছে কিন্তু ওখান থেকে না বের হওয়া পর্যন্ত সে তাকে কিছুই বলেনি এটাই ছিলো নিরাপদ করার তাৎপর্য । এমনকি আরব জাহেলিয়াতের যুগে আশপাশের এলাকার লোকেরাও এ ঘরকে সম্মান দিতো। আল্লাহ্ তায়ালা এ ঘরের মর্যাদাকে আরবের জন্যে এক বিশেষ ‘এহসান’ হিসাবে উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, “ওরা কি একটু চিন্তা করে দেখে না যে, আমি তাদের জন্যে কেমন নিরাপদ “হারাম শরীফ’ বানিয়ে দিয়েছি। অথচ তার ত্রিসীমানার আশপাশ থেকেও লোকদের ছো মেরে নিয়ে যাওয়া হয় ?” আরো আশ্চর্যের বিষয়, কাবা শরীফের এই সর্বব্যাপী মর্যাদার ব্যাপ্তি এতদূর পর্যন্ত প্রসারিত যে, সেখানে কোনো জীবজন্তু শিকার করা পর্যন্ত নিষিদ্ধ, পাখীকূলকে তাদের বাসা থেকে তাড়ানো এখানে হারাম। এমনকি কোনো গাছপালাও সেখানে কাটা যায় না। বোখারী ও মুসলিম শরীফে এই মর্মে কতিপয় হাদীস এসেছে। মুসলিম শরীফে বর্ণনায় হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রসূল্লাহ (স.) মক্কা বিজয়ের দিন বলেছেন, এই শহরকে আল্লাহ তায়ালা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সম্মানিত করেছেন। এ কারণে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহরই মর্জিতে এ ঘর মর্যাদাবান থাকবে৷ আমার পূর্বে কোনো আমলেই এখানে যুদ্ধবিগ্রহ বৈধ ছিলো না এবং একদিনের এক বিশেষ সময় ব্যতীত আমার জন্যেও কখনও এ ঘরের এলাকায় যুদ্ধ করা বৈধ করা হয়নি। সুতরাং আল্লাহর মর্যাদাদানের কারণেই এ ঘর কেয়ামত পর্যন্ত মর্যাদাবান থাকবে। এখানকার কোনো গাছের কাটা কর্তিত হবে না, কোনো শিকারের পশুপাখীকে এখান থেকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে না, কোনো পতিত জিনিস সেই ব্যক্তি ছাড়া কেউ তুলবে না, যে জানে যে জিনিসটি কার এবং নির্জনতা নষ্ট করা হবে না…. হাদীসটির শেষ পর্যন্ত দ্রষ্টব্য । অতএব, এই হচ্ছে সেই ঘর যাকে আল্লাহ তায়ালা মহান মর্যাদা দিয়ে মুসলমানদের কেবলা বানিয়েছেন। এটিই সেই ঘর, যা এবাদাতের জন্যে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ঘর মুসলমানদের পিতৃপুরুষ ইবরাহীম(আ.)-এর ঘর। এখানে নিদর্শন বা সাক্ষ্যদানকারী এমন জিনিস রয়েছে যা এ ঘরটি ইবরাহীম কর্তৃক নির্মিত এ কথার প্রমাণ দেয় । আর ইসলাম তো হচ্ছে ইবরাহীম(আ.) অনুসৃত জীবনবিধান সুতরাং তার ঘরই সেই প্রথম ঘর, যার দিকে মুখ করে মুসলমানরা নামায পড়ে৷ এ ঘর পৃথিবীতে নিরাপদ আশ্রয়স্থল ৷ এ ঘরেই রয়েছে সমগ্র মানব মন্ডলীর জন্যে হেদায়াতের আলো । এ ঘরই হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মিলনকেন্দ্র ৷
# *আদর্শপুরুষ ইবরাহীম (আ.)-এর দোয়া : আল্লাহর স্মরণে ও কৃতজ্ঞতায় চির নিমগ্ন একজন মানুষের পূর্ণাংগ রূপ যদি কেউ দেখতে চায় তাহলে সে নবীকুল পিতা হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর মাঝে তা পেতে পারে, দেখতে পারে। এই গােটা সূরা জুড়ে তারই বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। আরাে উল্লেখ রয়েছে তার কৃতজ্ঞতার কথা, তাঁর বিনয় ও খােদা ভক্তির কথা, তার হৃদয়ের গভীর থেকে উদ্ভূত ভক্তি মাখা দোয়া, কাকুতি মিনতি ও আরযির কথা, যে আরযির ভাষা ও ছন্দ তরংগায়িত হয়ে আকাশের দিকে উত্থিত হয়েছিলাে, ওই আরবি ভাষা ছিল নিম্নরূপ-(আয়াত ৩৫-৪১) সুরায় বর্ণিত প্রেক্ষাপটে ইবরাহীম(আ.)-কে বায়তুল্লাহর পাশে দেখানাে হয়েছে। তিনি কোরায়শ অধ্যুষিত নগরে আল্লাহর পবিত্র ঘরের ভিত্তি স্থাপন এবং এর নির্মাণ কাজ সমাধা করেন,কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, ওই নগরের আদি বাসিন্দা কুরাইশ বংশের লােকেরা আল্লাহকে অস্বীকার করে বসলাে, তারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয়ে পড়লাে। যে ঘরটি তিনি কেবল আল্লাহর এবাদাতের জন্যে নির্মাণ করেছিলেন, ওই ঘরের আশেপাশেই তারা এসব কুফুর ও শিরক চালিয়ে যেতে লাগলাে। ঠিক এই নাযুক ও করুণ মুহূর্তটিতে তাকে দেখানাে হয়েছে ভয় ও ভক্তিগদগদ একজন বান্দা হিসাবে, চিরমগ্ন একজন বান্দা হিসাবে, যিনি অবাধ্যকে বাধ্য করছেন, অকৃতজ্ঞকে কৃতজ্ঞ করছেন, খােদাবিমুখ লােকদের খােদামুখী করছেন, তার বিপথগামী সন্তানদের তাদের পিতার আদর্শের প্রতি অনুপ্রাণিত করছেন যেন তারা সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে, তারা সত্য আদর্শের অনুসারী হতে পারে। ইবরাহীম(আ.) তার দোয়া ও মােনাজাতে বললেন, ‘হে প্রভু, তুমি এই নগরকে নিরাপদ রাখাে।’ কারণ, শান্তি ও নিরাপত্তা হচ্ছে মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়ােজন ও চাহিদা। এই প্রয়ােজন সে প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুভব করে। তার নিজের জীবনের জন্যেও সে এই নিরাপত্তার প্রয়ােজনীয়তা বোধ করে। আলােচ্য আয়াতের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই, মক্কা নগরীতে তৎকালীন যুগে যারা বসবাস করতাে তারা আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামত ভােগ করেও তাঁর শােকর আদায় করতাে না। তাদের পিতা ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়ার বদৌলতে তারা শান্তি ও নিরাপত্তার মতাে আল্লাহর বড় নেয়ামত ভােগ করছিলাে, কিন্তু এই নেয়ামতের শোকর আদায় করা তো দূরে থাক, তারা বরং তাদের পিতার দেখানাে পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলতে থাকে। তারা আল্লাহর সাথে বিভিন্ন দেব দেবীকে শরীক বানিয়ে নেয়। ফলে তারা আল্লাহর সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। হযরত ইবরাহীম(আ.) মক্কা নগরীর নিরাপত্তার আরযির সাথে সাথে আল্লাহর নিকট আর একটি আরযি পেশ করেছিলেন। সেটি হলাে, ‘আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা করুন’। এই আরযির মাধ্যমে ইবরাহীম(আ.) নিজেকে পরিপূর্ণরূপে তার প্রতিপালকের নিকট সঁপে দিচ্ছেন। তিনি হৃদয়ের গভীর অনুভূতিটুকু তার প্রতিপালকের সামনে পেশ করছেন। কাতর স্বরে আবেদন জানাচ্ছেন যেন আল্লাহ তাঁকে এবং তার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজার মতাে জঘন্য অপরাধ থেকে রক্ষা করেন। তিনি সাথে সাথে আল্লাহর কাছে হেদায়াত কামনা করছেন, সঠিক দিকনির্দেশনা চাচ্ছেন। এর দ্বারা তিনি বুঝাতে চাচ্ছেন, শিরক থেকে বেঁচে থাকাও আল্লাহর এক বড় নেয়ামত। বড় নেয়ামত এই জন্যে যে, এর ফলে একজন মানুষ শিরক ও কুফরীর অন্ধকার থেকে রক্ষা পায়। আর ঈমান ও হেদায়াতের আলাে লাভ করার পর মানুষ গোমরাহী, আদর্শহীনতা, লক্ষ্যহীনতা ও পথভ্রষ্টতার কবল থেকে রক্ষা পায় এবং তার হৃদয়ে তখন সে জ্ঞান, প্রশান্তি, স্বস্তি ও স্থিরতা অনুভব করতে পারে। তখন সে অগণিত প্রভুর দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে একমাত্র প্রভু আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের মাঝে নিজেকে সঁপে দেয়। এটা নিসন্দেহে একটা বড় নেয়ামত, সে জন্যেই হযরত ইবরাহীম(আ.) তার প্রভুর কাছে এই নেয়ামতের জন্যে সকাতর আবেদন জানিয়েছেন যেন তিনি নিজে এবং তাঁর সন্তানরা সবাই মূর্তিপূজা থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। মূর্তিপূজার কুফল সম্পর্কে হযরত ইবরাহীম(আ.) অবগত ছিলেন বলেই এই জঘন্য পাপাচার থেকে মুক্তি কামনা করে আল্লাহর দরবারে আরযি পেশ করেছেন। তিনি ভালাে করেই জানতেন যে, এই মূর্তিপূজার কারণে অতীতে ও তার যুগের অসংখ্য মানুষ আল্লাহর দ্বীনকে হারিয়েছে, সঠিক পথ হারিয়েছে। তাই তিনি নিজের প্রভুর কাছে ফরিয়াদ করে যাচ্ছেন, ‘হে আমার প্রভু! এ সকল দেব দেবী অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে।’ এরপর তিনি ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, যারা আমার দেখানাে পথ অনুসরণ করে চলবে এবং এ সকল দেব দেবীর ফিতনায় লিপ্ত হবে না, তারাই হবে সত্যিকার অর্থে আমার বংশধর, আমার আদর্শের অনুসারী, এ মহান আদর্শ ও আকীদার বন্ধনেই তারা আমার সাথে আবদ্ধ। আর যারা আমার বিরুদ্ধাচরণ করবে, আমার আদর্শের বিপরীত আদর্শের অনুসারী হবে, তাদের বিচারের ভার আমি পরম করুনাময় আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিচ্ছি, ‘যদি কেউ আমার বিরুদ্ধাচরণ করে তাহলে (হে প্রভু) তুমি তাে ক্ষমাশীল দয়ালু।’ হযরত ইবরাহীম(আ.) যে কতাে দয়ালু, স্নেহপরায়ণ, উদার ও কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তা এই দোয়ার মাধ্যমেই প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ তিনি তাঁর বিরুদ্ধবাদী ও আদর্শচ্যুত সন্তানদের ধ্বংস কামনা করেননি, এমনকি তাদের দ্রুত শাস্তিও কামনা করেননি; বরং এখানে তিনি শাস্তির বিষয়টিই উল্লেখ করেননি। তার পরিবর্তে তিনি তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার বিশাল ছায়ায় খােদাদ্রোহিতা ও না-ফরমানী ঢাকা পড়ে যায়। উদার ও দয়াল নবী হযরত ইবরাহীম(আ.) ওই নাফরমানীজনিত শাস্তির বিষয়টি তাই উল্লেখই করেননি। এরপর তিনি আল্লাহর কাছে আরো একটি আরযি পেশ করেন। আর সেটা হচ্ছ, পবিত্র কাবা গৃহের আশেপাশের এই অনুর্বর ও শুষ্ক ভূমিতে তার কিছু সন্তানদের জন্যে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেয়া। এর পেছনে যে উদ্দেশ্য রয়েছে তার প্রতি ইংগিত করে তিনি বলেন, ‘তারা সালাত কায়েম করবে।’ আর এই মহৎ উদ্দেশ্যের খাতিরে তারা এই বৈরী পরিবেশের সব ধরনের কষ্ট ও যাতনা স্বীকার করতে প্রস্তুত হবে। তার সন্তানরা যাতে এই অনুর্বর ও শুষ্ক মরুভূমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে সে জন্যে তিনি তার পরম করুণাময় প্রভুর নিকট আরাে একটি আরযি পেশ করে বলেন, ‘হে আমাদের মালিক, আমি আমার কিছু সন্তানকে তােমার পবিত্র ঘরের কাছে একটি অনুর্বর উপত্যকায় এনে আবাদ করলাম, যাতে করে হে আমাদের মালিক, এরা নামায প্রতিষ্ঠা করতে পারে, (এখন) তুমি তােমার দয়ায়) এমন করো, যেন মানুষদের অন্তর এদের দিকে অনুরাগী হয়, তুমি ফলমূল দিয়ে তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করাে, যাতে ওরা তােমার নেয়ামতের শােকর আদায় করতে পারে।’ (আয়াত ৩৭) অর্থাৎ এখানে হযরত ইবরাহীম(আ.) যে ভাষা ও ভংগি ব্যবহার করেছেন তা অত্যন্ত কোমল ও হৃদয়গ্রাহী। হৃদয়ের এই শিশিরসিক্ত কোমলতা যেন মরুভূমির রুক্ষতার মাঝে এনে দেয় শিশিরের নরম স্পর্শ। পৃথিবীর আনাচে কানাচে থেকে যারা এই পবিত্র গৃহটির উদ্দেশ্যে মক্কায় আসবে তারা বিভিন্ন ফলমূল বয়ে নিয়ে আসবে। আর এই ফলমূলই হবে হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সন্তানদের মূল জীবিকা। আর এই জীবিকা লাভ করে তারা আল্লাহর পরম শােকর আদায় করবে কাবা গৃহের নিকটে বসবাস করার উদ্দেশ্যে কেবল খানাপিনা ও আরাম আয়েশ নয়; বরং তারা সালাত আদায় করবে, আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য করবে এবং তার প্রতিটি নেয়ামতের শােকর আদায় করবে। আর এর মাধ্যমেই কাবা গৃহের দুই শ্রেণীর প্রতিবেশীর মধ্যকার সুস্পষ্ট পার্থক্য ধরা পড়ে। এ দুটো শ্রেণীর একটি হচ্ছে কোরায়শ বংশীয় লােকেরা। এরা সালাত আদায় করে না, যেসব নেয়ামত ভােগ করে তার শােকর আদায় করে না। এখানে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে এই যে, ইবরাহীম(আ.) তাঁর মনের কাকুতি মিনতির গােটা বিষয়টি আল্লাহর কাছে গােপনে পেশ করছেন এবং বলছেন, তুমি অন্তর্যামী, মনের গভীরে কি লুকায়িত আছে তা তুমি জান । আসমান ও যমীনের মধ্যকার প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সব বিষয়ই তােমার জানা। লোক দেখানাে দোয়া ও আহাজারি আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং আমার মনের গভীরে লুকায়িত উদ্দেশ্য ও আরযিটুকুই তােমাকে জানাতে চাই। তিনি বলেন, ‘হে আমাদের মালিক, আমরা যা কিছু গােপন করি এবং যা কিছু প্রকাশ করি, নিশ্চয়ই তুমি তা জানাে (সত্যি কথা হচ্ছে), আসমানসমূহে কিংবা যমীনের (যেখানে যা কিছু ঘটে এর) কোনােটাই আল্লাহর কাছে গােপন থাকে না।'(আয়াত ৩৮) এই পবিত্রময় মুহূর্তে হযরত ইবরাহীম(আ.) তার প্রতি মহান আল্লাহর অন্যান্য অনুগ্রহ ও কৃপার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।(আয়াত ৩৯) বার্ধক্যকালে সন্তান সন্ততিলাভ আল্লাহর একটা বিশেষ দান। তাই এর দ্বারা মানুষের মনে এক বিরাট প্রভাব সৃষ্টি হয়। কারণ, মানুষের মাঝে একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে আর তা হলাে বংশ বিস্তার। আর এই বংশ বিস্তার যদি তখন ঘটে যখন মানুষের জীবনের বিদায়ের ঘন্টা বেজে ওঠে, তখন এটা নিঃসন্দেহে আল্লাহর একটা বড় নেয়ামত হিসেবে গণ্য হয়। আর এ জাতীয় একটা বড় নেয়ামত লাভ করে হযরত ইবরাহীম(আ.) তার প্রভুর দরবারে শােকর আদায় করছেন এবং সাথে সাথে কামনা করছেন যেন চিরকাল তিনি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হিসাবে বাকী জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন। তাঁর ইবাদত বন্দেগীতেই যেন সদা মশগুল থাকতে পারেন। কোনাে বাধা বিপত্তিই যেন তাকে এই শােকর ও এবাদাত বন্দেগী থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে না পারে। তার এই চরম চাওয়া ও আকংখা যেন বাস্তবায়িত হয় সে জন্যে আবার মহান প্রভুর দরবারে মিনতি জানাচ্ছেন। ‘হে আমার মালিক, তুমি আমাকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী বানাও, আমার সন্তানদের মাঝ থেকেও (এমন সব লােক তৈরী করাে যারা নামায প্রতিষ্ঠা করবে), হে আমাদের মালিক, (অামার এই) দোয়া তুমি কবুল করে।'(আয়াত ৪০) এই দোয়ার মাঝে কাবা গৃহের সেই দুই শ্রেণীর প্রতিবেশীর মধ্যকার পার্থক্য আবার স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ছে। মােমেন শ্রেণী তথা ইবরাহীম(আ.) আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল থাকার জন্যে তার সাহায্য কামনা করছেন, তার তাওফীক কামনা করছেন। অপরদিকে কোরায়শ বংশীয় প্রতিবেশীরা আল্লাহর এবাদাত বন্দেগী থেকে দূরে সরে দাড়াচ্ছে, আল্লাহর পথ এড়িয়ে চলছে। সাথে সাথে সেই সকল নবী রসূলকেও অস্বীকার করছে যাদের প্রেরণের জন্যে ইবরাহীম(আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া জানিয়েছেন। সব শেষে ইবরাহীম(আ.) তার হৃদয় নিংড়ানাে দোয়া এই বলে শেষ করছেন। ‘হে আমাদের মালিক, যেদিন (মানব সন্তানের চূড়ান্ত) হিসাব কিতাব হবে, সেদিন তুমি আমাকে, আমার পিতা মাতাকে এবং সমস্ত ঈমানদার মানুষদের (তােমার অনুগ্রহ দ্বারা) ক্ষমা করে দিয়ো।'(আয়াত ৪১) নিজের জন্যে, নিজের পিতা মাতার জন্যে এবং সকল মােমেন মুসলমানের মাগফেরাতের দোয়া জানাচ্ছেন। কারণ, পরকালে এবং হাশরের ময়দানে নিজের আমল ব্যতীত অন্য কিছুই মানুষের উপকারে আসবে না। কাজেই এই আমলের মাঝে কোনাে ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে থাকলে তার জন্যে আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া অন্য কোনাে উপায় নেই, তাই এই মাগফেরাতের দোয়া। আর এভাবেই একজন খােদাভক্ত ও অনুরক্ত বান্দার মিনতিভরা দোয়ার দীর্ঘ দৃশ্যটি শেষ হলাে। তিনি হচ্ছেন হযরত ইবরাহীম(আ.)- যার গােটা চরিত্রের মাঝে মিশে আছে আল্লাহর আনুগত্য, দাসত্ব ও পরম কৃতজ্ঞতায় অতুলনীয় বৈশিষ্ট্যসমূহ। তিনি নিসন্দেহে একজন আদর্শ মানব। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে সকল বান্দাকে। বিশেষ করে দোয়ার শুরুতে তিনি যাদের লক্ষ্য করে বক্তব্য রেখেছেন। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়। হযরত ইবরাহীম(আ.) তার মিনতিভরা দোয়ায় রাব্বানা অথবা রাব্বি এই শব্দ দুটো বার বার উল্লেখ করেছেন। তিনি আল্লাহকে ‘ইলাহ’ বা মাবুদ নামে ডাকেননি; বরং মালিক বা প্রভু নামে ডেকেছেন। কারণ মাবুদ বা উপাস্য শব্দটি অধিকাংশ জাহেলী সমাজে বিশেষ করে আরবীয় জাহেলী সমাজে খুব একটা বিতর্কের বিষয় ছিলাে না। কিন্তু যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে সব সময়ই বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সেটা হলো, জাগতিক জীবনে কার আনুগত্য চলবে? কার প্রভুত্ব চলবে? এটা মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তারকারী একটা বিরাট প্রশ্ন, যার সম্পর্ক ছিলাে বাস্তবতার সাথে, ব্যবহারিক জীবনের সাথে। এটাকে কেন্দ্র করেই ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়েছে। এর মাধ্যমেই তাওহীদ ও শিরকের পার্থক্য প্রতিভাত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ যারা সকল বিষয়ে আল্লাহর আনুগত্য করে, আল্লাহই হচ্ছেন তাদের প্রভু, মালিক বা রব’। অপরদিকে যারা গায়রুল্লাহর আনুগত্য করে সেই গায়রুল্লাহই হচ্ছে তাদের প্রভু বা ‘রব’। তাওহীদ ও শিরক এবং ইসলাম ও জাহেলিয়াতের পার্থক্য বাস্তব জীবনে এ রূপই। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এই পার্থক্যটুকু হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর দোয়ার মাধ্যমে তাঁর সন্তান তথা আরববাসীদের জানিয়ে দিয়েছেন। সাথে সাথে তাদের আদি পিতার দোয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত সেই চরম সত্যটির ব্যাপারে তাদের অনীহা, অস্বীকার এবং তাচ্ছিল্যের প্রতিও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
# হজ্জ ফরজ হওয়া প্রসংগ : তারপর যাদের এ ঘর পর্যন্ত আসার সম্বল আছে তাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা এ ঘরে এসে হজ্জ করা ফরয করে দিয়ে জানিয়ে দিলেন, তাওফীক থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি হজ্জ না করলে তা হবে কুফরীর শামিল, এতে আল্লাহর কোনো ক্ষতি হবে না । ক্ষতি হবে তার নিজের । এরশাদ হচ্ছে, ‘যাদের সামর্থ আছে তাদের জন্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এই ঘরে এসে হজ্জ করা ফরয। যারা এ কাজ করতে অস্বীকার করবে তাদের জানা দরকার যে, আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব জগতের সবার থেকে মুখাপেক্ষীহীন ।’ ওপরের আয়াতের ব্যাখ্যায় দেখা যায় ‘আ’লান্নাস’ বলে জানানো হয়েছে, সকল মানুষের ওপর হজ্জ ফরয । এ প্রসংগে বলা যায়, আয়াতের অর্থে প্রথমত মনে হয় সকল ইহুদীদের ওপর হজ্জ ফরয, যারা কাবা শরীফের দিকে মুখ করে নামায পড়াতে ঘোরতর আপত্তি তুলেছিলো । একই সময় দেখা যায়, এ ঘরটি তাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম(আ.) এর ঘর বিধায় তাদের কাছে এই ঘরে এসে হজ্জ করার দাবী জানানো হচ্ছে। কারণ এ ঘর তাদের পিতা ইবরাহীম(আ.)-এরই ঘর। আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের জন্যে এ ঘরটিই প্রথম নির্মিত হয়, কিন্তু একমাত্র ইহুদী জাতিই আল্লাহর কাছে আনুগত্য প্রকাশের প্রতীক হিসাবে এই ঘরের দিকে মুখ করে নামায পড়তে সর্বপ্রথম অস্বীকার করে, তারা ইচ্ছা করেই এই নাফরমানী করে এবং একমাত্র তাদের থেকেই প্রথম এই ত্রুটি প্রকাশিত হয় ৷ দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে, এই হজ্জ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে যেন এই চেতনা জাগে যে দ্বীন ইসলামী জীবন ও সমাজব্যবস্থা সকল মানুষের কাম্য । সবারই প্রয়োজন এর নির্দেশনাবলী ও অনুষ্ঠানসমূহ পালন করা । আর মোমেনরা যেমন করে এই ঘরের দিকে মুখ করে এবাদত করে, তেমনি অন্যরাও যেন সেই দিকে মুখ করে এবাদাত করে এবং সেই ঘরে হজ্জের জন্যে আসে । এ না হলে কুফরীই করা হবে, তা সে যে কোনো ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন। আল্লাহ তায়ালা বিশ্বের সবার থেকে মুখাপেক্ষীহীন মহান ও পবিত্র । আল্লাহর এতে কিছু আসে যায় না- কেউ ঈমান আনুক আর না আনুক আর কেউ হজ্জ করুক আর না করুক। ঈমান ও এবাদাতের কারণে কল্যাণ আসবে তাদেরই আর সফল ও হবে তারা নিজেরা। হজ্জ তখনই ফরয হয়, যখন বায়তুল্লাহ শরীফে আসা যাওয়ার পথ খরচ কারো হাতে এসে যায় এবং সে সুস্থ থাকে ও আসা-যাওয়ার পথকে নিরাপদ মনে করে। ঠিক কোন্ সময় হজ্জ ফরয হওয়ার নির্দেশ এসেছিলো সে বিষয়ে কিছু মতভেদ আছে। তবে যারা বিশ্বাস করে যে, হজ্জ সম্পর্কিত আলোচ্য আয়াতটি নবম হিজরীতে নাজরানের প্রতিনিধিবর্গ আগমনের বছরে নাযিল হয়েছে, তারা মনে করে হজ্জ এই বছরেই ফরয হয়। তারা তাদের পক্ষে দলীল হিসাবে রসূলুল্লাহ(স.) এর হজ্জকে গ্রহণ করেন, যা এই তারিখের পর সংঘটিত হয়েছিলো কেবলা পরিবর্তন সম্পর্কে ‘ফী যিলালিল কোরআন-‘এর দ্বিতীয় খন্ডে আমরা এ বিষয়ের ওপর আলোচনা রেখেছি যে, রসূলুল্লাহ(স.)-এর হজ্জ করাটাই হজ্জ দেরীতে ফরয হওয়ার পক্ষে কোনো দলীল নয়। বরং অনেকের মতে এর কারণ হচ্ছে, মোশরেকরা বায়তুল্লাহ শরীফে উলংগ হয়ে তাওয়াফ করত । মক্কা বিজয়ের পরও তারা এইভাবে তাওয়াফ করতে থাকায় রসূলুল্লাহ(স.) তা অপছন্দ করেন, শেষ পর্যন্ত নবম বছরে সূরা ‘বারআত’ নাযিল হওয়ার পর মোশরেকদের জন্যে বায়তুল্লাহর তওয়াফ নিষিদ্ধ হয়ে যায় । এর পরের বছরে রসূলুল্লাহ(স.) হজ্জ করেন। তারপর থেকে হজ্জ ফরয হয়ে যায়। অথচ জানা কথা, হিজরতের পরে এবং ওহুদ যুদ্ধের পরে অথবা এর কাছাকাছি সময়ে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। এটা অবশ্যই স্পষ্ট যে, আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমেই হজ্জ ফরয করা। এতে বলা হয়েছে, সামর্থবান সকল মানুষের ওপর এই ঘরের হজ্জ ফরয। মুসলমানদের জন্যে হজ্জ হচ্ছে বাৎসরিক মহাসম্মেলন। এই পবিত্র ঘরে তারা সমবেত হয়ে পরস্পরের সাক্ষাত লাভ করবে৷ এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমান জাতির পিতা ইবরাহীম(আ.)-এর হাতে যে মহাসম্মেলনের সূচনা হয় এবং একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর এবাদাতের জন্যে আল্লাহ তায়ালা এই ঘরকেই সর্বপ্রথম মনোনীত করেন তা জানা যায়। হজ্জের এই হচ্ছে তাৎপর্য । এই পবিত্র ঘর সেই মহাম্মৃতিই বহন করে চলেছে, যার তওয়াফ দিবারাত্রি সর্বক্ষণ জারি রয়েছে যেখানে এসে মানুষ তার সৃষ্টিকর্তার একান্ত সান্নিধ্যে পৌছে যায়। এ বিশ্বাসের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয় এবং এর ফলে মানুষ সত্যিকার মানুষে পরিণত হয়। মানুষ এখানে একত্রিত হয়ে বিশ্বমানবতাবোধ ফিরে পায়। তাই সবাইকে এই মহা সমাবেশে উপস্থিত হওয়ার জন্যে আহ্বান জানানো হয়েছে।
*হজ্জের কিছু বিধিবিধান ও তার তাৎপর্য : এখানে সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলােতে হজ্জের কিছু কিছু নিয়ম-বিধি ও তার উদ্দেশ্যের ওপর আলােকপাত করা হয়েছে, ‘তারা নির্দিষ্ট দিনগুলােতে আল্লাহর নাম নিয়ে আল্লাহ প্রদত্ত কিছু পশু কোরবানী করবে…’ এটা কোরবানীর ঈদের দিনে ও তার পরবর্তী তাশরীকের তিন দিনের পশু কোরবানীর দিকে ইংগিত। কোরআন পশু কোরবানীর সাথে আল্লাহর নাম উচ্চারণের বিষয়টা প্রথমে উল্লেখ করেছে। কারণ পরিবেশ ও পটভূমিটা হচ্ছে এবাদাতের এবং মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভ। তাই কোরবানীর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হলাে যবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ, যেন এটাই কোরবানীর আসল উদ্দেশ্য, শুধু যবাই করা ও গােশত খাওয়া নয়। কোরবানী যদিও একটা গুরুত্বপূর্ণ সদকা এবং ফকীর মিসকীনকে খাওয়ানাের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়। তথাপি এটা হযরত ইসমাঈলের পরিবর্তে পশু কোরবানীর স্মৃতি, আল্লাহর একটা নিদর্শনের স্মৃতি এবং আল্লাহর দুই বান্দা হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈলের আনুগত্যের স্মৃতিও বটে। আয়াতে যে ‘বাহীমাতুল আনয়াম’ অর্থাৎ চতুস্পদ জন্তুর উল্লেখ রয়েছে তা দ্বারা উট, গরু, ছাগল ও ভেড়া বুঝানাে হয়েছে। ‘অতপর, তােমরা তা থেকে নিজেরাও খাও এবং বিপন্ন অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও।’ কোরবানীর গােশত নিজেরাও খাও এই নির্দেশ দানের অর্থ হলাে, কোরবানী দাতার পক্ষে সে গােশত খাওয়া হালাল, বৈধ ও উত্তম। এ আদেশের উদ্দেশ্য সম্ভবত এই যে, দরিদ্র মিসকীনরা যেন মনে করে, সে গােশত ভালাে। আর দরিদ্রদেরকে খাওয়ানের নির্দেশের অর্থ হলাে, তাদেরকে খাওয়ানাে অবশ্য কর্তব্য ও ওয়াজিব। হজ্জের সময় কোরবানীর মাধ্যমে ইহরামের সমাপ্তি ঘটে। এরপর হাজীরা চুল কামাতে বা ছাঁটতে পারেন, বােগলের পশম কামাতে পারেন, নখ কাটতে পারেন ও গােসল করতে পারেন, যা ইহরামের সময় তার জন্য হারাম ছিলাে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তারপর তারা যেন দূর করে ফেলে নিজেদের শরীরের অপরিচ্ছন্নতা এবং নিজেদের মান্নত যেন পূর্ণ করে।’ অর্থাৎ হজ্জের অপরিহার্য অংগ যে কোরবানী, তার অতিরিক্ত কোনাে মান্নত যদি করে থাকে, তা যেন পূর্ণ করে এবং তারা সুরক্ষিত ঘরটির তাওয়াফ করে! এটাকে ‘তওয়াফে এফাযা’ বলা হয়, যা আরাফার ময়দানে অবস্থানের পরেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর দ্বারাই হজ্জের এবাদাতটি সমাপ্ত হয়। তওয়াফে এফাযা’ ‘তওয়াফে বিদা’ বা বিদায়ী তওয়াফ থেকে ভিন্ন। ‘আল বাইতুল আতীক’ বা সুরক্ষিত গৃহ বলতে মাসজিদুল হারামকে বুঝানাে হয়েছে। এ ঘকে আল্লাহ তায়ালা যে কোনাে আগ্রাসী শক্তির দখল থেকে চিরদিন মুক্ত রেখেছেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা এ ঘরকে ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা করেছেন। তাই হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর সময় থেকেই মাঝে মাঝে এ ঘরের সংস্কার হয়ে এসেছে। এতাে গেলাে আল্লাহর ঘরের নির্মাণের কাহিনী ও তার ভিত্তি বিষয়ক বক্তব্য, আল্লাহ তায়ালা তার বন্ধু ইবরাহীম(আ.)-কে আদেশ দিয়েছিলেন এ ঘরকে তাওহীদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে শিরক থেকে পবিত্র করতে, এই ঘরে হজ্জ করার জন্যে মানুষকে আহ্বান জানাতে, এখানে হজ্জের সময় আল্লাহর নামে পশু কোরবানী করতে- তথাকথিত দেব-দেবীর নামে নয় এবং সেই পশুর গােশত খেতে ও খাওয়াতে। এই সম্মানিত ও পবিত্র গৃহে আল্লাহর যাবতীয় পবিত্র বিধি-বিধান সুরক্ষিত। তন্মধ্যে সর্বপ্রথম বিধানটা হলাে তাওহীদ এবং এর দরজা একমাত্র ইসলামী পন্থায় তওয়াফকারী ও নামায আদায়কারীদের জন্যে উন্মুক্ত। এ ছাড়া এ ঘরের চতুর্সীমায় রক্তের পবিত্রতা, ওয়াদা ও অংগীকারের অলংঘনীয়তা এবং শান্তি ও সন্ধির অলংঘনীয়তা সুরক্ষিত।(আয়াত ৩০-৩১) বস্তুত আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিসগুলাের সম্মান করার অর্থ এই যে, তার নিষিদ্ধতা লংঘন করা যাবে না। এটা আল্লাহর কাছে উত্তম কাজ। এটা সাধারণ বিবেক ও অনুভূতির কাছে এবং বাস্তবতার দৃষ্টিতেও উত্তম। যে মানুষের বিবেকনিষিদ্ধ জিনিসগুলােকে এড়িয়ে চলে, সে পবিত্রতাকামী বিবেকবান মানুষ। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিসকে মেনে চলে তাকেই মানব সমাজ নিরাপদ, ঝুকিহীন, ও অনাগ্রাসী ব্যক্তি মনে করে। এ ধরনের লােকেরা যেখানে কর্তৃত্ব চালায় সেটা হয়ে থাকে শান্তি, নিরাপত্তাপূর্ণ স্থান। আরবের মোশরেকরা নিজেদের মনগড়া কিছু জিনিসকে নিষিদ্ধ ও পবিত্র ঘােষণা করেছিলাে। অথচ সেগুলাে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিলাে না। পক্ষান্তরে আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিসগুলােকে তারা অকাতরে লংঘন করতাে। কোরআন আল্লাহর নিষিদ্ধ করা প্রাণী ছাড়া অন্যসব পশুকে হালাল ঘােষণা করেছে যেমন মৃত জন্তু, রক্ত, শুকরের গােশত এবং হালাল করা হয়েছে কেবল যেগুলোর কথা তােমাদেরকে জানানাে হয় তা ছাড়া। এর উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর নিষিদ্ধ করা জিনিস ছাড়া অন্য কিছু যেন নিষিদ্ধ না থাকে, কেউ যেন আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কোনো আইন রচনা না করতে পারে এবং আল্লাহর বিধান ছাড়া শাসন না চালাতে পারে। চতুস্পদ জন্তুর হালাল হওয়ার প্রসংগে পৌত্তলিকতা পরিহার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মােশরেকরা বিভিন্ন দেব-দেবীর নামে পশু যবাই করতাে। অথচ এসব দেব-দেবী হচ্ছে ‘রিজ্স’ বা অপবিত্রতা। এখানে ‘অপবিত্রতা’ দ্বারা মনের অপবিত্রতা বুঝানাে হয়েছে। আল্লাহর সাথে শিরক করা এমন এক অপবিত্রতা ও নােংরামি, যা বিবেক ও মনকে নােংরা ও কলুষিত করে, যেমন কোনাে নাপাক জিনিস শরীর ও পােশাককে অপবিত্র করে। আর যেহেতু শিরক আল্লাহর প্রতি এক ধরনের অপবাদ আরােপ ও মিথ্যাচারের নামান্তর, তাই আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের মিথ্যাচার পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘অতএব তােমরা মূর্তিপূজার অপবিত্রতা পরিহার করো এবং মিথ্যাচার পরিহার করো।’ কোরআন ও হাদীসে মিথ্যাচারকে পৌত্তলিকতার পর্যায়ভুক্ত করে এর জঘন্যতাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। ইমাম আহমদ বর্ণনা করেন যে, রসূল(স.) একবার ফজরের নামাযের পর দাঁড়িয়ে বলেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দান আল্লাহর সাথে শরীক করার সমপর্যায়ের অপরাধ। অতপর তিনি আলােচ্য আয়াত পাঠ করেন। আসলে আল্লাহ তায়ালা চান মানুষ সব ধরনের শিরক এবং সব ধরনের মিথ্যাচারকে পরিহার করুক এবং পরিপূর্ণ ও নির্ভেজাল তাওহীদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হােক। ‘যারা আল্লাহর প্রতি একাগ্র চিত্ত, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে না।’ (আয়াত ৩১) ৩১ নং আয়াতের পরবর্তী অংশে সেই ব্যক্তির ভয়াবহ পরিণতির চিত্র অংকন করা হয়েছে যে তাওহীদের শীর্ষস্থান থেকে পা পিছলে শিরকের গভীর খাদে পতিত হয়েছে। ফলে সে এমনভাবে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়েছে যেন ধরাপৃষ্ঠে তার অস্তিত্ব কখনাে ছিলাে না। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়লাে, অতপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলাে অথবা বাতাস তাকে কোনাে দূরবর্তী স্থানে ফেলে দিলো।’ এখানে উচ্চ স্থান থেকে নীচে পতিত মানুষের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। আর এক নিমিষেই সে যেন টুকরাে টুকরাে হয়ে গেলো। এজন্যেই পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে, ‘ফলে পাখিরা তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেলাে’ । অথবা ‘বাতাস তাকে উড়িয়ে দৃষ্টির আড়ালে দূরে কোথাও নিয়ে ফেলে দিলাে।’ অর্থাৎ তার কোনাে স্থীতি নেই। এখানে ‘ফা’ অব্যয়টি বারবার ব্যবহার করে শব্দের মধ্যে দ্রুততা ও প্রচন্ডতা আর দৃশ্যের ভেতরে দ্রুত উধাও হয়ে যাওয়ার ভাবটা ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এটা কোরআনের শৈল্পিক বাচনভংগির অন্তর্ভুক্ত, যাতে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের ছবি ভাষার মাধ্যমে চিত্রিত করা হয়। এটা আসলে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্তকারীদের নিখুঁত চিত্র। তারা ঈমানের সুউচ্চ অবস্থান থেকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হয়। কেননা তাওহীদের যে ভিত্তির ওপর মানুষ পরম নিশ্চিন্তে অবস্থান করতে পারে এবং যাকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, একজন মােশরেক তা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে তার অসংযত কামনা বাসনাগুলাে তাকে শিকারী পাখীর মতাে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ও কুরে কুরে খায় এবং নানারকমের ভিত্তিহীন কল্পনা তাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে বেড়ায়। অথচ সে কোনাে অটুট বন্ধনের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখে না- যা তাকে তার আবাসস্থল এই পৃথিবীর সাথে বেঁধে রাখে।
*কোরবানীর পশুসংক্রান্ত বিধি বিধানের তাৎপর্য : আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিসগুলাে পরিহার করার মাধ্যমে সেগুলােকে সম্মান দেখানাের বিষয়টা আলােচনার পর পরবর্তী আয়াতে হজ্জের কোরবানীযােগ্য পশুগুলাের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের তাগিদ দেয়া হয়েছে। পশুগুলােকে মোটা বানিয়ে ও ওগুলােকে অধিকতর দামী পশুতে পরিণত করার মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন সম্পর্কেও আলােকপাত করা হয়েছে। (আয়াত ৩২) এ আয়াতে হাজীর যবাই করা কোরবানীর পশুর সাথে আন্তরিক তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতির সংযােগ ঘটানাে হয়েছে। কেননা তাকওয়াই হচ্ছে হজ্জ ও কোরবানীর মূল উদ্দেশ্য। হজের প্রতিটা কাজ ও কোরবানী আল্লাহর প্রতি মনােনিবেশ ও আনুগত্যের প্রতীক ছাড়া আর কিছু নয়। এর গভীরে হযরত ইবরাহীম(আ.) ও তার পরবর্তী সময়কার নবীদের ত্যাগ-তিতীক্ষা ও আনুগত্যের স্মৃতি জড়িত রয়েছে। মুসলিম জাতির ভিত্তি পত্তনকাল থেকেই এই ত্যাগ, কোরবানী, আনুগত্য ও মনোনিবেশ সক্রিয় রয়েছে। সুতরাং দোয়া, নামায ও কোরবানী আনুগত্য একই পর্যায়ভুক্ত। যে সমস্ত জন্তুকে এহরামের শেষ দিনগুলােতে কুরবানী করার জন্যে নেয়া হয়, তা দ্বারা উপকৃত হওয়াও মালিকের জন্যে বৈধ। প্রয়ােজন হলে সে তার পিঠে আরোহণ করতে পারে, প্রয়ােজন হলে তার দুধপান করতে পারে যতােক্ষণ না তাকে পবিত্র কাবা গৃহের কাছে পৌছানাে ও কুরবানী করা হয়, যাতে গরীব-দুঃখীদের খাওয়ানাের ব্যবস্থা করা যায়। রসূল(স.)-এর আমলে মুসলমানরা কোরবানীর পশুকে কেন্দ্র করে নানারকমের বাড়াবাড়ি করতাে। কেউ কেউ মােটা মােটা ও দেখতে দামী জানােয়ার কুরবানী করতাে এবং এ দ্বারা কোরবানীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতাে। আর এটা তারা আল্লাহভীতির মনােভাব নিয়েই করতো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর(রা.) বর্ণনা করেন যে, হযরত ওমর(রা.)-কে একটা অল্পবয়স্ক উট উপহার দেয়া হলাে। তিনি তার বিনিময়ে তিনশত দিনার দিলেন। তারপর রসূল(স.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাে ইয়া রসূলাল্লাহ, আমি একটা অল্পবয়স্ক উট উপহার পেয়েছি। ওটার বিনিময়ে আমি তিনশত দিনার দিয়েছি। এখন এটাকে কি বিক্রি করে দেবাে এবং এর দাম দিয়ে কয়েকটা বাদানা (বয়ঙ্ক উট বা গরু, যা হজ্জের সময় আট জনের জন্যে যথেষ্ট হয়ে যায়) কিনবাে? রাসূল(স.) বললেন, না, ওটাই কুরবানী করো। যে অল্প বয়স্ক উটনী হযরত ওমরের কাছে উপঢৌকন হিসেবে এসেছিলে এবং যার দাম তিনশত দিনার নির্ধারিত হয়েছিলাে, হযরত ওমর তার মূল্য রেখে দিতে চাননি, বরং সে উটনীটাকে বিক্রি করে দিয়ে তা দিয়ে একাধিক গরু বা উট কিনতে চেয়েছিলেন কোরবানী করার জন্যে। কিন্তু রসূল(স.) ইচ্ছা করলেন যে, ওমর সে অল্প বয়স্ক উটনীটাকেই কোরবানী করুক, কেননা ওটা অপেক্ষাকৃত দামী ও সুন্দর। তার পরিবর্তে অনেকগুলাে বড়াে বড়াে উট বা গরু কিনে কোরবানী করাকে তিনি পছন্দ করেননি। এতে গােশতের পরিমাণ বেশী পাওয়া যেতাে। কিন্তু এগুলাের ভাবাবেগগত দাম কম, আর কোরবানীর মূল লক্ষ্য হলাে জানােয়ারটা যেন ভাবাবেগগতভাবে বেশী দামী হয়। রসূল(স.)-এর ‘এটাই কোরবানী করাে’ কথাটার মর্ম এটাই। পবিত্র কোরআন বলছে যে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে এসব কোরবানীর যথেষ্ট প্রচলন রয়েছে। কিন্তু ইসলাম এগুলােকে সঠিক দিকে পরিচালিত করেছে এবং এক আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারাে উদ্দেশ্যে কোরবানী না হয় এটা নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক জাতির জন্যে আমি বিধান দিয়েছি যেন তারা আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত জন্তুকে আল্লাহর নামে যবাই করে…'(আয়াত ৩৩-৩৪) আসলে দৃষ্টিভংগী ও ভাবাবেগকে আল্লাহমুখী করাই ইসলামের প্রধান কাজ। তাই সে সকল ভাবাবেগ, কাজ, ব্যস্ততা, এবাদাত, আদত অভ্যাস ও চালচলনকে আল্লাহর দিকেই চালিত করে এবং সবগুলােকে আল্লাহর রংগে রঞ্জিত করে। এরই ভিত্তিতে যেসব জানােয়ার আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কারাে নামে যবাই করা হয়, তাকে হারাম করা হয়েছে। যবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণকে এতাে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যেন যবাই করাটাই আল্লাহর নাম উচ্চারণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত। (আয়াত ৩৩) এরপর পুনরায় আল্লাহর একত্ব ঘােষণা করে এ বিষয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। ‘অতএব তােমাদের ইলাহ একই ইলাহ।’ অতপর সেই এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। ‘অতএব তারই কাছে তােমরা আত্মসমর্পণ করাে।’ আর এরপরই পরিঙ্কার করে বলে দেয়া হচ্ছে যে, ‘এই আত্মসমর্পণ বল প্রয়ােগে ও বাধ্য করে করানাে হবে না। বরং স্বেচ্ছা প্রণােদিত হয়ে করা হবে, এবং বিনয়ীদের সুসংবাদ দাও, যারা আল্লাহর নাম শুনলেই তাদের মন কেঁপে ওঠে।’ অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর নাম উচ্চারণেই তাদের হৃদয় ও বিবেক আলােড়িত হয়। ‘এবং বিপদ-মুসিবতে যারা ধৈর্যধারণ করে।’ অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহর সিদ্ধান্তে তারা কোনাে আপত্তি তােলে না। ‘এবং যারা নামায কায়েম করে।’ অর্থাৎ তারা যথাযথভাবে আল্লাহর এবাদাত করে। ‘এবং আমার দেয়া জীবিকা থেকে দান করে।’ অর্থাৎ আল্লাহর পথে দান করতে কার্পণ্য করে না। এভাবে আকীদা বিশ্বাস ও কোরবানীকে এক সূত্রে গ্রোথিত করা হয়েছে। কোরবানী আসলে ইসলামী আকীদা বিশ্বাস থেকেই উৎসারিত এবং তার ওপরই প্রতিষ্ঠিত। কোরবানী ও যাবতীয় এবাদাতে এই আকীদা বিশ্বাসই প্রতিফলিত। আসল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু কোরবানীও নয়, এবাদাতও নয় জীবনের সমস্ত কর্মকান্ডকেই এবং গােটা জীবনকেই ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের রং-এ রঞ্জিত করতে হবে। এতে শক্তি ও দৃষ্টি একই কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধ হবে এবং মানব সত্ত্বা নানা ভাগে বিভক্ত হবে না। (আমার রচিত বিশ্ব শান্তি ও ইসলাম’ নামক পুস্তকে ‘জীবন ও বিশ্বাস’ শীর্ষক অধ্যায়টি দেখুন)
*কোরবানীর সঠিক মর্ম : বর্তমান অধ্যায় হজ্জের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য উটনী কুরবানী সম্পর্কে বিশেষভাবে আলােচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কাবা শরীফের জন্যে উৎসর্গীকৃত উটনীকে আমি মহান আল্লাহ, বানিয়েছি তােমাদের জন্যে, আমার ক্ষমতার নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযােগ্য নিদর্শন, এর মধ্যে রয়েছে তােমাদের জন্যে প্রভুত কল্যাণ… আর এহসানকারীকে চূড়ান্ত সাফল্যের সুসংবাদ দিয়ে দাও।'(আয়াত ৩৬-৩৭) এখানে বিশেষভাবে কোরবানীর উটনীর উল্লেখ এই জন্যে করা হয়েছে যাতে করে মানুষ বুঝতে পারে যে এটাই হচ্ছে সকল কোরবানীর শ্রেষ্ঠ কোরবানী, কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিশেষ করে আরবের অধিবাসীদের জন্যে এর মধ্যে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন বলে আলােচ্য আয়াতে জানাচ্ছেন। জীবন্ত আরােহণযােগ্য ও দুগ্ধবতী উটনীকে কোরবানী করার মধ্যে কল্যাণ এ মহা কল্যাণের সর্বাংশ আমাদের বােধগম্য না হলেও এতােটুকু তাে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর গোশত আংশিক খাওয়া হয় এবং বাকি অংশ বিলিয়ে দেয়া হয় যা স্থানীয় ও দূরবর্তী বহ লােকের ভােগ ব্যবহারে আসে (এখন প্রশ্ন হচ্ছে উটনী কেন, এখানে উটও তাে হতে পারতাে এর একটি জওয়াব হচ্ছে উটনী যদি দুগ্ধবতী হয় তার মূল উটের থেকে অনেক বেশী যা কেউ হাতছাড়া করতে চায় না। এজন্য আল্লাহর মহব্বতের এই মূল্যবান পশু কুরবানী করার মাধ্যমে নিজেদেরকে সহজেই আল্লাহ পাকের দরবারে মঅর্যাদাবান বানানাে যায়। এর হয়তো আরো কারণ আছে যা আল্লাহ তায়ালাই ভালাে জানেন) এই প্রিয় পশুকে আল্লাহর মহব্বতে কোরবানী করায় তার সন্তোষ প্রাপ্তিকেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়, যার কারণে তার বিশেষ মেহেরবানী নাযিল হয়। এ কোরবানী আল্লাহ তায়ালা যে কবুল করেন এই অবস্থার মধ্যে তার প্রমাণ পাওয়া যায় যে কোরবানীর সে শক্তিশালী পশুগুলােকে যখন লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে তাদের গলার হলকুমে তরবারির অগ্রভাগ বা বল্লম দিয়ে খোঁচা মেরে রক্ত প্রবাহিত করা হয়, তখন তারা মোটেই নড়া চড়া করে না। রক্ত ঝরে ঝরে যখন তাদের শরীর রক্তহীন হয়ে আসে তখন তারা আস্তে করে পার্শ্বদেশে শুয়ে পড়ে। এজন্যে হুকুম দেয়া হয়েছে, ‘সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাের পর তাদের ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো।’ উটদেরকে তিন পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে এবং শুধুমাত্র চতুর্থ পাকে বেঁধে রেখে নহর করা হয়। তারপর যখন পার্শ্ব দেশে প্রাণীটি পড়ে যায় এবং মাটিতে পড়ে বেরিয়ে গেছে বলে নিশ্চিত হয়ে যাওয়া হয় তখন এর মালিকরা মহব্বতের সাথে এর থেকে গােশত কেটে নিয়ে খাওয়া দাওয়া করে, এসব কোরবানীর পশুর গােশত থেকে তাদেরকে খাওয়ানাে হয় যারা অভাবগ্রস্ত, যদিও তারা কিছু চায় না, আর সেই সব ভাগ্যহারা মানুষকেও দেয়া হয় যারা নিজেদের অভাব জানাতে বাধ্য হয়ে যায়। সুতরাং এটা স্পষ্ট হলাে যে, এসব জন্তুকে আল্লাহ তায়ালা মানুষের নিয়ন্ত্রণে এনে দিয়েছেন, যাতে করে মানুষ এসব নেয়ামতের জন্যে আল্লাহর শােকরগােরি করে এবং জীবন্ত ও জবাইকৃত উভয় অবস্থাতেই এসব পশুর ভােগ ব্যবহারে ধন্য মানুষ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘এমনি করেই, আমি নিয়ন্ত্রিত করেছি এগুলােকে তােমাদের জন্যে যেন তােমরা শোকরগুজারী করো। আর যদিও আল্লাহর নামেই এসব পশুকে নহর করতে বলা হয়েছে, কিন্তু তাই বলে এদের গোশত ও রক্ত কোনাে কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে পৌছায় না।’ অর্থাৎ মহান ও পবিত্র আল্লাহর কাছে এদের গােশত বা রক্ত কিছুই পৌছায় না; তাঁর কাছে পৌছায় শুধু যে ব্যক্তি কোরবানী করলাে তার অন্তরের তাকওয়া (আল্লাহভীতি) ও তার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার মনােভাব, সেইভাবে এগুলাের রক্ত ছিটানাে হয় না যেভাবে, পূজা পার্বন উপলক্ষে আরব মােশরেকরা, বলির পশুর রক্ত মূর্তির ওপর ছিটিয়ে আনুগত্য জানতাে। এটা এক চরম জাহেলী ও কঠিন শিরক! এরশাদ হচ্ছে, ‘এমনি করে তিনি তােমাদের (ভােগ ব্যবহারের) জন্যে এগুলােকে তােমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দিয়েছেন, যেন তােমরা তার শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞাপন করতে পারাে, কেননা তিনি তােমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করেছেন…’ অবশ্যই তিনি তােমাদেরকে তার একত্ব প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে দিয়েছেন, এগিয়ে দিয়েছেন তিনি তোমাদেরকে তার নিজের দিকে, এগিয়ে দিয়েছেন তােমাদেরকে রব (মনিব) ও বান্দার (গােলামের) সম্পর্ক সঠিকভাবে বুঝার দিকে; তিনি তােমাদেরকে, বাস্তব কাজ করা ও সৎ কাজে প্রবৃত্ত থাকার সূক্ষ্ম ও সঠিক তাৎপর্যকে বুঝার তৌফিক দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘এবং সুসংবাদ দাও এহসানকারীদেরকে… যারা চিন্তা চেতনায়, এবাদাত বন্দেগীতে এবং জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে এবং সকল তৎপরতায় সুন্দর-সঠিক পথ অবলম্বন করে।’ এমনি করে একজন (প্রকৃত) মুসলমান জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে এবং দিবা-রাত্রির প্রতিটি অংগ সঞ্চালনের সময়ে অবশ্যই খেয়াল করে যে, সে আল্লাহর পথে আছে তাে! আল্লাহর ভয়ে তার হৃদয় মন উদ্বেলিত হতে থাকে, একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি ও রেযামন্দি হাসিল করার জন্যে তার মধ্যে এক প্রবল আগ্রহ, সৃষ্টি হয় সুতরাং তার গােটা জীবনই এবাদাতের জীবন হিসাবে গন্য হয়ে যায়, যেখানে সব কিছুই সম্পাদিত হয় মহান আল্লাহরই ইচ্ছায়, যিনি সকল বান্দাকে সৃষ্টি করেছেন। এর ফলে, পৃথিবীর যেখানেই সে বাস করুক না কেন সেখানেই তার দ্বারা সংশােধনী ও কল্যাণ প্রসার লাভ করে এবং তার এই মহত্ব তাকে আরশের মালিকের কাছে প্রিয় বানিয়ে দেয়।