أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৫২)
[ يَكَادُونَ يَسْطُونَ بِالَّذِينَ يَتْلُونَ عَلَيْهِمْ ايَاتِنَا
যারা তাদের নিকট আমার আয়াত আবৃত্তি করে, তাদেরকে তারা আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। ]
সূরা:- আল্ – হাজ্জ।
সুরা:২২
৬১-৭২ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২২:৬১
ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ یُوۡلِجُ الَّیۡلَ فِی النَّہَارِ وَ یُوۡلِجُ النَّہَارَ فِی الَّیۡلِ وَ اَنَّ اللّٰہَ سَمِیۡعٌۢ بَصِیۡرٌ ﴿۶۱﴾
এসব এজন্য যে, আল্লাহই রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিনকে প্রবেশ করান রাতের মধ্যে এবং তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন।
২২:৬২
ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡحَقُّ وَ اَنَّ مَا یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِہٖ ہُوَ الۡبَاطِلُ وَ اَنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡعَلِیُّ الۡکَبِیۡرُ ﴿۶۲﴾
এসব এজন্য যে, আল্লাহই সত্য এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে এরা যাদেরকে ডাকে তারা সবাই মিথ্যা। আর আল্লাহই পরাক্রমশালী ও মহান।
২২:৬৩
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً ۫ فَتُصۡبِحُ الۡاَرۡضُ مُخۡضَرَّۃً ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَطِیۡفٌ خَبِیۡرٌ ﴿ۚ۶۳﴾
তুমি কি দেখো না, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তার বদৌলতে জমি সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে? আসলে তিনি সূক্ষ্মদর্শী ও সর্বজ্ঞ।
২২:৬৪
لَہٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ اِنَّ اللّٰہَ لَہُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿٪۶۴﴾
যা কিছু আকাশে ও পৃথিবীতে আছে সব তাঁরই। নিঃসন্দেহে তিনিই অমুখাপেক্ষী ও প্রশংসার্হ।
২২:৬৫
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰہَ سَخَّرَ لَکُمۡ مَّا فِی الۡاَرۡضِ وَ الۡفُلۡکَ تَجۡرِیۡ فِی الۡبَحۡرِ بِاَمۡرِہٖ ؕ وَ یُمۡسِکُ السَّمَآءَ اَنۡ تَقَعَ عَلَی الۡاَرۡضِ اِلَّا بِاِذۡنِہٖ ؕ اِنَّ اللّٰہَ بِالنَّاسِ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۶۵﴾
তুমি কি দেখো না, তিনি পৃথিবীর সবকিছুকে তোমাদের জন্য অনুগত করে রেখেছেন এবং তিনিই নৌযানকে নিয়মের অধীন করেছেন যার ফলে তাঁর হুকুমে তা সমুদ্রে বিচরণ করে আর তিনিই আকাশকে এমনভাবে ধরে রেখেছেন যার ফলে তাঁর হুকুম ছাড়া তা পৃথিবীর ওপর পতিত হতে পারে না। আসলে আল্লাহ লোকদের জন্য বড়ই স্নেহশীল ও মেহেরবান।
২২:৬৬
وَ ہُوَ الَّذِیۡۤ اَحۡیَاکُمۡ ۫ ثُمَّ یُمِیۡتُکُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡکُمۡ ؕ اِنَّ الۡاِنۡسَانَ لَکَفُوۡرٌ ﴿۶۶﴾
তিনিই তোমাদের জীবন দান করেছেন, তিনিই তোমাদের মৃত্যু দান করেন এবং তিনিই আবার তোমাদের জীবিত করবেন; সত্য বলতে কি, মানুষ বড়ই সত্য অস্বীকারকারী।
২২:৬৭
لِکُلِّ اُمَّۃٍ جَعَلۡنَا مَنۡسَکًا ہُمۡ نَاسِکُوۡہُ فَلَا یُنَازِعُنَّکَ فِی الۡاَمۡرِ وَ ادۡعُ اِلٰی رَبِّکَ ؕ اِنَّکَ لَعَلٰی ہُدًی مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۶۷﴾
প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি একটি ইবাদাতের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করেছি, যা তারা অনুসরণ করে; কাজেই হে মুহাম্মাদ! এ ব্যাপারে তারা যেন তোমার সাথে ঝগড়া না করে। তুমি তোমার রবের দিকে দাওয়াত দাও। অবশ্যই তুমি সঠিক সরল পথে আছো।
২২:৬৮
وَ اِنۡ جٰدَلُوۡکَ فَقُلِ اللّٰہُ اَعۡلَمُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ﴿۶۸﴾
আর যদি তারা তোমার সাথে ঝগড়া করে তাহলে বলে দাও, “যা কিছু তোমরা করছো আল্লাহ তা খুব ভালোই জানেন।
২২:৬৯
اَللّٰہُ یَحۡکُمُ بَیۡنَکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ فِیۡمَا کُنۡتُمۡ فِیۡہِ تَخۡتَلِفُوۡنَ ﴿۶۹﴾
তোমরা যেসব বিষয়ে মতভেদ করছো আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে সেসব বিষয়ে ফায়সালা করে দেবেন।”
২২:৭০
اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰہَ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّ ذٰلِکَ فِیۡ کِتٰبٍ ؕ اِنَّ ذٰلِکَ عَلَی اللّٰہِ یَسِیۡرٌ ﴿۷۰﴾
তুমি কি জানো না, আকাশ ও পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসই আল্লাহ জানেন? সবকিছু একটি কিতাবে লিখিত আছে। আল্লাহর জন্য এটা মোটেই কঠিন নয়।
২২:৭১
وَ یَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ مَا لَمۡ یُنَزِّلۡ بِہٖ سُلۡطٰنًا وَّ مَا لَیۡسَ لَہُمۡ بِہٖ عِلۡمٌ ؕ وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ نَّصِیۡرٍ ﴿۷۱﴾
তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কিছুর ইবাদাত করে যাদের জন্য না তিনি কোন প্রমাণ পত্র অবতীর্ণ করেছেন আর না তারা নিজেরাই তাদের ব্যাপারে কোন জ্ঞান রাখে।এ জালেমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।
২২:৭২
وَ اِذَا تُتۡلٰی عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتُنَا بَیِّنٰتٍ تَعۡرِفُ فِیۡ وُجُوۡہِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوا الۡمُنۡکَرَ ؕ یَکَادُوۡنَ یَسۡطُوۡنَ بِالَّذِیۡنَ یَتۡلُوۡنَ عَلَیۡہِمۡ اٰیٰتِنَا ؕ قُلۡ اَفَاُنَبِّئُکُمۡ بِشَرٍّ مِّنۡ ذٰلِکُمۡ ؕ اَلنَّارُ ؕ وَعَدَہَا اللّٰہُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ؕ وَ بِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿٪۷۲﴾
আর তাদের কাছে আমাদের সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হলে আপনি কাফেরদের মুখমণ্ডলে অসন্তোষ দেখতে পাবেন। যারা তাদের কাছে আমাদের আয়াত তিলাওয়াত করে তাদেরকে তারা আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। বলুন, ‘তবে কি আমি তোমাদেরকে এর চেয়েও মন্দ কিছুর সংবাদ দেব? — এটা আগুন । যারা কুফরি করে আল্লাহ্ তাদেরকে এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর এটা কত নিকৃষ্ট ফিরে যাওয়ার স্থান!’
৬১-৭২ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
* প্রসংগে বলা হচ্ছে, ‘এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ তায়ালা রাতকে দিনের মধ্যে…'(আয়াত নং ৬১) দিবা-রাত্রির এই যে পরিবর্তন, সেটা একটা প্রাকৃতিক ও সাধারণ বিষয় যা মানুষ সকাল বিকাল এবং শীত ও গ্রীষ্মে প্রত্যক্ষ করে থাকে। সূর্য যখন অস্তমিত হয় তখন দিনের মাঝে রাত প্রবেশ করে আর যখন উদিত হয় তখন রাতের মাঝে দিন প্রবেশ করে। এ ছাড়া শীতের মৌসুমে যখন দিন ছােট হয় এবং রাত বড় হয় তখনও বলতে পারি যে, দিনের মাঝে রাত প্রবেশ করেছে। ঠিক তেমনিভাবে গরমের মৌসুমে যখন রাত ছােট হয়ে দিন বড়াে হয়, তখনও আমরা বলতে পারি যে, রাতের মাঝে দিন প্রবেশ করেছে, এই প্রাকৃতিক বিষয়টি মানুষ অহরহ প্রত্যক্ষ করছে এবং একটি অতি সাধারণ বিষয় হিসেবে এর প্রতি তেমন কোনাে গুরুত্ব দেয় না। তারা ভুলে যায় যে, এর পেছনে এক সূক্ষ্ম ও চিরস্থায়ী নিয়ম কাজ করছে। ফলে এর মাঝে কোনাে ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা যায় না, কোনাে ব্যতিক্রম দেখা যায় না এবং কোনাে বৈকল্যও দেখা যায় না, এর দ্বারাই প্রমাণ হয় যে, মহা শক্তিধর সত্ত্বা এই অপরিবর্তণীয় ও অলঙ্ঘনীয় নিয়মের অধীনে গােটা বিশ্বকে পরিচালনা করছেন, নিয়ন্ত্রণ করছেন। অহরহ ঘটে যাওয়া এই জাগতিকে বিষয়টির প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাও আলােচ্য আয়াতের উদ্দেশ্য। এই আয়াতের বক্তব্য দ্বারা আল্লাহর কুদরত ও শক্তির ব্যাপারে মানুষের দৃষ্টিকে উন্মোচিত করা হচ্ছে, তাদের চিন্তা চেতনাকে নাড়া দেয়া হচ্ছে। ফলে মানুষ যেন উপলব্ধি করতে পারে, যে মহান সত্ত্বা একদিকে দিনকে গুটিয়ে নিয়ে রাতের পর্দা টেনে দিচ্ছেন, অপরদিকে রাতকে গুটিয়ে নিয়ে দিনের আলাে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অত্যন্ত সুচারু রূপে, সূক্ষ্ম ভাবে এবং অপরিবর্তণীয় এক স্থায়ী নিয়মের অধীনে। তিনি অবশ্যই সেসব মযলুমদের সাহায্য করতে সক্ষম যারা যুলুমকে প্রতিহত করতে গিয়ে যুলুমের বদলা নিতে গিয়ে পুনরায় যুলুমের শিকার হবে। রাত ও দিনের পরিবর্তন যেমন ভাবে আল্লাহ তায়ালা করছেন ঠিক সে ভাবেই সে মযলুমদেরকেও সাহায্য করবেন। এটা তার অমােঘ বিধান, অলঙ্ঘনীয় বিধান। এই বিধান অনুযায়ীই আল্লাহ তায়ালা যুলুমবাজদের ক্ষমতার কালো রাত্রিকে গুটিয়ে নিয়ে ন্যায়পরায়নদের ক্ষমতার আলাে ছড়িয়ে দেবেন। দুটোই ঘটবে বা ঘটছে একই নিয়মের অধীনে, কিন্তু মানুষ এগুলাে দেখেও দেখে না। যেমনটি দেখে না জগতময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আল্লাহর অসংখ্য কুদরত ও নিদর্শনাবলী । এসব বাস্তব বিষয়াদি এ কথাই প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন মহা সত্য। এই মহাসত্যের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে গােটা বিশ্ব, তারই মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এই গােটা প্রকৃতি। কাজেই আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর যা কিছু আছে, তা সবই মিথ্যে ভ্রান্ত, অচল, অস্থায়ী ও অস্থিতিশীল। এ কথাই নিচের আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘এটা এ কারণেও যে, আল্লাহ তায়ালাই সত্য…'(আয়াত ৬২) যেহেতু আল্লাহ তায়ালা সত্য, কাজেই তিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষই অবলম্বন করবেন এবং অসত্য ও অন্যায়ের বিপক্ষে থাকবেন। আর এটাই সত্যের বিজয় ও মিথ্যার পরাজয় প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট-এর দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, জাগতিক নিয়ম কানুন যেমন স্থায়ী, অভ্রান্ত ও অলংঘনীয় তেমনিভাবে সত্যের জয় ও মিথ্যার পরাজয়ও অভ্রান্তও অলংঘনীয় ।
* *সৃষ্টি জগতের সবকিছুই মানুষের সেবায় নিয়ােজিত : অত্যাচারীদের তুলনায় আল্লাহ তায়ালা অনেক উর্ধে। জুলুমবাজদের তুলনায় তিনি অনেক বড়াে ও ক্ষমতাধর। কাজেই তিনি অত্যাচারকে বাড়তে দিতে পারেন না, অন্যায় অবিচারকে দীর্ঘ হতে দিতে পারেন না। ‘এবং আল্লাহ তায়ালাই সবার উচ্চে, সর্বমহান’। প্রতি মুহূর্তে মানুষ যেসব নিদর্শন গােটা প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান দেখতে পায় সেগুলাের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখাে না, আল্লাহ আকাশ থেকে…'(আয়াত ৬৩) আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ, তারপর রাতারাতি ধনীর শ্যামল রূপ ধারণ এ গুলাে অতিসাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা যা অহরহ ঘটছে। এগুলাে দেখতে দেখতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাজেই তা মনের মাঝে তেমন কোনাে আলােড়ন সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু যখন সংবেদনশীল অনুভূতির উন্মেষ ঘটে তখন ধরনীর এসব সাধারণ দৃশ্যাবলী মনের মাঝে এক ধরনের ভাবাবেগ ও চেতনার জন্ম দেয়। তখন মানুষ হৃদয়ের গভীর থেকে উপলদ্ধি করতে পারে এবং দেখতে পায় যে, ধরনীর বুক চিরে উদিত ছােট চারাগুলাে বর্ণে ও সম্পর্কে যেন কচি কচি শিশু যারা আনন্দে উল্লাসে হাসছে এবং আলাের পাখার ভর দিয়ে যেন উড়ে চলছে। এভাবে যারা উপলব্ধি করতে পারে, অনুভব করতে পারে, তারা ‘নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সব বিষয়ে জ্ঞাত’ এই বক্তব্যের মর্ম অনুধাবন করতেও সক্ষম। কারণ তাদের অনুভূতি সুক্ষ্ম, তাদের অনুধাবন শক্তি গভীর, কাজেই তারা এ জাতীয় সুক্ষ্ম দৃশ্যের তাৎপর্য ও মর্ম বুঝতে সক্ষম। একইভাবে আল্লাহর সূক্ষ্মদর্শীতার তাৎপর্যও অনুধাবন করা তাদের পক্ষে সম্ভব। আল্লাহর কুদরতী কোমল হাতের স্পর্শের ফলেই মাটির নিচ থেকে অত্যন্ত দুর্বল ও কোমল চারা গাছ ধীরে ধীরে উঁকি মারতে পারে। আল্লাহর কুদরতী হাতই ওটাকে বাতাসে মেলে ধরে, পৃথিবীর আকর্ষণ এবং ভূমির ভারের ওপর ভিত্তি করে ওটাকে ওপরের দিকে বাড়িয়ে দেয়। এরপর আল্লাহর ইচ্ছায় বৃষ্টি ধর্ষণের সকল আয়ােজন সম্পন্ন করা হয়। ফলে সময়মতাে ও প্রয়ােজনমতাে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়, এরপর বৃষ্টির পানি মাটির সাথে মিশে গিয়ে সে বাড়ন্ত চারা গাছগুলাের প্রতিটি জীবন্ত কোষে শক্তি জোগায় এবং সজীবতা ও শ্যামলতায় ভরে তােলে। এই বৃষ্টি আল্লাহর আকাশ থেকে বর্ষিত হয়ে তাঁরই যমীনে পতিত হয়। এর মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর বুকে জীবনের উম্মেষ ঘটান। এর মাধ্যমে আহার যােগান, ঐশ্বর্য যােগান। তিনিই এই গােটা জগত ও জগতবাসীদের মালিক এবং কর্তা। তিনি কারাে মুখাপেক্ষী নন। তিনি পানির দ্বারা, বৃষ্টি দ্বারা এবং বৃক্ষ তরুলতা দ্বারা সকল প্রাণীর আহার যােগান। এর বিনিময়ে প্রাণী জগতের কাছ থেকে লাভ করার মতাে তার কিছুই নেই। কারণ, আল্লাহ তায়ালাই অভাব মুক্ত, প্রশংসার অধিকারী। আকাশবাসী ও যমীনবাসী কারাে কাছ থেকে আল্লাহর কিছু চাওয়ার নেই এবং পাওয়ারও নেই, তিনি সব ধরনের প্রয়ােজন হতে মুক্ত। বরং তিনি স্বীয় নেয়ামতের জন্য সকলের কাছে প্রশংসার অধিকারী কৃতজ্ঞতার দাবীদার এবং আনুগত্যের উপযুক্ত। প্রতি মুহূর্তে মানুষ যেসব খােদায়ী কুদরতের নিদর্শনাবলী দেখতে পায়, পুনরায় সেগুলাে তার সামনে তুলে ধরা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, ‘তুমি কি দেখােনা যে, ভূপূষ্টে যা আছে…'(আয়াত ৬৫) এই পৃথিবীর বুকে কতাে শক্তি, কতাে সম্পদই না আল্লাহ তায়ালা মানুষের সেবায় নিয়ােজিত রেখেছেন। অথচ মানুষ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। সে বুঝতেই পারে না যে, এর পেছনে কোনাে মহান সত্ত্বার হাত কাজ করছে। পৃথিবীর বুকে যা কিছু রয়েছে তার সবটাই আল্লাহ তায়ালা এই মানুষের সেবায় নিয়ােজিত রেখেছেন। ফলে পৃথিবীর প্রকৃতি ও স্বভাব মানুষের প্রকৃতি ও স্বভাবের অনুকুল করা হয়েছে। মানুষের স্বভাব ও তার গঠন প্রকৃতি যদি এই পৃথিবীর স্বভাব ও প্রকৃতি হতে ভিন্ন হতাে, তাহলে এখানে টিকে থাকা এবং বেঁচে থাকাই তার পক্ষে সম্ভব হতাে না, উপকৃত হওয়া ও লাভবান হওয়া তাে অনেক দূরের কথা। মানুষের দৈহিক গঠন প্রণালী যদি পৃথিবীর তাপমাত্রা, আলাে, বাতাস, খাদ্য ও পানির অনুকূল না হতাে, তাহলে এক মুহূর্তের জন্যেও সে এখানে টিকতে পারত না। মানুষের দেহের ঘনত্ব আর পৃথিবীর ঘনত্ব বর্তমানে যা আছে, তার চেয়ে যদি সামান্যও ব্যতিক্রম হতাে, তাহলে মাটির ওপর তার পা টিকে থাকতাে না। বরং বাতাসে উড়ে যেতাে, অথবা মাটির নিচে তলিয়ে যেতাে। এই পৃথিবীর বুকে যদি বায়ুর কোনাে অস্তিত্বই না থাকতাে, অথবা বর্তমানে বায়ূর যে ঘনত্ব আছে, তার চেয়ে যদি বেশী হতাে, অথবা কম হতাে, তাহলে মানুষ দম আটকে মারা যেতাে অথবা তার স্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধার সৃষ্টি হতাে। সে কারণেই মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি পৃথিবীর সব কিছুকেই তার সেবায় নিয়ােজিত রাখা হয়েছে। আর এসব কিছুই হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশে। পৃথিবীকে মানুষের সেবায় নিয়ােজিত করেই আল্লাহ তায়ালা ক্ষান্ত হননি। বরং পৃথিবীর প্রকাশ্য ও গোপন যাবতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করার মতাে যােগ্যতা, ক্ষমতা ও শক্তিও তাকে দান করেছেন। ফলে মানুষ একের পর এক প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার উদ্ঘাটন করে চলেছে। যখনই তার নতুন সম্পদের প্রয়ােজন দেখা দেয়, তখনই সে নতুন নতুন ভান্ডারের মুখ খুলে দেয়। এক ভান্ডার শেষ হলে আর এক ভান্ডার আবিষ্কার করে নেয়। বর্তমানে পৃথিবীর বুকে গ্যাস ও তেল আকারে যে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ মজুদ রয়েছে তা এখনও শেষ হতে না হতেই আনবিক শক্তি, পারমাণবিক শক্তি ও সৌরশক্তির নয়া ভান্ডার মানুষের সামনে উন্মুক্ত হতে চলেছে। তবে মানুষ যখন এসব সম্পদ কল্যাণমুখী কাজে এবং গঠনমূলক কাজে ব্যবহার করে তখনই আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে, যখন সে আল্লাহর নির্দেশিত পথে নিজেকে পরিচালিত করবে এবং জীবন সম্পর্কিত আল্লাহর বিধান মেনে চলবে। নচেত তার অবস্থা সেই অবুঝ শিশুর ন্যায় হবে যে আগুন নিয়ে খেলা করতে গিয়ে নিজেকেও জ্বালিয়ে মারে এবং অন্যকেও জ্বালিয়ে মারে। ‘সমুদ্রে চলমান নৌকা’- প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতিগুলাে আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে সাজিয়েছেন যে, সমুদ্রের বুকে নৌকা ভাসতে পারে ও চলতে পারে। এই প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতির তত্ত্বজ্ঞান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিখিয়েছেন। ফলে সে নিজের কল্যাণ ও উপকারে এগুলােকে ব্যবহার করতে পারে। যদি সমুদ্র বা নৌকার স্বভাব ও প্রকৃতির মাঝে সামান্যতম ব্যতিক্রম দেখা দিতাে, অথবা এ সবের জ্ঞানের ব্যাপারে মানুষের মাঝে অভাব থাকতাে, তাহলে যা হচ্ছে ও ঘটছে, তা কখনও হতাে না। এবং তিনি আকাশ স্থির রাখেন, যাতে তাঁর আদেশ ব্যতীত ভূপৃষ্ঠে পতিত না হয় অর্থাৎ তিনি একটা নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে এই জগত সৃষ্টি করেছেন এবং এই নিয়মের অধীনেই তা পরিচালিত করছেন। সে নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন থাকার ফলেই গ্রহ-নক্ষত্র পরস্পর থেকে অনেক দূরে ও শূন্যে অবস্থান করছে। কাজেই ভূপৃষ্ঠে সেগুলাে পতিতও হয় না এবং পরস্পরের মাঝে সংঘর্ষও হয় না। মহা জাগতিক নিয়ম নীতি সম্পর্কিত জ্যোতির্বিদ্যার যে কোনাে ব্যাখ্যা মূলত সেই সুসংঘবদ্ধ প্রাকৃতিক নিয়ম নীতিরই ব্যাখ্যা প্রয়াস যা এই নিখিল বিশ্বের স্রষ্টার অন্যতম সৃষ্টি। কিন্তু অনেকেই এই জাজ্জল্যমান সত্যটিকে ভুলে যায়। ফলে তারা এই মহা জাগতিক নিয়ম নীতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অস্বীকারই করে বসে যে, এর পেছনে কোনাে মহান সত্ত্বার সুনিপুণ হাত কাজ করছে। এটা একটা আজগুবী ধারণা, অমূলক ধারণা এক অদ্ভূত ভ্রান্ত চিন্তাধারা। প্রথমত. জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিতান্তই অনুমান নির্ভর হয়ে থাকে। সেগুলাে সত্য হতে পারে এবং মিথ্যাও হতে পারে। এমনকি আজকে যে মতবাদ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, আগামী কাল হয়তাে নতুন কোনাে মতবাদের মাধ্যমে তা বাতিল বলেও সাব্যস্ত হতে পারে। তা সত্তেও এগুলােকে যদি সঠিক বলে মেনে নেয়া হয়, তবুও এর দ্বারা জাগতিক নিয়ম নীতির স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় এবং এই নিয়ম নীতির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় স্রষ্টার প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম-নীতির ফলে ও প্রভাবেই আকাশ ভূপৃষ্ঠে পতিত হতে পারে না। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশে সেদিন এই নিয়ম নীতি অচল হয়ে পড়বে, অকার্যকর হয়ে পড়বে সেদিন অবশ্যই আকাশ ভেংগে চুরমার হয়ে যাবে। এর পেছনেও আল্লাহর রহস্য কাজ করছে।
* আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শনাবলী এবং সুক্ষ্ম প্রাকৃতিক ও মহা জাগতিক নিয়মনীতি বর্ণনার পর এখন মানব জগতে জীবন মৃত্যুর বিধান সম্পর্কে আলােচনা করা হচ্ছে। নিচের আয়াতে এ প্রসংগে বলা হচ্ছে, ‘তিনিই তােমাদেরকে জীবিত…'(আয়াত ৬৬) জীবনের উৎপত্তিই হচ্ছে এক অলৌকিক ঘটনা। দিন ও রাতের প্রতিটি মুহর্তে যে সব জীবনের উৎপত্তি ঘটছে তার প্রত্যেকটির মাধ্যমে সে অলৌকিক ঘটনার পুনরাবৃত্তিও ঘটছে। এর পেছনে যে নিগূঢ় রহস্য লুকায়িত আছে তা অনুধাবন করতে গিয়ে মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধি খেই হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, এটা একটা বিশাল বিষয়। এর জন্যে চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রও অনেক প্রশস্ত । মৃত্যু হচ্ছে আর এক রহস্য। এই রহস্য উদঘাটন করতে গিয়েও মানুষ অপারগ হয়ে পড়ছে। এই মৃত্যু ঘটে এক নিমিষেই । জীবনের প্রকৃতি আর মৃত্যুর প্রকৃতির মাঝে যে ব্যবধান, তা শত যােজন। কাজেই এই রহস্য সম্পর্কে চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রও অনেক প্রশস্ত ও দীর্ঘ। মৃত্যুর পরের জীবন একটি অদৃশ্য ব্যাপার। কিন্তু সে জীবন যে অবধারিত ও নিশ্চিত তার প্রমাণ রয়েছে জীবনের উৎপত্তির ঘটনার মাঝেই। অতএব এ সম্পর্কেও চিন্তা ভাবনা করার মতাে সুযােগ রয়েছে। কিন্তু মানুষ এ সব অকাট্য প্রমাণাদি এবং এসব নিগূঢ় রহস্যাদি সম্পর্কে আদৌ চিন্তা ভাবনা করে না। তাই বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয় মানুষ বড়াে অকৃতজ্ঞ।’ এসব নিদর্শনাবলী পেশ করে আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়টি অত্যন্ত জোরালােভাবে প্রমাণ করতে চান যে, যুলুম অত্যাচারকে প্রতিহত করতে গিয়ে কেউ পুনরায় অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হলে আল্লাহর মদদ তার সহায়ক হবেই। এই জোরালােভাবে প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে হচ্ছে, মানুষের হৃদয়কে এসব নিদর্শনাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সেগুলাের ব্যাপারে চিন্তা করতে উঘুদ্ধ করা। এটা পবিত্র কোরআনের বর্ণনা ভংগিরই একটি অন্যতম রূপ। এর মাধ্যমে জাগতিক ও প্রাকৃতিক নিদর্শনাবলী পেশ করা হয়। সৃষ্টি জগত সম্পর্কিত সত্য ও ন্যায় নীতি বিধানের মাঝে একটা যােগসূত্র স্থাপন করা হয়। উদ্দেশ্য সে একটাই। আর তা হচ্ছে মানুষের হৃদয়কে এই সত্যতা ও বাস্তবতাকে স্বতস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে উদ্বুদ্ধ করা।
*ইসলামী আন্দোলনে আপােষকামীতার সুযােগ নেই : মহা জাগতিক ঘটনাবলীর অন্তরালে আল্লাহ তায়ালা কুদরতের প্রমাণাদি পেশ করার পর এখন সরাসরি রসূল(স.)-কে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তিনি যেন নিজের পথই অনুসরণ করে চলেন এবং মােশরেকদের দিকে না তাকান, ওদের তর্ক বিতর্কের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেন। কারণ, ওদের সাথে ঝগড়া বিবাদ করে, তর্ক বিতর্ক করে ওদেরকে আল্লাহর মনােনীত পথে পরিচালিত করা সম্ভব নয়। ওদের কাছে সত্যের দাওয়াত পৌছিয়ে দেয়াই নবীর কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করলেই যথেষ্ট। বলা হচ্ছে, ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে এবাদাতের একটা নিয়ম কানুন নির্ধারণ করে দিয়েছি…'(আয়াত ৬৭-৬৮) এটা একটা বাস্তব সত্য যে, প্রত্যেক জাতির জীবন যাপন, চিন্তা চেতনা, আচার আচরণ এবং বােধ ও বিশ্বাসের একটা স্বতন্ত্র পদ্ধতি ও আদর্শ থাকে। এই আদর্শ আল্লাহর সেই চিরন্তন নীতিরই অধীন যার মাধ্যমে মানবীয় স্বভাব ও মানসিকতা নিয়ন্ত্রিত হয়। কাজেই যে জাতি জীবন ও জগতকে কেন্দ্র করে আবর্তিত সত্যের সন্ধানদাতা অগনিত প্রমাণাদি ও নিদর্শনাবলীর ডাকে সাড়া দিয়ে খোলা মনে তা গ্রহণ করে নেয়, সে জাতিই আল্লাহর পথের সন্ধান পায়, হেদায়াত লাভে ধন্য হয়। অপরদিকে যে জাতি এসব প্রমাণাদি ও নিদর্শনাবলীর ডাকে সাড়ে দেয় না, ভ্রুক্ষেপ করে না, সে জাতি পথভ্রষ্ট জাতি। কাজেই সে জাতির এই তাচ্ছিল্য ও ঔদাসীন্য তাদেরকে সত্যের পথ থেকে এবং ন্যায়ের পথ থেকে আরাে দূরে সরিয়ে রাখবে। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন পথ ও আদর্শ সৃষ্টি করে রেখেছেন। কাজেই এসব বিষয় নিয়ে নবীর ব্যস্ত হওয়ার কোনাে কারণ নেই এবং এগুলাে নিয়ে মােশরেকদের সাথে তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হওয়ারও কোনাে প্রয়ােজন নেই। কারণ, ওরা ইচ্ছ করেই সত্যের পথ থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এবং উৎসাহ ভরে নিজেদেরকে ভুল পথেই চালিয়ে নিচ্ছে। নবীর আদর্শের ব্যাপারে এবং মত ও পথের ব্যাপারে ওরা যাতে নবীর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার সুযােগ না পায় সে নির্দেশ তাকে দেয়া হচ্ছে। সাথে সাথে তাকে আরাে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, তিনি যেন নিজের আদর্শের ওপরই অটল থাকেন এবং কাফের মােশরেকদের তর্ক বিতর্কের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করেন। বরং তর্ক বিতর্কের সুযােগই যেন ওদেরকে না দেন। কারণ তিনি যে আদর্শের ধারক ও প্রচারক সেটাই হচ্ছে প্রকৃত আদর্শ এবং সত্য আদর্শ। তাই নবীকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, ‘তুমি তােমার পালনকর্তার দিকে আহ্বান করাে। নিশ্চয়ই তুমি সরল পথেই আছে।’ অতএব নবীকে নিশ্চিত হতে হবে যে, তিনি সঠিক আদর্শের ওপরই আছেন এবং সত্য পথই অনুসরণ করে চলেছেন। এরপরও যদি কাফের মােশরেক সম্প্রদায় তার সাথে তর্ক করতে আসে তাহলে তিনি যেন অহেতুক সময় ও শ্রমের অপচয় না করে সংক্ষেপে এভাবে উত্তর দিয়ে দেন, তারা যদি আপনার সাথে বিতর্ক করে, তবে বলে দিন, তােমরা যা করাে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অধিক জ্ঞাত যারা সত্যকে জানার জন্যে তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হয় এবং যাদের মাঝে সত্য গ্রহণের যােগ্যতা আছে, কেবল তাদের সাথেই তর্ক করা যায়। এতে কাজও হয়। কিন্তু যারা গোয়ার প্রকৃতির, দাম্ভিক ও অহংকারী; যারা নিজেদের ভুল পথ ও মত থেকে এক চুল পরিমাণ সরতেও রাযী নয়- তাদের সাথে তর্ক বিতর্ক করে কোনাে লাভ নেই। কারণ, ওদের চোখের সামনে শত শত আলামত ও নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যা লা-শরীক আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু, এসব কিছু দেখেও ওরা সত্যকে মেনে নেয় না। কাজেই ওদের ব্যাপারটা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালাে। তিনিই ওদের ফয়সালা করবেন। কারণ, সত্য ও মিথ্যার ব্যাপারে এবং বিভিন্ন মত ও পথের ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দেয়ার মালিক একমাত্র তিনিই। তাই বলা হচ্ছে, ‘তােমরা যে ব্যাপারে মত বিরােধ করছে সে ব্যাপারে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা সিদ্ধান্ত দেবেন'(আয়াত ৬৯) কারণ, তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আপত্তি করার কারও ক্ষমতা নেই। সেই কেয়ামতের দিন কারাে তর্ক করার সাহস হবে না। তার চূড়ান্ত রায়ের ব্যাপারে কারাে দ্বিমত ব্যক্ত করার সুযােগ থাকবে না। আল্লাহ যখন কোনাে বিষয়ে রায় দেন, তখন পরিপূর্ণভাবে জেনে শুনেই দেন। তিনি অসীম জ্ঞানের অধিকারী। কোনাে দলীল প্রমাণ ও কার্যকারণই তাঁর জ্ঞানের আওতার বাইরে নয়। কোনাে কিছুই তার অজানা নয়। তিনি যমীন ও আসমানের যা কিছু ঘটছে, সবই জানেন। এমনকি মানুষের অন্তরে কি ঘটছে তাও জানেন। মানুষের নিয়তের খবরও তিনি রাখেন। তাই বলা হচ্ছে, ‘তোমার কি জানা নেই…'(আয়াত ৭০) আল্লাহর জ্ঞান হচ্ছে পরিপূর্ণ ও সূক্ষ্ম। কাজেই জগতের কোনাে কিছুই তার জ্ঞানের আওতার বাইরে নেই। যে সব কারণে মানুষ ভুলে যায় বা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে- সেগুলাে আল্লাহর মাঝে নেই। কাজেই তার সত্ত্বাকে একটি বিশাল গ্রন্থের সাথেই তুলনা করা যায়, যার মাঝে সব কিছুরই তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। অপরদিকে মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির পরিধি খুবই সীমিত। কাজেই তার পক্ষে আল্লাহর জ্ঞানের বিশালতা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। এমনকি তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। তাই জগতের সকল বস্তু, সকল ব্যক্তি, সকল কর্ম, সকল অনুভূতি এবং সকল গতিবিধি সম্পর্কে আল্লাহর পূর্ণাংগ ও সুক্ষ্ম জ্ঞানের বিষয়ে চিন্তা করতে গিয়েও মানুষ ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ে। অথচ বিষয়টা তার জন্যে অসম্ভব হলেও, আল্লাহর জন্যে নয়। বরং আল্লাহর জন্যে তা খুবই সহজ। তাই বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয়ই তা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’
* সত্যের আহবানে বাতিলের গাত্রদাহ অবশ্যম্ভাবী : রসূলের সত্য আদর্শের ব্যাপারে কাফের মােশরেকদেরকে অহেতুক তর্ক বিতর্কের সুযােগ না দেয়ার আদেশ করার পর এখন আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী আয়াতে ওদের মতাদর্শের স্বরূপ তুলে ধরছেন। ওদের মতাদর্শে কি বক্রতা রয়েছে, কি দুর্বলতা রয়েছে, কি অজ্ঞতা ও কুসংস্কার রয়েছে এবং সত্যের প্রতি কি অন্যায় ও অবিচার রয়েছে তা তুলে ধরছেন এবং প্রমাণ করছেন যে, ওরা তাঁর মদদ ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত। কাজেই ওদের পক্ষে কেউ নেই। বলা হচ্ছে, ‘ওরা আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত এমন কিছুর উপাসনা করে…'(আয়াত ৭১) যে কোনাে মত ও পথ, যে কোনাে ধর্ম ও আদর্শ তার শক্তি আহরণ করে একমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে। কাজেই যে মতবাদ বা আদর্শের পেছনে আল্লাহর সমর্থন নেই এবং স্বীকৃতি নেই সে মতবাদ অবশ্যই দুর্বল, নড়বড়ে এবং মৌলিকতাবিহীন মতবাদ। সে মােশরেকদের দল বিভিন্ন মূর্তিরূপী দেব-দেবী অথবা মানুষ ও শয়তান রূপী দেব-দেবীর পূজা অর্চনা করে থাকে। এসব দেব-দেবীর পেছনে আল্লাহর কোনাে শক্তি নেই, সমর্থন নেই। কাজেই ওরা শক্তিহীন এবং সামর্থ্যহীন। কোনাে বলিষ্ঠ বা সন্তোষজনক যুক্তি প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে ওরা এ সবের পূজা অর্চনা করে না। বরং অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বশবর্তী হয়েই করে থাকে। সবচেয়ে বড়াে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, ওরা আল্লাহর নির্দেশ ছাড়াই এবং নিতান্ত অজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে এসব দেব-দেবীর পূজা অর্চনা করা সত্তেও হক কথা শুনতে মােটেও রাজি নয়। সত্যের আহ্বানে সাড়া দিতেও রাজী নয়। বরং তাদেরকে হক কথা বলা হলে বা সত্যের পথে আহবান করা হলে সেটাকে তারা নিজেদের জন্যে অবমাননাকর বলে মনে করে। ফলে কেউ তাদের সামনে পবিত্র কোরআনের বাণী পাঠ করে শুনাতে গেলে তার ওপর চড়াও হতে তারা উদ্যত হয় । নিচের আয়াতে সে কথাই বলা হচ্ছে, ‘আর যখন তাদেরকে আমার আয়াতসমূহ পাঠ করে শুনানাে হয়…'(আয়াত ৭২) অর্থাৎ ওরা যুক্তির মােকাবেলা যুক্তি এবং সাক্ষ্য প্রমাণের মােকাবেলা সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে করতে সক্ষম নয়। তাই যুক্তি-তর্কে হেরে যাওয়ার ভয়ে তারা বল প্রয়ােগের আশ্রয় নেয়, যুলুম নির্যাতনের পথ বেছে নেয়। উগ্রবাদী ও স্বৈরাচারী লােকদের স্বভাবই এ রকম। যুলুম অত্যাচার এবং উৎপীড়ন নিপীড়ন ওদের অস্থি মজ্জার সাথে মিশে থাকে। তাই, ওরা হক কথা বরদাশত করতে পারে না। বরং এই হক কথার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যে ওরা সর্ব শক্তি প্রয়ােগ করে। কারণ, ওদের বিশ্বাস, কঠোর হস্ত ব্যতীত এই কণ্ঠ স্তব্ধ করা যায় না। কোরআন ওদেরকে জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে মারার হুমকি দিচ্ছে এবং বলছে যে, তােমাদের এসব যুলুম অত্যাচার ও নির্যাতনের পরিণতি খুবই খারাপ হবে। তােমাদের স্থান জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই হবে না। কাজেই হুশিয়ার, সাবধান।
# যেখানে শৈথিল্য বা আপোসের কোনো সুযোগ নেই : সবার ‘শেষে’ বিবরণ দেয়া হয়েছে শেষ নবীর মাধ্যমে আগত সর্বশেষ শরীয়তের, তথা ইসলামের। এই শরীয়ত ইসলামের সর্বশেষ সংস্করণ বহন করে এনেছে যাতে তা সমগ্র মানব জাতির দ্বীন ও শরীয়ত হতে পারে, পূর্ববর্তী সকল দ্বীন ও শরীয়তকে বাতিল করে, সে সবের ওপর স্থান গ্রহণ করতে পারে এবং তা আল্লাহর সর্বশেষ ও চুড়ান্ত বিধান গণ্য হতে পারে। এই বিধান মানবজাতির জীবনের সকল দিক ও বিভাগ তথা আকীদা বিশ্বাস, সমাজ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যেই এসেছে । এ বিধান অনুসারে বিচার ফায়সালা ও শাসন কার্য পরিচালনা করা হবে এ উদ্দেশ্যেই তা এসেছে এ জন্যে আসেনি যে, তা নিয়ে কেবল অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করা হবে এবং বড় বড় বই পুস্তক রচনা করা হবে । আল্লাহর এ বিধান এ জন্যে এসেছে যে, তা সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ও অবিকলভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। এর কোনো একটি হুকুমও পরিত্যক্ত হবে না বা পরিবর্তন করা হবে না, চাই তা জীবনের যতো-ছোটো বা বড় অবস্থার সাথেই যুক্ত হোক না কেন। এভাবে যদি আল্লাহর বিধানকে মেনে চলা হয়,তাহলে সেটা হবে ইসলাম, নচেত জাহেলিয়াত, স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রবৃত্তি পুজা, আল্লাহর দ্বীনের বিরোধিতা করা আর এ কথা বলা যে, দ্বীনের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, একেরারেই অর্থহীন ও অযৌক্তিক । আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে জনগণকে তিনিই ঐক্যবদ্ধ করে দিতে পারতেন তিনি সেটা চাননি। তিনি চেয়েছেন তার শরীয়ত অনুযায়ী বিচার ফয়সালা ও শাসন পরিচালনা করা হোক, তাতে জনগণের প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক না কেন। আল্লাহর এ বক্তব্যই ৪৮, ৪৯ ও ৫০ নং আয়াতে বিবৃত হয়েছে। এ তিনটি আয়াতে যে রূপ খোলাখুলিভাবে ও দ্ব্যার্থহীনভাবে ‘আল্লাহর বিধানের কোনো’ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও কোনো বিশেষ পরিস্থিতি ও পরিবেশের দোহাই দিয়ে, কোনো যুক্তিতেই ত্যাগ না করার ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, তা অধ্যয়ন করার পর কোনো মানুষ যখন দেখে যে, কেউ নিজেকে মুসলমান পরিচয় দিয়েও পরিস্থিতি ও পারিবেশের দোহাই দিয়ে পুরো শরীয়তকেই পরিত্যাগ করে চলেছে তখন সে অরাক না হয়ে পারে না। আল্লাহর আইনকে জীবনের সকল ক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত করে কিভাবে মানুষ মুসলমান হবার দাবী করে তা সে বুঝে উঠতে পারেনা । জীবনের সকল পরিস্থিতিতে ও সকল পরিবেশেই যে ইসলাম উপযোগী এবং আল্লাহ তায়ালা যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্যে ইলাহ তথা প্রভু ও আইনদাতা, তা অস্বীকারকারী কিভাবে ‘মুসলমান’ বলে দাবী করে, তা সত্যিই দুর্বোধ্য । আল্লাহ্ তায়ালা বললেন, ‘আমি তোমার কাছে সত্য সহকারে কিতাব নাযিল করেছি ।’ বস্তুত আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো কিছু নযিল হওয়াই তার সত্য হওয়ার প্রমাণ। তিনিই শরীয়ত নাযিল করা ও আইন চালু করার অধিকারী ৷ এ শরীয়তের সব ধারাতেই সত্য প্রতিফলিত ৷ আকীদা হোক, আইন হোক, আদেশ হোক বা সংবাদ হোক, সব কিছুতেই নিরেট ও নির্ভেজাল সত্য প্রকাশিত । ‘এ কেতাব তার পূর্ববর্তী সকল কেতাবের সমর্থক ও সকল কেতাবের ওপর অগ্রগণ্য ।’ বস্তুত ইসলাম হচ্ছে দ্বীনের সর্বশেষ রূপ ৷ জীবন বিধান ও মানুষের আইন হিসাবেও এটা সর্বশেষ এতে কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের অবকাশ নেই । চাই যে কোনো মতভেদ নিরসনের জন্যে তাঁকে এই কেতাবের আলোকে বিবেচনা রূরা উচিত । তাই সে মতভেদ মুসলমান, ইহুদী ও খৃষ্টানদের মধ্যে আকীদা নিয়ে সংঘটিত হোক, ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে সংঘটিত হোক, অথবা স্বয়ং মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত হোক এই কেতাবের আলোকেই সকল মতামতের বিচার করতে হবে । এই কেতাব দ্বারা সমর্থিত না হলে, মানুষের মতামতের কোনো মূল্য নেই । আর এই সত্যেরই দাবী এইযে, ‘অতএব তুমি আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুসারে তাদের মধ্যে সকল বিবাদের নিষ্পত্তি করে দাও….’ এ নির্দেশ মূলত রসূল(স.) কে দেয়া হয়েছে ৷ কেননা আহলে কেতাব তার কাছে নিজেদের বিরাদের নিষ্পত্তির জন্যে আসতো। তবে এটা শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি সর্বব্যাপী নির্দেশ । এ নির্দেশ কেয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলমানের ওপর প্রযোজ্য । কেননা কেয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নতুন নবী রসূল আসবে না এবং এই কেতাবের কোনো কিছু সংশোধনের জন্যে কোনো ওইীও আসবে না? আল্লাহর এ দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে এবং এতে কোনো কিছুই পরিবর্তনযোগ্য নেই । এ দ্বীনকে আল্লাহ তায়ালা যখন মানুষের জন্যে মনোনীত করেছেন; তখন তিনি: জানতেন যে, -এ দ্বীন সকল মানুষের জন্যে যথেষ্ট এবং এতে মানুষের যাবতীয় কল্যাণ নিশ্চিত রূরা হয়েছে। এ দ্বীন কেয়ামত পর্যন্ত সকল মীনুষের জন্যে যথেষ্ট । এতে কিছুমাত্র পরিবর্তন বা পরিবর্ধন এই পূর্ণাংগ বিধানকে অস্বীকার করার শামিল এবং এ কাজ দ্বারা মানুষ ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যাবে, যদিও সে হাজার বার মুখে বলে যে, ‘আমি মুসলমান’। আল্লাহ্ তায়ালা এ কথা জানতেন যে, আল্লাহর দ্বীন থেকে সরে আসার জন্যে বহু রকমের ছল ছুতোর আশ্রয় নেয়া হতে পারে এবং অন্তরে এরূপ কুপ্ররোচনা আসা বিচিত্র কিছু নয় যে, বিশেষ বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে আল্লাহর বিধানের সব কিছুকে বাস্তবায়িত করা ও সব কিছু অনুসারে বিচার ফয়ালা করা তেমন জরুরী নয়। তাই আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর নবীকে সাবধান করে দিচ্ছেন যে, তোমার কাছে বিচারপ্রার্থী হয়ে আগমনকারীদের খেয়ালখুশী মোতাবেক আল্লাহর বিধানের অংশ বিশেষকে পরিত্যাগ বা রদবদল করতে রাজী হয়ে যেও না । এ ধরনের কুপ্ররোচনাগুলোর মধ্যে যেটি সর্বাগ্রে উল্লেখের দাবী রাখে তা হলো এই যে, বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারী শ্রেণী ও গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে ঐক্য ও মনের মিল প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে ছোটখাট ও মৌলিক নয় এমন সব বিধিতে কিছুটা শৈথিল্য প্রদর্শন করা যেতে পারে যখন শরীয়তের কোনো বিধির সাথে ওই সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর ইচ্ছা আকাংখার সংঘাত দেখা দেয় । বর্ণিত আছে যে, ইহুদীরা রসূল (স.) কে এই মর্মে প্রস্তাব দিয়েছিলো যে, পাথর মেরে হত্যার বিধিসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিধিতে তিনি যদি নমনীয় হন, তাহলে তারা তার প্রতি ঈমান আনবে । এই প্রস্তাব সম্পর্কেই আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়েছিলো বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে আয়াতের বক্তব্য যে এ ধরনের কোনো বিশেষ প্রস্তাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তা সুস্পষ্ট । আল্লাহ তায়ালা সাধারণভাবে এই আপোসহীন নীতি ঘোষণা করেছেন যে, পরিস্থিতি ও পরিবেশের দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে কোনো অবস্থাতেই নমনীয়তা প্রদর্শন ও মনের মিল ঘটানোর স্বার্থে আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোনোই সুযোগ নেই। তাই এ ব্যাপারে লুকিয়ে লুকিয়ে আপোষকামী মনোভাব পোষণ করা যাবে না তাই তিনি তার নবীকে বলেন, দুনিয়ার সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যদি আল্লাহর ইচ্ছা হতো, তবে তিনিই সেটা করতেপারতেন । কিন্তু তা তিনি চাননি। প্রত্যেকের জন্যে স্বতন্ত্র বিধি ও আইন তৈরী করেছেন এবং তাদেরকে তিনি যে দ্বীন ও শরীয়ত দিয়েছেন, সে ব্যাপারে তাদেরকে তিনি পরীক্ষা করতে ইচ্ছুক । মানুষকে পার্থিব জীবনে আল্লাহ তায়ালা যে সব নেয়ামত দিয়েছেন, সেগুলোর ব্যাপারেও তিনি তাদেরকে পরীক্ষা করতে চান। প্রত্যেকে নিজ নিজ মত ও পথ অনুসারে চলবে, অতপর সবাই যখন আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে, তখন তিনি তাদেরকে জানাবেন যে, তারা কে কেমন কাজ করে এসেছে। তাদের কৃতকর্মের হিসাব নেবেন ও কর্মফল দেবেন। কাজেই ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথ অবলম্বনকারীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যে আল্লাহর শরীয়তের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানো জায়েয নেই। কেননা তারা ঐক্যবদ্ধ হবে না। ‘সকলের জন্যে স্বতন্ত্র নীতি ও বিধি তৈরী করেছি…’ এভাবে আল্লাহ তায়ালা শয়তানের অনুপ্রবেশের সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। বিশেষত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা ও মনের মিল ঘটানোর নামে সবাইকে খুশী করা বা ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর শরীয়তের কোনো বিধিতে নমনীয়তা প্রদর্শনের পথ রুদ্ধ করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর শরীয়ত এতো মূল্যবান এবং এতো অপরিবর্তনীয় যে, যে ঐক্য কখনো হবে না বলে আল্লাহ তায়ালা স্থির করে রেখেছেন, তার খাতিরে শরীয়তের কোনো একটি অংশকেও বিসর্জন দেয়ার অবকাশ নেই । মানুষ সৃষ্টিই হয়েছে রকমারি যোগ্যতা, রুচি, অভিমত, নীতি এবং মত ও পথ সহকারে । আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাদেরকে এরূপ বহু মত, বহু পথ ও বহু রুচির অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন। এর পেছনে তার কোন সুক্ষ্ম ও মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটা তিনিই ভালো জানেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের সামনে হেদায়াতের পথ উন্মুক্ত করে দেখিয়ে দিয়েছেন এবং সবাইকে প্রতিযোগিতা করে তার দিকে অগ্রসর হবার জন্যে ছেড়ে দিয়েছেন, আর এটাই তাদের পরীক্ষা । এই পরীক্ষার ওপরই তাদের প্রতিফল নির্ভর করছে। যেদিন তারা আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে, সেই দিন তার কাছ থেকে এর যথোচিত প্রতিফল পাবে । এমতাবস্থায় আল্লাহর আইনের বিনিময়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা একটা নিষ্ফল চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। অন্য কথায় বলা যায়, মানুষের জীবনের সঠিক কল্যাণ ও সুস্থতাকে বিপন্ন করে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা ব্যর্থ না হয়ে পারে না। বস্তুত আল্লাহর আইনকে লংঘন বা পরিবর্তনের অর্থ দাড়াবে এই যে, পৃথিবীতে বিপর্যয় ও অরাজকতার সৃষ্টি হবে। সঠিক পথ থেকে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। মানব জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না এবং মানুষ মানুষকে প্রভু মানতে আরম্ভ করবে। এর যেটাই ঘটুক, তা এতো বড় ও মারাত্মক বিপর্যয় যে, মানুষের স্বভাবের বিপরীত ও আল্লাহর ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী একটা জিনিস অর্জন করার জন্যে তা সংঘটিত করা বৈধ হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিকর্তা । তিনি যা খুশী সৃষ্টি করেন, যা খুশী স্থির করেন, তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত । তিনিই যখন মানুষের মত, পথ, রুচি ও নীতির বিভিন্নতা চেয়েছেন, তখন তা পাল্টানো কারো পক্ষে সম্ভব নয় এবং তার জন্যে আল্লাহর বিধানকে রদবদল করা বা লংঘন করার অবকাশ থাকতে পারে না। এ ধরনের কোনো উদ্দেশ্যে শরীয়তের কোনো বিধির ব্যাপারে নমনীয়তা প্রদর্শন করা এ আয়াতের দৃষ্টিতে একটা ঘৃণ্য ও ধিক্কারযোগ্য কাজ ৷ এ ব্যাপারে আল্লাহর কোনো অনুমোদন নেই । কোনো মুসলমানও এটা মেনে নিতে পারে না। কেননা সে আল্লাহর ইচ্ছার বিরোধি কোনো কাজের উদ্যোগ নিতে পারে না। এ আয়াতের আলোকে তাই এটা একেবারেই দুর্বোধ্য যে, যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, তারা কিভাবে বলতে পারে যে, আমরা শরীয়তের বিধান বাস্তবায়িত করে পর্যটকদেরকে হারাতে পারি না ?
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# এ প্যারাটির সম্পর্ক শুধুমাত্র নিকটবর্তী শেষ বাক্যটির সাথে নয় বরং উপরের পুরো প্যারাটির সাথে রয়েছে। অর্থাৎ কুফরী ও জুলুমের পথ অবলম্বনকারীদের ওপর আযাব নাযিল করা, মু’মিন সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে পুরস্কার দেয়া, সত্যপন্থী, মজলুমদের ফরিয়াদ শোনা এবং শক্তি প্রয়োগ করে জুলুমের মোকাবিলাকারী সত্যপন্থীদের সাহায্য করা, এসবের কারণ কি? এসবের কারণ হচ্ছে আল্লাহর এই গুণাবলী।
# তিনিই সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থার শাসনকর্তা এবং দিন-রাত্রির আবর্তন তাঁরই কর্তৃত্বাধীন। এই বাহ্যিক অর্থের সাথে সাথে এ বাক্যের মধ্যে এদিকেও একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, রাতের অন্ধকার থেকে যে আল্লাহ দিনের আলো বের করে আনেন এবং উজ্জ্বল দিনের ওপর যিনি রাতের অন্ধকার জড়িয়ে দেন তাঁরই এমন ক্ষমতা আছে। যার ফলে আজ যাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সূর্য মধ্যগগনে কিরণ দিচ্ছে তাদের পতন ও সূর্যাস্তেরর দৃশ্যও দ্রুত দুনিয়াবাসী দেখতে পারে এবং কুফর ও জাহেলীয়াতের যে অন্ধকার আজ সত্য ও ন্যায়ের প্রভাতের উদয়ের পথ রোধ করে আছে তা ক্ষণকালের মধ্যেই তাঁর হুকুমে সরে যাবে এবং এ সঙ্গে সেদিনের উদয় হবে যেদিন সত্য, সততা ও জ্ঞানের আলোকে সারা দুনিয়া আলোকিত হয়ে উঠবে।
# তিনি অন্ধ ও বধির আল্লাহ নন বরং এমন আল্লাহ যিনি দেখতে ও শুনতে পান।
# তিনিই সত্যিকার ক্ষমতার অধিকারী ও যথার্থ রব। তাঁর বন্দেগীকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। আর অন্যান্য সকল মাবুদই আসলে পুরোপুরি অসত্য ও অর্থহীন। তাদেরকে যেসব গুণাবলী ও ক্ষমতার মালিক মনে করা হয়েছে সেগুলোর মূলত কোন ভিত্তি নেই সুতরাং আল্লাহর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের ভরসায় যারা বেঁচে থাকে তারা কখনো সফলতা লাভ করতে পারে না।
# এখানে আবার প্রকাশ্য অর্থের পেছনে একটি সূক্ষ্ম ইশারা প্রচ্ছন্ন রয়েছে। প্রকাশ্য অর্থ তো হচ্ছে কেবলমাত্র আল্লাহর ক্ষমতা বর্ণনা করা। কিন্তু এর মধ্যে এ সূক্ষ্ম ইশারা রয়েছে যে, আল্লাহ যে বৃষ্টি বর্ষণ করেন তার ছিটেফোঁটা পড়ার সাথে সাথেই যেমন তোমরা দেখো বিশুষ্ক ভূমি অকস্মাৎ সবুজ শ্যামল হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি আজ যে অহীর শান্তিধারা বর্ষিত হচ্ছে তা শিগগির তোমাদের এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখাবে। তোমরা দেখবে আরবের অনুর্বর বিশুষ্ক মরুভূমি জ্ঞান, নৈতিকতা ও সুসংস্কৃতির গুলবাগীচায় পরিণত হয়ে গেছে।
# মূলে لَطِيفٌ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, অনুভূত পদ্ধতিতে নিজের ইচ্ছা ও সংকল্প পূর্ণকারী। তিনি এমন কৌশল অবলম্বন করেন যার ফলে লোকেরা তার সূচনায় কখনো তার পরিণামের কল্পনাও করতে পারে না। লাখো লাখো শিশু দুনিয়ায় জন্মলাভ করে। কে জানতে পারে, তাদের মধ্যে কে হবে ইবরাহীম, যিনি নেতা হবেন দুনিয়ার চার ভাগের তিন ভাগ মানুষের? আর কে হবে চেংগীজ, যে বিধ্বস্ত করে দেবে এশিয়া ও ইউরোপ ভূখণ্ডকে? দূরবীন যখন আবিষ্কার হয়েছিল তখন কে ধারণা করতে পেরেছিল যে এর ফলে এটম বোমা ও হাইড্রোজেন বোমা পর্যন্ত মানুষ পৌঁছে যাবে? কলম্বাস যখন সফরে বের হচ্ছিল তখন কে জানতো এর মাধ্যমে আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের ভিত গড়া হচ্ছে? মোটকথা আল্লাহর পরিকল্পনা এমন সূক্ষ্মতর ও অজ্ঞাত পদ্ধতিতে বাস্তবায়িত হয় যে, যতক্ষণ তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে না যায় ততক্ষণ কিসের জন্য কাজ চলছে তা কেউ জানতেও পারে না।
মূলে আরো বলা হয়েছে خَبِيرٌ অর্থাৎ তিনি নিজের দুনিয়ার অবস্থা, প্রয়োজন ও উপকরণাদি সম্পর্কে অবগত। নিজের প্রভুত্বের কাজ কিভাবে করতে হয় তিনি জানেন।
# তিনি “অমুখাপেক্ষী” অর্থাৎ একমাত্র তাঁর সত্তাই কারো মুখাপেক্ষী নয়। আর তিনিই “প্রশংসার্হ” অর্থাৎ প্রশংসা ও স্তব-স্তুতি একমাত্র তাঁরই জন্য এবং কেউ প্রশংসা করুক বা না করুক নিজের সত্তার মধ্যে তিনি নিজেই প্রশংসিত।
# আকাশ বলতে এখানে সমগ্র ঊর্ধ্বজগতকে বুঝানো হয়েছে, যার প্রত্যেকটি জিনিস নিজ নিজ জায়গায় আটকে আছে।
# এসব কিছু দেখেও আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম যে সত্য পেশ করেছেন তা অস্বীকার করে যেতে থাকে।
# প্রত্যেক নবীর উম্মত।
# এখানে ‘মানসাক’ শব্দটি কুরবানী অর্থে নয় বরং সমগ্র ইবাদাত ব্যবস্থা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর আগে এ শব্দটির অনুবাদ করা হয়েছিল “কুরবানীর নিয়ম” কারণ সেখানে “যাতে লোকেরা ঐ পশুগুলোর ওপর আল্লাহর নাম নেয়, যা তিনি তাদেরকে দিয়েছেন” এ পরবর্তী বাক্যটি তার ব্যাপক অর্থের মধ্য থেকে শুধুমাত্র কুরবানীকেই চিহ্নিত করছিল। কিন্তু এখানে একে নিছক “কুরবানী” অর্থে গ্রহণ করার কোন যৌক্তিকতা নেই। বরং ইবাদাতকে যদি অর্চনার পরিবর্তে “বন্দেগী”র ব্যাপকতর অর্থে গ্রহণ করা হয় তাহলে তা মূল উদ্দেশ্যের বেশী নিকটবর্তী হবে। এভাবে শরীয়াত ও মিনহাজের যে অর্থ হয় মানসাকেরও (বন্দেগীর পদ্ধতি) সে একই অর্থ হবে। এটি সূরা মায়েদার বিষয়বস্তুর পুনরাবর্তন হবে, যেখানে বলা হয়েছে— لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا “আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি শরীয়াত ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারিত করেছি।”
# সুরা: আল-মায়িদাহ
আয়াত নং :-৪৮
وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ مِنَ الْكِتٰبِ وَ مُهَیْمِنًا عَلَیْهِ فَاحْكُمْ بَیْنَهُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ عَمَّا جَآءَكَ مِنَ الْحَقِّ١ؕ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّ مِنْهَاجًا١ؕ وَ لَوْ شَآءَ اللّٰهُ لَجَعَلَكُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةً وَّ لٰكِنْ لِّیَبْلُوَكُمْ فِیْ مَاۤ اٰتٰىكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَیْرٰتِ١ؕ اِلَى اللّٰهِ مَرْجِعُكُمْ جَمِیْعًا فَیُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ فِیْهِ تَخْتَلِفُوْنَۙ
তারপর হে মুহাম্মাদ! তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাযিল করেছি, যা সত্য নিয়ে এসেছে এবং আল কিতাবের মধ্য থেকে তার সামনে যা কিছু বর্তমান আছে তার সত্যতা প্রমাণকারী ও তার সংরক্ষক। কাজেই তুমি আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী লোকদের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালা করো এবং যে সত্য তোমার কাছে এসেছে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।–তোমাদের প্রত্যেকের জন্য একটি শরীয়াত ও একটি কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে রেখেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সবাইকে একই উম্মতের অন্তর্ভুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন তার মধ্যে তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য এমনটি করেছেন। কাজেই সৎকাজে একে অপরের চাইতে অগ্রবর্তী হবার চেষ্টা করো। শেষ পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে হবে। তারপর তিনি সেই প্রকৃত সত্যটি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যে ব্যাপারে তোমরা মতবিরোধ করে আসছিলে।
# এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ বক্তব্যটিকে যদিও এভাবে বলা যেতো যে, “আগের কিতাবগুলোর মধ্য থেকে যা কিছু তার প্রকৃত ও সঠিক অবস্থায় বর্তমান আছে কুরআন তার সত্যতা প্রমাণ করে।” কিন্তু আল্লাহ এখানে “আগের কিতাবগুলোর” পরিবর্তে “আল কিতাব” শব্দ ব্যবহার করেছেন। এ থেকে এ রহস্য উদঘাটিত হয় যে, কুরআন এবং বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন ভাষায় আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কিতাবগুলো নাযিল হয়েছে সবই মূলত একটি কিতাবের অন্তর্ভুক্ত। তাদের রচয়িতাও একজন। তাদের মূল বক্তব্য, উদ্দেশ্য-লক্ষ্যও একই। তাদের শিক্ষাও একই। তাদের মাধ্যমে মানব জাতিকে একই জ্ঞান দান করা হয়েছে। এ কিতাবগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলে তা আছে কেবল মাত্র ইবারাত অর্থাৎ বাক্য সংগঠন ও বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে একই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বিত হয়েছে। কাজেই প্রকৃত সত্য কেবল এতটুকুই নয় যে, এ কিতাবগুলো পরস্পরের বিরোধী নয় বরং সমর্থক এবং পরস্পরের প্রতিবাদকারী নয় বরং সত্যতা প্রমাণকারী। বরং প্রকৃত সত্য এর চাইতেও অনেক বেশী। অর্থাৎ এরা সবাই একই “আল কিতাবের” বিভিন্ন সংস্করণ মাত্র।
# মূলে “মুহাইমিন” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৷ আরবীতে হাইমানা, ইউহাইমিনু, হাইমানাতান (আরবী) মানে হচ্ছে দেখাশুনা, সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, সাক্ষ দান, আমানতদারী, সহায়তা দান ও সমর্থন করা ৷ যেমন বলা হয় (আরবী) অর্থাৎ লোকটি অমুক জিনিসটি হেফাজত ও সংরক্ষণ করেছে ৷ আরো বলা হয়ঃ (আরবী) অর্থাৎ পাখিটি নিজের বাচ্চাকে নিজের ডানার মধ্যে নিয়ে সংরক্ষিত করে ফেলেছে ৷ হযরত উমর (রা) একবার লোকদের বলেনঃ انى داع فهيمنوا অর্থাৎ আমি দোয়া করি, তোমরা সমর্থনে আ-মীন বলো। অর্থাৎ কুরআনকে আল-কিতাব বলার পর “মুহাইমিন” বলার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবগুলোতে যেসব সত্য শিক্ষা ছিল কুরআন তার সবগুলোই নিজের মধ্যে সংরক্ষিত করে নিয়েছে। সে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণকারী এই হিসেবে যে, এখন তাদের এ সত্য শিক্ষাগুলোর কোন অংশের নষ্ট হবার আর কোন সম্ভাবনাই নেই। সে সেগুলোর সমর্থক এ অর্থে যে, ঐ কিতাবগুলোতে আল্লাহর কালাম যে অবস্থায় আছে কুরআন তার সত্যতা প্রমাণ করে। সে সেগুলোর ওপর সাক্ষ্যদানকারী এ অর্থে যে, ঐ কিতাবগুলোতে আল্লাহর কালাম ও মানুষের বাণীর মধ্যে যে মিশ্রণ ঘটে গেছে কুরআনের সাক্ষ্যের মাধ্যমে তাকে আবার ছেঁটে আলাদা করা যেতে পারে। সেগুলোর মধ্যে যেগুলো কুরআনের সাথে সামঞ্জস্যশীল এবং তার অনুরূপ সেগুলো আল্লাহর কালাম আর যেগুলো কুরআন বিরোধী সেগুলো মানুষের বাণী।
# এটি একটি প্রসঙ্গ কথা। একটি প্রশ্নের বিশ্লেষণই এর উদ্দেশ্য। ওপরের ধারাবাহিক ভাষণ শোনার পর শ্রোতার মনে এ প্রশ্নটি সংশয় ও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। প্রশ্নটি হচ্ছে, সকল নবী ও সকল কিতাব যখন একই ধর্মের দিকে আহবান জানিয়েছে এবং তারা সবাই পরস্পরের সত্যতা প্রমাণ করে ও পরস্পরের সহযোগী তখন শরীয়াতের বিস্তারিত বিধানের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে পার্থক্য কেন? ইবাদাত-বন্দেগীর বাহ্যিক অবয়ব ও আনুষ্ঠানিকতা, হালাল-হারামের বিধি-নিষেধ এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আইন-কানুনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে বিভিন্ন নবী ও আসমানী কিতাবসমূহের শরীয়াতগুলোর মধ্যে কমবেশী পার্থক্য দেখা যায় কেন?
# এটি হচ্ছে উপরোল্লিখিত প্রশ্নটির একটি পরিপূর্ণ জবাব। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপঃ
একঃ নিছক শরীয়াতের বিভিন্নতা দেখে এ শরীয়াতগুলো বিভিন্ন মূল ও বিভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত হয়েছে বলে মনে করা ভুল হবে। আসলে মহান আল্লাহ বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন অবস্থায় বিধি বিধান নির্ধারণ করে থাকেন।
দুইঃ নিঃসন্দেহে প্রথম থেকেই সমগ্র মানব জাতির জন্য একটি বিধান নির্ধারিত করে সবাইকে এক উম্মতে পরিণত করা যেতো। কিন্তু বিভিন্ন নবীর শরীয়াতের মধ্যে আল্লাহ যে পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন তার পেছনে বিভিন্ন কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ এই ছিল যে, এভাবে আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। যারা প্রকৃত দ্বীন, তার প্রাণসত্তা ও তাৎপর্য অনুধাবন করে, দ্বীনের মধ্যে এ বিধানগুলোর যথার্থ মর্যাদা জানে এবং কোন প্রকার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন হয় না তারা সত্যকে চিনে ফেলবে এবং গ্রহণ করে নেবে, যেভাবেই তা আসুক না কেন। তারা আল্লাহ প্রেরিত আগের বিধানের জায়গায় পরবর্তী বিধান মেনে নেবার ব্যাপারে কোন প্রকার ইতস্তত করবে না। পক্ষান্তরে যারা দ্বীনের মূল প্রাণশক্তি থেকে দূরে অবস্থান করে, দ্বীনের বিধান ও খুটিনাটি নিয়ম-কানুনকেই আসল দ্বীন মনে করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত জিনিসের গায়ে নিজেরাই তকমা এঁটে দিয়ে সে ব্যাপারে স্থবিরতা ও বিদ্বেষে নিমজ্জিত হয়, তারা পরবর্তীকালে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত প্রত্যেকটি আয়াত প্রত্যাখ্যান করতে থাকে। এ দুই ধরনের লোককে পৃথক করার জন্য এ ধরনের পরীক্ষা অপরিহার্য ছিল। তাই মহান আল্লাহ বিভিন্ন শরীয়াতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
তিনঃ সমস্ত শরীয়াতের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে নেকী ও কল্যাণ অর্জন করা। যে সময় আল্লাহ যে হুকুম দেন তা পালন করার মাধ্যমেই এগুলো অর্জিত হতে পারে। কাজেই যারা আসল উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখে তাদের জন্য শরীয়াতের বিভিন্নতা ও পথের পার্থক্য নিয়ে বিরোধ করার পরিবর্তে আল্লাহর কাছে গৃহীত পথের মাধ্যমে মূল উদ্দেশ্যের দিকে অগ্রসর হওয়াই হচ্ছে সঠিক কর্মপদ্ধতি।
চারঃ মানুষেরা নিজেদের স্থবিরতা, বিদ্বেষ, হঠকারিতা ও মানসিক অস্থিরতার কারণে নিজেরাই যে সমস্ত বিরোধ সৃষ্টি করেছে, কোন বিতর্ক সভায় বা যুদ্ধের ময়দানে সেগুলোর চূড়ান্ত ফায়সালা হবে না। সেগুলোর চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন আল্লাহ নিজেই, যেদিন প্রকৃত সত্যকে সকল প্রকার আবরণমুক্ত করে দেয়া হবে। সেদিন লোকেরা দেখবে, যেসব বিরোধের মধ্যে তারা নিজেদের সমগ্র জীবনকাল অতিবাহিত করে দুনিয়া থেকে চলে এসেছে তার মধ্যে “সত্য” কতটুকু ছিল এবং “মিথ্যা” মিশ্রণ কতটুকু।
# পূর্ববর্তী নবীগণ যেমন নিজের যুগের উম্মতের জন্য একটি পদ্ধতি (মানসাক) এনেছিলেন তেমনি এ যুগের উম্মতের জন্য তুমি একটি পদ্ধতি এনেছো। এখন এ ব্যাপারে তোমার পথে কারোর ঝগড়া করার অধিকর নেই। কারণ এ যুগের জন্য এ পদ্ধতিই সত্য। সূরা জাসীয়ায় এ বিষয়বস্তুটি এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ
ثُمَّ جَعَلْنَاكَ عَلَى شَرِيعَةٍ مِنَ الْأَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
“তারপর (বনী ইসরাঈলের নবীদের পরে) হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে দ্বীনের ব্যাপারে একটি শরীয়াতের (পদ্ধতি) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। কাজেই তার অনুসরণ করো এবং যারা জ্ঞান রাখে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।”
# পূর্ববর্তী বাক্যের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এ মাত্র আমি যে অর্থ বর্ণনা করে এসেছি এ বাক্যটি সে অর্থই পুরোপুরি সুস্পষ্ট করে তুলে ধরছে।
# সুরা: আল-জাসিয়া
আয়াত নং :-১৮
ثُمَّ جَعَلْنٰكَ عَلٰى شَرِیْعَةٍ مِّنَ الْاَمْرِ فَاتَّبِعْهَا وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَ الَّذِیْنَ لَا یَعْلَمُوْنَ
অতঃপর হে নবী, আমি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাকে একটি সুস্পষ্ট রাজপথের (শরীয়তের) ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছি। সুতরাং তুমি তার ওপরেই চলো এবং যারা জানে না তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।
# ইতিপূর্বে যে কাজের দায়িত্ব বনী ইসরাইলদের ওপর অর্পণ করা হয়েছিলো এখন তার দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। তারা জ্ঞান লাভ করা সত্ত্বেও আত্মস্বার্থের জন্য দ্বীনের মধ্যে এমন মতভেদ সৃষ্টি করে এবং পরস্পর এমন দলাদলিতে লিপ্ত হয়ে পড়ে যার ফলে দুনিয়ার মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান জানানোর যোগ্যতাই হারিয়ে বসে। বর্তমানে তোমাদের সেই দ্বীনের সুস্পষ্ট রাজপথের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে তোমরা সেই খেদমত আঞ্জাম দিতে পার যা বনী ইসরাঈলরা পরিত্যাগ করেছে এবং যার যোগ্যতাও তাদের ছিল না। (আরো ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, সূরা আশ শূরা, আয়াত ১৩ থেকে ১৫ এবং টীকা ২০ থেকে ২৬ )।
# প্রথম আয়াতে যে কথাটি বলা হয়েছিলো এখানে সেই কথাটিই আরো বেশী পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। এখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, মুহাম্মাদ ﷺ কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নন। নবী-রসূলদের মধ্যে কেউই কোন নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন না। প্রথম থেকেই সমস্ত নবী-রসূল আল্লাহর পক্ষ থেকে একই দ্বীন পেশ করে আসছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেই একই দ্বীন পেশ করছেন। এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম হযরত নূহের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মহাপ্লাবনের পর তিনিই ছিলেন বর্তমান মানব গোষ্ঠীর সর্বপ্রথম পয়গস্বর। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যিনি শেষ নবী। তারপর হযরত ইবরাহীমের (আ) নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আরবের লোকেরা যাঁকে তাদের নেতা বলে মানতো। সর্বশেষে হযরত মুসা এবং ঈসার কথা বলা হয়েছে যাঁদের সাথে ইহুদী ও খৃস্টানরা তাদের ধর্মকে সম্পর্কিত করে থাকে। এর উদ্দেশ্য এ নয় যে, শুধু এই পাঁচজন নবীকেই উক্ত দ্বীনের হিদায়াত দান করা হয়েছিলো। বরং একথা বলে দেয়াই এর উদ্দেশ্য যে, পৃথিবীতে যত নবী-রসূলই আগমন করেছেন তাঁরা সবাই একই দ্বীন নিয়ে এসেছেন। নমুনা হিসেবে এমন পাঁচজন মহান নবীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে যাঁদের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ সুবিখ্যাত আসমানী শরীয়তসমূহ লাভ করেছে।
যেহেতু এ আয়াতটি দ্বীন ও দ্বীনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোকপাত করেছে। তাই সে বিষয়ে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তাকে বুঝে নেয়া আবশ্যকঃ বলা হয়েছে شَرَعَ لَكُمْ “তোমাদের জন্য নির্ধারিত করেছেন।” شَرَعَ শব্দের আভিধানিক অর্থ রাস্তা তৈরী করা এবং এর পারিভাষিক অর্থ পদ্ধতি, বিধি ও নিয়ম-কানুন রচনা করা। এই পারিভাষিক অর্থ অনুসারে আরবী ভাষায় تشريع শব্দটি আইন প্রণয়ন (Legislation) شرع এবং شريعة শব্দটি আইন (Law ) এবং شارع শব্দটি আইন প্রণেতার (Law giver) সমার্থক বলে মনে করা হয়। আল্লাহই বিশ্ব-জাহানের সব কিছুর মালিক, তিনিই মানুষের প্রকৃত অভিভাবক এবং মানুষের মধ্যে যে বিষয়েই মতভেদ হোক না কেন তার ফায়সালা করা তাঁরই কাজ। কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের যেসব মৌলিক সত্য বর্ণিত হয়েছে তারই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি হচ্ছে আল্লাহর এই আইন রচনা। এখন মৌলিকভাবে যেহেতু আল্লাহই মালিক, অভিভাবক ও শাসক, তাই মানুষের জন্য আইন ও বিধি রচনার এবং মানুষকে এই আইন ও বিধি দেয়ার অনিবার্য অধিকার তাঁরই। আর এভাবে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে বলা হয়েছে مِنَ الدِّينِ ‘দ্বীন’ থেকে শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এর অনুবাদ করেছেন আইন থেকে। অর্থাৎ আল্লাহ শরীয়ত নির্ধারণ করেছেন আইনের পর্যায়ভুক্ত। আমরা ইতিপূর্বে সূরা যুমারে ৩নং টীকায় دِّينِ শব্দের যে ব্যাখ্যা করেছি তা যদি সামনে থাকে তাহলে একথা বুঝতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, দ্বীন অর্থই কারো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তার আদেশ-নিষেধের আনুগত্য করা। এ শব্দটি যখন পন্থা বা পদ্ধতি অর্থে ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ হয় এমন পদ্ধতি যাকে ব্যক্তি অবশ্য অনুসরণীয় পদ্ধতি এবং তার যার নির্ধারণকারীকে অবশ্য অনুসরণযোগ্য বলে মেনে চলে। এ কারণে আল্লাহর নির্ধারিত এই পদ্ধতিকে দ্বীনের বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আইন বলার পরিষ্কার অর্থ হলো এটা শুধু সুপারিশ (Recomendation) ও ওয়াজ-নসীহতের মর্যাদা সম্পন্ন নয়। বরং তা বান্দার জন্য তার মালিকের অবশ্য অনুসরণীয় আইন, যার অনুসরণ না করার অর্থ বিদ্রোহ করা। যে ব্যক্তি তা অনুসরণ করে না সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আধিপত্য, সার্বভৌমত্ব এবং দাসত্ব অস্বীকার করে।
এরপরে বলা হয়েছে, দ্বীনের বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত এ আইনই সেই আইন যার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো নূহ, ইবরাহীম ও মূসা আলাইহিমুস সালামকে এবং এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সে নির্দেশই দান করা হয়েছে। এ বাণী থেকে কয়েকটি বিষয় প্রতিভাত হয়। এক-আল্লাহ এ বিধানকে সরাসরি সব মানুষের কাছে পাঠাননি, বরং মাঝে মধ্যে যখনই তিনি প্রয়োজন মনে করেছেন এক ব্যক্তিকে তাঁর রসূল মনোনীত করে এ বিধান তার কাছে সোপর্দ করেছেন। দুই-প্রথম থেকেই এ বিধান এক ও অভিন্ন। এমন নয় যে, কোন জাতির জন্য কোন একটি দ্বীন নির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং অন্য সময় অপর এক জাতির জন্য তা থেকে ভিন্ন ও বিপরীত কোন দ্বীন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে একাধিক দ্বীন আসেনি। বরং যখনই এসেছে এই একটি মাত্র দ্বীনই এসেছে। তিন-আল্লাহর আধিপত্য ও সার্বভৌমত্ব মানার সাথে সাথে যাদের মাধ্যমে এ বিধান পাঠানো হয়েছে তাদের রিসালাত মানা এবং যে অহীর দ্বারা এ বিধান বর্ণনা করা হয়েছে তা মেনে নেয়া এ দ্বীনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। জ্ঞান-বুদ্ধি ও যুক্তির দাবীও তাই। কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত তা আল্লাহর তরফ থেকে বিশ্বাসযোগ্য (Authentic) হওয়া সম্পর্কে ব্যক্তি নিশ্চিত না হবে ততক্ষণ সে এই আনুগত্য করতেই পারে না।
অতঃপর বলা হয়েছে, এসব নবী-রসূলদেরকে দ্বীনর বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত এই বিধান দেয়ার সাথে তাগিদসহ এ নির্দেশও দেয়া হয়েছিলো যে, أَقِيمُوا الدِّينَ শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলবী এ আয়াতাংশের অনুবাদ করেছেন, “দ্বীনকে কায়েম করো” আর শাহ রফিউদ্দিন ও শাহ আবদুল কাদের অনুবাদ করেছেন, “দ্বীনকে কায়েম রাখো” এই দু’টি অনুবাদই সঠিক। اقامت শব্দের অর্থ কায়েম করা ও কায়েম রাখা উভয়ই। নবী-রসূলগণ আলাইহিমুস সালাম এ দু’টি কাজ করতেই আদিষ্ট ছিলেন। তাঁদের প্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল, যেখানে এই দ্বীন কায়েম নেই সেখানে তা কায়েম করা। আর দ্বিতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল যেখানে তা কায়েম হবে কিংবা পূর্ব থেকেই কায়েম আছে সেখানে তা কায়েম রাখা। একথা সুস্পষ্ট যে কোন জিনিসকে কায়েম রাখার প্রশ্ন তখনই আসে যখন তা কায়েম থাকে। অন্যথায় প্রথমে তা কায়েম করতে হবে, তারপর তা যাতে কায়েম থাকে সেজন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এই পর্যায়ে আমাদের সামনে দু’টি প্রশ্ন দেখা দেয়। একটি হলো, দ্বীন কায়েম করার অর্থ কি? অপরটি হলো, দ্বীন অর্থই বা কি যা কায়েম করার এবং কায়েম রাখার আদেশ দেয়া হয়েছে? এ দু’টি বিষয়ও ভালভাবে বুঝে নেয়া দরকার।
কায়েম করা কথাটি যখন কোন বস্তুগত বা দেহধারী জিনিসের জন্য ব্যবহৃত হয় তখন তার অর্থ হয় উপবিষ্টকে উঠানো। যেমন কোন মানুষ বা জন্তুকে উঠানো। কিংবা পড়ে থাকা জিনিসকে উঠিয়ে দাঁড় করানো। যেমন বাঁশ বা কোন থাম তুলে দাঁড় করানো অথবা কোন জিনিসের বিক্ষিপ্ত অংশগুলোকে একত্র করে সমুন্নত করা। যেমনঃ কোন খালি জায়গায় বিল্ডিং নির্মাণ করা। কিন্তু যা বস্তুগত জিনিস নয়, অবস্তুগত জিনিস তার জন্য যখন কায়েম করা শব্দটা ব্যবহার করা হয় তখন তার অর্থ শুধু সেই জিনিসের প্রচার করাই নয়, বরং তা যথাযথভাবে কার্যে পরিণত করা, তার প্রচলন ঘটানো এবং কার্যত চালু করা। উদাহরণস্বরূপ যখন আমরা বলি, অমুক ব্যক্তি তার রাজত্ব কায়েম করেছে তখন তার অর্থ এ হয় না যে, সে তার রাজত্বের দিকে আহবান জানিয়েছে। বরং তার অর্থ হয়, সে দেশের লোকদেরকে নিজের অনুগত করে নিয়েছে এবং সরকারের সকল বিভাগে এমন সংগঠন ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করেছে যে, দেশের সমস্ত ব্যবস্থাপনা তার নির্দেশ অনুসারে চলতে শুরু করেছে। অনুরূপ যখন আমরা বলি, দেশে আদালত কায়েম আছে তখন তার অর্থ হয় ইনসাফ করার জন্য বিচারক নিয়োজিত আছেন। তিনি মোকদ্দমাসমূহের শুনানি করছেন এবং ফায়সালা দিচ্ছেন। একথার এ অর্থ কখনো হয় না যে, ন্যায় বিচার ও ইনসাফের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা খুব ভালভাবে করা হচ্ছে এবং মানুষ তা সমর্থন করছে। অনুরূপভাবে কুরআন মজীদে যখন নির্দেশ দেয়া হয়, নামায কায়েম করো তখন তার অর্থ কুরআন মজীদের দাওয়াত ও তাবলীগ নয়, বরং তার অর্থ হয় নামাযের সমস্ত শর্তাবলী পূরণ করে শুধু নিজে আদায় করা না বরং এমন ব্যবস্থা করা যেন ঈমানদারদের মধ্যে তা নিয়মিত প্রচলিত হয়। মসজিদের ব্যবস্থা থাকে, গুরুত্বের সাথে জুমআ ও জামা’য়াত ব্যবস্থা হয়, সময়মত আযান দেয়া হয়, ইমাম ও খতিব নির্দিষ্ট থাকে এবং মানুষের মধ্যে সময়মত মসজিদে আসা ও নামায আদায় করার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। এই ব্যাখ্যার পরে একথা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামদের যখন এই দ্বীন কায়েম করার ও রাখার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো, তার অর্থ শুধু এতটুকুই ছিল না যে, তাঁরা নিজেরাই কেবল এ দ্বীনের বিধান মেনে চলবেন এবং অন্যদের কাছে তার তাবলীগ বা প্রচার করবেন, যাতে মানুষ তার সত্যতা মেনে নেয়। বরং তার অর্থ এটাও যে মানুষ যখন তা মেনে নেবে তখন আরো অগ্রসর হয়ে তাদের মাঝে পুরো দ্বীনের প্রচলন ঘটাবেন, যাতে সে অনুসারে কাজ আরম্ভ হতে এবং চলতে থাকে। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে দাওয়াত ও তাবলীগ এ কাজের অতি আবশ্যিক প্রাথমিক স্তর। এই স্তর ছাড়া দ্বিতীয় স্তর আসতেই পারে না। কিন্তু প্রত্যেক বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন এই নির্দেশের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বানানো হয়নি, দ্বীনকে কায়েম করা ও কায়েম রাখাকেই উদ্দেশ্য বানানো হয়েছে। দাওয়াত ও তাবলীগ অবশ্যই এ উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যম, কিন্তু মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নয়। নবী-রসূলদের মিশনের একমাত্র উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য দাওয়াত ও তাবলীগ করো একথা বলা একেবারেই অবান্তর।
এখন দ্বিতীয় প্রশ্নটি দেখুন। কেউ কেউ দেখলেন, যে দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা সমানভাবে সমস্ত নবী-রসূলের দ্বীন। কিন্তু তাদের সবার শরীয়ত ছিল ভিন্ন ভিন্ন। যেমন আল্লাহ কুরআন মজীদে বলেছেন لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا “আমি তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্য স্বতন্ত্র শরীয়ত এবং একটি পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছি।” তাই তারা ধরে নিয়েছে যে, এ দ্বীন অর্থ নিশ্চয়ই আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধান নয়, এর অর্থ শুধু তাওহীদ, আখেরাত, কিতাব ও নবুওয়াতকে মানা এবং আল্লাহর ইবাদাত করা। কিংবা বড় জোর তার মধ্যে শরীয়তের সেই সব বড় বড় নৈতিক নীতিমালাও অন্তর্ভুক্ত যা সমস্ত দ্বীনের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
কিন্তু এটি একটি অপরিপক্ব মত। শুধু বাহিক্যভাবে দ্বীনের ঐক্য ও শরীয়তসমূহের বিভিন্নতা দেখে এ মত পোষণ করা হয়েছে। এটি এমন একটি বিপজ্জনক মত যে যদি তা সংশোধন করা না হয় তাহলে তা অগ্রসর হয়ে দ্বীন ও শরীয়তের মধ্যে এমন একটি পার্থক্যের সূচনা করবে যার মধ্যে জড়িয়ে সেন্ট পল শরীয়তবিহীন দ্বীনের মতবাদ পেশ করেছিলেন এবং সাইয়েদেনা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উম্মতকে ধ্বংস ও বিপর্যস্ত করেছিলেন। কারণ, শরীয়ত যখন দ্বীন থেকে স্বতন্ত্র একটি জিনিস আর নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুধু দ্বীন কায়েমের জন্য, শরীয়ত কায়েমের জন্য নয় তখন মুসলমানরাও খৃস্টানদের মত অবশ্যই শরীয়তকে গুরুত্বহীন ও তার প্রতিষ্ঠাকে সরাসরি উদ্দেশ্য মনে না করে উপেক্ষা করবে এবং দ্বীনের শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়গুলো ও বড় বড় নৈতিক নীতিসমূহ নিয়েই বসে থাকবে। এভাবে অনুমানের ওপর নির্ভর করে دين এর অর্থ নিরূপণ করার পরিবর্তে কেনই বা আমরা আল্লাহর কিতাব থেকেই একথা জেনে নিচ্ছি না যে, যে দ্বীন কায়েম করার নির্দেশ এখানে দান করা হয়েছে তার অর্থ কি শুধু ঈমান সম্পর্কিত বিষয়সমূহ এবং কতিপয় বড় বড় নৈতিক মূলনীতি না শরীয়তের অন্যান্য আদেশ নিষেধও? কুরআন মজীদ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি কুরআন মজীদে যেসব জিনিসকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে নিম্নোক্ত জিনিসগুলোও আছেঃ
একঃوَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ-البينة : 5
“তাদেরকে এছাড়া আর কোন নির্দেশ দেয়া হয়নি যে, তারা একনিষ্ঠ চিত্তে দ্বীনকে আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে কেবল তাঁরই ইবাদাত করবে, নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে এটাই সঠিক দ্বীন।” এ আয়াত থেকে জানা যায়, নামায এবং রোযা এই দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত। অথচ নামায ও রোযার আহকাম বিভিন্ন শরীয়তে বিভিন্ন রকম ছিল। পূর্ববর্তী শরীয়তসমূহে বর্তমানের মত নামাযের এই একই নিয়ম-কানুন, একই খুঁটি-নাটি বিষয়, একই সমান রাকআত, একই কিবলা, একই সময় এবং এই একই বিধি-বিধান ছিল একথা কেউ বলতে পারে না। অনুরূপ যাকাত সম্পর্কেও কেউ এ দাবী করতে পারে না যে, সমস্ত শরীয়তে বর্তমানের ন্যায় যাকাতের এই একই হিসাব, একই হার এবং আদায় ও বন্টনের এই একই বিধি-নিষেধ ছিল। কিন্তু শরীয়তের ভিন্নতা সত্ত্বেও আল্লাহ এ দু’টি জিনিসকে দ্বীনের মধ্যে গণ্য করেছেন।
حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ…………… الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ…………..-المائدة: 3 . “তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জন্তু, রক্ত, শূকরের গোশত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে যবেহকৃত জন্তু, দমবন্দ হয়ে, আঘাত প্রাপ্ত হয়ে, ওপর থেকে পড়ে কিংবা ধাক্কা খেয়ে মরা জন্তু অথবা যে জন্তুকে কোন হিংস্র প্রাণী ক্ষত-বিক্ষত করেছে কিন্তু তোমরা তাকে জীবিত পেয়ে যবেহ করেছো কিংবা যে জন্তুকে কোন আস্তানায় জবেহ করা হয়েছে। তাছাড়া লটারীর মাধ্যমে নিজের ভাগ্য সম্পর্কে অবহিত হতে চাওয়াকেও তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে। এসবই গুনাহর কাজ। আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গিয়েছে। তাই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না, আমাকে ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম।” এ থেকে জানা গেল যে, শরীয়তের এসব হুকুম আহকামও দ্বীনের মধ্যে শামিল।
তিনঃ قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ- التوبة: 29 “তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যারা আল্লাহ ও আখেরাত দিবসে বিশ্বাস করে না, আর আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা কিছু হারাম করেছেন তা হারাম করে না এবং সত্য দ্বীনকে নিজের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে না।” এ থেকে জানা যায়, আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল যেসব আদেশ-নিষেধ করেছেন তা মানা ও তার আনুগত্য করাও দ্বীন।
চারঃ الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ وَلَا تَأْخُذْكُمْ بِهِمَا رَأْفَةٌ فِي دِينِ اللَّهِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ- النور: 2 “ব্যভিচারী নারী ও পুরুষ উভয়কে একশটি করে বেত্রাঘাত করো। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করো তাহলে দ্বীনের ব্যাপারে তাদের প্রতি মায়া-মমতা ও আবেগ যেন তোমাদেরকে পেয়ে না বসে।” مَا كَانَ لِيَأْخُذَ أَخَاهُ فِي دِينِ الْمَلِكِ- يوسف: 76 “বাদশার দ্বীন অনুসারে ইউসুফ তার ভাইকে পাকড়াও করতে পারতো না।” এ থেকে জানা গেলো, ফৌজদারী আইনসমূহও দ্বীনের মধ্যে শামিল। ব্যক্তি যদি আল্লাহর দেয়া ফৌজদারী আইন অনুসারে চলে তাহলে সে আল্লাহর দ্বীনের অনুসারী আর যদি বাদশার দ্বীন অনুসারে চলে তাহলে বাদশাহর দ্বীনের অনুসারী।
এ চারটি উদাহরণই এমন যেখানে শরীয়তের আদেশ-নিষেধ ও বিধি-বিধানকে সুস্পষ্ট ভাষায় দ্বীন বলা হয়েছে। কিন্তু গভীর মনোযোগ সহকারে দেখলে বুঝা যায়, আরো যেসব গোনাহর কারণে আল্লাহ জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন (যেমন ব্যভিচার, সুদখোরী, মু’মিন বান্দাকে হত্যা, ইয়াতীমের সম্পদ আত্নসাৎ, অন্যায়ভাবে মানুষের অর্থ নেয়া ইত্যাদি) যেসব অপরাধকে আল্লাহর শাস্তির কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে (যেমনঃ লূতের কওমের মত পাপাচার এবং পারস্পরিক লেনদেনে শু’আইব আলাইহিস সালামের কওমের মত আচরণ) তার পথ রুদ্ধ করার কাজও অবশ্যই দ্বীন হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত। কারণ, দ্বীন যদি জাহান্নাম ও আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করার জন্য না এসে থাকে তাহলে আর কিসের জন্য এসেছে। অনুরূপ শরীয়তের যেসব আদেশ-নিষেধ লংঘনকে চিরস্থায়ী জাহান্নাম বাসের কারণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে সেই সব আদেশ-নিষেধও দ্বীনের অংশ হওয়া উচিত। যেমন উত্তরাধিকারের বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর বলা হয়েছেঃ
وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُودَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِينٌ- النساء: 14
“যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের অবাধ্য হবে এবং আল্লাহর সীমাসমূহ লংঘন করবে আল্লাহ তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবেন। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব।”
অনুরূপ আল্লাহ যেসব জিনিসের হারাম হওয়ার কথা কঠোর ভাষায় অকাট্যভাবে বর্ণনা করেছেন, যেমনঃ মা, বোন ও মেয়ের সাথে বিয়ে, মদ্যপান, চুরি, জুয়া এবং মিথ্যা সাক্ষ্যদান। এসব জিনিসের হারাম হওয়ার নির্দেশকে যদি “ইকামাতে দ্বীন” বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার মধ্যে গণ্য করা না হয় তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ কিছু অপ্রয়োজনীয় আদেশ-নিষেধও দিয়েছেন যার বাস্তবায়ন তাঁর উদ্দেশ্য নয়। অনুরূপ আল্লাহ যেসব কাজ ফরয করেছেন, যেমনঃ রোযা হজ্জ-তাও দ্বীন প্রতিষ্ঠার পর্যায় থেকে এই অজুহাতে বাদ দেয়া যায় না যে, রমযানের ৩০ রোযা পূর্ববতী শরীয়তসমূহে ছিল না এবং কা’বায় হজ্জ করা কেবল সেই শরীয়তেই ছিল যা ইবরাহীমের (আ) বংশধারার ইসমাঈলী শাখাকে দেয়া হয়েছিলো।
প্রকৃতপক্ষে সমস্ত ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির কারণ হলো, ভিন্ন উদ্দেশ্যে ( لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا ) (আমি তোমাদের প্রত্যেক উম্মতের জন্য একটি শরীয়ত ও পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি) আয়াতের এ অর্থ করা যে, যেহেতু প্রত্যেক উম্মতের জন্য শরীয়ত ছিল ভিন্ন কিন্তু কায়েম করতে বলা হয়েছে দ্বীনকে যা সমানভাবে সব নবী-রসূলের দ্বীন ছিল, তাই দ্বীন কায়েমের নির্দেশের মধ্যে শরীয়ত অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ এ আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। সূরা মায়েদার যে স্থানে এ আয়াতটি আছে তার পূর্বাপর অর্থাৎ ৪১ আয়াত থেকে ৫০ আয়াত পর্যন্ত যদি কেউ মনযোগ সহকারে পাঠ করে তাহলে সে জানতে পারবে আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ যে নবীর উম্মতকে যে শরীয়ত দিয়েছিলেন সেটিই ছিল তাদের জন্য দ্বীন এবং সেই নবীর নবুওয়াত কালে সেটিই কায়েম করা কাম্য ও উদ্দেশ্য ছিল। এখন যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের যুগ, তাই উম্মতে মুহাম্মাদীকে যে শরীয়ত দান করা হয়েছে এ যুগের জন্য সেটিই দ্বীন এবং সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করাই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করা। এরপর থেকে ঐ সব শরীয়তের পরস্পর ভিন্নতা। এ ভিন্নতার তাৎপর্য এ নয় যে, আল্লাহর প্রেরিত শরীয়তসমূহ পরস্পর বিরোধী ছিল। বরং এর সঠিক তাৎপর্য হলো, অবস্থা ও পরিবেশ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ঐ সব শরীয়তের খুটিনাটি বিষয়ে কিছু পার্থক্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ নামায ও রোযার কথাই ধরুন। সকল শরীয়তেই নামায কায়েম ফরয ছিল কিন্তু সব শরীয়তের কিবলা এক ছিল না। তাছাড়া নামাযের সময়, রাকআতের সংখ্যা এবং বিভিন্ন অংশে কিছুটা পার্থক্য ছিল। অনুরূপ রোযা সব শরীয়তেই ফরয ছিল। কিন্তু রমযানের ৩০ রোযা অন্যান্য শরীয়তে ছিল না। এ থেকে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ঠিক নয় যে, নামায ও রোযা ‘ইকামাতে দ্বীন’ বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত ঠিকই, কিন্তু নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নামায পড়া এবং নির্দিষ্ট কোন সময়ে রোযা রাখা ইকামতে দ্বীনের নির্দেশ বহির্ভূত। বরং এর সঠিক অর্থ হলো, প্রত্যেক নবীর উম্মতের জন্য তৎকালীন শরীয়তে নামায ও রোযা আদায়ের জন্য যে নিয়ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছিলো সেই সময়ে সেই পদ্ধতি অনুসারে নামায পড়া ও রোযা রাখাই ছিল দ্বীন কায়েম করা। বর্তমানেও এসব ইবাদতের জন্য শরীয়তে মুহাম্মাদীতে যে নিয়ম-পদ্ধতি দেয়া হয়েছে সে মোতাবেক এসব ইবাদাত বন্দেগী করা ‘ইকামাতে দ্বীন’। এ দু’টি দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে শরীয়তের অন্যসব আদেশ-নিষেধও বিচার করুন।
যে ব্যক্তি চোখ খুলে কুরআন মজীদ পড়বে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে যে, এ গ্রন্থ তার অনুসারীদেরকে কুফরী ও কাফেরদের আজ্ঞাধীন ধরে নিয়ে বিজিতের অবস্থানে থেকে ধর্মীয় জীবন-যাপন করার কর্মসূচী দিচ্ছে না, বরং প্রকাশ্যে নিজের শাসন ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে, চিন্তাগত, নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং আইনগত ও রাজনৈতিক ভাবে বিজয়ী করার লক্ষ্যে জীবনপাত করার জন্য অনুসারীদের কাছে দাবী করছে এবং তাদেরকে মানব জীবনের সংস্কার ও সংশোধনের এমন একটি কর্মসূচী দিচ্ছে যার একটা বৃহদাংশ কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যদি সরকারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ঈমানদারদের হাতে থাকে। এ কিতাব তার নাযিল করার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলেঃ
إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ- النساء: 105
“হে নবী, আমি ন্যায় ও সত্যসহ তোমার কাছে এই কিতাব নাযিল করেছি যাতে আল্লাহ তোমাকে যে আলো দেখিয়েছেন তার সাহায্যে তুমি মানুষের মধ্যে ফায়সালা করো।”
এই কিতাবে যাকাত আদায় ও বন্টনের যে নির্দেশাবলী দেয়া হয়েছে সেজন্য তা সুস্পষ্টভাবে এমন একটি সরকারের ধারণা পেশ করেছে যে, একটি নির্দিষ্ট নিয়মানুসারে যাকাত আদায় করে হকদারদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব নেবে (আত তাওবা ৬০ ও ১০৩ আয়াত )। এই কিতাবে সুদ বন্ধ করার যে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং সুদখোরী চালু রাখার কাজে তৎপর লোকদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে (আল বাকারা ২৭৫-২৭৯ আয়াত) তা কেবল তখনই বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে যখন দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণরূপে ঈমানদারদের হাতে থাকবে। এই কিতাবে হত্যাকারীর থেকে কিসাস গ্রহণের নির্দেশ (আল বাকারা ১৭৮ আয়াত), চুরির জন্য হাত কাটার নির্দেশ (আল মায়েদা ৩৮ আয়াত ) এবং ব্যভিচার ও ব্যভিচারের অপবাদ আরোপের জন্য হদ জারী করার নির্দেশ একথা ধরে নিয়ে দেয়া হয়নি যে, এসব আদেশ মান্যকারীদেরকে কাফেরদের পুলিশ ও বিচারালয়ের অধীন থাকতে হবে। এই কিতাবে কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নির্দেশ (আল বাকারা- ১৯০-২১৬ আয়াত) একথা মনে করে দেয়া হয়নি যে, এ দ্বীনের অনুসারীরা কাফের সরকারের বাহিনীতে সৈন্য ভর্তি করে এ নির্দেশ পালন করবে। এ কিতাবে আহলে কিতাবদের নিকট থেকে জিযিয়া আদায়ের নির্দেশ (আত তাওবা ২৯ আয়াত ) একথা ধরে নিয়ে দেয়া হয়নি যে, মুসলমানরা কাফেরদের অধীন থেকে তাদের থেকে জিযিয়া আদায় করে এবং তাদের রক্ষার দায়িত্ব নেবে। এ ব্যাপারটি শুধু মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। দৃষ্টিশক্তির অধিকারীরা মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের মধ্যে স্পষ্টতই দেখতে পারেন, প্রথম থেকেই যে পরিকল্পনা ছিল তা ছিলো দ্বীনের বিজয় ও কর্তৃত্ব স্থাপন, কুফরী সরকারের অধীনে দ্বীন ও দ্বীনের অনুসারীদের জিম্মি হয়ে থাকা নয়। উদাহরণস্বরূপ দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা বনী-ইসরাইল, আয়াত ৭৬ ও ৮০ ; সূরা কাসাস, আয়াত ৮৫-৮৬ ; সূরা রূম, আয়াত ১ থেকে ৬ ; সূরা আস সাফফাত , আয়াত ১৭১ থেকে ১৭৯ , (টীকা ৯৩-৯৪) এবং সূরা সোয়াদ, ভূমিকা ও ১১ আয়াত ১২ টীকাসহ।
ব্যাখ্যার এই ভ্রান্তি যে জিনিসটির সাথে সবচেয়ে বেশী সাংঘর্ষিক তা হচ্ছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের বিরাট কাজ। যা তিনি ২৩ বছরের রিসালাত যুগে সমাধা করেছেন। তিনি তাবলীগ ও তলোয়ার উভয়টির সাহায্যেই যে গোটা আরবকে বশীভূত করেছিলেন এবং বিস্তারিত শরীয়ত বা বিধি-বিধানসহ এমন একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় আদর্শ কায়েম করেছিলেন যা আকীদা-বিশ্বাস ও ইবাদাত থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডে, সামাজিক চরিত্র, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি, রাজনীতি ও ন্যায় বিচার এবং যুদ্ধ ও সন্ধিসহ জীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগে পরিব্যাপ্ত ছিল তা কে না জানে? এ আয়াত অনুসারে নবী ﷺ সহ সমস্ত নবী-রসূলকে ইকামাতে দ্বীনের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো নবীর ﷺ এসব কাজকে যদি তার ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করা না হয় তাহলে তার কেবল দু’টি অর্থই হতে পারে। হয় নবীর ﷺ বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে (মা’আযাল্লাহ) যে, তিনি আদিষ্ট হয়েছিলেন শুধু ঈমান ও নৈতিক চরিত্র সম্পর্কিত বড় বড় মূলনীতিসমূহের তাবলীগ ও দাওয়াতের জন্য কিন্তু তা লংঘন করে তিনি নিজের পক্ষ থেকেই একটি সরকার কায়েম করেছিলেন, যা অন্যসব নবী-রসূলদের শরীয়ত সমূহের সাধারণ নীতিমালা থেকে ভিন্নও ছিল অতিরিক্তও ছিল। নয়তো আল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আরোপ করতে হবে যে, তিনি সূরা শূরায় উপরোক্ত ঘোষণা দেয়ার পর নিজেই তাঁর কথা থেকে সরে পড়েছেন এবং নিজের নবীর নিকট থেকে ঐ সূরায় ঘোষিত “ইকামাতে দ্বীনের” চেয়ে কিছুটা বেশী এবং ভিন্ন ধরনের কাজই শুধু নেননি, বরং উক্ত কাজকে পূর্ণতা লাভের পর নিজের প্রথম ঘোষণার পরিপন্থী দ্বিতীয় এই ঘোষণাটিও দিয়েছেন যে, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ (আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করলাম) নাউযুবিল্লাহি মিন যালিকা। এ দু’টি অবস্থা ছাড়া তৃতীয় এমন কোন অবস্থা যদি থাকে যেক্ষেত্রে ইকামাতে দ্বীনের এই ব্যাখ্যাও বহাল থাকে এবং আল্লাহ কিংবা তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও না আসে তাহলে আমরা অবশ্যই তা জানতে চাইবো।
দ্বীন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়ার পর আল্লাহ এ আয়াতে সর্বশেষ যে কথা বলেছেন তা হচ্ছে وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ “দ্বীনে বিভেদ সৃষ্টি করো না” কিংবা “তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ো না।” দ্বীনে বিভেদের অর্থ ব্যক্তির নিজের পক্ষ থেকে এমন কোন অভিনব বিষয় সৃষ্টি করা এবং তা মানা বা না মানার ওপর কুফর ও ঈমান নির্ভর করে বলে পীড়াপীড়ি করা এবং মান্যকারীদের নিয়ে অমান্যকারীদের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া, অথচ দ্বীনের মধ্যে তার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। এই অভিনব বিষয়টি কয়েক ধরনের হতে পারে। দ্বীনের মধ্যে যে জিনিস নেই তা এনে শামিল করা হতে পারে। দ্বীনের অকাট্য উক্তিসমূহের বিকৃত প্রায় ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে অদ্ভূত আকীদা-বিশ্বাস এবং অভিনব আচার-অনুষ্ঠান আবিষ্কার করা হতে পারে। আবার দ্বীনের উক্তি ও বক্তব্যসমূহ রদবদল করে তা বিকৃত করা, যেমন যা গুরুত্বপূর্ণ তাকে গুরুত্বহীন বানিয়ে দেয়া এবং যা একেবারেই মোবাহ পর্যায়ভুক্ত তাকে ফরয ও ওয়াজিব এমনকি আরো অগ্রসর হয়ে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ বানিয়ে দেয়া। এ ধরনের আচরণের কারণেই নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামদের উম্মতদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। অতঃপর এসব ছোট ছোট দলের অনুসৃত পথই ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করেছে যার অনুসারীদের মধ্যে বর্তমানে এই ধারণাটুকু পর্যন্তও বর্তমান নেই যে, এক সময় তাদের মূল ছিল একই। দ্বীনের আদেশ-নিষেধ বুঝার এবং অকাট্য উক্তিসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে মাসয়ালা উদ্ভাবন করার ক্ষেত্রে জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই যে মতভেদ সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর কিতাবের ভাষার মধ্যে আভিধানিক, বাগধারা ও ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে যার অবকাশ আছে সেই বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত মতভেদের সাথে এই বিবাদের কোন সম্পর্ক নেই। এই বিষয় সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত ২১৩, টীকা ২৩০ ; সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৯, টীকা ১৬ ও ১৭ , আয়াত ৫১, টীকা ৪৮ ; সূরা আন নিসা, আয়াত ১৭১, টীকা ২১১ থেকে ২১৬ ; আল মায়েদা আয়াত ৭৭, টীকা ১০১ , আল আন’আম, আয়াত ১৫৯, টীকা ১৪১ ; সূরা আন নাহল, আয়াত ১১৮ থেকে ১২৪, টীকা ১১৭ থেকে ১২১ ; সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯২-৯৩, টীকা ৯১ , আল হাজ্জ, আয়াত ৬৭-৬৯, টীকা ১১৬, ১১৭ ; আল মু’মিনুন, আয়াত ৫১ থেকে ৫৬, টীকা ৪৫ থেকে ৪৯ ; সূরা আল কাসাস, আয়াত ৫৩ ও ৫৪, টীকা ৭৩ ; সূরা আর রূম, আয়াত ৩২ থেকে ৩৫, টীকা ৫১ থেকে ৫৪ ।
# বর্ণনা পরম্পরায় সাথে এ প্যারার সম্পর্ক বুঝতে হলে এ সূরার ৫৫ থেকে ৫৭ আয়াত পর্যন্ত দৃষ্টি সমক্ষে রাখতে হবে।
# আল্লাহর কোন কিতাবে বলা হয়নি, “আমি অমুক অমুককে আমার সাথে প্রভুত্বের কর্তৃত্বে শরীক করেছি। কাজেই আমার সাথে তোমরা তাদেরকেও ইবাদাতে শরীক করো।” আর কোন জ্ঞান মাধ্যমেও তারা এ কথা জানেনি যে, এরা অবশ্যই প্রভুত্বের কর্তৃত্বে অংশীদার এবং এজন্য এরা ইবাদাত লাভের হকদার। এখন এ যেসব বিভিন্ন ধরনের উপাস্য তৈরি করে এদের গুণাবলী ও ক্ষমতা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আকীদা তৈরি করে নেয়া হয়েছে এবং এদের আস্তানায় কপাল ঠেকানো হচ্ছে, প্রয়োজন পূরণের জন্য এদের কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে, এদের বেদীতে ভেঁট ও নযরানা চড়ানো হচ্ছে, আস্তানা প্রদক্ষিণ করা হচ্ছে এবং সেখানে উপাসনার জন্য নির্জনবাস করা হচ্ছে— এসব কিছু জাহেলী ধারণার অনুসরণ ছাড়া আর কি হতে পারে?
# এ নির্বোধরা মনে করছে, এ উপাস্যরা দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সাহায্যকারী হবে। অথচ আসলে তাদের কোনই সাহায্যকারী নেই, এ উপাস্যরা তো নয়ই। কারণ তাদের সাহায্য করার কোন ক্ষমতা নেই। আর আল্লাহও তাদের সাহায্যকারী নন। কারণ তারা তো তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পথ অবলম্বন করেছে। কাজেই নিজেদের এই নির্বুদ্ধিতার কারণে তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করছে।
# আল্লাহর কালাম শুনে তোমাদের মনে যে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে তার চেয়ে মারাত্মক জিনিস অথবা তাঁর আয়াত যারা শুনায় তাদের সাথে যে সবচেয়ে খারাপ ব্যবহার তোমরা করতে পারো তার চেয়েও খারাপ জিনিসের মুখোমুখি তোমাদের হতে হবে।