أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৫৩)
[وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ
জিহাদ কর আল্লাহ্র পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত।]
সূরা:- আল্ – হাজ্জ।
সুরা:২২
৭৩-৭৮ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২২:৭৩
یٰۤاَیُّہَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسۡتَمِعُوۡا لَہٗ ؕ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰہِ لَنۡ یَّخۡلُقُوۡا ذُبَابًا وَّ لَوِ اجۡتَمَعُوۡا لَہٗ ؕ وَ اِنۡ یَّسۡلُبۡہُمُ الذُّبَابُ شَیۡئًا لَّا یَسۡتَنۡقِذُوۡہُ مِنۡہُ ؕ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَ الۡمَطۡلُوۡبُ ﴿۷۳﴾
হে মানুষ! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, মনোযোগের সাথে তা শোনঃ তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্র হলেও । এবং মাছি যদি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের কাছ থেকে, এটাও তারা তার কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। অন্বেষণকারী ও অন্বেষণকৃত কতই না দুর্বল ।
২২:৭৪
مَا قَدَرُوا اللّٰہَ حَقَّ قَدۡرِہٖ ؕ اِنَّ اللّٰہَ لَقَوِیٌّ عَزِیۡزٌ ﴿۷۴﴾
তারা আল্লাহর যথোচিত মর্যাদা উপলব্ধি করে না; আল্লাহ নিশ্চয়ই চরম ক্ষমতাবান, মহাপরাক্রমশালী।
২২:৭৫
اَللّٰہُ یَصۡطَفِیۡ مِنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ رُسُلًا وَّ مِنَ النَّاسِ ؕ اِنَّ اللّٰہَ سَمِیۡعٌۢ بَصِیۡرٌ ﴿ۚ۷۵﴾
আসলে আল্লাহ (নিজের ফরমান পাঠাবার জন্য) ফেরেশতাদের মধ্য থেকেও বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। তিনি সবকিছু শোনেন ও দেখেন।
২২:৭৬
یَعۡلَمُ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ مَا خَلۡفَہُمۡ ؕ وَ اِلَی اللّٰہِ تُرۡجَعُ الۡاُمُوۡرُ ﴿۷۶﴾
তাদের সামনে ও পিছনে যা কিছু আছে তিনি তা জানেন এবং সব বিষয়ই আল্লাহ্র কাছে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।
২২:৭৭
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ارۡکَعُوۡا وَ اسۡجُدُوۡا وَ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمۡ وَ افۡعَلُوا الۡخَیۡرَ لَعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿ۚٛ۷۷﴾
হে ঈমানদারগণ! রুকূ’ ও সিজদা করো, নিজের রবের বন্দেগী করো এবং নেক কাজ করো, হয়তো তোমাদের ভাগ্যে সফলতা আসবে।
২২:৭৮
وَ جَاہِدُوۡا فِی اللّٰہِ حَقَّ جِہَادِہٖ ؕ ہُوَ اجۡتَبٰىکُمۡ وَ مَا جَعَلَ عَلَیۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ مِنۡ حَرَجٍ ؕ مِلَّۃَ اَبِیۡکُمۡ اِبۡرٰہِیۡمَ ؕ ہُوَ سَمّٰىکُمُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ۬ۙ مِنۡ قَبۡلُ وَ فِیۡ ہٰذَا لِیَکُوۡنَ الرَّسُوۡلُ شَہِیۡدًا عَلَیۡکُمۡ وَ تَکُوۡنُوۡا شُہَدَآءَ عَلَی النَّاسِ ۚۖ فَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ اعۡتَصِمُوۡا بِاللّٰہِ ؕ ہُوَ مَوۡلٰىکُمۡ ۚ فَنِعۡمَ الۡمَوۡلٰی وَ نِعۡمَ النَّصِیۡرُ ﴿٪۷۸﴾
আল্লাহর পথে জিহাদ করো যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়। তিনি নিজের কাজের জন্য তোমাদেরকে বাছাই করে নিয়েছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোন সংকীর্ণতা আরোপ করেননি।তোমাদের পিতা ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাও। আল্লাহ আগেও তোমাদের নাম রেখেছিলেন “মুসলিম” এবং এর (কুরআন) মধ্যেও (তোমাদের নাম এটিই) যাতে রসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হন এবং তোমরা সাক্ষী হও লোকদের ওপর। কাজেই নামায কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাও। তিনি তোমাদের অভিভাবক, বড়ই ভালো অভিভাবক তিনি, বড়ই ভালো সাহায্যকারী তিনি।
৭৩-৭৮ নং আয়াতের তাফসীর:
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*পৌত্তলিকতার অসারতা প্রমাণে কোরআনের উপমা : এর পর প্রকাশ্য ঘােষণার মাধ্যমে মানব জাতির সামনে একটা বাস্তব সত্য তুলে ধরা হচ্ছে আর সেটা হচ্ছে কল্পিত দেব-দেবীদের শক্তি সামর্থ্যের বিষয়টি। কিছু সংখ্যক মানুষ যেসব কল্পিত দেব-দেবীকে নিজেদের ত্রাণকর্তা মনে করে তাদের সামনে সাহায্যের জন্যে হাত বাড়ায় এবং ওদের চরণে নিজেদেরকে সঁপে দেয় সেগুলাে যে কত দুর্বল ও সামর্থ্যহীন তা চোখে আংগুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে অত্যন্ত বাস্তব ও চাক্ষুষ একটা দৃষ্টান্ত পেশ করে বলা হচ্ছে, ‘হে লােক সকল! একটা দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে, তােমরা মনােযােগ শােনাে'(আয়াত ৭৩) একদম খােলামেলা ঘােষণা, একদম জোরালাে কন্ঠের ঘোষণা। সকল মানুষকে ডেকে বলা হচ্ছে, ‘তােমরা শােনাে’ অর্থাৎ যা কিছু বলা হচ্ছে তাতে লুকোচুরির কিছু নেই এবং তা বিশেষ কোনাে দল বা গােষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নয়। বরং সকলের অবগতির জনন্য জানানাে হচ্ছে। একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হচ্ছে সবার জন্যে, তাই সকলকে খেয়াল করে শুনার জন্যে বলা হচ্ছে। দৃষ্টান্তটি হচ্ছে এই যে, আল্লাহ ব্যতীত যাদের উপাসনা তােমরা করছে, তারা সকলে একত্রিত হয়েও একটা মাছি পর্যন্ত সৃষ্টি করার মতাে ক্ষমতা রাখে না। এসব কল্পিত উপাস্য কোনাে মূর্তি, কোনাে ব্যক্তি, কোনাে আদর্শ বা কোনাে মূল্যবােধ যাই হােক না কেন এদের কোনাে ক্ষমতা নেই। মাছির মতাে একটা নগণ্য ও তুচ্ছ প্রাণী সৃষ্টি করার মতাে ক্ষমতাও এদের নেই। অথচ এদেরকেই মানুষ উপাস্যের আসনে বসিয়ে এদের চরণে পূজা অর্চনা নিবেদন করছে! এদের কাছে সাহায্য কামনা করছে, আশ্রয় কামনা করছে! একটা উট বা হাতি সৃষ্টি করা যেমন অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব ছােট একটা মাছি সৃষ্টি করাও। কারণ, প্রাণ নামক যে বিস্ময়কর রহস্যটি উট বা হাতির মাঝে কাজ করছে, সেই একই রহস্য মাছির মাঝেও কাজ করছে। কাজেই উভয় শ্রেণীর প্রাণী সৃষ্টি করা একই পর্যায়ের অসম্ভব কাজ। কিন্তু পবিত্র কোরআনের অনুকরণীয় বর্ণনা ভংগিতে একটা নগন্য ও তুচ্ছ মাছির দৃষ্টান্তই স্থান পেয়েছে। কারণ, একটা হাতি বা উট সৃষ্টি না করার অক্ষমতার মাঝে দুর্বলতার যে চিত্র ফুটে উঠবে, তার চেয়েও অনেক বেশী দুর্বলতা ফুটে উঠবে একটা মাছি সৃষ্টি না করার অক্ষমতার মাঝে। অথচ এই বর্ণনা ভংগির ফলে প্রকৃত সত্যের মাঝে কোনাে হেরফের হচ্ছে না। এখানেই কোরআনের বিস্ময়কর বর্ণনা ভংগির সার্থকতা নিহিত। এরপর আর এক কদম আগে অগ্রসর হয়ে ওই কল্পিত দেব-দেবীদের অক্ষমতার অপর একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত পেশ করে বলা হচ্ছে, ‘আর যদি মাছি তাদের কোনাে অংশ ছিনিয়ে নেয়, তাহলে সেটাও তারা রক্ষা করতে পারবে না।’ এসব তথাকথিত মূর্তিরূপী, বস্তুরূপী অথবা মানুষরূপী উপাস্যদের মাঝে আসলেও এতােটুকু ক্ষমতা নেই যে, নিজেদেরকে মাছির মতাে একটা তুচ্ছ প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। এমন অনেক প্রিয়বস্তু মানুষের হাত থেকে মাছি ছিনিয়ে নেয় কিন্তু সে তা পুনরায় উদ্ধার করতে পারে না। মাছি যদিও একটি দুর্বল ও ছােট্ট প্রাণী। কিন্তু এর মাঝে এমন মারাত্মক জীবাণু বহন করার মতাে ক্ষমতা রয়েছে যার মাধ্যমে সে মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান অংগ-প্রত্যংগের ক্ষতি সাধন করতে পারে। এমনকি মানুষের প্রাণ বা জীবনও ছিনিয়ে নিতে পারে। কারণ, মাছি যক্ষ্মা, টাইফয়েড, আমাশয় ও ডাইরিয়ার মতাে মারাত্মক রােগের জীবাণু বহন করে। ফলে তুচ্ছ ও নগন্য। হওয়া সত্তেও সে মানুষের এমন ক্ষতি করতে পারে যা পূরণ করা কখনও সম্ভব নয়। পবিত্র কোরআনের অননুকরণীয় বর্ণনাভংগির মাঝে আর একটি বাস্তব সত্য ধরা পড়েছে। আয়াতে যদি বলা হতাে যে, কোনাে হিংস্র পশু ওদের কোনাে অংশ ছিনিয়ে নিলে তা উদ্ধার করার মতো ক্ষমতা ওদের নেই তাহলে এর দ্বারা ওদের শক্তিই বুঝাতাে, দুর্বলতা নয়। অথচ হিংস্র পশু যা ক্ষতি করতে পারে তা মাছির ক্ষতির চেয়ে কিন্তু বড় নয়। কাজেই মাছির দৃষ্টান্তই তুলে ধরা হয়েছে। আর এটাই হচ্ছে পবিত্র কোরআনের অসাধারণ বর্ণনাভংগির বাস্তব নিদর্শন, ওপরের দৃষ্টান্তটি পেশ করার পর মন্তব্য আকারে বলা হচ্ছে, ‘দুর্বল প্রার্থী ও প্রার্থিত।’ এর ফলে দৃষ্টান্তটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও মূল ভাবটি মনের মাঝে গেঁথে যায় ।
* কল্পিত দেব-দেবীদের অন্তসারশূন্যতা ও সামর্থহীনতা বর্ণনা করার সঠিক ও উপযুক্ত মুহূর্তটিতে আল্লাহ তায়ালা নিজের কুদরত ও অসীম ক্ষমতার মূল্যায়নে যারা ব্যর্থ-তাদেরকে নিন্দাবাদ জানিয়ে ঘােষণা করছেন, ‘তারা আল্লাহকে যথার্থরূপে মূল্যায়ন করতে পারেনি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন শক্তিধর ও মহাপরাক্রমশালী'(আয়াত ৭৪) সত্যিই ওরা আল্লাহর মর্যাদা যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পারেনি। নইলে ওরা কখনাে এমন দুর্বল ও অক্ষম উপাস্যদেরকে আল্লাহর শরীক বলে বিশ্বাস করতাে না, যাদের মাঝে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটা মাছিও সৃষ্টি করার মতাে ক্ষমতা নেই, এমনকি মাছির হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার মতাে শক্তিও নেই! ঠিকই ওরা আল্লাহর মর্যাদা যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। নইলে আল্লাহর অপার কুদরতের শত শত নিদর্শন দেখেও এবং তাঁর সৃষ্টি নৈপুণ্যের শত শত প্রমাণ স্বচক্ষে দেখেও ওরা কিভাবে তার সাথে এমন কল্পিত উপাস্যকে শরীক করে যার মাঝে একটা তুচ্ছ ও নগণ্য মাছি সৃষ্টি করার মতাে ক্ষমতা নেই? ওরা ঠিকই আল্লাহর মর্যাদা সঠিকভাবে বুঝতে পারেনি। তা না হলে ওরা কি করে মহাশক্তিধর ও মহা পরাক্রমশালী আল্লাহকে ত্যাগ করে এমন কিছু দুর্বল ও শক্তিহীন দেব-দেবীর কাছে ধর্ণা দেয় যেগুলাে মাছির আক্রমণ থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার মতো ক্ষমতা রাখে না। বিবেককে নাড়া দেয়ার জন্যে মনের মাঝে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করার জন্যে ওপরের বর্ণনাভংগি ও বক্তব্য সাবধান বাণী হিসেবে কাজ করছে।
* পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তায়ালা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি ফেরেশতাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক ফেরেশতাকে মনােনীত করে নবী রসূলদের কাছে পাঠান এবং মানব জাতির মধ্য থেকে কিছুসংখ্যক পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদেরকে নবী বা রসূল হিসেবে মনােনীত করে মানব জাতির হেদায়াতের জন্যে প্রেরণ করেন। এগুলাে আল্লাহ তায়ালা সম্পূর্ণ রূপে নিজের অসীম জ্ঞান ও কুদরতের ওপর ভিত্তি করে নিধারণ করেন। নিচের আয়াতে এ কথাই বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতা ও মানুষ জাতির মধ্য থেকে…'(আয়াত ৭৫-৭৬) অর্থাৎ ফেরেশতা ও নবী রসূলদের মনােনয়ন সম্পন্ন হয় মহা শক্তিধর আল্লাহর হাতেই। এই মহা শক্তিধর আল্লাহর পক্ষ থেকেই মােহাম্মদ(স.) নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন এবং তার কাছ থেকেই ক্ষমতা লাভ করেছেন। তিনি এই আল্লাহরই মনােনীত ও নির্বাচিত রসূল। কাজেই তাকে বাধা দেয়ার শক্তি ঐসব লােকদের কোথায় থাকবে যারা দুর্বল, অক্ষম ও তুচ্ছ দেব-দেবীর চরণে মাথা ঠুকে বেড়ায়? ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ অর্থাৎ তিনি শুনেন ও দেখেন। কাজেই তিনি জানেনও। আগে পিছে কি ঘটছে তার পরিপূর্ণ জ্ঞান তিনি রাখেন। উপস্থিত অনুপস্থিত, কাছের এবং দূরের কোনাে কিছুই তার জ্ঞানের আওতার বাইরে নয়। শুধু তাই নয়, বরং সব কিছুর মীমাংসা ও সমাধানও তার হাতেই ন্যস্ত । সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাও তাঁর হাতেই ন্যস্ত ।
*যে মহান দায়িত্ব পালনের জন্যে মুসলিম জাতির মনােনয়ন : মােশরেকদের আদর্শের দুর্বল দিক তুলে ধরার পর এবং ওদের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারপূর্ণ পূজা অর্চনার প্রসংগ উল্লেখ করার পর এখন মুসলিম জাতিকে লক্ষ্য করে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, তারা যেন দাওয়াত ও তবলীগের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে এবং শাশ্বত ও চিরন্তন সত্য আদর্শের ওপর অটল থাকে। বলা হচ্ছে, ‘হে মােমেনরা! তােমরা রুকু করাে ও সেজদা করাে…'(আয়াত ৭৭-৭৮) এই দুটো আয়াতে মুসলিম জাতির জীবনাদর্শের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। মুসলিম জাতির দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয়েছে। মুসলিম জাতির জন্যে আল্লাহ তায়ালা কী স্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন তা বলা হয়েছে এবং সাথে সাথে এ বাস্তব সত্যটিও তুলে ধরা হয়েছে যে, এই জাতির অস্তিত্ব ও শিকড় ততােদিন পর্যন্ত অটুট ছিলাে, আছে এবং থাকবে যতােদিন পর্যন্ত এই জাতি তার নিজস্ব আদর্শ ও ঐতিহাের ওপর অটল থাকবে, অনড় থাকবে। এখানে মোমেন বান্দাদেরকে রুকু এবং সিজদার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এই রুকু ও সিজদা হচ্ছে নামাযের দুটো গুরুত্বপূর্ণ ও দৃশ্যমান অংগ। এর দ্বারা গােটা নামাযই বুঝানাে হয়েছে। ফলে গােটা নামাযই একটি দৃশ্যমান চিত্র, একটা প্রকাশ্য কর্মকান্ড, একটা প্রত্যক্ষ দৃশ্য এবং একটা জ্বলন্ত অভিব্যক্তি রূপে ধরা পড়ছে। বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, এ জাতীয় বর্ণনাভংগির প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয় এবং এর আবেদন হয় অত্যন্ত গভীর। এরপর এবাদাতের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, এবাদাত নামাযের তুলনায় ব্যাপক। কারণ, আল্লাহর এবাদাত বা আনুগত্যের আওতায় এমন প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আচরণ, প্রতিটি পদক্ষেপ এবং প্রতিটি চিন্তা চেতনায়ই পড়ে যা বান্দা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করে থাকে। এই হিসেবে মানুষের জীবনের প্রতিটি কর্মকান্ডই এবাদাতরূপে গণ্য হতে পারে যদি সেগুলাের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ উদ্দেশ্য হয়। এমনকি জাগতিক বৈধ উপকরণ ভােগ করার মাধ্যমে মানুষ যে তৃপ্তি লাভ করে থাকে সেগুলােও কেবল একটু খানি সতর্কতার ফলে নেক কাজে রূপান্তরিত হয়ে অশেষ সওয়াবের কারণ হতে পারে। এর জন্যে মানুষকে কেবল আল্লাহর কথা স্মরণ রাখতে হবে যিনি তাকে এই নেয়ামত দান করেছেন। সাথে সাথে নিয়ত থাকতে হবে যে, এসব উপকরণ ভােগ করার মাধ্যমে সে আল্লাহর এবাদাতবন্দেগীর জন্যে প্রয়ােজনীয় শক্তি অর্জন করছে। কেবল এতােটুকু নিয়তের ফলেই সে এবাদাতের সওয়াব লাভ করতে সক্ষম হবে। অথচ এই নিয়তের ফলে তার সম্ভোগ তৃপ্তির মাঝে কোনােই পার্থক্যের সৃষ্টি হবে না। বরং তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ একটা নিরেট দুনিয়ামুখী কাজ ও নিয়তের ফলে আল্লাহমুখী হয়ে যাচ্ছে। নামায ও এবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর দায়-দায়িত্ব পালন করার নির্দেশের পর সব শেষে সাধারণভাবে সৎ কাজ করার মাধ্যমে মানুষের দায়-দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। কামিয়াবী ও সফলতা লাভের আশা নিয়েই মুসলিম জাতিকে এসব নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ এসব নির্দেশ পালনের মধ্যেই কামিয়াবী ও সফলতা নিহিত। এবাদাতবন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। এর ফলে তার জীবন মযবুত ভিত্তির ওপর কায়েম থাকবে, নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত থাকবে। তাছাড়া, সৎ কাজের মাধ্যমে জীবনে স্থিতিশীলতা আসে, ব্যক্তি-কেন্দ্রিকতার পরিবর্তে সামাজিকতার গুণ সৃষ্টি হয়। কারণ এ জাতীয় জীবনের ভিত্তি হচ্ছে অটল ঈমান ও সঠিক আদর্শ। আল্লাহর সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর, জীবনে স্থিতিশীলতা আসার পর এবং বিবেক বুদ্ধিতে পরিপক্কতা আসার পর সে একটি কঠিন দায়িত্ব পালনের যােগ্যতা লাভ করে। তাই তাকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, ‘তােমরা আল্লাহর খাতিরে জিহাদ করাে, যেমনটি করা উচিত।’ এটা একটা ব্যাপক ও সুক্ষ্ম অর্থবহ বর্ণনাভংগি । এর দ্বারা এমন একটি বিরাট ও গুরুদায়িত্বের প্রতি ইংগিত করা হচ্ছে যা পালন করার জন্যে এ জাতীয় ঈমানী শক্তি, আমলের হাতিয়ার এবং মানসিক প্রস্তুতির প্রয়ােজন হয়। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার অর্থ অনেক ব্যাপক এর দ্বারা শত্ৰুর সাথে লড়াই করা বুঝায়, নফস বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা বুঝায় এবং অমংগল ও অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই বুঝায়। এক কথায় এই সব ধরনের লড়াই জিহাদ শব্দের আওতায় পড়ে । আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকেই এই কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্যে নির্বাচিত করেছেন, মনােনীত করেছেন। কাজেই এই দায়িত্ব ত্যাগ করারও কোনাে অবকাশ নেই এবং তা এড়িয়ে চলারও কোনাে সুযােগ নেই। বরং এই দায়িত্বকে নিজেদের জন্যে একটা গৌরব ও মর্যাদার বিষয় হিসেবে গণ্য করা উচিত এবং বিনিময়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। সাথে সাথে এই গুরুদায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করাও উচিত । এই গুরুদায়িত্বের মাঝে আল্লাহর রহমত ও দয়া নিহিত রয়েছে। তাই বলা হচ্ছে, ‘এবং জীবন বিধানের ব্যাপারে তােমাদের ওপর কোনাে সংকীর্ণতা রাখেননি।’ এর অর্থ হচ্ছে এই যে, ইসলামের সকল আদেশ নিষেধ, সকল এবাদাত বন্দেগী এবং সকল বিধি বিধানের ক্ষেত্রে মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি, শক্তি ও সামর্থের দিকটি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। আরাে বিবেচনায় রাখা হয়েছে সেই স্বভাবের দাবী পূরণের বিষয়টি। এই ধর্মে মানবীয় শক্তি-সামর্থ্যকে গঠনমূলক কাজে, উন্নতি ও অগ্রগতির কাজে নিয়ােগের স্বাধীনতা রয়েছে। ফলে তা আটকে থাকা বাম্পের ন্যায় অবরুদ্ধও থাকে না এবং বাঁধনমুক্ত পশুর ন্যায় অবাধে বিচরণও করে না। এটা হচ্ছে একটা শাশ্বত ও চিরন্তন আদর্শ যার সূচনা মানবতার আদিকাল থেকে এবং যা অতীত ও বর্তমানের মাঝে যােগসূত্র স্থাপন করে। তাই বলা হয়েছে, ‘তােমরা তােমাদের পিতা ইবরাহীমের ধর্মে কায়েম থাকো।’ কারণ এই ধর্মই হচ্ছে তাওহীদের উৎস যার ধারাবাহিকতা হযরত ইবরাহীম(আ.)-এর যুগ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসছে। এতে মূল আকীদা বিশ্বাসের চিহ্ন মিটিয়ে দেয়ার মতাে কোনাে ব্যবধান বা ফারাক সৃষ্টি হয়নি যেমনটি সৃষ্টি হয়েছে ইবরাহীম(আ.)-এর পূর্ববর্তী যুগের রিসালাতের ক্ষেত্রে। আল্লাহ তায়ালা এই তাওহীদবাদী জাতিকে মুসলিম জাতি নামে আখ্যায়িত করেছেন, পূর্বেও এই নামে আখ্যায়িত করেছেন এবং এখন কোরআনেও এই একই নামে আখ্যায়িত করছেন। বলা হচ্ছে, ‘তিনিই তােমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন পূর্বেও এবং এই কোরআনেও।’ ইসলামের মর্মার্থ হচ্ছে, কায়মনোবাক্য একমাত্র লা-শরীক আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করা। তাই বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন নবী রসূলদের আমলে এবং বিভিন্ন আসমানী কিতাবের সময়ে এই জাতি একই আদর্শের অধিকারী ছিলাে। এই ধারাবাহিকতা হযরত মুহাম্মদ(স.)-এর উম্মত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে এই আদর্শ উম্মতে মােহাম্মাদীকে হস্তান্তরিত করা হয় এবং মানবতার প্রতি যে অংগীকার ও দায়িত্ব সেটা তার ওপর ন্যস্ত করা হয়। ফলে এই জাতি বা উম্মতের অতীতের সাথে তার বর্তমান ও ভবিষ্যত একই বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। আল্লাহ পাকের অভিপ্রায়ও এটাই ছিলাে। তাই বলা হচ্ছে, ‘যাতে রসূল তােমাদের জন্যে সাক্ষাদাতা এবং তােমরা সাক্ষ্যদাতা হও মানবমন্ডলীর জন্যে।’ অর্থাৎ রসূলুল্লাহ(স.) এই উম্মতের জন্যে সাক্ষী হবেন। এই উম্মতের আদর্শ ও লক্ষ্য নির্ধারণ করবেন এবং তাদের ভালাে-মন্দ ও শুদ্ধতা অশুদ্ধতার দিকগুলাে চিহ্নিত করবেন। একইভাবে এই উম্মত ও অন্যান্য মানব গােষ্ঠীর জন্যে সাক্ষী হবে। ফলে নবীর পরে এই উম্মতই হবে মানব জাতির অভিভাবক। এই উম্মতের আইনের মানদন্ড, এর শিক্ষার মানদন্ড এবং জীবন ও জগত সম্পর্কিত এর চিন্তা ও দর্শনই হবে অন্যান্য মানব গােষ্ঠীর জন্যে অনুসরণীয় ও পালনীয় বিষয়। আর এটা তখনই সম্ভব হবে যখন স্বয়ং এই উম্মত তার নিজস্ব আদর্শের ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হবে, যত্নশীল হবে। কারণ তার আদর্শ আল্লাহর পক্ষ থেকে মনােনীত। তার আদর্শ শাশ্বত ও চিরন্তন। যততদিন পর্যন্ত এই উম্মত সেই আদর্শের ওপর অটুট ছিলাে এবং যতােদিন পর্যন্ত এই আদর্শকে নিজের ব্যবহারিক জীবনে বাস্তবায়িত করেছে, ততােদিন পর্যন্ত সে গােটা মানব জাতির অভিভাবক ছিলাে। কিন্তু যখনই সে এই আদর্শ হতে বিচ্যুত হয়েছে, এই আদর্শের দায় দায়িত্ব ত্যাগ করেছে তখনই আল্লাহ তায়ালা তাকে নেতৃত্বের প্রথম সারি থেকে হটিয়ে দিয়ে অনুগামীদের পেছন সারিতে নিয়ে দাঁড় করিয়েছেন। এই অবস্থা চলতে থাকবে যতােদিন পর্যন্ত না এই আদর্শ রক্ষার গুরুদায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা মনােনীত জাতির হাতে ন্যস্ত হয়। এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্যে যেহেতু সংঘবদ্ধতার প্রয়ােজন, প্রস্তুতির প্রয়ােজন তাই মুসলিম উম্মাহকে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে সালাত কায়েমের, যাকাত প্রদানের এবং আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরার। কারণ, সালাত হচ্ছে সহায় ও শক্তির উৎসের সাথে দুর্বল ও মরণশীল বান্দার যােগসূত্র। যাকাত হচ্ছে সামষ্টিক জীবনের বন্ধন, প্রয়ােজন ও দুঃসময়ে নিরাপত্তার চাবিকাঠি। আর আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ততা হচ্ছে মাবুদের সাথে বান্দার এমন অটুট বন্ধন যা ছিন্ন হওয়ার নয়। এসব প্রস্তুতি গ্রহণের পর মুসলিম জাতি গােটা বিশ্ব মানবতার অভিভাবকরূপে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে, যার জন্যে আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্বাচিত করেছেন, মনােনীত করেছেন। এর সাথে সে পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ও শক্তিকে নিজের কল্যাণে ও স্বার্থে কাজে লাগাতে পারবে। এসব পার্থিব সম্পদের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন উদাসীন নয়। বরং প্রয়ােজনীয় ঐক্য, শক্তি ও সামর্থ্য লাভ করার মাধ্যমে এগুলাের দ্বারা উপকৃত হতে আহ্বান করে। কারণ এগুলাের সদ্ব্যবহার কল্যাণমুখী ব্যবহার, গঠনমূলক ব্যবহার এবং উন্নয়নমুখী ব্যবহার একমাত্র তাদের দ্বারাই সম্ভব যারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী। মানব জাতির জন্যে মনােনীত আল্লাহর বিধান বা আদর্শের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে, এর মাধ্যমে মানব জাতি জাগতিক জীবনে আল্লাহর নির্ধারিত পূর্ণতার শীর্ষে পৌছতে পারে। কারণ, এই আদর্শ মানব জাতিকে চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায় কেবল আহার, বিহার ও ভােগের শিক্ষা দেয় না। উন্নত মানবিক মূল্যবােধ অবশ্যই প্রয়ােজনীয় বস্তুতান্ত্রিক জীবনের ওপর নির্ভর করবে। তবে এই আদর্শের প্রধান মূল্যবােধ ইসলাম চায়, মানুষ আল্লাহর মনােনীত জীবন বিধানে অবিচল থেকে এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে সেখান থেকে প্রয়ােজনীয় উপায়-উপকরণ গ্রহণ করুক।
* মুসলিম জাতির পরিচয় : তারপর কোরআনে কারীম এই সৃষ্টির মধ্যকার গভীর সত্যকে উম্মতে মোহাম্মাদীর সামনে পেশ করেছে। জানিয়ে দিয়েছে’ পৃথিবীতে তার প্রধান কর্তব্য সম্পর্কে, গোটা মানবগোষ্ঠীর মধ্যে তার মহান মর্যাদার কথা স্থিরভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে এবং মানব জীবনে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের মৌলিক ভূমিকা কি হওয়া দরকার তাও তাদের বিশেষ কেবলা ও বিশেষ ব্যক্তিত্বকে প্রকাশ করার মাধ্যমে কোরআনে কারীম স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, যেন তারা কোনো অবস্থাতেই নিজেদের পরওয়ারদেগারের কথা ছাড়া আর কারো কোনো কথার প্রতি কর্ণপাত না করে, যেহেতু এই কেবলার মাধ্যমেই আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মর্যাদাবান বানিয়েছেন, অধিষ্ঠিত করেছেন তাদেরকে বিশ্ব মানবের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। মুসলিম জাতি হচ্ছে এমন একটি কেন্দ্রীয় জাতি যারা গোটা মানব জাতির কাছে এমনভাবে সত্যের সাক্ষী হিসেবে ফুটে উঠবে যে, তাদের দেখেই মানুষ সত্যের চমৎকারিত্ব বুঝতে পারবে । তারা হবে সত্য ও ন্যায়ের ধারক ও বাহক! তারা মানুষের মধ্যে ন্যায়-নীতি ও ইনসাফ কায়েম করবে, তুলে ধরবে তারা সবার সামনে সত্যনীতি, জীবনের মূল্যবোধ ও সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার মাপকাঠি । ফলে, এহেন ব্যক্তিদের পরামর্শ ও মতামতই জনগণের কাছে নির্ভরযোগ্য বলে মনে হবে। তারা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার রীতিনীতি,দৃষ্টিভংগী ও নিয়ম পদ্ধতিগুলো যাচাই করার পর সত্য মিথ্যা নির্ণয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দান করবে। জানিয়ে দেবে তারা কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা । গ্রহণ করবে না তারা অন্য কোনো মানুষ থেকে নেয়া কোনো দৃষ্টিভংগী, মূল্যবোধ বা কোনো মানদন্ড । কেননা তারাই তো আল্লাহর পক্ষ থেকে গোটা মানবজাতির জন্যে তদারককারী এবং সত্যের সাক্ষী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মানুষের মধ্যে ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা এবং হক ও ইনসাফের সাথে বিচার ফয়সালার। আর এইভাবেই তারা সারা দুনিয়ার মানুষের মাঝে সত্যের সাক্ষীর ভূমিকা পালন করবে এবং রসূল (স.) তাদের জন্যে সত্যের সাক্ষী হিসেবে নিজেকে পেশ করবেন, উম্মতের যাবতীয় কার্যকলাপ, অভ্যাস ও রীতিনীতি নির্ধারনকারী হবেন তিনিই এবং উম্মতের মধ্য থেকে আগত যে কোনো চিন্তাভাবনা বা পছন্দের সঠিকতা বিবেচনা করে তিনিই দেবেন শেষ সিদ্ধান্ত । এইটিই হচ্ছে এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য এবং তার কর্তব্যও সে এইভাবে পালন করবে। তারা সর্বোত্তম উম্মতরূপে আখ্যায়িত হওয়ার সঠিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেদেরকে গৌরবান্বিত করবে। অবশ্যই মুসলিম উম্মাহ সকল দিক বিবেচনায় ‘উম্মতে ওয়াসাত’ হওয়ার যোগ্য ৷ “ওয়াসাত’ শব্দটি ‘বিসাতাত’ থেকে এসেছে বলে ধরে নিলে তার অর্থ দাড়ায় ন্যায়নিষ্ঠা ও ভারসাম্য, অর্থাৎ তারা হবে সত্য ও ন্যায়ের নিশানবর্দার এবং সকল দিক থেকে ভারসাম্যপূর্ণ। আর প্রচলিত শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করলে তার অর্থ হয় মধ্যবর্তী বা কেন্দ্রীয় গোষ্ঠী । সামগ্রিকভাবে মুসলিম জাতি আকীদা বিশ্বাস ও চিন্তাধারার নিরীখে “উম্মতে ওয়াসাত’ বা মধ্যম পথ অবলম্বনকারী উম্মত আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে নেই তাদের কোনো বাড়াবাড়ি আর না তারা জড়বাদ বা বস্তুবাদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে নির্মম নিষ্ঠুর । প্রকৃত মানবতার ধারক ও বাহক তারা৷ তারা মনে প্রাণে যেমন বিশ্বাস করে, তেমনি অনুভবও করে যে, সব কিছুর সাথে মানবাত্মার সম্পর্ক সুনিবীড়, কিন্তু এই অনুভূতি তাদেরকে সংসার বিরাগী বানায় না। আবার বস্তুর প্রয়োজন বাস্তব জীবনের জন্যে অপরিহার্য বলে তারা বুঝা সত্ত্বেও তারা বস্তু-সর্বস্ব হয়ে যায় না। বস্তুর ব্যবহার তাদেরকে আল্লাহবিমুখ বা আল্লাহর হুকুম আহকাম থেকে বেপরওয়া বানায় না। বস্তুত প্রকৃত মুসলিম উম্মাহ এই দুই আকর্ষণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলে, আর এইখানেই তার কৃতিত্ব ও তার চমৎকারিত্ব । তারা মানুষের বাস্তব প্রকৃতি ও তার চাহিদাকে উপেক্ষা করে না, কিন্তু সাথে সাথে তারা গভীরভাবে অনুভব করে মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব একটি জীবই নয়, বরং তার মধ্যে রয়েছে ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিকারী একটি আত্মাও। তার অস্তিত্বের উভয় দিকই তার সামনে স্পষ্ট, আর সেই উভয়ের অধিকার আদায়ে সে সচেতন । জীবনে উন্নতি ও অগ্রগতি লাভের জন্যে ঝুঁকি নেয়ার সাথে সাথে সে জীবনের নিরাপত্তা ও বিপদমুক্তির খেয়ালও রাখে ৷ লোভ-লালসায় ভরা জগতের সব কিছুর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা সত্ত্বেও সে বস্তুবাদের মায়া জালে এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে যায় না যে, নিজ মুনিবের সাথে সম্পর্ক রাখা ও তার কাছে ফিরে যাওয়ার চিন্তা থেকে সে সম্পূর্ণ দূর হয়ে যেতে পারে। জ্ঞান গবেষণা ও চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রেও উম্মতে মুসলিমাহ, উম্মতে ওয়াসাত হওয়ার অধিকারী । কোনো সময়েই সে নিজের জ্ঞানকে যথেষ্ট মনে করে না, বরং সে নবী (স.)-এর অনুপ্রেরণায় সদা সর্বদা জ্ঞান সাধনায় ব্যাপৃত। দুনিয়ার সাধারণ মানুষের মতো যে কোনো আহবানকারীর হাতে “বায়াত” করে অন্ধ অনুসারী হয়ে যায় না, ছুটে বেড়ায় না কোনো আলেয়ার পেছনে বা ধাধার আকর্ষণে, অথবা বানরের মতো না বুঝে কারো আনুগত্যও করতে পারে না। একাধারে আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে সে আকন্ঠ পান করে, অপর দিকে মানুষের জ্ঞান গবেষণা ও তার ফলাফল থেকেও সে উপকৃত হয়। সে ন্যায়-নীতি ও সত্যের অনুসারী, সুতরাং যেখানেই সে সত্যের সন্ধান পায় সেখান থেকেই সে তার পিপাসা মিটায় ৷ সত্য প্রাপ্তির জন্যে সে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা অবশ্যই করে। সংগঠন ও সামাজিক অবস্থান বিবেচনায়ও মুসলিম উম্মাহ উম্মাতে ওয়াসাত, কেননা সে কোনো উচ্চাভিলাষী ব্যক্তির আবেগের কাছে যেমন নিজেকে সোপর্দ করে না, তেমনি মানব নির্মিত কোনো আইন আদালত বা সংগঠনের কাছে নিরংকুশভাবে আত্মসমর্পণও করে না বরং সঠিক পথে চলার ব্যাপারে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে সে সাহায্য করে এবং সঠিক পরামর্শ দানের মাধ্যমে সমাজ সংগঠনকে কল্যাণকর পথে এগিয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে ত্রুটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। জনগণকে সে এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করে যে তারা শাসক শ্রেণীর রক্ত চক্ষুর সামনে থেকেও নিজ নিজ বিবেকের ডাকে সাড়া দেয় এবং ওহীভিত্তিক ব্যবস্থা ও মানব রচিত আইনের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করে না। ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ককে উম্মতে মুসলিমাহ্ সুসংবদ্ধ করে। সে ব্যক্তিকে তার নিজ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত রাখে এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় । ব্যক্তিকে সে সমাজের কাছে বিলীন করে দেয় না। অপরদিকে ব্যক্তিকে সে এমন স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয় না যে তার কার্যকলাপ ও ব্যবহার সমাজ জীবনকে বিঘ্নিত করতে পারে বরং ব্যক্তিকে এমনভাবে সে প্রশিক্ষণ দেয় যে সে নিজ ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্ভ্রমবোধকে বজায় রেখেও সমাজের উপকারী বন্ধুতে পরিণত হয়। যে নিজেকে সদা সর্বদা নিয়ন্ত্রণ করে, যে ব্যক্তি জীবনকে নিয়মমাফিক ও সুন্দরভাবে গড়ে তোলে তার পক্ষে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর ও সুবিধাবাদীতে পরিণত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, প্রকৃতিগতভাবে ব্যক্তির মধ্যে যে আবেগ অনুভূতি ও উদ্ভাবনী শক্তি আছে তাকে সুশৃংখলভাবে কাজে লাগায়, কোনো অবস্থাতেই তার স্বাধীনতা হরণ করে না কিন্তু সাথে সাথে তার প্রতি এমন বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয় যে, সে সীমা লংঘন থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয় । ফলে সে হয়ে যায় সমাজের দরদী খেদমতগার আর সমাজও হয়ে যায় তার জন্যে শুভাকাংখী । আর এ সব কিছুই সংঘটিত হয় ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে অবস্থিত পরিপুর্ণ ঐক্যবোধের কারণে । পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে মুসলিমদের প্রথম অবস্থান ক্ষেত্র গড়ে উঠেছিলো । সুতরাং এ কেন্দ্রস্থলের অধিবাসী হিসেবেও মুসলমানদের কেন্দ্রীয় উম্মত বলে অভিহিত করা যায়। রসূলুল্লাহ্ (স.)-এর সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত ইসলামের ও মুসলমানদের বাসস্থানগুলো অধিকাংশ ওই কেন্দ্রের সাথে ঘনিষ্ঠতাবে জড়িত । এ স্থানের উত্তর দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমের সকল এলাকাতেই মুসলমানদের বাসভূমি আগেও যেমন ছিলো, আজও তেমনি আছে । এই পজিশনে থাকায় তাদের ওপর গোটা পৃথিবীর তদারকীর দায়িত্ব বর্তায়। তাদের কাছে আগত সত্যের নির্ঝরিনীতে তারা যেমন অবগাহন করেছে তেমনি এই ফোয়ারার অমিয় ধারা থেকে সারা পৃথিবীবাসী যেন পরিতৃপ্ত হয় তার ব্যবস্থা করাও এই মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য । তাদের কাছে জ্ঞান ভান্ডার রয়েছে তার আলোকে তারা জীবন গড়ে ধন্য হয়। তাদের ব্যবহার ও কার্যকলাপ দ্বারা সত্যের সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্ব অপর সবার সামনে তারা ফুটিয়ে তুলবে এবং এই নৈতিকতার প্রভাবে অপরকে বাধ্য করবে এই সুশৃংখল জীবন পদ্ধতি গ্রহণ করতে, এই ভাবেই তারা কেন্দ্রীয় উম্মত হওয়ার দায়িত্ব পালন করবে । বুদ্ধিগত, চিন্তাগত, আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত উন্নতি ও অগ্রগতির ফসল তারা বয়ে নিয়ে যাবে দেশ থেকে দেশান্তরে এবং তারাই হবে সর্ব বিষয়ে সিদ্ধান্ত দানকারী । কালের আবর্তনে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে, সেখানেও দেখা যায় মুসলিম উম্মত জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে আঁধারের যাত্রীদের পথ দেখাচ্ছে, অর্থাৎ সর্ব যুগেই কোরআনের আলোকে মুসলমানরা মানুষকে পথ দেখিয়ে এসেছে এবং এখনও দেখাচ্ছে। মুসলমানদের এই সর্বগ্রাসী বলয় থেকে বাঁচার জন্যে জ্ঞানপাপীরা মুসলমানদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরানোর জন্যে সদা সর্বদা উদগ্রীব ৷ মহাকালের বাল্যকাল সমাপ্ত হয় নবী (স.)-এর আগমনের সাথে সাথে। উম্মাতে মুসলিমাহর আগমন কাল থেকে শুরু হয়েছে মানব জাতির যৌবনকাল ৷ তাই উম্মাতে মুসলিমাহর দায়িত্ব এসে পড়েছে শিশুসুলভ ধ্যান ধারণা ও ধারণা অনুমান ভিত্তিক যে সব আবর্জনা সমাজে পুঞ্জীভূত হয়েছিলো সেগুলো থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার এবং তাদেরকে সত্য সঠিক পথের দিশা দিয়ে সত্যের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ দেয়ার ৷ মুসলমানদেরকে দেয়া উম্মাতে ওয়াসাতের এই মহান ও মর্যাদাপূর্ণ উপাধি, এর সঠিক মান রক্ষা করার ব্যাপারে আজ একটি মাত্র বাধা পরিলক্ষিত হচ্ছে, আর তা হচ্ছে, আজ সামগ্রিকভাবে সারা পথিবীর মুসলমানরা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা অনুসরণ ও কায়েম করার কাজ থেকে সরে দাড়িয়েছে এবং তার পরিবর্তে তারা মানব নির্মিত জীবনের ব্যবস্থা বা আইন কানুনকে গ্রহণ করেছে যা আল্লাহর কাছে কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মহান আল্লাহর পছন্দনীয় রংকে বাদ দিয়ে তারা নানা প্রকার রং-এ নিজেদেরকে রঞ্জিত করছে। আল্লাহর রং এ নিজেদেরকে রঞ্জিত করার মূল কথাটি হচ্ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহরই আনুগত্য করতে হবে। অন্য কারো আনুগত্য সেখানে অনুপ্রবেশ করতে পারে না। আনুগত্য হতে হবে কেবল আল্লাহ ও রাসূলের জন্যে । কেবলা পরিবর্তন সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ইতিপূর্বে যে কেবলার অনুসরণ করা হচ্ছিলো তার পেছনে কিছু নিগুঢ় রহস্য লুকিয়ে ছিলো যা তোমরা বুঝতে পারোনি। এরশাদ হচ্ছে, “তুমি এতোদিন যে কেবলার অনুসরণ করছিলে, আমি তার অনুসরণকে এইজন্যে নির্দিষ্ট করেছিলাম যাতে করে আমি জেনে নিতে পারি ওই সকল ব্যক্তিদেরকে, যারা আমার হুকুম পালন করা থেকে বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তাদের মধ্য থেকে কে রসূলের অনুসরণ করে ।” ওপরে বর্ণিত আয়াত থেকে আল্লাহর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে জানা যায়! আল্লাহ তায়ালা যাদেরকে ঈমানদার বলে মনযুর করে নিয়েছেন এবং তাঁর খেলাফতের দায়িত্ব দান করার জন্যে তিনি যাদেরকে পছন্দ করেছেন, তিনি চান যে তারা একমাত্র তারই হয়ে থাকুক । জাহেলিয়াতের যাবতীয় কলুষ কালিমা থেকে ও তার সকল প্রকার আকর্ষণ থেকে তারা সম্পূর্ণভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করুক । পুরাতন দিনের জাহেলিয়াতের সকল চিহ্ন ও নিদর্শন এবং তার প্রতি মনের গোপন কোণে প্রতিপালিত মোহাব্বাত বা আকর্ষণ থেকে তারা পুরোপুরিভাবে মুক্ত হয়ে যাক। জাহেলিয়াতের বিজয় পতাকাকে অতীতে যেভাবে তারা উঁচিয়ে রেখেছিলো এবং যেভাবে তার বহু নিদর্শন তাদের জীবনকে রাংগিয়ে রেখেছিলো সে সব কিছুকে ধুয়ে মুছে তারা সম্পূর্ণভাবে পাক সাফ হয়ে যাক। তাদের মন প্রাণ ও অনুভূতির মধ্যে একমাত্র আল্লাহ রসূল ও ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল বাতি জ্বলে উঠুক এবং ইসলামের চিহ্নই পরিস্ফুট হয়ে উঠুক তাদের গোটা জীবনে। ৩৬০টি মূর্তি কাবা ঘরের মধ্যে থাকার কারণে সে দিকে মুখ করে নামায পড়ার ব্যাপারে যেহেতু কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছিলো এজন্যে প্রথম প্রথম মুসলমানরা বায়তুল মাকদাসকে আল্লাহর নির্দেশে কেবলা বানিয়েছিলো ৷ কিন্তু আল্লাহ তায়ালা কিছুতেই চাননি যে তাঁর এবাদাতের জন্যে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ঘরটি মূর্তি পূজারীদের ঘর হিসেবে স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যাক। যে ঘরকে আল্লাহর ঘর হিসেবে জানার কারণে পৃথিবীর এই ঘরকেন্দ্রিক একতার সূত্রপাত করেছিলো তারা পুনরায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ুক, তাই অনতিকাল পরেই তিনি এই ঘরের দিকে মুখ করে নামায পড়ার ঘোষণা দান করলেন। এতে নবীর আনুগত্যের প্রমাণ দিয়ে মুসলমানরা জানিয়ে দিলো যে তারা সর্বাবস্থায় নবীর আনুগত্য করছে ও করবে । এইভাবে তাদের অন্তরের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠলো। যারা নিজ জাতি, গোত্র ও নিজেদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল স্থান গুলোর ব্যাপারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিলো তারাও মনে প্রশান্তি লাত করলো। এটা ছিলো ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটা জটিল মোড় ৷ সত্য কথা বলতে কি ইসলামী আকীদা বিশ্বাসের মধ্যে শেরেকের কোনো স্থান থাকতে পারে না। জাহেলী যামানার কোনো রীতিনীতি বা নোংরা জিনিসকে কোনো অবস্থাতেই উম্মাতে মুসলিমাহ মেনে নিতে পারে না, তা সে ছোটই হোক আর বড়ই হোক ৷ কোরআনে পাকের আয়াত, ‘তোমরা যে কেবলার ওপর এতোদিন প্রতিষ্ঠিত ছিলে আমি তা এ উদ্দেশ্যেই নির্ধারন করেছিলাম যেন আমি জেনে নিতে পারি কে আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় আর কে রসূলের আনুগত্য করে।’ কোনো জিনিস বাস্তবে আসার অনেক পূর্ব থেকেই আল্লাহ্ তায়ালা সে সম্পর্কে অবগত ৷ কিন্তু অবশ্যই মানুষের অন্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন কথাগুলোকে তিনি দেখে ও জেনে নিতে চান যাতে তিনি তার হিসাব নিতে পারেন৷ অবশ্য, আল্লাহ তায়ালা, আর এজন্যেই অন্তরের গোপন কন্দরে লুকিয়ে থাকা কোনো জিনিসের হিসাব তিনি নেন না বা পাকড়াও করেন না, যতক্ষণ না তা বাস্তব কার্যকলাপ আকারে প্রকাশ পেয়ে কারো ক্ষতি বা লোকসানের কারণ হয়। আল্লাহ তায়ালা ভালো করেই জানেন যে অন্তরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা কোনো নাপাক বাসনা, শিরকের প্রতি আকর্ষণ বা তার কোনো চিহ্ন যদি তার কার্যকলাপ বা ব্যবহারে প্রকাশ পায় তা ঝেড়ে মুছে ফেলা এবং তার প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া কতো কঠিন। এ কাজ তখনই সম্ভব যখন তার অন্তর-প্রাণ ঈমানের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে যায় এবং আল্লাহর তরফ থেকে তার ওপর রহমত বর্ষিত হয়। তাই আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, ‘অবশ্যই এটা বড়ো কঠিন কাজ ৷ তবে তাদের জন্যে কঠিন নয় যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা হেদায়াত দিয়েছেন ।’ যে আল্লাহর কাছ থেকে হেদায়াত পায় তার জন্যে কোনো জিনিসই কঠিন থাকে না বা কোনো বাঁধাই তাকে সঠিক পথে চলা থেকে বিরত রাখতে পারে না। আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন সঠিক পথের দিশা কারো কাছে পৌছে যায় তখন তার অন্তর-প্রাণ জাহেলিয়াতের যাবতীয় খারাবী থেকে পাক সাফ হয়ে একমাত্র আল্লাহকেন্দ্রিক হয়ে যায় এবং যখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে কোনো বার্তা পৌছে যায় তখন সে নির্দ্বিধায় তা অনুসরণ করতে শুরু করে। তার মুখকে আল্লাহ তায়ালা যে দিকে ঘুরিয়ে দেন সেই দিকেই সে ঘুরে যায় এবং রসূল তাকে যে দিকে নিয়ে যেতে চান সেই দিকেই সে যেতে থাকে। কেবলা পরিবর্তনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা পুনরায় তাদেরকে ঈমান সম্পর্কে সচেতন করছেন এবং সুন্দর সুষ্ঠুভাবে নামায কায়েমের ব্যাপারে হেদায়াত দান করছেন। বলছেন, আল্লাহ তায়ালা কিছুতেই তোমাদের ঈমানকে নষ্ট করে দিতে চান না। আল্লাহরই দেয়া মানুষের সীমিত শক্তি সম্পর্কে তিনি পুরোপুরিই অবগত ৷ কাউকে তিনি তার সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো দায়িত্বভার দেন না। ঈমানদার ব্যক্তিদেরকে তিনি সত্য সঠিকভাবে পরিচালিত করেন এবং তাদের নিয়ত সঠিক হলে সঠিক পথে চলতে তিনি তাদেরকে সাহায্যও করেন। বান্দাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে তার বিজ্ঞানসম্মত কর্মকান্ডের একটি বহিপ্রকাশ এবং তাদের সে পরীক্ষায় পাস করানো এটাও তার দয়া ও স্নেহের নমুনা । এরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চই আল্লাহ তায়ালা মানুষের প্রতি বড়ই স্নেহশীল ও অত্যস্ত করুণাময় ।” আল্লাহ্র পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি দয়া অনুগ্রহের এই ঘোষণা মানুষের অন্তর-প্রাণকে নিশ্চিন্ততা দান করে, সমস্যার জটিলতা ও অনাগত দিনের বিপদাশংকার বোঝা তার হালকা হয়ে যায়, দিশেহারা অবস্থা কেটে গিয়ে তার দিল হয়ে যায় শান্ত-নির্লিপ্ত এবং এক অনাবিল আস্থা তার মন মগযকে দিয়ে যায় প্রশান্তির দোলা ।
* গোটা মানবজাতিকে পরিচালনা করা মুসলিম জাতিরই দায়িত্ব : এরপর আলোচনার মধ্যে দেখা যায়, উম্মতে মুসলিমাহ যেন নিজেদের মান-মর্যাদা ও মানবমন্ডলীর মধ্যে তাদের সঠিক অবস্থান নিরূপণ করতে পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে আহলে কেতাবদের পূর্ববর্তী অবস্থার পরিবর্তন হয়ে তাদের যে পতন হবে- সে সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে৷ সাথে সাথে মুসলমানদের মান-মর্যাদা, কর্তব্য এবং ঈমানের দাবী পূরণের লক্ষ্যে তাদের কি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হবে তা জানানোর পর তার থেকে ফায়দা হাসিল করার জন্যে তাদের মধ্যে তীব্র আকাংখা সৃষ্টি করছেন, মুসলমানদের তিনি দুশমনের দুশমনি থেকে নিশ্চিন্ত করছেন । সুতরাং তাদের ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ কিছুই মুসলমানদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালা কখনও তাদেরকে কোনো সাহায্য করবে না। ওদের মধ্যে যারা সত্যকে অস্বীকার করেছে তাদের জন্যে রয়েছে পরকালে আগুনের আযাব, সেখানে ঈমান ও তাকওয়া ব্যতীত কোনো নেক আমলই কোনো কাজে লাগবে না। এরশাদ হচ্ছে, “তোমরা হচ্ছ সর্বোত্তম জাতি, গোটা মানবমন্ডলীকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে তোমাদেরকে বের করা হয়েছে।… বরং তারা নিজেদের ওপর নিজেরাই যুলুম করে ।” আয়াতের প্রথম অংশে যে আলোচনা এসেছে তার দ্বারা গোটা মুসলিম উম্মাহর কাধে একটি ভারী বোঝা তুলে দেয়া হয়েছে, যা তাদের মান-মর্যাদার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল এবং এ বিষয়টি মানবমন্ডলীর মধ্যে তাদের উচ্চতর অবস্থানও নিরূপণ করে। এই বিশেষ মর্যাদার একক অধিকারী একমাত্র তারাই, এ মর্যাদা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে দেয়া হয়নি। “তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, গোটা মানবমন্ডলীর জন্যে যাদের আবির্ভাব ঘটানো হয়েছে, তোমরা মানুষকে সর্বপ্রকার ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে, আর তোমরা নিজেরা আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ ঈমানদার থাকবে ।” বাক্যের মধ্যে ‘উখেরিজাত’ শব্দটিতে কর্তার উল্লেখ নেই, অর্থাৎ,কর্মবাচক পদে বাক্যটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। এ কারণে আয়াতটি গভীরভাবে চিস্তা করার দাবী রাখে এবং এতে বুঝা যাচ্ছে যে, এই মুসলিম উম্মতকে আদর্শবাদী এবং আদর্শের পতাকাবাহী জাতি হিসাবে গড়ে তোলার জন্যে এক অদৃশ্য হাত নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। রসূলুল্লাহ (স.)-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই উম্মতকে গোটা মানবমন্ডলীর পথ-প্রদর্শক বানানো হয়েছে এবং সমগ্র মানবজাতির মধ্য থেকে এদেরকে; নেতৃত্ব দান করার উদ্দেশ্যে বাছাই করে নেয়া হয়েছে। রহস্যাবৃত সে গায়েব থেকেই এদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অজানা সে রহস্যের পেছনে রয়েছে সেই চিরস্থায়ী সত্ত্বা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন, যিনি অন্তরীক্ষ থেকে সব কিছু পরিচালনা করছেন। আলোচ্য বাক্যটির মাধ্যমে জানা যায় যে, এক গোপন শক্তি সব কিছুর পেছনে অতি সূক্ষভাবে এবং সংগোপনে সর্বক্ষণ কাজ করে যাচ্ছে ক্রিয়াশীল সেই মহাশক্তি এই মহান জাতিকে পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে হাযির করেছেন যারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি যুগের সূচনা করেছে, যারা বিশ্বসভায় এক বিশিষ্টস্থান অধিকার করে রয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, “তোমরাই সেই শ্রেষ্ঠ জাতি যাদেরকে গোটা মানবমন্ডলীর জন্যে বের করা হয়েছে ।” এই কারণে মুসলিম উম্মাহকে বিশ্বের দরবারে তার মর্যাদাপূর্ণ স্থান সংরক্ষণ করতে হবে এবং সেই মর্যাদার আসনে সমাসীন হওয়ার জন্যে তার সম্মানজনক অবস্থানকে বুঝতে হবে এবং তার নিজের সঠিক পরিচয়ও জানতে হবে। তাকে আরও জানতে হবে যে, তাকে মানবতার অগ্রদূত বানানো হয়েছে এবং তাকে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব দান করা হয়েছে, সার্বিক বিবেচনায় তারাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ জাতি । আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই চান যে, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব ভালো লোকের হাতে থাক এবং মন্দ লোকের হাতে তা কখনই না যাক। একমাত্র ভালো লোকের হাতে গেলেই ভালো কাজ হওয়ার আশা করা যায়, তাই তিনি তাদেরকে বাদ দিয়ে জহেলী যুগে উত্থিত কোনো কওমের হাতে নেতৃত্ব দান করা পছন্দ করেননি। গোটা মানবজাতির সার্বিক কল্যাণের জন্যে এই আমানত চিরদিন সেই সব ঈমানদার ও বিশ্বস্ত লোকের হাতে থাকতে হবে যাদের আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা সঠিক খাতে প্রবাহিত হয়, যাদের মধ্যে সঠিক সংগঠন, সঠিক চরিত্র, সঠিক জ্ঞান সঠিক বিদ্যা ও অভিজ্ঞতা বিদ্যমান রয়েছে। এই সব গুণাবলী তার অবস্থানকে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করতে পারে এবং তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকেও সফল করে তুলতে পারে। এই সকল শুণাবলীই তার অগ্রযাত্রাকে স্থায়ী ও সুনিশ্চিত করতে পারে এবং নেতৃত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে তাকে সমাসীন করে দিতে পারে। আসলে নেতৃত্বের এই আমানত নিজস্ব গুণের দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই পাওয়ার জিনিস- এটা দাবী করে পাওয়ার বস্তু নয় এবং প্রকৃত যোগ্যতা ছাড়া কাউকে এমনি এমনিই এ দায়িত্ব দেয়াও হয় না। আন্তরিক বিশ্বাস ও সমাজ সংগঠনের গুণ হচ্ছে এর প্রধান যোগ্যতা ৷ তবে খেলাফত বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া এবং দেশ পরিচালনার জন্যে জ্ঞানগত যোগ্যতাও সমধিক জরুরী ৷ অতএব, একথা স্পষ্টভাবে বুঝা গেলো যে, এ উম্মতকে ইসলামী ব্যবস্থা কায়েম করার যে গুরুদায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালন করতে গেলে বহু জিনিসের প্রয়োজন, প্রয়োজন সেসব গুণের অধিকারী হওয়া । এসব গুণ অর্জন করতে পারলে এবং সেগুলোর দাবী পূরণ করতে পারলে অতীতের মতো আজও উম্মাতে মুসলিমাহ্র হাতে নেতৃত্বের আমানত এসে যাওয়া সুনিশ্চিত। নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় গুণাবলী : নেতৃত্বের আমানত হাসিলের জন্যে যে সব গুণের প্রয়োজন, তার প্রথমটি হচ্ছে যাবতীয় আবিলতা থেকে জীবনের পরিচ্ছন্নতা । কলুষ-কালিমা থেকে জীবনকে পবিত্র রাখা এবং বিশৃংখলা ও ভারসাম্যহীনতা থেকে তাকে মুক্ত রাখা । তারপর প্রয়োজন ‘আমর বিল মা’রূফ’ (ভালো কাজের নির্দেশ দান) ‘ওয়া নেহী আনিল মুনকার ‘ (অপ্রিয় ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা) ৷ সংক্ষেপে এই গুণগুলো থাকলে নিজেদের সেই উম্মত বা জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা সম্ভব, যাদেরকে মানবমন্ডলীর পরিচালক বানানোর জন্যে তৈরী করা হয়েছে। এই সর্বোত্তম জাতি বানিয়ে দেয়াটা কোনো চাট্টিখানি কথা নয়। কিছু সৌজন্য বিনিয়য় বা ভালোবাসা বিনোদনের গুণ অথবা স্রেফ মানুষকে আকৃষ্ট করার মতো আচার আচরণ কিংবা কথার যাদু দ্বারা মানুষকে মোহান্বিত করার যোগ্যতা দিয়েও সে মহান যোগ্যতা অর্জন করা সম্ভব নয়, যার দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদের ওপর নেতৃত্ব করা যেতে পারে। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন এমন মেকি ও ঠুনকো জিনিসের বিনিময়ে এতো বড় গুরু-দায়িত্বের বোঝা কাউকে দান করেন না। কিছু খেতাব বা সম্মানসূচক পদবী, উপাধি বা পদমর্যাদা দানের মাধ্যমেও সেই মহিমান্বিত গুণ অর্জিত হয় না, যা বিশ্বনেতৃত্বের আসল প্রয়োজন মিটাতে পারে। যেমন আহলে কেতাবরা বলতো, আমরা তো আল্লাহর ছেলে এবং তাঁর প্রিয় পাত্র । না, মোটেই ঠিক নয়, এগুলো আসলে নেতৃত্ব হাসিলের কোনো গুণ নয়। এ গুণের অধিকারী হয়ে মানবসমাজকে অপ্রিয় জিনিস থেকে রক্ষা করার জন্যে অবশ্যই ইতিবাচক কিছু ভূমিকা রাখতে হবে- ন্যায় ও সদগুণাবলীর প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব কিছুর সাথে সেই বলিষ্ঠ ঈমানের অধিকারী হতে হবে, যা ভালো কাজ করার প্রবণতাকে সুতীক্ষ্ণ করে এবং মন্দ কাজ বিদূরিত করার উদ্দেশ্যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে উদ্বৃদ্ধ করে। তাই আল্লাহ তায়ালা জানাচ্ছেন, নেতৃত্ব দানের জন্যে তোমরা অবশ্যই কল্যাণকর কাজের নির্দেশ দেবে এবং যাবতীয় অকল্যাণকর কাজ বন্ধ করার জন্যে অগ্রগামী ভুমিকা পালন করবে৷ এসব গুণাবলীর অধিকারী হওয়ার সাথে সাথে তোমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহর ওপর অবিচল বিশ্বাসী হতে হবে। সর্বোত্তম জাতি হিসাবে গড়ে ওঠার জন্যে অন্যান্য ক্লান্তি ও কন্টকাকীর্ণ পথে চলার যোগ্যতাসহ অবশ্যই এই গুণগুলো অর্জন করতে হবে, অর্থাৎ যা কিছু অন্যায়-অশোভন, ক্ষতিকর বা মন্দ তাকে রুখে দাড়াতে হবে এবং সর্বপ্রকার কল্যাণকর কাজ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং সমাজকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচারের কাজের গ্লানি থেকে পবিত্র রাখতে হবে৷ যে সকল ব্যবস্থা বিশৃংখলা বা উচ্ছৃংখলতা বয়ে আনতে পারে সেগুলোর দ্বার রুদ্ধ করে দিতে হবে, আল্লাহর দেয়া সেই জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে যার কারণে জীবন সুন্দর ও সজীব হয়ে উঠবে। সমাজ জীবনে ঈমানের অবশ্যম্ভাবী ফল হচ্ছে, এর প্রতিটি স্তরে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে মানুষের জীবনের সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং বাস্তব কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভালো ও মন্দ ব্যবস্থার পার্থক্য নির্ণয় করতে হবে, নেতৃত্ব হাসিলের জন্যে সংগঠন ও সংগঠন-পদ্ধতি এবং কিছু সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য ও তৎপরতাই যথেষ্ট নয়। গোটা সমাজের বুকে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা না করলে শুধু সংগঠন ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়া চালু করায় সাধারণভাবে অশান্তি ও বিশৃংখলা দূর করা সম্ভব নয়। অতএব, সাংগঠনিক তৎপরতার সাথে সাথে নিজ নিজ পরিবেষ্টনীতে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের প্রতিকার, গুণীজনের কদর ও হীনমন্যতা, নীচুতা ও মন্দ ব্যবৰহারকে দমন করা, ভালো কাজকে উৎসাহিত করা ও অপ্রিয় কাজগুলোকে দাবিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চালু রাখতে হবে। কারণ, যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা মানুষের গতানুগতিক ভালো মানুষীপনার থেকে তা অনেক উর্ধে । ওপরে বর্ণিত কাজ প্রতিষ্ঠা ও সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে দ্বিতীয় মাইলফলক । ঈমান বা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ওপর অবিচল বিশ্বাস ও তার শক্তি-ক্ষমতার ওপর দৃঢ আস্থা। মানবজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে স্রষ্টার সাথে তার সঠিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। প্রকৃতপক্ষে ঈমান এই কাজটাই করাতে চায়। এটিই মানবজীবনের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং সৃষ্টিজগতে তার প্রকৃত কাজ ও কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য এই-ই ৷ সাধারণত এই চিত্তাধারা থেকেই নৈতিক চরিত্রের মূলনীতি উদগত হয় এবং এইসব মূলনীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর গযব ও আযাব থেকে রেহাই পাওয়ার আশা করা যায়। ব্যক্তি ও সমাজজীবনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করার দৃঢ় সংকল্প সেসব মূলনীতি জাগ্ৰত রাখার ওপরেই নির্ভর করে। তারপর ঈমানের এটাও অন্যতম দাবী যে, প্রত্যেক মোমেন অন্য মানুষকে ভালোর দিকে ডাকবে, যার জন্যে বলা হয়েছে, ‘তারা নেক কাজের প্রতি আহ্বানকারী এবং মন্দ কাজের প্রতিরোধকারী ।’ তাদের কর্তব্য হচ্ছে তাদের সে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে এবং এ পথের সকল কষ্ট তাদের বরদাশত করতে হবে৷ তারা যালেম ও অহংকারী শাসকের মুখোমুখী দাড়িয়ে হক কথা বলে, আর যখন উদভ্রান্ত যৌবন তাদেরকে পাগল করে তোলে তখন তারা দুরন্ত যৌন কামনা-বাসনার মোকাবেলা করে, মোকাবেলা করে নানা প্রকার লোভ-লালসা ও উস্কানির ৷ এর ফলে তাদের ঈমান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় । সবকিছুর মোকাবেলা করার জন্যে ঈমানী শক্তিই আসলে তাকে প্রস্তুত করে। তাদের সাহায্যকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ সোবহানাহু ওয়া তায়ালা । সব সত্যের ওপর একথা সত্য যে, ঈমান ব্যতীত অন্য সব কিছুই একদিন ফুরিয়ে যাবে এবং ঈমানের প্রস্তুতি ব্যতীত অন্যান্য সকল প্রস্তুতি মায়া-মরীচিকাসম ও পথভ্রষ্ঠকারী । আল্লাহর সাহায্য ছাড়া অপর সকল সাহায্য খোকলা বা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো । মুসলিম জামায়াতের একটি বড় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে প্রত্যেক মুসলিম জনপদ থেকে একটি দলকে অবশ্যই ইসলামের দাওয়াত দান করার জন্যে আশেপাশের এলাকা ও দেশগুলোতে প্রেরণ করতে হবে । এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ ইতিমধ্যে অন্যস্থানে এসে গেছে। এই দাওয়াত দানকারীরা মানুষকে কল্যাণকর কাজের নির্দেশ দেবে এবং অকল্যাণকর কাজ থেকে বিরত রাখবে । এ দূরূহ কাজের সময় তাদের একমাত্র হাতিয়ার ও রসদ হবে আল্লাহর ওপর ঈমান । ঈমানের এ হাতিয়ার মজুদ থাকলে তাদের কাছে অন্য সবাই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে, এর অভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা আসবে না এবং ইসলামের গুণাবলীও তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে না। একথার সপক্ষে কোরআনের বিভিন্ন স্থানে অনেক কথা এসেছে, যথাস্থানে আলোচনার জন্যে আমরা এখানে এ প্রসংগের অবতারণা করছি না। হাদীস শরীফেও রসূল(স.)-এর নির্দেশবহনকারী একদল লোকের খবর জানা যায়, আমরা এ বিষয়ের কয়েকটি হাদীস এখানে তুলে ধরছি, ১. আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ(স.)-কে বলতে শুনেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোনো অন্যায় কাজ দেখে, তাহলে তার কর্তব্য হবে, সে যেন শক্তি দিয়ে তা দূর করে, যদি না পারে, তাহলে যেন সে তার জিহ্বা (কথা) দ্বারা তা দূর করে এবং এতোটুকু করার শক্তি-ক্ষমতাও যদি তার না থাকে, তাহলে সে যেন তার অন্তরে তা (ঘৃণা) করে। আর এটা তার দুর্বলতম ঈমানের পরিচয় বহনকারী হবে । (মুসলিম) ২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স.) এরশাদ করেছেন, বনী ইসরাঈল জাতি অন্যায় ও গুনাহের মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়লে তাদের মধ্যকার ওলামায়ে কেরাম প্রথমে তাদেরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন এবং সে সব অন্যায় কাজ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু তারা অন্যায় কাজ থেকে বিরত না হলেও সেই আলেমরা তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে উঠাবসা করতে থাকে, খাওয়া দাওয়ার অনুষ্ঠানেও তারা তাদের সাথে শরীক হয়, এর ফলে তাদের অন্তরগুলো একে অপরের ওপর প্রভাব ফেলতে থাকে এবং অন্যায়কারীদের সাথে মিশে যাওয়ার কারণে দাউদ সোলায়মান ও মূসা (আ.) তাদের ভাষায় তাদের ওপর অভিসম্পাত দেয়া হয়। এতটুকু বলার পর রসূলুল্লাহ (স.) উঠে সোজা হয়ে বসলেন। এর আগে তিনি ঠেস দিয়ে বসেছিলেন। তারপর বললেন, ‘না, তাদের সাথে কিছুতেই মেলামেশা করা যাবে না যতোক্ষণ পর্যন্ত না তাদেরকে বাকিয়ে সোজা পথে নিয়ে আসবে, অর্থাৎ মন্দ পথ থেকে ফিরিয়ে না আনবে ।’ ৩. হোযায়ফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (স.) এরশাদ করেছেন, যার হাতে আমার জীবন নিবন্ধ রয়েছে, তার কসম থেয়ে আমি বলছি, অবশ্যই তোমরা ভালো কাজের নির্দেশ দেবে এবং মন্দ কাজ করতে মানুষকে নিষেধ করবে, তা না হলে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি এ কাজ না করার শাস্তি স্বরূপ গযব নাযিল করবেন বলে আশংকা রয়েছে। তখন তোমরা দোয়া করতে থাকবে, কিন্তু তোমাদের দোয়া তিনি কবুল করবেন না। (তিরমিযী) ৪. উরস ইবনে উমায়রাতুল কুন্দী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (স.) এরশাদ করেছেন, পৃথিবীতে কোনো অন্যায় সংঘটিত হতে থাকলে কেউ যদি তা দেখে ও অপছন্দ করে তাহলে তার অবস্থা সেই ব্যক্তির মতো, যে এই ঘটনা থেকে দূরে রয়েছে, আর যে ব্যক্তি দূরে থেকেও সে অন্যায় সম্পর্কে জানলো ও সন্তুষ্টচিত্তে তাকে মেনে নিলো তার অবস্থা হবে সেই ব্যক্তির মতো, যে এই অন্যায়কে প্রত্যক্ষ করলো অথচ কোনো প্রতিবাদ করলো না। (আবু দাউদ) ৫. আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, রসূলুল্লাহ (স.) এরশাদ করেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ জেহাদ হচ্ছে যালেম শাসকের সামনে ‘হক’ কথা বলা । (আবু দাউদ ও তিরমিযী) ৬. জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, শহীদদের এক নেতা হচ্ছেন হামযাহ আর এক নেতা সেই ব্যক্তি, যে যালেম শাসকের সামনে দাড়িয়ে হক কথা বলে, তাকে জোরালোভাবে ভালো কাজ করতে বলে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত হতে বলে, ফলে সে যালেম তাকে শাসক কতল করে দেয়। (হাকেম) এগুলো ছাড়াও এ সম্পর্কে আরও বহু হাদীস আছে, যেগুলোর প্রত্যেকটি মুসলিম জনপদের মধ্যে এই কর্তব্যবোধ পয়দা করার জন্যে প্রেরণা জুগিয়েছে তাছাড়া মুসলমানদের অস্তিত্বের জন্যেও এই কর্তব্য পালন করা জরুরী ৷ অবশ্য এজন্যে ব্যাপক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন ৷ এ সম্পর্কিত কোরআনের শিক্ষা প্রচুর পরিমাণ থাকা সত্ত্বেও আমরা সাধারণভাবে তা থেকে গাফেল হয়ে আছি। তার তাৎপর্য আমরা যথাযথভাবে বুঝতে পারি না। (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্যে মোহাম্মদ কুতুব প্রণীত কেতাব ‘ক্কাবাসাতুম্ মিনার্ রসূল’ ‘ক্কাবলা আন্ তাদউনী উজীবু।’ পড়ুন প্রকাশনা দারুশ শারুক্ব বৈরুত) আহলে কিতাবদের চরিত্র : এবার আমরা ফিরে যাবো এই বিষয়ে আয়াতটির দ্বিতীয় অংশের আলোচনায় “আহলে কেতাবরা যদি ঈমান আনত তাহলে সেটা তাদের জন্যে কল্যাণকরই হতো । তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে মোমেন ৷ কিন্তু তাদের অধিকাংশই হচ্ছে ফাসেক ।” আয়াতের এই অংশে বর্ণিত কথাগুলোর মাধ্যমে আহলে কেতাবদের ঈমান আনার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এখানে এই যে কথা ‘ফাহুয়া খাউরুল্ লাহুম’ তাদের জন্যে সেটা কল্যাণকর, এ বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে থাকার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে এবং সেই সমস্ত দলাদলির কোন্দল থেকে রেহাই পাবে, যার মধ্যে তারা বিশ্বাসগত চিন্তার বিভিন্নতা হেতু আকণ্ঠ ডুবে ছিলো ৷ এই সব দলীয় কোন্দল তাদেরকে বিচ্ছিন্নতা পরিহার করে একদলে কোনোদিনই একদলে পরিণত করতে পারেনি। তাদের এই সব বিভিন্ন চিন্তাধারা তাদের সামাজিক জীবনের জন্যে একটি সমন্বিত আইন-কানুন বা ব্যবস্থা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এক হয়ে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠনে পরিণত হতে পারেনি। কারণ, তাদের কোনো কিছুরই স্থায়ী ভিত্তি ছিলো না। যা ছিলো তা একটা খোঁড়া বাবস্থায় হাওয়ায় ভাসমান এক তরী, যার কোনো স্থায়িত্ব নেই। অন্যান্য মানব-নির্মিত মতবাদের মতোই ছিলো তাদের সমাজ-সংগঠনের বিধি-বিধান । সেগুলো পথহারা ও সমস্যাজর্জরিত মানুষকে কোনো পথ দেখাতে না পারায় গোটা মানবসমাজের সমস্যাসমূহের কোনো স্থায়ী সমাধান তারা দিতে পারেনি সৃষ্টিকুলের মধ্যে তাদের বিশিষ্ট মর্যাদাই বা কিসের জন্যে এবং তাদের এমন কি কি সুকীর্তি আছে যার কারণে আখেরাতে তারা মুক্তি পাওয়ার আশা করতে পারে! তারপর তাদের অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে বলা হচ্ছে, নেককার মানুষকে তাদের সুকীর্তির ন্যায্য বিনিময় থেকে কিছুমাত্র কম দেয়া হবে না। এরশাদ হচ্ছে, “ওদের মধ্যে কিছু সংলোক আছে, কিন্তু ওদের অধিকাংশ লোকই হচ্ছে ফাসেক ” অর্থাৎ গুরুতর অপরাধপ্রবণ, নানা প্রকার অপরাধে লিপ্ত। সত্য বলতে কি সে আহলে কেতাবদের মধ্যে একদল সত্যপন্থী ও সত্যাশ্রয়ী লোকও ছিলো ৷ এরা সুন্দরভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলো এবং অত্যন্ত ভালো মুসলমানে পরিণত হয়েছিলো । এ লোকগুলো হলেন, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম, আসাদ ইবনে উবায়েদ, সা’রাবা ইবনে শু’বা এবং কা’ব ইবনে মালেক ৷ আলোচ্য আয়াতে তাদের বিস্তারিত বিবরণও আসছে, তারা নিজ নিজ নবীর সাথে ওয়াদা করেছিলো যে, তাঁদের ভাই যখন তাঁর সে আদর্শ ও শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীকালে আসবেন তখন তারা তার প্রতি ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যখন আল্লাহর দ্বীন নিয়ে শেষ নবী এসে গেলেন তখন তাদের কিছু লোক বাদে অনেকেই এই অজুহাতে তার আনীত জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করতে রাযি হলো না যে, তিনি বনী ইসরাঈল বংশে জন্মগ্রহণ করেননি। এইভাবে তারা এই রসূলের আনুগত্য মেনে নিতে তারা অস্বীকৃতি জানালো । এ সময়ে মুসলমানদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক মদীনার ইহুদীদের সাথে আপত্তিকরভাবে গোপন সম্পর্ক স্থাপন করে চলেছিলো। তারা মনে করত ইহুদীরা একটি মযবুত শক্তি, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তারা অত্যন্ত সমৃদ্ধ । এই সময়কার তাদের এই দুর্বল অবস্থার ছবি তুলে ধরতে গিয়ে কোরআনে করীম ঘোষণা করছে যে, তারা মহা অপরাধী ফাসেক, যদিও তারা মুসলমান বলে পরিচিত । আল্লাহর রসূল(স.)-এর বিনা অনুমতিতে কাফেরদের সাথে সম্পর্ক রাখার কারণে কোরআন তাদেরকে নাফরমান, কাফের ও ফাসেক বলে অভিহিত করা হয়েছে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# সাহায্যপ্রার্থী তো দুর্বল হবার কারণেই তার চাইতে উচ্চতর কোন শক্তির কাছে সাহায্য চাচ্ছে। কিন্তু এ উদ্দেশ্যে সে যাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে তাদের দুর্বলতার অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা একটি মাছির কাছেও হার মানে। এখন তাদের দুর্বলতার অবস্থা চিন্তা করো যারা নিজেরাও দুর্বল এবং যাদের ওপর নির্ভর করে তাদের আশা-আকাংখা-বাসনাগুলো দাঁড়িয়ে আছে তারাও দুর্বল।
# এর অর্থ হচ্ছে, মুশরিকরা সৃষ্টিকূলের মধ্য থেকে যেসব সত্তাকে উপাস্যে পরিণত করেছে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি হচ্ছে ফেরেশতা বা নবী। তারা শুধুমাত্র আল্লাহর বিধান পৌঁছে দেবার মাধ্যম। এর বেশী তাদের অন্য কোন মর্যাদা নেই। আল্লাহ তাদেরকে শুধুমাত্র এ কাজের জন্যই বাছাই করে নিয়েছেন। নিছক এতটুকুন মর্যাদা তাদেরকে প্রভু বা প্রভুত্বের ব্যাপারে আল্লাহর সাথে শরীকে পরিণত করে না।
# কুরআন মজীদে এ বাক্যটি সাধারণত শাফায়াতের মুশরিকী ধারণা খণ্ডন করার জন্য বলা হয়ে থাকে। কাজেই এ স্থানে একে পেছনের বাক্যের পরে বলার এ অর্থ দাঁড়ায় যে, ফেরেশতা, নবী ও সৎলোকদেরকে অভাবপূরণকারী ও কার্য উদ্ধারকারী মনে না করেও যদি আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী মনে করেও তোমরা পূজা-অর্চনা করো তাহলে তাও ঠিক নয়। করণ একমাত্র আল্লাহই সবকিছু দেখেন ও শোনেন। প্রত্যেক ব্যক্তির প্রকাশ্য ও গোপন অবস্থা একমাত্র তিনিই জানেন। দুনিয়ার প্রকাশ্য ও গোপন কল্যাণ-অকল্যাণের বিষয়াবলী একমাত্র তিনিই জানেন। ফেরেশতা ও নবীসহ কোন সৃষ্টিও ঠিকভাবে জানে না কোন্ সময় কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয়। কজেই আল্লাহ তাঁর সবচেয়ে নিকটবর্তী সৃষ্টিকেও এ অধিকার দেননি যে, সে তাঁর অনুমতি ছাড়া নিজের ইচ্ছামতো যে কোন সুপারিশ করে বসবে এবং তার সুপারিশ গৃহীত হয়ে যাবে।
# বিষয়াবলীর পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান সম্পূর্ণরূপে তাঁর ক্ষমতাধীন। বিশ্ব-জাহানের ছোট বড় কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপক ও পরিচালক অন্য কেউ নয়। কাজেই নিজের আবেদন নিবেদন নিয়ে অন্য কারো কাছে যাবার কোন প্রশ্ন ওঠে না। প্রত্যেকটি বিষয় ফায়সালার জন্য আল্লাহর সামনেই উপস্থাপিত হয়। কাজেই কোন কিছুর জন্য আবেদন করতে হলে তাঁর কাছেই করো। যেসব সত্তা নিজেদেরই অভাব ও প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে না তাদের মতো ক্ষমতাহীনদের কাছে কি চাও?
# এ নীতি অবলম্বন করলে সফলতার আশা করা যেতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি এ নীতি অবলম্বন করবে তার নিজের কার্যক্রমের ব্যাপারে এমন অহংকার থাকা উচিত নয় যে, সে যখন এত বেশী ইবাদাতগুজার ও নেককার তখন সে নিশ্চয়ই সফলকাম হবে। বরং তার আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থী হওয়া এবং তাঁরই রহমতের সাথে সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা বিজড়িত করা উচিত। তিনি সফলতা দান করলেই কোন ব্যক্তি সফলতা পেতে পারে। নিজে নিজেই সফলতা লাভ করার সামর্থ্য কারো নেই।
“হয়তো তোমাদের ভাগ্যে সফলতা আসবে” —এ বাক্যটি বলার অর্থ এ নয় যে, এ ধরনের সফলতা লাভ করার বিষয়টি সন্দেহপূর্ণ। বরং এটি একটি রাজকীয় বর্ণনা পদ্ধতি। বাদশাহ যদি তাঁর কোন কর্মচারীকে বলেন, অমুক কাজটি করো, হয়তো তুমি অমুক পদটি পেয়ে যাবে, তখন কর্মচারীর গৃহে খুশীর বাদ্য বাজতে থাকে। কারণ এর মধ্যে রয়েছে আসলে একটি প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত। কোন সদাশয় প্রভুর কাছ থেকে কখনো এটি আশা করা যেতে পারে না যে, কোন কাজের পুরস্কার স্বরূপ কাউকে তিনি নিজেই কিছু দান করার আশা দেবেন এবং তারপর নিজের বিশ্বস্ত সেবককে হতাশ করবেন।
ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ, আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহ্— এর মতে সূরা হজ্জের এ আয়াতটিও সিজদার আয়াত। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা, ইমাম মালেক, হাসান বসরী, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, সাঈদ ইবনে জুবাইর, ইবরাহীম নাখঈ ও সুফিয়ান সওরী এ জায়গায় তেলাওয়াতের সিজদার প্রবক্তা নন। উভয় পক্ষের যুক্তি প্রমাণ আমি এখানে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি।
প্রথম দলটির প্রথম যুক্তিটির ভিত্তি হচ্ছে আয়াতের বাহ্যিক অর্থ। যাতে সিজদার হুকুম দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে উকবাহ ইবনে আমেরের (রা.) রেওয়ায়াত। আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মারদুইয়া ও বাইহাকী এটি উদ্ধৃত করেছেন। বলা হয়েছেঃ
قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفُضِّلَتْ سُورَةُ الْحَجِّ عَلَى سَائِرِ الْقُرْآنِ بِسَجْدَتَيْنِ قَالَ نَعَمْ فَمَنْ لَمْ يَسْجُدْهُمَا فَلاَ يَقْرَأْهُمَا
“আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! সূরা হজ্জ কি সমগ্র কুরআনের ওপর এ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে যে, তার মধ্যে দু’টি সিজদা আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ; কাজেই যে সেখানে সিজদা করবে না সে যেন তা না পড়ে।”
তৃতীয় যুক্তি হচ্ছে, আবু দাউদ ও ইবনে মাজার হাদীস, যাতে আমর ইবনুল আস (রা.) বলছেন, নবী ﷺ তাঁকে সূরা হজ্জের দু’টি সিজদা শিখিয়েছিলেন। চতুর্থ যুক্তি হচ্ছে, হযরত উমর (রা.), উসমান (রা.), আলী (রা.), ইবনে উমর (রা.), ইবনে আব্বাস (রা.), আবুদ দারদা (রা.), আবু মূসা আশআরী (রা.) ও আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) থেকে একথা উদ্ধৃত হয়েছে যে, সূরা হজ্জে দু’টি সিজদা আছে।
দ্বিতীয় দলের যুক্তি হচ্ছে, আয়াতে নিছক সিজদার হুকুম নেই বরং একসাথে রুকূ’ ও সিজদা করার হুকুম আছে আর কুরআনে যখনই রুকূ’ ও সিজদা মিলিয়ে বলা হয়, তখনই এর অর্থ হয় নামায। তাছাড়া রুকূ’ ও সিজদার সম্মিলিত রূপ একমাত্র নামাযের মধ্যেই পাওয়া যায়। উকবা ইবনে আমেরের (রা.) রেওয়ায়াত সম্পর্কে তারা বলেন, এর সনদ দুর্বল। একে ইবনে লাহীআহ বর্ণনা করেছেন আবুল মাস’আব বাসরী থেকে এবং এরা দু’জনই যঈফ তথা অনির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী। বিশেষ করে আবু মাস’আব তো এমন এক ব্যক্তি যিনি হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের সাথে ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে কা’বা ঘরের ওপর পাথর বর্ষণ করেছিলেন। আমর ইবনুল আস (রা.) বর্ণিত রেওয়ায়াতটিকেও তাঁরা নির্ভরযোগ্য নয় বলে গণ্য করেছেন। কারণ এটি সাঈদুল আতীক রেওয়ায়াত করেছেন আবুদল্লাহ ইবনে মুনাইন আল কিলাবী থেকে। এরা দু’জনই অপরিচিত। কেউ জানে না এরা কারা এবং কোন পর্যায়ের লোক ছিল। সাহাবীদের উক্তি সম্পর্কে তারা বলেন, ইবনে আব্বাস সূরা হজ্জে দু’টি সিজদা হবার এই পরিষ্কার অর্থ বলেছেন যে, الاولى عزمة والاخرة تعليم অর্থাৎ প্রথম সিজদা অপরিহার্য এবং দ্বিতীয়টি শিক্ষামূলক।
# জিহাদ মানে নিছক রক্তপাত বা যুদ্ধ নয় বরং এ শব্দটি প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব এবং চূড়ান্ত চেষ্টা চালানো অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আবার জিহাদ ও মুজাহিদের মধ্যে এ অর্থও রয়েছে যে, বাধা দেবার মতো কিছু শক্তি আছে যেগুলোর মোকাবিলায় এই প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম কাম্য। এই সঙ্গে “ফিল্লাহ” (আল্লাহর পথে) শব্দ এ বিষয়টি নির্ধারিত করে দেয় যে, বাধাদানকারী শক্তিগুলো হচ্ছে এমনসব শক্তি যেগুলো আল্লাহর বন্দেগী, তাঁর সন্তুষ্টি লাভ ও তাঁর পথে চলার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের উদ্দেশ্য হয় তাদের বাধা ও প্রতিবন্ধকতাকে প্রতিহত করে মানুষ নিজেও আল্লাহর যথাযথ বন্দেগী করবে এবং দুনিয়াতেও তাঁর কালেমাকে বুলন্দ এবং কুফর ও নাস্তিক্যবাদের কালেমাকে নিম্নগামী করার জন্য প্রাণপাত করবে। মানুষের নিজের “নফসে আম্মারা” তথা বৈষয়িক ভোগলিপ্সু ইন্দ্রিয়ের বিরুদ্ধে এ মুজাহাদা ও প্রচেষ্টার প্রথম অভিযান পরিচালিত হয়। এ নফসে আম্মারা সবসময় আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে এবং মানুষকে ঈমান ও আনুগত্যের পথ থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা চালায়। তাকে নিয়ন্ত্রিত ও বিজিত না করা পর্যন্ত বাইরে কোন প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের সম্ভাবনা নেই। তাই এক যুদ্ধ ফেরত গাজীদেরকে নবী ﷺ বলেনঃ
قَدَّمْتُمْ خَيْرَ مَقْدَمٍ مِنْ الْجِهَادِ الَاصْغَرِ اِلَى الْجِهَادِ الَاكْبَرِ
“তোমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে এসে গেছো।”
আরো বলেন, مجاهدة العبد هواه “মানুষের নিজের প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম।” এরপর সারা দুনিয়াই হচ্ছে জিহাদের ব্যাপকতর ক্ষেত্র। সেখানে কর্মরত সকল প্রকার বিদ্রোহাত্মক, বিদ্রোহোদ্দীপক ও বিদ্রোহোৎপাদক শক্তির বিরুদ্ধে মন, মস্তিষ্ক, শরীর ও সম্পদের সমগ্র শক্তি সহকারে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালানোই হচ্ছে জিহাদের হক আদায় করা, যার দাবী এখানে করা হচ্ছে।
# উপরে যে খিদমতের কথা বলা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির মধ্য থেকে তোমাদেরকে তা সম্পাদন করার জন্য বাছাই করে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়বস্তটি কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন সূরা বাকারায় বলা হয়েছেঃ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا ( ১৪৩ আয়াত ) এবং সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছেঃ كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ ( ১১০ আয়াত )
# সুরা: আলে-ইমরান
আয়াত নং :-১১০
كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ١ؕ وَ لَوْ اٰمَنَ اَهْلُ الْكِتٰبِ لَكَانَ خَیْرًا لَّهُمْ١ؕ مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ اَكْثَرُهُمُ الْفٰسِقُوْنَ
এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম দল। তোমাদের কর্মক্ষেত্রে আনা হয়েছে মানুষের হিদায়াত ও সংস্কার সাধনের জন্য। তোমরা নেকীর হুকুম দিয়ে থাকো, দুষ্কৃতি থেকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনো। এই আহলি কিতাবরা ঈমান আনলে তাদের জন্যই ভালো হতো। যদিও তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক ঈমানদার পাওয়া যায়; কিন্তু তাদের অধিকাংশই নাফরমান।
# ইতিপূর্বে সূরা বাকারার ১৭ রুকূ’ তে যে কথা বলা হয়েছিল এখানেও সেই একই বিষয়বস্তুর অবতারণা করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদের বলা হচ্ছে, নিজেদের অযোগ্যতার কারণে বনী ইসরাঈলদেরকে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও পথপ্রদর্শনের যে আসন থেকে বিচ্যুত করা হয়েছে সেখানে এখন তোমাদেরকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ নৈতিক চরিত্র ও কার্যকলাপের দিক দিয়ে এখন তোমরাই দুনিয়ায় সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী। সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য যেসব গুণাবলীর প্রয়োজন সেগুলো তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে ন্যায় ও সৎবৃত্তির প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায় ও অসৎবৃত্তির মূলোৎপাটন করার মনোভাব ও কর্মস্পৃহা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এই সঙ্গে তোমরা এক ও লা-শরীক আল্লাহকেও বিশ্বাসগত দিক দিয়ে এবং কার্যতও নিজেদের ইলাহ, রব ও সর্বময় প্রভু বলে স্বীকার করে নিয়েছো। কাজেই এ কাজের দায়িত্ব এখন তোমাদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তোমরা নিজেদের দায়িত্ব অনুধাবন করো এবং তোমাদের পূর্ববর্তীরা যেসব ভুল করে গেছে তা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখো।
# এখানে আহলি কিতাব বলতে বনী ইসরাঈলকে বুঝানো হয়েছে।
এখানে একথাটিও জানিয়ে দেয়া সঙ্গত মনে করি যে, সাহাবায়ে কেরামের মর্যাদা যেসব আয়াতের মাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং যেসব আয়াতের মাধ্যমে সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে বিদ্রূপ ও দোষারোপকারীদের ভ্রান্তি প্রমাণিত হয় এ আয়াতটি সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত। একথা সুস্পষ্ট যে, এ আয়াতে সরাসরি সাহাবায়ে কেরামকে সম্বোধন করা হয়েছে, অন্য লোকদের প্রতি সম্বোধন মূলত তাঁদেরই মাধ্যমে করা হয়েছে।
# পূর্ববর্তী উম্মতদের ফকীহ, ফরিশী ও পাদরীরা তাদের ওপর যেসব অপ্রয়োজনীয় ও অযথা নীতি-নিয়ম চাপিয়ে দিয়েছিল সেগুলো থেকে তোমাদেরকে মুক্ত করে দিয়েছেন। এখানে চিন্তা-গবেষণার ওপর এমন কোন বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়নি যা তাত্ত্বিক উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। আবার বাস্তব কর্মজীবনেও এমন বিধি-নিষেধের পাহাড় দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়নি যা সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নের পথ রুদ্ধ করে দেয়। তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে একটি সহজ-সরল বিশ্বাস ও আইন। এ নিয়ে তোমরা যতদূর এগিয়ে যেতে চাও এগিয়ে যেতে পারো। এখানে যে বিষয়বস্তুটিকে ইতিবাচক ভংগীতে বর্ণনা করা হয়েছে সেটি আবার অন্যত্র উপস্থাপিত হয়েছে নেতিবাচক ভংগীতে। যেমন-
يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ
“এ রসূল তাদেরকে পরিচিত সৎকাজের হুকুম দেয় এবং এমন সব অসৎকাজ করতে তাদেরকে নিষেধ করেন যেগুলো করতে মানবিক প্রকৃতি অস্বীকার করে আর এমন সব জিনিস তাদের জন্য হালাল করে যেগুলো পাক-পবিত্র এবং এমন সব জিনিস হারাম করে যেগুলো নাপাক ও অপবিত্র। আর তাদের ওপর থেকে এমন ভারী বোঝা নামিয়ে দেয়, যা তাদের ওপর চাপানো ছিল এবং এমন সব শৃংখল থেকে তাদেরকে মুক্ত করে যেগুলোয় তারা আটকে ছিল।” ( আ’রাফঃ১৫৭ )
# যদিও ইসলামকে ইবরাহীমের মিল্লাতের ন্যায় নূহের মিল্লাত, মূসার মিল্লাত ও ঈসার মিল্লাত বলা যেতে পারে কিন্তু কুরআন মজীদে বার বার একে ইবরাহীমের মিল্লাত বলে তিনটি কারণে এর অনুসরণ করার দাওয়াত দেয়া হয়েছে। এক, কুরআনের বক্তব্যের প্রথম লক্ষ্য ছিল আরবরা, আর তারা ইবরাহীমের সাথে যেভাবে পরিচিত ছিল তেমনটি আর কারো সাথে ছিল না। তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আকীদা-বিশ্বাসে যার ব্যক্তিত্বের প্রভাব সর্বব্যাপী ছিল তিনি ছিলেন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। দুই, হযরত ইবরাহীমই এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যাঁর উন্নত চরিত্রের ব্যাপারে ইহুদী, খৃস্টান, মুসলমান, আরবীয় মুশরিক ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবেয়ী তথা নক্ষত্র পূজারীরা সবাই একমত ছিল। নবীদের মধ্যে দ্বিতীয় এমন কেউ ছিলেন না এবং নেই যার ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারে। তিন, হযরত ইবরাহীম এসব মিল্লাতের জন্মের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছেন। ইহুদীবাদ,খৃস্টবাদ ও সাবেয়বাদ সম্পর্কে তো সবই জানে যে, এগুলো পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত হয়েছে আর আরবীয় মুশরিকদের ব্যাপারে বলা যায়, তারা নিজেরাও একথা স্বীকার করতো যে, তাদের সমাজে মূর্তি পূজা শুরু হয় আমর ইবনে লুহাই থেকে। সে ছিল বনী খুযা’আর সরদার। মা’আব (মাওয়াব) এলাকা থেকে সে ‘হুবুল’ নামক মূর্তি নিয়ে এসেছিল। তার সময়টা ছিল বড় জোর ঈসা আলাইহিস সালামের পাঁচ-ছ’শ বছর আগের। কাজেই এ মিল্লাতটিও হযরত ইবরাহীমের শত শত বছর পরে তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় কুরআন যখন বলে এ মিল্লাতগুলোর পরিবর্তে ইবরাহীমের মিল্লাত গ্রহণ করো তখন সে আসলে এ সত্যটি জানিয়ে দেয় যে, যদি হযরত ইবরাহীম সত্য ও হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে থাকেন এবং এ মিল্লাতগুলোর মধ্য থেকে কোনটিরই অনুসারী না থেকে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর মিল্লাতই প্রকৃত সত্য মিল্লাত। পরবর্তীকালের মিল্লাতগুলো সত্য নয়। আর মুহাম্মাদ ﷺ এ মিল্লাতের দিকেই দাওয়াত দিচ্ছেন। আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা ১৩৪ – ১৩৫ , সূরা আলে ইমরান ৫৮ , ৭৯ এবং সূরা আন নহল ১২০ টীকা।
# “তোমাদের” সম্বোধনটি শুধুমাত্র এ আয়াতটি নাযিল হবার সময় যেসব লোক ঈমান এনেছিল অথবা তারপর ঈমানদারদের দলভুক্ত হয়েছিল তাদের উদ্দেশ্যে করা হয়নি বরং মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকেই যারা তাওহীদ, আখেরাত, রিসালাত ও আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী দলভুক্ত থেকেছে তাদের সবাইকেই এখানে সম্বোধন করা হয়েছে। এখানে মূল বক্তব্য হচ্ছে, এ সত্য মিল্লাতের অনুসারীদেরকে কোনদিন “নূহী” “ইবরাহিমী”, “মূসাভী” বা “মসীহী” ইত্যাদি বলা হয়নি বরং তাদের নাম “মুসলিম (আল্লাহর ফরমানের অনুগত) ছিল এবং আজো তারা “মুহাম্মাদী” নয় বরং মুসলিম। একথাটি না বুঝার কারণে লোকদের জন্য এ প্রশ্নটি একটি ধাঁধার সৃষ্টি করে রেখেছে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীদেরকে কুরআনের পূর্বে কোন্ কিতাবে মুসলিম নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল?
# ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল বাকারাহ ১৪৪ টীকা । এর চাইতেও বিস্তারিত আকারে এ বিষয়টি আমার “সত্যের সাক্ষ্য” বইতে আলোচনা করেছি।
# অন্য কথায় মজবুতভাবে আল্লাহকে আঁকড়ে ধরো। পথনির্দেশনা ও জীবন যাপনের বিধান তাঁর কাছ থেকেই নাও। তাঁরই আনুগত্য করো। তাঁকেই ভয় করো। আশা-আকাংখা তাঁরই সাথে বিজড়িত করো। সাহায্যের জন্য তাঁরই কাছে হাত পাতো। তাঁরই সত্তার ওপর নির্ভর করে তাওয়াক্কুল ও আস্থার বুনিয়াদ গড়ে তোলো।
# সুরা: আল-বাক্বারাহ
আয়াত নং :-১৪৩
وَ كَذٰلِكَ جَعَلْنٰكُمْ اُمَّةً وَّسَطًا لِّتَكُوْنُوْا شُهَدَآءَ عَلَى النَّاسِ وَ یَكُوْنَ الرَّسُوْلُ عَلَیْكُمْ شَهِیْدًا١ؕ وَ مَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِیْ كُنْتَ عَلَیْهَاۤ اِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ یَّتَّبِعُ الرَّسُوْلَ مِمَّنْ یَّنْقَلِبُ عَلٰى عَقِبَیْهِ١ؕ وَ اِنْ كَانَتْ لَكَبِیْرَةً اِلَّا عَلَى الَّذِیْنَ هَدَى اللّٰهُ١ؕ وَ مَا كَانَ اللّٰهُ لِیُضِیْعَ اِیْمَانَكُمْ١ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ
আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মাতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা দুনিয়াবাসীদের ওপর সাক্ষী হতে পারো এবং রসূল হতে পারেন তোমাদের ওপর সাক্ষী। প্রথমে যে দিকে মুখ করে তুমি নামায পড়তে, তাকে তো কে রসূলের অনুসরণ করে এবং কে উল্টো দিকে ফিরে যায়, আমি শুধু তা দেখার জন্য কিব্লাহ নির্দিষ্ট করেছিলাম। এটি ছিল অত্যন্ত কঠিন বিষয়, তবে তাদের জন্য মোটেই কঠিন প্রমাণিত হয়নি যারা আল্লাহর হিদায়াত লাভ করেছিল। আল্লাহ তোমাদের এই ঈমানকে কখনো নষ্ট করবেন না। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, তিনি মানুষের জন্য অত্যন্ত স্নেহশীল ও করুণাময়।
# এটি হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের নেতৃত্বের ঘোষণাবানী। ‘এভাবেই’ শব্দটির সাহায্যে দু’দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। একঃ আল্লাহর পথ প্রদর্শনের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যার ফলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যকারীরা সত্য-সরল পথের সন্ধান পেয়েছে এবং তারা উন্নতি করতে করতে এমন একটি মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে যেখানে তাদেরকে ‘মধ্যপন্থী উম্মাত’ গণ্য করা হয়েছে। দুইঃ এ সাথে কিব্লাহ পরিবর্তনের দিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বোধরা একদিক থেকে আর একদিকে মুখ ফিরানো মনে করছে। অথচ বাইতুল মাকদিস থেকে কা’বার দিকে মুখ ফিরানোর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে বিশ্ববাসীর নেতৃত্ব পদ থেকে যথানিয়মে হটিয়ে উম্মাতে মুহাম্মাদীয়াকে সে পদে বসিয়ে দিলেন।‘মধ্যপন্থী উম্মাত’ শব্দটি অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্যের অধিকারী। এর অর্থ হচ্ছে, এমন একটি উৎকৃষ্ট ও উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন দল, যারা নিজেরা ইনসাফ, ন্যায়-নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দুনিয়ার জাতিদের মধ্যে যারা কেন্দ্রীয় আসন লাভের যোগ্যতা রাখে, সত্য ও সততার ভিত্তিতে সবার সাথে যাদের সম্পর্ক সমান এবং কারোর সাথে যাদের কোন অবৈধ ও অন্যায় সম্পর্ক নেই।বলা হয়েছে, তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মাতে পরিণত করার কারণ হচ্ছে এই যে, “তোমরা লোকদের ওপর সাক্ষী হবে এবং রসূল তোমাদের ওপর সাক্ষী হবেন।” এ বক্তব্যের অর্থ কি? এর অর্থ হচ্ছে, আখেরাতে যখন সমগ্র মানবজাতিকে একত্র করে তাদের হিসেব নেয়া হবে তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল প্রতিনিধি হিসেবে রসূল তোমাদের ব্যাপারে এ মর্মে সাক্ষ্য দেবেন যে, সুস্থ ও সঠিক চিন্তা এবং সৎকাজ ও সুবিচারের যে শিক্ষা দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয়েছিল তা তিনি তোমাদের কাছে হুবহু এবং পুরোপুরি পৌঁছিয়ে দিয়েছেন আর বাস্তবে সেই অনুযায়ী নিজে কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছেন। এরপর রসূলের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সাধারণ মানুষদের ব্যাপারে তোমাদের এই মর্মে সাক্ষ্য দিতে হবে যে, রসূল তোমাদের কাছে যা কিছু পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন তা তোমরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছো। আর তিনি যা কিছু কার্যকর করে দেখিয়ে ছিলেন তা তাদের কাছে কার্যকর করে দেখিয়ে ছিলেন তা তাদের কাছে কার্যকর করে দেখাবার ব্যাপারে তোমরা মোটেই গড়িমসি করোনি।এভাবে কোন ব্যক্তি বা দলের এ দুনিয়ায় আল্লাহর পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দানের দায়িত্বে নিযুক্ত হওয়াটাই মূলত তাকে নেতৃত্বের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার নামান্তর। এর মধ্যে যেমন একদিকে মর্যাদাও সম্মান বৃদ্ধির প্রশ্ন রয়েছে তেমনি অন্যদিকে রয়েছে দায়িত্বের বিরাট বোঝা। এর সোজা অর্থ হচ্ছে, রসূলুল্লাহ ﷺ যেভাবে এ উম্মাতের জন্য আল্লাহভীতি, সত্য-সঠিক পথ অবলম্বন, সুবিচার, ন্যায়-নিষ্ঠা ও সত্যপ্রীতির জীবন্ত সাক্ষী হয়েছেন তেমনিভাবে এ উম্মাতকেও সারা দুনিয়াবাসীদের জন্য জীবন্ত সাক্ষীতে পরিণত হতে হবে। এমন কি তাদের কথা, কর্ম, আচরণ ইত্যাদি প্রত্যেকটি বিষয় দেখে দুনিয়াবাসী আল্লাহভীতি, সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা ও সত্যপ্রীতির শিক্ষা গ্রহণ করবে। এর আর একটি অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর হিদায়াত আমাদের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারে যেমন রসূলের দায়িত্ব ছিল বড়ই সুকঠিন, এমনকি এ ব্যাপারে সামান্য ত্রুটি বা গাফলতি হলে আল্লাহর দরবারে তিনি পাকড়াও হতেন, অনুরূপভাবে এ হিদায়াতকে দুনিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারেও আমাদের ওপর কঠিন দায়িত্ব আরোপিত হয়েছে। যদি আমরা আল্লাহর আদালতে যথার্থই এ মর্মে সাক্ষ্য দিতে ব্যর্থ হই যে, “তোমার রসূলের মাধ্যমে তোমার যে হিদায়াত আমরা পেয়েছিলাম তা তোমার বান্দাদের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারে আমরা কোন প্রকার ত্রুটি করিনি”, তাহলে আমরা সেদিন মারাত্মকভাবে পাকড়াও হয়ে যাবো। সেদিন এ নেতৃত্বের অহংকার সেখানে আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের নেতৃত্বের যুগে আমাদের যথার্থ ত্রুটির কারণে মানুষের চিন্তায় ও কর্মে যে সমস্ত গলদ দেখা দেবে, তার ফলে দুনিয়ায় যেসব গোমরাহী ছড়িয়ে পড়বে এবং যত বিপর্যয় ও বিশৃংখলার রাজত্ব বিস্তৃত হবে—সে সবের জন্য অসৎ নেতৃবর্গ এবং মানুষ ও জিন শয়তানদের সাথে সাথে আমরাও পাকড়াও হবো। আমাদের জিজ্ঞেস করা হবে, পৃথিবীতে যখন জুলুম, নির্যাতন, অন্যায়, অত্যাচার, পাপ ও ভ্রষ্টতার রাজত্ব বিস্তৃত হয়েছিল তখন তোমরা কোথায় ছিলে?
# এর উদ্দেশ্য ছিল এটা দেখা যে, কে জাহেলী বিদ্বেষ এবং মাটি ও রক্তের গোলামিতে লিপ্ত আর কে এসব বাঁধন মুক্ত হয়ে প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করেছে। একদিকে আরবরা তাদের দেশ, বংশ ও গোত্রের অহংকারে ডুবে ছিল। আরবের কা’বাকে বাদ দিয়ে বাইরের বাইতুল মাকদিসকে কিব্লায় পরিণত করা ছিল তাদের জাতীয়তাবাদের মূর্তির ওপর প্রচণ্ড আঘাতের শামিল। অন্যদিকে বনী ইসরাঈলরা ছিল তাদের বংশ পূজার অহংকারে মত্ত। নিজেদের পৈতৃক কিব্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিব্লাহকে বরদাসত করার ক্ষমতাই তাদের ছিল না। কাজেই একথা সুস্পষ্ট, এ ধরনের মূর্তি যাদের মনের কোণে ঠাঁই পেয়েছে, তারা কেমন করে আল্লাহর রসূল যে পথের দিকে আহবান জানাচ্ছিলেন সে পথে চলতে পারতো। তাই মহান আল্লাহ এ মূর্তি পূজারীদের যথার্থ সতপন্থীদের থেকে ছেঁটে বাদ দেয়ার পরিকল্পনা নিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে বাইতুল মাকদিসকে কিব্লাহ নির্দিষ্ট করলেন। এর ফলে আরব জাতীয়তাবাদের দেবতার পূজারীরা তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। অতঃপর তিনি এ কিব্লাহ বাদ দিয়ে কা’বাকে কিব্লাহ নির্দিষ্ট করেন। ফলে ইসরাঈলী জাতীয়তাবাদের পূজারীরাও তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেল। এভাবে যারা কোন মূর্তির নয় বরং নিছক আল্লাহর পূজারী ছিলেন একমাত্র তারাই রসূলের সাথে রয়ে গেলেন।