(বই#৯৫৪) [ قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ﴿۱﴾ নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা।] সূরা:- আল্-মুমিনূন। সুরা:২৩ ০১-১১ নং আয়াত:- www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৫৪)
[ قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ﴿۱﴾
নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা।]
সূরা:- আল্-মুমিনূন।
সুরা:২৩
০১-১১ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৩:১
قَدۡ اَفۡلَحَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ﴿۱﴾
নিশ্চিতভাবে সফলকাম হয়েছে মু’মিনরা।
২৩:২
الَّذِیۡنَ ہُمۡ فِیۡ صَلَاتِہِمۡ خٰشِعُوۡنَ ۙ﴿۲﴾
যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র।
২৩:৩
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَنِ اللَّغۡوِ مُعۡرِضُوۡنَ ﴿ۙ۳﴾
যারা বাজে কাজ থেকে দূরে থাকে,
২৩:৪
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ لِلزَّکٰوۃِ فٰعِلُوۡنَ ۙ﴿۴﴾
যারা যাকাত দানে সক্রিয় ।
২৩:৫
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ لِفُرُوۡجِہِمۡ حٰفِظُوۡنَ ۙ﴿۵﴾
যারা নিজেদের লজ্জা-স্থানের হেফাজত করে।
২৩:৬
اِلَّا عَلٰۤی اَزۡوَاجِہِمۡ اَوۡ مَا مَلَکَتۡ اَیۡمَانُہُمۡ فَاِنَّہُمۡ غَیۡرُ مَلُوۡمِیۡنَ ۚ﴿۶﴾
নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত; এতে তারা নিন্দনীয় হবে না।
২৩:৭
فَمَنِ ابۡتَغٰی وَرَآءَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡعٰدُوۡنَ ۚ﴿۷﴾
তবে যারা এর বাইরে আরও কিছু চাইবে তারাই হবে সীমালংঘনকারী,
২৩:৮
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ لِاَمٰنٰتِہِمۡ وَ عَہۡدِہِمۡ رٰعُوۡنَ ۙ﴿۸﴾
এবং যারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে।
২৩:৯
وَ الَّذِیۡنَ ہُمۡ عَلٰی صَلَوٰتِہِمۡ یُحَافِظُوۡنَ ۘ﴿۹﴾
আর যারা নিজেদের নামাযে যত্নবান থাকে।
২৩:১০
اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡوٰرِثُوۡنَ ﴿ۙ۱۰﴾
তারাই হবে উত্তরাধিকারী।
২৩:১১
الَّذِیۡنَ یَرِثُوۡنَ الۡفِرۡدَوۡسَ ؕ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۱۱﴾
উত্তরাধিকারী হবে ফিরদাউসের; যাতে তারা চিরস্থায়ী হবে।
০১-১১ নং আয়াতের
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*সংক্ষিপ্ত আলোচনা : আলােচ্য সূরাটি হচ্ছে সূরা আল মুমিনূন। সূরাটির এই বিশেষ নামই এর মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হবে তার দিকে ইংগিত করছে। সূরাটি শুরু হচ্ছে মােমেনদের গুণাবলীর কথা দিয়ে। এরপরই আলােচনার গতি ফিরে যাচ্ছে মানুষের নিজেদের মধ্যে ও প্রকৃতির সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা ঈমানের প্রমাণাদি পেশ করার দিকে, তারপর সেইভাবে ঈমানের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য পেশ করা হয়েছে যেমন করে নূহ(আ.) থেকে নিয়ে শেষ নবী মােহাম্মদ(স.) পর্যন্ত সকল রাসূল পেশ করেছেন। আলােচ্য সূরার মধ্যে সেসব সন্দেহ সংশয় এবং বিভিন্ন প্রশ্নাবলীর জওয়াব দেয়া হয়েছে যা ঈমানের তাৎপর্য সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে উত্থাপন করা হয়ে থাকে। অতীতে অনেক সময় রসূলরা সেসব হঠকারী ব্যক্তির অযৌত্তিক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্যে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেছেন এবং তাদেরকে ধংস করা ও মােমেনদের সাহায্য করার জন্যে দোয়াও করেছেন। তারপর আলােচনার গতি ফিরে গেছে রসূলদের ইন্তেকালের পর, ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ভিন্ন কেউ নয়-এই প্রশ্নে মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা নানা প্রকার মতপার্থক্যের দিকে। এখান থেকে আবার প্রিয় নবী মােহাম্মদ(স.) সম্পর্কে মােশরেকদের আপত্তিকর মন্তব্যসমূহের দিকে আলােচনার মােড় ফিরেছে এবং সূরাটি সমাপ্ত করা হয়েছে কেয়ামতকে অস্বীকারকারী কাফেরদের শাস্তির দৃশ্যের একটি স্বার্থক চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে, সে কঠিন অবস্থার দৃশ্যের বর্ণনা দ্বারা সন্দেহবাদীদের অন্তরকে চিন্তান্বিত করতে চাওয়া হয়েছে, বরং পরােক্ষভাবে তাদেরকে সে আযাব এসে পাকড়াও করবে বলে ধমক দেয়া হয়েছে। যাতে করে তারা আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতার কথা স্বীকার করে ও সময় থাকতেই শুধরে যায়। এই হচ্ছে সূরা আল মােমেনূন’ অথবা সূরাতুল ঈমান, যেখানে মােমেননদের সকল প্রকার গুণাবলী ও ঈমানের অকাট্য প্রমাণাদির কথা তুলে ধরা হয়েছে এবং এই গুণাবলী বর্ণনা করাই সূরাটির লক্ষ্য ও মূল আলােচ্য বিষয়। সূরাটিকে প্রধানত চারটি অংশে ভাগ করে ঈমানদারদের চারটি অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, প্রথম পর্যায়ে, মােমেনদের কৃতকার্য হওয়ার জন্যে জরুরী শর্তাবলীর উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘অবশ্যই মােমেনরা কৃতকার্য হবে’… একথা ঘােষণা দেয়ার পর পরই তাদের মধ্যে যে সব গুণাবলী থাকা দরকার সেগুলাের উল্লেখ করে বলা হয়েছে এসব গুণ থাকলে অবশ্যই তারা কৃতকার্য হবে। তাদের জন্যে কৃতকার্য হওয়াকে বাধ্যতামূলক করে দেয়া হয়েছে। এ কথাগুলাে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, মানুষের নিজেদের মধ্যে এবং গোটা পরিবেশে ঈমানের এসব প্রমাণ থাকতে হবে। এরপর তুলে ধরা হয়েছে মানব জীবনের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত যতাে প্রকার অবস্থা ঘটেছে ও ঘটবে এবং ভ্রুণ থেকে নিয়ে পূর্ণাংগ মানুষ সৃষ্টির যেসব পর্যায় এসেছে এসব অবস্থাকে, আরাে যে সব স্তর মানুষকে সাধারণভাবে অতিক্রম করতে হয় সেগুলােরও সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করা হয়েছে তারপর কেয়ামত দিবসে পুনরায় মানুষ যখন যিন্দা হয়ে উঠবে সেই সময় পর্যন্ত মানুষের পর্যায়ক্রমিক অবস্থারও একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এরপর কথার গতি পরিবর্তন হয়ে এগিয়ে গেছে মানব জীবন থেকে বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত প্রমাণাদির দিকে। আকাশ সৃষ্টি, বৃষ্টির পানি বর্ষণ, ফল ফসল, বৃক্ষ ও তরুলতাদি উৎপন্ন হওয়া এবং জীবজন্তু সব কিছুকে মানুষের খেদমতে নিয়ােজিত করার দিকে, আর সে সব নৌযান এবং ভারবাহী পশুগুলাের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যা মানুষ ও পণ্য বহন করে সাগরের উত্তাল তরংগ ও মরু মরীচিকার বুক চিরে চিরে দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি জমায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে আলােচনা এসেছে মানব প্রকৃতি থেকে নিয়ে বিশ্ব প্রকৃতির বুকে ছড়িয়ে থাকা রহস্যরাজি ও সেই ঈমানের তাৎপর্য সম্পর্কে, যা মানব মনে মহান সৃষ্টিকর্তা এক আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে চেতনা জাগিয়ে তােলে এবং একমাত্র তাঁর কাছ থেকেই যে রসূলরা মানবতার মুক্তিদূত হিসাবে প্রেরিত হয়েছেন সে সম্পর্কে বিদগ্ধ হৃদয়ে প্রতীতি জন্মায়। আল্লাহর আয়াতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, ‘হে আমার জাতি, তিনি ছাড়া তােমাদের জন্যে কোনাে মাবুদ নেই।’ একথা যেমন নূহ(আ.) উচ্চারণ করেছিলেন, তেমনি পরবর্তীতে আগত সকল নবী রসূলরা এই একই কথার দিকে দাওয়াত দিয়েছেন, যার ধারা এসে সমাপ্ত হয়েছে শেষ নবী ও রসূল মুহাম্মদ(স.)-এ এসে। কিন্তু আফসােস কোরায়শ জাতির জন্যে, তাদের মধ্যেই লালিত-পালিত এবং তাদের পরম প্রিয়জন ও আস্থাভাজন এমন মধুর মানুষটিকে একথা বলে তারা উপেক্ষা করেছে যে, ‘আরে, এতাে তােমাদের মধ্যে বাস করে, এতাে একজন সাধারণ মানুষ। এর কাছে কি করে আল্লাহর বার্তা আসবে। ‘এ কাজের জন্যে চাইলে তাে আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদেরকেই নাযিল করতে পারতেন!’… একইভাবে পুনরুত্থান সম্পর্কে রসূলের কথাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলতাে ‘এ ব্যক্তি কি তােমাদের কাছে এ ওয়াদাও করছে যে, তােমরা মরে যাবে এবং সবাই মাটি ও হাড্ডিতে পরিণত হবে, এ অবস্থা থেকেও কি তোমাদেরকে কেউ বের করে আনবে?’… আর সকল রসূলদের একই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেছে যে সবাই আল্লাহরই কাছে সাহায্য প্রার্থী হয়েছেন এবং কামনা করেছেন যে আল্লাহ তায়ালা যেন তাদের দোয়া কবুল করেন। অতপর তিনি যেন সকল প্রত্যাখ্যানকারীদেরকে নির্দেশের সাথে শেষ হচ্ছে যে, ধ্বংস করে দেন… আর এই পর্যায়টি সকল রাসূলের প্রতি ‘হে রসূলরা খাও… এবং আমিই তােমাদের রব, অতএব একমাত্র আমাকে ভয় করাে।’ এরপর আসছে তৃতীয় পর্যায়ের আলােচনা রসূলদের অবর্তমানে মানুষের মধ্যে এই বিভেদ-অনৈক্য ও বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে। এক আল্লাহ তায়ালাই সর্বময় শক্তি ক্ষমতার মালিক এই প্রশ্নে যেহেতু সবাই এক এবং এই একই দাওয়াত নিয়ে এসেছেন, অতপর, তারা এই মৌলিক বিষয়টিকে নানাভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে, প্রতি ভাগই তাদের নিজ নিজ মত ও পথ নিয়ে খুশী। (আয়াত ৫৩) আসলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে যে সব নেয়ামত দিয়েছেন তার শােকরগােযারী না করে তারা ভুলে গেছে যে, পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী সময়টি মােটেই চিরদিনের নয় এবং খাওয়া পান করা ও মওজ করার জন্যে নয়। এ জীবন যে অবশ্যই একটি পরীক্ষা, একথাটা একেবারেই তারা বেমালুম ভুলে বসে আছে। আর ভাবছে, আজকে যেমন আছে এমনই চিরদিন চলবে। অবশ্য, এই ভুলে থাকা মানব শ্রেণীর মধ্যে মােমেন মুসলমান অর্থাৎ আল্লাহর কৃপাধন্য আত্মসমপর্ণকারী আর একটি দল রয়েছে, তারা ভয়ে ভয়ে থাকে। যাবতীয় কাজ কর্ম, কথা বার্তা ও চাল চলনে সদা-সর্বদা সাবধানে থাকে, পাছে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন এ চিন্তা তাদেরকে কোনাে ব্যাপারেই বে-পরওয়া হতে দেয় না। তারা বিনা শর্তে ও দ্বিধাহীন চিত্তে একমাত্র তারই আনুগত্য করে, তার অস্তিত্বে, তার ক্ষমতায় ও তার গুণাবলীতে অন্য কাউকে তারা শরীক করে না, কিছুতেই তারা ভাবে না যে, শক্তি-ক্ষমতা বা অন্য কোনাে গুণাবলীতে অন্য কারাে এতটুকু অংশ আছে- এজনাে অন্য কারাে কাছে তারা ধর্ণা দেয় না বা কারাে ওপর তারা ভরসাও করে না; তবুও সার্বক্ষণিক এ ভয় তাদের লেগে থাকে, কিছু বিচ্যুতি হয়ে যাচ্ছে না তাে! আল্লাহ তায়ালা তাদের এ অনুভূতিতে খুশী হয়ে তাদের কথা গর্বভরে তাঁর পাক পবিত্র কালামে বর্ণনা করছেন, ‘তাদের অন্তরগুলাে ভীত সন্ত্রস্ত, কারণ তার কাছেই তাদের ফিরে যেতে হবে।’ আর পাশাপাশি তাদের চিত্র আঁকা হচ্ছে যারা অপরিণামদর্শী, যারা আজকের এ নগদ নিয়ে বড়ই খুশী, এদেরকে হঠাৎ করে যখন অকল্পনীয় আযাবে পেয়ে বসবে, তখন তারা চরমভাবে অস্থির হয়ে যাবে, কিন্তু তখন কোনাে উপায়ই থাকবে না। এজন্য এখনই তাদেরকে আযাবের ভয় দেখিয়ে সাবধান হতে বলা হচ্ছে, বলা হচ্ছে, অবশ্যই আমার আয়াত (ও শক্তির নিদর্শনসমূহ) তােমাদের কাছে এসেছিলে, কিন্তু তােমরা সেগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতো। অহংকারী হয়ে চলতো এবং গল্প গুজব করে বে-ফায়দা সময় কাটাতো। রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে তাদের ব্যবহারটা বড়ই অদ্ভুত, তাঁকে তারা চির সত্যবাদী, বিশ্বস্ত ও সত্যপন্থী বলে জানতাে, চিনতাে, তার কোনাে কাজে তারা অসন্তুষ্ট ছিলাে না এবং তাকে কোনাে সময়ই তারা বিমুখ করেনি, অথচ যখন তিনি তাদের কাছে সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা নিয়ে এলেন, যার জন্যে তিনি তাদের কাছে কোনাে প্রতিদানও চাইছিলেন না, এমতাবস্থায় তাদের কাছে তার কোন জিনিস খারাপ লাগছিলাে এবং কেনই বা তার আনীত সত্যকে তারা অস্বীকার করছিলাে? অথচ তারা আল্লাহকে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যে বিরাজমান সব কিছুর মালিক বলে জানতো ও মানতাে, আসমান যমীনের রব বা কর্তা হিসাবেও তাকে তারা মানতাে, আর এটাও মানতাে যে ‘বিশ্বের সব কিছুর ওপর তার নিরংকুশ ক্ষমতা ছড়িয়ে রয়েছে, এতদসত্তেও তারা মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হয়ে উঠতে হবে’ কথাটাকেই মানতে চাইতাে না। তারা মনে করতাে আল্লাহর সন্তান আছে, নাউযুবিল্লাহ!- তিনি মানবীয় এসব ধারণা কল্পনা ও দুর্বলতার সম্পূর্ণ উর্ধে। তারা আল্লাহর সাথে অন্য অনেক কিছুকেই সর্বময় ক্ষমতার মালিক বা পূজনীয় মনে করতাে ‘অতপর (তাদের জন্যে ঘােষণা) যেসব জিনিসকে (তার সাথে তার শরীক বানাচ্ছে সেসব কিছুর দুর্বলতা) থেকে তিনি প্রশ্নাতীতভাবে পবিত্র। আর এ সূরার শেষ পর্যায়ে এসে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে তাদের শরীকদেরকে পরিত্যাগ করতে ঘােষণা দিচ্ছেন এবং তাদের ধ্যান-ধারণাকে বাতিল বলে ঘোষণা দিচ্ছেন, তারপর রসূলুল্লাহ(স)-কে সম্বােধন করে বলছেন তিনি যেন তাদের সকল মন্দ ব্যবহারের জবাব সর্বোত্তম জিনিস বা সব থেকে ভালাে ব্যবহার দ্বারা দেন। (এ সূরাটি হচ্ছে মক্কী, যার কারণে এসময়ে ইচ্ছা করলেও তাদের দুর্ব্যবহারের জওয়াবে কোনাে প্রতিশােধ নেয়ার মতাে অবস্থা মুসলমানের ছিলাে না) আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরো চাইছেন, তিনি যেন শয়তানের যাবতীয় ষড়যন্ত্র ও অনিষ্ট থেকে বাচার জন্যে তাঁরই সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি যেন রাগ না করেন, আর ওরা যা কিছু অন্যায় বলছে তার জন্যে হৃদয়কে যেন তিনি কখনাে সংকীর্ণ না করেন, আর এসব কথার পাশপাশি কেয়ামতের সেই ভয়াবহ দৃশ্যাবলী ছবির মতাে তিনি তার সামনে ফুটিয়ে তুলছেন, যার ব্যবস্থা তিনি তাদের জন্যে করছেন- সে দৃশ্য হচ্ছে অতি কঠিন আযাবের দৃশ্য, তাদের নিরন্তর অপমান ও সদা-সর্বদা ভীতি প্রদর্শনের দৃশ্য। তারপর সূরাটি সমাপ্ত করা হচ্ছে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনার সাথে। এরশাদ হচ্ছে, ‘মহামহীয়ান আল্লাহ, যিনি বিশ্ব জাহানের প্রকৃত সম্রাট। তিনি ছাড়া এমন কেউ সর্বশক্তিমান নেই (যার সামনে মাথা নত করা যায়), তিনি মহান আরশের মালিক।’ এখানে আরাে দেখা যায়, সূরাটির প্রথাংশে কৃতকার্যতার শর্তাবলী বর্ণনা করার সাথে সাথে কাফেরদের ব্যর্থতার কথাও পেশ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে ইলাহ’ হিসেবে ডাকে, যার কোনাে যুক্তিই তার কাছে নেই, সে অবস্থায় (জেনে নাও যে) অবশ্যই তার রবের কাছে তার হিসাব (গৃহীত হবে), নিশ্চয়ই কাফেররা সফল হবে না।’ (আয়াত ১১৭) এ আয়াতে মানুষের মনযােগকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তাঁর রহমত ও ক্ষমার দিকে মানুষকে এগিয়ে দেয়া হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আরাে বলো, হে আমার রব, ক্ষমা কারাে এবং রহম কারাে অবশ্যই তুমি সর্বোত্তম রহমকারী।’

* সূরাটির গােটা পরিবেশই হচ্ছে বর্ণনামূলক, যেখানে মানুষকে হেদায়াতের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্যে প্রচুর যুক্তিতর্ক ও আবেগপূর্ণ অকাট্য কথা রয়েছে, আরাে আছে এমন এমন সুন্দর কথা, যা হৃদয়কে মুগ্ধ করে এবং বিবেককে সজোরে নাড়া দিয়ে যায়। যে পরিবেশের মধ্যে এসব যুক্তি বিজয়ী হয়েছে তার জন্যে প্রয়ােজনীয় বিষয়বস্তু ছিলাে ঈমান,…… এ ঈমানের উৎসের যে দৃশ্যটা নযরে পড়ে তা হচ্ছে নামাযে বিনয়-নম্রতা, এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা নামাযে বিনয়াবনত থাকে’ তারপর মােমেনদের গুণাবলীর মধ্যে পরবর্তী বিষয়ের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘আর যারা যথারীতি তাদের যাকাত আদায় করে… যৌনাংগসমূহের যথাযথ হেফাযত করে…’ আর একথা বলার সময় যে আবেগের ছোঁয়া সেখানে পাওয়া যায় তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তিনি হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যিনি তােমাদের কান, চোখ ও অন্তরসমূহ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু খুব অল্পই তােমরা শোকরগুজারী করে।’ উপরােক্ত গুণাবলী উল্লেখ করার পর পরিশেষে বলা হয়েছে, আর এসব কিছু সূক্ষ্ম ও সুগভীর ঈমানের ছায়াতলে লালিত পালিত হয়।  *জান্নাতুল ফেরদাউসের ওয়ারিশদের গুণাবলী : অবশ্যই সেই সব মােমেন সাফল্যমন্ডিত যারা তাদের নামাযে বিনয়াবত থাকে… যারা জান্নাতুল ফেরদাওসের উত্তরাধিকারী তারা সেখানে চিরদিন থাকবে।'(আয়াত ১-১১) এ যে আল্লাহর ওয়াদা, অবশ্যই তা সত্য, বরং মােমেনদের সাফল্য মন্ডিত হওয়ার ফয়সালা আরাে বড় সত্য, কারণ এ যে আল্লাহর ওয়াদা, কখনাে আল্লাহ তায়ালা তার ওয়াদা খেলাফ করেন না। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এ ওয়াদাকে কেউ বদলে দেয়ার ক্ষমতাও রাখে না। এ সাফল্য দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় স্থানে, প্রত্যেক মােমেন, ব্যক্তি হিসাবে এবং দলগতভাবে উভয় অবস্থাতেই তারা সফলকাম। এ এমন মহামূল্যবান সাফল্য যা একজন মােমেন তার অন্তর দিয়ে অনুভব করে এবং এর সত্যতা তার বাস্তব জীবনে বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে সে দেখতে পায়, সাধারণভাবে মানুষ কৃতকার্যতা বলতে যা বুঝে তাও যেন মােমেনরা লাভ করে, আরাে এমন কিছু সফলতা মােমেন বান্দাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন যার তাৎপর্য তারা নিজেরাও ভালো করে জানে না। এখন আসুন আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, কারা সেই মােমেন যাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা এ ওয়াদা করেছেন এবং তাদের সাফল্যের এই ঘােষণা তিনি দিয়েছেন? কারা সেই মােমেন ব্যক্তি যাদের জন্যে কল্যাণ, সৌভাগ্য এবং পৃথিবীর পবিত্র সম্পদকে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত অবধারিত করে দিয়েছেন তাদের জন্যে সাফল্য ও নাজাত এবং আখেরাতের জন্যে সওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন, এ ছাড়া আল্লাহ তায়ালা উভয় জীবনের জন্যে আরাে যা কিছু চেয়েছেন, যা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না? কে সেই উত্তরাধিকারী মােমেন; যারা হবে ফেরদাওসের উত্তরাধিকারী, যেখানে তারা থাকবে চিরদিন?  নিশ্চয়ই ওরা হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি যাদের গুণাবলী সম্পর্কে সূরাটি শুরু করার পরপরই বিস্তারিত আলােচনা এসেছে। বলা হচ্ছে, যারা তাদের নামাযের মধ্যে বিনয়ানত, যারা বেফায়দা জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় যারা রীতিমতাে যাকাত প্রদান করে, যারা তাদের লজ্জাস্থানগুলােকে হেফাযত করে, নিজেদের স্ত্রী অথবা তাদের অধিকারভূক্ত দাসীদের বাদে অন্য সবার কাছ থেকে… যারা তাদের সকল প্রকার আমানত এবং ওয়াদাগুলােকে সংরক্ষণ করে, যারা তাদের সকল নামাজ হেফাযত করে শেষ পর্যন্ত।’ এখন দেখতে হবে এসব গুণাবলীর মূল্য কি? এগুলাের মূল্য হচ্ছে, এগুলাে দ্বারা একজন মুসলমানের ব্যক্তিত্ব সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌছে যায় এবং সে মর্যাদা হাসিল হয় সৃষ্টির সেরা মানুষ মােহাম্মদ(স.)-এর পূর্ণাংগ অনুকরণ ও অনুসরণের মাধ্যমে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন নিজে তাকে সুন্দরতম সে গুণাবলী শিখিয়েছেন এবং তিনি তার কেতাবে সে শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘অবশ্যই (হে রসূল) তুমি শ্রেষ্ঠ চরিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’ হযরত আয়শা(রা.)-কে একদিন, রসূলুল্লাহ(স.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘মহাগ্রন্থ আল কোরআনই হচ্ছে তাঁর চরিত্র। এরপর তিনি সূরায়ে মােমেনূন এর আয়াত ‘কাদ আফলাহাল মােমেন থেকে পড়তে শুরু করলেন এবং যারা তাদের নামসমূহের ওপর হেফাযতকারী হয়’ পর্যন্ত পড়লেন, তারপর তিনি বললেন, এই আয়াতগুলােতে যেসব গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে তারই বাস্তব রূপ ছিলেন রসূলুল্লাহ (স.)।( নাসাঈ শরীফে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে) আবারও লক্ষ্য করুন তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে এ গুণাবলীর কি কি প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

* সূরাটির গােটা পরিবেশই হচ্ছে বর্ণনামূলক, যেখানে মানুষকে হেদায়াতের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্যে প্রচুর যুক্তিতর্ক ও আবেগপূর্ণ অকাট্য কথা রয়েছে, আরাে আছে এমন এমন সুন্দর কথা, যা হৃদয়কে মুগ্ধ করে এবং বিবেককে সজোরে নাড়া দিয়ে যায়। যে পরিবেশের মধ্যে এসব যুক্তি বিজয়ী হয়েছে তার জন্যে প্রয়ােজনীয় বিষয়বস্তু ছিলাে ঈমান,…… এ ঈমানের উৎসের যে দৃশ্যটা নযরে পড়ে তা হচ্ছে নামাযে বিনয়-নম্রতা, এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা নামাযে বিনয়াবনত থাকে’ তারপর মােমেনদের গুণাবলীর মধ্যে পরবর্তী বিষয়ের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘আর যারা যথারীতি তাদের যাকাত আদায় করে… যৌনাংগসমূহের যথাযথ হেফাযত করে…’ আর একথা বলার সময় যে আবেগের ছোঁয়া সেখানে পাওয়া যায় তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তিনি হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যিনি তােমাদের কান, চোখ ও অন্তরসমূহ সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু খুব অল্পই তােমরা শোকরগুজারী করে।’ উপরােক্ত গুণাবলী উল্লেখ করার পর পরিশেষে বলা হয়েছে, আর এসব কিছু সূক্ষ্ম ও সুগভীর ঈমানের ছায়াতলে লালিত পালিত হয়।  *জান্নাতুল ফেরদাউসের ওয়ারিশদের গুণাবলী : অবশ্যই সেই সব মােমেন সাফল্যমন্ডিত যারা তাদের নামাযে বিনয়াবত থাকে… যারা জান্নাতুল ফেরদাওসের উত্তরাধিকারী তারা সেখানে চিরদিন থাকবে।'(আয়াত ১-১১) এ যে আল্লাহর ওয়াদা, অবশ্যই তা সত্য, বরং মােমেনদের সাফল্য মন্ডিত হওয়ার ফয়সালা আরাে বড় সত্য, কারণ এ যে আল্লাহর ওয়াদা, কখনাে আল্লাহ তায়ালা তার ওয়াদা খেলাফ করেন না। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এ ওয়াদাকে কেউ বদলে দেয়ার ক্ষমতাও রাখে না। এ সাফল্য দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় স্থানে, প্রত্যেক মােমেন, ব্যক্তি হিসাবে এবং দলগতভাবে উভয় অবস্থাতেই তারা সফলকাম। এ এমন মহামূল্যবান সাফল্য যা একজন মােমেন তার অন্তর দিয়ে অনুভব করে এবং এর সত্যতা তার বাস্তব জীবনে বিভিন্ন অবস্থার মাধ্যমে সে দেখতে পায়, সাধারণভাবে মানুষ কৃতকার্যতা বলতে যা বুঝে তাও যেন মােমেনরা লাভ করে, আরাে এমন কিছু সফলতা মােমেন বান্দাদের জন্যে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন যার তাৎপর্য তারা নিজেরাও ভালো করে জানে না। এখন আসুন আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, কারা সেই মােমেন যাদের সাথে আল্লাহ তায়ালা এ ওয়াদা করেছেন এবং তাদের সাফল্যের এই ঘােষণা তিনি দিয়েছেন? কারা সেই মােমেন ব্যক্তি যাদের জন্যে কল্যাণ, সৌভাগ্য এবং পৃথিবীর পবিত্র সম্পদকে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত অবধারিত করে দিয়েছেন তাদের জন্যে সাফল্য ও নাজাত এবং আখেরাতের জন্যে সওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন, এ ছাড়া আল্লাহ তায়ালা উভয় জীবনের জন্যে আরাে যা কিছু চেয়েছেন, যা একমাত্র তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না? কে সেই উত্তরাধিকারী মােমেন; যারা হবে ফেরদাওসের উত্তরাধিকারী, যেখানে তারা থাকবে চিরদিন?  নিশ্চয়ই ওরা হচ্ছে সেই সব ব্যক্তি যাদের গুণাবলী সম্পর্কে সূরাটি শুরু করার পরপরই বিস্তারিত আলােচনা এসেছে। বলা হচ্ছে, যারা তাদের নামাযের মধ্যে বিনয়ানত, যারা বেফায়দা জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় যারা রীতিমতাে যাকাত প্রদান করে, যারা তাদের লজ্জাস্থানগুলােকে হেফাযত করে, নিজেদের স্ত্রী অথবা তাদের অধিকারভূক্ত দাসীদের বাদে অন্য সবার কাছ থেকে… যারা তাদের সকল প্রকার আমানত এবং ওয়াদাগুলােকে সংরক্ষণ করে, যারা তাদের সকল নামাজ হেফাযত করে শেষ পর্যন্ত।’ এখন দেখতে হবে এসব গুণাবলীর মূল্য কি? এগুলাের মূল্য হচ্ছে, এগুলাে দ্বারা একজন মুসলমানের ব্যক্তিত্ব সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পৌছে যায় এবং সে মর্যাদা হাসিল হয় সৃষ্টির সেরা মানুষ মােহাম্মদ(স.)-এর পূর্ণাংগ অনুকরণ ও অনুসরণের মাধ্যমে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন নিজে তাকে সুন্দরতম সে গুণাবলী শিখিয়েছেন এবং তিনি তার কেতাবে সে শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘অবশ্যই (হে রসূল) তুমি শ্রেষ্ঠ চরিত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’ হযরত আয়শা(রা.)-কে একদিন, রসূলুল্লাহ(স.)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, ‘মহাগ্রন্থ আল কোরআনই হচ্ছে তাঁর চরিত্র। এরপর তিনি সূরায়ে মােমেনূন এর আয়াত ‘কাদ আফলাহাল মােমেন থেকে পড়তে শুরু করলেন এবং যারা তাদের নামসমূহের ওপর হেফাযতকারী হয়’ পর্যন্ত পড়লেন, তারপর তিনি বললেন, এই আয়াতগুলােতে যেসব গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে তারই বাস্তব রূপ ছিলেন রসূলুল্লাহ (স.)।( নাসাঈ শরীফে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে) আবারও লক্ষ্য করুন তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে এ গুণাবলীর কি কি প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

* একটি দলের মধ্যে যখন এ গুণাবলী সৃষ্টি হয় তখন তার দ্বারা কি কি কাজ সাধিত হয়? আর গােটা মানব জাতি যখন এ মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হয় তখন তারা সম্মিলিতভাবে কি কি কল্যাণের ফল্গুধারা বইয়ে দিতে পারে। পর্যায়ক্রমে একবার সেগুলোর দিকে লক্ষ করুন, ১. যারা তাদের নামাযে (ভয় ভরা মন নিয়ে) বিনয়াবনত’… নামাযে দাঁড়ানাে অবস্থায় যখন তারা মহান আল্লাহর সামনে উপস্থিত বলে মনে করে, তখন তাদের হৃদয়ে প্রচন্ড ভয় জাগে, যার লক্ষণ ফুটে উঠে তাদের প্রতিটি অংগ প্রত্যংগে এবং তাদের প্রতিটি নড়া চড়ায়, প্রতিটি মুহূর্তে। মহান আল্লাহর সামনে দন্ডায়মান থাকার চেতনা তাদের আত্মার ওপর পরিব্যাপ্ত থাকে। এর ফলে তাদের মন-মস্তিষ্ক থেকে অন্য সকল চিন্তা চেতনা ও ব্যস্ততা দূর হয়ে যায়। এ সময়ে আল্লাহর চিন্তা চেতনা ছাড়া অন্য কিছু তাকে অস্থির করে না, প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভূতি তাকে সংগােপনে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করে এবং সে তখন মনে মনে মুনাজাত করতে থাকে। এ ধরনের একান্ত সান্নিধ্য লাভের পবিত্র অনুভূতি তাকে আশে-পাশের সব কিছু ভুলিয়ে দেয় এবং তার মনকে অন্য সবার থেকে সরিয়ে নেয়। তখন তারা তায়ালা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না, হৃদয়ের গভীরে তাঁকে ছাড়া তারা আর কাউকে অনুভব করে না, এ বিশ্বের অস্তিত্বের সব কিছুই তখন তাদের কাছে অর্থহীন হয়ে যায়, তখন যাবতীয় ক্লেদ থেকে মুক্ত হয়ে তাদের হৃদয়গুলাে পবিত্রতায় ভরে যায় এবং তাদের মনমগজ পৃথিবীর যাবতীয় সংকীর্ণতা ও আত্মম্ভরিতার আবর্জনা থেকে পরিষ্কার হয়ে ধুয়ে মুছে যায়, এসময় তাদের অন্তরের মধ্যে আল্লাহর অনুভূতি ছাড়া আর কারাে কথাই থাকে না… ফলে মাটির এ দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু তখন যেন মূল উৎসের সাথে সম্মিলিত হয়ে যায় এবং তাদের উদ্ভ্রান্ত-বিভ্রান্ত ও দিশেহারা আত্মাগুলাে তাদের বাঞ্ছিত পথ খুঁজে পায়, পৃথিবীর ধূম্রজালে আচ্ছাদিত তাদের অস্থির হৃদয় জীবনের আসল ঠিকানাটির সন্ধান পেয়ে ধন্য ও কৃতার্থ হয়ে যায়, তখন তার কাছে পৃথিবীর বস্তুবাদী মূল্যমান স্নান হয়ে যায়।

* যারা যে কোনাে বে-ফায়দা জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।’… বে-ফায়দা, অর্থহীন বা মানব জীবনের জন্যে সত্যিকারে যার কোনাে প্রয়ােজন নেই এমন যা কিছু, তা কথা হােক, কাজ হােক, মূল্যায়ন হােক বা চেতনা হােক, একজন মােমেন অবশ্যই এগুলাে থেকে দূরে থাকে। আবার এটাও একজন মােমেন খেয়াল করে যে, মানুষ যে কোনাে কথা কাজ ও ব্যবহার করবে তাতে দুনিয়াবী কল্যাণ বেশী না আখেরাতের কল্যাণ বেশী। এ হিসাবে অবশ্যই সে আখেরাতের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেবে, আল্লাহর স্মরণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার প্রত্যাশা তাকে সদা-সর্বদা সতর্ক করে রাখবে। তার মন-মগযে মানুষের অস্তিত্ব ও দিগন্ত ব্যাপী ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী ও বস্তু নিচয়ের মধ্যে পরিব্যাপ্ত মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর মহিমা বিরাজ করবে, সুনিপুণ ও বিস্ময়কর পরিচালনার কথা তার যুক্তি বুদ্ধির ওপর নিরন্তর প্রভাব বিস্তার করবে, আল্লাহর রাজ্যের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা সকল রহস্যরাজি এবং তার চিন্তা স্রোতকে সৃষ্টিজগতের মধ্যে বিরাজিত এই মহাবিশ্বের বিশালত্ব ভীষণভাবে আন্দোলিত করবে। ধরার সব কিছু তার হৃদয়াবেগকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেবে, তার আকীদাকে নিয়ন্ত্রিত করবে তার গােটা সত্ত্বাকে পবিত্র করার ক্ষেত্রে এবং তার বিবেককে সকল প্রকার আবিলতা মুক্ত করতে গিয়ে তার ব্যবহারকে সুন্দর করবে। পরিপূর্ণ ঈমানী জীবন গড়ে তােলার লক্ষ্যে যেসব গুণাবলী প্রয়ােজন সেগুলােকেও নিশ্চিত করবে, তাকে ‘আমর বিল মারূফ’ (অর্থাৎ শক্তি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ভালাে কাজের নির্দেশ দান) করতে এবং মন্দ কাজকে নিষেধ করতে উদ্বুদ্ধ করবে। নামাযের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এসব মহামূল্যবান গুণ দলীয় জীবনকে মতভেদ, বিশৃংখলা ও আনুগত্যহীনতার কলুষতা থেকে মুক্ত করে। আল্লাহর পথে দৃঢ়তার সাথে টিকে থাকতে এবং এ দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্যে সকল প্রকার দুঃখ কষ্ট ও কঠোরতা স্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করে। সকল প্রকার চেষ্টা সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে সাহায্য করার জন্যে, সকল প্রকার ঝুঁকি নিতে এবং শক্রর যে কোনাে আক্রমণ প্রতিহত করে দ্বীনকে মযবুত বানাতে তাকে উৎসাহিত করবে। এ কঠিন দায়িত্ব মােমেনের ঘাড় থেকে কখনাে নেমে যায় না এবং সে কখনাে এ দায়িত্ব থেকে উদাসীন হয় না, আর তার মনও কখনাে তাকে এ দায়িত্ব থেকে রেহাই দেয় না। এ মহান ও কঠিন দায়িত্ব পালনকে সে ফরযে আইন অথবা ফরযে কেফায়া বলে বুঝে। ফরযে কেফায়া এই জন্যে মনে করা যায় যে মানুষ তাে তার মানবীয় সীমাবদ্ধ প্রচেষ্টাই চালাতে পারে, যেহেতু তার বয়স সীমাবদ্ধ এবং তার শক্তিও সীমিত। তার নিজের জীবন দিয়ে সময় ও শ্রম দিয়ে যতােখানি সংশােধনী প্রচেষ্টা চালানাে তার পক্ষে সম্ভব ততােখানিই সে করতে পারে, আর প্রত্যেক মােমেন ব্যক্তি তার সকল সম্পদ, শ্রম ও চূড়ান্ত প্রচেষ্টা দ্বারা তার আদর্শ কায়েম এর কাজ করার জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্য মাঝে মাঝে মােমেন ব্যক্তি একটু ঢিল হয়ে যেতে পারে বা সে একটু আমােদ আহল্লাদ করতে পারে, বিচ্ছিন্ন এসব সম্ভাবনাকে মানুষের জন্যে একেবারে নাকচ করে দেয়া যায় না, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তারা ফুযুল বা নিরর্থক কাজে জড়িয়ে পড়বে এবং তারা তাদের সমস্ত শ্রম ও অর্থ বে-ফায়দা কোনাে কিছুর জন্যে ব্যয় করবে এটা আশা করা যায় না।

* মােমেনদের তৃতীয় গুণ হচ্ছে তারা রীতিমতাে যাকাত আদায় করবে অর্থাৎ আল্লাহর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পর অবশ্যই তারা বাজে কথা এবং বে-ফায়দা কাজ ও ব্যবহার পরিহার করে এবং এইভাবে তাদের অন্তর ও সম্পদকে তারা পবিত্র করবে। অন্তরের পবিত্রতা অর্জন করবে, যাবতীয় সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করবে এবং মানবতাকে সমুন্নত করার জন্যে তারা সর্বদা সচেষ্ট থাকবে, শয়তান মানুষকে দারিদ্রের ভয় দেখিয়ে যে ওয়াসওয়াসা দেয় সেই মরদূদ শয়তানের ওপর অবশ্যই তারা বিজয়ী হবে, তারা আল্লাহর কাছেই প্রতিদান ও পুরস্কার পাওয়ার জন্যে আশান্বিত থাকবে। হালাল পথে অর্জিত অর্থ সম্পদের পবিত্রতা তাদের জীবনের বাকি সব কিছুকে পবিত্র করে তুলবে। জরুরী অবস্থা ছাড়া তারা নিজেদের স্বার্থের কথাটাকে মােটেই বড় করে দেখবে না এবং সব সময় শুধু নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্যেই সংগ্রাম করবে না অন্যদের কথাও মনে রাখবে। মােমেনদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে এতো মধুর, এতাে সহানুভূতিপূর্ণ এবং পরস্পরের প্রতি এতে আস্থাপূর্ণ যে কারাে সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তারা কোনাে সন্দেহ পােষণ করবে না। প্রকৃত ঈমানদার মুসলমানরা অবশ্যই তাদের দলীয় জীবনের সংহতি বজায় রাখার জন্যে পরস্পর দরদী এবং আস্থাভাজন হবে, তারা হবে সুখে ও দুঃখে, সংকটে সমস্যায় দারিদ্র ও সচ্ছলতার সময়ে ও আনন্দঘন মুহূর্তে ও বেদনায় পরস্পরের প্রতি দরদী, প্রত্যেক ব্যক্তির স্বার্থ যাতে অক্ষুন্ন থাকে তার জন্যে গােটা সমাজের মধ্যে এক তীব্র অনুভূতি বজায় থাকবে, অক্ষমদের সমস্যাকে গােটা দলের সামষ্টিক সমস্যা বিবেচনায় তার সমাধানের জন্যে তারা সামগ্রিকভাবে চেষ্টা চালাবে এবং বিচ্ছিন্নতা ও ভাংগন থেকে তার দল ও দলীয় যিন্দেগীকে রক্ষা করা হবে গােটা দলের যৌথ দায়িত্ব।

* সুরা: আন্-নূর
আয়াত নং :-৩১

وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَ فُرُوْجَهُنَّ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَ لْیَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰى جُیُوْبِهِنَّ١۪ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ اِلَّا لِبُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اٰبَآئِهِنَّ اَوْ اٰبَآءِ بُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اَبْنَآئِهِنَّ اَوْ اَبْنَآءِ بُعُوْلَتِهِنَّ اَوْ اِخْوَانِهِنَّ اَوْ بَنِیْۤ اِخْوَانِهِنَّ اَوْ بَنِیْۤ اَخَوٰتِهِنَّ اَوْ نِسَآئِهِنَّ اَوْ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُهُنَّ اَوِ التّٰبِعِیْنَ غَیْرِ اُولِی الْاِرْبَةِ مِنَ الرِّجَالِ اَوِ الطِّفْلِ الَّذِیْنَ لَمْ یَظْهَرُوْا عَلٰى عَوْرٰتِ النِّسَآءِ١۪ وَ لَا یَضْرِبْنَ بِاَرْجُلِهِنَّ لِیُعْلَمَ مَا یُخْفِیْنَ مِنْ زِیْنَتِهِنَّ١ؕ وَ تُوْبُوْۤا اِلَى اللّٰهِ جَمِیْعًا اَیُّهَ الْمُؤْمِنُوْنَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ

আর হে নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখ এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে আর তাদের সাজসজ্জা না দেখায়, যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে। তারা যেন তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, তবে নিম্নোক্তদের সামনে ছাড়া স্বামী, বাপ, স্বামীর বাপ, নিজের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, নিজের মেলামেশার মেয়েদের, নিজের মালিকানাধীনদের, অধীনস্থ পুরুষদের যাদের অন্য কোন রকম উদ্দেশ্য নেই এবং এমন শিশুদের সামনে ছাড়া যারা মেয়েদের গোপন বিষয় সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ। তারা যেন নিজেদের যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের সামনে প্রকাশ করে দেবার উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।

*চারিত্রিক বিকৃতি রােধে কোরআনের কর্মসূচী : এরপর চলাচলের পথে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সেই আপদটি নিয়ে আলােচনা শুরু করা হচ্ছে, যা দৃষ্টি ও চলাচলের মধ্য দিয়ে বিপথগামিতায় প্ররোচিত করে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে…'(আয়াত ৩০-৩১) ইসলাম এমন একটা পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যেখানে সর্বক্ষণ যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি করা হয় না এবং সর্বক্ষণ যৌন ভাবাবেগকে উদ্দীপিত করার কার্যক্রম চালু থাকে। কেননা অব্যাহত যৌন সুড়সুড়িমূলক তৎপরতা সমাজে এমন কামােন্মাদনা সৃষ্টি করে, যা কখনাে প্রশমিত ও পরিতৃপ্ত হয় না। দৃষ্টি নিক্ষেপ, উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ভংগিতে চলাফেরা, সৌন্দর্য প্রদর্শন করে চলা এবং নগ্নতা এর কোনােটাই পাশবিক কামােন্মত্ততা সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোনাে সুফল বয়ে আনে না। মানুষের আত্মসংযমের ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে দেয়াই হচ্ছে এগুলাের একমাত্র স্বার্থকতা। আত্মসংযমের এই ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়ার পর যদি অবাধ যৌনাচারের সুযােগ দেয়া হয়, তাহলে সেটা হবে সমাজকে এক উদ্দাম উচ্ছৃংখলতা, বেলেল্লাপনা ও নৈরাজ্যের মধ্যে নিক্ষেপ করার শামিল। আর উত্তেজিত করার পর যদি কঠোর দমন নীতি অবলম্বন করা হয়, তাহলে স্নায়বিক রোগ ও মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়া অবশ্যম্ভাবী। এই শেষােক্ত ব্যাপারটা হবে এক ধরনের নির্যাতনমূলক কার্যক্রম। যৌন আবেগকে প্ররােচিত ও উত্তেজিত করার এ জাতীয় তৎপরতা প্রতিহত করা, নর নারীর স্বাভাবিক যৌন আবেগকে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বহাল রাখা এবং কোনাে কৃত্রিম উপায়ে তাকে উস্কে না দিয়ে তার পবিত্র ও নিরাপদ প্রয়ােগ অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করাই ইসলামের পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ার অন্যতম কর্মপন্থা। এক সময়ে বলা হতাে যে নরনারীর অবাধ দৃষ্ট বিনিময়, নিয়ন্ত্রণহীন আলাপ ও ভাবের আদান প্রদান, অবাধ মেলামেশা, পরস্পরের গােপনীয় অংগ প্রত্যংগ সম্পর্কে অবগতি, ও নর নারীর মধ্যে অবাধ যােগাযােগ ইত্যাদি তাদের সম্পর্ককে স্বাভাবিকতা ও স্বাচ্ছন্দ দান করে, তাদের অবরুদ্ধ কামনা বাসনাগুলােকে স্বাধীন ও মুক্ত করে, মানসিক পীড়ন ও মনস্তাত্বিক জটিলতা থেকে রক্ষা করে, যৌন উৎপীড়ন ও চাপজনিত উত্তাপ ও উত্তেজনাকে প্রশমিত করে এবং অন্যান্য অবাঞ্ছিত দৈহিক ও মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করে। নর নারীর সম্পর্ককে অবাধ ও বল্লাহীন করার স্বপক্ষে এই প্রচারণা ফ্রয়েড ও তার সমমনা দার্শনিকদের রচিত বিভিন্ন মতবাদ প্রচারিত হবার ফলেই ব্যাপকতা লাভ করে। সেসব মতবাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সেই সমস্ত গুণ বৈশিষ্ট্য থেকে বঞ্চিত করা, যা তাকে পশু থেকে পৃথক ও উন্নত এক প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করে। মানুষকে পুরােপুরি পশুতে রূপান্তরিত করাই ছিলাে সেসব মতবাদের একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু উল্লেখিত প্রচারণা নিছক তাত্ত্বিক আন্দাজ অনুমান ছাড়া আর কিছু নয়। যেসব দেশে নর নারীর সম্পর্ক সবচেয়ে অবাধ, বাহীন ও স্বেচ্ছাচারিতায় পূর্ণ এবং সব রকমের সামাজিক, নৈতিক, ধর্মীয় ও মানবীয় কড়াকড়ি বর্জিত, সেসব দেশে আমি স্বচক্ষে যা দেখেছি, তা সে প্রচারণাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও অসার প্রতিপন্ন করে। আমি সেসব দেশে প্রত্যক্ষ করেছি যে, নগ্নতা ও অবাধ মেলামেশা যতাে রকমের ও যতাে আকারের হতে পারে, তার সবই সেখানে বিদ্যমান এবং তাতে বিন্দুমাত্রও কোনাে কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু এর ফলে যৌন আবেগ কিছুমাত্র পরিচ্ছন্ন ও পরিশীলিত হয়নি, বরং এর ফলে যৌনতা আরাে বল্লাহীন, উদ্দাম, অবাধ ও স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে। এ উন্মত্ততা ও স্বেচ্ছাচারিতা কোনােক্রমেই শান্ত ও পরিতৃপ্ত তাে হয়নি, উপরন্তু তা আরাে উগ্র ও আরাে তৃষ্ণার্ত রূপ ধারণ করেছে। যে সমস্ত মানসিক রােগ ও জটিলতা নিছক পর্দা প্রথার কারণে নারী সংগ লাভে ব্যর্থ ও বঞ্চিত থাকার কারণে সৃষ্ট হয় বলে মনে করা হতাে। সেগুলাে প্রচুর পরিমাণে দেখেছি। সেই সাথে সব ধরনের যৌন বিকৃতির হিড়িকও দেখেছি। এ সবই দেখা দিয়েছে সীমাহীন, বল্লাহীন ও অবাধ মেলামেশা ও প্রেম প্রণয়ের প্রত্যক্ষ ফল হিসাবে, যার উপস্থিতিতে কোনাে কিছুই আর নিষিদ্ধ থাকে না। প্রকাশ্য রাস্তাঘাটে নগ্ন দেহের প্রদর্শনী, যৌন সুড়সুড়ি দানকারী কার্যকলাপ- যার বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার অবকাশ এখানে নেই এবং অনুরূপ অন্যান্য উত্তেজক কর্মকান্ডই এ সব বিড়ম্বনার ফল। এ থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয় যে, ফ্রয়েড ও তার সমমনাদের সে সব মতবাদ পুনর্বিবেচনা করা প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। কেননা চাক্ষুস বাস্তবতাই গুলোকে মিথ্যা ও ভ্রান্ত প্রমাণিত করেছে। প্রাণীজগতের জন্ম ও বিকাশে নারী ও পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ সহজাত ও মজ্জাগত। কেননা আল্লাহ তায়ালা এ পদ্ধতিতেই পৃথিবীতে জীবনের বিস্তার ও মানুষের খেলাফত বাস্তবায়িত করেছেন। নর নারীর এই পারস্পরিক টান ও আকর্ষণ একটা স্থায়ী জিনিস। স্বাভাবিকভাবে তা কখনাে উত্তেজিত এবং কখনাে প্রশমিত হয়ে থাকে। তাকে ক্রমাগতভাবে উত্তেজিত করতে থাকলে তার তেজ ও তীব্রতা বাড়তেই থাকে এবং তাকে দৈহিক মিলনের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। কিন্তু সেই মিলন যখন সম্ভব হয় না, তখন উত্তেজিত স্নায়ুমন্ডলী অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এটা একটা সার্বক্ষণিক নির্যাতনে পর্যবসিত হয়। যৌন উত্তেজনা নানাভাবে সৃষ্টি হয়। কখনাে চাহনি দ্বারা, কখনাে আচরণ দ্বারা, কখনাে হাসি দ্বারা এবং কখনাে কৌতুক ও রসিকতা দ্বারা এর সৃষ্টি হয়ে থাকে। কখনাে বা আকর্ষণ প্রকাশকারী কথাবার্তা দ্বারাও এর সৃষ্টি হয়। এসব উত্তেজক উপকরণকে কমিয়ে রাখাই নিরাপদ, যাতে পারস্পরিক আকর্ষণ স্বাভাবিক সীমার মধ্যে থাকে এবং স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করে। এটাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত ও কল্যাণময় পথ। এর সাথে সাথে সে স্বভাব চরিত্রকে পরিশীলিতও করে এবং মানবীয় শক্তিকে শুধু রক্ত মাংসের চাহিদা পূরণের কাজে নিয়ােজিত না করে জীবনের। অন্যান্য কাজেও নিয়ােজিত করে। ফলে শুধু যৌন চাহিদা পূরণই মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় না। এ আয়াত দুটোতে নর নারী উভয়ের পক্ষ থেকে উত্তেজনা, প্ররােচনা ও বিকৃতির সুযােগ কিভাবে কমাতে হয়, তার কিছু নমুনা পেশ করা হয়েছে। যেমন, ‘ঈমানদার পুরুষদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। এটা তাদের জন্যে পবিত্রতম ব্যবস্থা। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত।’ পুরুষদের পক্ষ থেকে দৃষ্টি সংযত রাখা রিপু ও কূ-প্রবৃত্তি দমনের একটা উৎকৃষ্ট উপায় এবং নারীর চেহারা ও দেহের সুন্দর ও প্রলুব্ধকারী বৈশিষ্ট্যসমূহ জানার ইচ্ছা ও দেখার কৌতুহল সংযত করার এক স্বার্থক প্রচেষ্টা। এটা বিপথগামিতা ও অশ্লীলতার পথ বন্ধ করারও অব্যর্থ পন্থা। লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ দৃষ্টি সংযমেরই স্বাভাবিক ফল। অন্য কথায়, এটা মনােবাসনা নিয়ন্ত্রণ, আত্মসংযম এবং কু-প্রবৃত্তি দমনের পথের প্রাথমিক পদক্ষেপ। এ জন্যে এই দুটোকে একই আয়াতে একত্রিত করা হয়েছে। কারণ এ দুটোর একটা কারণ ও অপরটা ফল। মনােজগতে ও বাস্তবতার জগতে এ দুটো পর্যায়ক্রমিক পদক্ষেপ। এভাবে দুটোই পরস্পরের কাছাকাছি। ‘এটা তাদের জন্যে পবিত্রতম ব্যবস্থা।’ অর্থাৎ মনের ইচ্ছা ও আবেগকে পবিত্র রাখার সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবস্থা, অবৈধ ও অপবিত্র স্থানে যৌন চাহিদা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকার নিশ্চয়তার ব্যবস্থা এবং মানুষের ভাবাবেগকে পশুত্বের পর্যায়ে নেমে যাওয়া থেকে বিরত রাখার প্রকৃষ্ট উপায়। এটা সমাজ জীবনের শালীনতা, পরিচ্ছন্নতা, নারীদের মানসম্ভ্রম ও পরিবেশে সুস্থতা বজায় রাখারও সর্বোত্তম পন্থা। যেহেতু আল্লাহ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ও স্বভাবগত গঠন এবং তাদের দেহ ও মনের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল, তাই তিনিই তাদের চরিত্রের পবিত্রতা রক্ষার এই ব্যবস্থা করেছেন। ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত।’  *পর্দার বিধান অপরাধ দমনের নিশ্চিত গ্যারান্টি : আল্লাহ তায়ালা পুনরায় বলেন, ‘ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত ও লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে…’ অর্থাৎ পুরুষদের মনের সুপ্ত কদর্য বাসনাকে উস্কে দেয় এমন চোরা চোরা ও বুভূক্ষু চাহনি এবং ইংগিতপূর্ণ ও উত্তেজক দৃষ্টি নিক্ষেপ থেকে যেন বিরত থাকে। আর এমন পবিত্র ও বৈধ পন্থায়ই যেন লজ্জাস্থানকে ব্যবহৃত হতে দেয়, যা পরিচ্ছন্ন ও নিরুদ্বেগ পরিবেশে দেহের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করে এবং এভাবে যে সন্তান জনুগ্রহণ করবে, তারা যেন সমাজের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা না পায়। ‘আর তাদের সাজ সজ্জাকে যেন প্রকাশ না করে, কেবল আপনা থেকে যা প্রকাশিত হয়ে পড়ে তা ছাড়া।’ বস্তুত নারীর স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগত দাবী অনুসারেই সাজ-সজ্জা করা বৈধ। সুন্দরী হওয়া ও সুন্দরী সাজা প্রত্যেক নারীর মজ্জাগত ইচ্ছা। সময়ের ব্যবধানে আকৃতিগতভাবে সাজ গােছের রকম ফের হতে পারে, কিন্তু তার স্বভাবগত ও প্রকৃতিগতভাবে তা মূলত একই রকম। সেটা এই যে, প্রত্যেক নারীই পুরুষদেরকে আকৃষ্ট করার জন্যে সৌন্দর্যমন্ডিত হতে চায়, আর জন্মগত সৌন্দর্য পুরুষদের আকৃষ্ট করার জন্যে যথেষ্ট না হলে সাজ সজ্জা দ্বারা সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দান করতে চায়। ইসলাম এই সহজাত ইচ্ছাকে প্রতিহত করে না। সে শুধু একে সুশৃংখল ও পরিশীলিত করে। সে চায় প্রত্যেক নারী তার সাজ সজ্জা ও সৌন্দর্য শুধু একজন পুরুষকে দেখতে দিক, যে তার জীবন সংগী। কেননা এই জীবন সংগী তার জীবনের এমন অনেক কিছুই দেখবার অধিকারী, যা অন্য কেউ দেখবার অধিকারী নয়। তবে তার সৌন্দর্য ও সাজ সজ্জার কিছু অংশ জীবন সংগী ছাড়া মহররম ও এই আয়াতের পরবর্তী অংশে বর্ণিত পুরুষরাও দেখতে পারে। কেননা তাতে এসব। পুরুষের মধ্যে কামাে্তেজনার সৃষ্টি হয় না। পক্ষান্তরে সৌন্দর্যের যে অংশটুকু এমনিতেই প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তা হচ্ছ হাত ও মুখের সৌন্দর্য। এটুকু উন্মুক্ত করা জায়েজ আছে। কারণ রাসূল(স.) হযরত আবু বকরের মেয়ে আসমাকে বলেছিলেন, ‘হে আসমা, একজন বয়ােপ্রাপ্তা মেয়ের হাত ও মুখমন্ডল ছাড়া আর কিছু খােলা বৈধ নয়।’ আর তারা যেন তাদের চাদর বুকের ওপর জড়িয়ে রাখে।’ ‘জাইব’ শব্দটা দ্বারা এখানে বুকের ওপর কাপড়ের সংযােগস্থলকে বুঝানাে হয়েছে। আর ‘খেমার হলাে মাথা, গলা ও বুক ঢাকার চাদর বা ওড়না। এই ওড়না বা চাদর দিয়ে বুক ঢাকতে বলার উদ্দেশ্য নারীর দেহের বিপজ্জনক স্থানগুলােকে শিকারী চোখ থেকে এমনকি আকস্মিক দৃষ্টি থেকেও নিরাপদ রাখা। এগুলােকে উন্মুক্ত রাখা হলে এগুলাের ওপর যাদের নযর পড়তাে, তাদের জন্যে তা পরবর্তী সময়ে কূ-প্ররােচনার উৎস হতে পারতাে। মােমেনদের মনকে আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে নিক্ষেপ করতে চান না। যে সকল ঈমানদার নারীর প্রতি এই নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছিলাে, তাদের অন্তর আল্লাহর জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় ছিলাে এবং সৌন্দর্য ও সাজ সজ্জা প্রকাশের স্বাভাবিক আগ্রহ তাদের মধ্যে থাকলেও তাদের ভেতর স্বামীর আনুগত্য কোনো কমতি ছিলাে না। জাহেলী যুগের নারীরা পুরুষদের সামনে বুক ফুলিয়ে চলতাে এবং তাতে কোনাে আবরণ জড়াতাে না। তারা তাদের ঘাড়, চুল কান খােলা রেখেই চলাফেরা করতাে। যখন আল্লাহ তায়ালা নারীদেরকে চাদর দিয়ে বুক ঢাকার নির্দেশ দিলেন এবং আপনা থেকে প্রকাশিত হওয়া অংশ ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা অপর পুরুষের সামনে খুলতে নিষেধ করলেন, তখন তারা এই নিষেধাজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। হযরত আয়শা বলেন, প্রাথমিক যুগের মােহাজের মহিলাদের ওপর আল্লাহ তায়ালা রহমত বর্ষণ করুন। কেননা আল্লাহ তয়ালা যখনই নাযিল করলেন যে, তারা যেন তাদের বুকের ওপর চাদর বা ওড়না জড়িয়ে নেয়।’ অমনি তারা তাদের ব্যবহারের অন্যান্য কাপড় ছিড়ে তা দিয়ে ওড়না বানিয়ে বুক ঘাড় ইত্যাদি ঢাকতে শুরু করলেন। (বােখারী) হযরত সফিয়া বিনতে শায়বা বর্ণনা করেন যে, আমরা একদিন হযরত আয়েশা(রা.)-এর কাছে বসেছিলাম। তিনি কোরায়শ বংশীয় নারীদের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করছিলেন। তিনি বললেন, কোরায়েশী নারীদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি আনসারদের স্ত্রীদের চেয়ে আল্লাহর কেতাবের ভক্ত ও বিশ্বাসী আর কাউকে দেখিনি। যখন সূরা নূরের এই অংশ নাযিল হলাে, তারা যেন চাদর দিয়ে তাদের বুক ঢাকে তখন তাদের পুরুষরা তাদের কাছে ছুটে এলাে, সদ্য নাযিল হওয়া বিধানগুলাে তাদেরকে পড়ে শােনালেন এবং প্রত্যেক পুরুষ নিজ নিজ স্ত্রী, মেয়ে, বােন ও প্রত্যেক আত্মীয়কে তা পড়ে শােনাতে লাগলেন। এ আয়াত নাযিল হবার পর কোনাে মুসলিম মহিলা বসে থাকেনি। প্রত্যেকে নিজ নিজ কোমরবন্দ খুলে ওড়না বানিয়ে নিয়েছে, যাতে আল্লাহর নাযিল করা বিধান বাস্তবায়িত করা যায়। তারপর রসূল(স.)-এর পেছনে ফজরের সময় যতাে মহিলা নামাযে দাড়িয়েছে, তাদের সবাই ওড়না পরিহিত ছিলাে। (আবু দাউদ) বস্তু ইসলাম মুসলিম সমাজের রুচির উন্নতি ঘটিয়েছে এবং তার সৌন্দর্যবােধকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করেছে। সৌন্দর্যবােধের যে অশালীন রূপ রয়েছে, সেটা তার মনােপুত নয়। সুসভ্য মানবীয় সৌন্দর্যবােধই তার পছন্দনীয়। দেহকে অনাবৃত রাখার মাধ্যমে যে সৌন্দর্যবােধের প্রকাশ ঘটে সেটা অশালীন ও অসভ্যজনােচিত সৌন্দর্যবােধ। এ সৌন্দর্যের প্রতি কোনাে মানুষ যখন আকৃষ্ট হয়, তখন সে পাশবিক আবেগ অনুভূতি নিয়েই আকৃষ্ট হয়, চাই তা যতােই সুষ্ঠু ও সর্বাংগীন সুন্দর হােক না কেন। পক্ষান্তরে লজ্জা ও শালীনতার মধ্য দিয়ে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে, সেটাই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন সৌন্দর্য, সেটাই সৌন্দর্যবােধকে সমুন্নত করে, সেটাই মানুষের উপযােগী এবং সেটাই মানুষের চেতনা অনুভূতি ও মানসিকতাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে। আজও ইসলাম মুসলিম নারীদের মধ্যে এই পরিবর্তন সূচিত করে থাকে। যদিও সর্বত্র নিম্নমানের রুচিবােধ ও মানসিকতার ছড়াছড়ি, যদিও সমাজের অশালীন ও পাশবিক স্বভাবের ব্যাপক প্রচলন, যদিও সর্বত্র নগ্নতা, নির্লজ্জতা ও পশুসুলভ বেহায়ামি প্রকট তথাপি মুসলিম নারীরা স্বতস্ফূর্তভাবেই নিজ নিজ দেহের সৌন্দর্যকে ও আকর্ষণীয় অংশকে লুকিয়ে রাখতে সদা সচেষ্ট। যে সমাজের সর্বত্র নগ্নতা, অবাধ মেলামেশা, ঢলাঢলি ও বেলেল্লাপনার হিড়িক চলছে, যে সমাজে পশুদের মত নারীরা পুরুষদেরকে কুরুচিপূর্ণ ইংগিত দিতে অভ্যস্ত, সেই একই সমাজে বাস করে মুসলিম নারীদের এই শালীন ও পবিত্র চাল চলন বিস্ময়কর বৈ কি? এই লজ্জা, শালীনতা ও কঠোর পর্দা ব্যক্তি ও সমাজের নিরাপত্তার অন্যতম ব্যবস্থা। পক্ষান্তরে যেখানে বিপদের আশংকা নেই, সেখানে কোরআন পর্দার কড়াকড়ি শিথিল করে। এ জন্যে সাধারণত যাদের মধ্যে যৌন আকর্ষণ একেবারেই জাগে না, সেসব মহররম পুরুষ থেকে পর্দা না করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। যেমন বাপ দাদা, ছেলে, স্বামীদের বাপ দাদা ও ছেলেরা, ভাইরা ও ভাইয়ের ছেলেরা, বােনদের ছেলেরা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে মুসলিম নারীদের বেলায়ও এই বিধি শিথিল। তবে অমুসলিম নারীদের বেলায় নয়। কেননা তারা তাদের স্বামী, ভাই ও তাদের স্বজাতীয় পুরুষদের কাছে নিজেদের দেখা মুসলিম নারীদের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে পারে। বােখারী ও মুসলিম বর্ণিত এক হাদীসে রাসূল(স.) বলেছেন, কোনাে নারীর অন্য (বিধর্মী) নারীর সামনে নিজের দেহকে অনাবৃত করা উচিত নয়। তাহলে হয়তাে সে নিজ স্বামীর কাছে তার এমন বিবরণ দেবে যে তাকে তার স্বচক্ষে দেখার মতােই মনে হবে। এ ব্যাপারে মুসলিম নারীরা যথেষ্ট বিশ্বস্ত। ইসলাম তাদেরকে নিজ স্বামীর কাছে অন্য কোনাে মুসলিম নারীর দেহ ও সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে নিষেধ করে। ইসলাম দাসদের বেলায়ও পর্দার বিধিনিষেধ শিথিল করে। কেউ কেউ বলেন, শুধু দাসীদের বেলায়। আবার কেউ কেউ বলেন, দাসদের বেলায়ও। কেননা কোনাে দাস তার মহিলা। মনীবের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করে না। তবে প্রথম মতটাই ভালাে। অর্থাৎ পর্দার শিথীলতা শুধু দাসীর মধ্যে সীমিত রাখাই উত্তম। কেননা দাস তাে রক্ত মাংসেরই মানুষ। সাময়িকভাবে তার অবস্থা যতােই ভিন্নতর হােক না কেন তার মধ্যে যৌন আকর্ষণ সৃষ্টি হতেও পারে। পর্দার বিধান আরাে শিথিল করা হয়েছে, সেসব পুরুষের ক্ষেত্রেও, যারা কোনো কারণবশত নারীদের প্রতি যৌন আকর্ষণ পােষণ করে না। যেমন নপুংশক, নির্বোধ, পাগল কিংবা অন্য এমন কোনাে প্রতিবন্ধী পুরুষ, যার নারীর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টিতে কোনাে গুরুতর বাধা রয়েছে। কেননা এক্ষেত্রে কোনাে বিপদ বা প্রলুব্ধতার আশংকা নেই। অনুরূপভাবে ‘যে শিশু নারী দেহের গােপনীয়তা সম্পর্কে অবহিত নয়।’ তাকেও এই কড়াকড়ির আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সেসব শিশু যাদের নারীর দেহ কোনাে যৌন অনুভূতি জাগে না। যখন এই অনুভূতি জাগবে, তখন তাদের যৌবন প্রাপ্তি না ঘটলেও তারা এই কড়াকড়ির আওতায় পড়বে। একমাত্র স্বামী ছাড়া এসব বিপদমুক্ত পুরুষকে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত ব্যতীত শরীরের সকল অংশ দেখতে দেয়া জায়েয এবং তাদেরও শরীরের সকল অংশ দেখা নারীর জন্যে বৈধ। কারণ যে বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করা এই পর্দার উদ্দেশ্য, তা এখানে অনুপস্থিত। অবশ্য স্বামীর জন্যে স্ত্রীর দেহের সকল অংশ দেখা জায়েয। আর যেহেতু নারীর সতিত্ব ও সম্ভ্রমের সুরক্ষাই এই বিধানের উদ্দেশ্য, তাই আয়াতে নারীর এমন কার্যকলাপও নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা তার গুপ্ত সৌন্দর্যকে প্রকাশ করে অন্যের সুপ্ত যৌন আবেগকে উস্কে দেয়, যদিও সরাসরি তারা তাদের সৌন্দর্যকে প্রকাশ না করে। ‘তারা যেন এমন জোরে জোরে পা না ফেলে, যাতে তাদের লুকানাে সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়ে পড়ে।’ এ উক্তি থেকে বুঝা যায় যে, মানুষের মন মানসিকতা, গঠন প্রক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আল্লাহর জ্ঞান কতো গভীর যার ভিত্তিতে তিনি এ নির্দেশ দিয়েছেন। এ দ্বারা বুঝা যায় যে, অনেক সময় চাক্ষুস দর্শনের চেয়ে কল্পনা যৌন আবেগ উস্কে দেয়ার ব্যাপারে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে থাকে। কেউ কেউ এমনও আছে, যাদের যৌন আবেগ নারীর দেহ দর্শনের চেয়েও তার জুতাে, পােশাক বা গহনা দর্শনে অধিকতর উত্তেজিত হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে, অনেকে এমনও আছে, যার সামনে নারীর প্রকাশ্য উপস্থিতির চেয়ে তার কল্পনা তাকে অধিকতর উত্তেজিত করে থাকে। এসব উপসর্গ আধুনিক মনােব্যাধি বিশেষজ্ঞদের কাছে সুপরিচিত। এ ছাড়া দূর থেকে গহনার শব্দ শ্রবন ও আতর বা সেন্টের সুবাস গ্রহণ বহু পুরুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করে, তাদের স্নায়ুতন্ত্রীকে উত্তেজিত করে এবং তাদেরকে এমনভাবে আলােড়িত ও প্রলুব্ধ করে যে, তা থেকে তারা কিছুতেই নিস্তার পায় না। কোরআন এই সমস্ত জটিল সমস্যার সমাধান দেয়। কেননা যিনি এ কোরআন নাযিল করেছেন তিনিই মানুষ সহ যাবতীয় সৃষ্টির স্রষ্টা এবং তিনি তার সৃষ্টি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত। তিনি সুক্ষ্মদর্শী সর্বজ্ঞ। সবার শেষে সকল মােমেনের অন্তরকে আল্লাহর দিকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে এবং কোরআন নাযিল হবার পূর্বে কৃত সকল গুণাহ থেকে তাওবা করার নির্দেশ দিয়ে তাওবার সুযােগ উন্মুক্ত করা হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা তােমরা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, হয়তাে তােমরা সফলকাম হবে।’ এভাবে আল্লাহর তদারকী, তত্ত্বাবধান ও দয়াশীলতা সম্পর্কে সকলকে সচকিত করা হয়েছে, বিপরীত লিংগের প্রতি মানুষের সুগভীর স্বাভাবিক দুর্বলতায় তিনিই যে একমাত্র সাহায্যকারী এবং তার অনুভূতি ও ভীতিই যে তাকে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করতে পারে, সে কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

* মােমেনদের চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ‘তারা তাদের লজ্জাস্থানগুলাের হেফাযতকারী হবে। প্রকৃতপক্ষে এটাই হচ্ছে রূহ বা আত্মার হেফাযত এবং মুসলমানদের গােটা দলের হেফাযতের উপায়ও এখানে। এই হেফাযতের মাধ্যমেই ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। লজ্জাস্থানসমূহকে হেফাযতের মাধ্যমে হালাল বিষয়গুলাে বহির্ভূত অন্য সব কিছুর খারাপ থেকে বাঁচা যায়। অন্তরের হেফাযতের মাধ্যম হালাল বিষয় ছাড়া অন্যসব কিছু নিয়ে মাথা ঘামানাে থেকে দূরে থাকা যায় এবং বেহিসাবী প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানােকে যখন মানুষ কন্ট্রোল করে তখন গােটা দলের মধ্যে শান্তি-শৃংখলা ও নিরাপত্তা বিরাজ করে এবং ব্যক্তি ও বংশ পরিবারগুলাে বিভিন্নমুখী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা পায়। আর যে মানব গােষ্ঠীর মধ্যে অনিয়মিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে যৌনাচার চলে; সেখানে অবশ্যই শান্তি শৃংখলা বিনষ্ট হয় এবং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা নষ্ট হয়। কেননা পারস্পরিক অবিশ্বাসের কারণে পরিবার তথা মানব সমাজে কোনাে শান্তি থাকে না আর পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও কারাে প্রতি কারো কোনাে মর্যাদাবােধ থাকে না, যেহেতু পরিবারই হচ্ছে সমাজ সংগঠনের প্রথম ভিত্তি। এই সূতিকাগারেই মানব শিশুর জন্ম ও বুদ্ধি। এখানকার শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও পবিত্রতার রক্ষাকবচ হচ্ছে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা, আর তা আল্লাহর ভয়ে গড়ে ওটা সুনিয়ন্ত্রিত যৌন ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এখানকার নিরাপত্তা ও শৃংখলার কারণে বাপ-মা নিশ্চিন্তে ও তৃপ্তির সাথে এই সূতিকাগারে তাদের বাচ্চাকে প্রতিপালন করে। এই সূতিকাগারের পরিচালক তাে এই পিতামাতাই। এদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও মহাব্বত গড়ে তােলা ও এদের নিরাপত্তা বিধান করা দেশের আইন সংস্থা তথা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে সেই সরকারই সফল হতে পারে যার মধ্যে আল্লাহর ভয় ও তার আনুগত্য আছে। যে জনসমাজে লাগামহীন যৌনচার চলতে থাকে সেটা হচ্ছে এক পাপপঙ্কিলময় সমাজ, সে সমাজ গােটা মানব জাতিকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করে, মানুষকে যে মানদন্ড এই অপরাধ করা থেকে বাঁচাতে পারে তা হচ্ছে ইচ্ছার এবং সদিচ্ছাকে বিজয়ী করার সংকল্প। এর সাথে প্রবৃত্তির চাহিদা সুন্দর ও ফলপ্রসূভাবে নিয়ন্ত্রণ করার মনােভাবও থাকতে হবে। এই নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃংখলা আজকের আধুনিক সমাজে কিছুতেই আশা করা যায় না, যেখানে নিয়মিত মেলামেশা বাচ্চাদের মনের লজ্জা শরমকে দূর করে দিচ্ছে। বাচ্চারা জন্মের পর থেকে সব থেকে বেশী কাছে পায় বাপ-মাকে, নিজেদের অজান্তেই তাদের ভাবধারা, অভ্যাসসমূহ এবং কাজ কর্ম তাদের অন্তরে গভীরভাবে অংকিত হতে থাকে। সন্তানরা মায়ের পর সর্বপ্রথম বাপকেই চেনে এবং তার অনুসরণ করে। এর ব্যতিক্রম যদি হয় তা ব্যতিক্রমই, সেটাকে সাধারণ নিয়ম বলে কেউ মেনে নেয় না। অপরদিকে রয়েছে নিকৃষ্ট পদের নিয়ম, সেখানে নরপশুর শুক্র মাদী পশুর জরায়ুতে পৌছে দেয়া হয়, এর ফলে যে বাচ্চা পয়দা হয় সে জানে না তার বাপ-কে, সে জানে না সে কেমন করে ধরা পৃষ্ঠে আগমন করলাে এবং কোন উপায়ে হলাে একটি জীব হিসাবে তার সৃষ্টি হলাে। এখানে পুরুষরা কোথায় তাদের বীজ বপণ করবে সেই স্থানগুলােকে আল কোরআন সীমাবদ্ধ করে দিয়ে বলছে, ‘একমাত্র তাদের স্ত্রীরা ও সেই সকল দাসী যাদের ওপর তাদের ন্যায়ানুগ কর্তৃত্ব রয়েছে, সেখানে তাদেরকে কোনাে দোষ দেয়া হবে না।’ বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর জীবন যাপন করা বা বৈবাহিক সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে কোনাে তর্ক-বিতর্ক করার সুযােগ নেই, কেননা সকল যামানায়, সকল দেশে এবং সকল সমাজেই লােকদের মধ্যে এটা হচ্ছে সর্বজন স্বীকৃত নিয়ম। এখন দাসীর ওপর যতাে মানুষের ওপর কর্তৃত্ব লাভের প্রশ্নটির একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়ােজন। তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে দাসীদেরকে ব্যবহার করা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা এসেছে। সেখানে আলােচনা করা হয়েছে যে, যখন দাসী সম্পর্কিত এ আয়াতগুলাে নাযিল হয়, তখন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাবে দাস প্রথা চালু ও স্বীকৃত ছিলাে। আর এখনও বন্দী-বিনিময় না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস দাসী হিসাবে ব্যবহারের রীতি চালু আছে, যেহেতু ইসলাম মুসলমানরা সেসব দেশ ও শক্তিসমূহের সাথে যুদ্ধরত ছিলাে- যারা বস্তুগত শক্তিতে এগিয়ে ছিলাে। সেই সময়ে একতরফাভাবে তাদের ওপর দাসত্ব প্রথা রহিত করার নিয়ম চাপিয়ে দেয়া সম্ভবও ছিলাে না। এটা করতে গেলে (মহিলাসহ) মুসলমান বন্দীরা অবশ্যই শত্ৰু দেশের হাতে থেকে যেতাে, এজন্যে যুদ্ধবন্দী ছাড়া দাসত্ব প্রথার অন্যান্য উৎসগুলােকে ইসলাম গুটিয়ে ফেলেছে এবং গােটা মানব জাতির জন্যে বন্দী বিনিময়ের ভারসাম্যপূর্ণ নীতির পক্ষে স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। এই সময় ইসলামী সেনাদলের ছাউনীতে বন্দীনীদের আগমন শুরু হলাে। যখন বন্দী বিনিময় নিয়ম অনুসারে বন্দীবিনিময়ও হতে থাকে তখন এই দাসীদের রাখার প্রয়ােজনে তাদেরকে কিভাবে রাখা হবে তার জন্যে নীতিও নির্ধারণ করে দেয়া হলাে। বিবাহের মাধ্যমে তাদেরকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া যাবে না, কিন্তু তাদেরকে স্ত্রীর মতাে ব্যবহারের জন্যে ইসলাম অনুমতি দিলাে। স্থির হলাে যাদের জন্যে এদেরকে ভাগ করে দেয়া হবে তারা এদেরকে ব্যবহার করতে পারবে এবং এক এক জনকে এক এক জনের পূর্ণ কর্তৃত্বে সােপর্দ করা হবে। তবে, ওদের মধ্যে কেউ যদি ইসলাম অনুমােদিত পন্থাসমূহের যে কোনাে একটি অনুযায়ী মুক্তি লাভ করতে চায় তাহলে তাকে আর সেভাবে ব্যবহার করা যাবে না। এভাবে ব্যবহার করার অনুমতি সম্ভবত এই অবস্থাকে সামনে রেখে দেয়া হয়েছে যে, মানুষ হিসাবে সে বন্দী মহিলাদেরও তাে প্রাকৃতিক প্রয়ােজন আছে। যদি তাদের জন্যে অনুমােদিত কোনাে পদ্ধতি খােলা না রাখা হয় তাহলে উচ্ছৃংখলতার নিন্দনীয় অবস্থায় তারা পতিত হবে এবং সেই দায়িত্বহীন পন্থায় তারা জীবন যাপন করবে যা আজকের আধুনিক সমাজে সেনাঘাঁটিগুলােতে যুদ্ধ বিনিময় চুক্তি মেনে নেয়া সত্তেও অবাধে চলছে। এমন যৌন উচ্ছৃংখলতা ইসলাম অনুমোদন করে না। কিন্তু এটাকে ইসলাম কোনাে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসাবেও রেখে দেয়নি, বরং ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে তাদেরকে বিভিন্ন পন্থায় স্ত্রীর মর্যাদা বা স্বাধীন হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে, যেমন, এক. বন্দী বিনিময় চুক্তির ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভ করে তারা নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ পরিবারের সাথে মিলিত হতে পারে। দুই. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মানসে বা কারাে কোনাে গুনাহের কাফফারা দান করতে গিয়ে কেউ কোনাে দাসীকে মুক্তি দিলে সে দাসী মুক্তি পেতে পারে। তিন. অর্থের বিনিময়ে মুক্তি লাভে ইচ্ছুক কোনাে মহিলা নিজেকে মুক্ত করতে পারে। চার. মনিবের ঔরসজাত কোনাে সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর সে মনিবের মৃত্যু হলে সে দাসী আপনা থেকেই স্বাধীন হয়ে যাবে। পাঁচ. মনিব যদি কোনাে সময়ে তার দাসীর চেহারার ওপর আঘাত করে, তাহলে তার কাফফারা হিসাবে সে দাসী মুক্তি লাভ করবে।(দেখুন মােহাম্মদ কুতুব রচিত ‘শােবাহাতুন হাওলাল ইসলাম’ গ্রন্থের দাসী’ সম্পর্কিত অধ্যায়) যাই হােক, বন্দী রাখা বা দাসত্ব প্রথা ইসলাম যুদ্ধকালীন সময়ের জন্যে সাময়িকভাবে অনুমােদন করেছে এবং এটাকে একটা অপরিহার্য সাময়িক প্রয়ােজন বলে জানিয়েছে। বন্দী বিনিময়ের প্রয়ােজন অনুভব করে সারা বিশ্বে এখন পারস্পরিক সম মর্যাদার ভিত্তিতে যে সমঝােতা গড়ে উঠেছে তারই ভিত্তিতে যুদ্ধ বন্দী বিনিময় আন্তর্জাতিকভাবে এখন স্বীকৃত এক নীতি হিসাবে গৃহীত হয়েছে। এটাকে কখনাে ইসলামের সমাজ বিধির অংশ মনে করা হয়নি। এরশাদ হয়েছে, ‘অতপর, যদি কোনাে ব্যক্তি এই নির্ধারিত সীমা লংঘন করে (যারাই এ সীমার বাইরে যাবে) তারাই হবে সীমা অতিক্রমকারী।’… অর্থাৎ, স্ত্রী ও দাসী ছাড়া অন্য যে কোনাে পদ্ধতিতে যারাই যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে তারাই হালাল পথের বাইরে চলে যাবে, পরিস্কার হারামে পতিত হবে। এ হারাম অবস্থায় যে পৌছে যাবে সে নিজেকে ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে দেবে, কারণ এ চেতনা তাকে অনবরত দংশন করতে থাকবে যে সে এমন চারণ ক্ষেত্রে বিচরণ করছে যা তার জন্যে হালাল নয়। এভাবে সে নিজেকে এবং নিজের ঘরকে ধ্বংস করবে, কারণ (হারাম পথে যাওয়ার কারণে) তার মনে কোনাে শাস্তি থাকবে না এবং নিজেকে সে আযাব থেকে নিরাপদও মনে করতে পারবে না এবং সে সমাজকেও সে ধ্বংস করবে, কারণ তার সীমাহীন লােভের নেকড়েগুলাে এখানে ওখানে নির্বিচারে যারা বিচরণ করে সেই শান্তি বেষ্টনীকে ধ্বংস করে দেবে যাকে ইসলাম রক্ষা করতে চেয়েছে।

* মােমেনদের পঞ্চম গুণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যারা তাদের আমানত ও ওয়াদাসমূহকে রক্ষা করে অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে ও দলীয় পর্যায়ে তাদেরকে যেসব আমানত দেয়া হয় তার হক তারা আদায় করে এবং কোনাে মুসলিম ব্যক্তি বা দল যদি কারো সাথে কিছু ওয়াদা করে তাহলে সে ওয়াদা তারা পূরণ করে। ব্যক্তিগতভাবে পরিশােধযােগ্য যেমন বহু আমানত আছে, তেমনি দলীয়ভাবেও অনেক আমানতের হক আদায় করতে হয়। এর মধ্যে প্রথম হচ্ছে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি, মেজাজ ও চরিত্রের আমানত। প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথক মেজাজ রুচি, চাহিদা ঝোক প্রবণতা ও বিশেষ বিশেষ কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন যেগুলােকে তারা আল্লাহর নিয়ম ও ইচ্ছাতেই হাসিল করেছে। চিন্তা করলে সৃষ্টির এসব স্বাভাবিক নিয়মের মধ্য দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের সাক্ষ্য পাওয়া যায়, এসব কিছুর মধ্য দিয়ে একথার প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং সকল ক্ষমতা এককভাবে একমাত্র তাঁরই। আন্তরিকভাবে মানুষ একথা বুঝে যে, সারাবিশ্বের সর্বত্র একটিমাত্র নিয়ম চালু আছে, যার অধীনে সব কিছু নড়াচড়া করছে, বেঁচে আছে এবং সেই একই নিয়মে তাদের জীবনাবসান হচ্ছে, মহান সেই আল্লাহর ইচ্ছাই সর্বত্র কার্যকর রয়েছে, সকল নিয়মের নিয়ামক একমাত্র তিনি। প্রকৃতির বুকে বিরাজমান সারা বিশ্ব প্রকৃতির সবকিছু এ নিয়মের অধীনে চলছে, তারা এসব নিয়ম-বিধান মানতে বাধ্য; মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কিছু স্বাধীনতা দিয়েছেন। এ স্বাধীনতা হচ্ছে তার ইচ্ছা শক্তি পরিচালনার করার, কিন্তু তার শরীরের অংগ প্রত্যংগে, তার চাহিদা এবং তার স্বভাব প্রকৃতিতে আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন কিছু প্রয়ােজন, এসব কিছুকে পরিচালনা করার জন্যে তিনি কিছু নিয়মও দিয়েছেন। এসব নিয়ম অনুযায়ী চললে মানুষেরই কল্যাণ হবে- এ বুঝ শক্তিও তিনি তাকে দিয়েছেন, এটাই হচ্ছে তার জন্যে আল্লাহর দেয়া সব থেকে বড় নেয়ামত ও আমানত, বিশেষ করে মােমেনদের জন্যে এটাই বড় আমানত। তারা প্রকৃতির চাহিদাকে অস্বীকার করবে না, পরিত্যাগ করবে না, এ চাহিদা পূরণের জন্যে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের দেয়া বিধান রূপ আমানতের হক তারা আদায় করবে এবং তার হুকুম মতােই তাদের সকল প্রাকৃতিক চাহিদা মেটাবে। প্রকৃতির সব কিছুর মতােই মানুষের সাথে আল্লাহর প্রথম চুক্তি সংঘটিত হয়েছিলাে। এ হচ্ছে সেই চুক্তি যা সৃষ্টির সূচনাতে সর্বপ্রথম মানুষ আল্লাহর সাথে করেছিলাে। এ চুক্তির শর্ত ছিলাে মানুষ একমাত্র আল্লাহকে রব বলে মানবে ও জীবনের সকল ক্ষেত্রে সর্বদা তাঁরই আনুগত্য করবে। এই প্রথম চুক্তির ওপরেই গড়ে উঠেছে পরবর্তী কালের সম্পাদিত সকল চুক্তি। অতপর মােমেন কারাে সাথে যে কোনাে চুক্তি বা ওয়াদা করে আল্লাহকে সাক্ষী রেখেই তা করে এবং আল্লাহর ভয়েই সে চুক্তি বা ওয়াদা তারা পূরণ করে। মুসলিম জামায়াত সকল প্রকার আমানত রক্ষা করবে বলে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তারা আমানত রক্ষা করছে কিনা বা ওয়াদা পূরণ করছে কিনা সে বিষয়ে তারা আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার খেয়াল রাখে এবং তার কাছেই নিজেদেরকে দায়ী মনে করে। এই মূলনীতির ভিত্তিতেই পর্যায়ক্রমে মােমেনের জীবনের সব কিছু পরিচালিত হয়। আল কোরআন সংক্ষেপে মানুষকে সকল প্রকার চুক্তি রক্ষা ও ওয়াদা পূরণের জন্যে নির্দেশ দিয়েছে এবং খাস করে মােমনদের সম্পর্কে জানিয়েছে যে তারা সকল প্রকার ওয়াদা ও আমানতের মর্যাদা রক্ষা করে। মােমেনের জীবনে ওয়াদা পূরণের এ গুণটি হচ্ছে একটি স্থায়ী গুণ। এ ওয়াদা পূরণের জন্যে তারা সকল সময়ে সজাগ ও বদ্ধপরিকর থাকে। ওয়াদা পূরণ ও পারস্পরিক চুক্তি রক্ষায় দৃঢ় না থাকলে কোনাে দলীয় জীবন ম্যবুত হতে পারে না। এগুণটির অভাবেই দলীয় সংহতি বিপর্যস্ত হয়, দলের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্ট হয়। কেউ কারাে ওপর নির্ভর করতে পারে না এবং সংকট সমস্যায় সদিচ্ছা থাকা সত্তেও একে অপরকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়। মানুষ সামাজিক জীব বিধায় নানা সংকট সমস্যায় পারস্পরিক সাহায্য সহযােগিতার মুখাপেক্ষী হয়, কিন্তু এই মৌলিক গুণের অভাবে তাদের পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্য সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়।

* এরপর সাফল্যমন্ডিত মােমেনদের ৬ষ্ঠ গুণ সম্পর্কে জানানাে হচ্ছে যে, ‘তারা তাদের সকল নামাজের হেফাযতকারী হয়।’ তারা কখনাে অলসতাবশত বা হেলায় ও খেলায় নামায পরিত্যাগ করে না- যেভাবে তাদেরকে নামায কায়েম করতে বলা হয়েছে সেই ভাবেই তারা নামায কায়েম করে। তারা কখনাে পরিবার ও প্রতিবেশীদের মধ্যে নামায ও নামাযের পরিবেশ গড়ে তােলার ব্যাপারে পিছপা হয় না। তারা নিয়মিতভাবে নামাযের ফরজ ও সুন্নাত সমুহ আদায় করে এবং সময় মতােই প্রত্যেক নামায আদায় করে। সঠিকভাবে তারা নামাযের সকল আহকাম ও আরকান আদায় করে এবং মন-প্রাণ ও অন্তরের আগ্রহ সহকারে তারা নামায আদায় করে, আদায় করে উচ্ছসিত হৃদয়াবেগ সহকারে। প্রকৃতপক্ষে নামাযই হচ্ছে বান্দা ও তার মনিবের মাঝে সব থেকে বড় ও মযবুত সেতুবন্ধ যােগাযােগ রক্ষাকারী কাজ। নামাযই মােমেন অন্তরের বিশ্বাসের প্রথম ও বাস্তব প্রমাণ এবং নামাজ ঈমানের প্রথম বহিপ্রকাশ। জামায়াতবদ্ধ নামায জানায় যে সে মুসলিম জামায়াতের একজন নিয়মিত সদস্য, নামাযই মুসলিম জীবনে শৃংখলা সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, পরিচ্ছন্নতা, পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযােগিতার মনােভাব আনে। সুতরাং, যারা নামাজ হেফাযত করে না, তারা মানুষে মানুষে সম্পর্ক সৃষ্টির কোনাে ধার ধারে না, তারা অন্তর প্রাণ দিয়ে নামাযের তাৎপর্য সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয় না। নামাযের গুরুত্ব যে কতাে বেশী তা বুঝাতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ রব্দুল আলামীন সাফল্যমন্ডিত মােমেনদের গুণাবলী বর্ণনায় শুরু করেছেন নামাযের গুণ দ্বারা এবং শেষ করেছেন এর হেফাযত-এর কথায় যাতে করে একথা বুঝানো যায় যে, ঈমানের বুনিয়াদ গড়ে তােলায় নামাযের ভূমিকা কতাে বড়ো এবং আনুগত্য প্রকাশ ও আল্লাহর দিকে একাগ্রতা প্রদর্শনে এই এবাদাতের অবদান কত বেশী।

* ওপরে বর্ণিত ছয়টি গুণ মােমেনদের সাফল্যের গ্যারান্টি হিসাবে আলােচ্য সূরাটি জানিয়েছে, বলেছে যাদের মধ্যে এ ছয়টি গুণ থাকবে তারা অবশ্যই সাফল্যমন্ডিত হবে। এ গুণগুলাে মােমেন দল ও সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদের মধ্যে সমভাবে ক্রিয়াশীল ও প্রভাব সৃষ্টিকারী হবে। যেসব মানুষের মধ্যে উক্ত গুণাবলী গড়ে উঠবে তারা যেখানেই থাকুক না কেন এবং যে জনপদেই বসবাস করুক না কেন অন্যদের ওপর তাদের প্রভাব পড়বেই এবং তারা মর্যাদাবান মানুষ বলে বিবেচিত হবে, তারা বিবেচিত হবে আল্লাহর কৃপাধন্য মানুষ হিসাবে। প্রকৃতপক্ষে এসব গুণাবলীর অধিকারী মানুষকে আল্লাহ তায়ালা পূর্ণত্ব দান করতে চেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা চান না, তার প্রিয়তম সৃষ্টি আশরাফুল মাখলকাত জীব জানোয়ারের মত জীবন যাপন করুক, পশুরা যেভাবে আহার বিহার করে তারাও সেইভাবে আহার বিহার করুক এটাও আল্লাহ তায়ালা চান না। যখন পৃথিবীতে গােটা মানব জাতির সবাই পশুত্বের স্তর পার হয়ে মানবতার পূর্ণ মর্যাদা লাভ করার চেষ্টা করছে তখন অন্তত যেসব মােমেনরা আল্লাহর পথে চলবে বলে অংগীকারাবদ্ধ, আল্লাহ তায়ালা চান, তারা মানবতার পূর্ণ বিকাশ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা রাখুক, যার জন্যে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাহলে তাদের জন্যে জান্নাতুল ফেরদাউস প্রস্তুত রয়েছে, যার ক্ষয় নেই, লয় নেই, যেখানে তারা চিরদিন থাকবে নিরাপদ নির্ভয়ে, স্থায়িত্বের নেই সীমা, নেই কোনাে শেষ। এদের সম্পর্কেই এরশাদ হচ্ছে, ‘তারাই হচ্ছে ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী, তারা সেখানে চিরদিন থাকবে।’ সকল সাফল্যের শেষ লক্ষ্যই তাে এই জান্নাত লাভ এবং মােমেনদের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা এই মনােরম বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখে দিয়েছেন। কোনাে মানুষ এর বাইরে আর কিছুই আশা করে না।

Leave a Reply