أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৫৮)
[ فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُم بَيْنَهُمْ زُبُرًا
কিন্তু পরে লোকেরা নিজেদের দ্বীনকে পরস্পরের মধ্যে টুকরো করে নিয়েছে।]
সূরা:- আল্-মুমিনূন।
সুরা:২৩
পারা:১৮
৪২-৫৬ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৩-৪২
ثُمَّ اَنۡشَاۡنَا مِنۡۢ بَعۡدِہِمۡ قُرُوۡنًا اٰخَرِیۡنَ ﴿ؕ۴۲﴾
তারপর তাদের পরে আমরা বহু প্রজন্ম সৃষ্টি করেছি।
২৩:৪৩
مَا تَسۡبِقُ مِنۡ اُمَّۃٍ اَجَلَہَا وَ مَا یَسۡتَاۡخِرُوۡنَ ﴿ؕ۴۳﴾
কোন জাতিই তার নির্ধারিত কালকে ত্বরান্বিত করতে পারে না, বিলম্বিতও করতে পারে না।
২৩:৪৪
ثُمَّ اَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا تَتۡرَا ؕ کُلَّمَا جَآءَ اُمَّۃً رَّسُوۡلُہَا کَذَّبُوۡہُ فَاَتۡبَعۡنَا بَعۡضَہُمۡ بَعۡضًا وَّ جَعَلۡنٰہُمۡ اَحَادِیۡثَ ۚ فَبُعۡدًا لِّقَوۡمٍ لَّا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿۴۴﴾
এরপর আমরা একের পর এক আমাদের রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি। যখনই কোন জাতির কাছে তার রাসূল এসেছেন তখনই তারা তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছে। অতঃপর আমরা তাদের একের পর এককে ধ্বংস করে তাদেরকে কাহিনীর বিষয় করে দিয়েছি। কাজেই যারা ঈমান আনে না সে সমস্ত সম্প্রদায়ের জন্য ধ্বংসই রইল!
২৩:৪৫
ثُمَّ اَرۡسَلۡنَا مُوۡسٰی وَ اَخَاہُ ہٰرُوۡنَ ۬ۙ بِاٰیٰتِنَا وَ سُلۡطٰنٍ مُّبِیۡنٍ ﴿ۙ۴۵﴾
অতঃপর আমি আমার নিদর্শন ও সুস্পষ্ট প্রমাণসহ মূসা ও তার ভাই হারূনকে পাঠালাম;
২৩:৪৬
اِلٰی فِرۡعَوۡنَ وَ مَلَا۠ئِہٖ فَاسۡتَکۡبَرُوۡا وَ کَانُوۡا قَوۡمًا عَالِیۡنَ ﴿ۚ۴۶﴾
ফেরাউন ও তার রাজ পারিষদদের কাছে। কিন্তু তারা অহংকার করলো এবং তারা ছিল বড়ই আস্ফালনকারী।
২৩:৪৭
فَقَالُوۡۤا اَنُؤۡمِنُ لِبَشَرَیۡنِ مِثۡلِنَا وَ قَوۡمُہُمَا لَنَا عٰبِدُوۡنَ ﴿ۚ۴۷﴾
তারা বলল, ‘আমরা কি আমাদেরই মত দু’ব্যক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন করব; অথচ তাদের সম্প্রদায় আমাদের দাসত্ব করে।’
২৩:৪৮
فَکَذَّبُوۡہُمَا فَکَانُوۡا مِنَ الۡمُہۡلَکِیۡنَ ﴿۴۸﴾
সুতরাং তারা তাদেরকে মিথ্যাবাদী বলল। ফলে তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হল।
২৩:৪৯
وَ لَقَدۡ اٰتَیۡنَا مُوۡسَی الۡکِتٰبَ لَعَلَّہُمۡ یَہۡتَدُوۡنَ ﴿۴۹﴾
আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম; যাতে তারা সৎপথ পায়।
২৩:৫০
وَ جَعَلۡنَا ابۡنَ مَرۡیَمَ وَ اُمَّہٗۤ اٰیَۃً وَّ اٰوَیۡنٰہُمَاۤ اِلٰی رَبۡوَۃٍ ذَاتِ قَرَارٍ وَّ مَعِیۡنٍ ﴿٪۵۰﴾
আর মারয়ামপুত্রও তার মাকে আমি একটি নিদর্শনে পরিণত করেছিলাম এবং তাদেরকে রেখেছিলাম একটি সুউচ্চ ভূমিতে, সে স্থানটি ছিল নিরাপদ এবং সেখানে স্রোতম্বিনী প্রবহমান ছিল।
২৩:৫১
یٰۤاَیُّہَا الرُّسُلُ کُلُوۡا مِنَ الطَّیِّبٰتِ وَ اعۡمَلُوۡا صَالِحًا ؕ اِنِّیۡ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ عَلِیۡمٌ ﴿ؕ۵۱﴾
হে রসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকর্ম কর; তোমরা যা কর, সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবগত।
২৩:৫২
وَ اِنَّ ہٰذِہٖۤ اُمَّتُکُمۡ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً وَّ اَنَا رَبُّکُمۡ فَاتَّقُوۡنِ ﴿۵۲﴾
নিশ্চয় তোমাদের এই জাতি একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব তোমরা আমাকে ভয় কর।
২৩:৫৩
فَتَقَطَّعُوۡۤا اَمۡرَہُمۡ بَیۡنَہُمۡ زُبُرًا ؕ کُلُّ حِزۡبٍۭ بِمَا لَدَیۡہِمۡ فَرِحُوۡنَ ﴿۵۳﴾
কিন্তু পরে লোকেরা নিজেদের দ্বীনকে পরস্পরের মধ্যে টুকরো করে নিয়েছে। প্রত্যেক দলের কাছে যা কিছু আছে তার মধ্যেই নিমগ্ন হয়ে গেছে।
২৩:৫৪
فَذَرۡہُمۡ فِیۡ غَمۡرَتِہِمۡ حَتّٰی حِیۡنٍ ﴿۵۴﴾
সুতরাং তুমি কিছুকালের জন্য তাদেরকে স্বীয় বিভ্রান্তিতে থাকতে দাও।
২৩:৫৫
اَیَحۡسَبُوۡنَ اَنَّمَا نُمِدُّہُمۡ بِہٖ مِنۡ مَّالٍ وَّ بَنِیۡنَ ﴿ۙ۵۵﴾
তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্য স্বরূপ যে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি তার দ্বারা,
২৩:৫৬
نُسَارِعُ لَہُمۡ فِی الۡخَیۡرٰتِ ؕ بَلۡ لَّا یَشۡعُرُوۡنَ ﴿۵۶﴾
তাদের জন্যে সর্বপ্রকার মঙ্গল ত্বরান্বিত করছি? বরং তারা বুঝে না ।
৪২-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
#নিদর্শনের পরে “সুস্পষ্ট প্রমাণ” বলার অর্থ এত হতে পারে যে, ঐ নিদর্শনাবলী তাঁদের সাথে থাকাটাই একথার সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিল যে, তাঁরা আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর। অথবা নিদর্শনাবলী বলতে বুঝানো হয়েছে “লাঠি” ছাড়া মিসরে অন্যান্য যেসব মু’জিযা দেখানো হয়েছেসেগুলো সবই, আর “সুস্পষ্ট প্রমাণ” বলতে “লাঠি” বুঝানো হয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে যে মু’জিযার প্রকাশ ঘটেছে সেগুলোর পরে তা একথা একবারেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এরা দু’ভাই আল্লাহর পক্ষ থেকে নিযুক্ত হয়েছেন,
# এসব নিদর্শন বলতে বুঝানো হয়েছে সেই নিদর্শনসমূহকে যা আল্লাহ পরবর্তীকালে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে তাদের দেখিয়ে ছিলেন। নিদর্শনগুলো ছিলঃ
একঃ জনসমক্ষে যাদুকরদের সাথে আল্লাহর নবীর মোকাবিলা হয় এবং তারা পরাজিত হয়ে ঈমান আনে। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা আল আ’রাফ, টীকা ৮৮ থেকে ৯২ ; ত্বাহা, টীকা ৩০ থেকে ৫০ ; আশ শু’আরা, টীকা ২৯ থেকে ৪০ ।
দুইঃ হযরত মূসার ভবিষ্যত বাণী আনুসারে মিসর দেশে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ হয় এবং হযরত মূসার দোয়ার কারণেই তা দূরীভূত হয়।
তিনঃ তাঁর ভবিষ্যত বাণীর পর গোটা দেশে ভয়াবহ বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি, বজ্রপাত এবং বিদ্যুৎ বর্ষণসহ প্রবল ঝড়, তুফান আসে, যা জনপদ ও কৃষি ক্ষেত্র ধ্বংস করে ফেলে। বিপদও তাঁর দোয়াতেই কেটে যায়।
চারঃ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে গোটা দেশে পঙ্গপালের ভয়ানক আক্রমণ হয় এবং এ বিপদও ততক্ষণ পর্যন্ত দূরীভূত হয়নি যতক্ষন না তিনি তা দূরীভূত হওয়ার জন্য দোয়া করেছেন।
পাঁচঃ তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী গোটা দেশে উকুন ও কীটানু ছড়িয়ে পড়ে যার কারণে একদিকে মানুষ ও জীবজন্তু মারাত্মক কষ্টে পড়ে, অপর দিকে খাদ্য শস্যের গুদাম ধ্বংস হয়ে যায়। এ আযাব কেবল তখনই দূরীভূত হয় যখন কাকুতি-মিনতি করে হযরত মূসার দ্বারা দোয়া করানো হয়।
ছয়ঃ হযরত মূসা (আ) এর পূর্ব-সতর্ক বাণী অনুসারে গোটা দেশের আনাচে-কানাচে ব্যাঙের সয়লাব আসে যার ফলে গোটা জনপদের প্রায় দমবদ্ধ হওয়ার মত অবস্থা হয়। আল্লাহর এ সৈনিকরাও হযরত মূসার দোয়া ছাড়া ফিরে যায়নি।
সাতঃ ঠিক তাঁর ঘোষণা মোতাবেক রক্তের আযাব দেখা দেয়। যার ফলে সমস্ত নদী নালা, কূপ, ঝর্ণাসমূহ, দীঘি এবং হাউজের পানি রক্তে পরিণত হয়, মাছ মরে যায়, সর্বত্র পানির আধারে দূর্গন্ধ সৃষ্টি হয় এবং পুরো এক সপ্তাহ পর্যন্ত মিশরের মানুষ পরিষ্কার পানির জন্য তড়পাতে থাকে। এ বিপদও কেবল তখনই কেটে যায় যখন তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হযরত মূসাকে দিয়ে দোয়া করানো হয়। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন, তাফহীমুল কুরআন, সুরা আল আ’রাফ, টীকা ৯৪-৯৬ ; আন নামল টীকা ১৬ ও ১৭ ; আল মু’মিন, টীকা ৩৭ ।
বাইবেলের যাত্রা পুস্তকের ৭, ৮ , ৯ , ১০ ও ১২ অধ্যায়েও এসব আযাবের বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে। তবে তা কল্পকাহিনী ও সত্যের সংমিশ্রণ মাত্র। সেখানে বলা হয়েছে, যখন রক্তের আযাব এলো তখন যাদুকররাও অনুরূপ রক্ত তৈরী করে দেখালো। কিন্তু উকুনের আযাব আসলে জবাবে যাদুকররা উকুন সৃষ্টি করতে পারলো না। তারা বললো, এটা আল্লাহর কাজ। এর চেয়েও অধিক মজার ব্যাপার হলো, অসংখ্য ব্যাঙের সয়লাব সৃষ্টি হলে জবাবে যাদুকররাও ব্যাঙের সয়লাব আনলো এবং এরপরও ফেরাউন মূসার কাছেই আবেদন জানালো যে আল্লাহর কাছে দোয়া করে এ আযাব দূর করিয়ে দিন। প্রশ্ন হচ্ছে যাদুকররাও যেখানে ব্যাঙের সয়লাব আনতে সমর্থ ছিল সেখানে ফেরাউন যাদুকরদের দিয়েই এই আযাব দূর করিয়ে নিলো না কেন? তাছাড়া কোনগুলো যাদুকরদের ব্যাঙ আর কোনগুলো আল্লাহর ব্যাঙ তাই বা কি করে বুঝা গেল? রক্ত সম্পর্কেও এই প্রশ্ন দেখা দেয় যে, হযরত মূসার সাবধান বাণী অনুসারে যখন সব জায়গায় পানির ভাণ্ডার রক্তে পরিণত হয়েছিলো তখন যাদুকররা কোন পানিকে রক্ত বানিয়েছিলো এবং কিভাবে বুঝা গেল অমুক জায়গার পানি যাদুকরদের যাদু বিদ্যা দ্বারা রক্তে পরিণত হয়েছে? এ ধরনের বক্তব্যের কারণে স্পষ্ট বুঝা যায়, বাইবেল আল্লাহর নির্ভেজাল বাণী সমাহার নয়। বরং যারা তা রচনা করেছে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে তার মধ্যে অনেক কিছু সংযোজিত করেছে। তবে সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ঐ সব রচয়িতারা ছিল নগণ্য জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন লোক। কোন কথা সুন্দর করে রচনা করার যোগ্যতা পর্যন্ত তাদের ছিল না।
# মূলে وَكَانُوا قَوْمًا عَالِينَ শব্দগুএলো ব্যবহার করা হয়েছে। এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, তারা ছিল বড়ই আত্মম্ভরী, জালেম ও কঠোর। দুই, তারা নিজেদেরেক অনেক বড় মনে করতো এবং উদ্ধত আস্ফালন করতো।
# আরবী ভাষায়কারো “ফরমানের অনুগত” হোয়া এবং “তার ইবাদাতগুজার” হওয়া প্রায় একই অর্থে ব্যবহার হয়। যে ব্যক্তি কারোর বন্দেগী-দাসত্ব ও আনুগত্য করে সে যেন তার ইবাদাত করে। এ থেকে “ইবাদাত” শব্দটির অর্থের ওপর এবং একমাত আল্লাহর ইবাদাত করার ও তাঁর ছাড়া বাকি সবার ইবাদাত পরিত্যাগ করার যে আদেশ নবীগণ তাদের দাওয়াতের মধ্যে দিতেন তার পূর্ণ অর্থ কি ছিল তার ওপর বড়ই গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত হয়। তাঁদের কাছে “ইবাদাত” নিছুক “পূজা অনুষ্ঠান” ছিল না। তাঁরা এ দাওয়াত ও আনুগত্য করতে থাকো। বরং তাঁরা মানুষকে আল্লাহর পূজারী করতে চাইতেন এবং একই সঙ্গে তাঁর ফরমানের অনুগতও। আর এ উভয় অর্থের দৃষ্টিতে অন্য কারো ইবাদাত করাকে পথভ্রষ্টতা গণ্য করতেন।
# এখানে আবার সেই একই বিষয়বস্তু বর্ণনা করা হয়েছে যা ইতিপূর্বে কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর বিধান ও তাঁর নির্দেশাবলী অমান্য করে অন্য কারো বিধান ও নেতৃত্ব মেনে চলা আসলে তাকে মুখে আল্লাহর শরীক বলে ঘোষণা না দিলেও আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব তাকে শরীক করারই শামিল। বরং ঐ ভিন্ন সত্তাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করেও যদি আল্লাহর হুকুমের মোকাবিলায় তাদের হুকুম মেনে চলা হয় তাহলেও মানুষ শিরকের অপরাধে অভিযুক্ত হবে। কাজেই এখানে শয়তানদের ব্যাপারে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে, দুনিয়ায় সবাই তাদের ওপর অভিশাপ বর্ষণ করছে কিন্তু এ অভিশাপের পরও যারা তাদের অনুসরণ করে কুরআন তাদের সবার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনছে যে, তোমরা শয়তানদেরকে আল্লাহর শরীক করে রেখেছো। এটি বিশ্বাসগত শিরক নয় বরং কর্মগত শিরক এবং কুরআন একেও শিরক বলে। (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, ১ খণ্ড, আন নিসা, টীকা ৯১-১৪৫ , আল আন ’আম ৮৭-১০৭ ; ২ খণ্ড, আত তাওবাহ, টীকা ৩১ ; ইবরাহীম, টীকা ৩২; ৩ খণ্ড মারয়াম , ৩৭ টীকা; আল মু’মিনুন, ৪১ টীকা; আল ফুরকান ৫৬ টীকা, আল কাসাস, ৮৬ টীকা; ৪ খণ্ড সাবা ৫৯, ৬০, ৬১, ৬২, ৬৩; ইয়াসীন ৫৩ টীকা; আশ শূরা, ৩৮ টীকা; আল-জাসিয়াহ, ৩০ টীকা) ।
# একথা বলা হয়নি যে, মারয়াম পুত্র একটি নিদর্শন ছিল এবং স্বয়ং মারয়াম একটি নিদর্শন ছিল। আবার একথাও বলা হয়নি যে, মারয়াম পুত্র ও তার মাকে দু’টি নিদর্শনে পরিণত করেছিলাম। বরং বলা হয়েছে, তাদের দু’জনকে মিলিয়ে একটি নিদর্শনে পরিণত করা হয়েছিল। এর অর্থ এছাড়া আর কি হতে পারে যে, পিতা ছাড়া ইবনে মারয়ামের জন্ম হওয়া এবং স্বামীর সাহচর্য ছাড়া মারয়ামের গর্ভধারণ করাই এমন একটি জিনিস যা তাদের দু’জনকে একটি নিদর্শনে পরিণত করে দেয়। যারা পিতা ছাড়া হযরত ঈসার জন্ম অস্বীকার করে তারা মাতা ও পুত্রের একটি নিদর্শন হবার কি ব্যাখ্যা দেবেন? (আরো বিস্তারিত জানার জন্য তাফহীমুল কুরআন, সূরা আলে ইমরান ৪৪-৫৩ টিকা , আন নিসা ১৯০ টিকা , ২১২ টিকা , ২১৩ টিকা , মারয়াম ১৫ থেকে ২২ টিকা এবং আল আম্বিয়া ৮৯ টিকা – ৯০ টীকা দেখুন) এখানে দু’টি কথা আরো ব্যাখ্যা যোগ্য।
এক, হযরত ঈসা ও তাঁর মাতার ব্যাপারটি মূর্খ লোকদের আর একটি দুর্বলতা চিহ্নিত করছে। ও পরে যে সকল নবীর কথা আলোচনা করা হয়েছে তাদের প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারটি তো এ বলে অস্বীকার হয়েছে যে, তোমরা তো মানুষ আর মানুষ কি কখনো নবী হতে পারে? কিন্তু লোকেরা যখন হযরত ঈসার ও তাঁর মায়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলো এবং তাদের ভক্ত হয়ে গেলো তখন তাদেরকেমানুষেরমর্যাদা থেকে উঠিয়ে নিয়ে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দিল।
দুই, যারা হযরত ঈসার অলৌকিক জন্ম এবং দোলনায় শায়িত অবস্থায় তাঁর ভাষণ শুনে তাঁর মুজিযা হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ দেখে নেয়া সত্ত্বেও ঈমান আনতে অস্বীকার করেছিল এবং হযরত মারয়ামকে অপবাদ দিয়েছিল তাদেরকে এমন শাস্তি দেয়া হয়েছিল যা সমগ্র দুনিয়াবাসীর জন্য চিরকালীন শিক্ষণীয় হয়ে রয়েছে।
# বিভিন্ন জন এ থেকেবিভিন্ন স্থানের কথা মনে করেছেন। কেউ বলেন, এ স্থানটি ছিল দামেশ্ক। কেউ বলেন, আর্রম্লাহ। কেউ বলেন, বাইতুল মাক্দিস আবার কেউ বলেন মিসর। খৃষ্টীয় বর্ণনা অনুযায়ী হযরত মার্য়াম ঈসার জন্মের পর তাঁরহেফাজতের জন্য দু’বার স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রথমবার বাদশাহ হিরোডিয়াসের আমলে তিনি তাকে মিসরে নিয়ে যান এবং বাদশাহর মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকেন। তারপর আয্খিলাউসের শাসনামলে তাঁকে গালীলের নাসেরাহ শহরে আশ্রয় নিতে হয়। (মথি ২: ১৩ থেকে ২৩) এখন কুরআন কোন্ স্থানটির প্রতি ইঙ্গিত করছে তা নিশ্চয়তা সহকারে বলা কঠিন। আভিধানিক অর্থে “রাবওয়াহ” এমন সুউচ্চ ভূমিকে বলা হয় যা সমতল এবং আশপাশের এলাকা থেকে উঁচু। অন্যদিক “যা-তি কারার” ذَاتِ قَرَارٍ মানে হচ্ছে এমন জায়গা যেখানে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদী পাওয়া যায় এবং অবস্থানকারী সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন যাপন করতে পারে। আর “মাঈন” مَعِينٍ মানে হচ্ছে বহমান পানি বা নির্ঝারিণী।
# আগের ২টি রুকূ’তে বিভিন্ন নবীর কথা বলার পর এখন يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ বলা সকল নবীকে সম্বোধন করার অর্থ এই নয় যে, সকল নবী এক সঙ্গে এক জায়গায় ছিলেন এবং তাঁদেরকে সম্বোধন করে একথা বলা হয়েছে। বরং এ থেকে একথা বলাই উদ্দেশ্য যে, প্রতি যুগে বিভিন্ন দেশে ও জাতির মধ্যে আগমণকারী নবীদেরকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং স্থান-কালের বিভিন্নতা সত্ত্বেও তাঁদের সবাইকে একই হুকুম দেয়া হয়েছিল। পরের আয়াতে যেহেতু সকল নবীকে এক উম্মত, এক জামায়াত ও এক দলভুক্ত গণ্য করা হয়েছে তাই এখানে এমন বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে যার ফলে চোখের সামনে তাদের সবার এক দলভুক্ত হবার ছবি ভেসে ওঠে। তারা যেন সবাই এক জায়গায় সমবেত আছেন এবং সবাইকে একই নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ যুগের একদল স্থুল বুদ্ধি সম্পন্ন লোক এ বর্ণনা রীতির সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্য অনুধাবন করতে পারেননি এবং তারা এ থেকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, এ সম্বোধনটি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরপরে আগমনকারী নবীদেরকে করা হয়েছে এবং এ থেকে তাঁর পরে নবুওয়াতের ধারা পরম্পরা জারী হবার প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাবতে অবাক লাগে যে, যারা ভাষা ও সাহিত্যের সূক্ষ্ম রসবোধ থেকে এত বেশী বঞ্চিত তারা আবার কুরআনের ব্যাখ্যা করার দুঃ সাহস করেন।
# পাক-পবিত্র জিনিস বলে এমন জিনিস বুঝানো হয়েছে যা নিজেও পাক-পবিত্র এবং হালাল পথে অর্জিতও হয়। পবিত্র জিনিস খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বৈরাগ্যবাদ ও ভোগবাদের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মুসলমান বৈরাগী ও যোগীর মতো পবিত্র জীবিকা থেকে যেমননিজেকে বঞ্চিত করতে পারে না, তেমনি দুনিয়া পূজারী ও ভোগবাদীর মতো হালাল-হারামের পার্থক্য না করে সব জিনিসে মুখও লাগাতে পারে না।
সৎকাজ করার আগে পবিত্র ও হালাল জিনিস খাওয়ার নির্দেশের মধ্যে এদিকে পরিষ্কার ইঙ্গিত রয়েছে যে, হারাম খেয়ে সৎকাজ করার কোন মানে হয় না। সৎকাজের জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে হালাল রিযিক খাওয়া। হাদীসে বলা হয়েছে, নবী ﷺ বলেছেনঃ “হে লোকেরা! আল্লাহ নিজে পবিত্র, তাই তিনি পবিত্র জিনিসই পছন্দ করেন।” তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করেন এবং তারপর বলেনঃ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ وَغُذِىَ بِالْحَرَامِ يَمُدُّ يَدَيهُ إِلَى السَّمَاءِ يَا رَبِّ يَا رَبِّ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ- “এক ব্যক্তি আসে সুদীর্ঘ পথ সফল করে। দেহ ধূলি ধূসরিত। মাথার চুল এলোমেলো। আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করেঃ হে প্রভু! হে প্রভু! কিন্তু অবস্থা হচ্ছে এই যে, তার খাবার হারাম, পানীয় হারাম, কাপড় চোপড় হারাম এবং হারাম খাদ্যে তার দেহ প্রতিপালিত হয়েছে। এখন কিভাবে এমন ব্যক্তির দোয়া কবুল হবে।” (মুসলিম, তিরমিযী ও আহমাদ, আবু হুরাইরা (রাঃ ) থেকে)
# “তোমাদের উম্মত একই উম্মত” – অর্থাৎ তোমরা একই দলের লোক। “উম্মত” শব্দটি এমন ব্যক্তি সমষ্টির জন্য বলা হয় যারা কোন সম্মিলিত মৌলিক বিষয়ের জন্য একতাবদ্ধ হয়। নবীগণ যেহেতু স্থান-কালেরর বিভিন্নত সত্ত্বেও একই বিশ্বাস, একই জীবন বিধান ও একই দাওয়াতের ওপর একতাবদ্ধ ছিলেন, তাই বলা হয়েছে, তাঁদের সবাই একই উম্মত। পরবর্তী বাক্য নিজেই সে মৌলিক বিষয়ের কথা বলে দিচ্ছে যার ওপর সকল নবী একতাবদ্ধ ও একমত ছিলেন। (অতিরিক্ত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন সূরা আল বাকারাহ ১৩০ থেকে ১৩৩ ; আলে ইমরান ১৯, ২০ , ৩৩, ৩৪ , ৬৪ ও ৭৯ থেকে ৮৫ ; আন নিসা ১৫০ থেকে ১৫২ ; আল আ’রাফ ৫৯ , ৬৫ , ৭৩ , ৮৫ ; ইউসুফ ৩৭ থেকে ৪০ ; মার্য়াম ৪৯ থেকে ৫৯ এবং আল আম্বিয়া ৭১ থেকে ৯৩ আয়াত।)
# এটা নিছক ঘটনার বর্ণনা নয় বরং সূরার শুরু থেকে যে যুক্তিধারা চলে আসছে তার একটি পর্যায়। যুক্তির সারসংক্ষেপ হচ্ছে, নূহ আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে ঈসা আলাইহিস সালাম পর্যন্ত সকল নবী যখন এ তাওহীদ ও আখেরাত বিশ্বাসের শিক্ষা দিয়ে এসেছেন তখন অনিবার্যভাবে এ থেকে প্রমাণ হয়, এ ইসলামই মানব জাতির আসল দ্বীন বা ধর্ম। অন্যান্য যেসব ধর্মের অস্তিত্ব আজ দুনিয়ার বুকে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো এ দ্বীনেরই বিকৃত রূপ। এর কোন কোন নির্ভুল অংশের চেহারা বিকৃত করে এবং তার মধ্যে অনেক মনগড়া কথা বাড়িয়ে দিয়ে সেগুলো তৈরী করা হয়েছে। এখন যারা এসব ধর্মের উক্ত-অনুরক্ত তারাই ভ্রষ্টতার মধ্যে অবস্থান করছে। অন্যদিকে যারা এগুলো ত্যাগ করে আসল দ্বীনের দিকে আহবান জানাচ্ছে তারা মোটেই বিভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতার মধ্যে অবস্থান করছে না।
# প্রথম বাক্য ও দ্বিতীয় বাক্যের মাঝখানে একটি ফাঁক আছে। এফাঁকটি ভরে দেয়ার পরিবর্তে শ্রোতার চিন্তা-কল্পনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কারণ ভাষণের পটভূমি নিজেই তাকে ভরে ফেলছে। এ পটভূমি হচ্ছে, আল্লাহর এক বান্দা পাঁচ ছয় বছর থেকে মানুষকে আসল দ্বীনের দিকে ডাকছেন। যুক্তির সাহায্যে তাদেরকে নিজের কথা বুঝিয়ে বলছেন। ইতিহাসেরনজীর পেশ করছেন। তার দাওয়াতের প্রভাব ও ফলাফল কার্যত চোখের সামনে আসছে। তারপর তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রও সাক্ষ্য দিয়ে চলছে যে, তিনি একজন নির্ভরযোগ্য ও আস্তাভাজন ব্যক্তি। কিন্তু এ সত্ত্বেও লোকেরা শুধু যে বাপ-দাদাদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বাতিলের মধ্যে নিমগ্ন রয়েছে তা নয় এবং শুধু যে সুস্পষ্ট যুক্তি-প্রমাণ সহকারে যে সত্য পেশ করা হচ্ছে তাকে মেনে নিতেও তারা প্রস্তুত হয়নি তা নয়। বরং তারা আদাপানি খেয়ে সত্যের আহবায়কের পিছনেও লেগে যায় এবং র্তাঁর দাওয়াতকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য হঠকারিতা, অপবাদ রটনা, জুলুম, নিপীড়ন, মিথ্যাচার তথাযাবতীয় নিকৃষ্ট ধরনের কৌশল অবলম্বন করার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে থাকছে না। এহেন পরিস্থিতিতে আসল সত্য দ্বীনের একক অস্তিত্ব এবং পরবর্তীতে উদ্ভাবিত ধর্মসমূহের স্বরূপ বর্ণনা করার পর “ছেড়ে দাও তাদেরকে, ডুবে থাকুক তারা নিজেদের গাফিলতির মধ্যে” একথা স্বতস্ভূর্তভাবে এ অর্থ প্রকাশ করে যে, “ঠিক আছে, যদি এরা না মেনে নেয় এবং নিজেদের ভ্রষ্টতার মধ্যে আকন্ঠ ডুবে থাকতেচায় তাহলেএদেরকে সেভাবেই থাকতে দাও।” এই “ছেড়ে দাও”-একে একেবারেই শাব্দিক অর্থে গ্রহণ করে “এখন আর প্রচারই করো না” বলে মনে করা বাকভংগী সম্পর্কে অজ্ঞতাই প্রমাণ করবে। এ ধরনের অবস্থায় প্রচার ও উপদেশ দানে বিরত থাকার জন্য নয় বরং গাফিলদেরকে ঝাঁকুনি দেবার জন্য বলা হয়ে থাকে। তারপর “একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত” শব্দগুলোর মধ্যে শব্দগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি গভীর সতর্ক সংকেত। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, এ গাফলতির মধ্যেডুবে থাকার ব্যাপারটা দীর্ঘক্ষণ চলতে পারবে না। এমন একটি সময় আসবে যখন তারা সজাগ হয়ে যাবে এবং আহবানকে যে জিনিসের দিকে আহবান করছিল তার স্বরূপ তারা উপলব্ধি করতে পারবে এবং তারা নিজেরা যে জিনিসের মধ্যে ডুবে ছিল তার সঠিক চেহারাও অনুধাবনকরতে সক্ষম হবে।
# এখানে এসে সূরার সূচনা পর্বের আয়াতগুলোর ওপর আর একবার নজর বুলিয়ে নিন। সে একই বিষয়বস্তুকে আবার অন্যভাবে এখানে বর্ণনা করা হচ্ছে। তারা “কল্যাণ”, “ভালো” ও “সমৃদ্ধি”র একটি সীমিত বস্তুবাদী ধারণা রাখতো। তাদের মতে, যে ব্যক্তি ভালো খাবার, ভাল পোশাক ও ভালো ঘর-বাড়ী লাভ করছে, যাকে অর্থ –সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দান করা হয়েছে এবং সমাজে যে খ্যাতি ও প্রভাব – প্রতিপত্তি অর্জন করতে পেরেছে সে সাফল্য লাভ করছে। আর যে ব্যক্তি এসব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে ব্যর্থহয়ে গেছে। এ মৌলিক বিভ্রান্তির ফলে তারা আবার এর চেয়ে অনেক বড় আর একটি বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে। সেটি ছিল এই যে, এ অর্থে যে ব্যক্তি কল্যাণ ও সাফল্য লাভ করেছে সে নিশ্চয়ই সঠিক পথে রয়েছে বরং সে আল্লাহর প্রিয় বান্দা, নয়তো এসব সাফল্য লাভ করা তার পক্ষে কেমন করে সম্ভব হলো। পক্ষান্তরে এ সাফল্য থেকে যাদেরকে আমরা প্রকাশ্যে বঞ্চিত দেখছি তারা নিশ্চয়ই বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে ভুল পথে রয়েছে এবং তারা খোদা বা খোদাদের গযবের শিকার হয়েছে। এ বিভ্রান্তিটি আসলে বস্তুবাদী দৃষ্টিভংগীর অধিকারী লোকদের ভ্রষ্টতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর অন্যতম। একে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে একে খণ্ডন করা হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে প্রকৃত সত্য কি তা বলে দেয়া হয়েছে। (দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখুন সূরা আল বাকারাহ ১২৬ ও ২১২ ; আল আ’রাফ ৩২ , আত্ তাওবাহ ৫৫, ৬৯ ও ৮৫ ; ইউনুস ১৭ ; হূদ ৩ , ২৭ থেকে ৩১ , ৩৮ ও ৩৯ ; আর রাআদ ২৬ ; আল কাহ্ফ ২৮ , ৩২ থেকে ৪৩ ও ১০৩ থেকে ১০৫ ; মার্য়াম ৭৭ থেকে ৮০ ; ত্বা-হা ১৩১ ও ১৩২ ও আল আম্বিয়া ৪৪ আয়াত এবং এই সঙ্গে টীকাগুলো)।
এক্ষেত্রে এমন পর্যায়ের কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ সত্য রয়েছে যেগুলো ভালোভাবে অনুধাবন না করলে চিন্তা ও মন-মানস কখনোই পরিচ্ছন্ন হতে পারে না।
একঃ “মানুষের সাফল্য”কে কোন ব্যক্তি, দল বা জাতির নিছক বস্তুবাদী সমৃদ্ধি ও সাময়িক সাফল্য অর্থে গ্রহণ করার চাইতে তা অনেক বেশী ব্যাপক ও উন্নত পর্যায়ের জিনিস।
দুইঃ সাফল্যকে এ সীমিত অর্থে গ্রহণ করার পর যদি তাকেই সত্য ও মিথ্যা এবং ভালো ও মন্দের মানদন্ড গণ্য করা হয় তাহলে তা এমন একটি মৌলিক ভ্রষ্টতায় পরিণত হয় যার মধ্য থেকে বাইরে বের না হওয়া পর্যন্ত কোন মানুষ কখনো বিশ্বাস, চিন্তা, নৈতিকতা ও চারিত্রিক ক্ষেত্রে সঠিক পথ লাভ করতেই পারে না।
তিনঃ দুনিয়াটা আসলে প্রতিদান দেবার জায়গা নয় বরং পরীক্ষাগৃহ। এখানে নৈতিক শাস্তি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকলেও তা বড়ই সীমিত পর্যায়ের ও অসম্পূর্ণ ধরণের এবং তার মধ্যেও পরীক্ষার দিকটি রয়েছে। এ সত্যটি এড়িয়ে গিয়ে একথা মনে করা যে, এখানে যে ব্যক্তি যে নিয়ামতই লাভ করছে তা লাভ করছে “পুরস্কার” হিসেবেই এবং সেটি লাভ করা পুরস্কার লাভকারীর সত্য, সৎ ও আল্লাহর প্রিয় হবার প্রমাণ আর যার ওপর যে বিপদও আসছে তা হচ্ছে তার ‘শাস্তি” এবং তা একথাই প্রমাণ করছে যে, শাস্তি লাভকারী মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে অসৎ ও আল্লাহর কাছে অপ্রিয়। আসলে এসব কিছু একটি বিভ্রান্তি বরং নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সম্ভবত আমাদের সত্য সম্পর্কিত ধারণা ও নৈতিকতার মানদণ্ডকে বিকৃত করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় আর কোন জিনিস নেই। একজন সত্যসন্ধানীকে প্রথম পদক্ষেপেই একথা অনুধাবন করতে হবে যে, এ দুনিয়াটি মূলত একটি পরীক্ষাগৃহ এবং এখানে অসংখ্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যক্তিদের, জাতিদের ও সমগ্র বিশ্বমানবতার পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। এ পরীক্ষার মাঝখানে লোকেরা যে বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয় সেগুলো পুরস্কার ও শাস্তির শেষ পর্যায় নয়। কাজেই সেগুলোকে মতবাদ, চিন্তাধারা, নৈতিকতা ও কর্মকাণ্ডের সঠিক ও বেঠিক হওয়ার মানদণ্ডে পরিণত করা এবং আল্লাহর কাছে প্রিয়ও অপ্রিয় হবার আলামত গণ্য করা যাবে না।
চারঃ সাফল্যের প্রান্ত নিশ্চিতভাবেই সত্য সৎকর্মের সাথে বাঁধা আছে এবং মিথ্যা ও অসৎকর্মের পরিণাম ক্ষতি এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এ দুনিয়ায় যেহেতু মিথ্যা ও অসৎকর্মের সাথে সাময়িক ও বাহ্যিক সাফল্য এবং অনুরূপভাবে সত্য ও সৎকর্মের সাথে প্রকাশ্য ও সাময়িক ক্ষতি সম্ভবপর আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ জিনিসটি ধোঁকা বলে প্রমাণিত হয়েছে, তাই সত্য-মিথ্যা ও সৎ-অসৎ যাচাই করার জন্য একটি স্থায়ী ও স্বতন্ত্রমানদণ্ডের প্রয়োজন, যার মধ্যে প্রতারণার ভয় থাকবে না। নবীগণের শিক্ষা ও আসমানী কিতাবসমূহ আমাদের এ মানদণ্ড সরবরাহ করে। মানুষের সাধারণ জ্ঞান (Common sense)-এর সঠিক হওয়ার সত্যতা বিধান করে এবং “মারূফ” ও “মুন্কার” তথা সৎ কাজ ও অসৎকাজ সম্পর্কিত মানব জাতির সম্মিলিত মানসিক চিন্তা-অনভুতি এর সত্যতার সাক্ষ্য দেয়।
পাঁচঃ যখন কোন ব্যক্তি বা জাতি একদিকে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ফাসেকী, অশ্লীল কার্যকলাপ, জুলুম ও সীমালঙ্ঘন করতে থাকে এবং অন্যদিকে তা ওপর অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকে তখন বুজতে হবে, বুদ্ধি ও কুরআন উভয় দৃষ্টিতে আল্লাহ তাকে কঠিনতর পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন এবং তার ওপর আল আল্লাহর করুণা নয় বরং তাঁর ক্রোধ চেপে বসেছে। ভুলের কারণে যদি তার ওপর আঘাত আসতো তাহলে এর এই অর্থ হতো যে, আল্লাহ এখনো তার প্রতি অনুগ্রহশীল আছেন, তাকে সতর্ক করছেন এবং সংশোধিত হবার সুযোগ দিচ্ছেন। কিন্তু ভুলের জন্য “পুরস্কার” এ অর্থ প্রকাশ করে যে, তাকে কঠিন শাস্তি দেবার ফয়সালা হয়ে গেছে এবং পেট ভরে পানি নিয়ে ডুবে যাওয়ার জন্য তার নৌকাটি ভাসছে। পক্ষান্তরে যেখানে একদিকে থাকে আল্লাহর প্রতি সত্যিকার আনুগত্য, চারিত্রক পবিত্রতা, পরিচ্ছন্ন লেনদেন, আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সদাচার, দয়া, স্নেহ ও মমতা এবং অন্যদিকে তার প্রতি বিপদ-আপদ ও কাঠিন্যের অবিরাম ধারা বর্ষিত হতে থাকে এবং আঘাতের পর আঘাতে সে হতে থাকে জর্জরিত সেখানে তা আল্লাহরক্রোধের নয় বরং হয় তাঁরঅনুগ্রহেরই আলামত। স্বর্ণকার স্বর্ণকে খুব বেশী উত্তপ্ত করতে থাকে যাতে তা খুব বেশী ঝকঝকে তকতকে হয় যায় এবং দুনিয়াবাসীর সামনে তার পূর্ণনিখাদ হওয়া প্রমাণ হয়ে যায়। দুনিয়ার বাজারে তার দাম না বাড়লে কিছু আসে যায় না। স্বর্ণকার নিজেই তার দাম দেবে। বরং নিজের অনুগ্রহে বেশী দিয়ে দেবে। তার বিপদ-আপদে যদি ক্রোধের দিক থেকে থাকে তাহলে তা তার নিজের জন্য নয় বরং তার শত্রুদের জন্য অথবা যে সমাজে সৎকর্মশীলরআ উৎপীড়িত হয় এবং আল্লাহর নাফরমানরা হয় অনুগৃহীত সে সমাজের জন্য।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*নবীদের ইতিহাস পর্যালোচনা : পরবর্তী কটা আয়াতে যুগ যুগ কালের ইতিহাস পর্যালােচনা করা হয়েছে। এভাবে, ‘অতপর আমি তাদের পরে অন্যান্য অনেক জাতি সৃষ্টি করেছি।'(আয়াত ৪২ থেকে ৪৪) এভাবে সংক্ষেপে হযরত নূহ ও হুদের মধ্যবর্তী ধারা এবং হযরত মূসা ও ঈসা(আ.)-এর মধ্যবর্তী ধারার দীর্ঘস্থায়ী ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে আল্লাহর প্রচলিত শাশ্বত প্রাকৃতিক বিধানও। প্রত্যেকটা জাতি তার নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করেছে এবং ইতিহাস নিজস্ব গতিতে চলেছে, ‘কোনাে জাতি তার মেয়াদকে ত্বরান্বিতও করতে পারে না, বিলম্বিতও করতে পারে না। ‘যখনই কোনাে জাতির কাছে তার (প্রতি পাঠানাে) আমার রসূল আসতাে, তারা তাকে মিথুক সাব্যস্ত করতাে। আর যখনই বিপথগামীরা নবীদেরকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করতাে, তখনই আমি এক জাতির পর আর এক জাতি ধ্বংস করেছি। তাদের ধ্বংসের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণকারীদের জন্যে শিক্ষা নিহিত রয়েছে। তাদেরকে কাহিনীর বিষয়ে পরিণত করেছি।’ অর্থাৎ এমন শিক্ষণীয় বিষয়ে পরিণত করেছি, যা যুগ যুগ ধরে জনশ্রুতির আকারে এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হবে। অতপর এই আকস্মিক ও সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনার সমাপ্তি টানা হয়েছে অভিশাপ বাণী উচ্চারণের মধ্য দিয়ে, সুতরাং যারা ঈমান আনে না তাদের ওপর অভিসম্পাত। এরপর মূসা(আ.)-এর নবী রূপে প্রেরিত হওয়া ও মিথ্যুক সাব্যস্ত হওয়ার কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে আলােচনার ধারাবাহিকতা রক্ষা পায় এবং এর উদ্দেশ্য সফল হয়। ‘তারপর আমি প্রেরণ করলাম মূসা ও হারুনকে… তারা উভয়কে মিথ্যুক সাব্যস্ত করলাে, ফলে তারা ধ্বংস হয়ে গেলাে।'(আয়াত ৪৫-৪৮) এখানেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, কাফেররা একজন মানুষের নবী হওয়ার ওপরই আপত্তি তুলেছে। ‘তারা বললাে আমাদেরই মধ্যে দু’জন মানুষের ওপর আমরা ঈমান আনবাে নাকি?’ এই সাথে তৎকালীন মিসরে বনী ইসরাঈলের সামাজিক অবস্থার কথাও উত্থাপন করা হয়েছে যে, ‘অথচ মূসা ও হারুনের গােত্র তাে আমাদের দাসত্ব করছে।’ অর্থাৎ আমাদের অনুগত ও পদানত । বনী ইসরাঈলের এই সামাজিক অবস্থাই মুসা ও হারুন(আ.)-কে হেয় করা ও অপমাণিত করার প্রতি ফেরাউন ও তার দল বলকে অধিকতর প্ররোচিত করেছিলাে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে যে নবী ভ্রাতৃদ্বয়ের কাছে যে অলৌকিক নিদর্শন বা মােজেযা ছিলাে এবং সেই সুবাদে তাদের হাতে যেটুকু প্রভাব ছিলাে, তা কি ফেরাউনকে কিছুমাত্র প্রভাবিত করতে পারেনি? এর জবাব এই যে, তাদের মন পার্থিব জাঁকজমক ও শান শওকত, প্রচলিত সামাজিক ধ্যান ধারণা, মানসিকতা ও সন্তা মূল্যবােধের বৃত্তে আটকা পড়ে এতােই বিকৃত হয়ে গিয়েছিলাে যে, সে মােজেযা তাদেরকে মােটেই প্রভাবিত করতে পারেনি। এরপর সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে হযরত ঈসা ও তার মা মারিয়াম(আ.)-এর প্রসংগ এবং ঈসার অলৌকিক জন্মের বিষয়টা। হযরত মূসা(আ.)-এর মােজেযার ন্যায় এটাকেও অবিশ্বাসীরা মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিলাে। (আয়াত ৪৯-৫০) ৫০ নং আয়াতে যে ‘রাবওয়া’ অর্থাৎ সুউচ্চ জলাশয় বিশিষ্ট নিরাপদ আশ্রয়স্থলে হযরত ঈসা ও তার মা মরিয়মকে আশ্রয় দেয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই স্থানটা নিয়ে মতভেদ রয়েছে যে, ওটা কি মিশরে, দামেস্কে না বাইতুল মাকদিসে অবস্থিত? হযরত মারিয়াম, হযরত ঈসা(আ.)-কে তার শৈশরে ও কৈশরে এসব জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন বলে খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। আসলে এখানে তাদের আশ্রয় স্থলের অবস্থান নির্ণয় করা উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ আল্লাহ তায়ালা তাদের উভয়কে একটা সুজলা, সুফলা ও সুরক্ষিত চমৎকার জায়গায় আশ্রয় দিয়েছিলেন, এ কথা জানা নেই এর উদ্দেশ্য। রেসালাতের ধারাবাহিক বিবরণ দিতে দিতে এই পর্যায়ে এসে নবী ও রসূলদেরকে সামষ্টিকভাবে সম্বোধন করা হয়েছে। আর এই সম্বােধন করার সময়ে তাদের স্থান ও কালের ব্যবধানের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তাদের সবাইকে একই জায়গায় সমবেত ধরে নেয়া হয়েছে এবং যে অভিন্ন আদর্শ তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে, সেই অভিন্ন আদর্শকে আঁকড়ে ধরতে বলা হয়েছে, ‘হে রসূলরা, তােমরা পবিত্র খাবার খাও ও সৎ কাজ করাে।'(আয়াত ৫১-৫২) নবীদেরকে সম্বােধন করে এই ভাষণ এ জন্যেই দেয়া হয়েছে, যাতে তারা তাদের মানবীয় স্বভাব প্রকৃতি বজায় রেখে নবুওতের দায়িত্ব পালন করেন এবং এই স্বভাব প্রকৃতির স্বীকৃতি দিতে যারা নারায, তাদের ভ্রান্তি দূর করতে পারেন। বলা হয়েছে, ‘পবিত্র খাবার খাও।’ খাওয়া দাওয়া একটা সাধারণ স্বভাবসুলভ মানবিক দাবী। কিন্তু বিশেষভাবে পবিত্র ও হালাল খাদ্য খাওয়া এমন একটা মহৎ কাজ যা মানুষের মর্যাদাকে আরাে সুসংহত করে, তাকে বিশুদ্ধ করে এবং ফেরেশতাদের পর্যায়ভুক্ত করে। আর পৃথিবীতে সৎভাবে জীবন যাপনের আদেশ দেয়াও এই ভাষণের উদ্দেশ্য। বলা হয়েছে, ‘এবং সৎ কাজ করো।’ বস্তুত কাজ করা মানুষ মাত্রেরই স্বভাব। কিন্তু সৎ কাজ মানুষের মধ্য থেকে সৎ ও ন্যায় পরায়ন মানুষকে বাছাই করে আলাদা করে, এতে তার কাজের একটা নিয়ম ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, যা তাকে সৃষ্টির সর্বোচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করে। রসূল তার মানবীয় স্বভাব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলুন এটা কাম্য নয়। বরং স্বাভাবিক মানবিক স্বভাব বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার সম্ভাব্য সেই সর্বোচ্চমানে উন্নীত করাটাই কাম্য, যা আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্যে নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং নবীদেরকে যার সর্বোত্তম নমুনা বানিয়েছেন। আর আল্লাহ তায়ালাই তার সূক্ষ্ম মানদন্ডে তাদের কর্মকান্ডকে যাচাই ও মূল্যায়ন করবেন। এ জন্যেই বলেছেন, ‘তোমরা যা করো তা আমি জানি।’ যে একমাত্র ও অভিন্ন আদর্শ রসূলরা সাথে করে এনেছেন, যে অভিন্ন স্বভাব ও চরিত্র তাদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক ও অসাধারণ মানুষে পরিণত করেছে, যে একমাত্র স্রষ্টা তাদেরকে প্রেরণ করেছেন, তার সামনে তাদের স্থান ও কালের সকল পার্থক্য দূরীভূত হয়ে গেছে। এ কথাই বলা হয়েছে ৫২ নং আয়াতে, তোমাদের এই যে জাতি, তা তো একই জাতি এবং আমিই তােমাদের মনিব, সুতরাং আমাকেই তােমরা ভয় করো।
* এ অংশটা সূরার তৃতীয় পাঠ বা তৃতীয় অধ্যায়। পূর্ববর্তী নবীদের অনুসারীদের পরের যে মানব সমাজকে শেষ নবী এসে পেয়েছেন, তাদের চিত্র এ অংশে ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। এতে দেখানাে হয়েছে যে, যে অভিন্ন মতাদর্শ নিয়ে নবীরা এসেছিলেন, সে বিষয়ে তারা বিরােধ ও বিতর্কে লিপ্ত ছিলাে। এ অংশে এটাও দেখানাে হয়েছে যে, এই প্রজন্মের মানব গােষ্ঠী নবীদের প্রচারিত আদর্শ তথা ইসলাম সম্পর্কে উদাসীন এবং তাদের সে উদাসীনতার পরিণতি সম্পর্কে তারা অচেতন ছিলাে। অথচ যারা ঈমান এনেছিলাে, তারা আল্লাহর এবাদাত করতাে ও সৎকাজ করতাে। আর এই এবাদাত ও সৎকাজ সত্তেও তারা তাদের পরিণতি সম্পর্কে শংকিত এবং আপন মনিবের কাছে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ভীত সন্ত্রস্ত থাকতাে। এভাবে একদিকে মােমেনের অন্তরের সতর্কতা ও সচেতনতাকে এবং অপরদিকে কাফেরের মনের অসতর্কতা ও অচৈতন্যকে পাশাপাশি তুলে ধরা হয়েছে। অতপর এই অবস্থাগুলাে নিয়ে বারবার পর্যালােচনা করা হয়েছে। কখনাে তাদের চিন্তাধারা ও সন্দেহ সংশয়কে ঘােরতর নিন্দা সমালােচনার মাধ্যমে এবং কখনাে মানব মনের অভ্যন্তরে ও প্রকৃতির বিশাল প্রান্তরে বিরাজমান নিদর্শনাবলীকে সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে অপনােদনের চেষ্টা করা হয়েছে। এই বিস্তারিত আলােচনার পর জনগণকে তাদের অবধারিত পরিণতির হাতে সমর্পণ করা হয়েছে এবং রসূল(স.)-কে সম্বােধন করে বলা হয়েছে যে, তিনি যেন তার কাজ চালিয়ে যান, কাফেরদের শত্রুতা ও গােয়ার্তুমিতে রেগে না যান, তাদের অপতৎপরতাকে তিনি যেন যথাসম্ভব সৌজন্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে প্রতিরােধ করেন এবং যে শয়তান কাফেরদেরকে বিপথগামী করেছে, সেই শয়তান থেকে তিনি যেন আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করেন। তারা তাদের (মৌলিক) বিষয়টিকে বহু খন্ডে বিভক্ত করে ফেললো…'(আয়াত ৫৩-৫৬) নবীরা তাে ছিলেন পরিপূর্ণ ঐক্যমত পােষণকারী একটা সুসংহত মানব গােষ্ঠী, তাদের দাওয়াত, মতামত, এবাদাত, দৃষ্টিভংগি সবই ছিলাে এক ও অভিন্ন। অথচ তাদের তিরােধানের পর মানব জাতি হয়ে পড়ে নানা মতের নানা গােষ্ঠীতে বিভক্ত। কোনাে ব্যাপারেই তারা ঐক্যমত পােষণ করতাে না। কোরআনের বর্ণনা ভংগি তাদের এই মতবাদকে অত্যন্ত স্বচ্ছ, সুস্পষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছে। এতে বলা হয়েছে যে, তারা নবীদের প্রচারিত দ্বীন সম্পর্কে এতাে বিতর্কে লিপ্ত হলাে যে, এ ব্যাপারে তাদের অভিমতকে তার বহু খন্ডে বিভক্ত করলাে। অতপর প্রত্যেকটা গােষ্ঠী তার ভাগে যে খন্ডটা পড়েছে, তা নিয়ে আনন্দে বিভাের হয়ে পড়লাে। এই আনন্দে তারা এতােই দিশেহারা হয়ে পড়লাে যে, আর কোনাে দিকে তাদের কোনাে হুস থাকলাে না। তারা একেবারেই অচেতন ও উদাসীন হয়ে পড়লাে ভিন্ন মতামতের ব্যাপারে। তাদের এই চিত্র তুলে ধরার সাথে সাথে রসূল(স.)-কে সম্বােধন করা বলা হয়েছে যে, ‘ওদেরকে ওদের সে দিশেহারা অবস্থায় মত্ত থাকতে দাও।’ অর্থাৎ ওরা নিজেদের মতামত ও তৎপরতায় ডুবে থাকুক। একদিন যখন সহসা তারা অবধারিত পরিণতির সম্মুখীন হবে, তখন মজাটা টের পাবে। পরবর্তী আয়াতে তাদের উদাসীনতার প্রতি উপহাস ও বিদ্রুপ করে বলা হয়েছে, তারা ভেবেছে যে, তাদেরকে যে কিছু কাল যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ানাের অবাধ সুযােগ দেয়া হয়েছে এবং পরীক্ষার মেয়াদকালে অর্থ সম্পদ ও জন সম্পদ দিয়ে যে তাদেরকে ভূষিত করা হয়েছে, সেটা তাদের দ্রুত কল্যাণ সাধন ও তাদেরকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অনুগৃহীত করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে, কিন্তু আসলে তা নয়। এই প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধি তাদেরকে পরীক্ষা স্বরূপই দেয়া হয়েছে। এর পশ্চাতে তাদের জন্যে যে মহা অকল্যাণ ও শােচনীয় পরিণতি অপেক্ষা করছে, সেটা তারা বুঝতেই পারছে না। (আয়াত ৫৫-৫৬)
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪২-৪৪ নং আয়াতের তাফসীর:
সালেহ (عليه السلام)-এর জাতি সামুদকে তাদের অবাধ্যতার কারণে ধ্বংস করার পর আল্লাহ তা‘আলা আরো অনেক জাতি নিয়ে এসেছিলেনন যেমন লূত, শু‘আইব, আইয়ুব ও ইউনুস প্রমুখ নাবীর জাতি। যেমন সূরা আ‘রাফে ও হুদে তাদের ঘটনাগুলো অনুরূপ আলোচিত হয়েছে। قرون শব্দটি قرن এর বহুবচন। অর্থ যুগ, কাল; এখানে জাতি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যেহেতু কালক্রমে জাতির উত্থান-পতন সেহেতু এ অর্থে ব্যবহৃত হয়।
(مَا تَسْبِقُ مِنْ أُمَّةٍ)
অর্থাৎ দুনিয়াতে আসার জন্য যে জাতির যে সময় নির্ধারিত ছিল তারা সে সময়েই আগমন করেছে, অগ্র-পশ্চাত হয়নি এবং যে সময়ে বিদায় নেয়ার সে সময়েই বিদায় নিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لِكُلِّ أُمَّةٍ أَجَلٌ ط إِذَا جَا۬ءَ أَجَلُهُمْ فَلَا يَسْتَأْخِرُوْنَ سَاعَةً وَّلَا يَسْتَقْدِمُوْنَ)
“প্রত্যেক জাতির এক নির্দিষ্ট সময় আছে; যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহূর্তকালও আগপিছ করতে পারবে না।” (সূরা ইউনুস ১০:৪৯)
تَتْرَا অর্থ ধারাবাহিকভাবে আসা, একের পর এক আসা। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ধারাবাহিকভাবে রাসূল প্রেরণ করেছেন। এমন নয় যে, কোন জাতির কাছে প্রেরণ করেছেন আর কোন জাতির কাছে প্রেরণ করেননি। যেমন সূরা নাহলের ৩৬ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক জাতির লোকেরাই রাসূলদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। তাই আল্লাহ তা‘আলা আফসোস করে বলেন:
(يَا حَسْرَةً عَلَي الْعِبَادِ مَا يَأْتِيْهِمْ مِّنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا كَانُوْا بِه۪ يَسْتَهْزِئُوْنَ)
“আফসোস বান্দাদের জন্য! তাদের কাছে কখনও এমন কোন রাসূল আসেনি, যাকে নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেনি।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৩০)
(فَأَتْبَعْنَا بَعْضَهُمْ بَعْضًا)
অর্থাৎ তারা যেমন রাসূলের প্রতি ঈমান আনেনি আমিও তাদেরকে একের পর এক ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ধ্বংসের কাহিনী ছাড়া আর কিছুই বাকী নেই, এসব কাহিনী পরবর্তীদের উপদেশ গ্রহণের জন্য রেখে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(فَقَالُوْا رَبَّنَا بَاعِدْ بَيْنَ أَسْفَارِنَا وَظَلَمُوْآ أَنْفُسَهُمْ فَجَعَلْنٰهُمْ أَحَادِيْثَ وَمَزَّقْنٰهُمْ كُلَّ مُمَزَّقٍ ط إِنَّ فِيْ ذٰلِكَ لَاٰيٰتٍ لِّكُلِّ صَبَّارٍ شَكُوْرٍ)
“কিন্তু তারা বলল: হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ভ্রমণের পরিসর বাড়িয়ে দিন। তারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। ফলে আমি তাদেরকে কাহিনীর বস্তুতে পরিণত করে দিলাম এবং সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিলাম। নিশ্চয়ই এতে রয়েছে দৃষ্টান্ত প্রত্যেক ধৈর্যশীল, কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।” (সূরা সাবা ৩৪:১৯)
সুতরাং রাসূলদের দাওয়াতে যারা সাড়া দিয়ে ঈমান আনবে তারাই সফলকাম, আর যারা তাদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করবে তাদের জন্য দুর্ভোগ।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল প্রেরণ করেছেন যাতে কিয়ামতের দিন কেউ অভিযোগ করতে না পারে।
২. প্রত্যেক জাতি নির্ধারিত সময়ে আগমন করে আবার নির্ধারিত সময়ে চলে যায়।
৩. যারা রাসূলদের ডাকে সাড়া দেয়নি তাদের পরিণাম খুবই ভয়াবহ হয়েছে।
৪৫-৪৯ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে মূসা (عليه السلام) ও তাঁর সহোদর ভাই হারূন (عليه السلام) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নবুওয়াত দিয়ে ফির‘আউনের কাছে দাওয়াত দেয়ার জন্য প্রেরণ করলেন। কারণ ফিরআউন ছিল সে দেশের বাদশা, যে আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ছিল এবং একটি অত্যাচারী সম্প্রদায় ছিল। বানী-ইসরাঈলদের ওপর নির্যাতন করত, নিজে রব দাবী করত। মূসা ও হারূন (عليه السلام) তার কাছে তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে আসলে সে তাদেরকে মানুষ বলে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। এছাড়াও অনেক কারণ ও বিস্তারিত ঘটনা সূরা ত্বা-হা- ও সূরা কাসাসে আলোচনা করা হয়েছে।
৫০-৫৬ নং আয়াতের তাফসীর:
(وَجَعَلْنَا ابْنَ مَرْیَمَ…)
এখানে ঈসা (عليه السلام) ও তাঁর মা মারইয়াম আলাইহাস সালাম-এর কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা দুজনকেই নিদর্শন বানিয়েছিলেন। ঈসা (عليه السلام) তো একজন নিজেই নিদের্শন; শিশু অবস্থায় কথা বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিতে মৃত মানুষ জীবিত করতেন, এছাড়াও তাঁকে অনেক নিদর্শন দেয়া হয়েছিল। মারইয়াম (عليه السلام) নিদর্শন হলেনন তিনি বিনা স্বামীতে গর্ভধারণ করেছেন। رَبْوَةٍ অর্থ উঁচু ভূমি। যখন মারইয়াম (عليه السلام) গর্ভবতী হলেন তখন হয়তো লোকালয় থেকে উঁচু কোন স্থানে চলে গিয়েছিলেন। সে জায়গাটা ছিল নিরাপদ, আর প্রস্রবণ বলতে সে ঝরণাকে বুঝানো হয়েছে যা ঈসা (عليه السلام)-এর জন্মের সময় অলৌকিভাবে প্রবাহিত হয়েছিল। এ বিষয়ে পূর্বে সূরা মারইয়ামে আলোচনা করা হয়েছে।
(أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا….. بَلْ لَّا یَشْعُرُوْنَ)
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সমস্ত রাসূলদেরকে নির্দেশ প্রদান করছেন যে, তারা যেন হালাল খাদ্য ভক্ষণ করে এবং সৎ আমল করে। কেননা হালাল ভক্ষণ ব্যতীত সৎ আমল কবূল হয় না। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
আবূ হুরাইরাহ (رضي الله عنه) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: হে মানুষ সকল! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র, আর তিনি পবিত্র ব্যতীত অপবিত্র কোন কিছু গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে তাই নির্দেশ দিয়েছেন যার নির্দেশ দিয়েছেন নাবী-রাসূলদেরকে। তখন তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন। অতঃপর এক ব্যক্তির কথা আলোচনা করলেন, সে তার সফরকে দীর্ঘায়িত করেছে, তার চুলগুলো ছিল এলোমেলো। তার খাদ্য-পানীয় ও পোশাকসহ তার সমস্ত কিছু ছিল হারাম। সে তার দু’হাত আকাশের দিকে তুলে বলতে লাগল, হে আমার প্রতিপালক! হে আমার প্রতিপালক! কিন্তু তার দু‘আ কিভাবে কবূল করা হবে, এটা অসম্ভব। (সহীহ মুসলিম: ৬৫)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُلُوْا مِنْ طَيِّبٰتِ مَا رَزَقْنٰكُمْ وَاشْكُرُوْا لِلّٰهِ إِنْ كُنْتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُوْنَ)
“হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যা জীবিকাস্বরূপ দান করেছি সেই পবিত্র বস্তুসমূহ খাও এবং একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর যদি তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত কর।” (সূরা বাকারাহ ২:১৭২) প্রত্যেক নাবী-রাসূল হালাল রুযী উপার্জন করতেন এবং খেতেন। যেমন দাঊদ (عليه السلام)-এর ব্যাপারে এসেছে: তিনি নিজ হাতের পরিশ্রমে উপার্জন খেতেন। (সহীহ বুখারী হা: ২০৭২)
নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: প্রত্যেক নাবী ছাগল চরিয়েছেন। আমিও সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীর ছাগল চরিয়েছি। (সহীহ বুখারী হা: ২২৬২)
সুতরাং প্রত্যেক মু’মিন ও মুসলিম নর-নারীর ওপর আবশ্যক হল যে, হালাল খাদ্য ভক্ষণ করা এবং হারাম খাদ্য পরিহার করা। কেননা হারাম খাদ্য খেয়ে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করলে সে ইবাদত কখনো কবূল হয় না। তাই মুসলিম সমাজে একজন হারামখোরের কোন সম্মান নেই, যদিও সে কারূনের মত পাহাড় সমান সম্পদ গড়ে তুলে। সম্মান ও ইজ্জতের অধিকারী একমাত্র তারাই যারা পরিশ্রম করে হালাল উপার্জন খায় যদিও তারা গরীব হয়।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা সকলে একই জাতি, তোমাদের দীন এক, রব একজন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন আর নিষেধ বর্জন করার মাধ্যমে তাঁকে ভয় কর। এর দ্বারা মূলত আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে দলে দলে বিভক্ত না হয়ে জামাতবদ্ধ হয়ে থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(اِنَّ ھٰذِھ۪ٓ اُمَّتُکُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةًﺘ وَّاَنَا رَبُّکُمْ فَاعْبُدُوْنِﮫوَتَقَطَّعُوْٓا اَمْرَھُمْ بَیْنَھُمْﺚ کُلٌّ اِلَیْنَا رٰجِعُوْنَ)
“নিশ্চয়ই এরা তোমাদের জাতিন এরা তো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক, অতএব আমার ইবাদত কর। কিন্তু তারা নিজেদের ব্যাপারে পরস্পরের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেকেই আমার নিকট প্রত্যাবর্তনকারী।” (সূরা আম্বিয়াহ ২১:৯২-৯৩)
এভাবে নিষেধ করার পরও যারা নাবীদের পথ বর্জন করে নিজেদের মাঝে দলাদলি সৃষ্টি করে তারা তাদের দীনকে নাবীদের দীন থেকে সম্পর্কচ্যুত করে ফেলেছে। প্রত্যেক দল নিজেদের নিকট যে সকল দলীল-প্রমাণ রয়েছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট, তারা তাদের দলীল-প্রমাণের আলোকে মনে করে তারাই সঠিক পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
غمرة অর্থ প্রচুর পরিমাণ পানি যা মাটি ঢেকে নেয়। ভ্রষ্টতার অন্ধকারও এত গভীর যে, তাতে নিমজ্জিত ব্যক্তির সত্য দৃষ্টিগোচর হয় না। এখানে غمرة অর্থ বিমূঢ়তা, গাফলতি, উদাসীনতা ও বিভ্রান্তি। আয়াতে ধমকস্বরূপ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে থাকতে দেয়া বা ছেড়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। উপদেশ বা নসীহত করা হতে বাধা দেয়া উদ্দেশ্য নয়। অতএব নিষেধ করা সত্ত্বেও যারা দলে দলে বিভক্ত হয় এবং ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তাদের স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।
সুতরাং প্রত্যেকটি মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য হল মুসলিম মিল্লাতকে আঁকড়ে ধরে থাকা এবং দলে দলে পৃথক না হওয়া। যারা দলাদলি সৃষ্টি করে তারা ইসলামের বাইরে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সর্বদা হালাল খাদ্য ভক্ষণ করতে হবে।
২. সকল নাবীর ধর্ম একই, আর তা হল এক আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত আর কারো ইবাদত করা যাবে না।
৩. দলে দলে বিভক্ত হওয়া মানে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা।
৪. আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল করে দিয়েছেন সে সকল বস্তু পবিত্র।