أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৬১)
[أَفَلَمْ يَدَّبَّرُوا الْقَوْلَ
তারা কি কখনো এ বাণী সম্পর্কে চিন্তা করেনি?]
সূরা:- আল্-মুমিনূন।
সুরা:২৩
পারা:১৮
৬৮-৭৫ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৩:৬৮
اَفَلَمۡ یَدَّبَّرُوا الۡقَوۡلَ اَمۡ جَآءَہُمۡ مَّا لَمۡ یَاۡتِ اٰبَآءَہُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۫۶۸﴾
তারা কি কখনো এ বাণী সম্পর্কে চিন্তা করেনি? অথবা সে এমন কথা নিয়ে এসেছে যা কখনো তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আসেনি?
২৩:৬৯
اَمۡ لَمۡ یَعۡرِفُوۡا رَسُوۡلَہُمۡ فَہُمۡ لَہٗ مُنۡکِرُوۡنَ ﴿۫۶۹﴾
অথবা তারা কি তাদের রসূলকে চিনে না বলে তাকে অস্বীকার করে?
২৩:৭০
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ بِہٖ جِنَّۃٌ ؕ بَلۡ جَآءَہُمۡ بِالۡحَقِّ وَ اَکۡثَرُہُمۡ لِلۡحَقِّ کٰرِہُوۡنَ ﴿۷۰﴾
অথবা তারা কি বলে যে, সে পাগল? বস্তুতঃ সে তাদের নিকট সত্য এনেছে। আর তাদের অধিকাংশ সত্যকে অপছন্দ করে।
২৩:৭১
وَ لَوِ اتَّبَعَ الۡحَقُّ اَہۡوَآءَہُمۡ لَفَسَدَتِ السَّمٰوٰتُ وَ الۡاَرۡضُ وَ مَنۡ فِیۡہِنَّ ؕ بَلۡ اَتَیۡنٰہُمۡ بِذِکۡرِہِمۡ فَہُمۡ عَنۡ ذِکۡرِہِمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿ؕ۷۱﴾
আর হক্ক যদি তাদের কামনা-বাসনার অনুগামী হত তবে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ত আসমানসমূহ ও যমীন এবং এগুলোতে যা কিছু আছে সবকিছুই । বরং আমরা তাদের কাছে নিয়ে এসেছি তাদের ইজ্জত ও সম্মান সম্বলিত যিকর কিন্তু তারা তাদের এ যিকর (কুরআন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
২৩:৭২
اَمۡ تَسۡـَٔلُہُمۡ خَرۡجًا فَخَرَاجُ رَبِّکَ خَیۡرٌ ٭ۖ وَّ ہُوَ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ ﴿۷۲﴾
অথবা তুমি কি তাদের কাছে কোন প্রতিদান চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রুযীদাতা।
২৩:৭৩
وَ اِنَّکَ لَتَدۡعُوۡہُمۡ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۷۳﴾
অবশ্যই তুমি তো তাদেরকে সরল পথের দিকে আহবান করছ।
২৩:৭৪
وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ عَنِ الصِّرَاطِ لَنٰکِبُوۡنَ ﴿۷۴﴾
আর নিশ্চয় যারা আখেরাতে ঈমান রাখে না, তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত,
২৩:৭৫
وَ لَوۡ رَحِمۡنٰہُمۡ وَ کَشَفۡنَا مَا بِہِمۡ مِّنۡ ضُرٍّ لَّلَجُّوۡا فِیۡ طُغۡیَانِہِمۡ یَعۡمَہُوۡنَ ﴿۷۵﴾
আমি তাদের উপর দয়া করলেও এবং তাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করলেও তারা অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরতে থাকবে।
৬৮-৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৬৮-৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:
يَدَّبَّرُوا অর্থ চিন্তা করা, গবেষণা করা, الْقَوْلَ দ্বারা উদ্দেশ্য কুরআন। অর্থাৎ কাফির-মুশরিকরা যদি কুরআন নিয়ে চিন্তা করত, গবেষণা করত তাহলে ঈমান না আনার প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যেত। যদি তারা সত্য জানার জন্য কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করত তাহলে তারা বুঝতে পারত যে, এ কুরআন সত্য গ্রন্থ এবং এর ওপর ঈমান নিয়ে আসার সৌভাগ্য হত। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
(أَفَلَا يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ ط وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللّٰهِ لَوَجَدُوْا فِيْهِ اخْتِلَافًا كَثِيْرًا)
“তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে অনুধাবন করে না? এটা যদি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো নিকট হতে আসত তবে তারা তাতে অবশ্যই অনেক অসঙ্গতি পেত।” (সূরা নিসা ৪:৮২) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(أَفَلَا يَتَدَبَّرُوْنَ الْقُرْاٰنَ أَمْ عَلٰي قُلُوْبٍ أَقْفَالُهَا)
“তবে কি তারা কুরআন সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরে তালা লেগে গেছে?্র” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:২৪)
মূলত তারা সত্যকে জানার ও বুঝার জন্য কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করত না। তারা ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে চিন্তা-ভাবনা করত যার ফলে তারা সত্য বুঝত না এবং পথপ্রাপ্তও হয়নি।
অথবা তাদের ঈমান আনতে এটা কি প্রতিবন্ধক হল যে, তারা রাসূলকে চিনে না? না চিনার কোন কারণ নেই, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো তাদের কাছে বড় হয়েছে, তাদের চোখের সামনে লালিত-পালিত হয়েছে। তারাই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল আমীন বলে খেতাব দিয়েছে। নাকি তারা বলতে চায় মুহাম্মাদ পাগল। তিনি তো পাগলও নন, গণকও নন (সূরা তুর ৫২:২৯)। প্রকৃতপক্ষে এসব কিছুই না, বরং তাদের কাছে সত্য আসার পরেও অধিকাংশরাই সত্য গ্রহণ করতে অপছন্দ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لَقَدْ جِئْنٰكُمْ بِالْحَقِّ وَلٰكِنَّ أَكْثَرَكُمْ لِلْحَقِّ كَارِهُوْنَ)
“(আল্লাহ তা‘আলা বলবেন:) অবশ্যই আমি তোমাদের নিকট সত্য পৌঁছিয়েছিলাম; কিন্তু তোমাদের অধিকাংশই ছিল সত্যকে অপছন্দকারী।” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৭৮)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এ সত্য তথা দীন ও শরীয়ত যদি তাদের কামনা-বাসনা অনুযায়ী হত তাহলে আকাশমণ্ডলী, জমিন ও তাদের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সকল কিছু ফেতনা-ফাসাদে পরিপূর্ণ হয়ে যেত। যেমন তাদের কামনা-বাসনা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقَالُوْا لَوْلَا نُزِّلَ هٰذَا الْقُرْاٰنُ عَلٰي رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيْمٍ)
“এবং তারা বলে: এই কুরআন কেন অবতীর্ণ করা হল না দুই জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর?” (সূরা যুখরুফ ৪৩:৩১)
(وَلَوْ رَحِمْنٰهُمْ) অর্থাৎ যারা ঈমানদার নয় তাদেরকে যতই রহম করি না কেন, আর বিপদ থেকে যতই মুক্তি দেই আবার তারা অবাধ্য কাজে লিপ্ত হবে। এটাই হল কাফিরদের স্বভাব। তারা বিপদে পড়লে আল্লাহ তা‘আলার কাছে কাকুতি-মিনতি করে বলে, আর কখনো অবাধ্য কাজে জড়িত হবে না, কিন্তু বিপদ থেকে মুক্তি দিলে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সত্যকে জানার জন্য কুরআন নিয়ে গবেষণা করতে হবে।
২. কুরআন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত কিতাব।
৩. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সত্যসহ প্রেরিত রাসূল। তিনি কোন পাগল নন।
৪. কুরআন অবতীর্ণের উদ্দেশ্য হল শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
৫. কাফিরদেরকে দুনিয়ার শাস্তি দিয়ে ভয় দেখালেও ভয় চলে গেলে তারা পূর্বের অবস্থায় ফিয়ে যায়।
৬. মানুষকে সত্য পথের দিকে আহ্বান করতে বিনিময় গ্রহণ না করাই উত্তম।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন্য বলেছেন :-
# তাদের এ মনোভাবের কারণ কি? তারা কি এ বাণী বোঝেইনি, তাই একে মানছে না? মোটেই না, কারণ এটা নয়। কুরআন কোন হে আয়ালি নয়। কোন দুর্বোধ্য ভাষায় কিতাবটি লেখা হয়নি। কিতাবটিতে এমন সব বিষয়বস্তুর সমাবেশ ঘটানো হয় নি যা মানুষের বোধগম্য নয়। তারা এর প্রত্যেকটি কথা ভালোভাবে বোঝে। এরপরো বিরোধিতা করছে। কারণ তারা একে মানতে চায় না। এমন নয় এ, তারা একে বুঝার চেষ্টাকরছে কিন্তু বুঝতে পারছে না তাই মানতে চায় না।
# তিনি কি এমন একটি অভিনব কথা পেশ করছেন যাতাদের কান কোনদিন শুনেনি এবং এটিই তাদের অস্বীকারের কারণ? মোটেই না, কারণ এটাও নয়। আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের আসা, কিতাবসহকারে আসা, তাওহীদের দাওয়াত দেয়া, আখেরাতের জবাবদিহির ভয় দেখানো এবং নৈতিকতার পরিচিত সৎবৃত্তিগুলো পেশ করা, এগুলোর মধ্য থেকে কোন একটিও এমন নয় যা ইতিহাসে আজ প্রথমবার দেখা দিয়েছে এবং ইতিপূর্বেআর কখনো এসব কথা শুনা যায় নি। তাদের আশপাশের দেশগুলো তারা জানে না এমন নয়। তাদের নিজেদের দেশেই ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সামালাম এসেছেন। হুদ, সালেহ ও শোআইব আলাইহিমুস সালামো এসেছেন। তাঁদের নাম আজও তাদের মুখে মুখে। তারা নিজেরাই তাঁদেরকে আল্লাহর প্রেরিত বলে মানে। তারা একথাও জানে যে, তাঁরা মুশরিক ছিলেন না বরং এক আল্লাহর বন্দেগীর শিক্ষা দিতেন। তাই প্রকৃতপক্ষে তাদের অস্বীকারের কারণ এই নয় যে, তারা এমন একটি পুরোপুরি আনকোরা নতুন কথা শুনছে যা ইতিপূর্বে কখনো শোনেনি।
# একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তি, যাকে তারা কোনদিনই জানতো না হঠাৎ তাদের মধ্যে এসে পড়েছেন এবং বলছেন আমাকে মেনে নাও, এটাই কি তাদের অস্বীকারের কারণ? না, একথা মোটেই নয়। যিনি এ দাওয়াত পেশ করছেন তিনি তাদের নিজেদের গোত্রের ও ভ্রাতৃসমাজের লোক। তাঁর বঙমঘত মর্যাদা তাদের অজানা নয়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন তাদের চোখের আড়ালে নেই। তিনি তাঁদের সামনেই শৈশব থেকে যৌবন এবং যৌবন থেকে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। তাঁর সততা, সত্যতা, আমানতাদারী, বিশ্বস্ততা ও নিষ্কলুষ চরিত্র সম্পর্কে তারা খুব ভালোভাএবই জানে। তারা নিজেরাই তাঁকে আমীন বলতো। তাদের সমগ্র ভাতৃসমাজ তাঁর বিশ্বস্ততার ওপর ভরসা করতো। তা নিকৃষ্টতম শত্রুও একথা স্বীকার করে যে, তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি। সমগ্র যৌবনকালেই তিনি ছিলেন পূতপবিত্র ও পরিচ্ছন্ন চরিত্রের অধিকাআরী। সবাই জানে তিনি একজন অত্যন্ত সৎ ভদ্র,ধৈর্য্যশীল, সহিষ্ণু, সত্যসেবী ও শান্তিপ্রিয় লোক। তিনি ঝগড়া বিবাদ থেকে দূরে থাকেন। পরিচ্ছন্ন লেনদেন করেন। প্রতিশুতি রক্ষায় তাঁর জুড়ি নেই। নিজে জুলুম করেন না এবং জালেমদের সাথে সহযোগিতাও করেন না। কোন হকদারেরর হক আদায় করতে তিনি কখনো কুন্ঠিত হননি। প্রত্যেক বিপদগ্রস্ত, অভাবী ও অসহায়ের জন্য তাঁর দরা হচ্ছে একজন দয়ার্দ্রচিত্ত, স্নেহপরায়ন সহানুভূতিশীলের দরজা। তারপর তারা এও জানতো যে, নবুওয়াতের দাবীর একদিন আগে পর্যন্ত কেউ তাঁর মুখ থেকে এমন কোন কথা শোনেনি যা থেকে এ সন্দেহ করা যেতে পারে যে, তিনি কোন দাবী করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর যেদিন থেকে এ সন্দেহ করা যেতে পারে যে, তিনি কোন দাবী একই কথা বলে আসছেন। তিনি কোন মোড় পরিবর্তন করেননি বা ডিগবাজী খাননি। নিজের দাওয়াত ও দাবীর মধ্যে কোন রদবদল করেননি। তাঁর দাবীর মধ্যে এমন কোন পর্যায়ক্রমিক ক্রমবিকাশ দেখা যায়নি যার ফলে এ ধারণা করা যেতে পারে যে, ধীরে ধীএর পা শক্ত করে দাবী ময়দানে এগিয়ে চলার কাজ চলছে। আবার তাঁর জীবন যাপন প্রণালী সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, অন্যদেরকে তিনি যা কিছু বলেন, তা সবার আগে নিজে পালন করে দেখাবার জন্য এক রকম এবং খাবার জন্য আবার অন্য রকম। তিনি নেবা জন্য এক পাল্লা এবং দেবার জন্য ভিন্ন পাল্লা ব্যবহার করেন না। এ ধরনের সুপরিচিত ও সুপরীক্ষিত ব্যক্তি সম্পর্কে তারা একথা বলেত পারে না যে, “ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। বড় বড় প্রতারক আসে এবং হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় কথা বলে প্রথম প্রথম আসর জমিয়ে ফেলে, পরে জানা যায় সবই ছিল ধোঁকা। এ ব্যক্তিও কি জানি আসলে কি এবং বানোয়াট পোশাক আশাক নামিয়ে ফেলার পর ভেতর থেকে কে বের হয়ে আসে কি জানি! তা একে মেনে নিতে আমাদের মেন সংশয় জাগছে।”
# তাদের অস্বীকার করার কারণ কি এই যে, তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাগল মনে করে? মোটেই না, এটাও আসলে কোন কারণই নয়। কারণ মুখে তারা যাই বলুক না কেন মনে মনে তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা স্বীকৃতি দিয়ে চলছে। তাছাড়া একজন পাগল ও সুস্থ-সচেতন ব্যক্তির মধ্যকার পার্থক্য এমন কোন অস্পষ্ট বিষয় নয় যে, উভয়কে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। একজন হঠকারী ও নির্লজ্জ ব্যক্তি ছাড়া কে এ বানী শোনার পর একথা বলতে পারে যে, এটা একজন পাগলের প্রলাপ এবং এ ব্যক্তির জীবনধারা দেখার পর এ অভিমত ব্যক্ত করতে পারে যে, এটা একজন বুদ্ধিভ্রষ্ট উন্মাদের জীবন? বড়ই অদ্ভুত সেই পাগলামি (অথবা পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদদের প্রলাপ অনুযায়ী মৃগীরোগীর সংজ্ঞাহীনতা) যার মধ্যে মানুষের মুখ দিয়ে কুরআনের মতো অলৌকিক সৌন্দর্যময় বাণী বের হয়ে আসে এবং যার মাধ্যমে মানুষকে একটা আন্দোলনের এমন সফল পথনির্দেশনা দেয় যার ফলে কেবলমাত্র নিজের দেশেরই নয়, সারা দুনিয়ার ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যায়।
# এ ছোট্ট বাক্যটির মধ্যে একটি অনেক বড় কথা বলা হয়েছে। এটি ভালোভাবে বুঝে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। দুনিয়ায় সাধারণত অজ্ঞ মূর্খ লোকদের নিয়ম এই হয়ে থাকে যে, তাদের সামনে যে ব্যক্তি সত্য কথাটি বলে দেয় তারা তার প্রতি অসন্তষ্ট হয়। প্রকারন্তরে তারা যেন বলতে চায়, যা সত্য ও বাস্তবসম্মত তা না করুক সত্য সব অবস্থায়ই সত্য থাকে। সারা দুনিয়ার লোকেরা এক জোট হলেও সত্য ও বাস্তবতাকে এক এক ব্যক্তির ইচ্ছা ও বাসনা অনুযায়ী ঢেলে বের করে আনা এবং প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য বিপরীতমুখী বাসনার সাথে একাত্ন হওয়া তো দূরের কথা কোন বাস্তব ঘটনাকে অবাস্তব এবং সত্যকে অসত্যে পরিণত করাও সম্ভবপর নয়। নির্বুদ্ধিতায় আক্রান্ত বুদ্ধিবৃত্তি কখনো এ কথা চিন্তা করার প্রয়োজনই বোধ করে না যে, সত্য ও তাদের বাসনার মধ্যে যদি বিরোধ থাকে তাহলে এ দোষটা সত্যের নয় বরং তাদের নিজেদের। তার বিরোধিতা করে তারা তার কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না বরং তাদের নিজেদের ক্ষতি করবে। বিশ্ব-জাহানের এ বিশাল ব্যবস্থা যেসব অবিচল সত্য ও আইনের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে তার ছত্রছায়ায় বাস করে মানুষের জন্য নিজের চিন্তা, বাসনা ও কর্মপদ্ধতিকে সত্য অনুযায়ী তৈরী করে নেয়া এবং এ উদ্দেশ্যে সর্বক্ষণ যুক্তি, অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য জানার চেষ্টা করতে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কেবলমাত্র একজন নির্বোধই এখানে যা কিছু সে বোঝে বা যা কিছু হয়ে যাক বলে তার মন চায় অথবা নিজের বিদ্ধিষ্ট মনোভাবের কারণে যা কিছু হয়েছে বা হওয়া উচিত বলে সে ধারণা করে নিয়েছে তার ওপর দ্বিধাহীন হয়ে যাওয়া এবং তার বিরুদ্ধে কারোর সবচেয়ে শক্তিশালী ও ন্যায়সঙ্গত যুক্তি-প্রমাণও শুনতে প্রস্তুত না হওয়ার চিন্তা ও কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে।
# এখানে ‘কথা’ শব্দটির তিনটি অর্থ হওয়া সম্ভব এবং তিনটি অর্থই এখানে প্রযোজ্য।
(ক) ‘কথা’ প্রকৃতির বর্ণনা অর্থে। এ প্রেক্ষিতে আয়াতের অর্থ হবে, আমি অন্য কোন জগতের কথা বলছি না। বরং তাদের নিজেদেরই সত্য ও প্রকৃতি এবং তার দাবী-দাওয়া তাদের সামনে পেশ করছি, যাতে তারা নিজেদের এ ভুলে যাওয়া পাঠ মনে করতে পারে। কিন্তু তারাএটা গ্রহণ করতে পিছপাও হচ্ছে। তাদের এ পলায়ন কোন অসংশ্লিষ্ট জিনিস থেকে নয় বরং নিজেদেরই কথা থেকে।
(খ) ‘কথা’ উপদেশ অর্থে। এ প্রেক্ষিতে আয়াতের ব্যাখ্যা হবে, যা কিছু পেশ করা হচ্ছে তা তাদেরই ভালোর জন্য একটি উপদেশ এবং তাদের এ পলায়ন অন্যকোন জিনিস থেকে নয় বরং নিজেদেরই কল্যাণেরকথা থেকে।
(গ) ‘কথা’ সম্মান ও মর্যাদা অর্থে। এ অর্থ গ্রহণ করলে আয়াতের অর্থ হবে, আমরা এমন জিনিস তাদের কাছে এনেছি যা তারা গ্রহণ করলে তারাই মর্যাদা ও সম্মানের অধীকারী হবে। এ থেকে তাদের এ মুখ ফিরিয়ে নেয়া অন্য কোন জিনিস থেকে নয় বরং নিজেদেরই উন্নতি এবং নিজেদেরই উত্থানের একটি সুবর্ণ সুযোগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নামান্তর।
# এটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের পক্ষে আর একটি প্রমাণ। অর্থাৎ নিজের এ কাজে আপনি পুরোপুরি নিস্বার্থ। কোন ব্যক্তি সততার সাথে এ দোষারোপ করতে পারেনা যে, নিজের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য আপনার সামনে রয়েছে তাই আপনি এ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে আপনার ভালোই উন্নতি হচ্ছিল। এখন দারিদ্রও অর্থসংকটের সম্মুখীন হলেন। জাতির মধ্যে আপনাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হতো। লোকেরা মাথায় করে রাখতো। এখন গালাগালি ও মার খাচ্ছেন বরং প্রাণ নাশের পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। নিজের পরিবার –পরিজন নিয়ে নিশ্চিন্তে সুখে জীবন যাপন করছিলেন। এখন এমন একটি কঠিন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্যে পড়ে গেছেন যার ফলে এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না। এর ওপর আরো সমস্যা হলো এমন বিষয় নিয়ে সামনে এসেছেন যারফলে সারা দেশের লোক শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এমনকি নিজের জ্ঞাতি ভাইরা আপনাকে হত্যা করার জন্য পাগলপারা হয়ে উঠেছে। কে বলতে পারে, এটা একজন স্বার্থবাদী লোকের কাজ? স্বার্থবাদী লোক তো নিজের জাতি ও গোত্রপ্রীতির ঝান্ডা উঁচিয়ে নিজের যোগ্যতা ও যোগসাজশের মাধ্যমে নেতৃত্ব লাভ করার প্রচেষ্টা চালাতেন। তিনি কখনো এমন কোন বিষয় নিয়ে আবির্ভূত হতেন না যা কেবলমাত্র সমগ্র জাতীয় ও গোষ্ঠীগত স্বার্থপ্রীতির বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জই নয় বরং আরবের মুশরিকদের মধ্যে তার গোত্রের সরদারী যে জিনিসের বদৌলতে প্রতিষ্ঠিত আছে তার শিকড়ও কেটে দেয়। এটি এমন একটি যুক্তি যা কুরআনে শুধুমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরই নয় বরং সাধারণভাবে সকল নবীর সত্যতার প্রমাণ হিসেবে বারবার পেশ করা হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, আল আন’আম ৯০ , ইউনুস ৭২ , হুদ ২৯ ও ৫১ , ইউসুফ ১০৪ , আল ফুরকান ৫৭ , আশ শু’আরা ১০৯ , ১২৭ , ১৪৫ , ১৬৪ ও ১৮০ , সাবা ৪৭, ইয়াসীন ২১ , সাদ ৮৬ , আশশূরা ২৩ ও আন-নাজম ৪০ আয়াত এবং এই সঙ্গে টীকাগুলোও দেখুন।
# আখেরাত অস্বীকার করার ফলে তারা দায়িত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং দায়িত্বের অনুভূতি না থাকায় তারা একেবারেই বেপরোয়া হয়ে গেছে। তাদের এ জীবেনের একটা সমাপ্তি ও ফলাফল যে আছে এবং কারোর সামনে এ সমগ্র জীবনকালের কার্যাবলীর হিসেব যে দিতে হবে, এটাই যখন তারা বুঝে না তখন সত্য কি ও মিথ্যা কি তা নিয়ে তাদের কিইবা চিন্তা হতে পারে? জন্তু-জানোয়ারের মতো দেহ ও প্রবৃত্তির প্রয়োজন খুব ভালোভাবে পূর্ণ হবার পর সত্য ও মিথ্যার আলোচনা তাদের কাছে নেহাতই অর্থহীন। আর এ উদ্দেশ্য লাভের ক্ষেত্রে কোন ত্রুটি দেখা দিলে বড় জোর তারা এ ত্রুটির কারণ কি এবং কিভাবে একে দূর করা যায় এতটুকুই চিন্তা করবে। এ ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন লোকেরা কোন দিন সঠিক পথ চাইতে পারেনা এবং পেতেও পারেনা।
# দুর্ভিক্ষের কারণে আরববাসী যে কষ্ট ও বিপদের মধ্যে অবস্থান করছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত হাদীস উদ্ধৃত করতে গিয়ে কেউ কেউ দু’টি দুর্ভিক্ষকে এক সাথে মিশিয়ে ফেলেছন। এর ফলে একটি হিজরতের আগের না পরের ঘটনা তা বুঝা মানুষের পক্ষা কঠিন হয়ে যায়। আসল ঘটনা হচ্ছ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে মক্কাবাসীরা দুবার দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। একবার নবোয়াতের সূচনার কিছুদিন পর। দ্বিতীয়বার হিজরাতের কয়েক বছর পর যখন সামামাহ ইবনে উসাল ইয়ামামাহ থেকে মক্কার দিকে খাদ্য শস্য রফতানী করা বন্ধ করে দিয়েছিল। এখানে দ্বিতীয় দুর্ভিক্ষটির নয় প্রথমটির কথা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) এ বর্ণনা পাওয়া যায় যে, যখন কুরাইশরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত অস্বীকার করতেই থাকলো এবং কঠোরভাবে বাধা দিতে শুরু করলো তখন তিনি দোয়া করলেনঃ
– “হে আল্লাহ! এদের মোকাবিলায় ইউসুফের আট বছরের দুর্ভিক্ষের মতো সাত বছরব্যাপী দুর্ভিক্ষ দিয়ে আমাকে সাহায্য করো।”
ফলে এমন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেলো যে, মৃতের গোশ্ত খাওয়ার ঘটনাও ঘটলো। মক্কী সূরাগুলোতে বহু জায়গায় এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
* (আয়াত ৬৮-৭৪) বস্তুত রসূল(স.)-এর কাছে যে বাণী এসেছে, তা নিয়ে যে ব্যক্তি চিন্তা ভাবনা করে তার পক্ষে সে বাণীকে প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা এ বানীতে যে পূর্ণতা সমন্বয়, আকর্ষণ, মানবীয় স্বভাব প্রকৃতির সাথে সংগতি, মানবীয় বিবেকের স্বাভাবিক ও স্বতস্ফূর্ত মতের প্রতিফলন, মনের খােরাক, চিন্তা গবেষণার উপাদান, উচ্চতর ও মহৎ দৃষ্টিভংগি এবং সুষ্ঠু ও নিখুঁত আইন ও বিধান রয়েছে, তা মানবীয় স্বভাব প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানকে উদ্দীপিত ও পরিপুষ্ট করার নিশ্চয়তা দান করে। সুতরাং আল্লাহর এ বাণীকে প্রত্যাখ্যান করার একমাত্র কারণ ও এর অন্তর্নিহিত একমাত্র রহস্য এই যে, তারা এ বাণী নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না এবং একে হৃদয়ংগম করার চেষ্টা করে না। ‘না কি তাদের কাছে এমন কিছু এসেছে, যা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে আসেনি?’ অর্থাৎ তাদের কাছে একজন রসূলের আগমন বা তাওহীদের বার্তা নিয়ে কারাে আগমন কি তাদের ও তাদের পূর্বপুরুষদের জন্যে একেবারেই অভিনব, অনাকাংখিত ও অপ্রত্যাশিত। সমগ্র ইতিহাসই তাে সাক্ষী যে, প্রতিটা মানব গােষ্ঠীর কাছে অনবরতই কোনাে না কোনাে রসূল এসেছেন এবং প্রত্যেকে একই বার্তা বহন করে এনেছেন। ‘না কি তারা তাদের রসূলকে চিনতেই পারেনি…?’ আর এই চিনতে না পারাই কি তাদের প্রত্যাখ্যানের আসল কারণ? কিন্তু তা নয়। তারা তাদের রসূলকে সঠিকভাবেই চেনে ও জানে। তার ব্যক্তিগত পরিচয় ও তাঁর বংশীয় পরিচয় উভয়ই তাদের জানা। তার গুণাবলী তারাই সবচেয়ে ভালাে জানে। তার সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তারা এতাে ওয়াকিফহাল যে রসূল হিসাবে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বেই তারা তাকে ‘আল আমীন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাে। না কি তারা বলে সে উন্মাদ? তাদের মধ্যকার কিছু কিছু নির্বোধ ব্যক্তি একথা বলতাে। অথচ তারা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করতাে যে, তাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র পরিপক্ক ও পূর্ণাংগ বুদ্ধিমান। কেননা তার সুদীর্ঘ জীবনেতিহাসে তার কোনাে পদস্খলন ঘটতে তারা দেখেওনি, শােনেওনি।
* *সত্য কারাে যুক্তি বা খেয়াল খুশীর ধার ধারে না : এসব সন্দেহ সংশয়ের একটারও কোনাে ভিত্তি নেই। এসবের আসল কারণ হলাে, এই অকাট্য সত্য বিধানের প্রতি তাদের অধিকাংশের বিরাগ বা অপছন্দ। কেননা যে বাতিল চিন্তাধারা ও ধ্যান ধারণা নিয়ে তারা বেঁচে আছে ও গর্ব বােধ করে, এই অকাট্য সত্য বাণী তার বিরােধী ও তাকে উৎখাত করতে চায়। বরঞ্চ এই রসূল সত্য বাণী নিয়ে এসেছে এবং তাদের অধিকাংশই সত্যকে অপছন্দ করে। সত্য কখনাে মানুষের খেয়াল-খুশীর অনুসারী হতে পারে না। এই সত্যের ওপরই আকাশ ও পৃথিবী টিকে আছে, এই সত্য বিধান অনুসারেই গােটা সৃষ্টি জগত নির্ভুলভাবে চলছে এবং বিশ্বজগতের যেখানে যা কিছু আছে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই সত্য বিধানই মেনে চলছে। ‘সত্য যদি তাদের কামনা-বাসনা অনুসারে চলতাে, তাহলে আকাশ, পৃথিবী ও তার অভ্যন্তরে যা কিছু আছে, সব ধ্বংস হয়ে যেতো।’ কেননা সত্য এক ও চিরস্থায়ী। কিন্তু কামনা বাসনা বহু ও পরিবর্তনশীল। চিরন্তন ও শাশ্বত সত্যের ভিত্তিতেই বিশ্বজগত পরিচালিত। সুতরাং জগত পরিচালনার নীতি নিত্য পরিবর্তনশীল কামনা বাসনার দাবী অনুসারে বিকৃত হতে পারে না। প্রকৃতির বিধান ক্ষণস্থায়ী আবেগ দ্বারা চালিত হতে পারে না। প্রকৃতির রাজ্য যদি মানুষের ক্ষণস্থায়ী ও নিত্য পরিবর্তনশীল ভাবাবেগের অনুসারী হতাে, তা হলে তা ধ্বংস হয়ে যেতাে এবং সেই সাথে লন্ড ভন্ড হয়ে যেতাে গােটা মানব জাতি, সমাজ ব্যবস্থা ও মূল্যবােধ, মানদন্ড ও মাপ কাঠি । আর তাহলে এই মূল্যবােধ ও মানদন্ড ক্রোধ ও সন্তোষের ক্ষেত্রে, অনুরাগ ও বিরাগের ক্ষেত্রে, ভয় ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে, সক্রিয়তা ও নিষ্ক্রিয়তার ক্ষেত্রে এবং সকল ধরনের ভাবাবেগের ক্ষেত্রে দোদুল্যমান থাকতাে এবং একবার এদিকে আর একবার ওদিকে যেতাে। বস্তু জগতের নির্মাণ ও সে লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যে তার একটা স্থীতিশীল ভিত্তির ওপর চলে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে ক্রমাগত সামনের দিকেই পরিচালিত হওয়া আবশ্যক। ডানে বামে ঝোক, পশ্চাৎপদতা ও দোদুল্যমানতা এড়িয়ে পূর্ণ ভারসাম্য সহকারে অবিচল গতিতে লক্ষ্য পানে অগ্রসর হওয়া সৃষ্টি জগতের পক্ষে অপরিহার্য। বিশ্ব জগতের গঠন ও পরিচালনা সংক্রান্ত এই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির আলােকেই ইসলাম মানব জীবনের জন্যে আইন প্রণয়নকে প্রাকৃতিক বিধানেরই একটা অংশে পরিণত করেছে। যে মহাশক্তিধর হাত ও এ বিশ্বজগতের পরিচালনা ও এর সকল অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেন, তিনিই মানব জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় আইন রচনা করেন। যেহেতু মানুষ এই মহাবিশ্বের অংশ এবং মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণকারী সর্বব্যাপী প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন, তাই যে সত্তা গােটা বিশ্ব প্রকৃতির নিয়ম-বিধি রচনা করেছেন, মহাবিশ্বের এই অংশ মানুষের জন্যে আইন ও বিধান রচনা করাও তাঁর পক্ষেই শােভন ও সমীচীন। এ বিশ্বজগতকে তিনি এক বিস্ময়কর ভারসাম্য সহকারে পরিচালনা করছেন। ফলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ব্যবস্থা কারাে ভাবাবেগ বা খেয়াল খুশী মােতাবেক চলে না এবং চলে না বলেই তার শৃংখলা ব্যাহত হয় না ও অরাজকতার কবলে পড়ে না। বরঞ্চ তা সর্বাত্মক সত্য বিধানের তথা আল্লাহর বিধানের অনুসারী এবং আল্লাহর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার অধীন। যে জাতির মধ্যে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটেছে, সত্যের অনুসরণ ও আনুগত্যের যােগ্যতা এই জাতির মধ্যেই সর্বাধিক। আর এই সত্য ইসলাম ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলাম শুধু যে একমাত্র সত্য ও নির্ভুল বিধান তা নয়, বরং এটা মুসলিম জাতির জন্যে সম্মান ও মর্যাদার বাহনও। পৃথিবীতে ইসলাম না এলে এই জাতির নামও কেউ জানতাে না। ‘বরঞ্চ আমি তাদের খ্যাতি এনে দিয়েছি। তখন তারা তাদের খ্যাতি থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।’ বস্তুত ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে বিশ্ব ইতিহাসে আরব জাতির কোনাে খ্যাতি ছিলাে না। পরে যতােদিন তারা ইসলামকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে, ততদিন তাদের নাম বিশ্ববাসীর কর্ণগােচর হয়েছে। কিন্তু যখনই তারা ইসলাম থেকে দূরে সরে গিয়েছে, তখন থেকে তাদের খ্যাতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে আরম্ভ করেছে। তারা পুনরায় তাদের এই বৃহৎ ঠিকানায় ফিরে না আসা পর্যন্ত তাদের খ্যাতি আর কিছুতেই পুনর্বহাল হবে না। সত্যের দাওয়াত আরবদের কাছে আসার পর তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের পৌত্তলিক মতাদর্শকেই সত্য বলে দাবী করেছিলাে। এই প্রসংগেই এই আনুষংগিক মন্তব্যটি করা হয়েছে যে, সত্য যদি তাদের খেয়ালখুশী ও ধ্যান-ধারণার অনুসারীই হতাে, তাহলে আকাশ ও পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতাে।… এই আনুষংগিক মন্তব্যের পর পুনরায় তাদের মতাদর্শের নিন্দা সমালােচনা ও তাদের সেসব সন্দেহ-সংশয় দূর করা হচ্ছে, যা তাদেরকে এই সৎ ও বিশ্বাসভাজন নবীর দাওয়াত প্রত্যাখ্যানের প্ররোচনা দিচ্ছিলাে। ‘তবে কি তুমি তাদের কাছে কোনাে পারিশ্রমিক চাইছো?’ অর্থাৎ ইসলামের শিক্ষা ও পথনির্দেশ দানের পারিশ্রমিক চেয়েছে বলেই কি তারা তােমার কাছ থেকে পালাচ্ছে? আসলে তুমি তাে তাদের কাছে কিছুই চাওনি। কেননা তােমার প্রভুর কাছে তােমার জন্যে যে প্রতিদান ও পুরষ্কার রয়েছে, সেটাই উত্তম প্রতিদান। ‘তোমার প্রভুর প্রতিদানই উত্তম এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ দাতা।’ বস্তুত আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের হকদার একজন নবীর জন্যে দুনিয়ার দরিদ্র, পরমুখাপেক্ষী ও দুর্বল মানুষের কাছে চাওয়ার ও পাওয়ার কী ইচ্ছা থাকতে পারে? নবী তাে দূরের কথা, নবীর অনুসারীদের জন্যেই বা এসব নগণ্য পার্থিব সম্পদের মধ্যে এমন কী লােভনীয় সামগ্রী আছে, যার জন্যে তারা লালায়িত হতে পারে? তাদের মন ও দৃষ্টি তাে নিবদ্ধ থাকার কথা আল্লাহর কাছে সঞ্চিত পুরস্কারের দিকে, যিনি অল্প বা বেশী শ্রমের বিনিময়েও জীবিকা দিয়ে থাকেন। প্রকৃত পক্ষে যখন কারাে মন আল্লাহর সাথে মিলিত হয়, তখন তার দৃষ্টিতে গােটা পৃথিবী ও তার সমস্ত-সহায়-সম্পদ হেয় মনে হয়। বস্তুত আল্লাহর রসূল মানুষের কাছ থেকে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া ও সৎ কাজ করা ছাড়া আর কিছুই কামনা করেন না। ‘তুমি তাে তাদেরকে সঠিক পথের দিকেই আহ্বান কর।’ যে পথ মানুষকে আল্লাহর সাথে মিলিত করে এবং আল্লাহর অনুগত বিশ্ব-প্রকৃতির সাথে এক কাতারে শামিল করে। ফলে তার গােটা জীবন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং কখনাে বিপথগামী হয় না। পক্ষান্তরে মােশরেকরা পরকালে অবিশ্বাসী অন্যান্যদের মত বিপথগামী, ‘আর যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না, তারা সঠিক ও সত্য পথ থেকে বিচ্যুত।’ তারা যদি সুপথগামী হতাে, তাহলে তাদের বিবেক ও মন আখেরাতে বিশ্বাসের পথই অনুসরণ করতাে। কেননা আখেরাতই হচ্ছে সর্বাত্মক পূর্ণতা পরিপক্কতা ও ন্যায় বিচার বাস্তবায়নের সুনিশ্চিত স্থান। আখেরাত হচ্ছে ইহকালীন জীবনের সুষ্ঠু পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে আল্লাহর মনােনীত প্রাকৃতিক বিধানেরই অংশ বিশেষ। পরবর্তী আয়াতগুলােতে আল্লাহ বলছেন যে, যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না এবং যারা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত, তাদেরকে বিপদ-মুসিবত, দুঃখ ও দারিদ্র অথবা সুখ, শান্তি ও প্রাচুর্য যেটা দিয়েই পরীক্ষা করা হােক না কেন, তা সুফল বয়ে আনে না। তাদেরকে যদি সম্পদ ও প্রাচুর্য দান করা হয়, তাহলে তারা মনে করে যে, তাদের জন্যে আমি ত্বরিত কল্যাণ কামনা করি বলেই তাদেরকে মানব সম্পদ ও অর্থ সম্পদে প্রাচুর্য দান করে থাকি। আর যদি তাদের ওপর বিপদ-মুসিবত আসে তাহলেও তাদের মন নরম হয় না, তাদের বিবেক জাগ্রত হয় না এবং তারা বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করে না। এভাবে অনমনীয় ও হঠকারী মানসিকতা নিয়েই তারা শেষ পর্যন্ত মারা যায় এবং কেয়ামতের দিন কঠিন আযাবের সম্মুখীন হয়ে চরম হতাশায় দিশেহারা হয়ে পড়ে। আর যদি আমি তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করি ও তারা যে বিপদে আছে তা থেকে উদ্ধার করি, তাহলে তারা তাদের হঠকারিতা অব্যাহত রাখে আর আমি তাদেরকে আযাব দিয়েও পাকড়াও করেছি। তাতেও তারা তাদের প্রতিপালকের সামনে কিছুমাত্র নতি স্বীকার ও কাকুতি মিনতি করে না। ‘অবশেষে আমি যখন তাদের ওপর কঠিন আযাবের দ্বারােদঘাটন করেছি, অমনি তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।’ এটা এমন একশ্রেণীর মানুষের চরিত্রের সাধারণ বিশ্লেষণ যাদের হৃদয় পাষাণ হয়ে গেছে, যারা আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে উদাসীন এবং যারা আখেরাতকে মিথ্যা মনে করে। রসূল(স.)-এর সময়ের পৌত্তলিক এই শ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। বিপদে আপদে আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করে ও অনুতপ্ত হয়ে দোয়া করা ও উদ্ধার চাওয়া আল্লাহর নাফরমানী পরিত্যাগ করে তাঁর আনুগত্যের দিকে ফিরে যাওয়ার প্রমাণ বহন করে। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আক্রান্ত মানুষটা আল্লাহকেই একমাত্র আশ্রয়স্থল ও একমাত্র ত্রাণকর্তা বলে মনে করে। যখন কারাে মন এভাবে আল্লাহর কাছে নত হয়, তখন তা অবশ্যই নরম হয়ে যায়, জাগ্রত ও সচেতন হয়ে যায়। একমাত্র এই জাগৃতি ও সচেতনতা এবং এই সংবেদনশীলতা ও স্পর্শকাতরতাই মানুষকে উদাসীনতা, পদস্খলন ও গোমরাহী থেকে রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। এই জাগরণও অনুশােচনা থাকলে মানুষ বিপদ মুসিবত দ্বারা উপকৃত হয়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি বিপদ মুসিবতে পড়েও গােমরাহী ও বিকৃতি অব্যাহত রাখে, তার আর সংশােধনের আশা করা যায় না। আখেরাতের আযাব তার জন্যে অবধারিত হয়ে যায় এবং সে আকস্মিকভাবেই তার শিকার হয়ে যায়। যখন সে এই আযাবের সম্মুখীন হয়, তখন তার আর মুক্তির কোনাে আশা থাকে না।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৬৮-৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:
মুশরিকরা যে কুরআন বুঝতো না, ওর সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করতো না, বরং ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। কেননা, তিনি তাদের প্রতি এমন পবিত্র কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যা ইতিপূর্বে কোন নবীর উপর অবতীর্ণ করেননি। এই কিতাব সবচেয়ে বেশী মর্যাদা সম্পন্ন ও উত্তম। তাদের যেসব পূর্বপুরুষ অজ্ঞতার যুগে মৃত্যুবরণ করেছিল তাদের কাছে কোন আসমানী গ্রন্থ ছিল না এবং তাদের কাছে কোন নবীরও আগমন ঘটেনি। সুতরাং এদের উচিত ছিল আল্লাহর এই রাসূল (সঃ)-কে মেনে নেয়া, তাঁর কিতাবের মর্যাদা দেয়া এবং দিবা-নিশি এর উপর আমল করতে থাকা। যেমন তাদের মধ্যকার বিবেকবান লোকেরা করেছিল। তারা মুসলমান হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পূর্ণ অনুসারী হয়ে গিয়েছিল। আর নিজেদের কাজের দ্বারা তারা মহান আল্লাহকে সন্তুষ্ট করেছিল। বড়ই দুঃখের বিষয় যে, কাফিররা বিবেক-বুদ্ধির সাথে কাজ করেনি। কুরআন কারীমের অস্পষ্ট মর্ম বিশিষ্ট আয়াতগুলোর পিছনে পড়ে তারা নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সততা, সত্যবাদিতা এবং বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তারা কি ওয়াকিফহাল নয়? তিনি তো তাদের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তাদেরই মধ্যে প্রতিপালিত হয়ে বড় হয়েছেন। অথচ এখন কি কারণে তারা তাকে মিথ্যাবাদী বলতে শুরু করে দিলো? এর পূর্বে তো তারা তাঁকে বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এখন তাদের তার থেকে বিমুখ হওয়ার কারণ কি? হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ) আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাশীর সামনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সম্পর্কে এ কথাই বলেছিলেনঃ “বিশ্ব প্রতিপালক এক ও অংশীবিহীন আল্লাহ আমাদের মধ্যে এমন একজন রাসূল (সঃ) প্রেরণ করেছেন যার বংশ গরিমা, সত্যবাদিতা এবং বিশ্বস্ততা সম্পর্কে আমাদের পূর্ণ অবগতি ছিল।”
হযরত মুগীরা ইবনে শুবাহ (রাঃ) জিহাদের প্রান্তরে পারস্য সম্রাট কিসরার সামনেও একথাই বলেছিলেন। আবু সুফিয়ান সখর ইবনে হারব (রাঃ) রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সামনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা এবং সদ্বংশের কথা ঘোষণা করেছিলেন। যে সময় সম্রাট তাঁকে তাঁর সঙ্গীদের সামনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। অথচ আবু সুফিয়ান (রাঃ) ঐ সময় মুসলমান ছিলেন না।
কাফির ও মুশরিকরা বলতো যে, হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) পাগল কিংবা তিনি নিজেই কুরআন রচনা করেছেন। অথচ প্রকৃত ব্যাপার তা নয়। প্রকৃত কথা শুধু এটাই যে, তাদের অন্তর ঈমান-শূন্য। তারা কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে। মুখে যা আসে তাই তারা বলে দেয়। কুরআন তো এমন কালাম যার তুল্য কিছু পেশ করতে সারা দুনিয়া অপারগ হয়ে গেছে। কঠিন বিরোধিতা, পূর্ণ চেষ্টা এবং সীমাহীন মুকাবিলা সত্ত্বেও কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি যে, এই কুরআনের অনুরূপ নিজে বানিয়ে নেয় বা সবারই সাহায্যের মাধ্যমে এইরূপ একটি সূরা আনয়ন করে। এটা তো সরাসরি সত্য। কিন্তু তাদের অধিকাংশই সত্যকে অপছন্দ করে। পরবর্তী বাক্যটি ‘হাল’ বা অবস্থাববাধক বা এটা খাবারিয়্যাহ মুসতানেফাও হতে পারে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) একদা একটি লোকের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে বলেনঃ “ইসলাম কবুল কর।” তখন লোকটি বলেঃ “আপনি আমাকে এ বিষয়ের দিকে আহ্বান করছেন যা আমি অপছন্দ করি।” নবী (সঃ) তখন তাকে বলেনঃ “যদিও তুমি অপছন্দ কর (তবুও ইসলাম কবুল করে নাও।)”
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, নবী (সঃ) একটি লোকের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে বলেনঃ “তুমি ইসলাম কবূল কর।” একথা তার কাছে খুব কঠিন ঠকে এবং তার চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। তিনি তখন তাকে বলেনঃ “দেখো, তুমি যদি কোন জনমানবহীন বিপদ সংকুল পথে চলতে থাকে এবং এমতাবস্থায় পথে এক লোকের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হয়, যার নাম ও বংশ এবং সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তুমি পূর্ণ ওয়াকিফহাল। এখন সে যদি তোমাকে বলেঃ তুমি ঐ পথে চল যে পথটি প্রশস্ত, সহজ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তাহলে তুমি তার প্রদর্শিত ঐ পথে যাবে কি যাবে না?” লোকটি উত্তরে বলেঃ “হ্যা, অবশ্যই আমি ঐ পথই ধরবো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ “তাহলে বিশ্বাস রেখো যে, আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই তুমি দুনিয়ার এই কঠিন ও বিপদ সংকুল পথের চেয়েও বেশী মন্দ ও ভয়াবহ পথে রয়েছে। আর আমি তোমাকে সরল সঠিক পথের দিকে আহ্বান করছি। সুতরাং আমার কথা মেনে নাও।”
আর একটি রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, একটি লোকের সাথে নবী (সঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাকে ইসলামের দাওয়াত দেন এবং তা তার কাছে কঠিন বোধ হয়। তখন তিনি তাকে বলেনঃ “আচ্ছা, যদি তোমার দু’জন সঙ্গী থাকে, যাদের একজন সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত এবং অপরজন মিথ্যাবাদী ও বিশ্বাসঘাতক, তবে তুমি কার সাথে ভালবাসা রাখবে?” উত্তরে লোকটি বলেঃ “আমি সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত সঙ্গীটিকেই ভালবাসবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট এরূপই বটে।” (আরবী)-এই আয়াতে দ্বারা মুজাহিদ (রঃ), আবু সালেহ (রঃ) এবং সুদ্দী (রঃ)-এর উক্তি হিসেবে মহামহিমান্বিত আল্লাহকেই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যদি তাদের বাসনা অনুযায়ী শরীয়ত নির্ধারণ করতেন তবে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী বিশৃংখল হয়ে পড়তো। যেমন মহান আল্লাহ তাদের উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “দুই জনপদের মধ্য হতে কোন বড় (নেতৃস্থানীয়) লোকের উপর কেন এই কুরআন অবতীর্ণ করা হয়নি?” (৪৩:৩১) তাদের এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ তারাই কি তোমার প্রতিপালকের করুণা বন্টন করছে?” আর এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ ‘তুমি বলে দাওঃ যদি তোমাদেরই হাতে আমার প্রতিপালকের রহমতের ভাণ্ডার থাকতো তবে তোমরা অবশ্যই খরচের ভয়ে তা আটকিয়ে রাখতে।” (১৭:১০০) আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তবে কি রাজ-শক্তিতে তাদের কোন অংশ আছে? সে ক্ষেত্রেও তো তারা কাউকেও এক কপর্দকও দিবে না।” (৪:৫৩) সুতরাং এ সমুদয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা বর্ণনা দিচ্ছেন যে, মানবীয় মস্তিষ্ক মাখলুকের ব্যবস্থাপনার মোটেই যোগ্যতা রাখে না। এটা একমাত্র আল্লাহর মাহাত্ম্য যে, তাঁর গুণাবলী, তার ফরমান, তাঁর কার্যাবলী, তাঁর শরীয়ত, তার তকদীর, তার তদবীর তাঁর সৃষ্টজীবের জন্যে কামেল বা পূর্ণ এবং সবই সমস্ত মাখলুকের প্রয়োজন পূরণের অনুকূলে। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং নেই কোন প্রতিপালক।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি তাদের দিয়েছি উপদেশ অর্থাৎ কুরআন, কিন্তু তারা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
স্বীয় নবী (সঃ)-কে আল্লাহ সম্বোধন করে বলছেনঃ তুমি কি তাদের কাছে কোন প্রতিদান চাও? অর্থাৎ তুমি তাদের কাছে তো কোন প্রতিদান চাও না। তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ জীবিকা প্রদানকারী। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ এক জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তোমাদের কাছে যে প্রতিদান চেয়েছি তা তোমাদেরই জন্যে, আমার প্রতিদান তো রয়েছে আল্লাহরই দায়িত্বে।” (৩৪:৪৭) আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি আমি এর জন্যে তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাচ্ছি না। এবং আমি লৌকিকতা প্রদর্শনকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (৩৮:৮৬) অন্যত্র বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি বলঃ এর জন্যে আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান যাজ্ঞা কহিনা, শুধু আত্মীয়তার সম্পর্ক যুক্ত রাখাই আমার কাম্য।” (৪২৪:২৩) আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “নগরীর প্রান্ত হতে এক ব্যক্তি ছুটে আসলো, সে বললোঃ হে আমার সম্প্রদায় রাসূলদের অনুসরণ কর। অনুসরণ কর তাদের যারা তোমাদের নিকট কোন প্রতিদান চায় না।” (৩৬:২০-২১) এখানে মহান আল্লাহ বলেনঃ তিনিই শেষ্ঠ রিযিকদাতা। তুমি তো তাদেরকে সরল পথে আহ্বান করছো।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, (একদা) রাসূলুল্লাহ (সঃ) শায়িত ছিলেন, এমন সময় দু’জন ফেরেশতা তাঁর নিকট আগমন করেন। তাঁদের একজন তার পদদ্বয়ের নিকট এবং অপরজন তাঁর শিয়রে উপবেশন করেন। তাঁর পদদ্বয়ের পাশে উপবিষ্টজন শিয়রে উপবিষ্টজনকে বলেনঃ “তাঁর ও তাঁর উম্মতের দৃষ্টান্ত বর্ণনা কর।” তিনি তখন বললেনঃ “তাদের দৃষ্টান্ত ভ্রমণরত ঐ যাত্রী দলের মত যারা জনশূন্য এক মরুপ্রান্তরে অবস্থান করছিল। না তাদের কাছে পাথেয় ছিল, না খাদ্য ও পানীয় ছিল। তাদের সামনে অগ্রসর হওয়ারও শক্তি ছিল না এবং পিছনে হটবারও ক্ষমতা ছিল না। তাদের পরিণতি কি হবে এই চিন্তায় ছিল তারা উদ্বিগ্ন। এমন সময় তারা দেখলো যে, একজন সৎ ও ভদ্রলোক সুন্দর পোষাক পরিহিত অবস্থায় চলে আসছেন। তিনি তাদেরকে ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখে বললেনঃ “যদি তোমরা আমার কথা মেনে নিয়ে আমার সাথে যাত্রা শুরু কর তবে আমি তোমাদেরকে ফলভর্তি বাগানে এবং পানিপূর্ণ জলাশয়ে পৌঁছিয়ে দিবো।” তারা তাঁর কথা মেনে নিলো এবং সত্যিই তিনি তাদেরকে সবুজ-শ্যামল তরুতাজা বাগানে এবং প্রবাহিত জলাশয়ে পৌছিয়ে দিলেন। সেখানে তারা নির্বিঘ্নে পানাহার করলো এবং পরিতৃপ্ত হওয়ার কারণে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে গেল। একদিন ঐ ভদ্রলোকটি তাদেরকে বললেনঃ “দেখো, আমি তোমাদেরকে ঐ ধ্বংস ও দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করে এখানে এনেছি। যদি এখন তোমরা আমার কথা মেনে নাও তবে আমি তোমাদেরকে এর চেয়েও উন্নতমানের বাগানে, এর চেয়েও উত্তম জায়গায় এবং এর অপেক্ষাও বেশী উন্নতমানের জলাশয়ে পৌঁছিয়ে দিবো।” তাঁর এ কথায় তাদের একটি দল সম্মত হয়ে গেল এবং তার সাথে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো। কিন্তু অপর একটি দল বললোঃ “আমাদের অন্য কিছুর প্রয়োজন নেই। আমরা এখানেই থাকবো।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদের কোমর ধরে তোমাদেরকে জাহান্নামে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করতে চাচ্ছি, কিন্তু তোমরা প্রজাপতি ও বর্ষাকালীন পোকা-মাকড়ের মত আমার থেকে ছুটে ছুটে আগুনে পড়তে রয়েছে। তোমরা কি চাচ্ছ যে, আমি তোমাদেরকে ছেড়ে দিই? জেনে রেখো যে, হাউযে কাওসারের উপরও আমি তোমাদের নেতা হবো। তোমরা এক এক করে এবং দলবদ্ধ হয়ে আমার নিকট আসবে। আমি তোমাদেরকে চিহ্ন ও লক্ষণ দেখে চিনে নেবো, যেমন একজন অপরিচিত লোক অন্যদের উটগুলোর মধ্য হতে নিজের উটকে চিনে থাকে। আমার চোখের সামনে তোমাদের মধ্য হতে কাউকে কাউকে বাম দিকের শাস্তির ফেরেশতারা ধরে নিয়ে যেতে চাইবে। আমি তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহর কাছে আরয করাবোঃ হে আমার প্রতিপালক! এরা তো আমার সম্প্রদায়ের ও উম্মতের লোক। উত্তরে তিনি বলবেনঃ ‘তোমার (তিরোধানের) পর তারা ধর্মকার্যে যে নতুনত্ব সৃষ্টি করেছিল তা তুমি জান না। তোমার পরে তারা পশ্চাদপদে ফিরে গিয়েছিল। আমি ঐ লোকটিকেও চিনে নেবো যে কাঁধের উপর বকরী উঠিয়ে নিয়ে আসবে। বকরী পা পা শব্দ করতে থাকবে। লোকটি আমার নাম ধরে ডাকতে থাকবে। কিন্তু আমি পরিষ্কারভাবে বলে দেবোঃ “আমি আজ আল্লাহর সামনে তোমার কোন উপকার করতে পারবো না। আমি তোমার কাছে আল্লাহর বাণী পৌছিয়ে দিয়েছিলাম। অনুরূপভাবে কেউ উট নিয়ে আসবে, উট শব্দ করতে থাকবে। লোকটি হে মুহাম্মাদ (সঃ)! হে মুহাম্মাদ (সঃ)! বলে ডাক দেবে। কিন্তু আমি তাকে বলবোঃ আল্লাহর কাছে তোমার ব্যাপারে আমি কোনই অধিকার রাখি না। আমি তোমার নিকট তার বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম। কেউ কেউ এমন অবস্থায় আসবে যে, ঘোড়া তার কাঁধে সওয়ার হয়ে থাকবে এবং ঐ ঘোড়া হ্রেষা ধ্বনি করবে। লোকটি আমাকে ডাকবে। কিন্তু অনুরূপ জবাবই আমি দেবো। কেউ চামড়ার মোশক বহন করে নিয়ে আসবে এবং বলবেঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! হে মুহাম্মাদ (সঃ)! আমি বলবোঃ আমি আজ তোমার ব্যাপারে কোন কিছুই অধিকারী নই। আমি তো তোমার কাছে মহান আল্লাহর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম।” (এ হাদীসটি আবু ইয়ালা মুসিলী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলী ইবনে মাদীনী (রঃ) বলেন যে, হাদীসটির সনদ তো হাসান বটে, কিন্তু এর হাফস ইবনে হুযাইদ নামক একজন বর্ণনাকারী অজ্ঞাত। তবে ইমাম ইয়াহইয়া আবি মুঈন (রঃ) তাঁকে সৎ বলেছেন এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) ও ইমাম ইবনে হিব্বানও (রঃ) তাকে বিশ্বাসযোগ্য বলেছেন)
মহান আল্লাহ বলেনঃ যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তারা তো সরল পথ হতে বিচ্যুত। যখন কোন লোক সোজা-সরল পথ হতে সরে পড়ে তখন আরববাসী বলে থাকে। (আরবী) অর্থাৎ ‘অমুক রাস্তা হতে বিচ্যুত হয়েছে।’ আল্লাহ তা’আলা তাদের কুফরীর পরিপক্কতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ আমি তাদের প্রতি দয়া করলেও এবং তাদের দুঃখ দৈন্য দূর করলেও তারা অবাধ্যতায় বিভ্রান্তের ন্যায় ঘুরতে থাকবে।
যা কিছু হয়নি তা যখন হবে তখন কিভাবে হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ পাকই জানেন। এজন্যেই অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ যদি তাদের মধ্যে কল্যাণ জানতেন তবে অবশ্যই তাদেরকে শুনাতেন। আর যদি তাদেরকে শুনাতেনও তবুও তারা বিমুখ হয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতো।” (৮:২৩) আর এক জায়গায় আছে- “হায়, যদি তুমি দেখতে! যখন তাদেরকে জাহান্নামের উপর দাঁড় করানো হবে তখন তারা বলবে, হায়! যদি আমাদেরকে (পুনরায় দুনিয়ায়) ফিরিয়ে দেয়া হতো তবে আমরা আমাদের প্রতিপালকের আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম না এবং মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। যদি তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়াও হয় তবুও তারা নিষিদ্ধ কাজগুলোর দিকে আবার ফিরে যাবে (শেষ পর্যন্ত)।” সুতরাং এগুলো এমন বিষয় যা হবে না, কিন্তু হলে কি হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কুরআন কারীমে যে বাক্য দ্বারা শুরু করা হয়েছে তা কখনই সংঘটিত হবে না।
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#961)
أَفَلَمْ يَدَّبَّرُوا الْقَوْلَ ]
Have they not pondered over the Word,]
Sura:23
Para:18
Sura: Al-Muminoon.
Ayat: 68-75
www.motaher21.net
23:68
اَفَلَمۡ یَدَّبَّرُوا الۡقَوۡلَ اَمۡ جَآءَہُمۡ مَّا لَمۡ یَاۡتِ اٰبَآءَہُمُ الۡاَوَّلِیۡنَ ﴿۫۶۸﴾
Then have they not reflected over the Qur’an, or has there come to them that which had not come to their forefathers?
Refutation and Condemnation of the Idolators
Allah says;
أَفَلَمْ يَدَّبَّرُوا الْقَوْلَ أَمْ جَاءهُم مَّا لَمْ يَأْتِ ابَاءهُمُ الاَْوَّلِينَ
Have they not pondered over the Word, or has there come to them what had not come to their fathers of old,
Allah denounces the idolators for not understanding the Qur’an or contemplating its meaning, and for turning away from it, even though they had been addressed specifically in this Book which Allah did not reveal to any Messenger more perfect and noble, and especially since no Book or warner had come to their forefathers who had died during the Jahiliyyah.
What these people, upon whom the blessing had been bestowed, should have done, was to accept it and give thanks for it, and try to understand it and act in accordance with it night and day, as was done by the wise ones among them who became Muslim and followed the Messenger, may Allah be pleased with them.
أَفَلَمْ يَدَّبَّرُوا الْقَوْلَ
Have they not pondered over the Word,
Qatadah said,
“Because, by Allah, if the people had pondered the meaning and understood it properly, they would have found in the Qur’an a deterrent to disobeying Allah. But they only paid attention to the Ayat which are not entirely clear, and so they were destroyed because of that.”
Then Allah says, denouncing the disbelievers of the Quraysh:
أَمْ لَمْ يَعْرِفُوا رَسُولَهُمْ فَهُمْ لَهُ مُنكِرُونَ
23:69
اَمۡ لَمۡ یَعۡرِفُوۡا رَسُوۡلَہُمۡ فَہُمۡ لَہٗ مُنۡکِرُوۡنَ ﴿۫۶۹﴾
Or did they not know their Messenger, so they are toward him disacknowledging?
Or is it that they did not recognize their Messenger so they deny him,
means, `do they not recognize Muhammad and the honesty, trustworthiness and good character with which he grew up among them! Can they deny that or argue against it!’
Jafar bin Abi Talib said to An-Najashi, the king of Ethiopia:
“O King, Allah has sent to us a Messenger whose lineage, honesty and trustworthiness are known to us.”
Al-Mughirah bin Shu`bah said something similar to the deputy of Kisra when he wanted to challenge him.
When the Byzantine ruler Heraclius asked Abu Sufyan Sakhr bin Harb and his companions — who were still disbelievers and had not yet become Muslim — about the characteristics, lineage, honesty and trustworthiness of the Prophet, they could only tell the truth and admit that he was indeed noble and truthful
23:70
اَمۡ یَقُوۡلُوۡنَ بِہٖ جِنَّۃٌ ؕ بَلۡ جَآءَہُمۡ بِالۡحَقِّ وَ اَکۡثَرُہُمۡ لِلۡحَقِّ کٰرِہُوۡنَ ﴿۷۰﴾
Or do they say, “In him is madness?” Rather, he brought them the truth, but most of them, to the truth, are averse.
أَمْ يَقُولُونَ بِهِ جِنَّةٌ
Or they say:There is madness in him,
This is a narration of what the Quraysh said about the Prophet.
They said that he was making up the Qur’an by himself, or that he was crazy and did not know what he was saying.
Allah tells us that their hearts did not believe that, they knew that what they were saying about the Qur’an was falsehood, for it had come to them from the Words of Allah and could not be resisted or rejected. So Allah challenged them and all the people of the world to produce something like it if they could — but they could not and would never be able to do so.
So Allah says:
بَلْ جَاءهُم بِالْحَقِّ وَأَكْثَرُهُمْ لِلْحَقِّ كَارِهُونَ
Nay, but he brought them Al-Haqq, but most of them are averse to the truth.
Truth does not follow Whims and Desires
Allah says
23:71
وَ لَوِ اتَّبَعَ الۡحَقُّ اَہۡوَآءَہُمۡ لَفَسَدَتِ السَّمٰوٰتُ وَ الۡاَرۡضُ وَ مَنۡ فِیۡہِنَّ ؕ بَلۡ اَتَیۡنٰہُمۡ بِذِکۡرِہِمۡ فَہُمۡ عَنۡ ذِکۡرِہِمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿ؕ۷۱﴾
But if the Truth had followed their inclinations, the heavens and the earth and whoever is in them would have been ruined. Rather, We have brought them their message, but they, from their message, are turning away.
وَلَوِ اتَّبَعَ الْحَقُّ أَهْوَاءهُمْ لَفَسَدَتِ السَّمَاوَاتُ وَالاَْرْضُ وَمَن فِيهِنَّ
And if Al-Haqq had followed their desires, verily, the heavens and the earth, and whosoever is therein would have been corrupted!
Mujahid, Abu Salih and As-Suddi said,
“Al-Haqq is Allah, may He be glorified.”
What is meant by the Ayah is that if Allah had responded to the desires in their hearts and prescribed things accordingly, the heavens and the earth and whosoever is therein, would have been corrupted, i.e., because of their corrupt and inconsistent desires.
As Allah says of them elsewhere:
لَوْلَا نُزِّلَ هَـذَا الْقُرْءَانُ عَلَى رَجُلٍ مِّنَ الْقَرْيَتَيْنِ عَظِيمٍ
“Why is not this Qur’an sent down to some great man of the two towns!” (43:31)
Then He says:
أَهُمْ يَقْسِمُونَ رَحْمَةَ رَبِّكَ
Is it they who would portion out the mercy of your Lord! (43:32)
And Allah says:
قُل لَّوْ أَنتُمْ تَمْلِكُونَ خَزَايِنَ رَحْمَةِ رَبِّى إِذًا لامْسَكْتُمْ خَشْيَةَ الاِنفَاقِ
Say:”If you possessed the treasure of the mercy of my Lord, then you would surely hold back for fear of spending it.” (17:100)
أَمْ لَهُمْ نَصِيبٌ مِّنَ الْمُلْكِ فَإِذاً لاَّ يُوْتُونَ النَّاسَ نَقِيراً
Or have they a share in the dominion! Then in that case they would not give mankind even a Naqir. (4:53)
All of this goes to show how incapable mankind is and how divergent and inconsistent their ideas and desires are. Only Allah, may He be glorified, is Perfect in all His attributes, words, actions, laws, power and control of His creation, may He be exalted and sanctified. There is no God but He and no Lord besides Him.
Then He says:
بَلْ أَتَيْنَاهُم بِذِكْرِهِمْ
Nay, We have brought them their reminder,
meaning the Qur’an,
فَهُمْ عَن ذِكْرِهِم مُّعْرِضُونَ
but they turn away from their reminder.
The Prophet does not ask for any payment, and he calls to the straight path
Allah says
23:72
اَمۡ تَسۡـَٔلُہُمۡ خَرۡجًا فَخَرَاجُ رَبِّکَ خَیۡرٌ ٭ۖ وَّ ہُوَ خَیۡرُ الرّٰزِقِیۡنَ ﴿۷۲﴾
Or do you, [O Muhammad], ask them for payment? But the reward of your Lord is best, and He is the best of providers.
أَمْ تَسْأَلُهُمْ خَرْجًا
Or is it that you ask them for some Kharj,
Al-Hasan said,
“A reward.”
Qatadah said,
“Some payment.”
فَخَرَاجُ رَبِّكَ خَيْرٌ
But the recompense of your Lord is better,
means, you are not asking for any wages or payment or anything for calling them to right guidance, rather you are hoping for a great reward from Allah, as He says:
قُلْ مَا سَأَلْتُكُم مِّن أَجْرٍ فَهُوَ لَكُمْ إِنْ أَجْرِىَ إِلاَّ عَلَى اللَّهِ
Say:”Whatever wage I might have asked of you is yours. My wage is from Allah only.” (34:47)
قُلْ مَأ أَسْـَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ وَمَأ أَنَأ مِنَ الْمُتَكَلِّفِينَ
Say:”No wage do I ask of you for this, nor am I one of the pretenders.” (38:86)
قُل لاَّ أَسْـَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْراً إِلاَّ الْمَوَدَّةَ فِى الْقُرْبَى
Say:”No reward do I ask of you for this except to be kind to me for my kinship with you.” (42:23)
وَجَأءَ مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يقَوْمِ اتَّبِعُواْ الْمُرْسَلِينَ اتَّبِعُواْ مَن لاَّ يَسْـَلُكُمْ أَجْراً
And there came a man running from the farthest part of the town. He said:”O my people! Obey the Messengers. Obey those who ask no wages of you, and who are rightly guided.” (35:20-21)
وَهُوَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
and He is the Best of those who give sustenance.
وَإِنَّكَ لَتَدْعُوهُمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ
23:73
وَ اِنَّکَ لَتَدۡعُوۡہُمۡ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ ﴿۷۳﴾
And indeed, you invite them to a straight path.
And certainly, you call them to the straight path.
وَإِنَّ الَّذِينَ لَاإ يُوْمِنُونَ بِالاْإخِرَةِ عَنِ الصِّرَاطِ لَنَاكِبُونَ
23:74
وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ عَنِ الصِّرَاطِ لَنٰکِبُوۡنَ ﴿۷۴﴾
But indeed, those who do not believe in the Hereafter are deviating from the path.
And verily, those who believe not in the Hereafter are indeed deviating far astray from the path.
meaning, they have gone astray and deviated.
The Situation of the Disbelievers
Allah says;
وَلَوْ رَحِمْنَاهُمْ وَكَشَفْنَا مَا بِهِم مِّن ضُرٍّ لَّلَجُّوا فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ
23:75
وَ لَوۡ رَحِمۡنٰہُمۡ وَ کَشَفۡنَا مَا بِہِمۡ مِّنۡ ضُرٍّ لَّلَجُّوۡا فِیۡ طُغۡیَانِہِمۡ یَعۡمَہُوۡنَ ﴿۷۵﴾
And even if We gave them mercy and removed what was upon them of affliction, they would persist in their transgression, wandering blindly.
And though We had mercy on them and removed the distress which is on them, still they would obstinately persist in their transgression, wandering blindly.
Here Allah tells of their stubbornness in their disbelief, in that even if He had removed the calamity from them and made them understand the Qur’an, they still would not follow it; they would still persist in their disbelief and stubborn transgression.
This is like the Ayat:
وَلَوْ عَلِمَ اللَّهُ فِيهِمْ خَيْرًا لَاسْمَعَهُمْ وَلَوْ أَسْمَعَهُمْ لَتَوَلَّواْ وَّهُم مُّعْرِضُونَ
Had Allah known of any good in them, He would indeed have made them listen; and even if He had made them listen, they would but have turned away with aversion. (8:23)
وَلَوْ تَرَى إِذْ وُقِفُواْ عَلَى النَّارِ فَقَالُواْ يلَيْتَنَا نُرَدُّ وَلَا نُكَذِّبَ بِـَايَـتِ رَبِّنَا وَنَكُونَ مِنَ الْمُوْمِنِينَ بَلْ بَدَا لَهُمْ مَّا كَانُواْ يُخْفُونَ مِن قَبْلُ وَلَوْ رُدُّواْ لَعَـدُواْ لِمَا نُهُواْ عَنْهُ
And if (Lauw) you could but see when they will be held over the (Hell) Fire! They will say:”Would that we were but sent back (to the world)! Then we would not deny the Ayat of our Lord, and we would be of the believers!”
Nay, it has become manifest to them what they had been concealing before. But if they were returned (to the world), they would certainly revert to that which they were forbidden. Until His statement:
بِمَبْعُوثِينَ
(be resurrected). (6:27-29)
This has to do with the knowledge of Allah. He knows about some- thing that will not happen, but if it were to happen, He knows how it would be.
Ad-Dahhak reported from Ibn Abbas:
“Every- thing that is implied in the word:
لَوْ
(If (Lauw)) is something that will never happen.
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran