(বই#৯৬৬) [ فَاِذَا نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, ] সূরা:- আল্-মুমিনূন। সুরা:২৩ পারা:১৮ ১০১-১১৮ নং আয়াত:- www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৬৬)
[ فَاِذَا نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ
যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, ]
সূরা:- আল্-মুমিনূন।
সুরা:২৩
পারা:১৮
১০১-১১৮ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৩:১০১
فَاِذَا نُفِخَ فِی الصُّوۡرِ فَلَاۤ اَنۡسَابَ بَیۡنَہُمۡ یَوۡمَئِذٍ وَّ لَا یَتَسَآءَلُوۡنَ ﴿۱۰۱﴾
যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, সেদিন পরস্পরের মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরের খোঁজ-খবর নেবে না।
২৩:১০২
فَمَنۡ ثَقُلَتۡ مَوَازِیۡنُہٗ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰۲﴾
সুতরাং যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে সফলকাম।
২৩:১০৩
وَ مَنۡ خَفَّتۡ مَوَازِیۡنُہٗ فَاُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ خَسِرُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ فِیۡ جَہَنَّمَ خٰلِدُوۡنَ ﴿۱۰۳﴾ۚ
আর যাদের পাল্লা হাল্কা হবে, তারাই নিজেদের ক্ষতি করেছে; তারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে।
২৩:১০৪
تَلۡفَحُ وُجُوۡہَہُمُ النَّارُ وَ ہُمۡ فِیۡہَا کٰلِحُوۡنَ ﴿۱۰۴﴾
আগুন তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে এবং তারা সেখানে থাকবে বীভৎস চেহারায়।
২৩:১০৫
اَلَمۡ تَکُنۡ اٰیٰتِیۡ تُتۡلٰی عَلَیۡکُمۡ فَکُنۡتُمۡ بِہَا تُکَذِّبُوۡنَ ﴿۱۰۵﴾
তোমাদের নিকট কি আমার আয়াতসমূহ আবৃত্তি করা হতো না? অথচ তোমরা সেগুলিকে মিথ্যা মনে করতে।
২৩:১০৬
قَالُوۡا رَبَّنَا غَلَبَتۡ عَلَیۡنَا شِقۡوَتُنَا وَ کُنَّا قَوۡمًا ضَآلِّیۡنَ ﴿۱۰۶﴾
তারা বলবে, ‘হে আমাদের রব! দুর্ভাগ্য আমাদেরকে পেয়ে বসেছিল এবং আমরা ছিলাম এক পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়;
২৩:১০৭
رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡہَا فَاِنۡ عُدۡنَا فَاِنَّا ظٰلِمُوۡنَ ﴿۱۰۷﴾
‘হে আমাদের রব! এ আগুন থেকে আমাদেরকে বের করুন; তারপর আমরা যদি পুনরায় কুফরী করি, তবে তো আমরা অবশ্যই যালিম হব।’
২৩:১০৮
قَالَ اخۡسَـُٔوۡا فِیۡہَا وَ لَا تُکَلِّمُوۡنِ ﴿۱۰۸﴾
আল্লাহ বলবেন, ‘তোমরা হীন অবস্থায় এখানেই থাক এবং আমার সাথে কোন কথা বলো না।
২৩:১০৯
اِنَّہٗ کَانَ فَرِیۡقٌ مِّنۡ عِبَادِیۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاغۡفِرۡ لَنَا وَ ارۡحَمۡنَا وَ اَنۡتَ خَیۡرُ الرّٰحِمِیۡنَ ﴿۱۰۹﴾ۚۖ
আমার বান্দাদের মধ্যে একদল ছিল যারা বলত, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা বিশ্বাস করেছি; সুতরাং তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও ও আমাদের উপর দয়া কর, তুমি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু।
২৩:১১০
فَاتَّخَذۡتُمُوۡہُمۡ سِخۡرِیًّا حَتّٰۤی اَنۡسَوۡکُمۡ ذِکۡرِیۡ وَ کُنۡتُمۡ مِّنۡہُمۡ تَضۡحَکُوۡنَ ﴿۱۱۰﴾
‘কিন্তু তাদেরকে নিয়ে তোমরা এতো ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে যে, তা তোমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছিল আমার স্মরণ। আর তোমরা তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টাই করতে।’
২৩:১১১
اِنِّیۡ جَزَیۡتُہُمُ الۡیَوۡمَ بِمَا صَبَرُوۡۤا ۙ اَنَّہُمۡ ہُمُ الۡفَآئِزُوۡنَ ﴿۱۱۱﴾
আজ তাদের সে সবের ফল আমি এই দিয়েছি যে, তারাই সফলকাম।
২৩:১১২
قٰلَ کَمۡ لَبِثۡتُمۡ فِی الۡاَرۡضِ عَدَدَ سِنِیۡنَ ﴿۱۱۲﴾
তিনি বলবেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে কত বছর অবস্থান করেছিলে?’
২৩:১১৩
قَالُوۡا لَبِثۡنَا یَوۡمًا اَوۡ بَعۡضَ یَوۡمٍ فَسۡـَٔلِ الۡعَآدِّیۡنَ ﴿۱۱۳﴾
তারা বলবে, ‘আমরা অবস্থান করেছিলাম একদিন বা দিনের কিছু অংশ; সুতরাং আপনি গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করুন।’
২৩:১১৪
قٰلَ اِنۡ لَّبِثۡتُمۡ اِلَّا قَلِیۡلًا لَّوۡ اَنَّکُمۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۱۴﴾
তিনি বলবেন, ‘তোমরা অল্পকালই অবস্থান করেছিলে; যদি তোমরা জানতে।
২৩:১১৫
اَفَحَسِبۡتُمۡ اَنَّمَا خَلَقۡنٰکُمۡ عَبَثًا وَّ اَنَّکُمۡ اِلَیۡنَا لَا تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۱۱۵﴾
তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে না?
২৩:১১৬
فَتَعٰلَی اللّٰہُ الۡمَلِکُ الۡحَقُّ ۚ لَاۤ اِلٰہَ اِلَّا ہُوَ ۚ رَبُّ الۡعَرۡشِ الۡکَرِیۡمِ ﴿۱۱۶﴾
সুতরাং আল্লাহ্‌ মহিমান্বিত, প্রকৃত মালিক, তিনি ছাড়া কোন হক্ক ইলাহ নেই; তিনি সম্মানিত ‘আরাশের রব।
২৩:১১৭
وَ مَنۡ یَّدۡعُ مَعَ اللّٰہِ اِلٰـہًا اٰخَرَ ۙ لَا بُرۡہَانَ لَہٗ بِہٖ ۙ فَاِنَّمَا حِسَابُہٗ عِنۡدَ رَبِّہٖ ؕ اِنَّہٗ لَا یُفۡلِحُ الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿۱۱۷﴾
এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কোন মাবুদকে ডাকে, যার পক্ষে তার কাছে কোন যুক্তি প্রমাণ নেই, তার হিসেব রয়েছে তার রবের কাছে। এ ধরনের কাফের কখনো সফলকাম হতে পারে না।
২৩:১১৮
وَ قُلۡ رَّبِّ اغۡفِرۡ وَ ارۡحَمۡ وَ اَنۡتَ خَیۡرُ الرّٰحِمِیۡنَ ﴿٪۱۱۸﴾
বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি ক্ষমা কর ও দয়া কর, দয়ালুদের মধ্যে তুমিই তো শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’

১০১-১১৮ আয়াতের তাফসির:-

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

*কেয়ামতের দৃশ্য : পুনরুত্থানের দিনটির দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে এখানে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না।’ অর্থাৎ এই ভয়াবহ মুহূর্তটিতে সকল প্রকারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পড়বে, পৃথিবীর পরিচিত সকল মূল্যবোধ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না, রক্তের বন্ধন থাকবে না। এক ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করবে। আতঙ্কে কারাে মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হবে না। নীরব ও নিথর হয়ে সকলেই দাঁড়িয়ে। কেউ কাউকে কোনাে প্রশ্ন করবে না, কুশল বিনিময় করবে না। এরপর দ্রুত হিসাব নিকাশের কাজ সমাধা করা হবে। এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে…'(আয়াত ১০২-১০৩) আমলের ওজন পাল্লার মাধ্যমে করার বক্তব্যটি পবিত্র কোরআনের নিজস্ব বর্ণনা ভংগির অন্যতম বৈশিষ্ট। এই বর্ণনা ভংগির মাধ্যমে কোনাে অদৃশ্য বিষয় বা বস্তুকে দৃশ্যমান করে প্রকাশ করা হয়। এর ফলে বিষয়টি উপলব্ধি করা সহজ হয়। আগুনে পুড়ে চেহারা কালাে হয়ে যাওয়া, বিকৃত হয়ে যাওয়া এবং বিবর্ণ হয়ে যাওয়া অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক দৃশ্য। যাদের আমলের পাল্লা হাঙ্কা হবে তারা সব কিছুই হারাবে এমনকি নিজেকেও হারাবে। মানুষ নিজেকে হারালে তার আর কী বাকী থাকে? নিজেকে হারিয়ে এবং সর্বস্বান্ত হয়ে সে তখন হয়ে পড়বে অস্তিত্বহীন। এরপর সরাসরি কথােপকথনের মাধ্যমে কঠিন শাস্তির চিত্রটি দৃশ্যমান করে ফুটিয়ে তােলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ‘তােমাদের সামনে কি আমার আয়াতসমূহ পঠিত হতাে না? তােমরা তাে সেগুলােকে মিথ্যা বলতে।’ এই প্রশ্ন শােনার পর পাপীরা মনে করবে যে, তাদের এখন কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়েছে, তাদেরকে আবেদন করার সুযােগ দেয়া হয়েছে। তাই নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে এবং আল্লাহর করুণা ভিক্ষা করে তারা বলে উঠবে, ‘হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা দুর্ভাগ্যের হাতে পরাভূত ছিলাম এবং আমরা ছিলাম বিভ্রান্ত জাতি…'(আয়াত ১০৬-১০৭) তাদের এই স্বীকৃতির মাঝেই তাদের দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে। কিন্তু এর দ্বারা আদব-কায়দা এবং শিষ্টাচারের সীমালংঘন হবে বলে তাদেরকে আর একটা কথাও বলার সুযােগ দেয়া হবে না। বরং তাদেরকে প্রচন্ড ধমক দিয়ে বলা হবে, ‘তোমরা ধিকৃত অবস্থায় এখানেই পড়ে থাকো এবং আমার সাথে কোনাে কথা বলাে না।’ অর্থাৎ ধিকৃত ও লাঞ্ছিত ব্যক্তিদের মত চুপ মেরে বসে থাকো, কোনাে টু শব্দ করবে না কারণ এই মর্মান্তিক ও লজ্জাকর শাস্তিই তােমাদের প্রাপ্য। তােমাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণই এর জন্যে দায়ী। আমার নেক বান্দাদের সাথে তােমরা হাসি ঠাট্টা করতে। তারা আমার রহমত ও মাগফেরাত কামনা করতে বলে তাদেরকে নিয়ে তোমরা মশকরা করতে। এর ফলে তােমরা আমার স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে পড়েছিলে। আমার বিভিন্ন নিদর্শনাদির ব্যাপারে চিন্তা ভাবনা থেকে বিরত হয়ে পড়েছিলে। কাজেই আজ স্বচক্ষে দেখে নাও, তােমাদের স্থান কোথায় আর ওদের স্থান কোথায়। আজ আমি তাদেরকে তাদের সবরের কারণে এমন প্রতিদান দিয়েছি যে, তারাই সফলকাম। এই কড়া উত্তর দেয়ার পর, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জেরা করতে গিয়ে বলবেন, ‘তােমরা পৃথিবীতে কতাে দিন অবস্থান করলে বছরের গণনায়?’ উত্তরে তারা বলবে, আমরা একদিন অথবা দিনের কিছু অংশ অবস্থান করেছি। তুমি গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করাে। এই উত্তরের ভাষায় গ্লানী, হতাশা, নিরাশা ও বেদনার চিত্র ফুটে উঠেছে। উত্তরে আল্লাহ তায়ালা বলবেন, ‘তােমরা তাতে অল্প দিনই অবস্থান করেছো, যদি তােমরা জানতে অর্থাৎ পরকালীন জীবনের তুলনায় তােমাদের পার্থিব জীবনের স্থায়িত্বকাল খুবই নগণ্য। কিন্তু তােমরা এই সত্যটিকে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলে। এরপর তাদেরকে পরকালীন জীবনের হিসাব নিকাশের বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করার জন্যে কড়া ভাষায় বলা হচ্ছে, ‘তােমরা কি ধারণা করাে যে, আমি তােমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তােমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না?’ অর্থাৎ তােমাদের সৃষ্টিই প্রমাণ করে যে, তােমাদেরকে হিসাব নিকাশের জন্যে নির্দিষ্ট একটি দিনে পুনরুজ্জীবিত করা হবে। বস্তুত পুনরুত্থান হচ্ছে উৎপত্তিরই একটা ধাপ। এর মাধ্যমে উৎপত্তি তার চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে উপনীত হয়। এর মাধ্যমে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। এই বাস্তব ও নিরেট সত্যটি কেবল তারাই উপলব্ধি করতে পারে না যারা বিকারগ্রস্ত ও চিন্তা চেতনায় বৈকল্যের শিকার। কারণ, এদের পক্ষে সৃষ্টি তত্ত্বের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব নয়। এমনকি গােটা জগতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য খোদায়ী নিদর্শনগুলাে প্রত্যক্ষ ও অনুধাবন করার সামর্থ্যও এদের নেই।

*ঈমানের প্রথম ও প্রধান স্তম্ভ : আলােচ্য সূরাটি হচ্ছে মূলত ঈমান ও বিশ্বাস সংক্রান্ত। তাই সূরাটি শেষ করতে গিয়ে ঈমানের প্রথম ও প্রধান স্তম্ভ তাওহীদের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে। সাথে সাথে কাফের-মােশরেকদের চরম ব্যর্থতা ও দুর্গতির ঘােষণাও দেয়া হয়েছে, যেমন সূরার প্রথমে মােমন বান্দাদের সফলতা ও মংগলের ঘােষণা দেয়া হয়েছে। পরিশেষে পরম দয়ালু ও পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা ও দয়া প্রার্থনা করার জন্যে মানব জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘অতপর শীর্ষ মহিমায় আল্লাহ তায়ালা, তিনিই সত্যিকার মালিক, তিনি ব্যতীত কোনাে মাবুদ নেই। তিনি সম্মানিত আরশের মালিক…'(আয়াত ১১৬-১১৮) এই চূড়ান্ত বক্তব্যটি এসেছে কেয়ামতের দৃশ্য অবতারণা করার পর, বিভিন্ন, যুক্তি-তর্ক ও দলীল প্রমাণ পেশ করার পর। এ সবের পর স্বাভাবিকভাবেই এবং যৌক্তিক উপায়েই আল্লাহর শরীকবিহীন সত্ত্বার ঘােষণাটি দেয়া হচ্ছে। এই ঘােষণায় বলা হচ্ছে যে, মােশরেকদের সব ধরনের অলীক বিশ্বাস ও ধারণা থেকে আল্লাহর মহান সত্ত্বা পাক ও পবিত্র। তিনিই হচ্ছেন গােটা বিশ্বের প্রকৃত মালিক, তিনিই গােটা বিশ্বের নিয়ন্ত্রক। তিনিই একমাত্র মাবুদ। তিনি ব্যতীত অন্য কোনাে মাবুদ নেই, কোনাে উপাস্য নেই । যাবতীয় ক্ষমতা, প্রভাব প্রতিপত্তি ও শাসনের মালিক একমাত্র তিনিই। তিনি মহান আরশের অধিপতি। ইবাদত বন্দেগী ও আনুগত্য দাসত্বের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্য কারাে শরীকানার দাবী করা হলে তা হবে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক দাবী। এ জাতীয় দাবীর পেছনে জাগতিক কোনাে দলীল প্রমাণ নেই, স্বভাবজাত কোনাে দলীল প্রমাণ নেই, এমন কি বুদ্ধি বৃত্তিক কোনাে যুক্তি প্রমাণও নেই। কাজেই যারা ওই জাতীয় ভ্রান্ত দাবীর ধারক ও বাহক, তাদের বিচার আল্লাহ তায়ালাই করবেন এবং তাদের শেষ পরিণতিও আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন। তিনি নিজেই সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘কাফেররা সফলকাম হবে না।’ এটাই হচ্ছে আল্লাহর চিরন্তন বিধান। এই বিধানের কোনাে পরিবর্তন নেই, কোনাে ব্যতিক্রম নেই। অপরদিকে কামিয়ামী ও সফলতা মুমিন বান্দাদের জন্যেই অবধারিত। এটাও একটা চিরন্তন বিধান। পার্থিব জীবনে দেখা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রে আল্লাহ বিদ্রোহী লোকেরা ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছে, সুযােগ সুবিধা ভােগ করছে, অঢেল সম্পত্তির মালিক বনে আছে এবং প্রভাব প্রতিপত্তির সাথে জীবন যাপন করছে। এগুলাে বাহ্যিক দৃষ্টিতে সফলতা ও কামিয়াবী মনে হলেও চুড়ান্ত বিচারে তা আদৌ কোনাে সফলতা নয়। বরং এক ধরনের পরীক্ষা, এক ধরনের ছাড়। এর পরিণতি শুভ নয়। তাই পৃথিবীর বুকেই তাদেরকে এই অশুভ পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়। আর যদি কেউ এ থেকে পৃথিবীতে রেহাই পেয়ে যায়, তাকে পরকালে অবশ্যই সে পরিণতি ভোগ করতে হবে। পরকালই হচ্ছে জীবনের শেষ অধ্যায়। কাজেই তা অবধারিত ও চূড়ান্ত। এই জীবনের কোনাে কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়, অসংলগ্ন নয়। বরং এক চিরন্তন নীতি ও শৃংখলায় তা আবদ্ধ। আলােচ্য সূরার শেষ ভাগে আল্লাহর প্রতি মনােনিবেশ করতে বলা হয়েছে, তাঁর রহমত ও মাগফেরাত কামনা করতে বলা হয়েছে। যেমন, ‘বলো, হে আমার পালনকর্তা, ক্ষমা করাে ও রহম করাে। রহমকারীদের মধ্যে তুমি শ্রেষ্ঠ রহমকারী।’ এখানেই আমরা সূরার সূচনা ও এর সমাপ্তির মাঝে একটা সঙ্গতি লক্ষ্য করি। যেমন সূরার সূচনায় মােমেনদের কামিয়াবী ও সফলতার কথা বলা হয়েছে। তেমনি সমাপ্তিতে বলা হয়েছে কাফের তথা আল্লাহদ্রোহী লােকদের ব্যর্থতার কথা। ঠিক তেমনিভাবে সূরার সূচনায় সমাজে একাগ্রতা ও নিবিষ্টতার কথা বলা হয়েছে, আর সমাপ্তিতে বলা হয়েছে আল্লাহর প্রতি মনােনিবেশের কথা, তার রহমত কামনার কথা। ফলে সূরার সূচনা ও সমাপ্তি এক অভিন্ন ঈমানী চেতনার মােহনায় এসে মিলিত হয়েছে।

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এর মানে এ নয় যে, বাপ আর বাপ থাকবে না এবং ছেলে ছেলে থাকবে না। বরং এর অর্থ হচ্ছে, সে সময় বাপ ছেলের কোন কাজে লাগবে না এবং ছেলে বাপের কোন কাজেলাগবে না। প্রত্যেকে এমনভাবে নিজের অবস্থার শিকার হবে যে, একজন অন্যজনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা তো দূরের কথা কারোর কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার মতো চেতনাওথাকবে না। অন্যান্য স্থানে এ বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ————“কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু নিজের বন্ধুকে জিজ্ঞেস করবে না।” (আল মা’আরিজ, ১০ আয়াত )। ———————- “সেদিন অপরাধীর মন তার নিজের সন্তান, স্ত্রী, ভাই ও নিজের সহায়তাকারী নিকটতম আত্মীয় এবং সারা দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে এবং নিজেকে আযাব থেকে মুক্ত করতে চাইবে।” (আল মা’আরিজ ১১থেকে ১৪ আয়াত) ———————- “সেদিন মানুষ নিজের ভাই, মা, বাপ, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের থেকে পালাতে থাকবে। সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের অবস্থার মধ্যে এমনভাবে লিপ্ত থাকবে যে, তার কারোর কথা মনে থাকবে না।” (আবাসা, ৩৪ থেকে ৩৭ )
# যাদের নেক কাজের পাল্লা অসৎকাজের পাল্লা থেকে বেশী ভারী হবে।
# সূরার শুরুতে এবং তারপর চতুর্থ রুকূ”তে সাফল্য ও ক্ষতির যে মানদন্ড পেশ করা হয়েছে তাকে আর একবার মনের মধ্যে চাংগা করে নিন।
# মূলে—–শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।—–আরবী ভায়ায় এমন চেহারাকে বলা হয় যার চামড়া আলাদা হয়ে গেছে এবং দাঁত বাইরে বের হয়ে এসেছে। যেমন খাশির ভুনা মাথা। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রা.) এক ব্যক্তি “কালেহ”-এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ—————অর্থাৎ “তুমি কি ভুনা খাশির কল্লা দেখোনি? ”
# নিজের মুক্তির জন্য আবেদন নিবেদন করো না। নিজের ওজর পেশ করো না। চিরকালের জন্য একেবারেই নীরব হয়ে যাও, এ অর্থ নয়। হাদীসের বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ হবে তাদের শেষ কথাবার্তা। এরপর তাদের কন্ঠ চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু একথা বাহ্যত কুরআন বিরোধী। কারণ সামনের দিকে কুরআন নিজেই তাদের ও আল্লাহর মধ্যকার কথাবার্তা উদ্ধৃত করছে। কাজেই হয় হাদীসের এ বর্ণনা সঠিক নয় অথবা এর অর্থ এই যে, এরপর তারা মুক্তির জন্য কোন আবেদন নিবেদন করতে পারবে না।
# আবার একই বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ কে হবে সাফল্যের অধিকারী এবং কে ক্ষতির অধিকারী।
# দুনিয়ায় আমার নবী ক্রমাগতভাবে তোমাদের বলেছেন যে, দুনিয়ার জীবন নিছক হাতে গোনা কয়েকটি পরীক্ষার ঘণ্টা মাত্র। একেই আসল জীবন এবং একমাত্র জীবন মনে করেবসো না। আসল জীবন হচ্ছে আখেরাতের জীবন। সেখানে তোমাদের চিরকাল থাকতে হবে। এখানকার সাময়িকলাভ ও স্বাদ-আহলাদের লোভে এমন কাজ করো না যা আখেরাতের চিরন্তন জীবনে তোমাদের ভবিষ্যত ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু তখন তোমরা তাঁর কথায় কান দাওনি। তোমরা এ আখেরাতের জগত অস্বীকার করতে থেকেছো। তোমরা মৃত্যুপরের জীবনকে একটি মনগড়া কাহিনী মনে করেছো। তোমরা নিজেদের এ ধারণার ওপর জোর দিতে থেকেছো যে, জীবন-মৃত্যুর ব্যাপারটি নিছক এ দুনিয়ার সাথে সম্পর্কিত এবং এখানে চুটিয়ে মজা লুটে নিতে হবে। কাজেই এখন আর অনুশোচনা করে কী লাভ। তখনই ছিল সাবধান হবার সময় যখন তোমরা দুনিয়ার কয়েক দিনেরজীবনের ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে এখানকার চিরন্তন জীবনের লাভ বিসর্জন দিচ্ছিলে।
# মূলে—–শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, “খেলাচ্ছলে” এবং দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, “খেলার জন্য”। প্রথম অবস্থায় আয়াতের অর্থ হবে, “তোমরা কি মনে করেছিলে, তোমাদেরকে এমনিই খেলাচ্ছলেআমোদ-আহলাদ করতে করতে তৈরী করা হয়েছে, তোমাদের সৃষ্টির কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই, নিছক একটি উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি হিসেবে তৈরী করে তোমাদের চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন? ” দ্বিতীয় অবস্থায় এর অর্থ হবে, “তোমরা কি একথা মনে করতে যে, তোমাদেরকে নিছক খেলাধূলা, আমোদ-আহলাদ, ফূর্তি ও এমন সব আজেবাজে অর্থহীন কাজ করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে যেগুলোর কোনদিন কোন ফল হবে না? ”
# তিনি কোন বাজে কাজ করার ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন এবং তাঁর কোন বান্দা ও গোলাম তাঁর প্রভুত্বের কার্যক্রমে তাঁর সাথে শরীক হবে এরও অনেক ঊর্ধ্বে তাঁর অবস্থান।
# এর দ্বিতীয় অনুবাদ এই হতে পারেঃ “যে কেউ আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে মাবুদ হিসেবে ডাকে তার জন্য তার নিজের এ কাজের সপক্ষে কোন যুক্তি ও প্রমাণ নেই।

# সে জবাবদিহি ও হিসেব-নিকেশ থেকে রক্ষা পেতে পারে না।

# আবার সে একই বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে অর্থাৎ আসলে কে সাফল্য লাভকারী এবং কে তা থেকে বঞ্চিত?
#এখানে এ দোয়ার সূক্ষ্ম ও গভীর অর্থ দৃষ্টিসম্মুখে থাকা উচিত। এখনই কয়েক ছত্র ওপরে বলা হয়েছে, আখেরাতে আল্লাহ‌ নবী ﷺ ও সাহাবায়ে কেরামের দুশমনদেরকে একথা বলে মাফ করে দিতে অস্বীকার করবেন যে, আমার যেসব বান্দা এ দোয়া করতো তোমরা তাদেরকে বিদ্রূপ করতে। এরপর এখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের (ও আনুসঙ্গিকভাবে সাহাবায়ে কেরামকেও) এ হুকুম দেয়া হচ্ছে যে, ঠিক সে একই দোয়া করো যার কথা আমি এইমাত্র বলে এসেছি। আমার পরিষ্কার সতর্কবাণী সত্ত্বেও এখন যদি তারা তোমাকে বিদ্রূপ করতে থাকে তাহলে আখেরাতে যেন তারা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী মোকদ্দমা তৈরী করে দেবে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

১০১-১০৪ নং আয়াতের তাফসীর:

….. فَإِذَا نُفِخَ فِي الصُّوْرِ

‘এবং যেদিন শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে’ এখানে যে ফুৎকারের কথা বলা হয়েছে তা দ্বিতীয় ফুঁৎকার (যদি ফুঁৎকার দুটি হয়) এ ফুঁৎকার দিলে মানুষ পুনরুত্থিত হবে, হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে।

فَلَآ أَنْسَابَ অর্থাৎ দুনিয়াতে যেমন আত্মীয়দের নিয়ে গর্ব করত, এক জনের দ্বারা অন্য জন উপকৃত হত সেখানে তা হবে না। প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে যে, না জানি তার কী হয়। মূল আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে তা বলা হয়নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(یَوْمَ یَفِرُّ الْمَرْئُ مِنْ اَخِیْھِﭱﺫ وَاُمِّھ۪ وَاَبِیْھِﭲﺫ وَصَاحِبَتِھ۪ وَبَنِیْھِ)

“সেদিন মানুষ পলায়ন করবে তার নিজের ভাই হতে, এবং তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও তার সন্তান হতে।” (সূরা আবাসা ৮০:৩৪-৩৬) সুতরাং আত্মীয় থাকবে কিন্তু কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করবে না, যদি কিছু চেয়ে বসে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন: কিয়ামতের দিন বংশ নিয়ে গর্ব করবে না যেমন দুনিয়াতে করত, দুনিয়াতে যেমন একজন অন্যজনের খোঁজ খবর নিত কিয়ামতের দিন তেমন কেউ কারো খোঁজ-খবর নিবে না। (তাফসীর কুরতুবী)

(وَّلَا يَتَسَا۬ءَلُوْنَ)

‘এবং একে অপরের খোঁজ-খবর নিবে না’। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে তারা একজন অপরজনের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করবে। (সূরা সাফফাত ৩৭:৫০) এখানে জিজ্ঞাসা করবে না বা খোঁজ-খবর নিবে না বলা হয়েছে। আর প্রাথমিক অবস্থায় এমন হবে এবং পরবর্তীতে পরস্পরে চিনবে ও পরস্পরে জিজ্ঞাসা করবে।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন: যার নেকীর পাল্লা ভারী হবে সে সফলকাম হবে আর যার নেকীর পাল্লা হালকা হবে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(فَاَمَّا مَنْ ثَقُلَتْ مَوَازِیْنُھ۫ﭕﺫ فَھُوَ فِیْ عِیْشَةٍ رَّاضِیَةٍﭖﺚ وَاَمَّا مَنْ خَفَّتْ مَوَازِیْنُھ۫ﭗﺫ فَاُمُّھ۫ ھَاوِیَةٌﭘﺚ وَمَآ اَدْرٰٿکَ مَا ھِیَھْﭙﺚ نَارٌ حَامِیَةٌﭚ)

“অতএব যার পাল্লা ভারী হবে, সে সন্তোষজনক জীবন যাপন কররে, আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার ঠিকানা হবে হাবিয়া। তুমি কি জান তা কী? প্রজ্জ্বলিত অগ্নি।” (সূরা কারিয়া ১০১:৬-১১) এ সম্পর্কে সূরা আ‘রাফের ৮-৯ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

تَلْفَحُ কঠিনভাবে পুড়ে ফেলা। অর্থাৎ জান্নামের আগুন তাদের চেহারা পুড়িয়ে ফেলবে। كٰـلِحُوْنَ অর্থ ঠোঁট জড়ো হয়ে দাঁত বেরিয়ে যাওয়া। জাহান্নামের আগুন তাদের চেহারা এমনভাবে দগ্ধ করবে যে, তাদের ঠোঁট পুড়ে জড়ো হয়ে যাবে ফলে দাঁত দেখা যাবে যা দেখতে হবে বিভৎস। মোট কথা তাদের মর্মান্তিক শাস্তি দেয়া হবে। আল্লাহ তা‘আলা বাণী:

(وَمَنْ جَا۬ءَ بِالسَّيِّئَةِ فَكُبَّتْ وُجُوْهُهُمْ فِي النَّارِ ط هَلْ تُجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ)

“যে কেউ অসৎ কর্ম নিয়ে আসবে, তাকে অধোমুখে নিক্ষেপ করা হবে জাহান্নামে (এবং তাদেরকে বলা হবে) ‘তোমরা যা করতে তারই প্রতিফল তোমাদেরকে দেয়া হচ্ছে।” (সূরা নামল ২৭:৯০)

এ সম্পর্কে কুরআনের বহু জায়গায় আলোচনা রয়েছে। যেমন সূরা আ‘রাফের ৬৬ নং, যুমারের ২৪ নং ও সূরা কাহফের ২৯ নং আয়াতে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. কিয়ামতের দিন যখন মানুষ কবর থেকে জীবিত হয়ে বের হবে তখন কারো সাথে কারো কোন সম্পর্ক থাকবে না।
২. যারা ভাল কাজ করবে তারা জান্নাতে যাবে, আর যারা মন্দ কাজ করবে তারা জাহান্নামে যাবে।
৩. জাহান্নামীদেরকে লাঞ্ছিতভাবে আগুনের শাস্তি দেয়া হবে।
৪. জাহান্নামের আগুন মানুষের চেহারাকে পুড়িয়ে বীভৎস করে দিবে।
১০৫-১০৭ নং আয়াতের তাফসীর:

কিয়ামতের দিন কাফির-মুশরিকদেরকে বলা হবে তোমাদের কাছে যখন আমার আয়াতসমূহ পাঠ করা হত তখন তোমরা কি তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে না? তখন তারা সত্য বুঝতে পারবে যে, রাসূলগণ তাদেরকে আসমানী কিতাব দ্বারা সত্যের দিকে আহ্বান করেছেন কিন্তু তারা সত্য গ্রহণ করেনি।

আমরা যে জুলুম ও সত্য বিমুখ হয়েছি তার ফলে দুর্ভাগ্য আমাদের ওপর প্রাধান্য লাভ করেছে, তাই আজ আমরা জাহান্নামী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “অত্যধিক ক্রোধে তা ফেটে পড়ার উপক্রম হবে, যখনই তাতে কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তখনই তাদেরকে জাহান্নামের রক্ষীরা জিজ্ঞেস করবেঃ তোমাদের নিকট কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা উত্তরে বলবে: হ্যাঁ, আমাদের নিকট সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিলাম এবং বলেছিলাম: আল্লাহ তা‘আলা কিছুই নাযিল করেননি, তোমরা তো মহা গুমরাহীতে রয়েছ। এবং তারা আরো বলবে: যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করতাম, তবে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না। অতঃপর তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে। সুতরাং অভিশাপ জাহান্নামবাসীদের জন্য!” (সূরা মুলক ৬৭:৮-১১)

অতঃপর তারা আল্লাহ তা‘আলার কাছে আবেদন পেশ করবে, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এখান থেকে বের করুন, আমরা কোনদিন আপনার ও আপনার রাসূলদের বিরোধিতা করব না বরং তাদের প্রতি ঈমান আনব এবং তাদের নির্দেশিত পথে চলব। আর যদি পুনরায় কুফরী করি তাহলে তো আমরা জালিম। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, যদি তাদেরকে দুনিয়াতে আবার প্রেরণ করা হয় তাহলে সেরূপই কুফরী করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَوْ رُدُّوْا لَعَادُوْا لِمَا نُهُوْا عَنْهُ وَإِنَّهُمْ لَكٰذِبُوْنَ)‏

“এবং তারা প্রত্যাবর্তিত হলেও যা করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল পুনরায় তারা তাই করত এবং নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী” (সূরা আন‘আম ৬:২৮) এ সম্পর্কে অত্র সূরার ৯৯-১০০ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলার বিধান সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে, মিথ্যা প্রতিপন্ন করলে জাহান্নামে যেতে হবে।
২. কাফিররা যখন শাস্তি দেখবে তখন তারা তাদের অপরাধের কথা স্বীকার করবে।
১০৮-১১১ নং আয়াতের তাফসীর:

যখন কাফির-মুশরিকরা জাহান্নাম হতে বের হতে চাইবে তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধমক দিয়ে বলবেন: তোমরা এখানেই অবস্থান কর আর এ ব্যাপারে আমার সাথে কোন কথাবার্তা বল না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(يُرِيْدُوْنَ أَنْ يَّخْرُجُوْا مِنَ النَّارِ وَمَا هُمْ بِخٰرِجِيْنَ مِنْهَا ز وَلَهُمْ عَذَابٌ مُّقِيْمٌ)‏

“তারা চাইবে বের হয়ে আসতে জাহান্নাম থেকে কিন্তু তারা সেখান থেকে বের হতে পারবে না এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী শাস্তি।” (সূরা মায়িদাহ ৫:৩৭)

অতঃপর তাদেরকে তাদের পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হবে যে, যারা আমার মু’মিন বান্দা ছিল তোমরা তাদের ঈমানের কারণে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করতে ও হাসি-তামাশা করতে, যার ফলে আজ তোমাদের পরিণতি জাহান্নাম। অতএব তোমরা জাহান্নামের শাস্তি আস্বাদন কর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(اِنَّ الَّذِیْنَ اَجْرَمُوْا کَانُوْا مِنَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا یَضْحَکُوْنَﭬﺘ وَاِذَا مَرُّوْا بِھِمْ یَتَغَامَزُوْنَﭭ)

“নিশ্চয়ই যারা অপরাধী তারা মু’মিনদরকে উপহাস করত। এবং তারা যখন তাদের নিকট দিয়ে যেতো তখন চোখ টিপে কটাক্ষ করত।” (সূরা মুতাফ্ফিফীন ৮৩:২৯-৩০)

আর এসব কারণেই তারা ঈমান নিয়ে আসতে পারেনি, বরং আরো বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, মু’মিনরা ঈমানের ওপর অটল থাকতে গিয়ে যত রকম বাধা-বিপত্তি এসেছে সকল বাধা বিপত্তিতে এবং তাদেরকে নিয়ে যত ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করা হয়েছে সকল ঠাট্টা-বিদ্রপ উপেক্ষা করে যে ধৈর্য ধারণ করেছে সে জন্য আমি উত্তম পুরষ্কার প্রদান করলাম।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

(أَهٰٓؤُلَا۬ءِ الَّذِيْنَ أَقْسَمْتُمْ لَا يَنَالُهُمُ اللّٰهُ بِرَحْمَةٍ ط اُدْخُلُوا الْجَنَّةَ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمْ وَلَآ أَنْتُمْ تَحْزَنُوْنَ)‏

“এরাই কি তারা, যাদের সম্বন্ধে তোমরা শপথ করে বলতে যে, ‘আল্লাহ তা‘আলা এদের প্রতি কোন দয়া প্রদর্শন করবেন না। এদেরকে বলা হবে, ‘তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর, তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না।’’ (সূরা আ‘রাফ: ৭:৪৯)

সুতরাং ঈমানের ওপর অটল থাকতে গিয়ে মু’মিনদেরকে অনেক ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অনেকে অনেক মন্তব্য করবে, কেউ বিদ্রƒপ করবে, তাই বলে ঈমান থেকে দূরে সরে যাওয়া যাবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. জাহান্নামে যাবার পর সেখান থেকে বের হবার সুযোগ থাকবে না।
২. কাউকে কোন ভাল কাজের জন্য উপহাস করা যাবে না।
৩. ধৈর্যধারণ করলে তার পুরস্কার আখিরাতে পাওয়া যাবে।
১১২-১১৬ নং আয়াতের তাফসীর:

যখন জান্নাতীদেরকে জান্নাতে এবং জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে দেয়া হবে তখন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে তোমরা কতদিন দুনিয়াতে অবস্থান করেছিলে? তখন তারা বলবে:

(يَّتَخَافَتُوْنَ بَيْنَهُمْ إِنْ لَّبِثْتُمْ إِلَّا عَشْرًا)

“সেদিন তারা নিজেদের মধ্যে চুপি চুপি বলাবলি করবে, ‘তোমরা মাত্র দশ দিন (দুনিয়াতে) অবস্থান করেছিলে।’’ (সূরা ত্বা-হা- ২০:১০৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(وَيَوْمَ تَقُوْمُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُوْنَ مَا لَبِثُوْا غَيْرَ سَاعَةٍ) ‏

“যেদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে, সেদিন পাপীরা শপথ করে বলবে যে, তারা মুহূর্তকালের বেশি অবস্থান করেনি।” (সূরা রূম ৩০:৫৫)

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)‎ বলেন: আল্লাহ তা‘আলা যখন জান্নাতীদেরকে জান্নাতে এবং জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন তখন জান্নাতীদেরকে লক্ষ্য করে বলবেন: তোমরা দুনিয়ায় কত বছর অবস্থান করেছ? তখন তারা বলবে, আমরা একদিন বা তার চেয়ে কিছু কম সময় অবস্থান করেছি। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন: তবে তো তোমরা বড়ই ভাগ্যবান যে, এ অল্প সময়ে তোমরা এত বেশি প্রতিদান প্রাপ্ত হয়েছ যে, আমার রহমত , সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ করেছ এবং এখানে চিরকাল অবস্থান করবে। অতঃপর জাহান্নামীদেরকে বলা হবে, হে জাহান্নামবাসী! তোমরা কত দিন দুনিয়াতে অবস্থান করেছ। তারা বলবে, একদিন বা তার চেয়েও কম। তখন তিনি তাদেরকে বলবেন: তোমরাতো বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত, এ অল্প সময়ের মধ্যে তোমরা আমার অসন্তুষ্টি, ক্রোধ ও জাহান্নাম ক্রয় করে নিয়েছ। যেখানে তোমরা চিরকাল অবস্থান করবে। (দুররুল মানসূর ৫/১৭)

الْعَادِّيْنَ

গণনাকারী দ্বারা উদ্দেশ্য হল ফেরেশতাগণ, যে সকল ফেরেশতারা মানুষের কর্ম ও আয়ু লিখে রাখত। অর্থাৎ কিয়ামতের ভয়াবহতা দেখে তাদের মাথা থেকে দুনিয়াতে অবস্থানের কথা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ফলে তাদের মনে হবে কিছুক্ষণ বা অর্ধ বেলা দুনিয়াতে ছিল।

(إِنْ لَّبِثْتُمْ إِلَّا قَلِيْلًا)

অর্থাৎ আখেরাতের চিরস্থায়ী জীবনের তুলনায় দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সময় সত্যিই খুবই অল্প। কিন্তু তোমরা দুনিয়াতে তা অনুধাবন করোনি। তোমাদের বলা হয়েছিল আখেরাত উত্তম ও চিরস্থায়ী, কিন্তু দুনিয়ার মোহে পড়ে আখেরাতকে মূল্যায়ন করোনি, আখেরাতের প্রতি ঈমান আনোনি।

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষদেরকে লক্ষ্য করে বলছেন, তোমরা কি মনে করেছ যে, আমি তোমাদেরকে কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই সৃষ্টি করেছি? তোমরা দুনিয়াতে উপভোগ করবে, আর কোন আদেশ বা নিষেধ জারি করা হবেনা? আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانُ أَنْ يُّتْرَكَ سُدًي) ‏

“মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনিই ছেড়ে দেয়া হবে?” (সূরা কিয়ামাহ ৭৫:৩৬)

না, বরং তোমাদেরকে সৃষ্টি করার পিছনে একটি মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে। তা হল তোমরা এক আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না।

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُوْنِ‏)‏

“আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এজন্য যে, তারা একমাত্র আমারই ইবাদত করবে।” (সূরা যারিআত ৫১:৫৬)

সুতরাং মানুষ আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে যে অমূলক ধারণা করে থাকে তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।

অতএব আমরা জানতে পারলাম আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেননি। সৃষ্টি করার একটি লক্ষ্য রয়েছে। তিনি চান আমরা যেন সে লক্ষ্য বাস্তবায়ন করি। তবে আমরা তাঁর ইবাদত করলে তাঁর কোন উপকার হবে না বরং নিজেরই উপকার হবে।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং তা অতি অল্প সময়ের।
২. কোন সৃষ্টিকেই অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি।
৩. মানুষকে সবশেষে আল্লাহ তা‘আলার দিকেই ফিরে যেতে হবে।
৪. আরশের অধিপতি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, তিনি ব্যতীত আর কোন সত্য মা‘বূদ নেই।
১১৭-১১৮ নং আয়াতের তাফসীর:

بُرْهَانَ অর্থ সুস্পষ্ট প্রমাণ যা সত্যের ব্যাপারে কোন সংশয় রাখে না। অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য মা‘বূদের ইবাদত করে তাদের এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই। আল্লাহ তা‘আলা বিগত কোন কিতাব নাযিল করেননি বা কোন রাসূল প্রেরণ করেননি যারা একথা বলেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য মা‘বূূদের ইবাদত করা যাবে । আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَيَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِه۪ سُلْطٰنًا وَّمَا لَيْسَ لَهُمْ بِه۪ عِلْمٌ ط وَمَا لِلظّٰلِمِيْنَ مِنْ نَّصِيْرٍ)

“এবং তারা ইবাদত করে আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে এমন কিছুর যার সম্পর্কে তিনি কোন দলীল প্রেরণ করেননি এবং যার সম্বন্ধে তাদের কোন জ্ঞান নেই। আর জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।” (সূরা হজ্জ ২২:৭১)

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন:

(لَا تَجْعَلْ مَعَ اللّٰهِ إلٰهًا اٰخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُوْمًا مَّخْذُوْلًا)

“আল্লাহ তা‘আলার সাথে অপর কোন ইলাহ্ সাব্যস্ত কর না; করলে নিন্দিত ও লাঞ্ছিত হয়ে পড়বে।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২২) যেহেতু তারা বিনা দলীলে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য মা‘বূদের ইবাদত করে সেহেতু তাদের হিসাব আল্লাহ তা‘আলার দায়িত্বে। এখান থেকে বুঝা যাচ্ছেন মুশরিকরা আখিরাতে সফলকাম হবে না। কারণ আল্লাহ তা‘আলা যার হিসাব নেবেন সে কোনদিন সফল হতে পারবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যার হিসাব নেয়া হবে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হা: ১০৩) সুতরাং প্রকৃত সফলতা আখিরাতের সফলতা, শুধুমাত্র দুনিয়ার ধন-দৌলত ও ক্ষমতা সফলতার মাপকাঠি নয়। এ সব তো পৃথিবীতে কাফিরদেরও রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাদের সফলতাকে নাকচ করে দিলেন।

সূরার সর্বশেষে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলছেন, তুমি বল, হে আল্লাহ তা‘আলা আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমার প্রতি রহম করুন, আপনি সর্বোত্তম রহমকারী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিষ্পাপ ও রহমতপ্রাপ্তই ছিলেন। এতদসত্ত্বেও তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনা ও রহমতের দু‘আ শিক্ষা দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা উম্মতকে শিক্ষা দেয়ার জন্য যে, তোমাদের এ ব্যাপারে খুবই যত্মবান হওয়া উচিত।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. আল্লাহ তা‘আলার সাথে অন্য মা‘বূদের ইবাদতের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।
২. কিয়ামতের দিন যাদের হিসাব নেয়া হবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
৩. বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-

১০১-১০৪ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা খবর দিচ্ছেন যে, যখন পুনরুত্থানের জন্যে শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং মানুষ জীবিত হয়ে কবর হতে বেরিয়ে পড়বে তখন আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে এবং একে অপরের কোন খোঁজ খবর নিবে না। না পিতার সন্তানের উপর কোন ভালবাসা থাকবে, না সন্তান পিতার দুঃখে দুঃখিত হবে। অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “সুহৃদ সুহৃদের তত্ত্ব নিবে না, তাদের এককে অপরের দৃষ্টি গোচর করা হবে।” (৭০-১০-১১) আর এক জায়গায় আছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সেই দিন মানুষ পলায়ন করবে তার ভ্রাতা হতে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তান হতে।” (৮০:৩৪-৩৬)

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী লোকদেরকে একত্রিত করবেন। অতঃপর একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করবেনঃ “যার কোন হক অন্যের উপর রয়েছে সে যেন এসে তার হক তার নিকট থেকে নিয়ে যায়।” এ কথা শুনে কারো হক তার পিতার উপর থাকলে বা পুত্রের উপর থাকলে অথবা স্ত্রীর উপর থাকলে সেও আনন্দিত হয়ে দৌড়িয়ে আসবে এবং নিজের হক বা প্রাপ্যের জন্যে তার কাছে তাগাদা শুরু করে দেবে। যেমন এই আয়াতে রয়েছে। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ফাতেমা (রাঃ) আমার দেহের একটা অংশ। যে তাকে কষ্ট দেয় সে আমাকেও কষ্ট দেয়। আর যে তাকে খুশী করে সে আমাকেও খুশী করে। কিয়ামতের দিন সমস্ত আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, কিন্তু আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এই হাদীসের মূল সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ফাতেমা (রাঃ) আমার দেহের একটা অংশ। তাকে অসন্তুষ্টকারী ও কষ্টদানকারী আমাকেও অসন্তুষ্টকারী ও কষ্টদানকারী।”

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে মিম্বরের উপর বলতে শুনেছেনঃ “লোকদের কি হয়েছে যে, তারা বলে-রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আত্মীয়তার সম্পর্কও তাঁর কওমের কোন উপকারে আসবে না? আল্লাহর শপথ! আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক দুনিয়া ও আখিরাতে মিলিতভাবে রয়েছে। হে লোক সকল! আমি তোমাদের আসবাব পত্রের রক্ষক হবো যখন তোমরা আসবে।” একটি লোক বলবেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি অমুকের পুত্র অমুক।” আমি উত্তরে বলবোঃ “হ্যা, আমি বংশ চিনে নিয়েছি। কিন্তু আমার পরে তুমি বিদআতের আবিষ্কার করেছিলে এবং উল্টো পদে ফিরে গিয়েছিলে।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর মুসনাদে কয়েকটি সনদের মাধ্যমে আমরা বর্ণনা করেছি যে, যখন তিনি হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলসুম (রাঃ)-কে বিয়ে করেন তখন তিনি বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছিঃ “কিয়ামতের দিন সমস্ত মূল ও বংশের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে, কিন্তু আমার বংশ ও মূলের সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।” এটাও বর্ণিত আছে যে, হযরত উমার (রাঃ) হযরত উম্মে কুলসুম (রাঃ)-এর মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাঁর মোহরর ধার্য করেছিলেন চল্লিশ হাজার (দিরহাম)।

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “কিয়ামতের দিন আমার বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া সমস্ত বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি হাফিয ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি আমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছি যে, যেখানে আমার বিয়ে হয়েছে এবং যার সাথে আমি বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছি তারা সবাই যেন জান্নাতে আমার সঙ্গ লাভ করে। আল্লাহ তা’আলা আমার এ দু’আ কবুল করেছেন।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ যাদের পাল্লা ভারী হবে তারাই হবে সফলকাম। যার একটি মাত্র পুণ্য পাপের উপর বেশী হবে সেই পরিত্রাণ পেয়ে যাবে। সে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে এবং জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে। তার উদ্দেশ্য সফল হবে এবং যা থেকে সে ভয় করতো তা থেকে সে বেঁচে যাবে। পক্ষান্তরে, যাদের পাল্লা হালকা হবে, অর্থাৎ পুণ্যের চেয়ে পাপ বেশী হয়ে যাবে তারা হবে চরমভাবে ক্ষগ্রিস্ত।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, কিয়ামতের দিন একজন ফেরেশতা দাঁড়িপাল্লার উপর নিযুক্ত থাকবেন যিনি প্রত্যেক মানুষকে দাড়ি-পাল্লার দুই পাল্লার মাঝে দাঁড় করিয়ে দিবেন। অতঃপর পাপ ও পুণ্য ওজন করা হবে। যদি পুণ্য বেশী হয়ে যায় তবে তিনি উচ্চ স্বরে ঘোষণা করবেনঃ “অমুকের পুত্র অমুক মুক্তি পেয়ে গেছে। এরপর ক্ষতি ও ধ্বংস তার কাছেও যাবে না। আর যদি পাপ বেশী হয়ে যায় তবে সবারই সামনে তিনি উচ্চ স্বরে ঘোষণা করবেনঃ “অমুকের পুত্র অমুক ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন সে কল্যাণ লাভে বঞ্চিত হয়েছে।” (এটা হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এর সনদ দুর্বল। বর্ণনাকারী দাউদ ইবনে হাজর দুর্বল ও বর্জনীয়)

মহান আল্লাহর উক্তিঃ তারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে। অর্থাৎ তারা চিরদিনই জাহান্নামে থাকবে। কখনো তাদেরকে তা থেকে বের করা হবে না। অগ্নি তাদের মুখমণ্ডল দগ্ধ করবে। আগুনকে সরিয়ে ফেলার ক্ষমতা তাদের হবে না।

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রথম অগ্নিশিখা তাদেরকে জড়িয়ে ধরামাত্রই তাদের গোশ্ত অস্থি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং তাদের পায়ের উপর পড়ে যাবে। (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে) ফলে তাদের চেহারা বীভৎস ও বিকৃত হয়ে যাবে। দাঁত বের হয়ে থাকবে, ওষ্ঠ উপরের দিকে উঠে যাবে এবং অধর নীচের দিকে নেমে থাকবে। উপরের ঠোট তালু পর্যন্ত উঠে যাবে এবং নীচের ঠোট নাভী পর্যন্ত নেমে আসবে।” (এটা মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে মারফু’রূপে বর্ণিত আছে)
১০৫-১০৭ নং আয়াতের তাফসীর:

কাফিরদেরকে তাদের কুফরী, পাপ ও সত্য-প্রত্যাখ্যানের কারণে কিয়ামতের দিন যে ভীতি প্রদর্শন করা হবে ও ধমক দেয়া হবে এখানে তারই বর্ণনা দেয়া হচ্ছে।

তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা বলবেনঃ আমি তোমাদের নিকট রাসূল পাঠিয়েছিলাম, তোমাদের উপর কিতাব অবতীর্ণ করেছিলাম, তোমাদের সন্দেহ। দূর করে দিয়েছিলাম, তোমাদের কোনই যুক্তি-প্রমাণ অবশিষ্ট রাখিনি। যেমন মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেন রাসূলদের পরে লোকদের জন্যে আল্লাহর উপর কোন বাদানুবাদের সুযোগ না থাকে।” (৪: ১৬৫) আর এ জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “রাসূল প্রেরণ না করা পর্যন্ত আমি শাস্তি প্রদানকারী নই।” (১৭:১৫) তিনি আরো বলেনঃ (আরবী) পর্যন্ত। অর্থাৎ “যখনই তাতে (জাহান্নামে) কোন দলকে নিক্ষেপ করা হবে, তাদেরকে রক্ষীরা জিজ্ঞেস করবেঃ তোমাদের কাছে কি কোন সতর্ককারী আসেনি? তারা বলবেঃ অবশ্যই আমাদের কাছে সতর্ককারী এসেছিল, আমরা তাদেরকে মিথ্যাবাদী গণ্য করেছিলাম এবং বলেছিলামঃ আল্ল। “ই অবতীর্ণ করেননি, তোমরা তো মহা-বিভ্রান্তিতে রয়েছে। তারা আরো বলবেঃ যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম তাহলে আমরা জাহান্নামবাসী হতাম না। তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করবে; সুতরাং অভিশাপ জাহান্নামীদের জন্যে।” (৬৭: ৮-১১)

এ জন্যেই তারা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! দুর্ভাগ্য আমাদেরকে পেয়ে বসেছিল এবং আমরা ছিলাম এক বিভ্রান্ত সম্প্রদায়।

তারা বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! এই আগুন হতে আমাদেরকে উদ্ধার করুন এবং পুনরায় দুনিয়ায় ফিরিয়ে দিন। অতঃপর আমরা যদি পুনরায় কুফরী করি তবে তো আমরা অবশ্যই সীমালংঘনকারী হবো ও শাস্তির যোগ্য হয়ে যাবো। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তা’আলা তাদের উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করছি, এখন বের হওয়ার কোন পথ আছে কি? তোমাদের এই শাস্তি তো এই জন্যে যে, যখন এক আল্লাহকে ডাকা হতো তখন তোমরা তাকে অস্বীকার করতে এবং আল্লাহর শরীক স্থির করা হলে তোমরা তা বিশ্বাস করতে; বস্তুতঃ সমুচ্চ, মহান আল্লাহরই সমস্ত কর্তৃত্ব।” (৪০:১১-১২) অর্থাৎ এখন তোমাদের জন্যে সব পথই বন্ধ। আমলের সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন হলো প্রতিদান প্রদানের সময়। তাওহীদের সময় তোমরা শিরক করেছিলে। সুতরাং এখন অনুশোচনা করে কি লাভ?
১০৮-১১১ নং আয়াতের তাফসীর:

এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে কাফিরদেরকে জবাব দেয়া হচ্ছে যে, যখন তারা জাহান্নাম হতে বের হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করবে তখন তাদেরকে বলা হবেঃ তোমরা হীন অবস্থায় এখানেই থাকো। খবরদার! এ ব্যাপারে তোমরা আমার সাথে কথা বলো না! প্রম দয়ালু ও দাতা আল্লাহর হবে এটা উক্তি। কাফির ও মুশরিকরা সমস্ত কল্যাণ থেকে নিরাশ হয়ে যাবে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেন যে, জাহান্নামীরা প্রথমে জাহান্নামের রক্ষককে ডাকতে থাকবে। ডাকতে থাকবে তারা চল্লিশ বছর পর্যন্ত। কিন্তু কোন উত্তর তারা পাবে না। চল্লিশ বছর পরে উত্তর দেয়া হবেঃ “তোমরা এখানেই পড়ে থাকো।” জাহান্নামের রক্ষকের কাছে এবং মহান আল্লাহর কাছে তাদের ডাকের কোনই গুরুত্ব থাকবে না। আবার তারা আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করবে ও বলবেঃ “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুর্ভাগ্যের কারণে আমরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছি এবং বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছি। হে আল্লাহ! এখন আপনি আমাদেরকে এখান থেকে বের করে নিন এবং পুনরায় দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন! এরপরেও যদি আমরা মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ি তবে আপনার ইচ্ছামত শাস্তি আপনি দিবেন। আমাদের আর কিছুই বলার থাকবে না। তাদের এ কথার জবাব তাদেরকে এই দুনিয়ার দ্বিগুণ বয়স পর্যন্তও দেয়া হবে না। তারপর তাদেরকে বলা হবেঃ “তোমরা আমার রহমত হতে দূর হয়ে গিয়ে এই জাহান্নামের মধ্যেই লাঞ্ছিত অবস্থায় অবস্থান করতে থাকো। আমার সাথে আর একটি কথাও বলো না।” তখন তারা সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হয়ে যাবে এবং গাধার মত বিকট শব্দ করতে থাকবে। ঐ সময় তাদের চেহারা বদলে যাবে এবং তাদের সুন্দর আকৃতি কদাকৃতিতে রূপান্তরিত হবে। এমন কি কতকগুলো, মুমিন ব্যক্তি শাফাআতের অনুমতি লাভ করে এখানে আসবে কিন্তু তাদের কাউকেও চিনতে পারবে না। জাহান্নামীরা তাদেরকে দেখে বলবেঃ “আমি অমুক।” কিন্তু তারা তাদেরকে উত্তরে বলবেঃ “তোমরা মিথ্যা বলছো, আমরা তোমাদেরকে চিনি না।” তখন ঐ জাহান্নামীরা মহান আল্লাহকে ডাকতে থাকবে। উত্তরে তাদেরকে যে কথা বলা হবে তা উপরে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর জাহান্নামের দরযা বন্ধ করে দেয়া হবে এবং তারা সেখানেই সড়তে পচতে থাকবে।

তাদেরকে লজ্জিত করার উদ্দেশ্যে তাদের সামনে এক বড় পাপকার্য পেশ করা হবে। মহান আল্লাহ তাদেরকে বলবেনঃ আমার বান্দাদের মধ্যে এক দল এমন ছিল যারা বলতো-হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনি তো দয়ালুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দয়ালু। কিন্তু হে জাহান্নামীর দল! তোমরা আমার ঐ বান্দাদেরকে নিয়ে এতো ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে যে, ওটা তোমাদেরকে আমার কথা ভুলিয়ে দিয়েছিল। তোমরা তো তাদেরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টাই করতে। যেমন অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “পাপীরা মুমিনদেরকে দেখে হাসততা ও তাদেরকে উপহাস করতো।” (৮৩:২৯)

তাই আল্লাহ তাআলা জাহান্নামীদেরকে বলবেনঃ আমি আজ আমার ঐ মমিন বান্দাদেরকে তাদের ধৈর্যের কারণে এমনভাবে পুরস্কৃত করলাম যে, তারাই হলো সফলকাম। আমি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে নিলাম এবং জান্নাতে প্রবিষ্ট করলাম।
১১২-১১৬ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা’আলা বলছেন যে, দুনিয়ার সামান্য কয়েকদিনের বয়সে এই। মুশরিক ও কাফিররা অন্যায় কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। যদি তারা মুমিন হয়ে সৎ কাজ করে থাকতো তবে আজ আল্লাহর সৎ বান্দাদের সাথে তাদের সৎ কার্যাবলীর প্রতিদান লাভ করতো। কিয়ামতের দিন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ “তোমরা দুনিয়ায় কতদিন অবস্থান করেছিলে?” তারা উত্তরে বলবেঃ “খুবই অল্প সময় আমরা দুনিয়ায় অবস্থান করেছিলাম। ঐ সময়টুকু হবে এক দিন বা এক দিনের কিছু অংশ। গণনাকারীদের জিজ্ঞেস করলেই আমাদের কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যাবে।” তখন তাদেরকে বলা হবে যে, এ সময়টুকু বেশী বটে, কিন্তু আখিরাতের সময়ের তুলনায় নিঃসন্দেহে এটা অতি অল্প সময়। যদি তোমরা এটা জানতে তবে নশ্বর দুনিয়াকে কখনো অবিনশ্বর আখিরাতের উপর প্রাধান্য দিতে না আর খারাপ কাজ করে এই অল্প সময়ে আল্লাহ তা’আলাকে এতো অসন্তুষ্ট করতে না। এই সামান্য সময় যদি তোমরা ধৈর্যের সাথে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে লেগে থাকতে তবে আজ পরম সুখে থাকতে। তোমাদের জন্যে থাকতো শুধু আনন্দ আর আনন্দ।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন জান্নাতীদেরকে জান্নাতের মধ্যে এবং জাহান্নামীদেরকে জান্নামের মধ্যে প্রবেশ করানো হবে তখন আল্লাহ তা’আলা জান্নাতীদেরকে জিজ্ঞেস করবেন- “তোমরা দুনিয়ায় কতদিন অবস্থান করেছিলে? উত্তর তারা বলবে- এই তো একদিন বা একদিনের কিছু অংশ।’ আল্লাহ তা’আলা তখন বলবেন- তবে তো তোমরা বড়ই ভাগ্যবান যে, এই অল্প সময়ের সৎ কার্যের বিনিময়ে এতো বেশী প্রতিদান প্রাপ্ত হয়েছে যে, তোমরা আমার রহমত, সন্তুষ্টি ও জান্নাত লাভ করেছে এবং এখানে চিরকাল অবস্থান করবে। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা জাহান্নামীদেরকে তাদের দুনিয়ার অবস্থানকাল জিজ্ঞেস করলে তারাও উত্তর দিবে যে, তারা এক দিন বা এক দিনের কিছু অংশ দুনিয়ায় অবস্থান করেছে। তখন তিনি তাদেরকে বলবেন- ‘তোমরা তো তোমাদের ব্যবসায়ে বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে! এটুকু সময়ের মধ্যে তোমরা আমার অসন্তুষ্টি, ক্রোধ ও জাহান্নাম ক্রয় করে নিয়েছে, যেখানে তোমরা চিরকাল অবস্থান করবে।

মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা কি মনে করেছে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি? তোমাদেরকে সৃষ্টি করার মধ্যে আমার কোন হিকমত নেই? তোমাদেরকে কি আমি শুধু খেল-তামাশার জন্যেই সৃষ্টি করেছি। যে, তোমরা শুধু লাফালাফি করে বেড়াবে? তোমরা পুরস্কার ও শাস্তির অধিকারী হবে না? তোমাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তোমাদেরকে আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর নির্দেশ পালনের জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা কি এটা মনে করে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছ যে, তোমাদেরকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না? এটাও তোমাদের ভুল ধারণা। যেমন মহান আল্লাহ অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “মানুষ কি মনে করে যে, তাকে নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হবে?” (৭৫:৩৬) আল্লাহর সত্তা এর বহু ঊর্ধ্বে যে, তিনি অযথা কোন কাজ করবেন, তিনি অনর্থক বানাবেন এবং ভেঙ্গে ফেলবেন। এই সত্য ও প্রকৃত সম্রাট এ সবকিছু থেকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। সম্মানিত আরশের তিনি অধিপতি, যা ছাদের মত সমস্ত মাখলুককে ছেয়ে রয়েছে। ওটা খুবই ভাল, সুন্দর ও সুদৃশ্য। যেমন তিনি বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি তাতে উদগত করি সর্বপ্রকার কল্যাণকর উদ্ভিদ।” (২৬:৭)

আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনে আবদিল আযীয (রঃ) তাঁর শেষ ভাষণে আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা ও গুণকীর্তনের পর বলেনঃ “হে লোক সকল! তোমরা অনর্থক সৃষ্ট হওনি এবং তোমাদেরকে নিরর্থক ছেড়ে দেয়া হয়নি। মনে রেখো যে, ওয়াদার একটা দিন রয়েছে যেই দিন স্বয়ং আল্লাহ ফায়সালা করার জন্যে অবতীর্ণ হবেন। ঐ ব্যক্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হতভাগ্য হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে এবং শূন্য হস্ত হয়ে গেছে যে আল্লাহর করুণা হতে দূর হয়ে গেছে এবং ঐ জান্নাতে প্রবেশ লাভে বঞ্চিত হয়েছে যার বিস্তৃতি সমস্ত যমীন ও আসমানের সমান। তোমাদের কি জানা নেই যে, কাল কিয়ামতের দিন ঐ ব্যক্তি আল্লাহর শাস্তি হতে রক্ষা পেয়ে যাবে যার অন্তরে আজ ঐ দিনের ভয় রয়েছে? আর যে এই নশ্বর দুনিয়াকে ঐ চিরস্থায়ী আখিরাতের উপর উৎসর্গ করে দিয়েছে? যে এই অল্পকে ঐ অধিক লাভের উদ্দেশ্যে দ্বিধাহীন চিত্তে ব্যয় করে দিচ্ছে? আর ঐ দিনের ভয়কে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তিত হওয়ার উপায় অবলম্বন করছে? তোমরা কি দেখো না যে, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এখন তোমরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে, অনুরূপভাবে তোমরাদেরকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। এরপর পরবর্তীরা আসবে এবং শেষ পর্যন্ত এমন এক সময় এসে যাবে যখন সারা দুনিয়া কুঞ্চিত হয়ে ঐ খাইরুল ওয়াসীন আল্লাহর দরবারে হাযির হবে। হে জনমণ্ডলী! মনে রেখো যে, তোমরা রাত দিন নিজেদের মৃত্যুর নিকটবর্তী হতে রয়েছে এবং নিজেদের কবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছ। তোমাদের ফল পাকতে রয়েছে, তোমাদের আশা শেষ হতে চলেছে, তোমাদের বয়স পূর্ণ হতে রয়েছে এবং তোমাদের আয়ু ফুরিয়ে যাচ্ছে। তোমাদের যমীনের গর্তে দাফন করে দেয়া হবে। যেখানে না আছে কোন বিছানা, না আছে কোন বালিশ। বন্ধুৰাৰ সব পৃথক হয়ে যাবে। হিসাব নিকাশ শুরু হবে। আমল সামনে এসে যাবে। যা ছেড়ে এসেছে তা অন্যদের হয়ে যাবে এবং যা আগে পাঠিয়েছে তা তোমার সামনে দেখতে পাবে। তোমরা পুণ্যের মুখাপেক্ষী হবে এবং পাপের শাস্তি ভোগ করবে। হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর তার ওয়াদা সামনে আসার পূর্বে। মৃত্যুর পূর্বেই জবাবদিহি করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও।” এসব কথা বলার পর তিনি চাদর দ্বারা মুখ ঢেকে নিয়ে কাঁদতে শুরু করেন এবং জনগণও কান্নায় ফেটে পড়ে। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

বর্ণিত আছে যে, জ্বিনে ধরা এক রুগ্ন ব্যক্তি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট আগমন করে। তখন তিনি(আরবি) সূরাটির শেষ পর্যন্ত আয়াতগুলো লোকটির কানের মধ্যে পাঠ করেন। সাথে সাথে লোকটি ভাল হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে ঘটনাটি বর্ণনা করা হলে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আব্দুল্লাহ (রাঃ)! তুমি তার কানের মধ্যে কি পাঠ করেছিলে?” তিনি উক্ত আয়াতগুলো পাঠের কথা বলে দিলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি এ আয়াতগুলো তার কানে পাঠ করে তাকে জ্বালিয়ে (পুড়িয়ে) দিয়েছে। আল্লাহর কসম! যদি কেউ এই আয়াতগুলো বিশ্বাসসহ কোন পাহাড়ের উপর পাঠ করে তবে ঐ পাহাড়টিও নিজের স্থান থেকে সরে যাবে।” (এটাও মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত ইবরাহীম ইবনে হারিস (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি (তাঁর পিতা) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে এক সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রেরণ করেন এবং নির্দেশ দেন যে, আমরা যেন সকাল-সন্ধ্যায় (আরবি) এই আয়াতটি পাঠ করতে থাকি। তাঁর নির্দেশমত আমরা সকাল-সন্ধ্যায় এটা বরাবরই পাঠ করতে থাকি। “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে, আমরা বিজয় লাভ করে গনীমতের মালসহ নিরাপদে ফিরে আসি।” (এটা আবু নঈম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের জন্যে পানিতে নিমজ্জিত হওয়া থেকে নিরাপত্তা লাভের উপায় হলো এই যে, তারা যখন নৌকায় আরোহণ করবে তখন পাঠ করবেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি সত্য মালিকের নামে শুরু করছি। তারা আল্লাহকে তার সঠিক ও ন্যায্য মর্যাদা দেয়নি, অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত যমীন তার মুষ্টির মধ্যে থাকবে এবং আকাশমণ্ডলী তার দক্ষিণ হস্তে জড়ানো থাকবে, তিনি পবিত্র ও সমুন্নত ঐগুলো হতে যেগুলোকে তারা তাঁর শরীক করছে। আল্লাহর নামে এর গতি ও স্থিতি, আমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে)
১১৭-১১৮ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তাআলা মুশরিকদেরকে ধমকের সুরে বলছেন যে, তারা যে শিরক করছে এর কোন দলীল প্রমাণ ও যুক্তি তাদের কাছে নেই। এটা হলো (আরবি) এবং শরতের জাযা। (আরবি) এর মধ্যে রয়েছে। অর্থাৎ এর হিসাব আল্লাহর কাছে রয়েছে। কাফির তাঁর কাছে কৃতকার্য হতে পারে না। সে পরিত্রাণ লাভে বঞ্চিত হবে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি লোককে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কার উপাসনা কর?” উত্তরে লোকটি বলেঃ “আল্লাহর এবং অমুক অমুকের (আমি উপাসনা করে থাকি)।” পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে প্রশ্ন করেনঃ “এদের মধ্যে কাকে তুমি তোমার বিপদের সময় ডেকে থাকো এবং তিনি তোমাকে বিপদ থেকে মুক্তি দান করে থাকেন?” জবাবে সে বলেঃ “তিনি হলেন একমাত্র মহামহিমান্বিত আল্লাহ।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তাহলে তার সাথে অন্যদের ইবাদত করার তোমার কি প্রয়োজন? তুমি কি মনে কর যে, তিনি একাই তোমার জন্যে যথেষ্ট হবেন না?” সে উত্তর দেয়ঃ “এ কথা আমি বলতে পারি না। তবে তাঁর সাথে অন্যদের উপাসনা করি এই উদ্দেশ্যে যে, এর মাধ্যমে পুরোপুরিভাবে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “সুবহানাল্লাহ! জ্ঞানের সাথে এই অজ্ঞতা? তুমি জান অথচ অজ্ঞ হচ্ছো?” এরপর সে আর কোন জবাব দিতে পারলো না। পরে সে মুসলমান হয়েছিল। ইসলাম গ্রহণের পর সে বলেঃ “আমি এমন একটি লোকের সাথে মিলিত হয়েছি যিনি তর্কে আমার উপর জয়যুক্ত হয়েছেন।” (এ হাদীসটি মুরসাল। ইমাম তিরমিযী (রঃ)-ও এটা বর্ণনা করেছেন)

এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ (হে নবী সঃ)! তুমি বলঃ হে আমার প্রতিপালক! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন, দয়ালুদের মধ্যে আপনিই তো শ্রেষ্ঠ দয়ালু। আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি একটি প্রার্থনার বাক্য, যা বান্দাদেরকে বলতে বলা হয়েছে (আরবি) শব্দের সাধারণ অর্থ হলো পাপরাশি মিটিয়ে দেয়া এবং ওগুলো লোকদের থেকে গোপন রাখা। আর (আরবি) এর অর্থ হলো সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং ভাল কথা ও কাজের তাওফীক দেয়া।

Leave a Reply