أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৭০)(মুনাফিক কি? বই নং ২৪)
[ اِنَّ الَّذِیۡنَ جَآءُوۡ بِالۡاِفۡکِ عُصۡبَۃٌ مِّنۡکُمۡ ؕ
যারা মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল;]
সূরা:- আন-নূর।
সুরা:২৪
পারা:১৮
১১-২৫ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৪:১১
اِنَّ الَّذِیۡنَ جَآءُوۡ بِالۡاِفۡکِ عُصۡبَۃٌ مِّنۡکُمۡ ؕ لَا تَحۡسَبُوۡہُ شَرًّا لَّکُمۡ ؕ بَلۡ ہُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ؕ لِکُلِّ امۡرِیًٴ مِّنۡہُمۡ مَّا اکۡتَسَبَ مِنَ الۡاِثۡمِ ۚ وَ الَّذِیۡ تَوَلّٰی کِبۡرَہٗ مِنۡہُمۡ لَہٗ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۱﴾
যারা এ মিথ্যা অপবাদ তৈরী করে এনেছে তারা তোমাদেরই ভিতরের একটি অংশ। এ ঘটনাকে নিজেদের পক্ষে খারাপ মনে করো না বরং এও তোমাদের জন্য ভালই। যে এর মধ্যে যতটা অংশ নিয়েছে সে ততটাই গোনাহ কামাই করেছে আর যে ব্যক্তি এর দায়-দায়িত্বের বড় অংশ নিজের মাথায় নিয়েছে তার জন্য তো রয়েছে মহাশাস্তি।
২৪:১২
لَوۡ لَاۤ اِذۡ سَمِعۡتُمُوۡہُ ظَنَّ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بِاَنۡفُسِہِمۡ خَیۡرًا ۙ وَّ قَالُوۡا ہٰذَاۤ اِفۡکٌ مُّبِیۡنٌ ﴿۱۲﴾
এ কথা শোনার পর বিশ্বাসী পুরুষ এবং নারীগণ কেন নিজেদের বিষয়ে সুধারণা করেনি এবং বলেনি, ‘এ তো নির্জলা অপবাদ?’
২৪:১৩
لَوۡ لَا جَآءُوۡ عَلَیۡہِ بِاَرۡبَعَۃِ شُہَدَآءَ ۚ فَاِذۡ لَمۡ یَاۡتُوۡا بِالشُّہَدَآءِ فَاُولٰٓئِکَ عِنۡدَ اللّٰہِ ہُمُ الۡکٰذِبُوۡنَ ﴿۱۳﴾
তারা কেন এ ব্যাপারে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনি? যেহেতু তারা সাক্ষী উপস্থিত করেনি, সেহেতু তারা আল্লাহর নিকটে মিথ্যাবাদী।
২৪:১৪
وَ لَوۡ لَا فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ وَ رَحۡمَتُہٗ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ لَمَسَّکُمۡ فِیۡ مَاۤ اَفَضۡتُمۡ فِیۡہِ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿ۚۖ۱۴﴾
ইহলোকে ও পরলোকে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে, তোমরা যাতে মগ্ন ছিলে, তার জন্য কঠিন শাস্তি তোমাদেরকে স্পর্শ করত।
২৪:১৫
اِذۡ تَلَقَّوۡنَہٗ بِاَلۡسِنَتِکُمۡ وَ تَقُوۡلُوۡنَ بِاَفۡوَاہِکُمۡ مَّا لَیۡسَ لَکُمۡ بِہٖ عِلۡمٌ وَّ تَحۡسَبُوۡنَہٗ ہَیِّنًا ٭ۖ وَّ ہُوَ عِنۡدَ اللّٰہِ عَظِیۡمٌ ﴿۱۵﴾
যখন তোমরা মুখে মুখে এ (কথা) প্রচার করছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে, যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা একে তুচ্ছ গণ্য করেছিলে; যদিও আল্লাহর দৃষ্টিতে এ ছিল গুরুতর বিষয়।
২৪:১৬
وَ لَوۡ لَاۤ اِذۡ سَمِعۡتُمُوۡہُ قُلۡتُمۡ مَّا یَکُوۡنُ لَنَاۤ اَنۡ نَّتَکَلَّمَ بِہٰذَا ٭ۖ سُبۡحٰنَکَ ہٰذَا بُہۡتَانٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۶﴾
আর তোমরা যখন এটা শুনলে তখন কেন বললে না, ‘এ বিষয় বলাবলি করা আমাদের উচিত নয়; আল্লাহ্ পবিত্র, মহান। এটাতো এক গুরুতর অপবাদ!’
২৪:১৭
یَعِظُکُمُ اللّٰہُ اَنۡ تَعُوۡدُوۡا لِمِثۡلِہٖۤ اَبَدًا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿ۚ۱۷﴾
আল্লাহ্ তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘তোমরা যদি মুমিন হও তবে কখনো যাতে অনুরূপ আচরণের পুনরাবৃত্তি না করো ।
২৪:১৮
وَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمُ الۡاٰیٰتِ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۱۸﴾
আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর বাক্যসমূহ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
২৪:১৯
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُحِبُّوۡنَ اَنۡ تَشِیۡعَ الۡفَاحِشَۃُ فِی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ۙ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ اللّٰہُ یَعۡلَمُ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۹﴾
নিশ্চয় যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ্ জানেন, তোমরা জানো না।
২৪:২০
وَ لَوۡ لَا فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ وَ رَحۡمَتُہٗ وَ اَنَّ اللّٰہَ رَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ ﴿٪۲۰﴾
যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর করুণা তোমাদের প্রতি না হতো এবং আল্লাহ যদি স্নেহশীল ও দয়ার্দ্র না হতেন (তাহলে যে জিনিস এখনই তোমাদের মধ্যে ছড়ানো হয়েছিলো তার পরিণাম হতো অতি ভয়াবহ। )
২৪:২১
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَّبِعۡ خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ فَاِنَّہٗ یَاۡمُرُ بِالۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لَوۡ لَا فَضۡلُ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ وَ رَحۡمَتُہٗ مَا زَکٰی مِنۡکُمۡ مِّنۡ اَحَدٍ اَبَدًا ۙ وَّ لٰکِنَّ اللّٰہَ یُزَکِّیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۲۱﴾
হে মুমিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। আর কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কাজেরই নির্দেশ দেয়। আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তোমাদের কেউই কখনো পবিত্র হতে পারতে না, তবে আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে পবিত্র করেন এবং আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।
২৪:২২
وَ لَا یَاۡتَلِ اُولُوا الۡفَضۡلِ مِنۡکُمۡ وَ السَّعَۃِ اَنۡ یُّؤۡتُوۡۤا اُولِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنَ وَ الۡمُہٰجِرِیۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۪ۖ وَ لۡیَعۡفُوۡا وَ لۡیَصۡفَحُوۡا ؕ اَلَا تُحِبُّوۡنَ اَنۡ یَّغۡفِرَ اللّٰہُ لَکُمۡ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۲۲﴾
তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তকে এবং আল্লাহর রাস্তায় যারা গৃহত্যাগ করেছে, তাদের কিছুই দেবে না; তারা যেন ওদেরকে ক্ষমা করে এবং ওদের দোষ-ত্রুটি মার্জনা করে। তোমরা কি পছন্দ করো না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিন? আর আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়।
২৪:২৩
اِنَّ الَّذِیۡنَ یَرۡمُوۡنَ الۡمُحۡصَنٰتِ الۡغٰفِلٰتِ الۡمُؤۡمِنٰتِ لُعِنُوۡا فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۪ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿ۙ۲۳﴾
যারা সচ্চরিত্রা, সরলমনা-নির্মলচিত্ত, ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে তারা তো দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি ।
২৪:২৪
یَّوۡمَ تَشۡہَدُ عَلَیۡہِمۡ اَلۡسِنَتُہُمۡ وَ اَیۡدِیۡہِمۡ وَ اَرۡجُلُہُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿۲۴﴾
যেদিন তাদের বিরুদ্ধে তাদের রসনা, তাদের হাত ও পা তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষী দেবে,
২৪:২৫
یَوۡمَئِذٍ یُّوَفِّیۡہِمُ اللّٰہُ دِیۡنَہُمُ الۡحَقَّ وَ یَعۡلَمُوۡنَ اَنَّ اللّٰہَ ہُوَ الۡحَقُّ الۡمُبِیۡنُ ﴿۲۵﴾
সেদিন তারা যে প্রতিদানের যোগ্য হবে, তা আল্লাহ তাদেরকে পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে, আল্লাহই সত্য এবং সত্যকে সত্য হিসেবে প্রকাশকারী।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*দুর্নাম শোনার পর একজন মুমিনের করণীয় : আর মুসলমানরা যদি এর কারণ বুঝতে চেষ্টা করে তাহলে তাদের অন্তরই তাদেরকে সঠিক কথাটা বলে দেবে, আর যদি কেউ যুক্তি দিয়ে বুঝতে চায় সেও এর সঠিক কারণটা সহজেই বুঝতে পারবে। যে কোনাে বিষয় বুঝার জন্যে আল কোরআন এভাবেই সাহায্য করে, এজন্যে এ মহান কোরআন প্রথম পদক্ষেপেই তার বিবেককে আহ্বান জানায়। দেখুন আল কোরআন বলছে, ‘মােমেন পুরুষ ও স্ত্রী লোক যখন তোমরা একথাটা শুনলে, তখন কেন তোমাদের নিজেদের ভালাে ধারনা রাখলে না? আর কেনই বা তােমরা বললে না, এটা নির্জলা মিথ্যা রটনা?’ হাঁ, অবশ্যই মােমেনদের জন্যে এটাই প্রথম কর্তব্য ছিলাে যে যখনই তাদের কানে একথাটা পৌছুল তখনই স্পষ্ট করে তাদের বলা উচিত ছিলো, অসম্ভব কথা, এটা হতে পারে না, অবশ্যই এটা এক নির্জলা মিথ্যা, এটাকে তাদের জন্যে কল্যাণকর মনে করা উচিত ছিলাে যে এই রটনা দ্বারা মােনাফেকদের খাসলাত-চরিত্র ও ব্যবহার সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিলাে এবং তাদের খােলস উন্মােচিত হয়ে গিয়েছিলাে এবং এই ওজুহাতে, তাদের কোনাে প্রকার সমর্থন না দিয়ে, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখার একটা সুযােগ তাদের হাতে এসে গিয়েছিলাে। এরপর, খেয়াল করে দেখুন তাদের সামনে এই যে দুই ব্যক্তির অবস্থা- একজন তাদেরই নবীর পবিত্র স্ত্রী এবং অপরজন তাদেরই ভাই একজন সাহাবী ও একজন মােজাহেদ। দু’জনই তাে তাদের নিজেদের লােক তারা তাে জাহেলী যুগের ও জাহেলী সমাজের এমন লােক নয়, যাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় বা আখেরাতে জওয়াবদিহির চিন্তা নেই, কাজেই তাদের সম্পর্কে ভালাে চিন্তাটাই তাে প্রথম আসা দরকার ছিলাে। এটা কি তাদের মনে করা উচিত ছিলাে না যে, মােমেনদের নিজেদের কোনাে মেয়ে এমন বিপদাপন্ন হলে এমন কিছু কি ঘটতে পারে? ঈমান অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের বিশ্বাস যাদের মধ্যে আছে তারা প্রকাশ্যে ও গােপনে জীবনের শুদ্ধি রক্ষা করবে, সদা-সর্বদা, আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে- এ চিন্তা নিয়েই নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করবে। সুতরাং তাদের সম্পর্কে ভালাে ধারণা পােষণ করাই তাে ছিলাে উত্তম পন্থা। তাদের কারাে দ্বারা এমন অন্যায় হতে পারাটা যদি সম্ভব বলে মনে না হয় তাহলে নবী(স.)-এর স্ত্রী দ্বারা এটা কি করে সম্ভব মনে করা যায় এবং সে ব্যক্তির দ্বারাই বা এমন অন্যায় পথে পা বাড়ানাে কেমন করে সম্ভব মনে করা যেতে পারে, যার সম্পর্কে ভাল ছাড়া কোনাে মন্দ কখনাে জানা যায়নি। আবু আইয়ুব খালেদ ইবনে যায়দ আনসারী(রা.) ও তার স্ত্রী এভাবেই চিন্তা করেছিলেন, ইমাম মােহাম্মদ ইবনে এসহাক বর্ণনা করেছেন, একদিন আইয়ুবের বাপকে আয়ুবের মা বললেন, আচ্ছা, আইউবের বাপ, আপনি কি শােনেননি আয়শা(রা.) সম্পর্কে লােকেরা কী বলাবলি করছে? তিনি বললেন, হাঁ, এবং এটা ডাহা মিথ্যা। আয়ুবের মা, এমন পরিস্থিতি যদি তােমার হতাে তাহলে তুমি কি এমনই কোনাে অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়তে? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি এমন কাজ করতাম না। আবু আইয়ুব বললেন, আল্লাহর কসম, আয়শা(রা.) অবশ্যই তোমার থেকে উত্তম ব্যক্তি… আবার ইমাম মাহমুদ ইবনে ওমর আযু-যামাখশারী তার তাফসীর (আল কাশশাফ)-এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন, আবু আইয়ুব একদিন তার স্ত্রী উম্মে আইয়ুবকে বললেন, তুমি কি খেয়াল করেছে, কি সব কথা বলাবলি হচ্ছে তিনি বললেন, হাঁ, কিন্তু আপনি যদি সাফওয়ানের স্থানে হতেন, তাহলে আপনি কি রসূলুল্লাহ(স.)-এর ইযযতের ওপর হামলা করার কথা চিন্তা করতে পারতেন? তিনি বললেন, কখনাে নয়। তখন উম্মে আইয়ুব বললেন, শুনুন আমিও যদি আয়শার স্থানে হতাম, তাহলে কিছুতেই আল্লাহর রসূলের খেয়ানত করতে পারতাম না, অতপর অবশ্যই এটা সত্য যে আয়শা আমার চেয়ে ভালো এবং অবশ্যই সাফাওয়ানও আপনার থেকে উত্তম ব্যক্তি। এ দুটি বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, মুসলমানদের অনেকে তাদের বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েছে এবং আন্তরিকভাবে ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করেছে, আর তারপর আয়শা(রা.) এবং একজন মুসলমান সম্পর্কে যেসব উল্লেখ করা হয়েছে তার থেকে তারা নিজেদেরকে দূরে রেখেছে দূরে রেখেছে আল্লাহর নাফরমানী করা থেকে এবং রসূলুল্লাহ(স.)-এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা থেকে। এভাবে তারা লজ্জাকর ও পাপের চোরাবালির মধ্যে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া নিজেদেরকে বাঁচিয়েছে। কখনাে তারা শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কারাে সম্পর্কে কোনাে। মন্তব্য করেনি এবং কোনাে আলােচনাতেও অংশ নেয়নি। এই হচ্ছে আল কোরআনে উপস্থাপিত যে কোনাে বিষয়ে মাথা ঘামানাের পদ্ধতি, অর্থাৎ, কোনাে সাক্ষ্য প্রমাণ তালাশ করার আগে প্রথমেই নিজের বিবেককে ব্যবহার করা। এটা হচ্ছে মুসলমানদের প্রথম কর্তব্য এবং সমস্যাদি সমাধানের ব্যাপারে তাদের প্রথম পদক্ষেপ। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে বাস্তব দলীল প্রমাণ দ্বারা কোনাে কিছুর ব্যাপারে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘কেন তারা (তাদের উত্থাপিত অভিযােগের পক্ষে প্রমাণস্বরূপ) চারজন (দেখা) সাক্ষী হাযীর করে না! যদি চারজন সাক্ষী হাযীর করতে ওরা না পারে তাহলে ওরাই আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত হবে।’ অর্থাৎ, এসব নির্জলা ও ডাহা মিথ্যার দৌড় বহু দূরে। এসব মিথ্যার বিহিত না করা হলে এর আওতায় ছােট বড় গরীব ধনী এবং সর্বোচ্চ সম্মানী ব্যক্তি পর্যন্ত এসে যাবে, যেমন এর ধাক্কা থেকে আল্লাহর মহান নবী ও তার পবিত্র পরিবার পর্যন্ত রেহাই পায়নি। সুতরাং, এহেন অপরাধকে সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না বা তুচ্ছও মনে করা উচিত হবে না। বিনা সাক্ষীতে এবং বিনা দলীল প্রমাণে যে যার নামে যা চাইবে মুখােরােচক গল্প হিসাবে আলাপ আলােচনা করতে থাকবে, যার মুখে যা আসবে সে তাই বলবে এবং এভাবে মানুষের ইযযত আবরুকে ধুলায় মিশিয়ে দেবে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের রাজ্যে এমন অরাজকতা সহ্য করা সম্ভব নয়। আল্লাহ পরওয়ারদেগার এসব দেখবেন এবং তিনি এর কোনাে বিহিত করবেন না বা করতে পারবেন না, এমন তাে হতে পারে না, তিনি কোনাে আঁধার নগরীর মুকুটবিহীন ও দেউলে বা ক্ষমতাহীন রাজা নন যে, কিছু করতে চাইলে করতে পারবেন না। এজন্যেই এরশাদ হচ্ছে, কেন তারা চারজন (দেখা) সাক্ষী নিয়ে আসে না অর্থাৎ তারা যদি এরকম সাক্ষী হাযির না করে তাহলে অবশ্যই তারা মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণিত হবে। তারা মহান আল্লাহর কাছে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত হবে, যার কাছে কোনাে কথা পরিবর্তন হয় না এবং তার হুকুম পরিবর্তিতও হয় না, তার নিদের্শ বাস্তবায়িত হওয়া বন্ধও হয় না। এ অপরাধীদের জন্যে এ এমন কঠিন শাস্তি, যা প্রযােজ্য হবেই অবশ্যই এ শাস্তি দেয়া হবে এবং এ শাস্তি স্থায়ীভাবে থাকবে। এর থেকে রেহাই পাওয়ার কোনাে উপায় নেই এবং এ শাস্তির পরিণাম আরাে আরাে ধ্বংসাত্মক- এর থেকে বাঁচার আর কোনাে পথ নেই। তাহলে বুঝা গেলাে, এ ধরনের কোনাে খবর বা দোষারােপের কথা কানে আসার সাথে সাথে মুসলমানরা দুটি কাজ করবে। এক. নিজেদের বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে সে খবরের যথার্থতা বুঝার চেষ্টা করবে। দুই. সে খবরের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না কাউকে বলাও যাবে না বা কোনাে খারাপ মন্তব্যও করা যাবে না, কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে মােমেনরা সে মােনাফেকদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে আটকে গিয়েছিলাে এবং শত্রুর উদ্দেশ্যকে সফল করে নিজেরাও ধ্বংসের অতল তলে ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলাে। তারা মিথ্যা ও মনগড়া অপবাদ রটনাকারীদেরকে প্রতিরােধ না করে, বরং গােটা পরিবেশকে বিষাক্ত করার জন্যে তাদেরকে খােলা আযাদী দিয়ে দিয়েছিলাে এবং স্বয়ং সােনার মানুষ মােমেনদের চোখের মনি ও প্রাণ প্রিয় নেতার মান-সম্মান ধ্বংসের কাজ করার জন্যে তাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছিলাে। এটা তাে এতাে বড় কঠিন ব্যাপার ছিলাে যে আল্লাহর মেহেরবানী না থাকলে গােটা মুসলিম জামায়াত এক মহা-বিপদে পড়ে যেতাে। এজন্য আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদেরকে চূড়ান্তভাবে সতর্ক করছেন এতাে কঠিন ও বেদনাদায়ক শিক্ষা লাভ করার পর যে, আর কোনােদিন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি তারা না ঘটায়। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যদি দুনিয়া এবং আখেরাতে তােমাদের ওপর আল্লাহর মেহেরবানী এবং দয়া না থাকতাে তাহলে তােমরা যা শুরু করেছিলে, তাতে তােমাদেরকে অবশ্যই মহা বিপদজনক আযাব স্পর্শ করতে।’ ওপরের আয়াতে বুঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালা উদীয়মান মুসলিম জামায়াতকে অত্যন্ত কঠোরভাবে এক শিক্ষা দিলেন, তারপর তাদের ওপর মান-মর্যাদা ও দয়ার বৃষ্টি নাযিল করলেন এবং তাদেরকে তার কঠিন পাকড়াও থেকে ও ভীষণ আযাব থেকে রেহাই দিলেন, যদিও তাদের আচরণ তাদেরকে আযাবের হকদারই বানিয়ে দিয়েছিলাে। তারা রসূলুল্লাহ(স.) তার স্ত্রী এবং তার এমন এক সংগীর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাে যার সম্পর্কে কেউ কোনাে দিন ভালাে ছাড়া মন্দ পায়নি- এদেরকে তারা যে কষ্টের মধ্যে ফেলেছিলাে তার প্রতিদানে তারা অবশ্যই বিরাট শাস্তি পাওয়ার যােগ্য হয়ে গিয়েছিলাে। আর তাদের ওপর সেই শান্তি অবধারিত হয়ে গিয়েছিলাে যা মুসলিম জামায়াতকে কঠিন কষ্টের মধ্যে ফেলার কারণে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানাের কারণে তাদের ভাগ্যে তারা নিজেরা ডেকে এনেছিলাে। তারা সেসব পবিত্র বিষয়গুলােকে মলিন করার চেষ্টা করেছিলাে যার ওপর জামায়াতী জীবনের শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করে। মুসলমানদের দলীয় জীবন ও সামষ্টিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্যে এবং আল্লাহর প্রতি ও নবী (স.)-এর প্রতি তাদের যে গভীর বিশ্বাস ছিলাে তাকে মূলােৎপাটিত করার জন্যে পূর্ণ একটি মাস ধরে যে মারাত্মক চক্রান্ত তারা করেছিলাে তার জন্যে তারা আল্লাহর মহা গযবের হকদার হয়ে গিয়েছিলাে। কোনাে নিশ্চিত তথ্য ছাড়াই তারা গােটা মুসলিম জামায়াতকে ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে দেয়ার জন্যে এই গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে দিলাে, কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বেদনাদায়ক এক শিক্ষা দান করার পর তাদেরকে নিজ মেহেরবানী ও রহমত দ্বারা নাজাত দিলেন।
* আল কোরআন অতি চমৎকারভাবে সে সময়টির ছবি এঁকেছে, যখন মানুষের নৈতিকতার লাগাম ঢিল হয়ে গেলাে, ভালাে মন্দ বিচারের মানদন্ডসমূহ পরিত্যক্ত হলাে, মানুষের মূল্যবােধ বিভ্রান্তিতে ছেয়ে গেলাে এবং মূল নীতিসমূহ সংকীর্ণ হয়ে গেলাে। এরশাদ হচ্ছে, ‘স্মরণ করে দেখাে সেই সময়ের কথা যখন… এবং সেটা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত বড় ব্যাপার।'(আয়াত ১৫)। এ আয়াতটি এমন একটি অবস্থার ছবি এঁকেছে যা দেখে বুঝা যাচ্ছে, সে দলটি এমন একটি কঠিন বিষয় নিয়ে কতাে হালকাভাবে চিন্তা করেছে এবং কতাে অবহেলার সাথে এতাে বড় ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা করেছে, তোমরা বলাবলি করছিলে অর্থাৎ চিন্তাহীনভাবে, না দেখে যাচাই না করে এবং গভীরভাবে খেয়াল না করে এক জিহবা আর এক জিহ্বার সাথে সাক্ষাত করছিলো, এমনকি তাদের মনেই হয়নি যে এ কথাটার ক্ষতি মনের মধ্যে যাচাই করার পূর্বেই কথাটা কানে কানে ছড়িয়ে পড়বে, এ নিয়ে বহু লােকই মাথা ঘামাতে শুরু করবে। তাই এরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা ভাবছাে ব্যাপারটা তাে তেমন কিছু নয়, তুচ্ছ। কিন্তু তােমরা একটুও চিন্তা করলে না, বিষয়টা স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের মান সম্ভ্রমের সাথে জড়িত, তার সম্মানের ওপর এটা প্রচন্ড এক আঘাত। এর অন্তরালে অপর যে কথাটি প্রত্ন ছিলাে তা হচ্ছে, মােহাম্মদ(স.) সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার দাবী করছে, অথচ তার ঘর বিগড়ে গেলাে, সেখানে তার মালিক তাকে কোনাে সাহায্য করতে পারলাে না। তাহলেই বােঝ কেমন নবী সে। এ ঘটনা তার ওপর এমন তীব্র ব্যথা-বেদনা ডেকে আনলাে যে তার স্ত্রী ও গােটা পরিবারের অন্তর ফেটে চৌচির হয়ে গেলাে, এমনকি যালেমরা সিদ্দীকে আকবরের ঘরকেও এই মারাত্মক অপরাধের সাথে জড়িয়ে ফেললাে। তিনি তাে ছিলেন সেই মহান ব্যক্তিত্ব যার ওপর জাহেলী যুগেও এ ধরনের অপবাদ দিতে কেউ সাহস পায়নি এবং আল্লাহর পথে জেহাদকারী উল্লেখিত সে সাহাবীকেও কোনাে দিন কেউ এভাবে দোষারােপ করতে পারেনি, কেউ রসূলুল্লাহ(স.)-এর চরিত্রের ওপর আঘাত হানতে পারেনি এবং তার রবের সাথে তার মহব্বতের কেউ চিড় ধরাতেও পারেনি বা আল্লাহর পরিচালনার বাইরেও তিনি কখনাে থাকেননি। এজন্যেই খােদ আল্লাহ তায়ালাই বলছেন, ‘তােমরা ভাবছাে এটা খুব সহজ ব্যাপার অথচ আল্লাহর কাছে এটা এক বিরাট ব্যাপার।'(আয়াত ১৫) আর আল্লাহর কাছে তাে সেসব জিনিসই বড় এবং ভারী যা পাহাড়কে কাঁপিয়ে তােলে এবং পৃথিবী থেকে আকাশ পর্যন্ত এক তুফান শুরু হয়ে যায় । যে কোনাে মুসলমানের পক্ষে এ ন্যক্কারজনক কথা কানে আসার সাথে সাথে তাদের অন্তর ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠা উচিত ছিলাে এবং তাদের সামনে এ সম্পর্কিত কোনাে কথা উচ্চারিত হলে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাওয়াটাই ছিলাে বাঞ্ছনীয়, এটাকে কোনাে আলােচ্য বিষয় মনে করাকেও অবশ্যই খারাপ মনে করা উচিত ছিলো, উচিত ছিলাে মনকে আল্লাহর দিকে রুজু করে নবীকে এসব কিছুর দুর্বলতার উর্ধে ভাবা এবং উচিত ছিলাে সে পবিত্র পরিবেশ থেকে বহু বহু দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া এই দোষারােপের নিকৃষ্টতম কথাগুলােকে উপেক্ষা করা। এরশাদ হচ্ছে, ‘তােমরা যখন এ কথাটা শুনলে তখন কেন বলে উঠলে না, অবশ্যই এ বিষয়ে আমাদের কোনাে মন্তব্য করা উচিত নয়, এ বিষয়ে কোনাে আলাপ-আলােচনা করাও ঠিক হবে না। পবিত্র তুমি হে আল্লাহ! অবশ্যই এ হচ্ছে এক ভয়ানক মিথ্যা অপবাদ।’ আর যখনই তােমাদের কাছে এ গুজবটা পৌছুলো, তােমাদের অন্তরের গভীরে রেখাপাত করলাে, তােমাদের গােটা সত্ত্বাকে, আন্দোলিত করলাে আসলে সে সময়ে যে কথাগুলাে চালাচালি হচ্ছিলাে, তখন তার ভয়াবহতা এবং তার ঘৃণ্য প্রকাশ ও প্রচারের কারণে তােমাদের মধ্যে মারাত্মক এক ভয় ছড়িয়ে পড়া উচিত ছিলাে। এজন্যে তােমাদেরকে এ ধরনের কঠিন অবস্থা যখন যেখানেই আসুক না কেন, তােমরা যেন সাবধান থাক এবং সেসব অপপ্রচার থেকে তােমাদের মনােযােগকে সংগে সংগে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এরশাদ হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা তােমাদের নসীহত করছেন যেন তােমরা পুনরায় আর কখনই এ ধরনের ঘটনার সাথে জড়িয়ে না পড়। ‘তিনি তােমাদেরকে নসীহত করছেন’ মানুষকে গড়ে তােলার জন্যে এ এক অতি উত্তম ও প্রভাবপূর্ণ পদ্ধতি। শােনা, আনুগত্য করা এবং বিবেচনা করার জন্যে এটাই সর্বাপেক্ষা সুন্দর পদ্ধতি। আল্লাহ তায়ালা তােমাদেরকে নসীহত করছেন যেন তোমরা পুনরায় এ ধরনের কাজ আর না করো। আল্লাহ তায়ালা চান তারা এ নসীহত গ্রহণ করে উপকৃত হােক। ‘যদি তোমরা মােমেন হও’ কারণ এই যে ঘৃণ্য কথাগুলাে ছড়ানাে হলাে যারা প্রকৃত মোমেন তারা এগুলা করতে পারবে না এসব আচরণ করতে গেলে অবশ্যই তাদেরকে আল্লাহর ভয় নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তাদের প্রতি এই সতর্কবানী উচ্চারণ করা হচ্ছে যেন অতীতে যেসব ভুল ভ্রান্তি হয়েছে সেগুলাে পুনরায় আর না হয়, যেহেতু তারা মােমেন এ সাবধানতা তাদের জন্যে একান্ত প্রয়ােজন। ‘আর তােমাদের কাছে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে এ আয়াতগুলাে বর্ণনা করছেন।’ মিথ্যা অপবাদের যে ঘটনাটি ওপরে উল্লেখিত হয়েছে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরো যেসব চক্রান্ত চলেছে এবং এসবের সাথে পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ার কারণে যার যে সব ত্রুটি বিচ্যুতি হয়েছে সেগুলাে আল্লাহ তায়ালা ছাফ ছাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, যেন মানুষ এসব ত্রুটির ভয়াবহতা বুঝতে পারে এবং এসবের পুনরাবৃত্তি আর না ঘটায়, ‘আর আল্লাহ তায়ালা মহাজ্ঞানী মহা বিজ্ঞানময়।’ তিনি জানেন মানুষের মন-মানসিকতা এবং তাদের উদ্দেশ্য লক্ষ্য কি, জানেন তাদের অন্তরে কি সব কথা নিশিদিন আনাগােনা করে, তিনি জানেন মানুষের জীবনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তার সমস্যাসমূহও। আর তিনিই সেগুলাের সমাধান দিয়ে থাকেন। তিনিই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এবং তাদের যাবতীয় কাজের ব্যবস্থা তিনিই করে থাকেন; তাদের জীবনের শৃংখলা বিধান এবং তাদেরকে সঠিক পথে রাখার জন্যে তিনিই সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করেন, আর ভুল-ত্রুটি হয়ে গেলে তাদের সংশােধনের ব্যবস্থাও তিনিই দিয়ে থাকেন। মিথ্যা অপবাদ-রটনার ঘটনা বর্ণনা, এ অপরাধের শাস্তির উল্লেখ এবং ঘৃণিত এই কাজের ফলে সমাজের সর্বত্র যে অশান্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেগুলাে সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করার পর এ ধরনের অপরাধ যেন মুসলিম সমাজে আর না ঘটে তার জন্যে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, যারা কোনাে চক্রান্তের শিকার হয়ে এ ঘৃণ্য অপরাধে ইন্ধন জুগিয়েছে এবং যারা পরিণামের চিন্তা করে হেলা ভরে এ ষড়যন্ত্রের সমর্থন দিয়েছে, তাওবা করলে তাদেরকে ক্ষমা করা হবে বলে সংবাদ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে, তাদের জন্যে রয়েছে আল্লাহর রহমতের অবারিত দ্বার। সাথে সাথে দৃঢ়তার সাথে তাদেরকে একথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে সরলা, সতী সাধ্বী মােমেনদের বিরুদ্ধে যখন কেউ অপপ্রচার চালাবে, তার চরিত্রে কলংক লেপন করবে, আন্দাজে তাদেরকে বদনাম করার চেষ্টা করবে, তাদের জন্যে (দুনিয়ার শাস্তির সাথে সাথে) পরকালেও রয়েছে আল্লাহর আমাব। এটা এজন্যেই বলে দেয়া হয়েছে যেন কেউ এ অপরাধকে হালকা মনে করে এবং দুনিয়ার অন্যান্য বিষয়ের মতাে এটাকে ছােটখাট কোনাে ঘটনা মনে না করে। আর যদি কেউ এ বিষয়টির গুরুত্ব বুঝার পর সঠিকভাবে তাওবা করে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যেন সর্বান্তকরণে তাকে ক্ষমা করে দেয় এবং খেয়াল রাখা হয় যেন এর কোনাে প্রভাব দুনিয়াবী লেনদেন ও ব্যবহারের ওপর পড়তে না পারে, যেমনকি আবু বকর(রা.)-এর ব্যবহারে তার আত্মীয় মিসতাহ ইবনে আসাসাকে- আর দান করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করার কারণে ঘটেছিলাে, এ ছিলাে সেই ব্যক্তি যে, অপবাদের এ ঘটনাটির ওপর যারা মন্তব্য করেছিলাে তাদের সাথে সে যােগ দিয়ে কিছু কথা বলেছিলাে। তাই এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা মােমেনদের (কোনোভাবে) অশ্লীলতার প্রসার ঘটায় তাদের জন্যে রয়েছে দুনিয়া ও আখেরাতে বেদনাদায়ক আযাব, আর আল্লাহ তায়ালা জানেন এবং তােমরা জানাে না।’
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
১১-২৫ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
আয়িশাহ (رضي الله عنها) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অভ্যাস ছিল যে, সফরে যাওয়ার সময় তিনি তাঁর স্ত্রীদের নামে লটারী করতেন। লটারীতে যার নাম উঠতো তাকে তিনি সাথে নিয়ে যেতেন। ঘটনাক্রমে তাঁর এক যুদ্ধে গমনের সময় লটারীতে আমার নাম উঠে আসে। আমি তাঁর সাথে গমন করি। আর এটা ছিল পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পরের ঘটনা। আমি আমার হাওদাতে বসে থাকতাম। যখন যাত্রীদল কোন জায়গায় নামতো তখন আমার হাওদা নামিয়ে নেয়া হত। আমি হাওদার মধ্যেই বসে তাকতাম। আবার যখন কাফেলা চলতে শুরু করত তখন আমার হাওদাও উটের ওপর উঠিয়ে দেয়া হত।
এভাবে আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যাই। যুদ্ধ শেষে আমরা মদীনায় ফিরতে শুরু করি। আমরা মদীনার নিকটবর্তী হলে রাতে গমনের ঘোষণা দেয়া হয়। আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ি এবং সেনা বাহিনীর তাঁবু থেকে বহু দূরে চলে যাই। প্রয়োজন পুরো করে আমি ফিরে এসে গলায় হাত দিয়ে দেখি যে, গলায় হার নেই। তখন হার খুঁজতে পুনরায় সেখানে যাই। আর তখন সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করে দিল। যে লোকগুলো আমার হাওদা উঠিয়ে দিত তারা মনে করল যে, আমি ঐ হাওদার মধ্যেই আছি, তাই তারা আমার হাওদাটি উটের পিঠে উঠিয়ে দিল এবং চলতে শুরু করল। ঐসময় পর্যন্ত স্ত্রীলোকেরা বেশি পানাহার করত না, ফলে তাদের দেহ বেশি ভারী হতো না। তাই আমাকে বহনকারীরা হাওদার মধ্যে আমার থাকা না থাকার কোন টেরই পেল না। তাছাড়া আমি ছিলাম ঐ সময় খুবই অল্প বয়সের মেয়ে। দীর্ঘক্ষণ পর আমি আমার হারানো হারটি খুঁজে পেলাম। সেনাবাহিনীর বিশ্রামস্থলে পৌঁছে সেখানে কাউকে পেলাম না। আমি যেখানে আমার উটটি ছিল সেস্থানে পৌঁছলাম। সেখানে আমি এ অপেক্ষায় বসে পড়লাম যে, সেনাবাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে যখন আমার না থাকার খবর জানবে তখন অবশ্যই এখানে লোক পাঠাবে। এমতাবস্থায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আর সফওয়ান বিন মুআত্তাল আস-সুলামী আয-যাকওয়ানী যিনি সেনাবাহিনীর পিছনে ছিলেন এবং শেষ রাত্রে চলতে শুরু করলেন সকালে এখানে পৌঁছেন। তিনি একজন ঘুমন্ত মানুষকে দেখতে পেয়ে আমার নিকট আসলেন এবং আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। তার
(إِنَّالِلّٰهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ)
শব্দ শুনে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেকে চাদর দ্বারা সামলিয়ে নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি তার উটটি বসিয়ে দেন এবং ওর হাতের ওপর নিজের পা রেখে সওয়ারীর ওপর আরোহণ করি। তিনি উটকে উঠিয়ে চালাতে শুরু করেন। আল্লাহ তা‘আলার শপথ! তিনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি এবং আমিও তার সাথে কোন কথা বলিনি। প্রায় দুপুর বেলায় আমরা আমাদের যাত্রীদলের সাথে মিলিত হই। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মিথ্যুকেরা অপবাদের ঘটনা রটিয়ে দেয়। আর এই افك বা মিথ্যা অপবাদের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সূরা নূরের ১১-২০ নং আয়াত পর্যন্ত নাযিল হয় এবং প্রমাণিত হয় যে, আয়িশাহ সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৫০, সহীহ মুসলিম হা: ২৭৭০)
الْإِفْكِ বলতে সে মিথ্যা অপবাদ রটনার ঘটনাকে বুঝানো হয়েছে, যে ঘটনায় আয়িশাহ -কে অপকর্মের অপবাদ দেয়া হয়েছে।
(عُصْبَةٌ مِّنْكُمْ)
অর্থাৎ যারা এ মিথ্যা অপবাদ দানে জড়িত তারা তোমাদের মধ্যকার একটি জামাত, যারা নিজেদেরকে মু’মিন বলে থাকে। এদের মধ্যে কেউ মুনাফিক, আর কেউ প্রকৃত মু’মিন, কিন্তু মুনাফিকদের প্ররোচনায় সে সব হয়েছে। তারা হলেন হাসসান বিন সাবেত যিনি রাসূলের কবি বলে পরিচিত, মিসত্বাহ বিন আসাসাহ ও হামনাহ বিনতে জাহাশ।
(لَا تَحْسَبُوْهُ شَرًّا لَّكُمْ)
অর্থাৎ এ মিথ্যা অপবাদ রটানোর ঘটনাকে নিজেদের জন্য খারাপ মনে করো না। মান-সম্মানের ব্যাপার বলে যদিও বাহ্যিকভাবে খারাপ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু এর মাধ্যমে যাকে অপবাদ দেয়া হয়েছে তাকে অপবাদ থেকে মুক্ত করা হবে, তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেয়া হবে এবং এর মাধ্যমে এ বিষয়ে শরীয়তের বিধান দেয়া হবে যা তোমাদের উপকারে আসবে। আর যারা অপবাদ দিয়েছে তাদের মধ্যে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী এবং কে মূল হোতা তা চিহ্নিত করা হবে।
(وَالَّذِيْ تَوَلّٰي كِبْرَه)
‘এবং তাদের মধ্যে যে এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে’ প্রধান ভূমিকা পালন করেছে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সুলুল। সে এ অপবাদ রটনার ব্যাপারে অন্যদেরকে প্ররোচিত করেছে।
(لَوْلَآ إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ ظَنَّ….)
মু’মিনরা যখন নিজেদের মাঝে এরূপ অপবাদমূলক কথা শুনবে তখন কী করণীয় হবে সে দিক নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: হে মু’মিনগণ! যখন তোমরা এরূপ অপবাদমূলক কথা শুনলে কেন নিজেদের ব্যাপারে ভাল ধারণা করলে না? তা হলন যে অপবাদ দেয়া হয়েছে তা থেকে তিনি মুক্ত, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদ। অথচ অপবাদের জন্য চারজন সাক্ষী উপস্থিত করা উচিত তাও তারা করতে পারেনি, তারপরেও তোমরা মিথ্যা বলনি। উক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার পরে হাসসান, মিসত্বাহ ও হামনাহ বিনতে জাহাশকে অপবাদের শাস্তি প্রদান করা হয়। (তিরমিযী হা: ৩১৮১, আবূ দাঊদ হা: ৪৪৭৪, হাসান) কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন উবাইকে শাস্তি দেয়া হয়নি। বরং তার জন্য আখেরাতের শাস্তি প্রস্তুত রাখা হয়েছে, অপর দিকে মু’মিনদেরকে শাস্তি দিয়ে দুনিয়াতেই পবিত্র করা হয়েছে। ফলে আখিরাতে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে না।
অর্থাৎ তোমরা যে মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছ, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে পাকড়াও করতেন যদি তোমাদের প্রতি দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ তা‘আলার রহমত না থাকত।
(إِذْ تَلَقَّوْنَه۫ بِأَلْسِنَتِكُمْ….)
অর্থাৎ তোমরা বিষয়টি সত্য-মিথ্যা না জেনে, না বুঝে মুখে মুখে প্রচার শুরু করছ, আর বিষয়টিকে খুবই তুচ্ছ মনে করছ অথচ এটা আল্লাহ তা‘আলার নিকট খুবই বড় ধরণের অপরাধ। তোমাদের উচিত ছিল প্রচার না করে আল্লাহ তা‘আলার দিকে সোপর্দ করা। যেমন হাদীসে এসেছে: কোন কোন সময় মানুষ আল্লাহ তা‘আলার অসন্তুষ্টির এমন কথা উচ্চারণ করে ফেলে যার কোন গুরুত্ব তার কাছে নেই। কিন্তু ঐ কারণে সে জাহান্নামের এত নিম্নে পৌঁছে যায় যত নিম্নে আকাশ হতে জমিন রয়েছে। এমনকি তার চেয়েও নিম্নে চলে যায়। (সহীহ বুখারী হা: ৬৪৭৮, সহীহ মুসলিম হা: ২৯৮৮)
(وَلَوْلَآ إِذْ سَمِعْتُمُوْهُ قُلْتُمْ….)
এখানে মু’মিনদেরকে দ্বিতীয়বার শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে যে, যখন তারা এ অপবাদের কথা শুনেছিল তখন এ ব্যাপারে কোন কথা না বলে তাদের এমনটি বলা উচিত ছিল যে, আমাদের এ ব্যাপারে কিছুই বলা উচিত নয়। যখন তারা এমনটি করেনি তখন তাদের প্রথম বারের ঘটনার জন্য সর্তক করে বলা হচ্ছে যে, দ্বিতীয়বার যেন তারা আর এমনটি না করে। মূলত তাদেরকে এ বিষয়ে সর্তক করে হচ্ছে।
(إِنَّ الَّذِيْنَ يُحِبُّوْنَ أَنْ…..)
‘নিশ্চয়ই যারা পছন্দ করে যে, মু’মিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার হোক’ এটা তৃতীয় সতর্ক বাণী যে, যারা এ ধরণের কথা শুনবে তার জন্য ওটা ছড়ানো হারাম। কারণ যারা ছড়ায় তাদের মূল উদ্দেশ্য হল মু’মিনদেরকে কষ্ট দেয়া এবং তাদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার করা। যারা এ রকম জঘন্য কথা ছড়িয়ে বেড়ায় তাদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি (হদ) এবং পরলৌকিক শাস্তি জাহান্নামে দেয়া হবে। হাদীসে এসেছে:
সাওবান (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমরা আল্লাহ তা‘আলার বান্দাদেরকে কষ্ট দিও না। এবং তাদের গোপনীয় দোষ অনুসন্ধান করো না। যে তার মুসলিম ভাইয়ের গোপনীয় দোষ অনুসন্ধান করবে আল্লাহও তার গোপনীয় দোষের পিছনে লাগবেন এবং তাকে এমনভাবে লাঞ্ছিত করবেন যে, তাকে তার বাড়ির লোকেরাও খারাপ দৃষ্টিতে দেখতে থাকবে। (মুসানাদ আহমাদ ৫/২৭৯)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
كَفَي بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ
একজন ব্যক্তি মিথ্যুক হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে তাই বলে বেড়াবে। (সহীহ মুসলিম হা: ৫)
الْفَاحِشَةُ শব্দের অর্থ নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা। কুরআনে ব্যভিচার অর্থেও শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। যেমন সূরা বানী ইসরাঈলের ৩২ নং আয়াতে বলা হয়েছে। অত্র আয়াতে ব্যভিচারের একটি মিথ্যা খবর প্রচার করাকেও অশ্লীলতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ অপরাধ করা ও অপরাধমূলক কাজে সহযোগিতা করা উভয়ই সমান। সুতরাং শুধু অশ্লীলতার একটি মিথ্যা সংবাদ প্রচার করার কারণে যদি আল্লাহর কাছে এত বড় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, তাহলে যারা প্রতিনিয়ত সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি, ভিডিও, সিডি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমাজে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে ও ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে তারা আল্লাহর নিকট কত বড় অপরাধী। এমনিভাবে যারা পরিবারের মাঝে টি-ভি, ডিসের নামে অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয় তারাও কম অপরাধী নয়। সুতরাং আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত, আমরা কোন্ দিকে পা বাড়াচ্ছি, আর সমাজকে কোন্ দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আবার মু’মিন বান্দাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। কারণ শয়তান কখনো ভাল কাজের দিক-নির্দেশনা দেয় না। সে শুধু অশ্লীল ও মন্দ কাজের দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন যার মাধ্যমে সমাজে খারাপ কাজ ছড়ানো যাবে এবং বিশৃংখলা সৃষ্টি করা যাবে ইত্যাদি। তাই আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوْهُ عَدُوًّا ط إِنَّمَا يَدْعُوْا حِزْبَه۫ لِيَكُوْنُوْا مِنْ أَصْحٰبِ السَّعِيْرِ)
“নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্র“, সুতরাং তাকে তোমরা শত্র“রূপেই গ্রহণ কর। সে তার দলবলকে শুধু এজন্যই আহ্বান করে, যেন তারা (পথভ্রষ্ট হয়ে) জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।” (সূরা ফাতির ৩৫:৬)
(وَلَوْلَا فَضْلُ اللّٰهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُه)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার রহমত না থাকলে তোমাদের কেউ পাপ থেকে পবিত্র হতে পারত না, শয়তানের অনুসরণ থেকে পবিত্র হতে পারত না। শয়তান যেভাবে খারাপ কাজকে সুশোভিত করে দেয় সেদিকে তোমাদের মন চলে যেত। কেননা মানুষের মন তো খারাপ কাজের দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়, তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে রহম করেন সে ব্যতীত। তাই আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা পবিত্র করেন। সেজন্য নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘আ করে বলতেন:
اللّٰهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا، وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا، أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا
হে আল্লাহ তা‘আলা, আমার মনে তাক্বওয়া দাও, তা পবিত্র কর, কারণ তুমিই তো সর্বোত্তম পবিত্রকারী। তুমি এ মনের মালিক। (সহীহ মুসলিম হা: ২৭২২) ইফকের ঘটনা বর্ণনা করার পর এ আয়াত নিয়ে আসার উদ্দেশ্য হলন যারা উক্ত মিথ্যারোপে জড়িত হয়নি তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ রহমত রয়েছে। আর যারা জড়িত হয়েছে তাদের মধ্য হতে যাদেরকে পবিত্র করা হয়েছে তাদের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহ ছিল।
(وَلَا يَأْتَلِ أُولُوا الْفَضْلِ….) শানে নযূল:
আবূ বকর (رضي الله عنه) যখন দেখলেন, মিসতাহ বিন আসাসাহ তার কন্যা আয়িশাহ (رضي الله عنها)-এর নামে মিথ্যা অপবাদ রটনায় জড়িত, তখন তিনি শপথ করলেন, আমি তার জন্য আর কোন কিছুই খরচ করব না। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৭৫৭, সহীহ মুসলিম হা: ২৪৮৮)
মিসতাহ একজন গরীব মুহাজির সাহাবী ছিলেন। আত্মীয়তার দিক থেকে তিনি আবূ বকর (রাঃ) এর খালাত ভাই ছিলেন। এ জন্য তিনি তার তত্ত্বাবধান ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। যখন সে অপবাদের সাথে জড়িত হয়ে যায় তখন আবূ বকর (রাঃ) এ শপথ করে বসেন।
উক্ত আয়াতে মূলত মন্দ কাজে শপথ গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্য থেকে যারা প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন এমন অঙ্গীকারাবদ্ধ না হয় যে, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন এবং যারা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় হিজরত করেছে তাদেরকে কোন কিছুই দান করবে না। বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি আরো সদয় হওয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যদি তাদের প্রতি সদয় হও, যদি তাদেরকে ক্ষমা কর তাহলে আল্লাহ তা‘আলাও তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা সতী-সাধ্বী, মু’মিন, অশ্লীলতার ব্যাপারে বেখবর তাদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দিবে, তারা দুনিয়া ও আখিরাতে লা‘নতপ্রাপ্ত। যেমনটি অত্র সূরার প্রথম দিকে ৪ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যারা এরূপ সতী-সাধ্বী স্ত্রীদের নামে অপবাদ রটনা করবে তারা তো অভিশপ্ত, এমনকি তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো কাল কিয়ামাতের মাঠে তাদের বিরুদ্ধে এ সকল কাজের জন্য সাক্ষ্য প্রদান করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلٰٓي أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَآ أَيْدِيْهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ)
“আজ আমি এদের মুখে মোহর মেরে দেব, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে যা তারা করত সে সম্পর্কে।” (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৬৫)
আনাস বিন মালিক (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট ছিলাম। তখন তিনি হেসে দিলেন। তিনি বললেন, তোমরা কি জান কিসে আমাকে হাসাল? আমরা বললাম, আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তখন তিনি বললেন: কিয়ামতের দিনে বান্দা তার রবের সাথে ঝগড়া করবে; এ দৃশ্য আমাকে হাসাল। সে বলবে, হে আমার রব! আপনি কি আমাকে জুলুম হতে বিরত রাখেননি? আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, হ্যাঁ। তখন সে বলবে: আমি আমার সাক্ষ্য ব্যতীত আর কারো সাক্ষ্যকে আমার জন্য যথেষ্ট মনে করি না। তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, আজকের দিনে তোমার সাক্ষ্যই তোমার জন্য যথেষ্ট। তবে সম্মানিত লেখকগণ এ ব্যাপারে সাক্ষী। তখন তার মুখে মোহর মেরে দেয়া হবে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে বলা হবে কথা বল, তখন তারা তার সকল কিছুই প্রকাশ করে দিবে। তখন সে বলবে: তোমরা ধ্বংস হও। তোমাদের পক্ষ থেকেই তো আমি বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলাম। (সহীহ মুসলিম হা: ২২৮০)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সেদিন প্রত্যেককে তার কর্মফল পুরোপুরি দেয়া হবে। কারো প্রতি কোন প্রকার কম করা হবে না। এবং কারো প্রতি কোন জুলুমও করা হবে না।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কোন বিষয়ে সংবাদ পাওয়া মাত্রই তা রটিয়ে দেয়া যাবে না, বিশেষ করে যদি সেটা কারো জন্য কোন লজ্জাজনক বা অপমানকর বিষয় হয়।
২. মু’মিনগণ সর্বদা নিজেদের ব্যাপারে ভাল ধারণা পোষণ করবে, কারো সম্পর্কে কোন মন্দ ধারণা পোষণ করবে না।
৩. ব্যভিচারের ক্ষেত্রে চারজন সাক্ষী না মিললে ব্যভিচারের অভিযোগ করা যাবে না।
৪. কোন মন্দ কাজের ব্যাপারে শপথ করা যাবে না। যদি করা হয় তাহলে যখনই জানা যাবে যে, এটি ঠিক নয়, তখনই তা থেকে ফিরে এসে শপথ ভঙ্গের কাফফারা দিতে হবে।
৫. কারো দোষ-ত্র“টি অন্বেষণ করা যাবে না এবং তা প্রকাশও করা যাবে না।
৬. শয়তানের অনুসরণ করা যাবে না। কারণ শয়তান কখনো ভাল কাজের নির্দেশ প্রদান করে না।
৭. মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিয়ামতের মাঠে সাক্ষ্য প্রদান করবে।
৮. মানুষের প্রতি কোন জুলুম করা হবে না।
৯. মানুষ কিয়ামতের মাঠে তাদের রবের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবে।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# হযরত আয়েশার (রাঃ) বিরুদ্ধে যে অপবাদ রটানো হয়েছিল সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ অপবাদকে “ইফ্ক” শব্দের মাধ্যমে উল্লেখ করে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই এ অপরাধকে পুরোপুরি খণ্ডন করা হয়েছে। ‘ইফ্ক’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, কথা উল্টে দেয়া, বাস্তব ঘটনাকে বিকৃত করে দেয়া। এ অর্থের দিক দিয়ে এ শব্দটিকে ডাহা মিথ্যা ও অপবাদ দেয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। আর কোন দোষারোপ অর্থে শব্দটি ব্যবহার করলে তখন এর অর্থ হয় সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ।
এ সূরাটি নাযিলের মূলে যে ঘটনাটি আসল কারণ হিসেবে কাজ করেছিল এখান থেকে তার ওপর আলোচনা শুরু হয়েছে। ভূমিকায় এ সম্পর্কিত প্রারম্ভিক ঘটনা আমি হযরত আয়েশার বর্ণনার মাধ্যমে উদ্ধৃত করেছি। পরবর্তী ঘটনাও তাঁরই মুখে শুনুন। তিনি বলেনঃ “এ মিথ্যা অপবাদের গুজব কমবেশি এক মাস ধরে সারা শহরে ছড়াতে থাকে। নবী ﷺ মারাত্মক ধরনের মানসিক কষ্টে ভুগতে থাকেন। আমি কাঁদতে থাকি। আমার বাপ-মা চরম পেরেশানী ও দুঃখে-শোকে ভুগতে থাকেন। শেষে একদিন রসূলুল্লাহ্ ﷺ আসেন এবং আমার কাছে বসেন। এ সমগ্র সময়-কালে তিনি কখনো আমার কাছে বসেননি। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও উম্মে রুমান (হযরত আয়েশার মা) অনুভব করেন আজ কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকর কথা হবে। তাই তাঁরা দু’জনেও কাছে এসে বসেন। রসূলুল্লাহ্ ﷺ বলেন, আয়েশা! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এই খবর পৌঁছেছে। যদি তুমি নিরপরাধ হয়ে থাকো তাহলে আশা করা যায় আল্লাহ তোমার অপরাধ মুক্তির কথা প্রকাশ করে দেবেন। আর যদি তুমি সত্যিই গোনাহে লিপ্ত হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহর কাছে তাওবা করো এবং ক্ষমা চাও। বান্দা যখন তার গোনাহ স্বীকার করে নিয়ে তাওবা করে তখন আল্লাহ তা মাফ করে দেন। একথা শুনে আমার চোখের পানি শুকিয়ে যায়। আমি আমার পিতাকে বলি, আপনি রসূলুল্লাহর কথার জবাব দিন। তিনি বলেনঃ “মা, আমি কিছু বুঝতে পারছিনা, কি বলবো।” আমি আমার মাকে বললাম, “তুমিই কিছু বলো” তিনিও একই কথা বলেন, “আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না।” একথায় আমি বলি, আপনাদের কানে একটা কথা এসেছে এবং তা মনের মধ্যে জমে বসে গেছে। এখন আমি যদি বলি, আমি নিরপরাধ এবং আল্লাহ সাক্ষী আছেন আমি নিরপরাধ— তাহলে আপনারা তা মেনে নেবেন না। আর যদি এমন একটি কথা আমি স্বীকার করে নিই যা আমি করিনি— আর আল্লাহ জানেন আমি করিনি— তাহলে আপনারা তা মেনে নেবেন। আমি সে সময় হযরত ইয়াকুবের (আঃ) নাম স্মরণ করার চেষ্টা করি কিন্তু নামটি মনে করতে পারিনি। শেষে আমি বলি, এ অবস্থায় আমার জন্য এছাড়া আর কি উপায় থাকে যে, আমি সেই একই কথা বলি যা হযরত ইউসুফের বাপ বলেছিলেন فَصَبْرٌ جَمِيلٌ (এখানে সে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যখন হযরত ইয়াকুবের সামনে তার ছেলে বিন ইয়াইমিনের বিরুদ্ধে চুরির অপবাদের কথা বর্ণনা করা হয়েছিলঃ সূরা ইউসুফ ১০ রুকূ’তে একথা আলোচিত হয়েছে)। একথা বলে আমি শুয়ে পড়ি এবং অন্যদিকে পাশ ফিরি। সে সময় আমি মনে মনে বলছিলাম, আল্লাহ জানেন আমি গোনাহ করিনি, তিনি নিশ্চয়ই সত্য প্রকাশ করে দেবেন। যদিও একথা আমি কল্পনাও করিনি যে, আমার স্বপক্ষে অহী নাযিল হবে এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত পঠিত হতে থাকবে। আল্লাহ নিজেই আমার পক্ষ সমর্থন করবেন। এ থেকে নিজেকে আমি অনেক নিম্নতর মনে করতাম। কিন্তু আমার ধারণা ছিল, রসূলুল্লাহ ﷺ কোন স্বপ্ন দেখবেন, যার মাধ্যমে আল্লাহ আমার নির্দোষিতার কথা জানিয়ে দেবেন। এরই মধ্যে রসূলুল্লাহ্র ﷺ ওপর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গেলো যা অহী নাযিল হবার সময় হতো, এমন কি ভীষণ শীতের দিনেও তাঁর মুবারক চেহারা থেকে মুক্তোর মতো স্বেদবিন্দু টপকে পড়তে থাকতো। আমরা সবাই চুপ করে গেলাম। আমি তো ছিলাম একদম নির্ভীক। কিন্তু আমার বাপ-মার অবস্থা ছিল যেন কাটলে শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্তও পড়বে না। তারা ভয় পাচ্ছিল, না জানি আল্লাহ কি সত্য প্রকাশ করেন। যখন সে অবস্থা খতম হয়ে গেলো তখন রসূলুল্লাহ্ ﷺ ছিলেন অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি হেসে প্রথমে যে কথাটি বলেন, সেটি ছিলঃ মুবারক হোক আয়েশা! আল্লাহ তোমার নির্দোষিতার কথা নাযিল করেছেন এবং এরপর নবী ﷺ দশটি আয়াত শুনান (অর্থাৎ ১১ নম্বর আয়াত থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত)। আমার মা বলেন ওঠো এবং রসূলুল্লাহ্র ﷺ প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। আমি বললাম, “আমি তাঁর প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো না, তোমাদের দু’জনের প্রতিও না। বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যিনি আমার নির্দোষিতার কথা নাযিল করেছেন। তোমরা তো এ মিথ্যা অপবাদ অস্বীকারও করোনি।” (উল্লেখ্য, এটি কোন একটি বিশেষ হাদীসের অনুবাদ নয় বরং হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে এ সম্পর্কিত যতগুলো বর্ণনা হযরত আয়েশার (রাঃ) উদ্ধৃত হয়েছে সবগুলোর সার নির্যাস আমি এখানে পরিবেশন করেছি)।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি সূক্ষ্ম কথা অনুধাবন করতে হবে। হযরত আয়েশার (রাঃ) নিরপরাধ হবার কথা বর্ণনা করার আগে পুরো একটি রুকূ’তে যিনা, কাযাফ ও লি’আনের বিধান বর্ণনা করে মহান আল্লাহ প্রকৃতপক্ষে এ সত্যটির ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে দিয়েছেন যে, যিনার অপবাদ দেবার ব্যাপারটি কোন ছেলেখেলা নয়, নিছক কোন মাহফিলে হাস্যরস সৃষ্টি করার জন্য একে ব্যবহার করা যাবে না। এটি একটি মারাত্মক ব্যাপার। অপবাদদাতার অপবাদ যদি সত্য হয় তাহলে তাকে সাক্ষী আনতে হবে। যিনাকারী ও যিনাকারীনীকে ভয়াবহ শাস্তি দেয়া হবে। আর অপবাদ যদি মিথ্যা হয় তাহলে অপবাদদাতা ৮০ ঘা বেত্রাঘাত লাভের যোগ্য, যাতে ভবিষ্যতে সে আর এ ধরনের কোন কাজ করার দুঃসাহস না করে। এ অভিযোগ যদি স্বামী দিয়ে থাকে তাহলে আদালতে লি’আন করে তাকে ব্যাপারটি পরিষ্কার করে নিতে হবে। একথাটি একবার মুখে উচ্চারণ করে কোন ব্যক্তি ঘরে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে না। কারণ এটা হচ্ছে একটা মুসলিম সমাজ। সারা দুনিয়ায় কল্যাণ ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য এ সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এখানে যিনা কোন আনন্দদায়ক বিষয়ে পরিণত হতে পারে না এবং এর আলোচনাও হাস্য রসালাপের বিষয়বস্তুতে পরিণত হতে পারে না।
# হাদীসে মাত্র কয়েকজন লোকের নাম পাওয়া যায়। তারা এ গুজবটি ছড়াচ্ছিল। তারা হচ্ছে আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই, যায়েদ ইবনে রিফা’আহ (এ ব্যক্তি সম্ভবত রিফা’আ ইবনে যায়েদ ইহুদী মুনাফিকের ছেলে), মিস্তাহ ইবনে উসামাহ, হাস্সান ইবনে সাবেত ও হামনা বিনতে জাহশ। এর মধ্যে প্রথম দু’জন ছিল মুনাফিক এবং বাকি তিনজন মু’মিন। মু’মিন তিন জন বিভ্রান্তি ও দুর্বলতার কারণে এ চক্রান্তের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরা ছাড়া আর যারা কমবেশী এ গোনাহে জড়িয়ে পড়েছিলেন তাদের নাম হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে আমার নজরে পড়েনি।
# এর অর্থ হচ্ছে ভয় পেয়ো না। মুনাফিকরা মনে করছে তারা তোমাদের ওপর একটা বিরাট আঘাত হেনেছে। কিন্তু ইনশাআল্লাহ্ এটি উল্টো তাদের ওপরই পড়বে এবং তোমাদের জন্য ভালো প্রমাণিত হবে। যেমন আমি ইতিপূর্বে ভূমিকায় বর্ণনা করে এসেছি, মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্বের যে আসল ময়দান ছিল মুনাফিকরা সেখানেই তাদেরকে পরাস্ত করার জন্য এ প্রপাগাণ্ডা শুরু করে। অর্থাৎ নৈতিকতার ময়দান। এখানে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করার কারণে তারা প্রত্যেকটি ময়দানে নিজেদের প্রতিপক্ষের ওপর বিজয় লাভ করে চলছিল। আল্লাহ তাকেও মুসলমানদের কল্যাণের উপকরণে পরিণত করে দিলেন। এ সময় একদিকে নবী ﷺ , অন্যদিকে হযরত আবু বকর ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং তৃতীয় দিকে সাধারণ মু’মিনগন যে কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেন তা থেকে একথা দিবালোকের মতো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, তাঁরা অসৎকর্ম থেকে কত দূরে অবস্থান করেন, কতটা সংযম ও সহিষ্ণুতার অধিকারী, কেমন ন্যায়নিষ্ঠ ও কি পরিমাণ ভদ্র ও রুচিশীল মানসিকতার ধারক। নবী ﷺ এর ইজ্জতের ওপর যারা আক্রমণ চালিয়েছিল তাঁর একটি মাত্র ইঙ্গিতই তাদের শিরচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট ছিল, কিন্তু এক মাস ধরে তিনি সবরের সাথে সবকিছু বরদাশ্ত করতে থাকেন এবং আল্লাহর হুকুম এসে যাবার পর কেবলমাত্র যে তিনজন মুসলমানের বিরুদ্ধে কাযাফ তথা যিনার মিথ্যা অপবাদের অপরাধ প্রমাণিত ছিল তাদের ওপর ‘হদ’ জারি করেন। এরপরও তিনি মুনাফিকদেরকে কিছুই বলেননি। হযরত আবু বকরের নিজের আত্মীয়, যার নিজের ও পরিবারের ভরণপোষন তিনি করতেন, সেও তাঁদের কলিজায় তীর বিঁধিয়ে দিতে থাকে কিন্তু এর জবাবে আল্লাহর এ নেক বান্দাটি না তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেন, না তার পরিবার-পরিজনকে সাহায্য-সহায়তা দেয়া বন্ধ করেন। নবীর পবিত্র স্ত্রীগণের একজনও সতীনের দুর্নাম ছড়াবার কাজে একটুও অংশ নেননি। বরং কেউ এ অপবাদের প্রতি নিজের সামান্যতমও সন্তোষ, পছন্দ অথবা মেনে নেয়ার মনোভাবও প্রকাশ করেননি। এমনিক হযরত যয়নবের সহোদর বোন হাম্না বিনতে জাহ্শ নিছক নিজের বোনের জন্য তার সতীনের দুর্নাম রটাচ্ছিলেন কিন্তু তিনি স্বয়ং সতীনের পক্ষে ভালো কথাই বলেন। হযরত আয়েশার নিজের বর্ণনা, রসূলের স্ত্রীগণের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আড়ি চলতো আমার যয়নবের সাথে। কিন্তু “ইফ্ক”-এর ঘটনা প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ্ ﷺ যখন তাকে জিজ্ঞেস করেন, আয়েশা সম্পর্কে তুমি কি জানো? তখন এর জবাবে তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম, আমি তার মধ্যে ভালো ছাড়া আর কিছুই জানি না। হযরত আয়েশার নিজের ভদ্রতা ও রুচিশীলতার অবস্থা এই ছিল যে, হযরত হাস্সান ইবনে সাবেত তাঁর দূর্নাম রটাবার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করেন কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি সবসময় তাঁর প্রতি সম্মান ও বিনয়পূর্ণ ব্যবহার করেছেন। লোকেরা স্মরণ করিয়ে দেয়, ইনি তো সেই ব্যক্তি যিনি আপনার বিরুদ্ধে দুর্নাম রটিয়েছিলেন। কিন্তু এ জবাব দিয়ে তিনি তাদের মুখ বন্ধ করে দেন যে, এ ব্যক্তি ইসলামের শত্রু কবি গোষ্ঠীকে রসূলুল্লাহ্ ﷺ ও ইসলামের পক্ষ থেকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। এ ঘটনার সাথে যাদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল এ ছিল তাদের অবস্থা। আর সাধারণ মুসলমানদের মানসিকতা কতদূর পরিচ্ছন্ন ছিল তা এ ঘটনা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর স্ত্রী যখন তাঁর কাছে এ গুজবগুলোর কথা বললেন তখন তিনি বলেন, “আইয়ুবের মা! যদি সে সময় আয়েশার জায়গায় তুমি হতে, তাহলে তুমি কি এমন কাজ করতে?” তিনি বলেন, “আল্লাহর কসম, আমি কখনো এমন কাজ করতাম না।” হযরত আবু আইয়ুব বলেন, “তাহলে আয়েশা তোমার চেয়ে অনেক বেশী ভাল। আর আমি বলি কি, যদি সাফওয়ানের জায়গায় আমি হতাম, তাহলে এ ধরনের কথা কল্পনাই করতে পারতাম না। সফওয়ান তো আমার চেয়ে ভালো মুসলমান।” এভাবে মুনাফিকরা যা কিছু চেয়েছিল ফল হলো তার একেবারে উল্টো এবং মুসলমানদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব আগের তুলনায় আরো বেশী সুস্পষ্ট হয়ে গেল।
এছাড়া এ ঘটনার মধ্যে কল্যাণের আর একটি দিকও ছিল। সেটি ছিল এই যে, এ ঘটনাটি ইসলামের আইন-কানুন, বিধি-বিধান ও তামাদ্দুনিক নীতি-নিয়মের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের উপলক্ষ্যে পরিণত হয়। এর বদৌলতে মুসলমানরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব নির্দেশ লাভ করে যেগুলো কার্যকর করে মুসলিম সমাজকে চিরকালের জন্য অসৎকর্মের উৎপাদন ও সেগুলোর সম্প্রসারণ থেকে সংরক্ষিত রাখা যেতে পারে আর অসৎকর্ম উৎপাদিত হয়ে গেলেও যথাসময়ে তার পথ রোধ করা যেতে পারে।
এছাড়াও এর মধ্যে কল্যাণের আর একটি দিকও ছিল। মুসলমানরা সকলেই একথা ভালোভাবে জেনে যায় যে, নবী ﷺ অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী নন। যা কিছু আল্লাহ জানান তাই তিনি জানেন। এর বাইরে তাঁর জ্ঞান ততটুকুই যতটুকু জ্ঞান একজন মানুষের থাকতে পারে। একমাস পর্যন্ত হযরত আয়েশার (রাঃ) ব্যাপারে তিনি ভীষণ পেরেশান থাকেন। কখনো চাকরানীকে জিজ্ঞেস করতেন, কখনো পবিত্র স্ত্রীগণকে, কখনো হযরত আলীকে (রাঃ), কখনো হযরত উসামাকে (রাঃ)। শেষ পর্যন্ত হযরত আয়েশাকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেও এভাবে জিজ্ঞেস করেন যে, যদি তুমি এ গোনাহটি করে থাকো, তাহলে তাওবা করো আর না করে থাকলে আশা করা যায় আল্লাহ তোমার নিরপরাধ হওয়া প্রমাণ করে দেবেন। যদি তিনি অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী হতেন তাহলে এ পেরেশানী, এ জিজ্ঞাসাবাদ এবং এ তাওবার উপদেশ কেন? তবে আল্লাহর অহী যখন সত্য কথা জানিয়ে দেয় তখন সারা মাসে তিনি যা জানতেন না তা জানতে পারেন। এভাবে আকীদার অন্ধ আবেগের বশবর্তী হয়ে সাধারণত লোকেরা নিজেদের নেতৃবর্গের ব্যাপারে যে বাড়াবাড়ি ও আতিশয্যের শিকার হয়ে থাকে তা থেকে আল্লাহ সরাসরি অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বাঁচার ব্যবস্থা করেন। বিচিত্র নয়, এক মাস পর্যন্ত অহী না পাঠাবার পেছনে আল্লাহর এ উদ্দেশ্যটাও থেকে থাকবে। প্রথম দিনেই অহী এসে গেলে এ ফায়দা লাভ করা যেতে পারতো না।
# আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই। সে ছিল এ অপবাদটির মূল রচয়িতা এবং এ কদর্য প্রচারাভিযানের আসল নায়ক। কোন কোন হাদীসে ভুলক্রমে হযরত হাস্সান ইবনে সাবেতকে (রাঃ) এ আয়াতের লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এটা মূলত বর্ণনাকারীদের নিজেদেরই বিভ্রান্তির ফল। নয়তো হযরত হাস্সানের (রাঃ) দুর্বলতা এর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না যে, তিনি মুনাফিকদের ছড়ানো এ ফিত্নায় জড়িয়ে পড়েন। হাফেয ইবনে কাসীর যথার্থ বলেছেন, এ হাদীসটি যদি বুখারী শরীফে উদ্ধৃত না হতো, তাহলে এ প্রসঙ্গটি আলোচনাযোগ্যই হতো না। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় মিথ্যা অপবাদ হচ্ছে এই যে, বনী উমাইয়াহ হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে এ আয়াতের লক্ষ্য মনে করে। বুখারী, তাবারানী ও বাইহাকীতে হিশাম ইবনে আবদুল মালিক উমুবীর উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে الَّذِى تَوَلَّى كِبْرَهُ অর্থ হচ্ছে আলী ইবনে আবু তালেব। অথচ এ ফিত্নায় হযরত আলীর (রাঃ) গোড়া থেকেই কোন অংশ ছিল না। ব্যাপার শুধু এতটুকু ছিল, যখন তিনি নবী ﷺ কে খুব বেশী পেরেশান দেখেন, তখন নবী ﷺ তাঁর কাছে পরামর্শ চাওয়ায় তিনি বলেন, আল্লাহ এ ব্যাপারে আপনাকে কোন সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ রাখেননি, বহু মেয়ে আছে, আপনি চাইলে আয়েশাকে তালাক দিয়ে আর একটি বিয়ে করতে পারেন। এর অর্থ কখনোই এটা ছিল না যে, হযরত আয়েশার বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হচ্ছিল হযরত আলী তাকে সত্য বলেছিলেন। বরং শুধুমাত্র নবী ﷺ এর পেরেশানী দূর করাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
# অন্য একটি অনুবাদ এও হতে পারে, নিজেদের লোকদের অথবা নিজেদের সমাজের লোকদের ব্যাপারে ভালো ধারণা করোনি কেন? আয়াতের শব্দাবলী দু’ধরনের অর্থের অবকাশ রাখে। আর এ দ্ব্যর্থবোধক বাক্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে একটি গভীর তত্ত্ব। এটি ভালোভাবে অনুধাবন করতে হবে। হযরত আয়েশা (রাঃ) ও সাফ্ওয়ান ইবনে মু’আত্তালের (রাঃ) মধ্যে যে ব্যাপারটি ঘটে গিয়েছিল তা তো এই ছিল যে, কাফেলার এক ভদ্র মহিলা (তিনি নবী পত্নী ছিলেন একথা বাদ দিলেও) ঘটনাক্রমে পেছনে থেকে গিয়েছিলেন। আর কাফেলারই এক ব্যক্তি যিনি ঘটনাক্রমে পেছনে থেকে গিয়েছিলেন, তিনি তাঁকে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। এখন যদি কেউ বলে, নাউযুবিল্লাহ্ এরা দু’জন নিজেদেরকে একান্তে পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হয়ে গেছেন, তাহলে তার একথার বাহ্যিক শব্দাবলীর আড়ালে আরো দু’টো কাল্পনিক কথাও রয়ে গেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, বক্তা (পুরুষ হোক বা নারী) যদি নিজেই ঐ জায়গায় হতেন, তাহলে কখনোই গোনাহ না করে থাকতেন না। কারণ তিনি যদি গোনাহ থেকে বিরত থেকে থাকেন তাহলে এটা শুধু এজন্য যে, বিপরীত লিংগের কেউ এ পর্যন্ত এভাবে একান্তে তার নাগালে আসেনি নয়তো এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাবার লোক তিনি নন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যে সমাজের তিনি একজন সদস্য, তার নৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তার ধারণা হচ্ছে, এখানে এমন একজন নারী ও পুরুষ নেই যিনি এ ধরনের সুযোগ পেয়ে গোনাহে লিপ্ত হননি। এতো শুধুমাত্র তখনকার ব্যাপার যখন বিষয়টি নিছক একজন পুরুষ ও একজন নারীর সাথে জড়িত থাকে। আর ধরুন যদি সে পুরুষ ও নারী উভয়ই এক জায়গার বাসিন্দা হন এবং যে মহিলাটি ঘটনাক্রমে কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন তিনি ঐ পুরুষটির কোন বন্ধু, আত্মীয় বা প্রতিবেশীর স্ত্রী, বোন বা মেয়ে হয়ে থাকেন তাহলে ব্যাপারটি আরো গুরুতর হয়ে যায়। এক্ষেত্রে এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, বক্তা নিজেই নিজের ব্যক্তি সত্ত্বা সম্পর্কেও এমন জঘন্য ধারণা পোষণ করেন যার সাথে ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের দূরতম সম্পর্কও নেই। কে এমন সজ্জন আছেন যিনি একথা চিন্তা করতে পারেন যে, তার কোন বন্ধু, প্রতিবেশী বা পরিচিত ব্যক্তির গৃহের কোন মহিলার সাথে বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তার পথে দেখা হয়ে যাবে এবং প্রথম অবস্থায়ই তিনি তার ইজ্জত লুটে নেবার কাজ করবেন তারপর তাকে গৃহে পৌঁছিয়ে দেবার কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু এখানে তো ব্যাপার ছিল এর চেয়ে হাজার গুণ গুরুতর মহিলা অন্য কেউ ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ ﷺ এর স্ত্রী, যাঁদেরকে প্রত্যেকটি মুসলমান নিজের মায়ের চেয়েও বেশী সম্মানের যোগ্য মনে করতো এবং যাঁদেরকে আল্লাহ নিজেই প্রত্যেক মুসলমানের ওপর নিজের মায়ের মতই হারাম গণ্য করেছিলেন। পুরুষটি কেবলমাত্র ঐ কাফেলার একজন সদস্য, ঐ সেনাদলের একজন সৈন্য এবং ঐ শহরের একজন অধিবাসীই ছিলেন না বরং তিনি মুসলমানও ছিলেন। ঐ মহিলার স্বামীকে তিনি আল্লাহর রসূল এবং নিজের নেতা ও পথপ্রদর্শক বলে মেনে নিয়েছিলেন আর তাঁর হুকুমে প্রাণ উৎসর্গ করে দেয়ার জন্য বদরের যুদ্ধের মতো ভয়াবহ জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন। এ অবস্থায় তো এ উক্তির মানসিক প্রেক্ষাপট জঘন্যতার এমন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যার চেয়ে নোংরা ও ঘৃণা কোন প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তাই করা যায় না। তাই মহান আল্লাহ বলছেন, মুসলিম সমাজের যেসব ব্যক্তি একথা তাদের কণ্ঠে উচ্চারণ করেছে অথবা কমপক্ষে একে সন্দেহযোগ্য মনে করেছে তারা নিজেদের মন-মানসিকতারও খুবই খারাপ ধারণা দিয়েছে এবং নিজেদের সমাজের লোকদেরকেও অত্যন্ত হীন চরিত্র ও নিকৃষ্ট নৈতিকবৃত্তির অধিকারী মনে করেছে।
# একথাতো বিবেচনার যোগ্যই ছিল না। একথা শোনার সাথে সাথেই প্রত্যেক মুসলমানের একে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার, মিথ্যা ও বানোয়াট কথা ও অপবাদ আখ্যা দেয়া উচিত ছিল। সম্ভবত কেউ এখানে প্রশ্ন করতে পারে, একথাই যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে স্বয়ং রসূলুল্লাহ্ ﷺ ও আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুই বা প্রথম দিনই একে মিথ্যা বলে দিলেন না কেন? কেন তারা একে এতটা গুরুত্ব দিলেন? এর জবাব হচ্ছে, স্বামী ও পিতার অবস্থা সাধারণ লোকদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের হয়। যদিও স্ত্রীকে স্বামীর চেয়ে বেশী কেউ চিনতে বা জানতে পারে না এবং একজন সৎ, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত স্ত্রী সম্পর্কে কোন সুস্থ বুদ্ধি সম্পন্ন স্বামী লোকদের অপবাদের কারণে খারাপ ধারণা করতে পারে না, তবুও যদি তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া হয় তাহলে তখন সে এমন এক ধরনের সংকটের মুখোমুখি হয় যার ফলে সে একে মিথ্যা অপবাদ বলে প্রত্যাখ্যান করলে প্রচারণাকারীদের মুখ বন্ধ হবে না বরং তারা নিজেদের কণ্ঠ আরো এক ডিগ্রী উঁচুতে চড়িয়ে বলতে থাকবে, দেখো, বউ কেমন স্বামীর বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সবকিছু করে যাচ্ছে আর স্বামী মনে করছে আমার স্ত্রী বড়ই সতী সাধ্বী। এ ধরনের সংকট মা-বাপের ক্ষেত্রেও দেখা দেয়। সে বেচারারা নিজেদের মেয়ের সতীত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদের প্রতিবাদে যদি মুখ খোলেও তাহলে মেয়ের অবস্থান পরিষ্কার হয় না। প্রচারণাকারীরা একথাই বলবে, মা-বাপ তো, কাজেই নিজের মেয়ের পক্ষ সমর্থন করবে না তো আর কি করবে। এ জিনিসটিই রসূলুল্লাহ্ ﷺ এবং হযরত আবু বকর ও উম্মে রুমানকে ভিতরে ভিতরে শোকে-দুঃখে জর্জরিত ও বিহবল করে চলছিল। নয়তো আসলে তাদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। রসূলুল্লাহ্ ﷺ তো তাঁর ভাষণে পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, আমি আমার স্ত্রীর মধ্যে কোন খারাপ জিনিস দেখিনি এবং যে ব্যক্তির সম্পর্কে এ অপবাদ দেয়া হচ্ছে তার মধ্যেও না।
# “আল্লাহর কাছে” অর্থাৎ আল্লাহর আইনে অথবা আল্লাহর আইন অনুযায়ী। নয়তো আল্লাহ তো জানতেন ঐ অপবাদ ছিল মিথ্যা। তারা সাক্ষী আনেনি বলেই তা মিথ্যা, আল্লাহর কাছে তার মিথ্যা হবার জন্য এর প্রয়োজন নেই। এখানে যেন কেউ এ ভুল ধারণার শিকার না হন যে, এক্ষেত্রে নিছক সাক্ষীদের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতিকে অপবাদের মিথ্যা হবার যুক্তি ও ভিত্তি গণ্য করা হচ্ছে এবং মুসলমানদের বলা হচ্ছে যেহেতু অপবাদদাতা চার জন্য সাক্ষী আনেনি তাই তোমরাও শুধুমাত্র এ কারণেই তাকে সুস্পষ্ট মিথ্যা অপবাদ গণ্য করো। বাস্তবে সেখানে যা ঘটেছিল, তার প্রতি দৃষ্টি না দিলে এ ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়। অপবাদদাতারা এ কারণে অপবাদ দেয়নি যে, তারা তাদের মুখ দিয়ে যা কিছু বলে যাচ্ছিল তারা সবাই বা তাদের কোন একজন স্বচক্ষে তা দেখেছিল। বরং হযরত আয়েশা (রাঃ) কাফেলার পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন এবং হযরত সাফ্ওয়ান পরে তাঁকে নিজের উটের পিঠে সওয়ার করে কাফেলার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন শুধুমাত্র এরই ভিত্তিতে তারা এতবড় অপবাদ তৈরী করে ফেলেছিল। কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তি এ অবস্থায় হযরত আয়েশার এভাবে পিছনে থেকে যাওয়াকে নাউযুবিল্লাহ্ কোন ষড়ষন্ত্রের ফল ছিল বলে ভাবতে পারতেন না। সেনা প্রধানের স্ত্রী চুপিচুপি কাফেলার পিছনে এ ব্যক্তির সাথে থেকে যাবে তারপর ঐ ব্যক্তিই তাকে নিজের উটের পিঠে বসিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে ঠিক দুপুরের সময় সবার চোখের সামনে দিয়ে সেনা ছাউনিতে পৌঁছে যাবে, কোন ষড়যন্ত্রকারী এভাবে ষড়যন্ত্র করে না। স্বয়ং এ অবস্থাটাই তাদের উভয়ের নিরাপরাধ নিষ্পাপ হওয়ার প্রমাণ পেশ করছে। এ অবস্থায় যদি অপবাদদাতারা নিজেদের চোখে কোন ঘটনা দেখতো তাহলে কেবলমাত্র তারই ভিত্তিতে অপবাদ দিতে পারতো। অন্যথায় যেসব লক্ষণের ওপর কুচক্রীরা অপবাদের ভিত্তি রেখেছিল সেগুলোর ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
# এ আয়াতগুলো এবং বিশেষ করে আল্লাহর এ বাণী “মু’মিন পুরুষ ও নারীরা নিজেদের লোকদের সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করে না কেন” থেকে এ মূলনীতির উৎপত্তি হয় যে, মুসলিম সমাজে সকল ব্যবহারিক বিষয়ের ভিত্তি সুধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। কুধারণা কেবলমাত্র এমন অবস্থায় পোষণ করা উচিত যখন তার জন্য কোন ইতিবাচক ও প্রমাণসূচক ভিত্তি থাকবে। এ ব্যাপারে নীতি হচ্ছেঃ প্রত্যেক ব্যক্তি নির্দোষ, যতক্ষণ তার অপরাধী হবার বা তার প্রতি অপরাধের সন্দেহ করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকে আর প্রত্যেক ব্যক্তিই সত্যবাদী, যতক্ষণ তার অনির্ভরযোগ্য হবার কোন প্রমাণ না থাকে।
# পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আয়াতের প্রত্যক্ষ অর্থ হচ্ছে, যারা এ ধরনের অপবাদ তৈরী করে ও তা প্রচার করে মুসলিম সমাজে চরিত্রহীনতার প্রসার ঘটাবার এবং উম্মতে মুসলিমার চরিত্র হননের চেষ্টা করছে তারা শাস্তি লাভের যোগ্য। কিন্তু আয়াতের শব্দাবলী অশ্লীলতা ছড়াবার যাবতীয় অবস্থার অর্থবোধক। কার্যত ব্যভিচারে আড্ডা কায়েম করার ওপরও এগুলো প্রযুক্ত হয়। আবার চরিত্রহীনতাকে উৎসাহিত করা এবং সেজন্য আবেগ-অনুভূতিকে উদ্দীপিত ও উত্তেজিতকারী কিস্সা-কাহিনী, কবিতা, গান, ছবি ও খেলাধূলার ওপরও প্রযুক্ত হয়। তাছাড়া এমন ধরনের ক্লাব, হোটেল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এর আওতায় এসে যায় যেখানে নারী-পুরুষের মিলিত নৃত্য ও মিলিত আমোদ ফূর্তির ব্যবস্থা করা হয়। কুরআন পরিষ্কার বলছে, এরা সবাই অপরাধী। কেবল আখেরাতেই নয়, দুনিয়ায়ও এদের শাস্তি পাওয়া উচিত। কাজেই অশ্লীলতার এসব উপায়-উপকরণের পথ রোধ করা একটি ইসলামী রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। কুরআন এখানে যে সমস্ত কাজকে জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধ গণ্য করছে এবং যেগুলো সম্পাদনকারীকে শাস্তিলাভের যোগ্য বলে ফায়সালা দিচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্রের দণ্ডবিধি আইনে সে সমস্ত কাজ শাস্তিযোগ্য ও পুলিশের হস্তক্ষেপ লাভের উপযোগী হতে হবে।
# তোমরা জানো না এ ধরনের এক একটি কাজের প্রভাব সমাজে কোথায় কোথায় পৌঁছে যায়, কত লোক এগুলোতে প্রভাবিত হয় এবং সামষ্টিকভাবে এর কি পরিমাণ ক্ষতি সমাজ জীবনকে বরদাশত করতে হয়। এ বিষয়টি আল্লাহই খুব ভালোভাবে জানেন। কাজেই আল্লাহর ওপর নির্ভর করো ও দাবিয়ে দেবার চেষ্টা কর। এগুলো ছোট ছোট বিষয় নয় যে, এগুলোর প্রতি উদারতা প্রদর্শন করতে হবে। আসলে এগুলো অনেক বড় বিষয়। কাজেই যারা এসব কাজ করবে তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত।
# শয়তান তো তোমাদের গায়ে অসৎকাজের নাপাকী মাখিয়ে দেবার জন্য এমন উন্মুখ হয়ে বসে আছে যে, যদি আল্লাহ নিজেই অনুগ্রহ ও দয়া করে তোমাদের সততা ও অসততার পার্থক্য না শেখান এবং তোমাদের সংশোধনের শিক্ষা ও সুযোগ লাভের সৌভাগ্য দান না করেন, তাহলে তোমাদের একজনও নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের জোরে পবিত্র ও পাপ-পংকিলতা থেকে মুক্ত হতে পারো না।
# আল্লাহ চোখ বন্ধ করে, আন্দাজে যাকে তাকে পবিত্রতা দান করেন না বরং নিজের নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে দান করেন। আল্লাহ জানেন কে কল্যাণ চায় এবং কে অকল্যাণ আকাংখী। প্রত্যেক ব্যক্তি একান্তে যেসব কথা বলে আল্লাহ তা সবই শুনে থাকেন। প্রত্যেক ব্যক্তি মনে মনে যা চিন্তা করে আল্লাহ তা থেকে মোটেই বেখবর থাকেন না। এ সরাসরি ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ ফায়সালা করেন, কাকে পবিত্রতা দান করবেন ও কাকে পবিত্রতা দান করবেন না।
# হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, ওপরে বর্ণিত আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহ যখন আমার নির্দোষিতার কথা ঘোষণা করেন তখন হযরত আবু বকর (রা.) কসম খেয়ে বসেন, তিনি আগামীতে মিস্তাহ ইবনে উসাসাকে সাহায্য করা বন্ধ করে দেবেন। কারণ মিস্তাহ আত্মীয়-সম্পর্কের কোন পরোয়া করেননি এবং তিনি সারা জীবন তার ও তার সমগ্র পরিবারের যে উপকার করে এসেছেন সেজন্য একটুও লজ্জা অনুভব করেননি। এ ঘটনায় এ আয়াত নাযিল হয় এবং এ আয়াত শুনেই হযরত আবু বকর (রা.) সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, بلى والله انا نحب ان تغفر لنا يا ربنا ‘আল্লাহর কসম, অবশ্যই আমরা চাই, হে আমাদের রব! তুমি আমাদের ভুল-ভ্রান্তি মাফ করে দেবে।’ কাজেই তিনি আবার মিস্তাহকে সাহায্য করতে থাকেন এবং এবার আগের চেয়ে বেশী করে করতে থাকেন। হযরত আবদুল্লাহু ইবনে আব্বাসের (রা.) বর্ণনা হচ্ছে, হযরত আবু বকর ছাড়া আর কয়েকজন সাহাবীও এ কসম খেয়েছিলেন যে, যারা মিথ্যা অপবাদ ছড়াতে অংশ নিয়েছিল তাদেরকে তাঁরা আর কোন সাহায্য-সহায়তা দেবেন না। এ আয়াতটি নাযিল হবার পর তারা সবাই নিজেদের কসম ভেঙ্গে ফেলেন। এভাবে এ ফিত্নার ফলে মুসলিম সমাজে যে তিক্ততার সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তা এক মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়। এখান একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, যদি কোন ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে তারপর সে জানতে পারতো এতে কোন কল্যাণ নেই এবং এর ফলে কসম ভেঙ্গে ফেলে যে বিষয়ে কল্যাণ আছে তা অবলম্বন করে, তাহলে এক্ষেত্রে তাকে কসম ভাঙ্গার কাফ্ফারা আদায় করতে হবে কি না। এক দল ফকীহ বলেন, কল্যাণের পথ অবলম্বন করাই কাফ্ফারা, এছাড়া আর কোন কাফ্ফারার প্রয়োজন নেই। তারা এ আয়াত থেকে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, আল্লাহ হযরত আবু বকরকে কসম ভেঙ্গে ফেলার হুকুম দেন এবং কাফ্ফারা আদায় করার হুকুম দেননি। এছাড়া নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত উক্তিটিকেও তারা যুক্তি হিসেবে পেশ করেনঃ مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ فرَأَى غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا فَلْيَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ وَذَالِك كَفَّارتُهُ- “যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে তারপর সে জানতে পারে অন্য বিষয়টি তার চেয়ে ভালো, এ অবস্থায় তার ভালো বিষয়টি গ্রহণ করা উচিত এবং এই ভালো বিষয়টি গ্রহণ করাই তার কাফ্ফারা।”
অন্য দলটি বলেন, কসম ভাঙ্গার জন্য আল্লাহ কুরআন মজীদে একটি পরিষ্কার ও স্বতন্ত্র হুকুম নাযিল করেছেন ( আল বাকারাহ ২২৫ ও আল মায়েদাহ ৮৯ আয়াত )। এ আয়াতটা ঐ হুকুম রহিত করেনি এবং পরিষ্কারভাব এর মধ্যে কোন সংশোধনও করেনি। কাজেই ঐ হুকুম স্বস্থানে অপরিবর্তিত রয়েছে। আল্লাহ এখানে হযরত আবু বকরকে অবশ্যি কসম ভেঙ্গে ফেলতে বলেছেন কিন্তু তাঁকে তো এ কথা বলেননি যে, তোমার ওপর কোন কাফ্ফারা ওয়াজিব নয়। আর নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তিটির অর্থ হচ্ছে, শুধু এই যে, একটি ভুল ও অসঙ্গত বিষয়ের কসম খেয়ে ফেললে যে গুনাহ হয় সঠিক ও সঙ্গত পন্থা অবলম্বন তার অপনোদন হয়ে যায়। কসমের কাফ্ফারা রহিত করা এর উদ্দেশ্য নয়। বস্তুতঃ অন্য একটি হাদীস-এর ব্যাখ্যা করে দেয়। তাতে নবী করীম ﷺ বলেনঃ مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ فرَأَى غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا فَلْيَأْتِ الَّذِي هُوَ خَيْرٌ , وَلْيُكَفِّرْ عَنْ يَمِينِهِ- “যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম খেয়ে বসে তারপর সে জানতে পারে অন্য বিষয় তার চেয়ে ভালো, তার যে বিষয়টি ভালো সেটিই করা উচিত এবং নিজের কসমের কাফ্ফারা আদায় করা উচিত।” এ থেকে জানা যায়, কসম ভাঙ্গার কাফ্ফারা আলাদা জিনিস এবং ভালো কাজ না করার গোনাহের কাফ্ফারা অন্য জিনিস। ভালো কাজ করা হচ্ছে একটি জিনিসের কাফ্ফারা এবং দ্বিতীয় জিনিসের কাফ্ফারা কুরআন নিজেই নির্ধারিত করে দিয়েছে।
# মূলে غَافِلَاتِ (গাফেলাত) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সরলমনা ও ভদ্র মহিলারা, যারা ছল-চাতুরী জানে না, যাদের মন নির্মল, কলুষমুক্ত ও পাক-পবিত্র, যারা অসভ্যতা ও অশ্লীল আচরণ কি ও কিভাবে করতে হয় তা জানে না এবং কেউ তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেবে একথা যারা কোনদিন কল্পনাও করতে পারে না। হাদীসে বলা হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহ আল্লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিষ্কলুষ-সতী-সাধ্বী মহিলাদের বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া সাতটি “সর্বনাশা” কবীরাহ গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। তাবারানীতে হযরত হুযাইফার বর্ণনায় বলা হয়েছে, নবী (সা.) বলেছেনঃ قذف المحصنة يهدم عمل ماة سنة “একজন নিরপরাধ সতী সাধ্বী নারীর বিরুদ্ধে অপবাদ দেয়া একশ বছরের সৎকাজ ধ্বংস করে দেবার জন্য যথেষ্ট।”