أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৭৫)
[ اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ
আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর।]
সূরা:- আন-নূর।
সুরা:২৪
পারা:১৮
৩৪-৩৫ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৪:৩৪
وَ لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ اٰیٰتٍ مُّبَیِّنٰتٍ وَّ مَثَلًا مِّنَ الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ مَوۡعِظَۃً لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿٪۳۴﴾
আর অবশ্যই আমরা তোমাদের কাছে নাযিল করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, তোমাদের পূর্ববর্তীদের থেকে দৃষ্টান্ত ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশ।
২৪:৩৫
اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ مَثَلُ نُوۡرِہٖ کَمِشۡکٰوۃٍ فِیۡہَا مِصۡبَاحٌ ؕ اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّہَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ زَیۡتُوۡنَۃٍ لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّ لَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ یَّکَادُ زَیۡتُہَا یُضِیۡٓءُ وَ لَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡہُ نَارٌ ؕ نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ یَہۡدِی اللّٰہُ لِنُوۡرِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿ۙ۳۵﴾
আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর তাঁর নূরের উপমা যেন একটি দীপাধার যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত, তা জ্বালানো হয় বরকতময় যায়তূন গাছের তৈল দ্বারা যা শুধু পূর্ব দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্ত) নয় আবার শুধু পশ্চিম দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্তও) নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তৈল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; নূরের উপর নূর! আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে হেদায়েত করেন তাঁর নূরের দিকে। আল্লাহ্ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করে থাকেন এবং আল্লাহ্ সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ আয়াতটির সম্পর্ক কেবলমাত্র ওপরের শেষ আয়াতটির সাথে নয়। বরং সূরার শুরু থেকে এখান পর্যন্ত যে বর্ণনা ধারা চলে এসেছে তার সবের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। দ্ব্যর্থহীন পথনির্দেশক আয়াত বলতে এমনসব আয়াত বুঝানো হয়েছে যেগুলোতে যিনা, কাযাফ ও লি’আনের আইন বর্ণনা করা হয়েছে, ব্যভিচারী পুরুষ ও মহিলার সাথে মু’মিনদের বিয়েশাদী না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সৎ চরিত্রবান ও সম্ভ্রান্ত লোকদের ওপর ভিত্তিহীন অপবাদ দেয়া এবং সমাজে দুষ্কৃতি ও অশ্লীলতার প্রচার ও প্রসারের পথ বন্ধ করা হয়েছে, পুরুষ ও নারীকে দৃষ্টি সংযত ও যৌনাংগ হেফাজত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে, নারীদের জন্য পর্দার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, বিবাহযোগ্য লোকদের বিবাহ না করে একাকী জীবন যাপনকে অপছন্দ করা হয়েছে, গোলামদের আজাদীর জন্য লিখিত চুক্তি করার নিয়ম প্রবর্তন করতে বলা হয়েছে এবং সমাজকে বেশ্যাবৃত্তির অভিশাপ মুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব কথা বলার পর বলা হচ্ছে, আল্লাহকে ভয় করে সহজ-সরল পথ অবলম্বনকারীদেরকে যেভাবে শিক্ষা দেয়া দরকার তাতো আমি দিয়েছি, এখন যদি তোমরা এ শিক্ষার বিপরীত পথে চলো, তাহলে এর পরিষ্কার অর্থ দাঁড়াবে এই যে, তোমরা এমন সব জাতির মতো নিজেদের পরিণাম দেখতে চাও যাদের ভয়াবহ ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত আমি এ কুরআনে তোমাদের সামনে পেশ করেছি। —সম্ভবত একটি নির্দেশনামার উপসংহারে এর চেয়ে কড়া সতর্কবাণী আর হতে পারে না। কিন্তু অবাক হতে হয় এমন জাতির কার্যকলাপ দেখে যারা এ নির্দেশনামা তেলাওয়াতও করে আবার এ ধরনের কড়া সাবধান বাণীর পরও এর বিপরীত আচরণও করতে থাকে!
# এখান থেকে শুরু হয়েছে মুনাফিকদের প্রসঙ্গ। ইসলামী সমাজের মধ্যে অবস্থান করে তারা একের পর এক গোলযোগ ও বিভ্রাট সৃষ্টি করে চলছিল এবং ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী রাষ্ট্র ও দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে তৎপর ছিল যেমন বাইরের প্রকাশ্য কাফের ও দুশমনরা তৎপর ছিল। তারা ছিল ঈমানের দাবীদার। মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা। মুসলমানদের বিশেষ করে আনসারদের সাথে ছিল তাদের আত্মীয়তা ও ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক। এ জন্য তারা মুসলমানদেরমধ্যে ফিতনা বিস্তারের সুযোগও বেশী পেতো এবং কোন কোন আন্তরিকতা সম্পন্ন মুসলমানও নিজের সরলতা বা দুর্বলতার কারণে তাদের ক্রীড়নক ও পৃষ্ঠপোষকেও পরিণত হয়ে যেতো। কিন্তু আসলে বৈষয়িক স্বার্থ তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল এবং ঈমানের দাবী সত্ত্বেও কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের বদৌলতে দুনিয়ায় যে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল তা থেকে তারা ছিল একেবারেই বঞ্চিত। এ সুযোগে তাদেরকে সম্বোধন না করে তদের সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে তার পিছনে রয়েছে তিনটি উদ্দেশ্য। প্রথমত তাদেরকে উপদেশ দেয়া। কারণ আল্লাহর রহমত ও রবুবিয়াতের প্রথম দাবী হচ্ছে, পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত মানুষকে তার সকল নষ্টামি ও দুষ্কৃতি সত্ত্বেও শেষ সময় পর্যন্ত বুঝাবার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত ঈমান ও মুনাফিকির পার্থক্যকে পরিষ্কার ও খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করে দেয়া। এভাবে কোন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য মুসলিম সমাজে মু’মিন ও মুনাফিকের মধ্যে ফারাক করা কঠিন হবে না। আর এ ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত বর্ণনার পরও যে ব্যক্তি মুনাফিকদের ফাঁদে জড়িয়ে পড়বে অথবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে সে তার নিজের এ কাজের জন্য পুরোপুরি দায়ী হবে। তৃতীয়ত মুনাফিকদেরকে পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করে দেয়া। তাদেরকে এ মর্মে জানিয়ে দেয়া যে, মু’মিনদের জন্য আল্লাহর যে ওয়াদা রয়েছে তা কেবলমাত্র তাদের জন্য যারা সাচ্চা দিলে ঈমান আনে এবং তারপর এ ঈমানের দাবী পূরণ করে। এ প্রতিশ্রুতি এমন লোকদের জন্য নয় যারা নিছক আদমশুমারীর মাধ্যমে মুসলমানদের দলে ভিড়ে গেছে। কাজেই মুনাফিক ও ফাসিকদের এ প্রতিশ্রুতির মধ্য থেকে কিছু অংশ পাওয়ার আশা করা উচিত নয়।
# আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী শব্দ সাধারণভাবে কুরআন মজীদে “বিশ্ব-জাহান” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই অন্য কথায় আয়াতের অনুবাদ এও হতে পারেঃ আল্লাহ সমগ্র বিশ্ব-জাহানের আলো। আলো বলতে এমন জিনিস বুঝানো হয়েছে যার বদৌলতে দ্রব্যের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ যে নিজে নিজে প্রকাশিত হয় এবং অন্য জিনিসকেও প্রকাশ করে দেয়। মানুষের চিন্তায় নূর ও আলোর এটিই আসল অর্থ। কিছুই না দেখা যাওয়ার অবস্থাকে মানুষ অন্ধকার নাম দিয়েছে। আর এ বিপরীতে যখন সবকিছু দেখা যেতে থাকে এবং প্রত্যেকটি জিনিস প্রকাশ হয়ে যায় তখন মানুষ বলে আলো হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’আলার জন্য “নূর” তথা আলো শব্দটির ব্যবহার ও মৌলিক অর্থের দিক দিয়েই করা হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ তিনি এমন কোন আলোকরশ্মি নন যা সেকেণ্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বেগে চলে এবং আমাদের চোখের পর্দায় পড়ে মস্তিষ্কের দৃষ্টি কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে, আলোর এ ধরণের কোন অর্থ এখানে নেই। মানুষের মস্তিষ্ক এ অর্থের জন্য এ শব্দটি উদ্ভাবন করেছে, আলোর এ বিশেষ অবস্থা সে অর্থের মৌল তত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তার ওপর এ শব্দটি আমরা এ বস্তুজগতে আমাদের অভিজ্ঞতায় যে আলো ধরা দেয় তার দৃষ্টিতে প্রয়োগ করি। মানুষের ভাষায় প্রচলিত যতগুলো শব্দ আল্লাহর জন্য বলা হয়ে থাকে সেগুলো তাদের আসল মৌলিক অর্থের দৃষ্টিতে বলা হয়ে থাকে, তাদের বস্তুগত অর্থের দৃষ্টিতে বলা হয় না। যেমন আমরা তাঁর জন্য দেখা শব্দটি ব্যবহার করি। এর অর্থ এ হয় না যে, তিনি মানুষ ও পশুর মতো চোখ নামক একটি অংগের মাধ্যমে দেখেন। আমরা তাঁর জন্য শোনা শব্দ ব্যবহার করি। এর মানে এ নয় যে, তিনি আমাদের মতো কানের সাহায্যে শোনেন। তাঁর জন্য আমরা পাকড়াও ও ধরা শব্দ ব্যবহার করি। এর অর্থ এ নয় যে, তিনি হাত নামক একটি অংগের সাহায্যে ধরেন। এসব শব্দ সবসময় তাঁর জন্য একটি প্রায়োগিক মর্যাদায় বলা হয়ে থাকে এবং একমাত্র একজন স্বল্প বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এ ভুল ধারণা করতে পারে যে, আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় শোনা, দেখা ও ধরার যে সীমাবদ্ধ ও বিশেষ আকৃতি রয়েছে তার বাইরে এগুলোর অন্য কোন আকৃতি ও ধরন হওয়া অসম্ভব। অনুরূপভাবে “নূর” বা আলো সম্পর্কেও একথা মনে করা নিছক একটি সংকীর্ণ চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে, এর অর্থের ক্ষেত্র শুধুমাত্র এমন রশ্মিরই আকারে পাওয়া যেতে পারে যা কোন উজ্জ্বল অবয়ব থেকে বের হয়ে এসে চোখের পর্দায় প্রতিফলিত হয়। এ সীমিত অর্থে আল্লাহ আলো নন বরং ব্যাপক, সার্বিক ও আসল অর্থে আলো। অর্থাৎ এ বিশ্ব-জাহানে তিনিই এক আসল “প্রকাশের কার্যকারণ”, বাকি সবই এখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যান্য আলোক বিতরণকারী জিনিসগুলোও তাঁরই দেয়া আলো থেকে আলোকিত হয় ও আলো দান করে। নয়তো তাদের কাছে নিজের এমন কিছু নেই যার সাহায্যে তারা এ ধরনের বিস্ময়কর কাণ্ড করতে পারে। আলো শব্দের ব্যবহার জ্ঞান অর্থেও হয় এবং এর বিপরীতে অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাকে অন্ধকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এ অর্থেও আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের আলো। কেননা, এখানে সত্যের সন্ধান ও সঠিক পথের জ্ঞান একমাত্র তাঁর মাধ্যমেই এবং তার কাছ থেকেই পাওয়া যেতে পারে। তাঁর দান গ্রহণ করা ছাড়া মূর্খতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার এবং তার ফলশ্রুতিতে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়।
# মুবারক অর্থাৎ বহুল উপকারী, বহুমুখী কল্যাণের ধারক।
# যা খোলা ময়দানে বা উঁচু জায়গায় অবস্থান করে। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর রোদ পড়ে। তার সামনে পেছনে কোন আড় থাকে না যে, কেবল সকালের রোদটুকু বা বিকালের রোদটুকু তার ওপর পড়ে। এমন ধরনের যয়তুন গাছের তেল বেশী স্বচ্ছ হয় এবং বেশী উজ্জ্বল আলো দান করে। নিছক পূর্ব বা নিছক পশ্চিম অঞ্চলের যয়তুন গাছ তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছ তেল দেয় এবং প্রদীপে তার আলোও হালকা থাকে।
# এ উপমায় প্রদীপের সাথে আল্লাহর সত্তাকে এবং তাদের সাথে বিশ্ব-জাহানকে তুলনা করা হয়েছে। আর চিমনি বলা হয়েছে এমন পর্দাকে যার মধ্যে মহাসত্যের অধিকারী সমস্ত সৃষ্টিকুলের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন, অর্থাৎ এ পর্দাটি যেন গোপন করার পর্দা নয় বরং প্রবল প্রকাশের পর্দা। সৃষ্টির দৃষ্টি যে তাঁকে দেখতে অক্ষম এর কারণ এটা নয় যে, মাঝখানে অন্ধকার আছে, বরং আসল কারণ হচ্ছে, মাঝখানের পর্দা স্বচ্ছ এবং এ স্বচ্ছ পর্দা অতিক্রম করে আগত আলো এত বেশী তীক্ষ্ম, তীব্র, অবিমিশ্র ও পরিবেষ্টনকারী যে, সীমিত শক্তি সম্পন্ন চক্ষু তা দেখতে অক্ষম হয়ে গেছে। এ দুর্বল চোখগুলো কেবলমাত্র এমন ধরনের সীমাবদ্ধ আলো দেখতে পারে যার মধ্যে কমবেশী হতে থাকে, যা কখনো অন্তর্হিত আবার কখনো উদিত হয়, যার বিপরীতে কোন অন্ধকার থাকে এবং নিজের বিপরীতধর্মীর সামনে এসে সে সমুজ্জ্বল হয়। কিন্তু নিরেট, ভরাট ও ঘন আলো, যার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিযোগীই নেই, যা কখনো অন্তর্হিত ও নিশ্চিহ্ন হয় না এবং যা সবসময় একইভাবে সব দিক আচ্ছন্ন করে থাকে তাকে পাওয়া ও তাকে দেখা এদের সাধ্যের বাইরে।
আর “এ প্রদীপটি যয়তুনের এমন একটি মুবারক গাছের তেল দিয়ে উজ্জ্বল করা হয় যা পূর্বেরও নয় পশ্চিমের নয়।” এ বক্তব্য কেবলমাত্র প্রদীপের আলোর পূর্ণতা ও তার তীব্রতার ধারণা দেবার জন্য বলা হয়েছে। প্রাচীন যুগে যয়তুনের তেলের প্রদীপ থেকে সর্বাধিক পরিমাণ আলোক লাভ করা হতো। এর মধ্যে আবার উঁচু ও খোলা জায়গায় বেড়ে ওঠা যয়তুন গাছগুলো থেকে যে তেল উৎপন্ন হতো সেগুলোর প্রদীপের আলো হতো সবচেয়ে জোরালো। উপমায় এ বিষয়বস্তুর বক্তব্য এই নয় যে, প্রদীপের সাথে আল্লাহর যে সত্তার তুলনা করা হয়েছে তা অন্য কোন জিনিস থেকে শক্তি (Energy) অর্জন করছে। বরং একথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, উপমায় কোন মামুলি ধরনের প্রদীপ নয় বরং তোমাদের দেখা উজ্জ্বলতম প্রদীপের কথা চিন্তা করো। এ ধরনের প্রদীপ যেমন সারা বাড়ি আলোকাজ্জল করে ঠিক তেমনি আল্লাহর সত্তাও সারা বিশ্ব-জাহানকে আলোক নগরীতে পরিণত করে রেখেছে। আর এই যে বলা হয়েছে, “তার তেল আপনা আপনিই জ্বলে ওঠে আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও”, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রদীপের আলোকে অত্যধিক তীব্র করার ধারণা দেয়া। অর্থাৎ উপমায় এমন সর্বাধিক তীব্র আলো দানকারী প্রদীপের কথা চিন্তা করো যার মধ্যে এ ধরণের স্বচ্ছ ও চরম উত্তেজক তেল রয়েছে। এ তিনটি জিনিস অর্থাৎ যয়তুন, তার পুরবীয় ও পশ্চিমী না হওয়া এবং আগুনের স্পর্শ ছাড়াই তার তেলের আপনা আপনি জ্বলে ওঠা উপমার স্বতন্ত্র অংশ নয় বরং উপমার প্রথম অংশের অর্থাৎ প্রদীপের আনুসঙ্গিক বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। উপমার আসল অংশ তিনটিঃ প্রদীপ, তাক ও স্বচ্ছ চিমনি বা কাঁচের আবরণ।
আয়াতের “তাঁর আলোর উপমা যেমন” এ বাক্যাংশটিও উল্লেখযোগ্য। “আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর আলো” আয়াতের একথাগুলো পড়ে কারোর মনে যে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারতো ওপরের বাক্যাংশটির মাধ্যমে তা দূর হয়ে যায়। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহকে “আলো” বলার মানে এ নয় যে, নাউযুবিল্লাহ, আলোই তাঁর স্বরূপ। আসলে তিনি তো হচ্ছেন একটি পরিপূর্ণ ও পূর্ণাংগ সত্তা। তিনি জ্ঞানী, শক্তিশালী, প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ইত্যাদি হবার সাথে সাথে আলোর অধিকারীও। কিন্তু তাঁর সত্তাকে আলো বলা হয়েছে নিছক তাঁর আলোকোজ্জলতার পূর্ণতার কারণে। যেমন কারোর দানশীলতা গুণের পূর্ণতার কথা বর্ণনা করার জন্য তাকেই “দান” বলে দেয়া অথবা তার সৌন্দর্যের পূর্ণতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে স্বয়ং তাকেই সৌন্দর্য আখ্যা দেয়া।
# যদিও আল্লাহর এ একক ও একচ্ছত্র আলো সমগ্র বিশ্ব-জাহান আলোকিত করছে কিন্তু তা দেখার, জানার ও উপলব্ধি করার সৌভাগ্য সবার হয় না। তা উপলব্ধি করার সুযোগ এবং তার দানে অনুগৃহীত হবার সৌভাগ্য আল্লাহই যাকে চান তাকে দেন। নয়তো অন্ধের জন্য যেমন দিনরাত সমান ঠিক তেমনি অবিবেচক ও অদূরদর্শী মানুষের জন্য বিজলি, সূর্য, চাঁদ ও তারার আলো তো আলোই, কিন্তু আল্লাহর নূর ও আলো সে ঠাহর করতে পারে না। এ দিক থেকে এ দুর্ভাগার জন্য বিশ্ব-জাহানে সবদিকে অন্ধকারই অন্ধকার। দু’চোখ অন্ধ। তাই নিজের একান্ত কাছের জিনিসই সে দেখতে পারে না। এমনকি তার সাথে ধাক্কা খাওয়ার পরই সে জানতে পারে এ জিনিসটি এখানে ছিল। এভাবে ভিতরের চোখ যার অন্ধ অর্থাৎ যার অন্তর্দৃষ্টি নেই সে তার নিজের পাশেই আল্লাহর আলোয় যে সত্য জ্বলজ্বল করছে তাকেও দেখতে পায় না। যখন সে তার সাথে ধাক্কা খেয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের শিকলে বাঁধা পড়ে কেবলমাত্র তখনই তার সন্ধান পায়।
# এর দু’টি অর্থ হয়। এক, তিনি জানেন কোন্ সত্যকে কোন্ উপমার সাহায্যে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে বুঝানো যেতে পারে। দুই, তিনি জানেন কে নিয়ামতের হকদার এবং কে নয়। যে ব্যক্তি সত্যের আলোর সন্ধানী নয়, যে ব্যক্তি সমগ্র মনপ্রাণ দিয়ে নিজের পার্থিব স্বার্থেরই মধ্যে বিলীন হয়ে যায় এবং বস্তুগত স্বাদ ও স্বার্থের সন্ধানে নিমগ্ন থাকে আল্লাহ জানেন যে, সে এর সন্ধানী ও ঐকান্তিক সন্ধানী সে-ই এ দান লাভের যোগ্য।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
পূর্ববর্তী দুটো অধ্যায়ে মানব চরিত্রের নিকৃষ্টতম নৈতিক দোষগুলাে আলােচিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য মানব চরিত্রকে এগুলো থেকে সংশােধন করে নির্মল পবিত্র ও জ্যোতির্ময় করা। এই নৈতিক দোষগুলাে হচ্ছে মানুষের রক্ত মাংস থেকে উদ্ভুত যৌন কামনা ও কু-দৃষ্টি, মানুষের প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরােপ ও কুৎসা রটনা এবং অপবাদ আরােপকারীর প্রতি আক্রোশ ও প্রতিশােধের স্পৃহা। অশ্লীলতাকে যাতে ব্যক্তির চরিত্র, সমাজ জীবন ও কথাবার্তা সব কিছু থেকে উচ্ছেদ করা যায় সে জন্যে ব্যভিচারের শাস্তি ও অপবাদের শাস্তি কঠোরভাবে আরােপ করা হয়েছে। সরলমনা, সতী ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরােপের এক জঘন্য ও পৈশাচিক নমুনা তুলে ধরা হয়েছে এবং কতিপয় সতর্কতামূলক ও নিরাপত্তামূলক বিধি জারী করা হয়েছে। যেমন, বাড়ীতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি লাভ, দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ, সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা গােপন করণ, কামোত্তেজক উপকরণসমূহ নিষিদ্ধকরণ, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী উপকরণসমূহ নিষিদ্ধকরণ,বিয়ের যােগ্য নরনারীর বিয়ের ব্যবস্থা করা, বেশ্যাবৃত্তির উচ্ছেদ ও দাসমুক্তি প্রভৃতি। এসব বিধির উদ্দেশ্য হলাে রক্ত ও মাংস থেকে উদ্ভূত কাম বাসনা নিবৃত্ত করা এবং মানুষের সতিত্ব, সততা, শ্লীলতা ও স্বচ্ছতা রক্ষার ব্যবস্থা করা। অপবাদ আরােপ সংক্রান্ত ঘটনার জের হিসেবে যে আক্রোশ ও প্রতিশােধ স্পৃহা জাগ্রত হয় এবং মূল্যবােধের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় ও যে উদ্বেগের সঞ্চার হয়, ঘটনার শেষে তার সমাধান আলােচিত হয়েছে। এ সমাধানের পর রাসূল(স.), হযরত আয়েশা, হযরত আবুবকর সাফওয়ান বিন মােয়াত্তাল সকলেই শাস্ত, পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হয়ে যান। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সাক্ষ্য ও অপবাদ দূরীকরণে সবার মন প্রসন্ন ও উৎফুল্ল হয়ে যায়। সাধারণ মুসলমানরাও আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে যায় এবং তাওবা করে। তাদের মনের সকল ক্লেদ ও বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়, সবার মন আল্লাহর অনুগ্রহ ও পথ নির্দেশনা লাভে কৃতজ্ঞতায় পরিপ্লুত হয়। *আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন আসমান ও যমীনের নুর : এরূপ নির্মল ও চমকপ্রদ শিক্ষা ও দিক নির্দেশনার মাধ্যমে মানুষকে পরিশুদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে পরিশুদ্ধ মানুষগুলাে আল্লাহর জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়েছে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মুক্ত দিগন্তে মহান আল্লাহর বৃহত্তম জ্যোতি লাভ করে আপন অন্তরাত্মাকে উদ্ভাসিত করেছে। শুধু উদ্ভাসিতই করেনি, বরং জ্যোতির্ময় এক জগতে নিজেকে নিরন্তর আল্লাহর নূর লাভের যােগ্যও বানিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি…’ এই চমকপ্রদ বাক্য উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই উজ্জ্বল দিক নির্দেশক আলাে গােটা জগতে ছড়িয়ে পড়ে, সমগ্র সৃষ্টিজগতকে তা উল্লসিত করে, মানব জাতির সমগ্র চিন্তা চেতনা ও অংগ প্রত্যংগ দেদিপ্যমান করে। সকল আবেগ ও অনুভূতিকে পরিপ্লুত করে, আর এই নয়নাভিরাম জ্যোতির দিগন্তপ্লাবী জোয়ারে সমগ্র সৃষ্টিজগত আল্লাহর তাসবীহ করে, এই জাতিকে সকলের চোখ আলিংগন করে, সকল পর্দা অপসৃত হয়, সকল অন্তর দর্পণের মতাে স্বচ্ছ হয়, সকল আত্মা আনন্দে উদ্বেলিত হয়, আলোর বন্যায় প্লাবিত সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতিতে সকল সৃষ্টি তাসবীহ পাঠ করতে থাকে। আলাের সমুদ্রে অবগাহন করে সকল জিনিস পবিত্র হয়ে যায়, প্রত্যেক জিনিস স্বীয় কলুষ কালিমা ও মরিচা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ফলে সর্বত্র ওড়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির পতাকা, অনুষ্ঠিত হয় জ্ঞান ও মিলনের মহােৎসব। প্রীতি, ভালােবাসা, আনন্দ ও খুশীর মহা সমারােহ। সমগ্র সৃষ্টিজগত ও তার অভ্যন্তরে বিদ্যমান সকল বস্তু ও প্রাণী সব রকমের বাধা ও সীমানার বন্ধনমুক্ত এমন এক আলােয় আলােকিত হয়ে যায়, যার মধ্যে আকাশ ও পৃথিবী মিলিত হয়ে একাকার হয়ে যায়, সকল জড় ও প্রাণী, সকল নিকট ও দূরের সৃষ্টি, সকল পাহাড় ও সমতল প্রান্তর, সকল গােপন ও প্রকাশ্য বস্তু এবং সকল হৃদয় ও অনুভূতি এক দেহে লীন হয়ে যায় । ‘আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি।’ অর্থাৎ যে জ্যোতি থেকে আকাশ ও পৃথিবীর অস্তিত্বের উদ্ভব ঘটেছে এবং যে জ্যোতি দ্বারা আকাশ ও পৃথিবীর শৃংখলা রক্ষিত ও বিধি ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালাই সেই জ্যোতি। এই জ্যোতিই বিশ্ব জগতকে অস্তিত্ব দান করে এবং এর নিয়ম শৃংখলা ও বিধিব্যবস্থা | রচনা করে। মানব জাতি সাম্প্রতিককালে তাদের বিজ্ঞানের শক্তি দ্বারা এই নিগূঢ়তম তত্ত্বের কিছু অংশ উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাদের হাতেই যখন এটম বা অনু ভেদে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বস্তুকে নিছক আলােকরশ্মীতে রূপান্তরিত করেছে, তখন তারা স্বচক্ষেই দেখতে পেরেছে যে, বস্তুর মূল উৎস আলাে ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তুর প্রতিটা অনু বহুসংখ্যক ইলেকট্রনের সমষ্টি মাত্র, যাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করলে একটা রশ্মীর আকার পরিগ্রহ করে এবং যার সারাংশ আলাে ছাড়া আর কিছু নয় মানুষের অন্তর এই সুক্ষ্মতম ও নিগূঢ়তম সত্যকে বিজ্ঞানের অভ্যুদয়ের শত শত বছর আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলাে। মন যখন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার থাকে এবং আলাের জগতে পরিভ্রমণ করতাে, তখন এ সত্য অনুধাবন করতাে। রসূলের হৃদয় এ সত্যকে তায়েফ থেকে ফেরার সময় পূর্ণাংগভাবে উপলব্ধি করেছিলাে। দু’হাত মেলে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করে তিনি বলেছিলেন, তােমার সেই আলাের কাছে আশ্রয় চাই, যা সকল অন্ধকারকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে এবং যার কল্যাণে দুনিয়া ও আখেরাতের সব কিছু শুধরে গেছে।’ মেরাজের সফরেও তিনি এই সত্যকে অবলােকন করেছিলেন। হযরত আয়েশা(রা.) যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আপনার প্রভুকে দেখেছেন? তখন তিনি বললেন, তিনি তাে জ্যোতি। কিভাবে তাঁকে দেখবাে তবে মানব সত্ত্বার মধ্যে এই জ্যোতির প্লাবনকে ধারণ ও গ্রহণ করার ক্ষমতা সব সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেই দূর দিগন্তকে দীর্ঘদিন সে পর্যবেক্ষণ করতে পারে না। এই দূর দিগন্তকে আয়াতে স্পষ্ট করে দেয়ার পর পুনরায় তার অবস্থান নির্ণয় করার জন্যে এবং একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে বলা হচ্ছে, তার জ্যোতির দৃষ্টান্ত যেন একটা তাক, তাতে আছে, একটা প্রদীপ, সে প্রদীপটা একটা কাচের ফানুসের মধ্যে রয়েছে, কাচের ফানুসটা যেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র, সে প্রদীপ জ্বালানাে হয় পূত পবিত্র যয়তুন গাছের তেল দিয়ে, যা পূর্বমুখীও নয়, পশ্চিম মুখীও নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তেল নিজেই উজ্জল আলাে দিচ্ছে (আর যদি স্পর্শ করে তাহলে তা হবে), জ্যোতির ওপর জ্যোতি। এটা এমন একটা উদাহরণ, যার সাহায্যে সীমাবদ্ধ বােধশক্তিকে একটা অসীম বিষয় বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং অনুভূতি শক্তি যখন কোনাে জিনিসের আসল রূপ কল্পনা করতে অক্ষম হয়, তখন তার ক্ষুদ্র নমুনাকে চিত্রায়িত করে তার সামনে রাখা হয়। মানবীয় বােধশক্তি যখন আল্লাহর জ্যোতির ব্যাপকতাকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়, তখন এ উদাহরণ দ্বারা তাকে সে জ্যোতির স্বভাব ও প্রকৃতি কি, তা বুঝিয়ে দেয়া হয়। কেননা তার বােধশক্তি এতাে সীমিত ক্ষমতা সম্পন্ন যে, আল্লাহর জ্যোতির ব্যাপকতা ও তার বিশাল বিচরণ ক্ষেত্রকে সে কল্পনা করতে পারে না। যে জ্যোতি সমগ্ৰ আকাশ ও পৃথিবী জুড়ে বিরাজমান, তাকে এই উদাহরণে আকাশ ও পৃথিবীর বিস্তৃত একে বিশাল ক্ষেত্র থেকে নিয়ে একটা তাকের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। এই তাক হলাে প্রাচীরের গায়ে অবস্থিত জানালার চেয়ে ক্ষুদ্র একটা ফোকর। এতে প্রদীপ রাখা হয়। এই ক্ষুদ্র তাকে যখন প্রদীপ রাখা হয়, তখন তার আলাে ওর ভেতরে সংকুচিত ও সীমাবদ্ধ হওয়ার কারণে জোরদার ও তীব্র মনে হয়। একটা তাকের মতাে যার ভেতরে প্রদীপ রয়েছে। প্রদীপটি রয়েছে একটা কাচের ফানুসের ভেতরে। এই কাঁচের ফানুস প্রদীপকে বাতাস থেকে রক্ষা করে, প্রদীপের আলােকে স্বচ্ছ ও তীব্র করে। কাঁচের ফানুসটা যেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র। অর্থাৎ তা স্বকীয়ভাবেই উজ্জল, দেদিপ্যমান ও আলো বিকিরণকারী। এখানে আসল ও উদাহরণের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন করা হচ্ছে, নমুনা ও আসলকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র কাচের ফানুসকে সুবৃহৎ নক্ষত্রের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে আসল ও নমুনার মধ্যে সংযােগ স্থাপন করা হচ্ছে, যাতে কল্পনা কেবল ক্ষুদ্র নমুনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থেকে না যায়, যাকে কেবল সুবৃহৎ আসলকে বুঝানাের জন্যেই ব্যবহার করা হয়েছে। এই তুলনা সম্পন্ন করার পর পুনরায় নমুনার দিকে তথা প্রদীপের দিকে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সে প্রদীপ জ্বালানাে হয় পূতপবিত্র যয়তুন গাছের তেল দিয়ে। এটা সবার জানা ছিলাে যে, যয়তুন তেলের প্রদীপ সবচেয়ে স্বচ্ছ আলাে দেয়। কিন্তু শুধুমাত্র এ কারণেই এ উদাহরণটা দেয়া হয়নি। বরং পূত পবিত্র যয়তুন গাছ থেকে যে মহিমান্বিত ভাবচিত্রটা পাওয়া যায়, সেটাই এ উদাহরণ দেয়ার মূল কারণ। তূর পর্বত সংলগ্ন সেই পবিত্র উপত্যকার ভাবচিত্রটা এখানে পাওয়া যায়, যা আরব উপদ্বীপের নিকটতম যয়তুন উৎপাদনকারী স্থান। কোরআনে এই যয়তুন গাছের দিকে আরো আভাস ইংগিত দেয়া হয়েছে। যেমন সূরা মােমেনূনে বলা হয়েছে, ‘সিনাই এর তূর উপত্যকা থেকে জন্মানাে সেই গাছ, যা আহরণকারীদের জন্যে তেল ও রং নিয়ে উৎপন্ন হয়ে থাকে।’ যয়তুন একটা দীর্ঘজীবী গাছ, যার তেল, কাঠ, ফল ও পাতা সব কিছুই জনহিতকর। অতপর ক্ষুদ্র নমুনা বাদ দিয়ে পুনরায় বৃহৎ আসলের উল্লেখ করা হচ্ছে। কেননা এই গাছ কোনাে নির্দিষ্ট গাছ নয় এবং তা কোনাে নির্দিষ্ট স্থান বা দিকের সাথেও সংশ্লিষ্ট নয়। বরং এটা নিছক বুঝানাের জন্যে একটা উদাহরণ মাত্র, পূর্বমুখীও নয়, পশ্চিমমুখীও নয়। এর তেলও এই সুনির্দিষ্ট ও দৃষ্টিগ্রাহ্য তেল নয়, বরং তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এক বিস্ময়কর। তেল, ‘আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তেল নিজেই উজ্জ্বল আলাে দিচ্ছে।’ অর্থাৎ তা স্বতই এতাে স্বচ্ছ এবং এতাে উজ্জ্বল যে, আগুন দিয়ে না জ্বালালেও তা যেন জ্বলে। ‘জ্যোতির ওপর জ্যোতি।’ এভাবে আমরা চুড়ান্ত পর্যায়ে গভীর ও উদ্ভাসিত জ্যোতির দিকে ফিরে যাই। বস্তুত আল্লাহর জ্যোতির কল্যাণেই আকাশ ও পৃথিবীর অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হয়। এই জ্যোতির প্রকৃত স্বরূপ এবং এর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি আমরা বুঝতে অক্ষম এ জ্যোতির উল্লেখের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে তার দিকে আকৃষ্ট করা ও তার সাথে আত্মার সম্পর্ক সৃষ্টি করার জন্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তােলা ছাড়া আর কিছু নয়। ‘তিনি তার জ্যোতির দিকে যাকে চান পথ প্রদর্শন করেন।’ অর্থাৎ যারা নিজেদের হৃদয়কে আল্লাহর জ্যোতি দর্শনের জন্যে উন্মুক্ত করে, তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ তায়ালা যাকে যাকে চান এই জ্যোতির দিকে পথ প্রদর্শন করেন, ফলে তারা এই জ্যোতি দেখতে পায়। এই জ্যোতি আকাশ ও পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান, সর্বত্র বহমান, সর্বত্র সর্বক্ষণ বিদ্যমান। কখনো তার প্রবাহ বন্ধ হয় না, বিচ্ছিন্ন হয় না, নেভে না। যেদিকেই কেউ মনােনিবেশ করে, সেদিকেই সে এই জ্যোতি দেখতে পায়। পথহারা ব্যক্তি যে দিকেই তাকায় এই জ্যোতি তাকে পথ দেখায়। যেখানেই কেউ এই জ্যোতির সন্ধান পায়, সেখানেই সে আল্লাহকে পেয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তার জ্যোতি সম্পর্কে যে উদাহরণই দেন, মানুষের কাছে তা সহজবােধ্য করার জন্যেই দেন। কেননা মানুষের বােধশক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত, আল্লাহ মানুষের সুবিধার্থেই উদাহরণ দেন। তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। ওই উক্ত, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বত্র প্রবহমান জ্যোতি আল্লাহর সেই সব গৃহে দীপ্তিমান, যেখানে আল্লাহর সাথে মানুষের মন মিলিত হয়, আল্লাহর সন্ধান করে, আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর জন্যে নিবেদিত ও উৎসর্গীত হয় এবং পৃথিবীর সকল লােভনীয় সামগ্রীর ওপর আল্লাহকেই অগ্রাধিকার দেয়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৭৫)
[ اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ
আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর।]
সূরা:- আন-নূর।
সুরা:২৪
পারা:১৮
৩৪-৩৫ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৪:৩৪
وَ لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ اٰیٰتٍ مُّبَیِّنٰتٍ وَّ مَثَلًا مِّنَ الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ مَوۡعِظَۃً لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿٪۳۴﴾
আর অবশ্যই আমরা তোমাদের কাছে নাযিল করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ, তোমাদের পূর্ববর্তীদের থেকে দৃষ্টান্ত ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশ।
২৪:৩৫
اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ مَثَلُ نُوۡرِہٖ کَمِشۡکٰوۃٍ فِیۡہَا مِصۡبَاحٌ ؕ اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّہَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ زَیۡتُوۡنَۃٍ لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّ لَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ یَّکَادُ زَیۡتُہَا یُضِیۡٓءُ وَ لَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡہُ نَارٌ ؕ نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ یَہۡدِی اللّٰہُ لِنُوۡرِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿ۙ۳۵﴾
আল্লাহ্ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর তাঁর নূরের উপমা যেন একটি দীপাধার যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত, তা জ্বালানো হয় বরকতময় যায়তূন গাছের তৈল দ্বারা যা শুধু পূর্ব দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্ত) নয় আবার শুধু পশ্চিম দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্তও) নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তৈল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; নূরের উপর নূর! আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে হেদায়েত করেন তাঁর নূরের দিকে। আল্লাহ্ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করে থাকেন এবং আল্লাহ্ সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# এ আয়াতটির সম্পর্ক কেবলমাত্র ওপরের শেষ আয়াতটির সাথে নয়। বরং সূরার শুরু থেকে এখান পর্যন্ত যে বর্ণনা ধারা চলে এসেছে তার সবের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। দ্ব্যর্থহীন পথনির্দেশক আয়াত বলতে এমনসব আয়াত বুঝানো হয়েছে যেগুলোতে যিনা, কাযাফ ও লি’আনের আইন বর্ণনা করা হয়েছে, ব্যভিচারী পুরুষ ও মহিলার সাথে মু’মিনদের বিয়েশাদী না করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সৎ চরিত্রবান ও সম্ভ্রান্ত লোকদের ওপর ভিত্তিহীন অপবাদ দেয়া এবং সমাজে দুষ্কৃতি ও অশ্লীলতার প্রচার ও প্রসারের পথ বন্ধ করা হয়েছে, পুরুষ ও নারীকে দৃষ্টি সংযত ও যৌনাংগ হেফাজত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে, নারীদের জন্য পর্দার সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, বিবাহযোগ্য লোকদের বিবাহ না করে একাকী জীবন যাপনকে অপছন্দ করা হয়েছে, গোলামদের আজাদীর জন্য লিখিত চুক্তি করার নিয়ম প্রবর্তন করতে বলা হয়েছে এবং সমাজকে বেশ্যাবৃত্তির অভিশাপ মুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব কথা বলার পর বলা হচ্ছে, আল্লাহকে ভয় করে সহজ-সরল পথ অবলম্বনকারীদেরকে যেভাবে শিক্ষা দেয়া দরকার তাতো আমি দিয়েছি, এখন যদি তোমরা এ শিক্ষার বিপরীত পথে চলো, তাহলে এর পরিষ্কার অর্থ দাঁড়াবে এই যে, তোমরা এমন সব জাতির মতো নিজেদের পরিণাম দেখতে চাও যাদের ভয়াবহ ও শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত আমি এ কুরআনে তোমাদের সামনে পেশ করেছি। —সম্ভবত একটি নির্দেশনামার উপসংহারে এর চেয়ে কড়া সতর্কবাণী আর হতে পারে না। কিন্তু অবাক হতে হয় এমন জাতির কার্যকলাপ দেখে যারা এ নির্দেশনামা তেলাওয়াতও করে আবার এ ধরনের কড়া সাবধান বাণীর পরও এর বিপরীত আচরণও করতে থাকে!
# এখান থেকে শুরু হয়েছে মুনাফিকদের প্রসঙ্গ। ইসলামী সমাজের মধ্যে অবস্থান করে তারা একের পর এক গোলযোগ ও বিভ্রাট সৃষ্টি করে চলছিল এবং ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী রাষ্ট্র ও দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে ঠিক তেমনিভাবে তৎপর ছিল যেমন বাইরের প্রকাশ্য কাফের ও দুশমনরা তৎপর ছিল। তারা ছিল ঈমানের দাবীদার। মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত ছিল তারা। মুসলমানদের বিশেষ করে আনসারদের সাথে ছিল তাদের আত্মীয়তা ও ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক। এ জন্য তারা মুসলমানদেরমধ্যে ফিতনা বিস্তারের সুযোগও বেশী পেতো এবং কোন কোন আন্তরিকতা সম্পন্ন মুসলমানও নিজের সরলতা বা দুর্বলতার কারণে তাদের ক্রীড়নক ও পৃষ্ঠপোষকেও পরিণত হয়ে যেতো। কিন্তু আসলে বৈষয়িক স্বার্থ তাদের চোখ অন্ধ করে দিয়েছিল এবং ঈমানের দাবী সত্ত্বেও কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের বদৌলতে দুনিয়ায় যে আলো ছড়িয়ে পড়ছিল তা থেকে তারা ছিল একেবারেই বঞ্চিত। এ সুযোগে তাদেরকে সম্বোধন না করে তদের সম্পর্কে যা কিছু বলা হচ্ছে তার পিছনে রয়েছে তিনটি উদ্দেশ্য। প্রথমত তাদেরকে উপদেশ দেয়া। কারণ আল্লাহর রহমত ও রবুবিয়াতের প্রথম দাবী হচ্ছে, পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত মানুষকে তার সকল নষ্টামি ও দুষ্কৃতি সত্ত্বেও শেষ সময় পর্যন্ত বুঝাবার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত ঈমান ও মুনাফিকির পার্থক্যকে পরিষ্কার ও খোলাখুলিভাবে বর্ণনা করে দেয়া। এভাবে কোন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য মুসলিম সমাজে মু’মিন ও মুনাফিকের মধ্যে ফারাক করা কঠিন হবে না। আর এ ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত বর্ণনার পরও যে ব্যক্তি মুনাফিকদের ফাঁদে জড়িয়ে পড়বে অথবা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করবে সে তার নিজের এ কাজের জন্য পুরোপুরি দায়ী হবে। তৃতীয়ত মুনাফিকদেরকে পরিষ্কার ভাষায় সতর্ক করে দেয়া। তাদেরকে এ মর্মে জানিয়ে দেয়া যে, মু’মিনদের জন্য আল্লাহর যে ওয়াদা রয়েছে তা কেবলমাত্র তাদের জন্য যারা সাচ্চা দিলে ঈমান আনে এবং তারপর এ ঈমানের দাবী পূরণ করে। এ প্রতিশ্রুতি এমন লোকদের জন্য নয় যারা নিছক আদমশুমারীর মাধ্যমে মুসলমানদের দলে ভিড়ে গেছে। কাজেই মুনাফিক ও ফাসিকদের এ প্রতিশ্রুতির মধ্য থেকে কিছু অংশ পাওয়ার আশা করা উচিত নয়।
# আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী শব্দ সাধারণভাবে কুরআন মজীদে “বিশ্ব-জাহান” অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কাজেই অন্য কথায় আয়াতের অনুবাদ এও হতে পারেঃ আল্লাহ সমগ্র বিশ্ব-জাহানের আলো। আলো বলতে এমন জিনিস বুঝানো হয়েছে যার বদৌলতে দ্রব্যের প্রকাশ ঘটে। অর্থাৎ যে নিজে নিজে প্রকাশিত হয় এবং অন্য জিনিসকেও প্রকাশ করে দেয়। মানুষের চিন্তায় নূর ও আলোর এটিই আসল অর্থ। কিছুই না দেখা যাওয়ার অবস্থাকে মানুষ অন্ধকার নাম দিয়েছে। আর এ বিপরীতে যখন সবকিছু দেখা যেতে থাকে এবং প্রত্যেকটি জিনিস প্রকাশ হয়ে যায় তখন মানুষ বলে আলো হয়ে গেছে। আল্লাহ তা’আলার জন্য “নূর” তথা আলো শব্দটির ব্যবহার ও মৌলিক অর্থের দিক দিয়েই করা হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ তিনি এমন কোন আলোকরশ্মি নন যা সেকেণ্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বেগে চলে এবং আমাদের চোখের পর্দায় পড়ে মস্তিষ্কের দৃষ্টি কেন্দ্রকে প্রভাবিত করে, আলোর এ ধরণের কোন অর্থ এখানে নেই। মানুষের মস্তিষ্ক এ অর্থের জন্য এ শব্দটি উদ্ভাবন করেছে, আলোর এ বিশেষ অবস্থা সে অর্থের মৌল তত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং তার ওপর এ শব্দটি আমরা এ বস্তুজগতে আমাদের অভিজ্ঞতায় যে আলো ধরা দেয় তার দৃষ্টিতে প্রয়োগ করি। মানুষের ভাষায় প্রচলিত যতগুলো শব্দ আল্লাহর জন্য বলা হয়ে থাকে সেগুলো তাদের আসল মৌলিক অর্থের দৃষ্টিতে বলা হয়ে থাকে, তাদের বস্তুগত অর্থের দৃষ্টিতে বলা হয় না। যেমন আমরা তাঁর জন্য দেখা শব্দটি ব্যবহার করি। এর অর্থ এ হয় না যে, তিনি মানুষ ও পশুর মতো চোখ নামক একটি অংগের মাধ্যমে দেখেন। আমরা তাঁর জন্য শোনা শব্দ ব্যবহার করি। এর মানে এ নয় যে, তিনি আমাদের মতো কানের সাহায্যে শোনেন। তাঁর জন্য আমরা পাকড়াও ও ধরা শব্দ ব্যবহার করি। এর অর্থ এ নয় যে, তিনি হাত নামক একটি অংগের সাহায্যে ধরেন। এসব শব্দ সবসময় তাঁর জন্য একটি প্রায়োগিক মর্যাদায় বলা হয়ে থাকে এবং একমাত্র একজন স্বল্প বুদ্ধিমান ব্যক্তিই এ ভুল ধারণা করতে পারে যে, আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় শোনা, দেখা ও ধরার যে সীমাবদ্ধ ও বিশেষ আকৃতি রয়েছে তার বাইরে এগুলোর অন্য কোন আকৃতি ও ধরন হওয়া অসম্ভব। অনুরূপভাবে “নূর” বা আলো সম্পর্কেও একথা মনে করা নিছক একটি সংকীর্ণ চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয় যে, এর অর্থের ক্ষেত্র শুধুমাত্র এমন রশ্মিরই আকারে পাওয়া যেতে পারে যা কোন উজ্জ্বল অবয়ব থেকে বের হয়ে এসে চোখের পর্দায় প্রতিফলিত হয়। এ সীমিত অর্থে আল্লাহ আলো নন বরং ব্যাপক, সার্বিক ও আসল অর্থে আলো। অর্থাৎ এ বিশ্ব-জাহানে তিনিই এক আসল “প্রকাশের কার্যকারণ”, বাকি সবই এখানে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যান্য আলোক বিতরণকারী জিনিসগুলোও তাঁরই দেয়া আলো থেকে আলোকিত হয় ও আলো দান করে। নয়তো তাদের কাছে নিজের এমন কিছু নেই যার সাহায্যে তারা এ ধরনের বিস্ময়কর কাণ্ড করতে পারে। আলো শব্দের ব্যবহার জ্ঞান অর্থেও হয় এবং এর বিপরীতে অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাকে অন্ধকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এ অর্থেও আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের আলো। কেননা, এখানে সত্যের সন্ধান ও সঠিক পথের জ্ঞান একমাত্র তাঁর মাধ্যমেই এবং তার কাছ থেকেই পাওয়া যেতে পারে। তাঁর দান গ্রহণ করা ছাড়া মূর্খতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার এবং তার ফলশ্রুতিতে ভ্রষ্টতা ও গোমরাহী ছাড়া আর কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়।
# মুবারক অর্থাৎ বহুল উপকারী, বহুমুখী কল্যাণের ধারক।
# যা খোলা ময়দানে বা উঁচু জায়গায় অবস্থান করে। যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার ওপর রোদ পড়ে। তার সামনে পেছনে কোন আড় থাকে না যে, কেবল সকালের রোদটুকু বা বিকালের রোদটুকু তার ওপর পড়ে। এমন ধরনের যয়তুন গাছের তেল বেশী স্বচ্ছ হয় এবং বেশী উজ্জ্বল আলো দান করে। নিছক পূর্ব বা নিছক পশ্চিম অঞ্চলের যয়তুন গাছ তুলনামূলকভাবে অস্বচ্ছ তেল দেয় এবং প্রদীপে তার আলোও হালকা থাকে।
# এ উপমায় প্রদীপের সাথে আল্লাহর সত্তাকে এবং তাদের সাথে বিশ্ব-জাহানকে তুলনা করা হয়েছে। আর চিমনি বলা হয়েছে এমন পর্দাকে যার মধ্যে মহাসত্যের অধিকারী সমস্ত সৃষ্টিকুলের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন, অর্থাৎ এ পর্দাটি যেন গোপন করার পর্দা নয় বরং প্রবল প্রকাশের পর্দা। সৃষ্টির দৃষ্টি যে তাঁকে দেখতে অক্ষম এর কারণ এটা নয় যে, মাঝখানে অন্ধকার আছে, বরং আসল কারণ হচ্ছে, মাঝখানের পর্দা স্বচ্ছ এবং এ স্বচ্ছ পর্দা অতিক্রম করে আগত আলো এত বেশী তীক্ষ্ম, তীব্র, অবিমিশ্র ও পরিবেষ্টনকারী যে, সীমিত শক্তি সম্পন্ন চক্ষু তা দেখতে অক্ষম হয়ে গেছে। এ দুর্বল চোখগুলো কেবলমাত্র এমন ধরনের সীমাবদ্ধ আলো দেখতে পারে যার মধ্যে কমবেশী হতে থাকে, যা কখনো অন্তর্হিত আবার কখনো উদিত হয়, যার বিপরীতে কোন অন্ধকার থাকে এবং নিজের বিপরীতধর্মীর সামনে এসে সে সমুজ্জ্বল হয়। কিন্তু নিরেট, ভরাট ও ঘন আলো, যার কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিযোগীই নেই, যা কখনো অন্তর্হিত ও নিশ্চিহ্ন হয় না এবং যা সবসময় একইভাবে সব দিক আচ্ছন্ন করে থাকে তাকে পাওয়া ও তাকে দেখা এদের সাধ্যের বাইরে।
আর “এ প্রদীপটি যয়তুনের এমন একটি মুবারক গাছের তেল দিয়ে উজ্জ্বল করা হয় যা পূর্বেরও নয় পশ্চিমের নয়।” এ বক্তব্য কেবলমাত্র প্রদীপের আলোর পূর্ণতা ও তার তীব্রতার ধারণা দেবার জন্য বলা হয়েছে। প্রাচীন যুগে যয়তুনের তেলের প্রদীপ থেকে সর্বাধিক পরিমাণ আলোক লাভ করা হতো। এর মধ্যে আবার উঁচু ও খোলা জায়গায় বেড়ে ওঠা যয়তুন গাছগুলো থেকে যে তেল উৎপন্ন হতো সেগুলোর প্রদীপের আলো হতো সবচেয়ে জোরালো। উপমায় এ বিষয়বস্তুর বক্তব্য এই নয় যে, প্রদীপের সাথে আল্লাহর যে সত্তার তুলনা করা হয়েছে তা অন্য কোন জিনিস থেকে শক্তি (Energy) অর্জন করছে। বরং একথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, উপমায় কোন মামুলি ধরনের প্রদীপ নয় বরং তোমাদের দেখা উজ্জ্বলতম প্রদীপের কথা চিন্তা করো। এ ধরনের প্রদীপ যেমন সারা বাড়ি আলোকাজ্জল করে ঠিক তেমনি আল্লাহর সত্তাও সারা বিশ্ব-জাহানকে আলোক নগরীতে পরিণত করে রেখেছে। আর এই যে বলা হয়েছে, “তার তেল আপনা আপনিই জ্বলে ওঠে আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও”, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রদীপের আলোকে অত্যধিক তীব্র করার ধারণা দেয়া। অর্থাৎ উপমায় এমন সর্বাধিক তীব্র আলো দানকারী প্রদীপের কথা চিন্তা করো যার মধ্যে এ ধরণের স্বচ্ছ ও চরম উত্তেজক তেল রয়েছে। এ তিনটি জিনিস অর্থাৎ যয়তুন, তার পুরবীয় ও পশ্চিমী না হওয়া এবং আগুনের স্পর্শ ছাড়াই তার তেলের আপনা আপনি জ্বলে ওঠা উপমার স্বতন্ত্র অংশ নয় বরং উপমার প্রথম অংশের অর্থাৎ প্রদীপের আনুসঙ্গিক বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। উপমার আসল অংশ তিনটিঃ প্রদীপ, তাক ও স্বচ্ছ চিমনি বা কাঁচের আবরণ।
আয়াতের “তাঁর আলোর উপমা যেমন” এ বাক্যাংশটিও উল্লেখযোগ্য। “আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর আলো” আয়াতের একথাগুলো পড়ে কারোর মনে যে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারতো ওপরের বাক্যাংশটির মাধ্যমে তা দূর হয়ে যায়। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহকে “আলো” বলার মানে এ নয় যে, নাউযুবিল্লাহ, আলোই তাঁর স্বরূপ। আসলে তিনি তো হচ্ছেন একটি পরিপূর্ণ ও পূর্ণাংগ সত্তা। তিনি জ্ঞানী, শক্তিশালী, প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ ইত্যাদি হবার সাথে সাথে আলোর অধিকারীও। কিন্তু তাঁর সত্তাকে আলো বলা হয়েছে নিছক তাঁর আলোকোজ্জলতার পূর্ণতার কারণে। যেমন কারোর দানশীলতা গুণের পূর্ণতার কথা বর্ণনা করার জন্য তাকেই “দান” বলে দেয়া অথবা তার সৌন্দর্যের পূর্ণতার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে স্বয়ং তাকেই সৌন্দর্য আখ্যা দেয়া।
# যদিও আল্লাহর এ একক ও একচ্ছত্র আলো সমগ্র বিশ্ব-জাহান আলোকিত করছে কিন্তু তা দেখার, জানার ও উপলব্ধি করার সৌভাগ্য সবার হয় না। তা উপলব্ধি করার সুযোগ এবং তার দানে অনুগৃহীত হবার সৌভাগ্য আল্লাহই যাকে চান তাকে দেন। নয়তো অন্ধের জন্য যেমন দিনরাত সমান ঠিক তেমনি অবিবেচক ও অদূরদর্শী মানুষের জন্য বিজলি, সূর্য, চাঁদ ও তারার আলো তো আলোই, কিন্তু আল্লাহর নূর ও আলো সে ঠাহর করতে পারে না। এ দিক থেকে এ দুর্ভাগার জন্য বিশ্ব-জাহানে সবদিকে অন্ধকারই অন্ধকার। দু’চোখ অন্ধ। তাই নিজের একান্ত কাছের জিনিসই সে দেখতে পারে না। এমনকি তার সাথে ধাক্কা খাওয়ার পরই সে জানতে পারে এ জিনিসটি এখানে ছিল। এভাবে ভিতরের চোখ যার অন্ধ অর্থাৎ যার অন্তর্দৃষ্টি নেই সে তার নিজের পাশেই আল্লাহর আলোয় যে সত্য জ্বলজ্বল করছে তাকেও দেখতে পায় না। যখন সে তার সাথে ধাক্কা খেয়ে নিজের দুর্ভাগ্যের শিকলে বাঁধা পড়ে কেবলমাত্র তখনই তার সন্ধান পায়।
# এর দু’টি অর্থ হয়। এক, তিনি জানেন কোন্ সত্যকে কোন্ উপমার সাহায্যে সর্বোত্তম পদ্ধতিতে বুঝানো যেতে পারে। দুই, তিনি জানেন কে নিয়ামতের হকদার এবং কে নয়। যে ব্যক্তি সত্যের আলোর সন্ধানী নয়, যে ব্যক্তি সমগ্র মনপ্রাণ দিয়ে নিজের পার্থিব স্বার্থেরই মধ্যে বিলীন হয়ে যায় এবং বস্তুগত স্বাদ ও স্বার্থের সন্ধানে নিমগ্ন থাকে আল্লাহ জানেন যে, সে এর সন্ধানী ও ঐকান্তিক সন্ধানী সে-ই এ দান লাভের যোগ্য।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
পূর্ববর্তী দুটো অধ্যায়ে মানব চরিত্রের নিকৃষ্টতম নৈতিক দোষগুলাে আলােচিত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য মানব চরিত্রকে এগুলো থেকে সংশােধন করে নির্মল পবিত্র ও জ্যোতির্ময় করা। এই নৈতিক দোষগুলাে হচ্ছে মানুষের রক্ত মাংস থেকে উদ্ভুত যৌন কামনা ও কু-দৃষ্টি, মানুষের প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ আরােপ ও কুৎসা রটনা এবং অপবাদ আরােপকারীর প্রতি আক্রোশ ও প্রতিশােধের স্পৃহা। অশ্লীলতাকে যাতে ব্যক্তির চরিত্র, সমাজ জীবন ও কথাবার্তা সব কিছু থেকে উচ্ছেদ করা যায় সে জন্যে ব্যভিচারের শাস্তি ও অপবাদের শাস্তি কঠোরভাবে আরােপ করা হয়েছে। সরলমনা, সতী ঈমানদার নারীদের প্রতি অপবাদ আরােপের এক জঘন্য ও পৈশাচিক নমুনা তুলে ধরা হয়েছে এবং কতিপয় সতর্কতামূলক ও নিরাপত্তামূলক বিধি জারী করা হয়েছে। যেমন, বাড়ীতে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি লাভ, দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ, সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা গােপন করণ, কামোত্তেজক উপকরণসমূহ নিষিদ্ধকরণ, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী উপকরণসমূহ নিষিদ্ধকরণ,বিয়ের যােগ্য নরনারীর বিয়ের ব্যবস্থা করা, বেশ্যাবৃত্তির উচ্ছেদ ও দাসমুক্তি প্রভৃতি। এসব বিধির উদ্দেশ্য হলাে রক্ত ও মাংস থেকে উদ্ভূত কাম বাসনা নিবৃত্ত করা এবং মানুষের সতিত্ব, সততা, শ্লীলতা ও স্বচ্ছতা রক্ষার ব্যবস্থা করা। অপবাদ আরােপ সংক্রান্ত ঘটনার জের হিসেবে যে আক্রোশ ও প্রতিশােধ স্পৃহা জাগ্রত হয় এবং মূল্যবােধের ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় ও যে উদ্বেগের সঞ্চার হয়, ঘটনার শেষে তার সমাধান আলােচিত হয়েছে। এ সমাধানের পর রাসূল(স.), হযরত আয়েশা, হযরত আবুবকর সাফওয়ান বিন মােয়াত্তাল সকলেই শাস্ত, পরিতৃপ্ত ও সন্তুষ্ট হয়ে যান। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত সাক্ষ্য ও অপবাদ দূরীকরণে সবার মন প্রসন্ন ও উৎফুল্ল হয়ে যায়। সাধারণ মুসলমানরাও আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে যায় এবং তাওবা করে। তাদের মনের সকল ক্লেদ ও বিভ্রান্তি দূর হয়ে যায়, সবার মন আল্লাহর অনুগ্রহ ও পথ নির্দেশনা লাভে কৃতজ্ঞতায় পরিপ্লুত হয়। *আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন আসমান ও যমীনের নুর : এরূপ নির্মল ও চমকপ্রদ শিক্ষা ও দিক নির্দেশনার মাধ্যমে মানুষকে পরিশুদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে পরিশুদ্ধ মানুষগুলাে আল্লাহর জ্যোতিতে জ্যোতির্ময় হয়েছে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মুক্ত দিগন্তে মহান আল্লাহর বৃহত্তম জ্যোতি লাভ করে আপন অন্তরাত্মাকে উদ্ভাসিত করেছে। শুধু উদ্ভাসিতই করেনি, বরং জ্যোতির্ময় এক জগতে নিজেকে নিরন্তর আল্লাহর নূর লাভের যােগ্যও বানিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি…’ এই চমকপ্রদ বাক্য উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই উজ্জ্বল দিক নির্দেশক আলাে গােটা জগতে ছড়িয়ে পড়ে, সমগ্র সৃষ্টিজগতকে তা উল্লসিত করে, মানব জাতির সমগ্র চিন্তা চেতনা ও অংগ প্রত্যংগ দেদিপ্যমান করে। সকল আবেগ ও অনুভূতিকে পরিপ্লুত করে, আর এই নয়নাভিরাম জ্যোতির দিগন্তপ্লাবী জোয়ারে সমগ্র সৃষ্টিজগত আল্লাহর তাসবীহ করে, এই জাতিকে সকলের চোখ আলিংগন করে, সকল পর্দা অপসৃত হয়, সকল অন্তর দর্পণের মতাে স্বচ্ছ হয়, সকল আত্মা আনন্দে উদ্বেলিত হয়, আলোর বন্যায় প্লাবিত সমগ্র বিশ্ব প্রকৃতিতে সকল সৃষ্টি তাসবীহ পাঠ করতে থাকে। আলাের সমুদ্রে অবগাহন করে সকল জিনিস পবিত্র হয়ে যায়, প্রত্যেক জিনিস স্বীয় কলুষ কালিমা ও মরিচা থেকে মুক্ত হয়ে যায়। ফলে সর্বত্র ওড়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির পতাকা, অনুষ্ঠিত হয় জ্ঞান ও মিলনের মহােৎসব। প্রীতি, ভালােবাসা, আনন্দ ও খুশীর মহা সমারােহ। সমগ্র সৃষ্টিজগত ও তার অভ্যন্তরে বিদ্যমান সকল বস্তু ও প্রাণী সব রকমের বাধা ও সীমানার বন্ধনমুক্ত এমন এক আলােয় আলােকিত হয়ে যায়, যার মধ্যে আকাশ ও পৃথিবী মিলিত হয়ে একাকার হয়ে যায়, সকল জড় ও প্রাণী, সকল নিকট ও দূরের সৃষ্টি, সকল পাহাড় ও সমতল প্রান্তর, সকল গােপন ও প্রকাশ্য বস্তু এবং সকল হৃদয় ও অনুভূতি এক দেহে লীন হয়ে যায় । ‘আল্লাহ তায়ালা আকাশ ও পৃথিবীর জ্যোতি।’ অর্থাৎ যে জ্যোতি থেকে আকাশ ও পৃথিবীর অস্তিত্বের উদ্ভব ঘটেছে এবং যে জ্যোতি দ্বারা আকাশ ও পৃথিবীর শৃংখলা রক্ষিত ও বিধি ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালাই সেই জ্যোতি। এই জ্যোতিই বিশ্ব জগতকে অস্তিত্ব দান করে এবং এর নিয়ম শৃংখলা ও বিধিব্যবস্থা | রচনা করে। মানব জাতি সাম্প্রতিককালে তাদের বিজ্ঞানের শক্তি দ্বারা এই নিগূঢ়তম তত্ত্বের কিছু অংশ উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাদের হাতেই যখন এটম বা অনু ভেদে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে বস্তুকে নিছক আলােকরশ্মীতে রূপান্তরিত করেছে, তখন তারা স্বচক্ষেই দেখতে পেরেছে যে, বস্তুর মূল উৎস আলাে ছাড়া আর কিছু নয়। বস্তুর প্রতিটা অনু বহুসংখ্যক ইলেকট্রনের সমষ্টি মাত্র, যাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করলে একটা রশ্মীর আকার পরিগ্রহ করে এবং যার সারাংশ আলাে ছাড়া আর কিছু নয় মানুষের অন্তর এই সুক্ষ্মতম ও নিগূঢ়তম সত্যকে বিজ্ঞানের অভ্যুদয়ের শত শত বছর আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলাে। মন যখন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার থাকে এবং আলাের জগতে পরিভ্রমণ করতাে, তখন এ সত্য অনুধাবন করতাে। রসূলের হৃদয় এ সত্যকে তায়েফ থেকে ফেরার সময় পূর্ণাংগভাবে উপলব্ধি করেছিলাে। দু’হাত মেলে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করে তিনি বলেছিলেন, তােমার সেই আলাের কাছে আশ্রয় চাই, যা সকল অন্ধকারকে উদ্ভাসিত করে দিয়েছে এবং যার কল্যাণে দুনিয়া ও আখেরাতের সব কিছু শুধরে গেছে।’ মেরাজের সফরেও তিনি এই সত্যকে অবলােকন করেছিলেন। হযরত আয়েশা(রা.) যখন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আপনার প্রভুকে দেখেছেন? তখন তিনি বললেন, তিনি তাে জ্যোতি। কিভাবে তাঁকে দেখবাে তবে মানব সত্ত্বার মধ্যে এই জ্যোতির প্লাবনকে ধারণ ও গ্রহণ করার ক্ষমতা সব সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেই দূর দিগন্তকে দীর্ঘদিন সে পর্যবেক্ষণ করতে পারে না। এই দূর দিগন্তকে আয়াতে স্পষ্ট করে দেয়ার পর পুনরায় তার অবস্থান নির্ণয় করার জন্যে এবং একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে বলা হচ্ছে, তার জ্যোতির দৃষ্টান্ত যেন একটা তাক, তাতে আছে, একটা প্রদীপ, সে প্রদীপটা একটা কাচের ফানুসের মধ্যে রয়েছে, কাচের ফানুসটা যেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র, সে প্রদীপ জ্বালানাে হয় পূত পবিত্র যয়তুন গাছের তেল দিয়ে, যা পূর্বমুখীও নয়, পশ্চিম মুখীও নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তেল নিজেই উজ্জল আলাে দিচ্ছে (আর যদি স্পর্শ করে তাহলে তা হবে), জ্যোতির ওপর জ্যোতি। এটা এমন একটা উদাহরণ, যার সাহায্যে সীমাবদ্ধ বােধশক্তিকে একটা অসীম বিষয় বুঝিয়ে দেয়া হয় এবং অনুভূতি শক্তি যখন কোনাে জিনিসের আসল রূপ কল্পনা করতে অক্ষম হয়, তখন তার ক্ষুদ্র নমুনাকে চিত্রায়িত করে তার সামনে রাখা হয়। মানবীয় বােধশক্তি যখন আল্লাহর জ্যোতির ব্যাপকতাকে উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়, তখন এ উদাহরণ দ্বারা তাকে সে জ্যোতির স্বভাব ও প্রকৃতি কি, তা বুঝিয়ে দেয়া হয়। কেননা তার বােধশক্তি এতাে সীমিত ক্ষমতা সম্পন্ন যে, আল্লাহর জ্যোতির ব্যাপকতা ও তার বিশাল বিচরণ ক্ষেত্রকে সে কল্পনা করতে পারে না। যে জ্যোতি সমগ্ৰ আকাশ ও পৃথিবী জুড়ে বিরাজমান, তাকে এই উদাহরণে আকাশ ও পৃথিবীর বিস্তৃত একে বিশাল ক্ষেত্র থেকে নিয়ে একটা তাকের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। এই তাক হলাে প্রাচীরের গায়ে অবস্থিত জানালার চেয়ে ক্ষুদ্র একটা ফোকর। এতে প্রদীপ রাখা হয়। এই ক্ষুদ্র তাকে যখন প্রদীপ রাখা হয়, তখন তার আলাে ওর ভেতরে সংকুচিত ও সীমাবদ্ধ হওয়ার কারণে জোরদার ও তীব্র মনে হয়। একটা তাকের মতাে যার ভেতরে প্রদীপ রয়েছে। প্রদীপটি রয়েছে একটা কাচের ফানুসের ভেতরে। এই কাঁচের ফানুস প্রদীপকে বাতাস থেকে রক্ষা করে, প্রদীপের আলােকে স্বচ্ছ ও তীব্র করে। কাঁচের ফানুসটা যেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র। অর্থাৎ তা স্বকীয়ভাবেই উজ্জল, দেদিপ্যমান ও আলো বিকিরণকারী। এখানে আসল ও উদাহরণের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন করা হচ্ছে, নমুনা ও আসলকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র কাচের ফানুসকে সুবৃহৎ নক্ষত্রের সাথে তুলনা করার মাধ্যমে আসল ও নমুনার মধ্যে সংযােগ স্থাপন করা হচ্ছে, যাতে কল্পনা কেবল ক্ষুদ্র নমুনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থেকে না যায়, যাকে কেবল সুবৃহৎ আসলকে বুঝানাের জন্যেই ব্যবহার করা হয়েছে। এই তুলনা সম্পন্ন করার পর পুনরায় নমুনার দিকে তথা প্রদীপের দিকে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সে প্রদীপ জ্বালানাে হয় পূতপবিত্র যয়তুন গাছের তেল দিয়ে। এটা সবার জানা ছিলাে যে, যয়তুন তেলের প্রদীপ সবচেয়ে স্বচ্ছ আলাে দেয়। কিন্তু শুধুমাত্র এ কারণেই এ উদাহরণটা দেয়া হয়নি। বরং পূত পবিত্র যয়তুন গাছ থেকে যে মহিমান্বিত ভাবচিত্রটা পাওয়া যায়, সেটাই এ উদাহরণ দেয়ার মূল কারণ। তূর পর্বত সংলগ্ন সেই পবিত্র উপত্যকার ভাবচিত্রটা এখানে পাওয়া যায়, যা আরব উপদ্বীপের নিকটতম যয়তুন উৎপাদনকারী স্থান। কোরআনে এই যয়তুন গাছের দিকে আরো আভাস ইংগিত দেয়া হয়েছে। যেমন সূরা মােমেনূনে বলা হয়েছে, ‘সিনাই এর তূর উপত্যকা থেকে জন্মানাে সেই গাছ, যা আহরণকারীদের জন্যে তেল ও রং নিয়ে উৎপন্ন হয়ে থাকে।’ যয়তুন একটা দীর্ঘজীবী গাছ, যার তেল, কাঠ, ফল ও পাতা সব কিছুই জনহিতকর। অতপর ক্ষুদ্র নমুনা বাদ দিয়ে পুনরায় বৃহৎ আসলের উল্লেখ করা হচ্ছে। কেননা এই গাছ কোনাে নির্দিষ্ট গাছ নয় এবং তা কোনাে নির্দিষ্ট স্থান বা দিকের সাথেও সংশ্লিষ্ট নয়। বরং এটা নিছক বুঝানাের জন্যে একটা উদাহরণ মাত্র, পূর্বমুখীও নয়, পশ্চিমমুখীও নয়। এর তেলও এই সুনির্দিষ্ট ও দৃষ্টিগ্রাহ্য তেল নয়, বরং তা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এক বিস্ময়কর। তেল, ‘আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তেল নিজেই উজ্জ্বল আলাে দিচ্ছে।’ অর্থাৎ তা স্বতই এতাে স্বচ্ছ এবং এতাে উজ্জ্বল যে, আগুন দিয়ে না জ্বালালেও তা যেন জ্বলে। ‘জ্যোতির ওপর জ্যোতি।’ এভাবে আমরা চুড়ান্ত পর্যায়ে গভীর ও উদ্ভাসিত জ্যোতির দিকে ফিরে যাই। বস্তুত আল্লাহর জ্যোতির কল্যাণেই আকাশ ও পৃথিবীর অন্ধকার দূরীভূত হয়ে আলোয় উদ্ভাসিত হয়। এই জ্যোতির প্রকৃত স্বরূপ এবং এর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি আমরা বুঝতে অক্ষম এ জ্যোতির উল্লেখের উদ্দেশ্য মানুষের মনকে তার দিকে আকৃষ্ট করা ও তার সাথে আত্মার সম্পর্ক সৃষ্টি করার জন্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তােলা ছাড়া আর কিছু নয়। ‘তিনি তার জ্যোতির দিকে যাকে চান পথ প্রদর্শন করেন।’ অর্থাৎ যারা নিজেদের হৃদয়কে আল্লাহর জ্যোতি দর্শনের জন্যে উন্মুক্ত করে, তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ তায়ালা যাকে যাকে চান এই জ্যোতির দিকে পথ প্রদর্শন করেন, ফলে তারা এই জ্যোতি দেখতে পায়। এই জ্যোতি আকাশ ও পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজমান, সর্বত্র বহমান, সর্বত্র সর্বক্ষণ বিদ্যমান। কখনো তার প্রবাহ বন্ধ হয় না, বিচ্ছিন্ন হয় না, নেভে না। যেদিকেই কেউ মনােনিবেশ করে, সেদিকেই সে এই জ্যোতি দেখতে পায়। পথহারা ব্যক্তি যে দিকেই তাকায় এই জ্যোতি তাকে পথ দেখায়। যেখানেই কেউ এই জ্যোতির সন্ধান পায়, সেখানেই সে আল্লাহকে পেয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা তার জ্যোতি সম্পর্কে যে উদাহরণই দেন, মানুষের কাছে তা সহজবােধ্য করার জন্যেই দেন। কেননা মানুষের বােধশক্তির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত, আল্লাহ মানুষের সুবিধার্থেই উদাহরণ দেন। তিনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত। ওই উক্ত, সর্বত্র বিরাজমান ও সর্বত্র প্রবহমান জ্যোতি আল্লাহর সেই সব গৃহে দীপ্তিমান, যেখানে আল্লাহর সাথে মানুষের মন মিলিত হয়, আল্লাহর সন্ধান করে, আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর জন্যে নিবেদিত ও উৎসর্গীত হয় এবং পৃথিবীর সকল লােভনীয় সামগ্রীর ওপর আল্লাহকেই অগ্রাধিকার দেয়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
অত্র আয়াতে বলা হচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং আকামণ্ডলী ও জমিনের নূর বা আলো। এটি
الحسي والمعنوي
তথা ইন্দ্রিয়গত ও অর্থগত উভয় দিক থেকে। তা হলন আল্লাহ তা‘আলা সত্ত্বাগত নূর, তাঁর হিযাব নূর। তাঁর হিযাব যদি খুলে দেয়া হয় তাহলে সৃষ্টির যে পর্যন্ত তাঁর জ্যোতি যাবে ততদূর পুড়ে যাবে। (সহীহ মুসলিম হা: ৭৯) অর্থগত হলন আল্লাহ তা‘আলার কিতাব নূর, শরীয়ত নূর, মু’মিন বান্দাদের অন্তরের ঈমানও নূর। যদি মু’মিনের অন্তরে এ নূর না থাকত তাহলে তাগুতের অন্ধকার তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নিত। এতে বুঝা যায়, আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্ব আছে, যদি অস্তিত্ব না-ই থাকত তাহলে পৃথিবী ও আকাশে আলো থাকত না, আর পৃথিবী ও আকাশের কেউই সুপথপ্রাপ্ত হত না। মানুষ প্রদীপের আলো দ্বারা যেমন পথ চলাচল করে, তেমনি আল্লাহ তা‘আলার আলো দিয়ে মানুষ সঠিক পথের সন্ধান পায় যা জান্নাতের দিকে চলে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা আকাশমণ্ডলী ও জমিনের আলো এ কথা সহীহ হাদীসের দ্বারাও প্রমাণিত। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাহাজ্জুদের সালাতে দাঁড়িয়ে সানায় পড়তেন:
اللَّهُمَّ لَكَ الحَمْدُ، أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ
হে আল্লাহ তা‘আলা! তোমারই যাবতীয় প্রশংসা। তুমি আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী এবং উভয়ের মধ্যে অবস্থিত সকল কিছুর জ্যোতি। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১৭, সহীহ মুসলিম হা: ৭৬৯)
এরপর আল্লাহ তাঁর নূরের উপমা পেশ করেছেন, যে নূর হল মু’মিনের অন্তরে ঈমান ও কুরআনের নূর। আল্লাহ তা‘আলার জ্যোতির উপমা হলন যেমন একটি তাকে একটি প্রদীপ রাখা আছে এবং তা রাখা আছে একটি কাঁচের আবরণের ভিতর। আর ওর মধ্যে এমন এক বরকতময় গাছের বিশেষ ধরনের তেল ভরা হয়েছে; যা বিনা দিয়াশলাই-এ নিজে নিজেই আলোকিত হওয়ার উপক্রম। এভাবে সমস্ত আলো একটি তাকে জমা হয়েছে এবং তা আলোয় আলোময় হয়ে রয়েছে। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত দলীল-প্রমাণের অবস্থা যা অতি স্পষ্ট এবং একটি অন্যের তুলনায় আরো উত্তম। যা আলোর ওপর আলো। যা প্রাচ্যের নয়, পাশ্চাত্যেরও নয়। অর্থাৎ পূর্বের নয়, পশ্চিমেরও নয়। এর অর্থ হল ঐ বৃক্ষ এমন এক খোলা ময়দান ও বৃক্ষহীন প্রান্তরে বিদ্যমান যার ওপর সূর্যের আলো সব সময় পড়ে।
لنوره এখানে তাঁর নূর বলতে ইসলাম ও ঈমানকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ঈমান ও ইসলাম গ্রহণ করার মাধ্যমে পবিত্র কুরআনের নির্দেশিত পথে চলার সুযোগ করে দেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সমগ্র আকাশ-জমিন ও এদের মধ্যে যা কিছু আছে সকল কিছুর নূর বা জ্যোতি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
২. আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্ব রয়েছে।
৩. যায়তুন বৃক্ষের ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল।
৪. আল্লাহ তা‘আলার নূরের একটি উপমা পাওয়া গেল।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# মহান আল্লাহ বলেনঃ আমি আমার পাক কালাম কুরআন কারীমের এই উজ্জ্বল ও সুস্পষ্ট আয়াত তোমাদের সামনে বর্ণনা করে দিয়েছি। পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনাবলীও তোমাদের সামনে বিদ্যমান রয়েছে যে, সত্যের ঐ বিরুদ্ধাচরণকারীদের পরিণাম কি হয়েছে এবং কেমন হয়েছে! ওটাকে একটি কাহিনী বানিয়ে দেয়া হয়েছে। পরবর্তী লোকদের জন্যে ওটাকে একটা শিক্ষা ও উপদেশমূলক ঘটনা করে দেয়া হয়েছে। যাতে আল্লাহভীরু লোকেরা এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং আল্লাহ তা’আলার বিরুদ্ধাচরণ হতে বেঁচে থাকে।
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “কুরআন কারীমে তোমাদের মতভেদের ফায়সালা বিদ্যমান রয়েছে। এতে রয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেদের সংবাদ এবং পরে সংঘটিত হবে এরূপ বিষয়ের অবস্থার বর্ণনা। এগুলো বাজে কথা নয়। এগুলোকে যে বেপরোয়াভাবে ছেড়ে দিবে তাকে আল্লাহ তা’আলা ধ্বংস করবেন এবং যে এটা ছাড়া অন্য কিতাব খোজ করবে, আল্লাহ তাকে পথভ্রষ্ট করবেন।
# হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা’আলা আসমানবাসী ও যমীনবাসীদের পথ-প্রদর্শক। তিনিই এ দুটোর মধ্যে সূর্য, চন্দ্র ও তারকারাজীর ব্যবস্থাপনা করে থাকেন। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহর নূর হলো হিদায়াত। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাকেও অবলম্বন করেছেন। হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বলেন যে, তার নূরের দৃষ্টান্ত’-এর ভাবার্থ হচ্ছে তাঁর নূর ধারণকারী মুমিনের দৃষ্টান্ত, যার বক্ষে ঈমান ও কুরআন রয়েছে তার দৃষ্টান্ত। এর উপমা আল্লাহ তা’আলা বর্ণনা করেছেন। প্রথমে তিনি নিজের নূরের বর্ণনা দিয়েছেন, তারপর মুমিনের জ্যোতির বর্ণনা দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনকারীর জ্যোতির উপমা বর্ণনা করেছেন। এমনকি হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) তো (আরবি) এরূপ পড়তেন। অর্থাৎ যে তাঁর উপর ঈমান এনেছে তার জ্যোতির উপমা। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে নিম্নরূপ পড়াও বর্ণিত আছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “এরূপই জ্যোতি ঐ ব্যক্তির যে আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে।” কারো কারো কিরআতে (আরবি) রয়েছে। অর্থাৎ “আল্লাহ আসমান ও যমীনকে জ্যোতির্ময় বানিয়েছেন।” সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ “তারই জ্যোতিতে আসমান ও যমীন উজ্জ্বল রয়েছে।” সীরাতে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকে রয়েছে যে, যেই দিন তায়েফবাসী রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে খুবই কষ্ট দিয়েছিল ঐ দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর দু’আয় বলেছিলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আপনার চেহারার জ্যোতির মাধ্যমে আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি যা অন্ধকারকে আলোকিত করে দেয় এবং যার উপর দুনিয়া ও আখিরাতের উপযুক্ততা নির্ভরশীল। যদি আমার উপর আপনার গযব পতিত হয় বা আমার উপ্র আপনার ক্রোধ নাযিল হয় তবে আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে একবো যে পর্যন্ত না আপনি সন্তুষ্ট হন এবং আল্লাহর তাওফীক ছাড়া গুনাহ হতে ফিরা যাবে না এবং ইবাদত করার ক্ষমতা হবে না।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) রাত্রে ন তাহাজ্জুদ পড়তে উঠতেন তখন তিনি বলতেনঃ(আরবি)
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা। আপনি আসমানসমূহ ও যমীন এবং এগুলোর মধ্যে যত কিছু রয়েছে সবগুলোরই জ্যোতি।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের প্রতিপালকের নিকট রাত ও দিন নেই। তাঁর চেহারার জ্যেতিতেই তাঁর আরশ জ্যোতির্ময়।”
কারো কারো মতে (আরবি)-এর (আরবি) সর্বনামটি আল্লাহর দিকে ফিরেছে। অর্থাৎ আল্লাহর হিদায়াত যা মুমিনের অন্তরে রয়েছে ওর উপমা এইরূপ। আবার কারো মতে (আরবি) সর্বনামটি মুমিনের দিকে ফিরেছে। অর্থাৎ মুমিনের অন্তরের জ্যোতির দৃষ্টান্ত যেন একটি দীপাধার। সুতরাং মুমিনের অন্তরের পরিচ্ছন্নতাকে প্রদীপের কাঁচের সাথে উপমা দেয়া হয়েছে। অতঃপর কুরআন ও শরীয়ত দ্বারা যে সাহায্য সে পেয়ে থাকে ওটার উপমা দেয়া হয়েছে যয়তুনের ঐ তেলের সাথে যা স্বয়ং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চকমকে ও উজ্জ্বল। অতএব, দীপাধার এবং দীপাধারের মধ্যে প্রদীপ এবং প্রদীপটিও উজ্জ্বল। ইয়াহূদীরা প্রতিবাদ করে বলেছিলঃ আল্লাহর জ্যোতি কিরূপে আকাশকে ভেদ করতে পারে? তাদের এ কথার উত্তর তাদেরকে উপমা দ্বারা বুঝানো হয় যে, যেমন প্রদীপের চিমনির মধ্য হতে আলো পাওয়া যায় তদ্রপ আল্লাহ তা’আলার জ্যোতিও আকাশ ভেদ করে আসে। তাই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর জ্যোতি।
(আরবি) -এর অর্থ হলো ঘরের তাক। এটা দ্বারা আল্লাহ তাআলা নিজের আনুগত্যের উপমা দিয়েছেন এবং নিজের আনুগত্যকে তিনি নূর বা জ্যোতি বলেছেন। এর আরো বহু নাম রয়েছে। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, হাবৃশের ভাষায় এটাকে তাক বলা হয়। কেউ কেউ বলেন যে, এটা এমন তাককে বলা হয় যার মধ্যে কোন ছিদ্র থাকে না ইত্যাদি। বলা হয়েছে যে, ওর মধ্যে প্রদীপ রাখা হয়। প্রথমটিই সবল উক্তি। অর্থাৎ প্রদীপ রাখার স্থান। কুরআন কারীমেও এ কথাই রয়েছে যে, তাতে প্রদীপ রয়েছে। সুতরাং দ্বারা নূর বা জ্যোতি বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ কুরআন ও ঈমান যা মুসলমানের অন্তরে থাকে। সুদী (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা প্রদীপ উদ্দেশ্য।
এরপর বলা হচ্ছেঃ প্রদীপটি একটি কাচের আবরণের মধ্যে রয়েছে এবং কাঁচের আবরণটিও উজ্জ্বল। এটা হলো মুমিনের অন্তরের উপমা। কাঁচের আবরণটি মণি-মুক্তা সদৃশ, যেমন উজ্জ্বল নক্ষত্র। (আরবি) -এর অন্য কিরআত(আরবি) এবং(আরবি) -ও রয়েছে। এটা (আরবি) হতে গৃহীত, যার অর্থ হলো দূর করা। তারকা যখন ছিটকে পড়ে তখন ওটা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়। আর যে তারকা অপরিচিত ওটাকেও আরবের লোকেরা (আরবি) বলে থাকে। ভাবার্থ হচ্ছে চমকিত ও উজ্জ্বল তারকা, যা খুব প্রকাশমান ও বড় হয়।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ এই প্রদীপকে প্রজ্বলিত করা হয় পূত-পবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল দ্বারা। (আরবি) শব্দটি বা (আরবি) হয়েছে।
অতঃপর বলা হচ্ছেঃ ঐ যয়তুন বৃক্ষ প্রাচ্যেরও নয় যে, দিনের প্রথম ভাগ হতে ওর উপর রৌদ্র এসে পড়বে না এবং প্রতীচ্যেরও নয় যে, সূর্য অস্তমিত হওয়ার পূর্বে ওর উপর হতে ছায়া সরে যাবে। বরং বৃক্ষটি আছে মধ্যস্থলে। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওটা সূর্যের পরিষ্কার আলোতে থাকে। তাই ওর তেলও খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও উজ্জ্বল হয়।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ ঐ বৃক্ষটি মাঠের মধ্যে রয়েছে। কোন গাছ, পাহাড়, গুহা বা অন্য কোন জিনিস ওকে আড়াল করে। এ কারণেই ঐ গাছের তেল খুবই পরিষ্কার হয়।
হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, খোলা বায়ু এবং পরিষ্কার রৌদ্র ওতে পৌছে থাকে। কেননা, ওটা খোলা মাঠের মধ্যস্থলে থাকে। আর এ কারণেই ওর তেল অত্যন্ত পাক-সাফ, উজ্জ্বল ও চকচকে হয়। ওটাকে প্রাচ্যেরও গাছ বলা যাবে না এবং প্রতীচ্যেরও নয়। এরূপ গাছ খুবই তরু-তাজা ও সবুজ-শ্যামল হয়ে থাকে। সুতরাং এরূপ বৃক্ষ যেমন বিপদ-আপদ হতে রক্ষা পেয়ে থাকে, অনুরূপভাবে মুমিনও ফিত্না-ফাসাদ থেকে রক্ষিত থাকে। যদি সে ফিক্সার কোন পরীক্ষায় পড়েও যায় তবুও আল্লাহ পাক তাকে ঈমানের উপর স্থির ও অটল রাখেন।
অতএব, আল্লাহ তা’আলা তাকে চারটি গুণের অধিকারী করেন। ওগুলো হলোঃ কথায় সত্যবাদিতা, বিচারে ন্যায়পরায়ণতা, বিপদে ধৈর্যধারণ এবং মিতের উপর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। তাই সে অন্যান্য সমস্ত মানুষের মধ্যে এমনই যেমন মৃতদের মধ্যে কোন জীবিত মানুষ।
হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, এই বৃক্ষটি যদি দুনিয়ার মাটিতে থাকতো তবে তো অবশ্যই ওটা প্রাচ্যের হতো অথবা প্রতীচ্যের হতো। কিন্তু এটা তো আল্লাহর জ্যোতির উপমা!
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এটা হলো ভাল লোকের দৃষ্টান্ত যে ইয়াহূদীও নয় এবং খৃষ্টানও নয়। এসব উক্তির মধ্যে সর্বোত্তম হলো প্রথম উক্তিটি যে, ওটা যমীনের মধ্যভাগে রয়েছে। সকাল ও সন্ধ্যায় বিনা বাধায় সেখানে রৌদ্র পৌছে থাকে। কেননা, ওর চারদিকে কোন গাছ নেই। কাজেই এরূপ গাছের তেল নিঃসন্দেহে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, পাতলা এবং উজ্জ্বল হবে। এ জন্যেই বলা হয়েছে যে, এটা প্রজ্বলিত করা হয়েছে পূত-পবিত্র যয়তুন তেল দ্বারা। ওটা এমনই উজ্জ্বল যে, ওকে অগ্নি স্পর্শ না করলেও যেন ওর তেল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে। সুতরাং এটা জ্যোতির উপর জ্যোতি। সুতরাং মুমিন পাঁচটি নূর বা জ্যোতি লাভ করেছে। তার কথা জ্যোতি, তার আমল জ্যোতি, তার আসা জ্যোতি, তার যাওয়া জ্যোতি এবং তার শেষ ঠিকানাও জ্যোতি অর্থাৎ জান্নাত।
হযরত কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এটা হলো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দৃষ্টান্ত। তাঁর নবুওয়াত জনগণের উপর এমনভাবে প্রকাশমান যে, তিনি মুখে না বললেও জনগণের উপর তা প্রকাশ হয়ে পড়বে। যেমন এই যয়তুন তেল যে, ওকে না জ্বালালেও নিজেই উজ্জ্বল। তাহলে এখানে দু’টো জ্যোতি একত্রিত হয়েছে। একটি যয়নের এবং অপরটি আগুনের। এ দুটি যৌথভাবে আলো দেয়। অনুরূপভাবে কুরআনের জ্যোতি ও ঈমানের জ্যোতি একত্রিত হয় এবং মুমিনের অন্তর জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথ-নির্দেশ করেন তাঁর জ্যোতির দিকে। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “আল্লাহ তাআলা সৃষ্টজীবকে এক অন্ধকারের মধ্যে সৃষ্টি করেন। তারপর তিনি ঐ দিন তাদের উপর নিজের জ্যোতি নিক্ষেপ করেন। সুতরাং ঐ দিন যে তার ঐ নূর বা জ্যোতি লাভ করেছে সে সুপথ প্রাপ্ত হয়েছে। আর যে তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। এ জন্যেই আমি বলি যে, আল্লাহর কলম তার ইলম মুতাবেক চলার পর শুকিয়ে গেছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ তাআলা মুমিনের অন্তরের হিদায়াতের উপমা নূর বা জ্যোতির সাথে দেয়ার পর বলেনঃ আল্লাহ তাআলা এই দৃষ্টান্তসমূহ মানুষের উপদেশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর ইলমেও তার মত কেউ নেই। কে হিদায়াত লাভের যোগ্য এবং কে পথভ্রষ্ট হওয়ার উপযুক্ত তা তিনি খুব ভালরূপই জানেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অন্তর চার প্রকার। প্রথম হলো পরিষ্কার ও উজ্জ্বল, দ্বিতীয় আবরণীর মধ্যে আবদ্ধ, তৃতীয় উল্টোমুখী এবং চতুর্থ হলো উল্টো সোজা। প্রথম অন্তর হলো মুমিনের অন্তর। দ্বিতীয় অন্তর হলো কাফিরের অন্তর। তৃতীয় হলো। মুনাফিকের অন্তর যে, সে জানে ও অজানা হয়ে যায় এবং চিনে ও বুঝে, আবার অস্বীকার করে এবং চতুর্থ অন্তর হলো ঐ অন্তর যাতে ঈমানও আছে এবং নিফাকও আছে। এতে ঈমানের দৃষ্টান্ত হলো তরকারীর গাছ, যে ভাল পানি ওকে বাড়িয়ে তোলে। এতে নিফাকের দৃষ্টান্ত হলো ফোড়া, রক্ত ও পূজ ওকে উত্তেজিত করে। যেটা জয়যুক্ত হয় সেটা ঐ অন্তরের উপর ছেয়ে যায়।
اللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(Book#975)
[ اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ
Allah is the Light of the heavens and the earth.]
Sura:24
Para:18
Sura: An- Noor.
Ayat: 34-35
www.motaher21.net
24:34
وَ لَقَدۡ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ اٰیٰتٍ مُّبَیِّنٰتٍ وَّ مَثَلًا مِّنَ الَّذِیۡنَ خَلَوۡا مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ مَوۡعِظَۃً لِّلۡمُتَّقِیۡنَ ﴿٪۳۴﴾
And We have certainly sent down to you distinct verses and examples from those who passed on before you and an admonition for those who fear Allah .
وَلَقَدْ أَنزَلْنَا إِلَيْكُمْ ايَاتٍ مُّبَيِّنَاتٍ
And indeed We have sent down for you Ayat that make things plain,
meaning, in the Qur’an there are Ayat which are clear and explain matters in detail.
وَمَثَلً مِّنَ الَّذِينَ خَلَوْا مِن قَبْلِكُمْ
and the example of those who passed away before you,
means, reports about the nations of the past and what happened to them when they went against the commandments of Allah, as Allah says:
فَجَعَلْنَـهُمْ سَلَفاً وَمَثَلً لِّلٌّخِرِينَ
And We made them a precedent, and an example to later generations. (43:56)
We made them a lesson, i.e., a rebuke for committing sin and forbidden deeds.
وَمَوْعِظَةً
and an admonition,
لِّلْمُتَّقِينَ
for those who have Taqwa.
meaning, for those who remember and fear Allah.
24:35
اَللّٰہُ نُوۡرُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ مَثَلُ نُوۡرِہٖ کَمِشۡکٰوۃٍ فِیۡہَا مِصۡبَاحٌ ؕ اَلۡمِصۡبَاحُ فِیۡ زُجَاجَۃٍ ؕ اَلزُّجَاجَۃُ کَاَنَّہَا کَوۡکَبٌ دُرِّیٌّ یُّوۡقَدُ مِنۡ شَجَرَۃٍ مُّبٰرَکَۃٍ زَیۡتُوۡنَۃٍ لَّا شَرۡقِیَّۃٍ وَّ لَا غَرۡبِیَّۃٍ ۙ یَّکَادُ زَیۡتُہَا یُضِیۡٓءُ وَ لَوۡ لَمۡ تَمۡسَسۡہُ نَارٌ ؕ نُوۡرٌ عَلٰی نُوۡرٍ ؕ یَہۡدِی اللّٰہُ لِنُوۡرِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ یَضۡرِبُ اللّٰہُ الۡاَمۡثَالَ لِلنَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿ۙ۳۵﴾
Allah is the Light of the heavens and the earth. The example of His light is like a niche within which is a lamp, the lamp is within glass, the glass as if it were a pearly [white] star lit from [the oil of] a blessed olive tree, neither of the east nor of the west, whose oil would almost glow even if untouched by fire. Light upon light. Allah guides to His light whom He wills. And Allah presents examples for the people, and Allah is Knowing of all things.
The Parable of the Light of Allah
Ali bin Abi Talhah reported that Ibn Abbas said:
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالاَْرْضِ
Allah is the Light of the heavens and the earth.
means, the Guide of the inhabitants of the heavens and the earth.
Ibn Jurayj reported that Mujahid and Ibn Abbas said concerning the Ayah:
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالاَْرْضِ
(Allah is the Light of the heavens and the earth).
“He is controlling their affairs and their stars and sun and moon.”
As-Suddi said concerning the Ayah:
اللَّهُ نُورُ السَّمَاوَاتِ وَالاَْرْضِ
(Allah is the Light of the heavens and the earth).
“by His Light the heavens and earth are illuminated.”
In the Two Sahihs, it is recorded that Ibn Abbas, may Allah be pleased with him, said:
“When the Messenger of Allah got up to pray at night, he would say:
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالاَْرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالاَْرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ
O Allah,
to You be praise, You are the Sustainer of heaven and earth and whoever is in them.
To You be praise, You are the Light of the heavens and the earth and whoever is in them.
It was narrated that Ibn Mas`ud said,
“There is no night or day with your Lord; the Light of the Throne comes from the Light of His Face.”
مَثَلُ نُورِهِ
The parable of His Light,
There are two views concerning the meaning of the pronoun (His).
The first is that it refers to Allah, may He be glorified and exalted, meaning that the parable of His guidance in the heart of the believer is
كَمِشْكَاةٍ
(as a niche).
This was the view of Ibn Abbas.
The second view is that the pronoun refers to the believer, which is indicated by the context of the words and implies that the parable of the light in the heart of the believer is as a niche. So the heart of the believer and what he is naturally inclined to of guidance and what he learns of the Qur’an which is in accordance with his natural inclinations are, as Allah says:
أَفَمَن كَانَ عَلَى بَيِّنَةٍ مِّن رَّبِّهِ وَيَتْلُوهُ شَاهِدٌ مِّنْهُ
Can they who rely on a clear proof from their Lord, and whom a witness from Him recites it (can they be equal with the disbelievers). (11:17)
The heart of the believer in its purity and clarity is likened to a lamp in transparent and jewel-like glass, and the Qur’an and Shariah by which it is guided are likened to good, pure, shining oil in which there is no impurity or deviation.
كَمِشْكَاةٍ
as (if there were) a niche,
Ibn Abbas, Mujahid, Muhammad bin Ka`b and others said,
“This refers to the position of the wick in the lamp.”
This is well-known, and hence Allah then says:
فِيهَا مِصْبَاحٌ
and within it a lamp.
This is the flame that burns brightly.
Or it was said that the niche is a niche in the house.
This is the parable given by Allah of obedience towards Him. Allah calls obedience to Him as light, then He calls it by other numerous names as well.
Ubayy bin Ka`b said,
“The lamp is the light, and this refers to the Qur’an and the faith that is in his heart.”
As-Suddi said,
“It is the lamp.”
الْمِصْبَاحُ فِي زُجَاجَةٍ
the lamp is in a glass,
means, this light is shining in a clear glass.
Ubayy bin Ka`b and others said,
“This is the likeness of the heart of the believer.”
الزُّجَاجَةُ كَأَنَّهَا كَوْكَبٌ دُرِّيٌّ
the glass as it were a star Durriyyun,
Some authorities recite the word Durriyyun with a Dammah on the Dal and without a Hamzah,
which means pearls, i.e., as if it were a star made of pearls (Durr).
Others recite it as Dirri’un or Durri’un, with a Kasrah on the Dal, or Dammah on the Dal, and with a Hamzah at the end,
which means reflection (Dir’), because if something is shone on the star it becomes brighter than at any other time.
The Arabs call the stars they do not know Darari.
Ubayy bin Ka`b said:
a shining star.
Qatadah said:
“Huge, bright and clear.”
يُوقَدُ مِن شَجَرَةٍ مُّبَارَكَةٍ
lit from a blessed tree,
means, it is derived from olive oil, from a blessed tree.
زَيْتُونِةٍ
an olive,
This refers to the blessed tree mentioned previously.
لاَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ
neither of the east nor of the west,
means, it is not in the eastern part of the land so that it does not get any sun in the first part of the day, nor is it in the western part of the land so that it is shaded from the sun before sunset, but it is in a central position where it gets sun from the beginning of the day until the end, so its oil is good and pure and shining.
Ibn Abi Hatim recorded that Ibn Abbas commented on:
زَيْتُونِةٍ
لاَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ
(an olive, neither of the east nor of the west),
“This is a tree in the desert which is not shaded by any other tree or mountain or cave, nothing covers it, and this is best for its oil.”
Mujahid commented on:
لاَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ
(neither of the east nor of the west) saying;
“It is not in the east where it will get no sun when the sun sets, nor is it in the west where it will get no sun when the sun rises, but it is in a position where it will get sun both at sunrise and sunset.”
Sa`id bin Jubayr commented:
زَيْتُونِةٍ
لاَّا شَرْقِيَّةٍ وَلَا غَرْبِيَّةٍ
يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ
an olive, neither of the east nor of the west, whose oil would almost glow forth (of itself),
“This is the best kind of oil. When the sun rises it reaches the tree from the east and when it sets it reaches it from the west, so the sun reaches it morning and evening, so it is not counted as being in the east or in the west.”
يَكَادُ زَيْتُهَا يُضِيءُ وَلَوْ لَمْ تَمْسَسْهُ نَارٌ
whose oil would almost glow forth (of itself), though no fire touched it.
Abdur-Rahman bin Zayd bin Aslam said:
(this means) because the oil itself is shining.
نُّورٌ عَلَى نُورٍ
Light upon Light!
Al-Awfi narrated from Ibn Abbas that this meant the faith and deeds of a person.
As-Suddi said:
نُّورٌ عَلَى نُورٍ
(Light upon Light!),
“Light of the fire and the light of the oil:when they are combined they give light, and neither of them can give light without the other.
Similarly the light of the Qur’an and the light of faith give light when they are combined, and neither can do so without the other.”
يَهْدِي اللَّهُ لِنُورِهِ مَن يَشَاء
Allah guides to His Light whom He wills.
means, Allah shows the way to the ones whom He chooses, as it says in the Hadith recorded by Imam Ahmad from Abdullah bin Amr, who said,
“I heard the Messenger of Allah say:
إِنَّ اللهَ تَعَالَى خَلَقَ خَلْقَهُ فِي ظُلْمَةٍ ثُمَّ أَلْقَى عَلَيْهِمْ مِنْ نُورِهِ يَوْمَيِذٍ فَمَنْ أَصَابَ مِنْ نُورِهِ يَوْمَيِذٍ اهْتَدَى وَمَنْ أَخْطَأَ ضَلَّ فَلِذَلِكَ أَقُولُ جَفَّ الْقَلَمُ عَلَى عِلْمِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ
Allah created His creation in darkness, then on the same day He sent His Light upon them. Whoever was touched by His Light on that day will be guided and whoever was missed will be led astray. Hence I say:the pens have dried in accordance with the knowledge of Allah, may He be glorified.”
وَيَضْرِبُ اللَّهُ الاَْمْثَالَ لِلنَّاسِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
And Allah sets forth parables for mankind, and Allah is All-Knower of everything.
Having mentioned this parable of the Light of His guidance in the heart of the believer, Allah ends this Ayah with the words:
وَيَضْرِبُ اللَّهُ الاَْمْثَالَ لِلنَّاسِ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
(And Allah sets forth parables for mankind, and Allah is All-Knower of everything).
meaning, He knows best who deserves to be guided and who deserves to be led astray.
Imam Ahmad recorded that Abu Sa`id Al-Khudri said,
“The Messenger of Allah said:
الْقُلُوبُ أَرْبَعَةٌ
قَلْبٌ أَجْرَدُ فِيهِ مِثْلُ السِّرَاجِ يُزْهِرُ
وَقَلْبٌ أَغْلَفُ مَرْبُوطٌ عَلَى غِلَفِهِ
وَقَلْبٌ مَنْكُوسٌ
وَقَلْبٌ مُصْفَحٌ
فَأَمَّا الْقَلْبُ الاْأَجْرَدُ فَقَلْبُ الْمُوْمِنِ سِرَاجُهُ فِيهِ نُورُهُ
وَأَمَّا الْقَلْبُ الاْأَغْلَفُ فَقَلْبُ الْكَافِرِ
وَأَمَّا الْقَلْبُ الْمَنْكُوسُ فَقَلْبُ الْمُنَافِقِ عَرَفَ ثُمَّ أَنْكَرَ
وَأَمَّا الْقَلْبُ الْمُصْفَحُ فَقَلْبٌ فِيهِ إِيمَانٌ وَنِفَاقٌ وَمَثَلُ الاْأِيمَانِ فِيهِ كَمَثَلِ الْبَقْلَةِ يُمِدُّهَا الْمَاءُ الطَّيِّبُ وَمَثَلُ النِّفَاقِ فِيهِ كَمَثَلِ الْقَرْحَةِ يُمِدُّهَا الدَّمُ وَالْقَيْحُ فَأَيُّ الْمدَّتَيْنِ غَلَبَتْ عَلَى الاْأُخْرَى غَلَبَتْ عَلَيْهِ
Hearts are of four kinds:
the heart that is clear like a shining lamp;
the heart that is covered and tied up;
the heart that is upside-down; and
the heart that is clad in armor.
– As for the clear heart, it is the heart of the believer in which is a lamp filled with light;
– as for the covered heart, this is the heart of the disbeliever;
– as for the upside-down heart, this is the heart of the hypocrite, who recognizes then denies;
– as for the armor-clad heart, this is the heart in which there is both faith and hypocrisy. The parable of the faith in it is that of legume, a sprout that is irrigated with good water, and the likeness of the hypocrisy in it is that of sores that are fed by blood and pus. Whichever of the two prevails is the characteristic that will dominate.
Its chain of narrators is good (Jayyid) although they (Al-Bukhari and Muslim) did not record it.
For getting Quran app: play.google.com/store/apps/details?id=com.ihadis.quran