أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৭৯)[মুনাফিক রা বলে:- বই নং ২৫।]
[ وَ یَقُوۡلُوۡنَ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَ بِالرَّسُوۡلِ وَ اَطَعۡنَا ثُمَّ یَتَوَلّٰی فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِکَ ؕ وَ مَاۤ اُولٰٓئِکَ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۴۷﴾
তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করেছি কিন্তু এরপর তাদের মধ্য থেকে একটি দল (আনুগত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মু’মিন নয়।]
সূরা:- আন-নূর।
সুরা:২৪
পারা:১৮
৪৭-৫২ নং আয়াত:-
www.motaher21.net
২৪:৪৭
[ وَ یَقُوۡلُوۡنَ اٰمَنَّا بِاللّٰہِ وَ بِالرَّسُوۡلِ وَ اَطَعۡنَا ثُمَّ یَتَوَلّٰی فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِکَ ؕ وَ مَاۤ اُولٰٓئِکَ بِالۡمُؤۡمِنِیۡنَ ﴿۴۷﴾
তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করেছি কিন্তু এরপর তাদের মধ্য থেকে একটি দল (আনুগত্য থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মু’মিন নয়।]
২৪:৪৮
وَ اِذَا دُعُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَہُمۡ اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡہُمۡ مُّعۡرِضُوۡنَ ﴿۴۸﴾
ওদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের দিকে ওদেরকে আহবান করা হলে, ওদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়।
২৪:৪৯
وَ اِنۡ یَّکُنۡ لَّہُمُ الۡحَقُّ یَاۡتُوۡۤا اِلَیۡہِ مُذۡعِنِیۡنَ ﴿ؕ۴۹﴾
সিদ্ধান্ত ওদের স্বপক্ষে হবে মনে করলে, ওরা বিনীতভাবে রসূলের নিকট ছুটে আসে।
২৪:৫০
اَفِیۡ قُلُوۡبِہِمۡ مَّرَضٌ اَمِ ارۡتَابُوۡۤا اَمۡ یَخَافُوۡنَ اَنۡ یَّحِیۡفَ اللّٰہُ عَلَیۡہِمۡ وَ رَسُوۡلُہٗ ؕ بَلۡ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿٪۵۰﴾
তাদের মনে কি (মুনাফিকীর) রোগ আছে? না তারা সন্দেহের শিকার হয়েছে? না তারা ভয় করছে আল্লাহ ও তাঁর রসূল তাদের প্রতি যুলুম করবেন? আসলে তারা নিজেরাই যালেম।
২৪:৫১
اِنَّمَا کَانَ قَوۡلَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اِذَا دُعُوۡۤا اِلَی اللّٰہِ وَ رَسُوۡلِہٖ لِیَحۡکُمَ بَیۡنَہُمۡ اَنۡ یَّقُوۡلُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ؕ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ ﴿۵۱﴾
মু’মিনদের কাজই হচ্ছে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রসূল তাদের মোকদ্দমার ফায়সালা করেন, তখন তারা বলেন, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। এ ধরনের লোকেরাই সফলকাম হবে।
২৪:৫২
وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰہَ وَ رَسُوۡلَہٗ وَ یَخۡشَ اللّٰہَ وَ یَتَّقۡہِ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفَآئِزُوۡنَ ﴿۵۲﴾
আর সফলকাম তারাই যারা আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মেনে চলে এবং আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকে।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
বিশাল সৃষ্টিজগতের দৃশ্যাবলীর মধ্য থেকে দুটো জ্যোতির্ময় ক্ষেত্র সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনার পর এবার সূরা তার মূল আলােচ্য বিষয়ে ফিরে এসেছে। বিষয়টা হলাে, সেই সব নিয়ম বিধি সংক্রান্ত, যার ভিত্তিতে কোরআন মুসলমানদেরকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন মনমানসিকতা সম্পন্ন ও আল্লাহর জ্যোতিতে উদ্ভাসিত একটা সুসভ্য জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে সেই সব সৎ লােক সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে, যারা ব্যবসা বাণিজ্য ও বেচাকেনায় লিপ্ত থেকেও আল্লাহর স্মরণ নামায ও যাকাতের ব্যাপারে উদাসীন হয় না। আরো আলােচিত হয়েছে কাফেরদের সৎ কর্মের পরিণতি এবং তাদের অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার বিষয়। এবারের অধ্যায়টাতে আলােচনা করা হয়েছে মােনাফেকদের সম্পর্কে, যারা আল্লাহর সুস্পষ্ট আয়াতগুলাে দ্বারাও উপকৃত হয় না এবং হেদায়াত লাভ করে না। তারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে পরিচয় দিলেও মােমেনরা যেভাবে আল্লাহর রসূলের আনুগত্য করে ও তাঁর আদেশে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থাকে, তারা সেভাবে আনুগত্য করে না। এ অধ্যায়ে তাদের ও খাঁটি মােমেনদের পার্থক্য দেখানাে হয়েছে। বলা হয়েছে যে, খাঁটি মােমেন যারা, তাদেরকে তাে আল্লাহ তায়ালা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাদেরকে পৃথিবীর খেলাফত দান করবেন। ইসলামী জীবন যাপনের সুযােগ দেবেন, নিরাপত্তা দেবেন এবং এ সবই আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের আনুগত্যে পুরস্কার হিসেবে দেবেন যদিও কাফেররা তাদের প্রতি শত্রুতা পােষণ করে থাকে। বস্তুগত দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক শক্তিশালী হতে পারে, কিন্তু কাফেররা পৃথিবীতে অজেয় শক্তির অধিকারী নয়। তাদের শেষ পরিণতি জাহান্নাম, যা খুবই খারাপ জায়গা। *ইসলামের প্রতিষ্ঠা না চাওয়াটাই মুনাফিকের লক্ষণ : আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি সুস্পষ্টভাবে বর্ণনাকারী আয়াতসমূহ নাযিল করেছি, আল্লাহ তায়ালা যাকে চান সঠিক পথ দেখান।’ বস্তুত আল্লাহর আয়াতগুলাে দ্ব্যর্থহীন ও আকাটা। এগুলাে আল্লাহর জ্যোতিকে স্বচ্ছভাবে প্রতিফলিত করে এবং তার হেদায়াতের উৎসকে স্পষ্ট করে। ভালাে ও মন্দ এবং ন্যায় ও অন্যায়কে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয় এবং ইসলামের জীবন ব্যবস্থাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরে। পৃথিবীতে আল্লাহর নির্দেশগুলােকে সন্দেহমুক্তভাবে পেশ করে। মানুষ যখন আল্লাহর বিধান অনুসারে পথ নির্দেশ চায়, তখন একটা সুস্পষ্ট ও নির্ভুল শরিয়তের কাছেই পথ নির্দেশ চায়। এতে কারাে অধিকার হরণেরও আশংকা থাকে না, হকের সাথে বাতিলের বা হারামের সাথে হালালের মিশ্রণও ঘটে না। আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছা তাকে সরল পথের সন্ধান দেন অর্থাৎ এ ব্যাপারে আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত ও শর্তহীন। তবে আল্লাহ তায়ালা হেদায়াতের জন্যে একটা পথ নির্ধারণ করে রেখেছেন। যারা নিজেদেরকে সে পথে পরিচালিত করতে সচেষ্ট হয় তারাই হেদায়াত লাভ করতে পারে, আল্লাহর নূর লাভ করতে পারে, তার সাথে সম্পৃক্ত হতে পারে, সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারে। অপরদিকে যারা সেই পথ থেকে দূরে সরে যাবে অথবা উপেক্ষা করবে তারা সত্যের আলাে থেকে বঞ্চিত হবে, বিপথে চলে যাবে। এখানেও আল্লাহর ইচ্ছাই কাজ করবে। আর এভাবেই হেদায়াত ও গােমরাহীর ক্ষেত্রে আল্লাহর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। এতাে সব সুস্পষ্ট দলীল প্রমাণ ও নিদর্শনাদি দেখার পরও একদল কপট ও মােনাফেক লােকেরা বাহ্যিকভাবে নিজেদেরকে মুসলমান রূপে যাহির করতে অথচ ইসলামের আদব কায়দা ও গুণাবলী তারা ধারণ করতাে না। তারা বলতাে, ‘আমরা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান এনেছি…'(আয়াত ৪৭-৫০) সঠিক ও নির্ভেজাল ঈমান হৃদয়ের গভীরে বন্ধমূল হলে তার প্রভাব ব্যক্তির আচার আচরণেও প্রকাশ পাবে। ইসলাম হচ্ছে একটি গতিময় আদর্শের নাম। এতে নেতিবাচক আচরণের কোনাে অবকাশ নেই। ফলে এই আদর্শের প্রতিফলন চেতনার জগতে যখনই ঘটবে তখনই তার বহিপ্রকাশ ঘটবে বাস্তব জগতে, কর্মের মাধ্যমে ও আচার আচরণের মাধ্যমে। ইসলামের মৌলিক শিক্ষাই হচ্ছে এই যে, মানুষ তার হৃদয়ের সুপ্ত আকীদা বিশ্বাসকে বাস্তব রূপ দান করবে এবং স্থির প্রথা বা নীতিতে রূপান্তরিত করবে। সাথে সাথে প্রতিটি আচরণ ও কর্মের পেছনে ওই মূল আকীদা বিশ্বাসের চেতনা ও প্রেরণা ক্রিয়াশীল থাকতে হবে। এর ফলে প্রতিটি আচরণ ও কর্ম হবে জীবন্ত এবং মূল উৎসের সাথে সম্পৃক্ত। এই সে তারা বলতাে, ‘আমরা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ঈমান এনেছি এবং আনুগত্য স্বীকার করেছি’ এটা তাদের নিছক একটা মৌলিক দাবী ছিলাে। কারণ, এর কোনাে বাস্তব প্রতিফলন তাদের কর্ম জীবনে ঘটেনি। বরং তাদের কর্ম জীবন তাদের এই মৌলিক দাবীর সম্পূর্ণ পরিপন্থী ছিলাে। তাই আল্লাহ তায়ালা ঘােষণা দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘এরা মােমেন নয়। কারণ মােমেনদের কথা ও কাজ এক হয়। তাদের কাছে ঈমান কোনাে খেল তামাশার বস্তু নয় যে, কিছুক্ষণ খেলার পর তা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যে দিক খুশী যাওয়া যাবে। বরং তাদের কাছে ঈমান হচ্ছে অন্তরের গভীরে স্থান দেয়ার মতাে একটা বস্তু, একটা মানসিক চেতনার নাম এবং বাস্তব জীবনে চর্চা করার মতাে এটা আদর্শ। হৃদয়ের গভীরে এই চেতনা ও বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়ে গেলে তা থেকে বিন্দু পরিমাণও বিচ্যুত হওয়া সম্ভব হয় না। ওই মােনাফেকগােষ্ঠী মুখে ঈমানের দাবী করলেও নিজেদের আচরণের মাধ্যমেই এই দাবীর অসারতা নিজেরাই প্রমাণ করে দিতাে যখন তাদেরকে শরীয়ত অনুযায়ী বিচার করার জন্যে রসূলুল্লাহ(স.)-কে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করতে আহ্বান করা হতাে। এই প্রসঙ্গে নিচের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্যে যখন তাদেরকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তাদের একদল মুখ ফিরিয়ে নেয়। সত্য তাদের সপক্ষে হলে তারা বিনীতভাবে রসূলের কাছে ছুটে আসে।’ ওদের ভালই জানা ছিলাে যে, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের বিচার পক্ষপাতমূলক হতে পারে না, মনগড়া হতে পারে না এবং শক্রতা ও মিত্রতার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে না। কিন্তু তা সত্তেও তারা এই ন্যায় বিচারকে এড়িয়ে যেতাে, আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের ইনসাফপূর্ণ ফয়সালার প্রতি অনীহা প্রকাশ করতাে। কারণ, তারা সত্যের প্রত্যাশী নয়। কাজেই ন্যায় বিচারকে তারা বরদাশত করতে পারে না। কিন্তু তাদের নিজেদের কোনাে স্বার্থ বা অধিকারের ব্যাপারে থাকলে তখন তারা বিচারের জন্যে রসূলুল্লাহ(স)-এর কাছে দৌড়ে যেতাে এবং তার ফয়সালা মাথা পেতে নিতাে, তাতে রাযী খুশী থাকতাে। কারণ, তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতাে যে, রসূলুল্লাহ(স.) শরীয়ত অনুযায়ী ন্যায় বিচারই করবেন, তিনি এতে কোনাে অন্যায়ের প্রশ্রয় দেবেন না এবং কারাে অধিকার খর্ব করবেন না । ঈমানের দাবীদার এই গােষ্ঠীই আবার অন্যায়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন আচরণের আশ্রয় নিতাে। এরা হচ্ছে কপটের দল, মােনাফেকের দল। প্রত্যেক যুগে ও প্রত্যেক স্থানে এর এই পরিচয়েই আবির্ভূত হয়। এরা নিজেদের কুফরী বিশ্বাসকে লুকিয়ে রাখে, জনসমক্ষে প্রকাশ করতে সাহস পায় না। তাই ইসলামের আবরণে নিজেদেরকে পেশ করে, অথচ শরীয়ত অনুযায়ী তাদের বিচার আচার হােক এতে তারা রাযী নয়। তাই আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের ফয়সালার দিকে তাদেরকে আহ্বান করা হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, অস্বীকৃতি জানায় এবং নানা ওযর আপত্তি ও টাল বাহানার আশ্রয় নেয়। কারণ ওরা প্রকৃত অর্থে মােমেন নয়। ঈমান যদি তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হতাে, তাহলে তারা কখনাে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূলের ফয়সালা কে অগ্রাহ্য করতে পারতাে না, অমান্য করতে পারতাে না এবং কেবল নিজেদের স্বার্থ রক্ষার খাতিরেই শরীয়তের দ্বারস্থ হতাে না, ইসলামী আইনের আশ্রয় নিতাে না। আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের ফয়সালায় রাযী খুশী থাকা ও সন্তুষ্ট থাকাই হচ্ছে প্রকৃত ঈমানের পরিচয়। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, হৃদয়ের গভীরে ঈমানের হাকীকত ও তাৎপর্য বদ্ধমূল হয়েছে কিনা। এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার গভীরতা। কাজেই যারা আল্লাহর ফয়সালাকে অগ্রাহ্য করে, আল্লাহর রাসূলের ফয়সালা কে অগ্রাহ্য করে, তাদের মাঝে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবােধের বহিপ্রকাশ ঘটেনি, তাদের হৃদয়ে ঈমানের আলো প্রজ্জলিত হয়নি। তারা রােগাগ্রস্ত, তারা সংশয়বাদী, তারা অদ্ভুত চরিত্রের অধিকারী। ওই কারণেই আল্লাহ তায়ালা বিস্ময় প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করছেন, ‘তাদের অন্তরে কি রােগ আছে, না তারা ধোকায় পড়ে আছে…'(আয়াত ৫০) প্রথম প্রশ্নটি ওদের চারিত্রিক ব্যাধিই প্রমাণিত করে। কারণ, অন্তরে রােগ থাকলেই কেবল এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তির দ্বারা কখনাে এ জাতীয় আদর্শচ্যুতি ঘটতে পারে না, বরং হৃদয় রােগাগ্রস্ত হলেই মানুষের স্বভাব ও চরিত্রের মাঝে বিকৃতি ঘটে ও নৈতিক পদস্খলন ঘটে। তখন মানুষ ঈমানের বাস্তবতা ও তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না এবং ঈমানের সঠিক আদর্শকে ধারণ করতে পারে না। দ্বিতীয় প্রশ্নটি দ্বারা ওদের সংশয়বাদী স্বভাবের প্রতি বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এরা ঈমানের দাবীদার হয়েও আল্লাহর ফয়সালার ব্যাপারে কি করে সন্দেহ পােষণ করে? তাহলে কি এরা ওই ফয়সালাকে খােদায়ী ফয়সালা হিসেবে বিশ্বাস করতে দ্বিধাগ্রস্ত? অথবা এরা কি মনে করে যে ওই ফয়সালার দ্বারা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়? এই মনােভাবই যদি ওদের হয়ে থাকে তাহলে নিসন্দেহে বলা যায়, ওরা মােমেনদের আদর্শের অনুসারী নয়। তৃতীয় প্রশ্নটি দ্বারা ওদের এই অদ্ভুত স্বভাব ও প্রকৃতির প্রতি নিন্দাবাদ জানানাের সাথে সাথে বিস্ময়ও প্রকাশ করা হয়েছে। অর্থাৎ, ওরা কি ভাবে মনে করতে পারে যে, ওদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূল অবিচার করবেন? ওই জাতীয় আশংকা ঈমানের দাবীদার একজন ব্যক্তির মনে কি ভাবে দেখা দিতে পারে। কারণ, আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন সবার সৃষ্টিকর্তা এবং সবার পালনকর্তা। কাজেই তিনি নিজের সৃষ্টির প্রতি অবিচার করতে পারেন না, কারাে প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণও করতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, কেবল আল্লাহর ফয়সালাই হতে পারে পক্ষপাতমুক্ত, সব ধরনের সংশয় সন্দেহের উর্ধে। কারণ, আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন একমাত্র ন্যায় বিচারক যিনি কখনাে কারাে প্রতি অন্যায় ও অবিচার করেন না। তাঁর দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান। কাজেই তিনি একজনের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে আর এক জনের প্রতি অবিচার করতে পারেন না, যুলুম করতে পারেন না। আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত আর যে কোনাে ব্যক্তির বিচারের মাঝে পক্ষপাতিত্ব বা অনিয়মের আশঙ্কা থাকতে পারে। কারণ, ব্যক্তি বা গােষ্ঠী বা রাষ্ট্র নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। কাজেই আইন প্রণয়নের সময় অথবা আইন প্রয়ােগের সময় এই ব্যক্তি স্বার্থ বা দলীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থের উর্ধে থাকা সম্ভবপর হয় না। ব্যক্তি যখন আইন প্রণয়ন করে অথবা আইন প্রয়ােগ করে তখন সে নিজের জীবন ও স্বার্থ রক্ষা করার বিষয়টির প্রতি সচেতন থাকে। এই একই নিয়ম দল বা গােষ্ঠীর বেলায়ও দেখা যায় এবং রাষ্ট্র বা একাধিক রাষ্ট্রীয় বলয়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। কিন্তু একমাত্র আল্লাহর ক্ষেত্রেই এই নিয়ম পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, তার আইনের পেছনে তার নিজের কোনাে স্বার্থ নেই, নিজের কোনাে লাভ লােকসান নেই। যা আছে তা আগাগােড়াই ন্যায় বিচার ও পক্ষপাতহীন বিধি বিধান। এর সমকক্ষ অন্য কোনো বিচার ব্যবস্থা নেই এবং এর মতাে বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সম্মত অন্য কোনাে বিধি-বিধান নেই। কাজেই যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের ফয়সালা সন্তুষ্টি চিত্তে মেনে নেয় না তারা নিজেরাই অত্যাচারী ও যালেম। কারণ, এরা চায় না সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হােক, এরা চায় সমাজে সত্যের জয় হােক। সত্য বলতে কি, এরা আল্লাহর বিচার ও ফয়সালায় পক্ষপাতিত্বেরও আশঙ্কা করে না এবং আল্লাহর ন্যায় বিচারের ব্যাপারেও সন্দেহ পােষণ করে না। বরং এরা নিজেরাই অত্যাচারী ও যালেম। কাজেই এরা সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার গ্রহণ করতে পারছে না।
*মােমেনের যথার্থ পরিচয় : অপরদিকে যারা সত্যিকার অর্থে মােমেন, তাদের আচার-আচরণই ভিন্ন। তাই, আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের ফয়সালার প্রতি তাদেরকে আহবান করা হলে তাদের মুখ দিয়ে সে কথাই বের হয় যা একজন মােমেনের জন্যে শােভা পায়, যা তাদের হৃদয়ের ঈমানী চেতনারই পরিচয় বহণ করে। তাদের বক্তব্য পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে। ‘মােমেনদের বক্তব্য কেবল একথাই যখন তাদের মধ্যে ফয়সালা করার জন্যে…’ অর্থাৎ মােমেনদের বক্তব্যে দ্বিধাহীন, সংকোচহীন ও তর্কবিহীন আনুগত্য প্রকাশ পায় কারণ তাদের পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, ন্যায় বিচার কেবল আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের বিচারই হতে পারে। আর অন্যদের বিচার হয় মনগড়া ও পক্ষপাতদুষ্ট। মােমেনরা একমাত্র মহান আল্লাহর প্রতিই নিশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করে থাকে। কারণ একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই হচ্ছেন জীবন দাতা, জীবনের নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক। তাঁর ইচ্ছায়ই গােটা সৃষ্টি জগত পরিচালিত হয়, তিনি মানুষের জন্যে যা কামনা করেন ও করবেন তা নিসন্দেহে মংগলজনক। এমনকি খােদ মানুষ নিজের জন্যে যা কামনা করে, তার চেয়েও অধিক মংগলজনক হচ্ছে আল্লাহর কামনা। কারণ আল্লাহ তায়ালা হচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। কাজেই তার সৃষ্টির জন্যে কোন জিনিসটি মংগলজনক, তা তিনিই ভাল জানেন। মােমেনরাই সফলকাম। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল বিষয় দেখা-শুনা করেন, তাদের গােটা জাগতিক সম্পর্কের মাঝে শৃংখলা বিধান করেন এবং তাদের ভালো মন্দের সব কিছুর ফয়সালা করেন। আর এই ফয়সালা হয় তার জ্ঞান ও ন্যায়নীতির ওপর ভিত্তি করেই। কাজেই মােমেনরা সেসব লােকদের তুলনায় অবশ্যই সফলকাম হবে যাদের সকল খুটি নাটি বিষয় ও বিচার আচারের ভার তাদেরই মতে একদল দুর্বল ও স্বল্পজ্ঞানের অধিকারী মানুষের হাতে ন্যস্ত। মােমেনরাই সফলকাম। কারণ তাদের গােটা জীবন পরিচালিত হয় একটি সহজ, সরল ও সত্য আদর্শের ওপর ভিত্তি করে। এই আদর্শের প্রতি তাদের রয়েছে অবিচল আস্থা, এই আদর্শের ওপর চলতে গিয়ে তারা কখনাে বিভ্রান্তির শিকার হয় না। ফলে তাদের সময় ও শক্তির অপচয় হয় না, ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট কোনাে আদর্শ তাদেরকে আঘাত করতে পারে না। নিজেদের খেয়াল-খুশী মতাে তারা জীবন যাপন করে না। বরং তাদের সামনে থাকে সুস্পষ্ট ও সরল খােদায়ী আদর্শ। যারা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তার শাস্তি থেকে বেঁচে থাকে তারাই কৃতকার্য। আগের আয়াতে খােদায়ী বিধানের প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের ব্যাপারে আলােচনা করা হয়েছে। এখন আলােচনা করা হচ্ছে, সকল বিষয়ে খােদায়ী বিধি-নিষেধ মেনে চলার প্রসংগটি। এখানে আল্লাহর প্রতি ভয় ও খােদাভীতি প্রদর্শনের বিষয়টিও স্থান পেয়েছে। উল্লেখ্য যে, খােদাভীতি বা তাকওয়া পরহেযগারী হচ্ছে ভয় ও ভীতির তুলনায় একটা ব্যাপক গুণ। কারণ তাকওয়া ও পরহেযগারী হচ্ছে ছােট বড় সকল বিষয়ে আল্লাহকে হাযির ও নাযির মনে করা, তাঁর অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা এবং আল্লাহর মহাসত্ত্বার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও সমীহ প্রদর্শন করার মানসে তার অপছন্দনীয় কোনাে কাজ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া এবং সাথে সাথে তাকে ভয়ও করা। কাজেই যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহকে ভয় করবে ও বেঁচে থাকবে তারা অবশ্যই এই পৃথিবীর বুকেও সফলকাম হবে এবং পরকালেও সফলকাম হবে এটা আল্লাহর ওয়াদা । আর আল্লাহ তায়ালা কখনাে ওয়াদা বরখেলাপ করেন না। এই শ্রেণীর বান্দারা সফলকাম হওয়ার উপযুক্তই। এর পেছনে বাস্তব কারণও রয়েছে তাদের জীবনে। কারণ আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের আনুগত্যের দাবী হচ্ছে আল্লাহর পছন্দনীয় ও মনােনীত আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করা। আর যাদের জীবন খোদায়ী আদর্শ অনুযায়ী পরিচালিত হবে তারা তাে সফলকাম হবেই। তদুপরি তারা প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহকে হাযির নাযির মনে করে, প্রতিটি মুহূর্তে তার অস্তিত্বকে অনুভব করে। ফলে তাদের মাঝে কখনাে আদর্শচ্যুতি ঘটে না, তারা কখনাে জীবনের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে না এবং বিভ্রান্তির গহ্বরে তলিয়ে যায় না। ভয় ও ভক্তি এবং তাকওয়া ও পরহেযগারীর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের প্রতি যে আনুগত্য প্রদর্শন করা হয় তা অত্যন্ত উঁচুদরের আনুগত্য। কারণ এই আনুগত্যের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, হৃদয় ও মন খােদায়ী নূর দ্বারা কতটুকু নূরান্বিত, আল্লাহর সাথে সম্পর্কের গভীরতা কতােটুকু এবং আল্লাহর প্রতাপ ও প্রতিপত্তির প্রতি সচেতনতা কতােটুকু। শুধু তাই নয়, এর দ্বারা মােমেনদের উঁচু মন-মানসিকতার ও মান-মর্যাদারও পরিচয় মেলে। যে আনুগত্য আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল নয় তা অমর্যাদারই নামান্তর, এই অমর্যাদাকে একজন প্রকৃত মােমেন কখনাে মেনে নিতে পারে না, তার বিবেক কখনাে এতে সায় দিতে পারে না। কারণ, একজন প্রকৃত মােমেনের মাথা একমাত্র মহা ক্ষমতাধর ও লা-শরীক আল্লাহর সামনেই নত হয়, অন্য কারো সামনে নয়।
# ন্যায় বিচারের মানদণ্ড :: এরপর আলোচনা করা হয়েছে আমানত ও আদল (সুবিচার) এর মাপকাঠি সম্পর্কে । কোন সে মাপকাঠি বা কোন সে পদ্ধতি যার দ্বারা জীবনের সব দিক ও বিভাগের এ দুটি জিনিস সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না তা বুঝা যায়। প্রশ্ন হলো আমানত ও আদল-এর বিষয়গুলো, তার প্রয়োগ পদ্ধতিকে এবং সেগুলা পরখ করার উপায় উপকরণকে কি আমরা মানুষের বুঝ ও ব্যবহার পদ্ধতির ওপর ছেড়ে দেবো? ছেড়ে দেবো কি এসব কিছুকে তাদের বুদ্ধির ফয়সালা ও খোশখেয়ালের ওপর। না তা কিছুতেই হতে পারে না। মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি এবং সঠিক পথপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞান সাধনা অবশ্যই এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এটা সত্য বলে স্বীকার করা সত্ত্বেও মানতে হবে যে ব্যক্তিগতভাবে বা দলীয়ভাবে মানুষ যখন কোনো কিছু চিন্তা ভাবনা করে স্থির করতে চায় তখন সে বিশেষ কোনো পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে থেকেই তা করে। কোনো নির্দিষ্ট এলাকার পরিবেশের প্রভাবমুক্ত সে কখনো থাকতে পারে না বলে সকল দিক চিন্তা ভাবনা করে পরিপূর্ণ ভারসাম্য আনা এবং সুসামঞ্জস্যভাবে গোটা মানবমন্ডলীর জন্যে কোনো পথ বের করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সেখানে আমার-আপনার, অমুক-তমুকের এবং বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠীর বুদ্ধি অবশ্যই কাজ করে। যে কোনো এলাকা বা যে কোনো সময়ের কথা চিন্তা করা হোক না কেন- সবখানেই এই একই ধারায় মানুষ কাজ করে এবং সবখানেই মানুষ বিশেষ কোনো পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবাধীন থাকে আর এই কারণেই কখনো সে এদিকে ঝুঁকে পড়ে আবার কখনো অন্যদিকে ঝুঁকে পড়ে । ফলে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে সে অনেক দূরে চলে যায়। সর্বকালের, সব দেশের, সব পরিবেশের মানুষের জন্যে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা এবং উপকারী-অপকারী জানার জন্যে এমন একটি স্থায়ী মানদন্ড প্রয়োজন যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, যেন এই মানদন্ডের মাধ্যমে তারা তাদের কার্যাবলী যাচাই করতে পারে। শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ভালো মন্দ, তাদের চিন্তাধারা, ব্যবহারের মধ্যে সীমাতিরিক্ত পদক্ষেপ অথবা কাজের ত্রুটি বিচ্যুতি এবং অবহেলা পূর্ণ চিন্তা ও চেষ্টাকে যেন তারা পরিমাপ করতে পারে। মানব কল্যাণ সম্পর্কিত তাদের পরিকল্পনা ও পদ্ধতিকে যেন সঠিকভাবে মুল্যায়ন করতে পারে, সর্বশেষে এই মানদন্ড দ্বারা তাদের হুকুম আহকামকেও যেন বাছাই করতে পারে তাও নিশ্চিত করতে হবে । এ হবে এমন একটি স্থায়ী মানদন্ড যা কারো কোনো অভিরুচি ও প্রবৃত্তির তাড়নে পরিচালিত হবে না, টলবে না কোনো অবস্থায় নিজ বলিষ্ঠ স্থান থেকে অথবা কোনোক্রমেই কারো কোনো প্রভাব সে গ্রহণ করবে না। মন বুদ্ধি উদ্ভুত কোনো মানদন্ডে সর্বকালের, সকল পরিবেশের সব মানুষের জন্যে কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে না। মানব নির্মিত এসব মানদন্ডে কিছু না কিছু ত্রুটি থাকবেই এবং এই মানব নির্মিত মানদন্ড দ্বারা যা কিছু যাচাই বাছাই করা হবে তা সবই হবে ত্রুটিপূর্ণ, আর এ ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে ততোধিক মানুষ রেহাই পাবে না। যতোদিন এ স্থায়ী মানদন্ডের দিকে সে ফিরে না আসবে। গোটা মানবমন্ডলীর জন্যে এই মানদন্ড একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীনই তৈরী করে দিয়েছেন, যেন মানুষ এর দ্বারা আমানত, সুবিচার ব্যবস্থা আদল, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের উপায় উপকরণকে পরখ করে নিতে পারে। এরশাদ হচ্ছে, “হে ঈমানদাররা নিরংকুশভাবে আনুগত্য করো আল্লাহর, আনুগত্য করো রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা হুকুমদাতা আছে তাদেরও….তোমাদের জন্যে সুন্দরতম পদক্ষেপ ও আচরণ ।” (আয়াত ৫৯) কোরআনের এই ছোট্ট আয়াতটিতে আল্লাহ তায়ালা ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমা বর্ণনা করেছন। আয়াতটিতে মুসলিম জামায়াতের সংগঠন পদ্ধতির মৌলিক কথাগুলোও বর্ণিত হয়েছে; বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত শাসন পদ্ধতি ও ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে । এ কথাও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এসব কিছুর সূচনা হয়েছে যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে, এগুলোর সমাপ্তিও একমাত্র তার কাছেই হবে । সকল শক্তি ক্ষমতা যে তার কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে, এ কথা কোরআনে করীমে স্পষ্ট করে বলা হয়নি, যেহেতু এগুলো মানুষের জীবনে যতোগুলো আনুসাংগিক বিষয় আছে তার অন্যতম এবং এসব বিষয়ে মানুষের বুদ্ধি, মতামত ও বুঝ এর মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সেই সব মৌলিক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আয়াত নাযিল করেছেন, যা সকল মানুষের যুক্তি বুদ্ধি, মতামত ও বুঝ শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে গ্রহণ করতে পারে। তাই এরশাদ হচ্ছে, “মানুষের জীবন পরিচালনার জন্যে শাসন ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ হতে হবে, যেহেতু প্রকাশ্য, গোপন এবং বড় ছোট সব কিছুর ওপর আল্লাহ তায়ালাই নিরংকুশ শাসন ক্ষমতার মালিক ।” এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কোরআনে কারীমে সুনির্দিষ্ট বিধান দিয়েছেন এবং মানুষের কাছে বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার জন্যে তিনি তার রসূল পাঠিয়েছেন রসূল সম্পর্কে তিনি সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বললেন, সে মনগড়া কিছু বলে না। অতএব বুঝা যাচ্ছে তার সুন্নত তার চালু করা পদ্ধতি আল্লাহর বিধানেরই অংশ । আল্লাহর আনুগত্য সবার জন্যেই বাধ্যতামূলক। তার সর্বময় ক্ষমতার মালিক হওয়ার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে তার রাজ্যে তার বিধানকে সবার কাছে পরিচিত করা ও যথাযথভাবে পৌছে দেয়া এবং এরপর সবার জন্যে বাধ্যতামূলক হিসেবে সে বিধানকে চালু করা। যারা ঈমান আনবে তাদের কর্তব্য হচ্ছে প্রথমত আল্লাহর আনুগত্য করা এবং তারপর পদাংক অনুসরণ করতে হবে তার রসূলের, কারণ আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাকে তার বার্তাবাহক হওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন ও তার আনুগত্য করার জন্যে মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তার আনুগত্য করার অর্থ সেই আল্লাহরই আনুগত্য করা যিনি তাকে এই জীবন বিধান দিয়ে পাঠিয়েছেন এবং তাকে এই বিধানের আনুগত্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। তার চালু করা জীবন পদ্ধতি অনুযায়ী বিচার ফয়সালা করা সেই দ্বীন জীবন পদ্ধতিরই অপরিহার্য্য অংশ চালু ও প্রয়োগ করা বাধ্যতামূলক এবং কোরআনের আয়াত অনুসারে এই আনুগত্য করা না করা এবং তাঁর প্রদর্শিত জীবন পদ্ধতি চালু করা না করার ওপর ঈমান থাকা না থাকা নির্ভর করে তাই, এরশাদ হচ্ছে, “যদি তোমরা আল্লাহর ওপর এবং শেষ বিচার দিনের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে থাকো ।” অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত হতে হবে সে ‘উলুল আমর’ যারা তাদের মধ্যে ঈমানের শর্তগুলোকে কার্যকর করবে এবং নির্ধারণ কর দেবে কোরআনের আয়াতে বর্ণিত ইসলামের সুস্পষ্ট সীমানাকে ৷ ইসলামের এই সীমানা হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মানা, রসূলের পদাংক অনুসরণ করে চলা, শাসন ক্ষমতার নিরংকুশ মালিক একমাত্র আল্লাহকেই জানা, গোটা মানবমন্ডলীর জন্যে আইন রচনা করার অধিকারী একমাত্র আল্লাহ তায়ালা-এ কথা স্বীকার করা ও তাঁর সাথে মোলাকাত হবে ও তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে-কোরআনের আয়াত অনুসারে এ কথা বিশ্বাস করা; আর যেসব বিষয়ে কোরআনে সুম্পষ্টভাবে কোনো আয়াত নাযিল হয়নি, যার কারণে এসব বিষয় বুঝা, মতামত কায়েম করা এবং রায় দেয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে, সেই সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে আল্লাহর দিকে রুজু করা! স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির কোনো আনুগত্য নেই :: এ আয়াতে যেমন আল্লাহর আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে তেমনি রসূল(স.)-এর আনুগত্যও যে একইভাবে আসল আনুগত্য তাও জানানো হয়েছে, যেহেতু রসূল(স.) তারই প্রেরিত ব্যক্তি; আর তোমাদের মধ্যে থেকে যে ব্যক্তি ‘উলুল আমর’ (হুকুমদানকারী) হবে, অর্থাৎ যে নিজে আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের অনুগত হবে এবং সেই আনুগত্যবোধ নিয়েই হুকুম দেবে তারও আনুগত্য করা বাধ্যতামূলক ৷ তবে এখানে তার আনুগত্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে সরাসরি (অনুগত) শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি যেমন করে সে শব্দটি আল্লাহ তায়ালা ও রসূল(স.)-এর আনুগত্য করার কথা বলতে গিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। এই বাচনভংগী ব্যবহার করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ কথা জানানো যে, আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের আনুগত্য থেকে যেসব নেতৃবৃন্দের আনুগত্য করার নির্দেশ গৃহীত হয়েছে এবং মোমেনদের সম্বোধন করে ‘তোমাদের মধ্যে থেকে’ বলে যাদের কথা জানানো হয়েছে, অবশ্যই মোমেন হতে হবে এবং ঈমানের শর্তগুলো তারা মেনে চলবে। তোমাদের মধ্যে থেকে হুঁকুমদানকারী কর্তৃপক্ষের আনুগত্য হতে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বিধান অনুযায়ী, যেমন এ কথা ওপরে বর্ণিত হয়েছে, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে আনুগত্যের যে সীমা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে থেকেই আনুগত্য করতে হবে এবং কোন্ কোন্ ব্যক্তির বা কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে আনুগত্য করা যাবে না সে বিষয়ে কোরআনে করীমে খুব স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি, তবে শাসন কতৃপক্ষের কোনো হুকুমে যখন মতভেদ হবে তখন আনুগত্য করতে হবে ততোটুকু যতোটুকুতে আনুগত্য করা নিশ্চিতভাবে হারাম বলে মনে না হবে। বোখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আ’মাশ থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে, ‘অবশ্যই আনুগত্য করতে হবে জানা সকল ভালো কাজের ব্যাপারে ।’ ইয়াহইয়া আল কাত্তান থেকে উভয়ে আর একটি হাদীস এনেছেন, ‘মুসলমান যে কোনো ব্যক্তির জন্যে প্রিয় অপ্রিয় সকল বিষয়েই আনুগত্য করা কর্তব্য যতোক্ষণ পর্যন্ত তাকে কোনো স্পষ্ট গুনাহের কাজে (আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কাজের জন্যে) হুকুম না দেয়া হয়। তারপর যখন আল্লাহর না-ফরমানি করার জন্যে কোনো হুকুম দেয়া হবে তা শুনবেও না, মানবেও না ।’ উম্মুল হোসাইন (হোসাইন-এর মা)-এর প্রতি বরাত দিয়ে মুসলিম শরীফে একটি হাদীস এসেছে, “যদি তোমাদের ওপর কোনো দাসকে (যে ব্যক্তি কোনো সময়ে দাস ছিলো এমন ব্যক্তিকে) নেতা নিয়োগ করা হয় এবং সে তোমাদেরকে আল্লাহর কেতাব অনুসারে পরিচালনা করো, সে অবস্থায় তার কথা মেনে চলো এবং তার আনুগত্য করো ।’ ইসলাম এইভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আল্লাহর রিধান ও রসূল(স.)-এর সুন্নাহ পালন করার ব্যাপারে আমানতদার (বিশ্বস্ত) বানিয়েছে, তার ঈমান ও দ্বীনের ব্যাপারেও আমানতদার বানিয়েছে, তার ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধির ওপরও আমানতদার বানিয়েছেন এবং আমানতদার বানিয়েছেন তাকে দুনিয়া- আখেরাতের সকল কাজের ব্যাপারে ৷ তাকে আল্লাহ তায়ালা এক বন্য জন্তু বানাননি যে তাকে এখানে ওখানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বা থাকতে বলা হবে আর সে শুনবে ও মানবে। মানুষের জন্যে স্পষ্ট পথ খুলে রাখা হয়েছে এবং স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে তাকে আনুগত্যের সীমা সম্পর্কেও এবং যে আইন কানুন সে মেনে চলবে এবং রসূল(স.)-এর যে পদ্ধতি তাকে অবলম্বন করতে বলা হয়েছে তা এক ও অভিন্ন, সেখানে আন্দায অনুমান করে চলার জন্যে কাউকে বলা হয়নি। পারস্পরিক মতভেদ নিরসনে কোরআনের মূলনীতি যে ব্যক্তি অথবা যে সমাজ পরিবেশ পরিস্থিতির বিভিন্নতায় এমন কোনো সংকটে বা সমস্যায় পড়েছে যে কোরআন হাদীস থেকে সুস্পষ্ট বিধান জানতে পারেনি অথবা আদৌ সে বিষয় কোনো বিধান আসেনি, আর এ কারণে বিষয়টির মীমাংসার ব্যাপারে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মত দিয়েছে, সে অবস্থায়ও তাকে দিশেহারা হয়ে বেড়ানোর জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়নি, তাকে সত্য মিথ্যা বাছ বিচার করার মতো কোনো মানদন্ড দেয়া হয়নি- এমনও নয়। ছোট বড় যে কোনো বিষয়ে আইন কানুন বিহীনভাবে সে চলবে, এমন অবস্থায়ও তাকে ছেড়ে দেয়া হয়নি। তাই আলোচ্য ছোট্ট আয়াতটিতে সর্বাবস্থায় তার করণীয় কি হবে তার পদ্ধতি বলে দেয়া হয়েছে; যার ওপর চিন্তা ভাবনা করলে সে যে কোনো সমস্যা সমাধানের রূপরেখা লাভ করতে পারবে, “তারপর যখন কোনো ব্যাপারে তোমরা মতভেদে লিপ্ত হয়ে পড়বে তখন সে ব্যাপারটিকে সমাধানের জন্যে আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও ৷” বিবাদমান বিষয়টিকে কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত অনুরূপ সমস্যার সমাধান সম্পর্কিত বিধানের দিকে এবং সেই আলোকে সতর্কতার সাথে এমনভাবে সমাধান বের করা যা কোরআন ও হাদীসের মূলনীতির বিপরীত না হয় অথবা মানবকল্যাণ বিরোধী না হয়। আসলে, এ কথা সত্য যে, মানুষের জীবনকে ভাসমান অবস্থায় অথবা দিশেহারা হয়ে চলার জন্যে আল্লাহ তায়ালা ছেড়ে দেননি, আর এমনও নয় যে, তারা তাদের জীবনের আইন কানুন নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে ঠিক করে নেবে এবং এমন অনিশ্চিত অন্ধকারের মধ্যেও তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়নি যে, বুদ্ধিহারা হয়ে তারা সমস্যার জটিলতার কারণে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে থাকবে; যেমন : কোনো কোনো ধোকাবাজ বা প্রবঞ্চনাকারী বলতে চেয়েছে যে, এই দ্বীন ইসলামের মধ্যে স্পষ্ট করে কিছু মূলনীতি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে মাত্র, যা পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে জীবনের মৌলিক বিষয়সমূহের ওপর ৷ তাদের কথায় “এ দ্বীন মানুষকে একটি সীমা বা ঘোরের মধ্যে আবদ্ধ করে দিলেও এর মধ্যে এমন অনেক ফাটল বা ছিদ্র পথ আছে যা মুসলমানদের মযবুত বিবেকের কাছে গোপন নেই এবং এই দ্বীনকে পরিমাপ করায় জীবনের নানা সমস্যায় খাপ খাওয়ানোর জন্যে সেগুলো যথেষ্ট । এরশাদ হচ্ছে, “যদি তোমরা আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে থাকো ।” আল্লাহর প্রতি ঈমানের বাস্তব প্রকাশ হচ্ছে, নিসংকোচে ও বিনা যুক্তিতে আল্লাহর হুকুম মেনে চলা, নিরংকুশভাবে রসূল(স.)-এর পদাংক অনুসরণ করা এবং আল্লাহর বিধান ও রসূলের সুন্নত যারা মেনে চলে এমন নেতার আনুগত্য করা এবং মতভেদ সম্বলিত বিষয়সমূহের সমাধানের জন্যে আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করা, এই কাজ গুলো যারা করবে তাদেরই আল্লাহর ওপর ঈমান ও আখেরাত দিবসের ওপর ঈমানের দাবী গ্রাহ্য হবে। যেহেতু এর চাহিদা এটাই যে, বাস্তবে মানুষ বিনা দ্বিধায় আল্লাহর কথা মেনে নিক, রসূলের পুরোপুরি আনুগত্য করুক এবং এসব নেতৃবৃন্দেরও পুরোপুরি আনুগত্য করুক যারা নিজেরা আল্লাহ তায়ালা ও তার রসূলের আনুগত্য করে এবং আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের বিধান মোতাবেক অপরকে চালাতে চায়, আর যখনই সেসব নেতৃবৃন্দের মধ্যে কারো সাথে কোনো বিষয়ে মতভেদ সৃষ্টি হবে তখন সে বিষয়ের ফয়সালার জন্যে কোরআন ও হাদীসে কি রূপরেখা দেয়া হয়েছে তা খুঁজে বের করে সেই অনুসারে যেন তারা ফয়সালা করে নেয়। এটিই আল্লাহ তায়ালা ও আখেরাতের ওপর ঈমানের শর্ত যেহেতু এই কাজগুলোই ঈমানদারদের কাছে দাবী করা হয়েছে। সুতরাং সর্বপ্রথম এই শর্তের অনুপস্থিতি ঘটলে বুঝতে হবে, তার ঈমান নেই। দ্বিতীয় যখনই দেখা যাবে কেউ ঈমানের প্রভাব থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দূরত্বে সরে রয়েছে তখন তারও ঈমান নেই বলে মনে করা হবে। কোরআনে করীমের জিজ্ঞাসাবোধক বাক্যটির মধ্যে সাফল্যের জন্যে কিছু শর্ত পেশ করার পর উৎসাহ উদ্দীপনা জাগানোর উদ্দেশ্যে পুনরায় উপদেশ দান করা হচ্ছে, যেমন ইতিপূর্বে আল্লাহর মহব্বতে সুবিচার করা ও আমানত ও রক্ষা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছিলো।এরশাদ হচ্ছে, “এইটিই উত্তম ও পরিণতির দিক দিয়ে সুন্দরতম পন্থা ।” অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানের জন্যেই এটিই ভালো কাজ এবং দুনিয়া ও আখেরাতের শেষ পরিণতির কথা চিন্তা করলে বুঝা যাবে আনুগত্য করার জন্যে এই নিয়ম মেনে চললেই তা দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জীবনে প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনবে । তবে এ কাজগুলো করার ব্যাপারে এবং নেতৃত্বের আনুগত্য করার এই নিয়ম নীতি অবলম্বনে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের কল্যাণ হবে কি না সে বিষয়ে সুষ্ঠুভাবে কোনো কথা আসেনি । আখেরাতের সে ব্যাপারটি তো আরও অনেক অনেক ডীতিজনক এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যার চিন্তা এখানে দেয়া হয়নি; বরং আখেরাতের চেতনা দান করায় দুনিয়ার কল্যাণ ও ব্যক্তি এবং দলীয় জীবনে যে কল্যাণ রয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এই কর্মসূচীর অর্থ হচ্ছে, মানুষ যেন সেই জীবন পদ্ধতি অবলম্বন করে যা আল্লাহ তায়ালা তার জন্যে নির্ধারণ করে রেখেছেন । আল্লাহ তায়ালাই সব কিছুর নির্মাতা, তিনিই বিজ্ঞানময়, তিনিই জ্ঞানী, তিনিই সবকিছু দেখেন এবং সবকিছুর খবর রাখেন । এ কর্মসূচী প্রণয়নের ক্ষেত্রে, মানুষের অজ্ঞতার মতো কোনো দুর্বলতা এ কর্মসূচীতে নেই৷ নেই কোনো অযৌক্তিক আবেগ উচ্ছ্বাস বা ত্রুটি, নেই এমন কোনো যথেচ্ছার যা কারো অধিকার খর্ব করতে ভূমিকা রাখে । এ কর্মসূচীতে কোনো বিশেষ বিশিষ্ট ব্যক্তি, শ্রেণী, গোত্র, কোনো মানব প্রকৃতি বা বিশেষ কোনো যামানার মানুষের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে তা নয়, অথবা বিশেষ কোনো যুগের মানুষকে অন্যান্য যুগের মানুষ থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে, তাও নয়, কারণ আল্লাহ তায়ালা তো সারা বিশ্বের সবার প্রতিপালক, মালিক ও মনিব আর এমনও নয় যে তিনি কারো সাথে আগে থেকে কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে আছেন। আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের সকল প্রকার দুর্বলতা থেকে উর্ধে । কোনো বিশেষ ব্যক্তির সাথে ভালোবাসার বিনিময়ে এ ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে তা নয়। বিশেষ মানবগোষ্ঠী, শ্রেণী অথবা কোনো জাতি, কোনো বিশেষ ধরনের মানুষ অথবা কোনো বিশেষ যুগের মানুষের সাথে তাঁর বিশেষভাবে সম্পর্কিত হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। মানুষকে যতো প্রকার সুবিধা দান করা প্রয়োজন তার জন্যে আল্লাহর নিজস্ব এক পরিকল্পনা রয়েছে। যেহেতু তিনিই সৃষ্টিকর্তা, এ জন্যে তার প্রকৃতির চাহিদার ধরন কেমন এবং তার প্রকৃত চাহিদাই বা কি তা সঠিকভাবে জানা একমাত্র আল্লাহর পক্ষেই সম্ভব, যেমন করে একমাত্র তিনিই জানেন মানুষের অন্তরের ঝোক প্রবণতা কি ও কোন সংকটাবর্তে সে ঘুরপাক খায় আবার তার থেকে বাঁচার উপায়ই বা কি। তাকে কোন কোন পদ্ধতিতে সম্বোধন করতে হবে এবং তাকে সংশোধনের উপায়ই বা কি তা একমাত্র তিনিই জানেন। মহান সে সত্ত্বা যিনি সব বিষয়ে পরিচালনা করতে গিয়ে কখনো ক্লান্ত হন না। দিশেহারাও হয়ে যান না। আল্লাহ তায়ালা সকল প্রকার সীমাবদ্ধতার উর্ধে ৷ মানুষের জন্যে কোন পথ ও পদ্ধতি উপযোগী তার খবর আল্লাহর জ্ঞান ভান্ডারে সবই সংরক্ষিত রয়েছে। এ যেন এক সীমাহীন মরুভূমিসম অভিজ্ঞতা । এই কঠিন অভিজ্ঞতা অর্জন করা বা এতো প্রশস্ত জ্ঞান গবেষণা করতে গিয়ে মানুষ যখন ভুল করে, তখনই আল্লাহ তায়ালা সাথে সাথে তাকে পাকড়াও করেন না। মানুষ তো মনে করে বস্তুগত ময়দানে তারা যা ইচ্ছা তাই আবিষ্কার করতে পারে। অবশ্যই বস্তুত এ জগৎ মানুষের জগৎ, মানুষের জ্ঞান গবেষণার জন্যে অত্যন্ত প্রশস্ত ক্ষেত্র, এক্ষেত্রে মানুষের বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর বিস্তর সুযোগ রয়েছে; কিন্তু অসংখ্য জটিল পথের মধ্যে থেকে তার জন্যে উপযোগী ও সঠিক পথ খুঁজে বের করার ব্যাপারে তার বুদ্ধিকে বড় মনে করবে বিধায় তারা স্থায়ী কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে না। মানুষের বিভিন্ন চিন্তাধারার মধ্যে এ বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে যে, আল্লাহ তায়ালাই তার সৃষ্টিকর্তা । তিনি সেই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, যার মধ্যে মানুষ বাস করে। অতএব, মানুষের জন্যে, বিশ্বের সব কিছুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি জীবন বিধান রচনা করে দেয়ার দায়িত্ব অবশ্যই তিনি বহন করেন। এমতাবস্থায় সৃষ্টির সেরা এই মানুষ ঝগড়া ফ্যাসাদ করতে থাকবে আর তিনি নিশ্চিন্ত থাকবেন অথবা খুশিবোধ করবেন এটা কখনোই হতে পারে না বরং তখনই তিনি খুশী হবেন যখন দেখবেন মানুষ তাঁর দেয়া বিধান জেনে বুঝে তার সত্যতা স্বীকার করছে এবং তার দ্বারা উপকৃত হচ্ছে । প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এ পথ অবশ্যই তাকে সঠিক পথ দেখাবে এবং যখন সে সংকটাবর্তে পড়ে হাবুডুবু থেতে থাকবে তখন এই জীবন পদ্ধতিই তাকে উদ্ধার করবে। চিন্তা গবেষণার ক্ষেত্রে মানুষের পক্ষে আর একটি বিষয়ে বিশেষভাবে ভাবা প্রয়োজন ৷ যিনি তাকে নানা প্রকার গোলক ধাঁধার মধ্যে থেকে বের করে এনে সঠিক পথে পরিচালনা করছেন এবং সকল ব্যাপারে তাকে নিজ অদৃশ্য হাতে সাহায্য করে চলেছেন, অবশ্যই জ্ঞান রূপ এ নেয়ামত দ্বারা তিনি তাকে সম্মানিত করেছেন এবং জীবন পথে তার বুদ্ধিকে ব্যবহার করার জন্যে তিনি তার জন্যে বিস্তর সুযোগ করে দিয়েছেন তার কাছ থেকে আগত বার্তা (কোরআনী ভাষা) সমূহের ওপর চিন্তা গবেষণার ক্ষেত্রেও তাকে তিনি এ সুযোগ দিয়েছেন, তারপর আরও ইখতিয়ার দিয়েছেন যে কোনো প্রচলিত রসম রেওয়ায বা কোনো মনীষীর সেই সব কথাকে অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা দেয়ার যা কোরআনের মূল শিক্ষা ও মানুষের কল্যাণের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় । আসলে এই স্বাধীন বিবেক বুদ্ধি ও চিন্তা গবেষণার ক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা দান’ মানুষের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মূল জিনিস । এ ব্যাপারে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়েছে, স্ষ্টজগত সম্পর্কে জ্ঞান গবেষণা আর বস্তুগত আবিষ্কার উদ্ভাবনের জন্যে চেষ্টা-সাধনায় তাকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, “এটাই কল্যাণকর ও পরিণতি বিবেচনায় সুন্দরতম পথ ও পদ্ধতি ৷ আল্লাহ, তায়ালা সত্য সঠিক কথাই বলেছেন ।”
# মানব রচিত আইনের কাছে বিচার চাওয়াই হচ্ছে তাগুতের অনুসরণ : ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমারেখা সম্পর্কিত আলোচনা, মুসলিম উম্মাহর জন্যে মৌলিক জীবন ব্যবস্থা, আইন কানুন, এ সবের উৎস এবং এ সম্পর্কিত পরিপূর্ণ ও সাধারণ মূলনীতির বর্ণনা এখানে শেষ হচ্ছে । এরপর আলোচনা আসছে সেসব লোক সম্পর্কে যারা ঝুঁকে থাকে সেই সব লোকের দিকে যারা দ্বীন ইসলামের মূলনীতি থেকে দূরে সরে গেছে, আর এর পরেও তারা মনে করে যে, তারাই মোমেন; অথচ তারা প্রকাশ্যভাবে ঈমানের শর্ত ভংগ করে এবং ইসলামের সীমা লংঘন করে। এই সীমা লংঘনকর আচরণ ও কাজ তখনই সংঘটিত হয় যখন তারা আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনো আইন কানুনের কাছে বিবাদমান বিষয়াদির বিচার ফয়সালার জন্যে এগিয়ে যায়। আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য আইন শুধু মান্যই করে না, বরং মানুষের তৈরী আইনকে (স্বজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায়) আল্লাহর আইন থেকে ভালো মনে করে। এ জন্যে তারা হচ্ছে ‘তাগুত’ অর্থাৎ আল্লাহদ্রোহী । তাই এরশাদ হচ্ছে, “ওরা তাগুত-এর কাছে বিচার পাওয়ার জন্যে যায় অথচ তাদেরকে অস্বীকার করার জন্যেই তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো ।” আল্লাহদ্রোহী এসব ব্যক্তির দিকে তারা এই জন্যে ঝুঁকে থাকে যে, ওদের জীবন যাপন, আচার আচরণ এবং ওদের বিভিন্ন অবস্থা তাদেরকে মুগ্ধ করে, আর এ জন্যে আল্লাহর আইনকে অস্বীকার করে ওদের তৈরী আইন দ্বারা তারা সুবিচার পেতে চায়; অথবা তাদেরকে তারা ভয় করে, যেহেতু শয়তান তাদেরকে ভুল পথে চালিত করতে চায় বলেই সে আল্লাদ্রোহীদের আতংক এদের অন্তরে জমিয়ে দেয় । যখন তাদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে আগত আয়াতগুলোর দিকে আহ্বান জানানো হয় এবং রসূলের আনুগত্য করতে বলা হয় তখন তারা দূরে সরে যায় এবং আল্লাহর কথাগুলোকে বাধাদান করে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে। এই বাধাদানকেই নেফাক বা মোনাফেকী কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যেমন করে তাগুতী শক্তির কাছে বিচার ফয়সালা চাইতে যাওয়াকে ঈমান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার শামিল মনে করা হয়েছে, বরং এই মানষিকতা যারা রাখে তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা আদৌ ঈমান আনেনি । যেহেতু এসব মিথ্যা ক্ষমতাধরদের আনুগত্য করার জন্যে তারা যে সমস্ত খোঁড়া ওযর পেশ করতে চায় সেগুলো কোনো যুক্তিতেই টেকে না এবং এসব ওজুহাত তাদেরকে ভীষণ মুসিবত ও চরম পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এতদসত্তেও রসূল(স.) তাদেরকে নানাভাবে উপদেশ দিয়েছেন। তারপর এ অধ্যায়ের আলোচনা সমাপ্ত করতে গিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন রসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন যে, তাদেরকে পাঠানোই হয়েছিলো যেন মানুষ তাদের পদাংক অনুসরণ করে চলে । এরপর পুনরায় স্পষ্ট আয়াত দ্বারা ঈমানের শর্ত ও ইসলামের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, “তুমি কি দেখছো সেসব ব্যক্তিকে যারা মনে করে, তারা ঈমান এনেছে তোমার ওপর ও তোমার পূর্বে ………..আর শয়তান তো চায়ই তাদেরকে বহু দূরের ভুল পথে নিয়ে যেতে ।” (আয়াত ৬০) আবার যখন তাদেরকে বলা হয়, ‘এসো সেসব জিনিসের দিকে যা আল্লাহ তায়ালা নাযিল করেছেন এবং এসো রসূলের …..হয় আর সর্বাস্তকরণে খুশী মনে সে ফয়সালা মেনে না নেয় ।’ (আয়াত ৬১-৬৫) কোরআনের আয়াতগুলোতে মোনাফেকদের সামগ্রিক কাজ ও ব্যবহারের যে ছবি তুলে ধরা হয়েছে তাতে হিজরতের পর পরই মোনাফেকদের বিভিন্ন আচার আচরণ ফুটে উঠেছে। এ সময় মদীনা ও তার উপকণ্ঠে অবস্থিত ইহুদীরা মোনাফেকদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো, যাতে করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপতৎপরতা চালানোর জন্যে তাদের কাছ থেকে ওরা প্রয়োজনীয় সহায়তা লাভ করতে পারে । ওরা ছিলো মোনাফেকদের বিশেষ একটি দল, যারা নিজেদের মধ্যে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্যে শরীয়তের আইনকে বাদ দিয়ে আল্লাহদ্রোহী শক্তি ইহুদীদের কাছে যাওয়া পছন্দ করতো। আলোচ্য অধ্যায়ের দ্বিতীয় আয়াতে এমনই একটি আচরণের প্রতি ইংগীত করা হয়েছে। এ সময় ইহুদীদের একটি দলকে স্পষ্টভাবে আহ্বান জানানো হয়েছিলো, তারা যেন তাদের পারস্পরিক বিবাদ বিসম্বাদের ফয়সালার জন্যে আল্লাহর কেতাবের দিকে এগিয়ে আসে। তারপরও তারা কখনো কখনো তাওরাতের ফয়সালা চাইতো। আর কখনো রসূলুল্লাহ (স.)-এর কাছে আসতো । এ সময় কিছু কিছু এমন ঘটনা ঘটেছে যেগুলোর ফয়সালার জন্যে তারা আল্লাহ্র আইনকে বাদ দিয়ে তৎকালে প্রচলিত জাহেলী রীতি নীতির আশ্রয় নিয়েছে; তাই ওদের সম্পর্কে আল্লাহর উচ্চারিত কথাটিকেই তারা গ্রহণ করতে পারছে না, যাতে বলা হয়েছে “ওরা মনে করে ও দাবীও করে যে, তোমার প্রতি যা কিছু নাযিল হয়েছে তার প্রতি তারা ঈমান এনেছে এবং এমন সব কথার প্রতিও যা তোমার পূর্বে নাযিল হয়েছিলো ।” আর আমাদের জানা আছে যে ইহুদীরা মানতোও না এবং দাবীও করতো না যে তারা রসূল (স.)-এর প্রতি এবং তার পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি অবতীর্ণ কথাগুলোকে বিশ্বাস করে [যেহেতু সকল নবী রসূল(স.)-এর ওপর ঈমান আনাই ইসলামী আকীদার দাবী] আর এসব ঘটনা হিজরতের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই সংঘটিত হয়েছে, যেহেতু তখনও বনু কোরায়যা ও বনু নযীর ইহুদী গোত্রদ্বয়ের শক্তি পুরোপুরি চূর্ণ হতে পারেনি এবং ইহুদীদের পতনের পূর্বে মোনাফেকদের অবস্থা দুর্বল হয়নি। অবস্থা যাই হোক না কেন, আলোচ্য আয়াতগুলো থেকে আমরা ঈমানের পরিপূর্ণ, সুক্ষ ও অকাট্য সীমারেখা নির্ধারণ করতে পারছি এবং ইসলামের সীমানাও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছি। উপরন্তু আমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে সে মোনাফেকদের বিরুদ্ধে আসা স্পষ্ট সাক্ষ্য পেয়ে যাচ্ছি যারা আল্লাহ তায়ালা ও রসূলের কাছে না এসে অন্যদের কাছে বিচার মীমাংসা পেতে চায় তারা পুরোপুরি মোনাফেক। “অথচ তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে ওদেরকে অস্বীকার করার জন্যে ” যেহেতু আল্লাহর শপথ বাণী রয়েছে যে, তারা ঈমানের গন্ডির মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে না এবং তাদেরকে তখন পর্যন্ত মোমেন মনে করা যাবে না যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা রসূল(স.)-কে তাদের বিবাদ বিসম্বাদে বিচারকর্তা মেনে নেবে এবং তার হুকুমের পুরোপুরি আনুগত্য না করে। সত্যিকারে মোমেন হতে চাইলে তার ফয়সালাকেই সন্তুষ্টির সাথে চূড়ান্ত ফয়সালা বলে মেনে নিতে হবে। অন্তরের পূর্ণ প্রশান্তি সহকারে এবং পরিপূর্ণ খুশীর সাথে রসূল(স.) এর সিদ্ধান্তকে নিজেদের জন্যে কল্যাণকর বলে মানতে হবে, কোনো মজবুরীর অনুভুতি নিয়ে নয়; একমাত্র এভাবেই পরিপূর্ণ ঈমানদার হওয়া সম্ভব। এরশাদ হচ্ছে, “তুমি কি দেখোনি সেই সব ব্যক্তিকে যে দাবী করে ….. তাদেরকে সত্য থেকে বহুদূরে নিয়ে যাবে ।” তুমি কি এই আশ্চর্যের বিষয়টি সম্পর্কে একটু খেয়াল করে দেখোনি যে, একটি জনগোষ্ঠী দাবী করে যে, তারা ঈমান এনেছে, তারপর এক মুহূর্তের মধ্যেই তারা নিজেরাই সে দাবীর বিপরীত কাজ করে এবং সে দাবী ভংগ করে। সে জাতির দাবী হচ্ছে যে, তোমার ও তোমার পূর্ববর্তী নবী রসূলদের কাছে অবতীর্ণ যাবতীয় জিনিসকে তারা বিশ্বাস করে। এরপর বিবদমান অনেক বিষয়ের মীমাংসার জন্যে তারা তোমার ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রেরিত আইন কানুনের দিকে রুজু করে না বরং বাস্তব জীবনে বিচারক মানে তারা অন্য কাউকে, অন্য পদ্ধতিতে ৷ তারা চূড়ান্ত ফয়সালাদাতা হিসেবে গ্রহণ করে এমন আল্লাহদ্রোহী শক্তিকে যারা বিচার ব্যবস্থার নীতি হিসেবে তোমার কাছে অবতীর্ণ ও তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে অবতীর্ণ আল্লাহর আয়াতসমূহকে গ্রহণ করে না। তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো জীবন পদ্ধতি নেই, নেই তোমার ও তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে অবতীর্ণ কেতাব থেকে গৃহীত কিছু। তাদের হাতে সত্য মিথ্যা বা ভালো মন্দ যাচাই করার মতো কোনো মাপকাঠি নেই। তাদের কাছে যা আছে তা হচ্ছে তাগুত-আল্লাহদ্রোহী বা আল্লাহ তায়ালা বিরোধী শক্তি; এই আল্লাহদ্রোহী শক্তি, সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহর ক্ষমতার কিছু অংশের অধিকারী বলে নিজেকে মনে করে, কিন্তু সে শক্তি কোনো একটি মযবুত মানদন্ডের উপরে টিকে থাকে না বা টিকে থাকতেও পারে না। আর এইভাবে তাগুতকে যারা বিচারক মনে করে তারা না বুঝে বা না জেনেই যে এমন হঠকারিতা করে তারা নিছক একটা ধারণার বশবর্তী হয়ে এসব কাজ করে তা নয়, বরং তারা নিশ্চিতভাবে জানে ও পুরোপুরি বুঝে যে ওদের কাছে বিচার প্রার্থী হওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ৷ ‘আর তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ওদেরকে অস্বীকার করার জন্যে এই হুকুমের মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা ও আন্দায অনুমান নেই; বরং স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে তারা এই হুকুম অমান্য করছে, কাজেই তাদের এ ঈমানের দাবী কিছুতেই টিকে থাকতে পারে না। “তোমার ও তোমার পূর্ববর্তী নবী রসূলদের প্রতি অবতীর্ণ কেতাবের প্রতি তারা বিশ্বাসী ” এভাবে তাদের এই দাবী নস্যাৎ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে শয়তান চায় ওরা গোমরাহ হয়ে যাক এবং তাদেরকে সঠিক পথ থেকে এতদূরে নিয়ে যাক যেন কোনো দিন সেখান থেকে তারা আর ফিরে আসতে না পারে। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর শয়তান চায় তাদেরকে গোমরাইীর বহু দূরবর্তী ব্যবধানে নিয়ে যেতো ।’ ‘শয়তানের শড়যন্ত্র’ এইটিই হচ্ছে গোপন কারণ যা তাদেরকে তাগুতের কাছে বিচার প্রার্থী করতে উদ্বুদ্ধ করে। এটিই সেই প্ররোচনা যা তাদেরকে স্বেচ্ছায় ইমানের শর্ত ও সীমার বাইরে গিয়ে তাগুতকে বিচারক মানতে উৎসাহিত করে । শয়তানের এই প্ররোচনাই তাদেরকে সত্য থেকে দূরে নিয়ে যায়, বিশেষ করে অনেক সময় সে ষড়যন্ত্র মুসলিম জামায়াতের জন্যেও সমস্যা হয়ে যায়, তবে তারা বুঝতে পারে কে তাদের অন্যায় কাজে প্ররোচনা দিচ্ছে এবং মযবুত ঈমান থাকার কারণে আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং তারা যে কোনো অন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে থেমে যায়।
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
# আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াই তাদের ঈমানের দাবী মিথ্যা প্রমাণ করে দেয়। তাদের এহেন কার্যকলাপ থেকে বুঝা যায় যে, তারা যখন বলেছে আমরা ঈমান এনেছি ও আনুগত্য স্বীকার করেছি তখন তারা অসত্য বলেছে।
# এ শব্দগুলো পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছে, রসূলের ফায়সালা হচ্ছে আল্লাহর ফায়সালা এবং তাঁর হুকুম আল্লাহরই হুকুমের নামান্তর মাত্র। রসূলের দিকে আহবান করা নিছক রসূলের দিকেই আহবান করা নয় বরং আল্লাহ ও রসূল উভয়েরই দিকে আহবান করা। তাছাড়া এ আয়াতটি এবং ওপরের আয়াতটি থেকে একথা নিঃসন্দেহে পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য ছাড়া ঈমানের দাবী অর্থহীন এবং আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্যের এছাড়া আর কোন অর্থ নেই যে, মুসলমান ব্যক্তি ও জাতি হিসেবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দেয়া আইনের অনুগত হবে। সে যদি এ কর্মনীতি অবলম্বন না করে, তাহলে তার ঈমানের দাবী একটি মুনাফিকী দাবী ছাড়া আর কিছুই নয়।
# উল্লেখ্য, এ ব্যাপারটি কেবল মাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনেরই জন্য ছিল না বরং তারপর যিনিই ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারকের পদে আসীন থাকেন এবং আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত অনুযায়ী ফায়সালা দেন তাঁর আদালতের সমন হচ্ছে আসলে আল্লাহ ও রসূলের আদালতের সমন এবং যে ব্যক্তি তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে মূলত তা থেকে নয় বরং আল্লাহ ও রসূলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি মুরসাল হাদীসে এ বিষয়ে এ ব্যাখ্যাই বর্ণিত হয়েছে। হাসান বস্রী রহমাতুল্লাহে আলাইহে এ হাদীসটি রেওয়ায়াত করেছেন। হাদীসটি হচ্ছেঃ مَنْ دُعِىَ إِلَى حَاكِمٍ مِنْ حُكَّامِ الْمُسْلِمِينَ فَلَمْ يُجِبْ فَهُوَ ظَالِمٌ لاَ حَقَّ لَهُ “যে ব্যক্তিকে মুসলমানদের আদালতের বিচারপতিদের মধ্য থেকে কোন বিচারপতির কাছে ডাকা হয় এবং সে হাজির হয় না সে জালেম, তার কোন অধিকার নেই।” (আহকামুল কুরআন-জাস্সাস, ৩ খণ্ড, ৪০৫ পৃষ্ঠা) অন্য কথায় এ ধরনের লোক শাস্তি লাভের যোগ্য আবার এ সঙ্গে তাকে অন্যায়কারী প্রতিপন্ন করে তার বিরুদ্ধে একতরফা ফায়সালা দিয়ে দেয়াও ন্যায়সঙ্গত।
# সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-৫৯
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَطِیْعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ وَ اُولِی الْاَمْرِ مِنْكُمْ١ۚ فَاِنْ تَنَازَعْتُمْ فِیْ شَیْءٍ فَرُدُّوْهُ اِلَى اللّٰهِ وَ الرَّسُوْلِ اِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ١ؕ ذٰلِكَ خَیْرٌ وَّ اَحْسَنُ تَاْوِیْلًا۠
হে ঈমানদারগণ! আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রসূলের আর সেই সব লোকের যারা তোমাদের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী। এরপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে বিরোধ দেখা দেয় তাহলে তাকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহ ও পরকালের ওপর ঈমান এনে থাকো। এটিই একটি সঠিক কর্মপদ্ধতি এবং পরিণতির দিক দিয়েও এটিই উৎকৃষ্ট।
# এ আয়াতটি ইসলামের সমগ্র ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের বুনিয়াদ। এটি একটি ইসলামী রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের প্রথম নম্বর ধারা। এখানে নিম্নলিখিত মূলনীতিগুলো স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া হয়েছে।
একঃ ইসলামের জীবন ব্যবস্থায় আসল আনুগত্য লাভের অধিকারী হচ্ছেন আল্লাহ। একজন মুসলমানের সর্বপ্রথম পরিচয় হচ্ছে সে আল্লাহর বান্দা। এরপর সে অন্য কিছু। মুসলমানের ব্যক্তিগত জীবন এবং মুসলমানদের সমাজ ব্যবস্থা উভয়ের কেন্দ্র ও লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য করা ও বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর নির্দেশ মেনে চলা। অন্যান্য আনুগত্য ও অনুসৃতি কেবল মাত্র তখনই গৃহীত হবে যখন তা আল্লাহর আনুগত্য অনুসৃতির বিপরীত হবে না। বরং তার অধীন ও অনুকূল হবে। অন্যথায় এই আসল ও মৌলিক আনুগত্য বিরোধী প্রতিটি আনুগত্য শৃংখলকে ভেঙ্গে দূরে নিক্ষেপ করা হবে। এ কথাটিকেই নবী ﷺ নিম্নোক্ত বক্তব্যে পেশ করেছেনঃ لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِى مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ অর্থাৎ স্রষ্টার নাফরমানি করে কোন সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না।
দুইঃ ইসলামী জীবন ব্যবস্থার দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে, রসূলের আনুগত্য। এটি কোন স্বতন্ত্র ও স্বয়ং সম্পূর্ণ আনুগত্য নয়। বরং আল্লাহর আনুগত্যের এটিই একমাত্র বাস্তব ও কার্যকর পদ্ধতি। রসূলের আনুগত্য এ জন্য করতে হবে যে, আল্লাহর বিধান ও নির্দেশ আমাদের কাছে পৌঁছার তিনিই একমাত্র বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। আমরা কেবলমাত্র রসূলের আনুগত্য করার পথেই আল্লাহর আনুগত্য করতে পারি। রসূলের সনদ ও প্রমাণপত্র ছাড়া আল্লাহর কোন আনুগত্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর রসূলের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নামান্তর। নিম্নোক্ত হাদীসে এই বক্তব্যটিই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছেঃ مَن أَطَاعَنِي فَقَد أَطَاعَ الله وَ مَن عَصَانِي فَقَد عَصى الله যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহর আনুগত্য করলো এবং যে ব্যক্তি আমার নাফরমানি করলো সে আসলে আল্লাহর নাফরমানি করলো। একথাটিই কুরআনে সামনের দিকে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে পেশ করা হয়েছে।
তিনঃ উপরোল্লিখিত দু’টি আনুগত্যের পর তাদের অধীনে তৃতীয় আর একটি আনুগত্য ইসলামী জীবন ব্যবস্থার আওতাধীনে মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব। সেটি হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে থেকে ‘উলিল আমর’ তথা দায়িত্ব ও ক্ষমতার অধিকারীদের আনুগত্য। মুসলমানদের সামাজিক ও সামষ্টিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে দায়িত্ব সম্পন্ন ও নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি মাত্রই ‘ উলিল আমর ’-এর অন্তর্ভুক্ত। তারা মুসলমানদের মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তাগত ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানকারী উলামায়ে কেরাম বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হতে পারেন, আবার দেশের শাসনকার্য পরিচালনাকারী প্রশাসকবৃন্দ হতে পারেন, অথবা আদালতে বিচারের রায় প্রদানকারী শেখ সরদার প্রধানও হতে পারেন। মোটকথা যে ব্যক্তি যে কোন পর্যায়েই মুসলমানদের নেতৃত্বদানকারী হবেন তিনি অবশ্যি আনুগত্য লাভের অধিকারী হবেন। তার সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে মুসলমানদের সামাজিক জীবনে বাধা-বিপত্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা যাবে না। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে, তাকে মুসলিম দলভুক্ত হতে হবে এবং আল্লাহ ও রসূলের অনুগত হতে হবে। এই আনুগত্যের জন্য এই শর্ত দু’টি হচ্ছে অপরিহার্য ও বাধ্যতামূলক। কেবলমাত্র উল্লেখিত আয়াতটির মধ্যভাগে এ সুস্পষ্ট শর্তটি সংশ্লিষ্ট হয়নি বরং হাদীসেও নবী করীম ﷺ পরিপূর্ণ ব্যাপকতার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে এটি বর্ণনা করেছেন। যেমন নিম্নোক্ত হাদীসগুলো দেখা যেতে পারেঃ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ عَلَى الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ ، فِيمَا أَحَبَّ وَكَرِهَ ، مَا لَمْ يُؤْمَرْ بِمَعْصِيَةٍ ، فَإِذَا أُمِرَ بِمَعْصِيَةٍ فَلاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ (بخارى ومسلم) নিজের নেতৃবৃন্দের কথা শোনা ও মেনে চলা মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য, তা তার পছন্দ হোক বা না হোক, যে পর্যন্ত না তাকে নাফরমানির হুকুম দেয়া হয়। আর যখন তাকে নাফরমানির হুকুম দেয়া হয় তখন তার কিছু শোনা ও আনুগত্য করা উচিত নয়। (বুখারী ও মুসলিম) لاَ طَاعَةَ فِى مَعْصِيَةٍ ، إِنَّمَا الطَّاعَةُ فِى الْمَعْرُوفِ (بخارى ومسلم) আল্লাহ ও রসূলের নাফরমানীর ক্ষেত্রে কোন আনুগত্য নেই, আনুগত্য করতে হবে শুধুমাত্র ‘মারুফ’ বা বৈধ ও সৎকাজে।”(বুখারী ও মুসলিম) يكُونُ عَلَيكُم أُمَرَاءُ تَعْرِفُونَ وَتُنْكِرُونَ فَمَنْ أَنْكَرَ فَقَدْ بَرِئَ وَمَنْ كَرِهَ فَقَدْ سَلِمَ وَلَكِنْ مَنْ رَضِىَ وَتَابَعَ فقَالُوا أَفَلاَ نُقَاتِلُهُمْ؟ قَالَ لاَ مَا صَلَّوْا (مسلم) নবী ﷺ বলেছেনঃ তোমাদের ওপর এমন সব লোকও শাসন কর্তৃত্ব চালাবেন যাদের অনেক কথাকে তোমরা মারুফ (বৈধ) ও অনেক কথাকে মুনকার (অবৈধ) পাবে। এক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তাদের মুনকারের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে, সে দায়মুক্ত হয়ে গেছে। আর যে ব্যক্তি তা অপছন্দ করেছে, সেও বেঁচে গেছে। কিন্তু যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্টি হয়েছে এবং তার অনুসরণ করেছে সে পাকড়াও হবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেন, তাহলে এ ধরনের শাসকদের শাসনামলে কি আমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবো না? নবী ﷺ জবাব দেনঃ না, যতদিন তারা নামায পড়তে থাকবে (ততদিন তাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারবে না)।-(মুসলিম) অর্থাৎ নামায পরিত্যাগ করা এমন একটি আলামত হিসেবে বিবেচিত হবে, যা থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যাবে যে, তারা আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য থেকে বের হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ন্যায়সঙ্গত হবে। নবী ﷺ বলেনঃ شِرَارُ أَئِمَّتِكُمُ الَّذِينَ تُبْغِضُونَهُمْ وَيُبْغِضُونَكُمْ وَتَلْعَنُونَهُمْ وَيَلْعَنُونَكُمْ قِلَنا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ نُنَابِذُهُمْ عِنْدَ ذَلِكَ؟ مَالَ لاَ مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ لاَ مَا أَقَامُوا فِيكُمُ الصَّلاَةَ (مسلم) “ তোমাদের নিকৃষ্টতম সরদার হচ্ছে তারা যারা তোমাদেরকে ঘৃণা করে এবং তোমরা তাদেরকে ঘৃণা করো, তোমরা তাদের প্রতি লানত বর্ষণ করতে থাকো এবং তারা তোমাদের প্রতি লানত বর্ষণ করতে থাকে। সাহাবীগণ আরজ করেন, হে আল্লাহর রসূল। যখন এ অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন কি আমরা তাদের মোকাবিলা করার জন্য মাথা তুলে দাঁড়াবো না? জবাব দেনঃ না, যতদিন তারা তোমাদের মধ্যে নামায কায়েম করতে থাকবে! না, যতদিন তারা তোমাদের মধ্যে নামায কায়েম করতে থাকবে!” এই হাদীসটি ওপরে বর্ণিত শর্তটিকে আরও সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। ওপরের হাদীসটি থেকে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক ছিল যে, যতদিন তারা ব্যক্তিগত জীবনে নামায পড়তে থাকবে ততদিন তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। কিন্তু এই হাদীসটি থেকে একথা জানা যায় যে, নামায পড়া মানে আসলে মুসলমানদের সমাজ জীবনে নামাযের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ কেবলমাত্র তাদের নিজেদের নিয়মিতভাবে নামায পড়াটাই যথেষ্ট হবে না বরং এই সঙ্গে তাদের আওতাধীনে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে সেখানেও কমপক্ষে “ইকামাতে সালাত’ তথা নামায প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরী বিবেচিত হবে। তাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার আসল প্রকৃতির দিক দিয়ে যে একটি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এটি হবে তারই একটি আলামত। অন্যথায় যদি একটুকুও না হয়, তাহলে এর অর্থ হবে যে, তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের শাসন ব্যবস্থাকে উলটে ফেলার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালানো মুসলমানদের জন্য বৈধ হয়ে যাবে। একথাটিকেই অন্য একটি হাদীসে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছেঃ নবী ﷺ আমাদের থেকে অন্যান্য আরো বিভিন্ন বিষয়ের সাথে এ ব্যাপারেও অঙ্গীকার নিয়েছেনঃ أَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ ، إِلاَّ أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا ، عِنْدَكُمْ مِنَ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ “অর্থাৎ আমরা আমাদের সরদার ও শাসকদের সাথে ঝগড়া করবো না, তবে যখন আমরা তাদের কাজে প্রকাশ্য কুফরী দেখতে পাবো যার উপস্থিতিতে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে পেশ করার জন্য আমাদের কাছে প্রমাণ থাকবে। ” (বুখারী ও মুসলিম)
চারঃ চতুর্থ যে মূলনীতিটি এ আয়াতটি থেকে স্থায়ী ও চূড়ান্তভাবে স্থিরীকৃত হয়েছে সেটি হচ্ছে এই যে, ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় আল্লাহর হুকুম ও রসূলের সুন্নাত হচ্ছে মৌলিক আইন ও চূড়ান্ত সনদ (Final Authority) মুসলমানদের মধ্যে অথবা মুসলিম সরকার ও প্রজাদের মধ্যে কোন বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে তার মীমাংসার জন্য কুরআন ও সুন্নাতের দিকে ফিরে আসতে হবে। কুরআন ও সুন্নাত এ ব্যাপারে যে ফায়সালা দেবে তাঁর সামনে মাথা নত করে দিতে হবে। এভাবে জীবনের সকল ব্যাপারে কুরআন ও রসূলের সুন্নাতকে সনদ, চূড়ান্ত ফয়সালা ও শেষকথা হিসেবে মেনে নেয়ার বিষয়টি ইসলামী জীবন ব্যবস্থার এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যা তাকে কুফরী জীবন ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়। যে ব্যবস্থায় এ জিনিসটি অনুপস্থিত থাকে সেটি আসলে একটি অনৈসলামী ব্যবস্থা।
এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করে বলে থাকেন যে, জীবনের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালার জন্য কুরআন ও সুন্নাতের দিকে ফিরে যাওয়া কিভাবে সম্ভব হতে পারে? কারণ মিউনিসিপ্যালিটি, রেলওয়ে, ডাকঘর ইত্যাদি অসংখ্য বিষয় সম্পর্কিত কোন নিয়ম-কানুনের উল্লেখই সেখানে নেই। কিন্তু এ সংশয়টি আসলে দ্বীনের মূলনীতি সঠিকভাবে অনুধাবন না করার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। একজন মুসলমানকে একজন কাফের থেকে যে বিষয়টি আলাদা ও বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত করে সেটি হচ্ছে, কাফের অবাধ স্বাধীনতার দাবীদার। আর মুসলমান মূলত আল্লাহর বান্দা ও দাস হবার পর তার রব মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে যতটুকু স্বাধীনতা দান করেছেন শুধুমাত্র ততটুকু স্বাধীনতা ভোগ করে। কাফের তার নিজের তৈরী মূলনীতি ও আইন-বিধানের মাধ্যমে তার যাবতীয় বিষয়ের মীমাংসা করে। এসব মূলনীতি ও বিধানের ক্ষেত্রে কোন ঐশী সমর্থন ও স্বীকৃতির প্রয়োজন আছে বলে সে মনে করে না এবং নিজেকে এর মুখাপেক্ষীও ভাবে না। বিপরীত পক্ষে মুসলমান তার প্রতিটি ব্যাপারে সর্বপ্রথম আল্লাহ ও তাঁর নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দিকে ফিরে যায়। সেখান থেকে কোন নির্দেশ পেলে সে তার অনুসরণ করে। আর কোন নির্দেশ না পেলে কেবল মাত্র এই অবস্থায়ই সে স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করে। এক্ষেত্রে তার এই কর্মের স্বাধীনতার মূলভিত্তি একথার ওপরই স্থাপিত হয় যে, এই ব্যাপারে শরীয়াত রচয়িতার পক্ষ থেকে কোন বিধান না দেয়াই একথা প্রমাণ করে যে তিনি এক্ষেত্রে কর্মের স্বাধীনতা প্রদান করেছেন।
# কুরআন মজীদ যেহেতু নিছক একটি আইনের কিতাব মাত্র নয় বরং একই সঙ্গে এটি একটি শিক্ষা ও উপদেশমূলক গ্রন্থও, তাই প্রথম বাক্যে যে আইনগত মূলনীতির বিবরণ দেয়া হয়েছিল এই দ্বিতীয় বাক্যে তার অন্তর্নিহিত কারণ ও যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে দু’টি কথা বলা হয়েছে। প্রথমত, উপরোল্লিখিত চারটি মূলনীতি মেনে চলা ঈমানের অপরিহার্য দাবী। একদিকে মুসলমান হবার দাবী করা এবং অন্যদিকে এই মূলনীতিগুলো উপেক্ষা করা, এ দু’টি পরস্পর বিরোধী জিনিসের কখনো একত্র সমাবেশ হতে পারে না। দ্বিতীয়, এই মূলনীতিগুলোর ভিত্তিতে নিজেদের জীবন বিধান নির্মাণ করার মধ্যেই মুসলমানদের কল্যাণ নিহিত। কেবলামাত্র এই একটি জিনিসই তাদেরকে দুনিয়ায় সত্য-সরল পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারে এবং এর মাধ্যমেই তারা পরকালেও সফলকাম হতে পারে। যে ভাষণে ইহুদীদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার ওপর মন্তব্য করা হচ্ছিল এই উপদেশ বাণীটি ঠিক তার শেষে উক্ত হয়েছে। এভাবে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মত দ্বীনের এই মূলনীতিগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যেভাবে অধপতের গভীর গর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তা থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। যখন কোন জনগোষ্ঠী আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রসূলের হিদায়াত পেছনে ফেলে দিয়ে এমন সব নেতা ও সরদারের আনুগত্য করতে থাকে, যারা আল্লাহ ও রসূলের হুকুম মেনে চলে না এবং নিজেদের ধর্মীয় নেতা ও রাষ্ট্রীয় শাসকদের কাছে কুরআন ও সুন্নাতের সনদ ও প্রমাণপত্র জিজ্ঞেস না করেই তাদের আনুগত্য করতে থাকে তখন তারা এই বনী ইসরাঈলদের মতোই অসৎ ও অনিষ্টকর কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে এমন সব দোষ-ত্রুটি সৃষ্টি হয়ে যায়, যার হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা কোনক্রমেই সম্ভবপর নয়।
# সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-৬০
اَلَمْ تَرَ اِلَى الَّذِیْنَ یَزْعُمُوْنَ اَنَّهُمْ اٰمَنُوْا بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ وَ مَاۤ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ یُرِیْدُوْنَ اَنْ یَّتَحَاكَمُوْۤا اِلَى الطَّاغُوْتِ وَ قَدْ اُمِرُوْۤا اَنْ یَّكْفُرُوْا بِهٖ١ؕ وَ یُرِیْدُ الشَّیْطٰنُ اَنْ یُّضِلَّهُمْ ضَلٰلًۢا بَعِیْدًا
হে নবী! তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলেছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই কিতাবের প্রতি যা তোমার ওপর নাযিল করা হয়েছে এবং সেই সব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমরা পূর্বে নাযিল করা হয়েছিল কিন্তু তারা নিজেদের বিষয়সমূহ ফায়সালা করার জন্য ‘তাগুতে’র দিকে ফিরতে চায়, অথচ তাদেরকে তাগুতকে অস্বীকার করার হুকুম দেয়া হয়েছিল? শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল সোজা পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
# এখানে ‘তাগুত’ বলতে সুস্পষ্টভাবে এমন শাসককে বুঝানো হয়েছে যে আল্লাহর আইন বাদ দিয়ে অন্য কোন আইন অনুযায়ী ফয়সালা করে এবং এমন বিচার ব্যবস্থাকে বুঝানো হয়েছে যা আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতার আনুগত্য করে না এবং আল্লাহর কিতাবকে চূড়ান্ত সনদ (Final Authority) হিসেবে স্বীকৃতিও দেয় না। কাজেই যে আদালত তাগুতের ভূমিকা পালন করছে, নিজের বিভিন্ন বিষয়ের ফায়সালার জন্য তার কাছে উপস্থিত হওয়া যে একটি ঈমান বিরোধী কাজ এ ব্যাপারে এ আয়াতটির বক্তব্য একেবারে সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের ওপর ঈমান আনার অপরিহার্য দাবী অনুযায়ী এ ধরনের আদালতকে বৈধ আদালত হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃত জানানোই প্রত্যেক ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য। কুরআনের দৃষ্টিতে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা ও তাগুতকে অস্বীকার করা, এ দু’টি বিষয় পরস্পরের সাথে অংগাংগীভাবে সংযুক্ত এবং এদের একটি অন্যটির অনিবার্য পরিণতি। আল্লাহ ও তাগুত উভয়ের সামনে একই সাথে মাথা নত করাই হচ্ছে সুস্পষ্ট মুনাফেকী।
# সুরা: আন-নিসা
আয়াত নং :-৬১
وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا اِلٰى مَاۤ اَنْزَلَ اللّٰهُ وَ اِلَى الرَّسُوْلِ رَاَیْتَ الْمُنٰفِقِیْنَ یَصُدُّوْنَ عَنْكَ صُدُوْدًاۚ
আর যখন তাদেরকে বলা হয়, এসো সেই জিনিসের দিকে, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং এসো রসূলের দিকে, তখন তোমরা দেখতে পাও ঐ মুনাফিকরা তোমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।
# এ থেকে জানা যায়, মুনাফিকদের সাধারণ রীতি ছিল, যে মামলার ব্যাপারে তারা আশা করতো যে, ফয়সালা তাদের পক্ষে যাবে সেটি তারা নিয়ে আসতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কিন্তু যে মামলাটির ফয়সালা তাদের বিপক্ষে যাবে বলে তারাআশঙ্কা করতো সেটি তাঁর কাছে আনতে অস্বীকার করতো। বর্তমান কালের বহু মুনাফিকেরও এই একই অবস্থা। শরীয়াতের ফায়সালা যদি তাদের অনুকূল হয় তাহলে তারা নত মস্তকে তা মেনে নেয়। অন্যথায় যে আইন, প্রচলিত রীতি-রেওয়াজ ও আদালতের মাধ্যমে তারা নিজেদের মন-মাফিক ফায়সালা লাভের আশা রাখে, তারই কোলে তারা আশ্রয় নেয়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৪৭-৫২ নং আয়াতের তাফসীর:
উক্ত আয়াতগুলোতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্যগুলোই আলোচনা করা হয়েছ্ েযারা মুখে ঈমান ও ইসলামের কথা বলে, কিন্তু অন্তর কুফর ও নিফাকীতে ভরপুর। يَتَوَلّٰي অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য থেকে, ঈমান থেকে বেরিয়ে যায়। তাদের মাঝে আপোষে কোন দ্বন্দ্বের ফায়সালার জন্য আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূলের দিকে তথা কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ডাকা হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ তারা জানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে কোন বিচারের ফায়সালার জন্য গেলে সঠিক বিচার হবে, যার বিপক্ষেই রায় যাক তাকে ক্ষমা করা হবে না। হ্যাঁ, যদি তারা বুঝতে পারে যে, তারা হকের ওপর রয়েছে এবং ফায়সালা তাদের পক্ষে আসবে তাহলে সাগ্রহে আসবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
“তুমি কি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাস করে, এবং তারা তাগূতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, অথচ তা প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর শয়তান তাদেরকে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তা‘আলা যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে আস, তখন মুনাফিকদেরকে তুমি তোমার নিকট হতে মুখ একেবারে ফিরিয়ে নিতে দেখবে।” (সূরা নিসা ৪:৬০-৬১)
আর এ সকল মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সূরা বাকারার প্রথম দিকেই বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَإِنْ يَّكُنْ لَّهُمُ الْحَقُّ)
আর যখন ফায়সালা তাদের বিরুদ্ধে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়ার ও দূরে থাকার কারণ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, হয় তাদের অন্তরে কুফরী ও নিফাকীর রোগ আছে, অথবা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুআতের ব্যাপারে সন্দেহ আছে অথবা তাদের এ আশংকা রয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূূল তাদের প্রতি অবিচার করবেন। অথচ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে অবিচারের কোন সম্ভাবনাই নেই। বরং আসল কথা হলন তারা নিজেরাই জালিম। এ থেকে ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন: ন্যায়পরায়ণ ও কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে বিজ্ঞ বিচারক থাকলে মামলা মুকাদ্দামাহ পেশ করা আবশ্যক, অন্যথায় জরুরী নয়।
পক্ষান্তরে যারা সত্যিকার মু’মিন তাদেরকে যখন কোন বিবাদের ফায়সালার জন্য কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহ্বান করা হয় তখন বিনা দ্বিধায় কুরআন ও সুন্নাহর ফায়সালা তারা মেনে নেয়। তারা এদিক সেদিক থেকে ফায়সালা নেয়ার চিন্তা করে না। প্রতিটি মু’মিনের এমন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া উচিত, তারা যে কোন ফায়সালা খুঁজবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে। কুরআন সুন্নাহর ফায়সালা নিয়েই তারা সন্তুষ্ট থাকবে। কারণ যারা সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য করে, তাদের দেয়া আদর্শ, সুন্নাত ও ফায়সালাকে মেনে নেয় তারাই সফলকাম।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. একশ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা মুখে ঈমানের কথা বলে কিন্তু অন্তর কুফরীতে পরিপূর্ণ।
২. তারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের দেয়া বিধান নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
৩. যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের দেয়া আদর্শ ও ফায়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে না নিবে তারা মু’মিন নয়।
৪. মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য হল কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহ্বান করলে তারা সাড়া দেয় এবং তাঁর ফায়সালা মেনে নেয়।
৫. সফলতার মাপকাঠি হল আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর একচ্ছত্র আনুগত্য ও আল্লাহ তা‘আলার ভয়।