أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৮১)[ আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,ও তার শর্ত :-]
www.motaher21.net
সূরা:- আন-নূর।
সুরা:২৪
পারা:১৮
৫৫- ৫৭ নং আয়াত:-
২৪:৫৫
وَعَدَ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ لَیَسۡتَخۡلِفَنَّہُمۡ فِی الۡاَرۡضِ کَمَا اسۡتَخۡلَفَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ۪ وَ لَیُمَکِّنَنَّ لَہُمۡ دِیۡنَہُمُ الَّذِی ارۡتَضٰی لَہُمۡ وَ لَیُبَدِّلَنَّہُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ خَوۡفِہِمۡ اَمۡنًا ؕ یَعۡبُدُوۡنَنِیۡ لَا یُشۡرِکُوۡنَ بِیۡ شَیۡئًا ؕ وَ مَنۡ کَفَرَ بَعۡدَ ذٰلِکَ فَاُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ ﴿۵۵﴾
আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যাকে আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা শুধু আমার বন্দেগী করুক এবং আমার সাথে কাউকে যেন শরীক না করে। আর যারা এরপর কুফরী করবে তারাই ফাসেক।
২৪:৫৬
وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ ﴿۵۶﴾
তোমরা যথাযথভাবে নামায পড়, যাকাত দাও এবং রসূলের আনুগত্য কর; যাতে তোমরা করুণাভাজন হতে পার।
২৪:৫৭
لَا تَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مُعۡجِزِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ۚ وَ مَاۡوٰىہُمُ النَّارُ ؕ وَ لَبِئۡسَ الۡمَصِیۡرُ ﴿٪۵۷﴾
যারা কুফরী করছে তাদের সম্পর্কে এ ভুল ধারণা পোষণ করো না যে, তারা পৃথিবীতে আল্লাহকে অক্ষম করে দেবে। তাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম এবং তা বড়ই নিকৃষ্ট আশ্রয়।
ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-
*দ্বীন প্রতিষ্ঠার ওয়াদা ও তার শর্ত : এখন মােনাফেকদের প্রসংগ বাদ দিয়ে মােমেনদের প্রসংগ আলােচিত হচ্ছে। অর্থাৎ যারা সত্যিকার অর্থে আল্লাহর আনুগত্য করে এবং তার প্রতি বাস্তব অর্থে ঈমান রাখে তাদের প্রতিদান কেয়ামতের আগে এই পৃথিবীর বুকেই কি হবে, সে সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে…'(আয়াত ৫৫) রসূলের উন্মতের জন্যে আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করছেন যে, যারা ঈমান গ্রহণ করবে এবং সৎকাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীর রাজত্ব দান করবেন, তাদের দ্বীনকে জয়ী করবেন এবং তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় রূপান্তরিত করবেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর আল্লাহর ওয়াদা সব সময় সত্য হয়ে থাকে, তার ওয়াদা সব সময়ই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা কখনাে ওয়াদার বরখেলাপ করেন না, এখন প্রশ্ন সেই ঈমান কেমন হওয়া উচিৎ আর সেই রাজত্ব ও ক্ষমতাই বা কেমন হবে? উত্তরে বলছি, যে ঈমানের ফলে খােদায়ী ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে সেই ঈমানের প্রকৃতি ও বাস্তবতা অত্যন্ত সুবিশাল, এই ঈমানের আওতায় গােটা মানব জীবনের কর্মকান্ডই এসে যায়, এই ঈমানই গােটা মানবজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে ও পথনির্দেশনা করে থাকে। এই ঈমান যখনই হৃদয়ের গভীরে প্রােথিত হবে তখনই তার প্রকাশ ঘটবে ব্যক্তির কাজে কর্মে, আচার আচরণে ও চলনে-বলনে। তখন ব্যক্তির প্রতিটি কাজ ও প্রতিটি পদক্ষেপই হবে আল্লাহ তায়ালা মুখী। তার প্রতিটি কাজই হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, যে ঈমানের বিনিময়ে আল্লাহর এই ওয়াদা সে ঈমান হচ্ছে একমাত্র আল্লাহরই আনুগত্যের নাম, আল্লাহর হাতেই খুটি-নাটি সব কিছুই ছেড়ে দেয়ার নাম। এই ঈমানের যখন প্রকাশ ঘটবে তখন ব্যক্তির খেয়াল খুশীর কোনাে অস্তিত্ব থাকবে না, জৈবিক চাহিদার হাতে সে বন্দী থাকবে না এবং স্বভাব ও প্রকৃতির টানে ভেসে যাবে না। বরং এসব বিষয়েও সে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের পূর্ণ আনুগত্য ও দাসত্ব করবে। যে ঈমানের বিনিময়ে আল্লাহর এই ওয়াদা, সেই ঈমানের আওতায় পড়ে গােটা মানব জীবনের কর্মকান্ড । এই ঈমানের প্রভাব ব্যক্তির চিন্তা জগতে পড়বে, মনোজগতে পড়বে, আধ্যাত্মিক জগতে পড়বে, স্বভাব প্রবণতায় পড়বে, দেহের ওপর পড়বে, অংগ প্রত্যংগের ওপর পড়বে এবং পরিবার পরিজন ও সকল মানুষের সাথে তার আচরণেও পড়বে। অর্থাৎ ব্যক্তির সকল কর্মকান্ডই হবে তখন একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। আলােচ্য আয়াতে বিষয়টির প্রতি স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ইংগিত করে বলছেন ‘তারা আমার ইবাদত করে এবং আমার সাথে কোনাে কিছুকে শরীক করে না।…’ বলাবাহুল্য যে, শিরকের বিভিন্ন প্রকার ও শ্রেণী রয়েছে। এমনকি গায়রুল্লাহর উদ্দশ্যে কোনাে আমল নিবেদন করা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনাে উৎস থেকে উৎসারিত কোনাে জীবন ব্যবস্থা বা কোনাে আইন কানুন মেনে নেয়া অথবা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য কোনাে ব্যক্তি, চক্র বা গোষ্ঠীর কোনাে মতাদর্শ, তন্ত্র বা মতবাদ চেতনায় স্থান পাওয়াও শিরক। শিরেক ও কুফরমুক্ত ঈমানই হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন বিধান। এতে আল্লাহর সব ধরনের বিধি-নিষেধ রয়েছে, জীবন পরিচালনার জন্যে অপরিহার্য সব কিছুই গ্রহণ করার নির্দেশ রয়েছে। সর্বোপরি পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব বা খেলাফতের শুরুদায়িত্ব পালনের জন্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা রয়েছে। পৃথিবীর রাজত্ব বলতে কী বুঝি? এই রাজত্ব বলতে নিছক কর্তৃত্ব প্রভাব প্রতিপত্তি, দমন পীড়ন এবং শাসনকে বুঝায় না, বরং রাজত্ব বলতে এসব কিছুই বুঝাৰে যদি তা সংস্কার ও সংশােধনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, নির্মাণ ও গড়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, মানবজাতির জীবন পরিচালনার জন্যে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত আদর্শের বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং আশরাফুল মখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা মানুষের জীবনকে এই পৃথিবীর বুকে পরিপূর্ণতার শীর্ষে পৌছিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর রাজত্ব হচ্ছে এমন একটি ক্ষমতা যার মূল উদ্দেশ্য হবে গঠন ও সংস্কার; ধ্বংস ও নৈরাজ্য নয়। এই ক্ষমতার উদ্দেশ্য হবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা; যুলুম-অত্যাচার ও দমন-পীড়ন নয়। এই ক্ষমতা মানবজীবন উন্নত করে, মানুষের জীবন ব্যবস্থাকে উন্নত করে। এই ক্ষমতা কখনাে মানুষকে পশুর স্তরে নিয়ে পৌছায় না। এই রাজত্ব আল্লাহ তায়ালা কেবল তাদেরকেই দান করবেন বলে আল্লাহ ওয়াদা করছেন। যেমনটি তিনি অতীতেও সকর্মশীল মােমেনদেরকে দান করেছিলেন। এর দ্বারা মােমেন বান্দারা আল্লাহর মনােনীত আদর্শের বাস্তবায়ন ঘটাবে, আল্লাহর মনােনীত ন্যায় বিচার ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ঘটাবে, এবং গােটা মানব জাতিকে পূর্ণতার পথে এবং মংগল ও কামিয়াবীর পথে পরিচালিত করবে। অপরদিকে যারা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হাতে পেয়ে পৃথিবীর বুকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে, যুলুম অত্যাচারের বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং গােটা সমাজ ব্যবস্থাকে পাশবিকতার স্তরে নিয়ে পৌছায় তারা কখনাে পৃথিবীর বুকে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হতে পারে না, তারা কখনাে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হতে পারে না। বরং তাদের এই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব হচ্ছে এক প্রকার পরীক্ষা। এই পরীক্ষার সম্মুখীন তারা নিজেরাও এবং তাদের প্রজারাও। এর পেছনে অবশ্য আল্লাহর হেকমত ও কুদরতই কাজ করে থাকে। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের এই যথার্থ ধারণা আমরা আল্লাহর এই বক্তব্যের মাঝেই পাই, এবং তিনি অবশ্যই তাদের দ্বীনকে সুদৃঢ় করবেন যা তিনি তাদের জন্যে পছন্দ করেছেন অর্থাৎ এই দ্বীনকে প্রথমে অন্তরের মাঝে সুদৃঢ় করতে হবে। এর পর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর বাস্তবায়ন হতে হবে। আর তখনই আল্লাহর ওয়াদাও বাস্তবায়িত হবে। ফলে তারা পৃথিবীর রাজত্ব ও কর্তৃত্ব লাভ করতে সক্ষম হবে, তাদের জন্যে মনােনীত দ্বীনই পৃথিবীর বুকে বিজয়ী হবে। কারণ তাদের এই দ্বীন সংস্কার ও সংশােধনের নির্দেশ দেয়, হক ও ইনসাফের নির্দেশ দেয়, পৃথিবীর সকল কামনা বাসনার উর্ধে থাকার নির্দেশ দেয়, পৃথিবীকে গড়ার নির্দেশ দেয় এবং পৃথিবীর মাঝে আল্লাহ তায়ালা যে সব সম্পদ ও শক্তি রেখেছেন সে গুলােকে ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। আর এই সব কিছুই হতে হবে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি-লাভের উদ্দেশ্যে। ‘এবং তাদের ভয় ভীতির অবস্থা পরিবর্তন করে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন…’ অর্থাৎ তারা ভয়-ভীতির মাঝে জীবন যাপন করছিলাে, তাদের জীবনে কোনাে নিরাপত্তা ছিলাে না এবং মদীনায় রসূলুল্লাহ(স.)-এর হিজরতের আগ পর্যন্ত তারা কখনাে অস্ত্র ত্যাগ করতে পারতাে না। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আবুল আলিয়ার বরাত দিয়ে রবী এবনে আনাস বলেন যে, রসূলুল্লাহ(স.) ও তাঁর সাহাবারা দশ বছর পর্যন্ত মক্কায় গােপনে মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিতেন, তাদেরকে শিরক ত্যাগ করে কেবল আল্লাহর এবাদাত বন্দেগীর জন্যে আহ্বান জানাতেন। তাঁরা ভয়-ভীতির মাঝে এই দাওয়াতী কাজ আঞ্জাম দিতেন। তাদের প্রতি কখনো লড়াইয়ের নির্দেশ ছিলাে না। এই নির্দেশ মদীনায় হিজরতের পর তাদেরকে দেয়া হয়েছিলাে। তারা মদীনায় পৌছার পর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে লড়াইয়ের নির্দেশ দেন, মদীনায়ও তারা ভয় ভীতির মাঝে দিন যাপন করতাে। ফলে অস্ত্র হাতেই তাদের দিন-রাত কাটতাে। এই অবস্থার ওপরই তারা আল্লাহর ইচ্ছায় ধৈর্যধারণ করেছেন, এরপর একজন সাহাবী রসূলকে উদ্দেশ্য করে বললাে, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কি এভাবেই সারাক্ষণ ভীত ও সন্ত্রস্ত থাকতে হবে। এমন দিন কি কখনাে আসবে না যখন আমরা নিরাপদ হতে পারবে এবং হাত থেকে অস্ত্র নামাতে পারবো? উত্তরে রসূল বললেন, আর অল্প কিছু দিনই তােমাদেরকে ধৈর্যধারণ করতে হবে, এরপর তােমাদের কেউ বিরাট জনসমক্ষে বসলে সেখানে একটি লােহাও থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা আলােচ্য আয়াতটি নাযিল করেন এবং এর মর্মানুসারে তার প্রিয় নবীকে গােটা আরব জাহানের কর্তৃত্ব দান করেন। ফলে মুসলমানরা জীবনের নিরাপত্তা ফিরে পান, যুদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তি পান। আল্লাহর নবী দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর আবু বকর, ওমর ও ওসমান(রা.) এই তিনজন খলিফার শাসন আমলেও মুসলমানরা নিরাপদে ছিলেন, শান্তিতে ছিলেন, এরপর যা ঘটার তাই ঘটেছে। ফলে সমাজ জীবনে ভয় ভীতি দানা বেঁধে উঠেছে। শাসকবর্গ নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে প্রহরী ও পুলিশ নিয়ােগ করতে বাধ্য হয়েছে। তারা নিজেরাও বদলে গিয়েছিলাে, ফলে আল্লাহ তায়ালাও তাদের সাথে সেভাবেই ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তাদের জীবন থেকে নিরাপত্তা উঠিয়ে নিয়েছেন। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই হবে অবাধ্য অর্থাৎ আল্লাহর শর্তের ব্যাপারে অবাধ্য হবে, আল্লাহর ওয়াদার ব্যাপারে অবাধ্য হবে এবং অংগীকারের ব্যাপারে অবাধ্য হবে। আল্লাহ তায়ালা একবার তার ওয়াদা পূর্ণ করে দেখিয়েছেন এবং তিনি ভবিষ্যতেও পূর্ণ করে দেখাবেন যদি মুসলমানরা তার শর্ত অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে। আর তা হচ্ছে, ‘তারা আমার এবাদত করবে আমার সাথে কোনাে কিছুকে শরীক না করে’ অর্থাৎ আমার সাথে কোনাে দেব-দেবী, ব্যক্তি, গােষ্ঠী, চক্র এবং নিজের ব্যক্তিগত খেয়াল খুশী ও কামনা বাসনাকে শরীক করবে না সকল কিছুর উর্ধে আমার ইচ্ছাকে, আমার হুকুমকে প্রাধান্য দেবে, আমার প্রতি অবিচল ঈমান ও বিশ্বাস রাখবে এবং সৎকাজ করবে। আল্লাহর এই ওয়াদা কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে, কাজেই এই উম্মতের যে কোনাে ব্যক্তি ওপরে বর্ণিত শর্তগুলাে পালন করবে, তার ক্ষেত্রেই আল্লাহর ওই ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। আর যদি উক্ত শর্তগুলাে পালনে কোনাে রূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করা হয়, তাহলে আল্লাহর সাহায্য বিলম্বিত হবে, ক্ষমতা প্রাপ্তি বিলম্বিত হবে, পৃথিবীর বুকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা বিলম্বিত হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাও বিলম্বিত হবে। তবে মুসলিম জাতি আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষান্বরূপ যদি কোনাে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে, অথবা লাঞ্ছনা গঞ্জনার সম্মুখীন হয়ে আল্লাহর কাছে মান সম্মান কামনা করে, অথবা পশ্চাদপদতায় নিমজ্জিত হয়ে উন্নতি-অগ্রগতি কামনা এবং আল্লাহ তায়ালা নির্দেশিত পথ অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহ তায়ালা তার ওয়াদা পূরণ করে দেখাবেন। এ ব্যাপারে কোনাে কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কাজেই এই ওয়াদা পালনের পূর্ব শর্ত হিসেবে নামায আদায় করতে, যাকাত আদায় করতে এবং আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্যের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। সাথে সাথে রসূল (স.) কে বলা হচ্ছে তিনি এবং তার উম্মত যেন কোনােভাবেই কাফের সম্প্রদায়কে ভয় করে না চলেন, আমলে না আনেন। তাই বলা হচ্ছে, ‘নামায কায়েম করাে, যাকাত প্রদান করাে এবং রসূলের আনুগত্য করাে যাতে তােমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও…'(আয়াত ৫৬-৫৭) আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, নামায আদায়ের মাধ্যমে অন্তরের পরিচ্ছন্নতা, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে চারিত্রিক নির্মলতা, রসূলের প্রতি আনুগত্য, আল্লাহর নির্দেশের প্রতি আত্মসমর্পণ, ছােটো বড়াে সকল বিষয়ে আল্লাহর বিধানের অনুসরণ, আল্লাহর মনােনীত জীবনাদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন এসবই হচ্ছে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ লাভের উপায় উপকরণ। এর মাধ্যমেই মানুষ পৃথিবীর বুকে সব ধরনের আপদ বিপদ, ভয় ভীতি, উদ্বেগ উৎকণ্ঠা এবং ভ্রান্তি ও বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষা পায়। আর পরকালে মুক্তি পায় আল্লাহর গযব, আযাব ও শাস্তির কবল থেকে। আলােচ্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম জাতিকে লক্ষ্য করে বলছেন যে, তােমরা যদি সঠিক আদর্শের অনুসারী হও, তাহলে কাফের মােশরেকদের কোনাে শক্তিই তােমাদেরকে টলাতে পারবে না। তােমাদের চলার পথে তারা কখনাে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ তােমাদের শক্তির উৎস হচ্ছে তােমাদের ঈমান, তােমাদের আদর্শ এবং তােমাদের নৈতিক মনােবল। জাগতিক ও বৈষয়িক শক্তি সামর্থ্যের দিক থেকে তােমরা দুর্বল হলেও তােমরা অজেয় ঈমানী শক্তির অধিকারী। এই ঈমানী শক্তির বলেই তােমরা অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম। ইসলাম হচ্ছে একটি বিরাট সত্য। এই সত্য উপলব্ধি করতে না পারলে আলােচ্য আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর ওয়াদার তাৎপর্যও উপলব্ধি করা সম্ভবপর হবে না। কাজেই আল্লাহর ওয়াদার ব্যাপারে কোনােরূপ সংশয় সন্দেহ পােষণ করার আগে মানব ইতিহাসে ইসলামী জীবন বিধানের অবদান ও প্রভাবগুলাে খতিয়ে দেখতে হবে। এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, মুসলিম জাতি যখনই আল্লাহর বিধান মেনে চলেছে, আল্লাহর দ্বীনকে জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়িত করেছে তখনই আল্লাহ তায়ালা নিজের ওয়াদা পূরণ করেছেন এবং মুসলিম জাতিকে পৃথিবীর শাসন ও কর্তৃত্ব দান করেছেন। আর যখনই সে খােদায়ী বিধানের বরখেলাপ করেছে তখনই তাকে পেছন সারিতে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, তার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং শত্রুদের হাতে তাদের অসহায়ভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মনে রাখতে হবে, আল্লাহর ওয়াদা এখনও বলবৎ রয়েছে। এই ওয়াদা বাস্তবায়নের পূর্ব শর্তগুলােও সবার সামনে রয়েছে। কাজেই কেউ এই ওয়াদার বাস্তবায়ন চাইলে তাকে প্রথমে এর পূর্ব শর্তগুলাে পূরণ করে দেখাতে হবে। যদি এই শর্তগুলাে পূরণ করা হয় তাহলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই তার ওয়াদা বাস্তবায়িত করবেন। কারণ, তার চেয়ে বড় ওয়াদা রক্ষাকারী আর কে হতে পারে?
তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-
#এ বক্তব্যের শুরুতেই আমি ইঙ্গিত করেছি, এ উক্তির উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফিকদেরকে এ মর্মে সতর্ক করা যে, আল্লাহ মুসলমানদের খিলাফত দান করার যে প্রতিশ্রুতি দেন তা নিছক আদমশুমারীর খাতায় যাদের নাম মুসলমান হিসেবে লেখা হয়েছে তাদের জন্য নয় বরং এমন মুসলমানদের জন্য যারা সাচ্চা ঈমানদার, চরিত্র ও কর্মের দিক দিয়ে সৎ, আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীনের আনুগত্যকারী এবং সব ধরনের শিরক মুক্ত হয়ে নির্ভেজাল আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বকারী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, নিছক মুখে ঈমানের দাবীদার, তারা এ প্রতিশ্রুতি লাভের যোগ্য নয় এবং তাদের জন্য এ প্রতিশ্রুতি দানও করা হয়নি। কাজেই তারা যেন এর অংশীদার হবার আশা না রাখে।
কেউ কেউ খিলাফতকে নিছক রাষ্ট্র ক্ষমতা, রাজ্য শাসন, প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি অর্থে গ্রহণ করেন। তারপর আলোচ্য আয়াত থেকে তারা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে, দুনিয়ায় যে ব্যক্তিই এ শক্তি অর্জন করে সে মু’মিন, সৎ, আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীনের অনুসারী, আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বকারী এবং শিরক থেকে দূরে অবস্থানকারী। এরপর তারা নিজেদের এ ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রতিপন্ন করার জন্য ঈমান, সৎকর্মশীলতা, সত্য দ্বীন, আল্লাহর ইবাদাত ও শির্ক তথা প্রত্যেকটি জিনিসের অর্থ বিকৃত করে তাকে এমন কিছু বানিয়ে দেন যা তাদের এ মতবাদের সাথে খাপ খেয়ে যায়। এটা কুরআনের নিকৃষ্টতম অর্থগত বিকৃতি। এ বিকৃতি ইহুদী ও খৃস্টানদের বিকৃতিকেও ম্লান করে দিয়েছে। এ বিকৃতির মাধ্যমে কুরআনের একটি আয়াতের এমন একটি অর্থ করা হয়েছে যা সমগ্র কুরআনের শিক্ষাকে বিকৃত করে দেয় এবং ইসলামের কোন একটি জিনিসকেও তার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকতে দেয় না। খিলাফতের এ সংজ্ঞা বর্ণনা করার পর নিশ্চিতভাবে এমন সব লোকের ওপর এ আয়াত প্রযোজ্য হয় যারা কখনো দুনিয়ায় প্রাধান্য ও রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করেছে অথবা বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। তারা আল্লাহ, অহী, রিসালাত, আখেরাত সবকিছু অস্বীকারকারী হতে পারে এবং ফাসেকী ও অশ্লীলতার এমন সব মলিনতায় আপ্লুতও হতে পারে যেগুলোকে কুরআন কবীরা গুনাহ তথা বৃহৎ পাপ গণ্য করেছে, যেমন সুদ, ব্যভিচার, মদ, জুয়া। এখন যদি এসব লোক সৎ মু’মিন হয়ে থাকে এবং এজন্যই তাদেরকে খিলাফতের উন্নত আসনে অধিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে, তাহলে এরপর ঈমানের অর্থ প্রাকৃতিক আইন মেনে নেয়া এবং সৎকর্মশীলতা অর্থ এ আইনগুলোকে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা ছাড়া আর কি হতে পারে? আর আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীন বলতে প্রাণী বিদ্যা, পদার্থ বিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করে শিল্প, কারিগরী, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে ব্যাপক উন্নতি লাভ করা ছাড়া আর কি হতে পারে? এরপর আল্লাহর বন্দেগী বলতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রচেষ্টা ও সংগ্রামে সাফল্য লাভ করার জন্য যেসব নিয়ম-কানুন মেনে চলা প্রকৃতিগতভাবে লাভজনক ও অপরিহার্য হয়ে থাকে সেগুলো মেনে চলা ছাড়া আর কি হতে পারে? তারপর এ লাভজনক নিয়ম-কানুনের সাথে কোন ব্যক্তি বা জাতি কিছু ক্ষতিকর পদ্ধতি অবলম্বন করলে তাকেই শির্ক নামে অভিহিত করা ছাড়া আর কাকে শির্ক বলা যাবে? কিন্তু যে ব্যক্তি কখনো দৃষ্টি ও মন আচ্ছন্ন না রেখে বুঝে কুরআন পড়েছে সে কি কখনো একথা মেনে নিতে পারে যে, সত্যিই কুরআনের বক্তব্য অনুযায়ী ঈমান, সৎকাজ, সত্য দ্বীন, আল্লাহর ইবাদাত এবং তাওহীদ ও শিরকের এ অর্থই হয়? যে ব্যক্তি কখনো পুরো কুরআন বুঝে পড়েনি এবং কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু আয়াত নিয়ে সেগুলোকে নিজের চিন্তা-কল্পনা ও মতবাদ অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়েছে সে-ই কেবল এ অর্থ গ্রহণ করতে পারে। অথবা এমন এক ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে, যে কুরআন পড়ার সময় এমন সব আয়াতকে একেবারেই অর্থহীন ও ভুল মনে করেছে যেগুলোতে আল্লাহকে একমাত্র রব ও ইলাহ, তাঁর নাযিল করা অহীকে পথনির্দেশনার একমাত্র উপায় এবং তাঁর পাঠানো প্রত্যেক নবীকে চূড়ান্ত পর্যায়ে অপরিহার্যভাবে মেনে নেবার ও নেতা বলে স্বীকার করে অনুসরণ করার আহবান জানানো হয়েছে। আর এই সঙ্গে বর্তমান দুনিয়াবী জীবনের শেষে দ্বিতীয় আর একটি জীবন কেবল মেনে নেবারই দাবী করা হয়নি বরং একথাও পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, যারা এ জীবনে নিজেদের জবাবদিহির কথা অস্বীকার করে বা এ ব্যাপারে সকল প্রকার চিন্তা বিমুক্ত হয়ে নিছক এ দুনিয়ায় সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে কাজ করবে তারা চূড়ান্ত সাফল্য থেকে বঞ্চিত থাকবে। কুরআনে এ বিষয়বস্তুগুলো এত বেশী পরিমাণে, বিভিন্ন পদ্ধতিতে এবং সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বারবার বলা হয়েছে যে, খিলাফত লাভ সম্পর্কিত এ আয়াতের এ নতুন ব্যাখ্যাদাতাগণ এ ব্যাপারে যে বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন, যথার্থ সততা ও আন্তরিকতার সাথে এ কিতাব পাঠকারী কোন ব্যক্তি কখনো তার শিকার হতে পারেন, একথা মেনে নেয়া আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ খিলাফত ও খিলাফত লাভের যে অর্থের ওপর তারা নিজেদের চিন্তার এ বিশাল ইমারত নির্মাণ করেছেন তা তাদের নিজেদের তৈরী। কুরআনের জ্ঞান রাখে এমন কোন ব্যক্তি কখনো এ আয়াতের এ অর্থ করতে পারেন না।
আসলে কুরআন খিলাফত ও খিলাফত লাভকে তিনটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে। প্রত্যেক জায়গায় পূর্বাপর আলোচ্য বিষয় থেকে কোথায় এ শব্দটি কি অর্থে বলা হয়েছে তা জানা যায়।
এর একটি অর্থ হচ্ছে, “আল্লাহর দেয়া ক্ষমতার অধিকারী হওয়া।” এ অর্থ অনুসারে সারা দুনিয়ার সমস্ত মানব সন্তান পৃথিবীতে খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত।
দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, “আল্লাহর সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে তাঁর শরীয়তী বিধানের (নিছক প্রাকৃতিক বিধানের নয়) আওতায় খিলাফতের ক্ষমতা ব্যবহার করা।” এ অর্থে কেবল মাত্র সৎ মু’মিনই খলীফা গণ্য হয়। কারণ সে সঠিকভাবে খিলাফতের হক আদায় করে। বিপরীতপক্ষে কাফের ও ফাসেক খলীফা নয় বরং বিদ্রোহী। কারণ তারা আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতাকে নাফরমানীর পথে ব্যবহার করে।
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, “এক যুগের বিজয়ী ও ক্ষমতাশালী জাতির পরে অন্য জাতির তার স্থান দখল করা।” খিলাফতের প্রথম দু’টি অর্থ গৃহীত হয়েছে “প্রতিনিধিত্ব” শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ থেকে। আর এ শেষ অর্থটি “স্থলাভিষিক্ত” শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। এ শব্দটির এ দু’টি অর্থ আরবী ভাষায় সর্বজন পরিচিত। এখন যে ব্যক্তিই এখানে এ প্রেক্ষাপটে খিলাফত লাভের আয়াতটি পাঠ করবে সে এক মুহূর্তের জন্যও এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করতে পারে না যে, এখানে খিলাফত শব্দটি এমন এক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা আল্লাহর শরীয়াতী বিধান অনুযায়ী (নিছক প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী নয়) তাঁর প্রতিনিধিত্বের যথাযথ হক আদায় করে। এ কারণেই কাফের তো দূরের কথা ইসলামের দাবীদার মুনাফিকদেরকেও এ প্রতিশ্রুতিতে শরীক করতে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে। তাই বলা হচ্ছে, একমাত্র ঈমান ও সৎকর্মের গুণে গুণান্বিত লোকেরাই হয় এর অধিকারী। এজন্য খিলাফত প্রতিষ্ঠার ফল হিসেবে বলা হচ্ছে, আল্লাহর পছন্দনীয় দ্বীন অর্থাৎ ইসলাম মজবুত বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আর এজন্য পুরস্কার দানের শর্ত হিসেবে বলা হচ্ছে, নির্ভেজাল আল্লাহর বন্দেগীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো। এ বন্দেগীতে যেন শিরকের সামান্যতমও মিশেল না থাকে। এ প্রতিশ্রুতিকে এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক ময়দানে পৌঁছিয়ে দেয়া এবং আমেরিকা থেকে নিয়ে রাশিয়া পর্যন্ত যারই শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতাপ-প্রতিপত্তির ডংকা দুনিয়ায় বাজতে থাকে তারই সমীপে একে নজরানা হিসেবে পেশ করা চূড়ান্ত মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ শক্তিগুলো যদি খিলাফতের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থেকে থাকে তাহলে ফেরাউন ও নমরূদ কি দোষ করেছিল, আল্লাহ কেন তাদেরকে অভিশাপ লাভের যোগ্য গণ্য করেছেন? (আরো বেশী ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, আল আম্বিয়া, ৯৯ টিকা)। এখানে আর একটি কথাও উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালের মুসলমানদের জন্য এ প্রতিশ্রুতি পরোক্ষভাবে পৌঁছে যায়। প্রত্যক্ষভাবে এখানে এমন সব লোককে সম্বোধন করা হয়েছিল যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ছিলেন। প্রতিশ্রুতি যখন দেয়া হয়েছিল তখন সত্যিই মুসলমানরা ভয়-ভীতির মধ্যে অবস্থান করছিল এবং দ্বীন ইসলাম তখনো হিজাযের সরেজমিনে মজবুতভাবে শিকড় গেড়ে বসেনি। এর কয়েক বছর পর এ ভয়ভীতির অবস্থা কেবল নিরাপত্তায় বদলে যায়নি বরং ইসলাম আরব থেকে হয়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বৃহত্তর অংশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার শিকার কেবল তার জন্মভূমিতেই নয়, বহির্বিশ্বেও মজবুতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। আল্লাহর তাঁর এ প্রতিশ্রুতি আবু বকর সিদ্দীক, উমর ফারুক ও উসমান গনী রাদিয়াল্লাহু আনহুমের জামানায় পুরা করে দেন, এটি একথার একটি ঐতিহাসিক প্রমাণ। এরপর এ তিন মহান ব্যক্তির খিলাফতকে কুরআন নিজেই সত্যায়িত করেছে এবং আল্লাহ নিজেই এদের সৎ মু’মিন হবার সাক্ষ্য দিচ্ছেন, এ ব্যাপারে কোন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তির পক্ষে সন্দেহ পোষণ করা কঠিন। এ ব্যাপারে যদি কারোর মনে সন্দেহ দেখা দেয় তাহলে তাঁর “নাহ্জুল বালাগায়’ সাইয়েদুনা হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর ভাষণ পাঠ করা দরকার। হযরত উমরকে ইরানীদের বিরুদ্ধে সশরীরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য তিনি এ ভাষণটি দিয়েছিলেন। এতে তিনি বলেনঃ এ কাজের বিস্তার বা দুর্বলতা সংখ্যায় বেশী হওয়া ও কম হওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। এ হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। তিনি একে বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত করেছেন। আর আল্লাহর সেনাদলকে তিনি সাহায্য-সহায়তা দান করেছেন। শেষ পর্যন্ত উন্নতি লাভ করে তা এখানে পৌঁছে গেছে। আল্লাহ নিজেই আমাদের বলেছেনঃ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ………………. “আল্লাহ নিশ্চয়ই এ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবেন এবং নিশ্চয়ই নিজের সেনানীদেরকে সাহায্য করবেন। মোতির মালার মধ্যে সূতোর যে স্থান, ইসলামে কাইয়েম তথা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাকারীও সে একই স্থানে অবস্থান করছেন। সূতো ছিড়ে গেলেই মোতির দানাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং শৃংখলা বিনষ্ট হয়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর আবার একত্র হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে সন্দেহ নেই, আরবরা সংখ্যায় অল্প। কিন্তু ইসলাম তাদেরকে বিপুল সংখ্যায় পরিণত করেছে এবং সংঘবদ্ধতা তাদেরকে শক্তিশালী করে দিয়েছে। আপনি কেন্দ্রীয় পরিচালক হিসেবে এখানে শক্ত হয়ে বসে থাকুন, আরবের যাঁতাকে নিজের চারদিকে ঘুরাতে থাকুন এবং এখানে বসে বসেই যুদ্ধের আগুন জ্বালাতে থাকুন। নয়তো আপনি যদি একবার এখান থেকে সরে যান তাহলে সবদিকে আরবীয় ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করবে এবং অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছবে যে, আপনাকে সামনের শত্রুর তুলনায় পেছনের বিপদের কথা বেশী করে চিন্তা করতে হবে। আবার ওদিকে ইরানীরা আপনার ওপর দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত করবে। তারা মনে করবে, এই তো আরবের মূল গ্রন্থি, একে কেটে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কাজেই আপনাকে খতম করে দেবার জন্য তারা নিজেদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। আর আজমবাসীরা এসময় বিপুল সংখ্যায় এসে ভীড় জমিয়েছে বলে যে কথা আপনি বলেছেন এর জবাবে বলা যায়, এর আগেও আমরা তাদের সাথে লড়েছি, তখনো সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে লড়িনি বরং আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তাই আজ পর্যন্ত আমাদের সফলকাম করেছে।”
জ্ঞানী পর্যবেক্ষক নিজেই দেখতে পারেন হযরত আলী (রা.) এখানে কাকে খিলাফত লাভের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য করছেন।
# এখানে কুফরী করা মানে নিয়ামত অস্বীকার করাও হতে পারে আবার সত্য অস্বীকার করাও। প্রথম অর্থের দৃষ্টিতে এর ক্ষেত্র হবে এমন সব লোক যারা খিলাফতের নিয়ামত লাভ করার পর সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আর দ্বিতীয় অর্থের দৃষ্টিতে এর ক্ষেত্র হবে মুনাফিকবৃন্দ, যারা আল্লাহর এ প্রতিশ্রুতি শুনার পরও নিজের মুনাফিকী মনোভাব ও কর্মনীতি পরিহার করে না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-
৫৫ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত মু’মিনদেরকে প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদের জমিনে খেলাফত দান করবেন যেমন ইতোপূর্বে যারা সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদেরকে জমিনে খেলাফত দান করেছিলেন। জমিনে তাদের ক্ষমতা থাকবে তারা যা বলবে তা করতে পারবে। কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে যা প্রমাণ করে যারা সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা জমিনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাদেরকে খেলাফত দান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلَّذِيْنَ إِنْ مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ ط وَلِلّٰهِ عَاقِبَةُ الْأُمُوْرِ)
“আমি এদেরকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করলে এরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করবে; আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহ তা‘আলার এখতিয়ারে।” (সূরা হজ্জ ২২:৪১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(يٰٓأَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْآ إِنْ تَنْصُرُوا اللّٰهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ)
“হে ঐসব লোক, যারা ঈমান এনেছ! তোমরা যদি আল্লাহ তা‘আলাকে সাহায্য কর তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের কদমকে মযবুত করে দেবেন।” (সূরা মুহাম্মাদ ৪৭:৭) এ সম্পর্কে আরো বলেন:
(عَسٰي رَبُّكُمْ أَنْ يُّهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُوْنَ)
‘শীঘ্রই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্র“কে ধ্বংস করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে জমিনে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন, অতঃপর তোমরা কী কর তা তিনি লক্ষ্য করবেন।’ (সূরা আ‘রাফ ৭:১২৯)
(وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِيْنَهُمُ)
‘তিনি অবশ্যই তাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন’ সে দীন হল ইসলাম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِيْنًا)
“আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম।” (সূরা মায়িদা ৫:৩) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:
لَا يَبْقَي عَلَي ظَهْرِ الْأَرْضِ بَيْتُ مَدَرٍ، وَلَا وَبَرٍ إِلَّا أَدْخَلَهُ اللّٰهُ كَلِمَةَ الْإِسْلَامِ، بِعِزِّ عَزِيزٍ أَوْ ذُلِّ ذَلِيلٍ، إِمَّا يُعِزُّهُمُ اللّٰهُ فَيَجْعَلُهُمْ مِنْ أَهْلِهَا، أَوْ يُذِلُّهُمْ فَيَدِينُونَ لَهَا
পৃথিবীর বুকে তৈরি করা মাটি ও খড়ের প্রত্যেক বাড়িতে আল্লাহ ইসলামের বাণী প্রবেশ করাবেন। কোন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিকে ক্ষমতায় অথবা পরাক্রমশালীদেরকে সম্মানিত করে অথবা অপদস্থদেরকে অপমানিত করে। হয়তো তাদেরকে সম্মানিত করবেন, ফলে তাদেরকে ইসলামের অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত করবেন অথবা তাদেরকে অপমানিত করবেন ফলে তারা সে দীনের অনুসারী হবে। (মুসনাদ আহমাদ হা: ২৩৮১৪, সহীহ)
(وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِّنْۭ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا)
অর্থাৎ মু’মিনদের সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য আরো ফলাফল হল তাদের ভয়কে নিরাপত্তায় পরিবর্তন করে দেবেন। অর্থাৎ নিজেদের সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে, অস্ত্রহীনতার কারণে বা অন্যান্য যে সকল কারণে সর্বদা কাফিরদের থেকে ভয় পেয়ে থাকে অথবা অন্য যে কোন ভয় থাকুক তা থাকবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আল্লাহ তা‘আলা যখন দীনকে পূর্ণতা দান করবেন তখন একজন আরোহী সানআ থেকে হাজরামাওত পর্যন্ত সফর করবে, আল্লাহ তা‘আলার ভয় ছাড়া অন্য কোন ভয় থাকবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৩৮৫২)
কিছুসংখ্যক বিদ্বান এ প্রতিশ্র“তিকে সাহাবায়ে কিরামদের সাথে অথবা খোলাফায়ে রাশেদীনের সাথে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কিন্তু এ সীমাবদ্ধতার কোন দলীল নেই। সুতরাং যদি মুসলিমরা সঠিক ঈমান ও আমলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে আল্লাহ তা‘আলা উক্ত প্রতিশ্র“তি যে কোন সময় বাস্তবে রূপ দান করবেন।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ঈমানদার বান্দাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা জমিনের প্রতিনিধি বানাবেন।
২. তারা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, আর কাউকে শরীক করবে না।
৩. তাদের অন্তরে কোন প্রকার ভয় কাজ করবে না।
৫৬-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদেরকে নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, তারা যেন সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنٰتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَا۬ءُ بَعْضٍ م يَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللّٰهَ وَرَسُوْلَه۫ ط أُولٰٓئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللّٰهُ ط إِنَّ اللّٰهَ عَزِيْزٌ حَكِيْمٌ)
“মু’মিন নর ও মু’মিন নারী একে অপরের বন্ধু, এরা সৎ কাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎ কাজ নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে; এদেরকেই আল্লাহ তা‘আলা কৃপা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা তাওবাহ ৯:৭১)
সুতরাং বুঝা যাচ্ছে সালাত কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য করা আল্লাহ তা‘আলার রহমত পাওয়ার অন্যতম উপায়। যেখানেই এ সকল আমল বলবত থাকবে সেখানেই আল্লাহ তা‘আলার রহমত নাযিল হবে।
এরপর আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সম্বোধন করে বলছেন: তুমি এরূপ মনে কর না, কাফির-মুশরিকরা দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলাকে অপারগ করে ফেলবে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পাকড়াও করতে পারবেন না। বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে পাকড়াও করতে সক্ষম, তিনি যা চান তা কেউ প্রতিহত করতে পারে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَسِيْحُوْا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَّاعْلَمُوْآ أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللّٰهِ لا وَأَنَّ اللّٰهَ مُخْزِي الْكٰفِرِيْنَ)
“অতঃপর তোমরা দেশে চার মাসকাল চলাফেরা কর ও জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহ তা‘আলাকে হীনবল করতে পারবে না এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদেরকে লাঞ্ছিত করে থাকেন।” (সূরা তাওবাহ ৯:২)
এ সম্পর্কে সূরা তাওবার ২ নং আয়াতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সালাত আদায় এবং যাকাত প্রদান করতে হবে।
২. আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করতে হবে।
৩. কাফির-মুশরিকরা যতকিছুই করুক না কেন তারা আল্লাহ তা‘আলার শক্তির নিকট অপারগ।
তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
# আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা’আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-এর সাথে ওয়াদা করছেন যে, তিনি তাঁর উম্মতকে যমীনের মালিক বানিয়ে দিবেন, তাদেরকে তিনি লোকদের নেতা করবেন এবং দেশ তাদের দ্বারা জনবসতিপূর্ণ হবে। আল্লাহর বান্দারা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকবে। আজ জনগণ লোকদের থেকে ভীত-সন্ত্রস্ত রয়েছে, কাল তারা পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করবে। হুকুমত তাদের হবে এবং তারাই হবে সাম্রাজ্যের মালিক। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে, হয়েছেও তাই। মক্কা, খায়বার, বাহরাইন, আরব উপদ্বীপ এবং ইয়ামন তো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যুগেই বিজিত হয়েছিল। হিজরের মাজুসীরা জিযিয়া কর দিতে স্বীকৃত হয়ে মুসলমানদের অধীনতা স্বীকার করে নেয়। সিরিয়ার কোন কোন অংশেরও এই অবস্থাই হয়। রোমক সম্রাট কায়সার উপহার উপঢৌকন পাঠিয়ে দেন। মিসরের গভর্নরও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে উপঢৌকন পাঠায়। ইসকানদারিয়ার বাদশাহ মাকুকাস এবং আম্মানের বাদশাহরাও এটাই করেন এবং এইভাবে নিজেদের আনুগত্য প্রমাণ করেন। হাবশের বাদশাহ নাজ্জাসী (রঃ) তো মুসলমানই হয়ে যান যিনি আসহামার পরে হাবশের বাদশাহ হয়েছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন ইন্তেকাল করেন এবং হযরত আবু বকর (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তখন তিনি হযরত খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী পারস্য অভিমুখে প্রেরণ করেন। সেখানে তিনি ক্রমান্বয়ে বিজয় লাভ করতে থাকেন এবং কুফরীর গাছগুলোকে কেটে ফেলে চতুর্দিকে ইসলামের চারা রোপণ করেন। হযরত আবু উবাদাহ ইবনে জাররাহ (রাঃ) প্রমুখ সেনাবাহিনীর অধীনে ইসলামের বীর সৈনিকদেরকে সিরিয়ার রাজ্যগুলোর দিকে প্রেরণ করেন এবং তাঁরা সেখানে মুহাম্মাদ (সঃ) পতাকা উত্তোলন করেন এবং ক্রুশ চিহ্নযুক্ত পতাকাগুলোকে উল্টোমুখে নিক্ষেপ করেন। হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী মিসরের দিকে প্রেরিত হয়। বসরা, দামে, আম্মান প্রভৃতি রাজ্য বিজয়ের পর হযরত আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুর ডাকে সাড়া দেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি মহান। আল্লাহর ইঙ্গিতক্রমে হযরত উমার (রাঃ)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। এটা সত্য কথা যে, আকাশের নীচে কোন নবীর পরে হযরত উমার (রাঃ)-এর যুগের মত যুগ আর আসেনি। তার স্বভাবগত শক্তি, তাঁর পুণ্য, তার চরিত্র, তাঁর ন্যায়পরায়ণতা এবং তার আল্লাহভীতির দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় তার পরে অনুসন্ধান করা বৃথা কালক্ষেপণ ছাড়া কিছুই নয়। সমগ্র সিরিয়া ও মিসর এবং পারস্যের অধিকাংশ অঞ্চল তার খিলাফতের আমলে বিজিত হয়। পারস্য সম্রাট কিসরার সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। স্বয়ং সম্রাটের মাথা লুকাবার কোন জায়গা থাকে। তাকে লাঞ্ছিত অবস্থায় পালিয়ে বেড়াতে হয়। রোমক সম্রাট কায়সারকেও সাম্রাজ্যচ্যুত করা হয়। সিরিয়া সাম্রাজ্য তার হাত ছাড়া হয়ে যায় এবং কনস্টান্টিনোপলে পালিয়ে গিয়ে তাকে আত্মগোপন করতে হয়। এই সাম্রাজ্যগুলোর বহু বছরের সঞ্চিত ধন-সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয়। আল্লাহর এই সৎ ও মধুর চরিত্রের অধিকারী বান্দাদের মধ্যে এগুলো বন্টন করা হয়। এইভাবে মহান আল্লাহ তাঁর ঐ ওয়াদা পূর্ণ করেন যা তিনি তার প্রিয় বন্ধু হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর সাথে করেছিলেন।
অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ)-এর খিলাফতের যুগ আসে এবং পূর্ব হতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীন ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহর সেনাবাহিনী একদিকে পূর্ব দিকের শেষ প্রান্ত এবং অপরদিকে পশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। ইসলামী মুজাহিদদের উন্মুক্ত তরবারী আল্লাহর তাওহীদকে দুনিয়ার প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছিয়ে দেন। স্পেন, কিবরাস এমন কি সুদূর চীন পর্যন্ত হযরত উমার (রাঃ)-এর যুগে বিজিত হয়। পারস্য সম্রাট কিসরা নিহত হয়। তার সাম্রাজ্যের নাম ও নিশানা নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। অগ্নি উপাসকদের হাজার হাজার বছরের উপাসনালয় নির্বাপিত হয় এবং প্রত্যেকটি উঁচু টিলা হতে আল্লাহু আকবার ধ্বনি গুঞ্জরিত হয়। অপরদিকে মাদায়েন, ইরাক, খখারাসান, আহওয়ায ইত্যাদি সাম্রাজ্য জয় করা হয়। তুর্কীদের সাথে বিশাল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে তাদের বড় বাদশাহ খাকান মাটির সাথে মিশে যায়। সে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও পর্যদস্ত হয় এবং যমীনের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্ত হতে হযরত উসমান (রাঃ)-এর দরবারে খাজনা পৌছতে থাকে। সত্য কথা তো এটাই যে, মুসলিম বীর পুরুষদের এই জীবন মরণ সংগ্রামের মূলে ছিল হযরত উসমান (রাঃ)-এর তিলাওয়াতে কুরআনের বরকত। কুরআন কারীমের প্রতি তাঁর যে আসক্তি ও অনুরাগ ছিল তা বর্ণনাতীত। কুরআনকে একত্রিতকরণ ও মুখস্থকরণ এবং প্রচার ও প্রসারকরণে তিনি যে খিদমত আঞ্জাম দেন তার তুলনা মিলে না। তাঁর যুগের থতি লক্ষ্য করলে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীটি মানসপটে ভেসে ওঠে। তিনি বলেছিলেনঃ “আমার জন্যে যমীনকে এক জায়গায় একত্রিত ও জড় করা য়, এমনকি আমি পূর্ব দিক ও পশ্চিম দিক দেখে নিই। আমার উম্মতের সাম্রাজ্য ইন পর্যন্ত পৌঁছে যাবে যেখান পর্যন্ত আমাকে দেখানো হয়েছিল। এখন আৰা দেখতে পাই যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) আমাদের সাথে যে ভদ করেছিলেন তা সত্যে পরিণত হয়েছে। সুতরাং আমরা আল্লাহর প্রতি এবং তৰ ৰাসূল (সঃ)-এর প্রতি ঈমানের প্রার্থনা করছি এবং যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তিনি সন্তুষ্ট হন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার আমরা তাঁর কাছে তাওফীক চাচ্ছি। হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছি- “মুসলমানদের কাজ উত্তমরূপে চালু থাকবে, শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বারো জন খলীফা হবে।” অতঃপর তিনি একটি বাক্য আস্তে বলেন যা আমার কর্ণগোচর হয়নি। আমি ওটা আমার পিতাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে কথাটি আস্তে বলেছিলেন তাহলোঃ “এদের সবাই কুরায়েশী হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ) স্বীয় সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
রাসূলুল্লাহ (সঃ) একথাটি ঐদিনের সন্ধ্যায় বলেছিলেন যেই দিন হযরত মায়েয ইবনে মালিক (রাঃ)-কে রজম বা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়েছিল। সুতরাং জানা গেল যে, এই বারোজন খলীফা অবশ্যই হবেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, এই বারো জন খলীফা তারা নয় যাদেরকে শিয়া সম্প্রদায় ধারণা করছে। কেননা শিয়াদের ইমামদের মধ্যে এমন বহু ইমামও রয়েছে যারা খিলাফত ও সালতানাতের কোন অংশ সারা জীবনেও লাভ করেনি। এই বারো জন খলীফা সবাই হবেন কুরায়েশ বংশের। তাঁরা হবেন ন্যায়ের সাথে ফায়সালাকারী। তাঁদের সুসংবাদ পূর্ববর্তী কিতাবসমূহেও রয়েছে। এটা শর্ত নয় যে, এই বারো জন খলীফা পর্যায়ক্রমে ও ক্রমিকভাবে হবেন। বরং হতে পারে যে, তারা বিভিন্ন যুগে হবেন। চার জন খলীফা তো ক্রমিকভাবেই হয়েছেন। যেমন হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ)। তাঁদের পর ক্রম কেটে গেছে। পরে এরূপ খলীফা গত হয়েছেন এবং পরবর্তীতেও কোন কোন খলীফার আগমন ঘটতে পারে। সঠিক যুগের অবগতি একমাত্র মহান আল্লাহরই রয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত কথা যে, ইমাম মেহেদীও এই বারো জনের একজন হবেন যার নাম ও কুনিয়াত হবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম ও কুনিয়াত মুতাবেক। তিনি সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠকে আদল ও ইনসাফ দ্বারা পূর্ণ করে দিবেন, যখন সারা দুনিয়া অন্যায় ও অত্যাচারে ছেয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুক্ত দাস হযরত সাফীনা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার (ইন্তেকালের) পরে ত্রিশ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে, তারপর দন্তকর্তিত রাজ্য হয়ে যাবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আবুল আলিয়া (রঃ) আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, (ইসলামের আবির্ভাবের পর) রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সহচরবর্গ দশ বছরের মত মক্কায় অবস্থান করেন। ঐ সময় তারা দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর ইবাদতের দিকে আহ্বান করতে থাকেন। কিন্তু ঐ যুগটি ছিল গোপনীয়তা, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতার যুগ। তখন পর্যন্ত জিহাদের হুকুম নাযিল হয়নি। মুসলমানরা ছিলেন অত্যন্ত দুর্বল। এরপর হিজরতের হুকুম হয় এবং তাঁরা মদীনায় হিজরত করেন। অতঃপর জিহাদের হুকুম অবতীর্ণ হয়। চতুর্দিকে শত্রু পরিবেষ্টিত ছিল। মুসলমানরা ছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত। কোন সময়ই বিপদ শূন্য ছিল না। সকাল সন্ধ্যায় সাহাবীগণ (রাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত থাকতেন। একজন সাহাবী একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমাদের জীবনের একটা মুহূর্তও কি শান্তিতে কাটবে না? হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ক্ষণেকের জন্যেও কি আমরা অস্ত্র-শস্ত্র রেখে দিয়ে তৃপ্তি ও স্বস্তির শ্বাস গ্রহণ করতে পারবো না?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) অত্যন্ত শান্তভাবে উত্তর দেনঃ “আরো কিছুদিন ধৈর্যধারণ কর। অতঃপর এমন শান্তি এবং নিরাপত্তা বিরাজ করবে যে, মানুষ ভরা মজলিসে আরামে ও নিশ্চিন্তে বসে থাকবে, একজনের কাছে কেন, কারো কাছেই কোন অস্ত্র থাকবে।” ঐ সময় আল্লাহ তা’আলা এই আয়াত অবতীর্ণ করেন।
অতঃপর আল্লাহর নবী (সঃ) আরব উপদ্বীপের উপর বিজয় লাভ করেন। আরবে কোন কাফির থাকলো না। সুতরাং মুসলমানদের অন্তর ভয়শূন্য হয়ে গেল। আর সদা-সর্বদা অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত থাকার কোন প্রয়োজন থাকলো না। ভারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকালের পরেও তিনজন খলীফার যুগ পর্যন্ত সর্বত্র ঐ শান্তি ও নিরাপত্তাই বিরাজ করে। অর্থাৎ হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ) এবং হযরত উসমান (রাঃ)-এর যুগ পর্যন্ত। এরপর মুসলমানদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কাজেই আবার তাদের মধ্যে ভয় এসে পড়ে এবং প্রহরী, চৌকিদার, দারোগা ইত্যাতি নিযুক্ত করতে হয়। মুসলমানরা যখন নিজেদের অবস্থা নিজেরাই পরিবর্তন করে তখন তাদের অবস্থা পবির্তিত হয়ে যায়।
পূর্ব যুগীয় কোন কোন গুরুজন হতে বর্ণিত আছে যে, তারা হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমার (রাঃ)-এর খিলাফতের সত্যতার ব্যাপারে এই আয়াতটিকে পেশ করেছেন।
হযরত বারা ইবনে আযিব (রাঃ) বলেনঃ “যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন আমরা অত্যন্ত ভয় ও দুর্ভাবনার অবস্থায় ছিলাম। যেমন আল্লাহ তা’আলা (আরবি)
অর্থাৎ “তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমরা ছিলে খুবই অল্প এবং ভূ-পৃষ্ঠে তোমাদেরকে দুর্বল মনে করা হতো।” (৮:২৬) অর্থাৎ পদে পদে তোমরা ভীত ও শংকিত থাকতে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেন এবং তোমাদেরকে শক্তিশালী করেন। আর তিনি তোমাদেরকে নিরাপত্তা দান করেন।
মহান আল্লাহ বলেনঃ যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে। যেমন হযরত মূসা (আঃ) তাঁর কওমকে বলেছিলেন (আরবি)
অর্থাৎ “এটা খুবই নিকটে যে, তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুদেরকে ধ্বংস করবেন এবং যমীনে তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন।” (৭:১২৯) অন্য আয়াতে বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি চাই যে, ভূ-পৃষ্ঠে যাদেরকে দুর্বল জ্ঞান করা হতো তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো।” (২৮: ৫)
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তিনি অবশ্যই তাদের জন্যে সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্যে মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন।
হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) যখন প্রতিনিধি হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কি হীরা নামক দেশ দেখেছো?” উত্তরে হযরত আদী ইবনে হাতিম (রাঃ) বলেনঃ “জ্বী না, আমি হীরা দেখিনি, তবে নাম শুনেছি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! আল্লাহ তা’আলা আমার এই দ্বীনকে পূর্ণরূপে ছড়িয়ে দিবেন। তখন এমনভাবে শান্তি ও নিরাপত্তা এসে যাবে যে, হীরা হতে একজন মহিলা উন্ত্রীর উপর সওয়ার হয়ে একাই বেরিয়ে পড়বে এবং বায়তুল্লাহ শরীফে পৌঁছে তাওয়াফ কার্য সম্পন্ন করতঃ ফিরে আসবে। সে না কাউকেও ভয় করবে এবং না কারো আশ্রয়ে থাকবে। জেনে রেখো যে, ইরানের বাদশাহ কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগার বিজিত হবে।” হযরত আদী (রাঃ) বিস্ময়ের সুরে বলেনঃ “ইরানের বাদশাহ কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগার মুসলমানরা জয় করবেন!” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হ্যাঁ, কিসরা ইবনে হরমুযের কোষাগারই বটে। ধন-সম্পদ এতো বৃদ্ধি পাবে যে, তা গ্রহণকারী কেউ থাকবে না।” হযরত আদী (রাঃ) বলেনঃ “দেখুন, বাস্তবিকই স্ত্রীলোকেরা হীরা হতে কারো আশ্রয় ছাড়াই যাতায়াত করছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হতে আমি স্বচক্ষে দেখলাম। দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীও আমার চোখের সামনে পুরো হয়েছে। কিসরার ধনভাণ্ডার জয়কারীদের মধ্যে স্বয়ং আমিও বিদ্যমান ছিলাম। তৃতীয় ভবিষ্যদ্বাণীটিও নিঃসন্দেহে পূর্ণ হবে। কেননা, এটাও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এরই ভবিষ্যদ্বাণী ।”
হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “এই উম্মতকে ভূ-পৃষ্ঠে উন্নতি, উচ্চ মর্যাদা, দ্বীনের প্রসার ও সাহায্যের সুসংবাদ দিয়ে দাও। তবে যে ব্যক্তি দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যে আখিরাতের কাজ করবে তার জানা উচিত যে, পরকালে তার জন্যে কোনই অংশ নেই।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করবে না।
হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি উটের উপরে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনে বসেছিলাম। আমার ও তার মাঝে জিনের (উটের গদীর) শেষ কাষ্ঠখণ্ড ছাড়া কিছুই ছিল না (অর্থাৎ আমি নবী (সঃ)-এর খুবই সংলগ্ন ছিলাম)। তখন তিনি বললেনঃ “হে মুআয (রাঃ)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সঃ) সামনে কিছুক্ষণ অগ্রসর হলেন। আবার তিনি বললেনঃ “হে মুআয (রাঃ)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! আবার তিনি কিছুক্ষণ সামনে চললেন। পুনরায় তিনি বললেনঃ “হে মুআয (রাঃ)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক! তিনি (এবার) বললেনঃ “বান্দার উপর আল্লাহর হক কি তা কি তুমি জান?” আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূল (সঃ) অধিকতর ভাল জানেন ও জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেনঃ “বান্দার উপর আল্লাহর হক এই যে, তারা একবার তারই ইবাদত করবে এবং তার সাথে এতটুকুও শরীক করবে না।” অতঃ তিনি কিছুক্ষণ সামনে গেলেন এবং আবার বললেনঃ “হে মুআয! (৯)!” আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাব্বায়েক ওয়া সাদায়েক!
তিনি বললেনঃ “আল্লাহর উপর বান্দার হক কি তা তুমি জান কি?” আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) সবচেয়ে ভাল জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেনঃ “আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে এই যে, তিনি তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন না। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাদের সহীহ গ্রন্থে এটা তাখরীজ করেছেন)
অতঃপর আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আর যারা অকৃতজ্ঞ হবে তারা তো সত্যত্যাগী অর্থাৎ এর পরেও যারা আমার আনুগত্য পরিত্যাগ করবে সে আমার হুকুম অমান্য করলো এবং এটা খুবই কঠিন ও বড় পাপ।
আল্লাহর মাহাত্ম্য এই যে, যেই যুগে ইসলামের শক্তি বেশী থেকেছে সেই যুগে তিনি সাহায্যও বেশী করেছেন। সাহাবীগণ ঈমানে অগ্রগামী ছিলেন, কাজেই তঁারা বিজয় লাভের ব্যাপারেও সবারই অগ্রে থেকেছেন। যেমন ঈমানে দুর্বলতা দেখা দেয় তেমন পার্থিব অবস্থা, রাজত্ব এবং শান-শওকতও নীচে নেমে গেছে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সদা সত্যের উপর থাকবে এবং তারা থাকবে সদা জয়যুক্ত। তাদের বিরোধীরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। কিয়ামত পর্যন্ত এই অবস্থাই থাকবে। আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ওয়াদা এসে যাবে। একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত এই দলটিই সর্বশেষে দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে। আর একটি হাদীসে আছে যে, হযরত ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ পর্যন্ত এই লোকগুলো কাফিরদের উপর জয়যুক্ত থাকবে। এই সব রিওয়াইয়াত বিশুদ্ধ এবং সবগুলোরই ভাবার্থ একই।
৫৬-৫৭ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা স্বীয় ঈমানদার বান্দাদেরকে শুধু তাঁরই ইবাদত করার নির্দেশ দিচ্ছেন। তিনি বলছেনঃ তাঁরই জন্যে তোমরা নামায সুপ্রতিষ্ঠিত কর এবং সাথে সাথে তাঁর বান্দাদের প্রতি অনুগ্রহ কর ও তাদের সাথে সৎ ব্যবহার কর। দুর্বল, দরিদ্র এবং মিসকীনদের খবরাখবর নিতে থাকো। মালের মধ্য হতে আল্লাহর হক অর্থাৎ যাকাত বের কর এবং প্রতিটি কাজে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য করতে থাকো। তিনি যে কাজের নির্দেশ দেন তা পালন কর এবং যা করতে নিষেধ করেন তা হতে বিরত থাকো। জেনে রেখো যে, আল্লাহর রহমত লাভের এটাই একমাত্র পন্থা। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “ওরাই তারা যাদের উপর আল্লাহ সত্বরই করুণা বর্ষণ করবেন।” (৯:৭১)
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! তুমি ধারণা করো না যে, তোমাকে অবিশ্বাসকারীরা আমার উপর জয়যুক্ত হবে বা এদিক-ওদিক পালিয়ে গিয়ে আমার কঠিন শাস্তি হতে রক্ষা পেয়ে যাবে। আমি তাদের প্রকৃত বাসস্থান জাহান্নামে ঠিক করে রেখেছি যা বাসের পক্ষে অত্যন্ত জঘন্য স্থান।