(বই#৯৮২)[পর্দার বিধান] www.motaher21.net

أعوذ باللّٰه من الشيطان الرجيم
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيمِ
(বই#৯৮২)[পর্দার বিধান]
www.motaher21.net
সূরা:- আন-নূর।
সুরা:২৪
পারা:১৮
৫৮- ৬১ নং আয়াত:-
২৪:৫৮
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لِیَسۡتَاۡذِنۡکُمُ الَّذِیۡنَ مَلَکَتۡ اَیۡمَانُکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ لَمۡ یَبۡلُغُوا الۡحُلُمَ مِنۡکُمۡ ثَلٰثَ مَرّٰتٍ ؕ مِنۡ قَبۡلِ صَلٰوۃِ الۡفَجۡرِ وَ حِیۡنَ تَضَعُوۡنَ ثِیَابَکُمۡ مِّنَ الظَّہِیۡرَۃِ وَ مِنۡۢ بَعۡدِ صَلٰوۃِ الۡعِشَآءِ ۟ؕ ثَلٰثُ عَوۡرٰتٍ لَّکُمۡ ؕ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ وَ لَا عَلَیۡہِمۡ جُنَاحٌۢ بَعۡدَہُنَّ ؕ طَوّٰفُوۡنَ عَلَیۡکُمۡ بَعۡضُکُمۡ عَلٰی بَعۡضٍ ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمُ الۡاٰیٰتِ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۵۸﴾
হে মুমিনগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়নি তারা যেন তোমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে তিন সময় অনুমতি গ্রহণ করে, ফজরের সালাতের আগে, দুপুরে যখন তোমরা তোমাদের পোষাক খুলে রাখ তখন এবং ‘ইশার সালাতের পর; এ তিন সময় তোমাদের গোপনীয়তার সময়। এ তিন সময় ছাড়া (অন্য সময় বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করলে) তোমাদের এবং তাদের কোন দোষ নেই । তোমাদের এককে অন্যের কাছে তো যেতেই হয়। এভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বিবৃত করেন। আর আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
২৪:৫৯
وَ اِذَا بَلَغَ الۡاَطۡفَالُ مِنۡکُمُ الۡحُلُمَ فَلۡیَسۡتَاۡذِنُوۡا کَمَا اسۡتَاۡذَنَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِہِمۡ ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمۡ اٰیٰتِہٖ ؕ وَ اللّٰہُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۵۹﴾
আর যখন তোমাদের সন্তানরা বুদ্ধির সীমানায় পৌঁছে যায় তখন তাদের তেমনি অনুমতি নিয়ে আসা উচিত যেমন তাদের বড়রা অনুমতি নিয়ে থাকে। এভাবে আল্লাহ‌ তাঁর আয়াত তোমাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন ও বিজ্ঞ।
২৪:৬০
وَ الۡقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَآءِ الّٰتِیۡ لَا یَرۡجُوۡنَ نِکَاحًا فَلَیۡسَ عَلَیۡہِنَّ جُنَاحٌ اَنۡ یَّضَعۡنَ ثِیَابَہُنَّ غَیۡرَ مُتَبَرِّجٰتٍۭ بِزِیۡنَۃٍ ؕ وَ اَنۡ یَّسۡتَعۡفِفۡنَ خَیۡرٌ لَّہُنَّ ؕ وَ اللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۶۰﴾
আর যেসব যৌবন অতিক্রান্ত মহিলা বিয়ের আশা রাখে না, তারা যদি নিজেদের চাদর নামিয়ে রেখে দেয়, তাহলে তাদের কোন গোনাহ নেই, তবে শর্ত হচ্ছে তারা সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী হবে না। তবু তারাও যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করে তাহলে তা তাদের জন্য ভালো এবং আল্লাহ‌ সবকিছু শোনেন ও জানেন।
২৪:৬১
لَیۡسَ عَلَی الۡاَعۡمٰی حَرَجٌ وَّ لَا عَلَی الۡاَعۡرَجِ حَرَجٌ وَّ لَا عَلَی الۡمَرِیۡضِ حَرَجٌ وَّ لَا عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ اَنۡ تَاۡکُلُوۡا مِنۡۢ بُیُوۡتِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ اٰبَآئِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ اُمَّہٰتِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ اِخۡوَانِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ اَخَوٰتِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ اَعۡمَامِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ عَمّٰتِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ اَخۡوَالِکُمۡ اَوۡ بُیُوۡتِ خٰلٰتِکُمۡ اَوۡ مَا مَلَکۡتُمۡ مَّفَاتِحَہٗۤ اَوۡ صَدِیۡقِکُمۡ ؕ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَاۡکُلُوۡا جَمِیۡعًا اَوۡ اَشۡتَاتًا ؕ فَاِذَا دَخَلۡتُمۡ بُیُوۡتًا فَسَلِّمُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ تَحِیَّۃً مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰہِ مُبٰرَکَۃً طَیِّبَۃً ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ ﴿٪۶۱﴾
অন্ধের জন্য দোষ নেই, খঞ্জের জন্য দোষ নেই, রুগ্নের জন্য দোষ নেই এবং তোমাদের নিজেদের জন্যও দোষ নেই খাওয়া-দাওয়া করা তোমাদের ঘরে অথবা তোমাদের পিতাদের ঘরে, মাতাদের ঘরে, ভাইদের ঘরে, বোনদের ঘরে, চাচা-জেঠাদের ঘরে, ফুফুদের ঘরে, মামাদের ঘরে, খালাদের ঘরে অথবা সেসব ঘরে যেগুলোর চাবির মালিক তোমরা অথবা তোমাদের বন্ধুদের ঘরে। তোমরা একত্রে খাও বা পৃথক পৃথকভাবে খাও তাতে তোমাদের জন্য কোন অপরাধ নেই। তবে যখন তোমরা কোন ঘরে প্রবেশ করবে তখন তোমরা পরস্পরের প্রতি সালাম করবে অভিবাদনস্বরূপ যা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র। এভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার।

ফী জিলালিল কুরআন বলেছেন:-

‘হে মােমেনরা! তােমাদের দাস দাসীরা এবং তােমাদের মধ্যে যারা প্রাপ্ত বয়স্ক হয়নি…'(আয়াত ৫৮) ইসলাম হচ্ছে একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান। আর সে কারণে মানব জীবনের খুঁটি নাটি প্রতিটি বিষয় ও দিক সম্পর্কে এর নির্দেশনা রয়েছে। সাধারণ জীবন যাপন করতে গিয়ে কি কি নিয়ম কানুন ও আদব কায়দা মেনে চলতে হবে- সে শিক্ষাও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ইসলাম মানুষকে দিয়ে থাকে। মােট কথা ইসলাম মানব জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে আল্লাহমুখী করে তােলে। আলোচ্য সূরা আমাদের এই বক্তব্যের বাস্তব প্রমাণ। এই সূরার প্রথম দিকে কিছু ফৌজদারী বিধান বর্ণিত হয়েছে। তারপর বর্ণিত হয়েছে কারাে বাড়ীতে প্রবেশ করার আগে অনুমতি প্রার্থনার বিষয়টি। এরপর বর্ণিত হয়েছে বিশাল সৃষ্টি জগতের বিভিন্ন বিষয়াদি। এরপর বর্ণিত হয়েছে আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের ফয়সালার প্রতি মুসলমান ও মুনাফিকের দৃষ্টিভংগির পার্থক্য। এরপর বর্ণিত হয়েছে পৃথিবীর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা দানের ব্যাপারে আল্লাহর ওয়াদার বিষয়টি। আর এখন আবার আলােচনায় আসছে ঘরে প্রবেশের পূর্বে অনুমতি প্রার্থনার বিষয়টি। সাথে সাথে রসূলের বৈঠক থেকে ওঠার পূর্বে অনুমতি প্রার্থনা, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত, আদর আপ্যায়ন ও খানাপিনা সংক্রান্ত আদব কায়দার প্রসংগও আলােচনা করা হয়েছে। এসব আদব কায়দা মেনে চলে মুসলিম সমাজ নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক সুসংহত ও সুশৃংখল করতে সক্ষম হােক, এটাই পবিত্র কোরআনের উদ্দেশ্য। সে কারণেই জীবনের খুঁটি-নাটি সকল ক্ষেত্রেই পবিত্র কোরআন দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।  *ঘরের লােকদেরও অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হবে : এর আগে কারাে বাড়ীতে প্রবেশ করার আগে অনুমতি প্রার্থনার বিষয়টি আলােচিত হয়েছে। এখন আলােচনা করা হচ্ছে ঘরের ভেতরে থাকা অবস্থায় অনুমতি প্রার্থনার বিষয়টি। আলােচ্য আয়াতে বলা হচ্ছে যে, বাড়ীর ভেতর সেবায় নিয়ােজিত ক্রীতদাস এবং বােধ সম্পন্ন শিশুরা অনুমতি ছাড়াই ঘরে প্রবেশ করতে পারবে। তবে তিনটি সময়ে তাদেরকেও অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে হবে। সময় তিনটি হচ্ছে, ফজরের নামাযের পূর্বে, দুপুরে বিশ্রামের সময় এবং এশার নামাযের পর। কারণ, এই তিনটি মুহূর্তে মানুষ সাধারণত পরনের কাপড় খুলে বিশ্রামের জন্যে হাল্কা কাপড় পরে থাকে। এই তিনটি মুহূর্তে অসর্তকতার কারণে মানুষের লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হতে পারে। তাই দাস দাসী ও ছােট বাচ্চাদেরকে অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে বলা হয়েছে যেন তাদের পিতা-মাতা বা আত্মীয় স্বজনদের কারাে লজ্জাস্থানের প্রতি নযর না পড়তে পারে। এটা একটা অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় আদব বা শিষ্টাচার । অথবা এই প্রয়ােজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচারটির ব্যাপারে ঘরােয়া জীবনে অনেকেই উদাসীন। তাদের ধারণা, চাকর-বাকরদের দৃষ্টি কখনাে মনিবদের লজ্জাস্থানের ওপর পড়তে পারে না। তাদের আরাে ধারণা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচ্চারা কখনাে এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। অথচ আধুনিক মনােবিজ্ঞান এতাে যুগ পরে এসে প্রমাণ করে দেখাচ্ছে যে, বাল্যকালে দেখা কোনাে অবাঞ্ছিত ঘটনা বা দৃশ্য মানুষের গােটা জীবনকে প্রভাবিত করে এবং এর অশুভ পরিণতি হিসেবে শিশুরা দুরারােগ্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু, আল্লাহ তায়ালা তাে সব কিছুই জানেন ও দেখেন। তিনি এমন একটি জাতি গঠন করতে চান যে জাতি হবে সুস্থ মন মানসিকতার অধিকারী, নির্মল অনুভূতির অধিকারী, পবিত্র মনের অধিকারী এবং পরিচ্ছন্ন চিন্তা চেতনার অধিকারী! তাই তিনি এসব আদব কায়দার তালিম দিচ্ছেন। এই তিনটি মুহূর্তে লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হওয়ার আশংকা আছে বলেই অনুমতি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করার কথা বলা হয়েছে। অন্য সময় চাকর বাকর ও ছােট-বাচ্চাদের অনুমতি নেয়ার প্রয়ােজন নেই। কারণ, এটা তাদের জন্যে কষ্টকর হবে। তারা প্রতি মুহুর্তে ভেতর বাড়ীতে থাকার ফলে সময় অসময়ে বড়দের ঘরে ঢুকে থাকে। তাই যে মুহূর্তে লজ্জাস্থান উন্মুক্ত হওয়ার আশংকা থাকে কেবল সে মুহূর্তগুলােতেও তাদেরকে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে বলা হয়েছে, অন্য সময়ে নয় । তবে ছােট বাচ্চারা সাবালক হয়ে গেলে তখন তাদেরকেও বেগানা পুরুষদের মতােই অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে। কারণ তাদের বেলায়ও অনুমতি প্রার্থনা সংক্রান্ত বিধান কার্যকর হবে। এই বিধান পূর্বে আলােচিত হয়েছে। আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ অর্থাৎ এসব আদব কায়দা মানুষের জীবনের জন্যে কতােটুকু প্রয়ােজন ও গুরুত্বপূর্ণ তা আল্লাহ তায়ালা যথার্থরূপে জানেন। সাথে সাথে তিনি আরো জানেন, কোন পন্থায় ও কোন পদ্ধতিতে মানুষের হৃদয় ও মনের চিকিৎসা করা সম্ভব।

*ক্ষেত্র বিশেষ শিথিলতা প্রদর্শন ও আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্কের ধরণ : ইতিপূর্বে মেয়েদেরকে নিজেদের সাজগােজ লুকিয়ে রেখে চলাফেরার কথা বলা হয়েছে যেন কোনাে প্রকার অশ্লীল ও অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি না হয়। এখন আলােচনা করা হচ্ছে সেই সকল নারীদের ব্যাপারে যারা বিগত যৌবনা, যাদের মাঝে কামােদ্দিপক দৈহিক বৈশিষ্ট্যগুলাে অনুপস্থিত। তাদের ব্যাপারে আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘বৃদ্ধা নারী যারা বিবাহের আশা রাখে না, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের বস্ত্র খুলে রাখে তাদের জন্যে দোষ নেই। তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্যে উত্তম।’ অর্থাৎ দুটো শর্ত সাপেক্ষে বিগত যৌবনা বৃদ্ধা মহিলারা নিজেদের বহিরাবরণ খুলে রাখতে পারবেন। প্রথম শর্ত হলাে, এর দ্বারা যেন তাদের লজ্জাস্থান উন্মুক্ত না হয়ে পড়ে। আর দ্বিতীয় শর্ত হলাে, এর ফলে যেন তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শিত না হয়। তবে ঢেকে ঢুকে থাকাটাই হবে তাদের জন্যে উত্তম। কারণ, খােলামেলা পােষাক অনেক অনাচারের জন্ম দেয়। অপরদিকে শালীনতাপূর্ণ পোষাকাদি মানুষকে উপহার দেয় সংযত জীবন ও নির্মল চরিত্র । ওই কারণেই ইসলাম সব ধরনের অশ্লীলতা অশালীনতা ও কামোদ্দীপক পোষাক পরিচ্ছদ ও আচার-আচরণকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছে। আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ’ অর্থাৎ তিনি শুনেন ও জানেন। মানুষ মুখে কি বলে, সে সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন এবং তার মনের গভীরে কি সব জল্পনা কল্পনা চলে সে সম্পর্কেও তিনি অবগত আছেন। কারণ গােটা বিষয়টাই হচ্ছে বিবেক নির্ভর, সদিচ্ছা নির্ভর। বিবেকের খবরও যেহেতু আল্লাহর জানা আছে, কাজেই এখানে কপটতার কোনাে অবকাশ নেই। এর পরের আয়াতে ভাই-বেরাদর, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যকার সম্পর্ক ও দায় দায়িত্ব কি রূপ হওয়া উচিত সে সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেমন, ‘অন্ধের জন্যে দোষ নেই, খঞ্জের জন্যে দোষ নেই… এমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা তােমাদের জন্যে আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন যাতে তােমরা বুঝে নাও'(আয়াত ৬১) বর্ণিত আছে যে, সাহাবায়ে কেরামরা আয়াতে উল্লেখিত বাড়ীগুলােতে কোনাে প্রকার পূর্ব অনুমতি ছাড়াই ঢুকতেন এবং খাবার গ্রহণ করতেন। অনেক সময় তাদের আত্মীয়রা অন্ধ, খোড়া ও অসুস্থ ব্যক্তিদেরকেও খাওয়ানাের জন্যে তাদের সাথে করে নিয়ে আসতে বলতেন। কিন্তু দাওয়াত ছাড়া এসব লােকদেরকে আনতে তারা দ্বিধাবোধ করতেন। এমনকি ওইসব লােকেরা বিনা দাওয়াতে কারাে বাড়ীতে খেতে দ্বিধাবােধ করতাে। কারণ, অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ গ্রাস করাে না।'(সূরা নিসা ২৯) এই আয়াতের মর্মার্থ তাদের সামনে ছিলাে বলে তারা অন্যের বাড়ীতে বিনা দাওয়াতে খাবার গ্রহণ করতে এতাে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তারা সব সময়ই সতর্ক থাকতেন যেন কোনাে নিষিদ্ধ কাজ তাদের দ্বারা না হয়ে যায়। তাই আল্লাহ তায়ালা আলােচ্য আয়াত নাযিল করে অন্ধ, খোড়া, অসুস্থ ও আত্মীয়স্বজনদের ব্যাপারে ছাড় দিয়ে বলেছেন যে, তারা আয়াতে বর্ণিত ব্যক্তিদের বাড়ীতে নিসংকোচে খেতে পারে এবং অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদেরকেও সাথে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে এই যে, বাড়ীর কর্তার যেন এতে কোনাে আপত্তি না থাকে এবং এর দ্বারা যেন তার কোনাে ক্ষতি না হয়। কারণ শরীয়তের একটা সাধারণ বিধান হচ্ছে, কারাে ক্ষতি করা যাবে না এবং সন্তুষ্টি ও অনুমতি ব্যতীত কোনাে মুসলমানের সম্পদ অপর মুসলমানের জন্যে বৈধ নয়। আলোচ্য আয়াতটি যেহেতু আইন সংক্রান্ত, তাই এর বর্ণনা ভংগি অত্যন্ত সুস্পষ্ট, শব্দ বিন্যাস। অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতাও অত্যন্ত যুক্তিসংগত । আরাে একটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হচ্ছে আত্মীয়তার বর্ণনার মাঝে ধারাবাহিকতা। আয়াতে ‘পুত্র ও স্বামীর ঘরকে তােমাদের নিজেদের ঘর’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, পুত্রের ঘর পিতার জন্যে আপন ঘর হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে স্বামীর ঘরও স্ত্রীর জন্যে আপন ঘর হিসেবেই গণ্য হয়। এরপর এসেছে পিতার ঘর, তারপর মাতার ঘর, তারপর ভাইদের ঘর, তারপর বােনদের ঘর, তারপর চাচাদের ঘর, তারপর ফুফুদের ঘর, তারপর মামাদের ঘর, তারপর খালাদের ঘর। এই আত্মীয়তার সম্পর্কের সাথে আর এক প্রকার সম্পর্ককে যােগ করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে কর্মের সম্পর্ক। অর্থাৎ কেউ যদি কারাে সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকে তাহলে সেও প্রয়ােজন অনুসারে নিয়ােগকর্তার ঘরে খাবার গ্রহণ করতে পারে। এরপর বন্ধু বান্ধবদেরকে ও আত্মীয়স্বজনদের পর্যায়ে স্থান দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যদি কোনাে আপত্তি না থাকে তাহলে যে কোনাে বন্ধু অপর বন্ধুর ঘরে অনুমতি ছাড়াই খাবার গ্রহণ করতে পারে এখন খাবার গ্রহণের নিয়ম বলা হচ্ছে, ‘তোমরা একত্রে আহার করো, অথবা পৃথকভাবে আহার করো, তাতে তােমাদের কোনাে দোষ নেই।’ ইসলাম পূর্ব যুগে আরবদের মাঝে একটা প্রথার প্রচলন ছিলাে। সেটা হচ্ছে, তারা একা একা খেতাে না। কাউকে না পেলে আহার বন্ধ রাখতাে। আল্লাহ তায়ালা এই কষ্টসাধ্য প্রথা রহিত করে একটা সহজ ও স্বাভাবিক নিয়ম প্রবর্তন করে বলছেন যে, তােমরা একত্রেও খেতে পারাে এবং পৃথক পৃথকও খেতে পারাে এতে দোষের কিছু নেই। এখন কারাে ঘরে প্রবেশ করার আগে কি করতে হবে তা বর্ণনা করা হচ্ছে, ‘অতঃপর যখন তােমরা গৃহে প্রবেশ করাে, তখন তােমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম করবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া।’ অর্থাৎ নিজেদের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের প্রতি সালাম জানানাের মাধ্যমে মানুষ প্রকৃতপক্ষে নিজের জন্যেই কল্যাণের দোয়া করে থাকে। আর এই দোয়া অন্য কারাে পক্ষ থেকে নয়, বরং স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে। এর মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন আরাে দৃঢ় হয়, আরাে গভীর হয়। কেবল আত্মীয়তার বন্ধনই দৃঢ় হয় না। বরং বান্দার সাথে তার রব বা প্রতিপালকের বন্ধনও দৃঢ় হয়। সাথে সাথে বান্দা তার প্রতিপালকের নির্দেশের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যও উপলব্ধি করতে পারে। তাই বলা হয়েছে, ‘এমনিভাবে আল্লাহ তােমাদের জন্যে আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তােমরা বুঝতে পারো।’

তাফসীরে তাফহীমুল কুরআন বলেছেন:-

# এখান থেকে আবার সামাজিক বিধানের ধারাবাহিক বর্ণনা শুরু হচ্ছে। সূরা নূরের এ অংশটি ওপরের ভাষণের কিছুকাল পরে নাযিল হওয়া মোটেই বিচিত্র নয়।
# অধিকাংশ মুফাস্সির ও ফকীহের মতে “মালিকানাধীন” বলতে দাস-দাসী উভয়কে বুঝানো হয়েছে। কারণ এখানে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ইবনে উমর ও মুজাহিদ এ আয়াতে মামলুক তথা মালিকানাধীন শব্দটি কেবলমাত্র দাস অর্থে নিয়েছেন। তাঁরা দাসীকে এর বাইরে রেখেছেন। অথচ সামনের দিকে যে হুকুম বর্ণনা করা হয়েছে সেদিকে দৃষ্টি দিলে এ বিশেষ অর্থের কোন কারণ দেখা যায় না। একান্তে অবস্থান করার সময় যেমন নিজের ছেলেমেয়েদের অকস্মাৎ এসে যাওয়া সঙ্গত নয় তেমনি দাসী-চাকরানীর এসে যাওয়াও অসঙ্গত। এ আয়াতের আদেশ প্রাপ্ত বয়স্ক-অপ্রাপ্ত বয়স্ক উভয় ধরনের দাস-দাসীর জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, এ ব্যাপারে সবাই একমত।
# দ্বিতীয় অনুবাদ হতে পারে, “প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো স্বপ্ন দেখার বয়সে পৌঁছেনি।” এ থেকেই ফকীহগণ স্বপ্নদোষকে ছেলেদের বয়ঃপ্রাপ্ত হবার সূচনা বলে মেনে নিয়েছেন। এ ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু আমি নিজে মূল অনুবাদে যে অর্থ করেছি তা অগ্রগণ্য হবার কারণ হচ্ছে এই যে, এ হুকুমটি ছেলে ও মেয়ে উভয়ের জন্য। অন্যদিকে স্বপ্নদোষকে বয়ঃপ্রাপ্ত হবার আলামত হিসেবে গণ্য করার পর হুকুমটি শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট হয়ে যায়। কারণ মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্ক হবার সূচনা হচ্ছে মাসিক ঋতুস্রাব, স্বপ্নদোষ নয়। কাজেই আমার মতে হুকুমের উদ্দেশ্য হচ্ছে, যতদিন ঘরের ছেলে মেয়েরা যৌন চেতনা জাগ্রত হবার বয়সে পৌঁছে না ততদিন তারা এ নিয়ম মেনে চলবে। এরপর যখনই তারা এ নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে যাবে তখনই তাদের যে হুকুম মেনে চলতে হবে তা সামনে আসছে।
# মূলে عَوْرَاتٍ (আওরাত) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “এ তিনটি সময় তোমাদের জন্য আওরাত।” আওরাত বলতে আমাদের ভাষায় মেয়েলোক বা নারী জাতি বুঝায়। কিন্তু আরবী ভাষায় এর মানে হয় বাধা ও বিপদের জায়গা এবং যে জিনিসের খুলে যাওয়া মানুষের জন্য লজ্জার ব্যাপার এবং যার প্রকাশ হয়ে পড়া তার জন্য বিরক্তিকর হয় এমন জিনিসের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া কোন জিনিসের অসংরক্ষিত হওয়া অর্থেও এর ব্যবহার হয়। এ অর্থগুলো সবই পরস্পর নিকট সম্পর্কযুক্ত এবং আয়াতের অর্থের সাথে কোন না কোন পর্যায়ে সংযুক্ত। এর অর্থ হচ্ছে এ সময়গুলোতে তোমরা একাকী বা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে এমন অবস্থায় থাকো যে অবস্থায় গৃহের ছেলেমেয়ে বা চাকর বাকরদের হঠাৎ তোমাদের কাছে চলে যাওয়া সংগত নয়। কাজেই এ তিন সময়ে তারা যখন তোমাদের নির্জন স্থানে আসতে চায় তখন তাদের পূর্বাহ্ণে অনুমতি নেবার নির্দেশ দাও।
# এ তিন সময় ছাড়া অন্য সময় নাবালক ছেলেমেয়েরা এবং গৃহস্বামীর ও গৃহকর্ত্রীর মালিকানাধীন গোলাম ও বাঁদীরা সবসময় নারীর ও পুরুষদের কাছে তাদের কামরায় বা নির্জন স্থানে বিনা অনুমতিতে যেতে পারে। এ সময় যদি তোমরা কোন অসতর্ক অবস্থায় থাকো এবং তারা অনুমতি ছাড়াই এসে যায় তাহলে তাদের হুমকি-ধামকি দেবার অধিকার তোমাদের নেই। কারণ কাজের সময় নিজেদেরকে এ ধরনের অসতর্ক অবস্থায় রাখা তোমাদের নিজেদেরই বোকামী ছাড়া তো আর কিছুই নয়। তবে যদি তোমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সত্ত্বেও নির্জনবাসের এ তিন সময় তারা অনুমতি ছাড়াই আসে তাহলে তারা দোষী হবে। অন্যথায় তোমরা নিজেরাই যদি তোমাদের সন্তান ও গোলামী-বাঁদীদের এ আদব-কায়দা ও আচার-আচরণ শিক্ষা না দিয়ে থাকো, তাহলে তোমরা নিজেরাই গোনাহগার হবে।
# উপরোক্ত তিনটি সময় ছাড়া অন্য সবসময় ছোট ছেলেমেয়ে ও গোলাম-বাঁদীদের বিনা হুকুমে আসার সাধারণ অনুমতি দেবার এটিই হচ্ছে কারণ। এ থেকে উসূলে ফিকাহর এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, শরীয়াতের বিধানসমূহ কোন না কোন প্রয়োজন ও উপযোগিতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রত্যেক হুকুমের পেছনে নিশ্চিতভাবেই কোন না কোন কার্যকারণ আছেই, তা বিবৃত হোক বা না হোক।

# সাবালক হয়ে যায়, যেমন ৮৭ টীকায় বলা হয়েছে ছেলেদের ক্ষেত্রে স্বপ্নদোষ ও মেয়েদের ক্ষেত্রে মাসিক ঋতুস্রাব থেকেই তাদের সাবালকত্ব শুরু হয়। কিন্তু যেসব ছেলেমেয়ে কোন কারণে বেশী বয়স পর্যন্ত এসব পরিবর্তন মুক্ত থাকে তাদের ব্যাপারে ফকীহগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। ইমাম শাফেঈ, ইমাম আবু ইউসুফ, ইমাম মুহাম্মাদ ও ইমাম আহমাদের মতে এ অবস্থায় ১৫ বছরের ছেলেমেয়েকে সাবালক মনে করা হবে। ইমাম আবু হানীফার একটি উক্তি এর সমর্থন করে। কিন্তু ইমামের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে এ অবস্থায় ১৭ বছরের মেয়ে ও ১৮ বছের ছেলেকে সাবালক গণ্য করা হবে। কুরআন ও হাদীসের কোন বক্তব্য এ দু’টি উক্তির ভিত্তি নয় বরং এর ভিত্তি গড়ে উঠেছে ফিকাহভিত্তিক ইজতিহাদের ওপর কাজেই সারা দুনিয়ায় চিরকালই যেসব ছেলের স্বপ্নদোষ হয়নি ও যেসব মেয়ের ঋতুস্রাব দেখা দেয়নি তাদের সাবালকত্বের জন্য ১৫ বা ১৮ বছর বয়সকেই যে সীমানা হিসেবে মেনে নেয়া হবে এমন কোন কথা নেই। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন যুগে শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশের অবস্থা বিভিন্ন হয়। আসলে, সাধারণত কোন দেশে যেসব বয়সের ছেলেমেয়েদের স্বপ্নদোষ ও মাসিক ঋতুস্রাব হওয়া শুরু হয় তাদের গড়পড়তা পার্থক্য বের করে নিতে হবে, তারপর যেসব ছেলেমেয়ের মধ্যে কোন অস্বাভাবিক কারণে এ চিহ্নগুলো যথাযথ উপযোগী সময়ে প্রকাশিত না হয় তাদের জন্য সর্বাধিক পরিমাণ বয়সের ওপর এ গড়পড়তার বৃদ্ধি ধরে তাকে সাবালকত্বের বয়স গণ্য করতে হবে। যেমন কোন দেশে সাধারণত কমপক্ষে ১২ এবং বেশীরপক্ষে ১৫ বছর বয়সের ছেলের স্বপ্নদোষ হয়। এক্ষেত্রে গড়পড়তা পার্থক্য হবে দেড় বছর। আর অস্বাভাবিক ধরনের ছেলেদের জন্য আমরা সাড়ে ষোল বছর বয়ঃসীমাকে সাবালকত্বের বয়স গণ্য করতে পারবো। এ নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের আইনবিদগণ নিজেদের এলাকার অবস্থার প্রেক্ষিতে একটি সীমা নির্ধারণ করতে পারেন। ১৫ বছরের সীমার পক্ষে একটি হাদীস পেশ করা হয়। এটি ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেন, “আমার বয়স ছিল চৌদ্দ, সে সময় ওহোদ যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে আমাকে পেশ করার হয়। তিনি আমাকে যুদ্ধে অংশ নেবার অনুমতি দেননি। তারপর খন্দকের যুদ্ধের সময় আমাকে আবার পেশ করা হয়। তখন আমার বয়স হয় ১৫ বছর। এ সময় তিনি আমাকে অনুমতি দেন।” (সিহাহে সিত্তা ও মুসনাদে আহাদ) কিন্তু দু’টি কারণে এ হাদীসটি থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করা যেতে পারে না। এক ওহোদ যুদ্ধ ৩ হিজরীর শওয়াল মাসের ঘটনা এবং খন্দকের যুদ্ধ মুহাম্মাদ ইবনে সা’দের বক্তব্য মতে ৫ হিজরীর যিলকদ মাসে সংঘটিত হয়। দুটো যুদ্ধের মধ্যে পুরো দু’বছর বা তার চেয়ে বেশী দিনের ব্যবধান রয়েছে। এখন যদি ওহোদ যুদ্ধের সময় ইবনে উমরের বয়স হয় ১৪ বছর তাহলে কেমন করে খন্দকের যুদ্ধের সময় তা শুধুমাত্র ১৫ বছর হয়?” হতে পারে তিনি ১৩ বছর ১১ মাস বয়সে ১৪ বছর এবং ১৫ বছর ১১ মাসকে ১৫ বছর বলেছেন। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, যুদ্ধের জন্য সাবালক হওয়া এক জিনিস এবং সামাজিক ব্যাপারের জন্য আইনগতভাবে সাবালক হওয়া অন্য জিনিস। এ দু’য়ের মধ্যে কোন অনিবার্যতার সম্পর্ক নেই। কাজেই এদের একটিকে অন্যটির জন্য প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে না। তাই যেসব ছেলের স্বপ্নদোষ হয়নি তাদের সাবালকত্বের জন্য ১৫ বছর বয়ঃসীমা নির্ধারণ করা একটি আনুমানিক ও ইজতিহাদী সিদ্ধান্ত, কুরআন ও হাদীসের হুকুম নয়, এ ব্যাপারে এটিই সঠিক কথা।

# মূলে বলা হয়েছে وَالْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَاءِ অর্থাৎ “মহিলাদের মধ্য থেকে যারা বসে পড়েছে” অথবা “বসে পড়া মহিলারা।” এর অর্থ হচ্ছে, হতাশার বয়স অর্থাৎ মহিলাদের এমন বয়সে পৌঁছে যাওয়া যে বয়সে আর তাদের সন্তান জন্ম দেবার যোগ্যতা থাকে না। যে বয়সে তার নিজের যৌন কামনা মৃত হয়ে যায় এবং তাকে দেখে পুরুষদের মধ্যেও কোন যৌন আবেগ সৃষ্টি হতে পারে না। পরবর্তী বাক্য এ অর্থের দিকেই ইঙ্গিত করেছে।
# মূল শব্দ হচ্ছে يَضَعْنَ ثِيَابَهُنَّ “নিজেদের কাপড় নামিয়ে রাখে।” কিন্তু এর অর্থ সমস্ত কাপড় নামিয়ে উলংগ হয়ে যাওয়া তো হতে পারে না। তাই সকল মুফাস্সির ও ফকীহ্ সর্বসম্মতভাবে এর অর্থ নিয়েছেন এমন চাদর যার সাহায্যে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখার হুকুম সূরা আহযাবের يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ আয়াতে দেয়া হয়েছিল।
# মূল শব্দ হচ্ছে غَيْرَ مُتَبَرِّجَاتٍ “সৌন্দর্য সহকারে সাজসজ্জা প্রকাশকারী হয় না। تَبَرَج মানে হচ্ছে প্রকাশ ও প্রদর্শনী করা। بَارِج বলা হয় এমন খোলা নৌকা বা জাহাজকে যার ওপর ছাদ হয় না। এ অর্থে মহিলাদের জন্য এ শব্দটি তখনই বলা হয় যখন তারা পুরুষদের সামনে তাদের নিজেদের সৌন্দর্য ও সাজসজ্জা প্রদর্শনী করে। কাজেই আয়াতের অর্থ হচ্ছে, চাদর নামিয়ে দেবার এ অনুমতি এমন সব বৃদ্ধাদেরকে দেয়া হচ্ছে যাদের সাজসজ্জা করার ইচ্ছা ও শখ খতম হয়ে গেছে এবং যৌন আবেগ শীতল হয়ে গেছে। কিন্তু যদি এ আগুনের মধ্যে এখনো একটি স্ফুলিংগ সজীব থেকে থাকে এবং তা সৌন্দর্যের প্রদর্শনীর রূপ অবলম্বন করতে থাকে তাহলে আর এ অনুমতি থেকে লাভবান হওয়া যেতে পারে না।
# এ আয়াতটি বুঝতে হলে তিনটি কথা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। প্রথমত এ আয়াতটির দু’টি অংশ। প্রথম অংশটি রুগ্ন, খঞ্জ, অন্ধ ও অনুরূপ অন্যান্য অক্ষমদের ব্যাপারে এবং দ্বিতীয় অংশটি সাধারণ লোকদের ব্যাপারে বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত কুরআনের নৈতিক শিক্ষাবলীর মাধ্যমে আরববাসীদের মন-মানসে যে বিরাট বিপ্লব সাধিত হয়েছিল সে কারণে হালাল-হারাম ও জায়েয-নাজায়েযের পার্থক্যের ব্যাপারে তাদের অনুভূতি হয়ে উঠেছিল চরম সংবেদশীল। ইবনে আব্বাসের উক্তি অনুযায়ী আল্লাহ যখন তাদের হুকুম দিলেনঃ لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ (একে অন্যের সম্পদ নাজায়েয পথে খেয়ো না) তখন লোকেরা একে অন্যের বাড়িতে খাবার ব্যাপারেও খুব বেশী সতর্কতা অবলম্বন করতে লাগলো। এমনকি যতক্ষণ গৃহ মালিকের দাওয়াত ও অনুমতি একেবারে আইনগত শর্ত অনুযায়ী না হতো ততক্ষণ তারা মনে করতো কোন আত্মীয় ও বন্ধুর বাড়ীতে খাওয়াও জায়েয নয়। তৃতীয়ত এখানে নিজেদের গৃহে খাবার যে কথা বলা হয়েছে তা অনুমতি দেবার জন্য নয় বরং একথা মনের মধ্যে বসিয়ে দেবার জন্য যে, নিজের আত্মীয় ও বন্ধুর বাড়িতে খাওয়াও ঠিক তেমনি যেমন নিজের বাড়িতে খাওয়া। অন্যথায় একথা সবাই জানে, নিজের বাড়িতে খাবার জন্য কারোর অনুমিত নেবার প্রয়োজন ছিল না। এ তিনটি কথা বুঝে নেয়ার পর আয়াতের এ অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, অক্ষম ব্যক্তি নিজের ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য প্রত্যেক গৃহে ও প্রত্যেক জায়গায় খেতে পারে। তার অক্ষমতাই সমগ্র সমাজে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। তাই যেখান থেকেই সে খাবার জিনিস পাবে তা তার জন্য জায়েয হবে। আর সাধারণ লোকের ব্যাপারে বলা হয় যায়, তাদের জন্য তাদের নিজেদের গৃহ এবং যাদের কথা বলা হয়েছে তাদের গৃহ সমান। তার মধ্যে যেখানেই তারা খাক না কেন সেজন্য গৃহস্বামীর যথারীতি অনুমতি পেলে তবে খাবে, অন্যথায় তা অবিশ্বস্ততা ও আত্মসাত বলে গণ্য হবে, এ ধরনের কোন শর্তের প্রয়োজন নেই। লোকেরা যদি তাদের মধ্য থেকে কারোর গৃহে যায়, সেখানে গৃহস্বামী উপস্থিত না থাকে এবং তার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা কিছু খাবার নিয়ে আসে তাহলে তারা নিঃসংকোচে তা খেতে পারে। যেসব আত্মীয়-পরিজনের নাম এখানে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে সন্তানদের উল্লেখ এজন্য করা হয়নি যে, সন্তানদের গৃহ নিজেরই গৃহ হয়ে থাকে। বন্ধুদের ব্যাপারে মনে রাখতে হবে, অন্তরঙ্গ বন্ধুদের কথা বলা হয়েছে, যাদের অনুপস্থিতিতে অতিথি বন্ধুরা যদি তাদের সবকিছু খেয়েও চলে যায় তাহলে তারা নারাজ হওয়া তো দূরের কথা উল্টো আরো খুশিই হবে।
# প্রাচীন আরবের কোন কোন গোত্রের আচার ও রীতিনীতি এই ছিল যে, তারা প্রত্যেকে নিজের খাবার নিয়ে আলাদা বসে খেতো। তারা সবাই মিলে এক জায়গায় বসে খাওয়াটা খারাপ মনে করতো। যেমন হিন্দুরা আজও এটা খারাপ মনে করে। অন্যদিকে কোন কোন গোত্র আবার একাকী খাওয়া খারাপ মনে করতো। এমন কি সাথে কেউ খেতে না বসলে তারা অভুক্ত থাকতো। এ আয়াতটি এ ধরনের বিধি-নিষেধ খতম করার জন্য নাযিল করা হয়েছে।

তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ বলেছেন:-

৫৮-৬০ নং আয়াতের তাফসীর:

পর্দা, সামাজিকতা ও পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাতের উত্তম রীতিনীতি অত্র সূরার ২৭, ২৮, ২৯ নং আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কারো সাথে দেখা সাক্ষাত করতে গেলে অনুমতি নিয়ে গৃহে প্রবেশ করতে হবে। অনুমতি না দিলে প্রবেশ করা যাবে না। এসব বিধান ছিল বাহির থেকে আগন্তুক ব্যক্তিদের জন্য। অত্র আয়াতগুলোতেও এমন সব ব্যক্তিদের বিশেষ সময়ে অনুমতি নিয়ে প্রবেশের নির্দেশ দেয়া হয়েছে যারা সাধারণত সর্বদা বাড়ির ভিতরে থাকে এবং তাদের সাথে নারীদের পর্দাও জরুরী নয়। অর্থাৎ দাস-দাসী এবং ছোট ছেলে মেয়ে যারা প্রাপ্ত বয়স্কা হয়নি। এরাও তিনটি সময় অন্য রুমে প্রবেশকালীন অনুমতি নিবে। সে তিনটি সময় হলন (১) ফজরের সালাতের পূর্বে, কারণ এ সময় সাধারণত গায়ের পোশাক ঠিক মত নাও থাকতে পারে। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার থাকতে পারে। (২) দুপুরে বিশ্রামের সময়ন এ সময় বিশ্রামের জন্য গায়ের পোশাক ঠিক না থাকতে পারে। (৩) ইশার সালাতের পর ঘুমানোর সময়। দাস-দাসীই হোক আর ছোট বাচ্চাই হোক এ সময়গুলোতে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে ফেললে আর তখন অসতর্ক অবস্থায় থাকলে লজ্জার কারণ ঘটবে। তাই অনুমতি নেয়া আবশ্যক।

(ثَلٰثُ عَوْرٰتٍ)

অর্থাৎ এ সময়গুলোকে পর্দার সময় বলা হয়েছে। কারণ এ সময় পুরুষ বা মহিলারা (স্বামী-স্ত্রী) পোশাক সম্পর্কে সচেতন থাকে না।

এ তিন সময় ব্যতীত অন্য সময়ে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করাতে কোন দোষ নেই। কারণ তোমরা একজন অপরের কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনে যাতায়াত করে থাক। তোমাদের দাস-দাসীরা তোমাদের সেবা করার জন্য আসে, ছোট বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করে থাকে বা প্রয়োজনে আসা যাওয়া করে থাকে। কিন্তু বাচ্চারা যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাবে তখন বড়দের ন্যায় যে কোন সময় প্রবেশ করতে চাইলে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করবে। যেমনভাবে অনুমতি নেয়ার কথা অত্র সূরার প্রথমে বলা হয়েছে।
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বৃদ্ধা নারীদের পর্দার কথা উল্লেখ করে বলেন, যারা বিবাহের আশা রাখে না অর্থাৎ একবারে বৃদ্ধা, তারা যদি তাদের চাদর নামিয়ে দিয়ে শুধু দোপাট্টা পরে থাকে তাহলে তাদের কোন গুনাহ হবে না। তবে এর দ্বারা যেন উদ্দেশ্য না থাকে সৌন্দর্য প্রকাশ করা। এ ব্যাপারে আয়িশাহ (رضي الله عنها)-কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: তোমাদের জন্য সাজ-সজ্জা অবশ্যই বৈধ, কিন্তু এটা যেন অপর পুরুষের চক্ষু ঠাণ্ডা করার জন্য না হয়। (দুররুল মানসূর ৫/৫৭)

এখানে প্রথম আয়াতটিতে গোলাম ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক আপন সন্তানদের সম্পর্কে, দ্বিতীয় আয়াতটিতে বয়ঃপ্রাপ্ত আপন সন্তানদের সম্পর্কে এবং তৃতীয় আয়াতটিতে বৃদ্ধা মহিলাদের বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তবে বৃদ্ধা মহিলাদের ওড়নার ওপরে চাদর ব্যবহার করাই উত্তম।

সুতরাং মহিলাদের এ বিষয়টি জানা থাকা দরকার, কারণ অজ্ঞতার কারণে কখন কী হয়ে যায় যার জন্য পরে আফসোস করতে হবে কিন্তু তা কোন উপকারে আসবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:

১. তিন সময় আপন সন্তান ও দাস-দাসীরা গৃহে প্রবেশ করলেও অনুমতি নিতে হবে। আর তা হচ্ছে ফজরের পূর্বে, দ্বিপ্রহরে এবং এশার পরে।
২. আপন সন্তানেরাও প্রাপ্ত বয়স্ক হলে অনুমতি নিয়ে গৃহে প্রবেশ করতে হবে।
৩. বৃদ্ধা মহিলারাও সৌন্দর্য প্রকাশ করতে পারবে না। তবে পর্দার ব্যাপারে তাদের কিছুটা শিথিলতা রয়েছে।
৪. ছোট বাচ্চা ও দাস-দাসীদের ক্ষেত্রে পোষাকের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

# ৬১ নং আয়াতের তাফসীর:

যে সকল মুসলিমরা কোন অঙ্গহানির কারণে শরীয়তের ওয়াজিব বিধান পালন করতে অক্ষম, তাদেরকে সে বিধান না পালন করার জন্য পাকড়াও করা হবে না এবং তাদের দীনের ও ঈমানের কোন ক্ষতি হবে না। যেমন যারা অন্ধ, খোঁড়া, এমন অসুস্থ চলতে পারে না ও অনুরূপ ব্যক্তিরা জিহাদ ও তৎসদৃশ কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে না। কারণ জিহাদে যেতে হলে দৃষ্টিসস্পন্ন ও বিকলাঙ্গতামুক্ত হতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(لَيْسَ عَلَي الْأَعْمٰي حَرَجٌ وَّلَا عَلَي الْأَعْرَجِ حَرَجٌ وَّلَا عَلَي الْمَرِيْضِ حَرَجٌ ط وَمَنْ يُّطِعِ اللّٰهَ وَرَسُوْلَه۫ يُدْخِلْهُ جَنّٰتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ ج وَمَنْ يَّتَوَلَّ يُعَذِّبْهُ عَذَابًا أَلِيْمًا)‏

“অবশ্য যদি অন্ধ, খোঁড়া ও রোগী জিহাদে না আসে তাহলে কোনো দোষ নেই। যে কেউ আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের কথা মেনে চলবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার নীচে ঝর্ণাধারা বহমান। আর যে ব্যক্তি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে তাকে তিনি যন্ত্রণাদায়ক আযাব দেবেন।” (সূরা ফাতহ ৪৮:১৭)

অনুরূপ সূরা তাওবার ৯১-৯২ নং আয়াতে বলা হয়েছে।

(أَنْ تَأْكُلُوْا مِنْم بُيُوْتِكُمْ)

এখানে তোমাদের গৃহ বলতে তোমাদের সন্তানদের গৃহে। কারণ নিজের গৃহে খাওয়া দাওয়া করতে অসুবিধার কোন প্রশ্নই আসতে পারে না। হাদীসে এসেছে: মানুষ যা উপার্জন করে তার মধ্যে উত্তম উপার্জন হল সন্তান। (তিরমিযী হা: ১৩৫৮, ইবনু মাযাহ হা: ২২৯০, সহীহ) সুতরাং সন্তানের বাড়িতে খাবে এতে কোন অসুবিধা নেই।

(مَا مَلَكْتُمْ مَّفَاتِحَه)

অর্থাৎ যে সকল বাড়ির কর্তৃত্ব পেয়েছন হয় দায়িত্বশীল হিসেবে বা অন্য কারণে, সে সকল বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতে কোন অসুবিধা নেই। প্রাথমিক যুগে কারো বাড়িতে খাদ্যগ্রহণ করাটা অপছন্দনীয় মনে করা হত, আবার একাকী খাওয়াও ভাল মনে করা হত না এমনকি যদি তাদের মনিবেরা তাদের ধন-ভাণ্ডারের চাবি দিত তথাপি তারা সেখান থেকে খাবার অনুমতি থাকলেও খেত না। তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ জাহিলী প্রথা দূর করণার্থে বিধান নাযিল করেন যে, তোমরা তোমাদের পিতৃ গৃহে, বন্ধুদের গৃহে, যাদের ধন-ভাণ্ডারের চাবি তোমাদের নিকট রয়েছে তাদের ধন-ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজন মোতাবেক খাওয়াতে এবং পৃথক বা একত্রিতভাবে খাওয়াতে তোমাদের কোন দোষ নেই।

(فَسَلِّمُوْا عَلٰٓي أَنْفُسِكُمْ)

অর্থাৎ নিজের বাড়ি হোক আর অন্যের বাড়ি হোক প্রবেশের পূর্বে ভিতরে অবস্থানরত মানুষদের সালাম দিবে। অনেকে নিজের স্ত্রী, মা-বাবাদেরকে সালাম দিতে কুণ্ঠাবোধ করে; না, এমনটি হওয়া উচিত নয়। বরং তারা সালাম পাওয়ার আরো বেশি হকদার।

(تَحِيَّةً مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِ)

অর্থাৎ বাড়িতে প্রবেশকালে

السَّلَامُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللّٰهِ বা

السَّلاَمُ عَلَيْنَا وَعَلَي عِبَادِ اللَّهِ الصَّالِحِينَ)

বলা এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অভিবাদন এবং তিনি তা শরীয়ত সিদ্ধ করে দিয়েছেন। এতে বরকত রয়েছে এবং তোমরা যত কথা বলে থাক তার মধ্যে এটি উত্তম।

সুতরাং প্রতিটি মু’মিন ব্যক্তির উচিত নিজ বাড়িসহ অন্যের বাড়িতে প্রবেশকালে ভিতরে অবস্থানরত ব্যক্তিদের সালাম দেয়া। নিজের লোকদেরকে সালাম দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।

আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. যারা বিকলাঙ্গ তারা যদি অসুবিধার কারণে জিহাদে বা এরূপ ফরয জাতীয় কোন কাজ তরক করে তাতে তাদের কোন গুনাহ নেই।
২. কারো বাড়িতে খাওয়াটা কোন দোষের বিষয় নয়।
৩. দাস-দাসী তার মনিবের মাল থেকে প্রয়োজন মোতাবেক খাদ্য গ্রহণ করতে পারবে।
৪. কারো গৃহে প্রবেশ করার পূর্বে প্রথমে সালাম প্রদান করতে হবে।
৫. একাকী খাওয়া বৈধ তবে একাকী খাওয়ার চেয়ে একত্রিতভাবে খাওয়াতে বরকত বেশি।

তাফসীরে ইবনে কাছীর বলেছেন:-
৫৮-৬০ নং আয়াতের তাফসীর

এই আয়াতে নিকটাত্মীয়দেরকেও নির্দেশ দেয়া হচ্ছে যে, তারাও যেন অনুমতি নিয়ে বাড়ীতে প্রবেশ করে। ইতিপূর্বে এই সূরার প্রথম দিকের আয়াতে যে হুকুম ছিল তা ছিল পর পুরুষ ও অনাত্মীয়ের জন্যে। এখানে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিন সময়ে গোলামদেরকে এমনকি নাবালক বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদেরকেও অনুমতি নিতে হবে। ঐ তিন সময় হলোঃ ফজরের নামাযের পূর্বে। কেননা, এটা হলো ঘুমানোর সময়। দ্বিতীয় হলো দুপুরের সময়, যখন মানুষ সাধারণতঃ কিছুটা বিশ্রামের জন্যে কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে থাকে। আর তৃতীয় হলো এশার নামাযের সময়। কেননা, ওটাই হচ্ছে শিশুদেরকে নিয়ে শয়নের সময়। সুতরাং এই তিন সময় যেন গোলাম ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেরাও অনুমতি ছাড়া ঘরে প্রবেশ না করে। তবে এই তিন সময় ছাড়া অন্যান্য সময়ে তাদের ঘরে প্রবেশের জন্যে অনুমতির প্রয়োজন নেই। কেননা, তাদের ঘরে যাতায়াত জরুরী। তারা বারবার আসে ও যায়। সুতরাং প্রত্যেকবার অনুমতি প্রার্থনা করা তাদের জন্যে এবং বাড়ীর লোকদের জন্যেও বড়ই অসুবিধাজনক ব্যাপার। এ জন্যেই নবী (সঃ) বলেছেনঃ “বিড়াল অপবিত্র নয়। ওটা তো তোমাদের বাড়ীতে তোমাদের আশে পাশে সদা ঘোরাফেরা করেই থাকে।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক (রঃ), ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ) এবং আহলুস সুনান বর্ণনা করেছেন) হুকুম তো এটাই, কিন্তু এর উপর আমল খুব কমই হয়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “তিনটি আয়াতের উপর আমল মানুষ প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। একটি এই আয়াতটি। দ্বিতীয় হলো সূরায়ে নিসার (আরবি) (৪: ৮) এই আয়াতটি এবং তৃতীয়টি হলো সূরায়ে হুজুরাতের (আরবি) (৪৯: ১৩) এই আয়াতটি। শয়তান লোকদের উপর ছেয়ে গেছে এবং সে তাদেরকে এই আয়াতগুলোর উপর আমল করা হতে উদাসীন রেখেছে, যেন তাদের এ আয়াতগুলোৱ উপর ঈমান নেই। আমি তো আমার দাসটিকেও নির্দেশ দিয়েছি যে, সে যেন এই তিন সময়ে বিনা অনুমতিতে কখনো না আসে।” প্রথম আয়াতটিতে দাস-দাসী ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদেরকেও অনুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতটিতে ওয়ারিসদের মধ্যে মাল বন্টনের সময় আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম ও মিকসীন এসে গেলে তাদেকেও কিছু দেয়া ও তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করার হুকুম করা হয়েছে। আর তৃতীয় আয়াতে বংশ ও আভিজাত্যের উপর গর্ব না করা, বরং আল্লাহভীরু লোককেই সম্মান প্রাপ্তির যোগ্য মনে কর বর্ণনা রয়েছে।

মূসা ইবনে আবি আয়েশা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি শাবী (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন (আরবি) -এই আয়াতটি কি মানসূখ বা রহিত হয়ে গেছে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “না, রহিত হয়নি।” তখন পুনরায় তিনি প্রশ্ন করেনঃ “জনগণ এর প্রতি আমল ছেড়ে দিয়েছে যে?” জবাবে তিনি বলেনঃ “(এই আয়াতের প্রতি আমল করার জন্যে) আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত।”

হযরত ইকরামা (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, দু’জন লোক কুরআন কারীমে বর্ণিত তিন সময়ে অনুমতি প্রার্থনা সম্পর্কে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “এই আয়াতের উপর আমল ছেড়ে দেয়ার একটি বড় কারণ হলো লোকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ও প্রশস্ততা। পূর্বে জনগণের আর্থিক অবস্থা এমন ভাল ছিল না যে, তারা ঘরের দরযার উপর পর্দা লটকাবে বা কয়েকটি কক্ষ বিশিষ্ট একটি বড় ঘর নির্মাণ করবে। বরং তাদের একটিমাত্র ঘর থাকতো এবং অনেক সময় দাস-দাসীরা তাদের অজ্ঞাতে ঘরে প্রবেশ করতো। ঐ সময় স্বামী স্ত্রী হয়তো ঘরে একত্রে থাকতো, ফলে তারা খুবই লজ্জিত হতো এবং বাড়ীর লোকেরাও এতে কঠিনভাবে অস্বস্তিবোধ করতো। অতঃপর যখন আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে আর্থিক স্বচ্ছলতা দান করলেন এবং তারা পৃথক পৃথক কক্ষ বানিয়ে নিলো ও দরযার উপর পর্দা লটকিয়ে দিলো তখন তারা রক্ষিত হয়ে গেল। আর এর ফলে যে যৌক্তিকতায় অনুমতি প্রার্থনার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা পূর্ণ হয়ে গেল। তাই জনগণ এই হুকুমের পাবন্দী ছেড়ে দিলো এবং তারা এর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করতে শুরু করলো।” (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এই তিনটি এমন সময় যখন মানুষ কিছুটা অবসর পায় এবং বাড়ীতেই অবস্থান করে। আল্লাহ জানেন তারা তখন কি অবস্থায় থাকে। এজন্যেই দাস-দাসীদেরও অনুমতি প্রার্থনার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা, সাধারণতঃ ঐ সময়েই মানুষ স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়ে থাকে, যেন গোসল করে পাক-পবিত্র হয়ে বের হতে পারে এবং নামাযে শরীক হতে পারে। | মুকাতিল ইবনে হাইয়ান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একজন আনসারী এবং তার স্ত্রী আসমা বিনতে মুরসিদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্যে কিছু খাদ্য তৈরী করেন। লোকেরা বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশ করতে শুরু করে। তখন হযরত আসমা (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটাতো খুবই জঘন্য প্রথা যে, স্বামী স্ত্রী একই কাপড়ে রয়েছে এমতাবস্থায় তাদের গোলাম ঘরে প্রবেশ করে।” ঐ সময় (আরবি)-এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।

এই আয়াত যে মানসূখ বা রহিত নয়, শেষের শব্দগুলো তার ইঙ্গিত বহন করছে। ঘোষিত হয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “এইভাবে আল্লাহ তোমাদের নিকট তাঁর নির্দেশ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” হ্যাঁ, তবে যখন ছেলেরা প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছে যাবে তখন তাদেরকে এই তিন সময় ছাড়া অন্য সময়েও অনুমতি নিতে হবে। যে তিন সময়ের কথা মহান আল্লাহ বর্ণনা করেছেন এই তিন সময়ে ছোট ছেলেকেও তার পিতা-মাতার কাছে যাওয়ার সময় অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। কিন্তু প্রাপ্ত বয়সে পৌঁছার পর সব সময়েই অনুমতি চাইতে হবে যেমন অন্যান্য বড় মানুষ অনুমতি চেয়ে থাকে, তারা নিজস্ব লোকই হোক অথবা অপর লোকই হোক।

ঘোষিত হচ্ছেঃ বৃদ্ধা নারী, যারা বিবাহের আশা রাখে না, অর্থাৎ তারা এমন বয়সে পৌছে গেছে যে, পুরুষদের প্রতি তাদের কোনই আকর্ষণ নেই, তাদের জন্যে অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের বহির্বাস খুলে রাখে। অর্থাৎ অন্যান্য নারীদের মত তাদের পর্দার দরকার নেই। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এটি (আরবি) (২৪:৩১) এই আয়াতটি হতে স্বতন্ত্র।

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এরূপ বৃদ্ধা নারীর জন্যে বুরকা এবং চাদর নামিয়ে দিয়ে শুধু দো-পাট্টা এবং জামা ও পায়জামা পরে থাকার অনুমতি রয়েছে। তার কিরআতও(আরবি) এরূপই বটে। এর দ্বারা দোপাট্টার উপরের চাদরকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং বুড়ী স্ত্রীলোকেরা যখন মোটা, চওড়া দোপাট্টা পরে থাকবে তখন ওর উপরে অন্য চাদর রাখা জরুরী নয়। কিন্তু এর দ্বারাও যেন সৌন্দর্য প্রকাশ উদ্দেশ্য না হয়।

শ্রীলোকেরা হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে এই ধরনের প্রশ্ন করলে তিনি তাদেরকে বলেনঃ তোমাদের জন্যে সাজ-সজ্জা অবশ্যই বৈধ, কিন্তু এটা যেন অর পুরুষদের চক্ষু ঠাণ্ডা করার জন্যে না হয়।”

হযরত হুযাইফা (রাঃ)-এর স্ত্রী খুবই বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছিলেন। ঐ সময় তিনি তার গোলামের দ্বারা তার মাথায় মেহেদী লাগিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ “আমি এমন বার্ধক্যে উপনীত হয়েছি যে, আমার পুরুষদের প্রতি কোন আকর্ষণই নেই।”

শেষে মহান আল্লাহ বলেনঃ (চাদর না নেয়া তো এরূপ বুড়ী স্ত্রীলোকদের জন্যে জায়েয বটে, কিন্তু এটা হতে তাদের বিরত থাকাই (অর্থাৎ বুরকা ও চাদর ব্যবহার করাই) তাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

# এই আয়াতে যে দোষ না হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে সে সম্পর্কে হযরত আতা (রঃ) প্রমুখ গুরুজনতো বলেন যে, এর দ্বারা অন্ধ ও খোঁড়াদের জিহাদে যোগদান না করা বুঝানো হয়েছে। যেমন সূরায়ে আল-ফাতহুতে রয়েছে। সুতরাং এ ধরনের লোক যদি জিহাদে গমন না করে তবে তাদের শরীয়ত সম্মত ওজর থাকার কারণে তাদের কোন অপরাধ হবে না। সূরায়ে বারাআতে রয়েছেঃ “যারা দুর্বল, যারা পীড়িত এবং যারা অর্থ সাহায্যে অসমর্থ, তাদের কোন অপরাধ নেই, যদি আল্লাহ ও রাসূল (সঃ)-এর প্রতি তাদের অবিমিশ্র অনুরাগ থাকে। যারা সৎকর্মপরায়ণ তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন হেতু নেই; আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। তাদেরও কোন অপরাধ নেই যারা তোমার নিকট বাহনের জনে আসলে তুমি বলেছিলেঃ তোমাদের জন্যে কোন বাহন আমি পাচ্ছি না, তারা অর্থ ব্যয়ে অসামর্থ্য জনিত দুঃখে অশ্রু বিগলিত নেত্রে ফিরে গেল।” তাহলে এই আয়াতে তাদের জন্যে অনুমতি রইলো যে, তাদের কোন অপরাধ নেই।

কতকগুলো লোক ঘৃণা করে তাদের সাথে খেতে বসতো না। শরীয়ত এসব অজ্ঞতাপূর্ণ অভ্যাস উঠিয়ে দেয়। হযরত মুজাহিদ (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জনগণ এইরূপ লোকদেরকে নিজেদের পিতা, ভ্রাতা, ভগ্নী প্রভৃতি নিকটতম আত্মীয়দের নিকট পৌঁছিয়ে দিতো, যেন তারা সেখানে আহার করে। এ লোকগুলো এটাকে দূষণীয় মনে করতো যে, তাদেরকে অপরের বাড়ী নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।

সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, মানুষ যখন তার ভ্রাতা, ভগ্নী প্রভৃতির বাড়ী যেতো এবং স্ত্রীলোকেরা কোন খাদ্য তার সামনে হাযির করতো তখন সে তা খেতো না এই মনে করে যে, সেখানে বাড়ীর মালিক তো নেই। তখন আল্লাহ তা’আলা ঐ খাদ্য খেয়ে নেয়ার অনুমতি দেন। এটা যে বলা হয়েছে যে, তোমাদের নিজেদের জন্যেও কোন দোষ নেই, এটা তো প্রকাশমানই ছিল, কিন্তু এর উপর অন্যগুলোর সংযোগ স্থাপনের জন্যে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং এর পরবর্তী বর্ণনা এই হুকুমের ব্যাপারে সমান। পুত্রদের বাড়ীর হুকুমও এটাই, যদিও শব্দে এর বর্ণনা দেয়া হয়নি। কিন্তু আনুষঙ্গিকভাবে এটাও এসে যাচ্ছে। এমনকি এই আয়াত দ্বারাই দলীল গ্রহণ করে কেউ কেউ বলেছেন যে, পুত্রের মাল পিতার মালেরই স্থলবর্তী। মুসনাদ ও সুনান গ্রন্থে কয়েকটি সনদে হাদীস এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তুমি ও তোমার মাল তোমার পিতার (-ই মালিকানাধীন)।” আর যাদের নাম এসেছে তাদের দ্বারা দলীল গ্রহণ করে কেউ কেউ বলেছেন যে, নিকটতম আত্মীয়দের একের খাওয়া পরা অপরের উপর ওয়াজিব। যেমন ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ও ইমাম আহমাদ (রঃ)-এর প্রসিদ্ধ উক্তি এটাই।

আল্লাহ পাকের যার চাবী তোমাদের মালিকানায় রয়েছে’ -এই উক্তি দ্বারা গোলাম ও প্রহরীকে বুঝানো হয়েছে যে, তারা তাদের মনিবের মাল হতে প্রয়োজন হিসেবে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী খেতে পারে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন জিহাদে গমন করতেন তখন প্রত্যেকেরই মনের বাসনা এটা হতো যে, সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে যদি যেতে পেতো! যাওয়ার সময় তারা নিজেদের বিশিষ্ট বন্ধুদেরকে চাবি দিয়ে যেতো এবং তাদেরকে বলে যেতো: “প্রয়োজনবোধে তোমরা আমাদের মাল থেকে খেতে পারবে। আমরা তোমাদেরকে অনুমতি দিলাম। কিন্তু এরপরেও এরা নিজেদেরকে আমানতদার মনে করে এবং এই মনে করে যে, তারা হয়তো ভোলা মনে অনুমতি দেয়নি। পানাহারের কোন জিনিসকে তারা স্পর্শই করতো না। তখন এই হুকুম নাযিল হয়।

এরপর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ তোমরা তোমাদের বন্ধুদের গৃহেও খেতে পার, যখন তোমরা জানবে যে, তারা এটা খারাপ মনে করবে না এবং তাদের কাছে এটা কঠিনও ঠেকবে না। কাতাদা (রঃ) বলেনঃ “যখন তুমি তোমার বন্ধুর বাড়ীতে যাবে তখন তার অনুমতি ছাড়াই তুমি তার খাদ্য হতে খেতে পারবে।”

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তোমরা একত্রে আহার কর অথবা পৃথক পৃথকভাবে আহার কর তাতে তোমাদের জন্যে কোন অপরাধ নেই।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, যখন (আরবি) অর্থাৎ “হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।” (৪: ২৯) এই আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন সাহাবীগণ (রাঃ) পরস্পর বলাবলি করেনঃ “পানাহারের জিনিসগুলোও তো মাল, সুতরাং এটাও আমাদের জন্যে হালাল নয় যে, আমরা একে অপরের সাথে আহার করি। কাজেই তারা ওটা থেকেও বিরত হন। ঐ সময় এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।

অনুরূপভাবে পৃথক পৃথকভাবে পানাহারকেও তারা খারাপ মনে করতেন। কেউ সঙ্গী না হওয়া পর্যন্ত তারা খেতেন না। এজন্যে আল্লাহ পাক এই হুকুমের মধ্যে দুটোরই অনুমতি দিলেন, অর্থাৎ অন্যদের সাথে খেতেও এবং পৃথক পৃথকভাবে খেতেও। বানু কিনানা গোত্রের লোক বিশেষভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তারা ক্ষুধার্ত থাকতো, তথাপি সঙ্গে কাউকেও না পাওয়া পর্যন্ত খেতো না। সওয়ারীর উপর সওয়ার হয়ে তারা সাথে আহারকারী সঙ্গীর খোঁজে বেরিয়ে পড়তো। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা একাকী খাওয়ার অনুমতি দান সম্পর্কীয় আয়াত অবতীর্ণ করে অজ্ঞতাযুগের ঐ কঠিন প্রথাকে দূর করে দেন।

এ আয়াতে যদিও একাকী খাওয়ার অনুমতি রয়েছে, কিন্তু এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, লোকদের সাথে মিলিত হয়ে খাওয়া নিঃসন্দেহে উত্তম। আর এতে বেশী বরকতও রয়েছে।

ওয়াহশী ইবনে হারব (রাঃ) তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন যে, একটি লোকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি খাই, কিন্তু পরিতৃপ্ত হই না (এর কারণ কি?)।” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “ সম্ভবতঃ তুমি পৃথকভাবে একাকী খেয়ে থাকো। তোমরা খাদ্যের উপর একত্রিত হও এবং আল্লাহর নাম নিয়ে খেতে শুরু কর, তোমাদের খাদ্যে বরকত দেয়া হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা সবাই একত্রিতভাবে খাও, পৃথক পৃথকভাবে খেয়ো না। কেননা, বরকত জামাআতের উপর রয়েছে।” (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

এরপর শিক্ষা দেয়া হচ্ছেঃ যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি অভিবাদন স্বরূপ সালাম করবে।

হযরত জাবির (রাঃ) বলেনঃ “যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করবে তখন আল্লাহ তা’আলার শেখানো বরকতময় উত্তম সালাম বলবে। আমি তো পরীক্ষা করে দেখেছি যে, এটা সরাসরি বরকতই বটে।”

ইবনে তাউস (রঃ) বলেনঃ “তোমাদের যে কেউ বাড়ীতে প্রবেশ করবে সে যেন বাড়ীর লোকদেরকে সালাম দেয়।”

হযরত আতা (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “এটা কি ওয়াজিব?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “কেউ যে এটাকে ওয়াজিব বলেছেন তা আমার জানা নেই। তবে আমি এটা খুবই পছন্দ করি যে, যখনই তোমরা বাড়ীতে প্রবেশ করবে তখন সালাম দিয়ে প্রবেশ করবে। আমি তো এটা কখনো ছাড়িনি। তবে কোন সময় ভুলে গিয়ে থাকি। সেটা অন্য কথা।” মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ “যখন মসজিদে যাবে তখন বলবেঃ (আরবি) অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ যখন নিজের বাড়ীতে প্রবেশ করবে তখন নিজের ছেলে মেয়েদেরকে সালাম দিবে এবং যখন এমন কোন বাড়ীতে যাবে যেখানে কেউই নেই তখন বলবেঃ(আরবি) অর্থাৎ আমাদের উপর ও আল্লাহর সৎ বান্দাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ এটাই হুকুম দেয়া হচ্ছে। এইরূপ সময়ে তোমাদের সালামের জবাব আল্লাহর ফেরেশতারা দিয়ে থাকেন।”

হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, নবী (সঃ) আমাকে পাঁচটি অভ্যাসের অসিয়ত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ “হে আনাস (রাঃ)! তুমি পূর্ণভাবে অযু কর, তোমার বয়স বৃদ্ধি পাবে। আমার উম্মতের যার সাথেই তোমার সাক্ষাৎ হবে তাকেই সালাম দেবে, এর ফলে তোমার পুণ্য বেড়ে যাবে। যখন তুমি তোমার বাড়ীতে প্রবেশ করবে তখন তোমার পরিবারের লোককে সালাম দেবে, তাহলে তোমার বাড়ীর কল্যাণ বৃদ্ধি পাবে। চাশতের নামায পড়তে থাকবে, তোমাদের পূর্ববর্তী দ্বীনদার লোকদের এই নীতিই ছিল। হে আনাস (রাঃ)! ছোটদেরকে স্নেহ করবে এবং বড়দেরকে সম্মান করবে, তাহলে কিয়ামতের দিন তুমি আমার বন্ধুদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মহান আল্লাহ বলেনঃ এটা আল্লাহর নিকট হতে কল্যাণ ও পবিত্র। অর্থাৎ এটা হলো দু’আয়ে খায়ের যা আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এটা কল্যাণময় ও পবিত্র।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “আমি তাশাহ্হুদ তো আল্লাহর কিতাব হতেই গ্রহণ করেছি। আমি আল্লাহকে বলতে শুনেছিঃ (আরবি)

অর্থাৎ “যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম করবে অভিবাদন স্বরূপ যা আল্লাহর নিকট হতে কল্যাণময় ও পবিত্র।” সুতরাং নামাযের তাশাহহুদ হলোঃ (আরবি)

অর্থাৎ কল্যাণময় অভিবাদন ও পবিত্র সালাত আল্লাহর জন্যে। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। (হে নবী সঃ)! আপনার উপর শান্তি এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হোক। আমাদের উপর এবং আল্লাহর সৎ বান্দাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তারপর নামাযী ব্যক্তি নিজের জন্যে দু’আ করবে, অতঃপর সালাম ফিরাবে।” (এটা মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন। আবার সহীহ মুসলিমে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেই মারফু’রূপে যা বর্ণিত আছে তা এর বিপরীত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী)

অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ এইভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্যে তাঁর নির্দেশ বিশদভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা বুঝতে পার এবং জ্ঞান লাভ কর।

Leave a Reply